শুক্রবার, ২২ জানুয়ারী, ২০২১

গেট স্মার্ট। মূল: ব্রায়ান ট্রেসি। অনুবাদ: ফারহা আহমেদ। সম্পাদনা: ফজলে রাব্বি। ঢাকা, সাফল্য প্রকাশনী, ২০২১।


স্মার্ট হোন

যেকোনো কর্মক্ষেত্রের সফল ও সর্বোচ্চ বেতনধারী ব্যক্তিরা কীভাবে চিন্তা ও কাজ করে তারই বিচারবিশ্লেষণ


আমার জীবনের একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য হচ্ছে মানুষের জন্য উপকারী সেবা সম্পন্ন করা, একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যের ক্ষমতাকে তুলে ধরা যাতে করে মানুষ নিজেদের জীবনকে সমৃদ্ধি ও সাফল্যের পথে পরিচালিত করতে পারে। ঠিক এই কারণেই আমি প্রতিদিন সকালবেলা ঘুম থেকে উঠি, নতুন নতুন পথ খুঁজি, কী কী করা যায় তা নিয়ে চিন্তাভাবনা করি। এরই একটি উপায় হচ্ছে সাফল্য প্রকাশনীর মাধ্যমে ২০৩০ সালের মধ্যে অনুপ্রেরণার ৬৪টি বই প্রকাশ করা।

 ―ফজলে রাব্বি (সাফল্য প্রকাশনী, ঠিক ধারণা ব্লগ)


গেট স্মার্ট

(স্মার্ট হোন)


মূল: ব্রায়ান ট্রেসি

অনুবাদ: ফারহা আহমেদ

সম্পাদনা: ফজলে রাব্বি


প্রকাশক

সাফল্য প্রকাশনী

৩০২, লালবাগ রোড, ওয়ার্ড নং: ২৫,

লালবাগ, ঢাকা-১২১১।

মোবাইল: ০১৫৩৪ ৯০২ ৮৮২

সাপ্র: ০১৪

প্রথম প্রকাশ: পৌষ ১৪২৭ / জানুয়ারি ২০২১

বিষয়: ব্যক্তিগত উন্নয়ন

স্বত্ব:র্  ফজলে রাব্বি

প্রচ্ছদ: সাফল্য কম্পিউটার্স


দাম: দুইশত পঞ্চাশ টাকা মাত্র ($২৫০.০০)


পরিবেশক: নীলক্ষেত বুক মার্কেট, ৬৪, ইসলামিয়া মার্কেট, নীলক্ষেত, ঢাকা-১২০৫।

ফোনে অর্ডার করতে কল করুন ০১৬৮২ ০৫৮ ১৭১

সাফল্য প্রকাশনীর অনলাইন ওয়েরসাইট– িি.িংধঢ়যড়ষষড়.পড়স

সাফল্য প্রকাশনীর যেকোনো বই কিনতে ভিজিট করুন

িি.িৎড়শড়সধৎর.পড়স/সাফল্য-প্রকাশনী

যঃঃঢ়://িি.িভধপবনড়ড়শ.পড়স/হরষশযবঃনসধৎশবঃ


এবঃ ঝসধৎঃ, ঊফরঃবফ নু ঋধুষব জধননর, চঁনষরংযবফ নু ঝধঢ়যড়ষষড় চৎড়শধংড়হর, ৩০২, খধষনধময জড়ধফ, ডধৎফ ঘড়: ২৫, খধষনধময, উযধশধ-১২১১. ঈড়হঃধপঃ ঙভভরপব: ০১৫৩৪ ৯০২ ৮৮২.

ডবনংরঃব: িি.িংধঢ়যড়ষষড়.পড়স

ঊ-সধরষ: ধফসরহ@ংধঢ়যড়ষষড়.পড়স

চৎরপব: ঞশ ২৫০.০০ ঙহষু. টঝ: $১২. (ঐধৎফপড়াবৎ). ওঝইঘ: ৯৭৮-৯৮৪-৯৩৬১৫-৭-৯

 



অনুবাদকের উৎসর্গ

আমার ছোট বোন ছোঁয়া এবং ছোট ভাই রাকিবকে




সূচি

অনুবাদকের ভূমিকা ১১

সম্পাদকের ভূমিকা ১২

সূচনা আপনার ভেতরে থাকা আবদ্ধ সম্ভাবনাকে মুক্ত করুন ১৩

সম্ভাবনার মাত্র ১০ শতাংশ ক্ষমতার ব্যবহার ১৪

সমন্বয় করতে শিখুন ১৫

আপনার ব্যাখ্যা শৈলী তথা যেভাবে সবকিছুকে ব্যাখ্যা করেন ১৫

ভালো দিক খুঁজুন ১৬

দৃষ্টিভঙ্গির ভিন্নতা ১৭

এক মহাআবিষ্কার ১৭

অধ্যায় ১ দীর্ঘমেয়াদি দৃষ্টিভঙ্গি বনাম স্বল্পমেয়াদি দৃষ্টিভঙ্গি ১৯

বুদ্ধিমত্তা কী? ২০

কর্মই সব ২০

কাজটি কি সফল হলো? ২১

ফলাফল নিয়ে ভাবুন ২১

ভয়ঙ্কর কিছু সৃষ্টি ২২

ভবিষ্যতের চিন্তা করুন ২২

সর্বজনীন বৈশিষ্ট্য ২৩

সময় সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি এবং উপার্জন ২৪

ভবিষ্যতে কী করবেন তা নির্ধারণ করুন ২৫

অনুশীলনী ৩১

অধ্যায় ২ ধীর চিন্তা বনাম দ্রুত চিন্তা ৩২

প্রতিক্রিয়াশীল-প্রতিক্রিয়া প্রক্রিয়া ৩৩

চিন্তা এক কঠিন কাজ ৩৩

ধীর চিন্তা ৩৪

দুইটি ভিন্ন চিন্তা প্রক্রিয়া ৩৪

ফলাফল বিবেচনা করুন ৩৫

নিজের চিন্তাধারা বিশ্লেষণ করুন ৩৫

বিবরণ লিখে ফেলুন ৩৬

মানুষ সম্পর্কিত সিদ্ধান্ত ৩৬

নিয়োগ রহস্য ৩৭

অনুশীলন ৪১

অধ্যায় ৩ জ্ঞাত চিন্তা বনাম অজ্ঞাত চিন্তা ৪২

ব্যবসায় সফলতার কারণ ৪২

তথ্য যাচাই করুন ৪৩

বৈজ্ঞানিক উপায় অবলম্বন করুন ৪৪

ব্যর্থতার জন্য প্রস্তুত থাকুন ৪৫

নির্ভুল হওয়া আবশ্যক ৪৫

অভিজ্ঞতার বিকল্প নেই ৪৬

খেলায় আধিপত্য বিস্তার করুন ৪৬

অভিজ্ঞতার গুরুত্ব অপরিসীম ৪৭

এক নম্বর নিয়ম ৪৭

ধনীদের কৌশল ৪৮

অনুশীলন ৪৯

অধ্যায় ৪ লক্ষ্যভিত্তিক চিন্তা বনাম প্রতিক্রিয়াভিত্তিক চিন্তা ৫০

জীবনের টানিং পয়েন্ট তথা সন্ধিক্ষণ ৫০

লক্ষ্য আবিষ্কার ৫১

সম্পদ অর্জনের চাবিকাঠি ৫২

দশগুণ আয় করুন ৫২

বৃহৎ তিন গঠন করুন ৫৩

বিক্ষিপ্ত চিন্তা কমান ৫৪

পরিবর্তনের প্রভাব ৫৪

তথ্য বিস্ফোরণ ৫৪

প্রযুক্তির বিস্তার ৫৫

অনুশীলন ৬৪

অধ্যায় ৫ ফলাফলভিত্তিক চিন্তা বনাম কার্যভিত্তিক চিন্তা ৬৫

বেশি বেশি আয় করুন ৬৬

আয় করার ক্ষমতার সংজ্ঞা ৬৬

শীর্ষ ২০ শতাংশে যোগ দিন ৬৭

নি¤œমুখী কর্মদক্ষতার মূল কারণসমূহ ৬৮

অভ্যাসের প্রভাব ৬৮

কাজের সময় কাজ ৬৮

কখন কাজ করছেন? ৬৯

শুরু করুন এবং চালিয়ে যান ৭০

সময় ব্যবস্থাপনা কৌশল ৭০

ইমেইল চেক করবেন না ৭১

গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো লিস্টে উল্লেখ করুন ৭১

অনুশীলন ৭৮

অধ্যায় ৬ ইতিবাচক চিন্তা বনাম নেতিবাচক চিন্তা ৭৯

প্রকৃত উপায় ৭৯

সফল মানুষ কী করে? ৮০

এক মহান আবিষ্কার ৮০

এক সময় একটি চিন্তা ৮১

একটি সদ্যজাত শিশু ৮২

ব্যর্থতা ও সমালোচনার ভীতি ৮২

সমালোচনা ভীতি ৮৩

প্রতিসংহৃত (দমনকারী) ভালোবাসা ৮৩

ঘাটতি ও প্রয়োজনীয়তা ৮৩

অনুশীলনী ৯৩

অধ্যায় ৭ অনমনীয় চিন্তা বনাম নমনীয় চিন্তা ৯৪

আপনার উত্তরগুলো বদলে গেছে ৯৫

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গুণ ৯৫

পরিবর্তনের গতি দ্রুত থেকে দ্রুততর হচ্ছে ৯৬

বিশ লাখ চাকরি উধাও ৯৬

আপনার ব্যবসায়িক মডেল ৯৬

ত্বরিত বিলোপপ্রবণতা ৯৭

৮০/২০ নীতি এবং আয় ৯৮

অপরিকল্পিত অপ্রচলিত দক্ষতা ৯৮

প্রতিযোগিতা চলছে ৯৯

অনুশীলন ১১০

অধ্যায় ৮ সৃষ্টিশীল চিন্তা বনাম যান্ত্রিক চিন্তা ১১১

যান্ত্রিক চিন্তা ১১১

আপনি একজন সম্ভাবনাময় প্রতিভাধর ব্যক্তি ১১২

যুগের পরিক্রমায় প্রতিভা ১১২

উদারমনা ১১৩

শ্রেষ্ঠ সমাধান ১১৩

নিয়মানুগ প্রচেষ্টা ১১৪

নিয়মানুগ সমস্যা-সমাধান কৌশল ১১৫

পণ্য ব্যর্থ হওয়ার হার ১১৫

বিক্রয় উন্নয়ন প্রক্রিয়া ১১৬

সঠিক সংজ্ঞা উত্তম সমাধান এনে দেয় ১১৭

একটি বিকল্প পরিকল্পনা তৈরি করুন ১১৮

অনুশীলনী ১২৫

অধ্যায় ৯ উদ্যোক্তা চিন্তা বনাম কর্পোরেট চিন্তা ১২৬

ক্রেতা নিয়ে ভাবুন ১২৬

কর্পোরেট চিন্তা ১২৭

সংযুক্ত হওয়ার অক্ষমতা ১২৭

প্রতিশ্রুতিই হলো মূল চাবিকাঠি ১২৮

বিক্রয় হলো মূল জিনিস ১২৮

নিজেকে কিছু মৌলিক প্রশ্ন জিজ্ঞেস করুন ১২৯

ক্রেতার মতো চিন্তা করুন ১২৯

আপনার শ্রেষ্ঠ ক্ষেত্র ১৩০

আপনার ব্যবসায়িক নকশা ১৩১

অনুশীলন ১৩৪

অধ্যায় ১০ ধনী চিন্তা বনাম দরিদ্র চিন্তা ১৩৫

আগে ভেতরে পরে বাইরে ১৩৫

স্ব-প্রতিষ্ঠিত কোটিপতি ১৩৬

আপনার চিন্তা পুনর্গঠন করুন ১৩৭

ধনী না হতে পারার কারণসমূহ ১৩৭

১। চিন্তাটি তাদের মাথায়ই আসে না ১৩৮

২। তারা ধনী হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় না ১৩৮

৩। তারা অলস ১৩৮

৪। তারা ব্যর্থতাকে ভয় পায় ১৩৯

৫। তারা সমালোচনা ও অসমর্থনকে ভয় পায় ১৩৯

৬। তারা শেখা ও উন্নত হওয়া বন্ধ করে দেয় ১৪০

৭। তারা অধ্যবসায়হীন ১৪০

শিক্ষা ও অনুশীলন ১৪০

মানুষ যা চিন্তা করে ১৪১

একটি সমৃদ্ধশালী মানসিকতা গঠন করুন ১৪১

সম্পদের ঐতিহাসিক উৎস ১৪২

আজকের দিনে সম্পদ অর্জন ১৪২

শূন্য থেকে সূত্রপাত ১৪৩

ধনীদের মতো অভ্যাস গঠন করুন ১৪৩

অনুশীলনী ১৫৭

ব্যক্তিগত উন্নয়নে অন্যান্য বইয়ের তালিকা ১৫৮


 

অনুবাদকের ভূমিকা

সাফল্য সবার কাম্য কিন্তু এই সাফল্য অর্জনের পথ সহজ নয়। সাফল্য অর্জনের পথে প্রতিকূলতা দূর করতে প্রয়োজন সঠিক দিকনির্দেশনা ও অনুপ্রেরণা। সফল ব্যক্তিরা কীভাবে তাদের সাফল্য অর্জন করেছেন এবং তাদের পথ অনুসরণ করে আমরাও কীভাবে সাফল্য অর্জন করতে পারি, বেস্ট-সেলিং লেখক ব্রায়ান ট্রেসি তার বিখ্যাত গেট স্মার্ট বইটিতে সে কথাগুলো অত্যন্ত সহজ ও সাবলীলভাবে তুলে ধরেছেন। আজকের এই দ্রুতগামী ও প্রতিযোগিতামূলক যুগে টিকে থাকতে হলে মানুষকে তার মানসিক ক্ষমতার সর্বোচ্চ বিকাশ ঘটাতে হবে। আর এজন্য তাকে হতে হবে স্মার্ট। স্মার্ট ব্যক্তি বলতে আমরা এমন একজনকে বুঝি যে কিনা বুদ্ধিমান ও সচেতন। যে কিনা তার জ্ঞান ও দক্ষতা যথাযথভাবে কাজে লাগাতে সক্ষম। সকল স্মার্ট ব্যক্তি সফল না হলেও একথা নিশ্চিতভাবে বলা যেতে পারে যে সকল সফল ব্যক্তিই স্মার্ট। কীভাবে স্মার্ট হওয়া যায় এবং এই স্মার্টনেসকে কাজে লাগিয়ে জীবনে সফলতা অর্জন করা যায় এই বইতে সেটি সুন্দরভাবে ব্যখ্যা করা হয়েছে। স্মার্ট ও সফল হওয়ার জন্য কোন কাজগুলো করা উচিত, কীভাবে লক্ষ্য নির্ধারণ এবং লক্ষ্য অর্জনের পথে অগ্রসর হওয়া উচিত, লেখক সহজ ভাষায় ধাপে ধাপে সেই পদ্ধতিগুলো ব্যাখ্যা করেছেন।

সফল ব্যক্তিদের কিছু সর্বজনীন বৈশিষ্ট্য ও অভ্যাস থাকে। এই অভ্যাসগুলো অনুসরণ করে আমরাও কীভাবে সফল ব্যক্তিদের গুণাবলি অর্জন করতে পারি সে কথাগুলো এ বইয়ে তুলে ধরা হয়েছে। এই বইয়ে বর্ণিত উপদেশগুলো বাস্তবসম্মত এবং এদের অনুসরণ করা অত্যন্ত সহজ বিধায় এগুলো পাঠকদের ব্যক্তিগত ও পেশাগত জীবনের উন্নয়নে সহায়ক হবে। বইটি অনুবাদ করতে গিয়ে আমি নিজে অনেক মূল্যবান জ্ঞান অর্জন করতে পেরেছি যা আমি নিজের জীবনে কাজে লাগাতে পারব। আশা করি বইটি পাঠকদের ভালো লাগবে এবং তাদের সাফল্য অর্জনের পথে অগ্রসর হতে সাহায্য করবে।

সবশেষে আমি ফজলে রাব্বি ভাইয়াকে ধন্যবাদ জানাতে চাই আমাকে বইটি অনুবাদের সুযোগ দেওয়ার জন্য। অনুবাদে কোন ভুল ত্রুটি থাকলে আশা করি পাঠক সেটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।

- ফারহা আহমেদ

জানুয়ারি, ২০২১

ধানমন্ডি, ঢাকা

 

সম্পাদকের ভূমিকা

গেট স্মার্ট তথা স্মার্ট হোন। লেখক ব্রায়ান ট্রেসি তার বইয়ের শিরোনামেই তার ইচ্ছা, উদ্দেশ্য এবং বইয়ের বিষয়বস্তু তুলে ধরেছেন। ইংরেজিতে স্মার্ট শব্দটির চমৎকার ব্যাখ্যা আছে। SMART acronym: Specific, Measurable, Achievable, Realistic, and Timely. একটি লক্ষ্য বা পরিকল্পনার কতগুলো বৈশিষ্ট্য থাকতে হবে। একটি লক্ষ্যকে অবশ্যই নির্দিষ্ট হতে হবে, পরিমাপযোগ্য, অর্জনযোগ্য, বাস্তবিক ও সময়সীমা থাকতে হবে। এ বৈশিষ্ট্যগুলোই স্মার্ট শব্দটির মধ্য দিয়ে খুব সুন্দরভাবে প্রকাশিত হয়েছে।


 এছাড়াও ব্রায়ান ট্রেসি মানুষের চিন্তাভাবনার শক্তি বৃদ্ধির কলাকৌশল সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। যেমন: দীর্ঘমেয়াদি দৃষ্টিভঙ্গি বনাম স্বল্পমেয়াদি দৃষ্টিভঙ্গি, ধীর চিন্তা বনাম দ্রুত চিন্তা, লক্ষ্যভিত্তিক চিন্তা বনাম প্রতিক্রিয়া চিন্তা প্রভৃতি। এভাবে তিনি নানান ধরনের মানুষের চিন্তাভঙ্গিকে বিচারবিশ্লেষণ করে আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন। শেষ অধ্যায়ে তিনি বিচার করেছেন ধনী চিন্তা বনাম দরিদ্র চিন্তা। এভাবে প্রতিটি অধ্যায় এগিয়ে গিয়েছে এবং আমাদের সামনে কার্যকর ধ্যানধারণা তুলে ধরার পাশাপাশি অকার্যকর চিন্তাভাবনা তুলনা করেছেন। এতে করে পাঠক খুব সহজেই নিজের চিন্তা ও অন্যের চিন্তাকে বিচারবিশ্লেষণ করতে সক্ষম হবে। আর নিজের জন্য, নিজের সাফল্যের জন্য প্রয়োজনীয় দিক-নির্দেশনা খুঁজে পাবে।

আমরা বিশ্বাস করি একজন মানুষ নিজে সফল হলে, নিজে সুখী ও সমৃদ্ধ হলে তিনি তার আশেপাশের মানুষ ও সমাজকে তার সুখ ও সমৃদ্ধির ছোঁয়ায় বিকশিত করবেন। আমাদের সেই বিশ্বাস থেকেই ব্রায়ান ট্রেসির গেট স্মার্ট বইয়ের কলাকৌশল খুব সহজ ও সাবলীল বাংলা ভাষায় পাঠকের সামনে তুলে ধরতে চেষ্টা করেছি। পাঠকের কাছে সমাদৃত হলেই আমাদের চেষ্টা সার্থক হবে।

- ফজলে রাব্বি

জানুয়ারি, ২০২১

লালবাগ, ঢাকা


 




সূচনা

আপনার ভেতরে থাকা আবদ্ধ সম্ভাবনাকে মুক্ত করুন


আমার প্রজন্মের সবচেয়ে বড় আবিষ্কার হচ্ছে মানুষ তার চিন্তার পরিবর্তনের মাধ্যমে তার জীবন বদলাতে পারে।

- উইলিয়াম জেমস

ঞৎঁঃয রং রিঃযরহ ড়ঁৎংবষাবং; রঃ ঃধশবং হড় ৎরংব

ঋৎড়স ড়ঁঃধিৎফ ঃযরহমং, যিধঃব’বৎ ুড়ঁ সধু নবষরবাব.

ঞযবৎব রং ধহ রহসড়ংঃ পবহঃৎব রহ ঁং ধষষ,

ডযবৎব ঃৎঁঃয ধনরফবং রহ ভঁষহবংং;

. . .

অহফ ঃড় শহড়,ি

জধঃযবৎ পড়হংরংঃং রহ ড়ঢ়বহরহম ড়ঁঃ ধ ধিু

ডযবহপব ঃযব রসঢ়ৎরংড়হবফ ংঢ়ষবহফড়ৎ সধু বংপধঢ়ব,

ঞযধহ রহ বভভবপঃরহম বহঃৎু ভড়ৎ ধ ষরমযঃ

ঝঁঢ়ঢ়ড়ংবফ ঃড় নব রিঃযড়ঁঃ.

—জঙইঊজঞ ইজঙডঘওঘএ


হার্ভাডের উইলিয়াম জেমস লিখেছিলেন, ‘আমার প্রজন্মের সবচেয়ে বড় আবিষ্কার হচ্ছে মানুষ তার চিন্তার পরিবর্তনের মাধ্যমে তার জীবন বদলাতে পারে।’

আপনার একটি অসাধারণ মস্তিষ্ক আছে। আপনার মস্তিষ্কে দশ হাজার কোটি কোষ আছে, যার প্রতিটি কোষ আরও প্রায় বিশ হাজার গ্যাংগলিয়া ও নিউরনের সাহায্যে সংযুক্ত। অর্থাৎ আপনার মস্তিষ্ক দশ হাজার কোটির ২০ হাজার গুণ চিন্তা করতে সক্ষম।

মস্তিষ্ক বিশেষজ্ঞ টনি বুযানের মতে এর অর্থ হলো আপনার চিন্তাক্ষমতা ১ এর পরে ৮ পৃষ্ঠা ভর্তি ০ বসালে যত সংখ্যা হয় তার সমান। অর্থাৎ আপনি মহাবিশ্বে যত অণু আছে তার চেয়েও বেশি সংখ্যক চিন্তা করতে সক্ষম।

তাহলে প্রশ্ন হলো, ‘আপনি কীভাবে এই মহাশক্তিশালী মস্তিষ্ক নামক সুপার কম্পিউটারটিকে কাজে লাগাচ্ছেন?’

এখনই, এই মুহূর্তে, যেকোনো লক্ষ্য নির্ধারণ করে সেই লক্ষ্য অর্জনের ক্ষমতা আপনার আছে। নিজের মস্তিষ্ক ব্যবহার করে আপনি যেকোনো চিন্তা, পরিকল্পনা বা সৃষ্টি করতে পারেন। আপনি আশ্চর্য দক্ষতার সাথে, সূক্ষ্মভাবে যেকোনো সমস্যার সমাধান এবং বাধা থেকে উত্তরণের পথ বের করে নিজের কাক্সিক্ষত লক্ষ্য অর্জন করতে পারেন।

আপনার মস্তিষ্ক এতটাই শক্তিশালী যে, একশবার জন্ম নিলেও এর ক্ষমতার পূর্ণ ব্যবহার করতে পারবেন না।


সম্ভাবনার মাত্র ১০ শতাংশ ক্ষমতার ব্যবহার

আমার বয়স যখন একুশ, তখন এটা জেনে চমকিত হয়েছিলাম যে একজন মানুষ তার মস্তিষ্কের মাত্র ১০ শতাংশই ব্যবহার করে। পরে জানতে পারি আসল সংখ্যাটি ২ শতাংশের কাছাকাছি। বেশির ভাগ মানুষই তাদের মস্তিষ্কের ক্ষমতার সিকিভাগও কাজে লাগাতে পারে না। যেন তারা সেই ক্ষমতা কোনো জরুরি কাজে ব্যবহারের জন্য বরাদ্ধ করে রেখেছে।

কল্পনা করুন তো, আপনার ব্যাংক একাউন্টে এক কোটি টাকা আছে এবং এই টাকার অঙ্ক সুদের সাথে দিন দিন বেড়েই চলেছে। কিন্তু আপনি এখান থেকে কেবল দুই লাখ টাকাই তুলতে পারলেন। কেননা বাকি টাকা তোলার জন্য যে কোড দরকার তা আপনার জানা নেই। অবশিষ্ট অর্থের সবটাই আপনার। কেবল সঠিক একাউন্ট নাম্বার ও পাসওয়ার্ড না জানার কারণে তা পাচ্ছেন না।

অধিকাংশ মানুষেরই অবস্থা এক। তাদের মস্তিষ্কে বিপুল সম্ভাবনার সুবিশাল ভান্ডার রয়েছে। কিন্তু অভ্যাসবশত তারা তা ব্যবহারে অক্ষম।

সামনের পৃষ্ঠাগুলোতে আপনি সহজ, বাস্তব ও পরীক্ষিত উপায়ে নিজের স্বাভাবিক চিন্তাশক্তি কীভাবে উন্নত থেকে উন্নততর করা যায় তা শিখবেন। আপনাকে অন্য কারও মত কিংবা আপনার নিজস্ব ক্ষমতার বেশি কিছু হতে হবে না। আপনি যা আছেন তাই থাকবেন। কেবল আপনার মাঝে বিদ্যমান মানসিক শক্তির বিকাশ ঘটাতে হবে।


সমন্বয় করতে শিখুন

জীবন একটা কম্বিনেশন লকের মতো। এতে শুধু সংখ্যার পরিমাণ বেশি। সব কম্বিনেশন লক একই ভাবে কাজ করে। আপনি প্রথম সংখ্যাটি ঘুরাবেন, এরপর পিছনে গিয়ে দ্বিতীয় সংখ্যাটি ঘুরাবেন, এরপর আবার সামনের দিকে তৃতীয় সংখ্যায় যাবেন। যদি সব সংখ্যা সঠিকভাবে দিতে পারেন তবেই আপনার তালাটি খুলবে, তা সে বাইসাইকেলের লকই হোক কিংবা বড় কোনো ব্যাংকের ভল্টই হোক।

মনে করুন, আপনার কাছে সাফল্যের দরজার তালা খোলার সব নম্বরই আছে, কেবল একটি বাদে। ঐ একটি নম্বরের অভাবে আপনি সারাজীবন চেষ্টা করলেও তালাটি খুলতে পারবেন না। ফলে মনের সিন্দুকের তালা খুলে সেখানের সম্পদও আহরণ করতে পারবেন না।

কিন্তু সেই অজানা নম্বরটি পেয়ে গেলে আপনি ঠিকভাবে সব নম্বর দিয়ে তালাটি খুলতে পারবেন এবং জীবনে অসামান্য সাফল্য লাভ করতে পারবেন।

এই বইয়ে এমনই কিছু কম্বিনেশনের কথা বলা আছে, যা আপনার চিন্তার জগতকে বদলে দিবে। আপনি জীবনে অকল্পনীয় সাফল্য অর্জন করতে পারবেন। আপনার পথের বাধা কেবল আপনার দৃষ্টিভঙ্গি এবং আপনার পৃথিবীকে দেখার ধরন।


আপনার ব্যাখ্যা শৈলী তথা যেভাবে সবকিছুকে ব্যাখ্যা করেন

পেনিসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. মার্টিন সেলিগম্যান, মানুষের কোনোকিছু অনুধাবন কিংবা ব্যাখ্যা করার পদ্ধতিকে তাদের নিজস্ব ‘ব্যাখ্যা শৈলী’ নামে আখ্যায়িত করেছেন।

এটা আশাবাদ ও নিরাশাবাদের মধ্যকার পার্থক্যের মতোই সহজ। কেউ গ্লাস অর্ধেক পূর্ণ দেখে, কেউবা অর্ধেক খালি দেখে। আশাবাদীরা সবকিছুর ভালো দিকটাই খোঁজার চেষ্টা করে এবং নিরাশাবাদীরা খোঁজে সমস্যা।

কিন্তু পশ্চিমের হিউমারিস্ট জোশ বিলিংস বলেন, ‘মানুষ যা জানে তা তাকে কষ্ট দেয় না; কষ্ট দেয় যা সে জানে না।’

কোনোকিছু না জানায় প্রশান্তি নেই। যথাযথভাবে চিন্তাশক্তির ব্যবহার করতে না পারলে তার ফল ভয়াবহ হতে পারে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই চিন্তা শৈলীর ব্যবহার না করার ফল হয় আবশ্যম্ভাবী ব্যর্থতা।


ভালো দিক খুঁজুন

প্রত্যেক সমস্যার আড়ালে একটি সমান অথবা এর তুলনায় বড় কোনো সুযোগ থাকে।

- নেপোলিয়ন হিল


অনেক ক্ষেত্রেই দেখবেন শুধু দৃষ্টিভঙ্গি বদলের কারণে আপনি সবকিছু ভিন্নভাবে দেখছেন, আপনার পরিস্থিতি ভিন্নভাবে পর্যালোচনা করছেন, ভিন্ন সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন এবং ভিন্ন ফলাফল পাচ্ছেন। নেপোলিয়ন হিল তার বিখ্যাত ‘থিংক অ্যান্ড গ্রো রিচ’ বইয়ে লিখেছেন, ‘প্রত্যেক সমস্যার আড়ালে একটি সমান অথবা এর তুলনায় বড় কোনো সুযোগ থাকে।’

প্রায় পাঁচশোর অধিক আমেরিকান কোটিপতিদের সাক্ষাৎকার নেওয়ার পর তিনি গবেষণা করে দেখেন যে কিছু বৈশিষ্ট্য তাদের সকলের মাঝেই বিদ্যমান। এমন একটা বৈশিষ্ট্য হলো: তার গবেষণায় অংশ নেওয়া ধনী ব্যক্তিগণ কোনো সমস্যা বা ব্যর্থতা দেখে হাল ছেড়ে দেন না। বরং তারা এর থেকে শিক্ষাগ্রহণ করেন। সব সমস্যার মাঝেই তারা কোনো না কোনো গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা খুঁজে পান।

তাদের অধিকাংশ সম্পদই এই শিক্ষাগুলো প্রয়োগের মাধ্যমে অর্জিত হয়েছে। তারা তাদের ব্যর্থতা ও কষ্ট থেকে শিক্ষা নিয়ে এমন কোনো অসাধারণ পণ্য কিংবা সেবা তৈরি করতে পেরেছেন যা তাদের সম্পদশালী করে তুলেছে। এই সাময়িক সমস্যা কিংবা ব্যর্থতার সম্মুখীন না হলে তারা এই অসামান্য সাফল্য অর্জন করতে পারতেন না।

একটা সহজ পদ্ধতি আপনাদের শিখিয়ে দিই। এই পদ্ধতি মেনে চললে সমাজের সবচেয়ে সফল এবং আশাবাদী মানুষের মতো ভাবতে পারবেন। এই মুহূর্তে আপনার জীবনের সবচেয়ে বড় সমস্যাটি নিয়ে চিন্তা করুন। এবার কল্পনা করুন এই সমস্যা আপনার জন্য উপহার হিসাবে পাঠানো হয়েছে, যাতে আপনি এর থেকে কিছু শিখতে পারেন। এবার নিজেকে জিজ্ঞেস করুন, ‘আমি এই সমস্যা থেকে কী শিখলাম যা আমাকে ভবিষ্যতে সুখী ও সমৃদ্ধ জীবন গড়ে তুলতে সহায়তা করবে?’

হয়তো আপনার আজকের এই সমস্যা আসলে কোনো সমস্যাই নয়। হয়তো এটা একটা সুযোগ। হেনরি ফোর্ড বলেছিলেন, ‘ব্যর্থতা হলো আরও বুদ্ধিমত্তার সাথে নতুনভাবে শুরু করার এক সুযোগ।’


দৃষ্টিভঙ্গির ভিন্নতা

আমরা পৃথিবীকে নিজের মতো করেই দেখি।

- আনাইস নিন


আপনারা ‘অন্ধের হাতি দেখা’ গল্প শুনে থাকবেন। ছয়জন অন্ধ একটা হাতির বর্ণনা দেওয়ার চেষ্টা করে। প্রত্যেকে হাতিটিকে স্পর্শ করে এবং একই হাতির ভিন্ন ভিন্ন বর্ণনা দেয়। তারা সবাই কিন্তু নিজ নিজ জায়গায় সঠিক।

এদের একজন হাতির কান স্পর্শ করে বলে হাতিটি দেখতে একটা মোটা কম্বলের মতো। আরেকজন দাঁত ছুঁয়ে বলে হাতিটি সরু ও ধারালো। অন্য একজন হাতির এক পাশ ধরে বলে সেটি একটি দেওয়ালের মতো। একজন লেজ ধরে বলে হাতিটি হলো দড়ির মতো। সর্বশেষ ব্যক্তি হাতিটির মাথা স্পর্শ করে বলে তা পাথরের মতো। তারা সবাই নিজের অভিজ্ঞতা অনুযায়ী সঠিক বর্ণনা দিলেও, তাদের প্রত্যেকেরই ধারণায় অনেক ভুল রয়েছে। কারণ একটাই, তারা হাতিটিকে দেখতে পাচ্ছে না।

নিজের এবং পৃথিবীর প্রতি আপনার দৃষ্টিভঙ্গি ও মনোভাব কেমন? আনাইস নিন লিখেছিলেন, ‘আমরা পৃথিবীকে নিজের মতো করেই দেখি।’


এক মহাআবিষ্কার

আপনি যা দেখেন তাই বিশ্বাস করেন না, যা আগে থেকে বিশ্বাস করেন তাই দেখেন।

- ওয়েন ডায়ার


হয়তো মানব ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ আবিষ্কার এটাই যে, ‘তুমি সবসময় যা চিন্তা করবে, তুমি তাতেই পরিণত হবে।’ আপনার যা বিশ্বাস তা ইতিবাচক বা নেতিবাচক, সহায়ক কিংবা কষ্টদায়ক, যাই হোক না কেন– আপনার কাজ এবং কাজের ধারাকে নির্ধারণ করে দেয়।

আপনি বেশির ভাগ সময় কী নিয়ে চিন্তা করেন? কীভাবে তা চিন্তা করেন?

ওয়েন ডায়ার যেমন লিখেছেন, ‘আপনি যা দেখেন তাই বিশ্বাস করেন না, যা আগে থেকে বিশ্বাস করেন তাই দেখেন।’

জিম রন বলেছিলেন, ‘আপনি জীবনে যা কিছু পেয়েছেন তার সবই নিজের কারণেই পেয়েছেন, আপনার নিজের জীবন বদলে দেওয়ার ক্ষমতা আছে, কারণ আপনি চাইলেই নিজের চিন্তা ও মনোভাবের পরিবর্তন করতে পারেন।’

আমার বেস্ট-সেলিং বইয়ের নাম হলো change your thinking change your life তথা চিন্তা বদলান, জীবন বদলে দিন। বইয়ের শিরোনামটি সম্পূর্ণ সত্যি।

আপনি যখন বিভিন্ন উপায়ে চিন্তাভাবনা করতে শিখবেন তখন দেখবেন আপনার ভেতরের মানুষটিও পরিবর্তিত হচ্ছে।

ল অফ করেসপন্ডেন্স তথা সংগতি নীতি মতে, ‘ভেতরে যেমন, বাইরেও তেমন’। অর্থাৎ আপনার ভেতরের জীবন যখন পরিবর্তিত হবে আপনার বাইরের জীবনেও সেই পরিবর্তনের প্রতিফলন ঘটবে। আপনি যখন নতুনভাবে চিন্তা করতে শিখবেন, তখন আপনার বাহ্যিক জীবনও এই নতুন চিন্তার সাথে সামঞ্জস্য রেখে পরিবর্তিত হবে। শেক্সপিয়ার বলেছেন, ‘ভালো খারাপ বলে কিছু নেই, আমাদের চিন্তাই কোনোকিছু ভালো না মন্দ তা নির্ধারণ করে দেয়।’

তাহলে চলুন, সবচেয়ে সফল ও সুখী মানুষদের মতো চিন্তা কীভাবে করতে হয় তা শেখা যাক। যাতে আপনিও তাদের মতো সুখ ও সাফল্য অর্জন করতে পারেন।

 


অধ্যায় ১

দীর্ঘমেয়াদি দৃষ্টিভঙ্গি বনাম স্বল্পমেয়াদি দৃষ্টিভঙ্গি


মানুষ তাদের অবস্থা পরিবর্তনে আগ্রহী কিন্তু তারা নিজেদের পরিবর্তন করতে অনিচ্ছুক। আর তাই তারা একটি গণ্ডিতেই আবদ্ধ রয়ে যায়। যে ব্যক্তি আত্মবিসর্জনে ভয় পায় না, সে যেকোনো লক্ষ্য অর্জন করতে পারে। স্বর্গীয় ও পার্থিব, উভয় ক্ষেত্রে কথাটি সত্য। এমনকি যে ব্যক্তির একমাত্র উদ্দেশ্য সম্পদ অর্জন, তাকেও নিজের উদ্দেশ্য পূরণের জন্য অনেক ব্যক্তিগত ত্যাগ স্বীকার করতে প্রস্তুত থাকতে হবে। তাহলেই সে একটি শক্তিশালী ও সুশৃঙ্খল জীবন লাভ করতে পারবে।

- জেমস অ্যালেন


যত বেশি ইতিবাচক চিন্তা করবেন, জীবনে ততই বেশি সাফল্য পাবেন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং একমাত্র উপায় হলো, আপনার চিন্তার গুণগত মান পরিমাপ করা। আপনার সিদ্ধান্তগুলো আপনার চিন্তারই বহিঃপ্রকাশ। আপনার চিন্তা যেমন হবে, আপনি তেমনই ফলাফল পাবেন।

অর্থনীতিবিদ মিল্টন ফ্রিডম্যান লিখেছিলেন, ‘আপনার চিন্তা এবং চিন্তা অনুযায়ী করা কাজের ফলাফল সম্পর্কে সঠিক ভবিষ্যদবাণী করার ক্ষমতাই আপনার চিন্তার গুণগত মানের পরিমাপক।’ তিনি বোঝাতে চেয়েছেন, কোনো অর্থনৈতিক তত্ত্বের ভুল প্রয়োগে কী হতে পারে।

ফলাফল বা পরিণতই সব! প্রশ্ন একটাই, ‘আপনার বুদ্ধি কাজে লাগল কিনা?’

অনেক মানুষই দীর্ঘমেয়াদি ফলাফলের গুরুত্ব সম্পর্কে বিভ্রান্ত থাকে। তারা চিন্তা করে তাদের উদ্দেশ্যটাই আসল, ফলাফল নয়। এটাই বর্তমানে আমাদের সমাজে বিভ্রান্তি সৃষ্টির মূল কারণ।

তারা বলে, ‘আমার উদ্দেশ্য যদি সৎ হয়, তবে আমার চিন্তা বা কাজের ফল ভালো না হলেও আমাকে দোষ দিতে পারবে না।’

আপনার সিদ্ধান্ত ও কাজের ফলাফল আগে থেকে সঠিকভাবে ধারণা করতে পারার ক্ষমতাই, আপনার বুদ্ধিমত্তার আসল পরিমাপক।


বুদ্ধিমত্তা কী?

আইকিউ, স্কুলের গ্রেড কিংবা ডিগ্রির সংখ্যা দিয়ে বুদ্ধিমত্তাকে মাপা যায় না। বুদ্ধিমত্তা হলো ‘আচরণ কিংবা কর্মধারা’। এর অর্থ হলো, আপনি যদি বুদ্ধিমানের মতো আচরণ করেন তবেই আপনি স্মার্ট। কিন্তু আপনি যদি বোকার মতো কাজ করেন, তাহলে আপনার গ্রেড কিংবা আউকিউ যতই হোক না কেন, আপনি বোকাই।

তাহলে ‘বুদ্ধিমান আচরণ’ কী? উত্তরটা সহজ। একটি ‘বুদ্ধিমান আচরণ’ হলো এমন কাজ করা যা আপনাকে নিজের কাঙ্ক্ষিত বস্তুর কাছে নিয়ে যায়। আর মূর্খ আচরণ হলো এমন সব কাজ যা আপনাকে নিজের লক্ষ্যবস্তুর কাছে যাওয়া থেকে শুধু বিরতই রাখে না, অনেক সময় তা থেকে দূরেও সরিয়ে দেয়।

আপনি কী চান অথবা কী চান না― সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাই বলে দিবে আপনি বুদ্ধিমান নাকি বোকা। উইনস্টন চার্চিল বলেছেন, ‘আমি অনেক আগেই মানুষের কথা শোনা বন্ধ করে দিয়েছি। এখন আমি শুধু দেখি তারা কাজ কী করে। আচরণই চরম সত্য।’


কর্মই সব

একজন মানুষ কী চায়, কী ভাবে, কেমন অনুভব করে, কীসে বিশ্বাস করে এবং কীসের প্রতি সে অনুরক্ত― এসব কথা কীভাবে জানা সম্ভব? কাজটা সহজ। শুধু তাদের আচরণ দেখুন। মানুষ কী বলে, চায়, আশা করে কিংবা তার উদ্দেশ্য কী তাতে কিছু যায় আসে না। সে কী করে, বিশেষ করে প্রলোভন কিংবা চাপের মুখে সে কেমন আচরণ করে তাই মুখ্য।

একজন বলল, ‘আমি ব্যক্তিগত এবং পেশাগত জীবনে সফল হতে চাই।’ কথাটা সে বিশ্বাসও করে। কিন্তু তার আচরণ দেখুন। লোকটি আলসেমি করে, সবচেয়ে দেরিতে অফিসে ঢোকে। তার প্রিয় নাটকের নতুন পর্বটা সময়মতো দেখার জন্য সবার আগে অফিস থেকে বেরিয়ে যায়। তার আচরণে এটাই স্পষ্ট যে সে জীবনে সফলতা চায় না, চায় টেলিভিশন দেখে জীবন পার করে দিতে। কীভাবে বুঝলেন? কারণ সে প্রতিরাতে বাড়ি ফিরে ঠিক এ কাজই করছে।


কাজটি কি সফল হলো?

আপনার সিদ্ধান্ত এবং কাজের সফলতার পরিমাপক হলো, ‘কাজটি কি সফল হলো?’ আপনার চিন্তা অনুযায়ী যেই কাজ করলেন, তা কি আপনাকে নিজের লক্ষ্য কিংবা স্বপ্নের কাছে নিয়ে যেতে পেরেছে?

দুটি নীতি মানুষকে ব্যক্তিগত জীবনে, রাজনীতিতে এবং আন্তর্জাতিক বিষয়ে ভুল করতে হতে বাধ্য করে:

১। ল অফ আনইন্টেন্ডেড কন্সিকোয়েন্সেস তথা অনিচ্ছাকৃত ফলাফল নীতি (খধি ড়ভ টহরহঃবহফবফ ঈড়হংবয়ঁবহপবং)

২। ল অফ পারভার্স কন্সিকোয়েন্সেস তথা বিপথগামী ফলাফল নীতি (খধি ড়ভ চবৎাবৎংব ঈড়হংবয়ঁবহপবং)

অর্থনীতিবিদ হেনরি হ্যাজলিট তাঁর কালজয়ী ইকোনমিক্স ইন ওয়ান লেসন বইতে লিখেছেন যে মানুষ স্বার্থান্বেষী তার প্রতিটি কাজই নিজের অবস্থা উন্নয়নের প্রচেষ্টা মাত্র। মানুষ সবসময়ই নিজের ইচ্ছাপূরণের সবচেয়ে সহজ ও দ্রুত উপায় খোঁজে, কিন্তু সেই উপায়গুলো অবলম্বনের ফলে পারিপাশির্^ক তথা সেকেন্ডারি বা টারশিয়ারি ফলাফল কী হতে পারে তা চিন্তা করে না। প্রাথমিক

হ্যাজলিট আরও বলেন, কোনো কাজের কাঙ্খিত ফলাফল সবসময়ই পূর্বের অবস্থার উন্নতি ঘটায়। এই উন্নয়ন হলো প্রধান বা প্রাইমারি ফলাফল, যা ছিল কাম্য। এটি সবসময়ই ইতিবাচক। সব কাজই কোনো না কোনো ধরনের উন্নয়নের লক্ষ্যেই করা হয়ে থাকে।


ফলাফল নিয়ে ভাবুন

সেকেন্ডারি ও টারশিয়ারি ফলাফল― পরবর্তীতে যা ঘটে এবং তারও পরে যা ঘটে― এগুলো হলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ল অফ আনইন্টেন্ডেড কন্সিকোয়েন্স তথা অনিচ্ছাকৃত ফলাফল নীতি বলে― অনেক ক্ষেত্রেই একটি কাজ কিংবা আচরণের সাথে করে ইতিবাচক ফলাফল নিয়ে আসে। কিন্তু তা সাময়িক। কিন্তু এর সুদূরপ্রসারী ফলাফল ভয়াবহ।

উদাহরণস্বরূপ, এক যুবক টাকা উপার্জনের জন্য পড়াশোনা ছেড়ে দিল। তার ইচ্ছে সে গাড়ি কিনবে, বন্ধুবান্ধব নিয়ে ঘুরবে, মেয়েদের সাথে ডেটে যাবে; জীবনকে পুরোপুরি উপভোগ করবে।

এগুলো ইতিবাচক ইচ্ছা এবং সকল তরুণেরই এমন অনেক লক্ষ্য এবং ইচ্ছে থাকে। তারা চায় দ্রুততম সময়ে এগুলো অর্জন করতে।

কিন্তু, শিক্ষার অভাবে অনেক সময়ই তারা জীবনে বড় হতে পারে না। তারা খুব অল্প উপার্জন করে এবং কখনোই নিজের প্রতিভার সম্পূর্ণ বিকাশ ঘটাতে পারে না।


ভয়ঙ্কর কিছু সৃষ্টি

ল অফ পারভার্স কন্সিকোয়েন্সেস তথা বিপথগামী ফলাফল নীতি বলে, কোনো ভালো কাজের ফলাফল খারাপ হলে, তা অনেক ক্ষেত্রে কোনো কাজ না করার চেয়েও খারাপ পরিণাম বয়ে আনে।

যেমন, আমাদের সমাজে যারা অসহায় তাদের অর্থ প্রদান করার সাময়িক ফল হলো তাদের সাহায্য করা এবং তাদের কষ্ট লাঘব করা।

এই নীতি মোতাবেক, কেউ কেউ এই ‘ফ্রি টাকা’ পেতে পেতে অভ্যস্ত হয়ে যাবে। তারা কাজ ছেড়ে দিবে এবং এই অর্থ সাহায্যের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়বে। তারা নিজের গৌরব, আত্মসম্মান এবং আত্মবিশ্বাস হারাবে। তখন মনে হবে এদের সাহায্য না করলেই হয়তো ভালো হতো।

আমাদের সমাজে দুঃস্থদের সাহায্যার্থে প্রচলিত সামাজিক কার্যক্রমগুলোর প্রধান বা প্রাইমারি উদ্দেশ্য হলো তাদের জীবনের মান উন্নয়ন। কিন্তু এর বিরূপ প্রভাব হলো এটি আজীবনের জন্য একজন মানুষকে অপরের উপর নির্ভরশীল করে তার প্রতিভার বিকাশ ঘটাতে বাধা দেয়।


ভবিষ্যতের চিন্তা করুন

দাবা খেলায় থাকে অনেক ঘুটি এবং অসংখ্য চাল। এ খেলায় জেতার সম্ভাবনা নির্ভর করে আপনি প্রতিপক্ষের চাল কতটা নিখুঁতভাবে অনুমান করতে পারছেন তার ওপর। জীবন অনেকটা দাবা খেলার মতো। এখানে আপনার সাফল্য নির্ভর করে আপনার ‘খেলায় পারদর্শিতা’ এবং সঠিক চাল চালতে পারার দক্ষতার ওপর।

হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. এডয়ার্ড ব্যানফিল্ড পঞ্চাশ বছর ধরে আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশের সামাজিক এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হারের ওপর গবেষণা করেছেন। তিনি জানতে চেয়েছিলেন কেন কিছু মানুষ ও পরিবার প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে নিম্ন আর্থসামাজিক অবস্থান থেকে উচ্চ আর্থসামাজিক অবস্থানে উঠেই চলেছে। এদের অনেকেই শ্রমিক হিসাবে কাজ শুরু করে পরবর্তীতে অত্যন্ত ধনী ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছে। কেন অল্পসংখ্যক মানুষই এমনটা করতে সক্ষম হয়েছে, কিন্তু অন্যরা নয়?

এখন ২০১৫ সালে, শুধু আমেরিকাতেই দশলাখের বেশি লাখপতি পাওয়া গেছে [দশ লাখ ডলারের মালিক, বাংলাদেশি টাকায় ৮ কোটি ৫০ লাখ টাকার মতো] এবং এদের অধিকাংশই স্ব-প্রতিষ্ঠিত। অর্থাৎ তারা খুব অল্প থেকে শুরু করে একজীবনে মিলিয়ন-ডলার আয় করেছে। ফোর্বস ম্যাগাজিনে প্রকাশিত তালিকা অনুযায়ী (মার্চ, ২০১৫) পৃথিবীতে বিলিওনেয়ারের সংখ্যা ১ হাজার ৮২৬ জন [বিলিওনেয়ার মানে ১০০ কোটি ডলারের মালিক, বাংলাদেশি টাকায় ৮ হাজার ৫০০ কোটি টাকার মতো]। যাদের মাঝে নতুন ২৯০ জন ২০১৫ সালেই এই তালিয়ায় স্থান পেয়েছে। এদের মাঝে ৬৬% বিলিওনেয়ারই প্রথম প্রজন্মের, স্ব- প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তি। তারা শূন্য থেকে শুরু করে এক জীবনেই এ সংখ্যা স্পর্শ করতে পেরেছে।


সর্বজনীন বৈশিষ্ট্য

ব্যানফিল্ড এসব প্রতিষ্ঠিত মানুষের মাঝে বিদ্যমান সর্বজনীন বৈশিষ্ট্যগুলো জানতে চেয়েছিলেন। তিনি তার গবেষণার ফলাফল দ্য আনহেভেনলি সিটি (ঞযব টহযবধাবহষু ঈরঃু) নামক এক অসাধারণ বইয়ে তুলে ধরেছেন। বইটি ব্যাপক সমালোচিত এবং বিতর্কিত হয়েছিল। এটি অধিকাংশ মানুষের এ বিশ্বাসে আঘাত হেনেছিল যে― দরিদ্রতা নিরীহ মানুষের ওপর তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে চাপিয়ে দেওয়া হয় এবং এতে তাদের কোনো হাত নেই।

তার গবেষণার ফলাফল ছিল সহজ এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে অকাট্য। মানুষের অর্থনৈতিক সাফল্য অথবা বিফলতা সম্পর্কে গবেষণা করতে গিয়ে তিনি দেখেছেন যে ‘সময় সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি’ ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ গুণনীয়ক।

ব্যানফিল্ড সমাজকে সর্বনিম্ন থেকে সর্বোচ্চ পর্যন্ত সাতটি শ্রেণীতে বিভক্ত করেছেন: নিম্ন-নিম্নবিত্ত শ্রেণী, উচ্চ-নিম্নবিত্ত শ্রেণী, নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণী, মধ্য-মধ্যবিত্ত শ্রেণী, উচ্চ-মধ্যবিত্ত শ্রেণী, নিম্ন-উচ্চবিত্ত শ্রেণী এবং উচ্চ-উচ্চবিত্ত শ্রেণী।

দেখা যায়, প্রতিটি আর্থসামাজিক অর্জনের শ্রেণীতে সেই শ্রেণীর ব্যক্তিদের সময় সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি আগের শ্রেণীর চেয়ে অধিক এবং অধিকতর। তাদের পটভূমি, লেখাপড়া, কিংবা বর্তমান অবস্থা যাই হোক না কেন, সময় সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্যই ছিল তাদের অবস্থানের মাঝে একমাত্র অপরিবর্তিত বৈশিষ্ট্য।


সময় সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি এবং উপার্জন

আর্থসামাজিক শ্রেণীবিভাগের সর্বনিম্ন ধাপ, নিম্ন-নিম্নবিত্ত শ্রেণীর মানুষের সময় সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি মাত্র কয়েক ঘণ্টা, এমনকি কয়েক মিনিট স্থায়ী হয়। এটা অনেকটা একজন মদ্যপ কিংবা মাদকাসক্ত ব্যক্তির মতো যে কিনা শুধু পরবর্তী খাবার কিংবা পানীয়ের কথাই চিন্তা করে।

সর্বোচ্চ ধাপে যারা, দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় প্রজন্মের ধনী, তাদের সময় সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি কয়েক বছরব্যাপী, কয়েক যুগ এমনকি পরবর্তী কয়েক প্রজন্ম পর্যন্ত টিকে রয়েছে। দেখা গেছে যে সফল ব্যক্তিগণ সবসময়ই ভবিষ্যৎ নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করেন। পিটার ড্রুকার বলেন, ‘একজন নেতার; বিশেষ করে ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে এক নেতার প্রধান কাজ হলো ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করা। এ দায়িত্ব আর কেউ পালন করবে না। এটা আপনারই দায়িত্ব।’

প্রত্যেক সমাজের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিগণ দৈনন্দিন জীবনের সিদ্ধান্তগুলো নেওয়ার আগে, সামনের কয়েক বছর এমনকি কয়েক যুগের কথাও চিন্তা করে। তবেই সেই সিদ্ধান্তগুলো নিয়ে থাকেন। কোনো গুরুত্বপূর্ণ কিংবা অলঙ্ঘনীয় প্রতিশ্রুতি দেওয়ার আগে তারা এর ফলাফল নিয়ে সতর্কভাবে চিন্তা করে।

আরেকটি চমকপ্রদ আবিষ্কারের কথা বলি। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করার চিন্তাই আপনার দৃষ্টিভঙ্গিকে ধারালো করার পাশাপাশি আপনার স্বল্পমেয়াদি সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাকে নাটকীয়ভাবে উন্নত করবে।

এর কারণ হলো, ‘আপনি যা চিন্তা করেন আপনি তাতেই পরিণত হোন।’ দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার ভাবনা, আপনার বর্তমান চিন্তাধারা এবং কাজের ধারাকে বদলে দেওয়ার মাধ্যমে আপনার ভবিষ্যৎ সাফল্যের পথ সুগম করবে।

 

ভবিষ্যতে কী করবেন তা নির্ধারণ করুন

১৯৯৪ সালে গ্যারি হ্যামেল এবং সি.কে. প্রাহালাদ ব্যবসায়িক কৌশল সম্পর্কে এক যুগান্তকারী বই লেখেন যার নাম ছিল ভবিষ্যৎ নির্মাণের সংগ্রাম (ঈড়সঢ়বঃরহম ভড়ৎ ঃযব ঋঁঃঁৎব)। এই বইতে তারা ভবিষ্যতে কী করবেন তথা ভবিষ্যৎ নির্মাণের ধারণাকে জনপ্রিয় করে তোলেন।

তারা বলেন, ভবিষ্যতে নিজেকে কোন অবস্থানে দেখতে চান― এই ধারণা যত স্পষ্ট হবে, বর্তমান সিদ্ধান্তগুলো সঠিকভাবে নেওয়া ততই সহজ হবে।

তাদের সবচেয়ে জনপ্রিয় ধারণাগুলোর একটি ছিল― নিজ কর্মক্ষেত্রের শীর্ষ একজন হতে চাইলে ৫ বছর সামনে এগিয়ে নিজেকে জিজ্ঞেস করুন, ‘একটি শীর্ষ প্রতিষ্ঠান হওয়ার জন্য আর ৫ বছর পর আমাদের কি ধরনের কর্দমক্ষতা, সামর্থ্য এবং সক্ষমতা থাকা চাই?’

ভবিষ্যতে কী করবেন সেই উদ্দেশ্য এবং ভবিষ্যৎ পরিস্থিতি সম্পর্কে যত স্পষ্ট ধারণা থাকবে আপনি ততই পরিষ্কারভাবে চিন্তা করতে পারবেন। আর এই চিন্তাধারা আপনাকে বর্তমানে এমন সব পদক্ষেপ নিতে সাহায্য করবে যাতে আপনি নিজের দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য অর্জন করতে পারেন।

দীর্ঘমেয়াদি দৃষ্টিভঙ্গির মূল কথা হলো ‘আত্মত্যাগ’।

সফল মানুষেরা আত্মত্যাগ করতে সদা প্রস্তুত। তারা বর্তমানের ক্ষণস্থায়ী সাফল্য বিসর্জনের মাধ্যমে দীর্ঘস্থায়ী সাফল্য অর্জন করে।

‘দীর্ঘমেয়াদি সুখের জন্য স্বল্পমেয়াদি কষ্ট’ এই নীতিতে বিশ্বাস স্থাপন করার অদম্য ইচ্ছা এবং শৃঙ্খলাবোধ না থাকলে জীবনে সাফল্য লাভ অসম্ভব।


অবসর জীবনের সংকট

বর্তমানে আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশে ‘আসন্ন অবসর জীবনের সংকট’ নামক অর্থনীতি প্রচলিত রয়েছে। শুধু আমেরিকাতেই প্রতি বছর বেবি বুমার (যাদের জন্ম ১৯৪৬ থেকে ১৯৬৪ সনের মাঝে) প্রজন্মের দশ হাজার সদস্য প্রতিদিন অবসর গ্রহণের বয়সে উপনীত হচ্ছে। [আমেরিকাতে অবসরে যাওয়ার বয়স ৬২ থেকে ৬৬ বছর।] নিউ ইয়র্ক টাইমস এর মতে, অবসর বয়সে পৌঁছানো প্রত্যেক দম্পতির গড় সঞ্চয় মাত্র ১ লাখ ৪ হাজার ডলার (৮৫ লাখ টাকার মতো)। [বাংলাদেশে ১ লাখ ডলার বা ৮৫ লাখ টাকা বেশি মনে হলেও আমেরিকার জনগণের জন্য তা নয়। কারণ তাদের দেশে এক কাপ কফির দাম ৫ ডলার, যা বাংলাদেশি টাকায় ৪২৫ টাকা। এ হিসাবে আমেরিকার ১ লাখ ডলারে যা পাওয়া যাবে তা খুব বেশি নয়।]

এই পরিমাণ অর্থ নিয়ে অবসর পরবর্তী জীবনের পনেরো থেকে বিশ বছর তাদের অতিবাহিত করতে হবে। ৪% উত্তোলন হারে (প্রস্তাবিত) গড়ে প্রতি দম্পতি বছরে ৪,১৬০ ডলার (৩.৫ লাখ টাকার মতো) এবং মাসে ৩৪৬ ডলার (২৯ হাজার টাকার মতো) উত্তোলন করতে পারবে। সোশাল সিকিউরিটিসহ এ অর্থ দিয়েই তাদের বাকি জীবন কাটাতে হবে।

১ লাখ ৪ হাজার ডলার মধ্যম আকারের সঞ্চয়। ৫০% অবসরপ্রাপ্ত নাগরিক এর ঊর্ধ্বে এবং ৫০% এর নিচে অবস্থান করে। অনেক অবসরপ্রাপ্ত নাগরিকের কোনো সঞ্চয়ই থাকে না। মানব ইতিহাসের সবচেয়ে প্রাচুর্যপূর্ণ রাষ্ট্রে কীভাবে এমনটা হওয়া সম্ভব?

উত্তরটা স্পষ্ট― সময় সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গির অভাব। আরও স্পষ্টভাবে বললে, ভবিষ্যৎ সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গির অভাব। লাখো মানুষ কর্মজীবনের শুরু থেকেই নিজের উপার্জিত অর্থ নির্দ্বিধায় ব্যয় করার অভ্যাস গড়ে তোলে। অনেকের ক্ষেত্রে এ অভ্যাস আজীবন বজায় থাকে। বর্তমানে প্রাপ্তবয়স্কদের ৭০ শতাংশ পে-চেক থেকে পে-চেকে জীবনধারণ করে। তাদের আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। তাদের অভিযোগ, ‘তাদের টাকার অঙ্কের চেয়ে মাস বেশি বড়।’

তারা বিশ্বাস করে বর্তমানের এই অমিতব্যয়িতা কখনোই ভবিষ্যতের ওপর প্রভাব ফেলবে না। তাদের এই ধারণা সম্পূর্ণ ভুল।


ধনসম্পদ নিয়ে বড়াই না করা লাখপতি

আজকের অনেক মিলিওনেয়ার এবং মাল্টিমিলিওনেয়ারই সাধারণ মধ্যবিত্ত শ্রেণীর। এরা সাধারণ এলাকার সাধারণ বাড়িতেই থাকে। এদের অনেকেই শিক্ষক, ট্রাকচালক এবং সেলসম্যান। কিন্তু পুরো কর্মজীবন ধরে উপার্জনের ১০-১৫% সঞ্চয়ের মাধ্যমে তারা এখন ধনবান এবং সুখী।

চক্রবৃদ্ধি হারে ২১ থেকে ৬৫ বছর বয়স পর্যন্ত ৭ অথবা ৮% সুদে প্রতিমাসে ১০০ ডলার সঞ্চয় করলে, স্টক মার্কেটের আশি বছরের গড়বৃদ্ধি অনুসারে সঞ্চয় দাঁড়াবে ১ মিলিয়ন ডলার (৮.৫ কোটি টাকার মতো)।

দীর্ঘমেয়াদি দৃষ্টিভঙ্গি গঠন, আগামী ৫, ১০ অথবা এর চেয়েও বেশি বছরের জন্য আগাম পরিকল্পনার অভ্যাস, আপনার বর্তমানের চিন্তাধারাকে বদলে দিবে।


দ্বিগুণ উপার্জন করুন

ক্যামেরুন হেরল্ড তাঁর ডাবল ডাবল (২০১১) বইতে কীভাবে তিন বছরে ব্যবসার আয় দ্বিগুণ করা যায়, সেই উপায় দেখিয়েছেন। তার উপদেশটি সহজ― নিজেকে তিন বছর পরে কল্পনা করুন। আপনি ব্যবসা থেকে আজকে যা আয় করছেন, ঠিক তিন বছর পরে সেই আয়ের দ্বিগুণ উপার্জন করবেন এই সিদ্ধান্ত নিন। এজন্য আপনাকে প্রতি বছর ২৫% করে আয় বৃদ্ধি করতে হবে।

এবার বর্তমানে ফিরে আসুন। এরপর এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য আপনাকে কী কী পদক্ষেপ নিতে হবে সেগুলো নির্ধারণ করুন। আপনি প্রতি মাসে ২% এবং বছরে ২৬% আয় বৃদ্ধি করতে সক্ষম হলে তিন বছরেই ব্যবসার আয় দ্বিগুণ হবে।

আপনি চাকরিজীবী হলে নিজের উৎপাদনক্ষমতা, কর্মদক্ষতা এবং আউটপুট যদি প্রতি সপ্তাহে ১% বৃদ্ধি করতে পারেন তবে তা মাসে ২% এবং বছরে ২৬% হবে এবং আপনার আয় ৩৬ মাসে দ্বিগুণ হবে।


ভবিষ্যৎ থেকে ফিরে আসা

দীর্ঘমেয়াদি সময় সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি গঠনের জন্য আপনাকে ‘ভবিষ্যৎ থেকে ফিরে আসা’ চিন্তার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। মনে করুন, আপনার কাছে একটা জাদুর কাঠি আছে এবং এটা আপনার ভবিষ্যৎ জীবনকে পরিপূর্ণ করে গড়ে তোলার ক্ষমতা রাখে। তাহলে একবার ভাবুন তো, আপনার সেই পরিপূর্ণ জীবন কেমন হবে? আর তা আপনার আজকের জীবন থেকে কতটা ভিন্ন হবে?

এবার বর্তমানে ফিরে আসুন এবং নিজেকে প্রশ্ন করুন, ‘আজ থেকে কী করলে, ভবিষ্যতে পরিপূর্ণ জীবন গড়ে তুলতে পারব?’

আদর্শ ভবিষ্যৎকে কল্পনা করুন। এ নিয়ে চিন্তা করুন। আপনার ভবিষ্যৎ অর্জনের কোন সীমা-পরিসীমা নেই। নিজের জীবনকে চারটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র দিয়ে বিচার করুন: ১) ব্যবসা ও ক্যারিয়ার, ২) পরিবার ও সম্পর্ক, ৩) স্বাস্থ্য ও সুস্থতা এবং ৪) আর্থিক স্বাধীনতা।

পাঁচ বছর সময় এগিয়ে যান এবং আপনার ব্যবসা, ক্যারিয়ার ও উপার্জন নিয়ে কল্পনা করুন। সবদিক থেকে যেমন চান তেমন আদর্শভাবে চিন্তা করুন। আপনি কত উপার্জন করছেন? আপনি কী ধরনের কাজ করছেন? আপনি ক্যারিয়ারের কোন পর্যায়ে আছেন? আপনি কী ধরনের মানুষের সাথে কাজ করছেন?― এগুলো নিয়ে কল্পনা করুন।


পাঁচ বছরের পরিকল্পনা

পিটার ড্রুকার বলেছেন, ‘মানুষ প্রায়ই এক বছরে নিজের অর্জনের সক্ষমতাকে অতিরঞ্জিত করে দেখে। অপরদিকে পাঁচ বছরের অর্জনের ক্ষমতাকে হেয় করে দেখে।’

পাঁচ বছর পরে নিজের ক্যারিয়ার এবং উপার্জনকে কোথায় দেখতে চান― এটা ঠিক করার পর বর্তমানের দিকে তাকান। এরপর ভাবুন এখান থেকে ঐ অবস্থানে যেতে আপনাকে কোন কোন ধাপ অতিক্রম করতে হবে।

এবার প্রথম ধাপে পা রাখুন। আনন্দের বিষয় হলো আপনি প্রথম ধাপটি সবসময়ই দেখতে পাবেন। আপনাকে সিঁড়ি বেয়ে ওঠার সময় সব ধাপ দেখতে হবে না। শুধু প্রথম ধাপে উঠুন। প্রথম ধাপে পা রাখলে দ্বিতীয় ধাপ আপনা থেকেই সামনে হাজির হবে। যখন দ্বিতীয় ধাপে পা রাখবেন তখন তৃতীয় ধাপের দেখা পাবেন। এভাবেই আপনি সবসময় এক ধাপ এগিয়ে থাকবেন। আর এটাই আপনার জন্য যথেষ্ট। কিন্তু সবার আগে আপনাকে পা ফেলতে হবে।

কনফুসিয়াস বলেছিলেন, ‘হাজার মাইল পথ পরিক্রমার শুরু হয় প্রথম পা ফেলার মাধ্যমে।’ প্রথম ধাপটা সবসময়েই কঠিন। এর জন্য দৃঢ় সংকল্প এবং প্রচ- ইচ্চাশক্তির প্রয়োজন হয়। যাতে আপনি আগের থেকে ভিন্নভাবে কিছু করতে পারেন। প্রথম ধাপ অতিক্রম করলে দ্বিতীয় ধাপ সহজ হয়ে আসে। এরপর তৃতীয় ধাপ আরও সহজ হয়। এভাবে শীঘ্রই আপনি নিজেকে সাবলীলভাবে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে আবিষ্কার করবেন। এ নীতি মেনে চললে আপনি এক মাসে এমন সব অর্জন করতে সক্ষম হবেন যা গত এক বছরেও পারেননি।


 পরিবার ও সম্পর্ক

আপনার সেই জাদুর কাঠি আবার ঘোরান। এবার কল্পনা করুন আপনার পারিবারিক জীবন এবং অন্যান্য সম্পর্ক। সবদিক থেকে আদর্শভাবে চিন্তা করুন। তাহলে কেমন দেখাচ্ছে সেই অবস্থাটা? আপনি কার কার সাথে থাকতে চান? কার কার সাথে থাকতে চান না? যদি বিবাহিত হন, তবে পরিবারের জন্য কেমন বাড়ি এবং লাইফস্টাইল চান? কোথায় ঘুরতে যেতে চান এবং পরিবারকে কেমন জীবন দিতে চান?

এবার আবার বর্তমানে ফিরে এসে নিজেকে প্রশ্ন করুন, ‘আজকে কি করলে আমি আগামীতে এই জীবন পাব?’


চমৎকার শারীরিক সুস্থতা

স্বাস্থ্য ও সুস্থতার কথা চিন্তা করুন। আপনার স্বাস্থ্য এখন কেমন এবং ভবিষ্যতে কেমন দেখতে চান? আপনার ওজন কত? আপনার ডায়েট কেমন? কী ধরনের খাবার খাচ্ছেন? কেমন ব্যায়াম করছেন? কীভাবে, কতটুকু বিশ্রাম আপনার প্রয়োজন ? আপনি কীভাবে এবং কোথায় ছুটি কাটাতে চান?

এরপর বর্তমানে ফিরে এসে নিজেকে জিজ্ঞেস করুন, ‘আজকে কী করলে আমি আগামীতে এমন সুস্থ ও সমৃদ্ধ জীবন পাব?’

প্রথম পদক্ষেপটি নিন। কিছু করুন। যেকোনো কিছু। বিশ্বাস নিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসুন। প্রথম ধাপটিকে সবসময় নিজের সামনেই পাবেন।


আর্থিক স্বাধীনতা

চতুর্থ ক্ষেত্রটি হলো জীবনে আর্থিক স্বাধীনতা, অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জন। আগামীর কথা ভাবুন। নিজেকে প্রশ্ন করুন, ‘ভবিষ্যতে স্বাচ্ছন্দ্যে জীবন কাটানোর জন্য আমাকে কত টাকা উপার্জন করতে হবে?’

ব্যবসায়ীদের সাথে সেমিনারে আমরা তাদের ‘দ্য নম্বর’ ধারণা শেখাই। এই নামে একই বিষয়ের উপর একটা চমৎকার বইও আছে। এই তত্ত্বটি সহজ। এটি শুধু প্রশ্ন করে, ‘আপনার সংখ্যাটি কত?’ নিজের কর্মজীবনে আপনি ঠিক কী পরিমাণ অর্থ উপার্জন, সঞ্চয়, বিনিয়োগ এবং জমা করতে চান? বিশেষ করে আপনার লাইফস্টাইল সমর্থন করার জন্য প্রতি মাসে এবং প্রতি বছরে আপনার ঠিক কী পরিমাণ অর্থ প্রয়োজন?

আর্থিক স্বাধীনতা অর্জনের জন্য খুব সোজা এক সূত্র আছে। প্রথমে প্রশ্ন করুন, কোনো উপার্জন না থাকা অবস্থায় বর্তমান লাইফস্টাইল ধরে রাখার জন্য আপনার মাসে ঠিক কত টাকা প্রয়োজন? 

প্রাপ্তবয়স্কদের প্রায় ৭০ ভাগ এই প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে পারে না।


বাৎসরিক খরচ

নিজের মাসিক প্রয়োজন নির্ধারণ করুন। এজন্য আপনার বর্তমান খরচ― নিয়মিত এবং অপ্রত্যাশিত উভয়ই পরিমাপ করুন। এরপর এই সংখ্যাকে ১২ দিয়ে গুণ করুন। কোন উপার্জন না থাকা অবস্থায় এই পরিমাণ অর্থই আপনাকে এক বছরে সঞ্চয় কিংবা বিনিয়োগ করতে হবে।

আপনার বর্তমান লাইফস্টাইল ধরে রাখার জন্য যদি ট্যাক্স বাদে ৫ হাজার ডলার (৪ লাখ টাকার মতো) প্রয়োজন হয় তবে বেকার অবস্থায় আপনার স্বাচ্ছন্দ্য জীবনযাপনের জন্য বছরে ৬০ হাজার ডলার (৫১ লাখ টাকার মতো) প্রয়োজন হবে।

সবশেষে এই বাৎসরিক সংখ্যাকে ২০ দিয়ে গুণ করুন। এই ২০ হলো আপনার এবং/অথবা আপনার স্বামী/স্ত্রী’র অবসর পরবর্তী আনুমানিক জীবনকাল। আগের উদাহরণটাই ধরা যাক, বছরে ৬০,০০০ ডলার (৫১ লাখ টাকার মতো) প্রয়োজন হলে ২০ বছরে আপনার লাগবে ১.২ মিলিয়ন ডলার (১০ কোটি টাকার মতো)। অবসরের পর আরামে বাকি জীবন কাটিয়ে দিতে আপনার এই পরিমাণ অর্থই দরকার হবে। (আপনি মাসিক/বাৎসরিক কত পেনশন পাবেন তা এই সংখ্যা থেকে বিয়োগ করে নিতে পারবেন।)


প্রথম পদক্ষেপটি নিন

এবার প্রথম পদক্ষেপটি নিন। অবসরের জন্য একটি রিটায়ারমেন্ট একাউন্ট খুলুন। এ হচ্ছে একটি আর্থিক স্বাধীনতা একাউন্ট। এ একাউন্টে প্রতি মাসে টাকা জমা করুন এবং কোনো কারণেই এ টাকা ওঠাবেন না। একজন ফাইন্যানশিয়াল এডভাইজারের পরামর্শ নিন। আয়ের ৮৫-৯০ ভাগ খরচ করুন। আর বাকিটা সঞ্চয় অথবা বিনিয়োগ করুন। এ কাজকে জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এক লক্ষ্য হিসাবে বিবেচনা করুন। তাহলেই নির্দিষ্ট সময় পর নিজের ‘সংখ্যা’ স্পর্শ করে আর্থিক মুক্তি অর্জন করতে পারবেন।

নিজের সংখ্যা নির্ধারণ, তা অর্জনের জন্য পরিকল্পনা তৈরি এবং সেই পরিকল্পনা মোতাবেক কাজ করে নিয়মিত সঞ্চয় ও বিনিয়োগ করুন। এভাবে কাজ করলে ভবিষ্যতে সেই সংখ্যার প্রায় দশগুণ অর্জন করার সম্ভব।


সিদ্ধান্ত নিন

আজকেই দীর্ঘমেয়াদি সময় সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি গঠনের প্রতিজ্ঞা করুন। নিজেকে গভীরভাবে ভবিষ্যতের চিন্তায় নিমজ্জিত করুন। চেষ্টা করবেন বেশির ভাগ সময় এটা নিয়েই ভাবতে।

নিজের সিদ্ধান্ত এবং কাজের ফলাফল চিন্তা করুন। কী হতে পারে? এরপর কী হতে পারে? এবং পরবর্তীতে কী হতে পারে?

স্ব-শৃংখলা, স্ব-দক্ষতা এবং স্ব-নিয়ন্ত্রণ অনুশীলন করুন। আজকের ক্ষুদ্র স্বার্থ বিসর্জনের মাধ্যমে আগামীকাল আরও অধিক সাফল্য অর্জন করুন।

আর প্রথম ধাপটিতে পা রাখুন। সৎ উদ্দেশ্য, আশা, আকাক্সক্ষা ও স্বপ্ন; সাফল্য ও ব্যর্থতার মাঝে পার্থক্যকারী সীমারেখা নয়। এটা নির্ভর করে আপনি নিজের জীবনের এই চারটি মূল ক্ষেত্রে কী চান এবং প্রথম ধাপ নিচ্ছেন কিনা তার ওপর। মনে রাখবেন, প্রথম ধাপটি সবসময়ই দৃশ্যমান।


অনুশীলনী

১) দীর্ঘমেয়াদি চিন্তার সংকল্প করুন যাতে কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার আগে তার ফলাফল সম্পর্কে ধারণা নিতে পারেন।

২) পাঁচ বছর পরে নিজেকে কল্পনা করুন এবং দেখুন আপনার জীবন সবদিক দিয়ে পরিপূর্ণ। সেই আদর্শ জীবনটা আজকের জীবন থেকে কতটা ভিন্ন?

৩) আদর্শ ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে এই মুহূর্তে কোন পদক্ষেপটি নিবেন তা ভাবুন। আর সেই প্রথম পদক্ষেপটি নিন।


 

অধ্যায় ২

ধীর চিন্তা বনাম দ্রুত চিন্তা


সফল ব্যক্তিরা সেসব কাজ করার অভ্যাস গড়ে তুলেছে যা বিফল ব্যক্তিরা করতে পছন্দ করে না। তারাও যে কাজগুলো খুব পছন্দ করে তা নয়। কিন্তু তাদের উদ্দেশ্য পূরণের চাহিদার সামনে এ অপছন্দ অতি নগণ্য।

- অ্যালবার্ট ই এন গ্রে


আপনার মস্তিষ্ক অতুলনীয়। এই মহাবিশ্বে যত অণু-পরমাণু আছে, তার চেয়েও বেশি সংখ্যক চিন্তা করার ক্ষমতা আপনার রয়েছে। নিজের মস্তিষ্কের এই অভাবনীয় ক্ষমতাকে যথাযথভাবে কাজে লাগালে আপনি যেকোনো লক্ষ্য অর্জন করতে পারবেন।

আপনার মস্তিষ্ক সার্বক্ষণিক চলছে। আপনার মস্তিষ্ক প্রতি মিনিটে ১,৫০০ শব্দ চিন্তা করতে পারে। আপনার মস্তিষ্ক এক চিন্তা থেকে আরেক চিন্তায় দ্রুততর সময়ে চলে যেতে পারে। এই চিন্তার অবিরাম ¯্রােতকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য অসাধারণ শৃঙ্খলা এবং ইচ্ছাশক্তি প্রয়োজন, যাতে আপনি নিজের চিন্তাশক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারেন।

আসলে আপনি একটানা হাজারটা চিন্তা করতে পারলেও, এক সময়ে কেবল একটাই চিন্তা করতে পারেন। এজন্য আপনার পক্ষে নিজের চিন্তার ¯্রােত নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। আর এই নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা আয়ত্তে আনতে পারলে আপনি নিজের চেতনাকে একটি নির্দিষ্ট সময়ে কেবল একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যের দিকেই ধাবিত করতে পারবেন।


প্রতিক্রিয়াশীল-প্রতিক্রিয়া প্রক্রিয়া (ঞযব জবধপঃরাব-জবংঢ়ড়হংরাব গড়ফব)

কোনো কাজ বারবার করলে তা অভ্যাসে পরিণত হয়। অধিকাংশ মানুষই প্রতিক্রিয়াশীল-প্রতিক্রিয়া প্রক্রিয়ায় চালিত হয়। তারা কোন যৌক্তিক চিন্তা ছাড়াই চারপাশে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর প্রতি অবিরাম প্রতিক্রিয়া দেখাতে থাকে।

এলার্ম ঘড়ির প্রথম ঘণ্টা থেকে শুরু করে ঘুমানোর আগ পর্যন্ত নিজেদের পারিপার্শিক পরিস্থিতি, উদ্দীপক, নিয়মিত ও অনিয়মিত ঘটনাবলি, আবেগ, ক্ষুধা ইত্যাদির প্রতি মানুষ প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে। মানুষের স্বাভাবিক চিন্তাপ্রবাহ তাৎক্ষণিক: একে উদ্দীপনা বা উদ্দীপক বলা হয়। এরপর তৎক্ষণাৎ প্রতিক্রিয়া। এর মাঝে কোনো ফাঁক নেই।

উচ্চতর চিন্তা প্রক্রিয়াতেও প্রথমে উদ্দীপক এবং পরে প্রতিক্রিয়া থাকে। কিন্তু এই দুইয়ের মাঝে প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে চিন্তা করার জন্য কয়েক মুহূর্ত ফাঁকা থাকে। যেমনটা আমার মা বলতেন, ‘মনে রাগ কিংবা দুঃখ থাকলে জবাব দেওয়ার আগে ১০ থেকে ১ পর্যন্ত উল্টা গণনা করো।’

কিছু বলার বা করার আগে কয়েক মুহূর্ত থেমে নিজের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে চিন্তা করার অভ্যাস, আপনার চূড়ান্ত প্রতিক্রিয়ার মান বৃদ্ধি করবে। এটা সাফল্যের জন্য অত্যাবশ্যকীয়। এই গুণটি ধনী ব্যক্তিদের মাঝেও দেখা যায়।


চিন্তা এক কঠিন কাজ

আইবিএম এর প্রতিষ্ঠাতা, থমাস জে. ওয়াটসন (সিনিয়র) তাঁর অফিসের প্রত্যেক দেওয়ালে একটা সাইন লাগানো বাধ্যতামূলক করেছিলেন। তা হলো― ‘চিন্তা করুন’। কোম্পানির শুরুর দিকে কোনো সমস্যার সম্মুখীন হলেই তারা একে ওপরকে এই সাইনের দিকে নির্দেশ করে মনে করিয়ে দিতেন যে সমস্যা যত বড়ই হোক না কেন, সময় নিয়ে চিন্তা করলে ঐ সমস্যার সমাধান অবশ্যই মিলবে।

থমাস আলভা এডিসন একসময় বলেছিলেন, ‘চিন্তা করা সবচেয়ে কঠিন কাজ। একারণেই মানুষ এই কাজটা সহজে করতে চায় না।’

কথায় বলে, ‘অনেকে চিন্তা করে, অনেকে ভাবে যে তারা চিন্তা করে। আর অনেকে চিন্তার চেয়ে মৃত্যুকে সহজ মনে করে।’

ইতিবাচক চিন্তা কঠিন কাজ। নিজের মানসিক শক্তির নিয়ন্ত্রণ নিতে হলে আপনাকে ইতিবাচক চিন্তা করার কৌশল শিখে তা বারবার অনুশীলন করতে হবে।

সৌভাগ্যবশত আপনি বারবার কিছু করলে তা অভ্যাসে পরিণত হয়। আর একবার কিছু অভ্যাসে পরিণত হলে তা করাটা খুব সহজ হয়ে যায়। গ্যেটে বলেছেন, ‘সহজ হওয়ার আগ পর্যন্ত সবই কঠিন।’ নতুন অভ্যাস গড়ে তোলার ক্ষেত্রে এই কথাটা পুরোপুরি প্রযোজ্য।


ধীর চিন্তা

প্রয়োজন মোতাবেক ধীরস্থির ভাবে চিন্তা করা একটি চমৎকার অভ্যাস। প্রথম অধ্যায়ে আমরা ফলাফলের গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করেছি। নিজের কাজের ফলাফল সম্পর্কে আগে না ভাবার কারণেই আমরা জীবনে বেশির ভাগ ভুল করে থাকি।

ড্যানিয়েল ক্যানেম্যানের বেস্ট-সেলিং থিংকিং, ফাস্ট এন্ড স্লো (ঞযরহশরহম, ঋধংঃ ধহফ ঝষড়)ি বইটি নির্ভুল চিন্তার ব্যাপারেই নিবেদিত। আর.এইচ. থুলেস এবং সি.আর. থুলেসের লেখা ক্লাসিক স্ট্রেইট এন্ড ক্রুকড থিংকিং (ঈৎড়ড়শবফ ঞযরহশরহম) বইয়ের মতো ক্যানেম্যানের বইও ভুল চিন্তা এবং ভুল কাজের ফলে প্রাপ্ত ব্যর্থতা নিয়ে আলোচনা করে।

লেখক এ বইতে দেখাতে চেষ্টা করেছেন কীভাবে আমরা তথ্য গ্রহণ করি এবং কীভাবে আংশিক তথ্য, নির্বাচিত পরিসংখ্যান অথবা নিজের মতাদর্শ এবং বিশ্বাস অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিই।

ভুল কিংবা দুর্বল চিন্তার ওপর গবেষণা করে দেখা গেছে ব্যক্তি এবং পেশাগত জীবনে কোন বড় সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে ধীরেসুস্থে সবদিক বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নিলে তবেই এসব ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জন সম্ভব।

এটা করার একটা সহজ উপায় হলো কোন তথ্য পেলে আগে নিজেকে এই প্রশ্নটি জিজ্ঞেস করা― ‘এই তথ্যটি কি সঠিক?’


দুইটি ভিন্ন চিন্তা প্রক্রিয়া

ধীর চিন্তা এবং দ্রুত চিন্তা দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রক্রিয়া। দ্রুত চিন্তা প্রক্রিয়ায় আমরা দ্রুততর সময়ে, প্রবৃত্তিগতভাবে এবং স্বয়ংক্রিয় উপায়ে তথ্য আত্মস্থ করি। বিষয়টা অনেকটা লম্বা জ্যামের মধ্যে গাড়ি চালানোর সময় সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো। এই প্রক্রিয়ায় আমরা সামান্য ভাবনা অথবা কোনো ভাবনা ছাড়াই সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকি।

আমাদের দৈনন্দিন জীবনে আলাপচারিতা, মিটিং, বাজার করা প্রভৃতি ক্ষেত্রে দ্রুত চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রয়োজন পড়ে। আপনি লাঞ্চে হ্যামবার্গার খেলেন নাকি মাছ খেলেন তা কোনো বিশেষ গুরুত্ব বহন করে না। এটি আপনার জীবনে বড় কোন প্রভাব ফেলবে না।

কিন্তু জীবনের এমন অনেক ক্ষেত্র আছে যেখানে ধীরচিত্তে চিন্তার প্রয়োজন পড়ে। নিজের মনমতো ফলাফল পাওয়ার জন্য দীর্ঘমেয়াদি সিদ্ধান্ত নিতে ধীর চিন্তার বিকল্প নেই।

এই বিষয়ে ক্যানেম্যানের অন্তর্দৃষ্টি তাঁর বইকে বেস্টসেলারে পরিণত করেছিল। তিনি বলেছিলেন, মানুষের সবচেয়ে বড় ভুল হলো তারা অল্প সময় ভেবেই দীর্ঘমেয়াদি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে। অথচ এসব ক্ষেত্রে দরকার ধীর চিন্তা।


ফলাফল বিবেচনা করুন

উদাহরণস্বরূপ, আপনি কলেজে কোন কোর্সটি নিবেন, কোন পেশাকে বেছে নিবেন, কাকে বিয়ে করবেন, কীভাবে অর্থ আয়, সঞ্চয় ও বিনিয়োগ করবেন― এসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য প্রয়োজন ধীরস্থির চিন্তা।

যেই সিদ্ধান্তের পরিণাম যত বেশি সুদূরপ্রসারী, ততই ধীরেসুস্থে সব দিক বিবেচনা করে সেই সিদ্ধান্তটি নিতে হবে।

একটি ব্যবসা শুরু করতে হলে অনেক ক্ষেত্রেই ধীরচিন্তা অত্যাবশ্যক হয়ে পড়ে। কোন পণ্য অথবা সেবায় আপনি বিশেষজ্ঞ, কোন ধরনের ক্রেতার দিকে নজর দিতে হবে, কোন পদ্ধতিতে পণ্য উৎপাদন, বিক্রয়, বাজারজাত এবং বন্টন করবেন, উৎপাদন খরচ এবং বিক্রয়মূল্য কত হবে― এই সিদ্ধান্তগুলোর ওপর একটি ব্যবসার সাফল্য অথবা ব্যর্থতা নির্ভর করে।


নিজের চিন্তাধারা বিশ্লেষণ করুন

এখন থেকে নিজেকে নিয়মিত প্রশ্ন করবেন, ‘এই পরিস্থিতে কি ধীর নাকি দ্রুত চিন্তা করা উচিত?’ যখনই সুযোগ পান নিজেকে সময় দিন। উদ্দীপক ও প্রতিক্রিয়ার মাঝে যত বেশি সম্ভব ব্যবধান রাখুন। ‘বাহাত্তর ঘণ্টা নীতি’ অনুসরণ করুন। কোনো বড় সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে বাহাত্তর ঘণ্টা বা তিনদিন সময় হাতে রাখুন তা নিয়ে ভাবার জন্য।

লর্ড একটন লিখেছেন, ‘যদি সিদ্ধান্ত নেওয়া জরুরি না হয় তবে সিদ্ধান্ত নিবেন না।’ যত বেশি সময় নিয়ে ভেবে সিদ্ধান্ত নিবেন সেই সিদ্ধান্ত ততই সঠিক হবে। সবসময় এই কথাটি বলুন, ‘আমি ভেবে জানাচ্ছি।’

যদি কেউ আপনাকে কোনো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে চাপ দেয় তবে তাকে বলুন, ‘যদি এখনই উত্তর চাও তবে সেটি হবে “না”। কিন্তু আমাকে ভাববার সময় দিলে উত্তরটি ভিন্ন হতে পারে।’


বিবরণ লিখে ফেলুন

কাগজে লিখে ভাবুন। কাগজ চিন্তা করার অত্যন্ত শক্তিশালী এক যন্ত্র। এখানে আপনি নিজের সমস্যা কিংবা সিদ্ধান্তের প্রতিটি খুঁটিনাটি বিবরণ লিপিবদ্ধ করতে পারবেন। হাতে লেখার সময় আপনার মস্তিষ্কে চমৎকার কিছু বিষয় ঘটে। কাগজে বিবরণ লেখা আপনার মস্তিষ্ককে ধীরে এবং খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ভাবতে বাধ্য করে। টাইপ করার চেয়ে হাতে লেখাটা এক্ষেত্রে বেশি কার্যকর। অনেক সময় লিখতে লিখতে পূর্বের অনেক দুর্বোধ্য বিষয়ও বোধগম্য হয়ে ওঠে। ফলে সিদ্ধান্ত নেওয়াটা সহজ হয়ে আসে। এজন্যই ফ্রান্সিস বেকন লিখেছিলেন, ‘লেখনি, যোগ্য মানুষ গড়ে তোলে।’

কোনো সিদ্ধান্তের পরিণাম যত তাৎপর্যপূর্ণ সেই সিদ্ধান্তটি নিতে তত বেশি সময় ব্যয় করুন। দ্রুত নেওয়া সিদ্ধান্তের চেয়ে তার ফলাফল অবশ্যই ভালো হবে।


মানুষ সম্পর্কিত সিদ্ধান্ত

অনেক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, একটি ব্যবসার ৯৫ ভাগ সাফল্য নির্ভর করে সেই ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সাথে কোন ধরনের মানুষ জড়িত তার ওপর। কাকে কাকে আপনি নিয়োগ দিচ্ছেন, কার কার সাথে কাজ করছেন, কারা আপনার সাথে কাজ করছে; এসব বিষয় একটি ব্যবসাকে গড়তে এবং ধ্বংস করতে পারে। একারণে পিটার ড্রুকার লিখেছেন, ‘মানুষের ব্যাপারে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো ভুল সিদ্ধান্ত।’

আপনি কার অধীনে কাজ করছেন, আপনার অধীনে কে কাজ করছে, কার কার সাথে কাজ করছেন, কার কার সাথে বন্ধুত্ব করছেন, কাকে বিয়ে করছেন, কার সাথে ব্যবসা করছেন; এই সিদ্ধান্তগুলোই আপনার ব্যক্তিগত ও পেশাগত জীবনের ৮৫ ভাগ সাফল্য নির্ধারণ করে দিবে।


নিয়োগ রহস্য

একটি বড় কোম্পানির সেলস ম্যানেজারের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। তিনি নিজের কোম্পানিতে অসংখ্য সেরা সেলসম্যান নিয়োগের জন্য বিখ্যাত ছিলেন। তাকে এই নিয়োগ সাফল্যের রহস্য জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, ‘উত্তরটি সহজ, আমি ‘ত্রিশ দিন নীতি’ অনুসরণ করি। কোন প্রার্থীকে যতই পছন্দ হোক না কেন, তার বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে আমি ত্রিশ দিন সময় নিই। কোন প্রার্থীকে প্রথম কিংবা দ্বিতীয় সাক্ষাতে যোগ্য মনে হলেও অনেক ক্ষেত্রেই পরবর্তী সময়ে তারা অযোগ্য প্রমাণিত হয়।’

অধিকাংশ সফল কোম্পানি ও ম্যানেজার এই নীতির বিভিন্ন সংস্করণ অনুশীলন করে। তারা জানে একটি ভুল নিয়োগের ফল মারাত্মক হতে পারে। এই নীতি ব্যবসায় অংশীদারিত্ব এবং ক্রয়বিক্রয়য়ের ক্ষেত্রেও খাটে।


কৌশলগতভাবে চিন্তা করুন

সময়ের সাথে অনেক ধরনের ম্যানেজমেন্ট টেকনিকের আবির্ভাব হলেও গুরুত্বের দিক দিয়ে কৌশলগত পরিকল্পনা সবসময়ই শীর্ষে ছিল এবং এখনও আছে। কৌশলগত পরিকল্পনা আপনাকে একটি পদক্ষেপ বা সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে তার ফলাফল সম্পর্কে ধীরেসুস্থে এবং সতর্কভাবে ভাবতে বাধ্য করে। ব্যবসার ভবিষ্যৎ নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় এটি অত্যন্ত কার্যকর।

ব্যক্তিগত জীবনেও এটি একইভাবে কাজ করে। এক্ষেত্রে আপনি নিজের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা করবেন। নিজেকে কয়েক বছর পরের একটি অবস্থানে কল্পনা করে দেখতে হবে যে আপনি আসলে জীবনে কী করতে চান এবং কোথায় পৌঁছাতে চান। কৌশলগত পরিকল্পনা বিশেষজ্ঞ মাইকেল ক্যামি লিখেছেন, ‘যে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা করে না তার কোনো ভবিষ্যৎ নেই।’

ব্যক্তিগত ক্ষেত্রে কৌশলগত পরিকল্পনা আপনাকে ধীরে এবং নিখুঁতভাবে ভাবতে বাধ্য করে। আপনি ভবিষ্যতে কী হতে চান, কী পেতে চান, কী করতে চান? এ বিষয়গুলো ভাবতে এই পদ্ধতি আপনাকে বাধ্য করবে।

দিনের কিছু সময়, এমন কি দুই একদিন পর পর কিছু সময় নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করার জন্য বরাদ্ধ রাখা উচিত। বিশেষ করে কোনো সমস্যা, বিপত্তি, কিংবা পরিবর্তনের সময় এই কাজটি অবশ্যই করা উচিত। কিছু সময় বাইরে খোলা বাতাসে হেঁটে আসুন। নিজের মন ও মস্তিষ্ককে শান্ত করুন। নিজের স্বামী/স্ত্রী’র সঙ্গে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করুন। দুইতিন দিনের জন্য সব কিছু থেকে নিজেকে দূরে রাখুন, বিশেষ করে মোবাইল, কম্পিউটার, ইন্টারনেটের মতো ইলেক্ট্রনিক বাধা যেন আপনার চিন্তায় ব্যাঘাত না ঘটাতে পারে সেদিকে লক্ষ রাখুন। এবার শান্ত মস্তিষ্কে ভাবা শুরু করুন।


একান্তে সময় কাটানোর অভ্যাস গড়ে তুলুন

ধীর চিন্তা অনুশীলনের একটি শক্তিশালী ও কার্যকরী উপায় হলো নিয়মিতভাবে একান্তে সময় কাটানো। অনেক মানুষই জীবনে একদিনের জন্যেও একান্তে সময় কাটায় না। তাদের সর্বক্ষণ কিছু একটা নিয়ে ব্যস্ত থাকতেই হবে। কোনো ধরনের উদ্দীপক ছাড়া তারা চলতে পারে না। কিন্তু এটা আপনার জন্য নয়।

একাকিত্বের অভ্যাস করা খুব সহজ। প্রতিদিন ত্রিশ কিংবা ষাট মিনিটের জন্য একা বসে থাকুন। এসময় সংগীত কিংবা অন্য কোনো কিছুতে মন দিবেন না। নিরবে, নিভৃতে একান্ত কিছু সময় কাটাবেন। কোনো শোরগোল নেই, এমন কোনো পার্কে প্রকৃতির সান্নিধ্যে বসেও কাজটি করতে পারেন।

একাকিত্ব অনুশীলনের সেরা কৌশল সম্ভবত ‘জলের উৎস নিয়ে চিন্তা করা’। কোন জলাধার এমনকি সুইমিং পুল বা জলাশয়ের সামনে বসে পানির দিকে তাকিয়ে থাকলে মনে প্রশান্তি আসে। পাশাপাশি অবচেতন এবং অতি সচেতন মনের দরজাও উন্মুক্ত হয়।


একাকিত্বের জন্য প্রয়োজন শৃঙ্খলা

প্রথম প্রথম একাকিত্বের অনুশীলন করাটা কষ্টকর মনে হবে। নানা কাজের কথা মনে পড়বে। প্রথম বিশ-পঁচিশ মিনিট অনেকটা জোর করেই নিজেকে ধরে রাখতে হবে।

কিন্তু এরপরেই দারুণ এক ব্যাপার ঘটবে। আপনার সব দুশ্চিন্তা আস্তে আস্তে কমতে শুরু করবে। একসময় আপনি সম্পূর্ণ নিশ্চিন্ত বোধ করবেন। এসময় আপনি একাকিত্বকে উপভোগ করতে শুরু করবেন। আর তখনই নতুন নতুন বুদ্ধি, উপায়, সমাধান, অনুপ্রেরণা, দৃষ্টিভঙ্গি আপনার মাথায় ভর করবে। এদের যেকোনোটি আপনার জীবন বদলে দিবে।

নিজের চিন্তাকে নদীর মতো বয়ে যেতে দিন। কিছু লেখার প্রয়োজন নেই। যদি চিন্তাটা ভালো হয় তবে তা আপনার মনে গেঁথে যাবে। বলা হয়, ‘মানুষ একান্তে সময় কাটানোর মাধ্যমে সেরা হয়ে ওঠে।’

যদি কখনোই একান্তে ত্রিশ থেকে ষাট সময় কাটিয়ে না থাকেন, তবে আজকেই নিজের সাথে এপয়েন্টমেন্ট করে ফেলুন। আমি প্রায়ই সন্ধ্যায় ঘরে ফেরার পথে কোন পার্কে গাড়ি থামিয়ে ঘণ্টাখানেক একা বসে থাকি। সবাই চলে যাবার পর আপনি অফিসেও একা সময় কাটাতে পারেন। নিজের বাড়ির উঠনে কিংবা বারান্দায় এমনি নিজের শোবার ঘরেও একা নিঃশব্দে বসে এ কাজটি করতে পারেন।


এটি সবসময় কাজ করে

আপনাকে কথা দিচ্ছি। জীবনে যখনই কোনো সমস্যা, বাধা, হতাশা কিংবা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবেন, তখনই একান্তে কিছু সময় কাটাবেন। প্রথম চেষ্টাতেই দেখবেন আপনার সবচেয়ে বড় সমস্যার সমাধান আপনার সামনে এসে উপস্থিত হবে।

আমার অনেক শিক্ষার্থীই আমাকে জানিয়েছে, তারা যেই সমস্যা নিয়ে কয়েক সপ্তাহ এমনকি কয়েক মাস ধরে চিন্তিত ছিল, তা একাকিত্বের প্রথম বসাতেই সমাধান হয়ে গেছে।

আপনার সামনে আসা সমাধানটি নিখুঁত ও পরিপূর্ণ হবে। এটি সমস্যার প্রতিটি দিক ব্যাখ্যা করবে। সমাধানটি সহজ, স্পষ্ট ও সম্পূর্ণভাবে আপনার আয়ত্ত্বাধীন হবে। এটি আপনার সমস্যাকে সম্পূর্ণভাবে সমাধান করবে। যখন নিজের একান্ত সময় থেকে বের হয়ে কাজে নেমে পড়বেন, দেখবেন সব আপনা থেকেই সমাধান হয়ে যাচ্ছে। আপনি প্রশান্তি লাভ করবেন।


অভ্যন্তরীণ শক্তি উন্মোচন করুন

নিয়মিত একাকিত্বের অনুশীলনের জন্য প্রয়োজন ধীর চিন্তা। আপনাকে সব কাজ ছেড়ে চুপচাপ বসে থাকতে হবে। খুশির সংবাদ হলো যত বেশি একাকিত্বের অনুশীলন করবেন, প্রতিবার ততই দ্রুততর সময়ে একটি উত্তম ও স্বয়ংসম্পূর্ণ সমাধান আপনার সামনে এসে উপস্থিত হবে।

ব্যবসায়িক যেসব ক্ষেত্রে ফলাফল অনেক বেশি গুরত্ব বহন করে সেসব জায়গায় কিছুটা সময় নিয়ে ভেবেচিন্তে সবদিক বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। এ সিদ্ধান্তগুলোই একটি ব্যবসাকে সফল অথবা ব্যর্থ করে দিতে পারে।

সময় ব্যবস্থাপনার একটি নীতি হলো, এক মিনিট ভাবলে দশ মিনিট সময় বাঁচে।’ একটি সফল ব্যবসা, একটি কৌশলের সফল প্রয়োগেরই ফলাফল। এই সাফল্য অনেক সময় নিয়ে করা ধীর ও সতর্ক চিন্তারই ফসল।


লউকৌঅপ থিংকিং মডেল ব্যবহার করুন

সঠিকভাবে ধীর চিন্তা করার জন্য নিয়মিতভাবে লউকৌঅপ মডেল ব্যবহার করুন। লউকৌঅপ’র পূর্ণরূপ হলো: ‘লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, কৌশল, অগ্রাধিকার এবং পদক্ষেপ’ (এড়ধষং, ঙনলবপঃরাবং, ঝঃৎধঃবমরবং, চৎরড়ৎরঃরবং, ধহফ অপঃরড়হং)।

লক্ষ্য (এড়ধষং): দীর্ঘমেয়াদি, নির্দিষ্ট, পরিমাপযোগ্য, সময়-বেষ্টিত যেসকল বৃহৎ লক্ষ্য ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে অর্জন করতে চান― কোন ধরনের বিক্রয়, লাভ, উন্নয়ন, শেয়ার দর ও গুণগত মান অর্জন করতে আপনি ইচ্ছুক।

উদ্দেশ্য (ঙনলবপঃরাবং): আপনার বৃহৎ লক্ষ্যকে অর্জন করার জন্য অন্তর্বতী যেসব উদ্দেশ্য পূরণ করতে হবে। মনে করুন, আপনার দীর্ঘমেয়াদি বৃহৎ লক্ষ্যগুলো একটি মইয়ের শেষ প্রান্তে আছে। মইয়ের প্রতিটি ধাপ একেকটি অন্তর্বতী উদ্দেশ্য যা আপনাকে বৃহৎ লক্ষ্যে পৌঁছে দিবে।

কৌশল (ঝঃৎধঃবমরবং): প্রতিটি লক্ষ্য অর্জনের জন্য কিছু কৌশল অবলম্বন করতে পারেন। যেমন ধরুন, ব্যবসার একটি উদ্দেশ্য হলো সর্বোচ্চ বিক্রয় নিশ্চিতকরণ। এই উদ্দেশ্য পূরণের জন্য বিভিন্ন কৌশল রয়েছে।

অগ্রাধিকার (চৎরড়ৎরঃরবং): কিছু কাজ লক্ষ্য অর্জনের জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ। সবক্ষেত্রে ৮০/২০ নীতির প্রয়োগ করুন। কোন ২০ ভাগ কাজ করলে আপনার লক্ষ্যের ৮০ ভাগ অর্জিত হবে?

পদক্ষেপ (অপঃরড়হং): নির্দিষ্ট, পরিমাপযোগ্য, সময়-বেষ্টিত কোন কোন পদক্ষেপ নিলে, কৌশল খাটিয়ে উদ্দেশ্যগুলো পূরণ করে নিজের লক্ষ্য অর্জন করতে পারবেন?

এই চিন্তা পদ্ধতি কাজে লাগিয়ে সতর্কভাবে প্রতিটি পদক্ষেপ বিবেচনা করলে আপনার সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা নাটকীয়ভাবে বেড়ে যাবে। এই পদ্ধতি মানুষকে ধীর চিন্তা এবং দীর্ঘমেয়াদি চিন্তা, উভয়ই করতে বাধ্য করে।


সম্ভাব্যতা নীতি

অনেক মানুষই নিজের সাফল্য কিংবা ব্যর্থতার জন্য ভাগ্যকে দায়ী করে। কিন্তু বাস্তবতা তা নয়। নিজের অতীতের দিকে তাকালে দেখবেন, আপনার এই সাফল্য মোটেই ভাগ্যের ব্যাপার নয়, এটি কেবলই সম্ভাব্যতা।

সম্ভাব্যতার নীতি বলে, সব ধরনের ঘটনাই ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে এবং কিছু গাণিতিক সূত্র ব্যবহার করে এই সম্ভাব্যতা প্রায় নিখুঁত ভাবে নির্ণয় করা সম্ভব। সহজভাবে বলতে, এই নীতি অনুযায়ী, আপনি যত বেশি সফল ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠানের মতো কাজ করবেন, সঠিক সময়ে সঠিক কাজটি করে আপনার সফল হওয়ার সম্ভাবনা ততই বৃদ্ধি পাবে।

প্রয়োজনে ধীর চিন্তা করার মাধ্যমে আপনার ভুল করার পরিমাণ কমিয়ে আনুন, আপনি সঠিক সময়ে সঠিক কাজটি করতে পারবেন। আর এভাবেই আপনি কাঙ্খিত সাফল্য অর্জন করতে পারবেন।

সাফল্য কোনো দুর্ঘটনা নয়, ব্যর্থতাও না। কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার পূর্বে যত ভালোভাবে পরিকল্পনা করবেন তত দ্রুত সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যাবেন।


অনুশীলনী

১) কোনো উদ্দীপক, সমস্যা কিংবা বাধা দেখে প্রতিক্রিয়ার করার আগে কিছুটা সময় ব্যবধান রাখার প্রতিজ্ঞা করুন।

২) ব্যক্তিগত কিংবা পেশাগত জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র চিহ্নিত করে সেখানে লউকৌঅপ মডেল প্রয়োগ করে ভবিষ্যতের জন্য একটি স্পষ্ট পরিকল্পনা করুন।

৩) আজকেই ত্রিশ থেকে ষাট মিনিট নিরবে, একান্তে নিজের মনের কথা শোনার পরিকল্পনা করুন। কাজটি নিয়মিত করার অভ্যাস গড়ে তুলুন।


 




অধ্যায় ৩



জ্ঞাত চিন্তা বনাম অজ্ঞাত চিন্তা


রাতারাতি সফল হওয়ার চেষ্টা করবেন না। এমন চেষ্টা দশ হাজারে একটি সফল হতে পারে, অর্থাৎ এর সম্ভাবনা অতি নগণ্য।

- বেঞ্জামিন ডিজরায়েলি


অভিজ্ঞ ব্যবসায়ীদের মাঝে প্রচলিত দুটি বিখ্যাত শব্দ হলো ‘যথোচিত প্রচেষ্টা’। এর মানে হলো: যত সময়ই লাগুক না কেন, জরুরি তথ্য সংগ্রহ করে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া।

আমাদের সবচেয়ে বড় ভুল হলো আমরা সকল তথ্য না জেনেই নিজেদের সময়, অর্থ ও সম্পদ কোন কাজে ব্যয় করে ফেলি।

কোনো বিষয়ে সম্পূর্ণ জ্ঞানার্জনের পরেই কেবল সেই বিষয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব। কথায় বলে, ভাবিয়া করিও কাজ, করিয়া ভাবিও না।


ব্যবসায় সফলতার কারণ

ফোর্বস ম্যাগাজিনের মতে, কোনো ব্যবসা ব্যর্থ হওয়ার এক নম্বর কারণ হলো সেই ব্যবসায় উৎপাদিত পণ্য কিংবা সেবার চাহিদা না থাকা। ব্যবসায় টিকে থাকার জন্য যেই দামে পণ্য বিক্রয় প্রয়োজন, ক্রেতা সেই দামে ঐ পণ্য কিনতে আগ্রহী নয়।

২০১৩ সালে কেবল আমেরিকাতেই মার্কেট রিসার্চ তথা বাজার গবেষণার জন্য ৮ বিলিয়ন ডলার [বাংলাদেশি টাকায় ৬৭ হাজার কোটি টাকা] খরচ করা হয়েছিল। এই গবেষণার উদ্দেশ্য ছিল কোনো পণ্য বাজারে আনার আগে ক্রেতাদের চাহিদা সম্পর্কে জানা।

কিন্তু বিশদ গবেষণার পরেও মার্কেটে আনা ৮০ ভাগ পণ্যই ব্যর্থ হয়েছিল। ম্যাকেঞ্জি এন্ড কোম্পানি নামক একটি বিখ্যাত বিজনেস কনসালটেন্সি প্রতিষ্ঠানের মতে, ব্যবসায় সাফল্যের প্রধান কারণ হলো অধিক বিক্রয়। আর ব্যর্থতার মূল কারণ অল্প বিক্রয়। বাকি সব কথাই অপ্রয়োজনীয়।

ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে ব্যবসায় ক্ষতি হওয়ার মূল কারণ হলো: সঠিক তথ্য সংগ্রহ এবং যাচাই না করেই কোন পণ্য উৎপাদন এবং বিক্রয় করা।


তথ্য যাচাই করুন

হ্যারল্ড জেনিন আইটিটিতে প্রায় ১৫০ প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে একটি সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন। তার মতে, ‘ব্যবসায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো তথ্য। সঠিক তথ্য জানতে হবে। কেবল ধারণা বা অনুমানের বশে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না। সঠিক তথ্য জানতে হবে। তথ্য কখনো মিথ্যে বলে না।’

আজকের দিনে ব্যবসায় একটি গুরুত্বপূর্ণ শব্দ হলো ‘প্রমাণিত’। ধারণা বা অনুমান করবেন না। কোনো ভালো বুদ্ধি মাথায় এলে তৎক্ষণাৎ তা যাচাই করুন। এর সত্যতা এবং যথাযোগ্যতা প্রমাণের জন্য তথ্য সংগ্রহ করুন।

কাগজে কলমে চিন্তা করুন। চূড়াান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে, কোনো পণ্য বা সেবা সম্পর্কে যেসব তথ্য জানা আছে, আর যা যা জানতে হবে তার একটি লিস্ট তৈরি করুন।

অন্যদের সাথে কথা বলুন। একই পরিস্থিতির সম্মুখীন আগে হয়েছে, এমন মানুষের উপদেশ নিন। একজন বিশেষজ্ঞ নিয়োগ দিন। একজন বিশেষজ্ঞের উপদেশ আপনার প্রচুর সময় ও অর্থ বাঁচিয়ে দিবে।

গুগলে সার্চ দিন। আপনার সমস্যা সম্পর্কিত প্রশ্ন এবং শব্দগুলো লিখে সার্চ দিন। দেখুন কী তথ্য পাওয়া যায়। অনেক সময়ই দেখবেন আপনার সমস্যার সমাধান আগেই কেউ করে রেখেছে।

অন্যদের মতামত নিন। অন্যান্য ব্যবসায়ীদের সাথে কথা বলে তাদের অভিজ্ঞতা থেকে জ্ঞান আহরণ করুন। হয়তো কোনো একটি ধারণা কিংবা উপদেশ আপনার দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দিবে।

বৈজ্ঞানিক উপায় অবলম্বন করুন

এখনও-প্রমাণ-হয়নি, এমন একটি হাইপোথিসিস তৈরি করুন। [হাইপোথিসিস হচ্ছে একটি অনুমান বা প্রস্তাবিত ধারণাকে একটি সূচনা পয়েন্ট ধরে আরও তদন্তের জন্য এগিয়ে যাওয়া।] এবার সেই হাইপোথিসিসটিকে অর্থাৎ আপনার ধারণাটিকে ভুল প্রমাণ করার আপ্রাণ চেষ্টা করুন। বিজ্ঞানীরা এভাবেই কাজ করেন।

কিন্তু অধিকাংশ মানুষ এর ঠিক উলটা করে। তারা প্রথমে একটি ধারণা করে, এরপর সেই ধারণটিকে সঠিক প্রমাণ করার জন্য উঠে পড়ে লাগে। তারা ‘কনফার্মেশন বায়াস’ কিংবা ‘নিশ্চিতকরণ পক্ষপাত’ চর্চা করে। তারা কেবলই নিজের ধারণাকে সঠিক প্রমাণ করতে চায়। তাদের বিশ্বাস বহির্ভূত সকল তথ্যউপাত্তকে তারা অস্বীকার করে।

একটি বিপরীত বা নেতিবাচক হাইপোথিসিস গঠন করুন। এটা আপনার প্রাথমিক থিয়োরির ঠিক উলটা হবে। কল্পনা করুন যে আপনি আইজ্যাক নিউটন, মাধ্যাকর্ষ তত্ত্ব এইমাত্র আপনার মাথায় এসেছে। আপনার প্রাথমিক হাইপোথিসিস হবে, ‘বস্তু পতনশীল’। এবার এই ধারণার বিপরীত তত্ত্ব প্রমাণের চেষ্টা করুন। তা হবে: ‘বস্তু উপরে ওঠে’।

যদি এই বিপরীত হাইপোথিসিসকে সঠিক প্রমাণ করতে না পারেন তাহলে বুঝবেন আপনার প্রাথমিক হাইপোথিসিসটিই সঠিক।

ধরুন, একটি নতুন পণ্য বা সেবা চালু করার বুদ্ধি আপনার মাথায় এসেছে। এবার প্রমাণ করার চেষ্টা করুন এই দামে এই পণ্যটি কেউ কিনতে আগ্রহী হবে না কিংবা বাজারে এই পণ্যটির কোন চাহিদাই নেই। একজন সম্ভাব্য ক্রেতাকে পণ্য কিংবা সেবাটি দেখিয়ে তার মতামত নিন। তাকে বলুন, ‘আপনি নিশ্চয়ই এই দামে এই জিনিসটি কিনতে চাইবেন না, তাই না?’

যদি ক্রেতা আপনার কথায় সায় দেয় তাহলে একটি অতি মূল্যবান তথ্য মূল্যবান সংগ্রহ করতে পারবেন যা আপনাকে ভবিষ্যতে সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা করবে। অন্যদিকে, ক্রেতা যদি বলে, ‘না, না, না। এই পণ্যটি বাজারে আসলে আমি অবশ্যই এই দামে এই পণ্যটি কিনব।’ তাহলে আপনার প্রাথমিক ধারণাটি সঠিক বলে প্রমাণিত হবে। অর্থাৎ আপনার পণ্য কিংবা সেবাটির বাজারে চাহিদা আছে।

 

ব্যর্থতার জন্য প্রস্তুত থাকুন

বারবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকুন। ব্যর্থতা, চেষ্টা এবং ভুল আপনার চূড়ান্ত সফলতার জন্য একান্ত জরুরি। নিজেই নিজের ম্যানেজমেন্ট কনসালটেন্ট হোন। নিজের ধারণাকে নিজেই পর্যালোচনা করুন। একজন কনসালটেন্ট হিসাবে নিজেকে কঠিন প্রশ্নগুলো জিজ্ঞেস করুন।

‘বাজারে কি এই নতুন পণ্যের চাহিদা আছে?’

‘যদি থাকে তবে তা কতটুকু এবং কত মূল্যে?’

‘নিজের প্রাথমিক ধারণায় কতটুকু পরিবর্তন আনলে ক্রেতারা পর্যাপ্ত পরিমাণে পণ্যটি কিনবে?’

‘পণ্যটির চাহিদা কি এটি উৎপাদনের জন্য যথেষ্ট নাকি অন্য কোনো পণ্য উৎপাদন করা উচিত?’

‘এই পণ্যের বাজার কি পর্যাপ্ত ক্রেতা পাওয়ার জন্য যথেষ্ট বড়?’

‘ক্রেতারা কি যথেষ্ট পরিমাণে পণ্যটি কিনবে যাতে আপনি অন্য পণ্যের চেয়ে অধিক লাভ করতে পারেন?’

তথ্য যাচাইয়ের জন্য নিজের প্রতি কঠোর হতে হবে। নিজেকে কোনোভাবেই ছাড় দিবেন না। জিগ জিগলার বলেছিলেন, ‘যদি নিজের প্রতি কঠোর হোন, তবে জীবন আপনার জন্য সহজ হবে। কিন্তু নিজেকে ছাড় দিলে, জীবন আপনাকে ছাড় দিবে না।’


নির্ভুল হওয়া আবশ্যক

মনোবিদ জেরি জ্যামপলস্কি লিখেছিলেন, ‘আপনি কি নির্ভুল হতে চান নাকি সুখী হতে চান?’

অবাক করা বিষয় হলো অধিকাংশ মানুষই নতুন কোনো চিন্তা মাথায় আসলে তার যৌক্তিকতা প্রমাণের আগেই সেটির প্রেমে পড়ে যায়। যথেষ্ট সংখ্যক ত্রেতা তাদের পণ্যটি আদৌ কিনতে চায় কিনা সেটি তারা যাচাই করার প্রয়োজন বোধ করে না।

একটি স্পষ্ট পরিকল্পনা গঠনের আগপর্যন্ত তথ্য সংগ্রহ করতে থাকুন। তথ্যগুলোকে বারবার যাচাই করুন। বিশ্বাসের ওপর ভর করে সিদ্ধান্ত নিবেন না। নিজেকে প্রশ্ন করুন, ‘কীভাবে বুঝব কথাটি সত্যি?’

সবশেষে গুপ্ত ত্রুটিটি খুঁজে বের করুন। কোনো একটি দুর্বলতা কিংবা দোষ যা আপনার ব্যবসার ক্ষতি করতে পারে। এক সময়কার পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি জে. পল গেটি তার ব্যবসায়িক পরিকল্পনার জন্য বিখ্যাত ছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা প্রথমে ব্যবসায়িক সুযোগটি ভালো কিনা তা নির্ণয় করি। এরপর জিজ্ঞেস করি, এই সুযোগটি গ্রহণ করলে সবচেয়ে বড় ক্ষতি কী হতে পারে? এরপর আমরা সেই ক্ষতিটি যাতে না হয় তা নিশ্চিত করি।’

যদি সকল প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করে গুপ্ত ত্রুটিটিকে দূর করতে সক্ষম হোন, তবে অন্যদের চেয়ে উত্তম সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন।


অভিজ্ঞতার বিকল্প নেই

অনভিজ্ঞ চিন্তার চেয়ে অভিজ্ঞ চিন্তা অনেক বেশি মূল্যবান। আজকের এই দ্রুতগতির, সদা পরিবর্তনশীল ব্যবসাক্ষেত্রে অভিজ্ঞতার কোন বিকল্প নেই। কোনো বিশেষ ক্ষেত্রে বারবার ভুল করে পুনরায় চেষ্টা করে, অসংখ্য অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের মাধ্যমেই কেবল কিছু কিছু অমূল্য শিক্ষা অর্জন করা সম্ভব।

অভিজ্ঞ মানুষেরা ‘প্যাটার্ন রিকগনিশন’ গঠন করে। ব্যবসায় কোনো নতুন সুযোগ পেলে তারা পূর্বের অভিজ্ঞতার আলোকে তা বিবেচনা করে। তারা পূর্বের পরিস্থিতির সাথে বর্তমান পরিস্থিতির মিলগুলো ধরতে পারে এবং বুঝতে পারে কোন কাজগুলো করলে তারা সফল হবে। তারা জানে ঠিক কোন সিদ্ধান্ত নিলে কিংবা বিনিয়োগ করলে তারা ক্ষতির সম্মুখীন হবে। তারা নতুন সুযোগটির ত্রুটি নির্ণয় করতে পারে। কারণ একই ধরনের ত্রুটি তারা আগেও দেখেছে। তারা দ্রুততার সাথে সেইসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর দিকে মনোযোগ দেয়, যার ওপর একটি ব্যবসার সাফল্য কিংবা ব্যর্থতা নির্ভর করে।


খেলায় আধিপত্য বিস্তার করুন

দাবা খেলোয়াড়দের ওপর এক গবেষণায় দেখা গেছে, স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক সকল গ্র্যান্ড মাস্টারগণের সাফল্যের, কারণ প্রতিপক্ষের চাল অনুমান করার ক্ষমতা। যে যত বেশি চাল অনুমান করতে পারে সে সাফল্যের তত উপরের স্তরে অবস্থান করে। গবেষকরা আরও দেখেছেন, সকল স্তরের খেলোয়াড়রা একটি খেলায় একসাথে তিন চারটির বেশি চাল অনুমান করেন না। এর চেয়ে বেশি চাল অনুমান করা জেতার পক্ষে সহায়ক নয়।

বরং তারা দেখেছেন, অভিজ্ঞতার প্রতি স্তরের খেলোয়াড়রা আগের স্তরের খেলোয়াড়দের চাইতে অধিক সংখ্যক প্যাটার্ন চিনতে সক্ষম। আর এটা কেবল অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের মাধ্যমেই সম্ভব হয়েছে।

একজন গ্র্যান্ড মাস্টার দাবার বোর্ডের দিকে তাকিয়ে প্রায় সাথে সাথে ৫০ হাজারের বেশি সম্ভাব্য চাল অনুমান করতে পারে। দাবার গুটির প্যাটার্ন দেখে সে প্রতিপক্ষের পরবর্তী চাল নিখুঁত ভাবে বলে দিতে পারে। আর তাই একজন দাবা চ্যাম্পিয়ন একই সাথে দশ, বিশ, এমনকি ত্রিশ জন খেলোয়াড়ের সাথে খেলে জিততে পারে। সে শুধু বোর্ডগুলো ঘুরে ঘুরে দেখবে, প্যাটার্ন চিনবে এবং চাল দিবে। এরপর পরবর্তী বোর্ডে অগ্রসর হবে।


অভিজ্ঞতার গুরুত্ব অপরিসীম

ব্যবসা এবং অন্যান্য সব পেশার ক্ষেত্রে একই কথা খাটে। দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতার ফলে একজন বিশেষজ্ঞ যেকোনো জটিল পরিস্থিতি এক নজর দেখেই তার সমাধান বাতলে দিতে পারে। এই অভিজ্ঞতা একদিনে অর্জন করা সম্ভব নয়। একজন কম অভিজ্ঞ ব্যক্তি কখনোই এটা পারবে না।

ফরচুন ৫০০ কোম্পানির সিইওগণ বছরে গড়ে ১০ মিলিয়ন ডলারের বেশি পারিশ্রমিক পান [বাংলাদেশি টাকায় ৮৪ কোটি টাকা]। এর কারণ তারা যেকোনো জটিল সমস্যার তাৎক্ষণিক সমাধান দিতে সক্ষম। বহু বছরের অভিজ্ঞতার কারণে তারা এক নজর দেখেই কোন সমস্যার প্যাটার্ন বুঝে পূর্ববর্তী সমস্যার সাথে মিল খুঁজে বের করতে পারে এবং সেই অনুযায়ী ত্বরিত গতিতে সঠিক সিদ্ধান্তটি নিতে পারে। তাদের এই সিদ্ধান্তের সাথে তাদের কোম্পানির লক্ষ কোটি ডলার অর্থ জড়িত থাকে।


এক নম্বর নিয়ম

ধনী ব্যক্তিরা সবচেয়ে বেশি যেই উপদেশটি দিয়ে থাকেন তা হলো, ‘অর্থ খোয়াবেন না’। ব্যবসায়িক এবং ব্যক্তিগত জীবনে আপনার লক্ষ্য এটাই হওয়া উচিত। যুদ্ধে যেই সমরনায়ক সবচেয়ে কম ভুল সিদ্ধান্ত নেন, সাধারণত তিনিই জয়লাভ করেন। ব্যবসায়িক ক্ষেত্রেও যে সবচেয়ে কম ভুল সিদ্ধান্ত নেয়, তার কোম্পানি কিংবা ব্রাঞ্চই সবচেয়ে বেশি লাভ অর্জন করে। কোন সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে যত বেশি তথ্য সংগ্রহ করবেন, আপনার সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা ততই বৃদ্ধি পাবে। আর এভাবেই আপনি কাঙ্খিত সাফল্য অর্জন করতে পারবেন।

কোনো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সকল তথ্য সম্পর্কে অবগত হয়ে, তবেই নিজের লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব।


ধনীদের কৌশল

আমেরিকার অন্যতম স্ব-প্রতিষ্ঠিত ধনী বার্নার্ড বারুখ তার মাই ওউন স্টোরি বইয়ে লিখেছেন, ‘তার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল ছিল নিজের অর্থ বিনিয়োগের পূর্বে সকল তথ্য সংগ্রহের জন্য যথোচিত প্রচেষ্টা না করা।’

আজকের বিশ্বের দ্বিতীয় স্ব-প্রতিষ্ঠিত সর্ববৃহৎ ধনী ব্যক্তি, মাল্টিবিলিওনেয়ার ওয়ারেন বাফেট দিনের প্রায় আশিভাগ সময় তার বিনিয়োগের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করতে পারে, এমন সব বিষয়ে পড়াশোনা এবং তথ্য সংগ্রহে ব্যয় করেন। তিনি কখনোই শেখা এবং তথ্য সংগ্রহ করা বন্ধ করেন না।

কার্লোস স্লিম কয়েক বছর আগে বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি মেক্সিকো সিটিতে তার বাড়িতে মেক্সিকোসহ পৃথিবীর নানা দেশের পত্রিকা সংগ্রহ করেন। তিনি নিয়মিতভাবে এগুলো পড়েন যাতে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য সকল তথ্য আহরণ করতে পারেন।


কখনো তথ্য সংগ্রহ বন্ধ করবেন না

আপনার লক্ষ্য হবে ব্যক্তিগত এবং ব্যবসায়িক জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলোতে সকলের চেয়ে বেশি ওয়াকিবহাল থাকা। অবিরাম তথ্য সংগ্রহ, যাচাই এবং বিভিন্ন তথ্য তুলনা করার মাধ্যমেই এটা করা সম্ভব। আপনাকে সংশয়ী হয়ে ধীরেসুস্থে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

যত বেশি তথ্য সংগ্রহ এবং অভিজ্ঞতা অর্জন করবেন, ততই নির্ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে কাঙ্খিত ফলাফল অর্জন করতে পারবেন।


 

অনুশীলনী

১) ব্যক্তিগত কিংবা ব্যবসায়িক জীবনের এমন একটি ক্ষেত্র নির্বাচন করুন যেখানে আপনাকে অর্থ এবং সময় ব্যয় করতে হবে এবং যার ফলাফল সুদূরপ্রসারি। এবার কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার আগে সেই বিষয়ের সাথে জড়িত সকল তথ্য সংগ্রহ করার সংকল্প করুন। বিশ্বাসের ওপর ভর করে কোন সিদ্ধান্ত নিবেন না।

২) অন্যদের সাথে কথা বলুন। পূর্বে একই সমস্যার মুখোমুখি হয়েছে এমন মানুষের উপদেশ নিন।

৩) এমন একটি মারাত্মক ত্রুটি খুঁজে বের করুন যার ওপর ভিত্তি করে আপনি কাজটি করবেন কি করবেন না সেই সিদ্ধান্ত নিবেন। সবসময় মনে করবেন, এমন একটি ত্রুটি অবশ্যই আছে।


 




অধ্যায় ৪



লক্ষ্যভিত্তিক চিন্তা বনাম প্রতিক্রিয়াভিত্তিক চিন্তা


মানসিক দৃঢ়তা অনেক কিছু নিয়ে গঠিত এবং তা ব্যাখ্যা করা কঠিন। এর বৈশিষ্ট্য হলো আত্মবিসর্জন ও ত্যাগ। এছাড়াও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো এটি সম্পূর্ণরূপে শৃঙ্খলাবদ্ধ ইচ্ছাশক্তির সাথে মিলিত হয় যা মানুষকে হার মানতে দেয় না। এটি একটি মানসিক অবস্থা, আপনি একে ‘কাজেকর্মে চারিত্রিক দৃঢ়তার প্রকাশ’ বলতে পারেন।

- ভিন্স লমবার্ডি


একদল স্ব-প্রতিষ্ঠিত লাখপতি তাদের দলের একজনের বাড়িতে ডিনার করছিলেন। তাদের সকলেই শূন্য থেকে শুরু করে অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে আজকের এই অবস্থানে পৌঁছেছেন। তারা সাফল্যের কারণ নিয়ে আলোচনা করছিলেন। কেন ঐ টেবিলের সবাই অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করতে সক্ষম হলেও অনেক মানুষই তা পারে না, এটা নিয়ে তারা কথা বলছিলেন। অবশেষে দলের সবচেয়ে সফল ব্যক্তি জিজ্ঞেস করলেন, ‘সাফল্য কী?’

তারা তার কাছে এর উত্তর জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সাফল্য হলো লক্ষ্য, বাকি সব ফাঁকা বুলি।’


জীবনের টার্নিং পয়েন্ট তথা সন্ধিক্ষণ

জীবনে অনেক টার্নিং পয়েন্টের মুখোমুখি হবেন। এসব মুহূর্ত, অন্তর্দৃষ্টি এবং অভিজ্ঞতা কয়েক সেকেন্ড কিংবা কয়েক মাস স্থায়ী হতে পারে। কিন্তু একবার এমন একটি টার্নিং পয়েন্টের মুখোমুখি হলে আপনার জীবন সম্পূর্ণ বদলে যাবে।

অনেক সময় এগুলো ঘটার সাথে সাথেই বুঝতে পারবেন। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সময়টা পার হওয়ার পরেই এদের চেনা যায়। নিজের অতীতের দিকে তাকালে দেখবেন, কিছু ছোট ছোট বিষয় আপাতদৃষ্টিতে গুরত্বপূর্ণ মনে না হলেও এদের কারণে পরবর্তীতে আপনার জীবনে আমূল পরিবর্তন এসেছে।

আমার এবং অধিকাংশ সফল ব্যক্তির জীবনের সবচেয়ে বড় টার্নিং পয়েন্ট ছিল জীবনের লক্ষ্য আবিষ্কার। আমার বয়স তখন চব্বিশ, আমি দেউলিয়া হয়ে পড়ি এবং কাজেকর্মে ছিলাম অদক্ষ। আমি বাড়ি বাড়ি ঘুরে বিক্রয়কর্মীর কাজ করতাম। আমার বিক্রি ও আয় ছিল খুবই কম। আমি এক বন্ধুর এক রুমের এপার্টমেন্টের মেঝেতে ঘুমাতাম। এরপর আমি নিজের লক্ষ্য আবিষ্কার করি।


লক্ষ্য আবিষ্কার

সেই এক রুমের এপার্টমেন্টের পুরনো একটা ড্রেসারের নিচের ড্রয়ারে আমি একটি পুরনো বই খুঁজে পাই। বইটি উলটে-পালটে দেখার সময় একটা লাইন আমার নজরে আসে, ‘যদি সফল হতে চাও তবে লক্ষ্য নির্ধারণ করো।’

কয়েক পৃষ্ঠা পড়ে একটি কাগজ নিয়ে তাতে নিজের ভবিষ্যৎ লক্ষ্যগুলো লেখার কথা বলা ছিল। আমার হারানোর মতো কিছু ছিল না। তাই একটি কাগজ নিয়ে তাতে নিজের দশটি লক্ষ্যের কথা লিখে ফেলি। কিছুদিন পর অবশ্য লিস্টটা হারিয়েও ফেলি। কিন্তু ত্রিশ দিন পর আমার জীবন সম্পূর্ণ বদলে যায়। আমি ঐ লিস্টের প্রায় সব লক্ষ্যই অপ্রত্যাশিতভাবে অর্জন করতে সক্ষম হই।

আমি নিজের বিক্রি তিনগুণ করার একটি পদ্ধতি আবিষ্কার করি। এর ফলে আমার আয় একলাফে বহুগুণ বেড়ে যায়। আমাকে সেলস ম্যানেজার পদে উন্নীত করে একদল লোককে আমার আবিষ্কৃত পদ্ধতিতে ট্রেনিং দেওয়ার দায়িত্ব দেওয়া হয়। আমার হাতে তাদের বিক্রি তদারকির সমস্ত দায়িত্ব দেওয়া হয়। এর সবই হয়েছিল আমি ঐ কাগজে নিজের লক্ষ্য লেখার ত্রিশ দিনের মধ্যে!


 

সম্পদ অর্জনের চাবিকাঠি

এরপর থেকে আমি লক্ষ্য নির্ধারণ এবং লক্ষ্য অর্জনের উপরে অসংখ্য প্রোগ্রাম পড়েছি, গবেষণা করেছি, পড়িয়েছি এবং তৈরি করেছি। এসব প্রোগ্রাম বিশ্বব্যাপী লক্ষ লক্ষ মানুষ ব্যবহার করেছে। আমি যেখানেই যাই না কেন, মানুষ আমাকে একই কথা বলে, ‘আপনি আমার জীবন বদলে দিয়েছেন। আপনি আমাকে ধনী বানিয়েছেন।’

যখন তাদের জিজ্ঞেস করি আমার শিক্ষার কোন দিকটি বিশেষ করে তাদের উপর প্রভাব ফেলেছিল, তারা সবসময় একই জবাব দেয়। আর তা হলো: নিজের লক্ষ্য নির্ধারণ এবং অর্জনের কৌশল শিক্ষা। এটি তাদের জীবনের টার্নিং পয়েন্ট ছিল, যেমনটি ছিল আমার।

এখনকার যুগে মানুষের ‘১ ভাগ বনাম ৯৯ ভাগ’ এর বিরুদ্ধে অভিযোগ, এমনকি রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করাটাও নতুন কিছু নয়। কিন্তু তাদের এই ধারণা ভুল। বাস্তবে এটা হলো ‘৩ ভাগ বনাম ৯৭ ভাগ’।

মাত্র তিনভাগ মানুষের স্পষ্ট, নির্দিষ্ট এবং লিখিত লক্ষ্য ও পরিকল্পনা রয়েছে। তারা এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য প্রতিনিয়ত চেষ্টা করে যাচ্ছে। বাকি ৯৭ ভাগের আছে আশা, স্বপ্ন, ইচ্ছা ও কল্পনা। কিন্তু তাদের কোনো লক্ষ্য নেই। সবচেয়ে দুঃখের বিষয় হলো তারা দুটোর মাঝে পার্থক্যই বোঝে না।


দশগুণ আয় করুন

গত কয়েক দশকের অভিজ্ঞতায় এবং লক্ষ্য ও লক্ষ্যহীন মানুষের ওপর করা সব গবেষণাপত্র পড়ে আমি দেখেছি যে শীর্ষ ৩ ভাগ মানুষ নিচের ৯৭ ভাগ মানুষের সমন্বিত আয়ের চেয়ে গড়ে প্রায় দশগুণ বেশি আয় করে।

কেন এমন হয়? এর কারণ অনেক। আগের অধ্যায়ে আমরা দেখেছিলাম ধনী মানুষের মন্ত্র হলো, ‘টাকা হারাবেন না’।

সাফল্যের ক্ষেত্রে আমরা তাহলে বলতে পারি, ‘সময় হারাবেন না’।

আসল কথা হলো আপনার যখন নির্দিষ্ট ও স্পষ্ট লক্ষ্য থাকবে এবং সেই লক্ষ্য অর্জনের জন্য আপনি রোজ কাজ করবেন তখন আপনার প্রচুর সময় বেঁচে যাবে। আপনি কয়েক মাস কিংবা কয়েক বছরে এমন সব অর্জন করতে সক্ষম হবেন যা অনেক মানুষ এক জীবনেও অর্জন করতে পারবে না। লক্ষ্য নির্ধারণের ফলে আপনার মানসিক জিপিএস চালু হয় যা একটি গাইডেড মিসাইলের মতো আপনাকে নিজের লক্ষ্যের দিকে ধাবিত করে, আপনার লক্ষ্যবস্তুর প্রতিক্রিয়া সংগ্রহ করে এবং আপনি লক্ষ্যে না পৌঁছান পর্যন্ত ‘কোর্স কারেকশন’ করতেই থাকে। [ফজলে রাব্বির কথা― কোর্স কারেকশন মানে একটি লক্ষ্য অর্জনের একাধিক পথ রয়েছে। লক্ষ্য অর্জনের জন্য যতক্ষণ পর্যন্ত না ঠিক পথ পাওয়া যাচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত চেষ্টা করে যাওয়া। লক্ষ্য অর্জনের একাধিক পথ থেকে ঠিক পথ বাছাই করে নেওয়াই কোর্স কারেকশন।]

থমাস কার্লাইল লিখেছিলেন, ‘লক্ষ্যহীন মানুষ সবচেয়ে সহজ পথেও এগিয়ে যেতে পারে না। অপরদিকে স্পষ্ট লক্ষ্যযুক্ত মানুষ বন্ধুর পথেও দ্রুত বেগে এগিয়ে চলে।

আপনি হয়তো শুনে থাকবেন, ‘যদি গন্তুব্য অজানা থাকে তবে কোনো পথই আপনাকে সেখানে নিতে পারব না।’

 

বৃহৎ তিন গঠন করুন

উন্নত চিন্তার ‘বৃহৎ তিন’― স্পষ্টতা, মনোযোগ এবং একাগ্রতা গঠনের শ্রেষ্ঠ উপায় হলো জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রের জন্য নির্দিষ্ট লক্ষ্য স্থাপন করা।

সাফল্যের ৯৫ ভাগ আসে চিন্তার স্বচ্ছতা থেকে। আপনার নিজের সম্পর্কে― নিজের শক্তি, দক্ষতা, প্রতিভা, দুর্বলতা, জীবনের লক্ষ্য ইত্যাদি সম্পর্কে আপনার স্পষ্ট ধারণা থাকতে হবে। এরপর কোন বিক্ষিপ্ত চিন্তা ব্যতীত এক সময় কেবল একটি বিষয়ের ওপর মনোনিবেশ করে সেই কাজটি করতে হবে।

বিল গেটস এবং ওয়ারেন বাফেট উভয়ের মতেই আজকের দ্রুত গতির জীবনে এক সময়ে একটি কাজের ওপর মনোনিবেশ করার ক্ষমতা সাফল্য লাভের জন্য অপরিহার্য।

নিজের এবং নিজের লক্ষ্য সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়ার পর আপনাকে সেই লক্ষ্য অর্জনের জন্য পদক্ষেপ নিতে হবে এবং এক সময়ে কেবল একটি বিষয়ের উপরেই কাজ করতে হবে এবং যতক্ষণ পর্যন্ত কাজটি শতভাগ শেষ না হচ্ছে সেই কাজ ছেড়ে ওঠা যাবে না।

লক্ষ্য আপনাকে দ্রুততম সময়ে স্পষ্টতা, মনোযোগ এবং একাগ্রতা গঠনে সাহয্য করবে। হতাশা এবং ব্যর্থতার জন্য দ্বায়ী ‘অলস চিন্তার’ সবচেয়ে বড় প্রতিষেধক হলো লক্ষ্য।


বিক্ষিপ্ত চিন্তা কমান


দ্রুত পরিবর্তন এবং ক্রমাগত ইলেক্ট্রনিক বাধা যেমন: ইমেইল, মেসেজ, ফোন কল এবং সোশাল মিডিয়ার কারণে দিন দিন মানুষের মনোযোগ কমে আসছে। মানুষ এটেনশন ডেফিসিট ডিসর্ডার তথা মনোযোগের ঘাটতি জনিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। যার ফলে তারা কোনো কাজে ‘লেগে থাকতে’ পারছে না। এখন মানুষ দিনে গড়ে প্রায় ৪৫ মিনিট সময় ইমেইল দেখার পিছনে ব্যয় করে। [বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বলা চলে, মানুষ গড়ে প্রায় ৪৫ মিনিট সময় সোশাল মিডিয়া দেখার পিছনে ব্যয় করে।] তারা মেসেজ, ইমেইল এবং ফোন কলের দাস হয়ে পড়েছে এবং চকচকে ও উত্তেজক বস্তুর পিছনে ছুটছে। 

যাদের লক্ষ্য নেই তারা লক্ষ্যযুক্ত মানুষের অধীনে খেটেই জীবন পার করে। জীবনে হয় নিজের লক্ষ্য অর্জন করবেন অথবা অন্য কারও লক্ষ্য অর্জনের জন্য কাজ করতে হবে। সবচেয়ে উত্তম হলো কোম্পানির লক্ষ্য অর্জনের সাথে সাথে নিজের লক্ষ্যও অর্জন করা।


পরিবর্তনের প্রভাব

হয়তো বর্তমানে আপনার জীবনের সবচেয়ে বড় প্রভাবক হলো পরিবর্তনের গতি। সমগ্র মানব ইতিহাসে এখনকার মতো এত দ্রুত পরিবর্তনের গতি আগে কখনো দেখা যায়নি। হয়তো ভবিষ্যতে এই গতি আরও বৃদ্ধি পাবে।

তিনটি প্রধান কারণে পরিবর্তনের গতি এত বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং আমাদের নিয়ন্ত্রণ হারাতে বাধ্য করছে। এই প্রধান ক্ষেত্রগুলোতে পরিবর্তনের ফলে একরাতের মাঝেই হয়তো আমাদের সেরা পরিকল্পনাগুলো ভেস্তে যাচ্ছে।


তথ্য বিস্ফোরণ

পরিবর্তনের প্রথম কারণ হলো তথ্য ও জ্ঞানের বিস্ফোরণ। দিন দিন নিত্য নতুন সব তথ্য আমাদের সামনে উঠে আসছে, বিস্তার লাভ করছে, বৃদ্ধি পাচ্ছে; দ্রুত থেকে দ্রুততর গতিতে। একটি নতুন তথ্য, আইডিয়া কিংবা অন্তর্দৃষ্টি একটি বড় শিল্পকে ধ্বংস করে দিতে পারে।

আজকের দিনে অধিক সংখ্যক স্মার্ট মানুষ ভালো এবং ধ্বংসাত্মক সব আইডিয়া বের করছে যা মানব ইতিহাসে আগে কখনো দেখা যায়নি।

প্রযুক্তির বিস্তার

দ্বিতীয় কারণটি হলো প্রযুক্তি― যা আজকের দিনে অসম্ভব দ্রুত গতিতে বৃদ্ধি এবং বিস্তার লাভ করছে। প্রযুক্তির বিস্তার একটি শিল্পকে দ্রুততম সময়ে পরিবর্তন করতে সক্ষম। নোকিয়া আর ব্ল্যাকবেরির কথাই ভাবুন। ২০০৭ সালে আইফোন আসার আগ পর্যন্ত মার্কেট এদেরই দখলে ছিল। মাত্র পাঁচ বছরের মাথায় এরা প্রায় গায়েবই হয়ে গেছে। এই সময়ের মাঝে ব্ল্যাকবেরি মার্কেটের নিয়ন্ত্রণ ৪৯ ভাগ থেকে ০.৪ ভাগে নেমে আসে। নোকিয়া সেলফোন বিক্রি বন্ধ করে মাইক্রোসফটের কাছে বিক্রি হয়ে যায়। বিশ্বের এক প্রান্তের প্রযুক্তিগত আবিষ্কার অপর প্রান্তে থাকা আপনার ব্যবসা ধ্বংস করে দিতে পারে যদি না আপনি তার সাথে তাল মিলিয়ে চলতে শেখেন।


আক্রমণাত্মক প্রতিযোগিতা

তৃতীয় এবং শেষ কারণটি সম্ভবত সবচেয়ে বেশি ধ্বংসাত্মক। আর তা হলো― প্রতিযোগিতা। আপনার প্রতিদ্বন্দ্বীরা আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে অধিক হিং¯্র, আক্রমণাত্মক এবং দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। আপনার প্রতিদ্বন্দ্বীরা নতুন তথ্য এবং প্রযুক্তি ব্যবহার করে কাস্টমারদের রুচি পরিবর্তন, পরিবর্ধন এবং নতুন নতুন  পণ্য ও সেবা তৈরি করে আপনার পণ্য বা সেবাকে অচল করে দিতে বদ্ধপরিকর।

আপনার প্রতিদ্বন্দ্বীরা ক্রমাগত নতুন সুযোগ খুঁজছে আরও কম দামে আরও ভালো পণ্য উৎপাদনের মাধ্যমে আপনার কাস্টমারদের নিজেদের দিকে আকর্ষিত করার।

ম্যাকডোনাল্ডস, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ফাস্টফুড চেইন চিপোটল মেক্সিকান গ্রিলের (ঈযরঢ়ড়ঃষব গবীরপধহ এৎরষষ) মতো কোম্পানির কাছে হার মেনেছে। দ্য গ্যাপ এবং এব্যারক্রম্বি ও ফিচ, অধিক আক্রমণাত্মক প্রতিদ্বন্দ্বীদের সাথে তাল মেলাতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে, যারা কিনা তাদের চেয়ে কম মূল্যে আরও ভালো মানের পণ্য সরবরাহ করছে।  তাদের পণ্য আজকের দিনের কাস্টমারদের পছন্দসই।

সূত্রটি হলো, পরিবর্তনের গতি (ংঢ়ববফ ড়ভ পযধহমব) = তথ্য বিস্ফোরণ ী প্রযুক্তির বিস্তার ী প্রতিযোগিতা (পরিবর্তনের গতি হচ্ছে তথ্য বিস্ফোরণ গুণ প্রযুক্তির বিস্তার গুণ প্রতিযোগিতা)। {ঝঙঈ = ওঊ ী ঞঊ ী ঈ (ঃযব ংঢ়ববফ ড়ভ পযধহমব রং বয়ঁধষ ঃড় রহভড়ৎসধঃরড়হ বীঢ়ষড়ংরড়হ ঃরসবং ঃবপযহড়ষড়মু বীঢ়ধহংরড়হ ঃরসবং পড়সঢ়বঃরঃরড়হ)}. আমরা শুধু জানি এই গতি সময়ের সাথে কেবল বৃদ্ধিই পাবে। চার্লস ডারউইন লিখেছেন, ‘সবচেয়ে শক্তিশালী কিংবা বুদ্ধিমান প্রাণীরা টিকে থাকে না, টিকে থাকে তারাই যারা পরিবর্তনের সাথে খাপ খাইয়ে চলতে পারে।’


লক্ষ্য থাকা অপরিহার্য

লক্ষ্য থাকার গুরুত্ব অপরিসীম। লক্ষ্য আপনাকে পরিবর্তনের দিক নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে। ফলে আপনার ব্যক্তিগত ও কর্মজীবনের নিয়ন্ত্রণও আপনার হাতে চলে আসে।

সাফল্যের অনেক বড় একটি রহস্য হলো― যা আপনি নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন না, তা নিয়ে দুশ্চিন্তা না করা। আপনি পরিবর্তনের গতি বদলাতে কিংবা কমাতে পারবেন না। কিন্তু আপনি সেই গতির সাথে নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারবেন। আর এটা তখনই সম্ভব যখন আপনার পরিষ্কার এবং নির্দিষ্ট লক্ষ্য থাকবে।

আপনি হয় পরিবর্তনকে জয় করবেন নয়তো তার কাছে হার মানবেন। আপনি ফলাফলের নির্ধারক হতে পারেন নয়তো ফলাফলের বলি হতে পারেন, ক্রমাগত পরিবর্তনশীল জীবনের ধারাবাহিকতায় হারিয়ে যেতে পারেন।

লক্ষ্য আপনাকে শক্তি, উদ্দেশ্য এবং দিকনির্দেশনা দান করে। লক্ষ্য আপনাকে নিজের সেরাটা দিতে সাহায্য করে, নিজের সম্পূর্ণ ক্ষমতা উপলব্ধি করতে সাহায্য করে।


লক্ষ্য নির্ধারণ একজন মানুষের সেরাটা বের করে আনে

লক্ষ্য নির্ধারণের জন্য প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি, ধীর এবং জ্ঞাত চিন্তা। [ফজলে রাব্বির কথা― জ্ঞাত চিন্তা কী? হ্যারল্ড জেনিন আইটিটিতে প্রায় ১৫০ প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে একটি সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন। তার মতে, ‘ব্যবসায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো তথ্য। সঠিক তথ্য জানতে হবে। কেবল ধারণা বা অনুমানের বশে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না। সঠিক তথ্য জানতে হবে। তথ্য কখনো মিথ্যে বলে না।’ জ্ঞাত চিন্তা তথা রহভড়ৎসবফ ঃযরহশরহম মানে কোনো কাজ, ব্যবসা বা উদ্যোগ নেওয়ার আগে সকল তথ্য সংগ্রহ করুন এবং তথ্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিন।] সাফল্যের একটি মূল সূত্র হলো, ‘কাগজে চিন্তা করুন।’ শুধু লক্ষ্য লেখার কাজটাই আপনার লক্ষ্য অর্জনের সম্ভাবনা শতগুণ বাড়িয়ে দিবে। মনে রাখবেন, লক্ষ্য না দেখতে পেলে লক্ষ্যভেদও করা যায় না। যেই লক্ষ্য কাগজে লিখে বোঝান যায় না তা অর্জনও করা যায় না।

আপনার চিন্তার মান নিজেকে করা প্রশ্নগুলোর মানের সাথে সম্পর্কিত। লক্ষ্য নির্ধারণ ও অর্জন সম্পর্কিত যত ভালো প্রশ্ন নিজেকে জিজ্ঞেস করবেন ততই আপনার চিন্তার মান বৃদ্ধি পাবে। নিচে কিছু প্রশ্ন দেওয়া হলো যা নিয়মিত নিজেকে জিজ্ঞেস করলে আপনার চিন্তার স্বচ্ছতা, মনোযোগ এবং একাগ্রতা বহুগুণ বৃদ্ধি পাবে।


ঠিক করুন: আপনি আসলেই কী চান

আপনি আসলেই, আসলেই, আসলেই জীবনে কোন জিনিসটা পেতে চান? দেখা গেছে, এই তৃতীয় ‘আসলেই’টি আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে একটি স্পষ্ট ধারণা পেতে সাহায্য করে।

যখনই তিনবার ‘আসলেই’ কথাটি বলবেন তখনই নিজের মনের গভীরে গিয়ে আপনার প্রকৃত ইচ্ছাকে উপলব্ধি করতে পারবেন।


আপনি কোন জিনিসকে সবচেয়ে বেশি মূল্যায়ন করেন

আপনি কোন জিনিসগুলোকে বেশি মূল্যায়ন করেন? আপনার মূলনীতিগুলো কী? কোন কোন বৈশিষ্ট্য ও চারিত্রিক গুণাবলি আপনাকে আকর্ষণ করে? কোন ধরনের মানুষকে আপনি সবচেয়ে বেশি মূল্যায়ন করেন?

মানব জীবনের বেশির ভাগ সমস্যা নিজের মূলনীতি অনুসরণের মাধ্যমে সমাধান সম্ভব। আপনার নীতি ও বিশ্বাস আপনার চিন্তার কেন্দ্রবিন্দু। এই অক্ষকে ঘিরেই আপনার জীবন চালিত হয়। আপনার বিশ্বাস আপনার গভীরতম অনুভূতিগুলোকে নির্ধারণ করে। এই নীতিগুলোই আপনার বিশ্বাস, আশা ও দৃষ্টিভঙ্গির নির্ধারক। ‘আপনি যা দেখেন তাই বিশ্বাস করেন না। যা বিশ্বাস করেন তাই দেখেন।’

এক সপ্তাহ যাবৎ নিজেকে বারবার এই প্রশ্নটি জিজ্ঞেস করুন, ‘আমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নীতি কোনটি?’

প্রথম উত্তরেই সন্তুষ্ট হয়ে যাবেন না। আপনার প্রথম উত্তরটি সবসময়ই সহজ এবং অন্যদের খুশি করার জন্য হবে। কিন্তু প্রশ্নটি বারবার জিজ্ঞেস করলে আসল উত্তরটি বেরিয়ে আসবে। ‘আমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নীতি কোনটি?’ আপনার সর্বশেষ উত্তরটি হয়তো আপনাকে অবাক করবে।


নিজের তিনটি প্রধান গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য

বর্তমানে আপনার জীবনের সবচেয়ে গুরত্বপূর্ণ তিনটি লক্ষ্য কী?

ত্রিশ সেকেন্ডের মাঝে উত্তরটি লিখে ফেলুন। ৩০ সেকেন্ডের মাঝে লেখা উত্তরগুলো ৩০ মিনিট কিংবা ৩ ঘণ্টা ধরে লেখা উত্তরের মতোই সঠিক হবে।


পরাজয়ে ভীত হবেন না

মনে করুন, আপনার ব্যাংক একাউন্টে ২ কোটি আছে কিন্তু আপনার আয়ু আর ১০ বছর। তাহলে আগামী দশ বছর আপনি কী করবেন?

এই প্রশ্নটি আপনাকে সাময়িকভাবে অর্থ ও সম্পদের দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত করবে। বেশির ভাগ মানুষই অর্থ, সময়, প্রতিভা এবং সম্পদের অভাবে নিজের প্রকৃত ইচ্ছা প্রকাশ করা থেকে বিরত থাকে।

কিন্তু যখন কল্পনা করবেন যে ব্যাংকে ২ কোটি টাকা আছে এবং হাতে দশ বছর সময় আছে তখন নিজের প্রকৃত ইচ্ছা এবং লক্ষ্য স্পষ্টভাবে দেখতে পাবেন। আপনার মনের প্রকৃত ইচ্ছা উপলব্ধি করতে পারবেন। আপনার এই ইচ্ছাটি কী?


ছয় মাস আয়ু

ধরুন, আপনার ডাক্তার একটি পূর্ণাঙ্গ পরীক্ষার পর আপনাকে বসিয়ে জানাল তার কাছে দুটি সংবাদ আছে। একটি ভালো অপরটি মন্দ। ভালো সংবাদটি হলো আগামী ছয় মাস আপনি অসামান্য সুস্বাস্থ্য উপভোগ করবেন। কিন্তু দুঃসংবাদটি হলো ১৮১ তম দিনে একটি দুরারোগ্য অসুখে আপনার মৃত্যু হবে।

যদি আপনার হাতে আর মাত্র ছয়মাস সময় থাকে তবে আপনি সেই সময়কে কীভাবে কাজে লাগাবেন? কী করবেন এই সময়ে? কার সাথে সময় কাটাবেন? কোন কাজটি সম্পন্ন করতে চাইবেন? নিজের উত্তরাধিকার হিসাবে কী রেখে যেতে চাইবেন?

এই প্রশ্নগুলো আপনার কাছে কোন জিনিসগুলো গুরুত্বপূর্ণ তা পরিষ্কার ভাবে বুঝতে সাহায্য করবে। নিশ্চয়ই শুনে থাকবেন, ‘মৃত্যুশয্যায় গিয়ে কেউ অফিসে কাজ করার ইচ্ছা পোষণ করে না।’


গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার অনুভূতি

কোন কাজগুলো করলে আপনার নিজেকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়? কোন কাজগুলো করলে আপনার নিজের মূল্য ও আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি পায়?

ডেল কার্নেগি বলেছিলেন, ‘একজন মানুষ কোন কাজ করে সবচেয়ে বেশি আত্মবিশ্বাস অর্জন করে আমাকে তা জানাও, আমি তোমাকে তার সমগ্র জীবন-দর্শন বলে দিব।’

জীবনে কোন কাজ কিংবা অর্জন আপনাকে সবচেয়ে বেশি আনন্দ দিয়েছে? আপনি কোন কাজে পারদর্শী? আপনার সবচেয়ে বড় সাফল্যের কারণ কী? কোন কাজটি আপনি বিনামূল্যে সারাদিন করতে চাইবেন?


একটি বৃহৎ লক্ষ্য

যদি বিফল হওয়ার কোনো ভয় না থাকে তবে কোন বৃহৎ লক্ষ্যটি আপনি অর্জন করতে চাইবেন?

ব্যর্থতার ভয় মানুষের জীবনে সাফল্য লাভের অন্তরায় এবং ব্যর্থ হওয়ার প্রধান কারণ। ধরুন, আপনার কোনো সীমাবদ্ধতা নেই। আপনার কাছে নিজের লক্ষ্য অর্জনের জন্য অফুরন্ত সময় ও অর্থ, লোকবল ও সম্পর্ক, বন্ধুবান্ধব ও যোগাযোগব্যবস্থা, প্রতিভা ও সক্ষমতা আছে। তবে কোন লক্ষ্যটি আপনি অর্জন করতে চাইবেন?

আপনার নিজের প্রকৃত রূপ এবং লক্ষ্য সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা আপনাকে একটি হাই-পারফর্মেন্স জীবন গড়ে তুলতে সহায়তা করবে। নিয়মিতভাবে নিজে এই প্রশ্নগুলো জিজ্ঞেস করলে আপনার স্বচ্ছতা, একাগ্রতা এবং মনোযোগ বৃদ্ধি পাবে।


 

লক্ষ্য নির্ধারণ প্রক্রিয়া

নেপলিয়ান হিল লিখেছিলেন, সাফল্যের চাবিকাঠি হলো ’প্রমাণিত সাফল্যের সূত্রগুলো’ ব্যবহার করা। সফল ব্যক্তিরা কোন কাজগুলো বারবার করে তা খুঁজে বের করুন। এরপর সেই কাজগুলো নিজে করুন। ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়া নীতি অনুযায়ী আপনি সফল ব্যক্তিদের মতো কাজ করলে (ক্রিয়া), আপনি শীঘ্রই একই ফল পাবেন (প্রতিক্রিয়া)।

লক্ষ্য নির্ধারণ ও অর্জনের একটি সহজ কিন্তু শক্তিশালী প্রক্রিয়া রয়েছে যা প্রয়োগ করলে আপনার জীবনে আমূল পরিবর্তন আসবে এবং আপনার কর্মক্ষমতা তড়িৎগতিতে বৃদ্ধি পাবে। পদ্ধতিটি নিম্নরূপ:

১। জীবনে আসলেই কী চান নির্ধারণ করুন। অধিকাংশ মানুষই এ কাজ করে না। বেশির ভাগ মানুষই অনেক কিছু আশা করে কিন্তু নির্দিষ্ট কিছু চায় না।

জীবনে ব্যর্থতার অন্যতম প্রধান কারণ হলো ‘আমার লক্ষ্য আছে’ এটা ধরে নেওয়া। কিন্তু তাদের যেটা আছে তা লক্ষ্য নয়। এগুলো কেবলই ইচ্ছা, আশা ও কল্পনা। অপরদিকে আসল লক্ষ্য হলো স্পষ্ট ও নির্দিষ্ট।

আইনস্টাইন বলেছিলেন, ‘যদি নিজের লক্ষ্য একজন ছয় বছর বয়সী শিশুকে না বোঝাতে পারেন তাহলে ঐ লক্ষ্যটি আপনার নিজের কাছেই স্পষ্ট নয়।’

২। লিখে ফেলুন। অলিখিত লক্ষ্য কেবলই ইচ্ছা কিংবা আশা। কথায় বলে, লক্ষ্য হলো ‘সময় বাঁধা স্বপ্ন’। একটি লক্ষ্য যখন লিখিত রূপ লাভ করে তখন তা অদৃশ্য এক বস্তু থেকে বাস্তবে রূপ নেয়। আপনি তা দেখতে পারেন, স্পর্শ করতে পারেন, পড়তে পারেন। লক্ষ্যটি এখন দৃশ্যমান, আপনার অবাস্তব কল্পনা নয়। সিগারেটের ধোঁয়ার মতো নিরাকার নয়।

মাত্র তিন ভাগ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের স্পষ্ট ও লিখিত লক্ষ্য আছে এবং বাকিরা তাদের অধীনেই কাজ করে। তাদের পুরো কর্ম জীবনে তারা একজন সাধারণ মানুষের চেয়ে প্রায় দশগুণ বেশি উপার্জন করে। লিখিত লক্ষ্যযুক্ত ব্যক্তি এক বছরে যা আয় করে একজন সাধারণ মানুষের তা আয় করতে ৫ এমনকি ১০ বছরও লেগে যায়।

এটাই হলো আবিষ্কার। প্রতিবার নিজের লক্ষ্য লেখার সময় আপনি আসলে নিজের অবচেতন মনকে লক্ষ্যটি অর্জনের জন্য প্রোগ্রাম করছেন।

একবার কোনো লক্ষ্য লিখে ফেললে আপনার অবচেতন মন সেটিকে নির্দেশ হিসাবে গ্রহণ করে আপনাকে ঐ লক্ষ্যের দিকে দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টা ধাবিত করে। লিখিত লক্ষ্য অত্যন্ত শক্তিশালী।

৩। ডেডলাইন তথা সময়সীমা দিয়ে দিন। অবচেতন মনের জন্য সময়সীমা একটি ‘বল প্রয়োগকারী ব্যবস্থা’ হিসাবে কাজ করে। এটি আপনার অবচেতন ও অচেতন মনের জন্য একটি টার্গেট ঠিক করে দেয়। লক্ষ্য লিখে একটি সময়সীমা সেট করলে তা অর্জনের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে আপনি সর্বোচ্চ অনুপ্রাণিত হবেন।

সময়সীমা যুক্ত একটি লিখিত লক্ষ্য আকর্ষণ সূত্রকে সক্রিয় করে তোলে। আপনি তখন এমন সব মানুষ, আইডিয়া, সম্পদ ও সুযোগকে নিজের দিকে আকৃষ্ট করতে শুরু করবেন যা আপনাকে দ্রুততর সময়ে নিজের লক্ষ্যের দিকে চালিত করবে।

যদি সময়সীমার মাঝে লক্ষ্যটি অর্জিত না হয়? খুব সহজ― আরেকটি সময়সীমা ঠিক করুন। আপনার নিয়ন্ত্রণের বাইরে এমন অনেক কিছুই ঘটতে পারে যার কারণে লক্ষ্যটি অর্জনে দেরি হচ্ছে। কোনো সমস্যা নেই। আরেকটি সময়সীমা ঠিক করুন। মনে রাখবেন, কোনো লক্ষ্যই অবাস্তব নয়, অবাস্তব হয় শুধু সময়সীমা।

৪। লিস্ট বানান। লক্ষ্য অর্জনের জন্য যা যা করতে হবে তার একটি তালিকা তৈরি করুন। যে লোকবল, জ্ঞান ও সম্পদের প্রয়োজন হবে তা-ও সেখানে লিখুন। যতদিন সম্পূর্ণ না হচ্ছে লিস্টে জিনিসপত্র যোগ করতে থাকুন।

তালিকা বানানোর কাজটাই আপনার লক্ষ্য অর্জনের স্পৃহাকে বহুগুণ বাড়িয়ে দিবে। এটি আপনাকে অনুপ্রাণিত ও উজ্জীবিত করবে। হেনরি ফোর্ড বলেছিলেন, ‘যেকোনো লক্ষ্যই অর্জন সম্ভব যদি আপনি সেই লক্ষ্যটিকে ছোট ছোট অংশে বিভক্ত করে নেন।’

৫। লিস্টটিকে একটি পরিকল্পনায় রূপান্তরিত করুন। পরিকল্পনা তৈরির প্রথম উপায় হলো লিস্টটিকে ধারাবাহিক ভাবে সাজান। একটি চেকলিস্ট তৈরি করুন, লক্ষ্য অর্জনের জন্য করণীয় ধাপের লিস্ট। একটার পর একটা সাজান। একটি লিখিত চেকলিস্ট রেখে কাজ করলে আপনার লক্ষ্য অর্জনের গতি পাঁচ থেকে দশগুণ বৃদ্ধি পাবে।

দ্বিতীয় উপায় হলো, গুরত্ব অনুসারে লিস্ট সাজান। কোনটি বেশি গুরুত্বপূর্ণ, কোনটি কম? আপনার লিস্টের ২০ ভাগ কাজের ওপর আপনার ৮০ ভাগ সাফল্য নির্ভর করে। সেই কাজগুলো কী?

৬। পরিকল্পনা মাফিক তৎক্ষণাৎ কাজে নেমে পড়–ন। কিছু করুন। যেকোনো কিছু। প্রথম পদক্ষেপটি নিন। আইনস্টাইন বলেছিলেন, ‘কিছু না চললে, কিছুই হবে না।’ একইভাবে আপনি না চললে কিছুই হবে না।

৭। আপনার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্যটি অর্জনের জন্য প্রতিদিন কিছু না কিছু কাজ করুন। সপ্তাহের একদিনও বাদ দিবেন না।

প্রতিদিন কিছু করলে ‘গতিশীল সাফল্যের নীতি’ বা ‘মোমেন্টাম প্রিন্সিপাল’ সক্রিয় হয়। লক্ষ্য অর্জনের প্রথম ধাপটি কঠিন হলেও একবার পদক্ষেপটি নিতে সমর্থ হলে পরবর্তী ধাপগুলো আস্তে আস্তে সহজ হয়ে আসে। আপনি গতিবেগ অর্জন করেন। আপনি দ্রুত নিজের লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যান এবং লক্ষ্যও দ্রুত আপনার দিকে এগিয়ে আসে। আর জানেনই তো, প্রথম ধাপটি সবসময় দৃশ্যমান।


লক্ষ্য নির্ধারণ অনুশীলন

এই সহজ অনুশীলনটি বিশ্বজুড়ে লাখো মানুষের জীবন পালটে দিয়েছে। এটি কার্যকরী, কারণ এটি সহজ।

১। একটি কাগজ নিয়ে তাতে আজকের তারিখ দিয়ে কাগজের শীর্ষে ‘লক্ষ্য’ কথাটি লিখুন। এরপর আগামী ১২ মাসের মধ্যে আপনি কোন লক্ষ্যগুলো অর্জন করতে চান সেগুলো লিখে ফেলুন। এগুলো এক সপ্তাহ, এক মাস কিংবা ১২ মাসেরও লক্ষ্য হতে পারে। কিন্তু এই লক্ষ্যগুলো আপনি আগামী বছরের মাঝে অর্জন করতে চান।

এগুলো এক সপ্তাহ, এক মাস, ছ’মাস কিংবা বারো মাসব্যাপী লক্ষ্য হতে পারে। কিন্তু এগুলো সেসব লক্ষ্য হতে হবে যা আপনি আগামী বছরের মাঝেই অর্জন করতে চান।

দেখা গেছে, ১ বছরের মাঝে অর্জন করতে চাওয়া লক্ষ্য ৫ কিংবা ১০ বছরের মাঝে অর্জন করতে চাওয়া লক্ষ্য থেকে বেশি অনুপ্রাণিত করে। যদিও সেই লক্ষ্যগুলোও আপনি একসময় অবশ্যই নির্ধারণ করবেন।

লক্ষ্যগুলো লেখার সময় এ তিন জিনিস মাথায় রাখবেন। লক্ষ্য লেখার সময়কাল বিবেচনা করবেন― বর্তমান কাল (ঢ়ৎবংবহঃ ঃবহংব), ব্যক্তিগত (ঢ়বৎংড়হধষ) লক্ষ্য নিবেন এবং ইতিবাচক (ঢ়ড়ংরঃরাব) লক্ষ্য তৈরি করবেন। আপনার অবচেতন মন এভাবে লেখা লক্ষ্য নিয়েই কেবল কাজ করতে পারে। প্রতিটি লক্ষ্য শুরু হবে ‘আমি’ দিয়ে এবং শেষ হবে ক্রিয়াপদ দিয়ে।

উদাহরণস্বরূপ, আপনার লক্ষ্য হতে পারে: ‘আমি এই বছরের ডিসেম্বরের মাঝে ... ... টাকা আয় করছি।’

এমন ভাবে লক্ষ্যটি লিখুন যাতে মনে হয় আপনি লক্ষ্যটি অর্জন করে ফেলেছেন এবং কাউকে তা জানাচ্ছেন।

আমি ‘সিগারেট খাওয়া ছেড়ে দিব’ বলার বদলে লিখুন ‘আমি সিগারেট খাওয়া ছেড়ে দিয়েছি’।

এখনই মাথায় আছে এমন ১০টি লক্ষ্য বর্তমান কালে লিখে ফেলুন। সেগুলো যেন অবশ্যই ব্যক্তিগত ও ইতিবাচক হয়।

২। ১০ টি লক্ষ্য লেখা হয়ে গেলে এই প্রশ্নটি জিজ্ঞেস করুন, ‘এই লিস্টের কোন লক্ষ্য অর্জিত হলে আমার জীবনে সবচেয়ে বেশি ইতিবাচক প্রভাব পড়বে?’

এমন একটি লক্ষ্য অবশ্যই লিস্টে থাকবে। এই লক্ষ্যটি নির্ধারণ করে ফেলতে পারলে তা আপনার জীবনের ‘নির্দিষ্ট প্রধান উদ্দেশ্য’ হয়ে দাঁড়াবে।

৩। আরেকটি খালি কাগজে এই লক্ষ্যটিকে বর্তমান কালে, ব্যক্তিগত ও ইতিবাচক ভাবে লিখুন।  উদাহরণস্বরূপ, ‘আমি অমুক তারিখের মাঝে এই পরিমাণ অর্থ উপার্জন করছি।’

৪। এবার এই লক্ষ্যটি অর্জন করতে হলে আপনাকে কী কী পদক্ষেপ নিতে হবে সেগুলো লিখে ফেলুন। অন্তত ২০টি উপায় লিখবেন।

প্রতিটি উপায় লিখে তার বিপরীতে বিকল্প উপায়টি লিখুন। এভাবে যথাযথ বিশটি উপায় না পাওয়া পর্যন্ত লিখতে থাকুন।

৫। এবার এই উপায়গুলোকে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত ক্রমানুসারে সাজিয়ে নিয়ে একটি পরিকল্পনা তৈরি করুন।

৬। লিস্টের প্রথম পদক্ষেপটি নিয়ে কাজ শুরু করে দিন এবং যত দ্রুত সম্ভব কাজটি সম্পন্ন করুন।

৭। এখন থেকে প্রতিদিন এই লিস্টের ওপর কাজ করুন এবং নিজের প্রধান লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যান। কখনোই যাতে এর ব্যত্যয় না ঘটে। সপ্তাহের ৭ দিনই এটি নিয়ে কাজ করুন।


 

নিজের লক্ষ্য নিয়ে চিন্তা করুন

‘আপনি বেশির ভাগ সময় যা চিন্তা করেন আপনি তাতেই পরিণত হবেন।’ এ এক চরম সত্য কথা। কথাটি মনে রাখবেন। প্রতিদিন সকালে উঠে নিজের লক্ষ্যের কথা ভাবুন। সারাদিন নিজের লক্ষ্যের কথা চিন্তা করুন। সন্ধ্যায় নিজের প্রধান লক্ষ্য অর্জনে কতদূর অগ্রসর হলেন তা নিয়ে পর্যালোচনা করুন।

যত বেশি নিজের লক্ষ্য নিয়ে চিন্তা করবেন তত বেশি তা অর্জনের বিভিন্ন উপায় আপনার মাথায় আসবে। তীব্র লক্ষ্যমুখী চিন্তা আপনার অবচেতন ও অচেতন মনকে উদ্দীপিত করে লক্ষ্য অর্জনের দিকে অগ্রসর হতে উদ্বুদ্ধ করবে। যত বেশি নিজের লক্ষ্য নিয়ে ভাববেন, পরিকল্পনা করবেন এবং তা নিয়ে কাজ করবেন তত বেশি আপনি লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাবেন এবং লক্ষ্যটি আপনার দিকে এগিয়ে আসবে।

আজ থেকেই একজন লক্ষ্যকেন্দ্রিক ব্যক্তিতে পরিণত হোন। এটি আপনার মানসিক শক্তিকে উন্মুক্ত করবে, আপনার প্রতিভার বিকাশ ঘটাবে, আপনার কর্মশক্তিকে চালিত করবে এবং আপনাকে সামনে অগ্রসর হতে অনুপ্রাণিত করবে।


অনুশীলনী


১) জীবনের যেকোনো একটি ক্ষেত্রে কোন লক্ষ্যটি অর্জিত হলে আপনার জীবনে সবচেয়ে বেশি ইতিবাচক প্রভাব পড়বে তা নির্ধারণ করুন।

২) এবার সেই লক্ষ্যটি ব্যক্তিগত ও ইতিবাচক ভাবে বর্তমান কালে এমন ভাবে লিখুন যেন তা অর্জিত হয়ে গেছে।

৩) এই লক্ষ্যটি অর্জনের জন্য একটি পরিকল্পনা তৈরি করুন এবং সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রতিদিন কাজ করুন।

 




অধ্যায় ৫



ফলাফলভিত্তিক চিন্তা বনাম কার্যভিত্তিক চিন্তা


যারা নিজের সেরাটা দিতে বদ্ধপরিকর থাকে, যারা কোনোভাবেই এর কমে সন্তুষ্ট হয় না, তারাই অন্যদের জন্য অগ্রগতির সীমা নির্ধারণ করে থাকে।

- অরিসন সোয়েট মারডেন


আমার বয়স যখন বিশোর্ধ্ব তখন আমার জীবনে একটি বড় টার্নিং পয়েন্ট এসেছিল। আমি আমার চারপাশে তাকিয়ে দেখেছিলাম যে আমার বয়সী অনেকেই ব্যক্তিগত ও কর্মজীবনে আমার চেয়ে অনেক ভালো অবস্থানে আছে। তাদের পোশাক, চাকুরি আমার চেয়ে ভালো ছিল। তারা নতুন গাড়িতে চড়ত। তাদের অনেকে বিয়ে করে বাড়িও কিনেছিল।

অপরদিকে আমি পুরনো একটি গাড়ি চালাতাম, পুরনো পোশাক পরতাম, সেলসম্যানের কাজ করতাম, সারাক্ষণ টাকা নিয়ে দুশ্চিন্তা করতাম, কীভাবে মাস চলবে এই চিন্তায় মগ্ন থাকতাম। এভাবে বাঁচাটা সুখকর কিছু নয়।

আমার টার্নিং পয়েন্ট এসেছিল যখন নিজেকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘কেন কিছু মানুষ অন্যদের থেকে বেশি সফল?’

এ প্রশ্ন আমার জীবন বদলে দিয়েছিল। এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আমি আমার জীবনকে নিয়োজিত করেছিলাম। বাইবেলে বলা হয়েছে, ‘খোঁজ, তবেই পাবে। কারণ যারা খোঁজে তারাই পায়।’ কথাটি আমার ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ সত্য প্রমাণিত হয়েছিল। যখনই আমি উত্তর খুঁজতে বেরিয়েছিলাম উত্তরগুলো চুম্বকের মতো আমার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে ছুটে আসছিল।


বেশি বেশি আয় করুন

আর্থিক ক্ষেত্রে উত্তরটি সহজ ও স্পষ্ট। যারা বেশি পরিশ্রমী তারা বেশি আয় করে। তারা সাধারণ মানুষের চাইতে তাদের সময়ের বেশি সদ্ব্যবহার করে। তারা ভালো ফলাফল আনে তাই মানুষ তাদেরকে বেশি অর্থ প্রদান করে। তারা অধিক সময় অধিক ফলাফল অর্জনে ব্যয় করে।

এখন প্রশ্ন হলো: আপনার সবচেয়ে মূল্যবান আর্থিক সম্পদ কোনটি? যখন প্রথমবার প্রশ্নটি শুনেছিলাম তখন এর উত্তর আমার কাছে স্পষ্ট ছিল না। পরে জেনেছিলাম উত্তরটি হচ্ছে আপনার ‘আয় করার ক্ষমতা’। আপনার অর্থ আয়ের ক্ষমতা হলো আপনার সবচেয়ে মূল্যবান আর্থিক সম্পদ।

আপনি চাকুরি, বাড়িঘর, সঞ্চয়, বিনিয়োগ সব হারিয়ে নিঃস্ব হতে পারেন। কিন্তু যতক্ষণ আপনার আয় করার ক্ষমতা আছে আপনি এসব আবারও অর্জন করতে পারবেন। এটি এত মানুষের সাথে এত বার ঘটেছে যে একে এখন প্রায় রূপকথাই বলা চলে।

কেন ফরচুন ৫০০ কোম্পানির সিইওগণ বছরে গড়ে প্রায় ১ কোটি টাকা উপার্জন করে? কারণ তারা নিজেদের আয় করার ক্ষমতাকে এমন অবস্থানে নিয়ে গেছে যে তারা নিজেদের বেতনের চাইতে কয়েকশ গুণ লাভ কোম্পানিকে এনে দিতে সক্ষম। কোম্পানিগুলো তাদের এত অর্থ দিতে ইচ্ছুক কারণ তারা জানে এই লোকগুলো লক্ষ কোটি টাকা তাদের এনে দিতে পারবে। কোনো কারণে যদি তারা চাকুরি হারিয়েও ফেলে অন্য কোনো কোম্পানি সাথে সাথে এক কোটি কিংবা এর বেশি পরিমাণ অর্থ দিয়ে তাদের নিজের কোম্পানিতে চাকুরি দিবে।


আয় করার ক্ষমতার সংজ্ঞা

আপনার আয় করার ক্ষমতা হলো আপনার কাঙ্খিত ফলাফল এনে দেওয়ার ক্ষমতা যার জন্য মানুষ আপনাকে অর্থ প্রদান করবে। এটি আপনি কত ঘণ্টা কাজ করলেন, সবার সাথে মিলে কাজটি করলেন কিনা এসবের সাথে সম্পর্কিত নয়। এটি হলো নির্দিষ্ট সময় এবং অর্থ দিয়ে কোন কাজ সফল ভাবে সম্পন্ন করার ক্ষমতা যার থেকে কাঙ্খিত ফলাফল অর্জন করা যায়।

পৃথিবীর সকল কাজের কাঙ্খিত ফলাফল একটাই: কার্য সম্পন্ন হওয়া। দিনশেষে আপনার কোনো কাজ নিয়মিত এবং নির্ভরশীল ভাবে সম্পন্ন করার ক্ষমতাই আপনাকে নিজের প্রতিষ্ঠানে একজন মূল্যবান ও অপরিহার্য ব্যক্তিতে পরিণত করবে।

শীর্ষে থাকা ব্যক্তিরা যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ ও মূল্যবান কাজ সম্পন্ন করতে সক্ষম। তাদের মর্যাদা এমনই যে তাদের বলা হয়, ‘গো-টু-পার্সন’ বা ‘এর কাছেই যাও’। [ফজলে রাব্বির কথা― ‘গো-টু-পার্সন’ তথা ‘এর কাছে যাও’ বলতে বোঝায় এমন ব্যক্তি যার ওপর ভরসা করা যায়। আপনার কোনো সমস্যা হলে এমন ব্যক্তি আপনাকে সাহায্য করবে বলে আশা করা যায়। এমন ভরসাবান ব্যক্তিকেই বলা হয় ‘গো-টু-পার্সন’। বাংলাদেশে এমন ভরসাবান ব্যক্তিকে বলা হয় বড় ভাই। আমরা সাধারণত কোনো সমস্যায় পড়লে বিশ^স্ত ও ভরসাবান ব্যক্তিকে খুঁজি এবং তাকে ডাকি ‘বড় ভাই’ বলে।]

মানুষ বলে, ‘যদি কাজটি দ্রুত ও ভালোভাবে করতে চাও তবে এর কাছেই যাও।’


শীর্ষ ২০ শতাংশে যোগ দিন

৮০/২০ নিয়মটি কর্মজগতের ক্ষেত্রেও খাটে। ২০ ভাগ দ্রুতবেগে আগাচ্ছে, নিজেদের কর্দক্ষতা বাড়াচ্ছে, উপরে উঠছে, অধিক থেকে অধিকতর উপার্জন করছে। বাকি ৮০ ভাগ লোক হলো শুধু সময়মাফিক কর্মী। তারা শেষ মুহূর্তে কাজে যোগদান করে এবং সবার আগে বেরিয়ে যায়। আর যতক্ষণ কাজে থাকে সেই সময়টাও ঠিক মতো কাজে লাগায় না।

রবার্ট হাফ ইন্টারন্যাশনালের মতে, কর্মদিবসের পুরো ৫০ ভাগ সময়ই অপচয় হয়। এই সময়ের বেশির ভাগ অপচয় হয় সহকর্মীদের সাথে অপ্রয়োজনীয় আড্ডা দিয়ে। এছাড়াও ইমেইল, ফোন কল, মেসেজ, সোশাল মিডিয়া ইত্যাদির পিছনেও অনেক সময় অপব্যয় হয়। গড়ে প্রত্যেক কর্মী (ম্যানেজারসহ) প্রতিদিন প্রায় ৪৫ বার তার ইমেইল চেক করে।

মানুষ দেরিতে কর্মক্ষেত্রে আসে, আগে বের হয়, কফি-টাইম ও লাঞ্চে অধিক সময় ব্যয় করে। তারা খবরের কাগজ পড়ে, ব্যক্তিগত কাজ করে, ফলে তাদের সার্বিক কর্মদক্ষতা খুব নি¤œ পর্যায়ে থাকে।


 

নি¤œমুখী কর্মদক্ষতার মূল কারণসমূহ

কেন এমন হয়? আসলে অল্প বয়স থেকেই এই অভ্যাসগুলো গড়ে ওঠে। একজন শিশুর কর্মজগতের সাথে প্রথম পরিচয় হয় যখন সে প্রথম স্কুলে যায়। সেখানে সে সমবয়সী শিশুদের সান্নিধ্যে আসে। সমবয়সীদের সান্নিধ্যে এলে আপনি কি করবেন? আপনি খেলবেন!

৫/৬ বছর বয়স থেকে স্কুুলই শিশুদের প্রধান খেলার স্থানে পরিণত হয়। একটি শিশু সময়ের সাথে সাথে এই সহপাঠীদের ও সমবয়সীদের সাথে স্কুলের আগে, স্কুলের সময়, স্কুলের পরে এবং ছুটির দিনে খেলে ও আড্ডা দিয়ে বেড়ে ওঠে।

এই শিশুই যখন যৌবনে পা দিয়ে স্কুল ছেড়ে কর্মজীবনে প্রবেশ করে তখন সে প্রথমেই নিজের সমবয়সীদের খুঁজে বের করে। আর সমবয়সীদের সান্নিধ্যে আসলে আপনি কি করবেন? আপনি খেলবেন!


অভ্যাসের প্রভাব

এই অভ্যাসের বশে প্রায় স্বয়ংক্রিয়ভাবেই কর্মস্থল তখন স্কুলে পরিণত হয়। এটি তখন প্রাপ্তবয়স্ক জীবনের খেলার স্থানে পরিণত হয়। দেখা গেছে গড়ে একজন মানুষ আসলে সকাল ১১টার আগে কাজ শুরু করে না। এরপর থেকে তার কাজের গতি কমতে থাকে এবং ৩টায় তা সর্বনি¤œ পর্যায়ে পৌঁছায়। এই সময়ের মাঝেও সে অনেকটা সময় তার বন্ধুদের সাথে খেলে ব্যয় করে। কিন্তু এটা আপনার জন্য নয়।

সারাদিন খেলায় ব্যয় তারাই করে যাদের কোনো ভবিষ্যৎ নেই। কিন্তু আপনি তাদের দলে নন। আপনি কর্মক্ষেত্রে সাফল্য ও অর্জনকে নিজের লক্ষ্য ও সাফল্য অর্জনের অংশ হিসাবেই দেখেন।


কাজের সময় কাজ

তাহলে নিয়মটি এই― কাজের সময় শুধু কাজই করুন। যখন কাজে যাবেন কাজ করবেন। বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিবেন না, ৫ মিনিট পরপর ইমেইল চেক করবেন না, খবরের কাগজ পড়বেন না, ব্যক্তিগত কাজ করবেন না। কাজের সময় কেবলই কাজ করুন। যদি ভালো ফলাফল পেতে চান তবে একটু আগেই কাজে যান। আগের চেয়েও বেশি কর্মঠ হোন। দেরিতে কাজ থেকে বের হোন। কাজের গতি বাড়ান। সবচেয়ে জরুরি কাজগুলোতে অধিক মনোযোগ দিন। সময় অপচয় করবেন না।

কেউ কাজের সময় কথা বলতে চাইলে বলুন, ‘তোমার সাথে অবশ্যই কথা বলব কিন্তু এখন নয়। এখন আমার কাজ আছে।’

বেশির ভাগ মানুষই একথা শোনার পর আর আপনাকে বিরক্ত করবে না। কে কীভাবে আপনাকে ‘কাজ করতে’ বাধা দিতে পারে? তাদের বলুন, তাদের সাথে কথা বলতে আপনি অবশ্যই ইচ্ছুক কিন্তু তা ছুটির দিনে কিংবা কাজ শেষে। এর মাঝে মনে মনে এই কথাটি মন্ত্রের মতো জপতে থাকুন, ‘কাজে যাও! কাজে যাও! কাজে যাও!’

আপনার লক্ষ্য যেটা কেবল আপনিই জানেন। আর তা হলো, আপনার কোম্পানির সবচেয়ে কর্মঠ ব্যক্তিতে পরিণত হওয়া। কাজের সময় তাই শুধুই কাজ করুন।


কখন কাজ করছেন?

অধিকাংশ মানুষ মনে করে তারা কর্মক্ষেত্রে আছে মানেই তারা কাজ করছে। কিন্তু আপনি প্রকৃত পক্ষে তখনই কাজ করছেন যখন আপনি একটি জরুরি কাজ শুরু করে তা সম্পন্ন করছেন। আপনি তখনই কাজ করছেন যখন মূল্যবান ও লাভজনক কাজ করে আপনার কোম্পানির জন্য কাঙ্খিত ফলাফল নিয়ে আসছেন। শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিগণ সবসময় অধিক থেকে অধিকতর মূল্যবান কাজসমূহ করে থাকেন। অপরদিকে সাধারণ মানুষ কম মূল্যবান কিংবা মূল্যহীন কাজ করে সময় পার করে।

সময় ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত সকল শিক্ষা, বইপুস্তক, কোর্সসমূহের মূল কাজ আপনাকে এই প্রশ্নটি জিজ্ঞেস করতে এবং এর উত্তর জানতে সাহায্য করা, ‘এই মুহূর্তে কোনটি কাজটি করলে আপনার মূল্যবান সময়ের সর্বাধিক সদ্ব্যবহার হবে?’ সঠিকভাবে এই প্রশ্নটি জিজ্ঞেস করা, এর উত্তর হিসাবের ক্ষমতা এবং সেই উত্তর অনুযায়ী ঐ মুহূর্তে ওই কাজটি করে আপনার মূল্যবান সময় কাজে লাগানোই আপনার কর্মক্ষেত্রে সাফল্য নির্ধারণ করে দিবে। এটি অন্য যেকোনো পদ্ধতির চেয়ে সাফল্য লাভে অধিক কার্যকরী।


 

শুরু করুন এবং চালিয়ে যান

আপনি ধারাবাহিকভাবে কিছু কৌশল, পদ্ধতি ও উপায় ব্যবহার করে কাজ শুরু করতে পারেন। একবার কাজ শুরু করে তা শেষ না হওয়া পর্যন্ত কাজ চালিয়ে যান। সময়ের যথাযথ ব্যবহার করে সর্বাধিক সফল ফলাফল পাওয়ার জন্য স্পষ্ট লক্ষ্য নিয়ে কাজ শুরু করুন। এগুলো সেসব কাজ যাদের প্রতি আপনি একান্ত ভাবে নিয়োজিত থাকবেন।

যেসব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন নিয়মিতভাবে নিজেকে জিজ্ঞেস করবেন এবং সেসবের উত্তর খুঁজবেন:


১. আমি কী করার চেষ্টা করছি?

২. আমি কীভাবে এটি করার চেষ্টা করছি?

৩. এটি কি আমার জন্য কার্যকরী? আমি কি কাঙ্খিত ফলাফল পাচ্ছি?

৪. আমার অনুমান কী কী?

৫. এই ক্ষেত্রে আমার অনুমানগুলো ভুল হলে কী হবে?

৬. আমি যে ফলাফলগুলো চাই তা অর্জনের জন্য আরও ভালো কোনো উপায় কী থাকতে পারে?

৭. আমি যদি আবার এই কাজটি শুরু করি, তবে আমি অন্য কোনভাবে কাজটি করব?


সময় ব্যবস্থাপনা কৌশল

সবচেয়ে শক্তিশালী সময় ব্যবস্থাপনার কৌশল হলো লিস্ট তৈরি। নিজের সবচেয়ে বড় লক্ষ্যগুলো দিয়ে শুরু করুন, এরপর ঐ লক্ষ্য কিংবা লক্ষ্যগুলো অর্জনের জন্য কী কী পদক্ষেপ নিতে হবে তার একটি চেকলিস্ট তৈরি করুন। কর্মক্ষেত্রে আপনি ঐ দিন কোন কোন কাজ করতে চান তার একটি লিস্ট তৈরি করুন।

আদর্শ ভাবে যেদিন কাজ করতে হবে তার আগের রাতে লিস্ট তৈরি করা উচিত। আগের রাতে লিস্ট তৈরির মাধ্যমে বস্তুত আপনি পরের দিনের জন্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র লক্ষ্য নির্ধারণ করছেন। এই লিখিত লিস্ট রাতে ঘুমানোর সময় আপনার অবচেতন মনকে পরদিন এই লক্ষ্যগুলো অর্জনের জন্য কাজ করতে প্রস্তুত করবে। অনেক সময় দেখবেন এমন সব উপায় ও কৌশল মাথায় নিয়ে ঘুম থেকে জেগে উঠেছেন যা আপনার ঐদিনের লক্ষ্য অর্জনের পথকে আরও সুগম করে তুলবে।

যদি কোনো কারণে আগের রাতে লিস্ট তৈরি করতে ব্যর্থ হোন তবে সেদিন সকালে উঠে প্রথমেই একটি কাগজ নিয়ে ঐদিন কী কী কাজ করতে চান তার লিস্ট তৈরি করে ফেলবেন। লিস্ট তৈরির সম্পূর্ণ হওয়ার আগে আর কোনো কাজ করবেন না। এমনকি ফোন কলও করবেন না।

দিনের শুরুতেই লিস্ট তৈরি, আপনার কর্মদক্ষতা ২৫-৫০% বাড়িয়ে দিবে।


ইমেইল চেক করবেন না

নিজেকে কঠোর অনুশাসনে রাখুন যাতে দিনের শুরুতেই ইমেইল দেখার অভ্যাস পরিত্যাগ করতে পারেন। ইলেক্ট্রনিক বাধাসমূহ বিশেষ করে বারবার ইমেইল দেখা, সোশাল মিডিয়া দেখার অভ্যাস ত্যাগ কররার মাধ্যমে কর্মদক্ষতা দ্বিগুণ থেকে তিনগুণ করা সম্ভব। দিনে কেবল দু’বার ইমেইল দেখার অভ্যাস করুন; সকাল ১১টা এবং বিকেল ৩টায়। কম্পিউটারে ইমেইল আসার নোটিফিকেশন বন্ধ করে রাখুন। অপ্রয়োজনীয় বিষয় যা পরে দেখলেও ক্ষতি নেই সেসব কাজের সময় দেখা থেকে বিরত থাকুন।


গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো লিস্টে উল্লেখ করুন

লিস্ট তৈরি করা হয়ে গেলে কাজ শুরু করার আগে গুরুত্ব অনুযায়ী লিস্টের কাজগুলোকে সাজান। এই অনুশীলন কিংবা অভ্যাসটি নাটকীয়ভাবে আপনার কর্মদক্ষতা ও উৎপাদনশীলতা বহুগুণ বৃদ্ধি করবে।

নিজের দৈনন্দিন কাজের লিস্টে ৮০/২০ নিয়মটি প্রয়োগ করুন। মনে রাখবেন, আপনার কাজের ৮০ ভাগ ফলাফল লিস্টের ২০ ভাগ কাজ করার মাধ্যমে অর্জিত হবে। যদি দিনে ১০টি কাজও করার থাকে তবুও সেখানে এমন দুটি কাজ অবশ্যই থাকবে যার গুরুত্ব বাকি ৮টি কাজের চাইতে বেশি হবে। এই কাজগুলো কী?


কখগঘঙ পদ্ধতি

কখগঘঙ পদ্ধতি ব্যবহার করে কাজগুলোকে শ্রেণীবিভক্ত করুন। প্রতিটি কাজের পাশে তার ‘ফলাফল’ লিখুন। সময় ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে যেই কাজগুলো বেশি গুরুত্বপূর্ণ তার ফলাফলও অনেক বেশি গুরুত্ববহ হয়ে থাকে। যেই কাজ গুরুত্বহীন তার ফলাফলের গুরুত্ব কম কিংবা তা একবারেই গুরুত্বহীন। তাই ভেবেচিন্তে এরপরই কাজ শুরু করুন।


ক = করতেই হবে― এই কাজগুলো করা বা না করার ফলাফল গুরুতর। লিস্টের এই গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলোর পাশে ক লিখুন।

খ = করা উচিত― এই কাজগুলো করা বা না করার ফলাফল মোটামুটি গুরুতর। তবে এই কাজগুলো ‘ক’ লিস্টের কাজের মতো গুরুত্ব বহন করে না।

গ = করা ভালো― এই কাজগুলো করলে বা না করলে কিছুই আসে যায় না। যেমন- কফি খাওয়া, সোশাল মিডিয়া চেক করা, সহকর্মীদের সাথে আড্ডা দেওয়া।

ঘ = অর্পণ করা― যেই কাজগুলো নিজে না করলেও চলে সেগুলো অন্য সময় করুন কিংবা অন্য কাউকে করতে দিন। কাজগুলো আপনার পছন্দের হলেও তা করুন এবং জরুরি কাজগুলো করার জন্য আপনার মূল্যবান সময় ফাঁকা রাখুন।

ঙ = পরিত্যাগ করা। কম মূল্যবান কিংবা মূল্যহীন কাজ করা একেবারেই পরিত্যাগ করুন।


সব কাজের পাশে এই অক্ষরগুলো দেওয়া হয়ে গেলে এবার প্রতিটি অক্ষরের অন্তর্গত কাজগুলোকে আবার গুরুত্ব অনুসারে সাজান। যেমন: ক কাজগুলোর ক্ষেত্রে ক-১, ক-২, ক-৩; খ এর ক্ষেত্রে খ-১, খ-২, খ-৩ ইত্যাদি।

নিয়ম হলো ‘ক’ তালিকার কাজ বাকি থাকতে কখনোই ‘খ’ তালিকার কাজ শুরু করবেন না। ক-১ কাজটি তৎক্ষণাৎ শুরু করে দিন। এভাবে লিস্ট সাজানো শেষ হলে ক-১ কাজের তুলনায় বাকি সব কাজ তুচ্ছ বলে মনে হবে।

৭০% নিয়ম চর্চা করুন। কেউ যদি কোন কাজের ৭০ ভাগ আপনার মতোই সফলভাবে করতে পারে তবে সেই কাজটি তাকে দিয়ে দিন। আমরা কেবল সেই কাজগুলোই করতে চাই যা করে আমরা অভ্যস্ত। এই কাজগুলোর প্রকৃত পক্ষে কোনো গুরুত্ব নেই।

লিস্টের এ কাজগুলো করার ওপর মনোনিবেশ করুন এবং কাজগুলো শেষ না হওয়া পর্যন্ত থামবেন না। [ব্রায়ান ট্রেসি রচিত টাইম ম্যানেজমেন্ট বইয়ের ৪৭ পৃষ্ঠায় প্রনিল পদ্ধতি আছে। প্রনিল মানে প্রতিদিনের নির্দিষ্ট লক্ষ্য। কখগঘঙ পদ্ধতির মতোই সহজ এক পদ্ধতি। আপনার কাজগুলোকে ১-২-৩-৪-৫ ক্রমিক নং অনুসারে সাজাতে হবে। পড়ে দেখতে পারেন। টাইম ম্যানেজমেন্ট। মূল: ব্রায়ান ট্রেসি। অনুবাদ: মোহাম্মদ রাশেদুল হক ও ফজলে রাব্বি। ঢাকা, সাফল্য প্রকাশনী, ২০২০।]


তিনের নীতি

সময় ব্যবস্থাপনার সবচেয়ে শক্তিশালী ও কার্যকরী উপায় হলো তিনের নীতি। এই নীতি অনুযায়ী মাত্র তিনটি কাজ কোম্পানিতে আপনার ৯০ ভাগ গুরুত্ব নির্ধারণ করে দেয়। বাদ বাকি যা করেন তা বাকি ১০ ভাগে পড়ে।

আমি নিজের ক্লায়েন্টদের তারা এক সপ্তাহ কিংবা এক মাসের মাঝে কী কী কাজ করে থাকে তার একটি লিস্ট তৈরি করতে দিই। তা সেই কাজ যত বড় বা যত ছোটই হোক না কেন। বেশির ভাগ মানুষই ২০ থেকে ৩০টি কাজ লিপিবদ্ধ করে আনে। অনেকে তো ৫০ থেকে ৬০টি কাজও লিপিবদ্ধ করে!

কাজের লিস্ট তৈরি শেষ হলে নিচের তিনটি জাদুকরি প্রশ্ন নিজেকে জিজ্ঞেস করুন:


১। আপনাকে যদি এই লিস্টের যেকোনো একটি কাজ সারাদিন করতে বলা হয় তবে কোন কাজটি করলে আপনার নিজের এবং কোম্পানির উন্নতিতে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখতে পারবেন?


উত্তরটি সঙ্গে সঙ্গেই আপনার চোখের সামনে ভেসে উঠবে। উত্তরটি সাধারণত স্পষ্ট এবং সহজ হয়ে থাকে। আর উত্তরটি আপনার অবশ্যই জানা। যদি আপনার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজটি সম্পর্কে আপনার কোন ধারণাই না থাকে তবে আপনি কখনোই অত্যন্ত কার্যক্ষম একজন ব্যক্তিতে পরিণত হতে পারবেন না।


গুরুত্বপূর্ণ জিনিসকে গুরুত্ব দিন

আমি একবার একটি বড় কোম্পানির প্রেসিডেন্টের ক্ষেত্রে এই ব্যক্তিগত ব্যবস্থাপনা কৌশল অনুশীলন করেছিলাম। তার মনে হয়েছিল সারাদিন কোন গুরুত্বপূর্ণ কাজটি তার করা উচিত সে সম্পর্কে তিনি স্পষ্ট ধারণা পেয়ে গেছেন। কিন্তু আরও গভীর ভাবে আলোচনা করে দেখা যায় যে তার এই ধারণা সম্পূর্ণ ভুল ছিল। তার ভাবা কাজটি অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ ছিল কিন্তু কাজটি তার নিজের ছিল না। তার সময়ের সবচেয়ে সদ্ব্যবহার হবে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি কাজ করলে।

এই আবিষ্কার তার পেশা এবং তার কোম্পানির দিকনির্দেশনা সম্পূর্ণ রূপে বদলে দিয়েছিল। পরবর্তী ১২ মাস যাবৎ তার কোম্পানির সবাই এই তিনের নীতি অনুসরণ করায় কোম্পানির বিক্রি ও লাভ দ্বিগুণ হয়ে গিয়েছিল।


২। এবার নিজেকে জিজ্ঞেস করুন, ‘আপনাকে যদি এই লিস্টের যেকোনো দু’টি কাজ সারাদিন করতে বলা হয় তবে সেই দ্বিতীয় কাজটি কী হবে?


এটিও নির্ণয় করা ততটা সহজ নয়। অনেক সময় আপনাকে নিজের ঊর্ধ্বতন ও সহকর্মীদের সাথে আলোচনা করে তাদের পরামর্শ নিতে হতে পারে। আপনার কাছে কোন একটি কাজ বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে হলেও আপনার ঊর্ধ্বতন ও সহকর্মীদের কাছে অন্য একটি কাজে আপনার অবদান অধিক তাৎপর্যপূর্ণ মনে হতে পারে।


৩। এবার তৃতীয় জাদুকরি প্রশ্নটি জিজ্ঞেস করুন, ‘আপনাকে যদি এই লিস্টের যেকোনো তিনটি কাজ সারাদিন করতে বলা হয় তবে সেই তৃতীয় কাজটি কী হবে?’


যদি নিজে নিশ্চিত না হোন তবে এক্ষেত্রেও আপনার আশেপাশে থাকা মানুষের পরামর্শ গ্রহণ করুন। অনেকের ক্ষেত্রে এ উত্তর প্রশ্নটি জিজ্ঞেস করার সাথে সাথেই স্পষ্ট হয়ে যায়। বাকিদের কাছে উত্তরটি স্পষ্ট না-ও হতে পারে। কিন্তু এই প্রশ্নগুলোর উত্তর আপনাকে অবশ্যই জানতে হবে। যদি না জানেন তবে আপনি কম মূল্যবান কিংবা মূল্যহীন কাজ করে সময় অপচয় করার মারাত্মক ঝুঁকিতে আছেন।


 

তিনের নীতির চারটি অনুসিদ্ধান্ত

একবার ‘বৃহৎ তিন’ নির্ধারণ হয়ে গেলে এরপর এই সহজ নিয়মগুলো অনুশীলন করে নিজের কর্মদক্ষতা দ্বিগুণ থেকে তিনগুণ বাড়িয়ে ফেলুন:

১। কম কাজ করুন। বাস্তবতা হলো আপনি কখনোই আপনার করণীয় প্রতিটি কাজ করে শেষ করতে পারবেন না। তাই নিজের জীবনের নিয়ন্ত্রণ নিতে হলে কম গুরুত্বপূর্ণ কিংবা গুরুত্বহীন কাজ করা বন্ধ করে দিন।

২। অধিক গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো করুন। বৃহৎ তিনের একটি কিংবা তিনটি নিয়েই কাজ করুন।

৩। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজের পিছনে সর্বাধিক সময় ব্যয় করুন। প্রয়োজন হলে সারাদিন সেই কাজে ব্যয় করুন।

৪। নিজের গুরুত্বপূর্ণ কাজে পটু হোন। সাফল্যের জন্য নিয়মিত শেখা ও ব্যক্তিগত উন্নয়ন আবশ্যক, কিন্তু কোন কোন ক্ষেত্রে?

উত্তর: সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো সম্পাদন করে কাঙ্খিত ফলাফল অর্জন করা।


যে প্রশ্নগুলো জিজ্ঞেস করবেন

সময় ব্যবস্থাপনার সবচেয়ে সেরা প্রশ্নটি হলো: ‘আমি কোন কাজে দক্ষ হলে আমার কর্মক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ইতিবাচক প্রভাব পড়বে?’

এই প্রশ্নের উত্তর অবশ্যই পাবেন। কোন কাজটি কেবল আপনিই করতে পারেন যা ঠিকমতো করতে পারলে তার ফলাফল হবে সুদূরপ্রসারী। উত্তরটি যাই হোক না কেন, আপনাকে সেই কাজটির পিছনেই সর্বাধিক সময় ব্যয় করতে হবে। উত্তরটি অবশ্যই আপনার ‘বৃহৎ তিন’ কাজের একটি হবে।

প্রতিদিনের কাজের লিস্টটি দেখে এই প্রশ্নটি জিজ্ঞেস করুন, ‘যদি আমাকে এক মাসের জন্য শহর ছেড়ে যেতে হয় এবং এই লিস্টের যেকোনো একটি কাজ করতে বলা হয় তবে কোন কাজটি আপনি অবশ্যই সম্পূর্ণ করতে চাইবেন?’

উত্তরটি যাই হোক না কেন, আপনার উচিত এখনই সেই কাজটি শুরু করে দেওয়া।


অলসতা পরিত্যাগ করুন

অলসতা পরিত্যাগ করে নিজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজে মনোনিবেশ করা অত্যন্ত মূল্যবান একটি অভ্যাস। আসলে সবাই গড়িমসি করে। কর্মঠ ব্যক্তিরাও অলস ব্যক্তিদের মতোই গড়িমসি করে। তাহলে তাদের মাঝে পার্থক্য কোথায়? উত্তর হলো: কর্মঠ ব্যক্তিগণ কম গুরুত্বপূর্ণ কাজের ক্ষেত্রে গড়িমসি করে। তারা ‘সৃজনশীল বিলম্ব’ চর্চা করে। তারা সচেতনভাবে ঠিক করে কোন কাজটি তারা এখন না করে পরে করবে।

অপরদিকে অলস ব্যক্তিরা অধিক গুরুত্বপূর্ণ কাজের ক্ষেত্রে গড়িমসি করে। অথচ এই কাজগুলোই তাদের এবং তাদের কোম্পানির ভাগ্য বদলে দিতে পারে।

অলসতা ত্যাগ করার কিছু প্রমাণিত উপায়:

১। দিন শুরুর আগে সেদিন কী কী কাজ করতে হবে তার একটি লিস্ট তৈরি করুন। এটি আগেই সবিস্তারে আলোচনা করা হয়েছে।

২। লিস্টের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজটি নিয়ে তা করার জন্য আপনাকে কী কী পদক্ষেপ নিতে হবে তার আলাদা একটি লিস্ট তৈরি করুন।

৩। এই ক্ষেত্রে ‘রুটি পদ্ধতি’ অবলম্বন করুন। একটি বড় কাজের এক টুকরা নিয়ে কেবল সেই অংশটুকু করুন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এটি আপনার কর্মস্পৃহা বাড়িয়ে আপনার অলসতা দূর করে দিবে।

[ফজলে রাব্বির কথা― রুটি পদ্ধতি সম্পর্কে আরও কিছু বর্ণনা করছি। ‘একটি রুটি আপনি কীভাবে খান? একটু একটু করে, ছিঁড়ে ছিঁড়ে খান। ঠিক তেমনি একটি বড় প্রকল্পকে টুকরা করুন। যতটুকু কাজ একবারে করা সম্ভব তা হাতে নিন। সেই কাজটুকু শেষ না হওয়া পর্যন্ত অন্য কিছুতে হাত দিবেন না। এভাবে ভাগ ভাগ করে প্রতিটি কাজ সম্পন্ন করুন। এক সময়ে কেবল একটি কাজ। অন্য যেকোনো কাজ তখন এড়িয়ে চলুন।’ উদ্ধৃত এ অংশ নেওয়া হয়েছে টাইম ম্যানেজমেন্ট বই থেকে। মূল: ব্রায়ান ট্রেসি। অনুবাদ: মোহাম্মদ রাশেদুল হক ও ফজলে রাব্বি। ঢাকা, সাফল্য প্রকাশনী, ২০২০। পৃ. ৮০।]

৪। ‘সুইস চিজ’ কৌশল অবলম্বন করুন। একটি বৃহৎ কাজের একটি মাত্র অংশ নিন এবং তৎক্ষণাৎ সেটি সমাপ্ত করুন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এটি আপনার অলসতার শিকল ভেঙ্গে আপনাকে পুরো কাজটি সম্পন্ন করতে উদ্বুদ্ধ করবে।

৫। নিজেকে পুরস্কৃত করুন। কোনো কাজ সম্পন্ন হলে নিজেকে নির্দিষ্ট কোনো উপহার দিন। যেমন: এক কাপ কফি কিংবা পরবর্তী কাজ শুরু করার আগে কিছুক্ষণের বিরতি।

৬। দশ মিনিট নিয়ম অনুশীলন করুন। কোনো কাজ সম্পন্ন করার চিন্তায় বিচলিত না হয়ে দশ মিনিট টানা পূর্ণ উদ্যমে কাজটি করার সংকল্প করে কাজ শুরু করে দিন।

৭। কাজ শুরু আগে প্রয়োজনীয় সকল জিনিস হাতের কাছে রাখুন। কাজ শুরুর জন্য প্রস্তুত হওয়ার প্রক্রিয়াই অনেক ক্ষেত্রে কাজ শুরুর আগ্রহ সৃষ্টি করে।

৮। বৃহৎ কাজের ক্ষেত্রে ৮০/২০ নীতি অনুসরণ করুন। এই নীতি অনুযায়ী: ২০ ভাগ কাজ ৮০ ভাগ ফলাফল বয়ে আনে। এই ২০ ভাগ কাজে নিজেকে নিয়োজিত করুন। দেখবেন অলসতা ও গড়িমসি করার প্রবণতা দূর হয়ে যাবে।

কর্মক্ষেত্রে সাফল্যের চাবিকাঠি হলো কর্ম সম্পাদন। এইজন্য হয়তো সবচেয়ে শক্তিশালী সময় ব্যবস্থাপনা কৌশল হলো ‘একক মনোযোগ’।

অর্থাৎ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ শুরু করার পর কেবল সেই কাজেই ১০০ ভাগ মনোযোগ দেওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলুন। কাজটি শেষ না হওয়া পর্যন্ত মনোযোগ কোনভাবেই সরতে দেওয়া যাবে না। 


শুরুতেই অর্ধেক সমাপ্তি

প্রতিদিন নিজের কাজ শুরু ও সমাপ্ত করার অভ্যাস আপনার জীবন বদলে দিবে। কর্ম সম্পাদন মস্তিষ্কে এন্ডোরফিনস নামক হরমোন নিঃসরণ করে। এটি প্রকৃতির ‘আনন্দ মাদক’ নামে পরিচিত। এই এন্ডোরফিনস আপনার সৃজনশীলতা বৃদ্ধি করে, আপনার ব্যক্তিত্ব গঠন করে, আপনাকে অনুপ্রাণিত করে এবং আপনাকে উজ্জীবিত করে আপনার কর্মশক্তি বাড়িয়ে দেয়। আপনাকে শক্তিশালী ও কর্মক্ষম অনুভূত করায়।

সকালে উঠেই কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজ সম্পন্ন করার মাধ্যমে আপনি নিজেকে ‘দ্য জোন’ তথা ‘নির্দিষ্ট বলয়ে’ নিয়ে যাচ্ছেন। ফলে আপনি সারাদিন অধিক সংখ্যক গুরুত্বপূর্ণ কাজ সম্পাদনের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করছেন।


ফলাফলে মনোনিবেশ করুন

নিজেকে বারবার জিজ্ঞেস করুন, ‘সবাই আমার থেকে কী রকম ফলাফল আশা করছে?’ যেই ফলাফল অর্জন করতে হবে সেই কাজগুলোই আপনার জন্য সর্বাধিক তাৎপর্যপূর্ণ এবং আপনার এক্ষুনি সেই কাজগুলো শুরু করে দেওয়া উচিত। তবে সেই কাজগুলো কী যা করলে আপনার পেশাগত জীবনকে উন্নতির শিখরে নিয়ে যেতে পারবেন?

এই প্রশ্নের উত্তর পেলেই সেই কাজটি আরম্ভ করুন এবং শেষ না হওয়া পর্যন্ত চালিয়ে যান। এই অভ্যাস গঠন করতে পারলে আপনি দ্রুত থেকে দ্রুততর সময়ে নিজের কর্মক্ষেত্রের সবচেয়ে সফল ও দক্ষ ব্যক্তিতে রূপান্তরিত হতে পারবেন।


অনুশীলনী


১) কাগজে-কলমে চিন্তা করুন। লেখার অভ্যাস করুন। সবসময় লিস্ট দেখে, আরও ভালো হয় চেকলিস্ট দেখে কাজ করুন।

২) নিজের ‘বৃহৎ তিন’ নির্ধারণ করুন যাদের ওপর আপনার ৯০ ভাগ সাফল্য নির্ভর করবে।

৩) প্রতিদিন সকালে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজে নিজের মূল্যবান সময় ব্যয় করার অভ্যাস গড়ে তুলুন। কাজ শতভাগ শেষ না হওয়া পর্যন্ত কাজ ছেড়ে উঠবেন না।


 




অধ্যায় ৬



ইতিবাচক চিন্তা বনাম নেতিবাচক চিন্তা


নিজেকে অন্যের ধারণার চেয়েও উচ্চ অবস্থানে বিবেচনা করুন। নিজেকে ছাড় দিবেন না। নিজেকে করুনা করবেন না। নিজের প্রতি কঠোর হোন আর অন্যের প্রতি সহনশীল।

- হেনরি ওয়ার্ড বিচার


সর্বশ্রেষ্ঠ দার্শনিক অ্যারিস্টটল মানুষের আচরণ নিয়ে যেকোনো মানুষের চাইতে বেশি গবেষণা করেছেন। তিনি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে মানুষের চূড়ান্ত আকাক্সক্ষা হলো সুখ প্রাপ্তি। তিনি বলেন মানুষ যেভাবেই ব্যাখ্যা করুক না কেন সে প্রতিটি পদক্ষেপ আসলে এই সুখ অর্জনের উদ্দেশ্যেই নিয়ে থাকে।

আপনি একটি ভালো চাকুরি চান। কেন? অর্থ উপার্জন করার জন্য। কেন? নিজের ও নিজের পরিবারের জন্য একটি স্বচ্ছল জীবন পাওয়ার জন্য। কেন? ব্যক্তিগত ও আর্থিক সুরক্ষা লাভের জন্য। কিন্তু কেন? কারণ যাতে আপনি সুখী হতে পারেন।


প্রকৃত উপায়

বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই জীবনের প্রকৃত সাফল্য নির্ভর করে আপনি কতটা সুখী তার ওপর । আপনি যদি ধনী, বিখ্যাত ও প্রভাবশালী হওয়ার পরেও সুখী না হোন তবে মানুষ হিসাবে আপনি ব্যর্থ।

বিভিন্ন মানুষ বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করলেও মানুষের প্রতিটি পদক্ষেপ, প্রতিটি কাজই আসলে চরম সুখ অর্জনের প্রচেষ্টা মাত্র। তার মানে এই নয় যে প্রতিটি কাজের ফলেই সুখ অর্জন করা যায়। অনেকেই সুখ অন্বেষণ করতে গিয়ে জীবনে বিপর্যয় ডেকে আনে। এমনকি যারা কোনো পদক্ষেপ নেয়নি তারা তাদের চেয়েও বেশি অসন্তুষ্ট ও অসুখী হয়ে পড়ে। এরা অনিচ্ছাকৃত ফলাফল নীতি ও বিপথগামী ফলাফল নীতির উদাহরণ।

ভালোবাসা, আনন্দ, শান্তি , উচ্ছ্বাস, সাফল্য ও নিজের প্রতিভার সম্পূর্ণ বিকাশের মতো ইতিবাচক অনুভূতিগুলো অর্জনই মূলত সকলের প্রধান ও প্রকৃত লক্ষ্য।


সফল মানুষ কী করে?

সফল মানুষ সবসময় ইতিবাচক চিন্তা করে। আর তাই তারা সাধারণ মানুষের চাইতে বেশি সুখী, অমায়িক ও বিখ্যাত। তারা অন্যদের চেয়ে বেশি জীবনের আশ্বাস গ্রহণ করে থাকে।

ইতিবাচক চিন্তার বিপরীত হলো নেতিবাচক চিন্তা। যারা নেতিবাচক চিন্তা করে তারা সন্দেহপ্রবণ ও শত্রুভাবাপন্ন হয়ে থাকে। তারা কাউকে বিশ্বাস করে না। তারা ধরেই নেয় তাদের সাথে সবসময় খারাপ কিছুই হবে। তাদের দৃষ্টিভঙ্গি নেতিবাচক এবং তারা নিজের ও অন্যের সমালোচনায় ব্যস্ত থাকে। যাই ঘটুক না কেন তারা কিছুতেই সন্তুষ্ট হয় না। তাদের কাছে জীবন হলো অগণিত সমস্যার সমষ্টি যার ওপর তাদের কোন নিয়ন্ত্রণ নেই।

অনেক বছর আগে যখন নিজেকে প্রশ্ন করেছিলাম, ‘কেন কিছু মানুষ অন্যদের চেয়ে বেশি সফল ও সুখী?’, তখন থেকেই ইতিবাচক ও নেতিবাচক অনুভূতির মধ্যকার পার্থক্য নিয়ে গবেষণা শুরু করেছিলাম। আর এই গবেষণার ফল আমার জীবন বদলে দিয়েছিল।


এক মহান আবিষ্কার

আমি আবিষ্কার করেছিলাম, মানুষ যেভাবেই ব্যাখ্যা করে থাকুক না কেন সকলেই আসলে সুখী হতে চায়। আর এই সুখ অর্জনের পথে প্রধান অন্তরায় হলো নেতিবাচক অনুভূতি। মানব জীবনের সকল সমস্যার মূলে রয়েছে এই নেতিবাচক অনুভূতি। যদি কোনো উপায়ে এই নেতিবাচক অনুভূতিগুলো দূর করা যেত তাহলে মানবজাতির অধিকাংশ সমস্যা সমাধান হয়ে যেত।

এটা করার একটি উপায় আছে। প্রকৃতি শূন্যতা পছন্দ করে না। মস্তিষ্ক থেকে নেতিবাচক অনুভূতি সরিয়ে দিলে সেই জায়গা আপনাআপনি ইতিবাচক অনুভূতি দ্বারা পূর্ণ হয়ে যাবে। নেতিবাচক অনুভূতি অপসারণ করতে পারলে আপনি একজন স্বয়ংসম্পূর্ণ মানুষ হয়ে উঠবেন, নিজের প্রতিভার সম্পূর্ণ বিকাশ ঘটাতে পারবেন।

জীবনের প্রধান কাজ হলো নেতিবাচক অনুভূতি অপসারণ করা।


এক সময় একটি চিন্তা

ইতিবাচক কিংবা নেতিবাচক― আপনার মস্তিষ্ক এক সময় একটি মাত্র চিন্তাই ধারণ করতে পারে। যদি মনে ইতিবাচক ধারণা পোষণ করতে না পারেন তবে সেই জায়গায় নেতিবাচক ধারণা এসে ভর করবে, প্রাথমিক ভাবে হলেও। নেতিবাচক চিন্তা করা খুব সহজ, তাই এটা সহজেই মানুষের ওপর ভর করতে পারে।

অভ্যাস না হওয়া পর্যন্ত ইতিবাচক চিন্তা ধারণ করার জন্য প্রয়োজন দৃঢ় প্রতিজ্ঞা ও কঠোর প্রচেষ্টা। সৌভাগ্যসবশত নিয়মিত শিক্ষা ও চর্চার মাধ্যমে আপনি একজন প্রকৃত ইতিবাচক চিন্তার অধিকারী মানুষ হয়ে উঠতে পারবেন।

নেতিবাচক অনুভূতি অপসারণের প্রথম ধাপ হলো চিন্তার উৎস খুঁজে বের করা। সুখবর হলো কোনো শিশুই ভীতি কিংবা নেতিবাচক চিন্তা নিয়ে জন্মগ্রহণ করে না। বেড়ে ওঠার সময় সে এই ভীতি ও নেতিবাচক চিন্তার শিক্ষা আশেপাশের পরিবেশ থেকে পায়। আর এই শিক্ষার কারণেই এগুলো সহজে ভোলা যায় না।

যেহেতু এই নেতিবাচক অনুভূতিগুলো মানুষ ও পরিস্থিতি দেখে প্রতিক্রিয়া দেখানোর স্বভাবসুলভ উপায়, তাই গঠনমূলক প্রতিক্রিয়া শিক্ষার মাধ্যমে এদের প্রতিস্থাপন করা সম্ভব। এটা শুধুই ইচ্ছার ব্যাপার।

আব্রাহাম লিংকন বলেছেন, ‘বেশির ভাগ মানুষই তত সুখী, যত সুখী তারা নিজেদের চিন্তা করে।’

 

একটি সদ্যজাত শিশু

শিশুরা অসাধারণ বৈশিষ্ট্য, নির্ভীকতা ও স্বতঃস্ফূর্ততা নিয়ে জন্মায়। একটি সদ্যজাত শিশু সম্পূর্ণ ভয়ভীতিহীন। বেড়ে ওঠা শিশু যেকোনো কিছু এমনকি ভয়ঙ্কর জিনিসও স্পর্শ করতে অথবা স্বাদ নিতে ভয় পায় না, নতুন কিছু চেষ্টা করতে সে পিছপা হয় না। অভিভাবকদের প্রথম কয়েক বছর সময় শুধু শিশুদের নিজের ক্ষতি করা থেকে বিরত রাখতেই ব্যয় করতে হয়।

একটি শিশু জন্মগতভাবেই স্বতঃস্ফূর্ত। সে কোনো বাধা বা সীমা ছাড়াই হাসে, কাঁদে, প্র¯্রাব ও মলত্যাগ করে। দিন রাত চব্বিশ ঘণ্টা নিজের সব অনুভূতি সম্পূর্ণভাবে প্রকাশ করে। কে কী ভাবল তা নিয়ে সে মাথা ঘামায় না। তার কিছুই যায় আসে না।


ব্যর্থতা ও সমালোচনার ভীতি

অল্পবয়সী শিশুরা বেড়ে ওঠার সময় তাদের অভিভাবকদের ভুল থেকে প্রাপ্তবয়স্ক জীবনের দুটি প্রধান ভয় শেখে― ব্যর্থতার ভয় এবং সমালোচনার ভয়। যখন একজন অভিভাবক তার সন্তানকে বলে, ‘না! থামো! এটা করো না! সরে এসো ওখান থেকে!’ এমনকি শিশুকে শারীরিক ও মানসিক ভাবে শাস্তিও দিয়ে থাকে তখন সেই শিশুর নির্ভীকভাবে তার পৃথিবীকে অনুসন্ধান করার প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়। পাশাপাশি তার মনে এটাও ঢুকে যায় যে সে আসলে ক্ষুদ্র ও অযোগ্য।

আর তাই দ্রুতই সে নতুন কিছু করা থেকে বিরত হওয়া শুরু করে। নতুন কিছু দেখলেই সে বলতে থাকে, ‘আমি পারব না, পারব না, পারব না’।

এই ‘আমি পারব না’ অনুভূতি ব্যর্থতার ভয়ে রূপ নেয়। প্রাপ্তবয়স্ক অবস্থায় এই ধারণা আরও বদ্ধমূল হয়ে ক্ষতি কিংবা দারিদ্রের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে পড়ে। একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ অর্থ, সময়, নিরাপত্তা, সম্মতি, ভালোবাসা, স্বাস্থ্য ইত্যাদি হারানোর ভয়ে থাকে। সে দারিদ্রতাকে ভয় পায়। এই সমন্বিত ভীতি প্রথমে একজন শিশুর এবং পরবর্তীতে একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের পূর্ণ বিকাশের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এটি জীবনে সাফল্য অর্জনের পথে সবচেয়ে বড় অন্তরায়।

 

সমালোচনা ভীতি

শিশুরা দ্রুতই তাদের স্বতঃস্ফূর্ততাও হারিয়ে ফেলে। অভিভাবকদের অন্যতম ভুল হলো তারা সন্তানদের তখনই ভালোবাসা ও মমতা দেখিয়ে থাকেন যখন তারা তাদের কথামতো চলে। এই কারণে শিশুরা অল্প বয়সেই সমালোচনা ও প্রত্যাখ্যানের ভীতি অর্জন করে। তার কথা মতো না চললে যখন একজন অভিভাবক ক্ষিপ্ত হয়ে তার সন্তানকে নিজের ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত করার ভয় দেখায় তখন সন্তানটি ভাবে, ‘বাবা-মা যা বলে আমাকে তাই করতে হবে, নইলে তারা আমাকে ভালোবাসবে না।’ এর কারণ― একজন শিশুর অস্তিত্বের প্রধান অংশ হলো পিতামাতার মমতা ও নিরাপত্তা। এই মমতা হারানোর শঙ্কা তাদের জন্য অত্যন্ত ভীতিকর। আর তাই তারা বাবা-মা অপছন্দ করে এমন কাজ করা থেকে নিজেদের বিরত রাখতে শুরু করে।


প্রতিসংহৃত (দমনকারী) ভালোবাসা

সাধারণভাবে মনোবিজ্ঞানীগণ এই বিষয়ে একমত যে প্রাপ্তবয়স্ক জীবনের সিংহভাগ সমস্যার মূল কারণ হলো শৈশবের ‘প্রতিসংহৃত (দমনকারী) ভালোবাসা’ বা ‘লাভ উইথহেল্ড’ (খড়াব ডরঃযযবষফ)। শৈশবে ‘ভালোবাসার অভাব’ কিংবা ভালোবাসা দিয়ে এরপর তা প্রতিসংহৃত (নিবারণ বা দমন) করা প্রাপ্তবয়স্ক জীবনকে ব্যাপকভাবে বিকৃত করতে পারে।

গোলাপের প্রস্ফুটিত হওয়ার জন্য যেমন বৃষ্টি প্রয়োজন তেমনি একজন শিশুর বিকাশের জন্য প্রয়োজন ভালোবাসা, মায়া-মমতা ও যতœ। অপরিসীম ও নিঃস্বার্থ ভালোবাসা না পেলে একজন শিশু মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে গড়ে ওঠে এবং শীঘ্রই সবরকম নেতিবাচক অনুভূতির বশবর্তী হয়ে পড়ে।

অ্যালেকজান্ডার পোপ লিখেছেন, ‘ডাল বাঁকালে গাছও নুয়ে পড়ে।’ নেতিবাচক শৈশব নেতিবাচক যৌবনে পরিণত হয়।


ঘাটতি ও প্রয়োজনীয়তা

মনোবিজ্ঞানী আব্রাহাম মাসলো, যিনি আত্ম-উপলব্ধ বা স্ব-নির্মিত (ংবষভ-ধপঃঁধষরুরহম) মানুষের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে গবেষণা করেছেন, এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে ৯৮ ভাগ প্রাপ্তবয়স্ক লোক ‘ঘাটতি চাহিদা’ (ফবভরপরবহপু হববফং) দ্বারা চালিত হয়। নিজের প্রতিভার পূর্ণ বিকাশ ঘটানোর পরিবর্তে তারা সারাজীবন তাদের আপাত ঘাটতি পূরণেই ব্যয় করে দেয়। তাদের প্রধান ভাবনা হলো ‘আমি অযোগ্য’।

মাসলো বলেন মাত্র দুই ভাগ মানুষই ‘আত্ম-চাহিদা’ (নবরহম হববফং) অনুভব করে। তিনি আত্ম-চাহিদাকে নিজের প্রতিভা অনুধাবন করার আত্মবিশ্বাস এবং সেই প্রতিভার পূর্ণ বিকাশের আকাক্সক্ষা বলে ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি আমাদের সমাজের এই উচ্চ আত্মবিশ্বাস ও আত্মসম্মান ধারণকারী মানুষদের ‘আত্ম-উপলব্ধ বা স্ব-নির্মিত’ মানুষ বলে আখ্যায়িত করেছেন।


রাশিয়ান মেটাফিজিশিয়ান তথা অধ্যাত্মতত্ত্ববিৎ

প্রায় একশ বছরেরও আগে পিটার অস্পেন্সকি এবং জি.আই. গার্ডজিয়েফ নামক দুজন রাশিয়ান মেটাফিজিশিয়ান তথা অধ্যাত্মতত্ত্ববিৎ (আত্মবিদ্যাচর্চাকারী), তাদের ছাত্রদের ভেতরকার নেতিবাচক অনুভূতি সনাক্ত এবং অপসারণের জন্য একটি শিক্ষামূলক পদ্ধতি গঠন করেন। আধুনিক মনোবিজ্ঞানিদের মতো তারাও এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে সব নেতিবাচক অনুভূতি দূর করা হলে যা থাকে তা হলো পরিপক্ক, কার্যকরী, পূর্ণরূপে ইতিবাচক, আত্ম-উপলব্ধ বা স্ব-নির্মিত একজন মানুষ। দেখা গেছে এই অবস্থায় পৌঁছানোই অধিকাংশ মানুষের জীবনের মূল লক্ষ্য।

তাহলে প্রাপ্তবয়স্ক জীবনের নেতিবাচক অনুভূতিগুলোর কারণ কী? অনেক কারণ রয়েছে। চলুন সেগুলো নিয়ে আলোচনা করা যাক।


নেতিবাচক অনুভূতির মূল কারণসমূহ

১। যুক্তি: নেতিবাচক অনুভূতির উৎপত্তি হয় যখন আমরা কোনো অপ্রীতিকর আচরণ কিংবা ঘটনাকে যৌক্তিক বানানোর চেষ্টা করি। যুক্তির সংজ্ঞা হলো, ‘একটি অপ্রীতিকর ঘটনার প্রীতিকর ব্যাখ্যা।’

আমাদের জীবনের লক্ষ্য, সাফল্য ও সুখ অর্জনের পথে যেই নেতিবাচক আচরণগুলো বাধা তাদের আমরা যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করি। আমরা অসাধুতাকে এই বলে ব্যাখ্যা করি যে, ‘সবাই তো তাই করে।’ আমরা স্থূলতাকে এই বলে ব্যাখ্যা করি যে, ‘এটা আমার জিন কিংবা হরমোনের দোষ।’ আমরা অলসতা, বিলম্ব, স্ব-শৃঙ্খলার অভাব এবং বাজে কর্মদক্ষতাকে এই বলে যৌক্তিকতা দান করি যে, ‘আমি তো এমনই।’ এরপর নিজেদের এমন মানুষের সাথে তুলনা করি যারা আমাদের চেয়েও খারাপ অবস্থানে আছে, যাতে আর আত্মউন্নয়ন করতে না হয়।

এভাবে প্রতিনিয়ত আমাদের নেতিবাচক আচরণকে যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করার মাধ্যমে আমরা দুঃখী ও অসন্তুষ্ট হয়ে পড়ি। ফলে জীবনে উন্নতি করতে ব্যর্থ হই।

২। ন্যায্যতা: নেতিবাচক অনুভূতির আরেকটি প্রধান উৎস হলো আমাদের নেতিবাচক অনুভূতিগুলোকে ন্যায্যতা প্রদানের স্বভাব। আমরা আমাদের নেতিবাচক আচরণগুলোকে কোনো না কোনোভাবে ব্যাখ্যা করে তাদের ন্যায্য বলে দাবি করার চেষ্টা করি। নিজেদের ও অন্যদের বলি, আমার সাথে এই ঘটনা ঘটেছে কিংবা কেউ আমার সাথে অমন করেছে বলে আমি এমন করেছি, আর তাই আমার আচরণটি ন্যায্য।

ন্যায্যতা আমাদের এবং অন্যদের জীবনে বিদ্যমান সমস্যাগুলোকে দীর্ঘায়িত করে। যদি কোনো নেতিবাচক অনুভূতি কিংবা আচরণকে ন্যায্যতা দান করতে না পারেন তবে সেটি তৎক্ষণাৎ বিলীন হয়ে যাবে।

৩। বিচারবিবেচনা: অন্য মানুষকে বিচার করার অভ্যাস থেকে অনেক নেতিবাচক অনুভূতি জন্ম নেয়। আমরা নিজেদের বিচারক, বাদী, ও জল্লাদ ধরে নিই। আমরাই ঠিক করে নিই কেউ ভুল করল কি করল না এবং আমরাই তাদের ক্ষমা কিংবা শাস্তির হিসাব করার সিদ্ধান্ত নিই।

এজন্য বাইবেলসহ অন্যান্য ধর্মগ্রন্থে বলা হয়েছে, ‘অন্যের বিচার করতে হলে নিজেকেও বিচার করতে হবে।’ অর্থাৎ আপনি অন্যের কাজকে বিচার করার সময় আসলে নিজেরই বিচার করছেন। অন্যকে বিচার করে তাকে দোষী সাব্যস্ত করতে পারলেও তাকে নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখার মাধ্যমে আপনি আসলে নিজেকেও সেই একই নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখছেন। অন্যের প্রতি থাকা নেতিবাচক অনুভূতি নিজের প্রতিও সঞ্চারিত হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় যাকে নিয়ে এত চিন্তা করছেন সে আপনার মনোভাব কোনোদিন জানতেই পারবে না। যার ওপর আপনি রাগ করে আছেন তার আপনার রাগে কিছুই আসে যায় না।

৪। সংবেদনশীলতা (যুঢ়বৎংবহংরঃরারঃু): শৈশবে প্রত্যাখ্যান ও সমালোচনা ভীতি গঠনের ফলে অনেক মানুষই বড় হয়ে অন্যের চিন্তা, অনুভূতি ও আচরণের প্রতি সংবেদনশীল হয়ে পড়ে। আমরা এমন সব সমালোচনা ও অসমাদর দেখতে আরম্ভ করি যার বাস্তবে কোন অস্তিত্বই নেই। কে আমাদের নিয়ে কী ভাবল তার প্রতি আমরা অতি সংবেদনশীল। পাছে লোকে কী বলে এই ভয়ে আমরা অনেক সময়ই নিজের পছন্দমতো কাজ করা থেকে নিজেদের বিরত রাখি।

বিক্রয় ও ব্যবসায় আমরা প্রতিনিয়ত এমন সব সম্ভাব্য ক্রেতার মুখোমুখি হয়ে থাকি যারা তাদের পরিবার কিংবা প্রতিষ্ঠানের এক বা একাধিক মানুষের পরামর্শ বা অনুমতি না নিয়ে কিছু ক্রয় করার সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। চরম মাত্রার সংবেদনশীলতা মানুষকে অসাড় করে তাদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা পুরোপুরি ধ্বংস করে দিতে পারে।


নেতিবাচক অনুভূতির কারণ

নেতিবাচক অনুভূতিগুলো শেষ পর্যন্ত ক্রোধে রূপ নেয়, এই ক্রোধ হয় ভেতরে জমতে থাকে নইলে বাইরে প্রকাশ পায় যা অন্যদেরও ক্রোধান্বিত করে।

অধিকাংশ মানসিক ও মনোদৈহিক সমস্যার কারণ জমে থাকা এবং চেপে রাখা নেতিবাচক অনুভূতি, নেতিবাচক অনুভূতি থেকে জন্ম নেওয়া বিষণœতা, অন্যদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া নেতিবাচক অনুভূতি এবং নেতিবাচক অনুভূতির ফলে সৃষ্ট ক্রোধ। আমরা অনেক সময় এই নেতিবাচক অনুভূতিগুলো হতে সৃষ্ট রাগ অন্যের ওপর চাপিয়ে দিই অথচ বাস্তবে এই রাগটা আসলে নিজের ওপরেই।

আমাদের সমাজের মূল নেতিবাচক অনুভূতিগুলো হলো আগের অংশে আলোচনা করা সেই ভীতিগুলো। আরও দুটি অনুভূতি আছে যা পৃথিবীর বেশির ভাগ সমাজের রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকে চালিত করে। এগুলো হলো: হিংসা ও অসন্তোষ। এছাড়াও রয়েছে হীনমন্যতা থেকে উৎপন্ন ঈর্ষা যা মানুষকে ভাবতে বাধ্য করে, ‘আমাকে কেউ ভালোবাসতে পারে না।’ আরও রয়েছে ঘৃণা, সন্দেহ, শত্রুতা ও অবিশ্বাস।


নেতিবাচক অনুভূতির বৃক্ষ

একটি ‘নেতিবাচক অনুভূতির বৃক্ষ’ কল্পনা করুন। এই বৃক্ষে থাকা প্রতিটি ফল হলো যত রকম নেতিবাচক অনুভূতি রয়েছে তার প্রতিরূপ। এই নেতিবাচক অনুভূতি দূর করতে হলে আপনাকে এই বৃক্ষটি কেটে ফেলতে হবে।

এবার একটি যুগান্তকারী কথা জানাই আপনাদের― এই গাছের গুঁড়িটি হলো দোষারোপ। কাউকে কোনো কিছু করা বা না করার জন্য দোষারোপ করা ছাড়া নেতিবাচক অনুভূতিসমূহ অনুভব করা অসম্ভব। যখনই এই দোষারোপ করা বন্ধ করে দিবেন, আপনার সকল নেতিবাচক অনুভূতি সম্পূর্ণ বিলীন হয়ে যাবে।

দোষারোপ করার অভ্যাস দূর করুন

কীভাবে দোষারোপ করা বন্ধ করা সম্ভব? উত্তরটি খুব সহজ ও যুগান্তকারী। অন্য কাউকে নেতিবাচক অনুভূতির জন্য দোষারোপ করে একই সময়ে সেই পরিস্থিতির দায়িত্ব নিজের ওপর নেওয়া অসম্ভব। যেকোনো পরিস্থিতি মেনে তার দায়িত্ব নিজের ওপর নেওয়াটাই সেই পরিস্থিতির সাথে সংশ্লিষ্ট সকল নেতিবাচক অনুভূতিকে দূরীভূত করে দেয়।

এখন কীভাবে এই দায়িত্ব নেওয়া সম্ভব? আপনাকে শুধু এই জাদুকরি বাক্যটি বলতে হবে, ‘আমি দায়ী’,

এই ইতিবাচক, বর্তমান কালে বলা সম্মতি তৎক্ষণাৎ আপনার সকল নেতিবাচক অনুভূতিকে ধ্বংস করে দিবে।

কারণ আপনার মস্তিষ্ক একই সময়ে কেবল একটি চিন্তাই করতে পারে― ইতিবাচক অথবা নেতিবাচক। আপনি যেকোনো সময়ে যেকোনো নেতিবাচক অনুভূতি কেবল একটি কথার পুনরাবৃত্তি করার মাধ্যমেই দূর করতে পারেন― ‘আমি দায়ী! আমি দায়ী! আমি দায়ী!’

আপনার ক্রিসমাস ট্রি এর সকল বাতি কীভাবে এক সাথে নেভাতে পারবেন? সহজ! আপনাকে ইলেকট্রিক কর্ডটা সকেট থেকে বের করে ফেলতে হবে। তাহলেই সব বাতি একসাথে বন্ধ হয়ে যাবে।

কীভাবে সকল নেতিবাচক অনুভূতি দূর করবেন ? উত্তর একই। শুধু নিজেকে বলুন― ‘আমি দায়ী!’

তাহলেই সকল নেতিবাচক অনুভূতি সঙ্গে সঙ্গে দূর হয়ে যাবে।


শতভাগ দায়িত্ব গ্রহণ করুন

আত্মসম্মান, আত্মবিশ্বাস, স্ব-নির্ভরতা ও আত্মমর্যাদা অর্জনের মূল চাবিকাঠি হলো জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সকল পরিস্থিতির শতভাগ দায়িত্ব গ্রহণ করা। যখনই কোনোরকম অজুহাত ব্যতীত পূর্ণ দায়িত্ব গ্রহণ করবেন তখনই নিজেকে শান্ত, স্বচ্ছ ও ইতিবাচক অবস্থায় পাবেন। আপনার জীবনের সূর্য উঠবে এবং সকল অন্ধকার দূরীভূত হবে।

নেতিবাচক অনুভূতি দূরীকরণ পদ্ধতির আরেকটি অংশ হলো― ক্ষমা। প্রতিটি মানুষই জীবনে কারও না কারও দ্বারা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। আমরা সকলেই শৈশবে কঠিন অবস্থার সম্মুখীন হয়েছি, বেড়ে ওঠার সময় নেতিবাচক অভিজ্ঞতা লাভ করেছি, কষ্টদায়ক সম্পর্কে জড়িয়েছি, ভালো চাকুরি পাইনি, ভুল বিনিয়োগ করেছি। সকলেই প্রতারণা, মিথ্যা, দুঃখ, অত্যাচার এবং অন্যায়ের শিকার হয়েছি। দুর্ভাগ্যবশত এসব স্বাভাবিক, প্রাকৃতিক ও জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাহলে প্রশ্ন হলো, ‘এক্ষেত্রে আপনার কী করার আছে?’


স্বচ্ছন্দে ক্ষমা করুন এবং ভুলে যান

উত্তরটি হলো― নিজে মুক্ত হতে চাইলে আপনার অন্যদেরকেও মুক্ত করতে হবে। সুখী হতে চাইলে আপনাকে যারা কষ্ট দিয়েছে তাদের ক্ষমা করে দিতে হবে। আপনাকে প্রকাশ্যে, অবাধে ও সম্পূর্ণরূপে সকলের প্রতি থাকা সকল নেতিবাচক অনুভূতি ত্যাগ করতে হবে। সবার জন্য সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করতে হবে।

বর্তমানে আমার সেমিনার ও ওয়ার্কশপে অংশ নেওয়া অনেকেই আমার যুক্তি শুনে সকলকে ক্ষমা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যদি ক্ষমায় বিশ্বাস স্থাপন করে থাকেন তবে পরবর্তী প্রশ্ন হলো, ‘কাকে ক্ষমা করবেন?’

তিন ধরনের মানুষকে ক্ষমা করতে হবে:

১। অবশ্যই নিজের মাতাপিতাকে ক্ষমা করবেন। তাদের ক্ষমা করে মুক্ত করে দিন। আপনাকে পালন করার সময় তারা যত ভুল করেছে সব ক্ষমা করে দিন।

অনেক শিশুই এই ধারণা নিয়ে বেড়ে ওঠে যে তাদের পালনকারী বাবা-মা’কে অবশ্যই নিখুঁত মানুষ হতে হবে। কিন্তু সত্য হচ্ছে বাবা-মা’রা সাধারণ মানুষ। তারা ভুলত্রুটির উর্ধ্বে নন। অজ্ঞানতা ও অনভিজ্ঞতার কারণে তারাও অনেক ভুল করে থাকেন।

তাই আপনাকে লালনপালনে তারা যেসকল ভুল ত্রুটি করেছেন সেসব ভুলে তাদের ক্ষমা করে দিন। তাদের সম্পূর্ণরূপে মুক্ত করে দিন। আরও ভালো হয় যদি তাদের সামনে গিয়ে তাদের এই কথা জানাতে পারেন। তাদের মুক্ত করে নিজেও মুক্তি লাভ করুন।

২। আপনাকে যেসকল মানুষ যত ভাবে কষ্ট দিয়েছে তাদের ক্ষমা করুন। ব্যক্তিগত, ব্যবসায়িক, বৈবাহিক সম্পর্ক যা আপনাকে তীব্রভাবে যন্ত্রণা দিয়েছে তার সাথে সম্পর্কিত সকলকে ক্ষমা করুন। আপনাকে এটা অবশ্যই করতে হবে।

যাদের কথা ভেবে আপনি কষ্ট পান এবং আপনার মাঝে নেতিবাচক অনুভূতির জন্ম হয় তাদের সবার জন্য সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করুন। তাদেরকে শাস্তি দেওয়া কিংবা প্রতিশোধ নেওয়ার সকল ইচ্ছা পরিত্যাগ করুন।

মনে রাখবেন, আপনি তাদের জন্য নয়, নিজের জন্য তাদের ক্ষমা করছেন। ক্ষমা বস্তুত একটি স্বার্থপর কাজ। আপনি আসলে নিজেকেই ক্ষমা করছেন। ক্ষমার মাধ্যমে তাদের মুক্ত করে একই সময়ে নিজেকেও মুক্তি দিচ্ছেন।

৩। সবশেষে নিজেকে অবশ্যই ক্ষমা করুন। জীবনে যত ভুল, খারাপ, বোকামি, অবিবেচক কাজ করেছেন যা অন্যের এবং নিজের কষ্টের কারণ হয়েছে সেসবের জন্য নিজেকে ক্ষমা করুন।

মনে রাখবেন, একদিন যে অন্যকে কষ্ট দিয়েছিলেন আপনি আজ আর সেই মানুষটি নন। আজকে আপনি যেই মানুষে পরিণত হয়েছেন সেই মানুষটি এমন কাজ কখনোই করবে না।


সবকিছু থেকে মুক্ত হোন

জীবনে যত ভুল করেছেন সবকিছুর জন্য নিজেকে ক্ষমা করে নিজেকে সেসব বোঝা থেকে মুক্ত করুন। আপনার অন্তর অবশ্যই কলুষিত নয়। আপনি বাস্তবিকই একজন ভালো মানুষ। আগে যা ভুল করেছেন তার কারণ ছিল অল্প বয়স, অনভিজ্ঞতা, অজ্ঞানতা ও অবিবেচনা। কিন্তু এখন সেই দিন আর নেই। এগুলো কেবলই অতীত। এসব ভুলে যান আর নিজেকে মুক্ত করুন।

হেলেন কেলার বলেছেন, ‘যখন সূর্যের দিক মুখ করে দাঁড়াবেন তখন সকল ছায়া পিছনে পড়ে রইবে।’

যদি একজন পূর্ণ ইতিবাচক মানুষ হতে চান তবে আপনার প্রধান কাজ হলো অতীতের অন্ধকার ভুলে আলোর দিকে এগিয়ে চলা। একজন পূর্ণ ইতিবাচক মানুষে পরিণত হোন। জীবনে কী চান তা নিয়ে ভাবুন। মানুষ হিসাবে আপনি কতটা অসাধারণ এবং ভবিষ্যতে আরও কতটা অসাধারণ হতে পারেন সেই চিন্তায় মনোনিবেশ করুন।


 

দ্য ট্রিপ ক্লজ

এই উপায়গুলো নিয়ে আমি প্রায় ১০ লাখ মানুষের সাথে কাজ করেছি। তাদের প্রায় সকলেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে তারা ক্ষমা করবে, ভুলে যাবে এবং মুক্ত হবে। কিন্তু এর সাথে সাথে তারা নিজেদের মাঝে ধ্বংসের বীজও বপন করেছে।

তারা এমনটা বলে থাকে, ‘জীবনে যারা আমাকে যত ভাবে কষ্ট দিয়েছে আমি তাদের সকলকে ক্ষমা করে মুক্ত করে দিলাম (শুধু এই মানুষ বা এই ঘটনা বাদে)।’

সকল ধরনের মানসিক ও মনোদৈহিক সমস্যার মূলে রয়েছে কোনো একটি নেতিবাচক ঘটনা যার কারণে আপনি এখনও ক্রোধান্বিত এবং যা আপনি ভুলতে ও ক্ষমা করতে পারছেন না।


নতুন মার্সেডিজ-বেঞ্জ

একটি উদাহরণ দিই। মনে করুন, আপনি কারখানা থেকে একটি নতুন মার্সেডিজ-বেঞ্জ গাড়ি অর্ডার করেছেন। গাড়িটি পাওয়ার পর দেখলেন সেটি সবদিক থেকে নিখুঁত, কেবল একটি দিক বাদে। গাড়ি তৈরির সময় কোনোভাবে ইঞ্জিনিয়াররা গাড়ির সামনের চাকার একটি ব্রেক ভুল জায়গায় বসিয়েছে। এর ফলে ব্রেক লক হয়ে গেছে এবং চাকা ঘুরছে না।

আপনি নতুন মার্সেডিজ-বেঞ্জে চড়ে ইগনিশন কি (রমহরঃরড়হ শবু) চালু করলেন। আপনি ইঞ্জিন চালু করে গিয়ার শিফট করলেন, একসিলেটরে চাপ দিলেন। কী হবে? আপনার সামনের চাকার একটি ব্রেক যদি লক থাকে তাহলে আপনার চমৎকার গাড়িটি শুধু একই জায়গায় গোল গোল ঘুরতে থাকবে। আপনি স্টিয়ারিং হুইল ঘুরিয়ে গ্যাসে চাপ দিতে পারেন, কিন্তু তা-ও গাড়িটি একই জায়গায় ঘুরতে থাকবে। ফলে আপনি কোথাও যেতে না পেরে একই জায়গায় পড়ে থাকবেন। যত বেশি গ্যাসে চাপ দিবেন তত বেশি আপনার ইঞ্জিন ও পিছনের চাকা ক্ষয় হতে থাকবে।


 

ব্রেক কষা

আপনার জীবনের ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে। যদি জীবনে একজন মানুষকেও ক্ষমা করতে ব্যর্থ হোন তবে গাড়ির চাকার মতো আপনার জীবনও একই জায়গায় আটকে থাকবে। আপনি একই জায়গায় বারবার ঘুরতে থাকবেন। আপনি শারীরিক ও মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হবেন। আপনি কখনোই প্রকৃত রূপে সুখী হতে পারবেন না, সামনে অগ্রসর হতে পারবেন না। আপনি সারাজীবন কেবল ঐ একটি মানুষের কথাই ভাবতে থাকবেন এবং আপনার জীবন থেকে সেই নেতিবাচক অনুভূতিটি কখনোই দূর হবে না। আপনার মানসিক চাকা আর ঘুরবে না। আটকেই থাকবে।

এই পরিস্থিতি থেকে বের হওয়ার উপায় হলো মানুষের মানসিক ও মনোদৈহিক অসুখ সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা। এক বা একাধিক ঘটনাকে ভুলতে না পারা, মানুষকে তার অতীতে আটকে রাখে। এই এক বা একাধিক ঘটনা ভুলতে অস্বীকৃতি জানালে কখনোই সামনে অগ্রসর হওয়া সম্ভব নয়।

কোন সেই নেতিবাচক মানুষ কিংবা ঘটনা আছে যা আপনি এখনও ভুলতে পারছেন না? তা যাই হোক না কেন আপনার তাকে ভুলে যাবার সাহস ও সামর্থ্য অবশ্যই আছে। যত কষ্টদায়ক ঘটনাই হোক না কেন এই জাদুকরি বাক্যটি বলুন, ‘আমি তাকে সবকিছুর জন্য ক্ষমা করে দিলাম। তাকে মুক্ত করে দিলাম। এর সমাপ্তি এখানেই।’


দায়িত্ব, নিয়ন্ত্রণ ও ইতিবাচক অনুভূতি

জীবনে দায়িত্ব নেওয়ার সাথে জীবন নিয়ন্ত্রণের সরাসরি সম্পর্ক আছে। কারণ প্রায় সব ধরনের হতাশা ও মানসিক চাপের উৎপত্তি ঘটে জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করার ব্যর্থতা থেকে। যখনই জীবনে দায়িত্ব গ্রহণ করতে সমর্থ হবেন তখনই নিজের জীবনের উপর নিয়ন্ত্রণ ফিরে পাবেন।

দায়িত্ব গ্রহণ, নিয়ন্ত্রণ ও ইতিবাচক অনুভূতি একে অপরের সাথে সরাসরি জড়িত। যত বেশি দায়িত্ব নিবেন, ততই জীবনের ওপর নিয়ন্ত্রণ ফিরে পাবেন আর ততই নিজের ও পৃথিবীর প্রতি আপনার ইতিবাচক অনুভূতি বৃদ্ধি পাবে। সবশেষে বলব, ইতিবাচক অনুভূতি ও সুখ সরাসরি সম্পর্কিত। আর এটি সম্পূর্ণ আপনার ইচ্ছার ওপর নির্ভরশীল।

 

নিয়ন্ত্রণ নিন

যখন কোনোকিছুর জন্য অন্যকে দোষারোপ করবেন, তখনই নিজের জীবনের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারাবেন। এই কাজটি করার মাধ্যমে যাকে দোষ দিচ্ছেন তার কাছে নিজের অনুভূতির নিয়ন্ত্রণ দিয়ে দিচ্ছেন, তা সেই ব্যক্তি উক্ত বিষয় সম্পর্কে অবগত হোক আর নাই হোক। কাউকে দোষ দেওয়ার মানে আপনি তাকে নিজের অনুভূতিকে দূর থেকে চালিত করার ক্ষমতা দিচ্ছেন। তাকে ক্ষমা বা মুক্ত না করার ফলে নিজের সুখ ও শান্তি তার নিয়ন্ত্রণে দিয়ে দিচ্ছেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সেই ব্যক্তি এটা জানতেই পারে না যে আপনার সুখ ও শান্তির ওপর তার কতটা নিয়ন্ত্রণ আছে।

অন্যকে দোষারোপ ও সমালোচনা করে আপনি নিজেকে ‘পরিস্থিতির শিকার’ হিসাবে দাবি করছেন। অন্যকে দোষ দেওয়ার ফলে নিজেকে ছোট ও দুর্বল হিসাবে প্রমাণ করছেন। নিজেকে সম্পূর্ণরূপে দায়িত্ববান ও আত্মনির্ভরশীল প্রমাণের বদলে আপনি অন্যের হাতের পুতুল হয়ে পড়ছেন। নিজের অনুভূতি ও জীবনের ওপর আপনার কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকছে না। যখন অন্যকে দোষ দিবেন তখন নিজেকে নেতিবাচক, ক্রোধান্বিত, অসন্তুষ্ট ও দুর্বল অবস্থায় পাবেন। আপনি কি এটাই চান?


জাদুকরি শব্দাবলি নির্বাচন করুন

আনন্দের সংবাদ হলো আপনি যেকোনো সময় এই জাদুকরি শব্দগুলো বলতে পারবেন― ‘আমিই দায়ী’। এই শব্দ চয়নের ফলে আপনি আবার জীবনের নিয়ন্ত্রণ ফিরে পাবেন। আপনার জীবনের চালিকাশক্তি আপনার হাতে চলে আসবে। যখনই কোনো নেতিবাচক অনুভূতি মনে ভর করবে তখনই সেটি দূর করার জন্য বলুন, ‘আমিই দায়ী!’ যতদিন এটি অভ্যাসে পরিণত না হচ্ছে ততদিন এটি বারবার বলতেই থাকুন। দায়িত্ব গ্রহণ করা নেতৃত্বসুলভ এবং স্বনির্ভরশীল মানুষের আচরণ।

আজ থেকেই একজন সম্পূর্ণ দায়িত্ববান, পরিপক্ক ও কার্যকরী মানুষ হওয়ার সংকল্প করুন। শুধু বারবার বলুন, ‘আমিই দায়ী!’ এটাই ইতিবাচক চিন্তার আসল চাবিকাঠি।

 

অনুশীলনী

১) আজ থেকেই একজন সম্পূর্ণ ইতিবাচক মানুষ হওয়ার সংকল্প করুন। যেকোনো মানুষ ও পরিস্থিতির ভালো দিকটি দেখার অভ্যাস করুন। কোনো না কোনো ভালো দিক অবশ্যই খুঁজে পাবেন।

২) আজ থেকে আপনার সুখের পথে বাধা হয় এমন সকল নেতিবাচক অনুভূতি ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিন। আপনার মাঝে রাগ কিংবা হতাশার সৃষ্টি করে এমন সব বিষয় নিয়ে চিন্তা ও আলোচনা করা পরিত্যাগ করুন।

৩) যারা আপনাকে কোনো না কোনোভাবে কষ্ট দিয়েছে তাদের সকলের প্রতি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করুন। ক্ষমা করুন এবং সামনে অগ্রসর হোন।


 




অধ্যায় ৭



অনমনীয় চিন্তা বনাম নমনীয় চিন্তা


যেই ব্যক্তি ব্যবসায়ে উন্নতির সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছাতে চায় তাকে অবশ্যই অভ্যাসের শক্তি এবং গুরুত্ব অনুধাবন করতে হবে। যেই অভ্যাস তাকে ধ্বংস করতে পারে সেই অভ্যাসকে তার পরিত্যাগ করতে হবে এবং যেই অভ্যাস তার জীবন গড়ে দিবে এবং সাফল্য নিশ্চিত করবে সেই অভ্যাসগুলো গড়ে তুলতে হবে।

- জে. পল গেটি


আজকের দ্রুত পরিবর্তনশীল ও দূর্যোগপূর্ণ সময়ে সহজভাবে চিন্তা করতে পারাটা অত্যাবশ্যক। যেকোনো পরিবর্তিত পরিস্থিতির সবদিক বিচার করে সেই অনুযায়ী যথাযথভাবে প্রতিক্রিয়া দেখানোর ক্ষমতা আপনার পেশা এবং ব্যবসার ক্ষেত্রে গুরুতর প্রভাব ফেলতে পারে।

১৯৫২ সালে আলবার্ট আইনস্টাইন প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। একদিন তিনি তার সহকারীর সাথে অফিসে ফিরছিলেন। সহাকারীর হাতে একদল উচ্চস্তরের পদার্থবিদ্যার শিক্ষার্থীদের জন্য আইনস্টাইনের তৈরি করা পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ছিল।

সেই সহকারী কিছুটা দ্বিধা নিয়ে ড. আইনস্টাইনকে জিজ্ঞেস করে, ‘জিজ্ঞেস করার জন্য ক্ষমা চাইছি। কিন্তু আপনি গত বছরও একই প্রশ্নে পদার্থবিদ্যার শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা নিয়েছিলেন, তাই নয় কি?’

আইনস্টাইন জবাব দেন, ‘হ্যাঁ, ঠিক তাই। এটি একই প্রশ্নপত্র।’

সহকারী এবার আরও বেশি দ্বিধা নিয়ে প্রশ্ন করে, ‘কিন্তু কেন পরপর দুুই বছর শিক্ষার্থীদের একই প্রশ্নে পরীক্ষা নিচ্ছেন?’

আইনস্টাইন সহজভাবে উত্তর দেন, ‘কারণ উত্তরগুলো বদলে গেছে।’

সেই সময় সারা বিশ্বব্যাপী পদার্থবিদ্যার নিত্যনতুন সব তত্ত্ব, তথ্যউপাত্ত ইত্যাদি প্রতিনিয়ত আবিষ্কার হচ্ছিল। এই সব যুগান্তকারী আবিষ্কারের কারণে গত বছর যেই উত্তর সঠিক ছিল তাই এ বছর ভুল প্রমাণিত হয়েছে।


আপনার উত্তরগুলো বদলে গেছে

আপনার পরিস্থিতি একই আছে। কিন্তু জীবনের অনেক ক্ষেত্রেই আপনার প্রশ্নের উত্তরগুলো বদলে গেছে। এক বছর আগে যা যৌক্তিক মনে হয়েছিল তা এখন আংশিক কিংবা সম্পূর্ণরূপে অযৌক্তিক প্রমাণিত হয়েছে। যেই বুদ্ধিগুলো দুই-এক বছর কিংবা এক মাস আগেও আপনার পছন্দের তালিকায় ছিল তা এখনকার বাজারে অচল হয়ে পড়েছে।

উদাহরণস্বরূপ, প্রযুক্তির ক্ষেত্রে আজকের বাজারে বলা হয়, একটি পণ্য বাজারে আসা মাত্রই অচল হয়ে পড়ে। যতদিনে পণ্যটি বাজারে এসে পৌঁছায় ততদিনে অন্য কোম্পানির তৈরি একটি পণ্য তার জায়গা দখল করে নেয়। প্রযুক্তির আয়ুষ্কাল দিন দিন কমে আসছে। একই কথা তথ্য এবং প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রেও খাটে। যেই গতিতে এরা পরিবর্তিত হচ্ছে তা শ্বাসরুদ্ধকর।


সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গুণ

১৯৯৫ সালে নিউ ইয়র্কের মেনিঞ্জার ইন্সটিটিউট একবিংশ শতাব্দীতে ব্যবসায় সাফল্যের জন্য কী কী গুণাবলি থাকতে হয় তার ওপর একটি গবেষণা চালায়। এই গবেষণায় দেখা যায় ব্যবসায় সাফল্যের সবচেয়ে বড় গুণ হলো ‘নমনীয়তা’।

নমনীয়তা হলো দ্রুত পরিবর্তনশীল যুগের সাথে তাল মিলিয়ে তৎক্ষণাৎ উপযুক্ত প্রতিক্রিয়া দেখানোর ক্ষমতা। এই দৃষ্টিভঙ্গি গঠন করার মূলমন্ত্র হলো ‘উত্তরগুলো বদলে গেছে’ এই কথাটি মেনে নেওয়া। এই দৃষ্টিভঙ্গি একজন মানুষ কিংবা সংগঠনকে তাদের অনমনীয় এবং কঠোর প্রতিদ্বন্দ্বীদের চেয়ে অনেকদূর এগিয়ে যেতে সাহায্য করবে।

পরিবর্তনের গতি দ্রুত থেকে দ্রুততর হচ্ছে

আমরা মানব ইতিহাসের যেকোনো সময়ের চেয়ে সবচেয়ে দ্রুত পরিবর্তনশীল, ধ্বংসাত্মক এবং উত্তাল সময়ে বাস করছি। আর এই গতি সামনে আরও বেগবান হবে।

বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্তও একজন মানুষের লেখাপড়া শেষ করে একটি কোম্পানিতে যোগ দিয়ে সেখানে পুরো কর্মজীবন কাটিয়ে দেওয়া খুব স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল।

বর্তমানে প্রায় ৪০ ভাগ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষকে অনিশ্চিত কর্মী বলে ধরা হয়― এরা এমন ফ্রিল্যান্সার যাদের পুরো কর্মজীবন স্বাধীনভাবে বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন ধরনের কাজ করে কাটে। এদের বেশির ভাগই কখনোই একটি মাত্র কাজ দীর্ঘদিন যাবৎ করে না।


বিশ লাখ চাকরি উধাও

প্রতি বছর কেবল আমেরিকাতেই গড়ে বিশ লাখ কর্মসংস্থান গায়েব হয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন কোম্পানির সরবরাহকৃত পণ্য এবং সেবা ক্রেতার পরিবর্তিত রুচির সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারছে না। ফলে যারা এসব কাজের সাথে জড়িত তাদের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে যাচ্ছে। আজকের কর্ম জগতে এটি অনেক বড় এক সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে। আর এই সমস্যা সামনের দিনগুলোতে আরও মারাত্মক আকার ধারণ করবে।

সৌভাগ্যবশত আমেরিকায় গড়ে প্রতি বছর প্রায় ২২ লাখ কর্মসংস্থান তৈরি হয়। এই নতুন কাজের পুরো ৮০ ভাগই আসে বিভিন্ন বাজারে বিভিন্ন নতুন পণ্য কিংবা সেবা সরবরাহ করা নতুন কোম্পানি থেকে।

পরিবর্তনের এই গতিশীলতার কারণে বর্তমানে অনেক শিল্পকারখানা এবং কোম্পানি এমন এমন ব্যবসায়িক মডেল মেনে চলছে যা এখন অচল কিংবা আগের মতো বিক্রি ও মুনাফা আদায় করতে অক্ষম।


আপনার ব্যবসায়িক মডেল

একটি ব্যবসায়িক মডেলকে সংজ্ঞায়িত করা যায় এই ভাবে― এটি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একটি পূর্ণাঙ্গ পদ্ধতি যা অনুসরণ করে একটি কোম্পানি তাদের পণ্য কিংবা সেবা উৎপাদন ও বিক্রয় করে মুনাফা অর্জন করে।

একটি কোম্পানি অন্তত প্রায় ৫৫টি ভিন্ন ভিন্ন ব্যবসায়িক মডেল ব্যবহার করতে পারে। বর্তমান বাজারের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় এমন ব্যবসায়িক মডেল অনুসরণ করলে বিক্রয় হ্রাস, ক্ষতি; এমনকি ব্যবসা সম্পূর্ণ অচল হয়ে পড়তে পারে।

অ্যাপল যখন ২০০৭ সালে প্রথম আইফোন বাজারে আনে তখন ব্ল্যাকবেরির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা একে খেলনা বলে উড়িয়ে দেয়। তারা ধারণা করেছিল কেবল নিজের বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে চাওয়া তরুণরাই এটা ব্যবহার করবে। কিন্ত মাত্র ৫ বছরের মাথায় ব্ল্যাকবেরির শেয়ার বাজারের আধিপত্য ৪৯ শতাংশ থেকে ০.৪ শতাংশে নেমে আসে এবং কোম্পানিটি প্রায় দেউলিয়া হয়ে পড়ে।


ত্বরিত বিলোপপ্রবণতা

আইপ্যাড বাজারে এসে পাঠকদের ই-বুক সহজে, কম সময়ে এবং কম খরচে ডাউনলোড করার সুবিধা দেয় যার ফলে বইয়ের বাজার আমূল বদলে যায়। এক বছরের মাথায় বর্ডারস, বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ বইয়ের খুচরা বিক্রয় প্রতিষ্ঠান দেউলিয়া হয়ে পড়ে এবং তাদের ৬০০ দোকান বন্ধ করতে বাধ্য হয়। এমনটা বিশ্বব্যাপী প্রায় সব শিল্পের ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে। এর কারণ হলো তারা আজকের দিনের নিত্যনতুন তথ্যপ্রবাহ, প্রযুক্তির বিস্তার এবং আক্রমণাত্মক প্রতিযোগিতার বাজারের নতুন ব্যবসায়িক মডেলের সাথে খাপ খাওয়াতে পারছে না। আর তাই অনেক পুরাতন এবং নামকরা কোম্পানিও ব্যবসায়িক ইতিহাসের পাতা থেকে হারিয়ে যাচ্ছে।

আপনার ব্যক্তিগত ব্যবসায়িক মডেল, যেই পদ্ধতিতে আপনি নিজের ব্যক্তিগত এবং পেশাগত জীবন পরিচালিত করছেন তা যেকোনো মুহূর্তে আংশিক কিংবা সম্পূর্ণরূপে অচল হয়ে পড়তে পারে। এখন যদি না-ও হয় ভবিষ্যতে এমনটা হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল।

ব্যবসাসমূহ তখনই বিপদে পড়ে যখন ক্রেতাদের চাহিদা এবং রুচির পরিবর্তন হয়। চাকুরিজীবীরা বিপদে পড়ে যখন তাদের প্রতিষ্ঠানের বিশেষ দক্ষতা এবং ক্ষমতার চাহিদার প্রয়োজনীয়তা পরিবর্তন হয়। আজকের দিনে সফল ভাবে টিকে থাকতে হলে আপনাকে, আপনার প্রতিষ্ঠান এবং ব্যবসাকে যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হবে।


৮০/২০ নীতি এবং আয়

এখনকার দিনে যাদের দক্ষতা সীমিত এবং সেকেলে; তারা অধিক চাহিদা সম্পন্ন আধুনিক, মানানসই এবং অধিক উপযোগী দক্ষতার মানুষের দ্বারা প্রতিস্থাপিত হচ্ছে। নোবেল পুরস্কার জয়ী অর্থনীতিবিদ গ্যারি বেকার ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে আয় বৃদ্ধির ওপর একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে বেকার তার গবেষণায় দেখেন যে, নিম্ন ৮০ ভাগে থাকা মানুষের আয় প্রতি বছর গড়ে ৩ শতাংশ বৃদ্ধি পায় যা মুদ্রাস্ফীতি হারের সমান কিংবা সামান্য বেশি।

অপরদিকে শীর্ষ ২০ ভাগে থাকা মানুষের আয় বছরে গড়ে প্রায় ১১ শতাংশ বৃদ্ধি পায় যার ফলে তাদের আয় প্রতি ৬ কিংবা ৭ বছরে দ্বিগুণ হচ্ছে। এই কারণে তাদের কর্মজীবনেই তারা মধ্যবিত্ত থেকে উচ্চ মধ্যবিত্ত এমনকি উচ্চবিত্ত সমাজেও প্রবেশ করতে সক্ষম হচ্ছে।

এই ২০ ভাগ এবং ৮০ ভাগের মাঝে প্রধান পার্থক্য কী? পার্থক্য হচ্ছে নিয়মিত ভাবে শিক্ষা লাভ করে নিজেদের দক্ষতাকে উন্নত থেকে উন্নততর করার অঙ্গীকার। শীর্ষ ২০ ভাগ মানুষ সব বই পড়ে, সব কোর্সে উপস্থিত থাকে, সব অডিও প্রোগ্রাম শোনে এবং সবসময় নিজেদের কাজ আগের চেয়েও ভালো ও সস্তা উপায়ে এবং দ্রুত গতিতে করার উপায় খুঁজতে থাকে।


অপরিকল্পিত অপ্রচলিত দক্ষতা

নিম্ন ৮০ ভাগ মানুষ এই ধারণার সম্পূর্ণ বিপরীত। তারা কদাচিৎ বই পড়ে, কোর্সে অনুপস্থিত থাকে , অডিও প্রোগ্রাম প্রায় শোনেই না। তারা নিজেদের দক্ষতা বাড়ানোর কোনো চেষ্টাই করে না। তারা অবসর সময় দক্ষতা বাড়িয়ে লক্ষ্য অর্জনের বদলে আরাম করে কাটায়। ফলস্বরূপ অনেকটা নিজের অজান্তেই তারা ক্রমেই পিছিয়ে পড়তে থাকে।

যখন শেষ পর্যন্ত তারা চাকরি কিংবা কাজ হারিয়ে ফেলে তখন তারা দেখতে পায় যে তাদের দক্ষতা যার বেশির ভাগই অভিজ্ঞতা থেকে অর্জিত, আসলে তাদের বর্তমান নিয়োগকর্তার কোনো কাজেই আসছে না। যেহেতু ক্রমাগত নতুন দক্ষতা এবং নতুন জ্ঞানার্জন তাদের জীবনযাত্রার অন্তর্ভুক্ত ছিল না, তাই তারা বাড়ি গিয়ে কেবল টেলিভিশন দেখে সময় অপচয় করতেই বেশি পছন্দ করত। যার কারণে পরবর্তীতে তারা নিজেদের মাসের পর মাস এমনকি বছরের পর বছরও বেকার অবস্থায় পায়।

আজকের দিনে সকল ধরনের পেশা এবং উপার্জন ক্ষমতার অধিকাংশ মানুষই দক্ষতা উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তা এবং তাৎপর্য সম্পর্কে অনবগত। কিন্তু বাস্তবতা এটাই যেমনটা বাস্কেটবল কোচ প্যাট রাইলি বলেছেন, ‘যদি উন্নতি না করতে পারেন তবে আপনার অবনতি হচ্ছে।’


প্রতিযোগিতা চলছে

কেউই এক জায়গায় বেশিদিন থাকে না। যদি প্রতিনিয়ত নিজের জ্ঞান এবং দক্ষতার পরিধি বাড়াতে ব্যর্থ হোন আপনি সামনে এগোতে পারবেন না। আপনি কেবল পশ্চাদপদই হতে থাকবেন। অপরদিকে আপনার চারপাশের সবাই আপনাকে পিছনে ফেলে ক্ষিপ্রগতিতে সামনে অগ্রসর হতেই থাকবে।

এখনকার দিনে অনেক মানুষই একটি খাতে আটকে থাকে, আর একটি খাত আর সমাধির মাঝে পার্থক্য কেবল গভীরতায়। মোটিভেশনাল স্পিকার জিম রন বলেছেন, ‘যদি কোনো খাতে আটকা পড়ে থাকেন তবে প্রার্থনা করি যাতে একটি ওয়াগন এসে আপনাকে অনুপ্রাণিত করে সেখান থেকে উদ্ধার করে নিয়ে যায়।’


তিন শত্রু

পরিবর্তনশীলতা এবং নমনীয়তার তিন শত্রুকে প্রতিহত করতে হবে। প্রথম এবং সবচেয়ে ভয়ঙ্কর হলো ‘অভ্যস্ততা’। মানুষ কোনো কাজ শুরু করে দ্রুতই সেই কাজে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। এরপর তারা পরিবর্তন মানতে অস্বীকৃতি জানায়। কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন হলেও কেবল নতুন কিছু করার ভয়ে তারা নিজেদের বদলাতে চায় না।

নতুন কিছু শেখা, উন্নতি করা, জ্ঞানের পরিধি বিস্তার করা, নতুন নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করার বদলে তারা নিজেদের ক্ষুদ্র গ-িতেই পড়ে থাকতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। তারা পরিবর্তনের প্রতি এই উদাসীনতাকে যৌক্তিক দেখানোর চেষ্টা করে, এমনকি অনেক সময় অন্যের পরিবর্তনের চেষ্টাকেও দমন করার প্রয়াস করে।

ওয়ারেন বেনিস, তার লিডারস বইতে কীভাবে শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিগণ নিজেদের অভ্যস্ততার জায়গা থেকে বেরিয়ে নিজেদের এবং নিজেদের প্রতিষ্ঠানের জন্য বৃহৎ থেকে বৃহত্তর লক্ষ্য নির্ধারণ করেন তা নিয়ে আলোচনা করেছেন। তারা যদি নিজেদের পরিবর্তন করে আরও উন্নত না করত তবে এই লক্ষ্যগুলো কখনোই অর্জন করা সম্ভব হতো না।

২০১৫ সালে প্রকাশিত বোল্ড বইতে পিটার ডায়ামান্ডিস পৃথিবী পালটে দেওয়া ব্যক্তিদের কথা উল্লেখ করেন। এসব ব্যক্তি বিক্রয়, মুনাফা এবং উপার্জনের ক্ষেত্রে নিজেদের বর্তমান ক্ষমতার চেয়েও দশ এমনকি একশ গুণ বৃহৎ লক্ষ্য নির্ধারণ করে এবং তা অর্জনের অনুসারীদের উদ্বুদ্ধ করে। লক্ষ্যের আকার দেখে প্রথমে তা অর্জন অসম্ভব মনে হলেও সময়ের সাথে নতুন চিন্তা এবং নতুন উপায় বিস্তার লাভ করে যা ‘মানুষকে এমন জায়গায় নিয়ে যায় যেখানে আগে কেউ যেতে পারেনি।’ (স্টার ট্রিক)


ভয় মানুষকে পিছিয়ে দেয়

পরিবর্তনশীলতার দ্বিতীয় প্রধান অন্তরায় হলো ‘ভয়’। বিশেষ করে ব্যর্থতার ভয় যা মানুষকে নিজের গ-ির বাইরে যেতে দেয় না, স্বস্তির দেওয়াল ভেঙে বাইরের জগতে প্রবেশ করতে দেয় না। মানুষ ভাবে, ‘নতুন কিছু চেষ্টা করে যদি ব্যর্থ হই?’

২০১৩ অক্টোবরের হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউ এর মতে, নতুন ব্যবসায়িক মডেলে নতুনত্ব আনার সবচেয়ে বড় অন্তরায় হলো ‘ভয়’ এবং অনিশ্চয়তা। ৮০ ভাগ কর্পোরেট কর্মকর্তা গুরুত্বের দিক থেকে ব্যবসায়িক মডেলকে নতুন পণ্য কিংবা সেবা উৎপাদনের চেয়েও এগিয়ে রাখে। কিন্তু তারা জানে না এটা কীভাবে করতে হয়। আর তাই তারা গড়িমসি করে। আর আশা করে আগামী প্রজন্মের নেতারা এই পরিবর্তন এনে তাদের প্রতিষ্ঠানকে উন্নতির শিখরে পৌঁছে দিবে।


পরিবর্তনের অক্ষমতা

পরিবর্তনকে ভয় পাওয়ার এবং প্রতিরোধ করার তৃতীয় কারণ হলো, ‘শিক্ষিত অসহায়ত্ব’ (ষবধৎহবফ যবষঢ়ষবংংহবংং)। [কোনোকিছু সম্পর্কে শিক্ষা গ্রহণের পরও মানুষ যখন উন্নতি করতে পারে না তখন তার মধ্যে এক ধরনের শিক্ষিত অসহায়ত্ব বিরাজ করে।]

মানুষ জানে পরিবর্তন আবশ্যম্ভাবী, কিন্তু তারা নিজেকে অসহায় মনে করে। চিন্তা করে তারা নিজেরা পরিবর্তিত হয়ে জটিল পরিস্থিতি মোকাবেলা করার যোগ্য নয়।

শিক্ষিত অসহায়ত্বকে এই ভাবে ভাষায় প্রকাশ করা যায়― ‘আমি পারব না’ বা ‘আমরা পারব না’। এরপর শুরু হয় অজুহাত দেওয়া― সময় নেই, অর্থ নেই, প্রতিভা নেই ইত্যাদি আরও বহুবিধ বাহ্যিক চাপ এবং অভ্যন্তরীণ সীমাবদ্ধতার কারণে পরিবর্তন হওয়া সম্ভব নয়।

কিন্তু উইনস্টন চার্চিল বলেছেন, ‘যদি বিজয়ের সম্ভাবনা আছে জেনেও লড়াই না করো, তবে এমন সময় লড়াই করতে হবে যখন বিজয়ের কোনো সম্ভাবনাই থাকবে না।’ নিয়ম হলো, যখন সম্ভব তখনই পরিবর্তন হওয়া, বাধ্য হয়ে পরিবর্তন হওয়া নয়।

এই কথাটা ব্লকবাস্টার কোম্পানির (ইষড়পশনঁংঃবৎ) কর্মকর্তাদেরকে বলা দরকার ছিল। ব্লকবাস্টার একটি নামকরা কোম্পানি। একসময় যারা বাড়িতে ভিডিওতে মুভি সরবরাহের মার্কেট নিয়ন্ত্রণ করত। যখন নেটফ্লিক্স আসে তখন ব্লকবাস্টারের কর্তারা একে সামান্য একটি কোম্পানি বলে উড়িয়ে দেয়। তারা বলে দেশের জাতীয় বাজারে এটি কখনোই ব্লকবাস্টারের সাথে পাল্লা দিয়ে টিকে থাকতে পারবে না। কিন্তু তাদের গ্রাহকদের চাহিদা পরিবর্তন হয়েছে এবং কয়েক বছরের মাথায় নেটফ্লিক্স মুভি সরবরাহের সবচেয়ে বড় কোম্পানিতে পরিণত হয়েছে। অপরদিকে অফলাইন এবং অনলাইন; উভয় ক্ষেত্রেই ব্লকবাস্টার কোম্পানি দেউলিয়া হয়ে পড়েছে।


চিন্তার জগৎ প্রসারিত করুন

অনেক শক্তিশালী এবং বাস্তবধর্মী চিন্তার কৌশল আছে যা ব্যবহার করে নিজের প্রতিভার বিকাশ ঘটাতে, চিন্তার জগৎ প্রসারিত করতে এবং নিজেকে অভ্যস্ততার জগৎ থেকে বের করতে পারবেন।

নিজের দৃষ্টিভঙ্গির বিকাশ ঘটানোর এবং উচ্চস্তরের নমনীয়তা অর্জনের পরীক্ষিত এক কৌশল হলো ‘শূন্য-কেন্দ্রিক চিন্তা’।

শূন্য-কেন্দ্রিক চিন্তার ধারণা এসেছে শূন্য-কেন্দ্রিক হিসাববিজ্ঞান থেকে। শূন্য-কেন্দ্রিক হিসাববিজ্ঞানে প্রতিটি হিসাবরক্ষণ পর্যায়ের শুরুতে প্রতিটি ব্যয়কে চ্যালেঞ্জ করা হয়।

এক্ষেত্রে আপনি কোনো ব্যয় বাড়ানো বা হ্রাস করা উচিত কিনা তা জিজ্ঞেস করবেন না বরং আপনাকে জিজ্ঞেস করতে হবে এই খাতে অর্থ ব্যয় করা আদৌ উচিত হবে কিনা। শূন্য-কেন্দ্রিক চিন্তায় আপনাকে এই কঠিন প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে হবে, ‘এখন যা জানি তার ওপর ভিত্তি করে এমন কোন কাজ কি এখন আমরা করছি যা পরবর্তীতে কাজটি পুনরায় শুরু করার সুযোগ পেলে আমরা কখনোই করব না?’ (ওং ঃযবৎব ধহুঃযরহম ঃযধঃ বি ধৎব ফড়রহম ঃড়ফধু ঃযধঃ, শহড়রিহম যিধঃ বি হড়ি শহড়,ি বি ড়িঁষফহ’ঃ ংঃধৎঃ ঁঢ় ধমধরহ রভ বি যধফ ঃড় ফড় রঃ ড়াবৎ?)


কেডব্লিউআইএনকে (কডওঘক) বিশ্লেষণ করুন

নিজের ব্যক্তিগত ও পেশাগত জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে কেডব্লিউআইএনকে (কডওঘক) বিশ্লেষণ (কহড়রিহম ডযধঃ ও ঘড়ি কহড়)ি তথা ‘আমি এখন যা জানি’ বিশ্লেষণ প্রয়োগ করুন। এখন যেই জ্ঞান আছে তা অনুযায়ী এমন কোনো কাজ কি আপনি করছেন যা পরবর্তীতে পুনরায় কাজটি শুরু করার সুযোগ পেলে কখনোই করতেন না?

কীভাবে বুঝবেন যে আপনি শূন্য-কেন্দ্রিক চিন্তা করার পরিস্থতিতে আছেন কিনা? সহজ উত্তর হলো মানসিক চাপ! যদি জীবনে এমন কিছু কাজ করে থাকেন যা পরবর্তীতে কখনোই আবার করতেন না তাহলে আপনি প্রচ- মানসিক চাপ, দুশ্চিন্তা, ক্রোধ, হতাশা এবং অসন্তুষ্টি অনুভব করবেন। এই নেতিবাচক পরিস্থিতি প্রায়শই আপনার কথায় এবং কাজে প্রকাশ পাবে, আপনাকে সারদিন দুশ্চিন্তায় রাখবে এবং রাতে ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাবে।


আপনার সম্পর্কগুলো দিয়ে শুরু করুন

শূন্য-কেন্দ্রিক চিন্তা সব ধরনের সম্পর্কের ক্ষেত্রে খাটে। আপনার ব্যক্তিগত কিংবা পেশাগত জীবনে এমন কোনো ব্যক্তি কি আছে যার সাথে আপনি আবার সুযোগ পেলে কখনোই সম্পর্ক রাখতেন না?

বর্তমানে যা জানেন সেই জ্ঞান অনুযায়ী এমন কেউ কি আছে যাকে পুনরায় সুযোগ পেলে কখনোই কাজ দিতেন না, তার হয়ে কাজ করতেন না, তাকে নিয়োগ করতেন না কিংবা প্রমোশন দিতেন না?

যদি এমন কেউ আপনার জীবনে বর্তমানে থেকে থাকে তবে প্রশ্ন হলো, ‘কত দ্রুত সময়ে কীভাবে এই পরিস্থিতি থেকে বের হওয়া যায়?’

আপনি কি ধারণা করতে পারেন সময়ের সাথে সাথে আপনার কত সিদ্ধান্ত ভুল প্রমাণিত হতে পারে? আমেরিকান ম্যানেজমেন্ট এসোসিয়েশনের মতে, পেশাগত এবং ব্যক্তিগত জীবনের পুরো ৭০ ভাগ সিদ্ধান্ত ভুল হয়ে থাকে। এগুলো অল্প ভুল, অনেক ভুল কিংবা সসম্পূর্ণ ভুল হতে পারে। নিজের সেরাটা দেওয়ার জন্য এবং উচ্চস্তরের নমনীয়তা অর্জনের জন্য আপনাকে সফল ব্যক্তিদের তিনটি বাক্য বলার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।


আপনি নিখুঁত নন― এটি মেনে নিন

‘আমার ভুল হয়েছে।’ নিজের চারপাশে তাকান। বিশেষ করে সেসব ক্ষেত্রের দিকে নজর দিন যা আপনার মানসিক চাপ, অসন্তুষ্টি কিংবা দুঃখের কারণ হয়েছে এবং স্বীকার করুন যে আপনি ভুল করেছিলেন। তখন হয়তো কাজটিকে কিংবা সিদ্ধান্তটিকে সঠিক মনে হয়েছিল। তখন আপনি যা জানতেন বা যেই পরিস্থিতিতে ছিলেন তা অনুযায়ী তাই যৌক্তিক মনে হয়েছিল। কিন্তু এখন ‘উত্তরগুলো বদলে গেছে।’

আপনি এখন অনেক কিছু জানেন যা আগে জানতেন না, তাছাড়া পরিস্থিতিও এখন বদলে গেছে। তখন যা সঠিক মনে হয়েছিল আজ তা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। যখনই এটা স্বীকার করে নিবেন যে, সেই সময় আপনার ভুল হয়েছিল, তখনই আপনার মানসিক চাপ সাথে সাথে অদৃশ্য হয়ে যাবে।

অনেকেই চিন্তা করে নিজের ভুল স্বীকার করে তারা নিজেদের দুর্বল প্রমাণ করছে। তারা চিন্তা করে তারা ভুল করেছে এটা জানার পর মানুষ তাদের সম্মান করবে না বা তাদের সিদ্ধান্তকে মেনে নিবে না। কিন্তু বাস্তবে এর ঠিক উল্টো ঘটে। আজকের এই দ্রুত পরিবর্তনশীল উত্তাল সমাজে নিজের ভুল স্বীকার করাটা দুঃসাহসিক কাজ এবং তা মানুষের চরিত্রের দৃঢ়তাকেই প্রকাশ করে। যখন সবাই ভুলটা জানবে তখন আপনার প্রতি তাদের শ্রদ্ধা আরও বেড়ে যাবে এবং তারা ভবিষ্যতেও আপনার কথা মানতে চাইবে।

অপরদিকে যে নিজের ভুল জেনেও স্বীকার করে না সে নিজের দুর্বলতা এবং বোকামিকেই প্রকাশ করে।

একটি মজার কথা বলি। যতদিনে বুঝবেন যে পুনরায় শুরু করার সুযোগ পেলে আপনি কোনো কাজটি আর কখনোই করতেন না, ততদিনে সেই পরিস্থিতি কিংবা মানুষকে রক্ষা করার সুযোগ শেষ হয়ে গেছে। তাহলে প্রশ্নটি হলো, ‘নিজের ভুল স্বীকার করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার বদলে নিজেকে সঠিক প্রমাণের জন্য আর কত অর্থ ও সময় অপচয় করবেন এবং কষ্ট ও হতাশা ভোগ করবেন?’


ভুল স্বীকার করুন

‘আমি ভুল করেছি।’ অনেকেই অহমিকার জন্য নিজেদের ভুল স্বীকার করতে চায় না। এমনকি সবাই তাদের ভুল সম্পর্কে জানার পরেও তারা নিজেদের সঠিক বলে দাবি করে। কিন্তু আপনি এ ভুল করবেন না।

কারণ ৭০ ভাগ সময়েই আপনি ভুল সিদ্ধান্ত নিবেন কিংবা ভুল কাজ করবেন। এটাই স্বাভাবিক। তাই অন্যরা জানার অপেক্ষা না করে আগেই নিজের দোষ স্বীকার করে নিন। ‘আমি ভুল করেছি।’ ‘আমার ভুল হয়েছে।’ এই কথাগুলো বলার অভ্যাস করুন। এরপর যত দ্রুত সম্ভব পরিস্থিতি ঠিক করার চেষ্টায় নিজেকে নিয়োজিত করুন।


নিজের মনোভাব বদলান

‘আমি মত বদলেছি।’ যখন কোনো নতুন তথ্য সামনে আসবে তখন নিজের মত বদল করা সাহস, নমনীয়তা এবং চারিত্রিক দৃঢ়তার পরিচয় বহন করে। এটি মোটেই কোনো দুর্বলতা নয়। যদি কোনো নতুন ব্যবসায়িক পরিকল্পনা, পণ্য উৎপাদন কৌশল গঠনের পিছনে আঠারো মাস সময় ব্যয় করার পরেও এমন কোনো তথ্য সামনে এসে হাজির হয় যা ঐ পরিকল্পনা কিংবা কৌশলকে অচল প্রমাণিত করে তবে নিজের মত বদলানোর জন্য প্রস্তুত থাকুন। সেক্ষেত্রে এই অচল কৌশলকে পরিত্যাগ করে, নতুন লব্ধ জ্ঞান অনুযায়ী সম্পূর্ণ নতুন, ভিন্ন এবং আরও কার্যকরী পদ্ধতি আবিষ্কারে মনোনিবেশ করুন। যত দ্রুত ‘আমি ভুল করেছি, আমার ভুল হয়েছে, আমি মত বদলেছি’ এই কথাগুলো বলার অভ্যাস গড়ে তুলবেন, তত দ্রুত আপনার চিন্তার দক্ষতা বাড়বে এবং মানুষ আপনাকে তত বেশি সম্মানের দৃষ্টিতে দেখবে।


নিজের ব্যবসা ও পেশা পুনর্বিবেচনা করুন

দ্বিতীয় যেই ক্ষেত্রে শূন্য-কেন্দ্রিক চিন্তা প্রয়োগ করবেন তা হলো নিজের পেশাগত ও ব্যবসায়িক জীবনে, বিশেষ করে আপনার ব্যবসায়িক মডেল গঠনের ক্ষেত্রে।

এখন যা জানেন সেই অনুযায়ী এমন কোন পণ্য কিংবা এমন কী আছে যা আপনি পুনরায় শুরুর সুযোগ পেলে বাজারে আনতেন না? আপনার এখনকার জ্ঞান অনুযায়ী এমন কোনো প্রক্রিয়া, পদ্ধতি কিংবা ব্যয় কি আছে যা আজকের দিনে আপনি ব্যবহার করতেন না? এমন কোনো কৌশল কি আছে যা আপনাকে পুনরায় শুরুর সুযোগ দেওয়া হলে কখনোই প্রয়োগ করতেন না?

আপনার পেশাগত জীবনের এমন কোনো কাজ, এমন কোনো পদক্ষেপ কি আছে যা আপনি এখন যা জানেন সেই জ্ঞান অনুযায়ী পুনরায় শুরুর সুযোগ পেলে কখনোই নিতেন না? মনে রাখবেন, একই মানুষের পুরো কর্মজীবনে ভিন্ন ভিন্ন দক্ষতা শিখে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে, বিভিন্ন ধরনের কাজ করাটা খুবই স্বাভাবিক। অর্থনীতির পরিবর্তনে অনেকেই নতুন ক্ষেত্রে, নতুন দক্ষতা শিখে, নতুন ভাবে কাজ শুরু করে থাকে। এটা কি আপনার ক্ষেত্রে খাটে?

যদি উত্তরটি হয়― হ্যাঁ। তাহলে পরবর্তী প্রশ্ন হলো, ‘কীভাবে দ্রুততম সময়ে আমি এই অবস্থা থেকে বের হয়ে নতুন ভাবে শুরু করতে পারি?’


নিজের বিনিয়োগ নিরীক্ষণ করুন

শূন্য-কেন্দ্রিক চিন্তা প্রয়োগের তৃতীয় ক্ষেত্র হলো বিনিয়োগ, বিশেষ করে সময়, অর্থ এবং অনুভূতির বিনিয়োগ।

হিসাববিজ্ঞানে সাঙ্ক কস্ট (ংঁহশ পড়ংঃং) তথা ডুবন্ত অর্থ বলে একটা কথা আছে। এটি হলো এমন অর্থ যা খরচ হয়ে গেছে এবং তা আর কখনোই ফেরত পাওয়া যাবে না। এটা অনেকটা মাঝসাগরে জাহাজ থেকে কিছু ফেলে দেওয়ার মতো। একবার ফেলে দিলে আর কখনোই তা ফেরত পাওয়া যাবে না। এটি চিরদিনের জন্য গায়েব হয়ে যাবে। এই হলো ডুবন্ত অর্থ।

ভেবে আশ্চর্য লাগে কত ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং ব্যবসায়ী এখনও এই ব্যাপারে বিভ্রান্ত। তারা প্রতিনিয়ত এই ডুবন্ত অর্থ উদ্ধারের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। একে বলে ‘মন্দের ওপর ভালো অর্থ বিসর্জন’ বা ‘উলুবনে মুক্তা ছড়ানো’।


আপনার বিনিয়োগ চিরদিনের জন্য হারিয়ে গেছে

ডুবন্ত অর্থের ব্যাপারটি সময়ের ক্ষেত্রেও সত্য। একে অনেকেই অস্বীকার করে। আপনার জীবনের এমন কোনো ক্ষেত্রে কি আপনি বিপুল পরিমাণ সময় কোনো পরিকল্পনা, সেবা, ব্যক্তি এমনকি কোনো দক্ষতা অর্জনের জন্য বিনিয়োগ করেছেন যা পরবর্তীতে অপ্রয়োজনীয় কিংবা অচল বলে প্রমাণিত হয়েছে?

এই ব্যয়িত সময় এখন ডুবন্ত অর্থে পরিণত হয়েছে। এই কথাটি মেনে নিন এবং সেখান থেকে সরে আসুন। এ ক্ষেত্রে আর কোনো সময় ব্যয় করবেন না। আপনি জানেন এ ক্ষেত্রে আর সময় ব্যয় করা অর্থহীন।

ডুবন্ত অর্থের দ্বিতীয় ক্ষেত্রটি হচ্ছে আর্থিক বিনিয়োগ। এমন কোনো আর্থিক বিনিয়োগ কি আছে যা আজকে যা জানেন যদি তখন জানতেন তবে আপনাকে পুনরায় সুযোগ দিলে কখনোই করতেন না?

যদি থেকে থাকে তবে পরের প্রশ্নটি হলো, ‘আমি কীভাবে এবং কত দ্রুত সময়ে এই বিনিয়োগ থেকে মুক্ত হতে পারি?’

ভেবে কষ্ট হয় যে কত শত প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তি জেনেশুনে এমন সব ক্ষেত্রে অর্থ বিনিয়োাগ করতেই থাকে যেখানে পুনরায় সুযোগ পেলে তারা কখনোই অর্থ বিনিয়োগ করত না।


আজকেই পুনরায় শুরু করার কল্পনা করুন

অনুভূতি বা আবেগ হলো শূন্য-কেন্দ্রিক চিন্তা প্রয়োগের তৃতীয় ক্ষেত্র। মনোবিজ্ঞানীদের মতে মানুষ সময়, অর্থ এবং আবেগ ব্যয় কিংবা অপচয় করতে ঘৃণা করে। অনেক ক্ষেত্রেই তারা এই ক্ষতিকে মানতে চায় না এবং এই ভুলের খেসারত দেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যায়।

জীবনে অনেক মানুষ, পরিকল্পনা এবং পরিস্থিতিতে অনেক আবেগ বিনিয়োগ করতে হয়। কোনো সম্পর্ক কিংবা কাজকে সার্থক করার জন্য আপনি মনেপ্রাণে চেষ্টা চালিয়ে যাবেন। কিন্তু হয়তো শেষ পর্যন্ত দেখা যাবে আপনি ব্যর্থ হয়েছেন। আপনার মূল্যবান অনুভূতির অপচয় হয়েছে। এটি চিরদিনের জন্য হারিয়ে গেছে। একে আর ফেরত পাওয়া যাবে না। আর তাই এর ক্ষতিপূরণ করতে যাওয়ার চেষ্টাও বৃথা। এটি একটি ডুবন্ত অর্থ।

কোনো পরিস্থিতিতে নিজের ভুল স্বীকার করে বাস্তবতা মেনে নিতে প্রচ- চারিত্রিক দৃঢ়তা ও মনোবল প্রয়োজন। আমি ভুল করেছি, আমার ভুল হয়েছে কিংবা আমি মত বদলেছি― এ কথাগুলো বলতে সাহস লাগে। কিন্তু যত বেশি শূন্য-কেন্দ্রিক চিন্তা প্রয়োগে অভ্যস্ত হবেন, কাজটি তত বেশি সহজ হয়ে আসবে।


বড় পুরস্কার

সুসংবাদ হলো, যখন যেকোনো পরিস্থিতিতে শূন্য-কেন্দ্রিক চিন্তা প্রয়োগে তা সমাপ্ত করার সাহস জুটিয়ে ফেলবেন তখন পৃথিবীর সবার মতো একই প্রতিক্রিয়া অনুভব করবেন। প্রথমে আপনি খুবই নিশ্চিন্ত অনুভব করবেন, এমনকি নিজেকে খুব স্বাধীন বলেও মনে হবে। মনে হবে যেন আপনার বুকের ওপর থেকে বড় একটি পাথর নেমে গেছে।

দ্বিতীয়ত, আপনি নিজেকে জিজ্ঞেস করবেন, ‘আমি কেন এই কাজটি আরও আগে করিনি?’

ব্যক্তিগত ও পেশাগত জীবনে নিজের পূর্ণ প্রতিভার সম্পূর্ণ বিকাশ ঘটাতে চাইলে শূন্য-কেন্দ্রিক চিন্তা করা অত্যাবশ্যক। আর যত বেশি এটি অনুশীলন করবেন ততই এতে পটু হবেন। ফলে শীঘ্রই এই কথাটি বলতে সমর্থ হবেন, ‘আমার জীবনে এখন আর এমন কোন পরিস্থিতি নেই যা আমাকে পুনরায় শুরুর সুযোগ দেওয়া হলে আমি পরিবর্তন করতে চাইব।’


উচ্চতর চিন্তার সাত কৌশল

অনেক সময় খুব সহজ উপায় আপনার চিন্তার জগতকে আলোড়িত করে আপনার কোনো পরিস্থিতিকে দেখার ধরন সম্পূর্ণ বদলে দিতে পারে। এর মূলমন্ত্র হলো খোলা মনে সবকিছু বিচার করা । আপনার ভুল হতেই পারে। আপনি যা ভাবছেন তার চেয়েও কোনো ভালো উপায়ে হয়তো কাজটি করা যেতে পারে। এমন কোনো উপায় অবশ্যই আছে।

সাতটি কৌশল মেনে আপনি চিন্তার নমনীয়তা ও মানসিক তৎপরতা বৃদ্ধি করতে পারেন:

১। পুনরায় চিন্তা: এর জন্য আপনাকে সময়ের কাঁটা বন্ধ করতে হবে, একটু সময় নিতে হবে এবং নিজের পরিস্থিতিকে নিয়ে পুনরায় চিন্তা করতে হবে। নিজেকে এ তিনটি প্রশ্ন করুন:


আমি কী করতে চেষ্টা করছি?

আমি কীভাবে এটি করার চেষ্টা করছি?

এর চেয়ে ভালো উপায় আর কী হতে পারে?


নিজের লক্ষ্য অর্জনের পথে যখনই কোনো বাধাবিপত্তির মুখোমুখি হবেন তখনই একটু থেমে নিজেকে এ প্রশ্নগুলো জিজ্ঞেস করুন।

প্রায়ই দেখবেন আপনি যেভাবে কাজটি করার চেষ্টা করছেন তা ঐ কাজটি করার সঠিক উপায় নয় কিংবা এই কাজটির গুরুত্ব ফুরিয়ে গেছে। আপনার পদ্ধতি সঠিক নয়। আরও কোনো ভালো উপায় আছে কিনা?― এই প্রশ্নটি জিজ্ঞেস করার মাধ্যমে আপনি নিজের জন্য অসীম সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত করছেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আরও ভালো একটি উপায় অবশ্যই থাকবে।

২। পুনর্বিবেচনা: শূন্য-কেন্দ্রিক চিন্তা অনুশীলন করুন এবং কোনো কাজ করার আগে বিভিন্ন ধরনের উপায় বিবেচনা করুন।

কোনো পরিস্থিতি নিয়ে আপনি অসন্তুষ্ট থাকলে নিজেকে জিজ্ঞেস করুন, ‘এখন এই পরিস্থিতিতে না থাকলে আমি এখন যা জানি সেই অনুযায়ী আমাকে পুনরায় কাজটি শুরু করতে দেওয়া হলে আমি কি কাজটি করতাম?’

যদি উত্তরটি না হয় তবে কীভাবে এবং কত দ্রুত সময়ে এই অবস্থা থেকে মুক্ত হতে পারেন?

৩। পুনঃপরিকল্পনা করা: যেই লোকবল এবং সম্পদ আছে তা কাজে লাগিয়ে কীভাবে নিজের কার্যকারিতা ও কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি করা যায় তার বিভিন্ন উপায় খুঁজুন।

আপনার চাকরি ও ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য কী কী? সেগুলোর কি পরিবর্তন হয়েছে?

আপনার সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ, মূল্যবান ও উৎপাদনশীল কর্মী কারা?

আপনি কীভাবে আপনার কাজের পুনঃগঠন করতে পারেন যাতে আপনার সেরা ও সর্বাধিক উৎপাদনশীল লোকেরা আপনার সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য ও সেরা সুযোগগুলোতে মনোনিবেশ করতে পারে?

৪। পুনঃগঠন: এক্ষেত্রে আপনাকে নিজের লোকবল ও সম্পদ এমন ভাবে কাজে লাগাতে হবে যেন


আপনি ২০ ভাগ কাজ করে ৮০ ভাগ ফল পেতে পারেন।

কোন ২০ ভাগ কাজ করে আপনি ৮০ ভাগ লাভ অর্জন করতে পারেন?

কোন শীর্ষ ২০ ভাগ কাজ আপনার ৮০ ভাগ ফলাফলের জন্য দায়ী?

কোন ২০ ভাগ কর্মী তাদের কাজের মাধ্যমে ৮০ ভাগ ফলাফল এনে দেয়?


ব্যবসায় আপনার মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত মুনাফা অর্জন। নিজের লোকবল ও সম্পদকে এমন ভাবে ব্যবহার করুন যাতে মুনাফা অর্জনের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ইতিবাচক প্রভাব পড়ে।

৫। পুনঃনির্মাণ: প্রতিনিয়ত কিছু কিছু কাজ আউটসোর্সিং, ডাউনসাইজিং বা বাদ দিয়ে নিজের কাজ ও জীবন সহজ করার উপায় খুঁজুন।

কোন কোন কাজ কিংবা প্রক্রিয়াগুলো আপনি অন্যকে দিয়ে করাতে পারেন যাতে সেগুলো সহজে, কম সময়ে এবং স্বল্প অর্থ ব্যয়ে সম্পন্ন হয়?

আপনি কী কী কাজ অন্যের কাছে অর্পণ করতে পারেন বা বিশেষজ্ঞকে আউটসোর্স করতে পারেন?

কোন কোন অপ্রয়োজনীয় কিংবা কম গুরুত্বপূর্ণ কিংবা মুনাফাহীন কাজ করা আপনি সম্পূর্ণরূপে বাতিল করতে পারেন?

যতবার নিজেকে এই প্রশ্নগুলো জিজ্ঞেস করবেন আপনার বুদ্ধিমত্তা উদ্দীপিত হয়ে আপনাকে সঠিক উত্তর পেতে সাহায্য করবে যা আপনি নিজের ব্যবসায় কাজে লাগিয়ে কম খরচে স্বল্প সময়ে অধিক সাফল্য অর্জন করতে পারবেন।

৬। পুনঃআবিস্কার: নিজেকে প্রতিনিয়ত জিজ্ঞেস করুন কোন কাজগুলো আপনাকে পুনরায় করার সুযোগ দিলে ভিন্ন ভাবে করতেন।

মনে করুন, আপনার ব্যবসা কিংবা চাকরি আজকে পুনরায় শুরু করছেন। কোন কাজটি আপনি ভিন্নভাবে করতেন?


কোন কাজটি বেশি করতেন?

কোন কাজটি কম করতেন?

এখন করছেন না এমন কোন কাজ তৎক্ষণাৎ করা শুরু করতেন?

কোন কাজটি করা একেবারেই থামিয়ে দিতেন?


প্রতিবার এই প্রশ্নগুলো জিজ্ঞেস করার সময় আপনার জ্ঞান এবং চিন্তার পরিধির বিস্তার ঘটবে। কোন কাজগুলো করবেন কিংবা করবেন না কিংবা কম করবেন বা বেশি করবেন?

৭। পুনঃনিয়ন্ত্রণ: এবার আপনাকে ব্যবসায়িক বা চাকরির কোনো নির্দিষ্ট একটি ক্ষেত্রে উপরোক্ত ৬টি কৌশল কাজে লাগিয়ে কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হবে।


ব্যক্তিগত কিংবা কর্মজীবনের ক্ষেত্রে কোন পদক্ষেপটি এখনই নিতে চান?

নিজের কর্মীদের সাথে সম্পর্কিত কোন পদক্ষেপটি এখনই নিতে চান?

আপনার ব্যবসা সম্পর্কিত কোন পদক্ষেপটি এখনই নিতে চান?


প্রতিটি ক্ষেত্রে কল্পনা করবেন যে আপনার কোনো সীমা বা বাধ্যবাধকতা নেই। কল্পনা করবেন, আপনার ব্যক্তিগত ও ব্যবসায়িক জীবনে যেকোনো কিছু অর্জন করার মতো অফুরন্ত সময়, অর্থ, প্রতিভা ও ক্ষমতা আছে; বন্ধু, লোকবল ও সম্পদ আপনার হাতে রয়েছে। 

আপনার প্রধান কাজ হলো সঠিক কাজ সম্পর্কে সম্পূর্ণ স্পষ্ট ধারণা নিয়ে এরপর নিজেকে কাজটি সম্পন্ন করায় একান্তভাবে নিজেকে নিয়োজিত করা।


অনুশীলনী

১) আপনার ব্যক্তিগত ও কর্পোরেট ব্যবসার মডেল নিরীক্ষণ করুন। নিজেকে জিজ্ঞেসা করুন যে এর থেকে আরও ভালো উপায় আর কী হতে পারে যাতে আপনার বিক্রয়, মুনাফা ও ব্যক্তিগত আয় বৃদ্ধি পায়?

২) আপনার ব্যবসায়িক ও ব্যক্তিগত জীবনের প্রতিটি অংশে কেডব্লিউআইএনকে (কডওঘক) বিশ্লেষণ (কহড়রিহম ডযধঃ ও ঘড়ি কহড়)ি তথা ‘আমি এখন যা জানি’ বিশ্লেষণ প্রয়োগ করুন। ‘এমন কোনো কাজ কি এখন করছি যা আমি এখন যা জানি তা যদি আগে জানতাম তবে আমাকে পুনরায় শুরু করার সুযোগ দিলে কখনোই করতাম না?’

৩) আরও ভালো ফলাফল পেতে আপনি কোন কাজ কম করতেন, বেশি করতেন কিংবা একেবারেই করতেন না?


 




অধ্যায় ৮



সৃষ্টিশীল চিন্তা বনাম যান্ত্রিক চিন্তা


কল্পনার জগতই মানুষের সকল পরিকল্পনা তৈরির কারখানা।

- নেপোলিয়ন হিল


সৃষ্টিশীল মানুষ পৃথিবীর ওপর রাজত্ব করে! তারা প্রতিনিয়ত অন্যদের উপকার হয় এমন সব লক্ষ্য অর্জনের দ্রুততর, সহজতর এবং কার্যকরী উপায় খোঁজার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তারা ঈঅঘঊও তথা সিএএনইআই নীতি মেনে চলে। যার পূর্ণরূপ হলো ‘ঈড়হঃরহঁড়ঁং ধহফ ঘবাবৎ-ঊহফরহম ওসঢ়ৎড়াবসবহঃ’ তথা ‘অবিচ্ছিন্ন এবং প্রতিনিয়ত উন্নয়ন’।

মানব ইতিহাসের সকল যুগান্তকারী আবিষ্কার ও অগ্রগতি এদের হাত ধরেই এসেছে। তারা জানে একটি ভালো চিন্তা কিংবা কৌশল একজন মানুষের জীবন কিংবা একটি ব্যবসাকে সম্পূর্ণ পালটে দিতে সক্ষম।


যান্ত্রিক চিন্তা

অপরদিকে যান্ত্রিক চিন্তা হলো অনমনীয় ও কঠিন। এটি হলো, ‘আমার কথাই ঠিক’ জাতীয় চিন্তা। যান্ত্রিক চিন্তার মূলে রয়েছে ব্যর্থতা কিংবা ভুল করার ভয় এবং অর্থ বা সময় কিংবা উভয় হারানোর ভীতি। কোনো কাজে ব্যর্থ হয়ে সমালোচনা কিংবা অসমর্থন পাওয়ার ভীতি থেকেই এ চিন্তার উৎপত্তি।

এই ধরনের মানুষ পৃথিবীকে ধূসরের বিভিন্ন মাত্রায় দেখার বদলে কেবল সাদাকালো রঙে দেখে। তারা ভাবে ‘হ্যাঁ’ এর বিপরীত কেবল ‘না’ এবং ‘উপর’ এর বিপরীত কেবল ‘নিচে’। তারা চিন্তা করে কোনো কাজ করার কেবল একটি উপায়ই রয়েছে। অথচ সবসময়ই যেকোনো কাজ সুষ্ঠুভাবে করার একাধিক উপায় অবশ্যই খুঁজে পাওয়া যায়। পরিবর্তন ও বিরোধিতার মুখে তারা সাইকোসেক্লরোসিসে (ঢ়ংুপযড়ংপষবৎড়ংরং) ভুগে যার অর্থ হলো ‘যেমন আছে তেমনই থাকার চেষ্টা করা বা অপরিবর্তন অবস্থায় থাকার জন্য লড়াই করা’।

তারা সকলেই ‘হোমিওস্টেসিস’ (যড়সবড়ংঃধংরং) এ আক্রান্ত, যার মানে হলো স্থায়িত্বের সাধনা। তারা নিজেদের অভ্যস্ততার জগতেই বিচরণ করতে ইচ্ছুক। তারা নতুন কিংবা ভিন্ন কিছুকে ভয় পায়, তা তাদের বর্তমান পরিস্থিতির চেয়ে উন্নত কিছু হলেও। কিন্তু এটা আপনার জন্য নয়।


আপনি একজন সম্ভাবনাময় প্রতিভাধর ব্যক্তি

আপনার যত সৃষ্টিশীল প্রতিভা আছে তা শতজনমেও ব্যবহার করে শেষ করতে পারবেন না। যত বেশি নিজের সৃষ্টিশীলতাকে কাজে লাগাবেন তা ততই বৃদ্ধি পাবে। যখনই নতুন কিছু আবিষ্কার করবেন আপনার প্রতিভার তখনই বিকাশ ঘটবে। বলা হয়ে থাকে প্রতিটি শিশুই অসামান্য প্রতিভা নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। তার মানে আপনিও তাদের একজন।

বস্তুত সৃষ্টিশীলতা ব্যক্তিগত ও কর্মজীবনে সাফল্যের সবচেয়ে বড় নির্দেশক। যত বেশি সৃষ্টিশীল হবেন, তত বেশি নিত্যনতুন উপায় ও কৌশল কাজে লাগিয়ে ব্যক্তিগত ও কর্মজীবনের উন্নতি সাধন করতে সক্ষম হবেন। একটি শুভবুদ্ধি আপনার জীবনের দিকনির্দেশনা সম্পূর্ণ পালটে দিতে পারে।

কীভাবে সৃষ্টিশীলতাকে চিনবেন? সৃষ্টিশীল মানুষ কৌতূহলী। তারা অনেক প্রশ্ন করে এবং কখনোই সন্তুষ্ট হয় না। আপনার চারপাশের সবকিছু কীভাবে হচ্ছে, কেন হচ্ছে? এসকল প্রশ্নের উত্তর জানতে চেয়ে এবং কখনোই কেবল একটি সাদামাটা উত্তরে সন্তুষ্ট না হয়ে আপনি নিজের সৃষ্টিশীলতার বিকাশ ঘটাতে পারেন।


যুগের পরিক্রমায় প্রতিভা

যুগে যুগে প্রতিভাবানদের বৈশিষ্ট্যের ওপর অনেক গবেষণা করা হয়েছে। প্রথম আবিষ্কারটি ছিল যে বুদ্ধিমত্তা আইকিউ কিংবা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সাথে সম্পর্কিত নয়। অনেক তথাকথিত প্রতিভাবানেরই বুদ্ধিমত্তা সাধারণ কিংবা সাধারণের সামান্য উপরে ছিল। প্রতিভা কিংবা সৃষ্টিশীল চিন্তা বলতে আসলে বোঝায় জীবনের অবশ্যম্ভাবী চ্যালেঞ্জগুলোকে মোকাবেলার দৃষ্টিভঙ্গি। দেখা গেছে প্রতিভাবানেরা সময়ের সাথে তিনটি গুণাবলি অর্জন করে।


উদারমনা

প্রথমত, তারা প্রতিটি সমস্যা অথবা পরিস্থিতিকে প্রায় শিশুসুলভ আগ্রহ নিয়ে খোলামনে বিচার করে। জীবনে সম্পূর্ণ নতুন কোনো পরিস্থিতির সম্মুখীন হলে নিজের মনকে যত উদার রাখবেন, তত সহজে নিজের অভ্যস্ততার জগত থেকে বের হতে পারবেন। একই সাথে সেই পরিস্থিতি মোকাবেলার নতুন নতুন ধারণা ও অন্তর্দৃষ্টি আপনার সামনে উন্মোচিত হবে। আপনি সৃষ্টিশীল চিন্তা করতে সমর্থ হবেন। প্রতিভাবানেরা অবিরাম জিজ্ঞেস করে― ‘কেন?’ এবং ‘কেন নয়?’ এবং ‘হলে কী হতো?’

দ্বিতীয়ত, প্রতিভাবানেরা একটি সমস্যার প্রতিটি দিক বিবেচনা করে, তারা হুট করেই কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হয় না। বরং আরও নতুন নতুন তথ্য সংগ্রহে ব্রতী হয়। তারা প্রতিটি পদক্ষেপ নেওয়ার আগে তাদের সম্ভাব্য পরিকল্পনা যাচাইবাছাই করে নেয়। তারা জানে যে তাদের ভুল হতে পারে কিংবা তাদের পরিকল্পনাটি অচল হয়ে পড়তে পারে।


শ্রেষ্ঠ সমাধান

আলবার্ট আইনস্টাইনকে একবার জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, ‘যদি জানতে পারেন আগামী ৬০ মিনিটের মাঝে কোনো বড় এক দুর্ঘটনায় পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে এবং এই ৬০ মিনিটের মাঝে আপনাকে এই দুর্যোগ মোকাবেলার কোনো সমাধান খুঁজতে হবে তাহলে কী করবেন?’

আইনস্টাইন জবাব দেন, ‘আমি ৫৯ মিনিট দূর্যোগ সংক্রান্ত সকল প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহে ব্যয় করব এবং বাকি এক মিনিট সমস্যাটির শ্রেষ্ঠ সমাধান খোঁজার চেষ্টা করব।’

ব্যবসায় বিশেষ করে নতুন পণ্য উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে, আপনার নতুন পণ্য কিংবা সেবাটি ক্রেতাদের রুচি ও চাহিদার সাথে মিলে কিনা, তারা সেটি কেনার জন্য অর্থ ব্যয় করতে ইচ্ছুক কিনা ইত্যাদি তথ্য জানতে যত বেশি সময় ব্যয় করবেন, আজকের এই প্রতিযোগিতামূলক ও দ্রুত পরিবর্তনশীল বাজারে আপনার সফল হওয়ার সম্ভাবনা তত বেশি বৃদ্ধি পাবে।

নিয়মানুগ প্রচেষ্টা

তৃতীয়ত, সব রকমের প্রতিভাবানেরা কোনো সমস্যার সমধান ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে নিয়মানুগ প্রচেষ্টার প্রয়োগ করে। সুদক্ষ ও সফল গণিতবিদ, পদার্থবিদ, ডাক্তার, প্রকৌশলী ও অন্যান্য পেশার মানুষ অন্ধভাবে কোনো সমস্যা সমাধানের পিছে ছোটে না। বরং তারা সতর্কভাবে তৈরি একটি চেকলিস্ট অনুযায়ী ধাপে ধাপে সমস্যাটি সমধানের পথ খোঁজে।

অতুল গাওয়ান্দে তার দ্য চেকলিস্ট ম্যানিফেস্টো বইতে দুজন সফল বিনিয়োগ বিশেষজ্ঞের গল্প বলেছেন। এদের একজন আরেকজনের চাইতে বেশি সফল।

দেখা গেছে, এদের দুইজনেরই নিজেদের ও নিজেদের ক্লায়েন্টদের জন্য বিনিয়োগ করার এবং বিনিয়োগ মূল্যায়ন করার বহু বছরের অভিজ্ঞতা রয়েছে। কিন্তু অধিক সফল বিনিয়োগকর্তা বিনিয়োগ মূল্যায়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রশ্ন এবং পরীক্ষা সম্বলিত একটি চেকলিস্ট তৈরি করেছিলেন। তিনি যেকোনো বিনিয়োগ প্রস্তাব পেয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে এই চেকলিস্ট ব্যবহার করতেন।

অন্য উপদেষ্টাও কোনো বিনিয়গের ক্ষেত্রে একই রকমের পদ্ধতি এবং কলাকৌশল প্রয়োগ করলেও, তিনি নিজের অভিজ্ঞতা ও স্বজ্ঞার ওপর বেশি নির্ভর করতেন। ফলশ্রুতিতে এমন অনেক ক্ষেত্রেই তার বিনিয়োগ ব্যর্থ হতো যেখানে তা হওয়ার কথা ছিল না।

গাওয়ান্দে একটি কৌতূহলদ্দীপক তথ্য দিয়েছিলেন। প্রথম উপদেষ্টা, দ্বিতীয় উপদেষ্টার চাইতে অধিক সফল ছিলেন। তবে মাঝে মাঝে তারও ভুল হতো এবং বিনিয়োগ ব্যর্থ হতো। কারণ একই। তিনি সেসব ক্ষেত্রে নিজের চেকলিস্ট সঠিকভাবে না দেখে ঐ সিদ্ধান্তগুলো নিয়েছিলেন। তিনি চেকলিস্টের এক বা একাধিক গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট উপেক্ষা করেছিলেন। কিন্তু তিনি যখন আবার নির্ভুলভাবে সেই চেকলিস্ট দেখায় ফিরে গিয়েছিলেন তার সফলতার হার উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছিল।

 

নিয়মানুগ সমস্যা-সমাধান কৌশল

বিশেষজ্ঞ ও চিন্তাবিদগণের বহু বছরের প্রচেষ্টায় সমস্যা-সমাধান ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার একটি কাঠামোবদ্ধ / অকাঠামোবদ্ধ পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়েছে। আমি এর মাঝে শ্রেষ্ঠ উপায়গুলোকে একত্রিত করে একটি সহজ পদ্ধতি আবিষ্কার করেছি যা আপনি নিজের পেশাগত জীবনের সকল ক্ষেত্রে সবসময় ব্যবহার করতে পারবেন।

প্রথম ধাপ: একটি কাগজে সমস্যা কিংবা লক্ষ্যটি স্পষ্টভাবে লিখুন। যদি কাজটি দলগত হয়ে থাকে তবে সেই সমস্যা কিংবা লক্ষ্যটিকে একটি ফ্লিপ চার্ট কিংবা হোয়াইট বোর্ডে বারবার লিখুন যতক্ষণ না পর্যন্ত সবাই তাতে সম্মত হয়, ‘হ্যাঁ, এটিই আমাদের সমস্যার প্রকৃত সংজ্ঞা।’

চিকিৎসা বিজ্ঞানে একটি কথা আছে, ‘সঠিক রোগ নির্ণয় মানে অর্ধ আরোগ্য।’

ব্যবসাক্ষেত্রে, সমস্যার সঠিক সংজ্ঞা উপলব্ধি অধিকাংশ ক্ষেত্রে সমস্যার সমাধানকে স্পষ্ট করে তোলে।

দ্বিতীয় ধাপ: সঠিকভাবে লক্ষ্য কিংবা সমস্যার সংজ্ঞা নির্ণয়ের পর জিজ্ঞেস করুন, ‘আর কী সমস্যা রয়েছে?’

যেসকল সমস্যার একটি মাত্র সংজ্ঞা রয়েছে তাদের প্রতি সতর্ক থাকবেন। সমস্যাটিকে বিভিন্ন উপায়ে বারবার সংজ্ঞায়িত করার চেষ্টা করবেন যতক্ষণ পর্যন্ত না তার কোনো যৌক্তিক সমাধান লাভের উপায় বের হয়। (নোট: হয়তো দেখা যাবে সমস্যাটি আসলে সমস্যাই নয় বরং সুযোগ।)

সবচেয়ে বড় ভুল হলো, ভুল সমস্যার কিংবা অস্তিত্বহীন সমস্যার অসাধারণ সমাধান আবিষ্কার করা।


পণ্য ব্যর্থ হওয়ার হার

নতুন পণ্য ও সেবার পূর্ণ ৮০ ভাগই ১২ মাসের মাথায় অচল হয়ে পড়ে। এর মূল কারণ হলো কোম্পানিগুলো এমন সব পণ্য বা সেবা বাজারে আনে যার কোনো চাহিদাই নেই।

এক্ষেত্রে একটি কুকুরের খাবার উৎপাদন কোম্পানির কথা মনে পড়ে যায়। তারা সকল পুষ্টিগুণাগুণসম্পন্ন একটি নিখুঁত কুকুরের খাদ্য উৎপাদনে কয়েক কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছিল। কিন্তু পণ্যটি বাজারে ব্যর্থ হয়। ঐ কোম্পানিকে এই ব্যর্থতার কারণ জিজ্ঞেস করা হলে তারা জবাব দেয়, ‘সমস্যাটি হলো, কুকুরগুলো খাবারটিকে ঘৃণা করে।’

আপনার নির্ণয় করা সমস্যার সংজ্ঞাই আপনার সমাধান আবিষ্কারের পথ বাতলে দিবে। যদি সমস্যার সংজ্ঞাটি ভুল হয় তবে আপনার সমাধান যতই কার্যকরী হোক না কেন তা কোন কাজে আসবে না।


বিক্রয় উন্নয়ন প্রক্রিয়া

বিক্রয় প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে কাজ করার সময় আমি সৃষ্টিশীল চিন্তার একটি নিয়মানুগ পদ্ধতি অনুসরণ করি। প্রায় সব ক্ষেত্রেই একটি ব্যবসায় সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো নিম্ন বিক্রয় হার। তাই আমি শুরুতেই এই প্রশ্নটি জিজ্ঞেস করি, ‘সমস্যাটি কী?’

সমস্যার প্রথম সংজ্ঞাটি সচরাচর হয়ে থাকে, ‘আমাদের বিক্রয় হার খুবই কম।’


আর কী সমস্যা রয়েছে?

আমরা নতুন ক্রেতাদের আকর্ষণ করতে পারছি না।

আর কী সমস্যা রয়েছে?

যেই ক্রেতাদের আকৃষ্ট করতে পারছি তারা যথেষ্ট পরিমাণে ক্রয় করছে না।

আর কী সমস্যা রয়েছে?

আমরা যথেষ্ট পরিমাণে সম্ভাব্য ক্রেতাদের প্রকৃত ক্রেতায় রুপান্তর করতে পারছি না।

আর কী সমস্যা রয়েছে?

আমাদের বিজ্ঞাপন ও প্রচার যথেষ্ট পরিমাণে নতুন ক্রেতাদের আকর্ষণে ব্যর্থ।

আর কী সমস্যা রয়েছে?

আমাদের ক্রেতারা নিয়মিত ক্রয় করছে না।

আর কী সমস্যা রয়েছে?

আমাদের ক্রেতারা আমাদের প্রতিদ্বন্ধীদের কাছ থেকে অধিক পরিমাণে ক্রয় করছে।


যতক্ষণ পর্যন্ত সমস্যার সঠিক সংজ্ঞা না পাচ্ছেন এই ‘আর কী’ প্রশ্নটি জিজ্ঞেস করতে থাকুন।

সঠিক সংজ্ঞা উত্তম সমাধান এনে দেয়

এই উত্তরগুলোর প্রত্যেকটির সমাধান সম্পূর্ণ ভিন্ন। তাই এদের মাঝে যেই উত্তরটিকে আপনার সমস্যা হিসাবে চিহ্নিত করবেন তার সমধানও বাকিগুলোর থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন হবে। আর তাই উত্তরগুলোকে বারবার যাচাই করে সঠিক সমস্যাটিকে বের করে আনা অত্যধিক গুরুত্বপূর্ণ।

তৃতীয় ধাপ: এবার প্রশ্ন করুন, ‘আমাদের সমস্যার সমাধান কী?’

উত্তর পাওয়ার পর আবার জিজ্ঞেস করুন, ‘আর কী সমাধান থাকতে পারে?’

যেই সমস্যার একটি মাত্র সমাধান থাকবে তাদের প্রতি সতর্ক থাকুন। সম্ভাব্য সমাধান সংখ্যা এবং চূড়ান্ত সমাধানের মাঝে সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। অনেক সময় দুটি অবাস্তব সমাধান মিলে এমন একটি অসাধারণ সমাধানে পরিণত হতে পারে যা আপনার ব্যবসার চেহারাই বদলে দিবে।

চতুর্থ ধাপ: যখন অনেক সম্ভাব্য সমাধান পেয়ে যাবেন তখন তাদের মধ্য থেকে সবচেয়ে ভালোগুলোকে নিয়ে সিদ্ধান্ত নিন। অনেক ক্ষেত্রেই সিদ্ধান্তহীনতার চেয়ে যেকোনো একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া উত্তম। যদি তৎক্ষণাৎ কোনো সিদ্ধান্ত নিতে না পারেন তবে একটি ডেডলাইন ঠিক করে সেই সময়ের মাঝে নিজের চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে উপনীত হোন এবং সেই অনুযায়ী পদক্ষেপ নিন।

স্টিভ জবস বলেছিলেন, ‘সৃষ্টিশীল চিন্তার উৎপত্তি হয় ভিন্নভাবে বিন্দুগুলোর মাঝে সংযোগ স্থাপনের মাধ্যমে।’ উন্নত চিন্তাশীল ব্যক্তিদের মূলমন্ত্র হলো: যদি কোনো সিদ্ধান্ত নিতে সমস্যা হয় তবে আরও বেশি বিন্দু সংগ্রহ করুন। আরও বেশি তথ্য যাচাই করুন। একজন বিশেষজ্ঞের সাহায্য নিন। শ্রেষ্ঠ তথ্যগুলো সংগ্রহে কার্পণ্য করবেন না। একটি নতুন কৌশল কিংবা উপায় আপনার প্রচুর অর্থ বাঁচিয়ে দিবে।

পঞ্চম ধাপ: কীভাবে আপনার সিদ্ধান্তের সাফল্য যাচাই করবেন তা নির্ধারণ করুন। এর জন্য স্পষ্ট একটি মানদ- তৈরি করুন। আপনার কাক্সিক্ষত ফলাফলকে সংখ্যায় ব্যক্ত করুন। নিয়ম হলো: ‘যদি ব্যবসায় সাফল্য চান তবে সবকিছুর মানদন্ড নির্ধারণ করুন। যদি ধনী হতে চান তবে সবকিছুকে আর্থিক মাপকাঠিতে বিচার করুন।’

মনে রাখবেন যদি কিছু পরিমাপ করতে না পারেন তবে সেটি নিয়ন্ত্রণও করতে পারবেন না। যা পরিমাপ করা যায় তা অর্জন করা যায়।

ষষ্ঠ ধাপ: প্রকল্প, কাজ কিংবা কাজের ধাপগুলো নির্দিষ্ট ব্যক্তি কিংবা ব্যক্তিদের হাতে সমর্পণ করুন।

প্রত্যেকটি পণ্য, সেবা অথবা প্রকল্পের জন্য প্রয়োজন একজন বিজয়ী যে, প্রকল্পটিকে নিয়ন্ত্রণ করবে। এই ব্যক্তির ব্যক্তিগত সাফল্য, বেতন, পদোন্নতি সবকিছু তার কাজের সাফল্যের ওপর নির্ভর করবে।

ছোটবড় সব কোম্পানির একটি বড় ভুল হলো তারা একটি নতুন পণ্য, সেবা কিংবা প্রকল্পের পরিকল্পনা করেই আবার স্বাভাবিক কাজে ফিরে যায়। নির্দিষ্ট কাউকে এই প্রকল্পের দায়িত্ব দেওয়া হয় না। এর ফলে তা ‘এতিম প্রকল্প’ হয়ে পড়ে― কাজটি সবারই আবার কারোই নয়। আপনার প্রতিষ্ঠানে কখনো এমনটি হতে দিবেন না।

সপ্তম ধাপ: কাজ সম্পন্ন করার একটি ডেডলাইন এবং সাব-ডেডলাইন নির্ধারণ করুন। সম্ভাব্য ফলাফল যত বেশি গুরুত্বপূর্ণ হবে আপনাকে তত বেশি যথাযথভাবে তার অগ্রগতি পরিমাপ ও নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। আপনি যা চান তা হচ্ছে কিনা যাচাই করুন। যা যাচাই করা হয় তা অর্জন করা হয়।

অষ্টম ধাপ: একটি বিকল্প পরিকল্পনা রাখুন যাতে কোনো কারণে প্রথম পরিকল্পনাটি বিফল হলে বিকল্প পথে অগ্রসর হতে পারেন। ‘দূর্যোগ প্রতিবেদন’ ফর্ম পূরণ করুন। নিজেকে জিজ্ঞেস করুন, ‘এই অবস্থায় সবচেয়ে খারাপ কী হতে পারে?’

সবচেয়ে খারাপ ফলাফল হলো প্রকল্পটি সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়ে আপনার সকল বিনিয়োগকৃত অর্থ ও সময় অপচয় হওয়া।

কীভাবে এই ব্যর্থতার সম্ভাবনাকে হ্রাস করা যায়? কীভাবে সাফল্যের সম্ভাবনাকে বৃদ্ধি করা যায়? যদি আপনার সমাধান কাজে না লাগে তবে কী করবেন?


একটি বিকল্প পরিকল্পনা তৈরি করুন

শ্রেষ্ঠ নৃপতিগণ সব যুদ্ধই জয় করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, কিন্তু তারা পরাজয়ের জন্যেও সদা প্রস্তুত। তারা যোদ্ধা ও সমরাস্ত্র মজুদ রাখে। তারা একটি বিকল্প পরিকল্পনা রাখে। তারা জানে সম্পূর্র্ণ পরাজয়ের চেয়ে পিছু হটা উত্তম।

একটি নতুন কাজে কখনোই নিজের সর্বস্ব বিলিয়ে দিবেন না। সবসময় পরিকল্পিতভাবে ঝুঁকি নিবেন, এমন ঝুঁকি যার ক্ষতি কাজটি বিফল হলেও আপনি কাটিয়ে উঠতে পারবেন।

‘আশা’ করা কোনো কৌশল হতে পারে না, এটি কেবল বিপর্যয়ের সূত্র। ব্যবসায় কোনো পণ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে ‘বানাও তবেই ক্রেতা আসবে’― এই কথাটি ব্যর্থতার নিশ্চিত সূত্র।

নবম ধাপ: আপনার পরিকল্পনা অনুযায়ী পদক্ষেপ নিন। দ্রুত কাজে নেমে পড়–ন। কাজের তাৎপর্য উপলব্ধি করুন। কিছু করুন। যেকোনো কিছু। কিন্তু যত দ্রুত সম্ভব কাজটি শুরু করুন। 

জেনারেল জর্জ প্যাটন বলেছেন, ‘এই মুহূর্তে দ্রুতবেগে নিষ্পন্ন একটি ভালো পরিকল্পনা আগামী সপ্তাহে নিষ্পন্ন একটি নিখুঁত পরিকল্পনার চাইতে উত্তম।’

ব্যবসা ক্ষেত্রে যেকোনো সমস্যা কিংবা বাধার সম্মুখীন হলে এই নিয়মানুগ পদ্ধতি ধাপে ধাপে অনুসরণ করুন এবং উচ্চতর চিন্তার কৌশল অবলম্বন করুন। ফলাফল আপনাকে অবাক ও আনন্দিত করবে।


সমাধানমূলক চিন্তা বনাম সমস্যামূলক চিন্তা

আপনার বুদ্ধিমত্তার আসল পরিচয় আপনার সমস্যা সমাধান ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতায় নিহিত। আপনার বিজনেস কার্ডে যেই পদবিই লেখা থাকুক না কেন আপনার আসল পরিচয় হলো ‘সমস্যার সমাধানকারী’। সকালে কাজ শুরু পর থেকে সন্ধ্যায় কাজ শেষের আগ পর্যন্ত আপনি সারাদিন ছোটবড় নানা সমস্যার সমাধানই করে থাকেন।

জেনারেল কলিন পাওয়েল বলেছেন, ‘নেতৃত্ব হলো সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা।’ সফলতাও আসলে সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা। কোনো লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থতা বস্তুত ঐ ক্ষেত্রে সমস্যা সমাধানে অপারগতা। আর একারণেই সমস্যা সমধানে একটি উচ্চতর ও ধারাবাহিক নিয়মানুগ পরিকল্পনা অনুসরণ করা আপনার সর্বোচ্চ সফলতা লাভের জন্য একান্ত জরুরি।


সমাধান নিয়ে ভাবুন

সফল ব্যক্তিরা সর্বদা সমস্যার সমাধানে মনোনিবেশ করে। আর অসফল ব্যক্তিরা সমস্যা নিয়ে ভেবেই সময় অপচয় করে। সফল ব্যক্তিরা কোনো পদক্ষেপ নিলে সমস্যার সমাধান হবে কিংবা বাধা দূর হবে তা আবিষ্কারের চেষ্টায় মগ্ন থাকে।

অসফল ব্যক্তিরা সমস্যায় জর্জরিত থাকে আর ভাবে কাকে দোষারোপ করা যায়। কোনো সমস্যা কিংবা বাধার সম্মুখীন হলেই তারা নিজেদের ক্রোধ ও হতাশায় নিমজ্জিত হতে দেয়। এটি নেতিবাচক চিন্তার জন্ম দেয় এবং দোষীকে খোঁজার আহ্বান জানায়― ‘কে এর জন্য দায়ী?’

অথচ এই মনোভাব সমস্যার সমাধান প্রাপ্তিতে কোনো ভূমিকাই রাখে না।


আপনার সৃষ্টিশীলতাকে উন্মুক্ত করুন

সৃষ্টিশীলতাকে উন্মুক্ত করার তিনটি চাবিকাঠি রয়েছে যা আমরা আগেই আলোচনা করেছি। এগুলো হলো― স্পষ্টতা, একাগ্রতা ও মনোযোগ।

প্রথমত, আপনাকে লক্ষ্য সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা রাখতে হবে কিন্তু সেই লক্ষ্য অর্জনের প্রক্রিয়ায় নমনীয় হতে হবে। মন উদার রাখুন। একই ফলাফল অর্জনের বিভিন্ন উপায় থাকতে পারে― এই কথাটি সবসময় মাথায় রাখুন।

দ্বিতীয়ত, নিজের ও অন্যদের সমস্ত বুদ্ধিমত্তার সমন্বয়ে একটি সমস্যা, বাধা কিংবা বিপত্তির ওপর একাগ্রভাবে মনোনিবেশ করুন। কোনো বিক্ষেপ যাতে আপনার মনোযোগ নষ্ট করতে না পারে সেদিকে লক্ষ্য রাখুন। একই সময় কেবল একটি বিষয়ের ওপর কাজ করুন।

তৃতীয়ত, সবকিছু বাদ দিন এবং কাক্সিক্ষত ফল না পাওয়া পর্যন্ত শতভাগ মনোযোগের সাথে সমস্যা সমাধানে কিংবা লক্ষ্য অর্জনের ওপর মনোনিবেশ করুন।


বিক্ষিপ্ত জিনিসের প্রতি আকর্ষণ

আজকের কম্পিউটার ও ই-মেইলের আধুনিক যুগে হয়তো মানুষের সবচেয়ে বড় শত্রু হলো ‘ধঃঃৎধপঃরড়হ ড়ভ ফরংঃৎধপঃরড়হ’ তথা ‘বিক্ষিপ্ত জিনিসের প্রতি আকর্ষণ’। মানুষ প্রতিনিয়ত চকচকে ও ক্ষণিক উত্তেজক জিনিসের পিছনে ছুটছে। ই-মেইল, টেক্সট মেসেজ, ফোনকল ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম মানুষের মনঃসংযোগ করার ক্ষমতা কমিয়ে দিচ্ছে।

ইউএসএ টুডের মতে, প্রতিনিয়ত ইলেক্ট্রনিক বিক্ষেপের (বষবপঃৎড়হরপ রহঃবৎৎঁঢ়ঃরড়হং) প্রতি প্রতিক্রিয়া দেখানোর ফলে বিশেষ করে ই-মেইল ও টেক্সট মেসেজের প্রতি আসক্তির কারণে মানুষের মস্তিস্কের জ্বালানি তথা গ্লুকোজ দ্রুত ক্ষয় হয়। একজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি সারাদিন ই-মেইল দেখে নিজের মনোযোগ ব্যাহত করে। স্মার্ট ফোনের মেসেজ, ই-মেইলের নোটিফিকেশন তাকে একাগ্র মনে কাজ করতে দেয় না। ফলশ্রুতিতে একজন ই-মেইল আসক্ত মানুষ প্রতিদিন পূর্ণ ১০ পয়েন্ট আইকিউ হারায় এবং প্রতি ঘন্টায় তার বুদ্ধিমত্তা হ্রাস পায়। দিনশেষে অনেকেই কর্মশক্তি হারিয়ে অচল হয়ে পড়ে এবং সহজ সিদ্ধান্তগুলো নিতেও অপারগতা প্রকাশ করে। আর তাই তারা কর্মক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়তে থাকে।


মাল্টি টাস্কিং বনাম টাস্ক সুইচিং

ঘনঘন ইমেইল, ফোনকল, মেসেজ দেখার ফলে মানুষ মাল্টি টাস্কিং বা একাধিক কর্ম করা শুরু করে। তবে এর সঠিক সংজ্ঞা হলো টাস্ক সুইচিং বা ঘন ঘন কাজের পরিবর্তন। আপনি আসলে মাল্টি টাস্কিং কিংবা অনেক কাজ এক সাথে করছেন না বরং আপনি বারবার এক কাজ থেকে আরেক কাজের দিকে ছুটছেন। এক গবেষণায় দেখা গেছে, একটি কাজ থেকে সরে কোনো মেসেজ দেখে আবার ঐ কাজে ‘ফেরত’ আসতে ১৭ মিনিট সময় লাগে।

সারাদিন এক কাজ থেকে এক আরেক কাজে ছোটাছুটির ফলে আসলে কোনো কাজই সঠিকভাবে সম্পাদন হয় না। এর সাথে যখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম যেমন ফেসবুক, টুইটার, লিঙ্কডিন ইত্যাদির আসক্তি যুক্ত হয় তখন তা আপনার পেশার জন্য অভিশাপে পরিণত হয়। এজন্যেই বলে, ‘সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যোগাযোগ হয় কাজ হয় না।’

এই সমস্যার সমাধান কিন্তু সহজ। নিয়ম তৈরি করে নিন। দিনে দুইবার ইমেইল দেখবেন, সকাল ১১টায় আর বিকাল ৩টায়। বাকি সময় সবকিছু বন্ধ করে সমস্ত মনোযোগ দিয়ে নিজের কাজ করুন।


সীমাবদ্ধতা নীতি

এটি অন্যতম সেরা একটি চিন্তা কৌশল। সীমাবদ্ধতা নীতি (ঃযব ঢ়ৎরহপরঢ়ষব ড়ভ পড়হংঃৎধরহঃং) বলে, আপনার এবং আপনার লক্ষ্য অর্জনের পথে যেই বাধা আছে তা আপনি কত দ্রুত সময়ে ঐ লক্ষ্য অর্জন করতে পারবেন সেটি নির্ধারণ করে।

মাঝে মাঝে একে বোটলনেক (নড়ঃঃষবহবপশ) কিংবা চোক পয়েন্টও (পযড়শব ঢ়ড়রহঃ) বলা হয়। ইন্টেলের প্রাক্তন কর্মকর্তা এন্ড্রু গ্রোভ, কোনো উৎপাদন প্রক্রিয়ার প্রধান বাধাকে ‘ষরসরঃরহম ভধপঃড়ৎ’ তথা ‘সীমাবদ্ধতা গুণক’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। বর্তমানে আপনার জীবনের প্রধান লক্ষ্য কী, কোন বাধাটি এই লক্ষ্য অর্জনের গতি নির্ধারণ করছে?

প্রশ্নটিকে এভাবেও সাজানো যায়, ‘আপনি এখনও কেন লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারেননি?’

যদি আপনার লক্ষ্য হয়ে থাকে আপনার বিক্রয় ও মুনাফা ৫০ ভাগ বৃদ্ধি, তবে এখনও কেন তা করতে পারেননি? যদি আপনার লক্ষ্য ওজন কমানো হয়ে থাকে, তবে এখনও কেন নিজের কাক্সিক্ষত ওজনে পৌঁছাতে পারেননি? এই প্রশ্নগুলো জিজ্ঞেস করলে প্রথমেই যেই উত্তর মাথায় আসবে তা হলো আপনার সীমাবদ্ধতা। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই যেই উত্তর মাথায় আসবে তা হলো আপনার প্রিয় অজুহাত যার কারণে আপনি কোনো বিশেষ ক্ষেত্রে উন্নতি করতে পারছেন না।


সীমাবদ্ধতা গুণকটিকে চিহ্নিত করুন

প্রতিটি পরিস্থিতিতে আপনার প্রথম কাজ হলো সীমাবদ্ধতা গুণকটিকে চিহ্নিত করে সেই সীমাবদ্ধতাটিকে দূর করায় একান্তচিত্তে মনোনিবেশ করা। এভাবে চিন্তা করে এবং কর্ম সম্পাদনের মাধ্যমে আপনি দ্রুততর সময়ে নিজের লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবেন।

৮০/২০ নীতি আপনার ব্যক্তিগত ও পেশাগত জীবনের সীমাবদ্ধতার ক্ষেত্রেও খাটে। আপনার পথের ৮০ ভাগ বাধা আপনার নিজের এবং ব্যবসায়িক ক্ষেত্রের মাঝেই নিহিত। বাকি ২০ ভাগ হলো বাহ্যিক বাধা।

যখনই বাধা দূর করার কাজ শুরু করবেন তখনই নিজেকে দিয়ে শুরু করুন। আসল প্রশ্নটি জিজ্ঞেস করুন, ‘আমার অথবা আমার ব্যবসার কোন সীমাবদ্ধতার কারণে আমি নিজের লক্ষ্য অর্জন করতে পারছি না?’

মনে রাখবেন, মানুষের স্বভাবজাত প্রতিক্রিয়া হলো বাহ্যিক বাধা কিংবা অন্য মানুষের ওপর দোষ চাপানো। উন্নত চিন্তাশীল মানুষের মূলনীতি হলো তারা যেকোনো সমস্যার দায়িত্ব সম্পূর্ণ নিজের ওপর নিয়ে নেয় এবং নিজের ত্রুটি আবিষ্কার করে। এরপর তারা নিজের লক্ষ্য অর্জনের সময়সীমা নির্ধারণ করে।

 

যদি― প্রশ্নমূলক চিন্তা

সৃষ্টিশীলতাকে উন্মুক্ত করার একটি শক্তিশালী প্রশ্ন হলো ‘যদি’। প্রতিবার নিজেকে এই প্রশ্ন জিজ্ঞেসের মাধ্যমে আপনি নিজের সীমাবদ্ধ চিন্তার শৃঙ্খল ভেঙে নিজের চিন্তার জগতের বিস্তৃতি ঘটাতে পারবেন।

এই ‘যদি’ ভিত্তিক চিন্তাকে একটি যুগান্তকারী ধারণা হিসাবে গণ্য করা হয় যা কিনা ফেডারেল এক্সপ্রেসকে (ঋবফবৎধষ ঊীঢ়ৎবংং ড়ৎ ঋবফঊী) পৃথিবীর অন্যতম সফল কোম্পানিতে পরিণত করেছে। এটি শুরু হয়েছিল এ প্রশ্ন জিজ্ঞেসের মাধ্যমে, ‘যদি একটি চিঠি দেশের যেকোনো প্রান্তে রাতারাতি পৌঁছানো যায় তবে কেমন হবে?’

যখন ফ্রেড স্মিথ, ফেডএক্সের প্রতিষ্ঠাতা, চেয়ারম্যান, প্রেসিডেন্ট ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। তিনি যখন ইয়েলে তার স্নাতক কোর্সের টার্ম পেপারে এই তত্ত্বটি প্রকাশ করেন তখন তার অধ্যাপক তাকে ‘সি’ গ্রেড দিয়ে বলে তার এ ধারণা বাস্তবসম্মত নয়। সেই সময় আমেরিকার সবচেয়ে দ্রুত মেইল সার্ভিস দেশের যেকোনো জায়গায় একটি চিঠি পৌঁছাতে ৩ থেকে ৫ দিন সময় নিত। অনেক সময় এরচেয়ে বেশি সময়ও লেগে যেত। এই এক রাতের মাঝে চিঠি পৌঁছানো তখনকার দিনে প্রায় অবাস্তবই ছিল।


বাঁধ ভাঙুন

বারবার ‘যদি’ প্রশ্ন জিজ্ঞেসের মাধ্যমে ফ্রেড স্মিথ এবং ফেডএক্সের কর্মকর্তারা নতুন নতুন সৃষ্টিশীল উদ্ভাবনের মাধ্যমে শুধু নিজেদের লক্ষ্য অর্জনই করেনি বরং পৃথিবীর অন্যতম সফল প্রতিষ্ঠানে পরিণত হতে সক্ষম হয়েছে।


‘যদি মোবাইল ফোনের স্ক্রিনে কী-বোর্ড দেওয়া যায় তবে কেমন হবে?’

(অ্যাপল, বর্তমানে পৃথিবীর বৃহত্তম কোম্পানি)

‘যদি যেকোনো বই ই-মেইলে অর্ডার করে সরাসরি বাসায় পৌঁছে দেওয়া যায় তবে কেমন হবে?’

(আমাজন.কম, পৃথিবীর বৃহত্তম বই বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠান)

‘কেমন হবে যদি একজন মানুষকে চাঁদে পাঠিয়ে আবার নিরাপদে পৃথিবীতে ফেরত আনা যায়?’

(জন এফ. কেনেডি― ১৯৬২ সাল)

যখন প্রেসিডেন্ট জন এফ. কেনেডি আমেরিকান স্পেস প্রোগ্রামের প্রধান বিজ্ঞানী ওয়ের্নার ভন ব্রাউনকে জিজ্ঞেস করেন যে একজন মানুষকে চাঁদে পাঠিয়ে আবার নিরাপদে পৃথিবীতে ফেরত আনতে কী প্রয়োজন তখন ভন ব্রাউন সহজভাবে জবাব দেন, ‘শুধু কাজটি করার সংকল্প চাই।’

আপনার ব্যক্তিগত ও পেশাগত জীবনের অনেক ক্ষেত্রেই সফলতার জন্য যা প্রয়োজন হলো, ‘কাজটি করার সংকল্প।’

আমার বন্ধু জোয়েল ওয়েল্ডোন তার এই উক্তির জন্য বিখ্যাত ছিলেন, ‘সাফল্য আমি পারব বলাতে আসে, পারব না বলাতে নয়।’ এই কথাটি আপনার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।


উদ্ভাবন প্রক্রিয়া

সকল সফল ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং কর্মকর্তাদের দর্শন হলো ঈঅঘঊও তথা সিএএনইআই নীতি। যার পূর্ণরূপ হলো ‘ঈড়হঃরহঁড়ঁং ধহফ ঘবাবৎ-ঊহফরহম ওসঢ়ৎড়াবসবহঃ’ তথা ‘অবিচ্ছিন্ন এবং প্রতিনিয়ত উন্নয়ন’।

নিজের অভ্যস্ততার জায়গা থেকে বেরিয়ে আসার দৃঢ় সংকল্প করুন। নিয়মিতভাবে দ্রুততর সময়ে, কম খরচে নিজের লক্ষ্য অর্জনের জন্য নিত্যনতুন উপায় খুঁজুন এবং সামনে অগ্রসর হোন। নতুন পণ্য, সেবা, পরিকল্পনা কিংবা কৌশল গঠন বা তৈরির ক্ষেত্রে বারবার ব্যর্থতার সম্মুখীন হওয়ার জন্য নিজেকে সদা প্রস্তুত রাখুন। সফলতার পথে আপনাকে অনেক বাধা, বিপত্তি, হতাশা ও সাময়িক ব্যর্থতার মুখোমুখি হতে হবে।

আইবিএম এর প্রতিষ্ঠাতা থমাস জে. ওয়াটসন সিনিয়রকে একবার জিজ্ঞেস করা হয়েছিল কীভাবে দ্রুত সফলতা অর্জন করা যায়। তিনি উত্তরে বলেছিলেন, ‘যদি দ্রুত সফল হতে চান তবে ব্যর্থতার হার দ্বিগুণ করুন। ব্যর্থতার পরেই সফলতার দেখা মেলে।’

আসলে ব্যর্থতা বলতে কিছু নেই। শুধু রয়েছে প্রতিক্রিয়া। দুঃসময় আপনাকে ভাঙ্গতে নয়, গড়তে আবির্ভূত হয়। সূত্রটি সবসময় একই, ‘বারবার চেষ্টা করো, এরপর অন্যভাবে চেষ্টা করো।

আপনার সমস্যার সমাধান, সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা এবং নতুন ও সৃষ্টিশীল উপায়ে বিক্রয় ও মুনাফা বৃদ্ধি করে নিজের ব্যবসায় উন্নতি করার ক্ষমতাই আপনার সাফল্যের মূল চাবিকাঠি।

 

অনুশীলনী

১) আপনি বা আপনার ব্যবসা আজ যেই সমস্যায় জর্জরিত তাকে বেছে নিন এবং সমস্যা সমাধানের নিয়মানুগ পদ্ধতিতে তা সমধানের চেষ্টা করুন। এটি আপনার ভবিষ্যৎ পরিবর্তন করতে সক্ষম।

২) একটি লক্ষ্য নির্ধারণ করে তার সীমাবদ্ধতা গুণকটি সনাক্ত করুন যা লক্ষ্যটি অর্জনের গতি নিয়ন্ত্রণ করছে। এই সীমাবদ্ধতা দূর করতে আপনি কী করতে পারেন?

৩) একটি পণ্য বা সেবা নির্বাচন করুন এবং তাকে আরও উন্নত করার সম্ভাব্য যত উপায় রয়েছে তা উদ্ভাবন করুন যাতে আপনার গ্রাহকরা দ্রুত সময়ে এবং সস্তায় তা ক্রয় করতে পারে।



 




অধ্যায় ৯



উদ্যোক্তা চিন্তা বনাম কর্পোরেট চিন্তা


আপনার জ্ঞানের প্রতি সৎ থাকুন। এটিই আপনার প্রকৃত আদর্শ। যদি নিজের সেরাটা করতে পারেন তবে আর কিছু করতে হবে না।

- এইচ.ডব্লিউ. ড্রেসার


সব মানুষই তাদের পেশাগত জীবনে আর্থিক সাফল্যের সর্বোচ্চ চূড়ায় আরোহণ করতে চায়। দ্য মিলিওনেয়ার নেক্সট ডোর বইয়ের লেখক থমাস স্ট্যানলির মতে পূর্ণ ৮০ ভাগ স্ব-প্রতিষ্ঠিত ধনকুবেরই উদ্যোক্তা। তারা এক জীবনেই নিজেদের ব্যবসা শুরু করে এবং নতুন পণ্য উৎপাদন ও বিক্রয় করে নিজেদের সম্পদ অর্জন করেছে। তারা বেশির ভাগ সময়ে উদ্যোক্তাদের মতোই আচরণ করেছে।

২০১৫ সালের মার্চে প্রকাশিত ফোর্বস ম্যাগাজিনের মতে পৃথিবীতে বর্তমানে ১,৮২৬ জন ধনকুবের রয়েছে যাদের ৬৬ ভাগ স্ব-প্রতিষ্ঠিত। তারা উদ্যোক্তা হিসাবে শূন্য থেকে কাজ করে নিজেদের এই সম্পদ গড়ে তুলেছে। তারা এমন সব পণ্য কিংবা সেবা উদ্ভাবন ও বিক্রয় করেছে যা মানুষ টাকা দিয়ে কিনতে চেয়েছে ও কিনেছে।


ক্রেতা নিয়ে ভাবুন

উদ্যোক্তা চিন্তার মানে হলো সর্বক্ষণ ক্রেতাদের ওপর মনোনিবেশ করা এবং তাদের নিয়ে চিন্তা করা।

টম পিটার্স তার ইন সার্চ অফ এক্সিলেন্স বইতে লিখেছেন সফল ব্যবসার সবচেয়ে বড় গুণ হলো, ‘গ্রাহক সেবার প্রতি দুর্নিবার আসক্তি।’

কিছুদিন আগে আমি ২ বিলিয়ন ডলার সমমূল্যের এক প্রতিষ্ঠানের প্রেসিডেন্টের সাথে সারাদিন কাটিয়েছিলাম। তার এই ২ বিলিয়ন ডলারের ব্যবসার সূত্রপাত হয়েছে তাদের বাসার রান্নঘরে। যখন তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম তার ব্যবসার কোনো পদে তিনি নিজেকে কল্পনা করেছিলেন তখন তিনি জবাব দেন, ‘প্রধান বিক্রয় কর্মকর্তা’। তিনি আরও বলেন, ‘আমরা যখন শুরু করি তখন এটাই আমার পদবি ছিল আর এখনও আছে। আমি সারাক্ষণ বিক্রয় নিয়েই ভাবি।’


কর্পোরেট চিন্তা

কর্পোরেট চিন্তা, উদ্যোক্তা চিন্তা থেকে আলাদা। একটি প্রতিষ্ঠানের লোকবল: কর্মচারী, পরিচালক বা প্রযুক্তিবিদ যাই হোক না কেন, ক্রেতারা নতুন বা ভিন্ন কিছু চাইলে কিংবা কোনো অনুরোধ বা অভিযোগ করলে তাকে বিরক্তি অথবা বিতৃষ্ণার দৃষ্টিতে দেখে। তারা বেশির ভাগ সময়ে ক্রেতাদের ইচ্ছাকে মাছির মতো তাচ্ছিল্যের সাথে উড়িয়ে দেয়।

কর্পোরেট চিন্তাকারীরা শুধু নিজের কাজ, ঊর্ধ্বতনদের সন্তুষ্টি, নিয়ম মানা নিয়েই ব্যস্ত থাকে। তারা ততটুকুই কাজ করে যতটুকু না করলে তাদের চাকরি চলে যাবে। যেসব কর্মচারীদের চিন্তা এমন তারা নিজেদের প্রতিষ্ঠান ও প্রতিষ্ঠানের উচ্চপদস্থের সম্বোধন করতে ‘তারা বা তাদের’ এই সর্বনামগুলো ব্যবহার করে।

তারা ভাবে প্রতিষ্ঠানের সার্বিক অবস্থার সাথে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই। তারা বলে, ‘কাজ কাজই’। একবার এক কর্পোরেট চিন্তার অধিকারী ব্যক্তি আমাকে বলেছিল, ‘যখন কাজে যাই তখন কাজের কথা ভাবি, যখন বাসায় আসি তখন একবারও নিজের চাকরি কিংবা প্রতিষ্ঠানের কথা মাথায় আসে না।’


সংযুক্ত হওয়ার অক্ষমতা

অনেক গবেষক এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, ছোটবড় সব প্রতিষ্ঠানের ৬০ ভাগেরও বেশি কর্মচারী হলো ‘সংযোগচ্যুত’। নিজেদের প্রতিষ্ঠানের প্রতি তাদের কোনো রকম আনুগত্য কিংবা আকর্ষণ নেই। তারা শুধু যন্ত্রের মতো কাজ করে যাচ্ছে এবং অন্য কিছু নিয়ে ভাবছে। তারা নিয়মিত চাকরির বিজ্ঞাপন দেখে এবং ক্রেইগসলিস্ট, লিংকডিনসহ অন্যান্য ওয়েবসাইটে নিজেদের যোগ্যতা পোস্ট করে ভিন্ন চাকরি খোঁজে।

কর্পোরেট চিন্তার অধিকারীরা শেষ মুহূর্তে কাজ শেষ করে, কফি খেতে কিংবা দুপুরের খাবার খেতে সর্বোচ্চ সময় ব্যয় করে, অফিসের ৫০ ভাগ সময় আড্ডা দিয়ে, ই-মেইল দেখে কিংবা এমন সব কাজ করে অপচয় করে যার সাথে তাদের কর্মক্ষেত্রের উন্নয়নের কোনো সম্পর্কই নেই।

 

প্রতিশ্রুতিই হলো মূল চাবিকাঠি

উদ্যোক্তা চিন্তাবিদরা ভিন্ন চিন্তা করে। তারা নিজেদের প্রতিষ্ঠানের সাফল্য অর্জনে বদ্ধপরিকর। তারা নিজেদেরকে স্ব-নির্ভর ও স্ব-নিযুক্ত চিন্তা করে। তারা নিজেদের প্রতিষ্ঠানকে আপন মনে করে।

তারা ‘আমি, আমার, আমরা’ সর্বনাম দিয়ে প্রতিষ্ঠান এবং এর পণ্য ও পরিষেবাকে সম্বোধন করে। সর্বোপরি তারা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব নিতে কখনোই পিছপা হয় না।

উদ্যোক্তা চিন্তাবিদরা সবসময় নিজ থেকেই অতিরিক্ত দায়িত্ব নিতে পছন্দ করে। তারা অধিক থেকে অধিকতর অবদান রাখতে বদ্ধপরিকর। তারা সর্বদা নিজেদের দক্ষতার উন্নয়ন, নতুন ও সমকালীন জ্ঞান লাভ এবং নতুন নতুন উপায়ে কাজ করায় নিজেদের নিয়োজিত রাখে যাতে তারা নিজেদের কর্মক্ষেত্রের অমূল্য সম্পদে পরিণত হতে পারে।

সবচেয়ে বড় কথা হলো উদ্যোক্তা চিন্তাবিদরা প্রতিষ্ঠানের বিক্রয় ও মুনাফা বৃদ্ধির জন্য অভিনব কৌশল অনুসন্ধান করে।

উদ্যোক্তা চিন্তা হলো গ্রাহকভিত্তিক ও গ্রাহককেন্দ্রিক চিন্তা। উদ্যোক্তা চিন্তাবিদরা সর্বক্ষণ গ্রাহকদের কথাই চিন্তা করে।


বিক্রয় হলো মূল জিনিস

গত অধ্যায়ে আমরা বলেছিলাম যে ব্যবসায়িক সাফল্যের এক নম্বর কারণ হলো উচ্চ বিক্রয় হার। আর নিম্ন বিক্রয় হার হলো ব্যর্থতার এক নম্বর কারণ। বাকি সব হলো ফাঁকা বুলি।

সাফল্যের মূল চাবিকাঠি হলো এসএমএস (ঝগঝ) তথা বেশি বেশি জিনিস বিক্রয় করুন (ঝবষষ গড়ৎব ঝঃঁভভ)। উদ্যোক্তা চিন্তাবিদরা এটার ওপরেই সবচেয়ে বেশি মনোনিবেশ করে। কীভাবে আমরা বেশি বেশি জিনিস বিক্রয় করতে পারি?

সফল ব্যবসায়ীদের কিছু গুণ, বৈশিষ্ট্য ও নীতি রয়েছে যা তাদেরকে সাধারণ মানুষের চেয়ে অধিক উপার্জনে সক্ষম করে তোলে।

অনেক উপায়ে আপনি উদ্যোক্তা চিন্তাবিদদের বৈশিষ্ট্য গঠন করে নিজের প্রতিষ্ঠানের বিক্রয় ও মুনাফা বৃদ্ধিতে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে পারেন। তিনটি শব্দ মনে রাখবেন: স্পষ্টতা, একগ্রতা ও মনোযোগ।


নিজেকে কিছু মৌলিক প্রশ্ন জিজ্ঞেস করুন

ব্যবসায়ে কিছু মৌলিক প্রশ্ন রয়েছে যা আপনাকে নিয়মিত জিজ্ঞেস করে তাদের উত্তর খুঁজতে হবে। বিশেষ করে, যখন ত্বরিত পরিবর্তনশীল জ্ঞান, প্রযুক্তি ও প্রতিদ্বন্দ্বিতার সম্মুখীন হবেন তখন এই কাজটি করা একান্ত প্রয়োজন।

প্রথমত, আপনি আসলে কীসের ব্যবসা করছেন? কীভাবে আপনার গ্রাহকদের সেবা করছেন এবং কীভাবে আপনার পণ্য কিংবা পরিষেবা তাদের জীবনকে পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করছে তার আলোকে আপনার ব্যবসাকে সংজ্ঞায়িত করুন।

কর্পোরেট চিন্তাবিদরা তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে কেবল পণ্য, পরিষেবা উৎপাদন ও বিক্রয়কেন্দ্র হিসাবে দেখে।

উদ্যোক্তা চিন্তাবিদরা তাদের গ্রাহকদের জীবন উন্নয়ন ও সমৃদ্ধ করাকে নিজের ব্যবসায়িক লক্ষ্য হিসাবে বিবেচনা করে।

আপনার পণ্য বা পরিষেবা গ্রাহকদের জীবনে কী ধরনের ইতিবাচক পরিবর্তন কিংবা উন্নয়ন আনে তা উল্লেখ করে আপনার ব্যবসায়ের বর্ণনা দেওয়ার চেষ্টা করুন। প্রথম চেষ্টায় কাজটি কঠিন মনে হতে পারে।


ক্রেতার মতো চিন্তা করুন

কর্পোরেট বলে, ‘আমি গাড়ি বিক্রয় করি।’

উদ্যোক্তা বলে, ‘আমি মানুষকে আরামে ও নিরাপদে চলাফেরার ব্যবস্থা করে দিই।’

যখন একজন ক্রেতার কাছে আপনার পণ্যটির গুণাগুণ বর্ণনা করবেন তখন বুঝতে পারবেন সেই পণ্যটি কী সমস্যার সমাধান করে এবং ঐ পণ্য বা সেবার দ্বারা ক্রেতাদের কী উপকার হতে পারে। কারণ তখন আপনি তাদের থেকে এই প্রতিক্রিয়া বের করে আনতে পারবেন, ‘এটা কী করে সম্ভব?’ কিংবা ‘আমার এটা চাই!’ কিংবা ‘এটাই তো আমি খুঁজছিলাম।’

কে আপনার আদর্শ ক্রেতা? ক্রেতা হলো এমন এক জনতাত্ত্বিক এবং মনস্তাত্বিক দলের সদস্য যে কিনা আপনার প্রদানকৃত সেবা কিংবা পণ্যের বৈশিষ্ট্য, উপকারিতা ও গুণাবলির মর্ম সবচেয়ে বেশি উপলব্ধি করবে।

আপনার আদর্শ গ্রাহক কোন জিনিসকে মূল্যবান বলে মনে করে?

তাকে আপনি এমন কোন গুরুত্বপূর্ণ জিনিসটি সরবরাহ করতে পারেন যার সামনে আপনার পণ্যের দাম গুরুত্বহীন বলে মনে হবে?

কোনো ব্যবসা ব্যর্থ হওয়ার মূল কারণ হলো তাদের পণ্য কিংবা পরিষেবার কোনো চাহিদা না থাকা।

মানুষের কাছে তা মূল্যহীন বা তারা সেটি কিনতে আগ্রহী নয়।


আপনার শ্রেষ্ঠ ক্ষেত্র

আপনি কোন কাজে পটু? আপনার প্রতিদ্বন্দ্বীদের তুলনায় কোন ক্ষেত্রে আপনি শ্রেষ্ঠ যার কারণে ক্রেতারা আপনার পণ্যটি কিনতে আগ্রহী হবে?

সকল প্রতিষ্ঠান, পণ্য ও পরিষেবার অবশ্যই তাদের প্রতিদ্বন্দ্বীদের তুলনায় অধিক প্রতিযোগিতামূলক, তুলনামূলক সুফল বা সুবিধা থাকতে হবে যা তাদের বাজারে ক্রেতাদের প্রধান ও একমাত্র পছন্দ হিসাবে প্রমাণ করবে। আপনার ক্ষেত্রে এটি কী? কী হতে পারে?

জ্যাক ওয়েলচ বলেছিলেন, ‘আপনার যদি প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা না থাকে তবে প্রতিযোগিতা করবেন না।’

তার একটি বিখ্যাত নীতি ছিল যে জেনারেল ইলেকট্রিক সব ধরনের বাজারে এক নম্বর বা দুই নম্বর অবস্থানে থাকবে। আর তা না হলে তারা সেই বাজারটি ছেড়ে অন্য কোথাও মনোনিবেশ করবে।

কোনো প্রতিষ্ঠানকে সফল হতে হলে তাকে অবশ্যই বাজারে আধিপত্য বিস্তার করতে হবে। কমপক্ষে যেকোন একটি ক্ষেত্রে তাকে অবশ্যই বাজারের নির্দিষ্ট গ্রাহকদের কাছে ‘সেরা’ বলে স্বীকৃত হতে হবে।

কোন ক্ষেত্রে আপনি বাজারে আধিপত্য বিস্তার করতে পারেন? কোন কাজটি কম কিংবা বেশি করবেন? কোন কাজটি করা শুরু করবেন? কোন কাজটি করা একেবারেই বন্ধ করে দিবেন?

জ্যাক ওয়েলচের উপদেষ্টা পিটার ড্রুকার বলেছেন, ‘যদি আপনার স্পষ্ট একটি প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা না থাকে তবে তা তৈরি করুন।’

উদ্যোক্তা চিন্তার মূলে রয়েছে প্রতিযোগিতামূলক বাজারে একটি অর্থবহ প্রতিযোগিতামূলক সুবিধার বিকাশ ঘটান এবং তা বজায় রাখা।


আপনার ব্যবসায়িক নকশা

আজকের দিনে উদ্যোক্তারা ব্যবসায়িক নকশা গঠনে সবচেয়ে বেশি মনোনিবেশ করে। এটি এমন একটি জটিল কৌশল যা ব্যবহার করে আপনার প্রতিষ্ঠান লাভজনক উপায়ে এবং সুলভ মূল্যে অধিক সংখ্যক ক্রেতার কাছে আপনার পণ্য কিংবা পরিষেবা বিক্রয় করতে এবং পৌঁছে দিতে পারবেন। আপনার ব্যবসায়িক নকশা কোনটি?

ফরচুন ম্যাগাজিনের জিওফ্রে কলভিনের মতে, বেশির ভাগ না হলেও অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান একটি পুরানো ব্যবসায়িক নকশা মেনে কাজ করছে, যা বর্তমানে আংশিক বা সম্পূর্ণরূপে অপ্রচলিত।

আপনি সঠিক ব্যবসায়িক নকশা মেনে চলছেন কিনা তা কীভাবে জানবেন?

সবচেয়ে সহজ উপায় হলো আপনার বিক্রয় ও মুনাফা নিয়মিত ও কাক্সিক্ষত ভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে কিনা তা পরিমাপ করা।

আপনার বিক্রয় হার যদি ত্রুটিযুক্ত বা বেমানান হয় কিংবা হ্রাস পায়, তার অর্থ হতে পারে যে আপনার ব্যবসায়িক নকশাটি আর কাজ করছে না। তাই যদি হয় এবং আপনি নিজের ব্যবসায়িক নকশা পরিবর্তন না করেন তবে আপনার ব্যবসার ধ্বংস অনিবার্য।

 

আপনার ব্যবসা সম্পর্কিত চিন্তা

উদ্যোক্তা চিন্তার জন্য আপনার ব্যবসায়িক নকশার প্রয়োজনীয় উপাদানগুলো ক্রমাগত পর্যালোচনা ও মূল্যায়ন করা প্রয়োজন।

১. আপনার পণ্যের গুরুত্ব কী? আপনার পণ্য ক্রেতার কী কাজে লাগে? এটি কোনো সমস্যার সমাধান করে? এটি তাদের কী উপকার করে? এটি আপনার গ্রাহকদের কোন লক্ষ্যগুলো অর্জনে সহায়তা করে? বিশেষত আপনার পণ্যের মূল সুবিধাগুলো গ্রাহকদের কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ?

এই প্রশ্নগুলোর সঠিকভাবে জিজ্ঞাসা ও উত্তর দেওয়ার ক্ষমতার ওপর আপনার ব্যবসায়ের ভবিষ্যৎ অনেকাংশে নির্ভরশীল।

২. আপনার গ্রাহক কে? আপনার পণ্য বা পরিষেবাগুলো দ্বারা কোন গ্রাহক সবচেয়ে বেশি উপকৃত হতে পারে? তারা কোন জনমিতির অংশ? তাদের বয়স, আয়, শিক্ষাগত যোগ্যতা, লিঙ্গ, পেশা ও পারিবারিক বিন্যাস কেমন?

তাদের মনস্তত্ত্ব কেমন? আপনি যা বিক্রয় করেন তার সাথে সম্পর্কিত তাদের আশা, স্বপ্ন, ভয়, উচ্চাভিলাষ ও আকাক্সক্ষাগুলো কী?

বিশেষত, তাদের এথনোগ্রাফি (বঃযহড়মৎধঢ়যরপং) তথা মানুষ এবং সংস্কৃতির রীতিনীতি, অভ্যাস ও পারস্পরিক পার্থক্যগুলোর বৈজ্ঞানিক বিবরণ কী? তারা কীভাবে আপনার পণ্য বা পরিষেবা ব্যবহার করে? এটি তাদের জীবনে বা কাজের ক্ষেত্রে কী ভূমিকা পালন করে? এটি অন্যান্য জিনিসের তুলনায় তাদের কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ?

৩. আপনার পণ্য বাজারজাত (নতুন গ্রাহক আকর্ষণ), বিক্রয় (তাদের ক্রেতায় রূপান্তর) এবং বিতরণ (পণ্য গ্রাহকের হাতে পৌঁছে দেওয়া) করার কার্যকরী উপায় কী কী?

কীভাবে আপনি বেশি সংখ্যক ও ভালো-অর্থ প্রদানকারী গ্রাহকদের আকর্ষণ করতে পারেন? যেসব সম্ভাব্য ক্রেতাদের আকর্ষণ করতে পেরেছেন তাদের কাছে কীভাবে আরও দ্রুত ও কার্যকরভাবে পণ্য বিক্রয় করবেন? কীভাবে আপনার পণ্যটি দ্রুত এবং আরও দক্ষতার সাথে বিতরণ করবেন? (আমাজন ডটকমের কথা ভাবুন!)

নিয়মটি হলো বর্তমান বাজারে টিকে থাকতে হলে আপনি আজ যা কিছু করছেন, আগামী এক বছরের মাঝে আপনাকে এর থেকেও আরও ভালো কিছু করতে হবে।

৪. কত ভালো গ্রাহক সেবা প্রদান করলে ক্রেতারা শুধু আপনার থেকেই বারবার বেশি সংখ্যক পণ্য ক্রয় করবে এবং অন্যদেরও আপনার পণ্য ক্রয় করতে উৎসাহ দিবে?

৫. আপনার ব্যবসায়ের ব্যয় কাঠামো কেমন এবং আপনি কীভাবে এটিকে পরিবর্তন করে অধিক মুনাফা অর্জন করতে পারেন?

কোন কাজগুলো অন্যকে প্রদান করে, কম করে কিংবা সম্পূর্ণ বাদ দিয়ে আপনি কম খরচে উচ্চমান সম্পন্ন পণ্য উৎপাদন করতে পারবেন?


প্রশ্ন করুন অবিরত

সব ধরনের ব্যবসা উদ্যোক্তারা এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো সম্পর্কে সর্বক্ষণ চিন্তা করে। তারা এই ধারণায় বিশ্বাসী যে তাদের ভুল হতেই পারে কিংবা এই ক্ষেত্রগুলোতে আশানুরূপ ফলাফল পাওয়ার একাধিক ভালো উপায় অবশ্যই আছে।

উদ্যোক্তারা প্রতিটি ক্ষেত্রে নিয়মিত শূন্যভিত্তিক চিন্তা অনুশীলন করে। তারা জিজ্ঞাসা করে, ‘আমি এখন যা জানি, তা জেনে আমি এমন কিছু করছি কিনা যা আমাকে পুনরায় করার সুযোগ দিলে কখনোই করতাম না?’

উদ্যোক্তারা কে সঠিক তার চেয়েও কোনটি সঠিক তা নিয়ে বেশি উদ্বিগ্ন। তারা তাদের অহংকারকে কাজে বাধা সৃষ্টি করতে দেয় না।

উদ্যোক্তারা স্বীকার করতে রাজি, ‘আমি ভুল করতে পারি।’

উদ্যোক্তারা প্রকাশ্যে স্বীকার করে ‘আমি ভুল করেছিলাম’ এবং তারপর, তারা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ভুলটি সংশোধনে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তারা মিথ্যের আশ্রয় নিয়ে নিজেদের ভুলকে গোপন করার চেষ্টা করে না।

নতুন তথ্য প্রাপ্তির সাথে সাথে উদ্যোক্তারা সহজেই বলে, ‘আমি আমার মত পরিবর্তন করেছি।’

তারা ভালো ফলাফল পেতে দ্রুত নতুন ধারণা ও পদ্ধতিকে আলিঙ্গন করে, তা যেই উৎস থেকেই প্রাপ্ত হোক না কেন।

 

গ্রাহক কেন্দ্রিকতা

উদ্যোক্তা চিন্তা করতে হলে আপনাকে সর্বদা গ্রাহক নিয়ে ভাবতে হবে।

আপনাকে ক্রমাগত নতুন, ভিন্ন, আরও ভালো, দ্রুত ও সস্তা উপায়ে পণ্য উৎপাদনের কৌশল অনুসন্ধান করতে হবে যাতে গ্রাহকদের প্রকৃত চাহিদা ও আকাক্সক্ষা মেটাতে পারেন।

একজন কর্মচারীর মতো না ভেবে একজন উদ্যোক্তার মতো চিন্তা করার ক্ষমতা পেশাগত জীবনে আপনার প্রতিভার পূর্ণ বিকাশ ঘটাতে সাহায্য করবে। এটি আপনাকে ধনবানও করতে পারে।


অনুশীলনী

১) আপনার গ্রাহককে নিখুঁত ও স্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করুন। আপনি কীভাবে প্রতিদ্বন্দ্বীদের চাইতে তার অধিক সেবা করতে পারেন?

২) আপনার পণ্যের তাৎপর্য নির্ধারণ করুন, এমন একটি বা দুটি গুণাবলি যা প্রতিদ্বন্দ্বীদের পণ্য হতে উত্তম।

৩) আপনার ব্যবসায়িক নকশাকে মূল্যায়ন করুন। আপনি এখন যেই ব্যবসায়িক নকশা অনুসরণ করছেন তা আজকের দিনে বিক্রয় ও মুনাফা অর্জনের সর্বোত্তম উপায় কিনা তা যাচাই করুন।


 




অধ্যায় ১০



ধনী চিন্তা বনাম দরিদ্র চিন্তা


চিন্তাই হলো সমস্ত সম্পদ, সকল সাফল্য, সব অর্জন, সকল দুর্দান্ত আবিষ্কার ও অনুসন্ধান এবং সমস্ত কৃতিত্বের মূল উৎস।

- ক্লড এম. ব্রিস্টল


ধনী হওয়ার এত বেশি সুযোগ এবং সম্পদ অর্জনের এত নানাবিধ উপায় আগে কখনো দেখা যায়নি যেমনটা আজকের দিনে দেখা যাচ্ছে। অন্য যেকোনো সময়ের তুলনায় আজকের দিনে অধিক সংখ্যক মানুষ বিভিন্ন শিল্পের নানা ব্যবসার সাথে জড়িত হচ্ছে। অধিক জ্ঞান, তথ্য ও প্রযুক্তি আরও বেশি পণ্য ও পরিষেবা তৈরি করছে যা মানুষের প্রয়োজন এবং যার জন্য তারা অর্থ প্রদান করতে ইচ্ছুক। কেবল একটি নতুন ধারণা আপনার ভাগ্য বদলে দিতে পারে।

২০০ বছরের অর্থনৈতিক বিকাশ ও প্রবৃদ্ধির পর ১৯০০ সালে আমেরিকাতে কোটিপতির সংখ্যা ছিল প্রায় ৫ হাজার জন। ১৯৮০ সালে এই সংখ্যা ১০ লাখে এসে দাঁড়ায়। ২০১৫ সালে এসে আমেরিকার কোটিপতির সংখ্যা ১ কোটিরও বেশিতে এসে পৌঁছায় এবং শতকোটি টাকার মালিকের সংখ্যা দাঁড়ায় ১,৮২৬ জনে। এদের অধিকাংশই অল্প কিংবা শূন্য পুঁজি থেকে শুরু করে আজকের এই সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছে। আপনার পক্ষেও এমনটি সম্ভব।

আগে ভেতরে পরে বাইরে

ল অফ করেস্পন্ডেন্স (খধি ড়ভ ঈড়ৎৎবংঢ়ড়হফবহপব) তথা সংগতি নীতি সবসময় সবার ক্ষেত্রে সকল পরিস্থিতিতে কার্যকর। এই নীতি বলে আপনার বাহ্যিক পৃথিবী হলো আপনার অভ্যন্তরীণ পৃথিবীর প্রতিচ্ছবি। সবকিছু ভেতর থেকে বাইরের দিকে প্রবাহিত হয়। যদি আগে ভেতরে কিছু অর্জন করতে না পারেন তবে বাইরেও তা অর্জন করতে পারবেন না। বাইরে ধনী হতে হলে আপনাকে ভেতরে একজন ধনী ব্যক্তির মতো চিন্তা করতে হবে। এছাড়া আর কোনো উপায় নেই।

দরিদ্র মানুষ দরিদ্রের মতোই চিন্তা করে। তাদের স্ব-সীমিত বিশ্বাস তাদের ধনী হওয়ার চেষ্টা পর্যন্ত করতে দেয় না। কয়েক বছর আগে ওয়ান হান্ড্রেড মিলিওন মিলিওনেয়ার নামক এক গবেষণায় বলা হয়েছে যদি আপনি নিজের সমস্ত কর্মজীবন ব্যাপী প্রতি মাসে ১০০ ডলার (বাংলাদেশি টাকায় ৮,৫০০ টাকা) জমান, বিনিয়োগ করেন এবং এই অর্থকে চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়তে দেন, এভাবে আপনি অবসরের সময় ১ মিলিয়ন ডলারের (বাংলাদেশি টাকায় সাড়ে ৮ কোটি টাকা) মালিক হবেন। কেন সবাই এটা করছে না? কারণ দরিদ্র চিন্তা!

টনি রবিন্স তার ২০১৪ সালে প্রকাশিত মানি: মাস্টার দ্য গেম বইতে আইনস্টাইনের এই উক্তির ওপর জোর দিয়েছেন, ‘চক্রবৃদ্ধি হার হলো পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী ক্ষমতা।’


স্ব- প্রতিষ্ঠিত কোটিপতি

কয়েক বছর আগে আমাকে স্ব-প্রতিষ্ঠিত কোটিপতিদের ওপর একটি বক্তৃতা দিতে বলা হয়েছিল। এই বক্তব্যের শ্রোতা ছিল সারা দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা ব্যবসায়ীদের এক বিশাল দল। এই বক্তব্যের আমন্ত্রণ আমাকে গভীরভাবে ভাবতে বাধ্য করেছিল। এই চিন্তা আমার জীবন বদলে দেয়।

কিশোর বয়স থেকেই আমার জীবনের লক্ষ্য ছিল আমার বয়স ত্রিশ বছর হওয়ার আগেই একজন কোটিপতিতে পরিণত হওয়া। কিন্তু ত্রিশে পা দেওয়ার পরেও আমি দেউলিয়া ছিলাম। তাই আমি সময় ৩৫ বছর বয়স পর্যন্ত বাড়িয়েছিলাম। ৩৫ এ এসে সময় ৪০ পর্যন্ত বাড়াই। এসময় আমার কোটিপতি হওয়ার স্বপ্ন ধীরে ধীরে ভাঙ্গতে শুরু করে। আমি ভাবতে শুরু করি এই জাদুকরি সংখ্যায় হয়তো কখনোই পৌঁছাতে পারব না।

কিন্তু আমাকে যখন স্ব-প্রতিষ্ঠিত কোটিপতিদের ওপর বক্তৃতা দিতে বলা হয় তখন বুঝতে পারি আমি তাদের সম্পর্কে খুব কমই জানি। আর তাই আমি একান্তচিত্তে তাদের ওপর গবেষণা শুরু করি। তারা কে এবং কী করে শূন্য থেকে ১ মিলিওন ডলারের (বাংলাদেশি টাকায় সাড়ে ৮ কোটি টাকা) সংখ্যায় পৌঁছেছে এটা জানাই ছিল আমার মূল উদ্দেশ্য।

আমার গবেষণার প্রাপ্ত ফল নিয়ে আমি স্ব-প্রতিষ্ঠিত কোটিপতিদের সাফল্যের ২১টি গোপন নীতি নামক একটি কর্মসূচি তৈরি করি। সময়ের পরিক্রমায় আমি এই কর্মসূচি ৫০ টি দেশের প্রায় দশ লাখ মানুষের সামনে উপস্থাপন করেছি। মজার কথা হলো স্ব-প্রতিষ্ঠিত কোটিপতিদের ওপর গবেষণা করতে করতে এবং এই কর্মসূচি মানুষকে শেখাতে শেখাতে আমি নিজেও এই নীতিগুলো মানতে শুরু করি। পাঁচ বছরের মাথায় আমি নিজে একজন কোটিপতিতে পরিণত হই।


আপনার চিন্তা পুনর্গঠন করুন

সারা বিশ্বের অনেক মানুষ আমাকে জানিয়েছে যে এই কর্মসূচিটি বারবার শুনে এবং এই নীতিগুলো মেনে বহু বছরের দারিদ্র্যের যাতনার পর তারাও কোটিপতিতে পরিণত হতে পেরেছে। তারা যদি পারে তবে আপনিও পারবেন।

এই অধ্যায়ে আমি কিছু সহজ উপায় আপনাদের শেখাব যা আপনি নিজের জীবনে প্রয়োগ করতে পারবেন। এই উপায়গুলো হাজারো ধনী মানুষের জীবনের ওপর করা বহু বছরের গবেষণার ফসল।

ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়ার নীতি (খধি ড়ভ ঈধঁংব ধহফ ঊভভবপঃ) মতে, আপনি যদি ধনী ব্যক্তিদের মতো চিন্তা ও কাজ করেন তবে আপনিও দ্রুতই তাদের মতো ফল পাবেন।

বেস্ট সেলিং লেখক অগ মানডিনো আমাকে বলেছিলেন, ‘সাফল্যের কোনো গোপন সূত্র নেই। কেবল কিছু সর্বজনীন ও নিরন্তর নীতি রয়েছে যা মানব ইতিহাসের সময়ের পরিক্রমায় আবিষ্কার ও পুনঃআবিষ্কার হয়েছে। আপনার কাক্সিক্ষত সাফল্য অর্জনের জন্য আপনাকে শুধু সেগুলো শিখে নিয়মিত চর্চা করতে হবে।’


ধনী না হতে পারার কারণসমূহ

১ মিলিওন ডলারের জাদুকরি সংখ্যা স্পর্শ করার পর আমি নিজের চারপাশে তাকিয়ে প্রশ্ন করতে শুরু করি, ‘কেন সবাই এই সহজ নীতিগুলো মেনে ধনী হতে পারছে না?’

আমার গবেষণা চালিয়ে যাওয়ার সময় আমি ৭টি কারণ আবিষ্কার করি যার কারণে মানুষ ধনী হতে পারছে না। চলুন এগুলো নিয়ে আলোচনা করা যাক:


১। চিন্তাটি তাদের মাথায়ই আসে না

তারা যে ধনী হতে পারে এই কথাটি তাদের মাথায়ই আসে না। মানুষের প্রতিপালন, মানসিক অবস্থা, পরিবারের দরিদ্রতা, দরিদ্র মানুষের সাহচর্য ইত্যাদি কারণে তারা নিজের অবস্থা পরিবর্তনের চিন্তাই করে না। অন্য লাখো মানুষের মতো তারাও ধনী হতে পারবে― এই কথাটি তারা কল্পনাই করে না।


২। তারা ধনী হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় না

অধিকাংশ মানুষই স্বপ্ন দেখে যে তাদের অনেক অর্থ থাকলে তাদের জীবন কত ভিন্ন হতো। তারা চারপাশের ধনী মানুষদের প্রশংসা ও ঈর্ষার দৃষ্টিতে দেখে। তারা সবসময় অর্থ নিয়ে দুশ্চিন্তা করে।

কিন্তু তারা কখনোই ধনী হওয়ার দৃঢ় সংকল্প গ্রহণ করে না। আর তাই তারা প্রথম পদক্ষেপটি নেয় না। তারা অর্থ উপার্জনের কৌশল শেখে না। তারা নিজেদের জ্ঞান ও দক্ষতা বৃদ্ধির চেষ্টা করে না, ফলে কর্মক্ষেত্রে তারা মূল্যবান সম্পদে পরিণত হয় না। তারা সাফল্যকে ‘ভাগ্যের ব্যাপার’ বলে উড়িয়ে দিয়ে নিজেদের অবস্থাকে যৌক্তিক দেখানোর চেষ্টা করে।


৩। তারা অলস

যদি ধনী হওয়ার চিন্তা তাদের মাথায় আসে এবং তারা ধনী হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েও থাকে, তারপরেও তারা কাজ শুরু করে না। তারা অলসতা করে। তারা ‘আমি একদিন করব’ নামক কাল্পনিক জগতে চলে যায়।

‘একদিন আমি আমার সমস্ত অর্থ ব্যয় না করে সঞ্চয় করব’

‘একদিন আমি আমার জ্ঞান ও দক্ষতা বৃদ্ধি করব’

‘একদিন আমি আরও বেশি পরিশ্রম করব এবং নিজেকে আরও মূল্যবান ব্যক্তি হিসাবে প্রমাণ করব’

‘একদিন আমি ঋণ থেকে মুক্তি পাব।’

তাদের জীবনের বেশির ভাগ সময়ই ঐ ‘একদিনেই’ কেটে যায়। সাফল্যের একটি অন্যতম কৌশল হলো ‘নিজেকে এই কাল্পনিক জগত থেকে বের করা।’

অজুহাত দেওয়া বন্ধ করে উন্নয়নের পথে পা বাড়ান।


৪। তারা ব্যর্থতাকে ভয় পায়

শৈশবের ধ্বংসাত্মক সমালোচনা ও যৌবনের ভুলের কারণে ভুলের ভয় তাদের অসাড় করে ফেলে। তারা অর্থ ও সময় হারাতে ভয় পায়। যদি কোনো সুযোগ তাদের সামনে এসেও থাকে তারা নিজের ভীতির কারণে এই অসাড়তা কাটিয়ে উঠতে পারে না।

তাদের এই ব্যর্থতা ভীতি তাদের কাজটি না করার নানা অজুহাত তৈরিতে উদ্বুদ্ধ করে। তাদের সময় নেই। তারা নূন্যতম বিনিয়োগ করতে অক্ষম। তাদের প্রয়োজনীয় জ্ঞান কিংবা দক্ষতা নেই। হেডলাইটের সামনে পড়া হরিণের মতো তারা ব্যর্থতার ভয়ে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়ে। যার ফলে তারা কখনো কোনো পদক্ষেপ নিতেই পারে না।

দেখা গেছে, আমেরিকার বেশির ভাগ সম্পদ গড়ে উঠেছে ব্যক্তিগত পরিষেবা বিক্রয়ের মাধ্যমে। এই মানুষগুলোর কোন অর্থ ছিল না, কিন্তু তাদের ছিল কঠোর পরিশ্রম করার প্রত্যয়, দক্ষতা বৃদ্ধির আগ্রহ, আর নিজেকে মূল্যবান প্রমাণ করার সদিচ্ছা। ফলশ্রুতিতে তাদের জন্য সম্ভাবনার সকল দ্বার খুলে গিয়েছিল।


৫। তারা সমালোচনা ও অসমর্থনকে ভয় পায়

অনেকেই ভাবে তারা নিজেদের আর্থিক উন্নয়নের জন্য কোনো লক্ষ্য নির্ধারণ করলে তাদের চারপাশের লোকজন তাদের নিয়ে হাসিতামাশা করবে। তারা ভাবে মানুষ সর্বক্ষণ তাদের ভুল ধরবে। তারা মানুষের অসমর্থনকে এতটাই ভয় পায় যে শেষ পর্যন্ত কোনো পদক্ষেপই নিতে পারে না।

এর সমাধান সহজ। যখন ধনী হওয়ার সিদ্ধান্ত নিবেন, সেই কথা কাউকে জানাবেন না। কথাটি গোপন রাখুন। গোপনে নিজের লক্ষ্য নিয়ে কাজ করুন। আর মানুষকে তখনই কথাটি জানাবেন যখন তারা আপনার উন্নতি দেখবে এবং এর পিছনের রহস্য জানতে চাইবে।

৬। তারা শেখা ও উন্নত হওয়া বন্ধ করে দেয়

আগে কখনো অর্জন করেননি এমন কিছু অর্জন করতে হলে আপনাকে অবশ্যই নতুন জিনিস শিখতে ও অনুশীলন করতে হবে। আর্থিক সাফল্যের মইয়ের ধাপ হলো জ্ঞান ও দক্ষতা। শূন্য থেকে শুরু করে আর্থিক সাফল্য লাভ করতে হলে আপনাকে সম্পূর্ণ নতুন দক্ষতাসমূহ জানতে, শিখতে ও অনুশীলন করতে হবে যাতে আপনি কর্মক্ষেত্রের একজন মূল্যবান ও অপরিহার্য সম্পদে পরিণত হতে পারেন।

আব্রাহাম লিংকন বলেছিলেন, ‘আমি নিজেকে শিক্ষিত করে প্রস্তুত রাখব, তবেই একদিন আমার সুযোগ আসবে।’

যখন নিজেকে শিক্ষিত করে প্রস্তুত রাখবেন, কোনো এক সর্বজনীন নীতি অনুযায়ী আপনার এই নতুন দক্ষতা অনুশীলনের সুযোগ আপনার সামনে অবশ্যই আসবে। কিন্তু এই দক্ষতা গঠনের দায়িত্ব সম্পূর্ণ আপনার ওপর এবং সারাজীবন আপনাকে এই উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে হবে।


৭। তারা অধ্যবসায়হীন

অধিকাংশ মানুষই সফল হওয়া পর্যন্ত অধ্যবসায় ধারণ করতে পারে না। সফল মানুষ বলবে তাদের সফল হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ হলো তারা কখনো হাল ছাড়েনি। তারা কঠিন সময়েও পরাজয় স্বীকার করেনি। আর্থিকভাবে ধ্বংস ও দেউলিয়া হওয়ার পরেও তারা অধ্যবসায়ের সাথে বছরের পর বছর ধরে চেষ্টা চালিয়ে গেছে। তারা কখনো থামেনি।

ভেবে অবাক লাগে কীভাবে কিছু মানুষ জীবনের বড় টার্নিং পয়েন্টের কয়েক ধাপ আগে এসে হাল ছেড়ে দেয়। অথচ আরেকটু সময় ধৈর্য ধরলেই তাদের জীবন সম্পূর্ণ বদলে যেত। অধ্যবসায় ও সংকল্প আপনার আর্থিক সাফল্য লাভের মূল কারিগর।


শিক্ষা ও অনুশীলন

সৌভাগ্যবশত, আর্থিক সাফল্য অর্জনের এই প্রত্যেকটি বাধাকে শিক্ষা ও অনুশীলনের মাধ্যমে কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। যখন ধনী ব্যক্তির মতো চিন্তা করতে শুরু করবেন তখন এই প্রতিটি বাধাকে সাফল্য লাভের সিঁড়ি বানিয়ে সাফল্যের চূড়ায় আরোহণ করতে পারবেন।

সংগতি নীতি একটি অপরিবর্তনীয় মানসিক আইন। এটি সকল অবস্থায় সবসময় সকল মানুষের জন্য কার্যকর। এটি অনিবার্য এবং প্রায় সম্পূর্ণভাবে অনুমানযোগ্য।

সম্পদ সংগ্রহের ক্ষেত্রে এই নীতি বলে আপনার বাহ্যিক কর্মকা-ের সাথে আপনার চিন্তা, বিশ্বাস ও ধারণার সংগতি থাকতে হবে। আপনি অন্তর থেকে যা বিশ্বাস করেন আপনার বাইরের কাজকর্মে তার বহিঃপ্রকাশ ঘটবেই। ফলে আপনি একই বিশ্বাসের অধিকারী মানুষের মতোই ফল পাবেন।


মানুষ যা চিন্তা করে

মনোবিজ্ঞানীগণ একে স্ব-ধারণা বলে এবং একে মানবিক উন্নয়নে বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে বড় যুগান্তকারী আবিষ্কার হিসাবে গণ্য করা হয়। আপনার স্ব-ধারণা হলো আপনার চিন্তাধারা, বিশ্বাস ও আপনার নিজের সম্পর্কে ধারণা। আপনার বাহ্যিক আচরণ আপনার এই স্ব-ধারণারই বহিঃপ্রকাশ। কে কী ভাবে, কেমন অনুভব করে, তাদের বিশ্বাস কেমন― এই ধারণাগুলো আপনি তাদের দৈনন্দিন জীবনের কার্যকলাপ দেখেই বুঝতে পারবেন।

সকল বাহ্যিক উন্নয়নের সূত্রপাত ঘটে স্ব-ধারণার উন্নয়নের মাধ্যমে। যখন আপনি ভেতরে ইতিবাচক, গঠনমূলক এবং আর্থিক সাফল্যজনিত চিন্তা গঠন করবেন তখন আপনি বাইরে সেই বিশ্বাসের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় এমন সব কাজ করতে আরম্ভ করবেন যতক্ষণ পর্যন্ত এই বিশ্বাস বাস্তবে রূপ না নিচ্ছে।

এক প্রজন্মের শিশুরা যারা সচ্ছল পরিবারে বড় হয়েছে, বিশেষ করে যাদের অভিভাবকেরা উদ্যোক্তা; তাদের বড় হয়ে সফল ও ধনী হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। তারা সারাজীবন সাফল্য ও সচ্ছলতা দেখে বড় হয়েছে। ফলে তাদের মাঝে এই বিশ্বাস গড়ে উঠেছে যে তারাও সফল ও স্বচ্ছলই হবে। আর তাই এই সফলতা অর্জন না করা পর্যন্ত তারা কখনো হাল ছাড়ে না।


একটি সমৃদ্ধশালী মানসিকতা গঠন করুন

একটি সমৃদ্ধশালী স্ব-ধারণা গঠনের জন্য ধনী মানুষের বহু বছরের অভ্যাস ও আচরণের সাথে সম্পৃক্তার প্রয়োজন হয়। কিন্তু অনেক সময় একজন প্রভাবশালী মানুষের সাহচর্যে একবার এসেই এই ধারণা গঠন করা যায়। এটা কোনো সেমিনার, বই কিংবা অডিও প্রোগ্রাম যেকোনো কিছুর মাধ্যমে ঘটতে পারে, এমন কিছু যা একজন মানুষের ওপর এমন সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলে যে সে নিজেকে একজন আর্থিকভাবে সফল ব্যক্তি হিসাবে দেখতে আরম্ভ করে এবং সেই সাফল্য অর্জনের পথ খুঁজতে শুরু করে।

অনেক মানুষই মাত্র একটি অডিও প্রোগ্রাম শুনে কিংবা, একটি সেমিনারে অংশ নিয়েই ব্যাপক ভাবে প্রভাবিত হয়ে নিজেকে ধনী ব্যক্তিতে পরিণত করতে সক্ষম হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে একটি বইয়ের কৌশল ও প্রেরণা একজন মানুষকে সাফল্য ও সম্পদ অর্জনের পথে ধাবিত করেছে এবং মাত্র কয়েক বছরেই মাঝেই তারা নিজেদের কাক্সিক্ষত অবস্থানে পৌঁছাতে পেরেছে।


সম্পদের ঐতিহাসিক উৎস

সমগ্র মানব ইতিহাস জুড়ে, এমনকি এখনও অনেক দেশে মানুষ অন্যের বা অন্য দেশের সম্পদ কেড়ে নিয়ে নিজের সম্পদ গড়ে তুলেছে। কোনো দেশ বা অঞ্চল জয় করার পর নেপোলিয়নের সৈন্যদল প্রথমেই যেই কাজটি করতে তা হলো বহন করা যায় এমন সকল সম্পদ লুট করে প্যারিসে পাঠিয়ে দিত। নেপোলিয়ান ফ্রান্সে এই লুটতরাজের জন্য এতটাই বিখ্যাত ছিলেন যে তাকে পরবর্তীতে স¤্রাট বানিয়ে সমগ্র ইউরোপে নিজের সৈন্যদল পাঠিয়ে সম্পদ লুট করার অনধিকার স্বীকৃতি দিয়ে দেওয়া হয়।

হিটলারের নাৎসি বাহিনী কোনো দেশে আক্রমণ করার পরেই বহনযোগ্য সব কিছু লুট করে ট্রেনে করে জার্মানি পাঠিয়ে দিত। রাশিয়ানরা যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পালটা আক্রমণ শুরু করে তখন তারা তাদের পথের সব কিছু লুট করে নেয়। ইতিহাস জুড়ে কোনো দেশে যখনই কোন একনায়ক ক্ষমতায় এসেছে তারা তৎক্ষণাৎ হাতের কাছে যা পেয়েছে তা দখল করে নিয়েছে। এসব ক্ষেত্রে সম্পদ গঠন হয়নি কেবল দুর্বল থেকে সবলের কাছে স্থানান্তর হয়েছে।

আজকের দিনে সম্পদ অর্জন

এরপর ১৮১৫ সালে ইউরোপে এবং পরবর্তীতে আমেরিকায় এমন এক ঘটনা ঘটে যা মানব ইতিহাসে আগে কখনো ঘটেনি। মানুষ জানতে পারে তারা অন্যের চাহিদা মতো জিনিস তৈরি ও বিক্রয় করে সম্পদ অর্জন করতে পারে। এই উপায়ে উৎপাদন ও সম্পদ অর্জনের প্রক্রিয়াকে রক্ষা করার জন্য আইন প্রণয়ন করা হয় যার ফলে এমন বাজার ব্যবস্থা যে যে দেশ আত্মস্থ করেছে উক্ত প্রতিটি দেশ সম্পদশালী হয়ে ওঠে।

যেহেতু উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীদের ধন পাচার হওয়ার আর কোনো ভয় ছিল না তাই সেসময়ের সেরা প্রতিভাবান মানুষ সম্পদ স্থানান্তরের বদলে সম্পদ অর্জনের চিন্তায় নিজেদের নিয়োজিত করতে শুরু করে।

আমেরিকায় মানব ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ‘অর্থ তৈরি’ নামক ধারণা জনপ্রিয় ও স্বীকৃত হয়। সারাবিশ্ব থেকে মানুষ বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ উদ্যোক্তাকেন্দ্রিক সম্পদ তৈরির প্রণালীতে অংশ নিতে ছুটে আসতে শুরু করে এবং এখনও আসছে।


শূন্য থেকে সূত্রপাত

বস্তুত বর্তমানে আমেরিকায় আসা নতুন অভিবাসীদের কোটিপতি হওয়ার সম্ভাবনা আমেরিকার অধিবাসীদের চাইতে চারগুণ বেশি। এর কারণ আমেরিকার অধিবাসীরা ধনী হওয়ার মূল মন্ত্রটি ভুলে গেছে: চাহিদা খোঁজো এবং সেটি পূরণ করো।

হাউ রিচ পিপল থিংক বইয়ের লেখক স্টিভ সিবোল্ড বলেছেন, ‘যদি অনেক অর্থ উপার্জন করতে চান তাহলে বেশির ভাগ মানুষের আছে এমন একটি বড় সমস্যা খুঁজে বের করুন এবং সমস্যাটি নতুন উপায়ে সমাধান করুন।’

এটি আপনার সম্পদ গঠনের চাবিকাঠিও বটে। মানুষের চাহিদা অনুযায়ী জিনিস তৈরি, বিক্রয় ও সরবরাহ করা ছাড়া প্রকৃত ভাবে সম্পদশালী হওয়ার আর কোনো উপায় নেই।


ধনীদের মতো অভ্যাস গঠন করুন

সহজভাবে বলতে গেলে ধনী মানুষের অভ্যাস ধনীর মতোই। আর দরিদ্র মানুষের অভ্যাসও দরিদ্র। ম্যারি কে অ্যাশ (গধৎু কধু অংয), একজন স্ব-প্রতিষ্ঠিত কোটিপতি তার পরিবেশকদের অনুপ্রাণিত করার জন্য বলতেন, ‘খরগোশ নয়, বেঁজির মত চিন্তা করো।’ ধনী মানুষ জীবনের সবক্ষেত্রে বেঁজির মতোই চিন্তা করে।

আমার মনে পড়ে, ত্রিশ বছর বয়সে আমি যখন দেউলিয়া হয়ে জীবন যুদ্ধে লিপ্ত তখন স্থানীয় এক বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি এক্সিকিউটিভ এমবিএ প্রোগ্রামে ভর্তি হই। এক সন্ধ্যায় ক্লাস করতে এলে একজন সুপরিচিত স্থানীয় উদ্যোক্তা আমার পাশের পার্কিং স্পেসে তার ধূসর রুপালি রঙের ৪৫০ এসইএল মার্সেডিজ-বেঞ্জ গাড়িটি পার্ক করে। আমি নিজের পুরনো ভলভো গাড়ি থেকে বের হয়ে তার গাড়িটির দিকে তাকিয়ে থাকি। গাড়ির চালক একবার আমার এবং আমার গাড়ির দিকে এরপর নিজের গাড়ির দিকে তাকায়। এরপর হেসে ক্লাসের দিকে চলে যায়।

সেই মুহূর্তে আমি সিদ্ধান্ত নেই যে এরকম একটি সুন্দর দামি মার্সেডিজ-বেঞ্জ গাড়ির মালিক হওয়ার জন্য যতটা ধনী হওয়া লাগে তা হতে আমি যা প্রয়োজন তাই করব। আমি আবার গাড়িটির দিকে তাকিয়ে দেখতে পাই যে ভেতরে চামড়ার সিটটি ছিল নীল রঙের। আমি কথাটি মনে মনে নোট করে নিয়ে ক্লাসের দিকে পা বাড়াই।


ধনীর মতো চিন্তা করুন

সেই মুহূর্র্ত থেকে আমি ধনীর মতো চিন্তা করতে শুরু করি। আমি প্রতিদিন দুই থেকে তিন ঘণ্টা ধনী ব্যক্তিদের অভ্যাস ও আচরণ সংক্রান্ত বই পড়তে শুরু করে। আমি আরেকটি ভালো চাকরি নিই। আমি অতিরিক্ত দায়িত্ব নিতে শুরু করি এবং আমার পদোন্নতি হতে থাকে। আমি বেশি সময় কাজ করতাম, অনেক সময় দিনে প্রায় বারো ঘণ্টা। আমার কর্তা আমাকে বেশি বেশি অর্থ প্রদান করতে শুরু করে যা তিনি আমাকে বোনাস ও মুনাফার অংশ হিসাবে দিয়েছিলেন।

৩৬ মাসের মধ্যে আমি মার্সেডিজ-বেঞ্জ গাড়ির শোরুমে গিয়ে আমার গাড়ি পালটে, টাকা জমা দিয়ে নতুন ধূসর-রুপালি রঙের ৪৫০ এসইএল মার্সেডিজ-বেঞ্জ গাড়িতে চড়ে বেরিয়ে আসি যার ভেতরের সিটের চামড়ার রঙ ছিল নীল। এটি আমার জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ এক মুহূর্ত ছিল।


অভ্যাস গঠন করুন

ধনী হওয়ার লক্ষ্যে ধনীর মতো চিন্তা করার জন্য আপনাকে প্রথমে ধনী ব্যক্তিদের মতো চিন্তার অভ্যাস এবং তাদের কর্মকা- আয়ত্ত করতে হবে। জিম রন বলেছেন, ‘কোটিপতি হওয়াটা জরুরি নয়। একজন কোটিপতি হওয়ার জন্য আপনার নিজেকে কেমন মানুষে পরিণত হতে হবে তা বেশি গুরুত্বপূর্ণ।’

তবেই যদি আপনি কোনো কারণে নিজের সম্পদ হারিয়েও ফেলেন আপনি আবারও তা অর্জন করতে পারবেন। কারণ তখন আপনি এমন একজন মানুষে পরিণত হবেন যে জানে কীভাবে অর্থ উপার্জন করতে হয়।

মাইক টড― একজন চলচ্চিত্র প্রযোজক এবং এলিজাবেথ টেইলরের স্বামী, একসময় একটি বড় প্রযোজনায় নিজের সমস্ত অর্থ খুইয়ে দেউলিয়া হয়ে পড়েছিলেন। এই খবর পত্রপত্রিকায় প্রকাশ পেয়েছিল এবং তার অনেক ‘বন্ধু’ তার পিছনে তাকে নিয়ে হাসাহাসি করেছিল।

তাদের একজন তাকে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘মাইক দারিদ্রতা কেমন লাগছে?’

মাইক টড তখন তার এই জনপ্রিয় উক্তিটি জবাব হিসাবে দিয়েছিলেন, ‘আমি কখনোই দরিদ্র হইনি। কেবল দেউলিয়া হয়েছি। দারিদ্রতা হলো মানসিক অবস্থা। আর দেউলিয়া হওয়াটা সাময়িক এক পরিস্থিতি।’

এরপর তিনি নিজের পরবর্তী প্রকল্পে কাজ আরম্ভ করেন যা সফল হয় এবং কয়েক বছরের মাঝেই তিনি আবার ধনবান ব্যক্তিতে পরিণত হন।


প্রকৃতি নিরপেক্ষ

বিশ্বের সর্ববৃহৎ নীতি; ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া (খধি ড়ভ ঈধঁংব ধহফ ঊভভবপঃ) নীতি বলে যদি আপনি ধনী ব্যক্তিদের মতো আচরণ ও কর্মকা- করেন তবে আপনি শীঘ্রই তাদের একজনে পরিণত হবেন। যদি তা না করেন তবে হবেন না।

প্রকৃতি নিরপেক্ষ। প্রকৃতি ন্যায়ের অন্ধ মূর্তির মতো। সে কাউকে বিশেষ নজরে দেখে না। গ্যেটে বলেছিলেন, ‘ প্রকৃতি কোনো ঠাট্টা করে না, সে সবসময় সত্য, সবসময় গম্ভীর, সে সর্বদা সঠিক, আর ভুলত্রুটি যা আছে তা সব মানুষের নিজের। যারা তাকে মূল্যায়ন করে না তাদের সে ঘৃণা করে। যারা যোগ্য, সত্যবাদী, বিশুদ্ধ কেবল তাদের কাছেই সে ধরা দিয়ে নিজের রহস্যের ভা-ার উন্মোচন করে।’

সৌভাগ্যবশত আপনার মস্তিষ্ক হলো বিশ্বের একমাত্র জিনিস যার ওপর আপনার সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ রয়েছে এবং এখান থেকেই আপনাকে শুরু করতে হবে।

 

কিছুর-বদলে-কিছুমূলক চিন্তা বনাম কিছুর-বদলে-কিছু-নামূলক চিন্তা (ঝড়সবঃযরহম-ভড়ৎ-ঝড়সবঃযরহম ঞযরহশরহম ঠবৎংঁং ঝড়সবঃযরহম-ভড়ৎ-ঘড়ঃযরহম ঞযরহশরহম)

ধনী ও দরিদ্র ব্যক্তিদের চিন্তাধারার মাঝে একটি বড় পার্থক্য রয়েছে। ধনী ব্যক্তিরা সবসময় মূল্যবান জিনিস তৈরি করতে ইচ্ছুক, তারা এমন সব পণ্য বা পরিষেবা উৎপাদন করতে ইচ্ছুক যা মানুষের জীবন ও কাজের উন্নয়ন ঘটাবে।

তারা কিছু পাওয়ার আগেই কিছু দিতে ইচ্ছুক। তারা সহজ অর্থ প্রাপ্তি কিংবা কিছুর বদলে কিছু না এমন তত্ত্বে বিশ্বাসী নয়। ধনী মানুষ বিশ্বাস করে তাদের কাক্সিক্ষত ধনসম্পদ ন্যায়ভাবে এবং পরিশ্রমের মাধ্যমে অর্জন করার জিনিস।

দরিদ্র মানুষ এই মৌলিক ধারণা সম্পর্কে অজ্ঞ যে― তুমি যা দিবে তাই পাবে। তারা সবসময় কিছু না করে বা সামান্য কিছু করে সবকিছু পেতে চায়। তারা সাফল্য অর্জন করে নিতে চায় না। তারা পরিশ্রম বিহীন সম্পদ, চেষ্টা বিহীন অর্থ এবং প্রতিভা বিহীন খ্যাতি অর্জন করতে চায়।

দরিদ্র মানুষ জুয়া খেলে, লটারি কেনে, শেষ মুহূর্তে অফিসে ঢোকে, সবার আগে অফিস থেকে বের হয়। লাখ লাখ মানুষ এই ভেবে আমেরিকান আইডলের মতো অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়ায় যেকোনো প্রতিভা কিংবা দক্ষতা অর্জন ছাড়াই সহজে তারা অর্থ ও খ্যাতি অর্জন করতে পারবে।

ধনী হওয়ার অন্যতম একটি সেরা রহস্য হলো যা উপার্জন করবেন তার তুলনায় বেশি পরিশ্রম করা। যদি তা করেন তবে একসময় অবশ্যই এখনকার চেয়ে বেশি উপার্জন করতে পারবেন। এছাড়া আর কোনো উপায় নেই।

এক ধাপ এগিয়ে থাকুন। যা পাচ্ছেন তার চেয়েও বেশি করার মনোভাব গঠন করুন। যারা এক ধাপ এগিয়ে থাকে তাদের পথে কোনো বাধা আসতে পারে না।


নতুন অভ্যাস গঠন

আপনি যা করেন তার ৯৫ ভাগই হলো অভ্যাস, প্রথমে চিন্তা পরে কর্ম। সফল মানুষ ভালো অভ্যাস গঠন করে যার ফলে তারা সুখী, কার্যক্ষম ও আর্থিক ভাবে সচ্ছল জীবনযাপন করে। দরিদ্র মানুষ দরিদ্র কিংবা বদভ্যাস গঠন করে যার ফলাফল হয় বিপরীত। সৌভাগ্যবশত সকল অভ্যাসই চর্চা ও অনুশীলনের মাধ্যমে শেখা যায়। আপনার লক্ষ্যে পৌঁছাতে প্রয়োজন হবে এমন যেকোনো অভ্যাস কিংবা দক্ষতা আপনি ইচ্ছা করলেই শিখতে পারেন।

আসল প্রশ্ন হলো, ‘আপনি কতটা তীব্রভাবে তা চান?’ ধনী ও দরিদ্র মানুষের মাঝে পার্থক্য বোঝার জন্য তাদের ওপর বছরের পর বছর ধরে গবেষণা ও তুলনা করা হয়েছে।

মূল কথা হলো আপনি সকল সুবিধা― ভালো পরিবার, চমৎকার শিক্ষাগত যোগ্যতা, আদর্শ সুযোগসুবিধা, লোকবল ইত্যাদি সবকিছু নিয়ে জীবন শুরু করলেও যদি আপনার সাফল্য অর্জনের জন্য প্রয়োজনীয় মানসিকতা না থাকে তবে এগুলো কোনো কাজেই আসবে না।

অপরদিকে কোনো সুযোগসুবিধা ছাড়া শুরু করে, যেমনটা অনেক মানুষ একনায়কতান্ত্রিক কিংবা দরিদ্র দেশ ছেড়ে এসে কোনো বন্ধু, আত্মীয়, লোকবল ব্যতীত এমনকি অপরিচিত ভাষা দিয়ে শুরু করে তারাও সাফল্য অর্জন করতে পারে। কারণ একটাই, তারা অসাধারণ অভ্যাসের অধিকারী।


সাত ধাপের কৌশল

একটি সহজ সাত ধাপের কৌশল মেনে অভ্যাস গড়ে তোলা যায়।

প্রথমত, এক সময়ে কেবল একটিই অভ্যাস গঠনের চেষ্টা করুন। যদি উচ্চাকাক্সক্ষী হয়ে একাধারে অনেক ভালো অভ্যাস গঠনের সিদ্ধান্ত নেন তবে একটি অভ্যাসও গঠন করা হবে না। ধৈর্যশীল হোন। ‘ধীরে ধীরে ত্বরান্বিত করুন।’

এর কারণ হলো একটি নতুন অভ্যাস গঠন করতে সেই কাজটিকে বিশ থেকে ত্রিশ দিন পুনরাবৃত্তি করতে হয়। আদতে আপনি প্রতি মাসে একটি করে সম্পদ গঠনের অভ্যাস গড়ে তুলতে পারেন। তার মানে বছরে প্রায় ১২টি নতুন অভ্যাস গড়ে তোলা সম্ভব। এটাই আপনার জন্য যথেষ্ট।

উদাহরণস্বরূপ, বেশির ভাগ ধনী ব্যক্তি ভোর ছয়টায় ঘুম থেকে ওঠে, তাদের প্রথম কাজ শুরুর ঠিক তিন ঘণ্টা আগে। তারা দৈনিক কিছু নিয়ম মেনে চলে। তারা ঘুম থেকে উঠে, ব্যায়াম করে, পোশাক পরে, দিনের বাকি সময় কী করবে তার পরিকল্পনা করে। তারা পড়াশোনা করে, নতুন কিছু শেখার চেষ্টা করে, নিজেকে গুছিয়ে নেয়। সাধারণ মানুষ এক কাপ কফি খাবার আগেই তারা অনেক কাজ করে ফেলে। এই অভ্যাসটি আপনি এখনই গড়ে তুলতে পারেন। এটি হয়তো আপনার জীবন বদলে দিবে।

দ্বিতীয়ত, নতুন তথ্য সংগ্রহ করুন। এমন একটি অভ্যাস গঠনের কথা ভাবুন যা আপনার কাজে লাগবে। এই আচরণ সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা রাখুন। এই অভ্যাসটি সম্পর্কে সবসময় চিন্তা করুন।

উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, ধনী ব্যক্তিরা সবসময় অর্থ উপার্জনের কথা ভাবে। তারা টাকা আয় করার নিত্যনতুন সুযোগ খুঁজতে থাকে। চারপাশের মানুষ বর্তমানে কী চাচ্ছে, তারা কোনো পণ্য কিংবা সেবাটি পেতে অর্থ ব্যয় করতে ইচ্ছুক, ভবিষ্যতে তাদের চাহিদা কী হতে পারে, তারা সবসময় এই চিন্তায় মগ্ন থাকে। তারা প্রতিনিয়ত মুনাফা অর্জনের চিন্তা করে। আপনিও এই কাজটি করতে পারেন।

তৃতীয়ত, নিজেকে আশ্বাস দিন যে আপনার এই অভ্যাসটি আছে। নিজেকে বারবার বলুন, ‘আমি সবখানে অর্থ উপার্জনের সুযোগ দেখতে পাচ্ছি।’ নিজেকে বলা কথাগুলোই আপনার জন্য সবচেয়ে বেশি কার্যকরী।

নিয়মিত অর্থ উপার্জন সংক্রান্ত তথ্য পড়–ন, জানুন ও শিখুন। অল্প কিংবা শূন্য থেকে শুরু করে যারা সম্পদশালী হয়েছে তাদের সাক্ষাৎকার দেখুন এবং তাদের গল্প শুনুন। আপনি কীভাবে একই কাজটি করতে পারেন তার উপায় খুঁজুন।

চতুর্থত, নিজেকে এই অভ্যাসটি গঠন করা অবস্থায় কল্পনা করুন। মনে রাখবেন, ‘আপনি নিজেকে যেই দৃষ্টিতে দেখেন আপনি তারই প্রতিচ্ছবি।’

সকল আত্মউন্নয়নের সূত্রপাত ঘটে আপনার নিজের সম্পর্কে নিজের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের মাধ্যমে। আপনি নিজেকে নিজের ভেতর যেভাবে কল্পনা করবেন বাইরে ঠিক তেমনি আচরণ করবেন।

কল্পনা করুন, আপনি প্রতিদিন ভোর ৬:০০ টার আগে ঘুম থেকে উঠছেন এবং তখন থেকেই কাজ শুরু করছেন। শুনে অবাক হবেন অনেক ধনী ব্যক্তি ভোর ৪:০০ টায় কিংবা ৫:০০ টায় উঠে ত্রিশ থেকে ষাট মিনিট ব্যায়াম করে দিন শুরু করে। যদি একমাস যাবৎ প্রতিদিন এই কাজটি করেন তবে আপনি দ্রুত একটি ইতিবাচক অনুভূতি গঠন করবেন। আপনার নিজেকে সারাদিন উজ্জ্বল, উচ্ছল ও প্রাণবন্ত বলে মনে হবে।

পঞ্চমত, এমন ভাব করুন যেন এই অভ্যাসটি আপনার আগে থেকেই ছিল। মানুষের সেরা কিছু পরিবর্তনের জন্য দায়ী দ্বিমুখিতা নীতি (খধি ড়ভ জবাবৎংরনরষরঃু) ব্যবহার করে আপনি আর্থিক সাফল্য অর্জনের পথে অগ্রসর হতে পারবেন।

এই নীতি বলে আপনি যদি কোনো নির্দিষ্ট কিছু বিশ্বাস ধারণ করেন বা আপনি নিজেকে কোনো বিশেষ দৃষ্টিতে দেখেন তবে আপনি স্বভাবগত ভাবে সেভাবেই আচরণ করবেন। কিন্তু যদি আপনি নিজেকে একজন সফল কিংবা ধনী ব্যক্তি হিসাবে না দেখেন তাহলে কী হবে?

হার্ভার্ডের উইলিয়াম জেমস বলছেন যে, ‘যদি কাক্সিক্ষত একটি অভ্যাস না থাকে তবে এমন ভাব করুন যেন সেই অভ্যাসটি আপনার আগে থেকেই ছিল। শুধু এই কাজটি করা শীঘ্রই আপনাকে ঐ অভ্যাসটি গঠন করতে সাহায্য করবে।’

সফল মানুষ আগে থেকেই প্রতিদিনের পরিকল্পনা করে রাখে, সাধারণত আগের রাতে তারা এই কাজটি করে। তারা কাজগুলোকে গুরুত্ব অনুসারে সাজায় এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজটিকে সবার প্রথমে রাখে। আপনিও আগামীকাল থেকে এই কাজটি করতে পারেন।

নিজের দৈনিক কার্যাবলি গোছানোর সময় এই কথাটি ভাবুন, ‘ধনী মানুষ এই কাজটি করে। খুব শীঘ্রই এটি আপনার অভ্যাসে পরিণত হবে এবং আপনার দৈনন্দিন জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হবে।

ষষ্ঠত, কোনোভাবেই এর ব্যত্যয় হতে দিবেন না। একটি অভ্যাস গঠনের সংকল্প করার পর কখনো সেই অভ্যাসটি স্থায়ী না হওয়া পর্যন্ত হাল ছাড়বেন না। এটি দরিদ্র মানুষের কাজ।

সপ্তমত, যদি নিজের পথ থেকে ‘ছিটকে’ পড়েন, তবে তৎক্ষণাৎ আবার সেই পথে ফিরে আসুন। যদি আবার আগের অভ্যাসে ফিরে যান, যেটা প্রায়ই হবে তবে নিজেকে সংযত করে আবার নতুন অভ্যাসটি চর্চায় নিজেকে ফিরিয়ে আনুন।

নিজের সাময়িক পদস্খলনকে উড়িয়ে দিয়ে বলুন, ‘পরেরবার আরও ভালোভাবে চেষ্টা করব।’ এরপর আবার কাজ শুরু করুন। প্রথম চেষ্টায় সফল হওয়ার আশা করবেন না। প্রথম কয়েকবার হয়তো ব্যর্থ হতে পারেন। ধৈর্যশীল ও অধ্যবসায়ী হোন।


ভালো অভ্যাস গঠন করুন

ভালো অভ্যাস গঠন করা কঠিন, কিন্তু মেনে চলা সহজ। অপরদিকে বদ অভ্যাস গঠন করা সহজ, কিন্তু মেনে চলা কঠিন। নিয়ম হলো ভালো অভ্যাস গঠন করে সেগুলো মেনে চলতে হবে।

নতুন অভ্যাস শেখা এবং অনুশীলন করা প্রথমে কঠিন, কিন্তু পরে তারা স্বাভাবিক ও সহজ হয়ে আসে। দ্রুতই এই নতুন অভ্যাস অনুশীলন করা আগের অভ্যাসে ফিরে যাওয়ার চেয়ে সহজ হয়ে আসে।


ধনী মানুষের অভ্যাস

ধনী মানুষেরা চর্চা করে এমন অনেক অভ্যাস রয়েছে যা আপনি গঠন করতে পারেন। উদারহরণস্বরূপ, ফোর্বস ম্যাগাজিনের ২০১৫ সালের এক জরিপ অনুযায়ী স্ব-প্রতিষ্ঠিত ধনকুবেরদের পুরো ৭৬ ভাগ তাদের সাফল্যের কারণ হিসাবে ‘কঠোর পরিশ্রম ও আত্মনিয়ন্ত্রণ’কে চিহ্নিত করেছেন।

কোটিপতিরা সপ্তাহে প্রায় ষাট ঘণ্টা কাজ করে, সাধারণত সপ্তাহে ছয়দিন, দিনে ১০ ঘণ্টা বা এর অধিক সময় ধরে। তারা খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে, সকাল ৭:০০টা বা ৮:০০টার মাঝে দিন শুরু করে এবং সন্ধ্যা ৬:০০টা বা ৭:০০টা পর্যন্ত কাজ চালিয়ে যায়। অপেরা দলের কর্মসচিব ডেভিড ফস্টার বলেছেন, ‘আমি এমন কোনো সফল ব্যক্তিকে চিনি না যে কিনা সপ্তাহে ছ’দিনের কম কাজ করে।’


যা করতে ভালোবাসেন তাই করুন

নিয়মটি এই― যা করতে ভালোবাসেন তাই করুন। যেই কাজ করতে ভালো লাগে, যা আপনাকে আকৃষ্ট করে, যা আপনাকে সুখী করে সেই কাজগুলো করুন। বেশির ভাগ কোটিপতি বলে যে তারা জীবনে একদিনও কাজ করেনি। তারা এমন সব কাজ করে যা করতে তারা ভালোবাসে এবং তার জন্য তাদের অর্থ প্রদান করা হয়। আপনারও তাই করা উচিত।

কঠোর পরিশ্রম ও আত্মনিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি কোটিপতিরা সময় অপচয় করে না।

তারা সবসময় তাদের সেবা দিয়ে প্রতিযোগীদের তুলনায় আরও ভালো, দ্রুত ও সস্তা জিনিস গ্রাহকদের কাছে সরবরাহের মাধ্যমে মুনাফা অর্জনের চিন্তা করে। তারা নিয়মিত নিজেকে জিজ্ঞেস করে, ‘আমার লক্ষ্য অর্জনের জন্য কী আমি আমার সময়ের সর্বোত্তম ব্যবহার করছি?’

 

স্পষ্ট লক্ষ্য নির্ধারণ করুন

অধিকাংশ কোটিপতিরা তীব্রভাবে লক্ষ্যকেন্দ্রিক। তাদের একটি বৃহৎ এবং নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য, একটি বড় লক্ষ্য যাকে অনেক সময় বিএইচএজি (ইঐঅএ - ইরম ঐধরৎু অঁফধপরড়ঁং এড়ধষ) তথা ‘বড় বড় দুঃসাহসিক লক্ষ্য’ রয়েছে যা নিয়ে তারা সারাক্ষণ চিন্তা করে এবং সেই অনুযায়ী কাজ করে। আপনার এই লক্ষ্যটি কী?

কোটিপতিরা লক্ষ্য অর্জনের বিভিন্ন ব্যবস্থা, বিশেষ করে আর্থিক ব্যবস্থা গ্রহণ করে এবং প্রতিটি লক্ষ্য অর্জনের একটি সময়সীমা নির্ধারণ করে।

কোটিপতিরা সাশ্রয়ী এবং নিজের অর্থের প্রতি যতœবান। তারা কোনো বিনিয়োগ করার আগে সতর্কভাবে সবদিক পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে যাচাই করে। তারা অর্থ উপার্জন করতে ভালোবাসে কিন্তু অর্থ হারাতে ঘৃণা করে।

কোটিপতিরা আর্থিক উপার্জন, অর্থ সঞ্চয়, পুঁজি এবং আরও অর্থ লাভের প্রতি মনোনিবেশ করে। জাপানিজ একটি প্রবাদ আছে, ‘অর্থ উপার্জন হলো একটি বালতিতে চামচ দিয়ে পানি নেওয়া। আর অর্থ হারানো হলো বালতির পানি ঢেলে দেওয়া।’


সময়ের সদ্ব্যবহার করুন

কোটিপতিরা অত্যন্ত কার্যক্ষম এবং তারা নিজের সময়ের যথাযথ ব্যবহার করে। তারা অগ্রিম ভাবে প্রতিদিনের পরিকল্পনা করে। তারা স্পষ্ট লক্ষ্যের ওপর সময় ব্যয় করে। তারা নিজের সময়ের প্রতিটি মিনিট, প্রতিটি ঘণ্টার সবচেয়ে মূল্যবান ব্যবহারের ওপর গুরত্বারোপ করে।

দরিদ্র লোকেরা কোনো পরিকল্পনা ছাড়াই কাজে নেমে পড়ে এবং নিজের প্রচুর সময় অপচয় করে, অবশেষে সাফল্য অর্জনের আগেই ক্লান্ত ও নিরুৎসাহিত হয়ে পড়ে।

আপনি যেসকল মূল্যবান দক্ষতা শিখতে পারেন তার মধ্যে একটি হলো আপনার পছন্দসই আয় বা ঘণ্টামাফিক উপার্জন গণনা করা। ২ হাজার সংখ্যাটি দিয়ে (যা সফল মানুষের এক বছরের কাজের সময়) আপনার কাক্সিক্ষত বার্ষিক আয়কে ভাগ করুন। যদি আপনার লক্ষ্য বছরে ১ লাখ ডলার বা ৫০ লাখ টাকা আয় করা হয়ে থাকে তবে একে ২ হাজার দিয়ে ভাগ করলে আপনার প্রতি ঘণ্টায় কাক্সিক্ষত আয় দাঁড়ায় ৫০ ডলার বা ২,৫০০ টাকা।

এরপর থেকে প্রতিদিন, প্রতি ঘণ্টায়, প্রতি মিনিটে নিজেকে জিজ্ঞেস করুন আপনি এখন যা করছেন তা করে আপনার কাক্সিক্ষত আয় পাচ্ছেন কিনা। যদি তা না হয় তবে এখনই কাজটি করা বন্ধ করুন। কাজটি অন্য কাউকে করতে দিন বা করা বন্ধ করে দিন। আপনার কাক্সিক্ষত আয় আসে না এমন যেকোনো কাজ করা থেকে নিজেকে একেবারে বিরত রাখুন।


কেবল না বলুন

ন্যান্সি রিগান কিশোরদের মাদক ব্যবহার সম্পর্কে উপদেশ দিতে গিয়ে বলেছেন, ‘কেবল না বলুন!’

আপনার সময়ের সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার হয় না, আপনার কাক্সিক্ষত আয় আসে না এমন সকল কাজকে না বলুন।

যখন ওয়ারেন বাফেটকে তার সাফল্যের রহস্য সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা তিনি তৎক্ষণাৎ উত্তর দেন, ‘আমি সবকিছুকে না বলি।’

সিলিকন ভ্যালির শতকোটি টাকার পুঁজিবাদী উদ্যোক্তা জন ডয়ারের একদল কর্মী আছে যাদের কাজ হলো তিনি সামান্য যেসব কাজ করেন তা ব্যতীত বাকি সকল কাজ করা। তার এই সামান্য কাজই তার প্রতিষ্ঠানের কোটি কোটি অর্থ উপার্জনের জন্য দায়ী। এই কাজগুলো বাদে তিনি বাকি সব কাজকে না বলেন।


শিখতে থাকুন, জানতে থাকুন

কোটিপতিরা সবসময় নতুন নতুন উপায় ও কৌশল শেখে। তারা দিনে ২ থেকে ৩ ঘণ্টা পড়া, জানা ও শোনার কাজে ব্যয় করে। তারা ব্যবসায়িক বই ও প্রবন্ধ পড়ে এবং অডিও বুক শোনে। তারা জানে তাদের বর্তমান জ্ঞান এবং একটি নতুন কৌশল মিলে তাদের ব্যবসার ভবিষ্যৎ বদলে দিতে পারে। তারা সঠিক পদ্ধতির অস্তিত্বে বিশ্বাসী এবং সর্বদা তার খোঁজ করে চলে।


টেলিভিশনের ফাঁদে পা দিবেন না

ধনী মানুষ দিনে এক ঘণ্টার বেশি টেলিভিশন দেখে না। দরিদ্র মানুষ দিনে ৫ থেকে ৮ ঘণ্টা সময় টেলিভিশন দেখে এবং দেখা শেষ করে খুবই ক্লান্ত হয়ে বিছানায় যায়, এরপর ঘুম থেকে উঠে আবার টেলিভিশন ছেড়ে দেয়।

টেলিভিশন একটি দারুণ দাস কিন্তু মারাত্মক মনিব। আপনার টেলিভিশন আপনাকে ধনী কিংবা দরিদ্র বানাতে পারে। যদি কম সময় এর পিছনে ব্যয় করেন তবে এটি আপনাকে ধনী করবে আর যদি ঘণ্টার পর ঘণ্টা দেখতে থাকেন এটি আপনার জন্য দারিদ্রতা বয়ে আনবে।

নতুন এক গবেষণায় দেখা গেছে মানুষ যত বেশি ধনী হয় তারা তত বেশি টেলিভিশন থেকে দূরে সরে যায়। ধনী মানুষ আসলে ‘টেলিভিশন রুম’ নামক আলাদা ঘর বানিয়ে নেয় যাতে টেলিভিশন তাদের ঘরের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত না হয়। আলাদা ঘরে টেলিভিশন রাখার কারণে তাদের ঐ ঘর পর্যন্ত গিয়ে তারপর টেলিভিশন দেখতে হয়। তারা ইচ্ছাকৃত ভাবে টেলিভিশন দেখার কাজটিকে কঠিন করে তোলে। অনেকে তো টেলিভিশন সেট বাড়ি থেকে বিদায়ই করে দেয়।


অতৃপ্ত কৌতূহলী হয়ে উঠুন

ধনী ব্যক্তিদের আরেকটি অভ্যাস হলো তারা অনেক বেশি প্রশ্ন করে এবং গভীর মনোযোগের সাথে উত্তরগুলো শোনে। মধ্যম মানের ব্যবস্থাপক এবং মধ্যম আয়ের মানুষ অনেক কথা বলে কিন্তু অন্যের কথায় কান দেয় না। ধনী ব্যক্তিরা অনেক প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে, অনেক বেশি শোনে, এমনকি নোটও করে নেয়। তারা জানে যেকেউ অর্থ উপার্জনের নতুন নতুন উপায় জেনে থাকতে পারে।


আপনার স্বাস্থ্য ও শারীরিক শক্তির প্রতি যতœবান হোন

ধনী ব্যক্তিরা সবসময় নিজের স্বাস্থ্যের প্রতি যতœবান। কী করলে তারা সুস্থ ও সবল থাকবে এবং তাদের আয়ু বৃদ্ধি পাবে সেসব বিষয়ের প্রতি তারা নজর রাখে।

সফল হতে, দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করতে, অন্যদের আগে কাজ শুরু করতে এবং দেরিতে কাজ শেষ করতে অনেক শক্তির প্রয়োজন। ধনী মানুষ সবসময় নিজের শারীরিক শক্তি বৃদ্ধির উপায় খোঁজে।

এক বিশেষজ্ঞের মতে যেকোনো ব্যবসার গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ হলো― কোম্পানির এক্সিকিউটিভ তথা কার্যনির্বাহী যখন বিশ্রাম নেয় এবং ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করে তা। (ঙহব বীঢ়বৎঃ ংধরফ ঃযধঃ ঃযব সড়ংঃ রসঢ়ড়ৎঃধহঃ ধংংবঃ ড়ভ ধহু নঁংরহবংং রং ৎবংঃবফ বীবপঁঃরাব ঃযরহশরহম ঃরসব)। এটি আপনার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানসিক সম্পদও বটে। কীভাবে আপনি এটি আরও বেশি পরিমাণে পেতে পারেন?

সঠিক ওজন

সঠিক ওজন থাকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। স্থুলতা নানা ধরনের রোগের জন্ম দেয়। অতিরিক্ত ওজন শরীরের ওপর চাপ ফেলে, অতিরিক্ত শক্তি ক্ষয় করে যা আপনি কাক্সিক্ষত সাফল্য অর্জনে ব্যয় করতে পারতেন।

ওজন হ্রাসের ৬টি সহজ শব্দ হলো― ‘কম খান এবং বেশি ব্যায়াম করুন।’

ধনী মানুষ পুষ্টিকর খাবার খায় এবং অনেক পানি পান করে। ফলে তারা অধিক শারীরিক শক্তির অধিকারী হয়, বিশেষ করে তাদের মানসিক শক্তি দৃঢ় হয় যার ফলে তারা অধিক অর্থ উপার্জনে মনোনিবেশ করতে পারে।


উপযুক্ত বিশ্রাম

ফ্লোরিডা স্টেট ইউনিভার্সিটির মনস্তত্ত্বিক অ্যান্ডার্স এরিকসনের মতে একজন অভিজাত কর্মী প্রতিরাতে গড়ে ৮.৪৬ ঘণ্টা ঘুমায়। তিনি দেখেছিলেন শীর্ষ কর্মক্ষমতা হলো কঠোর পরিশ্রম। আর এজন্য অনেক বেশি শক্তির প্রয়োজন। প্রতি রাতে মাত্র ৫, ৬ কিংবা ৭ ঘণ্টা ঘুমিয়ে আপনি কর্মক্ষেত্রে নিজের সেরাটা দিতে পারবেন না। শরীর ও মনকে পরিপূর্ণ বিশ্রাম দিতে হলে আপনাকে রাতে ৮ থেকে ৯ ঘণ্টা ঘুমাতে হবে।


উপযুক্ত ব্যায়াম

ধনী ব্যক্তিরা দিনে গড়ে ৩০ মিনিট এবং সপ্তাহে গড়ে ২০০ মিনিট ব্যায়াম করে। তারা প্রতিদিন ভোরে উঠে ব্যায়াম শুরু করে। তারা অনেক হাঁটে, সিঁড়ি বেয়ে ওঠে, পারতপক্ষে লিফট ব্যবহার করে না। তারা সবসময় তাদের শরীরকে চলমান রাখার উপায় খোঁজে।

আমাকে একজন বলেছিলেন, ‘দেহের প্রতিটি সন্ধিকে প্রতিদিন সম্পূর্ণরূপে আলোড়িত করতে হবে।’ এই উপদেশটি আমার ব্যক্তিগত ব্যায়াম কার্যক্রম তৈরিতে বহু বছর ধরে দিকনির্দেশনা দিয়েছে।

পরিকল্পিত ঝুঁকি গ্রহণ

ধনী ব্যক্তিরা তাদের সম্পদ বাড়াতে ঝুঁকি নিতে ইচ্ছুক। তবে তারা জুয়া খেলতে কিংবা ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দিতে রাজি নয়। তারা অধিক অর্থ উপার্জনের ক্ষেত্রে একটি বিশেষ ধরনের ‘ঝুঁকি পরিহার’ কৌশল মেনে চলে। কোনো নতুন কিংবা ভিন্ন কিছু করায় যেই ঝুঁকি থাকে তা তারা সকল ধরনের তথ্য সংগ্রহের মাধ্যমে কমিয়ে আনে।

ধনী ব্যক্তিরা নিজেদের অভ্যস্ততার জায়গা থেকে বেরিয়ে নতুন কিছু করতে প্রত্যয়ী হয়। তারা নিজেদের আর্থিক সাফল্য অর্জনের জন্য যেকোনো কিছু চেষ্টা করে দেখতে রাজি। ধনী ব্যক্তিরা প্রতিনিয়ত নতুন নতুন সুযোগ খোঁজে যেখানে তারা বিভিন্ন উৎস থেকে লব্ধ জ্ঞান ও সম্পদ কাজে লাগিয়ে নিজেদের উপার্জন বৃদ্ধি করতে পারে।

ধনী ব্যক্তিরা বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ মেনে চলে এবং সতর্কভাবে বিনিয়োগের ওপর নজর রাখার মাধ্যমে বিনিয়োগ ঝুঁকি হ্রাস করে। একবার অর্থ উপার্জন করে তারা সেটি ধরে রাখতে বদ্ধপরিকর।


প্রতিনিয়ত যোগাযোগ গড়ে তুলুন

ধনী ব্যক্তিরা প্রতিনিয়ত তাদের যোগাযোগ বৃদ্ধি করে। তারা সবসময় তাদের কাজে লাগবে এবং তারা সাহায্য করতে পারবে এমন মানুষের সাথে যোগাযোগ করার উপায় অনুসন্ধান করে। কিন্তু যেমনটা ব্যারন ডে রথচাইল্ড বলেছেন, ‘অপ্রয়োজনীয় সঙ্গী বানাবে না।’

ধনী ব্যক্তিরা অকর্মণ্য ব্যক্তিদের সাথে সময় অপচয় করে না। তারা নিজেদের শিল্পে এবং সমাজে সফল ব্যক্তিদের সাহচর্য অন্বেষণ করে। যারা নেতিবাচক, যারা অপরের সমালোচনা করে, যারা কুৎসা রটায়, যারা অভিযোগ করে এমন মানুষ থেকে তারা দূরে থাকে। কর্মক্ষেত্রে অসন্তুষ্ট এবং অলস কোনো ব্যক্তির সংস্পর্শে এলে তারা ভদ্রভাবে তাদের পরিহার করে চলে।


সংযুক্ত হোন

ধনী ব্যক্তিদের মতো কাজ করুন। আপনার কর্মক্ষেত্রে উপকারে আসবে এমন একটি বা দুটি ব্যবসায়িক সমিতিতে যোগ দিন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সমিতিগুলো চিহ্নিত করুন এবং তাদের একটিতে যোগদান করুন। যেকোনো সংস্থার সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ সমিতি ঐ শিল্পের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষদের আকৃষ্ট করে। যখন এই সব সমিতিতে যোগদান করবেন তখন একটি নিরপেক্ষ ও বন্ধুসুলভ পরিবেশে তাদের সাথে দেখা করার এবং তাদের জানার সুযোগ পাবেন। একদিক দিয়ে আপনি আসলে তাদের ‘সাক্ষাৎকার’ নেওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন এবং একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠানে কাজ করার মাধ্যমে নিজের মানবিক গুণাবলি তাদের জানাতে পারছেন।


সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য

ধনী ব্যক্তিদের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য গুণটি হলো তারা কর্মক্ষেত্রে সবসময় নিজের সর্বোচ্চ কর্মদক্ষতা দেখানোয় মনোনিবেশ করে, তারা নিজেদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজে অধিক থেকে অধিকতর পারদর্শী হওয়ার চেষ্টা করে।

চূড়ান্ত বিশ্লেষণে বলা যায়, কর্মক্ষেত্রে ‘এর কাছেই যাও’ নামক ব্যক্তি হওয়ার চাইতে বড় সুখ্যাতি আর নেই। এটি আপনাকে নিজ নিজ ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠ কর্মী হিসাবে স্বীকৃতি পেতে সহায়তা করবে।

কোনো প্রতিষ্ঠানের সেরা বিনিয়োগ যেমন তারা যেই পণ্য বা পরিষেবা সরবরাহ করছে; গ্রাহকদের রুচি ও চাহিদা অনুযায়ী তার সর্বোচ্চ মান নিশ্চিত করা, একইভাবে ধনী ব্যক্তিদের সেরা বিনিয়োগ হচ্ছে নিজেদের যোগ্যতা বৃদ্ধিতে সময় ও শ্রম বিনিয়োগ করা যাতে তারা স্বক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি হিসাবে প্রমাণিত হতে পারে।


আপনার ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা অফুরন্ত

আজকের দিনে অর্থ উপার্জনের এবং দ্রুত নিজের আর্থিক লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের যত সুযোগ দেখা যাচ্ছে তা আগে কখনো দেখা যায়নি। কিন্তু যেমনটি আর্ল নাইটিঙ্গেল বলেছেন, ‘বেশি কিছু এবং ভিন্ন কিছু পেতে হলে আপনাকে আগে বেশি ও ভিন্ন কিছু হতে হবে।’

পরোক্ষ প্রচেষ্টার নীতি (খধি ড়ভ ওহফরৎবপঃ ঊভভড়ৎঃ) অনুযায়ী, যদি আপনি একান্তচিত্তে ধনী ব্যক্তিদের গুণাবলি, অভ্যাস ও আচরণ রপ্ত করায় নিজেকে নিয়োজিত করে প্রতিদিন তা অনুশীলন করেন, তবে খুব শীঘ্রই নিজের ভেতর ও বাইরে একজন ধনী ব্যক্তিতে পরিণত হবেন। [ফজলে রাব্বির কথা― পরোক্ষ প্রচেষ্টার নীতি (খধি ড়ভ ওহফরৎবপঃ ঊভভড়ৎঃ) হচ্ছে আপনি অন্যদের সাথে যোগাযোগ বা সম্পর্ক তৈরি করতে সরাসরি চেষ্টা করার চেয়ে পরোক্ষ প্রচেষ্টা চালালে বেশি ইতিবাচক সাড়া পাবেন।]

অনুশীলনী

১) আজকেই ধনী ব্যক্তিদের মতো চিন্তা ও আচরণ করার সংকল্প করুন। এই অধ্যায়ে বলা উপায়গুলো অনুশীলন করুন। অত্যন্ত সফল ব্যক্তিদের সাক্ষাৎকার, গল্প ও বই পড়ুন এবং তাদের মতো কাজ করুন।

২) এমন একটি অভ্যাস নির্বাচন করুন যা আপনার মতে আপনাকে ধনী ব্যক্তিদের মতো ভাবতে ও আচরণ করতে সাহায্য করবে। এরপর সেই অভ্যাসটি আয়ত্ত না করা পর্যন্ত সেটি প্রতিদিন অনুশীলন করুন।

৩) সফল ব্যক্তিদের জীবনযাত্রার যেকোনো একটি কাজ বা আচরণ নির্বাচন করে সেটি আপনার জীবনযাত্রার সাথে একীভূত করুন। এখনই কাজটি করুন।


 

ব্যক্তিগত উন্নয়নে

অন্যান্য বইয়ের তালিকা


০১. থিংক অ্যান্ড গ্রো রিচ। মূল: নেপোলিয়ন হিল। অনুবাদ: ফজলে রাব্বি। ঢাকা, সাফল্য প্রকাশনী, ২০১৫।

০২. ডিভেলপিং দ্য লিডার উইদিন ইউ। মূল: জন সি. ম্যাক্সওয়েল। অনুবাদ: ফজলে রাব্বি। ঢাকা, সাফল্য প্রকাশনী, ২০১৭।

০৩. সাকসেস থ্রো এ পজেটিভ মেন্টাল এটিটিউড। মূল: নেপোলিয়ন হিল ও ডব্লিউ. ক্লেমেন্ট স্টোন। অনুবাদ: ফজলে রাব্বি। ঢাকা, সাফল্য প্রকাশনী, ২০১৭।

০৪. টাইম ম্যানেজমেন্ট। মূল: ব্রায়ান ট্রেসি। অনুবাদ: মোহাম্মদ রাশেদুল হক ও ফজলে রাব্বি। ঢাকা, সাফল্য প্রকাশনী, ২০২০।

০৫. অবজারভেশন। মূল: রাসেল এইচ. কনওয়েল। অনুবাদ: ফজলে রাব্বি। ঢাকা, সাফল্য প্রকাশনী, ২০১৭।

০৬. জিরো টু ওয়ান। মূল: পিটার থিয়েল ও ব্লেইক মাস্টার। অনুবাদ: ফজলে রাব্বি। ঢাকা, সাফল্য প্রকাশনী, ২০১৮।

০৭. আউটলায়ার্স। মূল: ম্যালকম গ্ল্যাডওয়েল। অনুবাদ: এ.এম. নাইম হোসেন ও ফজলে রাব্বি। ঢাকা, সাফল্য প্রকাশনী, ২০১৮।

০৮. ৭ স্ট্র্যাটেজিস ফর ওয়েলথ এন্ড হ্যাপিনেস। মূল: জিম রন। অনুবাদ: ফজলে রাব্বি। ঢাকা, সাফল্য প্রকাশনী, ২০১৯।

০৯. ওয়ান স্মল স্টেপ ক্যান চেঞ্জ ইউর লাইফ। মূল: ড. রবার্ট মৌরার (পিএইচডি)। অনুবাদ: ফজলে রাব্বি। ঢাকা, সাফল্য প্রকাশনী, ২০১৯।

১০. অ্যাজ আ ম্যান থিংকথ। মূল: জেমস অ্যালেন। অনুবাদ: ফজলে রাব্বি। ঢাকা, সাফল্য প্রকাশনী, ২০১৯।

১১. স্টার্ট উইথ হোয়াই। মূল: সাইমন সিনেক। অনুবাদ: ফজলে রাব্বি। ঢাকা, সাফল্য প্রকাশনী, ২০২০।

১২. এটিটিউড ইজ এভরিথিং। মূল: জেফ কেলার। অনুবাদ: ফারহা আহমেদ, শাহরিয়ার মাহমুদ ও ফজলে রাব্বি। ঢাকা, সাফল্য প্রকাশনী, ২০২০।

১৩. মেনটরিং ১০১। মূল: জন সি. ম্যাক্সওয়েল। অনুবাদ: ফজলে রাব্বি। ঢাকা, সাফল্য প্রকাশনী, ২০২০।

১৪. গেট স্মার্ট। মূল: ব্রায়ান ট্রেসি। অনুবাদ: ফারহা আহমেদ। সম্পাদনা: ফজলে রাব্বি। ঢাকা, সাফল্য প্রকাশনী, ২০২১।

১৫. সেল্ফ-ইমপ্রুভমেন্ট ১০১। মূল: জন সি. ম্যাক্সওয়েল। অনুবাদ: ফজলে রাব্বি। ঢাকা, সাফল্য প্রকাশনী, ২০২১।

১৬. টিমওয়ার্ক ১০১। মূল: জন সি. ম্যাক্সওয়েল। অনুবাদ: ফজলে রাব্বি। ঢাকা, সাফল্য প্রকাশনী, ২০২১।

 

সেল্ফ-ইমপ্রুভমেন্ট ১০১


আমাদের পরবর্তী নতুন বই আসবে নিউ ইয়র্ক বেস্ট সেলার লেখক জন সি. ম্যাক্সওয়েল রচিত সেল্ফ-ইমপ্রুভমেন্ট ১০১। ম্যাক্সওয়েল তার রচনায় আত্ম-উন্নয়নের প্রতি বিশেষ জোর দিয়েছেন। আত্ম-উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে বলতে গিয়ে লিখেছেন:

‘আমরা যদি পরিবর্তিত না হই, তবে আমাদের বিকাশ বা উন্নতি হবে না। আমরা যদি বিকশিত না হই, তবে আমরা প্রাণহীন জীবনযাপন করব। বিকশিত হতে গেলে নিরাপত্তাকে সাময়িকভাবে সমার্পিত করতে হয়। এতে করে হয়তো এক ধরনের পরিচিত গ-ির বাইরে বের হতে হয়। এ পরিচিত গ-ি কী? এ গ-িতে আমরা নিরাপদ তো থাকি, তবে তা উৎসাহদায়ক নয়। পরিচিত এ গ-িতে মূল্যবোধের কোনো দাম নেই, একে অপরের সাথে যে সম্পর্ক তার মানে হারিয়ে গেছে বহু আগেই। এ অবস্থাকে দস্তয়ভস্কি যেমন বলেছেন, “লোকজন একটি নতুন পদক্ষেপ নিতে, একটি নতুন শব্দ উচ্চারণ করতে সবচেয়ে বেশি ভয় পায়।” আসলে ভয় তো মূলত এর বিপরীত অবস্থাকে পাওয়া উচিত।’

লেখক ম্যাক্সওয়েল আত্ম-উন্নয়নের মূল সূত্রাবলি উল্লেখ করতে গিয়ে লিখেছেন:

১। একটি উন্নত জীবনের ইচ্ছা পোষণ করুন।

২। আজকে থেকেই বিকশিত হোন।

৩। কেবল নিজ স্বার্থের দিকে নয়, আত্ম-উন্নয়নের দিকে একনিষ্ঠ মনোযোগ দিন।

৪। কখনো আজকের অর্জন নিয়ে আত্মতৃপ্ত হয়ে বসে থাকবেন না।

৫। প্রতিনিয়ত কিছু একটা শেখার চেষ্টা করুন।

৬। বিকশিত বা উন্নত হতে একটি পরিকল্পনা তৈরি করুন।

৭। দাম পরিশোধ করতে হবে।

৮। আপনি যা কিছু শিখেছেন তা প্রয়োগ করার মতো একটি উপায় খুঁজে বের করুন।

এভাবেই আপনি ধাপে ধাপে নিজের আত্ম-উন্নয়নের পথে দৃঢ়পদে এগিয়ে যাবেন। বইটি অর্ডার করতে এখনই ক্লিক করুন: িি.িংধঢ়যড়ষষড়.পড়স.

 

পাঠকের জন্য:


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন