বৃহস্পতিবার, ২৭ অক্টোবর, ২০২২

গান্ধী বইয়ের নির্বাচিত উক্তি


বই: ১৮। গান্ধী। লেখক: সুভাষ ঘোষাল। কলকাতা, প্যাপিরাস, ২০১৬।

- ১৭। লেনিন। লেখক: জয়দেব বসু। কলকাতা, প্যাপিরাস, ২০০০।

- ১৯। রামের সুমতি। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। ঢাকা, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র, ২০২১।
- ২০। শ্রেষ্ঠ ছোটগল্প। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। ঢাকা, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র, ২০২০।

১। গান্ধী জানেন গ্রাম শেষ হয়ে গেলে ভারতও শেষ হয়ে যাবে। যেমন, রূপকথার রাজপুত্রের প্রাণভোমরা একটা কৌটার মধ্যে লুকিয়ে থাকে, তেমনি এই ভারতবর্ষের প্রাণভোমরাও লুকিয়ে আছে গ্রামের মধ্যে।


২। সেবাগ্রামে ঢুকলেই চোখে পড়বে ওই মানুষটি যে জায়গায় বসে কাজ করছেন তা কোন আরাম কেদারা নয়। একটা কাঠের তক্তা। পাশেই ছোটো ছোটো তিনটি মূর্তি। তিনটে মূর্তিই বাঁদরের। তিন মূর্তির তিন রকমের ভঙ্গির মধ্যে তিনটে শিক্ষা আছে। কেউ জানতে চাইলে তিনি নিজেই বুঝিয়ে দেবেন। চোখ হাত দিয়ে ঢেকেছে। তার মানে, খারাপ কিছু দেখবে না। মুখ হাত দিযে বন্ধ করেছে। তার মানে, খারাপ কিছু বলবে না। দু-কানে আঙুল দিয়ে বসে আছে। তার মানে? মানেটা তো এখন খুব সোজা হয়ে গেল। খারাপ কিছু শুনবে না।

  • যিনি পরের জন্য কাজ করবেন তাঁকে এই তিনটে বাঁদরের ছবি মনের মধ্যে জাগিয়ে রাখতে হবে আজীবন।


৩। শ্রবণ আর হরিশ্চন্দ্র, দুটো নাটকের এই দুটো চরিত্র গান্ধীজির জীবনে এগিয়ে যাবার প্রেরণা জুগিয়েছে।


৪। নিজের সুবিধা মতো ব্রত করলাম আর অসুবিধে হলেই সেই ব্রত ভাঙলাম, গান্ধীজির মা, পুতলী বাঈ, কিন্তু তেমন মানুষ নন। মায়ের এই মনের জোর, এই বিশ্বাস আঁকড়ে থাকার শক্তি, গান্ধীজির জীবনেও দেখা গেছে বার বার।


৫। গান্ধীজির বাবা যখন কর্মসূত্রে রাজকোটে ছিলেন, তখন তাঁর বাবার কাছে নানা মত ও পথের সাধকেরা আসতেন। বাবাকে সেবা করতে করতে গান্ধীজি তাঁদের নানা রকম আলোচনা শুনতেন। সব কতা যে বুঝতে পারতেন তা নয়। তবে এটুকু বুঝতে পারতেন যে, সব ধর্মের মধ্যেই সত্য আছে। তাই কোন ধর্মের কোন মানুষকেই তুচ্ছ করা চলবে না।


৬। যাঁদের আমরা মনীষী বলি, যাঁরা কোন না কোনভাবে দেশ ও সমাজকে এমন কিছু দিয়ে যান যা ভোলা যায় না, যাঁদের প্রতিভার আলোয় দশ দিক ভরে ওঠে, তাঁরা কিন্তু মনীষী হয়ে জন্মান না। জীবনের অনেক সংগ্রাম, অনেক দুঃখকষ্ট, অনেক পরীক্ষা পার হয়ে তবেই তাঁরা প্রমাণ করেন যে তাঁরা আর পাঁচজনের থেকে অনেক বড়ো, অনেক আলাদা। অনেক সময় সাধারণ মানুষের মতো তাঁদেরও দোষ ও দুর্বলতা থাকে। কিন্তু তাঁরা তাঁদের দোষগুলোর সম্পর্কে, দুর্বলতাগুলোর সম্পর্কে সচেতন হয়ে সেগুলোকে আস্তে আস্তে জীবন থেকে দূর করে দেন। - পৃষ্ঠা ১৮।


৭। ১৮৮৮ সালের চৌঠা সেপ্টেম্বর গান্ধীজি বোম্বাই থেকে জাহাজে চাপলেন। এই জাহাজই তাঁকে একদিন পৌঁছে দেবে বিলেতে।


৮। জানো তো, পুরুষমাছিরা চুপ করে বসে থাকে। কোন কাজ করে না।


৯। গান্ধীজি বুঝতে পেরেছিলেন অল্প কথার শক্তি। যারা বক্তৃতা দিতে উঠে আর থামতে চান না, বড়ো বেশি কথা বলেন, তিনি কোনদিনও তাদের দলে নাম লেখাননি। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, বেশি কথা বলা মানে রঙ চড়িয়ে কথা বলা, ঘটনা অতিরঞ্জিত করা। তাতে যেমন শ্রোতার সময় নষ্ট হয়, তেমন দেশেরও কোন উপকার হয় না।


১০। এমনভাবে লিখতে হবে যাতে কোন অসংযমের ভাব ফুটে না ওঠে। গান্ধীজি বলেন, আমি এখন অনেক ভেবেচিন্তে বলি, অনেক ভেবেচিন্তে লিখি।


১১। তোমরা তাঁর গুজরাতিতে লেখা আত্মজীবনী যদি পড়ো কখনো, যদি তাঁর ইংরেজি রচনার দিকে তাকাও, তবে দেখতে পাবে কত অল্প কথায়, কত বলিষ্ঠভাবে তিনি তাঁর অভিমত জানতে পেরেছেন।


১২। এই যে চুপ করে থাকা, এই যে মৌনব্রত পালন, এর যে বিশেষ শক্তি আছে, তা গান্ধীজি বুঝতে পেরে নিয়ম করে তিনি এই ব্রত পালন করতেন। যিনি সত্যের পূজারী তাঁকে যে এই ব্রত পালন করতে হবে, এই বোধটা তাঁর এক সময়কার লাজুক স্বভাব থেকেই জন্ম নিয়েছিল। তাই বলা যেতে পারে, বিলেতে থেকে তিনি কেবল ব্যারিস্টারই হননি, সেইসঙ্গে ভিতরে ভিতরে হয়ে উঠছিলেন একজন বোদ্ধা। কীসের বোদ্ধা? শব্দের বোদ্ধা। যেখানে যে শব্দ মানায় সেখানে সেই শব্দ বসাতে হবে। আর যেখানে কোন শব্দই মানায় না, সেখানে হতে হবে নিঃশব্দ।


১৩। সেই সময় দক্ষিণ আফ্রিকায় কোন গরিব ভারতবাসী পাঁচ বছরের চুক্তিতে কাজ করতে এলে তাকে 'কুলি' বলা হত।


১৪। ডারবান থেকে ট্রেনে উঠেছেন। নাতালের রাজধানীতে এসে পৌঁছাল। সেই ট্রেন থেকে গান্ধীজিকে শাদা চামড়ার একজন ট্রেন থেকে নামিয়ে দিলেন। আর সেই অসম্ভব শীতের রাতে কাঁপতে কাঁপতে তিনি সংকল্প করেন, এই যে বর্ণবিদ্বেষ, এই যে মহারোগ, এই রোগের প্রতিকার করতেই হবে। - পৃষ্ঠা ২৯।


১৫। পরদিন আবার ট্রেনে চড়লেন। এই রোগের প্রতিকার করতে গিয়ে যত দুঃখ-দুর্দশাই আসুক তা সহ্য করতে হবে বিচলিত না হয়ে। ট্রেন চার্লসটাউন এসে থামল। সেখানে না নেমে উপায় ছিল না। তখনকার দিকে চার্লসটাউন নেমে কিছুদূর ঘোড়ার গাড়িতে যেতে হত। এই ঘোড়ার গাড়িতে যাত্রীরা গাড়ির মধ্যে বসবে এটাই তো নিয়ম। এটাই তো স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু সমস্ত নিয়ম, সমস্ত স্বাভাবিকতা তো যাদের গায়ের রঙ শাদা তাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। কুলি ব্যারিস্টারের ক্ষেত্রে নয়। তাই গান্ধীজিকে বসতে হলো কোচবাক্সে, কোচোয়ানের পাশে। কিন্তু সেখানেও শান্তি নেই। সাহেব কন্ডাক্টর। তার হঠাৎ খোলা জায়গায় চুরুট খাবার ইচ্ছে হলো। সে গাড়ির ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে পাদানিতে একটা চট পেতে দিয়ে গান্ধীজিকে বলল নেমে গিয়ে সেখানে বসতে। গান্ধীজি জানিয়ে দিলেন তাঁর সিদ্ধান্ত - তিনি আর একচুলও সরবেন না। এই ‘বেয়াদপি’ দেখে লোকটা ঘুষির পর ঘুষি চালায়, টেনে নামাতে চায় গান্ধীজিকে। তিনি যেখানে বসেছিলেন তার পেতলের ডান্ডাটা ধরে, দৃঢ়ভাবে ধরে তিনি অটল থাকার চেষ্টা করে যান। তাঁর তখনকার মনোভাব হলো - আমার হাত ভেঙে গেলেও আমি পেতলের ডান্ডা ছাড়ব না। - পৃষ্ঠা ২৯।


১৬। প্রিটোরিয়া যাবার পথে পরপর এই যে দুটো দৃশ্য দেখা গেল, এ-দুটোর গুরুত্ব খুব বেশি। প্রথম দৃশ্যে তিনি শীতে কাঁপতে কাঁপতে সংকল্প করলেন, অত্যাচারী অন্যায় অত্যাচার যেকোনো মূল্যে বন্ধ করতে হবে। আর দ্বিতীয় দৃশ্যে অত্যাচারিত হতে হতে তিনি এই মনোবল দেখালেন, যেটা সত্য সেটাকে রক্ষা করার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করে যেতে হবে। মারের বদলে মার নয়, হিংসার বদলে হিংসা নয়, অহিংস সত্যাগ্রহই হবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার একমাত্র অস্ত্র।


১৭। ‘সত্যাগ্রহ’ শব্দটা গান্ধীজি হঠাৎ-ই পেয়ে যান। দক্ষিণ আফ্রিকায় থাকতে থাকতে একটা পত্রিকার সঙ্গে তিনি জড়িয়ে পড়েন। পত্রিকাটা ‘ইন্ডিয়ান ওপিনিয়ন’ নামে বের হয়। দক্ষিণ আফ্রিকার ভারতীয়রা বিভিন্ন ব্যাপারে যাতে তাদের প্রতিক্রিয়া জানাতে পারে, জানাতে পারে নির্ভীক মতামত, সেই দিকে লক্ষ্য রেখে জন্ম হয় এই পত্রিকার। - পৃষ্ঠা ৩০।


১৮। গান্ধীজি ইন্ডিয়ান ওপিনিয়ন পত্রিকায় একটি নাম পাঠানোর জন্য পাঠকদের আমন্ত্রণ জানান। পাঠকদের তরফ থেকে যেসব নাম আসে সেগুলোর মধ্য থেকে নির্বাচিত হয় মগনলাল গান্ধীর ‘সদাগ্রহ’। সৎ + আগ্রহ = সদাগ্রহ। এই নামটাকে আর একটু উজ্জ্বল করার জন্য গান্ধীজি ‘সৎ’-এর জায়গায় ‘সত্য’ বসিয়ে নিলেন। তখন নামটা হয়ে দাঁড়াল সত্য + আগ্রহ = সত্যাগ্রহ।


১৯। সত্যাগ্রহ আন্দোলন কী? সত্যের পথে থেকে আন্দোলন করা। এই আন্দোলনে এমন কিছু করা চলবে না যার সঙ্গে মিথ্যার যোগ আছে, হিংসার যোগ আছে। শত্রুকে হিংসা করা চলবে না, অত্যাচারীকে হিংসা করা চলবে না। ….

  • আমি যদি সত্যপথে থাকি, আমি যদি হিংসা না করি, আমি যদি অত্যন্ত সংযমের সঙ্গে মার খেতে খেতে আমার প্রতিবাদ জানিয়ে যাই, তবে একটা সময় আসবে যখন শত্রুর বা অত্যাচারীর মনের পরিবর্তন হবে। সে বুঝতে পারবে তার ভুল। ….

  • অহিংসা পরম ধর্ম এবং সত্যেরই জয় হয়।


২০। মনে রাখতে হবে, অহিংসা আর সত্যাগ্রহ হলো একই মুদ্রার দুটো পিঠ। একটার থেকে আর একটাকে আলাদা করা যাবে না।


২১। জাতীয় কংগ্রেসের আদলে তিনি নাতালে ‘নাতাল-ইন্ডিয়ান-কংগ্রেস’ প্রতিষ্ঠা করেন। এই প্রতিষ্ঠান তাঁর নেতৃত্বে ভারতীয়দের ওপর যেসব অবিচার এত বছর ধরে চলে আসছিল সেগুলো দূর করার ব্যাপারে এগিয়ে আসে।


২২। তিনটি সম্পদের কথা আমরা খুব সহজেই বলে ফেলতে পারি। অহিংসা, তথা সত্যাগ্রহের প্রয়োগের অভিজ্ঞতা, উদারতা এবং সেবা।


২৩। গান্ধীজির ভাষায় সুভাষচন্দ্র বসু হলেন ‘এ প্রিন্স অব দি প্যাট্রিয়টস’। অর্থাৎ যাঁরা স্বদেশপ্রেমিক তাঁদের মধ্যে তিনি রাজপুত্র। আর সুভাষচন্দ্র তাঁর আজাদ হিন্দ অভিযান পরিচালনা করার সময় গান্ধীজিকে প্রণাম জানাতে ভুলে যান না। গান্ধীজিকে তিনিই বলে ওঠেন ‘জাতির জনক’। ‘জাতির জনক, ভারতের এই মুক্তিযুদ্ধে আপনার আশীর্বাদ চাই।’


২৪। ভাইসরয় হার্ডিঞ্জ বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করতে এসেছিলেন। সেই উপলক্ষে যে অনুষ্ঠান শুরু হয়েছে তাতে অনে দেশীয় রাজা আমন্ত্রিত হয়ে এসেছেন। সেখানে গান্ধীজি বললেন, যিনি এই দেশের শাসক, সেই হার্ডিঞ্জ আসবেন বলে বেনারসের অলি-গলি পুলিশে পুলিশে ঢেকে দেওয়া হযেছে। এত নিরাপত্তা কেন? তার মানে যিনি শাসক তিনি নিজেই কি সারাক্ষণ ভয়ে অস্থির নন? ….

  • আজও যাঁরা গরিবের কল্যাণের কথা বলেন তাঁদের অনেকেই চূড়ান্ত ভোগী। শাসক কি নিজেই ভয়ে অস্থির নন?


২৫। যোগেন্দ্রনাথ গুপ্তর ‘বাংলার ডাকাত’-এ কুঠিয়াল কেরী সাহেবের কথা যে আলোচিত হয়েছে তার পেছনে যথেষ্ট কারণ আছে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন