বুধবার, ১ ডিসেম্বর, ২০২১

মার্কেটিং মানে কী?

মার্কেটিং এবং বিক্রয় দুইটি আলাদা জিনিস। মার্কেটিং মানে আপনার পণ্য বা সেবার ব্যাপারে মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করানো। ব্যবসায় মার্কেটিং একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুসঙ্গ। এ ব্যাপারে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কলাকৌশল নিয়ে আলোচনা করা হলো।

ব্যবসা বা উদ্যোগের অন্যতম দিক হচ্ছে আপনার পণ্য বা সেবা উল্লেখযোগ্যভাবে অসাধারণ হতে হবে। যেমন পায়ের পাঁচ আঙুলের ডিজাইন সহ জুতা দেখতে কিছুটা অদ্ভুত হলেও তা সকলের নজর কাড়ে। এ জুতা জোড়া দেখতে ব্যাঙের মতো, মোজা ও গ্লাভসের মাঝামাঝি। অনেকেই খালি পায়ে দৌড়াতে চায়, কিন্তু এই রাবারে জুতা থাকার কারণে পাথর বা গ্লাস পায়ে ঢুকতে পারবে না এবং খালি পায়ে দৌড়ানোর স্বাদ পাবেন।


একটি সফল ব্যবসা (১) কাস্টমারদের জন্য মূল্যবান কিছু তৈরি করে (২) যা তারা চায়, (৩) যা তারা কিনতে বা সেবা নিতে আগ্রহী, (৪) এভাবে কাস্টমারদের চাহিদা ও প্রত্যাশা পূরণ হয় যাতে করে (৫) ব্যবসার মালিকদের জন্য যথেষ্ট পরিমাণ মুনাফা আসে ব্যবসার কর্মকাণ্ডকে প্রতিনিয়ত চালিয়ে নেওয়ার জন্য। [দ্য পারসোনাল এমবিএ বই অনুসারে, পৃষ্ঠা ৫৭]। সফল ব্যবসার অন্যতম এক সূত্র হচ্ছে কাস্টমারের প্রত্যাশাকে অতিক্রম করে যাওয়া। উপরোক্ত পাঁচ আঙুলের ডিজাইন সহ জুতা কাস্টমারের সেই প্রত্যাশাকেই অতিক্রম করেছে।

সেথ গোডিন তার বই পার্পেল কাউ (Purple Cow by Seth Godin) তে এ ব্যাপারটি চমৎকারভাবে পাঠকের মনোযোগ আকর্ষণ করেছেন। আপনি রাস্তা দিয়ে যাচ্ছেন। এখন রাস্তার পাশের এক মাঠে দেখলেন অনেক গরু চরছে। গরু সাধারণত খয়েরি রঙের হয়। আপনি যদি মাঠে দেখেন সব গরুর রঙই খয়েরি, তবে তা আপনার মধ্যে ততটা আগ্রহের সৃষ্টি করবে না। কিন্তু হঠাৎ আপনি যদি দেখেন একটা বেগুনি রঙের গরু, তবে আপনি অবশ্যই থমকে দাঁড়াবেন। কারণ বেগুনি রঙের গরু আপনার প্রত্যাশাকে অতিক্রম করবে। এতে করে স্বাভাবিকভাবেই এটা আপনার মনোযোগ এবং আগ্রহ টানবে।

সম্ভাব্য কাস্টমার: এ পৃথিবীতে ৭০০ কোটি মানুষ আছে। আর এর মধ্যে ৯৯.৯৯৯% মানুষই হয়তো আপনার পণ্য বা সেবাটা টাকা দিয়ে কিনতে চায় না। এমন এক বক্তব্য দেন হিউজ ম্যাকলিওড। তিনি একজন কার্টুনিস্ট এবং Ignore everybody বইয়ের লেখক।

সম্ভাব্য গ্রাহক বা কাস্টমারের দিকে বেশি মনোযোগ দিন। আপনার পণ্য বা সেবা কার কাজে লাগতে পারে, কেমন ধরনের মানুষ তা ব্যবহার করতে পারে, তা বিবেচনা করে ঠিক সেই ধরনের গ্রাহকদের দিকেই মনোযোগ নিবন্ধ রাখুন। বলা হয়,

সূর্যের আলো কেবল ম্যাগনিফাইং গ্লাসে কেন্দ্রীভূত হয় বলেই তার মাধ্যমে আগুন জ্বলে ওঠে। নতুবা আগুন জ্বালানোর ক্ষেত্রে বিক্ষিপ্ত আলোর ততটা শক্তি নেই।

মানুষের মনোযোগও তেমন এক ব্যাপার। যখন আপনি আপনার মনোযোগ কেবল সম্ভাব্য গ্রাহকদের দিকেই নিবিষ্ট করবেন, তখনই তা সর্বোত্তম ফলাফল দিবে।

সর্বশেষ ফলাফল: সব শেষে কী ফলাফল আসতে পারে সেইদিকে মনোযোগ দিন। মানুষ কাঠ, স্টিল বা লোহার জন্য আলমারি কিনে না, কিনে আলমারিতে মূল্যবান জিনিসপত্র নিরাপদে রাখার জন্য। তাই সব শেষে মানুষ কী চায়, কেন চায় তাই সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

গুণগত মান ধরে রাখুন: যেসব পণ্য বিজ্ঞাপন ছাড়া চলে না, সেগুলো বিজ্ঞাপন দিয়েও খুব একটা সুবিধা করতে পারে না।

বাজার বা মার্কেটে প্রবেশের সময়: যারা আপনার পণ্য সম্পর্কে আগ্রহ দেখায় না, তাদেরকে পণ্যের ব্যাপারে আগ্রহী করে তোলাটা একটা সময়ের অপচয়। এরচেয়ে ভালো হয়, যারা আগ্রহী তাদের কাছ থেকে শোনা যে তারা কী ধরনের পণ্য বা সেবা চায়।

কম চলাচল করে এমন রাস্তাই যে সবসময় ভালো তা বলা যায় না: ব্যঙ্গরসাত্মক অভিনেতা ও বক্তা জেফ্রি সেইফিল্ড (Jerry Seinfeld) বলেন, যে রাস্তায় কম চলাচল করা হয় তার নিশ্চয় কোন একটা কারণ আছে।

এ ব্যাপারে রাজনৈতিক একটা কৌতুকও আছে। বলা হয়, ‘একজন ভালো বিক্রয়কর্মী সেই যে এস্কিমো বা বরফের দেশের মানুষের কাছেও ফ্রিজ বিক্রি করতে পারে।’

ব্যাপারটা শুনতে হয়তো হাস্যকর মনে হতে পারে, কিন্তু বরফের দেশের মানুষের জন্যও তাদের খাবার যাতে বরফে জমে না তার দরকার আছে। তাই মানুষকে কেবল তাদের চাহিদা ও প্রয়োজন সম্পর্কে বুঝিয়ে দিতে হবে। তাহলেই আপনি আপনার দরকারি পণ্য বা সেবা বিক্রি করতে সক্ষম হবেন।

আকাঙ্ক্ষা: প্রায় সময় দেখবেন দুই-তিন বছরের বাচ্চারা তাদের পছন্দের কোন জিনিস দেখলেই বলে ওঠে, আমি এটা চাই, আমি এটা চাই। যতক্ষণ পর্যন্ত সে তা না পাচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত কথাটা বলতেই থাকে। বিভিন্ন কোম্পানি হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে কেবল এরকম এক আকাঙ্ক্ষা কাস্টমারদের মধ্যে তৈরি করার জন্য। কিন্তু এটাও বাস্তবতা যে কেউ যদি একটা জিনিস না চায় তবে সেটা যত চেষ্টাই করা হোক না কেন, সে তা কিনবে না।

ধরুন, আপনি বিয়ে করেছেন, কিন্তু এখনই বাচ্চা নেওয়ার চিন্তা করেননি। হয়তো দুই-চার বছর পরে নিবেন। তো, এখন যদি কেউ আপনাকে বাচ্চাদের বিভিন্ন জিনিসপত্র ক্রয় করতে বলে, তবে আপনি কি তা নিতে আগ্রহী হবেন? আবার যখন আপনার প্রয়োজন হবে, তখন আপনি নিজেই এগুলো খুঁজে বের করবেন।

মানুষের মধ্যে কিছু মৌলিক চাহিদা রয়েছে:

লেখক পল আর লরেন্স এবং নিতিন নোহরিয়া তাদের বই ড্রিভেন (Driven: How Human Nature Shapes Our Choices by Paul R. Lawrence  (Author), Nitin Nohria (Author)) এ মানুষের ৪টি মৌলিক চাহিদা সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন:

১। অর্জন করার চাহিদা: আমরা বস্তুগত কোন জিনিস, যেমন গাড়ি, বাড়ি, মোবাইল ইত্যাদি অর্জন করতে চাই। আবার অবস্তুগত, যেমন ক্ষমতা, পদ-পদবি প্রভৃতি অর্জন করতে চাই।

২। বন্ধন বা সম্পর্ক তৈরির চাহিদা: মানুষের সাথে আমরা আত্মীয়তা বা ভালোবাসার বন্ধন ও সম্পর্ক তৈরি করতে চাই।

৩। শেখার চাহিদা: আমরা আমাদের কৌতূহল পূরণ করতে নানা জিনিস শিখি। এজন্য তৈরি হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা বিভাগ, প্রোগ্রাম, ট্রেনিং, বই প্রভৃতি।

৪। নিরাপত্তার চাহিদা: আমরা নিজেদের, ভালোবাসার মানুষদের এবং আমাদের সম্পদকে রক্ষা করতে চাই। এজন্য তৈরি হয়েছে নানা ধরনের নিরাপত্তামূলক যন্ত্রপাতি, বীমা ব্যবস্থা, আইনকানুন ইত্যাদি।

বিজনেস ট্রেনিং এর ওপর বেস্টসেলিং বই জশ কফম্যান রচিত দ্য পারসোনাল এমবিএ বইয়ে লেখক আরও একটি চাহিদার উল্লেখে করেন।

৫। অনুভব করার চাহিদা: আমরা নানা ধরনের আবেগীয় জিনিস অনুভব করতে চাই। রেস্টুরেন্ট, মুভি, গেমস, কনসার্ট ইত্যাদি এ চাহিদার ওপর নির্ভর করে তৈরি করা হয়েছে।

যখন এসব চাহিদার কোন একটার ঘাটতি দেখা যাবে, তখনই দেখবেন বাজারে তথা মার্কেটে সেই চাহিদা পূরণের জন্য কোন না কোন পণ্য বা সেবা চলে এসেছে।


তথ্যসূত্র:

দ্য পারসোনাল এমবিএ বই অনুসারে

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন