শুক্রবার, ২৬ ফেব্রুয়ারী, ২০২১

কাজটি কি সফল হলো?


আপনার সিদ্ধান্ত এবং কাজের সফলতার পরিমাপক হলো, ‘কাজটি কি সফল হলো?’ আপনার চিন্তা অনুযায়ী যেই কাজ করলেন, তা কি আপনাকে নিজের লক্ষ্য কিংবা স্বপ্নের কাছে নিয়ে যেতে পেরেছে?

দুটি নীতি মানুষকে ব্যক্তিগত জীবন, রাজনীতিত ও আন্তর্জাতিক বিষয়ে ভুল করতে হতে বাধ্য করে:

১। ল অফ আনইন্টেন্ডেড কন্সিকোয়েন্সেস তথা অনিচ্ছাকৃত ফলাফল নীতি (Law of Unintended Consequences)

২। ল অফ পারভার্স কন্সিকোয়েন্সেস তথা বিপথগামী ফলাফল নীতি (Law of Perverse Consequences)

অর্থনীতিবিদ হেনরি হ্যাজলিট তার কালজয়ী ইকোনমিক্স ইন ওয়ান লেসন বইতে লিখেছেন যে মানুষ স্বার্থান্বেষী তার প্রতিটি কাজই নিজের অবস্থা উন্নয়নের প্রচেষ্টা মাত্র। মানুষ সবসময়ই নিজের ইচ্ছাপূরণের সবচেয়ে সহজ ও দ্রুত উপায় খোঁজে, কিন্তু সেই উপায়গুলো অবলম্বনের ফলে পারিপার্শ্বিক তথা সেকেন্ডারি বা টারশিয়ারি ফলাফল কী হতে পারে তা চিন্তা করে না।

হ্যাজলিট আরও বলেন, কোনো কাজের কাঙ্ক্ষিত ফলাফল সবসময়ই পূর্বের অবস্থার উন্নতি ঘটায়। এই উন্নয়ন হলো প্রধান বা প্রাইমারি ফলাফল, যা ছিল কাম্য। এটি সবসময়ই ইতিবাচক। সব কাজই কোনো না কোনো ধরনের উন্নয়নের লক্ষ্যেই করা হয়ে থাকে।

তথ্যসূত্র: গেট স্মার্ট। মূল: ব্রায়ান ট্রেসি। অনুবাদ: ফারহা আহমেদ। সম্পাদনা: ফজলে রাব্বি। ঢাকা, সাফল্য প্রকাশনী, ২০২১।

সোমবার, ২২ ফেব্রুয়ারী, ২০২১

জীবন দেখেছি আমি

 জীবন দেখেছি আমি

লোকাল বাসের ভাঙ্গা গ্লাসের লেপ্টানো রোদে, রিকশাওয়ালার ঘামে ভেজা কুঁচকানো পুরাতন শার্টে। সদ্য কিশোরীর লাজুক চোখে, দিগন্তে হারিয়ে যাওয়া বালকের চিরচেনা মেঠো পথে। জীবন দেখেছি আমি রাজপথের রক্তাক্ত লাশে, পচন ধরা নোংরা মানুষে। ড্রেনের পাশে। বকুলের গন্ধে ভরা শীতের সকালে, প্রেয়সীর ওড়নার মত শরতের নীল আকাশে, তরুণীর কাশফুলে। জীবন দেখেছি আমি মেধাবী বেকার ছেলের পাতলা জুতোয়, গৃহিণীর নকশী কাঁথার রঙিন সুতোয়। ঘুম ভাঙ্গানো গানে মুয়াযযিনের আযানে। জীবন দেখেছি আমি নগরীর জ্যামে, ষাটোর্ধ্বো বুদ্ধিজিবী আর তরুণীর প্রেমে। কিছুটা ভাল থাকার আশায়- অসভ্য লম্পটের চাটুকারিতায়, সে প্রাণে , নিত্য যে সাহস যোগায়। জীবন দেখেছি আমি মৃত পুত্রের পাশে পিতার মুখে, সরল ছেলেটির ব্যর্থ প্রেমে কী করে দুঃখরা আসে নেমে ঘন কালো দুচোখে। হাসপাতালের বারান্দায়, মায়ের পাটিসাপটা পিঠায়। জীবন দেখেছি আমি কিশোরের গোল্লাছুটে ,বর্ষায়; চির হাস্যোজ্বল রূপালী ঝর্ণায়। বারান্দার ঝুলন্ত কাপড়ে, বড়দের ধমকেও থামেনা সাঁতার আমার বাড়ির সে পুকুরে। জীবন দেখেছি আমি বিপ্লবীর ফাঁসির দড়িতে, মুক্তিযোদ্ধার বিধবার স্ত্রীর ছেঁড়া শাড়িতে। রাত আটটার পর সোহরাওয়ার্দীতে, রমনায় নগরীর ক্লান্ত যুবক যেথা ক্লান্তি তাড়ায়। জীবন দেখেছি আমি শোষকের সাম্যের বুলিতে, বাসের হেল্পার, মাঝি মাল্লা আর কুলিতে। মসজিদে , মন্দিরে; ধূমায়িত চায়ের কাপে, সিগারেটের ফিল্টারে। 23, 10, 2017 (রচনাকাল) মুহাম্মদ নাইম

ব্রেভহার্ট: একজন প্রমিথিউসের গল্প

 

শিল্প  শিল্পীর কোন দেশ নেই,কাল নেই,ধর্ম কিংবা গোত্র নেইস্থান কিংবা কালিক সীমারেখায় তাদেরকে আবদ্ধ করা যায় না চিরায়ত শিল্প যা জীবন  জগতের সত্য উন্মোচন করে কিংবা চিরন্তন মানবমনের আকাংখাকে মূর্ত করে তোলে তা কোন নির্দিষ্ট সময়ের,নির্দিষ্ট দেশের গণ্ডিতে সৃষ্ট হলেও তা সকল দেশেরসকল কালের

একঝাঁক তরুণের  উদ্যোগে যাত্রা করতে চলেছে লিটল ম্যাগ “জ্ঞানকুঁড়ি” সেই ম্যাগের প্রথম সংখ্যাতেই বিদেশী চলচ্চিত্র দিয়ে যাত্রা শুরু হওয়াটা অনেকের কাছেই প্রশ্নবিদ্ধ হলেও লেখক যুক্তি খোঁজেন উপরোক্ত উক্তিতেই- শিল্পের কোন দেশ নেই’। দেশীয় কিংবা বিদেশীয় গণ্ডির সীমাবদ্ধতায় তাকে বাঁধা যায় না আর আজকের যুগে চলচ্চিত্রও যে একধরণের শিল্পমাধ্যমসমঝদার ব্যক্তিমাত্রই তা বুঝেন


মানুষ জন্মায় স্বাধীন হয়েকিন্তু সর্বত্রই সে শৃঙখলিত” জ্যাঁক রুশোর এই কথাটির মর্মবাণী মানুষ উপলব্ধি করেছে সভ্যতার ঊষালগ্ন থেকেই কিন্তু কখনোই অত্যাচারীরা এই অন্যায় শৃংখল চিরজীবনের জন্য পরাতে পারে নি মুক্তির আকাঙ্ক্ষায় প্রজ্জ্বলিত মানুষকে দৈহিকভাবে হয়তো মেরে ফেলা যায় কিন্তু আদর্শিক  নৈতিকভাবে তাকে পরাজিত করা যায় না বরং তাঁর আত্মদানই পরবর্তী প্রজন্মকে শৃংখল ভাঙার প্রেরণা জোগায়ব্রেভহার্ট (Braveheart) মুভিটির মূলকথা এখানেই
মুভিটির গল্প আবর্তিত হয়েছে ত্রয়োদশ শতকের বিখ্যাত স্কটিশ যোদ্ধা উইলিয়াম ওয়ালেস কর্তৃক স্কটল্যান্ডের স্বাধীনতার জন্য তাঁর সংগ্রামকে নিয়ে শৈশবেই পিতৃ-মাতৃহীন ওয়ালেসের স্বপ্ন ছিল আর দশজন সাধারণ স্কটের মতই একটা খামার থাকবে,ছোটবেলার ভালোবাসাকে বিয়ে করে সুখের নীড় গড়বে স্ত্রীসন্তানসহ সুখীশান্তিময় জীবন। ব্যস,এটুকুইকিন্তু এই অতি সাধারণ স্বপ্নটুকুও লুট হয়ে যায় পরাধীন স্কটল্যান্ডে ইংরেজ প্রবর্তিত প্রাইমা নকটিস’ (এই প্রথার বলে সদ্য বিবাহিত স্কট রমণীরা বিবাহের প্রথম রাতেই ইংরেজ নোবলদের সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপনে বাধ্য হতথেকে বাঁচার জন্য লুকিয়ে বিয়ে করে ছেলেবেলার ভালোবাসাকে কিন্তু তবুও শেষ রক্ষা হয় না ধর্ষণ প্রয়াসী ইংরেজ সৈন্যকে আঘাত করার ফলে সৈন্যরা তাঁর স্ত্রীকে মেরে ফেলে স্ত্রীহত্যার প্রতিশোধে ওয়ালেস ঝাঁপিয়ে পড়ে। যদিও তার ইচ্ছে ছিল সুখী,ঝামেলামুক্ত জীবন গড়ারকিন্তু সময়ের প্রয়োজনেপরিস্থিতির তাগিদে সাধারণ উইলিয়াম ওয়ালেস থেকে জনগণের আকাঙ্ক্ষার প্রতীক যোদ্ধা উইলিয়াম ওয়ালেসে উত্তোরণ ঘটে তাঁর উত্থান ঘটে নায়ক উইলিয়াম ওয়ালেসের

নিজের গোষ্ঠীর অল্প কয়েকজনকে নিয়ে শুরু করেছিলেন কিন্তু ক্রমে তাঁর কিংবদন্তী এমনভাবে ছড়িয়ে যায় যে আশেপাশের অন্যান্য গোষ্ঠীও বিভেদ ভুলে তাঁর সাথে হাত মেলায় কারণটা এই যেতিনিই ইংরেজদের গত একশো বছরের হত্যাধর্ষণঅন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে আশা দেখাতে পেরেছিলেন। নিভু নিভু হওয়া স্বাধীনতার সলতেটা উস্কে দিতে পেরেছিলেন

মেল গিবসন পরিচালিত মহাকাব্যিক এই মুভিতে উইলিয়াম ওয়ালেসের চরিত্রে অভিনয় করেন মেল গিবসন নিজেই অনবদ্য সংলাপকলাকুশলীদের অসাধারণ অভিনয় পারঙ্গমতাকস্টিউম,ব্যয়বহুল সেট ডিজাইনএবং গল্পের জাদুকরী মোহময়তায় দর্শক হারিয়ে যাবেন সেই সময়ে আর আবহসঙ্গীতপাশ্চাত্য সংগীতে অনভ্যস্ত দর্শকও বুঝতে পারবেন যে এমন মুভিতে ঠিক এমন অসাধারণ আবহসংীতের যোগসাজশ না হলে হয় না জেমস হরনার পরিচালিত এই সাউন্ড ট্র‍্যাকটি উঠে এসেছে সর্বকালের সেরা বাণিজ্যিকভাবে সফল ট্র‍্যাকের তালিকায়। একাডেমী এওয়ার্ডগোল্ডেন গ্লোববাফটা (BAFTA) এবং আরও অসংখ্য পুরষ্কারে মনোনীত হওয়ার পাশাপাশি বোদ্ধাদের প্রশংসাও কুড়িয়েছে বেশ

উইলিয়াম ওয়ালেসের দুর্ভাগ্য যেপ্রতি দেশেইপ্রতি কালেই শোষক শ্রেণীর উচ্ছিষ্টভোগী এমন কিছু নোবল সম্প্রদায় থাকে যারা নিজের তখত ঠিক রাখার জন্য জনগণের চাওয়ার সংগে প্রতারণা করে সাধারণ শ্রেণীর মানুষদের নিয়ে তুলনায় বড় প্রতিপক্ষ ইংরেজের বিরুদ্ধে তার যে স্বাধীনতার সংগ্রাম শেষ পর্যন্ত তা ব্যর্থ হয় এই নোবলদের বিশ্বাসঘাতকতার কারণে ইংরেজদের তিনি স্টারলিং এর যুদ্ধে হারিয়ে দেনইংরেজ দুর্গ দখল করেন এবং যে মুহূর্তে ইংল্যান্ডে আঘাত হানার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন ঠিক তখনই নোবলদের বিশ্বাসঘাতকতায় হেরে যান ফালকার্ক যুদ্ধে যাকে বিশ্বাস করেছিলেন সেই রবার্ট দ্য ব্রুস ইংরেজদের সংগে হাত মিলান এবং সেই অসাধারণ দৃশ্যটি যখন ওয়ালেস আবিষ্কার করেন তাকে হত্যা করতে ধেয়ে আসা ব্যক্তিটি আর কেউ নয় স্বয়ং রবার্ট দ্য ব্রুসসেই সময়ে ব্যথায় কাতর উইলিয়াম ওয়ালেসের মুখচ্ছবি অভিনেতা এমন সুনিপুনভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন যে দীর্ঘদিন সে চাউনি ভুলে যাওয়ার নয়

পরবর্তীতে তিনি আবারো বিশ্বাসঘাতকতার স্বীকার হয়ে ইংরেজ সৈন্যদের হাতে ধরা পড়েন। কিন্তু অকথ্য নির্যাতন সহ্য করেও কখনোই ক্ষমা ভিক্ষা চান নি এবং মৃত্যুর আগ মুহূর্তে উচ্চারিত মুক্তি কথাটার মাধ্যমে বুঝিয়ে দেনতুমি আমার প্রাণ কেড়ে নিতে পারো,কিন্তু পরাজিত করতে পার না এভাবেই মুভিটির প্রতিটি দৃশ্য জুড়ে ধ্বনিত হয়েছে স্বাধীনতার জন্য মানুষের আকাঙ্ক্ষা
১৯৯৫ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমাটি বক্স অফিসে দারুণ হিটের পাশাপাশি কুড়িয়েছে সমালোচকদেরও প্রশংসা ৬৮ তম একাডেমী এওয়ার্ড আসরে ১০ টি বিভাগে মনোনয়ন পেয়ে ৫টি বিভাগেই (best picture, best director, best cinematography, best make up, best sound editing)  জিতে নেয় পুরষ্কার
অনেক বোদ্ধাই মুভিটির খুব কড়া সমালোচনা করেছেন এই বলে যে এখানে ইতিহাসের বিকৃতি ঘটেছে কিন্তু এখানেই তো শিল্পীর স্বাধীনতা তিনি তো ইতিহাসের কাহিনীকার নন বরং ইতিহাস থেকে উপাদান নিয়ে সেই ইতিহাসের কংকালের উপর কল্পনার রঙ মিশিয়ে শিল্প সৃষ্টি করতে পারলে তবেই না তাঁর স্বার্থকতা ইতিহাস বলার দায়িত্ব তো নিশ্চয়ই পরিচালকের নয়

পরিচালকের স্বার্থকতা এখানেই যেতিনি ইতিহাসের উপাদান নিয়ে মুভি বানালেও তা নিছক ইতিহাসের কচকচি হয়ে ওঠে নাবরং তিনি খুব শৈল্পিকভাবে মানুষের স্বাধীনতার আকাংখাকে ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হন মানুষের স্বাধীনতা অর্জনের আকাঙ্ক্ষা চিরন্তন এবং গোটা সিনেমা জুড়ে ধ্বনিত হয়েছে পরাধীনতা থেকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা ব্রেভহার্ট তাই সেলুলয়েডের ফিতায় বন্দী বিংশ শতাব্দীর অন্যতম সেরা শিকল ভাঙার গান

লেখক - ধ্রুব শঙ্কর রায়