শনিবার, ৭ আগস্ট, ২০২১

হোয়াই নেশনস ফেইল তথা কোনো জাতি কেন উন্নতি করে আর কেউ কেন তা করে না?

কোনো জাতি কেন উন্নতি করে আর কেউ কেন তা করে না?

লিখেছেন: জিয়া হাসান,

জিডিপির প্রবৃদ্ধি হলেই দেশ এগিয়ে যাচ্ছে এই তত্ত্বে যাঁরা আস্থা রাখেন না তাঁদের জন্যে দুটি মৌলিক বই হচ্ছে এমআইটির অধ্যাপক ড্যারন আসেমেগলু আর জেমস রবিন্সনের ‘হোয়াই নেশনস ফেইল’ এবং রুচির শর্মার ‘রাইজ অ্যান্ড ফল অফ নেশনস’।

বই দুইটির মধ্যে রাইজ অ্যান্ড ফল অফ নেশনস-এ রুচির শর্মা দেখিয়েছেন অর্থনীতির অন্য সূচকগুলোকে আমলে না নিয়ে শুধু জিডিপির প্রবৃদ্ধি নিয়ে অতিরিক্ত উচ্ছ্বাস বিপজ্জনক।

তাঁর চমৎকার একটা তত্ত্ব হলো, যে রাষ্ট্রগুলো উন্নয়নের জন্যে প্রশংসিত হয়ে আন্তর্জাতিক শিরোনাম হয়, সেই রাষ্ট্রগুলো পরবর্তী বছরগুলোতে অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যে পড়ার সম্ভাবনা প্রবল।

অন্যদিকে হোয়াই নেশনস ফেইলে ডারেন আসেমেগলু বলেছেনে, রাষ্ট্রের দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নের অনেকগুলো তত্ত্ব আছে। যেমন ভৌগোলিক তত্ত্ব, ধর্ম-বিষয়ক তত্ত্ব, সাংস্কৃতিক তত্ত্ব, অজ্ঞতা তত্ত্ব, পুঁজিবাদ বনাম সাম্যবাদ তত্ত্ব।

তুর্কি অধ্যাপক আসেমেগলু বিশ্বের বিভিন্ন দেশের উদাহরণ দিয়ে দেখান, ওপরের কোনো তত্ত্বই এককভাবে উন্নয়নের কারণ হতে পারে না। আসেমেগলুর মতে, প্রধান যে কারণকে প্রতিটা ক্ষেত্রে বিশ্বের প্রতিটা রাষ্ট্রের উন্নয়ন বা অবনমনের কারণ হিসেবে দেখানো যেতে পারে, তা হচ্ছে ইন্টেগ্রেটেড ইনস্টিটিউশন বা সমন্বিত প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর সক্ষমতা বা অভাব।

তাঁর মতে, যখন রাষ্ট্রের প্রশাসনিক এবং অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো সক্ষম হয় এবং তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় নাগরিকসংশ্লিষ্টতা থাকে ঠিক তখনই কোনো সমাজ বা রাষ্ট্র দীর্ঘস্থায়ী উন্নয়নের ধারায় পা দিতে পারে। কারণ, একমাত্র সমন্বিত প্রতিষ্ঠানগুলোই রাজনীতিবিদ বা আমলাদের হাতে রাষ্ট্রীয় সম্পদের লুণ্ঠন ঠেকাতে পারে।

তাঁর মতে, একমাত্র স্বনির্ভর সমন্বিত প্রতিষ্ঠানই নাগরিকের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ব্যবসা, বিচারব্যবস্থাসহ সবকিছুতেই অধিকার এবং সুসম সুযোগ নিশ্চিত করতে পারে। যার ফলে অসম প্রতিযোগিতার মাধ্যমে শুধু কিছু এলিটের হাতে সম্পদ পুঞ্জিভূত হতে পারে না বা নাগরিক অধিকার নির্দিষ্ট কিছু এলিটের ইচ্ছায় কুক্ষিগত হয় না। এতে দীর্ঘ মেয়াদে হলেও অর্থনীতিতে একটা সমতা তৈরি হয় কিংবা মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন ঘটে।
আসেমেগলুর মতে, সমন্বিত প্রতিষ্ঠানের অপর প্রান্তে রয়েছে কর্তৃত্ববাদী এবং শোষণমুখী প্রতিষ্ঠান, যেখানে অল্প কিছু ক্ষমতাশীলের জন্যে প্রতিষ্ঠানগুলো মানুষের অধিকার ও সম্পদ কেড়ে নিতে থাকে এবং এই প্রতিষ্ঠানগুলোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়াতে নাগরিকের কোনো অংশগ্রহণের সুযোগ থাকে না।

তিনি দেখিয়েছেন, আফ্রিকার অনেক দেশে এখন আর সাদাদের রাজত্ব না থাকলেও অল্প কিছু ক্ষমতাশীল ব্যক্তি রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহার করে সম্পদ লুটে নিচ্ছে—যাদের কারও গায়ের রংই সাদা নয়।
তিনি দেখিয়েছেন, এই ধরনের লুটেরা প্রতিষ্ঠানময় দেশগুলো দুষ্টচক্রে আবর্তিত হয়। কিছু এলিট তাদের রাজনৈতিক, সামাজিক এবং প্রশাসনিক ক্ষমতা ব্যবহার করে রাষ্ট্রকে লুট করে সম্পদশালী হয়ে ওঠে। পরবর্তী সময়ে এই লুণ্ঠিত সম্পদ ব্যবহার করে কিছু সুনির্দিষ্ট গ্রুপকে প্রমোশন, কন্ট্রাক্ট, ক্ষমতা, দুর্নীতি ইত্যাদি সুযোগ-সুবিধা দিতে থাকে অথবা অস্ত্রের জোরে যেকোনো মূল্যে তাদের রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক ক্ষমতাকে টিকিয়ে রাখে।

ফলে মুক্ত সমাজ, সমতাভিত্তিক রাষ্ট্র এবং উদ্যোক্তা অর্থনীতি তৈরির সব সক্ষমতা এরা বিনষ্ট করে।

ইতিহাস থেকে দেখা যায়, যেসব দেশে এই ধরনের এক্সপ্লয়েটিভ বা লুটেরা প্রতিষ্ঠান প্রাধান্য বিস্তার করে সেখানে কোনো সাময়িক বিপ্লব বা পরিবর্তন এলেও, এই লুটেরা প্রতিষ্ঠানগুলো জনগণের ইচ্ছাকে চাপিয়ে রেখে পুনরায় লুণ্ঠনের সংস্কৃতি চালু করে। ফলে, এই ধরনের লুটেরা প্রতিষ্ঠানের দেশে জনগণের সম্পদের লুণ্ঠন দুষ্টচক্রের মতো বারবার ফিরে আসে।
আসেমেগলুর মতে, এ ধরনের দেশ নিজস্ব সম্পদ যেমন খনিজ, অথবা শ্রমসম্পদ অথবা কৃষিকে ব্যবহার করে আপাত কিছু উন্নয়ন সম্ভব। কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী উন্নয়ন ধরে রাখতে যে সৃষ্টিশীলতা এবং প্রাযুক্তিক পরিবর্তন দরকার, তা কোনোমতেই এ ধরনের দেশে অর্জিত হয় না। ফলে আপাত উন্নয়ন এবং প্রবৃদ্ধি অল্প কিছু সময়ের মধ্যেই থমকে দাঁড়ায়।

কারণ, এলিটরা এই সৃষ্টিশীলতা এবং প্রযুক্তির পরিবর্তনকে ঠেকিয়ে রাখে। পরিবর্তনের ধাক্কায় এলিটদের পুঁজি ও ক্ষমতা বিপর্যস্ত হতে পারে যা তারা কোনোমতেই হতে দেয় না। আসেমেগলুর এই ধারণার প্রমাণ পাই আমরা মার্ক্সবাদী অর্থনীতিবিদ জোসেফ স্কাম্পিটারের ক্রিয়েটিভ ডিসট্রাকশন বা সৃষ্টিশীল ধ্বংসতত্ত্বে। তিনি বলেছেন, অর্থনীতিতে প্রযুক্তির পরিবর্তন অথবা নতুন আইডিয়ার আবির্ভাবে পুরাতন বিজনেস মডেলে আঘাত আসে, যার ফলে বিদ্যমান অর্থনৈতিক কাঠামোয় আঘাত হানলেও তা পরবর্তী সময়ে উন্নয়নে গতি আনতে পারে। আসেমেগলু বলেন, প্রথাগত এলিটরা নিজের ক্ষমতা এবং সম্পদ টিকিয়ে রাখার জন্যে এই সৃষ্টিশীল ধ্বংসের পথ বন্ধ করে রাখে।

আসেমগলুর মতে, এই ধরনের কর্তৃত্বপরায়ণ রাষ্ট্রে দীর্ঘস্থায়ী উন্নয়ন কখনোই সম্ভব হয় না। কারণ, এই রাষ্ট্র উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি এবং পরিবর্তনের জন্যে উদ্যোক্তাদের উৎসাহ দেয় না। ক্ষমতা ধরে রাখার জন্যে কেন্দ্রমুখী পরিকল্পনার মাধ্যমে কিছু উদ্ভাবনের আশ্রয় নিলেও পরিকল্পনার জটিলতা এবং প্রাতিষ্ঠানিক অক্ষমতার কারণে সেগুলো বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয় না। খুব মোটাদাগে এই কথাগুলোকে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ব্যাপকভাবে ব্যাখ্যা করার সুযোগ আছে, এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে দ্বিমতের সুযোগও আছে।

কিন্তু এটা পরিষ্কার, জনগণের ভাগ্যোন্নয়নের যে বাধাগুলোর কথা আসেমেগলু বলেছেন তার সব ক্রমাগতই বাংলাদেশে স্পষ্ট হচ্ছে। এখন ব্যাংক, প্রশাসন, পুলিশ, ব্যবসা, শ্রমিক অধিকার, ধর্ম, বিচার ব্যবস্থা, সংস্কৃতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, মিডিয়া, আন্তর্জাতিক সম্পর্কসহ সব প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতাকে ভেঙে এমনভাবে সবকিছু হস্তগত করা হচ্ছে, যেন আগামীকালই পৃথিবীর শেষ দিন।

জনগণের মধ্যে আস্থা তৈরি করতে দীর্ঘস্থায়ী উন্নয়নের নীতির বদলে কিছু গোষ্ঠীকে তুষ্ট করাই সরকারের প্রধান নীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর ফলে কী হয়েছে তা আমরা নিয়ত টের পাচ্ছি। প্রবাসী ও পোশাকশ্রমিকের ঘামে-রক্তের বিনিময়ে ফুলে ওঠা রিজার্ভ, নিত্য নতুন ট্যাক্স বসিয়ে বিদ্যুৎ-পানি-গ্যাসের দাম দফায় দফায় বাড়িয়ে রাজস্ব আয় বাড়ানো এবং সঞ্চয়পত্র থেকে অস্বাভাবিক পরিমাণ ঋণ নিয়ে সরকারের খরচ চালানো হচ্ছে। পৃথিবীর সর্বোচ্চ মূল্যে তৈরি কিছু সেতু, রাস্তা ও উড়ালসড়ককেই বলা হচ্ছে উন্নয়ন। কিন্ত জীবনযাত্রায়, নাগরিক সুবিধাতে, চিকিৎসা বা শিক্ষা ব্যবস্থায় ক্রমাগতভাবে জনগণকে নাজেহাল হতে হচ্ছে।

মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে সেই বাস্তবতাকে লুকিয়ে একটা হীরক রাজার দেশের পরাবাস্তব উন্নয়ন বুদ্‌বুদ তৈরি করা হচ্ছে। এই ছলনা থেকে মুক্তি পেতে অর্থনৈতিক সুযোগের সন্ধানে পালানো যুবকদের ঠাই হচ্ছে ভূমধ্যসাগরে আর মালয়েশিয়ার গণকবরে। আসেমেগলুর তত্ত্বকে আমলে নিলে এর পূর্ণ দায় আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা এবং কর্তৃত্বপরায়ণ রাষ্ট্রের ওপরেই পড়ে।

প্রতিষ্ঠানগুলোকে ভেঙে শাসন চালিয়ে যাওয়া বিএনপি, আওয়ামী লীগ এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারসহ সব আমলেই ছিল। অন্যদিকে প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা তৈরির জন্যে রাজনীতিবিদ এবং আমলাদের ওপরে সব সময়েই সিভিল সোসাইটি এবং বৃহত্তর সমাজের চাপ ছিল। কিন্তু কে শোনে কার কথা?

এমআইটির অর্থনীতির অধ্যাপক ডারেন আসেমেগলুর হোয়াই নেশনস ফেইল বইটা আজকে তাই আমাদের পরিষ্কার সংকেত দিচ্ছে। জিডিপির প্রবৃদ্ধি যে ধারাই থাকুক না কেন লুটেরা প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশকে অনিবার্যভাবে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করেছে বা করবে। বীজগণিতের সূত্রের মতো লিখে দেওয়া এই নিয়তি কি কেউ ঠেকাতে পারবে? সেটাই সামনের প্রশ্ন।
জিয়া হাসান: রাজনৈতিক বিশ্লেষক।

তথ্যসূত্র: https://www.prothomalo.com/opinion/%E0%A6%95%E0%A7%8B%E0%A6%A8%E0%A7%8B-%E0%A6%9C%E0%A6%BE%E0%A6%A4%E0%A6%BF-%E0%A6%95%E0%A7%87%E0%A6%A8-%E0%A6%89%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A8%E0%A6%A4%E0%A6%BF-%E0%A6%95%E0%A6%B0%E0%A7%87-%E0%A6%86%E0%A6%B0-%E0%A6%95%E0%A7%87%E0%A6%89-%E0%A6%95%E0%A7%87%E0%A6%A8-%E0%A6%A4%E0%A6%BE-%E0%A6%95%E0%A6%B0%E0%A7%87-%E0%A6%A8%E0%A6%BE

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন