সোমবার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২১

হোয়াই নেশনস ফেইল (Why Nations Fail) তথা কেন একটি জাতি বা দেশ ব্যর্থ হয়

হোয়াই নেশনস ফেইল তথা কেন একটি জাতি বা দেশ ব্যর্থ হয়:


মুখবন্ধ

এ বই হচ্ছে মূলত বিশ্বের ধনী দেশ এবং গরিব দেশের (এদের মধ্যে অনুন্নত দেশ ও উন্নয়নশীল দেশ নামক তকমাধারীরাও বিদ্যমান) মধ্যে যে আয় ও জীবনমানের বিরটা বৈষম্য রয়েছে তা নিয়ে লেখা। যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, গ্রেট ব্রিটেন এবং জামার্নি। আরও আছে আফ্রিকা মহাদেশের সাহারা মরুভূমির দক্ষিণাংশের দেশসমূহ, মধ্য আমেরিকা এবং দক্ষিণ এশিয়া। আমরা যখন এ ভূমিকা লিখছি তখন মধ্যপ্রাচ্যে জেসমিন বিপ্লব বলে একটি আন্দোলন হচ্ছে। যা মূলত রাস্তার এক বিক্রেতা মোহাম্মদ বোযাজিজি’র আত্মহত্যাকে ঘিরে গড়ে ওঠে। তার আত্মহত্যা থেকেই জনরোষের মাধ্যমে এ আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে। মোহাম্মদ বোয়াজিজি আত্মহত্যা করেন ১৭ ডিসেম্বর ২০১০ সালে। এ আন্দোলনের ফলে তিউনিশিয়ার রাষ্ট্রপতি জিন এল আবিদিন বেল আলী, যিনি ১৯৮৭ সাল থেকে প্রেসিডেন্ট দায়িত্বে আছেন, তিনি ১৪ জানুয়ারি ২০১১ তারিখে পদত্যাগ করেন। কিন্তু এতে করেও আন্দোলন স্তিমিত হয়নি। বরং বিদ্যমান এলিট শ্রেণির বিরুদ্ধে আন্দোলন আরও জোরদার হয় এবং এর রেশ ছড়িয়ে পড়ে মধ্যপ্রাচ্যের বাকি দেশগুলোতে। হোসনে মোবারক ইজিপ্টি শাসন করেন ৩০ বছর যাবৎ। তিনি খুব শক্ত হাতে দেশ শাসন করেছেন। কিন্তু ২০১১ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি ক্ষমতাচ্যুত হন। অবশ্য মধ্যপ্রাচ্যের বাকি দেশগুলো, যেমন, বাহারাইন, লিবিয়া, সিরিয়া এবং ইয়েমেনের শাসনকর্তাদের ভাগ্য সম্পর্কে এখনো আমরা জানি না কী ঘটবে।


যাই হোক, এসব দেশের জনগণের যে অসন্তুষ্টি তার মূল হচ্ছে তাদের দারিদ্রতা। ইজিপ্টি তথা মিশরের নাগরিকদের গড় আয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের গড় আয়ের মাত্র ১২%। অর্থাৎ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের গড় আয় ১০০ টাকা হলে, মিশরের নাগরিকদের গড় আয় ১২ টাকা। আবার মিশরের নাগরিকদের গড় আয়ু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের গড় আয়ুর থেকে ১০ বছর কম। অর্থাৎ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের গড় আয়ু ৭৭ বছর হলে, মিশরের নাগরিকদের গড় আয়ু ১০ বছর কম ৬৭ বছর হবে। আবার মিশরের ২০ শতাংশ মানুষ চরম দারিদ্র্যের মধ্যে বাস করে। যদিও এসব পার্থক্যগুলো অনেক গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু আমরা যদি অন্যান্য দেশের সাথে তুলনা করি, যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং বিশ্বের দরিদ্রতম দেশগুলো, যেমন উত্তর কোরিয়া, সিয়েরা লিওন এবং জিম্বাবুয়ের মধ্যে তুলনা করলে এ সংখ্যা খুব ছোট মনে হবে, যেখানে জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি দারিদ্র্যের মধ্যে বাস করে।

মিশর দেশটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে এত গরিব কেন? মিশরীয়দের আরও উন্নত হতে বাধা দেয় কী কী বিষয়? দারিদ্রতা কি মিশরের জন্য অনিবার্য? নাকি এটা নির্মূল করা সম্ভব? এসব প্রশ্নের জবাব পেতে হলে স্বাভাবিকভাবেই প্রথমে চিন্তা আসে মিশরীয়রা তাদের সমস্যা সম্পর্কে কী চিন্তা করে তা জানা  এবং কেন তারা মোবারক সরকারের শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করল তা বোঝা। কায়রোর এক বিজ্ঞাপন সংস্থার কর্মী, বয়স চব্বিশ বছর, নোহা হামিদ তাহরির স্কোয়ারে প্রতিবাদ জানানোর সময় তার মতামত স্পষ্টভাবে জানান, আমরা দুর্নীতি, নিপীড়ন এবং মন্দ শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে নির্যাতিত। আমরা একটা দুর্নীতিগ্রস্ত সিস্টেমের মধ্যে বাস করছি যা অবশ্যই পরিবর্তন করতে হবে।

তাহরির স্কয়ারের আরেক আন্দোলনকারী, ফার্মেসি বিভাগের ছাত্র, মোসাব এল শামি  একমত প্রকাশ করে বলেন, আমি আশা করি যে এই বছরের শেষের দিকে আমাদের একটি নির্বাচিত সরকার থাকবে এবং সার্বজনীন স্বাধীনতা প্রয়োগ করা হবে। আর যে দুর্নীতি এ দেশকে গ্রাস করে নিয়েছে তা থেকে দেশকে মুক্ত করব। তাহরির স্কোয়ারের অন্যান্য বিক্ষোভকারীরাও সরকারের দুর্নীতি, জনসেবা প্রদানে অক্ষমতা এবং মিশরে সুযোগের সমতার অভাব নিয়ে একই সুরে কথা বলেছেন। তারা বিশেষ করে রাজনৈতিক অধিকারের অনুপস্থিতি এবং দমন-পীড়নের ব্যাপারে অভিযোগ করেছিল।

আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার প্রাক্তন পরিচালক মোহাম্মদ এল বারাদেই যেমন টুইটারে লিখেছেন ১৩ জানুয়ারী, ২০১১, "তিউনিসিয়া: দমন-পীড়ন + সামাজিক ন্যায়বিচারের অনুপস্থিতি + শান্তিপূর্ণ পরিবর্তনের জন্য যেসব সিস্টেম ও চ্যানেল দরকার সেগুলোকে অস্বীকার = একটি টাইম বোমা।" মিশর এবং তিউনিশিয়ান, উভয়েই তাদের অর্থনৈতিক সমস্যাকে মৌলিকভাবে তাদের রাজনৈতিক অধিকারের অভাবের কারণে দেখেছিল। বিক্ষোভকারীরা যখন তাদের দাবিগুলো আরো সুশৃঙ্খলভাবে গঠন করতে শুরু করে, তখন মিশরীয় প্রতিবাদ আন্দোলনের অন্যতম নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার ও ব্লগার ওয়ায়েল খলিলের পোস্ট করা প্রথম বারোটি দাবি, সবই ছিল রাজনৈতিক পরিবর্তনের দিকে মনোনিবেশ করা। ন্যূনতম মজুরি বাড়ানোর মতো বিষয়গুলো কেবল সেই ক্রান্তিকাল দাবিগুলির মধ্যে উপস্থিত হয়েছিল যা পরে বাস্তবায়িত হওয়ার কথা ছিল।

মিশরীয়দের কাছে, যে জিনিসগুলি তাদের দারিদ্রের দুষ্টচক্রের মধ্যে আটকে রেখেছে তার মধ্যে রয়েছে একটি অকার্যকর এবং দুর্নীতিগ্রস্ত রাষ্ট্র এবং এমন একটি সমাজ যেখানে তারা তাদের মেধা, উচ্চাকাঙ্ক্ষা, বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করতে পারে না এবং তারা উন্নত শিক্ষা পেতে পারে, কিন্তু তা পায় না। কিন্তু তারা এটাও স্বীকার করে যে এই সমস্যাগুলোর শিকড় রাজনৈতিক পটভূমি। মিশরের জনগণ অর্থনৈতিকভাবে যত বাধার সম্মুখীন হচ্ছে তার মূল কারণ মিশরে রাজনৈতিক ক্ষমতার ব্যবহার এবং অভিজাত শ্রেণী এ ক্ষমতাকে এমন সংকীর্ণ পথে ব্যবহার করে যাতে করে এই রাজনৈতিক ক্ষমতার একচেটিয়া ব্যবহার করা যায়। এতে করে সব অর্থনৈতিক সুবিধাদি কেবল অভিজাত শ্রেণীর জন্য নির্দিষ্ট হয়ে পড়ে। এভাবেই জনগণ বুঝতে পারে যে রাজনৈতিক পটভূমি পরিবর্তন করাই তাদের প্রথম কাজ।


সমস্যার মূূল হচ্ছে রাজনৈতিক অধিকারের অভাব। তাহরির স্কয়ারের আন্দোলনকারীদের মনে এ কথা থাকা সত্ত্বেও তারা এ বিষয়টি থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়ে। যখন তারা কারণ দেখায় যে কেন মিশরের মতো একটি সম্ভাবনাময় দেশ গরিব হয়ে আছে, তখন বেশিরভাগ শিক্ষাবিদ এবং মন্তব্যকারীরা সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়ের ওপর জোর দেয়। কিছু মানুষ জোর দিয়ে বলে মিশরের দারিদ্রতার মূল কারণ এর ভৌগলিক ব্যাপার। কারণ দেশের বেশিরভাগ জায়গা মরুভূমি এবং পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাতের অভাব রয়েছে। এর ফলে মাটি এবং জলবায়ুও উৎপাদনশীল কৃষির অনুকূল নয়। আর কিছু মানুষ বলে যে ভৌগলিক পরিস্থিতির বদলে মিশরের সাংস্কৃতিক কারণে মিশর একটি গরিব দেশ। তারা মিশরের সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যের দিকে ইঙ্গিত দেয় যে এর কারণেই মিশরে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি সম্ভব হচ্ছে না। এসকল মিশরীয় শিক্ষাবিদরা আরও যুক্তি দেখান যে অন্য যারা উন্নতি করেছে তাদের যেসব নৈতিকতা ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে তার অভাব মিশরে বিদ্যমান। তাই তারা উন্নতি করতে পারছে না। তারা আরও বলেন, এসব ক্ষেত্রে ইসলামী বিশ্বাসগুলোও রয়েছে যা অর্থনৈতিক সাফল্যের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ। আরেক দল অর্থনীতিবিদ এবং পণ্ডিত রয়েছেন যারা বেশ প্রভাবশালী। এদের বক্তব্য হচ্ছে মিশরের শাসকরা জানে না যে তাদের দেশকে সমৃদ্ধ করতে কী কী প্রয়োজন। শাসকরা কেবল ভুল নীতি ও কলাকৌশল অনুসরণ করে যাচ্ছে। যদি এই শাসকরা সঠিক উপদেষ্টাদের কাছ থেকে সঠিক পরামর্শ পেত, তবে শাসকরা সঠিকভাবে দেশকে সমৃদ্ধির পথে পরিচালিত করতে পারত। এসব অর্থনীতিবিদ এবং পণ্ডিতদের কাছে মিশর যে অল্প কিছু এলিট শ্রেণি দ্বারা শাসিত, যারা (এলিট শ্রেণি) দেশের বেশিরভাগ মানুষের শ্রমের বিনিময়ে রাজার হালে বাস করছে, এসব এলিট শ্রেণি যে মিশরের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পথে মূল বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তা অপ্রাসঙ্গিক বলে মনে হয়। অর্থনীতিবিদরা এবং পণ্ডিতরা এসব এলিট শ্রেণির শোষণের কথা বাদ দিয়ে তাদের বক্তব্য পেশ করেন।


এ বইয়ে আমরা যুক্তি উপস্থাপন করবে যে মিশরের তাহরির স্কয়ারের আন্দোলনের মূল গোড়া কোথায় এবং বেশিরভাগ শিক্ষাবিদ ও মন্তব্যকারীদের ঘাটতি কোথায়।


নিঃসন্দেহে মিশর একটি গরিব দেশ। কারণ দেশটি শাসিত হয় অল্প কিছু এলিট তথা অভিজাত শ্রেণি দ্বারা, যারা পুরো সমাজকে এমনভাবে সংগঠিত করেছে যাতে করে দেশের অধিকাংশ মানুষের শ্রমের ফল তারা তাদের নিজেদের সুবিধার জন্য কাজে লাগাতে পারে। রাজনৈতিক ক্ষমতাও এসব এলিট শ্রেণির মধ্যে ঘনীভূত হয়ে আছে। আর এই রাজনৈতিক ক্ষমতাই তাদেরকে বিপুল সম্পত্তি ও সম্পদ গড়তে সাহায্য করছে। যেমন মিশরের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট এভাবে বিপুল সম্পদের মালিক হন, যার আর্থিক মূল্য ৭০ বিলিয়ন ডলার তথা ৬ লাখ কোটি টাকার ওপর। এতে করে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মিশরের জনগণ। কারণ তাদেরকে শোষণ করেই এই বিপুল পরিমাণ সম্পদ গড়ে তোলা হয়েছে।


আমরা দেখাব, মিশরের এই দারিদ্রতার কারণ, এই সম্বন্ধে জনগণের ব্যাখ্যা এবং সেখান থেকে একটি কমন ব্যাখ্যা দাঁড় করাব যে গরিব দেশগুলো কেন গরিব। এবার দেশ হিসাবে যে দেশই হোক না কেন; উত্তর কোরিয়া, সিয়েরা লিওন বা জিম্বাবুয়ের মতো যে দেশই হোক না কেন, আমরা দেখাব যে গরিব দেশগুলো ঠিক একই কারণে গরিব যে কারণে মিশর দেশটা গরিব। গ্রেট ব্রিটেন এবং আমেরিকার মতো দেশগুলো ধনী হয়ে উঠেছিল তার কারণ তাদের নাগরিকরা দেশের ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণকারী অভিজাতদের উৎখাত করতে সক্ষম হয়েছিল এবং এমন এক সমাজ গড়ে তুলেছিল যেখানে রাজনৈতিক অধিকারগুলো আরও বিস্তৃত পরিসরে বিতরণ করা হয়েছে; যেখানে সরকার নাগরিকদের কাছে দায়বদ্ধ এবং জবাবদিহি করতে বাধ্য; যেখানে বিপুল সংখ্যক জনগণ অর্থনৈতিক সুযোগের সদব্যবহার করতে পারে। আমরা দেখাব যে কেন আজ বিশ্বে এত বেশি বৈষম্য বিদ্যমান। এজন্য আমাদেরকে অতীতে খুঁজে দেখতে হবে এবং ইতিহাসের পরিক্রমাকে অধ্যয়ন করতে হবে। আমরা দেখব যে ব্রিটেন মিশরের চেয়ে সমৃদ্ধ হওয়ার কারণ ১৬৮৮ সালের এক আন্দোলন। ব্রিটেনে (তৎকালীন সময়ে ডাকা হত ইংল্যান্ড নামে) ১৬৮৮ সালে এক আন্দোলন হয়। সেই আন্দোলন পরে বিপ্লবে পরিণত হয়, যেখানে ইংল্যান্ডের রাজনৈতিক অধিকারের বিপুল পরিবর্তন সাধিত হয়। তৎকালে ইংল্যান্ডে এই বিপ্লবের ফলে রাজনৈতিক পরিবর্তনের ফলে জনগণের অর্থনৈতিক পরিবর্তনও সাধিত হয়। এরপর জনগণ আরও রাজনৈতিক অধিকারের জন্য লড়াই করেছে এবং জিতেছে। ফলস্বরূপ এসব রাজনৈতিক অধিকার তাদেরকে অর্থনৈতিক সুযোগ এনে দিয়েছে। রাজনৈতিক অধিকার আদায়ের এসব আন্দোলনের ফলাফল কেবল রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সুবিধাদির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি; বরং এগুলোর ফলে পরবর্তীতে শিল্প বিপ্লবের সূচনা ঘটেছে।


শিল্প বিপ্লব এবং এর ফলে যে প্রযুক্তিগুলো বিকাশ লাভ করেছিল তা মিশরে বিস্তার লাভ করেনি। কাণ তখন মিশর অটোমান সাম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রণে ছিল। ফলে অটোমান সম্রাটরাও মিশরকে আজকের মোবারক পরিবারের মতোই আচরণ করেছিল। নেপোলিয়ন বোনাপার্ট ১৭৯৮ সালে মিশরে অটোমান শাসনের পতন ঘটান। কিন্তু দেশটি তখন ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। ব্রিটিশদেরও অটোমানদের মতো মিশরের সমৃদ্ধিতে সামান্যই আগ্রহ ছিল। যদিও মিশরীয়রা অটোমান এবং ব্রিটিশ সাম্রাজ্যকে ঝেড়ে ফেলেছে এবং ১৯৫২ সালে অটোমানদের রাজতন্ত্রকে উৎখাত করেছে, তবুও এ পরিবর্তনগুলো ১৬৮৮ সালের ইংল্যান্ডের বিপ্লবের মতো ছিল না। এতে করে মিশরের রাজনীতিতে মৌলিক কোন পরিবর্তন আসেনি; বরং পূর্বের এলিট শ্রেণির বদলে নতুন এক এলিট শ্রেণি ক্ষমতায় এসেছে, যারা সাধারণ মিশরীয় জনগণের চেয়ে নিজেদের সমৃদ্ধিতেই বেশি আগ্রহী। ফলস্বরূপ, সমাজের মৌলিক কাঠামোর কোন পরিবর্তন হয়নি এবং মিশর যেই গরিব গরিবই রয়ে গেছে।


এ বইতে আমরা দেখাব কীভাবে সামাজিক প্যাটার্নগুলো শত শত বছর পরও টিকে থাকে ও নতুন রূপে উপস্থিত হয় এবং কেন এগুলো বদলায়। যেমন বদলেছে ১৬৮৮ সালের ইংল্যান্ড এবং ১৭৮৯ সালের ফ্রান্সের বিপ্লবের কারণে। এটা আমাদের বুঝতে সাহায্য করবে যে আজকে মিশরের আন্দোলনের ফলাফল কী হতে পারে, মোবারককে উৎখাত করার বিপ্লব সামনের দিনে সাধারণ মিশরীয় নাগরিকদের সমৃদ্ধি আনতে পারে কিনা। অবশ্য মিশরে এমন বিপ্লব আগেও হয়েছে, কিন্তু পরিবর্তন কিছুই হয়নি। কারণ যারা বিপ্লব করেছে তারা কেবল ক্ষমতা দখল করেছে। বিপ্লবকারীরা একই ধরনের ব্যবস্থা বা সিস্টেম পুনরায় তৈরি করেছে যাতে সাধারণ জনগণকে শোষণ করা যায়। অবশ্য সাধারণ নাগরিকদের জন্য প্রকৃত রাজনৈতিক ক্ষমতা অর্জন করা এবং তাদের সমাজের কর্মপদ্ধতি পরিবর্তন করা কঠিন। কিন্তু কঠিন হলেও এটা সম্ভব। ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, বতসোয়ানা এবং ব্রাজিলে এটা কীভাবে ঘটেছিল তাই আমরা দেখব।


সত্যি বলতে, আমরা পরিবর্তন বলতে এমন এক অবস্থার কথা বলছি যা এক ধরনের রাজনৈতিক রূপান্তর, যা একটি দরিদ্র সমাজকে ধনী করতে হলে আবশ্যক। এর প্রমাণ আমরা মিশর থেকেই পাব। তাহরির স্কয়ারের এক বিক্ষোভকারী রেদা মেটওয়ালি বলেন, ‘এ আন্দোলনে আপনি মুসলমান ও খ্রিস্টানদের একসাথে দেখছেন, বৃদ্ধ ও তরুণকে একসাথে দেখছেন। এরা সবাই এক জিনিসই চায়।’ আমরা দেখাব যে সমাজে এ ধরনের বিস্তৃত আন্দোলন কতটা দরকার এবং এর ফলে কীভাবে পৃথিবীর নানান জায়গায় রাজনৈতিক পরিবর্তনগুলো সাধিত হয়। আমরা যদি বুঝতে পারি কখন এবং কেন এ ধরনের রূপান্তর ঘটে, তখন আমরা মূল্যায়ন করতে পারব যা আমাদেরকে আরও সমৃদ্ধ হতে সাহায্য করবে। এতে করে আমরা বুঝতে পারব যে কোন ধরনের আন্দোলন অতীতের মতো ব্যর্থ হবে না এবং দেশের জনগণের জীবনে, লাখ লাখ মানুষের জীবনে সমৃদ্ধি বয়ে আনবে।
















কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন