আপনি কি আজকের মধ্যেই কাজ শেষ করতে চান?
অনেক কর্মচারীকেই এ কথা শুনতে হয়। “কী ব্যাপার! আপনার কাজটা কি শেষ হয়েছে? কবে শেষ করবেন? এত সময় লাগে নাকি?”
এ ধরনের কথা শুনতে কার-বা ভালো লাগে। প্রায় সময় আমরা কাজের চাপে ঠিক সময়ে অনেক কাজটা শেষ করতে পারি না। এজন্য আমাদের ভালোমন্দ কথা শুনতে হয়। যা আমাদের মধ্যে আরও মানসিক চাপ তৈরি করে। কিন্তু এই মানসিক চাপ নিয়ে থাকতে হবে এমন নয়। একে দূর করা সম্ভব।
জার্নাল অফ কনজিউমার রিসার্চের এক গবেষণায় দেখা যায় কর্মচারীদেরকে সময়সীমা দিলে কর্মীরা দক্ষভাবে কাজ করে। কিন্তু ডেডলাইন দিলে কর্মীরা কাজটাকে প্রকৃত কাজের চেয়ে বেশি কঠিন বলে মনে করে। এজন্য তারা উক্ত কাজ নিয়ে বেশিই চিন্তায় পড়ে যায় এবং এ নিয়ে নানা তথ্যউপাত্ত সংগ্রহ করতে লেগে পড়ে। হয়তো এতকিছুর দরকারও নেই। আর অপ্রয়োজনীয় জিনিস যোগাড় করতে গিয়েই কাজে গড়িমসি বা দেরি হওয়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়।
গবেষকরা একটি কমিউনিটি সেন্টারে রোগীদের সাথে কথা বলে। এই গবেষণায় তারা ভলেন্টিয়ার হিসাবে যোগ দেয়। তাদেরকে তাদের অবসরের যাওয়ার পরিকল্পনার কথা জিজ্ঞেস করা হয়। দুইটি গ্রুপে তাদেরকে ভাগ করা হয়। প্রথম গ্রুপকে ৭ দিনের ডেডলাইন বা সময়সীমা দেওয়া হয়। আর দ্বিতীয় দলকে ১৪ দিনের ডেডলাইন। দেখা গেছে যাদেরকে ১৪ দিনের সময়সীমা দেওয়া হয়েছে, তারা অবসর পরিকল্পনাকে বেশি জটিল করে ফেলেছে। এ সম্পর্কিত তথ্যউপাত্ত সংগ্রহ করতে করতেই তাদের দিন চলে গেছে। কিন্তু ৭ দিন সময় পাওয়া দল অপেক্ষাকৃত ভালো করেছে। এতে করে, বোঝা যায় বেশি সময় দিলে কাজে গড়িমসি করে এবং হাল ছেড়ে দেওয়ার প্রবণতা তৈরি হয়।
অন্য একটি গবেষণায় দেখা যায়, কিছু করদাতারা ট্যাক্স দাখিলের জন্য তাদের সমপরিমাণ আয় করা ব্যক্তিদের থেকে বেশি টাকা খরচ করেছে। যেমন, কেউ মাসে ৪০ হাজার টাকা আয় করে। সে ট্যাক্স দিতে ৩-৪ হাজার টাকা ব্যয় করল। কিন্তু একই বেতনের আরেকজন ২ হাজার টাকা খরচ করল। এর কারণ কী? গবেষকরা খুঁজে পেলেন এর আসল কারণ গড়িমসির অভ্যাস। যারা বেশি টাকা খরচ করেছে তারা মূলত কাজে গড়িমসি করে। এক বছরের টাকা আরেক বছর দেয়। দেরি করে। এতে করে তাদের খরচও বৃদ্ধি পায়। অথবা ট্যাক্স আইনজীবীর সাথে কথা বলা, সফটওয়্যার ব্যবহার করা, একই আয় করা অন্যদের সাথে আলাপ করা প্রভৃতি কাজ করতে করতে তাদের সময় চলে যায়।
এই গবেষণাটা ম্যানেজার বা পরিচালকদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
প্রথমত, আপনি নিশ্চয়ই পারকিনসনের নীতি সম্পর্কে পড়েছেন।
জনাব পারকিনসন ছিলেন ব্রিটিশ আমলাতন্ত্রের একজন অভিজ্ঞ ও দক্ষ কর্মচারী। তিনি বহু বছরের
চাকরির অভিজ্ঞতা থেকে এই সিদ্ধান্তে আসেন যে কর্মীদেরকে কাজের জন্য বেশি সময় দিলে বা
লম্বা ডেডলাইন দিলে কাজে অসুবিধা সৃষ্টি হয়। কর্মীরা গড়িমসি করে। এমনকি কাজে হাল ছেড়ে
দেয়।
দ্বিতীয়ত, পারকিনসন তো কাজ এবং সময়ের সাথে সম্পৃক্ত করে
কথা বলেছেন। আমরা উপরোক্ত উদাহরণ থেকে দেখলাম, কাজে দেরি হলে সময়ের সাথে সাথে অর্থেরও
অপচয় ঘটে। কর্মীরা দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়লে কোম্পানির বিরাট আর্থিক ক্ষতি হয়।
তৃতীয়ত, এতক্ষণ তো আমরা একটা কাজের ডেডলাইন সম্পর্কে জানলাম।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, যদি একাধিক কাজে ডেডলাইন থাকে, তবে কী হবে? গবেষণায় দেখা গেছে, একসাথে
অনেক ডেডলাইন থাকলে, কর্মচারীরা বেশি গুরুত্বপূর্ণ কাজ ফেলে কম গুরুত্বপূর্ণ কাজ আগে
করে। এতে বেশি গুরুত্বপূর্ণ কাজ পড়ে থাকে।
আপনি নিশ্চয়ই জরুরি/গুরুত্বপূর্ণ কাজের ভাগ করার সূত্র
সম্পর্কে জানেন। একে বলা হয় 4Ds of Effective Prioritisation তথা কার্যকরভাবে অগ্রাধিকার
নির্ণয়ে ৪-ডি ফর্মুলা।
জরুরি-গুরুত্বপূর্ণ: এমন কাজ সাথে সাথে করুন। এখনই করুন।
জরুরি-গুরুত্বপূর্ণ নয়: এমন কাজ কখন করবেন সিদ্ধান্ত নিন।
জরুরি নয়-তবে গুরুত্বপূর্ণ: এমন কাজ অন্য কারও হাতে দিন।
জরুরি নয়-গুরুত্বপূর্ণ নয়: বাদ দিন।
উদাহরণ দিলে বলা যায় আমরা প্রায় সময় অফিসে ইমেইল থেকে ফেসবুকের নোটিফিকেশন বেশি চেক করি। ডাক্তারের রুটিন চেকআপের চেয়ে শপিংমলে ঘোরাঘুরি এবং খাওয়াদাওয়া বেশি সময় দিই। এক্ষেত্রে রুটিন চেকআপ বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলেও আমরা কম গুরুত্বপূর্ণ কাজে বেশি সময় কাটাই। এতে করে বেশি গুরুত্বপূর্ণ কাজ পড়ে থাকে। এর অবশ্য তাৎক্ষণাৎ ফল ভোগ করতে হয় না। কিন্তু এর দীর্ঘমেয়াদে ফলাফল খুব খারাপ হতে পারে।
চতুর্থত, এমন অনেক কাজ আছে যা শেষ করতে আসলেই অনেক সময় দরকার। সেজন্য কীভাবে ডেডলাইন সেট করবেন? এক্ষেত্রে দরকার হতে পারে আপনার সহকর্মীদের সহযোগিতা, বাইরের কোন জায়গা থেকে তথ্য সংগ্রহ। এজন্য কাজকে ছোট ছোট অংশে ভাগ করে নিন। বড় ডেডলাইন থাকলে, ছোট ছোট করে দিন ঠিক করে কাজ করুন। এতে করে গড়িমসি অভ্যাস দূর হবে। কাজে হাল ছেড়ে দেওয়ার প্রবণতাও কমবে। ম্যানেজার যদি প্রতিদিন কর্মীরা কী কী কাজ করবে তার লক্ষ্য সেট করে দেয়, তবে কর্মীদের মধ্যে কাজের গতি বৃদ্ধি পাবে।
সবশেষে বলব, সব কাজে যে লম্বা ডেডলাইন দিলে সমস্যা হয় তা নয়। কিছু কিছু কাজে লম্বা ডেডলাইন লাগে, যেমন পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল প্রভৃতি। কিন্তু গবেষণা মতে লম্বা ডেডলাইনের সাথে গড়িমসির একটা সম্পর্ক রয়েছে। তাই ম্যানেজারদের উচিত তাদের কর্মীদের মনোযোগ ধরে রাখতে প্রতিদিনকার কাজ প্রতিদিনই চেকলিস্টের মাধ্যমে শেষ করা। আজকে এই এই কাজ হয়েছে, চেকলিস্ট তৈরি করে তাতে টিকচিহ্ন দিয়ে দেওয়া। এতে করে কর্মচারীদের মধ্যে কাজের গতি এবং দক্ষতা বৃদ্ধি পারে। আর গড়িমসির অভ্যাস এবং কাজে হাল ছেড়ে দেওয়ার প্রবণতা হ্রাস পাবে।
আত্ম-উন্নয়ন এবং ক্যারিয়ার ডেভেলপমেন্ট বিষয়ক বই দেখুন