গলিতে অন্ধকার। গাঢ় আঁধার। নিজের চোখে নিজেকে দেখা যায় না। সায়হান বলল, একটু অপেক্ষা কর। একটু পরেই ভোরের আলো ফুটবে। বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। তবুও বন্ধু মানুষ। যখন বলেছে, একটু অপেক্ষা করেই দেখি।
ধীরে ধীরে যাত্রাবাড়ির অন্ধকার গলিতে ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। গলির দেয়ালে দেয়ালে সারিবদ্ধ পোস্টার—বিক্ষোভ, প্রতিরোধ আর পরিবর্তনের চিহ্ন। গত ৩-৪ দিন ধরেই এই এলাকা উত্তাল। রাস্তায় গাড়িঘোড়া নেই। মানুষজন ভয় আর ক্ষোভের মিশ্র অনুভূতিতে ঘরে বন্দী। তবে সায়হানের মতো কিছু সাহসী তরুণ ঠিক করেছে, এই অচলাবস্থা ভাঙতেই হবে।
১৮ বছর বয়সী সায়হান যাত্রাবাড়ীর একটি মাদ্রাসার ছাত্র। ধর্মীয় পড়াশোনার পাশাপাশি সমাজের ন্যায়বিচার নিয়ে তার আগ্রহ সবসময়। বন্ধুদের সঙ্গে ফজরের নামাজ পড়ে ফেরার পথে সে শুনতে পায়, তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী মেইন রোডে দখল নিতে হবে। কিন্তু রাস্তাটা ততটা নিরাপদ নয়। সেখানে কোথাও লুকিয়ে রয়েছে অদৃশ্য স্নাইপার, যার লক্ষ্য আন্দোলনকারীদের থামিয়ে দেওয়া।
যাত্রার শুরুতেই তার বন্ধু মারুফ গুলির শিকার হয়। গলগল করে রক্ত বের হচ্ছে তার কাঁধ থেকে। বন্ধুরা হতবিহ্বল হয়ে পড়ে। মেইন রোডে পৌঁছানোর আগেই তাদের ওপর নেমে আসে মৃত্যুর ছায়া। কিছুক্ষণ পরে আবার গুলির শব্দ। এবার সবাই রাস্তায় মাটিতে শুয়ে পড়ে। আশপাশের গলি থেকেও খবর আসে। স্নাইপার আগেই মেইন রোডের প্রবেশপথ অবরুদ্ধ করে রেখেছে।
মারুফের রক্তাক্ত দেহ গলির ভেতরে টানতে টানতে নিয়ে যাওয়া হয়। সায়হান তার বন্ধুর চোখে তাকিয়ে বুঝতে পারে, সময় বয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কেউ জানে না পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে! সবাই গুলির উৎস নিয়ে আলোচনা করতে থাকে। এলাকার এক বড় ভাই, শরীফ জানায়, স্নাইপার সম্ভবত রাস্তার মুখের ছয়তলা বিল্ডিং থেকে গুলি ছুঁড়ছে। তবে সুনির্দিষ্ট জায়গাটা এখনো অজানা।
“স্নাইপারকে খুঁজে বের করতেই হবে,” শরীফ বলে। “কিন্তু কে যাবে?” প্রশ্ন শুনে সবাই পিছনে সরে যায়। কারো সাহস নেই গলির বাইরে পা রাখার। একসময় সায়হান মুখ তোলে। ভেতরের ভয়কে চেপে রেখে সে বলে, “আমি যাব।”
তার বন্ধুরা থমকে যায়। “তুই পাগল নাকি? এটা আত্মহত্যা,” একজন বলে।
কিন্তু সায়হানের চোখে তখন অন্যরকম এক দৃঢ়তা। “আমরা যদি কেউই না যাই, তাহলে এভাবে বন্দী হয়ে থাকব কতদিন?” সে বলে।
শরীফ তাকে শক্ত করে কাঁধে হাত রেখে বলে, “আল্লাহ তোকে রক্ষা করবেন। সাবধানে যা।”
সায়হান গলির শেষ প্রান্তে এসে দাঁড়ায়। তার বুকের ভেতর হৃদস্পন্দন যেন দ্রুত বাজছে। রাস্তার ওপাশের বিল্ডিংগুলো অন্ধকারে ঢাকা। হঠাৎ, প্রথম গুলিটি ছুটে আসে। সায়হান আগেই সতর্ক ছিল। দ্রুত সরে গিয়ে সে দেয়ালের আড়ালে আশ্রয় নেয়।
তবে থেমে যাওয়ার কোন উপায় নেই। গলির শেষ প্রান্তে পৌঁছানোর আগেই আরও দুটি গুলি তার কাছ দিয়ে ছুটে যায়। সায়হান এবার আর পিছু হটে না। তার পেছনে আরও দুই তরুণ এলোমেলোভাবে দৌঁড়াতে থাকে। তাদের সাহায্যে শরীফ ও শাহাদাৎ স্নাইপারের অবস্থান আন্দাজ করতে পারে।
স্থানীয় জনতা তখন প্রায় একশোর মতো জড়ো হয়েছে। সবার হাতে কিছু না কিছু আছে—লাঠি, ইট, কাঠের টুকরো। তাদের সামনে দাঁড়িয়ে শরীফ বলে, “এখন আমাদের সময়। বিল্ডিংটার দখল নিতে হবে। স্নাইপার যদি এভাবেই থাকে, আমরা কেউই নিরাপদ নই।”
জনতা দলবেঁধে বিল্ডিংয়ের দিকে এগোতে থাকে। তারা দেয়ালের সাথে গা ঘেঁষে ঘেঁষে যায়, যাতে স্নাইপারের চোখে না পড়ে। এভাবে তারা ছয়তলা বিল্ডিংয়ের সামনে পৌঁছায়।
বিল্ডিংয়ের গেট বন্ধ। দারোয়ান প্রথমে ভয় পেয়ে দরজা খুলতে চায় না। জনতার হুংকারে সে দরজা খুলে দিতে বাধ্য হয়। ভেতরে ঢুকেই জনতা বিল্ডিংয়ের বিভিন্ন তলার দিকে ছড়িয়ে পড়ে।
৪ এবং ৬ তলার দুটি ফ্ল্যাটকে সন্দেহ হয়। একদল ৪ তলার দরজায়, আরেকদল ৬ তলার দরজায় ধাক্কা দিতে থাকে। ৬ তলার দরজা খুলে গেলে জনতা দেখতে পায়, সেখানে ভীতসন্ত্রস্ত পরিবারের লোকজন। “এখানে কেউ নেই!” তারা চিৎকার করে বলে।
৪ তলার দরজা বন্ধ। পাশের এক বাসিন্দা জানায়, “বাসাটি ফাঁকা।" কিন্তু জনতা তা মানতে নারাজ। দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকে তারা দেখতে পায়, পুলিশের পোশাক পরা দুইজন স্নাইপার নিয়ে সেখানে লুকিয়ে আছে। তাদের রাইফেলের নল এখনো গরম।
স্নাইপারদের ধরে জনতা উত্তেজিত হয়ে ওঠে। কয়েকজন তাদের উপর হামলা শুরু করে। সায়হান তখনও ভেতরে দাঁড়িয়ে। সে চিৎকার করে বলে, “এভাবে মেরে লাভ নেই। তাদের আইন অনুযায়ী শাস্তি দিতে হবে।”
কিন্তু জনতার রাগ থামে না। স্নাইপারদের টেনে হিঁচড়ে নিচে নামিয়ে আনা হয়। ইতোমধ্যে বিল্ডিংয়ের মালিক পালিয়ে যায়।
হাজারো জনতা দলে দলে সড়কে নেমে আসে। তাকবিরের ধ্বনিতে যাত্রাবাড়ির আকাশ-বাতাস কেঁপে ওঠে। রাস্তায় স্নাইপারদের উলঙ্গ দেহ ঝুলিয়ে রাখা হয়। তাদের পা উপরে আর মাথা নিচে।
সায়হান এই দৃশ্য দেখে হতবাক। সে ফিরে এসে মারুফের পাশে বসে। বন্ধুর চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে থাকে।
সায়হান বুঝতে পারে, এই লড়াইয়ের মধ্যে শুধুই রাগ আর প্রতিশোধ ছিল। কিন্তু এই পথে প্রকৃত মুক্তি পাওয়া যায় না। সে মনে মনে বলে, “আমাদের লড়াই হওয়া উচিত ছিল ন্যায়বিচারের জন্য, প্রতিশোধের জন্য নয়।”
১৮ জুলাই ২০২৪, যাত্রাবাড়ির এই দিনটি স্থানীয়দের চিরকাল মনে থাকবে। সায়হান, এক তরুণ যোদ্ধা, এই যাত্রায় শুধু সাহসিকতার নয়, নৈতিকতারও উদাহরণ সৃষ্টি করে।
সায়হানের বন্ধুদের চোখে সে এখন নায়ক। কিন্তু তার মনে সবসময় একটি প্রশ্ন জেগে থাকে, “আমি কি ঠিক কাজ করলাম?”
শেষ পর্যন্ত, সে উপলব্ধি করে, “ভয়কে জয় করাই আসল সাহস। তবে দায়িত্বের পথে নৈতিকতা ভুলে গেলে সেই সাহস মূল্যহীন।”
সায়হানে চোখে পড়ে ভোরের সূর্যের প্রথম কিরণ। চোখে তার নতুন দিনের স্বপ্ন। এই স্বপ্নের ওপর ভর করে ভবিষ্যতের পথে এগিয়ে যাবে সায়হান।
আরও পড়ুন: