সোমবার, ২২ মার্চ, ২০২১

আব্রাহাম মাসলোর চাহিদার সোপান তত্ত্ব

মাসলোর চাহিদার সোপান তত্ত্ব হচ্ছে আব্রাহাম মাসলোর একটি মনস্তাত্ত্বিক তত্ত্ব। ১৯৪৩ সালে মাসলো ‘সাইকোলজিকাল রিভিউ’ তথা ‘মনস্তাত্ত্বিক পর্যালোচনা’ পত্রিকায় তার ‘মানব প্রেষণা তত্ত্ব’ নামক গবেষণা পত্র প্রকাশ করেন। এই তত্ত্বটির বৈজ্ঞানিক ভিত্তি ছিল খুবই সামান্য: এটা মাসলো নিজেও উল্লেখ করেছিলেন। পরে মাসলো মানুষের জন্মগত কৌতূহল সম্পর্কে তার পর্যবেক্ষণগুলি অন্তর্ভুক্ত করার জন্য ধারণাটি প্রসারিত করেছিলেন। তার তত্ত্বগুলো মানুষের মনোস্তাত্ত্বিক বিকাশের অন্যান্য অনেক তত্ত্বের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। তার তত্ত্বে মানুষের মনস্তাত্ত্বিক বিকাশে কয়েকটি ধাপ দেখানো হয়েছে। এসব ধাপের প্রতিই মাসলো বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। তারপর তিনি তার তত্ত্বে ভিত্তিতে সমাজের সর্বজনীন চাহিদাকে ভাগ করেন।

হায়ারারকিকে আমরা স্তর-পারম্পর্য বলতে পারি। মাসলোর চাহিদার সোপান তত্ত্বকে মানুষ কীভাবে স্বতঃস্ফূর্তভাবে আচরণ করে তা খুঁজে বের করতে অধ্যয়ন করা হয়। মাসলো কিছু শব্দ ব্যবহার করেছেন, যেমন, ‘জৈবিক’, ‘নিরাপত্তা ও ভালোবাসা’, ‘সামাজিক চাহিদা’ বা ‘সম্মান’, এবং ‘আত্ম উপলব্ধি’। এসব শব্দের মাধ্যমে মাসলো বলতে চেয়েছেন, মানুষের অনুপ্রেরণা কাজ করে। এগুলোর মাধ্যমে মাসলো মানুষের প্রেরণা কাজ করার একটি পদ্ধতি বের করেছেন। এ তত্ত্ব মতে, একজন ব্যক্তির মধ্যে পরবর্তী ধাপে প্রেরণা কাজ করতে হলে এর আগের ধাপকে অবশ্যই পূরণ করে যেতে হবে। এছাড়াও, মানুষের আচরণের ক্ষেত্রে চেষ্টা ও প্রেরণা কীভাবে সম্পৃক্ত তা নিয়ে আলোচনা করতে এ স্তর-পারম্পর্য বা চাহিদার সোপান তত্ত্বকে মূল ভিত্তি হিসাবে ধরা হয়। চাহিদার সোপান তত্ত্বের প্রতিটি ধাপে যেতে হলে আগের ধাপে ব্যক্তিকে সন্তুষ্ট হতে হয়। তারপরই পরের ধাপে যাওয়া হয়। প্রতিটি ধাপেরই কিছু অভ্যন্তরীণ উপাদান থাকে যা ব্যক্তিকে পূরণ করে পরের ধাপে অগ্রসর হতে সাহায্য করে। মাসলোর স্তর-পারম্পর্যের লক্ষ্য হচ্ছে পঞ্চম ধাপ বা স্তর অর্জন করা। পঞ্চম ধাপ হচ্ছে আত্ম উপলব্ধি।

মাসলোর এ তত্ত্বটি ১৯৫৪ সালে তার মোটিভেশন ও পারসোনালিটি তথা অনুপ্রেরণা ও ব্যক্তিত্ব বইয়ে পুরোপুরি প্রকাশিত হয়েছিল। এ স্তর-পারম্পর্য সমাজ বিজ্ঞানের গবেষণা, ব্যবস্থাপনা বিষয়ক প্রশিক্ষণ, মাধ্যমিক ও উচ্চতর মনোবিজ্ঞান বিষয়ক নির্দেশনার ক্ষেত্রে জনপ্রিয় কাঠামো হিসাবে ব্যবহৃত। মাসলোর স্তর-পারম্পর্য বা শ্রেণিবদ্ধকরণ শ্রেণিবিন্যাসকে সময়ের সাথে সাথে সংশোধন করা হয়েছে। আসল শ্রেণিবিন্যাসে বলা হয়েছে যে উচ্চতর ধাপ বা স্তরে যাওয়ার আগে এর পূর্বের স্তরকে অবশ্যই সম্পূর্ণরূপে সন্তুষ্ট ও পরিপূর্ণ হতে হবে। যাই হোক, আজকের গবেষকরা এসব স্তরকে ক্রমাগত একে অপরের সাথে মিশিয়ে কাজ করাকেই বেশি পছন্দ করেন। এর মানে হলো, নিম্নস্তরের যেকোনো স্তর যেকোনো সময় অন্যান্য স্তরের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে।

মাসলোর এ ধারণা বা আইডিয়ার জন্ম হয়েছিল ব্ল্যাকফিট তথা কালোপা জাতির সাথে তার কাজ করার সুবাদে। তিনি কালোপা জাতির বয়স্ক ব্যক্তিদের সাথে আলাপ-আলোচনা করেন। এ জাতির সদস্যরা চামড়ার তৈরি তাবুর মধ্যে থাকেন। তাদের সাথে কথা বলতে গিয়ে মাসলো এ তত্ত্বে ধারণা পান। যাই হোক, মাসলোর তত্ত্বকে সমালোচনা করা হয়। কারণ তার আইডিয়ার মধ্যে কালোপা জাতির আসল তত্ত্বকে ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। আসল তত্ত্ব ছিল, আত্ম উপলব্ধির মূল ভিত্তি হচ্ছে সামাজিক উপলব্ধি এবং সামাজিক উপলব্ধির মূল হচ্ছে সাংস্কৃতিক চিরস্থায়ীত্বতা। এই সাংস্কৃতিক বাস্তবায়ন বা চিরস্থায়ীত্বতাকে কালোপা জাতি দর্শনের সর্বোচ্চ ধাপ হিসাবে ধরা হয়।


হায়ারারকি তথা স্তর-পারম্পর্য

মাসলোর চাহিদার সোপান তত্ত্বকে প্রায়ই পিরামিডের সাথে তুলনা করা হয়। প্রাথমিক চাহিদাগুলো থাকে পিরামিডের নিচের স্তরে। এরপর চাহিদাগুলো উচ্চতর স্তরে উঠতে থাকে। সবার উপরে হলো আত্মোপলব্ধির স্তর। অন্য কথায় বলতে গেলে, ব্যক্তির মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ করার পরেই সে উচ্চতর চাহিদা পূরণের পথে পা বাড়াতে পারে। উচ্চতর চাহিদা পূরণের প্রেরণা পায় আগের স্তরের চাহিদাগুলো পূরণ করার মাধ্যমে। যদিও পিরামিড সদৃশ এ হায়ারারকি তথা স্তর-পারম্পর্যের স্তরগুলো মাসলোর আইডিয়া, কিন্তু মাসলোর প্রকৃত তত্ত্বে এভাবে পিরামিড সদৃশ আকারে সাজানো ছিল না।


পিরামিড সদৃশ এ স্তর-পারম্পর্যের প্রথম চারটি স্তরকে মাসলো বলতেন, ‘ন্যূনতম চাহিদা’। সম্মান, বন্ধুত্ব ও ভালোবাসা, নিরাপত্তা ও জৈবিক চাহিদা এর মধ্যে পড়ে। যদি এ ‘ন্যূনতম চাহিদা’ পূরণ না হয় তবে মৌলিক (জৈবিক) চাহিদা ব্যতীত, অন্য চাহিদাগুলোর জন্য হয়তো কোনো শারীরিক ইঙ্গিত দেখা যাবে না, কিন্তু ব্যক্তি ভিতর থেকে উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তা বোধ করবে। মাসলোর তত্ত্ব মতে, মৌলিক চাহিদাগুলো আগে পূরণ হতে হবে। তারপর ব্যক্তির মধ্যে উচ্চতর চাহিদার জন্য আকাঙ্ক্ষা শক্তিশালী হবে (বা একাগ্রভাবে মনোযোগ দিতে পারবে)। ভিন্নভাবে বলা যায়, পূর্বের চাহিদা পূরণ হওয়ার পরই পরবর্তী স্তরের প্রতি ব্যক্তির আকাঙ্ক্ষা শক্তিশালী হবে। মাসলো ‘মেটামোটিভেশন’ বলে একটি শব্দের উল্লেখ করেন। এর মানে হচ্ছে যারা আত্মোপলব্ধি অর্জনের পথে অগ্রসর হয়, তারা পূর্বে নিজেদের মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ করার পরেই অগ্রসর হয়। মৌলিক (জৈবিক) চাহিদা ও অন্যান্য স্তরের চাহিদা পূরণ করার পরেই লোকজন আরও উন্নত ধাপে উন্নীত হতে সংগ্রাম করে।


মানব মস্তিষ্ক একটি জটিল সিস্টেম এবং একই সময়ে সমান্তরাল প্রক্রিয়ায় চলতে থাকে, সুতরাং মাসলোর হায়ারারকির বিভিন্ন স্তরে বিভিন্ন প্রেরণা একই সময়ে ঘটতে পারে। মাসলো এই স্তরগুলোর "আপেক্ষিক", "সাধারণ" এবং "প্রাথমিকভাবে" এদের মধ্যকার সম্পর্ক ও সন্তুষ্ট হওয়ার শর্ত সম্পর্কেও বলে গেছেন। একজন ব্যক্তি নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট প্রয়োজনের দিকে মনোনিবেশ করে-তার পরিবর্তে, মাসলো বলেছিলেন যে একটি নির্দিষ্ট প্রয়োজন মানবজীবনের ওপর "আধিপত্য" করে। এভাবে মাসলো স্বীকার করেন যে একই সময় বিভিন্ন স্তরের প্রেরণা ক্রিয়া করতে পারে। তবে তিনি মূলত অনুপ্রেরণার মূল ধরনগুলি এবং তাদের স্তরগুলোর পর্যায়ক্রম চিহ্নিত করার দিকে মনোনিবেশ করেছিলেন।


জৈবিক চাহিদা


জৈবিক চাহিদাকে আমরা শারীরবৃত্তীয় চাহিদাও বলতে পারি। জৈবিক চাহিদা হলো এক ধরনের ধারণা বা তত্ত্ব যা অনুপ্রেরণা তত্ত্বের ব্যাখ্যা ও ব্যবহার থেকে উদ্ভূত হয়। এই ধারণার মূল হচ্ছে মানুষকে বেঁচে থাকতে  হলে শারীরিক যেসব প্রয়োজন মেটাতে হয় তা। এর মানে হচ্ছে শারীরিক তথা জৈবিক চাহিদা একটি বিশ্বব্যাপী চাহিদা। এটা মানুষের প্রাথমিক চাহিদা। এ অনেকটা মানুষের জন্মের সাথে সাথে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই থাকে। একে বলা যায় একটি জেলার নির্বাহী কার্যক্রম চালানোর জন্য জেলা প্রশাসকের মতো। এ প্রশাসক মানুষের উচ্চতর চাহিদাগুলো পূরণের প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দেয়। ব্যক্তি যখন উচ্চতর চাহিদা পূরণ করতে যায় তখন প্রাথমিক চাহিদা পূরণ না হলে উচ্চতর চাহিদা পূরণ বাধাগ্রস্ত হয়। প্রাথমিক চাহিদা, যেমন, খাবার বা বাতাসের অভাব। জৈবিক চাহিদাগুলোকে মাসলোর চাহিদার সোপান তত্ত্ব মতে অভ্যন্তরীণ প্রেরণা বলে বিবেচনা করা হয়েছে। মাসলোর তত্ত্ব মতে, মানুষ এসব জৈবিক চাহিদা পূরণ করতে বাধ্য। ব্যক্তি যদি উচ্চতর চাহিদার খোঁজেও যায়, তবুও সে আগে এসব জৈবিক চাহিদা পূরণ করতে বাধ্য। যদি এসব চাহিদা পূরণ না হয়, তবে ব্যক্তির মধ্যে এক ধরনের অতৃপ্তির জন্ম হয়। এর বিপরীতে, ব্যক্তির মধ্যে যখন অতৃপ্তির জন্ম হয়, তখন ব্যক্তির মধ্যকার প্রেরণা হ্রাস পায় এবং অতৃপ্তির বৃদ্ধি ঘটে। জৈবিক চাহিদাকে একই সাথে এক ধরনের বৈশিষ্ট্য ও অবস্থা বলা যেতে পারে। জৈবিক চাহিদাকে বৈশিষ্ট্য হিসাবে উল্লেখ করলে বলতে হয় এটা দীর্ঘমেয়াদি বৈশিষ্ট্য, অপরিবর্তশীল চাহিদা, যা মানুষের জীবন ধারণের জন্য অত্যাবশ্যক। আর জৈবিক চাহিদাকে অবস্থা হিসাবে উল্লেখ করলে বলতে হয় এটা আনন্দের অপ্রীতিকর হ্রাস ঘটায় এবং একটি প্রয়োজন পূরণের দিকে তাগাদ দেয়। ব্যক্তির মধ্যে নিহিত তথা সহজাত প্রেরণা রয়েছে উচ্চতর চাহিদা পূরণের। তবে এ চাহিদা পূরণ করতে হলে আগে ব্যক্তিকে অবশ্যই জৈবিক চাহিদা পূরণ করতে হবে। তার মানে, একজন মানুষকে যদি তার জৈবিক চাহিদা পূরণে সংগ্রাম করতে হয়ে, তবে সে পরের স্তরের চাহিদাগুলোর দিকে, যেমন নিরাপত্তা, সামাজিক চাহিদা, সম্মান ও আত্মোপলব্ধির স্তরের দিকে ধাবিত হওয়ার সম্ভাবনা নেই।


জৈবিক চাহিদাগুলোর মধ্যে রয়েছে:


বাতাস

হোমিওস্টেসিস

পানি

খাবার

যৌনতা

ঘুম

স্বাস্থ্য

পোশাক

আশ্রয়


--- --- --- ---

উদ্দীপকে মিলন মাসলোর চাহিদাতত্ত্ব অনুযায়ী তৃতীয় স্তর অর্থাৎ সামাজিক চাহিদার স্তরে অবস্থান করছেন। সমাজের একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হিসেবে অন্যদের সঙ্গে মিলেমিশে চলার চাহিদাকেই সামাজিক চাহিদা বলে। মানুষ যখন নিরাপত্তাবোধে তৃপ্ত হয়, তখন সে বন্ধুবান্ধব ও অন্যদের সঙ্গে মিলেমিশে চলতে চায় এবং অন্যদের ভালোবাসা পাওয়ার প্রত্যশা করে। এ পর্যায়ে সে বিভিন্ন সামাজিক কার্যক্রমে উত্সাহিত হয় ও নিজেকে সমাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে ভালোবাসে।

তৃতীয় স্তর অর্থাৎ সামাজিক চাহিদার স্তর

উদ্দীপকে মিলন (মিলন একটি নমুনা নাম) মাসলোর চাহিদাতত্ত্ব অনুযায়ী তৃতীয় স্তর অর্থাৎ সামাজিক চাহিদার স্তরে অবস্থান করছেন। সমাজের একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হিসেবে অন্যদের সঙ্গে মিলেমিশে চলার চাহিদাকেই সামাজিক চাহিদা বলে। মানুষ যখন নিরাপত্তাবোধে তৃপ্ত হয়, তখন সে বন্ধুবান্ধব ও অন্যদের সঙ্গে মিলেমিশে চলতে চায় এবং অন্যদের ভালোবাসা পাওয়ার প্রত্যশা করে। এ পর্যায়ে সে বিভিন্ন সামাজিক কার্যক্রমে উত্সাহিত হয় ও নিজেকে সমাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে ভালোবাসে।

পঞ্চম স্তর অর্থাৎ সেলফ অ্যাকচুয়ালাইজেশন - আত্ম উপলব্ধি

চতুর্থ স্তর অর্থাৎ সম্মান

তৃতীয় স্তর অর্থাৎ সামাজিক চাহিদার স্তর

দ্বিতীয় স্তর অর্থাৎ নিরাপত্তার চাহিদার স্তর

প্রথম স্তর অর্থাৎ জৈবিক চাহিদার স্তর

আব্রাহাম মাসলো তাঁর চাহিদার সোপান তত্ত্বে বলেছেন, মানুষ প্রথম তার জৈবিক চাহিদা (খাদ্য, ঘুম, যৌনতা) পূরণ করতে চায়, এরপর ধাপে ধাপে সে চায় আশ্রয়, নিরাপত্তা, ভালোবাসা, নিজের সম্মান, অপরের প্রশংসা। এসব চাহিদা পূরণ হয়ে গেলে সে চায় ‘সেলফ অ্যাকচুয়ালাইজেশন’। সেলফ অ্যাকচুয়ালাইজড মানুষের উপজীব্য হয় নৈতিকতা, সৃষ্টিশীলতা, সমস্যা সমাধানের দক্ষতা, নিজস্ব ভাবনা আর সংস্কারমুক্ত হয়ে নতুন কিছু করার প্রেরণা। কিন্তু অভিভাবকদের হিসাবি, ক্লিশে ভাবনা আর আটপৌরে পারিপার্শ্বিকতা তরুণদের এই সোপানের সর্বোচ্চ শিখরে উঠতে উৎসাহিত করে না।

জ্ঞানীয় বিকাশ (কগনিটিভ ডেভেলপমেন্ট) - Cognitive development




তথ্যসূত্র:

১। https://www.prothomalo.com/education/%E0%A6%AC%E0%A7%8D%E0%A6%AF%E0%A6%AC%E0%A6%B8%E0%A6%BE%E0%A7%9F-%E0%A6%B8%E0%A6%82%E0%A6%97%E0%A6%A0%E0%A6%A8-%E0%A6%93-%E0%A6%AC%E0%A7%8D%E0%A6%AF%E0%A6%AC%E0%A6%B8%E0%A7%8D%E0%A6%A5%E0%A6%BE%E0%A6%AA%E0%A6%A8%E0%A6%BE-%E0%A7%A8%E0%A7%9F-%E0%A6%AA%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%B0-%E0%A6%B8%E0%A7%83%E0%A6%9C%E0%A6%A8%E0%A6%B6%E0%A7%80%E0%A6%B2-%E0%A6%AA%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%B6%E0%A7%8D%E0%A6%A8-3

২। https://www.prothomalo.com/opinion/column/%E0%A6%A4%E0%A6%B0%E0%A7%81%E0%A6%A3%E0%A6%A6%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%9A%E0%A6%BF%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A4%E0%A6%BE%E0%A6%B0-%E0%A6%A7%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A6%BE-%E0%A6%AC%E0%A6%A6%E0%A6%B2%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%9A%E0%A7%87%E0%A6%B7%E0%A7%8D%E0%A6%9F%E0%A6%BE-%E0%A6%A8%E0%A7%9F

৩। https://www.prothomalo.com/opinion/%E0%A6%97%E0%A7%8D%E0%A6%B2%E0%A6%BE%E0%A6%B8%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%85%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%A7%E0%A7%87%E0%A6%95-%E0%A6%96%E0%A6%BE%E0%A6%B2%E0%A6%BF-%E0%A6%B8%E0%A6%BE%E0%A6%82%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%A6%E0%A6%BF%E0%A6%95%E0%A6%95%E0%A7%87-%E0%A6%B8%E0%A7%87%E0%A6%96%E0%A6%BE%E0%A6%A8%E0%A7%87%E0%A6%87-%E0%A6%A8%E0%A6%9C%E0%A6%B0-%E0%A6%A6%E0%A6%BF%E0%A6%A4%E0%A7%87-%E0%A6%B9%E0%A6%AC%E0%A7%87

৪।

৫।

শুক্রবার, ১৯ মার্চ, ২০২১

বই পর্যালোচনা: নেগোসিয়েশন। ব্রায়ান ট্রেসি।


#ব‌ই_পর্যালোচনা:

নেগোসিয়েশন: ব্রায়ান ট্রেসি

Negotiation by Brian Tracy

[এখানে রয়েছে ৪,৭০৪টি শব্দ। পড়তে সময় লাগতে পারে ১৭:০৭ মিনিট।]

নেগোসিয়েশন। একে বাংলায় বলা যেতে পারে দর কষাকষি, কথায় জেতার কৌশল অথবা আলাপ-আলোচনা। নেগোসিয়েশন এক ধরনের দক্ষতা। আর অন্য সব দক্ষতার মতো এটাও শেখা যায়।

অন্যের জামাকাপড়, অবস্থা, পরিস্থিতি বা চুক্তির শর্তাবলি দেখে কখনও ভয় পাবেন না। ভয়ের বিপরীত আচরণ করে ভয় দূর করতে পারেন। একে বলে 'systematic desensitization'. সিস্টেমেটিক ডিসেনসিটাইজেশন পদ্ধতি বলে, আপনি যদি আপনার ভীতির সম্মুখীন হন এবং কাজটি বারবার করে যান, তবে একসময় ভয় দূর হয়ে যাবে। ভয় যেমন এক ধরনের অভ্যাস, সাহসও তেমন এক ধরনের অভ্যাস।

প্রত্যাখ্যান কোনো ব্যক্তিগত বিষয় নয়। প্রত্যাখ্যানকে ব্যক্তিগতভাবে নিবেন না। আমি যখন থেকে এই ধারণা পেয়েছি তখন থেকে একজন অসাধারণ বিক্রয়কর্মী হয়ে উঠেছি।

নেগোসিয়েশন এক ধরনের খেলার মতো। এটা গুরুগম্ভীর কোনো বিষয় নয়, বাঁচা-মরার ব্যাপার নয়। এটাকে এক ধরনের খেলা হিসাবে ধরে নিন।

দুই ধরনের নেগোসিয়েশন আছে। একটি হচ্ছে ওয়ান অফ স্টাইল (one-off style) তথা দর-কষাকষি কেবল একবারই করব। আরেকটি হচ্ছে লং-টার্ম নেগোসিয়েশন (long-term negotiation) তথা দীর্ঘমেয়াদি আলাপ-আলোচনা।


চাইনিজ কন্ট্রাক্ট তথা চীনের চুক্তি করার ধরন হচ্ছে প্রথমে তারা বসে এক অপরের সাথে আলাপ-আলোচনা করে। যেসব বিষয়ে একমত হয় সেগুলো কাগজে লিখে নেয়। তারপর সেগুলো পুনর্বিবেচনা করে, পুনরায় আলাপ-আলোচনা করে এবং উভয় পক্ষ একমত হলে চুক্তি তৈরি করার পর স্বাক্ষর করে। আর পশ্চিমা চুক্তি অনেক সময় ও পরিশ্রম ব্যয় করে আগে তৈরি করা হয়। এদিক থেকে চীনের চুক্তি করার ধরনকে লেখক ব্রায়ান ট্রেসি উত্তম বলেছেন।

পেশাগত জীবনে নেগোসিয়েশনের একজন বিশেষজ্ঞ হিসাবে পরিচিত জেরার্ড নিরেনবার্গের (Gerard Nierenberg) মতে, 'নেগোসিয়েশন এর উদ্দেশ্য হচ্ছে একটি ঐকমত্যে পৌঁছানো, যাতে করে সব অংশগ্রহণকারী তাদের চাহিদা অনুযায়ী সন্তুষ্ট হতে পারে। এই সন্তুষ্টি থেকেই তারা ভিতরগতভাবে তাদের অঙ্গীকার পূরণের প্রেরণা পায়। একই সন্তুষ্টির কারণে তারা আরও নেগোসিয়েশন করতে এবং অপর পক্ষের সাথে আরও লেনদেন করতে আগ্রহী হয়।'

আসুন, জেরার্ড নিরেনবার্গের বক্তব্যকে আমরা ভাগ করে দেখি:

প্রথমত, একটি ঐকমত্যে পৌঁছানো … মানে নেগোসিয়েশনের উদ্দেশ্য হচ্ছে হারজিত বা অপর পক্ষকে পরাজিত করানো নয়; বরং একটি ঐকমত্যে পৌঁছানো।

দ্বিতীয়ত, নিরেনবার্গের সংজ্ঞার দ্বিতীয় অংশ যদি আমরা দেখি, যেখানে সব অংশগ্রহণকারী তাদের চাহিদা অনুযায়ী সন্তুষ্ট হতে পারে … মানে নেগোসিয়েশনে অংশগ্রহণকারী প্রত্যেক পক্ষের কিছু চাওয়া ও আকাঙ্ক্ষা রয়েছে। সেসব চাওয়া ও আকাঙ্ক্ষা একে অপরের থেকে ভিন্ন হতে পারে। এ জন্যই নেগোসিয়েশন তথা আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে এসব চাওয়া ও আকাঙ্ক্ষা পূরণের চেষ্টা করা হয়।

তৃতীয়ত, এই সন্তুষ্টি থেকেই তারা ভিতরগতভাবে তাদের অঙ্গীকার পূরণের প্রেরণা পায়। … তার মানে উভয় পক্ষ যখন তাদের চাহিদা অনুযায়ী সন্তুষ্ট হতে পারে, তখন তারা এ সন্তুষ্টি থেকে ভিতরগতভাবে তাদের অঙ্গীকার পূরণের প্রেরণা পায়। তারা তাদের ব্যবসা বা কাজ চালিয়ে নিতে নিজে নিজেই উৎসাহিত হয়।


চতুর্থত, এই সন্তুষ্টির কারণে তারা আরও নেগোসিয়েশন করতে এবং অপর পক্ষের সাথে আরও লেনদেন করতে আগ্রহী হয়। … নিরেনবার্গের এ অংশ দীর্ঘমেয়াদি ব্যবসায়িক সম্পর্ক বজায় রাখতে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আলাপ-আলোচনায় অংশগ্রহণকারী উভয় পক্ষ যখন একে অপরের চাহিদা অনুযায়ী সন্তুষ্ট হতে পারে, তখন তারা এ সন্তুষ্টির কারণে পরবর্তী সময়ও একসাথে কাজ করতে আগ্রহ প্রকাশ করে। এটাই দীর্ঘমেয়াদি ব্যবসায়িক সম্পর্ক তৈরি করে।

দ্য ল অফ ইনডাইরেক্ট ইফেক্ট (The Law of Indirect Effort) তথা পরোক্ষ নীতির প্রভাব: বলা হয়ে থাকে, সরাসরি চেষ্টা করার চেয়ে পরোক্ষভাবে চেষ্টা করা উত্তম। আপনি যত বেশি অন্যকে পরোক্ষভাবে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করবেন, তত বেশি অন্যরা আপনার প্রতি সন্তুষ্ট হবে এবং আপনাকে সাহায্য করার চেষ্টা করবে। রালফ ওয়াল্ডো এমারসন বলেন, ‘কাউকে বন্ধু হিসাবে পেতে হলে প্রথমে আপনাকে তার বন্ধু হতে হবে।’

নেগোসিয়েশন বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। তবে আমরা এর মধ্যে সবচেয়ে বহুল ব্যবহৃত ছয় ধরনের নেগোসিয়েশনকে আলাপ-আলোচনার প্রকারভেদ হিসাবে ধরে নিই।

১। জিত-হারের আলাপ-আলোচনা

২। হার-জিতের আলাপ-আলোচনা

৩। হার-হার আলাপ-আলোচনা বা উভয় পক্ষ হেরে যাওয়ার আলাপ-আলোচনা

৪। সমঝোতাভিত্তিক আলাপ-আলোচনা

৫। একমত না হওয়ার আলাপ-আলোচনা

৬। আপনার লাভ-আমারও লাভ (win-win) তথা উভয় পক্ষ জয়ী হওয়ার আলাপ-আলোচনা

সবসময় উভয় পক্ষ জয়ী হয়, এমন আইডিয়া, কলাকৌশল, বুদ্ধি ও ধারণা খুঁজবেন। এতে করে আপনার যেমন আকাঙ্ক্ষা ও চাহিদা পূরণ হবে, তেমন অন্যেরও চাহিদা পূর্ণ হবে।


সবসময় অন্যান্য পক্ষ নেগোসিয়েশনে কী চায় সেই সম্পর্কে স্পষ্ট থাকবেন। এ বিষয়গুলো কাগজে লিখে রাখবেন। এতে করে আলাপ-আলোচনা করার সময় স্পষ্ট ও পরিষ্কারভাবে সকলের সামনে থাকবে।

নেগোসিয়েশনের ক্ষেত্রে অন্য পক্ষের বিনিয়োগ যত বেশি হবে, আপনার ক্ষেত্রে আলাপ-আলোচনা করতে তত সহজ হবে।

আলাপ-আলোচনা করার সময়, আলোচ্য মূল বিষয় নিয়ে কথা বলবেন। আলোচ্য বিষয়টি যত দুর্লভ হবে, অন্যের আকাঙ্ক্ষা ও চাহিদা যত বৃদ্ধি পাবে, আপনার নেগোসিয়েশন করতে তত সহজ হবে।

সবসময় নেগোসিয়েশন করার আগে আলাপ-আলোচনার মূল বিষয় সম্পর্কে যত বেশি তথ্য সংগ্রহ করতে পারেন, তত ভালো। দরকার হলে, কোন একজন বিশেষজ্ঞের মতামত নিন অথবা বিশেষজ্ঞ ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে সাথে নিয়ে আলাপ-আলোচনায় অংশগ্রহণ করুন।

নেগোসিয়েশনের সময় আবেগ ও অনুভূতিকে নিয়ন্ত্রণে রাখুন। প্রথমত, লোভ। আপনি একটি জিনিস কত তীব্রভাবে চান? কোনো জিনিস সম্পর্কে আগ্রহ থাকা ভালো। তবে তা নিয়ে লোভী হয়ে ওঠা কখনোই উত্তম নয়। তারপর ভীতি। আলাপ-আলোচনাকালে ভয় পাওয়া যাবে না। এজন্য নেগোসিয়েশনের সময় একটু উদাসীন থাকা উত্তম। উদাসীন ভাব নিয়ে আলাপ-আলোচনা করে গেলেন। আপনি একটি জিনিস চান, তবে তা পাবেন বা পাবেন না, এ নিয়ে উদাসীন থেকে আলাপ-আলোচনা করে গেলেন।

সবসময় শান্তভাব বজায় রাখুন। তাতে হয়েছে কী? যদি এই আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে আপনি যা চান তা অর্জন করতে না পারেন, তাতে হয়েছে কী? ব্যবসায়িক শিক্ষাদীক্ষার ক্ষেত্রে আমার গুরু একজন সফল ব্যবসায়ী। তিনি বলতেন, ‘ব্রায়ান, ব্যবসায়িক লেনদেন বা সুযোগ এক ধরনরে বাসের মতো। একটি গেলে, আরেকটি আসবে। কোনো চিন্তা নেই। এ নিয়ে বেশি উদ্বিগ্ন হয়ো না। বেশি চিন্তা করো না। কোন একটি আলাপ-আলোচনা যদি সফল না হয়, তবে যেতে দাও, বাদ দাও। ভুলে যাও। অন্য কিছু নিয়ে কাজ করো। এটা হয়নি। তাতে কী? অন্যটা হবে।’


উদাসীনতা বা অনাসক্ত ভাব দেখান। নির্লিপ্ত থাকার অভ্যাস করুন। আপনি যখন কোনো নেগোসিয়েশন তথা আলাপ-আলোচনায় যাবেন, তখন অনাসক্ত ভাব দেখান, নির্লিপ্ত থাকনু। নিজেকে লক্ষ করুন। শান্ত হোন। একেবারে বুদ্ধের মতো। নিজের আবেগ অনুভূতিকে নিজের ওপর চেপে বসতে দিবেন না। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করুন। তবেই যেকোনো ব্যবসায়িক লেনদেন বা সুযোগ কাজে লাগাতে পারবেন।

নেগোসিয়েশনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে সময় এবং সময়ের অবস্থান। আপনাদের সাথে একটি গোপন কথা শেয়ার করি। গাড়ি ক্রয় করার সর্বোত্তম উপায় হচ্ছে মাসের শেষের দুই-তিনদিন আগে ক্রয় করা। কারণ, তখন বিক্রয়কর্মীরা মাসিক বিক্রয়ের টার্গেট পূরণের চাপে থাকে। টার্গেট পূরণ করতে, প্রায় সময় বিক্রয়কর্মীরা অল্প লাভেও বিক্রি করে ফেলে। তাই মাসের শেষের দুই-তিনদিন আগে গাড়ি ক্রয় করতে যাওয়া উত্তম।

জরুরি বা তাড়ার গুরুত্ব অনুভব করুন। কেউ যদি আপনাকে বলে, এখনই ক্রয় করলে এ এ সুবিধা পাবেন, কিন্তু পরে কিনতে গেলে, আর এসব সুবিধা পাবেন না। তখন এ তাড়াকে এভাবে নিয়ন্ত্রণ করুন: আমাকে যদি এখনই সিদ্ধান্ত নিতে হয়, তবে সিদ্ধান্ত হবে ‘না’। কিন্তু আমি যদি এসব সুবিধা নিয়ে পরবর্তী সময় বিচারবিবেচনা করার সুযোগ পাই, তবে আমার উত্তর হয়তো ভিন্ন হতে পারে।

কখনো কোনো সিদ্ধান্ত নিতে তাড়াহুড়া করবেন না। যখনই কেউ আপনাকে দ্রুত কোনো সিদ্ধান্ত নিতে চাপ দিবে, আপনি এভাবে এ তাড়াকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন: এ বিষয়ে আমার আরও চিন্তা করতে হবে। আমি আপনাকে পরে এ ব্যাপারে জানাব।

সবচেয়ে ভালো নেগোসিয়েশন তথা আলাপ-আলোচনা হচ্ছে সময় ক্ষেপন করা তথা আরও সময় নেয়া। আলাপ-আলোচনার মধ্যে সবসময় এক ধরনের সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর জন্য তাড়া থাকে। এজন্য সবচেয়ে ভালো হয় সময় ক্ষেপন করা বা আরও সময় নেয়া। একটি সিদ্ধান্ত নিতে আপনি যত বেশি সময় নিবেন, আপনি তত বেশি উত্তম সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন।


সময়সীমা নির্ধারণ করে দিন। যখনই আপনি কোনো ধরনের আলাপ-আলোচনা করবেন, তখনই অন্য পক্ষকে একটি সময়সীমা নির্ধারণ করে দিন। আমাদের এক সহকর্মী একবার জাপানের এক কোম্পানির সাথে একটি ব্যবসায়িক চুক্তি নেগোসিয়েশন করতে গিয়েছিল। সহকর্মী জাপানে রওনা দেয়। প্লেন থেকে নামার পর জাপানিজ কোম্পানি তাকে লিমুজিন গাড়িতে সংবর্ধনা জানায়। গাড়িতে সহকর্মীকে জিজ্ঞেস করে, সে কবে চলে যাবে তাহলে প্লেনের টিকেট অগ্রিম কেটে রাখত। এভাবে তারা জেনে যায়, সহকর্মী কবে জাপান থেকে চলে যাবে। ভালো হোটেলে থাকার ব্যবস্থা করে। তারপর তাদের কারখানা ঘুরিয়ে দেখায়। এ কয়েকদিন তারা চুক্তি নিয়ে একটি কথাও বলেনি। পরে, সহকর্মীকে প্লেনে ওঠার সময় যখন গাড়িতে করে এয়ারপোর্টে পৌঁছে দিচ্ছে তখন তারা চুক্তি নিয়ে আলাপ করে। আমাদের সহকর্মী তাড়াহুড়ার মধ্যে ছিল, তাই সে খুব বাজে চুক্তি করে এসেছে। সে বুঝতে পারেনি যে তাকে সুযোগ-সুবিধা দিয়ে, সময় ক্ষেপন করে, তাকে এক ধরনের চাপের মধ্যে রেখে আলাপ-আলোচনা করা হয়েছে। ফলাফল যা হয়, ব্যবসায়িক চুক্তিটি আমাদের জন্য লাভজনক হল না।

নেগোসিয়েশনে ২০/৮০ সূত্র কাজে লাগান। এ সূত্র বলে, কোনো একটি লেনদেন বা সুযোগ নিয়ে আলাপ-আলোচনা করার সময় শেষ ২০ শতাংশ সময় পুরো লেনদেনের ৮০ শতাংশ ফলাফল দেয়। একটি ব্যবসায়িক লেনদেন বা সুযোগ নিয়ে আলাপ করার জন্য আপনার হাতে যদি ২ ঘণ্টা সময় থাকে তবে শেষের ৩০ মিনিট সবসময় খুব গুরুত্বপূর্ণ। ধৈর্য ধরুন।

আপনি কী চান? তা ঠিক করে নিন। একটি কাগজে লিখে নিন। আপনি যা কিছু চান তার তালিকা তৈরি করুন।

হার্ভার্ড নেগোসিয়েশন প্রকল্প। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে নেগোসিয়েশনের কলাকৌশল, ধারণা ও বিভিন্ন বুদ্ধি-পরামর্শ নিয়ে একটি প্রকল্প করা হয়। এর নাম দেয়া হয় হার্ভার্ড নেগোসিয়েশন প্রকল্প। এ প্রকল্পের সবকিছুই একটি বইয়ে প্রকাশ করা হয়। বইয়ের শিরোনাম: Getting to Yes: Negotiating Agreement Without Giving In, by Roger Fisher, William Ury, and Bruce Patton. এ বইয়ের বিষয়বস্তুর মূল ধারণা এখানে সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো:

১। লোকজন: যুক্তি দিয়ে সবকিছু বিচার করুন। আবেগ অনুভূতি থেকে দূরে থাকুন। নেগোসিয়েশনকে ব্যক্তিগতভাবে তথা নিজের ওপর নিবেন না। আপনার মনমস্তিষ্ক ও চোখ সবসময় নেগোসিয়েশনের মূল বিষয়বস্তুর ওপর রাখুন (এজন্য একটি কাগজে লিখে নিয়ে যান এবং তা সবসময় চোখের সামনে রাখুন)। নিজেকে কখনো অপর ব্যক্তির চালচলন, পোশাক-আশাক বা ইতিবাচক-নেতিবাচক কিছুর দ্বারা প্রভাবিত হতে দিবেন না।


২। আগ্রহ: আপনি এ আলাপ-আলোচনা থেকে কী কী ফলাফল চান?-তার একটি তালিকা তৈরি করুন। আপনি যখন অপর পক্ষের সাথে আলাপ-আলোচনা করবেন তখন অন্যদের আগ্রহের ব্যাপারেও সজাগ থাকুন।

৩। একাধিক খাত তৈরি করুন (options): আলাপ-আলোচনা করার মতো বিভিন্ন সুযোগ ও সম্ভাবনা তৈরি করুন। আলাপ-আলোচনা করার মতো একাধিক খাত তৈরি করুন। নিজেদের চাহিদা ও আকাঙ্ক্ষা পূরণের অনেক রাস্তা খুঁজে বের করুন। অনেকে একসাথে বসে আলোচনা করুন। ব্রেইনস্ট্রমিং করুন। বিভিন্ন বিকল্প উপায় ও পথ নিয়ে কথা বলুন। মাইন্ড ম্যাপ, ফ্লিপচার্ট, ব্ল্যাকবোর্ড বা হোয়াইটবোর্ড ব্যবহার করুন।

৪। নির্ণায়ক বা মানদণ্ড (Criteria): এগুলো হচ্ছে এমন কিছু নির্ণায়ক বা মানদন্ড যেগুলোর বাইরে আপনি আলাপ-আলোচনা করবেন না।

সবসময় আলাপ-আলোচনা করা আগে কী ধরনের চুক্তি বা ফলাফল হলে আপনি সন্তুষ্ট হবেন তা নিয়ে চিন্তা করবেন। আমি এরকম ফলাফল দেখতে চাই। 'আমি এ আলাপ-আলোচনা থেকে এটা অর্জন করতে চাই। আমি এ আলাপ-আলোচনা থেকে এই লক্ষ্য অর্জন করতে চাই।' এভাবে আলাপ-আলোচনা করার আগেই কী ধরনের ফলাফল হলে আপনি সন্তুষ্ট হবেন তা নিয়ে চিন্তাভাবনা করবেন।

পূর্বপ্রস্তুতি হচ্ছে সাফল্যের মূল চাবিকাঠি। যেকোনো কাজে পূর্বপ্রস্তুতি নেয়া পেশাগত আচরণের লক্ষণ। আপনি কী নিয়ে কথা বলতে যাচ্ছেন? এই আলাপ-আলোচনার উদ্দেশ্য কী? আপনি কী অর্জন করতে চান তা পরিষ্কারভাবে লিখুন। লিখিত আলোচ্যসূচি নিয়ে টেবিলে বসে আলাপ-আলোচনা করুন। এই নেগোসিয়েশন তথা আলাপ-আলোচনা করার উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য কী? এগুলো সম্পর্কে স্পষ্টভাবে একটি কাগজে লিখে নিয়ে আলাপ-আলোচনায় বসুন।

একাধিক খাত (options) তৈরি করুন। বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সম্ভাবনার কথা তুলে ধরুন। বিভিন্ন খাত তৈরি করে আলাপ-আলোচনা করা মানে স্বাধীনতা দেয়া। বলা হয়ে থাকে একাধিক খাত তৈরি করে আলাপ-আলোচনা করা সর্বোত্তম কৌশল।


আপনার হাতে যদি একাধিক খাত না থাকে, বিভিন্ন সুযোগ-সম্ভাবনার কথা তুলে না ধরেন, তবে অপর পক্ষ যা বলবে আপনাকে তাই মেনে নিতে হবে। তখন আপনার হাত বাঁধা থাকবে। কিন্তু আপনি যদি বিভিন্ন ধরনের খাত, সুযোগ-সম্ভাবনার কথা তুলে ধরেন, তবে আলাপ-আলোচনা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত হতে পারে। তখন আপনার হাতে শক্তি থাকবে। বিভিন্ন দিক নিয়ে কথা বলতে পারবেন। যত বেশি সম্ভব বিকল্প উপায় চিন্তা করে কাগজে লিখে রাখুন। আলাপ-আলোচনা শুরু হওয়ার আগেই সতর্কভাবে চিন্তাভাবনা করুন।

এ আলাপ-আলোচনায় আপনি কী দাম পরিশোধ করবেন? কোন সময় এবং কোন তারিখে তা পরিশোধ করবেন?-এসব বিষয় নিয়ে চিন্তা করুন। যখন আপনার হাতে পর্যায়ক্রমিক অনেক খাত থাকবে, তখন আপনি স্বাধীনভাবে অপর ব্যক্তির শর্ত ও নিয়মাবলির যেকোনো একটি নির্বাচন বা প্রত্যাখ্যান করতে পারবেন।

প্রস্তুতির মূল চাবিকাঠি হচ্ছে যাদের সাথে আপনি নেগোসিয়েশন করবেন তাদের সম্পর্কে আগে থেকেই কিছু হোমওয়ার্ক করা।

যাদের সাথে নেগোসিয়েশন করবেন তাদের সম্পর্কে খোঁজখবর নিতে তাদের পরিচিতজনদের ফোন করুন, তাদের সম্পর্কে খোঁজখবর নিন। আপনার দরকারি বিষয়গুলো জিজ্ঞেস করে জেনে নিন।

পিটার ড্রুকার বলেন, 'সব ব্যর্থতার মূল হচ্ছে ভুল অনুমান।' নেগোসিয়েশনের আগেই নিজেকে জিজ্ঞেস করুন, আমার অনুমানগুলো কী? কোন কোন অনুমানকে আমি নিশ্চিত বলে মনে করি? আমার মনের ভিতর লুকানো অনুমানগুলো কী? নেগোসিয়েশনের বিপরীত পক্ষ আপনাকে কী হিসাবে মনে করে-উদাসীন, বন্ধুত্বপূর্ণ বা আক্রমণাত্মক?

আপনার অনুমানগুলোকে পরীক্ষা করে দেখুন। একটি অনুমানের ব্যাপারে আমরা বলতে পারি, আমরা যখন কোন নেগোসিয়েশনে প্রবেশ করি তখন অপর পক্ষ একটি উপসংহার বা সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে চায়। সবসময় যে এ রকম হবে তা নয়। তবে সাধারণভাবে এটা চিন্তা করা হয়।

নেগোসিয়েশন তথা আলাপ-আলোচনার মূল বিষয়বস্তু কী?-এটা খুঁজে বের করুন।


যেকোনো নেগোসিয়েশনে আপনার নিজ অবস্থান সম্পর্কে স্পষ্ট থাকা খুব গুরুত্বপূর্ণ। আপনি কোথা থেকে আরম্ভ করলেন, কোথায় যাচ্ছেন এবং কত বেশি বা কম গ্রহণ করবেন-তাও আগে থেকে স্পষ্ট ও নির্দিষ্ট হয়ে নিন।


আপনি যার বা যাদের সাথে নেগোসিয়েশন করছেন তাদের আকাঙ্ক্ষা কী, তারা কী ধরনের ফলাফল চায়?-তা নিয়েও চিন্তা করুন। এটা খুঁজে বের করতে যা করা দরকার করুন। অপর পক্ষের সর্বোচ্চ ও সবনিম্ন চাওয়া-পাওয়া সম্পর্কে বিচারবিবেচনা করুন।


পরিস্থিতিকে পুরোপুরি পালটে দিন। যেকোনো নেগোসিয়েশনের যেকোনো পরিস্থিতি বদলানোর উত্তম পন্থা হচ্ছে নিজের যুক্তিতর্ক আরম্ভ করার আগে অপর পক্ষের যুক্তিতর্ক থেকে আরম্ভ করা।


শুরু করার আগে পরিস্থিতিকে পালটে দিন। নিজেকে অন্যের অবস্থানে রেখে বিচারবিবেচনা করুন। আপনি যদি অপর পক্ষ হতেন তবে কী চাইতেন। আপনার অবস্থান বা দর কষাকষির শক্তিশালী ও দুর্বল দিকগুলো কী? সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ কী? সবচেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ কী?


আমার ব্যক্তিগত জীবনে নেগোসিয়েশন থেকে শেখা এক শিক্ষা। আমি একবার আমার নতুন অফিসের জন্য একটি নতুন জায়গা ভাড়া নিব বলে চিন্তা করছি। তখন আমি এক ভবনের মালিকের সাথে কথা বললাম। সে খুব কঠিন এবং নিজের মতো করে সবকিছু চায়। তার সাথে পেরে ওঠা খুব কঠিন হচ্ছিল।


তারপর আমি নেগোসিয়েশনের আগে, নিজে নিজে কিছু কাজ করলাম। প্রথমে একটি কাগজ নিয়ে বসলাম। ভবন মালিক আমার কাছ থেকে যা কিছু চাইতে পারে তার সবকিছু আমি সেই কাগজে লিখে নিলাম। আমার লিস্টে প্রায় ২০টির মতো জিনিস লেখা হল। তারপর অন্য একটি কাগজে আমি কী কী চাই তার তালিকা তৈরি করলাম। এরপর আমি নেগোসিয়েশন করতে গেলাম। উক্ত নেগোসিয়েশনে আমি অবাক হয়ে দেখলাম, আমাদের মধ্যে অনেক কিছুতেই মিল রয়েছে। কয়েক ঘণ্টা আলাপ করার চেয়ে ভবন মালিকের সাথে মাত্র ৩০ মিনিটের মধ্যেই আমি একটি সম্মতিতে পৌঁছাতে পারলাম।


তাই নিজে নিজে সবসময় আগে থেকে চিন্তা করুন, যদি এই নেগোসিয়েশন সফল হয়, তবে আপনি কী ফলাফল আশা করেন?


চার নীতির সূত্র মেনে চলুন। নেগোসিয়েশন তথা আলাপ-আলোচনার মধ্যে একাধিক বিষয়বস্তু থাকতে পারে। তবে মূল বিষয়বস্তু সাধারণত চারটি হয়ে থাকে। একে আবার মুখ্য ও গৌণ হিসাবে ভাগ করা যায়। সাধারণত নেগোসিয়েশনের মূল বিষয়বস্তুর একটি মুখ্য বিষয় এবং তিনটি গৌণ বিষয় থাকে।


আপনি যদি একটি বাড়ি কিনতে যান তবে মুখ্য বিষয় হচ্ছে এর নকশা, দেখতে কতটা সুন্দর এবং বাড়ির অবস্থা। অথবা আপনি যদি একটি গাড়ি কিনতে যান তবে মুখ্য বিষয় হচ্ছে এর মডেল, রঙ ও গাড়ির আকার আয়তন। এরপর আপনি গৌণ বিষয় হিসাবে দাম, কোনো দোকান থেকে কিনবেন, কীভাবে দাম পরিশোধ করবেন তা নিয়ে আলাপ করতে পারেন।


নেগোসিয়েশনের অচলাবস্থা। যদি নেগোসিয়েশনের উভয় পক্ষের মুখ্য বিষয় একই থাকে, তবে নেগোসিয়েশনে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়।


চাকরি করার ক্ষেত্রে অনেকেই মনে করে বেতনই একমাত্র নেগোসিয়েশনের জিনিস। এছাড়া আরও জিনিস আছে। আপনি অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার জন্য নেগোসিয়েশন করতে পারেন। যেমন: কোম্পানি থেকে পরিবহণের সুবিধা, স্বাস্থ্য সেবার সুযোগ, আইনে যতটুকু সময় কর্মঘণ্টা আছে তার থেকে কম কাজ করার সুযোগ, ইচ্ছা মতো সময়ে কাজ করার সুযোগ বা অন্য যা কিছু আপনার কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় তাই নিয়ে নেগোসিয়েশন করতে পারেন।


এমনকি আপনি এটাও বলতে পারেন যে আপনি আগামী নব্বই দিন কাজ করবেন এবং কোনো ধরনের টার্গেট পূরণ করে আপনার যোগ্যতার প্রমাণ রাখবেন। এটা অবশ্যই লিখিত ও সংখ্যায় লেখা থাকবে, যাতে করে আপনি পরিমাপ করতে পারেন। এভাবে আপনি আপনার নেগোসিয়েশনের শক্তি বৃদ্ধি করতে পারেন এবং নিজের দিকে সুযোগ-সুবিধা টানতে পারেন।


মানুষ তার আশেপাশের পরিবেশ পরিস্থিতি দ্বারা অনেক বেশি প্রভাবিত। তাদের আশেপাশের মানুষের পরামর্শ ও বক্তব্য দ্বারা আকর্ষিত। মানুষের প্রায় ৯৫% চিন্তাভাবনা তাদের আশেপাশের মানুষের দ্বারা প্রভাবিত। আপনার কাজ হচ্ছে:


১। এসব পারিপার্শ্বিক পরামর্শ ও প্রভাব সম্পর্কে সচেতন থাকা।

২। এসব পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে দরকারি সবকিছু করুন।


  • দরকার হলে জায়গা বদল করুন।

  • নিজের ব্যক্তিত্বকে সমুন্নত করুন।

  • নিজের দৈহিক অঙ্গভঙ্গিকে উন্নত করুন।

  • আপনার হাত রাখার ধরন থেকেও অনেক কিছু বোঝা যায়। উদাহরণস্বরূপ, দুই হাত বুকের কাছে ভাঁজ করে রাখা মানে আপনি অপর ব্যক্তির বক্তব্যের সাথে দ্বিমত পোষণ করছেন। আর দুই হাত খুলে রাখা মানে মুক্তমনা, বিনয় ও ন্যায্যতা বোঝায়।


আরও কিছু পারিপার্শ্বিক উপাদান রয়েছে।


  • আরামদায়ক ব্যবস্থা। যেখানে নেগোসিয়েশন করবেন সেখানকার আসবাবপত্র, লাইট, ঘরের তাপমাত্রা যেন আরামদায়ক হয়। [একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ঘরের তাপমাত্রা কম হলে অর্থাৎ একটু ঠান্ডা ঠান্ডা থাকলে বেশি ভালোভাবে কাজ করা যায়। কিন্তু বেশি তাপমাত্রায় ঘাম নিঃসৃত হয়। তাই কাজ করা যায় না। আবার তাপমাত্রা যেন বেশি ঠান্ডা না হয় সেদিকেও খেয়াল রাখবেন।]


  • বিশ্রাম বা ক্লান্তি। নেগোসিয়েশনের আগে বিশ্রাম করা খুব দরকার। কারণ ক্লান্তি নিয়ে নেগোসিয়েশনের গেলে আপনি কখনো ভালো করতে পারবেন না।


  • খাবার, ক্ষুধা ও তৃষ্ণা। নেগোসিয়েশনের আগে পর্যাপ্ত খাবার খেয়ে নিন। আপনার মধ্যে যেন ক্ষুধা বা তৃষ্ণা না থাকে।


  • আপনার মনোভাব। সর্বশেষ ও সর্বোত্তম উপাদান হচ্ছে আপনার মনোভাব। আপনি যত বেশি প্রস্তুতি নিবেন, একটি ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে নেগোসিয়েশনে বসবেন, তত ভালো করতে পারবেন।


পারস্পরিক আদান-প্রদানের মাধ্যমে প্রভাব বিস্তার করা। রবার্ট কালদিনির বই ইনফ্লুয়েন্স তথা প্রভাব একটি অসাধারণ বই। এ বইয়ে মানুষ কীভাবে চিন্তা করে, কীভাবে আচার আচরণ করে তার সম্পর্কে বিস্তারিত লেখা আছে। এখানে কালদিনি পারস্পরিক আদান-প্রদানের মাধ্যমে মানুষের ওপর প্রভাব বিস্তার করার প্রতি গুরুত্বারোপ করেন। সত্যি কথা বলতে, মানব সভ্যতার মূল হচ্ছে পারস্পরিক আদান-প্রদানের মাধ্যমে অর্জিত চুক্তিসমূহ। একে আমরা চুক্তি আইন (the Law of Contact) বলতে পারি।


অন্যদের জন্য কিছু করুন। যখনই সময় সুযোগ পান অন্যদের জন্য কিছু করুন। তাদের জীবনমান, কাজ বা পরিবারের উন্নতির জন্য কিছু করুন। তাদের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনুন। পাশে হাঁটুন। এতে করে তারা খুশি হবে। কাউকে খুশি করতে পারাও অনেক বড় অবদান।


সক্রেটিসের পদ্ধতি প্রয়োগ করুন। সক্রেটিস বলেন, ‘দ্বিমত পোষণ করার আগে যেসব ক্ষেত্রে একমত হবে তা আগে খুঁজে বের করো।’


যেসব বিষয়ে আপনি একমত হতে পারছেন না দ্বিমত আছে সেগুলো ব্যাপারে বলতে পারেন, ‘আচ্ছা, এ ব্যাপারে আমরা পরে আবার আলাপ করব।’ এভাবে যেসব বিষয়ে একমত হবেন সেসব বিষয়ে এগিয়ে যাবেন। আপনি যত দ্রুত দ্বিমতের বিষয়গুলো এড়িয়ে যাবেন, তত বেশি নেতিবাচকতা থেকে রক্ষা পাবেন। এরপর আলাপ-আলোচনা করতে করতে দেখবেন দ্বিমতের বিষয়গুলোতেও একমত হতে পারছেন। সবসময় দেখবেন, অপর পক্ষের সাথে একমত হওয়া যায় কী কী বিষয়ে। সেগুলোতে একমত হয়ে গেলে, বাকি বিষয়গুলো সহজভাবেই সমাধান হয়ে যাবে।


ধীরভাবে সম্মত হোন। দ্রুত কিছুতে একমত হয়ে যাবেন না। এমন তাড়াহুড়ার মনোভাব রোধ করুন।


বেশি বেশি ‘ন্যায্য’ বা ‘ন্যায্যতা’ শব্দের উল্লেখ করুন। যেমন বলতে পারেন:

‘আমার মনে হয় এ কাজ করা ন্যায্য হবে।’

‘এটা ন্যায্য মনে হচ্ছে না।’

‘এ দর কষাকষি যেন দুইজনের জন্যই ন্যায্য হয়।’


অপর পক্ষকেও পারস্পরিক আদান-প্রদানে উৎসাহিত করুন। বিনিময়ের জন্য জিজ্ঞেস করুন। এভাবে বলতে পারেন, ‘দেখুন, আমরা এ এ বিষয়ে একমত হয়েছি। আপনি এসব জিনিস চেয়েছেন সেগুলোতে আমরা একমত হয়েছি। এখন আমি কিছু বিষয়ে আপনার সম্মতি চাই। এগুলো অবশ্য আপনার জন্যও গুরুত্বপূর্ণ।’


দাম আর শর্ত, দুইটি ভিন্ন জিনিস।


আমার কিছু বন্ধু মিলে একবার একটি বাড়ি ক্রয় করতে নেগোসিয়েশন করছিল। বাড়ির ক্রয় মূল্য বাংলা টাকা সাড়ে ৮ কোটি টাকার মতো ছিল। বেশ দামি বাড়ি। কিন্তু তারা হিসাব করে দেখল বাড়িটির মূল্য ৫ কোটি টাকার বেশি হবে না। কিন্তু বাড়ির মালিক কিছুতেই কম দাম নিবে না। কারণ উক্ত বাড়ি থেকে অদূরে আরেকটি একই রকম বাড়ি ৮.৫ কোটি টাকায় কিছুদিন আগে বিক্রি হয়েছে। কিন্তু আমার বন্ধুরা বাড়ির মালিককে বুঝিয়ে বলল যে সেই বাড়ির অবস্থান আর এ বাড়ির অবস্থান এক নয়। কিন্তু বাড়ির মালিক কোনো মতেই কম দামে বিক্রি করতে রাজি নয়।


তারপর আমার বন্ধুরা টাকার ব্যাপারে একমত হল। তারা সাথে কিছু শর্ত জুড়ে দিল। তারা ৮.৫ কোটি টাকায় বাড়ি ক্রয় করতে রাজি হল, তবে টাকাটা আগামী ২০ বছরে বাড়ির মালিককে দিবে। প্রতিবছর ৪২.৫ লাখ টাকা করে পরিশোধ করবে। এভাবে তারা জমির নানা অংশ উন্নত ও বিক্রয় করার মাধ্যমে প্রতিবছর বাড়ির মালিকের টাকা পরিশোধ করতে সক্ষম হল। গ্রাহকদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে বাড়ির মালিককে অনায়াসেই টাকা দিয়ে মোট টাকা পরিশোধ করতে সক্ষম হল।


যেহেতু ৮.৫ কোটি টাকাটা বাড়ির মালিকের কাছে মূূল বিষয়বস্তু। আর শর্তটা ছিল আমার বন্ধুদের কাছে মূল বিষয়বস্তু। সুতরাং তারা উভয়ে এমন এক সন্তোষজনক জায়গায় একমত হতে পারল যেখানে তারা উভয়েই একসাথে কাজ করতে রাজি।


প্রায় সময় দেখা যায়, প্রথমে আপনি কোনো জায়গায় নেগোসিয়েশন করতে গেলেন, কিন্তু এমন এক জায়গায় এসে আটকে গেলেন যেখান থেকে বের হওয়ার রাস্তা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এসব ক্ষেত্রে, আপনার উচিত আপনার মনোযোগ একটু ভিন্ন দিকে ঘোরানো। সাধারণত দামটাই মূল বিষয়বস্তু হিসাবে দেখা হয়। কিন্তু আপনি যদি দাম ভিন্ন অন্যান্য দিকে একটু মনোযোগ দেন, তবে নানা শর্ত দিয়েও আপনি আপনার মূল বিষয়বস্তু হাসিল করতে পারেন। এতে করে প্রায়ই দেখা যায় জিত-জিত তথা উভয় পক্ষ জয়ী হওয়ার মতো জায়গায় এসে পৌঁছানো সম্ভব হয়। ইতিহাসের অনেক বড় বড় ব্যবসায়িক চুক্তিগুলোই এমনভাবে অর্জিত হয়েছে।


সামাজিক প্রমাণ তুলে ধরে প্রভাবিত করুন। মানুষকে প্রভাবিত করার একটি অন্যতম উপায়। একই রকম অবস্থা ও পরিস্থিতিতে অন্যরা যা করে তা বলুন। যেমন: অন্যরা এটা করছে, আপনি তা করতে পারেন। আপনার প্রতিবেশীরা এটা ব্যবহার করে, আপনিও করতে পারেন। বেশির ভাগ লোকজন এ পণ্য ব্যবহার করে, আপনিও করতে পারেন। এ রকম সামাজিক প্রমাণ তুলে ধরে মানুষকে প্রভাবিত করতে পারেন।


আপনার ভাই এটা কিনেছে। অথবা আপনার বন্ধুরা এটা ব্যবহার করে ভালো বলেছে। এভাবে মানুষকে প্ররোচিত করা যায়।


সামাজিক প্রমাণ যোগাড় করুন। যত ধরনের জরিপ, নাম, নম্বর, প্রমাণ, তথ্য-উপাত্ত, যা কিছু পান যোগাড় করুন। তারপর তা অপর পক্ষের সামনে হাজির করুন। সামাজিক প্রমান, অন্যদের সুপারিশ ও পূর্বের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে একই ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে অপর পক্ষকে প্রভাবিত করুন। এটা বেশি শক্তিশালী প্রভাবক।


যেসব লোকজন একই ধরনের পেশায় নিযুক্ত আছে তাদেরকে একই তথ্য-উপাত্ত, জরিপ ও প্রমাণ দিয়ে প্রভাবিত করুন।


মানুষের কাছ থেকে প্রশংসাপত্র যোগাড় করুন। চিঠিপত্র বা পরিচিত লোকজনের তালিকা সংগ্রহ করুন। এগুলো সামাজিক প্রমাণ হিসাবে সামনে তুলে ধরুন।


আমি একবার একটি ব্যাংকে ট্রেনিং ও কনসালটেন্সি প্রোগ্রাম চালানোর জন্য দরপত্র জমা দিই। ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট প্রোগ্রামের ফিস নিয়ে ততটা সন্তুষ্ট ছিলেন না। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, এ ধরনের প্রোগ্রাম আর কোন কোন ব্যাংক নিয়েছে। আমি তাকে আমার প্রোগ্রাম পরিচালিত করেছি এমন ১০টি দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ব্যাংকের নাম, ঠিকানা ও যোগাযোগ করার মতো ব্যক্তির নাম-ঠিকানা দিলাম। এতে করে তিনি আশ্বস্ত হলেন এবং সাথে সাথে আমার প্রোগ্রাম তার ব্যাংকের জন্য গ্রহণ করলেন।


তিনি উক্ত ব্যাংকগুলোর ব্যক্তিদের সাথে যোগাযোগও করেননি। তিনি যেহেতু দেখলেন আমি অন্যান্য ব্যাংকে যোগাযোগ করার মতো ব্যক্তিদের নাম-ঠিকানা দিয়েছি, তাতেই আশ্বস্ত হলেন। যেহেতু তার মতো অন্যান্য ব্যাংকগুলোও এ প্রোগ্রাম করেছে, তাই সেও তার ব্যাংকের জন্য এ প্রোগ্রাম ক্রয় করলেন। একটি কার্যকর ও সফল নেগোসিয়েশনের জন্য এরকম সামাজিক প্রমাণ খুব শক্তিশালী এক মাধ্যম।


দাম নিয়ে নেগোসিয়েশন করার কিছু কলাকৌশল


আঁতকে উঠুন। কেউ যদি বেশি দাম বলে, তবে আঁতকে উঠুন বা বিস্ময় প্রকাশ করুন। এতে করে তারা বুঝতে পারবে যে তারা বেশি দাম বলেছে।


প্রশ্ন করুন। আপনি কি এর কমে পারবেন? শেষ কত হলে পারবেন? বিক্রির দাম বলুন? এরকম প্রশ্ন করে নেগোসিয়েশন চালিয়ে যান।


মূল্যহ্রাসের সময় ক্রয় করুন।


নিশ্চিত দাবি তুলুন। আমি তো এরচেয়েও কমে অন্য জায়গা থেকে কিনতে পারি। এরকম নিশ্চিত দাবি তুলুন। মনে রাখবেন, সবসময় আপনার আচরণ হবে অমায়িক ও বন্ধুত্বপূর্ণ। এমন আচরণের মাধ্যমে যেকোনো কঠিন ও গুরুগম্ভীর আলাপ-আলোচনাকেও নিজের বশে আনা যায়।


অর্ধেক দাম বলুন। যখনই কেউ আপনাকে কোনো কিছুর দাম বলবে, ১ হাজার টাকা। আপনি তার দাম বলুন, ৫০০ টাকা। এভাবে অর্ধেক দাম বলার মাধ্যমে নেগোসিয়েশন চালিয়ে যান।


একটু একটু করে এগিয়ে যান। নেগোসিয়েশনের ক্ষেত্রে একটু একটু করে সম্মত হোন। এভাবেও বলতে পারেন, ঠিক আছে, আমি আপনার দামের সাথে একমত, কিন্তু আমাকে ফ্রি ডেলিভারি দিতে হবে।


একটি বাড়ি ক্রয় থেকে শিক্ষা। আমার এক বন্ধু আবাসন ব্যবসা করে। সে তার ব্যবসায় একজন দক্ষ ব্যক্তি। সে একবার এ বাড়ি কিনতে যায়। বাড়ির মালিক তার কাছে বাড়ির দাম চায় ২০ কোটি টাকা। প্রায় ছয় মাস ধরে এ নেগোসিয়েশন চলে। পরে ভবন মালিকরা অন্য কোথাও চলে যাবে। তাদের তাড়া ছিল। তাই তারা ৮.৫ কোটি টাকায় একমত হয়। আমার বন্ধুটি ভবন মালিকের তাড়া বুঝতে পেরে তাদের বাড়ির সব জিনিসপত্রও দাবি করে। বলে, ৮.৫ কোটি টাকার মধ্যে নিশ্চয় বাড়ির সব জিনিসপত্রও অন্তর্ভুক্ত?


ভবন মালিক চিন্তা করল, এখন তাদের অন্যত্র চলে যেতে হবে। এত সব জিনিসপত্র আবার কোথায় বিক্রি করবে। তাই বাড়ি বিক্রির টাকার মধ্যে জিনিসপত্রও অন্তর্ভুক্ত করে দিল। আমার বন্ধু হিসাব করে দেখল বাড়ির মধ্যে কিছু চিত্রশিল্প ছিল, যেগুলোর দাম প্রায় ৮০ লাখ টাকারও বেশি। তাই বলব, যেকোনো নেগোসিয়েশনে একটু একটু করে এগিয়ে যান। ভালো ফলাফল পাবেন।


হেঁটে-চলে-যাওয়ার কৌশল। আরেকটি শক্তিশালী নেগোসিয়েশন কৌশল হল হেঁটে-চলে-যাওয়া। এ ধরনের নেগোসিয়েশনে বলা হয়, আপনার সর্বনিম্ন দাম বলুন। আমার হলে ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ বলব। তারপর চলে যাব।


অনেকে বলে, আমার যদি জিনিসটি পছন্দ হয় তবে আমি কীভাবে তা ছেড়ে দিয়ে হেঁটে-চলে-আসি। মনে রাখবেন, হেঁটে-চলে-যাওয়া নেগোসিয়েশনের আরেকটি কৌশল মাত্র। আপনি যেমন দোকান বা আলাপ-আলোচনার টেবিল থেকে উঠে-চলে-যেতে পারেন, তেমন আবার ঘুরে এসে বসতেও পারেন। এটা সম্পূর্ণ স্বাভাবিক এক বিষয়। মনে রাখবেন, আপনি তো আর জিনিসটা আসল দাম জানেন না। তাই হেঁটে-চলে-যাওয়ার হুমকি দেখিয়ে আসল দাম জানার চেষ্টা করছেন।


একটি গাড়ি ক্রয় থেকে শিক্ষা। আমি একবার আমার স্ত্রীর জন্য একটি গাড়ি কিনতে গেলাম। আমার স্ত্রী, আমি ও আমার দুই বন্ধু মিলে একটি শো-রুমে গাড়ি ক্রয় করতে গেলাম। আমার স্ত্রী একটি গাড়ি পছন্দ করলেন। গাড়ির দাম বিক্রয়কর্মী চাইল, ২৫ লাখ। আমি বিক্রয়কর্মীকে সরাসরি বললাম, আমি আপনাকে ২১ লাখ টাকা ক্যাশ দিব এবং তা এখন, এই মুহূর্তেই। সাথে ট্যাক্স ও এর জন্য দরকারি কাগজপত্র করতে যা কিছু লাগে তার সব। আপনি কি বিক্রি করবেন?


বিক্রয়কর্মী বলল, তিনি ২৫ লাখ টাকার কমে পারবেন না। আমরা সাথে সাথে উঠে চলে এলাম। পার্কিং এর কাছে আসতেই বিক্রয়কর্মী দৌড়ে এলো। আবার আমাদের ঢেকে নিয়ে গেল। তারপর ক্যালকুলেটরে হিসাব করে ২৪.৫ লাখ টাকায় বিক্রি করতে পারবে। আমরা আবার উঠে এলাম। এভাবে আমরা তিন-চারবার হেঁটে-চলে-এসেছি।


তারপর শেষবারে বিক্রয়কর্মী তার ম্যানেজারের সাথে আলাপ করে ২১ লাখ টাকায় গাড়ি বিক্রয় করতে রাজি হল।


মনে রাখবেন, আপনি তো আর জিনিসটা আসল দাম জানেন না। তাই হেঁটে-চলে-যাওয়ার হুমকি দেখিয়ে আসল দাম জানার চেষ্টা করছেন। আপনাকে কেবল বারবার হেঁটে-চলে-যাওয়ার সাহস দেখাতে হবে। একবার, দুইবার, বারবার। যতক্ষণ পর্যন্ত না আপনার পক্ষের দিকে নেগোসিয়েশনের পাল্লা ঝুঁকে যায় ততক্ষণ চেষ্টা করে যাবেন।


নেগোসিয়েশন কখনো শেষ হয় না।


সবসময় কিছু না কিছু প্রস্তাব করুন।


আমি একবার আমার ব্যবসায়িক সমস্যার কারণে আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হই। কয়েক মাস ধরে আমার মাসিক লোন পরিশোধ করতে ব্যর্থ হই। আমি তাদের ফোন না ধরার বদলে তাদের সাথে কথা বলি। আমি আমার সকল পাওনাদারদের তালিকা তৈরি করি। যারা যারা আমার কাছে টাকা পাবে, কত পাবে, তার সবকিছুর তালিকা তৈরি করি। তারপর তাদের সাথে গিয়ে সরাসরি কথা বলি। ব্যবসায়িক মন্দার কারণে আমার ব্যবসা এখন ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। কিন্তু ব্যবসা অচিরেই চাঙা হয়ে উঠবে। সামনে ব্যবসার সুদিন ফিরে আসবে। তবে এজন্য তিন থেকে ছয় মাস আমাকে সময় দিতে হবে। যাতে করে আমি আমার ব্যবসাকে পুনরায় চাঙা করে তুলতে পারি। ব্যবসা চাঙা হলেই আমি আপনার সকল পাওনা পরিশোধ করব মুনাফা সহ। কিন্তু আপনি যদি প্রায় সময় আমাকে পাওনা টাকার জন্য চাপ দিতে থাকেন, তবে আমার কোম্পানি দেউলিয়া হয়ে পড়বে। এতে করে আমিও ক্ষতির সম্মুখীন হবো। আর আপনিও পাওনা টাকা না পেয়ে ক্ষতির সম্মুখীন হবেন। আপনি কী করতে চান?


এভাবে বলার পর পাওনাদাররা সকলেই আমাকে পর্যাপ্ত সময় দেয় এবং আমিও ব্যবসা চাঙা হয়ে উঠলে তাদের পাওনা টাকা মুনাফা সহ পরিশোধ করি।


একটি ব্যাংক লোন থেকে শিক্ষা। আপনার লেনদেনকৃত ব্যাংকের সাথে কথা বলুন। ব্যাংকের লোনের মাসিক টাকা পরিশোধে অনেকেই চিন্তিত থাকে। কিন্তু ব্যাংক যতক্ষণ পর্যন্ত ইন্টারেস্টের টাকা পেয়ে যাবে ততক্ষণ আপনাকে মূল টাকার জন্য বিরক্ত করবে না। আমার ব্যবসার মন্দা চলাকালীন সময়ে আমি আমার লোনকৃত ব্যাংকের ম্যানেজারের সাথে গিয়ে কথা বললাম। আমি ইন্টারেস্ট দিতে পারব। আগামী তিন বা ছয় মাস পর আমার ব্যবসা আবার চাঙা হলে মূলধনের টাকা প্রতি মাসে ইন্টারেস্ট সহ লোন পরিশোধ করব। ম্যানেজারকে এ প্রস্তাব দিতেই তিনি সানন্দে রাজি হলেন। এরপর তিনি, হিসাব করে বললেন, প্রতি মাসে কত ইন্টারেস্ট দিতে হবে। আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, এ টাকা কি দিতে পারব? আমি সম্মতি জানালাম।


একজন সফল নেগোসিয়েটরের চিহ্ন কী? আপনি কীভাবে একজন সফল ও সার্থক নেগোসিয়েটরকে চিনবেন?


প্রথমত, নেগোসিয়েশন একটি জীবনভর প্রক্রিয়া। এ শিক্ষা সারাজীবন ব্যাপী শিখতে হয় এবং প্রতিনিয়ত শিক্ষা ও কাজে প্রয়োগের মাধ্যমে অগ্রগতি করতে হয়। ভালো নেগোসিয়েটররা মুক্তমনা, পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে। তারা তাদের অবস্থানে অনড় হয়ে বসে থাকে না। আর দুর্বল নেগোসিয়েটরদের মাথায় কেবল একটি আইডিয়াই ঘুরপাক খায়। তারা তাদের সেই একটি ধারণার জন্যই মারামারি করে।


ভালো নেগোসিয়েটররা নম্র হয়, তাদের আচার-আচরণ ও বক্তব্যের ধরন নমনীয়। তারা খুব দ্রুত পারস্পরিক সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য কাজ করতে পারে।


সফল নেগোসিয়েটররা আক্রমণাত্মক নয়; বরং সহযোগিতাপূর্ণ মনোভাবসম্পন্ন।


দক্ষ নেগোসিয়েটররা প্রতিযোগিতামূলক মনোভাবসম্পন্ন নয়; বরং সৃজনশীল। তারা নানা ধরনের পথ, পন্থা ও উপায়ে উভয়ের সন্তষ্টি অর্জনের চেষ্টা করে।


সবশেষে বলব, সার্থক নেগোসিয়েটররা ধান্দাবাজি করে অপর পক্ষ থেকে কথা আদায় করে না। তারা জিত-হারের খেলা খেলে না।  তারা জিত-জিত তথা উভয় পক্ষ জয়ী হওয়ার জন্য আলাপ-আলোচনা করে।


নেগোসিয়েটরদেরকে অবশ্যই দীর্ঘমেয়াদে চিন্তা করতে হবে। ব্যবসায়িক সম্পর্ক তৈরির ক্ষেত্রে এটা আর বেশি সত্য।


দুনিয়ার বাস্তবতা হচ্ছে যারা সৎ, সরাসরি কথা বলে, স্পষ্টভাষী, বিনয়ী এমন পুরুষ বা নারী, যারা তাদের আকাঙ্ক্ষা সম্পর্কে নিশ্চিত এবং এমন এক চুক্তিতে আবদ্ধ হয় যেখানে জিত-জিত (win-win) তথা উভয় পক্ষ জয়ী হওয়ার সুযোগ রয়েছে, তারাই সবচেয়ে সফল ও সার্থক নেগোসিয়েটর।


চারটি প্রয়োজনীয় সূত্র (The four essentials):


১। প্রয়োজনীয় সকল তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করুন এবং আগে থেকে প্রস্তুতি নিন।

২। আপনি কী চান?-তা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করুন।

৩। জিত-জিত তথা উভয় পক্ষ জয়ী হওয়ার দিকগুলো খুঁজে বের করুন। আলাপ-আলোচনা করার সময় জিত-জিত তথা উভয় পক্ষ জয়ী হওয়ার দিকগুলো খুঁজে দেখুন। তা যদি না পান, তবে কোনো আলাপ-আলোচনা করবেন না। আপনি যদি অপর পক্ষকে ঠকিয়ে কিছু অর্জন করে, তবে এ অপরাধ আপনার পিছন ছাড়বে না। মানুষ তার কর্মের ফল ভোগ করে। আজ অন্যকে ঠকালে আরেকদিন অন্য কেউ আপনাকে ঠকাবে। আজ অন্যকে জেতালে আরেকদিন অন্য কেউ আপনাকে জিততে সাহায্য করবে।

৪। অনুশীলন, অনুশীলন ও অনুশীলন। কাজে প্রয়োগ করুন। নিয়মিত চর্চা করুন। শিখুন, কাজে লাগান, অভিজ্ঞতা থেকে শিখুন, তারপর আবার কাজে লাগান। নেগোসিয়েশনের দক্ষতা আপনার জীবনকে সুন্দর ও সুখী করে তুলতে পারে। আপনি যা কিছু আয় করেন, সঞ্চয় করেন তার শতকরা ২০ ভাগ বৃদ্ধি পেতে পারে আপনার নেগোসিয়েশনের দক্ষতা বৃদ্ধির কারণে। ভালো নেগোসিয়েনের কারণে আপনার অর্থ, সময় ও শক্তি বেঁচে যাবে।


নেগোসিয়েমন অন্যান্য বিষয়ের মতো শেখার মতো একটি বিষয়। আপনি এ বইয়ে যেসব সূত্র শিখলেন সেগুলো কাজে প্রয়োগ করুন, চর্চা করুন, প্রতিনিয়ত কাজ করে যান, দেখবেন নেগোসিয়েশন করা আপনার একটি স্বাভাবিক প্রবণতায় পরিণত হয়েছে।


ভালো থাকবেন।

সোমবার, ৮ মার্চ, ২০২১

অনুপ্রেরণামূলক উক্তি


[ছবিসূত্র: https://www.thegentlemansjournal.com/article/top-10-mountains-to-climb-around-the-world/]

আপনি সবসময় আপনার আশেপাশের পরিবেশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন না। কিন্তু আপনি আপনার নিজের চিন্তাভাবনাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন।- চালর্স পপপ্লেস্টোন

তথ্যসূত্র: এটিটিউড ইজ এভরিথিং। মূল: জেফ কেলার। অনুবাদ: ফারহা আহমেদ, শাহরিয়ার মাহমুদ ও ফজলে রাব্বি। ঢাকা, সাফল্য প্রকাশনী, ২০২০।

ভষ্যিতের পরিকল্পনা করুন স্মার্টভাবে

 

ছবিসূত্র: https://english8blog.wordpress.com/2014/02/12/317/

ভবিষ্যতের চিন্তা করুন

দাবা খেলায় থাকে অনেক ঘুটি এবং অসংখ্য চাল। এ খেলায় জেতার সম্ভাবনা নির্ভর করে আপনি প্রতিপক্ষের চাল কতটা নিখুঁতভাবে অনুমান করতে পারছেন তার ওপর। জীবন অনেকটা দাবা খেলার মতো। এখানে আপনার সাফল্য নির্ভর করে আপনার ‘খেলায় পারদর্শিতা’ এবং সঠিক চাল চালতে পারার দক্ষতার ওপর।

হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. এডয়ার্ড ব্যানফিল্ড পঞ্চাশ বছর ধরে আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশের সামাজিক এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হারের ওপর গবেষণা করেছেন। তিনি জানতে চেয়েছিলেন কেন কিছু মানুষ ও পরিবার প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে নিম্ন আর্থসামাজিক অবস্থান থেকে উচ্চ আর্থসামাজিক অবস্থানে উঠেই চলেছে। এদের অনেকেই শ্রমিক হিসাবে কাজ শুরু করে পরবর্তীতে অত্যন্ত ধনী ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছে। কেন অল্পসংখ্যক মানুষই এমনটা করতে সক্ষম হয়েছে, কিন্তু অন্যরা নয়?

এখন ২০১৫ সালে, শুধু আমেরিকাতেই দশলাখের বেশি লাখপতি পাওয়া গেছে [দশ লাখ ডলারের মালিক, বাংলাদেশি টাকায় ৮.৫ কোটি টাকার মতো] এবং এদের অধিকাংশই স্ব-প্রতিষ্ঠিত। অর্থাৎ তারা খুব অল্প থেকে শুরু করে একজীবনে মিলিয়ন-ডলার আয় করেছে। ফোর্বস ম্যাগাজিনে প্রকাশিত তালিকা অনুযায়ী (মার্চ, ২০১৫) পৃথিবীতে বিলিওনেয়ারের সংখ্যা ১,৮২৬ [বিলিওনেয়ার মানে ১০০ কোটি ডলারের মালিক, বাংলাদেশি টাকায় ৮ হাজার ৫০০ কোটি টাকার মতো]। যাদের মাঝে নতুন ২৯০ জন ২০১৫ সালেই এই তালিয়ায় স্থান পেয়েছে। এদের মাঝে ৬৬% বিলিওনেয়ারই প্রথম প্রজন্মের, স্ব- প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তি। তারা শূন্য থেকে শুরু করে এক জীবনেই এ সংখ্যা স্পর্শ করতে পেরেছে। এ সবই সম্ভব হয়েছে, কারণ তারা ভবিষ্যতের পরিকল্পনা করেছে স্মার্টভাবে। আপনিও স্মার্টভাবে আপনার ভবিষ্যত সময়কে পরিকল্পনা করুন এবং জীবনে সুখ ও সমৃদ্ধি লাভ করুন।

তথ্যসূত্র: গেট স্মার্ট। মূল: ব্রায়ান ট্রেসি। অনুবাদ: ফারহা আহমেদ। সম্পাদনা: ফজলে রাব্বি। ঢাকা, সাফল্য প্রকাশনী, ২০২১।

বৃহস্পতিবার, ৪ মার্চ, ২০২১

universal declaration of human rights bangla 1948 - ১৯৪৮ সালের মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণাপত্র



মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণাপত্র  (১৯৯৮) 
লিখেছেন জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ

মানবাধিকারের সার্বজনীন

ঘোষণাপত্র

 

মুখবন্ধ

যেহেতু মানব পরিবারের সকল সদস্যের সমান ও অবিচ্ছেদ্য অধিকারসমূহ এবং সহজাত মর্যাদার স্বীকৃতিই হচ্ছে বিশ্বে শান্তি, স্বাধীনতা এবং ন্যায়বিচারের ভিত্তি;

যেহেতু মানব অধিকারের প্রতি অবজ্ঞা এবং ঘৃণার ফলে মানুষের বিবেক লাঞ্ছিত বোধ করে এমন সব বর্বরোচিত ঘটনা সংঘটিত হয়েছে এবং যেহেতু এমন একটি পৃথিবীর উদ্ভবকে সাধারণ মানুষের সর্বোচ্চ আকাঙ্ক্ষা রূপে ঘোষণা করা হয়েছে, যেখানে সকল মানুষ ধর্ম ও বাক স্বাধীনতা ভোগ করবে এবং অভাব ও শংকামুক্ত জীবনযাপন করবে;

যেহেতু মানুষ যাতে অত্যাচার ও উত্‍পীড়নের মুখে সর্বশেষ উপায় হিসাবে বিদ্রোহ করতে বাধ্য না হয় সেজন্য আ‌ইনের শাসন দ্বারা মানবাধিকার সংরক্ষণ করা অতি প্রয়োজনীয়;

যেহেতু জাতিসমূহের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক উন্নয়নের প্রয়াস গ্রহণ করা অত্যাবশ্যক;

যেহেতু সদস্য জাতিসমূহ জাতিসংঘের সনদে মৌলিক মানবাধিকার, মানব দেহের মর্যাদা ও মূল্য এবং নারী পুরুষের সমান অধিকারের প্রতি তাঁদের বিশ্বাস পুনর্ব্যক্ত করেছেন এবং বৃহত্তর স্বাধীনতার পরিমণ্ডলে সামাজিক উন্নতি এবং জীবনযাত্রার উন্নততর মান অর্জনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়েছেন;

যেহেতু সদস্য রাষ্ট্রসমূহ জাতিসংঘের সহযোগিতায় মানবাধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতা সমূহের প্রতি সার্বজনীন সম্মান বৃদ্ধি এবং এদের যথাযথ পালন নিশ্চিতকরণের লক্ষ্য অর্জনে অঙ্গীকারবদ্ধ;

যেহেতু এ স্বাধীনতা এবং অধিকারসমূহের একটি সাধারণ উপলব্ধি এ অঙ্গীকারের পূর্ণ বাস্তবায়নের জন্য সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ

 

এজন্য এখন

সাধারণ পরিষদ

 

এই

 

মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণাপত্র

জারী করছে

 

এ ঘোষণা সকল জাতি এবং রাষ্ট্রের সাফল্যের সাধারণ মানদণ্ড হিসাবে সে‌ই লক্ষ্যে নিবেদিত হবে, যেখানে প্রতিটি ব্যক্তি এবং সমাজের প্রতিটি অঙ্গ এ ঘোষণাকে সবসময় মনে রেখে পাঠদান ও শিক্ষার মাধ্যমে এ‌ই স্বাধীনতা ও অধিকার সমূহের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ জাগ্রত করতে সচেষ্ট হবে এবং সকল সদস্য রাষ্ট্র ও তাদের অধীনস্থ ভূখণ্ডের জাতিসমূহ উত্তরোত্তর জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রয়াসের মাধ্যমে এ‌ই অধিকার এবং স্বাধীনতাসমূহের সার্বজনীন ও কার্যকর স্বীকৃতি আদায় এবং যথাযথ পালন নিশ্চিত করবে।

ধারা ১

সমস্ত মানুষ স্বাধীনভাবে সমান মর্যাদা ও অধিকার নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। তাঁদের বিবেক ও বুদ্ধি আছে; সুতরাং সকলেরই একে অপরের প্রতি ভ্রাতৃত্বসুলভ মনোভাব নিয়ে আচরণ করা উচিত।

ধারা ২

এ ঘোষণায় উল্লেখিত স্বাধীনতা ও অধিকারসমূহে গোত্র, ধর্ম, বর্ণ, শিক্ষা, ভাষা, রাজনৈতিক বা অন্যবিধ মতামত, জাতীয় বা সামাজিক উত্‍পত্তি, জন্ম, সম্পত্তি বা অন্য কোন মর্যাদা নির্বিশেষে প্রত্যেকের‌ই সমান অধিকার থাকবে।

কোন দেশ বা ভূখণ্ডের রাজনৈতিক, সীমানাগত বা আন্তর্জাতিক মর্যাদার ভিত্তিতে তার কোন অধিবাসীর প্রতি কোনরূপ বৈষম্য করা হবে না; সে দেশ বা ভূখণ্ড স্বাধীন‌ই হোক, হোক অছিভূক্ত, অস্বায়ত্বশাসিত কিংবা সার্বভৌমত্বের অন্য কোন সীমাবদ্ধতায় বিরাজমান।

ধারা ৩

জীবন, স্বাধীনতা ও দৈহিক নিরাপত্তায় প্রত্যেকের অধিকার আছে।

ধারা ৪

কা‌উকে অধীনতা বা দাসত্বে আবদ্ধ করা যাবে না। সকল প্রকার ক্রীতদাস প্রথা ও দাসব্যবসা নিষিদ্ধ করা হবে।

ধারা ৫

কা‌উকে নির্যাতন করা যাবে না; কিংবা কারো প্রতি নিষ্ঠুর, অমানবিক বা অবমাননাকর আচরণ করা যাবে না অথবা কা‌উকে এহেন শাস্তি দেওয়া যাবে না।

ধারা ৬

আইনের সামনে প্রত্যেকেরই ব্যক্তি হিসাবে স্বীকৃতি লাভের অধিকার আছে।

ধারা ৭

আইনের চোখে সবাই সমান এবং ব্যক্তিনির্বিশেষে সকলেই আইনের আশ্রয় সমানভাবে ভোগ করবে। এই ঘোষণা লঙ্ঘন করে এমন কোন বৈষম্য বা বৈষম্য সৃষ্টির প্ররোচনার মুখে সমানভাবে আশ্রয় লাভের অধিকার প্রত্যেকেরই আছে।

ধারা ৮

শাসনতন্ত্রে বা আইনে প্রদত্ত মৌলিক অধিকার লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে উপযুক্ত জাতীয় বিচার আদালতের কাছ থেকে কার্যকর প্রতিকার লাভের অধিকার প্রত্যেকেরই রয়েছে।

ধারা ৯

কাউকেই খেয়ালখুশীমত গ্রেপ্তার বা অন্তরীণ করা কিংবা নির্বাসন দেওয়া যাবে না।

ধারা ১০

নিজের অধিকার ও দায়িত্ব নির্ধারণ এবং নিজের বিরুদ্ধে আনীত ফৌজদারী অভিযোগ নিরূপণের জন্য প্রত্যেকেরই পূর্ণ সমতার ভিত্তিতে একটি স্বাধীন এবং নিরপেক্ষ বিচার-আদালতে প্রকাশ্য শুনানি লাভের অধিকার রয়েছে।

ধারা ১১

১. দণ্ডযোগ্য অপরাধে অভিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তির আত্মপক্ষ সমর্থনের নিশ্চিত অধিকারসম্বলিত একটি প্রকাশ্য আদালতে আইনানুসারে দোষী প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত নির্দোষ গণ্য হওয়ার অধিকার থাকবে।

২. কা‌উকে‌ই এমন কোন কাজ বা ত্রুটির জন্য দণ্ডযোগ্য অপরাধে দোষী সাব্যস্ত করা যাবে না, যে কাজ বা ত্রুটি সংঘটনের সময় জাতীয় বা আন্তর্জাতিক আ‌ইনে দণ্ডনীয় অপরাধ ছিলনা। দণ্ডযোগ্য অপরাধ সংঘটনের সময় যে শাস্তি প্রযোজ্য ছিল, তার চেয়ে গুরুতর শাস্তি‌ও দে‌ওয়া চলবে না।

ধারা ১২

কারো ব্যক্তিগত গোপনীয়তা কিংবা তাঁর গৃহ, পরিবার ও চিঠিপত্রের ব্যাপারে খেয়ালখুশীমত হস্তক্ষেপ কিংবা তাঁর সুনাম ও সম্মানের উপর আঘাত করা চলবে না। এ ধরনের হস্তক্ষেপ বা আঘাতের বিরুদ্ধে আ‌ইনের আশ্রয় লাভের অধিকার প্রত্যেকের‌ই রয়েছে।

ধারা ১৩

১. নিজ রাষ্ট্রের চৌহদ্দির মধ্যে স্বাধীনভাবে চলাফেরা এবং বসবাস করার অধিকার প্রত্যেকের‌ই রয়েছে।

২. প্রত্যেকের‌ই নিজ দেশ সহ যে কোন দেশ পরিত্যাগ এবং স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের অধিকার রয়েছে।

ধারা ১৪

১. নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা পা‌ওয়ার জন্য ভিন্নদেশে আশ্রয় প্রার্থনা করবার এবং সে দেশের আশ্রয়ে থাকবার অধিকার প্রত্যেকের‌ই রয়েছে।

২. অরাজনৈতিক অপরাধ এবং জাতিসংঘের উদ্দেশ্য এবং মূলনীতির পরিপন্থী কাজ থেকে সত্যিকারভাবে উদ্ভূত অভিযোগের ক্ষেত্রে এ অধিকার প্রার্থনা না‌ও করা যেতে পারে।

ধারা ১৫

১. প্রত্যেকের‌ই একটি জাতীয়তার অধিকার রয়েছে।

২. কা‌উকে‌ই যথেচ্ছভাবে তাঁর জাতীয়তা থেকে বঞ্চিত করা যাবে না, কিংবা কারো জাতীয়তা পরিবর্তনের অধিকার অগ্রাহ্য করা যাবে না।

ধারা ১৬

১. ধর্ম, গোত্র ও জাতি নির্বিশেষে সকল পূর্ণ বয়স্ক নরনারীর বিয়ে করা এবং পরিবার প্রতিষ্ঠার অধিকার রয়েছে। বিয়ে, দাম্পত্যজীবন এবং বিবাহবিচ্ছেদে তাঁদের সমান অধিকার থাকবে।

২. বিয়েতে ইচ্ছুক নরনারীর স্বাধীন এবং পূর্ণ সম্মতিতে‌ই কেবল বিয়ে সম্পন্ন হবে।

৩. পরিবার হচ্ছে সমাজের স্বাভাবিক এবং মৌলিক গোষ্ঠী-একক, সুতরাং সমাজ ও রাষ্ট্রের কাছ থেকে নিরাপত্তা লাভের অধিকার পরিবারের রয়েছে।

ধারা ১৭

১. প্রত্যেকের‌ই একা অথবা অন্যের সঙ্গে মিলিতভাবে সম্পত্তির মালিক হ‌ওয়ার অধিকার আছে।

২. কা‌উকে‌ই যথেচ্ছভাবে তাঁর সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করা যাবে না।

ধারা ১৮

প্রত্যেকের‌ই ধর্ম, বিবেক ও চিন্তার স্বাধীনতায় অধিকার রয়েছে। এ অধিকারের সঙ্গে ধর্ম বা বিশ্বাস পরিবর্তনের অধিকার এবং এ‌ই সঙ্গে, প্রকাশ্যে বা একান্তে, একা বা অন্যের সঙ্গে মিলিতভাবে, শিক্ষাদান, অনুশীলন, উপাসনা বা আচারব্রত পালনের মাধ্যমে ধর্ম বা বিশ্বাস ব্যক্ত করার অধিকার‌ও অন্তর্ভুক্ত থাকবে।

ধারা ১৯

প্রত্যেকের‌ই মতামত পোষণ এবং মতামত প্রকাশের স্বাধীনতায় অধিকার রয়েছে। অবাধে মতামত পোষণ এবং রাষ্ট্রীয় সীমানা নির্বিশেষে যে কোন মাধ্যমের মারফত ভাব এবং তথ্য জ্ঞাপন, গ্রহণ ও সন্ধানের স্বাধীনতা‌ও এ অধিকারের অন্তর্ভুক্ত।

ধারা ২০

১. প্রত্যেকের‌ই শান্তিপূর্ণ সমাবেশে অংশগ্রহণ ও সমিতি গঠনের স্বাধীনতায় অধিকার রয়েছে।

২. কা‌উকে কোন সংঘভূক্ত হতে বাধ্য করা যাবে না।

ধারা ২১

১. প্রত্যক্ষভাবে বা অবাধে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে নিজ দেশের শাসন পরিচালনায় অংশগ্রহণের অধিকার প্রত্যেকের‌ই রয়েছে।

২. নিজ দেশের সরকারী চাকুরীতে সমান সুযোগ লাভের অধিকার প্রত্যেকের‌ই রয়েছে।

৩. জনগণের ইচ্ছা‌ই হবে সরকারের শাসন ক্ষমতার ভিত্তি; এ‌ই ইচ্ছা নিয়মিত সময়ের ব্যবধানে অনুষ্ঠিত প্রকৃত নির্বাচনের মাধ্যমে ব্যক্ত হবে; গোপন ব্যালট কিংবা সমপর্যায়ের কোন অবাধ ভোটদান পদ্ধতিতে এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।

ধারা ২২

সমাজের সদস্য হিসাবে প্রত্যেকের‌ই সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার আছে। জাতীয় প্রচেষ্টা ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমে রাষ্ট্রের সংগঠন ও সম্পদের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে প্রত্যেকের‌ই আপন মর্যাদা এবং ব্যক্তিত্বের অবাধ বিকাশের জন্য অপরিহার্য সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারসমূহ আদায়ের অধিকার রয়েছে।

ধারা ২৩

১. প্রত্যেকের‌ই কাজ করার, স্বাধীনভাবে চাকুরী বেছে নেবার, কাজের ন্যায্য এবং অনুকূল পরিবেশ লাভ করার এবং বেকারত্ব থেকে রক্ষিত হবার অধিকার রয়েছে।

২. কোনরূপ বৈষম্য ছাড়া সমান কাজের জন্য সমান বেতন পাবার অধিকার প্রত্যেকের‌ই আছে।

৩. কাজ করেন এমন প্রত্যেকের‌ই নিজের এবং পরিবারের মানবিক মর্যাদার সমতুল্য অস্তিত্বের নিশ্চয়তা দিতে পারে এমন ন্যায্য ও অনুকূল পারিশ্রমিক লাভের অধিকার রয়েছে; প্রয়োজনবোধে একে অন্যান্য সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থাদি দ্বারা পরিবর্ধিত করা যেতে পারে।

৪. নিজ স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য প্রত্যেকের‌ই ট্রেড ই‌উনিয়ন গঠন এবং তাতে যোগদানের অধিকার রয়েছে।

ধারা ২৪

প্রত্যেকের‌ই বিশ্রাম ও অবসরের অধিকার রয়েছে; নিয়মিত সময়ের ব্যবধানে বেতনসহ ছুটি এবং পেশাগত কাজের যুক্তিসঙ্গত সীমা‌ও এ অধিকারের অন্তর্ভূক্ত।

ধারা ২৫

১. খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিত্‍সা ও প্রয়োজনীয় সমাজ কল্যাণমূলক কার্যাদির সুযোগ এবং এ সঙ্গে পীড়া, অক্ষমতা, বৈধব্য, বার্ধক্য অথবা জীবনযাপনে অনিবার্যকারণে সংঘটিত অন্যান্য অপারগতার ক্ষেত্রে নিরাপত্তা এবং বেকার হলে নিরাপত্তার অধিকার সহ নিজের এবং নিজ পরিবারের স্বাস্থ্য এবং কল্যাণের জন্য পর্যাপ্ত জীবনমানের অধিকার প্রত্যেকের‌ই রয়েছে।

২. মাতৃত্ব এবং শৈশবাবস্থায় প্রতিটি নারী এবং শিশুর বিশেষ যত্ন এবং সাহায্য লাভের অধিকার আছে। বিবাহবন্ধন-বহির্ভূত কিংবা বিবাহবন্ধনজাত সকল শিশু অভিন্ন সামাজিক নিরাপত্তা ভোগ করবে।

ধারা ২৬

১. প্রত্যেকের‌ই শিক্ষালাভের অধিকার রয়েছে। অন্ততঃপক্ষে প্রাথমিক ও মৌলিক পর্যায়ে শিক্ষা অবৈতনিক হবে। প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক হবে। কারিগরী ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা সাধারণভাবে লভ্য থাকবে এবং উচ্চতর শিক্ষা মেধার ভিত্তিতে সকলের জন্য সমভাবে উন্মুক্ত থাকবে।

২. ব্যক্তিত্বের পূর্ণ বিকাশ এবং মানবিক অধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতা-সমূহের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ সুদৃঢ় করার লক্ষ্যে শিক্ষা পরিচালিত হবে। শিক্ষা সকল জাতি, গোত্র এবং ধর্মের মধ্যে সমঝোতা, সহিষ্ণুতা ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক উন্নয়নের প্রয়াস পাবে এবং শান্তিরক্ষার স্বার্থে জাতিসংঘের কার্যাবলীকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।

৩. কোন ধরনের শিক্ষা সন্তানকে দে‌ওয়া হবে, তা বেছে নেবার পূর্বাধিকার পিতামাতার থাকবে।

ধারা ২৭

১. প্রত্যেকের‌ই সমষ্টিগত সাংস্কৃতিক জীবনে অংশগ্রহণ করা, শিল্পকলা উপভোগ করা এবং বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি ও তার সুফল সমূহে অংশীদার হ‌ওয়ার অধিকার রয়েছে।

২. বিজ্ঞান, সাহিত্য ও শিল্পকলা ভিত্তিক কোন কর্মের রচয়িতা হিসাবে নৈতিক ও বৈষয়িক স্বার্থ সংরক্ষণের অধিকার প্রত্যেকের‌ই থাকবে।

ধারা ২৮

এ ঘোষণাপত্রে উল্লেখিত অধিকার ও স্বাধীনতাসমূহের বাস্তবায়ন সম্ভব এমন একটি সামাজিক ও আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় অংশীদারীত্বের অধিকার প্রত্যেকের‌ই আছে।

ধারা ২৯

১. প্রত্যেকের‌ই সে সমাজের প্রতি পালনীয় কর্তব্য রয়েছে, যে সমাজে‌ই কেবল তাঁর আপন ব্যক্তিত্বের স্বাধীন এবং পূর্ণ বিকাশ সম্ভব।

২. আপন স্বাধীনতা এবং অধিকারসমূহ ভোগ করার সময় প্রত্যেকে‌ই কেবলমাত্র ঐ ধরনের সীমাবদ্ধতা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবেন যা অন্যদের অধিকার ও স্বাধীনতাসমূহ নিশ্চিত করা এবং একটি গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় নৈতিকতা, গণশৃংখলা ও সাধারণ কল্যাণের ন্যায়ানুগ প্রয়োজন মেটাবার জন্য আ‌ইন দ্বারা নির্ণীত হবে।

৩. জাতিসংঘের উদ্দেশ্য ও মূলনীতির পরিপন্থী কোন উপায়ে এ অধিকার ও স্বাধীনতাসমূহ ভোগ করা যাবে না।

ধারা ৩০

কোন রাষ্ট্র, গোষ্ঠী বা ব্যক্তি এ ঘোষণাপত্রের কোন কিছুকে‌ই এমনভাবে ব্যাখ্যা করতে পারবেন না, যার বলে তারা এ‌ই ঘোষণাপত্রে উল্লেখিত অধিকার ও স্বাধীনতাসমূহ নস্যাত্‍ করতে পারে এমন কোন কাজে লিপ্ত হতে পারেন কিংবা সে ধরনের কোন কাজ সম্পাদন করতে পারেন।


১৯৪৮ সালের মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণাপত্রের ইংরেজি পিডিএফ এবং বাংলা পিডিএফ এর ডাউনলোড লিংক।


তথ্যসূত্র: উইকিসোর্স