শুক্রবার, ২২ জানুয়ারী, ২০২১

টিমওয়ার্ক ১০১। মূল: জন সি. ম্যাক্সওয়েল। অনুবাদ: ফজলে রাব্বি। ঢাকা, সাফল্য প্রকাশনী, ২০২১।

দলবদ্ধ কাজ ১০১

 

আমার জীবনের একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য হচ্ছে মানুষের জন্য উপকারী সেবা সম্পন্ন করা, একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যের ক্ষমতাকে তুলে ধরা যাতে করে মানুষ নিজেদের জীবনকে সমৃদ্ধি ও সাফল্যের পথে পরিচালিত করতে পারে। ঠিক এই কারণেই আমি প্রতিদিন সকালবেলা ঘুম থেকে উঠি, নতুন নতুন পথ খুঁজি, কী কী করা যায় তা নিয়ে চিন্তাভাবনা করি। এরই একটি উপায় হচ্ছে সাফল্য প্রকাশনীর মাধ্যমে ২০৩০ সালের মধ্যে অনুপ্রেরণার ৬৪টি বই প্রকাশ করা।

 

―ফজলে রাব্বি (সাফল্য প্রকাশনী, ঠিক ধারণা ব্লগ)

 


         সাফল্য সম্বন্ধে সহযোগিতা


২০০৯ সালে প্রকাশিত ঞবধসড়িৎশ ১০১: ডযধঃ ঊাবৎু খবধফবৎ ঘববফং ঃড় কহড়ি / ঔড়যহ ঈ. গধীবিষষ  বইয়ের অনুসরণে বাংলা অনুবাদ




টিমওয়ার্ক ১০১

দলবদ্ধ কাজ ১০১




মূল

জন সি. ম্যাক্সওয়েল



অনুবাদ 

ফজলে রাব্বি





 








ঞবধসড়িৎশ ১০১: ডযধঃ ঊাবৎু খবধফবৎ ঘববফং ঃড় কহড়ি

নু ঔড়যহ ঈ. গধীবিষষ

গ্রন্থের বঙ্গানুবাদ।


প্রথম প্রকাশ ২০০৯


ঐধৎঢ়বৎঈড়ষষরহং খবধফবৎংযরঢ়

টহরঃবফ ঝঃধঃবং ড়ভ অসবৎরপধ.

র্

 ২০০৯ নু গধীবিষষ গড়ঃরাধঃরড়হ, ওহপ.

‘ঞযব সড়ৎধষ ৎরমযঃং ড়ভ ঃযব ধঁঃযড়ৎ যধাব নববহ ধংংবৎঃবফ’


প্রথম সাফল্য সংস্করণ বৈশাখ ১৪২৭ / এপ্রিল ২০২০


বাংলা অনুবাদর্  ফজলে রাব্বি ২০২১


সাফল্য প্রকাশনী, ৭৬, ইসলামিয়া মার্কেট, নীলক্ষেত, ঢাকা-১২০৫

মোবাইল: ০১৫৩৪৯০২৮৮২

সাপ্র: ০১১



দাম:  ১৭৫ টাকা মাত্র


নীলক্ষেত পরিবেশক: মমতাজ বুক সেন্টার, ৭৬-৭৭, ইসলামিয়া মার্কেট, ঢাকা-১২০৫। ফোনে অর্ডার করতে কল করুন ০১৬৮২০৫৮১৭১।

সাফল্য প্রকাশনীর ওয়েবসাইট - িি.িংধঢ়যড়ষষড়.পড়স

সাফল্য প্রকাশনীর যেকোনো বই কিনতে ভিজিট করুন

িি.িৎড়শড়সধৎর.পড়স/সাফল্য-প্রকাশনী


ঞবধসড়িৎশ ১০১, ঞৎধহংষধঃবফ নু ঋধুষব জধননর, চঁনষরংযবফ নু ঝধঢ়যড়ষষড় চৎড়শধংড়হর, ৩০২, খধষনধময জড়ধফ, ডধৎফ ঘড়: ২৫, খধষনধময, উযধশধ-১২১১. ঈড়হঃধপঃ ঙভভরপব: ০১৫৩৪ ৯০২ ৮৮২.

ডবনংরঃব: িি.িংধঢ়যড়ষষড়.পড়স

ঊ-সধরষ: ধফসরহ@ংধঢ়যড়ষষড়.পড়স

চৎরপব: ১৭৫ ঞধশধ ড়হষু.

ওঝইঘ: ৯৭৮-৯৮৪-৯৩৬১৫-৮-৫






উৎসর্গ


হুমায়ূন আহমেদ

মানুষের মনের কথা যিনি প্রাঞ্জল ভাষায় রূপ দিয়েছেন



 

 


এই ধরনের বই কেন পাঠ করবেন?


০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০


০০০০০০০০০০০০০০০০০০০



০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০


০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০




 

কীভাবে বই পাঠ করবেন? (জ৪প পদ্ধতি)


বাংলাদেশের পাঠকের বোঝার সুবিধার্থে আমি (ফজলে রাব্বি) অনুবাদ করার ক্ষেত্রে দেশের সংস্কৃতি বিবেচনা করেছি। আমি বিভিন্ন ভাষার বই, সংবাদ, চলচ্চিত্র, আলোচনা, অডিও, ভিডিও এবং বন্ধুদের সাথে আড্ডায় পাঠককে বোঝাতে সহায়ক যেসব উদাহরণ পেয়েছি তা প্রয়োগ করেছি। পাঠকের সাফল্য সম্বন্ধে সহযোগিতা করাই আমার একমাত্র লক্ষ্য। তাই এ কথাকে আমি সাফল্য প্রকাশনীর স্লোগান হিসাবে ব্যবহার করি। আমি পূর্বে উল্লেখ করেছি: পাঠ → বোঝা → উপলব্ধি। আমি পাঠ করি, পাঠ করার পর বোঝার চেষ্টা করি এবং পাঠকের কাছে বোধগম্য রূপে উপস্থাপনের চেষ্টা করি। আমি পাশ্চাত্যের বক্তব্য পদ্ধতি অনুসরণ করি― যে বক্তা তার দায়িত্ব হচ্ছে শ্রোতা বা পাঠককে বক্তব্য সম্পর্কে স্পষ্টভাবে বুঝিয়ে বলা। আপনি এ সম্পর্কে আরও পাঠ করতে পারেন― আউটলায়ার্স। মূল: ম্যালকম গ্ল্যাডওয়েল। অনুবাদ: এ.এম. নাইম হোসেন ও ফজলে রাব্বি। ঢাকা, সাফল্য প্রকাশনী, ২০১৮। পৃ. ১২২। এরপর উপলব্ধির জায়গায় পাঠক সেই শিক্ষা বাস্তবে প্রয়োগ করে এর কার্যকারিতা উপলব্ধি করবে।

বই পাঠ করার সবচেয়ে সহজ ও প্রচলিত উপায় সম্পর্কে বলছি। এর জন্য আমি আমার শিক্ষক অধ্যাপক মো. আলী নকী স্যারের প্রতি বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ। বই পড়ার উত্তম ও কার্যকর এই পদ্ধতির নাম জ৪প। জ’তে জরিপ, আর ৪প মানে― প্রশ্ন, পাঠ, পুনরূদ্ধার, পর্যালোচনা। জ৪প পদ্ধতিকে চিত্রের মাধ্যমে প্রকাশ করা হলো:


 

 

জরিপ


১। বইয়ের মূল বক্তব্য কী?

- বইয়ের আকার আয়তন, প্রচ্ছদ, বাঁধাই, কাগজ, ছাপা, ঘ্রাণ ইত্যাদি পরখ করে দেখুন।

- নাম, শিরোনাম ও উপশিরোনামের দিকে লক্ষ করুন।

- ছবি, তালিকা, টেবিল বা মানচিত্রের নিচের লেখা পাঠ করুন।

- সূচনার দিকে লক্ষ দিন। শেষ অনুচ্ছেদ দেখুন। প্রায়ই দেখা যায় - শেষ অনুচ্ছেদে মূল বক্তব্য বলার চেষ্টা করা হয়।

প্রশ্ন


- এই অধ্যায় কী নিয়ে?

- এই অধ্যায়ে কী কী প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে?

- এই তথ্য আমাকে কীভাবে সহায়তা করবে?


পাঠ


- বই থেকে বইকে উপলব্ধি করা।

- আপনার প্রশ্নের উত্তর খুঁজুন।


পুনরূদ্ধার


- পূর্বে জানা কোনো জ্ঞানকে বর্তমান বই থেকে লব্ধ জ্ঞানের সাথে সমন্বয় করা।

- কারও সাথে বইয়ের বিষয় নিয়ে আলাপ করুন। এতে করে আপনি যা কিছু পড়েছেন তা আরও পরিষ্কার হবে।


পর্যালোচনা


- টীকা ও বই থেকে প্রাপ্ত আপনার উপলব্ধি লিখুন।

- আপনার তথ্য ও অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে পর্যালোচনা লিখুন।






সূচি



প্রথম খ- অন্যদের মেনটরিং করতে তথা বিজ্ঞ পরামর্শ দ্বারা প্রশিক্ষণ দিতে প্রস্তুত হোন

১৩

অধ্যায় ১ আরম্ভ করার আগে কী কী জিনিস জানা দরকার? ০০

বেশির ভাগ মানুষ কেন অন্যদের (বিজ্ঞ পরামর্শ দ্বারা) প্রশিক্ষণ দেয় না তথা মেনটরিং করে না

০০

নিরাপত্তাহীনতা

অহমিকা বা ইগো ০০

অন্যের মধ্যে থাকা ‘সাফল্যের বীজ’ খুঁজে বের করতে না পারা

০০

সাফল্য সম্পর্কে ভুল ধারণা পোষণ করা ০০

প্রশিক্ষণের অভাব

আরম্ভ করার আগে আপনার কী কী জিনিস জানা দরকার

প্রত্যেকেই নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ হিসাবে দেখতে চায়

প্রত্যেকেরই উৎসাহের দরকার আছে এবং উৎসাহের প্রতি সাড়া দেয়

উৎসাহ বা প্রেরণা মানুষের প্রকৃতির মধ্যেই বিদ্যমান

একজন লোকের নেতৃত্ব মানার আগে মানুষ ঐ লোককে দেখে

০০

অধ্যায় ২ আমি কীভাবে একজন মেনটর বা বিজ্ঞ পরামর্শকের মনোভাব ও চিন্তাধারা অর্জন করব?

০০

নামসূচক নির্দেশিকা ১২৩

বিষয়সূচক নির্দেশিকা ১২৪

ব্যক্তিগত উনয়নে অন্যান্য বইয়ের তালিকা ১২৭






 








প্রথম খ-


দলবদ্ধ কাজের ক্ষমতা


 







    



একটি ছোট্ট পদক্ষেপ আপনার জীবন বদলে দিতে পারে।


- কাইযেন পদ্ধতি

  


 



 

দলবদ্ধ কাজ কেন এত গুরুত্বপূর্ণ?


বিরাট কিছু অর্জন করতে ১ খুবই ছোট একটি সংখ্যা।


আপনার ব্যক্তিগত হিরো কারা? ঠিক আছে। ধরি, আপনার এমন কোনো হিরো নেই। তাহলে এ প্রশ্নের জবাব দিন: আপনি কোন কোন লোককে বেশি প্রশংসা করেন? আপনি কার কার মতো হতে চান? কোন কোন লোক আপনাকে প্রেরণা জুগিয়েছে? আপনি কাকে প্রশংসা করেন...


ব্যবসায়িক উদ্ভাবক, যেমন জেফ বেজোস, ফ্রেড স্মিথ বা বিল গেটস? [ফ্রেড স্মিথ হচ্ছে ফেডএক্স কুরিয়ার কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা]

বড় বড় খেলোয়াড়, যেমন মাইকেল জর্ডান, ম্যারিওন জোন্স বা মার্ক ম্যাকগওয়ার?

সৃজনশীল ব্যক্তি, যেমন পাবলো পিকাসো, বাকমিনিস্টার ফুলার বা ভল্ফগাং আমাডিউস মোৎসার্ট?

পপ-কালচার আদর্শ, যেমন ম্যাডেনা, এন্ডি ওয়ারহোল বা এলভিস প্রিসলে?

আধাত্মিক নেতা, যেমন জন ওয়েসলে, বিলি গ্রাহাম বা মাদার তেরেসা?

রাজনৈতিক নেতা, যেমন চার্লিম্যাগনি, মহান আলেকজান্ডার বা উইনস্টন চার্চিল?

বিপ্লবী চিন্তাবিদ, যেমন ম্যারি কুরি, টমাস আলভা এডিসন বা আলবার্ট আইনস্টাইন?


অথবা আপনার তালিকায় এমন এমন লোক আছে যাদেরকে আমি চিনি না।

আমরা সবাই কম-বেশি কৃতিত্ব অর্জনকারীদের প্রশংসা করি। আর বিশেষ করে আমেরিকার মানুষ অগ্রদূত বা সাহসী ব্যক্তি উদ্যোক্তাদের বেশিই ভালোবাসে। যারা একা একা সংগ্রাম করেছে। তাদের সামনে হয়তো সমস্যার পাহাড় ছিল। কিন্তু তারা সেই পাহাড় কেটে রাস্তা বানিয়েছে। পাশ্চাত্য বিশে^র মানুষ অতীতকাল থেকেই এমন লোকের প্রশংসা করে। এমন একজন পুলিশ প্রধান যিনি হয়তো একাই শত্রুদের বিরুদ্ধে বন্দুকযুদ্ধে নেমে গেছেন, এমন একজন পাইলট যিনি হয়তো একাই আটলান্টিক মহাসাগর পাড়ি দিয়েছেন এবং এমন একজন বৈজ্ঞানিক যিনি একাই পুরো বিশ^কে বদলে দিয়েছেন তার মন-মস্তিষ্কের জোরে― আমরা এমন সকলকে ভালোবাসি এবং প্রশংসা করি।


একা একা জীবনযুদ্ধ আর বিজয়ের গল্পগাথার মিথ


[মিথ হচ্ছে এক ধরনের স্থানীয় সাংস্কৃতিক গল্প। বিশেষ করে, বৈজ্ঞানিক বিচার-বিশ্লেষণের আগের যুগে মানুষ যেভাবে প্রাকৃতিক ও সামাজিক পরিবেশকে বর্ণনা করত তাকে মিথ হিসাবে বোঝান হয়। যেমন আমাদের ঠাকুরমার ঝুলি।]

বিশে^ আজ পর্যন্ত আবিষ্কার হওয়া গুরুত্বপূর্ণ কিছু একা কোনো মানুষ দ্বারা অর্জিত হয়নি। আপনার কাছে যদি মনে হয়, অনেক কৃতিত্ব অর্জনকারী মানুষ আছে যারা একা একা সবকিছু অর্জন করেছে, তবে আমি বলব, তাদের জীবন আরও ভালো করে দেখুন। তাদের কাজের পিছনে খেয়াল করলে দেখবেন সেখানে দলবদ্ধ প্রচেষ্টা বিদ্যমান। সীমান্তবাসী ড্যানিয়েল বুন (আমেরিকার স্থানীয় এক জনহিতৈষী ব্যক্তি) যখন বনজঙ্গলের রাস্তা দিয়ে নতুন নতুন জায়গা ও পথ আবিষ্কার করছেন তখনও তার সঙ্গী ছিল ট্রান্সেলভেনিয়া কোম্পানির লোকেরা। বিখ্যাত আইনবিদ ও পুলিশ প্রধান শেরিফ ওয়াট ইয়ার্পের পাশে ছিল তার দুই ভাই এবং ডক হলিডে। আমেরিকার নামকরা বিমান চালক চার্লস লিন্ডবার্গের পাশে ছিল সেন্ট লুইসের নয়জন ব্যবসায়িক ব্যক্তি এবং রেয়ান এরোনটিকাল কোম্পানির সহযোগিতা। এমনকি বিশে^র সাড়া জাগানো বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন, যিনি আপেক্ষিকতার সূত্র দিয়েছেন, তিনিও যে মাঠে একা ছিলেন তা নয়। আইনস্টাইন যে অন্যদের কাছ থেকে কতকিছু নিয়েছেন তার ঋণ স্বীকার স্বরূপ একবার তিনি বলেন, ‘আমি প্রতিদিন চিন্তা করি আমার আশেপাশের লোকজনের কাছ থেকে, যারা জীবিত এবং যারা আজ আমার পাশে নেই, তাদের উভয়ের কাছ থেকে কত যে সাহায্য পেয়েছি তা অগণিত। এ থেকে আমার নীতি দাঁড়িয়েছে, আমি যেমন অনেকের কাছ থেকে সাহায্য পেয়েছি তেমন আমারও উচিত অনেককে কিছু দিয়ে যাওয়া।’ তবে এ কথাও সত্য যে আমাদের ইতিহাস থেকে আমরা এমন অনেক স্বতন্ত্র ব্যক্তিদের দেখি যারা তাদের সাহসী সিদ্ধান্তের জন্য অমর হয়ে আছেন। এমন এমন দৃঢ়চেতা নেতা ও উদ্ভাবক রয়েছে যারা একা একা অনেক বড় বড় ঝুঁকি নিয়েছে। কিন্তু তারা সকলেই কোনো না কোনোভাবে দলবদ্ধ কাজের অংশীদার ছিলেন।

অর্থনীতিবিদ লেস্টার সি. থুরো বলেন, ‘আমেরিকার ইতিহাস, সংস্কৃতি বা সমাজে দলবদ্ধ কাজের বিপরীত কিছু নেই। ইতিহাসে দলবদ্ধ কাজের গুরুত্ব সবসময়ই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দেখা গেছে― রেলপথ তৈরির ক্ষেত্রে এ দলবদ্ধতা চোখে পড়ার মতো। রেলপথের কারণেই আমরা সমগ্র দেশকে এক করতে পেরেছি। রেলপথের কারণে মানুষ এক হয়ে কাজ করেছে, দেশের উন্নতির জন্য কার্যকর ও সুফল প্রদানকারী পরিকল্পনা ও কলাকৌশল গ্রহণ করা গেছে। এমনকি দলবদ্ধ কাজের জন্য একজন আমেরিকান চাঁদে পর্যন্ত কদম রাখতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু আমেরিকার সমাজ ও সংস্কৃতিতে স্বতন্ত্র ব্যক্তির জয়জয়কার... আমেরিকায় খ্যাতির জন্য, বড় বড় কৃতিত্বসম্পন্ন কাজের জন্য বড় বড় হলরুম আছে। কিন্তু দলবদ্ধ কাজের প্রশংসার জন্য এমন কোনো মিনার বা সৌধ নেই।’

 

[দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধ সংক্রান্ত আমেরিকার স্মৃতিস্মারক। ছবিসূত্র: যঃঃঢ়ং://িি.িসরষরঃধৎু.পড়স/ফরংপড়ঁহঃং/ঃৎধাবষ-ফবংঃরহধঃরড়হং/ধিংযরহমঃড়হ-ফপ/৯-সঁংঃ-ংবব-সরষরঃধৎু-ংরঃবং-ারংরঃ-ধিংযরহমঃড়হ-ফপ.যঃসষ]

আমি অবশ্য জনাব থুরোর বক্তব্যের সবকিছুর সাথে একমত নই। কারণ আমি আমেরিকার নৌ তথা মেরিন সেনাদের স্মৃতিস্মারক দেখেছি। ওয়াশিংটন ডিসিতে এ স্মৃতিস্মারক বিদ্যমান। তবে জনাব থুরো কিছু কিছু ক্ষেত্রে ঠিক বলেছেন। একটি দেশকে গড়তে দলবদ্ধ কাজ সবসময়ই দরকার। এ প্রয়োজন পূর্বে যেমন ছিল, তেমন ভবিষ্যতেও থাকবে। আর এ কথা কেবল আমেরিকার জন্য নয়, পৃথিবীর যেকোনো দেশের জন্যও সমানভাবে সত্য।


দলবদ্ধ কাজ করার গুরুত্ব


[দল বেঁধে থাকা, দল বেঁধে কাজ করা মানুষের ধর্ম বলেই সেই ধর্ম সম্পূর্ণভাবে পালন করাতেই মানুষের কল্যাণ, তার উন্নতি। - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর]


একটি চীনা প্রবাদ দিয়ে আরম্ভ করি, ‘প্রত্যেক সক্ষম ব্যক্তির পিছনে সবসময় আরও অনেক সক্ষম ব্যক্তি কাজ করে।’ সত্য কথা বলতে প্রতিটি মহান কাজের একদম মূল কেন্দ্রবিন্দুতে দলবদ্ধ কাজ বিদ্যমান। দলবদ্ধ কাজের গুরুত্ব আছে কি নেই তা প্রশ্ন নয়। আসল প্রশ্ন হচ্ছে আমরা কি দলবদ্ধ কাজ সম্পর্কে জ্ঞান রাখি কিনা এবং নিজেদেরকে দলের আরও ভালো খেলোয়াড় হিসাবে তৈরি করতে পারি কিনা। এজন্যই আমি বলেছিলাম যে বিরাট কিছু অর্জন করতে ১ খুবই ছোট একটি সংখ্যা। আপনি একা একা মূল্যবান বা গুরুত্বপূর্ণ কিছু করতে পারেন না।

আমি আপনাকে চ্যালেঞ্জ করতে পারি যে মানব ইতিহাসের যেকোনো একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা দেখান যা কেবল একজন প্রতিভাবান ব্যক্তির দ্বারা সংগঠিত। আপনি যার নামই বলুন না কেন, একটু গভীরভাবে খোঁজ নিলে দেখতে পাবেন তার সহযোগী হিসাবে একদল মানুষ ছিল। এজন্যই রাষ্ট্রপতি লিন্ডন জনসন বলেছিলেন, ‘এমন কোনো সমস্যা নেই যা আমরা একতাবদ্ধ হলে সমাধান করতে পারি না। এর বিপরীত কথাও সত্য। এমন খুব কম সমস্যাই আছে যা আমরা একা একা সমাধান করতে পারি।’

সি জিন উইলকস একটি বই লিখেন। তার বইয়ের শিরোনাম― জেসাসের মতো নেতৃত্ব (ঔবংঁং ড়হ খবধফবৎংযরঢ়) । এ বইয়ে তিনি আধুনিক ব্যবসায়িক দুনিয়ায় দলবদ্ধ কাজের ক্ষমতা সম্পর্কে তুলে ধরেন। তিনি তার পর্যবেক্ষণ থেকে নানা উদাহরণ টেনে আনেন। এখানে তিনি বাইবেলের সময়কাল থেকে দলবদ্ধ কাজের নানা উদাহরণ দেন। উইলকস লিখেছেন:

দলবদ্ধ কাজে ক্ষেত্রে বহু লোক দরকার। এভাবে একজন ব্যক্তির চেয়ে বেশি কাজের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ পাওয়া যায় এবং বেশি বুদ্ধি, আইডিয়া, অর্থ ও শক্তি পাওয়া যায়।

দলবদ্ধ কাজ একজন নেতার সম্ভাবনাকে বৃদ্ধি করে এবং তার দুর্বলতাকে হ্রাস করে। কিন্তু একা একা কাজ করলে শক্তি ও দুর্বলতা উভয়ই প্রকাশ পেয়ে যায়।

দলবদ্ধ কাজের ফলে একটি লক্ষ্যকে কীভাবে বিভিন্ন উপায়ে পূরণ করা সম্ভব তা খুঁজে পাওয়া যায়। এভাবে প্রতিটি অবস্থার জন্য বা সমস্যার সমাধানের জন্য বিভিন্ন উপায় পাওয়া যায়। কিন্তু একজন ব্যক্তির জন্য একটি দলের মতো এত বৃহৎ ও গভীর করে চিন্তা করা সম্ভব নয়।

দলবদ্ধ কাজ করলে দল তার জয়ের জন্য কৃতিত্ব অর্জন করে এবং ক্ষতির জন্য দায় স্বীকার করে। এতে করে সমাজে ন¤্রতা ও বিশ^াসযোগ্যতা বৃদ্ধি পায়। কিন্তু স্বতন্ত্র ব্যক্তি হলে তিনি একাই কাজের কৃতিত্ব ও ক্ষতির জন্য দায় নেয়। এতে করে জয়ী হলে অহংকার অথবা ব্যর্থ হলে হতাশা বৃদ্ধি পায়।

দল থাকলে তারা লক্ষ্য অর্জনের জন্য নেতাদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করে। কিন্তু স্বতন্ত্র ব্যক্তি কারও সাথেই যুক্ত নয়। তাই সে লক্ষ্য অর্জিত হলো কি হলো না, তা নিয়ে কারও কাছে জবাবদিহি করে না এবং কাউকে না বলেই সে লক্ষ্য বদলে ফেলতে পারে।

সোজা কথা, একটি দল একজন বা স্বতন্ত্র ব্যক্তির চেয়ে বেশি কাজ করে দেখাতে সক্ষম।

আপনি যদি আপনার সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে চান বা এমন কোনো লক্ষ্যের জন্য সংগ্রাম করছেন যা অর্জন করা অসম্ভব বলে মনে হচ্ছে― যেমন আপনার বার্তা যেন আপনি চলে যাওয়ার দুই হাজার বছর পরেও মানুষের মাঝে আলো ছড়ায়― তবে আপনাকে অবশ্যই একজন টিম প্লেয়ার তথা দলবদ্ধ কাজ করতে দক্ষ এক ব্যক্তি হতে হবে। এখন যা বলব তা গতানুগতিক কথা বলে মনে হতে পারে, কিন্তু এ কথা সত্য: একজন স্বতন্ত্র ব্যক্তি হয়তো একটি খেলা আরম্ভ করতে পারে, কিন্তু চ্যাম্পিয়নশিপ জিততে হলে দরকার পুরো এক দল।

 

আমরা কেন একা লড়াই করি?


দলের সম্ভাবনা ও কৃতিত্বের বিষয়ে এত কিছু জানার পরও কেন কিছু লোক একা একা কাজ করতে চায়? আমার মনে হয় এর কিছু কারণ রয়েছে। আমি আমার দীর্ঘদিনের বিচার-বিশ্লেষণ থেকে যেসব কারণ খুঁজে পেয়েছি, তা হলো:


১। আমিত্ব

খুব অল্প লোকই স্বীকার করে যে তারা একাই সবকিছু করতে পারে না। কিন্তু মানুষ স্বীকার করুক আর নাই করুক, একার পক্ষে যে সবকিছু করা সম্ভব নয়, তা জীবনের এক চরম সত্য। সুপারম্যান বা সুপারওমেন বলে কিছু নেই। আমাদের ইনজয় গ্রুপের এক সদস্য ক্যারি ওয়ালস একবার বলেছিলেন, ‘কেবল বেশি বেশি প্লেট ঘোরাতে পারাই যথেষ্ট নয়। এতে করে আপনার মেধার বিকাশ ঘটে না; বরং প্লেট ভাঙার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়।’ তাই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন এ নয় যে আপনি একাই সব করতে পারেন কিনা; বরং গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে― আপনি কত দ্রুত এ কথা অনুভব করবেন যে আপনি একা সবকিছু করতে পারেন না?

 

[প্লেট ঘোরানোর খেলা। ছবিসূত্র: যঃঃঢ়ং://িি.িপধৎঃড়ড়হংঃড়পশ.পড়স/পধৎঃড়ড়হারব.িধংঢ়?পধঃৎবভ=ৎনড়হ১৬৫০]

নিষ্ঠাবান ও জনদরদি জনাব এন্ড্র কার্নেগি ঘোষণা করেন, ‘যখন তোমার অনুভব হবে যে তুমি একা যা কিছু করতে পারবে তারচেয়ে অনেক ভালোভাবে কাজ করতে পারবে যদি তুমি অন্যদের সাহায্য নাও, তখন তা তোমার জীবন পালটে দিবে।’ বড় কিছু করার জন্য নিজের আমিত্ব বর্জন করো এবং একটি দলের অংশ হয়ে কাজ করতে শুরু করো।


২। নিরাপত্তাহীনতা

আমি বহু বছর ধরে অনেক নেতার সাথে কাজ করেছি। আমি দেখলাম কিছু কিছু লোক দলবদ্ধ কাজকে উৎসাহ দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। কারণ তারা অন্যদের কারণে নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। ষোল শতকের ম্যাকিয়াভ্যালিও নিশ্চয় এমন কোনো পরিস্থিতির কথা চিন্তা করে লিখে গেছেন, ‘একজন নেতার বুদ্ধিমত্তার পরিচয় পেতে হলে প্রথমে তার আশেপাশের লোকজনের দিকে তাকিয়ে দেখো।’

আমার বিশ^াস নেতাদের নিরাপত্তাহীনতার সমস্যা তৈরি হয় দুর্বল বিচারবিবেচনা বা বুদ্ধির ঘাটতির কারণে নয়; বরং তারা দুর্বল লোকদের দ্বারা নিজেদের ঘিরে রাখে বলে। এজন্য আমি ঞযব ২১ ওৎৎবভঁঃধনষব খধংি ড়ভ খবধফবৎংযরঢ় তথা নেতৃত্বে অপরিহার্য ২১টি সূত্র বইয়ে লিখেছি, ‘কেবল নিরাপদ বোধ করে এমন নেতারাই অন্যদের ক্ষমতা বৃদ্ধি করে।’ একে ক্ষমতায়নের নিয়মকানুন তথা খধি ড়ভ ঊসঢ়ড়বিৎসবহঃ বলে। অপরপক্ষে, নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে যেসব নেতা তারা একটি মজবুত দল তৈরি করতে ব্যর্থ হয়। এর দুই কারণ। হয় তারা সবকিছুর ওপর নিজের নিয়ন্ত্রণ রাখতে চায়, নাহয় তারা ভয় পায় যে অন্য কোনো যোগ্য ব্যক্তি তাদের সরিয়ে দিবে। উভয় ক্ষেত্রেই যেসব নেতারা দল বেঁধে কাজ করতে ব্যর্থ হয় তারা নিজেদের সম্ভাবনাকে হ্রাস করে এবং যাদের সাথে কাজ করে তাদের সর্বোত্তম শক্তি ও চেষ্টাকে ক্ষয় করে। এক্ষেত্রে এসব নেতা রাষ্ট্রপতি উইড্রো উইলসনের পরামর্শ থেকে উপকার পেতে পারে: ‘আমাদের কাছে যতগুলো মাথা আছে ততগুলো মাথার বুদ্ধি কাজে লাগানোই যথেষ্ট নয়; বরং আরও যত মাথা ধার করা যায় সেগুলোও কাছে টানা উচিত।’


৩। সরলতা― অভিজ্ঞতা, বিজ্ঞতা ও বিচারবিবেচনার অভাব

ব্যবসায়িক পরামর্শক জন গেগানের টেবিলে একটি কার্ড আছে। সেখানে লেখা, ‘আমাকে যদি একই কাজ পুনরায় করতে হয়, তবে আমার উচিত অন্য কারও সাহায্য নেওয়া।’ এ কথা থেকে তৃতীয় এক ধরনের ব্যক্তির আভাস পাওয়া যায় যে দল বেঁধে কাজ করতে ব্যর্থ। এমন কিছু লোক আছে যারা তাদের সরলতার কারণে, অর্থাৎ অভিজ্ঞতা, বিজ্ঞতা ও বিচারবিবেচনার অভাবে বড় কিছু অর্জন করার ঝক্কি-ঝামেলা সম্পর্কে বুঝতে পারে না। এর ফলে, তারা একাই চেষ্টা করে যায়।

এদের মধ্যে কিছু মানুষ আছে যারা দল বেঁধে কাজ করতে গিয়ে ভালো করে। তারা বুঝতে পারে যে তাদের স্বপ্ন তাদের সক্ষমতার চেয়েও বড়। তারা অনুধাবন করে যে তারা একা তাদের স্বপ্ন পূরণ করতে পারবে না। তাই তারা দল বেঁধে কাজ করার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করে। তারা স্বপ্ন পূরণের জন্য দল তৈরি করে। কিন্তু অনেকেই এ সত্য উপলব্ধি করতে করতে অনেক দেরি করে ফেলে। ফলে দেখা যায়, তারা তাদের লক্ষ্য অর্জন করতে ব্যর্থ হয়। আর এ খুবই দুঃখজনক।


৪। স্বভাব

কিছু কিছু লোকের স্বভাবই হচ্ছে একা একা চিন্তা করা। তারা দলবদ্ধ কাজের কথা চিন্তা করতে পারে না। তাই তারা দল বেঁধে কাজও করতে পারে না। আবার কোনো এক দলে অংশও নিতে পারে না। এতে করে তারা চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়। তারা অন্যদেরও কখনো বড় কিছু অর্জন করতে সাহায্য করতে পারে না।

[মানুষের সাথে কথাবার্তা বলতে পছন্দ করে এবং বিশেষ করে মানুষের সাথে সুসম্পর্ক তৈরি করতে সক্ষম এমন ব্যক্তিদের বলা হয় পিপল পারসন তথা মানুষের সাথে সুসম্পর্ক তৈরি করতে সক্ষম ব্যক্তি। লেখক জন সি. ম্যাক্সওয়েল এমন এক ব্যক্তি।] আমি একজন পিপল পারসন। আমি নিজেও এ জিনিস উপলব্ধি করি। আমি যখনই কোনো চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হই, তখন আমি আমার দলের লোকজনকে ডাকি আমাকে সাহায্য করার জন্য। আমি ছোটবেলা থেকেই এমন। আমি সবসময় চিন্তা করতাম, জীবনের পথে চলতে গিয়ে যদি অন্যদেরকে সাথে নেওয়া যায় তবে একা একা কেন চলব?

আমি অবশ্য লক্ষ করেছি যে সবাই এমন করে চিন্তা করে না। আসলে স্বাভাবিকভাবে আপনার মধ্যে দল বেঁধে কাজ করার প্রবণতা আছে কি নেই তা প্রাসঙ্গিক নয়। আপনি যদি সবকিছু একা একা করেন এবং কখনো কারও সাথে দল বেঁঁধে কাজ না করেন, তবে আপনি নিজেই নিজের সম্ভাবনা কাজে লাগানোর পথে বিরাট বাধা তৈরি করছেন। ড. অ্যালেন ফ্রমমে এ সম্পর্কে এক দারুণ মন্তব্য করেন: ‘মানুষ মানুষের সাথে দল বেঁধে কাজ করে যত বড় বড় সাফল্য অর্জন করতে পারে তা কখনো তাদের বিরুদ্ধে একা একা কাজ করে পারে না।’ চমৎকার কথা! টেকসই কিছু তৈরি করতে আমাদের দরকার দলবদ্ধ কাজ। অনেকে বলতে পারেন অন্তর্মুখী ব্যক্তিদের কথা। তারা হয়তো একা একা কাজ করতে পছন্দ করে। কিন্তু আমি বলব, অন্তর্মুখী ব্যক্তিরাও একটি দলের অংশ হিসাবে কাজ করে অনেক সুযোগ-সুবিধা নিতে পারে। (এমনকি যারা অনেক বড় কিছু অর্জন করতে চায় না তারাও একটি দলের অংশ হিসাবে কাজ করে অনেক সুযোগ-সুবিধা নিতে পারে।)

আমার এক বন্ধু, চাক সুইন্ডল, দ্য ফিনিশিং টাচ (ঞযব ঋরহরংযরহম ঞড়ঁপয) এ দল বেঁধে কাজ করার গুরুত্ব সম্পর্কে লিখেছে [দ্য ফিনিশিং টাচ মানে শেষবারের মতো দেখে নেওয়া যে কাজ সম্পন্ন হতে আর কিছু বাকি আছে কিনা। থাকলে তা যোগ করে কাজ সম্পন্ন করা]:


একা কেউ কখনো পুরো এক দলের কাজ সম্পন্ন করতে পারে না... আমাদের উচিত দল বেঁধে কাজ করা। আপনার যেমন অন্যদের দরকার, তেমন অন্যদেরও আপনাকে দরকার। আমরা কেউই কোনো বিচ্ছিন্ন দ্বীপের বাসিন্দা নই। এ কাজ করার জন্য আমরা একে বলি জীবনকর্ম। আমাদেরকে অন্যদের দিকে ঝুঁকতে হয় এবং অন্যদের সাহায্য নিতে হয়। অন্যদের সাথে সম্পর্ক তৈরি করতে হয় এবং অন্যদের আবেদনে সাড়া দিতে হয়। নিতে এবং দিতে হয়। ভুল স্বীকার করতে হয় এবং ক্ষমাও করে দিতে হয়। অন্যদের দিকে হাত বাড়াতে হয়, আলিঙ্গন করতে হয় এবং নির্ভর করতে হয়... যেহেতু আমরা কেউই পুরোপুরি স্বয়ংসম্পূর্ণ, স্বাধীন, অসাধারণভাবে দক্ষ বা সবকিছুর ওপর ক্ষমতাশালী নই। তাই আমাদের উচিত এমন অভিনয় ত্যাগ করা। একা একা জীবনযাপনের অভিনয় করে যাওয়ার মতো দুঃখজনক ঘটনা আর কিছু হতে পারে না। তাই অভিনয় বাদ দিয়ে জীবনকে উপভোগ করুন। চলুন, অন্যদের সাথে যুক্ত হই।


 যে ব্যক্তি সবকিছু একা একা করতে চায় তার জন্য আসলেই এ কাজ অভিনয়ের মতো। এ খুবই দুঃখজনক ঘটনা। আপনি যদি বড় কোনো স্বপ্ন দেখে থাকেন, তবে আপনাকে অবশ্যই অন্যদের সাথে যুক্ত হতে হবে।



 



 

ভালো একটি দলের দলবদ্ধ কাজের গুরুত্ব ও প্রভাব কেমন হবে?


কিছু কিছু জিনিস আছে যা কেবল একটি দলই দলবদ্ধ কাজের মাধ্যমে অর্জন করতে পারে।


কিছুদিন আগে আমি আমেরিকার নৌবাহিনীর যুদ্ধবিমান পরিবাহক ইউএসএস এন্টারপ্রাইজ জাহাজটি দেখতে গিয়েছিলাম। জাহাজটি দেখতে পারা দারুণ এক অভিজ্ঞতা ছিল। তবে সবচেয়ে অসাধারণ ছিল নৌসেনাপতি রেমন্ড স্পাইসারের সাথে বসে রাতেরবেলা এফ/এ-১৮ হরনেট জেট বিমানের উঠানামা দেখা। সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য।

 

জেট বিমানগুলো অসাধারণভাবে জাহাজের ডেকে নামছে এবং উঠছে। মাত্র দুই সেকেন্ডের মধ্যে এগুলো নিজ নিজ কাজ সমাধা করছে। কিন্তু আমি আরও বেশি যা দেখে অবাক হই তা হলো, এসব কাজে লোক সংখ্যা এবং তাদের দলবদ্ধ কাজের গতিপ্রকৃতি। যখন আমি নৌসেনাপতি স্পাইসারকে জিজ্ঞেস করলাম এ কাজের জন্য তারা কী পদ্ধতি এবং দলবদ্ধ কাজের কলাকৌশল অনুসরণ করে তখন তিনি আমাকে সব বিস্তারিত বলার জন্য লেফটেন্টে কমান্ডার রেয়ান স্মিথকে দায়িত্ব দিলেন। তিনি আমাকে সব ব্যাখ্যা করে বললেন:


একজন এফ/এ-১৮ হরনেট জেট বিমানের পাইলট বিমানে উঠে নিয়ন্ত্রণ হাতে নেয়। সে বিমানকে ০ থেকে প্রতি ঘণ্টায় ১৬০ মাইল বেগে চলার জন্য মাত্র তিন সেকেন্ডের মধ্যে প্রস্তুত করে। বিমান যখন চালু হয়ে যায় এবং এয়ারক্রাফট বা যুদ্ধবিমান পরিবাহক জাহাজ ছেড়ে যায় তখন সে হঠাৎ করে রাতের অন্ধকারে উড়ে চলা নিঃসঙ্গ এক পাখির মতো একলা অনুভব করে। আধুনিক যুগে এমন একা একা লড়াই করার উদাহরণ খুব কমই আছে। এখন তো সবকিছু নেটওয়ার্কিং এর মাধ্যমে, অনেকের সহযোগিতা নিয়ে সম্পন্ন হয়। কিন্তু একজন পাইলট যখন বিমানে একা তার ককপিটে বসে বিমান চালায় তখন সে সম্পূর্ণ একা। তখন লক্ষ্য অর্জন করাটা পাইলটের একার মেধা, দক্ষতা ও চেষ্টার ওপরই বেশি নির্ভর করে। কিন্তু এ বিমান জাহাজে উঠানামা করতে জটিল এক দলবদ্ধ কাজের প্রয়োজন হয়। সেখানে প্রত্যেক ব্যক্তিকে তার স্বতন্ত্র কাজে সর্বোচ্চ দক্ষতায় দক্ষ হতে হয়। কারণ প্রত্যেক ব্যক্তি যখন তার নিজ নিজ নির্দিষ্ট কাজ দক্ষতার সাথে সম্পন্ন করে কেবল তখনই একটি বিমান ভালোভাবে উঠতে ও নামতে পারে। দলবদ্ধ এ কাজ যারা করে তারা সাধারণত মাত্র কলেজ থেকে পাশ করে আসা সব শিক্ষার্থী। তাদের প্রত্যেকের চেষ্টা ও সমন্বয় এমন সব অসাধারণ কাজ করে দেখায়, যা আলাদা আলাদাভাবে করা অসম্ভব। আর এ সমন্বিত কর্মই দলবদ্ধ কাজের অসাধারণ এক প্রেরণাদায়ী দৃষ্টান্ত।


তারপর কমান্ডার আমাকে আরও বিস্তারিত ব্যাখ্যা করল। জেট বিমান আকাশে ওড়ার কয়েক ঘণ্টা আগে অনেক ধরনের পরীক্ষানিরীক্ষা হয়। তখন একদল লোক, যারা মেকানিস ও টেকনেশিয়ান, তারা জেট বিমানকে পরীক্ষা করে দেখে। তখন পাইলটকে মিশনের ব্যাপারে সংক্ষেপে বুঝিয়ে বলা হয়। এতে থাকে আবহাওয়ার অবস্থা, টার্গেটের তথ্য, রেডিও সংক্রান্ত বক্তব্য এবং মানচিত্রের বিষয়। এ মানচিত্র আবার তৈরি করেছে একদল নাবিক। জেট বিমানও এমন সব পরীক্ষানিরীক্ষার ভেতর দিয়ে যায়। বিমান নিয়ে উড়ার আগে পাইলট জেট বিমানের সবকিছু ঠিক আছে কিনা তা কাগজপত্র দেখে যাচাই করে এবং নিজে জেট বিমানকে পর্যবেক্ষণ করে দেখে। তারপরই কেবল সে বিমান নিয়ে আকাশে ওড়ার জন্য প্রস্তুত হয়।

বিমান আকাশে ওড়ার ত্রিশ মিনিট পূর্বে, এক ধরনের নির্দিষ্ট পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। এক ধরনের নির্ভুল ও স্পষ্ট পদ্ধতি, যার মাধ্যমে ভুলত্রুটি আছে কিনা তা খুঁজে দেখা হয়। প্রথমে একজন কর্মকর্তা বিমানের ইঞ্জিন চালু দিয়ে দেখে তা ঠিকভাবে কাজ করছে কিনা। এর পাশাপাশি পাইলট তার নিজস্ব কিছু জিনিস পরীক্ষা করে দেখে। কর্মকর্তা ইঞ্জিনের অবস্থা দেখে এবং পাইলটের কাজকর্মও দেখে যে সব ঠিক আছে কিনা। যখন সবকিছু ঠিকঠাক বলে প্রতীয়মান হয়, কেবল তখনই বিমানে জ¦ালানি দেওয়া হয়।

এর মধ্য দিয়ে, বিমান পরিচালনার জন্য জাহাজের নির্দিষ্ট কর্মকর্তারাও নিজ নিজ নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে কাজ করে যায়। সে ডেকে যারা বিমান উড্ডয়নের সাথে জড়িত তাদের সাথে কথা বলে এবং বিমান উড়ার বিষয়গুলো পুনর্নিরীক্ষণ করে। এগুলো এক ধরনের পর্যায়ক্রমিক লিখিত কর্মধারা, যা তাদের প্রত্যেককে প্রতিবার বিমান উড্ডয়নের আগে পুনর্নিরীক্ষণ করতে হয়। এভাবে এয়ারক্রাফট হ্যান্ডেলিং কর্মকর্তা ডেকের কর্মকর্তাদের সাথে রেডিওতে যোগাযোগ করেন এবং নিশ্চিত হন সব বিষয় ঠিকভাবে পুনর্নিরীক্ষিত হয়েছে। সব যখন ঠিকঠাকভাবে হয়ে যায় তখন এফারক্রাফট হ্যান্ডেলিং কর্মকর্তা বিমান ওড়ার অনুমতি দেন।

জাহাজের ডেকে তিন ধরনের আলাদা আলাদা দল থাকে। এরা ফ্লাইট ডেক বিভাগের লোকজন। এখানে বিমানের ইঞ্জিনিয়ার, নাবিক ও অন্যান্য সদস্য থাকে। এ তিনদলের প্রতিটি দলের আলাদা আলাদা ক্ষেত্রে আলাদা আলাদা দায়িত্ব আছে। একদল নিশ্চিত করে যে ওড়ার আগে বিমান ঠিকভাবে চেইন মুক্ত হয়েছে। আরেকদল নিশ্চিত করে সামনে কোনো বিমান পার্ক করা নেই (প্রায়ই দেখা যায় মাত্র কয়েক ইঞ্চি জায়গা রেখে অন্য বিমানকে উড়ে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হলো)। আরেকদল দেখে, জাহাজ ও ডেক ঠিকভাবে আছে কিনা। অনেক সময় জাহাজকে বা ডেককে কোনো নির্দিষ্ট দিকে ঘোরাতে হয়। যখন ডেকের দল নিশ্চয়তা দেয় যে সব ঠিক আছে, তখন এয়ারক্রাফট বিমান উড্ডয়নের চার নির্দেশনার একটি মেনে চলে।

ডেকে তখনও আরও কিছু কাজ বাকি। সবশেষে ডেকের সদস্যরা সর্বশেষ এক পুনর্নিরীক্ষণ চালায়। মেনটেনেন্স চেকাররা এয়ারক্রাফটের পাশে দিয়ে হেঁটে যায় এবং প্রতিটি প্যানেল ও যন্ত্র পুনর্নিরীক্ষণ করে দেখে। এর পাশাপাশি বিমান উড্ডয়নের কর্মীরা বিমান ওড়ার জন্য যা যা পদক্ষেপ দরকার তা করতে থাকে। ডেকের নিচে অন্য দল থাকে যারা পারমাণবিক চুল্লি ঠিক আছে কিনা দেখে এবং এ থেকে প্রয়োজনীয় শক্তি যাতে ডেকে পৌঁছায় তা নিশ্চিত করে [ইউএসএস এন্টাপ্রাইজ এক ধরনের যুদ্ধবিমান পরিবাহক জাহাজ যা পারমাণবিক শক্তিতে চলে]। নিচের ডেক থেকে হাইড্রলিক ও অন্যান্য যন্ত্রপাতির মাধ্যমে এয়ারক্রাফটকে অল্প রানওয়েতে উড্ডয়নের জন্য প্রয়োজনীয় গতিশক্তি সঞ্চার করে। এ শক্তিও আসে পারমাণবিক চুল্লি থেকে। নিচের ডেকের দল এ কাজগুলো যাতে ঠিকভাবে হয় তা নিশ্চিত করে। 

এ সময় আরেকদল কর্মী বিমানকে অস্ত্রে সজ্জিত করে। ক্যাটাপুলেট কর্মকর্তা (পধঃধঢ়ঁষঃ ড়ভভরপবৎ) পাইলট সহ বিমানের ওজন চেক করে। সে ডেকের বাতাসের গতিবেগ ও আবহাওয়ার অবস্থা লিখে রাখে। সে হিসাব করে দেখে যে বিমান উড্ডয়নের জন্য যতটুকু শক্তি দরকার তা আছে কিনা।

এ সবকিছুর পরও জেট বিমান জাহাজ ছেড়ে উড়তে পারে না যদি তা ঠিক অবস্থানে (ঢ়ৎড়ঢ়বৎ ঢ়ড়ংরঃরড়হ) না থাকে। বিমান উড্ডয়নের জন্য কতটুকু গতিশক্তি দরকার এবং কোনদিকে উড়ে যাবে তা পরিমাপ করে জাহাজের নেভিগেশনাল দল। তাদের এ পরিমাপ করার তথ্য সরবরাহ করে জাহাজে থাকা আরেকদল মানুষ। এরপর এয়ারক্রাফট উড্ডয়নের জন্য প্রস্তুত।

 

[জাহাজের সামনের সারিতে যেখান দিয়ে বিমান উড্ডয়ন করে সেখানের চিত্র দেওয়া হলো। ক্যাটাপুলেট হচ্ছে বস্তু উৎক্ষেপণ যন্ত্র। উইকিপিডিয়া থেকে সংগৃহীত চিত্র দেওয়া হলো। ইউএসএস এন্টাপ্রাইজ এক ধরনের যুদ্ধবিমান পরিবাহক জাহাজে বিমান উড্ডয়নে ক্যাটাপুলেটের এ কৌশল ব্যবহার করা হয়েছে। এতে অল্প জায়গা থেকেও বিমান উড্ডয়নের প্রয়োজনীয় শক্তি সরবরাহ করা সম্ভব। এ চিত্রগুলো অতিরিক্ত। বাংলা পাঠকদের বোঝার সুবিধার্থে দেওয়া হলো।]

 

বিমানকে ক্যাটাপুলেটে এনে উড্ডয়নের জন্য প্রস্তুত করা হয়। এ সময় পাইলট বিমানের ইঞ্জিন পুরোদমে চালু দিয়ে চেক করে দেখে সব ঠিক আছে কিনা। পাইলট যদি দেখে বিমানের সবকিছু ঠিক আছে এবং আকাশে উড্ডয়ন করা যায়, তবেই সে ক্যাটাপুলেট কর্মকর্তাকে সংকেত দেয়। তখন ক্যাটাপুলেট কর্মকর্তা স্কোয়াড্রন ফাইনাল চেকার নামক কর্মকর্তার সিগন্যালের অপেক্ষায় থাকে। স্কোয়াড্রন ফাইনাল চেকার যখন ক্যাটাপুলেট কর্মকর্তাকে ঠিক আছে বলে আঙুল দিয়ে সংকেত দেয়। তারপরেই ক্যাটাপুলেট কর্মকর্তা ক্যাটাপুলেট অপারেটরকে ফায়ার বাটন চাপার জন্য বলে এবং এয়ারক্রাফট আকাশে উড়ে চলে।

অসাধারণ বিষয় হচ্ছে মাত্র এক মিনিটেরও কম সময়ের মধ্যে আরও তিনটি বিমান আকাশে ওড়ার জন্য প্রস্তুতি নেয়। এই প্রতিটি বিমান ঠিক একই পদ্ধতি অনুসরণ করে। আবার ঠিক পরবর্তী এক মিনিটের মাথায় ঐ একই ফ্লাইট ডেক বিমান অবতরণেরও প্রস্তুতি নেয়। বিমান উড়তে গেলে যেসব কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে যেতে হয়, তেমন বিমান নামতে গেলেও সেসব কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে যেতে হয়।


দলবদ্ধ কাজের গূঢ় সত্য


কিছু কিছু কাজে দলবদ্ধ কাজের প্রয়োজনীয়তা অনেক বেশি। যেমন জাহাজ থেকে যুদ্ধ বিমান উড্ডয়নের ক্ষেত্রে। এক্ষেত্রে অনেক দলের কিছু নির্দিষ্ট কাজ করতে হয় এবং এদের মধ্যে সমন্বয়ের প্রয়োজনীয়তা অনেক বেশি। তবে এসব কাজে দলবদ্ধ কাজের গুরুত্ব যে বেশি তা খুব সহজেই চোখে পড়ে। কিন্তু এমন এমন কাজও আছে যেখানে দলবদ্ধ কাজের প্রয়োজনীয়তা তত অনুভব হয় না। সেখানে হয়তো কাজকর্ম এত জটিল নয় যে দলবদ্ধ কাজের দরকার। আমি ২০০১ সালে দলবদ্ধ কাজ নিয়ে একটি বই লিখি। শিরোনাম― দ্য ১৭ ইনডিসপিউটেবল ল’স অফ টিমওয়ার্ক (ঞযব ১৭ ওহফরংঢ়ঁঃধনষব খধংি ড়ভ ঞবধসড়িৎশ তথা দলবদ্ধভাবে কাজ করার ১৭টি অকাট্য নীতি)। এ বইয়ে আমি প্রথম যে সূত্র ব্যবহার করি তা হলো: তাৎপর্য বা গুরুত্বের সূত্র (খধংি ড়ভ ঝরমহরভরপধহপব)। এ সূত্র মতে: বিরাট কিছু অর্জন করতে ১ খুবই ছোট একটি সংখ্যা। আপনি যদি মূল্যবান কিছু করতে চান, তবে দলবদ্ধ কাজ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

দলবদ্ধ কাজ যে কেবল একজন ব্যক্তি যা করতে পারে না তা করতে অন্যরা তাকে সাহায্য করে তাই নয়; এটা ব্যক্তির পুরো মেধা ও প্রতিভার ওপর দারুণ প্রভাব ফেলে। আপনি যদি বিশ^াস করেন একা একা কাজ করা একমাত্র আল্লাহর কাজ (এ কথা আমিও বিশ^াস করি), তবে আমি বলব, একদল মেধাবী লোকের একত্রে কাজ করা কাজের এক ধরনের আর্টের প্রকাশ। আপনার স্বপ্ন বা লক্ষ্য যাই হোক না কেন, দলবদ্ধ কাজ সেই স্বপ্ন বা লক্ষ্যকে পূরণ করার মতো কাজ করে দেখাতে সক্ষম।

অন্যদের সাথে দল বেঁধে একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যে কাজ করা অসাধারণ এক ব্যাপার। এ এক সুখময় অভিজ্ঞতা। আমি অনেক দলকে নেতৃত্ব দিয়েছি। অনেক ধরনের দলের সাথে ছিলাম। যেমন: খেলাধুলার দল, কর্মীদল, ব্যবসায়িক দল, যাজকদের দল, মার্কেটিং দল, গায়কদল, কমিটি বা বোর্ডের সাথে কাজ করেছি। আমি সারা বিশ^ ঘুরে বিভিন্ন দলকে পর্যবেক্ষণ করেছি। আর নেতাদের সাথেও আলাপ করেছি, কোচদের সাথে আলাপ করেছি এবং দল গঠন করতে তাদেরকে সাহায্য করেছি। দলবদ্ধ কাজ করতে বক্তৃতা দিয়েছি এবং প্রতিবেদন লিখেছি। এ থেকে আমি যা শিখলাম তা আপনার সাথে বিনিময় করছি:


১। দলবদ্ধ কাজ মানে কাজ করার যে খাটনি বা পরিশ্রম তাকে ভাগ করা এবং কার্যকারিতা বৃদ্ধি করা

আপনি কি আগের চেয়ে কম কাজ করে উত্তম ফলাফল লাভ করতে চান? আমার মনে হয়, এ ব্যাপারে সবাই একমত হবেন। ঠিক এ কাজই করে দলবদ্ধ কাজ।

একজন ব্যক্তি একা যত কাজ করতে পারে তারচেয়ে একদল মানুষ বেশি কাজ করতে পারবে তাই সাধারণ। কিন্তু তারপরেও কিছু লোক কেন দল বেঁধে কাজ করতে অনিচ্ছিুক? প্রথম প্রথম দল বেঁধে কাজ করা একটু কঠিন। কারণ দল তো আর এমনি এমনি একসাথে এসে কাজে জুড়ে যায় না। এর জন্য দরকার নেতৃত্ব ও পারস্পরিক সহযোগিতা। প্রথম প্রথম হয়তো সামনে অনেক কাজ দেখা যায়। কিন্তু এর পিছনে অনেক সুফল জড়িত এবং প্রথম দিককার পরিশ্রমের অত্যন্ত চমৎকার পুরস্কার পরের দিকে লাভ করা যায়।


২। মেধা দিয়ে একটি খেলায় জয় পেতে পারেন, কিন্তু দল বেঁধে কাজ করলে পুরো প্রতিযোগিতা তথা চ্যাম্পিয়নশিপ জয় করা যায়

মার্কিন ফুটবল দল নিউ ইংল্যান্ড প্যাট্রিওটদের লকার রুমে একটি লেখা আছে: ‘একা একা হয়তো একটি খেলায় জয় পাওয়া সম্ভব, কিন্তু দল বেঁধে খেললে পুরো প্রতিযোগিতা তথা চ্যাম্পিয়নশিপ জয় করা যায়।’ প্যাট্রিওট দলের খেলা দেখলেই বোঝা যায় তারা এ কথা কতটা অনুধাবন করেছে। চার বছরের খেলায় তারা তিনবারই জয়ী হয়েছে।

যেসব দল বারবার পুরো প্রতিযোগিতা তথা চ্যাম্পিয়নশিপ জয় করছে তারাই দলবদ্ধ কাজের উত্তম মডেল। দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে এনবিএ খেলায় বস্টন সেলটিক্স বাস্কেটবল দল চ্যাম্পিয়নশিপ জয় করে আসছে। তাদের দল এনবিএ ইতিহাসের অন্য যেকোনো দলের চেয়ে বেশি চ্যাম্পিয়নশিপ জয় করার ইতিহাস গড়েছে। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের দিকে সেলটিক্সরা টানা আটবার চ্যাম্পিয়নশিপ জয় লাভ করে। এ সময় সেলটিক্সে এমন কোনো এক খেলোয়াড় ছিল না যে একজনই স্কোর করবে, সকলেই সমানভাবে স্কোর করত। এ সময় তাদের কোচ ছিল রেড আউরবাচ। তিনি সেলটিক্সের দলকে দিকনির্দেশনা দিতেন। এরপর তিনি বাস্কেটবল দলের অন্য পদে কাজ করেন। তিনি সবসময়ই দলবদ্ধ কাজের ওপর গুরুত্বারোপ করতেন। তিনি বলতেন, ‘একজন ব্যক্তি যখন কেবল নিজের জন্য গৌরব অর্জনের চেষ্টা করে তখন সে খুব একটা বেশি কিছু অর্জন করতে পারে না; আমরা যা কিছু করেছি তার সবই ছিল আমাদের নির্দিষ্ট লক্ষ্যের প্রতি দল বেঁধে কাজ করার ফলাফল।’

খেলাধুলায় খুব সহজেই দলবদ্ধ কাজের ফলাফল দেখা যায়। কিন্তু এ কেবল খেলাধুলার জন্যই সীমাবদ্ধ নয়। দল বেঁধে কাজ করা খেলাধুলার মতো ব্যবসায়িক জগতের জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আইটিটি কোম্পানির ডাইরেক্টর, প্রেসিডেন্ট ও সিইও হিসাবে বিশ বছর কাজ করেছেন হ্যারল্ড এস. গ্রিননি। তিনি লক্ষ করেন, ‘নেতৃত্বের মূল উপাদান হচ্ছে একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যে অন্যদেরকে দল বেঁধে কাজ করতে উৎসাহিত করার ক্ষমতা।’ আপনি যদি আপনার সম্ভাবনাকে সবচেয়ে ভালোভাবে কাজে লাগাতে চান, তবে আপনার উচিত একটি দলের অংশ হিসাবে কাজ করা।


৩। দলবদ্ধ কাজ মানে কেবল আপনার একার কথা নয়

হার্ভাড বিজনেস স্কুল থেকে বলা হয়েছে একটি দল হচ্ছে ছোট্ট একদল মানুষের সমষ্টি যারা একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় দক্ষতার যোগান দেয়। তাদের দক্ষতার জায়গা ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। কিন্তু তারা একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যে এক হয় এবং একে অপরের পরিপূরক হিসাবে কাজ করে। তারা এ নির্দিষ্ট লক্ষ্য পূরণ করতে গিয়ে পারস্পরিক জবাবদিহিতার মাধ্যমে কাজ করে যায়। এজন্য বিভিন্ন ধরনের দক্ষতার মানুষকে এক ছাদের নিচে কাজ করানো একটি চ্যালেঞ্জ। এর জন্য খুব ভালো নেতৃত্ব দিতে হয়। আর দলের সদস্যরা যত বেশি মেধাবী হবে, সেই দলকে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য তত উত্তম নেতৃত্ব দরকার। এভাবে দলের সদস্যরা যত মেধাবী ও প্রতিভাবান হবে, তাদেরকে নেতৃত্ব দিতে তত উত্তম নেত্বত্বের দরকার হবে। লোকজনকে নিয়ে কেবল কাজ করলেই নেতৃত্ব দেওয়া হয় না। অথবা লোকজনকে নিয়ে কঠোর পরিশ্রম করলেও একে প্রকৃত নেতৃত্ব বলা যায় না। নেতৃত্বের আসল পরিচায়ক হচ্ছে একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যে সকলে দল বেঁধে কঠোর পরিশ্রম করা।

আমি অনেক অসাধারণ নেতা ও কোচদের নিয়ে অধ্যয়ন করেছি। তারা দলবদ্ধ কাজ করতে গিয়ে নানা অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। এ অভিজ্ঞতা তাদের বক্তব্যের মধ্যে ফুটে ওঠে। এখানে তাদের কিছু উক্তি তুলে ধরছি:

পল ‘বিয়ার’ ব্রায়ান্ট আমেরিকার একজন খ্যাতনামা ফুটবল কোচ। তিনি বলেন, ‘বিজয় পেতে হলে দলের সদস্যদের মধ্যে এক ধরনের ঐক্যের মনোভাব বিরাজ করতে হবে। প্রত্যেক খেলোয়াড়কে তার নিজের ব্যক্তিগত গৌরব অর্জনের চেয়ে পুরো দলের কথা আগে চিন্তা করতে হবে।’

বাড উইলকিন্সন, দ্য বুক অফ ফুটবল উইজডম তথা ফুটবল খেলার উত্তম কলাকৌশলের বই নামক বই প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, ‘একটি দল যদি তার সম্ভাবনায় পৌঁছাতে চায়, তবে প্রত্যেক খেলোয়াড়কে অবশ্যই তার ব্যক্তিগত লক্ষ্যকে দলের ভালোর জন্য দাবিয়ে রাখার ইচ্ছা প্রকাশ করতে হবে।’

লিউ হোল্টজ (খড়ঁ ঐড়ষঃু), আমেরিকার কলেজ ফুটবল দলের কোচ। এ দল কলেজ পর্যায়ে আমেরিকার জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপ জয় করেছে। তিনি বলেন, ‘আপনার ওপর যখন বাধ্যবাধকতা ও দায়িত্ব বর্তায় তখন নিজের স্বার্থে কাজ করার মতো স্বাধীনতা শেষ হয়ে যায়। আপনি যদি একা থাকেন, আপনি ব্যর্থ হতে পারেন। এটা আপনার ব্যাপার। কিন্তু আপনি যদি একটি দলে যুক্ত থাকেন তখন কেবল নিজের কাজই করে যেতে পারেন না, কারণ দলগতভাবে আপনার কিছু দায়িত্ব আছে।’

মাইকেল জর্ডান, বাস্কেটবল খেলার সবচেয়ে প্রতিভাবান ব্যক্তি। তিনি ছয়বার বিশ^ চ্যাম্পিয়ন হন। তিনি বলেন, ‘সব ধরনের খেলায় এমন অনেক দল আছে যাদের দলে খুব ভালো প্রতিভাবান খেলোয়াড় আছে, কিন্তু তারা কখনো কোনো পুরস্কার জিতেনি। বেশির ভাগ সময় দেখা যায়, এসব খেলোয়াড়রা দলের ভালোর জন্য নিজেদের গৌরব ও স্বার্থকে উৎসর্গ করেনি। মজার বিষয় হচ্ছে, শেষে দেখা যায় তাদের নিজেদের গৌরব ও স্বার্থ উৎসর্গ না করার কারণে তারা নিজেরাও ব্যক্তিগতভাবে লক্ষ্য অর্জন করতে পারে না বা লক্ষ্য অর্জন কঠিন হয়ে যায়। একটি কথা আমি নিশ্চিতভাবে বিশ^াস করি। আর তা হচ্ছে আপনি যদি দলগতভাবে চিন্তা করেন এবং কোনোকিছু অর্জন করেন তবে দেখা যায় ব্যক্তিগত সুনাম ও প্রশংসা উভয়ই পাওয়া যায়। মেধা দিয়ে একটি খেলায় জয় পেতে পারেন, কিন্তু দলবদ্ধ কাজ ও বুদ্ধি দিয়ে পুরো প্রতিযোগিতা তথা চ্যাম্পিয়নশিপ জয় করা যায়।’

যত ভালো ভালো দল আপনি দেখছেন, তার সবগুলোতেই তাদের খেলোয়াড়রা বাকি সবার জন্য যা ভালো তা চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নেয়। এ কথা কেবল খেলাধুলাতে নয়; ব্যবসা, সেনাবাহিনী ও স্বেচ্ছাসেবক সংঘের জন্যও সত্য। আর এ কথা যেকোনো কোম্পানির প্রতিটি পর্যায়ের জন্য সত্য। একজন পার্ট-টাইম কাজ করে এমন ব্যক্তি থেকে কোম্পানির ট্রেনার বা সিইও, প্রত্যেকের জন্য সত্য। সবচেয়ে ভালো নেতারা তাদের দলকে সবসময় আগে রাখে। সি. জিন উইলকেস বলেন, ‘দলনেতা একদম মন থেকেই বিশ^াস করেন যে তাদের কাছে সব প্রশ্নের উত্তর নেই― তাই তারা সব প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চেষ্টাও করেন না। তারা বিশ^াস করেন তাদেরকে সবকিছুর ঠিক ঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে এমন নয়― তাই তারা সবকিছুর ঠিক ঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার চেষ্টাও করেন না। তারা বিশ^াস করে একটি নির্দিষ্ট ফলাফল অর্জনের জন্য সব সদস্যের মিলিত প্রচেষ্টা খুব দরকারি জিনিস― তাই তারা এমন কোনো কাজ বা আচরণ করা থেকে বিরত থাকে যা দলের কাউকে কথা বা কাজ করতে বাধা দেয়। তাদের চিন্তার প্রধান বিষয় তাদের অহমিকা তথা ইগোকে নিয়ন্ত্রণ করা।’

প্রতিভাবান ও মেধাবী দলের সদস্যদের অহমিকা তথা ইগো থাকে অত্যন্ত শক্তিশালী। একটি সফল দলবদ্ধ কাজের অন্যতম গোপন সূত্র হচ্ছে প্রত্যেক সদস্যের অহমিকা তথা ইগোকে দলের আত্মবিশ^াসে পরিণত করা, ব্যক্তিগত স্বার্থকে উৎসর্গ করে দলে শক্তির মধ্যে সমন্বয় তৈরি করা। এনবিএ’র একজন চ্যাম্পিয়ন কোচ প্যাট রাইলে। তিনি বলেন, ‘দলবদ্ধ কাজের জন্য প্রত্যেকের চেষ্টাকে একটি নির্দিষ্ট পথে প্রবাহিত হওয়া দরকার। ব্যাপারটার গুরুত্ব বা তাৎপর্য তখনই অনুভব হয় যখন একটি দলের সমন্বিত শক্তি বাস্তবে কাজ করতে শুরু করে।’


৪। যেসব দল অসাধারণভাবে সফল তারা গোষ্ঠী তৈরি করে

যত ধরনের কার্যকর ও সফল দল আছে তারা এক ধরনের পরিবেশ তৈরি করে যেখানে মানুষের মধ্যে সম্পর্ক তৈরি হয় এবং দলের সদস্যরা একে অন্যের ব্যাপারে সহানুভূতিশীল। একে গোষ্ঠীবদ্ধ অনুভূতিও বলা হয়। এ গোষ্ঠীর পরিবেশ নির্ভর করে আস্থা ও বিশ^াসের ওপর, ভরসার ওপর। এ আস্থা ও বিশ^াস ছাড়া, ভরসা ছাড়া দলবদ্ধভাবে খুব একটা বেশি কিছু অর্জন করা যায় না।

ভালো দল গঠন করতে হলে, বিশ^াস বা আস্থা অপরিহার্য এক গুণ। এর পরিবর্তে অন্য কিছু ব্যবহার করা যায় না। ভালো দল হতে গেলে অবশ্যই দলের ভেতর একে অপরের প্রতি বিশ^াস বা আস্থা থাকতে হবে। বিজয়ী দলের সদস্যরা একে অপরকে বিশ^াস করে, একে অপরের প্রতি আস্থা রাখে, একে অন্যের ওপর ভরসা করে। প্রথম দিকে এ ব্যাপারটা একটু ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ বিশ^াস ভঙ্গ করা যায়। আর বিশ^াস ভঙ্গ করলে ক্ষতির মুখোমুখি হতে হয়। আবার একই সময়, তারা একে অপরের প্রতি মুক্তভাবে বিশ^াস করে, তারা একে অপরের সাথে এমন ব্যবহার করে যেন একে অন্যের বিশ^াস জয় করতে পারে। তারা নিজেদের ভেতর উচ্চ আদর্শ ও নীতিনৈতিকতা বজায় রেখে চলে। এভাবে একে অন্যের প্রতি যখন মুক্তভাবে বিশ^াস করে এবং সময়ের সাথে নানা পরীক্ষার মধ্য দিয়ে উত্তীর্ণ হয় তখন তাদের মধ্যে ভরসার এক বন্ধন তৈরি হয়। তখন তারা বিশ^াস করে যে তার পাশের লোকটার (গোষ্ঠীর সদস্য) আচরণ সংগতিপূর্ণ, কথা দিয়ে কথা রাখে (অঙ্গীকার রক্ষা করে), আত্মবিশ^াস বজায় রাখে এবং অন্যদের সাহায্য করে। দলের মধ্যে গোষ্ঠীগত এ অনুভূতি যত দৃঢ় হবে, তাদের এক সাথে কাজ করার সম্ভাবনা তত বৃদ্ধি পাবে।

একটি দলের মধ্যে গোষ্ঠীগত অনুভূতি তৈরি করা মানে এ নয় যে তাদের মধ্যে কখনো মতবিরোধ ঘটবে না। সব দলই কোনো না কোনো সময় মতভেদ বা বিবাদের সম্মুখীন হয়। সব ধরনের সম্পর্কের মধ্যেই উদ্বেগ বা দুশ্চিন্তা থাকে। কিন্তু আপনি সেগুলো সমাধান করতে পারেন। আমার বন্ধু বিল হাইবেলস, বিশ হাজারেরও বেশি লোকের একটি ধর্মসভা পরিচালনা করে। তিনি এ কথা মাথায় রেখেই বলেছিল:

‘মানুষের মধ্যে একতা বজায় রাখার ব্যাপারে জনপ্রিয় এক ধারণা হচ্ছে তারা এমন এক কল্পিত জায়গায় পৌঁছাবে যেখানে দলের সদস্যদের একে অপরের সাথে কোনো বিরোধ বা মতভেদ থাকবে না, একে অন্যকে জোর করে কিছু বোঝাতে চাইবে না। আমরা এখানে একতা বজায় রাখার কথা না বলে বলতে চাই গোষ্ঠী বা সমাজ তৈরির কথা। আমরা বলতে চাই, আমাদের মধ্যে কখনো মতভেদ বা বিরোধ ঘটবে না― এমন ভান আমরা করব না। আমাদের সদস্য সংখ্যা এখন ১৬ হাজার (এ কথা বলার সময়কার সদস্য সংখ্যা)। মানুষের সংখ্যা বেশি। সুতরাং পুরস্কারও হবে বেশ বড়। তাই বন্ধুগণ, আমরা যেন আমাদের বিচার-বিবেচনাগুলোকে লুকিয়ে না রাখি। আমরা যেন আমাদের বিচার-বিবেচনাগুলোকে একতার মিথ্যা ভান করার জন্য লুকিয়ে না রাখি। চলুন আমরা মতবিরোধের মুখোমুখি হই এবং একটি ভালো ব্যবহার ও উপায়ের মাধ্যমে এর সাথে ডিল (ফবধষ) করি।

একটি গোষ্ঠী বা সমাজ মানে এ নয় যে সেখানে কোনো মতবিরোধ থাকবে না। একটি গোষ্ঠী বা সমাজ মানে সেখানে পুনর্মিলিত হওয়ার এবং একমত হওয়ার চেতনা বিদ্যমান। মিটিং এ কারও সাথে হয়তো আমার কথায় মিলল না, উষ্ণ তর্ক-বিতর্ক হলো, কিন্তু আমরা যেহেতু উভয়ই গোষ্ঠী বা দলের প্রতি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ সেহেতু আমরা আমাদের মনের এক কোণে পুনর্মিলিত ও একমত হওয়ার চেতনা ধরে রাখি। আমাদের মধ্যে মতবিরোধ ঘটলে আমরা মিটিং শেষে কাজে ফিরে যেতে পারি এবং একে অপরকে পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলতে পারি, “আমি খুবই আনন্দিত যে আমরা একই দলে কাজ করি।” মতামতের ক্ষেত্রে আমাদের অবস্থান এক না হলেও আমরা কাউকে একঘরে করে দিই না।’

একটি দল যখন নিজেদের মধ্যে গোষ্ঠীগত এক ধরনের অনুভূতি শেয়ার করে, তখন দলের সদস্যরা একে অপরের সাথে মতবিরোধকে সম্পর্ক না ভেঙেই মিটিয়ে ফেলতে পারে।

 

৫। অন্যদের মধ্যে নীতিনৈতিকতা ও গুণাবলির বিকাশ ঘটানো মানে আপনার নিজের মধ্যে নীতিনৈতিকতা ও গুণাবলির বিকাশ

একবার এক মহিলা বড়াই করছিল, ‘আমাদের বৈবাহিক জীবন অত্যন্ত সুখের হবে। আমার স্বামী আমার জন্য কিছুই করবে না এবং আমিও তার জন্য কিছুই করব না। একে অন্যের জন্য কিছু না করেই আমরা জীবন কাটাব!’ যেকোনো বৈবাহিক সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার ক্ষেত্রে এমন মনোভাব দায়ী। একটি দলের ভাঙনের জন্যও এমন মনোভাবই যথেষ্ট।

বেশির ভাগ লোকজন একটি দলে যোগ দেয় ব্যক্তিগত মুনাফার জন্য। তারা এমন কিছু সাহায্যকারী লোকজন চায় যাতে করে তারা নিজে সফল হতে পারে। কিন্তু এমন মনোভাব দলের ক্ষতি করে। যখন সবচেয়ে মেধাবী লোকটির মনোভাব থাকে অন্যদেরকে সাহায্য করার, তখন বড় কোনো ফলাফল অর্জন করা সম্ভব। সাবেক এনবিএ খেলোয়াড় ম্যাজিক জনসন জন এফ. কেনেডির বক্তব্যকে নিজের মতো করে বলেন, ‘আপনার দলের সদস্যরা আপনার জন্য কী করতে পারে তা জিজ্ঞেস না করে আপনি আপনার দলের সদস্যদের জন্য কী করতে পারেন তা নিজেকে জিজ্ঞেস করুন।’ জনসন এ কথা কেবল বলার জন্যই বলেনি। তিনি তার কাজের মধ্য দিয়ে এ বিশ^াসকে ফুটিয়ে তোলেন। তিনি লস এঞ্জেলেস লেকারস দলে খেলোয়াড় হিসাবে থাকাকালীন সময়, তার দলের প্রত্যেক খেলোয়াড়কে ভালো খেলতে সাহায্য করে গেছেন।

আমেরিকার প্রেসিডেন্ট উইড্র উইলসন বলেন, ‘তুমি দুনিয়াতে কেবল কোনোরকম জীবনযাপনের জন্য আসনি। তুমি দুনিয়াতে এসেছ তোমার বড় বড় স্বপ্ন দিয়ে, মানুষের জন্য ভালো কিছু করার আশা নিয়ে এবং বড় বড় কৃতিত্বসম্পন্ন কাজ করে একে কানায় কানায় পরিপূর্ণ করে দিতে। তুমি এসেছ দুনিয়াকে সমৃদ্ধ করতে। তুমি যদি এ বার্তা ভুলে যাও তবে তুমি নিঃস্ব হয়ে পড়বে।’ যেসব লোক অন্যদেরকে কেবল নিজের সুবিধার জন্য কাজে লাগায় তারা অবধারিতভাবে ব্যবসায় এবং মানুষের সাথে সম্পর্ক তৈরির ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়। আপনি যদি সফল হতে চান, তবে আপনাকে এ কয়েকটি শব্দ আপনার মনে গেঁথে নিতে হবে: অন্যের মধ্যে নীতিনৈতিকতা ও গুণাবলির বিকাশ ঘটান। এ দর্শন আপনাকে জীবনে অনেক দূর এগিয়ে যেতে সাহায্য করবে।


 



 

আমার দল কি আমার স্বপ্ন পূরণ করতে পারবে?


সমানে এগিয়ে যাওয়ার চ্যালেঞ্জ যত বৃদ্ধি পাবে, দলবদ্ধ কাজ করার গুরুত্ব তত বাড়বে।


১৯৩৫ সাল। ২১ বছর বয়সী তেনজিং নোরগে এভারেস্ট পর্বতে তার প্রথম অভিযানে যাত্রা শুরু করে। তিনি কাজ আরম্ভ করেন মালবাহক হিসাবে। কিন্তু প্রথম অভিযানেই নিজের জাত চেনালেন। মালবাহক থেকে ধীরে ধীরে পর্বতারোহী হয়ে গেলেন। ইউরোপীয়রা যখন বড় বড় পাহাড়-পর্বতে ওঠার সিদ্ধান্ত নিল তখন তেনজিংও তাদের সাথে সাথে উঁচু উঁচু পর্বতে উঠলেন। ১৯২০ সালে ইউরোপীয়দের প্রথম দল পর্বতের চূড়ায় ওঠার চেষ্টা করে। ১৫ বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেলেও, পর্বতারোহীরা এভারেস্ট চূড়ায় ওঠার কোনো পথ খুঁজে পায়নি।

তারা সর্বোচ্চ উত্তর দিকের গিরিপথ দিয়ে হিমালয়ের ২২ হাজার ফুট উচ্চতা পর্যন্ত উঠতে পেরেছে। এ অনেকটা মালভূমির মতো। দুই পাহাড়ের মাঝে কিছু সমতল জায়গা ছিল। ততটুকু পর্যন্ত যাওয়া সম্ভব হয়েছে। কিন্তু এখনো পর্বতশৃঙ্গ জয়ের বাকি। কিন্তু পর্বতারোহীরা সেই মালভূমির একটু নিচে একটি লোমহর্ষক জিনিস আবিষ্কার করলেন। তারা একটি তাবু দেখতে পেলেন। যা বাতাসের ঝাপটায় অনেকটাই ছিঁড়ে গেছে। সেখানে একজন ব্যক্তির বরফে জমে যাওয়া কঙ্কাল ছিল। তিনি চেয়ারে কোনোরকম বসে আছেন। তার এক পায়ে বুটজুতা। অন্য পায়ের জুতা ছিঁড়া এবং সেখান থেকে তার কঙ্কালসার পায়ের আঙুল দেখা যাচ্ছে।

 

এ গ্রহের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর জায়গা


পর্বতারোহণ কোনো সহজ ব্যাপার নয়। কারণ পর্বত শৃঙ্গের জায়গাগুলো এ গ্রহের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর জায়গা। পরিবেশ খুবই প্রতিকূল। যা জীবন ধারণের উপযোগী নয়। কিন্তু তাই বলে মানুষ পর্বত জয় করার ইচ্ছাকে বিসর্জন দেয়নি। এসব ভয়ঙ্কর জায়গার মধ্যে এভারেস্ট পর্বতের চূড়া সবচেয়ে ভয়ানক। তা ২৯ হাজার ৩৫ ফুট উপরে। এ খুবই দুর্গম এক জায়গা। এ উচ্চতায় সবচেয়ে দক্ষ ও অভিজ্ঞ পর্বতারোহীরাই যেতে পারে। কারণ এখানকার পরিবেশ অত্যন্ত বিপদসংকুল। সামান্য ভুলে জীবন চলে যেতে পারে। দ্বিতীয়বার চিন্তা করারও সুযোগ পাবেন না। অনেক বিশেষজ্ঞ বিশ^াস করেন এখনো এ পর্বতে ১২০ জন ব্যর্থ পর্বতারোহীর লাশ রয়েছে।

১৯৩৫ সালে তেনজিং ও অন্যরা যে লাশ পেয়েছিল তা ছিল মৌরিস উইলসনের। তিনি একজন ইংরেজ ছিলেন। তিনি তিব্বত থেকে গোপনভাবে পর্বতে ওঠার চেষ্টা করেন। তিনি তিব্বত সরকারের অনুমোদন না নিয়েই এ চেষ্টা চালান। কারণ তিনি গোপনে এ অভিযান চালাতে চেয়েছিলেন। তিনি মাত্র তিনজন মালবাহককে নিয়ে যাত্রা করেন। মালবাহকরা যখন হিমালয়ের উত্তর দিকের গিরিপথ পর্যন্ত গেল, তখন তারা আর সামনে যেতে রাজি হলো না। তাই উইলসন একাই সামনে এগিয়ে যেতে সিদ্ধান্ত নিল। এ সিদ্ধান্তই তার জীবন কেড়ে নিল।


খরচ পরিমাপ করুন


[প্রথমে বলতে চাই, কেবল টাকাই পরিমাপ করবেন তা নয়। বুদ্ধি, সময়, শ্রম ও জীবন কতটুকু খরচ হবে তা পরিমাপ করুন। কারণ একটু আগেই পড়েছেন, মৌরিস উইলসনের সিদ্ধান্তের কারণে তার জীবনটাই খরচ হয়ে গেল।]

যারা কোনো দুর্দান্ত পর্বতের চূড়ায় উঠেছেন, একমাত্র তারাই জানেন চূড়ায় উঠতে কত কী লাগে। প্রায় বত্রিশ বছর ধরে, ১৯২০ থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত, এভারেস্টের চূড়ায় পৌঁছানোর জন্য সাতটি বড় বড় অভিযান চালান হয় এবং ব্যর্থ হয়। এ অভিযানগুলোর মধ্যে ছয়টিতেই একজন অভিজ্ঞ পর্বতারোহী ছিল। তার নাম তেনজিং নোরগে। তার সঙ্গীরা তাকে নিয়ে মজা করত যে তার নিশ্চয় তিন নম্বর ফুসফুস আছে। কারণ তেনজিং প্রতিনিয়ত ভারী মালামাল নিয়ে পর্বতে চড়তে পারতেন।


এ কোন সাধারণ ঘটনা ছিল না


১৯৫৩ সালে তেনজিং সপ্তমবারের মতো এভারেস্ট অভিযানে বের হয়। এ অভিযান পরিচালনা করেন কর্নেল জন হান্টের নেতৃত্বে একদল ব্রিটিশ অভিযাত্রী। তখন তেনজিং কেবল একজন মালবাহক হিসাবেই নয়, বরং একজন পর্বতারোহী হিসাবে পরিচিত। এদের শেরপা বলা হতো। এ এক সম্মানজনক উপাধি। এর আগের বছর তেনজিং একটি সুইস দলের সাথে ২৮ হাজার ২৫০ ফুট উচ্চতা পর্যন্ত পৌঁছেছিল। তখন পর্যন্ত এ ছিল পর্বতশৃঙ্গের সবচেয়ে কাছাকাছি জায়গা যেখানে মানুষ পা রাখে।

তেনজিং ব্রিটিশ দলের হয়েও কাজ করতেন। তিনি অভিযানের জন্য অন্য শেরপা খুঁজে দেওয়া, জিনিসপত্র গুছিয়ে দেওয়া এবং মালবাহক যোগাড় করে দেওয়ার কাজ করতেন। এ কোনো ছোটোখাটো কাজ নয়। মাত্র দুইজন মানুষকে বেস ক্যাম্প থেকে সামিট পর্যন্ত নিয়ে যেতে দশজনের এক পুরো দল দরকার, যারা অনেক উচ্চতায় পর্বতারোহণ করতে পারে। এদের মধ্যে নিউজিল্যান্ডের একজনও থাকত। তার নাম এডমন্ড হিলারি। সব মিলে, তাদের দরকার হতো প্রায় আড়াই টন বা আড়াই হাজার কেজির জিনিসপত্র ও খাবার। মাউন্টেন বেসে এ জিনিসপত্র ও খাবার পরিবহণের জন্য কোনো ট্রাক বা বিমানের ব্যবস্থা ছিল না। এগুলো কাঠমন্ডুতে পৌঁছাত। তারপর পুরুষ ও নারী মালবাহকের পিঠে করে বেস ক্যাম্পে নিতে হতো। এ বেস ক্যাম্প হিমালয়ের গিরিপথ দিয়ে ১৮০ মাইল উপরে অবস্থিত। আবার মাঝে মাঝে পাহাড়ি নদী আছে, পাথর ও খরস্রােতা নদী, সেসব নদী পার করে যেতে হতো। তেনজিংকে এ মালামাল কেবল পর্বতের কাছাকাছি পৌঁছাতেই দুইশ থেকে তিনশ মানুষকে ভাড়া করতে হতো। কাজের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ বা মালামাল বেস ক্যাম্পের উপরে পৌঁছাতে হলে একজন অভিজ্ঞ শেরপার নেতৃত্বে আরও চল্লিশজন মালবাহক নিয়ে বহন করতে হতো।


 

সফল হওয়ার জন্য একটি দল দরকার


পর্বতারোহীরা যখন পর্বতারোহণের এক একটি ধাপ পার করে তখন প্রতিটি ধাপে দলবদ্ধ কাজের প্রয়োজন পড়ে। একদল লোক পর্বতের উপরে আরেকদল লোকের কাছে কাজের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ তুলে দিতে পরিশ্রান্ত হয়ে পড়ে। দুইজনের একটি দল পর্বতের আগে আগে যায়। তারা দেখে যে পথ ঠিক আছে কিনা, কোথাও বরফ ভেঙে পড়ল কিনা বা নিরাপদে যাওয়ার মতো দড়ি আছে কিনা। তারা পরিশ্রান্ত হয়ে গেলে আরেকদল তাদের জায়গা নেয়। তারা কেবল পথ দেখে। এরপর তারা ঠিক আছে বললে আরেকদল মালামাল নিয়ে সেই পথ ধরে এগিয়ে যায়। এমন দলবদ্ধ কাজ সম্পর্কে তেনজিং বলেন,

‘এভারেস্টের মতো একটি পর্বত আপনি পায়ে দৌড়ানো প্রতিযোগিতার মতো একা একা দৌড়াতে পারবেন না অথবা অন্য প্রতিযোগী বা সঙ্গীদের সাথে প্রতিযোগিতা করেও এগিয়ে যেতে পারবেন না। এজন্য আপনার দরকার ধীরেসুস্থে ও সতর্কতার সাথে এগিয়ে যাওয়া। আর এ কাজ করতে হলে আপনাকে অবশ্যই নিঃস্বার্থে দলবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। অবশ্য আমি নিজেও এভারেস্টের চূড়ায় উঠতে চাই। এ স্বপ্ন আমি ছোটোবেলা থেকেই দেখে আসছি। কিন্তু আমার স্বপ্ন পূরণের অনেক কিছুই যখন অন্যদের ওপর নির্ভর করে তখন আমাকে তা একজন দৃঢ়চেতা পুরুষের মতো মেনে নিতে হবে, ছোট্ট শিশুর মতো নাকি-কান্না করলে হবে না।’

পর্বতারোহীরা সামিটের কাছে পৌঁছানোর জন্য চেষ্টা করে। প্রথমে টম বোর্ডিলন এবং চার্লস ইভান্স চেষ্টা করে। তারা চূড়ায় পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়। এরপর আরেকদল সুযোগ পায়। এ দলে ছিল তেনজিং নোরগে এবং এডমন্ড হিলারি। তেনজিং প্রথম দল সম্পর্কে লিখল:

‘তাদের পোশাক ছিঁড়ে গেছে। তারা অসুস্থ ও পরিশ্রান্ত। তারা নিজেদের চেষ্টায় সামিটে পৌঁছাতে পারেনি, তাই তারা প্রচ- হতাশ। কিন্তু তারপরও ... তারা আমাদেরকে সাহায্য করার জন্য যতটুকু করার দরকার তার সব করেছে। আর আমি চিন্তা করছিলাম, হ্যাঁ, পর্বতে ওঠার জন্য ঠিক এমন মানসিকতাই দরকার। ঠিক এভাবেই একটি পর্বত একজন পুরুষকে অসাধারণ করে গড়ে তোলে। অন্যদের ছাড়া হিলারি ও আমি আজ কোথায় থাকতাম? শত শত পর্বতারোহী ছাড়া, যারা পর্বতে ওঠার জন্য পথ তৈরি করেছে এবং সব শেরপা, যারা কাজের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ বয়ে নিয়ে গেছে তাদের ছাড়া আজ কোথায় থাকতাম? একমাত্র তাদের কাজ এবং ত্যাগের বিনিময়েই আজ আমরা পর্বতের চূড়ায় ওঠার সুযোগ পেয়েছি।’

তারা তাদের সুযোগের সর্বোত্তম ব্যবহার করেছে। ১৯৫৩ সালের ২৯ মে, তেনজিং নোরগে এবং এডমন্ড হিলারি তাদের পদচিহ্ন রাখে পৃথিবীর উচ্চতম স্থানে: তারা এভারেস্ট পর্বতের সামিট বা চূড়ায় মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে সক্ষম হয়।

তেনজিং ও হিলারি কি একা একা এ কাজ করতে পারত? জবাবটা হচ্ছে ‘না’। তারা কি অসাধারণ একটি দল ছাড়া এ কাজ করতে পারত? আবারও জবাবটা হচ্ছে ‘না’। কেন? কারণ চ্যালেঞ্জ যত বড় হবে, দলবদ্ধ কাজের প্রয়োজনীয়তা তত বাড়বে। এই হচ্ছে মাউন্ট এভারেস্টের নিয়ম।


আপনার এভারেস্ট কী?


আপনি হয়তো এভারেস্ট পর্বতে উঠতে চান না। হয়তো আপনি এভারেস্টের চূড়ায় পৌঁছানোর কোনো ইচ্ছাও পোষণ করেন না। কিন্তু আমি বাজি ধরতে পারি, আপনার একটি স্বপ্ন আছে। আমি এ ব্যাপারে আত্মবিশ^াসী, কারণ প্রত্যেকেরই মনের গভীরে একটি স্বপ্ন থাকে। এমনকি লোকজন তা জানেও না। কিন্তু তবুও প্রত্যেকেরই মনের গভীরে একটি স্বপ্ন থাকে। আপনার যদি মনের গভীরে একটি স্বপ্ন থেকে থাকে, তবে এ স্বপ্ন পূরণের জন্য আপনার একটি দল দরকার।

আপনি আপনার স্বপ্ন পূরণ করতে কীভাবে একটি দল তৈরি করবেন? আমার মনে হয় এ জন্য নিজেকে তিনটি প্রশ্ন করে সূচনা করতে পারেন:


১। ‘আমার স্বপ্ন কী?’

সবকিছুর শুরু হয় এ প্রশ্নের থেকে। কারণ আপনার জবাব থেকেই বোঝা যাবে কী হতে পারে। রবার্ট গ্রিনলিফ বলেন, ‘একটি স্বপ্ন ছাড়া কোনকিছুই সম্ভব নয়। বড় কিছু ঘটাতে হলে, অবশ্যই বড় কোন স্বপ্ন দেখতে হবে।’

আপনার হৃদয়ে কী আছে? আপনার জীবনের সম্ভাবনা নিয়ে আপনি কী দেখতে পান? এ দুনিয়ায় বেঁচে থাকা সময়ের মধ্যে আপনি কী অর্জন করতে চান? কেবল একটি স্বপ্নই পারে আপনাকে প্রশ্নের জবাব দিতে। সাংস্কৃতিক আন্দোলন যা হারলেম রেনেসাঁ নামে খ্যাত। এ সময়কার এক বিখ্যাত কবি ল্যাংস্টোন হিউজ লিখেছিলেন:

যত দ্রুত সম্ভব স্বপ্নকে ধরো, কারণ স্বপ্ন মরে যেতে পারে,

জীবন এক ভাঙা ডানাওয়ালা পাখির মতো যা উড়তে পারে না.

যত দ্রুত সম্ভব স্বপ্নকে ধরো, কারণ স্বপ্ন চলে যেতে পারে,

জীবন বন্ধ্যা জমির মতো যা বরফে ঢেকে যেতে পারে।

ঐড়ষফ ভধংঃ ঃড় ফৎবধসং ভড়ৎ রভ ফৎবধসং ফরব,

খরভব রং ধ নৎড়শবহ-রিহমবফ নরৎফ ঃযধঃ পধহহড়ঃ ভষু.

ঐড়ষফ ভধংঃ ঃড় ফৎবধসং ভড়ৎ যিবহ ফৎবধসং মড়,

খরভব রং ধ নধৎৎবহ ভরবষফ ভৎড়ুবহ রিঃয ংহড়.ি

আপনি যদি সত্যিই বড় কিছু, মহান কিছু করতে চান, তবে আপনাকে অবশ্যই একটি স্বপ্ন দেখতে হবে। তবে, কেবল স্বপ্ন হলেই চলবে না। একটি স্বপ্ন তখনই পূরণ করতে পারবেন যখন আপনি একটি দলের অংশ হবেন।


২। আমার দলে কে কে আছে?

এরপর দ্বিতীয় প্রশ্ন হচ্ছে আমার দলে কে কে আছে। এ প্রশ্নের মাধ্যমে আপনার বর্তমান অবস্থা বিবেচনা করা হয়। আপনার সম্ভাবনা ততটাই বিকশিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে যতটা আপনার দলের বর্তমান অবস্থা। এজন্যই আপনার যাত্রায় যে যুক্ত হবে তাকে পরীক্ষা করা দরকার। না হলে অবস্থা হবে পর্বতারোহী মাউরাইস উইলসনের মতো। তিনি পর্বতে ওঠার দলে তিনজন লোক নিলেন, যারা তার পর্বতে ওঠার স্বপ্নের ব্যাপারে ততটা উৎসাহী ছিলেন না। আর এর বিপরীতে, তেনজিং নোরগের মতো মানুষ, যে সবসময়ই বিশ^সেরা পর্বতারোহীদের সাথে এভারেস্টের চূড়ায় ওঠার চেষ্টা করতেন। আর এজন্যই তিনি চূড়ায় উঠতে পেরেছেন। একটি বড় স্বপ্ন পূরণের জন্য, সাথে যদি থাকে একটি বাজে দল, তবে তা দুঃস্বপ্নের মতো।


৩। আমার স্বপ্ন পূরণের দল কেমন হওয়া উচিত?

সত্য বলতে আপনার দল হওয়া উচিত আপনার স্বপ্নের আকার অনুযায়ী। যদি তা না হয়, তবে আপনি তা অর্জন করতে পারবেন না। আপনি একটি দশ নম্বরের স্বপ্ন কখনো চার নম্বরের দল দিয়ে জিততে পারবেন না। এ কখনো হওয়ার নয়। দশ নম্বরের স্বপ্ন দশ নম্বরের দল দিয়েই জিততে হবে। আপনি যদি মাউন্ট এভারেস্টে উঠতে চান, তবে আপনাকে মাউন্ট এভারেস্টের মতোই দল লাগবে। অন্য কোনো উপায়ে তা হওয়ার নয়। একটি দুর্বল দল নিয়ে অসাধারণ স্বপ্ন পূরণ করার চেয়ে একটি অসাধারণ দল নিয়ে একটি ছোট স্বপ্ন পূরণ করাও উত্তম।


দলের ওপর মনোযোগ দিন, স্বপের ওপর নয়


আমি দেখেছি, একটি ভুল প্রায় সবাই করে। তা হচ্ছে মানুষ দলের ওপর মনোযোগ না দিয়ে স্বপ্নের ওপর মনোযোগ দেয়। কিন্তু সত্য হচ্ছে আপনি যদি একটি যোগ্য দল গড়ে তুলতে পারেন তবে স্বপ্ন আপনাআপনি পূরণ হয়ে যাবে।

প্রতিটি স্বপ্নেরই নিজ নিজ চ্যালেঞ্জ থাকে। চ্যালেঞ্জের ধরনের ওপর নির্ভর করে আপনার কী ধরনের দল দরকার। এখানে কিছু উদাহরণ দিলাম। আপনি বিবেচনা করে দেখুন:


চ্যালেঞ্জের ধরন যে ধরনের দল দরকার

নতুন চ্যালেঞ্জ সৃজনশীল দল

বিতর্কিত চ্যালেঞ্জ ঐক্যবদ্ধ দল

পরিবর্তনশীল চ্যালেঞ্জ দ্রুত ও নমনীয় দল (পরিবর্তনশীল পরিস্থিতির সাথে দ্রুত মানিয়ে নিতে পারে এমন দল)

অপ্রীতিকর বা রসকষহীন চ্যালেঞ্জ উৎসাহী ও উদ্দীপ্ত দল

বিচিত্র চ্যালেঞ্জ পরিপূরক দল (বিচিত্র পরিস্থিতির ও চ্যালেঞ্জের সাথে চলতে পারে এমন পরিপূরক মনোভাব ও দক্ষতা সম্পন্ন দল)

দীর্ঘমেয়াদি চ্যালেঞ্জ দৃঢ়প্রতিজ্ঞ দল

এভারেস্ট আকারের চ্যালেঞ্জ অভিজ্ঞ দল

আপনি যদি আপনার স্বপ্ন পূরণ করতে চান― মানে আমি সত্যিই চাই আপনি আপনার স্বপ্ন পূরণ করুন, তবে আমি বলব স্বপ্ন নিয়ে কেবল কল্পনা করলেই হবে না― স্বপ্নকে সফল করতে আপনার দরকার একটি দলকে পরিচর্যা করা, একটি দলকে গড়ে তোলা। কিন্তু আপনি যখন এমন এক দল গড়ে তুলবেন, তখন যেন আপনার উদ্দেশ্য ঠিক থাকে। কিছু কিছু মানুষ একটি দল গড়ে তোলে কেবল নিজের মুনাফার জন্য। অন্যরা দল গড়ে তোলে কারণ তারা দলবদ্ধ আলাপ-আলোচনা ও সঙ্গ ভালোবাসে এবং তারা সমাজের জন্য একটি ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে চায়। আরও কিছু লোক আছে তারা একটি সংগঠন গড়তে চায়। দারুণ জিনিস হচ্ছে আপনি যদি এ ব্যাপারগুলোতে আগ্রহী হন, তারপর একটি দল গঠন করতে যান, তবে আপনি এমন মানুষকে পাবেন যারা প্রত্যেকেই দলের জন্য মূল্যবান কিছু করতে চায়। কিন্তু আপনি যদি এ ব্যাপারগুলোর যেকোন একটি কারণে আগ্রহী হয়ে কাজ করেন, তবে আপনার উচিত আপনার উদ্দেশ্যকে আবারও ভালো করে খুঁটিয়ে দেখা।


কীভাবে একটি দল গঠন ও পরিচর্যা করবেন?


আপনি যখন দেখেন আপনি এমন এক দল পেয়েছেন যারা আপনার স্বপ্ন পূরণের জন্য পর্যাপ্ত নয়, তখন আপনার সামনে দুইটি পথ খোলা থাকে: স্বপ্ন ত্যাগ করবেন অথবা দলকে পরিচর্যা করে উন্নত করবেন। আপনি যদি দ্বিতীয় পথ বেছে নেন, তবে আমার কিছু পরামর্শ রইল:


১। দলের সদস্যদের উন্নত করুন

আপনার প্রথম কাজ হচ্ছে দলের প্রত্যেক সদস্যকে বেড়ে ওঠার এবং অগ্রগতি করার ক্ষেত্রে সাহায্য করা। আপনি যদি উক্ত দলকে নেতৃত্ব দেন, তবে একজন নেতা হিসাবে আপনার অন্যতম দায়িত্ব হচ্ছে মানুষের মধ্যে সেই সম্ভাবনা দেখা এবং তাকে দেখানো, যা সে নিজে নিজের মধ্যে দেখে না। আপনি যখন এ কাজ করবেন, তখন আপনি একজন নেতা হিসাবে নিজের সর্বোত্তম দায়িত্ব পালন করলেন।

 

আপনার দলের সদস্যদের কথা চিন্তা করুন। তাদেরকে এ চাহিদাগুলোর ভিত্তিতে বিবেচনা করুন:


ক্স আগ্রহী ব্যক্তি― পথনির্দেশ দরকার

ক্স নির্মোহ শিক্ষার্থী― কোচিং দরকার

ক্স সতর্ক কাজ সম্পন্নকারী― সাহায্য দরকার

ক্স আত্মনির্ভরশীলতা অর্জনকারী― দায়িত্ব দরকার


[নির্মোহ- মোহ দূরীভূত হয়েছে এমন, মোহশূন্য (নির্মোহচিত্ত)। যেমন: একমাত্র শিশুরাই পারে নির্মোহ হয়ে সত্যকে গ্রহণ করতে। তথ্যসূত্র: আপনারে আমি খুঁজিয়া বেড়াই। লেখক: হুমায়ূন আহমেদ। ঢাকা, কাকলী প্রকাশনী, ২০১৫। পৃ. ২৩০।]

আপনার দলে যারা আছে তাদেরকে সবসময় বিকশিত হওয়ার এবং উন্নতি করার সুযোগ দিবেন। ঠিক এ কাজই করেছিলেন ব্রিটিশ অনুসন্ধানকারী এরিক শিপটন। তিনি ১৯৩৫ সালে তরুণ ও অনভিজ্ঞ তেনজিং এর মনে স্বপ্নের বীজ বুনে দেন। এর ফলে তেনজিং এর দেশ আঠারো বছর পর বিশে^র সর্বোচ্চ চূড়ায় ওঠার বিরল সম্মান পায়।


২। প্রভাব বিস্তার করতে পারে এমন ব্যক্তিদের যোগ করুন

আপনি যদি আপনার দলের সদস্যদের শেখার, বেড়ে ওঠার ও উন্নতি করার সুযোগ দেন, তবুও আপনি হয়তো মেধাবী লোকের অভাব বোধ করতে পারেন। তখন আপনার কাজ হচ্ছে মেধাবী লোক নিয়োগ দেওয়া। মাঝে মাঝে একটি দলের একজন মেধাবী ও প্রভাবশালী লোক দরকার হয়। এমন এক ক্ষেত্রে উক্ত ব্যক্তির মেধা আছে যা দলের ফলাফলকে ব্যর্থতা থেকে সাফল্যে পরিণত করতে পারে।


৩। নেতৃত্বের পরিবর্তন করুন

বিভিন্ন ধরনের দলের জন্য দরকার হয় বিভিন্ন ধরনের নেতৃত্ব। যদি একটি দলের মধ্যে পর্যাপ্ত মেধাবী সদস্য থাকে কিন্তু তারপরও উন্নতি না করে, তবে সবচেয়ে ভালো হয় দলের মধ্য থেকে একজনকে নেতৃত্বে দেওয়া। পূর্বে যে ব্যক্তি অনুসারী হিসাবে উত্তম ছিল এমন সদস্যকে নেতৃত্বের সুযোগ করে দেওয়া। এ পরিবর্তন হতে পারে খুব অল্প সময়ের জন্য অথবা অনেক সময়ের জন্য।

এখানে মূল চ্যালেঞ্জে হচ্ছে যাকে নেতৃত্ব দেওয়া হচ্ছে সে দলের চ্যালেঞ্জকে কীভাবে মোকাবিলা করবে। তাই এমন যোগ্য ব্যক্তিকে খুঁজে বের করা কঠিন। কেন? কারণ প্রত্যেক ব্যক্তিরই সক্ষমতা ও দুর্বলতা আছে, যা মাঠে কাজ করতে গিয়ে কাজে লাগে। এভারেস্টে উঠতে গিয়ে ঠিক এমন সমস্যায় পড়তে হয়। কর্নেল হান্ট পর্বতারোহীদের নির্বাচন করেছেন, ভবিষ্যৎ জয়ের স্বপ্ন নিজে দেখেছেন এবং অন্যদের দেখিয়েছেন, স্বার্থহীনভাবে কাজ করেছেন এবং কে কোন কাজে অংশ নিবে তা দেখিয়েছেন। তেনজিং নির্বাচন করল মালবাহকের কাজ, সকলকে নেতৃত্ব দেওয়া, জিনিসপত্র ও কাজকর্ম গুছিয়ে রাখা এবং পর্বতে পর্বতারোহীদের তাবু টাঙানো সহ নানাবিধ কাজে উৎসাহ দেওয়া। আর পর্বতারোহীদের কাজ ছিল নেতৃত্ব মেনে চলা, পর্বতের কঠিন রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে দড়ি বাঁধা এবং সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য রাস্তা তৈরি করা যাতে হিলারি ও তেনজিং পর্বতের চূড়ায় উঠতে পারে। যখন এমন বিশেষ চ্যালেঞ্জ এসে সামনে দাঁড়ায়, তখন একজন নেতার দরকার হয়। আর প্রত্যেকেই একসাথে মিলেমিশে যার যার অংশের দায়িত্ব পালন করে।

আপনার দল যদি অনেক বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয় এবং কোনো উন্নতি হচ্ছে না বলে মনে হয় (পর্বতের চূড়ায় উঠতে পারছে না বলে মনে হয়) তখন নেতৃত্বের পরিবর্তন দরকার। দলের মধ্যে নিশ্চয় এমন কেউ আছে যে উক্ত সময়ে আরও ভালো নেতৃত্ব দিতে সক্ষম।


৪। নিষ্ক্রিয় বা অকার্যকর সদস্যদের সরিয়ে দিন

মাঝে মাঝে একজন সদস্যের জন্য একটি বিজয়ী দলও ডুবতে পারে। হয়তো দক্ষতার অভাবে বা একটি মন্দ মনোভাবের কারণে অথবা উভয়ের কারণে। তখন আপনাকে দলের চিন্তা আগে করতে হবে। দলের আরও ভালোর জন্য নিষ্ক্রিয় বা অকার্যকর সদস্যদের সরিয়ে দিন।

তেনজিং ঠিক এমন এক অবস্থার সম্মুখীন হয় ১৯৫৩ সালের এভারেস্ট পর্বতারোহণের সময়। তখন ব্রিটিশ দল ও মালবাহকদের মধ্যে তীব্র বাদানুবাদ চলছে। তেনজিং উভয়ের মধ্যে এক ধরনের সমঝোতা আনার চেষ্টা করছে। দুই দলের সাথেই কথাবার্তা বলে একটি সমতা আনার চেষ্টা করছে। তেনজিং আবিষ্কার করল যে সমস্যার মূল হচ্ছে দুইজন শেরপা যারা মতবিরোধ চালিয়ে যাচ্ছিল। সে দ্রুত উক্ত দুইজনকে বরখাস্ত করল এবং তাদেরকে বাড়ি পাঠিয়ে দিল। এরপর দ্রুত শান্তি নেমে এল। যদি আপনার দলে এমন ভাঙন ধরে বা আকাক্সিক্ষত ফলাফল অর্জন করতে না পারে, তবে আপনার উচিত দলের মধ্যে পরিবর্তন আনা।

একটি দল নিয়ে উন্নতি করা খুবই চাপযুক্ত কাজ। আর এতে সময়ও লাগে। কিন্তু আপনি যদি আপনার স্বপ্ন পূরণ করতে চান, তবে আপনার অন্য কোনো সুযোগ নেই। স্বপ্ন যত বড় ও অসাধারণ হবে, দল হতে হবে তত অসাধারণ। চ্যালেঞ্জ যত বড় হবে, দলবদ্ধ কাজের গুরুত্বও তত বাড়বে। এই হচ্ছে মাউন্ট এভারেস্টের নিয়ম।


 



 

আমি কীভাবে এমন এক দল গঠন করব যা টেকসই হবে?


এমন এক পরিবেশ তৈরি করুন যাতে নতুন নতুন নেতার জন্ম হয়।


আপনি যদি আপনার কোম্পানির নেতা হন, তবে আমি আপনার সাথে কিছু সময় ব্যয় করতে চাই। এ অধ্যায় আপনার জন্য। অনেক কোম্পানিতে অনেক স্তরেই বিভিন্ন নেতা কাজ করে। কোম্পানির মধ্য পর্যায়ে যারা কাজ করে এমন অনেক নেতাই কোম্পানিতে কাজ করতে করতে মহাবিরক্ত হয়ে পড়ে। তাদের প্রচ- আগ্রহ ছিল তারা নেতৃত্ব দিয়ে কোম্পানিকে আরও এগিয়ে নিবে এবং সাফল্য অর্জন করবে। কিন্তু কোম্পানির ঊর্ধ্বতন মানুষের জন্য তারা তা করতে পারে না। প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ কর্মচারীরা ঠিক এ জন্যই চাকরি ছেড়ে দেয়। কারণ তারা অদক্ষ বা বাধাদানকারী নেতার অধীনে কাজ করতে পারে না। লোকজন তাদের কোম্পানিকে ছাড়ে না― ছাড়ে মূলত কোম্পানির নেতৃত্ব দেওয়া মন্দ নেতাদের।

একজন নেতা হিসাবে আপনার এমন সব ক্ষমতা আছে যা আপনি প্রয়োগ করে একটি ইতিবাচক নেতৃত্ব দিতে পারেন, যেখানে সম্ভাব্য নেতাদের নেতৃত্বের সম্ভাবনা বিকশিত হওয়ার সুযোগ পায়। আপনি যদি এমন এক ধরনের পরিবেশ তৈরি করতে পারেন, তাহলে সম্ভাব্য নেতারা শিখবে, অভিজ্ঞতা অর্জন করবে এবং নিজে থেকেই তারা কাজ করবে। তারা নিজেরাই উদ্যমী হবে। ফলে এদের দ্বারা সংগঠিত একটি দল এমন এক দলে পরিণত হবে যা কোম্পানিকে বিরাট ও মহান করে তোলে।

আপনি যদি চান আপনার কোম্পানিকে এমন এক স্থানে পরিণত করতে যেখানে সম্ভাব্য নেতারা তাদের নেতৃত্বের গুণাবলি বিকাশের সুযোগ পায় এবং এর সদ্ব্যবহার করতে পারছে, তবে আপনাকে আপনার মনোযোগ এসব দিকে কেন্দ্রীভূত করতে হবে:


লোকজন ও কোম্পানিকে নেতৃত্ব দেওয়ার চেয়ে...

লোকজনকে নেতৃত্ব দিন, সম্ভাব্য নেতাদের খুঁজে বের করুন এবং সংগঠনকে নেতৃত্ব দিন

সংগঠনকে নেতৃত্ব দেওয়ার চেয়ে...

লোকজনকে নেতৃত্ব দিন, সম্ভাব্য নেতাদের এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ দিন এবং সংগঠনকে নেতৃত্ব দিন

সংগঠনকে নেতৃত্ব দেওয়ার চেয়ে...

কোম্পানির মধ্যে অবস্থিত নেতারা যখন নেতৃত্ব দিচ্ছে তখন তাদেরকে নেতৃত্ব দিন, কাজের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ সরবরাহ করুন এবং তাদের সক্ষমতা বৃদ্ধি করুন একং সংগঠনকে নেতৃত্ব দিন

সংগঠনকে নেতৃত্ব দেওয়ার চেয়ে...

সম্ভাব্য নেতারা যখন কোম্পানিকে নেতৃত্ব দিচ্ছে তখন সেসব নেতাকে উপযুক্ত পুরস্কার, সম্মান ও পদ দিয়ে ভূষিত করুন।


এখন গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে আপনি কোথা থেকে আরম্ভ করবেন। এ কাজের জন্য আপনার হয়তো কয়েক বছর সময় লাগতে পারে। পর্বতে ওঠার মতো এ আরোহণও একটু কঠিন। কিন্তু এর বিপরীত মতামতও চিন্তা করে দেখুন। আজকে থেকে পাঁচ বছর পর আপনার সংগঠন বা কোম্পানি কোথায় থাকবে? আপনি যদি সম্ভাব্য নেতাদের নিয়ে দল গঠন করতে না পারেন এবং তাদেরকে এমন এক পরিবেশ দিতে না পারেন যেখানে তারা বিকশিত হবে তবে আপনার কোম্পানি পাঁচ বছর পর কোথায় থাকবে?


নেতাদের প্রতিদিনকার পুষ্টিকর খাবার


আপনি যদি আপনার কোম্পানিকে এগিয়ে নিতে চান, উন্নতি করতে চান, তবে আমি আপনাকে প্রতিদিনকার পুষ্টিকর খাবারের মতো প্রতিদিন কিছু কলাকৌশল গ্রহণ করতে বলব। একে আমি নাম দিয়েছি, ‘নেতাদের প্রতিদিনকার পুষ্টিকর খাবার’। আপনি যখন প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠবেন এবং আপনার কোম্পানিকে নেতৃত্ব দিয়ে প্রস্তুত করবেন, তখন নিচের এ কাজগুলো নিয়মিত পালন করুন। এসব কাজের ফলে আপনার মধ্যে অসাধারণ শক্তি ও ক্ষমতা তৈরি হবে এবং আপনি সাফল্যের দিকে দৃঢ়পদে এগিয়ে যাবেন।


১। কোম্পানি বা সংগঠনের লোকজনকে অনেক বেশি গুরুত্ব দিন

আপনার সংগঠন বা কোম্পানিতে একটি নেতৃত্ব বান্ধব পরিবেশ তৈরি করতে প্রথমে আপনার ভেতর সেই পরিবেশ তৈরি করতে হবে। আপনি কেবল সেসব জিনিসের প্রতিই অঙ্গীকারাবদ্ধ থাকেন যেগুলোকে আপনি সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেন। আর নীতিগতভাবে, আপনি যদি মানুষকে গুরুত্ব না দেন, তবে আপনি কখনো এমন এক পরিবেশ তৈরি করতে পারবেন না যা নেতৃত্ব বান্ধব সংস্কৃতি তৈরি করে অথবা সম্ভাব্য নেতাদের বিকশিত করে।

বেশির ভাগ নেতারা দুইটি দিকে লক্ষ দেয়: ভিশন বা স্বপ্নের দিকে এবং সবচেয়ে নিচের অংশে বা বটম লাইনের দিকে (নড়ঃঃড়স ষরহব)। স্বপ্ন মূলত এমন এক জিনিস যা আমাদের উত্তেজনা দেয়। আর সবচেয়ে নিচের অংশ বা বটম লাইন হচ্ছে ব্যবসা চালিয়ে নেয়। কিন্তু আপনার কোম্পানির স্বপ্ন ও বটম লাইনের মধ্যে যারা কাজ করে তারা হচ্ছে মানুষ। মজার ব্যাপার হচ্ছে আপনি যদি এসব মানুষকে উপেক্ষা করেন এবং কেবল স্বপ্নœ ও বটম লাইনের দিকে মনোযোগ দেন, তবে আপনি মানুষকেও হারাবেন এবং স্বপ্নকেও হারাবেন (আর হয়তো বটম লাইন তথা ব্যবসাও হারাবেন)। কিন্তু আপনি যদি মানুষের দিকে নজর দেন, তখন আপনি মানুষকেও জয় করতে পারবেন, স্বপ্ন পূরণ হবে এবং বটম লাইন তথা ব্যবসাও টেকসই হবে।

যখন জিম কলিন্স বড় বড় কোম্পানি নিয়ে তার অধ্যয়ন আরম্ভ করলেন, তখন তিনি নেতৃত্বের এক ধরনের সূত্র আবিষ্কার করলেন। একে নাম দিলেন পঞ্চম পর্যায়ের নেতৃত্ব। তিনি লক্ষ করলেন, এসব নেতা তাদের কোম্পানি বা সংগঠনের কৃতিত্ব নিজের বলে দাবি করে না। মূলত, এসব নেতা খুব বিনয়ী হয় এবং তারা তাদের কোম্পানি বা সংগঠনের লোকজনকে সব কৃতিত্বের দাবিদার বলে মনে করে। নিঃসন্দেহে এসব পঞ্চম পর্যায়ের নেতা মানুষকে অনেক বেশি গুরুত্ব দেয়।

অবশ্য অনেক কোম্পানিই তো বলে যে তারা তাদের কর্মচারী ও কাস্টমারদের সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়। এ কথা অনেকটা সবাই বলে বলেই বলতে হয়― এমন হয়ে গেছে। কিন্তু প্রচলিত এ কথা অনেকের মনের কথা নয়। আপনি যদি জানতে চান, আপনার সংগঠনে মানুষকে কতটা গুরুত্ব দেওয়া হয়, তবে এমন লোকজনের সাথে কথা বলুন যারা আপনার কোম্পানিকে খুব ভালো করে চেনে কিন্তু কোম্পানিতে কাজ করে না। তারা কী বলে শুনুন। এ জবাবই আপনাকে যথার্থ উত্তর দিবে।

কিন্তু আপনার নিজের হৃদয়ে কী আছে তা আপনিই সবচেয়ে ভালো জানেন। সবকিছুই আপনাকে দিয়ে শুরু হয়। আপনার নিজেকে প্রথমে জিজ্ঞেস করা দরকার: আমি কি লোকজনকে গুরুত্ব দিই? আমি কি লোকজনকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিই?


২। লোকজনকে উন্নত করতে প্রয়োজনীয় উপকরণ সরবরাহের অঙ্গীকার করুন

আমি একবার বিমানে করে ডালাস শহরে যাচ্ছিলাম। যাওয়ার সময় জিগ জিগলারের সাথে আমার দেখা হয়। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আমি কি কখনো মানুষের ধন্যবাদ লেখা বা কৃতজ্ঞতা প্রকাশক চিঠি পেয়েছি? আমি বললাম, জী পেয়েছি। তিনি আরও জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি কখন চিঠি পেয়েছেন? লোকজন আপনাকে কী জন্য ধন্যবাদ দিয়েছে?’ আমি আগে কখনো এ ব্যাপারে চিন্তা করিনি। তবে উত্তরটা পরিষ্কার ছিল। মানুষ সবসময়ই আমাকে আমার বই ও অন্যান্য পণ্যসামগ্রী যা আমি তৈরি করি নেতৃত্ব শেখানোর উপকরণ হিসাবে তার জন্য ধন্যবাদ দিত।

জিগলার বললেন, ‘আমার ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটে। কী আশ্চর্য! আপনি ও আমি বেশি পরিচিত বক্তা হিসাবে, কিন্তু আমাদের বক্তব্য শুনে লোকজন ধন্যবাদ লিখে বা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে চিঠি লিখতে তৎপর হয় না, যতটা বই পড়ে হয়।’

আমি গত পঁয়ত্রিশ বছর ধরে বক্তৃতা দিচ্ছি। আমার কাছে বক্তৃতা দিতে বেশ ভালো লাগে। আমি মনে করি এর অনেক মূল্য আছে। এ ধরনের আয়োজন মানুষের মধ্যে এক ধরনের উত্তেজনা ও আগ্রহ সৃষ্টি করে। কিন্তু আপনি যদি টেকসই উন্নতি চান, আপনাকে কাজের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ সরবরাহ করতে হবে এবং তা ক্রেতা বা ব্যবহারকারীর ক্রয়সীমার মধ্যে থাকতে হবে। কাজের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণই উন্নতির সহায়ক। কারণ এগুলো অনেকটা গোছানো থাকে। আপনি তা সাথে নিয়ে যেকোনো জায়গায় যেতে পারেন। আপনি এগুলো কাউকে সুপারিশ করতে পারেন। আপনি যেকোনো সময় যেকোনো দরকারি জিনিস খুঁজে দেখতে পারেন এবং তা নিজের গতি ও ছন্দেই খুঁজে পেতে পারেন।

আমি একবার একটি বড় কোম্পানির নেতাদের জন্য বক্তব্য রাখছিলাম। আয়োজন ছিল বেশ জাঁকজমকপূর্ণ। সেখানে এক নেতা আমাকে বললেন, আমাদের কর্মীরাই হচ্ছে আমাদের সবচেয়ে বড় সম্পদ। আমি তাকে তারিফ করলাম। আমি ঠিক এ বিষয়ই বক্তৃতায় বিস্তারিত বুঝিয়ে বললাম। একটি সংগঠন বা কোম্পানির কর্মীরা তখনই সংগঠন বা কোম্পানির সম্পদে পরিণত হয় যখন আপনি কর্মীদের উন্নত করবেন।

বিশেষ করে সম্ভাব্য নেতাদের উন্নত করতে বেশ সময় ও শ্রম দিতে হয়। যেকোনো নেতা এ কথা শুনে প্রথম প্রশ্ন করে, ‘এর জন্য কত ব্যয় হবে?’ আমার জবাব, ‘ব্যয় যতই হোক না কেন, এ ব্যয় তত বেশি নয় যত বেশি খরচ হবে আপনি যদি আপনার কর্মীদের উন্নত না করেন।’

এখন আপনার জন্য আমার এ প্রশ্ন। নিজেকে জিজ্ঞেস করুন, ‘আমি কি সম্ভাব্য নেতাদেরকে উন্নত করার জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ সরবরাহ করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ?’


৩। নেতৃত্বের ওপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিন এবং মূল্য আরোপ করুন

যারা এক ব্যক্তিকেন্দ্রিক ব্যবসা পরিচালনা করেন, তাদেরকে নেতৃত্ব নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকার দরকার নেই। কিন্তু যারা বড় বড় সংগঠন ও কোম্পানিকে নেতৃত্ব দেয়, তাদেরকে অবশ্যই নেতৃত্ব নিয়ে চিন্তা করার আছে। আপনি যখনই দুই বা ততোধিক লোককে নিয়ে কাজ করবেন, তখনই নেতৃত্ব সামনে চলে আসে। কিছু কিছু কোম্পানি অবশ্য বেশি বেশি চেষ্টা করার দিকে নজর দেয়। তারা নেতৃত্বের দিকে ততটা মনোযোগ দেয় না। কিন্তু সামনে যে পথ দেখাবে সে যদি ঠিক পথে নেতৃত্ব না দেয়, তবে আপনি যতই চেষ্টা করেন, তাতে কী লাভ!

বড় বড় সব নেতা নেতৃত্বের এ দিকগুলো মাথায় রাখেন এবং নেতৃত্বকে খুব গুরুত্ব দেন। জেনারেল টমি ফ্রাঙ্কসের এক কথা আমার খুব ভালো লাগে। তিনি সেনাবাহিনীর মধ্যে নেতৃত্বের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে বলেন,

‘আমাকে অনেক দিন আমার সেনাদের নিয়ে মরুভূমিতে কাটাতে হয়েছে। তখন আমি বাস্তবে দেখে বুঝতে পারলাম যে সার্জেন্টরা হচ্ছে সেনাবাহিনীর মেরুদ-। সাধারণ সৈন্যরা নন কমিশন্ড অফিসারদের নেতৃত্বের ওপর নির্ভরশীল। আমি স্যাম লঙ ও স্টাফ সার্জেন্ট কিটেলের কথা চিন্তা করি― সার্জেন্ট কেমন হওয়া উচিত এ ব্যাপারে তারা সবচেয়ে ভালো উদাহরণ। যদি একজন নন কমিশন্ড অফিসার তার দলের সৈন্যদের প্রতি নিবেদিত প্রাণ থাকে, তবে সেই দল বা স্কোয়াড সবচেয়ে কঠিন ও বাস্তবভিত্তিক প্রশিক্ষণ পায়, গরম খাবার পায় এবং গোসল সহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা পায়। আর যদি একজন সার্জেন্ট তার দলের সৈন্যদের চাহিদার প্রতি উদাসীন থাকে, তবে সৈন্যদের কর্মক্ষমতা হ্রাস পায়। এমনকি তাদের জীবনও চলে যেতে পারে। একজন স্মার্ট অফিসার নন কমিশন্ড অফিসারদের উন্নত করতে কঠোর পরিশ্রম করে।’

আমেরিকার সেনাবাহিনী নেতৃত্বের গুরুত্ব সম্পর্কে বোঝে। তাই তারা সবসময় নেতৃত্বের প্রতি সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়। আপনি যদি নেতৃত্বকে গুরুত্ব দেন, তাহলে দেখবেন সম্ভাব্য নেতারা তাদের নেতৃত্বের সম্ভাব্য গুণাবলি কাজে লাগিয়ে কোম্পানিকে নেতৃত্ব দিচ্ছে।

এবার নিজেকে একটি সহজ প্রশ্ন করুন: আমি কি আমার সংগঠন বা কোম্পানিতে নেতৃত্বের গুণাবলিকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিই?


৪। সম্ভাব্য নেতাদের খুঁজে বের করুন

নেতৃত্ব যদি আপনার গুরুত্বের তালিকায় প্রাধান্য পায় এবং আপনি একে ঠিকভাবে মূল্যায়ন করেন, তবে আপনি প্রতিনিয়ত সম্ভাব্য নেতাদের খুঁজতে থাকবেন। আমি কয়েক বছর আগে নেতৃত্বের উন্নয়ন নামক এক ধরনের টেপ বা ক্যাসেট ভিত্তিক অডিও প্রোগ্রাম চালু করি। সেখানে আমি নেতাদের বলতাম কীভাবে মানুষের মধ্যে সম্ভাব্য নেতাদের খুঁজে বের করবেন। আমরা এর নাম দিয়েছিলাম ‘ঈগলের খোঁজে’। এ প্রোগ্রামে আমরা প্রচুর সাড়া পেয়েছি। ঈগলের সর্বোত্তম দশটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে:


ক্স তারা ঘটনা ঘটিয়ে দেখায়।

ক্স তারা সুযোগ ও সম্ভাবনা দেখতে পায়।

ক্স তারা অন্যদের মতামত ও কাজকর্মকে প্রভাবিত করে।

ক্স তারা আপনার কাজে গুরুত্বপূর্ণ বা উপকারী কিছু (ভ্যালু) যোগ করে।

ক্স তারা বিজয়ীদেরকে আকর্ষণ করে।

ক্স তারা অন্য ঈগলদের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য প্রস্তুত করে।

ক্স তারা সংগঠন বা কোম্পানিকে সাহায্য করতে নানা আইডিয়া দেয়।

ক্স তারা অসাধারণ এক মনোভাবের অধিকারী।

ক্স তারা তাদের অঙ্গীকার রক্ষা করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।

ক্স তারা সংগঠন ও নেতার প্রতি তীব্রভাবে বিশ^স্ত।


আপনি যখন সম্ভাব্য নেতাদের খুঁজবেন, তখন এমন লোকদের খুঁজবেন যাদের এসব বৈশিষ্ট্য আছে। ইতোমধ্যে, নিজেকে জিজ্ঞেস করুন: আমি কি প্রতিনিয়ত সম্ভাব্য নেতাদের খুঁজি?


৫। আপনার লোকজনকে চিনুন এবং সম্মান করুন

আপনি যখন সম্ভাব্য নেতাদের খুঁজছেন এবং তাদের পেয়ে গেলে উন্নত করতে সহায়তা করবেন, তখন তাদেরকে ব্যক্তিগতভাবে ভালো করে চেনার চেষ্টা করুন। এছাড়াও সব নেতার মধ্যেই কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য থাকে। সম্ভাব্য নেতাদের উন্নত করার ক্ষেত্রে এ বিষয় মাথায় রাখবেন:


ক্স মানুষ ফলাফল দেখতে চায়।

ক্স মানুষ কর্মক্ষম হতে চায়― তারা সবচেয়ে ভালোভাবে যা করতে পারে, তাই ভালো করে করতে চায়।

ক্স মানুষ স্বপ্নের অংশ হতে চায়। (চবড়ঢ়ষব ধিহঃ ঃড় নব রহ ঃযব ঢ়রপঃঁৎব.)

ক্স মানুষ প্রশংসা পেতে চায়।

ক্স মানুষ উৎসবের অংশ হতে চায়।


আপনি যখন আপনার লোকজনকে উন্নত করতে নির্বাচন করবেন, তখন মানুষের সার্বজনীন চাহিদা ও ব্যক্তিগত চাহিদার মধ্যে ভারসাম্য রেখে কাজ করবেন। প্রত্যেক ব্যক্তিকে উন্নতি করার পদ্ধতি শিখিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবেন। যাতে করে সে নিজে শিখতে পারে। আবার অন্যকেও শেখাতে পারে। এ কাজ করার জন্য নিজেকে প্রতিনিয়ত জিজ্ঞেস করবেন, আমি আমার লোকজনকে কতটুকু জানি এবং সম্মান করি?


৬। আপনার লোকজনকে নেতৃত্বের অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ দিন

বাস্তবে নেতৃত্ব দেওয়া ছাড়া নেতৃত্ব শেখা সম্ভব নয়। যাই বলুন না কেন, নেতৃত্ব হচ্ছে এক ধরনের কাজ। কাজ করেই নেতৃত্ব দেওয়া শিখতে হবে। অনেক নেতাই যে জায়গায় উন্নতি করতে পারে না তা হচ্ছে নেতৃত্বকে অন্যের হাতে দিতে না পারা। আমাদের সাধারণ প্রবৃত্তি হচ্ছে অন্যদের কাজ দেওয়া। কিন্তু আমাদের উচিত অন্যদেরকে নেতৃত্ব দেওয়ার সুযোগ দেওয়া। আমাদেরকে এ ব্যাপারে আমাদের ধ্যানধারণা পরিবর্তন করতে হবে। আমরা যদি অন্যদের হাতে নেতৃত্ব দিতে না পারি― (আর সাথে কর্তৃত্ব দিতে এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে না পারি)― তবে তারা কখনো দক্ষ নেতৃত্ব দেওয়ার অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারবে না।

আপনার নিজেকে যে প্রশ্ন অবশ্যই করতে হবে, আমি কি আমার লোকজনকে নেতৃত্বের অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ দিচ্ছি?


৭। নতুন কোনো নেতৃত্বের উদ্যোগ নিলে পুরস্কৃত করুন

নতুন উদ্যোগ নেওয়া নেতৃত্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। সবচেয়ে ভালো নেতা হচ্ছে যারা উদ্যোগী। তারা কাজ করে দেখায়। বেশির ভাগ নেতারাই উদ্যোগী। কিন্তু তার মানে এ নয় যে অন্যরা যখন তাদের উদ্যোগকে ব্যবহার করে তখন তারা স্বস্তি অনুভব করে। তারা তাদের নিজেদের ভেতরগত তাড়না ও প্রেরণাকে বিশ^াস করে বলে যে তারা অন্যদের ভেতরগত তাড়না ও প্রেরণাকে বিশ^াস করবে তা নয়।

এ কথা সত্য যে প্রায়ই দেখা যায় উঠতি নেতারা প্রস্তুত হওয়ার আগেই নেতৃত্বের জায়গা নিতে চায় এবং নেতৃত্ব দিতে চায়। কিন্তু সম্ভাব্য নেতারা কেবল তখনই পুরোদমে নেতা হয়ে উঠবে যখন তারা নিজেদের উন্নত করবে এবং তাদের উদ্যোগকে কাজে লাগাবে। তাহলে সমাধান কি? ঠিক সময়ের অপেক্ষা করা! যদি আপনি সময়ের আগে ফলাফল চান, তবে বিকাশের পথকে ধ্বংস করতে পারেন। আর আপনি যদি সম্ভাব্য নেতাদের যোগ্যতা প্রমাণের পরও ধরে রাখেন, এগিয়ে যেতে না দেন, তবে আপনি কেবল তাদের উন্নতিতে কিছু সময়ের জন্য বাধা সৃষ্টি করতে পারবেন, সবসময়ের জন্য নয়।

এবার আসি সময়ের ব্যাপারে। আপনার মানসিকতা যেকোনো একদিকে থাকতে হবে। আপনার প্রচুর আছে বা অভাব আছে, এ দুইটির যেকোনো একটিকে মনে রেখে কাজ করলে আপনি সময়কে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন। আপনি যদি বিশ^াস করেন এ বিশে^র সম্পদ সীমিত, অল্প সংখ্যক সুযোগ এবং এরকম আর অনেক কিছু, তখন আপনি চিন্তা করবেন নেতারা ঝুঁকি নিক তবে আমি নিব না। কারণ আপনি চিন্তা করবেন আমার ভুল থেকে সংগঠন বা কোম্পানি হয়তো উঠে আসতে পারবে না। অপর পক্ষে, আপনি যদি বিশ^াস করেন অবারিত সুযোগ, বিশে^র সম্পদ নবায়নযোগ্য ও অসীম, তখন আপনি ঝুঁকি নিতে চিন্তা করতে পারবেন। আপনি তখন নিজের উঠে আসার সক্ষমতার ব্যাপারে সন্দেহ মুক্ত থাকবেন।

জীবনের এ দিক দিয়ে আপনি কেমন কাজ করছেন? নিজেকে জিজ্ঞেস করুন, আমি কি নেতৃত্বের উদ্যোগকে পুরস্কৃত করি?

[ফজলে রাব্বির কথা― এখানে দুইটি ব্যাপারে আরও কিছু কথা বলা দরকার। এক, নিজের ওঠে আসার সক্ষমতা। দুই, প্রোএকটিভ ও রিএকটিভ মানুষের বৈশিষ্ট্য।

 অনেকেই নিজের সক্ষমতা ও উদ্যোগের ব্যাপারে সন্দেহে থাকে। তার কারণ, যদি ব্যর্থ হয় তবে সেখান থেকে উঠে আসবে কীভাবে। এখন যে অবস্থানে আছে, ব্যর্থ হলে তো এ অবস্থানও হারাব।

কিন্তু আপনি কি কখনো চিন্তা করে দেখেছেন, আপনি একটি উদ্যোগ নিলে, উদ্যোগের ব্যাপারে খোঁজখবর নিতে গেলে কত মানুষের সাথে দেখা হবে, নতুন কতকিছু জানা হবে যা আপনি আগে জানতেন না। তাহলে ইতোমধ্যে আপনার অবস্থান উপরে উঠে গেছে। আমরা যদি সংখ্যা দিয়ে বলি, ধরি, আপনার বর্তমান অবস্থান ৩। আপনি একটি উদ্যোগ নিলেন। এজন্য উদ্যোগের বিষয়ে জানা শুরু করলেন। তখন আপনার অবস্থান হবে ৪ এ। এরপর আপনি নানা ধরনের লোকজনের সাথে কথা বললেন। এতে অবস্থান হবে ৫। তারপর উদ্যোগ নেওয়ার জন্য কাজ আরম্ভ করলেন। এ কাজের মাধ্যমে আপনার অবস্থান ৬। তাহলে ইতোমধ্যে আপনার অবস্থান উপরে উঠে গেছে। এখন যদি আপনি ব্যর্থও হন, আপনি বিচারবিবেচনা করার সুযোগ পাবেন যে কোথায় কী ভুল হয়েছে। সেই ভুল থেকে শিখলেন এবং পুনরায় কাজ আরম্ভ করলেন। এখন আপনার জন্য নতুন তথ্য জানা খুব সহজ। কারণ দুইটি। এক, আপনার আত্মবিশ^াস আছে আপনি যেকোনো নতুন উদ্যোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তা জানতে পারেন। আর দুই, আপনার পরিচিত লোকজন আছে। যাদের মাধ্যমে আপনি অন্য আরও যাদের দরকার তাদেরকে খুঁজে নিতে পারেন।

এখন বলি, প্রোএকটিভ লোকজনের বৈশিষ্ট্য:

কিছু প্রশ্ন ও উদাহরণের মাধ্যমে প্রোএকটিভ ও রিএকটিভ লোকজনের বৈশিষ্ট্য তুলে ধরছি।

১। নতুন কিছু শেখার প্রতি আপনার মনোভাব কেমন?

রিএকটিভ লোকজন চিন্তা করে তারা যা জানে তাই যথেষ্ট। আর জানার দরকার নেই।

প্রোএকটিভ লোকজন চিন্তা করে নতুন কিছু শিখতে হবে। তারা যা জানে তা যথেষ্ট নয়। আরও জানার দরকার আছে।


২। কাজকর্ম করতে গেলে আপনার মানসিকতা কেমন?

রিএকটিভ লোকজনকে যা কাজ করতে বলা হয় তা করে এবং কাজ শেষ করে নতুন কাজের অর্ডারের জন্য বসে থাকে।

প্রোএকটিভ লোকজন একটি কাজ করতে গিয়ে সবসময় কাজটিকে উন্নত করার চেষ্টা করে এবং নিত্যনতুন সুযোগ খোঁজে। এজন্যই প্রোএকটিভ লোকজনকে উচ্চতর পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়। আর যারা কাজের অর্ডারের জন্য বসে থাকে তাদেরকে কোনো পদোন্নতি দেওয়া হয় না।

৩। পরিবর্তনের প্রতি আপনার মনোভাব কেমন?

প্রোএকটিভ লোকজন পরিবর্তনের দিকে এগিয়ে যায় এবং সংগ্রামের মধ্য দিয়ে উন্নতি করে।

কিন্তু রিএকটিভ লোকজন পুরাতন রুটিনের মধ্যেই আটকে থাকে। নতুন রুটিনে কাজ করা তাদের জন্য অস্বস্তিকর। রিএকটিভ লোকজন প্রায় সময় এমন কিছু চিন্তা করে: আজকে কি পরীক্ষা নাকি? হায় আল্লাহ! সময় তো শেষ। এখন আমি এত কাজ কীভাবে করব। আমাকে এত কাজ কেন করতে হয়? একই সাথে মানুষ এত কাজ কীভাবে করতে পারে? আমি বিশ^াস করতে পারছি না, আমার এত কাজ জমে গেছে।

রিএকটিভ লোকজনের সমস্যা হচ্ছে তারা কোনো কিছু পরিকল্পনা করে না। জীবনে যা সামনে আসে তাতেই ঝাঁপ দেয়। অপ্রস্তুত অবস্থায় কাজ করে। এতে করে তারা দুইটি জিনিসের সম্মুখীন হয়:

ক। তারা অনুৎপাদনশীল বা অপ্রয়োজনীয় কাজে অনেক সময় অপচয় করে।

খ। তারা প্রায় সময় অনুভব করে: একই সাথে অনেক কাজের মধ্যে তাদেরকে ডুবে থাকতে হচ্ছে।

এ ব্যাপারে আর জানতে দেখুন সাফল্য ডটকমের ব্লগ পেইজ (িি.িংধঢ়যড়ষষড়.পড়স/নষড়ম) এবং ঠিক ধারণা ব্লগ পেইজে (যঃঃঢ়://ঃযরশফধৎড়হধ.নষড়মংঢ়ড়ঃ.পড়স/)।]


৮। একটি নিরাপদ পরিবেশ দিন যেখানে লোকজন প্রশ্ন করতে পারে, নিত্যনতুন বুদ্ধি ও আইডিয়া দিতে পারে এবং ঝুঁকি নিতে পারে

পুলিৎজার পুরস্কার প্রাপ্ত ইতিহাসবিদ গ্যারি উইলস বলেন, ‘নেতারা কী নেতৃত্ব দেয়, কেন নেতৃত্ব দেয় এ ব্যাপারে তাদের নিজস্ব কিছু ধ্যানধারণা রয়েছে। একজন নেতা যখনই উক্ত কারণকে অবহেলা করে, তখন সে নিজেকে পায় একা হিসাবে, অনুসারী শূন্য অবস্থায়।’ উচ্চ পদস্থ নেতা, যারা নিজেদের নেতৃত্ব নিয়ে নিরাপদ বোধ করে, তারা কোম্পানির অন্য নেতাদের জন্য এমন পরিবেশ ও ব্যবস্থা তৈরি করবে যা উঠতি নেতাদের জন্য সহায়ক। এজন্য উচ্চ পদস্থ নেতাদের কিছু নীতিনৈতিকতার দিক থেকে স্থির থাকতে হবে। যখন মধ্যম পর্যায়ের নেতারা এ নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে বা সমালোচনা করে, তখন সে এসব বক্তব্যকে ব্যক্তিগতভাবে না নিয়ে, গঠনমূলক হিসাবে নেয়। মধ্যম পর্যায়ের নেতারা যেন এ ভয় না পায় যে তারা আইডিয়া শেয়ার করলে তা চুরি বা কপি হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। বড় নেতাদের চেয়ে নিচে যারা আছে, তারা যখন কোনো ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে চায়, ঝুঁকি নিতে চায়, তখন যেন উঠতি নেতাদের সফল বা ব্যর্থ হওয়ার জায়গা দেওয়া যায়।

নেতৃত্ব ব্যাপারটাই একটা চ্যালেঞ্জের বিষয়। এটা পুরাতন ধ্যানধারণাকে চ্যালেঞ্জ জানায়। এটা প্রাচীন উপায়ে করা যেকোনো সমাধান, উপায় বা পথকে চ্যালেঞ্জ জানায়। সবাই যা মেনে নিয়েছে এটা এমন সব অবস্থাকে চ্যালেঞ্জ জানায়। সবসময় মনে রাখবেন, যা সম্পন্ন করলে পুরস্কার দেওয়া হয় তা বারবার করা হয়। আপনি যদি উঠতি নেতাদের পুরাতন ধ্যানধারণায় কাজ করে যাওয়া জন্য পুরস্কৃত করেন, তবে আপনি তাদের আরও বেশি বেশি পুরাতন ধ্যানধারণায় কাজ সম্পন্ন করতে দেখবেন। কিন্তু আপনি যদি নিরাপদ দূরত্বে থেকে তাদেরকে নতুন নতুন পথ ও উপায় খুঁজতে দেন, তবে তারা আপনার চেয়ে উত্তম পথ খুঁজে বের করবে। এতে করে সংগঠন বা কোম্পানি সেই নিত্যনতুন পথ ধরে আরও দ্রুত গতিতে এগিয়ে যাবে।

[ফজলে রাব্বির কথা― জন ই. জোনস বলেন, যা পরিমাপ করা হয় তা সম্পন্ন হয়, যা পরিমাপ করা হয় এবং ফিডব্যাক নেওয়া হয় তা আরও ভালোভাবে সম্পন্ন হয়, যা সম্পন্ন করলে পুরস্কার দেওয়া হয় তা বারবার করা হয়। ডযধঃ মবঃং সবধংঁৎবফ মবঃং ফড়হব, যিধঃ মবঃং সবধংঁৎবফ ধহফ ভবফ নধপশ মবঃং ফড়হব বিষষ, যিধঃ মবঃং ৎবধিৎফবফ মবঃং ৎবঢ়বধঃবফ. - ঔড়যহ ঊ. ঔড়হবং]

জনাব সব-প্রশ্নের-উত্তরদাতা (গৎ. অহংবিৎসধহ) অথবা জনাব সবকিছু-ঠিক-করার-একমাত্র-ব্যক্তি (গৎ. ঋরী-রঃ) না হয়ে অন্যদেরকে কাজের দায়িত্ব ও কর্তৃত্ব দিন এবং আপনি তাদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করুন। যখন সম্ভাব্য নেতা বা উঠতি নেতারা কাজ করতে আরম্ভ করে, তখন তারা পূর্বে যে কাজ ভালো পারতো, তাই করা শুরু করবে। তাদেরকে এগিয়ে যেতে বিজ্ঞ পরামর্শ দিন। নতুন কিছু শিখতে উৎসাহ দিন। সংগঠনকে এগিয়ে নিতে সম্ভাব্য বা উঠতি নেতাদের নিত্যনতুন আইডিয়া ও বুদ্ধি-পরামর্শকে কাজে লাগানোর জন্য উৎসাহ দিন। আমার মনে হয়, আপনি নিশ্চয় চিন্তা করেন সংগঠন বা কোম্পানির বিজয় মানে আপনার বিজয়।

তো, আপনি আপনার সংগঠনে কী ভূমিকা পালন করেন? আপনি কি ‘একজন বিশেষজ্ঞ’ বা কর্মদক্ষ ব্যক্তি নাকি একজন পরামর্শক? নিজেকে জিজ্ঞেস করুন, আমি কি এমন এক পরিবেশ তৈরি করছি যেখানে লোকজন প্রশ্ন করতে পারে, আইডিয়া শেয়ার করতে এবং ঝুঁকি নিতে পারে?


৯। আপনার লোকজনের সাথে সাথে আপনিও বেড়ে উঠুন তথা সমৃদ্ধ হোন

আমি আমার পেশাগত জীবনে অনেক নেতাদের সাথে আলাপ করেছি। মানুষ তার কর্মজীবনে দক্ষ হয়ে উঠতে গেলে কী কী মনোভাব দরকার তা আমি খুঁজে বের করেছি। এগুলোকে সংক্ষেপে উল্লেখ করছি:

ক্স আমি ইতোমধ্যে বেড়ে উঠেছি তথা সমৃদ্ধ হয়েছি।

ক্স আমি চাই আমার লোকজন বেড়ে উঠুক তথা সমৃদ্ধ হোক।

ক্স আমি আমার লোকজনের বেড়ে ওঠার প্রতি নিবেদিত প্রাণ।

ক্স আমি চাই আমি আমার লোকজনের সাথে বেড়ে উঠি তথা সমৃদ্ধ হই।

এবার বলুন তো, একটি সংগঠনের লোকজন যারা বেড়ে উঠছে তথা সমৃদ্ধ হচ্ছে― এমন অবস্থায় একজন নেতার কোন মনোভাব থাকলে এ অগ্রগতি বেগবান হবে?

একটি সংগঠন বা কোম্পানির লোকজন যখন দেখবে তাদের নেতাও বেড়ে উঠছে তথা সমৃদ্ধ হচ্ছে, তখন এ অগ্রগতি পুরো সংগঠনের সংস্কৃতিকে বদলে দিবে। এতে করে তাৎক্ষণিক এমন বহু বাধা সরে যাবে যা পূর্বে সংগঠনের লোকজন ও নেতার মধ্যে দেওয়াল হিসাবে বিদ্যমান ছিল। এতে করে, নেতাকে সংগঠনের লোকজনের পাশাপাশি এনে দাঁড় করায়। নেতাও বেড়ে উঠছে তথা সমৃদ্ধ হচ্ছে, লোকজনও বেড়ে ওঠার মাধ্যমে অগ্রগতি করছে। এভাবে নেতাকে আরও বেশি মানবিক করে তোলে এবং তার সাথে কথা বলা, যোগাযোগ করা সহজ হয়ে ওঠে। এতে করে সবার কাছে একটি পরিষ্কার ও স্পষ্ট মেসেজ পাঠায়: আমরা বেড়ে ওঠা তথা সমৃদ্ধ হওয়াকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিই।

এখন আমি আপনাকে বলব নিজেকে একটি সহজসরল প্রশ্ন করুন: আমি কি আমার লোকজনের সাথে বেড়ে উঠছি তথা সমৃদ্ধ হচ্ছি?


১০। উচ্চ সম্ভাবনাময় লোকজনকে নিয়ে আপনার অন্তরঙ্গ তথা ঘনিষ্ঠ সার্কেল তৈরি করুন

দ্য ফ্রেড ফ্যাক্টর বইয়ের লেখক মার্ক স্যানবার্ন একবার আমাদের এক নেতৃত্ব বিষয়ক অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন। তার একটি কথা আমার মনে একদম গেঁথে গেছে। তিনি বললেন, ‘একদল হরিণ নিয়ে একটি সিংহ যদি নেতৃত্ব দেয় তাও ভালো। কিন্তু একদল সিংহ নিয়ে যদি একটি হরিণ নেতৃত্ব দেয় তবে এরচেয়ে মন্দ কিছু আর হয় না।’ কেন? কারণ আপনার দল যদি হরিণের মতোও হয়, তবুও তাদেরকে নেতৃত্ব দিবে একটি সিংহ। তারা সিংহের নেতৃত্বে, সিংহের মতো গর্ব নিয়ে কাজ করবে। এ কী অসাধারণ এক উপমা নয়? খুবই সত্য কথা। মানুষ যখন কারও সাথে সময় ব্যয় করে এবং তাদের নির্দেশনা পায়, তাদের চিন্তাভাবনা শোনে, তখন তারা ঐ ব্যক্তির মতো চিন্তা ও কাজ করতে শুরু করে। তাদের কর্মদক্ষতা তখন তাদের নেতার সক্ষমতা অনুযায়ী বেড়ে যায়।

আমি যখন ডিভেলপিং দ্য লিডারস এরাউন্ড ইউ (উবাবষড়ঢ়রহম ঃযব খবধফবৎং অৎড়ঁহফ ণড়ঁ) বই নিয়ে কাজ করছিলাম, তখন আমি প্রায় অনুষ্ঠানে অনানুষ্ঠানিকভাবে কিছু জরিপ চালাতাম। আমি এ জরিপের মাধ্যমে খুঁজে দেখতাম লোকজন কীভাবে নেতা হয়ে উঠছে। আমি তাদেরকে এমন সব প্রশ্ন করতাম, আপনি কীভাবে নেতা হয়ে উঠলেন (ক) একটি পদ দেওয়ার কারণে; (খ) কোনো সংকট এসে পড়েছিল বলে; অথবা (গ) আপনাকে কেউ মেনটরিং বা বিজ্ঞ পরামর্শ দ্বারা পরিচর্যা করেছে। প্রায় ৮০ শতাংশেরও বেশি লোকজন বলেছে তাদেরকে কেউ একজন নেতৃত্ব দিতে মেনটরিং করেছে।

উচ্চ পর্যায়ের নেতা তৈরির সবচেয়ে ভালো উপায় হচ্ছে মানুষকে উচ্চ পর্যায়ের নেতাদের দ্বারা মেনটরিং করা। আপনি যদি আপনার সংগঠনকে নেতৃত্ব দেন, আপনি হয়তো সবচেয়ে ভালো ব্যক্তি (অথবা উত্তমদের মধ্যে একজন)। এখন আপনার উচিত উচ্চ সম্ভাবনাময় লোকজনকে নিয়ে আপনার অন্তরঙ্গ তথা ঘনিষ্ঠ একটি সার্কেল তৈরি করা। উচ্চ সম্ভাবনাময় লোকজনকে আমন্ত্রণ জানান। তাদেরকে নিজের ঘনিষ্ঠ সার্কেলে যুক্ত করুন এবং মেনটরিং করুন। আপনি চাইলে এক-একজন করে বা একসাথে অনেককে নিয়ে মেনটরিং করতে পারেন। মূল কথা হচ্ছে, আপনাকে আপনার সবচেয়ে ভালো লোকজনকে সবচেয়ে ভালো পরামর্শ, পথনির্দেশ, বুদ্ধি ও ধারণা দিয়ে মেনটরিং করতে হবে। [মেনটরিং সম্পর্কে আরও জানতে পড়–ন: মেনটরিং ১০১। মূল: জন সি. ম্যাক্সওয়েল। অনুবাদ: ফজলে রাব্বি। ঢাকা, সাফল্য প্রকাশনী, ২০২০।]

আপনি কি তা করছেন? এ প্রশ্নের জবাব দিন: আমি কি আমার ঘনিষ্ঠ সার্কেলে সম্ভাবনাময় লোকজনকে টেনে আনছি?


১১। নিজের সাথে ওয়াদা করুন যে একটি নেতৃত্ব দিতে সক্ষম এমন একটি দল গড়ে তুলব

আমি যখন নেতা হিসাবে কাজ আরম্ভ করলাম, তখন আমি সবকাজ একাই করতে চেষ্টা করলাম। একা একা কাজ করে যাওয়ার চেষ্টা করে গেছি আমার চল্লিশ বছর বয়স হওয়া পর্যন্ত। আমি মনে করেছিলাম সবকাজ আমি একাই করতে পারব। তারপর আমি আমার চল্লিশতম জন্মদিনে উপলব্ধি করলাম, আমি যদি অন্যদেরকে নেতা হিসাবে তৈরি না করি, তবে আমি আমার সম্ভাবনার খুব ছোট্ট এক অংশকেই কাজে লাগাতে পারব। তাই, পরের দশ বছরের জন্য আমি আমার লক্ষ্য নির্ধারণ করলাম। আমি মানুষকে ভালো নেতা হতে সাহায্য করব। মানুষকে দক্ষ নেতা হিসাবে গড়ে তুলতে আমি মনোযোগ দিব। কিন্তু এরও সীমাবদ্ধতা রয়েছে। আমি উপলব্ধি করলাম যে নেতৃত্বের সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছাতে হলে, আমাকে নেতৃত্ব দিতে সক্ষম এমন এক দল গড়ে তুলতে হবে।

তখন আমি নিজের সামনে নিজে দাঁড়ালাম। আমি স্বীকার করে নিতে বাধ্য হলাম যে, সবাই যে সবকাজে ভালো হবে, দক্ষ হবে তা নয়। আমি নিজেও সবকাজে দক্ষ নই। তাই সবকাজ আমার একার পক্ষে সম্ভব নয়। আপনার পক্ষে কি সম্ভব? আমি এসব বিষয় নিয়ে ঞযব ২১ ওৎৎবভঁঃধনষব খধংি ড়ভ খবধফবৎংযরঢ় তথা নেতৃত্বে অপরিহার্য ২১টি সূত্র বইয়ে লিখেছি। এ বইয়ে আমার জীবনের নেতৃত্ব বিষয়ক শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা থেকে প্রাপ্ত প্রতিটি সূত্রের কথা উল্লেখ করেছি। তারপর, আমি একা যে এই ২১টি সূত্রের সব করতে পারব তা সত্য নয়। তাই আমার সাহায্য দরকার।

আপনার ক্ষেত্রেও তাই। আপনি যদি চান আপনার সংগঠন বা কোম্পানি এর সম্ভাবনাকে পূর্ণরূপে কাজে লাগাক, আপনি যদি চান আপনার সংগঠন বা কোম্পানি ভালো থেকে উত্তম অবস্থায় যাক (অথবা গড় অবস্থান থেকে আরেকটু ভালো অবস্থায় যাক), তবে আপনার দরকার নেতৃত্ব দিতে সক্ষম এমন এক দল গড়ে তোলা। এমন লোকজনকে নিয়ে কাজ করা, যারা একে অপরের দক্ষতার অভাব পূরণ করবে। এমন লোকজন যারা একে অপরকে চ্যালেঞ্জ জানাবে এবং একে অপরকে শাণিত করবে। আমরা যদি সবকাজ একাই করতে যাই, তবে আমরা কখনো আমাদের নিজেদের ক্ষুদ্র গ-ি থেকে বের হতে পারব না।

এ ব্যাপারে আপনি কী চিন্তা করেন? নিজেকে জিজ্ঞেস করুন, আমি কি নিজের সাথে ওয়াদা করতে পারি যে এমন একটি দল গড়ে তুলব যারা নেতৃত্ব দিতে সক্ষম?


১২। আপনার নেতাদের বাস্তব জগতে নেতৃত্ব দিতে ছেড়ে দিন

নেতা হিসাবে, আমরা যদি আমাদের নেতৃত্বের উন্নীতকরণ প্রক্রিয়া বা পদ্ধতি নিয়ে অনিশ্চিত থাকি বা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগি, তবে এ সমস্যা আসলে আমরা যে প্রশিক্ষণ দিলাম তার সাথে জড়িত নয়। অনিশ্চয়তা আসে মূলত যখন আমরা নেতাদের বাস্তব জগতে নেতৃত্ব দিতে ছেড়ে দিব তখন। আমরা চিন্তা করি তারা আমাদের সাথে থাকবে কিনা। ঠিক এমন উদ্বেগ বাবা-মা’রও তৈরি হয় তাদের সন্তানদের নিয়ে। আমার নিজের সন্তানরা বড় হয়েছে। তারা তাদের নিজেদের পরিবার গঠন করেছে। কিন্তু তারা যখন কৈশোর শেষ করে যৌবনে পদাপর্ণ করল, তখন তাদেরকে তাদের নিজেদের পথে চলতে দেওয়া আমার ও আমার স্ত্রী’র জন্য সবচেয়ে কঠিন কাজ ছিল। এ কথা চিন্তা করলেই গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। কিন্তু আপনি যদি তাদেরকে ওড়ার অনুমতি না দেন, তবে তারা কখনো উড়তে শিখবে না।

আমার যখন বয়স বৃদ্ধি পাচ্ছে, তখন আমি নিজেকে চিন্তা করলাম একজন সাহায্যকারী হিসাবে। এমন এক সাহায্যকারী যে মানুষকে নেতৃত্ব দিতে সাহায্য করে। একটি দলের দলনেতা হিসাবে ঠিক এ কাজই হচ্ছে আমার সবচেয়ে প্রধান কাজ। আমি যদি আমার দলের সদস্যদেরকে নেতৃত্ব দিতে সাহায্য করে থাকি, তবে আমি আমার দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন করছি। আমি আমার লোকজনের সামনে থেকে যত বেশি বাধা দূর করে ফেলতে পারব, তারা তত বেশি তাদের সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে সক্ষম হবে। আর সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে দলনেতা যখন অন্য উঠতি নেতাদের আরও উপরে ওঠার সুযোগ করে দেয় তখন সংগঠন আরও উপরে ওঠে। উঠতি সেসব নেতারা আরও দায়িত্ব নিয়ে সংগঠনকে নেতৃত্ব দেয়। আপনি যদি একটি নেতৃত্ব দিতে সক্ষম এমন এক দল গড়ে তোলেন, তবে আপনার সংগঠন বা কোম্পানি আরও উপরে উঠবে, আরও সুপরিবর্তন ঘটবে এবং আপনার জীবনও সার্থক হবে।


 








দ্বিতীয় খ-


দলবদ্ধ কাজের গতিশক্তি বা সক্রিয়তা যা একটি দলের মধ্যে সুপরিবর্তন বা ইতিবাচক পরিবর্তন আনে



 



 

একটি ভালো দলের বৈশিষ্ট্য কী?


একটি ভালো দলে সবাই একই অবস্থানে থাকে।


মানুষ উন্নয়ন ও দলবদ্ধ কাজে আমি বহু বছর ধরে বিভিন্ন সংগঠন ও কোম্পানিকে সাহায্য করেছি। আমার এ অভিজ্ঞতা থেকে আমি দেখলাম সফল দলগুলোর কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য রয়েছে। আপনি যদি একজন খেলোয়াড় হিসাবে চিন্তা করেন, দলনেতা বা কোচ হন, তবে আপনি নিজের দলে এসব নিয়মকানুন প্রয়োগ করে সফল হতে পারেন। এ বৈশিষ্ট্যাবলি হচ্ছে:


দলের সদস্যরা একে অপরের প্রতি সহানুভূতিশীল


প্রতিটি ভালো ও দক্ষ দল আরম্ভ হয় গুণমান দিয়ে। এ হচ্ছে যেকোনো মহান দলের মূল ভিত্তিপ্রস্তর। যেসব দল নিজেদের মধ্যে বন্ধন তৈরি করতে পারে না তারা মহান দলও তৈরি করতে পারে না। কেন? কারণ তারা কখনো একে অপরের সাথে ব্যক্তিগত সম্পর্কের দিক দিয়ে সম্পৃক্ত নয়।

এ গুণের পরিচয় আমি সবচেয়ে ভালোভাবে পেয়েছি কলেজ ফুটবল কোচ লিউ হোল্টজের কাছে। তিনি বলেছিলেন, ‘তিনি একবার টিভিতে এক অনুষ্ঠান দেখেছিলেন। অনুষ্ঠানটি ছিল কেন পুরুষরা তাদের দেশের জন্য জীবন উৎসর্গ করে তা নিয়ে। সেই অনুষ্ঠানে ইউনাইটেড স্টেটস মেরিন, দ্য ফ্রেঞ্চ ফরেন লিজিওন এবং ব্রিটিশ কমান্ডোদের পর্যবেক্ষণ করে দেখানো হয়। সেখানে বলা হয় এসব পুরুষ তাদের দেশের জন্য জীবন উৎসর্গ করে, কারণ তারা তাদের সঙ্গীদের ভালোবাসে। অনুষ্ঠানে এক সৈন্যের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। তিনি যুদ্ধে আহত হয়েছিলেন এবং অনেকদিন হাসপাতালে ছিলেন। তারপর তিনি যখন শুনলেন তার ইউনিট একটি বিপদজনক মিশনে যাচ্ছে, তিনি হাসপাতাল থেকে পালিয়ে দলের সাথে যোগ দিলেন আবার আহত হওয়ার জন্য। যখন তাকে জিজ্ঞেস করা হলো আপনি এমন কাজ কেন করলেন। তখন তিনি জবাব দিলেন আপনি যাদের সাথে কাজ করেন, কাজ করা এবং দলের সদস্যদের সাথে জীবনকে ভাগ করে নেওয়ার পর, আপনি অনুভব করবেন যে আপনার বাঁচা-মরা নির্ভর করে একে অপরের ওপর।’

আমি দেখলাম যে একটি দলের মধ্যে সহানুভূতিশীল ও যত্নশীল এক সম্পর্ক তৈরির সবচেয়ে ভালো উপায় হচ্ছে তাদেরকে কাজের বাইরে কোথাও দেখা করার সুযোগ দেওয়া। এতে করে তাদের মধ্যে ব্যক্তিগত সম্পর্ক তৈরি হবে। আমাদের সংগঠনে আমরা প্রতি বছর কর্মক্ষেত্রের বাইরে সামাজিক সাক্ষাতের জন্য বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও ইভেন্টের আয়োজন করি। এসব অনুষ্ঠানে আমরা চেষ্টা করি তারা যেন তাদের এমন এমন সহকর্মীর সাথে আলাপ করার সুযোগ পায় যাদেরকে সাধারণত তারা ভালোভাবে চেনে না। এতে করে তারা যে কেবল সম্পর্ক তৈরি করছে তাই নয়, তারা নানা ছোট ছোট দলে উপদলে বিভক্ত হয়ে যাওয়ার শঙ্কা থেকেও মুক্ত হতে পারছে।


দলের সদস্যরা জানে যে সবচেয়ে বেশি কী গুরুত্বপূর্ণ


একটি দলের যে জিনিস আমার সবচেয়ে ভালো লাগে তা হচ্ছে একটি স্বতন্ত্র ইউনিট (ংরহমষব ঁহরঃ) হিসাবে তারা কীভাবে কাজ করে। একটি দলের প্রত্যেক অংশের বিভিন্ন কাজ থাকতে পারে। কিন্তু তাদের প্রত্যেকেই একটি সাধারণ লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে কাজ করে। যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য তাদেরকে একই বন্ধনে বেঁধে রাখে। এ গুণ পূর্বে উল্লিখিত (দলের সদস্যরা একে অপরের প্রতি সহানুভূতিশীল) গুণের মতোই দলবদ্ধ কাজের মূল ভিত্তিপ্রস্তর। এ গুণ ব্যতীত দলের সদস্যরা প্রকৃত অর্থে একত্রে কাজ করতে পারে না।

একটি খেলার কথা বলি। ধরুন, বাস্কেটবল খেলা। এ খেলায় বল জালে ফেলা তথা স্কোরিং করা খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ দলের সদস্যরা জানে যে তারা তাদের অনুশীলন, চর্চা ও প্রশিক্ষণ চালিয়ে গেছে স্কোরিং করার জন্য। তাদের মূল লক্ষ্যই থাকে স্কোরিং করার দিকে। অপরপক্ষে, সাংগঠনিক বা কোম্পানির দিক থেকে অনেকেই জানে না তাদের ‘স্কোরিং’ কী। তাদের সামনে হয়তো দায়িত্বের একটি বড় তালিকা আছে। কিন্তু তারা এ কথা জানে না যে এ দায়িত্বগুলো তাদের সংগঠন বা কোম্পানির স্কোরের সাথে কীভাবে সম্পৃক্ত। আমি যদি বাস্কেটবলের সাথে এ পরিস্থিতিকে মেলাই তবে এমন দেখাবে: একজন বাস্কেটবল খেলোয়াড় বল নিতে পারে, পাস দিতে ও অন্য খেলোয়াড়কে পাশ কাটিয়ে যেতে পারে, কিন্তু সে বল নিয়ে এরপর কী করবে বুঝতে পারছে না। এসব দক্ষতা নিয়ে সে যে বল ঝুড়িতে ফেলবে সেই বাস্কেটবলের ঝুড়িই নেই। অথবা এসব দক্ষতা নিয়ে তাকে যে বল বাস্কেটবলের ঝুড়িতে ফেলতে হবে তা সে জানে না।

বাস্কেটবল দলের মধ্যে একজনও যদি না জানে যে দলের জন্য কী গুরুত্বপূর্ণ, তবে এ না জানা তাকে অকার্যকর করে দেয়। আর সে যখন খেলায় অংশ নেয়, তখন উক্ত দলের জন্য বিজয়ী হওয়া এক অসম্ভব ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। ঠিক একই কথা যেকোনো সংগঠন বা কোম্পানির জন্য দায়ী। যে ব্যক্তি জানে না দলের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জিনিস কী সে দলের প্রতি দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়। সে যে শুধু তার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয় তাই নয়, তার কাজ পুরো দলকে সাফল্য অর্জনে বাধাও দেয়। এজন্য দলনেতাকে দলের জন্য কী গুরুত্বপূর্ণ তা স্পষ্ট করে দলের প্রত্যেক সদস্যকে জানাতে হয় এবং সেই অনুযায়ী দলের সদস্যদের পরিচালিত করতে হয়।


দলের সদস্যরা একে অপরের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে


একটি দক্ষ ও কার্যকর দলের জন্য তৃতীয় মূল ভিত্তিপ্রস্তর হচ্ছে যোগাযোগ রক্ষা করা। দলনেতা যেমন দলের জন্য কী গুরুত্বপূর্ণ তা দলের সদস্যদের বলবে, ঠিক তেমন গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে দলের সদস্যরা একে অপরের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করা। এ যোগাযোগ না থাকলে, সদস্যরা একে অপরের বিরুদ্ধে কাজ করবে। গুরুত্বপূর্ণ সব কাজ পড়ে থাকবে এবং সদস্যরা একে অপরের কাজ বা একই কাজ করে ভুল করবে।

যেকেউ যদি বাস্কেটবল খেলে থাকে তবে সে এ পরিস্থিতির সাথে পরিচিত। যেখানে দুইজন খেলোয়াড় একটি বলের জন্য ঝগড়া করে। অথচ তারা দুজনে একই দলের। যে দলের সদস্যরা একে অপরের সাথে যোগাযোগ করে, তারা যখন এমন পরিস্থিতিতে পড়ে তখন তৃতীয় এক খেলোয়াড় চিৎকার করে, ‘একই দল!’ এতে করে তৃতীয়জন সমঝোতা করে দেয়। এতে করে দলের অভ্যন্তরীণ বল নিয়ে কাড়াকাড়ির জন্য অন্য কেউ বল নিয়ে যাওয়ার সুযোগ পায় না। এই হচ্ছে দলের সদস্যদের মধ্যে একে অপরের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করার সুবিধা। এতে করে দলের সদস্যরা একে অপরকে বুঝে এবং সেই অনুযায়ী কাজ করে যাতে দলের স্বার্থ ও উদ্দেশ্য রক্ষা পায়।

ঠিক একই কথা খেলাধুলা ভিন্ন অন্য যেকোনো সংগঠনের জন্যও প্রযোজ্য। স্পষ্ট ও পরিষ্কারভাবে দলের সদস্যরা একে অপরের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতে হবে এবং দলনেতাকে এ ব্যবস্থা তৈরি করতে হবে। তারচেয়েও বড় কথা, প্রতিদিনকার চেষ্টা থাকতে হবে যে এ যোগাযোগের মধ্যে একটি ইতিবাচক আবহ বজায় থাকে। দলের লোকজন যেন এমন এক পরিবেশ পায় যেখানে তারা মন খুলে কথা বলতে পারে, যেখানে তারা নিরাপদ পরামর্শ দিতে পারে এবং কোনো সমালোচনার স্বীকার হওয়ার ভয় থাকবে না। তারা মুক্তভাবে একে অপরের সাথে আলোচনা করতে পারে, তথ্য বিনিময় করতে পারে এবং বিভিন্ন ধরনের আইডিয়া নিয়ে কথা বলতে পারে। তাদের মধ্যে নেতিবাচক সমালোচনার মুখোমুখি হতে হবে এমন কোনো ভয় থাকবে না। দলের সদস্যদের মধ্যে মন খুলে কথা বলতে পারা দলের কর্মদক্ষতা ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করে।


দলের সদস্যরা একত্রে বেড়ে ওঠে


একবার যখন দলের সদস্যরা একে অপরের প্রতি যত্নশীল হবে, একটি সাধারণ লক্ষ্য থাকবে এবং একে অপরের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করবে তখন তারা সমৃদ্ধ হবে, বেড়ে উঠবে। একটি সংগঠনে একজন দলনেতার কাজ হচ্ছে দলের সদস্যদের প্রতিনিয়ত সমৃদ্ধ হওয়ার দিকটা নজর রাখা এবং সুসমন্বিত করা। দলনেতাকে নিশ্চিত করতে হবে যে তার দলের সদস্যরা যেন ব্যক্তিগত ও পেশাগত, উভয় দিক দিয়ে সমৃদ্ধ হয়, বেড়ে ওঠে। আর দলনেতাকে অবশ্যই দেখতে হবে যেন এ সমৃদ্ধি দলবদ্ধভাবে― একটি দল হিসাবে গড়ে ওঠে।

আমি যখন আমার দলের সদস্যদের সমৃদ্ধ করছিলাম, আমি বিভিন্ন ধরনের উপায় অবলম্বন করলাম। প্রথমে, আমরা সকলেই প্রতিনিয়ত শিখতাম। কমপক্ষে মাসে একবার। এভাবে সংগঠনের সবাই প্রত্যেকের ব্যাপারে জানত এবং একে অপরের অভিজ্ঞতা শেয়ার করত। তাদের পদ, পদবি বা দায়িত্ব, যাই হোক না কেন, তারা একে অপরের কাছে মন খুলে কথা বলত।

দ্বিতীয়ত, আমি নিয়মিত ছোট ছোট দল গড়ে তুলতাম যারা শিখতে আগ্রহী তাদের নিয়ে। আমি এমন তিন চারটি দলকে একটি প্রজেক্টে কাজ দিতাম যেখানে তাদেরকে নতুন কিছু শিখতে হতো। এতে করে লোকজনের মধ্যে দৃঢ় সম্পর্ক তৈরি হতো। এ বুদ্ধি বেশ ভালো কাজে দিয়েছে। ছোট ছোট দল হওয়াতে তারা একে অপরের সাথে সহজেই যোগাযোগ করতে পারে এবং একত্রে কাজ সম্পর্কে অনেক কিছু শিখতে পারে। এতে করে আপনি নিজেও আইডিয়া পাবেন যে বিভিন্ন ধরনের দল একসাথে কীভাবে কাজ করে।

সবশেষে, আমি প্রায়ই আমার দলের সদস্যদের বিভিন্ন কনফারেন্স, ওয়ার্কশপ ও সেমিনারে পাঠাতাম। তারা যখন ফিরে আসত, তখন আমি আমাদের সংগঠনে তাদের কথা বলার সুযোগ করে দিতাম। এতে করে তারা যা শিখেছে তা তারা অন্যদের শেখানোর সুযোগ পেত। এতে করে সকলেই একে অপরকে শেখানোর ও শেখার সুযোগ পেত। অভিজ্ঞতা শেয়ার করা এবং একে অপরকে শেখানো ও শেখার ফলে দলের মধ্যে যোগাযোগ আরও দৃঢ় ও মজবুত হতো। এতে করে দলের সমৃদ্ধি আরও গতিশীল হয়।


দলের সুস্বাস্থ্যের জন্য কাজ করুন


লোকজন যখন একে অপরের ব্যাপারে যত্নশীল হয়, সমৃদ্ধ হয় এবং একটি কমন লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যায়, তখন তারা একে অপরের ব্যাপারে আরও ভালোভাবে জানতে পারে। তারা একে অপরের শক্তিশালী দিকগুলোর ব্যাপারে জানতে পারে এবং একে অপরের দুর্বলতার ব্যাপারে সচেতন থাকে। তারা একে অপরের বিশেষ দক্ষতার প্রশংসা করে। আর তাই একটি দলকে ‘দলীয় সুস্বাস্থ্যের’ দিকে নিয়ে যায়।

একটি দলের সুস্বাস্থ্য অনেক কিছুর ওপর নির্ভর করে। এ কেবল মেধাবী লোকজনকে এক জায়গায় কাজ করার সুযোগ দেওয়াই নয়, তারচেয়েও বেশি কিছু। আমরা অনেকেই দেখেছি মেধাবী লোকজনকে নিয়ে এক জায়গায় কাজ করার সুযোগ করে দেওয়ার পরও তারা ঠিকভাবে কাজ করতে পারেনি। তাদের মেধা থাকা সত্ত্বেও তাদের মধ্যে দলবদ্ধতার রসায়ন কাজ করে না।

 

একটি দলের সুস্বাস্থ্যের জন্য দরকারি জিনিস হচ্ছে একটি অংশীদারি মনোভাব (ধহ ধঃঃরঃঁফব ড়ভ ঢ়ধৎঃহবৎংযরঢ়)। দলের প্রত্যেক সদস্যকে অবশ্যই অন্য সদস্যকে সম্মান ও শ্রদ্ধা করতে হবে। তাদের সকলকেই দলে অবদান রাখার চেষ্টা করতে হবে এবং একে অপরের প্রতি অবদান রাখা ও অন্যের থেকে অবদান পাওয়ার আশা থাকতে হবে। একেই বলে বিশ^স্ততা। এ বিশ^াসই একে অপরের উপর ভরসা রাখতে সাহায্য করবে। এতে করে তারা একে অপরের দুর্বলতার শক্তিতে পরিণত হবে, নাকি দুর্বলতার সমালোচক হবে। এ ভরসার ফলে দলের এক সদস্য অন্যকে বলবে, ‘এ কাজটা তুমি করো, কারণ এ কাজে তুমি আমার চেয়ে বেশি দক্ষ।’ এ কথা তারা কোনো ধরনের লজ্জা বা কারসাজি ছাড়াই বলতে পারবে। একদল লোক একটি স্বতন্ত্র ইউনিট হিসাবে তখনই কাজ করতে পারে যখন তাদের মধ্যে ভরসা থাকে, বিশ^াস ও আস্থা থাকে। এতে করে তারা সবাই মিলে যা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করে ঠিক তাই অর্জন করতে পারবে। সদস্যরা একবার যখন একে অন্যকে জেনে যাবে এবং একে অন্যকে বিশ^াস করা শুরু করবে, তখন তারা দলীয় সুস্বাস্থ্য তৈরি করা আরম্ভ করবে। এখান থেকেই একটি দলের ব্যক্তিত্ব তৈরি হয় এবং দলীয় গর্ববোধের সূচনা ঘটে।


দলের সদস্যরা তাদের ব্যক্তিগত অধিকারের চেয়ে দলের সবচেয়ে ভালো হবে কীসে তাতে বেশি গুরুত্ব দেয়


একবার যখন দলের সদস্যরা তাদের দলগত লক্ষ্যের প্রতি বিশ^াস রাখতে শুরু করে এবং নিজেদের মধ্যে আস্থা স্থাপন করতে সক্ষম হয়, তখন তারা এমন এক জায়গায় থাকে যেখান থেকে তারা দলবদ্ধ কাজের প্রকৃত রূপ ফুটিয়ে তুলতে পারে। তাদের মধ্যকার পারস্পরিক আস্থা ও বিশ^াসই তাদেরকে তাদের ব্যক্তিগত অধিকারের চেয়ে দলের সবচেয়ে ভালো হবে কীসে তাতে বেশি গুরুত্ব দিতে উদ্বুদ্ধ করে।

আপনি নিশ্চয় লক্ষ করেছেন, আমি বলেছি তখন তারা এমন এক জায়গায় থাকে যেখান থেকে তারা দলবদ্ধ কাজের প্রকৃত রূপ ফুটিয়ে তুলতে পারে। এর মানে এ নয় যে তারা ঠিক ঠিক এমনই করবে। আসলে দলবদ্ধ কাজ সম্পন্ন হওয়ার জন্য কিছু জিনিস আগে সম্পন্ন হওয়া দরকার। প্রথমত, তাদের আসলেই বুঝতে হবে যে দলবদ্ধভাবে কাজ করে দলের জন্য সাফল্য আনাটা একজন ব্যক্তির কেবল নিজ স্বার্থে কাজ করে যাওয়ার চেয়েও বড়। তারা একমাত্র তখনই এমন কাজ করতে পারবে যখন তারা সত্যিই একে অপরের প্রতি যত্নশীল হবে এবং দলনেতা কার্যকরভাবে যখন দেখাতে পারবে যেকোনো জিনিস সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তারপর তারা বুঝতে পারবে যে তাদের সাফল্য মূলত দলের সাফল্য থেকেই আসবে।

দ্বিতীয়ত, দলের সদস্যরা তাদের ব্যক্তিগত অধিকারের চেয়ে দলের সবচেয়ে ভালো কীসে তাতে বেশি গুরুত্ব দিবে। তাই আত্মোৎসর্গকে উৎসাহিত করা দরকার। দলনেতা ও দলের অন্যান্য সদস্যরা মিলে এ আত্মোৎসর্গকে পুরস্কৃত করা দরকার। এভাবে দলের সদস্যরা একে অপরের জন্য আরও বেশি বেশি কাজ করবে এবং দলের জন্য নিবেদিত প্রাণ হবে। তখন এমন এক সময় আসবে, যখন তাদের বলা লাগবে না যে ব্যক্তিগত জয় কেবল ছোট ছোট সম্মাননা আনতে পারে, কিন্তু দলবদ্ধ জয় মানে বিরাট কিছু।


দলের প্রত্যেক সদস্যই একটি বিশেষ ভূমিকা পালন করে


দলের সুস্বাস্থ্য যখন বজায় থাকবে এবং প্রত্যেকেই দলকে গুরুত্বের দিক দিয়ে আগে স্থান দিবে, তখন লোকজন দলের মধ্যে তাদের বিশেষ ভূমিকার কথা উপলব্ধি করবে। তারা এ ভূমিকা পালন করবে কারণ তারা জানে যে দলগত বিজয় অর্জনের জন্য কী কী করতে হয় এবং তারা তাদের দলের সদস্যদেরও সক্ষমতা সম্পর্কে সচেতন। এ বোঝাপড়া নিয়ে এবং দলনেতা থেকে কিছু উৎসাহ থাকলে লোকজন আনন্দের সাথে নিজ নিজ ভূমিকা ঠিকভাবে পালন করতে সক্ষম হবে। লেখক ফিলিপ ভ্যান অকেন তাঁর বই দ্য ওয়েল-ম্যানেজড মিনিস্ট্রি তে এ গুণকে অন্যতম গুণ হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। তিনি বলেন, ‘মানুষ একটি দলে কাজ করতে গিয়ে নিজেকে দলের একজন গুরুত্বপূর্ণ ও দায়িত্বপ্রাপ্ত সদস্য হিসাবে চিন্তা করে এবং সেই গুরুত্ব ও দায়িত্ব অনুযায়ী কাজ করার চেষ্টা করে।’

একটি আদর্শ অবস্থা হচ্ছে, প্রত্যেক ব্যক্তি তার শক্তিশালী দিক নিয়ে কাজ করবে এবং এর উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি ঘটাবে। এতে করে প্রত্যেক ব্যক্তির প্রতিভা আরও সমৃদ্ধ হবে। তবে এ পদ্ধতিতে যে সবসময় কাজ হবে তাও নয়। কারণ দলের সাফল্যের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে, দলের সদস্যদের মধ্যে নমনীয়তা ও সহজবোধ্যতা থাকা। উদাহরণস্বরূপ, বাস্কেটবল খেলোয়াড় ম্যাজিক জনসনের কথা বলা যায়। পেশাগতভাবে বাস্কেটবল যারা খেলে তারা সকলেই ম্যাজিক জনসনের কথা জানে। তিনি লস এনঞ্জেলস লেকারস দলে খেলতেন। সেই ১৯৮০ সাল থেকে। তখন তারা বাস্কেটবলের সবচেয়ে নামকরা দল ছিল। জনসনের সবচেয়ে শক্তিশালী দিক ছিল তিনি খেলায় জেতার জন্য যা যা দরকার তার ব্যবস্থা করতে পারতেন। বিশেষ করে তিনি অন্যদের ভালো খেলতে উৎসাহ দিতে পারতেন। এর সাথে সাথে দল জয়ী হওয়ার জন্য যখন যেমন ভূমিকা দরকার হতো জনসন তেমন দক্ষতা দেখাতে পারতেন। তিনি বাস্কেটবল প্রতিযোগিতায় খেলার সময় গার্ড, ফরওয়ার্ড ও সেন্টার অবস্থানেও নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করেছেন। তিনি হয়তো একমাত্র খেলোয়াড় যিনি এমন বিভিন্ন অবস্থানে থেকেও নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করেন।

সবচেয়ে দরকারি জিনিস হচ্ছে দলের সকল সদস্যকে সংগঠনের লক্ষ্য ও প্রয়োজন অনুযায়ী ভূমিকা পালন করতে হবে। এর সাথে সাথে নিজেদের ব্যক্তিগত মেধা ও দক্ষতা কাজে লাগাতে হবে। যখন কোন এক ভূমিকা দলের লক্ষ্য ও প্রয়োজনের সাথে মিলে না তখন পুরো দলের সমস্যা হয়।

আপনি যদি দলের দলনেতা হন, তবে আপনাকে অবশ্যই বুঝতে হবে দলের কোন কোন সদস্যের কোন কোন ভূমিকা রয়েছে যা সংগঠনের লক্ষ্য ও প্রয়োজনের সাথে খাপ খায়। আর আপনি যখন দেখবেন কোন এক ভূমিকা দলের লক্ষ্য ও প্রয়োজনের সাথে খাপ খায় না তখন আপনাকে সেই ভূমিকাকে বদলে দলের লক্ষ্য ও প্রয়োজন অনুযায়ী ভূমিকা গ্রহণের জন্য দিকনির্দেশনা দিতে হবে।


একটি দক্ষ দলের রিজার্ভেও দক্ষ লোকজন থাকে


খেলাধুলায় রিজার্ভ বেঞ্চে কিছু খেলোয়াড় বসে থাকে। অনেকে এ থেকে ভুল ধারণা করে। এদের অতিরিক্ত খেলোয়াড় বলা হয়। একটি দলে এমন দক্ষ লোকজন রিজার্ভে থাকা ভালো। তবে মানুষ যে ভুল ধারণা করে তা হচ্ছে যেসব খেলোয়াড় দিয়ে খেলা আরম্ভ হয় তারা মনে হয় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। অন্যরা যারা বেঞ্চে অপেক্ষা করে তারা হয়তো ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। কিছু কিছু মানুষ চিন্তা করে যাদের দিয়ে খেলা শুরু হবে তাদেরকে ঢেলে সাজানোই গুরুত্বপূর্ণ। যারা বেঞ্চে অপেক্ষা করে তাদেরকে তত গুরুত্ব দেওয়ার দরকার নেই। তাদেরকে খেলার জন্য ততটা প্রস্তুত না করলেও চলবে। কিন্তু সত্য হচ্ছে, যে দলের রিজার্ভে দক্ষ লোকজন থাকে তারা অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে। রিজার্ভে একদল দক্ষ লোক ছাড়া একটি দল কখনো জয়ী হতে পারে না।

প্রথমত, রিজার্ভ বেঞ্চের সদস্যরা ভরসা দেয়। খেলাধুলায়, অনেক দলই ভালো খেলে এবং প্রতিযোগিতায় ভালো ফলাফল আনতে সক্ষম। কিন্তু প্রতিযোগিতা যখন আরও তীব্র হয়ে ওঠে, ধরুন জাতীয় বা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রতিযোগিতা হয়, তখন কেবল সামনের সারির লোকজন দিয়ে দল ভালো খেলতে পারে না। তখন দরকার হয় বেঞ্চের সদস্যদের ভরসা। যে দলের রিজার্ভ বেঞ্চে ভালো সদস্য থাকে না তারা বেশিদূর যেতে পারে না। আমি এখন পর্যন্ত এমন কোনো চ্যাম্পিয়ন দল দেখিনি যাদের ভালো রিজার্ভ বেঞ্চে লোক ছিল না। সত্যি বলতে, এ বইয়ের মূল বিষয়ই হচ্ছে একটি ভালো রিজার্ভ বেঞ্চ তৈরি করার উপায় নিয়ে; কীভাবে লোক নির্বাচন করবেন, লোকজনকে কাজের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ দিবেন এবং মানুষকে আরও সমৃদ্ধ করবেন যাতে তারা তাদের কাজ সর্বোত্তম উপায়ে করতে পারে।

দলের রিজার্ভ বেঞ্চ রাখার আরেকটি সুবিধা হচ্ছে এতে করে পুরো দলের মধ্যে এক ধরনের ঐকতান বিরাজ করে। এটা সত্য কথা। কারণ দলের প্রস্তুতি নির্ভর করে বেঞ্চের সদস্যদের প্রস্তুতির ওপর। যদি খেলা আরম্ভকারী খেলোয়াড়রা কেবল দুর্বল প্রতিপক্ষের বিপরীতে প্রস্তুতি নেয় তবে তাদের কর্মদক্ষতা কখনোই সমৃদ্ধ হবে না। কিন্তু রিজার্ভে একদল দক্ষ সদস্য থাকলে আরম্ভকারী খেলোয়াড়রা প্রতিনিয়ত উন্নত হতে উৎসাহ পায়। এ কথা যেকোনো প্রতিষ্ঠানের জন্য সত্য। যদি একটি সংগঠনের কর্মদক্ষতা প্রতিনিয়ত উন্নত হতে থাকে, তবে যখন দরকার হবে তখন দলের কর্মদক্ষতা ও উৎপাদনশীলতা সর্বোচ্চ থাকবে।

সবশেষে বলব, একটি সফল দল তৈরি করতে হলে একটি দক্ষ রিজার্ভ বেঞ্চ আবশ্যক। বেঞ্চে দক্ষ সদস্য থাকলে একজন ক্লান্ত খেলোয়াড় বিশ্রাম নিতে পারে এবং তার জায়গায় রিজার্ভ সদস্য কর্মদক্ষতা দেখাতে পারে। এতে করে মূল কাজের কোনো ব্যত্যয় ঘটে না। সফল দলের মধ্যে একজন সদস্য যখন ক্লান্তি, অবসাদ বা আহত হয়ে যাওয়ার কারণে আর বেশি কর্মদক্ষতা দেখাতে পারছে না, তখন তার রিজার্ভ সদস্যরা এ দায়িত্ব নেয় এবং তাকে বিশ্রাম করা সুযোগ দেয়। দলবদ্ধ কাজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে দলের সদস্যের যখন দরকার হয় (ক্লান্তি, অবসাদ বা আহত হওয়ার কারণে আর এগিয়ে যেতে পারছে না), তখন অন্য সদস্যরা নিজ ইচ্ছায় তার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিবে। এতে করে বোঝা যায় একজন সদস্য দল ও দলের লক্ষ্যকে সবার আগে গুরুত্ব দেয়।

 

দলের নীতিনৈতিকতা কেন এবং কী তা যেন দলের সদস্যরা স্পষ্টভাবে জানে


খেলাধুলার ক্ষেত্রে, একটি দল কখন কোন পর্যায়ে কেমন নীতিনৈতিকতা নিয়ে অবস্থান করবে তা খুব গুরুত্বপূর্ণ। সফল দলের সদস্যরা এ ব্যাপারে সদা সচেতন। আর ঠিক এ অবস্থান সম্পর্কে জানতে না পারাই গড়পড়তা দল ও সফল দলের মধ্যে পার্থক্য গড়ে দেয়। মেধার পাশাপাশি গুণাবলিও খুব গুরুত্বপূর্ণ। চারিত্রিক এ গুণাবলি একজন খেলোয়াড়কে উত্তমভাবে খেলতে উৎসাহ দেয়। ছাত্ররা যেমন কলেজ থেকে বিশ^বিদ্যালয়ে ওঠে। তেমন চারিত্রিক গুণাবলিও একজন খেলোয়াড়কে আরও উপরের অবস্থানে নিয়ে যায়। একেক কোচ হয়তো গুণাবলির এ বিষয়কে একেক নামে ডাকে। একজন ফুটবল কোচ হয়তো একে ফুটবল চেতনা বলে। আবার একজন বাস্কেটবল কোচ একে মাঠ চেতনা বা ভিশন বলে। এ হচ্ছে খেলার মাঠে চরম উত্তেজনার মধ্যেও আর কত সময় বাকি আছে তা জানা, কত পয়েন্ট পিছিয়ে আছে বা কোন খেলোয়াড় ভালো খেলে অথবা আহত তা জানা। এ এমন এক গুণ যা একজন খেলোয়াড়কে ভালো খেলোয়াড়ে পরিণত করে এবং একটি দলকে মহান করে তোলে।

খেলাধুলার বাইরে, এ গুণকে বলা যায় সাংগঠনিক চেতনা। এর মানে হচ্ছে সংগঠনের কোথায় কী হচ্ছে, কীভাবে হচ্ছে এবং তা সংগঠনের লক্ষ্যের সাথে কতটা সম্পৃক্ত তা জানা। প্রতিযোগীদের সাথে সামঞ্জস্য বা বিভিন্ন সদস্যের মধ্যে কে কীভাবে কাজ করছে এবং কীভাবে দলের লক্ষ্য পূরণের জন্য কাজ করা দরকার তা জানা। একটি দলের সব সদস্য যে এ গুণের অধিকারী হবে তা নয়। এ হচ্ছে দলনেতার কাজ। তিনি সকল সদস্যের ওপর চোখ রাখবেন। সকলের কথা শুনবেন এবং দরকারি জিনিস সকলকে জানাবেন। তিনি দলের গতিবিধি লক্ষ রাখবেন, অগ্রগতি খেয়াল করবেন এবং দলের সদস্যদের দলের লক্ষ্য ও নীতিনৈতিকতা সম্পর্কে অবহিত করবেন। তাকে অবশ্যই দলের লক্ষ্যের সাথে দলের সদস্যদের কার্যক্রমকে এক সুতায় গাঁথতে হবে। তিনি দলের সদস্যদের এমন এমন জায়গায় দাঁড় করাবেন যাতে করে দল সাফল্য অর্জন করতে সক্ষম হয়।

 

দলের সদস্যদের মধ্যে দলীয় বিজয় অর্জনের জন্য ব্যক্তিগত স্বার্থ উৎসর্গ করার মানসিকতা থাকতে হবে


সময়ের সাথে সাথে সাফল্য এমন অবস্থানে আসে যখন ব্যক্তিগত স্বার্থ উৎসর্গ করার দরকার পড়ে। এর মানে হচ্ছে আপনি যা কিছু অর্জন করতে চান তা অর্জনের জন্য প্রয়োজনীয় দাম পরিশোধ করা। দলের প্রত্যেক সদস্যকে প্রতিনিয়ত অনুশীলন ও প্রস্তুতির জন্য প্রয়োজনীয় সময় ও শক্তি উৎসর্গ করতে হবে। তাকে অবশ্যই জবাবদিহি করার মানসিকতা রাখতে হবে। তাকে অবশ্যই নিজের ব্যক্তিগত স্বার্থ উৎসর্গ করার মানসিকতা রাখতে হবে। তাকে অবশ্যই দলীয় জয় অর্জনের জন্য নিজের পক্ষ থেকে কিছু ছাড় দিতে হবে।

একজন ব্যক্তি দলের জন্য কী করতে আগ্রহী এবং নিজের স্বার্থ কতটা উৎসর্গ করতে পারে তার ইচ্ছার ওপর দলের সফলতা নির্ভর করে। খেলাধুলার মতো ব্যবসায়িক জগতেও এর গুরুত্ব বেশি। এমনকি যুদ্ধের জন্যও এ কথা সত্য। সেনাপতি নরম্যান শোয়ারজকফকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, ‘আপনি যুদ্ধ থেকে সবচেয়ে বড় কী শিক্ষা পেলেন?’ তিনি জবাব দেন:

‘আমার মনে হয় সেনাবাহিনীতে একটাই মৌলিক সত্য রয়েছে। আর তা হচ্ছে বাহিনীর শক্তির সাথে নিজের শক্তিকে একীভূত করা। আপনার কাছে ট্যাংক আছে, বিমান আছে এবং মাটিতে সৈন্য আছে। কিন্তু তারপরও মাটিতে থাকা সৈন্য বা বিমানে থাকা বৈমানিকের মনে যদি জয়ের ইচ্ছা না থাকে, যুদ্ধে যাওয়ার মতো চারিত্রিক দৃঢ়তা না থাকে, যে কারণে সে যুদ্ধ করছে সেই কারণের ওপর যদি তার বিশ^াস না থাকে এবং তার দেশ থেকে যদি সে সমর্থন না পায় তবে বাকি সবকিছু অপ্রাসঙ্গিক।’

প্রত্যেক ব্যক্তির মনের মধ্যে যদি লক্ষ্য ও কী কারণে সে কাজ করছে সেই সম্পর্কে দৃঢ় বিশ^াস না থাকে, তবে সে কখনোই কোনো লড়াইয়ে জয়ী হবে না। আর সেই দলও সফল হবে না। তাদের মধ্যে অবশ্যই দৃঢ় বিশ^াস থাকতে হবে। আপনি যখন আপনার সংগঠনে এমন একটি দল গঠন করবেন, তখন আপনি এমন পর্যায়ের সাফল্য অর্জন করতে সক্ষম হবেন যা আগে কখনো চিন্তা করেননি। একটি দূরদর্শী স্বপ্নকে পূরণ করতে দরকার দলবদ্ধ কাজ। দলবদ্ধ কাজই সাধারণ লোকজনকে একত্রিত করে অসাধারণ সব ফলাফল লাভ করে। আর দলের সদস্যরা যখন সাধারণ না হয়ে, নেতা হয়ে ওঠে, তখন তারা তাদের সাফল্যকে বারবার কপি করতে সক্ষম হয়।



 

দলের একজন ভালো টিম প্লেয়ার হওয়া মানে কী বোঝায়?


উত্তম টিম প্লেয়াররা সবসময় দলকে প্রথমে গুরুত্ব দেয়।


যখন জীবনমরণ সমস্যা দেখা দেয় তখন বেশির ভাগ লোক অন্যদের চেয়ে নিজের জীবন বাঁচাতে চিন্তা করে। তবে ফিলিপ টোসি এমন কাজ করেননি। তিনি দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা ছিলেন। তিনি নিজেকে রক্ষা করার অনেক সুযোগ পান। কিন্তু তিনি সবসময় দলের কথা চিন্তা করেছেন।

টোসি ১৯২৭ সালে, মাত্র ২৩ বছর বয়সে আঞ্চলিক সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। এটা ছিল মূল সেনাবাহিনীর এক ধরনের সংরক্ষিত বাহিনী। তিনি সেনাবাহিনীতে যোগ দেন, কারণ তিনি ব্যাংক বা অন্যান্য সেবামূলক কাজকর্মের চেয়ে সৈন্য হিসাবে দেশরক্ষার কাজকে বেশি গুরুত্ববহ মনে করতেন। তবে তার আরও শখ ছিল। তিনি ভালো খেলোয়াড় ছিলেন এবং রাগবি খেলা পছন্দ করতেন। তার অন্যান্য বন্ধুদের সাথে তিনিও সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। তিনি গোলান্দাজ বাহিনীতে পদোন্নতি পান। সেখানে তিনি নেতা হিসাবে উত্তম ভূমিকা রাখেন এবং ব্যাটারি বাহিনীর কমান্ডার হন। এরপর তিনি মেজর পদে উন্নীত হন।

১৯৩৯ সালে, তিনি ও তার বাহিনী পুরোদমে যুদ্ধে অংশ নেয়। তখন পুরো ইউরোপ জুড়ে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে। তিনি ফ্রান্সে কিছুদিন কর্মরত ছিলেন। তারপর প্রশান্ত মহাসাগরে কাজ করেন। তারপর তিনি মালয় পেনিনসুলাকে রক্ষার ব্যর্থ চেষ্টা করেন। তারপর জাপানিজ আগ্রাসন থেকে সিঙ্গাপুরকে রক্ষার চেষ্টা করেন। এ সময়ের মধ্যে টোসি লুটেনেন্ট কর্নেল এবং ১৮তম ডিভিশনের ১৩৫তম রেজিমেন্টের প্রধান হিসাবে পদোন্নতি পান। যদিও তিনি ও তার বাহিনী বেশ ভালোভাবে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু ব্রিটিশ বাহিনীকে সিঙ্গাপুর থেকে পিছিয়ে আসতে বাধ্য হতে হয়েছে।

এ সময় টোসি তার চারিত্রিক দৃঢ়তা দেখাতে সক্ষম হন। তিনি স্বার্থহীন কাজ করে অন্যদের যাওয়ার রাস্তা করে দেন। ব্রিটিশরা যখন বুঝতে পারল আত্মসমর্পণ করতে হবে, তখন টোসি তার বাহিনীর সদস্যদের চলে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন। আর তিনি গোলান্দাজ কর্মকর্তা হিসাবে একা জাহাজে রয়ে গেল এবং যুদ্ধ চালিয়ে গেলেন। তিনি আত্মসমর্পণ করবেন না। পরবর্তীতে তিনি এ কথা স্মরণ করে বলেন:

‘আমি নিজের কানকে বিশ^াস করতে পারছিলাম না। তিনি যখন আঞ্চলিক বাহিনীতে ছিলেন তখন তিনি গোলান্দাজ বাহিনীর আচরণবিধি পড়েছিলেন। যদিও যুদ্ধের এমন মুহূর্তে কে যাবে আর কে থাকবে তা আলোচনার বিষয় হতে পারে। কিন্তু তিনি পূর্বের গোলান্দাজ প্রশিক্ষণ আচরণবিধি, ভলিউম ২ এর কথা স্মরণ করে বলেন, আমার স্পষ্ট মনে আছে সেখানে বলা হয়েছে যেকোনো আত্মসমর্পণের ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দানকারী কর্মকর্তা সবশেষে স্থান ত্যাগ করবে।’

তিনি জানতেন তিনি যদি আগে আগে তার দলকে ত্যাগ করে পালিয়ে যান তবে অন্যদের চরিত্রের ওপর এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এরপর, ১৯৪২ সালের ফেব্রুয়ারিতে মিত্রবাহিনী যখন জাপানিজ বাহিনীর হাতে আত্মসমপর্ণ করল তখন টোসি তার বাহিনীর সাথে যুদ্ধবন্দি হিসাবে কারাগারে ছিল।

টোসি ও তার বাহিনীকে নিয়ে যাওয়া হয় তামারকানের নিকট এক যুদ্ধবন্দি শিবিরে। থাইল্যান্ডের প্রধান নদী, কোয়াই এর পাশেই এ বন্দিশালা। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হিসাবে তিনি মিত্রবাহিনীর বন্দিদেরও প্রধান ছিলেন। তাকে জাপানিরা নদীর ওপর দিয়ে একটি ব্রিজ তৈরি করার কাজে পাঠায়। (কোয়াই নদীর ওপর ব্রিজ তথা ঞযব ইৎরফমব ড়হ ঃযব জরাবৎ কধির নামে পরবর্তীতে একটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। তবে টোসি সিনেমার কর্নেল নিকোলসনের মতো ছিলেন না।)

প্রথমে যখন ব্রিজ তৈরির অর্ডার আসে, তখন টোসি তা প্রত্যাখ্যান করতে চেয়েছিলেন। ১৯০৭ সালে হল্যান্ড বা নেদারল্যান্ডের হেগ সম্মেলনে বলা হয়েছে, যুদ্ধবন্দিদের দিয়ে জোর করে এমন কোনো কাজ করানো যাবে না যাতে তাদের শত্রুদের সহায়তা হয়। যেখানে জাপানিরাও স্বাক্ষর করেছে। কিন্তু টোসিও জানতেন, প্রত্যাখ্যানের ফলে অন্যের মধ্যে প্রতিশোধ গ্রহণের ইচ্ছা জেগে উঠবে। যা হতে পারে তাৎক্ষণিকভাবে শারীরিক আঘাত ও কঠোর নির্যাতন। পিটার এন. ডেভিস ছিলেন টোসির আত্মজীবনীর লেখক। তিনি বলেন, ‘টোসি দ্রুতই বুঝতে পারলেন যে তার হাতে অন্য কোন উপায় নেই। এ অর্ডার গ্রহণ করা ছাড়া তিনি ভিন্ন কিছু করতে পারবেন না। তবে এ কাজে তার ও তার বাহিনীর লোকজনের মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে।’

টোসি বন্দিশালার বন্দিদেরকে জাপানিদের সাথে সহযোগিতা করতে জিজ্ঞেস করলেন। তবে টোসি তার লোকজনের জন্য প্রতিদিন সংগ্রাম করে গেছেন। পর্যাপ্ত খাবার, কর্মঘণ্টা এবং সপ্তাহে একদিন ছুটির জন্য দৃঢ়প্রত্যয়ের সাথে টোসি তর্কবিতর্ক করে গেছেন। টোসি পরবর্তী সময় তার অভিজ্ঞতার স্মরণে বলেন, ‘আপনি যদি এমন দায়িত্ব নেন, যেমন আমি নিয়েছি, তবে তা প্রতিনিয়ত আপনার দুর্দশা বৃদ্ধি করবে।’ তাকে নিয়মিত মারধর করা হতো এবং সূর্যের নিচে ১২ ঘণ্টা ধরে দাঁড় করিয়ে রাখা হতো। তারপরও তিনি বন্দিদের জন্য ভালো সুযোগ-সুবিধার দাবি জানিয়ে যান। দেখা যায়, দশ মাসের কঠোর পরিশ্রমের পর যখন ব্রিজ তৈরি হয়, তখন মাত্র নয়জন বন্দি মৃত্যুবরণ করে।

এরপর টোসি যুদ্ধবন্দি শিবিরের হাসপাতালের দায়িত্বে থাকেন। সাধ্যে যতটুকু সম্ভব ছিল টোসি তার লোকজনের জন্য সবটুকু করতে চেষ্টা করেছেন। হাসপাতালে যত বন্দি আসত, টোসি নিজে তাদের সাথে দেখা করতেন। এমনকি গভীর রাতে গিয়েও খোঁজখবর নিতেন। তিনি চোরবাজারের সাথেও লেনদেন করেছেন, যাতে বন্দিরা নিয়মিত ঔষধ, খাবার ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় উপকরণ পেতে পারে। যদিও এর শাস্তি ছিল মৃত্যুদ-। জাপানিজ গার্ডরা যদি কোনো রেডিও বা অবৈধ জিনিস পেত, তবে টোসি সেগুলোর দায় নিজের কাঁধে নিতেন। এরপর যখন যুদ্ধ শেষ হয়, তখন টোসির প্রথম চিন্তা ছিল তার রেজিমেন্টের লোকজনের খোঁজ নেওয়া। তিনি তিনশ মাইল অতিক্রম করে তার রেজিমেন্টের লোকজনের খোঁজ নেন এবং তারা নিরাপদে আছে তা নিশ্চিত করেন।

ইংল্যান্ডে ফিরে আসার পর, টোসি তিন সপ্তাহের ছুটি নেন এবং যুদ্ধের পূর্বের যে কাজ করতেন, ব্যাংকের চাকরিতে ফিরে যান। তিনি কখনো যুদ্ধে তার প্রচেষ্টার জন্য সম্মান বা প্রশংসা খোঁজেননি, না তিনি কোয়াই নদীর ওপর ব্রিজ তথা ঞযব ইৎরফমব ড়হ ঃযব জরাবৎ কধির নামক চলচ্চিত্রের ব্যাপারে সমালোচনা করেন। যদিও তিনি চলচ্চিত্রটি অপছন্দ করতেন। যুদ্ধের পর যুদ্ধ সম্পর্কিত তার একমাত্র কাজ ছিল সাবেক যুদ্ধ বন্দিশালা থেকে ছাড়া পাওয়া বন্দিদের নিয়ে কাজ। এ ছিল এমন এক মানুষের অনন্য চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য যিনি তার দলকে সবসময় নিজের আগে গুরুত্ব দিতেন।

সেল্ফলেসনেস গঠন করা


[সেল্ফলেসনেস (ঝবষভষবংংহবংং - পড়হপবৎহ সড়ৎব রিঃয ঃযব হববফং ধহফ রিংযবং ড়ভ ড়ঃযবৎং ঃযধহ রিঃয ড়হব'ং ড়হি) মানে নিজের স্বার্থের চেয়ে অন্যের প্রয়োজন ও চাহিদা নিয়ে বেশি চিন্তিত। একে বাংলায় পরোপকারী বলা যেতে পারে। তবে আমি এ বইয়ে সেল্ফলেসনেসই ব্যবহার করছি।]

কবি ডব্লিউ.এইচ. ওডেন বলেন, ‘আমরা দুনিয়াতে এসেছি অন্যের জন্য ভালো কিছু করার জন্য। আর অন্যরা কেন এসেছে, তা আমি বলতে পারছি না।’ দলবদ্ধ কাজের ক্ষেত্রে কোনো দলই সফল হতে পারে না, যদি না উক্ত দলের সদস্যরা দলের অন্যদেরকে নিজেদের চেয়ে আগে প্রধান্য বা গুরুত্ব দেয়। সেল্ফলেসনেস মানে নিজের স্বার্থের চেয়ে অন্যের প্রয়োজন ও চাহিদা নিয়ে বেশি চিন্তা করা। এটা কোনো সহজ কাজ নয়। কিন্তু এ জিনিস খুব দরকারি।

দলের একজন সদস্য হিসাবে, আপনি কীভাবে সেল্ফলেসনেসের মনোভাব গঠন করছেন? এ কাজগুলো দ্বারা শুরু করুন:


১। মহৎ মনের অধিকারী হোন

সাধু ফ্রান্সিস বলেন, ‘তুমি যদি সবকিছু নিজের দিকে টানতে চাও তবে তুমি অন্যদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। আর তুমি যদি সবকিছু অন্যদের দিতে চাও তবে তুমি অন্যদের সাথে একীভূত হবে।’ সেল্ফলেসনেসের মূল কথা হচ্ছে মহৎ মনের অধিকারী হওয়া। এতে করে আপনি কেবল দলকেই দলবদ্ধ করতে পারবেন তা নয়, এ গুণ দলকে এগিয়ে নিতেও সাহায্য করবে। যদি দলের সদস্যরা নিজের ইচ্ছায় দলের প্রতি নিজেকে নিবেদিত করে তবে সেই দল জয়ের জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত।


২। অভ্যন্তরীণ পলিটিকস তথা কোন্দল এড়িয়ে চলুন

মানুষের মধ্যে স্বার্থপরতার সবচেয়ে খারাপ যে চেহারা দেখা যায় তা হচ্ছে দলের মধ্যে পলিটিকস করা। এ পলিটিকস হতে পারে পদ, পদবি বা ক্ষমতার জন্য। নিজের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য অনেকে এ ধরনের কাজ করে। কিন্তু এমন কাজ দলের সম্পর্ক নষ্ট করে। কিন্তু দলের ভালো সদস্যরা তাদের নিজেদের চেয়ে দলের সদস্যদের স্বার্থ আগে চিন্তা করে। দলের সদস্যদের প্রতি এমন নিঃস্বার্থ কাজই দলকে এগিয়ে নিয়ে যায় এবং উক্ত সদস্যকে দাতা (ঃযব মরাবৎ) হিসাবে চিহ্নিত করে। বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন এ ব্যাপারে চমৎকার এক কথা বলেন, ‘একজন ব্যক্তি তখনই বাঁচতে আরম্ভ করে যখন সে নিজের স্বার্থচিন্তার বাইরে গিয়ে চিন্তা শুরু করে।’


৩। বিশ^স্ততা প্রদর্শন করুন

আপনি যদি আপনার দলের লোকজনের প্রতি বিশ^স্ততা প্রদর্শন করেন তবে তারাও প্রতিক্রিয়া স্বরূপ আপনার প্রতি বিশ^স্ততা প্রদর্শন করবে। ঠিক এ ঘটনাই কর্নেল টোসির সাথে ঘটেছিল। একবার, দুইবার, বারবার তিনি তার দলের লোকজনের জন্য নিজের জীবন বাজি রেখেছেন। আর তারই পরিপ্রেক্ষিতে দলের লোকজন কঠোর পরিশ্রম করেছে, তার নেতৃত্ব মেনে চলেছে এবং যেকোনো মিশন সম্পন্ন করেছে। এমনকি বন্দি থাকা অবস্থায় বা কঠিন পরিস্থিতিতেও তারা যেকোনো কাজ সম্পন্ন করেছে। বিশ^স্ততা এবং একতা আছে। আর একতা দলের জন্য সাফল্য আনে।


৪। স্বাধীন হওয়ার চেয়ে আত্মনির্ভরশীলতাকে বেশি মূল্যায়ন করুন

আমেরিকায়, আমরা স্বাধীনতাকে অনেক বেশি মূল্যায়ন করি, কারণ আমরা একে উদ্ভাবন (রহহড়াধঃরড়হ), কঠোর পরিশ্রম ও ন্যায়-নৈতিকতার পাশে দাঁড়ানোর ইচ্ছাকে বুঝাই। কিন্তু একজন ব্যক্তির চরিত্রের ক্ষেত্রে স্বাধীনতা ব্যাপারটা স্বার্থপরতার দিকে চলে যায়। বিশেষ করে, এটা যখন অন্যদেরকে ক্ষতি করতে ব্যবহার হয়। সেনেকা বলেন, ‘ যে ব্যক্তি নিজেকে একা হিসাবে চিন্তা করে সে কখনো সুখী হতে পারে না, আবার যে ব্যক্তি সবকিছুকে নিজের সুবিধা হিসাবে চিন্তা করে সেও কখনো সুখী হতে পারে না। আপনি যদি নিজের জন্য বাঁচতে চান, তবে আপনাকে অবশ্যই অন্যদের জন্য বাঁচতে হবে।’


 

আরও নিঃস্বার্থপরতার পথে


নিজের চেয়ে অন্যকে উন্নত হতে করতে সাহায্য করুন

আপনি যদি নিজের অর্জন ও সাফল্যকে অন্যদের উন্নত হতে সাহায্য করেন, তবেই আপনি প্রকৃত সুখ পাবেন। মাত্র দুই সপ্তাহ এ কাজ করে দেখুন। দেখবেন, মনের ভেতর কত শান্তি ও সুখ অনুভব করছেন। অন্যদের কাজ এবং গুণাগুণ সম্পর্কে ইতিবাচক কিছু খুঁজে বের করুন এবং তাদেরকে তা বলুন। বিশেষ করে, তাদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, পরিবার ও ঘনিষ্ঠ বন্ধু-বান্ধব সম্পর্কে ইতিবাচক কিছু বলুন।


একটি অধস্তন বা অপ্রধান ভূমিকা নিন

বেশির ভাগ লোকের প্রাকৃতিক স্বভাব হলো সবচেয়ে ভালো জায়গা খুঁজে বসা এবং অন্যদেরকে উন্নতি করতে বাধা দেওয়া। কিন্তু বর্তমানে একটি ইতিবাচক চর্চা চলছে, অন্যদের সেবার করার মনোভাবের চর্চা করা হচ্ছে, অন্যদেরকে আগে যাওয়ার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে অথবা একটি অপ্রধান ভূমিকা রেখে মানুষকে উন্নতি করার পথ দেখিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এক সপ্তাহের জন্য এ কাজ করে দেখুন। দেখবেন তা আপনার মনোভাবের ওপর কেমন প্রভাব ফেলে।


প্রদান করুন গোপনে

লেখক জন বুনইয়ান বলেন, ‘আজকের দিনটা তুমি ভালোভাবে যাপন করতে পারবে না, যদি-না তুমি এমন কাউকে সাহায্য করে থাকো যে তোমাকে তা কখনো ফেরত দিতে পারবে না।’ আপনি যদি আপনার দলের মানুষকে তাদের অজান্তেই সাহায্য করে থাকেন এবং জানেন যে তারা তা আপনাকে কখনো ফেরত দিতে পারবে না, তাই আপনাকে প্রকৃত সুখী করে তুলবে। চেষ্টা করে দেখুন। একে অভ্যাসে পরিণত করুন। দেখবেন, আপনি আর প্রদান করার সুখ থেকে নিজেকে কখনো বঞ্চিত করছেন না।


 



 

আমি কীভাবে একটি বিজয়ী দল তৈরি করব?


প্রত্যেক নেতা’র বিনিয়োগ হচ্ছে তার দল। আর দলই এ বিনিয়োগের উত্তম লভ্যাংশ।


প্রত্যেকেই জানে যে দলবদ্ধ কাজ করা একটি ভালো জিনিস। সত্যি কথা বলতে গেলে, এটা অপরিহার্যও বটে! কিন্তু এটা আসলে কাজ করে কীভাবে? বিজয়ী দল তৈরি করতে কী লাগে? কেন কিছু কিছু দল সোজা বিজয়ের চূড়ায় উঠে যায়, তাদের স্বপ্নকে বাস্তবে পরিণত করে যখন অন্যরা ব্যর্থতার পাঁকে আটকে যায়?

দল হতে পারে যেকোনো আকৃতির। আপনি যদি বিবাহিত হয়ে থাকেন, তবে আপনি ও আপনার স্ত্রী একটি দল। আপনি যদি একটি সংগঠনে কাজ করে থাকেন, তবে আপনি ও আপনার সহকর্মীরা একটি দল। আপনি যদি কোথায় স্বেচ্ছাসেবক হিসাবে কাজ করে থাকেন, তবে আপনি ও আপনার অনুসারী মানুষ মিলে একটি দল। ড্যান ডিভাইন মজা করে বলেছিলেন, ‘একটি দল তো দলের মতোই একটি দল। এ কথা তো শেকসপিয়ারও কত বার বলেছেন।’ যদিও প্রতিভাবান নাট্যকার শেকসপিয়ার ঠিক এ কথা বলেননি, কিন্তু বক্তব্যের মূল কথা তবুও সত্য। এজন্যই দলবদ্ধ কাজ এতো গুরুত্বপূর্ণ।

দল গঠন করতে কীভাবে বিনিয়োগ করবেন?

আমার বিশ^াস বেশির ভাগ মানুষ এটা বুঝতে পারে যে দল তৈরি করলে দলের প্রত্যেকেরই লাভ হয়। এখন আমাদের প্রশ্ন এটা হওয়া উচিত নয় যে তাহলে বেশির ভাগ মানুষ তা করে না কেন। বরং আমাদের প্রশ্ন হওয়া উচিত: দল কীভাবে তৈরি করতে হয়? আমি আপনার সাথে দশটি উপায় শেয়ার করছি, যাতে করে আপনি দল তৈরিতে নিজেকে বিনিয়োগ করতে পারেন। আপনি এ সূত্রাবলি একজন খেলোয়াড় হিসাবে যেমন ব্যবহার করতে পারবেন, তেমন একজন কোচ হিসাবেও কাজে লাগাতে পারবেন। আপনি মালিক হোন বা কর্মচারী, অনুসারী বা নেতা যাই হোন সেখান থেকেই এ বুদ্ধিগুলো কাজে লাগাতে পারবেন। সবসময় মনে রাখবেন, দলের মধ্যে সবসময়ই কেউ না কেউ থাকে যার জ্ঞান, বুদ্ধি ও দক্ষতা থেকে আপনি উপকৃত হতে পারেন। আর যখন দলের মধ্যে সবাই দলের ওপর বিনিয়োগ করে তখন চক্রবৃদ্ধি হারে লভ্যাংশ বৃদ্ধি পায়। সকলেই বেড়ে ওঠে, উন্নত হয় এবং সাফল্য লাভ করে। বুদ্ধি-পরামর্শগুলো নিম্নরূপ:


১। একটি দল তৈরির সিদ্ধান্ত নিন... এ থেকেই দল তৈরির বিনিয়োগ আরম্ভ হয়

বলা হয়ে থাকে, প্রতিটি অভিযাত্রা আরম্ভ হয় প্রথম পদক্ষেপ থেকে। একটি উত্তম দল গঠনের জন্য আপনি যখন লোকজন নির্বাচন করবেন এবং তাদেরকে নিয়ে অসাধারণ এক দল গঠনের চেষ্টা করবেন বলে সিদ্ধান্ত নিবেন, তখনই তা বড় কিছুর প্রতি প্রথম পদক্ষেপ হয়ে দাঁড়ায়। এর জন্য দরকার অঙ্গীকার।


২। যতটা সম্ভব দক্ষ ও যোগ্য লোকদের নিয়ে উত্তম দল তৈরির চেষ্টা করুন... এ থেকেই দলের সম্ভাবনা উন্নীত হয়

আমি যেমন পূর্বেই আলোচনা করেছি, দলে যত দক্ষ ও যোগ্য লোক থাকবে, দলের পক্ষে সাফল্য অর্জন করা তত বেশি সম্ভবপর হয়ে উঠবে। তবে একটি বিষয়ে সতর্ক থাকবেন। এমন একটি জায়গা আছে যেখানে কখনোই সদস্য খোঁজা উচিত নয়। আর তা হচ্ছে পরিবার। অন্য যেকোনো সদস্যদের থেকে দক্ষ ও যোগ্য ব্যক্তিদের নির্বাচিত করে উত্তম দল গঠন করুন।


৩। দল গঠন করতে উপযুক্ত দাম দিন... এ থেকেই দলের অগ্রগতি নিশ্চিত হয়

যখন মরগান বায়ার্ড ওয়াটেন যখন একটি বালককে সাহায্য করতে যান, যে বালক অনাথ আশ্রমে বড় হয়েছে, চুরি সহ অন্যান্য অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে, এমন বালককে তিনি তার বাসায় নিয়ে যান, মায়ের হাতের রান্না খাওয়ান। পরবর্তীতে সেই বালক ওয়াটেনের ভাই-বোনদের সাথে এতই মিলেমিশে যায় যে সে তাদের ভাইয়ের মতোই হয়ে ওঠে। তিনি সেই বালককে ভালো পরিবেশ দিতে, উত্তম জীবন দিতে সর্বাত্মক চেষ্টা করেন এবং উপযুক্ত দাম দেন। এ কাজ মোটেই প্রচলিত ছিল না, না ছিল আরামদায়ক কিছু। কিন্তু তারপরও তিনি করেছেন। এ কাজে তাদের উভয়ের শক্তি, সময় ও অর্থ ব্যয় হয়েছে।

একটি দল গঠন করতে উপযুক্ত দাম দিতে হয়। আপনি যদি একটি দল গঠন করতে চান তবে আপনাকেও উপযুক্ত দাম দিতে হবে। আপনাকে এমন এমন সময় উৎসর্গ করতে হবে যা আপনি নিজের প্রোডাক্টিভিটি তথা উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিতে কাজে লাগাতে পারতেন। আপনাকে অর্থ ব্যয় করতে হবে যা আপনি নিজের সুবিধার্থে ব্যবহার করতে পারতেন। আর মাঝে মাঝে তো নিজের কর্মসূচি পাশে রেখে উক্ত কাজ করতে হবে। কিন্তু এতে যে লাভ হবে তা ব্যক্তি বিশেষে এবং দলের জন্য― যথোপযুক্ত। আপনি যা কিছু দিবেন তা এক প্রকারের বিনিয়োগের মতো।


৪। একটি দলের মতো সব কাজ করুন... এ থেকেই দল একটি কমিউনিটি তথা গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের সুযোগ-সুবিধা লাভ করে

আমি একবার এ কথাটি পড়েছিলাম, ‘যদিও আপনি নিজে নিজের জীবনকে পরিচালিত করছেন, তবুও আপনি মনে রাখবেন কেবল দলবদ্ধ কাজের অনুভূতিগুলো। আপনি ঘটনা ভুলে যাবেন, কত কী করেছিলেন বা কত স্কোর করেছেন তা ভুলে যাবেন, কিন্তু আপনি কখনোই আপনার দলের সদস্যদের ভুলবেন না।’ এ জিনিসই এমন এক গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়কে সংজ্ঞায়িত করে যারা একসাথে কাজ করে।

দলের সদস্যদের মধ্যে কমিউনিটি ও সংহতি গড়ে তোলার একমাত্র উপায় হচ্ছে তাদেরকে নিয়ে একসাথে কাজ করা। শুধু পেশাগত মিটিং করলেই হবে না। বরং ব্যক্তিগতভাবে এক এক করে একে অপরের সাথে ভালো বোঝাপড়া থাকতে হবে। আপনার দলের সদস্যদের সাথে আপনার একটি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরির অনেক পন্থা থাকতে পারে। আবার তারাও একে অপরের সাথে অনেকভাবে যুক্ত হতে পারে। অনেক পরিবারই দূরে কোথাও পিকনিক বা ক্যাম্পিং করতে গিয়ে তাদের মধ্যকার পারিবারিক বন্ধনকে আরও দৃঢ় করে। এমনভাবে সহকর্মীরাও কর্মক্ষেত্রের বাইরে গিয়ে সামাজিক মেলামেশা করতে পারে (অবশ্যই তা এক যথোচিত উপায়ে)। এখানে জায়গা বা সময় তত গুরুত্বপূর্ণ নয়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে দলের সদস্যরা একে অপরের সাথে অভিজ্ঞতা বিনিময় করবে।

৫। দলের সদস্যদের দায়িত্ব ও কর্তৃত্ব দিয়ে ক্ষমতা প্রদান করুন... এ থেকে দলের মধ্যে নেতৃত্ব তৈরি হবে

মানুষের সবচেয়ে বড় অগ্রগতি ঘটে যখন তারা নিজেদের চেষ্টা ও ভুল থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে। এ অভিজ্ঞতাই সবচেয়ে বড় শিক্ষা। [trial and error method তথা ‘ট্রায়াল অ্যান্ড এরর’ বা ‘এটা না হলে, ওটা’]। যে দল চায় তাদের লোকজন উচ্চমাত্রার কর্মদক্ষতার প্রমাণ দেখাক এবং নেতৃত্বের সর্বোচ্চ পর্যায়ে আরোহণ করুক― তখন দলের সদস্যদের অবশ্যই কর্তৃত্ব ও দায়িত্ব দিতে হবে। আপনি যদি আপনার দলের নেতা হন, তবে পদ আঁকড়ে থাকবেন না বা ক্ষমতার দম্ভ দেখাবেন না। কর্তৃত্ব দিয়ে দিন। আপনার দলের সদস্যদের সমৃদ্ধ করতে এটাই একমাত্র পন্থা।


৬। সাফল্যের দাবিদার হিসাবে সদস্যদের কৃতিত্ব দিন... এ থেকেই দলের সদস্যদের নীতিনৈতিকতা তৈরি হবে

মার্ক টোয়েন বলেন, ‘আমি একটি ভালো প্রশংসার ওপর দুই মাস বাঁচতে পারি।’ বেশির ভাগ লোকই এমন কিছু অনুভব করে। মানুষ কঠোর পরিশ্রম করতে ইচ্ছুক যদি সে তার প্রচেষ্টার স্বীকৃতি পায়। এজন্যই নেপোলিয়ন বোনাপার্ট বলেন, ‘একজন সৈনিক একটি রঙিন ফিতার জন্য দীর্ঘ সময় ধরে এবং কঠিনভাবে লড়াই করে যেতে পারে।’ [যা বর্তমানে মেডেলের জন্য করে।] আপনার দলের সদস্যদের প্রশংসা করুন। তাদের সাথে তাদের কৃতিত্বপূর্ণ কাজ ও অর্জনগুলো নিয়ে কথা বলুন। আর আপনি যদি তাদের নেতা হন, তবে তাদের ব্যর্থতার দায় নিন, কিন্তু কখনো তাদের কৃতিত্বের দাবি করবেন না। এ কাজ করুন, দেখবেন আপনার দল আপনার জন্য সবসময় লড়াই করবে।


৭। দলের ওপর যে বিনিয়োগ করেছেন তার লভ্যাংশ আসছে কিনা দেখুন... এ থেকে দলের জবাবদিহিতা নিশ্চিত হয়

আপনি যদি কোথায় টাকা বিনিয়োগ করেন, তবে আপনি নিশ্চয় এর বিপরীতে লভ্যাংশের আশা করেন― হয়তো সাথে সাথে নয়, কিন্তু একটা নির্দিষ্ট সময় পর তো নিশ্চয় লভ্যাংশ প্রত্যাশা করেন। তারপর, আপনি কী করে বুঝবেন যে আপনার সেই বিনিয়োগের ওপর আপনি লাভ করছেন নাকি লস করছেন? আপনাকে এ জিনিস বুঝতে হলে, পুরো ব্যাপারটিকে পরিমাপ করতে হবে।

মানুষের ওপর বিনিয়োগ করতে গেলেও এ ব্যাপারটি সত্য। আপনাকে চোখে চোখে রাখতে হবে, পর্যবেক্ষণ করতে হবে আপনি যে মানুষের ওপর বিনিয়োগ করছেন তারা কি উন্নতি করছে। আপনি যে সময়, শক্তি ও সম্পদ বিনিয়োগ করছেন তার প্রতিফল বা অগ্রগতি কতটুকু ঘটছে? কিছু কিছু মানুষ খুব দ্রুত উন্নতি করে। আর কিছু আছে একটু সময় নিয়ে প্রতিক্রিয়া করে। ঠিক আছে। যতক্ষণ পর্যন্ত তারা সামনে এগিয়ে যাচ্ছে, তো ভালো। আপনার প্রধান চিন্তা থাকবে তাদের অগ্রগতি ঘটছে কিনা তা দেখা।


৮। যারা বৃদ্ধি পাচ্ছে না বা উন্নত হচ্ছে না তাদের ওপর বিনিয়োগ করা বন্ধ করুন... এ থেকে দল অনেক বড় ক্ষতি থেকে বেঁচে যাবে

যেকোনো দলের সবচেয়ে কষ্টকর অভিজ্ঞতা হচ্ছে দলের একজন সদস্যকে ত্যাগ করা। তথাপি আপনাকে এটাই করতে হবে। অবশ্যই করতে হবে। আপনার দলের মধ্যে কেউ যদি দলের উন্নতির জন্য, দলের সদস্যদের সুবিধার জন্য পরিবর্তিত হতে অসম্মত হয় বা উন্নত হতে অস্বীকৃতি জানায় তবে তাকে অবশ্যই দল থেকে বাদ দিতে হবে। তার মানে এই নয় যে আপনি উক্ত ব্যক্তিকে কম ভালোবাসেন। এর মানে হচ্ছে আপনি এমন কারও প্রতি আপনার সময় বিনিয়োগ করা বন্ধ করলেন যে দলকে উন্নত করতে চাচ্ছে না বা পারছে না।


৯। দলের জন্য নতুন নতুন সুযোগ তৈরি করুন... এ থেকে দল আরও বড় হয়

একটি দল তৈরির ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বিনিয়োগ যা আপনি করতে পারেন তা হচ্ছে তাদের জন্য নতুন নতুন সুযোগ তৈরি করা। যখন একটি দলকে নতুন নতুন সম্ভাবনার সামনে দাঁড় করানো হয়, তখন তারা আরও প্রসারিত হওয়ার, বিস্তৃত হওয়ার সুযোগ পায়। এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে একটি দল কেবল যে বেড়ে ওঠার, সমৃদ্ধ হওয়ার সুযোগ পায় তাই নয়, এর মাধ্যমে দলের প্রত্যেক সদস্য লাভবান হয়। প্রত্যেকেই তার (সে ছেলে হোক বা মেয়ে) সম্ভাব্য শক্তিশালী দিক বা প্রতিভার জায়গাগুলোকে পরিস্ফুটিত করার সুযোগ পায়।

১০। দলকে বিজয়ী হতে সবচেয়ে ভালো সুযোগটি দিন... এ থেকে দল নিশ্চিত করবে সবচেয়ে ভালো ফলাফল আনার

জেমস ই. হানটন বলেন, ‘এক সাথে কাজ আরম্ভ করা হচ্ছে বড় কিছু করার সূচনা। এক সাথে থাকা হচ্ছে অগ্রগতি। এক সাথে কাজ করে যাওয়া হচ্ছে সাফল্য।’ আপনার অন্যতম কাজ হচ্ছে দলের এগিয়ে যাওয়ার পথে বাধাবিপত্তি দূর করা, যাতে করে তারা কেবল সাফল্যের দিকে একাগ্র মনোযোগে কাজ করে যেতে পারে। আর আপনি যদি দলের একজন সদস্য হয়ে থাকেন, তাহলে নিজের ব্যক্তিগত স্বার্থ উৎসর্গ করা বা অন্যদেরকে একত্রে কাজ করতে উৎসাহ দেওয়াই আপনার অন্যতম কাজ। আর আপনি যদি একজন নেতা হয়ে থাকেন, তাহলে আপনার কাজ হচ্ছে এমন এক পরিবেশ তৈরি করা যাতে দলের সদস্যরা উত্তমভাবে কাজ করতে উৎসাহ বোধ করে এবং প্রত্যেক সদস্যের যা সময় ও কাজের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ দেওয়া দরকার তা দেওয়া যাতে সে সাফল্য নিশ্চিত করতে পারে।

একটি দল গড়ে তুলতে বা উন্নত করতে যে বিনিয়োগ করা হয় তা থেকে তার প্রতিফল বা মুনাফার হার অনেক বেশি পাওয়া যায়। কারণ একটি দল একজন ব্যক্তি মানুষের চেয়ে অনেক বেশি কিছু সম্পন্ন করে দেখাতে সক্ষম। আমার কনফারেন্সে অংশগ্রহণকারী এক দর্শক রেক্স মারফি বলেছিলেন, ‘যেখানে একটি ইচ্ছা আছে সেখানে একটি উপায় বের হয়; আর যেখানে একটি দল আছে, সেখানে বিজয়ের জন্য একটির চেয়েও বেশি উপায় বের হয়।’

 



 

দলে একজন দুর্বল খেলোয়াড়ের প্রভাব কী রকম হয়?


একটি দুর্বল দিক নেতার বিশ^াসযোগ্যতা নষ্ট করে এবং দলের পক্ষে সাফল্যের সম্ভাবনা ধ্বংস করে।


যেকোনো দলকে পরিমাপ করা হয় তার প্রতিভাবান ও দক্ষ লোকজন দ্বারা। কিন্তু আসল কথা হচ্ছে একটি দলের শক্তি নির্ভর করে এর দুর্বল দিকগুলো ওপর। মানুষ যতই তা যুক্তি দিয়ে লুকানোর চেষ্টা করুক না কেন, দলের দুর্বল দিকগুলো সহজে লুকানো যায় না। তা এক সময় না এক সময় উন্মোচিত হয়ে পড়ে।


সবাইকে আপনার দলে নেওয়া যাবে না


আমি আমার পেশাগত জীবনের শুরুতে সবচেয়ে বড় যে ভুল প্রায়ই করতাম তা ছিল, দলের নেতা হিসাবে আমি ভাবতাম আমার দলে যারা আছে তাদের প্রত্যেকেরই উচিত আমার দলের সাথেই থাকা। এ চিন্তা করার অবশ্য কয়েকটি কারণ ছিল। প্রথমত, আমি সাধারণত মানুষের মধ্যে সবচেয়ে উত্তম জিনিস বা গুণটাই দেখতাম। আমি মানুষের দিকে যখন তাকাতাম তখন তাদের মধ্যে সম্ভাবনা দেখতাম। তারা যদি নিজেরা তা নাও দেখত তবুও আমি তাদের মধ্যে তারা যা হয়ে উঠতে পারে সেই সম্ভাবনা দেখতাম। আর আমি চেষ্টা করতাম তাদেরকে উৎসাহ দেওয়ার, সফলতার জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ দিয়ে সহায়তা করার। দ্বিতীয়ত, আমি আসলেই মানুষকে পছন্দ করি। আমি দেখলাম, আমি যত বেশি মানুষের সাথে পরিচিত হই, তত বেশি সুখী হয়ে উঠি। তৃতীয়ত, আমি আমার রূপকল্পে বিশ^াস করি। আর আমার লক্ষ্য ও কর্ম এ পৃথিবীর জন্য মূল্যবান ও উপকারী বলে আমার দৃঢ় বিশ^াস। আমি তো মাঝে মাঝে এটাও বিশ^াস করি যে আমার এ উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের সাথে সকলেই চলতে চায়।

কিন্তু আমি সকলকেই আমার সাথে নিতে চাই, তার মানে এ নয় যে সকলেই আমার সাথে যাবে। আর বিষয়টা এভাবে কাজও করে না। আমার প্রথম স্মরণীয় অভিজ্ঞতা ছিল ১৯৮০ সালের দিকে। তখন আমি ইন্ডিয়ানা মারিয়নের ওয়েসলিয়ান ওয়ার্ল্ড সদর দফতরের এক্সিকিউটিভ পদে দায়িত্ব পাই। আমি উক্ত পদে অনেক দিন কাজ করেছি। আমি সেখানে কাজ করতে গিয়ে নতুন দল তৈরি করি। সেখানে আমি আমার পূর্বোক্ত দলের সহকারীদেরকেও যোগ দিতে আহ্বান জানাই। তখন আমার এক সহকারী ও তার স্বামী আমার প্রস্তাব গ্রহণ করে এবং তারা মারিয়নে এসে কাজকর্ম দেখে যায়। আমি তাদের সাথে দেখা করে, অনেক উত্তেজিত ছিলাম। আমি মারিয়নের নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ ও কাজকর্মের ব্যাপারে বেশ উৎসাহের সাথে কথা বলতে লাগলাম। এক সময় আমি দেখলাম, তাদের অভিব্যক্তি কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত। তখন আমি ধরে নিলাম, কোনো সমস্যা হয়েছে। আর তখনই তারা তাদের সমস্যার কথা বলল এবং সেখান থেকে চলে গেল।

তাদের বক্তব্যে আমি তো হতবাক। এমনকি, আমি তাদেরকে বুঝিয়ে বললাম যে তারা এ প্রস্তাব না নিয়ে ভুল করছে। তাদেরকে দ্বিতীয়বার বুঝিয়ে বললাম। তাদের মন পরিবর্তনের সর্বোচ্চ চেষ্টা করলাম। কিন্তু তাদেরকে একমত করতে পারলাম না। কিন্তু আমার বউ, মার্গারেট ব্যাপারটি বুঝতে পারল। তিনি আমাকে কিছু ভালো পরামর্শ দিলেন, ‘জন, তোমার সমস্যা কী জানো? তুমি সবাইকে তোমার সাথে নিতে চাও। কিন্তু সবাই তো এ অভিযাত্রায় যোগ দিবে না। তাদেরকে যেতে দাও।’ এ শিক্ষা আমার জন্য খুবই কঠিন এক শিক্ষা ছিল। কিন্তু আমি তা থেকে শিখেছি। তবে এখনো এমন অভিজ্ঞতা কম কষ্টকর নয়।

সেই অভিজ্ঞতা ও অন্যান্য শিক্ষা থেকে আমি আবিষ্কার করলাম যে যখন দলবদ্ধভাবে কাজ করতে হয় তখন...


১। অভিযাত্রায় সবাই যোগ দিবে না

কিছু কিছু লোক আপনার সাথে অভিযাত্রায় যোগ দিবে না। তারা যেতে চায় না। আমার সহকারী ও তার স্বামী ওহিও, ল্যানচেস্টার শহরে থাকতে চায়। সেখানে তারা বহু বছর ধরে একত্রে নিজেদের সম্পর্ক ও পরিচিতি তৈরি করেছে। অন্যদের জন্য সমস্যা ছিল তাদের মনোভাব। তারা পরিবর্তন চায় না। তারা অগ্রগতি বা উন্নতি করতেও চায় না। নতুন কোনো ক্ষেত্র আবিষ্কার করতে তাদের ভীতি রয়েছে। তারা স্ট্যাটাস কো (ংঃধঃঁং য়ঁড়) তথা স্থিতাবস্থা বা সবাই মেনে নিয়েছে এমন অবস্থাতে থাকতে চায়। এসব ক্ষেত্রে আপনি যা করতে পারেন তা হচ্ছে তাদেরকে তাদের পূর্বের কর্মকা-ের জন্য বিনয়ের সাথে ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় দিতে পারেন এবং সামনে এগিয়ে যান।


২। অভিযাত্রায় সবাইকে যুক্ত করা উচিতও নয়

এমন আরও কিছু লোক আছে যাদেরকে আপনার দলে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত নয়। কারণ তারা সবসময় তাদের আত্মস্বার্থ উদ্ধারে ব্যস্ত। তাদের নিজস্ব কিছু পরিকল্পনা থাকে। আর আপনি যেখানে যাচ্ছেন সেখানে পৌঁছা তাদের লক্ষ্য নয়। সবচেয়ে ভালো হয়, আপনি এমন ধরনের মানুষের জন্য ভালো কিছু দোয়া করুন এবং তাদেরকে তাদের লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে দূর থেকে যতটা সম্ভব সাহায্য করুন।


৩। অভিযাত্রায় সবাই যেতেও পারবে না

এ হচ্ছে তৃতীয় প্রকারের লোক। এদের সমস্যা হচ্ছে সামর্থ্য বা দক্ষতা নিয়ে। একটি দল যেখানে যেতে চায় বা যে লক্ষ্য অর্জন করতে চায় এমন ধরনের লোক দলের সহকর্মীদের সাথে গতি বজায় রাখতে পারে না। আপনি এ ধরনের লোকজনকে কীভাবে চিনবেন? তাদেরকে খুঁজে বের করা বেশি কঠিন কিছু নয়।

ক্স তারা দলের সদস্যদের সাথে গতি রেখে চলতে পারে না।

ক্স তারা তাদের দায়িত্ববান পদে উন্নতি করতে পারে না।

ক্স তারা কাজকর্মের বিগ পিকচার (নরম ঢ়রপঃঁৎব) তথা দূরদর্শী ছবি দেখতে এবং দূরদর্শী চিন্তা করতে পারে না।

ক্স তারা নিজেদের ব্যক্তিগত দুর্বলতা দূর করতে উদ্যোগী নয়।

ক্স তারা দলের অন্যান্য সদস্যদের সাথে একত্রে কাজ করে না।

ক্স তারা তাদের কর্মক্ষেত্রের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারে না।

আপনি যদি দেখেন আপনার দলের মধ্যে কোনো লোকের এমন লক্ষণ রয়েছে তবে তাকে দলের দুর্বলতা হিসাবে চিহ্নিত করুন। [দলের মধ্যে একজন দুর্বল সদস্য যে দলের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারে না সে একটি মজবুত শিকলের দুর্বল কড়ার মতো।]

 

এর মানে আমি এ বলছি না যে তারা মন্দ লোক। সত্যি বলতে, কিছু কিছু দলে আছে যেখানে এমন দুর্বল কড়াও তাদেরকে আরও শক্তিশালী হয়ে উঠতে সহায়তা করে। এটা নির্ভর করে দলের লক্ষ্যের ওপর। উদাহরণস্বরূপ, আমি যখন একজন সিনিয়র যাজক ছিলাম, আমরা সমাজের সুবিধাবঞ্চিত মানুষের কাছে খাবার ও সাহায্য-সহায়তা নিয়ে যেতাম। আমরা মানুষকে নেশামুক্ত জীবনযাপনে সাহায্য করেছি, তালাক না নিতে উৎসাহ দিয়েছি এবং নানান তিক্ত ও কঠিন অভিজ্ঞতা থেকে বের হয়ে আসতে অনেককে সাহায্য করেছি। আমাদের লক্ষ্য ছিল মানুষের সেবা করা। এসব ক্ষেত্রে যারা মানুষকে সাহায্য করতে চায় তাদের নিয়ে কাজ করা যায়। এমনকি দলের মধ্যে দুর্বল কড়া স্বরূপ সদস্য হলেও। কিন্তু তাদেরকে এমন কোনো দলে নেওয়া যেখানে তারা মানিয়ে নিতে পারছে না, তাদের অক্ষমতা বেশি বেশি প্রকাশ পাচ্ছে সেখানে তাদেরকে নিয়ে তাদেরই ক্ষতি করার সমতুল্য। তাছাড়া এতে পুরো দলেরও ক্ষতি হয়। এমনকি দলের পক্ষে তখন তাদের লক্ষ্যও অর্জন করা সম্ভব নাও হতে পারে।

আপনার দলের মধ্যে যদি এমন দুর্বল কড়া থাকে তবে আপনি কী করবেন? আপনার সামনে তখন দুইটি পথ খোলা: হয় আপনি তাদেরকে প্রশিক্ষণ দিবেন অথবা তাদের বিনিময়ে অন্য কোনো দক্ষ লোক নিয়োগ দিবেন। আপনার প্রথম চিন্তা থাকবে মানুষকে প্রশিক্ষণ দিয়ে যোগ্য করে তোলা। যাতে করে তারা দলের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারে। এমন সাহায্য হতে পারে বিভিন্ন ধরনের: দলের সদস্যদের পড়ার জন্য বই দেওয়া, তাদেরকে বিভিন্ন কনফারেন্সে পাঠানো, তাদের সামনে নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ পেশ করা অথবা তাদেরকে মেনটরিং করানো। আমার বিশ^াস মানুষ প্রায় সময়ই আপনার প্রত্যাশা অনুযায়ী উন্নতি করবে। তাদের প্রতি উচ্চ ধারণা পোষণ করুন, আশা রাখুন এবং প্রশিক্ষণ দিন। এ থেকে দেখা যায়, সাধারণত তারা উন্নতি করে।

কিন্তু একজন সদস্য যদি প্রতিনিয়ত প্রত্যাশা পূরণ করতে না পারে তবে কী করবেন? এমনকি প্রশিক্ষণ, উৎসাহ ও সুযোগ দেওয়ার পরেও যদি উন্নত হতে ব্যর্থ হয় তবে কী করবেন? এ ব্যাপারে আমার বাবা একটি কথা বলতেন, ‘পানি তার স্বভাব অনুযায়ী চলে।’ কেউ যদি আপনার দলের মধ্যে অদক্ষতার পরিচয় দেয়, দুর্বল কড়ি স্বরূপ নিজেকে প্রকাশ করে সে হয়তো অন্য কোনো দলে খুব ভালো করতে পারে। তাকে সেই সুযোগ দিন। আপনার উচিত তাকে অন্য কোথাও নিজের জন্য সবচেয়ে ভালো জায়গা খুঁজে বের করার সুযোগ দেওয়া।


একজন দুর্বল সদস্যের প্রভাব


আপনি যদি একটি দলের দলনেতা হন, তবে আপনি কোনোভাবেই দুর্বল সদস্যদের এড়িয়ে যেতে পারেন না। দলের যেসব সদস্য তাদের নিজেদের বোঝা নিজেরা বহন করে না, তারা দলের গতিকে ব্যাহত করে এবং আপনার নেতৃত্বের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। একজন দুর্বল সদস্য থাকলে দলে অনেক ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে:


১। দলের শক্তিশালী সদস্যরা দুর্বল সদস্যকে চিহ্নিত করে ফেলে

একজন দুর্বল সদস্য কখনো দলে লুকিয়ে থাকতে পারে না (যদি না পুরো দলটিই দুর্বল হয়)। আপনার দলে যদি শক্তিশালী সদস্য থাকে, তবে তারা সহজেই বুঝতে পারবে যে কে তাদের সমান কর্মদক্ষতা দেখাতে ব্যর্থ হচ্ছে।


২। দলের শক্তিশালী সদস্যদেরকে নিজের দায়িত্ব রেখে দুর্বলকে সাহায্য করতে হয়

আপনার দলের সদস্যদেরকে দলবদ্ধভাবে কাজ করতে হলে তাদের সাথে যদি একজন দুর্বল ও অদক্ষ সদস্য থাকে তবে তাদের সামনে কেবল দুইটি রাস্তা খোলা থাকে। এক, তারা উক্ত ব্যক্তিকে এড়িয়ে যাবে। এর ফলে পুরো দলের কার্যক্ষমতা হ্রাস পাবে। দুই, তারা দুর্বল ও অদক্ষ সদস্যকে সাহায্য করবে এবং দল আরও সফল হবে। যদি তারা দলবদ্ধ কাজে উদ্বুদ্ধ হয়ে থাকে তবে তারা নিশ্চয় সাহায্য করবে।


৩। শক্তিশালী সদস্যরা দুর্বলকে সাহায্য করতে করতে বিরক্ত বা ক্রুদ্ধ হয়ে উঠবে

দলের শক্তিশালী সদস্যরা দুর্বলকে সাহায্য করুক আর না করুক, ফলাফল সবসময় একই হয়: বিরক্তি। কেউই প্রতিনিয়ত একজন দুর্বল সদস্যের জন্য ব্যর্থ হতে বা পিছিয়ে পড়তে রাজি নয়।


৪। দুর্বল সদস্যকে দেখে দলের শক্তিশালী সদস্যদের মধ্যে সক্রিয়তা হ্রাস পায়

অন্য কারও বোঝা বহন করতে হলে একজনকে তার নিজের কর্মদক্ষতাকে হ্রাস করতে হয়। এমন কাজ যদি অনেকদিন ধরে করতে হয় তবে পুরো দল তার কার্যকারিতা হারায়।


৫। দলের শক্তিশালী সদস্যরা দলনেতার সক্ষমতা ও সামর্থ্য নিয়ে প্রশ্ন তোলে

দলের মধ্যে যখন একজন দুর্বল সদস্যকে দলনেতা থাকার অনুমতি দেয়, তখন দলের অন্যান্য সদস্যরা দুর্বল সদস্যের গ্যাপ তথা কার্যকারিতাকে পূরণ করতে বাধ্য হয়। এভাবে দুর্বল সদস্যের কাজকর্মের গ্যাপ পূরণ করতে গিয়ে দলের শক্তিশালী সদস্যরা দলনেতার নেতৃত্ব, সাহস ও বিচক্ষণতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে, সন্দিহান হয়ে উঠে। আপনি যখন দুর্বল ও অদক্ষ ব্যক্তিদের সাথে প্রয়োজনীয় আচার-আচরণ করতে ব্যর্থ হন, তখন আপনি দক্ষ ও শক্তিশালী সদস্যদের শ্রদ্ধা হারিয়ে ফেলতে বাধ্য।

অনেক দলের মধ্যে দেখা যায় তারা দলের দুর্বল ও অদক্ষ সদস্যদের নিয়ে কথা বলে না। এ ধরনের কঠিন সিদ্ধান্ত তারা এড়িয়ে চলে। কিন্তু নেতার পক্ষে তা এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। বরঞ্চ একজন নেতা ও অনুসারীর মধ্যে একটি পার্থক্য হচ্ছে তার কাজে। অনুসারীরা প্রায়ই এ ব্যাপারে জানে যে তাদের কী করতে হবে। কিন্তু তারা পুরোপুরি ব্যাপারটা মেনে চলতে বা অনুসরণ করতে অনিচ্ছুক বা অক্ষম। কিন্তু এ কথা মনে রাখবেন: আপনি যদি যা করা দরকার তা করতে অনিচ্ছুক বা অক্ষম হন, আর দলের অন্যরা আপনার হয়ে সিদ্ধান্ত নেয় তবে আপনার নেতৃত্ব দানের সক্ষমতা হ্রাস পাবে। আপনি আর আপনার দলের নেতৃত্ব দিতে পারবেন না।


শিকলকে মজবুত করুন


দলের শক্তিশালী সদস্যদের চেয়ে দলের দুর্বল সদস্যরা সবসময়ই দলের সময় অপচয় করে। এতে করে দেখা যায় দলে যারা বেশি দক্ষ তারা তাদের সময় বিনিয়োগ করে দুর্বল সদস্যের কাজকর্মের ক্ষতিপূরণ দিচ্ছে। দক্ষ সদস্যরা এমন সদস্যের জন্য ক্ষতিপূরণ দিচ্ছে যারা নিজেদের দায়দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন করতে অক্ষম। কর্মদক্ষতার দিক দিয়ে পার্থক্য যত বেশি হবে বেশি দক্ষ ও কম দক্ষ সদস্যের মধ্যে দূরত্ব তত বেশি বাড়বে, আর এতে করে দলের ক্ষতিও তত বাড়তে থাকবে। উদাহরণস্বরূপ, আপনি যদি আপনার সদস্যদের ১ থেকে ১০ এর মধ্যে তাদের কর্মদক্ষতা পরিমাপ করেন (১০ হচ্ছে সবচেয়ে উত্তম), তবে ১০ মানের সদস্যদের মধ্যে একজন ৫ মানের সদস্য দলের অনেক ক্ষতি করবে। কিন্তু ১০ মানের সদস্যদের মধ্যে একজন ৮ মানের সদস্যকে মানা যায়।

চলুন দেখা যাক এটা কীভাবে কাজ করে। আপনি যখন একদল লোককে দলবদ্ধ কাজে নিয়োগ দিবেন তখন তাদের মেধা ও কর্মদক্ষতাকে পরিমাপ করুন। ধরুন পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট একটি দল। তাদের মধ্যে ১০ মানের সদস্যদের মধ্যে একজন ৫ মানের সদস্য। একে যোগ করলে দাঁড়ায়:

১০ + ১০ + ১০ + ১০ + ৫ = ৪৫

এখন যদি ১০ মানের সদস্য পাঁচজন হয় তবে তা দাঁড়ায় ৫০ এ। এতে করে দুই দলের মধ্যে পার্থক্য দাঁড়ায় ৫০ ও ৪৫ এর মধ্যে ৫ এর ব্যবধান। এখানে শতাংশের হিসাব করলে দেখা যায় পার্থক্য মাত্র ১০ শতাংশ। কিন্তু একটি দল যখন কাজ আরম্ভ করে তাদের মধ্যে নানা ধরনের মেধা, প্রতিভা ও কর্মদক্ষতার মিশ্রণ ঘটে। তখন ব্যাপারটা আর যোগের মধ্যে থাকে না। তখন তা হয়ে দাঁড়ায় গুণের বিষয়। ঠিক তখনই একজন দুর্বল সদস্য দলের কার্যকারিতা নষ্ট করতে থাকে। চলুন পার্থক্যটা দেখা যাক:

১০ ী ১০ ী ১০ ী ১০ ী ১০ = ১,০০,০০০

আর দুর্বল সদস্যকে নিয়ে দল হলে:

১০ ী ১০ ী ১০ ী ১০ ী ৫ = ৫০,০০০

এখানে পার্থক্য দেখা যাচ্ছে ৫০ শতাংশ। দলের সক্ষম ও দক্ষ সদস্যরা হয়তো একটা সময় পর্যন্ত দুর্বলের দায়দায়িত্ব পালন করতে পারে, কিন্তু সবসময়ের জন্য তা করা সম্ভব হবে না। একজন দুর্বল ও অদক্ষ সদস্য প্রতিনিয়ত দলের কার্যক্ষমতা ও সম্ভাবনা নিঃশেষ করতে থাকে।

পরিহাস হলেও সত্য যে দলের দুর্বল ও অদক্ষ সদস্যরা তাদের দুর্বলতা ও অদক্ষতা নিয়ে শক্তিশালী সদস্যদের চেয়ে কম মনোযোগী। তারা তাদের জায়গায় টিকে থাকতে, তাদের পদ-পদবি ধরে রাখতে ব্যস্ত। আরও দেখবেন: মানুষের মধ্যে সম্পর্কের ক্ষেত্রে দুর্বল ব্যক্তিরা সাধারণ সম্পর্কের ওপর কর্তৃত্ব করে। উদাহরণস্বরূপ, নিজের সম্পর্কে ভালো ধারণা পোষণ করে এমন একজন ব্যক্তি নিজের সম্পর্কে দুর্বল ধারণা পোষণ করে এমন ব্যক্তির চেয়ে বেশি বিনয়ী ও অমায়িক। একজন ব্যক্তি যিনি নিজের কাজ সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা রাখে তিনি যে ব্যক্তি নিজের কাজ সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা রাখে না তারচেয়ে দ্রুত ও উত্তম পন্থায় কাজ করে। একজন ব্যক্তি যার দক্ষতা ও সামর্থ্য রয়েছে, প্রাণশক্তিতে ভরপুর তিনি যে ব্যক্তির মধ্যে দক্ষতার অভাব তারচেয়ে অনেক বেশি কাজ সম্পন্ন করতে পারে এবং দীর্ঘ সময় তার কাজে নিবিষ্ট থাকে। ধরুন, দুই ব্যক্তিকে পাশাপাশি কোনো কাজে পাঠালেন। দক্ষ সদস্য তার কাজ দ্রুত সম্পন্ন করে অদক্ষ ব্যক্তির কাজ সম্পন্নের অপেক্ষায় বসে থাকতে হবে। তখন দুর্বল ও অদক্ষ ব্যক্তির ওপর পুরো কাজের ফলাফল নির্ভর করবে।

আপনার দলে যদি একজন দুর্বল ও অদক্ষ সদস্য থাকে, আর সে যদি নিজেকে দলের প্রয়োজনে যথাযথ দক্ষতার পর্যায়ে নিজেকে উঠাতে না চায় বা না পারে তবে প্রথমে আপনি তাকে উন্নত করতে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নিবেন। কিন্তু তারপরও যদি সে উন্নত না হয় তবে আপনাকে কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে হবে। যখন এমন পরিস্থিতিতে পড়বেন তখন লেখক ড্যানি কক্স ও জন হুভারের কথা স্মরণ করবেন। আপনি যদি কাউকে দল থেকে বের করে দিতে চান তবে তা করুন বিচক্ষণতার সাথে, স্পষ্ট ও সৎভাবে এবং সংক্ষিপ্তাসারে। তারপর ব্যক্তিটি যখন চলে যাবে তখন এ ব্যাপারে দলের সাথে খোলামেলা আলোচনা করুন। এ আলোচনার সময় উক্ত ব্যক্তি সম্পর্কে শ্রদ্ধার সাথে কথা বলুন এবং তাকে অন্য কোথাও আরও ভালো সুযোগ খুঁজতে সাহায্য করলেন― তা বলুন। আর আপনার মধ্যে যদি ব্যক্তিটি চলে যাওয়ার পর বা তাকে বহিষ্কার করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর অন্য কোনো চিন্তা আসে তবে মনে রাখবেন: একটি দলে যতক্ষণ পর্যন্ত একজন দুর্বল সদস্য থাকবে, ততক্ষণ দলের সব সদস্যকে ভুগতে হবে।


 



 

আমি কীভাবে দলের মধ্যে একটি ইতিবাচক প্রাণশক্তির সঞ্চার করব?


কাজ সম্পন্ন করেছে এমন সদস্যদের নিয়ে দল গড়ে তুলুন।


ক্রিস হজস একজন অসাধারণ নেতা। তিনি লুইসিয়ানা রাজ্যের ব্যাটন রাউজ থেকে এসেছেন। তিনি তার বৌডরওস রসিকতার জন্য জনপ্রিয় ছিলেন। এ ছিল লুইসিয়ানার স্থানীয় কৌতুক। সম্প্রতি তার সাথে আমার দেখা হয়। তিনি আমাকে বলেন তিনি জাস্টিন উইলসনের কথা চিন্তা করতে করতে লিখে থাকেন এবং তার মতো লেখার ধরন রাখার চেষ্টা করেন:

বন্ধুরা বসে আড্ডা দিচ্ছে। তারা তাদের সাফল্যের গল্প নিয়ে বেশ খোশমেজাজে কথা বলছে। থিবিডঅক্স বলল, আমি আরেকটি মাছ ধরার নৌকা কিনেছি। জানিস, আমার অধীনে এখন দশজন লোক কাজ করে।

আরে এ তো কিছুই না। এ কথা বলে উড়িয়ে দিল ল্যান্ড্রি। আমি আমার বাহিনীতে পদোন্নতি পেয়েছি। এখন আমার অধীনে পঞ্চাশজন লোক কাজ করে।

বৌদ্রোক্স এগুলো শুনে চিন্তা করল আমারও তো কিছু বলার দরকার। নইলে তো মানইজ্জত কিছু থাকছে না। সে বলে বসল, আরে আমার আন্ডারে (ঁহফবৎ) থাকে তিনশ লোক।

থিবিডঅক্স বলল, যাহ্, তুই কী বলছিস! তুই তো সারাদিন ঘাস কাটিস।

বৌদ্রোক্স বলল, এ কথা সত্য। তবে এখন আমি একটি কবরস্থানে ঘাস কাটি। সেখানে আমার আন্ডারে তিনশ লোক আছে।

এখন বলতে গেলে প্রতিযোগিতা করতে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু আসল সমস্যা হচ্ছে অনেক নেতাই তাদের কোম্পানির নিজের দলের সাথে প্রতিযোগিতা করে। এতে করে দলের ক্ষতি হয়। আর তারা নিজেরাও ক্ষতির সম্মুখীন হয়। এটা নির্ভর করে আপনি কীভাবে প্রতিযোগিতাকে নিচ্ছেন এবং একে হ্যান্ডেল (যধহফষব) করছেন। একটি স্বাস্থ্যকর ও সহযোগিতামূলক পরিবেশে একই সাথে প্রতিযোগিতা ও দলবদ্ধ কাজ, উভয়ই বিরাজ করে। আপনার উচিত তাদেরকে স্বাস্থ্যকর ও সহযোগিতামূলক পরিবেশ দেওয়া নাকি তাদের সাথেই প্রতিযোগিতা করা। এখানে মোট দুই ধরনের চিন্তাধারা কাজ করে:

প্রতিযোগিতা (পড়সঢ়বঃরহম) বনাম একে অপরকে সম্পূর্ণ করা (পড়সঢ়ষবঃরহম)

প্রতিযোগিতা একে অপরকে সম্পূর্ণ করা

অভাবগ্রস্ত চিন্তাধারা প্রাচুর্যে ভরা চিন্তাধারা

আমি প্রথমে দল প্রথমে

আস্থা নষ্ট করে আস্থা তৈরি করে

চিন্তা করে জয়-পরাজয়ের ভিত্তিতে চিন্তা করে উভয়ের জয়-জয়ের ভিত্তিতে (ঃযরহশং রিহ-রিহ)

একা একা চিন্তা করে (চিন্তা করে আমার বুদ্ধিগুলোই উত্তম) চিন্তা অন্যদের সাথে শেয়ার করে এবং অন্যদের চিন্তা করতে উৎসাহ দেয় (চিন্তা করে আমাদের বুদ্ধিগুলোই উত্তম)

অন্যদের বাদ দিয়ে কাজ করে অন্যদের নিয়ে কাজ করে


 

আপনি যদি চিন্তা করেন যেকোনো মূল্যেই জিততে হবে, তখন তা আপনার সতীর্থদের বাজি রেখে, তাদের হারিয়ে মূল্য দিতে হয়। আর আপনার লক্ষ্য যদি থাকে আপনার সতীর্থদের হারিয়ে জিতবেন, তবে আপনি কখনোই তাদেরকে প্রভাবিত করতে পারবেন না।


কীভাবে প্রতিযোগিতা এবং একে অপরকে সম্পূর্ণ করার মধ্যে ভারসাম্য তৈরি করবেন?


শেষ কথা হচ্ছে, একজন ব্যক্তির সাফল্যের চেয়ে পুরো দলের সাফল্য লাভ করা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। একটি কোম্পানি বা সংগঠনের বিজয় লাভ করতে হলে এর মধ্যে প্রতিযোগিতা ও দলবদ্ধ কাজ, উভয়ই দরকার। যখন এই দুই উপাদানের মধ্যে ভারসাম্য থাকে, তখন অসাধারণ এক দল তৈরি হয়।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আপনি কীভাবে প্রতিযোগিতা ও একে অপরকে সম্পূর্ণ করার মধ্যে ভারসাম্য তৈরি করবেন? কীভাবে আপনি একটি থেকে অন্যটিতে সহজেই যেতে-আসতে শিখবেন? আমার কিছু পরামর্শ হচ্ছে:


১। আপনার মধ্যে যে প্রাকৃতিকভাবে প্রতিযোগিতা করার আকাক্সক্ষা আছে তাকে স্বীকার করুন

আমি কলেজ থেকে ¯œাত্মক ডিগ্রি নিয়ে পাশ করার চার-পাঁচ বছর পরে একদিন তখনকার বিদ্যমান কলেজ টিমের সাথে বাস্কেটবল খেলতে যাই। আগে আমি যখন দলে খেলতাম তখন শুটিং এ আমি থাকতাম। কিন্তু এবার আমাকে দিল বিপক্ষ দলের পয়েন্ট গার্ডকে বাধা দিতে। আমি যখন বিপক্ষ দলের পয়েন্ট গার্ডের খেলোয়াড়কে ওয়ার্ম-আপ করতে দেখলাম, তখনই বুঝলাম আমার খবর আছে। সে আমার চেয়ে অনেক দক্ষ খেলোয়াড়। তাই আমি দ্রুত একটি কৌশল অবলম্বন করলাম।

প্রথমবার সে যখন হুপে বল ফেলতে যাবে আমি তাকে ফাউল করলাম। আমি যে তাকে হুপে বল ফেলতে গিয়ে হাত ধরে বাধা দিয়েছি তা নয়। আমি তাকে খুব জোরে, শক্তভাবে ফাউল করলাম। তারপর সে উঠে দাঁড়াল। জরিমানা স্বরূপ, তাকে ফ্রি থ্রো করতে দেওয়া হলো। সে দুইবারই হুপে বল ফেলতে ব্যর্থ হলো। যাক, ভালোই হলো।

এরপর খেলা আরম্ভ হলো। আবার তার দল এগিয়ে এলো। সে একটু দূর থেকে হুপে বল থ্রো করতে চাইল। আমি আবার তাকে কঠোরভাবে ফাউল করলাম। এবার সে বিরক্ত।

এরপর যখন সে বল নিয়ে এগিয়ে যেতে চায় আমি বাধা দিই। কিন্তু আমি তার মতো লম্বা ছিলাম না। কিন্তু আমার ওজন তার চেয়ে বেশি ছিল। আমি আবার তাকে বাধা দিই।

এবার সে আমার দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে উঠল, ‘তুমি খুব কঠিনভাবে খেলছ। এ তো একটা খেলা মাত্র।’

আমি বললাম, ‘ঠিক আছে। তাহলে আমাকে জিততে দাও।’

ব্যাপারটা হচ্ছে, আপনি যেমন আপনি তেমনই আচরণ করবেন। এবার তা খেলার মাঠে হোক বা ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে। প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব একজন নেতার স্বাভাবিক প্রবৃত্তি। আমি এমন কোনো নেতার সাক্ষাৎ পাইনি যিনি জিততে চান না। অতীতের সেই বাস্কেটবল এবং অন্যান্য কর্মকা- যখন স্মরণ করি তখন আমি অবশ্য নিজেকে ততটা পরিপক্ক হিসাবে দেখি না। কিন্তু ভালো সংবাদ হচ্ছে, আমরা সেই বাস্কেটবল খেলায় জয়ী হয়েছিলাম। আমরা ছিলাম এলামনাই তথা প্রাক্তন ছাত্রদের দল। কিন্তু দুঃখের কথা হচ্ছে, আমি সেই দিন কোনো বন্ধু বানাতে পারিনি।

প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব বলতে আমি বুঝাতে চেয়েছি একে একটি ইতিবাচক উপায়ে ব্যবহার করা। আপনি যদি এ মনোভাবের প্রতি একরোখা হয়ে যান তবে আপনি সেই উদ্দীপনাগুলো হারিয়ে ফেলবেন যা আপনাকে আপনার সর্বোত্তম কাজ করতে উৎসাহিত করতে পারত। আপনি যদি একে বন্যভাবে চলার সুযোগ দেন, তবে এটা আপনার দলের সদস্যদের ওপরই চড়াও হয়ে পড়বে। কিন্তু আপনি যদি একে নিয়ন্ত্রণ করেন এবং ইতিবাচক উপায়ে পরিচালিত করেন, তবে প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব আপনাকে সফল হতে সাহায্য করবে।


২। স্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতাকে আলিঙ্গন করুন

আমার দেখা মতে প্রতিটি বিজয়ী দলের মধ্যে এক ধরনের স্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতা বিদ্যমান। একটি দলের ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতার অনেক উপকার আছে। এতে এমন কিছু সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যায় যা অন্য কোনোভাবে পাওয়া সম্ভব নয়।

স্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতা আপনার মধ্য থেকে সবচেয়ে ভালো গুণাগুণকে বের করে আনে। চিন্তা করে দেখুন তো, একজন দৌড়বিদ যদি একা একা দৌড়াত, তবে কতগুলো ওয়ার্ল্ড রেকর্ড হতো? আমার তো মনে হয়, একটিও হতো না! মানুষ সবচেয়ে ভালো কাজ করে দেখাতে পারে যখন তার আশেপাশে চাপ দেওয়ার মতো অন্যান্য মানুষ থাকে। এ কথা শিক্ষা, প্রশিক্ষণ বা খেলাধুলা সবকিছুর জন্য সত্য।

স্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতা সৎ মূল্যায়নকে উৎসাহিত করে। আপনার পেশাগত কাজকর্মকে মূল্যায়ন করার সবচেয়ে দ্রুত উপায় কোনটি? হয়তো মাসে বা বছরে আপনি যে লক্ষ্যগুলো নিয়েছিলেন তা পূরণ করেছেন কিনা তা দেখা। কিন্তু আপনি যদি জানতে চান আজকে আপনার কর্মদক্ষতা কেমন? তাহলে, তা আপনি কীভাবে পরিমাপ করবেন? এজন্য আপনি আপনার টু-ডু লিস্ট তথা দৈনন্দিন কাজকর্মের তালিকা দেখতে পারেন। কিন্তু আপনি যদি আপনার লক্ষ্যগুলো আপনার সক্ষমতার তুলনায় ছোট করে ধরে রাখেন তাহলে কী হবে? এক্ষেত্রে, আপনি আপনার বসকে জিজ্ঞেস করতে পারেন। কিন্তু সবচেয়ে ভালো হয়, আপনার পেশা বা কর্মক্ষেত্রে অন্যরা কীভাবে কাজ করছে তা দেখা। আপনি যদি তাদের চেয়ে এগিয়ে বা পিছিয়ে থাকেন, তবে তা থেকে কী আপনি কিছু বুঝতে পারছেন? আর আপনি যদি পিছিয়ে থাকেন, তবে আপনার কি উচিত নয় আপনি কী কী ভুল কাজ করে পিছিয়ে আছেন তা খুঁজে বের করা? এটা হয়তো নিজেকে মূল্যায়ন করার একমাত্র পন্থা নয়, তবে এ পন্থায় আপনি বেশ ভালোভাবেই নিজেকে মূল্যায়ন করতে পারবেন। নিজের ওপর নিজের একটি পুনর্নিরীক্ষণ হবে।

স্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতা পারস্পরিক আস্থা ও বন্ধুত্ব তৈরি করে। লোকজন যখন একত্রে প্রতিযোগিতা করে, তারা একই দলে হোক বা ভিন্ন দলে হোক, তখন তাদের মধ্যে এক ধরনের বন্ধন তৈরি হয়। যখন প্রতিযোগিতা একই দলের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ উপায়ে চলতে থাকে তখন তা একে অপরের মধ্যে আরও দৃঢ় বন্ধন তৈরি করে। এতে করে বন্ধুত্বপূর্ণ একটি দল তৈরি হয়।

স্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতা ব্যক্তিগত প্রতিযোগিতায় পরিণত হয় না। দলের সদস্যদের মধ্যে প্রতিযোগিতা মানে আনন্দ উপভোগ। যখন প্রতিযোগিতা স্বাস্থ্যকর হয়, তখন খেলা শেষেও দলের সদস্যরা বন্ধুই থাকে। তারা একে অপরের বিপরীতে প্রতিযোগিতা করে রোমাঞ্চিত হয়। আর যখন খেলা শেষ হয়ে যায়, তারা আবার একে অপরকে আঘাত করা ছাড়াই একসাথে হেঁটে যায়।

আমি আমার পছন্দের একটি কৌতুক বলি। একটি মোরগ মুরগিদের দেখানোর জন্য মুরগির খোঁয়াড়ে একটি উটপাখির ডিম নিয়ে যাচ্ছে। খোঁয়াড়ের মাঝখানে মোরগটি উটপাখির ডিম রেখে বলল, ‘ দেখ বালিকারা, আমি তোমাদের ছোট করতে চাই না। কিন্তু এই দেখো, রাস্তার ওপারের খামার ঘরের ডিমের কী অবস্থা!’ একটি দলকে সামনে এগিয়ে যেতে স্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতা দারুণভাবে সহযোগিতা করে।


৩। প্রতিযোগিতাকে এর যথার্থ স্থানে রাখুন

একটি স্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতার লক্ষ্য হচ্ছে কর্মীদের মধ্যে বিজয়ের প্রেরণা প্রবেশ করানো। প্রতিযোগিতাকে উদ্দেশ্য সাধনের উপায় হিসাবে কাজে লাগান। বাস্তবে প্রতিযোগিতা চর্চা করলে সদস্যদের মধ্যে প্রতিনিয়ত কর্মদক্ষতা ও উৎপাদনশীলতার উন্নয়ন ঘটে। স্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতাকে যদি ঠিকভাবে পরিচালিত করা যায় তবে এর দ্বারা বিপক্ষ দলকে হারানো সম্ভব।

অবশ্য কিছু কিছু নেতা প্রতিযোগিতাকে একদল চরমে নিয়ে যায়। এ ব্যাপারে সতর্ক থাকবেন। লস এঞ্জেলস ডজারসের সাবেক ম্যানেজার টমি লসর্ডা একবার এক গল্প বলেন। তিনি তার দলকে শিডিউল অনুযায়ী বেসবল দল সিনসিনাটি রেডসের বিপরীতে খেলতে নামান। তিনি খেলার আগে চার্চে যান দোয়া করতে। এ সময় রেডস দলের ম্যানেজার জনি ম্যাকনামারাও একই চার্চে দোয়া করতে যান। দোয়া শেষে জনি ম্যাকনামারা একটি মোমবাতি জ¦ালিয়ে চলে আসেন। টমি তখন মোমবাতিটি ফুঁ দিয়ে নিবিয়ে দেন। আর পুরো খেলা জুড়ে চিৎকার করে বলতে থাকেন, জনি, কোনো লাভ নেই। আমি তোমার মোমবাতি নিভিয়ে দিয়েছি।

সেদিন টমি লসর্ডা’র দল ১৩-২ পয়েন্টে জিতে যায়।


৪। কোথায় থামতে হয় তা-ও জানতে হয়

আপনি যতই জিততে চান না কেন, আপনি যদি একটি স্বাস্থ্যকর উপায়ে প্রতিযোগিতা করতে চান, তবে আপনার কখনোই লাইন ক্রস করা তথা লক্ষ্মণরেখা পার করা উচিত নয়। আপন সতীর্থদের গলা কেটে জয় পাওয়াকে বিজয় বলে না। কারণ আপনি যদি তা করেন তবে তার মাধ্যমে আপনি তাদেরকে দূরে সরিয়ে দিলেন। আর এ লাইন খুব সহজেই অনুভব হয়। তাই একে সংজ্ঞায়িত করা তত কঠিন নয়। আমি বলব, প্রতিযোগিতা যখন বাড়ছে, আর তা একে অন্যকে উন্নত করছে, তা স্বাস্থ্যকর। কিন্তু যখনই প্রতিযোগিতা সদস্যদের নীতিনৈতিকতাকে ক্ষয় করছে এবং দলকে আঘাত হানছে, তখনই তা অস্বাস্থ্যকর এবং লাইন ক্রস।

আমি যখন সান ডিয়াগোতে স্কাইলাইন চার্চে ছিলাম, তখন আমার কর্মচারীরা বেশ দক্ষ ও প্রতিযোগিতামূলক মনোভাবসম্পন্ন ছিল। মূল দলকে সবসময় ড্যান রাইল্যান্ড, শেরিল ফ্লিশার এবং টিম এলমোর নেতৃত্ব দিত। তাদের প্রত্যেকের নিজস্ব বিভাগ ও কর্মক্ষেত্রের বিশেষত্ব ছিল। কিন্তু তার মধ্যেও তারা ছিল প্রতিযোগিতামূলক মনোভাবসম্পন্ন। তারা সবসময় একে অপরের থেকে ভালো করার চেষ্টা করত। তাদের এ বন্ধুভাবাপন্ন প্রতিযোগিতা তাদেরকে উন্নত করেছে এবং এতে করে বাকি সদস্যরাও এ প্রতিযোগিতায় যুক্ত হয়ে তাদের সর্বোত্তম কাজ উপহার দিয়েছে। কিন্তু তারা যতই প্রতিযোগিতা করুক না কেন, তাদের মধ্যকার কেউ যদি কোনো সমস্যায় পড়ত, তবে সাথে সাথে অন্যের সাথে বিনিময় করত এবং অপরজনও তাকে হাত বাড়িয়ে সাহায্য করতে সদা প্রস্তুত ছিল। তারা সবসময়ই নিজেদেরকে সাহায্য করে, নিজেদের মধ্যে স্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতা বজায় রেখে একটি বিজয়ী দলে পরিণত হয়।

আজকে তারা তিনজন নেতা দেশের বিভিন্ন দিকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নেতৃত্ব দিচ্ছে। তারা এখনো বন্ধু। তারা এখনো একে অপরের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে। তাদের অভিজ্ঞতা শেয়ার করে এবং কোন দরকারে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেয়। আর যখনই সম্ভব হয় একে অন্যের সাথে দেখা করে। এ ধরনের বন্ধন তখনই গড়ে ওঠে যখন আপনি প্রতিযোগিতাও করেন, আবার সাহায্যের হাতও বাড়িয়ে দেন। এমন সম্পর্ক কখনো শেষ হয় না। তাদের মধ্যে একে অপরের জন্য এক ধরনের গভীর শ্রদ্ধাবোধ কাজ করে। আর এ শ্রদ্ধাবোধই তাদের মধ্যে আস্থার বন্ধনকে দৃঢ় করে এবং একে অপরকে প্রভাবিত করে যায়।


 



১০

 

আমি কীভাবে দলের সৃজনশীলতাকে শাণিত করব?


সবসময় এটা নিশ্চিত করবেন যেন সর্বোত্তম আইডিয়া নিয়ে কাজ করা হয়।


নিজে নিজে কল্পনা করুন। আপনি যেন একটি গুরুত্বপূর্ণ মিটিং এ যোগদান করছেন। যেখানে আপনার সমপর্যায়ের কর্মকর্তারা এবং কোম্পানির বস রয়েছে। একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রজেক্ট সম্পন্ন করার জন্য আপনাকে নির্বাচিত করা হলো। আপনি দেখতে পেলেন আপনার যোগ্যতা প্রমাণ করার সুযোগ। আপনি বাড়িতে বসে প্রজেক্টের পুরো বিষয়টার তথ্য-উপাত্ত পড়ে দেখলেন। তারপর কয়েক ঘণ্টা ব্যয় করে, অনেকের সাথে আলাপ-আলোচনা করে ভবিষ্যতে কী হতে পারে তা অনুমান করে পরিকল্পনা করলেন। আপনার সহকর্মী ও কর্মচারীদের সাথে আলাপ-আলোচনার পর আপনার মনে হলো, আপনার আইডিয়ার চেয়ে ভালো কোনো আইডিয়া আপনি শোনেননি।

এরপর ধরুন, আবার মিটিং হলো। সেখানে আপনি বেশ আত্মবিশ^াসের সাথে নিজের পরিকল্পনা উপস্থাপন করবেন বলে ঠিক করে রেখেছেন। কিন্তু কিছু সময় পরেই দেখা গেল, আপনি যেমন পরিকল্পনা করেছিলেন মিটিং তেমন যাচ্ছে না। আপনার বস হয়তো এমন এক মন্তব্য করে বসল যার ফলে আলোচনার খাত ভিন্ন দিকে মোড় নিল।

তারপর আপনার কোন সহকর্মী নতুন এক আইডিয়ার কথা বলল। আপনি এর আগে এ আইডিয়া নিয়ে তেমন কিছু চিন্তা করেননি। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, বাকি সবাই মনে করছে আইডিয়াটা বেশ চমকপ্রদ। কয়েকজন সহকর্মী তো সেই আইডিয়া নিয়ে আরও কিছু পরিকল্পনা বলে বসল। আপনি দেখলেন এ আইডিয়া নিয়ে সকলেই বেশ আগ্রহী। সবাই এ আইডিয়ার কার্যকারিতা ও ফলাফল নিয়ে আলাপ করতে লাগল। সকলেই এভাবে আপনার আইডিয়া, যা আপনি কয়েক সপ্তাহ ধরে পরিকল্পনা করেছেন তা থেকে বহুদূরে চলে যাচ্ছে। [আইডিয়াকে বলা হয় মস্তিষ্কপ্রসূত শিশু। নিজের ছেলেমেয়ের মতো মানুষ নিজের আইডিয়াকেও প্রচ- ভালোবাসে।]

এখন আপনি কী করবেন?

এক্ষেত্রে বেশির ভাগ মানুষের স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া হয় তাদের আইডিয়া নিয়ে লড়াই করে যাওয়া। আর যাই হোক, তারা তো এর পিছনে বেশ কিছু জিনিস বিনিয়োগ করেছে:

ক্স বুদ্ধিবৃত্তিক বিনিয়োগ― এর জন্য কয়েক ঘণ্টা ধরে চিন্তা, পরিকল্পনা, সমস্যা নিয়ে আলোচনা, সমাধানের জন্য নতুন আইডিয়া খোঁজা এবং উক্ত আইডিয়াকে কীভাবে কাজে প্রয়োগ করা যায় তা নিয়ে চিন্তা করা হয়েছে।

ক্স শারীরিক বিনিয়োগ― একটি গুরুত্বপূর্ণ মিটিং এর জন্য প্রায়ই অনেক সময়, চেষ্টা ও প্রয়োজনীয় উপকরণ কাজে লাগান হয়।

ক্স আবেগীয় বিনিয়োগ― লোকজন যখন একটি আইডিয়া নিয়ে আসে তখন একে একটি ভালো আইডিয়া হিসাবেই দেখে। এ দেখার মধ্যে যে কেবল কোম্পানির সম্ভাবনা ও লাভ থাকে তাই নয়, নিজেরও পেশাগত জীবনের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা ও মুনাফা থাকে।

এভাবে বিনিয়োগ করার ফলে মানুষ তাদের আইডিয়ার প্রতি বেশ ভালোভাবেই আসক্ত হয়ে পড়ে। তখন এ আইডিয়াকে ছেড়ে যেতে বেশ কষ্ট হয়, বিশেষ করে, যদি দেখা যায় অন্য কেউ নতুন কোনো আইডিয়া এনেছে এবং সব কৃতিত্ব নিয়ে গেছে।


আইডিয়া: একটি কোম্পানির রক্তধারা


আপনি যদি আপনার দলের সৃজনশীলতাকে শাণিত করতে চান, তবে আপনাকে আপনার নিজের আইডিয়া বা বুদ্ধি-পরামর্শই সবচেয়ে ভালো এমন মনোভাব রোধ করতে হবে। বিশেষ করে, আপনার আইডিয়াটি যদি সর্বোত্তম আইডিয়া না হয়, তখন নিজের আইডিয়া, নিজের গুরুত্ব বজায় রাখার যে অতি চেষ্টা থাকে তা রোধ করুন। কেন? কারণ কোম্পানি বা সংগঠনের জন্য সর্বোত্তম আইডিয়াই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ফায়ারস্টোন টায়ার ও রাবার কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা হার্ভে ফায়ারস্টোন বলেন, ‘ব্যবসায় মূলধন বা অর্থ ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। অভিজ্ঞতাও তত গুরুত্বপূর্ণ নয়। আপনি এ দুটোই পেতে পারেন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে জিনিস তা হচ্ছে আইডিয়া। আপনার কাছে যদি আইডিয়া থাকে, তবে আপনার কাছে আছে মূল জিনিস যা দিয়ে আপনি অন্যসব কাছে টানতে পারবেন। ব্যবসা এবং জীবনে একটি ভালো আইডিয়া মানে এ দিয়ে যে কতকিছু করা যায় তার কোনো সীমা নেই। যেকোনো ব্যক্তির সবচেয়ে বড় সম্পদ হচ্ছে― আইডিয়া।’

মহান সব প্রতিষ্ঠান এমন সব লোক নিয়ে কোম্পানি গড়ে তোলে যারা অসাধারণ সব আইডিয়ার জন্ম দিতে পারে। এভাবেই তারা মহান হয়ে ওঠে। তারা পৃথিবীকে উন্নত করতে যেসব উদ্ভাবন আনে তারা তা সাফল্যের চূড়ায় বসে বানায় না। তাদের সৃজনশীল চিন্তা প্রবাহ উপর-থেকে-নিচে বয়ে চলে না; বরং নিচের-থেকে-উপরে ওঠে। আবার তাদের ব্যাপারগুলো এমনও নয় যে প্রতিটি মিটিং এ প্রত্যেককে চাপ দিয়ে নতুন আইডিয়া বের করার চেষ্টা করা হচ্ছে। লোকজন দল বেঁধে কাজ করে। কর্মীরা একযোগে অংশ নেয়। তারা উন্নতি করে কারণ তারা বিজয়ের জন্য সর্বোত্তম আইডিয়াকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করে। [এখানে কোম্পানির বিজয় বা দলগত বিজয়ের দিকে তাদের মনোযোগকে বোঝানো হয়েছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কর্মীরা নিজ নিজ স্বার্থের প্রতি আকৃষ্ট থাকে। তাই এমন আইডিয়াকে সমর্থন করে যা ব্যক্তির ব্যক্তিস্বার্থকে পুষ্ট করে। কিন্তু বিজয়ী দলের কর্মীরা নিজ নিজ স্বার্থের চেয়ে দলীয় স্বার্থকে বেশি প্রাধান্য দেয়। তারা জানে তারা দলবদ্ধভাবে দলীয় লক্ষ্য পূরণ করলে মুনাফা কেবল দলের হবে না, তাদের সকলের হবে এবং সকলেই জিতে যাবে। একমাত্র তখনই কর্মীরা দলের বৃহৎ লক্ষ্য পূরণ করতে সর্বোত্তম আইডিয়া খুঁজে বের করতে এবং তাতে সফল হতে সক্ষম হবে।]

যেসব নেতা দল বা সংগঠনের লক্ষ্যকে আগে রাখে এবং সংগঠনের সবচেয়ে বেশি কী দরকার তার প্রতি সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয় তারাই সংগঠনকে এগিয়ে নিতে পারে। এমন কাজ তারা তাদের সঙ্গীসাথীদের মধ্যে কোম্পানির লক্ষ্যকে আগে রেখে কাজ করতে উৎসাহ দিয়ে করে থাকে। তারা নিজেরাও কোম্পানির লক্ষ্যকে আগে রেখে কাজ করে। তখন তাদের সঙ্গীসাথীরাও কোম্পানির লক্ষ্যকে আগে রেখে কাজ করে। এভাবে তারা দলে থেকে পুরো দলকে উন্নত হতে নেতৃত্ব দেয়।

সর্বোত্তম আইডিয়া কীভাবে খুঁজে পাবেন?


আপনি যদি কোম্পানির জন্য সর্বোত্তম আইডিয়া খুঁজে বের করতে চান, তবে আপনাকে প্রথমে ভালো ভালো আইডিয়া প্রকাশ করতে হবে। তারপর আপনি সেগুলোর উপর আলাপ-আলোচনা করে সর্বোত্তম আইডিয়া খুঁজে বের করবেন। দেশের সবচেয়ে ভালো ভালো দলনেতারা এ কাজ কীভাবে করে? তারা কীভাবে দলের জন্য সর্বোত্তম আইডিয়া খুঁজে বের করে? আমার বিশ^াস তারা এ পদ্ধতি অনুসরণ করে:


১। দলনেতারা সবার আইডিয়া শোনে

উত্তম আইডিয়া খুঁজে বের করতে হলে আমাদেরকে প্রথমে সবার আইডিয়ার কথা শোনার ইচ্ছা থাকতে হবে। গণিতবিদ ও দার্শনিক আলফ্রেড নর্থ হোয়াইটহেড বলেন, ‘প্রায় সব নতুন আইডিয়াই প্রথম প্রথম শুনলে হাস্যকর মনে হয়।’ আপনি যখন ব্রেইনস্ট্রমিং করবেন তথা দলবদ্ধভাবে আইডিয়া খুঁজতে বসবেন, তখন অন্য কারও আইডিয়ার কথা বলার মাঝখানে তাকে থামিয়ে দেওয়া ভালো ভালো আইডিয়া আসার পথে বাধা দেয়।

আমি আমার বই থিংকিং ফর এ চেঞ্জ এ এগারোটি চিন্তা করার কৌশল সম্পর্কে বলেছি। সেখানকার একটি অন্যতম কৌশল হিসাবে আমি বলব মানুষ সবচেয়ে ভালোভাবে শেখে যখন একে অপরের সাথে সে চিন্তার পারস্পরিক আদানপ্রদান করতে পারে তখন। এটা ধীর চিন্তার চেয়ে উত্তম ও দ্রুত ফলাফল দেয়। এটা আরও বেশি উদ্ভাবনীশক্তিপূর্ণ এবং অনেক মূল্যবান। আরও গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে (আমি নিজেও তা বিশ^াস করি) মহান সব আইডিয়া আসে ভালো ভালো চিন্তাকে একটি সহযোগিতাপূর্ণ পরিবেশে শেয়ার করার সুযোগ পেলে। তখন তারা এসব আইডিয়াকে নিজেদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অনুযায়ী আকার দেয় এবং এগুলোকে আরও উন্নত ও কার্যকর করে। একজন ভালো নেতা দলের মধ্যে এমন পরিবেশ তৈরি করতে সাহায্য করে।


২। দলনেতারা কখনো একটি মাত্র আইডিয়া নিয়ে বসে থাকে না

আমার মনে হয়, অনেক নেতাই আইডিয়া পেলেই তা নিয়ে দ্রুত ছোটাছুটি শুরু করে। তার কারণ নেতারা কর্মমুখী তথা কাজপ্রবণ। তারা কাজ নিয়ে এগিয়ে যেতে চায়। তারা কিছু একটা করতে চায়। কিছু একটা ঘটাতে চায়। তারা পাহাড়ের চূড়ায় পৌঁছাতে চায়। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে অনেক সময় দেখা যায় তারা অনেক লড়াই করে যে চূড়ায় উঠেছে তা সঠিক চূড়া নয়।

একটি আইডিয়া কখনো যথেষ্ট নয়। অনেক আইডিয়া থাকলে আমাদের মনোবল বাড়ে। আমি একবার এক বিশ্লেষককে বলতে শুনেছিলাম যে ঠিক এ কারণেই বিংশ শতকের শেষে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা মূলত একটি আইডিয়ার ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। কেউ যদি ভিন্ন কোনো পথে চেষ্টা করতে চায়, তবে তাদেরকে জেলে দেওয়া হয় বা সরিয়ে ফেলা হয়।

এর বিপরীতে, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা হচ্ছে বহু আইডিয়ার মিলনস্থল। লোকজন যদি ভিন্ন কিছু চেষ্টা করতে চায় তবে তাদেরকে সুযোগ দেওয়া হয়। তারা নানা ধরনের আইডিয়া নিয়ে, বিভিন্ন উপায়ে তাদের আকাক্সক্ষা পূরণের চেষ্টা করে এবং কী ঘটে তা দেখতে পায়। যদি আইডিয়া কার্যকর হয়, তবে তা চলতে থাকে। আর যদি কাজে না লাগে, তবে অন্য কোনো আইডিয়া দিয়ে একে প্রতিস্থাপন করা হয়। গণতান্ত্রিক দেশগুলোর এ স্বাধীনতার কারণে তাদের সৃজনশীলতার মাত্রা উচ্চমানের, অবারিত সুযোগ এবং অগ্রগতির সম্ভাবনা অসীম। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা হয়তো কিছুটা অগোছালো, কিন্তু এ কথা যেকোনো সৃজনশীল ও সহযোগিতাপূর্ণ কাজ করার ক্ষেত্রেও সত্য।

মুক্তবাজার অর্থনীতিও ঠিক একই মানসিকতা নিয়ে চলে। বিশে^র সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক বাজার এ ব্যবস্থার মাধ্যমেই চলে এবং দেশের সংগঠনগুলোও একই ভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। লোকজন যদি নানা ধরনের আইডিয়া ও অভিমত প্রকাশের সুযোগ পায়, তবে তারা আরও বড় হয়, উদ্ভাবনী শক্তিসম্পন্ন হয়ে ওঠে এবং জীবনে উন্নতি করে।


৩। সচরাচর যেসব জায়গা মানুষ দেখে না দলনেতারা সেখান থেকেই আইডিয়া খুঁজে বের করে

ভালো নেতারা আইডিয়ার প্রতি আকর্ষণ বোধ করে। তারা সবসময় আইডিয়ার খোঁজে থাকে। তারা নিজেদের মধ্যে নিয়মিত চর্চা করার মাধ্যমে আইডিয়ার প্রতি এক ধরনের মনোযোগ গড়ে তোলে। তারা যখন সংবাদপত্র পড়ে, সিনেমা দেখে, তাদের সহকর্মীদের কথা শোনে বা অবসর যাপন করে, সবসময়ই তারা আইডিয়া খুঁজতে থাকে বা তাদের কাজ ও নেতৃত্বকে কীভাবে উন্নত করা যায় সেই চিন্তায় অনুসন্ধানী মনোভাব নিয়ে থাকে। [দেখলে মনে হয়, সবসময়ই যেন কিছু একটা চিন্তা করছে।]

আপনি যদি ভালো ভালো আইডিয়া খুঁজে পেতে চান, তবে আপনাকে অনুসন্ধানী মনোভাব নিয়ে থাকতে হবে। এ ব্যাপারটি খুব দুর্লভ যে কোনো ভালো আইডিয়া আপনাকে খুঁজছে। এ দায়িত্ব আগে আপনাকেই কাঁধে তুলে নিতে হবে।


৪। দলনেতারা কখনো নিজের ব্যক্তিত্বকে উদ্দেশ্য বা লক্ষ্যের ওপর চাপিয়ে দেয় না [প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের চেয়ে নিজের ব্যক্তিত্বকে বড় করে দেখায় না]

যাকে পছন্দ বা সম্মান করেন না, এমন কেউ যদি আপনাকে কিছু করার পরামর্শ দেয়, তবে আপনার প্রথম প্রতিক্রিয়া কী হবে? আমি বাজি ধরে বলতে পারি, আপনি তা ডিসমিস করে দিবেন। আপনি নিশ্চয়ই সেই কথাটি শুনেছেন, ‘উৎস বিবেচনা করো (ঈড়হংরফবৎ ঃযব ংড়ঁৎপব)।’ [এর মানে হচ্ছে আমরা কোনো মতামতকে তখনই গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করি যখন তা সম্পর্কে আমরা আগে থেকে অবগত থাকি।] এ কিন্তু মন্দ নয়, তবে আপনি যদি সতর্ক না থাকেন, তাহলে হয়তো ভালো বাদ দিয়ে মন্দকে গ্রহণ করবেন।

মানুষের সাথে যখন কাজ করবেন তখন কারও ব্যক্তিত্বকে এত বড় করে দেখবেন না যে কাজের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যই হারিয়ে ফেললেন। দল ও সংগঠনের বৃহত্তর স্বার্থে কোনো আইডিয়া কাজে লাগবে তা সবসময় চিন্তা করুন। কোনো ব্যক্তির ব্যক্তিত্বের প্রভাব যেন এ কাজে বাধা হয়ে না দাঁড়ায়। এতে করে যদি আপনাকে এমন এমন ব্যক্তিদের কথা শুনতে হয় যাদের সাথে আপনার কোনো কেমেস্ট্রি নেই বা পূর্বের কোনো তিক্ত অভিজ্ঞতা আছে, তা হলেও শুনুন। আপনার ব্যক্তি অহংকে একপাশে সরিয়ে রাখুন এবং শুনুন। আর আপনি যখন অন্যদের আইডিয়াকে বাদ দিবেন, তখন মনে রাখবেন আপনি কেবল ঐ আইডিয়া বাদ দিয়েছেন, ব্যক্তিকে নয়।

 

৫। দলনেতারা সৃজনশীল ব্যক্তি এবং তাদের আইডিয়াকে আগলে রাখে

আইডিয়াগুলো এতই ভঙুর ও হালকা থাকে, বিশেষ করে, প্রথম প্রথম তাদেরকে খুব যত্ন সহকারে ঘিরে রাখতে হয়। [আইডিয়া যেন দুই হাতে ধরা প্রজাপতির মতো। বেশি জোরে ধরলে মরে যাবে। আবার হালকা করে ধরতে গেলে উড়ে যাবে।] বিখ্যাত বিজ্ঞাপন এক্সিকিউটিভ চার্লি ব্রওয়ার বলেন, ‘একটি নতুন আইডিয়া খুবই নাজুক থাকে। একটা টিটকারি বা হাই তোলার ফলে আইডিয়ার মৃত্যু ঘটতে পারে। একটা ঠাট্টা বা একজন যোগ্য ব্যক্তির ভ্রু উঠানোতেই আইডিয়া নিহত হতে পারে।’

আপনি যদি চান সর্বোত্তম আইডিয়া সামনে আসুক, তবে আপনাকে সৃজনশীল লোকজন নিয়ে কাজ করতে হবে এবং তাদেরকে আপনার সংগঠনে কাজ করার সুযোগ করে দিতে হবে। আপনি যখন এমন কর্মীদের খুঁজে পাবেন যারা সৃজনশীল তাদেরকে সাথে সাথে পদোন্নতি দিয়ে দিন। তাদেরকে উৎসাহ দিন এবং আগলে রাখুন। দেখা যায়, বাস্তববাদী লোকজন প্রায় সময় সৃজনশীল লোকজনের আইডিয়াকে গুলি করে মারে। যেসব নেতা সৃজনশীল ব্যক্তি এবং তাদের আইডিয়াকে আগলে রাখে, তাদেরকে সমৃদ্ধ হওয়ার সুযোগ দেয়, তারা নতুন নতুন আইডিয়া তৈরি করতে থাকে যা কোম্পানি বা সংগঠনকে লাভবান করে।


৬। দলনেতারা সমালোচনা বা প্রত্যাখ্যানকে ব্যক্তিগতভাবে নেয় না

আপনার আইডিয়াকে যখন অন্যরা ভালোভাবে গ্রহণ করে না, তখন চেষ্টা করবেন একে ব্যক্তিগতভাবে না নিতে। কেউ যদি মিটিং এর মধ্যে এমন কিছু করে তবে সে সৃজনশীল প্রক্রিয়াকেই ব্যাহত করছে। কারণ তখন আর আলোচনার কিছু থাকে না বা সংগঠনকে সাহায্য করার মতো কোনো কথা থাকে না। এতে করে যে ব্যক্তি আইডিয়া দিচ্ছিল তার মন ভেঙে যায়। এসব মুহূর্তে আপনি যদি অভিযোগকারীর অভিযোগকে বাদ দিয়ে আপনার শক্তি আইডিয়া প্রকাশ ও তৈরির দিকে কেন্দ্রীভূত করতে পারেন, তবে লোকজন খোলামনে তাদের আইডিয়াগুলো বলতে পারবে।

বিশ^বিখ্যাত বিজ্ঞাপন এজেন্সি বোজেল ওয়ার্ল্ডওয়াইডের এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট মেল নিউহফ। তার কথায় বলতে গেলে বলতে হয়, আইডিয়াই সব। নিউহফ ম্যান তার বিজ্ঞাপন ব্যবসার অভিজ্ঞতা থেকে কিছু পরামর্শ দেন:

আগ্রহ ও কৌতূহল নিয়ে নিজের কাজ করো। তোমার কাজ সম্পর্কে প্যাশেনেট (ঢ়ধংংরড়হধঃব) হও। [প্যাশেনেট হওয়া মানে নিজের কাজ সম্পর্কে গভীর আগ্রহ এবং প্রচ- ভালোবাসা থাকতে হবে।] নিজের আইডিয়া নিয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলার মতো সৎ সাহস রাখো। কিন্তু, কখন আপস করতে হবে, বসে পড়তে হবে, তাও জানতে হবে।

প্যাশান (ঢ়ধংংরড়হ) ব্যতীত আপনাকে কেউ সিরিয়াসলি নিবে না। আপনি যদি আপনার আইডিয়াকে রক্ষা না করেন, তবে অন্য কেউ তা করবে না। যখন মূল আদর্শ বা নীতিনৈতিকতায় নাড়া খায় তখন আপস করার প্রশ্নই আসে না।

এ জিনিসের আবার ভিন্ন এক দিকও রয়েছে। জীবনে অখ- সত্য বলে খুব কম জিনিসই রয়েছে। বেশির ভাগ বিষয়ে আসলে মতামত বা একেক জনের একেক রুচির তারতম্য দেখা যায়, নীতিনৈতিকতায় মতপার্থক্য খুব কমই ঘটে। এসব ক্ষেত্র বুঝে আপনি আপস করতে পারেন। আপনি যদি এমন একজনে পরিণত হন যে কখনো আপস করে না তাহলে এমন মানুষে পরিণত হবেন যারা স্বেচ্ছায় সুযোগকে তাড়িয়ে দেয়।

একজন উৎসাহদানকারী নেতা হিসাবে এবং সবাইকে নেতৃত্ব দেওয়া মানে এ নয় যে সবসময় কেবল নিজের নির্দিষ্ট করা রাস্তাতেই চালাতে হবে। যেকোনো মূল্যে জয়ী হতে হবে― ব্যাপারটা এমন নয়। ব্যাপারটা হচ্ছে আপনি আপনার সহকর্মী ও বন্ধুদের শ্রদ্ধা ও সম্মান জয় করলেন এবং তাদেরকে এমনভাবে প্রভাবিত করলেন যে তারা নিজেরাই দলবদ্ধ জয়ের জন্য উৎসাহী হয়ে উঠল। আপনি কি আপনার কাজ নিয়ে প্যাশেনেট ও দৃঢ়সংকল্প, আত্মবিশ^াসী এবং মানুষকে এগিয়ে নিতে নিজের সামর্থ্যরে ওপর আস্থাবান? এ ব্যাপারে নিশ্চিত তো। আপনার নীতিনৈতিকতা ও আদর্শ যখন ঝুঁকির মুখে পড়ে তখন কি আপনি সেগুলোকে দৃঢ়হস্তে ধরে রাখতে পারেন? অবশ্যই। কিন্তু সবসময় মনে রাখবেন একটি সংগঠন চালাতে গেলে সহযোগিতাপূর্ণ মনোভাব সবচেয়ে বেশি কাজে দেয়। আপনি যখন আমার আইডিয়া বা তার আইডিয়ার বদলে আমাদের আইডিয়া বলে চিন্তা করবেন, তখনই আপনি আপনার দলকে বিজয়ের পথে পরিচালিত করবেন। আপনার ভেতরের প্রেরণা শক্তি তাই হওয়া উচিত। কেবল বন্ধুবান্ধব তৈরি বা লোকজনকে প্রভাবিত করাই যথেষ্ট নয়। আর আমার মনে হয় আপনি যখন সর্বোত্তম আইডিয়াকে সবার উপরে জায়গা দিবেন, তখন আপনি লোকজনকে প্রভাবিত করতে পারবেন এবং বন্ধুতে পরিণত করতে সক্ষম হবেন।

 

ব্যক্তিগত উন্নয়নে

অন্যান্য বইয়ের তালিকা


০১. থিংক এন্ড গ্রো রিচ। মূল: নেপোলিয়ন হিল। অনুবাদ: ফজলে রাব্বি। ঢাকা, সাফল্য প্রকাশনী, ২০১৫।

০২. ডিভেলপিং দ্য লিডার উইদিন ইউ। মূল: জন সি. ম্যাক্সওয়েল। অনুবাদ: ফজলে রাব্বি। ঢাকা, সাফল্য প্রকাশনী, ২০১৭।

০৩. সাকসেস থ্রো এ পজেটিভ মেন্টাল এটিটিউড। মূল: নেপোলিয়ন হিল ও ডব্লিউ. ক্লেমেন্ট স্টোন। অনুবাদ: ফজলে রাব্বি। ঢাকা, সাফল্য প্রকাশনী, ২০১৭।

০৪. টাইম ম্যানেজমেন্ট। মূল: ব্রায়ান ট্রেসি। অনুবাদ: মোহাম্মদ রাশেদুল হক ও ফজলে রাব্বি। ঢাকা, সাফল্য প্রকাশনী, ২০২০।

০৫. অবজারভেশন। মূল: রাসেল এইচ. কনওয়েল। অনুবাদ: ফজলে রাব্বি। ঢাকা, সাফল্য প্রকাশনী, ২০১৭।

০৬. জিরো টু ওয়ান। মূল: পিটার থিয়েল ও ব্লেইক মাস্টার। অনুবাদ: ফজলে রাব্বি। ঢাকা, সাফল্য প্রকাশনী, ২০১৮।

০৭. আউটলায়ার্স। মূল: ম্যালকম গ্ল্যাডওয়েল। অনুবাদ: এ.এম. নাইম হোসেন ও ফজলে রাব্বি। ঢাকা, সাফল্য প্রকাশনী, ২০১৮।

০৮. ৭ স্ট্র্যাটেজিস ফর ওয়েলথ এন্ড হ্যাপিনেস। মূল: জিম রন। অনুবাদ: ফজলে রাব্বি। ঢাকা, সাফল্য প্রকাশনী, ২০১৯।

০৯. ওয়ান স্মল স্টেপ ক্যান চেঞ্জ ইউর লাইফ। মূল: ড. রবার্ট মৌরার (পিএইচডি)। অনুবাদ: ফজলে রাব্বি। ঢাকা, সাফল্য প্রকাশনী, ২০১৯।

১০. অ্যাজ আ ম্যান থিংকথ। মূল: জেমস অ্যালেন। অনুবাদ: ফজলে রাব্বি। ঢাকা, সাফল্য প্রকাশনী, ২০১৯।

১১. স্টার্ট উইথ হোয়াই। মূল: সাইমন সিনেক। অনুবাদ: ফজলে রাব্বি। ঢাকা, সাফল্য প্রকাশনী, ২০২০।

১২. এটিটিউড ইজ এভরিথিং। মূল: জেফ কেলার। অনুবাদ: ফারহা আহমেদ, শাহরিয়ার মাহমুদ ও ফজলে রাব্বি। ঢাকা, সাফল্য প্রকাশনী, ২০২০।

১৩. মেনটরিং ১০১। মূল: জন সি. ম্যাক্সওয়েল। অনুবাদ: ফজলে রাব্বি। ঢাকা, সাফল্য প্রকাশনী, ২০২০।

১৪. গেট স্মার্ট। মূল: ব্রায়ান ট্রেসি। অনুবাদ: ফারহা আহমেদ। সম্পাদনা: ফজলে রাব্বি। ঢাকা, সাফল্য প্রকাশনী, ২০২১।

১৫. সেল্ফ-ইমপ্রুভমেন্ট ১০১। মূল: জন সি. ম্যাক্সওয়েল। অনুবাদ: ফজলে রাব্বি। ঢাকা, সাফল্য প্রকাশনী, ২০২১।

১৬. টিমওয়ার্ক ১০১। মূল: জন সি. ম্যাক্সওয়েল। অনুবাদ: ফজলে রাব্বি। ঢাকা, সাফল্য প্রকাশনী, ২০২১।


 

পাঠকের জন্য:


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন