জ্ঞানদীপ্ত বই ‘Why Nations fail’ এবং এর পাঠ প্রতিক্রিয়া....
যদি বইটির টাইটেল হতো- 'Why Students fail' বা ছাত্ররা কেন ফেল করে, তাহলে সহজ, অনুমিত উত্তরটি হবে, পরীক্ষার জন্য ছাত্ররা ঠিকমতো প্রস্তুতি নেয় না, তাই তারা ফেল করে। ছাত্রের জায়গায় যদি আমরা পড়ি দেশ কিংবা রাষ্ট্র, ফেল এর জায়গায় ব্যর্থ, অর্থাৎ বইটির আক্ষরিক অর্থ হয় দেশ/ রাষ্ট্র কেন ব্যর্থ হয়!
২০১২ সালে এমআইটির দুই অর্থনীতিবিদ ডেরেন একমাগলু ও জেমস রবিনসন নিজেদের ১৫ বছরের গবেষণার ফসল "Why Nations fail" নামক ৫৪৬ পৃষ্ঠার বইটি বাংলাদেশের সিভিল সার্ভেন্ট, বিভিন্ন পেশাজীবী, উন্নয়নকর্মী, রাজনীতিবিদ, ছাত্রসহ সকলের জন্য আবশ্যিকপাঠ্য হিসেবে পরিগনিত হতে পারে।
বইটি শুরু এবং পর্যায়ক্রমে তা আবর্তিত হয়েছে কিছু গল্প, কিছু প্রশ্ন এবং গল্প ও প্রশ্নের বাঁকে বাঁকে লেখকেরা ব্যাখ্যা দিয়েছেন তাদের নিজস্ব নতুন থিওরির সাহায্যে।
শুরুটি সেই পুরনো প্রশ্ন দিয়ে, মানুষ গরিব কেন? আমরা গরীব কেন? সবচেয়ে সহজ অনুমিত উত্তর আমার বাবা গরীব ছিলেন তাই। তখন প্রশ্ন আসে বাবাই বা গরীব কেন ছিলেন। কিংবা দাদা, অথবা দাদার বাবা। এই জটিল প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্য বেশ অনেক বছর ধরে লেখকদ্বয় গবেষণা করছেন আর তাদের গবেষণার ফলাফল বেশ মজার, কৌতূহলোদ্দীপক।
কোনো একটি দেশ দরিদ্র কি ধনী, তা শুধুমাত্র তাদের ভূন্ডখগত অবস্থান কিংবা আমাদের পূর্ব-পুরুষদের ধর্ম বিশ্বাসের উপর নির্ভর করে না, তা কেবলমাত্র ভূগোল, রোগ-বালাই বা সংস্কৃতির উপর নির্ধারণ করে না। তা অনেক কিছুর উপর নির্ভর করতে পারে, যেমন: ভৌগোলিক অবস্থান, জলবায়ু, সংস্কৃতি, ধর্ম, রাজনীতি কিংবা সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর প্রতিষ্ঠানগুলোর চরিত্র ও তার রাজনীতির উপর নির্ভর করে । একটি সমাজকে কে পরিচালনা করবে, কিভাবে করবে, কার দ্বারা করবে তা নির্ধারণ করে প্রতিষ্ঠান, একটা সমাজের বিভিন্ন অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানসমূহ।
লেখকদ্বয় এ সমস্ত প্রতিষ্ঠানকে দুই ভাগে ভাগ করেছেন যার একটা হল “Inclusive Institutions”, যখন সেগুলোর ক্ষমতা কেবল অল্প কয়েকজনের হাতে না থেকে সমাজের প্রতিটি শ্রেণীর মানুষের হাতে থাকে। অন্য এক ধরনের প্রতিষ্ঠান হল “Extractive Institutions”, এ ধরনের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের ক্ষমতা গুটিকয়েক ব্যক্তি বা কোন গোষ্ঠীর হাতে থাকে যারা নিজেদের স্বার্থে তৈরি করে বিভিন্ন extractive অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান। Extractive সমাজব্যবস্থা মূলত চালিত হয় সমাজের এই নির্দিষ্ট শক্তিশালী মানুষদের ইচ্ছানুযায়ী।
কোন দেশের কিংবা রাষ্ট্রের সাফল্য অথবা ব্যর্থতা দেশটির অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সমন্বয় কিংবা সমন্বয়হীনতার ফলের উপর নির্ভর করে। এই বইয়ে দাবি করা হয়েছে যে, দুইটি দেশের মধ্যকার পার্থক্য, (দেশ ২টি প্রতিবেশিও হতে পারে) প্রধানত তৈরি হয় তাদের প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে। একটি দেশ এগিয়ে যায় যখন তা Inclusive বা অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান তৈরি করতে পারে, আর এই প্রতিষ্ঠানগুলো যাদের ক্ষেত্রে অল্প কিছু লোকের সুবিধা আদায়ের হাতিয়ার হয় তখনই রাষ্ট্র ব্যর্থ হয়, (Extractive সমাজব্যবস্থা)। কখন একটা সমাজব্যবস্থা ভেঙে পড়ে অথবা কখন তা চরম উন্নতির দিকে এগিয়ে যায়, এনিয়েই কাজ করেছেন লেখকদ্বয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, গ্রেট বৃটেন ও জার্মানির মতো দেশগুলো কেন ধনীই থাকছে, আর কেন সাব সাহারান আফ্রিকা, মধ্য আমেরিকা এবং দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে তাদের অবস্থার মধ্যে কেন এত তফাৎ? কেন একদিকের জনগণের বিপুল আয়। আর অন্যদিকের জনগণের নিম্ন আয়? জীবন মান এতটাই নিচু? এ বইটি তার উত্তর খুঁজেছে।
উত্তর আর দক্ষিণ কোরিয়া। একই ভৌগোলিক অবস্থান, জলবায়ু, সংস্কৃতি, এবং ধর্ম.. এমনকি আলাদা হয়ে যাওয়ার পরের বেশ অনেকটা সময় দুইটা দেশই স্বৈরাচার শাসকের অধীনে ছিলো। তাহলে ২০২০ সালে এসে উত্তর কোরিয়া এতো গরীব আর দক্ষিণ কোরিয়া ধনী হয় কিভাবে??
ব্রিটেন ও উত্তর আমেরিকার মতই জাপান, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া প্রভৃতি দেশের ইতিহাস পর্যালোচনা করে লেখকদ্বয় দেখিয়েছেন উন্নতির পথে এই প্রতিটি দেশের গল্পই একই। হয়ত গল্পের নায়ক ভিন্ন, প্রেক্ষাপট ভিন্ন, কিন্তু গল্পের মূল সুর একই। প্রতিটি ক্ষেত্রেই যথেষ্ট পরিমাণ inclusive প্রতিষ্ঠানের উপস্থিতি।
বইটিতে এই বিষয়ে চমৎকার, নজরকারা একটি উদাহরণ আছে।
যুক্তরাষ্ট্র ও মেক্সিকো, ২টি দেশের সীমান্তে অবস্থিত নোগালেস শহরটি কাঁটাতার দিয়ে বিভক্ত করা হয়েছে। ২টি অংশের এক প্রান্তে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের Arizona রাজ্যের অংশে অবস্থিত Nogales শহর এবং মেক্সিকোর Sonora রাজ্যের Nogales শহর। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের Arizona রাজ্যের অংশের শহরের বাসিন্দাদের গড় বার্ষিক আয় প্রায় ৩০ হাজার ডলার। বেশির ভাগ টিনএজাররা স্কুলগামী এবং প্রাপ্ত বয়স্কদের অধিকাংশ হাইস্কুল পেরোনো গ্র্যাজুয়েট। শহরের মানুষেরা অপেক্ষাকৃত স্বাস্থ্যবান। বিশ্বমানের তুলনায় তাদের গড় আয়ুষ্কাল বেশি। বাসিন্দাদের অনেকেরই বয়স ৬৫ বছরের বেশি এবং তাদের রয়েছে, স্বাস্থ্যসেবায় প্রবেশাধিকার। সরকারের দেয়া সুযোগ-সুবিধার মধ্যে স্বাস্থ্যসেবা অন্যতম। বিদ্যুৎ,টেলিফোন, পয়নিস্কাশন ব্যবস্থা, জনস্বাস্থ্য এবং তার সঙ্গে এমন একটি সড়ক ব্যবস্থা; যা তাদের আঞ্চলিক শহরগুলোকে তো বটেই বাদবাকি আমেরিকার সঙ্গেও যুক্ত করেছে। কোনো প্রকারের ভয়-ভীতি ছাড়াই অত্যন্ত নিরাপদে নোগালেসের জনগণ যেখানে খুশি সেখানে ভ্রমণ করতে পারেন। তারা সর্বদা চুরি-রাহাজানি বা ছিনতাইয়ের ভয়ে সন্ত্রস্ত থাকেন না। তারা একটুও উদ্বিগ্ন হন না এটা ভেবে যে,বাড়ি বা ব্যবসায়ে তাদের করা বিনিয়োগ ক্ষতিগ্রস্ত হয় কি না। আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, মাঝে মধ্যে কিছু দুর্নীতি এবং অদক্ষতা সত্ত্বেও সরকারই তাদের জীবনে বড় ভরসা। সরকারই তাদের কাছে নির্ভরশীল এজেন্ট। নির্বাচনে তারা ভোট দিয়ে এটা নিশ্চিত করতে পারেন যে, তাদের দেশকে কে নেতৃত্ব দেবে। গণতন্ত্র তাদের কাছে একটা সেকেন্ড ন্যাচার বা দ্বিতীয় প্রকৃতগত বিষয়।
ওপরে যে কাঁটাতারের কথা উল্লেখ করেছিলাম, তার পাশে দাঁড়িয়ে এবার নজর দিন দক্ষিণে। এবারে কিন্তু একটা ভিন্নতা চোখে পড়বে। নোগালেস শহরটির দক্ষিণ প্রান্ত মেক্সিকোর মধ্যে পড়েছে। সুতরাং নোগালেস যুক্তরাষ্ট্রের এরিজনার অঙ্গরাজ্যের শহর, আবার নোগালেস মেক্সিকোর সনোরা প্রদেশের শহর। এখন দুটি দেশ হওয়ার কারণে দুই শহরের মানুষেরা এত কাছাকাছি হওয়া সত্ত্বেও তাদের আয়ে কিন্তু বৈষম্য ঘটেছে এবং সেটা ব্যাপক। মেক্সিকোর অংশের শহরের মানুষের আয় যুক্তরাষ্ট্রের অংশের শহরের মানুষের আয়ের থেকে মাত্র এক-তৃতীয়াংশ। তাদের বেশির ভাগ বয়স্ক মানুষের হাইস্কুল ডিগ্রি নেই এবং বহু শিশু-কিশোর স্কুলে যায় না। মায়েরা শিশুর মৃত্যুর উচ্চহারের বিষয়ে উদ্বিগ্ন থাকেন। আর তাদের দুর্দশাগ্রস্ত জনস্বাস্থ্যর ব্যবস্থার অর্থই হলো, এটা জেনে কারও বিস্মিত না হওয়া যে, নোগালেসের বাসিন্দাদের আয়ুষ্কাল তাদের উত্তরের প্রতিবেশীদের চেয়ে অনেক কম। বহু ধরনের সরকারি সুযোগ-সুবিধা থেকেও তারা বঞ্চিত। কাঁটাতারের দক্ষিণের রাস্তার পরিস্থিতি করুণ,আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি খুবই বাজে, অপরাধের হার বেশি এবং দোকানপাট খোলা একটি ঝুঁকিপূর্ণ তৎপরতা এবং সেটা আপনার দোকানে কোনো ডাকাতি হবে শুধু এ ভেবে নয়, একটি দোকান খোলার জন্য আপনাকে অনুমতি জোগাড় করতে হলে ঘাটে ঘাটে ‘তেল’ দিতে হবে। সনোরার নোগালেস শহরের বাসিন্দারা তাই রাজনীতিবিদদের দুর্নীতি এবং অপুটতা নিয়েই কায়ক্লেশে জীবন-যাপন করতে বাধ্য হচ্ছেন।
দুই শহরের মানুষের পূর্বপুরুষরা একই রক্তের উত্তরাধিকার বহন করেছে। তাদের খাবার অভিন্ন এবং এটা বলা আমাদের জন্য ঝামেলাপূর্ণ, কিন্তু তবুও বলব, উভয় শহরের ‘সংস্কৃতি’ অভিন্ন।
কিন্তু দুই শহরের মধ্যে আসল পার্থক্যটা কোথায়, তার একটি সহজ ব্যাখ্যা নিশ্চয় আছে। আর সেটি হলো সীমান্ত। একটি সীমান্তরেখাই দুই শহরকে আলাদা করেছে সব দিক থেকে। অ্যারিজোনা অংশের মানুষের অবাধ প্রবেশাধিকার রয়েছে মার্কিন প্রতিষ্ঠানগুলোয়। আমেরিকার মাটিতে থেকে তাদের প্রত্যেকে তাদের পছন্দ অনুযায়ী পেশা বেছে নিতে পারেন। তারা স্কুলে যেতে পারেন। বাড়াতে পারেন কর্মদক্ষতা । একইসঙ্গে তারা রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানে অংশ নিতে পারেন। এর ফলে তারা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত হতে পারেন। তারা তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধি বসাতে পারেন। আবার অসদাচারণ করলে তারা ভোট দিয়ে তাদের সরাতেও পারেন। এর ফলে রাজনীতিকরা নাগরিকদের মৌলিক সেবা নিশ্চিত করতে সদা জাগ্রত থাকেন। ভোটাররা যাতে বেজার না হন, সেজন্য তারা সতর্কতার সঙ্গে পা ফেলেন। জনস্বাস্থ্য থেকে সড়ক এবং সড়ক থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা পর্যন্ত সবটাই তাদের খেয়ালে রাখতে হয়।
কিন্তু মেক্সিকোর Nogales শহরবাসীরা ততটা ভাগ্যবান নন। তারা একটি ভিন্ন জগতে বাস করেন। তাদের সেই জগত গড়েছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। সেকারণে দুই শহরের মানুষেরা ভিন্ন ভিন্ন প্রণোদনা লাভ করেন তাদের চারপাশের চেনা জগত থেকে। উত্তরের ব্যবসায়ীরা যতটাই উদ্যমী, দক্ষিণের ব্যবসায়ীরা ততটাই হতোদ্যম। সুতরাং তারা মানুষ হিসেবে একই রক্ত-মাংসের হলেও তাদের চেনাজগত তাদের সঙ্গে ভিন্ন ভিন্ন আচরণ করে, তারাও সেভাবে নিজেদের পরিচালিত করেন। আর সেকারণেই উত্তরের অর্থনীতি একরকম, দক্ষিণের অর্থনীতি আরেকভাবে গড়ে উঠেছে।
প্রশ্ন হল কী কারণে আমেরিকার প্রতিষ্ঠানগুলো এভাবে ব্যবসাবান্ধব হতে পারল, আর মেক্সিকো তথা গোটা দক্ষিণ আমেরিকায় সেটা হতে পারল না।
এই প্রশ্নের উত্তরটিও বইটির মধ্যে বিচরণ করছে। উত্তরটি পেতে আপনাকে বইটির আপন ভূবনে প্রবেশ করার আমন্ত্রন রইলো।