মঙ্গলবার, ৭ মার্চ, ২০২৩

থিংক অ্যান্ড গ্রো রিচ বইয়ের বাংলা অনুবাদ (Think and grow rich by Fazle Rabbi, Saphollo Prokasoni), চিন্তা করুন এবং ধনী হোন, নেপোলিয়ন হিল

 



চিন্তা করুন

এবং

ধনী হোন



 

আমার জীবনের একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য হচ্ছে মানুষের জন্য উপকারী সেবা সম্পন্ন করা, একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যের ক্ষমতাকে তুলে ধরা যাতে করে মানুষ নিজেদের জীবনকে সমৃদ্ধি ও সাফল্যের পথে পরিচালিত করতে পারে। ঠিক এই কারণেই আমি প্রতিদিন সকালবেলা ঘুম থেকে উঠি, নতুন নতুন পথ খুঁজি, কী কী করা যায় তা নিয়ে চিন্তাভাবনা করি। এরই একটি উপায় হচ্ছে সাফল্য প্রকাশনীর মাধ্যমে ২০৩০ সালের মধ্যে অনুপ্রেরণার ৬৪টি বই প্রকাশ করা।

 

―ফজলে রাব্বি (সাফল্য প্রকাশনী, ঠিক ধারণা ব্লগ)


 











আপনি যতই ইতিবাচক চিন্তা করুন আর কথা বলুন না কেন আপনি নিজের স্বপ্ন পূরণ করতে পারবেন না যদি-না আপনি কাজ করেন। আল্লাহ তাদেরকে সহায়তা করে যারা কাজ করে, নিজের স্বপ্ন পূরণের চেষ্টা করে।

- জেফ কেলার (এটিটিউড ইজ এভরিথিং)


 

 আপনার সাফল্যের সারথি


১৯৩৭ সালে প্রকাশিত ঞযরহশ অহফ এৎড়ি জরপয / ঘধঢ়ড়ষবড়হ ঐরষষ  বইয়ের অনুসরণে বাংলা অনুবাদ




চিন্তা করুন এবং ধনী হোন

থিংক অ্যান্ড

গ্রো রিচ



মূল

নেপোলিয়ন হিল



অনুবাদ 

ফজলে রাব্বি







 









প্রকাশক

সাফল্য প্রকাশনী

৩০২, লালবাগ,

লালবাগ রোড, ঢাকা-১২১১

মোবাইল: ০১৫৩৪ ৯০২ ৮৮২

সাপ্র: ০১

ষষ্ঠ মুদ্রণ: চৈত্র ১৪২৯ / মার্চ ২০২৩

প্রথম প্রকাশ: ভাদ্র ১৪২২ / সেপ্টেম্বর ২০১৫


বিষয়: ব্যক্তিগত উন্নয়ন

বাংলা অনুবাদর্  ফজলে রাব্বি ২০২৩

প্রচ্ছদ: মো. জোবায়ের আলম


দাম: চারশত সাতাশ টাকা মাত্র ($৪২৭.০০) (হার্ডকভার)


ফোনে অর্ডার করতে কল করুন ০১৬৮২ ০৫৮ ১৭১

সাফল্য প্রকাশনীর অনলাইন ওয়েরসাইট– িি.িংধঢ়যড়ষষড়.পড়স

সাফল্য প্রকাশনীর যেকোনো বই কিনতে ভিজিট করুন:

িি.িৎড়শড়সধৎর.পড়স /ংধঢ়যড়ষষড়-ঢ়ৎড়শধংড়হর/ 

িি.িনড়রভবৎৎু.পড়স/ঢ়ঁনষরংযবৎ/ংধঢ়যড়ষষড়-ঢ়ৎড়শধংড়হর/ 

িি.িধিভরষরভব.পড়স/ংধঢ়যড়ষষড়-ঢ়ৎড়শধংযড়হর/

িি.িঢ়নং.পড়স.নফ/ঢ়ঁনষরংযবৎ/ংধঢ়যড়ষষড়-ঢ়ৎড়শধংড়হর/ 

িি.িনড়রনধুধৎ.পড়স/ঢ়ঁনষরংযবৎ-নড়ড়শং/ংধঢ়যড়ষষড়-ঢ়ৎড়শধংড়হর/


ঞযরহশ ধহফ এৎড়ি জরপয নু ঘধঢ়ড়ষবড়হ ঐরষষ, ঞৎধহংষধঃবফ নু ঋধুষব জধননর, চঁনষরংযবফ নু ঝধঢ়যড়ষষড় চৎড়শধংড়হর, ৩০২, খধষনধময জড়ধফ, ডধৎফ ঘড়: ২৫, খধষনধময, উযধশধ-১২১১. ঈড়হঃধপঃ ঙভভরপব: ০১৫৩৪৯০২৮৮২.

ঊ-সধরষ: ংধঢ়যড়ষষড়ঢ়ৎড়শধংড়হর@মসধরষ.পড়স

চৎরপব: ঞশ ৪২৭.০০ ঙহষু. টঝ: $১৫. ওঝইঘ: ৯৭৮-৯৮৪-৯১৪৭৭-০-৩





উৎসর্গ

প্রিয় ছোট ভাই

ফজলে রাইয়ান


 









দুইটি জিনিস আছে যা আপনাকে অভিজ্ঞ ও জ্ঞানী করে তুলবে: এক, যেসব বই আপনি পড়ছেন। দুই, যে সকল মানুষের সাথে আপনি চলাফেরা করেন।

- জ্যাক ক্যানফিল্ড


 

সূচি


অধ্যায় ০১ সূচনা ২২

স্বর্ণ থেকে তিন ফুট পিছনে ২৫

পঞ্চাশ টাকায় অধ্যবসায়ের শিক্ষা ২৭

আপনি ‘কর্তৃত্ব করবেন আপনার ভাগ্যের, চালক হবেন আপনার আত্মার’, কারণ...

৩৩

অধ্যায় ০২ আকাক্সক্ষা ৩৭

মানুষের ইচ্ছার কাছে প্রকৃতির হার ৪৬

অধ্যায় ০৩ আস্থা ৫৭

কীভাবে আস্থা গঠন করবেন? ৫৮

আস্থা এমন একটি সুস্থির মস্তিষ্কজনিত অবস্থা যা স্বপরামর্শ দ্বারা প্রভাবিত করা যায়

৬১

আত্মবিশ্বাস গঠন পদ্ধতি ৬৪

শত কোটি টাকার একটি বক্তব্য ৭০

অধ্যায় ০৪ স্বপরামর্শ ৭৮

নির্দেশাবলির বিবরণ

৮৩

অধ্যায় ০৫ বিশিষ্ট জ্ঞান ৮৭

‘আপনি কীভাবে জ্ঞান ক্রয় করবেন’ এটা আপনার জানা দরকার ৯০

‘বিশেষজ্ঞদের চাহিদা বেশি’ ৯১

‘শিক্ষানবিস’ প্রস্তাব ৯১

অধ্যায় ০৬ কল্পনা ১০৫

দুই প্রকারের কল্পনা ১০৬

কীভাবে আপনার কল্পনাকে ব্যবহারিক প্রয়োগে আনবেন? ১০৯

মনোমুগ্ধকর কেটলি ১০৯

যদি আমার এক কোটি টাকা থাকত তবে আমি কী করতাম? ১১২

অধ্যায় ০৭ সংগঠিত পরিকল্পনা ১২০

নিজ দক্ষতাগুলো বিক্রয়ের জন্য পরিকল্পনা ১২৪

নেতৃত্বের প্রধান গুণাবলি ১২৬

নেতৃত্বে ব্যর্থতার ১০টি প্রধান কারণ ১২৮


এমন কিছু উর্বর জায়গা যেখানে ‘নতুন নেতৃত্ব’ দরকার হবে ১৩০

একটি পদের জন্য কখন ও কীভাবে আবেদন করবেন? ১৩২

যে সিস্টেমের মাধ্যমে দক্ষতা ও সেবা বাজারজাত হচ্ছে ১৩২

একটি ‘সংক্ষিপ্ত আবেদনপত্রে’ আপনার তথ্য দিন ১৩৩

কীভাবে আপনার আকাক্সিক্ষত পদটি পাবেন? ১৩৬

দক্ষতা বাজারজাত করার নতুন পথ হচ্ছে ‘অংশীদারিত্ব’ ১৩৮

আপনার গুণ, পরিমাণ ও চেতনা নির্ধারণ করুন ১৪৩

আপনার দক্ষতার উৎকৃষ্ট মূল্য ১৪৫

ব্যর্থতার ৩০টি কারণ, কতটি আপনাকে আটকে রেখেছে? ১৪৬

২৮টি প্রশ্ন দ্বারা নিজেকে আবিষ্কার করুন ১৫৫

নিজেকে উদ্ভাবন করুন ১৫৬

একজন কোথায় ও কীভাবে ধনী হওয়ার সুযোগ খুঁজে পাবে? ১৫৯

যে ‘অলৌকিক’ সিস্টেমে এই সুবিধাদি দেওয়া হয় ১৬৩

অধ্যায় ০৮ সিদ্ধান্ত ১৭৩

একটি সিদ্ধান্তে মুক্তি; নতুবা মৃত্যু ১৭৫

অধ্যায় ০৯ অধ্যবসায় ১৮৪

অধ্যবসায়ের অভাবের লক্ষণ ১৮৬

কীভাবে অধ্যবসায় গঠন করতে হয়? ১৯১

মহানবী (সা.)কে বিশ্লেষণ করেছেন থমাস সুগ্রু ১৯৬

অধ্যায় ১০ ঐক্যমনের ক্ষমতা ১৯৮

ঐক্যমনের মাধ্যমে ক্ষমতা অর্জন ১৯৯

অধ্যায় ১১ যৌনশক্তি রূপান্তরের রহস্য ২০৭

দশটি মন উত্তেজক ২০৯

ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে ‘প্রতিভাবান’ তৈরি হয় ২১০

কেন পুরুষরা ৪০ বছরের এর পূর্বে কদাচিৎ সফল হয়? ২১৭

অধ্যায় ১২ অবচেতন মন ২৩১

৭টি প্রধান ইতিবাচক আবেগ ২৩৫

৭টি প্রধান নেতিবাচক আবেগ ২৩৫

অধ্যায় ১৩ মস্তিষ্ক ২৩৮

বিশ্বের মহান বলগুলো অস্পষ্ট, তা সহজে দেখা যায় না ২৩৯

মস্তিষ্কের নাটকীয় ঘটনা ২৪০

অধ্যায় ১৪ ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়

২৪৫

স্বপরামর্শের মাধ্যমে চরিত্র নির্মাণ ২৪৮

আস্থা বনাম ভীতি! ২৫৬

অধ্যায় ১৫ কীভাবে ভীতির ৬ ভূতকে পরাজিত করবেন? ২৫৮

৬টি মূল ভীতি ২৫৯

দরিদ্রতা ভীতি ২৬১

দরিদ্রতা ভীতির উপসর্গ ২৬৪

টাকা কথা বলে! ২৬৬

নারীরা হতাশা গোপন করে ২৬৭

টাকা ভিন্নতা তৈরি করে ২৬৭

সমালোচনা ভীতি ২৬৮

সমালোচনা ভীতির উপসর্গ ২৭১

অসুস্থতা ভীতি ২৭২

অসুস্থতা ভীতির উপসর্গ ২৭৫

ভালোবাসার কাউকে হারানোর ভীতি ২৭৬

ভালোবাসার কাউকে হারানোর ভীতির উপসর্গ ২৭৭

বৃদ্ধ বয়স ভীতি ২৭৭

বৃদ্ধ বয়স ভীতি উপসর্গ ২৭৮

মৃত্যু ভীতি ২৭৯

মৃত্যু ভীতি উপসর্গ ২৮১

বৃদ্ধ বয়সের দুশ্চিন্তা ২৮১

শয়তানের দূর্গ ও দূর্গের নৃপতি ২৮৫

কীভাবে নিজেকে নেতিবাচক প্রভাব থেকে রক্ষা করবেন? ২৮৭

আত্মবিশ্লেষণ পরীক্ষার প্রশ্নাবলি ২৮৮

সুপ্রাচীন যদি দ্বারা মোড়ান ‘৫৭টি’ বিখ্যাত অজুহাত ২৯৫

ব্যক্তিগত উন্নয়নে অন্যান্য বইয়ের তালিকা ৩০১









যদি বিজয়ের সম্ভাবনা আছে জেনেও লড়াই না করো, তবে এমন সময় লড়াই করতে হবে যখন বিজয়ের কোনো সম্ভাবনাই থাকবে না।

- উইনস্টন চার্চিল



 




অনুবাদকের কথা


১৯৩৭ সালে প্রকাশিত হয় নেপোলিয়ন হিলের জনপ্রিয় বই থিংক অ্যান্ড গ্রো রিচ তথা চিন্তা করুন এবং ধনী হোন। এ বই প্রকাশের পূর্বে লেখক তার জীবনের ২৫ বছর সময় ধরে গবেষণা করেছে, তার কঠোর শ্রম ও বুদ্ধি প্রয়োগ করেছে। এ বই আজ পর্যন্ত হাজারো লাখো মানুষকে অনুপ্রাণিত করেছে এবং বলেছে, ‘আপনার মন যা চিন্তা করতে পারে এবং বিশ্বাস করে, এটা তাই অর্জন করতে পারে।’

নেপোলিয়ন হিলের এ বাক্য আমি চিন্তা করেছি, প্রয়োগ করেছি, প্রমাণ পেয়েছি এবং স্বীয় নীতি রূপে গ্রহণ করেছি। আমি লেখকের উক্ত বাক্য বিশ্বাস করি এবং তার লেখা যেহেতু আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে, আমাকে ভালো ও সৎ পথ দেখিয়েছে, তাই আমি এই প্রেরণা বাংলাদেশের মানুষের মাঝেও ছড়িয়ে দিতে আগ্রহী হলাম। বইটি অনুবাদ এবং সম্পাদনা করতে আমার প্রায় দুই বছরের অধ্যবসায় চালাতে হয়েছে। আমি বিশ্বাস করি যে জ্ঞান মানুষকে সৎ কাজে অনুপ্রেরণা দেয়, কর্মে উদ্বুদ্ধ করে, সেসব রচনা, ঘটনা, গল্প ও বর্ণনা সর্বদাই মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়া দরকার। এই আকাক্সক্ষা থেকেই এ বই অনুবাদ এবং প্রকাশ করা।

বইটি প্রায় ৮০ বছর পূর্বে প্রকাশিত হয়েছিল। কিন্তু এর মধ্যকার জ্ঞান আজও উজ্জ্বলভাবে প্রজ্বলিত এবং মানুষের জীবনে প্রয়োগযোগ্য। বর্তমানেও এ বইয়ের জ্ঞান প্রয়োগ করে আপনি সাফল্যের উচ্চ শিখরে পৌঁছাতে পারবেন।

বইয়ে উল্লেখিত একটি রহস্য এবং বর্ণিত ১৩টি সূত্র লেখক সংগ্রহ করেছে আমেরিকার ৫০০ এর অধিক কোটিপতি মানুষের সাক্ষাৎকার নিয়ে। এখানে বর্ণিত ১৩টি সূত্র তো আমি অনুবাদ করেছি। কিন্তু রহস্যটি খুঁজে পেতে হলে আপনাকেই দায়িত্ব নিতে হবে। আপনাকে নিজ দায়িত্বে রহস্যটি খুঁজতে হবে এবং গুপ্তরহস্যটি উন্মোচন করতে হবে। লেখক নিজেও তার মূল বইতে এই রহস্য প্রচ্ছন্ন রেখেছেন।

লেখক এবং লেখকের কর্ম সম্বন্ধে সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেওয়া হলো: নেপোলিয়ন হিল ১৮৮৩ সালে দরিদ্র এক পরিবারে জন্ম নেয়। সে একটি এক কক্ষের বাসায়, পাউন্ড নদীর তীরে জন্ম নেয়। তার জন্মস্থান ছিল বিজ্ঞ প্রদেশ নামে খ্যাত ভার্জিনিয়ায়। মাত্র দশ বছর বয়সে তার মা মারা যায়। এর মাত্র দুই বছরের মাথায় তার বাবা পুনরায় বিয়ে করে। সে এতে খুবই বিরক্ত হয়। এই বিরক্তি তাকে একগুঁয়ে বালকে পরিণত করে। কিন্তু তার সৎমায়ের প্রভাবে সে একজন চরিত্রবান ও মহান পুরুষ হয়ে বেড়ে ওঠে।

সে তার লেখালেখি আরম্ভ করে ১৩ বছর বয়স থেকে। সে নিজ শহরের একটি সংবাদপত্রের জন্য লিখত। সেখান থেকে সে হয়ে ওঠে আমেরিকার অতিপ্রিয় অনুপ্রেরণাদায়ী লেখক হিসাবে। সব ধরনের বড় বড় বাধাবিপত্তির বিরুদ্ধে লড়াই করে সে তার জীবনের ২৫ বছরেরও বেশি সময় উৎসর্গ করেছে। সে এই গবেষণায় একটি প্রশ্নেরই উত্তর খুঁজেছে। আর তা হলোÑ কেন এত বেশি লোকজন তাদের জীবনে সত্যিকার আর্থিক সাফল্য ও সুখ অর্জন করতে ব্যর্থ হয়?

ইতোমধ্যে সে একজন আইনজীবী ও সাংবাদিক হিসাবে অনেক সুনাম ও খ্যাতি অর্জন করে। একজন সাংবাদিক হিসাবে তার শৈশবের যে চাকরি ছিল, তাই তাকে আইন পাঠের খরচ জোগাতে আর্থিকভাবে সহায়তা করেছিল। সাংবাদিকের এই চাকরি করতে গিয়ে তাকে একবার একটি ধারাবাহিক প্রতিবেদন তৈরির দায়িত্ব দেওয়া হয়। প্রতিবেদনটি ছিলÑতৎকালীন বিখ্যাত মানুষদের সাক্ষাৎকার নিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদন তৈরি করা। এই প্রতিবেদন তৈরি করতে গিয়ে সে সাক্ষাৎকার নেয় বিশিষ্ট ইস্পাত ব্যবসায়ী এন্ড্রু কার্নেগির। জনাব কার্নেগি নেপোলিয়ন হিলের সাথে আলাপ করে তাকে একটি দীর্ঘমেয়াদি কাজে নিযুক্ত করে। নেপোলিয়ন হিলের কাজ হলো সে আমেরিকার তৎকালীন ৫০০ এর অধিক কোটিপতির সাক্ষাৎকার নিবে এবং এদের বক্তব্য বিশ্লেষণ করে এমন একটি বাস্তবভিত্তিক সাফল্য অর্জন পদ্ধতি খুঁজে বের করবে যা যেকোন সাধারণ মানুষই তার জীবনে প্রয়োগ করতে পারবে এবং সফল হবে। হিলের সাক্ষাৎকারের তালিকায় ছিলÑটমাস আলভা এডিসন, আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেল, হেনরি ফোর্ড, এলমার গেইটস, চার্লস এম. সোয়েব, থিয়োডোর রুজবেল্ট, উইলিয়াম রিগলে জুনিয়র, জন ওয়ানামেকার, উইলিয়াম জেনিংস ব্রায়ান, জর্জ ইস্টম্যান, উড্রো উইলসন রিগলে জুনিয়র, উড্রো উইলসন, উইলিয়াম এইচ. টেফট, জন ডি. রকফেলার, এফ. ডব্লিউ. উলয়োর্থ, জেনিংস রেনডল্ফ সহ প্রমুখ।

সে হয়ে ওঠে এন্ড্রু কার্নেগির একজন ব্যক্তিগত উপদেষ্টা এবং কার্নেগির সহায়তায় সে এমন এক সাফল্য দর্শন প্রস্তুত করে, এমন এক নকশা তৈরি করে যার উপাদান গ্রহণ করা হয়েছে একদম শূন্য থেকে, ছিন্নবস্ত্র থেকে যারা ধনী হয়েছে তাদের কাছ থেকে। এমন মহান পুরুষদের চিন্তা ও অভিজ্ঞতা বিশ্লেষণ করে, প্রায় ২০ বছর সাধনা করে সে তার এই অর্জিত জ্ঞানকে একটি বইয়ে সাজায়। যা ব্যক্তিগত উন্নয়নের জন্য সারা বিশ্বে এক নম্বর বই। যার শিরোনামÑ থিংক অ্যান্ড গ্রো রিচ তথা চিন্তা করুন এবং ধনী হোন। এ বই সারা বিশ্বে সাত কোটির বেশি কপি বিক্রি হয়েছে এবং লাখো মানুষকে তাদের জীবনে সাফল্য অর্জনে সহায়তা করেছে।

সাফল্যের রহস্যটি খুবই সহজসরল। কিন্তু এটা কী তা খুঁজে বের করতে হলে আপনাকে বইটি অবশ্যই পাঠ করতে হবে।

মনে রাখবেন, সাফল্য অর্জনের রাস্তা যেকেউ দেখিয়ে দিতে পারে। কিন্তু সেই পথে আপনার নিজেকেই চলতে হবে। নিজেকে চলে, নিজের চেষ্টায় ও বুদ্ধিতেই সেই পথে এগিয়ে গিয়ে আপনার সাফল্য আপনাকেই অর্জন করতে হবে। তাই রাস্তায় বের হওয়ার আগে একটু কষ্ট করে, সময় নিয়ে কোনটি সঠিক রাস্তা তা খুঁজে বের করুন। আর এই সঠিক রাস্তা খুঁজতে আপনাকে সহায়তা করবে চিন্তা করুন এবং ধনী হোন বই।

নেপোলিয়ন হিল ১৯৭০ সালের নভেম্বর মাসে মৃত্যু বরণ করে। সে ছিল একাধারে একজন সফল লেখক, শিক্ষক ও বক্তা। তার জীবনকর্ম একটি স্তম্ভ বা সৌধ রূপে মানুষকে পথ দেখাচ্ছে। সাধারণ মানুষ তার কীর্তি, রচনা ও কর্মজীবন থেকে অনুপ্রেরণা পাচ্ছে। তার রচিত চিন্তা করুন এবং ধনী হোন বইটি ব্যক্তিগত উন্নয়নের সর্বোৎকৃষ্ট বইগুলোর একটি।

একজন প্রকাশক চিন্তা করুন এবং ধনী হোন বই সম্বন্ধে যথার্থই বলেছেন, ‘এ বইয়ে অর্থ আয়ের ১৩টি সূত্র পাওয়া যাবে যা প্রত্যেক মানুষের জন্য আবশ্যক। যারা তাদের জীবনে আর্থিক স্বাধীনতা চায়, এগুলো তাদের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। এটা তৈরি করতে যে গবেষণা করতে হয়েছে সেই গবেষণায় ব্যয় হয়েছে দীর্ঘ ২৫ বছরেরও অধিক সময়। যদিও বইয়ে অর্থ আয়ের পদ্ধতি সম্পর্কে বলা হয়েছে, তবুও ‘সম্পদ কখনো অর্থ দিয়ে পরিমাপ করা যায় না!’

‘অর্থ এবং বস্তুগত জিনিস দৈহিক ও মানসিক মুক্তির জন্য প্রয়োজন। কিন্তু পৃথিবীতে এমন মানুষও আছে যারা এটা অনুভব করে যে শ্রেষ্ঠ সম্পদ হচ্ছেÑ চিরস্থায়ী বন্ধুত্ব, ঐক্যবদ্ধ পারিবারিক সম্পর্ক, ব্যবসায়িক সহযোগীদের মধ্যে সহানুভূতি ও পারস্পরিক বোঝাপড়া এবং নিজের ভেতরের চিন্তাধারাকে পরীক্ষা করতে পারা। এগুলো একজনের মনে শান্তি ও সুখ আনতে পারে, যা আর্থিক মূল্যে পরিমাপ করা সম্ভব নয়। কেবল আত্মা দিয়ে অনুভব করা যায়।

‘চিন্তা করুন এবং ধনী হোন বইয়ে উল্লেখিত সাফল্য দর্শন যখন আপনি পাঠ করবেন, হৃদয়ঙ্গম করবেন এবং আপনার জীবনে প্রয়োগ করবেন, তখন দেখবেন যে আপনি কেবল অর্থই আয় করছেন না, তার সাথে সাথে আপনি উচ্চস্তরের ব্যাপার যা আত্মাকে সুখ ও শান্তি দেয় সেগুলোও উপভোগ করছেন। অবশ্য যারা এই দর্শন মানতে অনাগ্রহী এবং অবজ্ঞা দেখায় তাদের কথা ভিন্ন।

‘তাহলে প্রস্তুত হোন একটি মহান অভিযাত্রার উদ্দেশ্যে। আপনি যখন এই দর্শনের প্রভাবে নিজেকে চিনবেন, উদ্ঘাটন করবেন, তখন আপনি এমন এক জীবনে প্রবেশ করবেন যেখানে আপনার চিন্তা ও কাজ একই তালে ও সুরে সম্পাদিত হবে। শুধু তাই নয়, আপনি একই সাথে প্রচুর পরিমাণ বস্তুগত ধনসম্পদও অর্জন করতে পারবেন এবং সেই ধনসম্পদ দিয়ে অন্যদেরকে সহায়তাও করতে পারবেন।’

তাহলে আসুন আরম্ভ করি সেই মহান অভিযাত্রা যার উদ্দেশ্য হচ্ছে একটি পরিবর্তিত, সমৃদ্ধ ও ধনী জীবন অর্জন করা।

Ñ ফজলে রাব্বি

১৭ মাঘ ১৪২৪

(৩০ জানুয়ারি ২০১৮)

 




লেখকের কথা


এ বইয়ের ভেতর যে সূত্রাবলি উল্লেখ করা হয়েছে তার উপাদান সংগ্রহ করা হয়েছে ৫০০ এর বেশি সম্পদশালী ব্যক্তির কাছ থেকে। এই ধনী ব্যক্তিদের বিশ্লেষণ করে আমি এখানে উল্লেখ করেছি যে কীভাবে তারা তাদের এই অগাধ সম্পদের মালিক হলো, কীভাবে তারা এত অর্থের সত্ত্বাধিকারী হলো। আমি দীর্ঘ দুই যুগ ধরে তাদের সবাইকে মনোযোগের সাথে বিশ্লেষণ করেছি এবং গবেষণা লব্ধ তথ্য এ বইয়ে প্রকাশ করেছি।

রহস্যের এ ব্যাপার আমার দৃষ্টিতে আনেন এন্ড্রু কার্নেগি। এ ছিল প্রায় ২৫ বছর আগের কথা। তার সাথে আমার দেখা হয় একটি সংবাদপত্রের সাক্ষাৎকারের সুবাদে। তিনি একজন বুদ্ধিমান ব্যক্তি এবং আমার খুব প্রিয় একজন ব্যক্তিত্ব। তিনি প্রায় অসাবধানেই কথাটি আমাকে বলে ফেলেন। আমি তখন একেবারে এক ছোট্ট বালক। তারপর তিনি আমাকে পর্যবেক্ষণ করছিলেন যে আমি তার কথার গভীরতা বুঝতে পারছি কিনা।

যখন তিনি আশ্বস্ত হলেন যে আমি ব্যাপারটি বুঝতে পেরেছি, তখন তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, যদি তোমার এই অনুসন্ধান চালাতে বিশ বছরেরও বেশি সময় লাগে, তুমি কি তাতে রাজি হবে? তুমি কি দেশের সর্বোচ্চ ধনী মানুষদের বিশ্লেষণ করে এমন এক দর্শন তৈরি করতে পারবে যা দেশের পুরুষ ও নারী উভয়ে সমানভাবে ব্যবহার করে তাদের জীবনকে সমৃদ্ধশালী করবে? যারা হয়তো আজ কোনো পথনির্দেশ ছাড়া হতাশার মধ্যে পড়ে আছে। তাদেরকে কি তুমি এমন একটি দর্শন দিতে পারবে যা তাদেরকে আর্থিক ও আত্মিক পথে ধনী হওয়ার দিকে নির্দেশিত করবে? আমি জবাব দিয়েছিলাম আমি করব এবং জনাব কার্নেগির সহায়তায় আমি সেই অঙ্গীকার রক্ষা করেছি।

এ বই সেই দর্শন বহন করে। যা বহু যুগ ও কাল যাবৎ রহস্য হয়েছিল। এই জ্ঞান হাজারো লোকজনের দ্বারা পরীক্ষা করা হয়েছে। তারা প্রত্যেকে এই জ্ঞান প্রয়োগে নিজেদের জীবনে আর্থিক ও আত্মিক শান্তি অর্জন করেছে। এটা জীবনের প্রায় প্রত্যেক ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা যায়। এটা মূলত কার্নেগির ধারণা ছিল যে জাদুকরী পদ্ধতি তাকে বিশাল ও বিস্ময়কর সৌভাগ্য এনে দিয়েছে তা সাধারণ লোকজনের জন্যও ব্যবহারযোগ্য। যেসব সাধারণ লোকজন অতিব্যস্ত, যারা চিন্তা ও পরিকল্পনা করার সময় পর্যন্ত পায় না, তারা পর্যন্ত এ রহস্য প্রয়োগ করে তাদের জীবনকে সমৃদ্ধ করে তুলেছে। কার্নেগির আশা ছিল আমি যাতে এই দর্শনকে সাধারণ মানুষের দ্বারা পরীক্ষা করে এর সত্যতা যাচাই করি। আমি তাই করেছি। এ বইয়ে সেসব পুরুষ ও নারীর উদাহরণও রয়েছে।

জনাব কার্নেগি বিশ্বাস করেন, এ পদ্ধতি প্রতিটি বিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ে শেখানো উচিত, আর যদি তা করা হয় তবে এটা গোটা শিক্ষাব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন আনবে এবং আমাদের ছাত্রছাত্রীদের বিদ্যালয়ে অপচয়কৃত সময় অর্ধেকে নেমে আসবে। তিনি একথা অভিজ্ঞতা থেকেই বলেছেন। তিনি এম. সোয়েব এবং আরও বহু অল্প শিক্ষিত বা অশিক্ষিত যুবকদের তার এ শিক্ষা দেন এবং তারা অবিস্মরণীয়ভাবে এত দক্ষ, যোগ্য ও সম্পদশালী পুরুষে পরিণত হন যে তা সত্যিই বিস্ময়কর। তার শিক্ষা দর্শন কেবল তাদেরকে অর্থ আয়ের পথ দেখায়নি; বরং তাদের মধ্যে ন্যায়, নিষ্ঠা ও নেতৃত্বের মতো মহান গুণও গঠন করেছে।

আস্থা নামক অধ্যায়ের ভেতর আপনি পাঠ করবেন একটি অবাক করার মতো ঘটনা। তা হচ্ছে ইউনাইটেড স্টেস স্টিল কর্পোরেশনের মতো বিরাট বড় কোম্পানি গড়ে ওঠার ঘটনা। এ কোম্পানিকে একত্রিত ও বাস্তবায়ন করেছেন কার্নেগির এক শিষ্য-জনাব সোয়েব। এ ঘটনা দেখে আপনি বুঝতে পারবেন যে এই পদ্ধতি কেবল তাদের জন্যই প্রযোজ্য যারা এটা বোঝার জন্য প্রস্তুত। কার্নেগি দর্শনের সেই রহস্য প্রয়োগ করেন চার্লস এম. সোয়েবÑযিনি নিজেকে বিশাল পরিমাণ অর্থ ও সম্পদ দিয়ে সৌভাগ্যশালী করেছিলেন। মোটামুটিভাবে বলতে গেলে এই পদ্ধতির যথাযথ প্রয়োগের দাম ছিল প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা।

সকলেই যারা কার্নেগিকে চেনে ও জানে তারা এই ঘটনার খুঁটিনাটি সবই জানে। আপনিও ইচ্ছা করলে খোঁজ নিয়ে দেখতে পারেন। এতে করে আপনি একটি স্বচ্ছ ধারণা পাবেন যে এ বই পাঠ করলে এটা আপনাকে কী এনে দিতে পারে। অবশ্য একটি শর্ত আছেÑতা হচ্ছে আপনাকে নির্দিষ্টভাবে জানতে হবে যে আপনি কী চান।

আপনার সামনে আজকে এ রহস্য উপস্থাপন করার আগে আমি প্রায় ২০ বছর যাবৎ এ নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করেছি। লাখো পুরুষ ও নারী তাদের জীবনে এই রহস্য প্রয়োগ করেছে এবং তাদের নিজেদের ব্যক্তিগত আশা অভিলাষ পূরণ করেছে। কার্নেগি যেমন আশা করেছিলেন যে সাধারণ মানুষ উপকৃত হবে। কিছু কিছু ব্যক্তি তো এ রহস্যের রহস্যময়ী শক্তিতে বিরাট সৌভাগ্য অর্জন করেছে। আর অন্যরা এই রহস্যকে তাদের ব্যক্তিগত বা পারিবারিক জীবনে সুখ ও সমৃদ্ধি আনতে সফলভাবে প্রয়োগ করেছে। এক শিক্ষক তো একে এত দক্ষভাবে প্রয়োগ করে যে সে নিঃস্ব অবস্থা থেকে বছরে ২৪ লাখ টাকার ওপরে আয় করেছে।

আর্থার নাস ছিল একজন সাধারণ দরজী। তার ব্যবসা ঋণের চাপে একদম বন্ধ হওয়ার উপক্রম। তারপর সে এ বই পেল। এ বইয়ের পদ্ধতি সে কিছুটা পরীক্ষা স্বরূপ তার ব্যবসায় প্রয়োগ করল। প্রথমে সে বিশ্বাস না করলেও, কিছুদিনের মধ্যে যখন তার ব্যবসায় প্রাণ ফিরে এলো, তখন সে প্রায় হতবাক হয়ে যায়। সে এ রহস্যের উন্মোচন করে। এ পদ্ধতি প্রয়োগ করে একটি অসাধারণ সৌভাগ্য অর্জন করে। যদিও আজ জনাব নাস বেঁচে নেই। কিন্তু তবুও সেই পদ্ধতি তার উত্তরাধিকারীদের জন্য সৌভাগ্য বয়ে আনছে। তার এই পরীক্ষামূলক কাজের কথা সংবাদপত্রেও ছাপা হয়। সংবাদপত্রগুলো প্রশংসা স্বরূপ এ পদ্ধতির জন্য যত প্রতিবেদন এবং সংবাদ তৈরি করেছে তা বিজ্ঞাপনে হিসাব করলে কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে।

রহস্যটি পৌঁছেছিল স্টুয়ার্ট অস্টিন উয়েরের কাছে। সে টেক্সাসের একজন ডালাসবাসী। সে এ রহস্যের জন্য ছিল পুরোপুরি প্রস্তুত। সে এতই প্রস্তুত ছিল যে সে তার বিদ্যমান চাকরি ছেড়ে দেয় এবং আইন নিয়ে পড়ালেখা আরম্ভ করে। সে কি সফল হয়েছে? তা আপনি বইয়ের ভেতরেই পাবেন।

আমি রহস্যটি দিয়েছিলাম জেনিংস রেনডলফের কাছে। সেদিন ছিল তাদের কলেজের শেষ দিন, ডিগ্রি অর্জনের উৎসব দিন। সে এটা এত সফলভাবে প্রয়োগ করেছে যে সে এখন তৃতীয়বারের মতো একজন কংগ্রেসের সদস্য রূপে দেশের জনগণের সেবা করছে। এটা প্রয়োগ করতে করতে সে হয়তো সামনে হোয়াইট হাউসেও কাজ করার সুযোগ পাবে।

যখন আমি লা-সালি বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন প্রচার ব্যবস্থাপক হিসাবে অতিরিক্ত শিক্ষক রূপে সেবা দিচ্ছিলাম, তখন এ এক নামমাত্র প্রতিষ্ঠান ছিল। এটা আমার সৌভাগ্য যে আমি দেখেছি কীভাবে জে. জি. চ্যাপলিন বিশ্ববিদ্যালয়ের সভাপতি হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়কে নেতৃত্ব দিল এবং লা-সালি বিশ্ববিদ্যালয়কে দেশের প্রথম সারির বিশ^বিদ্যালয়ে পরিণত করল।

যে রহস্যের কথা আমি বারবার বলে যাচ্ছি তা আমি আপনার সামনে এ বইয়ের মাধ্যমে কমপক্ষে ১০০ বারেরও বেশি উল্লেখ করব। তবে, এর সরাসরি কোনো নাম দেওয়া হয়নি। কারণ দেখা গেছে, এ রহস্য তখনই সবচেয়ে বেশি কাজ করে যখন এটা অন্মোচিত থাকে এবং দৃষ্টির আড়ালে অবস্থান করে। তবে আমি নিশ্চিত যারা এর জন্য খোঁজে ও প্রস্তুত তারা এটা দেখলেই চিনতে পারবে। এ আমি আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলছি। কারণ আমি যখন একে খুঁজে বেড়াচ্ছি তখন কার্নেগি একে আমার সামনে পেশ করেন এবং চুপ করে অপেক্ষা করতে থাকেন। আমাকে সরাসরি বলেননি বা কোনো নাম দেননি। কিন্তু তারপরেও আমি যখন দেখলাম তখন সাথে সাথেই আমি একে আকঁড়ে ধরলাম।

যদি আপনি আপনার জীবনে এ রহস্যকে খোঁজেন এবং একে প্রয়োগ করতে প্রস্তুত হন, তবে আপনি এ রহস্যকে প্রতি অধ্যায়ের ভেতর একবার করে দেখতে পাবেন। আমি হয়তো আপনাকে সেই রহস্য কী তা বলতে পারি এবং দেখিয়েও দিতে পারি। তবে আমি দেখেছি, যারা নিজেরাই এটা আবিষ্কার করে তারাই সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়। যারা নিজের চেষ্টায় এ রহস্যকে উন্মোচন করে তারা যেসব সুবিধা ও সম্ভাবনার সুযোগ পায় তা আমি দেখিয়ে দিলে কখনো সম্ভব হবে না।

যখন আমি এ বই লিখছি, তখন আমার ছোট ছেলে দ্বিতীয় অধ্যায়ের পা-ুলিপি তুলে নেয় এবং পড়ে দেখে। সে তখন কেবল কলেজের পড়ালেখা শেষ করেছে। সে অধ্যায়টি পড়ল এবং নিজে থেকেই রহস্যটি আবিষ্কার করল। সে রহস্যের সম্পদটি এত দক্ষভাবে প্রয়োগ করল যে সে সরাসরি এমন একটি দায়িত্বশীল পদে কাজ করার সুযোগ পেল যেখানে অন্য ব্যক্তিরা পাঁচ-ছয় বছরের চেষ্টায় পৌঁছাতে পারে। এমনকি সে তার অন্যান্য সহপাঠীর তুলনায়ও বেশ এগিয়ে গেল। তার ঘটনাটি বইয়ের ভেতর সংক্ষেপে বর্ণনা করা হয়েছে। এ ঘটনা পড়লে আপনি সহজে অনুধাবন করবেন যে এ বইয়ের শিরোনাম কতটা যৌক্তিক। আপনি যদি এ বইয়ের শিরোনাম দেখে একটু অবিশ্বাসও করে থাকেন, তবে আমার বিশ্বাস আপনি সেই ঘটনা পাঠ করে যৌক্তিকভাবে বিশ্বাস করবেন যে শিরোনামে খুব বেশি আশ্বাস দেওয়া হয়নি। যা বলা হয়েছে তা হওয়া সম্ভব। যদি আপনি কখনো নিরুৎসাহিত হয়ে থাকেন, আপনার পরাজয় অতিক্রম করতে অসমর্থ হয়ে থাকেন, যা হয়তো আপনার ভেতর থেকে আপনার আত্মাকে বের করে ফেলেছে, যদি আপনি চেষ্টা করা সত্ত্বেও ব্যর্থ হন অথবা আপনি অসুস্থতা বা শারীরিক কোনো প্রতিবন্ধকতার মধ্যে পড়ে আপনার সামনে চলার পথ বন্ধ হয়ে থাকে, তবে আমার ছেলের এ ঘটনা এবং কার্নেগি পদ্ধতি প্রয়োগের ফলে আপনি সেই সাহস ফিরে পাবেন যা আপনাকে আপনার জীবনে সাফল্য এনে দিবে। এ অনেকটা মরুভূমিতে মরূদ্যান খুঁজে পাওয়ার মতো যা আপনি বহুদিন যাবৎ খুঁজে বেড়াচ্ছেন।

মহামান্য রাষ্ট্রপতি উইড্রো উইলসন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে এ রহস্য ব্যাপকভাবে প্রয়োগ করেছেন। যুদ্ধে যত সৈনিক ছিল তাদের প্রশিক্ষণকালে তারা এ রহস্যের সম্পদ দ্বারা সমৃদ্ধ হয়েছিল। খুব মনোযোগের সাথে তাদের প্রশিক্ষণের ভেতর এ রহস্যকে ভাঁজ করে দেওয়া হয়েছিল। এমনকি রাষ্ট্রপতি উইলসন আমাকে নিজেই বলেছেন যে যুদ্ধের জন্য প্রয়োজনীয় মূলধন উঠাতে এ রহস্য কীভাবে তাকে সাহায্য করেছিল।

প্রায় বিশ বছর আগে হন ম্যানুয়েল এল. কুইজোন এ রহস্য দ্বারা অনুপ্রাণিত হন এবং তার লোকজনের জন্য স্বাধীনতার আন্দোলন করেন। তিনি পরবর্তীতে ফিলিপাইন্সদের জন্য স্বাধীনতা অর্জন করেন এবং সেই মুক্ত দেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি হন।

এ রহস্যের এক অদ্ভুত দিক আছে। তা হচ্ছে যারা একবার এর অধিকারী হয় এবং প্রয়োগ করে তারা সাফল্যের দিকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে যেতে থাকে। খুব অল্প চেষ্টায় যেতে থাকে। তারা আর কখনো ব্যর্থতার ভয়ে বশীভূত হয় না। খেয়াল করুন, আমি বলেছি ব্যর্থতার ভয়ে বশীভূত হয় না। ব্যর্থ হয় না বলিনি। ব্যর্থতার ভয়ে বশীভূত মানে একবার ব্যর্থ হলেই আর চেষ্টা না করা। অবশ্য আপনার যদি এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ থেকে থাকে, তবে আমি একটি নামের তালিকা দিচ্ছি যারা আমার দীর্ঘ গবেষণার তালিকায় ছিল। আপনি নিজেই তাদের সম্বন্ধে খোঁজ নিয়ে দেখতে পারেন, পরীক্ষানিরীক্ষা করতে পারেন এবং প্রমাণ প্রয়োগে আশ্বস্ত হতে পারেন যে এ রহস্যের কার্যকারিতা কেমন।

অবশ্য একটি কথা তো জানেনÑকিছু না দিয়ে কিছু পাওয়া যায় না!

রহস্যটি অবশ্য আমি বইয়ে উল্লেখ করেছি, কিন্তু এটা পেতে হলে আপনাকে একটি দাম দিতে হবে। যদিও দামটি এর মূল্যের চেয়ে অনেক কম। এ কেবল তারাই পেতে পারে যারা এর জন্য খোঁজে। এ এমনি এমনি দেওয়া যায় না। আপনি অর্থ দ্বারাও এটাকে ক্রয় করতে পারবেন না। কারণ এর দুই অংশ আছে। এক অংশ আসে তাদের কাছে যারা একে খোঁজে এবং একে গ্রহণ করতে প্রস্তুত। দ্বিতীয় অংশ আপনাকে খুঁজে বের করতে হবে।

রহস্যটি সবার প্রতি সমানভাবে কাজ করে। এর সাথে শিক্ষিত-অশিক্ষিতের কোনো শর্ত নেই। আমি জন্মানোর বহু পূর্বে, রহস্যটি এর পথ খুঁজে পায় টমাস আলভা এডিসনের মধ্যে। তিনি একে এত বুদ্ধিমত্তার সাথে প্রয়োগ করেন যে তিনি হয়ে ওঠেন বিশ্বের নেতৃত্ব দানকারী উদ্ভাবক। অথচ তার কিন্তু কেবল তিন মাসের বিদ্যালয় শিক্ষা ছিল।

রহস্যটি গিয়ে পৌঁছায় এডিসনের এক ব্যবসায়িক সহযোগীর কাছে। সে একে এত দক্ষভাবে প্রয়োগ করে যে সে একদম ছিন্নবস্ত্র থেকে একজন পাকা ব্যবসায়ী হয়ে ওঠে। বছরে ৩৬ লাখ টাকা আয় করে এবং একদম তরুণ বয়সেই অবসর গ্রহণ করে জীবনের স্বাদ উপভোগ করে। আপনি তার ঘটনা খুঁজে পাবেন বইয়ের একদম শুরুতেই। এ ঘটনা আপনাকে প্রমাণ প্রয়োগে বিশ্বাস জন্মাতে সাহায্য করবে যে ধনী হওয়া আপনার হাতের নাগালের বাইরে নয়। আপনি এখনো তাই হতে পারবেন যা আপনি হতে চান। আপনি অর্থ, খ্যাতি, সুখ ও সম্মান পাবেন এবং লোকজন দ্বারা স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। অবশ্য আপনি যদি এ আর্শীবাদ নিতে প্রস্তুত হন এবং দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হন।

আপনি কি প্রশ্ন করছেন, ‘আমি কীভাবে এ আর্শীবাদ পাব?’ আপনি এ বই পড়া শেষ করার আগেই আপনার জবাব পাবেন। হয়তো আপনি উত্তরটি প্রথম অধ্যায়ের মধ্যেই পেতে পারেন অথবা শেষ পৃষ্ঠার মধ্যে।

যখন আমি আমার বিশ বছরের গবেষণার কঠোর শ্রম সম্পাদনা করছিলাম, যে দায়িত্ব আমি কার্নেগির অনুরোধে নিয়েছিলাম, আমি ৫০০ এর বেশি সুপরিচিত মানুষকে বিশ্লেষণ করেছি, তাদের মধ্যে অনেকেই স্বীকার করেছেন যে তারা তাদের বিশাল সৌভাগ্য অর্জন করেছেন কার্নেগি রহস্যের সহায়তা দ্বারা। এদের মধ্যে যেসব ব্যক্তি ছিলেন:

হেনরি ফোর্ড টমাস আলভা এডিসন

উইলিয়াম রিগলে জুনিয়র ফ্রাংক আ. ভান্ডারলিপ

জন ওয়ানামেকার এফ.ডব্লিউ. উলয়োর্থ

জেমস জে. হিল কর্নেল রবার্ট আ. ডলার

জর্জ এস. পারকার এডওয়ার্ড আ. ফিল্যানি

ই.এম. স্টেটলার এডউইন সি. বার্নেস

হেনরি এল. ডরথি আর্থার ব্রিসবেন

সাইরাস এইচ.কে. কুরটিস উইড্রো উইলসন

জর্জ ইস্টম্যান ডব্লিউ.এম. হওয়ার্ড ট্যাফট

থিওডোর রুজভেল্ট লুথার বারব্যাংক

জন ডব্লিউ. ডেবিস এডওয়ার্ড ডব্লিউ. বক

এলবার্ট হুবার্ড ফ্রাংক আ. মুনসেই

উইলবার রাইট এলবার্ট এইচ. গ্যারি

উইলিয়াম জেনিংস ব্রায়ান ড. আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেল

ড. ডমটিড স্টার জর্ডান জন এইচ. প্যাটারসন

জে. অডজেন আর্মার জুলিয়াস রসেনওয়ার্ল্ড

চার্লস এম. সোয়েব স্টুয়ার্ট অস্টিন উয়ের

হারিস এফ. উইলিয়ামস ড. ফ্রাংক ক্রেন

ড. ফ্রাংক গানজালিস জর্জ এম. আলেকজান্ডার

ড্যানিয়েল উইলার্ড জে.জি. চ্যাপলিন

কিং গিলাটি জেনিংস রেনডল্ফ

র‌্যালফ আ. উইকস

আর্থার ন্যাস

জর্জ ড্যানিয়েল টি. রাইট ক্যারেন্স ডাররো

জন ডি. রকফেলার

আমেরিকার অনেক ধনী ও সুপরিচিত শত শত মানুষের মধ্যে অল্প কিছু ব্যক্তির নাম এখানে প্রকাশ করা হলো। এরা প্রত্যেকেই আর্থিক ও অন্যান্য দিক দিয়ে সফল। এদের সাক্ষাৎকার নিয়ে আমি নিশ্চিত হয়েছি যে তারা কার্নেগি রহস্যকে বুঝতে পেরেছে এবং বাস্তবে প্রয়োগ করতে সক্ষম হয়েছে। আর এভাবেই তারা তাদের জীবনের এ মহান উচ্চতায় এসে পৌঁছেছে। আমার কখনো এমন কারও সাথে পরিচয় হয়নি যে কার্নেগি রহস্য প্রয়োগ করতে উৎসাহী হয়েছে, কিন্তু তার নির্বাচিত পেশায় সে অবিস্মরণীয় সাফল্য অর্জন করতে পারেনি। আমার কখনো এমন কারও সাথে পরিচয় হয়নি যে এ রহস্যের অধিকারী হওয়া ছাড়া অন্য কোনোভাবে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে অথবা অন্য কোনোদিক দিয়ে ধনসম্পদ অর্জন করেছে। এ দুই ব্যাপার থেকে আমি উপসংহার টানতে পারি যে কার্নেগির আবিষ্কৃত এ রহস্য একজন ব্যক্তির দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হওয়ার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একে জ্ঞানের একটি অংশও বলা যায়। মানুষ সাধারণত শিক্ষা হিসাবে যা কিছু মূল্যায়ন করে, এ জ্ঞান এ রহস্য তেমনই এক গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা।

যাইহোক, শিক্ষা কী? এর উত্তর পূর্ণ বিবরণ ও উদাহরণ সহ দেওয়া হয়েছে।

যতদূর স্কুল শিক্ষা সম্পর্কে জানা গেছে, এ লোকগুলোর খুবই অল্প পড়ালেখা ছিল। জন ওয়ানামেকার একবার আমাকে বলেছিল যে কত অল্প স্কুল জীবনের পড়ালেখাই না সে করেছে। সে তার সাফল্য অর্জন করেছিল খুব সম্ভবত একই ব্যবহার দ্বারা যেমন একটি আধুনিক রেলগাড়ির ইঞ্জিন পানি থেকে গতিশক্তি তুলে নেয়। ‘যখন ইঞ্জিনে ক্রিয়া-বিক্রিয়া শুরু হয় এবং রেলগাড়ি দৌঁড়ায় তখন ইঞ্জিন যেমন পানি থেকে গতিশক্তিকে খুঁজে বের করে নেয় তেমন জন ওয়ানামেকারও এ কার্নেগি রহস্য থেকে নিজের জন্য শক্তি খুঁজে নিয়েছে।’ হেনরি ফোর্ড কখনো উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের গ-ি পার হয়নি। কলেজের কথা তো বাদই দিলাম। আমি স্কুলে পড়ালেখার করার গুরুত্বকে খাটো করার চেষ্টা করছি না। আমি চেষ্টা করছি আমার শ্রমসাধ্য অর্জিত বিশ্বাসকে প্রকাশ করতে যে যারা এ রহস্যের ওপর কর্তৃত্ব করে এবং তাদের জীবনে প্রয়োগ করে তারা জীবনে সাফল্যের চূড়ায় পৌঁছাবে, ধনসম্পদ অর্জন করবে এবং জীবনের সাথে দরকষাকষি করবে তাদের নিজস্ব শর্তের ওপর। এমনকি যদি তাদের স্কুল শিক্ষা কমও থাকে তবুও তাদের পক্ষে সফল হওয়া সম্ভব।

আপনি যখন এ বই পড়বেন তখন আমি যে রহস্যের কথা বলছি তা দেখবেন হঠাৎ কোন এক পৃষ্ঠা থেকে লাফ দিয়ে সাহসীভাবে আপনার সামনে দাঁড়াবে। এ কেবল তখনই ঘটবে যদি আপনি এ রহস্যের জন্য প্রস্তুত হবেন! যখন এটা উপস্থিত হবে, আপনি একে চিনতে পারবেন। যদিও আপনি রহস্যের দেখা বইয়ের প্রথম বা শেষ অধ্যায়ে পেতে পারেন। যখন এ রহস্য আপনার সামনে নিজেকে উপস্থিত করবে তখন এক মুহূর্তের জন্য থামুন এবং একটি গ্লাসকে উল্টে রাখুন। সেই উপলক্ষের জন্য এ কাজ করুন। এ হবে আপনার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিকাল তথা যে অবস্থা থেকে পরিবর্তনের সূচনা ঘটে। একে চিহ্নিত করে রাখুন।

আমরা এখন যাব, প্রথম অধ্যায়ে এবং আমার খুব প্রিয় এক বন্ধুর ঘটনা বলব। যে রহস্যময় চিহ্নের দেখা পেয়ে উদারভাবে তা স্বীকার করেছে এবং যার ব্যবসায়িক অর্জন যথেষ্ট সাক্ষ্য দেয় যে সে একটি গ্লাস উল্টে রেখেছে। যখন আপনি তার ঘটনা পাঠ করবেন এবং অন্যদের ঘটনাও পাঠ করবেন, তখন মনে রাখবেন, তারা জীবনে অনেক বড় বড় সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে। আমরা যেমন বড় বড় সমস্যার সামনে পড়ি, তেমন তারাও পড়েছে।

একজন মানুষ যখন জীবিকা আয় করতে চেষ্টা করে; আশা, সাহস, সন্তুষ্টি ও মনের শান্তি খুঁজতে চেষ্টা করে; ধনসম্পদ অর্জন এবং দেহ ও আত্মার মুক্তি উপভোগ করার চেষ্টা করে, তখনই সমস্যার উদয় হয়।

আরও, মনে রাখবেন, যখন আপনি বইয়ের মধ্য দিয়ে যাবেন, এ বই মানুষের জীবনের সাথে সম্পর্ক রাখে, নাকি রূপকথার সাথে। এ বইয়ের উদ্দেশ্য হচ্ছে একটি মহান সত্যকে বহন করা। যাতে করে যেসব মানুষ এ সত্যকে গ্রহণ করতে প্রস্তুত তাদের সামনে উপস্থিত করা যায়। এ সত্য থেকে আপনি শিখবেন জীবনে কী কী শিখতে হয়, কী কী করতে হয়। শুধু তাই নয়, বরং কীভাবে করতে হয়! আর একটি লক্ষ্য গ্রহণ করতে এবং লক্ষ্য অর্জনের পথে চলতে কীভাবে প্রয়োজনীয় উৎসাহ ও প্রেরণা গ্রহণ করবেন। বিশেষ করে, একটি লক্ষ্যের প্রথম পদক্ষেপ নিতে যে উৎসাহ ও প্রেরণা লাগে তা কীভাবে সংগ্রহ করবেন তা শিখবেন।

আমি আমার বক্তব্য শেষ করছি। আপনি এখন প্রথম অধ্যায় পড়তে যাচ্ছেন। আমি আপনাকে ছোট্ট একটি বিষয়ে ইঙ্গিত দিতে চাই। এতে করে আপনি আরেকটু সহজে কানের্গি রহস্যকে চিনতে পারবেন। পৃথিবীতে যত সফল ব্যক্তি আছে, তাদের যত কৃতিত্বপূর্ণ কাজ আছে তারা তা আরম্ভ করেছে একটি আইডিয়া তথা বুদ্ধি বা ধারণা থেকে! যদি আপনি এ রহস্যের জন্য প্রস্তুত হন, তবে আপনি অর্ধেক ধাঁধার সমাধান করে ফেলেছেন। তাই আমার বিশ^াস বাকি অর্ধেকও সমাধান করে ফেলতে পারবেন। কারণ তখন আপনি অর্ধেক পথ অতিক্রমকারী একজন জয়ী ব্যক্তি। রহস্যের ইঙ্গিত সামনে আসার সাথে সাথে আপনি এটাকে চিনতে পারবেন এবং এটাকে ভেদ করতে সক্ষম হবেন।


Ñ নেপোলিয়ন হিল

১৯৩৭ সাল


 




অধ্যায় - ০১

সূচনা


যে লোক ‘চিন্তা’ করেছিল টমাস আলভা এডিসনের সাথে অংশীদারিত্বে ব্যবসা করবে


সত্যি, ‘চিন্তাই সেই বিষয়’ এবং শক্তিশালী বিষয় যখন তা নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য, অধ্যবসায় এবং জ্বলন্ত আকাক্সক্ষার সাথে মিলিত হয়, তখন তা ধনসম্পদ বা বিষয়বস্তুতে রূপান্তরিত হতে পারে।

প্রায় ত্রিশ বছর আগে এডউইন সি. বার্নেস এই সত্য আবিষ্কার করে যে চিন্তা করুন এবং ধনী হোন এ কাজ লোকজন বাস্তবেই করে দেখাচ্ছে। সে এক বসাতেই এ জিনিস আবিষ্কার করেনি। এই উপলব্ধি এসেছে ধীরে ধীরে। শুরু হয়েছিল একটি জ্বলন্ত আকাক্সক্ষা থেকে। যেই জ্বলন্ত আকাক্সক্ষা ছিল মহান এডিসনের সাথে ব্যবসা করা।

বার্নেসের আকাক্সক্ষার অন্যতম এক বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই আকাক্সক্ষা ছিল নির্দিষ্ট। সে এডিসনের সাথে কাজ করতে চায়। এডিসনের জন্য নয়, নিজের জন্য। এই বর্ণনা মনোযোগ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করুন। কীভাবে বার্নেস তার আকাক্সক্ষাকে বাস্তবে রূপান্তর করে। এতে করে আপনি আরও ভালোভাবে বুঝতে পারবেন যে কীভাবে এই বইয়ের ১৩টি সূত্র আপনাকে ধনী হতে দিকনির্দেশনা দিবে।

যখন এই আকাক্সক্ষা বা চিন্তার তাড়না প্রথম তার মনে উদয় হলো তখন সে এরকম কোনো অবস্থায় ছিল না যে তা কাজে পরিণত করবে। তার সামনে ছিল দুইটা বাধা। সে এডিসনকে জানত না এবং তার কাছে রেলগাড়ির ভাড়া দিয়ে নিউ জার্সির অরেঞ্জে যাওয়ার মতো যথেষ্ট টাকা ছিল না।

বেশির ভাগ মানুষের আকাক্সক্ষাকে দমন করতে এ বাধাই যথেষ্ট। কিন্তু বার্নেসের এ কোন সাধারণ আকাক্সক্ষা ছিল না! সে তার আকাক্সক্ষা অনুযায়ী কাজ করার জন্য এতই দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিল যে সর্বশেষ সিদ্ধান্ত নিল পরাজয় মেনে নেওয়ার চেয়ে ‘কিছু ছাড়াই’ যাত্রা শুরু করবে। (পরবর্তীতে সে এক মালবাহী ট্রেনে করে পূর্ব অরেঞ্জে পৌঁছায়)।

সে নিজেকে এডিসনের গবেষণাগারে উপস্থিত করাল এবং এডিসনের সঙ্গে ব্যবসা করতে এসেছে বলে ঘোষণা করল। বার্নেস এবং এডিসনের এই প্রথম সাক্ষাতের বহু বছর পর এডিসন বলেন, ‘সে আমার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। দেখতে লাগছিল একজন ফকিরের মতো। কিন্তু তার বলার ভঙ্গিতে কিছু ছিল যা তার মুখের ভাবেই দেখা যাচ্ছিল যে সে যা নিতে এসেছে তা নিতে সে পুরোপুরি নিশ্চিত এবং দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। আমি আমার বহু বছরের অভিজ্ঞতা থেকে শিখেছি যে যখন একজন মানুষ কোনকিছুর জন্য সত্যিকার অর্থে এবং খুব গভীরভাবে আকাক্সক্ষা করে যে সে তার ভবিষ্যতের সবকিছুর বিনিময়ে হলেও একটি সুযোগ চায় সেই আকাক্সক্ষাকে বের করে আনার জন্য, তখন সে নিশ্চিত জয়ী। আমি তাকে সেই সুযোগ দিলাম। কারণ আমি দেখলাম যে সে তার মনকে এমনভাবে একাগ্র করিয়েছে যাতে সে সফল হবেই। পরবর্তী ঘটনাও প্রমাণ করেছে যে এ কোন ভুল সিদ্ধান্ত ছিল না।’

যুবক বার্নেস এডিসনকে প্রথম সাক্ষাতে কী বলেছে তা ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, যতটা গুরুত্বপূর্ণ বার্নেসের মনের ভেতরের চিন্তা। এডিসন নিজেও তাই বলেছেন। তরুণ এক যুবক এডিসনের দফতরে গিয়ে সে তার প্রথম সুযোগ পেয়ে গেল এমন নয়। কারণ এমন একজন দীনহীন যুবককে কেউ চাকরি দিত না। এখানে শুধু তার চিন্তাই গণনায় ধরা হয়েছে।

যদি বক্তব্যের গুরুত্ব, যারা পাঠ করেছেন তাদের মধ্যে পৌঁছে যায়, একে মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য এ বইয়ের আর প্রয়োজন নেই।

বার্নেস তার প্রথম সাক্ষাতেই এডিসনের সাথে ব্যবসায় অংশীদারিত্ব করার সুযোগ পায়নি। সে এডিসনের অফিসে কাজ করার সুযোগ পেয়েছিল। যা খুব কম বেতনের কাজ। যে কাজ ছিল এডিসনের কাছে গুরুত্বহীন, কিন্তু বার্নেসের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এ কাজ তাকে তার ‘অংশীদারকে’ তার যোগ্যতা দেখাবার সুযোগ দিবে। [ফজলে রাব্বির কথাÑএই যোগ্যতাকেই পণ্য বলা হয়েছে। যেহেতু বার্নেসের নিজের কোনো পণ্য উৎপাদনের কারিগরি দক্ষতা ছিল না, সেহেতু বার্নেস নিজের যোগ্যতাকে পণ্য হিসাবে বিক্রয়যোগ্য করে তুলল।]

মাসের পর মাস চলে গেল, যা বার্নেস তার মনে নিজের নির্দিষ্ট প্রধান উদ্দেশ্য রূপে ঠিক করেছে তার কিছুই হলো না। কিন্তু কিছু গুরুত্বপূর্ণ চিন্তা বার্নেসের মনে উদয় হলো। সে তার আকাক্সক্ষাকে প্রতিনিয়ত তীব্রতর করতে থাকে যে সে এডিসনের ব্যবসায় অংশীদার হবেই।

মনোবিজ্ঞানীরা ঠিকই বলে, ‘যখন একজন সত্যিকার অর্থে একটি বিষয়ের প্রতি প্রস্তুত, তখনই এর আবির্ভাব ঘটে।’

বার্নেস তখন এডিসনের সহযোগী হওয়ার জন্য প্রস্তুত। তার চেয়েও বেশি, সে দৃঢ়ভাবে প্রস্তুত রইল যতক্ষণ পর্যন্ত না সেই সুযোগ পাওয়া যায় যার সে খোঁজ করছিল।

সে নিজেকে এ কথা বলেনি, ‘আহ, ঠিক আছে, আর কী লাভ? মনে হয়, আমার এবার মন বদলানো দরকার এবং বিক্রয়কর্মী রূপে অন্য কোন চাকরি খোঁজা উচিত।’ বরং সে বলল, ‘আমি এখানে এসেছি এডিসনের সাথে ব্যবসা করার জন্য। আমি শেষ পর্যন্ত এটা করেই ছাড়ব। এতে যদি আমার বাকি জীবন চলে যায়, যাবে।’ সে তাই করেছে। কী ভিন্ন গল্পই না মানুষ বলতে পারত যদি তারা একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য গ্রহণ করে নিত এবং এর পাশে ঠিক ততক্ষণ পর্যন্ত দাঁড়াত যতক্ষণ না এর আবেশে তার আশেপাশের সবকিছু বশীভূত হয়ে যায়।

হয়তো তরুণ বার্নেস সেই সময় এ কথা জানতেন না। কিন্তু তার দৃঢ় সংকল্প, তার অধ্যবসায় দিয়ে একটি মাত্র আকাক্সক্ষার পাশে থাকার ফলে নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল সব বাধাকে কেটে ফেলার জন্য এবং সেই সুযোগ দেওয়ার জন্য যার খোঁজে সে আছে।

যখন সুযোগ এলো তখন সেটা উপস্থিত হলো ভিন্ন এক আকারে এবং ভিন্ন এক দিক থেকে, যা বার্নেস আশা করেনি। এই হচ্ছে সুযোগের এক ধরনের কৌশল। এর এক ধূর্ত অভ্যাস হলো যে এটা পিছনের দরজা দিয়ে আসে এবং এটা প্রায়ই দুর্ভাগ্যের ছদ্মবেশে বা সাময়িক পরাজয়ের ছদ্মবেশে আসে। এজন্য বেশির ভাগ মানুষ সুযোগকে চিনতে ভুল করে।

এডিসন এক নতুন যন্ত্র তৈরি করেছিল। যার নাম তখনকার দিনে ছিল এডিসন ডিকটেটিং যন্ত্র (এখন এডিফোন)। তার বিক্রয়কর্মীরা এই যন্ত্রের প্রতি আগ্রহী ছিল না। তারা দেখল অনেক পরিশ্রম ছাড়া এই যন্ত্র বিক্রয় করা যাবে না। বার্নেস তার সুযোগ দেখল। বার্নেস ধীরগতিতে এগিয়ে গেল দেখতে অপূর্ব সেই যন্ত্রের দিকে। যার প্রতি কেউ আগ্রহী ছিল না। একমাত্র বার্নেস এবং উদ্ভাবক ছাড়া।

বার্নেস জানত যে এডিসনের ডিকটেটিং যন্ত্র সে বিক্রয় করতে পারবে। সে এডিসনকে প্রস্তাব দিল এবং তৎক্ষণাৎ তার সুযোগ পেল। সে যন্ত্রটা বিক্রয় করেছিল। সত্যি বলতে সে যন্ত্রটা এত ভালোভাবে বিক্রয় করেছিল যে এডিসন তার সাথে সারা দেশে প্রসার ও বিপণনের জন্য একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। এর বাইরে ব্যবসায় একটি স্লোগানই তৈরি হয়ে গেলÑ‘এডিসনের তৈরি এবং বার্নেস প্রদত্ত।’

ত্রিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে এই ব্যবসায়িক সহযোগিতা চলে। এর মধ্যে বার্নেস নিজেকে টাকাপয়সার দিক দিয়ে ধনী করে তোলে। কিন্তু সে এর চেয়েও মহান কিছু সম্পন্ন করে দেখিয়েছে। সে প্রমাণ করে দেখিয়েছে যে একজন সত্যিই পারেÑ‘চিন্তা করুন এবং ধনী হোন।’

আসলে বার্নেসের প্রকৃত আকাক্সক্ষা নগদ মূল্যে তার কাছে কত ছিল আমার কাছে তা জানার উপায় নেই। যদিও এই অংশীদারী ব্যবসা তাকে বিশ বা ত্রিশ কোটি টাকা এনে দিয়েছিল। কিন্তু পরিমাণে এটা যাই হোক না কেন এই কাজ আরও তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ওঠে যখন একে তার অর্জনের সাথে তুলনা করা হয়। একটি নির্দিষ্ট আকারের জ্ঞানই হচ্ছে তার মূল্যবান অর্জন। যা হচ্ছে: চিন্তার অস্পষ্ট তরঙ্গকে বাহ্যিক বস্তুতে রূপান্তরিত করা যায়। আমাদের জানা নীতির দ্বারাই এ কাজ সম্ভব।

বার্নেস অবিকল চিন্তা করেছিল যে সে মহান এডিসনের সাথে অংশীদারিত্বে ব্যবসা করবেন যেরকম সে আজ ব্যবসা করছে। সে নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করল। কারণ তার আরম্ভ করার মতো কিছুই ছিল না। একমাত্র এই ক্ষমতা ছাড়া যে সে কী চায় তা সে জানে এবং সেই আকাক্সক্ষার পাশে দাঁড়ানোর মতো দৃঢ়তা যতক্ষণ পর্যন্ত না এই লক্ষ্য পূরণ হয়।

তার আরম্ভ করার মতো কোনো টাকাপয়সা ছিল না। তার শিক্ষা ছিল অল্প। তার কোনো পারিবারিক বা বংশীয় প্রভাব ছিল না। কিন্তু তার ছিল প্রথম পদক্ষেপ, বিশ্বাস ও জয়ের আকাক্সক্ষা। এসব অস্পষ্ট শক্তি দিয়ে সে নিজেকে তৈরি করেছে এক ধনী ও সফল ব্যক্তি হিসাবে। সে পৃথিবীর অন্যতম উদ্ভাবকের সাথে ব্যবসায় অংশীদার হয়েছে।

এখন চলুন, আমরা এক ভিন্ন পরিস্থিতির দিকে তাকাই এবং অধ্যয়ন করি একজন পুরুষকে, যার ধনী হওয়ার অনেক স্পষ্ট সম্ভাবনা ছিল, কিন্তু তা সে হারিয়ে ফেলেছে। কারণ সে যা খুঁজত, সেই লক্ষ্য থেকে মাত্র তিন ফুট দূরে থেমে গিয়েছিল।


স্বর্ণ থেকে মাত্র তিন ফুট পিছনে

ব্যর্থতার অনেক কারণের মধ্যে একটি সাধারণ কারণ হলোÑহাল ছেড়ে দেওয়ার অভ্যাস। মানুষ যখন সাময়িক বাধা পায় তখন সহজেই নিজের লক্ষ্য ত্যাগ করে। এক সময় না এক সময় এই ভুলের জন্য প্রত্যেক মানুষই নিজেকে দোষী বলে অনুতাপ করে। [ফজলে রাব্বির কথাÑকার্টুন ছবির মাধ্যমে লেখকের এ বক্তব্যকে আরও স্পষ্ট করে তুলে ধরা হয়েছে।]

 

ডার্বির এক কাকা যাকে গোল্ড রাশ তথা স্বর্ণ খোঁজার দিনগুলোতে ‘গোল্ড ফিভার তথা স্বর্ণ খোঁজার নেশায়’ পেয়ে বসেছিল এবং দেশের পশ্চিমাঞ্চলে গিয়েছিল মাটি খুঁড়বে ও ধনী হবে। সে এটা শোনেনি যে পৃথিবীতে আজ পর্যন্ত মাটি খুঁড়ে যত স্বর্ণ উত্তোলন হয়েছে তারচেয়েও বেশি স্বর্ণ বের হয়েছে মানুষের মাথা থেকে। সে একটা কোদাল ও খুন্তি নিয়ে কাজের জন্য বেরিয়ে গেল। যাওয়াটা কঠিন ছিল, তবুও স্বর্ণের জন্য তার নির্দিষ্ট লোভ তাকে তাড়িয়ে নিল।

এক সপ্তাহের পরিশ্রমের পর সে খনিজ আকর আবিষ্কারের মাধ্যমে পুরস্কৃত হলো। স্বর্ণের আকর মাটির উপরে তোলার জন্য তার আরও ভারী যন্ত্রপাতি দরকার ছিল। সে খনিটিকে চিহ্নিত করল, মেরিল্যান্ডে উইলিয়ামসবার্গে তার বাড়ি ফিরে গেল এবং এ ব্যাপারে তার আত্মীয় ও কিছু প্রতিবেশীদের বলল। তারা প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির জন্য টাকা দিতে রাজি হলো। তা নিয়ে ডার্বি ও তার কাকা খনিতে কাজ করার জন্য ফিরে গেল।

খনিজ আকরের প্রথম গাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হলো বিক্রয় এবং পরীক্ষার জন্য। তাদের বলা হলো তোমরা কলোরাডোর সবচেয়ে সমৃদ্ধশালী স্বর্ণ খনির খোঁজ পেয়েছ। আর কয়েক গাড়ি ভর্তি খনিজ আকর তাদের সব ঋণ পরিশোধ করে দিতে সক্ষম। তারপরই আসবে লাভের অংশ। [ফজলে রাব্বির কথাÑখনিজ আকর বলতে খনিতে স্বর্ণ বিভিন্ন পদার্থের সাথে মিশে থাকে। পরে এ খনিজ আকর থেকে স্বর্ণের উপাদানকে নিষ্কাশন করা হয়।]

গর্ত করার যন্ত্র যত নিচে যাচ্ছে, ডার্বি ও তার কাকার আশাও তত উপরে উঠছে। তারপরই হঠাৎ কিছু ঘটল। স্বর্ণ আকরের প্রবাহিত ধমনী হঠাৎ উধাও হয়ে গেল। তারা রংধনুর শেষ প্রান্তে চলে এলো যেখানে স্বর্ণ পাত্রে আর কিছু বাকি ছিল না। তারা আরও গর্ত করল, খুবই উত্তেজিত হয়ে আবার স্বর্ণের ধমনী ধরার চেষ্টা করল, কিন্তু সবই ব্যর্থ।

অবশেষে, তারা হাল ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিল।

তারা তাদের যন্ত্রপাতি একজন ভাংগারিওয়ালার কাছে অল্প দামে বিক্রয় করল এবং ট্রেনে চড়ে বাড়ি ফিরল। কিছু ‘ভাংগারিওয়ালা’ বোকা হয়, কিন্তু এ লোক তা নয়। সে একজন খনন বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলীকে ডাকল। খনিটি দেখাল এবং একটু হিসাব-নিকাশ করার জন্য বলল। প্রকৌশলী বলল যে প্রকল্প ব্যর্থ হয়েছে, কারণ পূর্বের খনি মালিকরা ‘পরাজিত রেখার’ সাথে পরিচিত ছিল না। সে হিসাব কষে দেখাল যে যেখান থেকে ডার্বি ও তার কাকা গর্ত খোঁড়া বন্ধ করেছিল সেখান থেকে মাত্র তিন ফুট নিচেই স্বর্ণের আকর পাওয়া যেতে পারে! একদম ঠিক সেই জায়গাতেই তা পাওয়া গেল!

খনি থেকে সেই ‘ভাংগারিওয়ালা’ কোটি টাকার স্বর্ণের আকর উত্তোলন করল। কারণ সে জানত যে হাল ছাড়ার আগে একজন বিশেষজ্ঞের মতামত নিতে হয়।

খনন যন্ত্রপাতির বেশির ভাগ এসেছিল তরুণ ডার্বির চেষ্টার কারণে। তার আত্মীয়স্বজন তাকে বিশ্বাস করেছিল বলেই টাকা দিয়েছিল। ডার্বি তাদের প্রতিটি টাকাই ফিরিয়ে দেয়। যদিও এতে তার অনেক বছর সময় লাগে।

এরপর, ডার্বি তার জীবনে অনেক বাধার সম্মুখীন হয়েও এগিয়ে গিয়েছে। কারণ তখন সে আবিষ্কার করল আকাক্সক্ষা বা ইচ্ছাকে স্বর্ণে রূপান্তর করা যায়। সে তার জীবন বীমা বিক্রয়ের ব্যবসায় গিয়ে এই আবিষ্কার করে।

ডার্বি অনেক বড় সৌভাগ্য হারিয়েছে এটা সে মনে রেখেছে যে সে স্বর্ণ থেকে মাত্র তিন ফুট পিছনে থেমে গিয়েছিল, সে তার অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে তার পছন্দের কাজ আরম্ভ করল। সে একটি সহজ পদ্ধতি ব্যবহার করত এবং নিজেকে বলতো, ‘আমি স্বর্ণ থেকে তিন ফুট পিছনে থেমেছিলাম, কিন্তু আমি আর কখনো থামব না, কারণ মানুষ “না” বলে যখন আমি তাদেরকে জীবন বীমা কিনতে জিজ্ঞেস করি।’

ডার্বি পঞ্চাশজনের ছোট্ট দলের মধ্যে একজন যে বছরে এক কোটি টাকার বেশি জীবন বীমা বিক্রয় করে। সে তার ‘আটকে থাকার’ শিক্ষা নিয়েছে স্বর্ণ খনি ব্যবসার ‘হাল ছাড়া’ থেকে।

প্রত্যেক মানুষের জীবনে সাফল্য আসার পূর্বে এটা নিশ্চিত যে সে কিছু সাময়িক বাধার সম্মুখীন হবে এবং ব্যর্থও হতে পারে। যখন মানুষের সামনে বাধা আসে তখন সবচেয়ে সহজ ও যুক্তিসঙ্গত কাজ হয় হাল ছেড়ে দেওয়া। বেশির ভাগ মানুষ এটাই করে।

এ দেশের (আমেরিকার) সুপরিচিত ৫০০ এর বেশি সফল মানুষ লেখককে বলেছে, ‘তারা সবচেয়ে কঠিন বাধার ঠিক এক কদম পরেই তাদের সবচেয়ে বড় সাফল্য অর্জন করেছে।’ ব্যর্থতা হচ্ছে লৌহ কঠিন এবং চতুর প্রকৃতির কৌশল। যখন একজন সাফল্যের কাছে পৌঁছে যায় তখন তাকে ল্যাং মেরে এটা খুব মজা পায়।


পঞ্চাশ টাকায় অধ্যবসায়ের শিক্ষা

কয়েক বছর পর ডার্বি যখন ‘জীবনের শক্ত আঘাতের বিশ্ববিদ্যালয়’ থেকে তার সনদপত্র পেয়েছে এবং স্বর্ণ খনি ব্যবসার অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়েছে তখন আরও একটি ঘটনায় সে নিজের কাছে প্রমাণ করল যে ‘না’ এর মানে না-ই হতে হবে এমন নয়।

এক দুপুরবেলা সে তার কাকার গমের পুরনো ধাঁচের কারখানায় সহায়তা করছিল। তার কাকা অনেক বড় খামার চালায় যেখানে কিছু কালো কৃষকও বাস করত। দরজা খোলা ছিল এবং নিশ্চুপে একটা ছোট্ট কালো শিশু যে ছিল কৃষকের কন্যা, ভেতরে প্রবেশ করল এবং দরজার কাছে দাঁড়াল।

কাকা তার দিকে তাকাল, শিশুটিকে দেখল এবং কর্কশভাবে চিৎকার করে বলল, ‘কী চাও তুমি?’

মিনমিনে সুরে শিশুটি বলল, ‘আমার মা তার পঞ্চাশ টাকা চেয়েছে।’

‘আমি এটা দিবো না।’ কড়াভাবে কাকা বলল। ‘এখন তুমি দৌড়ে বাড়ি যাও।’

‘হু হুম’, শিশুটি উচ্চারণ করল। কিন্তু সে নড়েওনি।

কাকা কাজের প্রতি এগিয়ে গেল, সে কাজের প্রতি এতটাই ব্যস্ত হয়ে পড়ল যে শিশুটি চলে গেছে কিনা তা খেয়ালও করল না। যখন সে তাকিয়ে দেখল যে শিশুটি এখনো আগের জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে, চোখ রাঙিয়ে বলল, ‘আমি তোমাকে বাড়ি যেতে বলেছি। এখন যাও; নতুবা আমি তোমাকে বেত মারব।’

ছোট্ট মেয়েটি বলল, ‘হু হুম।’ কিন্তু সে এক সুতাও সরেনি।

কাকা শস্যের বস্তাটি নিচে রাখল যা সে গুঁড়া করার জন্য যন্ত্রে ঢালতে যাচ্ছিল, একটি লাঠি তুলে নিল এবং শিশুটির দিকে এগিয়ে গেল। তার মুখের ভাবেই বোঝা যাচ্ছিল কোন অঘটন ঘটানোর জন্য যাচ্ছে।

ডার্বি রুদ্ধশ্বাসে তাকিয়ে রইল। সে নিশ্চিত হয়ে গেল যে সে একটি খুনের প্রত্যক্ষ স্বাক্ষী হতে যাচ্ছে। সে তার কাকার হিং¯্র রাগ সম্বন্ধে জানত। সে জানত যে দেশের এই অংশে কালো শিশুদের সাদা লোকদের বিরোধিতা করতে নেই।

যখন কাকা সেই স্থানে পৌঁছাল যেখানে শিশুটি দাঁড়িয়েছিল, শিশুটি দ্রুত এক কদম এগিয়ে এলো, কাকার চোখের দিকে তাকাল এবং চিৎকার করে উচ্চ কণ্ঠে বলল, ‘আমার মায়ের সেই পঞ্চাশ টাকা চাই!’

কাকা থমকে দাঁড়াল, তার দিকে এক মুহূর্ত তাকাল, তারপর ধীরে তার লাঠিটি নিচে রাখল। তার হাত তার পকেটে ঢুকাল, অর্ধশত টাকা বের করল এবং শিশুটিকে দিয়ে দিল।

শিশুটি টাকাটা নিল এবং ধীরে ধীরে পিছন ফিরে দরজা দিয়ে চলে গেল, কখনো তার চোখ দিয়ে দেখল না যাকে সে এইমাত্র জয় করেছে। সে চলে যাওয়ার পর কাকা একটি বাক্সের ওপর বসে পড়ল এবং জানালা দিয়ে প্রায় ১০ মিনিটেরও ওপরে বাইরে তাকিয়ে থাকল। যে বেত্রাঘাত সে এইমাত্র পেল তাই নিয়ে তার মনে বিস্ময়ে তোলপাড় চলছিল।

ডার্বিও কিছু চিন্তা করছিল। সে তার জীবনে এই প্রথম দেখল যে কোন কালো শিশু দৃঢ়তার সাথে একজন পূর্ণবয়স্ক সাদা লোকের উপর রাজত্ব করল। সে কীভাবে এটা করল? কী ঘটেছিল তার কাকার সাথে যাতে সে তার হিং¯্রতা ভুলে একটা বাধ্য ভেড়ার মতো হয়ে গেল? কী অদ্ভুত শক্তি সেই শিশুটি ব্যবহার করল যাতে সে তার ঊর্ধ্বতনের উপর রাজত্ব করল? এরকম আরও কিছু প্রশ্ন ডার্বির মনে জেগে উঠেছিল, কিন্তু সে তার জবাব পরবর্তী কয়েক বছরেও খুঁজে পায়নি।

বিস্ময়কর হলেও, লেখককে এই কাহিনীটি বলা হয়েছিল ঠিক সেই পুরানো কারখানায় যেখানে ডার্বির কাকা অভিভূত হয়েছিল। এটাও বিস্ময়কর যে আমি আমার জীবনে ২৫ বছর সময় ধরে গবেষণা করেছি এই শক্তিকে জানার জন্য যা দিয়ে একটি অজ্ঞ, অশিক্ষিত কালো শিশু একজন বুদ্ধিমান পুরুষকে জয় করেছে।

আমরা সেই দুর্গন্ধময় পুরানো কারখানায় দাঁড়িয়ে ছিলাম, ডার্বি পুনরায় সেই অসাধারণ জয়ের কাহিনী স্মরণ করে শেষ করল এই জিজ্ঞাসা নিয়ে যে, তুমি এটা দিয়ে কী করবে? সেই শিশুটি কী অদ্ভুত শক্তি ব্যবহার করেছিল, যা আমার কাকাকে সম্পূর্ণরূপে হারিয়ে দিল?

এই জবাবটি পাওয়া যাবে এ বইয়ের বর্ণিত সূত্রের মধ্যে। উত্তরটি পুরোপুরি এবং সম্পূর্ণভাবেই দেওয়া আছে। এর পর্যাপ্ত বর্ণনা ও নির্দেশনা দেওয়া আছে যাতে যেকেউ এটা বুঝতে পারে এবং ঠিক একই শক্তি ব্যবহার করতে পারে যা সেই ছোট্ট শিশুটি দুর্ঘটনাবশত প্রয়োগ করেছিল।

আপনার মনকে সজাগ রাখুন এবং ঠিক সেই ক্ষমতাকে পর্যবেক্ষণ করুন যা শিশুটিকে রক্ষা করেছিল, আপনি সেই ক্ষমতার এক ঝলক দেখতে পাবেন পরবর্তী অধ্যায়ে। এ বইয়ের কোন এক জায়গায় আপনার ধারণা আসবে যা আপনার ক্ষমতাকে আরও দ্রুত গ্রহণক্ষম করে তুলবে এবং আপনার নিজ লাভেরই জন্য এই অনিবার্য ক্ষমতাকে আপনার আয়ত্তে নিন। হয়তো প্রথম অধ্যায়েই আপনি এই ক্ষমতা সম্পর্কে সচেতন হবেন বা পরবর্তী অধ্যায়গুলোতে পেতে পারেন এই ক্ষমতার আভাস। এটা হয়তোবা একটি মাত্র আইডিয়া হিসাবে আসতে পারে। আবার এমনও হতে পারে যে এটা আপনাকে আপনার অতীত ব্যর্থতা বা পরাজয়ের অভিজ্ঞতা থেকে এমন কোন শিক্ষা রূপে আপনার কাছে আসবে যাতে আপনি আপনার সব ব্যর্থতাকে পুনরায় জয় করতে পারেন।

যখন আমি ডার্বিকে সেই কালো শিশুটির অসচেতনভাবে ব্যবহৃত ক্ষমতা সম্বন্ধে বললাম, সে দ্রুত তার ত্রিশ বছরের জীবনবীমা বিক্রয়ের অভিজ্ঞতাকে মনে করল এবং এই কর্মে তার যথার্থ সাফল্যের কারণ অনুধাবন করল। এ কোন ছোট্ট ব্যাপার নয় যা সে ঐ শিশুর কাছ থেকে শিখেছিল।

ডার্বি বুঝতে পারল এবং বলল, ‘প্রত্যেকবার যখন একটা বাধা আমাকে ভেঙে দিতে চাইত, গ্রাহকরা ক্রয় ছাড়া চলে যেত, আমি দেখতাম একটা শিশু পুরানো কারখানায় তার বড়, উজ্জ্বল চোখে যুদ্ধের আহ্বান নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এবং আমি নিজেকে বলতাম, আমাকে এই বিক্রয় করতেই হবে। লোকজন ‘না’ বলার পরেই আমি সবচেয়ে ভালো এবং বেশি অর্থের বীমা বিক্রয় করেছি।

সে আবারও বলল, ‘আমার ভুল হয়েছিল যে আমি স্বর্ণ থেকে মাত্র তিন ফুট পিছনে থেমে গিয়েছিলাম। কিন্তু আমার জন্য এই অভিজ্ঞতা ছিল ছদ্মবেশে এক আর্শীবাদ। এটা আমাকে শিখিয়েছে, “পরিস্থিতি যত কঠিনই হোক না কেন কাজ চালিয়ে নেওয়ার জন্য চলতেই হবে।” কোনকিছুতে সাফল্য অর্জন করার পূর্বে এই শিক্ষা আমার প্রয়োজন ছিল।’

ডার্বি এবং তার কাকার সেই কাহিনী, কালো শিশু এবং স্বর্ণের খনির ঘটনা সন্দেহাতীতভাবে লাখো লোকে পাঠ করবে যারা জীবনবীমা বিক্রয় করে তাদের জীবন নির্বাহ করে এবং এ সব ঘটনা থেকে লেখক অভিমত দিচ্ছে যে ডার্বি তার নিজের জীবনের এই দুই অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে প্রতি বছর কোটি টাকারও বেশি জীবনবীমা বিক্রয় করে।

জীবন অদ্ভুত এবং প্রায় অনুমানযোগ্যহীন! সাফল্য ও ব্যর্থতা উভয়ের শিকড়ই সাধারণ অভিজ্ঞতাতে থাকে। ডার্বির অভিজ্ঞতাও ছিল সহজ ও সাধারণ জায়গায়, তবুও সে তার জীবনে লক্ষ্যের দেখা পেয়ে গেল এবং এই শিক্ষা তার কাছে এমনভাবে গুরুত্ববহ হয়ে উঠলো যেরকম তার জীবন। সে এই দুই নাটকীয় অভিজ্ঞতা থেকে লাভবান হয়েছে, কারণ সে এদের বিশ্লেষণ করেছে এবং খুঁজে পেয়েছে সেই শিক্ষা যা এই ঘটনাগুলো তাকে শেখাতে চেয়েছিল। কিন্তু সেই লোকের কী হবে যার সময় নেই বা যার উদাসীন মনোভাব ব্যর্থতাকে বিশ্লেষণ করে সেই জ্ঞান নিতে যা তাকে সাফল্যের প্রতি ধাবিত করত? সে কখন শিখবে যে কীভাবে ব্যর্থতাকে সুযোগের সিঁড়িতে রূপান্তর করতে হয়?

প্রশ্নগুলোর জবাব দেওয়ার জন্যই এ বই লেখা হয়েছে।

উত্তরটা বর্ণনা করা হয়েছে ১৩টা সূত্রে। কিন্তু মনে রাখবেন, যেহেতু আপনি পড়ছেন আপনার সেই উত্তর খুঁজে পাওয়ার জন্য যা জীবনের অদ্ভুত ঘটনায় আপনার মনে প্রশ্ন জাগিয়েছে; হয়তো-বা জবাব পেতে পারেন আপনারই নিজের মনের মধ্যে কোন আইডিয়া, পরিকল্পনা বা উদ্দেশ্যের মাধ্যমে, যা পড়তে পড়তে আপনার মনে উদয় হতে পারে।

একটি আইডিয়াই সব যা আপনার জীবনে সাফল্য নিয়ে আসতে পারে। এ বইয়ের বর্ণিত সূত্রগুলো বহন করে সর্বোৎকৃষ্ট এবং সবচেয়ে বাস্তবিক জ্ঞান যা আপনার জীবনে প্রয়োগ করার মতো ধারণা তৈরি করতে এবং সেই অনুযায়ী চলতে আপনাকে সচেতন করবে।

আমরা এই সূত্রগুলোর বর্ণনায় যাওয়ার আগে আমাদের বিশ্বাস আপনার একটি গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ নেওয়া উচিত ... ... যখন ধনীরা ধনী হতে থাকে এবং এত দ্রুত বিশাল পরিমাণে ধনী হয়ে ওঠে যে মানুষ বিস্মিত হয় এত বছর সে কোথায় লুকিয়ে ছিল। এটা একটা বিস্ময়ের বর্ণনা এবং আমরা আপনাকে একটা জনপ্রিয় বিশ্বাসের প্রতি বিবেচনা করতে বলছি যে ধনী হয় শুধু তারাই যারা কঠোর পরিশ্রম করে এবং তা করে দীর্ঘ সময় ধরে।

যখন আপনি চিন্তা করুন এবং ধনী হোন আরম্ভ করবেন তখন পর্যবেক্ষণ করবেন যে ধনীরা একটি মানসিক অবস্থা দিয়ে আরম্ভ করে, নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যের সাথে, যা করা কঠিন কাজ নয়। আপনি কি জানতে চান যে ধনীরা কী করে এই মানসিক অবস্থা অর্জন করে? আমি আমার গবেষণায় ২৫ বছর ব্যয় করেছি, ২৫ হাজার মানুষকে বিশ্লেষণ করেছি। কারণ আমিও জানতে চাই যে ‘কীভাবে এই পথে মানুষ ধনী হয়?’

এই গবেষণা ব্যতীত, এ বই লেখা যেত না।

এখানে একটি সত্য ঘটনার উদাহরণ দেওয়া হলো: ১৯২৯ সালে আমেরিকার ব্যবসায় হতাশা নেমে আসে। এটা সর্বকালের সবচেয়ে বড় দুর্যোগপূর্ণ মুহূর্ত ছিল যতক্ষণ পর্যন্ত না রাষ্ট্রপতি রুজভেল্ট তার অফিসে প্রবেশ করে। তারপর এই হতাশা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়। একদম সিনেমা হলে অন্ধকারের মধ্যে বাতি জ্বালিয়ে দেওয়ার মতো, একজন বাতি জ্বালিয়ে দিল, আর অন্ধকার দূর হয়ে সব আলোকিত হয়ে উঠল। মানুষের মনে ভীতির অনুভূতি দূর হয়ে আশার আলো এবং বিশ্বাসে পূর্ণ হয়ে উঠল।

খুব নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করুন, যত দ্রুত আপনি এই দর্শনের সূত্রের ওপর কর্তৃত্ব করবেন এবং এই সূত্রগুলো প্রয়োগের জন্য নির্দেশাবলি অনুসরণ করতে আরম্ভ করবেন, তত দ্রুত আপনার অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি আরম্ভ হবে এবং আপনি যাই স্পর্শ করবেন তাই আপনার লাভের জন্য সম্পদে রূপান্তরিত হতে থাকবে। কী! অসম্ভব? মোটেও না!

মানবজাতির দুর্বলতার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে এই সুপরিচিত শব্দ ‘অসম্ভব’। সে সব নিয়মই জানে যা কাজ করবে না। সে সেসব বিষয়ও জানে যা করতে পারা যাবে না। এ বই লেখা হয়েছে তাদের জন্য যারা সেসব নিয়ম খোঁজে যেসব নিয়ম মেনে অন্যরা সফল হয়েছে এবং সেই নিয়মগুলোর জন্য যারা সবকিছু বাজি রাখতে ইচ্ছুক।

অনেক বছর আগে আমি একটি ভালো ডিকশনারি কিনেছিলাম। আমার প্রথম কাজ ছিল ‘অসম্ভব’ শব্দ বের করা এবং তা খুব সুন্দরভাবে কেটে ফেলা। এটা করা আপনার জন্য বুদ্ধিমানের কাজ হবে না।

সাফল্য তাদের কাছেই আসে যারা সাফল্য সচেতন। ব্যর্থতাও আসে তাদের কাছে যারা উদাসীনভাবে নিজেদের ব্যর্থতা সচেতন করে তুলেছে।

এ বইয়ের উদ্দেশ্য হচ্ছে তাদেরকে সহায়তা করা যারা খোঁজে এবং শিখতে চায় যে কোন কৌশলে তারা তাদের মনকে ব্যর্থতা সচেতন থেকে সাফল্য সচেতনে পরিবর্তন করতে পারবে।

আরও একটি দুর্বলতা একাধারে বেশির ভাগ লোকের মধ্যেই পাওয়া গেছে। তা হচ্ছে তাদের নিজেদের মনোভাব ও বিশ্বাস দ্বারা সবকিছু এবং সকলকে পরিমাপ করার অভ্যাস। কিছু লোক যারা চিন্তা করুন এবং ধনী হোন শিরোনাম পাঠ করবে তারা বিশ্বাস করে যে এটা কেউই পারবে না। কারণ তারা তাদের অভ্যাসগত চিন্তায় আটকে পড়েছে, যা হচ্ছে দরিদ্রতা, চাওয়া, দুর্দশা, ব্যর্থতা এবং পরাজয়।

এই সকল হতাভাগা মানুষ আমাকে এক প্রসিদ্ধ চিনা লোকের কথা মনে করিয়ে দেয়, যে আমেরিকায় এসেছিল আমেরিকান ধারায় পড়াশুনা করতে। সে শিকাগোর একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেয়। একদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ হারপার এই তরুণ শিক্ষার্থীর সাথে দেখা করে এবং কিছু সময় কথা বলে। তাকে জিজ্ঞেস করে আমেরিকার মানুষের কোন বৈশিষ্ট্য তোমাকে উদ্ভুদ্ধ করেছে?

চিনা লোকটি বলে উঠল, ‘কেন, তাদের অপূর্ব বাঁকা দৃষ্টি। অবশ্য তোমার দৃষ্টি বাঁকা নয়।’

আমরা এই চিনা লোক সম্পর্কে কী বলব?

যা আমরা বুঝতে পারি না তা আমরা বিশ্বাস করতে অস্বীকার করি। আমরা বোকার মতো বিশ্বাস করি যে আমাদের বেঁধে দেওয়া সীমাই হচ্ছে সীমার সঠিক পরিমাপ। নিশ্চয়ই, অন্যদের দৃষ্টি ‘বাঁকা নয়’, কারণ তারা আমাদের মতো একই রকম চিন্তা করে না।

লক্ষাধিক লোকজন দেখেছে হেনরি ফোর্ডের অর্জনকে, দেখেছে তার এগিয়ে যাওয়া এবং তাকে হিংসা করেছে, কারণ তার সৌভাগ্য বা ভাগ্য বা মেধা বা অন্য যেকোন কিছু যা ফোর্ডের ঐশ্বর্যের জন্য মানুষ নিজেরাই নির্ধারণ করেছে। হয়তো প্রতি এক লাখ লোকের মধ্যে একজন জানে ফোর্ডের সাফল্যের গোপন রহস্য এবং যারা জানে খুবই কম জানে অথবা এটা বলতে ইচ্ছুক নয়। কারণ এর সহজবোধ্যতা। নিচে একটি ঘটনার উল্লেখ করছি। এই একটি ঘটনাই ফোর্ডের সাফল্যের ‘গোপন রহস্য’কে সম্পূর্ণ ব্যাখ্যা করবে।

কয়েক বছর আগে, ফোর্ড তার বিখ্যাত ভি-৮ গাড়ি উৎপাদনের সিদ্ধান্ত নেয়। সে একটা ব্লকে ৮টা সিলিন্ডার বিশিষ্ট একটা ইঞ্জিন তৈরি করতে চায় এবং তার প্রকৌশলীদের নির্দেশ দেয় এরূপ এক ইঞ্জিনের নকশা তৈরি করতে। নকশাটা কাগজে তৈরি করা হলো, কিন্তু ইঞ্জিনিয়াররা একমত হলো যে মানুষের পক্ষে এক ব্লকে ৮টা সিলিন্ডার বিশিষ্ট ইঞ্জিন তৈরি করা একেবারেই অসম্ভব।

ফোর্ড বলল, ‘যেভাবেই হোক এটা তৈরি করো।’

তারা বলল, ‘কিন্তু এটা অসম্ভব!’

ফোর্ড নির্দেশ দিল, ‘চেষ্টা করে যাও। যতক্ষণ পর্যন্ত না সফল হও ততক্ষণ কাজ করে যাও। যত সময় লাগে লাগুক। কোন ব্যাপার না।’

প্রকৌশলীরা কাজ করতে লাগল। তাদের কিছুই করার ছিল না যদি তারা ফোর্ডের কর্মচারী রূপে থাকতে চায় তাহলে কাজ করে যেতে হবে। ছয় মাস চলে গেল কিছুই ঘটল না। আরও ছয় মাস গেল, এখনও কিছুই হলো না। ইঞ্জিনিয়াররা প্রত্যেক সম্ভাব্য উপায়ে এগিয়ে গেলে, কিন্তু দেখা গেল যে ‘অসম্ভব’।

বছর শেষে ফোর্ড তার প্রকৌশলীদের ডাকল এবং তারা আবারও জানাল যে, কোন পথেই সমাধান খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

ফোর্ড বলল, ‘আরও চেষ্টা করে যাও। আমি এটা চাই এবং আমি এটা পাবই।’

তারা কাজ চালিয়ে গেল এবং তারপরই যেন জাদুর আঘাতে সেই গোপন রহস্য উন্মোচিত হলো।

ফোর্ডের দৃঢ়বিশ্বাস আরও একবার জয়ী হল!

এই ঘটনা হয়তো এক মুহূর্তে বর্ণনা করা যাবে না, কিন্তু এর সমষ্টি এবং সারাংশ ঠিক ছিল। আপনি এখান থেকে অনুমান করুন যার ইচ্ছা আছে চিন্তা করুন এবং ধনী হোন, কোটিপতি ফোর্ডের গোপন রহস্য থেকে যদি আপনি বুঝতে পারেন তবে আপনাকে আর বেশিদূর দেখতে হবে না।

হেনরি ফোর্ড সফল কারণ তিনি বুঝতে পেরেছিল এবং সাফল্যের সূত্র প্রয়োগ করেছিল। এদের মধ্যে একটি হচ্ছে আকাক্সক্ষা: এটা জানা যে আপনি নিজে কী চান। আপনি যখন ফোর্ডের এই কাহিনী পাঠ করবেন তখন মনে রাখবেন এবং খুঁজে বের করুন সেই বাক্যের গোপন রহস্য যাতে বর্ণনা আছে ফোর্ডের বিস্ময়কর সাফল্যের। আপনি যদি তা করতে পারেন, যদি আপনি বিশেষ কিছু সূত্র ব্যবহার করে দক্ষ হয়ে ওঠেন যা হেনরি ফোর্ডকে ধনী করে তুলেছে, তবে আপনিও তার সমান সাফল্য অর্জন করতে পারবেন।

আপনি ‘আপনার ভাগ্যের কর্তৃত্ব করবেন, আত্মার চালক হবেন’, কারণ...

যখন হেনলি এই মহান লেখাটি লেখেন, ‘আমিই আমার ভাগ্যের কর্তৃত্ব করব, আত্মার চালক হবো’, তখন তিনি আমাদের জানাতে চেয়েছেন যে আমরাই আমাদের ভাগ্যের ওপর কর্তৃত্বকারী, আত্মার চালনাকারী, কারণ আমাদের আছে চিন্তাশক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা।

তার আমাদেরকে আরও বলা উচিত ছিল যে, ইথার যার মধ্যে আমাদের এই ছোট্ট পৃথিবী ভাসমান, যার মধ্যে আমরা চলাফেরা করি এবং আমাদের অস্তিত্ব বিদ্যমান, এটা এক ধরনের শক্তি যা একটি অচিন্তনীয় উচ্চ স্পন্দনের তরঙ্গ রূপে চলাচল করে এবং সেই ইথার পূর্ণ হয়ে আছে এক প্রকার মহা বৈশ্বিক শক্তিতে যা প্রকৃতগতভাবে আমরা আমাদের মনে চিন্তাগুলোর মাধ্যমে ধারণ করি এবং সাধারণভাবেই এটা আমাদের চিন্তাগুলোকে তাদের বাহ্যিক সমতুল্যে রূপান্তর করতে প্রভাবিত করে।

যদি কবি আমাদের এই মহান সত্যটি বলে যেতেন তবে আমরা জানতাম কেন আমরা আমাদের ভাগ্যের ওপর কর্তৃত্বকারী, আত্মার চালনাকারী। তার আরও জোর দিয়ে বলা উচিত ছিল যে এই ক্ষমতার মধ্যে ধ্বংসাত্মক চিন্তা ও গঠনমূলক চিন্তাকে পার্থক্য করার মতো কিছু নেই, যেরকম এটা আমাদের ঠেলে দেয় দরিদ্রতার মতো বাস্তবিক চিন্তা করতে আবার ততটাই দ্রুত গতিতে আমাদের প্রভাবিত করে ধনীদের চিন্তার মতো আচরণ করতে।

তার আরও বলা উচিত ছিল যে আমাদের মস্তিষ্ক আমাদের আধিপত্যশালী চিন্তায় চুম্বকায়িত হয়ে পড়ে যা আমরা আমাদের মনে ধারণ করি এবং এর সাথে কেউই পরিচিত নয়। এই চুম্বকায়ন শক্তি, ক্ষমতা ও মানুষের জীবনের পরিস্থিতিকেও আকর্ষণ করে এবং আমাদের আধিপত্যশালী চিন্তাগুলোকে একই সুতায় বেঁধে ফেলে। আমরা যেরকম চিন্তা বেশি করি তাই আকর্ষণ করি। দরিদ্রতার চিন্তা করলে দরিদ্র হই, ব্যর্থতার মনোভাব থাকলে ব্যর্থ হই। আর ধনীদের মতো চিন্তা করলে, সফল হওয়ার পথ খুঁজলে, আমরা তাই পাব।

তার আরও বলা উচিত ছিল যে বহু পরিমাণে ধনী হওয়ার পূর্বে আমাদের ধনী হওয়ার প্রতি প্রচ- আকাক্সক্ষায় আমাদের মনকে চুম্বকায়িত করতেই হবে যাতে আমরা ‘অর্থ সচেতন’ হতে পারি। এর ফলে এই আকাক্সক্ষাÑ‘অর্থের জন্য আকাক্সক্ষা’ আমাদের জন্য আমাদের মনের মধ্যে কিছু বুদ্ধি ও ধারণার উদ্ভব ঘটাবে।

কিন্তু, একজন কবি বলে, দার্শনিক রূপে নয়, হেনলি এই সুবৃহৎ তথ্যটি তার কাব্যিক আকারেই রেখে দেন তাদের জন্য যারা এর দার্শনিক অর্থকে ব্যাখ্যা করে অনুসরণ করবে।

ধীরে ধীরে, এ বইয়ে লেখা সূত্র দ্বারা এই সত্যটি উন্মোচিত হয়েছে। এই সূত্রগুলো সেই গোপন রহস্যটি উন্মোচন করে যাতে আপনি আপনার অর্থনৈতিক ভাগ্যের ওপর কর্তৃত্ব করতে পারেন।

আমরা এখন সূত্রগুলোর প্রথমটিকে পরীক্ষা করার জন্য প্রস্তুত, নিজের মনকে খোলা রাখার মানসিকতা বজায় রাখুন এবং মনে রাখবেন যে এই সূত্রগুলো একজন মানুষের আবিষ্কার নয়। এই সূত্রগুলো সংগ্রহ করা হয়েছে ৫০০ এর চেয়েও বেশি পুরুষদের জীবন অভিজ্ঞতা থেকে যারা বাস্তবে প্রচুর পরিমাণ আর্থিক সম্পদের অধিকারী হয়েছেন, সেসব মানুষ দরিদ্রতা দিয়ে আরম্ভ করেছিলেন, আরম্ভ করেছেন অল্প শিক্ষা নিয়ে কারও প্রভাব ব্যতীত। সূত্রগুলো এসব মানুষের জন্য কাজ করেছে। আপনিও এদের থেকে প্রাপ্ত শিক্ষাকে নিজের লাভের জন্য নিজের কাজে লাগাতে পারেন।

আপনি দেখবেন যে এটা করা সহজ। কঠিন নয়। আপনি করতে পারবেন।

পরবর্তী অধ্যায় পড়ার আগে আমি আপনাকে একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানাতে চাই যা আপনার সম্পূর্ণ আর্থিক ভাগ্যকে সহজেই পরিবর্তন করবে, যেভাবে এটা ব্যাপক পরিবর্তন এনেছিল নিচে বর্ণিত দুইটি লোকের প্রতি।

আমি আপনাকে জানাতে চাই যে এই দুইজনের সাথে আমার পরিচয় ব্যক্তিগত পর্যায়ের। এদের মধ্যে একজন আমার খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু যার সাথে আমার ২৫ বছরের ব্যক্তিগত সম্পর্ক রয়েছে, অপরজন আমার নিজের সন্তান। এই দুইজনের অসাধারণ সাফল্যের কারণ তারা উদারভাবে এই সূত্রের প্রতি বিশ্বাস করেছে যা পরবর্তী অধ্যায়ে উল্লেখ রয়েছে। ব্যক্তিগতভাবে পরিচিত এই দুইজনের বর্ণনা দেওয়ার মানে এই সূত্রের কার্যকারিতার ওপর জোর দেওয়া।

প্রায় ১৫ বছর পূর্বে, আমি পশ্চিম ভার্জিনিয়ার সেলিম মহাবিদ্যালয়ে একটি বক্তব্য দিয়েছিলাম। আমি পরবর্তী অধ্যায়ের সূত্রের প্রতি এতটাই জোর দিয়েছিলাম যে স্নাত্মকের একজন সদস্য একে নিশ্চিতভাবেই প্রয়োগ করে এবং একে তার জীবন-দর্শনের একটি অংশ করে নেয়। সেই তরুণ যুবক এখন কংগ্রেসের একজন সদস্য এবং বর্তমান প্রশাসনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। প্রকাশকের কাছে বইটি যাওয়ার আগ মুহূর্তে সে আমাকে একটি চিঠি লিখে পরবর্তী অধ্যায়ের সূত্রের ব্যাপারে তার স্পষ্ট অভিমত জানায় যা আমি এখানে পরবর্তী অধ্যায়ের পরিচিতি স্বরূপ প্রকাশ করছি।

এটা আপনাকে ধারণা দিবে যে এই সূত্র প্রয়োগে আপনি কী ধরনের এবং কত বড় পুরস্কার পেতে পারেন।

‘আমার প্রিয় নেপোলিয়ন,

‘কংগ্রেসের সদস্য রূপে দেশের সেবা করার সময় আমি পুরুষ ও নারীদের সমস্যা সম্বন্ধে অবহিত হই, আমি এই লেখার মাধ্যমে একটি পরামর্শ দিতে চাই যা হাজারো মানুষের উপকারে আসবে।

‘আমাকে ক্ষমা করবেন, যদিও আমি এই পরামর্শ আপনার কাছ থেকেই পেয়েছি এবং জীবনের বহু বছরের পরিশ্রম ও দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে একে ঠিকভাবে কাজে লাগিয়েছি। আমি আপনাকে এই কথা জানাতে চাই, কারণ আপনি মানুষকে অনেক ভালোবাসেন এবং তাদের সেবায় নিজের জীবন নিয়োজিত করেছেন।

‘১৯২২ সালে আপনি সেলিম কলেজে যে বক্তব্য দিয়েছিলেন সে সময় আমি স্নাত্মকের একজন শিক্ষার্থী ছিলাম। সেই সময় আপনি আমার মনে একটি ধারণা ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন যার জন্য আজ আমি আমার দেশের সেবা করছি এবং এই মহান দায়িত্ব ভবিষ্যতেও পালন করে যাব।

‘আমার মনে যে পরামর্শ রয়েছে তা হলো আপনি একটি বইয়ে সম্পূর্ণ ও সারমর্মভাবে সব বিষয় তুলে ধরুন যা আপনি সেদিন সেলিম কলেজের বক্তব্যে বলেছিলেন এবং আমেরিকার জনগণকে আপনার বহু বছরের অভিজ্ঞতা থেকে জানার একটি সুযোগ দিন। যে অভিজ্ঞতা আপনি আমেরিকার ধনী পুরুষদের সাথে থেকে অর্জন করেছেন তার থেকে মানুষকে লাভবান হওয়ার একটি সুযোগ দিন।

‘আমি আবারো বলছি, আপনি যে অসাধারণ বর্ণনা দিয়েছিলেন হেনরি ফোর্ডের পদ্ধতি সম্পর্কে যিনি বিদ্যালয়ের অল্প শিক্ষা, কোন টাকাপয়সা ছাড়া, প্রভাবিত করতে পারে এমন বন্ধু ছাড়া মহান উচ্চতায় উঠেছেন। আমি তখনই আমার মনকে তৈরি করে নিয়েছি, আপনার বক্তব্য শেষ হওয়ার পূর্বেই আমি ঠিক করেছি যে আমিও এরকম একটি স্থানে পৌঁছাব, আমাকে যতই বাধা অতিক্রম করতে হয় না কেন।

‘হাজারো তরুণ এ বছর তাদের পড়ালেখা শেষ করবে এবং সামনের বছরগুলোতে আরও শিক্ষার্থী পড়ালেখা শেষ করবে। এদের প্রত্যেকেই একটি বাস্তব সম্মত উৎসাহদায়ক পরামর্শ খুঁজবে যেরকম একটি পরামর্শ আমি পেয়েছি আপনার কাছ থেকে। তারা জানতে চায় কোথায় তারা ঘুরে দাঁড়াবে, কী করবে তাদের জীবনকে শুরু করার জন্য। আপনি তাদের বলতে পারেন, কারণ আপনি এই সমস্যা সমাধান করতে অনেক অনেক মানুষকে সহায়তা করেছেন।

‘আপনি যদি সেই অভিজ্ঞতাগুলো একটি বইয়ে প্রকাশ করে দেশবাসীকে ধন্য করেন, তবে আমার আরও পরামর্শ হলো প্রতিটি বইয়ে আপনার ব্যক্তিগত বিশ্লেষণের ছক দেওয়া, যাতে যে ব্যক্তি বই ক্রয় করবে তিনি যেন নিজেকে সম্পূর্ণভাবে আবিষ্কার করতে পারেন, নিজেকে নির্দেশিত করতে পারে যেভাবে আপনি আমাকে বহু বছর আগে দেখিয়ে দিয়েছিলেন সাফল্যের পথে বাধা রূপে একদম কী কী দাঁড়িয়ে থাকে।

‘আপনার বইয়ের মাধ্যমে পাঠকরা তাদের ভুলচুকের পরিপূর্ণ ও পরিষ্কার চিত্র দেখতে পাবে এবং তাদের গুণগুলোও ধরতে পারবে। এভাবে তারা পাবে সাফল্য ও ব্যর্থতার স্পষ্ট পার্থক্যের চিত্র। এই সেবাই হবে অমূল্য।

‘আমি আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলছিÑলাখো মানুষ আজও হতাশার জন্য নানান সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। আমি জানি যে এসব আয় সক্ষম মানুষ আপনাকে তাদের সমস্যা বলার সুযোগ পেতে চায় এবং সমস্যা সমাধানে আপনার পরামর্শ পেয়ে তারা ধন্য হবে।

‘মানুষের কাজ আরম্ভ করার বাধাগুলো সম্বন্ধে আপনি জানেন, এ দেশে হাজারো লোক বাস করেন যারা জানতে চায় যে কীভাবে তারা তাদের আইডিয়াকে টাকায় পরিণত করবে, কোন ধরনের আর্থিক সহায়তা ব্যতীত কীভাবে মানুষ বাধা অতিক্রম করবে এবং তাদের ব্যর্থতা থেকে কীভাবে ইতিবাচক বিষয় বের করে আনবে। তাদের যদি কেউ সহায়তা করতে পারে তবে সেই ব্যক্তি আপনি।

‘আপনি যদি বই প্রকাশ করেন তবে আপনার নিজের স্বাক্ষরসহ আমি বইয়ের প্রথম কপি নিতে চাই।

‘আপনার জন্য দোয়া রইল।

‘আন্তরিকতার সাথে

‘জেনিংস রেনডল্ফ

 




অধ্যায় - ০২

আকাক্সক্ষা

সাফল্যের আরম্ভ বিন্দু

ধনী হওয়ার ক্ষেত্রে প্রথম ধাপ


যখন এডউইন সি. বার্নেস অরেঞ্জের মালবাহী ট্রেন থেকে নামলেন সেই প্রায় ৩০ বছর আগে, তাকে দেখতে হয়তো ছন্নছাড়া বলে মনে হচ্ছিল কিন্তু তার চিন্তা ছিল রাজার মতো!

যেহেতু সে ট্রেন থেকে নেমেই টমাস আলভা এডিসনের দফতরে যাত্রা আরম্ভ করল তখন তার মনে একটাই চিন্তা চলছিল। সে নিজেকে এডিসনের সম্মুখে দাঁড়ানো অবস্থায় দেখছে। সে নিজেই শুনছে যে সে এডিসনকে জিজ্ঞেস করছে একটি সুযোগের জন্য যা তার জীবনের একটি সর্বগ্রাসী আবেশ, একটি জ্বলন্ত আকাক্সক্ষা যে এই মহান উদ্ভাবকের ব্যবসা সহযোগী হওয়া।

বার্নেসের এই আকাক্সক্ষা ছিল না কোন আশা! এটা ছিল না কোন চাওয়া! এটা ছিল একটি তীব্র অনুভূতি যা আকাক্সক্ষা রূপে প্রতিনিয়ত স্পন্দিত হচ্ছিল যা অন্য সবকিছুকে অতিক্রম করেছিল। এটা ছিল নির্দিষ্ট।

বার্নেসের এই আকাক্সক্ষা নতুন ছিল না। যখন সে এডিসনের সামনে এসে দাঁড়ায় তারও বহু পূর্ব থেকেই তার মনের ভেতর এই আকাক্সক্ষা ছিল। শুরুতে যখন এই আকাক্সক্ষা তার মনে প্রথম উদয় হয় তখন হয়তো এটা ছিল একটা চাওয়া মাত্র, কিন্তু এটা কোন সাধারণ চাওয়া হয়ে থাকল না যখন সে এডিসনের সামনে এসে দাঁড়ায়।

কয়েক বছর পর এডউইন সি. বার্নেস এডিসনের সামনে এসে দাঁড়ায় ঠিক সেই দফতরে যেখানে সে এই মহান উদ্ভাবকের সাথে প্রথম সাক্ষাৎ করেছিল। এইবার তার আকাক্সক্ষা বাস্তবেই পরিণত হয়েছে। সে ছিল এডিসনের ব্যবসা সহযোগী। তার জীবনে আধিপত্য বিস্তারকারী এই স্বপ্ন এবার বাস্তবে পরিণত হয়েছে। আজ লোকেরা যারা বার্নেসকে জানে তারা তাকে হিংসা করে, কারণ জীবন তাকে বড় হওয়ার ‘সুযোগ’ দিয়েছে। তারা বার্নেসকে দেখে তার সাফল্যের আনন্দের দিনগুলোতে, কিন্তু বার্নেসের সাফল্যের কারণ অনুসন্ধান করে দেখার কষ্ট নিতে চায় না।

বার্নেস সফল হয়েছে কারণ সে একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য ঠিক করেছিল, দিয়েছে তার সব শক্তি, ইচ্ছাশক্তি, চেষ্টা, সবকিছু শুধু সেই লক্ষ্যের পিছনে। যেদিন সে এডিসনের সাথে দেখা করতে আসে সেদিনই সে এডিসনের ব্যবসা সহযোগী হয়ে ওঠেনি। সে একটা ন্যূনতম কাজ শুরু করেই সন্তুষ্ট ছিল যতক্ষণ পর্যন্ত না একটা সুযোগ সে পায় যাতে আরও এক ধাপ এগিয়ে যাওয়া যাবে তার সযতেœ লালন করা সেই লক্ষ্যের দিকে।

সেই সুযোগের অপেক্ষায় ৫ বছর পেরিয়ে গেল যা বার্নেস খুঁজে যাচ্ছে। এত বছরে একটা আশার কিরণও দেখা দিল না, ছিল না তার আকাক্সক্ষা পূরণ হওয়ার মতো একটা ওয়াদা। সকলেই মনে করেছিল, বার্নেসও এডিসনের ব্যবসায়িক চাকার আরেকটি পেরেকে পরিণত হয়েছে। কিন্তু তার অভিমত ছিল ভিন্ন। বার্নেস তার নিজের মনে, সময়ের প্রতিটি মুহূর্তেই সে এডিসনের সহযোগী ছিল, একদম সেই প্রথম দিন থেকেই।

একটি নির্দিষ্ট আকাক্সক্ষার প্রচ- ক্ষমতা সম্বন্ধে এটা একটি অবিস্মরণীয় উদাহরণ। বার্নেস তার লক্ষ্য জয় করেছিল কারণ সে এডিসনের ব্যবসা সহযোগী হওয়াটা অন্য সবকিছুর চেয়েই বেশি চেয়েছে। সে তার উদ্দেশ্য পূরণের জন্য একটি পরিকল্পনা তৈরি করেছিল। কিন্তু তারচেয়েও বড় কথা সে তার পিছনের সব সেতু পুড়িয়ে ফেলেছে।

সে তার আকাক্সক্ষাকে নিয়ে ততক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল যতক্ষণ পর্যন্ত না এটা তার জীবনের তীব্র আবেশে পরিণত হয় এবং অবশেষে হয়েছেও তাই।

যখন সে অরেঞ্জে এসেছিল তখন সে নিজেকে বলেনি, ‘আমি এডিসনের সাথে দেখা করার চেষ্টা করব যাতে সে আমাকে কোনরকম একটা চাকরি দেয়।’ সে বলেছিল, ‘আমি এডিসনের সাথে দেখা করবই এবং তাকে এটা খেয়াল করাব যে আমি তার সাথে ব্যবসা করার জন্য এসেছি।’

সে এটা বলেনি যে, ‘আমি সেখানে কয়েক মাসের জন্য কাজ করব এবং যদি কোন উৎসাহ না পাই তবে কাজ ছেড়ে দিব এবং অন্য কোথাও চাকরি খুঁজে নেব।’ সে বলেছিল, ‘আমি যেকোন জায়গা থেকে শুরু করব। এডিসন আমাকে যা করতে বলবে আমি তাই করব, কিন্তু সবকিছুর মধ্য দিয়ে হলেও, আমি তার সহযোগী হবোই।’

সে এটা বলেনি যে, ‘আমি আরেকটি সুযোগের জন্য চোখ খোলা রাখব, যদি আমি এডিসনের সংগঠনের থেকে যা চাই তা পেতে ব্যর্থ হই।’ সে বলেছে, ‘সেখানে আর কিছুই নেই শুধু একটি জিনিস ছাড়া যা আমি এই পৃথিবীর মধ্যে নির্দিষ্টভাবেই চাই এবং তা হচ্ছে টমাস আলভা এডিসনের ব্যবসা সহযোগী হওয়া। আমি আমার পিছনের সব সেতু জ্বালিয়ে দিব এবং আমার যোগ্যতায় যা আমি চাই তাই পেতে আমার সম্পূর্ণ ভবিষ্যৎ বাজি রাখব।’

সে ফিরে যাওয়ার মতো সম্ভাব্য কোন পথই রাখল না। সে হয় জিতবে; না-হয় জীবন হারাবে!

এ সবই হচ্ছে বার্নেসের সাফল্যের কাহিনী! অনেক আগের কথা, এক মহান যোদ্ধা একবার একটি জরুরি অবস্থার মধ্যে পড়েছিল, সে কীভাবে যুদ্ধক্ষেত্রে তার জয় নিশ্চিত করবে। তাদের শক্তিশালী শত্রুদের সাথে যুদ্ধ করতে সে একদল সেনাবাহিনী নিল। কিন্তু তার শত্রুদের সেনা সংখ্যা তার নিজ বাহিনীর সেনা সংখ্যার চেয়েও অনেক বেশি। সে তার সেনাদের সমরাস্ত্রে সাজিয়ে তৈরি করল এবং জাহাজে করে শত্রুদেশে রওনা হল।  সৈন্য ও যুদ্ধাস্ত্র নামিয়ে সে আদেশ দিল যে জাহাজগুলো তাদের নিয়ে এসেছে সেগুলোকে জ্বালিয়ে দিতে। যুদ্ধের আগে সে সেই জ্বলন্ত জাহাজগুলো দেখিয়ে তার সৈন্যদের বলল, “তোমরা দেখতে পাচ্ছে যে জাহাজগুলো পুড়ে যাচ্ছে। তারমানে আমরা এই সৈকত জীবন্ত ত্যাগ করতে পারব না যতক্ষণ পর্যন্ত না আমরা জয়ী হই। এখন আমাদের কাছে কোন পথ খোলা নেই, হয় আমরা জিতব; না-হয় জীবন হারাব! তারাই জিতেছিল।

প্রত্যেক ব্যক্তি যে তার ইচ্ছানুযায়ী জয়ী হতে যেকোনো উপায় অবলম্বন করতে চায় তাদের অবশ্যই পেছনের সব জাহাজ জ্বালিয়ে দিতে হবে এবং কেটে ফেলতে হবে ফিরে যাওয়ার সব পথ। একমাত্র এভাবেই একজন মানুষ তার প্রয়োজনীয় স্থির মানসিক অবস্থা নিশ্চিত করতে পারে যাকে বলে জয়ের জন্য জ্বলন্ত আকাক্সক্ষা। যা সাফল্যের জন্য অত্যাবশ্যক।

শিকাগোর অনেক বড় অগ্নিকা-ের পর সেই সকালে তাদের এক ব্যবসায়ী দল রাস্তায় দাঁড়িয়ে তাদের কোষাগারে রাখা সঞ্চিত সম্পদ আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যেতে দেখছিল। তারা এক বৈঠকে বসল এটা নির্ধারণ করার জন্য যে তারা কি একে পুনরায় তৈরি করবে নাকি দেশের অন্য কোথাও সম্ভাবনাময় স্থানে নতুন করে ব্যবসা শুরু করবে। তারা সকলে সিদ্ধান্ত নিল যে তারা শিকাগো ছেড়ে চলে যাবে শুধু একজন ছাড়া। সেই ব্যবসায়ী যে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সে তার অবশিষ্ট পুড়ে যাওয়া দোকানের সেই জায়গার দিকে আঙুল দিয়ে বলল, ‘ভদ্রমহোদয়গণ, একদম ঠিক এই জায়গাতেই আমি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় দোকান নির্মাণ করব, কোন ব্যাপারই না যতবার এটা পুড়ে যাক না কেন।’

এটা প্রায় ৫০ বছর আগের ঘটনা। সেই দোকান নির্মিত হয়েছিল। এটা আজ দাঁড়িয়ে আছে, স্থির মানসিক অবস্থার সেই শক্তির সুউচ্চ স্তম্ভরূপে যাকে বলা হয় একটি জ্বলন্ত আকাক্সক্ষা। মার্শাল ফিল্ডের জন্য সহজ কাজটি ছিল যা তার সহযোগী ব্যবসায়ীরা করেছিল। যখন সামনে যাওয়াটা কঠিন হয়ে পড়ে এবং ভবিষ্যৎ মনে হয় কষ্টকর তখন তারা ছেড়ে দিয়েছে এবং সেখানে গিয়েছে যেখানে যাওয়া তাদের সহজ মনে হয়েছে।

মার্শাল ফিল্ড এবং অন্য ব্যবসায়ীদের মধ্যকার এই পার্থক্যে ভালো করে দাগ দিন, কারণ ঠিক এই পার্থক্য এডউইন সি. বার্নেসকে সেসব হাজারো যুবকদের থেকে আলাদা করেছে যারা এডিসনের সংগঠনে কাজ করত, ঠিক এই পার্থক্য ডার্বি ও হেনরি ফোর্ডকে অন্য হাজারো মানুষ থেকে আলাদা করেছে। এই সেই পার্থক্য যা জগতে সকল সফল মানুষকে ব্যর্থদের কাছ থেকে আলাদা করে।

প্রত্যেক মানুষই যে বয়সে অর্থের মূল্য বুঝতে সক্ষম হয়, তখন থেকে সে এটা আশা করে। আশা করাই একজন মানুষকে ধনী করে তোলে না। কিন্তু ধনী হওয়ার আকাক্সক্ষা যা স্থির মানসিক অবস্থার মাধ্যমে বাতিক হয়ে ওঠে, তারপর নির্দিষ্ট পথে পরিকল্পনা করে, যার মানে হয় ধনী হওয়া অর্জন করা এবং অধ্যবসায়ের সাথে এই পরিকল্পনায় এগিয়ে যায়, যা কোন ব্যর্থতাকেই চোখে দেখে না। এভাবেই মানুষ ধনী হয়।

যে পদ্ধতিতে ধনী হওয়ার আকাক্সক্ষা বাস্তবে আর্থিক অবস্থায় রূপান্তরিত হয় তা গঠিত হয় ছয়টি নির্দিষ্ট ধাপে। এই ধাপগুলো জীবনে প্রয়োগযোগ্য। যথা:

প্রথমত: আপনার মনে আপনার আকাক্সক্ষা অনুযায়ী নির্দিষ্ট সংখ্যক অর্থের পরিমাণ ঠিক করুন। এটা বলা যথেষ্ট নয় যে ‘আমি অনেক অর্থের মালিক হতে চাই।’ অর্থের পরিমাণ মানে টাকার অংকের ব্যাপারে নির্দিষ্ট হোন। (নির্দিষ্ট হওয়ার ক্ষেত্রে একটি মানসিক কারণ রয়েছে যা পরবর্তী অধ্যায়ে বর্ণনা দেওয়া হবে।)

দ্বিতীয়ত: যে পরিমাণ অর্থ আপনি চান তার পরিবর্তে আপনি কী দিতে পারেন তা নিশ্চিত করুন। (এই জগতে বিনামূল্যে কিছু পাওয়া যায় না।)

তৃতীয়ত: একটি নির্দিষ্ট তারিখ ঠিক করুন যেদিন আপনি আপনার আকাক্সক্ষা অনুযায়ী অর্থের অধিকারী হবেন।

চতুর্থত: আপনার আকাক্সক্ষা পূরণের জন্য একটি নির্দিষ্ট পরিকল্পনা তৈরি করুন এবং আপনি তৈরি থাকুন বা না থাকুন, এখনই আরম্ভ করুন। পরিকল্পনা অনুযায়ী এই মুহূর্ত থেকেই কাজ আরম্ভ করুন।

পঞ্চমত: আপনি যেই পরিমাণ টাকাপয়সা অর্জন করতে চান তা সংক্ষেপে লিখুন। এই অর্জনের জন্য আপনার নির্ধারিত সময়সীমা দিন। টাকাপয়সার পরিবর্তে আপনি কী দিতে চান লিখুন এবং যে পরিকল্পনায় আপনার আকাক্সক্ষা অনুযায়ী অর্থ জমা করতে চান তা পরিষ্কার করে বর্ণনা করুন।

ষষ্ঠত: আপনার লিখিত বিবৃতিকে উচ্চস্বরে পাঠ করুন, প্রতিদিন দুইবার করেÑএকবার রাতে ঘুমাবার আগে এবং আরেকবার সকালে উঠে। যখন আপনি পড়বেন, অনুভব এবং বিশ্বাস করবেন, দেখবেন আপনি ইতোমধ্যে সেই অর্থের অধিকারী হয়েছেন।

বর্ণিত এই ছয়টি ধাপ অনুসরণ করাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে ছয় নম্বর অংশটি গভীর আবেগের সাথে অনুশীলন করা খুব গুরুত্বপূর্ণ। আপনি হয়তো অভিযোগ করতে পারেন ‘ইতোমধ্যে সেই অর্থের অধিকারী হওয়া’কে, যা প্রকৃতপক্ষে এখনও পাননি। এখানেই আপনাকে সহায়তা করবে আপনার জ্বলন্ত আকাক্সক্ষা। যদি সত্যই আপনি অর্থকে এরূপভাবে চান যে আপনার আকাক্সক্ষা বাতিকে পরিণত হয়েছে, তাহলে নিজেকে এটা মানাতে কোন শক্ত কাজ হবে না যে সেই পরিমাণ অর্থ আপনি অর্জন করতে পারবেন। বিষয়টা হচ্ছে অর্থকে চাওয়া এবং এতটাই নিশ্চিত হয়ে নিজেকে মানানো যে তা আমি অবশ্যই পাব।

একমাত্র তারা যারা ‘অর্থ সচেতন’, তারাই অনেক ধনী হয়। ‘অর্থ সচেতনতা’ মানে আকাক্সিক্ষত অর্থ অর্জনে পুরোপুরি একাগ্র হওয়া যে সে ইতোমধ্যে সেই অর্থের অধিকারী রূপে নিজেকে দেখছে।

যারা মানব মনের কাজ করার সূত্র সম্বন্ধে জানে না তারা অশিক্ষিত। তাদের কাছে উপরোক্ত নির্দেশনা অবাস্তব বলে মনে হতে পারে। যারা এই ছয়টি ধাপের সামর্থ্যতা বুঝতে ব্যর্থ হবে তাদের জন্য এটা সহায়ক হবে। আপনাকে জানানোর জন্য বলছি, যে তথ্য আপনাদের দেওয়া হয়েছে তা সংগ্রহ করা হয়েছে এন্ড্রু কার্নেগি থেকে। যিনি শুরুতে লোহার কারখানার একজন সাধারণ শ্রমিক ছিলেন, কিন্তু তার দুর্দশাগ্রস্থ অবস্থা দিয়ে শুরু করা সত্ত্বেও তিনি এই সূত্র কাজে লাগান এবং এগুলো দিয়ে তিনি এক বিশাল সৌভাগ্য প্রায় ছয় হাজার কোটি টাকার মালিক হন।

এটা জানা আপনার জন্য আরও সহায়ক হবে যে এই ছয়টি ধাপ টমাস আলভা এডিসনও খুব মনোযোগের সাথে পরীক্ষা করেছেন। যিনি তার প্রতিপত্তি ও ক্ষমতা শুধু টাকা অর্জনেই দেখাননি; বরং এই ছয় ধাপ ব্যবহার করে যেকোন নির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জন করা যায় এটা তিনি তার কর্মজীবন দ্বারাই প্রমাণ করেছেন।

এই ধাপগুলোর জন্য কোন ‘কঠিন শ্রম’ লাগে না। এগুলোর জন্য কিছু উৎসর্গও করতে হবে না। এগুলো পালন করলে আপনি উপহাসের পাত্রও হবেন না বা সবকিছু সহজেই বিশ্বাস করবেন তাও নয়। এমনকি ধাপগুলো প্রয়োগ করতে আপনাকে অনেক বেশি শিক্ষিতও হতে হবে না। কিন্তু সফলভাবে এই ছয় ধাপ পালন করতে আপনাকে ‘কল্পনার’ সহায়তা নিতে হবে যাতে আপনি দেখতে পান এবং বুঝতে পারেন যে অনেক অর্থের মালিক হওয়াটা সুযোগ, সৌভাগ্য বা কপালের ওপর ছেড়ে দেওয়া যায় না। আপনাকে অবশ্যই অনুধাবন করতে হবে যে যারা বিশাল আকারের সৌভাগ্য গড়েছে তারা সেই অর্থের অধিকারী হওয়ার আগে নিশ্চিতভাবে কিছু স্বপ্ন দেখেছে, আশা করেছে, চেয়েছে, আকাক্সক্ষা করেছে এবং পরিকল্পনা করেছে। সুতরাং আকাক্সিক্ষত অর্থের অধিকারী হতে হলে এই কাজই আপনাকে আগে করতে হবে।

আপনি ভালোভাবেই জানেন, ঠিক এই মুহূর্তে, আপনি ধনীদের মতো বিশাল পরিমাণ অর্থ কখনই পাবেন না যতক্ষণ পর্যন্ত না আপনি আপনার নিজের মধ্যে অর্থ পাওয়ার সেই আকাক্সক্ষাকে জাগিয়ে তুলছেন এবং বিশ্বাস করছেন যে আপনি তা পাবেনই।

আপনি যদি বিশাল পরিমাণ অর্থের দেখা আপনার কল্পনায় না পান তবে আপনি সেই পরিমাণ অর্থ কখনই আপনার ব্যাংক-ব্যালেন্সে দেখবেন না।

এখন আমরা যারা ধনী হওয়ার প্রতিযোগিতায় রয়েছি, আপনারা জেনে অনুপ্রাণিত হবেন যে এই পরিবর্তিত পৃথিবী যেখানে আমরা বাস করছি তা চায় নতুন ধারণা, কাজের জন্য নতুন পথ, নতুন নেতা, নতুন উদ্ভাবক, নতুনভাবে শেখার পদ্ধতি, নতুন বাজারজাতকরণ পদ্ধতি, নতুন বই, নতুন সাহিত্য, রেডিও এর জন্য নতুন বৈশিষ্ট্য, টেলিভিশন মাধ্যমের জন্য নতুন আইডিয়া। এই সবকিছু নতুন এবং যেকোন জিনিসকে আরও ভালোভাবে করার জন্য। এসব জয় করার জন্য একজন ব্যক্তিকে একটি গুণের অধিকারী হতেই হবে এবং তা হচ্ছে উদ্দেশ্যের নির্দিষ্টতা। এই নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যের অধিকারী হওয়ার জন্য একজনের দরকার একটি জ্বলন্ত আকাক্সক্ষার অধিকারী হওয়া।

আমাদের ব্যবসায় বাজার ধ্বস প্রমাণ করে যে একটি যুগের শেষ হয়েছে এবং আরেকটি জন্ম নেবে। এই পরিবর্তিত পৃথিবী চায় কেবল সেই সব স্বপ্নদ্রষ্টাদের যারা তাদের স্বপ্নকে সত্যিকার কাজে রূপান্তর করতে পারবে এবং করবেই। সভ্যতার পথপ্রদর্শক রূপে স্বপ্নদ্রষ্টারাই সবসময় ছিল এবং থাকবে।

আমরা যারা ধনী হতে আকাক্সক্ষা পোষণ করি, আমাদের মনে রাখা উচিত যে এই পৃথিবীর আসল নেতারা যার নিজেদের লৌহবর্মে তৈরি করেছে এবং সেই অনুভবনীয় ও অদেখা শক্তিকে তাদের জীবনে প্রয়োগ করেছে। এই শক্তিকে (বা চিন্তার সেই তরঙ্গশক্তিকে) রূপান্তর করেছে আকাশচুম্বী শহরগুলোতে, কারখানা, বিমান, গাড়ি ও সম্ভাব্য প্রতিটি আকারে যাতে জীবন আরও উপভোগ্য হয়।

আজকের স্বপ্নদ্রষ্টাদের ধৈর্য ও আগ্রহী মন এই দুইটি জাগতিক গুণ দরকার। যারা নতুন আইডিয়া সম্বন্ধে ভয় পায় তারা শুরু করার আগেই অন্ধকারে হারিয়ে যাবে। অগ্রদূতদের জন্য আর কখনো সময় এতটা অনুকূলে ছিল না যেমন আজ রয়েছে। সত্যিই তো, আজকে সেই বন-জঙ্গলে ভরা ভূমি জয় করতে হবে না যা মালটানা গাড়ির দিনগুলোতে করতে হত। কিন্তু এখানে প্রচুর পরিমাণে ব্যবসা, বিনিয়োগ ও কল-কারখানার দুনিয়া রয়েছে যাকে পুনর্গঠন করতে হবে এবং নতুন পথে নিদের্শিত করতে হবেÑআরও ভালো উপায়ে।

আপনার অংশের ধনসম্পদ অর্জনে আপনি যে পরিকল্পনা করবেন তাতে আপনার স্বপ্নকে উপহাস করার মতো কাউকেই সঙ্গে নিবেন না। বড় বাধা জিততে হলে এই পরিবর্তিত দুনিয়ায় আপনাকে অবশ্যই অতীতের অগ্রদূতদের কাছ থেকে সাহস নিতে হবে। যাদের স্বপ্ন সভ্যতাকে সব দিয়েছিল যার সে যোগ্য। এই সাহসই আমাদের নিজেদের দেশের জীবনে রক্তের মতো বয়ে চলেছে। আপনার ও আমার সুযোগ রয়েছে আমাদের প্রতিভাকে উন্নত করার এবং বাজারজাত করার।

আমাদের ভুলে যাওয়া উচিত নয়, কলম্বাস এক অজানা বিশ্বের স্বপ্ন দেখেছিলেন, তিনি তার জীবন বাজি রেখেছিলেন এই রকম একটি বিশ্বের জন্য এবং তিনি তা আবিষ্কার করেন!

[ফজলে রাব্বির কথা–আমাদের ভুলে যাওয়া উচিত নয়, ত্রিশ লাখ শহীদ তাদের জীবন অকাতরে দান করেছেন আজকের বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের মানুষের জন্য এবং তারা এই দেশকে স্বাধীন করেই দেখিয়েছেন।]

এটা আবারও প্রমাণ করে যে ‘সাফল্য কোন ক্ষমা চায় না, ব্যর্থতা কোন অজুহাত মানে না।’

যদি আপনি যা চান তা ঠিক হয় এবং আপনি এতে বিশ্বাস করেন, তাহলে এগিয়ে যান এবং কাজটি করুন! আপনার স্বপ্নকে নির্দিষ্ট করুন, প্রতিনিয়ত দেখুন এবং যদি আপনি সাময়িক বাধার সম্মুখীন হন তাহলে ‘লোকজনের’ কথায় কিছু মনে করবেন না। ‘তাদের’ জন্য যারা হয়তো জানে না যে প্রতিটি ব্যর্থতাই ঠিক তার সমান সাফল্যের একটি বীজ নিয়ে আনে।

হেনরি ফোর্ড, গরিব ও অশিক্ষিত, ঘোড়া ছাড়া একটি গাড়ির স্বপ্ন দেখেছিলেন, তার কাছে যেসব যন্ত্র ছিল তাই নিয়ে কাজে নেমে পড়লেন, কখন সুযোগ আসবে এই অপেক্ষা ছাড়াই এবং এখন সারা পৃথিবীকে বেঁধে ফেলেছেন যা তার স্বপ্নের সাক্ষ্য দেয়। আজ পর্যন্ত পৃথিবীতে যত লোক এসেছে তাদের মধ্যে তিনিই সবচেয়ে বেশি চাকাকে কাজে পরিণত করেছেন, কারণ তিনি তার স্বপ্ন পূরণ করতে ভয় পেতেন না।

টমাস আলভা এডিসন একটি বাতির স্বপ্ন দেখতেন যা বিদ্যুতে চলবে। শুরুতে যখন তিনি তার স্বপ্নকে বাস্তবে রূপান্তরের জন্য কাজ করছিলেন তিনি দশ হাজার ব্যর্থতার পরও সেই স্বপ্নের সাথে দাঁড়িয়ে ছিলেন যতক্ষণ পর্যন্ত না এটা বাস্তব সত্যে পরিণত হয়। স্বপ্নদ্রষ্টারা কখনো হাল ছাড়ে না! তাদের নির্দিষ্ট লক্ষ্যকে কখনো ছেড়ে দেয় না। যেকোন কাজ অপূর্ণ রূপে ত্যাগ করে না।

লিংকন স্বপ্ন দেখেছিলেন কালো ক্রীতদাসদের মুক্তি। তিনি তার স্বপ্নকে কাজে রূপান্তরিত করলেন এবং খুবই কষ্টে বসবাসকারী সেই মানুষগুলো দেখল কীভাবে উত্তর ও দক্ষিণ উভয় দিকেই তার স্বপ্ন বাস্তবে রূপান্তরিত হলো।

রাইট ভ্রাতৃদ্বয় স্বপ্ন দেখেছিলেন একটি যন্ত্র যা বাতাসে উড়বে। আজ যেকেউ নিশ্চয়ই এর সাক্ষ্য সারা পৃথিবী জুড়ে দেখতে পাচ্ছে।

মার্কনি স্বপ্ন দেখেছিলেন একটি ব্যবস্থার যা ইথারের অনুভবনীয় শক্তিকে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে স্থানান্তর করবে। যা আমরা আজ পৃথিবীর প্রতিটি ওয়্যারলেস, মোবাইল ও রেডিওতে পাই। এর চেয়েও বেশি মার্কনি প্রতিটি ঘরকে একত্র করেছে, রাজ্যের প্রতিটি বাড়িকে কাছাকাছি এনেছে। এটা দেশের রাষ্ট্রপতিকে একটি মাধ্যম দিয়েছে যাতে তিনি দেশের সকল মানুষের সাথে একই সময়ে ও স্বল্প সময়ের মধ্যে কথা বলতে পারেন। আপনি জেনে আগ্রহী হবেন যে মার্কনির ‘বন্ধুরা’ তাকে চিকিৎসার জন্য মানসিক হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল যখন তিনি ঘোষণা করলেন যে তিনি একটি সূত্র আবিষ্কার করেছেন যা দিয়ে তিনি বাতাসের মাধ্যমে বার্তা পাঠাতে পারেন, যেকোন তারের সাহায্য ব্যতীত বা অন্য কোন বাহ্যিকভাবে ব্যবহারের মাধ্যম ব্যতীত। আজকের স্বপ্নদ্রষ্টাদের তো আরও ভালো ঘটবে।

পৃথিবী এখন নতুন আবিষ্কারের প্রতি অভ্যস্ত হয়ে গেছে। কারণ স্বপ্নদ্রষ্টারা, যারা এই পৃথিবীকে নতুন ধারণা দেয় তারা কোন পুরস্কারের আশা করে না।

‘সবচেয়ে বড় সাফল্য হচ্ছে, প্রথমত ও একটা সময়ের জন্য, আর কিছুই না শুধু একটা স্বপ্ন।’

‘একটি বীজের মাঝেই বিশাল এক বটগাছ ঘুমিয়ে থাকে। একটি ডিমের ভেতর অপেক্ষা করে পাখি এবং আমাদের আত্মার সবচেয়ে বড় দর্শনই একদিন জগতে বেরিয়ে আসবে। স্বপ্নই হচ্ছে বাস্তবতার বীজ।’

জাগুন, উঠুন ও নিজেকে নিশ্চিত করে বলুন যে আপনিও এই পৃথিবীর একজন স্বপ্নদ্রষ্টা। আপনার স্বপ্নই হচ্ছে আপনার ক্ষমতার সবচেয়ে উজ্জ্বল তারকা। বিশ্বের ব্যবসায়িক মন্দাই আপনাকে সেই সুযোগ এনে দিয়েছে যার আপনি অপেক্ষা করছিলেন। এটা মানুষকে ন¤্রতা, ধৈর্য এবং আগ্রহীমনা হতে শেখায়।

পৃথিবী আজ প্রচুর সুযোগে পরিপূর্ণ যা পূর্বের স্বপ্নদ্রষ্টারা কখনো জানতেনও না।

একজন স্বপ্নদ্রষ্টার আরম্ভ বিন্দু হতে হবে একটি জ্বলন্ত আকাক্সক্ষা দিয়ে এবং যা কাজে পরিণত করতেই হবে। স্বপ্নদ্রষ্টারা অসাধারণ নয়। তারা আলসেমী বা উচ্চাকাক্সক্ষার অভাব নিয়ে জন্মায় না।

আপনি হয়তো হতাশ হয়েছেন, বিপর্যয়ের কারণে আপনি ব্যর্থ হয়েছেন, আপনি অনুভব করছেন আপনার সরলমনা হৃদয় ভেঙে চুরমার হয়ে রক্তাক্ত হয়েছে। সাহস নিন, এই সকল মহান অভিজ্ঞতা থেকে যাদের আত্মা ছিল লোহার মতো এবং তাতে তারা এমন সব সম্পদ তৈরি করেছে যা অর্থ মূল্যের সাথে তুলনা করা যায় না।

এটাও মনে রাখবেন যে যারা সফল হয়েছে তারা বিছানা থেকে শুরু করে অনেক মন ভেঙে দেওয়া সংগ্রামের পরেই  ‘পৌঁছেছেন’, সফল হয়েছেন। যারা সফল হয়েছেন তাদের বিশেষ মোড় আসে সাধারণত কিছু সমস্যার সম্মুখীন হওয়ার পর যার মাধ্যমে তারা তাদের ‘অন্যান্য গুণকে’ চিনতে পারে।

হেনরি তার মনে ঘুমিয়ে থাকা প্রতিভাবানকে আবিষ্কার করেন, যখন তিনি অনেক বড় দুর্ভাগ্যের মুখোমুখী হন এবং ওহির কলম্বাস সংশোধনাগারে নিক্ষিপ্ত হন। দুর্ভাগ্য আকারে এবং জেলখানার বল প্রয়োগে, তিনি হয়ে ওঠেন ‘অন্য আমি’ এবং তার কল্পনা ব্যবহার করে তিনি নিজেকে মহান লেখক রূপে আবিষ্কার করেন অথচ তিনি ছিলেন একজন আইন অমান্যকারী ও অপরাধী। জীবনের পথ বড় অদ্ভুত ও নানান দিকে গিয়েছে; আর অসীম বুদ্ধিমত্তার পথগুলো এতটাই অদ্ভুত যার জন্য মানুষকে মাঝে মাঝে সব ধরনের শাস্তির মধ্য দিয়ে যেতে হয় তার আপন মনকে আবিষ্কারের আগে এবং কল্পনার মাধ্যমে নিজের প্রয়োজনীয় আইডিয়া তৈরি করার ক্ষমতা পাওয়ার আগে।

এডিসন, পৃথিবীর সবচেয়ে মহান উদ্ভাবক ও বিজ্ঞানী। তিনি ছিলেন ‘সাধারণ’ টেলিগ্রাফ চালনাকারী। আজকের জায়গায় আসতে তিনি অসংখ্যবার ব্যর্থ হয়েছেন। অবশেষে তিনি আবিষ্কার করলেন নিজের মস্তিষ্কে ঘুমিয়ে থাকা প্রতিভাবানকে।

চার্লস ডিকেন্স শুরু করেন কালো পাত্রে লেবেল লাগানোর কর্মী রূপে। তার প্রথম প্রেমের হৃদয় বিদারক ঘটনা তার আত্মার গভীরে নাড়া দেয় এবং তাকে রূপান্তরিত করে পৃথিবীর অন্যতম মহান লেখকে। সেই হৃদয় বিদারক ঘটনার উৎপাদ রূপে, প্রথম প্রকাশ, ডেভিড কপারফিল্ড, তারপর আরও সফল কিছু কাজ যা এই পৃথিবীকে সম্পদশালী করেছে এবং যারা এসব বই পড়ছে তাদের জন্য পৃথিবীকে আরও ইতিবাচক করে তুলেছে। ভালোবাসার হতাশামূলক ঘটনায় সাধারণত পুরুষরা মদ্যপানে ঝুঁকে পড়ে এবং নারীরা দুর্বিষহ জীবনযাপন করে এবং এটা এই কারণে হয় যে বেশির ভাগ লোকজন কখনো শেখেনি কোন কৌশলে তাদের সবচেয়ে শক্তিশালী আবেগকে গঠনমূলক উপায়ে মানে স্বপ্নে রূপান্তর করতে হয়।

হেলেন কিলার তার জন্মের কিছু সময় পরই বধির, বোবা ও অন্ধ হয়ে যান। তার এত বড় দুর্ভাগ্য সত্ত্বেও, তিনি তার নাম ইতিহাসের পাতায় মহান মানুষের পাশে অমোচনীয়ভাবে লিখে গেছেন। তার সম্পূর্ণ জীবন এ সাক্ষ্যই দেয় যে, কেউই কখনো ব্যর্থ হয় না যতক্ষণ পর্যন্ত না ব্যর্থতাকে বাস্তবে স্বীকার করে নেয়।

রর্বাট বার্নস ছিলেন একজন অশিক্ষিত গ্রাম্য বালক, তিনি দরিদ্রতার দরুন পিশে গিয়েছিলেন এবং একজন ঝগড়াকারী মাতাল রূপে বড় হয়ে উঠেছেন। তার এই রকম জীবনযাপনের দ্বারা পৃথিবী আজ আরও ভালো হয়ে উঠেছে, কারণ তিনি সাহিত্যে অত্যন্ত সুন্দর চিন্তাগুলোকে সেলাই করেছেন এবং সেখানে কাঁটা দিয়ে একটি গোলাপ তার জায়গা মতো স্থাপন করেছেন।

বোকার টি. ওয়াশিংটন জন্ম নিয়েছিলেন দাস রূপে, জাত ও রঙের প্রতিবন্ধকতা নিয়ে। তিনি ছিলেন সহ্যশীল, সবসময় একজন আগ্রহীমনা, সব বিষয়ে মনোযোগী এবং একজন স্বপ্নদ্রষ্টা, তাই তো তিনি সমগ্র জাতির ওপর চমৎকার ছাপ রেখে গেছেন।

বেথওবেন ছিলেন বধির, মিল্টন ছিলেন অন্ধ কিন্তু তাদের নাম রয়ে যাবে যতদিন সময় বয়ে চলবে। কারণ তারা স্বপ্ন দেখেছিলেন এবং তাদের স্বপ্নকে রূপান্তরিত করেছিলেন পরিকল্পিত চিন্তায়।

পরবর্তী অধ্যায়ে যাওয়ার আগে, আপনার মনে একটি নতুন আশার আলো জ্বলে উঠেছে। বিশ্বাস, সাহস ও ধৈর্যশীলতা সৃষ্টি হয়েছে। যদি আপনার মনে এগুলো সৃষ্টি হয়ে থাকে এবং যে সূত্র বর্ণনা করা হয়েছে সেই মতো কাজ করার জন্য মনোভাব তৈরি হয় তাহলে আর বাকি যা আপনার প্রয়োজন তার সবই আপনার কাছে আসবে যখন আপনি এসবের জন্য প্রস্তুত হবেন।

একটা কিছু চাওয়া এবং তা গ্রহণের জন্য প্রস্তুত হওয়ার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। কেউই একটা কিছুর জন্য প্রস্তুত হতে পারে না যতক্ষণ না সে বিশ্বাস করে যে সে তা অর্জন করতে পারবে। মনের স্থিরতা থাকতে হবে অবশ্যই বিশ্বাসের ওপর; নাকি অনির্দিষ্ট কোন চাওয়ার ওপর। বিশ্বাসের জন্য প্রয়োজন আগ্রহী মন। বদ্ধ মন আপনাকে আস্থাশীল, সাহসী ও বিশ্বাসী হতে উৎসাহিত করবে না।

মনে রাখবেন, জীবনে উচ্চ লক্ষ্য গ্রহণ করতে, প্রাচুর্য ও উন্নতি চাইতে কোন শ্রম লাগে না; বরং দুর্দশা ও দরিদ্রতাকে মেনে নিলে তা বেশি প্রয়োজন হয়।

মানুষের ইচ্ছার কাছে প্রকৃতির হার

এই অধ্যায়ের একটি যথার্থ চরমসীমা রূপে, আমি চাই, আমি যতদূর পর্যন্ত জানি সর্বাধিক অসাধারণ ব্যক্তিদের একজনকে পরিচয় করিয়ে দিতে। আমি তাকে প্রথম দেখতে পাই চব্বিশ বছর পূর্বে, তার জন্মের কয়েক মিনিট পরে। সে এই পৃথিবীতে আসে কানের কোন চিহ্ন ব্যতীত এবং চিকিৎসক স্বীকার করে, যখন একটি অভিমতের জন্য চাপ দেওয়া হয় যে, শিশুটি হয়তো বধির হতে পারে এবং সারা জীবনের জন্য বোবাও হতে পারে।

আমি চিকিৎসকের অভিমতে আপত্তি জানালাম। আমার তা করার অধিকার ছিল। কারণ আমি শিশুটির পিতা। আমিও, একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছালাম এবং একটি অভিমত পেশ করলাম। কিন্তু আমি অভিমতটি নিশ্চুপভাবে প্রকাশ করলাম, আমার হৃদয়ের গভীরে। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম যে আমার সন্তান শুনবে এবং বলবে। প্রকৃতি আমাকে কান ছাড়া একটি শিশু দিতে পারে, কিন্তু এই শারীরিক ত্রুটিকে স্বীকার করতে আমাকে প্রলুব্ধ করতে পারে না।

আমার নিজের মনের মধ্যে আমি জানতাম যে আমার সন্তান শুনবে এবং বলবে। কিন্তু কীভাবে? আমি নিশ্চিত ছিলাম যে কোন একটি পথ নিশ্চয়ই আছে এবং আমি জানি তা আমি খুঁজে বের করতে পারব। চিন্তা করলাম অমর এর্মাসনের কথা, ‘পরিস্থিতির পুরো কার্যক্রম আমাদের আস্থা শেখাতে যাচ্ছে। আমাদের কেবল মেনে চলতে হবে। সেখানে আমাদের প্রত্যেকের জন্য নির্দেশাবলি রয়েছে এবং মনোযোগ দিয়ে শোনার মাধ্যমে আমরা সঠিক শব্দ শুনতে পাব।’

সঠিক শব্দটি কী? তা হচ্ছে আকাক্সক্ষা! অন্য কোনকিছুর চেয়ে বেশি, আমি আকাক্সক্ষা করেছিলাম যে আমার সন্তান একজন বধির মূক হতে পারে না। সেই আকাক্সক্ষা যা থেকে আমি কখনো পিছনে সরে যাইনি, একটি মুহূর্তের জন্যও নয়।

বহু বছর আগে আমি লিখেছিলাম, ‘আমাদের সীমাবদ্ধতা হচ্ছে যা আমরা আমাদের নিজেদের মনে ধারণ করি।’ প্রথমবারের মতো, আমি বিস্মিত হলাম যদি সেই বক্তব্য সত্য হয়Ñআমার সামনে বিছানায় শুয়ে আছে একটি নতুন জন্ম নেওয়া শিশু, শ্রবণের জন্য প্রাকৃতিক সরঞ্জাম ব্যতীত। যদিও সে হয়তো শুনতে এবং বলতে পারে তবুও সে সারা জীবনের জন্য অবশ্যই বিকৃত হয়েই থাকবে। নিশ্চিতভাবে এটা একটা সীমাবদ্ধতা যা শিশুটাকে তার মনে ধারণ করতে দেওয়া যাবে না।

এই সম্বন্ধে আমি কী করতে পারি? যেমন করেই হোক, আমি একটি পথ খুঁজে পাব যাতে সেই শিশুর মনে আমার নিজের জ্বলন্ত আকাক্সক্ষা স্থানান্তর করে রোপণ করা যায়, যেকোনো পথ বা উপায় দিয়ে যা তার মস্তিষ্কে কানের সহায়তা ছাড়াই শব্দ বহন করবে।

যত শীঘ্র শিশুটি সহযোগিতা করার মতো বয়সের হলো, আমি তার মন সম্পূর্ণভাবে পূর্ণ করে দিতে চাইতাম শোনার প্রতি একটি জ্বলন্ত আকাক্সক্ষা দিয়ে। আর আশা করতাম প্রকৃতি হয়তো তার নিজস্ব কোন পদ্ধতি দ্বারা একে বাস্তবে পরিণত করবে।

এই সব চিন্তা আমার নিজের মনের মধ্যে রেখেছিলাম এবং আমি এটা সম্পর্কে কাউকে বলিনি। প্রতিদিন আমি পুনরায় নতুনভাবে প্রতিজ্ঞাটি দিয়ে নিজেকে তৈরি করতাম। একটি বধির মূক সন্তান রূপে মেনে না নেওয়ার জন্য নিজেকে স্ব-পরামর্শ দিয়ে যেতাম।

যখন তার আরও বয়স হলো এবং সে আশেপাশের জিনিসের প্রতি মনোযোগ দেওয়া শুরু করল, আমরা পর্যবেক্ষণ করলাম যে তার মধ্যে সামান্য শ্রবণ শক্তি রয়েছে। যখন সে বয়সটিতে পৌঁছালো যখন শিশুরা যথারীতি কথা বলতে শুরু করে, সে কথা বলার প্রতি কোন চেষ্টা করল না। কিন্তু আমরা তার কাজের দ্বারা বলতে পারতাম যে সে নিশ্চিতভাবে শব্দ সামান্যভাবে শুনতে পায়। এটাই আমার দরকার ছিল! আমি প্রমাণ পেয়ে বিশ্বস্ত হয়েছি যে যদি সে শুনতে পায়, যদিও সামান্যভাবে, সে হয়তো এখনও অধিকতর শোনার ধারণ ক্ষমতা গঠন করতে পারে। তারপর কিছু ঘটলো যা আমাকে আশা দিল। এটা একটা সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত জায়গা থেকে আসে।

আমরা একটি ভিকট্রোলা এনেছিলাম। যখন শিশুটি গান প্রথমবারের জন্য শোনে, সে উল্লাসিত হয়ে ওঠে এবং তাৎক্ষণাৎ যন্ত্রটি আত্মসাৎ করে। সে শীঘ্রই কিছু নির্দিষ্ট গান পছন্দ করে নেয়, তন্মোধ্যে একটি ছিলÑ‘এটা টিপারির দিকে এক দীর্ঘ পথ (ওঃ'ং ধ খড়হম ডধু ঃড় ঞরঢ়ঢ়বৎধৎু)।’ একদিন, সে গানটি বারবার বাজায়। প্রায় দুই ঘণ্টার মতো। ভিকট্রোলার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তার দাঁত দিয়ে চেপে ধরে রেখেছে খাপের এক কোণা। তার এই আত্মগঠিত অভ্যাসের তাৎপর্য আমাদের কাছে পরিষ্কার ছিল না যতক্ষণ পর্যন্ত না কয়েক বছর পরে, আমরা শুনতে পেলাম শব্দের ‘হাড় আচরণ’ (নড়হব পড়হফঁপঃরড়হ) সম্বন্ধে।

 

চিত্র: ভিকট্রোলা

ভিকট্রোলা আত্মসাৎ করার কিছু সময় পর, আমি আবিষ্কার করি যে যখন আমি আমার ঠোঁট তার শ্রবণ ইন্দ্রিয়ের হাড় স্পর্শ করে কথা বলি অথবা মস্তিষ্কের তলদেশ স্পর্শ করে কথা বলি তখন সে আমাকে পরিষ্কারভাবে শুনতে পায়। এই আবিষ্কার আমাকে জায়গা দিল আমার জ্বলন্ত আকাক্সক্ষা বাস্তবে রূপান্তরের জন্য, যাতে আমার সন্তানকে শ্রবণ এবং বাকশক্তিতে সহায়তা করতে পারি। সেই সময় থেকে সে কিছু নির্দিষ্ট শব্দ বলতে শুরু করল। দৃশ্যটি ছিল অনুপ্রেরণার চেয়েও বেশি কিছু। এ ছিল একটি জ¦লন্ত আকাক্সক্ষা যা আস্থা দ্বারা মোড়ানো। যা অসম্ভব বলে কোন শব্দকে চেনে না।

নিশ্চিত হওয়ার পর যে সে আমার কণ্ঠের শব্দ পরিষ্কারভাবে শুনতে পায়, আমি তার মনে শোনার এবং বলার আকাক্সক্ষা স্থানান্তর করার দিকে তাৎক্ষণিকভাবে কাজ শুরু করলাম। আমি শীঘ্রই আবিষ্কার করলাম যে শিশুটি ঘুমের আগে গল্প শুনতে পছন্দ করে। তাই আমি কাজ শুরু করলাম। এমন কিছু গল্প রচনা করলাম যা তার মধ্যে আত্মবিশ্বাস, কল্পনা, শোনার প্রতি এবং স্বাভাবিক হওয়ার প্রতি একটি গভীর আকাক্সক্ষা তৈরি করবে।

আমি সবসময় একটি গল্পই বলতাম। আমি জোর দিয়ে প্রতিরাতেই গল্প বলতাম। এটাতে কিছু নতুন এবং নাটকীয় রঙ মিশিয়ে দিতাম। এটা নকশা করা হয়েছিল তার মনে এই চিন্তা ঢুকানোর জন্য যে তার শারীরিক ত্রুটি কোন বোঝা নয়; বরং মহান এক মূল্যবান সম্পদ। এটা সত্ত্বেও ব্যাপারটি যা আমি অনুসন্ধান করেছি সব দর্শন শাস্ত্রে পরিষ্কারভাবে বলা আছে যে প্রতিটি প্রতিকূল ঘটনা এর সাথে একটি সমতুল্য সুবিধার বীজ নিয়ে আসে। আমি অবশ্য স্বীকার করি যে আমার সামান্যতম ধারণা ছিল না যে কীভাবে এই শারীরিক ত্রুটি কখনো একটি সম্পদে পরিণত হতে পারে। যেভাবেই হোক, আমি আমার গল্প বলার অভ্যাস চালু রাখলাম যাতে মোড়ানো ছিল ঐ দর্শন শাস্ত্রের শিক্ষা। তার ঘুমানোর আগে বলা গল্পের মধ্যে ছিল সেই চিন্তা। আশা করছিলাম এক সময় আসবে যখন সে হয়তো একটি পরিকল্পনা খুঁজে পাবে যার দ্বারা তার প্রতিবন্ধকতাকে কিছু সুবিধাজনক উদ্দেশ্যে তৈরি করবে।

আমার মস্তিষ্কের যুক্তি অংশ আমাকে বারবার বলছিল যে, কানের অভাব ও প্রাকৃতিক শ্রবণ উপাদানের প্রতিদানে সেখানে কোন পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই। আকাক্সক্ষা যা আস্থা দ্বারা মোড়ানো, মনের যুক্তিকে চাপ দিয়ে একপাশে সরিয়ে রেখেছিল এবং আমাকে এগিয়ে যাওয়ার প্রতি অনুপ্রেরণা দিচ্ছিল।

যখন আমি অতীতের দিকে তাকিয়ে অভিজ্ঞতা বিশ্লেষণ করি, আমি এখন দেখতে পারি যে, আমার ওপর আমার সন্তানের আস্থা ছিল যা অত্যন্ত বিস্ময়কর ফলাফলের জন্য অনেক কাজে দিয়েছে। আমি তাকে যা বলতাম সে তাই করত। কোন প্রশ্ন করত না। আমি তার কাছে এই আইডিয়া বিক্রি করলাম যে তার বড় ভাইয়ের চেয়ে তার একটা বিশেষ সুবিধা আছে এবং সেই সুবিধা বিভিন্ন পথে তাকে সাহায্য করবে। উদাহরণস্বরূপ, স্কুলের শিক্ষকরা যখন দেখবে যে তার কান নেই এবং এই কারণে তারা তার প্রতি বিশেষ মনোযোগ দেখাবে। আর তার সাথে স্নেহশীল আচরণ করবে। তারা সর্বদা তাই করত। তার মা দেখতো যে শিক্ষকরা তাকে বাসায় দেখতে আসে এবং তাদের সাথে বন্দোবস্ত করা হয়েছিল যাতে শিশুটিকে অতিরিক্ত মনোযোগ দেওয়া যায়। অধিকন্তু, আমি তার কাছে এ আইডিয়াও বিক্রয় করলাম যে যখন সে নিউজ পেপার বিক্রির জন্য বড় হবে, (তার বড় ভাই ইতোমধ্যে সংবাদপত্রের একজন পাকা ব্যবসায়ী), তার বড় ভাইয়ের চেয়ে তার একটি বাড়তি সুবিধা থাকবে, যে কারণে তার জিনিসের জন্য লোকজন তাকে বেশি টাকা দিবে। কারণ তারা দেখতে পাবে যে তার কান না থাকা সত্ত্বেও সে একজন উজ্জ্বল এবং পরিশ্রমী বালক।

আমরা দেখতে পাই যে, ক্রমানুযায়ী, শিশুর শ্রবণ শক্তি বৃদ্ধি পাচ্ছে। অধিকন্তু, তার শারীরিক ত্রুটির কারণে, তার সামান্যতম আত্ম-সচেতন হওয়ার সুযোগ ছিল না। যখন তার বয়স প্রায় সাত, সে প্রথম প্রমাণ দেখায় যে তার মনে পাঠানো আমাদের পদ্ধতি সুফল নিয়ে এসেছে। নিউজ পেপার বিক্রি অনুমতির জন্য সে কয়েক মাস আগে থেকেই অনুরোধ করছিল। কিন্তু তার মা তাকে সম্মতি দিচ্ছিল না। তার ভয় ছিল যে তার কানে না শোনার কারণে রাস্তায় একা একা চলাফেরা করা তার জন্য নিরাপদ নয়।

অবশেষে, সে ব্যাপারটা নিজের হাতে নিল। এক বিকালবেলা, যখন তাকে গৃহকর্মীর কাছে রেখে যাওয়া হলো। সে রান্নাঘরের জানালা বেয়ে উঠলো। মাটিতে লাফ দিল এবং সে নিজেই বেরিয়ে পড়ল। সে প্রতিবেশী মুচির কাছ থেকে ৬০ টাকা মূলধন রূপে ধার নিল। এটা নিউজ পেপারের মধ্যে বিনিয়োগ করল। বিক্রি শেষ করে পুনরায় বিনিয়োগ করল এবং পুনরাবৃত্তি করতে থাকে যতক্ষণ পর্যন্ত না সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে। হিসাব করার পর এবং ৬০ টাকা পরিশোধ করার পর, তার অবশিষ্ট মুনাফা ছিল ৪৩০ টাকা। যখন আমরা সেই রাতে ঘরে ফিরলাম, আমরা তাকে তার বিছানায় গভীর ঘুমরত অবস্থায় পেলাম। টাকাগুলো হাতে চেপে ধরেই সে ঘুমিয়ে যায়।

তার মা তার হাত খুলল। টাকা সরাল এবং কেঁদে দিল। সবকিছু দেখে খুব কাঁদল। তার সন্তানের প্রথম বিজয়ে সে খুবই আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ে। আমার প্রতিক্রিয়া ছিল ভিন্ন। আমি মন থেকে হেসেছিলাম। আমি জানতাম যে শিশুটির মনে তার নিজের প্রতি একটি বিশ্বাসের ভাব যা আমি রোপণ করার চেষ্টা করেছি তা সফলভাবে প্রকাশ পাবেই।

তার মা দেখল, তার ছেলের প্রথম সাহসী উদ্যোগ। একটি ছোট্ট বধির ছেলে যে রাস্তায় বেরিয়ে যায় এবং অর্থ আয়ের জন্য তার জীবন ঝুঁকিতে ফেলেছে। আমি দেখলাম একটি সাহসী, উচ্চাকাক্সক্ষী, আত্ম-নির্ভরশীল ছোট্ট ব্যবসায়ী পুরুষ, যার নিজের সংগ্রহকে সে ১০০% বৃদ্ধি করতে পেরেছে। কারণ সে ব্যবসায় গিয়েছে তার নিজ নেতৃত্বে এবং জয়ী হয়েছে। লেনদেনটা আমাকে সন্তুষ্ট করল। কারণ আমি জানতাম যে সে এমন একটি স্ব-উদ্যোগী বৈশিষ্ট্যের প্রমাণ দিবে যা তার সাথে সারাজীবন রয়ে যাবে। পরবর্তী ঘটনাও এটার প্রমাণ দেয়। যখন তার বড় ভাই কিছু চাইতো, সে মেঝেতে শুয়ে পড়তো, তার পা দিয়ে বাতাসে লাথি দিত, এর জন্য কান্না করত এবং তা পেত। কিন্তু যখন ‘ছোট্ট বধির বালক’ কিছু চাইতো, সে টাকা আয়ের একটা পরিকল্পনা করত। তারপর এটা নিজের জন্য ক্রয় করত। সে এখনও সেই অভ্যাস অনুসরণ করে!

সত্যিই, আমার নিজ সন্তান আমাকে শিখিয়েছে যে প্রতিবন্ধকতাকে সামনে এগিয়ে যাওয়ার ধাপে পরিণত করা যায়। যাতে একজন তার নির্দিষ্ট লক্ষ্যের প্রতি ধাবিত হতে পারে; যদি-না তারা বাধাবিপত্তিকে মেনে নেয় এবং অজুহাত রূপে প্রয়োগ করে।

ছোট্ট বধির বালক তার শিক্ষকদের কথা না শুনেও স্কুল, কলেজ ও ভার্সিটি বেশ ভালোভাবেই পার করেছে। অবশ্য শিক্ষকরা যখন তার খুব কাছ থেকে জোরে কিছু বলত তবেই সে শুনতে পেত। তাকে আমরা বধিরদের স্কুলে পাঠাইনি।

আমরা তাকে সাংকেতিক ভাষা শেখারও অনুমতি দেইনি। আমরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলাম যে সে এক স্বাভাবিক জীবনযাপন করবে এবং স্বাভাবিক শিশুদের সহযোগী হবে। আমরা সেই সিদ্ধান্তে অটল ছিলাম। যদিও আমাদেরকে স্কুলের অফিসের সাথে এ নিয়ে অনেক তর্ক-বিতর্ক করতে হয়েছে।

যখন সে হাইস্কুলে পড়ালেখা করছিল তখন সে একটি শ্রবণ যন্ত্রের সহায়তা নিতে চেষ্টা করেছিল। কিন্তু এটাতে কোন লাভ হলো না। যখন শিশুর বয়স ছিল ছয় বছর, তখন শিকাগোর চিকিৎসক জে. গর্ডন উইলসন আমাদেরকে তার সমস্যার কথা বলেছিল। তার মাথার এক পাশে অস্ত্রচিকিৎসা চালানো হয়েছিল। তখন চিকিৎসক আবিষ্কার করল যে তার খুলির মধ্যে প্রাকৃতিকভাবে কোন শ্রবণ উপকরণের চিহ্ন নেই।

কলেজে তার শেষ সপ্তাহ চলাকালীন, (অস্ত্রচিকিৎসার ১৮ বছর পরে), কিছু ঘটল। যা ছিল তার জীবনের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিকাল। এটা তার কাছে একটি সুযোগ রূপে আসে। তার কাছে অপর এক শ্রবণ যন্ত্র এলো যা তাকে নমুনা রূপে কোম্পানি থেকে পাঠানো হয়েছিল। সে এটাকে পরীক্ষা করতে বিলম্ব করছিল। কারণ একই রকম এক যন্ত্রের ওপর তার হতাশা ছিল। অবশেষে সে যন্ত্রটি তুলে নিল এবং অসাবধানে, এটা তার মাথায় বসালো। ব্যাটারি চালু করল এবং ওহ! যেন এক জাদুর আঘাত। তার জীবনভর আকাক্সক্ষা ছিল স্বাভাবিক শ্রবণের প্রতি। এখন তা বাস্তবে পরিণত হয়েছে! তার জীবনে সে এই প্রথমবারের মতো শুনতে পাচ্ছে। যথারীতি যেকোনো স্বাভাবিক মানুষের মতো। ‘আল্লাহ রহস্যময় পথে চলেন। তাঁর কৃতিত্ব বিস্ময়কর।’

সে খুবই খুশি হয়েছিল। কারণ তার শ্রবণ যন্ত্র তার কাছে নতুন এক  বিশ্বকে উন্মোচিত করেছে। সে টেলিফোনের দিকে দ্রুতবেগে ধাবিত হলো। তার মাকে ফোন করল এবং তার কণ্ঠস্বর পরিষ্কার শুনতে পেল। পরেরদিন সে তার জীবনে এই প্রথমবারের জন্য শিক্ষকদের কণ্ঠস্বর শুনতে পেল! আগে যখন তারা অল্প দূরত্বের মধ্যে চিৎকার করত কেবল তখনই সে শুনতে পেত। সে রেডিও শুনতে পেল। সে চলচ্চিত্র শুনতে পেল। তার জীবনে এই প্রথমবারের জন্য, সে মুক্তভাবে অন্যদের সাথে আলাপ করতে পারছে, তাদের উচ্চস্বরে বলার প্রয়োজনীয়তা ছাড়াই। সত্যিকারভাবেই, সে এক নতুন বিশ্বের অধিকারী হলো। আমরা প্রকৃতির ভুল গ্রহণ করতে অস্বীকার করেছিলাম এবং অধ্যবসায়ী আকাক্সক্ষা দ্বারা আমরা প্রকৃতিকে প্রবৃত্ত করেছিলাম সেই ভুল ঠিক করতে।

যদিও আকাক্সক্ষা অনুযায়ী লভ্যাংশ পাওয়া শুরু হয়েছিল, কিন্তু চুড়ান্ত বিজয় এখনও ঘটেনি। বালকটিকে এখনও একটি নির্দিষ্ট এবং বাস্তবিক পথ খুঁজে পেতে হবে যাতে তার প্রতিবন্ধকতা একটি সম্পদে পরিণত হতে পারে।

যা সে ইতোমধ্যে পেয়েছে তার তাৎপর্য সে অনুধাবন করেছে। শব্দের এই নতুন দুনিয়া আবিষ্কার করে আনন্দে উল্লাসিত হয়েছে। সে শ্রবণ সহায়ক যন্ত্র উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের প্রতি একটি চিঠি লিখে। তার অভিজ্ঞতাকে আগ্রহ ভরে বর্ণনা করে। তার চিঠির মধ্যে কিছু ছিল। এমনকিছু যা হয়তো শব্দে লেখা ছিল না। কিন্তু শব্দের পিছনে ছিল। কারণ প্রতিষ্ঠানটি তাকে নিউ ইয়র্কে আমন্ত্রণ জানায়। যখন সে পৌঁছায়, তাকে কারখানায় নিয়ে যাওয়া হয় এবং প্রধান ইঞ্জিনিয়ারের সাথে আলাপকালে, তাকে বলা হয় তার নতুন বিশ্ব, একটি ঝলক, একটি আইডিয়া অথবা একটি অনুপ্রেরণা সম্পর্কে বলতে। যা তার মনে উদয় হয়েছিল সেই অনুভূতিকে আপনি যা ইচ্ছা বলতে পারেন। এটা ছিল সেই চিন্তা তরঙ্গ যা তার শারীরিক ত্রুটিকে একটি সম্পদে পরিণত করে। চিন্তার সেই তরঙ্গ যা তার মন-মস্তিষ্ককে দখল করে রেখেছিল, তা তাকে অর্থ এবং সুখ পেতে যা যা করা দরকার তাই করতে উদ্বুদ্ধ করল। এটা অনেকটা গুপ্তধন পাওয়ার মতো সৌভাগ্যে পরিণত হলো।

সেই চিন্তা তরঙ্গের যোগফল এবং সারবস্তু ছিল অনেকটা এই রকম: সে যাতে তার অবশিষ্ট জীবনের প্রতিটি ঘণ্টা লাখো বধির লোকের সাহায্য করতে পারে যারা তাদের জীবন শ্রবণ যন্ত্রের সুবিধা ব্যতীত অতিবাহিত করছে। যদি সে তার নতুন পৃথিবীর অভিজ্ঞতা তাদেরকে বলার জন্য একটি পথ খুঁজে পেত তবে সে বধির মানুষদের সাহায্য করতে পারে। তারপর এবং সেখানেই, সে একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছায় যে সে তার বাকি জীবন বধির মানুষের প্রয়োজনীয় সেবা সম্পন্ন করার কাজে উৎসর্গ করবে।

পুরো এক মাস জুড়ে, সে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে গবেষণা চালায়। সে তৎকালীন সময়কার শ্রবণ যন্ত্র উৎপাদনকারীর সম্পূর্ণ বিপনণ ব্যবস্থা এবং সম্পূর্ণ দুনিয়া জুড়ে বধিরদের সাথে যোগাযোগের পথ এবং উপায় অনুসন্ধান করল। যাতে সে তাদের সকলের সাথে তার নতুনভাবে আবিষ্কৃত ‘নতুন বিশ্বের অভিজ্ঞতা’ বিনিময় করতে পারে। যখন এটা সম্পন্ন হয়, তার খোঁজগুলোর ওপর ভিত্তি করে সে একটি দুই বছরের পরিকল্পনা লিখে রাখে। যখন সে পরিকল্পনাটি ঐ প্রতিষ্ঠানের কাছে পেশ করে তখন তাকে তাৎক্ষণাৎ একটি দায়িত্ব দেওয়া হয় যাতে সে তার উচ্চাকাক্সক্ষা পূরণ করতে পারে।

তার স্বপ্নের ছোট্ট শুরু। সে হাজারো বধির মানুষের মনে আশা ও বিশ্বাস যোগায় যে তার মতো তারাও স্বাভাবিকভাবে শুনতে পারে এবং স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারে। হয়তো এসব বধির লোক তার সহায়তা ব্যতীত চিরকাল বধিরতার স্তব্ধতায় ডুবে থাকত।

সে তার শ্রবণ সহায়তা যন্ত্র উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের সহযোগী হওয়ার কিছু সময় পর, আমাকে একটি ক্লাসে আমন্ত্রণ জানায়। সে আমাকে দেখাতে চেয়েছিল যে তার সহযোগিতায় তার কোম্পানি কীভাবে বধির-মূকদের শোনা এবং বলার প্রতি শেখাচ্ছে। আমি কখনো এরকম কোন প্রশিক্ষণের ব্যাপারে শুনিনি। এজন্য আমি ক্লাস দেখতে গেলাম। কিছুটা সন্দেহ নিয়ে গেলাম। কিন্তু আশাবাদী ছিলাম যে আমার সময় হয়তো সম্পূর্ণ অপচয় হবে না। ক্লাসটি দেখে আমি প্রমাণ পেলাম যে বহু বছর আগে আমি যেভাবে তার মধ্যে শোনার প্রতি একটি তীব্র আকাক্সক্ষা জাগিয়ে তুলেছিলাম, ঠিক একই পদ্ধতিতে অন্যদের মধ্যেও সেই আকাক্সক্ষা জাগানো হচ্ছে। আমি দেখলাম বধির-মূকদের প্রকৃতপক্ষেই শোনা এবং বলার প্রতি শেখানো হচ্ছে। ঠিক একই স্ব-পরামর্শ সূত্রের মাধ্যমে যা আমি ২০ বছর আগে আমার ছেলের জন্য ব্যবহার করেছিলাম।

এরূপ, ভাগ্যের চাকার কিছু অদ্ভুত চক্রের মাধ্যমে আমার পুত্রÑব্লেয়ার এবং আমি বধির-মূকদের সাহায্য করতে ভাগ্য কর্তৃক নির্দিষ্ট ছিলাম। কারণ তখন পর্যন্ত এই পদ্ধতি সম্পর্কে কেউই জানত না। আমরাই একমাত্র জীবিত মানব সত্তা ছিলাম যারা জানতাম এবং এটা প্রমাণ করে দেখিয়েছি যে বধির-মূকতার ত্রুটিকে সংশোধন করা যায়। আমি যেমন আমার সন্তানের বধিরতাকে স্বীকার না করে, তাকে শোনার প্রতি একটি তীব্র আকাক্সক্ষা গঠনে সহায়তা করে গেছি, তেমনি সেও এটা অন্যদের মধ্যে সৃষ্টি করতে চেষ্টা করে যাচ্ছে। এটা একজনের প্রতি সম্পন্ন করা গেছে এবং আমাদের বিশ্বাস এটা অন্যদের প্রতিও সম্পন্ন করা যাবে।

আমার মনে কোন সন্দেহ নেই যে ব্লেয়ার একজন বধির-মূক রূপেই সারা জীবন থাকত, যদি তার মা এবং আমি তার মনের প্রতি তেমন ব্যবস্থা না নিতাম যেমনটা আমরা নিয়েছিলাম। সেই চিকিৎসক যিনি তার জন্মের সময় ছিল এবং আমাদের গোপনভাবে বলেছিল যে শিশুটি হয়তো কখনো শুনতে বা বলতে পারবে না। তার নাম ড. আরভিং ভোরহিস। তার সাথে কয়েক সপ্তাহ আগে আমাদের দেখা হয়। তিনি এমন বিষয়ে একজন বিখ্যাত বিশেষজ্ঞ। তিনি ব্লেয়ারকে খুব ভালোভাবে পরীক্ষা করে দেখল। সে বিস্মিত হলো যখন সে বুঝতে পারল যে আমার ছেলে কত ভালোভাবে শুনতে এবং বলতে পারে। অথচ তার পরীক্ষা নির্দেশ করছে যে ‘তত্ত্বগতভাবে ছেলেটি কোনোমতেই শুনতে পাওয়ার কথা না।’ কিন্তু ছেলেটি শুনতে পায়! এই ব্যাপার সত্ত্বেও যে এক্স-রশ্মির ছবি দেখাচ্ছে যে সেখানে মাথার খুলির মধ্যে কোনো ছিদ্র নেই বা অন্য যেকোনো কিছু যেখান থেকে তার কান মস্তিষ্কের সাথে যুক্ত থাকবে।

যখন আমি তার মনে শোনা এবং বলার প্রতি আকাক্সক্ষা রোপণ করেছিলাম এবং একজন স্বাভাবিক ব্যক্তির মতো জীবনযাপন করলাম, সেই তরঙ্গের সাথে সেখানে কিছু অদ্ভুত প্রেরণা গেল যা প্রকৃতিকে সেতু নির্মাতা হতে বাধ্য করল এবং প্রকৃতি নিশ্চুপভাবে খাদের ওপর একটি সেতু নির্মাণ করল। প্রকৃতি তার মস্তিষ্ক ও বহিঃবিশ্বের মধ্যে এমন কিছু উপায় দ্বারা সেতু নির্মাণ করে যে খুব বিচক্ষণ এবং বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকও এটা ব্যাখ্যা করতে অসমর্থ। প্রকৃতির এই অলৌকিক ঘটনাকে ব্যাখ্যা করা কঠিন। তবুও আমি চেষ্টা করছি। আমি বিশ্বাস করি এবং কোনো কারণ ছাড়াই আমার এই বিশ্বাস যে আস্থা দিয়ে মোড়ানো কোন আকাক্সক্ষায় যদি কোন ব্যক্তি অটল থাকে তবে তা সে ঐ আকাক্সক্ষা পূরণ করবেই। প্রকৃতির কাছে অসম্ভব বলে কিছু নেই। মার্ক টোয়েন বলেন, ‘আপনি যদি পারবেন বলে চিন্তা করেন তবে আপনি পারবেন। আপনি যদি পারবেন না বলে চিন্তা করেন তবে আপনি পারবেন না।’ পারবেন বলে চিন্তা করলে আপনি নিশ্চয়ই ঐ কাজে সফল হবেন। কিন্তু পারবেন না বলে চিন্তা করলে আপনার সাথে তাই ঘটবে।

সত্যই, একটি জ্বলন্ত আকাক্সক্ষা জীবনের আঁকাবাঁকা পথে নিজেকে বাস্তব করে দেখায়। ব্লেয়ারের জ¦লন্ত আকাক্সক্ষা ছিল স্বাভাবিক শ্রবণের প্রতি। এখন তার আকাক্সক্ষা পূরণ হয়েছে! সে একটি প্রতিবন্ধকতার সাথে জন্ম নেয় যা হয়তো সহজভাবে তাকে দরিদ্র আকাক্সক্ষার দিকে প্রেরণ করত। যেমন অনেক প্রতিবন্ধী মানুষই রাস্তায় একটি টিনের থালাসহ বসে পড়ে। সেই প্রতিবন্ধকতা এখন একটি গুণে পরিণত হয়েছে। যা দিয়ে সে লাখো মানুষের সেবা করছে। অধিকন্তু, এই প্রতিবন্ধকতাই এখন তার জীবিকা অর্জনের পথ বের করে দিয়েছে এবং খুব ভালোভাবেই সে তার জীবিকা অর্জন করছে।

যখন সে শিশু ছিল তখন আমি তার মনে যে ছোট্ট ‘সাদা মিথ্যা’ রোপণ করেছিলাম, তাই পরবর্তীতে তার বিশ্বাসে পরিণত হয়। যে বিশ্বাস তার শারীরিক ত্রুটিকে এক মহান সম্পদে পরিণত করে। সত্যই, এই দুনিয়ায় এমন কিছু নেই যা জ্বলন্ত আকাক্সক্ষা সহকারে বিশ্বাস করলে পাওয়া যায় না। আপনার মধ্যে যদি একটি জ্বলন্ত আকাক্সক্ষা থাকে এবং এর সাথে বিশ্বাস থাকে যে আপনি এটা অর্জন করতে পারবেন, তাহলে সেখানে এমন কিছু নেই যা আপনি অর্জন করতে পারেন না। আকাক্সক্ষা এবং বিশ্বাস এই গুণগুলো সকলের প্রতিই উন্মুক্ত।

আমার এত বছরের গবেষণায়, আমি যত পুরুষ ও নারীদের দেখেছি তাদের কারও মধ্যেই আমি আকাক্সক্ষার এমন জ্বলন্ত প্রমাণ পাইনি। কিছু কিছু লেখক যাদের আকাক্সক্ষার ক্ষমতা সম্পর্কে বিন্দুমাত্র জ্ঞান নেই, তারা প্রায়ই তাদের লেখনীতে আকাক্সক্ষার ক্ষমতাকে ভুলভাবে বর্ণনা করে থাকে। এটা আমার সৌভাগ্য যে আমি আমার ছেলের মাধ্যমে আকাক্সক্ষার এই প্রচ- ক্ষমতাকে পরীক্ষা করার সুযোগ পেয়েছি। হয়তো এটা একটা ঐশ্বরিক ব্যাপার। তবে আমি নিশ্চিত যে তার চেয়ে অন্য কেউ হয়তো এটা পরীক্ষার জন্য এতটা প্রস্তুত ছিল না। আমি আমার সন্তানের এই ঘটনা থেকে বলতে চাই, অনন্ত প্রকৃতি যদি আকাক্সক্ষার কাছে নত হয়, তবে একটি জ্বলন্ত আকাক্সক্ষাকে কি এই পৃথিবীর সাধারণ মানুষ পরাজিত করতে পারে?

মানব মনের ক্ষমতা অদ্ভুত এবং অনুভবহীন! মানব মনের ওপর আস্থা কীভাবে কাজ করে? আকাক্সক্ষার প্রচ- প্রভাব কেমন? বাস্তবতার সাথে এসব অদৃশ্য বিষয় কীভাবে কাজ করে? কীভাবে আকাক্সক্ষা এবং আস্থার যোগফলে অসম্ভব কাজও সম্ভব হয়ে ওঠে? হয়তো একদিন বিজ্ঞান আমাদেরকে এসব প্রশ্নের উত্তর দিবে।

আমি আমার পুত্রের মনের মধ্যে শোনা এবং বলার প্রতি আকাক্সক্ষা যেমন রোপণ করেছিলাম তেমন যেকোনো স্বাভাবিক মানুষের মধ্যেও তা রোপণ করা সম্ভব, যাতে করে সে শুনতে এবং বলতে পারে। সেই আকাক্সক্ষা এখন একটি বাস্তবতায় পরিণত হয়েছে। আমি তার মনের মধ্যে যে আকাক্সক্ষা রোপণ করেছিলাম তা ছিল যে তার শারীরিক ত্রুটি একদিন তার সম্পদে পরিণত হবে। সেই আকাক্সক্ষা আজকে বাস্তবে পরিণত হয়েছে। যে প্রক্রিয়ায় এই বিস্ময়কর ফলাফল অর্জন করা হয়েছে তা বর্ণনা করা কঠিন নয়। এটা গঠিত হয়েছে তিনটি খুবই নির্দিষ্ট ব্যাপার নিয়ে;

প্রথমত, আমি তার স্বাভাবিক শ্রবণের জন্য আকাক্সক্ষার সাথে আস্থা মিশ্রিত করলাম।

দ্বিতীয়ত, আমি তার সাথে যোগাযোগের ক্ষেত্রে আমার আকাক্সক্ষাটি অধ্যবসায়ের মাধ্যমে প্রতিটি দিক থেকে, প্রতিটি পথে দিতে থাকলাম। আমি বহু বছর ধরে এই কাজ করে গেছি।

তৃতীয়ত, সে আমাকে বিশ্বাস করেছিল!

যখন এই অধ্যায় সম্পূর্ণ লেখা শেষ হলো তখন আমি আর্নেস্টাইন সুয়াম্যান হিং এর মৃত্যু সংবাদ পাই। একটি জাতীয় দৈনিকে তার একটি সংক্ষিপ্ত জীবনী ছাপা হয়। প্রতিবেদনে এই অসাধারণ নারীর বিস্ময়কর সাফল্যের সংকেত দেওয়া হয়েছে। আমি অনুচ্ছেদটি উদ্ধৃত করলাম। কারণ এটা যে সংকেত বহন করছে তা আকাক্সক্ষা ভিন্ন অন্য কিছু নয়।

‘পেশাগত জীবনের শুরুর দিকে, আর্নেস্টাইন সুয়াম্যান হিং ভিয়েনা কোর্ট অপেরার পরিচালকের সাথে দেখা করেছিল। উদ্দেশ্য ছিল তার কণ্ঠস্বর পরীক্ষা করে দেখা। কিন্তু পরিচালক তার কণ্ঠস্বর শুনেও দেখল না। সুয়াম্যানের ময়লা এবং দরিদ্র অবস্থা দেখে সে হঠাৎ চিৎকার করে উঠল এবং বলল, “এমন একটি মুখ নিয়ে এবং কোন ব্যক্তিত্ব ছাড়াই, তুই কীভাবে আশা করতে পারিস যে তুই অপেরায় সফল হবি? শোন, এখনও সময় আছে। তুই একটা ভালো মেয়ে। গান গাওয়ার চিন্তা বাদ দে। একটা সেলাই মেশিন কিনে কাজে নেমে যা। তুই কোনোদিন গায়িকা হতে পারবি না।”

‘কখনো না! আপনি কখনো কাউকে এ সম্পর্কে বলতে পারেন না! ভিয়েনা কোর্ট অপেরার পরিচালক নিঃসন্দেহে গান গাওয়ার কৌশল সম্পর্কে প্রচুর জানত। কিন্তু সে আকাক্সক্ষার প্রচ- ক্ষমতা সম্বন্ধে খুব অল্পই জানত। আর যখন এই আকাক্সক্ষা একটি আবেশে পরিণত হয় তখন তো কথাই নেই। যদি পরিচালক সেই ক্ষমতা সম্পর্কে আরও বেশি জানত, তবে সে প্রতিভাবানকে নিন্দা করার ভুল করত না। অন্ততপক্ষে একটি সুযোগ না দিয়ে তো নয়ই।

পরবর্তীতে আর্নেস্টাইন সুয়াম্যান হিং  লন্ডনের রয়েল অপেরা হাউসে এবং নিউ ইয়র্কের মেট্রোপলিটন অপেরা হাউসে সফলভাবে সংগীত পরিবেশন করে।

কয়েক বছর আগে, আমার ব্যবসায়ী সহযোগীদের একজন অসুস্থ হয়ে পড়ে। যত সময় যাচ্ছিল তার অবস্থা আরও খারাপ হতে লাগল এবং অবশেষে তাকে দ্রুত চিকিৎসাকেন্দ্রে অপারেশনের জন্য নিয়ে যাওয়া হলো। অপারেশন রুমে যাওয়ার আগে যখন সে বিছানায় শুয়েছিল, আমি তার দিকে একবার তাকালাম এবং বিস্মিত হলাম যে তার মতো এমন একজন কৃশ এবং দুর্বল লোক কীভাবে একটি গুরুতর অস্ত্রপাচারের মধ্য দিয়ে সফলভাবে বেঁচে আসতে পারে। চিকিৎসক আমাকে সতর্ক করেছিল যে তাকে পুনরায় জীবিত দেখতে পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। কিন্তু তা ছিল চিকিৎসকের অভিমত। রোগীর অভিমত ছিল ভিন্ন। তাকে যখন স্ট্রেচারে করে নিয়ে যাওয়ার হচ্ছিল তখন সে মৃদুস্বরে বলল, ‘বস, দুঃখের কিছু নেই। আমি এখান থেকে কিছুদিনের মধ্যেই বের হবো।’ উপস্থিত নার্স আমার দিকে সহানুভূতি নিয়ে তাকাল। কিন্তু রোগীটি নিরাপদভাবেই ফিরে এসেছিল। অপারেশন শেষ হওয়ার পর, তার চিকিৎসক বলেছিল, ‘অন্য আর কিছু না; বরং তার নিজের বাঁচার আকাক্সক্ষাই তাকে বাঁচিয়েছে। সে কখনো এর মধ্য দিয়ে আসতে পারত না যদি সে মৃত্যুর সম্ভাবনাকে গ্রহণ করতে অস্বীকার না করত।’

আমি আস্থা দ্বারা মোড়ানো আকাক্সক্ষার ক্ষমতার মধ্যে বিশ্বাস করি। কারণ আমি দেখেছি যে এই ক্ষমতা অত্যন্ত নিচু জায়গা থেকে আরম্ভ করা মানুষকেও অনেক সম্পদশালীতে পরিণত করেছে। আমি দেখেছি যে এটা যেকোনো বাধা, সমস্যা এবং প্রতিকূলতাকে ভেঙে ফেলতে সক্ষম। আমি দেখেছি যে এটা একজন ব্যক্তিকে সেই ক্ষমতা দেয় যাতে করে সে ১০০ বার ব্যর্থ হলেও আবার সে সাফল্যের মঞ্চে ফিরে আসে। আমি দেখেছি যে এটা আমার নিজ সন্তানকে দিয়েছে একটি স্বাভাবিক, সুখী এবং সাফল্যম-িত জীবন, এটা সত্ত্বেও যে প্রকৃতি তাকে এই পৃথিবীতে শ্রবণশক্তি ছাড়াই পাঠায়।

কীভাবে একজন আকাক্সক্ষার ক্ষমতাকে শক্তি উৎপাদনের কাজে লাগাতে পারে এবং বাস্তবে প্রয়োগ করতে পারে? এর উত্তর দেওয়া হয়েছে এই অধ্যায়ে এবং এ বইয়ের পরবর্তী অধ্যায়গুলোতেও। এই বার্তা ছড়িয়ে পড়বে বিশ্বের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত এবং হয়তো বিশ্বের সর্বগ্রাসী হতাশাকে ধ্বংস করবে। এটা যৌক্তিকভাবে অনুমান করা যায় যে বার্তাটি অনেকের মনোযোগ আকর্ষণ করবে যারা হতাশা দ্বারা আহত হয়েছে, যারা তাদের সৌভাগ্য হারিয়েছে, অন্য যারা হারিয়েছে তাদের পদপদবি এবং বহু সংখ্যক মানুষ যাদেরকে অবশ্যই তাদের লক্ষ্যকে স্মরণ করতে হবে এবং পুনরায় সাফল্যের মঞ্চে ফিরে আসতে হবে। আশা করি এই চিন্তা সবখানে প্রবাহিত হবে যে সব কৃতিত্বপূর্ণ কাজ, কোন ব্যাপারই না এর প্রকৃতি বা উদ্দেশ্য যাইহোক না কেন, অবশ্যই আরম্ভ হয় কোনকিছুর জন্য একটি নির্দিষ্ট আকাক্সক্ষা থেকে।

একটি নির্দিষ্ট আকাক্সক্ষার মধ্যে কিছু অদ্ভুত এবং শক্তিশালী ‘মানসিক রসায়ন’ রয়েছে। বিশ^প্রকৃতি সহজে এটা প্রকাশ করে না। প্রকৃতি এটা শক্তিশালী আকাক্সক্ষার তরঙ্গের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছে। রহস্যময় এই ব্যাপার যাকে আমি একটি নির্দিষ্ট আকাক্সক্ষা বলছি তা অসম্ভব বলে কোন শব্দকে চেনে না; না এটা দুনিয়ার কোন ব্যর্থতাকে মেনে নেয়।

জীবনে বড় লক্ষ্য গ্রহণ করতে, প্রাচুর্য এবং উন্নতি চাইতে কোন শ্রম লাগে না; বরং দরিদ্রতা এবং দুর্দশাকে মেনে নিলে তা বেশি প্রয়োজন হয়।


 




অধ্যায় - ০৩

আস্থা 

যা আকাক্সক্ষা করা হয়েছে তা কল্পনাতে দেখা এবং অর্জন করবে বলে বিশ্বাস করা

ধনী হওয়ার ক্ষেত্রে দ্বিতীয় ধাপ


আস্থা হচ্ছে মনের প্রধান রাসায়নিক অবস্থা। আস্থা যখন চিন্তাশক্তির সাথে মিলিত হয় তখন মনের অবচেতন অংশ তাৎক্ষণিক সেই তরঙ্গ ধরে ফেলে, ঐশ্বরিক পর্যায়ে রূপান্তর করে এবং একে অসীম বুদ্ধিমত্তার কাছে পৌঁছে দেয় যেমনটা আমরা প্রার্থনা বা দোয়া চাইতে করে থাকি।

আস্থা, প্রেম ও যৌনতা; এ তিনটি হচ্ছে ইতিবাচক আবেগগুলোর মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী আবেগ। যখন এ তিনটি একত্রিত হয় তখন তারা এমন ‘রঙের’ সৃষ্টি করে যা তরঙ্গ শক্তি আকারে তাৎক্ষণাৎ অবচেতন মনে পৌঁছে যায়, যেখানে এটা ঐশ্বরিক পর্যায়ে পরিবর্তন হয়। আর এটাই হচ্ছে অসীম বুদ্ধিমত্তার দেখা পাওয়ার একমাত্র পথ।

প্রেম ও আস্থাÑএগুলো হচ্ছে মানসিক অবস্থা, যা ব্যক্তির আত্মিক দিকের সাথে সম্পৃক্ত। যৌনতা পুরোপুরি একটি জৈব রাসায়নিক ব্যাপার এবং এটা শুধু দৈহিক দিকের সাথে সম্পৃক্ত। এগুলো একে অপরের সাথে মিলিত হলে একজন ব্যক্তির সচেতন মন এবং অসীম বুদ্ধিমত্তার সাথে যোগাযোগের একটি সরাসরি পথ তৈরি হয়।

[অসীম বুদ্ধিমত্তা  বলতে সৃষ্টিকর্তা বা এক ধরনের সর্বব্যাপী চেতনাকে বোঝায় যা আপনাকে, আমাকে এবং আমাদের সকলকে সৃষ্টি করেছে। এই চেতনা একটি ইতিবাচক চেতনা। আমরা যখন অসুস্থ হয়ে পড়ে অথবা বিপদে পড়ি তখন এই চেতনাই আমাদেরকে সুস্থ হতে বা সমাধান খুঁজে পেতে সাহায্য করে। এই দর্শনকে নিউ থট তথা নতুন চিন্তা নামেও অবিহিত করা হয়। এটাকে এক ধরনের বিশ্বাস বলা যেতে পারে যা ভালো ও উপকারী চিন্তা করতে উৎসাহ দেয় বা ভালোবাসা  রূপেও চিন্তা করা হয় যেন এই পৃথিবীর সবাই একে অপরকে ভালোবাসে এবং একে অপরকে বিপদে-আপদে সাহায্য করে। এখান থেকেই ইতিবাচক চিন্তা, সৃজনশীল চিন্তা, আকর্ষণ সূত্র এবং ব্যক্তিগত ক্ষমতার উৎপত্তি ধরা হয়।

আমাদের চিন্তাশক্তির অনেক বড় ক্ষমতা রয়েছে। আমরা যা চিন্তা করি আমরা তাই। সেজন্য আমাদের চিন্তাশক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। আমরা যদি জীবনে উন্নতি করতে চাই তবে আমদেরকে উন্নতির চিন্তাই করতে হবে।]

কীভাবে আস্থা গঠন করবেন?

আপনাকে এখন স্বপরামর্শের গুরুত্ব সম্পর্কে কিছু তথ্য দিব, যা আপনার সাফল্য অর্জনে সহায়ক হবে। এতে করে আপনি বুঝতে পারবেন যে কেন আস্থা গঠন করা দরকার এবং কীভাবে তা গঠন করতে হয়। স্ব-পরামর্শ হচ্ছে আপনার আকাক্সক্ষাকে তার বাস্তব অথবা আর্থিক অবস্থায় পরিণত করার রূপান্তরক। স্ব-পরামর্শ হচ্ছে সেই সূত্র যার দ্বারা কিছু নির্দেশনা বারবার পড়ে আপনার অবচেতন মস্তিষ্কে একটি দৃঢ় বিশ্বাসের সৃষ্টি করে। আর এই স্থির মানসিক অবস্থাকেই বলে আস্থা।

আস্থাকে আরেকটু পরিষ্কার করে বর্ণনা করা দরকার। আস্থা হচ্ছে এক ধরনের দৃঢ় বা অটল বিশ্বাস। ধরুন, আপনি আল্লাহতে আস্থা রাখেন। এখন কেউ যদি আপনাকে বলে, আমি প্রমাণ করতে পারব যে আল্লাহ বলতে কিছু নেই। তখন আপনি যে বিশ্বাসের বলে তার যুক্তি, তর্ক বা প্রমাণকে অগ্রাহ্য করেন তাই আস্থা।

আপনি এ বই যে উদ্দেশ্যে পড়ছেন তাই নিয়ে একটু আলোচনা করা যাক। ব্যাপার হচ্ছে আপনি সেই ক্ষমতাকে অর্জন করতে চান যা আপনার আকাক্সক্ষার অনুভবযোগ্য চিন্তা তরঙ্গকে এর বাস্তবিক প্রতিফলন, মানে টাকায় রূপান্তরিত করবে। এ বইয়ে আরও ২টি অধ্যায় আছে। যাদের শিরোনামÑস্বপরামর্শ এবং অবচেতন মন। এই অধ্যায়গুলোতে কিছু দিকনির্দেশনা দেওয়া আছে। এগুলো যদি অনুসরণ করেন তাহলে আপনি হয়তো আপনার অবচেতন মনকে মানাতে পারবেন যে আপনি যা চান তাতে বিশ্বাস করলে আপনি তা পাবেনই এবং আপনার অবচেতন মন সেই বিশ্বাস অনুযায়ী কাজও করবে। আপনার অবচেতন মন ‘আস্থা’ আকারে আপনাকে ফেরত দিবে যাতে আপনি একটি নির্দিষ্ট পরিকল্পনা অনুসরণ করে আপনার আকাক্সক্ষা পূরণ করতে পারেন।

যেই পদ্ধতিতে একজন ব্যক্তি আস্থা গঠন করে, যার কোন বস্তুগত অস্তিত্ব নেই। আপনি এটা চেয়ার-টেবিলের মতো হাতে ধরতে পারবেন না। এটা বর্ণনা করাও খুব কঠিন। সত্যি বলতে এতটাই কঠিন যে একজন অন্ধ মানুষকে লাল রঙের বর্ণনা দেওয়া যে কোনদিনই রঙ দেখেনি এবং এমন কিছুই নেই যার সাথে তুলনা করে আপনি তাকে বর্ণনা দিবেন। কিন্তু তারপরও আস্থা গঠন করা যায় এবং এটা ইচ্ছাকৃতভাবেই সম্ভব। আপনি আস্থা নামক এই মানসিক অবস্থা আপনার আকাক্সক্ষার মাধ্যমে তৈরি করতে পারেন। আপনি এ বইয়ের ১৩টি সূত্রের ওপর আধিপত্য করার পর, এ বইয়ের বর্ণিত কিছু দিকনির্দেশনা আছে সেগুলো পালন করার পর আপনি সহজেই আস্থা গঠন করতে পারবেন। দিকনির্দেশনাগুলো পুরোপুরি বাস্তবসম্মত এবং এগুলো বহু মানুষের ওপর পরীক্ষানিরীক্ষার পরই এখানে যুক্ত করা হয়েছে। তাই আপনি নিশ্চিন্তে এগুলো পালন করতে পারেন।

আস্থা নামক এই আবেগকে গঠনের একমাত্র জানা উপায় হচ্ছে বারবার ইতিবাচক নির্দেশ উচ্চারণ করে নিজ অবচেতন মনে পৌঁছান।

হয়তো নি¤েœাক্ত ব্যাখ্যা এর মানেকে আরও পরিষ্কার করে তুলবে। মাঝে মাঝে মানুষ ঠিক একইভাবে অপরাধী হয়ে ওঠে। একজন বিখ্যাত অপরাধ বিজ্ঞানী তার লেখায় বলেন, ‘যখন ব্যক্তি প্রথম অপরাধের সংস্পর্শে আসে তখন সে এটাকে অত্যন্ত ঘৃণা করে। যদি সে একটা সময় পর্যন্ত অপরাধের সংস্পর্শে থাকে, তবে সে এর প্রতি অভ্যস্ত হয়ে পড়ে এবং সহ্য করে। যদি সে একটা দীর্ঘ সময় পর্যন্ত এর সংস্পর্শে থাকে, অবশেষে সে একে আলিঙ্গন করে নেয় এবং এর দ্বারা প্রভাবিত হতে থাকে।’

আমরা ঠিক একইভাবে বলতে পারি যে, কোন চিন্তা তরঙ্গ যদি বারবার অবচেতন মনে পৌঁছে দেওয়া হয়, তবে শেষ পর্যন্ত তা গৃহীত হয় এবং অবচেতন মন সেই অনুযায়ী কাজ করে, যার মাধ্যমে সেই তরঙ্গকে বাহ্যিকরূপে সমানভাবে রূপান্তর করে। এটাই আজ পর্যন্ত আবিষ্কৃত পদ্ধতিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে সহজ এবং বাস্তবিক পদ্ধতি।

এর সাথে আরও কিছু যুক্ত করা যাক। আরও মনে করে দেখুন, সব চিন্তাই আবেগযুক্ত (অনুভব থেকে উৎপত্তি) এবং আস্থার সাথে মিশ্রিত হলে, তাৎক্ষণিক নিজেদের বাস্তবে রূপান্তর করা শুরু করে। আপনি ইতিবাচক চিন্তা করেন, আপনার সাথে ভালো কিছু ঘটবে। আর আপনি যদি নেতিবাচক কিছুÑবিপদআপদ, সমস্যা নিয়ে চিন্তা করেন তবে আপনার সাথে তাই ঘটবে।

আবেগ বা ‘অনুভূতি’ যা চিন্তারই অংশ বিশেষ, এটাই হচ্ছে চিন্তার প্রাণশক্তি, জীবন ও কাজ। আস্থা, প্রেম ও যৌনতা যখন চিন্তা তরঙ্গের সাথে মিশ্রিত হয় তখন বিশাল কর্ম সম্পাদন করতে পারে। স্বতন্ত্রভাবেও এদের শক্তি আছে। কিন্তু এরা মিলিত হলে যা সম্পন্ন করতে পারে তা তারা একা থাকলে পারে না।

শুধু চিন্তা তরঙ্গের সাথে আস্থা মিশ্রিত হলেই হবে না, যদি-না এর সাথে আরও কোন ইতিবাচক আবেগ মিশ্রিত হয় অথবা নেতিবাচক আবেগ মিশ্রিত হয় যাতে অবচেতন মনে পৌঁছাতে এবং প্রভাবিত করতে পারে।

এই বিবৃতি থেকে আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন যে মানুষের অবচেতন মন অনেক শক্তিশালী। এটা যেকোনো চিন্তা তরঙ্গকে বাস্তবে পরিণত করতে পারে। যদিও চিন্তাটি নেতিবাচক বা ধ্বংসাত্মক হয় তবুও এটা কোন পার্থক্য করে না। ঠিক একইভাবে একটি ইতিবাচক বা গঠনমূলক চিন্তা তরঙ্গকেও এটা বাস্তবে পরিণত করতে পারে। এই সেই অদ্ভুত আশ্চার্যজনক বিষয় যার কারণে লাখো মানুষ দুর্ভাগ্যের শিকার হয়। তারা সবসময় সমস্যার চিন্তা করে, আর সমস্যা তাদের সামনে এসে দাঁড়ায়। এর বিপরীতে সফল মানুষ সম্ভাবনার চিন্তা করে, আর সমাধান তাদের সামনে এসে দাঁড়ায়।

লাখো মানুষ আছে যারা নিজেদের ক্ষেত্রে বিশ্বাস করে যে তারা দরিদ্রতা এবং ব্যর্থতার ‘কষ্ট ভোগ করতে ভাগ্য কর্তৃক নির্দিষ্ট করা’। অনেকেই বলে আমার কপালই খারাপ বা আমার পারিবারিক অবস্থা ভালো নেই অথবা অঢেল টাকা দিয়ে আমার পরিবার আমাকে সহায়তা করে না। এজন্যই আমার দুর্দশা। আবার অনেকে খারাপ বাতাস বা মানুষের কুদৃষ্টির মতো কিছু অদ্ভুত শক্তির ওপর বিশ্বাস করে যেগুলোর ওপর তাদের কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। অথচ তারা নিজেরাই তাদের ‘দুর্ভাগ্যের’ সৃষ্টিকারী। কারণ হচ্ছে এই নেতিবাচক বিশ্বাস, যা অবচেতন মন ধরে ফেলেছে এবং একে বাস্তবে পরিণত করেছে।

ঠিক এ জায়গাতেই আমি আপনাকে পরামর্শ দিতে চাই। এতে করে আপনি হয়তো লাভবান হবেন। আপনি যদি অবচেতন মনে কোন আকাক্সক্ষা প্রেরণ করেন, যা আপনি বাস্তবে চান বা আর্থিকরূপে চান তা প্রেরণ করতে হবে একটি স্থির বিশ্বাস রূপে। তবেই এটা বাস্তবে ঘটবে। আপনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করবেন যে আপনার সাথে ভালো কিছু ঘটবে, দেখবেন আপনার সাথে ঠিকই ভালো কিছু ঘটছে। আপনার বিশ্বাস বা আস্থা হচ্ছে ঠিক সেই উপাদান যা আপনার অবচেতন মনের কাজ নির্দিষ্ট করবে। এখানে বাধা দেওয়ার কিছু নেই। আপনি ‘চাতুরী করে’ আপনার অবচেতন মনকে স্ব-পরামর্শের মাধ্যমে নির্দেশনা দিয়ে যান, যেমন আমি চাতুরী করেছি আমার ছেলের অবচেতন মনের সাথে।

এই ‘প্রবঞ্চনা’কে আরও বাস্তবিক করার জন্য ঠিক সেই ভাবেই নিজেকে পরিচালিত করুন যেভাবে আপনি আশা করেন। এমনভাবে চলাফেরা করুন যেন আপনি যা চাচ্ছেন ইতোমধ্যে সেই বিষয়ের অধিকারী হয়েছেন। যখন আপনি অবচেতন মনকে নির্দেশনা দিবেন তখন পুরোপুরি বিশ্বাস করবেন যে আপনার পক্ষে কাজটি করা সম্ভব।

কিন্তু সাবধান! আপনি যদি দিনে দশবার বলেন ‘আমি সিগারেট ছাড়তে পারব না’, আর সিগারেট ছাড়তে চান তবে তা কোনদিনই ঘটবে না। আবার যদি মুখে বলেন, ‘আমি সিগারেট ছাড়তে পারব’, কিন্তু মনে মনে বিশ্বাস করেন না যে আপনি তা করতে পারবেন তাহলেও আপনি ব্যর্থ হবেন। মুখে বলা এবং মনেপ্রাণে তা বিশ্বাস করলেই, কেবল তখনই আপনার আকাক্সক্ষা বাস্তবে পরিণত হবে।

আপনি যদি পূর্ণ বিশ্বাস বা আস্থা সহকারে অবচেতন মনে প্রেরণ করেন তবে তা নির্দেশমতোই বেরিয়ে আসবে। আপনার মস্তিষ্কের এই অংশ, মানে অবচেতন মন আপনাকে যতটা সম্ভব সহজ এবং সোজা একটা বুদ্ধি দিবে যাতে আপনি আপনার আকাক্সক্ষা পূরণ করতে পারেন।

আপনাকে নিশ্চিতভাবে একটি সম্ভাবনাময় জায়গা দেখানো হলো যাতে করে আপনি আপনার একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য পূরণে অনুসন্ধান এবং অনুশীলন করতে পারেন। যাতে করে আপনি আপনার অবচেতন মনকে কাজে লাগিয়ে আপনার আকাক্সক্ষা অনুযায়ী লক্ষ্য পূরণ করতে পারেন। আপনাকে নিয়মিত চর্চা করতে হবে। নিজের বিশ্বাসকে দৃঢ় এবং গভীর করে তুলতে হবেÑআপনাকে বিশ্বাস করতে হবে যে আপনি যদি বিশ্বাস করেন তবে আপনি আপনার একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য পূরণ করতে পারবেন। আপনাকে প্রতিনিয়ত কাজ করে যেতে হবে। কেবল নির্দেশাবলি পাঠ করে গেলেই হবে না।

যদি এটা সত্যি হয় যে মানুষ অপরাধের সংস্পর্শে থাকলে অপরাধী হয়ে ওঠে (এবং এটা জানা কথা), এটাও সমানভাবে সত্য যে একজন মানুষ প্রতিনিয়ত তার অবচেতন মনে পরামর্শ দিয়ে আস্থা গঠন করতে পারে। আপনি যে বিষয়ে ওপর বিশ্বাস রাখেন আপনাকে কেবল তাই বলে যেতে হবেÑআপনি পারবেন, কাজটি আপনার দ্বারা সম্ভব। অবশেষে মন এমন প্রকৃতির প্রভাবে আসে যাতে এর ওপর আধিপত্য বিস্তার করা যায়। এই সত্যকে বুঝুন এবং আপনি জানতে পারবেন যে কেন ইতিবাচক আবেগগুলোকে আপনার মনের কর্তৃত্বকারী শক্তি রূপে উৎসাহিত করা প্রয়োজন এবং নেতিবাচক আবেগগুলোকে দূরীভূত করার জন্য নিরুৎসাহিত করা প্রয়োজন। (১২তম অধ্যায়ে ইতিবাচক এবং নেতিবাচক আবেগ সম্পর্কে লেখা আছে)।

একটি মন ইতিবাচক আবেগের প্রভাবে একটি সুস্থির মানসিক অবস্থায় বিরাজ করে। এটা অনেকটা সুন্দর সাজানো-গোছানো একটা ঘরের মতো, যেখানে প্রবেশ করলেই আপনার মন একটা শান্ত ও ¯িœগ্ধ চেতনায় পূর্ণ হয়ে ওঠে। একমাত্র তখনই আপনি আপনার মনকে আপনার আকাক্সক্ষা দ্বারা বারবার পরামর্শ দিয়ে গেলে, মনে মনে নিজেকে বলে গেলে আপনার অবচেতন মন তা গ্রহণ করে নিবে এবং তদানুযায়ী কাজ করবে। [ফজলে রাব্বির কথা–একেক মানুষের আকাক্সক্ষা একেক রকম। যেমন আমি নিজেকে প্রতিনিয়ত বলে যাই যে আমি আমার দেশের মানুষের জন্য উপকারী সেবা সম্পন্ন করব। কীভাবে? আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে ৬৪টি অনুপ্রেরণামূলক বই প্রকাশ করে। আপনিও এমন করে নিজের যেকোনো আকাক্সক্ষা যা অর্জন করতে চান তা মনে মনে বলে যাবেন। এতে করে আপনি অবচেতন মন থেকে এমন এমন সব আইডিয়া, বুদ্ধি, ধারণা বা সম্ভাবনা খুঁজে পাবেন যা আগে কখনো লক্ষ করেননি।]


আস্থা হচ্ছে এমন এক সুস্থির মস্তিষ্কজনিত অবস্থা যা স্বপরামর্শ দ্বারা প্রভাবিত করা যায়

আদিকাল থেকে সকল ধর্মবিদ মানবজাতিকে সতর্ক করার সংগ্রাম করেছেন যে এটাতে, ওটাতে, ঐ বিষয়ে এবং অন্যান্য মতবাদে বা ধর্মমতে ‘আস্থা রাখো।’ কিন্তু তারা সকলেই মানুষকে বলতে ব্যর্থ হয়েছে যে কীভাবে আস্থা রাখবে। তারা এটা বর্ণনা করেনি যে আস্থা একটি সুস্থির মানসিক অবস্থা এবং এটাকে স্ব-পরামর্শ দ্বারা প্রভাবিত করা যায়।

যেকোনো সাধারণ মানুষ যাতে সহজেই বুঝতে পারে সেজন্য আমরা খুব সহজভাবে সেই সব সূত্র বর্ণনা করব যাতে আস্থা উন্নতভাবে তৈরি করা যায়। যদিও এটাকে ধরা যায় না, ছোঁয়া যায় না। তবুও এ গুণকে তৈরি করা যায়।

আস্থা রাখুন নিজের ওপর। আস্থা রাখুন অনন্ত-অসীমে।

আমরা শুরু করার পূর্বে আপনাকে আবারো মনে করিয়ে দিতে চাই: আস্থা হচ্ছে ‘বাহ্যিক পরশপাথর’ যা জীবন, শক্তি এবং কাজকর্মকে সম্পন্ন করার জন্য চিন্তার তরঙ্গ দেয়।

আগামীতে লেখা বাক্য পাঠ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আপনি একবার, দুইবার, তিনবার যতবার পারেন এটা পড়–ন। জোরে জোরে পড়–ন যাতে আপনার কান দিয়ে আপনার কণ্ঠস্বরের শব্দশক্তি আপনার মস্তিষ্কে গিয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করে।

আস্থা হচ্ছে সকল বৈষ্যিক ধনীদের জন্য একটি আরম্ভ বিন্দু।

আস্থা হচ্ছে সব ‘অলৌকিক ঘটনার’ মূলভিত্তি এবং সব রহস্যের মূল যা বিজ্ঞানের নিয়ম দ্বারা পর্যবেক্ষণ করা যায় না।

আস্থা হচ্ছে ব্যর্থতার জন্য একমাত্র জানা প্রতিষেধক।

আস্থা হচ্ছে সেই উপাদান, ‘রাসায়নিক’ কিছু যা প্রার্থনার সঙ্গে মিশ্রিত হয় তখন একজন মানুষকে অসীম বুদ্ধিমত্তার সাথে সরাসরি যোগাযোগ করিয়ে দেয়।

আস্থা হচ্ছে সেই উপাদান যা সাধারণ চিন্তা তরঙ্গকে ঐশ্বরিক সমতুল্যে রূপান্তরিত করে। মানুষের সসীম মনকে উচ্চস্তরে নিয়ে যায়।

আস্থা শুধুমাত্র একটি মাধ্যম যার মধ্য দিয়ে অসীম বুদ্ধিমত্তার মহাজাগতিক শক্তিকে মানুষ নিজের কাজে লাগাতে এবং ব্যবহার করতে পারে।

আগামীতে লেখা প্রতিটি বর্ণনাই উক্ত বিবৃতির প্রমাণ দিতে সক্ষম!

প্রমাণটি হচ্ছে সরল এবং সহজেই কর্তৃত্ব করার মতো। এটা স্বপরামর্শের সূত্রের মধ্যে নিহিত। এখন আমরা আমাদের মনোযোগকে কেন্দ্রীভূত করব আত্ম-পরামর্শ বা স্বপরামর্শ বিষয়টির ওপর, আর খুঁজে বের করব যে এটা কী এবং এটা কী অর্জন করতে সক্ষম।

এটা একটা ভালোভাবে জানা ব্যাপার যে সত্যিকারভাবে যদি কেউ নিজের কাছে পুনঃব্যক্ত করতে থাকে যদিও বিবৃতিটি সত্য বা মিথ্যা হতে পারে তবুও সে তা বিশ্বাস করতে শুরু করবে। যদি একজন ব্যক্তি একটি মিথ্যা বিবৃতি বারবার নিজের কাছে ব্যক্ত করে, তবে সে ধীরে ধীরে সেই মিথ্যা বক্তব্যকেই সত্য বলে গ্রহণ করে নেয়। অধিকন্তু, সে বিশ্বাস করবে যে এটাই সত্য। প্রত্যেক ব্যক্তিই যা সে আছে, কারণ তার কর্তৃত্বকারী চিন্তা যা নিয়ে সে তার মনকে ভরাট করেছে। সারাক্ষণ একজন মানুষ যা চিন্তা করে সে তো তাই। চিন্তাগুলো যা একজন ব্যক্তি গভীরভাবে লালন করে তার নিজ মনে, আর সযতেœ উৎসাহ দেয় এবং যার সাথে সে যেকোন একটি বা একাধিক আবেগকে মিশ্রিত করে, চলার মতো শক্তি গঠন করে, যা সরাসরি এবং নিয়ন্ত্রণ করে তার প্রত্যেক পদক্ষেপ, পরিশ্রম ও কাজকে!

আসুন, এখন একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং সত্য বিবৃতি দেখি:

যেকোনো অনুভবে লব্ধ আবেগ দ্বারা যে চিন্তা মিশ্রিত হয় তা একটি ‘চৌম্বক’ শক্তি গঠন করে যা ইথারের তরঙ্গের থেকে অন্যান্য সমরূপী চিন্তাকে আকর্ষণ করে। একটি চিন্তা যা আবেগ দ্বারা ‘চৌম্বকায়িত’ হয়, এটাকে হয়তো একটি শস্য দানার সাথে তুলনা করা যায়। যখন একে উর্বর জমিতে রোপণ করা হয়, তখন অঙ্কুরোদগম হয়, বৃদ্ধি পায় এবং উত্তরোত্তর নিজে নিজেই বৃদ্ধি পায় ততক্ষণ পর্যন্ত যতক্ষণ পর্যন্ত না এটা সেই ছোট্ট এক বীজ থেকে অগণিত লক্ষাধিক সেই একই ধরনের বীজে পরিণত হয়!

ইথার হচ্ছে মহাজাগতিক রশ্মির স্তুপ যা তরঙ্গের শ্বাশত শক্তির এক বিরাট ভা-ার। এটা একই সাথে ধ্বংসাত্মক তরঙ্গ এবং গঠনমূলক তরঙ্গের দ্বারা তৈরি। এটা সব সময়ের ভীতির তরঙ্গ, দরিদ্রতা, রোগ, ব্যর্থতা, দুর্দশার তরঙ্গ বহন করে; আবার সমৃদ্ধির তরঙ্গ, স্বাস্থ্য, সাফল্য ও সুখের তরঙ্গও বহন করে। যেমন এটা সংগীতের শত যন্ত্রের সুর এবং মানুষের কণ্ঠস্বর বহন করে। সবকিছুই প্রত্যেকের জন্য আলাদাভাবে বহন করে এবং এটা নিজ নিজ পরিচয়ের সাথে রেডিও যন্ত্রের তরঙ্গও বহন করে চলেছে।

ইথারের এত বড় গুদামঘর থেকে মানুষের মন অবিরত তরঙ্গকে আকর্ষণ করছে। যার মনের চিন্তা যেমন সে ঠিক তেমন চিন্তাকেই আকর্ষণ করছে। যেকোনো চিন্তা, আইডিয়া, পরিকল্পনা বা উদ্দেশ্য যা একজন তার নিজ মনে ধারণ করে, তাই সে ইথারের তরঙ্গ থেকে আকর্ষণ করে। একজনের চিন্তা তরঙ্গের সাথে সম্পর্কিত যেসব চিন্তা তাই সে ইথারের ভা-ার থেকে আকর্ষণ করে। এই আকর্ষণ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পায়। একজনের মন যত বেশি একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যে চিন্তা করে সে তত বেশি সেই সম্পর্কিত বুদ্ধি বা আইডিয়াকে আকর্ষণ করতে থাকে। [এজন্যই দেখবেন, আপনার মাথায় কোন আইডিয়া এসেছে, আবার আপনার কাছের কোন বন্ধুও ঠিক একই রকম কিছু চিন্তা করেছে। কারণ চিন্তাগুলো আমাদের আশেপাশেই ঘোরে। আমরা কেবল আমাদের আইডিয়া সংক্রান্ত চিন্তাগুলোকে আকর্ষণ করি।]

এখন আমাদেরকে শুরুর সেই বিন্দুতে ফিরে যাওয়া উচিত এবং আপনাকে জানানো দরকার যে কীভাবে সত্যিকারের একটি আইডিয়া, বীজ, পরিকল্পনা বা উদ্দেশ্য মনে রোপণ করতে হয়। আশা করি তথ্যটি আপনি সহজেই বুঝতে পারবেন: আপনার মনে যেকোন আইডিয়া, পরিকল্পনা বা উদ্দেশ্য বসাতে পারবেন চিন্তাটি বারবার চিন্তা করার মাধ্যমে। এজন্যই আপনাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল যে আপনার প্রধান উদ্দেশ্যের একটি লিখিত বিবৃতি দিতে বা নির্দিষ্ট প্রধান লক্ষ্য দিতে। এটাকে স্মৃতিতে ধরে রাখুন এবং বারবার মনে করুন, জোরে জোরে বলুন, দিনের পর দিন, যতক্ষণ পর্যন্ত না এই শব্দ তরঙ্গ আপনার অবচেতন মনে পৌঁছায়।

আমরা তাই যা আমরা চিন্তা করি। কারণ হচ্ছে আমরা যা চিন্তা করি এই চিন্তা তরঙ্গগুলো আমরা আমাদের প্রাত্যহিক পরিবেশের উদ্দীপনা থেকেই তুলে নিই এবং গ্রহণ করি।

এগুলো সমাধান করলে আপনি দুর্ভাগ্যজনক পরিবেশের প্রভাব থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখতে পারবেন এবং আপনার জীবনকে নিজের আদেশ অনুযায়ী গঠন করতে পারবেন। মানসিক সম্পদ ও বোঝাগুলো উদ্ভাবনের মাধ্যমে আপনি আবিষ্কার করবেন যে আপনার সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হচ্ছে আত্মবিশ্বাসের অভাব। এই প্রতিবন্ধকতাকে অতিক্রম করা যায় এবং স্বপরামর্শের সহায়তায় ভীরুতাকে সাহসে পরিণত করা যায়। স্বপরামর্শের এই পদ্ধতি খুবই সহজ এবং ব্যবহারযোগ্য। এটা হচ্ছে একটি ইতিবাচক চিন্তা পদ্ধতি যা লিখতে হবে এবং মুখস্ত করতে হবে। যতক্ষণ না আপনার অবচেতন মনে এই কথা ঠিকভাবে বসছে ততক্ষণ আপনাকে বারবার নিজেকে স্বপরামর্শের বাক্যগুলো বলে যেতে হবে।


আত্মবিশ্বাস গঠন পদ্ধতি

প্রথমত। আমি জানি যে আমার জীবনের নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য পূরণ করার সামর্থ্য আমার আছে। এজন্য আমি নিজের কাছে অধ্যবসায় চাই, এটা পাওয়ার প্রতি অবিরাম কাজ করে যাওয়ার শক্তি চাই এবং আমি এখানে ও এখনই ওয়াদা করছি যে আমি আমার জীবনের একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য পূরণে সর্বাত্মক চেষ্টা করব।

দ্বিতীয়ত। আমি অনুভব করি যে আমার মনের কর্তৃত্বকারী চিন্তাগুলোই পর্যায়ক্রমে আমার কাজের মাধ্যমে প্রকাশ পাবে এবং এগুলো যথারীতি বাস্তবে রূপান্তরিত হবে। এজন্য, আমি আমার চিন্তাগুলোকে ৩০ মিনিটের জন্য প্রতিদিন মনে করব, সেই ব্যক্তির কথা চিন্তা করব যে রকম ব্যক্তি আমি হতে চাই, যাতে আমার মনে পরিষ্কারভাবে সেই ব্যক্তির ছবি তৈরি হয়।

তৃতীয়ত। আমি জানি যে স্বপরামর্শের সূত্রের মাধ্যমে যেকোনো আকাক্সক্ষা যা আমি অধ্যবসায়ের সাথে আমার মনে ধরে রাখব তা পর্যায়ক্রমে একটি রাস্তা খুঁজে বের করবেই যাতে এটা বাস্তবিক পথে বের হয়ে আসতে পারে। এজন্য আমি প্রতিদিন আমার আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধির জন্য ১০ মিনিট সমর্পণ করব।

চতুর্থত। আমি পরিষ্কারভাবে আমার জীবনের একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য লিখব এবং আমি কখনো আমার চেষ্টা থামাব না যতক্ষণ পর্যন্ত না আমি এটা অর্জন করার মতো পর্যাপ্ত আত্মবিশ্বাস তৈরি করতে পারছি।

পঞ্চমত। আমি পুরোপুরি বুঝতে পারছি যে, কোন সম্পদ স্থায়ী নয়; যদি-না আমি একে সত্য এবং ন্যায়ের ওপর প্রতিষ্ঠা করি। এজন্য আমি এমন কোন লেনদেন করব না যাতে সকলের উপকার না হয়। আমি মানুষকে আমার ইচ্ছা শক্তি ব্যবহার করে কাছে টেনে নিব এবং অন্যান্য মানুষকে সাহায্য করে সফল হবো। আমি মানুষের সেবা গ্রহণ করব, কারণ আমারও ইচ্ছা আছে তাদের সেবা করার। আমি মানবজাতির প্রতি ভালোবাসা তৈরির মাধ্যমে ঘৃণা, হিংসা, ঈর্ষাকাতরতা, স্বার্থপরতা এবং ঘৃণাপূর্ণ মন্তব্য ত্যাগ করব। কারণ আমি জানি যে অন্যদের প্রতি একটি নেতিবাচক মনোভাব আমাকে কখনো সাফল্য এনে দিবে না। অন্যরা আমাকে বিশ্বাস করার মতো কারণ আমি তৈরি করব, কারণ আমি তাদের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করব এবং আমার নিজের ওপরও বিশ্বাস করব।

আমি এই পদ্ধতিতে স্বাক্ষর করব, স্মৃতিতে ধারণ করব এবং প্রতিদিন একবার উচ্চস্বরে বলব। আমার পূর্ণ আস্থা সহকারে কাজটি করব যাতে পর্যায়ক্রমে এটা আমার চিন্তাকে এবং কাজকে প্রভাবিত করেÑযাতে আমি একজন আত্মনির্ভরশীল এবং সাফল্যম-িত ব্যক্তি হতে পারি।

আবারো এই পদ্ধতি সম্পর্কে বলি এটা একটা প্রাকৃতিক নিয়ম যা কোন মানুষই আজ পর্যন্ত ব্যাখ্যা করতে পারেনি। এটা সকল সময়ের বিজ্ঞানীদের হতবুদ্ধ করেছে। মনোবিজ্ঞানীরা এই নিয়মের নাম দিয়েছেন ‘স্বপরামর্শ’ এবং এটা এভাবেই চলছে।

এই নিয়মকে যে নামেই ডাকা হোক না কেন তা কম গুরুত্বপূর্ণ। গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে এটা মানবজাতির যশ এবং সাফল্যের জন্য কাজ করে। অবশ্য এটাকে গঠনমূলকভাবে ব্যবহার করতে হবে। আর যদি এটা ধ্বংসাত্মকভাবে ব্যবহার করা হয় তবে এটা ঠিক ততটাই দ্রুতভাবে আপনাকে ধ্বংস করবে। এই বিবৃতিতে আপনি একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার বুঝতে পারবেন যে, তারা যারা ব্যর্থতায় নিচে নেমে যায় এবং তাদের জীবন দরিদ্রতায়, দুঃখে ও দুর্দশায় যাপন করে, এমনটা করে কারণ তারা নেতিবাচক পদ্ধতিতে স্বপরামর্শের নিয়ম পালন করে। এটা আপনি এই ব্যাপার থেকে খুঁজে পাবেন যে, সব তরঙ্গ স্পন্দনেরই প্রবণতা থাকে নিজেদেরকে বাস্তবিক রূপে কাপড়ের সেলাইয়ের মতো একত্রিত রাখা। তারমানে আপনি যদি ইতিবাচক চিন্তা করেন, ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করেন তবে আপনার আশেপাশের সব জায়গা থেকে ইতিবাচক চেতনাই আপনার দিকে ধাবিত হবে। আর যদি নেতিবাচক চিন্তা করেন, দুঃখ-দুর্দশা এবং বিপদের আশঙ্কা করেন তবে সেই ব্যাপারগুলোই আপনার দিকে ধাবিত হবে।

অবচেতন মন (যে রাসায়নিক প্রয়োগশালাতে সব চিন্তার স্পন্দন মিশ্রিত হয় এবং বাস্তবে রূপান্তরিত হওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়), গঠনমূলক বা ধ্বংসাত্মক চিন্তার স্পন্দনের মধ্যে কোন ধরনের পার্থক্য করে না। এটা কাজ করে সেসব বিষয় দিয়ে যা আমরা একে আমাদের চিন্তার স্পন্দনের মাধ্যমে খাওয়াই। অবচেতন মন ভয়ের দ্বারা চালিত একটি চিন্তাকেও বাস্তবে রূপান্তর করে দিবে। আবার এটা ঠিক ততটাই দ্রুত সাহস বা আস্থা দ্বারা চালিত একটি চিন্তাকে বাস্তবে রূপান্তর করে দিবে।

[অনুবাদকের কথা– কম্পিউটারের ভাষায় একটি কথা আছেÑ ‘গিগো’ বা এওএঙ  এর পূর্ণরূপ হচ্ছে এধৎনধমব ওহ, এধৎনধমব ঙঁঃ. এর বাংলা মানে হচ্ছে আপনি যদি অস্বাস্থ্যকর খাবার খান তবে ডাইরিয়া হবে। আপনার অবচেতন মনও ঠিক একইভাবে কাজ করে। আপনি যদি সাহসী চিন্তা করেন, বিশ্বাস করেন যে আপনি আপনার জীবনের একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য পূরণ করতে পারবেন তবে আপনি ঠিকই পারবেন। আর যদি রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ধূলোবালিতে মাখা চা পান করতে করতে চিন্তা করেন এটা আমার দ্বারা সম্ভব নাÑতবে তাও সত্যÑআপনার পক্ষে সম্ভব না।]

চিকিৎসা ইতিহাসের পাতাগুলোতে এরকম অনেক ঘটনা ব্যাখ্যা সহকারে আছে। যার নাম ‘পরামর্শমূলক আত্মহত্যা।’ অন্য যেকোন উপায়ে আত্মহত্যা করার মতো একজন ব্যক্তি নেতিবাচক পরামর্শ দিয়েও আত্মহত্যা করতে পারে। একটি ঘটনা উল্লেখ করছি। একবার ইউরোপের এক শহরে এক ব্যক্তি যার নাম জোসেফ গ্রান্ট, তিনি এই ঘটনা ঘটান। তিনি ছিলেন একজন ব্যাংক কর্মকর্তা। তিনি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সম্মতি ব্যতীত ব্যাংক থেকে একটি বড় অংকের টাকা ‘ঋণ’ নিয়েছিলেন। তিনি জুয়া খেলে টাকা হারিয়ে ফেলেন। এক সময়, ব্যাংকের হিসাব নিরীক্ষা করে দেখার জন্য হিসাব নিরীক্ষক আসেন। গ্রান্ট ব্যাংক থেকে বের হয়ে আসেন, স্থানীয় একটি হোটেলে ঘর ভাড়া নেন এবং তিনদিন পর যখন ব্যাংক কর্তৃপক্ষ তাকে খুঁজে পেল, তিনি একটি বিছানায় শোয়া অবস্থায়, বিলাপ করছেন এবং গোঙাচ্ছেন। বারবার এই কথাই বলে যাচ্ছেন, ‘হায় আল্লাহ! এটা আমাকে মেরে ফেলবে! আমি এই অসম্মানের সামনে দাঁড়াতে পারব না।’ কিছু সময় পরই তিনি মারা যান। ডাক্তার ঘোষণা করে যে এটা একটা ‘মানসিক আত্মহত্যার’ ঘটনা।

স্বপরামর্শ ঠিক বিদ্যুতের মতোই। বিদ্যুৎ যেমন গঠনমূলকভাবে ব্যবহার করলে কারখানার চাকা ঘোরে এবং প্রয়োজনীয় সেবা প্রদান করে। আবার বিপরীতভাবে ব্যবহার করলে ধ্বংস নেমে আসে। ঠিক তেমনি স্বপরামর্শ এর নিয়ম আপনাকে শান্তি এবং উন্নতির পথে নিয়ে যাবে অথবা দুর্দশা, ব্যর্থতা এবং মৃত্যুর ভূমিতে নামিয়ে দিবে। এটা নির্ভর করবে আপনার বুঝজ্ঞান এবং ব্যবহারের ওপর।

আপনি যদি আপনার মনকে ভয়, সন্দেহ ও অবিশ্বাস দিয়ে ভরিয়ে রাখেন, আপনার ক্ষমতার সাথে যুক্ত করেন এবং অসীম বুদ্ধিমত্তার শক্তিকে সেদিকে ব্যবহার করেন, স্বপরামর্শের সূত্র আপনার এই উৎসাহকে (যা অবিশ্বাসের সাথে) গ্রহণ করবে এবং আপনার অবচেতন মন এই ধারা অনুযায়ী কাজ করে একে বাস্তবে পরিণত করবে।

এই বিবৃতি ঠিক সেই রকমই সত্য, যতটা সত্য দুই আর দুই চার হয়!

বাতাসের মতো, যা একটি জাহাজকে নিয়ে যায় পূর্বদিকে এবং অন্যটিকে নিয়ে যায় পশ্চিমে। স্বপরামর্শের সূত্র আপনাকে উপরে তুলতে পারে অথবা টেনে নিচে নামাতে পারে। এটা আপনার ওপর নির্ভর করে যে আপনি কীভাবে এবং কোনদিকে আপনার চিন্তার পাল ঠিক করবেন।

স্ব-পরামর্শের সূত্র দ্বারা যেকোন ব্যক্তি তার কল্পনায় কোন দ্বিধাদ্বন্দ্বের ভাব না রেখেই সাফল্যের শিখরে উঠতে পারে।

আপনার মস্তিষ্কের এমন কোন জায়গায় যেখানে আপনি তৈরি হওয়ার চেষ্টা করছেন (হয়তো আপনার মস্তিষ্কের কোষগুলোতে) সেখানে এক দৈত্য ঘুমিয়ে আছে। আপনার ভেতরের ঘুমন্ত দৈত্যকে জাগিয়ে তুলুন।  ভয় পাবেন না, এটাই হচ্ছে আপনার সাফল্যের বীজ। যদি দৈত্য জেগে ওঠে এবং কাজে পরিণত হয় তাহলে আপনাকে এমন উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারে যেমন আপনি হয়তো কখনো আশা করেননি।

ঠিক যেমন একজন দক্ষ সংগীতজ্ঞ খুব সুন্দরভাবে ভায়োলিনের তার থেকে সংগীত নিঃসৃত করে। তেমনিভাবে আপনার ভেতরের প্রতিভাবানকে জাগিয়ে তুলুন যা আপনার মস্তিষ্কে ঘুমিয়ে আছে এবং একে এই কারণে প্রয়োগ করুন যাতে আপনাকে সফলতার সর্বোচ্চ শিখরে ধাবিত করে। আপনি যে ধরনের সাফল্য চান তার দিকেই আপনাকে ধাবিত করবে।

আব্রাহাম লিংকন যতবার চেষ্টা করেছেন ততবার ব্যর্থ হয়েছেন যতক্ষণ পর্যন্ত না তিনি ৪০ বছর বয়স পার করেছেন। তাকে কেউ চিনতো না, যতক্ষণ না তার জীবনে একটি মহান অভিজ্ঞতা আসে, তার হৃদয় ও মন থেকে তার ঘুমন্ত প্রতিভাবান জেগে ওঠে এবং পৃথিবীকে একজন মহান পুরুষ উপহার দেয়। সেই ‘অভিজ্ঞতা’ ছিল দুঃখ ও ভালোবাসার আবেগ দ্বারা মিশ্রিত। এটা আসে অ্যানি রুটলেজের মাধ্যমে, একমাত্র নারী যাকে তিনি সত্যিকারেই ভালোবেসে ছিলেন।

এটা একটা জানা ব্যাপার যে ভালোবাসার আবেগ আস্থা নামক সুস্থির আবেগের সমান এবং এই কারণেই ভালোবাসা খুব গভীরভাবে একজনের চিন্তার তরঙ্গকে তাদের আত্মিক সমতুল্যে রূপান্তরিত করে। গবেষণার সময় লেখক এই আবিষ্কার করেন। হাজারো সফল পুরুষদের অসামান্য অবদান থেকে এবং তাদের কর্মজীবন বিশ্লেষণ করে লেখক এই তথ্য পেয়েছেন যে, তাদের প্রায় প্রত্যেকের সাফল্যের পিছনে একজন নারীর ভালোবাসা প্রভাবিত করেছে। ভালোবাসা নামক এই আবেগ মানব হৃদয়ে ও মস্তিষ্কে একটি পছন্দনীয় চৌম্বকীয় আকর্ষণ ক্ষেত্র তৈরি করে যার দ্বারা একটি উচ্চমানের এবং ভালো মানের এক তরঙ্গ সৃষ্টি হয় যা ইথারে খুব ভালোভাবেই ভেসে যেতে পারে।

আমরা এখন আস্থার ক্ষমতা বিবেচনা করব। এটা মানুষের ওপর কর্তৃত্ব করে। একজন ব্যক্তিকে এই পৃথিবীর সব মানুষই খুব ভালোভাবে চেনে। তিনি হলেন ভারতের মহাত্মা গান্ধী। এই ব্যক্তির মাধ্যমে পৃথিবীর সভ্যতা এক অত্যাশ্চার্যজনক ঘটনা পরিলক্ষিত করেছে, যা ছিল আস্থার সম্ভাব্যতা সম্বন্ধে। গান্ধী ছিলেন তৎকালীন সময়ের সবচেয়ে প্রভাব বিস্তারকারী ব্যক্তি। তার প্রভাব এখনও বজায় আছে। যদিও তার বৈষ্যিক ক্ষমতা: যেমন অর্থ, যুদ্ধ জাহাজ, সৈনিক এবং যুদ্ধের সমরাস্ত্র ছিল না। গান্ধীর কোন অর্থ ছিল না, তার কোন বাড়ি ছিল না, তার নিজের জন্য কোন কেতাবী পোশাক ছিল না, কিন্তু তার ক্ষমতা ছিল অসীম। তিনি কীভাবে সেই ক্ষমতা সৃষ্টি করলেন?

তিনি তার বোধজ্ঞান থেকে আস্থার সূত্র প্রয়োগ করেন এবং ২০ কোটি মানুষের মধ্যে আস্থার এই ক্ষমতা প্রয়োগ করেন।

গান্ধী যা সম্পন্ন করেছেন, যা ছিল আস্থার প্রভাব তা পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী সেনাবাহিনীর ক্ষমতাও করতে পারে না এবং তা সৈন্য ও সেনা সরঞ্জামের দ্বারা কখনো সম্ভব নয়। তার পদক্ষেপ অত্যাশ্চর্যজনকভাবে ২০ কোটি মানুষের মনকে প্রভাবিত করেছে। তাদেরকে একত্রিত করেছে এবং দলগতভাবে একসাথে নিয়ে গেছে, যেন একটি মন।

একমাত্র আস্থা ব্যতীত কি বিশ্বের অন্য কোন শক্তি এটা করতে পারে? এমন একদিন আসবে যখন কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা আস্থার সম্ভাব্যতা আবিষ্কার করবে। সেই দিনটি শীঘ্রই আসছে, যেন ঊষালগ্নে। আজকের পৃথিবী প্রচুর সুযোগে পরিপূর্ণ। যখন থেকে অর্থনৈতিক মন্দা শুরু হয়েছে তখন থেকেই এই সুযোগের সূচনা। অর্থনৈতিক এই মন্দাই স্বাক্ষ্য দেয় যে আস্থার অভাব ব্যবসায় কী করতে পারে।

নিশ্চিতভাবেই, সভ্যতা একটি পর্যাপ্ত সংখ্যক বুদ্ধিমান মানুষ তৈরি করে দিয়েছে যারা এই মহান শিক্ষাকে ব্যবহার করতে পারবে যা অর্থনৈতিক মন্দার মাধ্যমে বিশ্বের মানুষকে শিখিয়ে দিয়ে গেল। এই মন্দার সময় বিশ্ব দেখল যে সর্বব্যাপী ভয় কলকারখানা এবং ব্যবসার চাকাকে শক্তিহীন করে দেয়। এই অভিজ্ঞতা থেকে যারা শিক্ষা গ্রহণ করবে তারাই আগামীর ব্যবসা ও কারখানার নেতা হয়ে উঠবে। এই নেতারা আসবে অজানা মানুষের সারি ও নথি থেকে, যারা এখন লৌহ ব্যবসায়, কয়লা খনিতে, গাড়ির কারখানায় শ্রম দিচ্ছে এবং দেশের ছোট নগর ও শহরে যারা বাস করছে।

[লেখক মূলত ১৯২৯ সালের একটি ব্যবসায়িক বিপর্যয়ের কথা উল্লেখ করেছেন। এটা আরম্ভ হয় ওয়াল স্ট্রিটের শেয়ারবাজার ধ্বসের মাধ্যমে। একে উইকিপিডিয়ায় মহাবিপর্যয় বলে উল্লেখ করা হয়। এর স্থায়িত্ব ছিল ১৯২৯ থেকে ১৯৪১ পর্যন্ত। সারা বিশ্বের জিডিপি বা মোট উৎপাদন প্রায় ১৫ শতাংশ হ্রাস পায়। এই মহামারীতে ধনী-গরিব সবাই ক্ষতিগ্রস্থ হয়। কেবল আমেরিকাতেই বেকার সংখ্যা দাঁড়ায় ২৫ শতাংশের ওপরে। কোন কোন দেশে এই সংখ্যা ৩৩ শতাংশও ছাড়িয়ে যায়। 

এ সময় অনেক আমেরিকান লোক দেশ ত্যাগ করে কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও সাউথ আফ্রিকাতে চলে যায়। এদের মধ্যে আয়ারল্যান্ডে চলে যাওয়া উল্লেখযোগ্য একজন ছিলেন ফ্রাঙ্ক ম্যাকউর্ট। এই দুর্যোগ পুরো বিশ্বের অর্থনৈতিক চিন্তাকেই বদলে দেয়। যেমন লেখক নেপোলিয়ন হিল আবিষ্কার করেন। তখনকার দিনে আমেরিকান ব্যবসায় এত বেশি মাত্রায় লোভ ও মুনাফার প্রতি প্রচ- আকাক্সক্ষা ছড়িয়ে পড়ে যা কেবল বাংলাদেশের রমজান মাসের কিছু অতি মুনাফা লোভী ব্যবসায়ীর সাথেই তুলনা করা যায়।] 

ব্যবসার একটি পুনর্গঠন প্রয়োজন। এই ব্যাপারে কোন ভুল নেই! অতীতে মানুষ ব্যবসা করত অর্থনৈতিক শক্তি ও ভয় দেখিয়ে। এগুলো এখন আরো ভালো সূত্রÑআস্থা এবং সহযোগিতা দ্বারা পরিবর্তিত হবে। একজন ব্যক্তি যে দৈনিক বেতনের বিনিময়ে শ্রম দেয় সে এরচেয়েও বেশি পাবে; অধিকন্তু এসব শ্রমজীবীরা ব্যবসা থেকে ঠিক সেই পরিমাণ লভ্যাংশ পাবে যারা ব্যবসার জন্য মূলধন সরবরাহ করে। কিন্তু প্রথমে তাদেরকে অবশ্যই তাদের মালিকদের আরও বেশি দিতে হবে এবং সামান্য ব্যাপার নিয়ে ঝগড়া-বিবাদ করা থামাতে হবে, যা বেতন বৃদ্ধি, সুযোগ-সুবিধার কারণে লেগেই থাকে। তাদেরকে অবশ্যই লভ্যাংশের ন্যায্য দাবির যোগ্যতা অর্জন করতে হবে।

অধিকন্তু, সবার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জিনিস হচ্ছে যে তারা এমন পরিচালক দ্বারা পরিচালিত হবে যারা মহাত্মা গান্ধী যে সূত্র কাজে লাগিয়েছে সেগুলোকে বুঝবে এবং প্রয়োগ করবে। একমাত্র এভাবেই পরিচালকরা তাদের অনুসারীদের পূর্ণ সহযোগিতা পাবে যা গঠন করবে শক্তির উচ্চ পর্যায় এবং সবচেয়ে স্থায়ী আকার।

আজকের যান্ত্রিক যুগে যেখানে আমরা বসবাস করি এবং যেখান থেকে আমাদের সভ্যতা মাত্র উঠছে, এখানে ব্যক্তির আত্মাকে বের করে নেওয়া হয়েছে। এর পরিচালক তাদের কর্মচারীদের এমনভাবে চালায় যেন তারা ঠান্ডা যন্ত্রের টুকরার মতো; যারা তর্ক করে সেসব কর্মচারীর ওপর তাদের মালিকরা শক্তি প্রয়োগ করে, মালিকরা যেকোন মূল্যে শ্রমিকদের সচেতনতাকে ঠেকিয়ে রাখতে চায়, শুধু পেতে চায় এবং দিতে চায় না কিছুই। আগামীর ভবিষ্যদ্বাণী হবে মানব সুখ ও সন্তুষ্টি এবং যখন আমাদের মন এই ধরনের অবস্থা অর্জন করবে তখন উৎপাদন নিজে থেকেই চলতে থাকবে। আরও দক্ষতার সাথে যেকোন জিনিস সম্পন্ন হবে। বর্তমানে মানুষ তাদের প্রত্যেক শ্রমিকের আস্থা ও স্বতন্ত্র আগ্রহকে মিশ্রণ করতে হয়তো পারে না বা করে না। এই অবস্থার উন্নতি শীঘ্রই ঘটবে।

কারণ ব্যবসা ও কারখানা চালনা করতে আস্থা ও সহযোগিতা দরকার। আপনাদের বুঝতে হবে যে কারখানা মালিক ও ব্যবসায়ীরা আজকের বিশাল সম্পদের মালিক হয়েছে অনেক কিছু দিয়ে। তারা আজকের যেকোন সম্পদ পাওয়ার আগে বহুকিছু দিয়েছে। তাদের শ্রম, বুদ্ধি, সময় ও অর্থ দিয়েছে। ব্যাখ্যার জন্য একটি ঘটনা নির্বাচন করা হলো। যার জন্য আমরা ফিরে যাচ্ছি ১৯০০ সালের দিকে। যখন ইউনাইটেড স্টেস স্টিল কর্পোরেশন গঠিত হয়েছিল। যখন আপনি ঘটনাটি পড়বেন, তখন এর প্রাথমিক ব্যাপারগুলো মনে রাখবেন এবং আপনি বুঝতে পারবেন যে কীভাবে আইডিয়া, বুদ্ধি এবং ধারণা বিশাল সৌভাগ্যে রূপান্তরিত হয়।

প্রথমত, বিশাল ইউনাইটেড স্টেস স্টিল কর্পোরেশন জন্ম নিয়েছিল চার্লস এম. সোয়েব এর মনে, একটি আইডিয়া আকারে। তিনি একে তার কল্পনার মাধ্যমে সৃষ্টি করেছিলেন! দ্বিতীয়ত, তিনি তার ধারণার সাথে আস্থা মিশ্রণ করেন। তৃতীয়ত, তিনি একটি পরিকল্পনা উদ্ভাবন করেন যাতে তার আইডিয়াকে এর বাহ্যিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতায় রূপান্তর করতে পারেন। চতুর্থত, তিনি তার পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করেন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ব্যবসায়িক সমিতির সামনে বক্তব্য দেন। এই বক্তব্যের মাধ্যমেই তিনি তার আইডিয়াকে সবার সামনে তুলে ধরেন। পঞ্চমত, তিনি একে তার পরিকল্পনায় প্রয়োগ করেন এবং অধ্যবসায়ের সাথে অনুসরণ করেন। এর পিছনে ছিল দৃঢ় বিশ্বাস এবং অটল সিদ্ধান্ত। যতক্ষণ পর্যন্ত না এটা সম্পন্ন হবে ততক্ষণ পর্যন্ত কাজ করে যাওয়ার একটি দৃঢ় মানসিকতা। ষষ্ঠত, তিনি একটি জ্বলন্ত আকাক্সক্ষা দ্বারা সাফল্যের জন্য রাস্তা প্রস্তুত করেন।

যদি আপনি তাদের মধ্যে একজন যিনি প্রায়ই বিস্মিত হন যে কীভাবে মহান সৌভাগ্য অর্জিত হয়, ইউনাইটেড স্টেস স্টিল কর্পোরেশন সৃষ্টির এই ঘটনা আপনাকে আলোকিত করবে। যদি আপনার কোন সন্দেহ থাকে এই সম্বন্ধে যে চিন্তা করুন এবং ধনী হোন, এই ঘটনা সেই সন্দেহকে দূর করবে। কারণ আপনি ইউনাইটেড স্টেস স্টিল কর্পোরেশন ঘটনার মধ্যে সরাসরি দেখবেন সেই পদ্ধতি যাতে এ বইয়ে বর্ণিত ১৩টি সূত্রের এক মুখ্য অংশ প্রয়োগ করা হয়েছে। এই বিস্ময়কর ঘটনা হচ্ছে একটি আইডিয়ার ক্ষমতা। জন লোয়েল নিউ ইয়র্ক সংবাদপত্রে একে নাটকীয়ভাবে বর্ণনা করেন। তার সৌজন্যে প্রতিবেদনটি এখানে পুনরায় মুদ্রণ করা হলো।


শত কোটি টাকার এক বক্তব্য

‘১৯০০ সালের ১২ই ডিসেম্বর বিকালবেলা। দেশের প্রায় ৮০ জন সম্ভ্রান্ত অর্থবান মানুষ ইউনিভার্সিটি সমিতির সান্ধ্যভোজে একত্রিত হয়। সমিতির পক্ষ থেকে একটি সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এই সংবর্ধনা দেওয়া হবে একজন তরুণকে সম্মান জানানোর জন্য। তবে সমিতির সদস্যরা তখনও এটা বুঝতে পারেনি যে তারা আমেরিকান কারখানা ইতিহাসের সর্বাধিক তাৎপর্যময় অধ্যায়ের স্বাক্ষী হতে যাচ্ছে।

‘এই তরুণ ছিলেন ৩৮ বছর বয়সী ইস্পাত ব্যবসায়ী চার্লস এম. সোয়েব। সমিতির অন্যতম দুই সদস্য জে. এডওয়ার্ড সিমন্স এবং চার্লস স্টিওয়ার্ট স্মিথ সোয়েবের সাথে আগেই দেখা করেছিলেন। তারা সোয়েবের সাথে তার অফিস পিটাসবুর্গে দেখা করেছিলেন। তখন সোয়েবের অতিথিপরায়ণতা দেখে তারা মুগ্ধ হয়েছেন। এজন্য তারা আজকের এই ভোজসভার আয়োজন করে যাতে এদিককার, মানে পূর্বদিকের অর্থনৈতিক সমাজের সাথে সোয়েবকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া যায়। তবে তারা সোয়েবকে সতর্ক করে দেয় যে তাকে তার বক্তব্যে কৃপণ হতে হবে এবং মূল দিকগুলোকেই আগে তুলে ধরতে হবে। তা না হলে তার গায়ে লাগানো নিউ ইয়র্কের শার্টও কোন কাজে দিবে না।

‘এমনকি সেখানে জন পাইয়াপন্ট মরগানের মতো পাকা বিনিয়োগকারীও উপস্থিত ছিল। তিনি সোয়েবের ডান দিকে বসলেন যেন তার রাজকীয় পদে অসীন। তার উপস্থিতি সান্ধ্যভোজ টেবিলের লাবণ্যকে আরও বৃদ্ধি করেছে। পুরো ঘটনা এত অল্প সময়ের মধ্যে ঘটে যায় যে এটা কোন সংবাদপত্রেই স্থান পায়নি।

‘দুইজন নিমন্ত্রণকারী এবং তাদের বিশেষ অতিথিরা নিজেদের মতো করে যথারীতি ৭-৮ পদের খাবার গ্রহণ করল। সেখানে সোয়েব ও অন্যদের মধ্যে খুব সামান্যই আলাপ হয়েছিল এবং তা কী ছিল এটা অপ্রকাশিত। কিছু ব্যাংকার এবং বিনিয়োগকারী সোয়েবের সাথে সাক্ষাৎ করে। সোয়েবের ব্যবসা বড়ই হয়েছে ব্যাংকগুলোকে সাথে নিয়ে। অথচ এখানে তাকে ভালো করে কেউ চেনে না। কিন্তু সন্ধ্যা শেষ হওয়ার আগেই তারা ও তাদের সাথে অর্থ বিনিয়োগকারী মরগানের পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গেল এবং শত কোটি টাকার একটি শিশু, ইউনাইটেড স্টেস স্টিল কর্পোরেশন ভূমিষ্ট হলো।

‘ইতিহাসের জন্য এটা দুর্ভাগ্যজনক যে, রাতের খাবারে চার্লস সোয়েব যে বক্তব্য দিয়েছিলেন তার সংরক্ষিত কোন নথি নেই। তিনি তার সেই বক্তব্যের কিছু অংশ পরবর্তীতে শিকাগোর ব্যাংকারদের সাথে একটি অনুরূপ বৈঠকে পুনরাবৃত্তি করেন। আর পরবর্তীতেও, যখন সরকার ইস্পাত চুক্তি ভেঙে দেওয়ার জন্য মামলা-মকদ্দমা করে। তিনি তার নিজ অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে নিজের মতো করে বক্তব্য দেন। বক্তব্যের এই উত্তেজনায় মরগানও অনুপ্রাণিত হন।

‘এটা নিশ্চিত যে সোয়েবের বক্তব্য ছিল একটি ‘দেশীয়’ বক্তব্য। হয়তো ব্যাকরণ সম্মত নয় (দেশীয় ভাষা সোয়েবকে কখনো বিরক্ত করতে পারেনি)। সংক্ষিপ্ত, সরস এবং বুদ্ধিদীপ্ত। কিন্তু এটাকে এক পাশে সরালে, এটা ছিল একটা জোরালো বল এবং প্রভাব যার ফলে সেই রাতের খাবারের টেবিলেই ৫০০ কোটি টাকার মূলধন জোগাড় করা হয়েছিল। খাবারদাবার শেষ হওয়ার পর এবং মূলধন জোগাড় হওয়ার পর, যদিও সোয়েব ৯০ মিনিটের মতো কথা বলেছিলেন, তারা আরও ১ ঘণ্টা আলাপ করেন।

‘সোয়েবের ব্যক্তিত্বের জাদুতে তার বক্তব্য পূর্ণ শক্তি পায়। তিনি ইস্পাত ব্যবসা বৃদ্ধির জন্য বক্তব্য দিয়েছিলেন এবং লৌহ-ইস্পাত ব্যবসা যে আরও অনেক ব্যবসাকে উজ্জীবিত করবে তাই তার বক্তব্যে স্পষ্ট করে তোলেন। অন্যান্য অনেক মানুষ মরগানকে সারা দেশ জুড়ে ইস্পাত ব্যবসাকে একত্রিত করার প্রতি আগ্রহী করতে চেয়েছিলেন। তখন অনেকেই এই ধরনের উদ্যোগ নিয়েছিল। সারা দেশ জুড়ে এ ধরনের একত্রিত ব্যবসায়িক পণ্যদ্রব্য ছিল: বিস্কুট, তার ও হুক, চিনি, রবার, উইস্কি, তেল ও চুইংগাম প্রভৃতি। জন ডব্লিউ. গেটস, যে একজন জুয়াড়ী, এমন পদ্ধতি নিয়ে সামনে অগ্রসর হতে চেয়েছিল। কিন্তু মরগান তাকে বিশ্বাস করেনি। মুর ভাইয়েরা: বিল মুর এবং জিম মুর, তারা শিকাগোতে একটা দিয়াশলাই ও একটা শক্ত বিস্কুটের কোম্পানি তৈরি করেছিল, তারা লৌহ ব্যবসাকে একত্রিত করার উদ্যোগ নিয়ে সামনে অগ্রসর হয়েছিল এবং ব্যর্থ হয়। এলবার্ট এইচ. গেরি, ধর্মের ভানকারী দেশীয় আইনজীবী, এটাতে অগ্রসর হতে চেয়েছিল। কিন্তু তার ব্যক্তিত্বও যথেষ্ট চিত্তাকর্ষক ছিল না। যতক্ষণ পর্যন্ত না, সোয়েবের বাগ্মিতা জে.পি. মরগানকে সেই উচ্চতায় নিয়ে দেখার সুযোগ দিল যেখান থেকে এর প্রকৃত সুযোগ ও সম্ভাবনা দেখা যায়। এটা ছিল আর্থিক বিনিয়োগের দিক থেকে ইতিহাসের আজ পর্যন্ত পরিচালিত সবচেয়ে বড় এবং দুঃসাহসিক এক প্রকল্প। অনেকে এটাকে পাগলের প্রলাপ এবং দিবাস্বপ্ন বলে গালি দিতেও ছাড়েননি। বহু মানুষ এই প্রকল্পকে ভাঙা থালায় ভিক্ষাকারী ভিক্ষুকের সাথেও তুলনা করেছেন, যে ভাঙা থালা নিয়ে প্রচুর অর্থের স্বপ্ন দেখে।

ব্যবসাকে এই ধরনের দেশব্যাপী একত্রিতকরণ করার ব্যাপার চালু হয়েছে অনেক আগে থেকে। এই প্রজন্মেরও আগে। হাজারো ছোট-বড় প্রতিষ্ঠান, কারখানা মিলে একটি বৃহৎ ও প্রতিযোগিতা ধ্বংসকারী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। লৌহ ব্যবসাকেও এমনভাবে একত্রিত করার একটা উদ্যোগ চালু হয়েছিল। এই  উদ্যোগের একজন চালক ছিলেন জন ডব্লিউ. গেটস। গেটস ইতোমধ্যে গঠন করেছিল আমেরিকান ইস্পাত কোম্পানি। তার প্রতিষ্ঠান মরগানের সাথে একটা স্বল্প পরিসরে একত্রে সৃষ্টি করেছিল কেন্দ্রীয় ইস্পাত কোম্পানি। জাতীয় নল কোম্পানি এবং আমেরিকান সেতু কোম্পানি নামক আরও দুইটি প্রতিষ্ঠান মরগানের চিন্তা থেকে উদ্ভূত এবং মুর ভাইয়েরা, তাদের দেয়াশলাই ও শক্ত বিস্কুট ব্যবসা পরিত্যক্ত করে গঠন করে ‘আমেরিকান’ টিন ও লৌহ পাত কোম্পানি এবং জাতীয় ইস্পাত কোম্পানি।

‘কিন্তু এন্ড্রু কার্নেগির দানবতুল্য ব্যবস্থাপনার পাশে, একটি ব্যবস্থাপনা যার অধিকারী ও পরিচালনাকারী ছিল ৫৩ জন অংশীদার, তাদের সাথে তুলনা করলে অন্যদের মিশ্রণও হবে এক ছোট্ট শিশু। তারা হয়তো তাদের হৃদয় দিয়ে একত্রিত হবে, কিন্তু তাদের সম্পূর্ণ একত্রতাও কার্নেগি সংগঠনে একটা ছোট্ট গর্ত তৈরি করতে পারবে না এবং মরগানও এটা জানতেন।

অদ্ভুত হলেও, সেই বৃদ্ধ স্কটিশও এটা জানত। শিকাগোর প্রাসাদের জাঁকজমকশীল উচ্চতা থেকে তিনি মরগানের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত ছোট ছোট কোম্পানির দ্বারা তার ব্যবসার লভ্যাংশের কর্তিত অংশ দেখছিলেন। প্রথমে কৌতুকের সাথে, তারপর কিছুটা বিরক্তির সাথে। যখন চেষ্টাগুলো আরও সাহসী হয়ে উঠল তখন কার্নেগির মেজাজ বিগড়ে গেল। তিনি রেগে গিয়ে সিদ্ধান্ত নিলেন এবার কিছু একটা করতে হবে। প্রতিশোধ নিতে হবে। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন তার প্রতিদ্বন্দ্বীদের প্রত্যেক কারখানার মতো তিনি নতুন করে নিজের কারখানা প্রতিষ্ঠিত করবেন। তিনি নল, তার, লোহার আংটা বা পাত তৈরিতে আগ্রহী ছিলেন না। এর পরিবর্তে তিনি কাঁচা লোহা বিক্রয়ের একটি প্রতিষ্ঠান তৈরি করেই সন্তুষ্ট থাকতে চান। এরপর অন্যরা এই কাঁচা লোহা নিয়ে যা দরকার তা বানাতে পারে। এখন শোয়েব যেহেতু তার প্রধান এবং অন্যতম কর্মচারী, তাই তিনি তার শত্রুদের সোয়েবকে দিয়ে দেওয়ালে ঠেকানোর পরিকল্পনা করেন।

‘তাই, এটা ছিল সেই চার্লস এম. সোয়েবের বক্তব্যে। মরগানও দেখলেন তার সমস্যার জবাব। কার্নেগি সংগঠনের এমন এক ব্যবস্থাপনা ব্যতীত; পরিচালনা পর্ষদের ৫৩ জন অংশীদারদের মিশ্রণে তৈরি ব্যবস্থাপনা ব্যতীত; লৌহ ব্যবসা একত্রীকরণের কোন উদ্যোগই তৈরি করা যেত না। এটা হয়ে পড়ত, যেমন এক লেখক বলেছিল, ডিম ছাড়া একটা ডিমের চপ।

১৯০০ সালের ১২ই ডিসেম্বরের সেই রাতে, সোয়েবের বক্তব্যে সেই ইঙ্গিত ছিল যা কেবল কার্নেগির ব্যবস্থাপনা এবং মরগানের বিনিয়োগ নেটওয়ার্কের মাধ্যমেই তৈরি করা সম্ভব। সোয়েব বিশ্বের ইস্পাত ভবিষ্যৎ নিয়ে এবং কর্মীদের দক্ষতা নিয়ে আলাপ করেন। তিনি ইস্পাতের প্রতি বিশেষভাবে দৃষ্টি দেওয়া জন্য গুরুত্ব আরোপ করেন। জোড়াতালি দেওয়া অসফল কারখানাগুলোর কারণে কী ক্ষতি হচ্ছে এবং কেন্দ্রীভূত মনোযোগ দেওয়া হলে কী হবে তাই নিয়ে তার বক্তব্য রাখেন। লোহার মতো সৌভাগ্যশালী একটি সম্পদের ওপর সবার দৃষ্টি নিয়ে যান। তিনি খনিজ লোহার অর্থনীতির ওপর, সরকারি আমলাদের দৃষ্টি পেরিয়ে বিশ্ব অর্থনীতির ওপর এবং বৈদেশিক বাজার দখল করার ওপর বক্তব্য রাখেন।

‘অধিকন্তু, তিনি তাদের মধ্যকার জলদস্যুদের ভুলগুলো সম্বন্ধে বললেন যা রয়েছে তাদের প্রচলিত বিক্রয় ব্যবস্থার মধ্যে। তাদের উদ্দেশ্যগুলো তিনি উল্লেখ করলেন: খারাপভাবে তৈরি করা একচেটিয়া বাজার, দাম বৃদ্ধি করা এবং আইন ভঙ্গ করে কাজ করা যা তাদেরকে মোটা অঙ্কের লভ্যাংশ প্রদান করে। সোয়েব তার আন্তরিক আচরণ দ্বারা ব্যবস্থার নিন্দা করেছেন। ক্ষীণদৃষ্টি সম্পন্ন এমন একটা ব্যাপারের মধ্যে সমগ্র লৌহ ব্যবসার বাজারকে সীমাবদ্ধ করার এক প্রবণতা রয়েছে। অথচ আজকে এই যুগের সবকিছু প্রসারণের জন্য চিৎকার করছে। তিনি জোর দেন যে ইস্পাতের দাম সস্তা করা হলে একটা অধিক-প্রসারণশীল বাজার সৃষ্টি হবে; ইস্পাতের আরও ব্যবহার উদ্ভাবন হবে এবং সারাবিশ্ব থেকে লৌহ ব্যবসার একটা ভালো অংশ দখল করা যাবে। প্রকৃতপক্ষে, যদিও তিনি এটা জানতেন না, তবে সোয়েব ছিলেন আধুনিক ব্যাপক উৎপাদনের একজন সংস্কারক নেতা। অন্যরা যেখানে একত্রিত হয়ে ব্যবসা করতে চাইত কেবল বেশি বেশি মুনাফা অর্জনের জন্য, সেখানে সোয়েবের মতো একজন সংস্কারক নেতা চেয়েছেন দাম কমিয়ে পণ্য ব্যবহারের অধিক সুযোগ করে দিতে।

‘পরিশেষে, বিশ্ববিদ্যালয় সমিতির রাত্রীকালীন ভোজ শেষ হয়ে এলো। মরগান সোয়েবের কথা এবং প্রকল্প নিয়ে চিন্তা করার জন্য বাড়ি গেলেন। সোয়েব ফিরে গেলেন পিটার্সবুর্গে, ‘এন্ড্রু কার্নেগির’ জন্য ইস্পাত ব্যবসা পরিচালনা করতে।

‘এটা ঘটতে দেরি লাগেনি। সোয়েবের যুক্তিতে তৈরি খাবার হজম করতে মরগানের এক সপ্তাহ লেগেছে। যখন তিনি নিজেকে নিশ্চিত করাতে পারলেন যে কোন ধরনের অর্থনৈতিক মন্দাগ্নি তৈরি হবে না, তিনি সোয়েবের খোঁজে পাঠালেন এবং তরুণ মানুষটাকে কিছুটা লাজুক রূপে খুঁজে পেলেন। কার্নেগিকে উদ্দেশ্য করে, সোয়েব বললেন, তিনি হয়তো এটা পছন্দ করবেন না যে তার প্রতিষ্ঠানের ভরসাবান সভাপতি ওয়াল স্ট্রিটের স¤্রাটের সাথে মৈত্রী তৈরি করছেন। যে রাস্তায় না চলার জন্য কার্নেগি দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। (চালর্স এম. সোয়েব তখনও এন্ড্রু কার্নেগির প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ছিলেন)। তারপর জন ডব্লিউ. গেটস পরামর্শ দিল যে সোয়েব ফিলাডেলফিয়ার বেলেভিউ হোটেলে ‘উপস্থিত’ হয়ে জে. পি. মরগানের সাথে দেখা করে সবকিছু খুলে বলে। এতে করে হয়তো একটি নতুন পথ বের হতেও পারে। সোয়েব যখন বেলেভিউ হোটেলে পৌঁছালেন তখন আচমকা খবর পেলেন যে মরগান অসুস্থ হয়ে পড়েছেন এবং তিনি তার ঘর ছেড়ে বাইরে বের হতে পারবেন না। মরগান অসুস্থ হলেও সোয়েবকে তার নিউ ইয়র্কের বাড়িতে যাওয়ার জন্য জোর অনুরোধ করলেন। সোয়েব এই বয়স্ক ব্যক্তির আমন্ত্রণ রক্ষা করলেন। সোয়েব নিউ ইয়র্কে গিয়ে নিজেকে বিনিয়োগকারীর ঘরের দরজার সামনে উপস্থিত করলেন।

‘এখন কিছু অর্থনৈতিক ইতিহাসবিদগণের বিশ্বাস (নিজ কর্তৃক স্বীকৃত বিশ্বাস) যে নাটকের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত মঞ্চটি সাজানো ছিল এন্ড্রু কার্নেগি দ্বারা। সেই সোয়েবের রাত্রিকালীন ভোজ, বিখ্যাত বক্তব্য, সোয়েব এবং অর্থ রাজার মধ্যকার রবিবার রাতের বৈঠক, সব ঘটনা চতুর স্কটিশ দ্বারা সাজানো হয়েছিল। সত্যটা একদম ভিন্ন। যখন সোয়েবকে ব্যবসায়িক চুক্তি চূড়ান্ত করার জন্য ডাকা হয়েছিল তখন কার্নেগি এটা জানতও না। তবে তিনিও একটা বিক্রয় প্রস্তাব শোনার প্রতি আগ্রহী ছিলেন। তিনি তার কোম্পানি বিক্রয় করে অবসরে যেতে আগ্রহী। তাই তিনি চাচ্ছিলেন তার পরিচালক পর্ষদের কেউ একজন কাজটা সম্পন্ন করুক। তিনি তার দলের মানুষদের মহান বলে বিবেচনা করতেন এবং তাদেরকে পবিত্র বলে ভূষিত করতেও দ্বিধা করতেন না। তাই সোয়েব তাকে সেই বৈঠকে নিয়ে গিয়েছিলেন-তার হাতের লেখা কাগজগুলোতে, তার মানসিকতায় এবং সম্মিলিত ইস্পাত সংগঠন তৈরির প্রস্তাবের মধ্যে।

‘সারারাত ধরে ৪ জন মানুষ এই বিষয়গুলো নিয়ে চিন্তাভাবনা করলেন। প্রধান ছিলেন, অবশ্যই মরগান, তার অর্থের ঐশ্বরিক অধিকারের ওপর তার স্থিরসংকল্প বিশ্বাস রয়েছে। তার সাথে ছিলেন তার অভিজাত অংশীদার, রবার্ট বেকন, একজন বিদ্বান পুরুষ এবং একজন ভদ্রলোক। তৃতীয়জন ছিল জন ডব্লিউ. গেটস যাকে মরগান উপহাস করতেন যেন একজন জুয়াড়ী বলে। চতুর্থজন ছিল সোয়েব, যিনি ইস্পাত তৈরির পদ্ধতি এবং বিক্রয় ব্যবস্থাগুলো সম্বন্ধে অন্য যেকারও চেয়ে বেশি জানতেন। সেই সভার মাধ্যমে, পিটাসবুর্গের অঙ্কটা কখনো প্রশ্নবিদ্ধ হয়নি। তিনি বলেন, যদি একটি প্রতিষ্ঠানের মূল্য এত বেশি হয়, তবে এর দামও তত বেশিই দিতে হবে। সোয়েব আরও অনুরোধ করেন যে কোম্পানি তৈরিতে সদস্য নির্বাচন করা হোক শুধু তার বিবেচনায়। তিনি যাদেরকে মনোনীত করবেন তাদের নিয়ে এই সম্মিলিত কোম্পানি গড়ে উঠবে। তিনি এমন এক প্রতিষ্ঠানের জন্ম দিতে চান এবং দিয়েছিলেন যাতে কোন নকল থাকবে না, এমনকি বন্ধুদের লোভকে সন্তুষ্ট করার মতোও কিছু না। অনেক মানুষ আছে যারা তাদের প্রতিষ্ঠান মরগানের কাঁধের ওপর চাপাতে চায়। এরপর তিনি পরিকল্পনা নিয়ে বের হয়ে যান। যার সাথে যুক্ত রয়েছে বিশাল বড় অঙ্কের একটা বিনিয়োগ।

‘যখন ভোর হয়ে এলো, মরগান উঠলেন এবং তার পিঠকে সোজা করলেন। শুধু একটা প্রশ্ন অবশিষ্ট রয়েছিল।

মরগান জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি কি নিশ্চিত যে আপনি এন্ড্রু কার্নেগিকে বিক্রয়ে প্ররোচিত করতে পারবেন?‘

সোয়েব বললেন, ‘আমি চেষ্টা করতে পারি।’ 

মরগান, ‘ঠিক আছে, আপনি যদি তাকে বিক্রয়ে রাজি করাতে পারেন, বাকি ব্যাপার আমি দেখব।’

‘তাহলে তাই হোক। কিন্তু কার্নেগি কি বিক্রয় হবেন? তিনি কত দাবি করতে পারেন? (সোয়েব চিন্তা করেছিলেন ৩ হাজার দুইশত কোটি টাকা সম্বন্ধে)। তিনি কীসে এই অর্থ গ্রহণ করবেন? শেয়ারে? বন্ডে? নগদে? কোন ব্যক্তিই তিন হাজার কোটি টাকা নগদে উঠাতে পারবে না।

‘তখন জানুয়ারি মাস। ওয়েস্টচেস্টারে একটি গলফ খেলা চলছিল। এন্ড্রু শীতের বিরুদ্ধে নিজেকে সোয়েটার দিয়ে ঢেকে রেখেছেন এবং চার্লস, যথারীতি, তাকে উৎসাহ দিয়ে যেতে অর্নগল কথা বলে যাচ্ছেন। কিন্তু তখন পর্যন্ত কোন ব্যবসায়িক শব্দ উল্লেখ করা হয়নি। যখন এই জোড়া কার্নেগি ঘরের উষ্ণ আরামদায়ক আসনে বসেন, তারপর সেই একই প্ররোচিত করার যোগ্যতা নিয়ে যা সম্মোহিত করেছিল বিশ্ববিদ্যালয় সমিতির ৮০ জন কোটিপতিকে, সোয়েব আরামদায়ক অবসরের কথা বললেন, আরও বললেন সামাজিক কাজ সম্বন্ধে যা করার ফলে বৃদ্ধ মানুষটা লক্ষাধিক গুণে সন্তুষ্ট হবেন। কার্নেগি কয়েকটা শর্তাধীনে আত্মসমর্পণ করলেন। একটা কাগজের টুকরাতে একটা সংখ্যা লেখেন, এটা সোয়েবের হাতে দেন এবং বলেন, “ঠিক আছে, এই ধরো বিক্রয়মূল্য।”’

‘সংখ্যাটা ছিল প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা এবং ৩ হাজার দুইশত কোটি টাকায় স্থির হলো যা সোয়েব ধারণা করেছিলেন। সোয়েব আরও বললেন যে এই টাকা প্রাথমিকভাবে দেওয়া হবে এবং অবশিষ্ট ৮০০ কোটি টাকা পরবর্তী দুই বছরের মধ্যে যোগ হবে।

‘পরবর্তীতে, আটলান্টিক মহাসাগরের একটা জাহাজের ছাদে, স্কটিশ ব্যক্তি মরগানকে অনুতপ্তভাবে বললেন, “আমি যদি তোমার কাছে আরও ১ হাজার কোটি টাকা চাইতাম।”’

মরগান প্রফুল্লচিত্তে বললেন, ‘যদি তুমি এটা চাইতে, তবে এটাও পেয়ে যেতে।’

‘সেখানে অবশ্য একটা হাঙ্গামা ছিল। একটি ব্রিটিশ প্রতিনিধি সমিতি সংবাদ প্রেরণ করেছিল যে বৈদেশিক ইস্পাত বিশ্ব এই ধরনের দৈত্যকার মিশ্রণে ‘ভীত’। ভার্সিটি ইয়ালের এক সভাপতি, নাম তার হার্ডলি, ঘোষণা করেন যে যদি-না প্রতিষ্ঠানের সভাকে রাষ্ট্র দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করা হয়, তবে সম্ভাবনা আছে ‘আগামী ২৫ বছরের মধ্যে ওয়াশিংটনে একজন স¤্রাট সৃষ্টি হবে।’ কিন্তু এত সতর্ক বাণী সত্ত্বেও কিছুই ঘটেনি। বাজারে এসব সমালোচনারও কোন প্রভাব খাটেনি। শেয়ারবাজার বিশেষজ্ঞ, নাম তার কিনি, এই সম্মিলিত কোম্পানির শেয়ার প্রস্তুতের কাজে নেমে গেলেন। তিনি তার দক্ষতা দিয়ে জনগণের জন্য এত আকর্ষণীয় করে শেয়ার তৈরি করলেন যে তা চোখের পলকে বিক্রি হয়ে গেল, যা ছিল প্রায় ছয় হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি। এভাবে কার্নেগি তার কোটি টাকা পেল, মরগান সভা এটার সব ‘সমস্যা সমাধানের‘ জন্য তাদের কোটি টাকা পেল এবং সব ‘ছেলেরা’ গেটস থেকে গেরি পর্যন্ত সকলেই তাদের কোটি পেল।

‘৩৮ বছর বয়সী সোয়েব পেল তার পুরস্কার। তাকে নতুন প্রতিষ্ঠানের সভাপতি অলংকৃত করা হলো এবং ১৯৩০ সাল পর্যন্ত এর নিয়ন্ত্রণে ছিলেন।’

‘বড় ব্যবসা’ এর নাটকীয় ঘটনা যা আপনি এইমাত্র শেষ করলেন, এ বইয়ে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, কারণ এটা সেই পদ্ধতির একটি পূর্ণাঙ্গ ব্যাখ্যা যা দ্বারা আকাক্সক্ষা এর বাহ্যিক সমতুল্যে রূপান্তরিত হতে পারে!

আমার মনে হয় কিছু পাঠকের মনে হয়তো এখনও প্রশ্ন জাগতে পারে যে কেবল একটি অস্পর্শনীয় আকাক্সক্ষা কি সত্যিই এর বাহ্যিক সমতুল্যে রূপান্তরিত হতে পারে। নিঃসন্দেহে পারে। আবার অন্যরা হয়তো বলবে, ‘যেখানে কিছু নেই সেখানে আপনি কোনকিছু সৃষ্টি করতে পারেন না, কোনকিছু তৈরি করতে পারবেন না!’ ঠিক আছে, এই প্রশ্নের উত্তর রয়েছে ইউনাইটেড স্টেস স্টিল প্রতিষ্ঠার মধ্যে।

সেই দৈত্যাকার সংগঠন সৃষ্টি হয়েছিল একজন পুরুষের মনের মধ্যে। পরিকল্পনাটি যা দ্বারা সংগঠনকে ইস্পাত কারখানাগুলো থেকে আর্থিক সহায়তা হিসাবে দেওয়া হয়, এটাও সৃষ্টি হয়েছিল একই মানুষের মনে। তার আস্থা, আকাক্সক্ষা, কল্পনা এবং অধ্যবসায়ই ছিল সেই সব প্রকৃত উপাদান যা দিয়ে পরিণত হয় ইউনাইটেড স্টেস স্টিল কর্পোরেশন। এই প্রতিষ্ঠানের ছাতার নিচে যেসব ইস্পাতের কারখানা এবং যান্ত্রিক সরঞ্জাম যোগাড় করা হয়েছিল সেগুলোকে আইনি বৈধতা দেওয়ার পর, সতর্ক বিশ্লেষণে এই ব্যাপার উন্মুক্ত হয় যে প্রতিষ্ঠানটি দ্বারা অর্জিত সম্পদের দাম হচ্ছে ৬ হাজার কোটি টাকা। ১৯০০ সালের সময়কার এই ঘটনা। কেবল একটি প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনার অধীনে এই অর্থ জমা করা হয়।

আমি যদি একটু ভিন্নভাবে বলতে চাই তবে চার্লস এম. সোয়েবের আইডিয়া, যার সাথে তিনি আস্থা যোগ করেন এবং এটাকে তিনি নিয়ে যান জে.পি. মরগান ও অন্যদের কাছে, যা বাজারজাত করার ফলে একটি মুনাফা নিয়ে আসে, যার বাজার দর প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা। এটা কী একটা স্বতন্ত্র আইডিয়ার জন্য সামান্য এক অঙ্ক নয়!

সেসব মানুষের কী ঘটেছিল যারা এই কার্যপরিচালনার দ্বারা লক্ষাধিক টাকার শেয়ার ক্রয় করে মুনাফা অর্জন করেছে। তা এমন এক ব্যাপার যা সম্বন্ধে আমরা এখনো জানি না। এই অত্যন্ত বিস্ময়কর সাফল্যের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যে এটা নিশ্চিতভাবে এ বইয়ের দর্শন বর্ণনা করে। কারণ এই দর্শনের বাস্তবে পরিণত হয়ে দেখানোর একটা ভালো উদাহরণ হচ্ছে ইউনাইটেড স্টেস স্টিল কর্পোরেশন। যে কোম্পানি আমেরিকার ধনী ও সর্বাধিক ক্ষমতাশালী প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি হিসাবে গড়ে উঠেছে এবং সমৃদ্ধিশালী হয়েছিল এই দর্শনের প্রভাবে। যা হাজারো মানুষকে নিয়োগ দেয়, ইস্পাতের নতুন ব্যবহার বৃদ্ধি করে এবং নতুন নতুন বাজার উন্মুক্ত করে। এভাবে এই ঘটনা প্রমাণ করে যে একটি আইডিয়া থেকেই ৬ হাজার কোটি টাকা মুনাফা করা সম্ভব। যা চার্লস এম. সোয়েব নিজের স্বীয় চেষ্টায় করে দেখিয়েছেন।

ধনসম্পদের আরম্ভ হয় চিন্তা থেকে!

আপনি এরচেয়েও বেশি আয় করে দেখাতে পারেন। এই বিশাল অঙ্কও ছোট হয়ে যাবে যদি আপনি নিজেকে আপনার চিন্তা এবং পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজে লাগাতে পারেন। চিন্তা তখনই বাস্তবে পরিণত হয় যখন আপনি সেই চিন্তা এবং পরিকল্পনা অনুযায়ী জীবনে কাজ করে দেখান। আপনাকে আপনার চিন্তা এবং পরিকল্পনার ওপর বিশ^াস রাখতে হবে। আপনার বিশ্বাস বা আস্থা অন্য সব ধরনের সীমাবদ্ধতাকে সরিয়ে দিবে! যখন আপনি জীবনের সাথে যেকোন কিছুর দাম নিয়ে তর্ক করার জন্য প্রস্তুত হবেন, তখন এটা মনে রাখবেন যে সেই যুক্তিতর্ক যেন এই পথেই গমন করে।

আরও, মনে রাখবেন, যে মানুষ ইউনাইটেড স্টেস স্টিল কর্পোরেশন সৃষ্টি করেছিল তিনি বাস্তবিকভাবেই সেই সময়ে একজন অপরিচিত ব্যক্তি ছিলেন। তিনি কেবল এন্ড্রু কার্নেগির কর্মচারী বা ‘উদ্ধারকারী পুরুষ’ ছিলেন যতক্ষণ পর্যন্ত না তিনি তার বিখ্যাত আইডিয়ার জন্ম দেন। এরপর তিনি দ্রুত পৌঁছে যান ক্ষমতা, খ্যাতি এবং ধনসম্পদের শীর্ষে।

 




অধ্যায় - ০৪

স্ব-পরামর্শ

যে মাধ্যমে অবচেতন মনকে প্রভাবিত করা যায়

ধনী হওয়ার ক্ষেত্রে তৃতীয় ধাপ


স্ব-পরামর্শ হচ্ছে সব পরামর্শ এবং আত্ম-শাসনের উত্তেজনার জন্য প্রযোজ্য অন্যতম এক শর্ত। যা একজনের মনে ৫টি ইন্দ্রিয় দ্বারা পৌঁছায় [৫টি ইন্দ্রিয় হচ্ছে কান, চোখ, জিহ্বা, নাক এবং স্পর্শ]। সহজভাবে বর্ণনা করলে, স্ব-পরামর্শ হচ্ছে আত্ম-পরামর্শ। এটা মনের একটা যোগাযোগ সংস্থা যেখানে সচেতন চিন্তাগুলো বিদ্যমান এবং যা অবচেতন মনের চিন্তাগুলোকে কাজে রূপান্তর করার জন্য নির্দিষ্ট জায়গা করে দেয়।

আপনার যে চিন্তাগুলো সবচেয়ে বেশি চিন্তা করা হয় সেগুলোই কিন্তু আপনাকে সচেতন মনে থাকার অনুমতি দেয়; নতুবা আমাদের মন ও মস্তিষ্কে এত এত চিন্তা যে আমাদের প্রয়োজনীয় চিন্তাগুলোই আমরা সেসব অপ্রয়োজনীয় চিন্তার কারণে মনে রাখতে পারি না। এজন্যই দরকার স্ব-পরামর্শ। যাতে করে আমাদের প্রয়োজনীয় চিন্তাগুলো আমরা বারবার নিজেকে বলে বলে মনে রাখতে পারি। হতে পারে এই চিন্তাগুলো ইতিবাচক, নেতিবাচক বা অবস্তুগত। যখন আমরা স্ব-পরামর্শ প্রয়োগ করব তখন আমাদের এই নির্দেশ আমাদের অবচেতন মনকে প্রভাবিত করবে এবং অবচেতন মন সেই অনুযায়ী কাজ করবে।

যেকোন চিন্তা, হতে পারে নেতিবাচক বা ইতিবাচক, তা আবার স্ব-পরামর্শের সূত্রের সাহায্য ব্যতীতও অবচেতন মনে যেতে পারে। এটা চিন্তার ব্যতিক্রমতার ওপর নির্ভর করে। সহজভাবে বর্ণনা করলে বলতে হয় সব ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অনুভূতি যা পঞ্চ ইন্দ্রিয় দ্বারা গ্রহণ করা হয়, তা সচেতন চিন্তাশীল মন দ্বারা থামিয়ে দেওয়া হয় অথবা হয়তো পার হয়ে অবচেতন মনে পৌঁছায় বা ইচ্ছা দ্বারা বাতিল হয়। সচেতন বিভাগ কাজ করে অবচেতন অংশে পৌঁছানোর দ্বাররক্ষী রূপে।

প্রকৃতি মানুষকে বস্তুগত জিনিসের ওপর পূর্ণ ক্ষমতা দিয়ে তৈরি করেছে। যা মানুষের পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের দ্বারা তার অবচেতন মনে পৌঁছায় তার ওপরই সে কর্তৃত্ব করতে পারে। যদিও মানুষ এই ক্ষমতার অনুশীলন করে না বললেই চলে। মানব মনের এই বিশাল ক্ষমতার চর্চা যে খুব কম হয় তা আমরা এই পৃথিবীর বহু সংখ্যক দরিদ্র মানুষ দেখে বুঝতে পারি। ঠিক এই কারণেই, পৃথিবীতে এত বেশি মানুষ দরিদ্রতার মধ্য দিয়ে জীবনযাপন করে।

যা বলা হয়েছে তাকে পুনরায় বলতে গেলে বলতে হয়, অবচেতন মনকে একটি উর্বর বাগানের মতো চিন্তা করুন, যেখানে প্রচুর পরিমাণে জংলা জন্মে আছে, যদি-না সেখানে স্বেচ্ছায়, নিজ আকাক্সক্ষা অনুযায়ী অন্য কোন শস্য রোপণ করা হয়। আপনি যদি আপনার নিজ মনের যতœ না নেন, ইচ্ছাকৃতভাবে ইতিবাচক মনোভাব গঠন না করেন তবে সেখানে তো জংলাই জন্মাবে। স্ব-পরামর্শ হচ্ছে সেই নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা যা সৃজনশীল চিন্তাগুলোকে অবচেতন মনে প্রবেশের জন্য সহায়তা করে। আর স্ব-পরামর্শ বা আপনার ইচ্ছাকৃত আকাক্সক্ষা দ্বারা যদি আপনি আপনার মনকে পরামর্শ দিতে অবহেলা করেন তবে ধ্বংসাত্মক চিন্তাগুলোকে প্রবেশের অনুমতি দেয় যাতে এই চিন্তাগুলো মনের ধনী বাগানকে তছনছ করতে পারে।

আপনাকে আকাক্সক্ষা অধ্যায়ের শেষে ৬টি নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল যাতে আপনার আকাক্সিক্ষত অর্থের জন্য লিখিত সেই বিবৃতি উচ্চস্বরে প্রতিদিন ২ বার পাঠ করেন। এটা পড়ার সময় আবেগ আনতে হবে। আপনার কল্পচোখে দেখতে হবে যে আপনি সেই পরিমাণ অর্থের মালিক হয়েছেন। আর অনুভব করবেন যে আপনি ইতোমধ্যেই সেই অর্থের অধিকারী হয়েছেন! এই নির্দেশ মেনে আপনি আপনার আকাক্সক্ষার সাথে আস্থা যোগ করে সরাসরি যোগাযোগ করিয়ে দিচ্ছেন আপনার অবচেতন মনের সাথে। এই পদ্ধতির পুনরাবৃত্তির মাধ্যমে আপনি একটি নতুন চিন্তার অভ্যাস তৈরি করছেন যাতে আপনার আকাক্সক্ষাটি এর আর্থিক সমতুল্যে রূপান্তরিত হয়।

[দেখুন জীবনের একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য নেওয়া এবং তা পূরণ করার চেষ্টা করা মোটেই সহজ কাজ নয়। আমি এটা জানি এবং অনুভব করি। কারণ আমার নিজেরই একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য আছে। আমার জীবনের একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য হচ্ছে ২০৩০ সালের মধ্যে ৬৪টি অনুপ্রেরণামূলক বই প্রকাশ করা। এখন যেহেতু আমি এখনও আমার লক্ষ্যে পৌঁছাইনি, তাই আমি জানি যে নিজেকে অনেক বাধাবিপত্তির মধ্যেও একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যের প্রতি ধরে রাখা কতটা কষ্টকর। তবুও করতে হবে। চেষ্টা করে যেতে হবে। একটাই জীবন। এই এক জীবনে আমার একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য আমাকে পূরণ করতেই হবে। বাধা আসবে, সমস্যা আসবে, ব্যর্থ হবো, তবুও চেষ্টা করে যাব। নিজেকে বলুন, ‘আমি পারব, আমি পারব, আমি করব।’ দেখবেন আপনি ঠিকই পারবেন।]

দ্বিতীয় অধ্যায়ে ফিরে যান যেখানে ৬টি ধাপের বর্ণনা দেওয়া আছে এবং সেগুলো আবার পড়–ন। অত্যন্ত সতর্কভাবে পড়–ন। সামনের কোন পদক্ষেপ নেওয়ার আগে নিজের মনমস্তিষ্ককে প্রস্তুত করুন। তারপর (যখন শেষ হবে তখন এখানে ফিরে আসুন), খুবই সতর্কতার সাথে আপনার ‘ঐক্যমন’ দলের সংগঠন তৈরির জন্য ৪টি নির্দেশ পাঠ করুন, যা সংগঠিত পরিকল্পনা অধ্যায়ে বর্ণিত আছে। (অধ্যায় ৭Ñসংগঠিত পরিকল্পনা)। এই ২ ভাগের নির্দেশনা স্ব-পরামর্শের সাথে মিলিয়ে পাঠ করলে আপনি অবশ্যই দেখবেন যে স্ব-পরামর্শের পদ্ধতি কত ভালোভাবে কাজ করে।

মনে রাখবেন, যখন আপনি আপনার আকাক্সক্ষার বিবৃতি স্পষ্ট স্বরে পাঠ করবেন (যার মাধ্যমে আপনি একটি ‘অর্থ সচেতনতা’ গঠন করার চেষ্টা করছেন), তখন শুধু শব্দ পড়ে যাওয়াটা কোন প্রভাব ফেলবে না যদি-না আপনি আপনার কথাকে আবেগ বা অনুভূতি দিয়ে ভরিয়ে তোলেন। আপনি যদি লাখোবারও এমিল কো এর সূত্র ‘দিনের পর দিন, প্রতিটি দিক থেকে, আমি ভালো এবং আরও ভালো হচ্ছি’ কোন অনুভূতি ও আস্থা ছাড়াই পড়েন, তবে আপনি আপনার আকাক্সক্ষা অনুযায়ী কোন ফলই পাবেন না। আপনার অবচেতন মন শুধু সেই চিন্তাগুলো মনে রাখে এবং তদানুযায়ী কাজ করে যেগুলোতে ভালোভাবে আবেগ ও অনুভূতি মেশানো থাকে।

প্রতিটি অধ্যায় ভালোভাবে বোঝা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। দরকার হলে প্রতিটি অধ্যায় একাধিকবার পড়–ন। কারণ, আমি দেখেছি যে বেশির ভাগ মানুষ স্ব-পরামর্শ সূত্রটি ঠিকভাবে বোঝে না, তাই প্রয়োগও করতে পারে না। অবশেষে তারা তাদের আকাক্সক্ষা অনুযায়ী কোন ফলও পায় না।

সোজা, আবেগহীন কথা অবচেতন মনে কোন প্রভাব ফেলতে পারে না। আপনি কোন অভিনন্দন সূচক ফলাফল পাবেন না যতক্ষণ না আপনি ‘কীভাবে চিন্তাগুলোকে অবচেতন মনে পৌঁছানো যায়’ তা শিখতে পারছেন অথবা ‘কীভাবে উচ্চারিত শব্দগুলোকে অবচেতন মনে পৌঁছানো যায়’ তা বুঝতে পারছেন। এই কথা বা শব্দগুলো খুব ভালোভাবে বিশ্বাসের সাথে আবেগ দিয়ে পাঠ করতে হবে।

[এখন আপনার মনে প্রশ্ন জাগতে পারে যে স্ব-পরামর্শ রূপে কোন কথা বা শব্দগুলো বলব। আমি, ফজলে রাব্বি, স্ব-পরামর্শ হিসাবে আমার জীবনের একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যের কথা বলি। যেমন, আমার জীবনের একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য ২০৩০ সালের মধ্যে ...। আবার নিজের ইতিবাচক মনোভাব বজায় রাখতে বলি, ‘আমি স্বাস্থ্যবান, আমি সুখী, আমি সফল।’ এই ধরনের আরও স্ব-পরামর্শের তালিকা পেতে পড়–ন অনুবাদকের আরেকটি বই সাকসেস থ্রো এ পজিটিভ মেন্টাল এটিটিউড। এর বাংলা মানে হচ্ছে একটি ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে সাফল্য অর্জন করুন।

আবার অনেকে দেখবেন ভয়-ভীতি, বিপদ-আপদ নিয়েই চিন্তা করে, কেবল এগুলো নিয়েই কথা বলে। দেখবেন তাদের সাথে ঠিক তাই ঘটে। কারণ তারা না জেনেই এই নেতিবাচক কথাগুলোকে স্ব-পরামর্শ রূপে ব্যবহার করেছে। আর তাদের অবচেতন মন এগুলোকে বাস্তবে রূপান্তরিত করেছে। তাই সর্বদা নিজেকে ইতিবাচক বাক্য এবং কথা দ্বারা পরামর্শ দিন। সুযোগ ও সম্ভাবনা নিয়ে চিন্তা করুন, কথা বলুন এবং কাজ করুন। আর আপনি যখন আপনার সুবিধা কাজে লাগাবেন তখন সফল হওয়া তো স্বাভাবিক। তাই নয় কী!]

আপনি যদি প্রথমবার চেষ্টা করার পর আপনার আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে ও আপনার আকাক্সক্ষা অনুযায়ী পরিচালিত না পারেন তবে নিরুৎসাহিত হবেন না। মনে রাখবেন, কিছু না দিয়ে কিছু পাবেন, এমন কোন সম্ভাবনা নেই। আপনার অবচেতন মনে পৌঁছান এবং একে প্রভাবিত করার ক্ষমতা পেতে হলে এর একটি মূল্য আছে এবং আপনাকে অবশ্যই সেই মূল্য পরিশোধ করতে হবে। আপনি ধোঁকা দিতে পারবেন না। যদি আপনি করতেও চান, তাও কোন জালিয়াতি করতে পারবেন না। আপনার অবচেতন মনকে প্রভাবিত করার ক্ষমতার মূল্য হচ্ছে এখানে যে সূত্র বর্ণিত আছে সেগুলোকে অধ্যবসায়ের সাথে ব্যবহার করা। এটা আপনাকে আপনার বাকি জীবনের সবসময় পালন করতে হবে। আপনি ইচ্ছা করলেই কম মূল্য দিয়ে সেই ক্ষমতা গঠন করতে পারবেন না। এটার সঠিক মূল্য আপনাকে দিতেই হবে। কম দিলে হবে না। আপনি এবং একমাত্র আপনিই ঠিক করতে পারেন যে, কোন পুরস্কারের জন্য আপনি সংগ্রাম করবেন (‘অর্থ সচেতনতা’ গঠন করার চেষ্টা করবেন), এই চেষ্টার জন্য কী ধরনের মূল্য পরিশোধ করবেন। অর্থ সচেতনতা গঠনের জন্য কী ধরনের অধ্যবসায় পালন করবেন তা আপনাকেই ঠিক করতে হবে।

একমাত্র পড়ালেখা ও ‘চালাকি’ অর্থকে আকর্ষণ করে না অথবা ধরে রাখতে পারে না। খুব সামান্য ক্ষেত্রেই এর ব্যতিক্রম ঘটে। অবশ্য সাধারণ লোকজন মনে করে পড়ালেখা ও চালাকি থাকলে টাকা চলে আসে। আসলে সত্য তার বিপরীত। অর্থকে আকর্ষণ করার পদ্ধতি এখানে বর্ণনা করা হয়েছে। এটা কোন সাধারণ নিয়মের ওপর নির্ভর করে না। অধিকন্তু, এই পদ্ধতিতে খেললে কারও আনুকূল্যের প্রয়োজন হয় না। এটা একজন ব্যক্তির জন্য যেমন দক্ষভাবে কাজ করে তেমনি অন্য ব্যক্তির প্রতিও কাজ করে। কাজ করতে গেলে ব্যর্থতা আসতেই পারে। কিন্তু তাই বলে পদ্ধতি ব্যর্থ নয়। আপনি যদি চেষ্টা করেন ও ব্যর্থ হন, তাহলে আরেকবার চেষ্টা করুন এবং আরও একবার। যতক্ষণ পর্যন্ত না আপনি সফল হচ্ছেন ততক্ষণ পর্যন্ত চেষ্টা চালিয়ে যান।

[সাউথ আফ্রিকার বক্সবার্গ শহরে ইস্ট রেন্ড  নামক একটি স্বর্ণের খনি আছে। সেখানে হাজার হাজার টন মাটি উঠান হয় কেবল সামান্য কিছু আউন্স স্বর্ণের জন্য। আসলে কী তা সামান্য! আপনি আপনার জীবনে একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য পূরণে কাজে নেমেছেন তখন আপনার সামনের বাধা, বিপত্তি ও সমস্যা বড়; নাকি আপনার জীবনের একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যকে পূরণ করা বড়, সফল হওয়া বড়। আপনাকে কেবল আপনার লক্ষ্যের কথা মনে রাখতে হবে এবং ব্যর্থতা থেকে শিখতে হবে। হাজারো টন মাটি-পাথর আপনার উদ্দেশ্য নয়। আপনার উদ্দেশ্য হচ্ছে স্বর্ণ। তাই নিজের মনোযোগ ও চিন্তা কেবল আপনার জীবনের একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যের প্রতি ধরে রাখুন।]

স্ব-পরামর্শ সূত্র ব্যবহারে আপনার দক্ষতা নির্ভর করবে আপনার একটি আকাক্সক্ষার ওপর মনোযোগ দেওয়ার ক্ষমতার ওপর। তাই যতক্ষণ পর্যন্ত না সেই আকাক্সক্ষা একটি জ্বলন্ত আবেশে পরিণত হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত চেষ্টা চালিয়ে যান।

আপনি যখন দ্বিতীয় অধ্যায়ে বর্ণিত ৬টি ধাপ অনুসরণ করা শুরু করবেন, আপনার জন্য এটা জানা প্রয়োজন যে কীভাবে মনোযোগ ধরে রাখার সূত্র ব্যবহার করতে হয়।

আমরা এখন দক্ষতার সাথে মনোযোগকে ব্যবহার করা সম্বন্ধে জানতে যাচ্ছি। আপনি যখন ৬টি ধাপের প্রথম ধাপ শুরু করবেন যা আপনাকে নির্দেশ দিয়েছে যে ‘আপনার আকাক্সক্ষা অনুযায়ী একটি নির্দিষ্ট অর্থের পরিমাণ আপনার নিজের মনে নির্দিষ্ট করুন’, আপনার চিন্তাকে মনোযোগ দ্বারা সেই পরিমাণের ওপর ধরে রাখুন অথবা একাগ্রভাবে চিন্তা করে নির্দিষ্ট পরিমাণকে স্থায়ী করুন। একটি নির্জন স্থানে যান। শান্ত হয়ে বসুন। যতক্ষণ পর্যন্ত না আপনি প্রকৃতভাবেই সেই পরিমাণ অর্থের উপস্থিতি দেখছেন ততক্ষণ আপনার চোখ বন্ধ রাখুন। প্রতিদিন অন্তত একবার এটা করুন। আপনি যখন এই অনুশীলনের মধ্য দিয়ে যাবেন তখন আস্থা অধ্যায়ের নির্দেশাবলি অনুসরণ করুন। আস্তে আস্তে নিজেকে প্রকৃতপক্ষেই সেই অর্থের অধিকারী রূপে দেখবেন!

এটাই সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাপার। আপনি অবচেতন মনকে সাথে রেখে সম্পূর্ণ আস্থা নিয়ে যে চিন্তা-চেতনা পাঠাবেন তাই এটা গ্রহণ করবে এবং সেই নির্দেশাবলি অনুযায়ী কাজ করবে। যদিও সেই নির্দেশাবলি বারবার দিয়ে যেতে হয়। পুনঃউচ্চারণের মাধ্যমে, সেগুলো অবচেতন মনে ঢুকানোর পূর্বে বারবার বলে যেতে হয়। এই বর্ণিত পদ্ধতি অনুসরণকালে, এই পদ্ধতিকে আপনার অবচেতন মনের সাথে সম্পূর্ণ ন্যায়সঙ্গত একটি ‘কৌশল’ রূপে ধরে নিন। অবচেতন মনকে বিশ্বাস করান, কারণ আপনি এটা বিশ্বাস করেন যে, আপনি যে পরিমাণ অর্থ দেখেছেন তা আপনি অবশ্যই পাবেন। আপনার দাবিকৃত এই অর্থ আপনার জন্য অপেক্ষা করছে। অবচেতন মন অবশ্যই আপনাকে একটি বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা দিবে, বুদ্ধি বা ধারণা দিবে যাতে আপনি সেই অর্থ অর্জন করতে পারেন যা আপনারই।

আপনার কল্পনাকে এই চিন্তাটা দিন। দেখুন আপনার আকাক্সক্ষা অনুযায়ী অর্থ জোগাড়ের জন্য, আপনার কল্পনা একটি বাস্তবিক পরিকল্পনা তৈরি করার জন্য, বুদ্ধি বা আইডিয়া দেওয়ার জন্য কী করতে পারে অথবা কী করবে। আপনি দেখে অবাক হবেন যে আপনার মাথায় এমন এমন বুদ্ধি এবং আইডিয়া আসবে যা আপনি পূর্বে কখনো চিন্তাও করতে পারেননি।

একটি নির্দিষ্ট পরিকল্পনার জন্য অপেক্ষা করবেন না; বরং এখনই নিজেকে সেই পরিমাণ অর্থের অধিকারী রূপে দেখতে শুরু করুন। মধ্যবর্তী কালে দাবি করুন এবং আশা করুন যে আপনার অবচেতন মন আপনাকে পরিকল্পনাটি দিবে অথবা যে পরিকল্পনাগুলো আপনার প্রয়োজন তা দিবে। এই পরিকল্পনাগুলোর জন্য সতর্ক থাকুন এবং সেগুলো যখন উপস্থিত হবে, তাদের তাৎক্ষণাৎ কাজে লাগান। যখন পরিকল্পনাগুলো উপস্থিত হবে, এগুলো হয়তো ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় দ্বারা বুদ্ধির একটি ‘ঝলক’ রূপে আপনার মনে উদয় হবে, একটি ‘অনুপ্রেরণা’ আকারে। এই অনুপ্রেরণাকে হয়তো বিবেচনা করা যায় অসীম বুদ্ধিমত্তা থেকে একটি সরাসরি ‘চিঠি’ বা বার্তা রূপে। এটাকে সম্মানের সাথে গ্রহণ করুন এবং যত দ্রুত সম্ভব তদানুযায়ী কাজ করুন। এটা করতে ব্যর্থ হলে আপনার সাফল্যের প্রতি মারাত্মক ক্ষতি সাধিত হবে।

৬টি ধাপের মধ্যে চতুর্থ ধাপে আপনাকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে ‘একটি নির্দিষ্ট পরিকল্পনা তৈরির জন্য যাতে আপনার আকাক্সক্ষা প্রকাশ করা যায় এবং তাৎক্ষণাৎ এই পরিকল্পনাকে কর্মে পরিণত করুন।’ আপনার উচিত এই নির্দেশবলিকে অনুসরণ করা। যখন আপনার পরিকল্পনা তৈরি করছেন তখন আপনার মনের যুক্তি এবং কারণ অংশকে বিশ্বাস করবেন না। আপনার যুক্তি এবং কারণ অংশ দোষযুক্ত। অধিকন্তু, আপনার মস্তিষ্কের যুক্তি এবং কারণ অংশ হয়তো অলস। যদি আপনি সম্পূর্ণরূপে এটার ওপর ভরসা করেন তবে এটা হয়তো আপনাকে আশাহত করবে।

[ধরুন, আমার যুক্তি এবং কারণ অংশ বলেছিল যে আমার বই চলবে না, কারণ আমি একজন নতুন অনুবাদক। আমি বই ছাপাতে পারব না, কারণ বই ছাপানোর মতো টাকা আমার নেই। আমার বই কেউ পড়বে না কারণ বাংলাদেশের মানুষের কোন অনুপ্রেরণার দরকার নেই। আমি টিকব না কারণ আমার পিছনে কোন বড় রাজনৈতিক বা সাংস্কৃতিক সংগঠনের সমর্থন নেই। কিন্তু তবুও আমি এখনো টিকে আছি, কাজ করে যাচ্ছি আমার আস্থা ও বিশ্বাসের জন্য। তাই নিজের জীবনের একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস রাখুন এবং কাজ করে যান। দেখবেন বাকি যা যা দরকার তা-ও যোগাড় হয়ে গেছে।]

যখন আপনি আপনার বন্ধ চোখে আপনার আকাক্সক্ষা অনুযায়ী অর্থ জোগাড় করেছেন বলে দেখতে পাবেন, তখন দেখবেন নিজেকে সেই সেবা সম্পন্ন করতে বা পণ্য প্রদান করতে যার বিপরীতে সেই অর্থ রয়েছে। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ!


নির্দেশাবলির বিবরণ

আপনি এ বই পড়ছেন, এটাই সেই ব্যাপার যা নির্দেশ করে যে আপনি আগ্রহের সাথে জ্ঞান অন্বেষণ করেন। এটা আরও নির্দেশ করে যে আপনি এই বিষয়ের একজন মনোযোগী ছাত্র। আপনি যদি নিজেকে একজন ছাত্র হিসাবে চিন্তা করতে পারেন, তবে এই ধরনের একটি সম্ভাবনা থাকতে পারে যে আপনি অনেক কিছুই শিখেছেন যা আপনি আগে জানতেন না। শুধুমাত্র এরকম একটি বিনয়ী মনোভাবের দ্বারাই আপনি শিখতে পারবেন। যদি আপনি কিছু নির্দেশনা অনুসরণের জন্য নির্বাচন করেন আর অন্যান্য নির্দেশনা পালন করতে তাচ্ছিল্য বোধ করেন তবে আপনি ব্যর্থ হবেন! আশানুরূপ ফল পাওয়ার জন্য আপনাকে অবশ্যই সব নির্দেশনা আস্থা ও বিশ্বাসের সাথে অনুসরণ করতে হবে।

দ্বিতীয় অধ্যায়ে যে নির্দেশাবলি আপনাকে দেওয়া হয়েছিলÑ৬টি ধাপের মাধ্যমেÑসেই সম্বন্ধে এখানে বর্ণনা করা হবে এবং এই অধ্যায়ের সূচনা সূত্রÑ স্বপরামর্শ দ্বারা মিশ্রণ করা হবে। পদ্ধতিটি হচ্ছে:

প্রথমত: একটু নির্জন স্থানে যান (হতে পারে রাতে আপনার শোবার বিছানা) যেখানে আপনাকে বিরক্ত করার মতো কেউ নেই, চোখ বন্ধ করুন এবং লিখিত বিবৃতিটা উচ্চস্বরে বলুন (যাতে আপনি নিজে আপনার কথা শুনতে পান)। যে পরিমাণ অর্থ আপনি অর্জন করতে চান, এই প্রাপ্তির নির্ধারিত সময়সীমা দিন এবং সেই সেবা বা পণ্যের বর্ণনা দিন যা আপনি উক্ত অর্থের বিপরীতে দিতে চান। এভাবে এই নির্দেশনা পালন করে যান, দেখবেন আপনি সেই পরিমাণ অর্থের অধিকারী রূপে নিজেকে অনুভব করতে শুরু করেছেন। আপনার এই অনুভব হচ্ছে আত্মবিশ্বাস যে আমি যা বলেছি তা আমি অর্জন করতে পারব।

উদাহরণস্বরূপ: ধরুন আপনি আগামী ৫ বছর পর ঠিক আজকের দিনের মধ্যে ৫ লাখ টাকা আয় করতে চান। আপনি চান উক্ত অর্থের বিনিময়ে আপনি একজন বিক্রয়কর্মী রূপে পরিশ্রম করবেন। আপনার উদ্দেশ্যের লিখিত বিবৃতি হওয়া উচিত নি¤েœাক্ত অনুসারে: ‘২০.. .. সালের জানুয়ারির প্রথম দিন আমি ৫ লাখ টাকার অধিকারী হবো। যা আমার কাছে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পরিমাণে আসবে।’

‘এই অর্থের বিনিময়ে আমি আমার সবচেয়ে দক্ষ সেবা প্রদান করব। যাতে আমি সক্ষম বিক্রয়কর্মী রূপে আমার সম্পূর্ণ সম্ভাব্য সেবা দিতে পারি। (আপনি যে সেবা বা পণ্য বিক্রয় করবেন তার বর্ণনা দিন)।’

‘আমি বিশ্বাস করি আমি এই অর্থের অধিকারী হবোই। আমার আস্থা এতই শক্তিশালী যে আমি উক্ত অর্থকে এখনই আমার চোখের সামনে দেখছি। আমি আমার হাত দ্বারা একে স্পর্শ করতে পারি। এটা আমার কাছে আসতে এখন শুধু সময়ের ব্যাপার এবং আমি সেই অনুপাতে কাজ করে যাব যে সেবা আমি এই অর্থের বিনিময়ে সম্পন্ন করব বলেছিলাম। আমি একটি পরিকল্পনার জন্য অপেক্ষমাণ যার দ্বারা আমি উক্ত অর্থ অর্জন করতে পারব এবং যখন এটা আমার কাছে এসে পৌঁছাবে তখন আমি সেই পরিকল্পনা অনুসরণ করব।’

দ্বিতীয়ত: অবিরতভাবে এই পদ্ধতি চালিয়ে যান, রাতে এবং সকালে, যতক্ষণ পর্যন্ত না আপনি আপনার কল্পনায় উক্ত অর্থ দেখতে পাচ্ছেন।

তৃতীয়ত: আপনার বিবৃতির একটি লিখিত কাগজ এমন স্থানে রাখুন যেখানে আপনি রাতে ও সকালে দেখেন এবং এটা দেখামাত্র পড়–ন, বিশ্রাম নেওয়ার আগে পড়–ন এবং সকালে উঠে পড়–ন যতক্ষণ পর্যন্ত না এটা আপনার অন্তঃস্থ হয়, আপনার হৃদয়ের গভীরে পৌঁছায়।

মনে রাখবেন, আপনি এই নির্দেশনা চালিয়ে যাচ্ছেন আপনার স্ব-পরামর্শের সূত্র ব্যবহার করে। যার উদ্দেশ্য হচ্ছে আপনার অবচেতন মনকে আদেশ প্রদান করা। আরও মনে রাখবেন যে, আপনার অবচেতন মন শুধুমাত্র এই নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করবে যখন আপনি আবেগ নিয়ে পড়বেন এবং যা পাঠ করছেন তাকে অনুভব করবেন। অন্যান্য আবেগের মধ্যে আস্থা হচ্ছে সবচেয়ে শক্তিশালী এবং সর্বাধিক অনুভূতি জন্ম দানকারী। আস্থা অধ্যায়ের নির্দেশনাও অনুসরণ করুন।

এই নির্দেশনা হয়তো প্রথমে একটু কঠিন মনে হতে পারে। এর দ্বারা আপনি নিজেকে বিরক্ত হতে দিবেন না। নির্দেশনা অনুসরণ করে যান। যদি প্রথম দিকে এগুলোকে অবাস্তব বলেও মনে হয়। কোন ব্যাপার না। এমনটা মনে হতে পারে। ধীরে ধীরে ঠিক হয়ে যাবে। ভালো সময় দ্রুতই আসবে, যদি আপনি যেমন নির্দেশনা আছে ঠিক সেরূপ পালন করেন, কাজটি ভালোভাবে সম্পন্ন হওয়ার পর দেখবেন আপনার সামনে একটি সম্পূর্ণ নতুন শক্তির মহাবিশ্ব হাজির হয়েছে।

সন্দেহবাদ, সব ধরনের নতুন আইডিয়ার সাথেই যুক্ত। এটা সকল মানুষের চরিত্রের মধ্যে পাওয়া যায়। কিন্তু আপনি যদি নির্দেশনা অনুসরণ করেন, আপনার সন্দেহ খুব দ্রুতই বিশ্বাস দ্বারা প্রতিস্থাপিত হবে এবং এর বিপরীতে এটা দ্রুত পরিষ্কারভাবে আপনার সম্পূর্ণ আস্থায় পরিণত হবে। তখন আপনি সেই জায়গায় পৌঁছবেন যেখানে আপনি হয়তো সত্যিকারভাবেই বলতে পারবেন যে, ‘আমি রাজত্ব করি আমার ভাগ্যের ওপর, আমিই আমার আত্মার চালক!’

অনেক দার্শনিকই এই বিবৃতি দিয়েছে যে, মানুষই তার নিজের পৃথিবীগত ভাগ্যের কর্তা। কিন্তু তাদের বেশির ভাগ এটা বলতে ব্যর্থ হয়েছে যে কেন সে এই দুনিয়াগত ভাগ্যের কর্তা। কারণ হচ্ছে মানুষ হয়তো তার নিজ পৃথিবীগত অবস্থার এবং বিশেষত তার আর্থিক অবস্থার ওপর কর্তৃত্ব করতে পারে। এই ব্যাপার সম্পূর্ণভাবে এই অধ্যায়ে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। ব্যক্তি তার নিজের ওপর কর্তৃত্ব করতে পারে এবং তার পরিবেশের ওপরও কর্তৃত্ব করতে পারে। কারণ তার সেই ক্ষমতা আছে যার দ্বারা সে নিজের অবচেতন মনকে প্রভাবিত করতে পারে এবং এর দ্বারা অসীম বুদ্ধিমত্তার সহযোগিতা অর্জন করতে পারে।

আপনি এখন যে অধ্যায় পড়ছেন এটা এই দর্শনের প্রধান কেন্দ্রবিন্দু। এই অধ্যায়ে দেওয়া নির্দেশনা অবশ্যই বুঝতে হবে এবং অধ্যবসায়ের সাথে প্রয়োগ করতে হবে, যদি আপনি সফলভাবে আপনার আকাক্সক্ষাকে টাকাপয়সায় রূপান্তর করতে চান।

আকাক্সক্ষাকে টাকাপয়সায় রূপান্তর করার প্রকৃত কৃতিত্ব জড়ানো আছে স্ব-পরামর্শ ব্যবহারের ওপর। এটা এমন এক মাধ্যম যাতে একজন হয়তো তার অবচেতন মনে পৌঁছাতে পারে এবং এটাকে প্রভাবিত করতে পারে। অন্যান্য সূত্র হচ্ছে সাধারণ উপাদান যাতে স্ব-পরামর্শ প্রয়োগে সহায়তা করতে পারে। এই চিন্তা মনে রাখবেন এবং সব সময়ের জন্য এর গুরুত্বপূর্ণ অংশ সম্পর্কে সতর্ক থাকবেন যে স্ব-পরামর্শ সূত্র ঠিকভাবে কাজ করবে কি করবে না এটা আপনার চেষ্টার ওপর নির্ভর করে। আপনি আপনার আকাক্সিক্ষত অর্থ অর্জনে কতটা আগ্রহী তার ওপরই নির্ভর করে যে আপনি এই নির্দেশনা ঠিকভাবে মানবেন কি মানবেন না।

এই নির্দেশনা এমনভাবে পালন করুন যেন আপনি এক ছোট্ট শিশু। আপনার চেষ্টায় শিশুর মতো কিছুটা আস্থা প্রবেশ করান। লেখক এই বিষয়ে সর্বোচ্চ সতর্কভাবে দৃষ্টি রেখেছে যাতে কোন অবাস্তব নির্দেশনা প্রবেশ করতে না পারে। কারণ লেখকের প্রকৃত ইচ্ছা হচ্ছে আপনাকে সহায়তা করা।

এই সম্পূর্ণ বই পড়া শেষ করার পর, এই অধ্যায়ে ফিরে আসুন এবং মনের তেজ নিয়ে এই নির্দেশনা অনুসরণ করুন এবং তদানুযায়ী কাজ করুন।

সম্পূর্ণ অধ্যায়টি স্পষ্টভাবে এবং উচ্চস্বরে প্রতিরাতে একবার করে পাঠ করুন, যতক্ষণ পর্যন্ত না আপনি চিন্তার দিক থেকে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাসী হন যে স্ব-পরামর্শের সূত্রটি সঠিক। যা আপনার জন্য সবকিছু সম্পন্ন করবে। যা আপনি এটার কাছে দাবি করবেন তাই বাস্তবে পরিণত হবে। যখন আপনি পাঠ করবেন তখন যে বাক্য আপনার পছন্দ হয়েছে, যে বাক্য আপনাকে অনুপ্রাণিত করেছে সেগুলোর নিচে পেন্সিল দিয়ে দাগ দিন।

পরবর্তী নির্দেশনা অনুসরণ করে যান এবং দেখবেন এটা আপনার পূর্ণ বোধগম্যতার পথ খুলে দিয়েছে এবং সাফল্যের সূত্রগুলোতে আপনি কর্তৃত্ব করতে পারছেন।


 




অধ্যায় - ০৫

বিশিষ্ট জ্ঞান

ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বা পর্যবেক্ষণ

ধনী হওয়ার ক্ষেত্রে চতুর্থ ধাপ


জ্ঞানের ২টি প্রকারভেদ রয়েছে। একটি হচ্ছে সাধারণ, অন্যটি হচ্ছে বিশিষ্ট। সাধারণ জ্ঞান, যত বড় পরিমাণে বা যত ভিন্নই হোক না কেন এটা কোন ব্যাপার না। টাকাপয়সা অর্জনের ক্ষেত্রে সাধারণ জ্ঞানের ব্যবহার কিন্তু খুবই কম। বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের যত বিভাগ আছে সব হচ্ছে সভ্যতার আবিষ্কৃত সাধারণ জ্ঞানের ভা-ার। বেশির ভাগ অধ্যাপকদের টাকাপয়সা আছে। কিন্তু তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। তারা শিক্ষা দান করতেই বিশিষ্ট, কিন্তু তারা জ্ঞানের ব্যবহারিক প্রয়োগে বিশিষ্ট নয়।

জ্ঞান কখনো টাকাপয়সাকে আকর্ষণ করে না; যদি-না এটা অর্থ অর্জনের জন্য সংগঠিত হয় এবং বুদ্ধিমত্তার সাথে পরিচালিত হয়। এটাকে অবশ্যই একটি নির্দিষ্ট গন্তব্যের প্রতি এগিয়ে যেতে হবে, একটি বাস্তব কর্মপরিকল্পনা থাকতে হবে। এই ব্যাপার বোঝে না বলেই লাখো লোক মিথ্যাভাবে বিশ্বাস করে যে ‘জ্ঞানই শক্তি’। অন্যদের মতো ব্যাপারটাকে গুলিয়ে ফেলবেন না। ভালো করে বোঝার চেষ্টা করুন। ঠিক আছে জ্ঞান মানে শক্তি। তবে এখানে একটি কিন্তু আছে। জ্ঞান হচ্ছে শুধুমাত্র প্রচ্ছন্ন শক্তি। প্রচ্ছন্ন মানে ধোঁয়াশে, অস্ফুট, ভালোভাবে পরিচ্ছন্ন নয়। এটা শুধুমাত্র তখনই শক্তিতে পরিণত হবে যখন এবং যদি এটা নির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা দ্বারা সংগঠিত হয় এবং নির্দিষ্ট গন্তব্যে পরিচালিত হয়।

এই ‘হারিয়ে যাওয়া অংশ’ আজকের সভ্যতার সব ধরনের শিক্ষা পদ্ধতিতে অনুপস্থিত। এটা হয়তো পাওয়া যেতে পারে শিক্ষাদানকারী প্রতিষ্ঠানের ব্যর্থতা থেকে যে তারা তাদের শিক্ষার্থীদের এই শিক্ষা দেয়নি যে কীভাবে তারা জ্ঞান অর্জনের পর এটাকে সংগঠিত এবং ব্যবহার করবে।

অনেক লোকই এই ভুলটি গ্রহণ করেছে, যেহেতু হেনরি ফোর্ডের অল্প ‘পড়ালেখা’ ছিল, তারমানে সে ‘শিক্ষিত’ ব্যক্তি নয়। যারা এই ভুল করেছে তারা হেনরি ফোর্ডকে জানেন না অথবা তারা ‘শিক্ষা’ শব্দের প্রকৃত মানে বোঝে না। ইংরেজি ‘এডুকেট’ শব্দ উৎপন্ন হয়েছে ল্যাতিন শব্দ ‘এডুকো’ থেকে, যার মানে হচ্ছে এডুস অর্থাৎ বাহির করা, পর্যবেক্ষণে প্রাপ্ত তথ্য থেকে প্রকৃত মানে বাহির করা, ভেতরগত উন্নয়ন।

একজন শিক্ষিত ব্যক্তি বলতে এটা প্রয়োজনীয় নয় যে সে প্রচুর সাধারণ বা বিশিষ্ট জ্ঞানের অধিকারী। একজন শিক্ষিত মানুষ হয় সেই ব্যক্তি যার মনের বিভাগগুলো এতই বিকশিত যে সে যেকোন জিনিস চায় তা অর্জন করতে পারে অথবা এর কাছাকাছি পৌঁছায়। সে অন্য কারও অধিকার ক্ষুণœ না করে এই চেষ্টা করে থাকে। হেনরি ফোর্ড তার নিজেকে দিয়ে খুব ভালোভাবেই এই সংজ্ঞার অর্থ নিয়ে এসেছেন।

বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন, শিকাগোর একটি পত্রিকা কিছু সাধারণ সম্পাদকীয় প্রকাশ করেছিল। এই বিবৃতির মধ্যে হেনরি ফোর্ডকে বলা হলো ‘একজন অজ্ঞ শান্তিবাদী’। ফোর্ড তার খ্যাতি নষ্ট করার জন্য পত্রিকায় বিবৃত বিষয়টির বিরুদ্ধে মামলা করে। যখন মামলাটি আদালতে ন্যায়বিচারের জন্য আইনজীবীগণ বাদানুবাদ করার জন্য উঠাল তখন ফোর্ডকে সাক্ষী রূপে দাঁড় করানো হলো, যাতে বিচারকদের কাছে তাকে অজ্ঞ হিসাবে প্রমাণ করা যায়। আইনজীবীগণ তাকে বিভিন্ন ধরনের প্রশ্ন করেছিল, এসবের উদ্দেশ্য ছিল প্রমাণ করা, আইনজীবী তার নিজের জন্য সাক্ষ্য জোগাড় করা যে যদিও ফোর্ড গাড়ি উৎপাদনে বিশিষ্ট জ্ঞানের অধিকারী তবুও তিনি মূলত একজন অজ্ঞ লোক।

ফোর্ডকে এমন এমন প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছিল যে: ‘বেনেডিক্ট আরনল্ড কে?’ এবং ‘১৭৭৬ সালে আমেরিকার বিদ্রোহ দমনে ব্রিটিশরা কতজন সৈন্য পাঠিয়েছিল?’ সর্বশেষ প্রশ্নের উত্তরে ফোর্ড জবাব দেন যে, ‘আমি সঠিক সংখ্যা জানি না যে ব্রিটিশরা কতজন সৈন্য পাঠিয়েছিল, কিন্তু আমি শুনেছি যে আগে যত সৈন্য পাঠিয়েছে এটা অনুপাতের দিক থেকে তারচেয়ে বিশাল।

অবশেষে, ফোর্ড এই ধরনের প্রশ্নে বিরক্তবোধ করলেন এবং প্রশ্নের রক্ষণশীল জবাব দিতেও আর ধৈর্য রাখতে পারলেন না। তিনি হেলান দিলেন এবং আঙ্গুল তুলে ঐ আইনজীবীকে নির্দেশ করলেন যিনি তাকে প্রশ্ন করছিলেন এবং বললেন, ‘যদি আমি সত্যিই চাই আপনার মূর্খ প্রশ্নগুলোর জবাব দিতে যা আপনি মাত্র আমাকে জিজ্ঞেস করলেন অথবা অন্য যেকোন প্রশ্ন যা আপনি আমাকে জিজ্ঞেস করেছেন, আপনাকে আমি মনে করিয়ে দিতে চাই যে আমার ডেস্কে এক সারি সুইচ রয়েছে এবং যেকোন সুইচ চাপ দিয়ে আমি আমার সহায়তার জন্য এমন এমন মানুষকে ডাকতে পারি যারা আমার ব্যবসা সম্পর্কিত যেকোন প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে। আমি আমার ব্যবসাতেই আমার সব প্রচেষ্টা উৎসর্গ করেছি। এখন, আপনি কি আমাকে দয়া করে বলতে পারেন যে কেন আমি এসব সাধারণ জ্ঞানের দ্বারা আমার মাথাকে ভরিয়ে রাখব, যখন প্রশ্নগুলোর জবাব দেওয়ার মতো লোক আমার চারপাশে রয়েছে? আমার যখন যা দরকার, যে তথ্য দরকার তারা সব ধরনের জ্ঞানের যোগান দিতে পারে, তাহলে কেন আমি অযথাই এসব সাধারণ জ্ঞানের দ্বারা আমার মস্তিষ্ককে ভরিয়ে তুলব?’

এই জবাবে নিশ্চিতভাবে ভালো যুক্তি রয়েছে।

এই উত্তরে আইনজীবী ভূপাতিত হলো। আদালত কক্ষের প্রত্যেক মানুষই অনুধাবন করল যে উত্তরটি কোন অজ্ঞ ব্যক্তির উত্তর নয়, এটা একজন শিক্ষিত ব্যক্তির জবাব। সেই ব্যক্তি শিক্ষিত যে জানে কোথা থেকে জ্ঞান আহরণ করা যায় যখন তার এটার প্রয়োজন হয় এবং কীভাবে সেই জ্ঞানকে নির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনায় সংগঠিত করবে। তার ‘ঐক্যমন’ দলের সহায়তার মাধ্যমে, হেনরি ফোর্ডের ছিল সব ধরনের বিশিষ্ট জ্ঞানের অধিকারী ব্যক্তি যারা তাকে আমেরিকার সর্বোচ্চ ধনবান ব্যক্তি করেছে। এসব জ্ঞান যে তার নিজ মস্তিষ্কেই রাখতে হবে এটার কোন দরকার নেই। আশা করি এই বিবৃতি পড়ে এবং এর ব্যাখ্যা শুনে এমন কোন মানুষ নেই যিনি এর গুরুত্ব বুঝতে এখনো অসমর্থ।

আপনার আকাক্সক্ষাকে এর আর্থিক সমতুল্যে রূপান্তর করার পূর্বে আপনার ক্ষমতা সম্পর্কে নিশ্চিত হন। আপনি কী সেবা দিতে চান, কী পণ্য বা পেশা সম্পর্কে বিশিষ্ট জ্ঞান অর্জন করতে চান তা সম্পর্কে খোঁজ নিন। যা আপনি আপনার সৌভাগ্যের পরিবর্তে দিতে চান তা আগে থেকেই জেনে নিন। আপনার যতটা সামর্থ্য আছে বা অর্জনে ঝোঁক রয়েছে হয়তো আপনার এটার চেয়েও বেশি বিশিষ্ট জ্ঞান প্রয়োজন এবং যদি এটা সত্য হয়, আপনি আপনার দুর্বলতা দূর করতে পারেন আপনার ‘ঐক্যমন’ দলের সহায়তা দ্বারা।

এন্ড্রু কার্নেগি বিবৃতি দেন যে তিনি, ব্যক্তিগতভাবে, ইস্পাত ব্যবসার যান্ত্রিক ধাপসমূহের ব্যাপারে কিছুই জানতেন না; তারপরও তিনি বিশেষভাবে এ সম্পর্কে কিছু জানার জন্য সতর্ক হননি। ইস্পাত উৎপাদন ও বিপণন করতে যে বিশিষ্ট জ্ঞান তার প্রয়োজন ছিল, তা তিনি তার ঐক্যমন দলের মাধ্যমে খুঁজে পেতেন।

বিশাল সৌভাগ্যের পরিমাণকে বলা হয় ক্ষমতা এবং ক্ষমতা অর্জিত হয় উচ্চভাবে সংগঠিত ও বুদ্ধিমত্তার সাথে পরিচালিত বিশিষ্ট জ্ঞানের মাধ্যমে। কিন্তু এই জ্ঞান, প্রয়োজনীয় নয় যে, যিনি সৌভাগ্যের অধিকারী তাকেই জ্ঞানের অধিকারী হতে হবে।

পূর্ববর্তী অনুচ্ছেদ আশা ও উৎসাহ দিবে সেই ব্যক্তিকে যিনি সৌভাগ্য অর্জন করতে চান। তিনি হয়তো প্রয়োজনীয় ‘শিক্ষার’ অধিকারী নিজেকে করেননি। এমন কোন বিশিষ্ট জ্ঞানে নিজেকে শিক্ষিত করেননি যা হয়তো তার দরকার। অনেকে বিদ্যালয়ে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে শিক্ষা অর্জন করতে পারেনি তাই মাঝেমধ্যে জীবনে ‘হীনম্মন্যতা’ অনুভব করে। যে মানুষ সংগঠিত করতে এবং ‘ঐক্যমন’ দলের ব্যক্তিদের পরিচালিত করতে পারে, যারা টাকা অর্জনে দরকারি জ্ঞানের অধিকারী, তিনি ঠিক একই রকম শিক্ষিত, দলের অন্য যেকোন ডিগ্রিধারী ব্যক্তির মতোই। এটা মনে রাখবেন, যদি আপনি হীনম্মন্যতা অনুভব করেন যে আপনি বেশিদূর পড়ালেখা করতে পারেননি, তবে: টমাস আলভা এডিসন স্কুলে ‘পড়েছেন’ মাত্র তিন মাস। তার না শিক্ষার অভাব ছিল, না তিনি দরিদ্র্য হয়ে মৃত্যু বরণ করেন।

হেনরি ফোর্ড মাত্র ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত ‘পড়েছেন’। কিন্তু তিনি নিজেকে আর্থিকভাবে খুবই ভালোভাবেই ব্যবহার করেছেন।

যত সেবা আছে তন্মধ্যে বিশিষ্ট জ্ঞান সর্বাধিক প্রয়োজনীয় এবং সহজলভ্য!

‘আপনি কীভাবে জ্ঞান ক্রয় করবেন’- এটা আপনার জানা দরকার

সবার প্রথমে আপনাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে আপনি কী ধরনের বিশিষ্ট জ্ঞান অর্জন করতে চান এবং কী উদ্দেশ্যে এটা প্রয়োজন। আপনার জীবনের প্রধান উদ্দেশ্য কী, যে লক্ষ্যের প্রতি আপনি কাজ করবেন। আপনাকে ঠিক করতে হবে কোন জ্ঞান আপনার প্রয়োজন। এই প্রশ্নের সমাধান হলে, আপনার পরবর্তী পদক্ষেপ হবে জ্ঞানের নির্ভরযোগ্য উৎস হতে সঠিক তথ্য খুঁজে নেওয়া। আরও গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে:

(ক) একজনের নিজ অভিজ্ঞতা ও শিক্ষা

(খ) অপর ব্যক্তিদের অভিজ্ঞতা ও শিক্ষার সহযোগিতা গ্রহণ (ঐক্যমনের সহায়তা গ্রহণ)

(গ) কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়

(ঘ) গ্রন্থাগার (বই ও সাময়িক পত্রিকার মাধ্যমে আপনি সভ্যতার সব সংগঠিত জ্ঞান পাবেন)

(ঙ) বিশেষ প্রশিক্ষণ কর্মশালা (নৈশ বিদ্যালয় এবং বিশেষ বিশেষ বিদ্যালয়ের শিক্ষার মাধ্যম)

যেহেতু আপনি জ্ঞান অর্জন করছেন এটা অবশ্যই একটি নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যের জন্য সংগঠিত হতে হবে এবং ব্যবহারিক পরিকল্পনার মাধ্যমে ব্যবহারিক প্রয়োগ করতে হবে। জ্ঞানের কোন দাম নেই, যদি-না এটা ব্যবহারিক প্রয়োগের মাধ্যমে মূল্যবান শেষ প্রান্তে পৌঁছানো যায়। এই একটি কারণেই কলেজের ডিগ্রি উচ্চভাবে মূল্যায়ন পায় না। তারা শুধু পাঁচ-মিশালী জ্ঞান ব্যতীত আর কিছুই প্রকাশ করে না।

যদি আপনি অতিরিক্ত কোর্স করতে চান, প্রথমে উদ্দেশ্য স্থির করুন যে কেন আপনি জ্ঞান খুঁজছেন। তারপর দেখুন কোথা থেকে আপনি এই বিশেষ জ্ঞান লাভ করতে পারবেন।

একজন সফল ব্যক্তি, সবদিক থেকেই, কখনো চেষ্টা করা থামায় না। সে তার প্রধান উদ্দেশ্য, ব্যবসা অথবা পেশা সম্পর্কিত বিশিষ্ট জ্ঞান অর্জনে অবিরত চেষ্টা করে যায়। যারা সাধারণত সফল হয় না তারা ভুল বিশ্বাস করে যে বিদ্যালয় পার করলেই জ্ঞান অর্জনের সময় শেষ হয়ে যায়। সত্য হচ্ছে বিদ্যালয় শুধু একজনকে সেই পথেই রাখে যে কীভাবে ব্যবহারিক জ্ঞান অর্জন করা যায়।

এই পরিবর্তিত পৃথিবীর সাথে যা অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের পর নতুন করে শুরু হয়েছে, শিক্ষা পদ্ধতিরও বিস্ময়কর পরিবর্তন এসেছে। আজকের দিন হচ্ছে বিশিষ্টতার দিন! এই সত্যের ওপর কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি সচিব রর্বাট পি. মুর জোর দিয়েছেন।

‘বিশেষজ্ঞদের বেশি খোঁজা হয়’

চাকরিদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো এখন বিশেষজ্ঞদের বেশি খোঁজে। তারা চায়: ব্যবসায়িক কলেজের স্নাত্মকধারীদের, হিসাববিজ্ঞান ও পরিসংখ্যানের বাস্তব প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত ছাত্রদের, সকল প্রকার প্রকৌশলীদের, সাংবাদিক, নকশাবিদ, রসায়নবিদ এবং অসাধারণ নেতাদের যারা কলেজ প্রাঙ্গনে কর্মঠ ও দুরন্ত।

যে ব্যক্তি কলেজ প্রাঙ্গণে কর্মঠ, যার ব্যক্তিত্ব এমন যে সে সব ধরনের মানুষের সাথে চলতে পারে এবং যে তার শিক্ষার বিষয়াবলি নিয়ে পর্যাপ্ত কাজ করেছে, এমন ছাত্রদেরই তো দরকার। এদের মধ্যে কিছুর, তাদের সর্বব্যাপী গুণাবলির কারণে, বিভিন্ন ধরনের চাকরি পদের সুযোগ পেয়ে থাকে। আর অল্প কিছু বাকি থাকে তারা সাধারণ লোকদের মতোই পড়ে থাকে।

এই তত্ত্ব ব্যাখ্যা করে পাওয়া যায় যে ‘সবচেয়ে বেশি নম্বরপ্রাপ্ত’ শিক্ষার্থীই যে সবচেয়ে ভালো চাকরির সুযোগ পাবে তা প্রায় ক্ষেত্রে সত্য নয়। জনাব মুর বলেন বেশির ভাগ কোম্পানিই শুধু পাঠ্যক্রমের নথি দেখে না; বরং শিক্ষার্থীদের কর্ম নথি এবং ব্যক্তিত্ব দেখে।

একটি সুবৃহৎ কারখানা প্রতিষ্ঠানের, নেতৃস্থানীয়, তার পক্ষ হতে জনাব মুরকে লিখে পাঠান যে:

‘আমরা মুখ্যত এমন মানুষের জন্য আগ্রহী যারা ব্যবস্থাপনা কাজে ব্যতিক্রমধর্মী উন্নয়ন ঘটাতে পারবে। এই কারণে আমরা যে ধরনের গুণাবলিতে বেশি জোর দেই তা হচ্ছে: চরিত্র, বুদ্ধিমত্তা এবং ব্যক্তিত্ব। এগুলো নির্দিষ্ট শিক্ষাগত সনদের চেয়েও অনেক গুরুত্বপূর্ণ।


‘শিক্ষানবিস’ প্রস্তাব

শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন দফতরে, দোকানে এবং কারখানার পেশায় ‘শিক্ষানবিস’ পদ্ধতির সুযোগ প্রদান করা দরকার। জনাব মুর বলেন যে প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে কলেজের প্রথম বর্ষ বা দ্বিতীয় বর্ষেই জিজ্ঞেস করা উচিত ‘একটি নির্দিষ্ট ভবিষ্যৎ পাঠ্যক্রম নির্বাচন করতে এবং যদি তা না করে থাকে তবে তাকে উদ্দেশ্যহীনভাবে পড়ালেখা থেকে থামানো উচিত।’

কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অবশ্যই এই বাস্তবিক বিবেচনার মুখোমুখী হওয়া উচিত যে সব পেশা ও চাকরিতে এখন ‘বিশেষজ্ঞদের’ চাহিদা। তিনি আরও জোর দিয়ে বলেন যে, পেশা নির্দেশনার প্রতি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আরও সরাসরি দায়িত্ব পালন করা দরকার। যাদের বিশিষ্ট বিদ্যালয় পাঠ দরকার তাদের জন্য জ্ঞানের উৎসগুলোর একটি সর্বাধিক নির্ভরযোগ্য ও সহজলভ্য মাধ্যম হচ্ছে নৈশ বিদ্যালয় যা বেশির ভাগ বড় শহরে পরিচালনা করা হয়। অনুরূপ বিদ্যালয়ে বিশেষ প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। যেকোন জায়গায় থেকে যেকেউ এই প্রশিক্ষণ নিতে পারেন। যতদূর পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের ডাকঘরের চিঠি যায়, ততদূর পর্যন্ত এই ধরনের নৈশ বিদ্যালয় আছে। এসব বিদ্যালয়ে এমন সব বিষয়ে পড়ানো হয় যা বাস্তবে খুব দরকার। যেমন, কীভাবে হিসাব করবেন, ব্যবসায়িক ব্যবস্থাপনার সহজ ব্যাপার, গ্রাহকদের সাথে কীভাবে আচরণ করবেন, বিজ্ঞাপনের বিষয় সহ প্রভৃতি বিষয় শেখানো হয়। এখান থেকে অতিরিক্ত শিক্ষা হিসাবে আপনার যা দরকার তা শিখে নিতে পারেন। নৈশ পাঠ প্রশিক্ষণের একটি সুবিধা হচ্ছে শিক্ষা ব্যবস্থার নমনীয়তা যা একজনকে অনুমতি দেয় তার অবসর সময়ে পড়ালেখা করার। অপর একটি বিস্ময়কর সুবিধা হচ্ছে নৈশ পাঠ প্রশিক্ষণের (যদি বিদ্যালয়টি সতর্কভাবে নির্বাচন করা হয়) বেশির ভাগ কার্যক্রম সুযোগ দিয়ে থাকে নৈশ বিদ্যালয়ের মাধ্যমে তাদের সাথে উদার প্রকৃতির পরামর্শের সুবিধার মাধ্যমে। যার দাম অমূল্য হতে পারে যাদের বিশিষ্ট জ্ঞান দরকার। কোন ব্যাপারই নয় আপনি যেখানেই বাস করেন না কেন, আপনি সুবিধাগুলো ভোগ করতে পারেন।

চেষ্টা এবং খরচ ছাড়া কোনকিছু অর্জন সাধারণত প্রশংসাহীন, প্রায়ই দামহীন এক ব্যাপার। হয়তো এই জন্যই আমরা আমাদের সরকারি বিদ্যালয়গুলোর বিস্ময়কর সুযোগ থেকে এত অল্প ফলাফল পাই। আত্ম-শৃঙ্খলা একজন গ্রহণ করে বিশিষ্ট পাঠের একটি নির্দিষ্ট ব্যবস্থা হতে যাতে কিছু বিস্তার তৈরি হয়। কিন্তু সুযোগ অপচয় হয় যখন এই জ্ঞান বিনামূল্যে পাওয়া যায়। অনুরূপ বিদ্যালয় হচ্ছে উচ্চভাবে সংগঠিত ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান। তাদের শিক্ষাদানের জন্য বেতন এত কম যে তারা অবশিষ্ট অর্থ প্রদান করতে জোর দিয়ে অনুরোধ করে। বেতন দেওয়ার জন্য জিজ্ঞেস করার ফলে, যদিও শিক্ষার্থী ভালো বা নিম্ন ফলাফল তৈরি করে, যে একজন কার্যক্রমটি অনুসরণ করে তার ওপর এটার প্রভাব পড়ে; নতুবা সে হয়তো এটা ছেড়েই দিত। একই ধরনের অন্যান্য বিদ্যালয় এই দিকটির প্রতি পর্যাপ্তভাবে গুরুত্ব দেয়নি। নানা ধরনের বিষয় শেখানোর মতো এসব নৈশ বিদ্যালয়ের সংগ্রহ বিভাগ খুবই উৎকৃষ্ট ধরনের প্রশিক্ষণের ওপর গঠিত। এগুলো হচ্ছে: সিদ্ধান্ত, তৎপরতা, কাজ এবং এই অভ্যাসÑএকজন যে কাজ আরম্ভ করেছে তা শেষ করা।

আমি এটা ২৫ বছর আগে শিখেছি। আমার এক অভিজ্ঞতা থেকে। আমি বিজ্ঞাপন ব্যবস্থাপনা শিখতে একটি নৈশ বিদ্যালয়ে তালিকাভুক্ত হয়েছিলাম। ৮-১০টি ক্লাস করার পর আমি পড়ালেখা বন্ধ করে দিই। কিন্তু বিদ্যালয়টি আমাকে বকেয়া পরিশোধ করার জন্য বার্তা পাঠানো বন্ধ করছিল না। মোট ৩০টি ক্লাস করতে হবে। আমি আমার ১০টি ক্লাসের টাকা পরিশোধ করেছিলাম। ভাবলাম, আর যাব না এবং বাকি টাকাও দিব না। কিন্তু, স্কুল থেকে বাকি অর্থের জন্য অনুরোধ করছিল, যদিও আমি আমার পড়ালেখা চালু রাখি বা না রাখি। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম যে যদি আমাকে কোর্সের দাম দিতেই হয় (যা করার প্রতি আমি আইনত নিজের কাছে বাধ্য), আমি ক্লাসগুলো সম্পূর্ণ করব এবং আমার অর্থকে মূল্যবহ করে তুলব। আমি অনুভব করেছিলাম, সেই সময়, যে বিদ্যালয়ের সংগ্রহ ব্যবস্থা খুবই ভালোভাবে সংগঠিত ছিল। কিন্তু আমি পরবর্তী জীবনে শিখলাম যে এটা ছিল আমার প্রশিক্ষণের একটি মূল্যবান অংশ যে জন্য কোন ব্যয় করতে হয়নি। দাম দিতে বাধ্য করার ফলে, আমি এগিয়ে গেলাম এবং কোর্স সম্পূর্ণ করলাম। পরবর্তী জীবনে আমি আবিষ্কার করলাম যে স্কুলের দক্ষ সংগ্রহ ব্যবস্থা, যারা আমাকে বাকি টাকা পরিশোধের জন্য চাপ দিয়েছিল তাদের চেয়ে কোর্সটি আমার জন্য অনেক বেশি মূল্যের ছিল। যদিও বিজ্ঞাপনের প্রশিক্ষণ কোর্স আমাকে অনিচ্ছা সত্ত্বেও শেষ করতে হয়েছে, কিন্তু পরবর্তীতে এটা আমার অনেক কাজে লেগেছে।

এই যে আমাদের দেশের বিদ্যালয় ব্যবস্থা যাকে আমরা বিশ্বের মধ্যে শ্রেষ্ঠ সাধারণ স্কুল ব্যবস্থা বলে থাকি। আমরা সুন্দর ভবনের জন্য বিরাট অঙ্কের অর্থ বিনিয়োগ করেছি। আমরা উপযোগী যাতায়াত ব্যবস্থা প্রদান করেছি যাতে গ্রামে বাসকারী শিশুরা বিদ্যালয়ে আসতে পারে, যাতে তারা শ্রেষ্ঠ স্কুলে অংশ নিতে পারে। কিন্তু সেখানে একটি অত্যন্ত বিস্ময়কর দুর্বলতা হচ্ছে এই অবিশ্বাস্য ব্যবস্থাÑসম্পূর্ণ বিনামূল্যে প্রদান করা হয়! মানব সত্তার অদ্ভুত জিনিসের মধ্যে একটি হচ্ছে যে তারা কেবল সেটারই মূল্য দেয় যার দাম আছে। বিনামূল্যের আমেরিকান স্কুল এবং বিনামূল্যের গ্রন্থাগার, মানুষের ওপর কোন প্রভাব ফেলে না। কারণ এগুলো বিনামূল্যের। এটাই প্রধান কারণ যে জন্য এত বেশি লোকজন স্কুল ছাড়ার পরে কাজে যাওয়ার জন্য অতিরিক্ত প্রশিক্ষণের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। এটা মুখ্য কারণগুলোর মধ্যে আরও একটি যে কেন নিয়োগকর্তাগণ সিলেবাসের বাইরে একজন কী করেছে তা বেশি বিবেচনা করে। নিয়োগকর্তাগণ অভিজ্ঞতা থেকে শিখেছে, যে কোন ব্যক্তি যিনি উচ্চ আকাক্সক্ষার প্রতি তার অবসর সময় গৃহে পাঠ করে বা পাঠ্যক্রমের বাইরে কোন প্রশিক্ষণ কোর্স নেয় তার মধ্যে সেই গুণাবলি রয়েছে যাতে নেতৃত্ব তৈরি হয়। এই অনুধাবন একটি অঙ্গভঙ্গীর বদান্যে পাওয়া যায়নি, এটা নিয়োগকর্তাদের পরীক্ষিত ব্যবসায়িক বিচারের ওপর ভিত্তি করে পাওয়া গেছে।

লোকজনের মধ্যে একটি দুর্বলতা আছে যার জন্য কোন প্রতিকার নেই। এমন রোগ যা আরোগ্যের জন্য কোন ঔষধ নেই। এটা একটি সার্বজনীন দুর্বলতা। এটা হচ্ছে উচ্চাকাক্সক্ষার অভাব! ব্যক্তিরা, বিশেষ করে বেতনভুক্ত পুরুষরা, যারা শিডিউল তথা অনুসূচি [অনুসূচি মানে একদিনে কী করবেন এবং কখন করবেন তার তালিকা] থেকে তাদের অবসর সময় বের করে বিশেষ প্রশিক্ষণ নেয়, তারা কদাচিৎ বেশি সময় ধরে সমাজের নিচের স্তরে পড়ে থাকে। তাদের কাজই তাদেরকে উপরে উঠার পথ খুলে দেয়, তাদের পথ থেকে বহু বাধা সরিয়ে দেয় এবং বন্ধুত্বপূর্ণ আগ্রহ অর্জন করে। তাদের প্রতি সম্ভাবনার দুয়ার খুলে যায়।

যারা বহু বছর আগে বিদ্যালয় ত্যাগ করেছে সেসব কর্মজীবী লোকজনের জন্য নৈশ বিদ্যালয় বা তাদের ব্যবসা সম্পর্কিত বিশেষ প্রশিক্ষণ অত্যন্ত কার্যকরী এবং ফলদায়ক একটি ব্যাপার। তারা এটা বুঝতে পারে যে তাদের অবশ্যই অতিরিক্ত বিশিষ্ট জ্ঞান অর্জন করতে হবে, কিন্তু স্কুলে ফিরে গিয়ে সময় নষ্ট করা যাবে না।

যখন থেকে ব্যবসায়িক বিপর্যয় ঘটেছে তখন থেকে অর্থনৈতিক অবস্থা বদলে গেছে। এই পরিবর্তনের হাওয়া সব জায়গায় বিদ্যমান। এটা হাজারো মানুষকে বাধ্য করেছে যাতে আয়ের জন্য অতিরিক্ত কিছু খুঁজতে হয় অথবা নতুন উৎস খুঁজতে হয়। এদের মধ্যে বেশির ভাগের জন্য, তাদের সমস্যার সমাধান পাওয়া যেতে পারে কেবল বিশিষ্ট জ্ঞান অর্জন দ্বারা। অনেকে বলপূর্বক বাধ্য হয়েছে তাদের পেশা পরিবর্তন করতে।

যখন একজন সওদাগর খুঁজে পান যে একটি নির্দিষ্ট সারির পণ্যদ্রব্য বিক্রয় হচ্ছে না, তখন তিনি সাধারণত বাজারে চাহিদা আছে এমন অন্য কোন পণ্য দ্বারা বর্তমান পণ্যকে প্রতিস্থাপিত করেন। যে ব্যক্তি তার নিজের শ্রম, বুদ্ধি, সময় দিয়ে অর্থ আয় করতে চায় তার উচিত বাজারের চাহিদাকে বোঝা। তাকে অবশ্যই একজন দক্ষ সওদাগর হতে হবে। যদি সেবাগুলোÑ শ্রম, বুদ্ধি, সময়, আপনাকে পর্যাপ্ত বিনিময় মূল্য না দেয়, তবে আপনাকে আপনার পেশা পরিবর্তন করতে হবে। এমন কোন পেশা নির্বাচন করতে হবে যার বাজারদর আছে এবং আপনি পর্যাপ্ত বিনিময় মূল্য পাচ্ছেন।

স্টুয়ার্ট অস্টিন উয়ার নিজেকে একজন নির্মাণ প্রকৌশলী রূপে তৈরি করলেন এবং সেই সারির কাজ অনুসরণ করলেন যতক্ষণ পর্যন্ত না বিপর্যয় তার বাজারকে সীমিত করেছে, তাকে তার দরকার মতো আয় দিচ্ছে না। তিনি নিজেকে পুনরায় আবিষ্কার করলেন। সিদ্ধান্ত নিলেন তার পেশা পরিবর্তন করবেন। তিনি আইন পেশাকে নির্বাচন করলেন। আইনের কলেজে ফিরে গেলেন এবং বিশিষ্ট কার্যক্রম গ্রহণ করলেন। যার দ্বারা তিনি নিজেকে একজন প্রাতিষ্ঠানিক আইনজীবী রূপে প্রস্তুত করলেন। ব্যবসায়িক ধ্বস ব্যাপারটা সমাপ্ত না হওয়া সত্ত্বেও, তিনি তার প্রশিক্ষণ সম্পূর্ণ করলেন, বার কাউন্সিল পরীক্ষায় তিনি উত্তীর্ণ হলেন এবং দ্রুত একটি লাভজনক আইন ব্যবসা তৈরি করেন। টেক্সাসের ডালাসে তার চেম্বার। তার মক্কেলরা তার প্রশংসা করে এবং আরও মামলা নিয়ে তার কাছে আসছে।

বইটিকে সোজাসুজি করে ধরে রাখুন। এই পর্যায়ে এসে অনেকে অজুহাত দেয় এবং বলবে, ‘আমি কলেজ-ভার্সিটিতে যেতে পারব না। কারণ আমার একটি পরিবার আছে।’ অথবা ‘আমি আমার বয়স হয়েছে।’ আমি এই তথ্য যোগ করতে চাই যে জনাব উয়েরের বয়স ছিল ৪০ এবং তিনি যখন কলেজে ফিরে যান তখন তিনি ছিলেন বিবাহিত। অধিকন্তু, সতর্কতার সাথে উচ্চভাবে গঠিত বিশিষ্ট কোর্স নির্বাচন করতে হবে, কলেজগুলোতে শেখানোর জন্য যে কোর্স নির্ধারণ করা হয় সেগুলো বাস্তবসম্মত এবং সর্বোৎকৃষ্টভাবে প্রস্তুত করা হয় যাতে একজন তৎক্ষণাৎ কাজে লাগাতে পারে। বেশির ভাগ শিক্ষার্থীদের যা শিখতে ৪ বছর লাগে, জনাব উয়ের এটা শেখেন মাত্র ২ বছরের মধ্যে। কীভাবে জ্ঞান ক্রয় করা যায় এটা জানতে দাম দিতে হয়!

যে ব্যক্তি চিন্তা করে যে সে কলেজ-ভার্সিটির পড়ালেখা শেষ করেছে তাই আর কোন জ্ঞান অর্জন করার দরকার নেই। সে অসহায়ভাবে মধ্যম অবস্থায় কষ্ট ভোগ করে। কোন ব্যাপারই না, তার যে পেশাই হোক না কেন সে এই মধ্যম অবস্থার যন্ত্রণা ভোগ করবেই। সাফল্যের পথ হচ্ছে সেই পথ যা অবিরতভাবে জ্ঞানের অনুসরণ করে।

চলুন আমরা একটি বিশেষ উদাহরণ বিবেচনা করি। বিপর্যয় চলাকালীন একজন বিক্রয়কর্মী একটি মুদি দোকানে নিজেকে খুঁজে পেল দায়িত্ব ছাড়া অবস্থায়। তার কিছু অভিজ্ঞতা ছিল জিনিস সাজানোর ওপর। সে হিসাব বিজ্ঞানের একটি কোর্সে অংশ নিল, নিজেকে পরিচিত করাল সর্বাধুনিক জিনিস সাজানো ও দফতর উপকরণ দিয়ে এবং নিজের জন্য একটি ব্যবসায় নেমে গেল। ইতোপূর্বে যে মুদি দোকানে সে কাজ করত তার সাথে ব্যবসা শুরু করল। সে ১০০ এর বেশি ছোট্ট সওদাগরদের সাথে তাদের হিসাব রাখার জন্য চুক্তি করল। খুব কম চার্জের বিনিময়ে সে কাজ করে দিবে। তার ধারণা এতটা বাস্তবিক ছিল যে সে শীঘ্রই একটি গাড়ি কিনে নিল যাতে দোকানে দোকানে গিয়ে হিসাব করতে পারে। এই গাড়িকে আধুনিক জিনিস সাজানোর উপকরণ দিয়ে সাজিয়ে তুলল। সে এখন জিনিস সাজানো দফতরগুলোর একটি দল চালায়। সেই গাড়ি নিয়েই। তার কর্মচারীর সংখ্যাও কম নয়। এরা তাকে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের হিসাব রক্ষণে সহায়তা করে। তার মাসিক চার্জ এখনো খুব কম। এর ফলে সে আরও ব্যবসায়ীদের অনুরোধ পায়।

এই অসাধারণ ও সফল ব্যবসার মুখ্য উপকরণ হচ্ছে বিশিষ্ট জ্ঞান ও কল্পনা। গত বছর সেই ব্যবসার স্বত্বাধিকারী এমন একটি অঙ্কের রাজস্ব প্রদান করে যা তার গ্রাহক, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের দেওয়া রাজস্ব থেকে ১০ গুণ বেশি ছিল। যখন ব্যবসায়িক বিপর্যয় তার ওপর একটি সাময়িক বাধার বল প্রয়োগ করে, যা ছিল ছদ্মবেশে একটি আর্শীবাদ।

এই সাফল্যম-িত ব্যবসার আরম্ভ হয় একটি আইডিয়া থেকে!

[ফজলে রাব্বির কথাÑসামনে যাওয়ার আগে একটু জিনিস সাজানো ব্যবসা সম্পর্কে বলে নিই। আমাদের বইয়ের ব্যবসা আছে। বইয়ের দোকানে কোন বই কোথায় রাখা হয় তা সাধারণত এখনও মুখস্ত ও স্মৃতিশক্তিতে ধরে রাখতে হয়। মুদি দোকান, গাড়ির খুচরা যন্ত্রাংশের দোকান, স্টেশনারি দোকান ইত্যাদি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ব্যবসায় জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখা ও সময়মতো তা খুঁজে পাওয়া অত্যন্ত কষ্টকর এক ব্যাপার। তাই আমেরিকায় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের সহায়তা করতে ‘জিনিস সাজানো ব্যবসা’ নামক একটি ব্যবসা চালু হয়। যাতে করে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের তাদের দোকানের পণ্য খুঁজে পেতে সহজ হয় এবং তাদের মূল্যবান সময় ও শ্রম বাঁচে।]

যেহেতু আমার সুবিধা ছিল সেই আইডিয়া বেকারদেরকে সরবরাহ করার, আমি এখন অনুমান করি অপর একটি ধারণা সরবরাহ করার ফলে তাদের আরও সুবিধা হতে পারে, যাতে এর দ্বারা আরও বেশি আয়ের প্রতি সম্ভাবনা তৈরি হবে। অধিকন্তু প্রয়োজনীয় সেবা সম্পন্ন করার সম্ভাবনা রয়েছে হাজারো লোকের প্রতি যাদের ভয়ংকরভাবে সেই সেবা দরকার।

আইডিয়াতে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে সেসব বিক্রয় কর্মীর যারা বিক্রয় ত্যাগ করে দিয়েছেন এবং জিনিস সাজানো ব্যবসায় নেমেছে। যখন একজন মানুষ পরিকল্পনাটি পরামর্শ রূপে পাঠ করবে, যেন তার বেকার সমস্যার একটি সমাধান, সে দ্রুত বলে উঠবে, ‘আমি আইডিয়াটি পছন্দ করেছি, কিন্তু আমি জানি না কীভাবে এটাকে নগদে রূপান্তরিত করব।’ অন্য কথায় বলতে গেলে, তিনি অভিযোগ করবেন যে তিনি হয়তো তার এই জ্ঞান অর্জন করার পর কীভাবে তার জিনিস সাজানোর জ্ঞান প্রয়োগ করবেন তা নাও জানতে পারেন।

তাই, সে অপর সমস্যা নিয়ে এসেছে যা সমাধান করতে হবে। একজন তরুণ নারী, মুদ্রণ লেখকের সহায়তায়, যার চিঠি লেখার হাত চালু ছিল এবং যিনি যেকোন ঘটনাকে একত্র করতে পারেন, একটি খুবই আকর্ষণীয় বই প্রস্তুত করেছেন, নতুন পদ্ধতিতে জিনিস সাজানোর সুবিধা বর্ণনা করে। পৃষ্ঠাগুলো পরিচ্ছন্নভাবে মুদ্রণ করা এবং একটি সাধারণ খাতার মধ্যে আঠা দিয়ে লাগিয়ে দেন, যা একটি নীরব পরিচয়পত্র রূপে প্রয়োগ করা হয়। এই নতুন ব্যবসা তিনি এতটা দক্ষভাবে পালন করেন যে এর স্বত্বাধিকারী শীঘ্রই আরও দোকানের হিসাব রাখার জন্য অনুরোধ পান।

সারা দেশ জুড়ে এমন হাজারো লোক রয়েছে যাদের একটি পণ্যদ্রব্য বিশেষজ্ঞের সেবা দরকার। যাতে একটি আকর্ষণীয় সংক্ষিপ্ত বিবরণ থাকবে। [ফজলে রাব্বির কথাÑযেমন, আমার বর্তমানে এমন লোক দরকার যিনি সংক্ষিপ্ত আকারে সাফল্য প্রকাশনীর বইগুলোর কার্যকারিতা এবং উপকারিতা তুলে ধরবে। বাংলাদেশে এমন অনেক ব্যবসায়ী আছে যারা তাদের পণ্যের এমন সংক্ষিপ্ত বিবরণ চায় যা জনগণের সামনে তার পণ্যের কার্যকারিতা এবং উপকারিতা তুলে ধরবে।] ফলে কোম্পানি তাদের পণ্যকে ভালোভাবে বিপণন করতে সমর্থ হবে। এমন একটি কাজ থেকে সহজেই একটি ভালো অঙ্কের বাৎসরিক আয় সংগৃহীত হতে পারে। দ্রব্যটির উৎপাদনকারী সংস্থা ঠিক এই ধরনের লোকই তো খুঁজচ্ছে। তবে এই কাজের ফলে কোম্পানির চেয়ে যারা পণ্য ব্যবহারকারী তারা সবচেয়ে বেশি সুবিধা পাবে। তারা পণ্যের সঠিক ও যথার্থ ব্যবহার সম্পর্কে জানতে পারবে। তবে যেসব কোম্পানি ইচ্ছাকৃতভাবে তাদের পণ্যে যা নেই তাই প্রচার করে সেসব বিবরণ সম্পর্কে বলছি না। পণ্যের বিবরণ অবশ্যই সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত হতে হবে।

এখানে বর্ণিত আইডিয়ার জন্ম হয়েছিল প্রয়োজনীয়তা থেকে। একটি জরুরি সেতু নির্মাণ যাতে জরুরি অবস্থার সমাধান করা যায়। কিন্তু এটা কেবল একজন মানুষকে সেবা দিয়েই থেমে থাকেনি। যে নারী ঐ আইডিয়া সৃষ্টি করেছিলেন তার দূরদর্শী চিন্তা ছিল। তিনি দেখলেন তার নতুনভাবে জন্ম দেওয়া মস্তিষ্ক-শিশু একটি নতুন পেশা তৈরি করেছে, যা ভাগ্য কর্তৃক নির্দিষ্ট একটি মূল্যবান সেবা সম্পন্ন করবে হাজারো লোকের প্রতি যারা ব্যবসায়িক জগতে ব্যক্তিগত সেবা বিপণন করতে চায়।

তার ক্ষণিক সফল কর্মের উত্তেজনায় তিনি তার প্রথম ‘ব্যক্তিগত সেবা বাজারজাতের জন্য প্রস্তুতকৃত পরিকল্পনা’ তৈরি করেন। এই প্রাণবন্ত মহিলা তার ছেলের জন্য একই ধরনের সমস্যার সমাধান তৈরি করেন যে কেবল কলেজ সমাপ্ত করেছে। কিন্তু তার দক্ষতা নিয়ে একটি চাকরি খুঁজে পেতে সম্পূর্ণ অসমর্থ হয়েছে। পরিকল্পনাটি তিনি তার ছেলের জন্য প্রয়োগ করেছিলেন। যা ছিল আমার দেখা মতে ব্যক্তিগত গুণ বর্ণনার সর্বোৎকৃষ্ট নমুনা।

যখন পরিকল্পনা বইটি সম্পূর্ণ হলো, এটা বহন করছিল সুন্দরভাবে মুদ্রিত প্রায় ৫০টি পৃষ্ঠা। যথার্থভাবে তথ্যে সংগঠিত, তার পুত্রের মৌলিক কর্মদক্ষতা সম্বলিত ঘটনার বর্ণনা, বিদ্যালয় পাঠ, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এবং অন্যান্য তথ্যের এক মহাসমাবেশ যা এখানে বর্ণনার জন্য ব্যাপক। অধিকন্তু, পরিকল্পনা বইটি ছেলেটি সম্পর্কে একটি সম্পূর্ণ চিত্র বর্ণনা করছিল এবং সে কোম্পানিতে কী দায়িত্বের জন্য আগ্রহী ও যোগ্য তাও বর্ণিত ছিল। ব্যাপারটা পুরোই যেন শব্দ দ্বার তৈরি একটা ছবি।

পরিকল্পনা বই প্রস্তুত করতে কয়েক সপ্তাহের শ্রম প্রয়োজন হয়েছিল। তৎকালে এটার সৃষ্টিকারী তার ছেলেকে গ্রন্থাগারে পাঠান। প্রায় প্রতিদিন। যাতে নিজের চেষ্টায় সে প্রয়োজনীয় তথ্য লাভ করে যাতে সে কেন কোম্পানির ঠিক ঐ পদের জন্যই যোগ্য তা খুঁজে বের করা যায়। অধিকন্তু, তিনি ছেলেকে পাঠালেন তার ইচ্ছুক প্রতিষ্ঠানের বিপরীতে সব প্রতিদ্বন্দ্বীদের কাছে এবং তাদের কাছ থেকে তাদের ব্যবসা পদ্ধতির গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহের জন্য, যার মূল্য পরিকল্পনাটি তৈরি করার ক্ষেত্রে অনেক বেশি ছিল। এতে করে সে তার দায়িত্ব পূর্ণ করতে এগুলোর প্রয়োগ করতে পারবে। যখন পরিকল্পনাটি সমাপ্ত হলো, এটা বহু চমৎকার পরামর্শ ও বুদ্ধিতে ভরপুর ছিল। এতে করে ছেলেটির ইচ্ছুক প্রতিষ্ঠানটি এসব বুদ্ধি ও পরামর্শ প্রয়োগ করে মুনাফা করতে পারে। (পরবর্তীতে কোম্পানিটি এই পরামর্শগুলো ব্যবহার করেছিল।)

[চিন্তা করে দেখুন, যে ব্যক্তি চাকরি এবং দায়িত্ব পাওয়ার আগেই কোম্পানির উন্নয়নে নিজের শ্রম, বুদ্ধি ও সময় দেয় তাকে কোম্পানি নিয়োগ দিবে না-তো কাকে দিবে!]

একজন হয়তো উদাসীনভাবে জিজ্ঞেস করতে পারে, ‘একটি চাকরি নিশ্চিত করতে কেন এত ঘাঁটাঘাঁটি করব?’ জবাব সরাসরি দেওয়া হচ্ছে, অধিকন্তু এটা নাটকীয়, কারণ এটা একটা বিষয়ের অংশ যা থেকে অনুমান করা যায়, একটা হৃদয় বিদারক ঘটনার কিছু অংশ যা হচ্ছে লক্ষাধিক পুরুষ ও নারী যাদের স্বতন্ত্র আয়ের উৎস হচ্ছে ব্যক্তিগত দক্ষতা।

জবাব হচ্ছে, ‘একটি জিনিস উত্তমভাবে সম্পন্ন করা কখনো সমস্যা নয়!’ এই মহিলার দ্বারা পরিকল্পনা প্রস্তুত হয়েছে তার ছেলের সর্বোচ্চ মুনাফার জন্য। চাকরিটি পেতে তাকে সহায়তা করেছিল যা সে তার প্রথম সাক্ষাৎকারে প্রয়োগ করেছিল, তার দ্বারা ঠিক করে দেওয়া একটি বেতনে।’

[‘একটি জিনিস উত্তমভাবে সম্পন্ন করা কখনো সমস্যা নয়; বরং আনন্দের!’ আমি প্রথম যখন নেপোলিয়ন হিলের থিংক অ্যান্ড গ্রো রিচ বই অনুবাদ করি তখন আমার ২ বছর সময় লেগেছে। তারপর কেউ ছাপাবে না, এ বই চলবে না, এসব শোনার পর ১০টি বই ফটোকপি করি। তারপর বইটি আবার পড়ে এর ভুল সংশোধন করি। এরপর এক হাজার বই ছাপানো হয়। তারপরেও আমি আবার বইটিকে আরও পাঠক বোধগম্য ও সহজবোধ্য করার চেষ্টা করি এবং এখনো করছি। ব্যক্তিগতভাবে, আমার কাছে এ বইকে ভালো, আরও ভালো, উত্তমভাবে পাঠকের সামনে উপস্থিত করার মধ্যে কখনো কোন সমস্যা, ঝামেলা বা বাধা মনে হয়নি; বরং আনন্দের মনে হয়েছে। প্রতিবারই আমি অভিনব কিছু শিখছি আর পাঠকের সাথে বিনিময় করার সুযোগ পাচ্ছি। ঠিক একইভাবে আপনি যা ভালোবাসেন, যার আপনি যোগ্য, সেই দায়িত্ব পালনের জন্য, আপনার জীবনের একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য পূরণের জন্য আপনাকে উত্তম হতে হবে, আপনার দক্ষতাকে বৃদ্ধি করতে হবে, নানা ধরনের বুদ্ধি, পরামর্শ ও তথ্য সংগ্রহ করতে হবে। উত্তম হওয়ার প্রতি আপনার এই যাত্রা কখনো সমস্যা নয়। কারণ উত্তম হলে তো সবশেষে আপনিই লাভবান হবেন। তাই নয় কী!]

আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে যে এতে করে ছেলেটিকে একদম নিচের পদ থেকে আরম্ভ করতে হয়নি। সে একজন কনিষ্ঠ এক্সিকিউটিভ তথা কার্যনির্বাহী রূপে আরম্ভ করল, একজন নির্বাহীর বেতনে।

‘কেন এত সব সমস্যায় যাব?’ আপনি কি এখনও জিজ্ঞেস করছেন?

বেশ, একটি জিনিসের জন্য, এই তরুণ ব্যক্তির পরিকল্পিত উপস্থাপন হচ্ছে একটি পদ্ধতি যাতে একটি দায়িত্ব কেটে বের করে আনা হয়েছে; নতুবা যেখান থেকে সে আরম্ভ করেছে এই পদে পৌঁছাতেই তার ১০ বছর সময় লাগতো যদি সে ‘নিচের পদ থেকে আরম্ভ করত এবং কাজ করে উপরে উঠতো।’

নিচের পদ থেকে আরম্ভ করা এবং কাজ করে একজন উপরে উঠবে এই আইডিয়া কিছুটা ত্রুটিপূর্ণ। এটা হয়তো নিশ্চিত বলে মনে হয়। কিন্তু, এটার প্রতি মুখ্য আপত্তি হচ্ছে যারা নিচের পদ থেকে আরম্ভ করে তাদের বেশির ভাগ কখনো তাদের মাথা যথেষ্ট উঁচু করার ব্যবস্থা করতে পারে না যাতে সুযোগ দেখা যায়। তাই তারা নিচেই রয়ে যায়। আরও, এটা মনে রাখা উচিত, যে নিচের অবস্থা খুব উজ্জ্বল অথবা উৎসাহদায়ক নয়। এটার একটা প্রবৃত্তি আছে উচ্চাকাক্সক্ষাকে মেরে ফেলার। আমরা এটাকে ডাকি ‘খাদে পড়া’ অবস্থা বলে। যার মানে হচ্ছে আমরা আমাদের ভাগ্যকে গ্রহণ করে নিয়েছি। কারণ আমরা দৈনিক নিত্যকর্মের অভ্যাস গঠন করেছি। একটি অভ্যাস যা অবশেষে ফেলে দেওয়ার চেষ্টাও করতে পারি না। এটার অপর একটা কারণ হচ্ছে যে কেন নিচের থেকে ১-২ ধাপ উপরে আরম্ভ করলে বেশি দাম পাওয়া যায়। এটা করার মাধ্যমে একজন চারপাশে খুঁজে দেখার অভ্যাস গঠন করে। পর্যবেক্ষণের সাথে দেখে যে কীভাবে অন্যরা এগিয়ে যাচ্ছে। সে সুযোগ দেখতে পায় এবং এটাকে আলিঙ্গন করার চেষ্টা করতে পারে।

ড্যান হালপিন হচ্ছে একটা জমকালো উদাহরণ। আমি তার ঘটনাই এখানে উল্লেখ করছি। তার কলেজের দিনগুলো চলাকালীন, সে ছিল বিখ্যাত কোচ এবং ব্যবস্থাপক নোট রকনির অধীনে। রকনি নটর ডেম ফুটবল দলের বিজয়ের জন্য ১৯৩০ সালে জাতীয় পুরস্কার পায়। তরুণ হালপিন এই খ্যাতিমান কোচের পরামর্শ ও প্রশিক্ষণের সুযোগ পায়।

হয়তো হালপিন এই মহান ফুটবল প্রশিক্ষকের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিল। যা ছিল উঁচুতে লক্ষ্য স্থির করা এবং ব্যর্থতার মতো সাময়িক বাধার জন্য হাল না ছাড়া। যেমন ছিলেন এন্ড্রু কার্নেগি, একজন মহান প্রাতিষ্ঠানিক নেতা। কানের্গি তার তরুণ ব্যবসায়ী সহযোগীদের নিজেদের জন্য উঁচু লক্ষ্য নির্ধারণ করতে অনুপ্রাণিত করেছিলেন। যাইহোক, তরুণ হালপিন যখন তার কলেজের পড়ালেখা সমাপ্ত করল তখন দেশের শ্রমবাজার একটি প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে ছিল। ব্যবসায়িক বিপর্যয় তথা শেয়ার মার্কেটের ধ্বসের কারণে ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দা চলছিল এবং চাকরি খাতেও নিয়োগ দান প্রায় বন্ধ ছিল। তাই তিনি বিনিয়োগ খাত যেমন: ব্যাংক ও অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং চলচ্চিত্রে চাকরির জন্য চেষ্টা করার পর, একটি সম্ভাবনাসূচক ভবিষ্যতের প্রতি তার প্রথম পদক্ষেপ নিলেন। একটি নির্দিষ্ট লভ্যাংশের ভিত্তিতে তিনি শ্রবণ সহায়ক যন্ত্র বিক্রয়ের কাজ নিলেন। যেকেউ এই রকম একটি চাকরি থেকে আরম্ভ করতে পারে এবং হালপিন এটা জানতেন। কিন্তু এটাই তার প্রতি সুযোগের দরজা খুলে দিতে যথেষ্ট।

প্রায় ২ বছর ধরে সে অবিরত তার চাকরি করে গেল। যদিও সে কাজটি পছন্দ করত না। তবে সে যদি তার এই অসন্তোষ সম্বন্ধে কিছু না করত তাহলে সে সেই নিচের পদেই পড়ে থাকত। কখনো উপরে উঠতে পারত না। সে প্রথমে লক্ষ্য নিল তার প্রতিষ্ঠানের সহকারী বিক্রয় ব্যবস্থাপক হবে এবং সে চাকরিটি পেয়ে গেল। সেই এক ধাপ উপরে আসার ফলে সে ভিড় থেকে যথেষ্ট উঁচুতে দেখার সামর্থ্য পেলেন যাতে উত্তম সুযোগ দেখতে পায়। অধিকন্তু, এটা তাকে এমন জায়গায় রাখল যেখানে সুযোগ তাকে দেখতে পায়।

সে শ্রবণ সহায়ক যন্ত্রের এমন একটি ভালো বিক্রয় নথি তৈরি করল যে হালপিনের প্রতিদ্বন্দ্বী কোম্পানি ডিকটোগ্রাফের সভাপতি এ.এম. এন্ড্রু হালপিন সম্পর্কে আগ্রহী হয়ে ওঠে। সে হালপিনের জন্য লোক পাঠায় যে কে এই ব্যক্তি যে বহু বছরের সুনামধন্য কোম্পানি ডিকটোগ্রাফ থেকে বড় বড় বিক্রয়ের জায়গা দখল করে নিয়েছে। তিনি হালপিনের সাথে দেখা করলেন। যখন তাদের সাক্ষাৎকার শেষ হলো, হালপিনকে ডিকটোগ্রাফের আকসটিকন বিভাগের নতুন বিক্রয় ব্যবস্থাপকের দায়িত্ব দেওয়া হয়। তারপর ছিল তার পরীক্ষা। এ.এম. এন্ড্রু জানতে চান যে তরুণ হালপিন কোন ধাতুর তৈরি। এন্ড্রু ফ্লোরিডা থেকে তিন মাসের জন্য চলে গেলেন। হালপিনকে ছেড়ে গেলেন তার নতুন চাকরিতে ডুবা অথবা সাঁতার কাটার জন্য। কিন্তু হালপিন ডুবলেন না! নোট রকনির বলেন, ‘সারা বিশ্ব ভালোবাসে একজন বিজয়ীকে’ এবং একজন পরাজিতের জন্য কারও কোন সময় নেই যে তাকে আবার এগিয়ে যেতে অনুপ্রাণিত করবে। হালপিন নিজের মতো করে কাজ করে গেল, নানান কৌশল ও বুদ্ধি প্রয়োগ করল এবং ৩ মাস পর এন্ড্রু এসে দেখল যে হালপিন দৃঢ় ও মজবুত ধাতুতে গড়া একজন পুরুষ। সম্প্রতি হালপিন প্রতিষ্ঠানটির সহ-সভাপতি রূপে নির্বাচিত হয়েছে এবং আকসটিকন ও সাইলেন্ট রেডিও বিভাগের জেনারেল ম্যানেজার পদে উন্নীত হয়েছে। অধিকাংশ ব্যক্তিরা এমন এক পদ ১০ বছরের সৎ চেষ্টার মাধ্যমে অর্জন করতে পারলে গর্ব বোধ করত। আর হালপিন এটাকে তার কৌশল ও বুদ্ধি দিয়ে ৬ মাসেরও কম সময়ের মধ্যে অর্জন করে।

এটা বলা কঠিন যে এন্ড্রু বা হালপিন উভয়ের মধ্যে কে বেশি প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য। কারণ উভয়ের মধ্যেই এক বিরল গুণের দেখা পাওয়া যায়। যা হচ্ছে কল্পনা। জনাব এন্ড্রু সম্মানের যোগ্য কারণ তিনি হালপিনের মধ্যে একজন সর্বোচ্চ পর্যায়ের ‘গিয়ে-পাওয়া’ পুরুষকে দেখেছেন। গিয়ে-পাওয়া মানে হচ্ছে হালপিন একটি নির্দিষ্ট দায়িত্ব পালনের জন্য গিয়েছেন এবং এটা পেয়েছেন। হালপিন সম্মানের যোগ্য এই জন্য যে তিনি জীবনের সাথে সমঝোতা করতে অস্বীকার করেছেন। তিনি কোনরকম একটি চাকরি করে যেতে চাননি। চাকরিকে কোনরকম চালিয়ে নিতে চাননি। তিনি নিজের জন্য উঁচু লক্ষ্য স্থির করেছেন এবং সেটা অর্জনের জন্য কাজ করেছেন। আমি এই পুরো দর্শনে এটাই জোর দিয়ে বলার চেষ্টা করছি যে আমরা সফল হবো বা ব্যর্থ হবো, আমরা উচ্চপদে যাবো বা নি¤œপদেই রয়ে যাবো, এটা সম্পূর্ণ নির্ভর করে আমাদের আকাক্সক্ষার ওপর। আমরা যদি আমাদের এই আকাক্সক্ষাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি, একটি নির্দিষ্ট দিকে পরিচালিত করতে পারি তবেই আমরা সফল হবো।

অপর একটি দিক আমি জোর দিয়ে বলার চেষ্টা করেছি যে সাফল্য এবং ব্যর্থতা উভয়ই পুরোপুরি অভ্যাসের ফলাফল! আমার সামান্যতম সন্দেহ নেই যে আমেরিকার শ্রেষ্ঠ ফুটবল প্রশিক্ষকের সাথে ড্যান হালপিনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল, তিনিই হালপিনের মনে উচ্চাকাক্সক্ষার বীজ রোপণ করেছেন। এটা সেই একই ধরনের আকাক্সক্ষা যা দিয়ে নটর ডেম ফুটবল দল শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করেছে এবং বিশ্ববিখ্যাত হয়েছে। সত্যই, সেখানে আইডিয়াটার কিছু আছে যা বীরস্তুতিতে সহায়তা করে, আর সেই স্তুতি প্রদান করে একটি বিজয়। হালপিন আমাকে বলেছেন যে বিশ্ব ইতিহাসের মহান নেতাদের মধ্যে রকনি একজন। তাহলে বুঝতেই পারছেন কোচ রকনির প্রভাব হালপিনের ব্যক্তিগত উন্নয়ন এবং চারিত্রিক নীতি গঠনে কতটা প্রভাবিত করেছে।

এই তত্ত্বের মধ্যে আমার বিশ্বাস আছে যে ব্যবসা করতে গেলে সম্পর্ক জিনিসটা একটা অপরিহার্য ব্যাপার। ব্যর্থতা এবং সাফল্য উভয়ক্ষেত্রে এই সম্পর্ক খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আরেকটা ঘটনায় আমি এই প্রমাণ পেয়েছি যে সফল এবং দৃঢ় চরিত্রের লোকজনের সাথে থাকলে আপনার চরিত্রও দৃঢ় হয়ে উঠবে। কিছুদিন আগে আমার ছোট ছেলে ব্লেয়ার ড্যান হালপিনের কাছে একটি চাকরির সাক্ষাৎকারের জন্য যায়। হালপিন তাকে চাকরির একটি প্রস্তাব দেয়। প্রস্তাবটি ছিলÑব্লেয়ার জনাব হালপিনের প্রতিদ্বন্দ্বী কোম্পানি থেকে যে বেতন পেতে পারে তার অর্ধেক। স্বাভাবিকভাবেই ব্লেয়ার প্রস্তাবটিতে অসন্তুষ্ট ছিল। সে হয়তো অন্য কোন কোম্পানিতে যোগ দিত। কিন্তু আমি ব্লেয়ারকে অভিভাবকত্বের চাপ দিলাম এবং তাকে বুঝিয়ে বললাম যে হালপিনের প্রস্তাবই গ্রহণ করা কেন যুক্তিযুক্ত। কারণ আমি বিশ্বাস করি যে হালপিনের মতো এমন একজন মানুষের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রাখলে উপকার আছে। তার সবচেয়ে ভালো গুণ হচ্ছে তিনি যা অপছন্দ করেন তার সাথে তিনি সমঝোতা করেন না। এই গুণ অনেকের মধ্যেই অনুপস্থিত। আর যেহেতু ব্লেয়ার এই গুণ সম্বলিত একজন ব্যক্তির সংস্পর্শ পাচ্ছে, সেহেতু আমি আশা করি তারমধ্যেও এই গুণ তৈরি হবে। এটা এমন এক সম্পদ যা কখনো টাকা দিয়ে কেনা যায় না।

যেকোন কোম্পানির একদম শেষ পদ বা যেকোন কাজের একদম শুরুর ধাপের জায়গাটা খুবই বিষণœ, একঘেয়ে ও অলাভজনক। এটা যেকোন ব্যক্তির জন্যই সত্য। আমি এই কারণে এটা বর্ণনা করতে সময় নিয়েছি যে কীভাবে নিচ থেকে শুরু করে যথার্থ পরিকল্পনা দ্বারা কৌশলে সুবিধা করে নেওয়া যায়। অধিকন্তু, এই কারণেই বইয়ের এত জায়গা উৎসর্গ করেছি যে নতুন নতুন পেশা নিয়েও মানুষ উপরে উঠতে পারে। এই নতুন পেশা, যা একজন নারী দ্বারা সৃষ্ট, যিনি একটি উত্তম চাকরির পরিকল্পনা তৈরি করতে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন, কারণ তিনি চেয়েছিলেন তার ছেলে যেন একটি কাজ করার সুযোগ পায় যা সাধারণ পদ থেকে একটু উপরে।

বিশ্বের অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের কারণে নতুন নতুন সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। এখন বিশ্ব অর্থনীতিতে নতুন উদ্যোক্তা এবং নতুন সেবা যোগ হবে। এজন্যই বর্তমান শ্রমবাজারে যারা প্রবেশ করতে ইচ্ছুক তাদের উচিত এই নতুন ও পরিবর্তিত পরিবেশের সাথে মানিয়ে নেওয়া। তাদের উচিত তাদের ব্যক্তিগত দক্ষতাকে আরও শাণিত করা। এটা নিশ্চিত করা শক্ত যে কেন কেউ আগে এই বিস্ময়কর প্রয়োজনকে আবিষ্কার করল না। একটু চিন্তা করে দেখুন যে আমরা বিভিন্ন কোম্পানি, প্রতিষ্ঠান ও কারখানায় কর্মচারীদের কত টাকা বেতন দেই। এই অর্থ দেওয়া হয় তাদের ব্যক্তিগত সেবার জন্য। অন্য যেকোন মাধ্যমের চেয়ে এই জনশক্তি খাতেই সবচেয়ে বেশি অর্থের ব্যবহার হয়। [ধরুন, বাংলাদেশের ১ হাজারটি কোম্পানিতে ১ হাজার শ্রমিক আছে। তাদেরকে ১০ হাজার টাকা করে মাসিক বেতন দেওয়া হলো। তাহলে মাসে আর্থিক লেনদেন হচ্ছে ১ হাজার কোটি টাকা। আর অন্য যারা পারিশ্রমিকের বিনিময়ে কাজ করে তাদের বেতন ধরলে সংখ্যাটি এত বিশাল হবে যে এটা লাখ কোটিতে গিয়ে পৌঁছাবে।

এখানে সংক্ষিপ্তভাবে বর্ণিত এই ধারণার মধ্যে আপনি হয়তো খুঁজে পাবেন যে ধনীদের ধনসম্পদের কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে তাদের আকাক্সক্ষা! আর এই আকাক্সক্ষাই বিশ্বজয়ী আইডিয়া বা বুদ্ধির জন্ম দেয়। এই আইডিয়াই হচ্ছে এমন এক ধরনের বীজ যা সৌভাগ্যের জন্ম দেয়। ধরুন, উলয়োর্থের আইডিয়া ছিলÑ ৫ ও ১০ পয়সার দোকান। উলয়োর্থ ১৮৭৮ সালে তার এই ধারণাকে বাস্তবে পরিণত করেন।  লোকজন প্রথমে ধারণাটিকে সস্তা একটি ব্যবসায়িক আইডিয়া বলে অভিহিত করলেও, পরবর্তীতে ঠিক এই ধারণাই উলয়োর্থকে বিশাল অঙ্কের অর্থশালী করে তোলে।

যারা এই পরামর্শে লুকানো সুযোগটি দেখবে তারা হয়তো সংগঠিত পরিকল্পনা অধ্যায়ের মধ্যে নিজের জন্য একটি চমৎকার সুযোগ খুঁজে পাবে। প্রসঙ্গত যে ব্যক্তি তার নিজের শ্রম বিক্রয় করতে চায় সে এই ঘটনাগুলো থেকে একটি বাড়তি উদ্দীপনা পাবে। সে নতুন নতুন আরও ভালো এবং উত্তম বাজার খুঁজবে যেখানে তার শ্রম ও বুদ্ধির যথার্থ মূল্য পাবে। এ বইয়ে মাস্টার মাইন্ড গ্রুপ তথা ঐক্যমন দল সম্পর্কেও বলা হয়েছে। যদি আপনি অল্প কিছু উপযুক্ত লোকের সাথে কাজ করেন (মানসিক দিক দিয়ে একে অপরের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ এমন সব মানুষ), নিজেদের মধ্যে মৈত্রী গড়ে তুলতে ঐক্যমন সূত্র প্রয়োগ করেন, তবে আপনি দ্রুতই একটি লাভজনক ব্যবসা দাঁড় করাতে পারবেন। ব্যবসায় একজন সুন্দর লেখক দরকার যার বিজ্ঞাপনের প্রতি একটি সূক্ষ্ম বিচারবুদ্ধি রয়েছে। বিক্রয়ের ক্ষেত্রে একজন দক্ষ বিক্রয়কর্মী দরকার যে চিঠি লিখতে এবং পাঠাতে পারে। আর একজনকে হতে হবে অভিজাত ব্যক্তিত্বের অধিকারী যিনি বিশ্বকে পণ্যটি সম্পর্কে জানাবেন। যদি একজন ব্যক্তির মধ্যে এসব গুণ থাকে তবে সে হয়তো ব্যবসাকে একাই চালাতে পারবে। এমনভাবে সৃষ্ট কোম্পানি একদিন না একদিন প্রতিষ্ঠাতা ব্যক্তিকেও ছাড়িয়ে যাবে। তখন ব্যক্তিকে অবশ্যই অন্যদের সহযোগিতা নিতে হবে। এভাবেই মানুষ সফল হয়।

যে নারী তার সন্তানের জন্য একটি চমৎকার চাকরির আবেদনপত্র তৈরি করেছিলেন, যেখানে তার সন্তানের ব্যক্তিত্ব, দক্ষতা ও দায়িত্ব পালনের জন্য আগ্রহ ফুটে উঠেছে, তিনি এখন সারাদেশ থেকে অনেক মানুষের অনুরোধ পাচ্ছেন যাতে তাদের জন্যও এমন একটি বর্ণনা লিখে দেওয়া হয়। এখন তার দক্ষ কর্মচারীও আছে। যারা তাকে এই ধরনের বর্ণনা লিখে দিতে সহায়তা করে। তারা দক্ষ মুদ্রণকারী, শিল্পী এবং লেখক। তারা একজনের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতাকে এত চমৎকার করে বর্ণনা করে দিতে সক্ষম যে ব্যক্তিটি হয়তো এটার অভাবে চাকরিও পেত না। তিনি তার কাজ সম্পর্কে এতই আত্মবিশ্বাসী যে তার মক্কেলের চাকরি হলেই তিনি তার পারিশ্রমিক নেন; নতুবা নয়।

আবার এটা মনে করবেন না যে নারীটি অলস পুরুষ ও নারীদেরকে কম পরিশ্রমে বেশি বেতন আদায়ের কৌশল শেখাচ্ছে। তিনি প্রথমে তার মক্কেলদের দেখেন। তাদের ব্যক্তিগত দক্ষতা এবং অভিজ্ঞতা দেখেন। তারা যে পদের জন্য আবেদন করবেন সেই প্রতিষ্ঠানের পরিকল্পনাও দেখেন। যাতে তিনি বুঝতে পারেন যে এই কোম্পানি এই রকম পদে কেমন লোক নিবে। তারপর তার যাচাই-বাছাইয়ের পর তিনি মক্কেলের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতাকে সাজিয়ে তোলেন, তিনি যুক্তি তুলে ধরেন যে কেন সে এই পদের যোগ্য। অবশ্য এই পদ্ধতির আশ্চার্যজনক ফলাফলের আরও কিছু ব্যাপার রয়েছে। সেগুলো একটি পেশাদার গোপন ব্যাপার। এগুলো তিনি কেবল তার মক্কেলদের সাথেই বিনিময় করেন।

যদি আপনার কল্পনা শক্তি থাকে এবং আপনি আপনার নিজের ব্যক্তিগত দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা দিয়ে অধিক আয় করার পথ খোঁজেন, তবে আমি আপনাকে একটি মূল্যবান পরামর্শ দিচ্ছি। এই পরামর্শ বা আইডিয়ার মাধ্যমে আপনি চিকিৎসক, আইনজীবী বা প্রকৌশলীদের চেয়েও বেশি আয় করতে পারবেন। যদিও মনে রাখবেন এই চিকিৎসক, আইনজীবী বা প্রকৌশলীদেরকে তাদের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে প্রচুর পড়ালেখা এবং শ্রম ব্যয় করেই আজকের বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে আসতে হয়েছে। এই পরামর্শ বা ধারণাটি তাদেরও কাজে লাগবে যারা অভিনব কিছু খোঁজে, যারা কোম্পানির বড় বড় পদের জন্য লক্ষ্য স্থির করেছে, যেমন ব্যবস্থাপক বা নির্বাহী পদের দায়িত্বের জন্য। এতে করে তারা বর্তমানের চেয়ে বহুগুণ বেশি আয় করবে এবং তাদের জীবন স্বাচ্ছন্দে কাটাবে।

শক্তিশালী আইডিয়ার কোন নির্ধারিত দাম নেই!

সব আইডিয়ার পিছনে রয়েছে বিশিষ্ট জ্ঞান। তাদের জন্য দুর্ভাগ্য যারা পর্যাপ্ত পরিমাণে ধনসম্পদ খুঁজে পায়নি। যেকোন শক্তিশালী ধারণা খুঁজে পাওয়ার চেয়ে কোন একটি বিষয়ে বিশিষ্ট জ্ঞান অর্জন করা সহজ। [যেমন ফেসবুকের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বা গুগলের সার্চ ইঞ্জিনের মতো একটি আইডিয়া তৈরি করার চেয়ে একজন এন্ড্রয়েড অ্যাপ ডেভোলপার বা ওয়েব ডেভোলপার হওয়া সহজ।] আবার আরেকটি বিষয়ও রয়েছে। যে ব্যক্তি অন্যদের গুণাবলি ও দক্ষতাকে দেখে এবং একে ঠিকভাবে বাজারজাত করতে পারে তার চাহিদা কিন্তু বিশ্বব্যাপী। যদিও এমন মানুষের সংখ্যা কম। তবুও তারা নিজেদের জন্য এবং অন্যদের জন্য মহামূল্যবান। এমন ব্যক্তিদের অন্যতম গুণ হচ্ছে কল্পনা ও দূরদৃষ্টি। তারা তাদের এই বিশিষ্ট জ্ঞানকে নতুন নতুন ধারণার সাথে মিশ্রিত করে। তারপর সংগঠিত পরিকল্পনা তৈরি করে এবং তদানুযায়ী কাজ করে। এই নকশাই তাদেরকে ধনী হওয়ার দিকে নিয়ে যায়।

যদি আপনার মধ্যে কল্পনা শক্তি থাকে (যা সবার মধ্যেই থাকে কিন্তু অনেকেই ব্যবহার করে না) তাহলে আপনার সামনে আগামী অধ্যায় উপস্থিত করা হলো একটি সম্ভাবনা রূপে। আমি আশা করব আপনার কল্পনা আপনাকে এমন একটি আইডিয়া দিবে যা থেকে আপনার আকাক্সিক্ষত ধনী হওয়ার যাত্রাপথ আরম্ভ হবে। মনে রাখবেন, আইডিয়াই হচ্ছে অন্যতম জিনিস। আপনার চারপাশের যেকোন জায়গা থেকে আপনি কাজ শিখতে পারেন এবং তাতে বিশিষ্ট হতে পারেন। কিন্তু আইডিয়া তথা ধারণা বা বুদ্ধিই হচ্ছে সেই জিনিস যা আপনাকে শীর্ষ পর্যায়ে নিয়ে যাবে।


 




অধ্যায় - ০৬

কল্পনা

মনের কারখানা

ধনী হওয়ার ক্ষেত্রে পঞ্চম ধাপ


কল্পনা হচ্ছে একটি কারখানার মতো, যেখানে একজন ব্যক্তি তার পরিকল্পনাগুলোকে উপযুক্ত আকার দেয়। আপনার আকাক্সক্ষাকে গঠন করতে, নির্দিষ্ট আকার দিতে এবং কাজের মাধ্যমে বাস্তবে পরিণত করতে দরকার এই মানব কারখানা, মানে আপনার মনের কল্পনা বিভাগ।


বলা হয়ে থাকে, একজন ব্যক্তি যা কল্পনা করতে পারে সে তাই সৃষ্টি করতে পারে। এই সৃষ্টির কোন সীমা নেই।

বর্তমান যুগ কল্পনার বিকাশ লাভের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। কারণ এই যুগ হচ্ছে দ্রুত পরিবর্তনশীল। প্রত্যেকেই যিনি এই উদ্দীপনার সংস্পর্শে আসছেন তিনিই কল্পনা গঠন করছেন।

ব্যক্তি তার কল্পনা অনুষদের সহায়তার মাধ্যমে নতুন নতুন অনেক কিছু আবিষ্কার করেছে। প্রকৃতির বহু শক্তিকে গত ৫০ বছর ধরে নানান কাজে ব্যবহার করেছে। যা মানব ইতিহাসের অন্যান্য সময়ের চেয়েও দ্রুত। সে বাতাসকে পরিপূর্ণভাবে জয় করেছে। এখন তার উড়বার দক্ষতার কাছে আকাশের পাখিও নগণ্য। সে ইথারকে সজ্জিত করেছে এবং এটাকে তৈরি করেছে এমন কিছু যার দ্বারা অবিলম্বে পৃথিবীর যেকোন অংশ থেকে যোগাযোগ করা যায়। সে কোটি কোটি মাইল দূর থেকে সূর্যকে পর্যবেক্ষণ করেছে এবং ওজন করেছে। কল্পনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এসবই আপনার পক্ষেও সম্ভব। মানুষ আবিষ্কার করেছে যে তার নিজের মস্তিষ্ক চিন্তা তরঙ্গের জন্য একই সাথে একটি প্রচারক ও গ্রাহক স্টেশন এবং সে এখন শিখতে শুরু করেছে যে কীভাবে এই আবিষ্কারের ব্যবহারিক প্রয়োগ করা যায়। সে গতিশক্তির গতি বৃদ্ধি করেছে, এখন সে প্রতি ঘণ্টায় তিনশ মাইলের ওপরে ভ্রমণ করতে পারে।

একজন ব্যক্তির সীমাবদ্ধতা হচ্ছে তার কল্পনার ব্যবহার না করা। মানুষ এখনও তার কল্পনা অনুষদ ব্যবহারের চরম উন্নতির শিখরে পৌঁছায়নি। সে কেবল আবিষ্কার করেছে যে তার একটি কল্পনাশক্তি আছে এবং এটাকে একটি প্রাথমিক পথে ব্যবহার করা আরম্ভ করেছে।

দুই প্রকারের কল্পনা

কল্পনা অনুষদের কাজগুলো দুই ভাগে বিভক্ত। একটি হচ্ছে ‘সমন্বয় কল্পনা’ এবং অন্যটি হচ্ছে ‘সৃজনশীল কল্পনা’।

সমন্বয় কল্পনা:- এই অনুষদের মাধ্যমে একজন ব্যক্তি অতীতের মতামত, আইডিয়া বা পরিকল্পনাকে নতুন মিশ্রণে পরিণত করে। এই অনুষদ কিছুই সৃষ্টি করে না। আমরা যে অভিজ্ঞতা, শিক্ষা এবং পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে তথ্য পাঠাই তাই নিয়ে এটা কাজ করে। এটা হচ্ছে সেই অনুষদ যা বিজ্ঞানীরা সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করে। ব্যতিক্রমী যারা তারা উদ্ভাবক। যখন তারা তাদের সমাধান সমন্বয় কল্পনার মাধ্যমে খুঁজে পায় না তখন তারা সৃজনশীল কল্পনার অঙ্কিত পথে চলে।

সৃজনশীল কল্পনা:- এই অনুষদের মাধ্যমে, ব্যক্তির সচেতন মন সরাসরি যোগাযোগ করতে পারে অসীম বুদ্ধিমত্তার সাথে। এই অনুষদের মাধ্যমেই ‘ঝলক’ এবং ‘উৎসাহ’ গ্রহণ করা হয়। এই অনুষদই সবকিছুর ভিত্তি। এর মাধ্যমেই ব্যক্তির কাছে নতুন আইডিয়া হস্তান্তর হয়। এই অনুষদের মাধ্যমেই অন্যের মনের চিন্তা তরঙ্গ গ্রহণ করা হয়। এই অনুষদের দ্বারাই ব্যক্তি অন্য ব্যক্তির অবচেতন মনের কথা ‘বুঝতে পারে’ বা যোগাযোগ করতে পারে।

সৃজনশীল কল্পনা স্বয়ংক্রিয়ভাবে কাজ করে। এর আচরণ সম্পর্কে পরবর্তী কয়েক পৃষ্ঠায় বর্ণনা দেওয়া হবে। যখন সচেতন মনের তরঙ্গ অত্যাধিক দ্রুত গতিতে চালিত হয় তখন এই অনুষদ কাজ করে। উদাহরণস্বরূপ, যখন সচেতন মন একটি শক্তিশালী আকাক্সক্ষার অনুভূতি দ্বারা উত্তেজিত হয় তখন সৃষ্টিশীল কল্পনা কাজ করে।

যেকোন শক্তিশালী আকাক্সক্ষা দ্বারা সৃজনশীল কল্পনা বিভাগ আরও সতর্ক হয়ে ওঠে। আরও গ্রহণক্ষম হয়। এই আকাক্সক্ষাকে বারবার স্বপরামর্শ দ্বারা উজ্জীবিত করতে হবে। এই বিবৃতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ! এটা সামনে এগোনোর আগে বিবেচনা করে দেখুন।

এই সূত্র অনুসরণের ক্ষেত্রে এটা মনে রাখবেন যে একজন কীভাবে তার আকাক্সক্ষাকে টাকাপয়সায় রূপান্তর করবে তার পরিপূর্ণ গল্প এক বৈঠকে বলা যায় না। গল্পটি পরিপূর্ণ হবে, শুধুমাত্র যখন একজন ব্যক্তি সব সূত্রের ওপর কর্তৃত্ব করবে, সম্পূর্ণ উপলব্ধি করবে এবং ব্যবহারিক প্রয়োগ আরম্ভ করবে। [সম্পূর্ণ উপলব্ধি করা মানে খাদ্য যেমন হজম করে শরীরে শক্তি রূপে গ্রহণ করা হয়। তেমনিভাবে এই সূত্রগুলোকে পরিপূর্ণ গ্রহণ করতে হবে।]

সেসব মহান নেতা যারা ব্যবসা, কারখানা, অর্থায়ন এবং শিল্পখাতে মহান হয়েছে; সংগীতজ্ঞ, কবি এবং শ্রেষ্ঠ লেখক হয়েছে, তার কারণ তারা সৃজনশীল কল্পনা অনুষদের বিকাশ ঘটিয়েছে।

ব্যবহারিক প্রয়োগের ফলে একই সাথে সমন্বয় এবং সৃজনশীল কল্পনা বিভাগদ্বয় আরও দক্ষ হয়ে ওঠে। যেমন ব্যয়ামাগারে ব্যয়ামবিদরা বারবার ব্যয়াম করে দেহের মাংস পেশী বা অঙ্গকে বিকশিত করে।

আকাক্সক্ষা হচ্ছে শুধু একটি চিন্তা বা তরঙ্গ। এটা মেঘের মতো অস্পষ্ট এবং অল্পক্ষণ স্থায়ী। এটা বিমূর্ত এবং এর কোন দাম নেই যতক্ষণ পর্যন্ত না এটা বাস্তবে রূপান্তরিত হচ্ছে। আকাক্সক্ষার তরঙ্গকে টাকাপয়সায় রূপান্তর করার প্রক্রিয়ায় সমন্বয় কল্পনা সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হবে। তারপর এমন কিছু সমস্যা আসবে যেখানে শুধু সমন্বয় কল্পনা দিয়ে কাজ হবে না। উচ্চতর কল্পনা দরকার। এই উচ্চতর কল্পনাই হচ্ছে সৃষ্টিশীল কল্পনা। আপনাকে অবশ্যই এটা মনে রাখতে হবে যে আপনি হয়তো এমন কিছু কারণ এবং পরিস্থিতির সম্মুখীন হবেন যা সৃজনশীল কল্পনার প্রয়োগ চাইবে।

আপনার কল্পনা অনুষদ হয়তো ব্যবহার না করতে করতে দুর্বল হয়ে পড়েছে। এটাকে ব্যবহার দ্বারা পুনঃজীবিত করতে হবে। একে বারবার প্রয়োগ করতে হবে। এভাবে বারবার ব্যবহারের ফলে এর দক্ষতা বাড়বে। এখন হয়তো নিয়মিত ব্যবহার হয় না বলে একটু থিতিয়ে আছে। কিন্তু কল্পনা নাই বা কল্পনা অনুষদ গোল্লায় গেছে এমন নয়।

সমন্বয় কল্পনার বিকাশে বা উন্নয়নে আপনার মনোযোগকে কেন্দ্রীভূত করুন। কারণ আপনার আকাক্সক্ষাকে টাকাপয়সায় রূপান্তর করতে এই সেই অনুষদ যা আপনি প্রায়ই ব্যবহার করবেন।

আমাদের আকাক্সক্ষা হচ্ছে একটি অস্পষ্ট তরঙ্গের আকার। আপনি যদি এই আকাক্সক্ষাকে বাস্তবে পরিণত করতে চান তবে আপনাকে এক বা একাধিক পরিকল্পনার সাহায্য নিতে হবে। এই পরিকল্পনাগুলো অবশ্যই কল্পনার সহায়তায় গঠিত হতে হবে। প্রথমত আপনি সমন্বয় কল্পনার অনুষদই ব্যবহার করবেন।

পুরো বই পড়া শেষে, এই অধ্যায়ে আবার ফিরে আসুন। আপনার কল্পনাকে কাজে লাগিয়ে তৎক্ষণাৎ পরিকল্পনা তৈরি করুন এবং সেই অনুযায়ী কাজে নেমে যান। আপনার আকাক্সক্ষা যদি হয় টাকাপয়সা আয় নিয়ে, তবে এক বা একাধিক পরিকল্পনা তৈরি করে তৎক্ষণাৎ কাজে নেমে পড়–ন। বইয়ের প্রায় প্রত্যেক অধ্যায়েই আপনার পরিকল্পনা তৈরির জন্য পর্যাপ্ত দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। আপনার প্রয়োজন মতো নির্দেশনা কাজে লাগান। যদি এখনও তা না করে থাকেন, তবে এখনই একটি কাগজ-কলম নিন এবং পরিকল্পনা লিখে ফেলুন। যে মুহূর্তে আপনি এটা শেষ করবেন, আপনি পাবেন নির্দিষ্টভাবে অস্পষ্ট আকাক্সক্ষার কেন্দ্রীভূত আকার। চিন্তার অস্পষ্ট তরঙ্গ কাগজে লেখার ফলে অন্তত দ্বিমাত্রিকভাবে তো বাস্তবে পরিণত হয়েছে। এখন ত্রিমাত্রিক মানে আমাদের জীবনে আপনার আকাক্সক্ষাকে রূপান্তর করতে আপনাকে কাজ করতে হবে।

কাগজে লেখা আপনার পরিকল্পনা আরও একবার পড়–ন। জোরে জোরে এবং খুব ধীরে পাঠ করুন। এভাবে আপনি যখন পড়বেন, তখন স্মরণ করবেন যে এই মুহূর্তে আপনার আকাক্সক্ষা বিবৃতিতে এসেছে এবং এটার অনুধাবনের জন্য একটি পরিকল্পনা লেখার ফলে আপনি প্রকৃতপক্ষে আপনার আকাক্সক্ষাকে বাস্তবে পরিণত করতে প্রথম পদক্ষেপ নিয়েছেন। অন্য ধাপও আস্তে আস্তে নিতে পারবেন। জানেন তো প্রথম পদক্ষেপ নেওয়াই কষ্টকর।

এই পৃথিবী যেখানে আপনি বাস করেন, আপনি, আপনি স্বয়ং এবং প্রত্যেক বস্তুগত জিনিসই হচ্ছে পরিবর্তনের ক্রমবিকাশের ফলাফল যা বস্তুর আণুবীক্ষণিক ক্ষুদ্রাংশের ক্রমান্বয়ে সংগঠিত এবং সংগৃহীত হয়েছে একটি পর্যায়ক্রমিক ধারা অনুযায়ী।

অধিকন্তু, এই পৃথিবী, এই পৃথিবীর সব বস্তু, এমনকি আপনার শরীরও শত কোটি স্বতন্ত্র কোষ দিয়ে গঠিত যার প্রত্যেকটির মূল হচ্ছে পরমাণু। আর এই পরমাণুর ভেতরে নিহিত রয়েছে অস্পষ্ট শক্তির আকার।

আকাক্সক্ষা হচ্ছে চিন্তার তরঙ্গ! চিন্তার তরঙ্গ গঠন করে শক্তি। যখন আপনি চিন্তা তরঙ্গ দিয়ে শুরু করবেন, টাকাপয়সা অর্জনের আকাক্সক্ষায়, তখন আপনি আপনার সেবাকে সেই একই অস্পষ্ট শক্তিতে পরিণত করবেন।

যতদূর পর্যন্ত বিজ্ঞান নিশ্চিত হতে সমর্থ হয়েছে যে এই পুরো মহাবিশ্ব গঠিত হয়েছে ২টি উপাদান দিয়ে এবং এগুলো হচ্ছে বস্তু ও শক্তি।

বস্তু ও শক্তির মিশ্রণ দ্বারা সবকিছু তৈরি হয়েছে। মানুষ চোখে দেখে এমন সবকিছু। এমনকি মহাকাশে ভাসমান সবচেয়ে বড় তারা থেকে নিচে চলমান মানুষ নিজেও।

আপনি এখন যে কাজে যুক্ত হচ্ছেন তা হলো আপনি প্রকৃতির পদ্ধতি থেকে মুনাফা নিবেন। আমরা আশা করি আন্তরিকতা এবং আগ্রহের সাথে আপনি প্রকৃতির নিয়মানুসারে নিজেকে খাপ খাওয়ানোর চেষ্টা করছেন। আপনি যদি চেষ্টা করেন, তবে আপনার আকাক্সক্ষাকে বাস্তবে পরিণত করতে পারবেন বা আর্থিক সমতুল্যে পরিণত করতে পারবেন। চেষ্টা করা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। আপনি এটা করতে পারবেন! এটা আগেও সম্পন্ন করা হয়েছে!

এই নিয়মের সাহায্যে আপনি একটি সৌভাগ্য তৈরি করতে পারেন যা চিরন্তন সত্য। কিন্তু প্রথমে আপনাকে অবশ্যই এই নিয়মগুলোর সাথে পরিচিত হতে হবে এবং এদের ব্যবহারিক প্রয়োগ শিখতে হবে। আপনি যাতে এই সূত্র পুরোপুরি বুঝতে পারেন সেজন্য আমি বারবার নানাভাবে বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করব। প্রতিটি কোণা কোণা বর্ণনা করব যাতে আপনার সামনে সেই রহস্য উন্মোচিত হয়ে যে রহস্যময় চাবিকাঠি দ্বারা আপনি আপনার সৌভাগ্য অর্জন করতে পারেন।

এটা অদ্ভুত এবং প্রচলিত মতের বিরুদ্ধে মনে হতে পারে। হতে পারে, আপনি ভাবতে পারেন যে এই ‘রহস্য’ কোন রহস্য নয়। কিন্তু আসলে এটা একটা গোপন রহস্য। প্রকৃতি, স্বয়ং, এর বিজ্ঞাপন দিয়ে রেখেছে সারা পৃথিবীতে, নক্ষত্রে, আমাদের দেখা ঝুলানো গ্রহে; যা উপরে আছে বা আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে আছে এমন সব উপাদানে, ঘাসের প্রতিটি শীষে এবং প্রত্যেক জীবের জীবনে।

প্রকৃতি ‘রহস্যের’ এই বিজ্ঞাপন দিয়ে রেখেছে জীববিজ্ঞানে। একটি ক্ষুদ্র কোষের কথা বলি। এতই ছোট যে একটি কলমের বিন্দু থেকেও ছোট। কিন্তু পরিণত হয়েছে মানব সত্তায় যে এখন এই বাক্য পড়ছে। আকাক্সক্ষাকে এর বাস্তবিক সমতুল্যে রূপান্তর করা যায়। আপনি নিশ্চিত থাকতে পারেন। এটা আর কোন অলৌকিক ঘটনা নয়!

উপরের বর্ণনা পাঠ করে যদি আপনি এখনই সম্পূর্ণ হজম করতে না পারেন, তবুও হতাশ হবেন না। যতক্ষণ পর্যন্ত না আপনি মনের একজন শিক্ষার্থী হবেন ততক্ষণ পর্যন্ত এটা আশা করা যায় না যে আপনি এই অধ্যায় প্রথম একবার পড়েই হজম করে ফেলবেন।

কিন্তু আপনি পারবেন, একটা সময় ভালো উন্নতি করবেন।

এই সূত্রাবলি অনুসরণ করলে কল্পনাকে বোঝার পথ খুলে যাবে। হজম বলতে আপনি যা হৃদয়ঙ্গম করেছেন, যেহেতু আপনি এই দর্শন প্রথমবারের মতো পড়ছেন, যখন আপনি পুনঃরায় পাঠ করবেন এবং মনোযোগের সাথে অধ্যয়ন করবেন, তখন আবিষ্কার করবেন যে আপনার সাথে কিছু ঘটেছে যাতে এটা আপনার কাছে পরিষ্কার হয়ে উঠেছে এবং আপনাকে পুরো ব্যাপারটা আরও বড় আকারে বোঝার ক্ষমতা দিয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে থামবেন না, এই সূত্র অধ্যয়ন করতে ইতস্তত করবেন না যতক্ষণ পর্যন্ত না আপনি পুরো বই কমপক্ষে ৩ বার পড়ছেন। তারপর আপনি থামতেই চাইবেন না।


কীভাবে আপনার কল্পনাকে ব্যবহারিক প্রয়োগে আনবেন?

সব ধরনের সৌভাগ্যের আরম্ভ বিন্দু হচ্ছে আইডিয়া তথা ধারণা। আর ধারণা হচ্ছে কল্পনার পণ্য। আসুন আমরা কিছু আইডিয়া পর্যবেক্ষণ করি যেগুলো এদের সৃষ্টিকারীদের প্রচুর সৌভাগ্য দিয়েছে। আমরা এই আশা নিয়ে এগুলোর ব্যাখ্যা পড়ব যাতে এখান থেকে আমরা কিছু নির্দিষ্ট তথ্য পাই। যে তথ্য আমাদের কল্পনার সেই পদ্ধতি সম্বন্ধে জানাবে যা ব্যবহারে আমরা ধনসম্পদ অর্জন করতে পারব।


মনোমুগ্ধকর কেটলি

দেড়শ বছর আগের কথা, এক বৃদ্ধ চিকিৎসক তার ঘোড়ায় চড়ে শহরে এলো। শান্তভাবে ঔষধ দোকানের পিছনের দরজা দিয়ে প্রবেশ করল এবং তরুণ ঔষধ বিক্রেতার সাথে ‘দরকষাকষি’ করছে।

তরুণ ঔষধ বিক্রেতার জীবনের উদ্দেশ্য ভাগ্য কর্তৃক নির্দিষ্ট ছিল যে, সে অনেক সম্পদের মালিক হবে। এটা ভাগ্য কর্তৃক নির্দিষ্ট যা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে দেশের দক্ষিণ অংশে সবচেয়ে বেশি সম্পদ এনেছে।

এক ঘণ্টারও বেশি, টেবিলের পাশে বসে বৃদ্ধ চিকিৎসক এবং ঔষধ বিক্রেতা নিচু স্বরে কথা বলে চলছে। তারপর চিকিৎসক বেরিয়ে গেল। সে একটি হালকা খালি গাড়িতে গেল এবং ফিরে এলো একটি বৃহৎ, পুরাতন গঠনের কেটলি নিয়ে, একটি বড় কাঠের হাতল (কেটলির ভেতরে ঘোলানো উপাদান বের করার জন্য ব্যবহৃত) এবং এটাকে গুদাম ঘরে রাখল।

ঔষধ বিক্রেতা কেটলিকে পর্যবেক্ষণ করল, তার পকেটের ভেতর হাত ঢুকাল, একটি অর্থের তোড়া বের করল এবং চিকিৎসককে হস্তান্তর করল। তোড়ায় ছিল ৫০ হাজার টাকা। যা ছিল তরুণ ঔষধ বিক্রেতার পুরো জীবনের সঞ্চয়!

চিকিৎসক একটি ছোট কাগজের টুকরা হস্তান্তর করল যাতে লেখা ছিল একটি রহস্যময় তত্ত্ব। এই ছোট্ট কাগজের টুকরাতে লেখা শব্দ ছিল রাজার মুক্তিপণের চেয়েও দামি! [রাজার মুক্তিপণ এক রাজা কর্তৃক অন্য রাজা আটক হলে প্রদেয় প্রচুর টাকাপয়সা]। কিন্তু চিকিৎসকের কাছে এর তেমন দাম নেই! এই জাদুকরী শব্দ দিয়ে কেটলিকে গরম করার দরকার, কিন্তু না চিকিৎসক না তরুণ ঔষধ বিক্রেতা এটা জানত যে কী অবিস্মরণীয় সৌভাগ্য সেই কেটলি দিয়ে প্রবাহিত হবে।

বৃদ্ধ চিকিৎসক ৫০ হাজার টাকায় এটা বিক্রয় করতে পেরে খুব খুশি। টাকাটা তার ঋণ পরিশোধ করবে এবং তাকে মানসিক স্বাধীনতা দিবে। ঔষধ বিক্রেতা তার পুরো জীবনের সঞ্চয়ের বিনিময়ে একটি বড় সম্ভাবনা কিনল। সে তার পুরো সঞ্চয় একটি ক্ষুদ্র খ- কাগজ এবং একটি পুরাতন কেটলির উপর বিনিয়োগ করল! সে কখনো স্বপ্নেও ভাবেনি যে তার বিনিয়োগ একটি কেটলি থেকে শুরু হয়ে স্বর্ণের খনিতে গিয়ে পৌঁছাবে যা হয়তো আলাদীনের চেরাগের রহস্যকেও হার মানাবে।

যা তরুণ ঔষধ বিক্রেতা ক্রয় করেছিল তা ছিল মূলত একটি আইডিয়া! পুরাতন কেটলি, কাঠের হাতল এবং সেই কাগজের টুকরাতে লেখা গোপন বার্তা ছিল আকস্মিক। কেটলির অদ্ভুত কৃতিত্ব শুরু হলো যখন নতুন ক্রেতা এর মধ্যে গোপন নির্দেশাবলি এবং উপাদান মিশ্রিত করল। যেসব বিষয় সম্পর্কে বৃদ্ধ চিকিৎসক কিছুই জানত না। গল্পটি মনোযোগের সাথে পড়–ন। আপনার কল্পনাকে পরীক্ষা করুন! দেখুন, আপনি কি আবিষ্কার করতে পারেন যে তরুণ ব্যক্তি গোপন বার্তার সাথে কী মিশিয়ে ছিল, যার ফলে, কেটলি থেকে স্বর্ণ প্রবাহিত হলো। পাঠ করার ক্ষেত্রে মনে রাখবেন, এটা কোন আরব্য রজনীর কল্পকাহিনী নয়। এখানে গল্পটির একটি ব্যাপার আছে, কল্পকাহিনীর চেয়েও অদ্ভুত, ব্যাপারগুলো যা আরম্ভ হয় একটি আইডিয়া থেকে।

আসুন আমরা স্বর্ণের সুবৃহৎ সৌভাগ্যের দিকে তাকাই যা এই ধারণা উৎপাদন করেছে। এটা পৃথিবীর অনেক পুরুষ ও নারীদের, যারা কেটলির উপাদান বিতরণ করে থাকে, তাদের বেতন দিয়েছে এবং এখনও বেতন দিয়ে যাচ্ছে। পৃথিবীর লাখো মানুষকে কর্ম দিয়েছে।

সেই পুরাতন কেটলি এখন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় চিনি খরিদ্দার। এভাবে চাকরি দিয়ে যাচ্ছে হাজারো পুরুষ ও নারীদের যারা আখ উৎপাদনের সাথে জড়িত এবং বিশুদ্ধকরণ ও চিনির বিতরণে রয়েছে।

পুরাতন কেটলি এখন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় কাঁচের বোতল খরিদ্দার। যা একটি বড় সংখ্যক কাঁচ কর্মচারীদের চাকরি দিচ্ছে।

পুরাতন কেটলি সারা পৃথিবী জুড়ে একটি বড় পরিমাণের কেরানী, সচিব, লেখক এবং দক্ষ বিজ্ঞাপন কর্মীদের কর্মসংস্থান দিচ্ছে। এটা খ্যাতি এবং সৌভাগ্য এনেছে সেসব শিল্পীর প্রতি যারা পণ্যের বর্ণনা দিয়ে চমৎকার ছবি সৃষ্টি করেছে।

পুরাতন কেটলি দক্ষিণের একটি ছোট্ট শহরকে দক্ষিণের বাণিজ্যিক শহরে রূপান্তরিত করেছে, যার দ্বারা লাভবান হয়েছে সরাসরি বা পরোক্ষভাবে শহরের প্রত্যেক ব্যবসায়ী এবং নগরবাসী।

এই আইডিয়ার প্রভাবে লাভবান হয়েছে বিশ্বের প্রতিটি সভ্য দেশ। যারাই একে স্পর্শ করেছে তাদের প্রতি অবিরতভাবে স্বর্ণের ¯্রােতধারা প্রবাহিত করেছে।

কেটলি থেকে নির্গত স্বর্ণ দক্ষিণের একটি প্রসিদ্ধ কলেজের প্রতিষ্ঠাতা এবং এখনো কলেজকে চালিয়ে নিচ্ছে যেখানে হাজারো তরুণ শিক্ষার্থীরা তাদের জীবনের সাফল্যের জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ পাচ্ছে।

পুরাতন কেটলি আরও অসাধারণ বিষয় ঘটিয়েছে। বিশ্বের সব জায়গায় যখন অর্থনৈতিক হতাশা বিরাজ করছে; কারখানা, ব্যাংক ও ব্যবসায়িক দোকান উঠে যাচ্ছে এবং লোকজন হাজারো দোকান বন্ধ করে দিচ্ছে তখন মনমুগ্ধকর কেটলি মালিক এগিয়ে যাচ্ছে, অবিরতভাবে সারা বিশ্বের বহু সংখ্যক পুরুষ ও নারীদের কর্মসংস্থান দিয়ে যাচ্ছে এবং তাদেরকে স্বর্ণ বিক্রির অতিরিক্ত অংশের ভাগ দিচ্ছে যারা বহু আগে থেকেই এই আইডিয়ায় বিশ্বাস করত।

যদি পণ্যটি, সেই পুরাতন পিতলের কেটলি কথা বলতে পারত, তবে এটা প্রত্যেক ভাষায় ভালোবাসার রোমাঞ্চকর সব গল্প বলত। যারা এর দ্বারা প্রতিদিন উৎসাহিত হন তাদের প্রেম-ভালোবাসার গল্প, ব্যবসায়ীদের ভালোবাসার গল্প, দক্ষ পুরুষ ও নারীদের ভালোবাসার গল্প।

লেখকেরও এমন একটি ভালোবাসার কাহিনী রয়েছে। যিনি স্বয়ং এরই একটি অংশ এবং এসব কিছুরই শুরু হয় যে জায়গায় সেখান থেকে সেই তরুণ ঔষধ বিক্রেতার পুরাতন কেটলি ক্রয়ের স্থান বেশি দূরে নয়। এই কাহিনী সেখানের যেখানে লেখকের সাথে তার বউয়ের প্রথম সাক্ষাৎ হয় এবং তিনিই তাকে এই মনমুগ্ধকর কেটলির কথা শোনান। তারা সেই কেটলি থেকে উৎপাদিত পণ্য পান করছিল। আর তখনই লেখক তাকে ভালোবাসার প্রস্তাব জানায়। ‘যেকোন ভালো বা খারাপ পরিস্থিতিতে’ পাশে থাকার জন্য অঙ্গীকার করে।

এখন আপনারা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন যে কেটলির উপাদানটি একটি বিশ্ব বিখ্যাত পানীয়। আমি স্বীকার করি যে এই পানীয়র প্রথম উৎপাদনকারী শহর আমাকে একজন প্রেয়সী এবং বউ দিয়েছে। এরই সাথে পানীয়টি স্বয়ং আমাকে মাতলামি ছাড়াই চিন্তার উদ্দীপনা দেয় এবং এর দ্বারা মনকে পুনরায় সতেজ করে তোলে যা একজন লেখকের সর্বোৎকৃষ্ট কাজের জন্য আবশ্যক।

আপনি যেই হোন না কেন, যেখানেই থাকুন না কেন, আপনি যে পেশাতেই নিয়োজিত থাকুন না কেন, মনে রাখবেন ভবিষ্যতে যতবারই আপনি এই শব্দ দেখবেন ‘কোকা-কোলা’, যা এর সম্পদের বিশাল সা¤্রাজ্য গড়ে তুলেছে এবং একটি একক আইডিয়া থেকে প্রভাবিত হয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং সেই ঔষধ বিক্রেতা আসা গ্রিগস ক্যান্ডলর যে গোপন ও রহস্যময় উপাদান মিশ্রিত করেছেন তা হচ্ছে ... ... কল্পনা!

থামুন এবং এই ব্যাপারে একটু চিন্তা করুন!

আর এটাও মনে রাখবেন ধনী হওয়ার যে ১৩টি ধাপ এ বইয়ে বর্ণনা করা হয়েছে, এগুলো দ্বারাই কোকা-কোলা প্রভাবিত হয়েছে, প্রতিটি শহর, নগর, গ্রাম ও পৃথিবীর যেকোন কোণায় বর্ধিত হয়েছে এবং এমন কোন আইডিয়া যা আপনি হয়তো সৃষ্টি করবেন, ঠিক ততটাই সমগুরুত্বপূর্ণ এবং পুরস্কারের যোগ্য যেমন কোকা-কোলা। হতে পারে আপনিও এই বিশ্বব্যাপী তৃষ্ণা-নিবারকের মতো একটি আইডিয়াকে অনুসরণ করে বিশাল ইতিহাস গড়তে পারেন।

আসলে চিন্তাগুলো ঠিক এমনই এবং বাস্তবে এদের ফলাফল বিশ্ব নিজেই।


যদি আমার এক কোটি টাকা থাকত তবে আমি কী করতাম?

এই ঘটনা প্রমাণ করে সেই পুরাতন সত্য, ‘ইচ্ছা থাকিলে উপায় হয়।’ এটা আমাকে বলেছে সেই শ্রদ্ধেয় শিক্ষক ও পাদরি, মৃত ফ্রাংক ডব্লিউ. গানজালিস, যে তার পেশা শুরু করে দক্ষিণ শিকাগোর একজন ধর্মোপদেশক রূপে। যখন ড. গানজালিস কলেজে যেত, সে পর্যবেক্ষণ করল যে আমাদের শিক্ষা পদ্ধতিতে অনেক ত্রুটি রয়েছে। সে বিশ্বাস করত সে যদি একটি কলেজের প্রধান হত তবে ত্রুটিগুলো ঠিক করতে পারত। একটি কলেজের প্রধান হওয়ার প্রতি তার আকাক্সক্ষা ছিল গভীর। সে চিন্তা করল আমার কলেজ এমন হবে যেখানে তরুণ ছাত্র-ছাত্রীরা ‘কাজের দ্বারা শিখবে’।

সে একটি নতুন কলেজ প্রতিষ্ঠার জন্য তার মনকে স্থির করল। যেখানে সে তার আইডিয়াকে পরিচালিত করতে পারবে। গোঁড়া শিক্ষা পদ্ধতির বদলে সে শিক্ষার্থীদের কাজের দ্বারা শেখাবে।

এরকম একটি পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করতে তার প্রয়োজন ছিল এক কোটি টাকা! এই রকম বড় অঙ্কের টাকার জন্য সে কোথায় তার হাত পাতবে? এই প্রশ্নই তরুণ পাদরির উচ্চভিলাসী চিন্তার বেশির ভাগ শোষণ করে নিয়েছে।

কিন্তু সে কোন সমাধানের দেখা পাচ্ছিল না।

প্রতিরাতেই সে এই চিন্তা নিয়ে বিছানায় যেত। আবার সকালে এই চিন্তা নিয়েই বিছানা থেকে উঠত। সে যেখানেই যেত এই চিন্তা নিয়েই ঘুরত। সে তার মনে মনে এটা সম্পর্কে বারবার চিন্তা করল যতক্ষণ পর্যন্ত না এটা একটা সর্বগ্রাসী আবেশে পরিণত হয়। এক কোটি টাকা, এ এক বিশাল অঙ্কের অর্থ। সে ব্যাপারটা স্বীকার করল। কিন্তু সে আরও কবুল করল এই সত্য যে, মানুষের একমাত্র সীমাবদ্ধতা হচ্ছে যা সে নিজের মনে স্থির করে নেয়।

একজন দার্শনিক রূপে, আবার একজন ধর্মোপদেশক রূপে ড. গানজালিস বুঝতে পারল, জীবনে যারা সাফল্য অর্জন করেছে তারা তা করেছে কারণ হচ্ছে উদ্দেশ্যের নির্দিষ্টতা। এটা এমন এক আরম্ভ বিন্দু যেখান থেকে একজনকে অবশ্যই আরম্ভ করতে হবে। সে আরও স্বীকার করল যে, উদ্দেশ্যের নির্দিষ্টতাই জীবনে সজীবতা ও শক্তি দেয়। যখন আপনি একটি জ্বলন্ত আকাক্সক্ষা দ্বারা পরিচালিত হবেন তখন এই আকাক্সক্ষাই এটার আর্থিক সমতুল্যে রূপান্তরিত হবে।

সে এই সব মহান সত্য জানত, তবুও সে জানত না যে কোথায় বা কীভাবে তার হাত পাতলে এক কোটি টাকা পাবে। সাধারণ পদ্ধতি হওয়া উচিত ছিল আকাক্সক্ষাটি ছেড়ে দেওয়া এবং ইচ্ছা ত্যাগ করা, এটা বলে যে, ‘আহ! ঠিক আছে, আমার আইডিয়া একটা ভালো আইডিয়া ছিল। কিন্তু আমি এটা নিয়ে কিছুই করতে পারব না। কারণ আমি কখনো আমার প্রয়োজনীয় এক কোটি টাকা অর্জন করতে পারব না।’ বেশির ভাগ লোকজন ঠিক এরকমই বলবে, কিন্তু ড. গানজালিস তা বলেনি। সে কী বলেছে এবং কী করেছেন তাই সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাই আমি এখন তাকে তারই বক্তব্যে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি এবং তাকে তার নিজের জন্য বলার সুযোগ দিচ্ছি।

‘শনিবারের এক দুপুরবেলা, আমি আমার ঘরে বসে চিন্তা করছিলাম যে কীভাবে আমার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার জন্য কাজ করব, কোথা থেকে অর্থ পাব। আমি প্রায় ২ বছর ধরে চিন্তা করেছি। কিন্তু শুধু চিন্তা করা ব্যতীত আমি কোন কাজই করিনি!

‘সময় এসেছে কাজ করার!

‘তখনই এবং সেখানেই আমি আমার মনকে তৈরি করলাম যে আমি আমার প্রয়োজনীয় ১ কোটি টাকা এক সপ্তাহের মধ্যেই জোগাড় করব। কীভাবে? এটা আমি জানতাম না। মূল বিষয় হচ্ছে সিদ্ধান্ত যে একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে অর্থ পেতে হবে এবং আমি আপনাকে বলতে চাই যে মুহূর্তে আমি এই নির্দিষ্ট সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি যে একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে অর্থ জোগাড় করতে হবে, ঠিক তখনই আমার মধ্য দিয়ে নিশ্চয়তার এক অদ্ভুত শিহরণ বয়ে গেল, যেমনটা আমার আগে কখনো অভিজ্ঞতা ছিল না। আমার ভেতরে কিছু একটা বলতে লাগল, ‘কেন তুমি বহু বছর আগেই এই সিদ্ধান্তে পৌঁছাওনি? অর্থটা তো তোমার জন্য সবসময়ই অপেক্ষা করছিল!’

‘এরপর ঘটনা খুব দ্রুত ঘটতে আরম্ভ করে। আমি একটি পত্রিকা অফিসে ফোন দিলাম এবং বিজ্ঞাপন দিলাম যে আমি আগামীকাল সকালে একটি সভা অনুষ্ঠিত করব, যার শিরোনাম হবে, “যদি আমার ১ কোটি টাকা থাকত তবে আমি কী করতাম?”

‘আমি সভা তৈরির জন্য অতি দ্রুত কাজে চলে গেলাম, কিন্তু আমাকে অবশ্যই বলতে হবে যে কাজটি আমার জন্য তেমন কঠিন ছিল না। কারণ আমি তো এই সভার জন্য প্রায় ২ বছর ধরে প্রস্তুতি নিয়েছি। আমার সেই চেতনা ফিরে এসেছে যা আমারই একটি অংশ ছিল!

‘অনেক সময় ধরে আমি কাজ করলাম। ঠিক মধ্যরাতে আমি আমার সভার বক্তব্য লেখা শেষ করলাম। আমি বিছানায় গেলাম এবং একটি আত্মবিশ্বাসী মনোভাব নিয়ে ঘুমাতে গেলাম। কারণ আমি তখনই দেখছিলাম যে আমি কোটি টাকার অধিকারী হয়ে গেছি।

‘পরের দিন সকালে আমি ভোরে উঠি, গোসলঘরে গেলাম, সভার বক্তব্য পড়লাম, হাঁটু গেড়ে বসলাম এবং বললাম আমার সভায় আজ এমন কেউ অংশগ্রহণ করবে যে আমার প্রয়োজনীয় অর্থ সরবরাহ করতে পারে।

‘যখন আমি প্রার্থনা করছিলাম তখন পুনরায় সেই নিশ্চয়তার শিহরণ জেগে উঠল যে অর্থ আসবে। উত্তেজনায় আমি আমার লিখিত বক্তব্য ছাড়াই চলে গেলাম এবং এটা আমি ততক্ষণ আবিষ্কার করতে পারিনি যতক্ষণ না আমি মঞ্চে উঠলাম। উঠে দেখি আমি আমার লিখিত বক্তব্যের কাগজই আনিনি।

‘তখন আর বাসায় এসে লিখিত বক্তব্যের কাগজ নেওয়ার সুযোগ এবং সময় ছিল না। আমার বিশ্বাস এটা ঐশ্বরিক এক আর্শীবাদ যে আমি বক্তব্যের লিখিত কাগজ আনতে ভুলে গিয়েছিলাম! আমি নিজেকে ভরসা দিলাম। আমার অবচেতন মন আমাকে সহায়তা করল। যখন আমি মঞ্চে উঠে আমার বক্তব্য শুরু করলাম তখন আমি আমার চোখ বন্ধ করলাম এবং আমার হৃদয় থেকে, আত্মা থেকে আমার স্বপ্ন নিয়ে বললাম। আমি শুধু আমার শ্রোতাদের সাথেই কথা বলিনি, এমনকি আমার মনে হয় আমি সৃষ্টিকর্তার সাথেও কথা বলেছি। আমি বলেছি যে যদি আমার ১ কোটি টাকা থাকত তবে আমি কী করতাম। আমার পরিকল্পনার বর্ণনা দিলাম। যা আমার মনে ছিল ঠিক তাই বললাম। একটি মহান শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার জন্য যা করা দরকার তাই বললাম। যেখানে তরুণ ছাত্র-ছাত্রীরা কাজের দ্বারা বাস্তব বিষয় থেকে শিখতে পারবে এবং একই সময়ে তাদের মনের উন্নয়ন ঘটাতে পারবে।

‘যখন আমি শেষ করলাম তখন আমার সারা শরীর ঘেমে-নেয়ে শেষ। আমি একটি চেয়ারের ওপর বসে পড়লাম। পিছন দিকের সারি থেকে একজন লোককে দেখলাম খুব ধীরে গতিতে তার আসন থেকে উঠল এবং মঞ্চ বরাবর আসতে লাগল। আমি অবাক হয়ে চিন্তা করছিলাম ভদ্রলোক কী বলতে যাচ্ছে তাই ভেবে। তিনি মঞ্চে এলেন, তার হাত বাড়িয়ে দিলেন এবং “শ্রদ্ধেয় মহোদয়, আমি আপনার বক্তব্য পছন্দ করেছি। আমি বিশ্বাস করি আপনি সবকিছুই করতে পারবেন যা আপনি বলেছেন যে আপনি করবেন, যদি আপনার ১ কোটি টাকা থাকত। আমি যে আপনাকে এবং আপনার বক্তব্যকে বিশ্বাস করেছি এটা প্রমাণ করার জন্য বলছি, যদি আপনি আগামীকাল সকালে আমার অফিসে আসেন তো আমি আপনাকে সেই ১ কোটি দিব। আমার নাম ফিলিপ ডি. আরমার।’ [তখনকার দিনে ফিলিপ ড্যানফোর্থ আরমার  ছিলেন একজন শিল্পপতি।]

তরুণ গানজালিস জনাব আরমারের অফিসে গেলেন এবং কোটি টাকা তাকে দেওয়া হলো। সেই অর্থ দিয়ে তিনি প্রতিষ্ঠা করলেন আরমার ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি।

এটা এত বেশি পরিমাণ অর্থ ছিল যা বেশির ভাগ পাদরিরা তাদের পুরো জীবনেও দেখেনি। তবুও তরুণ পাদরির মনে অর্থের এই চিন্তা তরঙ্গ সৃষ্টি হয়েছিল এক মিনিট সময়েরও কম সময়ের মধ্যে। প্রয়োজনীয় কোটি টাকা এলো একটি আইডিয়া রূপে। আইডিয়াটি এসেছিল একটি আকাক্সক্ষা থেকে যা তরুণ গানজালিস প্রায় ২ বছর ধরে তার মনে লালন-পালন করছিল।

এই ব্যাপার পর্যবেক্ষণ করুন ... ... যখন সে অর্থ পাওয়ার জন্য একটি সিদ্ধান্ত নেয় এবং একটি নির্দিষ্ট পরিকল্পনা তৈরি করে তার ৩৬ ঘণ্টার মধ্যে সে অর্থ পেয়ে যায়!

যখন তরুণ গানজালিস অস্পষ্টভাবে ১ কোটি টাকা চাইত এবং যখন তার এই আশা দুর্বল ছিল তখন কোন কিছুই ঘটল না। আমি নিশ্চিত যে তার আগেও অন্য বহু লোক এই একই ধরনের চিন্তা করত। কিন্তু গানজালিসের ঘটনা সেই দিন, সেই শনিবারই বদলে যায় যখন সে অস্পষ্টতাকে পাশে সরিয়ে রাখে এবং নির্দিষ্টভাবে বলে, “আমি অবশ্যই এক সপ্তাহের মধ্যে সেই অর্থ পাব!”

অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে যে সূত্রের সহায়তায় ড. গানজালিস তার কোটি টাকা পেয়েছিল তা এখনও জীবন্ত! এটা আপনিও ব্যবহার করতে পারেন! এই চিরন্তন সত্য আজকের জন্য ততটাই কার্যকরী যতটা তরুণ ধর্মযাজক এটা ব্যবহার করে সফল হয়েছিল। এ বইয়ে সেই বর্ণনাই আছে। ধাপে ধাপে লেখা আছে। সেই মহান আইনের ১৩টি উপাদান সম্বন্ধে বলা আছে এবং কীভাবে তাদের প্রয়োগ করবেন তাও ব্যাখ্যা করা আছে।

পর্যবেক্ষণ করুন যে আসা গ্রিগস ক্যান্ডলর  ও ড. ফ্রাংক গানজালিস উভয়ের চরিত্রে একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য আছে। উভয়ে এই অসাধারণ সত্য জানত যে কোন একটি আইডিয়া, ধারণা বা বুদ্ধিকে টাকাপয়সায় রূপান্তর করা যায়। আর এটা করতে হয় নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যের সাথে নির্দিষ্ট পরিকল্পনা যোগ করে।

যদি আপনি তাদের মধ্যে একজন হন যারা বিশ্বাস করে যে কঠিন পরিশ্রম এবং সততাই শুধু ধনসম্পদ আনে। তবে চিন্তাটি মুছে ফেলুন! এটা সত্য নয়! ধনীরা, যখন তারা বিশাল পরিমাণের ধনসম্পদ গড়ে, তা কখনো কঠিন পরিশ্রমের ফলাফল নয়! ধনীরা ধনী হয়, যদি তারা নির্দিষ্ট চাহিদার প্রতি সাড়া দেয় কেবল তখনই তারা ধনী হয়। তাদের ভিত্তি থাকে নির্দিষ্ট সূত্রের ব্যবহার বিধি ওপর। কোন ধরনের সুযোগ বা ভাগ্যের ওপর নয়। সাধারণভাবে বলতে গেলে, একটি আইডিয়া, বুদ্ধি বা ধারণা হচ্ছে চিন্তার একটি তরঙ্গ যা একটি কল্পনার উপস্থিতিতে কাজে রূপান্তরিত হয়। যত অভিজ্ঞ এবং দক্ষ বিক্রয়কর্মী আছে তারা জানে যে যেখানে পণ্য বিক্রয় হয় না সেখানে আইডিয়া বিক্রি করা যায়। সাধারণ বিক্রয়কর্মীরা এটা জানে না। তাই তারা ‘সাধারণ’ হয়েই জীবন কাটায়। [যেমন বাংলাদেশের ওয়াল্টন কোম্পানি লিমিটেড । তাদের স্লোগান হচ্ছে ‘আমাদের পণ্য’। আমি এমনও লোক দেখেছি যারা অন্য কোম্পানির ফ্রিজ থাকা সত্ত্বেও ওয়াল্টনের ফ্রিজ ক্রয় করেছে। তাকে জিজ্ঞেস করলাম কেন এই ফ্রিজ কিনলেন। তিনি বললেন আমাদের দেশের কোম্পানি তাই।]

একজন বই প্রকাশক একটি আবিষ্কার করলেন। যা হয়তো প্রকাশকদের কাছে মূল্যবান বলে বিবেচিত হবে। তিনি খেয়াল করেন যে লোকজন বইয়ের উপাদান নয়; বরং বইয়ের শিরোনাম ক্রয় করে। তিনি কেবল একটি বইয়ের নাম পরিবর্তন করলেন যা ভালো চলছিল না, তার বিক্রয় লাফ দিয়ে ঊর্ধ্বদিকে হাজারো কপি ছাড়িয়ে গেল। বইয়ের ভেতরে উপাদানগত কোন পরিবর্তন ছিল না। তিনি শুধু বইয়ের শিরোনাম সংবলিত প্রচ্ছদ ছিঁড়ে ফেলতেন যদি তা ভালো না চলত এবং একটি নতুন শিরোনাম সংবলিত প্রচ্ছদ লাগাতেন যা পুরোদমে চলত।

এটা খুবই সাধারণ এক ব্যাপার। কিন্তু সবাই তা দেখতে পায় না। এটাই হচ্ছে আইডিয়া! এটাই হচ্ছে বুদ্ধি! যার কল্পনাশক্তি আছে, সে এই আইডিয়ার সাথে তার কল্পনাকে মিশিয়ে তৈরি করে অসাধারণ এক বুদ্ধি!

আইডিয়ার কোন আদর্শ মূল্য নেই। যিনি আইডিয়ার সৃষ্টিকর্তা তিনিই এর দাম নির্ধারণ করবেন এবং যদি তিনি বুদ্ধিমান হন, তবে তিনি তা পেয়েও যাবেন।

চলচ্চিত্রের ব্যবসা এক ঝাঁক কোটিপতি তৈরি করেছে। এদের মধ্যকার বেশির ভাগ লোক বিশেষ কোন আইডিয়া বা বুদ্ধি বের করতে পারে না। কিন্তু তাদের মধ্যে কল্পনাশক্তি রয়েছে, সেই সচেতনতা রয়েছে যা দিয়ে তারা কোন নতুন আইডিয়া, ধারণা বা অভিনব বুদ্ধি দেখলে তা সাথে সাথেই চিনে ফেলতে পারে।

কোটিপতিদের আগামী ঝাঁক তৈরি হবে রেডিও ব্যবসা থেকে, যা নতুন এবং এখনও কল্পনাশক্তিতে বলীয়ান মানুষ দ্বারা পূর্ণ হয়নি। তারাই অর্থ তৈরি করবে যারা নতুন এবং আরও মেধাবী রেডিও অনুষ্ঠান আবিষ্কার বা সৃষ্টি করবে। তাদের কল্পনাশক্তি প্রয়োগ করবে যাতে রেডিও শ্রোতাদের আরও সুযোগ-সুবিধা দিয়ে লাভবান করা যায়।

বর্তমানে রেডিও খাতে বিনিয়োগকারীরা দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভুগছে! তারা হতভাগ্য শিকার যারা এখনও রেডিও ‘বিনোদনের’ সব খরচ বহন করে, শীঘ্রই তারা আইডিয়া সচেতন হবে এবং তাদের প্রদেয় অর্থ অনুসারে বিনিময় চাইবে। যে ব্যক্তি বিনিয়োগকারীদের দেখাতে পারবে এবং এমন অনুষ্ঠানাদি প্রদান করতে পারবে যা কার্যকরী সেবা প্রদান করবে, সেই এই নতুন অঞ্চলের ধনী ব্যক্তি হয়ে উঠবে।

দ্রুত ও মৃদু ভাষী শিল্পীরা যারা এখন তাদের জ্ঞানপাপী এবং বোকা বক্তব্য দ্বারা বাতাস দূষিত করে তারা প্রতিস্থাপিত হবে সত্যিকারের শিল্পীদের দ্বারা। এসব শিল্পীরা তাদের সতর্ক পরিকল্পনা দ্বারা অনুষ্ঠানকে পরিচালনা করবে। এতে করে শিল্পীরা বিনোদনের সাথে সাথে মানুষকে সেবাও প্রদান করবে।

এখানে বিরাট এক সুযোগ রয়েছে, যা চিৎকার করে আন্দোলন করছে যে এই খাতে কল্পনাশক্তির দরকার। এটা যেকোন মূল্যে পুনরুজ্জীবিত হতে চায়। সবার উপরে যে বিষয় তা হচ্ছে রেডিওতে নতুন আইডিয়ার প্রয়োজন!

যদি সুযোগের এই নতুন ক্ষেত্র আপনাকে বিভ্রান্ত করে হয়তো আপনি এই পরামর্শ থেকে লাভবান হবেন যে ভবিষ্যতে সাফল্যম-িত রেডিও অনুষ্ঠান আরও বেশি মনোযোগ দিবে ‘ক্রয়কারী’ শ্রোতাদের প্রতি এবং কম গুরুত্ব দিবে শুধু ‘শ্রোতাদের’ প্রতি। আরও সোজাভাবে বলতে গেলে, ভবিষ্যতে যারা রেডিও অনুষ্ঠান তৈরি করে সফল হবে তাদেরকে অবশ্যই বাস্তবিক পথ খুঁজতে হবে যাতে ‘শ্রোতারা’ ‘ক্রয়কারীতে’ পরিণত হয়। আরও সফল পরিচালনাকারীরা রেডিও অনুষ্ঠানাদিতে এমন কিছু বিশিষ্ট অংশ রাখবে যাতে সে তার প্রচেষ্টার সরাসরি ফলাফল শ্রোতাদের ওপর দেখতে পায়। [যেমন ফেসবুকে বিজ্ঞাপন দিতে গেলে আপনাকে কতজনের কাছে পৌঁছাবে, কতজন পছন্দ করতে পারে তা দেখায় ঠিক তেমনই একটি ব্যাপার রেডিওতেও ঘটবে।]

বিনিয়োগকারীরা একটু চিন্তা করবে বাকপটু কথা ক্রয়ের ক্ষেত্রে যা তাদের পণ্যের ব্যাপারে হাল্কা বাতাসে বলা হয়ে থাকে। তারা বর্তমানে চায় এবং ভবিষ্যতের চাহিদা হবে অবধারিত প্রমাণ যাতে রেডিও অনুষ্ঠানাদি লাখো মানুষকে শুধু মুচকি হাসিই দিবে না, এই মুখ চাপিয়া হাসির অনুষ্ঠান পণ্যও বিক্রয় করতে পারবে!

যারা এই পেশায় অন্তর্ভুক্ত হতে আগ্রহী তাদের আরও একটি বিষয় বোঝা উচিত যে এই নতুন ক্ষেত্র, রেডিও খাতের বিজ্ঞাপন একটি নতুন এবং দক্ষ লোকজনের হাতে স্থানান্তর হতে যাচ্ছে, যারা পুরাতন সময়ের সংবাদপত্র ও সাময়িকী থেকে ভিন্ন ও পৃথক হবে। পুরাতন সময়ের বিজ্ঞাপনের খেলোয়াড়রা বর্তমানের আধুনিক রেডিও অনুষ্ঠানাদি পাঠ করতে পারবে না, কারণ তারা প্রশিক্ষণ নিয়েছে দেখা আইডিয়াগুলো থেকে। এই নতুন রেডিও কৌশল চায় সেই সব লোককে যারা আইডিয়াকে লিখিত রূপ থেকে রূপান্তর করতে পারবে শব্দে! লেখককে এটা শিখতে ১ বছরের কঠোর পরিশ্রম এবং কয়েক হাজার টাকা খরচ করতে হয়েছে।

রেডিও, এখনও সেই পর্যায়ে আছে যখন এক সময় চলচ্চিত্র ছিল। নির্বাক চলচ্চিত্রের যুগ। যারা রেডিও এর জন্য নতুন নতুন আইডিয়া সৃষ্টি করতে পারবে বা অভিনব কোন আইডিয়াকে চিনতে পারবে তাদের জন্য রেডিও খাতে অনেক সুযোগ ও সম্ভাবনা রয়েছে।

যদি পূর্ববর্তী বক্তব্যে আপনার আইডিয়ার কারখানা কাজ করতে শুরু না করে তবে এই ব্যাপার ভুলে যাওয়াই আপনার জন্য ভালো। অন্য কোন ক্ষেত্রে আপনার সুযোগ রয়েছে। আর যদি এই বক্তব্যে আপনি সামান্যও আলোড়িত হন তবে এটাতে এগিয়ে যান এবং আপনি হয়তো একটি আইডিয়া খুঁজে পেতে পারেন যা আপনার জীবিকা নির্বাহের জন্য প্রয়োজন।

যদি আপনার রেডিওতে কোন অভিজ্ঞতা না থাকে তবুও ভয় পাবেন না। অভিজ্ঞতা থাকা ভালো, কিন্তু অভিজ্ঞতা না থাকলে যে কাজ আরম্ভ করা যাবে না তা নয়। এমন চিন্তা দ্বারা নিজেকে কখনো হতাশ হতে দিবেন না। বিশিষ্ট শিল্পপতি এন্ড্রু কার্নেগি ইস্পাত উৎপাদন সম্পর্কে খুব কমই জানতেন। কিন্তু তারপরও তিনি এ বইয়ের ২টি সূত্রকে বাস্তবে কাজে লাগিয়ে নিজেকে সফল করে তুলেছেন।

প্রতিটি মহান সৌভাগ্যের বাস্তবিক গল্প শুরু হয় সেই দিন থেকে যখন আইডিয়ার একজন সৃষ্টিকর্তা এবং আইডিয়ার একজন বিক্রয়কর্তা একত্রিত হয় এবং একই সাথে কাজ করে। কার্নেগি নিজেকে ঘিরে রেখেছিলেন সেই লোকেদের দ্বারা যারা সবকিছু করতে পারে যা তিনি করতে পারেন না। তার সাথে ছিল যেসব ব্যক্তি আইডিয়া তৈরি করতে পারে এবং যেসব ব্যক্তি আইডিয়া কার্যে পরিণত করতে পারে। এরাই তাকে এবং অন্যদের অবিস্মরণীয়ভাবে সম্পদশালী রূপে গড়ে তুলেছে।

লক্ষাধিক মানুষ তাদের জীবন নির্বাহ করে এই আশায় যে তারা হয়তো তাদের পছন্দ মতো ‘একটি আরম্ভের সুযোগ’ পাবে। হয়তো একজন তার পছন্দ মতো আরম্ভ করার সুযোগ পেয়ে গেল, কিন্তু নিরাপদ পরিকল্পনা কখনো ভাগ্যের ওপর নির্ভর করে না। আমি আমার পছন্দ মতো ‘আরম্ভের’ সুযোগ পেয়েছিলাম যা ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে বড় সুযোগ। কিন্তু এই সুযোগকে একটি সম্পদে পরিণত করার আগে ২৫ বছরের দৃঢ়সংকল্পিত প্রচেষ্টা উৎসর্গ করতে হয়েছে।

‘আরম্ভের সুযোগ’ গঠিত হয়েছিল আমার ভালো সৌভাগ্যের জন্য যে আমি এন্ড্রু কার্নেগির সাথে সাক্ষাৎ করেছিলাম এবং তার সহযোগিতা অর্জন করেছিলাম। সেই অনুষ্ঠানেই কার্নেগি আমার মনে আইডিয়াটা রোপণ করে যাতে সাফল্য অর্জনের সূত্র সংগঠিত করে একটি সাফল্যের দর্শনে পরিণত করা যায়। ২৫ বছরের গবেষণায় হাজারো লোক এই আবিষ্কার থেকে লাভবান হয়েছে এবং অনেকেই এই দর্শনের ব্যবহারিক প্রয়োগ করে সম্পদশালী হয়েছে। আরম্ভটি খুবই সাধারণ ছিল। এটা একটি আইডিয়া যা থেকে যেকেউ উন্নতি করতে পারে।

পছন্দনীয় আরম্ভের সুযোগ আসে কার্নেগির মাধ্যমে। কিন্তু দৃঢ় প্রতিজ্ঞা, উদ্দেশ্যের নির্দিষ্টতা, লক্ষ্যটি অর্জনের আকাক্সক্ষা এবং ২৫ বছরের অধ্যবসায়ী প্রচেষ্টা সম্বন্ধে কী বলবেন? এটা কোন সাধারণ আকাক্সক্ষা ছিল না যা অতিক্রম করেছে হতাশা, নিরুৎসাহ, সাময়িক বাধা, সমালোচনা এবং লোকজনের ধ্রুবভাবে স্মরণ করিয়ে দেওয়া যে এটা ‘সময়ের অপচয়’। এটা ছিল এক জ্বলন্ত আকাক্সক্ষা! একটা আবেশ! আগুনের আবেশ বা স্পর্শ যেমন যেকোন বস্তুকে পুড়িয়ে এটা থেকে আগুন জ্বলার উপাদানটুকু শক্তি রূপে গ্রহণ করে তেমনি একটি জ্বলন্ত আকাক্সক্ষা হচ্ছে একটি আবেশ যা হতাশা, নিরুৎসাহ, সাময়িক বাধা, সমালোচনাকে পুড়িয়ে এটা থেকে এগিয়ে যাওয়ার উপাদানটুকু শক্তি রূপে গ্রহণ করে।

যখন আমার মনে জনাব কার্নেগি প্রথম আইডিয়াটা রোপণ করেন তখন এটা আমাকে খোশামোদে তুষ্ট করেছিল, সেবা করেছিল এবং বেঁচে থাকার জন্য প্রলুব্ধ করেছিল। ধীরে ধীরে আইডিয়াটা সুবিশাল হয়ে ওঠে। এটা নিজে নিজেই শক্তিশালী হয়ে ওঠে। এটা আমাকে তুষ্ট করেছিল, সেবা করেছিল এবং আমাকে সামনে চালিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। আইডিয়া এরকমই। প্রথমে আপনি জীবন ও কর্ম দিবেন এবং আইডিয়ার প্রতি নির্দেশনা দিবেন, তারপর এটা তাদের নিজ হাতে ক্ষমতা নিয়ে নেয় এবং সব বাধাকে বল পূর্বক সরিয়ে দেয়।

আইডিয়া বা ধারণা হচ্ছে একটি অস্পর্শনীয় চেতনা বা শক্তি। স্পর্শ দ্বারা অনুভব করা যায় না এমন এক শক্তি, কিন্তু এটার আরও বেশি ক্ষমতা আছে। মস্তিষ্ক থেকে সৃষ্টি হওয়ার পর এটার বেঁচে থাকার ক্ষমতা আছে। তবে এটা ধূলিসাৎ হয়ে যেতে পারে যদি-না আপনি একে নির্দিষ্ট পরিকল্পনা এবং কর্ম দ্বারা পরিচর্যা করেন।


 




অধ্যায় - ০৭

সংগঠিত পরিকল্পনা

আকাক্সক্ষার স্বচ্ছতাকে কর্মে রূপান্তর করে

ধনী হওয়ার ক্ষেত্রে ষষ্ঠ ধাপ


আপনি শিখেছেন যে সবকিছুই যা মানুষ তৈরি করে বা অর্জন করে তা আরম্ভ হয় আকাক্সক্ষা আকারে, যে আকাক্সক্ষা তাকে নিয়ে যায় যাত্রার প্রথম ধাপে, অদৃশ্য থেকে কঠিন দৃশ্যমানে, কল্পনার কারখানায় পৌঁছে দেয়, যেখানে পরিকল্পনা সৃষ্টি এবং সংগঠিত হতে স্থানান্তরিত হয়।

দ্বিতীয় অধ্যায়ে, আপনাকে ৬টি নির্দিষ্ট নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল, যা আপনার আকাক্সক্ষা অনুযায়ী অর্থকে এর আর্থিক সমতুল্যে রূপান্তরিত করতে প্রথম ধাপ হিসাবে ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে। এই ধাপের একটি দিক হচ্ছে নির্দিষ্টতা গঠন, ব্যবহারিক পরিকল্পনা বা পরিকল্পনাগুলো তৈরি করা, যার মাধ্যমে এই রূপান্তর ঘটবে। ব্যবহারিক পরিকল্পনা হচ্ছে আপনি কেবল পরিকল্পনা করেই ক্ষান্ত হবেন না। বসে থাকবেন না। সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজও করে দেখাবেন।

আপনাকে এখন নির্দেশনা দেওয়া হবে যে কীভাবে পরিকল্পনা তৈরি করবেন যা বাস্তবে প্রয়োগ করা যায়। তা হচ্ছে:

(ক) নিজেকে একটি দল দ্বারা সহায়তা করুন। আপনার পরিকল্পনা সৃষ্টির জন্য এবং বাস্তবায়ন করতে যত লোক আপনার দরকার তত লোকের সহযোগিতা গ্রহণ করুন। অর্থ অর্জনের জন্য ‘ঐক্যমন দল’ তৈরি করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং এটা কীভাবে তৈরি ও প্রয়োগ করবেন সে সম্বন্ধে পরবর্তী অধ্যায়ে বর্ণনা করা হয়েছে। (এই নির্দেশনার সাথে একমত হওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একে অবহেলা করবেন না।)

(খ) আপনার ‘ঐক্যমন দল’ গঠনের পূর্বে সিদ্ধান্ত নিন যে আপনার দলের প্রত্যেক স্বতন্ত্র সদস্যকে তার সহযোগিতার বদলে কী সুবিধা ও লাভ দিবেন। কোন প্রকার প্রতিদান ব্যতীত কেউই আপনার সাথে অনির্দিষ্টকাল কাজ করবে না। কোন বুদ্ধিমান ব্যক্তি এরকম অনুরোধ বা আশা করবে না যে কেউ তার জন্য পর্যাপ্ত প্রতিদান ব্যতীত কাজ করবে। যদিও প্রতিদান যে সবসময় অর্থ আকারে হতে হবে তাও নয়। অর্থ ছাড়াও মানুষ প্রতিদান হিসাবে আরও অনেক কিছু চায়। যেমন: সম্মান, ভদ্র আচরণ, ভালো খাবার-দাবার, যতœ, মনোযোগ প্রভৃতি।

(গ) আপনার ‘ঐক্যমন দলের’ সদস্যদের সাথে কমপক্ষে সপ্তাহে দুইবার সাক্ষাৎ করুন এবং যদি সম্ভব হয় তবে আরও বেশি সাক্ষাৎ করুন। যতক্ষণ পর্যন্ত না আপনি সবাইকে নিয়ে একত্রে প্রয়োজনীয় পরিকল্পনা নির্ধারণ করছেন অথবা অর্থ অর্জনের জন্য পরিকল্পনা নির্ধারণ করছেন ততক্ষণ পর্যন্ত সাক্ষাৎ চালিয়ে যান।

(ঘ) আপনার এবং আপনার ‘ঐক্যমন’ দলের প্রত্যেক সদস্যদের সাথে পূর্ণাঙ্গ সমসুর বজায় রাখুন। আপনি যদি এই নির্দেশনা পালন করতে ব্যর্থ হন, তবে আপনি আশা রাখতে পারেন যে ব্যর্থতার সাথে আপনার সাক্ষাৎ ঘটবে। যেখানে পূর্ণাঙ্গ সমসুর বজায় থাকে না সেখানে ‘ঐক্যমন’ সূত্র থাকতে পারে না। সমসুর মানে দুইজন বা ততোধিক ব্যক্তির মধ্যে মানসিক বোঝাপড়া এবং স্পষ্টতা বিরাজ করা।

এই ব্যাপারগুলো মনে রাখবেন:

প্রথমত। আপনি নিজের সাথে অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি অঙ্গীকার করেছেন। সাফল্যের নিশ্চয়তার জন্য আপনার পরিকল্পনা থাকতে হবে ত্রুটিহীন।

দ্বিতীয়ত। আপনাকে অবশ্যই অন্যদের মনের অভিজ্ঞতা, শিক্ষা, স্থানীয় সামর্থ্য এবং কল্পনার সুবিধা নিতে হবে। যারা বিশাল সৌভাগ্য অর্জন করেছেন তারা ‘ঐক্যমন দলের’ সদস্যদের সাথে সমসুর বজায় রেখেছে এবং এই পদ্ধতি অনুসরণ করেছে।

একজন ব্যক্তির অভিজ্ঞতা, শিক্ষা, স্থানীয় সামর্থ্য এবং জ্ঞান একটি বিশাল সৌভাগ্য নিশ্চিত করতে যথেষ্ট নয়। তাকে অবশ্যই অন্য ব্যক্তিদের সহযোগিতা নিতে হবে। আপনার সম্পদ অর্জনের চেষ্টায় যত পরিকল্পনাই আপনি অবলম্বন করুন না কেন আপনার এবং আপনার ‘ঐক্যমন দলের’ অন্য সদস্যের যৌথ প্রচেষ্টা অবশ্যই দরকার। আপনার যেকোন কাজ সকলের সম্মতিতে হওয়া উচিত। আপনি হয়তো আপনার স্বীয় পরিকল্পনা সৃষ্টি করতে পারেন, হতে পারে সম্পূর্ণ বা আংশিক পরিকল্পনা সৃষ্টি করতে পারেন, কিন্তু দেখবেন সেই পরিকল্পনা যেন আপনার ‘ঐক্যমন দলের’ সহায়তাকারী সদস্যদের দ্বারা পর্যবেক্ষিত এবং অনুমোদিত হয়।

যদি আপনার একটি পরিকল্পনা সফলভাবে কাজ না করে, তবে নতুন পরিকল্পনা নিন। যদি এই পরিকল্পনাও কাজে ব্যর্থ হয়, তবে এটাকে আবার অন্য এক পরিকল্পনা দ্বারা পরিবর্তন করুন এবং করতেই থাকুন, যতক্ষণ না আপনি এমন এক পরিকল্পনা পাচ্ছেন যা কাজ করে। ততক্ষণ পর্যন্ত খুঁজে যান। ঠিক এইখানটাই যেখানে বেশির ভাগ মানুষ ব্যর্থতার সম্মুখীন হয়। কারণ নতুন পরিকল্পনা সৃষ্টিতে তাদের অধ্যবসায়ের অভাব যা তাদেরকে ব্যর্থ করে। [ব্যর্থতা তো আপনার লক্ষ্য নয়। আপনার লক্ষ্য হচ্ছে সাফল্য। তাই সাফল্য না পাওয়া পর্যন্ত একের পর এক পরিকল্পনা কাজে লাগান। পরিকল্পনা পরিবর্তন করতে পারেন, কিন্তু নির্দিষ্ট লক্ষ্য কখনোই পরিবর্তন করবেন না। আপনি যদি কক্সবাজার যেতে চান তবে বাসে যেতে পারেন। বাস না চললে, ট্রেনে যাবেন। ট্রেন না চললে প্লেনে যাবেন। প্লেন না উড়লে পায়ে হেঁটে যাবেন। যানবাহন পরিবর্তন করতেই পারেন, কিন্তু নির্দিষ্ট গন্তব্য কখনোই পরিবর্তন করা যাবে না। ঠিক একই রকমভাবে, পরিকল্পনা পরিবর্তন করতে পারেন, কিন্তু নির্দিষ্ট লক্ষ্য কখনোই পরিবর্তন করবেন না।]

জীবিতদের মধ্যে সবচেয়ে বুদ্ধিমান ব্যক্তিও যথার্থ পরিকল্পনা ছাড়া টাকাপয়সা অর্জনে সফল হতে পারে না। যেকোন ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করলেও সফল হতে পারে না। তাকে অবশ্যই এমন পরিকল্পনা কাজে লাগাতে হবে যা বাস্তবসম্মত এবং করা যায়। বাস্তবে যদি নাই করা যায় এমন পরিকল্পনা নিয়ে কী লাভ? যখন আপনি আপনার পরিকল্পনায় ব্যর্থ হবেন তখন এটা মনে রাখবেন যে এই ব্যর্থতা কেবল একটা সাময়িক পরাজয়। কোন চিরস্থায়ী পরাজয় নয়। এর মানে হচ্ছে আপনার পরিকল্পনা নিখুঁত ছিল না। অন্য একটি পরিকল্পনা নিন। আবার সবকিছু নতুন করে আরম্ভ করুন। আপনি পারবেন।

টমাস আলভা এডিসন বৈদ্যুতিক আলোক বাতি তৈরি করার পূর্বে ১০ হাজার বার ‘ব্যর্থ হয়েছিলেন’। তিনি সাফল্যের মুকুট পরার আগে ১০ হাজার বার সাময়িক পরাজয়ের সম্মুখীন হয়েছেন। সাফল্য অর্জন করতে গেলে এমনই হয়। পরাজয় তো আপনার লক্ষ্য না। আপনার লক্ষ্য হচ্ছে সাফল্য। তাই যতক্ষণ সাফল্য অর্জন না করছেন ততক্ষণ চেষ্টা করে যেতেই হবে।

সাময়িক পরাজয়ের কেবল একটি মানেই হওয়া উচিতÑএটা নিশ্চিত যে আপনার পরিকল্পনায় কিছু ভুল আছে। লক্ষাধিক লোক তাদের জীবন দুর্দশা এবং দরিদ্রতায় অতিবাহিত করে, কারণ তাদের নিখুঁত পরিকল্পনা তৈরির অভাব যার মাধ্যমে সৌভাগ্য অর্জিত হয়। ভুল পরিকল্পনা কি আপনাকে সৌভাগ্য এনে দিবে? নিশ্চয়ই না। আর পরিকল্পনা যে ভুল সেটা তো পরিকল্পনা কাজে লাগিয়েই জানতে এবং বুঝতে হবে। তাই পরিকল্পনা ব্যর্থ হওয়া মানে আপনি ব্যর্থ নন। এই ব্যর্থতা থেকে শিখুন এবং নতুন করে আবার পরিকল্পনা তৈরি করুন। এতে করে আপনার জয়ে সম্ভাবনা বৃদ্ধি পাবে।

হেনরি ফোর্ড একটি সৌভাগ্য অর্জন করেছেন তার উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন মস্তিষ্কের জন্য নয়; বরং তিনি সৌভাগ্য অর্জন করেছেন, কারণ তিনি একটি নিখুঁত পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন এবং তা অনুসরণ করেছেন। এর আগে অবশ্য আরও বহু পরিকল্পনা করেও তিনি ব্যর্থ হয়েছেন। সেটা কিন্তু সাধারণ মানুষ দেখবে না। এমন এক হাজার মানুষকে দেখানো যেতে পারে যারা প্রত্যেকেই ফোর্ডের চেয়ে বেশি শিক্ষিত, তবুও প্রত্যেকে দরিদ্র জীবনযাপন করছে, কারণ তারা অর্থ অর্জনের জন্য ঠিক পরিকল্পনা তৈরি করতে পারেনি।

আপনার সাফল্য কখনো মহান হতে পারে না যদি আপনার পরিকল্পনা নিখুঁত না হয়। মহান তো দূরের কথা, আপনি সফলতাই পাবেন না যদি আপনার পরিকল্পনা নিখুঁত না হয়। এটা একটা প্রমাণিত বিবৃতি। এটাই সত্য। তাই পরিকল্পনাকে নিখুঁত করতে যথেষ্ট সময় দিন। এরকম এক ঘটনা বলছি। আপনি হয়তো এ ঘটনা থেকে বুঝতে পারবেন যে নিখুঁত পরিকল্পনা কতটা জরুরি। স্যামুয়েল ইনসাল নামক এক ব্যক্তি প্রায় এক কোটি টাকা হারিয়ে তার সৌভাগ্য হারান। ইনসালের সৌভাগ্য তৈরি হয়েছিল যে ধরনের পরিকল্পনাগুলোর ওপর সেগুলো ছিল নিখুঁত। কিন্তু শেয়ারবাজার ধ্বসের কারণে অর্থনৈতিক বাজারে যে বিপর্যয় আসে তাতে জনাব ইনসাল তার ব্যবসায়িক পরিকল্পনা পরিবর্তন করতে বাধ্য হন। কিন্তু পরিবর্তনের কারণে তার ব্যবসায় ক্ষতি হয়। পরিবর্তনটি ‘সাময়িক পরাজয়’ নিয়ে আসে। কারণ তার নতুন পরিকল্পনা আগের মতো নিখুঁত ছিল না। ইনসাল এখন একজন বৃদ্ধ ব্যক্তি, তিনি হয়তো এই সাময়িক পরাজয়কে ব্যর্থতা রূপেই গ্রহণ করতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি। তিনি নতুন করে পরিকল্পনা তৈরি করেন এবং সফল হন।

[ব্যর্থতাকে মেনে নেওয়া মানে আর চেষ্টা না করা। আর আপনি যদি ব্যর্থতাকে সাময়িক পরাজয় হিসাবে চিন্তা করেন তবে আপনি আবার চেষ্টা করার সাহস পাবেন। যদিও ব্যর্থতা এবং সাময়িক পরাজয় উভয়ই সমার্থক শব্দ বলে মনে হয়, আসলে তা নয়! কারণ ব্যর্থতা বললে মনে হয় একদম শেষ, সামনে বিশাল দেওয়াল। যাওয়ার কোন রাস্তা নেই। কিন্তু সাময়িক পরাজয় বললে মনে হয়, না এখন পড়ে গেছি কিন্তু আবার উঠতে হবে, চলতে হবে। যদিও সামনে বিশাল দেওয়াল, যাওয়ার কোন রাস্তা নেই। তবুও দেখি তো ঘুরে যাওয়ার কোন রাস্তা পাই কিনা। এই ঘুরে যাওয়ার রাস্তা খোঁজা বা আরও একবার চেষ্টা করার প্রবণতাই তৈরি করে সাময়িক পরাজয় শব্দটি। এখানেই ব্যর্থতার সাথে সাময়িক পরাজয় শব্দের পার্থক্য। তাই কখনোই বলবেন না আমি ব্যর্থ হয়েছি, বলবেন আমি সাময়িক পরাজয়ের সম্মুখীন হয়েছি।]

কোন মানুষই কখনো হেরে যায় না, যতক্ষণ পর্যন্ত না সে তার নিজের মনের মধ্যে চেষ্টা করার ইচ্ছা ত্যাগ করে। যার মধ্যে সফল না হওয়া পর্যন্ত চেষ্টা করে যাওয়ার ইচ্ছা বিদ্যমান সে কখনো হেরে যায় না। আর চেষ্টা করে যাওয়ার ইচ্ছাকে বজায় রাখে একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য।

এই ব্যাপারটির পুনরাবৃত্তি হবে অনেকবার। কারণ মানুষ যখন কোন লক্ষ্যে বা উদ্দেশ্যে কাজ করে তখন তাদের সামনে কোন বাধা এলে বা তারা সাময়িক পরাজয়ের সম্মুখীন হলে, লক্ষ্য বা উদ্দেশ্যটি ছুঁড়ে ফেলে দেয়। তারা আর চেষ্টা করে না। যেখানে মানুষ পরিকল্পনা পরিবর্তন করবে সেখানে তারা লক্ষ্যকেই বদলে ফেলে এবং বাকি জীবন অজুহাত দিয়ে যায়।

যখন জেমস জে. হিল পূর্ব দিক থেকে পশ্চিম দিকে একটি রেললাইন তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় মূলধন উঠাত যান তখন তিনি সাময়িক পরাজয়ের সাক্ষাৎ পান। কিন্তু তিনি তার অধ্যবসায়ের আগুন দিয়ে নতুন পরিকল্পনা তৈরি করেন এবং পরাজয়কে পুড়িয়ে বিজয়ে পরিণত করেন।

হেনরি ফোর্ড শুধু তার গাড়ি তৈরির শুরুতেই সাময়িক পরাজয়ের সাক্ষাৎ পাননি; বরং যখন তিনি চূড়ার নিকটবর্তী ছিলেন তখনও সাময়িক পরাজয়ের সম্মুখীন হন। তিনি নতুন পরিকল্পনা তৈরি করেন এবং আর্থিক বিজয়ের পথে স্বগর্বে এগিয়ে যান।

আমরা যখন সফল মানুষদের দেখি তখন কেবল তাদের জাঁকজমকপূর্ণ অবস্থাই দেখি। আজকের এই সাফল্যের চূড়ায় পৌঁছানোর পূর্বে তাদের জীবনে যে কত শত সাময়িক পরাজয় ঘটেছে তা আমরা উপেক্ষা করি।

আমাদের এই দর্শনের কোন অনুসারী সাময়িক পরাজয়ের অভিজ্ঞতা নেওয়া ব্যতীত একটি সৌভাগ্য অর্জন করার আশা করতে পারে না। যখন পরাজয় আসে তখন এটাকে একটা সংকেত রূপে গ্রহণ করুন যে আপনার পরিকল্পনা নিখুঁত নয়। পুনরায় নতুন পরিকল্পনা তৈরি করুন এবং আরও একবার আপনার কাক্সিক্ষত লক্ষ্যের দিকে পাল ঠিক করুন। যদি আপনি আপনার লক্ষ্যে পৌঁছানোর পূর্বেই হাল ছেড়ে দেন, নিজের লক্ষ্যকে ত্যাগ করেন তবে আপনি হচ্ছেন একজন ‘পরাজিত ব্যক্তি’। পরিবেশ, পরিস্থিতি, সমস্যা বা কোন বাধাই আপনাকে পরাজিত করেনি; বরং আপনি নিজের লক্ষ্যকে ত্যাগ করে নিজেই নিজেকে পরাজিত করেছেন।






এই বাক্য বুঝুন, এক টুকরা কাগজে এক ইঞ্চি বড় করে লিখে রাখুন এবং এমন জায়গায় স্থাপন করুন যাতে প্রত্যেক রাতে আপনি ঘুমাতে যাওয়ার পূর্বে দেখতে পান এবং প্রত্যেক সকালে কাজে যাওয়ার সময় দেখতে পান।

আপনি যখন আপনার ‘ঐক্যমন দলের’ সদস্য নির্বাচন করবেন তখন চেষ্টা করবেন এমন মানুষদের নির্বাচন করতে যারা পরাজয়কে গুরুতরভাবে নেয় না।

কিছু লোক বোকাভাবে বিশ্বাস করে যে শুধু টাকাই পারে টাকা তৈরি করতে। এটা সত্য নয়! এখানে বর্ণিত সূত্রের মাধ্যমে একজন তার আকাক্সক্ষাকে এর আর্থিক সমতুল্যে রূপান্তর করতে পারে। টাকাপয়সা জড় পদার্থ ছাড়া আর কিছুই নয়। এটা না চলতে পারে, না চিন্তা করতে পারে, না কথা বলতে পারে, কিন্তু এটা সেই ব্যক্তির ডাক ‘শুনতে পায়’ যে ব্যক্তি একে আকাক্সক্ষা করে!


নিজের দক্ষতা বিক্রয়ের জন্য পরিকল্পনা

এই অধ্যায়ে আপনাকে আবার মনে করিয়ে দেওয়া হচ্ছে যে কীভাবে আপনি আপনার ব্যক্তিগত দক্ষতাকে বাজারজাত করতে পারেন। সম্ভাব্য যত পথ আছে সব পথই আপনার সামনে তুলে ধরা হবে। এখানে যে তথ্যাবলির বর্ণনা দেওয়া হয়েছে তা পুরোপুরি বাস্তবে ব্যবহারযোগ্য। আপনি আপনার ব্যক্তিগত দক্ষতা বাজারজাত করতে পারবেন। কিন্তু এই তথ্যাবলির দ্বারা সবচেয়ে বেশি মুনাফা লাভ করবে তারাই যারা তাদের নিজ নিজ পেশায় নেতৃত্ব দিতে চাইবে।

ধনসম্পদ অর্জনের জন্য বুদ্ধিমান পরিকল্পনা তৈরি করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এখানে সেই পদ্ধতি এবং দিক-নির্দেশনা দেওয়া হবে যাতে করে একজন তার নিজের ব্যক্তিগত দক্ষতার মাধ্যমে ধনী হতে পারে।

এটা জেনে আপনারা উৎসাহিত হবেন যে বাস্তবে যারা বিশাল সৌভাগ্যের অধিকারী হয়েছে তারা তাদের কর্মজীবনের শুরু করেছিল ব্যক্তিগত দক্ষতার বিনিময়ে অথবা আইডিয়া বিক্রি করে। ধনী হওয়ার বিপরীতে একজন ব্যক্তি ব্যক্তিগত দক্ষতা বা আইডিয়া ছাড়া আর কী সম্পদ দিতে পারে?

[ব্যক্তিগত দক্ষতার বিনিময়ে সৌভাগ্য অর্জন করা যায়। যেমন প্রকৌশলী মো. আব্দুল আউয়াল। তিনি বর্তমানে দ্য স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। তিনি ১৯৮৩ সালে এই কোম্পানি চালু করেন। কিন্তু এরও আগে তিনি প্রকৌশলী হিসাবে একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করেছেন এবং প্রথম ব্যবসা আরম্ভ করার আগে ৬ বছর যাবৎ বিভিন্ন ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানিতে চাকরি করে অভিজ্ঞতা নিয়েছেন। অনুবাদক হিসাবে আমি নিজেই তার সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। তো এটা হচ্ছে ব্যক্তিগত দক্ষতার বিনিময়ে সৌভাগ্য অর্জন করার একটি ভালো উদাহরণ।

আইডিয়া বিক্রয়ের মাধ্যমে সৌভাগ্য অর্জন করা যায়। আইডিয়া বা ধারণা বিক্রয়ের কথা উঠলেই আমার প্রথম মনে পড়ে ওয়াল্টন গ্রুপের কথা। তাদের স্লোগান হল আমাদের পণ্য। আমি যখনই ওয়াল্টন দেখি তখনই আমাদের পণ্য শব্দটি আমার মনে ভেসে ওঠে। এতে করে আমি বাংলাদেশ সম্পর্কে একটি গর্ব অনুভব করি যে আমাদের পণ্য, আমাদের কোম্পানি। আপন বলে বোধ হয়। ঠিক এটাই হচ্ছে আইডিয়া বিক্রয়। ওয়াল্টন আমার কাছে পণ্য বিক্রয়ের আগে একটি আইডিয়া বিক্রয় করেছে যে এই ধারণা আমার মধ্যে গর্ববোধ তৈরি করে, আপন বোধ তৈরি করে। এভাবে ওয়াল্টন আইডিয়া বিক্রির মাধ্যমে নিজের জন্য বিশাল এক সৌভাগ্য অর্জন করে নিয়েছে।]

সত্যি বলতে, এই পৃথিবীতে ২ রকমের লোক রয়েছে। এক রকম যারা পরিচিত নেতা রূপে এবং অন্যরা পরিচিত অনুসারী রূপে। প্রথমে সিদ্ধান্ত নিন যে আপনি কী হতে চান। আপনি কি আপনার পেশায় একজন নেতা হতে চান; নাকি একজন অনুসারীই থাকতে চান? এদের মধ্যে বিনিময় মূল্যের পার্থক্য কিন্তু খুব বিশাল। একজন নেতা যে ধনসম্পদ বা অন্য যেকোন বিনিময় মূল্য পায়, একজন অনুসারী কিন্তু সেই রকম বিনিময় মূল্য পাওয়ার আশা করতে পারে না। যদিও অনেক অনুসারীই এমন বিনিময় মূল্য পাওয়ার প্রতি অযৌক্তিকভাবে আশা করে। এখানেই একজন অনুসারী ভুল করে।

একজন অনুসারী হওয়া কোন অসম্মানজনক ব্যাপার নয়। আবার একজন অনুসারী হয়ে থাকার মধ্যে কোন খ্যাতিও নেই। বেশির ভাগ মহান নেতা শুরু করেছে অনুসারীদের জায়গা থেকে। তারা মহান নেতা ছিল কারণ তারা ছিল বুদ্ধিমান অনুসারী। কিছু ব্যতিক্রম ব্যতীত, যে ব্যক্তি একজন নেতাকে বুদ্ধিমত্তার সাথে অনুসরণ করতে পারে না, সে একজন দক্ষ নেতা হয়ে উঠতে পারে না। যে ব্যক্তি একজন নেতাকে সবচেয়ে বেশি দক্ষভাবে অনুসরণ করতে পারে, সাধারণত সেই সবচেয়ে দ্রুত নেতৃত্বের গুণাবলি গঠন করে। একজন বুদ্ধিমান অনুসারীর অনেক সুবিধা আছে। এগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে নেতার কাছ থেকে জ্ঞান অর্জনের সুযোগ। সেই বুদ্ধিমান অনুসারী যে এই সুযোগকে কাজে লাগায়।


নেতৃত্বের প্রধান গুণাবলি

নিচের ব্যাপারগুলো নেতৃত্বের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ:

১. স্থির সংকল্প ও সাহস। স্থির সংকল্প ও সাহস গঠিত হয় আত্ম-জ্ঞান এবং নিজ পেশা সম্পর্কে জ্ঞান থাকলে। কোন অনুসারীই চায় না এমন একজন নেতা কর্তৃক শাসিত হতে যে আত্ম-বিশ্বাস এবং সাহসের অভাবে ভুগছে। কোন বুদ্ধিমান অনুসারী এমন একজন নেতার কর্তৃত্ব বেশি দিন মেনে চলবে না।

২. আত্ম-নিয়ন্ত্রণ। যে ব্যক্তি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না, সে কখনো অন্যদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। একজন নেতার পক্ষ থেকে তার অনুসারীদের জন্য আত্ম-নিয়ন্ত্রণ একটি শক্তিশালী উদাহরণ। এই উদাহরণ প্রতিষ্ঠা করাই নেতার কাজ।

৩. ন্যায়বিচার সম্পর্কে তীক্ষ্মধার অনুভূতি। ন্যায়বিচার ও ন্যায্যতার অনুভূতি ব্যতীত কোন নেতা তার অনুসারীদের সম্মান পেতে এবং চালনা করতে পারে না।

৪. সিদ্ধান্তের স্থিরতা। যে ব্যক্তি তার সিদ্ধান্তে নড়বড়ে, দেখা যায় সে তার নিজের ওপরও নিশ্চিত নয়। সে কখনো অন্যদের সফলভাবে নেতৃত্ব দিতে পারে না।

৫. পরিকল্পনার স্থিরতা। একজন সফল নেতা অবশ্যই তার কাজের পরিকল্পনা করবে এবং তার পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করবে। একজন নেতা যে অনুমান দ্বারা চলে, বাস্তবিক ও নির্দিষ্ট পরিকল্পনা ব্যতীত চলে তাকে তুলনা করতে হয় একটি পাল ছাড়া নৌকার সাথে। আগে বা পরে হোক সে পাথরের সাথে ধাক্কা খাবেই।

৬. বিনিময় মূল্যের বেশি কাজ করার অভ্যাস। নেতৃত্বের অভাবের কারণগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে আকাক্সক্ষার প্রয়োজনীয়তা। একজন নেতা তার অনুসারী থেকে যে কাজ চান প্রথমে নেতাকে তারচেয়ে বেশি কাজ করে দেখাতে হবে। তবেই অনুসারীরা নেতাকে অনুসরণ করবে।

৭. একটি আনন্দদায়ক ব্যক্তিত্ব। কোন অপরিচ্ছন্ন যতœহীন ব্যক্তি সফল নেতা হতে পারে না। পরিচ্ছন্নতা মানে আপনি নিজের প্রতি যতœশীল এবং অন্যদের প্রতিও যতœশীল হবেন। এই পরিচ্ছন্নতাই আনে সম্মান। অনুসারীরা সেই নেতাকে সম্মান করে না যে সব ব্যাপারে উঁচু পর্যায়ের একটি আনন্দদায়ক ব্যক্তিত্বের অধিকারী না হয়।

৮. সহানুভূতি এবং বুঝজ্ঞান। একজন সফল নেতা অবশ্যই তার অনুসারীদের সহানুভূতি প্রকাশ করবে। অধিকন্তু, তিনি অবশ্যই তাদের বুঝবে এবং তাদের সমস্যা অনুধাবন করবে।

৯. পুঙ্খানুপুঙ্খ রূপে দক্ষ। সফল নেতৃত্ব হচ্ছে নেতার অবস্থান বা দায়িত্ব সম্বন্ধে পুঙ্খানুপুঙ্খ রূপে দক্ষ এবং জ্ঞাত।

১০. পূর্ণ দায়িত্ব গ্রহণ করার আকাক্সক্ষা। সফল নেতাকে অবশ্যই তার অনুসারীদের ভুলের জন্য এবং ঠিক পথে না চলার জন্য দায়িত্ব গ্রহণ করার মানসিকতা থাকতে হবে। যদি সে এই দায়িত্ব বদল করার চেষ্টা করে, সে নেতা হিসাবে থাকবেন না। যদি তার কোন অনুসারী একটি ভুল করে এবং নিজেকে অযোগ্য দেখায় তবে নেতাকে অবশ্যই বিবেচনা করতে হবে যে অনুসারী নয়; বরং সে নিজে ব্যর্থ হয়েছে।

১১. সহযোগিতা। একজন সফল নেতাকে অবশ্যই সকলে মিলে কাজ করার সুবিধা-অসুবিধা বুঝতে হবে, প্রয়োগ করতে হবে এবং অনুসারীদেরকে এর সাথে পরিচিত করাতে হবে যাতে তারাও একই রূপ করতে পারে। নেতৃত্ব আনে ক্ষমতা এবং ক্ষমতা আসে সহযোগিতা থেকে।

বিশ্বে ২ প্রকারের নেতৃত্ব আছে। প্রথমটি ও এখন পর্যন্ত সবচেয়ে কার্যকরী হচ্ছে মতের একতা দ্বারা নেতৃত্ব এবং অনুসারীদের সহানুভূতির সাথে নেতৃত্ব। দ্বিতীয়টি হচ্ছে বল দ্বারা নেতৃত্ব, মতের একতা ও অনুসারীদের সহানুভূতি ব্যতীত নেতৃত্ব।

ইতিহাসে এমন অনেক উদাহরণ আছে যে বল দ্বারা নেতৃত্ব স্থায়ী হয় না। ‘স্বৈরশাসকদের’ ও রাজাদের অধঃপতন এবং তাদের অস্তিত্বের বিলুপ্তি হচ্ছে এরই প্রমাণ। এর মানে হচ্ছে যে লোকজন অনির্দিষ্ট কালের জন্য বল প্রয়োগের নেতৃত্ব অনুসরণ করবে না।

বিশ্ব কেবল প্রবেশ করেছে নেতাদের এবং অনুসারীদের সম্বন্ধের মধ্যকার একটি নতুন যুগে, যেখানে খুব পরিষ্কারভাবে নতুন নেতাদের ডাক এসেছে এবং ব্যবসা ও কারখানার প্রতি এক নতুন ধরনের নেতৃত্বের ডাক এসেছে। তারা যারা বল-দ্বারা-নেতৃত্বের পুরাতন বিদ্যালয়ে রয়েছে, তাদেরকে অবশ্যই এই নতুন ধরনের নেতৃত্বের একটি বুঝজ্ঞান অর্জন করতে হবে অথবা তারা অনুসারীদের সারি ও নথি থেকে হারিয়ে যাবে। তাদের যাবার জন্য অন্য কোন পথ নেই।

ভবিষ্যতে নিয়োগকর্তা ও নিয়োগকর্মীর মধ্যকার এই সম্বন্ধ অথবা নেতা ও অনুসারীর মধ্যকার এই সম্বন্ধ হবে একটি পারস্পরিক সহযোগিতার সম্বন্ধ, একটি সমান ভাগে ব্যবসার মুনাফা ভাগ করার ভিত্তির ওপর। ভবিষ্যতে, নিয়োগকর্তা ও নিয়োগকর্মীর মধ্যকার সম্বন্ধ পূর্বের চেয়ে বেশি হারে অংশীদারিত্বের সম্বন্ধে পরিণত হবে।

নেপোলিয়ন বোনাপার্ট, জার্মানীর কাইজার উইলহেলম, রাশিয়ার সিজার এবং স্পেনের রাজা হলেন বল দ্বারা নেতৃত্বের উদাহরণ। তাদের নেতৃত্ব চলে গেছে। কোন কষ্ট ব্যতীত, একজন হয়তো এই প্রাক্তন নেতাদের মধ্য থেকে সেই গুণ খুঁজে পাবে, যেমন আমেরিকার ব্যবসা, অর্থায়ন ও শ্রমিক নেতাদের মধ্যে যাদের এই গুণ ছিল তাদের সিংহাসনচ্যূত করা হয়েছে বা টেনে বের করে দেওয়ার জন্য নামানো হয়েছে। মতের একতা দ্বারা নেতৃত্ব হচ্ছে একমাত্র প্রকার যা অবিচলিতভাবে এগিয়ে যেতে পারে!

সাধারণ লোকজন বা অনুসারীরা হয়তো একজন নেতার বল দ্বারা নেতৃত্ব কিছুকাল মেনে চলবে। কিন্তু লোকজন কখনোই স্বেচ্ছায় বল দ্বারা নেতৃত্বকে মানবে না। এক সময় না এক সময় তারা বিদ্রোহ করবেই। তখন চারদিকে আগুন জ্বলে উঠবে।

নেতৃত্বের এই নতুন প্রকার এই অধ্যায়ে বর্ণিত ১১টি সূত্রই আলিঙ্গন করে। মতের একতা দ্বারা নেতৃত্ব দিলে অন্যান্য ব্যাপারও ঠিক থাকে। যে ব্যক্তি এই ১১টি সূত্রের ভিত্তিতে তার নেতৃত্বের গুণ তৈরি করে সে জীবনের যেকোন পদে নেতৃত্ব দেওয়ার প্রচুর সুযোগ খুঁজে পায়। পৃথিবীতে অর্থনৈতি বিপর্যয় ঘটার অন্যতম কারণ হচ্ছে বিশ্ব অর্থনীতি এই নতুন প্রকারের নেতৃত্বের অভাববোধ করে। কিছুদিন আগে ঘটে যাওয়া (১৯২৯ সালের শেয়ার মার্কেটের ধ্বস) বিশ্ব অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের শেষের দিকে নেতাদের চাহিদা অনেক বেড়ে যায়। যারা নেতৃত্বের নতুন পদ্ধতি প্রয়োগের প্রতি দক্ষ তারাই এই পদে দায়িত্ব নিতে পারবে। কিছু পুরাতন প্রকারের নেতা নিজেদের পুনর্গঠন করবে এবং নেতৃত্বের নতুন প্রকারের প্রতি খাপ খাওয়াতে চেষ্টা করবে। কিন্তু সত্যি বলতে গেলে, বিশ্ব খুঁজবে একটি নতুন নেতৃত্ব, নতুন নেতা। এই প্রয়োজনীয়তা হতে পারে আপনার সুযোগ!


নেতৃত্বে ব্যর্থতার ১০টি প্রধান কারণ

আমরা এখন প্রধান ভুল নিয়ে আলোচনা করব। যে ভুলের কারণে নেতারা ব্যর্থ হয়ে থাকে। কারণ কী করতে হয় না এটা জানা ততই গুরুত্বপূর্ণ যতটা কী করতে হয় জানা।

১. তথ্য সংগ্রহে অক্ষমতা। দক্ষ নেতৃত্ব হচ্ছে সংগঠিত করার সক্ষমতা এবং তথ্যের পূর্ণতা। কোন প্রকৃত নেতা কখনো এমন কিছুর প্রতি ‘অনেক ব্যস্ততা’ দেখায় না যেখানে তার নেতা রূপে থাকা প্রয়োজন। যখন একজন ব্যক্তি সে নেতা হোক বা অনুসারী হোক তার পরিকল্পনার পরিবর্তনে ‘অনেক ব্যস্ততা’ দেখায় বা কোন জরুরি ব্যাপারে মনোযোগী হয় না, তখন সে তার অদক্ষতারই পরিচয় দেয়। একজন সফল নেতা অবশ্যই তার অবস্থানের সাথে সম্পৃক্ত সব বিষয়ে দক্ষ হবে। এর মানে সে অবশ্যই সক্ষম কর্মকর্তাদের কাছ থেকে সব রকম তথ্য সংগ্রহ করবে এবং যোগ্য ব্যক্তিকে প্রয়োজনীয় পদে বসাবে।

২. বিনীত সেবা প্রদানে অনিচ্ছা। মহান নেতাদের আকাক্সক্ষাই প্রকৃত সত্য। যখন অবস্থা প্রয়োজনে যেকোন ধরনের শ্রম দিতে হয়, তারা পরিশ্রম দিতে রাজি এবং কাজ করে দেখায়। যদিও তা অন্য কাউকে দিয়ে করানো যেত তবুও তারা নিজেরাই কাজটি করে। ‘সবার মধ্যে সেই মহান যে সকলের সেবা করে।’ সকল নেতার এই সত্যকে অনুধাবন করা দরকার এবং মেনে চলা উচিত।

৩. লোকজন কী ‘জানে’ এর মূল্য দেওয়ার পরিবর্তে তারা যা জানে তা দিয়ে কী ‘করে’ তার মূল্য পরিশোধ করা। পৃথিবী সেসব ব্যক্তির মূল্য দেয় না যারা ‘জানে’। পৃথিবী কেবল তাদেরই মূল্য দেয় যারা তাদের জানা জ্ঞান দ্বারা অন্যদের উৎসাহিত করে। কেবল জানাই যথেষ্ট নয়, সেই জানা জ্ঞান দ্বারা কাজ করে দেখানোই মূল্যবান।

৪. অনুসারীদের সাথে প্রতিযোগিতার ভয়। যে নেতা ভয় পায় যে তার অনুসারীদের মধ্যে কেউ একজন তার স্থান নিতে পারে, বাস্তবে তা শীঘ্রই ঘটবে। সক্ষম নেতাকে অবশ্যই তার নিম্ন পদস্থদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে যাতে করে সে তাকে প্রতিনিধি রূপে নিজের আকাক্সক্ষায় যেকোন অবস্থানে বসাতে পারে। একমাত্র এভাবেই একজন নেতা নিজেকে বহু গুণে এবং জায়গায় প্রসারিত করতে পারে। এভাবে একজন নেতা ঠিক একই সময় বিভিন্ন মানুষের চেতনায়, কাজে-কর্মে উপস্থিত থাকতে পারে। যেসব ব্যক্তি অন্যদের দিয়ে কাজ করানোর সক্ষমতা অর্জন করেছে তারা অন্যদের চেয়ে অনেক বেশি বেতন পায়। এটা একটা চরম সত্য। অন্যদের দিয়ে কাজ করানোর দক্ষতা একটা মূল্যবান সম্পদ। একজন দক্ষ নেতা হয়তো, তার কাজ সম্বন্ধে তার জ্ঞান ও তার ব্যক্তিত্বের চুম্বকত্ব দ্বারা অন্যদের দক্ষতা অনেক পরিমাণ বৃদ্ধি করতে পারে এবং তাদেরকে আরও সেবা প্রদান করতে এবং অধিকতর ভালো সেবা দিতে প্রভাবিত করতে পারে যা হয়তো তারা নেতার উৎসাহ ও সহায়তা ছাড়া পারতো না।

৫. কল্পনার অভাব। কল্পনা ব্যতীত একজন নেতা জরুরি সভা করতে অক্ষম এবং পরিকল্পনা তৈরিতেও অক্ষম যার দ্বারা তার অনুসারীদের দক্ষভাবে পরিচালিত করবে।

৬. স্বার্থপরতা। যে নেতা সব ধরনের পুরস্কারের প্রতি দাবি জানায় যা তার অনুসারীরাও করেছে, সে নিশ্চিতভাবে নির্বাসনে প্রেরিত হবে। একজন প্রকৃত নেতা কোন পুরস্কার দাবি করে না। সে পুরস্কার দেখেই সন্তুষ্ট। যখন কোন পুরস্কার দেখে তা তার অনুসারীদের হাতে তুলে দেয়, কারণ সে জানে যে বেশির ভাগ মানুষই কঠিন পরিশ্রম করে প্রশংসার জন্য এবং তাকে যেন অন্যরা স্মরণ রাখে। একজন লোক টাকা পেলে যে কাজ করত তারচেয়ে অনেক বেশি কাজ করবে এই প্রশংসা বা অন্যের চিন্তায় স্মরণীয় হয়ে থাকার জন্য।

৭. অসংযম। অনুসারীরা কখনো একজন অসংযমী নেতাকে শ্রদ্ধা করে না। অধিকন্তু, যে ব্যক্তি তার অসংযমকে প্রশয় দেয় তার মধ্যকার সব সহ্যশক্তি এবং জীবনীশক্তি ধ্বংস হয়ে যায়। এটা যেকোন ব্যবসা বা উদ্যোগের জন্যও সমান সত্য।

৮. অবিশ্বস্ত। এটা হয়তো তালিকার একদম উপরে থাকা উচিত ছিল। একজন নেতা যিনি তার সহযোগী এবং কর্মচারীদের প্রতি আস্থাশীল নয়, তার উপরে যারা আছেন এবং তার নিচে যারা আছেন, কেউই বেশি সময় তার নেতৃত্ব মেনে নিতে পারে না। অবিশ্বস্ততা ধুলোবালির মতো। যার মধ্যে অবিশ্বস্ততা বিরজমান সে ধুলোবালির মতো সহজেই উড়ে যায়। কোথাও টিকতে পারে না। এই বিশ্বস্ততাই তার মাথাকে অপমানে নিচে নিয়ে আসে যার সে যোগ্য। আমাদের জীবনে ব্যর্থতার একটি অন্যতম প্রধান কারণ বিশ্বস্ততার অভাব।

৯. নেতৃত্বের ‘কর্তৃত্বের’ ওপর অধিক জোর দেওয়া। ‘আমি নেতা বা আমি মালিক। আমার কথাই তোমাকে মানতে হবে।’ এই ধরনের বক্তব্য একজন অদক্ষ নেতার পরিচায়ক। একজন দক্ষ নেতা পরিচালিত হন উৎসাহ দ্বারা এবং এটা নয় যে তার অনুসারীদের মনে ধীরে ধীরে ভয় প্রবেশ করিয়ে নেতৃত্ব দিবে। যে নেতা তার অনুসারীদের ‘কর্তৃত্বের’ ভয় দেখানোর চেষ্টা করে সে বল দ্বারা নেতৃত্বের প্রকারে পড়ে। যদি একজন নেতা, একজন প্রকৃত নেতাই হয়, তবে তার বিজ্ঞাপন দেওয়ার কোন প্রয়োজন নেই। শুধু তার আচরণ ব্যতীত। তার আচরণই বলে দিবে সে নেতৃত্বের কোন প্রকারে পড়ে। সে সহানুভূতি, বুঝজ্ঞান, ন্যায্যতা এবং জনমতের প্রকাশ সম্বন্ধে জানে যে এটা তার দায়িত্ব, এটা তার কাজ।

১০. পদবির ওপর জোর দেওয়া। অনুসারীদের সম্মান পেতে হলে একজন যোগ্য নেতার কোন ‘পদবি’র প্রয়োজন হয় না। যে ব্যক্তি তার পদবির ওপর খুব বেশি জোর দেয় সে সাধারণত নাম সর্বস্বই থাকে। প্রকৃত নেতার অফিসের দরজা সবসময় খোলা থাকে তাদের জন্য যারা প্রবেশ করতে চায় এবং তার কাজের অংশ লৌকিকতা বা বাহ্যাড়ম্বর থেকে মুক্ত।

নেতৃত্বে ব্যর্থতার কারণসমূহের মধ্যে এগুলো হচ্ছে বেশি সাধারণ। ব্যর্থতা ঘটাতে এই ভুলগুলোর যেকোন একটিই যথেষ্ট। তালিকাটি মনোযোগের সাথে পর্যবেক্ষণ করুন। যদি আপনি নেতৃত্বের প্রতি আগ্রহী হন তবে আগে নিশ্চিত হোন যে আপনি এই ভুল থেকে মুক্ত।


এমন কিছু উর্বর জায়গা যেখানে ‘নতুন নেতৃত্ব’ দরকার

এই অধ্যায় ত্যাগ করার পূর্বে, আপনার মনোযোগ দিন এমন কিছু উর্বর জায়গার ওপর যেখানে নেতৃত্বের হ্রাস ঘটেছে এবং যেখানে এক নতুন প্রকারের নেতা প্রচুর সুযোগ খুঁজে পাবে।

প্রথমত। রাজনৈতিক ক্ষেত্র যেখানে নতুন নেতাদের জন্য একটি অত্যন্ত জরুরি চাহিদা রয়েছে। এই চাহিদা নির্দেশ করে যে এখনই এই ক্ষেত্রে অভিনব নেতা দরকার, নতুন নেতৃত্ব দরকার। ব্যাপারটি একেবারে সংকটে গিয়ে পৌঁছেছে। বেশির ভাগ রাজনীতিবিদরা হচ্ছে উচ্চ শ্রেণির আইন অনুমোদিত মাস্তান। যে মাস্তান ক্ষতি করার ভয় দেখিয়ে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে টাকা আদায় করে। অন্তত বাহ্যিক দিক থেকে দেখলে তো তাদের মাস্তানের মতোই লাগে। তারা তেল-গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি করেছে এবং লোকজনকে সৎ পথ থেকে প্রলোভন দেখিয়ে বিপথে নিয়ে গেছে। ব্যবসা ও কারখানাকে লাইসেন্সের নামে হয়রানি করেছে এবং অতিরিক্ত বোঝা এদের ওপর চাপিয়ে দিয়েছে যাতে লোকজন বোঝার ভারে কখনো উঠে দাঁড়াতে না পারে। প্রতিবাদ তো দূরের কথা।

দ্বিতীয়ত। ব্যাংকিং ক্ষেত্র একটি পুনর্গঠনের দিকে যাচ্ছে। এই ক্ষেত্রের নেতারা প্রায় সম্পূর্ণভাবে জনগণের বিশ্বাস হারিয়েছে। ইতোমধ্যে ব্যাংক কর্মকর্তাগণ পুনর্গঠনের অনুভূতি পাচ্ছে এবং তারা এটা আরম্ভ করেছে।

তৃতীয়ত। শিল্প-কারখানাগুলো নতুন নেতাদের ডাকছে। পুরাতন ধরনের নেতাদের চিন্তা ও চালচলন ছিল লভাংশের ভিত্তিতে। কিন্তু বর্তমানে ব্যবসা ও কারখানায় নতুন চিন্তার আর্বিভাব ঘটেছে। এটা হচ্ছে মানুষকে সমান ভিত্তিতে চিন্তা করবে এবং চলবে। কেবল লভাংশের ভিত্তিতেই চিন্তা করবে না। ভবিষ্যতের শিল্প-কারখানার নেতারা দুঃখকষ্টে অবিচলিত থাকবে। তারা অবশ্যই নিজেকে বিবেচনা করবে যেন জনগণের একজন সেবাকারী হিসাবে। যাদের দায়িত্ব হচ্ছে তাদের বিশ্বাস এমনভাবে তৈরির ব্যবস্থা করা যে এটা কখনো অন্যায়ভাবে কোন স্বতন্ত্র ব্যক্তির ওপর বা কোন স্বতন্ত্র গোষ্ঠীর ওপর চাপিয়ে দেওয়া হবে না। মানুষের ওপর শোষণ, অধিক খাটিয়ে অল্প মজুরি দান, এগুলো হচ্ছে অতীতের বিষয়। যে মানুষ নিজের আগ্রহ থেকে ব্যবসা, কারখানা ও শ্রমখাতে নেতৃত্ব দেওয়ার আকাক্সক্ষা পোষণ করে সে অবশ্যই এটা স্মরণ রাখবে।

চতুর্থত। ভবিষ্যতের ধর্মীয় নেতারা তাদের অনুসারীদের ইহজীবনের প্রয়োজনগুলোর প্রতি, তাদের বর্তমান আর্থিক ও ব্যক্তিগত সমস্যাগুলো সমাধানের প্রতি বেশি মনোযোগ দিতে বাধ্য হবে এবং কম মনোযোগ দিবে মৃত্যু পরবর্তী সময়ের প্রতি এবং যে ভবিষ্যত জন্ম হয়নি তার প্রতি। ধর্ম কেবল মৃত্যু পরবর্তী জান্নাতে যাওয়ার টিকেট বিক্রির ব্যবসা নয়; বরং ধর্ম যে মানুষের পৃথিবীগত সমস্যারও সমাধান দিতে পারেÑঠিক এই ব্যাপারই ভবিষ্যতের ধর্মীয় নেতার বুঝতে সক্ষম হবে।

পঞ্চমত। আইন, ঔষধ ও শিক্ষা পেশাগুলোতে একটি নতুন ধরনের নেতৃত্ব গড়ে উঠবে এবং আরও কিছু ক্ষেত্রে, নতুন নেতাদের একটি প্রয়োজনীয়তা জরুরি হয়ে উঠবে। এটা বিশেষত শিক্ষাখাতের জন্য সত্য। এই খাতের নেতারা অবশ্যই ভবিষ্যতে এমন সব পথ ও উপায় খুঁজে পাবে যে ছাত্রছাত্রীরা তাদের জ্ঞানকে জীবনে কাজে লাগাবে। তারা এমন এমন পদ্ধতি বের করবে যাতে করে ছাত্রছাত্রীরা বিদ্যালয়ে বসে বসে কেবল বই মুখস্তই করবে না; বরং কাজের দ্বারা শিখবে, জ্ঞানের প্রয়োগ শিখবে। তারা আরও বেশি কাজের দ্বারা শেখার প্রতি গুরুত্ব দিবে এবং কেবল মুখস্ত করে যাওয়াটা ধীরে ধীরে কমে যাবে।

ষষ্ঠত। নতুন নেতাদের প্রয়োজন হবে সাংবাদিকতায়। সংবাদপত্রের ভবিষ্যৎ সফলভাবে পরিচালিত হবে নতুন নেতাদের দ্বারা। যারা রাজনৈতিক দল বা কোন বিশেষ অর্থনৈতিক গোষ্ঠীর কাছ থেকে ‘বিশেষ সুবিধা’ নিয়ে তাদের হয়ে কাজ করবে না। যারা সংবাদপত্রকে বিজ্ঞাপনের অত্যাচার থেকে রক্ষা করবে। আজকে যেমন তারা বিভিন্ন সংগঠনের সমর্থন লাভের জন্য সংবাদ, প্রতিবেদন বা শিরোনাম তৈরি করে, ভবিষ্যতের নেতারা তা করবে না। ভবিষ্যতের নেতারা এ ধরনের চাটুকারিতা বর্জন করবে। অন্য যেসব সংবাদপত্র মানুষের সমালোচনা নিয়ে মুখরিত এবং অশ্লীল ছবি ছাপিয়ে মানব মনকে বিপথে নিয়ে যায় তারাও পর্যায়ক্রমে হারিয়ে যাবে।

এই দেশে কিন্তু কাজের প্রচুর সুযোগ। এখানে অল্প কয়েকটি মূল জায়গার উল্লেখ করা হলো মাত্র যেখানে নতুন নেতা দরকার এবং একটি নতুন ধরনের নেতৃত্ব এখানে সহজলভ্য। বিশ্ব এখন দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে। এর মানে পরিবর্তনের সাথে সাথে মানুষের মানসিকতাও খুব দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে। যে নেতা হতে চায় তাকে অবশ্যই এই পরিবর্তনের সাথে খাপ খাওয়াতে হবে। এখানে যে ব্যবস্থা সম্পর্কে বর্ণনা করা হলো একমাত্র এই ধরনের ব্যবস্থাই সভ্যতার ধারা নিশ্চিত করবে।


একটি পদের জন্য কখন এবং কীভাবে আবেদন করবেন

এখন আপনাদের যে তথ্য দিবো তা হচ্ছে বহু বছরের অভিজ্ঞতার মোট ফলাফল। যাতে হাজারো পুরুষ ও নারীর অভিজ্ঞতা জড়িয়ে আছে। যেই সেবাগুলো দক্ষভাবে দিয়ে তারা আমাদের অর্থনৈতিক বাজারকে সহায়তা করেছে। সেজন্য, এর ওপর নিশ্চিত এবং বাস্তবিকভাবে আস্থা রাখা যায়।


যে সিস্টেমের মাধ্যমে দক্ষতা ও সেবা বাজারজাত হচ্ছে

আমি আমার অভিজ্ঞতা থেকে প্রমাণ পেয়েছি যে নি¤েœর এই ব্যবস্থা দিয়ে সবচেয়ে দ্রুত ও দক্ষভাবে যেকোন ব্যক্তি তার দক্ষতা ও সেবা প্রদান করতে পারে। এই ব্যবস্থার মাধ্যমেই একজন ক্রেতা এবং বিক্রেতা সবচেয়ে সহজে একে অপরের কাছে আসে।

১. জব পোর্টাল। সতর্কতার সাথে জব পোর্টাল নির্বাচন করতে হবে। কারণ অনেক জায়গায় চাকরির ভুয়া খবর থাকতে পারে। যা আপনার মূল্যবান তথ্য এবং সময়ের অপচয় ঘটাবে।

২. বিজ্ঞাপন। সংবাদপত্র, বাণিজ্য পত্রিকা, সাময়িক পত্রিকা এবং রেডিও’র বিজ্ঞাপন দেখুন। শ্রেণিভুক্ত বিজ্ঞাপন সাধারণভাবে নির্ভর করে সন্তোষজনক ফলাফল উৎপাদন করতে। এটা সেই ক্ষেত্রে প্রযোজ্য যারা সাধারণ বেতনের পদগুলোতে আবেদন করবে। আবেদনপত্রটি একজন দক্ষ ব্যক্তি দ্বারা প্রস্তুত করা উচিত, যে বোঝে যে কীভাবে পর্যাপ্ত বিক্রয়যোগ্য গুণাবলি প্রবেশ করানো যায় যাতে আবেদনপত্রের জবাব আসে।

৩. ব্যক্তিগত আবেদনপত্র। বিশেষ প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তিরা নিয়োগের ক্ষেত্রে যেরকম গুণাবলি চায় তা উল্লেখ করে দিন। এক্ষেত্রে আবেদনপত্র পরিষ্কারভাবে মুদ্রিত হতে হবে। আবেদনকারীর হাতের স্বাক্ষর থাকতে হবে। চিঠির সাথে একটি পূর্ণ ‘সংক্ষিপ্ত’ বর্ণনা পাঠানো উচিত যা হবে আবেদনকারীর গুণাবলির সংক্ষিপ্ত বর্ণনা। এই বিষয়গুলো একজন দক্ষ ব্যক্তি দ্বারা প্রস্তুত করানো উচিত। (পরের পৃষ্ঠায় একটি নমুনা দেওয়া হলো)।

৪. পরিচিত কারও মাধ্যমে আবেদন। যখন সম্ভব, আবেদনকারীর উচিত সম্ভাব্য নিয়োগকর্তাদের কাছে কিছু পরিচিত মানুষের দ্বারা পৌঁছানো। এই পদ্ধতিতে আপনি হয়তো কিছুটা বিশেষ সুবিধা পেতে পারেন। যারা চাকরি খোঁজার ব্যাপারে বেশি কষ্ট করতে চায় না তাদের উচিত এভাবে পরিচিত কারও মাধ্যমে আবেদন করা।

৫. সরাসরি নিজে গিয়ে আবেদন জমা। কিছু ক্ষেত্রে, এটা হয়তো আরও কার্যকরী হবে যদি আবেদনকারী ব্যক্তিগতভাবে তার সম্ভাব্য নিয়োগকর্তার সাথে সাক্ষাৎ করে, যাতে তার গুণাবলি সম্বন্ধীয় লিখিত কাগজ সরাসরি দেওয়া যায়। যে পদের জন্য সে উপস্থিত হবে সেই ব্যাপারে সম্ভাব্য নিয়োগকর্তার সাথে সরাসরি আলাপও করতে পারে।


একটি সংক্ষিপ্ত আবেদনপত্রে আপনার তথ্য দিতে হবে

চাকরির আবেদনের জন্য তথ্যাবলি যত সংক্ষিপ্ত এবং গোছানো হয় ততই উত্তম। একজন উকিল যেমন তার মামলা প্রস্তুত করে, সংক্ষেপে এবং সতর্কভাবে, তেমনি একজন আবেদনকারীকেও তার আবেদন সংক্ষিপ্ত এবং সহজবোধ্য রাখা উচিত। আর তা না হলে আপনি একজন অভিজ্ঞ ব্যক্তির পরামর্শ নিতে পারেন। তিনি আপনার দক্ষতা ও যোগ্যতাকে সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলবেন। সফল ব্যবসায়ীরা এমন পুরুষ ও নারীদের নিয়োগ দেন যারা বিক্রয় কৌশল ও গ্রাহকের মনস্তত্ব বুঝতে সক্ষম। একজন যিনি ব্যক্তিগত সেবা বিক্রয় করতে চান তার এমনই করা উচিত। এরপর নিচের তথ্যগুলোও নির্দিষ্টভাবে যোগ করতে পারেন।

১. শিক্ষা। সংক্ষিপ্তভাবে লিখুন। কিন্তু নির্দিষ্টভাবে প্রকাশ করুন। কোন ইউনিভার্সিটিতে পড়েছেন, কোন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ এবং বিশেষজ্ঞতার কারণ উল্লেখ করুন।

২. অভিজ্ঞতা। যে পদের জন্য আপনি আবেদন করবেন সেই পদের দায়িত্ব পালনের যদি আপনার কোন পূর্ব অভিজ্ঞতা থাকে তবে সেই ব্যাপারেও উল্লেখ করুন। পূর্বের প্রতিষ্ঠানের নাম, ঠিকানা, নিয়োগকর্তার নাম পরিষ্কার করে লিখুন। এছাড়াও আপনার যদি কোন বিশেষ অভিজ্ঞতা থাকে যা উক্ত পদে কাজে লাগবে বলে মনে করেন তবে তাও উল্লেখ করুন। এভাবে বর্ণনার মাধ্যমে আপনি কেন উক্ত পদের জন্য যোগ্য তা বলুন।

৩. সুপারিশ। বাস্তবে প্রতিটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানই সবকিছু সম্বন্ধে জানতে চায়। আগের কর্মক্ষেত্রের ইতিহাস, পূর্ব পরিচয় ইত্যাদি সম্পর্কে জানতে চায়। সম্ভাব্য কর্মীর অনেক তথ্যই জানতে চায় যাতে করে তারা বুঝতে পারে যে দায়িত্বশীল পদে সে সঠিকভাবে কাজ করতে পারবে কিনা। আপনার সংক্ষিপ্ত আবেদনে নিচে তথ্যাবলি যোগ করুন:

ক. পূর্ব নিয়োগকর্তাদের নাম এবং যোগাযোগের ঠিকানা

খ. যাদের কাছে আপনি অধ্যয়ন করেছেন সেই শিক্ষকদের নাম

গ. প্রসিদ্ধ লোকজনের নাম যাদের বিবেচনা হয়তো সহায়তা করতে পারে

৪. নিজের ছবি দিন। আপনার সংক্ষিপ্ত আবেদনপত্রে আপনার একটি সাম্প্রতিক ছবি যোগ করুন। খেয়াল রাখবেন ছবিতে আপনাকে যেন ঠিকঠাকমতো দেখা যায়।

৫. একটি নির্দিষ্ট পদের প্রতি আবেদন। যে বিশেষ পদ আপনি খুঁজচ্ছেন তা নিশ্চিতভাবে বর্ণনা করা ব্যতীত একটি পদের প্রতি আবেদন করবেন না। কখনো ‘শুধু একটি পদ’ এর প্রতি আবেদন করবেন না। এটা নির্দেশ করে আপনার বিশেষ কোন গুণ নেই।

৬. আপনার গুণাবলি লিখুন। যে বিশেষ পদের প্রতি আবেদন করছেন সেখানে আপনার গুণাবলির উল্লেখ করুন। আপনি যে কারণে বিশ্বাস করেন যে আপনি বিশেষ পদটির প্রতি যোগ্য তার পুরোপুরি যৌক্তিকতা বর্ণনা করুন। এই হচ্ছে আবেদন। এমন একটি আবেদন আপনাকে আপনার আকাক্সিক্ষত পদ অর্জনে আপনাকে সহায়তা করবে।

৭. শিক্ষানবিস কাজের প্রতি প্রস্তাব। আপনি যদি আপনার আকাক্সিক্ষত পদে আপনার যোগ্যতা নিয়ে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হন তবে সবচেয়ে ভালো হয় যদি আপনি বিনাবেতনে এক সপ্তাহ বা এক মাস কাজ করার প্রস্তাব দেন। যাতে করে আপনার সম্ভাব্য নিয়োগকর্তা আপনার মূল্য বিবেচনা করতে পারে। বেতন ছাড়া কাজ করে আপনি আপনার যোগ্যতা দেখানো সুযোগ পাবেন। যদিও এটা হয়তো একটা চরমপন্থী পরামর্শ বলে মনে হতে পারে। কিন্তু আমার অভিজ্ঞতা বলে এটা কদাচিৎ জয় আনতে ব্যর্থ হয়েছে। কমপক্ষে একটা পরীক্ষা তো করতেই পারেন। যদি আপনি আপনার গুণাবলিতে নিশ্চিত হন, একটি পরীক্ষাই সব যা আপনার দরকার। প্রসঙ্গত এমন এক প্রস্তাব নির্দেশ করে যে আপনার দক্ষতার ওপর আপনার বিশ্বাস আছে। আপনি যে পদ খুঁজচ্ছেন তার দায়িত্ব আপনি সম্পূর্ণ করতে পারবেন। বিশ্বাস করানোর জন্য এটা একটা উত্তম পন্থা। যদি আপনার প্রস্তাব গ্রহণ করা হয় এবং আপনি ভালো করেন, প্রায়ই দেখা যায়, আপনাকে আপনার ‘শিক্ষানবিসকালের’ জন্যও বেতন দিচ্ছে। আপনার প্রস্তাবের ভিত্তি স্পষ্ট করুন:

ক. আপনার দৃঢ়বিশ্বাস আপনার দক্ষতার ওপর।

খ. আপনার দৃঢ়বিশ্বাস আপনার সম্ভাব্য নিয়োগকর্তার সিদ্ধান্তের ওপর যে আপনাকে পরীক্ষার পর কর্মে নিযুক্ত করবে।

গ. আপনার দৃঢ়প্রতিজ্ঞা যে আপনি পদটি পাবেন যা আপনি খুঁজচ্ছেন।

৮. আপনার সম্ভাব্য নিয়োগকর্তার ব্যবসা সম্বন্ধে জ্ঞান। একটি পদের প্রতি আবেদন করার পূর্বে, পর্যাপ্ত গবেষণা করুন। যেই ব্যবসার সাথে নিজেকে যুক্ত করতে চান সেই ব্যবসা সম্বন্ধে এবং আপনার অভিজ্ঞতা সম্বন্ধে সংক্ষিপ্ত নির্দেশনা দিন। এটা চিত্তাকর্ষক হবে। যেহেতু এটা নির্দেশ করবে যে আপনার কল্পনা আছে এবং একটা বাস্তব আগ্রহ আছে সেই পদের প্রতি যা আপনি খুঁজচ্ছেন।

মনে রাখবেন, সবচেয়ে বেশি আইন জানে যে উকিল সেই যে মামলায় জিতবে তা নয়; বরং যে তার মামলা সর্বোৎকৃষ্টভাবে প্রস্তুত করে সেই জয়ী হয়। যদি আপনার মামলা বা ‘নথিপত্র’ ঠিকভাবে প্রস্তুত করা হয় এবং উপস্থাপন করা হয়, তবে আপনার ফলাফল লাভের আগেই আপনি অর্ধেক জয়ী।

আপনার সংক্ষিপ্ত বিবরণ অতি দীর্ঘ করতে ভয় পাবেন না। নিয়োগকর্তারা ভালো ও যোগ্য আবেদনকারীর ব্যাপারে ততটাই আগ্রহী যতটা আপনি চাকরির জন্য আগ্রহী। বাস্তবে সর্বাধিক সফল নিয়োগকর্তাদের সাফল্য নির্ভর মূলত ভালো ও যোগ্য কর্মচারীদের নির্বাচন করার তাদের নৈপুণ্যের ওপর। তারা সহজলভ্য সব তথ্য জানতে চায়।

আরও মনে রাখবেন, আপনার সংক্ষিপ্ত আবেদনপত্র সবসময় পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখবেন। এই পরিচ্ছনতা নির্দেশ করবে আপনি একজন অধ্যবসায়ী ব্যক্তি। আমি এমন অনেক মানুষকে তাদের আবেদনপত্র তৈরিতে সহায়তা করেছি। তাদের আবেদনপত্র ছিল সংক্ষিপ্ত ও আকর্ষণীয়। লাভজনক ব্যাপার হচ্ছে তাদের আবেদনপত্র দেখেই তাদেরকে নিয়োগ দেওয়া হয়। কোন রকম ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকার ছাড়াই।

যখন আপনার সংক্ষিপ্ত আবেদনপত্র তৈরি করবেন তখন একজন শিল্পী দিয়ে আপনার লেখাকে সজ্জিত করুন এবং অভিজ্ঞ বাঁধাইকারী দ্বারা পরিচ্ছন্নভাবে বাঁধাই করুন। নিচে একটি উদাহরণ দেওয়া হলো:


সংক্ষিপ্ত আবেদনপত্র

সালমান শাহ্

(যে পদের জন্য আবেদন করছেন সেটার নাম) ধরুন, ব্যক্তিগত সহকারী

প্রাপক: নির্বাহী পরিচালক

(এখানে প্রতিষ্ঠানের নাম)

আবেদনপত্র একই রকম থাকবে। যখনই কোন নতুন কোম্পানিতে আবেদন করবেন তখন কেবল কোম্পানির নাম পরিবর্তন করে দিবেন।

এই ব্যক্তিগত স্পর্শ নিশ্চিতভাবে আকর্ষণ টানবে। আপনার সংক্ষিপ্ত আবেদনপত্র পরিচ্ছন্নভাবে মুদ্রণ করুন অথবা সর্বোৎকৃষ্ট কাগজ দ্বারা এর ফটোকপি করুন। আর একটি ভারী কাগজের বৈচিত্রময় নকশার প্রচ্ছদ দিয়ে বাঁধাই করুন এবং সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের নাম ঠিকভাবে উল্লেখ করুন। পরবর্তীতে একাধিক প্রতিষ্ঠানে আবেদন প্রেরণের ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানের নাম পরিবর্তন করুন। আপনার ছবি আঠা দিয়ে আপনার আবেদনের প্রথম পৃষ্ঠাতে লাগান। চিঠির প্রতি এই নির্দেশনা অনুসরণ করুন। আবেদনপত্রের কোন স্থানে আরও কিছু তথ্য যোগ করলে আপনার সুবিধা হবে বলে মনে হলে এটা আপনার আবেদনপত্রে যোগ করতে পারেন।

সফল বিক্রয়কর্মীরা নিজেদেরকে যতেœর সাথে পরিচর্যা করে। তারা বোঝে যে প্রথম সাক্ষাৎকার স্থায়ী প্রভাব তৈরি করে। একজন ব্যক্তির সাথে প্রথম সাক্ষাতে যে আচরণ দ্বারা তাকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করা হয় এটা দীর্ঘদিন বজায় থাকে। আপনার সংক্ষিপ্ত আবেদনপত্র হচ্ছে আপনার বিক্রয়কর্মী। এটাকে একটা ভালো পোশাক দিন, তাতে একটি পদের প্রতি আবেদনপত্র সাহসীভাবে দাঁড়িয়ে আপনার সম্ভাব্য নিয়োগকর্তাকে যেকোন কিছু তুলনা করে পার্থক্য দেখাবে। যদি আপনার আবেদনকৃত পদের মূল্য থাকে, তবে এটা যতেœর সাথে পরিচর্যা করাও মূল্যবান। অধিকন্তু, যদি আপনি একজন নিয়োগকর্তার কাছে নিজেকে এমন এক রীতিতে বিক্রয় করেন যা আপনার স্বতন্ত্রতা দিয়ে তাকে প্রভাবিত করে, তবে আপনি সম্ভবত বেশি অর্থ পাবেন। আপনি চাকরির প্রতি চিরপ্রচলিত পথে আবেদন করলে যা পেতেন তারচেয়েও বেশি পাবেন যদি উল্লেখিত পথে আবেদন করেন।

যদি আপনি একটি বিজ্ঞাপন সংস্থা অথবা একটি চাকরি সংস্থার মাধ্যমে চাকরি খোঁজেন, তবে দেখবেন সেসব সংস্থায় এক ধরনের ফরম ব্যবহৃত হয়Ñআবেদনকারীর তথ্যাবলির জন্য একটি নির্দিষ্ট ফরম। সেই ফরম সংগ্রহ করতে পারেন। এতে করে আপনি আপনার আবেদনপত্রে কী কী দিতে হবে সে সম্পর্কে একটি ধারণা পাবেন।


কীভাবে আপনার আকাক্সিক্ষত পদ পাবেন?

প্রত্যেকে সেই ধরনের কাজ করে আনন্দ পায় যা সে করতে দক্ষ ও যোগ্য। যে ঘোড়ায় চড়তে ভালোবাসে সে ঘোড়ায় চড়ে আনন্দ পাবে। আর যে ঘোড়ায় চড়তে পারে না সে ঘোড়া থেকে পড়ে ব্যথা পাবে। এটা সব ধরনের কাজের জন্যই সত্য। একজন চিত্রকর ছবি আঁকতে ভালোবাসে, একজন কুমার তার হাত দিয়ে মাটি নিয়ে খেলা করে, একজন লেখক তার লেখায় আনন্দ পায়। যাদের নির্দিষ্ট মেধা রয়েছে তাদের অধিকতর পছন্দনীয় ক্ষেত্র হচ্ছে ব্যবসা ও শিল্পকারখানা। যদি আমেরিকা কোনকিছু ভালো করে থাকে, তা হচ্ছে, এটা মানুষকে সুযোগ দিয়েছে। যে জমিতে লাঙ্গল চাষ করতে চায় তাকে লাঙ্গল দিয়েছে, আরও উন্নত হতে ট্রাক্টর দিয়েছে, ধান কাটার যন্ত্র দিয়েছে, ধান ভাঙার স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র দিয়েছে এবং বাজারে টনে টনে চাল নিয়ে আসার মতো ট্রাক দিয়েছে।

প্রথমত। নিশ্চিতভাবে সিদ্ধান্ত নিন আপনি কী ধরনের চাকরি করতে চান। যদি চাকরিটি ইতোমধ্যে বিদ্যমান না থাকে, সম্ভবত আপনি এটা সৃষ্টি করতে পারেন।

দ্বিতীয়ত। সেই প্রতিষ্ঠান, কোম্পানি বা ব্যক্তি নির্বাচন করুন যার অধীনে আপনি কাজ করতে চান।

তৃতীয়ত। আপনার সম্ভাব্য নিয়োগকর্তাকে পর্যবেক্ষণ করুন। যেমন তার নীতি-নৈতিকতা, ব্যক্তিত্ব ও চাকরিতে পদোন্নতির সম্ভাবনা বিবেচনা করুন।

চতুর্থত। নিজেকে নিয়ে চিন্তা করুন। আপনার মেধা ও দক্ষতাগুলো বিবেচনা করুন। আপনি কি প্রস্তাব দিতে পারেন তা খুঁজে বের করুন এবং যে সুবিধা, সেবা, উন্নয়ন, আইডিয়াগুলো আপনি সফলভাবে দিতে পারবেন বলে আপনি বিশ্বাস করেন সেগুলো প্রয়োগের একটি ভালো পরিকল্পনা উপস্থাপন করুন।

পঞ্চমত। ‘একটি চাকরির কথা’ ভুলে যান। ভুলে যান যদিও-বা সেখানে কোন সুযোগ না থাকে। ভুলে যান সেই সহজাত বাধাধরা রীতি ‘আপনার কাছে কি আমার জন্য একটি চাকরি হবে?’। তারচেয়ে বরং আপনি কী দিতে পারেন সেদিকে গভীর মনোযোগ দিন।

ষষ্ঠত। যখন আপনার পরিকল্পনা আপনি মনে মনে তৈরি করেছেন তখন চুপচাপ বসে থাকবেন না। এটাকে কাগজের ওপর পরিচ্ছন্নভাবে একজন অভিজ্ঞ লেখককে সাথে নিয়ে সজ্জিত করুন এবং পূর্ণ বর্ণনা সহকারে স্পষ্টভাবে ফুটিয়ে তুলুন।

সপ্তমত। এটা যথার্থ ব্যক্তির কাছে পেশ করুন। পুরো বিধি মোতাবেক এবং অপেক্ষা করুন। প্রত্যেক প্রতিষ্ঠান এমন ব্যক্তিদের খোঁজে যারা মূল্যবান কিছু দিতে পারবে। হতে পারে এটা হবে ধারণা, সেবা, দক্ষতা, বহু মানুষের সাথে পরিচিতি বা অভিনব কিছু। আপনি যদি একটি প্রতিষ্ঠানের সুবিধা দেখিয়ে দিয়ে সেই কাজ করে প্রতিষ্ঠানের জন্য সুবিধা আনতে চান তবে উক্ত প্রতিষ্ঠান আপনাকে কেন নিবে না। এমনও প্রতিষ্ঠান আছে যারা এমন সব লোককে নিয়োগ দেয় যাদের ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে অনেক পরিচিতি আছে। প্রতিষ্ঠান এসব পরিচিতিকে নিজেদের কাজে লাগাতে চায়। আপনার মধ্যে এমন কী গুণাবলি আছে যেজন্য আপনার পছন্দ করা প্রতিষ্ঠান আপনাকে নিয়োগ দিবে?

এই ধরনের পদ্ধতিতে হয়তো কিছু দিন বা সপ্তাহ লাগতে পারে। কিন্তু পার্থক্য হবে আয় উন্নতিতে। আপনি বহু বছরের কঠোর পরিশ্রম দিয়ে যে পদ অর্জন করতে পারতেন তারচেয়ে ভালো দায়িত্ব পাবেন যদি এভাবে পরিকল্পনা করে আবেদন করেন। এর অনেক সুবিধা আছে। একটি মুখ্য সুবিধা হচ্ছে এই ধরনের পরিকল্পিত আবেদন আপনার ১-৫ বছরের সময় বাঁচায়।

এভাবে পরিকল্পিত আবেদন মানে অনেকটা মইয়ের অর্ধেক পথে উঠে যাওয়া। আপনার এখন কাজ হচ্ছে শান্তিতে আরও উপরের পদে উঠার জন্য চেষ্টা করা। অবশ্য এরও ব্যতিক্রম আছে। ব্যতিক্রম হচ্ছে মালিকের ছেলে।

দক্ষতা বাজারজাত করার নতুন পথ:

‘চাকরি’ এখন ‘অংশীদারিত্বে’ পরিণত হয়েছে

পুরুষ ও নারীরা যারা ভবিষ্যতে তাদের দক্ষতা ও যোগ্যতা বাজারজাত করতে চায় তাদের এটা জানা উচিত যে সময়ের পরিবর্তন ঘটেছে। আপনি হয়তো অবাক হবেন যে এখন নিয়োগকর্তা এবং নিয়োগকর্মীর মধ্যকার সম্পর্ক হয়েছে অংশীদারিত্বের।

ভবিষ্যতের অর্থনীতি ‘স্বর্ণ দ্বারা নীতি’তে চলবে না। চলবে ‘গোল্ডেন রুল তথা সোনালি নীতি’। সব জায়গায় ‘সোনালি নীতি’ ব্যবহৃত হবে। এই নীতি পণ্যদ্রব্যের বাজারজাত করতে কর্তৃত্ব করবে। এটা ব্যক্তিগত সেবার প্রতিও ঠিক ততই কার্যকরী হবে। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী পণ্যদ্রব্য বাজারজাত করতে ‘স্বর্ণ দ্বারা নীতি’ মেনে চলা হয়। এই নীতি হচ্ছে স্বর্ণের দামে পণ্যদ্রব্যের দাম। ভবিষ্যতে ‘গোল্ডেন রুল’ কর্তৃত্ব করবে যা হচ্ছে এ বইয়ে উল্লেখিত নীতি। নিয়োগকর্তা ও তাদের নিয়োগকর্মীদের সাথে ভবিষ্যৎ সম্পর্ক হবে আরও বেশি অংশীদারত্বের। এটার প্রকৃত গঠন হবে:

ক. নিয়োগকর্তা

খ. নিয়োগকর্মী

গ. জনগণ, যাদের তারা সেবা করে

ব্যক্তিগত সেবা বাজারজাত করার প্রতি এই নতুন পথ সত্যিই অসাধারণ। একে নতুন ডাকা হয় অনেক কারণে। প্রথমত, ভবিষ্যতে উভয় নিয়োগকর্তা এবং নিয়োগকর্মী নিজেদের বিবেচনা করবে এই নীতির অনুসারী রূপে যে তাদের ব্যবসাই হচ্ছে দক্ষভাবে জনগণের সেবা করা। অতীতে, নিয়োগকর্তা এবং নিয়োগকর্মীগণ তাদের মধ্যকার শ্রম ও বেতন নিয়ে যে ব্যাপারগুলো তা তারা দরকষাকষির মাধ্যমে ঠিক করত। বাস্তবে, তারা উভয়ই এই দরকষাকষি করছে তৃতীয় পক্ষের খরচের ওপর, জনগণের ওপর যাদের তারা সেবা করে তাদের ওপর চাপিয়ে দিত। একজন নিয়োগকর্তা ও একজন নিয়োগকর্মী পরস্পরের মধ্যে অর্থ ও শ্রম বিনিময়ের প্রতি যে দরকষাকষি করে এটার সরাসরি প্রভাব পড়ে জনগণের ওপর।

এই যে কিছুদিন আগে আমাদের ওপর অর্থনৈতিক বিপর্যয় ঘটে গেল, এটার একটাই মানেÑক্ষতিগ্রস্থ জনগণের এক শক্তিশালী প্রতিবাদ। যাদের অধিকারগুলো পদদলিত করা হয়েছে। এই কাজ করেছে পাইকারী ও খুচরা ব্যবসায়ীরা। তারা তাদের নিজেদের অতি মুনাফা ও লোভের কারণে জনগণকে কোণঠাসা করে অর্থ আদায় করেছে। [যেমন বাংলাদেশে রমজান মাসে দুধের দাম $৫ থেকে $২০ পর্যন্ত বাড়িয়ে দেওয়া হয়। পাইকারী ব্যবসায়ীর অজুহাত হচ্ছে চাহিদা বেশি যোগান কম। আর খুচরা ব্যবসায়ীর বক্তব্য হচ্ছে আপনি না নিলে অন্য কেউ নিবে। এইভাবে যখন উভয় পাইকারী ও খুচরা ব্যবসায়ীরা মিলে নিজেদের সুবিধা ও লাভের জন্য জনগণের অধিকারগুলোকে পদদলিত করে তখনই একটি অর্থনৈতিক বিপর্যয় দেখা দেয়, বাজারে ধ্বস নামে।] যখন বিপর্যয়ের জঞ্জাল পরিষ্কার হয়ে যাবে এবং ব্যবসা পুনরায় একবার সাম্যে বিরাজ করবে, উভয় নিয়োগকর্তাগণ ও নিয়োগকর্মীগণ বুঝতে পারবেন যে যাদের তারা সেবা করে তাদের খরচের প্রতি নিজেদের (কর্তা ও কর্মীর মধ্যকার) দরকষাকষিকে চালিত করে বা ঠেলে দিয়ে তারা আর সুবিধা পাবে না। ভবিষ্যতের সত্যিকার নিয়োগকর্তা হবে জনগণ। প্রত্যেক ব্যক্তির উচিত এটাকে মনের সর্বোচ্চ স্থানে রাখা। যারা ব্যক্তিগত দক্ষতা ও যোগ্যতা দিয়ে চাকরি করতে চান তাদেরকে এই কথা সবসময় মনে রাখা উচিত।

ভবিষ্যতের সত্যিকার নিয়োগকর্তা হবে জনগণ। কারণ একজন কর্মচারীকে যখন একজন মালিক বেতন দেয় সেই টাকা তো আর মালিকের পকেট থেকে দেয় না। সেই টাকা দেয় জনগণ বা ক্রেতার কাছ থেকে নেওয়া টাকা থেকে। তাহলে সবশেষে দেখা যায় জনগণই মালিক এবং কর্মচারী উভয়ের খরচ যোগাচ্ছে। তাহলে সেই জনগণই কি সত্যিকারের নিয়োগকর্তা নয়? সেই জনগণ কি ভদ্র আচরণ এবং উত্তম সেবা পাওয়ার যোগ্য নয়?

আমেরিকার মধ্যে প্রায় প্রতিটি রেলপথ অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে আছে। কার সেই দিনটির কথা স্মরণ নেই যখন যদি একজন নাগরিক টিকেট কাউন্টারে টিকেটের জন্য যেত, একটি ট্রেন স্টেশন ত্যাগ করে যাওয়ার সময় সম্পর্কে জানতে যেত, তাকে ভদ্রভাবে তথ্য দেওয়ার বদলে আকস্মিকভাবে (অভদ্রভাবে) নোটিশ বোর্ড দেখতে বলা হত।

রাস্তার গাড়ি কোম্পানিগুলোও এই অভিজ্ঞতা পেয়েছে। তারা ‘সময়ের পরিবর্তনের’ একটি আভাস পেয়েছে। সময় বেশি দূরে নয় যখন রাস্তার গাড়ির কন্ডাক্টররা (যে ব্যক্তিরা বাসে বা ট্রেনে ভাড়া আদায় করে) যাত্রীদের সাথে তর্ক করতে পেরে গর্ব অনুভব করত। এই কারণে অনেক রাস্তার গাড়ি তাদের ব্যবসা রাস্তা থেকে উঠিয়ে আনতে বাধ্য হয়েছে। যাত্রীরা সেই গাড়িতেই উঠে, যার চালক ‘ভদ্রভাবে আচরণ করে’।

সারা দেশের গাড়ি কোম্পানিগুলোকে কালক্রমে জনগণ বর্জন করেছে। এজন্য গাড়ি কোম্পানিগুলো বাধ্য হয়েছে তাদের গাড়ি উঠিয়ে নিতে। যেখানেই রাস্তার গাড়ি এখনও চালু আছে, যাত্রীরা হয়তো এখন তর্ক ছাড়াই গাড়িতে চড়তে এবং একজন হয়তো গাড়িকে হাত নাড়িয়ে রাস্তার মাঝ থেকেই উঠতে পারে। আর গাড়ির চালকও তাকে দয়ালুভাবে উঠিয়ে নেয়।

সময়ের কী পরিবর্তন হয়েছে! আমি কেবল এই দিকটার প্রতিই জোর দিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা করছি যে সময়ের পরিবর্তন ঘটেছে! অধিকন্তু, পরিবর্তন কেবল রেলপথ কাউন্টার ও রাস্তার গাড়িগুলোতেই প্রতিফলিত হচ্ছে না; বরং জীবনের অন্যান্য পথেও দৃশ্যমান। ‘জনগণকে-নিন্দা’ নীতি এখন অচল। এটার স্থান অধিকার করেছে ‘স্যার, আপনাকে-কীভাবে-সাহায্য-করতে-পারি?’ নীতি।

[বাংলাদেশেও বর্তমানে এই পরিবর্তনের হাওয়া বইছে। বর্তমানে মোটর বাইক কেনার হিড়িক পড়েছে। এটার অনেক কারণের অন্যতম কারণ হচ্ছে বাস, রিকশা ও সিএনজি চালকদের অভদ্র আচরণ।]

ব্যাংক কর্মকর্তারা এই দ্রুত পরিবর্তন থেকে একটি বা দুটি বিষয় শিখেছে যা গত কয়েক বছর ধরে ব্যাংকিং খাতে জায়গা করে নিয়েছে। একটি ব্যাংকের অফিস বা কর্মচারী থেকে গ্রাহকদের সাথে অভদ্র ব্যবহার করা আজ এত বিরল যতটা এক যুগ আগেও ছিল না। কয়েক বছর আগেও কিছু ব্যাংক কর্মকর্তা (অবশ্য সবাই না), কঠোরতার একটি আবহাওয়া বহন করত যা প্রত্যেক হয়তো-ঋণ নিতে ইচ্ছুক ব্যক্তিকে নিরুৎসাহিত করত যখন সে হয়তো তার ব্যাংক কর্মকর্তা থেকে একটি ঋণের জন্য চিন্তা করছিল।

বিপর্যয়কালে হাজারো ব্যাংকের ব্যর্থতা ছিল মেহগনি কাঠের দরজার পিছনে নিজেদের সরানোর প্রভাব যা দিয়ে ব্যাংক কর্মকর্তারা নিজেদের সামনে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছিল। তারা এখন খোলাখুলিভাবে টেবিলে বসে। যেখান থেকে তারা গ্রাহকদের দেখতে পারে এবং চাইলেই কাছে গিয়ে আলাপ করতে পারে। যেকোন জমা দানকারী গ্রাহককে শুভেচ্ছা জানাতে পারে। যেকোন ব্যক্তি খুব সহজেই তাদের কাছে আসতে পারে। বর্তমানে ব্যাংকের সম্পূর্ণ আবহাওয়া হচ্ছে একটি সৌজন্যতা ও বোধগম্যতার পরিবেশ।

[এটা ১৯৩৭ সালের বর্ণনা। বর্তমানে বাংলাদেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থা এক ধরনের বিপর্যয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। প্রতিটি ব্যাংক গ্রাহকদের উন্নত সেবা দানের নামে নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। বিশেষ করে নিজেদেরকে গ্লাসের আড়ালে নিয়ে যাওয়া। কারও সাথে আলাপ করতে বহু সময় অপেক্ষা করানো, কেউ একাউন্ট খুলতে গেলে তাকে নানা প্রশ্ন করে নাজেহাল করা। এমনকি কেউ পুরনো নোট নিয়ে গেলেও তার সাথে অভদ্র ব্যবহার করা। এমন অবস্থায় সেসব ব্যাংকই এগিয়ে যাবে যারা গ্রাহকদের সাথে ভদ্র ব্যবহার করবে।]

পূর্বে মুদি দোকানগুলোতে ক্রেতাদের সাথে অভদ্র আচরণ করা হত। ক্রেতারা দাঁড়িয়ে থাকত এবং মুদি দোকানের কর্মচারীরা তাদের বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিত। আর দোকানের মালিক তার ব্যাংকে জমা দেওয়ার জন্য কাগজপত্র তৈরি করত। এগুলো শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত ক্রেতাদের অপেক্ষা করতে হত। এরপর আসে সুপারস্টোর। যেখানে এক দোকানেই সব ধরনের জিনিস পাওয়া যায়। এই দোকানগুলো পরিচালিত হয় বিনীত ব্যক্তিদের দ্বারা যারা ক্রেতাদের সর্বোচ্চ সেবা দেয়। ক্রেতাদের সেবা করতে এরা সবকিছু করে। যেমন ক্রেতার জুতা চমকাতে সাহায্য করে। এই ধরনের ভদ্র ও বিনীত আচরণ পুরাতন সময়ের সওদাগরদের ধাক্কা দিয়ে পিছনের সারিতে সরিয়ে দিয়েছে। সময় এগিয়ে যাচ্ছে!

‘সেবা’ এবং ‘সৌজন্য’ হচ্ছে দৃশ্যমান-শব্দ যা আজ পণ্যদ্রব্য আকারে ব্যবহার করা হচ্ছে। আর কর্মচারীরা মালিকের প্রতি যে সেবা করে তার থেকেও বেশি সেবা করে জনগণের প্রতি। কারণ, সর্বশেষ পর্যবেক্ষণে, উভয় মালিক ও কর্মচারী হচ্ছে জনগণ দ্বারা নিয়োগকৃত। জনগণ আছে তাই মালিকের মুনাফা আছে এবং কর্মচারীর বেতন আছে। জনগণ নাই তখন মালিকও থাকবে না, আর কর্মচারীও থাকবে না। যদি তারা, মালিক ও কর্মচারী, জনগণের উত্তমভাবে সেবা করতে ব্যর্থ হয়, তারা তাদের ক্ষতির দ্বারা চরম মূল্য দিবে, যা তারা হয়তো জনগণের সেবার ফলে লাভ করতে পারত।

আমাদের সকলেরই সেই সময় মনে আছে যখন গ্যাস মিটার দেখার জন্য দরজায় লোক আসত। সে এমনভাবে দরজা ধাক্কা দিত যেন হাতল ভেঙে ফেলবে। যখন দরজা খোলা হত, সে ধাক্কা দিয়ে ভেতরে ঢুকত, অনাহুত ব্যক্তির মতো, তার মুখের একটা গোমড়া ভাব যা সমানভাবে বলছে, ‘যত্তোসব,-কী-জন্য-আমাকে-এতক্ষণ-অপেক্ষায়-রেখেছিলে?’ এ সবকিছুই আমাদের সহ্য করতে হয়েছিল। কিন্তু এখন একটা পরিবর্তন এসেছে। মিটার-ব্যক্তি এখন নিজেকে পরিচালিত করে যেন একজন ভদ্র ব্যক্তি যে হচ্ছে ‘স্যার-আপনার-সেবা-করতে-পেরে-আমি-খুশি’। গ্যাস প্রতিষ্ঠানগুলো আজকের এই সৌজন্যতা শেখার পূর্বে তাদের গোমড়া মিটার-কর্মীরা যে পাপ কামিয়েছে তা কখনো পরিষ্কার করা যাবে না। ইতোমধ্যেই, তেল চালিত চুলার ভদ্র বিক্রয়কর্মীরা এসে পড়ে এবং বিশাল এক ব্যবসার জায়গা করে নেয়।

অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের সময় আমি কয়েক মাস পেনসিলবেনিয়া রাজ্যের কয়লা খনিতে কাটিয়েছি। এক ধরনের খনির কয়লা যা ধীরে ধীরে পোড়ে এবং যা থেকে ধোঁয়া ও অগ্নিশিখা বের হয় না বললেই চলে। আমি মূলত কয়লা শিল্প কেন ধ্বংস হয়েছিল তার কারণ অনুসন্ধান করছিলাম। আমি অতি গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি জিনিস আবিষ্কার করলাম। ব্যাপারটি ছিল যে চালকরা, খনিতে চালানোর জন্য বিভিন্ন যন্ত্রাদির চালকরা এবং কোম্পানির কিছু কর্মচারীদের প্রচ- লোভ ছিল কয়লা শিল্প ধ্বংস হওয়ার অন্যতম কারণ। চালকদের জন্য ব্যবসার ক্ষতি হলো আর খনি শ্রমিকরা তাদের চাকরি হারাল।

অতি মুনাফাখোর ও লোভী প্রকৃতির শ্রমিক নেতাদের একটি দলের আন্দোলনের চাপের মুখে খনি শ্রমিকরা তাদের চাকরি হারায়। অসাধু কর্মচারী ও চালকদের লোভের কারণে কয়লা ব্যবসায় ধ্বস নামে। কয়লা খনি থেকে উত্তোলনের জন্য যন্ত্রগুলোর চালকরা এবং তাদের কর্মচারীদের ধারালো দরকষাকষি নিয়ে ঝগড়া টেনে আনল একে অপরের প্রতি বিপর্যয়। তারা এই ‘দরকষাকষির’ দাম যোগ করে দিল কয়লার দামের সাথে। যতক্ষণ পর্যন্ত না, তারা আবিষ্কার করল যে তারা একটি চমৎকার ব্যবসা তৈরি করে দিয়েছে জ্বালানি তেল দিয়ে চালিত চুলার কোম্পানিকে। জ্বালানি তেল দিয়ে চালিত এসব চুলা কোম্পানি কয়লাশিল্পের বিরাট বাজার দখল করে নেয় এবং কয়লাশিল্পে ধ্বস নামে।

[‘লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু!’ এটাকে আবার এভাবেও বলা যায় যে ‘পাপের বেতন হচ্ছে মৃত্যু!’ অনেকেই হয়তো এটা ধর্মগ্রন্থে পাঠ করেছে। কিন্তু খুব অল্প মানুষই এর মানে আবিষ্কার করেছে। এখন এবং গত কয়েক বছরের জন্য, সম্পূর্ণ বিশ্ব পরিচালিত হচ্ছে বল দ্বারা, এটা হচ্ছে একটা তিরস্কার একটা ধর্মোপদেশের প্রতি যা হচ্ছে ‘একজন মানুষ যা বপন করে, তাই সে পায়।’ পবিত্র আল কুরআনেও বলা আছে, ‘মানুষ তাই পায়, যা সে করে।’ -সূরা আন-নাজম, আয়াত: ৩৯।]

আজকের ব্যবসায়িক বিপর্যয় যতটা সর্বব্যাপীভাবে ঘটেছে, অন্য আর কোন কিছুই এত সর্বব্যাপী ও কার্যকরী হয়নি। এটা ‘কেবল একটা কাকতলীয় ঘটনা’ নয়। বিপর্যয়ের পিছনে নির্দিষ্ট কারণ ছিল। কারণ ছাড়া কখনো কিছু ঘটে না। প্রধানত, বিপর্যয়ের কারণ সরাসরি অঙ্কনযোগ্য এবং তা হচ্ছে বিশ্বব্যাপী এই অভ্যাসের চেষ্টা যে কাজ না করে, বপন না করেই কিছু পাওয়ার তীব্র মনোবাসনা। কাজ না করেই ফল পেতে চায়। যেমন নির্দিষ্ট আকাক্সক্ষা, পরিকল্পনা, কাজ এবং অধ্যবসায় ব্যতীত সম্মান, ক্ষমতা ও ধনী হতে চায়।

এটার ভুল মানে ধরা উচিত নয় যে আজকের এই অর্থনৈতিক বিপর্যয় ঘটেছে কোন রূপ বীজ বপন না করেই। সমস্যা হচ্ছে বিশ্ব ভুল বীজ বপন করা। যেকোন কৃষক জানে যে সে ধানের বীজ বপন না করে শস্য সংগ্রহ করতে পারে না। বিশ্বযুদ্ধ ছড়ানোর শুরুর দিকে, বিশ্বের জনগণ অপর্যাপ্ত সেবার বীজ বপন করতে শুরু করে। যা উভয় গুণাবলি এবং পরিমাণে অপর্যাপ্ত ছিল। প্রায় প্রত্যেকেই এই চেষ্টাতে লেগে পড়ে যে কাজ না করে, বপন না করেই কিছু পাওয়া যায় কিনা। এই ধরনের অনৈতিক চেষ্টাই সারা বিশ্বে অর্থনৈতিক মন্দা আনে এবং বিশ্বযুদ্ধের সূত্রপাত ঘটায়।

যারা নিজেদের ব্যক্তিগত দক্ষতা ও যোগ্যতা বাজারজাত করবে তাদের উচিত এই ব্যাখ্যাগুলো নিয়ে চিন্তা করা। এতে করে আমরা বুঝব যে আমরা কোথায় আছি, কীভাবে আছি এবং আমাদের নিজেদের আচরণ সারাদেশ ও পৃথিবীর জন্য কতটা গুরুত্ব বহন করে। এতে করে আমরা আরও বুঝতে পারব যে আমরা এখন যেখানে আছি এবং যা আমরা করছি তার অন্যতম কারণ আমাদের আচরণ! কারণ ও ফলাফলের সূত্র সব জায়গায় খাটে। খারাপ কারণ আনে খারাপ ফলাফল। আর ভালো কারণ আনে ভালো ফলাফল। এই কারণ ও ফলাফল সূত্র সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে। ব্যবসা-বাণিজ্য, অর্থায়ন, পরিবহন, সবকিছু। এই একই সূত্র আপনার, আমার, এই দেশের আর্থিক অবস্থা নিয়ন্ত্রণ করে। কারণ ও ফলাফল সূত্র একজন ব্যক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং তার অর্থনৈতিক অবস্থা নির্ধারণ করে দেয়। আপনি একজন ধনী পুরুষ, তার কারণ আপনি কথা দিয়ে কথা রাখেন, আপনার লেনদেনে কোন জালিয়াতি নেই। ফলাফল, আপনি একজন ধনী পুরুষ। আর যেকেউ গরীব অবস্থায় থাকে সেও এই কারণ ও ফলাফল সূত্রের জন্য দায়ী। সে কথা দিয়ে কথা রাখে না, তার লেনদেনে জালিয়াতি থাকে। ফলাফল, সে একজন গরীব ব্যক্তি।

আপনার গুণ , পরিমাণ এবং চেতনা নির্ধারণ করুন (ডযধঃ রং ুড়ঁৎ “ছছঝ” ৎধঃরহম?)

(ছছঝ সবধহং য়ঁধষরঃু, য়ঁধহঃরঃু ধহফ ংঢ়রৎরঃ). আপনার দক্ষতা ও যোগ্যতা বাজারজাত করার জন্য যা যা দরকার তা পরিষ্কারভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। সাফল্য অর্জন করতে যে কারণ ও সূত্রাবলি দরকার সেগুলোও বর্ণনা করা হয়েছে। যদি-না সেই কারণগুলো অধ্যয়ন এবং বিশ্লেষণ করা, বুঝতে পারা এবং প্রয়োগ করা হয়, কোন ব্যক্তিই তার সেবা কার্যকরভাবে বাজারজাত করতে পারবে না। প্রত্যেক ব্যক্তিকে অবশ্যই তার নিজের জন্য, ব্যক্তিগত দক্ষতা বিক্রয়ের জন্য নিজেকে বিক্রয়কর্মী হতে হবে। এখন আমরা আলোচনা করব একজন ব্যক্তির গুণ, পরিমাণ এবং চেতনা নিয়ে। একে সংক্ষেপে ‘গপচ’ বলা হয়। আপনার গুণ ও পরিমাণ এবং যে চেতনার মধ্য দিয়ে আপনি কাজ করেন তা আপনার কর্মক্ষেত্রে আপনার সাফল্য নিশ্চিত করতে বিরাট ভূমিকা পালন করে। ব্যক্তিগত সেবা কার্যকরভাবে বাজারজাত করার জন্য, (যার মানে হচ্ছে একটি স্থায়ী বাজারজাত, একটি সন্তোষজনক দামে, স্বস্তিদায়ক শর্ত নিয়ে), একজনকে অবশ্যই ‘গপচ’ পদ্ধতি মেনে চলতে হবে। যার মানে হচ্ছে গুণ + পরিমাণ + উপযুক্ত সহযোগিতার চেতনা = সাফল্য। এই পদ্ধতি অবলম্বন ও অনুসরণ করলে আপনার সাফল্য নিশ্চিত। তবে মনে রাখবেন, ‘গপচ’ পদ্ধতিকে কিন্তু অবশ্যই বেশি বেশি প্রয়োগ করে একটি অভ্যাসে মতো করে গড়ে তুলতে হবে!

আসুন আমরা পদ্ধতিটি বিশ্লেষণ করি যাতে নিশ্চিত হতে পারি যে আমরা এর মানে একদম ঠিক বুঝেছি।

১. গুণ। আপনার দায়িত্বের প্রতিটি তথ্য সম্বন্ধে আপনার জানা উচিত। আপনার পদ সম্বন্ধীয় তথ্যাবলি। এই দায়িত্ব পালন করতে যেসব গুণ দরকার সেগুলো অর্জনের চেষ্টা করুন। নিজের মনের মধ্যে সর্বদা এই চিন্তা রাখবেন যে আমাকে সর্বদা মহান এবং শ্রেষ্ঠ দক্ষতা অর্জন করতে হবে।

২. পরিমাণ। পরিমাণ বলতে বুঝানো হয়েছে আপনার অভ্যাসকে। যা হচ্ছে আপনি দায়িত্ব পালন করতে সদাপ্রস্তুত। আপনার মধ্যে নিজেকে উন্নত করার চিন্তা আছে, নিজের দক্ষতা ও যোগ্যতা বৃদ্ধির মনোভাব আছে। আপনি অনুশীলন ও অভিজ্ঞতার মাধ্যমে আপনার দক্ষতা ও যোগ্যতাকে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি করবেন। নিজেকে উন্নত করার চিন্তাকে একটি অভ্যাসে পরিণত করুন। আমি অভ্যাস শব্দের প্রতি আবারও জোর দিচ্ছি। এই অভ্যাসই আপনাকে সফল করবে।

৩. চেতনা। সহযোগিতার চেতনা নির্মাণ করা উচিত মানে এমন ধরনের অভ্যাস যেমন সম্মত হওয়ার প্রতি, সঙ্গীদের সাথে সমসুর আচরণ এবং সহযোগিতা করার মনোভাব পোষণ করা উচিত।

আপনার চাকরি বজায় রাখতে, আপনার সম্ভাবনা বজায় রাখতে আপনার বর্তমান গুণ ও পরিমাণ যথেষ্ট নয়। কারণ বাজার সর্বদা পরিবর্তনশীল। এই পরিবর্তিত বাজারে আপনাকে সর্বদা চলমান দক্ষতা ও বিষয়ের সাথে নিজেকে প্রস্তুত রাখতে হবে। [তাই বলে যখন-তখন ফেসবুক চালাবেন বা ইউটিউব দেখবেন তা হবে না।] এরপর আপনার মধ্যে সহযোগিতার চেতনা নির্মাণ করতে হবে। আপনার দাম বৃদ্ধির জন্য এই সহযোগিতার চেতনা বজায় রাখা একটি শক্তিশালী নির্ধারক। আপনি এখন চাকরিতে যে বেতন পান, আপনার সহযোগিতার চেতনা বৃদ্ধির ফলে আপনি আরও বেশি বেতন পাবেন। এটা যে সবসময় টাকাই হতে হবে তা নয়। আপনি বিভিন্নভাবে, নানান দিক থেকে অনেক ধরনের সুবিধা পাবেন যা আপনার কল্পনারও বাইরে।

এন্ড্রু কার্নেগি তার বর্ণনায় এই দিকটির প্রতি গুরুত্ব দিয়েছেন। সাফল্যের দিকে নেতৃত্ব দিতে এই ব্যাপার অন্যান্য অনেক বিষয়ের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তিনি সবচেয়ে জোর দিয়েছেন সহযোগিতার চেতনার প্রতি, সহকর্মীদের সাথে সমসুর আচরণের প্রয়োজনীয়তার প্রতি।

তিনি এই ব্যাপারটির প্রতি গুরুত্ব দিয়েছেন যে তিনি কোন ব্যক্তিকে বেতন দিয়ে কাজে নিযুক্ত করবেন না, তার কাজের পরিমাণ যত বেশিই হোক না কেন অথবা তার কাজের গুণটা যত দক্ষই হোক না কেন, যদি-না সে একটা সমসুর চেতনায় কাজ করে। কার্নেগি সহযোগিতার চেতনার প্রতি, সহকর্মীদের সাথে সমসুর আচরণের প্রয়োজনীয়তার সবচেয়ে বেশি জোর দিয়েছেন। সমসুর মানে দুইজন বা ততোধিক ব্যক্তির মধ্যে মানসিক বোঝাপড়া এবং স্পষ্টতা বিরাজ করা। আপনার বন্ধু রাইয়ান, সে একটা কাজে সফল হয়েছে, তাই আপনিও একই খুশির চেতনায় আনন্দিত হয়েছেন অথবা রাইয়ান একটা কাজে ব্যর্থ হয়েছে এবং দুঃখ পেয়েছে, তাই আপনিও একই দুঃখের চেতনায় দুঃখিত হয়েছেন। একেই বলে সমসুর চেতনা। একজন ব্যক্তি ব্যর্থ হলে তার দুঃখে দুঃখ প্রকাশ করা, তাকে সান্তনা দেওয়া, পুনরায় চেষ্টা করার প্রতি উৎসাহ দেওয়াই হচ্ছে সমসুর চেতনা। সহযোগিতার চেতনা বজায় রাখতে অমায়িক, মনোরম এবং শোভন (ধমৎববধনষব) স্বভাবের হওয়া দরকার। অমায়িক স্বভাব একটি চারিত্রিক গুণ। আমি আপনাকে তুচ্ছ বিষয়ে অমায়িক হওয়ার কথা বলছি যাতে তর্ক এড়ানো যায়। কিন্তু নীতির প্রতি নয়।

কার্নেগি তার বক্তব্য প্রমাণ করার জন্য যে তিনি এই গুণের ওপর একটি উচ্চ মূল্য বসিয়েছেন, তিনি অনেক পুরুষকে এই বিষয়ে শিক্ষা দেন। যারা তার নীতি মেনে চলে নিজেদের প্রচুর সম্পদশালী করেছে। যারা তার নীতিগুলো মানতে পারেনি, তাদেরকে সরে গিয়ে অন্যদের জায়গা করে দিতে হয়েছে। একজন সমসুর চেতনায় নীতিবান পুরুষ অন্য পুরুষ ও নারীদের সুযোগ দেয় তার নীতিকে তাদের মধ্যে গ্রহণ করার এবং এই নীতি প্রয়োগ করে সম্পদশালী হওয়ার।

আরেকটি গুণ সম্পর্কে বলতে চাই। এটা হচ্ছে একটি আনন্দদায়ক ব্যক্তিত্ব। আমাদের জীবনে আনন্দদায়ক ব্যক্তিত্ব বা হাসিখুশি মেজাজের গুরুত্ব অনেক। কারণ এই ব্যাপার একজনকে উপযুক্ত চেতনায় সেবা সম্পন্ন করার প্রতি সক্ষম করে। যদি একজনের মধ্যে একটি আনন্দদায়ক ব্যক্তিত্ব ও সেবা সম্পন্ন করার চেতনা থাকে, তবে এই সম্পদই তাকে অন্য সবার থেকে আলাদা করে দেয়। অন্য যেকোন ব্যক্তি থেকে তাকে খুব সহজেই আলাদা চোখে দেখা হয় এবং স্মরণ রাখা হয়। এমন এক ব্যক্তি যে হাসিখুশি এবং সদা সহযোগিতা করতে প্রস্তুত, এমন ব্যক্তিকে কে না মনে রাখে! তার এই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যই তাকে সফলতার দিকে নিয়ে যায়। একটি হাসিখুশি মনোভাব বা একটি আনন্দদায়ক আচরণ না থাকলে তার বিপরীতে অন্য কোন গুণই কাজে লাগে না।


আপনার দক্ষতার উৎকৃষ্ট মূল্য

ব্যক্তিটি যার আয় সম্পূর্ণভাবে আসে ব্যক্তিগত দক্ষতা বিক্রয় করে সে একজন পণ্য বিক্রয়কারী সওদাগরের চেয়ে কম নয় এবং এটা যোগ করলে ভালো হবে যে, এমন এক ব্যক্তির সেবা পরিচালনার জন্য নিয়ম হচ্ছে একদম সেই একই নিয়মের মতো যেমন একজন সওদাগর তার পণ্যদ্রব্য বিক্রয় করতে প্রয়োগ করে থাকে।

আমি এটাতে জোর দিই। কারণ আমাদের দেশের বেশির ভাগ লোকজনই নিজের হাতে কাজ করে, অনেক বড় বড় প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে। আমি এসব প্রতিষ্ঠানে কর্মরত লাখো শ্রমজীবী, কর্মজীবীদের কথাই বলছি। তারা তাদের ব্যক্তিগত সেবা বিক্রয় করেই তাদের জীবন নির্বাহ করে। আপনি যদি নিজের দক্ষতা দিয়ে কোথাও চাকরি করতে চান, তবে আপনাকে অবশ্যই আপনার দক্ষতাকে আরও শাণিত করতে হবে। আপনাকে আরও যোগ্য হতে হবে। তবেই আপনি আপনার দক্ষতার উৎকৃষ্ট মূল্য পাবেন। অনেকেই মনে করে আমি যে কাজটুকু করছি কেবল সেই কাজ করলেই হবে, আর কিছু করা লাগবে না। এটা আসলে ভুল ধারণা। আপনি যখন একটি দায়িত্বের সাথে যুক্ত হবেন, কোথাও চাকরি নিবেন, তখন আপনি যে পণ্য বিক্রয় করেন সেটাকে যতটা ভালো এবং আকর্ষণীয় হতে হবে, ঠিক ততটাই আপনার নিজেকেও ততটা ভালো এবং আকর্ষণীয় হতে হবে। লোকজন আপনাকে দেখে আপনার পণ্য কিনবে অথবা আপনার কোম্পানি সম্পর্কে ধারণা নিবে।

নতুন অর্থনৈতিক ধারণা, যা হচ্ছে সহযোগিতার অর্থনীতি। এই ধারণা মালিক ও কর্মচারীকে বাধ্য করেছে একে অপরের সাথে অংশীদারত্বে কাজ করার জন্য। তাদেরকে জনগণের অধিকার নিয়ে চিন্তা করতে বাধ্য করেছে। নতুন নতুন উদ্যোক্তা তৈরি হচ্ছে যারা জনগণকে আরও সেবা, আরও উন্নত সেবা দিতে বদ্ধপরিকর।

আগে ছিল ‘নিলে নেন, না নিলে ভাগেন!’। এই ধরনের রীতিনীতির এখন মেয়াদ শেষ। এখন এটার পরিবর্তে জিজ্ঞেস করা হয় ‘আমি আপনাকে আর কীভাবে সাহায্য করতে পারি? অথবা আপনার আর কী লাগবে?’ এটাকে বলে সেবা করার মনোভাব নিয়ে ব্যবসা করা। অবশেষে ব্যবসার মধ্যে অধিক-চাপ প্রয়োগের পদ্ধতির ঢাকনা উড়ে গেছে। সেখানে পুনরায় ঢাকনা রাখার কোন প্রয়োজন নেই। কারণ, ভবিষ্যতে ব্যবসা পরিচালিত হবে সহযোগিতা এবং সেবার মনোভাব থেকে। কোন চাপ বা বল প্রয়োগ করার দরকার নেই।

আপনার মস্তিষ্কের প্রকৃত মূল্য হয়তো নির্ধারণ হবে সেই পরিমাণ আয় দ্বারা যা আপনি উৎপাদন করতে পারেন (আপনার সেবা বাজারজাতের দ্বারা)। একটি ন্যায্য আচরণ, সেবা এবং সহযোগিতা করার মনোভাব আপনার বাৎসরিক আয়কে কয়েকগুণ বৃদ্ধি করবে। মনে রাখবেন, টাকা আপনার আচরণের চেয়ে বেশি দামী নয়। আচরণের সামনে টাকাকড়ি অনেক কম মূল্যবান। ভালো আচরণ, সেবা এবং সহযোগিতার মনোভাব দিয়ে আপনি যত টাকা আয় করতে পারবেন তা শুধু টাকা দিয়ে কখনো আয় করতে পারবেন না।

এবার মস্তিষ্কের কথা বলি। মস্তিষ্কের একটি অংশ হচ্ছে মন। আর এই মন থেকে, মনের চিন্তা থেকেই আমাদের আচরণ তৈরি হয়। আমরা যা চিন্তা করি আমরা তাই। এজন্য মস্তিষ্ক অন্য যেকোন জিনিসের চেয়ে অনেক দামী জিনিস। মস্তিষ্ক এমন এক জিনিস যার মূল্য কখনো কমানো অথবা হ্রাস করা যায় না। আপনি হতাশ হতে পারেন, কিন্তু আপনার মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা কখনো কমবে না। কেউ আপনার মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা চুরিও করতে পারবে না অথবা আপনি এই ক্ষমতাকে ব্যবহার করে যে শেষ করতে পারবেন তাও নয়। অধিকন্তু, ব্যবসা পরিচালনার জন্য টাকাপয়সা অনেক বেশি দরকারি বলে মনে হয়, কিন্তু মস্তিষ্কের তুলনায় তা এতই মূল্যহীন যতটা একটা বালির ঘর। যতক্ষণ পর্যন্ত না অর্থ কিছু ক্রিয়াশীল মস্তিষ্কের সাথে যুক্ত হতে পারছে ততক্ষণ অর্থের নিজস্ব কোন দাম নেই। ক্রিয়াশীল বা কার্যকর মস্তিষ্ক বলতে আমি বলতে চাচ্ছি আপনার জীবনে একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য সম্পর্কিত মাথাগুলো অথবা আপনার দলের লোকজনের কথা। আপনার ঐক্যমন দলের মাথাগুলোকে একত্র করুন। একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যের দিকে ধাবিত করুন। দেখবেন পর্যায়ক্রমে সাফল্য চলে আসবে। এভাবে কাজ করলে সাফল্য অবধারিত।


ব্যর্থতা হওয়ার ৩০টি প্রধান কারণ; এগুলোর কতটি আপনাকে পিছনে ধরে রেখেছে?

যেসব পুরুষ ও নারী তাদের সর্বাত্মক আগ্রহ নিয়ে চেষ্টা করে, কিন্তু তবুও ব্যর্থ হয় তাদের ঘটনার চেয়ে দুঃখজনক ঘটনা আর হয় না! এটা কেন দুঃখজনক? যদি আপনি অল্প কিছু সফল লোকের সাথে তুলনা করেন, তবে এটা হয়তো দুঃখজনক একটি ঘটনা।

আমি কয়েক হাজার পুরুষ ও নারীকে বিশ্লেষণ করার সুযোগ পেয়েছি। তাদের ৯৮% যাদেরকে শ্রেণিভুক্ত করেছি ‘ব্যর্থ’ রূপে। আসলে আমি দেখলাম আমাদের সভ্যতা এবং শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে কিছু মৌলিক ভুল রয়েছে। যা ৯৮% লোককে জীবনে ব্যর্থতার মধ্যে দিয়ে যাওয়ার অনুমোদন দিচ্ছে। কিন্তু আমি এ বই এই উদ্দেশ্যের জন্য লিখিনি যে বিশ্বের সঠিক এবং ভুলকে আদর্শায়িত করব; সেইজন্য হয়তো এ বইয়ের চেয়ে ১০০ গুণ বড় বইয়ের দরকার।

আমার বিশ্লেষিত কাজ প্রমাণ করেছে যে সেখানে ব্যর্থতার ৩০টি প্রধান কারণ রয়েছে এবং সাফল্য লাভের জন্য ১৩টি প্রধান সূত্র রয়েছে যার মাধ্যমে লোকজন নিজেদের সৌভাগ্য অর্জন করতে পারে। সাফল্যের ১৩টি প্রধান সূত্র নিয়েই এ বই। প্রতিটি অধ্যায়ে এক একটি সূত্রের বিস্তারিত বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। আর এখানে ব্যর্থতার ৩০টি প্রধান কারণ বর্ণনা করা হলো। আপনি যখন তালিকার ওপর দিয়ে যাবেন, তখন এটা দ্বারা নিজেকে খুঁজে দেখুন, একদম আগা থেকে গোঁড়া পর্যন্ত, এই উদ্দেশ্য আবিষ্কারের জন্য যে আপনার ও আপনার সাফল্যের মধ্যে এগুলোর কতটি এবং কোনটি দাঁড়িয়ে আছে।

১। প্রতিকূল জন্মগত অবস্থা। মস্তিষ্ক জনিত সমস্যা নিয়ে অনেকে জন্ম গ্রহণ করে। সেটা খুব একটা ভালো অবস্থা নয়। তারপরেও সুযোগ আছে, তবে অল্প। তবে এই ত্রুটিকেও জয় করে সাফল্য অর্জন করা যায়। এই ত্রুটিকে জয় করতে হলে দরকার ঐক্যমন দল। আপনার ঐক্যমন দল এই ত্রুটি দূর করে আপনার ও আপনার সাফল্যের মধ্যে সেতু বন্ধন তৈরি করবে। সেতু বন্ধন মানে নদীর অপর পাড়ে একটি চর বা অঞ্চলকে বিভিন্ন সুযোগসুবিধা দিয়ে উন্নত এবং শক্তিশালী করতে একটি সেতু নির্মাণ করা। এই সেতু বন্ধন উভয় পাশের অঞ্চলকে লাভবান এবং সমৃদ্ধ করবে। নিজের লাভের জন্য পর্যবেক্ষণ করুন। যাইহোক, এই একটিই হচ্ছে একমাত্র যা ব্যর্থতার ৩০টি কারণের মধ্যে হয়তো কোন স্বতন্ত্র ব্যক্তি দ্বারা সহজভাবে সংশোধন করা যায় না।

২। জীবনে একটি উত্তমভাবে বর্ণিত উদ্দেশ্যের অভাব। সেখানে সাফল্যের কোন আশাই নেই সেই ব্যক্তির জন্য যার একটি কেন্দ্রীয় উদ্দেশ্য নেই অথবা নির্দিষ্ট কোন গন্তব্য নেই যা নিয়ে যাবে তার বিজয় মুকুটের দিকে। আমি যাদের বিশ্লেষণ করেছি তার মধ্যে দেখেছি প্রত্যেক একশজনের মধ্যে আটানব্বইজনেরই কোন নির্দিষ্ট লক্ষ্য নেই। তারা মধ্যম অবস্থার ওপরে লক্ষ্য নিতে পারে না। তাদের মধ্যে উচ্চাশার অভাব রয়েছে।

৩। মধ্যম অবস্থার ওপরে লক্ষ্য না নেওয়া এবং উচ্চাশার অভাব। আমরা কোন আশার প্রস্তাব করতে পারি না সেই ব্যক্তির প্রতি যে এতটা উদাসীন যে জীবনে সামনে এগিয়ে যেতে চায় না এবং যে একটি নির্দিষ্ট আকাক্সক্ষার দাম দিতে ইচ্ছুক নয়। [ফজলে রাব্বির কথাÑআমি নিজেও অনেক তরুণকে বিশ্লেষণ করেছি। বাংলাদেশের বহু তরুণই একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য নিতে অনাগ্রহী। তাদের বক্তব্য হচ্ছে অনেক কাজ, অনেক কিছু করতে হবে, একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য নিলে কী হবে। কিন্তু আপনার যদি একটি নির্দিষ্ট গন্তব্য না থাকে তাহলে আপনি অনেক কাজ করেও সবশেষে পৌঁছাবেন কোথায়? এজন্যই তারা কোন একটি কাজ আরম্ভ করে, একটু কাজ করে, তারপর ছেড়ে দেয়, হতাশ হয়ে পড়ে। কিন্তু মুখে বলে কাজ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে গেছি। অবশেষে আমি একজনকে একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য নিতে সহায়তা করেছি। তার পরিশ্রম, ধৈর্য এবং ধীরপদে এগিয়ে চলা দেখে অন্যরা তো বটে আমি নিজেই অবাক হয়েছি। তার নাম উল্লেখ করতে পারছি না। তবে পাঠক, আপনি নিজেও আপনার নিজের জীবনে একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে দেখতে পারেন যে এটা কতটা কার্যকরী। আমার বিশ্বাস আপনিও অবাক হবেন।]

৪। অপর্যাপ্ত শিক্ষা। এই একটি প্রতিবন্ধকতা যা তুলনামূলক সহজভাবে অতিক্রম করা যায়। অভিজ্ঞতা প্রমাণ করেছে যে সর্বোৎকৃষ্ট-শিক্ষিত লোকজন হচ্ছে তারাই যারা স্ব-শিক্ষিত বা ‘স্ব-নির্মিত’। নিজেই নিজেকে নির্মাণ করেছে। এটা তৈরি করতে হলে একটি কলেজ ডিগ্রির চেয়েও বেশি শিক্ষা একজনকে নিতে হয়। যেকোন ব্যক্তি যে স্বশিক্ষিত সে অন্যদের অধিকার লঙ্ঘন না করে তার জীবনে সে যা চায় তাই পেতে শিখেছে। শিক্ষা আসলে গঠিত হয় অনেক বেশি জ্ঞান দিয়ে নয়; বরং সেই জ্ঞান দিয়ে যা কার্যকর এবং অধ্যবসায়ীভাবে প্রয়োগ করা হয়। একজন মানুষ কতটা জানে কেবল তার ভিত্তিতে তাকে বেতন দেওয়া হয় না; বরং সে যতটা জানে তা দিয়ে সে কী করেছে সেই ভিত্তিতে তাকে মূল্যায়ন করা হয়। [যুক্তরাষ্ট্রের কলোরাডো রাজ্যের ডেনভারে লেখকদের মিলনমেলা  নামক একটি জায়গা আছে। সেখানে একজন ব্যক্তির স্ব-শিক্ষিত বা ‘স্ব-নির্মিত’ অবস্থার প্রতীক স্বরূপ একটি ভাস্কর্য আছে। নিচের ছবিতে তাই দেখান হলো।]

 

৫। আত্ম-শৃঙ্খলার অভাব। শৃঙ্খলা আসে আত্ম-নিয়ন্ত্রণ থেকে। এটার মানে একজন মানুষকে তার সব নেতিবাচক গুণকে অবশ্যই নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। আপনার আশেপাশের অবস্থা নিয়ন্ত্রণ করার পূর্বে, আপনাকে অবশ্যই প্রথমে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। স্ব-কর্তৃত্ব মানে নিজের ওপর নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে কঠিনতম লড়াই যাতে আপনাকে জয়ী হতেই হবে। যদি আপনি আপনার আত্মাকে মানে নিজেকে অধ্যবসায় দ্বারা বশীভূত করতে না পারেন, তাহলে আপনি নিজের দ্বারাই পরাভূত হবেন। আপনি হয়তো নিজেকে একই সাথে সবচেয়ে বড় বন্ধু এবং সবচেয়ে বড় শত্রু রূপে দেখবেন। অনেকেই আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বলে, ‘আমিই আমার সবচেয়ে বড় শত্রু’। এর কারণ আত্ম-শৃঙ্খলার অভাব।

৬। অসুস্থ স্বাস্থ্য। কোন ব্যক্তিই ভালো স্বাস্থ্য ব্যতীত অসাধারণ সাফল্য উপভোগ করতে পারে না। অসুস্থ স্বাস্থ্যের কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে কর্তৃত্ব এবং নিয়ন্ত্রণ। আরও আছে, যেমন:

ক. অতিরিক্ত খাবার গ্রহণ স্বাস্থ্যের প্রতি সহায়ক নয়

খ. চিন্তার ভুল অভ্যাস; ফলে নেতিবাচক অভ্যাস এবং ভঙ্গি প্রকাশ পায়

গ. যৌনতার প্রতি অতিরিক্ত প্রশ্রয় দান এবং ভুল প্রয়োগ

ঘ. উপযুক্ত দৈহিক ব্যায়ামের অভাব

ঙ. বিশুদ্ধ বাতাসের অভাব, ফলে শ্বাসপ্রশ্বাসের সমস্যা তৈরি হয়

৭। প্রতিকূল পরিবেশের মধ্য দিয়ে বেড়ে ওঠা শৈশবকাল। ‘একটি গাছ ঠিক ততটাই বেড়ে ওঠে যত পাতার বোঝা এটা বহন করতে পারবে।’ বেশির ভাগ লোক যারা অপরাধের প্রবণতা অর্জন করেছে, এর কারণ তাদের শৈশবের খারাপ পরিবেশ এবং অনুপযুক্ত সহযোগীদের জন্য। [‘সৎ সঙ্গে স্বর্গ বাস, অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ!’]

৮। দীর্ঘসূত্রতা। দীর্ঘসূত্রতা মানে কাজ জটিল এবং দীর্ঘস্থায়ী করার প্রবণতা বা গড়িমসি করার অভ্যাস। [আরেকটি শব্দ আছে দীর্ঘসূত্রিতা, এর মানে চিরক্রিয়তা বা বহুদিন ধরে কাজ করে যাওয়া।] যাইহোক, দীর্ঘসূত্রতা হচ্ছে ব্যর্থতার সবচেয়ে সাধারণ কারণ। শতকরা ৯০% ব্যর্থ লোকের মধ্যে এই ব্যাপার পাওয়া যায় যে সে সফল হতে পারত যদি সে শুধু কাজটি করত। অনেকেই বলে, ‘আমি এই কাজ করলে ঠিকই সফল হতাম।’ এটাই দীর্ঘসূত্রতা। সে এই কাজ জীবনেও করতে পারবে না।

দীর্ঘসূত্রতাকে তুলনা করা যায় একজন বৃদ্ধ ব্যক্তির সাথে। এই ‘বৃদ্ধ ব্যক্তির দীর্ঘসূত্রতা’ প্রত্যেক মানব সত্তার ছায়ার মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে। তার সুযোগের জন্য অপেক্ষা করছে যাতে একজনের সাফল্যের সম্ভাবনাকে নষ্ট করা যায়। আমাদের মধ্যে বেশির ভাগ মানুষের জীবনই ব্যর্থতার মধ্য দিয়ে যায়। কারণ আমরা ‘সঠিক সময়ের’ অপেক্ষা করি। সময় হলে গুরুত্বপূর্ণ কোন কাজ করব, সময় হলে মূল্যবান কিছু শুরু করব। আরে ভাই! এই সময়টা আসবে কখন? উত্তর হচ্ছে “জীবনেও না”। সময় আসে না। সময়কে আনতে হয়, তৈরি করতে হয়, নির্মাণ করতে হয়। অপেক্ষা করবেন না। সঠিক সময় কখন আসবে তার জন্য বসে থাকবেন না। আপনি যেখানে দাঁড়িয়ে আছেন সেখান থেকেই শুরু করুন এবং আপনার কাছে যা যন্ত্রপাতি আছে তাই নিয়ে কাজ করুন। দেখবেন আরও যা যা দরকার তা আপনি কাজ করতে করতে, সামনে এগিয়ে যেতে যেতে পেয়ে যাবেন। একমাত্র তখনই দেখবেন সঠিক সময় এসে গেছে।

৯। অধ্যবসায়ের অভাব। আমাদের মধ্যে বেশির ভাগ মানুষ যেকোন কাজের ‘আরম্ভ’ বেশ ভালোভাবেই করে। প্রচুর উৎসাহ উদ্দীপনায় আরম্ভ করে। কিন্তু যেই না কিছুদূর আগায় সেই মুখ থুবড়ে পড়ে। ‘শেষ’ হয় দরিদ্রভাবে। অধিকন্তু, পরাজয়ের প্রথম যে চিহ্ন আমি দেখি সেটা হচ্ছে লোকজনের হাল ছাড়ার অভ্যাস। কাজ ছেড়ে দেওয়ার একটা তাড়া। এমন অবস্থায় অধ্যবসায়ের বিপরীতে প্রতিস্থাপন যোগ্য কিছু নেই। যে ব্যক্তির নীতি এবং চরিত্র গঠিত হয় অধ্যবসায় দিয়ে তার মধ্যে আপনি দেখবেন ‘এক জ্বলন্ত আগুন’। যেই আগুনের সাথে লড়াই করতে করতে দীর্ঘসূত্রতা, অলসতা এবং ব্যর্থতাও অবশেষে ক্লান্ত হয়ে যায়। এজন্যই ব্যর্থতা কখনো অধ্যবসায়ের সাথে কুলাতে পারে না।

১০। নেতিবাচক ব্যক্তিত্ব। সেই ব্যক্তির জন্য কোন আশা নেই যে একটি নেতিবাচক ব্যক্তিত্বের মাধ্যমে লোকজনকে হটিয়ে দেয়। সাফল্য আসে ক্ষমতার পদ্ধতি প্রয়োগ করার মাধ্যমে এবং ক্ষমতা অর্জন করা যায় অন্যান্য লোকের সহযোগিতার মাধ্যমে। [ক্ষমতা কীভাবে অর্জন এবং প্রয়োগ করতে হয় তা সম্পর্কে দশম অধ্যায়ে বলা হয়েছে।] একটি নেতিবাচক ব্যক্তিত্ব কখনো সহযোগিতা ঘটায় না।

১১। যৌন উত্তেজনাকে নিয়ন্ত্রণের অভাব। যৌনশক্তি হচ্ছে সব উত্তেজনার মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী এবং ক্ষমতাশালী, যা লোকজনকে কাজের দিকে চালিত করে। কারণ এটা হচ্ছে সব আবেগের মধ্যে সবচেয়ে বলশালী। এটা অবশ্যই নিয়ন্ত্রিত হতে হবে, অন্যান্য মাধ্যমে যেমন, কর্মশক্তিতে রূপান্তর এবং পরিবর্তিত হতে হবে। [অধ্যায় এগারোতে পাবেন যৌনশক্তি রূপান্তরের রহস্য।]

[এজন্যই পূর্বে আমাদের গ্রামগঞ্জে ছেলেরা কোন কাজকর্ম না করলে, অলস বসে থাকলে তাদের বিয়ে দিয়ে দিত। তারপর তারা বাধ্য হত কাজ করতে। কিন্তু এখন তাও হয় না। কারণ বিয়ে দিলেও, ছেলেদের কোন একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য না থাকার কারণে তাকে বাধ্য হয়ে কোনরকম একটা কাজ বা চাকরি করে দিন অতিবাহিত করতে হয়। আপনি যাই করুন না কেন, আপনি যদি আপনার জীবনে একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য না নেন, তবে আপনি ফুটবল মাঠে ফুটবল নিয়ে খুব উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে দৌড়ে যাবেন, কিন্তু গোল করার জন্য কোন গোলপোস্ট পাবেন না। এই অনন্তহীন দৌড় কোনদিন শেষ হবে না। তবে আপনার পরিশ্রম হবে, আপনি অনেক কাজ করবেন। কিন্তু জীবন শেষে দেখবেন স্কোরবোর্ড শূন্য।]

১২। ‘কিছু না দিয়ে কিছু পাওয়ার চেষ্টা’ এটার প্রতি অনিয়ন্ত্রিত আকাক্সক্ষা। আপনি কি কখনো জুয়া খেলেছেন? ‘কিছু না দিয়ে কিছু পাওয়ার চেষ্টা’ হচ্ছে জুয়া প্রবৃত্তি। এই প্রবৃত্তি বা মনোভাব লাখ কোটি মানুষকে ব্যর্থতার দিকে ঠেলে দেয়। আপনি একটু ইতিহাস ঘাটলেই এর সাক্ষ্য-প্রমাণ পাবেন। অথবা আপনি যদি ১৯২৯ সালের ওয়াল স্ট্রিট শেয়ার বাজারের পতন নিয়ে একটু অধ্যয়ন করেন, তবে দেখবেন লাখো মানুষ কীভাবে শেয়ার বাজারের ওপর জুয়া খেলে টাকা আয়ের চেষ্টা করেছিল। লাখো মানুষ, যারা শেয়ার বাজার সম্পর্কে কিছু জানেও না, তারা তাদের এই ‘কিছু না দিয়ে কিছু পাওয়ার চেষ্টা’ বা জুয়াড়ি মনোভাব নিয়ে অর্থ আয়ের চেষ্টা করছিল। ফলাফল তো আপনি জানেনই।

১৩। সিদ্ধান্তকে সঠিকভাবে বর্ণনার অভাব। সফল ব্যক্তিরা দ্রুত সিদ্ধান্তে পৌঁছায় এবং যদি দরকার হয় এগুলোকে খুব ধীরভাবে পরিবর্তন করে। তারমানে সহজে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে না। অন্যদিকে ব্যর্থ ব্যক্তিরা খুব ধীরভাবে সিদ্ধান্তে পৌঁছায় এবং যদি দরকার হয় এগুলোকে খুব দ্রুতভাবে পরিবর্তন করে। আর তারা এটা প্রায়ই করে। সিদ্ধান্তহীনতা এবং দীর্ঘসূত্রতা হচ্ছে যমজ ভাই। যেখানে একজনকে পাওয়া যায়, অন্যকে স্বাভাবিকভাবেই সেখানে পাওয়া যায়। এই জোড়াকে আগেই মেরে ফেলুন; নতুবা তারা আপনাকে ব্যর্থতার যাতাকলে পিষে শেষ করে ফেলবে।

১৪। ৬টি মূল ভীতির একটি বা অধিক ভীতির উপস্থিতি। আপনার জন্য এই ভীতিগুলোকে পরবর্তী একটি অধ্যায়ের মধ্যে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এগুলোর ওপর অবশ্যই কর্তৃত্ব করতে হবে। আপনার দক্ষতা এবং যোগ্যতা বাজারজাত করার আগেই এই ভীতিগুলোর ওপর কর্তৃত্ব করতে হবে।

১৫। বিবাহে ভুল সঙ্গী নির্বাচন। এটা ব্যর্থতার আরও একটি সাধারণ কারণ। প্রায় সব ব্যর্থ মানুষের মধ্যেই এটা পাওয়া যায়। বৈবাহিক সম্পর্ক মানুষের মধ্যে অন্তরঙ্গ ঘনিষ্ঠতা তৈরি করে। যদি-না এই সম্পর্কে সমসুর চেতনা বিরাজ করে, ব্যর্থতা স্বাভাবিকভাবেই অনুসরণ করবে। তারচেয়েও বড় কথা হচ্ছে, এটা এমন এক আকারের ব্যর্থতা তৈরি করবে যা দুর্দশা এবং সুখহীনতা দ্বারা চিহ্নিত করা যায়। এই ব্যর্থতা পুরোপুরি দৃশ্যমান। সবচেয়ে মারাত্মক ব্যাপার হচ্ছে ভুল সঙ্গী নির্বাচন করলে ব্যক্তির মধ্যকার সব উচ্চাকাক্সক্ষা ধ্বংস হয়ে যায়। এটা কেবল পুরুষের জন্য নয়, নারীর জন্যও সমানভাবে সত্য।

১৬। অতি-সতর্কতা। যে ব্যক্তি কোন ঝুঁকি নিতে রাজি নয়, সাধারণত তাকে অন্যরা যা কিছু ফেলে গেছে তাই নিতে হয়। অতি-সতর্কতা ততই খারাপ যতটা অল্প-সতর্কতা। উভয়ের বিরুদ্ধেই চরমভাবে সতর্ক থাকতে হবে। আমাদের জীবন অপ্রত্যাশিত ঘটনায় পরিপূর্ণ। আমরা ঝুঁকি নেই বা না নেই, যেকোন সময় আমাদের সাথে অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটতে পারে। এই চিরন্তন সত্যকে স্বীকার করে নেওয়া ভালো।

১৭। ব্যবসায় ভুল সহযোগী নির্বাচন। ব্যবসায় ব্যর্থতার কারণগুলোর মধ্যে এটা সবচেয়ে বড় কারণ। আপনি যদি আপনার দক্ষতা এবং যোগ্যতা দিয়ে চাকরি করতে যান তাহলেও এই বিষয়ে সতর্ক থাকবেন। আপনার মালিক বা নিয়োগকর্তা কেমন সেই সম্পর্কে সতর্ক থাকবেন। এমন একজন নিয়োগকর্তা নির্বাচন করতে হবে যে হবে অনুপ্রেরণাদায়ী এবং যে স্বয়ং বুদ্ধিমান ও সফল। যাদের আমরা ঘনিষ্ঠভাবে সহযোগী আমরা তাদেরই সমকক্ষ হতে চেষ্টা করি। এমন একজন নিয়োগকর্তা তুলে নিন যার সমকক্ষ হওয়াটা মূল্য রাখে।

১৮। কুসংস্কার এবং পূর্বসংস্কার। কুসংস্কার হচ্ছে ভীতির ফলে গঠিত এক রোগ। তাছাড়া এটা হচ্ছে অজ্ঞতারও একটি চিহ্ন। যেসব ব্যক্তি সফল হয় তাদের মনকে তারা উন্মুক্ত রাখে এবং কোন কিছুকেই ভয় পায় না। আর ভয় পেলেও সামনে এগিয়ে যেতে চেষ্টা করে।

১৯। ভুল পেশা নির্বাচন। কোন ব্যক্তি যদি এমন কোন কাজ করে বা চেষ্টা করে যা সে পছন্দ করে না তবে সে কোনদিনই সেই পেশায় সফল হতে পারে না। এমন কাজ করা ব্যক্তির আত্মা এবং হৃদয় কখনো তৃপ্ত হবে না। ব্যক্তিগত সেবাকে বাজারজাত করতে সর্বাধিক প্রয়োজনীয় ধাপ হচ্ছে এমন এক পেশা নির্বাচন করা যাতে আপনি নিজেকে সম্পূর্ণ আন্তরিকতার সাথে ছুঁড়ে দিতে পারেন।

২০। নিজের চেষ্টার প্রতি মনোযোগের অভাব। একজন ‘সবজান্তা’ ব্যক্তি কদাচিৎ কোনকিছুতে দক্ষ হয়। আপনার সব চেষ্টাকে মাত্র একটি নির্দিষ্ট প্রধান লক্ষ্যের প্রতি কেন্দ্রীভূত করুন।

২১। এলোমেলো খরচের প্রতি অভ্যাস। একজন অমিতব্যয়ী ব্যক্তি কখনো সফল হতে পারে না। প্রধান কারণ হচ্ছে সে সম্পূর্ণভাবে দরিদ্র ভীতির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। একটি পদ্ধতিগত সঞ্চয়ের অভ্যাস গঠন করুন। আপনার আয়ের একটি নির্দিষ্ট অংশ (হতে পারে আয়ের ১০% বা ২০%) পাশে সরিয়ে রাখার মাধ্যমে সঞ্চয়ের অভ্যাস গঠন করুন। ব্যাংকের সঞ্চিত অর্থ একজনকে একটি নিরাপদ ভিত্তি দেয় যাতে ভালো চাকরি খুঁজে পাওয়া যায় এবং দরকষাকষি করা যায়। (যেমন আমার এক বন্ধুর কাছে ৪০ হাজার টাকা সঞ্চয় ছিল। সে তার চাকরি ছেড়ে দিয়ে আরও কিছু দক্ষতা অর্জন করেছে এবং আগের থেকে ভালো একটি চাকরির জন্য সাক্ষাৎকার দিচ্ছে। তার সঞ্চয় তাকে চাকরি ছাড়া অন্ততপক্ষে ৬ মাস চলার খরচ জুগিয়েছে। তাই সে নির্বিঘেœ তার কাজে মন দিতে পারছে।) টাকাপয়সা ব্যতীত, একজনকে অবশ্যই তাই নিতে হবে যা মালিকপক্ষ প্রস্তাব দেয়। আর এটা পেয়েই খুশি থাকতে হবে।

২২। গভীর আগ্রহের অভাব। আগ্রহ আছে, তবে এই কোনরকম আরকি। এমন হলে চলবে না। গভীর আগ্রহ ব্যতীত আপনি অন্যের মধ্যে আপনার বিশ্বাসকে পৌঁছে দিতে পারবেন না। অধিকন্তু, গভীর আগ্রহ হচ্ছে সংক্রামক বা ছোঁয়াচে ব্যাপার। যেমন: হাসি। হাসি একটি সংক্রামক বা ছোঁয়াচে ব্যাপার। আমরা কাউকে প্রাণখুলে হাসতে দেখলে আমাদেরও হাসি পায়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কোন শিশুর হাসি দেখলে এটা ঘটে। আপনার আগ্রহও ঠিক এমনই হতে হবে। যে ব্যক্তির গাঢ় আগ্রহ রয়েছে এবং এটা তার নিয়ন্ত্রেণে রয়েছে সে যেকোন গোষ্ঠীর মানুষের কাছেই স্বাগত।

২৩। অধৈর্য। যে ব্যক্তি একটি ‘বদ্ধ’ মন নিয়ে থাকে সে কদাচিৎ উন্নতি করে। অধৈর্য বলতে বুঝাতে চাই এমন এক ব্যক্তি যে জ্ঞান আহরণ করা বন্ধ করে দিয়েছে। অধৈর্যের সর্বাধিক ক্ষতিকর উদাহরণ হচ্ছে ধর্ম নিয়ে অসহিষ্ণুতা, জাতিগত বিদ্বেষ এবং রাজনৈতিক ভিন্ন মতামতকে অশ্রদ্ধা করা।

২৪। অসংযম। সর্বাধিক ক্ষতিকর অসংযমের আকার হচ্ছে এগুলোর সাথে জড়িত থাকা। যেমন: অতিরিক্ত খাবার, সুরাপান এবং যৌন কর্মের সাথে জড়িত থাকা। এর যেকোনটির প্রতি অত্যধিক প্রশ্রয় দান করা সাফল্যের প্রতি মারাত্মক।

২৫। অন্যদের সাথে সহযোগিতার প্রতি অক্ষমতা। অনেক মানুষ তাদের জীবনে সঠিক পথ এবং বড় বড় সুযোগ হারায়। কারণ অন্যদের সাথে সহযোগিতার প্রতি অক্ষমতা। এই ভুল থেকেই অন্য ভুল আরম্ভ হয়। এটা হচ্ছে এমন এক ভুল যা কোন ভালো-পরিচিত ব্যবসায়ী ব্যক্তি বা নেতা সহ্য করবে না।

২৬। এমন ক্ষমতা যা নিজের চেষ্টায় অর্জিত নয়। ধনী ব্যক্তিদের পুত্র, কন্যা ও অন্য যারা উত্তরাধিকার সূত্রে অর্থ পেয়েছে, যা তারা তাদের স্বীয় চেষ্টায় আয় করেনি, তাদের ব্যর্থ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। যার স্বীয় চেষ্টা দ্বারা ধীরে ধীরে ক্ষমতা অর্জন হয়নি, যে উত্তরাধিকার সূত্রে ক্ষমতা পেয়েছে, প্রায়ই দেখা যায় সে ক্ষমতার অপব্যবহার করে। এটা সাফল্যের প্রতি মারাত্মক। হঠাৎ করে যারা ধনী হয় তারা দরিদ্রদের থেকেও ভয়ানক মানসিক রোগে আক্রান্ত।

২৭। ইচ্ছাকৃত অসততা। সততার বিপরীতে প্রতিস্থাপন যোগ্য কোনকিছু নেই। একজন হয়তো পরিস্থিতির চাপে পড়ে সাময়িকভাবে অসৎ হতে পারে। কারণ অনেক সময়ই দেখা যায় পরিস্থিতির ওপর আমাদের কোন নিয়ন্ত্রণ থাকে না। কিন্তু যে ইচ্ছাকৃতভাবে অসৎ তার জন্য কোন আশা নেই। কাছে বা দূরে, তার কাজের জন্য তাকে ধরা দিতেই হবে। সে সম্মান হারাবে। হয়তো তার স্বাধীনতাও হারাতে পারে। এভাবেই সে তার কৃতকর্মের মূল্য দিবে।

২৮। আমিত্ব এবং অহংকার। এ গুণ এমন সেবা দেয় যেন লাল বাতি যা অন্যদের সতর্ক করে যে ‘দূরে থাকুন’। এগুলো সাফল্যের প্রতি মারাত্মক ক্ষতিকর।

২৯। চিন্তা করার পরিবর্তে অনুমান করা। বেশির ভাগ মানুষ পর্যাপ্ত তথ্য নিয়ে, ঠান্ডা মাথায় বসে বিশ্লেষণ করে, পরিকল্পনা তৈরি করে কাজ করতে খুবই অনাগ্রহী বা অলস। এর পরিবর্তে তারা অনুমানের ভিত্তিতে কাজ করতে চায়। তারা অনুমান ভিত্তিক কাজ করতে পছন্দ করে বা হঠাৎ কোন কাজের কথা মনে পড়ল, ‘চল এটা করে ফেলি’, আর কাজটি করে ফেলল। তারপর আকাক্সিক্ষত ফলাফল না পেলে বলে, ‘আমার ভাগ্যে ছিল না।’ অথচ সে যদি পূর্বে তথ্য সংগ্রহ করে বিশ্লেষণ করত, তবে সে সহজেই দেখতে পেত যে এই পদ্ধতিতে কাজ করলে ব্যর্থতা নিশ্চিত।

৩০। পুঁজির অভাব। এটা একটা সাধারণ কারণ। যারা প্রথম ব্যবসা শুরু করে তাদের মধ্যেই এটা বেশি দেখা যায়। পর্যাপ্ত পুঁজি না থাকলে ব্যবসায় আপনার যে ক্ষতি হবে, ভুল হবে সেগুলো সংশোধন করে পুনরায় ব্যবসায় নামতে পারবেন না। একমাত্র ব্যর্থ হয়ে, ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিয়ে পুনরায় নতুন পরিকল্পনা নিয়ে কাজে নামলেই কেবল খ্যাতি পেতে পারেন।

৩১। এটার নিচে, যেকোন বিশেষ ব্যর্থতার কারণের নাম লিখুন যাতে আপনি ভুগছেন। যে নাম আমাদের উপরে উল্লেখিত তালিকায় যুক্ত করা হয়নি।

আপনি যেকোন ব্যর্থতার কারণ খুঁজতে গেলে প্রধানত এই ৩০টি পাবেন। এটা জীবনের এক দুঃখময় ঘটনার বিবৃতি। এই অভিজ্ঞতা তারাই লাভ করে যারা চেষ্টা করে এবং ব্যর্থ হয়। এটা সহায়ক হবে যদি আপনি কারও সাহায্য নেন যে আপনাকে উত্তমভাবে জানে যাতে সে আপনার সাথে তালিকার মধ্য দিয়ে যাবে এবং ৩০টি ব্যর্থতার কারণ বিশ্লেষণ করতে আপনাকে সহায়তা করবে। অথবা আপনি যদি একা একাই চেষ্টা করেন তবে আরও বেশি লাভবান হবেন। বেশির ভাগ মানুষ নিজেদের দেখতে পায় না, যেমন অন্যরা তাদের দেখে। আপনি হয়তো সেই একজন যে নিজেকে দেখতে পায় না।

সতর্কীকরণগুলোর মধ্যে সর্বাধিক পুরাতন হচ্ছে ‘মানুষ, নিজেকে জানো!’ যদি আপনি নিজেকে বা নিজের পণ্যকে সফলভাবে বাজারজাত করতে চান, তবে আপনাকে অবশ্যই নিজের সম্বন্ধে অথবা নিজের পণ্য সম্বন্ধে জানতে হবে। এ সত্য সব ধরনের কাজ করার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। আপনাকে আপনার সব ধরনের দুর্বলতা সম্বন্ধে জানতে হবে যাতে আপনি সেগুলোর ওপর সেতু নির্মাণ করতে পারেন অথবা সেগুলোকে সম্পূর্ণভাবে দূরীভূত করতে পারেন। আপনাকে জানতে হবে আপনার সব শক্তি সম্বন্ধে যাতে আপনি সেগুলোর প্রতি মনোযোগ দিতে পারেন। এতে করে আপনি আপনার চাকরি বা ব্যবসাতে নিজের শক্তিকে প্রয়োগ করতে পারবেন। আপনি নিজেকে জানতে পারবেন কেবল যথার্থ বিশ্লেষণের মাধ্যমে। আর এই বিশ্লেষণ কীভাবে করবেন? সামনে পড়ে যান। সামনেই কিছু প্রশ্ন দেওয়া হয়েছে যা আপনাকে সহায়তা করবে।

এখন এক তরুণ সম্পর্কে বলি। সে একটি পদে চাকরির জন্য একটি কোম্পানিতে আবেদন করে। তাকে সাক্ষাৎকারের জন্য ডাকা হয়। তো ব্যবস্থাপকের সাথে বেশ ভালোই আলাপ হলো। শেষে ব্যবস্থাপক তাকে জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি কত বেতন আশা করছ?’ জবাবে সে বলল, ‘আমি তো তেমন কোন সংখ্যা স্থির করি নাই।’ এটা হচ্ছে একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যের অভাব। তারপর ব্যবস্থাপক বলল, ‘আমরা তোমাকে ঠিক ততটুকুই বেতন দিব যতটুকুর তুমি যোগ্য। তবে আমার এখানে আগে এক সপ্তাহের জন্য কাজ করে দেখাতে হবে।’

আবেদনকারী এবার চটে গেল, ‘অসম্ভব! আমি এখন যেখানে কাজ করি সেখানে আমি বেশ ভালো বেতন পাই। আর আপনার এখানে পরীক্ষামূলক কাজ করার পর যদি আমি নির্বাচিত না হই তবে তো আমি পূর্বের চাকরিও হারাব।’

এজন্য আগেই চিন্তা করুন। বেতনের ব্যাপারও আগেই বলুন। নিজের যোগ্যতাকে সঠিক মাপকাঠিতে মেপে নিন। তারপর অন্য কোথাও যাওয়ার চিন্তা করুন। যেকোন চাকরি খোঁজার আগে দেখে নিন। হয়তো আপনি এখন যেখানে আছেন সেখানেই আপনি যথার্থ মূল্য পাচ্ছেন।

একটি জিনিস চাওয়া, আর সেটাকে নির্দিষ্টভাবে চাওয়ার মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে। সবাই টাকাপয়সা চায়। কিন্তু কত চায়? একজন মানুষ কত টাকা চায়? এটা যদি নির্দিষ্ট করে তবেই সে তার নির্দিষ্ট আকাক্সক্ষার জন্য নিজের পুরো মনোযোগ দিতে পারবে এবং নিত্যনতুন দক্ষতা ও যোগ্যতা অর্জন করে সেই অর্থ পাওয়ার চেষ্টা করবে।

আবার অনেকে বেতনের টাকার ওপর ভিত্তি করে তাদের চাওয়া নির্ধারণ করে। এটা ভুল। আপনার যোগ্যতা আপনার বেতনের চেয়ে অনেক বেশি। আপনার দক্ষতা, যোগ্যতা ও সম্ভবনা কখনো আপনার বেতনের টাকায় পরিমাপ করা যাবে না এবং যায়ও না। আপনার মূল্য তখনই প্রতিষ্ঠিত হবে যখন আপনি আপনার দক্ষতা এবং যোগ্যতাকে সম্পূর্ণভাবে কাজে লাগাবেন। এজন্য আপনাকে অবশ্যই নিজেকে জানতে হবে এবং নিজেকে চিনতে হবে। আর আপনার মধ্যে যদি নেতৃত্বের গুণাবলি থাকে, আপনি যদি অন্যদের দিয়ে কাজ করিয়ে নিতে সক্ষম এক ব্যক্তি হন, তবে আপনি নিশ্চয়ই আপনার সহকর্মীদের চেয়ে অনেক বেশি এগিয়ে যাবেন। এজন্য আপনাকে অবশ্যই নিজেকে নিজের কাছে প্রকাশ করতে হবে, চিনতে হবে এবং নিজেকে উদ্ভাবন করতে হবে। আপনাকে সহায়তা করতে নিচে কিছু প্রশ্ন দেওয়া হলো যা আপনার আত্ম-উন্মোচনে সহায়তা করবে।


নিজেকে উদ্ভাবন করুন; নিজেকে জানতে ২৮টি প্রশ্ন

নিজেকে জানুন! নিজেকে জানতে হলে প্রথমে নিজের আত্ম-বিশ্লেষণ দরকার। এজন্য প্রতি বছর অন্তত একবার নিজের আত্ম-বিশ্লেষণ করতে পারেন। এটা অনেকটা বাৎসরিক হালখাতার মতো। হালখাতার দিন যেমন পুরো বছরের হিসাব-নিকাশ করা হয়, কোথায় কত মুনাফা হয়েছে, কোথায় কত ঘাটতি ঘটেছে তা বিশ্লেষণ করা হয়, তেমনি আপনি বছরে একদিন নিজেকে সময় দিন, নিজেকে বিশ্লেষণ করুন যাতে আপনার গুণাবলি চিনতে পারেন এবং এগুলোর উন্নয়ন ঘটাতে পারেন। আর নিজের দোষগুলোও জানতে পারেন, যাতে এগুলোকে দূর করতে পারেন। যে ডাক্তার রোগীর রোগ ধরতে পারে না, সে সঠিক ঔষধও দিতে পারে না। নিজেকে একজন চিকিৎসকের মতো খুঁটেখুঁটে, অতি যতœ সহকারে বিশ্লেষণ করুন।

একটি ব্যবসায় যেমন ৩টি পরিস্থিতি ঘটে: হয় ব্যবসা সামনে এগিয়ে যায়; না-হয় ব্যবসা স্থির হয়ে থাকে অথবা ক্ষতি হয় বা ঋণাত্মক দিকে যেতে থাকে। তেমনি মানুষের জীবনেও এই ৩টি ধাপ রয়েছে: একজন হয় সামনে এগিয়ে যায়, স্থির দাঁড়িয়ে থাকে অথবা জীবনে পিছনে ফিরে যায়। সামনে এগিয়ে যাওয়াই একজনের উদ্দেশ্য হওয়া উচিত। বাৎসরিক আত্ম-বিশ্লেষণের মাধ্যমে উন্নতি হয়েছে কিনা জানা যায় এবং যদি হয়, কতটুকু হয়েছে তাও নিশ্চিত হওয়া যায়। এতে করে একজন পিছনের দিকে যাচ্ছে কিনা সেটাও বোঝা যায়। আপনি যদি নিজের দক্ষতা এবং যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরি খোঁজেন, তবে আপনাকে অবশ্যই সামনে এগিয়ে যাওয়া উচিত। যদি আপনার অগ্রগতি ধীর হয় তবুও এগিয়ে যেতে হবে।

আপনার বাৎসরিক আত্ম-বিশ্লেষণ তৈরি হওয়া উচিত প্রত্যেক বছরের শেষের দিকে। যাতে আপনি আপনার নতুন বছরের সংকল্পগুলোতে যেকোন সংশোধন, সংযোজন এবং পরিমার্জন করতে পারেন, যেকোন দরকারি কিছু অন্তর্ভুক্ত করতে পারেন। নিচের প্রশ্নগুলো নিজেকে জিজ্ঞেস করুন এবং নিজেকে উদ্ভাবন করুন। আপনি ইচ্ছা করলে অন্য কারও সহযোগিতা নিতে পারেন। এমন কারও সহযোগিতা নিন যে আপনার সাথে প্রতারণা করবে না। একদম ঠিক যা আপনি আছেন, ঠিক তাই আপনাকে বলবে।


নিজেকে উদ্ভাবন করুন; আত্ম-বিশ্লেষণের প্রশ্নাবলি

০১. আমি এই বছরের শুরুতে যে লক্ষ্য অর্জন করব বলে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম আমি কি তা অর্জনে চেষ্টা করেছি? (আপনার জীবনে একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য আছে। আপনি সেই লক্ষ্য পূরণের জন্য এই বছর কীভাবে কাজ করেছেন?)

০২. বাৎসরিক লক্ষ্য পূরণে আমার পক্ষে যতটা সম্ভব আমি কি তার সবটুকু দিয়ে চেষ্টা করেছি? অথবা আমি যদি চেষ্টা করেই থাকি, তবে এই গুণমান আর কীভাবে উন্নত করা যায়? এই কাজ করতে গিয়ে আমি কি আমার কোন দক্ষতা, যোগ্যতা বা গুণের অগ্রগতি সাধন করেছি?

০৩. আমি কি আমার পক্ষে যতটুকু সম্ভব ততটুকু চেষ্টা করেছি? সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি?

(২নং হচ্ছে: আপনার চেষ্টার গুণমান কেমন ছিল? কেবল চেষ্টা করলেই হবে না, ভালো মানের চেষ্টা করতে হবে, উত্তমভাবে চেষ্টা করতে হবে। আর ৩নং হচ্ছে: চেষ্টার পরিমাণ কেমন ছিল? আপনি কতটুকু চেষ্টা করেছেন? আপনার চেষ্টার তীব্রতা কতটুকু ছিল?)

০৪. আমার আচরণ কি সবসময় সহযোগিতাপূর্ণ ছিল?

০৫. আমি কি আমার কার্যকারিতা হ্রাস করতে গড়িমসির অভ্যাসকে অনুমতি দিয়েছিলাম? যদি তাই হয়, তবে কোন ক্ষেত্রে?

০৬. আমি কি আমার ব্যক্তিত্বে অগ্রগতি তৈরি করেছি এবং যদি করে থাকি, তবে কোন পথে?

০৭. আমি কি আমার পরিকল্পনা অনুসরণে অধ্যবসায়ী ছিলাম?

০৮. আমি কি সব পরিস্থিতিতে দ্রুত এবং নির্দিষ্টভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছি?

০৯. আমি কি ৬টি মূল ভীতির যেকোন একটি বা একাধিক ভীতিকে আমার কার্যকারিতা হ্রাস করতে অনুমতি দিয়েছিলাম?

১০. আমি কি ‘অতি-সতর্ক’ ছিলাম; নাকি ‘কম-সতর্ক’?

১১. আমার সহযোগীদের সাথে আমার সম্বন্ধ কি সন্তোষজনক; নাকি অসন্তোষজনক? যদি এটা অসন্তোষজক হয়, তবে ভুল কি আংশিকভাবে আমার; নাকি সম্পূর্ণভাবে আমার?

১২. আমি কি আমার চেষ্টার প্রতি মনোযোগ কেন্দ্রীভূত না করে আমার শক্তির অপচয় করেছি?

১৩. আমি কি লোকজনের সাথে যোগাযোগকালে মনোযোগ সহকারে কথা শুনেছি? আমি কি আলাপকালে ধৈর্যশীল ছিলাম?

১৪. আমি আমার দক্ষতা এবং যোগ্যতাকে কোন পথে বৃদ্ধি করেছি বা কোন কোন দিকে উন্নত করেছি?

১৫. আমার কোন অভ্যাসের প্রতি আমি অধৈর্য ছিলাম?

১৬. আমি কি কোন ধরনের আমিত্ব বা অহংকার প্রকাশ করেছিলাম? খোলাভাবে বা গোপনভাবে?

১৭. আমার আচরণ কি আমার সহযোগীদের প্রতি এমন ছিল যে আমাকে সম্মান করার প্রতি এটা তাদের প্রবৃত্ত করেছে?

১৮. আমার মতামত এবং সিদ্ধান্তের ভিত্তি কি অনুমান; নাকি যথার্থ বিশ্লেষণ এবং চিন্তার ওপর?

১৯. আমি কি আমার আয়, ব্যয় এবং সময় হিসাব করে খরচ করেছি? আমি কি মিতব্যয়িতার অভ্যাস গঠন করেছি? আমি কি উদ্দেশ্যবশত কম খরচ করেছি?

২০. আমি আমার কত সময় অলাভজনক চেষ্টায় উৎসর্গ করেছি যা আমি হয়তো আমার উত্তম সুবিধার জন্য প্রয়োগ করতে পারতাম?

২১. আমি কীভাবে আমার সময় এবং অভ্যাসকে পরিবর্তন করতে পারি যাতে আমি আগামী বছরে আরও কার্যকর হতে পারি?

২২. আমি কি এমন কোন আচরণ করেছি যাতে আমার বিবেক আমাকে অনুমতি দেয়নি?

২৩. আমি এখন যা বেতন পাই তারচেয়ে আমি আর কোন পথে আরও বেশি সেবা এবং উত্তম সেবা সম্পন্ন করতে পারি?

২৪. আমি কি কারও প্রতি অন্যায় করেছি এবং যদি করে থাকি তবে কোন পথে?

২৫. যদি আমি আমার নিজের সেবার ক্রয়কারী হতাম তবে কি আমি আমার ক্রয়ে সন্তুষ্ট হতাম?

২৬. আমি কি সঠিক পেশায় আছি এবং যদি না থাকি, তবে কেন নয়?

২৭. আমার সেবা ক্রয়কারী কি আমার দক্ষতা এবং যোগ্যতায় সন্তুষ্ট? আর যদি না হয়, তবে কেন নয়?

২৮. সাফল্যের মৌলিক সূত্রগুলোতে আমার বর্তমান ধাপ কত? (এই ধাপ তৈরি করুন ন্যায্য ও সাহসীভাবে এবং একে যথেষ্ট সাহসী একজনকে দিয়ে পরীক্ষা করান।)

এই অধ্যায় ধীরে ধীরে পাঠ করুন এবং এসব তথ্য সম্পূর্ণ উপলব্ধি করুন। যে অর্থ এই অধ্যায় বহন করে তা বোঝার চেষ্টা করুন। তারপর আপনি আপনার দক্ষতা এবং যোগ্যতা নিয়ে চাকরি পেতে একটি বাস্তবিক পরিকল্পনা তৈরি করুন। এই অধ্যায়ে আরেকটি বর্ণনা আছে যা আপনার কাজে লাগবে। তা হচ্ছে নেতৃত্বের প্রধান প্রধান বৈশিষ্ট্য; নেতৃত্বের সর্বাধিক সাধারণ ব্যর্থতার কারণ; জীবনের সব পথে ব্যর্থতার প্রধান কারণ এবং আত্ম-বিশ্লেষণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রশ্ন। আপনার পরিকল্পনা তৈরি করতে অবশ্যই এগুলো প্রয়োগ করুন। এই তথ্যাবলি এখানে লেখার আগে ব্যাপক এবং পুঙ্খানুপুঙ্খ রূপে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। কারণ আমিও চাই যাতে আপনি আপনার ব্যক্তিগত দক্ষতা এবং যোগ্যতা দিয়ে ধনসম্পদ অর্জন করতে পারেন। যারা ধনী হতে চায়, জীবনে সুখ এবং সম্মান পেতে চায় তাদেরকে অবশ্যই এসব ব্যাপার দিয়ে আরম্ভ করতে হবে। অন্য যারা শেয়ার বাজারে বা অন্য কোনভাবে তাদের সৌভাগ্য হারিয়েনে এবং যারা কেবল নিজেকে দিয়েই অর্থ আয় করতে চায় তারাও এসব ব্যাপার কাজে লাগাতে পারে। টাকাপয়সা না থাকলে একজন মানুষ কী দিতে পারে? নিজের শ্রম, বুদ্ধি, সময়; এগুলোই তো। আসলে ধনী হওয়ার পরিবর্তে এগুলো দেওয়া ছাড়া আর কিছু নেই। তাই নিজের ব্যক্তিগত দক্ষতা এবং যোগ্যাতাকে আর উন্নত করুন।

যারা তাদের নিজ নিজ পেশায় নেতৃত্ব দিতে চায় তাদের জন্য এই অধ্যায়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য রয়েছে। যেকেউ এই অধ্যায়ের তথ্যাবলি কাজে লাগিয়ে যেকোন প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ পর্যায়ে যেতে পারে।

তবে আপনাকে অবশ্যই এই অধ্যায়ের পুরো তথ্য সম্পূর্ণ উপলব্ধি এবং অনুধাবন করতে হবে। এতে করে আপনি কেবল নিজেকেই নয়, অন্যদেরও সঠিকভাবে বিশ্লেষণ করতে পারবেন। আপনি অন্যদের সাথে সঠিকভাবে আচরণ করতে পারবেন। যারা ব্যক্তিগত উপদেষ্টা, ব্যবস্থাপক, কার্যনির্বাহী বা নিয়োগ দানে কাজ করে তাদের জন্যও এই তথ্যাবলি অনেক কাজে লাগবে। এতে করে সে তার কোম্পানিকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে পারবে। যদি আপনি এই বিবৃতিতে সন্দেহ প্রকাশ করেন তবে আত্ম-বিশ্লেষণের ২৮টি প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দেখুন এবং এর কার্যকারিতা পরীক্ষা করে দেখুন। এটা মজাদার এবং লাভজনক। আপনি সন্দেহ প্রকাশ না করলেও মজা পাবেন এবং আপনার জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন আনবে।

একজন কোথায় এবং কীভাবে ধনী হওয়ার সুযোগ পাবে?

আমরা এতক্ষণ যা কিছু বিশ্লেষণ করলাম তা আমরা কাজে লাগানোর চেষ্টা করব। কারণ আপনি জানলেন কোন সূত্রাবলি দিয়ে ধনসম্পদ অর্জন করা যায়, কিন্তু কোন কাজ করলেন না। এতে করে কোন ফলাফলও পাবেন না। এখন হয়তো আপনার মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, ‘কোথায় একজন তার পছন্দনীয় সুযোগ খুঁজে পাবে যাতে এই সূত্র প্রয়োগ করবে?’ খুব ভালো প্রশ্ন। চলুন আমরা উদ্ভাবন করি এবং দেখি যে এদেশ একজন ব্যক্তিকে কী সুযোগ ও সম্ভাবনা দিচ্ছে যে বড় বা ছোট আকারের ধনী হতে চায়।

শুরুতেই, আমাদের মনে রাখতে হবে, আমাদের সকলের জন্য যে আমরা বাস করি এমন এক দেশে যেখানে প্রত্যেক আইন-মান্যকারী নাগরিক তাদের চিন্তা এবং কর্মের স্বাধীনতা উপভোগ করে। এমনকি সে এই সুবিধা আজকের পরিবর্তনশীল বিশ্বের যেকোন জায়গায় থেকেও সমানভাবে উপভোগ করতে পারে। আমাদের মধ্যকার বেশির ভাগ মানুষই আমাদের দেশের এসব সুবিধা কখনো আবিষ্কার করেনি। আমরা কখনো আমাদের সীমাহীন স্বাধীনতার সাথে অন্যান্য দেশের সংক্ষিপ্ত স্বাধীনতার তুলনা করিনি।

এখানে আমাদের আছে চিন্তার স্বাধীনতা। স্বাধীনতা আছে বিদ্যা এবং স্কুল নির্বাচন করার, ধর্ম ও রাজনীতিতে স্বাধীনতা আছে। স্বাধীনতা আছে একটি ব্যবসা, পেশা বা চাকরি নির্বাচন করার। স্বাধীনতা আছে নিজের অর্জনের প্রতি এবং অপরকে বিরক্ত না করে, সব সম্পদ যা আমরা অর্জন করতে পারি তাই অর্জন করার। স্বাধীনতা আছে আমাদের বসবাসের জায়গা নির্বাচন করার। বিবাহে স্বাধীনতা আছে। স্বাধীনতা আছে সমানভাবে সব গোষ্ঠীকে সুযোগ দেওয়ার প্রতি। স্বাধীনতা আছে এক জেলা থেকে অন্য জেলাতে যাওয়া-আসা করার। স্বাধীনতা আছে আমাদের খাবার নির্বাচন করার এবং স্বাধীনতা আছে জীবনের যেকোন মঞ্চে লক্ষ্য স্থির করার, যার জন্য আমরা নিজেদের প্রস্তুত করেছি। এমন কী আমরা এদেশের প্রধানমন্ত্রী পদের জন্যও লক্ষ্য স্থির করতে পারি। আছে কী আপনার এমন স্বাধীনতা!

আমাদের আরও স্বাধীনতা আছে। কিন্তু এই তালিকা দেওয়া হয়েছে পাখির তীক্ষè দৃষ্টির মতো, সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে উল্লেখ করা হলো, যা সর্বোচ্চ মাত্রার সুযোগকে তৈরি করে। এই স্বাধীনতার সুবিধা হচ্ছে অন্য সব সুবিধার মধ্যে খুব সহজেই দৃষ্টি আকর্ষণকারী। কারণ এদেশ হচ্ছে একমাত্র দেশ যা প্রত্যেক নাগরিকের প্রতি জামিনদার। যদিও নাগরিকের জন্ম দেশে বা বিদেশে যেখানেই হোক না কেন, স্বাধীনতা সব জায়গায় সমান। আছে আপনার দেশে এত বিস্তৃত স্বাধীনতা!

এরপর, আসুন আমরা পুনরায় আমাদের সেই বিস্তৃত স্বাধীনতার অল্প কিছু আশীর্বাদ নিয়ে চিন্তা করি যা আমাদের হাতের মুঠোয়। এদেশের একটি ছোট্ট পরিবারকে উদাহরণ হিসাবে নিন (মানে, একটি মধ্যম আয়ের পরিবার) এবং পরিবারের প্রত্যেক সদস্য যে সুবিধা পায় তা যোগ করুন। এই সুযোগ এবং প্রাচুর্যের দেশে তারা কী কী সুবিধা পায়:

ক. খাবার। আমাদের চিন্তা এবং কর্মে স্বাধীনতা আনতে দরকার খাবার, পোশাক ও বাসস্থান। জীবনের এই ৩টি মৌলিক চাহিদা খুব গুরুত্বপূর্ণ।

যেহেতু এদেশের গড় পরিবারের প্রতি আমাদের বৈশ্বিক স্বাধীনতা সহজলভ্য, সেহেতু তার দরজার নিকটে, বিশ্বের যেকোন জায়গা থেকে সর্বোৎকৃষ্ট খাবার পৌঁছে দেওয়া এবং এর দাম তাদের আর্থিক সীমার মধ্যে রাখা আমাদের কর্তব্য।

ধরুন, দুইজনের একটি পরিবার। তারা নিউ ইয়র্ক শহরের কেন্দ্রবিন্দুতে বাস করে। তারা থাকে খাবারের উৎপাদন উৎস থেকে বহুদূরে। আসুন আমরা দেখি তাদের সকালের নাস্তার খরচ কত পড়ে। আমি অবশ্য এটা প্রথমবার দেখে বিস্মিত হয়েছিলাম:

খাবারের নাম নাস্তার টেবিলে খরচ

আঙুর ফলের রস (ফ্লোরিডা থেকে) .... .... .... $২.০০

গুঁড়া করা গম (কেনসাস খামার) .... .... .... $২.০০

চা (চীন থেকে) .... .... .... $২.০০

কলা (দক্ষিণ আমেরিকা থেকে) .... .... .... $২.৫০

আটার রুটি (কেনসাস খামার থেকে) .... .... .... $১.০০

দেশি ডিম (উথাহ থেকে) .... .... .... $৭.০০

চিনি (কিউবা বা উথাহ থেকে) .... .... .... $০.৫০

ঘি ও মাখন (নতুন ইংল্যান্ড থেকে) .... .... .... $৩.০০

সর্বমোট .... .... .... $২০.০০

[খাবারের দাম ১৯৩৭ সালের ডলার ($) অনুসারে উল্লেখ করা হয়েছে।]

এই দেশে খাবার পাওয়া খুব কঠিন কিছু নয়। দুই  সদস্যের একটি পরিবার খুব সহজেই, খুব অল্প খরচেই তাদের সকালের নাস্তা করতে পারে! পর্যবেক্ষণ করুন, এই নাস্তা জোগাড়ের পদ্ধতি অনেকটা জাদুর (?) মতো। যেমন ভিন্ন ভিন্ন দেশ থেকে, চীন, দক্ষিণ আমেরিকা, উথাহ, কেনসাস এবং নতুন ইংল্যান্ড থেকে যা নাস্তার টেবিলের ওপর আনা ও সরবরাহ করা হয়ছে তা সত্যিই অসাধারণ। আমেরিকার সর্বাধিক ভিড়বহুল শহরের কেন্দ্রবিন্দুতে এগুলো জোগাড় করা হয়েছে যাতে আপনি এগুলো উপভোগ করতে পারেন। আর এগুলোর দামও এমন বৃত্তের মধ্যে রাখা হয়েছে যা আপনি সামান্য শ্রমের বিনিময়েই আয় করতে পারেন।

আবার এই দামের মধ্যেই সব কেন্দ্রীয়, রাজ্য এবং শহরের ট্যাক্স অন্তর্ভুক্ত! (রাজনীতিবিদরা যখন জনগণের কাছে আর্জি জানায় যে জনগণ ট্যাক্স বা রাজস্ব দিতে দিতে মরে যাচ্ছে এবং তারা সরকার গঠন করলে জনগণকে এ থেকে মুক্তি দিবে তখন তারা এই ব্যাপার উল্লেখ করে না।)

খ. বাসস্থান। এরপর আছে বাসস্থান। সেই পরিবার একটি আরামদায়ক বাসায় বাস করে। যেখানে বিদ্যুতের সুবিধা আছে, গ্যাস দিয়ে রান্না করা যায় এবং পানির লাইন আছে। সবকিছুর জন্য একমাসে খরচ হয় মাত্র ৬ হাজার ৫০০ টাকা। একটি অপেক্ষাকৃত ছোট শহরে বা নিউ ইয়র্ক শহর থেকে একটু দূরে, একই বাসার ভাড়া হতে পারে আরও কম, একমাসে ২ হাজার টাকা।

আটার রুটি যা তারা নাস্তার জন্য খাবে তা তৈরি করা হয় একটি বৈদ্যুতিক যন্ত্রে। যার দাম অল্প কিছু টাকা। বাসা একটি পরিষ্কারক যন্ত্রে পরিষ্কার করা হয় যা বিদ্যুতে চলে। পানির লাইনে সবসময় গরম এবং ঠান্ডা পানি পাওয়া যায়। রান্নাঘর এবং গোসলঘর, উভয় জায়গায় এই সুবিধা রয়েছে। খাবার রাখার জন্য ফ্রিজ আছে যা বিদ্যুতে চলে। গৃহিণী হয়তো তার চুল বাঁকা করবে, জামা-কাপড় ধুয়ে দিবে অথবা ইস্ত্রি করবে, এগুলোর সবই করতে পারবে বৈদ্যুতিক যন্ত্রের মাধ্যমে। এই সুবিধাদি খুব সহজেই পাওয়া যায়। দেওয়ালের একটি বৈদ্যুতিক সুইচ থেকেই। গৃহকর্তা দাঁড়ি কামাবে, সারা বিশ্ব থেকে বিনোদন গ্রহণ করবে, এর সবই করতে পারে বৈদ্যুতিক সুবিধাদি দ্বারা। আর তারা এই সুবিধাদি দিনের ২৪ ঘণ্টাই উপভোগ করতে পারে। প্রায় বিনামূল্যেই বলতে গেলে।

এই বাসার মধ্যে অন্য সুবিধাও রয়েছে। কিন্তু পরবর্তী তালিকা থেকে আমরা একটি ন্যায্য ধারণা পাব এবং কিছু শক্ত সাক্ষ্য-প্রমাণ পাব যা আমরা, আমেরিকানরা, উপভোগ করি। (এবং এই সুবিধা না রাজনৈতিক না অর্থনৈতিক সমর্থনলাভের জন্য এখানে উল্লেখ করা হচ্ছে।)

গ. পোশাক। যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে যেকোন জায়গায় গড়ে একজন নারীর আরামদায়ক ও পরিচ্ছন্ন পোশাকের জন্য প্রয়োজন ২ হাজার টাকার চেয়ে কম টাকা। তাও আবার পুরো এক বছরের জন্য। আর গড়ে একজন পুরুষের পোশাকের জন্য ঐ একই অর্থই প্রয়োজন।

এখানে মাত্র ৩টি মৌলিক অধিকার খাবার, পোশাক এবং বাসস্থানের উল্লেখ করা হয়েছে। একজন গড় আমেরিকান নাগরিকের আরও অন্য অধিকার এবং সুবিধা রয়েছে যা সে সহজেই পেতে পারে। প্রতিদিন ৮ ঘণ্টার শ্রমের অতিরিক্ত নয়। এগুলোর মধ্যে যাতায়াতের জন্য গাড়ির সুবিধা রয়েছে, যা দিয়ে একজন ব্যক্তি যেকোন জায়গায় ইচ্ছানুযায়ী যেতে এবং আসতে পারে। এর খরচও অল্প। [ফজলে রাব্বির কথাÑপ্রিয় পাঠক, যাতায়াতের এই গাড়ি প্রসঙ্গে আপনাকে একটি ঘটনা বলি। ঘটনাটি আমেরিকান উদ্যোক্তা হেনরি ফোর্ডের ।

হেনরি ফোর্ড জন্ম গ্রহণ করেন ১৮৬৩ সালের ৩০ই জুলাই। তিনি ১৫ বছর বয়স থেকে ডেট্রয়েটে একজন মেকানিক হিসাবে কাজ আরম্ভ করেন। তারপর ৩ বছর পর, ১৮৮২ সালে, ডেট্রয়েট ড্রাই ডক কোম্পানিতে চাকরি নেন। এরপর তিনি ১৮৯১ সালে এডিসন ইলিউমিনেটিং কোম্পানিতে চাকরি করা কালীন সময়ে একজন ইঞ্জিনিয়ার রূপে আত্মপ্রকাশ করেন। তারপর ২ বছর পর, ১৮৯৩ সালে, তিনি মুখ্য ইঞ্জিনিয়ার রূপে পদোন্নতি পান। এ সময় তিনি পর্যাপ্ত সময় এবং অর্থ পান যাতে করে তিনি ধীরেসুস্থে চিন্তা করতে পারেন।

ফোর্ড দেখলেন ঘোড়ার গাড়িতে করে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতে অনেক সময় লাগে। মানুষ এই ধীর গতির ব্যবস্থার জন্য বিরক্ত। তিনি দেখলেন এমন অবস্থায় ঘোড়ার চেয়ে দ্রুতগামী কিছু দরকার। তিনি নিজের চেষ্টায় ১৮৯৬ সালে আবিষ্কার করলেন ফোর্ড কোয়াড্রিসাইকেল । দ্রুত গতির পরিবহণ ব্যবস্থা। এরপর তিনি দেখলেন এই গাড়ির সুবিধা পাচ্ছে কেবল গুটিকয়েক বিত্তশালী লোক। অথচ সংখ্যাগরিষ্ঠ মধ্যবিত্ত শ্রেণি এই সুবিধার মুনাফা নিতে পারছে না। তাই তিনি বিরাট আকারে গাড়ি উৎপাদনের দিকে মন দিলেন, যার দাম মধ্যবিত্ত শ্রেণির ক্রয়সীমার মধ্যে থাকে। উইকিপিডিয়ায় ফোর্ড সম্পর্কে বলতে গিয়ে প্রথমেই বলা হয়, ‘যদিও হেনরি ফোর্ড যে প্রথম গাড়ি উদ্ভাবন করে তা নয়। কিন্তু সেই প্রথম যে মধ্যবিত্ত শ্রেণির ক্রয়সীমার মধ্যে প্রথম গাড়ি উৎপাদন করে।’ এতে করে ফোর্ড যে মুনাফা করেনি তা নয়। তবে ফোর্ড আগে মানুষকে সুবিধা দিয়েছে, মানুষের জন্য উপকারী সেবা সম্পন্ন করেছে, তারপর নিজের জন্য মুনাফা অর্জন করেছে।

ঠিক এই কথাই আমি আমার প্রতিটি বইয়ে বলার চেষ্টা করেছি। আপনি আগে মানুষের জন্য উপকারী সেবা সম্পন্ন করেন, দেখবেন মুনাফা আপনাআপনিই আসবে। কিন্তু আপনি যদি আগে মুনাফা বা টাকার চিন্তা করেন তবে আপনার সেবা দেওয়ার ইচ্ছা নষ্ট হয়ে যাবে। যেমন: বাংলাদেশে রমজান মাসে মানুষ মুনাফা বা টাকার চিন্তা আগে করে বলেই সব বিক্রেতার মধ্যে একটা লুটপাট করার মনোভাব চলে আসে। যার থেকে যত বেশি পারে আদায় করার একটা মানসিকতা সৃষ্টি হয়।]

একজন গড় আমেরিকানের সম্পত্তির নিরাপত্তামূলক অধিকারগুলো বিশ্বের অন্য কোন দেশে পাওয়া যাবে না। সে তার অতিরিক্ত অর্থ একটি ব্যাংকে রাখতে পারে এই নিশ্চয়তার সাথে যে তার সরকার এর নিরাপত্তা দিবে। আর যদি ব্যাংক নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয় তবে দেশের সরকার এর ভালো প্রতিদান দিবে।

যদি একজন আমেরিকান নাগরিক এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে ভ্রমণ করতে চায় তার কোন পাসপোর্টের দরকার নেই। এর জন্য কারও অনুমতির প্রয়োজন নেই। সে যেখানে খুশি সেখানে যেতে পারে। এমনকি সে বাস, ট্রেন, লঞ্চ বা ব্যক্তিগত গাড়ি, যেকোন যানবাহনে ভ্রমণ করতে পারে। তার পকেটে যেমন অর্থ আছে সে সেভাবেই খরচ করতে পারে। জার্মানি, রাশিয়া, ইটালি ও ইউরোপ এবং এশিয়ার বেশির ভাগ দেশের মানুষও এত স্বাধীনতার সাথে এবং এত অল্প খরচে ভ্রমণ করতে পারে না।

[আমেরিকা আজকে যে অবস্থানে আছে, আজকে সে তাদের জনগণকে যে সুবিধাদি দিচ্ছে তা আমেরিকার কোন রাজনৈতিক দল দ্বারা সৃষ্টি হয়নি। এই সুবিধাদি সৃষ্টি হয়েছে আমেরিকার কিছু দূরদৃষ্টি সম্পন্ন এবং লোকহিতৈষী ব্যবসায়ীদের জন্য; এন্ড্রু কানের্গি, টমাস আলভা এডিসন, হেনরি ফোর্ড, জন ডি. রকফেলার সহ প্রমুখ। আমি (ফজলে রাব্বি) বিশ্বাস করি, আমাদের আজকের প্রজন্ম যারা তরুণ, নতুন উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ী হওয়ার চেষ্টা করছে, তারা এমন দূরদৃষ্টি সম্পন্ন, লোকহিতৈষী উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ী হয়ে উঠবে যারা বাংলাদেশের জনগণকে সর্বোচ্চ সুযোগ-সুবিধা দিবে। জনগণকে সুযোগ-সুবিধা দিতে হলে রাজনীতি বা সরকারের অপেক্ষা না থেকে, ব্যবসা করেও এই সেবা দেওয়া সম্ভব। তবে অধিকার আদায়ের লড়াই রাজনৈতিক আন্দোলনের মাধ্যমেই সম্ভব।]


যে ‘অলৌকিক’ সিস্টেমে এই সুবিধাদি দেওয়া হয়?

আমরা প্রায়ই শুনি রাজনীতিবিদরা উচ্চকণ্ঠে এদেশের স্বাধীনতার কথা জাহির করে। যখন তারা ভোট পাবার চেষ্টা করে তখন তো তাদের চিৎকার আরও বেড়ে যায়। কিন্তু কদাচিৎ তারা এই ‘স্বাধীনতার’ প্রকৃতি বা উৎসকে বিশ্লেষণ করে দেখার জন্য সময় ব্যয় করে। উৎপীড়ন না করে, হিংসার চোখে না দেখে, দূরে দাঁড়িয়ে নয় কাছে গিয়ে দেখে প্রকাশ করার উদ্দেশ্যে আমি সেই ‘অলৌকিক কিছুকে’ বিশ্লেষণ করব যা আমাদের এত সুবিধাদি দিয়েছে। আমি সেই রহস্যময়, দুরূহ, মহানভাবে ভুল বোঝা ‘অলৌকিক কিছুকে’ স্পষ্ট ভাষায় বিশ্লেষণ করব যা আমেরিকার প্রত্যেক নাগরিককে অধিকতর আর্শীবাদ, অধিকতর সুযোগ দিয়েছে যাতে তারা সম্পদ অর্জন করতে পারে, যাতে তারা প্রত্যেক ধরনের অধিকতর স্বাধীনতা পায়, যাতে তারা অন্য যেকোন দেশের চেয়ে ভালোভাবে থাকতে পারে।

আমার অধিকার আছে এই অদেখা ক্ষমতার উৎস এবং প্রকৃতিকে বিশ্লেষণ করার। কারণ আমি জানি এবং ২৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে সেই ব্যক্তিদের মধ্যে চিনেছি যারা সেই ক্ষমতাকে সংগঠিত করেছে এবং অনেকেই যারা এখনও এটা বজায় রাখার জন্য দায়িত্বে রয়েছে।

মানবজাতির এই রহস্যময় উপকারী ব্যাপারটির নাম হচ্ছে পুঁজি! (আর্থিক, আত্মিক এবং মানসিক মূলধন)।

পুঁজি গঠিত হয়েছে শুধু অর্থ দিয়ে নয়, কিন্তু আরও বিশেষ করে উচ্চভাবে সংগঠিত, বুদ্ধিমান ব্যক্তি দল দ্বারা যারা পথ ও উপায় পরিকল্পনা করেছে যাতে টাকাপয়সা জনগণের উপকারের প্রতি এবং নিজেদের মুনাফার প্রতি কার্যকরভাবে ব্যবহার হয়।

এই দল গঠিত হয়েছে বিজ্ঞানী, শিক্ষক, রসায়নবিদ, উদ্ভাবক, ব্যবসা বিশ্লেষক, প্রচার প্রসারে দক্ষ ব্যক্তি, পরিবহণ বিশেষজ্ঞ, হিসাবরক্ষক, আইনজীবী, চিকিৎসককে নিয়ে এবং উভয় পুরুষ ও নারী যারা উচ্চভাবে কারখানা এবং ব্যবসার সব ক্ষেত্রে বিশিষ্ট জ্ঞানের অধিকারী। তারা অগ্রদূত। তারা তাদের অভিজ্ঞ এবং উজ্জ্বল আলোকচ্ছটা দিয়ে পথ তৈরি করে দিয়েছে যাতে মানুষ চেষ্টার মাধ্যমে নতুন নতুন উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে। তারা স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটি এবং হাসপাতালের খরচের ভার বহন করে। তারা জনগণের জন্য নতুন নতুন স্কুল ভবন নির্মাণ করে। তারা ভালো ভালো রাস্তা নির্মাণ করে, পত্রিকা ছাপায়, সরকারি খরচের বেশির ভাগ বহন করে এবং মানবজাতির অগ্রগতির জন্য বহুসংখ্যক অত্যাবশ্যক জিনিস তৈরি করে। এখানে সংক্ষিপ্তভাবে পুঁজিবাদীদের কাজ বিবৃত হলো। পুঁজিবাদীরা হচ্ছে সভ্যতার মস্তিষ্ক। কারণ তারা এমন এক ব্যবস্থার সৃষ্টি করেছে যাতে মানুষ শিক্ষার আলো পায়, সমাজ আলোকিত হয় এবং মানবজাতির অগ্রগতি ঘটে। [এখানে বাংলাদেশের কিছু অসাধু পুঁজিবাদীদের কথা বলা হয়নি যারা সম্পদ আত্মসাৎ করে, টাকার পাহাড় গড়ে; বরং সেই সব ন্যায়পরায়ণ পুঁজিবাদীদের কথা বলা হয়েছে যারা তাদের পুঁজি ব্যবহার করে মানুষকে দারিদ্র্যের অভিশাপ থেকে মুক্তি দেয়।]

মস্তিষ্ক ব্যতীত অর্থ সবসময়ই বিপদজ্জনক। এজন্যই এ বইয়ের শিরোনাম: চিন্তা করুন এবং ধনী হোন। কারণ যারা চিন্তা ছাড়া ধনী হয়, টাকাপয়সা আয় করে, তারা মানুষের গলায় ছুরি বসাতে এক সেকেন্ডও দ্বিধা করে না। আর যদি এই টাকাপয়সাই সঠিকভাবে প্রয়োগ করা হয়, তখন এটা মানব সভ্যতার প্রতি সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ এক জিনিসে পরিণত হয়। এখানে যে সকালের নাস্তার খরচের হিসাব উল্লেখ করা হলো তা এত কম দামে দেওয়া যেত না যদি-না পুঁজিবাদীদের সংগঠিত পুঁজি থাকত। তারা বাস, ট্রেন, লঞ্চ, স্টিমারের ব্যবস্থা করেছে। এগুলো পরিচালনা করা জন্য তাদের আছে বিশাল বড় প্রশিক্ষিত কর্মীবাহিনী।

এখানে সংগঠিত পুঁজি সম্পর্কে যৎসামান্য ধারণা দেওয়া হলো যার দ্বারা আপনি হয়তো বুঝতে পারবেন যে এই সংগঠিত ব্যবস্থাপনা ছাড়া নিউ ইয়র্কের মতো জায়গায় খাবার পৌঁছানো কতটা কঠিন হতো।

যদি এই সংগঠিত ব্যবস্থাপনা না থাকত তবে কী হত!

চায়ের যোগান দেওয়ার জন্য আপনি হয়তো চিন বা ভারতের দিকে একটা যাত্রা আরম্ভ করবেন। উভয় দেশই আমেরিকা থেকে অনেক দূরে। যদি-না আপনি একজন সুদক্ষ সাঁতারু হন, আপনি হয়তো এই যাওয়া-আসার যাত্রা পূর্ণ করার আগেই ক্লান্ত হয়ে যাবেন। তারপর আরও সমস্যা আপনার সামনে আসতে পারে। তাছাড়া, আপনাকে যদি সাঁতার দিয়ে মহাসাগর পাড়ি দিতে হয় তাহলে আপনার অর্থ কোন কাজে আসবে?

চিনি যোগান দেওয়ার জন্য, আপনাকে অপর এক দীর্ঘ সাঁতার দিতে হবে কিউবার দিকে বা উথের আখ ক্ষেতের দিকে একটি দীর্ঘ হাঁটা দিতে হবে। কিন্তু তারপরও, আপনাকে হয়তো চিনি ছাড়াই আসতে হবে। কারণ চিনি উৎপাদনে সংগঠিত চেষ্টা এবং অর্থ দরকার। আর চিনিকে বিশুদ্ধ করা, গাড়ি দিয়ে নিয়ে যাওয়া এবং এটাকে যুক্তরাষ্ট্রের যেকোন জায়গার নাস্তার টেবিলে পৌঁছে দেওয়া সম্বন্ধে কিছু নাই-বা বললাম।

আপনি হয়তো সহজেই ডিম পৌঁছে দিতে পারবেন। কারণ নিউ ইয়র্ক শহরের কাছেই মুরগির খামার রয়েছে। কিন্তু আপনাকে হয়তো ফ্লোরিডার দিকে একটি দীর্ঘ পথ হাঁটতে হবে এবং ২ গ্লাস আঙুরের শরবত টেবিলে দেওয়ার আগেই ফিরে আসতে হবে।

আপনাকে হয়তো আরেকটি দীর্ঘ হাঁটা দিতে হবে ক্যানসাসের দিকে বা অন্য কোন গম উৎপাদনকারী রাজ্যের দিকে। তারপর আপনি সেই গম সংগ্রহ করে, তা গুঁড়া করার জন্য যাবেন কোন কারখানায়।

গমের তৈরি রুটি বা বিস্কুট হয়তো তালিকা থেকে বাদ দিতে হবে। কারণ এগুলো সহজলভ্য নয় যদি-না একটি প্রশিক্ষিত সংগঠিত ব্যক্তিদের শ্রমের দ্বারা এবং উপযুক্ত যন্ত্রের সহায়তায় তৈরি হয়। সবকিছুর জন্যই দরকার পুঁজি।

বিশ্রাম নেওয়ার পর, আপনাকে আরেকটি ছোট্ট সাঁতার দিতে হবে দক্ষিণ আমেরিকার দিকে। যেখানে আপনি হয়তো কয়েক জোড়া কলা তুলে নিবেন এবং ফিরে আসার সময়, আপনি একটি ছোট্ট হাঁটা দিয়ে কাছাকাছি কোন গরুর খামার থেকে কিছু ঘি ও মাখন তুলে নিলেন। তারপর আপনার নিউ ইয়র্কের বাসায়, আপনার পরিবার হয়তো চেয়ারে বসার প্রতি প্রস্তুত হবে এবং নাস্তা উপভোগ করবে। আর আপনি আপনার এত শ্রমের বিনিময়ে সংগ্রহ করেছেন মাত্র ২০ ডলারের খাবার!

উদ্ভট, তাই না? বেশ, এই উল্লেখিত ব্যবস্থা কেবল সম্ভব হতো যদি আমাদের কোন পুঁজিবাদী ব্যবস্থা না থাকত।

এখন আমরা একটু এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থাপনার বিশালতা সম্পর্কে চিন্তা করে দেখব। এই ব্যবস্থাপনার জন্য দরকারি ভবন, রেল ও বাসের রাস্তা, জাহাজ ও পরিবহণের জন্য অন্য যানবাহনের মোট মূল্য কত হতে পারে? এই সবকিছু ব্যবহৃত হয় যাতে নিউ ইয়র্কের সেই পরিবারের কাছে কম দামে সকালের নাস্তা পৌঁছে দেওয়া যায়। এই পুরো ব্যবস্থাপনা এতই বিশাল যা একজনের কল্পনাকেও দ্বিধায় ফেলে দেয়। এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থা কোটি কোটি টাকা দিয়ে পরিচালিত হয়। সেই প্রশিক্ষিত কর্মবাহিনীর কথা আর নাই-বা উল্লেখ করলাম যাদের দরকার জাহাজ ও ট্রেন পরিচালনার জন্য। কিন্তু পুঁজিবাদী আমেরিকার এই পরিবহণ ব্যবস্থাপনা হচ্ছে পুরো ছবির কেবল একটি অংশ। পুরো চিত্র তো আর বিশাল। বাজারে কিছু উপস্থিত হওয়ার আগে সেগুলো অবশ্যই জমি থেকে উৎপাদন এবং প্রস্তুত করতে হবে। এটা করার জন্য আরও লক্ষাধিক টাকার উপকরণ এবং যন্ত্রাদি দরকার। মোড়কজাত ও বাজারজাত দরকার। এর সাথে জড়িত লাখো পুরুষ ও নারীর বেতন।

এই পুরো প্রক্রিয়া চালানোর জন্য যে জাহাজ, রেলগাড়ির, রেলগাড়ির রাস্তা এবং অন্য পরিবহণ দরকার তা নিশ্চয়ই হঠাৎ আকাশ থেকে পড়েনি। আর পড়লেও এগুলো তো আপনাআপনি কাজ করে না। তবে এসব সামগ্রী এসেছে সভ্যতার প্রয়োজন মেটাতে। এগুলো সেসব ব্যক্তির দ্রুত উদ্ভাবন শক্তি এবং সংগঠিত কর্মদক্ষতার মাধ্যমে এসেছে যাদের আছে কল্পনা, আস্থা, আগ্রহ, সিদ্ধান্ত ও অধ্যবসায়! এই ব্যক্তিরা পরিচিত পুঁজিপতি রূপে। তারা যে আকাক্সক্ষা দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছেন সেগুলো হচ্ছে নির্মাণ, তৈরি ও অর্জন করা, প্রয়োজনীয় সেবা সম্পন্ন করা, মুনাফা করা এবং ধনী হওয়া। তারা সভ্যতার জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ সরবরাহ করে সভ্যতার সেবা করেছে। নতুবা সেখানে কোন সভ্যতাই থাকত না। তারা নিজেদেরকে সেই পথে রেখেছে যেখানে ধনসম্পদ অর্জন করা যায়।

ব্যাপারটা সোজাসুজিভাবে বুঝুন। আমি আরও যোগ করব যে এই পুঁজিপতিরা হচ্ছে সেই একই ব্যক্তি যাদের সম্বন্ধে আমরা বিভিন্ন বক্তাদের কাছ থেকে শুনি। তারা সেই একই ব্যক্তি যাদেরকে চরমপন্থী, চাঁদাবাজ, অসৎ নেতা এবং অসাদু শ্রমিক নেতারা (অসুদপায়ে ভোট লাভ করে জয়ী নেতারা) ‘লুঠকারী অংশ’ বা ‘ওয়াল স্ট্রিট’ রূপে উল্লেখ করে থাকে।

আমি কারো পক্ষে কোন সাফাই গাইছি না; না আমি কোন ব্যক্তিগোষ্ঠী বা কোন অর্থনৈতিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে কিছু বলছি। আমি যখন ‘অসাদু শ্রমিক নেতা’ বলে উল্লেখ করেছি তখন আমি কাউকে দোষারোপ করছি না; না আমি যারা পুঁজিপতি তাদের সব কর্মের একটি পরিষ্কার ব্যাখ্যা দিতে লক্ষ্য নিয়েছি।

এ বইয়ের উদ্দেশ্য হচ্ছে, এমন একটি উদ্দেশ্য যার প্রতি আমি আমার জীবনের ২৫ বছর বিনিয়োগ করেছি, যে উদ্দেশ্যের প্রতি আমার সম্পূর্র্ণ আস্থা ছিল। আমি কেবল সেই উদ্দেশ্য সকলকে জানাতে চাই। সেই উদ্দেশ্য হচ্ছে একটি নির্ভরযোগ্য দর্শন প্রস্তুত করা যাতে একজন ব্যক্তি তার আকাক্সক্ষা অনুযায়ী ধনসম্পদ গড়তে পারে। সেটা যেকোন আকারের হোক না কেন। আপনার আকাক্সক্ষা যদি নির্দিষ্ট হয়, তবে আপনি পারবেন।

আমি এখানে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অর্থনৈতিক সুবিধা বিশ্লেষণ করেছি দুই ভাঁজের উদ্দেশ্য দেখানোর জন্য:

১. সবাই যারা ধনী হতে খুঁজচ্ছেন তাদেরকে অবশ্যই সেই ব্যবস্থা চিনতে হবে এবং নিজেদেরকে সেই ব্যবস্থার সাথে খাপ খাওয়াতে হবে যা সম্পদ অর্জনের প্রবেশ পথ নিয়ন্ত্রণ করে, এবং

২. ছবির বিপরীত পাশ প্রকাশ করার জন্য যা রাজনৈতিক নেতা এবং কথিত জননায়কদের বক্তব্যের দ্বারা দেখানো হয়। যারা ইচ্ছা করে সমস্যাকে এবং সমস্যার কারণকে মেঘাচ্ছন্ন করে। এর জন্য দোষারোপ করে সংগঠিত পুঁজির প্রতি যেন এটা বিষাক্ত কিছু।

এই দেশ একটি পুঁজিবাদী দেশ। এটা উন্নত হয়েছে পুঁজি ব্যবহার করে এবং আমরা যারা স্বাধীনতা ও সুযোগের আর্শীবাদগুলোতে অংশ নেওয়ার দাবি করি, আমরা যারা এখানে ধনী হতে খুঁজি, তাদেরকে ভালোভাবে এটাও জানা উচিত যে না ধন না সুযোগ আমরা পেতে পারতাম যদি-না সংগঠিত পুঁজি এই সুবিধা দিত।

২০ বছরেরও অধিক সময় ধরে এটা কোনভাবে জনপ্রিয় হয়েছে এবং অযথা সময় কাটানোর জন্য এটা তাদের আলাপে বৃদ্ধি পাচ্ছে যারা চরমপন্থী, আত্ম-স্বীকৃত রাজনৈতিক নেতা, চাঁদাবাজ, জালিয়াত শ্রমিক নেতা এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে ধর্মীয় নেতারাও ‘ওয়াল স্ট্রিট, অর্থ পরিবর্তনকারী এবং বড় ব্যবসার’ প্রতি ইট-পাটকেল ছোঁড়ায় অংশ নেয়।

এই অনুশীলন এতই সাধারণ হয়েছে যে আমরা ব্যবসায়িক বিপর্যয়ে এটা প্রত্যক্ষ করেছি, অবিশ্বাসযোগ্যভাবে সরকারি উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তারা নীচ রাজনৈতিক নেতা এবং শ্রমিক নেতাদের সাথে প্রকাশ্যে একই সারিতে দাঁড়ায় এই উদ্দেশ্যে যে ব্যবস্থাটির গলা টিপে ধরতে পারে যা শিল্পোন্নত আমেরিকাকে তৈরি করেছে পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী দেশ হিসাবে। সারিটি এত সাধারণ এবং এত উত্তমভাবে সংগঠিত ছিল যে এটা আমেরিকাতে আজ পর্যন্ত জানা সর্বাধিক খারাপ বিপর্যয় ডেকে এনেছে। লক্ষাধিক মানুষকে তাদের চাকরি হারিয়ে এর দাম দিতে হয়েছে। কারণ সেই চাকরিগুলো অবিচ্ছেদ্যভাবে কারখানা এবং পুঁজিবাদী ব্যবস্থার একটি অংশ ছিল, যাতে এই জাতির মেরুদ- গঠিত হয়েছে।

এই অবৈধ সম্বন্ধ চলাকালীন সরকারি কর্মকর্তা এবং আত্ম-স্বীকৃত নেতা (দালাল বা এজেন্টরা) আমেরিকার কারখানা ব্যবস্থার পরিবর্তে ‘খোলা বাজার’ ঘোষণা করে নিজেদের মধ্যে মুনাফা লুটার এক ব্যবস্থা তৈরি করে। এই আন্দোলনের সাথে এক ধরনের শ্রমিক নেতারাও যুক্ত ছিল যারা তাদের নিজেদের মুনাফার বিপরীতে লোকজনের ভোট নিয়েও কেনাবেচা আরম্ভ করল। এমন এক নীল-নকশা করা হলো যাতে করে ধনীদের কারখানা থেকে আইন দ্বারা নামিয়ে দিয়ে তাদের পছন্দমতো লোক বসানো যায়। আন্দোলন চালানোর জন্য স্লোগান হলো: একদিনের কাজ, একদিনের বেতন। সংগঠিত ব্যবস্থার বদলে তারা একদিনের কাজ, একদিনের বেতন বলে জনমানুষকে উত্তেজিত করে তুলল।

সারা দেশ জুড়ে লাখো পুরুষ ও নারী এখনও এই জনপ্রিয় এবং অযথা সময় কাটানো আলাপে যুক্ত হচ্ছে যা হচ্ছে কিছু না দিয়ে কিছু পাওয়ার চেষ্টা। এদের কিছু কিছু লোক শ্রমিক গোষ্ঠীর সাথে সারিবদ্ধ হয়েছে, যেখানে তারা দাবি করছে কাজের ঘণ্টা কমাতে এবং বেতন বাড়াতে! অন্যরা কোন রকমের কাজ করার সমস্যাতেই যেতে চাচ্ছে না। তারা দাবি করছে সরকার থেকে যেন তাদেরকে ভরণ পোষণের খরচ দেওয়া হয় এবং এটা তারা পাচ্ছে। স্বাধীনতার অধিকারগুলোর প্রতি তাদের ধারণা যে কী তা স্পষ্ট দেখা যাবে নিচের ঘটনায়। এটা নিউ ইয়র্ক শহরের ঘটনা। এক ব্যক্তি পুলিশের কাছে ডাক পিয়নের বিরুদ্ধে বিরক্ত করার জন্য একটি মামলা দায়ের করে। মামলা যে করেছে সে ছিল ‘ভরণ পোষণ খরচের সুবিধাভোগকারী’ দলের একজন। সে অভিযোগ জানায় যে ডাক পিয়ন সকাল ৭.৩০ মিনিটে টাকার চেক নিয়ে আসে। এতে করে তার ঘুমের সমস্যা হয়। তার দাবি চেক প্রদানের সময় যেন সকাল ১০টা করা হয়।

যদি আপনি এদের দলভুক্ত হন, যারা বিশ্বাস করে যে কম সেবার বিনিময়ে বেশি বেতন দাবি করে মানুষ ধনী হতে পারে, যদি আপনি এমন একজন হন যখন টাকা আপনার ঘরের দরজায় আঘাত করছে তখন আপনি আপনার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটবে বলে বিরক্ত অথবা আপনি যদি এমন বিশ্বাস করেন যে রাজনীতিবিদরা বাণিজ্যের পরিবর্তে এমন আইনের অনুমতি দিবে যাতে জনগণের সম্পদ লুঠ করা যায়, তবে আপনি আপনার বিশ্বাস নিয়ে নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন। এটাও জেনে রাখবেন যে এজন্য কেউ আপনাকে বিরক্ত করবে না। কারণ এই দেশ একটি মুক্ত এবং স্বাধীন দেশ যেখানে প্রত্যেক মানুষ তার নিজস্ব চিন্তাধারা নিয়ে বাঁচতে পারে, সে যেমন চিন্তা করে সন্তুষ্ট হয় সে তেমনই চিন্তা করতে পারে। আপনি আপনার যেকোন ধরনের চিন্তা নিয়ে, অল্প শ্রম এবং চেষ্টা দিয়ে এদেশে খুব ভালোভাবেই বাঁচতে পারবেন।

যাই হোক, এই স্বাধীনতা সংশ্লিষ্ট শব্দের পূর্ণ সত্য সম্পর্কে আপনার জানা উচিত যাতে অনেক মানুষ অহংকার করে এবং অল্প কিছু মানুষ তার সম্পূর্ণ সত্য অনুধাবন করে। এটা যত মহানই হোক না কেন, এটা যত দূরেই যাক না কেন অথবা এটা যত সুবিধাই প্রদান করুক না কেন এটা চেষ্টা ছাড়া ধনসম্পদ আনতে পারে না এবং আনে না। স্বাধীনতা মানে এই নয় যে একজন চেষ্টা না করলেও তার ঘরে ধনসম্পদ পৌঁছে যাবে। একজন ব্যক্তির স্বাধীনতা আছে ধনী হওয়ার, কিন্তু ধনসম্পদ আনতে হলে তাকে অবশ্যই চেষ্টা করতে হবে।

ধনসম্পদ অর্জন করার জন্য সেখানে কেবল একটিই নির্ভরযোগ্য পদ্ধতি আছে। আর এটা একটা বৈধ উপায়। সেটা হচ্ছে জনগণের জন্য উপকারী সেবা সম্পন্ন করা। এখন পর্যন্ত এমন কোন ব্যবস্থা সৃষ্টি হয়নি যাতে করে কেউ জোর করে বা একটি ন্যায্য বিনিময় মূল্য না দিয়ে ধনসম্পদ অর্জন করতে এবং ধরে রাখতে পারে।

এই হচ্ছে প্রকৃতির আইন! এটা একটা তত্ত্বের চেয়েও বেশি কিছু। এটা এমন এক আইন যা কোন মানুষই পরাজিত করতে পারে না।

এই সূত্রের নিচে ভালোভাবে দাগ দিন এবং একে মনে রাখবেন। কারণ এটা যেকোন রাজনীতিবিদ বা সরকারের চেয়েও অনেক শক্তিশালী। এটা সব শ্রম গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণের ওপরে এবং নাগালের বাইরে। এটাকে না শাসন করা যায়; না প্রভাবিত করা যায়; না চাঁদাবাজদের দ্বারা বা অন্য কোন পেশার আত্ম-স্বীকৃত নেতাদের দ্বারা ঘুষ দেওয়া যায়। অধিকন্তু, এর একটা সর্বদিক দেখার চোখ আছে এবং একটা পূর্ণাঙ্গ হিসাব রাখার ব্যবস্থা আছে। যার মধ্যে প্রত্যেক মানুষের সাথে প্রত্যেকের লেনদেনগুলোর একটা যথার্থ হিসাব রাখে। ব্যবসার যেখানে কিছু না দিয়ে কিছু পাওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে সেখানের খবরও প্রকৃতি তার হিসাবে রাখে। তারপর কাছে বা দূরে, এক সময় প্রকৃতি এই হিসাব কষে দেখে। আর মানুষ যখন অতিমাত্রায় কিছু না দিয়ে কিছু পাওয়ার চেষ্টা করে তখনই প্রকৃতি থেকে নেমে আসে ভয়ানক বিপর্যয়।

‘ওয়াল স্ট্রিট, বড় বড় ব্যবসা, পুঁজি লুঠকারী অংশ,’ বা অন্য যে নামেই আপনি ব্যবস্থাকে ডাকুন না কেন যা আমাদেরকে আমেরিকান স্বাধীনতা দিয়েছে, এই ব্যবস্থার প্রতিনিধিত্ব করে একদল এমন মানুষ যারা প্রকৃতির আইনকে বোঝে, শ্রদ্ধা করে এবং নিজেদেরকে এই ক্ষমতাশালী আইন অনুযায়ী পরিবর্তন করে! এই আইনকে শ্রদ্ধা করার ওপর তাদের আর্থিক ধারাবাহিকতা নির্ভর করে।

আমেরিকার মতো একটি দেশে যেখানে এর বেশির ভাগ মানুষ এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মধ্যে বাঁচে এবং এর সবকিছু নিয়ে বাঁচে। আমাকে অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে অন্য যেকোন দেশের চেয়ে এখানে একজন মানুষ ধনসম্পদ অর্জনের আরও বড় সুযোগ খুঁজে পাবে। অবশ্য এমন কিছু মানুষ আছে যাদের আচরণ এবং কাজ দেখে বোঝা যায় যে তারা এই দেশকে পছন্দ করে না। যারা এই দেশকে পছন্দ করে না, এর পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে অপছন্দ করে তারা অন্য যেকোন দেশে চলে যেতে পারে। এটা তাদের অধিকার। অন্য আরও অনেক দেশ আছে। যেমন জার্মানি, রাশিয়া, ইটালি প্রভৃতি। যেখানে একজন হয়তো ধনসম্পদ অর্জনের চেষ্টা করে দেখতে পারে এবং স্বাধীনতা ভোগ করতে পারে।

একজন সৎ ব্যক্তি যত যতটুকু ধনসম্পদ অর্জন করতে চায় এবং স্বাধীনতা ভোগ করতে চায় এদেশ ততোধিক প্রদান করে। ধরুন, একজন শিকারী শিকার করতে যাবে। সে কোথায় শিকার করতে যাবে? যেখানে পর্যাপ্ত শিকার আছে। সেখানেই তো! এই নিয়ম ধনসম্পদ খোঁজার ক্ষেত্রেও স্বাভাবিক।

যদি আপনি ধনসম্পদ খুঁজে থাকেন, তবে একটি দেশের সম্ভাবনাকে কখনো উপেক্ষা করবেন না। যার নাগরিকরা এত ধনী যে নারীরা, একাই, বাৎসরিক ২০০ কোটি টাকার বেশি লিপস্টিক এবং অন্যান্য প্রসাধনী সামগ্রীতে খরচ করে। আপনি যিনি ধনসম্পদ খুঁজচ্ছেন, এমন এক দেশের পুঁজিবাদী ব্যবস্থা ধ্বংস করার আগে দুইবার চিন্তা করুন। যার নাগরিকরা বাৎসরিক ৫০ কোটি টাকারও বেশি অর্থ শুভেচ্ছা কার্ডের জন্য খরচ করে। যা দিয়ে তারা তাদের পারস্পরিক ভালোবাসা এবং দেশের প্রতি মমত্ববোধ ফুটিয়ে তোলে!

আরেকটু চিন্তা করুন যে দেশের লোকজন বাৎসরিক ১৫০০ কোটি টাকা খরচ করে চলচ্চিত্র দেখার জন্য এবং আরও কিছু কোটি খরচ করে তরল পানীয় পানের জন্য।

এমন এক দেশ থেকে বের হয়ে যাওয়ার জন্য এত তাড়াহুড়ার কিছু নেই যে দেশের লোকজন ফুটবল, বেসবল এবং অন্যান্য খেলা দেখার জন্য বাৎসরিক কোটি কোটি টাকা খরচ করে।

আর সর্বতোভাবে, এমন এক দেশকে অধ্যবসায়ের সাথে ধরে রাখুন যার জনগণ চুইংগাম খেতে এবং দাড়ি কামাতে বাৎসরিক কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে।

আরও, মনে রাখবেন, এটা কিন্তু সহজলভ্য উৎসের মাত্র শুরু যার দ্বারা সম্পদ অর্জন করা যায়। আর অন্যান্য বিলাসিতার কথা নাই-বা উল্লেখ করলাম। এছাড়াও এসব পণ্য উৎপাদনের জন্য পরিবহণ, বাজারজাত এবং বিজ্ঞাপনের জন্য লাখ লাখ লোক দরকার। যারা তাদের শ্রমের বিনিময়ে প্রতি মাসে কোটি কোটি টাকা পারিশ্রমিক হিসাবে নিচ্ছে এবং তাদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র এবং বিলাসিতার জন্য খরচ করছে।

[অনুবাদকের কথাÑলক্ষ করুন, লেখক এখানে উল্লেখ করেছেন, ’যদি আপনি ধনসম্পদ খুঁজে থাকেন, তবে একটি দেশের সম্ভাবনাকে কখনো উপেক্ষা করবেন না।’ পরবর্তী লেখাতে লেখক সম্ভাবনাগুলো দেখিয়েছেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, একটি দেশের জনগণ যদি তাদের অর্জিত অর্থ প্রসাধনী সামগ্রী, শুভেচ্ছা কার্ড, চলচ্চিত্র ও তরল পানীয়; ফুটবল ও অন্যান্য খেলায় খরচ করে; চুইংগাম ও দাড়ি কামানোর ব্লেডের জন্য খরচ করে তবে এই অর্থগুলো যায় কোথায়? এখন, আমরা যদি ধরি, ১০ কোটি মানুষ উপরোক্ত পণ্যদ্রব্যে যদি ১ হাজার টাকা করে মাসে খরচ করে তবে মোট খরচ দাঁড়ায় ১০ হাজার কোটি টাকা। বছরে ১ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা। এই সুবিশাল পরিমাণ অর্থ এসে পৌঁছায় প্রতিটি পণ্যের তৈরিকারক প্রতিষ্ঠানের কাছে। তাহলে আপনি কেন এমন এক প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী হবেন না? লেখক আগেই উল্লেখ করেছে, ‘সেখানে কিন্তু ধনসম্পদ অর্জন করার এবং বৈধভাবে ধরে রাখার একটিই নির্ভরযোগ্য পদ্ধতি আছে এবং সেটা হচ্ছে জনগণের জন্য উপকারী সেবা সম্পন্ন করা।’ তাহলে আপনি কেন এমন এক প্রতিষ্ঠান তৈরি করে মানুষের জন্য উপকারী সেবা সম্পন্ন করছেন না? যদি আপনি ধনী হতে চান, যা মানুষ হচ্ছে, তবে আপনাকে অবশ্যই জনগণের জন্য উপকারী সেবা সম্পন্ন করতে হবে এবং এখনই কাজে নেমে পড়তে হবে, আপনি প্রস্তুত হন বা না হন।] আবার অনুবাদে ফিরে আসি।

বিশেষত মনে রাখবেন, যে এসব পণ্য এবং ব্যক্তিগত সেবার পরিবর্তে আপনি একটি বিশাল পরিমাণের ধনসম্পদ অর্জনের সুযোগ পেতে পারেন। এখানেই আমাদের দেশের স্বাধীনতা একজনের কাজে আসে। আমাদের দেশের স্বাধীনতা একজন ব্যক্তিকে জনগণের জন্য উপকারী সেবা সম্পন্ন করে ধনী হওয়ার সুযোগ দিয়েছে। সেখানে এমন কিছু নেই যা আপনাকে থামাতে পারে। যেকোন ব্যক্তি এমন যেকোন ব্যবসায় অংশ নিতে পারে। ছোট বা বড় আকারের প্রতিষ্ঠান নিয়ে যেকেউ কাজে নামতে পারে। যদি একজনের উচ্চতর প্রতিভা থাকে, প্রশিক্ষণ এবং অভিজ্ঞতা থাকে, তবে একজন ব্যক্তি যেকোন আকারের ধনসম্পদ অর্জন করতে পারে। যারা এত সৌভাগ্যশালী নয় তারা অপেক্ষাকৃত কম ধনসম্পদ অর্জন করবে। এখানে যেকেউ খুব সামান্য শ্রমের বিনিময়েও বেঁচে থাকতে পারে।

তো এইখানে আপনি!

সুযোগ আপনার আশেপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। এক কদম সামনে যান, আপনি কী চান নির্দিষ্ট করুন, আপনার পরিকল্পনা তৈরি করুন, পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ আরম্ভ করুন এবং অধ্যবসায়ের সাথে অনুসরণ করুন। আমাদের ‘পুঁজিবাদী দেশ’ বাকিটা করবে। আপনি এর ওপর পুরোপুরি নির্ভর করতে পারেন। প্রত্যেক ব্যক্তি যে দেশের মানুষের জন্য উপকারী সেবা সম্পন্ন করতে চায় তার জন্য আমাদের ‘পুঁজিবাদী দেশ’ জায়গা করে দিয়েছে। সে যতটুকু সম্ভব তার সেবার মূল্য গ্রহণ করতে পারে।

এই ‘ব্যবস্থা’ কারও অধিকার অস্বীকার করে না। কিন্তু এটা কিছু না দিয়ে কিছু পাওয়ার প্রতি কোন অঙ্গীকার করে না। কারণ ব্যবস্থা নিজেও প্রকৃতির আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত যা কিছু না দিয়ে কিছু পাওয়ার প্রতি চিন্তাকে সহ্য করে না।

এই প্রকৃতির আইন প্রকৃতির নিয়ম দিয়ে চলে! আইন লঙ্ঘনকারীর জন্য কোন উচ্চ আদালত নেই যেখান থেকে সে জামিন পাবে। এই আইনই সব। আইন অমান্যকারীকে জরিমানা করে। আবার আইন মান্যকারীকে পুরস্কৃত করে। এতে মানুষের কোন হাত নেই। আইনটি বাতিলও করা যায় না; আবার রদও করা যায় না। এটা এমন এক শাশ্বত আইন যেমন আকাশের তারা এবং আকাশের তারাগুলোকে যে ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করে এটাও সেই একই ব্যবস্থার অংশ।

একজন কি নিজের মধ্যে প্রকৃতির আইনকে খাপ খাওয়াতে অস্বীকার করবে?

নিশ্চয়ই! এটা একটা মুক্ত এবং স্বাধীন দেশ। যেখানে সব মানুষই সমান অধিকার নিয়ে জন্মেছে। এর সাথে প্রকৃতির আইনকে প্রত্যাখ্যান করার অধিকারও রয়েছে।

তাহলে, এরপর কী ঘটবে?

বেশ, কিছুই ঘটবে না যতক্ষণ পর্যন্ত না বিশাল সংখ্যক মানুষ একত্রিত হয়ে এই আইনকে প্রকাশ্যে প্রত্যাখ্যান করবে এবং তারা যা চায় তা তারা জোর করে আদায় করবে।

তারপর আসবে একনায়ক, নিরুঙ্কুশ ক্ষমতাসম্পন্ন এক শাসক। তার অধীনে থাকবে মেশিন গানের সৈনিক!

আমরা এখনও সেই পর্যায়ে যাইনি! কিন্তু আমরা খুব ভালোভাবেই শুনলাম যে সিস্টেম তথা ব্যবস্থা কীভাবে কাজ করে। হয়তো আমরা সকলেই যথেষ্ট সৌভাগ্যবান যে বাস্তবে আমরা এখনও এমন এক ভয়ানক অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হইনি। নিঃসন্দেহে আমাদের এই প্রকৃতির আইন বজায় রাখতে হবে, শ্রদ্ধা করতে হবে এবং স্বাধীনতার কথা বলে একে সমুন্নত রাখতে হবে; নাকি লঙ্ঘন করব।

সরকারি কর্মচারীদের দ্বারা, পুরুষ-নারী মিলে জনগণের সম্পদের ওপর যে লুটপাট চালিয়েছে তার ফলাফল দেখা গেছে আমাদের ব্যবসায়িক বিপর্যয়ে এবং নির্বাচনে। যেমন রাতের পরে দিন আসে। তেমনি প্রতিটি অপকর্মের পাই পাই হিসাব দিতে হয়েছে। মানুষ শুধু মূলধন দিয়েই এই ঋণ শোধ করেনি; বরং চক্রবৃদ্ধি হারে এই ঋণ শোধ করতে হয়েছে। যারা লুটপাট করেছে তাদেরকে যদি বল প্রয়োগ করে জরিমানা আদায় করা না হয় তবে এই বোঝা পড়বে তাদের সন্তানদের ওপর এবং তাদের সন্তানের সন্তানদের ওপর। এমনকি তৃতীয় ও চতুর্থ প্রজন্মের ওপরও। ঋণ এড়িয়ে যাবার কোন পথ নেই।

কিছু কিছু সময় মানুষ নিজেদেরকে এমন একটি দলভুক্ত করে যাতে কম ঘণ্টা কাজ করতে পারে এবং বেশি বেতন নিতে পারে। সেখানে একটি রেখা আছে যার নিচে তারা যেতে পারে না। এই রেখা হচ্ছে যেখানে প্রকৃতির আইন পা ফেলে এবং ন্যায়পালের মতো গ্রেফতার করে নিয়োগকর্তা ও নিয়োগকর্মী উভয়কে। [ন্যায়পাল হচ্ছে আইনকে কার্যে পরিণত করার কর্মচারী বিশেষ।]

আমেরিকার জনগণ, ধনী ও গরিব উভয় লোকজন দীর্ঘ ৬ বছর যাবৎ, ১৯২৯ হতে ১৯৩৫ পর্যন্ত, হতাশার মধ্যে ছিল। হরহামেশা লোকজন তাদের অসৎ কর্মের জন্য গ্রেফতার হতে দেখা গেছে। এমন কা- সব ক্ষেত্রে ঘটেছে। ব্যবসা বাণিজ্য, শিল্প কারখানা এবং ব্যাংকে। এটা কোন সুশ্রী দৃশ্য ছিল না! এটা দাঙ্গাকারী জনতার মানসিকতার প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা বৃদ্ধি করেনি যার মাধ্যমে মানুষ কারণ রূপে দেখায় যে বাতাসই এমন এবং চেষ্টা আরম্ভ করে কিছু না দিয়ে কিছু পাওয়া প্রতি।

আমরা যারা সেই ৬টি নিরুৎসাহী বছরের মধ্য দিয়ে গেছি, যখন সব জায়গায় ভীতি রাজত্ব করেছে এবং আস্থা ভূপতিত হলো। আমরা কি ভুলে যাব যে প্রকৃতির আইন কী নিষ্ঠুরভাবে ধনী-গরিব, সবল-দুর্বল, বড়-ছোট সবার কাছ থেকে মাসুল তুলেছে? আমাদের আর কখনো এমন অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাওয়া উচিত হবে না।

এই পর্যবেক্ষণ কিন্তু একদিনের নয়। এ হচ্ছে দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে মনোযোগের সাথে বিশ্লেষণ করা পর্যবেক্ষণের ফলাফল। আমি আমেরিকার সর্বাধিক পরিচিত সফল এবং অসফল উভয় ব্যক্তির এই দীর্ঘকাল পর্যবেক্ষণ করার পর এ তথ্য আজকে আপনার সামনে উপস্থিত করলাম। এই পদ্ধতির প্রয়োগ তাদেরকে সফল করেছে অথবা অপপ্রয়োগ অসফল করেছে।


 




অধ্যায় - ০৮

সিদ্ধান্ত

দীর্ঘসূত্রতার ওপর কর্তৃত্বকারী

ধনী হওয়ার ক্ষেত্রে সপ্তম ধাপ


যারা ব্যর্থতার অভিজ্ঞতা পেয়েছে এমন ২৫ হাজার পুরুষ এবং নারীর ওপর যথার্থ বিশ্লেষণ হয়েছে। এই পরীক্ষা থেকে জানা গেছে যে মানুষের ব্যর্থ হওয়ার ৩০টি প্রধান কারণের অন্যতম হচ্ছে সিদ্ধান্তের অভাব। এটা কোন তত্ত্ব নয়, এটাই সত্য। দীর্ঘসূত্রতা বা গড়িমসি করার অভ্যাস হচ্ছে সিদ্ধান্তের বিপরীত। এটা এমন এক শত্রু যাকে অবশ্যই জয় করতে হবে। যখন আপনি এ বই পড়ে শেষ করবেন তখন আপনি আপনার ক্ষমতা পরীক্ষার জন্য একটি সুযোগ পাবেন যাতে আপনি দ্রুত এবং নির্দিষ্টভাবে সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেন।

আমি গত ২৫ বছর যাবৎ শত শত মানুষকে বিশ্লেষণ করেছি যারা কোটি কোটি টাকা আয় করেছে। তাদের প্রত্যেকেরই দ্রুততার সাথে সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর অভ্যাস ছিল এবং তারা এসব সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করত ধীরভাবে। আর যারা অর্থ অর্জনে ব্যর্থ হয়, তারা প্রত্যেকেই দেরিতে সিদ্ধান্তে পৌঁছাত এবং এই সিদ্ধান্ত খুব দ্রুত পরিবর্তন করত।

হেনরি ফোর্ডের অসাধারণ গুণাবলির মধ্যে একটি হচ্ছে তার দ্রুত এবং নির্দিষ্টভাবে সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর অভ্যাস। আর সে যদি এগুলো পরিবর্তনও করত, তবে তা খুব ধীরভাবে পরিবর্তন করত। তার এই গুণ এতই সুনামধন্য ছিল যে ফোর্ডকে এটা দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হওয়ার সুনাম এনে দেয়। এই সেই গুণ যা ফোর্ডকে তার খ্যাতিমান “টি” গাড়ির (পৃথিবীর বিশ্রীতম গাড়ি) উৎপাদন অবিরত রাখার জন্য প্রেরণা দেয়। যখন তার সকল উপদেষ্টা এবং অনেক ক্রেতাও এটা পরিবর্তনের জন্য তর্ক করে, তখনও তিনি তার সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন।

হয়তো ফোর্ড তার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে অনেক দেরি করেছিলেন। কিন্তু গল্পের অপর পৃষ্ঠা হচ্ছে ফোর্ডের সিদ্ধান্তের দৃঢ়তাই তাকে আজকের এই সুবিশাল সৌভাগ্য এনে দিয়েছে, যা গাড়ির রূপ পরিবর্তনের আগে দরকার ছিল। এখানে কোন সন্দেহ নেই যে ফোর্ডের সিদ্ধান্তের নির্দিষ্টতার অভ্যাস তার চরিত্রের একটা অংশ।

বেশির ভাগ মানুষ যারা তাদের পর্যাপ্ত চাহিদা মেটানোর জন্য টাকাপয়সা অর্জন করতে ব্যর্থ হয়, তারা সহজেই অন্যদের কথায় প্ররোচিত হয়। তারা সংবাদপত্র এবং ‘গল্পগুজবকারী’ প্রতিবেশীর কথা শোনে। তার নিজের চিন্তা নিজে না করে অন্যের চিন্তা অনুযায়ী কাজ করে। ‘অন্যের অভিমত হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে সস্তা সুবিধা।’ প্রত্যেকের কাছেই এক গুচ্ছ অভিমত রয়েছে। যদি আপনি ‘অভিমত’ দ্বারা প্ররোচিত হয়ে আপনার সিদ্ধান্তে পৌঁছান, আপনি কোনদিন সফল হবেন না। আগেপরে আপনি ব্যর্থ হবেন।

যদি আপনি অন্যদের মতামত দ্বারা প্রভাবিত হন, তবে আপনার নিজের কোন আকাক্সক্ষাই থাকবে না। অন্যের কথায় প্রভাবিত হলে আপনি কোনদিনই আপনার ইচ্ছা পূরণ করতে পারবেন না।

নিজের পরামর্শদাতা নিজেই হতে পারবেন, যখন আপনি এখানে বর্ণিত সূত্র প্রয়োগ করবেন। এগুলো অনুসরণ করে আপনার নিজের সিদ্ধান্তে আপনি নিজেই পৌঁছাতে পারবেন। আপনার আত্মবিশ্বাসে অন্য কাউকে স্থান দিবেন না। শুধু আপনার ‘ঐক্যমন দলের’ সদস্য ব্যতীত। তাদের মতামত শুনবেন, কিন্তু নিজের চিন্তা এবং বিবেচনা বোধ জাগ্রত রাখুন।

আপনার ঘনিষ্ঠ বন্ধু বা আত্মীয়রা হয়তো-বা এটা নাও করতে পারে। এরা প্রায়ই উপহাস, পরিহাস, অপমান এবং ঠাট্টা করে তাদের মনোভাব প্রকাশ করে। হাজারো পুরুষ ও নারী তাদের সারাজীবন এই হীনম্মন্যতা বহন করে। কারণ কিছু ভালো এবং শিক্ষিত আত্মীয়স্বজন ভালো মনোভাব নিয়ে তাদের অপমান করে তাদের আত্মবিশ্বাস ধ্বংস করে দিয়েছে।

আপনার একটি মস্তিষ্ক এবং মন আছে যা আপনার নিজের। এগুলো ব্যবহার করুন এবং আপনার নিজের সিদ্ধান্তে নিজেই পৌঁছান। যদি আপনার কোন ব্যাপার বা তথ্য অন্যদের কাছ থেকে জানার দরকার হয়, তবে সেই তথ্য চুপচাপে জেনে নিন। আপনার উদ্দেশ্য প্রকাশ না করে নীরবে কাজ আদায় করুন।

এটা মানুষের চারিত্রিক একটি বৈশিষ্ট্য যে তারা চাতুর্য বা জ্ঞানী হওয়ার বাহ্য ছদ্মবেশ ধারণ করে বোঝাতে চায় যে তাদের কাছে অনেক জ্ঞান আছে। এমন লোকেরা সাধারণত অনেক বেশি কথা বলে এবং অনেক কম শোনে। যদি আপনি দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার অভ্যাস অর্জন করতে চান, তবে আপনার চোখকান সবসময় খোলা রাখুন এবং মুখ রাখুন বন্ধ। যারা বেশি কথা বলে তারা অন্যান্য বিষয়ে ক্ষীণ। যদি আপনি শোনার চেয়ে বেশি কথা বলেন, তবে আপনি শুধু নিজেকে অনেক প্রয়োজনীয় জ্ঞান অর্জন থেকেই বিরত রাখবেন না; বরং আপনার পরিকল্পনা এবং উদ্দেশ্য উন্মুক্ত করার ফলে লোকেরা আপনাকে পরাজিত করে বিশেষ আনন্দ নিবে। কারণ তারা আপনাকে হিংসা করে।

আরও মনে রাখবেন, যতবার আপনি আপনার মুখ খুলছেন এমন একজনের সামনে যার প্রচুর জ্ঞান আছে, আপনি সেই ব্যক্তিকে দেখাচ্ছেন আপনার জ্ঞানের সঠিক ভা-ার অথবা জ্ঞানের অভাব! প্রকৃত জ্ঞান সাধারণত ন¤্রতা এবং নিরবতার মাধ্যমে সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে।

ব্যাপারটি মনে রাখবেন যে প্রত্যেক ব্যক্তি যাদের আপনি সহযোগী, তারা যেন আপনার মতো হয়, অর্থ উপার্জনের সুযোগ খুঁজছে এমন। যদি আপনি আপনার পরিকল্পনা সম্পর্কে খোলাখুলিভাবে বলেন, আপনি হয়তো বিস্মিত হবেন এটা দেখে যে অপর ব্যক্তি আপনার লক্ষ্য আপনারই আগে কাজে লাগিয়ে আপনাকে পরাজিত করছে, যে পরিকল্পনার কথা আপনি অসচেতনভাবে বলেছিলেন।

তাহলে আপনি প্রথমে সিদ্ধান্ত নিন যে নিজের মুখ বন্ধ রাখবেন এবং চোখকান খোলা রাখবেন।

নি¤েœাক্ত উপদেশ পুনরায় আপনাকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। আরও ভালো হবে যদি আপনি এই উক্তি বড় বড় অক্ষরে লিখে রাখেন এবং এমন কোন স্থানে টাঙিয়ে রাখেন যেখানে আপনি প্রতিদিন এটা দেখতে পান।

‘আপনি কী করতে চান তা বিশ্বকে জানান, কিন্তু প্রথমে কাজটি করে দেখান।’

এটা বলা সমতুল্য যে, ‘খালি মুখের বুলি নয়; বরং আপনার কাজকে বেশি মূল্যায়ন করা হয়।’


একটি সিদ্ধান্তে মুক্তি; নতুবা মৃত্যু

সিদ্ধান্তের মূল্য নির্ভর করে তাদের সম্পন্ন করার প্রয়োজনীয় সাহসের ওপর। মহান সিদ্ধান্তগুলো, যা সভ্যতার ভিত্তি তৈরি করেছে, এগুলো সম্পন্ন হতে অনেক ঝুঁকি পাড়ি দিতে হয়েছে, যা প্রায়ই মৃত্যুর সম্ভাবনা তৈরি করেছিল।

লিংকনের সিদ্ধান্ত ছিল দাস প্রথার বিলুপ্তিকরণ, যা আমেরিকার বর্ণবাদী মানুষের স্বাধীনতা দেয়। তিনি এটা পুরোপুরি বুঝতে পেরেছিলেন যে তার এমন কাজ হয়তো তার হাজারো বন্ধু এবং রাজনৈতিক সমর্থনকারীকে তার বিরুদ্ধে দাঁড় করাবে। তিনি আরও জানতেন, দাস প্রথার বিলুপ্তিকরণ, এই ঘোষণাপত্র যুদ্ধক্ষেত্রে হাজারো সৈনিকের মৃত্যু আনতে পারে। অবশেষে, এটা লিংকন তার জীবন দিয়ে পরিশোধ করেন। এজন্য দরকার সাহস।

সক্রেটিসের সিদ্ধান্ত ছিল বিষে ভরা পেয়ালা পান করবে, তবুও তার ব্যক্তিগত বিশ্বাসে কোন সমঝোতা করবে না। এটা ছিল একটা সাহসী সিদ্ধান্ত। এটা বুঝতে মানুষের এক হাজার বছর সময় লেগেছে। তার সিদ্ধান্ত মানুষকে জাগিয়ে তুলেছে, মুক্তভাবে চিন্তা করার এবং বলার স্বাধীনতা দিয়েছে।

কিন্তু, সব সময়ের সর্বশ্রেষ্ঠ সিদ্ধান্ত, যতদূর পর্যন্ত কোন আমেরিকান নাগরিক জানে, তা হচ্ছে ১৭৭৬ সালের ৪ই জুলাই, ফিলাডেলফিয়ার স¦াধীনতার ঘোষণাপত্রের সিদ্ধান্ত, যখন ৫৬ জন ব্যক্তি একটি নথিতে তাদের নাম স্বাক্ষর করে, তারা উত্তমভাবে জানত যে এটা সকল আমেরিকানদের প্রতি স্বাধীনতা আনবে; না হয় ৫৬ জনের প্রত্যেককে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলতে হবে!

আপনি হয়তো এই বিখ্যাত নথি সম্বন্ধে শুনেছেন। কিন্তু আপনি হয়তো এটার মধ্যকার ব্যক্তিগত অর্জনের মহান শিক্ষা খেয়াল করেননি, যা এটা খুব সরলভাবে শেখায়।

আমরা সকলেই এই গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের তারিখ মনে রাখি, কিন্তু আমাদের মধ্যকার অল্প মানুষই অনুধাবন করি যে সেই সিদ্ধান্তের জন্য কী পরিমাণ সাহস দরকার ছিল। আমরা মনে রাখি আমাদের ইতিহাস। যেমন এটা আমাদের শেখানো হয়েছে। আমরা মনে রাখি ভেলি ফোর্জ এবং ইয়র্ক টাউনকে। আমরা মনে রাখি জর্জ ওয়াশিংটন এবং লর্ড কর্ণওয়ালিসকে। কিন্তু আমরা খুব অল্পই জানি সত্যিকার বলগুলো সম্বন্ধে যা এই নামের পিছনে ছিল। আমরা এখনও অল্পই জানি সেই অদেখা ক্ষমতা সম্বন্ধে, যা নিশ্চিত করেছে আমাদের স্বাধীনতা। এই শক্তি, এই ক্ষমতা ওয়াশিংটনের সেনাবাহিনী ইয়র্ক টাউনে পৌঁছাবার বহু আগেই আমাদের জনমনে পৌঁছে গেছে।

আমরা রাষ্ট্রবিপ্লবের ইতিহাস পড়ি এবং ভুলভাবে কল্পনা করি যে জর্জ ওয়াশিংটন ছিলেন আমাদের দেশের পিতা। যদিও এটা সত্য যে তিনিই আমাদের স্বাধীনতা জয় করেছিলেন, তবুও সত্য হচ্ছে ওয়াশিংটন ছিলেন ব্যাপারটি ঘটার ক্ষেত্রে একজন অতিরিক্ত সাহায্যকারী। কারণ তার সেনাবাহিনীর জন্য বিজয় নিশ্চিত হয়েছিল লর্ড কর্ণওয়ালিস আত্মসমর্পণ করার বহু আগেই। ওয়াশিংটনের কোন গৌরব চুরি করা আমার এই বিশ্লেষণের উদ্দেশ্য নয় যার তিনি উচ্চভাবে যোগ্য। বরং এর উদ্দেশ্য হচ্ছে আরও মহান এবং বিস্ময়কর ক্ষমতার প্রতি মনোযোগ আকর্ষণ করানো যা ছিল আমাদের মহান স্বাধীনতা বিজয়ের সত্যিকার কারণ।

এটা দুঃখজনক ঘটনা ছাড়া আর কিছুই না যে ইতিহাস লেখকরা সম্পূর্ণভাবে স্বাধীনতার এই দিকটি ছেড়ে গেছে। এমনকি এই অনিবার্য ক্ষমতা সম্বন্ধে সামান্যতম উল্লেখও নাই, যা একটি জাতির জন্ম এবং স্বাধীনতা দিয়েছে, যা একটি জাতির জন্য একটি নতুন আদর্শ গঠন করেছে, যা পৃথিবীর সব মানুষের জন্য স্বাধীনতার একটি নতুন চেতনা সৃষ্টি করেছে। আমি বলব এটা একটা দুঃখজনক ঘটনা। কারণ এটা হচ্ছে সেই একই ক্ষমতা যা অবশ্যই প্রত্যেক স্বতন্ত্র ব্যক্তিকে তার ব্যক্তিজীবনে প্রয়োগ করতে হবে যে তার জীবনের বাধা অতিক্রম করে তার ইচ্ছা-আকাক্সক্ষা পূরণ করতে চায়।

চলুন আমরা সংক্ষিপ্তে ঘটনা পুনর্বিচার করি যা এই ক্ষমতার জন্ম দিয়েছে। গল্পের আরম্ভ হয় একটি ঘটনার মধ্য দিয়ে। তখন ১৭৭০ সালের ৫ই মার্চ। বোস্টন শহরের রাস্তায় ব্রিটিশ সৈন্যরা টহল দিচ্ছে। তাদের উপস্থিতি দ্বারা প্রকাশ্যে নাগরিকদের ভয় দেখানো হচ্ছে। ব্রিটিশ উপনিবেশগুলোতে সশস্ত্র সৈন্যরা টহল দিচ্ছে। তারা প্রকাশ্যে তাদের বিদ্বেষ দেখানো শুরু করল। নেতৃত্ব দানকারী কর্মকর্তা নির্দেশ দিচ্ছে, ‘বন্দুক প্রস্তুত করো ... ... ... ফায়ার!’

লড়াই চলছিল। এর ফলাফল ছিল অনেকের আহত-নিহত হওয়া। ঘটনা এমন বিদ্বেষে পরিণত হয় যে নামকরা উপনিবেশগুলো নিয়ে একটি প্রাদেশিক সভা গঠিত হয়। সভার বৈঠক আহ্বান করা হয় যে এমত অবস্থায় কী ধরনের নির্দিষ্ট পন্থা অবলম্বন করতে হবে। এই সভার ২ জন সদস্য ছিল; জন হেনকক এবং স্যামুয়েল অ্যাডামস। তাদের নাম দীর্ঘজীবী হোক! তারা সাহসীভাবে কথা বলেছিল এবং ঘোষণা করেছিল যে বোস্টন থেকে সব ব্রিটিশ সৈন্যকে দূর করতে একটি কঠোর আন্দোলন তৈরি করতে হবে।

মনে রাখবেন, এটা ছিল একটা সিদ্ধান্ত, ২ জন ব্যক্তির মনের সিদ্ধান্ত। হয়তো ঠিকভাবে বলতে গেলে বলতে হয় আমাদের স্বাধীনতার আরম্ভ যা আমরা, আমেরিকার জনগণ এখন উপভোগ করছি। আরও, মনে রাখবেন, এই ২ ব্যক্তির সিদ্ধান্তের জন্য দরকার ছিল আস্থা এবং সাহস। কারণ তখনকার সময়ে এই ধরনের কথা উঠানো বিপদজনক ছিল।

সভা স্থগিত করার আগে, স্যামুয়েল অ্যাডামসকে নিযুক্ত করা হয় ঐ প্রদেশের গর্ভনর হাচিনসনের সাথে কথা বলার জন্য এবং দাবি জানানোর জন্য যে ব্রিটিশ সেনাদের উঠিয়ে নেওয়া হোক।

গর্ভনর হাচিনসন স্যামুয়েল অ্যাডামসের অনুরোধ রাখেন। তিনি বোস্টন থেকে সৈন্যদের সরিয়ে নেন। কিন্তু ঘটনা এখানেই শেষ হয়নি। এটা একটা অবস্থার কারণ হয়ে দাঁড়ায় যা ভাগ্য কর্তৃক নির্ধারিত ছিল যে সম্পূর্ণ সভ্যতার দিক পরিবর্তন করবে। অদ্ভুত! তাই না। কীভাবে বড় বড় পরিবর্তনের সূচনা ঘটে! প্রায়ই এর আরম্ভ হয় এমন অবস্থা থেকে যা দেখতে গুরুত্বহীন মনে হয়। এটা আরও মজাদার হবে যখন আপনি দেখবেন যে এই গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন সাধারণত আরম্ভ হয় অল্প কয়েকজন মানুষের মনের মধ্যে একটি নির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত আকারে। আমাদের মধ্যকার অল্প মানুষই আমাদের দেশের ইতিহাস যথেষ্ট ভালোভাবে অনুধাবন করতে পেরেছে যে জন হেনকক, স্যামুয়েল অ্যাডামস এবং রিচার্ড হেনরি লি (ভার্জিনিয়া প্রদেশের সদস্য) আমাদের দেশের সত্যিকারের জাতির পিতা ছিলেন।

রিচার্ড হেনরি লি গল্পের এক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হয়ে উঠেন কারণ তিনি এবং স্যামুয়েল অ্যাডামস প্রায়ই একে অপরের সাথে চিঠির মাধ্যমে যোগাযোগ করতেন। তারা মুক্তভাবে তাদের প্রদেশের জনগণের মঙ্গল সংক্রান্ত তাদের আশা এবং ভয়ের কথা বিনিময় করতেন। এই অনুশীলন থেকে, অ্যাডামস একটি ধারণা পান। তিনি পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধির জন্য ১৩টি উপনিবেশে চিঠি পাঠান, যাতে করে জনগণের সমস্যা সমাধানে সকলে মিলে একত্রে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করা যায়। বোস্টন সেনাদের সাথে সংঘর্ষের ২ বছর পর, মার্চ ১৭৭২ এ, অ্যাডামস একটি সভাতে এই আইডিয়া উপস্থাপন করেন। তিনি প্রস্তাব দেন উপনিবেশের মধ্যে যোগাযোগ বৃদ্ধির জন্য নির্দিষ্ট পত্রবাহক দিয়ে একটি নির্দিষ্ট সংস্থা থাকবে। এই সংস্থার উদ্দেশ্য হচ্ছে ‘ব্রিটিশ-আমেরিকা উপনিবেশের মঙ্গলের জন্য বন্ধুত্বপূর্ণ সহযোগিতা।’ কারণ তখনকার দিনে, ১৭৭০ সালের দিকে, ব্রিটিশরা আমেরিকাকে উপনিবেশ বানায় এবং আমেরিকাকে শাসন করত। এমন পরিস্থিতিতে আমেরিকার রাজ্যগুলো ছিল একে অপরের থেকে বহুদূরে এবং যোগাযোগের দিক থেকে বিচ্ছিন্ন।

এই ঘটনাতে উত্তমভাবে দাগ দিন! এটা ছিল সংগঠনের আরম্ভ, সেই সুদূরবর্তী ক্ষমতা যা ভাগ্য কর্তৃক নির্ধারিত ছিল স্বাধীনতা দিতে আপনার এবং আমার প্রতি। ইতোমধ্যে ঐক্যমন দল সংগঠিত হয়ে গিয়েছিল। এটা গঠিত হয়েছিল অ্যাডামস, লি এবং হেনকক কর্তৃক। আমি আরও এগিয়ে বলতে চাই, ‘যদি আপনারা দুইজন পৃথিবী সংক্রান্ত যেকোন বিষয়ে একমত হন যা আপনারা নির্দিষ্টভাবে চান, তবে এটা আপনাদের কাছে আসবেই।’

চিঠিপত্র চালাচালির জন্য একটি সংস্থা গঠিত হয়েছিল। পর্যবেক্ষণ করুন যে এই পদক্ষেপ সেই পথে চালিত করেছে যাতে ঐক্যমন দলের ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। তাদের এই ঐক্যমন দল অন্য উপনিবেশের মানুষকে যুক্ত করেছে এবং তাদের শক্তি বৃদ্ধি করেছে। খেয়াল করুন, এই প্রথম অসন্তুষ্ট উপনিবেশগুলোতে সংগঠিত পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হচ্ছে।

ঐক্যের মধ্যে শক্তি! উপনিবেশগুলোর নাগরিকরা ব্রিটিশ সেনাদের বিরুদ্ধে অসংগঠিতভাবে আন্দোলন করেছিল। এমন বিছিন্ন ঘটনার একটি ছিল বোস্টন দাঙ্গা। কিন্তু তাতে কোন লাভ হয়নি। একটি ঐক্যমন দল রূপে তাদের স্বতন্ত্র অভিযোগ জমাট বাঁধতে পারেনি। স্বতন্ত্রদের কোন দল তাদের হৃদয়, মন, আত্মা এবং দেহকে একটি নির্দিষ্ট সিদ্ধান্ততে পৌঁছাতে একত্রিত করতে পারেনি। যে নির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত ছিল ব্রিটিশদের শাসনের অবসান। অ্যাডামস, হেনকক এবং লি একত্রিত হওয়ার আগে অনেক আন্দোলনই ঘটে, কিন্তু কোনটাই দানা বাঁধতে পারেনি।

ইতোমধ্যে, ব্রিটিশরাও অলসভাবে বসেছিল না। তারাও তাদের নিজস্ব হিসাব অনুযায়ী পরিকল্পনা করছিল। তাদেরও ‘ঐক্যমন দল’ ছিল, যাদের পিছনে তাদের অর্থ এবং সংগঠিত সৈন্যদের সুবিধা ছিল।

ব্রিটিশ রাজা গর্ভনর হাচিনসনের সৈন্য সরানোর এই সিদ্ধান্তে বিরক্ত ছিলেন। কিন্তু তিনি তা প্রকাশ করলেন না। তিনি জনাব গেজকে হাচিনসনের পরিবর্তে মাসাচুটসের গর্ভনর রূপে নিযুক্ত করেন। গেজ একজন নতুন গর্ভনর হয়ে প্রথমেই স্যামুয়েল অ্যাডামসকে ডাকেন। তার উদ্দেশ্য ছিল তার বিপক্ষকে ভয় দেখিয়ে থামানোর চেষ্টা করা।

গর্ভনর গেজ তার পত্রবাহক হিসাবে কর্ণেল ফেনটনকে পাঠান। কর্ণেল ফেনটন এবং অ্যাডামসের মধ্যে যে আলাপ হয় তা উল্লেখ করছি। এই আলাপ থেকে আপনি সহজেই সেই চেতনা ধরতে পারবেন এবং বুঝতে পারবেন যে কী ঘটেছিল।

কর্ণেল ফেনটন: ‘আমি গর্ভনর গেজ দ্বারা অনুমোদিত, জনাব অ্যাডামস, আপনাকে নিশ্চিত করতে চাই, যে গর্ভনরকে ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে আপনার ওপর এমন সব সুবিধা অর্পণ করার প্রতি যেন আপনি সন্তুষ্ট হোন, (ঘুষ দেওয়ার অঙ্গীকার দ্বারা অ্যাডামসকে জয় করার চেষ্টা)। তবে আপনাকে সরকার বিরোধী কর্মকা-ে ক্ষান্ত দিতে হবে। আপনার প্রতি গর্ভনরের পরামর্শ হচ্ছে নিজের ওপর মহারাজের আর অসন্তুষ্টি আনবেন না। আপনার এমন কোন আচরণের জন্য নিজেই দায়ী হতে পারেন। যাতে করে মহারাজ অষ্টম হেনরি আপনাকে দ- দিবে। এর ফলে যেকোন ব্যক্তিকে তার রাজদ্রোহের বিচারের জন্য ইংল্যান্ডে নিয়ে যাওয়া হবে এবং কারাগারে নিক্ষেপ করা হবে। এটা প্রদেশের একজন গর্ভনরের আইনগত কথা। কিন্তু আপনি যদি আপনার রাজনৈতিক দিক পরিবর্তন করেন, তবে আপনি কেবল ব্যক্তিগত সুবিধাই লাভ করবেন না; বরং আপনি রাজার সাথে মৈত্রীও তৈরি করবেন।’

স্যামুয়েল অ্যাডামসকে দুইটি সিদ্ধান্তের মধ্যে একটিকে নির্বাচন করতে হয়েছিল। তিনি তার বিপক্ষের বিরুদ্ধে কাজ করা ক্ষান্ত দিয়ে ব্যক্তিগতভাবে ঘুষ গ্রহণ করবেন অথবা সামনে এগিয়ে যাবেন এবং ফাঁসিতে ঝুলার ঝুঁকি নিবেন! স্পষ্টভাবে, সেই সময় এসেছিল যখন অ্যাডামসকে বল প্রয়োগ করে তাৎক্ষণিক একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে হয়েছিল যার দাম হয়তো তার জীবন দিয়ে পরিশোধ করতে হবে। বেশির ভাগ মানুষকে যখন এমন এক সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে হয় তখন তারা একে কঠিন রূপে চিন্তা করে। বেশির ভাগ মানুষ এমন পরিস্থিতিতে ছলচাতুরীর আশ্রয় নিতে চায়। এমন পরিস্থিতিতে অন্যরা হয়তো একটি ছলনাপূর্ণ জবাব পাঠিয়ে দিত। কিন্তু অ্যাডামস এমন মানুষ নয়! তিনি কর্ণেল ফেনটনকে সম্মান জানান এবং অনুরোধ করেন যে, ‘আপনি গর্ভনরকে ঠিক সেই জবাবই দিবেন যা আমি আপনাকে বলছি।’

অ্যাডামসের জবাব, ‘তাহলে আপনি গর্ভনর গেজকে বলবেন যে আমার বিশ্বাস আমি দীর্ঘ সময় ধরে রাজাদের রাজা, মহারাজার সাথে আমার মৈত্রী বজায় রেখেছি। কোন ব্যক্তিগত বিবেচনা বা সুবিধা আমাকে আমার দেশের ন্যায্য অধিকার আদায় করা থেকে সরাতে পারবে না। আর গর্ভনর গেজকে বলবেন তার প্রতি এটা স্যামুয়েল অ্যাডামসের পরামর্শ যে আর কখনো একটি উত্তেজিত জনতার অনুভূতিকে অপমান না করতে।’

ঘুষ দিতে চায় এমন চরিত্রের মানুষের প্রতি এই মন্তব্য দেখতে অপ্রয়োজনীয় মনে হতে পারে। কিন্তু ধীরভাবে আপনার সিদ্ধান্ত বর্ণনা করার এটাই উত্তম পন্থা। অবশ্যই সকলের কাছে এটা স্পষ্ট যে এই বক্তা তার সর্বোচ্চ পর্যায়ের শাসনকর্তার প্রতি বিশ্বস্ততা দেখিয়েছে এবং দেশের জনগণের প্রতি তার কর্তব্যকেও বর্ণনা করেছে। এটাই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আজকের অসৎ এবং চাঁদাবাজ রাজনৈতিক ব্যক্তিরা এই সম্মানের অপব্যবহার করছে, যে সম্মানের জন্য অ্যাডামসের মতো মানুষরা মৃত্যুবরণ করতেও রাজি ছিল।

যখন গর্ভনর গেজ অ্যাডামসের তীব্র জবাব শুনলেন তখন তিনি ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে উঠলেন এবং একটি ইশতেহার জারি করলেন, ‘আমি, এতদ্বারা, মহারাজের নামে প্রস্তাব দিচ্ছি এবং অঙ্গীকার করছি যারা তাদের অস্ত্র জমা দিবে এবং শান্তিপূর্ণভাবে নিজ নিজ দায়িত্বে ফিরে যাবে তাদেরকে মহারাজের ক্ষমা প্রদর্শন করা হবে। তবে এমন ক্ষমার সুবিধা থেকে কেবল স্যামুয়েল অ্যাডামস এবং জন হেনকক বঞ্চিত, যাদের কর্মকা- অতি গর্হিত প্রকৃতির যা কেবল সমুচিত শাস্তির যোগ্য।’

একজন হয়তো আধুনিক অমার্জিত ভাষায় বলবে যে ‘ধ্যেত! অ্যাডামস এবং হেনকক সেই সময় সেই জায়গায় ছিল। এজন্যই তারা এমন কাজ করতে পেরেছে।’ কিন্তু আজও এমন সব ঘটনা ঘটে যেখানে এই ধরনের সমালোচনাকারী ব্যক্তিরা তাদের চারিত্রিক দৃঢ়তা দেখাতে ব্যর্থ হয়। যাইহোক, ক্রুদ্ধ গর্ভনরের ভীতি প্রদর্শনের ফলে এই দুই ব্যক্তি অপর এক সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে বাধ্য হয়েছিল, যা সমানভাবে বিপদজনক। তারা দ্রুত একটি গোপন বৈঠকের ডাক দিলো। তারা তাদের বিশ্বস্ত লোকজনকে নিয়ে একটি সাক্ষাতের ব্যবস্থা করল। (এখান থেকেই ঐক্যমন দলের কাজ আরম্ভ হলো)। বৈঠকে সবাই আসন গ্রহণ করার পর, অ্যাডামস রুমের দরজা বন্ধ করে দিলেন। চাবিটি তার পকেটে রেখে দিলেন এবং উপস্থিত সকলকে জানালেন যে এটা জরুরি যে উপনিবেশগুলোর একটি প্রতিনিধি সভা সংগঠিত হতে হবে এবং কোন ব্যক্তি এই কক্ষ ছেড়ে যেতে পারবে না যতক্ষণ পর্যন্ত না এমন একটি প্রতিনিধি সভা গঠনের সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায়।

বিরাট এক উত্তেজনা চলছিল। কিছু ব্যক্তি ভয় পেয়েছিল এমন চরমপন্থী বিবেচনায়। (এটা হচ্ছে বৃদ্ধ মানুষের ভীতি)। কিছু তাদের গম্ভীর সন্দেহ প্রকাশ করল এই বিজ্ঞতার সাথে যে স¤্রাটের বিরুদ্ধে এত নির্দিষ্ট একটি সিদ্ধান্ত নেওয়া কী ঠিক হবে! তালাবদ্ধ সেই কক্ষে কেবল দুইজন পুরুষ ছিল ভীতিমুক্ত। তারা ছিল ব্যর্থতার সম্ভাবনার প্রতি অন্ধ; হেনকক এবং অ্যাডামস। তাদের দৃঢ় মনোভাবের কারণে অন্যরা একটি মহাদেশীয় প্রতিনিধি সভা গঠন করতে রাজি হলো। সিদ্ধান্ত হলো ৫ই সেপ্টেম্বর, ১৭৭৪ সালে ফিলাডেলফিয়াতে এই প্রতিনিধি সভার বৈঠক হবে।

এই তারিখ মনে রাখবেন। এটা জুলাই ৪, ১৭৭৬ থেকেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। যদি সেখানে কোন সিদ্ধান্ত না হত যে একটি মহাদেশীয় প্রতিনিধি সভা অনুষ্ঠিত হবে, তবে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রেও কোন স্বাক্ষর হত না।

এই প্রতিনিধি সভা অনুষ্ঠিত হওয়ার আগে, দেশের অপর প্রান্তের এক নেতা একটি প্রতিবেদনে তার তীব্র বেদনা প্রকাশ করে। প্রতিবেদন ছিল ‘ব্রিটিশ আমেরিকান উপনিবেশের সংক্ষিপ্ত অধিকারের বিবরণ।’ তিনি ছিলেন টমাস জেফারসন, ভার্জিনিয়া প্রদেশের এক নেতা। ভার্জিনিয়ার গর্ভনর লর্ড ডানমোরের সাথে যার সম্পর্ক ছিল ঠিক তেমন অস্বাভাবিক যেমন হেনকক এবং অ্যাডামসের সাথে তাদের গর্ভনরের।

তার এই বিখ্যাত প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়ার পর পরই জেফারসনকে জানান হলো যে তিনি সরকারের বিরুদ্ধে রাজদ্রোহী রূপে অভিযুক্ত হয়েছেন। এই হুমকি দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে জেফারসনের সহযোগীদের একজন, পেটট্রিক হেনরি, সাহসীভাবে বলেছিল, ‘যদি এই হয় রাজদ্রোহ, তাহলে এটাকে বিরাট করে তৈরি করব।’ তার এই কথা ইতিহাসের পাতায় চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।

এরা ছিল এমন পুরুষ যারা ক্ষমতা, কর্তৃপক্ষ, সেনাবাহিনীর শক্তি এবং টাকাপয়সা ছাড়া একত্রিত হয়। এরা এক হয়ে বসে উপনিবেশের ভাগ্যের প্রতি ভক্তি ও শ্রদ্ধা নিয়ে প্রথম মহাদেশীয় প্রতিনিধি সভা আরম্ভ করে এবং পরবর্তী ২ বছর পর্যন্ত চলতে থাকে, যতক্ষণ পর্যন্ত না আসে ৭ই জুন, ১৭৭৬। এই দিন রিচার্ড হেনরি লি মঞ্চে উঠে দাঁড়ান, নিজের আসনের দিকে নির্দেশ দিয়ে দেখান এবং একটি প্রস্তাব দিয়ে সভায় উত্তেজনা সৃষ্টি করেন:

‘আমার প্রিয় ভাইয়েরা, আমি বিশ্বাস করি এই যুক্ত উপনিবেশগুলোর স্বাধীন এবং মুক্ত রাষ্ট্র হওয়ার অধিকার আছে। আমরা ব্রিটিশ মুকুট থেকে নিজেদের স্বাধীন বলে ঘোষণা করতে পারে। আমাদের অধিকার আছে ব্রিটিশদের সব রাজনৈতিক সংযোগ থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করার। আমার মনে হয় এই সময় এখন উপস্থিত হয়েছে।’

লি’র এই বিস্ময়কর প্রস্তাব ব্যগ্রভাবে আলোচিত হয় এবং এত দীর্ঘভাবে আলোচনা চলতে থাকে যে তিনি ধৈর্য হারাতে শুরু করেন। অবশেষে, কয়েক দিনের তর্কের পর, তিনি পুনরায় মঞ্চে এলেন এবং ঘোষণা করলেন, একটি দৃঢ় এবং স্পষ্ট কণ্ঠে, ‘জনাব সভাপতি, আমরা এই বিষয় নিয়ে কয়েক দিন যাবৎ আলোচনা করছি। আমাদের সামনে কেবল একটিই পথ খোলা। তাহলে স্যার, কেন আমরা দেরি করছি? কেন আমরা এখনও চিন্তা করছি? চলুন, এই আনন্দের দিনটিকে জন্ম দিই। একটি আমেরিকান প্রজাতন্ত্রের ঘোষণা দিই। চলুন, একে উঠতে দিই। এটাকে ধ্বংস এবং পরাজিত না করে; বরং শান্তি এবং আইনের আধিপত্যকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করি। সারা ইউরোপের চোখ আমাদের ওপর স্থির হয়ে আছে। এটা আমাদের কাছ থেকে স্বাধীনতার একটা জীবন্ত উদাহরণ দাবি করছে। আমাদের নাগরিকদের গভীর আকাক্সক্ষা হচ্ছে স্বাধীনতা। আমাদের সিদ্ধান্ত তাদের মুখে হাসি ফোটাবে। আজকের এই আনন্দ পূর্বে ঘটে যাওয়া সব অত্যাচারের বিরুদ্ধে বিজয়ের চিহ্ন হিসাবে ফুটে উঠবে।’

এটা ছিল একটা সিদ্ধান্ত। এমন এক সিদ্ধান্তই হচ্ছে যা আস্থার বহিঃপ্রকাশ। এমন সিদ্ধান্তই পারে আপনার ব্যক্তিগত সমস্যার সমাধান করতে। এমন সিদ্ধান্তই পারে আপনাকে প্রচুর সম্পদের মালিক বানাতে। আত্মিক এবং মানসিক সুখ দিতে। এটা আমাদের ভুলে যাওয়া উচিত নয়!

এরপর ৪ জুলাই, ১৭৭৬ এ, টমাস জেফারসন মঞ্চে উঠে দাঁড়ালেন। সভার সামনে নির্ভীকভাবে তাদের সিদ্ধান্ত পাঠ করলেন। সেই সিদ্ধান্তে ৫৬ জন সদস্য স্বাক্ষর করলেন। যাদের সিদ্ধান্তের ওপর, তাদের এই জীবন-মরণ সিদ্ধান্তের ওপর দাঁড়িয়ে আছে আজকের স্বাধীনতা।

স্বাধীনতার এই ঘটনা ঐক্যমনের দল দ্বারা সৃষ্টি হয়েছিল। সদস্য ছিল ৫৬ জন। ভালোভাবে লক্ষ করুন, তাদের সিদ্ধান্তই ওয়াশিংটনের সেনাবাহিনীর সাফল্য নিশ্চিত করে। কারণ সেই সিদ্ধান্তের চেতনা প্রত্যেক সৈন্যের হৃদয়ে বিরাজ করছিল। তারা এই চেতনা নিয়েই লড়াই করেছিল। এই ধরনের একটি আত্মিক চেতনা ব্যর্থতার মতো কোন বিষয়কেই চেনে না।

আরও লক্ষ করুন, (নিজের ব্যক্তিগত লাভের জন্য), যে ক্ষমতা এই দেশকে স্বাধীনতা দিয়েছে সেটা আপনিও ব্যবহার করতে পারেন। এই ক্ষমতা ব্যবহার করে আপনি হয়ে উঠবেন একজন আত্ম-প্রত্যয়ী ব্যক্তি। ক্ষমতা তৈরির সেই একই সূত্রাবলি এ বইয়ে বর্ণনা করা হয়েছে। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র থেকে এটা বের করা কঠিন হবে না। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে এ বইয়ের কমপক্ষে ৬টি সূত্র ব্যবহৃত: আকাক্সক্ষা, সিদ্ধান্ত, আস্থা, অধ্যবসায়, ঐক্যমন দল এবং সংগঠিত পরিকল্পনা।

[ফজলে রাব্বির কথাÑএই ঘটনার পরেই ব্রিটিশদের উপনিবেশ পরিচালনার নীতির পরিবর্তন হয়। তারা ভারতীয় উপমহাদেশ পরিচালনা করতে গিয়ে এই নীতির প্রচলন করে। নীতি হচ্ছে: এলাকা পরিচালনার ক্ষেত্রে স্থানীয় কোন দৃঢ়চেতা লোক নেওয়া যাবে না। কোন চরিত্রবান বা একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যে অটল এমন কোন ব্যক্তি দ্বারা স্থানীয় এলাকাকে শোষণ করা যায় না। কারণ এক সময় না এক সময় সেই ব্যক্তি এলাকার লোকজনের দুঃখ-দুর্দশার জন্য প্রতিবাদ জানাবেই। তাই ব্রিটিশরা ভারতীয় উপমহাদেশে এলাকা পরিচালনার জন্য কিছু দুর্নীতিপরায়ণ বা চাটুকার লোক নিয়োগ করে। যারা অর্থ, মদ এবং নারী নিয়ে মত্ত। এই কৌশল এখন পর্যন্ত চালু আছে। এখনও আমাদের শাসক গোষ্ঠী এমন লোকদের এলাকা পরিচালনা করার দায়িত্ব দেয় যারা অর্থ, মদ এবং নারী নিয়ে মত্ত। কিন্তু আমাদের দৃঢ়চেতা লোক কোথায়? সেই চরিত্রবান পুরুষ কোথায়? একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যে অটল এমন ব্যক্তি কোথায়?] আবার অনুবাদে ফিরে আসি।

এ বইয়ের সাফল্য দর্শনের মধ্যে আপনি একটি পরামর্শ পাবেন, একটি চিন্তা পাবেন যা আপনাকে আপনার সাফল্য অর্জনে আপনাকে সহায়তা করবে। সামনে যাওয়ার আগে, আমি আপনাকে একটি পরামর্শ দিতে চাই যে স্বাধীনতার ঘটনা এবং ইউনাইটেড স্টেস স্টিল কর্পোরেশন সংগঠনের ঘটনায় আপনি একটি চিন্তা পাবে যে চিন্তা-চেতনা আপনার মধ্য থেকে সেই সফল ব্যক্তিত্বকে বের করে আনবে যে আপনার ভেতরের আকাক্সক্ষা বাস্তবে রূপান্তর করে দেখাবে।

আপনি একটি অভিযানে বের হয়েছেন। আপনি আপনার আকাক্সক্ষাকে বাস্তবে পরিণত করতে চান। আপনি সাফল্যের গোপন রহস্য খুঁজে বের করতে চান। কিন্তু এখানে কোন ধরনের জাদুর খোঁজ পাবেন না অথবা কোন জাদুর জন্য খুঁজবেন না। কারণ আপনি তা পাবেন না। আপনি কেবল প্রকৃতির চিরন্তন সত্যকে খুঁজে পাবেন। এসব সত্য প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য উন্মুক্ত। যার এগুলো ব্যবহার করার আস্থা এবং সাহস আছে তার সামনে এগুলো উন্মুক্ত। এগুলো একটি জাতির স্বাধীনতা আনতে পারে অথবা ধনসম্পদ অর্জন করতে ব্যবহার হতে পারে। এগুলোর জন্য আপনাকে কোন বিনিময় মূল্য দিতে হবে না। আপনাকে কেবল এগুলো বোঝার এবং আয়ত্ত করার জন্য প্রয়োজনীয় সময় দিতে হবে।

যারা দ্রুত এবং নির্দিষ্টভাবে সিদ্ধান্তে পৌঁছায়, তারা জানে যে তারা কী চায় এবং সাধারণত তারা এটা পেয়ে থাকে। জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে নেতারা দ্রুত এবং দৃঢ় সিদ্ধান্ত নেয়। এটাই হচ্ছে তাদের নেতৃত্বের প্রধান কারণ। পৃথিবী সেই ব্যক্তিকে জায়গা করে দেয় যে কথায় এবং কাজে দেখায় যে সে জানে সে কোথায় যাচ্ছে।

সিদ্ধান্তহীনতা এমন এক অভ্যাস যা সাধারণত ছোটবেলা থেকে আরম্ভ হয়। এই অভ্যাস বড় হওয়ার সাথে সাথে স্থায়িত্ব লাভ করে। মানুষ যখন আস্তে আস্তে স্কুল, কলেজ, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ে ওঠে তখনোও এই সিদ্ধান্তহীনতা রয়ে যায়। তারা তাদের জীবনের একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য ছাড়াই পড়ালেখা করে। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার প্রধান দুর্বলতা হচ্ছে যে তারা নির্দিষ্ট সিদ্ধান্তের অভ্যাসকে না শিখায়, না উৎসাহিত করে।

যদি কোন কলেজে শিক্ষার্থীর জীবনের একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য না বলা পর্যন্ত ভর্তি বন্ধ থাকত, তবে এটা জাতির জন্য কল্যাণকর হত। আরও ভালো হত যদি প্রত্যেক শিক্ষার্থী যারা কলেজে প্রবেশ করতে যাচ্ছে তাদেরকে সিদ্ধান্তের অভ্যাস সংক্রান্ত একটি প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে বাধ্য করা হত।

সিদ্ধান্তহীনতার অভ্যাস অর্জন হয়, কারণ আমাদের বিদ্যালয় ব্যবস্থার ত্রুটি। এটা শিক্ষার্থীদের সাথে তার পেশাগত জীবনেও চলে যায়... ... যদি-না সে আগে থেকেই তার পেশা নির্বাচন করে থাকে। সাধারণত তরুণরা শিক্ষা গ্রহণের পর একটি চাকরি খোঁজে। যা পাওয়া যায় তাতেই আবেদন করে। কারণ সে সিদ্ধান্তহীনতার অভ্যাসে ভুগছে। একশর মধ্যে আটানব্বইজন মানুষই কাজ করে বেতনের জন্য, তাদের অবস্থান ধরে রাখার জন্য। কারণ তাদের সিদ্ধান্তের নির্দিষ্টতার অভাব রয়েছে, যাতে একটি নির্দিষ্ট অবস্থানের জন্য পরিকল্পনা করবে এবং জ্ঞানের অভাব যে কীভাবে একজন তার নিয়োগকর্তা নির্বাচন করবে। এ বইয়ের সূত্রাবলি কাজে লাগান। দেখবেন আপনি ধীরে ধীরে নিজের মধ্যে সিদ্ধান্তের নির্দিষ্টতার অভ্যাস তৈরি করছেন।


 




অধ্যায় - ০৯

অধ্যবসায়

যা প্রয়োজনীয় প্রচেষ্টার মাধ্যমে আস্থা ঘটায়

ধনী হওয়ার ক্ষেত্রে অষ্টম ধাপ


আকাক্সক্ষাকে এর আর্থিক সমতুল্যে পরিণত করতে অধ্যবসায় একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। অধ্যবসায়ের মূল ভিত্তি হচ্ছে ইচ্ছাশক্তি।

ইচ্ছাশক্তি এবং আকাক্সক্ষা যখন পুরোপুরি মিশ্রিত হয়, তখন অত্যন্ত শক্তিশালী এক জোড়া তৈরি করে। যেসব ব্যক্তি মহান সৌভাগ্য অর্জন করেছে তারা সাধারণত ঠান্ডা-রক্তের বলে পরিচিত এবং অনেক সময় তাদেরকে নিষ্ঠুরও বলা হয়। প্রায়ই তাদেরকে ভুল বোঝা হয়। বস্তুত তাদের প্রচ- ইচ্ছাশক্তি আছে, যা তারা অধ্যবসায়ের সাথে মিশ্রিত করে এবং এর পিছনে থাকে তাদের আকাক্সক্ষা যাতে তারা তাদের উদ্দেশ্য লাভ করতে পারে। এজন্যই তারা নিজেদের কাজ ভিন্ন অন্য কাজ সম্পর্কে খুব কমই কথা বলে।

হেনরি ফোর্ডকে সাধারণত নিষ্ঠুর এবং ঠান্ডা রক্তের মানুষ বলে ভুল বোঝা হয়। এই ভুল ধারণার কারণ হচ্ছে তিনি সবসময় অধ্যবসায়ের সাথে তার পরিকল্পনা অনুসরণ করে যান।

বেশির ভাগ লোকেরা তাদের লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য পূরণে চেষ্টা করে। কিন্তু তারা যখন প্রথম বাধা বা দুর্ভাগ্যের দেখা পায় তখনই তাদের লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য জলে ছুঁড়ে ফেলে। যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা তাদের লক্ষ্য অর্জন করছে ততক্ষণ পর্যন্ত খুব অল্প মানুষই সব বাধাবিপত্তি সত্ত্বেও এগিয়ে যায়। এই অল্প সংখ্যকই হয় ফোর্ড, কার্নেগি, রকফেলার এবং এডিসনের মতো মহান মানুষ।

সেখানে হয়তো ‘অধ্যবসায়ের’ কোন নায়কোচিত বা বীরোচিত কোন অন্তর্নিহিত মানে নেই। কিন্তু এর গুণ হচ্ছে এটা ব্যক্তির চরিত্রকে লোহা থেকে ইস্পাতে পরিণত করে।

সাধারণত একটি সৌভাগ্য অর্জনের জন্য, এই দর্শনের ১৩টি সূত্রই প্রয়োগ করতে হবে। যারা অর্থ অর্জন করতে চান তাদেরকে অবশ্যই এসব সূত্র বুঝতে হবে এবং অবশ্যই এ সূত্রাবলি অধ্যবসায়ের সাথে প্রয়োগ করতে হবে।

যদি আপনি এ বই অনুসরণ করার চিন্তা করে থাকেন এবং এটা যে জ্ঞান বহন করে তা প্রয়োগ করতে আগ্রহী হন, তবে আপনার প্রথম পরীক্ষা হবে অধ্যবসায় পালন করা। যখন আপনি দ্বিতীয় অধ্যায়ের ৬টি ধাপ অনুসরণ করা শুরু করবেন, তখন থেকেই আপনার অধ্যবসায়ের পরীক্ষা আরম্ভ হবে। অন্যথায় আপনি সেই ১০০ জনের মধ্যে দুইজনের একজন হবেন যাদের ইতোমধ্যে একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য আছে যাতে তারা মনোনিবেশ করেছে এবং একটি নির্দিষ্ট পরিকল্পনাও আছে এটা অর্জনের জন্য, কিন্তু তবুও তারা অসফল। কারণ তারা নির্দেশনা পড়তে ভুলে যায় এবং দৈনন্দিন কাজকর্ম করতে গিয়ে এগুলো আর মনে থাকে না।

লেখক আপনাকে এই মুহূর্তে বাধা দিয়ে মনে করিয়ে দিতে চায় যে, ব্যর্থতার একটি প্রধান কারণ হচ্ছে অধ্যবসায়ের অভাব। অধিকন্তু, হাজারো মানুষের অভিজ্ঞতা থেকে এটা প্রমাণ হয়েছে যে বেশির ভাগ মানুষের সাধারণ একটি দুর্বলতা ছিল অধ্যবসায়ের অভাব। এটা এমন একটা দুর্বলতা যা চেষ্টা দ্বারা জয় করা সম্ভব। অধ্যবসায়ের অভাব থেকে উত্তীর্ণ হওয়ার সুবিধা সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করে একজনের আকাক্সক্ষার গভীরতার ওপর।

সব অর্জনের আরম্ভ বিন্দু হচ্ছে আকাক্সক্ষা। এটাকে প্রতিনিয়ত মনে রাখুন। দুর্বল আকাক্সক্ষা দুর্বল ফলাফল আনে। এটা অল্প পরিমাণ আগুনের মতো, যা অল্প পরিমাণ তাপ উৎপন্ন করে। যদি আপনি নিজেকে অধ্যবসায়ের অভাবগ্রস্ত রূপে খুঁজে পান, তবে আপনার আকাক্সক্ষার নিচে একটি শক্তিশালী আগুন জ¦ালানোর মাধ্যমে এই দুর্বলতা থেকে রেহাই পেতে পারেন।

এ বইয়ের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পড়ে যান। তারপর দ্বিতীয় অধ্যায়ে ফিরে যান এবং অতি শীঘ্রই সেখানে দেওয়া ৬ ধাপের নির্দেশনা পালন করুন। এই নির্দেশনা অনুসরণ করার আকাক্সক্ষা পরিষ্কারভাবে নির্দেশ করবে আপনি কত বেশি বা কত কম অর্থ অর্জনের ব্যাপারে উদাসীন। আপনি নিশ্চিত হতে পারেন যে আপনি এখনও ‘অর্থ সচেতনতা’ অর্জন করেন নাই যা আপনাকে অবশ্যই একটি সৌভাগ্য নিশ্চিত করার পূর্বে অর্জন করতে হবে।

অধ্যবসায় হচ্ছে মনের একটি অবস্থা। সেজন্য এটা তৈরি করা যায়। মনের অন্য সব অবস্থার মতো, অধ্যবসায় নির্ভর করে নির্দিষ্ট কারণে ওপর। এগুলো হচ্ছে:

ক. উদ্দেশ্যের নির্দিষ্টতা: প্রথমে একজনকে জানতে হবে সে কী চায়। হয়তো অধ্যবসায় গঠনের জন্য এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। নিজের আকাক্সক্ষাকে নির্দিষ্টভাবে জানা একজনকে অনেক বাধা পেরিয়ে উত্তীর্ণ হওয়ার শক্তি দেয়।

খ. আকাক্সক্ষা: এটা তুলনামূলকভাবে অর্জন করা সহজ এবং একটি প্রচ- আকাক্সক্ষা বজায় রাখতে অধ্যবসায় দরকার।

গ. আত্ম-নির্ভরশীলতা: নিজ দক্ষতার ওপর বিশ্বাস করা যে একটি পরিকল্পনা পালন করব এবং অধ্যবসায়ের সাথে পরিকল্পনাটি অনুসরণ করব। (কীভাবে আত্ম-নির্ভরশীলতা গঠন করতে হয় তা সম্পর্কে স্ব-পরামর্শ অধ্যায়ে বলা হয়েছে।)

ঘ. পরিকল্পনার নির্দিষ্টতা: সংগঠিত পরিকল্পনা খুবই দরকারি। হয়তো প্রথম প্রথম এগুলো দুর্বল এবং অবাস্তব মনে হতে পারে, কিন্তু ধীরে ধীরে এগুলো পালন করলে এগুলোই আপনার সফলতার চাবিকাঠিতে পরিণত হবে। তাছাড়া সংগঠিত পরিকল্পনা অধ্যবসায় পালনেও উৎসাহিত করে।

ঙ. প্রকৃত জ্ঞান: নিজের পরিকল্পনা স্পষ্টভাবে জানা এবং অভিজ্ঞতা অর্জন বা পর্যবেক্ষণের ওপর ভিত্তি করা নতুন পরিকল্পনা তৈরি করা অধ্যবসায় পালনে উৎসাহিত করে। ‘নিশ্চিতভাবে জানার’ পরিবর্তে ‘অনুমান’ করে পরিকল্পনা তৈরি করবেন না। এটা অধ্যবসায়কে ধ্বংস করে। ‘আমি মনে করেছিলাম’ এই ধরনের কথাবার্তা বাদ দিন। মনে করা বাদ দিয়ে সরাসরি সঠিক তথ্য যোগাড় করুন এবং কাজে নামুন।

চ. সহযোগিতা: সহানুভূতি, বুঝজ্ঞান, অন্যদের সাথে সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে কাজ করা এবং তাদের যতœ নেওয়া অধ্যবসায় গঠন করে।

ছ. ইচ্ছাশক্তি: নিজের চিন্তাভাবনাকে নিজের কাজের ওপর একাগ্র মনোযোগের সাথে রাখার অভ্যাস। এই কাজটা করা বেশ কঠিন। কারণ আপনি যখন সামনে এগিয়ে যাবেন তখন নানা ধরনের সুযোগ-সম্ভাবনা আপনাকে হাত নাড়বে। সেখান থেকে সরে গিয়ে কেবল নিজের একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যে অবিচল থাকলেই আপনার মধ্যে অধ্যবসায় তৈরি হবে এবং আপনি সফল হবেন।

জ. অভ্যাস: অধ্যবসায় হচ্ছে অভ্যাসের সরাসরি ফলাফল। আমাদের মন প্রতিদিন যা শোষণ করে এবং অভিজ্ঞতা অর্জন করে এটা তারই একটা অংশ হয়ে ওঠে। কাজ করতে গেলে দেখবেন নানা ধরনের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা নিয়ে আপনি ভীত। এটাও সত্য যে কাজ করতে গেলে সবসময় যে ইতিবাচক কিছু ঘটবে তাও নয়। কিন্তু ভয় পেয়ে থেমে যাওয়া যাবে না। আপনার সবচেয়ে বড় শত্রু হচ্ছে এই ভীতি। নিজের ভেতরের এই ভীতিকে স্ব-পরামর্শ দ্বারা জয় করুন। বারবার বলুন আমার জীবনের একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য হচ্ছে ... ... ... এবং “আমি পারব, আমি করছি, আমি সফল”, বলে যান।

অধ্যবসায় বিষয়টি ছেড়ে যাওয়ার আগে নিজেকে পরীক্ষা করুন। যদি আপনি কোন প্রয়োজনীয় গুণাবলি থেকে পিছিয়ে থাকেন, তবে তা খুঁজে বের করুন। সাহস নিয়ে নিজেকে পরিমাপ করুন। প্রতিটি বিন্দু থেকে বিন্দুতে এবং দেখুন কীভাবে আপনি অধ্যবসায়ের ৮টি কাজ থেকে পিছিয়ে আছেন। এই পর্যবেক্ষণে হয়তো এমন কিছু আবিষ্কার করবেন যাতে আপনি নিজেকে নতুনভাবে দৃঢ় মুষ্টিতে ধরতে পারেন।


অধ্যবসায়ের অভাবের লক্ষণ

এখানে আপনি সেই শত্রুদের খুঁজে পাবেন যারা আপনার এবং আপনার সাফল্যের মাঝে দাঁড়িয়ে আছে। আপনি এখানে কেবল অধ্যবসায়ের অভাবের ‘লক্ষণই’ নয়; বরং এই দুর্বলতার কারণও খুঁজে পাবেন যা গভীরভাবে আপনার অবচেতন মনে বাসা বেঁধেছে। নিচের তালিকা সতর্কতার সাথে পর্যবেক্ষণ করুন এবং নিজের মুখোমুখি হোন যদি আপনি সত্যিই জানতে চান আপনি কে, আর আপনি কী করতে সক্ষম। যদি আপনি ধনী হতে চান তবে এই হচ্ছে সেই দুর্বলতা যার ওপর আপনাকে অবশ্যই কর্তৃত্ব করতে হবে।

১. বুঝতে ব্যর্থ এবং একজন কী চায় তা পরিষ্কার করে বর্ণনা করতে ব্যর্থ।

২. দীর্ঘসূত্রতা বা গড়িমসি করার অভ্যাস। এটা হতে পারে যুক্তিযুক্ত কারণে অথবা কারণ ছাড়া। (সাধারণত দীর্ঘসূত্রতার পিছনে থাকে ভীষণ সাজসজ্জায় ম-িত নানা ধরনের অজুহাত।)

৩. বিশিষ্ট জ্ঞান অর্জনে আগ্রহের অভাব।

৪. সিদ্ধান্তহীনতা। উৎপন্ন সমস্যার মুখোমুখি হওয়ার পরিবর্তে সব কাজে ‘পাশ কাটানোর’ অভ্যাস। (এর পিছনেও ওজর-অজুহাত বিদ্যমান।)

৫. অজুহাতের ওপর নির্ভর করার অভ্যাস। সমস্যার সমাধানে নির্দিষ্ট পরিকল্পনা সৃষ্টির পরিবর্তে নানান ধরনের ওজর-অজুহাত তৈরি করা।

৬. আত্ম-তুষ্টি। এই মানসিক ক্লেশ থেকে খুবই কম প্রতিকার পাওয়া যায়। যারা এতে ভোগে তাদের জন্য কোন আশা নেই।

৭. উপেক্ষা। অঙ্গীকার পালন করতে অনীহা। যেকোন কাজে বাঁধা এলে এর সাথে লড়াই করতে হবে; নাকি পালিয়ে যাবেন।

৮. একজনের ভুলের কারণে অন্যের ওপর দোষ চাপানোর অভ্যাস এবং কিছু করতে হবে বলে এই অজুহাত সৃষ্টি যে ভালো না লাগলেও এটা করতে হবে।

৯. আকাক্সক্ষার তীব্রতার অভাব। একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য নিতে অবহেলা, যা আপনাকে কাজ করতে তাড়িত করত।

১০. ইচ্ছা, এমনকি আগ্রহের অভাব। ব্যর্থতার প্রথম দেখা পাওয়া মাত্রই কাজ করার ইচ্ছা ত্যাগ করা। (৬টি মূল ভীতির যেকোন একটি বা একাধিক কারণে এটা হতে পারে।)

১১. সংগঠিত পরিকল্পনার অভাব। পরিকল্পনা লিখে রাখার এবং পর্যবেক্ষণের অভাব।

১২. ভিন্ন আইডিয়া গ্রহণ করতে অনীহা। যখন নতুন নতুন সুযোগ পাওয়া যায় তখন এগুলোকে আঁকড়ে ধরতে না পারা।

১৩. ইচ্ছুক হওয়ার পরিবর্তে শুধু কোনরকম চাওয়া।

১৪. ধনী হওয়ার দিকে লক্ষ্য রাখার পরিবর্তে দরিদ্রতার সাথে সমঝোতা করে চলার অভ্যাস। সাধারণত কী হবে, কী করবে এবং নিজের একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যের অনুপস্থিতি।

১৫. ধনী হওয়ার জন্য শটকাট পথ খোঁজা। একটি ন্যায্য দাম দেওয়ার পরিবর্তে অল্প চেষ্টায় বেশি আয়ের চিন্তা করা। এটা আসলে জুয়া খেলার আরেক নাম। এই ধরনের অভ্যাস একজনকে ‘ধারালো’ তর্ক বিতর্কের দিকে চালিত করে।

১৬. সমালোচনা ভীতি। পরিকল্পনা সৃষ্টি করতে এবং এদের কর্মে পরিণত করতে ব্যর্থ। কারণ লোকজন কী চিন্তা করবে, মানুষ কী বলবে এই চিন্তায় তার ঘুম হারাম। সমালোচনা ভীতি এমন এক জিনিস যা সহজেই কেউ ধরতে পারে না অথবা ছাড়তে পারে না। কারণ এটা একজনের অবচেতন মনে থাকে। তাই খুঁজে বের করা এবং এ থেকে নিস্তার পাওয়া একটু কঠিন। (শেষ অধ্যায়ের ৬টি মূল ভীতি দেখুন।)

চলুন, আমরা সমালোচনা ভীতির কিছু উপসর্গ পর্যবেক্ষণ করি। বেশির ভাগ মানুষ তাদের আত্মীয়, বন্ধু এবং আশেপাশের লোকজনকে তাদের জন্য চিন্তা করার অনুমতি দেয়। কারণ তারা সমালোচনাকে ভয় পায়।

বহু সংখ্যক মানুষ বিবাহে ভুল করে, তারা চুক্তির পাশে দাঁড়িয়ে থাকে এবং জীবন দুর্দশা ও দুঃখের মধ্য দিয়ে নির্বাহ করে। কারণ তারা সমালোচনাকে ভয় পায়। তারা চাইলে জীবনে সুখী হতে পারত, তাদের ভুলকে সংশোধন করতে পারত। কিন্তু লোকজন কী বলবে, এই চিন্তায় সঠিক কাজ করে না। (যেকেউ এমন ধরনের ভয়ে বশীভূত হয়েছে সে নিজের অপূরণীয় ক্ষতি করেছে। এটা একজনের জীবনের লক্ষ্য, আত্ম-প্রত্যয় এবং কিছু অর্জনের আকাক্সক্ষাকে ধ্বংস করে।)

লক্ষাধিক মানুষ যারা স্কুল ছেড়ে দেওয়ার পর আবার পড়ালেখা করতে অনীহা প্রকাশ করে কারণ তারা সমালোচনাকে ভয় পায়।

অগণিত পুরুষ এবং নারী তাদের আত্মীয়দের নানা কথা শোনে। আত্মীয়স্বজনকে অনুমতি দেয় দায়িত্বের নাম করে তাদের জীবন ধ্বংস করার। কারণ তারা সমালোচনাকে ভয় পায়। (এমন দায়িত্বের প্রয়োজন নেই যা একজন ব্যক্তির ব্যক্তিগত লক্ষ্যের বিনাশ ঘটায় এবং তার এই অধিকার ধ্বংস করে যে সে তার নিজের জীবন নিজ পথে নির্বাহ করবে।)

[ফজলে রাব্বির কথাÑআমাকে আমার বাবা, আত্মীয়স্বজন বলেছে, ‘এ বই কেউ পড়বে না। এ বই বিক্রি হবে না। আমাকে রাস্তায় রাস্তায় হেঁটে বই বিক্রয় করতে হবে। তুই কি রাস্তায় হেঁটে হেঁটে বই বিক্রি করবি? অথবা অন্য কেউ বই অনুবাদ করে দেয়, আর আমি নিজের নামে ছাপাই।’ সবচেয়ে ভালো বক্তব্য দিয়েছে আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু, ‘এসব আকাম বাদ দাও। একটু চাকরি-বাকরির চেষ্টা কর। বয়স তো কম হলো না। তোর চেয়ে আরও কত যোগ্য মানুষ আছে। তারা দেশের জনগণের জন্য উপকারী সেবা সম্পন্ন করবে। তুই তো এখনও সফল হসনি।’ এটা সত্য যে আমি আজকে সফল হইনি। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি আমি যদি আজকে দেশের জনগণের জন্য উপকারী সেবা সম্পন্ন করতে আমার সাধ্যমতো চেষ্টা না করি তবে আমি কোনদিনই সফল হবো না। সমালোচনায় আমি ভয় পাই না। আমি কাজ না করে বসে থাকতে ভয় পাই। আর যখনই হতাশ মনে হয়, মনে হয় আর পারছি না তখন কাজটা কেন শুরু করেছিলাম তাই চিন্তা করি। তখন আবার উৎসাহ উদ্দীপনায় মনটা নতুন করে ভরে ওঠে।] আবার অনুবাদে ফিরে আসি।

মানুষ ব্যবসায় নতুন কোন সুযোগ নিতে অমত করে। কারণ তারা সমালোচনাকে ভয় পায়। যদি তারা ব্যর্থ হয় তবে লোকে কী বলবে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে সমালোচনা ভীতি সাফল্যের আকাক্সক্ষার চেয়েও বেশি শক্তিশালী।

অনেকে তার নিজের জন্য বড় লক্ষ্য ঠিক করতে অমত করে অথবা এমনকি একটি পেশা নির্বাচন পর্যন্ত গ্রহণ করে না। কারণ তারা তাদের আত্মীয় এবং ‘বন্ধুদের’ ভয় পায় যারা হয়তো বলবে ‘বেশি বড় লক্ষ্য ঠিক করো না, লোকে ভাববে তুমি পাগল।’

যখন এন্ড্রু কার্নেগির পরামর্শে আমি আমার ২০ বছর এই গবেষণার প্রতি উৎসর্গ করেছি যা হচ্ছে সাফল্য অর্জনে একটি দর্শন খুঁজে বের করা। আমার প্রথম চিন্তা ছিল লোকে কী বলবে। পরামর্শটি আমার জন্য একটি লক্ষ্য ঠিক করে। অন্য সবকিছুর চেয়ে একেই আমি সবচেয়ে বেশি চেয়েছি। আলোর এক ঝলকের মতো, আমার মন ওজর-অজুহাত তৈরি করতে আরম্ভ করল। সবচেয়ে স্পষ্ট ছিল সমালোচনা ভীতি। আমার ভেতরের কিছু বলে উঠল, ‘তুমি এটা করতে পারবে না, কাজটা অনেক বড় এবং অনেক সময়ের প্রয়োজন। তোমার সম্পর্কে তোমার আত্মীয়স্বজন কী ভাববে? তুমি টাকা আয় করবে কীভাবে? সংসারের খরচ মিটাবে কীভাবে? কেউ কখনো একটি সাফল্যের দর্শন আবিষ্কার করেনি। তাহলে কোন যোগ্যতা বলে এটা করতে চাইছ? যাইহোক, তুমি কে, এতটা বড় লক্ষ্য নির্ধারণ করার? ভুলে যেও না, তোমার সামান্য জন্ম সম্পর্কে। তুমি দর্শন সম্বন্ধে কী জানো? লোকে ভাববে তুমি পাগল (এবং তারা ভেবেও ছিল)। অন্য কেউ কেন আজ পর্যন্ত এমন কিছু করেনি?’

এরকম আরও অনেক প্রশ্ন আমার মনে উঁকি দিল এবং মনোযোগ আকর্ষণ করতে চাইল। মনে হচ্ছিল যেন পুরো পৃথিবী হঠাৎ করে তার মনোযোগ আমার দিকে দিয়েছে। পৃথিবী যেন আমাকে তাচ্ছিল্য করছিল, আমি যেন কার্নেগির পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করার আকাক্সক্ষা বাদ দিই।

তখন এবং পরে আমার অনেক সুযোগ এসেছিল এই কর্মপ্রতিজ্ঞা ত্যাগ করার। এটা আমার ওপর নিয়ন্ত্রণ অর্জন করার আগে আমি নিজের উচ্চাকাক্সক্ষাকে মেরে ফেলতে পারতাম। পরবর্তী জীবনে আমি যখন হাজারো পুরুষ এবং নারীকে পর্যবেক্ষণ করলাম তখন আমি আবিষ্কার করলাম যে, নতুন নতুন আইডিয়া, বুদ্ধি ও ধারণা এখনও জন্ম নেয় এবং জীবনের শ্বাস-প্রশ্বাসের মতো তাদের মধ্যে নির্দিষ্ট পরিকল্পনার তাৎক্ষণিক কর্ম প্রবেশ করানো প্রয়োজন। নতুন কোন আইডিয়া আপনি আবিষ্কার বা উদ্ভাবন করলেন, কিন্তু পরিকল্পনা করে কাজ না করলে এই আইডিয়া, বুদ্ধি বা ধারণার কোন মূল্য নেই। একটি নতুন আইডিয়ার যতœ নেওয়ার সময় হচ্ছে যেই সময় এর জন্ম হয়। প্রতিটি মিনিটেই এটা বাঁচে। একে আরও ভালোভাবে বাঁচার সুযোগ দিতে হবে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নতুন নতুন আইডিয়া, বুদ্ধি, ধারণা বা উদ্যোগ কখনো কাজে পরিণত হয় না তার মূল কারণ সমালোচনা ভীতি। সমালোচনার ভয়েই মানুষ কাজ করে না।

অনেক লোক বিশ্বাস করে যে বস্তুগত সাফল্য হচ্ছে নিজের পছন্দ মতো কাজ ‘আরম্ভ’ করার ফলাফল। এই বিশ্বাসের একটি ভিত্তি আছে। কিন্তু যারা সম্পূর্ণভাবে ভাগ্যের ওপর নির্ভর করে, তারা প্রায়ই হতাশ হয়। কারণ তারা অপর একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার উপেক্ষা করে যা অবশ্যই সাফল্য নিশ্চিত হওয়ার পূর্বে উপস্থিত করতে হবে। এটা হচ্ছে জ্ঞান অর্জনের সাথে সাথে অভিজ্ঞতা অর্জন করা। এই অভিজ্ঞতা অর্জন করবেন নিজের নির্দিষ্ট লক্ষ্য সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে, গ্রাহকদের তথ্য সংগ্রহ করে এবং নতুন নতুন তথ্যাবলি সম্পর্কে জানবেন যাতে নিজেকে সবসময় সাম্প্রতিক তথ্য জেনে আধুনিক রাখতে পারেন। আপনার জীবনের নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য পূরণের জন্য কি জ্ঞান অর্জন করেছেন? নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য সম্বন্ধে তথ্য সংগ্রহ করেছেন কি?

১৯২৯ এর অর্থনৈতিক মন্দা চলাকালীন, ডব্লিউ. সি. ফিল্ডস, একজন অভিনেতা ছিলেন। এই মন্দায় তিনি তার সব টাকাপয়সা হারান। তিনি বেকার হয়ে যান। পূর্বে তার একটি বিলাসবহুল জীবন ছিল। এখন তার ছিটেফোঁটাও নেই। অধিকন্তু, তার বয়স হয়েছে ৬০ বছর। এই বয়সে অনেকেই নিজেকে বৃদ্ধ বলে চিন্তা করে। কিন্তু ফিল্ডস তেমন লোক না। তিনি মঞ্চে ফিরে আসার জন্য এতটাই আগ্রহী ছিলেন যে বেতন ছাড়াই কাজ করার প্রস্তাব দিলেন। তখন সবাক চলচ্চিত্র মাত্র আরম্ভ হয়েছে। তিনি এই সম্পর্কে কিছুই জানতেন না। তিনি সাহস নিয়ে কাজ আরম্ভ করলেন। কিন্তু তার সামনে বাধা এলো। তিনি নিচে পড়ে গেলেন এবং ঘাড়ে ব্যথা পেলেন। অনেকের কাছে এটা হয়তো সেই জায়গা যেখানে হাল ছেড়ে দিবেন এবং লক্ষ্য ত্যাগ করবেন। কিন্তু ফিল্ডস ছিলেন অধ্যবসায়ী। তিনি জানতেন, যদি তিনি এগিয়ে যান তবে তিনি কাছে বা দূরে সাফল্যের দেখা পাবেনই। আজকে তিনি সফল এবং তার এই সাফল্য হঠাৎ কোন সুযোগ দ্বারা সৃষ্টি হয়নি।

এমনই আরেকজন অধ্যবসায়ী নারী, মারিয়া ড্রেসলার। তিনিও তার ৬০ বছর বয়সে চাকরি হারান। তার কোন সঞ্চয় ছিল না। এজন্য তিনি আরও বেশি হতাশ হয়ে পড়েন। তিনি নতুন একটি বুদ্ধি পেলেন এবং নিজের সব শক্তি দিয়ে তা আকঁড়ে ধরলেন। তিনি তার কাজে অধ্যবসায় অবলম্বন করেন। শেষ জীবনে তার অধ্যবসায় একটি বিস্ময়কর বিজয় নিয়ে আসে। এটা এমন এক বয়স যখন বেশির ভাগ পুরুষ ও নারী নিজেদের উচ্চাকাক্সক্ষাকে মেরে ফেলে।

একমাত্র ‘আরম্ভ’ যার ওপর কেউ নির্ভর করতে পারে তা হচ্ছে নিজের তৈরি একটি আরম্ভ। এ কেবল অধ্যবসায়ের মাধ্যমেই সম্ভব। আর আপনাকে অবশ্যই একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে আরম্ভ করতে হবে।

যাদের সাথে আপনার দেখা হয় এমন ১০০ মানুষকে পরীক্ষা করে দেখুন। তাদেরকে তাদের জীবনের একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য বলতে বলুন। তারা জীবনে সবচেয়ে বেশি কী চায় এমন প্রশ্ন করুন। দেখবেন তাদের মধ্যকার ৯৮ জন আপনাকে উত্তর দিতে পারবে না। যদি আপনি তাদেরকে একটি উত্তরের জন্য চাপ দেন, কেউ কেউ বলবে নিরাপত্তা; অনেকেই বলবে টাকাপয়সা; অল্প কিছু মানুষ বলবে সুখ; অন্যরা বলবে খ্যাতি ও ক্ষমতা এবং বাকিরা বলবে সামাজিক স্বীকৃতি, সহজ জীবন ধারণ, গান গাওয়ার সামর্থ্য, নাচ বা লেখালেখির দক্ষতা। কিন্তু এদের মধ্যে কেউই এসব শর্ত সম্পর্কে নির্দিষ্টভাবে বলতে সমর্থ হবে না অথবা একটি পরিকল্পনা দ্বারা সামান্যতম দিকনির্দেশনা দিতে পারবে না যা তারা লাভ করতে আশা করে। ধনীরা কখনো অস্পষ্টভাবে কিছু চায় না। তারা শুধু নির্দিষ্ট পরিকল্পনার প্রতি সাড়া দেয়। যার পিছনে রয়েছে নির্দিষ্ট আকাক্সক্ষা, অধ্যবসায়ী কাজ এবং দূরদর্শিতা।


কীভাবে অধ্যবসায় গঠন করতে হয়

অধ্যবসায় গঠন করার জন্য এখানে ৪টি সহজ ধাপ বর্ণনা করা হয়েছে। এগুলো পালন করার জন্য যে অনেক জ্ঞানবুদ্ধি দরকার তা নয়। না দরকার কোন প্রকার আলাদা শিক্ষা; বরং একটু চেষ্টা দরকার। ধাপগুলো হচ্ছে:

১. একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য, যার পিছনে রয়েছে একটি জ্বলন্ত আকাক্সক্ষা।

২. একটি নির্দিষ্ট পরিকল্পনা, যা মেনে নিয়মিত কাজ করা হয়।

৩. শক্তভাবে বন্ধ একটি মন যা আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধবের সব ধরনের সমালোচনা এবং নেতিবাচক কথা থেকে আপনাকে দূরে রাখবে।

৪. আপনার লক্ষ্য সম্পর্কিত এক বা একাধিক লোকের সাথে একটি বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক যারা আপনাকে আপনার লক্ষ্য এবং পরিকল্পনা অনুসরণ করতে উৎসাহিত করবে।

জীবনের সর্বক্ষেত্রে সাফল্যের জন্য এ ৪টি ধাপ অপরিহার্য। এই দর্শনের ১৩টি নীতির উদ্দেশ্য হচ্ছে একজন মানুষকে এই ৪টি সূত্র গ্রহণ করতে সক্ষম করে গড়ে তোলা এবং একে একটি অভ্যাসে পরিণত করা। এ ধাপগুলো হচ্ছে সেই ধাপ যার মাধ্যমে একজন মানুষ তার অর্থনৈতিক ভাগ্যকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। এ ধাপগুলো একজন মানুষকে তার ব্যক্তি স্বাধীনতা এবং চিন্তার মুক্তির দিকে ধাবিত করে। এ ধাপগুলো একজন মানুষকে বড় বা ছোট আকারের ধনসম্পদের দিকে প্ররোচিত করে। এ ধাপগুলো ক্ষমতা, খ্যাতি এবং দুনিয়াবি সম্মানের দিকে নিয়ে যায়। এ ধাপগুলো সুযোগ ও সম্ভাবনার দিকে আকর্ষণ করে। এরা একজন মানুষকে এমন পদক্ষেপ নিতে বুদ্ধি ও সাহস যোগায় যাতে স্বপ্ন পূরণ হয়।

এ ধাপগুলো আমাদেরকে ভয়ভীতি, নিরুৎসাহ এবং উদাসীনতার ওপর কর্তৃত্ব করার সাহস যোগায়।

যারা এই ৪টি পদক্ষেপ নিতে শেখে তাদের জন্য রয়েছে এক বিরাট পুরস্কার। এটা হচ্ছে নিজের সৌভাগ্য নিজে লেখা এবং জীবন থেকে যা খুশি আদায় করে নেওয়া।

ইংল্যান্ডের উইন্ডসরের ডিউক, প্রাক্তন রাজা-স¤্রাট এডওয়ার্ড অষ্টমের স্ত্রী ছিলেন ওয়ালিস সিম্পসন। আমি কখনো বলতে পারব না তার স্বামীর প্রতি তার ভালোবাসা কতটা দুর্ঘটনামূলক, আর কতটা প্রাপ্ত সুযোগের ব্যবহার। তবে তার মধ্যে একটি জ¦লন্ত আকাক্সক্ষা ছিল। তিনি খুব সতর্কতার সাথে এই আকাক্সক্ষার দিকে তার প্রতিটি পদক্ষেপ নেন। তার প্রথম দায়িত্ব ছিল ভালোবাসা। এরচেয়ে আর দুনিয়ায় সবচেয়ে বড় কাজ কী হতে পারে? কথা আছে, মানুষের মধ্যে ভালোবাসা না থাকলে সে নিয়ম বানায়, সমালোচনা করে, তিক্ততা, অপবাদ বা রাজনৈতিক কারণে বিয়ে করে। কিন্তু মানুষকে মানুষ বানায় কেবল প্রেম, ভালোবাসা।

তিনি জানতেন তিনি কী চান। এই আকাক্সক্ষার ব্যাপারে তিনি কেবল ওয়েলসের প্রিন্সের সাথে দেখা করার পরে নয়, অনেক আগে থেকেই জানতেন। এর মধ্যে তিনি দুবার এটা পেতে ব্যর্থ হন। কিন্তু তার সাহস ছিল তার আকাক্সক্ষাকে খুঁজে দেখার। শেক্সপিয়ার যেমন হেমলেট নাটকে বলেন, তুমি যদি নিজের কাছে সত্য হও, তবে এই আশা, স্বপ্ন বা আকাক্সক্ষা যাই বলো না কেন তার দিকে তুমি ধাবিত হবে, যেমন রাত দিনকে অনুসরণ করে। এভাবেই তুমি কোন মানুষের কাছে মিথ্যা প্রতিপন্ন হবে না। [ফজলে রাব্বির কথাÑশেক্সপিয়ারের এ বক্তব্যের প্রথম অংশের মানে হচ্ছে মানুষ যা করতে বা হতে পারত তা যদি করে থাকে, তবে তার উচিত নিজেকে বিচার-বিশ্লেষণ করা। দ্বিতীয় অংশের মানে একজনের উচিত তার নিজের জীবন এবং সম্পর্কগুলোর ব্যাপারে সৎ থাকা। তৃতীয় অংশের মানে একজনের উচিত সবসময় সঠিক কাজটা করা। তথ্যসূত্র: যঃঃঢ়ং://ষরঃবৎধৎুফবারপবং.হবঃ/ঃড়-ঃযরহব-ড়হি-ংবষভ-নব-ঃৎঁব/]

তিনি অস্পষ্টতা থেকে ধীরে ধীরে ওঠেন। প্রগতি, অধ্যবসায় এবং দৃঢ়বিশ^াসের মাধ্যমে এগিয়ে যান। তিনি অবিশ^াস্য প্রতিকূলতার বিপরীতে জয় লাভ করেন। আপনি যেই হোন না কেন বা আপনি ওয়ালিস সিম্পসন সম্পর্কে যাই ভাবুন না কেন অথবা যে রাজা তার ভালোবাসার জন্য মুকুট পর্যন্ত ত্যাগ করেছে, ওয়ালিস সিম্পসন অধ্যবসায়ের এক চমকপ্রদ উদাহরণ। তিনি দৃঢ়সংকল্পের এক নির্দেশক, যার কাছ থেকে সারা বিশ^ শিক্ষা নিতে পারে।

আপনি যখন ওয়ালিস সিম্পসনের কথা ভাববেন, তখন এমন একজনের কথা চিন্তা করুন যিনি জানতেন তিনি কী চান এবং এটি পেতে তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ সা¤্রাজ্যকেও কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন। যেসব নারী অভিযোগ করে যে এই দুনিয়া পুরুষের দুনিয়া, এখানে নারীদের জয়ের জন্য সমান সুযোগ পাওয়া যায় না, তারা এই ঘটনা সতর্কভাবে অধ্যয়ন করতে পারেন। এই অসাধারণ নারীর ঘটনা বিশ্লেষণ করতে পারেন। যিনি এমন এক বয়সে তার স্বপ্ন পূরণ করেন, যে বয়সে নারীরা নিজেকে বুড়ি বলে চিন্তা করে। আর এই বয়সেই তিনি পৃথিবীর সবচেয়ে আকাক্সিক্ষত অবিবাহিত যুবককে ¯েœহের বন্ধনে আবদ্ধ করেন।

আর রাজা এডওয়ার্ডের কী হলো? তার দিক থেকে বিশ^ কী শিক্ষা নিতে পারে? তিনি কী তার পছন্দের নারীর ¯েœহ এবং ভালোবাসার জন্য বড্ড বেশি মূল্য দিয়ে ফেলেছেন?

নিশ্চিতভাবে এ প্রশ্নের সঠিক উত্তর কেউ দিতে পারবে না। আমরা শুধু পারি অনুমান করতে। আমরা এটুকু জানি যে রাজা নিজের সম্মতি ছাড়াই এ পৃথিবীতে এসেছিলেন। তিনি ধনী ঘরে জন্মগ্রহণ করেন, এর জন্য অনুরোধ করা ছাড়াই। তাকে ক্রমাগত বিয়ের জন্য চাপ দেওয়া হচ্ছিল। পুরো ইউরোপ জুড়ে রাজনীতিবিদ এবং রাষ্ট্রনায়করা তার পায়ে রাজকন্যাদের বন্যা বইয়ে দিচ্ছিলেন। কারণ তিনি তার পিতামাতার প্রথম সন্তান। আর উত্তরাধিকারসূতে তিনি মুকুটের অধিকারী। যা হয়তো তিনি চাননি। ৪০ বছরের বেশি সময় ধরে তিনি বন্দি জীবনযাপন করছেন। তার ব্যক্তিগত স্বাধীনতা বা গোপনীয়তা খুব সামান্যই ছিল। অবশেষে তিনি সিংহাসনে আরোহণ করেন এবং তার ওপর দায়িত্ব অর্পিত হয়।

কেউ কেউ বলবে, এই সমস্ত আশীর্বাদ নিয়ে রাজা এডওয়ার্ডের উচিত মন থেকে সন্তুষ্ট থাকা এবং তৃপ্তি নিয়ে জীবন উপভোগ করা। কিন্তু সত্য হচ্ছে রাজা এডওয়ার্ড মুকুট, সমস্ত অর্থ, খ্যাতি ও ক্ষমতা নিয়েও নিজের হৃদয়ে একটা শূন্যতা অনুভব করছিলেন। আর সেই শূন্যতা কেবল ভালোবাসা দ্বারাই পূর্ণ হতে পারে।

তার সবচেয়ে বড় ইচ্ছা ছিল ভালোবাসা। তিনি ওয়ালিস সিম্পসনের সাথে দেখা করার অনেক আগে থেকেই নিজের হৃদয়ের ভালোবাসার এ স্পন্দন অনুভব করতেন। যে ভালোবাসা তার আত্মার শান্তি এবং প্রকাশের জন্য চিৎকার করছিল। আর যখন তিনি আরেকজন মানুষ পেলেন যে তারই মতো ভালোবাসার কাঙাল, তিনি সাথে সাথেই চিনতে পারলেন এবং কোন ধরনের ভয়ভীতি ছাড়াই তার মনের দুয়ার খুলে দিলেন। শত ষড়যন্ত্র, কেলেঙ্কারি, নাটক হলেও ভালোবাসার এ সৌন্দর্য কেউ নষ্ট করতে পারে না। তারা দুজন দুজনার মধ্যে ভালোবাসা খুঁজে পেলেন যা তাদেরকে সাহস যুগিয়েছে শত বাধাবিপত্তি এবং সমালোচনার মুখোমুখি হতে।

রাজা এডওয়ার্ড বিশে^র সবচেয়ে শক্তিশালী সা¤্রাজ্যের মুকুট ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। তিনি তার বাকি জীবন তার পছন্দের মানুষের সাথে কাটানো সিদ্ধান্ত নিলেন। এমন সিদ্ধান্ত নিতে সাহস দরকার। এই সিদ্ধান্তের একটি দামও পরিশোধ করতে হয়েছে। তাকে মুকুট ছাড়তে হয়েছে। কিন্তু কার দাম বেশি, ভালোবাসার না মুকুটের? এ প্রশ্নের জবাব সেই দিতে পারে যে “তোমাদের মধ্যে ত্রুটিহীন এবং পাপ মুক্ত, সেই প্রথম পাথর নিক্ষেপ করবে।” [বাইবেল, কিং জেমস ভার্সন, জন ৮:৭। এ প্রশ্নের জবাব সেই দিতে পারে যে তোমাদের মধ্যে ত্রুটিহীন এবং পাপ মুক্ত। তথ্যসূত্র: যঃঃঢ়ং://িি.িনরনষবমধঃবধিু.পড়স/ঢ়ধংংধমব/?ংবধৎপয=ঔড়যহ%২০৮%৩অ৭্াবৎংরড়হ=কঔঠ]

এমন সমালোচক মানুষ যে উইন্ডসরের ডিউকের দোষ খুঁজে বের করতে চায় তার জন্য বলছি, কারণ ডিউক তার ভালোবাসার আকাক্সক্ষার জন্য, খোলাখুলিভাবে ওয়ালিস সিম্পসের জন্য তার ভালোবাসা প্রকাশের জন্য এবং তার রাজত্ব ও মুকুট ছেড়ে দেওয়ার যে সিদ্ধান্ত তিনি নিয়েছেন তা প্রকাশ্যে ঘোষণা না করলেও হত। উইন্ডসরের ডিউক ওয়ালিস সিম্পনের সাথে গোপনে যোগাযোগ রাখতে পারতেন, যা ইউরোপে শত বছর ধরে চলছে। এতে করে তাকে না সিংহাসন, না তার পছন্দের নারী থেকে দূরে থাকতে হত। এভাবে কাজ করলে সেখানকার গির্জা বা সাধারণ মানুষও এমন আচরণের সমালোচনা করত না। কিন্তু উইন্ডসরের ডিউক ছিলেন অসাধারণ এক ব্যক্তি। তার ভালোবাসা ছিল পরিষ্কার। এটা ছিল গভীর এবং আন্তরিক। অন্য সবকিছুর চেয়ে বেশি ডিউক চেয়েছেন তার আকাক্সিক্ষত ভালোবাসাকে। এজন্য তিনি যথাযোগ্য দামও পরিশোধ করতে প্রস্তুত ছিলেন।

যদি ইউরোপ এমন সব শাসক দ্বারা শাসিত হত যাদের হৃদয় এবং গুণাবলি প্রাক্তন রাজা এডওয়ার্ডের মত হত, তবে গত শতাব্দীতে এই পৃথিবী যে ধরনের লোভ, ঘৃণা, লালসা, রাজনৈতিক যোগসাজশ ও যুদ্ধ দেখেছে এবং এর দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তা হত না। আমরা বলার জন্য ভিন্ন এক গল্প পেতাম। এমন এক গল্প যেখানে ঘৃণা নয় ভালোবাসা মানুষকে শাসন করত।

স্টুয়ার্ট অস্টিন উইয়েরের কথায় আমরা এই প্রাক্তন রাজা এডওয়ার্ড এবং ওয়ালিস সিম্পসনের সুস্বাস্থ্য কামনা করে এই টোস্ট পান করি: “ধন্য সেই ব্যক্তি যে এটা জানতে পেরেছে, আমাদের নিঃশব্দ চিন্তাগুলো আমাদের মধুরতম চিন্তা। ধন্য সেই ব্যক্তি যে অন্ধকারের গভীর থেকে ভালোবাসার উজ্জ্বল আলো দেখতে পেয়েছে এবং শুধু দেখেইনি, এ নিয়ে গান গেয়েছে ও বলেছে: আমি যখন তোমার চিন্তা করি তখন তা মধুর চেয়েও মধুরতম প্রিয়।”

এসব কথার মাধ্যমে আমরা শ্রদ্ধা জানাতে চাই এই দুই ব্যক্তিকে, যারা আধুনিক সময়ে অন্য সবার চেয়ে বেশি সমালোচনার শিকার হয়েছেন এবং দুর্ব্যবহারের সম্মুখীন হতে হয়েছে। কারণ তারা জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ খুঁজে পেয়েছে এবং একে পাওয়ার জন্য সকলের সামনে ঘোষণা করেছে। *মিসেস সিম্পসন এই বিশ্লেষণ পড়েছেন এবং প্রকাশের অনুমতি দিয়েছেন।

বিশে^র বেশির ভাগ মানুষ উইন্ডসরের ডিউক এবং ওয়ালিস সিম্পসনকে সাধুবাদ জানাবে, কারণ জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ পুরস্কার না পাওয়া পর্যন্ত তারা অধ্যবসায়ের সাথে অনুসন্ধান চালিয়ে গেছেন। আমরা যারা জীবন থেকে আরও বেশি কিছু দাবি করি, তারা এডওয়ার্ড ও সিম্পসনের উদাহরণ থেকে লাভবান হতে পারি।

অধ্যবসায় কী সেই অতীন্দ্রিয় শক্তি যা মানুষকে বাধাবিপত্তির ওপর কর্তৃত্ব করার ক্ষমতা দেয়? অধ্যবসায়ের গুণ কি একজন মানুষের মনমস্তিষ্কে কোন ধরনের আত্মিক, মানসিক বা রাসায়নিক ক্রিয়াকলাপ করে যাতে একজন মানুষ অতিপ্রাকৃত শক্তির অধিকারী হয়ে ওঠে? সারা বিশ^ যার বিরুদ্ধে এমন ব্যক্তি যখন যুদ্ধে হেরে যাওয়ার পরও অধ্যবসায়ের সাথে লড়াই চালিয়ে যায় তখন কি অসীম বুদ্ধিমত্তা নিজেকে সেই ব্যক্তির পক্ষে দাঁড় করায়?

আমি যখন হেনরি ফোর্ডের মতো মানুষকে দেখি, যে ব্যক্তি একদম শূন্য থেকে বিশাল এক ইন্ডাস্ট্রিয়াল সা¤্রাজ্য গড়ে তুলেছে, তখন আমার মাথায় এসব প্রশ্ন এবং একই ধরনের আরও প্রশ্ন জাগে। হেনরি ফোর্ডের শুরুটা হয়তো ছোট্ট ছিল, কিন্তু সেখানে ছিল অধ্যবসায়। অথবা থমাস আলভা এডিসনের কথা, যিনি মাত্র ৩ মাসের স্কুল শিক্ষা নিয়ে পরবর্তীতে পৃথিবীর নেতৃত্বদানকারী উদ্ভাবক এবং আবিষ্কারকে পরিণত হন। তিনি তার অধ্যবসায়কে পরিণত করেন কথা বলার যন্ত্র, মুভিং পিকচার মেশিন, লাইট সহ আরও শত শত উপকারী উদ্ভাবনে।

আমি জনাব এডিসন এবং ফোর্ডকে দীর্ঘদিন ধরে বিশ্লেষণ করেছি। আমি তাদের সাথে বছরের পর বছর সময় কাটানোর সুযোগ পেয়েছি। সেজন্য আমি তাদের কাছাকাছি থেকে তাদেরকে অধ্যয়নের সুযোগ পেয়েছি। সেখান থেকে আমি আমার বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, আমি তাদের মধ্যে অধ্যবসায় ব্যতীত কোন গুণ খুঁজে পাইনি। তাদের উভয়ের মধ্যে এই সেই গুণ যা অন্য সব গুণের নির্মাতা এবং তাদের সব কৃতিত্বসম্পন্ন কাজের কারিগর।

কেউ যদি অতীতের যত নবী, অবতার, দার্শনিক, ‘অলৌকিক’ পুরুষ এবং ধর্মীয় নেতাদের নিরপেক্ষভাবে অধ্যয়ন করে, তবে সে অনিবার্যভাবে একটি উপসংহারে উপনীত হবে যে অধ্যবসায়, প্রচেষ্টার একাগ্রতা এবং উদ্দেশ্যের নির্দিষ্টতা ছিল তাদের সকলের কৃতিত্বের প্রধান উৎস।

উদাহরণস্বরূপ, মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর অসাধারণ এবং আকর্ষণীয় ঘটনার কথা বিবেচনা করুন। তার জীবন বিশ্লেষণ করুন। আধুনিক যুগের শিল্প এবং আর্থিক খাতের অসাধারণ কৃতিত্বের সাথে তাকে তুলনা করুন। এতে করে আপনি লক্ষ করবেন কী অসাধারণভাবে তার মধ্যে একটি অসামান্য বৈশিষ্ট্য রয়েছে। আর তা হচ্ছে অধ্যবসায়।

আপনি যদি এই দুনিয়ার অদ্ভুত সব শক্তি নিয়ে অধ্যয়ন করতে আগ্রহী হন, তবে আপনার উচিত মুহাম্মদ (সা.) এর জীবনী পাঠ করা। বিশেষ করে এশাদ বে রচিত (ধ নরড়মৎধঢ়যু ড়ভ গড়যধসসবফ নু ঊংংধফ ইবু)। এতে আপনি দেখবেন অধ্যবসায় কী ধরনের শক্তি দিতে সক্ষম। এ বই সম্পর্কে হেরাল্ড ট্রিবিউনে লেখা থমাস সুগ্রেুর বুক রিভিউ পড়তে পারেন। এই রিভিউতে অধ্যবসায়ের শক্তির সবচেয়ে আশ্চর্যজনক উদাহরণ দেওয়া হয়েছে। যারা পুরো বই পড়ে শেষ করতে পারবেন না, তাদের জন্য এ রিভিউ রতœস্বরূপ।


মহানবী (সা.)কে বিশ্লেষণ করেছেন

থমাস সুগ্রু

হযরত মুহাম্মদ (সা.) একজন নবী ছিলেন। কিন্তু তিনি কখনো কোন অলৌকিক জাদু দেখাননি। তিনি কোন রহস্যময় ব্যক্তিও ছিলেন না। তাঁর কোন আনুষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না। তাঁর বয়স ৪০ বছর না হওয়া পর্যন্ত তিনি তাঁর মিশন আরম্ভ করেননি। যখন তিনি ঘোষণা করলেন যে তিনি আল্লাহর বার্তাবাহক, সত্যিকারের ধর্মের বাণী নিয়ে এসেছেন, তাকে উপহাস করা হয়েছিল এবং সবাই তাকে পাগল আখ্যা দেয়। শিশুরা তাকে ধাক্কা মারে এবং মহিলারা তাঁর উপর আবর্জনা নিক্ষেপ করে। তাঁকে তাঁর জন্মস্থান মক্কা থেকে নির্বাসিত করা হয়। আর তাঁর অনুসারীদের দুনিয়াবি জিনিসপত্র কেড়ে নিয়ে মরুভূমিতে তাঁর সাথে ছেড়ে দেওয়া হয়। তিনি যখন প্রথম ১০ বছর ধরে প্রচার করছিলেন, তখন তাঁর কাছে দেখানোর মতো কিছুই ছিল না। শুধু নির্বাসন, দারিদ্র্য এবং উপহাস ছাড়া। কিন্তু এর পরের ১০ বছর পার হতে না হতেই তিনি মক্কার শাসক, একটি নতুন বিশ^ধর্মের প্রধান এবং সমস্ত আরবের শাসনকর্তা হয়ে ওঠেন। যে ধর্ম একদম দানিয়ুব থেকে পিরেনিস পর্যন্ত জনমানুষকে নাড়িয়ে দেয়। এই প্রেরণার ৩টি মূল বৈশিষ্ট্য ছিল: কথা বা বাণীর শক্তি, প্রার্থনার মাধ্যমে নিশ্চিত ফলদানের ক্ষমতা এবং আল্লাহর সাথে মানুষের আত্মীয়তা (ঃযব ঢ়ড়বিৎ ড়ভ ড়িৎফং, ঃযব বভভরপধপু ড়ভ ঢ়ৎধুবৎ ধহফ সধহ’ং শরহংযরঢ় রিঃয এড়ফ)।

তাঁর ক্যারিয়ারটা কখনো সাধারণ মানুষের বোধগম্য ছিল না। মুহাম্মদ (সা.) মক্কার একটি নেতৃস্থানীয় পরিবারের দরিদ্র সদস্যের ঘরে জন্মগ্রহণ করেন। মক্কা হচ্ছে পৃথিবীর সংযোগস্থল। কাবা নামক রহস্যময় পাথরের এক বাড়ি রয়েছে। এটা বাণিজ্যের জন্য প্রাচীন এবং মহান শহর। বাণিজ্য পথের কেন্দ্র। কিন্তু মরুভূমির রুক্ষ পরিবেশে অবস্থিত। এখানকার শিশুদের বেড়ে উঠতে হত মরুভূমির মধ্যে, বেদুঈনদের মতো। এভাবেই মুহাম্মদ (সা.)কে লালনপালন করা হয়। যাযাবরদের থেকে শক্তি ও স্বাস্থ্য লাভ করে। তাঁর একজন যাযাবর দুধমাতা ছিল। তিনি ভেড়া চরাতেন এবং শীঘ্রই একজন ধনী বিধবা মহিলার কাজে নিযুক্ত হন। সেই মহিলা তাঁকে তার ব্যবসা-বাণিজ্য তথা কাফেলার নেতা হিসাবে নিয়োজিত করেন। তিনি আগেই বিশে^র পূর্বদিকের বহু জায়গা ভ্রমণ করেছেন। বিভিন্ন মতবাদের অনেক মানুষের সাথে কথা বলেছেন। তিনি বিভিন্ন খ্রিস্টধর্মী সম্প্রদায়ের যুদ্ধের মধ্যে খ্রিস্টধর্মের পতন লক্ষ করেছেন। যখন তাঁর বয়স ২৮ বছর, তখন বিধবা খাদিজা তাঁকে পছন্দ করলেন এবং বিয়ে করলেন। খাদিজার বাবা এই ধরনের বিয়েতে আপত্তি জানান। তাই তাকে খাদিজা মাতাল করে আটকে রাখেন এবং তিনি ঐ অবস্থাতেই পৈতৃক আশীর্বাদ দেন। পরবর্তী ১২ বছর মুহাম্মদ (সা.) একজন ধনী, সম্মানিত এবং অত্যন্ত বুদ্ধিমান ব্যবসায়ী হিসাবে জীবনযাপন করেন। তারপর তিনি মরুভূমি থেকে ফিরে আসেন কোরআনের প্রথম আয়াত নিয়ে। তিনি খাদিজাকে বললেন যে জিব্রাইল ফেরেশতা তাঁর কাছে হাজির হয় এবং বলে যে তিনি আল্লাহর রাসুল হতে চলেছেন।

কোরআন হচ্ছে আল্লাহর বাণী। মোটামুটি অলৌকিক ঘটনা বলার মতো এটাই ছিল মুহাম্মদ (সা.) এর জীবনে অবিস্মরণীয় এক ঘটনা। তিনি কোন কবি ছিলেন না। না তাঁর মধ্যে শব্দের ব্যবহার বা কথা বলার মতো অসাধারণ প্রতিভা ছিল। তবুও তিনি কোরআনের আয়াত, যা তিনি গ্রহণ করেছিলেন, তা অবলীলায় পাঠ করেন এবং বিশ^স্তদের কাছে পড়ে শোনান। তাঁর উপজাতির সমস্ত পেশাদার কবি মিলে যে সমস্ত পদ্য তৈরি করতে পারত, কোরআনের আয়াত তারচেয়ে উত্তম ছিল। এটা ছিল আরবদের কাছে এক অলৌকিক ঘটনা। তাদের কাছে শব্দের দান ছিল সবচেয়ে বড় উপহার। কবি ছিলেন সর্বশক্তিমান। কোরআন আরও বলেছে যে আল্লাহ সব মানুষকে সমান করে সৃষ্টি করেছে এবং এই দুনিয়ার উচিত একটি গণতান্ত্রিক ইসলামিক রাষ্ট্রে পরিণত হওয়া। তখনকার দিনে এটা ছিল রাজনৈতিক এবং ধর্মীয়ভাবে বিদ্রোহ। এটা ছিল ধর্ম এবং রাষ্ট্রদ্রোহিতার সামিল। এর পাশাপাশি মুহাম্মদ (সা.) কাবা ঘরের আঙিনায় থাকা ৩৬০টি মূর্তি ধ্বংস করেন। ফলে তাঁকে নির্বাসিত করা হয়। মূর্তিগুলো ছিল মরুভূমির উপজাতিদের। তারা মক্কায় এদের পূজা দিতে আসত। তার মানে এর মাধ্যমে মক্কায় বাণিজ্য চলত। তাই মক্কার ব্যবসায়ী এবং পুঁজিপতিরা, যাদের মধ্যে তিনি নিজেও একজন ছিলেন, তাঁর ওপর বিরূপ হন। এরপর তাঁকে মরুভূমিতে নির্বাসন দেওয়া হয় এবং তিনি সমগ্র বিশে^র ওপর সার্বভৌমত্ব দাবি করেন।

ইসলামের উত্থান আরম্ভ হয়। মরুভূমি থেকে একটি অগ্নিশিখা এসেছে যা নিভে যাবে না। একটি গণতান্ত্রিক সেনাবাহিনী একটি ইউনিট হিসাবে লড়াই করে এবং জয়ী না হওয়া পর্যন্ত লড়াই করতে ও মরতে প্রস্তুত। মুহাম্মদ (সা.) ইহুদি এবং খ্রিস্টানদের আমন্ত্রণ জানায় তাঁর সাথে যোগ দেওয়ার। কারণ তিনি তো কোন নতুন ধর্ম সৃষ্টি করেননি। তিনি এক আল্লাহর বিশ^াসে বিশ^াসী সকলকে একযোগ হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। ইহুদি এবং খ্রিস্টানরা তাঁর দাওয়াত গ্রহণ করলে আজকে ইসলাম বিশ^ জয় করত। কিন্তু তারা তা করেনি। এমনকি মুহাম্মদ (সা.) এর মানবিক যুদ্ধের আহ্বানও তারা মানেনি। যখন মহানবী (সা.) এর সৈন্যবাহিনী জেরুজালেমে প্রবেশ করেছিল তখন তাঁর বিশ^াসের কারণে একজন মানুষও নিহত হয়নি। কিন্তু শতাব্দী পরে ক্রসেডরা যখন জেরুজালেম শহরে প্রবেশ করে তখন একজন মুসলমান পুরুষ, নারী এবং শিশুকেও রেহাই দেওয়া হয়নি। অবশ্য খ্রিস্টানরা মুসলমানদের একটি আইডিয়া গ্রহণ করেছিল। আর তা হচ্ছে শিক্ষার জায়গা-বিশ^বিদ্যালয়।


 




অধ্যায় - ১০

ঐক্যমনের ক্ষমতা

চালনাকারী বল

ধনী হওয়ার ক্ষেত্রে নবম ধাপ


অর্থ আয়ের জন্য ক্ষমতা দরকার।

ক্ষমতা ব্যতীত পরিকল্পনা কোন কাজে লাগে না। এই অধ্যায়ে বলা হবে একজন ব্যক্তি কীভাবে ক্ষমতা অর্জন করতে পারে এবং সেই ক্ষমতা কীভাবে জীবনে প্রয়োগ করতে পারে।

ক্ষমতাকে বর্ণনা করা যায় যেন ‘সংগঠিত এবং বুদ্ধিমত্তার সাথে জ্ঞানকে নির্দেশিত করা।’ ক্ষমতা নামক যে শব্দ এখানে ব্যবহৃত হয়েছে, এটা সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে একজন স্বতন্ত্র ব্যক্তির আকাক্সক্ষাকে এর আর্থিক সমতুল্যে পরিণত করতে পারে। সম্মিলিত প্রচেষ্টা উৎপন্ন হয় দুই বা ততোধিক লোকের চেষ্টায়, যারা একটি নির্দিষ্ট সমাপ্তির দিকে কাজ করে, একটি সহযোগিতামূলক মনোভাব নিয়ে।

অর্থ আয়ের জন্য ক্ষমতা প্রয়োজন! অর্থ আয়ের পর অর্থ ধরে রাখার জন্য ক্ষমতা প্রয়োজন!

আসুন, আমরা দেখি যে কীভাবে ক্ষমতা অর্জন করা যায়। যদি ক্ষমতা ‘সংগঠিত জ্ঞান’ হয় তবে আসুন আমরা জ্ঞানের উৎস পর্যবেক্ষণ করি:

ক. অসীম বুদ্ধিমত্তা। অসীম বুদ্ধিমত্তা বলতে জ্ঞানের উচ্চতর স্তর সম্পর্কে বোঝানো হয়েছে। এই স্তরের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য স্ব-পরামর্শ ব্যবহার করুন। এ সম্পর্কে স্ব-পরামর্শ অধ্যায়ে বলা হয়েছে। এর সাথে সৃজনশীল কল্পনার সংযোগ ঘটান। এ সম্পর্কে কল্পনা অধ্যায়ে বলা হয়েছে।

খ. অর্জিত অভিজ্ঞতা। ব্যক্তির অর্জিত অভিজ্ঞতা (যা সংগঠিত এবং নথি আকারে প্রকাশিত) পেতে পারেন যেকোন লাইব্রেরি বা গ্রন্থাগার থেকে। আপনি নিজে অভিজ্ঞতা অর্জন করতে না পারলে নানা ধরনের নৈশ বিদ্যালয় বা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে নতুন নতুন জিনিস শিখতে পারেন।

গ. পর্যবেক্ষণ ও গবেষণা। বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে এবং জীবনে চলার পথের বাস্তবতায় মানুষ প্রতিদিন নতুন নতুন জিনিস শিখছে এবং গ্রহণ করছে। এগুলো সম্পর্কে জানুন এবং এই উৎসের জ্ঞান দ্বারা নিজেকে প্রতিনিয়ত আধুনিক করুন। এখানেও আপনাকে প্রায়ই সৃজনশীল কল্পনার ব্যবহার করতে হবে।

আপনি যেকোন উৎস থেকে জ্ঞান অর্জন করতে পারেন। তবে এটাকে ক্ষমতায় রূপান্তর করতে হলে আপনার দরকার হবে নির্দিষ্ট পরিকল্পনা এবং সেই পরিকল্পনাকে কর্মে পরিণত করতে হবে।

আপনি যদি একা একা কাজ করেন, তবে জ্ঞানের ৩টি প্রধান উৎস থেকে লাভ উঠানো আপনার জন্য কঠিন হতে পারে। যদি একজন ব্যক্তি কেবল তার নিজের একার চেষ্টার ওপর নির্ভরশীল হয়, তবে তার জন্য কাজ করা কঠিন হয়ে যায়। একা জ্ঞান সংগ্রহ করা এবং একে নির্দিষ্ট পরিকল্পনার মাধ্যমে কর্মে প্রকাশ করা একটি কঠিন কাজ। যদি তার পরিকল্পনা ব্যাপক হয় এবং যদি তাদের বিশাল অংশ জুড়ে অনুশীলন করতে হয়, তবে তাকে অবশ্যই অন্যান্য ব্যক্তির সহযোগিতা নেওয়া উচিত। অন্যদের প্রভাবিত বা উদ্ভুদ্ধ করতে হবে। অন্যদের নিয়ে কাজ করার আগে, ক্ষমতার একটি অংশে পরিণত করার আগে আপনাকে অবশ্যই তাদেরকে সঠিক মনোভাব গঠনে, দৃঢ়চরিত্র নির্মাণে সহায়তা করতে হবে। [আরও পড়–ন ডিভেলপিং দ্য লিডার উইদিন ইউ বই। বাংলা করলে দাঁড়ায় আপনার মধ্যে নেতৃত্বের গুণাবলি গঠন করুন। লেখক: জন সি. ম্যাক্সওয়েল। অনুবাদ: ফজলে রাব্বি। ঢাকা, সাফল্য প্রকাশনী, ২০১৭।]


ঐক্যমনের মাধ্যমে ক্ষমতা অর্জন

‘ঐক্যমনকে’ বর্ণনা করা যায় যেন ‘দুই বা ততোধিক মানুষের মধ্যে, একটি নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য লাভের জন্য, জ্ঞান ও প্রচেষ্টার সমন্বয় সাধন করা এবং সহযোগিতামূলক মনোভাব নিয়ে কাজ করা।’

কোন স্বতন্ত্র ব্যক্তি ‘ঐক্যমনের’ অধিকারী না হয়ে ক্ষমতা অর্জন করতে পারে না। পূর্ববর্তী অধ্যায়ে পরিকল্পনা তৈরি করার যেসব নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে তাতে আপনি আপনার আকাক্সক্ষা অনুযায়ী টাকাপয়সা আয় করতে পারবেন। যদি আপনি এই নির্দেশনা অধ্যবসায় ও বুদ্ধিমত্তার সাথে পালন করেন এবং আপনার ‘ঐক্যমন’ দল গঠনে অনীহা দেখান, তবে আপনি আপনার উদ্দেশ্যের অর্ধেক পথে পৌঁছাবেন। আপনার পথকে সম্পূর্ণ করতে হলে অবশ্যই ঐক্যমন দল গঠন করতে হবে।

তাই আপনাকে আপনার মধ্যকার ‘অস্পর্শ’ ক্ষমতার প্রয়োজনীয়তাকে ভালোভাবে বুঝতে হবে। আপনি একে তখনই সম্পূর্ণভাবে কাজে লাগাতে পারেন যখন আপনি একটি ‘ঐক্যমন’ দল গঠন করবেন। আমরা এখানে ‘ঐক্যমন’ সূত্রের ২টি বৈশিষ্ট্যের ব্যাখ্যা দিব। একটি হচ্ছে অর্থনৈতিক প্রকৃতির এবং অন্যটি মানসিক প্রকৃতির। অর্থনৈতিক বৈশিষ্ট্য হচ্ছে স্পষ্ট। একজন ব্যক্তি অর্থনৈতিক সুবিধাবলি দ্বারা নিজেকে পরামর্শক, উপদেষ্টা এবং এক দল লোকের দ্বারা ঘিরে রাখতে পারে। যারা তাকে হৃদয় দিয়ে সহযোগিতা করতে প্রস্তুত, একই সহযোগিতাপূর্ণ মনোভাব দ্বারা। প্রায় সব মহান সৌভাগ্যের ভিত্তি হচ্ছে এই আকারের সমবায় সহযোগিতা। এই মহান সত্যের উপলব্ধি নিশ্চিতভাবে আপনার অর্থনৈতিক অবস্থাকে উন্নত করবে।

ঐক্যমন সূত্রের মানসিক অংশ আরো বেশি দুরূহ, হৃদয়ংগম করা আরও কঠিন। কারণ এর সাথে আত্মিক শক্তির সম্পর্ক রয়েছে যা মানবজাতি সম্পূর্ণরূপে জানে না। আপনি হয়তো এই বিবৃতি থেকে তাৎপর্যপূর্ণ পরামর্শ ধরতে পারবেন: দুইটি মন কখনো একত্রে একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যে কাজ করতে পারে না, যদি-না তাদের মন একটি অদৃশ্য এবং অস্পর্শ শক্তি দ্বারা যুক্ত থাকে।

এটা মনে রাখবেন যে এই পুরো মহাজগৎ কেবল ২টি উপাদান দিয়ে গঠিত: শক্তি এবং পদার্থ। আমরা খুব ভালোভাবেই জানি যে পদার্থকে অণু আকারে, পরমাণু এবং ইলেকট্রন আকারে ভাগ করা যায়। কিছু পদার্থ আছে যা গলানো, আলাদা করা এবং বিশ্লেষণ করা যায়।

তেমনি, শক্তিরও ভাগ আছে।

মানব মন শক্তির একটি ধরন। এর একটি অংশ পরিবেশের সাথে আত্মিকভাবে সম্পৃক্ত। যখন দুই ব্যক্তির মন সমসুর চেতনায় মিলিত হয়, প্রত্যেক মনের শক্তির আত্মিক ভাগ একটি ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে সম্পৃক্ত হয়, তখন এই মানসিক অবস্থা ‘ঐক্যমন’ দলের সৃষ্টি করে।

ঐক্যমন সূত্র বা এর কার্যকারিতার দিকটি আমার মনোযোগে প্রথম আনেন এন্ড্রু কার্নেগি। তাও প্রায় ২৫ বছরের আগে। এই সূত্রের আরও অধিক অনুসন্ধান ছিল আমার দায়িত্বের বড় অংশ। যে দায়িত্বকে আমি আমার জীবনের একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য রূপে নির্বাচন করেছিলাম।

কার্নেগির ঐক্যমন দল গঠিত ছিল প্রায় ৫০ জন পুরুষের একটি দল নিয়ে। তিনি যাদের দ্বারা নিজেকে ঘিরে রেখেছিলেন, নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে পূরণের জন্য যা হচ্ছে ইস্পাতের উৎপাদন এবং বাজারজাতকরণ। তার সৌভাগ্যের কারণ রূপে তিনি নির্দেশ করেছেন এই ‘ঐক্যমন দল’ দ্বারা অর্জিত ক্ষমতা। আপনার আশেপাশের মানুষ যখন শক্তিশালী হবে, তখন আপনিও শক্তিশালী হবেন।

যেকোন মানুষের ইতিহাস ঘেঁটে দেখবেন যিনি একটি মহান সৌভাগ্য অর্জন করেছেন এবং অনেকেই যারা সৌভাগ্য অর্জন করছেন, তারা সকলেই সচেতন বা অসচেতনভাবে ‘ঐক্যমনের’ প্রয়োগ করেছেন।

অন্য কোন সূত্র দ্বারা ক্ষমতা অর্জন করা যায় না!

শক্তি হচ্ছে প্রকৃতির মহাজাগতিক গঠনের একক, যা দ্বারা সে মহা জগতের প্রত্যেক বস্তুকে গঠন করেছে; মানুষ, পশুপাখি এবং উদ্ভিদের জীবন সৃষ্টি করেছে। এটা শক্তিকে পদার্থে রূপান্তর করেছে।

একজন মানুষের মধ্যেও এই শক্তি বিদ্যমান। এই শক্তি রয়েছে তার চিন্তায়! মানুষের মস্তিষ্ককে একটি তড়িৎ চালিত ব্যাটারির সাথে তুলনা করা যায়। এই মস্তিষ্ক ইথার থেকে শক্তি শোষণ করে এবং চিন্তায় রূপ দেয়। এই চিন্তা থেকেই পরবর্তীতে মানুষ বাহ্যিক কাজের মাধ্যমে চিন্তাকে বাস্তবে পরিণত করে। একজন মানুষ যেমন চিন্তা করে সে তেমন।

এটা আমরা ভালোভাবেই জানি যে একটা তড়িৎ চালিত ব্যাটারির চেয়ে এক দল তড়িৎ চালিত ব্যাটারি সম্মিলিতভাবে আরও বেশি শক্তি প্রদান করে। এটা আরও ভালোভাবে জানা ব্যাপার যে একটি ব্যাটারি যখন শক্তি উৎপাদন করে তখনও এটা তার পুরো শক্তি দিয়ে কাজ করতে পারে না।

যেকোন একটি ব্যাটারির যে শক্তি, ধরি ১টি ব্যাটারির ৭৫ শতাংশ শক্তি আছে। এই ব্যাটারি দিয়ে ১ ঘণ্টা কাজ করা যাবে। কিন্তু আমরা যদি ৪টি ব্যাটারি নিই, তবে ৪টি ব্যাটারির মোট শক্তি হবে ৭৫+৭৫+৭৫+৭৫=৩০০ শতাংশ শক্তি। ৪টি ব্যাটারি দিয়ে ৪ ঘণ্টা কাজ করা সম্ভব। এটা তো গাণিতিক হিসাব। কিন্তু বাস্তবে একজন মানুষ যে কাজ করে তার চেয়ে ৪ জন মানুষ একত্রে ৩০০ ী ৪ = ১২০০ শতাংশ বেশি শক্তি দিয়ে কাজ করে। ৩০০ শতাংশ তো তাদের মোট শক্তি, আর প্রত্যেকের একক শক্তি মানে ৪ দিয়ে গুণ করলে সর্বমোট শক্তি হয় ১২০০ শতাংশ। এটাই হচ্ছে ঐক্যমন দলের ক্ষমতা।


 

[এ ছবিতে একা বনাম ঐক্যমন ক্ষমতার পার্থক্য দেখান হয়েছে।]

মস্তিষ্কের কার্যাবলিও একই রকমভাবে কাজ করে। এটা বলার মানে কিছু মস্তিষ্ক অন্যদের চেয়ে বেশি দক্ষ এবং এই বাক্য একটি তাৎপর্যপূর্ণ বিবৃতির দিকে নিয়ে যায়। আর তা হচ্ছে একটি স্বতন্ত্র মস্তিষ্কের চেয়ে একদল মস্তিষ্ক অনেক বেশি চিন্তা, বুদ্ধি এবং পরামর্শের যোগান দেয়। ঠিক যেমন একদল তড়িৎ ব্যাটারি একটি স্বতন্ত্র ব্যাটারির চেয়ে বেশি শক্তি দেয়।

এই রূপক উদাহরণ দ্বারা এটা তো বুঝতে পারছেন যে ঐক্যমন সূত্র হচ্ছে একত্রে কাজ করা। জীবনে তারাই সফল যারা একদল মানুষকে একত্রে একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পরিচালিত করে পারে। একদল মানুষের আইডিয়া, বুদ্ধি, পরামর্শ এবং ধারণা দ্বারা নিজেকে ঘিরে রাখে। সফল ব্যক্তির সাফল্যের কারণই হচ্ছে সেই ঐক্যমন দল।

এখন আমরা ‘ঐক্যমন’ দলের মানসিক ধাপ বুঝতে পারব। যখন একদল স্বতন্ত্র মস্তিষ্ক একটি নির্দিষ্ট কাজে সমচেতনায় এগিয়ে যায় এবং একত্রে কাজ করে তখন সেই সম্পর্ক অনেক শক্তিশালী কাজও সম্পন্ন করে দেখাতে পারে। এটা হচ্ছে একের বোঝা দশের লাঠি। বুঝতেই পারছেন, একজনের বোঝা আর দশজনের লাঠি হলে তা অনায়াসে বহন করা যায়। সফল ব্যক্তিরা ঠিক এই কাজই করে। তারা ১০ জন ব্যক্তির মন এবং মস্তিষ্ককে একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পরিচালিত করে।

হেনরি ফোর্ডের ঘটনা বলি। এতে করে আপনি খুব সহজেই তার সাফল্যের সূত্র অনুধাবন করতে পারবেন। হেনরি ফোর্ড তার ব্যবসা আরম্ভ করে দরিদ্রতা, নিরক্ষতা এবং অজ্ঞতার প্রতিবন্ধকতা নিয়ে। অথচ মাত্র ১০ বছরের মধ্যে তিনি এই ৩টি প্রতিবন্ধকতার ওপর কর্তৃত্ব করেন এবং পরের ২৫ বছরের মধ্যে তিনি নিজেকে আমেরিকার ধনী মানুষের একজনে পরিণত করেন। এর সাথে আরও একটি ব্যাপার যোগ করুন। তার উঠতি সময়ে হেনরি ফোর্ড বন্ধুত্ব অর্জন করেন টমাস আলভা এডিসনের সাথে। তিনি এডিসনের একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে ওঠেন এবং আপনি বুঝতে পারছেন যে একটি শক্তিশালী মনের প্রভাবে অপর একটি মন কেমন শক্তি অর্জন করতে পারে। আরও আছে। হেনরি ফোর্ড আরও সুনাম অর্জন করে যখন তিনি হারভে ফায়ারস্টোন, জন বাররউফস এবং লুথার বারব্যাংকের সঙ্গী হয়ে ওঠেন। এরা প্রত্যেকেই তাদের মন এবং মস্তিষ্কের সঠিক প্রয়োগকারী। ক্ষমতা অর্জন করতে হলে আপনাকেও এমন শক্তিশালী মন এবং মস্তিষ্কের অধিকারী ব্যক্তিদের সঙ্গ নিতে হবে।

এখানে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই যে হেনরি ফোর্ড হচ্ছে ব্যবসা এবং কারখানা বিশ্বের সর্বাধিক তথ্যপ্রাপ্ত মানুষের মধ্যে একজন। তার সম্পদের ব্যাপারে আলাপ করার আর কোন দরকার নেই। ফোর্ডের ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের বিশ্লেষণ করলে আপনি দেখবেন এবং বুঝবেন যে ‘একজন পুরুষ যাদের সাথে সহানুভূতি এবং সহযোগিতার চেতনায় মিলিত হয়, সে অন্যদের চিন্তাভাবনা, আচার-আচরণ এবং অভ্যাস দ্বারা প্রভাবিত হয়।’

হেনরি ফোর্ড দরিদ্রতা, নিরক্ষরতা এবং অজ্ঞতাকে মুছে ফেলেছেন নিজেকে মহান মনের সাথে বন্ধুত্ব দ্বারা যুক্ত করে। যাদের চিন্তা তরঙ্গ তিনি তার নিজ মনের মধ্যে শোষণ করেছেন। এডিসন, বারব্যাংক, বাররউফস এবং ফায়ারস্টোনের সাথে তার এই সম্মিলন, ফোর্ড তার নিজ মস্তিষ্কে এই চারজন পুরুষের বুদ্ধিমত্তা, অভিজ্ঞতা, জ্ঞান এবং আত্মিক শক্তিকে প্রবেশ করিয়েছেন। অধিকন্তু, তিনি উপযুক্ত এবং যথাযথভাবে ঐক্যমন সূত্রের প্রয়োগ করেছেন। ঠিক সেই কার্যপ্রণালীই এ বইয়ে উল্লেখ আছে।

এই সূত্র আপনাকে দেওয়া হলো!

আমরা অনেকেই মহাত্মা গান্ধীকে চিনি। অধিকাংশ মানুষ যারা গান্ধী সম্পর্কে জানে তারা হয়তো তার বাহ্যিক অবস্থা দেখে অবাক হয়; ছোটখাট একজন পুরুষ, খাদি কাপড় পরা একজন সাধারণ লোক। অথচ এই লোকই পুরো ব্রিটিশ রাজের জন্য বিশাল এক সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়।

বাস্তবে, গান্ধী অদ্ভুত কোন মানুষ ছিলেন না; বরং তিনি ছিল তার সময়কার সবচেয়ে শক্তিশালী পুরুষ।

তার অনুসারীদের সংখ্যা গণনা করে এবং নেতার প্রতি তাদের আস্থা বিবেচনা করে এটা সহজেই বলা যায় যে মহাত্মা গান্ধী ইতিহাসের সবচেয়ে শক্তিশালী একজন পুরুষ। তার ক্ষমতা চোখে দেখা যায় না। কিন্তু এটা বাস্তব।

চলুন আমরা অধ্যয়ন করি সেই পদ্ধতি যার দ্বারা তিনি বিস্ময়কর ক্ষমতা লাভ করেছেন। এটা ব্যাখ্যা করা সহজ কিন্তু বোঝা কঠিন। তিনি এই ক্ষমতা দিয়ে প্রায় ২০ কোটি মানুষের মন, মস্তিষ্ক এবং চেতনাকে একত্রে আনেন। সকলের এই চেতনাকে একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য পূরণে ধাবিত করেন।

সংক্ষেপে, গান্ধী একটি অলৌকিক ঘটনা সম্পন্ন করেছেন। কারণ ২০ কোটি লোককে তিনি কোন ধরনের বল প্রয়োগ ছাড়াই একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পরিচালিত করেছেন। এটা একটা অলৌকিক ঘটনা। কারণ কোন ধরনের বল প্রয়োগ ছাড়া, একটি সহযোগিতাপূর্ণ চেতনার মাধ্যমে ২০ কোটি লোককে একই দিকে ধাবিত করা একটি দুঃসাধ্য কাজ। আর তিনি তাই করে দেখিয়েছেন। আপনার কাছে যদি ব্যাপারটি অবাক করার মতো মনে না হয়, তবে আপনি যেকোন দুইজন ব্যক্তিকে একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যে, সহযোগিতাপূর্ণ মনোভাবের চেতনায় প্রভাবিত করার চেষ্টা করে দেখতে পারেন।

যারা ব্যবসা করে তারা জানে যে কর্মচারীদের কাজে লাগান কতটা কঠিন। কর্মচারীদেরকে সহযোগিতাপূর্ণ মনোভাবের চেতনায় কাজ করান কতটা কঠিন।

ক্ষমতা লাভ করার উৎসের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে অসীম বুদ্ধিমত্তার সহায়তা গ্রহণ। এই বিশ্ব এক বৈশ্বিক শক্তি নিয়ে গঠিত। আপনি যা চিন্তা করবেন আপনি তাই আকর্ষণ করবেন। আপনি যেমন আপনার বন্ধু-বান্ধবও তেমন। তাই যখন দুই বা ততোধিক লোককে একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যের প্রতি সহযোগিতাপূর্ণ মনোভাবের চেতনায় ধাবিত করার চেষ্টা করবেন তখন চিন্তাটিও একই ধরনের রাখুন। এতে করে অসীম বুদ্ধিমত্তার কাছ থেকেও আপনি শক্তি পাবেন।

ধরুন আমাদের এই বিশ্বজগৎ চিন্তা তরঙ্গের সমন্বয়ে গঠিত এক জগৎ। এখানে আপনি যাই চিন্তা করুন না কেন তা চিন্তা তরঙ্গ রূপে সারা বিশ্বে ঘুরতে থাকে। যেকেউ ঠিক এই ধরনের চিন্তা করে বা কাছাকাছি কোন চিন্তা করে তার কাছে গিয়ে আপনার চিন্তা নতুন কোন আইডিয়া, বুদ্ধি বা ধারণা রূপে ধরা পড়বে। আপনার কাছেও এভাবে অন্যের চিন্তা তরঙ্গ এসে পৌঁছায়। পাশের চিত্র দেখুন। আমাদের বিশ্বজগৎও ঠিক এমনভাবে চিন্তা তরঙ্গ নিয়ে গঠিত। পাশের চিত্রের মতো আমাদের মস্তিষ্ক এই চিন্তার তরঙ্গকে গ্রহণ করে। কেবল সমজাতীয় চিন্তাই সবচেয়ে বেশি গ্রহণ করে। দেখবেন আপনি যেমন চিন্তা করবেন, ঠিক তেমন ধরনের আরও বহু চিন্তা আপনার মাথায় আসে। এজন্য কেবল নিজের একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যের প্রতি নিজের চিন্তাকে ধরে রাখার প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

অপর উৎসের মধ্যে প্রধান হচ্ছে মানুষের পঞ্চ ইন্দ্রিয়। এখান থেকেই ক্ষমতা অর্জনের জন্য যা যা দরকার সেসব জ্ঞান আসে।

তবে আপনার ইন্দ্রিয় হয়তো সবসময় সঠিক জবাব দিবে না। কিন্তু অসীম বুদ্ধিমত্তা কখনো ভুল করে না। তাই নিজের পঞ্চ ইন্দ্রিয় কাজে লাগানোর সাথে সাথে অসীম বুদ্ধিমত্তাকেও কাজে লাগান।

পরবর্তী অধ্যায়ে এ সম্বন্ধে বলা হয়েছে। পরের অধ্যায়ে সেই পদ্ধতি সম্বন্ধে বলা হয়েছে যাতে অসীম বুদ্ধিমত্তার সাথে যোগাযোগ করা যায়।

এটা কোন ধর্ম বিষয়ক কর্মসূচি নয়। এ বইয়ের কোন মৌলিক সূত্র কোন ব্যক্তির ধর্মে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রভাব ফেলবে না। এ বই মূলত এবং প্রধানত নির্দেশিত হয়েছে পাঠক কীভাবে অর্থের জন্য নিজের আকাক্সক্ষাকে বাস্তবে পরিণত করতে পারে।

যখন আপনি পাঠ করবেন তখন প্রতিটি বিষয় অধ্যয়ন, চিন্তা এবং ধ্যান করুন। শীঘ্রই পুরো বিষয় আপনার সামনে উদ্ঘাটিত হবে এবং আপনি এর ভেতরের সম্পূর্ণ চিত্র দেখতে পাবেন। আপনি এখন তো কেবল প্রতিটি স্বতন্ত্র অধ্যায়ের বর্ণনা দেখছেন।

অর্থ হচ্ছে লাজুক এবং পালিয়ে যেতে চায় এমন। আপনাকে অবশ্যই সেই পদ্ধতি সম্পর্কে জানতে হবে এবং পদ্ধতি ব্যবহার করতে হবে যেই পদ্ধতি একজন প্রেমিক তার পছন্দের নারীকে জয় করতে ব্যবহার করে। আপনাকে একজন দৃঢ় প্রতিজ্ঞ প্রেমিক হতে হবে। এটা প্রেমের চেয়ে ভিন্ন কিছু নয়। অর্থের সাথে আপনাকে প্রেম করতে হবে। প্রেম একটি ক্ষমতা। সেই ক্ষমতাকে অবশ্যই অর্থ অর্জনে ব্যবহার করতে হবে। আপনি তখনই অর্থ অর্জনে সফল হবেন যখন আপনার প্রেমের সাথে নিজের আস্থাকে মিশ্রিত করবেন। আস্থা মিশ্রিত করা মানে আপনাকে বিশ্বাস করতে হবে যে অর্থ আয় সম্পর্কিত আপনার প্রেম অবশ্যই সফল হবে। আপনাকে নিজের দৃঢ় আকাক্সক্ষা মেশাতে হবে। আপনাকে অধ্যবসায় মেশাতে হবে। একে অবশ্যই একটি সংগঠিত পরিকল্পনার মাধ্যমে প্রয়োগ করতে হবে এবং সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী অবশ্যই কাজ করতে হবে। তবেই না প্রেম সফল হবে।

আর একবার প্রেমে সফল হলে টাকা এত পরিমাণে আসতে থাকবে যেমন পাহাড়ের ওপর থেকে পানি নিচের ঝরণায় এসে জমা হয়। সেখানে একটি মহান অদেখা ক্ষমতার ¯্রােত বিদ্যমান। যা হয়তো একটি নদীর সাথে তুলনা করা যায়; এক পাশের ¯্রােত, যা সকলকে সমানের দিকে, সম্পদের দিকে ও জীবনের ঊর্ধ্বদিকে বহন করে নিচ্ছে এবং অপর পাশের ¯্রােত, যা বিপরীত দিকে ও দুর্ভাগ্যের দিকে বহন করে নিচ্ছে। নদীর এই ¯্রােত যা লোকজনকে দুর্দশা এবং দরিদ্রতার দিকে হয়ে নিয়ে যাচ্ছে তারা নিজেরা নিজেদের খুব কমই সম্পদের দিকে, ধনী হওয়ার দিকে নিয়ে যেতে পারে। এজন্যই তাদের দরকার একে অপরের সহযোগিতা।

প্রত্যেক মানুষ যে বিশাল আকারের সৌভাগ্য অর্জন করেছে, সে জীবনের এই ¯্রােতের অস্তিত্ব বোঝে। এটাই একজনের চিন্তা প্রক্রিয়া গঠন করে। চিন্তার ইতিবাচক অনুভূতি ¯্রােতের সেদিক থেকে আসে যা একজনের প্রতি সৌভাগ্য বয়ে আনে। নেতিবাচক অনুভূতি ¯্রােতের অপর দিক থেকে আসে যা একজনকে দরিদ্রতার দিকে নিয়ে যায়।

এটা ভালো করে বুঝুন। দরকার হলে আবার পড়–ন। কারণ এই জিনিসই আপনাকে আপনার সৌভাগ্য অর্জনে সহায়তা করবে। আপনি যদি এ বই অনুসরণ করে নিজের সৌভাগ্য অর্জন করতে চান, তবে ¯্রােতের এই ব্যাপার বোঝা আপনার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

একে ক্ষমতার ¯্রােত বলে। যদি আপনি ক্ষমতা ¯্রােতের সেদিকে থাকেন যা আপনাকে দরিদ্রতার দিকে নিয়ে যাচ্ছে তাহলে এই জ্ঞান নিশ্চয়ই আপনাকে একটি দাঁড় দিবে, যা দ্বারা আপনি হয়তো নিজেকে ¯্রােতের অপর দিকে চালিত করতে পারবেন। এটা করতে পারবেন শুধু এখানে বর্ণিত পদ্ধতি সঠিকভাবে আপনার জীবনে প্রয়োগ করার মাধ্যমে। আপনি যদি এই কালো অক্ষরগুলো পড়ে যান এবং এর সমালোচনা করে চলে যান, তবে আপনি কোনভাবেই লাভবান হবেন না।

কিছু মানুষ ¯্রােতের ইতিবাচক এবং নেতিবাচক উভয় দিকই অনুভব করে। ১৯২৯ সালে যখন আমাদের শেয়ার বাজারে ধ্বস হলো তখন এই দুর্দশার ¯্রােত লাখো লোককে ইতিবাচক দিক থেকে নেতিবাচক দিকে যেতে বাধ্য করে। এই লাখো লোক কষ্ট করে শ্রম দিচ্ছে, তাদের মধ্যে কিছু হতাশ এবং ভীত। তারা ¯্রােতের ইতিবাচক দিকে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করছে। এ বই লেখা হয়েছে বিশেষ করে সেই লাখো লোকের জন্য।

দরিদ্রতা এবং ধনসম্পদ প্রায়ই স্থান পরিবর্তন করে। ব্যবসায়িক ধ্বস বিশ্বকে এই সত্যই শিখিয়ে দিয়ে গেছে। যদিও মানুষ বেশি সময় ধরে এই শিক্ষা মনে রাখবে না। দরিদ্রতা হয়তো এবং সাধারণত এটাই করে, স্বতঃপ্রবৃত্ত বা নিজ ইচ্ছায় ধনসম্পদের স্থান দখল করে নেয়। আর যখন ধনসম্পদ দরিদ্রতার স্থান দখল করে নেয়, তখন পরিবর্তনটা ঘটে উত্তম রূপে চিন্তা করা এবং মনোযোগের সাথে কার্যে পরিণত করা পরিকল্পনার মাধ্যমে। দরিদ্রতার কোন পরিকল্পনা লাগে না। এর কোন সহায়তার দরকার হয় না। কারণ এটা হচ্ছে সাহসী এবং নিষ্ঠুর। ধনসম্পদ হচ্ছে লাজুক এবং সাহসহীন। একে অবশ্যই ‘আকর্ষণ’ করতে হবে।

যেকোন ব্যক্তি ধনসম্পদ চাইতে পারে এবং অনেক মানুষই চায়। কিন্তু শুধু অল্প মানুষই জানে যে একটি নির্দিষ্ট পরিকল্পনা, সাথে যোগ করতে হবে সম্পদের জন্য একটি জ্বলন্ত আকাক্সক্ষা। এই হচ্ছে সম্পদ অর্জনের জন্য একমাত্র নির্ভরযোগ্য উপায়।


 




অধ্যায় - ১১

যৌনশক্তি রূপান্তরের রহস্য

ধনী হওয়ার ক্ষেত্রে দশম ধাপ


‘রূপান্তর’ শব্দের মানে হচ্ছে ‘পরিবর্তন বা একটি পদার্থের অন্য এক পদার্থে পরিণতি হওয়া বা শক্তির অন্য এক আকারে পরিণত হওয়া।’

যৌনানুভূতি মনের একটি শক্তিশালী অবস্থা তৈরি করে।

এই বিষয়ে অজ্ঞতার কারণে, এই মানসিক অবস্থা সাধারণত শরীরগতভাবেই ঘটে থাকে এবং বেঠিক প্রভাবের কারণে বেশির ভাগ মানুষ যৌনজ্ঞান অর্জন করে শরীর বৃত্তিয় প্রয়োজনে যা মনকে পক্ষপাত দুষ্ট করে। দৈহিক ব্যবহার ছাড়াও যৌনশক্তির আরও ব্যবহার রয়েছে।

যৌন অনুভূতির ৩টি গঠনমূলক প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। এগুলো হচ্ছে:

১.   মানবজাতিকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করা।

২.  স্বাস্থ্য রক্ষা করা (যেমন একটি আরোগ্য বিদ্যা সম্বন্ধীয় বিভাগে এর সমতুল্য অন্য কিছু নেই)।

৩.   প্রতিভাবান হতে সহায়তা করে।

যৌনশক্তিকে যৌনতাও বলা যায়। যৌনতাকে আমরা আমাদের কর্মশক্তিতে রূপান্তর করতে পারি। এই রূপান্তরের সহজ এবং সাধারণ ব্যাখ্যা আছে। এর মানে মনের যে চিন্তার মাধ্যমে আমরা শারীরিক যৌনক্রিয়া ঘটাই, সেই চিন্তাকে একটু পরিবর্তন করলেই আমরা আমাদের যৌনতাকে কর্মশক্তিতে পরিণত করতে পারি।

মানব আকাক্সক্ষার মধ্যে মধ্যে যৌন আকাক্সক্ষা হচ্ছে সবচেয়ে শক্তিশালী আকাক্সক্ষা। যখন ব্যক্তি দৃঢ় আকাক্সক্ষা দ্বারা পরিচালিত হয়, তখন সে তীব্র কল্পনা, সাহস, ইচ্ছাশক্তি, অধ্যবসায় এবং সৃষ্টিশীল ক্ষমতা তৈরি করে, যা অনেক সময় তার নিজের কাছেই অপরিচিত। যৌনতার আকাক্সক্ষা এতই শক্তিশালী এবং উত্তেজক যে মানুষ এটা পেতে তার জীবন ও সম্মান ঝুঁকিতে ফেলতেও রাজি। যখন একে সজ্জিত করা হয় এবং অন্যান্য পথে পরিচালিত করা হয়, তখন এই প্রভাব বিস্তারকারী শক্তি সব ধরনের তীব্র কল্পনা, সাহস, ইচ্ছাশক্তি প্রভৃতি তৈরি করতে পারে। এই সৃষ্টিশীল শক্তিকে সাহিত্য, কলাকৌশল বা অন্য যেকোন পেশা বা আকাক্সক্ষায় প্রয়োগ করা যায়। ঠিক একইভাবে একে ধনী হওয়ার আকাক্সক্ষায়ও প্রয়োগ করা যায়।

যৌনশক্তিকে আকাক্সক্ষা শক্তিতে বা ইচ্ছাশক্তিতে রূপান্তর করার অনুশীলন নিশ্চিতভাবে এর প্রচেষ্টার চেয়ে অধিক মূল্যবান। যৌন প্রতিক্রিয়ার আকাক্সক্ষা আজন্ম এবং প্রাকৃতিক। এই আকাক্সক্ষাকে নিমজ্জিত করা যায় না বা ত্যাগ করা যায় না। করা উচিতও নয়। কিন্তু একে একটি নির্গম পথের মাধ্যমে প্রকাশ হতে দেওয়া উচিত যাতে এটা শরীর, মন এবং ব্যক্তির আত্মাকে সমৃদ্ধ করতে পারে। যদি একে এই নির্গম পথ না দেওয়া হয়, তবে এটা শুধু শারীরিক পথের মাধ্যমেই নির্গম পথ খুঁজে নিবে।

একটা নদীকে হয়তো বাঁধ দেওয়া যায় এবং এর পানিকে একটা সময়ের জন্য নিয়ন্ত্রণ করা যায়, কিন্তু এক সময় না এক সময় এটা বল প্রয়োগ করে হলেও এর একটা নির্গম পথ বের করবে। একই ব্যাপার যৌন অনুভূতির জন্যও সত্য। একে হয়তো একটা সময়ের জন্য নিমজ্জিত এবং নিয়ন্ত্রিত করা যায়। কিন্তু এর প্রকৃতিগত কারণেই এটা বহিঃপ্রকাশের জন্য যেকোন পথ খুঁজে নিবে। যদি-না এটা কিছু সৃষ্টিশীল প্রচেষ্টায় রূপান্তর হয়, এটা কোন নিম্ন মূল্যমানের নির্গম পথ খুঁজে নিবে।

সেই ব্যক্তি অবশ্যই সৌভাগ্যবান যে যৌন অনুভূতিকে একটি সৃষ্টিশীল প্রচেষ্টার মাধ্যমে রূপান্তর করতে পারে। তার এই আবিষ্কারের জন্যই সে নিজেকে একটি প্রতিভাবান অবস্থায় উন্নীত করেছে।

বৈজ্ঞানিক গবেষণায় এই তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাপার উদ্ঘাটিত হয়েছে:

১. সবচেয়ে সাফল্য অর্জনকারী পুরুষ হচ্ছে সেই পুরুষ যার যৌন প্রকৃতি উচ্চ পর্যায়ে গঠিত। পুরুষ, যারা যৌনতা রূপান্তরের কৌশল শিখেছে।

২. যেসব পুরুষ মহান সৌভাগ্য গড়েছে এবং সাহিত্য, কলাকৌশল, শিল্প-কারখানা, স্থাপত্যবিদ্যা এবং স্বীয় পেশায় অসাধারণ সাফল্য অর্জন করেছে, তারা একজন নারী দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে।

এই গবেষণা করা হয় গত দুই হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে তৈরি করা ইতিহাস থেকে। ইতিহাস থেকে পাওয়া মহান ব্যক্তিদের জীবনী থেকে এ আবিষ্কার করা হয়েছে। ইতিহাসের যেখানেই মহান সাফল্য গাঁথায় সজ্জিত পুরুষ ও নারীর সম্পর্ক পাওয়া গেছে সেখান থেকেই তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। এই বিশ্লেষণ থেকে এটা নিশ্চিতভাবে পাওয়া গেছে যে তারা উচ্চ মানের যৌন প্রকৃতির অধিকারী ছিলেন।

যৌন অনুভূতি একটি ‘অনিবার্য ক্ষমতা’ যার কোন প্রতিপক্ষ নেই, যেন একটি ‘নিথর দেহ’। যখন একজন ব্যক্তি এই অনুভূতি দ্বারা চালিত হয়, তখন সে কাজ করতে গিয়ে একটি উচ্চ মানের শক্তির উপহার পায়। এই সত্যকে বুঝুন এবং এই বিবৃতির তাৎপর্য আপনি ধরতে পারবেন যে যৌনতাকে রূপান্তর করে একজন পুরুষ প্রতিভাবান অবস্থায় পৌঁছাতে পারে।

যৌন অনুভূতি সৃষ্টিশীল সামর্থ্যরে গোপন রহস্য বহন করে।

মানুষ বা পশুর, যেকোনটির মধ্যেই যৌন গ্রন্থি ধ্বংস করা মানে আপনি এদের কর্মের প্রধান উৎস সরিয়ে দিলেন। এর প্রমাণের জন্য যেকোন প্রাণীকে বাচ্চা উৎপাদন ক্ষমতায় অক্ষম করে দিয়ে দেখুন কী ঘটে। একটি ষাঁড় বাধ্য হয়ে যায় যেন একটি গরু যখন এর যৌনাঙ্গ পরিবর্তন করা হয়। যৌনাঙ্গ পরিবর্তন পুরুষ জাতীয়দের মধ্যে, পুরুষ বা পশু যেকোনটির মধ্যেই হোক না কেন, তার মধ্যকার সব সংগ্রামকে কেড়ে নেয়। নারীদের মধ্যেও যৌনাঙ্গ পরিবর্তন একই প্রভাব ফেলে।


১০টি মন উত্তেজক

পুরুষরা মন উত্তেজনায় সাড়া দেয়, যার মাধ্যমে এটা উচ্চ হারের তরঙ্গের “জোয়ারে পরিণত হয়” যা পরিচিত আগ্রহ, সৃজনশীল কল্পনা, গভীর আকাক্সক্ষা প্রভৃতি নামে। যেসব উত্তেজকে মন সর্বাধিক মুক্তভাবে সাড়া দেয় সেগুলো হলো:

০১. যৌনতা বহিঃপ্রকাশের আকাক্সক্ষা

০২. ভালোবাসা

০৩. খ্যাতি, ক্ষমতা বা অর্থনৈতিক অর্জনের জন্য একটি জ্বলন্ত আকাক্সক্ষা

০৪. সংগীত

০৫. বন্ধুত্ব, হতে পারে একই লিঙ্গের মধ্যে অথবা বিপরীত লিঙ্গের মধ্যে

০৬. একটি ঐক্যমন সহযোগিতার ভিত্তিতে দুই বা ততোধিক লোকের মাঝে সমসুরে সৃষ্ট সম্পর্ক যারা নিজেদের মধ্যে আত্মিক বা সাময়িক উন্নতির জন্য সহযোগিতা বজায় রাখে

০৭. পারস্পরিক দুর্দশাগ্রস্থ অবস্থা যেমন কারাগারে নির্যাতিত ব্যক্তিবর্গ অভিজ্ঞতা অর্জন করে।

০৮. অটোসাজেশন তথা স্বপরামর্শ

০৯. ভয়ভীতি

১০. নিদ্রাকারক দ্রব্য এবং মদ জাতীয় পানীয়

যৌনতা বহিঃপ্রকাশের আকাক্সক্ষা উত্তেজক তালিকার মাথার দিকে রয়েছে, যা সর্বাধিক দক্ষভাবে মনের তরঙ্গকে ‘প্রস্তুত করে’ এবং শারীরিক কর্মের ‘চাকা’ সচল করে। উত্তেজকের মধ্যে ৮টি হচ্ছে প্রাকৃতিক এবং গঠনমূলক। ২টি হচ্ছে ধ্বংসাত্মক। এই তালিকা দেওয়া হয়েছে যাতে আপনি মন উত্তেজনার প্রধান উৎস নিয়ে একটি তুলনামূলক পর্যবেক্ষণ করতে পারেন। এই পর্যবেক্ষণ থেকে, আপনি দেখতে সক্ষম হবেন যে যৌন অনুভূতি সব মন উত্তেজকের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী উত্তেজক।

এই তুলনার প্রয়োজন আছে। এতে করে আপনার মধ্যে একটি ভিত্তি তৈরি হবে। যা প্রমাণ করবে যে যৌনশক্তির রূপান্তর একজনকে একটি প্রতিভাবান অবস্থায় তুলতে পারে। চলুন, আমরা খুঁজে বের করি যে একজন প্রতিভাবান কী দ্বারা গঠিত।

কিছু প-িত-মূর্খ মানুষ বলবে, একজন প্রতিভাবান হচ্ছে এমন একজন পুরুষ যার ‘লম্বা চুল রয়েছে, অদ্ভুত খাবার খায়, একা একা বসবাস করে এবং তাকে লক্ষ করে সবাই কৌতুক করবে।’ একজন প্রতিভাবানের অধিকতর ভালো সংজ্ঞা আছে এবং তা হচ্ছে, ‘একজন পুরুষ যে তার চিন্তা তরঙ্গকে বৃদ্ধি করার কৌশল আবিষ্কার করেছে, যে বিন্দু থেকে সে মুক্তভাবে জ্ঞানের উৎসের সাথে যোগাযোগ করতে পারে, সেই হচ্ছে যৌনশক্তি রূপান্তরে সক্ষম প্রতিভাবান ব্যক্তি।’ এটা কখনো সাধারণ হারে চিন্তা তরঙ্গের মাধ্যমে সম্ভব নয়।

যে ব্যক্তি প্রতিভাবানের সংজ্ঞা নিয়ে চিন্তা করবে তার মনে হয়তো কিছু প্রশ্ন জেগে উঠতে পারে। প্রথম প্রশ্ন হতে পারে, ‘কীভাবে একজন জ্ঞানের উৎসের সাথে যোগাযোগ করবে যা সাধারণ হারের চিন্তা তরঙ্গের মাধ্যমে সম্ভব নয়?’

পরবর্তী প্রশ্ন হতে পারে, ‘সেখানে কি কোন জ্ঞানের উৎস আছে যা শুধু প্রতিভাবানের কাছেই সহজপ্রাপ্য এবং যদি থাকে, সেসব উৎস কী এবং আসলে তারা সেখানে কীভাবে পৌঁছায়?’

আরও কিছু বিবৃতি যা আমরা এখানে উল্লেখ করেছি, সেগুলো নিশ্চিত প্রমাণ প্রদান করবে বা অন্ততপক্ষে এমন প্রমাণ দিবে যাতে আপনি নিজেই নিজের জন্য পর্যবেক্ষণ করে প্রমাণ করতে পারবেন এবং এভাবে করে আমরা উভয় প্রশ্নের উত্তর দিব।


ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে ‘প্রতিভাবান’ তৈরি হয়

‘ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের’ বাস্তবতা ন্যায্যভাবে প্রতিষ্ঠিত। এই ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় হচ্ছে ‘সৃষ্টিশীল কল্পনা বা সৃজনশীল কল্পনা।’ সৃষ্টিশীল কল্পনা হচ্ছে কল্পনার এমন এক বিভাগ যা বেশির ভাগ মানুষ কখনো ব্যবহার করে না। এমনকি তাদের পুরো জীবনেও এটা তারা ব্যবহার করে না। আর যদি ব্যবহার করেও থাকে, এটা সাধারণত ঘটে বিক্ষিপ্ত দুর্ঘটনা দ্বারা। খুব অল্প মানুষই সৃষ্টিশীল কল্পনার এই বিভাগ ব্যবহার করে। তারা তাদের বিচক্ষণতা এবং পূর্বকল্পিত উদ্দেশ্যের সাথে এই বিভাগকে কাজে লাগায়। যারা এই সৃষ্টিশীল কল্পনাকে স্বেচ্ছায় এবং বুঝেশুনে কাজে লাগায় তারাই প্রতিভাবান।

সৃষ্টিশীল কল্পনা অনুষদ হচ্ছে ব্যক্তির সসীম মন এবং অসীম বুদ্ধিমত্তার মধ্যে সরাসরি সংযোগ পথ। সব সুপ্রাচীন আন্দোলন, দর্শনের বিবৃতি এবং সব আবিষ্কারের ভিত্তি বা উদ্ভাবনের মূল শিকড় হচ্ছে সৃষ্টিশীল কল্পনা।

যখন কোন নতুন আইডিয়া, বুদ্ধি বা ধারণা একজনের মনে ঝিলিক দেয়, তখন এই বুদ্ধি বা ধারণা আসে সাধারণত নিচের এক বা একাধিক উৎস থেকে:

১. অসীম বুদ্ধিমত্তা

২. একজনের অবচেতন মন। মস্তিষ্কের পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে সব

ধরনের অস্পষ্ট ধারণার অনুভূতি এবং চিন্তা তরঙ্গ এই

অবচেতন মনে এসে জমা হয়।

৩. অন্য কোন ব্যক্তির মন থেকে কোন চিন্তা বা আইডিয়া সচেতন মনের মাধ্যমে আপনার মনে এসে পৌঁছাবে

৪. অন্য কোন ব্যক্তির অবচেতন মনের সংগ্রহশালা থেকে আগত

আর কোন জানা উৎস নেই যেখানে থেকে আইডিয়া বা ধারণা আসতে পারে।

সৃষ্টিশীল কল্পনা সবচেয়ে ভালো কাজ করে যখন মন অত্যাধিক উচ্চ হারে স্পন্দিত হয় (মনের উত্তেজনার কারণে)। যখন মন একটি উচ্চ হারে স্পন্দিত হয় তখন সৃষ্টিশীল কল্পনা সাধারণ চিন্তা তরঙ্গের স্পন্দনের চেয়ে অনেক বেশি কাজ করতে সক্ষম। যখন মস্তিষ্ক ১০টি মন উত্তেজকের যেকোন একটি বা একাধিকের সংস্পর্শে আসে তখন এর প্রভাবে একজন মানুষ এমন দূরত্বে দেখার সুযোগ পায়, এমন এমন চিন্তা করে যা সাধারণ অবস্থায় কখনো করতে পারত না।

এই পর্যায়ের চিন্তা তরঙ্গকে বিমানে চড়ার সাথে তুলনা করা যায়। আপনি যেমন বিমানে বসে নিচের অবস্থা দেখতে পারেন, নিজের পরিকল্পনা তৈরি করতে পারেন, ঠিক তেমন উচ্চ পর্যায়ের চিন্তাও আপনাকে এমন অবস্থান দিবে যাতে আপনি সামগ্রিকভাবে পুরো ব্যাপারটা দেখতে, বুঝতে এবং পরিকল্পনা করতে পারেন। এই পর্যায়ে কারও কোন ক্ষতি হয় না বা তার আইডিয়া বা বুদ্ধির ক্ষমতার কোন সীমা থাকে না। সে তখন এমন চিন্তার পৃথিবীতে থাকে যা এতদিন সাধারণ চিন্তাগুলো প্রতিদিনের কর্মচিন্তার মাধ্যমে সরিয়ে রেখেছিল। এটা আপনাকে প্রতিদিনের কর্মব্যস্ত চিন্তার বাইরেও চিন্তা করার সুযোগ দেয়। [ধরুন, আমরা মাটিতে দাঁড়িয়ে আছি। আমাদের দৃষ্টি তখন পাহাড়-পর্বত এবং অরণ্যের কারণে আটকে যায়। আমরা বেশিদূর দেখতে পারি না। কিন্তু যখন আমরা বিমান থেকে দেখি তখন আমাদের দৃষ্টি থেকে এসব বাধা দূর হয়ে যায় এবং আমাদের দৃষ্টি হয় অসীম।]

যখন এই উন্নত চিন্তার বিমানে আপনি অবস্থান করবেন, মনের সৃজনশীল অনুষদ আপনাকে দিবে কর্মের স্বাধীনতা, মুক্তির স্বাদ। এভাবে ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের কাজ করার জন্য রাস্তা পরিষ্কার হবে। এতে করে আপনার মস্তিষ্ক নতুন নতুন আইডিয়া, বুদ্ধি বা ধারণা গ্রহণক্ষম হবে যা কখনো সাধারণ কাজকর্মের কারণে ঘটত না। ‘ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়’ হচ্ছে সেই অনুষদ যা একজন প্রতিভাবান এবং একজন সাধারণ মানুষের মাঝে তফাত দেখিয়ে দেয়।

সৃষ্টিশীল বিভাগ আরও সতর্ক এবং চিন্তা তরঙ্গের প্রতি গ্রহণক্ষম হয় যখন এই বিভাগ আমরা বেশি বেশি ব্যবহার করব। অবচেতন মনের সহযোগিতা দ্বারা একজন মানুষ যতবেশি এটা বিশ্বাস দ্বারা ব্যবহার করবে ততবেশি এটা কাজ করবে। এই বিভাগকে শুধু নিয়মিত প্রয়োগ বা ব্যবহার দ্বারাই উন্নত করা যায়।

একেই বলা হয় একজনের ‘ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় অনুষদের মাধ্যমে সচেতনতাকে সম্পূর্ণভাবে পরিচালিত করা।’

মহান শিল্পী, লেখক, সংগীতজ্ঞ এবং কবিরা মহান হয়েছে, কারণ তারা নিজেদের ভেতর ‘শান্ত ছোট্ট কণ্ঠের’ আওয়াজ শুনেছে এবং তদানুযায়ী কাজ করেছে। সৃষ্টিশীল কল্পনা বিভাগের উন্নয়ন ঘটিয়েছে। এটা একটা ভালোভাবে জানা ব্যাপার যে যেসব মানুষের ‘তীব্র কল্পনা’ রয়েছে তাদের মধ্যে নতুন নতুন আইডিয়া, বুদ্ধি বা ধারণা আসে মূলত ‘হঠাৎ কোন ঝলক’ দ্বারা। হঠাৎ কোন ঝলক বলতে হঠাৎ কোন চিন্তার উদয় হওয়াকে বোঝানো হয়েছে। একটি বাতি এক মুহূর্তের জন্য জ্বালিয়ে আবার নিভিয়ে দিলে যে তাৎক্ষণিক আলোর ঝলক তৈরি হয়, তেমন কল্পনায় হঠাৎ একটি আইডিয়া বা ধারণার আগমনকে এখানে ঝলক বলা হচ্ছে।

আমি এখন একজন মহান বক্তার সাথে আপনাকে পরিচয় করিয়ে দিব, যে তার চোখ যতক্ষণ পর্যন্ত না বন্ধ করত ততক্ষণ সে মহানুভবতা অর্জন করত না। এরপর সে সৃজনশীল কল্পনা অনুষদের ওপর নির্ভর করে তার বক্তৃতা আরম্ভ করত। যখন তাকে জিজ্ঞেস করা হয় যে কেন সে তার বক্তৃতার আগে তার চোখ বন্ধ করে, সে জবাব দেয়, ‘আমি এটা করি, কারণ, চোখ বন্ধ করার পর থেকে আমি আমার ভেতর থেকে যে আইডিয়া, বুদ্ধি বা ধারণা আসে তাই নিয়ে কথা বলি। খুব সহজভাবে আমার ভেতর থেকে কথাগুলো চলে আসে।’

আমেরিকার সর্বাধিক সাফল্যম-িত ব্যক্তিদের একজন এবং সুপরিচিত ধনী পুরুষদের একজন ছিলেন যিনি নিজেও এই পদ্ধতি অনুসরণ করতেন। তিনি কোন একটি সিদ্ধান্ত নেওয়ার পূর্বে ২-৩ মিনিটের জন্য তার চোখ বন্ধ করার অভ্যাস চর্চা করতেন।

যখন জিজ্ঞেস করা হয় যে কেন তিনি এটা করেন, তিনি জবাব দেন, ‘আমার চোখ বন্ধ করার সাথে সাথেই আমি সর্বশ্রেষ্ঠ বুদ্ধিমত্তার সাথে যোগাযোগ করতে সক্ষম হই।’

মেরিল্যান্ডের বিগত ড. এলমার আর. গেটস ২০০ এরও বেশি যন্ত্র আবিষ্কারের মেধাস্বত্ব সৃষ্টি করেছেন। এগুলোর মধ্যে অনেক আবিষ্কার মৌলিক তত্ত্ব। তিনি তার সৃষ্টিশীল কল্পনা চাষ করেছেন এবং তা প্রয়োগ করে এসব আবিষ্কার করেন। তার পদ্ধতি তাৎপর্যপূর্ণ এবং কৌতূহল উদ্দীপক। তিনি নিজেকে একজন প্রতিভাবান পর্যায়ে উন্নীত করেছেন। কিন্তু তিনি অন্যান্য মহান ব্যক্তির মতো প্রচারে বিশ্বাস করতেন না। তাই হয়তো আপনি তার নাম ততটা জোরালোভাবে শুনবেন না। কিন্তু তার পদ্ধতি ছিল অনন্য।

তার গবেষণাগারের ভেতরে একটি ঘর ছিল। যাকে তিনি ডাকতেন তার ‘ব্যক্তিগত যোগাযোগ ঘর।’ এই ঘরে বাইরের শব্দ যাতে পৌঁছাতে না পারে সেজন্য সবরকম শব্দ নিরোধী ব্যবস্থা ছিল। একটি সুইচে যাতে সব আলো নিভানো যায় সেই ব্যবস্থাও ছিল। ঘরে একটি ছোট্ট টেবিল ছিল, একতাড়া কাগজ এবং লেখার জন্য কলম ছিল। যখন ড. গেটস সৃষ্টিশীল কল্পনার ব্যবহার করতে চাইতেন তখন তিনি সব আলো নিভিয়ে, শান্তচিত্তে টেবিলের সামনে বসে নিজের সমস্যার ওপর মনোযোগ দিতেন এবং বিভিন্ন সমাধান নিয়ে চিন্তা করতেন। এভাবে তিনি ততক্ষণ বসে থাকতেন যতক্ষণ না সমাধান তার মনের মধ্যে ‘ঝলক’ দিয়ে ওঠে।

একদিন তো এমনও গেছে যে তার আইডিয়া বা ধারণা এত দ্রুত আসতে শুরু করে যে তিনি প্রায় ৩ ঘণ্টা ধরে টানা কাগজে লিখে যান। যখন চিন্তাগুলোর প্রবাহ বন্ধ হয় এবং তিনি তার লেখনী পরীক্ষা করেন। তখন তিনি সমস্যার সমাধান খুঁজে পান।

ড. গেটসের দেখাদেখি অন্যরাও মেধাস্বত্ব তৈরিতে নেমে পড়ে। যাদের অধিকাংশের মস্তিষ্ক হচ্ছে অব্যবহৃত। তারা না তাদের সৃষ্টিশীল কল্পনাকে ব্যবহার করতে জানে, না তারা তাদের চিন্তাশক্তিকে বৃদ্ধি করতে জানে।

ড. গেটস তার জীবিকা আয় করত নিজের জন্য এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের জন্য নতুন নতুন আইডিয়া, বুদ্ধি বা ধারণা দিয়ে। তিনি মস্তিষ্কে ধারণা উৎপাদনের জন্য মনোযোগ সহকারে ধ্যানে বসতেন। একে ‘আইডিয়ার জন্য বসা’ বলা যায়। আমেরিকার কিছু বড় বড় প্রতিষ্ঠান তাকে এই ‘আইডিয়ার জন্য বসার’ প্রতি প্রচুর পারিশ্রমিক দিত।

প্রায়ই দেখা যায় আমরা আমাদের কল্পনা অনুষদকে ব্যবহার করি না। এর একটি বড় কারণ হচ্ছে অভিজ্ঞতা। অভিজ্ঞতা মানে কী? অভিজ্ঞতা মানে যা হয়ে গেছে, ঘটে গেছে। আমরা অভিজ্ঞতা বিশ্লেষণ করব। অভিজ্ঞতা থেকে শিখব। ব্যর্থতা থেকে শিখব, যাতে এই ভুল দ্বিতীয়বার না করতে হয়। তবেই না অভিজ্ঞতা কাজে লাগবে। কিন্তু অনেকেই একবার ব্যর্থ হয়ে। আর ব্যর্থতার ভয়ে কাজে নামতে চায় না। অন্য কেউ সেই কাজে নামতে গেলে বিজ্ঞ একটি ভাব নিয়ে তাকে বাধা দেয়, ‘আমি কাজটি করেছিলাম, কিন্তু ব্যর্থ হয়েছি। তুমি করো না। তুমি করলে তুমিও ব্যর্থ হবে।’ কিন্তু সে হয়তো কাজটি ভিন্নভাবে করবে, যাতে সে সফলও হতে পারে। এজন্য অভিজ্ঞতা থেকে শেখা অনেক বেশি জরুরি। তাই বলে অভিজ্ঞ হয়েছেন বলে আর কোন নতুন পথে, নতুন কাজে হাত দেওয়া যাবে না তা নয়! আপনার সৃষ্টিশীল কল্পনাকে কাজে লাগান এবং নতুন নতুন কাজে নেমে পড়–ন।

একজন প্রতিভাবান এবং একজন ‘খামখেয়ালি’ উদ্ভাবকের মধ্যে প্রধান পার্থক্য হচ্ছে সৃষ্টিশীল কল্পনার ব্যবহার। প্রতিভাবান উদ্ভাবক, যেমন ড. গেটস এবং এডিসনের মতো উদ্ভাবকরা সৃষ্টিশীল কল্পনার ব্যবহারে পারদর্শী। কিন্তু একজন ‘খামখেয়ালি’ ব্যক্তি এই ব্যাপারে কিছুই জানে না।

এখানে ড. গেটসের কিছু পদ্ধতি বর্ণনা করা হচ্ছে যাতে আপনিও আপনার কল্পনার দুই অংশ; সমন্বয় কল্পনা এবং সৃষ্টিশীল কল্পনা, উভয় অংশকে আপনার আকাক্সক্ষা পূরণে কাজে লাগাতে পারেন।

১. মন হচ্ছে মস্তিষ্কের একটি অংশ। ড. গেটস ১০টি মন উত্তেজকের যেকোন একটি বা একাধিক উত্তেজক দ্বারা নিজের মনকে উত্তেজিত করতেন। এতে করে তার চিন্তাশক্তি বহুগুণে বৃদ্ধি পেত।

২. তিনি তার মনোযোগকে তার উদ্ভাবনের পরিচিত তথ্যের ওপর কেন্দ্রীভূত করতেন এবং সম্ভাব্য উপায় নিয়ে চিন্তা করতেন। এই পুরো ব্যাপার একটি চিত্রের মতো করে তিনি তার মনের মধ্যে ধরে রাখতেন যতক্ষণ না এটা অবচেতন মন দ্বারা গৃহীত হয়। তারপর অবচেতন মন দ্বারা ব্যাপারটি গৃহীত হলে তিনি কিছুটা শিথিল হতেন। তিনি তার মন থেকে সব চিন্তা ঝেড়ে ফেলতেন এবং জবাবের জন্য অপেক্ষা করতেন। তিনি প্রায়ই তার জবাব পেতেন একটি ‘ঝলক’ আকারে। তিনি সাথে সাথে সমাধানটি খাতায় লিখে রাখতেন।

আপনিও এই পদ্ধতি ব্যবহার করতে পারেন। এতে করে আপনিও অসাধারণ ফলাফল লাভ করবেন। কখনো কখনো সমাধানগুলো হয়তো তৎক্ষণাৎ আপনার মনে উদয় হবে। কখনো-বা একটু সময় লাগবে। এটা নির্ভর করে আপনি আপনার ‘ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়’ বা সৃষ্টিশীল কল্পনা ব্যবহারে কতটা পারদর্শী হয়েছেন তার ওপর।

এডিসন একটি বৈদ্যুতিক বাতি সৃষ্টি করতে গিয়ে ১০ হাজার বারেরও বেশি চেষ্টা করেন। সফল হওয়ার আগে তিনি তার সমন্বয় কল্পনা এবং সৃষ্টিশীল কল্পনার সাথে বিভিন্ন আইডিয়া মিশ্রিত করেন। অবশেষে তিনি তার সৃষ্টিশীল কল্পনার কাছ থেকে জবাব পান। তিনি কথা বলার যন্ত্র উদ্ভাবন করতে গিয়েও ঠিক একই রকম অভিজ্ঞতা অর্জন করেন।

সৃজনশীল কল্পনা প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই বিদ্যমান এবং এর ব্যবহার করে যেকোন মানুষ সাফল্য অর্জন করতে পারে সেই ব্যাপারেও অনেক বিশ্বাসযোগ্য স্বাক্ষ্য-প্রমাণ আছে। যেসব ব্যক্তি পড়ালেখা না করে তাদের নিজ নিজ পেশায় নেতৃত্ব দিচ্ছে তাদের জন্য সৃজনশীল কল্পনা ব্যবহার করা আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ তারা তাদের পর্যবেক্ষণ এবং কল্পনার ব্যবহার করে তাদের প্রভাব প্রতিপত্তি আরও বৃদ্ধি করতে পারে। এক্ষেত্রে আব্রাহাম লিংকন একটি ভালো উদাহরণ। তিনি ছিলেন একজন মহান নেতা। তিনি তার এই সৃজনশীল কল্পনা অংশের চমৎকার ব্যবহার করেছেন। তবে তার এই ব্যবহার আরও বেশি সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে যখন তিনি এনি রুটলেজের সাথে সাক্ষাৎ করেন। এনি রুটলেজের প্রতি তার ভালোবাসা তার সৃজনশীল কল্পনাকে আরও বহুগুণে বৃদ্ধি করে।

ইতিহাসের পাতা মহান নেতাদের কৃতিত্বপূর্ণ কর্মে ভরপুর। তাদের অসাধারণ কাজের সন্ধান করলে আপনি দেখবেন তাদের জীবনে নারীর প্রভাব রয়েছে। এমনকি তাদের উচ্চাকাক্সক্ষার পিছনে, সৃজনশীল কল্পনা ব্যবহারের পিছনে রয়েছে নারীর প্রভাব। নেপোলিয়ন বোনাপোর্টও ছিলেন এদের মধ্যে একজন। যখন তিনি তার প্রথম বউ, জোসেফিন দ্বারা অনুপ্রাণিত হন তখন তিনি ছিলেন অত্যন্ত শক্তিশালী এবং অপরাজেয়। যখন তার ‘উত্তম বিবেচনা’ বা কারণ অনুষদ তাকে উৎসাহ দিল যে এখন তো আমার অনেক শক্তি হয়েছে, ক্ষমতা হয়েছ, অর্থ-সম্পদ হয়েছে এখন জোসেফিনকে ছাড়াও চলে। তখন তিনি জোসেফিনকে একপাশে সরিয়ে রাখলেন। আর তখন থেকেই তার পতনের সূত্রপাত। তার পরাজয় এবং সেন্ট হেলেনা কারাগার সেখান থেকে বেশি দূরে নয়।

আমরা এখানে পরিচিত কিছু পুরুষের নাম উল্লেখ করছি যারা আমেরিকার মানুষের কাছে বেশ পরিচিত। যারা তাদের সাফল্যের মহান উচ্চতায় আরোহণ করেছে তাদের বউয়ের উৎসাহ-উদ্দীপনায়। আবার আরও কিছু পুরুষ আছে যারা অনেক টাকাপয়সা আয় করার পর পুরাতন বউকে ছেড়ে দিয়ে নতুন করে বিয়ে করেছে এবং পরবর্তীতে তাদের জীবন ধ্বংস করেছে। এ থেকে আপনি বুঝতে পারবেন যে কেবল নেপোলিয়নই একমাত্র পুরুষ নন যিনি যৌনশক্তির রহস্যকে আবিষ্কার করেছিলেন, যিনি বুঝতে পেরেছেন যে যদি সঠিক উৎস থেকে যৌন প্রভাব আগত হয় তবে তা একজন পুরুষকে আরও ক্ষমতাশালী করতে পারে। কেবল কারণ এবং যুক্তি দিয়ে যে জায়গায় পৌঁছানো সম্ভব নয় সেখানে যৌনশক্তির প্রভাব নিয়ে পৌঁছানো সম্ভব। যৌনশক্তির প্রভাব বলতে বোঝানো হচ্ছে আপনি যাকে ভালোবাসেন, মন থেকে ভালোবাসেন, সেই ভালোবাসার প্রভাব। ভালোবাসার মানুষের প্রতি যে যৌন আকাক্সক্ষা কাজ করে সেই আকাক্সক্ষার প্রভাব।

মানুষের মন উদ্দীপনায় সাড়া দেয়!

উদ্দীপনা হচ্ছে এক ধরনের তাড়না: বুক ধুক-ধুক করা, অতি মাত্রায় চিন্তা করা এমন। আর এই উদ্দীপনা বা উত্তেজনার মধ্যে সবচেয়ে মহান এবং শক্তিশালী হচ্ছে যৌন উত্তেজনা। যখন একে সজ্জিত করা হয় এবং কর্মশক্তিতে রূপান্তর করা হয়, তখন এই চালক একজন পুরুষকে উচ্চতর চিন্তা ক্ষেত্রে তুলে ধরে। এই চিন্তা ক্ষেত্র এমন এক জায়গা যেখানে আপনি আপনার সব সমস্যা এবং ঝামেলা ভুলে নিজের জীবনে এগিয়ে যাওয়ার চিন্তা করতে পারবেন। এই চিন্তা ক্ষেত্রে আপনি এমন এমন শক্তি এবং বল পাবেন, যাতে করে আপনি আপনার সমস্যা এবং ঝামেলার ওপর কর্তৃত্ব করতে পারবেন। এতে করে আপনি আপনার জীবনের নানান বাধাবিপত্তি অতিক্রম করতে সক্ষম হবেন।

দুর্ভাগ্যবশত এটা কেবল প্রতিভাবানরাই আবিষ্কার করেছে। অন্যরা কেবল যৌন উত্তেজনাকে একটি দৈহিক অভিজ্ঞতা রূপেই গ্রহণ করেছে। এর প্রধান প্রধান সম্ভাবনা আবিষ্কার করা ছাড়াই তারা জীবন কাটাচ্ছে। ঠিক এজন্যই পৃথিবীতে প্রতিভাবানদের সংখ্যা কম।

আপনার স্মৃতিকে সতেজ করুন। এখানে কিছু সফল পুরুষদের নাম দেওয়া হচ্ছে যাদের জীবনী থেকে আপনি সহজেই বুঝবেন যে তারাও তাদের জীবনকে সফল এবং মহান করতে যৌনশক্তির প্রয়োগ করেছেন। এই পুরুষদের প্রত্যেকেই তাদের কৃতিত্বপূর্ণ কাজের দ্বারা বিশ্ব ইতিহাসে নাম লিখে গেছেন। তারা প্রত্যেকেই তাদের যৌনশক্তির প্রভাবকে কাজে লাগিয়েছেন। তারা প্রত্যেকেই প্রতিভাবান পর্যায়ে উন্নীত হয়েছেন এবং এটা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে তাদের ক্ষমতার উৎস ছিল যৌনশক্তির রূপান্তর।

জর্জ ওয়াশিংটন

নেপোলিয়ন বোনাপোর্ট

উইলিয়াম শেকসপিয়ার

আব্রাহাম লিংকন

রালফ ওয়াল্ডো এমারসন

রবার্ট বার্নস

টমাস জেফারসন

এলবার্ট হুবার্ড

এলবার্ট এইচ. গেরি

অস্কার ওয়াইল্ড

উইড্রো উইলসন

জন এইচ. পেটারসন

এন্ড্রু জ্যাকসন

এনরিকো কারুসো


আপনিও আপনার জীবনকে এই তালিকায় যোগ করতে পারেন। আর আপনার যদি কোন সন্দেহ থাকে তবে ইতিহাসের পাতায় এদের জীবনী খুঁজে দেখুন। আপনি নিঃসন্দেহে খুঁজে পাবেন যে এরা প্রত্যেকেই তাদের নিজ নিজ পেশায় অসাধারণ সাফল্য অর্জন করেছে। কারণ তারা তাদের যৌনশক্তিকে উত্তমভাবে কর্মশক্তিতে রূপান্তর করেছে।

যদি আপনার মনে হয় যে এরা তো মারা গেছে, এদের জীবনী থেকে হয়তো আপনি সেই তথ্য পাবেন না যা আপনি খুঁজচ্ছেন। তবে আপনি আপনার পরিচিত মানুষের মধ্য থেকে একজন পুরুষকে নির্বাচন করুন যিনি মহান সাফল্য অর্জন করেছে। তাকে দেখুন, পর্যবেক্ষণ করুন যে তিনি কি তার যৌনশক্তিকে উত্তমভাবে কর্মশক্তিতে রূপান্তর করেছেন না। আমি নিশ্চিত আপনি আপনার উত্তর পেয়ে যাবেন।

যৌনশক্তি হচ্ছে সকল প্রতিভাবানের সৃজনশীল শক্তি। সেখানে এমন কোন মহান নেতা, নির্মাতা বা শিল্পী নেই, ইতিহাসেও ছিল না এবং ভবিষ্যতেও কেউ আসবে না যে এই যৌনশক্তির ঐশ্বরিক বল ব্যতীত মহান হয়েছে।

আমার কথার কেউ ভুল মানে ধরবেন না। আমি বলেছি প্রতিভাবানরা সবসময় উচ্চ যৌনশক্তির অধিকারী। কারণ তারা তাদের যৌনশক্তিকে কর্মশক্তিতে রূপান্তর করতে পারে। এই কর্মশক্তি দিয়ে তারা পুরো বিশ্বকে জয় করে। কিন্তু তারমানে এই নয় যে কিছু ‘লম্পট’ এবং দুশ্চরিত্রের পুরুষ, যারা তাদের যৌনশক্তি কেবল দৈহিক কর্মে কাজে লাগায় তারাও প্রতিভাবান। এ ধরনের পুরুষ কখনো যৌনশক্তির আত্মিক দিক অনুভব করেনি। এজন্যই তারা কখনো তাদের যৌনশক্তিকে কর্মশক্তিতে রূপান্তর করতে পারে না।

একজন পুরুষ কেবল তখনই প্রতিভাবান অবস্থায় উন্নীত হয় যখন সে তার মনকে এতটা উত্তেজিত করতে পারে যা তার সৃজনশীল কল্পনাকে জাগিয়ে তোলে। সৃজনশীল কল্পনাকে জাগিয়ে তোলা, দূরদর্শী মানুষ হয়ে ওঠা সম্ভব কেবল যৌনশক্তির প্রভাব দ্বারা। আবার যারা উচ্চ যৌনশক্তির অধিকারী তারা সবাই যে প্রতিভাবান, তা নয়! শক্তি থাকলেই হয় না, এর ব্যবহার জানতে হয়। প্রতিভাবান কেবল তিনিই যিনি তার দৈহিক যৌনশক্তিকে তার আত্মিক শক্তিতে পরিণত করতে পারে, তার কর্মশক্তিতে পরিণত করতে পারে এবং মহান কার্য সাধন করে দেখাতে পারে। আর একজন পুরুষকে প্রতিভাবান অবস্থায় পৌঁছানোর পূর্বে এটা করে দেখাতে হবে। তবেই সে হবে একজন প্রতিভাবান।

যদিও আমাদের মধ্যকার অধিকাংশ পুরুষ নিজেদের এই মহান শক্তি, যৌনশক্তিকে বুঝতে ভুল করে এবং এর অপপ্রয়োগ করে নিজেদের নি¤œতর পশু শ্রেণিতে নামিয়ে ফেলে, তবুও আমরা যদি একে সঠিকভাবে বুঝি এবং প্রয়োগ করি, তবে আমাদের পক্ষে প্রতিভাবান পর্যায়ে উন্নীত হওয়া সম্ভব।


কেন পুরুষরা চল্লিশের পূর্বে কদাচিৎ সফল হয়?

আমি আমার ২৫ বছরের গবেষণায় ২৫ হাজার মানুষকে বিশ্লেষণ করেছি। এই বিশ্লেষণ থেকে আমি আবিষ্কার করলাম যে যেসব পুরুষ সফল হয়েছে, যারা জীবনে অসামান্য কৃতিত্ব অর্জন করেছে, তারা সাধারণত ৪০ বছর বয়সের পর সফল হয়েছে। অনেক সময় দেখেছি তাদের আসল সাফল্য এসেছে ৫০ বছর পার করার পরে। এই অসাধারণ ব্যাপার নিয়ে আমি আরও সতর্কতার সাথে অধ্যয়ন করি। আমি এর কারণ খুঁজে দেখার জন্য আরও চেষ্টা করি।

অবশেষে আমি খুঁজে পাই যে এর প্রধান কারণ হচ্ছে তাদের লম্পট আচরণ বা তাদের যৌনশক্তির অতিরিক্ত প্রশয়দান। মানে তারা তাদের যৌনশক্তির ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে ব্যর্থ। দেখা যায় আমাদের মধ্যকার বেশির ভাগ পুরুষ যৌনশক্তির অন্যান্য ব্যবহার সম্পর্কে অজ্ঞ। এজন্যই তারা কেবল দৈহিকভাবে যৌনশক্তি ব্যবহার করে। আর যারা যৌনশক্তির অন্যান্য ব্যবহার এবং সম্ভাবনা সম্পর্কে আবিষ্কার করে তারা প্রায় ৪০-৫০ বছর বয়সের পরে গিয়ে এই আবিষ্কার করে। এর আগে তারাও না জানার কারণে এই মহান শক্তির অপচয় করে থাকে। আর যখন তারা যৌনশক্তির রূপান্তর সম্পর্কে বুঝতে পারে, এটা হয় সাধারণত ৪৫-৫০ বছর বয়সে, তখন তারা এই জ্ঞান অনুসরণ করে অবিস্মরণীয় সাফল্য অর্জন করে।

অনেকে অবশ্য ৪০ পার করে ফেললেও অসংযমী থেকে যায়। যৌনশক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। যদি তারা যৌনশক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করত এবং একে অন্যান্য পথে, যেমন কর্মশক্তিতে পরিণত করত, তবে তারাও অসাধারণ সাফল্য অর্জন করত। কিন্তু একটি বাগান যেমন সঠিক যতœ এবং পরিচর্যার অভাবে বন্য জঙ্গলে পরিণত হয়, তেমন একজন অসংযমী পুরুষও মানুষ হয়েও জন্তু জানোয়ারের মতো আচরণ করে।

যৌনতা প্রকাশের জন্য আকাক্সক্ষা হচ্ছে মানব অনুভূতির মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী এবং ক্ষমতাধর। যদি একে নিয়ন্ত্রণ করা যায় এবং কর্মশক্তিতে রূপান্তর করা যায়, তবে এটা একজন মানুষকে, উভয় পুরুষ এবং নারীকে, প্রতিভাবান অবস্থায় উন্নীত করতে সক্ষম।

আমেরিকার একজন সফল ব্যবসায়ী অকপটে স্বীকার করেছেন যে তার আকর্ষণীয় সহকারী তার ব্যবসায়িক সমস্যা সমাধানে যথেষ্ট সহায়তা করেছে। তিনি স্বীকার করেছেন যে তার সহকারীর উপস্থিতি তাকে সৃজনশীল কল্পনার এমন এক উচ্চতায় নিয়ে যায় যেমনটা তিনি অন্য কোন উত্তেজনায় পাননি।

উত্তেজনা বৃদ্ধির জন্য পুরুষরা উত্তেজকের ওপর নির্ভরশীল। যেমন অ্যালকোহল এবং নিদ্রাকারক ঔষধ। ইতিহাসে এমন অনেক পুরুষ আছে যারা এ ধরনের উত্তেজক জিনিস ব্যবহার করেছেন।

এডজার অ্যালেন পো তার বিখ্যাত কবিতা ‘রাভেন’ রচনা করেন যখন তিনি কড়া মদের প্রভাবে কল্পনা রাজ্যের স্বপ্নে বিচরণ করছিলেন। এমন রচনা লেখা, এমন কল্পনার ব্যবহার করা এর আগে কোন মরণশীল ব্যক্তি করে দেখাতে পারেনি। ইতিপূর্বে কেউ এমন স্বপ্ন দেখার সাহস করেনি। জেমস উইটকম্ব রিলেই তার সর্বোৎকৃষ্ট রচনা লিখেছিলেন যখন তিনি অ্যালকোহলের প্রভাবে ছিলেন। হয়তো এভাবেই তিনি ‘বাস্তব ও স্বপ্নের মিশ্রণে রচিত নদীর ওপর একটি কারখানা এবং জল¯্রােতের ওপর কুয়াশার ছবি দেখেন।’ রবার্ট বার্নস মাতাল অবস্থায় তার সর্বোৎকৃষ্ট রচনা লিখে গেছেন।

কিন্তু আপনাকে এটাও মনে করিয়ে দিই যে এমন পুরুষদের অনেকেই শেষকালে নিজেদের ধ্বংস করেছে। প্রকৃতি তার নিজস্ব কায়দায় পুরুষের মনকে উত্তেজিত করার সুযোগ দিয়েছে। আপনি নিরাপদে আপনার মনকে উত্তেজিত করতে পারেন এবং দ্বিগুণ উৎসাহে আপনার কাজ সম্পন্ন করতে পারেন। আপনি যদি আপনার মধ্যকার যৌনশক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন তবে এই উত্তেজনা আপনার মধ্যে এমন এক স্পন্দন তৈরি করতে পারে যা আপনাকে দূরদর্শী এবং বিচক্ষণ চিন্তা করতে সক্ষম করবে। আপনার মাথায় স্বাভাবিক অবস্থায় কখনো এমন চিন্তা সৃষ্টি হবে না। আপনি মদ পান করতে পারেন, ঘুমের ঔষধ খেতে পারেন, অন্য যেকোন কৃত্রিম জিনিস দিয়ে নিজেকে উত্তেজিত করতে পারেন। কিন্তু প্রকৃতি থেকে প্রদত্ত উত্তেজনার পরিবর্তে আপনি কোন সন্তোষজনক প্রতিস্থাপক পাবেন না। প্রকৃতি থেকে প্রদত্ত উত্তেজক, ‘১০টি মন উত্তেজক’ সম্পর্কে আপনি একটু আগেই জেনেছেন।

বিশ্ব শাসিত হয়েছে এবং সভ্যতার ভাগ্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এমন পুরুষদের দ্বারা যারা তাদের এই ‘১০টি মন উত্তেজক’কে নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছে। বেশির ভাগ মানুষ কারণ দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে তাদের ‘আবেগ’ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে কাজ করে। এটা প্রতিভাবান মানুষ জানে। তাই তারা তাদের মনের সৃজনশীল অনুষদকে তাদের আবেগ দ্বারা কাজে লাগায়। তবে তাদের আবেগ থাকে তাদের নিয়ন্ত্রণে। আর এই আবেগের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী হচ্ছে যৌনশক্তি। সেখানে আরও অন্যান্য মন উত্তেজকও রয়েছে। কিন্তু সেগুলোর সব মিশ্রণও যৌনশক্তির সামনে কিছু না।

একটি মন নানা ধরনের উত্তেজক দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে। এই প্রভাব হয়তো সাময়িক হবে; না হয় চিরস্থায়ী হবে। এতে করে হয়তো আপনার চিন্তার স্পন্দনও বৃদ্ধি পাবে। কিন্তু কৃত্রিম সবকিছুরই একটি ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া আছে এবং এর দীর্ঘমেয়াদি ব্যবহার আপনার বড় ধরনের কোন ক্ষতি করতে পারে। তবে এখানে যে ‘১০টি মন উত্তেজক’ সম্পর্কে বলা হয়েছে সেগুলো প্রাকৃতিক এবং এগুলো আমরা প্রতিনিয়তই প্রয়োগ করে থাকি। এই উৎসের মাধ্যমে একজন হয়তো অসীম বুদ্ধিমত্তার সাথে ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে আসতে পারে অথবা নিজের ইচ্ছায় যখন দরকার তখন তার নিজের অবচেতন মনের ভা-ারে প্রবেশ করতে পারবে। এমনকি সে অন্য ব্যক্তির অবচেতন মনের ভা-ারেও প্রবেশ করতে পারবে। আর এই সেই পদ্ধতি যা দ্বারা একজন প্রতিভাবান সৃষ্টি হয়।

এখন একজন শিক্ষকের কথা জানাই, যিনি প্রায় ৩০ হাজারের উপর বিক্রয়কর্মীকে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। এই প্রশিক্ষণ দিতে গিয়ে তিনি একটি বিস্ময়কর আবিষ্কার করেন যে উচ্চভাবে যৌনশক্তি সম্পন্ন পুরুষ অধিক দক্ষ বিক্রয়কর্মী। ব্যাখ্যা হচ্ছে, আমরা যে ব্যক্তিত্বকে ‘ব্যক্তিগত চুম্বকত্ব’ বলে জানি তা আর কিছু না, তা হচ্ছে যৌনশক্তি। আমরা অনেক সময় যেমন বলি, ‘তার ব্যক্তিত্বের মধ্যে একটা আকর্ষণ আছে।’ এটাই ‘ব্যক্তিগত চুম্বকত্ব।’ আর এই ব্যক্তিগত চুম্বকত্ব বা আকর্ষণ শক্তি গঠিত হয় কেবল উচ্চ যৌনশক্তির বদৌলতে। উচ্চ যৌনশক্তি সম্পন্ন মানুষের আকর্ষণ শক্তি সবসময়ই বেশি থাকে। যখন তারা তাদের এই মহান শক্তিকে, যৌনশক্তিকে সঠিকভাবে বোঝে এবং নিয়ন্ত্রণ করে তখন এটা তাদের জন্য এক মহা সুবিধাজনক আকর্ষণ শক্তিতে পরিণত হয়। তারা লোকজনের সাথে সম্পর্ক বজায় রাখতে এবং প্রভাব বিস্তার করতে এই শক্তির ব্যবহার করে। এই শক্তির কিছু বাস্তবিক ব্যবহার এবং প্রয়োগ নি¤েœ দেখানো হলো। যাতে করে আপনিও নিজের মধ্যে যৌনশক্তির মহান দিক কাজে লাগাতে পারেন:

১। করমর্দন বা হাত ধরে পরস্পর শুভেচ্ছা বিনিময়। হাতের স্পর্শ নির্দেশ করে তাৎক্ষণাৎ চুম্বকত্বের উপস্থিতি বা এর অভাব। আপনি খুব সহজেই একজনের সাথে করমর্দন করে তার আকর্ষণ শক্তি সম্পর্কে বুঝতে পারবেন।

২। কণ্ঠের স্বর। যৌনশক্তি বা যৌন আকর্ষণ হচ্ছে সেই ব্যাপার যার সাথে কণ্ঠ রঙিন হয়ে ওঠে বা কণ্ঠকে সংগীতময় এবং মনোহর করে তোলে।

৩। দেহ এবং ভাবভঙ্গি। উচ্চ যৌনশক্তি সম্পন্ন মানুষ স্ফূর্তি এবং লাবণ্যতা নিয়ে শান্তভাবে চলাফেরা করে।

৪। চিন্তার স্পন্দন। উচ্চ যৌনশক্তি সম্পন্ন লোকজন তাদের যৌন অনুভূতিকে তাদের চিন্তার সাথে নিজ ইচ্ছায় মিশ্রণ করতে পারে এবং এভাবেই তারা তাদের আশেপাশের সবাইকে প্রভাবিত করে।

৫। দৈহিক সৌন্দর্য। যারা উচ্চ যৌনশক্তি সম্পন্ন তারা তাদের ব্যক্তিগত উপস্থিতি সম্বন্ধে খুব সতর্ক থাকে। তারা সাধারণত এমন এক ধরনের পোশাক নির্বাচন করে যা তাদের ব্যক্তিত্ব, শারীরিক গঠন, গায়ের চামড়ার রঙ প্রভৃতির সাথে সংগতিপূর্ণ।

যখন কোন একটি কোম্পানি তাদের পণ্য বিক্রয়ের জন্য বিক্রয়কর্মী নিয়োগ দেয় তখন কোম্পানির ব্যবস্থাপক কর্মীদের মধ্যে এই ব্যক্তিগত চুম্বকত্বের গুণ খোঁজে। এই জিনিস প্রথমেই খেয়াল করা হয়। যাদের যৌনশক্তির অভাব রয়েছে তারা কখনো কোন কাজে আগ্রহী হয়ে উঠতে পারে না অথবা অন্যদের আগ্রহে অনুপ্রেরণা দিতে পারে না। আর আগ্রহ হচ্ছে বিক্রয়বিদ্যায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সূত্র। একজন কী বিক্রয় করছে তা কোন ব্যাপারই না। যদি তার আগ্রহ থাকে, তবে সে নিশ্চয়ই তাতে সাফল্য অর্জন করবে।

একজন বিক্রয়কর্মী, বক্তা বা উকিল যে যেই পেশায় থাকুক না কেন তার যদি যৌনশক্তির অভাব থাকে তবে সে অন্যদেরকে প্রভাবিত করার ক্ষেত্রে ‘অকৃতকার্য’ হবে। এই ব্যাপারের সাথে আমি আরও একটু যোগ করি, অধিকাংশ মানুষকে শুধু তাদের অনুভূতির একটি আবেদন দ্বারা প্রভাবিত করা যায়। এতে করে আপনি বুঝতে পারবেন যে একজন বিক্রয়কর্মীর সামর্থ্য বৃদ্ধিতে যৌনশক্তির গুরুত্ব কতটা। যারা বিক্রয়বিদ্যায় গুরু তারা তাদের এই বিশেষ দক্ষতা অর্জন করেছে। কারণ তারা হয় সচেতনভাবে; না হয় অসচেতনভাবে, তাদের যৌনশক্তিকে বিক্রয় আগ্রহে রূপান্তরিত করেছে! এই বিবৃতির মাধ্যমে আপনি নিশ্চয়ই যৌনশক্তিকে কর্মশক্তিতে রূপান্তরের প্রকৃত কারণ বুঝতে পেরেছেন।

যে বিক্রয়কর্মী যিনি জানে যে কীভাবে তার মনকে যৌন বিষয় থেকে বিরত রাখা যায় এবং একে বিক্রয় প্রচেষ্টার দিকে নির্দেশিত করা যায় এত আগ্রহ এবং দৃঢ়সংকল্পের সাথে যতটা তিনি এর প্রকৃত উদ্দেশ্যে প্রয়োগ করতেন, তিনিই যৌনশক্তি রূপান্তরের আদর্শ পুরুষ। যদিও তিনি এটা জেনে বা না জেনেও করতে পারে। অধিকাংশ বিক্রয়কর্মীরা যারা তাদের যৌনশক্তিকে রূপান্তর করেন, তারা এটা সম্পর্কে না জেনেই করে থাকেন। তারা কী করছেন এবং এটা তারা কীভাবে করছেন এই রূপান্তর সম্বন্ধে তাদের ন্যূনতম সচেতনতা ব্যতীতই তারা কাজ করে থাকেন।

যৌনশক্তিকে রূপান্তর করতে প্রচ- ইচ্ছাশক্তির দরকার। যাদের ইচ্ছাশক্তি প্রবল তারা খুব সহজেই যৌনশক্তিকে রূপান্তরের ক্ষমতা অর্জন করে। আপনি যদি যৌনশক্তিকে রূপান্তর করতে চান তবে আপনার ইচ্ছাশক্তিকে প্রবল করে তুলুন। আপনার চেষ্টার চেয়ে আপনার ফলাফল অনেক বেশি, অনেক বড় পুরস্কার নিয়ে আসবে।

যৌনতা সম্পর্কে অনেক লোকই জানে না। অনেকেই এই বিষয়ে অজ্ঞ। এজন্য যৌনতার যে একটি মহান দিক রয়েছে সেই সম্পর্কে কেউ বুঝতে পারে না। এই অজ্ঞতার কারণে যৌনতাকে পুরোপুরি ভুল বোঝা হয়, কুৎসা প্রচার করা হয় এবং অজ্ঞ ও দুষ্ট ব্যক্তিদের দ্বারা অপমান করা হয়। এদের দ্বারা যৌনতা শব্দ এত বেশি ব্যবহার করা হয়েছে যে আজ আমাদের ভদ্র সমাজে এই শব্দ কদাচিৎ ব্যবহৃত হয়। যেসব পুরুষ ও নারী উচ্চ পর্যায়ের যৌনশক্তি দ্বারা আর্শীবাদপ্রাপ্ত তাদেরকে ভিন্ন চোখে দেখা হয়। যেন বাঘ-ভাল্লুক দেখছে। তাদেরকে আর্শীবাদপ্রাপ্ত না ডেকে, ডাকা হয় অভিশপ্ত বলে।

এমনকি আজ এই আলোকপ্রাপ্ত যুগেও লাখো মানুষ এই মিথ্যা বিশ্বাসের কারণে হীনতামন্যতায় ভোগে। এই মিথ্যা বিশ্বাস যে উচ্চ পর্যায়ের যৌন প্রকৃতি হচ্ছে একটি অভিশাপ। এর কারণে কতশত মানুষের প্রাণ দিতে হয়েছে। আমার কথার ভুল বুঝবেন না। আমি যৌনশক্তির মহান গুণকে পরিচিত করানোর চেষ্টা করছি। কিন্তু তারমানে এই নয় যে এই বিবৃতি লম্পট ব্যক্তিদের কর্মকে সঠিক বলে ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। যৌন অনুভূতি কেবল তখনই একটি গুণে পরিণত হয় যখন এটা বুদ্ধিমত্তা এবং নিয়ন্ত্রেণের সাথে ব্যবহৃত হয়। এর হয়তো অপপ্রয়োগ হতে পারে এবং যা প্রায়ই হয়ে থাকে। একে উন্নত করার পরিবর্তে একে ভূগর্ভে নামানো হয়। উভয় শরীর এবং মনের দিক থেকে এর অপব্যবহার হয়। এই শক্তির অধিকতর ভালো প্রয়োগ করাই হচ্ছে এই অধ্যায়ের বিষয়।

আমি যখন ইতিহাস থেকে বেছে বেছে মহান নেতাদের নির্বাচন করে বিশ্লেষণ করলাম, তখন আমি একটি গুরুত্বপূর্ণ জিনিস আবিষ্কার করলাম। আমি দেখলাম যে প্রত্যেক মহান পুরুষই একজন নারী দ্বারা অনুপ্রাণিত। বেশির ভাগ দৃষ্টান্তে নারীরা ছিল একজন বিনীত নারী, আত্মত্যাগী বউ, যার সম্বন্ধে জনগণ খুব কমই জানে বা কিছুই জানত না। এমন উদাহরণ খুব কমই পেয়েছি যেখানে পুরুষরা নিজেদের বউ ভিন্ন ‘অন্য কোন নারী’ দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছে। হয়তো এমন উদাহরণ আপনার কাছেও অজানা নয়।

যৌন আচরণে অসহিষ্ণুতা বা অধৈর্যতা হচ্ছে খাবার এবং মদ জাতীয় পানীয় পানের অসহিষ্ণু আচরণের মতো। পৃথিবীতে একমাত্র মানুষই সেই প্রাণী যে এই কাজে প্রকৃতির উদ্দেশ্যকে ব্যহত করেছে। অন্যান্য প্রত্যেক প্রাণী যৌনতাকে সংযম বা ধৈর্যের সাথে পালন করে এবং প্রকৃতির নিয়ম মেনে নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করে। যেখানে অন্য সব প্রাণী শুধু ‘নির্দিষ্ট ঋতুতে’ যৌনতায় সাড়া দেয়, সেখানে মানুষ মনের ঝোঁকবশত ‘যেকোন ঋতুতে’ যৌনতার ঘোষণা দেয়।

প্রত্যেক বুদ্ধিমান ব্যক্তিই জানে যে অতিরিক্ত মদ এবং ঘুমের ঔষধ সেবন করলে কী উত্তেজনা ঘটে। এটা এমন এক ধরনের অসহিষ্ণুতা তৈরি করে যা দেহের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গকেও ধ্বংস করতে পারে। এমনকি মস্তিষ্কেরও ক্ষতি সাধন করতে পারে। তেমনি মানুষ এও জানে যে, যৌনতার অতিরিক্ত প্রশয়দান এমন এক অভ্যাসে পরিণত হতে থাকে যা সৃজনশীল প্রচেষ্টাকে ধ্বংস করে। ঠিক যেমন করে মদ এবং ঘুমের ঔষধ জাতীয় জিনিস।

একজন যৌনাসক্ত মানুষ একজন মাদকাসক্ত মানুষ থেকে খুব বেশি ভিন্ন নয়। তারা উভয়ই তাদের ইচ্ছাশক্তি এবং বিবেকের নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে। তারা তাদের মনের যুক্তিগত অংশ বা যে অংশ অন্যায় করতে বাধা দেয় সেই অংশের নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে। এর চেয়েও খারাপ দিক আছে। এটা তাকে সাময়িক বা চিরতর বিচার-বুদ্ধিহীনতার দিকে নিয়ে যেতে পারে। এমন মানুষ সাময়িকভাবে বা চিরতরে নিজের বিচারবুদ্ধি হারিয়ে ফেলে। এমনকি এটা চিকিৎসা বিজ্ঞান দ্বারাও সমর্থিত। অনেক স্নায়ুবিক রোগের নথিপত্র বিশ্লেষণের পর দেখা গেল যে এসব রোগের মূল কারণ যৌন ক্রিয়া সম্বন্ধে অজ্ঞতা। ¯œায়ুবিক রোগ বলতে কিছু কাল্পনিক অসুস্থতাকে বোঝায়। এটা অনেকটা কল্পরাজ্যে বিরাজ করা। এই কল্পরাজ্যে বিচরণ যখন অতিমাত্রায় চলে যায়, তখন এটা ব্যক্তির নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। আর এ সবকিছুর শুরুই হয় যৌন ক্রিয়া সম্বন্ধে অজ্ঞতা থেকে।

এই সংক্ষিপ্ত বিবরণ থেকে আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন যে যৌনশক্তি রূপান্তর বিষয়ের ওপর অজ্ঞতা কত বড় বিপদ ডেকে আনতে পারে। এটা যেমন এক দিকে প্রচুর ক্ষতির দিকে ঠেলে দিতে পারে, আবার ঠিক একইভাবে অপর দিকে আপনি যদি যৌনশক্তি রূপান্তরের বিষয়ে জানেন, তবে এটা আপনাকে মহান পর্যায়ে উন্নীত করবে।

যৌনশক্তি রূপান্তর বিষয়ের ওপর আমাদের এই সর্বব্যপী অজ্ঞতার কারণ হচ্ছে এই বিষয় ঘিরে এক ধরনের রহস্য এবং কুয়াশা বিরাজমান। কিছু দুষ্ট বুদ্ধির লোক তাদের নিজেদের স্বার্থে এই রহস্য এবং কুয়াশা সৃষ্টি করেছে। আপনি যখন একটি শিশুকে কিছু নিতে মানা করলে সে আরও বেশি করে সেই জিনিস ধরতে যায়, ঠিক তেমনভাবে আমাদের তরুণরাও আচরণ করে। তাদেরকে নিষেধ করার ফলে তারা এই রহস্যময় এবং কুয়াশাবৃত ব্যাপারকে জানতে চায়। ফলাফলে তাদের আগ্রহ বৃদ্ধি পায় এবং এই ‘অস্পষ্ট’ বিষয়ের প্রতি আরও জ্ঞান অর্জনের ইচ্ছা জাগে। আমি আইন প্রণয়নকারী এবং অনেক ডাক্তারদের প্রতি ধিক্কার জানাই। কারণ তাদের এত উচ্চ প্রশিক্ষণ এবং শিক্ষা থাকা সত্ত্বেও আমাদের এই তরুণরা এই বিষয় সম্বন্ধে সহজে তথ্য পায় না।

ঠিক এজন্যই কদাচিৎ একজন ব্যক্তি ৪০ বছরের পূর্বে তার পেশাগত ক্ষেত্রে উচ্চ পর্যায়ের সৃজনশীল প্রচেষ্টা লাভ করতে পারে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা গেছে তারা ৪০-৬০ এর মধ্যবর্তী সময়ে তাদের এই সৃজনশীল ক্ষমতাকে ব্যবহারের সুযোগ পায়। আমি এই বিবৃতি রচনা করেছি হাজারো পুরুষ ও নারীকে বিশ্লেষণ করে। আমি খুব মনোযোগের সাথে তাদেরকে লক্ষ করেছি। দেখা যায় তারা ৪০ এর আগেই সফল হওয়ার খুব চেষ্টা করে। কারণ ‘বৃদ্ধ হয়ে যাবার ভীতি’। তারা যখন ৪০ এর কাছাকাছি থাকে তখন এই ভীতি আরও বেশি বিস্তৃতি লাভ করে। তবে যারা এই ভীতিকে জয় করে তারা ৪০-৫০ বছরের মধ্যবর্তী বছরকে অসাধারণভাবে কাজে লাগায়। আপনার মনে রাখা উচিত যে এই বয়স হচ্ছে অনেক অভিজ্ঞ এক বয়স। এই সময় হচ্ছে অনেক কর্মময় এক সময়। যারা ৪০ বছর পার করেছে তারা অনেক অভিজ্ঞতা লাভ করেছে, অনেক কাজ করেছে, এখনই তো সময় সেই কাজকে, অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগানোর এবং সাফল্যের চূঁড়ায় পৌঁছানোর। পুরুষদের উচিত এই বয়সে পৌঁছানো এবং বয়সের ভয়ে কম্পিত না হয়ে; বরং আশা এবং আগ্রহের সাথে তাই করা যা সে করতে চায়।

যদি আপনি সাক্ষ্য-প্রমাণ চান যে অধিকাংশ পুরুষ ঠিক কোন বয়সে তাদের সর্বোৎকৃষ্ট কাজ করেছে, তবে আপনি আপনার দেশের সবচেয়ে সফল পুরুষদের জীবনী অধ্যয়ন করে দেখুন। হেনরি ফোর্ড সাফল্য অর্জনে ‘তার পা ফেলতে’ পারেনি যতক্ষণ পর্যন্ত না তিনি ৪০ বছর বয়স পার করেছেন। বিখ্যাত ইস্পাত ব্যবসায়ী এন্ড্রু কার্নেগিকেও তার প্রচেষ্টার ফলাফল পেতে ৪০ পার করতে হয়েছিল। জেমস জে. হিল  তো ৪০ বছর বয়সেও একটি টেলিগ্রাফের চাবি ঘুরাচ্ছিলেন। অথচ পরবর্তীতে তার কর্মের কারণে তাকে ডাকা হত সা¤্রাজের নির্মাতা বলে। তিনি আমেরিকার উত্তরে রেলওয়ের রাস্তা নির্মাণ করেন, যার দৈর্ঘ্য ছিল ১৩ হাজার ৪৬৭ কি.মি.। একে বলা হয় ‘গ্রেট নর্দান রেলওয়ে (ইউএস)’ । তার বিস্ময়কর অর্জন এই বয়সের পরেই জায়গা নেয়। আমেরিকা বা বিশ্বের যেকোন শিল্পপতি এবং বিনিয়োগকারীর জীবনী এই সাক্ষ্যে পূর্ণ হয়ে রয়েছে যে ৪০-৬০ বছর বয়সের সময়কাল হচ্ছে পুরুষদের সর্বাধিক মুনাফাজনক বয়স, সাফল্য তৈরির জন্য উৎপাদনক্ষম বয়স।

৩০-৪০ এর মধ্যবর্তী বছরে একজন পুরুষ যৌনশক্তি রূপান্তরের শিল্প শিখতে আরম্ভ করে (যদি সে কখনো শেখে)। সাধারণত এই আবিষ্কার হয় আকস্মিকভাবে। আবার যে এটা আবিষ্কার করে এবং গঠন করে সেও তা গঠন করে এটা সম্পর্কে পুরোপুরি না জেনেই। সে হয়তো পর্যবেক্ষণ করে যে তার অর্জন করার ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে ৩৫-৪০ বছরের মাঝামাঝিতে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায় সে এই পরিবর্তনের কারণের সাথে পরিচিত নয়। যে পদ্ধতিতে প্রকৃতি একজন পুরুষের মধ্যে ভালোবাসা এবং যৌন অনুভূতিকে সমসুরে তৈরি করতে আরম্ভ করে সেটি ৩০-৪০ এর মধ্যবর্তী বছরে আরম্ভ হয়। এতে করে সে এই মহান বলকে চিনতে পারে এবং এদেরকে একত্রিত করে, এই সম্বলিত শক্তিকে কাজে প্রয়োগ করতে পারে।

যৌনতা একাই একটি শক্তিশালী উত্তেজক। এটা আমাদেরকে আমাদের কাজকর্মের প্রতি এমন শক্তি দেয় যেন জলচ্ছ্বাস। প্রায়ই দেখা যায় এটা নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। কিন্তু যখন আপনি যৌন অনুভূতির সাথে ভালোবাসার অনুভূতি মিশ্রিত করবেন তখন উদ্দেশ্যের নিশ্চিন্ততা, ধার্মিকতা, বিচারে দক্ষতা এবং সাম্য শুরু হয়। যে ব্যক্তি ৪০ বছরে পা রেখেছে এবং এটা বুঝতে অসমর্থ, সে দুর্ভাগ্যবান এবং সে তার নিজ অভিজ্ঞতাকেও বিশ্লেষণ করতে ব্যর্থ।

যখন একজন পুরুষ নারীকে সন্তুষ্ট করার ইচ্ছায় পরিচালিত হয় তখন সে শুধু যৌন আবেগের ওপর নির্ভরশীল। যদিও সে মহান সাফল্য অর্জনে সক্ষম হতে পারে। কিন্তু তার কর্ম হয়তো অসংগঠিত, বিকৃত এবং পুরোপুরি ধ্বংসাত্মক। যখন একজন পুরুষ নারীকে সন্তুষ্ট করার আকাক্সক্ষায় পরিচালিত হয়; আর এটা যদি হয় কেবল যৌন অভিপ্রায়ের ভিত্তিতে, তবে একজন পুরুষ হয়তো চুরি করে, প্রতারণা করে, এমনকি খুনও করে। কিন্তু যখন তার যৌন আবেগের সাথে ভালোবাসার আবেগ মিশ্রিত হয়, তখন ঠিক একই পুরুষ তার কর্মকে আরও সাধুতা, সাম্য এবং যুক্তির সঙ্গে প্রয়োগ করে।

অপরাধ বিজ্ঞানীরা এই আবিষ্কার করেন যে সর্বাধিক কঠিন অপরাধীরাও একজন নারীর ভালোবাসার প্রভাবে পুনঃগঠিত হতে পারে। সেখানে এমন কোন তথ্য নেই যে একজন অপরাধী কেবল যৌন প্রভাব দ্বারা পুনঃগঠিত হয়েছে। আমরা সবাই এই ব্যাপার কম-বেশি জানি; কিন্তু এর কারণ অজানা। পুনর্গঠন যদি আসে, তবে তা হবে হৃদয়ের মাধ্যমে অথবা পুরুষের অনুভূতিশীল দিক থেকে আসে। তার মাথার দ্বারা নয় বা তার মস্তিষ্কের যৌক্তিক অংশ থেকে নয়। পুনর্গঠন মানে ‘হৃদয়ের একটি পরিবর্তন।’ একজন ব্যক্তি হয়তো মস্তিষ্কের যৌক্তিক অংশের জন্য কিছু পরিবর্তন হতে পারে। তার ব্যক্তিগত আচরণে কিছু পরিবর্তন আনতে পারে যাতে সে কিছু অনাকাক্সিক্ষত প্রভাব থেকে দূরে থাকতে পারে। কিন্তু প্রকৃত পুনর্গঠন আসে কেবল হৃদয়ের একটি পরিবর্তন দ্বারা, পরিবর্তন হওয়ার একটি আকাক্সক্ষা দ্বারা।

ভালোবাসা, প্রেম এবং যৌনতা, এই ৩টি হচ্ছে অনুভূতির মধ্যে সর্বাধিক চালনা করতে সক্ষম অনুভূতি। যা একজন ব্যক্তিকে সর্বোচ্চ সাফল্যের শিখরে পৌঁছাতে পারে। ভালোবাসা হচ্ছে সেই অনুভূতি যা নিরাপদ বাতির মতো জ্বলে এবং সাম্য, পবিত্রতা ও গঠনমূলক প্রচেষ্টা নিশ্চিত করে। যখন একজনের মধ্যে এই ৩টি অনুভূতি মিশ্রিত হয় তখন সে একজন প্রতিভাবান রূপে উন্নীত হয়। যারা ভালোবাসার অনুভূতি সম্বন্ধে জানে না তাদের মধ্যকার বেশির ভাগকে পাওয়া যায় কোন ধরনের ধ্বংসাত্মক কাজে জড়িত বা অন্ততপক্ষে এমন কোন কাজে জড়িত যার ভিত্তি অন্যের প্রতি সাম্য এবং ন্যায়বিচার অনুযায়ী নয়। এমন হাজারো লোককে খুঁজে পাওয়া যাবে যারা ব্যবসা-বাণিজ্য এবং শিল্প-কারখানায় তাদের অনুসারী ব্যক্তিদের অধিকার নির্মমভাবে হরণ করছে। আপনি দেখবেন তাদের মধ্যে এই জ্ঞানের অভাব। পাঠক নিজেও এমন লোকজনের একটি তালিকা তৈরি করতে পারেন।

অনুভূতি হচ্ছে মনের অবস্থা। প্রকৃতি ব্যক্তিকে একটি ‘রাসায়নিক মন’ দিয়েছে, যা বস্তু রসায়নের মৌলিক সূত্রের মতোই পরিচালিত হয়। এটা খুব ভালোভাবেই আমাদের জানা যে একজন রসায়নবিদ যদি একাধিক রাসায়নিক দ্রব্য মিশ্রণ করে তবে তা মারাত্মক বিষাক্ত কিছু হয়ে উঠতে পারে। আবার সেই একই রাসায়নিক দ্রব্য যদি পরিমাণ ঠিক রেখে মেশানো হয়, তবে তা আর ক্ষতিকর হবে না। অনুভূতিও ঠিক একই রকম। যেকোন অনুপাতে মেশালে তা একটি মারাত্মক বিষ সৃষ্টি করবে। যৌনতা ও হিংসা, ঠিক এই অনুভূতি যখন মিশ্রিত হয় তখন একজন ব্যক্তি একটি বিচার-বুদ্ধিহীন পশুতে পরিণত হয়।

একটি রাসায়নিক দ্রবণে যেমন একটি ভুল দ্রব্যেরও মিশ্রণ পুরো দ্রবণকে বিষাক্ত করে তোলে তেমন আমাদের মনেও যদি একটি ধ্বংসাত্মক বা একাধিক নেতিবাচক অনুভূতির উপস্থিতি থাকে তবে তা আমাদের মনকে বিষাক্ত করে তোলে, আমাদের মনের সাম্য এবং ন্যায়বিচারের ধারণাকে ধ্বংস করে। এমনকি এই অনুভূতি ভুল পরিমাণের মিশ্রণ যদি বেশি হয়ে যায় তবে চরম পরিস্থিতি ঘটতে পারে। এই ধরনের মিশ্রণ একজনের মনের মধ্যে বেঁচে থাকার ইচ্ছাও নষ্ট করে দেয়।

একজন প্রতিভাবান গঠিত এবং উন্নত হয় ভালোবাসা, প্রেম ও যৌনতার প্রয়োগ ও নিয়ন্ত্রণের কারণে। সংক্ষিপ্তভাবে এই প্রক্রিয়াকে যদি বর্ণনা করি তবে এটা হবে:

এই অনুভূতিগুলোর উপস্থিতিকে উৎসাহিত করুন যেন এটা একজনের মনের কর্তৃত্বশীল তরঙ্গে পরিণত হয়। আর সব ধরনের ধ্বংসাত্মক অনুভূতিকে নিরুৎসাহিত করুন। মন হচ্ছে অভ্যাসের দাস। অভ্যাস দ্বারা মনকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। একে যে ধরনের চিন্তা বেশি বেশি খাওয়ানো হয় তা দিয়েই অভ্যাস গড়ে ওঠে। আর চিন্তা করতে বা একে নিয়ন্ত্রণ করতে ইচ্ছাশক্তি ব্যবহার করতে হয়। একজন ব্যক্তি তার ইচ্ছাশক্তি দিয়ে সব ধরনের নেতিবাচক অনুভূতিকে নিরুৎসাহিত করতে পারে। ইচ্ছাশক্তি দিয়ে মনের নিয়ন্ত্রণ নেওয়া যায়। এটা কঠিন কিছু নয়। এই নিয়ন্ত্রণ আসবে অধ্যবসায় এবং অভ্যাস দ্বারা। নিয়ন্ত্রণের রহস্য নিহিত রয়েছে যৌনশক্তি রূপান্তরের প্রক্রিয়া বোঝার মধ্যে। যখন কোন নেতিবাচক অনুভূতি একজনের মনে প্রকাশ পায় তখন একে একটি ইতিবাচক বা গঠনমূলক অনুভূতিতে রূপান্তরিত করা যেতে পারে। আর এটা করতে হয় রূপান্তরের পদ্ধতি দ্বারা।

আত্ম-প্রচেষ্টার সহায়তা ব্যতীত প্রতিভাবান হওয়ার অন্য কোন পথ নেই! একজন ব্যক্তি হয়তো শুধু যৌন শক্তির পরিচালিত ক্ষমতা দ্বারা আর্থিক বা ব্যবসায়িক সাফল্যের শিখরে পৌঁছাতে পারে; কিন্তু ইতিহাসে এমন অনেক প্রমাণ আছে যে এ ধরনের ব্যক্তিরা সাধারণত এমন চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বহন করে যা তার সাফল্য ধরে রাখা বা সাফল্য উপভোগ করার সামর্থ্য চুরি করে নেয়। তাই যৌনশক্তি রূপান্তরের পদ্ধতির পর্যবেক্ষণ, চিন্তা এবং ধ্যান খুবই মূল্যবান। এই বিবৃতি পুরুষদের জন্য যেমন সত্য তেমন নারীদের জন্যও সত্য। এই অজ্ঞতার কারণে হাজারো পুরুষ তাদের সুখ থেকে বঞ্চিত। হতে পারে তারা ধনী, কিন্তু তারপরেও তারা প্রকৃত সুখ থেকে বঞ্চিত।

আমাদের মানসিকতার ওপর ভালোবাসা এবং যৌনতা নামক অনুভূতি এক ধরনের অমোচনযোগ্য দাগ ছেড়ে যায়। সত্যি বলতে এই দাগ এতটা স্পষ্ট যে লোকজন এটা তাদের চেহারাতেই দেখতে পায়। যে ব্যক্তি ভাবাবেগের ঝড়ে পরিচালিত হয়, শুধু যৌন আকাক্সক্ষার ওপর ভিত্তি করে পরিচালিত হয় সে পুরো পৃথিবীকে এই ব্যাপার দেখায়। তার চোখের চাহনি দ্বারা এবং তার মুখের ভাবভঙ্গি দ্বারা এটা স্পষ্ট ফুটে ওঠে। যখন যৌন অনুভূতির সাথে ভালোবাসার অনুভূতি মিশ্রিত হয় তখন এটা মুখের প্রকাশ ভঙ্গিকে নরম করে, বিনীত এবং সৌন্দর্যম-িত করে। এটা দেখার জন্য কোন চরিত্র বিশ্লেষক লাগে না। আপনি লোকজনের চেহারা একটু ভালো করে লক্ষ করলেই তা দেখতে পাবেন।

ভালোবাসার অনুভূতি ব্যক্তির শৈল্পিক এবং রুচিজ্ঞান সম্পন্ন স্বভাবকে বের করে আনে ও উন্নত করে। এটা একজনের হৃদয়ে গভীরে ছাপ রেখে যায়। এমনকি আপনার ভালোবাসার মানুষ আপনাকে ছেড়ে গেলেও ভালোবাসার সেই অসাধারণ অনুভূতি দীর্ঘদিন রয়ে যায়। স্মৃতিময় এই ভালোবাসা আপনাকে কখনো ছেড়ে যায় না।

ভালোবাসার স্মৃতি কখনো মুছে যায় না। এটা বিদ্যমান থাকে, নির্দেশিত করে এবং প্রভাবিত করে। ভালোবাসার সেই উৎস না থাকলে তার বহু বছর পরও ভালোবাসার অনুভূতি থাকে। এটা নতুন কিছু না। প্রত্যেক ব্যক্তি, যিনি প্রকৃত ভালোবাসার ছোঁয়া পেয়েছেন তিনি জানেন যে এটা মানব হৃদয়ে এক ধরনের স্থায়ী ছাপ রেখে যায়। ভালোবাসার প্রভাব স্থায়ী। কারণ ভালোবাসা প্রকৃতিগতভাবে আত্মিক এক ব্যাপার। যে ব্যক্তি ভালোবাসা দ্বারা সাফল্যের মহান পর্যায়ে পৌঁছাতে পারেনি সে আশাহীন, সে মৃত। যদিও তাকে বাহ্যিক দিক থেকে জীবন্ত মনে হয় তবুও সে আশাহীন, সে মৃত।

এমনকি ভালোবাসার স্মৃতিও একজনকে সৃজনশীল প্রচেষ্টার দিকে পরিচালিত করতে যথেষ্ট। ভালোবাসার শক্তি হয়তো খরচ হয়ে গেছে এবং এখন হয়তো সেই ভালোবাসা নেই। আগুন যেমন জ্বলে নিঃশেষ হয়ে যায়। কিন্তু শেষ হয়ে গেলেও এটা সাক্ষ্য স্বরূপ একটা আমোচনীয় দাগ রেখে যায় যে এটা এই পথে বয়ে গেছে। এটার ত্যাগ করে যাওয়াটা প্রায়ই পুরুষের হৃদয়কে একটা মহান ভালোবাসার জন্য প্রস্তুত করে।

আপনার বিগত দিনগুলোতে ফিরে যান। সেই জায়গায় চলে যান যেখানে ছিল সূর্যের নরম আলো, সবুজ ঘাসের ওপর শিশির কণা এবং বকুল ফুলের ঘ্রাণ। আপনার মনকে অতীত ভালোবাসার সুন্দর স্মৃতিতে সিক্ত করুন। এটা আপনাকে আপনার আজকের অস্বস্তি এবং বিরক্তকর প্রভাবকে শীতল করতে সহায়তা করবে। এটা আপনাকে জীবনের বিষাদময়তা থেকে পলায়নের একটা উৎস দিবে এবং কে জানে, এটা হয়তো আপনার মনকে এমনভাবে বশীভূত করবে যে আপনি আপনার সাময়িক অস্বস্তি ভুলে গিয়ে মহান কোন কাজে উদ্বুদ্ধ হবেন। হয়তো এর ফলে আপনার সমস্যা সমাধানে পরিবর্তিত হবে। হয়তো এটা আপনার জীবনের সম্পূর্ণ আত্মিক অবস্থানই বদলে দিতে পারে।

যদি আপনি নিজেকে দুর্ভাগা বলে বিশ্বাস করেন, কারণ আপনি ‘একজনকে ভালোবেসে ছিলেন এবং তাকে হারিয়ে ফেলেছেন’। মুছে ফেলুন এই চিন্তা। আপনি যদি সত্যিকার অর্থেই একজনকে ভালোবেসে থাকেন, তবে তাকে কখনো সম্পূর্ণভাবে হারাতে পারেন না। ভালোবাসা অদ্ভুত এবং অভিমানী। এর প্রকৃতি ক্ষণস্থায়ী। এটা যখন আসে তখন এতে সন্তুষ্ট হোন এবং একে উপভোগ করুন। যতক্ষণ এটা থাকে ততক্ষণ একে পুরোপুরি ভালোবাসুন। কিন্তু এটা চলে যাবে বা হারিয়ে যাবে এটা নিয়ে চিন্তা করে সময় নষ্ট করবেন না, উদ্বিগ্ন হবেন না। উদ্বিগ্নতা কখনো একে ফিরিয়ে আনতে পারবে না।

আর এই চিন্তাও বাদ দিন যে ভালোবাসা কেবল একবার আসে। ভালোবাসা বহুবার আসতে পারে, আবার যেতে পারে। তবে দুই ভালোবাসার অভিজ্ঞতা কখনো এক রকম নয়। সেখানে হয়তো এবং সাধারণত এটাই হয় যে একটা ভালোবাসার অভিজ্ঞতা হৃদয়ে এত গভীর ছাপ রেখে যায় যে আর অন্য কোন ভালোবাসার অভিজ্ঞতাই চোখে পড়ে না। তখন মানুষ ক্রুদ্ধ হয়ে পড়ে এবং রূঢ় হয়ে যায় যে কেন আমার ভালোবাসা আমাকে ত্যাগ করল।

ভালোবাসার ওপর কোন হতাশা থাকা উচিত নয় এবং এটা থাকবে না যদি লোকজন ভালোবাসা ও যৌন অনুভূতির মধ্যে পার্থক্য বুঝতে পারে। এদের মধ্যে প্রধান পার্থক্য হচ্ছে ভালোবাসা আত্মিক আর যৌনতা জৈবিক। ভালোবাসা যখন মানব হৃদয়কে স্পর্শ করে তখন স্পর্শ ঘটে এক আত্মিক শক্তি রূপে। আর আত্মিক শক্তি কখনো কারও ক্ষতির কারণ হয়ে উঠতে পারে না। কিন্তু অজ্ঞতা বা হিংসা দ্বারা ক্ষতি হতে পারে।

প্রশ্নাতীতভাবে ভালোবাসা হচ্ছে জীবনের সবচেয়ে বড় অভিজ্ঞতা। এটা একজন পুরুষকে অসীম বুদ্ধিমত্তার সাথে যোগাযোগ করিয়ে দেয়। যখন ভালোবাসা যৌনতা এবং প্রেম নামক অনুভূতির সাথে মিশ্রিত হয়, তখন এটা একজনকে সৃজনশীল স্তরের শিখরে পৌঁছে দেয়। ভালোবাসা, যৌনতা এবং প্রেম নামক অনুভূতি হচ্ছে একজন প্রতিভাবান সৃষ্টির মূল উপাদান। প্রকৃতি আর অন্য কোন পথে প্রতিভাবান সৃষ্টি করে না।

ভালোবাসা একটি অনুভূতি যার অনেক দিক আছে, বহু রঙ এবং ছায়া আছে। একজন তার অভিভাবকদের জন্য বা তার সন্তানের জন্য যে ভালোবাসা অনুভব করে; আর একজন তার প্রেয়সীর জন্য যে ভালোবাসা অনুভব করে তার থেকে ভিন্ন। একটি হচ্ছে যৌন অনুভূতিসহ মিশ্রিত ভালোবাসা; আর অন্যটি তা নয়।

ভালোবাসা যা একজন সত্যিকারের বন্ধুত্বে অনুভব করে তা আবার প্রেয়সীর জন্য, অভিভাবক বা সন্তানের জন্য যে ভালোবাসা অনুভব করে তা থেকে ভিন্ন। কিন্তু এটাও ভালোবাসার একটি ধরন।

আবার, প্রাণহীন বস্তুর প্রতিও ভালোবাসার অনুভূতি রয়েছে। যেমন প্রকৃতির সৌন্দর্যের প্রতি ভালোবাসা। কিন্তু ভালোবাসার ধরনের মধ্যে সবচেয়ে গভীর এবং জ্বলন্ত হচ্ছে সেই অভিজ্ঞতা যখন ভালোবাসা ও যৌন অনুভূতি মিশ্রিত হয়। বিশেষ করে বিয়ের মাধ্যমে পুরুষ-নারীর সম্পর্ক যদি ভালোবাসার ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে আবদ্ধ না হয়, যতক্ষণ পর্যন্ত না সঠিকভাবে এবং আনুপাতিক হারে যৌনতা মিশ্রিত হয় ততক্ষণ পর্যন্ত সংসারে সুখ আসে না। সংসারে একা ভালোবাসা কখনো সুখ আনতে পারে না। আবার একা যৌনতাও পারে না। যখন এই দুইটি সুন্দর অনুভূতি একে অপরের সাথে মিশে যায় তখন বিবাহিত সংসার মনের এমন এক অবস্থা তৈরি করে যা আত্মিকতার সর্বাধিক কাছে পৌঁছে যায়, তখন হয়তো একজন এই পৃথিবীতে স্বর্গের সাক্ষাৎ পায়।

যখন এই ভালোবাসা এবং যৌনতার সাথে প্রেম অনুভূতি যুক্ত হয় তখন ব্যক্তির সসীম মন ও অসীম বুদ্ধিমত্তার মধ্যকার বাধা দূর হয়ে যায়।

তারপরই জন্ম নেয় এক প্রতিভাবান!

এটা এমন এক ব্যাখ্যা যা হয়তো সঠিকভাবে বুঝতে পারলে অনেক বিবাহিত সংসারে সুখ আনবে। এই বুঝজ্ঞানের অভাবে সংসারে প্রায়ই বিশৃঙ্খলা লেগে থাকে। প্রায়ই দেখা যায় একে অপরের সম্পর্কতে বিরক্তি এবং ঝগড়া দেখা যায়। এগুলো ঘটে কারণ হচ্ছে যৌন জ্ঞানের অভাবে। যেখানে ভালোবাসা, প্রেম ও অনুভূতির সঠিক বুঝজ্ঞান এবং যৌন ক্রিয়ার সহিষ্ণুতা বা ধৈর্য বিরাজ করে, সেখানে বিবাহিত লোকের মধ্যে কোন সহযোগিতামূলক মনোভাবের অভাব হয় না, সুখের অভাব হয় না।

সেই স্বামী সত্যিকার অর্থেই সৌভাগ্যবান যার বউ ভালোবাসা, যৌনতা এবং প্রেমের অনুভূতির মধ্যে বিদ্যমান সম্পর্ক বুঝতে পারে। যখন একজন পুরুষ বা নারী এই তিনটি পবিত্র অনুভূতি দ্বারা সঞ্চালিত হবে তখন কোন আকারের শ্রমই বোঝা মনে হবে না। কারণ প্রকৃতিতে শ্রমের সর্বনিম্ন চেষ্টাও লওয়া হয়ে থাকে ভালোবাসার জন্য।

প্রাচীনকাল থেকে বলা হয়, ‘একজন ব্যক্তির বউ তাকে গড়তেও পারে, আবার ভাঙতেও পারে।’ কিন্তু কারণ সবসময় বোধগম্য হয়ে উঠেনি। ‘গড়া’ বা ‘ভাঙা’ হচ্ছে ভালোবাসা, যৌনতা এবং প্রেম অনুভূতির প্রতি বউয়ের বোধগম্যতার ফলাফল বা বোধগম্যতার অভাব।

এই ব্যাপার সত্ত্বেও পুরুষরা বহুগামী। তাদের এই অতি প্রাকৃতিক জৈবিক গুণ উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত। ব্যাপার হচ্ছে, এটা সত্য যে একজন পুরুষ বহুগামী হতে পারে। কিন্তু এটাও সমানভাবে সত্য যে একজন পুরুষের ওপর তার বউয়ের প্রভাব সবচেয়ে বেশি। যদি একজন নারী ভালোবাসা, যৌনতা এবং প্রেম অনুভূতির মিশ্রণ সঠিকভাবে ঘটাতে পারে তবে সেই প্রভাব ছিন্ন করার সাধ্য কোন পুরুষের নেই।

এটাও সত্য যে অন্য কোন নারী এত মহান প্রভাব ফেলতে পারে না যতটা একজন ব্যক্তির ওপর তার বউ প্রভাব ফেলতে সক্ষম। অবশ্য পুরুষটি যদি এমন একজন নারীকে বিয়ে করে যে তার চারিত্রিক প্রকৃতির জন্য সম্পূর্ণরূপে অনুপযোগী, তাহলে ভিন্ন কথা। যদি একজন নারী তার স্বামীকে তার প্রতি আগ্রহ হারাতে অনুমতি দেয় এবং অন্যান্য নারীর প্রতি বেশি আগ্রহী হতে অনুমতি দেয়, তবে এটা হয় সাধারণত যৌনতা, ভালোবাসা এবং প্রেম বিষয়ের প্রতি তার অজ্ঞতা বা অনীহার কারণে। এই বিবৃতি থেকে ধরে নেওয়া যায় যে প্রকৃত ভালোবাসা একদা একজন পুরুষ এবং তার বউয়ের মধ্যে বিদ্যমান ছিল। ব্যাপারটি পুরুষের ক্ষেত্রেও সমানভাবে সত্য। যে স্বামী তার বউকে নিজের প্রতি আগ্রহ হারাতে অনুমতি দেয় এবং অন্যান্য পুরুষের প্রতি বেশি আগ্রহী হতে অনুমতি দেয় তাও ঘটে যৌনতা, ভালোবাসা এবং প্রেম বিষয়ের প্রতি তার অজ্ঞতা বা অনীহার কারণে।

বিবাহিত লোকেরা প্রায়ই সাধারণ এবং নগণ্য বিষয় নিয়ে ঝগড়া করে। এগুলো যদি ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করা দেখা হয়, তবে আপনি দেখবেন এর প্রকৃত কারণ হচ্ছে উপরোক্ত বিষয়ের প্রতি অজ্ঞতা বা অনীহা।

পুরুষের সবচেয়ে মহা প্রেরণাদায়ী শক্তি হচ্ছে নারীকে সন্তুষ্ট করার আকাক্সক্ষা! শিকারীরা যারা অতীত ইতিহাসের দিনে রাজত্ব করেছে, সভ্যতার আরম্ভের দিনগুলোতে, তা করেছিল কারণ তাদের আকাক্সক্ষা ছিল যে তারা নারীর চোখে মহান হবে। এই দিক থেকে পুরুষের প্রকৃতি আজও পরিবর্তন হয়নি। ‘শিকারী’ আজকে ঘরে বন্য প্রাণীদের ছাল আনে না; কিন্তু সে তার আকাক্সক্ষা নির্দেশ করে নারীর জন্য ভালো কাপড়, যান্ত্রিক গাড়ি এবং ধনসম্পদ দ্বারা। নারীকে সন্তুষ্ট করার প্রতি পুরুষের এই আকাক্সক্ষা সভ্যতার শুরুতে যেমন ছিল এখনও তেমনি আছে। পরিবর্তন যা হয়েছে তা হচ্ছে সন্তুষ্ট করার পদ্ধতিতে পরিবর্তন হয়েছে, এই যা। পুরুষরা আজও মহান সৌভাগ্য অর্জন করে, ক্ষমতা এবং খ্যাতির শিখরে পৌঁছায়। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে তাদের আকাক্সক্ষা যে তারা নারীদের সন্তুষ্ট করবে।

তাদের জীবন থেকে নারীদের বের করে নিন, বেশির ভাগ পুরুষের ক্ষেত্রে দেখবেন তাদের মহান সম্পদ অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়বে। এটা হচ্ছে নারীকে সন্তুষ্ট করার পুরুষের সেই অন্তর্নিহিত আকাক্সক্ষা যা নারীকে শক্তি দেয় একজন পুরুষকে গড়তে বা ভাঙতে।

একজন নারী যে পুরুষের প্রকৃতি এবং উপহার দেওয়ার কৌশল সম্বন্ধে বোঝে, অন্য নারীর সাথে তার প্রতিযোগিতা করার কোন ভয় নেই। পুরুষরা হয়তো তাদের আদম্য ইচ্ছাশক্তি দ্বারা ‘দানব’ হতে পারে যখন তারা অন্য পুরুষদের সাথে সম্পর্ক বজায় রাখে, কিন্তু তারা খুবই সহজভাবে পরিচালিত হয় তাদের নির্বাচিত নারীর দ্বারা।

বেশির ভাগ পুরুষ এটাতে সম্মত হয় না যে তারা সহজে তাদের পছন্দের নারীর দ্বারা প্রভাবিত হন, কারণ পুরুষের প্রকৃতির মধ্যে একটি চাওয়া রয়েছে যে সে জীবকূলের মধ্যে শক্তিশালী রূপে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। আরও হচ্ছে, বুদ্ধিমান নারী এই ‘পুরুষালি গুণ’ চিনতে পারে এবং খুবই দক্ষভাবে এটা নিয়ে কোন সমস্যা তৈরি করে না।

কিছু পুরুষ জানে যে তারা তাদের নির্বাচনকৃত নারীর দ্বারা প্রভাবিত হন; তাদের বউ, প্রেমিকা, মা অথবা বোনের দ্বারা। কিন্তু তারা কৌশলে এই প্রভাবের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে বিরত থাকে। কারণ তারা এটা বুঝতে যথেষ্ট বুদ্ধিমান যে কোন পুরুষ সঠিক নারীর কিছুটা রূপান্তরিত প্রেরণা ব্যতীত সুখী বা সম্পূর্ণ হতে পারে না। যে পুরুষ এই গুরুত্বপূর্ণ সত্য বুঝতে পারে না সে নিজেকে সেই শক্তি থেকে বঞ্চিত করে যা তাকে সাফল্য অর্জনে আরও বেশি সহায়তা করতে পারত। অন্য যেকোন শক্তির মিশ্রণের চেয়েও এই বুঝজ্ঞান আপনাকে অধিক প্রেরণা দিবে।

এখন আমরা পড়ব অবচেতন মনের ক্ষমতা নিয়ে। আমাদের অবচেতন মন এমন এক জায়গা, এমন এক ক্ষেত্র যেখান থেকে আমরা আমাদের আকাক্সক্ষাকে বাস্তবে পরিণত করতে অসীম বুদ্ধিমত্তার সহায়তা নিতে পারি।


 




অধ্যায় - ১২

অবচেতন মন

সংযোগকারী অংশ

ধনী হওয়ার ক্ষেত্রে এগারোতম ধাপ


অবচেতন মন গঠিত হয়েছে সচেতনতার ক্ষেত্র দ্বারা, যেখানে পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের দ্বারা প্রতিটি চিন্তা তরঙ্গ পৌঁছায়, শ্রেণি বিভক্ত হয়, সংরক্ষিত হয় এবং যেখান থেকে চিন্তাকে ডাকা যায় বা উঠানো যায়। যেমন এক বাক্স চিঠির মধ্য থেকে প্রয়োজনীয় চিঠি তুলে নেওয়া যায়।

এটা চিন্তার ধরন অনুযায়ী বিভিন্ন ধরনের চিন্তাকে গ্রহণ করে এবং নথিভুক্ত করে। আপনি আপনার আকাক্সক্ষাকে আপনার অবচেতন মনে যেকোন চিন্তা, উদ্দেশ্য বা পরিকল্পনা আকারে রোপণ করতে পারেন। অবচেতন মন সাধারণত সেই আকাক্সক্ষাতে ক্রিয়া করে যেগুলো আবেগ এবং বিশ্বাস দ্বারা মিশ্রিত। আপনার আকাক্সক্ষায় যতবেশি আবেগ থাকবে, আপনি আপনার আকাক্সক্ষার ওপর যতবেশি বিশ্বাস এবং আস্থা স্থাপন করবেন, আপনার অবচেতন মন ততবেশি এটা পূরণ করতে আপনাকে পথ দেখাবে।

এর সাথে আকাক্সক্ষা অধ্যায়ে দেওয়া নির্দেশনা পাঠ করুন। সেখানে ৬টি ধাপ গ্রহণের জন্য বলা হয়েছে এবং উক্ত নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে আপনার পরিকল্পনা গঠন এবং সম্পাদন করার জন্য। আপনি যদি নির্দেশনা সঠিকভাবে পালন করেন তবে আপনি নিশ্চয়ই এর গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারবেন।

অবচেতন মন দিনরাত কাজ করে। এটা মানুষের অজানা এক পদ্ধতির মাধ্যমে কাজ করে। অবচেতন মন অসীম বুদ্ধিমত্তার ক্ষমতার দিকে নিয়ে যায় যাতে একজন মানুষ তার আকাক্সক্ষা পূরণের জন্য শক্তি পায়। এটা আরও আপনাকে এমন এমন বাস্তবিক পথ বা উপায় দেখায় যা অনুসরণ করে আপনি আপনার আকাক্সক্ষা পূরণ করতে পারবেন।

আপনার অবচেতন মনকে আপনি সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন না। কিন্তু আপনি এর কাছে সহায়কভাবে কোন আকাক্সক্ষা, উদ্দেশ্য বা পরিকল্পনা দিতে পারেন। অবচেতন মনকে ব্যবহারের নির্দেশনা পুনরায় পাঠ করুন, যা স্বপরামর্শ অধ্যায়ে দেওয়া হয়েছে। এটা ভালো করে বুঝুন। তারপর নির্দেশনা প্রয়োগ করুন।

অবচেতন মন হচ্ছে ব্যক্তির সসীম মন এবং অসীম বুদ্ধিমত্তার মধ্যকার সংযোগকারী অংশ। এই বক্তব্যের প্রতি অনেক বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ আছে। এটা হচ্ছে সেই মাধ্যম যেখানে একজন মানুষ অসীম বুদ্ধিমত্তার ক্ষমতার প্রতি আকর্ষণ সৃষ্টি করতে পারে। এটা একাই সেই গোপন পদ্ধতি বহন করে যা দ্বারা মানসিক তরঙ্গ এর আত্মিক সমতুল্যে বিশেষিত এবং পরিবর্তিত হয়। এটা একাই সেই মাধ্যম যার দ্বারা আমাদের প্রার্থনা সেই উৎসের কাছে গিয়ে পৌঁছায় যে আমাদের প্রার্থনার জবাব দিতে সক্ষম।

সৃষ্টিশীল প্রচেষ্টার সম্ভাবনা অবচেতন মনের সাথে প্রচ- এবং ভারহীনভাবে সংযুক্ত। তারা একজন ব্যক্তিকে ভয় মিশ্রিত শ্রদ্ধার সাথে অনুপ্রাণিত করে।

সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো যে অবচেতন মন হচ্ছে ব্যক্তির চিন্তাশীল মন এবং অসীম বুদ্ধিমত্তার মধ্যে সংযোগ মাধ্যম। এটা এমন এক মাধ্যম যেখানে ব্যক্তিচিন্তার ‘কারণ ও যৌক্তিক অংশ’ প্রায় অকার্যকর হয়ে যায়। ধরুন, একজন ক্যান্সারের রোগীর রোগ নিরাময়ের জন্য আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করা হলো এবং রোগী ভালো হয়ে গেল। চিকিৎসা বিজ্ঞানে এই ধরনের ঘটনা অনেক আছে যা ব্যক্তিচিন্তার ‘কারণ ও যৌক্তিক অংশকে’ হার মানায়। সাধারণ মানুষ, এমনকি বড় বড় চিকিৎসকও এর কোন কারণ বলতে পারে না। ঠিক একই ধরনের শক্তি আপনি আপনার অর্থের প্রতি আকাক্সক্ষা পূরণ করতে প্রয়োগ করতে পারেন। দরকার কেবল বিশ্বাস, এই আস্থা যে আল্লাহ আমাকে পথ দেখাবেন, যাতে করে আমি আমার আকাক্সক্ষাকে বাস্তবে পরিণত করতে পারি।

আপনি একে একটা বাস্তবতা রূপে গ্রহণ করার পর, অবচেতন মনের অস্তিত্ব এবং এর সম্ভাবনা বোঝার পর, এটা আপনাকে এমন এক বুঝজ্ঞান দিবে যাতে করে আপনি আপনার আকাক্সক্ষাকে বাস্তবে পরিণত করতে পারবেন। আপনি আকাক্সক্ষা অধ্যায়ে দেওয়া নির্দেশনার তাৎপর্য পুরোপুরি হৃদয়ংগম করতে পারবেন। আপনি আরও বুঝতে পারবেন যে কেন আপনাকে বারবার সতর্ক করা হয়েছে, কেন আপনাকে আপনার আকাক্সক্ষাকে পরিষ্কারভাবে কাগজে লিখতে বলা হয়েছে। আপনি আরও বুঝতে পারবেন যে কেন এই নির্দেশনা বহন করতে অধ্যবসায়ের প্রয়োজন।

এ বইয়ে যে ১৩টি সূত্র ব্যবহার করা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে ‘সাফল্য দর্শনের’ অংশ। এই সূত্রাবলি হচ্ছে আপনার নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাবার ব্লুপ্রিন্ট। এগুলো আপনাকে সেই শক্তি এবং ক্ষমতা দিবে যার দ্বারা আপনি আপনার অবচেতন মনকে আপনার লক্ষ্য পূরণের জন্য প্রভাবিত করতে পারবেন। যদি আপনি প্রথমবার চেষ্টা করে না পারেন তবে নিরুৎসাহিত হবেন না। মনে রাখবেন, অবচেতন মনকে আয়ত্ত করা যায় কেবল অভ্যাসের মাধ্যমে, যা আস্থা অধ্যায়ে বর্ণিত। আপনার এখনও আস্থার ওপর কর্তৃত্ব করার মতো সময় হয়নি। ধৈর্য ধরুন। অধ্যবসায়ী হোন। আপনি পারবেন।

আস্থা এবং স্ব-পরামর্শ অধ্যায়ের অনেক ভালো বিবৃতি এখানে পুনরায় বিবৃত হবে। এটা আপনার অবচেতন মনের লাভের জন্য। মনে রাখবেন, আপনার অবচেতন মনকে আপনি সহায়তার মাধ্যমে কাজে লাগাবেন। অনেকটা ধরি মাছ না ছুঁই পানির মতো। সরাসরি তো যাওয়া যায় না। তাই সচেতন মনের মাধ্যমে, বারবার নিজের আকাক্সক্ষাকে বলে বলে অবচেতন মনে সহায়কভাবে নিজের আকাক্সক্ষাকে পৌঁছাতে হয়। এবার আপনাকে ভিন্ন এক পথ দেখাই। অবচেতন মনে যদি আপনি ইচ্ছাকৃতভাবে, সহায়কভাবে নিজের আকাক্সক্ষাকে না পৌঁছান তাতেও কিন্তু সেখানে চিন্তা তরঙ্গ যায়। এগুলো কী ধরনের চিন্তা তরঙ্গ? এগুলো হচ্ছে ভয়ভীতি, ব্যবসায় ক্ষতি হতে পারে, আপনি ধার-দেনায় পড়বেন, দরিদ্রতায় ডুবে যাবেন এমন ধরনের আরও অনেক নেতিবাচক চিন্তায় আপনার সচেতন মন ভরে যায়। তখন ধীরে ধীরে এই নেতিবাচক চিন্তা আপনার অবচেতন মনে পৌঁছায় এবং অবচেতন মন একে ধরে ফেলে। অবচেতন মন ঠিক এই চিন্তাকে বাস্তব করতে আপনাকে পথ দেখায় এবং আপনি না জেনেই সেই কাজ করেন যাতে আপনার ক্ষতি হবে। অবচেতন মন ইতিবাচক বা নেতিবাচক চিন্তা কোনটার মধ্যেই পার্থক্য করে না। আপনি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে ইতিবাচক চিন্তা, আপনার আকাক্সিক্ষত চিন্তা প্রবেশ না করান তবে এটা নেতিবাচক চিন্তা গ্রহণ করবে এবং একে বাস্তবে পরিণত করার পথ দেখিয়ে দিবে। আপনি যেমন খাবার দিবেন তেমন ফলাফল পাবেন।

আবারও বলি, অবচেতন মন অলস বসে থাকে না! যদি আপনি আপনার অবচেতন মনে আপনার আকাক্সক্ষা রোপণ করতে ব্যর্থ হন, তবে এটা আপনার অবহেলার দরুন বা উদাসীনতার ফলে যেকোন চিন্তাকে গ্রহণ করবে। আমরা ইতোমধ্যেই ব্যাখ্যা করেছি যে উভয় নেতিবাচক এবং ইতিবাচক চিন্তা তরঙ্গ সমানভাবে অবচেতন মনে প্রবেশ করতে থাকে। এই সম্পর্কিত ৪টি উৎস নিয়েও যৌনশক্তি রূপান্তরের রহস্য অধ্যায়ে বর্ণনা করা হয়েছে।

এটা মনে রাখুন যে আপনি আপনার প্রতিদিনকার জীবন থেকে যে চিন্তা তরঙ্গ আপনার অবচেতন মনে পাঠাবেন সে চিন্তা তরঙ্গই আপনার অবচেতন মনে পৌঁছাবে। এখন এটা আপনি ইচ্ছাকৃতভাবেও পাঠাতে পারেন। আর আপনি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে নাও পাঠান, তাতেও অবচেতন মনে সমানভাবে চিন্তা তরঙ্গ যেতে থাকে। এই তরঙ্গের কিছু যায় নেতিবাচক, কিছু যায় ইতিবাচক। আপনি এখন তেল প্রবাহের মতো নেতিবাচক তরঙ্গকে বন্ধ করার চেষ্টায় রত হয়েছেন এবং আপনার অবচেতন মনকে আপনার আকাক্সক্ষা অনুযায়ী ইতিবাচক তরঙ্গের দ্বারা প্রভাবিত করার চেষ্টা করছেন।

যখন আপনি এটা অর্জন করবেন তখন আপনি এমন এক চাবিকাঠির অধিকারী হবেন যা আপনার অবচেতন মনের দরজা খুলে দিবে। অধিকন্তু, আপনি সেই দরজাকে নিয়ন্ত্রণ করবেন এমনভাবে যে কোন অনিচ্ছাকৃত চিন্তা আপনার অবচেতন মনে প্রবেশ করতে পারবে না।

মানুষ যা কিছু সৃষ্টি করেছে তার সবকিছুই একটি চিন্তা তরঙ্গ থেকে শুরু। একজন পুরুষ যদি তার চিন্তায়, তার কল্পনায় কোনকিছু সৃষ্টি করতে না পারে, তবে সে তা বাস্তবেও পরিণত করতে পারে না। কল্পনার সহায়তার মাধ্যমে চিন্তা তরঙ্গ পরিকল্পনায় সজ্জিত হয়। কল্পনা যখন নিয়ন্ত্রণের অধীনে থাকে তখন এমন পরিকল্পনা সৃষ্টি হয় যা একজনকে তার সাফল্যের দিকে নেতৃত্ব দেয়।

আপনি যে আকাক্সক্ষাকে বাস্তবে পরিণত করতে চান তা নিয়ে চিন্তা করুন। সেই চিন্তা তরঙ্গকে ইচ্ছাকৃতভাবে বারবার স্মরণ করুন। এগুলোকে অবচেতন মনের মধ্যে রোপণ করুন। তবে এগুলো বাস্তব হওয়ার আগে এগুলোকে অবশ্যই কল্পনার মধ্য দিয়ে গমন করতে হবে এবং আস্থার সাথে মিশ্রিত হতে হবে। একটি আকাক্সক্ষা বা পরিকল্পনাকে কল্পনার সাথে ‘মিশ্রিত’ করলে এবং এই পরিকল্পনায় বিশ্বাস রাখলে এটা সহজেই অবচেতন মনে প্রবেশ করে।

এই বিবৃতি থেকে আপনি সহজেই বুঝতে পারবেন যে অবচেতন মনে প্রবেশ করার জন্য ১৩টি সূত্রের সমন্বয় এবং এসব পদ্ধতির প্রয়োগ দরকার।

এই সত্যকে বুঝুন এবং তদানুযায়ী কাজ করুন। একজনের মন থেকে যে চিন্তা বের হয়, এটা তার অবচেতন মনের মধ্যে দৃঢ় এবং গভীরভাবে স্থাপিত থাকে, যেখানে চিন্তাগুলো একটি চুম্বক বা নকশার মতো থাকে যা দ্বারা অবচেতন মন প্রভাবিত হয়। তখন এগুলোকে তাদের বাহ্যিক সমতুল্যে রূপান্তরিত করা যায়। চিন্তা আসলেই প্রকৃত জিনিস। এই জন্য যে প্রত্যেক বস্তুগত জিনিসই চিন্তাশক্তি আকারে আরম্ভ হয়।

অবচেতন মন ‘অনুভূতি’ বা আবেগ মিশ্রিত চিন্তা তরঙ্গের দ্বারা সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হয়। আপনি যুক্তি দিয়ে, কারণ দিয়ে চিন্তা করতে পারেন। কিন্তু এটা বেশি দূর যাবে না। আপনি যখন আবেগ দিয়ে চিন্তা করবেন তখনই সেই চিন্তা অবচেতন মনে পৌঁছায়। আসলে এই তত্ত্বকে সমর্থন করার মতো একাধিক সাক্ষ্য আছে। শুধু আবেগম-িত চিন্তাই অবচেতন মনের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে। এটা খুব ভালোভাবেই জানা যে, আবেগ বা অনুভূতিই বেশির ভাগ মানুষকে চালিত করে। যদি এটা সত্যি হয় যে অবচেতন মন আবেগ মিশ্রিত চিন্তাতে অধিক দ্রুতভাবে সাড়া দেয় এবং বেশি প্রভাবিত করে তবে আপনি নিশ্চয়ই এবার আবেগ সম্পর্কে জানতে চান। সেখানে ৭টি প্রধান ইতিবাচক এবং নেতিবাচক আবেগ রয়েছে। খারাপ জিনিসের যেমন কোন সহযোগিতা লাগে না, তেমন নেতিবাচক চিন্তারও কোন সহযোগিতা লাগে না। এগুলো আপনাআপনিই অবচেতন মনে প্রবেশের রাস্তা করে নেয়। অবশ্য যদি-না আপনি ইতিবাচক চিন্তা দ্বারা নিজের মনকে সুদৃঢ় করে রাখেন। ইতিবাচক চিন্তাকে অবশ্যই ইচ্ছাকৃতভাবে প্রয়োগ করতে হবে, স্ব-পরামর্শের সূত্র দ্বারা। (এটা কীভাবে করবেন তা স্ব-পরামর্শ অধ্যায়ে বর্ণনা দেওয়া আছে।)

এই আবেগ বা অনুভূতির তরঙ্গ এক টুকরা রুটির মধ্যে অবস্থিত আটার মতো। কারণ তারা কাজ করতে মানুষের মধ্যে তাড়না সৃষ্টি করে। ঠিক এই চিন্তাই একজনের মধ্যকার নিষ্ক্রিয়তাকে সক্রিয় করে। এভাবে একজন বুঝতে পারবে যে কেন চিন্তা তরঙ্গকে আবেগ দ্বারা ভালোভাবে মিশ্রিত করা দরকার। এভাবে একজন বুঝতে পারবে যে কেন ঠান্ডা যুক্তির চেয়ে আবেগ তাড়িত হলে দ্রুত কাজ করা সম্ভব।

এখন পুরোপুরি বোঝার পর আপনি নিজেকে প্রস্তুত করেছেন এবং আপনার অবচেতন মনের ‘অভ্যন্তরীণ শ্রোতাকে’ নিয়ন্ত্রণ করছেন যাতে করে আপনি আপনার অর্থ আয় করার প্রতি যে আকাক্সক্ষা সেটাকে অবচেতন মনের হাতে দেওয়া যায়। এটা গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এতে করে আপনি বুঝতে পারবেন যে কীভাবে এই ‘অভ্যন্তরীণ শ্রোতার’ কাছে পৌঁছানো যায়। আপনাকে অবশ্যই এর ভাষায় কথা বলতে হবে; নতুবা এটা আপনার ডাক শুনবে না। এটা সর্বাধিক ভালো বোঝে আবেগ বা অনুভূতির ভাষা। আসুন আমরা এখানে ৭টি প্রধান ইতিবাচক আবেগের বর্ণনা পাঠ করি এবং ৭টি প্রধান নেতিবাচক আবেগকে দেখি। যাতে করে যখন আপনি আপনার অবচেতন মনকে নির্দেশনা দিবেন তখন যেন আপনি ইতিবাচকের দিকে নজর দিতে পারেন এবং নেতিবাচক আবেগ এড়িয়ে চলতে পারেন।


৭টি প্রধান ইতিবাচক আবেগ ৭টি প্রধান নেতিবাচক আবেগ

(এগুলো এড়িয়ে চলতে হবে)

আকাক্সক্ষা ভীতি

আস্থা হিংসা

ভালোবাসা ঘৃণা

যৌনতা প্রতিশোধ

গভীর আগ্রহ লোভ

প্রেম কুসংস্কার

আশা রাগ


আরও ইতিবাচক আবেগ রয়েছে, কিন্তু এগুলো হচ্ছে সর্বাধিক শক্তিশালী এবং সর্বাধিক মুখ্য যা সাধারণত সৃজনশীল প্রচেষ্টায় প্রয়োগ হয়। এই ৭টি আবেগের ওপর কর্তৃত্ব করলে (এগুলোর ওপর কর্তৃত্ব করা যায় শুধু প্রয়োগ দ্বারা, নিয়মিত চর্চা দ্বারা) এবং অন্যান্য ইতিবাচক আবেগ আপনার নির্দেশ মেনে চলবে। মনে রাখবেন, এই সংযোগ যে আপনি এ বইয়ে অধ্যয়ন করছেন যার অভিপ্রায় হচ্ছে আপনার মধ্যে একটি ‘অর্থ সচেতনতা’ গঠন করা, আপনাকে অবশ্যই ইতিবাচক আবেগ দিয়ে আপনার মনকে পরিপূর্ণ করতে হবে। একজনের মন যদি নেতিবাচক আবেগ দ্বারা পূর্ণ থাকে তবে সে কখনো একজন অর্থ সচেতন ব্যক্তি হতে পারে না।

ইতিবাচক এবং নেতিবাচক আবেগ একই সময়ে একটি মনের অধিকারী হতে পারে না। যেকোন একটিকে একটির ওপর অবশ্যই শাসন করতে হবে। এটা আপনার দায়িত্ব। এটা আপনি নিশ্চিত করবেন যে ইতিবাচক আবেগকে আপনার মনের শাসনকারী প্রভাব রূপে গঠন করবেন। এখানে অভ্যাস সূত্র আপনার সহযোগিতা করবে। ইতিবাচক আবেগকে অভ্যাস মতো প্রয়োগ করতে হবে। এগুলোকে প্রতিদিন চর্চা করতে হবে। অবশেষে, এগুলো আপনার মনকে এতটা সম্পূর্ণভাবে শাসন করবে যে নেতিবাচক আবেগ এতে প্রবেশই করতে পারবে না।

শুধু এই নির্দেশনা হুবহু অনুসরণ করলে এবং বিরামহীনভাবে পালন করলে, আপনি আপনার অবচেতন মনের ওপর নিয়ন্ত্রণ অর্জন করতে পারবেন। আপনার সচেতন মনে কোন একটি নেতিবাচক চিন্তার উপস্থিতিই আপনার অবচেতন মনের সব গঠনমূলক সহায়তাকে ধ্বংস করতে যথেষ্ট।

যদি আপনি বিশ্বাস করেন যে এই দর্শন অর্জন করা অনেক দূরের ব্যাপার। তবে মানব জাতির অতীত ইতিহাসের দিকে একবার নজর দিন। ২০০ বছর আগে মানুষ বিশ্বাস করত যে বজ্রপাত হচ্ছে সৃষ্টিকর্তার রাগের সাক্ষ্যপ্রমাণ এবং একে ভয় পেত। এখন মানুষের আস্থার ক্ষমতাকে ধন্যবাদ জানাই। কারণ আস্থার কারণেই মানুষ এই আলোকশক্তিকে সজ্জিত করেছে এবং একে কারখানার চাকা সচল রাখতে বিদ্যুৎশক্তিতে রূপান্তর করেছে। ২০০ বছর আগে মানুষ বিশ্বাস করত মহাশূন্যে গ্রহগুলোর মধ্যবর্তী স্থানে কিছু নেই। শুধু একটি শূন্য অবস্থা। এমন একটি জায়গা যা মৃত। এখন আবারও সেই একই আস্থার ক্ষমতাকে ধন্যবাদ জানাই। কারণ আস্থার কারণেই মানুষ আজ জানে যে এটা মৃত বা খালি নয়; বরং মহাশূন্যের গ্রহগুলোর মধ্যবর্তী স্থান অনেকটাই সজীব। এটা হচ্ছে স্পন্দনের সর্বোচ্চ আকার। যাকে চিন্তা স্পন্দনও বলা যায়। অধিকন্তু, মানুষ জানে যে এই জীবন্ত, কম্পনশীল এবং স্পন্দনশীল শক্তি বস্তুর প্রতিটি পরমাণুতে বিদ্যমান এবং মহাশূন্যের প্রত্যেক উপযুক্ত স্থান এই শক্তি দিয়ে ভরে আছে। এমনকি প্রত্যেক মানব মস্তিষ্ককে অন্য মানব মস্তিষ্কের সাথে এই একই শক্তি পরস্পরের সাথে যুক্ত রাখে।

কী কারণে লোকে বিশ্বাস করবে না যে ঠিক একই শক্তি প্রত্যেক মানব মস্তিষ্ককে অসীম বুদ্ধিমত্তার সাথে সংযুক্ত করে না?

মানুষের সসীম মন এবং অসীম বুদ্ধিমত্তার মধ্যে কোন ট্যাক্স নেওয়ার দরজা নেই। অসীম বুদ্ধিমত্তার সাথে যোগাযোগ করতে ধৈর্য, আস্থা, অধ্যবসায়, বুঝজ্ঞান এবং যোগাযোগের একটি একান্ত আকাক্সক্ষা ব্যতীত আর কিছুই খরচ হয় না। আপনি নিজে ছাড়া অন্য কাউকে দিয়ে এই যোগাযোগ করতে পারবেন না। কেবল আপনি স্বয়ং নিজেই এই যোগাযোগ করতে পারেন। কাউকে টাকাপয়সা দেওয়া মূল্যহীন। অসীম বুদ্ধিমত্তা একের পরিবর্তে অন্যের সাথে ব্যবসা করে না। হয় আপনাকে সরাসরি যেতে হবে; না হয় আপনার সাথে যোগাযোগ হবে না।

অসীম বুদ্ধিমত্তার সাথে যোগাযোগ করানোর জন্য যে চিন্তা আপনি ঠিক করে রেখেছেন সেগুলোকে অবশ্যই রূপান্তর করে দিতে হবে। এই রূপান্তর হতে হবে শুধু আপনার নিজের অবচেতন মন দ্বারা।

যে পদ্ধতি দ্বারা আপনি অসীম বুদ্ধিমত্তার সাথে যোগাযোগ করবেন এটা প্রায় রেডিওতে যোগাযোগ করার মতোই। যদি আপনি রেডিও এর কার্যনীতি সম্পর্কে বুঝতে পারেন, আপনি অবশ্যই পারবেন, এটা জানবেন যে শব্দ ইথারের মধ্য দিয়ে যোগাযোগ করতে পারে না যতক্ষণ না এটা এমন একটা স্পন্দন হারে ‘গঠিত হয়’ বা পরিবর্তিত হয় যা মানুষের কান ধরতে পারে না। রেডিও প্রেরণ স্টেশন মানুষের কণ্ঠের শব্দ তুলে নেয় এবং ‘ভেঙেচুরে’ বা কিছুটা বিশেষিত করে একে স্পন্দনের দশ লাখ ভাগে ভাগ করে। শুধু এই পথেই শব্দের স্পন্দন ইথারের সাথে যোগাযোগ করতে পারে। এই রূপান্তর স্থান নেওয়ার পর ইথার শক্তিকে ‘তুলে নেয়’ (যা প্রকৃতভাবে শব্দের স্পন্দন আকারে ছিল), বহন করে নিয়ে যায় গ্রাহক স্টেশনগুলোতে এবং এই গ্রাহক যন্ত্র সেই শক্তিকে পুনরায় এর প্রকৃত স্পন্দন হারে ‘গঠন’ করে যাতে এটা সেই আগের শব্দে চিনতে পারা যায়।

অবচেতন মন হচ্ছে মধ্যম সংস্থা। যা একজনের আকাক্সক্ষাকে এমন শর্তে রূপান্তর করে যা অসীম বুদ্ধিমত্তা চিনতে পারে। এমনভাবে বার্তাটি পাঠ করতে পারে এবং জবাব ফেরত আনতে পারে যাতে একটি নির্দিষ্ট পরিকল্পনা বা আইডিয়া আকারে আকাক্সক্ষাকে বাস্তবে ঘটানো যায়। এই সূত্রকে বুঝুন। তাহলেই আপনি আপনার আকাক্সক্ষাকে বাস্তবে রূপান্তরিত করতে পারবেন।

অসীম বুদ্ধিমত্তার কাছে পৌঁছাতে হলে আপনার প্রকৃত চিন্তা স্পন্দনকে এর আত্মিক স্পন্দনে রূপান্তরিত হতে হবে। আস্থা হচ্ছে একমাত্র জানা মাধ্যম যা আপনার চিন্তাকে আত্মিক প্রকৃতিতে পরিণত করবে। আস্থা এবং ভীতি এরা সিঙেল বিছানার বাসিন্দা। যেখানে একটি পাওয়া যায় সেখানে অপরটি থাকতে পারে না।

এখন আমরা মানবদেহের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ মস্তিষ্ক সম্পর্কে পাঠ করব। ছোট্ট একটি তথ্য জানিয়ে রাখি মস্তিষ্কের সেরেবাল করটেক্সে ১ হাজার কোটি থেকে ১ হাজার ৪০০ কোটি স্নায়ু কোষ রয়েছে। মস্তিষ্ককে যদি একটি কোম্পানি বিবেচনা করেন, তবে এর একেকটি কোষ একেকজন কর্মচারীর মতো। তাহলে বুঝতেই পারছেন আপনি কত বড় এক কোম্পানির স্বত্বাধিকারী। এখন সময় এসেছে নিজের কোম্পানিকে জানার, নিজের কোম্পানিকে নিজের দখলে নেওয়ার।


 




অধ্যায় - ১৩

মস্তিষ্ক

আমাদের চিন্তার প্রচারকারী এবং গ্রহণকারী স্টেশন

ধনী হওয়ার ক্ষেত্রে বারোতম ধাপ


২০ বছর আগে, পরলোকগত লেখক ড. আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেল এবং ড. এলমার আর. গেটসের সাথে আমার কাজ করার সৌভাগ্য হয়েছিল। তারা পর্যবেক্ষণ করেন যে প্রত্যেক মানুষের মস্তিষ্ক চিন্তা তরঙ্গের জন্য একই সাথে একটি প্রচারকারী এবং গ্রহণকারী স্টেশন।

রেডিও প্রচারকারী সূত্রের মতো প্রায় একইভাবে প্রত্যেক মানুষের মস্তিষ্ক চিন্তা তরঙ্গ ধরার জন্য সক্ষম যা অন্যান্য মস্তিষ্ক প্রকাশ করে।

পূর্ববর্তী অনুচ্ছেদের বিবৃতির সাথে সৃজনশীল কল্পনার বিবৃতি, যা কল্পনা অধ্যায়ে উদ্ধৃত হয়েছে তা যোগ করুন, তুলনা এবং বিবেচনা করুন। সৃজনশীল কল্পনা হচ্ছে মস্তিষ্কের ‘গ্রাহক অংশ’, যা অন্যদের মস্তিষ্ক দ্বারা প্রকাশিত চিন্তাকে গ্রহণ করে। এটা হচ্ছে যোগাযোগ সংস্থা। একজনের মনের সচেতন অংশ এবং ৪টি ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে যোগাযোগ সংস্থা গঠিত হয়, যেখান থেকে একজন তার চিন্তা তরঙ্গ গ্রহণ করে।

যখন এটা স্পন্দনের একটা উচ্চ হারে উদ্দীপ্ত হয় বা ‘গঠিত হয়’ তখন মন আরও বেশি চিন্তা স্পন্দন গ্রহণক্ষম হয়। এই ‘গঠন’ প্রক্রিয়া ইতিবাচক বা নেতিবাচক আবেগ দ্বারা সৃষ্টি হয়। আবেগের মাধ্যমে চিন্তা স্পন্দন আরও বৃদ্ধি পেতে পারে।

স্পন্দন যখন একটি উচ্চ পর্যায়ে পৌঁছায় কেবল তখনই ইথার তা গ্রহণ করে নেয়। এই ইথারের মাধ্যমেই তখন স্পন্দনগুলো এক মস্তিষ্ক থেকে আরেক মস্তিষ্কে বয়ে যায়। এটা অনেকটা রেডিও স্টেশন থেকে বার্তা যেমন এক স্টেশন থেকে অন্য সব রেডিওতে পৌঁছায়, ঠিক তেমন এক ব্যাপার। সাধারণ চিন্তা কিন্তু এই পর্যায়ে যেতে পারে না। তাই তা অন্য মস্তিষ্কেও পৌঁছাতে পারে না। কিন্তু যেসব চিন্তা প্রধান আবেগ দ্বারা কিছুটা বিশেষায়িত হয়, আলোড়িত হয় কেবল সেই চিন্তাই উচ্চ পর্যায়ে পৌঁছায় এবং এক মস্তিষ্ক থেকে অন্য মস্তিষ্কে যায়। এটাই হচ্ছে মস্তিষ্কের প্রচার ব্যবস্থা।

মানুষের প্রধান আবেগগুলোর মাথায় বা একদম উপরে হচ্ছে যৌন আবেগ। একে সবার উপরে দেওয়া হয়েছে কারণ এর গভীরতা এবং মানুষকে চালিত করতে এর প্রচ- শক্তি। যে মস্তিষ্ক যৌনাবেগ দ্বারা উত্তেজিত নয় আর যে মস্তিষ্ক যৌন আবেগ দ্বারা উত্তেজিত; ২টির মধ্যে যেটার সাথে যৌন আবেগ জড়িত সেটা তুলনামূলক বেশি চিন্তা স্পন্দন তৈরি করে এবং দ্রুত প্রচার ও গ্রহণ করে।

যৌনতা রূপান্তরের ফলাফল খুবই উচ্চমানের। যে মস্তিষ্ক যৌনাবেগ দ্বারা তাড়িত সে মস্তিষ্ক উচ্চ স্পন্দনের চিন্তা উৎপন্ন করতে সক্ষম। আর তার এই উচ্চ স্পন্দনের চিন্তাই সৃজনশীল কল্পনা দ্বারা গৃহীত হয়, যা ইথার তুলে নিতে সক্ষম। অপর পক্ষে, যখন একটি মস্তিষ্ক দ্রুত গতিতে স্পন্দিত হয় তখন এটা শুধু চিন্তা এবং আইডিয়াই আকর্ষণ করে না; বরং অন্যান্য মস্তিষ্ক থেকে ইথারের মাধ্যমে এটা নিজের প্রয়োজন অনুযায়ী চিন্তাও তুলে নেয়। এভাবে এটা অন্যের অবচেতন মন থেকেও নিজের জন্য দরকারি চিন্তাগুলো তুলে নিতে পারে।

এই পর্যন্ত, আপনি দেখেছেন যে প্রচার সূত্র হচ্ছে সেই ব্যাপার যেখানে আপনি আপনার চিন্তার সাথে আপনার অনুভব বা আবেগ মিশ্রিত করেন এবং এগুলোকে অবচেতন মনে পৌঁছে দেন।

অবচেতন মন হচ্ছে মস্তিষ্কের ‘প্রেরক স্টেশন’, যার মাধ্যমে চিন্তার স্পন্দন প্রচারিত হয়। সৃজনশীল কল্পনা হচ্ছে মস্তিষ্কের ‘গ্রাহক অংশ’ যার মাধ্যমে চিন্তা স্পন্দন ইথার থেকে তুলে নেওয়া হয়।

অবচেতন মনের গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার এবং সৃজনশীল কল্পনার সাথে এখন স্ব-পরামর্শের সূত্রটি বিবেচনা করুন। এতে করে আপনি আপনার মানসিক প্রচার কলকব্জার পুরো ব্যাপারের একটি ধারণা পাবেন। আপনি আরও বুঝতে পারবেন যে কীভাবে আপনি আপনার এই ‘প্রচারকারী স্টেশনকে’ কাজে লাগাতে পারেন।

স্ব-পরামর্শ অধ্যায়ে বর্ণিত নির্দেশনা আবার পাঠ করুন। সেখানে আপনাকে নির্দিষ্ট করে সেই পদ্ধতি সম্বন্ধে জানানো হয়েছে যা দ্বারা আকাক্সক্ষাকে এর আর্থিক সমতুল্যে রূপান্তর করা যেতে পারে।

আপনার মানসিক ‘প্রচারকারী স্টেশনের’ কর্মসূচি হচ্ছে একটি অপেক্ষাকৃত সহজ প্রক্রিয়া। আপনি যদি আপনার মনে আপনার প্রচারকারী স্টেশন ব্যবহার করতে চান, তবে আপনাকে ৩টি সূত্র ব্যবহার করতে হবে; অবচেতন মন, সৃজনশীল কল্পনা এবং স্ব-পরামর্শ। আপনার মধ্যে একটি নির্দিষ্ট আকাক্সক্ষাকে জ্বলন্ত করে তোলার দ্বারা আপনি এই ৩টি সূত্রকে কাজে লাগাতে পারবেন। এই সম্পর্কে আকাক্সক্ষা অধ্যায়ে বর্ণনা করা হয়েছে।


বিশ্বের মহান বলগুলো অস্পষ্ট, তা সহজে দেখা যায় না

আমরা এখন একটি হতাশপূর্ণ যুগে বাস করছি। শেয়ার বাজারের ধ্বসের কারণে আমাদের মধ্যে হতাশা বিরাজ করছে। আমরা এই হতাশার কারণে বিশ্বের মহান বলগুলোকে দেখতে পারছি না। যদিও মহান বলগুলো অস্পষ্ট, তা সহজে দেখা যায় না। আমরা এখন এমন এক যুগ পার করছি যেখানে মানুষ মানুষকে তার বাহ্যিক বেশভূষা দিয়ে বিবেচনা করে, যে যুগে মানুষ তার বাহ্যিক দৃষ্টির ওপর খুব বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। আমরা এমন এক যুগে বাস করছি যেখানে মানুষ কেবল যা চোখে দেখে, যা ছুঁতে পারে, ওজন এবং পরিমাপ করতে পারে তাই বোঝে; তার বাহিরেও যে বিশাল এক জগৎ আছে যা দ্বারা এই মহাবিশ্ব গঠিত তা বুঝতে পারে না অথবা বুঝতে চায় না।

কিন্তু এখন আমরা দেখব, এখান থেকে শিখব যে কী করে আমরা বিশ্বের মহান বলগুলো দেখতে পারি এবং আমাদের সুবিধার জন্য এগুলোকে ব্যবহার করতে পারি। এখান থেকেই আমাদের এক নতুন যুগের সূচনা হবে। আমরা ইতোমধ্যেই সেই বিস্ময়কর যুগে চলে এসেছি যেখানে আমরা বিশ্বের অস্পষ্ট শক্তি সম্বন্ধে জানব এবং এগুলো প্রয়োগ করব। হয়তো পুরোপুরি পারব না, কিন্তু চেষ্টা করব। যখন আমরা এই যুগ অতিবাহিত করব তখন আমরা দেখব যে আমার মধ্যকার ‘অন্য আমি’ আমার বাস্তব আমির চেয়েও বেশি শক্তিশালী।

কিছু সময় মানুষ অস্পষ্ট বলগুলোর কথা হালকাভাবে বলে। সেই বিষয় যা আমাদের পঞ্চ ইন্দ্রিয় দ্বারা উপলব্ধি করি না এবং যখন আমরা এ সম্পর্কে শুনি, তখন এটা আমাদের সবাইকে মনে করিয়ে দেয় যে আমরা সবাই এই বলগুলো দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছি যা অদেখা এবং অস্পষ্ট।

এই বলগুলোর সাথে প্রতিযোগিতা করা; অথবা অস্পষ্ট বলকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা পুরো মানব জাতিরও নেই। এই বলই সমুদ্রের ঢেউকে আন্দোলিত করে। অভিকর্ষ বলের মতো মহান বলকে বোঝা। এর ধারণ ক্ষমতা সম্পর্কে বোঝা খুব একটা সহজ কাজ নয়। এই ছোট্ট পৃথিবীকে বাতাস সহ ধরে রেখেছে। এই মহাজগতে এই ছোট্ট পৃথিবীকে শূন্যের মাঝে ভাসিয়ে রেখেছে। এই বলকে নিয়ন্ত্রণ করার মতো ক্ষমতা মানুষের নেই। মানুষ সম্পূর্ণরূপে বজ্রপাতের বিদ্যুতের কাছে অসহায়। সে জানে না যে বিদ্যুৎ কী, এটা কোথা থেকে আসে বা এর উদ্দেশ্য কী!


মস্তিষ্কের নাটকীয় ঘটনা

মানুষ, তার সব অহংকারী সংস্কৃতি এবং শিক্ষা দ্বারা চিন্তার অস্পর্শনীয় বল সম্বন্ধে খুব অল্পই বুঝতে পেরেছে অথবা বলা যায় বুঝতে পারেনি। অস্পর্শনীয় বলগুলোর মধ্যে চিন্তাই হচ্ছে সর্বশ্রেষ্ঠ। মানুষ তার দেহের মস্তিষ্ক সম্পর্কে খুব কমই জানে। মস্তিষ্কের যে একটি সুবিশাল যোগাযোগ ব্যবস্থা আছে যাতে চিন্তার ক্ষমতাকে বাস্তবে পরিণত করা যায়, এ সম্পর্কেও মানুষ খুব একটা জানে না। কিন্তু সে এখন এমন এক যুগে প্রবেশ করছে যেখানে এই বিষয়ের ওপর আলোকপাত করা হয়েছে। ইতোমধ্যে বিজ্ঞানের কৃতী পুরুষরা এই বিস্ময়কর বিষয়ে তাদের মনোযোগ দেওয়া আরম্ভ করেছে। তারা বিষয়টি গভীর মনোযোগে অধ্যয়ন করছে। এখনও তারা তাদের অধ্যয়নের প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। এই প্রাথমিক অবস্থাতেই তারা আবিষ্কার করেছে যে মানুষের কেন্দ্রীয় মস্তিষ্কের একটি কোষের সাথে অপর কোষ খুব নিবিড়ভাবে জড়িত এবং এই কোষের সংখ্যা নেহাত কম নয়। এ এক বিশাল আকারের সংখ্যা, যা হচ্ছে ১৫০ লক্ষ শূন্যের সমান।

শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের ড.সি. জাডসন হেরিক বলেন, ‘এই আকৃতি এত বিস্ময়কর যে জ্যোতিঃশাস্ত্রের আকৃতিগুলো, শত লক্ষাধিক আলোকবর্ষের সাথে তুলনা করাও তুচ্ছ হয়ে যায়।’

এটা মোটামুটি নিশ্চিত যে মানুষের সেরেবাল করটেক্সে ১ হাজার কোটি থেকে ১ হাজার ৪০০ কোটি স্নায়ু কোষ রয়েছে এবং আমরা জেনেছি যে এগুলো নির্দিষ্ট গঠনে সুসজ্জিতভাবে বিদ্যমান। এই সজ্জা বিশৃঙ্খল নয়। তারা পর্যায়ক্রমিক। সম্প্রতি তড়িৎ-পদার্থবিদ্যার উন্নত পদ্ধতির দ্বারা বৈদ্যুতিক প্রবাহের চিত্র অংকন করা হয়েছে। মস্তিষ্কে অবস্থিত কোষগুলো থেকে বা ক্ষুদ্র-ইলেকট্রোডের তন্তুগুলো থেকে এই বৈদ্যুতিক প্রবাহ নির্গত হয়। এগুলোকে রেডিও এক্সরে যন্ত্রের মাধ্যমে ১০ লক্ষ গুণ বড় করে দেখা হচ্ছে এবং বিশ্লেষণ করা হচ্ছে যে কীভাবে এগুলো যোগাযোগের ক্ষেত্রে তথ্য প্রবাহিত করে।

এটা সাধারণভাবে আমাদের ধারণা শক্তির অতীত যে কেবল একটা মানুষের দেহের ব্যবস্থাপনার জন্য এমন এক দুর্বোধ্য পদ্ধতির প্রয়োগ করা হয়েছে। দেহের দৈনন্দিন কাজকর্ম করার জন্য এ এক মহাসমারোহ। এটা সেই একই ব্যবস্থা যা শত কোটি কোষকে একে অপরের সাথে যোগাযোগ করিয়ে দেয়। তাহলে আমরা কি বলতে পারি না যে এই সেই ব্যবস্থা বা মাধ্যম যা মানুষকে অস্পর্শনীয় বলগুলোর সাথে পরিচয় এবং যোগাযোগ করিয়ে দেয়?

এ বই লেখার পর এবং প্রকাশকের কাছে যাওয়ার আগে নিউ ইয়র্ক টাইমসে একটি বার্তা প্রকাশ পায়। এই প্রতিবেদনের সারমর্ম হচ্ছে বর্তমানে বিশ্বের মহান সব বিশ্ববিদ্যালয় মস্তিষ্ক নিয়ে এবং মানসিক দক্ষতা নিয়ে কমপক্ষে একটি করে গবেষণা চালাচ্ছে। প্রতিবেদনে ডিউক বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. রাইনি এবং তার সহযোগীদের কাজ সম্পর্কে বলা হয়েছে। তাদের গবেষণার অন্যতম বিষয় হচ্ছে ‘চিন্তা যোগাযোগ কী?’ আমি এখানে সেই বিষয়ে সংক্ষেপে তুলে ধরছি যাতে করে আপনি মস্তিষ্কের অপার সম্ভাবনা সম্পর্কে আরেকটু ধারণা পান।

পত্রিকার ভাষ্যমতে, ‘এক মাস আগে আমরা এই পৃষ্ঠায় কিছু আশ্চর্যজনক তথ্যের উল্লেখ করেছিলাম যা ছিল ডিউক বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. রাইনি এবং তার সহযোগীদের দ্বারা অর্জিত ফলাফল। তাদের এই গবেষণায় শত শত পরীক্ষা করা হয়েছে। বিষয় ছিল ‘চিন্তা যোগাযোগ’ এবং ‘ভবিষ্যৎ দৃষ্টি’। তারা এই দুই জিনিসের অনুসন্ধান চালিয়েছেন। তাদের এই প্রাথমিক অনুসন্ধানের ফলাফল অত্যন্ত চমকপ্রদ। তাদের ফলাফল সারমর্ম করে হারপার ম্যাগাজিনে ছাপানো হয়। তাদের ধারাবাহিক দুইটি প্রতিবেদন জনমনে প্রচুর সাড়া ফেলে। সেখান থেকে আমরাও ব্যাপারটির সত্যতা প্রমাণের জন্য ডিউক বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে হাজির হই। প্রতিবেদক ই.এইচ. রাইট ব্যাপারটির সারমর্ম তুলে ধরেন। তিনি স্বীকার করেছেন যে ব্যাপারটি পুরোপুরি প্রাকৃতিক। এটা অনেকটা অতিরিক্ত ইন্দ্রিয়ের মতো, যাকে আমরা বলি ‘ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়’।

‘চিন্তা যোগাযোগ এবং ভবিষ্যৎ দৃষ্টি’ বিষয়ের প্রকৃত অস্তিত্ব রয়েছে। লেখক রাইট ড. রাইনির নমুনা অভীক্ষা দেখে এই ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েছেন। অভীক্ষা মানে কোন নির্দিষ্ট কাজের মাধ্যমে কোন নির্দিষ্ট বিষয় সম্বন্ধে প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহে যেসব উপকরণ বা কৌশল ব্যবহৃত হয়। দেখা যাচ্ছে ড. রাইনির অভীক্ষার কারণে অনেক বিজ্ঞানী এই দুইটি অজানা বিষয় সম্বন্ধে জানতে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। এখানে দুই-একটি অভীক্ষার উল্লেখ করছি:

বিভিন্ন অংশগ্রহণকারীদের একটি নির্দিষ্ট নামের কার্ড তুলে নেওয়ার জন্য জিজ্ঞেস করা হয়। তবে তারা এগুলো দেখতে পারবে না। অনেক কার্ড থেকে পুরোপুরো দৈবভাবে যেকোন কার্ড নির্বাচন করতে হবে। পরীক্ষাটি হচ্ছে দুইজন পাশাপাশি না দেখেই অনেক কার্ড থেকে যেকোন কার্ড নির্বাচন করবে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে এরা কি একে অপরকে একই ধরনের কার্ড নির্বাচন করতে বার্তা পাঠাতে পারে। তাও আবার অন্যকিছু না কেবল মস্তিষ্কের ব্যবহার করে। দেখা গেছে কিছু সংখ্যক পুরুষ এবং নারী সঠিকভাবে একই ধরনের কার্ড নির্বাচন করেছে। যেখানে ভাগ্যক্রমেও এমন ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা লাখে একবার সেখানেও কয়েকবার ঘটনাটি ঘটেছে।

‘কিন্তু তারা এটা কীভাবে করল?’ মানুষের এই ক্ষমতা সহজে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয়। মানবদেহে এমন কোন নির্দিষ্ট অঙ্গ নেই যার কারণে এমন ঘটতে পারে। নমুনা অভীক্ষাগুলো এত ভালো করে কাজ করেছে যে কয়েক শত মাইল দূরে গিয়ে যে ফলাফল পেয়েছে, তাদের পরীক্ষাগারের কক্ষেও সেই একই ফলাফল পেয়েছে। এই ব্যাপার আরও উন্মুক্ত করে, জনাব রাইটের অভিমত অনুযায়ী যে চিন্তা যোগাযোগ এবং ভবিষ্যৎ দৃষ্টির এই অভীক্ষার মাধ্যমে দৈহিক বিকিরণ তত্ত্বের ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। সাধারণ বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব হচ্ছে সব আকারের পরিচিত বিকিরণ শক্তি বর্গাকারে দূরত্ব পার হতে বিপরীতভাবে হ্রাস পায়। কিন্তু চিন্তা যোগাযোগ এবং ভবিষ্যৎ দৃষ্টি এমন করে না; বরং তারা ভিন্নভাবে চলে। আমাদের অন্যান্য মানসিক ক্ষমতার মতো এগুলোও ভিন্ন পথে চলে। যদিও এই তত্ত্বে এখনও কিছুটা মতভেদ রয়েছে। তবে তত্ত্ব হচ্ছে যখন মানুষ ঘুমে থাকে বা অর্ধ-ঘুমে থাকে তখন এটা সঠিকভাবে কাজ করে না। এই শক্তি তখনই ভালোভাবে কাজ করে যখন মানুষ জাগ্রত থাকে এবং পুরোপুরি সচেতন থাকে। ড. রাইনি আরও আবিষ্কার করেছেন যে ঘুমের ঔষধ খেলে মানুষের মধ্যে এই ধরনের ক্ষমতা হ্রাস পায়। তবে প্রাকৃতিক যে ১০টি উত্তেজক রয়েছে এর মাধ্যমে এই ক্ষমতার প্রকাশ বৃদ্ধি পায়। (১০টি উত্তেজক সম্পর্কে জানতে যৌনশক্তি রূপান্তরের কৌশল অধ্যায় পাঠ করুন।) সবচেয়ে ভালো ফলাফল তখনই ঘটে যখন মানুষ তার সর্বশক্তি দিয়ে চেষ্টা করে।

প্রতিবেদনের উপসংহারে লেখক রাইট কিছুটা বিশ্বাসের সাথেই লেখেন যে চিন্তা যোগাযোগ এবং ভবিষ্যৎ দৃষ্টি হচ্ছে মানুষের প্রতি একটি আর্শীবাদ। এটা আমাদের মস্তিষ্কের এমন এক অংশ যা আমাদের দেখার সীমাকে অতিক্রম করার সুযোগ দেয়। ধরুন আপনি না জেনেই একটি কার্ড উল্টে রেখেছেন। আপনি জানেন না যে কার্ডে কী লেখা। কিন্তু আপনার সামনে বসা আপনার বন্ধুটি হয়তো সেই কার্ডটি পাঠ করেছে। আপনি আপনার মস্তিষ্কের ‘চিন্তা যোগাযোগ’ শক্তি ব্যবহার করে বন্ধুর মস্তিষ্ক থেকে আপনার মস্তিষ্কে তথ্যটি নিতে পারবেন। এভাবে আপনি না দেখে, না জেনেও কার্ডে কী লেখা হুবহু তা বলে দিতে পারবেন। ড. রাইনির পরীক্ষায় ঠিক এমনই ঘটেছে। সেখানে এই বিশ্বাসের জন্য অনেক ভিত্তি রয়েছে। সব মানুষের মধ্যেই এই দুইটি ক্ষমতা রয়েছে। কিন্তু খুব কম মানুষই এগুলো ব্যবহার করতে জানে। কেউ যদি যেকোন একটিও ব্যবহার করতে জানে তবে সে মহান পর্যায়ে উন্নীত হয়। আর দুইটি ক্ষমতাই ব্যবহার করতে জানে এমন মানুষ সত্যিই বিরল। এদের সামনে পর্দা, দেওয়াল বা দূরত্ব কোন প্রতিবন্ধকতাই নয়। রাইট এই উপসংহারকে আরও বর্ধিত করে বলেন যে কিছু কিছু সময় কিছু মানুষ তাদের স্বপ্নে ঝড়ের বা দুর্ঘটনার আগাম পূর্বাভাস পায়। এই সব পরীক্ষা থেকে বলা যায় যে এসব স্বপ্ন আসলেই সত্য। এই ধরনের অভিজ্ঞতা হয়তো আমাদের সাধারণ অভিজ্ঞতা থেকে ভিন্ন। কিন্তু তবুও এগুলো সত্য। এটা আরও প্রমাণ করে যে আমাদের মস্তিষ্কে এমন কিছু আছে যা আমাদেরকে ভবিষ্যৎ দেখার বা গঠন করার শক্তি, সাহস এবং ইঙ্গিত দেয়। আমি যদিও পাঠককে এখনই ব্যাপারটি গ্রহণ করে নিতে বলছি না। আপনি নিজে পরীক্ষা করে, দেখেশুনেই ব্যাপারটি গ্রহণ করুন। তবে আমি বলতে চাচ্ছি ড. রাইনির অনুসন্ধান নিঃসন্দেহে আমাদের সামনে নতুন জ্ঞানের দুয়ার খুলে দিয়েছে।

ড. রাইনির মতে আমাদের মন কিছু উত্তেজক দ্বারা আরও বেশি কাজ করে, বেশি চিন্তাশীল হয়ে ওঠে। এতে প্রমাণ হয় যে আমাদের মধ্যে একটি অতিরিক্ত ইন্দ্রিয় রয়েছে। ড. রাইনির প্রকাশ্য ঘোষণা দেখে আমিও কিছু বলার সাহস পাচ্ছি। আমি এবং আমার সহযোগীরা দীর্ঘদিন এই অতিরিক্ত ইন্দ্রিয় মানে ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় নিয়ে কাজ করেছি। মনকে কীভাবে উদ্দীপ্ত করা যায়, ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় দ্বারা কীভাবে বাস্তবে জীবনে কাজ করা যায় এই সম্পর্কে আমরাও দীর্ঘদিন কাজ করেছি। এই সম্পর্কে পরবর্তী অধ্যায়ে বিস্তারিত বলা হয়েছে।

আমি যে পদ্ধতির কথা উল্লেখ করব তা দুইজন বা ততোধিক ব্যক্তির মধ্যে সহযোগিতার মাধ্যমে ঘনিষ্ঠতা তৈরি করবে। আমরা আমাদের পরীক্ষা এবং অনুশীলনের মাধ্যমে আবিষ্কার করলাম যে কীভাবে আমরা আমাদের মনকে উদ্দীপ্ত করতে পারি যাতে করে আমরা আমাদের মনকে একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যে প্রয়োগ করতে পারি। অথবা কোন নির্দিষ্ট সমস্যার সমাধান খুঁজে পেতেও এই পদ্ধতি কাজে লাগানো যায়। আমি পরবর্তী অধ্যায়ে ‘অদৃশ্য উপদেষ্টা’ সম্পর্কে বলেছি। এর সাথে যোগাযোগের যে সূত্র আমি প্রয়োগ করেছি তাই উল্লেখ করেছি। যাতে করে আমি এবং আমার সহযোগীরা, আমাদের মনকে একত্রিত করে একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পরিচালিত করতে পারি বা সমস্যার সমাধান খুঁজে বের করতে পারি।

কার্যপ্রণালীটি খুবই সহজ। আমরা একটি গোল টেবিল ঘিরে বসতাম। আমাদের সমস্যাকে পরিষ্কারভাবে বর্ণনা করতাম। তারপর এর আলোচনা আরম্ভ করতাম। প্রত্যেকের মনে যে চিন্তাই উদয় হত তাই নিয়ে আলাপ হত। মন উদ্দীপনার এই পদ্ধতির অদ্ভুত দিক হচ্ছে এটা অংশগ্রহণকারীদেরকে জ্ঞানের অজানা উৎসের সাথে সংযোগ করিয়ে দেয়। সাধারণত এটা ব্যক্তির নিজ অভিজ্ঞতার বাইরে থাকে। হঠাৎ হঠাৎ এমন সব বুদ্ধি বা সমাধান আসে যা ব্যক্তি আগে কখনো কল্পনা করেনি।

যদি আপনি ঐক্যমন অধ্যায়ে বর্ণিত সূত্র অনুধাবন করেন, তবে আপনি এখানে বর্ণিত গোল টেবিল পদ্ধতি অবশ্যই বুঝতে পারবেন। এটা ঐক্যমনের এক বাস্তবিক প্রয়োগ।

তিনজন লোকের মধ্যে আমরা এই অনুশীলন করেছি। মন উদ্দীপনার এই পদ্ধতি বেশ কার্যকর। আপনি যদি নির্দিষ্ট বিষয় নিয়ে, একে অপরের মধ্যে সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে আলোচনা শুরু করতে পারেন, তবে খুব ভালো ফলাফল পাবেন।

এই দর্শনের অন্যতম জিনিস হচ্ছে এই পদ্ধতির ব্যবহারিক প্রয়োগ। যে চিন্তা করুন এবং ধনী হোন দর্শনের অনুসরণ করতে চায় সে যদি এই গোল টেবিল পদ্ধতি ব্যবহার করে তবে খুব সহজেই কার্নেগির সেই গোপন রহস্য সম্পর্কে বুঝতে পারবে যা এ বইয়ের সূচনা অধ্যায়ে বলা হয়েছে। যদি আপনি এই মুহূর্তে কথাটি নাও বুঝতে পারেন, সমস্যা নেই। জীবনে গোল টেবিল পদ্ধতি প্রয়োগ করে দেখুন এবং পুনরায় এই অধ্যায় পাঠ করুন। দেখবেন আপনি বুঝতে পারছেন এবং খুব ভালোভাবেই নিজের জীবনে প্রয়োগ করছেন।


 




অধ্যায় - ১৪

ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়

বিজ্ঞতার দরজা

ধনী হওয়ার ক্ষেত্রে তেরোতম ধাপ


ধনী হওয়ার ক্ষেত্রে ‘১৩তম সূত্র’ হচ্ছে ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়, যার মাধ্যমে অসীম বুদ্ধিমত্তা একজন মানুষের আকাক্সক্ষা পূরণে সহায়তা করে।

এই সূত্র সাফল্য দর্শনের চূড়ান্ত সূত্র। একে পাওয়া যেতে পারে, বোঝা যাবে এবং প্রয়োগ করা যায় শুধু প্রথমে অপর ১২টি সূত্রের ওপর কর্তৃত্ব করার পর। বইয়ে উল্লেখিত প্রতিটি অধ্যায়ের শিরোনামই একেকটি সূত্র। উক্ত ১২টি সূত্র পুরোপুরি বোঝার পর এবং নিজের জীবনে প্রয়োগের পরই কেবল এই সূত্র খুঁজে পাবেন।

ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় অবচেতন মনের সেই অংশ যাকে সৃজনশীল কল্পনা বলে উল্লেখ করা হয়েছে। একে ‘গ্রাহক অংশ’ লিখেও উল্লেখ করা হয়েছে যার মাধ্যমে আইডিয়া, পরিকল্পনা এবং চিন্তা মনের মধ্যে উঁকি দেয় বা হঠাৎ ঝলক দিয়ে ওঠে। এই ‘ঝলককেই’ সাধারণত বলা হয় ‘অনুপ্রেরণা’।

ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বর্ণনা দ্বারা প্রমাণ করা যায় না। এটা এমন কোন ব্যক্তির কাছে বর্ণনা করে বোঝানো সম্ভব নয় যে এই দর্শনের অপর সূত্রের ওপর কর্তৃত্ব না করছে। আবারও বলছি, অপর সূত্রকে কেবল বুঝলেই হবে না, এগুলোকে নিজের জীবনে প্রয়োগ করতে হবে এবং সূত্রগুলোর ওপর কর্তৃত্ব করতে হবে। তবেই সেই ব্যক্তির কাছে ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বোধগম্য হবে। কারণ যে ব্যক্তির সাফল্য দর্শন সম্পর্কে কোন জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতা নেই তাকে ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বোঝানো মানে একজন অন্ধ ব্যক্তিকে লাল রঙ দেখতে কেমন তা বোঝানো, যে অন্ধ ব্যক্তি কোনদিনই লাল রঙ দেখেনি। সুতরাং বুঝতেই পারছেন ব্যাপারটা কতটা কষ্টকর।

ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের বুঝজ্ঞান আসতে পারে শুধু নিজের ভেতর থেকে মন উন্নয়নের ধ্যানের মাধ্যমে। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় হচ্ছে ব্যক্তির সসীম মন এবং অসীম বুদ্ধিমত্তার মধ্যে যোগাযোগের মাধ্যম। আর এই কারণে এটা উভয় মানসিক এবং আত্মিক এক মিশ্রণ। এটা সেই বিন্দু যেখানে ব্যক্তির মন বিশ্ব মনের সাথে সংযুক্ত হয়।

এ বইয়ে বর্ণিত সূত্রের ওপর কর্তৃত্ব করার পর, আপনি একটি বিবৃতি সত্য রূপে গ্রহণ করতে প্রস্তুত হবেন যা হয়তো আপনার কাছে অন্য কোন সময় অবিশ্বাস্য বলে প্রতীয়মান হত। বর্ণনাটি হচ্ছে:

ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের সহায়তায় আপনি সময় মতো আসন্ন বিপদ থেকে সতর্ক হয়ে সেগুলো এড়াতে পারবেন এবং সময় মতো সুযোগ চিনতে পেরে সেগুলোকে আলিঙ্গন করতে পারবেন।

এই বর্ণনা আবার পড়–ন। বারবার পড়–ন। যতক্ষণ পর্যন্ত না ব্যাপারটি আপনার কাছে পুরোপুরি পরিষ্কার হয় ততক্ষণ পড়–ন। কারণ এটা এমন এক বিবৃতি যা মানুষ বহু বছরের সাধনার পরই কেবল আয়ত্ত করতে পারে। তখন আপনি অনুভব করবেন যে ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের উন্নতির সাথে সাথে আপনার সহায়তার জন্য এবং আপনার কাজ করে দেওয়ার জন্য ‘একজন রক্ষাকারী ফেরেশতা’ আসবে। এই ফেরেশতাই আপনার সামনে জ্ঞান রাজ্যের দুয়ার খুলে দিবে। (আপনার কি মনে হয় ফেরেশতা কেবল শাস্তি দেওয়ার জন্য রয়েছে? না তা নয়। মানুষকে সহায়তা করার জন্যও ফেরেশতা রয়েছে।)

যদিও এটা একটা সত্য বিবৃতি, তবুও আপনি যদি এ বইয়ের সূত্রাবলি, নির্দেশনা এবং পদ্ধতি নিজের জীবনে প্রয়োগ না করেন অথবা এমন কোন ব্যক্তিগত উন্নয়নের পদ্ধতি অনুসরণ না করেন, তবে আপনি কখনো এই সত্য অনুধাবন করতে পারবেন না।

আমি কোন ‘অলৌকিক ঘটনা’ বা জাদুর বর্ণনা দিচ্ছি না। ব্যক্তিগতভাবে আমি এসব জিনিস বিশ্বাসও করি না। কিন্তু প্রকৃতির নিয়তি বা বিধিবিধান সম্পর্কে আমার যথেষ্ট জ্ঞান আছে। আমি জানি যে প্রকৃতি কখনো তার প্রতিষ্ঠিত বিধিবিধান লঙ্ঘন করে না। এর মধ্যে কিছু কিছু নিয়ম আমাদের ধারণার বাইরে। এগুলো ঘটতে দেখলে আমাদের কাছে ‘অলৌকিক’ বলে মনে হয়। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় হচ্ছে ঠিক এমন এক ব্যাপার। আমি যখন ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় সম্পর্কে আরও বুঝতে লাগলাম, আরও অভিজ্ঞতা অর্জন করতে লাগলাম তখন সেই অভিজ্ঞতার কাছে অন্য কোন অভিজ্ঞতা খাটে না। যদিও আমি এই অভিজ্ঞতা অর্জনের আগে এই সম্পর্কে পুরোপুরি বুঝতাম না।

আমি অন্তত এতটুকু জানি যে প্রকৃতিতে এমন এক ক্ষমতা আছে বা একটি কারণ বা বুদ্ধিমত্তা আছে যা বস্তুর প্রত্যেক পরমাণুকে একে অপরের সাথে যোগাযোগের অনুমোদন দেয়। একজন মানুষের সামনে শক্তির প্রতিটি কণাকে গ্রহণ করার সুযোগ দেয়। এই সেই শক্তি যা ছোট্ট এক বীজকে বিশাল আকারের বট গাছে পরিণত করে। এই সেই কারণ যা অভিকর্ষের নিয়মে পাহাড় থেকে পানি নামিয়ে আনে। এই সেই বুদ্ধিমত্তা যা দিনকে রাতে এবং রাতকে দিনে পরিণত করে, শীত এবং গ্রীষ্মকে বজায় রাখে, প্রতিটি জিনিসকে যথাযথ স্থানে একে অপরের সাথে যুক্ত রাখে। এই সেই বুদ্ধিমত্তা যাকে আপনি আপনার আকাক্সক্ষা পূরণে কাজে লাগাতে পারেন। এই দর্শনের সূত্রাবলির মাধ্যমে, জীবনে এই সূত্রাবলি কাজে লাগালে আপনি এই অসীম বুদ্ধিমত্তাকে আপনার পাশে পাবেন। আপনি আপনার আকাক্সক্ষাকে বাস্তবে পরিণত করতে পারবেন। আমার এই সম্পর্কে জ্ঞান আছে। কারণ আমি এটা পরীক্ষা করেছি এবং এর সুফল ভোগ করার সুযোগ পেয়েছি।

একদম প্রথম অধ্যায় থেকে ধাপে ধাপে আপনাকে এই শেষ অধ্যায়ে, সাফল্য দর্শনের এই শেষ সূত্রে নেতৃত্ব দেওয়া হয়েছে। যদি আপনি পূর্ববর্তী সূত্রের প্রত্যেকটিতে কর্তৃত্ব করেন, তাহলে আপনি এখন নতুন নতুন আইডিয়া, বুদ্ধি, ধারণা এবং কৌশল গ্রহণ করার জন্য প্রস্তুত। তবে আপনি যদি অন্যান্য সূত্রে কর্তৃত্ব না করেন, তবে আপনি এটা কখনো পাবেন না। আপনাকে অবশ্যই পূর্বের সূত্রাবলির ওপর কর্তৃত্ব করতে হবে। কেবল তখনই ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় আপনার কাছে ধরা দিবে।

যখন আমি ‘বীরস্তুতির’ যুগের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি তখন আমি নিজেকে তাদের অনুকরণ করার চেষ্টা করেছি। আমি যাদের সর্বাধিক প্রশংসা করি তাদেরকে অনুসরণ করার চেষ্টা করেছি। অধিকন্তু, আমি আবিষ্কার করি, আমি যে দীর্ঘদিন আমার আদর্শদের বিশ্বাস এবং আস্থা নিয়ে অনুকরণ করার চেষ্টা করেছি, এই চেষ্টা আমাকে বিশেষ এক ক্ষমতা দিয়েছে। এই ক্ষমতাকে আমি আমার আকাক্সক্ষাকে বাস্তবে পরিণত করতে প্রয়োগ করেছি।

আমি কখনো নিজেকে ‘বীরস্তুতি’ থেকে বঞ্চিত করিনি। যদিও এখন বয়সের শেষ প্রান্তে পৌঁছে গেছি, তবুও চেষ্টা করে গেছি। আমার অভিজ্ঞতা আমাকে শিখিয়েছে যে প্রকৃতপক্ষে মহান হওয়ার পরবর্তী ধাপ হচ্ছে মহান ব্যক্তিদের সমকক্ষ হওয়ার চেষ্টা করা। অনুভূতি, অনুভব এবং কাজের দ্বারা যতটা সম্ভব তাদের নিকটে যাওয়া।

বহু বছর আগে যখন আমি প্রকাশনার জন্য একটি বাক্যও লিখতাম না তখন থেকেই আমি নিজের চরিত্র পুনঃনির্মাণের চেষ্টা করতাম। আমি ৯ জন মহান পুরুষকে অনুকরণ করার চেষ্টা করতাম। তাদের জীবনী আমি পাঠ করলাম। তাদের জীবন তারা যেভাবে পালন করত, কাজ করত ঠিক সেই ব্যাপার দ্বারা আমি নিজেকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করতাম। এই ৯ জন মহান পুরুষ, যাদের জীবন কর্মের দ্বারা আমি সবচেয়ে বেশি অনুপ্রাণিত ছিলাম তারা হচ্ছে: এমারসন, পেইন, এডিসন, ডারউইন, লিংকন, বারব্যাংক, নেপোলিয়ন, ফোর্ড এবং কার্নেগি।

আমি প্রতিটি রাতে একটি কল্পিত সভার আহ্বান করতাম। এই দলের সদস্যদের ডাকতাম ‘অদৃশ্য উপদেষ্টা’ বলে। বহু বছর ধরে আমি এই চেষ্টা চালিয়ে গেছি।

কার্যপ্রণালীটি খুব সহজ ছিল এবং সবসময় একই রকম ছিল। আমি প্রতি রাতে ঘুমাতে যাবার আগে, আমি আমার চোখ বন্ধ করতাম এবং আমার কল্পনার মধ্যে দেখতাম যে এই অদৃশ্য উপদেষ্টারা আমার সভা টেবিল ঘিরে আমার সাথে বসে আছে। এখানে আমি কেবল তাদের মাঝে বসারই সুযোগ পেতাম না; বরং আমি প্রকৃতপক্ষে এই সঙ্ঘের কর্তৃত্ব করতাম। যেমন একজন সভাপতি।

আমার উদ্দেশ্য ছিল খুবই নির্দিষ্ট। আমি আমার চরিত্রকে এসব মহান পুরুষের চরিত্রের মতো মহান করে গড়ে তুলব। এজন্য আমি আমার কল্পনায় এসব অদৃশ্য উপদেষ্টাদের নিয়ে কাজ আরম্ভ করলাম। আমি আমার জীবনের শুরুতেই অনুধাবন করেছিলাম যে আমাকে আমার জন্মের প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করতে হবে। অজ্ঞতা এবং কুসংস্কারের একটি পরিবেশের মধ্যে থেকেও আমাকে মহান হতে হবে। আমি নিজের ইচ্ছাকে নিজের মহান চরিত্র গঠনের কাজে লাগালাম। যে পদ্ধতির মাধ্যমে কাজটি সম্পন্ন করতাম তা এখানে উল্লেখ করা হলো।


স্ব-পরামর্শের মাধ্যমে চরিত্র নির্মাণ

আমি মনোবিজ্ঞানের একজন আগ্রহী ছাত্র। তাই আমি জানতাম যে সকল পুরুষ মহান হয়েছে তারা মহান হয়েছে, কারণ তাদের কর্তৃত্বশীল চিন্তা এবং আকাক্সক্ষা। আমি জানতাম যে তাদের প্রত্যেকের মনের গভীরে যে আকাক্সক্ষা ছিল, তাদের জীবনে তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। আমি জানতাম যে চরিত্র নির্মাণে স্ব-পরামর্শ হচ্ছে একটি ক্ষমতাশালী উৎপাদক। এই সেই বিস্ময়কর সূত্র যার মাধ্যমে চরিত্র নির্মাণ করা যায়।

মন পরিচালনার এই সূত্রের দ্বারা আমি ন্যায্যাভাবে জানতাম যে আমার চরিত্র পুনঃনির্মাণে কী ধরনের সরঞ্জাম প্রয়োজন। এই কল্পিত সভার সাক্ষাতে আমি আমার দলের সদস্যদের জ্ঞানের জন্য ডাকতাম। যে জ্ঞান আমি প্রত্যেকের কাছ থেকে নিজের জীবনে কাজে লাগাতে চাইতাম, তাই নিয়ে চিন্তা করতাম। নিজেকে দেখিয়ে প্রত্যেক সদস্যকে বলতাম,

‘জনাব এমারসন, আমি আপনার কাছ থেকে প্রকৃতির বিস্ময়কর বুঝজ্ঞান অর্জনে ইচ্ছুক। যে জ্ঞান আপনার জীবনকে বদলে দিয়েছে আমি তা বুঝতে এবং নিজের মধ্যে ধারণ করতে চাই। আমি আপনাকে অনুরোধ করি যাতে আপনি আমার অবচেতন মনে এমন এক প্রভাব তৈরি করেন। আপনি যেসব গুণের অধিকারী, যা আপনাকে প্রকৃতির নিয়ম বুঝতে এবং নিজের মধ্যে খাপ খাওয়াতে সক্ষম করেছে সেই গুণাবলির প্রভাব আমার মধ্যে তৈরি করুন। আমি আপনাকে আরও অনুরোধ করি যাতে আপনি আমাকে জ্ঞান রাজ্যে প্রবেশের রাস্তা দেখিয়ে দেন।

‘জনাব বারব্যাংক, আমি আপনার কাছ থেকে জীববৈচিত্র্যের রহস্য জানতে চাই। আমি অনুরোধ করি যাতে আপনি আমার কাছে সেই জ্ঞান প্রেরণ করুন যা আপনাকে এত চমৎকারভাবে প্রকৃতির নিয়ম বুঝতে সক্ষম করেছে যে আপনি ক্যাকটাস গাছের কাঁটা ছাড়িয়েছেন এবং একে একটি ভক্ষণীয় খাবারে পরিণত করেছেন। আমাকে সেই জ্ঞানে প্রবেশের সুযোগ দিন যা আপনাকে অর্কিড ফুলের মতো বিভিন্ন রঙের ফুল, একই ফুলের মধ্যে বিভিন্ন রঙ সৃষ্টিতে সহায়তা করেছে।

‘নেপোলিয়ন, আমি আপনার কাছে মানুষকে অনুপ্রাণিত করার উপায় শিখতে চাই। আপনি পুরুষদের আরও মহান এবং মহৎ কাজ করতে উৎসাহিত করেছেন, তাদের কর্মে সাহসী চেতনা প্রবেশ করিয়েছেন। আমি আপনার সেই বিস্ময়কর সামর্থ্যরে অধিকারী হতে চাই। আমি আপনাকে অনুকরণ করে মানুষকে আরও মহান এবং মহৎ কর্মে উদ্বুদ্ধ করতে চাই। আপনি যে বাধার সামনে, ব্যর্থতা এবং সমস্যার মুখোমুখি হয়েও এক বিশ্বাসী চেতনায় অবিচল থাকতেন, যে চেতনা আপনার ব্যর্থতাকে বিজয়ে রূপান্তর করত, আমি সেই চেতনার অধিকারী হতে চাই। আমি প্রতিদিনকার বাধাবিপত্তি এবং সমস্যাকে অতিক্রম করে মহান কাজ করতে চাই। হে ভাগ্যের স¤্রাট, সুযোগের রাজা, নিয়তির পুরুষ, আমি আপনাকে সালাম জানাই!

‘জনাব পেইন, আমি আপনার কাছ থেকে চিন্তার মুক্তি, সাহস এবং স্পষ্টতা অর্জন করতে চাই। যা আপনার মধ্যে দৃঢ় বিশ্বাস তৈরি করেছিল, যা আপনাকে এতটা পৃথক করেছিল!

‘জনাব ডারউইন, আমি আপনার কাছ থেকে বিস্ময়কর ধৈর্য, কারণ এবং প্রভাব অধ্যয়ন করার সামর্থ্য অর্জন করতে চাই। পক্ষপাতিত্ব বা পূর্বসংস্কার ব্যতীত, প্রকৃতির বিজ্ঞান ক্ষেত্র থেকে আপনার দৃষ্টান্ত থেকে শিখতে চাই।

‘জনাব লিংকন, আমি আমার স্বীয় চরিত্রে ন্যায়বিচারের গভীর অনুভূতি প্রবেশ করাতে চাই, ধৈর্যের অক্লান্ত চেতনা, হাস্যোদ্দীপ্ত অনুভূতি, মানব বুঝজ্ঞান এবং সহিষ্ণুতা নির্মাণ করতে ইচ্ছুক, যা ছিল আপনার বিশেষ গুণ।

‘জনাব কার্নেগি, আমি ইতোমধ্যেই আপনার কাছে আমার নির্বাচনকৃত একটি জীবন-কর্মের জন্য ঋণী, যা আমার মনে এনে দিয়েছে মহান আনন্দ এবং শান্তি। আমি সংগঠিত প্রচেষ্টার সূত্রাবলির বুঝজ্ঞান অর্জন করতে চাই, যা আপনি এত দক্ষভাবে কারখানা প্রতিষ্ঠান নির্মাণে প্রয়োগ করেছেন।

‘জনাব ফোর্ড, আপনি মানুষের মধ্যে সর্বাধিক সহায়তাকারী ছিলেন যিনি আমার কাজে এত বেশি প্রয়োজনীয় সামগ্রীর যোগান দিয়েছেন। আমি আপনার অধ্যবসায়, দৃঢ়সংকল্প, ধার্মিকতা এবং আত্মবিশ্বাসের চেতনা অর্জন করতে চাই যা আপনাকে সমর্থ করেছে দরিদ্রতা, সংগঠন, এক করা, মানব প্রচেষ্টাকে সহজতর করা এবং তাদের ওপর কর্তৃত্ব করার প্রতি, যাতে আমিও অন্যদেরকে আপনার পদচিহ্ন অনুসরণ করতে সহায়তা করতে পারি।

‘জনাব এডিসন, আমি আপনাকে আমার খুব কাছে বসিয়েছি, আমার ডানে পাশে। কারণ আপনি আমাকে আমার গবেষণা চলাকালীন যে ব্যক্তিগত সহযোগিতা দিয়েছেন। আমার গবেষণা ছিল মানুষের সাফল্য এবং ব্যর্থতার কারণ খুঁজে বের করা। আমি চাই আপনার কাছ থেকে বিশ^াস এবং আস্থার বিস্ময়কর চেতনা অর্জন করতে, যার সাথে আপনি প্রকৃতির অনেক রহস্য উন্মোচন করেছেন। আমি চাই আপনার কাছ থেকে অবিরাম কঠোর পরিশ্রমের চেতনা অর্জন করতে যা নিয়ে আপনি প্রায়ই ব্যর্থতা থেকে বলপূর্বক বিজয় ছিনিয়ে এনেছেন।

আমার এই অদৃশ্য উপদেষ্টাদের সাথে আলাপ হয়তো আপনার কাছে একটু অন্যরকম মনে হতে পারে। কিন্তু আমি আমার চারিত্রিক গুণাবলি অর্জনের জন্য সেই সময় সবচেয়ে বেশি আগ্রহী ছিলাম এবং এখনো আছি। আমি প্রত্যেক উপদেষ্টার জীবনকালের নথি অধ্যবসায়ের সাথে যতœ করে অধ্যয়ন করেছিলাম। এই রাতের কার্যপ্রণালীর কয়েক মাসের পর, আমি আবিষ্কার করে বিস্মিত হলাম যে এই কাল্পনিক আকার স্পষ্টরূপে বাস্তব হয়ে উঠেছে।

৯ জন পুরুষের মধ্যে প্রত্যেকেই আমার কল্পনায় স্বতন্ত্র চরিত্র গঠন করেছে, যা আমাকে বিস্মিত করেছিল। দৃষ্টান্ত স্বরূপ, লিংকন সর্বদা দেরিতে আসার অভ্যাস গঠন করে, তারপর চারপাশে মহাসমারোহে হাঁটত। যখন তিনি আসতেন, তিনি খুব ধীরভাবে হাঁটতেন, তার হাত পিছনে ধরে রেখে এবং যখন তিনি চলে যেতেন তখন এক মুহূর্ত থেমে তার হাত আমার কাঁধের ওপর রাখতেন। তিনি সর্বদা একটি গম্ভীর ভঙ্গি তার মুখে বজায় রাখতেন। কদাচিৎ আমি তাকে হাসতে দেখেছি। বিভিন্ন রাজ্যের প্রতি মনোযোগই তাকে গম্ভীর করেছে।

এটা অন্যদের জন্য সত্য নয়। বারব্যাংক এবং পেইন প্রায় সরস উক্তি করতেন, যাতে সভার অন্য সদস্যরা অবাক হতেন। এক রাতে পেইন পরামর্শ দেন যেন আমি ‘কারণ এবং যুক্তি যুগের’ ওপর একটি বক্তৃতা তৈরি করি এবং একটি চার্চের ধর্ম প্রচারের জন্য তৈরি মঞ্চ থেকে বক্তৃতা দিই। এই পরামর্শে টেবিল ঘিরে অনেকেই হৃদয় খুলে হেসেছিলেন। কিন্তু নেপোলিয়ন নয়! তিনি এক কোণায় বসেছিলেন, তার মুখটি নিচু করে এত উচ্চস্বরে চিৎকার করেন যে সবাই তার দিকে বিস্ময়ের সাথে ফিরে তাকায়। তার কাছে গির্জালয় দেশের বন্ধকী সম্পদ, পুনর্গঠন করার জিনিস নয়; বরং একটি সুবিধাজনক উত্তেজক রূপে প্রয়োগ করা যেতে পারে যাতে লোকজন দ্বারা বৃহৎ কর্ম সম্পাদন করা যায়।

একদিন বারব্যাংক দেরিতে এলেন। যখন তিনি এলেন, তিনি উত্তেজিত হয়ে তার দেরি করার কারণ ব্যাখ্যা করলেন যে তিনি একটি গবেষণা কর্ম চালাচ্ছিলেন যার মাধ্যমে তিনি যেকোন রকমের গাছে আপেল ধরাতে সমর্থ হবেন বলে আশা করেন। পেইন তাকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে ভর্ৎসনা করলেন যে একটি আপেলের কারণেই পুরুষ এবং নারীর মধ্যে সব সমস্যার সূচনা ঘটে। ডারউইন মৃদু চাপা হাসি দিয়ে যেন পেইনকে পরামর্শ দিলেন, পেইন যখন আপেল জোগাড় করতে জঙ্গলে যাবে তখন তার উচিত ছোট্ট সাপ থেকে সতর্ক থাকা। এগুলো কিন্তু বড় সাপের মতোই ছোবল দিতে পারে। এমারসন পর্যবেক্ষণ করলেন, ‘সাপ নাই, আপেল নাই!’ এবং নেপোলিয়ন মন্তব্য করলেন, ‘আপেল নাই, রাজ্য নাই!’

লিংকন প্রত্যেক সাক্ষাতে সবার শেষে টেবিল ছেড়ে যাওয়ার অভ্যাস গঠন করলেন। এক উপলক্ষে তিনি টেবিলের শেষ প্রান্তে ঠেস দিয়ে রইলেন, তার হাত ভাঁজকৃত এবং এই অবস্থায় অনেকক্ষণ রইলেন। আমি তাকে বিরক্ত করার চেষ্টা করলাম না। অবশেষে, তিনি তার মাথা ধীরভাবে তুললেন, উঠে দাঁড়ালেন এবং দরজার দিকে হেঁটে গেলেন, তারপর ঘুরে দাঁড়ালেন, ফিরে আসলেন এবং তার হাত আমার কাঁধের ওপর রাখলেন এবং বললেন, ‘প্রিয় বালক, তোমার আরও সাহস দরকার হবে যদি তুমি তোমার স্থির সংকল্পে অটল থাকো। তোমার জীবনের উদ্দেশ্যকে অর্জন করতে তোমাকে আরও সাহসী হতে হবে। কিন্তু মনে রেখো, যখন বাধাবিপত্তি তোমাকে ভেঙে দিতে চাইবে তখন কা-জ্ঞান বা কমনসেন্স প্রয়োগ করবে। কারণ বিপদের সামনে মানুষ কা-জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। তুমি সাধারণ লোক। আর সাধারণ লোকের আছে কা-জ্ঞান তথা সাধারণ বুদ্ধি। প্রতিকূল ঘটনাই এর বিকাশ ঘটায়। এগিয়ে যাও।’

এক সন্ধ্যায় এডিসন অন্য সবার আগে পৌঁছালেন। তিনি আমার কাছে হেঁটে এলেন এবং আমার বামে আসন নিলেন, যেখানে এমারসন বসতে অভ্যস্ত এবং বললেন, ‘তুমি জীবনের রহস্য আবিষ্কারের জন্য ভাগ্য কর্তৃক নির্দিষ্ট। খুব দ্রুতই তুমি এর স্বাক্ষী হবে। যখন সময় আসবে, তুমি পর্যবেক্ষণ করবে যে আমাদের জীবন শক্তির বা বাস্তু পদার্থের মহা সমাবেশে গঠিত হয়েছে, প্রত্যেক বুদ্ধিমান মানব সত্তা নিজেকে যেমন হওয়ার চিন্তা করে সে তেমনি হয়। জীবন সমাবেশের এই একক মৌমাছিদের মৌচাকের মতো এবং একত্রে থাকে যতক্ষণ না তাদের মূল অংশ থেকে পৃথক করা হয়। চিন্তাই সবকিছু। চিন্তার সামঞ্জস্য না থাকলে ব্যক্তির মধ্যে অহেতুক উত্তেজনা তৈরি হয়।

এই এককগুলোর বিভিন্ন অভিমত রয়েছে। এগুলো মানব সত্তার মতো এবং নিজেদের মধ্যে প্রায়ই লড়াই করে। এই সাক্ষাৎ যা তুমি পরিচালনা করছ তা তোমার জন্য অনেক সহায়ক হবে। এগুলো তোমার প্রতি দায়িত্ব আনবে যাতে তুমি একই রকমের জীবন এককগুলোকে রক্ষা করতে পারো। তোমার সভার সদস্যরা যাদের জীবনভর সেবা করেছে। এই এককগুলো শাশ্বত। এগুলো কখনো মরে না! তোমার স্বীয় চিন্তা এবং আকাক্সক্ষা চুম্বকের মতো আচরণ করে যা জীবনের এককগুলোকে আকর্ষণ করে। আমাদের এই পৃথিবী মহাসমুদ্রের মতো। যেখানে একজন মানুষের জীবন অন্যের সাথে জড়িত। এখানে কেবল একজনের যে আকাক্সক্ষা তার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ আকাক্সক্ষাগুলোই সামনে আসে।

সভার অন্য সদস্যরা কক্ষে আসা শুরু করল। এডিসন উঠে দাঁড়ালেন এবং ধীরভাবে হেঁটে তার স্বীয় আসনে বসলেন। যখন এটা ঘটেছিল তখনও এডিসন জীবিত ছিলেন। এটা আমাকে এত মহানভাবে প্রভাবিত করেছিল যে আমি তাকে দেখতে যাই এবং অভিজ্ঞতা সম্বন্ধে বলি। তিনি মুক্তভাবে হাসলেন এবং বললেন, ‘তোমার স্বপ্ন কল্পনার চেয়েও অধিক বাস্তব।’ তিনি আর কোন ব্যাখ্যা যোগ করলেন না।

এই সাক্ষাৎগুলো এতই বাস্তবিক হয়ে উঠেছিল যে আমি ভয় পেয়ে গেলাম। আমি কয়েক মাসের জন্য এগুলো বন্ধ রাখলাম। অভিজ্ঞতা এতটা রহস্যজনক ছিল যে আমি এই চিন্তা করে ভয় পেলাম যে যদি আমি এগুলো প্রতিনিয়ত চালিয়ে যাই, তবে আমি হয়তো বাস্তব এবং কল্পনার মধ্যকার পার্থক্য হারাব।

আমি আমার ‘অদৃশ্য উপদেষ্টাদের’ চর্চা থেকে বিচ্ছিন্ন হলাম। এভাবে প্রায় ৬ মাস কেটে যায়। আমি এক রাতে হঠাৎ জেগে উঠলাম বা আমি চিন্তা করেছিলাম যে আমি জাগ্রত। তখন আমি দেখলাম আমার বিছানার পাশে লিংকন দাঁড়িয়ে আছে। তিনি বললেন, ‘পৃথিবীতে শীঘ্রই তোমার কাজের দরকার পড়বে। এটা বিশৃঙ্খলতার একটা যুগের অধীন হতে যাচ্ছে, যার ফলে পুরুষ ও নারীরা তাদের আস্থা হারাবে এবং ভয়ে ভীত হয়ে উঠবে। তোমার কাজ নিয়ে এগিয়ে যাও এবং তোমার দর্শনকে পরিপূর্ণ করো। এই হচ্ছে তোমার জীবনের উদ্দেশ্য। যদি তুমি এটা অবহেলা করো, যেকোন কারণেই হোক না কেন, তোমাকে আদিম যুগের দিকে যেতে বাধ্য করা হবে এবং যা তুমি হাজারো বছর আগে পার করে এসেছ সভ্যতা সেই দিকেই পরিচালিত হবে।

পরদিন সকালে আমি ঘুম থেকে উঠলাম। আমি ঠিক বলতে পারব না। আমি কী স্বপ্ন দেখেছিলাম; নাকি এটা বাস্তব ছিল। তবে আমার মনে হয়েছে এটা স্বপ্ন ছিল। এটা আমার মনে এত তীব্র সাড়া দেয় যে আমি পরেরদিন থেকেই আমার সাক্ষাৎ সভা আরম্ভ করি।

আমাদের পরবর্তী সভায়, আমার সভার সকল সদস্য রুমে একত্রিত হলো এবং সভার টেবিল ঘিরে তাদের নির্ধারিত জায়গায় দাঁড়াল। লিংকন একটি পাত্র উঠিয়ে ধরলেন এবং বললেন, ‘ভদ্রমহোদয়গণ, আসুন আমরা একজন বন্ধুর জন্য খুশিতে পান করি যিনি বন্ধুমহলে ফিরে এসেছেন।’

তারপর থেকে, আমার সভায় আমি নতুন সদস্যদের যোগ করতে আরম্ভ করি, এ পর্যন্ত এই সভায় ৫০ জনেরও অধিক মানুষকে নেওয়া হয়েছে। এদের মধ্যে ছিলেন হযরত ঈসা (আ), সেন্ট পল, গ্যালিলিও, কোপারনিকাস, এরিস্টটল, প্লেটো, সক্রেটিস, হোমার, ভলতেয়ার, ব্রুনো, স্পিনোজা, ড্রমমন্ড, কান্ট, সোপেনহাওয়ার, নিউটন, কনফুসিয়াস, এলবার্ট হুবার্ড, ব্রান, ইজারসল, উইলসন এবং উইলিয়াম জেমস।

এই প্রথমবার আমি সাহস করে এর উল্লেখ করছি। ইতোপূর্বে আমি বিষয়টির ওপর নিশ্চুপ থাকতাম। কারণ আমি জানতাম, এমন ব্যাপার বর্ণনা করা সহজ, কিন্তু বোঝা কঠিন। আবার যে এই অসাধারণ অভিজ্ঞতা অনুভব করেছে তার জন্য এটা বোঝা সহজ। এগুলো প্রয়োগ এবং চর্চার মাধ্যমে বুঝতে হয়। আমি বহু বছরের চেষ্টা এবং চর্চার পর এখন আমার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করলাম। ছাপা কাগজে এই অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে আমার অনেক সাহস দরকার হয়েছে। তবে এখন আমি লোকজনের সমালোচনা নিয়ে ততটা উদ্বিগ্ন নই। বয়স বাড়ার সাথে সাথে, নিজের ভেতর বুঝজ্ঞান বৃদ্ধির সাথে সাথে আপনিও সত্যের প্রতি সাহসী হয়ে উঠার আশীর্বাদ পাবেন। যারা বোঝে না তারা কী চিন্তা করবে বা বলবেÑএই ধরনের আশঙ্কা সবসময়ই থাকবে। তবুও সত্য প্রকাশ করতে হবে। সময়ের সাথে সাথে সত্য নিজেই সূর্যের আলোর মতো চারিদিক আলোকিত করে তুলবে।

পাছে আমার বক্তব্যকে ভুল বোঝা হতে পারে, তাই বলছি যে আমি এখনও আমার সভার সাক্ষাৎকে একটি খাঁটি কাল্পনিক সত্তা রূপে উল্লেখ করি। কিন্তু আমি আমার অভিজ্ঞতা থেকে এই পরামর্শ দেওয়ার অধিকার অনুভব করি যে যদিও আমার সভার সদস্যরা খাঁটি রূপকথা এবং সাক্ষাৎগুলোর অস্তিত্ব শুধু আমার কল্পনায়, তারা আমাকে আমার দুঃসাহসিক কর্মের গৌরবময় পথে নেতৃত্ব দিয়েছে, সত্যিকারের মহানতর একটি পূর্ণ উপলব্ধিতে পুনরুদ্দীপিত করেছে, সৃজনশীল প্রচেষ্টায় উৎসাহ দিয়েছে এবং সৎ চিন্তাকে প্রকাশ করতে সাহস দিয়েছে।

মস্তিষ্কের কোষ-গঠনতন্ত্রের কোন এক জায়গায় এমন এক অঙ্গ আছে যা চিন্তার তরঙ্গকে গ্রহণ করে, সাধারণত যেগুলোকে আমরা ‘হঠাৎ ঝলক’ বা হঠাৎ বুদ্ধি বলে ডাকি। ষষ্ঠ অনুভূতির এই অঙ্গ কোথায় অবস্থিত এটা বিজ্ঞান এখনও আবিষ্কার করতে পারেনি। কিন্তু তা এখানে মুখ্য নয়। ব্যাপার হচ্ছে মানুষের মধ্যে এমন এক অঙ্গ রয়েছে যা অন্যান্য দৈহিক ইন্দ্রিয়ের চেয়ে ভিন্ন। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের পরিচয় আপনি তখনই পাবেন যখন আপনার মন অসাধারণ উদ্দীপনার অধীনে আসবে।

এমন সময় আমাদের আবেগ বৃদ্ধি পায় এবং হৃদস্পদন আরও দ্রুত স্পন্দিত হয়। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় যখন কাজ করে তখন এটা স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে দ্রুত কাজ করে। বিশেষ করে গাড়ি দুর্ঘটনা থেকে অতি অল্পে বেঁচে যাওয়া লোকজন এই অভিজ্ঞতা অর্জন করে। সেই বিশেষ মুহূর্তে একজনের জীবন রক্ষা করে কেবল ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়। খুব অল্প সময়ের মধ্যে, মুহূর্তের জন্য এসেই একজনের জীবন রক্ষা করে এবং একজনকে হয়তো দুর্ঘটনা বা বিপদআপদ থেকে রক্ষা করে।

আমি ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের এই ব্যাপার উল্লেখ করেছি যাতে আপনি এর ব্যবহার করতে পারেন এবং এর সুবিধা চিন্তা করে এর ব্যবহারে আগ্রহী হয়ে উঠতে পারেন। আমি যখন আমার ‘অদৃশ্য উপদেষ্টাদের’ সাথে সভা করতাম তখন আমি খেয়াল করলাম যে ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় দ্বারাই আমি সবচেয়ে বেশি নতুন নতুন আইডিয়া, ধারণা, বুদ্ধি এবং জ্ঞান পাই। যা অন্য কোনকিছুর সমান নয়। তাই আমি সত্যিকারভাবেই আমার ‘অদৃশ্য উপদেষ্টাদের’ কাছে ঋণী। তারা আমাকে আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় প্রয়োগ করতে অনেকভাবে অনুপ্রাণিত করেছে।

আমার ‘অদৃশ্য উপদেষ্টাদের’ প্রভাবের কারণে আমি এমন অনেক বিপদের মুখে পড়েও বেঁচে গেছি। এমন অনেক সংকট এসেছে যখন আমি কী করব তা নিয়ে দিশেহারা ছিলাম। তখন আমার উপদেষ্টারা আমাকে সঠিক পথ দেখিয়েছে।

কাল্পনিক সত্তাদের সাথে সাক্ষাৎ সভা চালনা করার ক্ষেত্রে আমার প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল স্বপরামর্শের সূত্রের মাধ্যমে আমার অবচেতন মনকে প্রভাবিত করা। কিছু নির্দিষ্ট চরিত্রের মহান ব্যক্তির কল্পনা করে, তাদের সাথে বসবাস করে আমি তাদের মহৎ গুণ অর্জন করতে চাই। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আমার অভিজ্ঞতা একটি ভিন্ন আঙ্গিকে পৌঁছেছে। আমি এখন আমার কাল্পনিক উপদেষ্টাদের কাছে যেকোন কঠিন সমস্যা নিয়েও যেতে পারি, যেকোন সময় যেতে পারি। ফলাফল প্রায়ই বিস্ময়কর। যদিও আমি এই উপদেশের ওপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল নই। তবুও এই ব্যাপার আমার সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা করে।

আপনি, অবশ্যই, মনে রেখেছেন যে এই অধ্যায় এমন এক বিষয় নিয়ে আলোচনা করছে যার সাথে অধিকাংশ মানুষ পরিচিত নয়। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় হচ্ছে একটি সম্পদ। যারা বিশালাকারের সম্পদ গড়তে চায় তাদের জন্য এই বিষয় একটি আগ্রহদায়ক এবং মুনাফাজনক ব্যাপার হতে পারে। কিন্তু যারা জীবনে কোনরকম সম্পদ আয় করতে চায় তাদের জন্য এটা না জানলেও চলবে।

এর একটি ভালো উদাহরণ হচ্ছে হেনরি ফোর্ড। তিনি নিঃসন্দেহে ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের ব্যাপার বুঝতেন এবং তার জীবনে প্রয়োগ করতেন। এটা তার বিশালাকার ব্যবসা এবং আর্থিক কর্মকা- দেখলে বোঝা যায়। প্রয়াত মহান বিজ্ঞানী টমাস আলভা এডিসনও তার উদ্ভাবনের বিকাশ সাধনে ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের প্রয়োগ করেছেন। বিশেষ করে তার মৌলিক উদ্ভাবনগুলোর ক্ষেত্রে। এগুলো এমন ক্ষেত্র ছিল যেগুলোর ব্যাপারে মানুষের পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল না এবং কেউ এই ব্যাপারে আগে কখনো চিন্তাও করেনি। যেমন কথা বলার যন্ত্র, চলন্ত ছবির যন্ত্র প্রভৃতি।

প্রায় সকল মহান নেতা, যেমন নেপোলিয়ন, বিসমার্ক, জোআন অব আর্ক, হযরত ঈসা (আ), বুদ্ধ এবং কনফুসিয়াস বুঝেছিলেন এবং সম্ভবত ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের প্রয়োগ করেছেন। তাদের মহান কাজের অধিকাংশ জায়গা তৈরি হয়েছে এই সূত্র সম্পর্কে তাদের জ্ঞানের ওপর।

ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় এমন কিছু নয় যা একজন যখন ইচ্ছা খুলে ফেলল; আর যখন ইচ্ছা পরে নিল। এই মহান ক্ষমতা প্রয়োগের সক্ষমতা আসে ধীরভাবে, এ বইয়ের অন্যান্য সূত্র প্রয়োগের পরে। ৪০ বছর বয়সের পূর্বে কদাচিৎ কোন ব্যক্তির কাছে ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় কাজে লাগানোর মতো জ্ঞান আসে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এই জ্ঞান সহজলভ্য হয় না যতক্ষণ না একজন ৫০ বছর পার করছে এবং এই কারণেই আত্মিক শক্তিগুলো, যেগুলোর সাথে ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় খুবই ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত সেগুলো বহু বছরের ধ্যান, আত্ম পরীক্ষণ এবং গুরুতর চিন্তা ব্যতীত পরিপক্কতা আসে না বা ব্যবহারযোগ্য হয়ে ওঠে না।

আপনার এ বই পড়ার উদ্দেশ্য যাই থাকুক না কেন, কোন ব্যাপার না। আপনি কে বা কোথায় আছেন সেটাও ব্যাপার না। আপনি এই অধ্যায়ের সূত্র ছাড়াও অন্য সূত্রাবলি প্রয়োগ করে লাভবান হতে পারেন। এই অধ্যায়ে বর্ণিত সূত্র আপনার না বুঝলেও চলবে। কিন্তু যারা এই বিশ্বে নিজেদের নাম স্বর্ণাক্ষরে লিখে রেখে যেতে চায়, তার জন্য ন্যায্য দাম দিতে প্রস্তুত অথবা প্রচুর ধনসম্পদ গড়তে চায় তাদেরকে এই সূত্র অবশ্যই বুঝতে হবে এবং জীবনে প্রয়োগ করতে হবে।

ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের এই অধ্যায় সংযুক্ত করা হয়েছে, কারণ এ বইকে একটি সম্পূর্ণ দর্শন আকারে উপস্থাপন করা হয়েছে। যা দ্বারা যেকোন ব্যক্তি তার জীবন থেকে যা চায় তা যেন নিজের প্রচেষ্টায় অর্জন করতে পারে। এটা হচ্ছে সাফল্য দর্শন। আর এই দর্শনের আরম্ভ বিন্দু হচ্ছে আকাক্সক্ষা, একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য। আকাক্সক্ষা, একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যে সফল হওয়ার আকাক্সক্ষা হচ্ছে সব ধরনের সাফল্যের আরম্ভ বিন্দু। আর শেষ বিন্দু হচ্ছে সফল হওয়ার যাত্রাপথে নিজেকে জানা, আত্ম অনুধাবন, অপরকে অনুধাবন, প্রকৃতির নিয়ম অনুধাবন, নতুন অভিজ্ঞতার সাথে পরিচয় এবং সুখের অনুধাবন।

এই প্রকারের অনুধাবন সম্পূর্ণ হয় কেবল ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের সাথে পরিচিত হওয়ার মাধ্যমেই এবং সূত্রটি প্রয়োগের দ্বারা। যেহেতু এই সূত্র এই দর্শনের একটা অংশ, সেহেতু এটা কেবল অর্থই নয়, তারচেয়েও বেশি কিছু দাবি করে।

এই অধ্যায় পড়ার সময়, আপনি অবশ্যই পর্যবেক্ষণ করেছেন যে যখন এটা পাঠ করছেন তখন আপনি নিজের মধ্যে একটা মানসিক উত্তেজনা অনুভব করেছেন। দারুণ! এক মাস পর আবার ফিরে আসুন। পুনরায় এটা পড়–ন এবং পর্যবেক্ষণ করুন যে আপনার মন এখনও একটা উচ্চ পর্যায়ের উত্তেজনায় উড্ডয়ন করছে কিনা। প্রায় প্রায় এই অভিজ্ঞতার পুনরাবৃত্তি করুন। ঠিক এখনই আপনি কতটা শিখেছেন বা কতটা কাজে লাগিয়েছেন এটা নিয়ে বেশি চিন্তিত হওয়ার দরকার নেই। আনন্দিত হোন। ধীরে ধীরে আপনি শিখবেন। পর্যায়ক্রমে আপনি নিজের ভেতর এক শক্তিশালী ‘আমিকে’ খুঁজে পাবেন। দেখবেন সেই ‘আমি’ আপনাকে এমন এক শক্তির অধিকারী করেছে যার ক্ষমতাবলে আপনি সব ধরনের নিরুৎসাহ, হতাশা এবং ভীতিকে ছুঁড়ে ফেলে দিবেন, গড়িমসির অভ্যাস জয় করবেন এবং আপনার কল্পনায় নিজের সাফল্যের পথ মুক্তভাবে অঙ্কন করতে পারবেন। তারপর আপনি সেই ‘অজানা কিছু’ স্পর্শ করার অনুভব করবেন যা হচ্ছে সব ধরনের সত্যিকার মহান নেতার, চিত্রকর, সংগীতজ্ঞ, লেখক এবং রাজনৈতিক ব্যক্তির চালক চেতনা। যে চেতনা মানুষকে মহান করেছে সেই চেতনা আপনার মধ্যেও বিরাজ করবে। তারপর আপনি সেই অবস্থানে থাকবেন যাতে আপনি আপনার আকাক্সক্ষাকে এর বাস্তব রূপে পরিণত করতে পারেন। আগে হয়তো আপনি একটি বাধা দেখলে শুয়ে পড়তেন এবং কাজই ত্যাগ করতেন। কিন্তু এখন আপনি আপনার নির্দিষ্ট আকাক্সক্ষা পূরণের জন্য রীতিমতো সংগ্রাম এবং লড়াই করবেন।


আস্থা বনাম ভীতি!

পূর্ববর্তী অধ্যায়ে কীভাবে স্ব-পরামর্শ, আকাক্সক্ষা এবং অবচেতন অংশের মাধ্যমে আস্থা গঠন করা যায় তাই বর্ণিত হয়েছে। আর পরবর্তী অধ্যায় হচ্ছে কীভাবে ভীতির ওপর কর্তৃত্ব করবেন তার বিস্তারিত নির্দেশনা।

এখানে ৬টি ভীতির একটি পূর্ণ বিবরণ পাওয়া যাবে। যেসব ভীতির কারণে সব ধরনের নিরুৎসাহ, ভীরুতা, দ্বিধাদ্বন্ধ, ভিন্নতা, সিদ্ধান্তহীনতা এবং উদ্দেশ্যের অভাব ঘটে থাকে; আত্মবিশ্বাস, প্রথম পদক্ষেপ, আত্মনিয়ন্ত্রণ এবং আগ্রহ নষ্ট হয়।

যখন আপনি ভীতির ৬ শত্রুকে পর্যবেক্ষণ করছেন, তখন নিজেকে সতর্কভাবে খুঁজে দেখুন, হয়তো এগুলো আপনার অবচেতন মনে অবস্থিত, যেখানে এদের উপস্থিতি নির্ণয় করা কঠিন।

এটাও মনে রাখবেন, যখন আপনি ‘ভীতির ৬ ভূতকে’ পর্যবেক্ষণ করছেন, তারা আর কিছুই না শুধু একটি অনুভূতিমূলক ছায়া মাত্র। কারণ এরা শুধু একজনের মনেই অবস্থান করে। ভূত বলতে এখানে একটি অনুভূতিমূলক ছায়াকেই বোঝানো হয়েছে। এটা একজন পুরুষের মনে অবস্থিত। এটাকে অনুভব করা যায়, কিন্তু ধরাছোঁয়ার বাইরে। যেমন একটা ছায়া। এটাকে ধরা যায় না। কারণ বাস্তবে এর কোন অস্তিত্ব নেই।

আরও মনে রাখবেন যে ভূতগুলো হচ্ছে আপনার অনিয়ন্ত্রিত কল্পনার সৃষ্টি। অধিকাংশ মানুষ তাদের নিজের মন দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এজন্য ভূতগুলো ততটাই বিপদজনক হতে পারে যতটা এগুলো জীবন্ত এবং বাহ্যিক দেহ নিয়ে এই পৃথিবীতে চলাচল করলে হত।

দরিদ্রতা ভীতির ভূত যা ১৯২৯ সালে লক্ষাধিক লোকের মনকে আক্রমণ করেছিল, এটা এতটা বাস্তবিক ছিল যে এর কারণে দেশে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ব্যবসায়িক ধ্বস সৃষ্টি হয়। অধিকন্তু, এই নির্দিষ্ট ভূত এখনও ভীতি প্রয়োগ করে আমাদের কিছু মানুষকে বুদ্ধিহীন করে রেখেছে।


 




অধ্যায় - ১৫

ভীতির ছয় ভূতকে কীভাবে উত্তম কৌশলে পরাজিত করবেন?


আপনি এ বইয়ের শেষ অধ্যায় পড়ছেন। পাঠ করতে করতে নিজেকে পর্যবেক্ষণ করুন এবং আপনার পথে কতগুলো ‘ভূত’ বাধা হয়ে আছে তা খুঁজে বের করুন।


এই দর্শনের যেকোন অংশ প্রয়োগের আগে আপনার মনকে অবশ্যই এটা গ্রহণের জন্য প্রস্তুত করতে হবে। প্রস্তুতিটা কঠিন কিছু নয়। এটা অধ্যয়ন, পর্যবেক্ষণ এবং বুঝজ্ঞান দ্বারা শুরু হয়। আপনাকে অবশ্যই নিজের ভেতর থেকে ৩টা শত্রুকে পরিষ্কারভাবে বের করে ফেলতে হবে। এগুলো হলো সিদ্ধান্তহীনতা, সন্দেহ এবং ভীতি!

যতক্ষণ এই ৩টা নেতিবাচক অনুভূতি আপনার মনের মধ্যে বাস করবে ততক্ষণ ষষ্ঠ অনুভূতি কাজ করবে না। এই ৩টা হচ্ছে অপবিত্র অনুভূতির সদস্য এবং এরা একে অপরের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত; যেখানে একটাকে পাওয়া যায়, সেখানে অপর ২টাও কাছাকাছি থাকে।

সিদ্ধান্তহীনতা হচ্ছে ভীতির বীজ স্বরূপ! যখন আপনি পাঠ করছেন তখন এটা মনে রাখবেন। সিদ্ধান্তহীনতা পরে সন্দেহে পরিণত হয়। তারপর এই দুটি মিশ্রিত হয়ে ভীতিতে পরিণত হয়! প্রায়ই দেখা যায় এই ‘মিশ্রণ’ খুব ধীরে ধীরে ঘটে। এজন্য অনেকে ধরতে পারে না। আর এই কারণেই এই তিনটি শত্রু অত্যন্ত বিপদজনক। একজনের পর্যবেক্ষণ ছাড়াই এগুলোর অঙ্কুরোধগম হয় এবং বেড়ে ওঠে। তাই ঘুণাক্ষরেও কেউ টের পায় না যে এগুলো এত বড় ক্ষতি করতে পারে।

এই অধ্যায়ের কাজ হচ্ছে আপনাকে এগুলোর ধ্বংসাত্মক দিক উন্মোচিত করে দেখানো। এই দর্শন অর্জনের পূর্বে এবং আপনার বাস্তবিক জীবনে প্রয়োগের পূর্বে আপনাকে অবশ্যই এগুলোকে ধ্বংস করতে হবে। এতে করে আপনি আরও একটি ব্যাপার পর্যবেক্ষণ করবেন যে কেন বহু সংখ্যক মানুষ দরিদ্রতায় বাস করে। আর আপনি এটাও বুঝবেন যে যারা এই ব্যাপারের সত্যতা ধরতে পেরেছে তারা সকলেই ধনী। এটা হচ্ছে তাদের বুঝজ্ঞান বা একটি স্থির মানসিক অবস্থা যা অর্থের চেয়েও বেশি মূল্যবান। এই অধ্যায়ের উদ্দেশ্য হচ্ছে ৬টি মূল ভীতির কারণ এবং সমাধানের ওপর আপনার মনোযোগের উজ্জ্বল ও কেন্দ্রীভূত আলো ফেলা। একজন শত্রুর ওপর কর্তৃত্বের পূর্বে আমাদেরকে অবশ্যই এটার নাম, স্বভাব এবং বাসস্থান সম্পর্কে জানতে হবে। আপনি যখন পাঠ করবেন তখন সতর্কতার সাথে নিজেকে পর্যবেক্ষণ করুন এবং নিজের ব্যাপারে নিশ্চিত হোন। যদি আপনার ভেতর এই ৬টি ভীতির কোন একটি থাকে তবে কোনটি আছে, কোনটি নিয়ে আপনি বসবাস করেন।

এই অতি সূক্ষ্ম শত্রুদের স্বভাব দ্বারা প্রতারিত হবেন না। এরা কখনো কখনো অবচেতন মনে লুকিয়ে থাকে, যেখানে তাদেরকে নির্ধারণ করা কঠিন। আর দূর করা তো আরও কঠিন।


৬টি মূল ভীতি

এখানে যে ৬টি ভীতির উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলোর সাথে প্রায় সব মানুষই পরিচিত। এগুলো বা এগুলোর মিশ্রণে তৈরি আরও কিছু ভীতির অনুভূতি মানুষের মনের গভীরে বাস করে। কিন্তু মূল হচ্ছে এই ৬টি। যারা পূর্ণরূপে এই ৬টি ভীতি থেকে মুক্ত তারা সত্যিই ভাগ্যবান। এখানে ভীতিগুলোর নাম উল্লেখ করা হলো। এগুলোর সাধারণ উপস্থিতির ভিত্তিতে নামের ক্রম তালিকা করা হয়েছে। এগুলো হল:


দরিদ্রতা ভীতি } আমাদের অধিকাংশ

সমালোচনা ভীতি } মানুষের দুশ্চিন্তার

অসুস্থতা ভীতি } মূলে এগুলোর বাস

ভালোবাসার কাউকে হারানোর ভীতি

বৃদ্ধ বয়স ভীতি

মৃত্যু ভীতি


অন্য যত ভীতি আছে তা তত গুরুত্বপূর্ণ নয়। সেগুলো হয়তো এই ৬টির পরে আসতে পারে। তবে প্রধান এবং প্রথম হচ্ছে এই ৬টি।

এই ভীতির সর্ব ব্যাপকতা যেন পৃথিবীর জন্য এক অভিশাপ। এটা চাকার মতো সারা বিশ্বময় ঘুরছে। যখন ব্যবসায়িক ধ্বস নামে তখন থেকে প্রায় ৬ বছর ধরে আমরা দরিদ্রতা ভীতির চাকার মধ্যে এপাশ-ওপাশ করছি। তারপর এলো বিশ্বযুদ্ধ। তখন আমরা ছিলাম মৃত্যু ভীতির চাকার মধ্যে। এরপর সেই যুদ্ধ অনুসরণ করে আমরা প্রবেশ করলাম অসুস্থতা ভীতির চাকার ভেতর। বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়া মহামারী রোগ এই সাক্ষ্য দেয়।

ভীতিগুলো আর কিছুই না শুধু মনের একটা অবস্থা ছাড়া। একজনের মানসিক স্থিরতাই এটা নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম। আমরা প্রত্যেকেই জানি যে ডাক্তাররা রোগ দ্বারা খুব কম আক্রান্ত হন যতটা হয় একজন অপেশাদার ব্যক্তি। এর কারণ হচ্ছে চিকিৎসকরা রোগকে ভয় পান না। চিকিৎসকরা ভয় বা দ্বিধা ছাড়াই প্রতিদিন শত শত লোকের সংস্পর্শে আসেন। তারা সংক্রামক রোগের রোগী যারা বসন্ত রোগে আক্রান্ত তাদেরও সংস্পর্শে আসেন। রোগের বিরুদ্ধে তারা ভয় পায় না। এটাই তাদের প্রতিরোধক। যদিও এটাই একমাত্র বিষয় নয়। তাদের এই সম্বন্ধে শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণ রয়েছে।

একজন ব্যক্তি কিছুই সৃষ্টি করতে পারে না; যদি-না সে এটা তার চিন্তায় সৃষ্টি করতে পারে। এই বিবৃতি অনুসারে, আরও একটি অধিক গুরুত্বপূর্ণ বিবৃতি আসে, যা হচ্ছে, ব্যক্তির চিন্তা তরঙ্গ তৎক্ষণাৎ সেগুলোকে বাস্তবে রূপান্তর করতে আরম্ভ করে, যদিও সেই চিন্তা ব্যক্তির ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় হোক। চিন্তা স্পন্দন, যা ইথার থেকে তুলে নেওয়া হয়, কেবল এই সুযোগ দ্বারা (চিন্তা যা অন্যদের মন থেকে প্রকাশ পায়) হয়তো একজন নিশ্চিত করতে পারে তার আর্থিক, ব্যবসায়িক, পেশাগত বা সামাজিক ভাগ্য যেমনটা নিশ্চিত করতে পারে সেই চিন্তা স্পন্দন যা একজন নিজের একাগ্র চিত্ত, মনোযোগ এবং কৌশল দ্বারা সৃষ্টি করে।

আমরা এখানে একটি বিষয়ের ভিত্তি তৈরি করছি। এতে করে সেই ব্যক্তির জন্য ভিত্তি তৈরি হবে যে ব্যক্তি এটা বুঝতে পারে না যে কেন কিছু লোক ‘ভাগ্যবান’ রূপে আবির্ভূত হয় যখন অন্যরাও সেই একই সমান বা এরচেয়েও বেশি দক্ষতা, প্রশিক্ষণ, অভিজ্ঞতা এবং মস্তিষ্কের ধারণ ক্ষমতা নিয়েও দেখা যায় দুর্ভাগ্যের শিকার হয়, যেন এটা আগে থেকেই নির্ধারণ করা। আমি এই ব্যাপারে ব্যাখ্যা দিতে চাই। প্রত্যেক মানব সত্তার সম্পূর্ণ ক্ষমতা আছে তার মনকে নিয়ন্ত্রণ করার এবং এই নিয়ন্ত্রণের সাথে, অবশ্যই, প্রত্যেক ব্যক্তি তার মন খুলে চিন্তা স্পন্দনকে মাড়াতে পারে যা অন্যদের মস্তিষ্ক থেকে প্রকাশিত হয় অথবা দরজা শক্ত করে বন্ধ করতে পারে এবং অনুমতি দিতে পারে শুধু তার নিজের পছন্দানুযায়ী চিন্তা স্পন্দনকে ঢোকার। না হলে অন্যের নেতিবাচক চিন্তা আমার মনে প্রবেশ করে আমার সাজানো বাগান, মানে মনের সাজানো ইতিবাচক চিন্তার বাগানকে তছনছ করে দিবে। এভাবেই অন্যের অভিশাপ প্রথমে আমাদের চিন্তার বাগানকে বিচলিত করে, তারপর আমাদের জীবনে ধ্বংস ডেকে আনে।

প্রকৃতি একটি বিষয়ে মানুষকে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা দিয়েছে। আর তা হচ্ছে চিন্তা করা। এই ব্যাপার আরও দুটি অতিরিক্ত ব্যাপার সংযুক্ত করে যে আজ পর্যন্ত মানুষ যা কিছু সৃষ্টি করেছে তার সবকিছুর আরম্ভ হয়েছে একটি চিন্তা আকারে। আর অন্যটি হচ্ছে চিন্তার এই সূত্র দ্বারা ভীতির ওপর কর্তৃত্ব করা যায়।

যদি এটা সত্য হয় যে সব চিন্তারই একটা প্রকৃতি হচ্ছে নিজেদেরকে এর বাহ্যিক সমতুল্যে পরিণত করার (এবং এতে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই), এটাও সমানভাবে সত্য যে ভীতি এবং দরিদ্রতার চিন্তা স্পন্দনকেও সাহস ও ধনসম্পদের চিন্তায় রূপান্তরিত করা যায়। একজন ব্যক্তি যদি ভীতি এবং দরিদ্রতার চিন্তা করে, তবে বাস্তবে সে কখনো সাহসী ও ধনী হতে পারে না। প্রথমত, ব্যক্তিকে সাহসী এবং ধনী হওয়ার চিন্তা করতে হবে। দ্বিতীয়ত, চিন্তা অনুযায়ী বাস্তবে সাহসী কাজ করবে এবং ধনী হবে।


দরিদ্রতা ভীতি

দরিদ্রতা এবং ধনীর মধ্যে কোন বোঝাপড়া হতে পারে না! দরিদ্রতা এবং ধনী হওয়ার গমন পথ পরস্পর ভিন্ন। যদি আপনি ধনী হতে চান, তবে আপনাকে অবশ্যই যেকোন ধরনের অবস্থা বাতিল করতে হবে যা দরিদ্রতার দিকে গমন করে। এখানে ‘ধনী’ শব্দের বৃহৎ মানে ব্যবহৃত হয়েছে। যার মানে হচ্ছে আর্থিক, আত্মিক, মানসিক এবং বস্তুগত অবস্থা অর্জন করা। পথের আরম্ভ বিন্দু যা ধনীদের দিকে গমন করে তা হচ্ছে আকাক্সক্ষা। প্রথম অধ্যায়ে আপনি যাতে আপনার আকাক্সক্ষার পরিপূর্ণ প্রয়োগ করতে পারেন সে সম্পর্কে পূর্ণ নির্দেশনা পেয়েছেন। এই অধ্যায়ে আপনি ভীতি সম্বন্ধে নির্দেশনা পাবেন যাতে করে আপনি আপনার মনকে পরিপূর্ণ রূপে আপনার আকাক্সক্ষা পূরণে প্রয়োগ করতে পারেন।

এখানে, এই মুহূর্তে, নিজেকে একটি প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য চ্যালেঞ্জ জানান। এতে করে আপনি বুঝতে পারবেন যে এই দর্শনের কতটুকু আপনি শোষণ করেছেন।

এই হচ্ছে সেই বিন্দু যেখানে আপনি ভবিষ্যৎ বক্তা রূপে রূপান্তর হতে পারেন। এখান থেকেই আপনি বলতে পারেন যে আপনার ভবিষ্যৎ সংগ্রহশালায় আপনার জন্য কী আছে। যদি এই অধ্যায় পড়ার পরেও, দরিদ্রতাকে গ্রহণ করে নিতে ইচ্ছুক হন, তবে আপনি হয়তো তদানুযায়ী আপনার মনকে দরিদ্রতা গ্রহণের জন্য তৈরি করবেন। এখন সিদ্ধান্ত নিন কী করবেন? এই একটি সিদ্ধান্ত যা আপনি কোনক্রমেই এড়াতে পারেন না।

যদি আপনি ধনী হতে দাবি করেন এবং কতটুকু পরিমাণ ধনী হবেন তা নিশ্চিত করেন, এই পরিমাণ যেন ততটুকুই হয় যতটুকুতে আপনি সন্তুষ্ট হবেন, তাহলে আপনি এখন সেই পথ সম্বন্ধে জানেন যা ধনীদের দিকে গমন করে। আপনাকে একটি পথের নকশা দেওয়া হয়েছে, যদি আপনি অনুসরণ করেন, তবে সেই পথ আপনাকে আপনার আকাক্সক্ষা পূরণের পথেই রাখবে। আর যদি আপনি পথ চলতে অবহেলা করেন অথবা পৌঁছানোর আগেই থেমে যান, তবে কেউ আপনাকে দোষারোপ করবে না, শুধু আপনি নিজে ছাড়া। এই দায়িত্ব শুধুই আপনার। এই দায়িত্ব গ্রহণ করা থেকে আপনাকে কোন অজুহাত রক্ষা করতে পারে না। যদি আপনি ধনী হওয়ার আকাক্সক্ষা গঠন করতে ব্যর্থ হন অথবা যেই পথে ধনী হওয়া যায় সেই পথে চলতে অস্বীকার করেন, তবে কোন অজুহাতই আপনাকে রক্ষা করবে না। এটা আপনি জানেন। কারণ ব্যর্থতা শুধু একটি সাময়িক বাধা মাত্র। আপনি যদি আপনার মানসিক অবস্থা নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন, তবে আপনি ব্যর্থতা থেকে শিখবেন এবং এগিয়ে যাবেন। মানসিক অবস্থাই সবকিছু। একটি মানসিক অবস্থা এমন কিছু যা একজন নিজের আকাক্সক্ষা দ্বারা অধিকার করে। এটা কিনতে পাওয়া যায় না। একে অবশ্যই তৈরি করতে হবে।

দরিদ্রতা ভীতি হচ্ছে একটি মানসিক অবস্থা। মানসিক অবস্থা ছাড়া এটা আর কিছুই না! কিন্তু এটাই একজনের সাফল্যের জন্য যেকোন অঙ্গীকার ধ্বংস করে দিতে যথেষ্ট। এটা ভয়ংকর এক সত্য। যখন ব্যবসায়িক বিপর্যয় দেখা দেয় তখন এটার বাস্তব রূপ দেখা যায়।

দরিদ্রতা ভীতি আমাদের যুক্তি বা কারণ অনুষদকে পঙ্গু করে দেয়, কল্পনা অনুষদকে ধ্বংস করে, আত্মবিশ্বাসকে খুন করে, আগ্রহের গোড়া ক্ষয় করে, নতুন উদ্যোগকে নিরুৎসাহিত করে, অনিশ্চিত উদ্দেশ্যের দিকে নিয়ে যায়, দ্বিধাদ্বন্ধকে উৎসাহিত করে, আগ্রহকে দূরীভূত করে এবং আত্মনিয়ন্ত্রণকে একটি অসম্ভব ব্যাপারে হিসাবে তৈরি করে। এটা একজনের ব্যক্তিত্ব থেকে উজ্জ্বলতা ছিনিয়ে নেয়, দক্ষভাবে চিন্তা করার সম্ভাবনাকে ধ্বংস করে, চেষ্টা করার মানসিকতাকে অনর্থক করে তোলে, অধ্যবসায়কে নষ্ট করে, ইচ্ছাশক্তিকে ‘কিছু না’তে পরিণত করে, উচ্চাশাকে ধ্বংস করে, স্মৃতিকে কুয়াশাচ্ছন্ন করে এবং প্রত্যেক সম্ভাব্য উপায়ে ব্যর্থতাকে নিমন্ত্রণ দেয়। দরিদ্রতা ভীতি ভালোবাসাকে খুন করে এবং হৃদয়ের সর্বাধিক ভালো অনুভূতিকে হত্যা করে, বন্ধুত্বকে নিরুৎসাহিত করে এবং দুর্ভাগ্যকে একশ উপায়ে নিমন্ত্রণ জানায়, অনিদ্রার দিকে নিয়ে যায়, দুঃখ ও সুখহীনতার দিকে ধাবিত করে এবং এই সবকিছু সত্ত্বেও একটি সুস্পষ্ট সত্য এই যে আমরা একটি পৃথিবীতে বাস করি যেখানে সবকিছুরই প্রাচুর্যতা রয়েছে। যা একটি হৃদয় আকাক্সক্ষা করে তা আমরা পেতে পারি। শুধু একটি নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যের অভাব ব্যতীত আমাদের এবং আমাদের আকাক্সক্ষার মধ্যে অন্য কোনকিছুই বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না।

সন্দেহাতীতভাবে দরিদ্রতা ভীতি হচ্ছে ৬টি মূল ভীতির মধ্যে সর্বাধিক ধ্বংসাত্মক। একে সবার উপরে স্থান দেওয়া হয়েছে, কারণ এর ওপর কর্তৃত্ব করাই সবচেয়ে কঠিন। এই ভীতির জন্ম সম্পর্কে সত্য বিবৃতি দিতে গেলে অনেকখানি সাহস দরকার এবং এই সত্য বিবৃতি দেওয়ার পর একে গ্রহণ করতে গেলে আরও বেশি সাহস দরকার। দরিদ্রতা ভীতি পুরুষের সহজাত প্রবণতার কারণে বেড়ে ওঠে যা হচ্ছে তার অনুসারী কর্মচারীদের অর্থনৈতিকভাবে শিকার এবং শোষণ করা। মানুষের চেয়ে নি¤œ জাতের যত প্রাণী আছে তারা সহজেই আবেগ দ্বারা চালিত হয়। তাদের ‘চিন্তা করার ক্ষমতা’ খুবই কম। তাই তারা একে অপরের ওপর দৈহিকভাবে শিকার করে। কিন্তু পুরুষ, তার উচ্চ অনুভূতিসম্পন্ন স্বতঃফূর্ত জ্ঞান, চিন্তা করার ক্ষমতা এবং যুক্তি দ্বারা তার অনুসারী কর্মচারীকে দৈহিকভাবে খায় না; বরং সে তাকে অর্থনৈতিকভাবে ‘খেয়ে’ আরও বেশি সন্তুষ্ট হয়। মানুষ এতই অর্থ লোভী যে তার কর্মচারী থেকে নিজেকে নিরাপদ রাখতে সে যত ধরনের আইন প্রয়োগ করা দরকার তা করে।

সভ্যতার শুরু থেকে ধীরে ধীরে আমরা আজকে এই আধুনিক পৃথিবীতে এসে পৌঁছেছি। আমরা ধরে নিয়েছি সব যুগ থেকে আজকের এই আধুনিক যুগ সবচেয়ে অসাধারণ। কারণ অর্থের প্রতি মানুষের উন্মাদনা, টাকাপয়সার প্রতি তার অনিয়ন্ত্রিত পাগলামি। একজন মানুষকে পৃথিবীর ধূলিকণা থেকেও ছোট মনে করা হয় যদি-না সে একটি মোটা অংকের ব্যাংক-ব্যালেন্স দেখাতে পারে। কিন্তু যদি তার টাকা থাকে, সেটা কোন ব্যাপারই না সে যেভাবেই টাকা অর্জন করে থাক না কেন। সে একজন ‘রাজা’ বা একটা ‘বড় কিছু’। সে সব আইনের ঊর্ধ্বে। সে রাজনীতিকে চালায়। সে ব্যবসায় কর্তৃত্ব করে এবং যখন সে পথ দিয়ে হেঁটে যায় তখন গোটা বিশ্ব সম্মানে ঝুঁকে পড়ে।

এত পরিমাণে দুর্দশা এবং অপমান আর কিছুই আনতে পারে না শুধু দরিদ্রতা ব্যতীত। একমাত্র তারাই এর পুরো মানে বুঝতে পারে যাদের দরিদ্র অবস্থার অভিজ্ঞতা আছে।

এটা আশ্চার্য বিষয় নয় যে পুরুষ দরিদ্রতাকে ভয় পায়। জীবনের লম্বা সারির দীর্ঘ অভিজ্ঞতা থেকে পুরুষ শিখেছে এবং নিশ্চিত হয়েছে যেখানে অর্থের ব্যাপার ও বৈষয়িক সম্পত্তি যুক্ত সেখানে কিছু লোককে বিশ্বাস করা যায় না। আর্থিক বিষয়ে বিভিন্ন মামলা মোকাদ্দমা দেখলেই এর সততা বুঝতে পারবেন।

অধিকাংশ বিবাহ একজনের সম্পদ দ্বারা বা উভয় পক্ষের সম্পদ দেখে প্রভাবিত হয়। এমনকি সম্পদের অভাবেও অনেক বিবাহ ভেঙে যায়। তালাকের আদালতে ভিড় দেখেই তা অনুমান করা যায়।

তাই পুরুষ সম্পদ অধিকারে এত আগ্রহী যে সে এটা যেকোন উপায়ে অর্জন করবে। যদি সম্ভব হয় বৈধ পথে অর্জন করবে; না হলে অন্য কোন সুবিধাজনক পদ্ধতিতে সম্পদ অর্জন করবে।

আত্মবিশ্লেষণ এই দুর্বলতাগুলো খুলে দেখায়। এজন্যই মানুষ আত্মবিশ্লেষণ করতে চায় না এবং এটা পছন্দ করে না। এই প্রকারের পরীক্ষা তাদের সকলেরই জন্য প্রয়োজন যারা জীবন থেকে আরও বেশি চায়, মধ্যবিত্ত বা দরিদ্রতার অবস্থা থেকে বেশি চায়। মনে রাখবেন, যখন আপনি নিজেকে প্রতিটি খুঁটিনাটিসহ পরীক্ষণ করছেন, তখন আপনি স্বয়ং উভয় আদালত ও বিচারক, বিবাদী পক্ষের উকিল ও বাদী পক্ষের উকিল এবং আপনি স্বয়ং অভিযোগকারী ও রক্ষাকারী, আরও হচ্ছে আপনি স্বয়ং বিচারের মুখোমুখী। সবদিক থেকে সমানভাবে ব্যাপারগুলোর মুখোমুখী হোন। নিজেকে সুনির্দিষ্ট প্রশ্ন করুন এবং সরাসরি উত্তর দাবি করুন। যখন পরীক্ষা শেষ হবে, আপনি নিজের সম্পর্কে আরও বেশি জানবেন। যদি আপনার মনে হয় যে আপনি একজন নিরপেক্ষ বিচারক হতে পারবেন না, তবে এই আত্মপরীক্ষায় বা আত্মবিশ্লেষণে এমন কাউকে সঙ্গে রাখুন যিনি একজন নিরপেক্ষ বিচারক হতে পারবে, যিনি আপনাকে ভালোভাবে জানে, যাকে আপনি বিশ্বাস করেন যে তিনি আপনাকে নিরপেক্ষভাবে বিচার বিশ্লেষণ করবে। এরপর আপনি নিজের সম্পর্কে সত্য জেনে যাবেন। এটা গ্রহণ করুন। কোন ব্যাপার না যত দামই দিতে হোক না কেন, যদিও এটা হয়তো আপনাকে সাময়িকভাবে লজ্জিত করবে! তারপরও এই সত্যকে গ্রহণ করুন।

অধিকাংশ লোককে, যদি জিজ্ঞেস করা হয় যে তারা সবচেয়ে বেশি কী ভয় পায়। তবে উত্তর দিবে, ‘আমি কিছুই ভয় পাই না।’ তাদের উত্তর সঠিক নয়। কারণ অল্প কিছু লোক অনুধাবন করে যে তাদের ক্ষমতা সীমাবদ্ধ, প্রতিবন্ধকতায় আবদ্ধ, এমন কিছু ভীতি আছে যা তাদেরকে আত্মিক এবং দৈহিকভাবে আকঁড়ে আছে। ভীতিগুলো একজনের মনের গভীরে এত সূক্ষ্মভাবে বসবাস করে যে একজন সারাজীবন এগুলো বয়ে বেড়ালেও এর উপস্থিতি অনুভবই করে না। একমাত্র একটি সাহসী পর্যবেক্ষণই এই সর্বব্যাপী শত্রুর উপস্থিতি উন্মোচন করতে পারে। যখন আপনি এমন একটি বিশ্লেষণ শুরু করবেন, তখন আপনার চরিত্রের গভীরে খোঁজ চালান। এখানে উপসর্গগুলোর একটি তালিকা দেওয়া হলো যা দেখে আপনি নিশ্চিত হতে পারেন।


দরিদ্রতা ভীতির উপসর্গ

উদাসীনতা। সাধারণত প্রকাশ পায় লক্ষ্যের অভাব থেকে, দরিদ্রতা সহ্য করার আকাক্সক্ষা থেকে; জীবনের প্রতি কোন ধরনের প্রতিবাদ না করা; জীবন থেকে যা ক্ষতিপূরণ পাওয়া যায় তাই গ্রহণ করার অভ্যাস; মানসিক ও দৈহিক অলসতা; প্রথম পদক্ষেপ নেওয়ার অভাব, কল্পনা, আগ্রহ এবং আত্মনিয়ন্ত্রণের অভাব।

সিদ্ধান্তহীনতা। নিজের জন্য অন্যদের চিন্তা করার অনুমতি দেওয়ার অভ্যাস। ‘নিরাপদ গ-ির ভেতর’ থাকা।

সন্দেহ। সাধারণত প্রকাশ পায় ওজর এবং অজুহাত দিয়ে নকশা করে মোড়া, ব্যাখ্যাহীন একটি ব্যাপার অথবা নিজের ব্যর্থতার জন্য ক্ষমা চাওয়া। এরপর শুরু হয় যারা সফল তাদের প্রতি হিংসা করা অথবা তাদের যারা সমালোচনা করে তাদেরকে ঘৃণা করা।

উদ্বিগ্ন বা বিরক্ত হওয়া। অন্যদের ভুল খোঁজার মধ্য দিয়ে সাধারণত এটা প্রকাশ পায়। নিজের আয়ের চেয়ে বেশি খরচ করার একটি প্রবণতা, নিজের উপস্থিতি অবহেলা করা, গোমড়ামুখো ভাব এবং ভ্রুকুটি করা; মদ্য পানের প্রতি অতিমাত্রায় ঝোঁক, কিছু কিছু সময় ঘুমের ঔষধ ব্যবহার করা; দুর্বল স্নায়ু বিশিষ্ট লোক মানে সহজেই উত্তেজিত বা ভীত হয় এমন, ধার্মিকতার অভাব, আত্মসচেতনতা এবং আত্মবিশ্বাসের অভাব।

অতিরিক্ত-সতর্কতা। প্রতিটি ঘটনার নেতিবাচক দিক খুঁজে বের করার অভ্যাস। চিন্তা করা এবং সাফল্যের সুযোগের দিকে মনোযোগ দেওয়ার পরিবর্তে সম্ভাব্য ব্যর্থতা নিয়ে কথা বলা। ধ্বংসের সব পথ সম্পর্কে জানে, কিন্তু কখনো ব্যর্থতাকে এড়ানোর জন্য পরিকল্পনা খোঁজে না। ‘সঠিক সময়’ আরম্ভ হওয়ার অপেক্ষা করে যাতে ধারণা এবং পরিকল্পনা কাজে পরিণত করা যায়। এভাবে অপেক্ষা করতে করতে অপেক্ষা করাকেই একটি স্থায়ী অভ্যাসে পরিণত করে। যারা ব্যর্থ হয়েছে তাদের মনে রাখা এবং যারা সফল হয়েছে তাদের ভুলে যাওয়া। ভিজা ময়দার তাল সেখানেও গর্ত দেখে। অথচ ভেজা ময়দার তালকে উপেক্ষা করে। দুঃখবাদ মানে জগৎ দুঃখময় এই অভিমত নিয়ে চলা। এটা হজমের সমস্যার দিকে নিয়ে যায়, নিম্নমানের বিবেচনা করতে প্ররোচিত করে, নিজের মধ্যে অতিশয় উত্তেজনা সৃষ্টি করে, শ্বাস-প্রশ্বাসে সমস্যা তৈরি করে এবং খারাপ মেজাজ বজায় রাখে।

দীর্ঘসূত্রতা বা গড়িমসি করার অভ্যাস। আগামীকালের জন্য রেখে দেওয়ার অভ্যাস। যা গত বছর করা উচিত ছিল তা এখনও করা হয়নি। একটি কাজ সম্পন্ন করার জন্য ওজর এবং অজুহাত সৃষ্টিতে যথেষ্ট সময় খরচ করা। এই উপসর্গ অতিরিক্ত-সতর্কতা, সন্দেহ এবং উদ্বিগ্ন হওয়ার সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। যখন দায়িত্ব এড়ানো যায় তখন দায়িত্ব গ্রহণে অস্বীকার করা। একটি একগুঁয়ে লড়াই রাখার পরিবর্তে বোঝাপড়া করার ইচ্ছা। বাধাকে সজ্জিত এবং ব্যবহার করে উন্নতির সিড়ি তৈরির ধাপে পরিণত করার পরিবর্তে বাধার সাথে বোঝাপড়া করা। জীবন থেকে সমৃদ্ধি, ঐশ্বর্য, ধনসম্পদ, সন্তুষ্টি এবং সুখ চাইবে তার পরিবর্তে জীবনের সাথে এক পয়সা নিয়ে ঝগড়া করা। সফল হওয়ার জন্য পিছনের সব সেতু পুড়িয়ে ফেলতে হবে এবং পিছনে ফেরা অসম্ভব করে তুলতে হবে। এর পরিবর্তে যদি এবং যখন ব্যর্থতায় পড়বে তখনকার জন্য পরিকল্পনা করা। প্রায়ই যেগুলোর অভাব ঘটে তা হচ্ছে পূর্ণ আত্মবিশ্বাস, প্রথম পদক্ষেপ, আগ্রহ, নির্দিষ্ট লক্ষ্য, মিতব্যয়িতা এবং যৌক্তিক কারণমূলক দক্ষতা। ধনী হওয়ার দাবি করবে তার পরিবর্তে দরিদ্রতা আশা করা। যারা ধনী হতে চায় এবং ধনী হয় তাদের সহযোগী হওয়ার পরিবর্তে যারা দরিদ্রতা গ্রহণ করেছে তাদের সহযোগী হওয়া।

টাকা কথা বলে!

কিছু লোক জিজ্ঞেস করবে, ‘কেন আপনি টাকা সম্পর্কে একটি বই লিখেছেন? ধনীদের শুধু টাকা দিয়ে কেন পরিমাপ করা হবে?’ কিছু লোক বিশ্বাস করে এবং আসলেই তাই যে, ধনী হওয়ার অন্যান্য প্রকার রয়েছে যা অর্থের চেয়েও আরও বেশি আকাক্সিক্ষত। হ্যাঁ, সেখানে ধনী হওয়ার আরও প্রকার রয়েছে যা টাকার ওপর নির্ভর করে পরিমাপ করা যায় না। কিন্তু এখানে লাখো মানুষ রয়েছে যারা বলবে, ‘আমাকে আমার ইচ্ছামতো টাকা দাও এবং আমি ইচ্ছামতো সবকিছু খুঁজে নিব।’

এ বই লেখার প্রধান কারণ যে কীভাবে টাকাপয়সা পাওয়া যায়। তা হচ্ছে বর্তমান পৃথিবী এমন একটি অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে যা লাখো পুরুষ ও নারীকে দরিদ্রতা ভীতি দিয়ে পঙ্গু করে দিয়েছে। এই ভীতি একজনের প্রতি কী করতে পারে তা বেশ ভালোভাবেই সাংবাদিক উস্টব্রুক পেগ্লার নিউ ইয়র্কের সংবাদপত্রে প্রকাশ করেছেন:

‘অর্থ শুধু একটি ধাতব চাকতি বা কাগজের টুকরা। অর্থ দিয়ে হৃদয় এবং আত্মার সম্পদ কখনো কেনা যায় না। কিন্তু অধিকাংশ লোক যখন ভেঙে পড়ে তখন তারা এটা মনে রাখতে পারে না। যখন একজন পুরুষ ভেঙে পড়ে, রাস্তা দিয়ে হেঁটে যায়, একটি ন্যূনতম চাকরিও সে খুঁজে পায় না তখন তার চেতনায় কিছু ঘটে যা তার নোয়ানো কাঁধ, হাঁটাচলা এবং স্থির দৃষ্টি পর্যবেক্ষণ করলেই বোঝা যায়। সে একটি অনুভূতি থেকে পালাতে পারে না। নি¤œ আয়কারী লোকের মাঝে নিজের প্রতি এ ধরনের হীনম্মন্যতা থাকে। যদিও সে জানে যে অন্য যারা সফল তারা নিশ্চিতভাবেই তার চরিত্র, বুদ্ধিমত্তা বা সক্ষমতার সমান নয়।

‘এই লোকগুলো যদিও তার বন্ধু তবুও অপরদিকে একটি শ্রেষ্ঠত্ব এবং সম্মানের অনুভূতি অনুভব হয় যা অচেতনভাবেই তাকে আহত করে। সে হয়তো একটা সময়ের জন্য ভান করতে পারে, কিন্তু সে এই অনুভূতিকে বেশিদিন বহন করতে পারে না। সে এই অনুভূতি নিয়ে সবার সাথে সহজ হতে পারে না। কিন্তু সে নিজের সাথে এই ভান করে। যখন একজন পুরুষ তার জীবনযাপন করার জন্য ভান করে, তখন এটা আসলে একটা হতাশামূলক চিত্র। যে অর্থ তার চেতনাকে পুনঃজীবিত করার জন্য আয় করা হয়, তখন অর্থ সেই ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। অবশ্য, এগুলোর কোনটাই প্রয়োগ যোগ্য হবে না যারা বোকা এবং অভ্যাসগতভাবে কোনকিছুতেই ভালো না ধরনের; বরং এগুলো শুধু সেই মানুষের জন্য যারা সাধারণ লক্ষ্য পোষণ করে এবং আত্মসম্মান অনুভব করে।


নারীরা হতাশা গোপন করে

নারীরা একই বিষয়ে ভিন্ন রূপ প্রদর্শন করে। তাদের চিন্তা ভিন্নধর্মী। তারা কদাচিৎ খাদ্যের জন্য অপেক্ষমান সারিতে দাঁড়ায়। তাদেরকে খুব কমই রাস্তায় ভিক্ষা করতে দেখা যায় এবং ভিড়ের মধ্যে তাদের চেনা যায় না যতটা চেনা যায় একজন হতাশ পুরুষকে দেখে। অবশ্যই আমি কুরূপা বৃদ্ধা নারীদের বোঝাচ্ছি না। আমি বোঝাচ্ছি তাদের যারা যথেষ্ট তরুণী, শালীনতাপূর্ণ এবং বুদ্ধিমান। এমন অনেক নারী আছে, কিন্তু তাদের হতাশা দৃশ্যমান নয়। হতে পারে এগুলো তাদেরকে ভেতর ভেতর মেরে ফেলছে। কিন্তু তাদেরকে বাইরে থেকে দেখলে বোঝা যায় না।

‘যখন একজন পুরুষ ভেঙে পড়ে এবং নিমগ্ন হয় তখন তার হাতে এটা চিন্তা করার জন্য যথেষ্ট সময় থাকে। সে হয়তো মাইলের পর মাইল পার হয়ে একটি চাকরির জন্য একজন লোকের সাথে দেখা করতে পারে, তারপর আবিষ্কার করে যে চাকরিটা হয়তো অন্য কারও হয়ে গেছে অথবা এটা এমন একটা চাকরি যার কোন মাসিক বেতন নেই, শুধু একটা বিক্রয় লব্ধ লভ্যাংশ দেওয়া হবে। অথবা এমন কোন অপ্রয়োজনীয় পণ্য বিক্রয় করতে হবে যা হয়তো কেউ কিনবে না, শুধু দয়া দেখানো ব্যতীত। এমনভাবে হতাশ হওয়ার পর, সে নিজেকে খুঁজে পায় ঠিক সেই রাস্তায় যেখান থেকে যাওয়ার কোন জায়গা নেই। সেখানে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া তার কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। তাই সে হাঁটে আর হাঁটে। সে স্থির দৃষ্টি দিয়ে বিলাসবহুল দোকানের জানালার দিকে তাকিয়ে থাকে যা তার জন্য নয় এবং নিকৃষ্টতর অনুভব করে। আর সেই লোকেদের যেতে দেয় যারা দাঁড়িয়ে তার দিকে আগ্রহী দৃষ্টি নিয়ে তাকায়। সে রেল স্টেশনে ঘুরে বেড়ায় অথবা নিজেকে গ্রন্থাগারে নিয়ে যায়, যাতে তার পাগুলোকে একটু আরাম দেওয়া যায় এবং নিজের উত্তাপ একটু কমে। কিন্তু এগুলোর কোনটাই চাকরি খোঁজার জন্য নয়। তাই সে আবার ওঠে, সামনে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত। সে হয়তো জানে না, কিন্তু তার উদ্দেশ্যহীনতা তাকে তার আকৃতি থেকে, তার চরিত্র থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে। সে হয়তো ভালো পোশাকে সজ্জিত হতে পারে যখন তার একটি স্থায়ী চাকরি ছিল, কিন্তু মানসিক দুর্বলতাকে পোশাক দিয়ে ঢাকা যায় না।


টাকা ভিন্নতা তৈরি করে

সে হাজারো লোক, বিক্রয়কর্মী বা চাকরিজীবী বা রসায়নবিদ অথবা গাড়ি চালকদের দেখে, তাদের কর্ম ব্যস্ততা দেখে এবং হৃদয়ের গভীর থেকে তাদের হিংসা করে। তাদের স্বাধীনতা আছে, আত্মসম্মান ও মনুষ্যত্ব আছে এবং সে নিজেকে কিছুতেই সহজভাবে মানাতে পারে না যে সেও একজন ভালো মানুষ, যদিও সে এটা নিয়ে তর্ক করে এবং ঘণ্টার পর ঘণ্টা ব্যয় করার পর একটা পছন্দনীয় রায়ে পৌঁছায়।

শুধু টাকা, কেবল টাকা যা আজকে তাকে এত ভিন্ন করেছে। অল্প কিছু টাকা হলেই সে আবার নিজেকে ফিরে পেতে পারত।

যেসব লোক নিমগ্ন এবং ভেঙে পড়েছে তাদের কাছ থেকে কিছু মালিক এমন আতঙ্কজনক অবস্থার সর্বোচ্চ সুবিধা নেয়। চাকরি সংস্থাগুলো এসব লোকের সামনে রঙিন কাগজ তুলে ধরে তাদেরকে দুর্দশাপূর্ণ পারিশ্রমিকের সুযোগ দেয়। যেমন সপ্তাহে $৫০০, সপ্তাহে $৭০০,  মাসে $২,০০০ অথবা $২,৫০০। আমার কাছে একটি বিজ্ঞাপন আছে যেখানে স্থানীয় পত্রিকায় একজন কর্মচারির জন্য বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছে। কর্মচারি হতে হবে ভালো, হাতের লেখা পরিষ্কার, একটি রুটির দোকানে সকাল ১১টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত টেলিফোনে অর্ডার নিতে হবে, মাসিক বেতন ৮০০ টাকা। এক সপ্তাহে ৮০০ টাকা নয়; বরং এক মাসে ৮০০ টাকা। বিজ্ঞাপনটি আরও বলেছে, ‘রাষ্ট্র-ধর্মী হতে হবে।’ আপনি কি চিন্তা করতে পারেন যে কী নির্দয়, কী নির্লজ্জ হলে একজন ভালো এবং পরিষ্কার লেখকের জন্য দাবি করতে পারে যে প্রতি ঘণ্টায় ৮.৫০ টাকার বিনিময়ে কাজ করবে। আবার তার ধর্মের ব্যাপারেও অনুসন্ধান করা হচ্ছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে হতাশাগ্রস্থ লোককে এমনটাই প্রস্তাব দেওয়া হয়।


সমালোচনা ভীতি

মানুষ প্রকৃতপক্ষে কীভাবে এই ভীতিতে ভয় পাওয়া আরম্ভ করে তা কেউ নির্দিষ্টভাবে বলতে পারে না। কিন্তু একটি বিষয় নিশ্চিত যে তার এই ভীতি তার ভেতরে খুব গভীরভাবে বিদ্যমান। কিছু লোক বিশ্বাস করে যে এই ভীতি প্রকাশ পায় যখন একজন পুরুষ রাজনীতিকে তার ‘পেশা’ হিসাবে গ্রহণ করে। অন্যরা বিশ্বাস করে এই ভীতি প্রকাশ পায় যে বয়সে প্রথম নারীরা তাদের নিজেদের পরিধেয় পোশাকের ‘ধরন’ সম্পর্কে সচেতন হতে আরম্ভ করে।

এই লেখক, কোন রসিক বক্তাও নন, না তিনি একজন ধর্ম প্রবর্তক মহাপুরুষ। তিনি কেবল সমালোচনা ভীতির গোড়ার কারণ দেখিয়ে দিতে চান। সমালোচনা ভীতির গোড়া হচ্ছে মানুষের বংশগতির পরিণতি। এটা সে উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করা। এই ভীতির কারণেই সে তার অনুসারী ব্যক্তিদের সম্পদ ও পণ্যদ্রব্য ছিনিয়ে নিতে উদ্ভুদ্ধ হয়। শুধু তাই নয়, নিজের কর্মকে ন্যায়সঙ্গত বিবেচনা করে তার অনুসারী পুরুষদের চরিত্রের সমালোচনা করে। আপনি নিশ্চয় খুব ভালোভাবে জানেন যে একজন চোর সেই ব্যক্তিকেই সমালোচনা করে যার থেকে সে চুরি করে। যেমন রাজনীতিবিদগণ নতুন নতুন অফিস ও ক্লাব খোঁজে তাদের নিজেদের বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলি দেখানোর জন্য নয়; বরং তাদের প্রতিপক্ষকে বিবর্ণ বা মলিন করার জন্য।

সমালোচনা ভীতি অনেক প্রকারের হতে পারে। অধিকাংশ হচ্ছে নগণ্য ও নিকৃষ্ট। উদাহরণ রূপে ধরে নিন একজন টাক মাথার পুরুষ। টাক হয় অন্য কোন কারণে নয়; বরং তাদের সমালোচনা ভীতির কারণে। সবাই টুপি পরে, তাই একজন পুরুষও টুপি পরে। কিন্তু টুপিকে মাথার সাথে এত শক্ত করে আটকানো হয় যে টুপির শক্ত অবস্থান চুলের গোড়া কেটে ফেলে। পুরুষরা টুপি পরিধান করে, কারণ এটা তাদের প্রয়োজনীয়তার জন্য নয়; বরং প্রধান কারণ হচ্ছে ‘সবাই তাই করছে বলে।’ ¯্রােতের বিপরীতে হাঁটতে গেলে পাছে অন্য পুরুষরা তার সমালোচনা করে। [বাংলাদেশে এখন শিক্ষিত তরুণদের যেমন দেখলেই জিজ্ঞাস করা হয়, ‘কী চাকরি করছো?’ মনে হয় চাকরি যেন শিক্ষিত তরুণদের জন্য আর ব্যবসা অশিক্ষিতের জন্য। এমনকি একজন অর্নাস পাশ করা ছেলে আমাকে তো বলেই ফেলেছে, ‘যদি তুমি ব্যবসাই করবে তবে তো উচ্চ মাধ্যমিকের পরেই করতে পারতে। অর্নাস পড়ার কী দরকার ছিল!’]

আবার অনুবাদে ফিরে আসি। নারীরা কদাচিৎ টাক মাথার হয় অথবা কম চুলের হয়, কারণ তারা সেই টুপিই মাথায় পরে যা ঢিলাঢালা। তাদের টুপি পরার একমাত্র কারণ হচ্ছে সৌন্দর্য বৃদ্ধি।

কিন্তু, এটা অবশ্যই ধরা যাবে না যে নারীরা সমালোচনা ভীতি থেকে মুক্ত। যদি কোন নারী এই ভীতির ক্ষেত্রে পুরুষের চেয়ে ঊর্ধ্বতন হওয়ার দাবি করে, তবে তাকে জিজ্ঞেস করুন যে সত্তর দশকের একটি টুপি পরে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যেতে।

বুদ্ধিমান কাপড় ব্যবসায়ীরা এই সমালোচনা ভীতিকে কাজে লাগিয়ে তাদের মূলধন বাড়িয়েছে। যদিও এটা পুরো মানবজাতির জন্য অভিশাপ। কিন্তু কথায় আছে, ‘কারও পৌষ মাস, কারও সর্বনাশ।’ শীত, গ্রীষ্ম বা বর্ষা, প্রত্যেক ঋতুতে পত্রিকার লেখা বা ম্যাগাজিনে পোশাকের ধরন পরিবর্তিত হয়। এই ধরনগুলো প্রতিষ্ঠা করে কে? নিশ্চয়ই ক্রেতারা নয়; বরং বিক্রেতা বা উৎপাদনকারীরা। কেন তারা প্রায়ই ফ্যাশন পরিবর্তন করে? উত্তর স্পষ্ট, তারা ফ্যাশন পরিবর্তন করে যাতে তারা আরও বেশি পোশাক বিক্রয় করতে পারে।

ঠিক একই কারণে গাড়ি উৎপাদনকারীরা (খুবই বিরল কিছু কোম্পানি ছাড়া) প্রত্যেক ঋতুতে গাড়ির গঠনগত ধরন পরিবর্তন করে। কোন মানুষই এমন একটি গাড়ি চালাতে চান না যা সর্বশেষ মডেলের না হয়। যদিও পুরাতন মডেলের গাড়ি বেশ ভালো, তবুও সে নতুন মডেলের গাড়ি চায়।

এভাবে বর্ণনা করার কারণ হচ্ছে লোকজন সমালোচনা ভীতির প্রভাবে কীভাবে আচরণ করে তা দেখানো। জীবনের ছোট ছোট কাজে, নগণ্য সব বিষয়ে এই ভীতির কী প্রভাব পড়ে তা দেখানো। আর কিছু কিছু মানুষ কীভাবে এর ফয়দা লুটে তা পরিষ্কার করা। চলুন, এবার আমরা দেখি যে এই ভীতি মানব সম্পর্কের মধ্যে কীভাবে আক্রমণ চালায়। ধরুন ৩৫ থেকে ৪০ বছর বয়সী একজন পুরুষ, যিনি তার ‘মানসিক পরিপক্কতার’ উচ্চসীমায় পৌঁছেছেন। কিন্তু আপনি যদি তার মনের গোপন চিন্তা পাঠ করেন, তবে আপনি দেখবেন যে পরকাল সম্পর্কে একটি অবিশ্বাস। যার অধিকাংশ শিখানো হয়েছে গত কিছু দশকের দৃঢ়ভাবে যুক্তিহীন মতবাদী এবং ধর্ম তত্ত্ববিদদের দ্বারা।

বেশি না, আপনি যদি এমন একজন পুরুষকে খুঁজে বের করতে পারেন যার এই বিষয়ে তার বিশ্বাসকে মুক্তভাবে বলার সাহস আছে, তিনি আপনাকে সত্যই বলবে। অধিকাংশ মানুষকে যদি যথেষ্ট চাপ প্রয়োগ করা হয়, তবে তারা একটি মিথ্যা কথা বলবে; তবুও বলবে না যে তারা পরকালের গল্পগুলোতে অবিশ্বাস করে। যে ধর্মের গঠন হচ্ছে লোকজনকে দাসত্বের শৃঙ্খলে বন্দী করে রাখা, তাতে তারা বিশ্বাস করে না। কিছুদিন আগেও, বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার এবং শিক্ষা যুগের পূর্বেও এমনটি করা হত।

কেন একজন গড়পড়তা পুরুষ, এমনকি আজকের এই আলোকিত দিনেও, পরকালের কাল্পনিক কাহিনীতে তার অবিশ্বাসের কথা স্বীকার করতে লজ্জা পায়? উত্তর হচ্ছে, ‘সমালোচনা ভীতি।’ কিছুদিন আগেও পুরুষ এবং নারীদেরকে তাদের এই সাহসী অবিশ্বাসের জন্য আগুনে জ্বালানো হয়েছিল। এটা কোন আশ্চার্যজনক বিষয় নয় যে আমরা বংশগতভাবে সমালোচনা ভীতির চেতনা পেয়েছি। খুব বেশি আগের কথা নয়, এই গত শতকের কথা যখন সমালোচনাকারীকে অত্যন্ত কঠোর শাস্তির মুখোমুখি হতে হত। এটা এখনও কিছু কিছু দেশে রয়ে গেছে।

সমালোচনা ভীতি মানুষের ভেতর থেকে তার প্রথম পদক্ষেপ বা উদ্যোগের সাহস ছিনিয়ে নেয়, তার কল্পনা শক্তিকে ধ্বংস করে, তার স্বতন্ত্রতাকে সীমাবদ্ধ করে, তার আত্মবিশ্বাস নিয়ে যায় এবং অন্য একশ পথে তার ক্ষতি করে। পিতামাতা প্রায়ই সমালোচনার দ্বারা তাদের সন্তানদের অপূরণীয় ক্ষতি করে। আমার শৈশবের এক অন্তরঙ্গ বন্ধুর মা তাকে প্রায় প্রতিদিনই শাস্তি দিত। সবসময় এই বিবৃতি দিয়ে কথা শেষ করত যে, ‘তুই ২০ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই জেলে যাবি।’ সে তার ১৭ বছর বয়সেই কারাগারে পুনর্গঠনের জন্য যায়।

সমালোচনা এমন এক ধরনের দোষ যা সবার মাঝেই প্রচুর পরিমাণে বিদ্যমান। প্রত্যেকের কাছেই এর যথেষ্ট মজুদ রয়েছে। এমনকি এই গুদামঘরের চাবিও তার হাতে নেই। তাই তো যখন যেখানে দরকার বা দরকার নেই, সব জায়গায় ফ্রিতে দেওয়া হচ্ছে, যদিও কেউ চায় বা না চায়। সবচেয়ে বেশি তো মানুষের নিকট আত্মীয়। আত্মীয়-স্বজন সমালোচনাকে প্রায় অপরাধের পর্যায়ে নিয়ে গেছে। একে অপরাধ রূপে ঘোষণা দেওয়া উচিত। (বাস্তবে এটি একটি নিকৃষ্ট প্রকৃতির অপরাধ)। যেকোন পিতামাতার জন্যও এটি অপরাধ যারা একটি শিশুর মনে অপ্রয়োজনীয় সমালোচনা দ্বারা হীনম্মন্যতা সৃষ্টি করে। সফল ব্যক্তিরা যারা মানব প্রকৃতিকে বোঝে, তারা মানুষের ভেতর থেকে সমালোচনা দ্বারা নয়; বরং গঠনমূলক পরামর্শ দ্বারা উৎকৃষ্ট কাজ বের করে আনে। পিতামাতাও তাদের সন্তানদের থেকে একই ফলাফল সম্পন্ন করতে পারে। সমালোচনা মানব হৃদয়ে ভীতির বীজ বপন করে। বিশেষত অপমানের সাথে রাগ বা বিরক্তবোধ তৈরি করে। কিন্তু এটি কখনো ভালোবাসা বা স্নেহ নির্মাণ করে না।


সমালোচনা ভীতির উপসর্গ

এই ভীতি প্রায় এতই বিশ্বব্যাপী যতটা দরিদ্রতা ভীতি এবং ব্যক্তিগত অর্জনে এর ফলাফল খুবই মারাত্মক। তার প্রধান কারণ হচ্ছে এই ভীতি একজন মানুষের প্রথম পদক্ষেপ নেওয়ার আকাক্সক্ষা ও সাহসকে ধ্বংস করে এবং কল্পনা শক্তি ব্যবহারে নিরুৎসাহিত করে। এই ভীতির প্রধান উপসর্গ হচ্ছে:

আত্ম-সচেতনতা। সাধারণত প্রকাশ পায় এর মাধ্যমে: দুর্বল স্নায়ু বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব, কথাবার্তায় এবং অপরিচিতদের সাথে সাক্ষাতে সাহসের অভাব, হাত ও অঙ্গের আনাড়ি চালচলন, চোখের দৃষ্টি এক স্থান থেকে অন্য স্থানে নাড়ানো।

ধার্মিকতার অভাব। এর মাধ্যমে প্রকাশ পায়: কণ্ঠ নিয়ন্ত্রণের অভাব, অন্যদের উপস্থিতিতে দুর্বল স্নায়ুবোধ, দেহের ভঙ্গি দুর্বল বা দুর্বল স্মৃতি।

ব্যক্তিত্ব। সিদ্ধান্তের দৃঢ়তার অভাব, ব্যক্তিগত আকর্ষণের অভাব এবং নির্দিষ্টভাবে অভিমত প্রকাশে অক্ষমতা। সমস্যা থেকে সরে দাঁড়ানোর অভ্যাস, এর পরিবর্তে যে সমানভাবে তাদের মুখোমুখি দাঁড়াবে। অন্যদের অভিমতের সতর্ক বিশ্লেষণ ছাড়াই একমত প্রকাশ করা।

হীনম্মন্যতা। আত্মস্বীকার অভ্যাস (নিজে নিজেই প্রমাণিত বলে স্বীকার করার অভ্যাস)। তার মুখের কথা এবং কাজ দ্বারা আত্মস্বীকার অভ্যাস। এর মানে হচ্ছে হীনম্মন্যতার একটি আবেগ ঢাকার চেষ্টা। ‘বড় বড় অপ্রচলিত শব্দ’ ব্যবহার করে অন্যদের প্রভাবিত করা চেষ্টা। (প্রায়ই শব্দাবলির প্রকৃত মানে না জেনেই ব্যবহার করা)। অন্যদের পোশাক, বক্তব্য এবং আচরণের অনুকরণ করা। কল্পিত সাফল্যে ফেটে পড়া। এতে করে কিছু কিছু সময় নিজের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হওয়ার একটি অনুভূতি উপস্থিত হয়।

অমিতব্যয়। একজন তার আয়ের চেয়ে বেশি ব্যয় করার অভ্যাস। এটি সাধারণত করা হয় ‘অন্যদের দেখানোর জন্য।’

প্রথম পদক্ষেপের অভাব। আত্মউন্নয়নের সুযোগ আলিঙ্গন করার ব্যর্থতা। মতামত প্রকাশে ভীতি, নিজের আপন ধারণাতে বিশ্বাসের অভাব, ঊর্ধ্বতন ব্যক্তিরা প্রশ্ন করলে ছলনাযুক্ত জবাব দেওয়া, আচরণ ও বক্তব্যে দ্বিধাগ্রস্ত ভাব, উভয় কথা ও কর্মে চাতুরী করা।

উচ্চাশার অভাব। মানসিক ও শারীরিক অলসতা, দৃঢ়সংকল্প হয়ে নিজের দাবি উপস্থাপনের অভাব, সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে ধীর গতি, সহজেই অন্যদের দ্বারা প্রভাবিত, অন্যদের অনুপস্থিতিতে সমালোচনা করার অভ্যাস এবং তাদের দেখলে তোষামোদ করা, প্রতিবাদ না করে ব্যর্থতা গ্রহণের অভ্যাস, যখন অন্যরা বিরোধী হয়ে যায় তখন অঙ্গীকার ভঙ্গ করা, কোন কারণ ছাড়াই অন্যদের ওপর সন্দেহপ্রবণ হওয়া, আচরণ এবং বক্তব্যে দক্ষতার অভাব, ভুলের জন্য দায়িত্ব গ্রহণে অনিচ্ছা।


অসুস্থতা ভীতি

এই ভীতির সন্ধান পাওয়া যায় শারীরিক এবং সামাজিক পরিবেশ থেকে। এর জন্ম হয় বৃদ্ধ বয়স এবং মৃত্যু ভীতির কারণ থেকে। কারণ এটা একজনকে নিয়ে যায় ‘কাল্পনিক এক ভয়ানক বিশ্বের’ দিকে যে সম্পর্কে মানুষ কিছুই জানে না। কিন্তু সে সচেতন হয় যখন তাকে কিছু অস্বাচ্ছন্দ্যজনক গল্প শোনানো হয়। এই মতামতের সাথে ব্যবসায় জড়িত নীতিহীন পুরুষদের কোন সম্পর্ক নেই। এ ধরনের নীতিহীন পুরুষের এক ধরনের অসুস্থতা ভীতি রয়েছে। এই ভীতি তাদের বিক্রির সাথে জড়িত। একে বিক্রয় স্বাস্থ্য বলা হয়। বিক্রয় স্বাস্থ্য মানে ব্যবসায় জড়িত নীতিহীন পুরুষরা বলে, ‘আজ বিক্রি কম হয়েছে তাই শরীরটা খারাপ লাগছে অথবা আজ বিক্রয় বেশি হয়েছে তাই শরীরটা ভালো লাগছে।’

প্রধানত মানুষ অসুস্থতাকে ভয় পায়। কারণ মৃত্যু হলে একটি ভয়ানক জিনিস ঘটতে পারে এই ধরনের এক দৃশ্য সে তার মনে মনে রোপণ করে রেখেছে। সে আরও ভয় পায় যে মানুষের কাছ থেকে যে ঋণ নেওয়া হয়েছে সেগুলোও তো তার পরিবারের কাছে দাবি করা হবে।

একজন খ্যাতিমান চিকিৎসাবিদ একটি জরিপ করেন। তিনি এই জরিপে দেখতে পান যে তার কাছে চিকিৎসার জন্য যেসব রোগী আসে তার প্রায় ৭৫% পুরুষ ¯œায়বিক রোগে আক্রান্ত। এটা হচ্ছে এক ধরনের কল্পিত রোগে আক্রান্ত হওয়া। দেখা যায় যদিও সেখানে ভয় পাওয়ার সামান্যতম কোন কারণ নেই, তারপরও যে রোগের ভয় বা কল্পনা করে থাকে আস্তে আস্তে তাই শরীরে প্রকাশ পায়।





অসুস্থতা ভীতির এই দুর্বলতার ওপর নির্ভর করে, ঔষধ কোম্পানির ঔষধ তাদের জন্য সৌভাগ্য বয়ে এনেছে। এই ভীতির কারণে ঔষধ তৈরিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো আজ সুবিশাল সৌভাগ্যের অধিকারী। শুধু তাই নয়। যারা ঔষধ বিক্রি করে মানে ফার্মেসির দোকানদার, তারাও এই ভীতির কারণে সৌভাগ্যশালী। বিশ্বাসপ্রবণ মানবজাতির সাথে দীর্ঘকাল ধরে এই রকম প্রতারণা চলছে। কিছুদিন আগে ‘কলিয়ার সাপ্তাহিক পত্রিকায়’ বিভিন্ন ঔষধ কোম্পানির ওপর একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়। সেখানে এই ব্যাপার পরিষ্কার হয়ে ফুটে ওঠে যে কীভাবে ঔষধ কোম্পানিগুলো এই ভীতিকে প্রণোদনা দিচ্ছে।

বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ‘ফ্লু রোগ’ যখন মহামারী আকারে ছড়িয়ে যায় তখন নিউ ইয়র্ক শহরের মেয়র একটি জোরালো পদক্ষেপ নেন যাতে লোকজন নিজেদেরকে অসুস্থতা ভীতির মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত না করে। তিনি সাংবাদিকদের ডাকেন এবং বলেন, ‘ভদ্রমহোদয়গণ, আমি আপনাদেরকে ‘ফ্লু মহামারী’র ব্যাপারে কোন ভয়ানক শিরোনাম প্রকাশ না করতে অনুরোধ করছি। যদি আপনারা আমার সাথে সহযোগিতা না করেন, তবে আমাদের প্রিয় শহরকে নিয়ে আমরা এমন এক অবস্থার মধ্যে পড়ব যা আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারব না।’ সংবাদপত্রগুলো ‘ফ্লু মহামারী’ নিয়ে প্রতিবেদন ছাপা বন্ধ করে দিল। অবশেষে কারও কোন ক্ষতি করতে না পেরে এক মাসের মধ্যে মহামারী চলে গেল।

কয়েক বছর আগে এক ধরনের পরীক্ষা চালানো হয়। পরীক্ষার দ্বারা এটা প্রমাণ করা হয় যে পরামর্শ দ্বারা লোকজন অসুস্থ হতে পারে। পরীক্ষায় বলা হয়:

‘আমরা এই পরীক্ষা চালিয়েছি ৩টি পরিচিত যুক্তি ও কারণ দ্বারা। যখন ‘পরীক্ষার জন্য নির্ধারিত ব্যক্তিদের’ সাথে দেখা হয়, তাদের প্রত্যেককে এই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করা হয়, “আপনি কী কোন সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন? কীসে আপনি কষ্ট পাচ্ছেন? আপনাকে ভয়ানক অসুস্থ দেখাচ্ছে।” প্রথম প্রশ্নকারীরা অধিকাংশ সময় ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে এবং অন্যরা উদ্দীপনাহীনভাবে বলে “ও, কিছু না, আমি ঠিক আছি।” দ্বিতীয় প্রশ্নকারীরা সাধারণত জবাব দেন, “আমি ঠিক জানি না, তবে আমার খারাপ লাগছে।” তৃতীয় প্রশ্নকারীরা সাধারণত স্পষ্টভাবে মেনে নেন যে তিনি সত্যি সত্যিই অসুস্থ অনুভব করছেন।’

পরামর্শ দ্বারাও মানুষকে অসুস্থ করা যায়। আপনার যদি এ ব্যাপারে এখনো সন্দেহ থাকে, তবে একজন পরিচিত ব্যক্তির ওপর এটি চেষ্টা করে দেখুন। এটা তাকে নিঃসন্দেহে অস্বস্তিতে ফেলবে। কিন্তু পরীক্ষা বেশি দূর নিবেন না। সেখানে কিছু নির্দিষ্ট ধর্ম সম্প্রদায় রয়েছে যাদের সদস্যরা প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য তাদের শত্রুদের ওপর ‘মন্ত্র’ পাঠ করে। তারা একে ডাকে ‘মন্ত্র প্রয়োগ’ বলে।

এটা নিশ্চিত যে নেতিবাচক চিন্তা স্পন্দন বা নেতিবাচক কথা দিয়ে মানুষকে অসুস্থ করা সম্ভব। এটা তরঙ্গের মতো। এটা অন্যের দ্বারা একজনের মনে প্রবেশ করতে পারে। আবার একজন মানুষ নিজে নিজেও নেতিবাচক চিন্তা করে নিজেকে অসুস্থ করতে পারে।

এজন্যই আমি ইতিবাচক চিন্তার প্রতি এত গুরুত্ব দিয়েছি। যে ব্যক্তি নিজের মধ্যে ইতিবাচক চিন্তার প্রসার ঘটায় তার মতো আর্শীবাদপ্রাপ্ত পুরুষ খুব কমই আছে। আবার এমন ধরনের পুরুষও আছে, যাকে আপনি যদি জিজ্ঞেস করেন কেমন আছেন তবে সে চিন্তা করবে একে এমন কী জবাব দেওয়া যায় যাতে সে আচমকা ঘাবড়ে যায়। এ ধরনের চিন্তা থেকে নিজেকে রক্ষা করুন।

ডাক্তাররা প্রায়ই রোগীদের স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য নতুন পরিবেশ বা নতুন জায়গায় যেতে বলে। এর কারণ হচ্ছে তার একটি ‘মানসিক পরিবর্তন’ দরকার। হয়তো রোগী যেই পরিবেশে বাস করে সেখানে নেতিবাচকতা বা একঘেয়ে ভাব বেশি। তাই তাকে পরিবেশ বদলানোর পরামর্শ দেওয়া হয়।

প্রত্যেক মানুষের মনেই অসুস্থতা ভীতির বীজ নিহিত। উদ্বিগ্নতা, ভয়, নিরুৎসাহ, ভালোবাসা এবং ব্যবসায়িক ব্যাপারে নৈরাশ্য, এই বীজকে অঙ্কুরোধগম করার এবং বেড়ে উঠার পুষ্টি দেয়। কিছুদিন আগে শেয়ারবাজার ধ্বসের কারণে ডাক্তাররা দৌড়ের ওপর ছিল। কারণ প্রত্যেকের মধ্যে নেতিবাচক চিন্তা ছিল যা তাদেরকে অসুস্থ করে তোলে।

অসুস্থতা ভীতির কারণের মধ্যে সবার উপরে হচ্ছে ব্যবসায়িক এবং ভালোবাসার নৈরাশ্য। একজন যুবক ভালোবাসার নৈরাশ্য ভোগ করছিল যা তাকে হাসপাতালে পাঠায়। কয়েক মাসের জন্য সে জীবন এবং মৃত্যুর মাঝে ঘোরাফেরা করছিল। একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারকে পরামর্শের জন্য ডাকা হলো। বিশেষজ্ঞ ডাক্তার প্রথমেই পুরাতন নার্সদের পরিবর্তন করে। তার জায়গায় একজন চমৎকার তরুণী নার্সের দায়িত্ব দেয়। চিকিৎসকের সাথে পূর্ব বন্দোবস্ত অনুযায়ী সে তার দায়িত্বের প্রথম দিন থেকেই রোগীর মধ্যে ভালোবাসা জাগিয়ে তুলল। তিন সপ্তাহের মধ্যে রোগী হাসপাতাল থেকে বের হয়ে গেল। যদিও এখনো সে ভুক্তভুগী। তবে সে এখন ভিন্ন এক ধরনের পীড়ায় পীড়িত। সে আবারও ভালোবেসেছে। যদিও প্রতিকার ছিল একটি নাটক। কিন্তু রোগী এবং নার্স উভয়ে পরবর্তীতে বিয়ে করে। এই লেখার সময় পর্যন্ত তারা উভয়ই ভালো স্বাস্থ্যে রয়েছে।


অসুস্থতা ভীতির উপসর্গ

এই উপসর্গও সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। এ হচ্ছে:

স্ব-পরামর্শ। আত্মপরামর্শ দ্বারা নেতিবাচক অভ্যাসের ব্যবহার করা। বিভিন্ন ধরনের রোগের উপসর্গ খুঁজে দেখে এবং আশা করা। কল্পিত অসুস্থতায় ‘আনন্দ পাওয়া’ এবং এটা সম্পর্কে এমনভাবে কথা বলা যেন এটা বাস্তবেই ঘটছে। ডাক্তারের পরামর্শ বাদ দিয়ে বিভিন্ন লোকের ‘তুচ্ছ কাজ’ এবং ‘বিশেষ মতবাদ’ অনুসরণ করার অভ্যাস তৈরি করা। আলাপ আলোচনায় সারাক্ষণ অন্যদের অস্ত্রপাচার, দুর্ঘটনা এবং বিভিন্ন রোগ সম্পর্কে আলাপ করা। কোন পেশাদার ব্যক্তি বা চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া শারীরিক ব্যায়াম করা, নির্দিষ্ট পানাহার করা। নিবন্ধিত ঔষধ ব্যবহার না করে টোটকা ঔষধ সেবন করা এবং ‘হাতুড়ে চিকিৎসকের’ প্রতিকার নেওয়া।

স্নায়বিক রোগ। সারাক্ষণ রোগ নিয়ে কথা বলার অভ্যাস। নিজের মনকে রোগের ওপর মনোযোগী করে তোলা এবং যতক্ষণ না একটি স্নায়বিক রোগ ঘটে ততক্ষণ এর উপস্থিতি আশা করা। মুখ বন্ধ বোতলের মতো অবস্থা। কিছুতেই এমন অবস্থার প্রতিকার করা যায় না। নেতিবাচক চিন্তা করে করে এটা আনা হয় এবং অন্য কিছুই না শুধু ইতিবাচক চিন্তার প্রভাব দ্বারা এর একটা প্রতিকার হতে পারে। একজন ব্যক্তির প্রতি স্নায়বিক রোগ (একটি কল্পিত রোগ) এমন ধরনের ক্ষতি করে যতটা বাস্তবে একটা রোগ ক্ষতি করতে পারে। কাল্পনিকভাবে অসুস্থতাকে চিন্তা করতে করতে অধিকাংশ ‘স্নায়বিক রোগ’ হয়।

ব্যায়াম। অসুস্থতা ভীতি প্রায়ই সঠিকভাবে ব্যায়াম করতে হস্তক্ষেপ করে। এর ফলে শরীরের ওজন বেড়ে যায় এবং এ ধরনের ব্যক্তি সামাজিক জীবন এড়িয়ে চলে।

সংবেদনশীলতা। সহজেই অভিভূত হয় এমন। অসুস্থতা ভীতি প্রাকৃতিক দেহের প্রতিরোধ ভেঙে ফেলে এবং দেহকে যেকোন ধরনের রোগ সৃষ্টির উপযোগী করে তোলে।

অসুস্থতা ভীতি প্রায়ই দরিদ্রতা ভীতির সাথে সম্পর্কযুক্ত। বিশেষ করে স্নায়বিক রোগের ঘটনায় এ সম্পর্ক আরও গভীর। এমন ব্যক্তি ডাক্তারের রশিদ, হাসপাতালের রশিদ ইত্যাদি নিয়ে বেশি চিন্তিত। এই ধরনের লোক অসুস্থতার প্রস্তুতির জন্য প্রচুর সময় ব্যয় করে, মৃত্যু সম্বন্ধে কথা বলে এবং গোরস্থানের জায়গার জন্য টাকা জমায়।

আত্ম সংকেত। একটু সহানুভূতি পাওয়ার অভ্যাস। লোকজনের সহানুভূতি পাওয়ার জন্য কল্পিত অসুস্থতাকে ব্যবহার করে। (কাজ এড়িয়ে যাওয়ার জন্য লোকজন প্রায়ই এই কৌশলের আশ্রয় নেয়)। অসুস্থতার ভান করার অভ্যাস ব্যক্তির আলসেমীকে ঢাকার জন্য ব্যবহার করা হয়। তাদের উচ্চাশার অভাবকে ঢাকার জন্যও একে অজুহাত রূপে ব্যবহার করা হয়।

অমিতাচার। ব্যথা ধ্বংস করতে অ্যালকোহল বা ঘুমের ঔষধ ব্যবহারের অভ্যাস। যেমন মাথা ব্যথা, স্নায়ুশূলের মতো বাত রোগ প্রভৃতির পূর্ণ চিকিৎসা করার পরিবর্তে অ্যালকোহল বা ঘুমের ঔষধ ব্যবহার।

অসুস্থতা সম্বন্ধে বেশি বেশি পড়া এবং রোগের সম্ভাব্য আঘাত নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকা। নিবন্ধিত ঔষধের বিজ্ঞাপন পাঠ করা। এগুলোকে অভ্যাসে পরিণত করা।


ভালোবাসার কাউকে হারানোর ভীতি

উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া এই ভীতির মূল উৎস সম্পর্কে একটু বর্ণনা দেওয়া দরকার। কারণ এটা পুরুষের বহুপতœীক অভ্যাস থেকে বেড়ে ওঠে যে সে তার অনুসারী পুরুষের নারী-সঙ্গীকে চুরি করবে এবং এমন অভ্যাস যে অন্যের নারী-সঙ্গীর সাথে যখনই কথা বলার সুযোগ পায় তখনই কথা বলে।

ঈর্ষা এবং একই ধরনের অন্যান্য আকার যেখানে ব্যক্তির মানসিক শক্তি হ্রাস পায় সেখানেই পুরুষের সহজাত ভীতি বেড়ে ওঠে যা হচ্ছে ভালোবাসার কাউকে হারানোর ভীতি। অন্যসব ভীতির মধ্যে এই ভীতি সর্বাধিক যন্ত্রণাদায়ক। অন্যান্য ভীতির চেয়ে এটা দেহ এবং মনের প্রতি ব্যাপক ধ্বংস ঘটায়। যেমন এটা প্রায়ই একজনকে চিরতরে উন্মত্ততার দিকে নিয়ে যায়।

ভালোবাসা হারানোর ভীতি সম্ভবত পাথর যুগ থেকে আরম্ভ হয়েছে। যখন পুরুষরা নারীদের বর্বর শক্তি দ্বারা চুরি করত। এখনও পুরুষদের এই চৌর্যবৃত্তি বিদ্যমান। কিন্তু তাদের কৌশলে পরিবর্তন ঘটেছে। শক্তির পরিবর্তে তারা এখন প্ররোচনা প্রয়োগ করে। সুন্দর পোশাকের আশ্বাস দেয়, যান্ত্রিক গাড়ি এবং অন্য প্রলোভনের ‘টোপ ফেলে’ যা দৈহিক শক্তির চেয়ে আরও বেশি কার্যকর। আজকেও পুরুষের অভ্যাস ঠিক একই রকম রয়েছে যেমন সভ্যতার ঊষালগ্নে ছিল। কিন্তু আজকে তার প্রকাশ ভঙ্গির পরিবর্তন ঘটেছে।

সতর্ক পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে যে নারীরা আরও বেশি সংবেদনশীল। তারা এই ভীতিতে পুরুষের চেয়েও বেশি সহজে অভিভূত হয়। ব্যাপারটি সহজেই ব্যাখ্যা করা যায়। নারীরা অভিজ্ঞতা থেকে শিখেছে যে পুরুষরা প্রকৃতগতভাবেই বহুপতœীক। পুরুষকে অন্য নারীদের হাতে বিশ্বাস করা যায় না।


ভালোবাসার কাউকে হারানোর ভীতির উপসর্গ

এই ভীতিকে চিনতে পারার উপসর্গ হচ্ছে:

ঈর্ষা। বন্ধুদের প্রতি এবং যাকে ভালোবাসে তার প্রতি সন্দেহ করার অভ্যাস। কোন যুক্তিযুক্ত কারণ ব্যতীত সন্দেহ করা। ঈর্ষা এক ধরনের চিত্তভ্রংশ বা মানসিক শক্তি হারানোর অভ্যাস যা কিছু সময় প্রবল আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে সামান্য কোন কারণ ছাড়াই। কোন কারণ ব্যতীত বউ বা স্বামীকে অবিশ্বাস করা। সাধারণত সবার ওপর সন্দেহ করা। কারও ওপর প্রকৃত আস্থা নেই।

ত্রুটি খোঁজার অভ্যাস। বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন, ব্যবসায়িক সহযোগী ও যাকে ভালোবাসে তার প্রতি সামান্য কারণে রাগ করা এবং ত্রুটি খোঁজার অভ্যাস।

জুয়ার অভ্যাস। অভ্যাস যেমন জুয়ার অভ্যাস, চুরি করা, ধোঁকা দেওয়া এবং যাকে ভালোবাসে তাকে অনিশ্চিত সুবিধার কথা বলা যা অর্থ দিয়ে পাওয়া যায়। ভালোবাসা কেনা যেতে পারে এই বিশ্বাস রাখা। যাকে ভালোবাসে তাকে উপহার দেওয়ার জন্য যা দরকার তারচেয়ে বেশি খরচের অভ্যাস বা ঋণে জড়িয়ে পড়া। যা আছে তারচেয়ে বেশি দেখানোর অভ্যাস। অনিদ্রা, সহজেই উত্তেজিত বা ভীত হওয়া, অধ্যবসায়ের অভাব, ইচ্ছার অভাব, আত্ম-নিয়ন্ত্রণের অভাব, আত্ম-বিশ্বাসের অভাব এবং খারাপ মেজাজ।


বৃদ্ধ বয়স ভীতি

প্রধানত, দুইটি উৎস থেকে এই ভীতি বেড়ে ওঠে। প্রথমত, এই চিন্তা যে বৃদ্ধ বয়স হয়তো দরিদ্রতা নিয়ে আসবে। দ্বিতীয়ত এবং যতদূর জানা যায় এটার জন্মের সর্বাধিক সাধারণ উৎস হচ্ছে অতীতের মিথ্যা ও নির্মম কৌশল যা খুব ভালোভাবে মিশ্রিত হয়েছে ‘আগুন ও গন্ধক’ দ্বারা। আর অন্যান্য জুজুর ভয় দেখানো যা চালাকির সাথে নকশা করা হয়েছে মানুষকে ভীতির মাধ্যমে ক্রীতদাস করার জন্য।

দুইটি অত্যন্ত বলিষ্ঠ কারণের জন্য মানুষের মধ্যে বৃদ্ধ বয়স ভীতির গোড়াপত্তন ঘটে। প্রথমটি হচ্ছে একজন পুরুষ দেখতে পায় যে তার অনুসারীদের মধ্যে তার অবিশ্বাসী একজন বেড়ে উঠেছে যে সে তার পৃথিবীগত সম্পত্তির যেকোন পরিমাণ দখল করতে পারে যা পুরুষটি এতদিনে অর্জন করেছে। আর দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে পরকালের ভয়ংকর চিত্র যা তার মনের গভীরে ছোটবেলা থেকে রোপণ করা হয়েছিল। পুরুষ তার নিজ মনের পূর্ণ অধিকারী হওয়ার পূর্বে এই ভীতি রোপণ করা হয়।

সম্ভবত অসুস্থ স্বাস্থ্য, সাধারণত যেজন্য লোকজন বয়স্ক হয়ে উঠেছে। প্রেম সংক্রান্ত বিষয়ের কারণেও বৃদ্ধ বয়স ভীতি ঘটে থাকে। যেমন কোন পুরুষই তার চিন্তায় যৌন আকর্ষণ কমে যাওয়ার আশা পোষণ করে না।

বৃদ্ধ বয়স ভীতির সর্বাধিক সাধারণ কারণ হচ্ছে আপন জীবন দরিদ্রতার সাথে যাপন করার সম্ভাবনা। ‘গরিবের ঘর’ শব্দটি কোন শ্রুতিমধুর শব্দ নয়। এটা এক ধরনের অস্বস্তিকর ঠান্ডা অনুভূতি সৃষ্টি করে। প্রত্যেক পুরুষের মনে নিরুৎসাহজনক অনুভূতি জাগায় যে তার বছরগুলো ক্ষয় হয়েছে একটি গরির ভূমিতে।

বৃদ্ধ বয়স ভীতি ঘটার আরেকটি কারণ হচ্ছে এই সম্ভবনা যে স্বাধীনতা ও মুক্তি হারানো। বৃদ্ধ বয়স হয়তো এর সাথে উভয় দৈহিক ও অর্থিক স্বাধীনতার বিনাশ ঘটাবে।


বৃদ্ধ বয়স ভীতির উপসর্গ

এই ভীতির সাধারণ উপসর্গ হচ্ছে:

এমন প্রবণতা যে ধীর গতিতে চলে এবং মানসিক পরিপক্কতার বয়সে একটি হীনম্মন্যতা গঠন করে। সাধারণত ৪০ বছর বয়স থেকে এটা আরম্ভ হয়। একজনের মধ্যে এক ধরনের মিথ্যা বিশ্বাস সৃষ্টি হয় যে সে বয়সের কারণে ‘পিছলে পড়েছে’। সত্যি কথা হচ্ছে যে এটাই একজন পুরুষের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বছর। যারা ৪০-৬০ এর মধ্যে রয়েছে তাদের জন্য মানসিক এবং আত্মিক সুখ অর্জন করার এটা সুবর্ণ সুযোগ।

একজন পুরুষ ‘বৃদ্ধ হয়েছে’ বলে, ৪০-৫০ বছর বয়সে পৌঁছেছে বলে ক্ষমা চাওয়ার অভ্যাস। এর পরিবর্তে যে বিজ্ঞতা ও বোধগম্যতার যুগে পৌঁছেছে বলে কর্তৃত্ব করবে এবং কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে।

অভ্যাস যেমন প্রথম পদক্ষেপ নেওয়ার আকাক্সক্ষা, কল্পনা এবং আত্মবিশ্বাসকে মেরে ফেলার অভ্যাস তৈরি করা। মিথ্যা বিশ্বাস করা যে এই গুণগুলো প্রয়োগ করার জন্য সে নিজে অতি বৃদ্ধ হয়ে গেছে। ৪০ বছর বয়সে এমন পোশাক পরিধান করার চেষ্টা করা যাতে খানিকটা তরুণ দেখায় এবং তরুণদের মতো বিশেষ ধারায় আচরণ করা এবং কথা বলা। তারা এর দ্বারা উভয় বন্ধু এবং অপরিচিতকে বিদ্রুপ করতে অনুপ্রাণিত করে।

মৃত্যু ভীতি

কিছু লোকের কাছে এটা অন্য সব ভীতির চেয়ে নিষ্ঠুরতম। কারণও সুস্পষ্ট। মৃত্যু চিন্তার সাথে সাথে একটি যন্ত্রণার ভাব আসে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এটা আসে ধর্মীয় উন্মাদনা থেকে। যাদের ‘অধার্মিক’ বলে ডাকা হয় তাদের মধ্যে ধার্মিকদের চেয়ে মৃত্যু ভীতি কম দেখা যায়। শত শত বছর ধরে মানুষ এই প্রশ্ন করে যাচ্ছে এবং এখনও করছে। সে জানতে চায় সে কোথা থেকে এসেছে এবং কোথায় যাচ্ছে।

অতীতের অন্ধকার যুগের চতুর এবং ধূর্ত ব্যক্তিরা একটি দামের বিনিময়ে এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে দেরি করত না। বর্তমানে এটাই মৃত্যু ভীতি প্রধান উৎস।

‘আমার তাবুতে আসুন, আমার দলে আসুন, আমার আস্থাকে আলিঙ্গন করুন, আমার মতবাদকে গ্রহণ করুন এবং আমি আপনাকে সরাসরি স্বর্গে যাওয়ার রাস্তা দেখিয়ে দিব।’ অন্য এক সম্প্রদায়ের নেতা চিৎকার করে বলছে, ‘আমার তাবু থেকে যদি দূরে থাকেন, তবে শয়তান আপনাকে ধরে নিয়ে যাবে এবং অনন্তকাল ধরে আগুনে জ্বালাবে।’

অনন্তকাল একটি দীর্ঘ সময়। আগুন একটি ভয়ানক জিনিস। আগুনের সাথে অনন্তকাল ধরে শাস্তির চিন্তা মানুষকে অসাড় করে দেয়। এটা শুধু মানুষের মৃত্যু ভীতির কারণই নয়; বরং এটা তার যুক্তি বা কারণ অনুষদের বিনাশ ঘটায়। এটা জীবনের প্রতি সব আগ্রহকে ধ্বংস করে এবং আনন্দকে অসম্ভব করে তোলে।

আমার গবেষণা কালে, আমি একটি বই দেখেছিলাম, যার শিরোনাম ছিল ‘প্রভুদের একটি তালিকা’। সেখানে প্রায় ৩০ হাজার প্রভুর তালিকা তৈরি করা হয়েছে যাদের মানুষ পূজা করে। একবার চিন্তা করে দেখুন তো! তারা প্রায় ৩০ হাজার। একটি বাগদা চিংড়ি থেকে শুরু করে মানুষ পর্যন্ত সবকিছুর তারা প্রতিনিধিত্ব করছে। এটা একটুও বিস্ময়কর নয় যে মানুষ কেন মৃত্যু ভীতির প্রতি এতটা ভীত।

ধর্মীয় নেতারা হয়তো নিরাপদে স্বর্গে যাওয়ার রাস্তা দিতে সক্ষম নয় বা এমন বন্দোবস্তও করতে পারবে না যা মানুষকে নরকে নামাবে। কিন্তু তারা যেসব কথা ব্যবহার করে, কথার দ্বারা এমন ভয়ানক সম্ভাবনা দেখায় যে এই কাল্পনিক ভীতিতে মানুষের যুক্তি ও কারণ অনুষদ পঙ্গু হয়ে যায় এবং মৃত্যু ভীতি প্রতিষ্ঠা করে।

সত্যি বলতে, কোন মানুষই জানে না এবং কেউ কখনো জানবে না যে স্বর্গ বা নরক দেখতে কেমন। যদি জায়গাটি থেকেও থাকে তবুও কেউ এর প্রকৃত জায়গা কোথায় তা জানে না। এই অতি ইতিবাচক জ্ঞানের অভাবে মানব মনের দরজা খুলে দেওয়া হয় প্রতারকদের সামনে। সেই প্রতারকরা মানব মনের ভেতর প্রবেশ করে এবং মনকে নিয়ন্ত্রণ করে। এরা এদের বিভিন্ন ধোঁকাবাজি এবং কলাকৌশল প্রয়োগ করে মানুষের মনকে নিয়ন্ত্রণ করে।

অন্ধকার যুগে যখন কোন কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয় ছিল না তখন মৃত্যু ভীতির প্রভাব ছিল অনেক বেশি। আজকের মহান কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয় আমাদেরকে সেই অভিশাপ থেকে মুক্তি দিয়েছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এখন এই মিথ্যার ওপর সরাসরি আলো ফেলেছে। এর ফলে পুরুষ ও নারীরা মৃত্যু ভীতি নামক অভিশাপ থেকে মুক্তি পেয়েছে। যেসব তরুণ পুরুষ ও নারী কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করে তারা সহজে ‘আগুন এবং গন্ধক’ দ্বারা ভয় পায় না। জীববিজ্ঞান, জ্যোর্তিবিজ্ঞান, ভূগোল ও অন্য বিভাগের সহায়তার মাধ্যমে মানুষের মন থেকে অন্ধকার যুগের ভীতি দূর হয়েছে। এই ভীতি মানুষের মনকে দৃঢ়মুষ্টিতে ধরে রেখেছিল এবং তাদের যুক্তি ও কারণ অনুষদ ধ্বংস করেছিল। আজকে তা শিক্ষার আলোয় দূর হয়েছে।

মৃত্যুর ভীতির কারণে উন্মাদ ব্যক্তিদের নিরাময় কেন্দ্র ভরে গেছে। শত শত পুরুষ ও নারী এই ভীতির কারণে পাগল হয়ে গেছে।

এই ভীতি আজ অকেজো। মৃত্যু তো হবেই। কেউ এই ব্যাপারে চিন্তা করুক আর না করুক। একে একটি আবশ্যক ব্যাপার রূপে গ্রহণ করুন এবং আপনার মন থেকে চিন্তাটি ফেলে দিন। এটা একটা চিরন্তন ব্যাপার। আর এটার দরকারও আছে; নতুবা এটা সকলের প্রতি আসত না। হয়তো মৃত্যু পরবর্তী চিত্র ততটা খারাপও নয় যতটা একে দেখানো হয়।

এই মহাবিশ্ব গঠিত হয়েছে শুধু দুইটি জিনিস দিয়ে: শক্তি এবং বস্তু। আমরা মৌলিক পদার্থবিজ্ঞান থেকে জানি যে শক্তি বা বস্তুকে না সৃষ্টি করা যায়, না ধ্বংস করা যায়। উভয় শক্তি এবং বস্তুকে পরিবর্তন করা যেতে পারে, রূপান্তর করা যেতে পারে; কিন্তু কোনটাকেই ধ্বংস করা যায় না। মানুষের জানা মতে শক্তি এবং বস্তু; এই দুইটিই হচ্ছে আসল বাস্তবতা।

জীবন যদি কিছু হয়ে থাকে তবে তা হচ্ছে শক্তি। যদি শক্তি এবং বস্তুকে ধ্বংস করা না যায়, তবে জীবনকেও ধ্বংস করা যায় না। শক্তির যেমন পরিবর্তন ঘটে তেমন জীবনেরও পরিবর্তন ঘটবে। কিন্তু এটা ধ্বংস হতে পারে না। মৃত্যু কেবল একটি পরিবর্তন মাত্র।

যদি মৃত্যু কেবল পরিবর্তন বা স্থানান্তর না হয় তাহলে মৃত্যু হবে একটি সুদীর্ঘ এবং শান্তিময় ঘুম। অতএব ঘুমকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। এভাবে আপনি হয়তো চিরতরে মৃত্যু ভীতিকে সমূলে বিনষ্ট করতে পারবেন।


মৃত্যু ভীতির উপসর্গ

এই ভীতির সাধারণ উপসর্গ হচ্ছে:

মৃত্যুবরণ করবে এই চিন্তার অভ্যাস। এর পরিবর্তে যে জীবনের অধিকাংশ সময়কে সুমধুর করে তৈরি করবে তা না। এটা সাধারণত উদ্দেশ্যের অভাবের কারণে ঘটে বা একটি যথোপযুক্ত পেশার অভাবে হয়। বয়স্কদের মধ্যে এই ভীতি সবচেয়ে বেশি প্রচলিত। কিন্তু মাঝে মাঝে দেখা যায় যুবকরাও এর শিকার হচ্ছে। মৃত্যু ভীতির জন্য সবচেয়ে ভালো প্রতিকার হচ্ছে জীবনে সাফল্য অর্জনের জন্য একটি জ্বলন্ত আকাক্সক্ষা সৃষ্টি। যার পিছনে থাকবে মানুষের জন্য উপকারী সেবা সম্পন্ন করার আকাক্সক্ষা। একজন ব্যস্ত পুরুষ কদাচিৎ মৃত্যু সম্বন্ধে চিন্তা করার সময় পায়। সে জীবনকে লোমহর্ষক রূপে খুঁজে পায়। যে জীবনকে উপভোগ করে তার তো মৃত্যু সম্বন্ধে উদ্বিগ্ন হওয়ার দরকার নেই। কিছু কিছু সময় মৃত্যু ভীতির ঘনিষ্ঠ সহযোগী হয় দরিদ্রতা ভীতি। এমন চিন্তা করে যে আমি মারা গেলে আমার পরিবারের কী হবে, তাদের না দরিদ্র অবস্থায় জীবন কাটাতে হয়। অন্য সময় অসুস্থতার কারণে মৃত্যু ভীতি ঘটে। এর ফলে দৈহিক প্রতিরোধ ভেঙ্গে পড়ে। মৃত্যু ভীতির সাধারণতম কারণ হচ্ছে: অসুস্থ স্বাস্থ্য, দরিদ্রতা, যথোপযুক্ত পেশার অভাব, ভালোবাসার ওপর নৈরাশ্য, পাগলামি এবং ধর্মীয় উন্মাদনা।


বৃদ্ধ বয়সের দুশ্চিন্তা

দুশ্চিন্তা একটি মানসিক অবস্থা যার মূলে রয়েছে ভীতি। এটা ধীরে ধীরে কাজ করে। কিন্তু অধ্যবসায়ী। এটা ধূর্ত এবং বিশ্বাসঘাতক। ধাপে ধাপে এটা ‘নিজেকে মনের গভীরে ঢুকায়’ যতক্ষণ পর্যন্ত না এটা একজনের যুক্তি ও কারণ অনুষদকে পঙ্গু করছে, আত্মবিশ্বাস ও প্রথম পদক্ষেপ নেওয়ার সাহস ধ্বংস করছে। দুশ্চিন্তা ঘটে মূলত সিদ্ধান্তহীনতার কারণে। এটা একটা মানসিক অবস্থা। তাই একে নিয়ন্ত্রণ করা যায়।

একটি অনিশ্চিত মন সর্বদাই অসহায়। সিদ্ধান্তহীনতার কারণে একটি মন অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। অধিকাংশ পুরুষ দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। কারণ তাদের ইচ্ছাশক্তির অভাব। আবার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর সেই সিদ্ধান্তের পাশেও দৃঢ়ভাবে দাঁড়াতে পারে না সেই একই কারণে। এমনকি ব্যবসায় স্বাভাবিক অবস্থা থাকাকালীন সময়েও তারা এটা করতে অসমর্থ। অর্থনৈতিক বিক্ষোভ চলাকালীন সময়ে (যেমনটা বিশ্ব সম্প্রতি শেয়ারবাজার ধ্বসের কারণে অভিজ্ঞ হয়েছে), স্বতন্ত্র ব্যক্তি খুব অসুবিধায় পড়ে। এটা যে শুধু তার নিজের সিদ্ধান্তহীনতার জন্য ঘটেছে তা নয়। এখানে অন্যদের সিদ্ধান্তহীনতার প্রভাবও রয়েছে। পরিবেশই যেন একটি ‘দলবদ্ধ সিদ্ধান্তহীন অবস্থা।’

অর্থনৈতিক হতাশা চলাকালীন সময়ে সারা বিশ্ব ‘ভীত এবং উদ্বিগ্ন মানুষ’ দিয়ে ভরে গিয়েছিল। এই দুই মানসিক জীবাণু সকলের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। এজন্য ওয়াল স্ট্রিটে ১৯২৯ সালের পর থেকে একটি সাময়িক পাগলামির দেখা পাওয়া যায়। এই দুই মানসিক জীবাণুর জন্য একমাত্র প্রতিষেধক হচ্ছে দ্রুত এবং দৃঢ় সিদ্ধান্ত গঠন। অধিকন্তু, এটি এমন একটি প্রতিষেধক যা প্রত্যেক ব্যক্তিকে অবশ্যই তার নিজের জন্য নিজেকে প্রয়োগ করতে হবে।

আমরা যদি একবার নির্দিষ্টভাবে সিদ্ধান্ত নিই, তবে আর পরিস্থিতির কারণে উদ্বিগ্ন হব না। আমরা আমাদের নির্দিষ্ট কাজ করে যাব এবং সেই অনুযায়ী ফলাফলও চলে আসবে।

আমি একবার একজন পুরুষের সাক্ষাৎকার নিয়েছি যাকে ২ ঘণ্টা পর তড়িৎ ক্রিয়ার সাহায্যে মৃত্যুদ- দেওয়া হবে। সেখানে মোট মৃত্যুদ- প্রাপ্ত আসামী ছিল ৮ জন। কেবল একজনই অন্যদের চেয়ে খুব শান্ত ছিল। তার শান্তভাব দেখে আমি কিছুটা অবাক হই। আমি তাকে তার অনুভূতি ব্যক্ত করার জন্য বললাম। সে অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই পরকালে চলে যাচ্ছে, এজন্য তার কেমন লাগছে? মুখে একটি দৃঢ় আত্মবিশ্বাসী হাসি দিয়ে সে বলল, ‘আমার জন্য এটা খুব ভালো। একটু চিন্তা করে দেখুন, আমার সব সমস্যার খুব দ্রুতই সমাধান হতে যাচ্ছে। সারাজীবন আমার সমস্যা ছাড়া আর কিছুই ছিল না। খাবার খোঁজার সমস্যা, পোশাক খোঁজার সমস্যা। এসবই একটি কষ্টকর ব্যাপার। একটু পরে আমার আর এই জিনিসের প্রয়োজন হবে না। আমি যখন থেকে বুঝতে পেরেছি যে আমার মৃত্যুদ- হবে তখন থেকে আমি খুব ভালো অনুভব করছি। আমি আমার মনকে তৈরি করে নিয়েছি যাতে আমার মন আমার ভাগ্যকে ভালো চেতনায় গ্রহণ করে নেয়।’

যখন সে কথাগুলো বলছিল তখন সে তার রাতের খাবার গোগ্রাসে গিলছিল। যার পরিমাণ ছিল তিনজন মানুষের সমান। প্রত্যেক লোকমা খাবার তাকে শান্তি এবং আনন্দ এনে দিচ্ছিল। দেখে মনে হচ্ছিল যেন খুশির প্রকাশ। এটা বোঝার কোন উপায় নেই যে একটু পরে তার জন্য একটা বিপদ অপেক্ষা করছে। একটা সিদ্ধান্ত তাকে নিশ্চয়তা দিয়েছে। সে তার ভাগ্য থেকে ছুটি নিয়েছে! এজন্যই বলছিলাম যে একটা সিদ্ধান্তই একজনকে অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা থেকে রক্ষা করে। মৃত্যু ভীতির কবল থেকে নিজেকে উদ্ধার করুন। মৃত্যুকে মেনে নিন এবং জীবনের একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য নিন। সে নির্দিষ্ট লক্ষ্যকে পূরণ করার সিদ্ধান্ত নিন।

আমাদের বর্তমান জীবনে ৬টি মূল ভীতি একটি বিভীষিকায় রূপান্তরিত হয়েছে। এর কারণ সিদ্ধান্তহীনতা। নিজেকে এসব ভীতি থেকে উদ্ধার করুন। একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর দ্বারা দরিদ্রতা ভীতিকে চাবুক মারুন যে আপনি দুশ্চিন্তা বা উদ্বিগ্নতা ছাড়াই যেকোন সম্পদ অর্জন করতে পারবেন। সমালোচনা ভীতির ঘাড়ে পা রাখার সিদ্ধান্ত নিন যে লোকে যাই বলুক না কেন আমি বিচলিত হব না। একটি সিদ্ধান্ত নিয়ে বৃদ্ধ বয়স ভীতি দূর করুন যেন বৃদ্ধ বয়স কোন প্রতিবন্ধকতা নয়; বরং একটি মহান আর্শীবাদ যা এর সাথে বিজ্ঞতা, আত্মনিয়ন্ত্রণ এবং বুঝজ্ঞান বহন করে, যা যুবক বয়সে জানা ছিল না। অসুস্থতা ভীতি থেকে নিজেকে মুক্ত বলে ঘোষণা দিন এবং সুস্থ থাকার সিদ্ধান্ত নিন। ভালোবাসার কাউকে হারানোর ভীতির ওপর কর্তৃত্ব করুন। ভালোবাসা থাকলে ভালো; আর না থাকলে সিদ্ধান্ত নিন যে যদি দরকার হয় তবে একাই চলব।

উদ্বিগ্ন হওয়ার অভ্যাসকে খুন করুন। এর বিভিন্ন ধরন এবং রূপকে হত্যা করুন। কম্বল চাপা দেওয়ার মতো একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছান। মনে রাখবেন, দুশ্চিন্তা বা উদ্বিগ্নতার দামে পাওয়া সুযোগ আপনার জীবনে কোন মূল্য রাখে না। আপনি যখনই উদ্বিগ্নতাকে ঝেড়ে ফেলবেন তখনই আপনার মন ও মস্তিষ্কে ভারসাম্য আসবে, মনের শান্তি ও চিন্তার শান্তভাব সৃষ্টি হবে। যা আপনার জন্য অনাবিল আনন্দ বয়ে আনবে।

একজন পুরুষ যার মন ভয়-ভীতির আশঙ্কায় পূর্ণ সে শুধু নিজের বুদ্ধিমান কর্মের সুযোগ নষ্ট করে না; বরং সে এই ধ্বংসাত্মক তরঙ্গকে অন্য মানুষের মনেও চালান করে যে সব মানুষ তার সংস্পর্শে আসে এবং তাদের সুযোগকেও ধ্বংস করে।

এমনকি একটি কুকুর বা ঘোড়াও জানে যখন এর মালিকের সাহসের অভাব ঘটে। অধিকন্তু, একটি কুকুর বা ঘোড়া তার মালিকের ভীতির তরঙ্গ তুলে নেয় এবং তদানুযায়ী আচরণ করে। বুদ্ধিমত্তার ভিত্তিতে প্রাণিরাজ্যের নিচের দিকে গেলেও আপনি দেখতে পাবেন যে এগুলোরও এই একই ধরনের ক্ষমতা রয়েছে যা হচ্ছে ভীতির তরঙ্গ তুলে নেওয়ার সামর্থ্য। একটি মৌমাছি খুব দ্রুত একজন ব্যক্তির ভীতি অনুভব করতে পারে। এজন্যই যে ব্যক্তির মন ভীতি প্রকাশ করে না তার তুলনায় যে ব্যক্তির মন ভীতি প্রকাশ করে তাকে মৌমাছি আগে হুল ফোটায়।

ভীতির তরঙ্গ এক মন থেকে অন্য মনে এত দ্রুত প্রবাহিত হয় যেমন রেডিওয়ের প্রচারকারী স্টেশন থেকে মানুষের কণ্ঠ রেডিও যন্ত্রে পৌঁছায়। আর এটা সেই একই মাধ্যম দ্বারা প্রবাহিত হয়। বর্তমানে মানসিক যোগাযোগ একটি বাস্তবতা। আমাদের চিন্তা এক মন থেকে অন্য মনে প্রবাহিত হয়। যদিও যে ব্যক্তি চিন্তা প্রকাশ করে বা তুলে নেয় সে এই ব্যাপার বুঝতে পারে না।

যে ব্যক্তি তার চিন্তা বা কথায় নেতিবাচক বা ধ্বংসাত্মক চিন্তার প্রকাশ করে সে বাস্তবেও এমন ধ্বংসাত্মক ঘটনার সম্মুখীন হয়। সেই শব্দের একটি খারাপ প্রভাব রয়েছে। এটা অনেকটা সেই ব্যক্তিকেই ‘ফিরে লাথি মারা’ ধরনের এক অভিজ্ঞতা দেয়। ধ্বংসাত্মক চিন্তা তরঙ্গের প্রকাশ খুবই বিপদজনক। আপনি হয়তো কথা কথায় নেতিবাচক কথা বলে ফেললেন; কিন্তু ঠিক এটাই আবার আপনার সাথে ঘটবে। একে বলা হয় ‘ফিরে লাথি মারা’ পরিস্থিত। সবার প্রথম আপনার মনে রাখতে হবে যে একজন ব্যক্তি যে নেতিবাচক বা ধ্বংসাত্মক চিন্তা প্রকাশ করে, তার সৃজনশীল কল্পনা অনুষদের ক্ষয় ঘটেছে বা ভেঙ্গে গেছে। দ্বিতীয়ত, মনের মধ্যে যেকোন ধরনের ধ্বংসাত্মক অনুভূতির উপস্থিতি এমন এক নেতিবাচক ব্যক্তিত্ব গঠন করে যা মানুষের মধ্যে বিতৃষ্ণার উদ্রেক ঘটায় এবং তাদেরকে প্রতিদ্বন্দ্বীতে পরিণত করে। তৃতীয়ত, যে ব্যক্তি নেতিবাচক চিন্তা পোষণ এবং প্রকাশ করে, সেটা অন্য কাউকে নয় বরং তাকেই ক্ষতি করে। এটা তার নিজের অবচেতন মনে দৃঢ় এবং গভীরভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। এটা তার চরিত্রের একটা অংশ হয়ে দাঁড়ায়।

একজন ব্যক্তি কখনো বলতে পারে না যে একটা চিন্তা কখন, কোথায়, কোন কাজে লাগতে পারে। এমনকি সে এটাও বলতে পারে না যে চিন্তাটা কোন মাধ্যমে ছড়াচ্ছে। তবে আমরা এতটুকু বলতে পারি যে চিন্তা তরঙ্গের বহনকারী মাধ্যম হচ্ছে ইথার। যখন একটি চিন্তা প্রকাশিত হয় তখন এটি ইথারের মাধ্যমে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু মূল বিষয় হচ্ছে যে ব্যক্তি এই চিন্তাটি প্রকাশ করে তার অবচেতন মনে এটি চিরকালের জন্য গেঁথে যায়।

জীবনে আপনার ব্যবসা হচ্ছে (আপাতত সত্য বলে ধরে নিচ্ছি) যে সাফল্য অর্জন করা। সাফল্যম-িত হওয়ার জন্য আপনাকে অবশ্যই মনের স্থিরতা খুঁজতে হবে। জীবনের বস্তুগত প্রয়োজন অর্জনের জন্য এবং এগুলো উপভোগ করার জন্য আপনার মধ্যে স্থিরতা দরকার। আর মনের স্থিরতা আরম্ভই হয় চিন্তা থেকে।

আপনি যদি আপনার মনকে নিয়ন্ত্রণ করতে চান, তবে একে কী চিন্তা খাওয়াচ্ছেন তার দিকে নজর দিন। আপনি ইচ্ছা করলেই এটি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। সুষম খাবার যেমন দেহকে সুস্থ রাখে; তেমন ইতিবাচক চিন্তাও মন ও মস্তিষ্ককে ভালো রাখে। ইতিবাচক চিন্তা করা, এটির গঠনমূলক প্রয়োগ করা আপনার দায়িত্ব। অন্য যেকোন কিছুর চেয়ে আপনার বেশি ক্ষমতা এবং অধিকার রয়েছে নিজের চিন্তাকে নিয়ন্ত্রণ করার। আপনি যদি আপনার চিন্তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন, তবে আপনি আপনার ভাগ্যের ওপরও কর্তৃত্ব করতে পারবেন। এভাবে নিজের চিন্তা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে একসময় আপনি আপনার আশেপাশের পরিবেশ এবং জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন। আর যদি এই দায়িত্বের প্রতি অবহেলা করেন, তবে আপনাকে এই বিশ্বের ঘটনা বহুল সমুদ্রের মধ্যে হাবুডুবু খেতে হবে। আপনি খড়কুটার মতো যেকোন দিকে ভেসে যাবেন।

শয়তানের দুর্গ এবং দুর্গের নৃপতি

(৭ নম্বর মূল ভীতি)

৬টি মূল ভীতির অতিরিক্ত একটি ভীতি রয়েছে যাকে দুর্গ এবং দুর্গের নৃপতি হিসাবে অখ্যায়িত করা হলো। এখানে দুর্গ এবং দুর্গের নৃপতি রূপে এই ভীতির তীব্রতা এবং ভয়ংকর অবস্থাকে বোঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে। এই ভীতি এমন এক ভীতি যা সমগ্র বিশ্বের মানুষকে আকঁড়ে আছে। উর্বর জমিতে যেমন প্রচুর আগাছা জন্মাতে পারে তেমনি এই ভীতিও মানুষকে আষ্টেপৃষ্টে ধরে রাখে। এটা এত ধূর্ত যে মানুষ প্রায়ই এর উপস্থিতি সম্পর্কে টের পায় না। এই ভীতিকে ঠিক ভীতির কাতারেও ফেলা যায় না। কারণ এর বাস ৬টি মূল ভীতির চেয়েও অনেক গভীরে। ৬টি মূল ভীতি একত্রিত হলেও এর ক্ষতির সামনে কিছু না। প্রথমে এর একটি উপযুক্ত নাম দিই। চলুন, আমরা এই দুষ্টকে ডাকব ‘নেতিবাচক প্রভাবের প্রতি সংবেদনশীলতা’ বলে। যদিও নামটি একটু বড়, তবে এর কার্যকারিতাকে তুলে ধরার জন্য উপযুক্ত। সংবেদনশীলতা মানে সহজেই অভিভূত হওয়া। নেতিবাচক প্রভাবের প্রতি সংবেদনশীলতা মানে হচ্ছে ব্যর্থ হলেই হাহুতাশ করা, সহজেই বাধার সামনে ভেঙে পড়া, প্রতিবন্ধকতা, দুর্বলতা, অসামর্থ্যতার দিকে বেশি মনোযোগ দেওয়া; বরং একজনের উচিত মানসিক স্থিরতার দিকে মনোযোগী হওয়া, একটি কাজের সম্ভাবনা নিয়ে চিন্তা করা, কাজটি করার ক্ষেত্রে নিজের সুযোগ ও সামর্থ্য বিবেচনা করা, সামনে বাধা থাকলে, প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হলে একে কীভাবে সমাধান করা যায়, কীভাবে সুযোগে পরিণত করা যায় তা নিয়ে চিন্তা করা। (অনুবাদকের কথাÑআমি আমার অনুবাদ করা টাইম ম্যানেজমেন্ট বইয়ে এই শিরোনামেÑযেকোন সমস্যার উদয় হলে চিন্তা করুন, ‘কীভাবে সমাধান করব?’Ñ একটি ছোট্ট রচনা লিখেছি তা পড়তে পারেন।)

যারা জীবনে সাফল্য অর্জন করেছে, ধনসম্পদ অর্জন করেছে তারা সবসময় নিজেদেরকে এই দুষ্টের হাত থেকে রক্ষা করেছে! দরিদ্ররা কখনো তা করে না! যারা জীবনে সফল হতে চান, তা যেকোন পেশায় হোক না কেন, তাদেরকে অবশ্যই এই দুষ্ট থেকে নিজের মনকে বাঁচাতে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। যদি আপনি এই দর্শন এই উদ্দেশ্যে পাঠ করেন যে আপনি জীবনে ধনী হবেন, তবে আপনাকে নিজের ভেতর অতি সতর্ক পর্যবেক্ষণ চালাতে হবে। আপনাকে দেখতে হবে যে আপনি কি নেতিবাচক প্রভাবের প্রতি সংবেদনশীল। যদি আপনি এই আত্মবিশ্লেষণকে অবহেলা করেন, তবে আপনি আপনার আকাক্সক্ষা অনুযায়ী কখনোই ধনী হতে পারবেন না। এই দর্শনও আপনার জন্য কিছু করতে পারবে না।

নিজের ভেতর একটি খোঁজ চালান। সামনে আত্মবিশ্লেষণের জন্য কিছু প্রশ্ন দেওয়া হয়েছে। এগুলো দিয়ে নিজেকে আবিষ্কার করুন। কোদাল দিয়ে যেমন মাটি খোঁড়ে, তেমন নিজের মন ও মস্তিষ্কের ভেতর খুঁজে দেখুন। নিজের আত্মঅনুসন্ধানের জন্য প্রস্তুত হোন। নিজেকে একটি শক্ত হিসাবের মধ্যে ধরুন এবং জবাব দাবি করুন। মনে রাখবেন, আপনি এমন এক শত্রুর খোঁজে যাচ্ছেন যে আপনার সাফল্যের পথে ওঁত পেতে আছে, যে অদৃশ্য। একজন দৃশ্যমান শত্রু হলে আপনি যা করতেন, এই অদৃশ্য শত্রুকেও সেই আচরণ উপহার দিন। [গ্রামগঞ্জে বলে শিং মাছ ঠিক ধরা যায় না, হাত পিছলে যায়। তাই হাতে আগে ছাই মেখে নিতে হয় যাতে শিং মাছ ছুটে যেতে না পারে। আপনি শিং মাছকে পরিবর্তন করতে পারেন না; কিন্তু নিজের হাতে ছাইয়ের মতো একটি ব্যবস্থা নিতে পারেন।]

রাস্তাঘাটে যদি ডাকাত বা চোরের হামলা ঘটে, তবে আপনি হয়তো লাঠি বা লোহা দিয়ে প্রতিরোধ করতে পারতেন। কিন্তু এই ৭ নম্বর মূল ভীতি খুবই চতুর এবং ছদ্মবেশধারী। এজন্য এর ওপর কর্তৃত্ব করা একটু কঠিন। আমি তো বলব বেশ কঠিন। কারণ এটা যে শুধু আপনি জেগে থাকলেই আঘাত করে তা নয়; বরং আপনি যখন সচেতন নন, গভীর ঘুমে থাকেন তখনও এটা আঘাত হানতে পারে। এর সেই ক্ষমতা আছে। আর এর হাতিয়ার হচ্ছে অদৃশ্য, যা হাতে স্পর্শ করা যায় না। এটা তলোয়ারের আঘাত নয় যে আপনি ঢাল দিয়ে রক্ষা করবেন। কারণ এটা গঠিত হয় একটা মানসিক অবস্থা দিয়ে। ‘নেতিবাচক প্রভাবের প্রতি সংবেদনশীলতা’ নামক এই দুষ্ট আরও বেশি বিপদজনক, কারণ এটা মানুষকে সব রকমভাবে সবদিক থেকে আঘাত করে। কিছু কিছু সময় এটা আত্মীয়-স্বজনের ভালো মনোভাবে বলা কথার মধ্য দিয়ে একজনের মনে প্রবেশ করে। অন্য সময় এটা একজনের আপন মানসিক আচরণের মাধ্যমে ধীরে ধীরে ভেতর প্রবেশ করে। এটা সিগারেটের মতো এমন এক ধীরগতির মারাত্মক বিষ যার প্রভাব বহু বছর পরে বোঝা যায়। সিগারেট যেমন একবার পান করলেই আপনি মরে যাবেন না, তেমন ‘নেতিবাচক প্রভাবের প্রতি সংবেদনশীলতা’ আপনাকে প্রথমদিনই যে গোরস্থানে পাঠিয়ে দিবে তা নয়। কিন্তু আস্তে আস্তে এর ধীরগতির বিষ যখন মানব মন ও মস্তিষ্কে ছড়িয়ে পড়বে, তখন একজন ব্যক্তি অল্প অল্প ব্যথা অনুভব করবে। তারপর আরও বহু বছর কেটে যাবে এবং হঠাৎ আপনার মৃত্যু ঘটবে। কিন্তু আপনি কখনো বুঝতেই পারবেন না।

[এই ব্যাপার আরেকটু পরিষ্কার করি। ধরুন, আপনি ধূমপান করেন। হঠাৎ আপনি গাড়ির ধাক্কায় মারা গেলেন। ডাক্তার লিখলেন গাড়ি চালক প্রচ- গতিতে গাড়ি চালিয়ে এক ব্যক্তিকে নিহত করেছে। দোষ গাড়ি চালকের। এখন একটু গভীরভাবে চিন্তা করুন। যখন একজন ব্যক্তি সুস্থ থাকে, তখন তার চলার গতি একটু দ্রুতই থাকে। সে যখনই রাস্তা পার হয় তখন সে তার নিজের চলার শক্তি সম্পর্কে জানে এবং গাড়ির অবস্থান দেখে সিদ্ধান্ত নেয় যে সে গাড়িটি এখানে আসার আগেই রাস্তা পার হয়ে যেতে পারবে। কিন্তু যখন সেই ব্যক্তি ধূমপান করে, তখন ধীরে ধীরে তার গতি কমতে থাকে, দেহের চলার শক্তি এবং স্ফূর্তি চলে যায়। এটা একদিনে হয় না। এটা হয়তো দীর্ঘ ১০-১৫ বা ২০ বছর সময় নেয়। আবার চলার শক্তির সাথে সাথে চোখের দৃষ্টিশক্তি, মস্তিষ্কের চিন্তাশক্তিকেও শ্লথ করে দেয়। তাই পূর্বে নিজের শক্তি এবং গাড়ির দূরত্বকে খুব দ্রুত হিসাব করে রাস্তা পার হয়ে গেছেন। আজকে সেখানে হিসাবটি ধীর হয়ে গেছে। কিন্তু গাড়ির গতি তো আর কমেনি। ব্যস! মৃত্যু অবধারিত!

এই তো গেল ধূমপানের কুপ্রভাব। ‘নেতিবাচক প্রভাবের প্রতি সংবেদনশীলতার’ প্রভাবও অনেকটা একই রকম। কিন্তু ধূমপানের প্রভাবের চেয়েও ‘নেতিবাচক প্রভাবের প্রতি সংবেদনশীলতা’ অনেক বেশি মারাত্মক এবং এর ব্যাপ্তিও অনেক বেশি।]


কীভাবে নিজেকে নেতিবাচক প্রভাব থেকে রক্ষা করবেন?

নিজেকে নেতিবাচক প্রভাবের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের জন্য প্রথমে আপনাকে আপনার নিজের ইচ্ছাশক্তি প্রয়োগ করতে হবে। আশেপাশের লোকজনও ইতিবাচক হওয়া দরকার যাতে করে তাদের কাজকর্মও ইতিবাচক হয়। কিন্তু তারচেয়েও বড় জিনিস হচ্ছে নিজের ইচ্ছাশক্তি। সবসময় মনে রাখবেন আপনার একটি ইচ্ছাশক্তি রয়েছে এবং একে প্রতিনিয়ত নেতিবাচক প্রভাবের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করতে থাকুন। যতক্ষণ পর্যন্ত না এটা আপনার নিজ মনের মধ্যে নেতিবাচক প্রভাবের বিরুদ্ধে একটি মজবুত দেওয়াল তৈরি না করছে ততক্ষণ এই চেষ্টা চালিয়ে যান।

ধীরে ধীরে আপনি ভালো করবেন। এভাবে চেষ্টা করার ফলে আপনি আরেকটি জিনিস লক্ষ করবেন যে মানুষ আসলে অলস ও উদাসীন এবং তার নিজের দুর্বলতার সাথে মিল পেলে নেতিবাচক পরামর্শ গ্রহণ করে। তাই আমাদের আলাপ আলোচনার মধ্যেও আমাদেরকে আগ্রহী, পরিশ্রমী এবং কর্মঠ হতে হবে। আরও দেখবেন, ৬টি মূল ভীতি মানুষের মনের অনেক ভেতরে বাস করে। এমনকি তারা নিজেরাও জানে না যে তারা এই ভীতিতে ভীত। এখানে ৬টি মূল ভীতি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে যাতে আপনি এই ব্যাপারে জ্ঞাত হন এবং সতর্ক হন। এখানে যে পদ্ধতি, অভ্যাস ও দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে তা আপনাকে ৬টি মূল ভীতি থেকে দূরে রাখবে এবং আপনার মধ্যে সাহস সঞ্চার করবে। আপনি নেতিবাচক প্রভাবকে চিনতে পারবেন এবং আপনার অবচেতন মনের ওপর এটা কীভাবে ক্রিয়া করে তাও ধরতে পারবেন। এতে করে আপনি আপনার মনের সব দরজা ইচ্ছামতো বন্ধ করতে এবং খুলতে পারবেন।

আপনার নিরাময়যোগ্য মনকে পরিষ্কার করুন। সব ধরনের ঔষধের বোতল ছুঁড়ে ফেলে দিন। মনের ভেতর চরম বিশৃঙ্খলা রোধ করুন এবং কল্পিত অসুস্থতার চিন্তা বাদ দিন। ইচ্ছা করে সেসব মানুষের সঙ্গ খুঁজুন যারা আপনাকে নিজের জন্য চিন্তা এবং কাজ করতে উৎসাহিত করে।

কখনো সমস্যা আশা করবেন না। কার কাছ থেকে সমস্যার কথা শুনবেনও না। কারণ সমস্যা কখনো হতাশ হয় না। আপনি, আমি হতাশ হতে পারি। কিন্তু সমস্যা থেমে থাকে না। তাই সবসময় সম্ভাবনা নিয়ে চিন্তা করুন। সুযোগ ও সুবিধা নিয়ে ভাবুন।

নিঃসন্দেহে মানব সত্তার সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হচ্ছে নিজের মনকে অন্যান্য মানুষের নেতিবাচক প্রভাবের সামনে খোলা ছেড়ে দেওয়া। আমাদের জীবনে যত ধরনের ক্ষতি হয় তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করে এই দুর্বলতা। কারণ অধিকাংশ মানুষ একে ক্ষতি হিসাবে ধরতেও পারে না। এটা এমন এক অভিশাপ যা ছদ্মবেশে কাজ করে। যারা এটা বুঝতে অবহেলা বা অস্বীকার করে তারাই জীবনে ব্যর্থতার শিকার হয়। অনেকে হয়তো একে চিনতে পারে; কিন্তু ততক্ষণে এটা তার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে এবং একে ছাড়তে পারে না। ততদিনে এই অভ্যাস আপনার যথেষ্ট ক্ষতি করে ফেলেছে যা আর পুনরায় ঠিক করা সম্ভব হয় না।

যারা জীবনে সাফল্য অর্জন করতে চায়, ব্যর্থতা থেকে উঠে দাঁড়াতে চায় এবং নিজের ও দেশের মানুষের জন্য উপকারী সেবা সম্পন্ন করতে চায় তাদের সহায়তার জন্য নিচে একটি প্রশ্ন তালিকা দেওয়া হলো। প্রশ্নগুলো জোরে জোরে পড়–ন। এর উত্তর উচ্চস্বরে বলে যান। যাতে আপনি নিজে আপনার কণ্ঠস্বর শুনতে পান। এতে করে আপনি সত্য বলছেন কিনা তা নিজেই ধরতে পারবেন।


আত্মবিশ্লেষণ পরীক্ষার প্রশ্নাবলি

আপনি কি প্রায়ই ‘খারাপ অনুভব’ করছেন বলে অভিযোগ করেন এবং যদি তাই হয়, তাহলে কারণ কী?

আপনি কি অন্যান্য মানুষের সামান্য উত্তেজনার মধ্যে ভুল খুঁজে পান?

আপনি কি প্রায়শই আপনার কাজে ভুল করতেন এবং যদি তাই হয়, তাহলে কেন?

আপনি কি আপনার আলোচনায় ব্যাঙ্গাত্মক এবং আক্রমণাত্মক?

আপনি কি ইচ্ছা করে কারও সহচার্য এড়িয়ে চলেন এবং যদি তাই হয়, তাহলে কেন?

আপনি কি প্রায়ই হজমে সমস্যা অনুভব করেন? যদি তাই হয়, তাহলে কারণ কী?

আপনার কাছে কি জীবন তুচ্ছ এবং ভবিষ্যৎ আশাহীন মনে হয়? যদি তাই হয়, তাহলে কেন?

আপনি কি আপনার পেশা পছন্দ করেন? আর যদি অপছন্দ করেন, তাহলে কেন অপছন্দ করেন?

আপনি কি প্রায়ই আত্মদুঃখ অনুভব করেন এবং যদি তাই হয়, তো কেন?

আপনি কি তাদের হিংসা করেন যারা আপনার চেয়ে অধিকতর শ্রেষ্ঠ?

আপনি কীসের প্রতি আপনার অধিকাংশ সময় উৎসর্গ করেন? সাফল্যের চিন্তা করেন; নাকি ব্যর্থতার?

আপনি যত বড় হচ্ছেন আপনি কি তত আপনার আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি করছেন; নাকি হারিয়ে ফেলছেন?

আপনি কি আপনার ভুল থেকে কিছু মূল্যবান শিক্ষা নিয়েছেন? আপনি কি পরিচিত কাউকে বা আত্মীয়-স্বজনকে আপনাকে উদ্বিগ্নতায় ফেলার জন্য অনুমতি দিয়ে যাচ্ছেন? যদি তাই হয়, তাহলে কেন?

আপনি কি কিছু সময় ‘মেঘের ওপর ভাসেন’ এবং অন্যান্য সময় নৈরাশ্যের গভীরে কাটান?

আপনি সবচেয়ে বেশি কার অনুপ্রেরণায় প্রভাবিত হন? এর কারণ কী?

আপনি কি নেতিবাচক বা নিরুৎসাহমূলক প্রভাব সহ্য করেন যা আপনি পাশ কাটাতে পারতেন?

আপনি কি আপনার ব্যক্তিগত উপস্থিতি নিয়ে অসতর্ক? যদি তাই হয়, তাহলে কখন এবং কেন?

আপনি কি শিখেছেন ‘কীভাবে সমস্যার মধ্যে ডুবে থাকতে হয়?’ কীভাবে এগুলোর দ্বারা ব্যস্ত এবং বিরক্ত হয়ে থাকতে হয়?

যদি আপনি অন্যদেরকে আপনাকে নিয়ে চিন্তা করার অনুমতি দিয়ে থাকেন, তবে আপনি কি নিজেকে ‘মেরুদ-হীন দুর্বল’ বলে ডাকবেন?

আপনি কি অভ্যন্তরীণ অবগাহন (আত্মবিশ্লেষণ) উপেক্ষা করেন যতক্ষণ পর্যন্ত না স্বীয়-বিষ আপনাকে অসুস্থ-মেজাজ এবং ক্রোধপ্রবণ করে তোলে?

কতগুলো প্রতিরোধযোগ্য বিরক্তিকর ব্যাপার আপনাকে বিরক্ত করে এবং আপনি কেন এগুলোকে সহ্য করছেন?

আপনি কি আপনার ‘স্নায়ুকে শান্ত রাখতে’ মদ, নিদ্রাকারক ঔষধ বা সিগারেটের আশ্রয় নেন? যদি তাই হয়, তাহলে আপনি কেন এর পরিবর্তে আপনার ইচ্ছাশক্তি প্রয়োগের চেষ্টা করেন না?

আপনাকে কি কেউ ‘ত্যক্ত’ করে এবং যদি তাই হয়, এর কারণ কী? আপনার জীবনে কি কোন নির্দিষ্ট প্রধান উদ্দেশ্য আছে এবং যদি তাই হয়, সেটা কী এবং আপনি তা অর্জন করার জন্য কী পরিকল্পনা নিয়েছেন?

আপনি কি ৬টি মৌলিক ভীতির কোন একটিতে ভুগছেন? যদি তাই হয়, তা কোনটি?

আপনার কি কোন পদ্ধতি আছে যার দ্বারা আপনি নিজেকে অন্যদের নেতিবাচক প্রভাব থেকে রক্ষা করতে পারেন?

আপনি কি আপনার মনকে ইতিবাচক রাখার জন্য সুপরিকল্পিতভাবে স্বপরামর্শ ব্যবহার করেন?

আপনি সবচেয়ে বেশি কি মূল্যায়ন করেন: আপনার বস্তুগত সম্পত্তির অধিকার; নাকি আপনার নিজস্ব চিন্তাকে নিয়ন্ত্রণ করার অধিকার?

আপনি কি আপনার নিজস্ব রায়ের বিরুদ্ধে সহজেই অন্যদের দ্বারা প্রভাবিত হন?

আপনি কি আপনার জ্ঞানের ভা-ার বা মনের রাজ্যে আজকে নতুন কিছু যোগ করেছেন?

আপনি কি প্রায়ই এমন কারণসমূহের সম্মুখীন হন যা আপনাকে অসুখী করে তোলে বা দায়িত্বকে এড়িয়ে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি করে?

আপনি কি আপনার জীবনের ভুল এবং ব্যর্থতা বিশ্লেষণ করেছেন, আর এগুলোর দ্বারা কি লাভবান হওয়ার চেষ্টা করেছেন; নাকি আপনি এই মনোভাব পোষণ করেন যে এটা আমার দায়িত্ব নয়?

আপনি কি আপনার ৩টি ক্ষতিকারক দুর্বলতার নাম বলতে পারেন? আপনি এগুলোকে ঠিক করার জন্য কী করেছেন?

আপনি কি সমবেদনা দেখানোর জন্য অন্যান্য মানুষকে তাদের দুশ্চিন্তা আপনার কাছে আনতে উৎসাহিত করেন?

আপনি কি আপনার প্রতিদিনের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নেন যে শিক্ষা আপনার ব্যক্তিগত উন্নয়নে সহায়তা করবে?

আপনার উপস্থিতি কি অন্যান্য মানুষের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে? এটা কি একটি নিয়মের মতো হয়ে গেছে?

অন্যান্য মানুষের কোন অভ্যাস আপনাকে সবচেয়ে বেশি বিরক্ত করে?

আপনি কি নিজে নিজের মতামত তৈরি করেন; নাকি নিজেকে অন্যান্য মানুষের প্রভাবে প্রভাবিত হওয়ার অনুমতি দেন?

আপনি কি শিখেছেন কীভাবে নিজ মনের মানসিক অবস্থা স্থির করা যায় যাতে আপনি নিজেকে সব নিরুৎসাহমূলক প্রভাবের বিরুদ্ধে রক্ষা করতে পারেন?

আপনার পেশা কি আপনার বিশ্বাস এবং আশাকে উৎসাহিত করে?

আপনি কি যথেষ্ট ক্ষমতার আধ্যাত্মিক বল অর্জনে সচেতন যাতে আপনি আপনার মনকে সব ধরনের ভীতি থেকে দূরে রাখতে সমর্থ হন?

আপনার ধর্ম কি আপনার মনকে ইতিবাচক রাখতে সহায়তা করে?

আপনি কি অনুভব করেন যে আপনার দায়িত্ব হচ্ছে অন্য মানুষের উদ্বিগ্নতার অংশীদার হওয়া? যদি তাই হয়, তাহলে কেন?

আপনি যদি বিশ্বাস করেন যে ‘চোরে চোরে মাসতুতো ভাই।’ তাহলে আপনার যেসব বন্ধুর প্রতি আপনি আকর্ষিত তাদের বিশ্লেষণ করে আপনি নিজের সম্বন্ধে কী শিখেছেন?

আপনার বন্ধুদের সাথে আপনার মিল কোথায়? সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের সাথে আপনার কী কোন অসুখী অভিজ্ঞতা রয়েছে?

এটা কি সম্ভব হতে পারে যে কিছু লোক যাদেরকে আপনি বন্ধু বলে বিবেচনা করেন, বাস্তবে তারা আপনার সবচেয়ে ক্ষতিকারক শত্রু, কারণ আপনার মনের ওপর তাদের নেতিবাচক প্রভাব?

আপনি কোন নিয়ম দ্বারা কে সহায়তাকারী এবং কে আপনার ক্ষতিকারী বিচার-বিবেচনা করেন?

আপনার অন্তরঙ্গ সহযোগীরা কি মন-মানসিকতায় আপনার চেয়ে ঊর্ধ্বতন; নাকি অধস্তন?

আপনি ২৪ ঘণ্টার কতটা সময় এর প্রতি উৎসর্গ করেন:

ক) আপনার পেশা

খ) ঘুম

গ) খেলা এবং বিশ্রাম

ঘ) প্রয়োজনীয় জ্ঞান অর্জন

ঙ) সময় অপচয়

আপনার পরিচিত ব্যক্তিদের মধ্যে:

ক) আপনাকে সবচেয়ে বেশি উৎসাহিত করে

খ) আপনাকে সবচেয়ে বেশি সতর্ক করে

গ) আপনাকে সবচেয়ে বেশি নিরুৎসাহিত করে

ঘ) আপনাকে সবচেয়ে বেশি অন্যান্য পথে সহায়তা করে

আপনার সবচেয়ে বড় উদ্বেগ কী? আপনি কেন এটা সহ্য করছেন?

যখন অন্যরা আপনাকে মুক্ত, অপ্রত্যাশিত পরামর্শের জন্য প্রস্তাব জানায় তখন আপনি কি কোন প্রশ্ন ছাড়াই গ্রহণ করেন বা তাদের অভিপ্রায় বা উদ্দেশ্য পর্যবেক্ষণ করা ছাড়াই জবাব দেন?

অন্য সবকিছুর চেয়ে আপনি সবচেয়ে বেশি কী আকাক্সক্ষা করেন? আপনি কি এটা অর্জনের জন্য মনোযোগী? আপনি কি অন্য সব আকাক্সক্ষাকে শুধু এই একটির জন্য নিচে রাখতে ইচ্ছুক? আপনি প্রতিদিন কত সময় এটা অর্জনের জন্য উৎসর্গ করেন?

আপনি কি আপনার মনকে প্রায়ই পরিবর্তন করেন? যদি তাই হয়, তাহলে কেন?

আপনি কি সাধারণত সবকিছু শেষ করেন যা আপনি শুরু করে থাকেন? এখানে শেষ করার ব্যাপারে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। কারণ আমাদের মধ্যে অনেকেই কাজ আরম্ভ করে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত কাজটি সম্পন্ন করে না।

আপনি কি সহজেই অন্যান্য লোকের ব্যবসা বা পেশার উপাধি, কলেজ ডিগ্রি বা সম্পদের প্রতি প্রভাবিত হন?

অন্যান্য মানুষ আপনার সম্বন্ধে যা চিন্তা করে বা বলে আপনি কি সহজেই তার দ্বারা প্রভাবিত হন?

গ্রুপে খেতে বসলে, আপনি কি লোকজনের সামাজিক বা আর্থিক অবস্থানের কারণে তাদেরকে খাদ্যাদি সরবরাহ করেন?

আপনার মতে বর্তমানে জীবিত মানুষের মধ্যে সবচেয়ে মহান ব্যক্তি কে? কোনদিক থেকে এই ব্যক্তিকে আপনার শ্রেষ্ঠ মনে হয়?

এসব প্রশ্ন বিশ্লেষণ করতে এবং জবাব দিতে আপনি কতটা সময় উৎসর্গ করেছেন? (এই সম্পূর্ণ তালিকা বিশ্লেষণ করতে এবং উত্তর দিতে কমপক্ষে একদিন প্রয়োজন।)

যদি আপনি সব প্রশ্নের উত্তর সত্যি সত্যিই দিয়ে থাকেন, তবে আপনি নিজের সম্বন্ধে অন্যান্য অধিকাংশ লোকের চেয়ে বেশি জানেন। প্রশ্নগুলোকে যতেœর সাথে পর্যবেক্ষণ করুন। আগামী কয়েক মাস ধরে প্রতি সপ্তাহে এগুলোর কাছে ফিরে আসুন। এতে করে আপনি নিজের সম্পর্কে বহু পরিমাণ অতিরিক্ত জ্ঞান জানতে পেরে অত্যন্ত বিস্মিত হবেন। এই জ্ঞান অমূল্য। এটা কেবল প্রশ্নগুলোর সত্যিকার উত্তর দিয়েই আপনি অর্জন করতে পারেন। যদি আপনি কিছু প্রশ্নের নিশ্চিত উত্তর দিতে অক্ষম হন, তবে এমন একজন পরামর্শক খুঁজুন যিনি আপনাকে খুব ভালোভাবে জানে এবং চেনে। বিশেষত আপনাকে তোষামোদ করার প্রতি যার উদ্দেশ্য নেই এবং নিজেকে তার চোখে দেখুন। অভিজ্ঞতাটি অত্যন্ত বিস্ময়কর হবে।

আপনার কেবল একটি বিষয়ের ওপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ আছে এবং তা হচ্ছে আপনার চিন্তাভাবনা। এটা হচ্ছে মানুষের জানা মতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং তাৎপর্যপূর্ণ। এতে মানুষের ঐশ্বরিক প্রকৃতি প্রতিফলিত হয়। এই ঐশ্বরিক অধিকার হচ্ছে একটি স্বতন্ত্র গুণ যা দ্বারা একজন ব্যক্তি তার নিজ ভাগ্যকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। যদি আপনি আপনার মনকে নিয়ন্ত্রণ করতে বিফল হন, আপনি নিশ্চিত থাকতে পারেন যে আপনি অন্য কোনকিছুই নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন না।

যদি আপনি অমনোযোগী হন, তবে এটা যেন আপনার বস্তুগত বিষয়ের প্রতি হয়। আপনার মন হচ্ছে আপনার আত্মিক সম্পত্তি! এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই একে সর্বমূল্যে রক্ষা করুন এবং একে যতেœর সাথে প্রয়োগ করুন যাতে ঐশ্বরিক মর্যাদার অধিকারী হওয়া যায়। আপনাকে একটি ইচ্ছাশক্তি দেওয়া হয়েছে তো এই উদ্দেশ্যের জন্যই।

দুর্ভাগ্যবশত, যারা অন্যের মনে নেতিবাচক পরামর্শ দ্বারা বিষ ঢুকায় তাদের জন্য কোন শাস্তিযোগ্য আইন নেই। তারা এটা কৌশলে বা অজ্ঞতার মাধ্যমে করে। উভয় ক্ষেত্রে আপনার নিজেরই ক্ষতি। তাই সতর্ক থাকুন। আপনার বস্তুগত সম্পত্তি বিনষ্ট হলে আইন দ্বারা আপনি একটি প্রতিকার পেতে পারেন। কিন্তু আপনার মনকে যারা নেতিবাচক পরামর্শ দিয়ে বিষাক্ত করে তাদের জন্য আপনাকেই ব্যবস্থা নিতে হবে। তাদের বিরুদ্ধে বাস্তবে কোন আইন নেই। আপনার নিজেকেই নিজের রক্ষাকারী হিসাবে দাঁড়াতে হবে।

লোকজন তাদের নেতিবাচক মন নিয়ে টমাস আলভা এডিসনকে প্রমাণ প্রয়োগে বিশ্বাস করানোর চেষ্টা করছিলেন যে সে এমন একটি যন্ত্র তৈরি করতে পারবে না যা মানুষের স্বরকে সংরক্ষণ এবং পুনরুৎপাদন করতে সক্ষম। ‘কারণ’ তারা বলল, ‘আজ পর্যন্ত কেউ এমন একটি যন্ত্র সৃষ্টি করতে পারেনি।’ এডিসন লোকজনের কথায় বিশ্বাস করেননি। তিনি জানতেন যে একজনের মন তাই সৃষ্টি করতে পারে যা সে কল্পনা এবং বিশ্বাস করতে পারে। এই সেই জ্ঞান যা এডিসনকে সাধারণের ভিড় থেকে উঠিয়ে মহান উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছে।

লোকজন তাদের নেতিবাচক মন নিয়ে এফ.ডব্লিউ. উলয়োর্থকে বলল তিনি একটি ৫ এবং ১০ পয়সার দোকান চালাতে চেষ্টা করলে ‘ভেঙে যাবেন’। উলয়োর্থ লোকজনকে বিশ্বাস করেননি। তিনি জানতেন যে তিনি যুক্তি সহকারে যেকোন কিছু করতে পারবেন, যদি তিনি তার পরিকল্পনার পিছনে একটি বিশ্বাস এবং আস্থা রাখেন। তার অধিকার তিনি প্রয়োগ করেছেন। অধিকারটি হচ্ছে লোকজনের নেতিবাচক পরামর্শ তার মন থেকে বের করে দেওয়ার অধিকার। এ বইয়ের ৫ অধ্যায়ে উলয়োর্থের সুউচ্চ ভবনের ছবি দেওয়া হয়েছে। তা দেখে আপনি সহজেই ধারণা করতে পারবেন যে একটি আইডিয়া, বুদ্ধি বা ধারণা একজন মানুষকে কোথায় পৌঁছে দিতে পারে।

লোকজন তাদের নেতিবাচক মন নিয়ে জর্জ ওয়াশিংটনকে বলল তিনি ক্ষমতাশালী ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে জয়ের আশা করতে পারেন না। কিন্তু তিনি তার ঐশ্বরিক অধিকার যা হচ্ছে বিশ্বাস, সেটা অনুশীলন করলেন এবং জয়ী হলেন।

সন্দেহপ্রবণ ব্যক্তিরা হেনরি ফোর্ডকে অবজ্ঞা ভরে উপহাস করছিল যখন তিনি তার প্রথম অপরিপক্ক গাড়িটি ডেট্রয়েটের সড়কে চালানোর চেষ্টা করছিলেন। কিছু লোক বলল এমন জিনিস কখনোই বাস্তবে সম্ভব না। অন্যরা বলল এমন এক বিচিত্র জিনিসের জন্য কেউ টাকা দিবে না। (তখনকার দিনে ঘোড়ার গাড়ি চলত।)





তার সিদ্ধান্তে তিনি বিশ্বাস করতেন। আর আজকে যদি আপনি দেখেন, তবে আপনি খুব সহজেই দেখবেন যে তার সিদ্ধান্ত এত বড়, এত বিশাল এক সৌভাগ্য গড়ে তুলেছে যা তার পরবর্তী ৫ প্রজন্মের অধঃগামী পুরুষরাও অপব্যয় করে শেষ করতে পারবে না। যারা বিশালাকার ধনসম্পত্তি অর্জনের জন্য খুঁজছেন তাদের সুবিধার জন্য বলছি, এটা মনে রাখবেন যে বাস্তবে হেনরি ফোর্ড এবং যারা হেনরি ফোর্ডের জন্য কাজ করে এমন ১ লাখ ব্যক্তির মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে ফোর্ডের একটি মন আছে এবং তিনি নিজেই এটা নিয়ন্ত্রণ করেন। আর অন্যরা নিজেদের মনকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে না।

মন নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারটি আসে আত্ম-শৃঙ্খলা এবং অভ্যাস দ্বারা। হয় আপনি আপনার মনকে নিয়ন্ত্রণ করবেন; নতুবা এটা আপনাকে নিয়ন্ত্রণ করবে। সমঝোতার কোন জায়গা নেই। মন নিয়ন্ত্রণের সবচেয়ে ভালো পথ হচ্ছে একে একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যের দিকে ব্যস্ত রাখা। যার পিছনে থাকবে একটি নির্দিষ্ট পরিকল্পনা। যেকোন সফল ব্যক্তির জীবনী পাঠ করে দেখুন, আপনি সহজেই দেখবেন যে তিনি তার মনের ওপর কর্তৃত্ব করতেন। আরও দেখবেন, তিনি একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যের দিকে নিজের মনকে ধাবিত করেছেন। একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যের প্রতি মনকে ধাবিত না করলে মন নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। আর এই নিয়ন্ত্রণ ছাড়া সাফল্যও সম্ভব নয়।


‘যদি’ দ্বারা মোড়ানো ৫৭টি সুপ্রাচীন এবং বিখ্যাত অজুহাত

যেসব মানুষ সফল হয় না তাদের সবার মাঝে একটি সূক্ষ্ম মিল রয়েছে। তারা সবাই ব্যর্থতার সব ধরনের “কারণ” জানে এবং তারা বিশ্বাস করে যে তাদের অজুহাতই হচ্ছে তাদের ব্যর্থতার প্রধান কারণ। তারা প্রতিনিয়ত তাদের জীবনে সফল হতে না পারার কারণ হিসাবে তাদের অজুহাতকে কৈফিয়ত রূপে ব্যবহার করে।

হয়তো এর মধ্যে অল্প কিছু কারণ সমর্থন করা যায়। হয়তো কিছু মানুষ এমন আচরণ করে চালাকি দেখাতে চায়। কিন্তু আপনি কখনো অজুহাত দিয়ে টাকা আয় করতে পারবেন না। বিশ্ব কেবল একটি জিনিসই জানতে চায় এবং তা হচ্ছে ‘আপনি কি সফল হয়েছেন?’

একজন চরিত্র বিশ্লেষক অজুহাতের একটি তালিকা তৈরি করেছেন। এই তালিকার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত অজুহাত দেখানো হয়েছে। তালিকাটি যখন পড়বেন তখন নিজেকে সতর্কতার সাথে পরীক্ষা করুন। যদি আপনার মধ্যে এই অজুহাতগুলোর কোনটি থাকে, তবে তা খুঁজে বের করুন। আর মনে রাখবেন, এ বইয়ে প্রকাশিত দর্শনটি এসব অজুহাতকে বাতিল করে দিয়েছে।

যদি আমার বউ এবং পরিবার না থাকত ... ...

যদি আমার ওপর যথেষ্ট ‘চাপ’ থাকত ... ...

যদি আমার টাকা থাকত ... ...

যদি আমার পড়ালেখা থাকত ... ...

যদি আমি একটি চাকরি পেতাম ... ...

যদি আমার স্বাস্থ্য ভালো থাকত ... ...

যদি আমার সময় থাকত ... ...

যদি সময়টা আরও ভালো হত ... ...

যদি লোকজন আমাকে বুঝত ... ...

যদি আমার পরিবেশ ভিন্ন হত ... ...

যদি আমি আমার জীবন পুনরায় যাপন করতে পারতাম ... ...

যদি আমি ‘লোকজন’ কী বলবে তাতে ভয় না পেতাম ... ...

যদি আমাকে একটি সুযোগ দেওয়া হত ... ...

যদি আমি এখন একটি সুযোগ পেতাম ... ...

যদি আমার জন্য অন্য লোকজন ‘এটা না নিত’ ... ...

যদি আমাকে থামাতে কিছুই না ঘটত ... ...

যদি আমি তরুণ হতাম ... ...

যদি আমি যা চাই তাই করতে পারতাম ... ...

যদি আমি ধনী ঘরে জন্মাতাম ... ...

যদি আমি ‘সঠিক লোকের’ সাক্ষাৎ পেতাম ... ...

যদি আমার অন্যদের মতো মেধা থাকত ... ...

যদি আমি নিজের সম্পর্কে আরও সাহসী হতাম ... ...

যদি আমি অতীতের সুযোগগুলোকে আলিঙ্গন করতাম ... ...

যদি লোকজন আমাকে এত উত্যক্ত না করত ... ...

যদি আমাকে ঘর সামলাতে এবং শিশুদের যতœ নিতে না হত ... ...

যদি আমি কিছু টাকা জমা করতে পারতাম ... ...

যদি আমার মালিক আমাকে একবার উৎসাহ দিত ... ...

যদি আমি এমন কাউকে পেতাম যে আমাকে সহায়তা করবে ... ...

যদি আমার পরিবার আমাকে বুঝত ... ...

যদি আমি একটি বড় শহরে বসবাস করতাম ... ...

যদি আমি এখনই আরম্ভ করতে পারতাম ... ...

যদি আমি মুক্ত হতাম ... ...

যদি আমার অন্যদের মতো ব্যক্তিত্ব থাকত ... ...

যদি আমি এত মোটা না হতাম ... ...

যদি আমার মেধার কথা সবাই জানত ... ...

যদি আমি এখন ‘আরম্ভ করার সুযোগ’ পেতাম ... ...

যদি আমি ঋণ থেকে বের হতে পারতাম ... ...

যদি আমি ব্যর্থ না হতাম ... ...

যদি আমি শুধু জানতাম কীভাবে ... ...

যদি সবাই আমার বিরুদ্ধে না থাকত ... ...

যদি আমি এত পরিমাণ উদ্বিগ্ন না হতাম ... ...

যদি আমি সঠিক পুরুষকে বিয়ে করতাম ... ...

অথবা যদি আমি সঠিক নারীকে বিয়ে করতাম ... ...

যদি লোকজন এত বেক্কেল না হত ... ...

যদি আমার পরিবার এত অপচয়ী না হত ... ...

যদি আমি নিজের ওপর বিশ্বাস রাখতাম ... ...

যদি ভাগ্য আমার বিরুদ্ধে না থাকত ... ...

যদি আমার রাশি ভালো হত ... ...

যদি এটা সত্য না হত যে ‘সবকিছু আগে থেকেই ঠিক করা’ ... ...

যদি আমাকে এত কঠিন কাজ করতে না হত ... ...

যদি আমি আমার অর্থকড়ি না হারাতাম ... ...

যদি আমি একটি ভিন্ন পরিবেশে থাকতাম ... ...

যদি আমার একটি ‘অতীত’ না থাকত ... ...

যদি আমার একটি নিজস্ব ব্যবসা থাকত ... ...

যদি লোকজন আমার কথা শুনত ... ...

যদি Ñ Ñ Ñ এবং এসবের মধ্যে এই শূন্যস্থানই (Ñ Ñ Ñ) হচ্ছে সবচেয়ে মারাত্মক। এখানে আপনার পছন্দমতো অন্য যেকোন অজুহাত বসাতে পারেন।

নিজেকে বলুন, ‘আমি নিজের সম্পর্কে জানার এবং নিজেকে খুঁজে দেখার সাহস দেখিয়েছি। আমি যেমন আমি তেমনি নিজেকে খুঁজে বের করব। আমার ভুল কোথায় আমি জানব। তারপর তা সংশোধন করব। এরপর আমি হয়তো আমার ভুল এবং ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিয়ে একটি নতুন সুযোগ পাব যা কাজে লাগিয়ে আমি সফল হবো। আমি জানি আমার কিছু ভুল আছে; নাহলে আমি আজকে সেই জায়গায় থাকতাম যেখানে আমার থাকার কথা। যদি আমি আমার দুর্বলতাগুলো আগেই নিরীক্ষা করতাম এবং সেগুলোকে ঢাকার জন্য অজুহাত না দিতাম, তবে আমিও আজ সাফল্যের শিখরে থাকতাম। তাই আমি পূর্বে যে ভুল করেছি, তা আজকে করব না। আমি নিজের আত্মবিশ্লেষণ করে নিজেকে সাফল্যের পথে ধাবিত করব।’

[বাংলাদেশের মানুষও এমন কিছু অজুহাত ব্যবহার করে। কিছু অজুহাত নিচে উল্লেখ করলাম:

মানুষ বেশি তো, তাই ... ...

প্রতিযোগিতা বেশি তো, তাই ... ...

ঘুষ দিতে পারি নাই, তাই ... ...

বয়স হয়ে গেছে, তাই ... ...

এখনো সময় হয়নি, তাই ... ...

আর এক বছর যেতে দাও, ... ...

আমার পরিবার আমাকে বোঝে না, তাই ... ...

আমার পরিবার আমাকে বেশি বেশি টাকা দেয় না, তাই ... ...

থাকা খাওয়ার সমস্যা, তাই ... ...

যদি আগে বুঝতে পারতাম, তাহলে ... ...]

আবার অনুবাদে ফিরে আসি। আসলে অজুহাত তৈরি করা হয় ব্যর্থতার ব্যাখ্যা দেওয়ার জন্য। কিন্তু অজুহাত দেওয়া মূলত একটি সময় কাটানো ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। এই অভ্যাস মানব জাতির একদম সৃষ্টিকালের আরম্ভের মতো পুরাতন। এটা সাফল্যের প্রতি মারাত্মক! এটা সম্পর্কে সাবধান থাকবেন। অজুহাত আপনাকে কখনো সাফল্য এনে দিবে না। তাহলে কেন লোকজন অজুহাতকে এত দৃঢ়ভাবে জড়িয়ে ধরে রাখে? উত্তর স্পষ্ট। তারা অজুহাতকে রক্ষা করে, কারণ তারাই অজুহাতের সৃষ্টিকারী! একটি অজুহাত হচ্ছে একজন ব্যক্তির কল্পনা থেকে সৃষ্ট। একে মানুষের শিশুসন্তানের সাথে তুলনা করা যায়। অজুহাত হচ্ছে তার মস্তিষ্কজাত শিশু। তাই সে তার আপন মস্তিষ্কজাত শিশুকে রক্ষা করে। রক্ষা বলতে শুধু রক্ষাই নয় আক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য প্রতিরোধের দেয়ালও তৈরি করে, মানে প্রতিরোধ এবং রক্ষা দুটোই করে।

যারা অজুহাত তৈরি করে তাদের মনের গভীরে এর শিকড় ছড়ানো থাকে। এজন্য এই অভ্যাস ভাঙা কঠিন। বিশেষ করে আপনি নিজেই যখন এর সৃষ্টিকারী এবং লালনপালনকারী। বিখ্যাত গ্রিক দার্শনিক প্লেটো এটা জানতেন। তাই তো তিনি বলেন, ‘নিজেকে অধ্যবসায় দ্বারা জয় করা হচ্ছে প্রথম এবং সর্বোচ্চ বিজয়। অন্য যেকোন কিছুর চেয়ে সবচেয়ে লজ্জাজনক এবং সবচেয়ে অস্বস্তিদায়ক ব্যাপার হচ্ছে নিজের দ্বারা নিজেকে জয় করা।’

অপর একজন দার্শনিকের মনে ঠিক একই চিন্তা ছিল যখন তিনি বলেন, ‘আমি একটি বিস্ময়কর আবিষ্কার করলাম যে আমি অন্যদের মধ্যে সবচেয়ে কুৎসিত এবং খারাপ যা দেখি তা কিন্তু আমার নিজেরই একটি প্রতিচ্ছবি।’

এলবার্ট হাববার্ড বলেন, ‘আমার কাছে এটা সবসময়ই একটি রহস্য হয়ে থাকবে যে কেন লোকজন এত গভীরভাবে চিন্তা করে অজুহাত তৈরি করে এবং নিজেদের বোকা বানায়। নিজের দুর্বলতাকে ঢাকার জন্য এত কষ্ট করে অজুহাত তৈরি করার দরকারই বা কী! যদি এই চিন্তা একটু ভিন্নভাবে প্রয়োগ করা হত, দুর্বলতাকে মুক্ত করতে প্রয়োগ করা হত, তবে আর অজুহাতের দরকার হত না।’

বিদায়কালে, আমি আপানকে মনে করিয়ে দিতে চাই যে, ‘জীবন হচ্ছে একটি দাবা খেলা এবং আপনার বিপক্ষ খেলোয়াড় হচ্ছে সময়। যদি আপনি চাল দেওয়ার আগে ইতস্তত করেন অথবা তৎপরভাবে চাল দিতে অবহেলা করেন, তবে আপনার সৈন্যরা সময় কর্তৃক নিহত হবে এবং দাবা ঘর থেকে বের হয়ে যাবে। আপনি এমন একজন বিপক্ষের বিরুদ্ধে খেলছেন যে সিদ্ধান্তহীনতা সহ্য করে না!

আগে হয়তো আপনার একটি যৌক্তিক অজুহাত ছিল, যেজন্য আপনি জীবনে যা চান তার দ্বারা নিজের জীবনকে বল প্রয়োগ করেননি। কিন্তু এখন সেই অজুহাত বাতিল হয়ে গেছে। কারণ, আপনি এখন এমন এক চাবিকাঠির অধিকারী হয়েছেন যার বদৌলতে জীবনের সব ধনসম্পদের দরজা খুলে যাবে।

এই চাবিকাঠিকে আপনি হাতে ছুঁয়ে দেখতে পারবেন না। কিন্তু এটা প্রচ- ক্ষমতাশালী! এটি হচ্ছে একটি নির্দিষ্ট আকাক্সক্ষা সৃষ্টি করার সুবিধা, আপনার মনের মধ্যে, যা দিয়ে আপনি বিশালাকারের ধনসম্পদ গড়ে তুলবেন। এই চাবিকাঠি প্রয়োগের পরিবর্তে আপনাকে অবশ্যই একটি দাম দিতে হবে। আপনি তো জানেন দাম ছাড়া কোনকিছু পাওয়া যায় না। সেই দাম হচ্ছে ব্যর্থতা। আপনাকে ব্যর্থতার মধ্য দিয়ে যেতে হবে। আর আপনি যখন এই চাবিকাঠি প্রয়োগ করে ব্যর্থতা পার হয়ে যাবেন, তারপরেই পাবেন আপনার আকাক্সিক্ষত সাফল্য। যারা এটা করতে পারে তাদের জন্য রয়েছে আরও এক পুরস্কার। এটা হচ্ছে সন্তুষ্টতা, যা আসে অধ্যবসায় দ্বারা নিজেকে জয় করার ফলে। আপনি জীবনকে নিজের আকাক্সক্ষা পূরণের জন্য বল প্রয়োগ করতে পারেন। যা চান তাই পেতে পারেন। এভাবেই প্রয়োগ হবে সাফল্যের চাবিকাঠি।

আরও এক পুরস্কার হচ্ছে আপনার সময় এবং শ্রমের যোগ্য মূল্য। আপনি আপনার সময় এবং শ্রমের যোগ্য মূল্য পাবেন। আপনি কি আরম্ভটি করবেন এবং নিজেকে প্রমাণ প্রয়োগে সাফল্য দর্শনে বিশ্বাস করাবেন?

অমর এমারসন বলেন, ‘যদি আমরা একই রকম হই, তবে আমাদের সাক্ষাৎ হবে।’ পরিসমাপ্তিতে, আমি কি তার চিন্তা ধার করতে পারি এবং বলতে পারি, ‘যদি আমরা একই রকম হই, যা আমরা এই বইয়ের পৃষ্ঠার মাধ্যমে হয়েছি, তাহলে আমাদের সাক্ষাৎ হয়েছে।’



- সমাপ্ত -

 

ব্যক্তিগত উন্নয়নে

অন্যান্য বইয়ের তালিকা

০১. থিংক অ্যান্ড গ্রো রিচ। মূল: নেপোলিয়ন হিল। অনুবাদ: ফজলে রাব্বি। ঢাকা, সাফল্য প্রকাশনী, ২০১৫।

০২. ডিভেলপিং দ্য লিডার উইদিন ইউ। মূল: জন সি. ম্যাক্সওয়েল। অনুবাদ: ফজলে রাব্বি। ঢাকা, সাফল্য প্রকাশনী, ২০১৭।

০৩. সাকসেস থ্রো এ পজিটিভ মেন্টাল এটিটিউড। মূল: নেপোলিয়ন হিল ও ডব্লিউ. ক্লেমেন্ট স্টোন। অনুবাদ: ফজলে রাব্বি। ঢাকা, সাফল্য প্রকাশনী, ২০১৭।

০৪. টাইম ম্যানেজমেন্ট। মূল: ব্রায়ান ট্রেসি। অনুবাদ: মোহাম্মদ রাশেদুল হক ও ফজলে রাব্বি। ঢাকা, সাফল্য প্রকাশনী, ২০২০।

০৫. অবজারভেশন। মূল: রাসেল এইচ. কনওয়েল। অনুবাদ: ফজলে রাব্বি। ঢাকা, সাফল্য প্রকাশনী, ২০১৭।

০৬. জিরো টু ওয়ান। মূল: পিটার থিয়েল ও ব্লেইক মাস্টার। অনুবাদ: ফজলে রাব্বি। ঢাকা, সাফল্য প্রকাশনী, ২০১৮।

০৭. আউটলায়ার্স। মূল: ম্যালকম গ্ল্যাডওয়েল। অনুবাদ: এ.এম. নাইম হোসেন ও ফজলে রাব্বি। ঢাকা, সাফল্য প্রকাশনী, ২০১৮।

০৮. ৭ স্ট্র্যাটেজিস ফর ওয়েলথ এন্ড হ্যাপিনেস। মূল: জিম রন। অনুবাদ: ফজলে রাব্বি। ঢাকা, সাফল্য প্রকাশনী, ২০১৯।

০৯. ওয়ান স্মল স্টেপ ক্যান চেঞ্জ ইউর লাইফ। মূল: ড. রবার্ট মৌরার (পিএইচডি)। অনুবাদ: ফজলে রাব্বি। ঢাকা, সাফল্য প্রকাশনী, ২০১৯।

১০. অ্যাজ আ ম্যান থিংকথ। মূল: জেমস অ্যালেন। অনুবাদ: ফজলে রাব্বি। ঢাকা, সাফল্য প্রকাশনী, ২০১৯।

১১. স্টার্ট উইথ হোয়াই। মূল: সাইমন সিনেক। অনুবাদ: ফজলে রাব্বি। ঢাকা, সাফল্য প্রকাশনী, ২০২০।

১২. এটিটিউড ইজ এভরিথিং। মূল: জেফ কেলার। অনুবাদ: ফারহা আহমেদ, শাহরিয়ার মাহমুদ ও ফজলে রাব্বি। ঢাকা, সাফল্য প্রকাশনী, ২০২০।

১৩. মেনটরিং ১০১। মূল: জন সি. ম্যাক্সওয়েল। অনুবাদ: ফজলে রাব্বি। ঢাকা, সাফল্য প্রকাশনী, ২০২০।

১৪. গেট স্মার্ট। মূল: ব্রায়ান ট্রেসি। অনুবাদ: ফারহা আহমেদ। সম্পাদনা: ফজলে রাব্বি। ঢাকা, সাফল্য প্রকাশনী, ২০২১।

১৫. টিমওয়ার্ক ১০১। মূল: জন সি. ম্যাক্সওয়েল। অনুবাদ: ফজলে রাব্বি। ঢাকা, সাফল্য প্রকাশনী, ২০২১।

১৬. ইট দ্যাট ফ্রগ! মূল: ব্রায়ান ট্রেসি। অনুবাদ: ফজলে রাব্বি ও ফারহা আহমেদ। ঢাকা, সাফল্য প্রকাশনী, ২০২১।

১৭. ক্রিয়েটিভিটি অ্যান্ড প্রবলেম সলভিং। মূল: ব্রায়ান ট্রেসি। অনুবাদ: ফজলে রাব্বি, শাহরিয়ার মাহমুদ। ঢাকা, সাফল্য প্রকাশনী, ২০২১।

১৮. লিডারশিপ। মূল: ব্রায়ান ট্রেসি। রূপান্তর: ফজলে রাব্বি। ঢাকা, সাফল্য প্রকাশনী, ২০২১।

১৯. এমনভাবে মিটিং করুন যেন সুফল বয়ে আনে। মূল: ব্রায়ান ট্রেসি। রূপান্তর: ফজলে রাব্বি। ঢাকা, সাফল্য প্রকাশনী, ২০২২।

২০. আত্ম-উন্নয়ন ১০১। মূল: জন সি. ম্যাক্সওয়েল। অনুবাদ: ফজলে রাব্বি। ঢাকা, সাফল্য প্রকাশনী, ২০২২।

২১. ইফেক্টিভ প্ল্যানিং অ্যান্ড টাইম ম্যানেজমেন্ট। মূল: ভিভেক বিন্দ্রা। অনুবাদ: ফজলে রাব্বি। ঢাকা, সাফল্য প্রকাশনী, ২০২২।

২২. স্টপ ওভারথিংকিং। মূল: নিক ট্রিনটন। অনুবাদ: ফজলে রাব্বি। ঢাকা, সাফল্য প্রকাশনী, ২০২৩।

 



























‘হতাশা’ হচ্ছে ছদ্মবেশে একটি আর্শীবাদ। এটা প্রায়ই বিশ্বকে সংকটে ফেলে। মানুষকে নতুন কিছু খুঁজে দেখতে বাধ্য করে। এখানেই একজন ব্যক্তির নতুন ও অভিনব কিছু করার সুযোগ তৈরি হয়।



পাঠকের জন্য: