বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে (Conflict Resolution Model) দ্বন্দ্ব ও সংঘাত সমাধান মডেলের ব্যবহার

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সংঘাত সমাধান মডেলের (Conflict Resolution Model) ব্যবহার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও ব্যক্তিগত পর্যায়ে সংঘাত এখানে একটি সাধারণ ঘটনা। এই মডেল প্রয়োগ করে সংঘাতকে ইতিবাচকভাবে মোকাবিলা করা যায় এবং স্থিতিশীলতা ও উন্নয়ন নিশ্চিত করা সম্ভব। নিচে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই মডেলের ব্যবহার নিয়ে আলোচনা করা হলো:

১. সামাজিক সংঘাত সমাধানে (Social Conflict Resolution)

বাংলাদেশে সামাজিক সংঘাতের উৎস হতে পারে ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ, সম্পত্তি বা সম্পদ বণ্টন ইত্যাদি বিষয় নিয়ে।  

- পালানো (Flight): অনেক সময় সামাজিক সংঘাত এড়িয়ে চলা হয়, যা সমস্যাকে আরও জটিল করে তোলে। যেমন, সম্পত্তি নিয়ে বিরোধে আদালতের পরোয়া না করে সমস্যাকে উপেক্ষা করা। এটা হার-হার (lose-lose) পরিস্থিতি তৈরি করে। মানে উভয়পক্ষের জন্যই ক্ষতিকর বলে বিবেচিত হয়।

- ঐকমত্যে পৌঁছানো (Consensus): স্থানীয় নেতা, সমাজকর্মী বা মধ্যস্থতাকারীদের মাধ্যমে উভয়পক্ষের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে একটি সমাধান খুঁজে বের করা যায়। যেমন, গ্রামীণ পর্যায়ে সালিশি ব্যবস্থার মাধ্যমে বিরোধ নিষ্পত্তি।  

২. রাজনৈতিক সংঘাত সমাধানে (Political Conflict Resolution)

বাংলাদেশে রাজনৈতিক সংঘাত একটি বড় চ্যালেঞ্জ। দলীয় কোন্দল, নির্বাচনী বিরোধ এবং সরকার-বিরোধী আন্দোলন প্রায়শই অচলাবস্থা তৈরি করে।  

- লড়াই (Fight): রাজনৈতিক দলগুলো প্রায়শই সংঘাতকে জয়-পরাজয়ের লড়াই হিশাবে দেখে, যা জয়-হার (win-lose) পরিস্থিতি তৈরি করে। যেমন, হরতাল বা সহিংস প্রতিবাদ। জয়-হার (win-lose) পরিস্থিতিতে একজন জয়ী হলেও, আরেকজন পরাজিত হয়। এতে করে পরাজিতের মনে প্রতিহিংসার আগুন জ্বলতে থাকে। সে আবার প্রতিশোধ নিতে থাকে। এভাবে ক্ষতিকর পরিস্থিতির চক্র চলতেই থাকে। এটাকে বন্ধ করা যায় উভয়ের মধ্যে আপস মিমাংসার মাধ্যমে। যেখানে উভয়ই জয়-জয় (win-win) একটি অবস্থানে পৌঁছাতে পারে।

- আপস (Compromise): রাজনৈতিক সংঘাত সমাধানে আপসের মাধ্যমে একটি মধ্যবর্তী সমাধান খুঁজে বের করা যেতে পারে। যেমন, নির্বাচনী সংস্কার বা কোটা সংস্কার নিয়ে আলোচনা।  

- ঐকমত্য (Consensus): রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে জাতীয় স্বার্থে ঐকমত্যে পৌঁছানো যায়। যেমন, সংবিধান সংশোধন বা জাতীয় নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা।  

৩. অর্থনৈতিক সংঘাত সমাধানে (Economic Conflict Resolution)

বাংলাদেশে শ্রমিক-মালিক বিরোধ, ভূমি দখল নিয়ে সংঘাত, বা ব্যবসায়িক প্রতিযোগিতা নিয়ে সংঘাত দেখা যায়।  

- দায়িত্ব এড়ানো (Evade Responsibility): অনেক সময় কর্তৃপক্ষ সংঘাত সমাধানের দায়িত্ব এড়িয়ে যায়, যা সমস্যাকে বাড়িয়ে তোলে। যেমন, শ্রমিক আন্দোলনের সময় সরকার বা মালিক পক্ষের নিষ্ক্রিয়তা।  

- ঐকমত্য (Consensus): শ্রমিক ও মালিক পক্ষের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে একটি সমাধান খুঁজে বের করা যায়। যেমন, ন্যায্য মজুরি ও কাজের পরিবেশ নিশ্চিত করা।  

৪. ব্যক্তিগত ও পারিবারিক সংঘাত সমাধানে (Personal and Family Conflict Resolution)

বাংলাদেশে পারিবারিক বিরোধ, বিবাহবিচ্ছেদ, সম্পত্তি বণ্টন ইত্যাদি নিয়ে সংঘাত সাধারণ ঘটনা।  

- হাল ছেড়ে দেওয়া (Give Up): অনেক সময় এক পক্ষ হেরে যায় বা নিজের দাবি ছেড়ে দেয়, যা লুজ-উইন পরিস্থিতি তৈরি করে। যেমন, নারীদের প্রায়শই নিজের অধিকার ছেড়ে দিতে দেখা যায়।  

- আপস (Compromise): পারিবারিক বিরোধে আপসের মাধ্যমে একটি সমাধান খুঁজে বের করা যায়। যেমন, সম্পত্তি বণ্টনে উভয় পক্ষের সম্মতিতে একটি সমাধান।  

- ঐকমত্য (Consensus): পারিবারিক সদস্যদের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে একটি নতুন সমাধান তৈরি করা যায়। যেমন, পরিবারের সদস্যদের মধ্যে দায়িত্ব ভাগ করে নেওয়া।  

৫. শিক্ষা ও যুব সমাজে সংঘাত সমাধানে (Conflict Resolution in Education and Youth)

বাংলাদেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে সংঘাত, রাজনৈতিক সংঘাত বা যুব সমাজের মধ্যে সহিংসতা দেখা যায়।  

- পালানো (Flight): অনেক সময় শিক্ষার্থীরা সংঘাত এড়িয়ে চলে, যা সমস্যাকে জটিল করে তোলে।  

- ঐকমত্য (Consensus): শিক্ষক ও ছাত্রদের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে একটি সমাধান খুঁজে বের করা যায়। যেমন, সহিংসতা প্রতিরোধে যৌথ উদ্যোগ।  

৬. পরিবেশ ও সম্পদ নিয়ে সংঘাত সমাধানে (Environmental and Resource Conflict Resolution)

বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তন, নদী দখল, ভূমি দখল ইত্যাদি নিয়ে সংঘাত দেখা যায়।  

- দায়িত্ব এড়ানো (Evade Responsibility): অনেক সময় সরকার বা স্থানীয় কর্তৃপক্ষ সংঘাত সমাধানের দায়িত্ব এড়িয়ে যায়।

- ঐকমত্য (Consensus): স্থানীয় সম্প্রদায়, সরকার এবং এনজিওগুলোর মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে একটি সমাধান খুঁজে বের করা যায়। যেমন, নদী দখল রোধে যৌথ উদ্যোগ।  


উপসংহার: বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সংঘাত সমাধান মডেল প্রয়োগ করে সংঘাতকে ইতিবাচকভাবে মোকাবিলা করা সম্ভব। পালানো বা লড়াইয়ের পরিবর্তে আপস বা ঐকমত্যের মাধ্যমে সংঘাত সমাধান করা উত্তম। এটা সামাজিক স্থিতিশীলতা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং রাজনৈতিক শান্তি নিশ্চিত করতে সাহায্য করে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে এই মডেলের সঠিক প্রয়োগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

ফজলে রাব্বি (Fazle Rabbi)

আমার জীবনের একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য ২০৩০ সালের মধ্যে ৬৪টি অনুপ্রেরণামূলক বই প্রকাশ করা। saphollo.com

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন