বুধবার, ২৪ নভেম্বর, ২০২১

জনগণের খোঁয়াড়-দক্ষিণ আমেরিকার এক চমকপ্রদ গল্প

এল কোরালিটো (El Corralito) তথা জনগণের খোঁয়াড়

২০০১ সালের শেষের দিকে দক্ষিণ আমেরিকার দেশ আর্জেন্টিনা এক অর্থনৈতিক সংকটের কবলে পড়েছিল। টানা তিন বছর ধরে আয় কমছে, বেকারত্ব বাড়ছে এবং দেশটি বিশাল এক আন্তর্জাতিক ঋণ জড়ো করছিল। এই পরিস্থিতির পেছনে কারণ ছিল ১৯৮৯ সালে কার্লোস মেনেম গঠিত সরকারের নেওয়া কিছু নীতি। তারা মূলত এসব নীতি গ্রহণ করে দেশের অত্যধিক মুদ্রাস্ফীতি রোধ এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে কিছু সময়ের জন্য তারা সফলও হয়েছিল।

১৯৯১ সালে মেনেম আর্জেন্টাইন মুদ্রা পেসোকে মার্কিন ডলারের সাথে সংযুক্ত করেন। এক আইন অনুসারে এক আর্জেন্টাইন মুদ্রা পেসো ছিল এক ডলারের সমান। বিনিময় হারে কোন পরিবর্তন ছিল না। এখানেই গল্পের শেষ। সরকার যে এই আইনকে প্রতিষ্ঠা করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ তা জনগণকে বোঝানোর জন্য তারা জনগণকে ইউএস ডলারে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খুলতে প্ররোচিত করে। এরপর সব জায়গায় ডলার ব্যবহার করা যেত। রাজধানী বুয়েনস আইরেসের যেকোন দোকানে এবং শহরজুড়ে ছড়িয়ে থাকা এটিএম মেশিন থেকেও নগদ ডলার বের করা যেত। একটা সময় পর্যন্ত এই নীতি দেশের অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করতে সাহায্য করেছে। কিন্তু এতে একটা বড় ধরনের ঘাটতি ছিল। এটা আর্জেন্টিনার রপ্তানিকে অত্যন্ত ব্যয়বহুল করে তোলে এবং বিদেশী আমদানিকে অত্যন্ত সস্তা করে তোলে। এতে করে রপ্তানি থমকে দাঁড়ায় এবং আমদানি হঠাৎ প্রচণ্ড মাত্রায় বৃদ্ধি পায়। [আর একটি দেশের জন্য আপনি যখন রপ্তানি করে আয় করতে পারছেন না, কিন্তু আমদানি করে প্রচুর ব্যয় করছেন, তখন অর্থ যোগাড় করার একটাই উপায় থাকে। তা হচ্ছে ঋণ নেওয়া।] তাদের জন্য অর্থ সংগ্রহের একমাত্র উপায় ছিল ঋণ নেওয়া। এটা ছিল একটা অস্থিতিশীল পরিস্থিতি। জনগণ যত বেশি  আর্জেন্টাইন মুদ্রা পেসোর ব্যাপারে উদ্বিগ্ন হতে লাগল, পেসোর স্থিতিশীলতা ততই কমতে লাগল এবং মানুষজন বেশি বেশি করে তাদের ব্যাংক একাউন্টে ডলার জমাতে লাগল। আর যাই হোক, সরকার যদি আইনটা ছিঁড়ে ফেলে এবং পেসোর মান কমিয়ে দেয়, তবে ব্যাংকের ডলার মান তো ঠিকই থাকবে। তাই না? জনগণ পেসোর ব্যাপারে দুশ্চিন্তায় ছিল এটা সত্য, তবে তারা ডলারের ব্যাপারে অতি আশাবাদী ছিল, তাও সত্য।


২০০১ সালের ১ ডিসেম্বর আর্জেন্টিনার সরকার সমস্ত ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট জব্দ করে ফেলে। প্রাথমিকভাবে এটা ছিল নব্বই দিনের জন্য। শুধু একটা ছোট পরিমাণ নগদ অর্থ উত্তোলনের জন্য অনুমোদিত ছিল। তাও আবার সপ্তাহে একবার করে। প্রথমে এটার পরিমাণ ছিল ২৫০ পেসো। তখন পর্যন্ত ২৫০ পেসো ছিল ২৫০ ডলারের সমান। তারপর হলো ৩০০ পেসো। কিন্তু এটি শুধু পেসো থেকে উত্তোলনের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। কাউকে তাদের ডলার একাউন্ট থেকে ডলার উঠানোর অনুমোদন দেওয়া হয়নি। যদি না তারা ডলারকে পেসোতে রূপান্তর করতে রাজি হয়, তাহলে পেসোও উঠাতে পারবে না। কেউ তা করতে চায়নি। আর্জেন্টাইনরা এই পরিস্থিতিকে নাম দিয়েছে এল কোরালিটো বলে, "দ্য লিটল কোরাল": আমানতকারীদের গরুর মতো একটি খোঁয়াড়ে আটকানো হয়েছিল-কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। অবশেষে জানুয়ারি মাসে মুদ্রার অবমূল্যায়ন কার্যকর করা হয় এবং এক ডলারের জন্য এক পেসোর মান পরিবর্তন করা হয়। এতে ছিল এক ডলার সমান চার পেসো। যারা মনে করেছিল তাদের সঞ্চয় ডলারে রেখেছে, এতে সরকার কী করতে পারবে তাদের জন্য এটা একটা ভালো উদাহরণ। সরকার এখানেই থেমে যায়নি। এরপর সরকার জোরপূর্বক ব্যাংকের সব ডলার পেসোতে রূপান্তর করে ফেলে। কিন্তু পূর্বের বিনিময় হারে। এক ডলারের বিপরীতে এক পেসো। তারপর ব্যাংকের একাউন্টধারীদের দেয় চার পেসোর বিপরীতে এক ডলার। অর্থাৎ কেউ যদি ব্যাংকে ১ হাজার ডলার জমা রাখে। হঠাৎ সে একাউন্টে দেখবে মাত্র ২৫০ ডলার আছে। এভাবে সরকার জনগণের তিন-চতুর্থাংশ অর্থই আত্মসাৎ করেছে।


অর্থনীতিবিদদের জন্য, আর্জেন্টিনা একটি বিভ্রান্তিকর দেশ। নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অর্থনীতিবিদ সাইমন কুজনেটস (Simon Kuznets) এ সম্পর্কে এক বিখ্যাত মন্তব্য করেছিলেন যে বিশ্বে চার ধরনের দেশ আছে: উন্নত, অনুন্নত, জাপান এবং আর্জেন্টিনা। কুজনেটস এমনটা চিন্তা করেছিলেন কারণ তিনি বিবেচনায় নিয়েছিলেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়কার আর্জেন্টিনাকে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় আর্জেন্টিনা ছিল বিশ্বে ধনী দেশগুলোর একটি। এরপর এটা অন্যান্য ধনী দেশ, পশ্চিম ও উত্তর আমেরিকার তুলনায় ক্রমাগত পিছিয়ে পড়তে থাকে। ১৯৭০ এবং ৮০ এর দশকে তো এই পতন স্পষ্ট হয়ে দেখা দেয়। যেকেউ যখন এই পতনকে ইনক্লুসিভ এবং এক্সট্রাক্টিভ ইনস্টিটিউশনের দৃষ্টিতে দেখবে তার কাছে এই পতন স্পষ্ট হয়ে দেখা দিবে। [ইনক্লুসিভ ইনস্টিটিউশন তথা জনগণের অংশগ্রহণমূলক বা অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রতিষ্ঠান এবং এক্সট্রাক্টিভ ইনস্টিটিউশন তথা শোষণমূলক প্রতিষ্ঠান]।


এটা সত্য যে ১৯১৪ সালের আগে আর্জেন্টিনা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির প্রায় পঞ্চাশ বছরের ফলাফল লাভ করেছিল। কিন্তু এটা ছিল এক্সট্রাক্টিভ ইনস্টিটিউশন তথা শোষণমূলক প্রতিষ্ঠানের অধীনে থাকা প্রবৃদ্ধির উদাহরণ। আর্জেন্টিনা তখন অল্প কিছু অভিজাত দ্বারা শাসিত হচ্ছিল। তাদের সর্বোচ্চ বিনিয়োগ ছিল কৃষি পণ্য রপ্তানির দিকে। তখন সারা বিশ্বেই এক ধরনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ছিল। বিশ্বের সেই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মাঝে আর্জেন্টিনা গরুর মাংস, চামড়া এবং শস্য রপ্তানি করে। আর তা রপ্তানি করে বিশ্ববাজারের দামে। এতে করে অন্য সব এক্সট্রাক্টিভ ইনস্টিটিউশন তথা শোষণমূলক প্রতিষ্ঠানের মতোই প্রচুর টাকা দেশে আসে। আসলে বলা উচিত, প্রচুর টাকা দেশের অল্প কিছু অভিজাত মানুষের হাতে আসে। এক্ষেত্রে ছিল না কোন সৃজনশীল ধ্বংস (creative destruction) এবং উদ্ভাবন (innovation)। আর এটা টেকসইও ছিল না। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং সশস্ত্র আন্দোলনের মধ্যে আর্জেন্টিনার অভিজাতরা দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে আরও বিস্তৃত এবং প্রসারিত করতে পারত, কিন্তু এই পরিসরকে তারা হয়তো নিয়ন্ত্রণ করতে পারত না। তাই তারা এ ব্যাপারে কিছুই করেনি। অবশেষে ১৯৩০ সালে এলো প্রথম সামরিক অভ্যুত্থান। তখন থেকে ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত স্বৈরাচার ও গণতন্ত্রের মধ্যে দোদুল্যমান এবং বিভিন্ন এক্সট্রাক্টিভ ইনস্টিটিউশন তথা শোষণমূলক প্রতিষ্ঠানের মধ্যেও দোদুল্যমান অবস্থা বিরাজমান। দেশের অভ্যন্তরে সেনাবাহিনীর শাসনের ফলে গণ-নিপীড়ন চলছিল। কেবল ১৯৭০ এর দশকেই প্রায় ৯ হাজার লোক, হয়তো আর বেশি লোককে বেআইনীভাবে মেরে ফেলা হয়। হাজার হাজার লোককে জেলে দেওয়া হয় এবং নির্যাতন করা হয়।


বেসামরিক শাসনের সময়ে নির্বাচন হতো। তা ছিল এক ধরনের গণতন্ত্রের মতোই। কিন্তু সেই রাজনৈতিক সিস্টেম ইনক্লুসিভ ইনস্টিটিউশন তথা জনগণের অংশগ্রহণমূলক বা অন্তর্ভুক্তিমূলক সিস্টেম থেকে বহু দূরের কথা। ১৯৪০ সাল থেকে জুয়ান পেরন এর কাল শুরু হয়। তিনি যেই রাজনৈতিক দল তৈরি করেন, সেই রাজনৈতিক দলই আর্জেন্টিনার কর্তৃত্বশালী রাজনৈতিক দল হিসাবে আর্বিভূত হয়। তার রাজনৈতিক দল পার্টিডো জাস্টিশিয়ালিস্টাকে (Partido Justicialista) সাধারণত পেরনের পার্টিই (Perónist Party) বলা হত। নির্বাচনের পর পেরনিস্টরা বিপুল ভোটে জয় লাভ করে। অবশ্য এর জন্য ধন্যবাদ দিতে হয় রাজনৈতিক কূটকৌশলকে। টাকা দিয়ে ভোট কেনা, পৃষ্ঠপোষকতা বিতরণ করা মানে বিভিন্ন সরকারি খাস জমি কাকে কাকে দিবে তা নিয়ে আগেই নির্বাচন করে দিয়ে টাকা হাতিয়ে নেওয়া এবং দুর্নীতি করা। আবার সরকারি কন্ট্রাক্ট এবং চাকরি দেওয়ার নাম করেও রাজনৈতিক সমর্থন আদায় করে নেয়। দেখতে গেলে এটাকেও এক ধরনের গণতন্ত্র বলা যায়। কিন্তু একে বহুত্ববাদী (pluralistic) রাজনীতি তথা জনগণের অংশগ্রহণমূলক বা অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতি বলা যায় না। দেশের রাজনীতির পুরো শক্তি পেরনের পার্টির মধ্যেই কেন্দ্রীভূত হতে থাকে। এতে করে দলটি খুব কমই বাধার সম্মুখীন হয়েছে। যা খুশি করতে পেরেছে। কিন্তু এমন অবস্থা থাকার কারণে পরবর্তীতে সামরিক বাহিনী খুব সহজেই এটাকে ক্ষমতা থেকে নিক্ষেপ করতে পেরেছে। কোন একটি রাজনৈতিক দলের নিরুঙ্কুশ ক্ষমতা থাকলে তা কী করে সেই সম্পর্কে আরও পড়ুন হোয়াই নেশনস ফেইল  ইংরেজি বইয়ের পৃষ্ঠা ৩২৯-৩৩২। যদি দেশের সর্বোচ্চ আদালত তথা সুপ্রিম কোর্টও সরকারের কোন নীতিকে চ্যালেঞ্জ জানায়, তবে তো সুপ্রিম কোর্টেরও খবর আছে।


১৯৪০ সালে পেরন আর্জেন্টিনার শ্রমিক আন্দোলনকে তার রাজনৈতিক ভিত্তি হিসাবে গড়ে তোলেন। যখন এটা ১৯৭০ এবং ৮০ এর দশকে সামরিক দমন-নিপীড়নের মুখে পড়ে দুর্বল হয়ে পড়ে, তখন তার দল গতিপথ পরিবর্তন করে। তার দল ভোট কেনা আরম্ভ করে। অর্থনৈতিক নীতি এবং প্রতিষ্ঠানগুলো জনগণকে আয়ের ব্যবস্থা করে দেয়। এগুলো তো রাজনীতির ক্ষেত্রে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করে না। মূলত অর্থনৈতিক নীতি এবং প্রতিষ্ঠানগুলো আসেই তো রাজনৈতিক নীতি এবং প্রতিষ্ঠান থেকে। যাই হোক, ১৯৮৯ থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত আর্জেন্টিনার রাষ্ট্রপতি হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন কার্লোস সাউল মেনেম আকিল (২ জুলাই ১৯৩০ - ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১)। তিনি ছিলেন আর্জেন্টিনার একজন আইনজীবী এবং রাজনীতিবিদ। রাষ্ট্রপতি মেনেম যখন পুনরায় নির্বাচনে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে বাধা পান, তখন তিনি বিদ্যমান নীতিকে বদলাতে কেবল সংবিধান সংশোধন করে ফেললেই হয়। এমন সংখ্যাগরিষ্ঠতাও তাদের দলের ছিল। এল কোরালিটো পরিস্থিতি থেকে আমরা দেখেছি, যদিও আর্জেন্টিনায় নির্বাচন হতো এবং জনপ্রিয় নির্বাচিত রাজনৈতিক দলই ক্ষমতায় যেত, সরকার কিন্তু সম্পত্তি আইন (property rights) পুনরায় লিখতে পারত এবং নিজের দেশের জনগণকে সম্পত্তি থেকে যখন তখন দখলচ্যুত করতে পারত। আর এতে করে সরকারের কোন শাস্তিও হবে না। কারণ এজন্য সরকার শাস্তি থেকে মুক্তি পেতেও দায়মুক্তি আইন পাস করিয়ে নিতে পারে এবং করেছেও। এতে করে আর্জেন্টিনার রাষ্ট্রপতি এবং রাজনৈতিক এলিটদের ওপর সামান্যতম চেক (check ) থাকে না। আর সেখানে নিশ্চিতভাবে নেই কোন বহুত্ববাদী (pluralistic) রাজনীতি তথা জনগণের অংশগ্রহণমূলক বা অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতি।

নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অর্থনীতিবিদ সাইমন কুজনেটস (Simon Kuznets) আর্জেন্টিনার ব্যাপারে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়েছেন তা সন্দেহ নেই। অন্য যারাই বুয়েনস আইরেসে গিয়েছেন, তারাই দেখেছেন এ শহরটি পেরুর রাজধানী লিমা, গুয়াতেমালার প্রজাতন্ত্রের রাজধানী গুয়াতেমালা থেকে আলাদা। এমনকি মেক্সিকো সিটি থেকেও আলাদা। আপনি এখানে কোন আদিবাসীদের দেখবেন না এবং আপনি এখানে কোন প্রাক্তন দাসদের বংশধরদেরও দেখতে পাবেন না। বেশিরভাগ সময় আপনি দেখবেন বেল যুগের (১৮৫২ খেকে ১৮৭০ পর্যন্ত সময়কালকে Belle Epoch তথা বেল যুগ বলা হয়) গৌরবময় স্থাপত্য এবং ভবনগুলো। এই বছরগুলো ছিল মূলত এক্সট্রাক্টিভ ইনস্টিটিউশন তথা শোষণমূলক প্রতিষ্ঠানের অধীনে অগ্রগতির সময়কাল। কিন্তু বুয়েনস আইরেসে আপনি শুধু আর্জেন্টিনার একটি অংশই দেখবেন। [যেমন ঢাকা বাংলাদেশের একটি অংশ মাত্র, পুরো বাংলাদেশের চিত্র ঢাকার মতো নয়।] উদাহরণস্বরূপ, মেনেম বুয়েনস আইরেসের বাসিন্দা নন। তিনি লা রিওজা (La Rioja) প্রদেশের অ্যানিলাকোতে (Anillaco) জন্মগ্রহণ করেন। যা ছিল বুয়েনস আইরেস থেকে উত্তর-পশ্চিমে, অনেক দূরে পাহাড়ে এবং তিনি তিন দফা সময়কাল পর্যন্ত উক্ত প্রদেশের গভর্নর হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। স্প্যানিশদের দ্বারা আমেরিকা আবিষ্কারের সময় আর্জেন্টিনার এই অঞ্চলটি ছিল ইনকা সাম্রাজ্যের একটি বহির্মুখী অংশ এবং এখানে আদিবাসীদের ঘনবসতি ছিল (বিস্তারিত দেখুন হোয়াই নেশনস ফেইল  ইংরেজি বইয়ের পৃষ্ঠা ১৭, মানচিত্র ১)। স্প্যানিশরা এখানে এনকোমিয়েন্ডা (encomiendas) তৈরি করেছিল।


সামনে যাওয়ার আগে, এনকোমিয়েন্ডা সম্পর্কে একটু বলে নেওয়া ভালো। এনকোমিয়েন্ডা (encomienda) ছিল একটি স্প্যানিশ শ্রম ব্যবস্থা যা অ-খ্রিস্টান জনগণের শ্রম দিয়ে বিজয়ী খ্রিস্টান সেনাপতি বা কর্মচারীদের পুরস্কৃত করে। স্প্যানিশ রাজা যখন অ-খ্রিস্টান জনগণের ওপর বিজয় লাভ করে, তখন পরাজিত জনগণ বিজয়ী রাজার জন্য শ্রম দিবে। এভাবেই রাজা শ্রমের ফসল ঘরে তুলবে। ক্যাথলিক ধর্মে এটা একটি প্রধান সুবিধা হয়ে দাঁড়ায়। এনকোমিয়েন্ডা প্রথমে স্পেনেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। যখন তারা মুরিশ অঞ্চল (খ্রিস্টানদের কাছে রিকনকুইস্তা - Reconquista নামে পরিচিত) জয় করে। মুর এবং মুরিশ হাসানিয়া আরবি ভাষা কথা বলা একটি নির্দিষ্ট জাতিগোষ্ঠীকে বোঝাত। তারা মৌরিতানিয়া এবং আলজেরিয়া, পশ্চিম সাহারা, তিউনিসিয়া, মরক্কো, নাইজার এবং মালির কিছু অংশে বসবাস করত। পরে এটা আমেরিকা এবং স্প্যানিশ ফিলিপাইনের স্প্যানিশ উপনিবেশের সময় অনেক বড় পরিসরে প্রয়োগ করা হয়েছিল। পরাজিত জনগণ স্প্যানিশ রাজার দাস হিসাবে বিবেচিত হত। রাজা সরকারি অনুদান হিসাবে কোন একজন বিশেষ ব্যক্তিকে এনকোমিয়েন্ডা (encomienda) স্বরূপ উক্ত জায়গা এবং জনগণের শ্রম ভোগদখল করার সুযোগ দিতেন। ষোড়শ শতাব্দীর সময়, স্পেনের সাম্রাজ্য বিস্তারের সময় এই অনুদানগুলোকে আদিবাসীদের শ্রমের উপর একচেটিয়া অধিকার বলে মনে করা হত। যারা এই অনুদান পেতেন তারা এনকোমেন্ডেরো নামে পরিচিত ছিল এবং তাদের বংশধররা এই সুবিধা চিরস্থায়ীভাবে লাভ করে।


স্প্যানিশরা আর্জেন্টিনায় অত্যন্ত শোষণমূলক অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে যাতে করে উত্তর দিকে পোটোসির খনি শ্রমিকদের জন্য খাবার ও খচ্চর উৎপাদন করা যায়। প্রকৃতপক্ষে লা রিওজা বুয়েনস আইরেসের মতো ছিল না। লা রিওজা ছিল পেরু এবং বলিভিয়ার পোটোসি অঞ্চলের মতো। উনবিংশ শতাব্দীতে, লা রিওজা বিখ্যাত যুদ্ধবাজ ব্যক্তি ফাকুন্ডো কুইরোগার মতো ব্যক্তিকে গড়ে তুলেছে। যিনি এ অঞ্চলকে অন্যায় এবং নীতিহীনভাবে শাসন করেন। এক সময় তিনি বুয়েনস আইরেস দখলের জন্য সেনাবাহিনী নিয়ে অগ্রসর হন। 


আর্জেন্টিনার রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের বিকাশের গল্প হচ্ছে কীভাবে অভ্যন্তরীণ প্রদেশগুলো যেমন লা রিওজা বুয়েনস আইরেসের সাথে চুক্তিতে আবদ্ধ হয়। এ চুক্তিগুলো ছিল মূলত যুদ্ধবিগ্রহের চুক্তি। এগুলো ছিল সাময়িক যুদ্ধবিরতির চুক্তি। লা রিওজার যুদ্ধবাজরা বুয়েনস আইরেসকে টাকা আয় করার সুযোগ দিল। আর শর্ত ছিল বছর বছর তারা নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ লা রিওজার যুদ্ধবাজদের কাছে পাঠাবে। এর ফলে বুয়েনস আইরেসের অভিজাতরা প্রদেশের অভ্যন্তরে যে প্রতিষ্ঠান গড়বে এবং জনগণের জন্য সংস্কারমূলক কাজ করবে তা ছেড়ে দিল। চুক্তি অনুযায়ী, অভিজাতদের কেবল টাকা দরকার এবং পার্শ্ববর্তী যুদ্ধবাজদের সেই অর্থের কিছু অংশ দিয়ে টিকে থাকার প্রয়োজন রইল।

প্রথমে আর্জেন্টিনাকে দেখলে পেরু বা বলিভিয়ার মতোই একটা আলাদা দুনিয়া বলে মনে হয়। কিন্তু বুয়েনস আইরেসের বিস্তৃত সড়ক (the elegant boulevards of Buenos Aires) বাদ দিলে এটা পেরু বা বলিভিয়ার চেয়ে আলাদা কিছু নয়। যুদ্ধ থেকে বাঁচার জন্য অভিজাতরা আত্মরক্ষার যে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পন্থা অবলম্বন করলো তা আর্জেন্টিনার প্রতিষ্ঠানগুলোর ধমনী তৈরি করে দিয়েছে, যে পথ দিয়ে রক্ত প্রবাহিত হয়। এ থেকেই বোঝা যায় আর্জেন্টিনা কেন লাতিন আমেরিকার অন্যান্য এক্সট্রাক্টিভ তথা শোষণমূলক দেশগুলোর মতো আচরণ করে। লাতিন আমেরিকার অন্যান্য এক্সট্রাক্টিভ দেশগুলো প্রতিষ্ঠানের মতো আর্জেন্টিনায়ও এমন প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে।

লাতিন আমেরিকার দেশসমূহ: লাতিন আমেরিকায় দেশ আছে ২০টি। আর্জেন্টিনা, বলিভিয়া, ব্রাজিল, চিলি, কলম্বিয়া, পেরু সহ অন্যান্য দেশ।


কেবল নির্বাচন হলেই যে ইনক্লুসিভ রাজনৈতিক সিস্টেম তথা জনগণের অংশগ্রহণমূলক বা অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যবস্থা তৈরি হয়ে যাবে তা নয়। এটা আমরা লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশের নির্বাচন দেখেই বুঝতে পারছি। কলম্বিয়াতে আধা সামরিক বাহিনী জাতীয় নির্বাচনের এক-তৃতীয়াংশ ঠিক করতে পারে। ভেনেজুয়েলায় যেমন গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকার হুগো শ্যাভেজ তার বিরোধীদের আক্রমণ করে, সরকারি চাকরি থেকে বরখাস্ত করে, সংবাদ পছন্দ না হলে সংবাদপত্র বন্ধ করে দেয় এবং ভিন্ন রাজনৈতিক মতাবলম্বীদের সহায়-সম্পত্তি দখন করে, ঠিক তেমন আর্জেন্টিনাতেও চলছে। আজকে হুগো শ্যাভেজ যা যা করতে পারে, ১৭২০ সালে স্যার রবার্ট ওয়ালপোল ব্রিটিনে ক্ষমতায় থাকা সত্ত্বেও তা করতে পারত না। কারণ স্যার রবার্ট ওয়ালপোল আইনকানুনের কাছে অনেকভাবে বাঁধা ছিল, জবাবদিহিতা করতে হতো। কিন্তু শ্যাভেজকে তা করতে হয় না। ১৭২০ সালে ব্রিটেনের স্যার রবার্ট ওয়ালপোল ব্ল্যাক এক্ট তথা কালো আইন দ্বারা (পৃষ্ঠা ৩০২-৩০৮) জন হান্ট্রিজকে ততটা ক্ষতির মুখোমুখি দাঁড় করাতে পারেননি যতটা আজকে ভেনেজুয়েলা বা আর্জেন্টিনায় নানা ধরনের আইনকানুন দিয়ে বিরোধী পক্ষকে দমন করা হচ্ছে। জনগণ যখন এসব আইনকানুন এবং এর প্রয়োগ দেখেও বিভিন্ন নাগরিক সংগঠন করে এসব আইনকানুনকে বাধা দিতে পারে না বা বাধা দেয় না, তখন এক সময় না এক সময় ক্ষমতাসীন সরকার ঠিক একই আইনকানুন দিয়ে জনগণকে দমনপীড়ন করে। কেউই রাজনৈতিক বলয়ের বাইরে নয়। আজকে আমার সামনে আরেকজনকে নির্যাতন করছে। আগামীদিন আমাকে নির্যাতন করবে।


যদিও লাতিন আমেরিকায় গণতন্ত্রের উদয় হচ্ছে নীতিগতভাবে

অভিজাত শাসনের বিরোধী, এবং অলঙ্কৃত ও কর্মে এটি চেষ্টা করে

অন্তত একটি অংশ থেকে দূরে অধিকার এবং সুযোগ পুনর্বন্টন

অভিজাতদের মধ্যে, এর শিকড় দৃঢ়ভাবে দুটি নিষ্কাশন শাসনের উপর ভিত্তি করে

ইন্দ্রিয় প্রথমত, নিষ্কাশনমূলক শাসনব্যবস্থার অধীনে বহু শতাব্দী ধরে বিদ্যমান বৈষম্যগুলি নতুন উদীয়মান গণতন্ত্রের ভোটারদের পক্ষে ভোট দেয়

চরম নীতির সাথে রাজনীতিবিদরা। আর্জেন্টাইনরা যে ঠিক তা নয়

নির্বোধ এবং মনে করেন যে জুয়ান পেরন বা আরও সাম্প্রতিক পেরোনিস্ট রাজনীতিবিদ যেমন মেনেম বা কির্চনাররা নিঃস্বার্থ এবং খুঁজছেন

তাদের স্বার্থ, অথবা ভেনেজুয়েলানরা তাদের পরিত্রাণ দেখতে পায় চাভেজের মধ্যে। পরিবর্তে, অনেক আর্জেন্টাইন এবং ভেনিজুয়েলানরা অন্য সকলকে স্বীকৃতি দেয়

রাজনীতিবিদ ও দলগুলো এতদিন তাদের আওয়াজ দিতে ব্যর্থ হয়েছে

তাদের সবচেয়ে মৌলিক জনসেবা প্রদান করে, যেমন রাস্তা এবং

শিক্ষা, এবং স্থানীয় অভিজাতদের শোষণ থেকে তাদের রক্ষা করা। তাই

অনেক ভেনিজুয়েলা আজকে চাভেজ যে নীতি গ্রহণ করছে তাকে সমর্থন করে

এমনকি যদি এই একই ভাবে দুর্নীতি এবং অপচয় সঙ্গে আসে

1940 এবং 1970 এর দশকে অনেক আর্জেন্টাইন পেরনের নীতি সমর্থন করেছিল।

দ্বিতীয়ত, এটি আবার অন্তর্নিহিত নিষ্কাশন প্রতিষ্ঠানগুলি তৈরি করে

রাজনীতি এত আকর্ষণীয়, এবং তাই পক্ষপাতদুষ্ট, যেমন শক্তিশালীদের পক্ষে

পেরোন এবং শ্যাভেজ, একটি কার্যকর পার্টি সিস্টেম উৎপাদনের পরিবর্তে

সামাজিকভাবে পছন্দসই বিকল্প। পেরন, শ্যাভেজ এবং আরও কয়েক ডজন

লাতিন আমেরিকার শক্তিশালী ব্যক্তিরা হল অলিগার্কির লৌহ আইনের আরেকটি দিক, এবং নাম থেকেই বোঝা যায়, এই লৌহ আইনের শিকড় রয়েছে

অন্তর্নিহিত অভিজাত-নিয়ন্ত্রিত শাসনব্যবস্থা।




তথ্যসূত্র:

হোয়াই নেশনস ফেইল, ৩৮৩ পৃষ্ঠা

https://en.wikipedia.org/wiki/Encomienda

https://en.wikipedia.org/wiki/Moors

https://bn.wikipedia.org/wiki/লাতিন_আমেরিকা


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন