বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে সাইনাস মিলিও এবং বুরদিউ মডেল (The Sinus Milieu and Bourdieu models)

ছবিসূত্র: ফরাসি সমাজবিজ্ঞানী পিয়েরে বুরদিউ। https://en.wikipedia.org/wiki/Pierre_Bourdieu

সাইনাস মিলিও এবং বুরদিউ মডেল (The Sinus Milieu and Bourdieu models): বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে উদাহরণ:

১. সাইনাস মিলিও মডেল: সাইনাস মিলিও মডেল অনুযায়ী, বাংলাদেশে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক এবং সামাজিক গ্রুপের মধ্যে পার্থক্য নিরূপণ করা যেতে পারে। এখানে কিছু উদাহরণ দেওয়া হলো:

উচ্চবিত্ত শ্রেণী (Upper Class): এই শ্রেণীর মানুষদের জীবনযাত্রা, শিক্ষা, চাকরি এবং সাংস্কৃতিক পছন্দ সাধারণত পশ্চিমা ট্রেন্ড অনুসরণ করে। তারা বিদেশে পড়াশোনা বা কাজ করতে আগ্রহী। তাদের সাংস্কৃতিক পছন্দ, যেমন পশ্চিমা ফ্যাশন, বিলাসবহুল জীবনধারা এবং আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড ব্যবহার করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। উদাহরণস্বরূপ, ঢাকা শহরের ধানমন্ডি, গুলশান বা বারিধারায় বসবাসকারী পরিবারগুলো এই শ্রেণীতে পড়ে।

মধ্যবিত্ত শ্রেণী (Middle Class): এই শ্রেণী দেশের উন্নত ভবিষ্যতের জন্য সচেতন, শিক্ষিত এবং সামাজিকভাবে বেশি সক্রিয়। তারা বেশিরভাগ সময় বাংলাদেশের নিজস্ব সাংস্কৃতিক মূল্যবোধে বিশ্বাসী এবং জীবনধারা আধুনিক হলেও ঐতিহ্যের ক্ষেত্রে পরিবারকেন্দ্রিক। এক্ষেত্রে ঢাকা, চট্টগ্রাম বা অন্যান্য শহরের কিছু কিছু মধ্যবিত্ত পরিবারের উদাহরণ দেয়া যেতে পারে, যারা চাকরি ও ব্যবসার মাধ্যমে মধ্যবিত্ত জীবিকা অর্জন করেন এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে।

নিম্নবিত্ত শ্রেণী (Lower Class): এই শ্রেণীর মানুষের জীবনধারা বেশ সাধারণ এবং তাদের প্রধান চাহিদা খাদ্য, আশ্রয় এবং নিরাপত্তা। তারা অধিকাংশ সময় সহজ-সরল জীবনযাপন করে এবং শহরের পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলোতে বসবাস করে। তাদের সাংস্কৃতিক পছন্দ ও জীবনধারা তেমন পরিবর্তনশীল নয়। উদাহরণস্বরূপ, ঢাকা বা অন্যান্য শহরের কাজের সুবিধা পাওয়া শ্রমিক শ্রেণী।

২. বুরদিউ মডেল: বুরদিউর মডেলটি সাংস্কৃতিক ভোগ ও শ্রেণীভিত্তিক পার্থক্যকে বিশ্লেষণ করে। বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে এটা কিছুটা এরকম হতে পারে:

বুরদিউর “ক্যাপিটাল” ধারণা: বুরদিউ সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক “ক্যাপিটাল”কে গুরুত্ব দেয়। বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষ নিজেদের শিক্ষা, পেশাগত সফলতা এবং সামাজিক নেটওয়ার্ককে প্রধান “ক্যাপিটাল” হিশাবে ব্যবহার করে, যা তাদের সমাজে উচ্চতর অবস্থান নিশ্চিত করে। উদাহরণস্বরূপ, একজন উচ্চমানের শিক্ষক বা উদ্যোক্তা, যিনি ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন, তাকে সমাজে একটি বিশেষ শ্রেণী হিশাবে দেখা হয়।

সাংস্কৃতিক ক্যাপিটাল: বুরদিউ বলেন, সমাজে একজন ব্যক্তি তার সাংস্কৃতিক পছন্দ, শিক্ষার ধরন, ভাষার ব্যবহার এবং অভ্যাসের মাধ্যমে শ্রেণীভুক্ত হয়। বাংলাদেশের শহুরে পরিবারের সদস্যরা সাধারণত বিদেশি ভাষা (ইংরেজি) এবং পশ্চিমা সংস্কৃতি গ্রহণ করে। তারা বিদেশী সিনেমা, মিউজিক, খাবার এবং ফ্যাশন পছন্দ করে। এর বিপরীতে, গ্রামীণ এলাকার মানুষরা তাদের সাংস্কৃতিক পছন্দে ঐতিহ্যবাহী এবং দেশীয় জিনিসকে রাখতে আগ্রহী।

সামাজিক ক্যাপিটাল: বুরদিউর মতে, একজন ব্যক্তির সামাজিক সম্পর্ক এবং নেটওয়ার্ক তাকে সমাজে উচ্চস্তরের নিয়ে আসে। বাংলাদেশে রাজনৈতিক, ব্যবসায়িক বা সামাজিক সম্পর্কও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়। যেমন, রাজনীতির সাথে সম্পর্কিত একজন ব্যক্তির সমাজে প্রভাব অনেক বেশি হতে পারে, অথবা বড় ব্যবসায়ীদের সন্তানরা সাধারণত ব্যবসা পরিচালনায় সক্ষম হয় তাদের পূর্বসূরিদের সামাজিক এবং অর্থনৈতিক অবস্থান দ্বারা।

অর্থনৈতিক ক্যাপিটাল: বাংলাদেশে যারা ব্যবসায়ী বা উচ্চপদস্থ চাকুরিজীবী, তাদের অর্থনৈতিক ক্যাপিটাল বুরদিউর বিশ্লেষণের সাথে মিলে যায়। তারা উচ্চমানের জীবনযাত্রা উপভোগ করে এবং তাদের অর্থনৈতিক সম্পদ তাদের সামাজিক অবস্থানকে সুদৃঢ় করে তোলে। উদাহরণস্বরূপ, দেশের বড় শিল্প গ্রুপগুলোর মালিকানাধীন পরিবারগুলো অর্থনৈতিক ক্যাপিটালের মাধ্যমে সমাজে প্রভাবশালী থাকে।

৩. লক-ইন প্রিন্সিপল: বাংলাদেশের বিভিন্ন সামাজিক শ্রেণী মধ্যে অভ্যাসের শক্তি প্রভাবশালী। লক-ইন প্রিন্সিপল এর মাধ্যমে মানুষ একবার যে সামাজিক বা সাংস্কৃতিক অবস্থানে অভ্যস্ত হয়ে যায়, তা পরিবর্তন করা কঠিন। উদাহরণস্বরূপ, গড়ে উঠা একাধিক ব্যবসায়ী পরিবার অথবা উচ্চশিক্ষিত সমাজ একবার প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলে, তাদের জন্য নতুন পরিবর্তন বা নতুন শ্রেণী ধারণা গ্রহণ করা কঠিন হতে পারে। যেমন, এক শ্রেণীর লোকেরা তাদের পারিবারিক ব্যবসা চালিয়ে যেতে থাকে, অন্যরা তাদের শিক্ষার ভিত্তিতে উচ্চতর সরকারি বা বেসরকারি চাকরি পেয়ে থাকে।

সারাংশ: সাইনাস মিলিও মডেল বাংলাদেশের বিভিন্ন সামাজিক শ্রেণী ও সাংস্কৃতিক পছন্দ এবং আচরণের মাধ্যমে সমাজের বিশ্লেষণ করতে সাহায্য করে। বুরদিউ মডেল বাংলাদেশের শ্রেণীভিত্তিক পার্থক্য, সাংস্কৃতিক ভোগ এবং সম্পর্কগুলোর মাধ্যমে সমাজে স্থান নির্ধারণ করতে ব্যবহৃত হতে পারে। এই মডেলগুলোর মাধ্যমে আমরা দেখতে পারি কীভাবে সামাজিক শ্রেণী, সাংস্কৃতিক অভ্যাস এবং অর্থনৈতিক অবস্থান একটি সমাজে মানুষের জীবনযাত্রা এবং পরিচয় গঠন করে।

ফজলে রাব্বি (Fazle Rabbi)

আমার জীবনের একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য ২০৩০ সালের মধ্যে ৬৪টি অনুপ্রেরণামূলক বই প্রকাশ করা। saphollo.com

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন