বৃহস্পতিবার, ৩০ মে, ২০১৯

বাল্টাসার গ্রাসিয়ান রচিত দুনিয়াবি বিচারবুদ্ধি - প্রথম প্রবচন

স্পেনের অন্যতম লেখক ও দার্শনিক বাল্টাসার গ্রাসিয়ান রচিত দুনিয়াবি বিচারবুদ্ধি (the art of Worldly Wisdom)। এখানে তাঁর ৩০০টি প্রবচন বা সাধারণ নিয়মনীতি নিয়ে লিখেছেন। এগুলোকে বিচক্ষণতা বা বিচারবুদ্ধি সম্পর্কিত নিয়মনীতিও বলা যায়। প্রথমটি নিয়ে আলোচনা করা হল।

১. আপনার আশেপাশে যা কিছু দেখছেন সবকিছুই তার পূর্ণপরিণতি নিয়ে অবস্থান করছে। বিশেষ করে যখন কেউ এ দুনিয়াতে পদার্পণ করে তখন তার পরিণতি পূর্ণ হয়েছে বলেই ভূমিষ্ট হয়। তবে পূর্বে সাতজন বিজ্ঞ ব্যক্তি হতে যা দরকার হত আজকে একজন ব্যক্তিকে বিজ্ঞ হতে তারচেয়েও বেশি দরকার। আজকে একজন ব্যক্তির সাথে লেনদেন করতে যে বুদ্ধির দরকার তা দিয়ে পূর্বে পুরো সমাজের সাথে লেনদেন করা সম্ভব ছিল।

সাত জ্ঞানী বা বিজ্ঞ ব্যক্তি বলতে গ্রিক দেশের সাতজন জ্ঞানী ব্যক্তিকে বোঝানো হয়। তবে আমার মনে হয় সাত জ্ঞানী বলতে সর্ববিষয়ে পারদর্শী এমন ব্যক্তি বা বিষয়কে বোঝানো হয়েছে। বর্তমানে জ্ঞানবিজ্ঞানের এত শাখা প্রশাখা যে একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করতেই সারাজীবন চলে যায়। বহু বিষয়ে পারদর্শী হওয়া অত্যধিক কঠিন। তাই গ্রাসিয়ান বক্তব্য বেশ সময়োপযোগী।

জ্ঞানের পাশাপাশি বর্তমানে লেনদেনও বেশ দুরূহ হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে কম্পিউটার ও ইন্টারনেট আসার পর থেকে মানুষকে প্রতিনিয়ত নিত্যনতুন মাধ্যম ও ব্যবস্থা সম্পর্কে জানতে হচ্ছে, শিখতে হচ্ছে। এখন এসব বিষয় সম্পর্কে না জানলে লেনদেনও পিছিয়ে থাকতে হয়। গ্রাসিয়ান তাঁর বক্তব্য এরকম সহজ সরলভাবেই বলে গেছেন।

বাল্টাসার গ্রাসিয়ান রচিত দুনিয়াবি বিচারবুদ্ধি বইটি বিনামূল্যে পড়ুন।

তথ্যসূত্র :

১। www.seandfrancis.com/2009/02/the-art-of-worldly-wisdom-the-first-maxim/
২। https://en.m.wikipedia.org/wiki/Baltasar_Gracian
৩। www.sacred-texts.com/eso/aww/index.htm

মঙ্গলবার, ২৮ মে, ২০১৯

সমাজ বদলাতে একজন মানুষই দরকার

লেখক এডওয়ার্ড এভারেট হেলের বক্তব্য দিয়ে আরম্ভ করছি,

'আমি তো মাত্র একজন! কিন্তু আমিই সেই একজন যে কাজটি করে দেখাব। আমি সবকিছু করতে পারব না, তবে আমি কিছু একটা করতে পারি। আর আমি যা করতে পারি না তার দ্বারা আমি যা করতে পারি তা নষ্ট হতে দিব না।'

১৮১৩ সনের কথা। ইংল্যান্ডের কারাগারে অর্ধনগ্ন অবস্থায় তিন চারশ মহিলা বিচারের অপেক্ষায় রয়েছে। তাদের জন্য ঘুমানোর কোন বিছানা নেই, ভালো কোন খাবারদাবার নেই। এদের মধ্যে বয়স্ক নারী, তরুণী ও বালিকারাও রয়েছে। তারা ময়লা মেঝেতে, ছেঁড়া কাপড়চোপড় পরে ঘুমায়। তাদের প্রতি কারও নজর নেই। সরকারও তাদেরকে এমন অখাদ্য দেয় যেন তাদেরকে বাঁচিয়ে রাখার কোন দায় নেই।

এলিজাবেথ ফ্রাই তাঁর সুযোগ দেখলেন। তিনি কারাগারে গিয়ে বন্দীদের সাথে দেখা করলেন। তিনি বন্দীদের জন্য শিক্ষার ব্যবস্থা করলেন। একটি বিদ্যালয় খুললেন। বন্দীদের বললেন যে তারা যেন নিজেদের মধ্য থেকে একজন শিক্ষক বেছে নেয়। তারা নিজেদের মধ্য থেকে একজনকে নেছে নিল যে কিছুদিন আগে ঘড়ি চুরির দায়ে গ্রেপ্তার হয়েছে। মাত্র তিন মাসের মাথায় যাদেরকে পূর্বে 'বন্য জন্তুজানোয়ার' বলে ডাকা হত, তারা আমূল বদলে গেল। তারা এখন অনেক ভদ্র ও সভ্য হয়ে উঠেছে।

এলিজাবেথ ফ্রাইয়ের এই সমাজকর্ম ততদিন চলল যতদিন না সরকার এহেন মহৎ কর্মকে আইনত স্বীকৃতি দিল। এরপর সারা দেশব্যাপী কারাগারের বন্দীদের পড়ালেখা ও সেলায়ের কাজ শেখান হল। ধীরে ধীরে সারা বিশ্বের সভ্য দেশসমূহ এ উদ্যোগকে সাধুবাদ জানালেন এবং গ্রহণ করলেন।

তথ্যসূত্র :

১। https://en.m.wikipedia.org/wiki/Elizabeth_Fry
২। https://www.thepositivemom.com/one-person-can-make-a-difference-and-everyone-try
৩। https://en.m.wikipedia.org/wiki/File:Mrs._Fry_reading_to_the_prisoners_in_Newgate_John_Johnson.jpg

রবিবার, ২৬ মে, ২০১৯

জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত এক সুযোগ

ফ্রেডেরিক ডগলাস (ফেব্রুয়ারি ১৮১৮ - ২০ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৫) একজন লেখক, বক্তা ও রাজনীতিবিদ। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ড অঙ্গরাজ্যের টালবট জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর মা ছিলেন ক্রীতদাস এবং তিনি নিজেও জন্ম থেকে ক্রীতদাস হিসাবে জীবন আরম্ভ করেন। তখনকার দিনে ক্রীতদাসদের জীবন অনেক ভয়ানক ছিল। দশ বছর বয়সে তিনি তাঁর মা’কে হারান। বারো বছর বয়সে, তাঁর মালিকের স্ত্রী সোফিয়া অলড তাঁকে লেখাপড়া শেখান। তখনকার দিনে ক্রীতদাসদের শিক্ষা অর্জন ছিল বেআইনি। মালিক অলড তার স্ত্রী’কে ফ্রেডেরিককে লেখাপড়া শেখাতে নিষেধ করলেন। কিন্তু ফ্রেডেরিক ছিলেন একজন বুদ্ধিমান ও আগ্রহী কিশোর। তিনি লুকিয়ে লুকিয়ে, অন্য সাদা শিশুদের লেখাপড়া দেখে শিখলেন।

এরপর তিনি যখন পড়তে শিখলেন তখন তিনি সংবাদপত্র পড়তে লাগলেন। দাসদের সম্পর্কে পড়তে লাগলেন। মানুষের সাথে মানুষের আচরণ কী রকম হওয়া উচিত তাই নিয়ে ফ্রেডেরিকের মধ্যে চেতনাবোধ তৈরি হতে লাগল। কিন্তু তিনি এক সময় ধরা পড়ে গেলেন। তাঁকে অন্য এক মালিকের কাছে বিক্রি করে দেওয়া হল। সেই মালিক ফ্রেডেরিককে বেদম প্রহার করতেন। ফ্রেডেরিকের মনোবল ভেঙে দিতে চাইলেন। কিন্তু এতে করে ফ্রেডেরিকের মনোবল ইস্পাতসম দৃঢ় হয়ে উঠল। তাঁর একমাত্র ধ্যানজ্ঞান হয়ে দাঁড়াল– স্বাধীনতা অর্জন।

১৮৩৮ সালে পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী তিনি নাবিকের ছদ্মবেশে মালিকের খামার থেকে পালিয়ে যান। তিনি একজন কৃষ্ণাঙ্গ ও মুক্ত ব্যক্তি এমন সনদও যোগাড় করেন। এরপর ট্রেনে করে নিউ ইয়র্কে এসে পৌঁছান।

ফ্রেডেরিক তাঁর দাস জীবন নিয়ে আত্মজীবনী লেখেন। তিনি নারীদের অধিকার নিয়ে বক্তব্য দেন। তিনি দাসপ্রথা বিলোপে আমেরিকা সহ ইংল্যান্ড ও আয়ারল্যান্ডেও বক্তব্য দেন। আমেরিকার গৃহযুদ্ধের সময় তিনি কৃষ্ণাঙ্গ সৈন্যদের অধিকার নিয়ে লড়াই করেন। যুদ্ধের সময় দক্ষিণ অংশ (কনফেডারেট স্টেটস অফ আমেরিকা) ঘোষণা দেয়, যেকোন কৃষ্ণাঙ্গ সৈন্যকে ধরতে পারলে হত্যা করা হবে অথবা দাস বানান হবে। ফ্রেডেরিক রাষ্ট্রপতি লিংকনকে (১৯৬১-১৯৬৫) এর বিপরীতে ব্যবস্থা নিয়ে সনির্বন্ধ অনুরোধ জানান। পরে রাষ্ট্রপতি লিংকন ঘোষণা করেন, কনফেডারেট (দক্ষিণ অংশ) যদি একজন বন্দী সৈন্যকেও হত্যা করে তবে উত্তর অংশও (যুক্তরাষ্ট্র ইউনিয়ন) ইউনিয়নও একজন বন্দী সৈন্যকে হত্যা করবে। তিনি রাষ্ট্রপতি এন্ড্রু জনসনের (১৯৬৫-১৯৬৯) উপদেষ্টা ছিলেন।

ফ্রেডেরিক ডগলাসের বিখ্যাত কিছু উক্তি,

‘দাস ব্যবসায়ীদের সাথে কোন সংহতি বা সংঘবদ্ধতা নয়।’

‘আমি ন্যায়ভিত্তিক কাজ করার জন্য যেকোন লোকের সাথে যুক্ত হতে রাজি আছি, কিন্তু অন্যায় কাজের জন্য কারও সাথেই যুক্ত হতে রাজি নই।’

লাখে একটি সুযোগ পাওয়ার কথা না। কিন্তু ফ্রেডেরিক ডগলাস পেয়েছেন। যেকোন সুযোগ আপনার সুবিধায় পরিণত হতে পারে যদি আপনি কাজ আরম্ভ করেন। আমার সুযোগ নেই। আমার কপালে নেই। এমন কথা হচ্ছে অলসদের অজুহাত। জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত এক সুযোগ। প্রত্যেক রোগী এক সুযোগ। পত্রিকার প্রতিটি প্রতিবেদন এক সুযোগ। ব্যবসার প্রতিটি গ্রাহক এক সুযোগ। সভাসমিতির প্রতিটি সাক্ষাৎ এক সুযোগ। ব্যবসার প্রতিটি চুক্তি এক সুযোগ। মানুষ্যোচিত প্রতিটি আচরণ এক সুযোগ। প্রতিটি সৎকর্ম এক সুযোগ। প্রতিটি বন্ধু এক সুযোগ। আপনার মধ্যকার আত্মবিশ্বাসী প্রতিটি কর্ম এক সুযোগ। যেকোন দায়িত্ব পালন করা, দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে নিজের সম্মান ও শক্তি বৃদ্ধি একটি সুযোগ। যদি একজন দাস– ফ্রেডেরিক ডগলাস নিজেকে একজন বক্তা, লেখক ও রাজনীতিবিদ হিসাবে তৈরি করতে পারেন তবে আপনার সম্ভাবনার দ্বার কি অসীম নয়?

এডউইন হুববেল চ্যাপিন বলেন,

‘মানুষের মধ্যে যারা উত্তম তারা সুযোগের জন্য অপেক্ষা করেন না বরং তারা সুযোগ তৈরি করে; সুযোগকে নিজের হাতের মুঠোয় চেপে ধরে এবং সুযোগকে তার সাহায্যকারী রূপে পরিণত করে।’

যারা কাজ করে তারা অভিযোগ জানায় না। আপনি দেখবেন, যারা অলস, কর্মবিমুখ তারাই ‘সুযোগ নেই, সম্ভবনা নেই’ বলে অভিযোগ জানায়। কিছু কিছু তরুণ জীবন থেকে এত কিছু গ্রহণ করে যেন ফুল থেকে মৌমাছির মধু সংগ্রহ। প্রতিটি ফুল থেকে, প্রতিবার কিছু না কিছু মধু সংগ্রহ করা। তেমনই জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত থেকে, প্রতিটি ঘটনা থেকে কিছু না কিছু শেখার চেষ্টা করুন যা আপনার ব্যক্তিগত উন্নয়নে কাজে আসবে।

এক মহান ব্যক্তি বলেছেন,

‘এমন কেউ নেই যার জীবনে একবার না একবার সুযোগ আসে না। কিন্তু সুযোগ এসে দেখল সেই ব্যক্তি প্রস্তুত নয়। তখন সুযোগ যেমন দরজা দিয়ে এসেছে তেমন জানালা দিয়ে বের হয়ে যায়।’

তথ্যসূত্র :

১। https://www.ducksters.com/history/civil_rights/frederick_douglass.php
২। https://www.biography.com/activist/frederick-douglass
৩। https://en.wikipedia.org/wiki/Frederick_Douglass

বৃহস্পতিবার, ২৩ মে, ২০১৯

বইয়ের পর্যালোচনা - বেকনের প্রবন্ধ। মূল : ফ্রান্সিস বেকন। অনুবাদ : কাওসার হুসাইন


বেকনের প্রবন্ধে আমরা মূলত উপযোগবাদী দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পাই। বেকন সবকিছুকে ব্যবহারিক মূল্য ও উপযোগিতার নিরিখে বিচার করেন। বেকন চান মানুষের সামর্থ্যরে ষোলো আনা ব্যবহার। মানুষ বাস্তব জগতে নিজের সামর্থ্য প্রয়োগ করবে এবং এর ব্যবহার থেকে সাফল্য লাভ করবে।

বাস্তবে কী কতটুকু কাজে আসবে তাই হচ্ছে বেকনের আসল কথা, সত্য মিথ্যা বিবেচনাটি অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। তাঁর চেষ্টা ছিল জীবনের সাফল্য ও ব্যর্থতা আলোচনা করা।

আমি প্রথমে ঈর্ষা প্রবন্ধের উল্লেখ করছি। দীর্ঘদিন থেকে আমার মনে একটি প্রশ্ন ছিল, মানুষ কেন ঈর্ষাপরায়ণ হয়? এর খুব সহজ ও যথার্থ এক উত্তর পাওয়া গেল বেকনের প্রবন্ধে। বেকন বলছেন,

‘যার নিজের কোন গুণ নেই, অন্যের গুণপনা তার ঈর্ষার উদ্রেক করে।’

‘নিজের কাজে যার মন রয়েছে, তার ঈর্ষান্বিত হবার মতো বিশেষ কিছু থাকে না। কারণ ঈর্ষার স্বভাবই হচ্ছে টো টো করা, সে পথে পথে ঘুরে বেড়ায়, ঘরে তার মন টেকে না।’

‘আবার ঈর্ষার পিছনে কাজ করে অন্যের সাথে নিজের তুলনা; যেখানে তুলনা নেই, সেখানে ঈর্ষাও নেই; যে কারণে রাজা ভিন্ন কেউ রাজাকে ঈর্ষা করে না।’

‘সম্মানের পথে যাদের বিস্তর দুর্ভোগ, দুশ্চিন্তা ও দুরবস্থা মোকাবিলা করতে হয়েছে, লোকে তাদের ঈর্ষা করে কম। অনেক ক্লেশে কষ্টে সম্মান অর্জিত হয়েছে জেনে অনেকে বরং তাদের করুণাই করে; আর করুণা ঈর্ষার দারুণ এক প্রতিষেধক। যে কারণে দেখবেন, চতুর ও কুশলী রাজনীতিকেরা সুসময়েও সর্বদা আফশোস করে বলছেন যে কী একটা জীবন তাঁদের, কাজের চাপে জীবনই শেষ। প্রকৃত অবস্থা যা-ই হোক, তাঁরা এসব বলেন ঈর্ষার ধার ভোঁতা করার অভিপ্রায়ে।’

উচ্চ পদ প্রবন্ধ থেকে একটি উক্তি দিচ্ছি।

‘ভালো কিছু করতে পারার শক্তি অর্জন– এই হওয়া চাই সকল উচ্চাকাক্সক্ষার প্রকৃত লক্ষ্য।’

ক্ষমতা অর্জন কেন করব? উচ্চ পদে কাজ করার শক্তি কেন আমরা অর্জন করব তার খুব সরল স্বীকারোক্তি দিয়েছেন বেকন। একে আমরা এভাবেও বলতে পারি যে মানুষের জন্য উপকারী সেবা সম্পন্ন করার আকাক্সক্ষা থাকাই হচ্ছে উচ্চাকাক্সক্ষার প্রারম্ভ।

অর্থবিত্ত প্রবন্ধের উক্তি দিয়ে শেষ করছি,

‘ধনী হোন সৎ রাস্তায়, ব্যয় করুন ভেবে চিন্তে, বিতরণ করুন আনন্দের সাথে এবং যাবার সময় হলে হাসিমুখে ছেড়ে চলে যান।’

তথ্যসূত্র :

১।  বেকনের প্রবন্ধ। মূল : ফ্রান্সিস বেকন। অনুবাদ : কাওসার হুসাইন। ঢাকা, ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড, ২০০০।

বুধবার, ২২ মে, ২০১৯

সুযোগকে নিজের হাতের মুঠোয় চেপে ধরুন

জন ডেভিসন রকফেলার (৮ জুলাই, ১৮৩৯ - ২৩ মে, ১৯৩৭) তার সুযোগ দেখলেন পেট্রোলিয়াম ব্যবসায়। তখন ১৮৭০ সাল। দেশে পেট্রোলিয়াম থেকে শোধিত তেল দিয়ে প্রচুর বাতি তৈরি করা হচ্ছে। দেশে পেট্রোলিয়াম প্রচুর, কিন্তু বিশোধন প্রক্রিয়া খুব একটা ভালো না। যা পাওয়া যায় তা খুবই নিকৃষ্ট মানের। রকফেলার নিজের সুযোগ দেখলেন।

তিনি স্যামুয়েল অ্যান্ড্রুজের (১০ ফেব্রুয়ারী, ১৮৩৬ - ১৫ এপ্রিল, ১৯০৪) সাথে অংশীদার হিসাবে ব্যবসা আরম্ভ করলেন। তারা একটি গুদামঘর থেকে কাজ আরম্ভ করলেন। স্যামুয়েল ছিলেন একজন রসায়নবিদ। পেট্রোলিয়াম বিশোধনে তিনি আরও উত্তম পদ্ধতি আবিষ্কার করলেন। তাদের বিশোধিত পেট্রোলিয়াম তেল ছিল বাজারে অন্যান্য তেলের চেয়ে উত্তম। ফলে তারা দ্রুত উন্নতি করতে লাগল।

তারা আরও একজন অংশীদার নিলেন, জনাব হেনরি ফ্লাগলর (২ জানুয়ারী, ১৮৩০ - ২০ মে, ১৯১৩)। কিন্তু স্যামুয়েল খুব দ্রুত অসন্তুষ্ট হতে লাগলেন। তিনি কোম্পানি ছেড়ে চলে যেতে চাইলেন।

রকফেলার : তুমি তোমার অংশের জন্য কত টাকা চাও?

স্যামুয়েল (কিছুটা অসতর্কভাবে) : এক কোটি টাকা।

রকফেলার : খুব সস্তায় বিক্রি করে দিলে। দশ কোটির বদলে এক কোটি চাইলে।

বিশ বছর পর সেই ব্যবসা যা ছোট্ট একটি কারখানা থেকে আরম্ভ হয়েছিল, যার মূল ছিল এক লাখ টাকা, সেখান থেকে কোম্পানির মোট মূল্য দাঁড়ায় নব্বই কোটি টাকা। স্ট্যান্ডার্ড ওয়েল ট্রাস্ট নামক রকফেলারের সেই কোম্পানি শেয়ার বাজারে প্রবেশ করে এবং কোম্পানি সর্বমোট মূল্য দাঁড়ায় একশত পঞ্চাশ কোটি টাকা।

এই ছিল সুযোগকে দেখতে পারা এবং তাকে হাতের মুঠোয় চেপে ধরার এক অনন্য ঘটনা। যদি এই ঘটনা ছিল অর্থ বিষয়ক। কিন্তু আজকের প্রজন্ম যেকোন জায়গায়, যেকোন পেশায় সুযোগ পেতে পারে। সুযোগকে নিজের হাতের মুঠোয় চেপে ধরতে পারে। আজকের যুগে নতুন ধরনের তড়িৎ প্রকৌশলী দরকার, শিল্পী, লেখক, কবি সহ সব ধরনের পেশায় সুযোগ রয়েছে।

যেকোন মাধ্যমে মহৎ কিছু করার, সাফল্য অর্জন করার সর্বাত্মক সুযোগ রয়েছে। সম্পদ কেবল অর্থ অর্জনে নয়, স্বাস্থ্য, সুখ ও জীবনের যেকোন আনন্দে উপভোগ অর্জন করা যায়। তবে সেই সম্পদ অর্জন করতে সংগ্রাম করতে হয়। সুযোগ মানে চূড়ান্ত কিছু নয়, বরং ছোটোখাটো ঘটনা। এসব ছোটোখাটো ঘটনা থেকে সুযোগ নিয়ে মানুষকে তার পেশায় সর্বোত্তম কাজ করে দেখাতে হয়।

তথ্যসূত্র :

১। https://bn.m.wikipedia.org/wiki/জন_রকফেলার
২। https://roar.media/bangla/main/history/history-of-john-d-rockefeller/
৩। https://en.m.wikipedia.org/wiki/John_D._Rockefeller
৪। https://en.m.wikipedia.org/wiki/Samuel_Andrews_(chemist)
৫। https://en.m.wikipedia.org/wiki/Henry_Flagler

সোমবার, ২০ মে, ২০১৯

দুর্বল মানুষ সুযোগের অপেক্ষায় বসে থাকে আর দৃঢ়চেতা মানুষ সুযোগ তৈরি করে

কিউপিডের চুম্বনে সাইকির পুনর্জাগরণ
ভাস্কর : আন্তোনিও কানোভা
প্রথম প্রদর্শন : ১৭৮৭ - ১৭৯৩
এই ঘটনাটি উল্লেখ করেন লেখক জর্জ ক্যারি ইগলেস্টন। সিঙ্গার ফেইলরের বিরাট অট্টালিকায় একবার এক ভোজসভার আয়োজন হয়। এই ভোজসভার আয়োজন করে বিরাট এক কোম্পানি। ভোজসভার ঠিক আগ মুহূর্তে খাবারের পরিচালককে জানানো হল যে কেউ একজন মূল খাবারটি নষ্ট করে ফেলেছে। পরিচালকের তো মৃতপ্রায় অবস্থা।

সেখানে রান্নাঘরে কাজ করছিল এক বালক। সে বলল, ‘আপনি যদি অনুমতি দেন তবে আমি এমন কিছু বানাতে পারি যা দেখে সকলে খুশি হবে।’

পরিচালক : তুমি! তুমি কে?

বালক : আমার নাম আন্তোনিও কানোভা, ভাস্কর পিসানোর নাতি।

পরিচালক : (একটু দ্বিধা নিয়ে) তুমি কী বানাতে পার?

আন্তোনিও : এমন কিছু যা টেবিলের মধ্যমণি হবে, যদি আপনি আমাকে চেষ্টা করার অনুমতি দেন।

তখন ভোজসভা আরম্ভ হতে খুব একটা সময়ও ছিল না। পরিচালক অনেকটা দ্বিধা নিয়েই আন্তোনিওকে বলল, ‘দেখ কী করতে পার।’ আন্তোনিও কিছু ঘি নিয়ে সেগুলোকে একত্রে মিশিয়ে একটি শুয়ে থাকা সিংহের ভাস্কর্য তৈরি করল এবং একে খাবার টেবিলের মাঝখানে সাজান হল।

ভোজসভায় ছিল ভেনিসের বড় বড় ব্যবসায়ী, রাজকুমার ও সংসদ সদস্যরা। তারা খাবার ঘরে ঢুকে সেই শায়িত সিংহকে দেখে তাজ্জব হয়ে গেল। তাদের মধ্যকার অনেকেই শিল্পসাহিত্যের চর্চাকারী। এমন অসাধারণ কাজ দেখে তাঁরা চোখ ফেরাতে পারল না। তারপর উপস্থিত অতিথিবৃন্দ সিঙ্গার ফেইলরকে জিজ্ঞেস করল, ‘ঘিয়ের মতো ক্ষণস্থায়ী জিনিসের ওপর কে এই অসাধারণ কর্ম করেছে?’ ফেইলর উত্তর দিতে পারলেন না। তিনি তাঁর খাবার পরিচালককে ডাকলেন এবং জিজ্ঞেস করলেন। পরিচালক আন্তোনিওকে সাথে করে নিয়ে এলেন।

অতিথিরা যখন বুঝতে পারলেন একজন রান্নাঘরের সাধারণ কর্মচারী এই অসাধ্য কাজ করেছে তখন তাঁরা হতবাক হলেন। গৃহকর্তা ফেইলরের কাজটি এত পছন্দ হয় যে তিনি সকলের সামনে ঘোষণা করেন আন্তোনিওকে তিনি সবচেয়ে ভালো ভাস্কর্য শিক্ষকের কাছে পাঠাবেন এবং তার সব ধরনের শিক্ষা ব্যয় বহন করবেন। তিনি তাঁর কথা রেখেছিলেন।

আন্তোনিও কানোভা
আত্মপ্রতিকৃতি : ১৭৯২
জীবনকাল : ১৭৫৭ - ১৮২২

আন্তোনিও তাঁর সৌভাগ্য দ্বারা বখে যাননি। তাঁর হৃদয়ে সেই একই বালকসুলভ সহজসরলতা, বিশ্বস্ততা ও পরিশ্রম করার মানসিকতা রয়ে যায়। তিনি বাল্যকালে যেমন কঠোর পরিশ্রম করতেন, পরবর্তী সময়েও তিনি একইভাবে পরিশ্রম করে যান। অনেকে হয়তো আন্তোনিও’র প্রথমবার সুযোগ তৈরি করার ঘটনা শোনেননি। কিন্তু অনেকেই বিশ্ববিখ্যাত ভাস্কর কানোভার নাম শুনেছে।

সুযোগ পাওয়া যায় না, তৈরি করতে হয়। দুর্বল মানুষ সুযোগের অপেক্ষায় বসে থাকে আর দৃঢ়চেতা মানুষ সুযোগ তৈরি করে। সুযোগ তৈরি করতে সাহস নিয়ে এগিয়ে যেতে হয়। আন্তোনিও কানোভা তাঁর সুযোগ দেখলেন এবং সাহস নিয়ে এগিয়ে গেলেন।

তথ্যসূত্র :

১। https://bn.m.wikipedia.org/wiki/সাইকি
২। https://en.m.wikipedia.org/wiki/Psyche_Revived_by_Cupid's_Kiss
৩। https://en.m.wikipedia.org/wiki/Antonio_Canova
৪। https://en.m.wikipedia.org/wiki/Luigi_Lablache
৫। https://en.m.wikipedia.org/wiki/George_Cary_Eggleston

শনিবার, ১৮ মে, ২০১৯

সুযোগ তৈরি করতে সাহস নিয়ে এগিয়ে যেতে হয়


আমার অভিধানে 'অসম্ভব' নামে কোন শব্দ নেই। - নেপোলিয়ন বোনাপার্ট

নেপোলিয়ন বোনাপার্ট তাঁর ষাট হাজার সৈন্য নিয়ে যাত্রা আরম্ভ করলেন অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে। সামনে দেখা হল আল্পস পর্বতমালার সাথে। তিনি তাঁর প্রকৌশলীদের পাঠালেন এই বিপদসঙ্কুল রাস্তায় পথ খুঁজে বের করতে। পথটি ছিল আল্পস পর্বতমালার গ্রেট সেন্ট বার্নার্ড পাস, বর্তমান সুইজারল্যান্ডে অবস্থিত।

নেপোলিয়ন : এই রাস্তা কি অতিক্রম করা সম্ভব?

প্রকৌশলীরা অনেকটা দ্বিধাদ্বন্দ্ব নিয়ে : হয়তো সম্ভব।

নেপোলিয়ন (দ্বিধাহীনভাবে) : তবে, সামনে চল।

ইংল্যান্ড ও অস্ট্রিয়ার সেনাপতিরা হেসে খুন। বলে কী! আল্পস পাড়ি দিবে। তাও আবার ষাট হাজার সৈন্য, সরঞ্জাম, ভারী গোলাবারুদ ও অস্ত্রশস্ত্রসহ। এদিকে জেনোয়া শহর অবরোধ করে রেখেছে অস্ট্রিয়ার সেনারা। কমান্ডার আন্দ্রে ম্যাসেনা প্রতিপক্ষ সেনাদের অনেক কষ্টে ঠেকিয়ে রেখেছে। নেপোলিয়ন বিপদের দিনে তাঁর বন্ধুদের পাশে থাকবেন না তা কি হয়।

অতঃপর এই 'অসম্ভব' কর্ম যখন সম্পন্ন হয় তখন কিছু কিছু মানুষ একে দেখে বলল এ কাজ তো বহু আগেই করা সম্ভব ছিল। আর কিছু মানুষ অজুহাত বের করল যে এ ধরনের কাজ আসলে অনতিক্রম্য। অনেক সেনাপতিরই পর্যাপ্ত খাদ্য সরবরাহ ছিল, যন্ত্রপাতি, যানবাহন ও সাহসী সৈন্য ছিল। কিন্তু তাদের সকলের মধ্যে যে জিনিসের অভাব ছিল তা হচ্ছে বোনাপার্টের মতো সঙ্কল্প ও দৃঢ়তা। সামনে কঠিন সমস্যা দেখে তিনি সঙ্কুচিত হননি, বরং তাঁর সুযোগকে তৈরি করতে সাহস নিয়ে এগিয়ে গেলেন।

সুযোগ পাওয়া যায় না, তৈরি করতে হয়। ইতিহাসে এমন শত শত ঘটনা আছে যেখানে মহান পুরুষরা তাদের সুযোগ নিজেরাই তৈরি করেছেন। তাঁদের কারও পথই মখমলের চাদরে আবৃত ছিল না। প্রত্যেকেই একের পর এক ভয়ানক সব বিপদের সামনে পড়েছেন। তারা সাহস নিয়ে এগিয়ে গেছেন এবং সমস্যাকে সুযোগে পরিণত করে লাভবান হয়েছেন।

তথ্যসূত্র :

১। https://www.sms-bangla.com/নেপোলিয়ন_বোনাপার্টের_উক্তি
২। https://bani.com.bd/author/226/
৩। https://en.wikipedia.org/wiki/Siege_of_Genoa_(1800)
৪। https://en.wikipedia.org/wiki/Bonaparte_Crossing_the_Alps
৫। https://en.wikipedia.org/wiki/Napoleonic_Wars#War_between_Britain_and_France
৬। https://bn.wikipedia.org/wiki/নেপোলিয়ন_বোনাপার্ট
৭। https://bn.wikipedia.org/wiki/নেপোলীয়_যুদ্ধ
৮। https://www.youtube.com/results?search_query=The+Little+Corporal
৯। https://bn.wikipedia.org/wiki/গিরিপথ
১০। https://en.wikipedia.org/wiki/Great_St_Bernard_Pass

বৃহস্পতিবার, ১৬ মে, ২০১৯

সুযোগ পাওয়া যায় না, তৈরি করতে হয়

কেউ যদি কাজ আরম্ভ না করে তবে এই পৃথিবীর কোন কাজই আপনাআপনিই আরম্ভ হয় না এবং হয়ওনি। আপনি কি কাজ করতে আগ্রহী? এই মুহূর্তকেই খপ করে ধরুন। যা করতে পারেন, যা কিছুর স্বপ্ন দেখেন, আজই আরম্ভ করুন। একটি ছোট্ট পদক্ষেপ নিন। হাজার বছর আগে চীনের দার্শনিক লাও জু তার রচিত গ্রন্থ তাও তে চিং এ যেমন বলে গেছেন সে কথা আজও অমলিন। 'হাজারো মাইলের যাত্রা আরম্ভ হয় একটি ছোট্ট পদক্ষেপ দিয়ে।'

সুযোগ পাওয়া যায় না, তৈরি করতে হয়। নিজের সুযোগ নিজেই তৈরি করুন। আজকে থেকে কাজ আরম্ভ করুন। দেখবেন, কাল যখন মঞ্চে ওঠার সুযোগ হবে আপনি দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দিচ্ছেন। কিন্তু আরম্ভ আপনাকে আগেই করতে হবে, আজই করতে হবে।


১৭৯৮ সালে ভূমধ্যসাগরের উপকূলে নীল নদের উপকণ্ঠে ব্রিটিশ নৌবহর ও ফরাসি ফার্স্ট রিপাবলিক নৌবহরের মধ্যে একটি নৌযুদ্ধ সংগঠিত হয়। একে নীল নদের নৌযুদ্ধও বলা হয়। ব্রিটিশ নৌবাহিনীর উপপ্রধান সেনাপতি হোরেশিও নেলসন মিশরীয় উপকূলে এসে পৌঁছান দুপুর ২টায়। তিনি তাঁর ক্যাপ্টেনদের সাথে যুদ্ধ পরিকল্পনা করছিলেন। নেলসন তাঁর পরিকল্পনা বলার পর ক্যাপ্টেন বেরি উৎফুল্ল হয়ে বললেন, 'যদি আমরা জয়ী হই তবে বিশ্ব কী বলবে?'

নেলসন, 'এক্ষেত্রে যদির কোন জায়গা নেই। আমাদেরকে জিততেই হবে। আর যদি তা না হয় তবে সেই গল্প বলার মতো কেউ বাঁচবে কিনা তা ভিন্ন কথা।' তিনি দৃঢ়তার সাথে আরও বললেন, 'আগামীকাল সকালে হয় আমি একটি খেতাব জিতব, না হয় ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবিতে আমার করব হবে।' ইতিহাস বলে তিনি খেতাব জিতেছেন।

তাঁর চোখে সাহসের ঝিলিক দিয়ে উঠল। অন্যরা যেখানে কেবল সম্ভাব্য পরাজয় দেখছেন, সেখানে তিনি অদম্য মানসিকতা নিয়ে মহিমান্বিত বিজয় দেখলেন। তিনি নিজেদের নৌবহরকে প্রস্তুত করলেন। সন্ধ্যায় আক্রমণ করলেন এবং বিজয়ী হলেন।