সায়হান একজন পাথরকাটা শ্রমিক। তার দিন কাটে বিশাল পাথরের টুকরো ভাঙতে ভাঙতে। সায়হানের জীবন ছিল একঘেয়ে এবং ক্লান্তিকর। প্রতিদিনের পরিশ্রমের পরেও তার জীবনের সাধারণ চাহিদাগুলো মেটানো কঠিন হয়ে পড়ত। সায়হান নিজের দুর্দশা নিয়ে হতাশ। সে সবসময় নিজের জীবন নিয়ে অসন্তুষ্ট থাকত।
একদিন কাজ শেষে বাড়ি ফেরার পথে সে এক ধনী ব্যবসায়ীর অট্টালিকার পাশ দিয়ে গেল। জানালা দিয়ে সে দেখল, ব্যবসায়ী বিলাসবহুল জীবনযাপন করছে। সোনা, রূপা, দামি পোশাক—সবকিছু যেন তাকে উপহাস করছিল। সায়হান মনে মনে ভাবল, "যদি আমি এমন ধনী ব্যবসায়ী হতে পারতাম!"
তারপর জাদুর মতো এক ঘটনা ঘটে। এক রহস্যময় আলোর ঝলকানির মধ্য দিয়ে সায়হান নিজেকে একজন ধনী ব্যবসায়ী হিশাবে খুঁজে পেল। তার চারপাশে বিলাসিতার ছড়াছড়ি। দামি পোশাক, সোনা দিয়ে মোড়ানো আসবাবপত্র, পরিচারকদের সারি প্রভৃতি।
প্রথমে মনে হলো তার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। কিন্তু ধীরে ধীরে সে বুঝতে পারল, ব্যবসায়ীর জীবন সুখকর নয়। ক্রমাগত চাপ, হিসাবপত্র এবং প্রতিদ্বন্দ্বীদের মোকাবিলা করতে করতে সে ক্লান্ত হয়ে পড়ে।
একদিন রাস্তায় সে দেখল রাজ্যের প্রধান বিচারক যাচ্ছে। সৈন্যদের দ্বারা বহন করা সেডান চেয়ারে বসে বিচারক নির্বিকার চিত্তে লোকজনের ওপর ক্ষমতা প্রদর্শন করছে। ব্যবসায়ীদের সৈন্যরা অপমান করছে, দোকানদারদের শাস্তি দিচ্ছে।
সায়হানের মনে হলো, "বিচারকই সত্যিকারের শক্তিশালী। যদি আমি বিচারক হতে পারতাম!"
আবারও সেই আলো। মুহূর্তেই সায়হান বিচারক হয়ে উঠল। সৈন্যরা তাকে সর্বত্র বহন করছে। লোকজন তার নাম শুনে ভয়ে কাঁপছে। কিন্তু অচিরেই সে বুঝতে পারল, বিচারকের জীবনও সুখের নয়। মানুষ তাকে ঘৃণা করে, তার প্রতি সম্মান নয়; বরং ভয় পোষণ করে।
এক গ্রীষ্মের দিনে, সেডান চেয়ারে বসে বসে, সে সূর্যের প্রখর তাপে ক্লান্ত হয়ে পড়ল। আকাশে চেয়ে সে ভাবল, "সূর্যই প্রকৃত শক্তিশালী। যদি আমি সূর্য হতে পারতাম!"
সায়হান সূর্য হয়ে উঠল। তার তেজস্বী আলোতে পৃথিবী জ্বলতে লাগল। ফসল পুড়ল, নদী শুকিয়ে গেল। সায়হান মনে করল, এখন সে সর্বশক্তিমান।
কিন্তু একদিন, এক বিশাল কালো মেঘ এসে তার আলোকে ঢেকে দিল। যতই সে চেষ্টা করল, মেঘকে সরাতে পারল না। সে বুঝল, "মেঘ সূর্যের চেয়েও শক্তিশালী। যদি আমি মেঘ হতে পারতাম!"
সায়হান মেঘ হয়ে বৃষ্টি, ঝড় এবং বজ্রপাতের মাধ্যমে তার শক্তি প্রদর্শন করল। মাঠ, ঘরবাড়ি প্লাবিত হলো।
কিন্তু শীঘ্রই সে অনুভব করলো, বাতাস তাকে ছড়িয়ে দিচ্ছে। বাতাসের প্রবল শক্তির কাছে সে অসহায়। সায়হান ভাবল, "বাতাসই আসল শক্তিমান। যদি আমি বাতাস হতে পারতাম!"
বাতাস হয়ে সায়হান গাছ উপড়ে ফেলল, বাড়ির ছাদ উড়িয়ে দিলো। কিন্তু অল্প সময় পরেই সে দেখল, তার গতিপথে একটি বিশাল পাথর দাঁড়িয়ে আছে। বাতাস তার সমস্ত শক্তি দিয়ে পাথরটিকে সরানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলো।
"পাথরই সবচেয়ে শক্তিশালী," সায়হান ভাবল। "আমি যদি পাথর হতে পারতাম!"
সায়হান পাথর হয়ে গেল। সে ভেবেছিল, এখন সে অপরাজেয়। কেউ তাকে সরাতে পারবে না।
কিন্তু কিছুক্ষণ পর সে হাতুড়ির শব্দ শুনতে পেল। নিচে তাকিয়ে সে দেখল, একজন শ্রমিক তার গায়ে হাতুড়ি চালিয়ে পাথর ভাঙছে।
পাথর তাকিয়ে দেখল, সেই শ্রমিক আর কেউ নয়—সে নিজেই।
সায়হান তখন উপলব্ধি করল, আসল শক্তি বাইরের অবস্থানে নয়। শক্তি নিজের অন্তরে, ভেতরে। সে ফিরে গেল তার প্রথম অবস্থানে, একজন পাথরকাটা শ্রমিক হিশাবে। কিন্তু এবার তার দৃষ্টিভঙ্গি বদলে গেছে। সে নিজের কাজকে ভালোবাসতে শিখল এবং জীবনের জন্য কৃতজ্ঞ হতে শিখল।
"কঠোর পরিশ্রমই আসল শক্তি," সে মনে মনে বলল। "আমি এর মধ্যেই পরিপূর্ণ।"
সায়হানের যাত্রা শেষ হলো। কিন্তু তার উপলব্ধি তাকে এক নতুন জীবনের দিশা দেখাল।
আরও পড়ুন: