শনিবার, ১৬ ফেব্রুয়ারী, ২০১৯

উচিৎ শিক্ষা বইয়ের পর্যালোচনা, লেখক শিশির ভট্টাচার্য্য

আমাদের শিক্ষা কেমন হওয়া উচিত সেই সম্পর্কে লেখক শিশির ভট্টাচার্য্য নানান সময়ে নানা পত্র পত্রিকায় বিভিন্ন প্রবন্ধের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন। এমন আঠারোটি প্রবন্ধ নিয়ে প্রকাশিত ‘উচিৎ শিক্ষা’ শিরোনামের বই।

‘কেমন শিক্ষক চাই?’ প্রবন্ধের শুরুতেই ফরাসি দার্শনিক মোঁতেঈন (১৫৩৩-১৫৯২) এর বক্তব্য ‘শিক্ষার সাফল্য শতভাগ নির্ভর করে শিক্ষকের দক্ষতার ওপর।’ শিক্ষক যদি চৌকশ হন এবং শিক্ষার্থীর যদি জ্ঞানার্জনে আগ্রহ থাকে, তবে বিদ্যালয় ভবন, শ্রেণিকক্ষ, ব্ল্যাকবোর্ড-কোনো কিছুর অভাবই উচিৎ শিক্ষাকে ব্যাহত করতে পারার কথা নয়। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ যেমনটা লিখেছেন : ‘নীচের ক্লাসে যে-সকল মাস্টার পড়ায়... তাহারা না জানে ভালো বাংলা, না জানে ভালো ইংরেজি। কেবল তাহাদের একটা সুবিধা এই যে, শিশুদিককে শিখানো অপেক্ষা ভুলানো ঢের সহজ কাজ, এবং তাহাতে তাহারা সম্পূর্ণ কৃতকার্যতা লাভ করে।’

উল্লিখিত বক্তব্যের পুরো অংশই বই থেকে উদ্ধৃত। শিশুশিক্ষা কতটা জরুরি তা বোঝানোর জন্য যথেষ্ট তথ্য উপাত্ত তুলে ধরা হয়েছে, কিন্তু আমরা আসলে শিশুশিক্ষা নিয়ে কতটা সচেতন। তবুও আমরা পূর্বের চেয়ে অনেক বেশি সচেতন হয়েছি। তবে আমাদের শিশু ও কিশোরদের জন্য বর্তমানে খেলাধুলার মাঠের স্বল্পতা বিরাট এক সমস্যা।

শিক্ষকের কর্তব্যগুলোর মধ্যে শিক্ষক কখনো শিক্ষার্থীকে পথের দিশা বলে দেবেন, কখনোবা শিক্ষার্থীকে নিজেই পথ খুঁজে নিতে সাহায্য করবেন। শিক্ষকের কাজ হচ্ছে এভাবে জ্ঞান অর্জনের পথে শিক্ষার্থীকে এগিয়ে যেতে সহায়তা করা। আবার লেখক বর্তমানের চাঞ্চল্যকর সমস্যা প্রশ্ন ফাঁস নিয়ে মতামত তুলে ধরেছেন। আমরা যদি অন্যান্য দেশের অভিজ্ঞতা থেকে শিখি তবে আরও ভালো সমাধান পেতে পারি। প্রশ্ন ফাঁস ও নকল করার সমস্যা পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও বিদ্যমান। সেখানে নানা দেশে নানান পদ্ধতিতে এ সমস্যার মোকাবিলা করা হয়েছে। আমরা সেখান থেকে বেছে আমাদের নিজেদের শিক্ষাব্যবস্থা ও পরিবেশ পরিস্থিতি অনুযায়ী সমাধান গ্রহণ করতে পারি।

পৃথিবীর তাবৎ ভাষাবিজ্ঞানী, শিক্ষাবিদরা বলছেন শিক্ষার মাধ্যম হওয়া উচিত তিনটি : মাতৃভাষা, মাতৃভাষা ও মাতৃভাষা। অথচ আমাদের দেশে শিশুকাল থেকেই শিশুদের বাংলা, ইংরেজি ও আরবি ভাষার মাধ্যমে শিক্ষা দেওয়া হয়। এভাবে শিশুটি না নিজের মাতৃভাষা সম্পর্কে দৃঢ়তা দেখাতে পারে না অন্য কোন ভাষায়। এতে সে কেবল ভাসা ভাসা জ্ঞান নিয়ে বড় হয় এবং আত্মবিশ্বাসের অভাবে হতাশা নিয়ে বেড়ে ওঠে।

সারা দেশে সংস্কৃতিচর্চা আর খেলাধুলার সুযোগ-সুবিধা এত সীমিত যে তরুণদের সামনে সন্ত্রাস ছাড়া নিজের গুরুত্ব বাড়ানোর আর কোনো পথ খোলা নেই। বাংলাদেশের শহরগুলোতে সুপার মার্কেট আছে প্রচুর, কিন্তু সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের সংখ্যা নগণ্য। আমরা যারা বয়সে চল্লিশ ঊর্ধ্ব জনগণ (বিশেষ করে পুরুষ), যারা অর্থ উপার্জন ও নগর পরিকল্পনার সাথে সরাসরি জড়িত তারা কী চিন্তা করে নিজেরা খেলাধুলা করতে পারছে না বলে খেলাধুলার কোন প্রয়োজনীয়তা নেই? কেবল অর্থ থাকাই যথেষ্ট নয়। খেলাধুলা, বিনোদন, সাংস্কৃতিক পরিবেশের সাথে পরিচিত হওয়ার সুযোগ দরকার। বিভিন্ন তথ্য উপাত্তের মাধ্যমে লেখক এ বিষয়গুলোর গুরুত্ব ও সমাধান তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন।

লেখক আরও একটি ভয়ানক বিষয় তুলে ধরেছেন। ৯০ পৃষ্ঠা থেকে উদ্ধৃত - ‘নোম চমস্কি তার সাম্প্রতিক এক লেখায় অভিযোগ করেছেন যে মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সর্বোচ্চ মুনাফা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে স্থায়ীভাবে অধ্যাপক নিয়োগে আর আগ্রহী নয়। অন্য সব করপোরেট প্রতিষ্ঠানের মতো কর্মকর্তারা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন চালাবেন, আর পাঠদান সম্পন্ন হবে প্রধানত খ-কালীন শিক্ষকদের দিয়ে। ... চমস্কির আশঙ্কা, এই অসুস্থ করপোরেট মানসিকতা আখেরে “বিশ্ববিদ্যালয়” নামক প্রতিষ্ঠানটিকে সমূলে বিনষ্ট করবে। বাংলাদেশেও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সম্ভবত এক একটি পরিচালক-কর্মকর্তা সংঘ যাদের অন্যতম লক্ষ্য বিদ্যাবিক্রয় করে টু-পাইস কামানো।’ এতে করে জ্ঞান অর্জনের চেষ্টা ও প্রয়াস চালানোর জন্য যে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি মৌলিক ভূমিকা তা ব্যাহত হবে।

আমরা উচিৎ শিক্ষা জানার, বোঝার ও অর্জনের চেষ্টা করব। এই প্রত্যাশা ব্যক্ত করে এখানেই ‘উচিৎ শিক্ষা’ বইয়ের পর্যালোচনা সমাপ্ত করছি। সকলকে বইটি পাঠ করে আনন্দ গ্রহণের আমন্ত্রণ জানাই। ভালো থাকবেন।


মঙ্গলবার, ৫ ফেব্রুয়ারী, ২০১৯

বইয়ের পর্যালোচনা - কালো সীমানা। মূল : সাদত হাসান মান্টো। ভাষান্তর : জাভেদ হুসেন

১৯৪৭- এর দাঙ্গার সময় নিয়ে সাদত হাসান মান্টোর অনুভূতি উঠে এসেছে তার ছোট গল্পের মধ্য দিয়ে। সেখান থেকেই একটি উল্লেখ করছি। গল্পের নাম চ্যালেঞ্জ।

‘আগুন লাগল যখন, সারা মহল্লা জ্বলে ছাই হলো...কেবল একটা দোকান বেঁচে গেল, সেই দোকানের ওপর সাইনবোর্ড তখনো পড়া যাচ্ছিল...

“এখানে বাড়ি বানানোর মাল-সামান পাওয়া যায়।”’

অনুবাদক জাভেদ হুসেন সাদত হাসান মান্টো সম্পর্কে সংক্ষেপে বেশ চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন। আর সরাসরি উর্দু থেকে বাংলা ভাষায় ভাষান্তর করেও মূলভাব বজায় রাখার পাশাপাশি বক্তব্যকে অসাধারণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। মান্টোর রচনা আমি এই প্রথম পাঠ করলাম। অনুবাদক মান্টো সম্পর্কে যথার্থই বলেছেন,

‘উন্মত্ততাকে মান্টো কোনো ব্যাখ্যায় ঢাকতে চাননি। কোনো প্রেক্ষাপটে ফেলার ঝামেলাও তিনি পোহানসি। গল্প সরাসরি ঘটনাস্থলে পাঠককে আচমকা টেনে আনে। এই গল্পগুলো একেকটা তীক্ষè সুচের মতো ঢুকে যায়, পাঠক শিউরে ওঠেন। তিনি নির্মমভাবে সেই সুচের মধ্য দিয়ে আমাদের শরীরে বিষ ঢুকিয়ে দেন। সেই বিষ আমাদের চেতনায় টিকার কাজ করবে বলে মান্টোর মনে হয়েছিল। ভারতের কোনো মহল্লা বা রাস্তায়, যেখানে নাম না-জানা চরিত্র, ঘটনা তুলে আনেন মান্টো সিনেমার দৃশ্যের নিখুঁত ক্যামেরার চোখে।’

মান্টো যে বিষ দিয়ে আমাদের চেতনায় টিকার মতো করে কাজ করবে বলে চিন্তা করেছিলেন তা অনেকটা সত্য। কারণ ক্ষতকে ক্ষত বলে মেনে নেওয়া একে সারানোর পূর্বশর্ত। আর বাংলায় প্রবাদ আছে, ‘লোহা লোহাকে কাটে।’ মান্টোর এমনই এক ছোট গল্প দিয়ে বই পর্যালোচনা শেষ করছি।

‘দুই বন্ধু মিলে দশ-বিশজন মেয়ের মধ্য থেকে একটা মেয়েকে বেছে বেয়াল্লিশ টাকায় কিনে নিল। রাত শেষ হলে পরে এক বন্ধু সেই মেয়েকে জিজ্ঞেস করল, “তোমার নাম কী?”

মেয়ে তার নাম বলল। নাম শুনে সেই বন্ধু হতবাক হয়ে রইল। বলল, “আমাদের তো বলল তুমি অন্য ধর্মের!”

 মেয়েটি জবাব দিল, “ওরা মিথ্যে বলেছে।”

এই কথা শুনে সে ছুটে তার বন্ধুর কাছে গিয়ে বলল, “ওই হারামজাদারা আমাদের ধোঁকা দিয়েছে। চল মেয়েটাকে ফিরিয়ে দিয়ে টাকা নিয়ে আসি।”’

গল্পে নাম ছিল - লোকসান।