শুক্রবার, ২২ জানুয়ারী, ২০২১

এটিটিউড ইজ এভরিথিং। মূল: জেফ কেলার। অনুবাদ: ফারহা আহমেদ, শাহরিয়ার মাহমুদ ও ফজলে রাব্বি। ঢাকা, সাফল্য প্রকাশনী, ২০২০।

 




মনোভাবের ওপর

সবকিছু নির্ভর করে




 

আমার জীবনের একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য হচ্ছে মানুষের জন্য উপকারী সেবা সম্পন্ন করা, একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যের ক্ষমতাকে তুলে ধরা যাতে করে মানুষ নিজেদের জীবনকে সমৃদ্ধি ও সাফল্যের পথে পরিচালিত করতে পারে। ঠিক এই কারণেই আমি প্রতিদিন সকালবেলা ঘুম থেকে উঠি, নতুন নতুন পথ খুঁজি, কী কী করা যায় তা নিয়ে চিন্তাভাবনা করি। এরই একটি উপায় হচ্ছে সাফল্য প্রকাশনীর মাধ্যমে ২০৩০ সালের মধ্যে অনুপ্রেরণার ৬৪টি বই প্রকাশ করা।

 

―ফজলে রাব্বি (সাফল্য প্রকাশনী, ঠিক ধারণা ব্লগ)

 


 সাফল্য সম্বন্ধে সহযোগিতা


১৯৯৯ সালে প্রকাশিত অঃঃরঃঁফব ওং ঊাবৎুঃযরহম বইয়ের বাংলা অনুবাদ




এটিটিউড ইজ এভরিথিং

মনোভাবের ওপর সবকিছু নির্ভর করে



মূল

জেফ কেলার




অনুবাদ

ফারহা আহমেদ

শাহরিয়ার মাহমুদ

ফজলে রাব্বি





 










প্রকাশক

সাফল্য প্রকাশনী

৩০২, লালবাগ রোড, ওয়ার্ড নং: ২৫,

লালবাগ, ঢাকা-১২১১।

মোবাইল: ০১৫৩৪ ৯০২ ৮৮২

সাপ্র: ০১২

প্রথম প্রকাশ: আশি^ন ১৪২৭ / অক্টোবর ২০২০

বিষয়: ব্যক্তিগত উন্নয়ন

স্বত্ব:র্  ফজলে রাব্বি

প্রচ্ছদ: সাফল্য কম্পিউটার্স


দাম: দুইশত পঁচিশ টাকা মাত্র ($২২৫.০০)


পরিবেশক: নীলক্ষেত বুক মার্কেট, ৬৪, ইসলামিয়া মার্কেট, নীলক্ষেত, ঢাকা-১২০৫।

ফোনে অর্ডার করতে কল করুন ০১৬৮২ ০৫৮ ১৭১

সাফল্য প্রকাশনীর অনলাইন ওয়েরসাইট– িি.িংধঢ়যড়ষষড়.পড়স

সাফল্য প্রকাশনীর যেকোন বই কিনতে ভিজিট করুন

িি.িৎড়শড়সধৎর.পড়স/সাফল্য-প্রকাশনী

যঃঃঢ়://িি.িভধপবনড়ড়শ.পড়স/হরষশযবঃনসধৎশবঃ


অঃঃরঃঁফব ওং ঊাবৎুঃযরহম, ঞৎধহংষধঃবফ নু ঋধুষব জধননর, চঁনষরংযবফ নু ঝধঢ়যড়ষষড় চৎড়শধংড়হর, ৩০২, খধষনধময জড়ধফ, ডধৎফ ঘড়: ২৫, খধষনধময, উযধশধ-১২১১. ঈড়হঃধপঃ ঙভভরপব: ০১৫৩৪ ৯০২ ৮৮২.

ডবনংরঃব: িি.িংধঢ়যড়ষষড়.পড়স

ঊ-সধরষ: ধফসরহ@ংধঢ়যড়ষষড়.পড়স

চৎরপব: ঞশ ২২৫.০০ ঙহষু. টঝ: $১১. (ঐধৎফপড়াবৎ). ওঝইঘ: ৯৭৮-৯৮৪-৯৩৬১৪-৭-৭

 





উৎসর্গ

(মূল লেখক জেফ কেলার উৎসর্গ করেছেন)



আমার স্ত্রী ডলোরিসকে

যে আমার প্রতি বিশ্বাস রেখেছে এবং আমার স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে কাজ করার জন্য উৎসাহিত করেছে




 

 

 





সূচি



ভূমিকা যে রাত আমার জীবন বদলে দেয় ১১

আমি কাজে যেতে ভয় পেতাম ১২

সাহায্য আসে অজানা জায়গা থেকে ১৩

উকিল থেকে মোটিভেশনাল স্পিকার ১৪

নিজের ভিত মজবুত করা ১৫

আপনি কীভাবে এ বই থেকে উপকৃত হবেন ১৭

চিন্তা করুন... কাজ করুন... কথা বলুন ১৮

প্রথম ভাগ সাফল্যের সূত্রপাত হয় চিন্তায় ১৯

এক আপনার মনোভাব হচ্ছে আপনার ভুবনকে দেখার জানালা ২০

মনোভাবের সংজ্ঞা ২২

সবাই একটি পরিষ্কার মনের জানলা দিয়ে আরম্ভ করে ২৩

নিজের জানালা পরিষ্কার করুন ২৪

আপনিই আপনার মনোভাবকে নিয়ন্ত্রণ করেন ২৪

মনোভাব ও সাফল্য ২৬

দুই আপনি একজন মনুষ্য চুম্বক ২৮

কীভাবে এই নীতি কাজ করে ৩০

একজন মানুষ যা কিছু নিয়ে সবচেয়ে বেশি চিন্তা করে তা তার জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করে

৩১

মনোভাব পরিবর্তনের কারণে আমি আবাসন কোম্পানির মালিক হলাম ৩২

মনোভাব বনাম কর্ম সাধন ৩৩

আপনার পরিস্থিতি আপনার চিন্তারই প্রতিফলন ৩৩

নিজের চিন্তা বদলান ৩৪

পুনরাবৃত্তি হল চাবিকাঠি ৩৫

রাতারাতি সাফল্য পাওয়ার আশা করবেন না ৩৬

তিন মনের জানালা দিয়ে নিজের সাফল্যকে স্পষ্টভাবে দেখুন ৩৭

ছোটবেলার ‘মনের চলচ্চিত্র’ ৩৮

নিজের মনের ছবির দায়িত্ব নিতে শিখুন ৩৯

পুরোনো ছবির অর্থ বদলে ফেলুন ৩৯

নতুন ছবি তৈরি করুন ৪০

বিক্রয়কর্মে সাফল্য লাভের জন্য কল্পচিত্র গঠন করুন ৪১

নিশ্চিন্ত থাকুন এবং নিজের ইন্দ্রিয়গুলোকে সজাগ রাখুন ৪১

নিজের জন্য একটি চেক লিখুন ৪২

পছন্দসই চাকরি পাওয়া ৪৩

এটি দু’ভাবে কাজ করে ৪৪

লাইটস... ক্যামেরা... একশন ৪৫

চার অঙ্গীকার করুন... আর জীবন বদলে দিন ৪৬

অঙ্গীকারের ‘জাদু’ ৪৭

বদ্ধদ্বার খুলে যাবে ৪৮

একটি সতর্কবাণী ৫০

অঙ্গীকার কীভাবে একজন উদীয়মান ঔপন্যাসিকের কাজে এল ৫০

তিনি হার মানতে রাজি হননি ৫২

যতদিন লাগে লাগুক ৫৩

অঙ্গীকার করার সময় হয়েছে ৫৪

পাঁচ সমস্যাকে সুযোগে রূপান্তর করুন ৫৫

সুবিধা খুঁজে নেওয়া ৫৬

শোক থেকে শক্তি ৫৭

ব্যবসায় অভিশাপ হচ্ছে ছদ্মবেশে থাকা আশীর্বাদ ৫৮

হতাশা থেকেই পেশাবদল হয় ৫৯

কীভাবে দুর্ভোগ আমাদের উপকার করে ৬১

ইতিবাচক জিনিস খুঁজুন ৬২

দ্বিতীয় ভাগ ভেবেচিন্তে কথা বলুন ৬৪

ছয় আপনার ব্যবহৃত শব্দগুলো আপনার জীবনের নতুন সূচনা করবে ৬৫

আমি আপনার ঘরের কিছু মেরামত করি তা আপনি কেন চাইবেন না ৬৭

বিজ্ঞানীদের ব্যবহৃত শব্দগুলো প্রয়োগ করতে পারেন ৬৮

বলব... নাকি বলব না ৬৯

কথা ও দায়বদ্ধতা ৭১

কথা ও অনুভূতি ৭২

আরও কাছ থেকে আপনার কথা পর্যবেক্ষণ করুন ৭৩

১। সম্পর্ক ৭৪

২। আর্থিক সংস্থান ৭৪

৩। ক্যারিয়ার ৭৪

৪। স্বাস্থ্য ৭৫

আপনার সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ রয়েছে ৭৫

সাত কেমন আছেন? ৭৭

নেতিবাচক উত্তর ৭৭

মধ্যপন্থি উত্তর ৭৮

ইতিবাচক উত্তর ৭৯

ইতিবাচক মানুষের সঙ্গ গ্রহণ করুন ৮০

নতুন অভ্যাস গড়ে তুলুন ৮১

যদি আমি ভালো বোধ না করি তবে? ৮৩

কথা বলার সময় উজ্জীবিত ও প্রাণবন্ত থাকুন ৮৪

আট অভিযোগ করা থেকে বিরত থাকুন ৮৬

কেউই আপনার দুঃখদুর্দশার গল্প শুনতে ইচ্ছুক নয় ৮৭

অন্যকে আপনার কাজে ব্যত্যয় ঘটাতে দিবেন না ৮৮

তার অভিযোগ যৌক্তিক ৮৮

ভিন্নভাবে মূল্যায়ন করতে শিখুন ৯০

যা কিছু কল্যাণকর তার উৎস হোন ৯২

তৃতীয় ভাগ আল্লাহ তাদের সাহায্য করে যারা কাজ করে ৯৩

নয় ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করে এমন লোকজনের সাথে চলাফেরা করুন

৯৪

বিষাক্ত মনের মানুষ এবং উন্নত মনোভাবের মানুষ ৯৬

রেডিও’র অর্থহীন গান ৯৭

স্মোকির স্পঞ্জ তত্ত্ব ৯৮

আপনার বন্ধুত্বকে নিয়মিত পরিমাপ করুন ৯৯

বিষাক্ত মনের আত্মীয় ১০০

কর্মক্ষেত্রে ইতিবাচক সহকর্মী ১০১

বন্ধু নির্বাচনে বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিন ১০২

দশ ভয়কে মোকাবিলা করে উন্নতি লাভ করুন ১০৪

ভয়ের স্বরূপ উন্মোচন ১০৫

স্বস্তিদায়ক বলয় তথা কমফোর্ট জোন ১০৫

ভয়ের সর্বাধিক সাধারণ কারণসমূহ ১০৭

ভয় থেকে পালিয়ে বেড়ানো ১০৮

যে মূল্য আপনি দিচ্ছেন ১০৯

কলেজে থাকাকালীন আমার কৌশল ১০৯

নতুন জীবন ১১০

পরিস্থিতি নিজের অনুকূলে আনুন ১১১

এগিয়ে যান, যদিও আপনি শঙ্কিত ১১২

সে তার স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করেছে ১১৩

কাজে নেমে পড়–ন ১১৪

এগারো কাজে নামুন এবং ব্যর্থ হোন ১১৬

কাজের প্রথম দিকের ঘটনা ১১৭

গতকাল ও আজ ১১৮

ব্যর্থতা হচ্ছে কোটি টাকা অর্জনের আসল সিঁড়ি ১১৯

ব্যর্থতার অভিজ্ঞতার মাধ্যমে নিজেকে নির্ভীক করে তুলুন ১২০

রাতারাতি সফলতা আসে না ১২২

কখনো হাল ছাড়বেন না ১২২

গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রশ্ন ১২৩

ব্যর্থতাকে সাফল্যে রূপান্তর ১২৪

বারো নেটওয়ার্কিং– যা সুফল বয়ে আনে ১২৬

নেটওয়াকিং এর সুবিধা ১২৭

মনোভাব ও কর্ম ১২৮

সুপারিশ ১৩০

যোগাযোগ ১৩১

পরিকল্পনা অনুসরণ করুন তথা ফলো-আপ (ভড়ষষড়-িঁঢ়) ১৩৪

নেটওয়ার্ক তথা সম্পর্কের হাত বড় করুন ১৩৫

উপসংহার মনোভাব বদলান, জীবন বদলে যাবে ১৩৭

জীবনের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করুন ১৩৮

ব্যক্তিগত উন্নয়নে অন্যান্য বইয়ের তালিকা ১৪১


 





ভূমিকা


আমার প্রজন্মের সবচেয়ে বড় আবিষ্কার হচ্ছে মানুষ তার চিন্তার পরিবর্তনের মাধ্যমে তার জীবন বদলাতে পারে।

- উইলিয়াম জেমস


যে রাত আমার জীবন বদলে দেয়


১৯৮০ সালে যখন আমি আইন পাশ করি, তখন চিন্তা করেছিলাম আমি বাকি জীবন একজন উকিল হিসাবেই কাটিয়ে দিব। আর চিন্তা করব নাইবা কেন, কিশোর বয়স থেকে আমি তো একজন উকিলই হতে চেয়েছিলাম।

প্রথমে সবকিছু পরিকল্পনা অনুযায়ী চলছিল। সেই গ্রীষ্মে প্রচুর পড়াশোনার করে আমি বার পরীক্ষায় (উকিল হওয়ার পরীক্ষায়) উত্তীর্ণ হয়ে নিউ ইয়র্কে ওকালতি করার সুযোগ পাই। আমার ব্যক্তিগত জীবনও ভালোই যাচ্ছিল। ১৯৮১ সালের শুরুতে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠী ডলোরিসকে বিয়ে করি। আমি সুখী ও সমৃদ্ধ জীবনের দিকেই অগ্রসর হচ্ছিলাম।

অন্তত আমি তাই চিন্তা করেছিলাম।

বেশ কয়েক বছর ওকালতি করার পর বুঝতে পারি যে আমি মোটেই সুখী নই। ওকালতির সাথে জড়িত অনেক বিষয় আমি ভালোবাসতাম। আমি মানুষের বিবাদ মীমাংসায় সাহায্য করতে পছন্দ করতাম। বিশেষ করে তাদের দীর্ঘসময় ধরে কোর্টে হাজিরা দেওয়া থেকে রক্ষা করতে আমার ভালো লাগত। তবুও এমন অনেক জিনিস ছিল যা উকিল হিসাবে আমি অপছন্দ করতাম। আর এই বিষয়গুলো আমার জীবনীশক্তি শুষে নিচ্ছিল। আমাকে স্তুপের পর স্তুপ নিরস বিধিসংক্রান্ত নথি পূরণ করতে হত। সময় পিছিয়ে যাওয়া বা বদল করা ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। এক বিচারদিবস দশবার পিছিয়ে যাওয়ায়ও অস্বাভাবিক ছিল না।


আমি কাজে যেতে ভয় পেতাম

আমি এভাবে একঘেয়ে কাজ করে যাচ্ছিলাম আর একই সাথে উকিল হিসাবে আমার অসন্তুষ্টি বেড়েই চলছিল। আমি খুবই হতাশ ও বিষণœ হয়ে পড়েছিলাম। সত্যি কথা বলতে জীবনের প্রতি আমার বিতৃষ্ণা জন্মাতে শুরু করেছিল। আমি চিন্তা করেছিলাম এই অবস্থা থেকে উত্তরণের বুঝি আর কোন সুযোগই নেই।

আপনি কি কখনো এমন চাকরি করেছেন যেখানে বেশির ভাগ দিনই আপনি কাজে যেতে ভয় পেতেন? আপনার কি কখনো মনে হয়েছে যে পুরো পৃথিবীর ভার আপনি প্রতিদিন একাই কাঁধে করে বয়ে চলেছেন?

আমি এমনই অনুভর করতাম। আমি মানসিক ও শারীরিক কষ্টের ভারে নুয়ে পড়েছিলাম। আমার চেহারায় বয়সের ছাপ পড়তে শুরু করেছিল (যদিও তখন আমার বয়স খুব বেশি ছিল না)। আমার সবসময় মাথা ব্যথা করত এবং পেট মোচড়াত। আমার কোনো কঠিন অসুখ হয়েছে ভেবে আমি ডাক্তারের শরণাপন্ন হই এবং তারা আমাকে একগাদা পরীক্ষানিরীক্ষা করতে দেয়। সব পরীক্ষার ফল একই আসে– আমার শরীরে কোন রোগ নেই। একজন ডাক্তার আমাকে পেটের অসুখের জন্য ম্যালক্স খেতে বলেন।

আমার মনের মৃত্যু ঘটেছিল। আমি জীবনের অর্থ হারিয়ে ফেলেছিলাম। প্রতিদিনের এ গোলামি আমার চেহারাতেও ছাপ ফেলছিল। যদিও আমার বয়স ছিল ত্রিশের কাছাকাছি কিন্তু আমাকে দেখে মনে হত আমার বয়স চল্লিশ!

১৯৮৫ সালের প্রথমভাগে, ত্রিশ বছর পূর্ণ করার পরেই আমি নিঃশেষ হয়ে যাই। এক সন্ধ্যায় যখন বাড়িতে একা বসে চিন্তা করছিলাম তখন হঠাৎ আমার মনে হয় এবার একটা পরিবর্তন দরকার। কিন্তু তা কী ভেবে না পেয়ে আমি উচ্চকণ্ঠে বলে উঠি–

আমার জীবন এমন হতে পারে না... আমার জীবনে এই দুঃখ ও দুর্দশার চেয়েও বেশি কিছু নিশ্চয় আছে।


সাহায্য আসে অজানা জায়গা থেকে

আপনি যা নন বলে আপনি চিন্তা করেন তা সত্য নয়। আপনি নিজেকে নিয়ে যা চিন্তা করেন আপনি তাই।

- নরম্যান ভিনসেন্ট পিল


সেই রাতে আমি বাসায় বসে টিভি দেখছিলাম । সময় তখন রাত ১:০০টা। আমার স্ত্রী, ডলোরিস তখন ঘুমিয়ে পড়েছে। কিন্তু আমার মন তখন এতই খারাপ যে ঘুমাতে পারছিলাম না। আমি সময় কাটাতে কিছু দেখার জন্য চ্যানেল বদল করছিলাম। হঠাৎ আমি একটি ইনফোমারসিয়ালে এসে থামলাম। (ইনফোমারসিয়াল মানে একটি বিজ্ঞাপন চিত্র যা একটি পণ্যকে তথ্যমূলক ও উদ্দেশ্যমূলকভাবে প্রচার করে)। অন্যসময় হলে আমি সাথে সাথেই চ্যানেল পাল্টে দিতাম। কিন্তু সেদিন কোনো কারণে তা করলাম না।

যেই পণ্যের কথা বলা হচ্ছিল তা ছিল মানসিক ভা-ার তথা দ্য মেন্টাল ব্যাংক। আর তার বিজ্ঞাপন দিচ্ছিল ‘ব্রেডি বাঞ্চ’ চলচ্চিত্রখ্যাত অভিনেত্রী ফ্লোরেন্স হ্যান্ডারসন। মানসিক ভা-ার তথা দ্য মেন্টাল ব্যাংক ছিল একটা হোমস্টাডি কোর্স। [হোমস্টাডি কোর্স মানে বাসায় বসে পড়া যায় এমন শিক্ষা কোর্স]। এ কোর্সে ব্যাখ্যা করা হবে কীভাবে আমাদের জীবনের সব অর্জন অবচেতন মনের বিশ্বাসের ওপর নির্ভরশীল।

সেই মুহূর্তে এতটাই অস্থির ছিলাম যে কোর্সটা করার সিদ্ধান্ত নিই। আমি ক্রেডিট কার্ড বের করে প্রোগ্রামটা অর্ডার করে দিই।

সেই রাত আমার জীবনকে বদলে দেয়।

দুই একদিন পর যখন ডলোরিসকে একথা জানাই তখন সে একেবারেই হতবাক হয়ে যায়। ‘তুমি কী করেছ?’, সে বিস্ময়ের সাথে প্রশ্ন করে। এমন না যে ওর এতে আপত্তি ছিল– কিন্তু আমার জন্য হুট করে এমন কিছু কেনা খুবই অদ্ভুত বিষয় ছিল। তাও আবার একটা বিজ্ঞাপন দেখে!

বেশ কিছুদিন পর মানসিক ভা-ার তথা দ্য মেন্টাল ব্যাংক প্রোগ্রাম আমার দোরগোড়ায় এসে পৌঁছায়। আমি অত্যন্ত বিস্ময় ও আগ্রহ নিয়ে জানতে শুরু করি যে কীভাবে আমাদের চিন্তাভাবনা আমাদের জীবনযাত্রার মানকে নিয়ন্ত্রণ করে। এর আগে এই বিষয়ে আমার কোনো জ্ঞান ছিল না। দুর্ভাগ্যজনকভাবে স্কুল বা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসব বিষয় আমাদের কখনো শেখানো হয় না।

মানসিক ভা-ার তথা দ্য মেন্টাল ব্যাংক আমাকে আরও এমন অনুপ্রেরণামূলক উপাত্ত খুঁজতে উৎসাহিত করে। আমি নেপোলিয়ন হিল, অগ মানডিনো, নরম্যান ভিনসেন্ট পিল ও রবার্ট শুলারের বই পড়তে আরম্ভ করি। পাশাপাশি নিয়মিত বাইবেলও পড়তে আরম্ভ করি। আমি আগ্রহের সাথে জিগ জিগলার, আর্ল নাইটিংগেল ও আরও অনেকের অডিও ক্যাসেট প্রোগ্রাম শোনা আরম্ভ করি। মনে হচ্ছিল আমি যেন বহুদিন ধরে মরুভূমিতে বিচরণ করা এক তৃষ্ণার্ত পথিক যে কিনা হঠাৎ এক ঝর্ণার সন্ধান পেয়েছে।

আমি বলছি না যে একদিনেই আমার জীবন আমূল বদলে গিয়েছিল। কারণ তা হয়নি। কিন্তু যেদিন থেকে আমি আমার নেতিবাচক মনোভাবকে ইতিবাচক মনোভাবে পরিবর্তন করতে আরম্ভ করেছিলাম সেদিন থেকেই এর ফল পেতে শুরু করি।

আমি প্রশান্তি অনুভব করছিলাম। আমার কর্মক্ষমতা বাড়ছিল। আমি এমন সব কাজ করতে সমর্থ হয়েছিলাম যা আগে আমার জন্য ছিল কল্পনাতীত ... আর এ সবই সম্ভব হয়েছিল আমার দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আনার ফলে। আনন্দের সাথে জানাচ্ছি এখন কেউ আমার বয়স জিজ্ঞেস করলে আমি যখন জবাব দেই ৪৪, তখন তারা অবিশ্বাসের সাথে বলে, ‘তোমাকে তো আরও কমবয়স্ক বলে মনে হয়।’

সবকিছুই মনোভাবের ওপর নির্ভর করে।


উকিল থেকে মোটিভেশনাল স্পিকার

আপনি নিজেকে বদলাতে সক্ষম। নিজের এ ক্ষমতাকে কখনো ছোট করে দেখবেন না।

- এইচ জ্যাকসন ব্রাউন জুনিয়র


আমি ওকালতির পাশাপাশি অবসর সময়ে আমার জ্ঞান অন্বেষণ চালিয়ে যাচ্ছিলাম। এই ইতিবাচক মনোভাব আমাকে কাজে সাহায্য করছিল ঠিকই, কিন্তু আমার শখের প্রতি দুর্নিবার আকর্ষণও বোধ করছিলাম যা কখনো কাজের প্রতি করিনি। আমি ওকালতি ছাড়ার স্বপ্নও দেখতে শুরু করেছিলাম।

চার বছর যাবৎ দৃষ্টিভঙ্গি ও অনুপ্রেরণামূলক ধারণার ওপর নিবিড় গবেষণার পর, ১৯৮৯ সালে আমি স্থানীয় এক হাইস্কুলে প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য কিছু সান্ধ্যকালীন শিক্ষামূলক সেমিনার আয়োজন করি। প্রতি দুই ঘণ্টা ক্লাসের জন্য আমার পারিশ্রমিক হবে ৩০০ টাকা। চাকরি ছাড়ার জন্য এই অর্থ যথেষ্ট নয়!

আমি যেদিন প্রথম সেমিনারে ক্লাসের সামনে দাঁড়াই সেদিন আতঙ্কে জমে গিয়েছিলাম। আমার হৃৎপি- লাফাচ্ছিল। আমি ঘামে ভিজে যাচ্ছিলাম। কিন্তু কোনোমতে সাহস জুগিয়ে সেমিনার শেষ করি। আমার ছাত্রদের ক্লাসটা খুব পছন্দ হয়। আমিও নিজের কথাগুলো অন্যদের সামনে উপস্থাপন করতে পেরে খুবই উত্তেজনা বোধ করি। যে তত্ত্বগুলো আমার জীবনে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনে দিয়েছে তা এখন অন্যদের কাজে আসবে!

আমি সঠিক পথেই এগোচ্ছি।

ধীরে ধীরে আমার স্পিকিং ফি বাড়তে আরম্ভ করে এবং ১৯৯০ সালে আমি সিদ্ধান্ত নিই আগামী কয়েক বছরের মাঝে ওকালতি ছেড়ে দেব। সিদ্ধান্তটা সহজ ছিল না। ৪ বছর কলেজ ও ৩ বছর আইনের কলেজে পড়ার পর আইনের ডিগ্রিটা পেয়েছিলাম। তার ওপর জীবনের ১০টা বছর ওকালতি করে কাটিয়েছি। নিজের ক্যারিয়ারের পিছনে এত সময় ব্যয় করলে সেখান থেকে সরে আসা মোটেই সহজ নয়।

এছাড়া টাকার বিষয় তো ছিলই। একজন উকিল হিসাবে আমি আর কয়েক বছরের মাঝেই বছরে ১২ লাখ টাকা আয় করতে পারতাম এবং পরবর্তী বছরগুলোতে এর চেয়েও অধিক টাকা উপার্জন করতে পারতাম।


নিজের ভিত মজবুত করা

একটি ইতিবাচক মনোভাব হচ্ছে একজন ব্যক্তির উজ্জ্বল ভবিষ্যতের চাবিকাঠি।

- অজানা বক্তা


যদিও এখন আমার ‘শখ’ দিয়ে আগের থেকে বেশি উপার্জন করছিলাম তা-ও দেখলাম যে আমার উদ্যোগের শুরুতে যে পুঁজি লেগেছিল তার কিছু এখনো রয়েছে। সৌভাগ্যবশত আমি ও ডলোরিস আগে কিছু অর্থ সঞ্চয় করেছিলাম। আমার আয়ের সম্পূরক হিসাবে আমি ‘সবকিছুই মনোভাবের ওপর নির্ভর করে’ লোগোযুক্ত কিছু পণ্য বিক্রয় করতে আরম্ভ করলাম। এতে সন্দেহের অবকাশ ছিল না যে আমার নতুন ব্যবসা চালু করতে বিপুল পরিমাণ অর্থ লাগবে। অন্তত প্রথমদিকে তো বটেই।

এত কিছুর পরেও এটাই ছিল সামনে অগ্রসর হওয়ার সময়। মনে হচ্ছিল যেন কেউ আমাকে আইনি পেশা থেকে টেনে নতুন পেশায় নিয়ে যাচ্ছে। যখনই আমি দর্শকের সামনে বক্তব্য দিতাম বা কোন অনুপ্রেরণামূলক রচনা লিখতাম, তখনই আমার মন প্রাণশক্তিতে ভরে উঠত। আমি বুঝতে পারছিলাম এটাই আমার আসল জায়গা।

আর তাই আমি ধীরে ধীরে পরিবর্তন আনতে শুরু করলাম। প্রথমে সপ্তাহে চারদিন উকিল হিসাবে কাজ করতাম। এরপর একে তিনদিনে নিয়ে আসলাম। এরপর দুইদিন... এভাবে ১৯৯২ সালের আগ পর্যন্ত চলল। ১৯৯২ সাল থেকে আমি সম্পূর্ণভাবে একজন মোটিভেশনাল স্পিকার ও লেখক বনে গেলাম।

বিশ্বাস করুন, আমার মাকে যখন ওকালতি ছেড়ে মোটিভেশনাল স্পিকার হওয়ার কথা জানালাম তখন তিনি মোটেও খুশি হননি। আসলে এতে তো ‘আমার ছেলে একজন আইনজীবী’ বলার মতো গর্ব বোধ হয় না!

কিন্তু জীবনে নিজের ভিত গড়তে হলে এসব সমস্যার মোকাবিলা করতে হবে। আপনাকে এ কথা মেনে নিতেই হবে যে কিছু মানুষ আপনার সিদ্ধান্তের বিরূদ্ধে থাকবে। আমি সাথে এও বুঝতে পেরেছিলাম যে জীবনে নতুন পথে পা বাড়াতে হলে প্রথমে কয়েক পা পিছাতে হবে, অনেক কিছু বিসর্জন দিতে হবে। নতুন জীবন পাওয়ার জন্য আমাকে যা কিছু বিসর্জন দিতে হয়েছিল তা ছিল অর্থ, মর্যাদা ও আমার আইনি পেশার সুরক্ষা।

তবে আশার কথা হল আমার মা পরবর্তীতে আমার নতুন পেশার প্রতি খুবই আগ্রহ দেখান। বিশেষ করে যখন থেকে তিনি আমার সাফল্য ও আমার সন্তুষ্টি দেখতে পান তখন তার মনোভাব বদলে যায়।

আমি কেন আপনাকে নিজের পেশা বদলের গল্প শোনাচ্ছি? এসব আপনাদের বিমুগ্ধ করার জন্য বলছি না। বিশ্বাস করুন, এই পথে অগ্রসর হওয়ার সময় আমি প্রচুর ভুলভ্রান্তি করেছি।

আমার গল্প আপনাদের শোনাচ্ছি যাতে আপনারা বুঝতে পারেন কীভাবে হুট করেই আমার জীবন বদলে গেল– কীভাবে তা আগের চেয়ে উন্নত হল– যখন আমি নিজের মনোভাব বদলে ফেললাম।

তাহলে প্রমাণ পাওয়া গেল যে সবকিছুই মনোভাবের ওপর নির্ভর করে!


 

আপনি কীভাবে এ বই থেকে উপকৃত হবেন

আপনি কি ইতিবাচক ফলাফল চান? তবে আগ্রহ নিয়ে চিন্তা করুন, কাজ করুন এবং কথা বলুন।

- মাইকেল লিবোউফ


মূল কথায় যাওয়ার আগে প্রাসঙ্গিক কিছু কথা বলে নেওয়া দরকার– আপনার মনোভাব এই মুহূর্তে যতই ইতিবাচক বা নেতিবাচক হোক না কেন, এই বইটি আপনাকে সাহায্য করতে পারবে।

আপনি মনোভাব যদি নেতিবাচক হয়ে থাকে তাহলে হতাশ হবেন না। আপনি এই তত্ত্বগুলো ব্যবহার করে ইতিবাচক মনোভাব গড়ে তুলতে পারবেন। আর এভাবেই আপনি জীবনে অসামান্য সাফল্য অর্জন করতে পারবেন। আর আপনি যদি একজন ইতিবাচক মানুষ হয়ে থাকেন তবে, এ নীতিগুলো ব্যবহার করে নিজেকে সাফল্য ও সমৃদ্ধির চূড়ায় নিয়ে যেতে পারবেন।

আমি জীবনের চৌদ্দ বছর এ গবেষণা করে কাটিয়েছি যে কেন কিছু মানুষ জীবনে সফল হয় আর কিছু মানুষ শুধুই হতাশাজনক ফল পায়। এই পুরো সময় জুড়ে আমি মনোভাব, দৃষ্টিভঙ্গি ও সাফল্যের ওপর কয়েকশ বই এবং কয়েক হাজার ম্যাগাজিন আর্টিকেল পড়েছি। আমি ২,০০০ ঘণ্টার বেশি অডিও ক্যাসেট প্রোগ্রাম শুনেছি। এর পাশাপাশি অগণিত অত্যন্ত সফল মানুষের সাক্ষাৎকার নিয়েছি যাতে তাদের ‘সাফল্যের রহস্য’ জানতে পারি।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হল, বইয়ে লেখা প্রতিটি সাফল্যের কৌশল আমি নিজে পরখ করে দেখেছি। তাই নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি– এই কৌশলগুলো খাঁটি এবং এদের আপনার জীবনকে বদলে দেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে!

দয়া করে আমাকে ভুল বুঝবেন না। আমি নিজেকে এই বিষয়ে ‘সবজান্তা’ বলছি না। আমি এর ধারেকাছেও নই। আমি নিজেই প্রতিনিয়ত শিখছি... এখনো।

কিন্তু আমি জানি নেতিবাচক মনোভাব ধারণ করা কত কষ্টকর। কারণ জীবনের প্রথম ৩০ বছর আমি এভাবেই কাটিয়েছি। আমি জানি নিজের ও নিজের সক্ষমতার ওপর অবিশ্বাস থাকলে কেমন বোধ হয়। কারণ ৩০ বছর আমি এমনই বোধ করেছি। যেই নীতিগুলো অনুশীলনের ফলে আমার জীবনে সকল ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে। সেগুলো সম্পর্কে এ বইয়ে আপনারা জানতে পারেবেন।


চিন্তা করুন... কাজ করুন... কথা বলুন

এই বইটি তিনভাগে বিভক্ত আর প্রতিটি ভাগেই কিছু ধারাবাহিক শিক্ষা রয়েছে। তাই যদি আপনার কোন বিশেষ অংশ পুনরায় ঝালাই করে নেওয়ার প্রয়োজন হয় আপনি তা খুব সহজেই করতে পারবেন। 

প্রথম ভাগে, সাফল্যের সূত্রপাত হয় চিন্তায়। আমরা আলোচনা করব কীভাবে মনোভাব ও বিশ্বাস আপনার ভাগ্য বদলে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। আপনি জানতে পারবেন কীভাবে আপনার সাফল্য প্রাথমিক ভাবে আপনার ‘চিন্তার’ ওপর নির্ভরশীল।

দ্বিতীয় ভাগে আছে চিন্তাভাবনা করে কথা বলার নানা কৌশল। আমরা মনোনিবেশ করব আপনার বাচনভঙ্গির ওপর। কীভাবে শব্দচয়ন আপনার দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন ঘটায় এবং কীভাবে ইতিবাচক বাচনভঙ্গি আপনাকে নিজের লক্ষ্যের দিকে নিয়ে যাবে– তা আমরা জানব এই অংশে।

তৃতীয় ভাগে, যারা কর্ম করে আল্লাহ তাদের সহায় হন। আমরা আমাদের যাত্রার শেষ অংশে এ নিয়ে আলোচনা করব। আপনি যতই ইতিবাচক চিন্তা করুন বা কথা বলুন না কেন, আপনি নিজের স্বপ্ন পূরণ করতে পারবেন না, যদি-না আপনি কাজ করেন। আপনি ঘরে অলস বসে থেকে কখনো আশা করতে পারেন না যে সাফল্য নিজেই আপনার কাছে এসে ধরা দিবে। এই অংশে জানবেন নিজের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপান্তরিত করতে আপনাকে কী কী কাজ করতে হবে।

যখন আপনি নিজের স্বপ্ন পূরণের উদ্দেশ্যে চিন্তা করবেন, কাজ করবেন এবং কথা বলবেন তখন আপনার পথে আর কোনো বাধা থাকবে না। বুঝবেন আপনি অভাবনীয় সাফল্যের পথে অগ্রসর হয়েছেন।



 





প্রথম ভাগ


সাফল্যের সূত্রপাত হয় চিন্তায়



    


সাফল্য হচ্ছে এক ধরনের মানসিক অবস্থা। আপনি যদি সফল হতে চান, তবে প্রথমে নিজেকে একজন সফল ব্যক্তি হিসাবে চিন্তা করুন।

- ড. জয়েস ব্রাদার্স

  







 





অধ্যায় ১


নিজেকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ও উজ্জ্বল করে গড়ে তুলুন; আপনার আচার-ব্যবহার আপনার আপন ভুবনকে প্রকাশ করে।

- জর্জ বানার্ড শ


আপনার মনোভাব হচ্ছে আপনার আপন ভুবনকে দেখার জানালা


দুপুর ১:০০টার পর কিছু সময় পার হয়েছে। সারার ক্ষুধা পাচ্ছে। সে নিজের ডেস্কে বসে অনেকক্ষণ মনোযোগের সাথে কাজ করেছে। সে ঠিক করল কাছেই একটা কফিশপ থেকে কিছু খেয়ে আসবে।

কয়েক মিনিট পর স্যাম একই কফি শপে প্রবেশ করল। সেও দুপুরের খাবার বিরতিতে খেতে এসেছে। সারার থেকে কয়েক ফুট দূরে একটা টেবিলে স্যাম বসল।

সেই দুপুরে একই ওয়েট্রেস ওদের দুজনকে খাবার পরিবেশন করল। তারা দুজনেই খাবারের অর্ডার নেওয়ার আগে একই সময় ধরে অপেক্ষা করল। প্রত্যেকেই প্রায় একই সময়ে তাদের খাবার পেল। প্রত্যেকেই ভালোভাবে প্রস্তুতকৃত স্বাস্থ্যকর খাবার পেল। তাদের দুজনেই তাদের বিল পাওয়ার জন্য একই সময় ধরে অপেক্ষা করল।

তাদের দুজনের মধ্যে এতটুকুই মিল। এবার তাদের মধ্যকার পার্থক্য দেখাব।

সারা কফি শপে ঢুকেছিল হাসি মুখে, দৃপ্তপায়ে এবং ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে। তাকে দেখে যে কেউ বুঝতে পারবে সে আশাবাদী একজন মানুষ। সে খুব আনন্দের সাথে দুপুরের খাবার খায়, ওয়েট্রেসের সাথে কিছু সময় গল্প করে। এরপর দ্বিগুণ উৎসাহের সাথে কাজে ফিরে যায়।

অপরদিকে স্যাম গোমড়া মুখে কফি শপে প্রবেশ করে। তার চেহারা দেখে মনে হচ্ছিল তাকে কেউ তেঁতো জিনিস খাইয়েছে। সে কুঁজো হয়ে হাঁটছিল এবং তাকে বেশ চিন্তিত মনে হচ্ছিল। তার ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছিল সে বলতে চাইছে ‘সবাই আমার থেকে দূরে সরে যাও!’ ওয়েট্রেস তৎক্ষণাৎ তার অর্ডার না নেওয়ায় সে বেশ বিরক্ত হয়। তার খাবার আসতে কিছুটা দেরি হওয়ায় সে বিরক্তি প্রকাশ করে। সে খাবার নিয়ে অভিযোগ করে এবং তার বিল সঙ্গে সঙ্গে না পাওয়ায় সে চটে যায়।

কেন একই কফি শপে সারা ও স্যামের এমন ভিন্ন অভিজ্ঞতা হল?

মনে রাখতে হবে তাদের সাথে একই ঘটনা ঘটেছিল। আসলে কারণ ছিল তাদের মনোভাব বা দৃষ্টিভঙ্গি। সারা পৃথিবীকে সহজভাবে দেখে। আর স্যাম দেখে জটিলভাবে। পার্থক্য শুধু তাদের মনোভাবে।

    


মনোভাব হচ্ছে এক ধরনের গোপন শক্তি, যা মানুষের ভেতর ২৪ ঘণ্টা ক্রিয়া করে। এর জন্যই মানুষ ভালো বা মন্দ অনুভব করে।

- অজানা বক্তা

  


 

মনোভাবের সংজ্ঞা

 

নিজের মনোভাব বা দৃষ্টিভঙ্গিকে একটা মানসিক ফিল্টারের মতো মনে করুন যার ভেতর দিয়ে আপনি পৃথিবীকে দেখেন। কিছু মানুষ পৃথিবীকে আশাবাদের ফিল্টার দিয়ে দেখে (যারা চিন্তা করে গ্লাসের অর্ধেক ভর্তি) আর কিছু মানুষ দেখে নিরাশাবাদের ফিল্টার দিয়ে (যারা চিন্তা করে গ্লাসটি অর্ধেক খালি)। আমি কিছু উদাহরণ দিয়ে আপনাদের ইতিবাচক ও নেতিবাচক মনোভাবের মধ্যে পার্থক্য বুঝিয়ে বলব।


নেতিবাচক মনোভাবের মানুষ চিন্তা করে, ‘আমি পারব না।’

ইতিবাচক মনোভাবের মানুষ চিন্তা করে, ‘আমি পারব।’

নেতিবাচক মনোভাবের মানুষ শুধু সমস্যা নিয়ে পড়ে থাকে।

ইতিবাচক মনোভাবের মানুষ সমস্যার সমাধানে মনোনিবেশ করে।

নেতিবাচক মনোভাবের মানুষ অন্যের দোষ খুঁজে বেড়ায়।

ইতিবাচক মনোভাবের মানুষ অন্যের ভালো দিকটাই দেখে।

নেতিবাচক মনোভাবের মানুষ কী নেই তা নিয়ে মাথা ঘামায়।

ইতিবাচক মনোভাবের মানুষ নিজের যা আছে তা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকে।

নেতিবাচক মনোভাবের মানুষ শুধু নিজের সীমাবদ্ধতাই দেখে।

ইতিবাচক মনোভাবের মানুষ দেখে সম্ভাবনা।

আরও উদাহরণ দিতে পারি কিন্তু আমি নিশ্চিত আপনারা ধারণা পেয়ে গেছেন। আমি যখন দর্শকের সামনে কথা বলি তখন শব্দের সাথে ছবিও ব্যবহার করি। এতে করে তারা আমার কথা বুঝতে ও মনে রাখতে সুবিধা হয়। আমি আপনাদের কল্পনায় একটা ছবি এঁকে দেখাই ‘আপনার মনোভাব হচ্ছে আপনার আপন ভুবনকে দেখার জানালা।’


সবাই একটি পরিষ্কার মনের জানালা দিয়ে আরম্ভ করে

আপনি সবসময় আপনার আশেপাশের পরিবেশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন না। কিন্তু আপনি আপনার নিজের চিন্তাভাবনাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন।

- চালর্স পপপ্লেস্টোন

এখন আমরা আলোচনা করব কেন আমি ‘আপনার মনোভাব হচ্ছে আপনার আপন ভুবনকে দেখার জানালা’ বলছি এ বিষয়ে। আমরা সবাই জীবন শুরু করি একটা ভালো মনোভাব নিয়ে– বা বলা ভালো পরিষ্কার দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে। ছোট শিশুদের দেখুন। তারা সবসময় হাসছে, তাদের মন আনন্দে পরিপূর্ণ। তারা নিত্যনতুন জিনিস আবিষ্কার করতে ভালোবাসে।

সবে হাঁটতে শিখছে এমন একটি শিশুর কথা চিন্তা করুন। সে যখন হোঁচট খেয়ে পড়ে যায় তখন কী করে? আমি আপনাকে বলব সে কী করে না? সে রেগে গিয়ে কার্পেটের দোষ দেয় না। সে তার বাবা-মাকে দোষারোপ করে না। সে হাঁটা বন্ধ করে দেয় না। কখনই না। সে হাসিমুখে উঠে দাঁড়ায় এবং আবার হাঁটার চেষ্টা করে। সে সপ্তাহের পর সপ্তাহ এভাবেই চেষ্টা চালিয়ে যায় যতক্ষণ পর্যন্ত না সে হাঁটতে শিখছে! তার জানালা ঝকঝকে পরিষ্কার। সে চিন্তা করে সে পৃথিবী জয় করবে।

কিন্তু আমরা জানি একটা সময় জীবন কঠিন হয়ে আসে আর আমাদের জানালায় ময়লা জমতে শুরু করে। এরপর যা হয়–

আমাদের জানালাগুলো বাবা-মা ও শিক্ষকদের সমালোচনায় কলুষিত হয়।

আমাদের জানালাগুলোতে বন্ধুদের টিটকারির দাগ পড়ে।

আমাদের জানালায় প্রত্যাখানের আঘাত পড়ে।

আমাদের জানালাগুলো হতাশায় সিক্ত হয়।

আমাদের জানালায় সন্দেহের কালিমা পড়ে।

সমস্যা হল আমাদের জানালায় এই আবর্জনাগুলো জমতেই থাকে। আর বেশির ভাগ মানুষই এর বিরূদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয় না। তারা এই অপরিষ্কার জানালা নিয়েই জীবন পার করে দেয়। তারা উদ্যম হারিয়ে ফেলে। তারা হতাশ ও বিষণœ হয়ে পড়ে। সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয় হল তারা নিজেদের স্বপ্ন বিসর্জন দেয়। আর এর সবই ঘটে তারা জানালাগুলো পরিষ্কারে বিফল হওয়ার কারণে।

আমি নিজেও একই কাজ করেছি। উকিল থাকা অবস্থায় আমার জানলাটা নোংরা ছিল। আমি যতদিন ঐ পেশায় ছিলাম ততদিনই তা ময়লা হচ্ছিল। আমি কোন আশা দেখতে পাচ্ছিলাম না। কীভাবে দেখতাম? আমার জানালা যে হতাশার আবর্জনায় ঘোলা হয়ে গিয়েছিল।

নিজের জানালা পরিষ্কার করুন

কিন্তু আল্লাহর অসীম কৃপায় আমি বুঝতে পারি যে আমাকে কী করতে হবে। আর তাই আমার জানালাটা পরিষ্কার করতে সক্ষম হই! পৃথিবী দেখার জন্য আমার নিজের মনোভাব বা দৃষ্টিভঙ্গি উন্নত করতে হয়েছে। আমার জানালা থেকে সব আবর্জনা পরিষ্কার করার পর আমার সামনে যেন নতুন এক পৃথিবী উন্মোচিত হয়। সকল হতাশা ও বিষন্নতা দূর হয়। আমার আত্মবিশ্বাস বাড়ে। অনেক বছর পর আমি সম্ভাবনাময় এক পৃথিবী দেখতে পাই।

এর ফলেই আমি পেশা বদলে এমন এক কাজ শুরু করি যা আমাকে আনন্দ দেয়, যেই কাজকে আমি মন থেকে ভালোবাসি। ভালোমতো চিন্তা করে দেখলে আমি এমন এক পেশায় আছি যা অন্যের জানালাকে পরিষ্কার করতে সহায়তা করবে– তাদেরকে উন্নত দৃষ্টিভঙ্গি বা মনোভাব পেতে সাহায্য করবে।

এখন হয়তো বুঝতে পারছেন যে আমি কেন বলেছিলাম, ‘আপনার মনোভাব হচ্ছে আপনার আপন ভুবনকে দেখার জানালা।’ আপনি কি এখন বুঝতে পারছেন কীভাবে আপনার মনোভাব আপনার জীবনকে প্রভাবিত করে? তারচেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হল, আপনি কি বুঝতে পারছেন আপনার জানালার কোন কোন অংশ আপনাকে পরিষ্কার করতে হবে?


আপনিই আপনার মনোভাবকে নিয়ন্ত্রণ করেন

ভালো বা মন্দ বলে কিছু নেই, আমাদের চিন্তাই তা তৈরি করে। আমরা যেমন চিন্তা করব তা তেমনই দেখাবে।

- উইলিয়াম শেকসপিয়ার

নিজের জানালা পরিষ্কার রাখার দায়িত্ব আপনার নিজের। হ্যাঁ, আমি আপনাকে কিছুটা উৎসাহ দিতে পারি, অন্যরাও আপনাকে উৎসাহ দিতে পারে। কিন্তু দিনশেষে কেউ আপনার হয়ে কাজটা করে দিবে না।

আপনার হাতেই সব ক্ষমতা। আপনি চাইলে নোংরা জানালাটা দিয়েই পৃথিবী দেখতে পারেন। কিন্তু তা সুফল বয়ে আনবে না। আপনি জীবনে হতাশ হয়ে পড়বেন। আপনি অসুখী হবেন। আপনার সক্ষমতার খুব সামান্যই অর্জন করতে পারবেন।

কিন্তু এর থেকে বের হওয়ার উপায় আছে। আপনি যখন আপনার জানালা পরিষ্কার করতে আরম্ভ করবেন, দেখবেন জীবন কত সুন্দর, কত উজ্জ্বল। আপনি সুখী ও সমৃদ্ধ হবেন। আপনি উচ্চাকাক্সক্ষী হবেন এবং নিজের লক্ষ্য অর্জনে সফল হবেন। আপনি নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শিখবেন!

এখনো সন্দেহ হচ্ছে যে আসলেই কি আপনি তা পারবেন? আপনি হয়তো চিন্তা করছেন, ‘জেফ, এসব বলা খুব সহজ। কিন্তু আমার জায়গায় থাকলে তুমি তা পারতে না।’

হ্যাঁ, একথা সত্যি। হয়তো আপনি জীবনে অনেক কঠিন সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন, হয়তো আপনি অনেক বেশি কষ্ট সহ্য করেছেন। হয়তো আপনি এখনো খুবই দুঃসহ সময় পার করছেন। কিন্তু আমি বলছি, সবচেয়ে বড় দুঃসময়েও আপনি নিজের মনোভাব নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। আপনার সেই ক্ষমতা আছে। আমি বলছি না কাজটা সহজ। কিন্তু কথা হল ক্ষমতা আপনার হাতেই আছে।


    


সুখ বলতে কিছু নির্দিষ্ট পরিবেশ পরিস্থিতিকে বোঝায় না; বরং সুখ বলতে একজন মানুষের নির্দিষ্ট কিছু মনোভাবকে বোঝায়।

- হিউ ডাউন্স

  


আপনাদের একজন মানুষের গল্প শোনাই যিনি মনোভাব বিষয়ে অভিজ্ঞ। তার নাম ড. ভিক্টর ফ্রাঙ্কেল। তিনি জীবনে অত্যন্ত কঠিন সময় পার করে এসেছেন। তিনি শুধু এই অবস্থা থেকে বেরই হননি, সাথে লাখো মানুষকে অনুপ্রাণিতও করেছেন। ড. ভিক্টর ফ্রাঙ্কেল অনেক বছর ধরে বিভীষিকাময় নাৎসি ডেথ ক্যাম্পের একজন বন্দী ছিলেন। আরও ভয়ংকর কথা হল তার বাবা, মা, ভাই ও স্ত্রীর মধ্যে কেউ কেউ এই ক্যাম্পে মৃত্যু বরণ করেছেন, কেউ-বা এর গ্যাস চেম্বারে খুন হয়েছেন। প্রতিদিন ড. ফ্রাঙ্কেল এবং অন্যান্য বন্দীদের ওপর অমানুষিক অত্যাচার করা হত। তাদের অসম্ভব ঠান্ডা ও ক্ষুধা সহ্য করতে হত। এমন অবস্থায় কি কোন মানুষের পক্ষে তার মনোভাব নিয়ন্ত্রণ রাখা সম্ভব?

ড. ভিক্টর ফ্রাঙ্কেল তার বেস্ট সেলিং বই ‘ম্যানস সার্চ ফর মিনিং’ এ মনোভাবের গুরুত্ব সম্পর্কে বলেছেন:

‘একজন মানুষের কাছ থেকে সবকিছু কেড়ে নেওয়া যায় কেবল একটি জিনিস বাদে, তার সর্বশেষ স্বাধীনতা– কোন অবস্থায় তার মনোভাব কেমন হবে তা নির্ধারণের ক্ষমতা, সে কোন পথ বেছে নিবে সেই সিধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা... যদিও কিছু জিনিস যেমন ঘুমের অভাব, অপর্যাপ্ত খাদ্য এবং বিভিন্ন ধরনের মানসিক চাপ বন্দীদের একটা নির্দিষ্ট আচরণ করতে বাধ্য করেছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে যেমন আচরণ করত বা যেই মানুষে পরিণত হয়েছিল তার পিছনে শুধু ক্যাম্পের পরিবেশই দায়ী ছিল না, তার নিজের সিদ্ধান্তও এর পিছনে ছিল।’

এখন ড. ফ্রাঙ্কেল এবং তার সহবন্দীরা যদি এমন দুর্বিসহ পরিস্থিতিতে নিজেদের মনোভাব নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন তাহলে আমরা কেন তা পারব না?

হিউ ডাউন্স বলেছিলেন, ‘একজন সুখী মানুষ কোন নির্দিষ্ট পরিবেশ পরিস্থিতির ফল নয়; বরং সে নির্দিষ্ট কিছু মনোভাবের ফল।’ এ কথা খুবই শক্তিশালী এক কথা– আর কথাটি সত্য।

সবশেষে এ কথাই সত্য যে আপনি, একমাত্র আপনিই পারেন নিজের মনোভাবকে নিয়ন্ত্রণ করতে।


মনোভাব ও সাফল্য

তাহলে চলুন, আপনার জানালা পরিষ্কার করি এবং একটি ইতিবাচক মনোভাব গড়ে তুলি। আপনি হাসছেন। আপনি বাসায় বসে আছেন আর ইতিবাচক চিন্তাভাবনা করছেন। কিন্তু এতেই কি আপনি অসামান্য সাফল্য অর্জন করতে পারবেন? নিজের সব স্বপ্ন পূরণ করতে পারবেন?

না, পারবেন না... কারণ শুধু চমৎকার মনোভাব দিয়ে সাফল্য অর্জন সম্ভব নয়।

আপনার সক্ষমতাকে সর্বোচ্চ সীমায় নিতে হলে এবং আপনার লক্ষ্য অর্জন করতে হলে আপনাকে সাফল্য অর্জনের কিছু নির্ধারিত সময়পোযোগী নিয়ম মেনে চলতে হবে। এই নিয়মগুলো লাখো মানুষকে অভাবনীয় ফলাফল পেতে সাহায্য করেছে এবং আপনাকেও করবে!

এই বইয়ের পরবর্তী এগারো অধ্যায়ে আমি আপনাদের এই নীতিগুলো ধাপে ধাপে বোঝাব। আপনি নিজের ভয়কে জয় করতে শিখবেন, প্রতিকূলতা পার হতে শিখবেন। শিখবেন কীভাবে দৃঢ়ভাবে অঙ্গীকার করা যায়। এমন আরও অনেক কিছু আপনি এ বই থেকে শিখতে পারবেন। আপনি আপনার স্বপ্নের জীবন পেতে যেই তথ্য ও অনুপ্রেরণা দরকার তার সবই এখানে পাবেন।

তাও আপনি হয়তো চিন্তা করছেন, মানোভাবের সাথে সাফল্যের কী সম্পর্ক?

এক কথায়– সবকিছু! এজন্যই আমি বলি সবকিছুই মনোভাবের ওপর নির্ভর করে!

ইতিবাচক মনোভাব ব্যতীত আপনি অন্যান্য নীতি মেনে চলতে পারবেন না। আপনার জীবনের সাফল্যের শুরু ও শেষ এই মনোভাবের ওপর নির্ভর করে।

আপনি আপনার মনোভাবের জানালা পরিষ্কার করলেই সাফল্য নীতি আপনার কাছে স্পষ্ট হবে। অপরিষ্কার জানালা দিয়ে খুব অল্প আলোই প্রবেশ করতে পারে। একই কথা নীতির ক্ষেত্রেও খাটে। আর এটাই আপনার সাফল্য অর্জনের পথকে দুর্গম, এমনকি বন্ধও করে দিতে পারে।

কিন্তু আপনি যখন আপনার মনোভাবের জানালা পরিচ্ছন্ন রাখতে শিখবেন তখন দেখবেন আপনার ঘর আলোয় উদ্ভাসিত হবে। আপনি এই জ্ঞানের আলো দিয়ে আরও উপার্জন করতে পারবেন, আপনার সম্পর্কগুলোকে আরও মজবুত করতে পারবেন, নিজের আধ্যাত্মিক শক্তিকে উপলব্ধি করতে পারবেন এবং পারবেন উন্নতির সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছাতে।

আপনি যখন আপনার ইতিবাচক মনোভাবের সাথে সাফল্য নীতিকে যোগ করবেন, দেখবেন আপনাকে কেউ ঠেকাতে পারবে না!


 





অধ্যায় ২


তুমি যদি চিন্তা কর– আমি পারব, তবে নিশ্চয় পারবে। আর যদি চিন্তা কর– আমি পারব না, তবে পারবে না। তোমার সাথে ঠিক তা-ই ঘটবে যা তুমি চিন্তা করবে।

- হেনরি ফোর্ড


আপনি একজন মনুষ্য চুম্বক


সাফল্যের চাবিকাঠি কী? কেন কেউ সফল হয় আর কেউ হয় না ?

আর্ল নাইটিঙ্গেল, সাফল্য বিষয়ক একজন লেখক, ব্রডকাস্টার তথা উপস্থাপিকা ও বক্তা। তার বিখ্যাত রেকর্ড করা ভাষ্যে এ বিষয়ে আলোকপাত করেছেন। ‘অদ্ভুত রহস্য’ তথা ‘দ্য স্ট্রেঞ্জেস্ট সিক্রেট’ নামক এ অনুষ্ঠানে তিনি সাফল্যের চাবিকাঠিকে ৭টি শব্দে চিহ্নিত করেছেন। অবশ্য তিনি পরে এ বিষয়কে আরও সবিস্তারে বর্ণনা করেছেন। তবে তার সাফল্যের রহস্যের ভিত্তি এ সাতটি শব্দই।

আপনি নিশ্চয় জানতে চাইছেন এই সাতটি শব্দ কী কী? কিন্তু তা বলার আগে এ কথা বলে নেওয়া ভালো যে, আপনি জানলে আশ্চর্য হবেন যে এই সাতটি শব্দ ব্যর্থতারও মূলভিত্তি!

তাহলে সাফল্যের চাবিকাঠি জানতে আপনি তৈরি তো? তাহলে দেখুন–

আমরা যেমন চিন্তা করি আমরা ঠিক তেমনই। (ডব নবপড়সব যিধঃ বি ঃযরহশ ধনড়ঁঃ)।

সত্যি করে বলুন তো। কথাটি কি আপনার কাছে অর্থবহ বলে মনে হচ্ছে?

নাইটিঙ্গেল তার গবেষণায় দেখেছেন যে সকল বিখ্যাত লেখক, দার্শনিক ও ধর্মীয় নেতাগণ এ বিষয়ে একমত যে আমাদের চিন্তাভাবনা আমাদের কাজের ধারাকে নিয়ন্ত্রণ করে।

নেপোলিয়ন হিল বলেছেন: ‘মানুষের মস্তিষ্ক যা চিন্তা করে এবং বিশ্বাস করে তা সে অর্জন করতে পারে।’ [নেপোলিয়ন হিলের কালজয়ী বই থিংক এন্ড গ্রো রিচ পড়–ন সম্পূর্ণ বাংলা ভাষায়। সাফল্য প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত থিংক এন্ড গ্রো রিচ। মূল: নেপোলিয়ন হিল। অনুবাদ: ফজলে রাব্বি। ঢাকা, সাফল্য প্রকাশনী, ২০১৫।]


    


মহান ব্যক্তিদের চিন্তাভাবনা পাঠের মাধ্যমে নিজের মনের যতœ নিন।

- বেঞ্জামিন ডিসরেলি

  



বাইবেলেও চিন্তাভাবনা বিষয়ে অনেক কথা বলা হয়েছে:

‘তুমি যা বিশ্বাস করবে তাই পাবে।’ (ম্যাথিউ ৯:২৯)

‘মানুষের মনে যা আছে সে তাই।’ (প্রোভার্বস ২৩:৭)

‘যদি তুমি বিশ্বাস কর তাহলে সবই সম্ভব।’ (মার্ক ৯:২৩)

রালফ ওয়াল্ডো এমারসন বলেন: ‘একজন মানুষ সারাদিন যা চিন্তা করে সে তারই প্রতিচ্ছবি।’

রবার্ট কোলিয়ার এ বিষয়ে তার মতামত দিয়েছেন, ‘আপনি যদি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন যে আপনি যা চান তা পাবেন, তাহলে পৃথিবীর এমন কিছু নেই যা আপনি পাবেন না।’

সবশেষে হেনরি ফোর্ডের বিখ্যাত একটি উক্তি বলি। তিনি বলেছিলেন, ‘তুমি যদি চিন্তা কর– আমি পারব, তবে নিশ্চয় পারবে। আর যদি চিন্তা কর– আমি পারব না, তবে পারবে না। তোমার সাথে ঠিক তা-ই ঘটবে যা তুমি চিন্তা করবে।’


কীভাবে এই নীতি কাজ করে

চলুন এই ধারণা নিয়ে আরও বিশদভাবে আলোচনা করা যাক– আমরা যেমন চিন্তা করি আমরা ঠিক তেমনই।

এই বাক্যটি আসলে এভাবে কাজ করে, আপনি যদি সারাদিন একটি বিশেষ লক্ষ্য নিয়ে চিন্তা করতে থাকেন তাহলে আপনি সেই লক্ষ্য অর্জনের জন্য পদক্ষেপ নিবেন। মনে করুন কেউ একজন (ধরুন তার নাম রবিন) চিন্তা করে সে প্রতি বছর ৪ লাখ টাকা উপার্জন করতে সক্ষম। [প্রতিমাসে ৩৩ হাজার টাকার বেশি]। একটি চুম্বকের মতো রবিন এমন সব চাকরিকে নিজের দিকে আকৃষ্ট করবে যা কিনা তাকে সেই লক্ষ্যে পৌঁছে দিবে। যতক্ষণ পর্যন্ত রবিন এই চিন্তায় মগ্ন থাকবে ততক্ষণ সে এই ৪ লাখ টাকা অর্জনের মানসিক শক্তি পাবে এবং সেই শক্তিবলে লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাবে।

এখন, যদি রবিন এ কথা চিন্তা করতে শুরু করে, ‘আমাকে আমার পরিবারের চাহিদা মেটাতে আরও বেশি উপার্জন করতে হবে। আমি ৬ লাখ টাকা আয় করতে চাই।’ [প্রতিমাসে ৫০ হাজার টাকা]। তাহলেই কি রবিন তা আয় করতে পারবে?

এটা আসলে নির্ভর করে রবিনের বিশ্বাসের শক্তির ওপর। সে আসলেই কতটা বিশ্বাস করে: সে কি ৫০ হাজার টাকা আয় করতে পারবে? এও হতে পারে যে রবিন মনেপ্রাণে চায় সে ৫০ হাজার টাকা আয় করুক, কিন্তু সে আদৌ তা করতে পারবে বলে বিশ্বাস করে না।

এক্ষেত্রে রবিন তার লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছাতে পারবে না। কিন্তু সে যদি সত্যিই নিজের ওপর বিশ্বাস রাখে, তবে অবশ্যই ৫০ হাজার টাকা আয় করতে পারবে।

আপনি হয়তো ভাবছেন এই তত্ত্বটি শুধু অর্থ উপার্জনের বেলায় খাটে। কিন্তু আসলে তা নয়। মনে করুন, আপনি এখন একটি গলফ কোর্সে ৯৫ রাউন্ডের একটি খেলা খেলছেন। আপনি যদি আপনার স্কোরকে ৮৫ তে নামিয়ে আনতে মনোনিবেশ করেন এবং নিজের সামর্থ্যরে ওপর আসলেই আস্থা রাখেন, তাহলে আপনি সেই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারবেন। আপনাকে খেলা সম্পর্কে আরও বেশি চর্চা করতে হবে, আরও বেশি শিখতে হবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আপনি আপনার স্কোর কমিয়ে এনে নিজের উদ্দেশ্য পূরণ করতে পারবেন।


একজন মানুষ যা কিছু নিয়ে সবচেয়ে বেশি চিন্তা করে তা তার জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করে

[আমরা এখানে সবচেয়ে বেশি চিন্তা করা হয় যা নিয়ে, প্রভাবশালী এমন কিছু চিন্তাকে প্রধান চিন্তা বলে উল্লেখ করছি। প্রধান চিন্তা বলে এমন এমন চিন্তাকে বোঝানো হয়েছে যা আমাদের মন-মস্তিষ্কে সবচেয়ে বেশি সময় ধরে বিরাজ করে, যেসব চিন্তা আমরা সারাদিন করতে থাকি।]

আমরা যেমন চিন্তা করি আমরা ঠিক তেমনি, এই তত্ত্বকে ল অফ ডমিনেন্ট থট তথা প্রাধান্য বিস্তারকারী চিন্তার সূত্র দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়। এর মানে হল আমাদের সবার মাঝেই এমন এক ক্ষমতা আছে যা কিনা আমাদেরকে নিজেদের সবচেয়ে প্রভাবশালী চিন্তার দিকে ধাবিত করে।

এখানে মূল শব্দ হল প্রাধান্য বিস্তারকারী তথা ডমিনেন্ট। আপনি দিনে মাত্র ১০ সেকেন্ড ইতিবাচক চিন্তা করে বাকি ১৬ ঘণ্টা নেতিবাচক চিন্তা করলে কখনোই ইতিবাচক ফলাফল পাবেন না।

মূল কথা হল, সামান্য ইতিবাচক চিন্তা থেকে ইতিবাচক ফলাফল পাওয়া যায় না। ঠিক যেমন অল্প একটু ডায়েট করলে ওজন হ্রাস পায় না। এটা অনেকটা দিনে একবেলা স্বাস্থ্যসম্মত, কম ক্যালরিযুক্ত খাবার খেয়ে বাকি দিনজুড়ে কেক ও আইস্ক্রিম খেয়ে ওজন কমানোর চেষ্টার মতো! একই কথা ব্যায়ামের ক্ষেত্রেও খাটে– আপনি সপ্তাহে মাত্র একদিন কয়েক মিনিটের জন্য ব্যায়াম করে শারীরিক গঠন পরিবর্তন করতে পারবেন না।

ইতিবাচক চিন্তাকেও একই দৃষ্টিতে দেখতে হবে। অল্পতে কাজ হবে না। বরং আপনাকে নিজের চিন্তাধারাকে নিয়ন্ত্রণ করা শিখতে হবে এবং প্রতিদিন ইতিবাচক চিন্তা করার চেষ্টা করতে হবে যতদিন পর্যন্ত না এটা অভ্যাসে পরিণত হয়। মনে রাখবেন এটাই হবে আপনার প্রাধান্য বিস্তারকারী তথা ডমিনেন্ট চিন্তা।

একটু চিন্তা করে দেখুন যে আপনার জীবনের বিশেষ ক্ষেত্রগুলো সম্পর্কিত প্রধান চিন্তাগুলো কেমন? সেগুলো কি আপনার উপকার করছে নাকি আপনার পথে বাধার সৃষ্টি করছে?


মনোভাব পরিবর্তনের কারণে আমি আবাসন কোম্পানির মালিক হলাম

তারা চিন্তা করতে পারে বলেই কাজ করতে পারে।

- ভার্জিল


চিন্তাশক্তির ক্ষমতা বোঝাতে আপনাদেরকে নিজের একটা অভিজ্ঞতার কথা বলব। সত্তর ও আশির দশকের প্রথমদিকে আমি লক্ষ্য করেছিলাম যে আমার এলাকার (লং আইল্যান্ড, নিউ ইয়র্ক) যাদের আয় অনেক বেশি তাদের অনেকেই অর্থ বিনিয়োগের জন্য বাড়ি কিনছে এবং ভাড়া দিচ্ছে। বাড়িগুলোর দর প্রতি বছরই বাড়ছিল। হ্যাঁ, ভাড়াটিয়া সামলানোর ঝক্কি কিছুটা ছিল বটে। কিন্তু তার বদলে যেই মুনাফা পাওয়া যাচ্ছিল তা ছিল লোভনীয়!

আমি তখন চিন্তা করছিলাম আমারও এমন কিছু বাড়ি কিনে ফেলা উচিত। কিন্তু আমি তা করিনি। কারণ আমার আত্মবিশ্বাস ছিল না। আমার চিন্তা জুড়ে ছিল শুধু সমস্যা, ক্ষতি হওয়ার চিন্তা। সহজভাবে বলতে গেলে আমার মন ছিল বিক্ষিপ্ত। আমার এই নেতিবাচক মনোভাব দেখে কল্পনা করা কঠিন নয় কেন আমি এই বিষয়ে কোন ব্যবস্থা নেইনি। তবে দৃৃষ্টিভঙ্গির প্রভাব সম্পর্কে পড়তে ও শুনতে শুরু করার পর আমি আবাসন ব্যবসার ব্যাপারে নিজের মনোভাব পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নিই। ১৯৮৬ সালের গ্রীষ্মে আমি ঠিক করি, বছর শেষ হওয়ার আগেই আমি দুটি বাড়ি কিনব। এইবার আমি নিজেকে কোন মন্দ চিন্তা করতে দিব না।

ছয়মাস যাবৎ আমি শুধু একটা চিন্তায় নিজেকে মগ্ন রেখছিলাম– আমাকে দুটি বাড়ির মালিক হতেই হবে। আমি প্রতিদিন কয়েকবার আমার লক্ষ্যের কথা লিখে রাখতাম এবং বারবার মনে মনে সেগুলো আওড়াম। আমি নিজের সমস্ত অস্তিত্ব দিয়ে এ কথা বিশ্বাস করেছিলাম যে বছর শেষের আগে আমার দুটি বাড়ি কেনা হবেই। ছুটির সন্ধ্যাগুলোতে আমি আবাসন ব্যবসার এজেন্টদের সাথে কথা বলতাম এবং বাড়ি দেখতে যেতাম। আমি নিজে প্রায় ১০০টিরও বেশি বাড়ি দেখতে গিয়েছি এবং আরও কয়েকশ বাড়ি সম্পর্কে খোঁজ খবর নিয়েছি।

১৯৮৬ সালের শরৎকালে আমি একটি বাড়ি কিনি। আমার জন্য এ এক অসামান্য অর্জন ছিল যা থেকে এতদিন আমি নিজেকে বঞ্চিত রেখেছিলাম! কিন্তু আমার কাজ তখনো বাকি। বছর শেষ হওয়ার ঠিক দুইদিন আগে, ২৯ ডিসেম্বরে দ্বিতীয় বাড়িটি কিনে আমি আমার লক্ষ্য অর্জনে সফল হই।

যখন আগের কথা চিন্তা করে নিজেকে প্রশ্ন করি– কেন ১৯৮৬  সালের আগে আমি রিয়েল এস্টেটে বিনিয়োগ করতে পারিনি? তার উত্তর এখন আমার কাছে পরিষ্কার। ১৯৮৬ সালে আমি নিজের ওপর বিশ্বাস করেছিলাম। আমার অনমনীয় ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি আমাকে নিজের লক্ষ্যের দিকে ধাবিত করেছিল।

এই পুরো অভিজ্ঞতা আমার জন্য অত্যন্ত মূল্যবান ছিল। আসলে এ ছিল অমূল্য... কারণ এটা আমাকে শিখিয়েছিল যে আপনি যদি আত্মবিশ্বাস রাখেন এবং শুধু ইতিবাচক চিন্তায় মনোনিবেশ করেন তাহলে আপনি নিজের লক্ষ্যে অবশ্যই পৌঁছাবেন।


মনোভাব বনাম কর্ম সাধন

আমি চিন্তাভাবনা নিয়ে অনেক কথা বলেছি । আপনারা হয়তো ভাবছেন তাহলে কর্মের জায়গা এখানে কোথায়? একথা সত্যি যে কর্ম না করলে কখনো আপনি আশানুরূপ ফলাফল পাবেন না। কিন্তু এও বুঝতে হবে আগে চিন্তা পরে কর্ম। আমি সবসময়ই জানতাম ঐ বাড়িগুলো কেনার জন্য আমাকে কী করতে হবে। কিন্তু আমি কখনো সেই কাজগুলো করিনি। কারণ একটাই– আমার নেতিবাচক মনোভাব। কিন্তু যখনই আমি নিজের মনোভাব পালটে ফেললাম তখন আমি ঐ কাজগুলো করতে শুরু করলাম যা আমাকে সফলতা এনে দিল। কোনকিছুই আমাকে আর আটকাতে পারল না!


আপনার পরিস্থিতি আপনার চিন্তারই প্রতিফলন

এই কথাটি মনে রাখুন– আপনার বিশ্বাস আপনাকে আজকের জায়গায় নিয়ে এসেছে। আর এই মুহূর্ত থেকে আপনি যা চিন্তা করবেন তাই আপনার ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে।

আসলে আপনার জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আপনি যেই ফলাফল পেয়েছেন তা আপনার মনের গহীনে নিহিত চিন্তারই ফসল। আপনার অর্থনৈতিক অবস্থার কথাই ধরুন। আপনি এই বিষয়ে কী চিন্তা করেন? আপনি কি নিজের অর্থনৈতিক অবস্থা নিয়ে হতাশ? আপনি যদি শুধু এই হতাশা নিয়েই পড়ে থাকেন তাহলে এ অবস্থা থেকে কখনো পরিত্রাণ পাবেন না।

তারপর ধরুন, সম্পর্কের ব্যাপারগুলো। যদি চিন্তা করে থাকেন আপনি ভালো কিছু পাওয়ার যোগ্য নন তাহলে আপনার সঙ্গী ও বন্ধুরাও আপনাকে মর্যাদা দিবে না। আমি নিশ্চিত আপনি এমন কাউকে চেনেন যে কিনা সবসময় ‘ভুল’ মানুষের সাথেই সম্পর্কে জড়ায়। এমন কি, সে শেষ যেই ২৯ জন মানুষের সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছে তাদের কেউই তার জন্য ঠিক ছিল না। আপনি কি চিন্তা করছেন ব্যাপারটা কাকতালীয়? মোটেই নয়। তাদের অবচেতন মনে এই ধারণা বদ্ধমূল যে তারা ভালো কিছু পাওয়ার যোগ্য নয়। এজন্য তারা নিজের অজান্তেই এমন সব ‘ভুল’ মানুষদের নিজের দিকে আকৃষ্ট করে।

অর্থনৈতিক অবস্থা, সম্পর্ক, ক্যারিয়ার যেটার কথাই বলি না কেন, শেষ কথা একটাই– আপনি যদি ভালো চিন্তা না করেন তাহলে ভালো ফল পাবেন না।


নিজের চিন্তা বদলান

মনের গভীর থেকে আমরা নিজের সম্পর্কে যা কিছু বিশ্বাস করি তাই আমাদের জন্য সত্য।

- ওরিসন সুইট মার্ডেন


খুশির সংবাদ হল আপনি নিজের চিন্তাধারা পালটে কাক্সিক্ষত ফল পেতে পারেন! কীভাবে? তাই বলছি। শুরতেই এটা অনুধাবন করার চেষ্টা করুন যে আপনি নিজেকে প্রতিদিন কী বলছেন। আমাদের প্রত্যেকের ভেতরেই এক অদৃশ্য কণ্ঠ আছে। অন্যভাবে বললে, আমরা নিজের সাথে নিজে কথা বলি! কিন্তু বেশিরভাগ সময়েই এই কণ্ঠ আত্মসমালোচনায় ব্যস্ত থাকে, নিজের ত্রুটিগুলোকে ধরিয়ে দেয়। আপনি হয়তো চিন্তা করেন, ‘আমি এটা করতে পারব না’ কিংবা ‘আমি কোন কাজ ঠিকমতো করতে পারি না।’ এই চিন্তাগুলো আপনার জন্য ক্ষতিকর। আপনি বরং নিজেকে বলুন, আপনি পারেন এবং আপনি পারবেন।

আমরা এই বইয়ের দ্বিতীয় অংশে এই ব্যাপারে আরও বিশদভাবে আলোচনা করব। আপনি দৈনন্দিন জীবনে কোন শব্দগুলো বেশি ব্যবহার করেন তা খেয়াল রাখা প্রয়োজন। উদাহরণস্বরূপ, আপনি কি নিজেকে নিয়ে হীনমন্যতায় ভোগেন আর চিন্তা করেন আপনার দ্বারা কিচ্ছু হবে না? আপনার মস্তিষ্ক আপনার প্রতিটি কথা শুনে এবং চুম্বকের মতো আপনাকে সেই সব কাজের প্রতি আকৃষ্ট করে যা এই চিন্তার সাথে মিলে যায়। তাই লক্ষ্য রাখবেন, যাতে আপনি নিজের সম্পর্কে ইতিবাচক শব্দগুলোই ব্যবহার করেন।


পুনরাবৃত্তি হল চাবিকাঠি

কেউই তার অসম্ভব আশা আকাক্সক্ষাকে সম্ভব করতে পারে না, যদি না সে কিছু অসম্ভব আশা আকাক্সক্ষা দিয়ে আরম্ভ করে।

- রালফ চেরেল


নিচে আরও দুটি ধাপ বর্ণনা করা হল যা আপনাকে ইতিবাচক চিন্তা করতে এবং লক্ষ্য অর্জন করতে সহায়তা করবে।

ধাপ ১: প্রতিদিন অনুপ্রেরণামূলক কোন বই বা আর্টিকেল পড়–ন। প্রতিদিন সকালে ১৫ থেকে ৩০ মিনিট এবং রাতে ঘুমানোর আগে কিছু না কিছু পড়–ন। অনুপ্রেরণা জোগায় এমন হাজারো বই ও প্রতিবেদন আছে। আপনি নিজের পছন্দমাফিক সেখান থেকে খুঁজে নিতে পারবেন। আপনার যা ভালো লাগে পড়–ন– বাইবেল বা অন্য ধর্মীয় গ্রন্থ কিংবা অনুপ্রেরণামূলক জীবনী। আপনি যেকোনো বইয়ের দোকান বা লাইব্রেরির মনোবিজ্ঞান ও আত্মোন্নয়ন বিভাগে এগুলো সহজেই পেয়ে যাবেন। তাই এখন থেকেই এ অভ্যাস গড়ে তুলুন।

ধাপ ২: প্রতিদিন অনুপ্রেরণামূলক ক্যাসেট বা রেকর্ডিং শুনুন। আপনি গাড়ি চালানোর সময় কিংবা ব্যায়াম করার সময় এই অডিওগুলো শুনতে পারেন। মূল কাজ হল পুনরাবৃত্তি। আপনি যখন বারবার এই কথাগুলো শুনবেন, এগুলো তখন আপনার জীবনের একটা অংশে পরিণত হবে। তখন এই উপদেশগুলো নিজের জীবনে কাজে লাগাতে পারবেন। এই টেপগুলো আপনাকে নিজের দৃষ্টিভঙ্গি এবং অন্যান্য সাফল্যের নীতি সম্পর্কে চিন্তা করতে উদ্বুদ্ধ করবে। অবশ্য শুধু ক্যাসেট শুনলেই কাজ হবে না। আপনাকে ক্যাসেটের উপদেশ মেনে সেভাবে কাজ করতে হবে। তবেই আপনি জীবনে উন্নতি করতে পারবেন!

তাই আপনি যদি নিয়মিতভাবে এমন অনুপ্রেরণামূলক কিছু পড়েন বা শোনেন তাহলে আপনার জীবনে অভূতপূর্ণ পরিবর্তন আসবে। তবে নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি এগুলো তখনই কাজ করবে, আপনি যখন সুশৃঙ্খলভাবে এই নিয়মগুলো মেনে চলবেন।

আমি নিজের জীবন থেকে শিখেছি: নিজের চিন্তা বদলান, জীবন বদলে যাবে! আপনি যা চিন্তা করবেন, তাই করতে পারবেন।


রাতারাতি সাফল্য পাওয়ার আশা করবেন না

শেষ করার আগে ইতিবাচক চিন্তাশক্তির ক্ষমতার বিষয়ে কিছু কথা স্পষ্ট করে নেওয়া দরকার।

প্রথমত, ইতিবাচক চিন্তা করা মানে এই নয় যে একরাতেই আপনার ভাগ্য বদলে যাবে। ব্যাপারটা এমন নয় যে আপনি সারারাত ধরে টাকার চিন্তা করলেন, আর পরদিন সকালে দেখলেন আপনার বিছানার পাশে টাকার স্তুপ হয়ে আছে। সাফল্য একদিনের ব্যাপার নয়। সাফল্যের জন্য প্রয়োজন চেষ্টা, ধৈর্য ও অধ্যবসায়।

দ্বিতীয়ত, ইতিবাচক চিন্তা করার মানে এই নয় যে আপনার জীবনে আর কোন সমস্যা থাকবে না। বিশ্বাস করুন, আপনি পদে পদে বাধার সম্মুখীন হবেন। কিন্তু আপনার যদি আত্মবিশ্বাস থাকে এবং মনোবল দৃঢ় হয়, তাহলে আপনি সকল বাধা অতিক্রম করতে পারবেন।

মনে রাখবেন, আপনি প্রতিনিয়ত আপনার প্রধান চিন্তাগুলোর দিকেই ধাবিত হচ্ছেন। আপনি ভালো চিন্তা করলে ভালো ফলাফল পাবেন, আর মন্দ চিন্তা করলে মন্দ। তাই নিজের মনোভাবের জানালা স্বচ্ছ ও উজ্জ্বল রাখতে হবে, যাতে ইতিবাচক মনোভাব সেখানে প্রবেশ করতে পারে।

আসলে নেতিবাচক চিন্তা কখনো কোনো কাজে আসে না, যদি না আপনি নেতিবাচক ফলাফল আশা করে থাকেন। আর আমি জানি আপনি কখনো তা চাইবেন না।

তাই এখন, এই মুহূর্ত থেকে বিচক্ষণভাবে নিজের মনের চিন্তাগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করুন এবং এই শক্তিশালী নীতিগুলোকে কাজে লাগিয়ে চমৎকার এক জীবন গড়ে তুলুন।




 





অধ্যায় ৩


কোনো কাজে সফল হওয়ার আগে নিজের মনের জানালা দিয়ে নিজের সাফল্যকে স্পষ্টভাবে দেখতে হবে।

- অ্যালেক্স মরিসন


মনের জানালা দিয়ে নিজের সাফল্যকে স্পষ্টভাবে দেখুন


আমি কিছুদিন আগে গায়িকা সেলিন ডিওনের একটা সাক্ষাৎকার দেখছিলাম। সেখানে তাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল তিনি কি কখনো চিন্তা করেছিলেন যে একদিন তিনি বিখ্যাত একজন গায়িকা হবেন, লাখ লাখ রেকর্ড বিক্রি করবেন, ভ্রমণে যাবেন এবং হাজারো দর্শকের সামনে গান গাইবেন? তিনি উত্তরে বললেন, এসবের কিছুই তাকে অবাক করেনি। কারণ মাত্র পাঁচ বছর বয়স থেকেই তিনি এ স্বপ্ন দেখতেন!

তিনি কিন্তু বড়াই করছিলেন না। তিনি কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে আজকের এই সাফল্য অর্জন করেছেন। তিনি খুব ছোট বেলাতেই একটি স্পষ্ট ও শক্তিশালী স্বপ্ন নিজের মনে লালন করেছিলেন– একদিন বিখ্যাত ও সফল একজন তারকা হবেন।

পৃথিবীখ্যাত সব ক্রীড়াবিদগণও নিজেদের কল্পনাশক্তি ব্যবহার করে যেমনটি চান ঠিক তেমনভাবেই পারফর্ম করে থাকেন। তা সে কঠিন এক লাফ দেওয়া কোন ফিগার স্কেটার হোক, নিজের প্রতিপক্ষকে নিখুঁত সার্ভ করা কোন দক্ষ টেনিস খেলোয়াড় হোক কিংবা ব্যাটের এক বাড়িতে ছক্কা মারা কোন ক্রিকেটারই হোক... তাদের অনেকেই কল্পনার মানসচিত্রে নিজেদের সাফল্যের প্রতিচ্ছবি আঁকেন এবং বাস্তব জীবনে তা অর্জনও করেন।

কল্পনাশক্তি কিন্তু শুধু সংগীতশিল্পী, ক্রীড়াবিদ কিংবা অভিনয়শিল্পীদের মাঝেই সীমাবদ্ধ নয়। এ এমন জিনিস যা আপনি নিজেও ছোটবেলা থেকে ব্যবহার করে আজকের এই অবস্থানে এসেছেন।

বিষয়টা আরও স্পষ্ট করে বলি। কল্পনাকে অনেক সময় ‘মনের চলচ্চিত্র’, ‘অন্তরের ছবি’ কিংবা ‘প্রতিচ্ছবি’ বলা হয়ে থাকে। আমরা প্রত্যেকেই নিজেদের সাফল্যের গতি, সম্পর্কের ধারা, পেশা ও আর্থিক স্বচ্ছলতার ধরন ইত্যাদির চিত্র নিজেদের কল্পনার দৃশ্যপটে ধারণ করে থাকি।


ছোটবেলার ‘মনের চলচ্চিত্র’

জ্ঞানের চেয়ে কল্পনার গুরুত্ব বেশি।

- আলবার্ট আইনস্টাইন


এই চিত্রগুলো কোথা থেকে আসে? আসলে আমরা খুব ছোটবেলা থেকেই এই ‘মনের ছবি’ ধারণ করতে আরম্ভ করি। আমাদেরকে যদি ছোটবেলায় সমালোচনা করা হয় কিংবা অযোগ্য হিসাবে গণ্য করা হয়, তাহলে আমরা সেই চিত্রগুলো মনে ধারণ করে ফেলি। আমরা যেহেতু প্রায়ই (সজ্ঞানে ও অবচেতন মনে) এই চিত্রগুলো নিয়ে চিন্তা করি, তাই জীবনে এমন সব পরিস্থিতি তৈরি করতে শুরু করি যা আমাদের এই কল্পনার চিত্রগুলোকে আবার বাস্তবে রূপ দেয়। মনে করুন, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ার সময় কোন শিক্ষক আপনার সমালোচনা করেন। এই ঘটনা আপনার খুব স্পষ্টভাবে মনে আছে। আপনি পুরো ক্লাসের সামনে লজ্জিত বোধ করছিলেন। এরপর থেকে আপনি আবার অপদস্থ হওয়ার ভয়ে ( হয়তো অবচেতন মনেই) মানুষের সামনে নিজের অভিমত ব্যক্ত করা থেকে বিরত থাকেন। এভাবেই একটি নেতিবাচক ঘটনার ছবি আপনার চিন্তা ও কাজের ওপর সারাজীবনের জন্য প্রভাব বিস্তার করল।

দুর্ভাগ্যজনকভাবে, আমাদের অনেকেই ছোটবেলার এই চিত্রগুলোকে আর বদলানোর চেষ্টা করি না। ফলে আমাদের পূর্ণ সম্ভাবনার বিকাশ ঘটে না। আর তাই আমি আপনাদের কল্পনাশক্তি ব্যবহার করে জীবনে উন্নতি লাভের  কিছু কৌশল শেখাব।


নিজের মনের ছবির দায়িত্ব নিতে শিখুন

সব ‘মনের ছবি’ কিন্তু ছোটবেলায় থেকে পাওয়া নয়। আপনি প্রতিনিয়ত নিজের পেশা, সম্পর্ক ও জীবনের অন্যান্য অভিজ্ঞতা থেকে এই ছবিগুলো ধারণ করছেন। এই ছবিগুলোর উৎস যাই হোক না কেন– আমি চাই আপনি এদের সম্পূর্ণরূপে নিয়ন্ত্রণ করতে শিখুন।

চলুন, একটি ছোট পরীক্ষা করা যাক, আপনার পছন্দের ফ্লেভারের আইস্ক্রিমের কথা চিন্তা করুন। আপনার কল্পনায় কি সেই আইস্ক্রিমের ছবিটি ফুটে উঠেছে? হ্যাঁ, অবশ্যই উঠেছে।

এবার একটি হাতির কথা কল্পনা করুন। এবার হাতিটির রঙ বদলে গোলাপি করে ফেলুন। দেখবেন মুহূর্তেই আপনার কল্পনায় গোলাপি এক হাতি ভাসছে। এবার আবার সেই আইস্ক্রিমের কথা ভাবুন তো। কি ভাবতে পেরেছেন তো? আলবত পেরেছেন।

এবার বুঝলেন তো আমি কি বলতে চাইছি? আপনার কল্পনার ছবিগুলোর ওপর আপনার নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। কিন্তু আপনি যদি সজ্ঞানে এই ছবিগুলোকে নিয়ন্ত্রণ না করেন, তাহলে আপনার মস্তিষ্কে স্মৃতির আর্কাইভ থেকে নিজের ইচ্ছামতো ছবি নিয়ে পুরোনো চলচ্চিত্রের মতো প্রদর্শন করতে থাকবে।


পুরোনো ছবির অর্থ বদলে ফেলুন

আপনার অতীতের কষ্টের স্মৃতিগুলোকে অস্বীকার করে লাভ নেই। যেমন ধরুন, সেই শিক্ষকের দ্বারা সমালোচিত হওয়ার ঘটনাকে আপনি চাইলেই পরিবর্তন করতে পারবেন না। কিন্তু আপনি সেই ঘটনার নতুন অর্থ বের করতে পারবেন।

আপনি যখন সেদিন লজ্জিত হন, হয়তো তখন চিন্তা করেছিলেন, ‘আমি অযোগ্য’ কিংবা ‘আমার মতামতের কোন দাম নেই’। ছোটবেলার এই ধারণা হয়তো আপনি পূর্ণবয়স্ক অবস্থাতেও লালন করছেন। কিন্তু এখন আপনি ইচ্ছা করলেই  ঘটনাটিকে ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখতে পারেন। যেমন সেই শিক্ষক শুধু আপনার সাথে দ্বিমত পোষণ করেছিলেন, তিনি আপনার বুদ্ধিমত্তা কিংবা যোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেননি!


নতুন ছবি তৈরি করুন

আমরা চাইলেই নতুন নতুন ‘মনের ছবি’ তৈরি করতে পারি। আমরা যদি খুব শক্তিশালী অনুভূতি তৈরি করতে পারে, এমন কোন ছবি তৈরিতে মনোনিবেশ করতে পারি, তাহলে সেই ছবি অনুযায়ী নিজেকে গড়ে তুলতে পারব! তাই প্রথম ধাপ হল নিজের পছন্দমাফিক ছবি তৈরি করা। কল্পনার কোন সীমাবদ্ধতা নেই।

আপনারা জানেন বেশিরভাগ মানুষই প্রকাশ্যে বক্তৃতা দিতে ভয় পায়। অধিকাংশ পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, এটা মানুষের ১ নম্বর ভয়। আর ২য় স্থানে রয়েছে মৃত্যুভীতি!

তাহলে যখন বেশিরভাগ মানুষকে প্রকাশ্যে বক্তৃতা দিতে বলা হয়, তখন তাদের মনে কেমন ছবি ফুটে ওঠে? হয়তো তারা দেখে– তারা বিচলিত ভঙ্গিতে দর্শকের সামনে দাঁড়িয়ে আছে, কী বলবে তা ভুলে গেছে। আপনার মনে যদি সারাক্ষণ এই দৃশ্যগুলো ঘুরপাক খায়, তবে নিশ্চিত থাকুন, আপনি কোনদিন একজন সফল বক্তা হতে পারবে না!

এর বদলে মনে মনে এমন একটি দৃশ্য কল্পনা করুন যেখানে আপনি আত্মবিশ্বাসের সাথে আপনার বক্তব্য পেশ করছেন। দর্শক খুব মনোযোগের সাথে আপনার প্রতিটি কথা শুনছে। আপনাকে তেজদীপ্ত দেখাচ্ছে। আপনি সাবলীলভাবে কথা বলছেন। আপনি একটি মজার গল্প বললেন আর সবাই হেসে উঠল। বক্তব্য শেষে সবাই করতালি দিয়ে উঠল। স্টেজ থেকে নামার পরে সবাই আপনাকে অভিনন্দন জানাতে এল।

এবার বুঝলেন, কীভাবে এই দৃশ্যগুলো আপনাকে একজন ভালো বক্তা হতে সাহায্য করবে?

তবে মনে রাখবেন, এই ছবিগুলো রাতারাতি আপনাকে সাফল্য এনে দিবে না। আপনাকে ধৈর্য ও অধ্যবসায়ের সাথে এই ছবিগুলো গঠনে গভীর মনোনিবেশ করতে হবে। তাহলেই আপনি নিজের কল্পনার ছবি অনুযায়ী কাজ করতে পারবেন।


 

বিক্রয়কর্মে সাফল্য লাভের জন্য কল্পচিত্র গঠন করুন

আপনার মনে যেসব কল্পচিত্র বাস করে সেগুলোকে আপনি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন।

- জেফ কেলার


আপনি যদি কোন পণ্য বা সেবা বিক্রয়ের সাথে জড়িত থাকেন, তাহলে আপনাকে প্রতিনিয়ত নিজের সাফল্য নিয়ে চিন্তা করতে হবে। আপনি যদি আশানুরূপ ফল না পেয়ে থাকেন, তাহলে বুঝতে হবে আপনি সাফল্য নিয়ে না চিন্তা করে ব্যর্থতা নিয়ে চিন্তা করছেন।

আপনার পরবর্তী মিটিংয়ের কথা চিন্তা করুন। আপনি কল্পনায় কী দেখছেন? আপনি কি নিজেকে আত্মবিশ্বাসী ও আত্মপ্রত্যয়ী হিসাবে দেখছেন? আপনি কি উৎসাহের সাথে আপনার পণ্যের গুণাগুণ বর্ণনা করতে পারছেন? ক্লায়েন্ট কি আপনার কথায় আগ্রহ পাচ্ছে? আপনি কি স্পষ্টভাবে মিটিংয়ের সফলতা দেখতে পাচ্ছেন?

মনে রাখবেন, আপনি নিজেই নিজের ‘মনের কল্পচিত্রের’ প্রযোজক, পরিচালক, কাহিনীকার, আলোকশিল্পী, কাস্টিং ডিরেক্টর ও কস্টিউম ডিজাইনার। আপনিই নির্ধারণ করবেন ছবির শেষ দৃশ্যে কী হবে! নিজের কল্পনায় নিজের সাফল্যকে বারবার অনুশীলনের মাধ্যমে আপনি বাস্তবে নিজের পেশায় সাফল্য লাভের পথ তৈরি করছেন।

বিপরীতভাবে, আপনি যদি কল্পনায় এটা দেখেন যে আপনার সকল চেষ্টা বিফলে যাচ্ছে। ক্লায়েন্ট আপনার কথা শোনায় আগ্রহী নয়, তাহলে দেখবেন আপনি খুব কম সাফল্যই অর্জন করেছেন। আর এটা হবে আপনার নেতিবাচক চিন্তারই ফলাফল।


নিশ্চিন্ত থাকুন এবং নিজের ইন্দ্রিয়গুলোকে সজাগ রাখুন

দূরদর্শী কল্পচিত্র বা রূপকল্প তথা ভিশন হচ্ছে অদৃশ্যকে দেখার কৌশল যা অন্যরা দেখতে পায় না।

- জনাথন সুইফট


কল্পনার চিত্রে মনোনিবেশ করার সর্বোত্তম পন্থা কী? এ কথা প্রমাণিত যে আপনার মস্তিষ্ক সবচেয়ে বেশি কল্পনাপ্রবণ হয় যখন আপনি শান্ত থাকেন এবং একসাথে অনেক বিষয় নিয়ে চিন্তা না করেন। তাই বাসায় আরামদায়ক একটি চেয়ারে বসে চোখ বন্ধ করুন এবং গভীরভাবে দম ছাড়ুন। এই ছোট্ট ব্যায়াম আপনার শরীর ও মনকে প্রশান্ত করবে এবং চিন্তাকে পরিচ্ছন্ন রাখবে। এখন এমন কিছু চিত্র কল্পনা করুন যাতে আপনার সবোর্চ্চ ইন্দ্রিয়ের ব্যবহার হয়। আপনি যত বেশি দর্শন, শ্রবণ, ঘ্রাণ, স্বাদ ও স্পর্শের ইন্দ্রিয়গুলোকে কল্পনার চিত্রে যোগ করবেন আপনার কল্পনা তত বেশি জীবন্ত হয়ে উঠবে। আর আপনি তত বেশি এই কল্পনাকে বাস্তবে রূপ দিতে আগ্রহী হবেন।

একটি উদাহরণ দিই, ধরুন আপনি সবসময় ক্যারিবিয়ানে একটি সমুদ্রঘেষা বাড়ি কেনার স্বপ্ন দেখেন। এখন এই সাদা ও পীচ রঙা বাড়িটিকে মনের পর্দায় দেখুন। হিমেল বাতাসে পাম গাছগুলো ধীরে ধীরে নড়ছে। নোনা বাতাসের ঘ্রাণ নিন। পায়ের তলায় নরম বালির পরশ অনুভব করুন। মুখে সূর্যের তাপ অনুভব করুন। ব্যাপারটা নৈসর্গিক নয় কি?

এর সবই সত্যি হতে পারে যদি আপনি এই দৃশ্যটিকে মনে আঁকড়ে ধরেন এবং একে বাস্তবে রূপ দিতে নিজের সর্বোচ্চ চেষ্টা করেন! মনে রাখবেন, আপনার অনুভূতিগুলো যত শক্তিশালী হবে, তাদের সাথে জড়িত ছবিগুলো ততটাই বেশি ক্ষমতাবান হবে। তাই আপনার কল্পনার সাথে ইতিবাচক অনুভূতিগুলো যোগ করতে ভুলবেন না। উদাহরণস্বরূপ, আপনি যখন আপনার আদর্শ চাকরির কথা চিন্তা করবেন, তখন এর সাথে চাকরি পেলে যে গর্ব ও সন্তুষ্টির সৃষ্টি হবে সেই অনুভব ও আপনার কল্পনাকে একীভূত করে নিবেন।

সর্বোপরি, আপনার কল্পচিত্রের গুণাগুণ নিয়ে চিন্তা করবেন না। কেউ খুব জীবন্ত চিত্র গঠন করতে পারে, আবার কারও ছবি অস্পষ্ট হয়। এমনও হতে পারে আপনি প্রথমে কোন স্পষ্ট চিত্র গঠনের বদলে শুধু অনুভব করলেন।

যাহোক, ঘাবড়াবেন না। আপনি যথাসাধ্য চেষ্টা করুন। অন্য কারও সাথে নিজের তুলনা করবেন না। আপনার ছবিগুলো সময়ের সাথে আরও স্পষ্ট হবে। শর্ত একটাই– প্রতিদিন একটু একটু করে নিয়মিত মনের ক্যানভাসে ছবি আঁকুন।


নিজের জন্য একটি চেক লিখুন

কাক্সিক্ষত ফল পাওয়ার জন্য মনের দৃশ্যপটে এমন ছবি আঁকা খুবই ফলপ্রসূ। কিন্তু এর বাইরেও আরেকটি কৌশল আছে। আপনি বাস্তবেও কোন বস্তুকে কাজে লাগিয়ে নিজের লক্ষ্য অর্জনে অগ্রগামী হতে পারেন।

১৯৯০ সালে তখনো প্রায় নতুন ও অজানা কমেডিয়ান জিম ক্যারি  ‘পারিশ্রমিক’ হিসাবে নিজের নামে ১০ কোটি টাকার একটি চেক সই করেন। চেকটা ১৯৯৫ সালের থ্যাংসগিভিং এর (উত্তর আমেরিকায় প্রচলিত ধর্মীয় উৎসব) সময় অচল হয়ে যায়। জিম ক্যারি পরে বলেছিলেন, বিষয়টা টাকার সাথে জড়িত ছিল না। তিনি জানতেন এই পরিমাণ উপার্জন করতে হলে তাকে সেরা লোকদের সাথে সেরা কাজটা করতে হবে।

জিম ক্যারি ‘এস ভেনচুরা’ এবং ‘দ্য মাস্ক’ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য ৮ কোটি টাকা পারিশ্রমিক পান। এরপর ১৯৯৪ সালে ‘ডাম্ব এন্ড ডাম্বার’ ছবিতে অভিনয়ের জন্য ৭ কোটি টাকা আয় করেন। ১৯৯৫ সালে তার উপার্জন আরও বৃদ্ধি পায়। এখন তিনি প্রতিটি ছবির জন্য ২০ কোটি টাকা পারিশ্রমিক পান!

জিম ক্যারির এই ‘অচল চেক’ পদ্ধতি অবচেতন মনকে নিজের লক্ষ্য অর্জনে উদ্বুদ্ধ করার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। আপনার কল্পনাশক্তি আপনাকে অনেক দূর নিয়ে যাবে, কিন্তু এর পাশাপাশি আপনি যদি একটি দৃশ্যমান বস্তুকেও অনুপ্রেরণার উৎস হিসাবে কাজে লাগাতে পারেন, তাহলে আপনার সাফল্য লাভের সম্ভাবনা বহুগুণে বেড়ে যাবে!

আমি কিন্তু এই গল্পটা মজার বলে আপনাকে বলছি না। আপনি এই পদ্ধতি কাজে লাগাতে পারেন!

তাহলে এখনই আপনার চেক বইটা বের করে একটা পাতা ছিঁড়ে ফেলুন। তাতে ৩ বা ৫ বছর পরের তারিখ দিয়ে কাক্সিক্ষত পারিশ্রমিকের পরিমাণ লিখে ফেলুন।

অবশ্য এই চেকটিকে প্রতিদিন অন্তত একবার দেখতে ভুলবেন না। এরপর এই লক্ষ্য অর্জনের পথে অগ্রসর হোন।


পছন্দসই চাকরি পাওয়া

আপনার লক্ষ্য নিয়ে আপনি যদি স্বপ্ন দেখতে পারেন, তবে আপনি তা পূরণও করতে পারবেন।

- ওয়াল্ট ডিজনি


আপনি অনেক ধরনের ভিজুয়াল রিমাইন্ডার ব্যবহার করতে পারেন– এটা শুধু চেকেই সীমাবদ্ধ নয়। আমার এক বন্ধুর উদাহরণ দেওয়া যাক। যাকে আমরা রবার্ট জোন্স বলে ডাকতে পারি। রবার্ট বিচারক তথা জজ হওয়ার জন্য তার পার্টির নমিনেশন পায় এবং সামনের এক নির্বাচনে সে ব্যালটে স্থান পাবে বলে জানতে পারে।

যদিও রবার্টের জেতার ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে (এবং জজ হওয়া তার স্বপ্নও বটে) তারপরেও সে কিঞ্চিৎ চিন্তিত এবং প্রায়ই তার মনে এটা নিয়ে সংশয় দেখা দেয়। আমি রবার্টকে একটি হাতে লেখা জজ রবার্ট জোন্স এর সাইনবোর্ড বানানোর উপদেশ দিই। সেইসাথে সাইনবোর্ডটিকে এমন জায়গা রাখতে বলি যেখানে তা প্রতিদিন তার চোখে পড়বে (যেমন তার নাইট-স্ট্যান্ড ও বাথরুমের আয়নায়)। আমি তাকে এই শব্দগুলো একটি কার্ডে লিখে তার মানিব্যাগেও রাখতে বলি।

প্রতিদিন এই শব্দগুলো দেখার মাধ্যমে রবার্ট নিজেকে জজ হিসাবে দেখার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত করছে। সে কালো রোব পরার কথা কল্পনা করছে। সে কল্পনা করছে তাকে দেখে কোর্টরুমের সবাই দাঁড়িয়ে সম্মান দেখাচ্ছে। কল্পনার এই ছবিগুলো যত স্পষ্ট হবে, রবার্ট তত বেশি এই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ হবে। সে নিশ্চিত করবে তার পার্টি যাতে নির্বাচনের দিন তার জন্য ভোটার পাওয়ার সর্বাত্মক চেষ্টা করে।

যদিও রবার্ট এই ভিজুয়াল সাইন বাদেও এই কল্পনাগুলো করতে পারত, কিন্তু এগুলো তার চিন্তাকে আরও বেশি স্পষ্ট করতে সহায়তা করবে। এই সাইনগুলো তাকে সবসময় জজ হওয়ার স্বপ্ন দেখতে উৎসাহিত করবে।

এই পদ্ধতি রবার্টের জন্য কাজ করেছে বলে যে আপনাদের ক্ষেত্রেও কাজ করবে তা বলা যায় না। এমনকি রবার্টের ক্ষেত্রেও সবসময়  কাজ করবে এমন গ্যারান্টি নেই। কিন্তু আপনি যদি একবার নিজের মতো করে এই পদ্ধতি ব্যবহার করেন, তাহলে আমার মনে হয় এটি আপনার লক্ষ্য অর্জনে অত্যন্ত কার্যকর প্রমাণিত হবে!

তাহলে এমন কোন পদ আছে কি আছে যা আপনি পেতে চান? সেলস ম্যানেজার, সুপারভাইজার, উকিল, ব্যবসায়ী? যাই হোক না কেন, নিজের মনে একটি (কাল্পনিক চিত্র) তথা ভিজুয়াল এইড তৈরি করুন এবং এই চিত্রকে বাস্তবে রূপান্তরিত করতে কাজে নেমে পড়–ন।


এটি দু’ভাবে কাজ করে

কাল্পনিক চিত্র তৈরির ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করুন। কিছু মানুষ নেতিবাচক চিত্র ব্যবহার করে যা ভালো ফল বয়ে আনে না। বাম্পার স্টিকার এর একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ।

কয়েক বছর আগে রাস্তায় আমার সামনে থাকা একটি গাড়ির বাম্পার স্টিকার নজরে পড়ে। সেখানে লেখা ছিল, আমার ঋণ আছে তাই, আমি কাজে যাই তথা ও ড়বি, ও ড়বি, ংড় ড়ভভ ঃড় ড়িৎশ ও মড়। গত কয়েক বছরে এই স্টিকারটি আমার অনেকবার চোখে পড়েছে। স্বভাবতই স্টিকারটি বেশ জনপ্রিয়। একটি মজার ছড়া, তাই না? সামান্য একটা কৌতুক এই তো?

ভুল! এটি মোটেও মজার কোন ছড়া বা কৌতুক নয়। আপনি যখন এমন একটি স্টিকার নিজের গাড়িতে লাগাচ্ছেন, তখন অজান্তেই নিজেকে সারাজীবন ঋণে থাকার শিক্ষা দিচ্ছেন!

এমন স্টিকার লাগানো একজন মানুষের কথা ভাবুন। তার নাম মনে করি এলিস। এলিস প্রতিদিন সকালে বাইরে বের হয়ে এই কথাটি দেখছে, ‘আমার ঋণ আছে’। সে কাজে যাচ্ছে, কাজ শেষে গাড়িতে করে বাড়ি ফিরে আসছে, আর একই কথাটি দেখছে ‘আমার ঋণ আছে’।  এভাবে দেখতে দেখতে কথাগুলো তার অবচেতন মনে গেঁথে যাবে, আর সে নিজেকে ঋণী হিসাবে কল্পনা করতে আরম্ভ করবে। আর যদি অধ্যায় ২ এর কথা মনে থাকে, তাহলে বুঝবেন এলিস সবসময় যা ভাবছে সেই বিষয়গুলোর দিকেই আকৃষ্ট হবে। এ ক্ষেত্রে সে ধারদেনা করতে আগ্রহী হবে।

আপনি যদি এলিসকে জিজ্ঞেস করেন তোমার এত অভাব কেন, তখন সে নিজের ভাগ্যকে দোষ দিবে। কিন্তু সত্যি কথা হল, এলিস নিজের চিন্তার জগৎ সম্পর্কে উদাসীন। আজকের এই ‘মজার’ বাম্পার স্টিকারই আগামীকাল আপনার বাস্তবতা হয়ে দাঁড়াবে।

এলিস আগে থেকেই ময়লা থাকা জানালায় আরও কাঁদা ছোড়ে এমন মানুষের উৎকৃষ্ট উদাহরণ। যদি ‘মনোভাবের ওপর সবকিছু নির্ভর করে’ হয়ে থাকে তবে এলিসের মূল দৃষ্টিভঙ্গি হল ‘আমার ঋণ আছে’! এমন মনোভাব নিয়ে আপনার কি মনে হয়, তার ভবিষ্যতে কী হবে? উন্নতি নাকি আরও ঋণ?

আমি আপনি দুজনেই এর উত্তর জানি।


লাইটস... ক্যামেরা... একশন

তাহলে এই হল নিজের মনের কল্পচিত্র গঠন এবং তা থেকে উপকার পাওয়ার কিছু পদ্ধতি। মনে রাখবেন, আপনি যদি নতুন কল্পচিত্র গঠন এবং তাদের নিয়ন্ত্রণ না করেন তাহলে পুরনো সব কল্পচিত্রই বারবার দেখতে থাকবেন। যদি পুরনো চিত্রগুলো ভালো হয় তবে ঠিক আছে, কিন্তু যদি না হয় এবং তারা আপনার লক্ষ্য অর্জনের পথে বাধা হয়ে থাকে তবে আজকেই সেগুলো পাল্টে ফেলুন। আর আপনার অসামান্য কল্পনাশক্তি ব্যবহার করে নতুন কল্পচিত্র গঠন করে সাফল্যের পথে এগিয়ে যান!

 





অধ্যায় ৪


এ কী ধরনের শক্তি তা আমি বলতে পারছি না; তবে এর অস্তিত্ব আছে এবং একে তখনি পাওয়া যায় যখন একজন মানুষ নির্দিষ্টভাবে জানে সে কী চায় এবং তা না পাওয়া পর্যন্ত দৃঢ়তার সাথে চেষ্টা করে যায়।

- আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেল


অঙ্গীকার করুন... আর জীবন বদলে দিন


আগে চিন্তা করতাম আমি অঙ্গীকার ও অধ্যবসায়ের সঠিক অর্থ জানি– দৃঢ়ভাবে বারবার চেষ্টা করা। কিন্তু আমি এই তত্ত্বগুলোর আসল অর্থ মার্ক হারনাকির লেখা ঞযব টষঃরসধঃব ঝবপৎবঃ ঞড় এবঃঃরহম অনংড়ষঁঃবষু ঊাবৎুঃযরহম ণড়ঁ ডধহঃ বইটি পড়ার আগে বুঝতে পারিনি।

লেখকের মতে সবচেয়ে গোপন সূত্র তথা দ্য আলটিমেট সিক্রেট হল অঙ্গীকার তথা কমিটমেন্ট এবং অঙ্গীকার পূরণের আসল চাবিকাঠি হল যেকোনো মূল্যে অঙ্গীকার পূরণ করার অদম্য ইচ্ছা। অর্থাৎ আপনি যা কিছু চান বলে নির্দিষ্ট করেছেন, অঙ্গীকার করেছেন তা পাওয়ার সর্বাত্মক চেষ্টা করা। আপনারা অন্য কিছু চিন্তা করার আগেই বলে নিই, ‘যেকোনো মূল্যে’ বলতে আমি বেআইনি, অনৈতিক কিংবা কারও ক্ষতি করে এমন কিছু বুঝাচ্ছি না। এসব পন্থা কখনোই অবলম্বন করা যাবে না।

তাহলে ‘অদম্য ইচ্ছা’ বলতে আমি কী বুঝাচ্ছি? এ হল এক মানসিক দৃষ্টিভঙ্গি যা বলে:

আমার লক্ষ্য অর্জনের জন্য যদি আমাকে ৫ ধাপ এগিয়ে যেতে হয়, আমি ৫ ধাপই এগিয়ে যাব।

আমার লক্ষ্য অর্জনের জন্য যদি আমাকে ৫৫ ধাপ এগিয়ে যেতে হয়, আমি ৫৫ ধাপই এগিয়ে যাব।

আমার লক্ষ্য অর্জনের জন্য যদি আমাকে ১৫৫ ধাপ এগিয়ে যেতে হয়, আমি ১৫৫ ধাপই এগিয়ে যাব।

অবশ্য আপনি শুরুতেই জানবেন না আপনাকে ঠিক কত ধাপ এগিয়ে যেতে হবে, কিন্তু তাতে কিছু আসে যায় না। সফল হওয়ার মূলমন্ত্র হল আগে যেকোনো সংখ্যক ধাপ অতিক্রমের অঙ্গীকার করা।

তাহলে, অধ্যবসায় কী কাজে আসে? অঙ্গীকারের পরবর্তী ধাপ হল অধ্যবসায়– অর্থাৎ আগে কিছু করার অঙ্গীকার করতে হবে, এরপর সেই অঙ্গীকার পূরণে অধ্যবসায়ী হতে হবে। তাহলেই আপনি সেই কাজটি সফলভাবে করতে পারবেন। আপনি যখন নিরলস সংকল্প নিয়ে কোন কাজ করতে থাকবেন, সাফল্য তখন আপনার হাতে ধরা দিবেই! [ফজলে রাব্বির কথা– যেমন, আমার জীবনের একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য হচ্ছে সাফল্য প্রকাশনীর মাধ্যমে ২০৩০ সালের মধ্যে অনুপ্রেরণার ৬৪টি বই প্রকাশ করা। আমি প্রথমে অঙ্গীকার করলাম যে ২০৩০ সালের মধ্যে অনুপ্রেরণার ৬৪টি বই প্রকাশ করব। তারপর সেই অঙ্গীকার পূরণে অধ্যবসায়ের সাথে কাজ করে যাচ্ছি।]

[অঙ্গীকার তথা কমিটমেন্ট মানে হল দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হওয়া, প্রতিজ্ঞা পালনে অবিচল থাকা। আপনি যদি কোন লক্ষ্য অর্জন করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হন, তাহলে পর্বতপ্রমাণ সমস্যাও অতিক্রম করতে পারবেন। নিজের লক্ষ্যের প্রতি অবিচল থাকা। বারবার চেষ্টা করা।] 


অঙ্গীকারের ‘জাদু’

চেষ্টার ফল পরিপূর্ণভাবে তখনই পাওয়া যায় যখন একজন ব্যক্তি হাল না ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেয়।

- নেপোলিয়ন হিল


আপনি যখন যেকোনো মূল্যে কিছু করার অদম্য ইচ্ছাশক্তি পোষণ করবেন তখন দেখবেন আপনার পারিপাশির্^ক পরিস্থিতি ও মানুষগুলো সেইভাবেই পরিবর্তন হবে যাতে আপনি নিজের লক্ষ্য অর্জন করতে পারেন। উদাহরণস্বরূপ, আপনি যদি একজন ‘বেস্ট সেলিং’ লেখক হওয়ার জন্য নিজেকে নিরলসভাবে নিযুক্ত করেন, তবে দেখবেন একদিন হুট করেই কোন প্রকাশক কিংবা এই সম্পর্কে উপদেশ দেয় এমন টিভি প্রোগ্রাম খুঁজে পেয়েছেন।

এমন না যে এই সুযোগগুলো আপনার কাছে আগে ছিল না, আপনি আসলে এগুলোর দিকে আগে মনোযোগ দেননি। যখনই আপনি নিজেকে কোনকিছু পাওয়ার লক্ষ্যে নিয়োজিত করবেন, তখনই আপনি সে বিষয়ক চিত্র কল্পনায় আঁকতে শুরু করবেন। আর যখন আপনার মস্তিষ্ক কোন বিষয়ে মনোযোগী হবে দেখবেন ঠিক চুম্বকের মতো আপনি এমন সব ঘটনা ও পরিস্থিতিকে আকর্ষণ করতে শুরু করবেন যা আপনার কল্পনাকে বাস্তবে রূপ দিতে সাহায্য করবে। তবে এটা জানা জরুরি যে কাজটি আপনি চাইলেই রাতারাতি করে ফেলতে পারবেন না। আপনাকে কর্মঠ  হতে হবে যাতে আপনি প্রতিটি সুযোগের সৎব্যবহার করতে পারেন।

অঙ্গীকারের এই জাদুর সবচেয়ে সঠিক ও চমকপ্রদ ব্যাখ্যা দিয়েছেন ডব্লিউ.এইচ. ম্যুরে। তিনি বলেছেন,

‘অঙ্গীকার যেখানে থাকে না সেখানে দ্বিধা থাকে; অক্ষমতা ও ব্যর্থতার সুযোগ থাকে। সমস্ত উদ্যোগের (ও সৃষ্টির) পিছনে একটি ধ্রুব সত্য রয়েছে, আর তা হল– অঙ্গীকার সম্পর্কে এই অজ্ঞতা আমাদের মধ্যকার অগণিত বুদ্ধি, ধারণা ও চমৎকার সব পরিকল্পনাকে হত্যা করে। যখন কেউ নিজের প্রতি অঙ্গীকার করবে তখনই সে দূরদর্শিতা অর্জন করতে পারবে।

আগে যেসব সুযোগ পাওয়া যায়নি সেগুলো সামনে আসবে। একজন মানুষ অঙ্গীকার করার পর থেকে এমন সব ঘটনাপ্রবাহ শুরু হবে, যা তার লক্ষ্য অর্জনে সহায়ক হবে। এমন সব জিনিস সে পাবে যা সে কখনো পাওয়ার কল্পনাও করেনি।’


বদ্ধদ্বার খুলে যাবে

সাধারণ মেধা ও অসাধারণ অধ্যবসায় থাকলে সবকিছুই অর্জন করা যায়।

- স্যার থমাস বাক্সটন


অঙ্গীকারের শক্তির আরেকটি অলৌকিক বৈশিষ্ট্য হল, আপনাকে শুরুতেই আপনার লক্ষ্য বাস্তবায়নের পন্থা জানতে হবে না। স্বভাবতই আগে থেকে পরিকল্পনা করা থাকলে আপনার কাজটি আরও সহজ হবে। তবে আপনাকে প্রতিটি পদক্ষেপই আগে থেকে জানতে হবে– এটি অত্যাবশ্যকীয় নয়।

আসলে আপনি যখন কিছু করার অঙ্গীকার করবেন তখন সেই কাজটি করার কৌশল আপনা থেকেই আপনার সামনে উন্মোচিত হবে। এমন সব মানুষের সাথে দেখা হবে যাদের সাথে দেখা করার কথা আপনি আগে চিন্তা করেননি। আগের বদ্ধ দরজাগুলো আপনার সামনে অপ্রত্যাশিতভাবে উন্মুক্ত হবে। হয়তো মনে হতে পারে, ভাগ্য আপনার প্রতি সুপ্রসন্ন হয়েছে; কিন্তু বাস্তবতা হল আপনার মস্তিষ্ক আপনার অঙ্গীকারের শক্তি দিয়ে এই সুযোগগুলোকে আপনার সামনে উন্মোচিত করেছে।

আমার জন্য এই সুযোগের দুয়ার কীভাবে অপ্রত্যাশিতভাবে খুলল সেই গল্প বলি। ১৯৮৯ সালে আমি অনুপ্রেরণামূলক আর্টিকেল লিখতে শুরু করি। আমি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির শক্তি এবং বিভিন্ন সাফল্যনীতি সম্পর্কে জেনেছিলাম এবং আমার এই লব্ধ জ্ঞান মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিতে বদ্ধ পরিকর ছিলাম। কিন্তু কোথা থেকে শুরু করব সেই সম্পর্কে আমার কোন ধারণা ছিল না। আমার লেখাগুলো কি কোন পত্রিকায় পাঠাব নাকি ম্যাগাজিনে? নাকি নিজেই একটা বই লিখব?

আমি প্রথমে আমার লেখা একটি আর্টিকেল স্থানীয় এক সংবাদ সংকলনে পাঠাই। লেখাটি ১৯৯০ এর গ্রীষ্মে প্রকাশিত হয়। এর কয়েক মাস পর স্টুয়ার্ট কামেন নামক একজন ভদ্রলোক আমাকে ফোন করেন। তিনি একজন ফ্রিল্যান্স লেখক ছিলেন এবং সংবাদ-সংকলন প্রচারের ব্যবসার সাথে জড়িত ছিলেন। স্টুয়ার্ট বলেন, তিনি তার বন্ধুর সাথে দেখা করতে এসে আমার লেখাটি পড়েছেন এবং লেখাটি তাকে মুগ্ধ করেছে।

এরপর তিনি জিজ্ঞেস করেন, ‘আপনি কি কখনো সংবাদ সংকলন লেখার চিন্তাভাবনা করেছেন?’ সত্যি বলতে আমি আগে কখনো একথা চিন্তা করিনি। আমরা দেখা করার সিদ্ধান্ত নিই। স্টুয়ার্ট আমাকে ব্যাখ্যা করেন, কীভাবে আমরা একসাথে একটি সংবাদ সংকলন প্রকাশ করতে পারি যাতে এই আত্মোন্নয়নমূলক তত্ত্বগুলো হাজারো মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া যায়।

এর প্রায় এক মাস পর, মনোভাবের ওপর সবকিছু নির্ভর করে নামক সংবাদ সংকলন প্রকাশিত হয়। এরপর নয় বছর পার হল। আর আমরা সাফল্যের সাথে এখনো হাজারো মানুষের কাছে এই জীবন বদলে দেওয়া তত্ত্বগুলো পৌঁছে দিচ্ছি!

এটা কীভাবে সম্ভব হল? আমি এই তত্ত্বগুলো মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে বদ্ধ পরিকর ছিলাম। আমার ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ছিল। আমি লিখতে শুরু করেছিলাম। আর এরপরেই স্টুয়ার্ট কামেন নামক একজন অচেনা ব্যক্তি আমার জীবনে প্রবেশ করেন– যিনি আমার এই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপান্তরিত করার পথ বাতলে দেন।

এই হল অঙ্গীকারের জাদু!


একটি সতর্কবাণী

আপনি অতি উৎসাহের সাথে আপনার লক্ষ্যের দিকে এগোনোর আগে একটু সতর্ক করে দিই। অঙ্গীকার করা সত্ত্বেও আপনার পথের সব বাধা কিন্তু দূর হয়ে যাবে না। জীবন বারবার আপনার পরীক্ষা নিবে, আপনার অঙ্গীকার কতটা দৃঢ়  তা পরখ করে দেখবে। আপনি ভুল করবেন, হতাশ হবেন, পশ্চাৎপদ হবেন। কিন্তু বিপদ যত কঠিনই হোক আপনি লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হবেন না।

এ সময় আপনাকে উইনস্টন চার্চিলের এই জ্ঞানগর্ভ কথা মনে রাখতে হবে, ‘কখনো, কোনো অবস্থাতেই হার মানা চলবে না।’

অথবা মনে রাখতে হবে জেমস জে. করবেটের এই উপদেশবাণী, ‘আরেকবার চেষ্টা করলেই তুমি জিততে পারবে। যখন সময় কঠিন হয়ে আসবে তখনো আরেকবার চেষ্টা করে দেখ।’

আপনি যদি অঙ্গীকারবদ্ধ হন তবে এই সাময়িক পরাজয়গুলো কাটিয়ে অবশ্যই বিজয়ী হতে পারবেন!


অঙ্গীকার কীভাবে একজন উদীয়মান ঔপন্যাসিকের কাজে এল

একজন অঙ্গীকারবদ্ধ মানুষ একশজন বিক্ষিপ্ত চিত্তের মানুষের চেয়ে উত্তম।

- ম্যারি ক্রোলে


কয়েক বছর আগে ‘আমেরিকান ওয়ে’ ম্যাগাজিন, বেস্ট সেলিং ঔপন্যাসিক ডেভিড বালদাচি’র একটি চিত্তাকর্ষক সাক্ষাৎকার প্রকাশ করে। বালদাচি অনংড়ষঁঃব চড়বিৎ, ঞড়ঃধষ ঈড়হঃৎড়ষ এবং ঞযব ডরহহবৎ নামক অত্যন্ত সফল উপন্যাসসমূহের লেখক। তার বইয়ের লক্ষাধিক কপি বিক্রিত হয়েছে।

আগেই বলে নিচ্ছি, বালদাচি’র এই সাফল্য একদিনে আসেনি। তার এই খ্যাতি ও আর্থিক সাফল্য অর্জন সম্ভব হয়েছে নিজের লেখক সত্ত্বার বিকাশের লক্ষ্যে অঙ্গীকারবদ্ধ হওয়ার কারণে। আমার মতো বালদাচিও প্রথমে উকিল ছিলেন। তিনি ১৯৮৩ তে আইনের পড়াশোনা শুরু করেন। তখন তিনি একজন বিখ্যাত লেখক হওয়ার কথা চিন্তাও করেননি। তিনি শুধু লিখতে ভালোবাসতেন।

তা সত্ত্বেও শুরুতেই বালদাচি জানতেন তিনি একজন ভালো লেখক হওয়ার সমস্ত গুণ তখনো অর্জন করেননি। তাই তিনি মনস্থির করেছিলেন নিজের লেখনী শৈলীর বিকাশ ঘটাবেন। প্রথম ৫ বছর তিনি কোন লেখাই শেষ করতে পারেননি। প্রতিদিন তিনি শুধু চরিত্র, কাহিনি, বৃত্তান্ত ও বিবরণ আর লেখার নিয়ম উন্নত করতে কাজ করেছিলেন।

সে সময় তিনি একজন উকিল হিসাবেও নিয়োজিত ছিলেন। তার পরিবারে ছিল স্ত্রী ও দুই সন্তান। তাহলে তিনি লেখার সময় কখন পেতেন? বালদাচি রোজ রাত ১০টা থেকে রাত ২টা পর্যন্ত লেখালিখি করতেন। একেই বলে যেকোনো মূল্যে কিছু করার অদম্য ইচ্ছা! তবে তিনি উল্লেখ করেছেন, তিনি লিখে আনন্দ পেতেন। এটা তার জন্য কাজ ছিল না। আমি কিন্তু আপনাকে রাত দুটা পর্যন্ত জেগে নিজের লক্ষ্যবস্তু অর্জনের জন্য কাজ করতে বলছি না। এই সময়সূচি আমার জন্যও প্রযোজ্য নয়, আপনার জন্য নাও হতে পারে!

১০ বছর লেখালিখির পর বালদাচি কিছু ছোট গল্প ও চিত্রনাট্য শেষ করতে পেরেছিলেন। তার প্রথম বিক্রি– শূন্য। এত বছরের ফলস্বরূপ তিনি শুধু প্রকাশকদের প্রত্যাখ্যানই পেল।

১৯৯৬ সালে বালদাচি তার কষ্টের প্রথম ফল পান... আর বড় আকারে পান! তার অত্যন্ত জনপ্রিয় থ্রিলার বই অনংড়ষঁঃব চড়বিৎ এবং এই বইয়ের চিত্রনাট্যের স্বত্ব বিক্রি করে তিনি কোটি টাকা আয় করেন। তার বইয়ের ওপর ভিত্তি করে বানানো চলচ্চিত্রের নায়ক ছিলেন ক্লিন্ট ইস্টউড।

একজন অঙ্গীকারবদ্ধ মানুষের এমনই ক্ষমতা।


 

তিনি হার মানতে রাজি হননি

বিজয়ের জন্য যেসব দুঃখকষ্টকে অতিক্রম করতে হয় তারচেয়েও বেশি পুরস্কার একমাত্র তারাই পায় যারা চেষ্টা করে যায় এবং অধ্যবসায় পালন করে।

- টেড ইংস্ট্রম


অঙ্গীকারের জাদু সম্পর্কে আমি আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু জেরি গ্ল্যাডস্টোন থেকে অনেক কিছু শিখেছি। ১৯৮৬ সালে জেরি নিজের কোম্পানি ‘আমেরিকান রয়েল আর্টস’ শুরু করে। এর কাজ ছিল বিভিন্ন সংগ্রাহক বস্তু বিক্রয় করা। এক বছর পর জেরি ঠিক করে সে এনিমেশন আর্ট বিক্রি করবে। সে ওয়ার্নার ব্রাদার্স, হান্না বারবারা ও অন্যান্য ছোট ছোট কোম্পানি থেকে লাইসেন্স নেয়। কিন্তু সে বুঝতে পারে তার ব্যবসার পসার ঘটাতে হলে তাকে ডিজনির আর্ট বিক্রি করতে হবে।

তিন বছর যাবৎ সে ডিজনি হেড কোয়ার্টারে লাইসেন্সের জন্য চিঠি পাঠায় এবং ফোন করে। কিন্তু প্রতিবার সে একই উত্তর পায়– না।

কিন্তু এই প্রত্যাখ্যান জেরিকে দমাতে পারেনি। সে ডিজনি এক্সিকিউটিভদের সাথে যোগাযোগ করতেই থাকে। শেষ পর্যন্ত এক এক্সেকিউটিভ আর জেরির অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে তাকে কঠোর জবাব দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। ভদ্রমহিলা ঘুমকুমারীর ম্যালেফিসেন্ট, তুষারকন্যার দুষ্ট রানী ও ১০১ ডালমেশিয়ানের ক্রুয়েলা ডেভিলের কণ্ঠ মেশানো গলায় তাকে বলে, ‘তুমি কখনোই ডিজনির লাইসেন্স পাবে না।’

হার মানার সময় হয়েছে, কী তাই তো? নাহ! জেরি হার মানার পাত্র নয়! এতবার প্রত্যাখ্যান পাওয়ার পরেও সে তার সংকল্প থেকে বিচ্যুত হয়নি। সে অন্যান্য এক্সিকিউটিভদের সাথে যোগাযোগ করতে থাকে। এরপর এক ভদ্রলোক জেরিকে একবারে বিদায় করে দেওয়ার জন্যেই বলে, ‘কেবল দুটি জায়গাতেই আমরা ডিজনির আর্ট প্রদর্শন করতে দিই– মিনিসোটা কিংবা ম্যাসেচুসেটস।’

জেরির ব্যবসা ছিল নিউ ইয়র্কে আর দূরবর্তী কোন স্থানে গ্যালারী খোলার তার কোন ইচ্ছেও ছিল না। তাহলে জেরি কী করল বলুন তো? সে পরদিনই প্লেনে করে বোস্টনে চলে যায়। আর সেদিনই সে বোস্টনের নিউবারি স্ট্রিটে একটা জায়গা ভাড়া নেয়!

সে ঐ ডিজনি এক্সিকিউটিভকে ফোন করে জানায় তার ম্যাসেচুসেটসের জায়গার কথা। তারা দুজনেই একচোট হেসে নেয়। আর সেই ভদ্রলোক জেরিকে বলে, ‘তোমার যেহেতু একদিনেই বোস্টনে গিয়ে নতুন জায়গা ভাড়া নেওয়ার মতো সাহস আছে, তাহলে তো তোমাকে ডিজনি প্রোগ্রামে নিতেই হয়।’ কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই জেরি বোস্টনে ডিজনির আর্ট গ্যালারী খুলে বসে।

এক বছরের মাথায় তারা জেরিকে নিউ ইয়র্কেও ডিজনির আর্ট প্রদর্শনের অনুমতি দেয়। এখন জেরি ১০ বছর ধরে ডিজনির সাথে ব্যবসা করছে। সে কোটি টাকার ডিজনি আর্ট বিক্রি করেছে এবং বর্তমানে সে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ডিজনি আর্ট ব্যবসায়ী!

একেই বলে অঙ্গীকার! একেই বলে প্রতিকূলতায় হার না মানা! জেরি যেকোনো মূল্যে ডিজনির লাইসেন্স পেতে বদ্ধ পরিকর ছিল। জেরিকে শুধু জিজ্ঞেস করুন আর সেই এক কথায় জবাব দিবে, ‘মনোভাবের ওপর সবকিছু নির্ভর করে’।


যতদিন লাগে লাগুক

আমি এখন আপনাদের বেঞ্জামিন রোলের গল্প শোনাতে চাই। তিনি ছিলেন ক্যালিফোর্নিয়ার নিউপোর্টের বাসিন্দা। ১৯৯০ সালে, ৬৭ বছর বয়সে তিনি আইন কলেজ থেকে পাশ করেন। উকিল হিসাবে যোগদানের আগে স্বভাবতই তাকে ক্যালিফোর্নিয়ার ‘বার’ পরীক্ষায় অংশ নিতে হয়েছিল।

প্রথমবার চেষ্টায় তিনি ফেল করেন, দ্বিতীয়বার চেষ্টায় তিনি আবারও ফেল করেন। তিনি তৃতীয়বারেও ফেল করেন... চতুর্থ... পঞ্চম... ষষ্ঠ... সপ্তম... অষ্টম... নবম... দশম... এগারোতম... বারোতম... এবং তেরোতম বারেও তিনি ফেল করেন।

আরেকটি কথা বলে নিই, বার পরীক্ষা বছরে মাত্র দু’বারই দেওয়া যায়। আর তাই তার ১৩তম চেষ্টার সময় তার বয়স দাঁড়ায় ৭৩ বছর। বেশিরভাগ মানুষই এতদিনে হার মেনে নিত। কিন্তু বেঞ্জামিন রোল হার মানার লোক নন!

তিনি ১৪তম বারের মতো পরীক্ষায় অংশ নেন... এবং পাশ করেন! ১৯৯৭ সালে ৭৪ বছর বয়সে তিনি ক্যালিফোর্নিয়া স্টেটে আইন চর্চা করার অনুমতি পান। একেই বলে অঙ্গীকার... একেই বলে যেকোনো মূল্যে লক্ষ্য অর্জনে লেগে থাকা। বেঞ্জামিন রোল বলেন, ‘আমি মরার আগে এই হতচ্ছাড়া পরীক্ষায় পাশ করব বলে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম... আর তাই করে দেখিয়েছি!’

এই গল্প কি আপনাকে মনোভাবের গুরত্ব সম্পর্কে কিছু শিক্ষা দেয়? বেশিরভাগ মানুষই ষাটোর্ধ অবস্থায় আইনের কলেজে ভর্তি হওয়ার চিন্তাই করবে না। কিন্তু রোল এমন একজন মানুষ যিনি কিনা শুধু আইনি কলেজে ভর্তিই হননি, ৬ বছর সময় ব্যয় করে বার পরীক্ষা পাশও করে দেখিয়েছেন।

কী দারুণ! বেঞ্জামিন রোলের এই গল্প এটাই প্রমাণ করে, মনোভাবের ওপর সবকিছু নির্ভর করে!


অঙ্গীকার করার সময় হয়েছে

মনে করুন, আপনার একটি লক্ষ্য আছে। নিজেকে এরপর প্রশ্ন করুন, ‘আমি কি যেকোনো মূল্যে এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য বদ্ধ পরিকর?’ যদি আপনার উত্তর হয়, ‘আমি সবই করব কেবল... করব না’ তাহলে সত্যি বলতে আপনি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ নন।

আর আপনি যদি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ না হন তবে আপনার পথ থেকে বিচ্যুত হওয়ার এবং লক্ষ্যে না পৌঁছাবার সম্ভাবনা প্রবল। অনেকেই এমন মনোভাব নিয়ে ব্যবসা শুরু করে, ‘আমি ছয়মাস চেষ্টা করব, এর মাঝে সফলতা না পেলে আমি ব্যবসা ছেড়ে দিব।’ এমন মনোভাব নিয়ে সাফল্য পাওয়ার চেষ্টা বৃথা।

যদি ঔপন্যাসিক ডেভিড বালদাচি চিন্তা করতেন, ‘আমি এক বছর লেখালিখি করব... এরপর যদি সাফল্য না পাই তবে লেখা ছেড়ে দেব।’ তবে তিনি নিজের পছন্দের কাজটি করা থেকে বঞ্চিত হতেন... তিনি এমন অভাবনীয় আর্থিক সাফল্য পেতেন না... নিজের স্বপ্নও বাস্তবায়ন করতে পারতেন না!

আমি বলছি না যে আপনি যেন তেন একটা পরিকল্পনা করে সাফল্যের আশা করুন। আপনাকে অবশ্যই একটা নির্দিষ্ট সময়সীমা নির্ধারণ এবং বাজেট তৈরি করে নিতে হবে, যাতে আপনি যত দ্রুত সম্ভব সাফল্য অর্জনের পথে অগ্রসর হতে পারেন। কিন্তু বাস্তবতা এটাই, আপনি যত ভালো পরিকল্পনাই করুন না কেন লক্ষ্যে পৌঁছাতে আপনার কত সময় লাগবে তা কেউ বলতে পারবে না। আপনি কখনোই নির্দিষ্ট করে এই সময় জানতে পারবেন না।

 

 





অধ্যায় ৫


প্রত্যেক সমস্যার আড়ালে একটি সমান অথবা এর তুলনায় বড় কোনো সুযোগ থাকে।

- নেপোলিয়ন হিল


সমস্যাকে সুযোগে রূপান্তর করুন


যখন জীবনে সমস্যার মুখোমুখি হন, তখন আপনার প্রথম প্রতিক্রিয়া কী হয়?

আপনি কি অন্য সবার মতোই অভিযোগ করতে শুরু করেন– ‘আমার সাথেই কেন এমন হল? আমি এখন কী করব? আমার জীবন বুঝি শেষ!’

এটাই মানুষের স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া। কিন্তু যখন হতাশার প্রাথমিক ধাক্কাটা কেটে যাবে তখন আপনাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আপনি হয় হতাশ হয়ে, নিজের অদৃষ্টের দোষ দিয়ে সময় পার করতে পারেন অথবা সমস্যার মাঝেই শিক্ষণীয় কিছু খুঁজে একে সুযোগে পরিণত করতে পারেন।

হ্যাঁ, আপনি অবশ্যই কিছু সময় অনিশ্চয়তা এবং প্রতিকূলতায় কাটাবেন। কিন্তু মনে রাখবেন প্রতিটি খারাপ দিকেরই একটি ভালো দিক আছে। আসলে সব ‘সমস্যা’ কিন্তু সবসময় সমস্যা নয়। কখনো কখনো এটি সুযোগও নিয়ে আসে। যেমন ধরুন, আপনার জীবনে উপনীত একটি সমস্যা মূলত আপনার জীবনের এমন একটি দিক উন্মোচিত করছে যা বদলে ফেললে আপনার জীবন আরও উন্নত হবে। ঐ সমস্যাটি না দেখা দিলে আপনি হয়তো কখনোই এই ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারতেন না।

আবার ধরুন, আপনি হয়তো এমন অনেকের কথাই শুনেছেন যারা নিজেদের চাকরি হারিয়ে পরবর্তীতে সফলভাবে ব্যবসা শুরু করেছে। তাদের অনেকেই আপনাকে বলবে, চাকরি না হারালে তারা এই নতুন ব্যবসায় নামতে পারত না। তাহলে ভাবুন, যা ছিল একটি কঠিন সমস্যা তা কীভাবে একটি চমৎকার সুযোগে পরিণত হল। আপনি হয়তো একদিন আপনার মনের মতো একটি চাকরির জন্য খুব ভালো একটি ইন্টারভিউ দিলেন। আপনি অফার লেটার পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছেন। আপনি নিশ্চিত চাকরি আপনিই পাবেন, কিন্তু আপনি চাকরিটা পেলেন না, পেল আরেকজন। আপনি ভেঙে পড়লেন! কয়েক দিন বা মাস পর আপনি নতুন একটি চাকরির অফার পেলেন, আর তখন বুঝতে পারলেন যে প্রথম চাকরিটা আসলে আপনার উপযুক্ত ছিল না, আর সেই প্রথম প্রত্যাখ্যান ছিল আপনার জন্য আশীর্বাদ। আরেকটি উদাহরণ হল– ‘স্বপ্নের বাড়ি’। আপনি হয়তো প্রথমে যা চেয়েছিলেন তা পাননি, কিন্তু পরে তারচেয়েও ভালো বাড়ি পেয়েছেন।


সুবিধা খুঁজে নেওয়া

নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকা একবার একটা লেখা ছাপাল, ‘ব্রেইন টিউমারের কি কোনো ভালো দিক আছে?’ লেখিকা ছিলেন ৪০ বছর বয়সী শ্যারন, যাকে বলা হয়েছিল তার বাম চোখের পিছনে বিশাল এক টিউমার রয়েছে। টিউমারটিকে ৬ ঘণ্টা অপারেশনের পর সফলভাবে সরিয়ে ফেলা হয়। কিন্তু এমন ভয়াবহ পরিস্থিতিতে আপনি কি ইতিবাচক কিছু খুঁজে পাওয়ার চিন্তা করতে পারবেন? কিন্তু শ্যারন পেরেছিলেন।

তিনি এই দুঃসহ সময়ে তার পরিবার ও সম্প্রদায়ের অভূতপূর্ব ভালোবাসা ও সহযোগিতা পেয়ে মুগ্ধ হয়েছিলেন। তার সম্প্রদায়ের মানুষেরা, এমনকি যারা তার স্বল্প পরিচিত ছিল তারাও তার স্বামী ও সন্তানদের রাতের খাবার পাঠাত। তার বন্ধুরা তাদের বাড়ি পরিষ্কারের ব্যবস্থা করে দিত। শ্যারন এই সময়ে মানুষের সহমর্মিতা ও মহানুভবতার পরিচয় পেয়েছিলেন।

মানুষের জীবন কত ক্ষণস্থায়ী, শ্যারন এই ঘটনার ফলে বুঝতে পেরেছিলেন। শ্যারন বলেন, তিনি এখন আগের চেয়েও বেশি আশাবাদী। হাসপাতালের বিছানায় শুয়েই তিনি নিজের জীবনের লক্ষ্যগুলো কীভাবে অর্জন করবেন তার পরিকল্পনা শুরু করেছেন। তার ভাইবোনের সাথেও তার সম্পর্ক আরও গভীর হয়েছে। শ্যারনের মতে, তার নিজের দুর্ভাগ্যের ফলে তিনি জানতে পেরেছেন যে জীবন আসলে কতটা সুন্দর। এই কঠিন অভিজ্ঞতা থেকে উত্তরণের মাধ্যমে তিনি তার জীবনকে আরও বেশি মূল্যায়ন করতে শিখেছেন।


শোক থেকে শক্তি

চাপ নেই তো হীরাও নেই।

- ম্যারি কেইস


[প্রচ- চাপ ও অত্যধিক তাপমাত্রার দরুন হীরা তৈরি হয়। হীরা তৈরি হতে ১০০ থেকে ৩০০ কোটি বছর সময় লাগে। এত সময়ে এই প্রচ- চাপ ও অত্যধিক তাপমাত্রাই হীরার গঠন সৃষ্টি করে।]

অনেক সময়ই প্রতিকূলতার দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে তবেই সাফল্যের দেখা মেলে। উদ্যোক্তা ডেভ ব্রুনোর কথাই ভাবুন। আশির দশকে ব্রুনো একটি মেডিকেল যন্ত্রপাতির কোম্পানিতে দেশব্যাপী সেলস ম্যানেজার হিসাবে নিয়োজিত ছিলেন। তিনি তার স্ত্রী মারলিন ও তিন সন্তানকে নিয়ে মিলওইয়াকিতে একটি সুন্দর ছিমছাম বাড়িতে বসবাস করতেন। তাদের জীবন ভালোই কাটছিল।

কিন্তু ১৯৮৪ সালে ব্রুনো চাকরি হারান। এর কয়েক মাস পর একরাতে ব্রুনোর গাড়ি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে রাস্তা থেকে ছিটকে পড়ে এবং তিনি গুরুতর আহত হন। তার হৃৎপি- এবং ফুসফুস আঘাতপ্রাপ্ত হয়, পাঁজরের হাড় ভাঙে, তার প্লীহা ও লিভারে ক্ষতের সৃষ্টি হয়।

ডাক্তাররা জানতেন না তিনি আদৌ বাঁচবেন কিনা। ব্রুনো নিজেও চিন্তা করেছিলেন তিনি মারা যাবেন। তিনদিন লাইফ সাপোর্টে থেকে যমের সাথে যুদ্ধের পর তিনি অলৌকিকভাবে সেরে ওঠেন। ব্রুনোর মনে হল, তিনি দ্বিতীয় জীবন লাভ করেছেন।

হাসপাতালে থাকাকালীন সময়ে তিনি নিজের জীবন নিয়ে ভাবতে শুরু করেন। তিনি প্রায় সারাজীবন ধরেই অনুপ্রেরণামূলক উক্তি সংগ্রহ করতেন। কিশোর বয়সেই তিনি এই উক্তিগুলোর অসাধারণ ক্ষমতা বুঝতে পেরেছিলেন। এর অনেকটা কৃতিত্ব অবশ্য তার মায়ের যিনি ফ্রিজসহ বাড়ির সর্বত্র এই ধরনের উক্তি লাগিয়ে রাখতেন যাতে সবার সেগুলো চোখে পড়ে। এগুলো সবসময়ই তাকে অনুপ্রেরণা দিত এবং পথ খুঁজে পেতে সাহায্য করত।

হঠাৎ তিনি বুঝতে পারেন তাকে কী করতে হবে। তিনি এই উক্তিগুলো মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করবেন যাতে তারাও অনুপ্রাণিত হতে পারে। কিন্তু কাজটি কীভাবে করবেন তা তিনি জানতেন না।

হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর আরও দুঃসংবাদ তার জন্য অপেক্ষা করছিল। হাসপাতালের আকাশচুম্বী বিল আর চাকরিহীনতার কারণে তিনি দেউলিয়া হয়ে পড়েন। তিনি ও তার পরিবার নিজেদের বাড়ি বিক্রি করে একটি জীর্ণ এপার্টমেন্টে থাকতে শুরু করেন।

এত কিছুর পরেও ব্রুনো হাল ছেড়ে দেননি। তিনি ইতিবাচক মনোভাব ও অদম্য সংকল্প নিয়ে সামনে এগিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নেন। পরের কয়েক বছর তিনি এমন সব কাজ করেন যাতে তিনি মার্কেটিং ও প্রিন্টিং সম্পর্কে জ্ঞানার্জন হয়। তিনি সর্বক্ষণ ঐ উক্তিগুলোকে প্রচার করার উপায় খুঁজছিলেন।


যন্ত্রণাকে গ্রহণ করুন, এতে করে আপনি এগিয়ে যাওয়ার শিক্ষা পাবেন।

- বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন


একদিন হঠাৎ করেই তার মাথায় একটি বুদ্ধি আসে। তিনি ক্রেডিট কার্ডের স্টকে এই উক্তিগুলো প্রিন্ট করবেন। সেদিন সন্ধ্যায় টিভি দেখার সময় এক ক্রেডিট কার্ড কোম্পানির ‘গোল্ড কার্ড’ এর বিজ্ঞাপন তার নজরে আসে।

তিনি চিন্তা করলেন, ধাতব গোল্ড কার্ডে প্রিন্ট করলে মানুষ সেগুলো যেকোনো জায়গায় বহন করতে পারবে। এরপর তিনি মনোভাব, দৃষ্টিভঙ্গি, নেতৃত্ব, অধ্যবসায় ও সাহস সহ নানা বিষয় নিয়ে উক্তির একটি সিরিজ শুরু করেন। তিনি এর নাম দেন ‘সাকসেস গোল্ড কার্ডস’।

হাসপাতাল ছাড়ার ৫ বছর পর ব্রুনো নিজের প্রথম সাকসেস গোল্ড কার্ড বিক্রি করেন। আর অত্যন্ত আনন্দের সাথে জানাচ্ছি তিনি এখন পর্যন্ত ২০ লাখের বেশি কার্ড বিক্রি করেছেন!

ডেভ ব্রুনো তার শোকাবহ দুর্ঘটনাকে অসামান্য এক শক্তিতে রূপান্তরিত করতে সক্ষম হন।


ব্যবসায় অভিশাপ হচ্ছে ছদ্মবেশে থাকা আশীর্বাদ

সবচেয়ে কঠিন পথই আমাদেরকে শ্রেষ্ঠত্বের দিকে নিয়ে যায়।

- সেনেকা


এটা ভাববেন না যে এই তত্ত্ব শুধু শোকের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। আমি একটি অন্য উদাহরণ দিই। এই ঘটনা ব্যবসা সম্পর্কিত যা কিনা এই তত্ত্বের ওপর আমার বিশ্বাস পুনঃস্থাপন করেছিল।

১৯৯১ সালের মার্চে নিরলস গবেষণার পর আমি একটি কোম্পানিকে মনোভাবের ওপর সবকিছু নির্ভর করে ছাপানো টি-শার্ট বানানোর অনুমোদন দিই।

জুনে আমি স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে এই টি-শার্ট বিক্রির জন্য এডাভারটাইজিং ক্যাম্পেইন করার সিদ্ধান্ত নিই। জুলাইতে একটা বড় সমস্যা দেখা দেয়। যদিও সেই প্রিন্টিং কোম্পানির দুই সপ্তাহের মাঝে অর্ডার পূরণ করার কথা ছিল, দেখা গেল ৫ সপ্তাহ পরেও তারা অর্ডার শেষ করতে পারল না। এটা কোনোভাবেই মানা যাচ্ছিল না। আমি তাই অন্য প্রিন্টিং কোম্পানির খোঁজ করতে শুরু করি।

কিন্তু আমি আগের কোম্পানির প্রিন্টিং মূল্যের ওপর ভিত্তি করেই আমার টি-শার্টের মূল্য নির্ধারণ করেছিলাম। এটা বড় একটা সমস্যা তাই না? আমি যদি একই মূল্যে একই মানের টি-শার্ট বানানোর মতো কোম্পানি খুঁজে না পাই? তখন কী হবে?

কিন্তু হতাশ হয়ে নিজের ভাগ্যকে দোষারোপ করার বদলে আমি সাথে সাথে কাজে নেমে পড়লাম। এক সপ্তাহের মাঝেই আমি আগের থেকেও ভালো প্রিন্টিং কোম্পানির খোঁজ পেলাম। এবার দু সপ্তাহের বদলে তারা দুই থেকে চারদিনের মাঝে অর্ডার পূরণ করার প্রতিশ্রুতি দিল। এরপর আট বছর পেরিয়ে গেছে। আমি এখনো সেই কোম্পানির সাথেই কাজ করছি।

প্রথম কোম্পানির সাথে চুক্তি বিচ্ছিন্ন হওয়া আমার জন্য আশীর্বাদ ছিল! যদিও আমি ঐ মুহূর্তে এ কথা বুঝতে পারিনি, কিন্তু আমার বিশ্বাস ছিল আমি এই ‘খারাপ পরিস্থিতিকে’ নিজের নিয়ন্ত্রণে নিতে পারব। আর আমি ঠিক তাই করেছিলাম। এই অভিজ্ঞতাগুলো আমাকে শিখিয়েছে এক দরজা বন্ধ হলে আরেকটি আগের চেয়েও ভালো দরজা খুলে যায়।


হতাশা থেকেই পেশাবদল হয়

সমস্যা ও বাধাবিপত্তি আমাদের মধ্যকার সম্ভাবনাগুলোকে জাগিয়ে তোলে।

- জেফ কেলার


আমার নিজের পেশাবদল ছিল সমস্যাকে সুযোগে রূপান্তরের উৎকৃষ্ট উদাহরণ। আইনের কলেজ থেকে পাশ করে অনেক বছর অসুখী থাকার পরেই আমি আত্মগঠনমূলক জিনিস নিয়ে কাজ করতে শুরু করি। আমার জীবনের সবচেয়ে কষ্টের সময় পার করার ফলেই আমি এই তত্ত্বগুলো সম্পর্কে জানতে পারি।

এখন বুঝতে পারি এই কষ্টগুলো বস্তুত আমার জন্য ছিল আশীর্বাদ! আমি এখন জানি এই দুঃসহ অভিজ্ঞতাগুলোই আমাকে আজকের এই অবস্থানে আসতে সাহায্য করেছে। অসহনীয় দুঃখ, হতাশা ও কঠিন সময় পার করার কারণেই আমি আজকের এই ইতিবাচক মনোভাব অর্জন করতে সক্ষম হয়েছি।

তাই আমাকে যখন কেউ বলে তারা নিরুৎসাহিত বোধ করছেন কিংবা নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করছেন, আমি তাদের কষ্ট অনুভব করতে পারি। কারণ আমিও একই কষ্ট অনুভব করেছি! জীবনের এই প্রতিকূল সময় পার করেছি বলেই আমি কিছু অমূল্য জিনিস শিখতে পেরেছি। এজন্যেই আমি আমার দর্শক ও পাঠকদের মনোভাবগুলো ভালোভাবে বুঝতে পারি।

বাস্তবতা হল আমি যদি আমার পেশা নিয়ে এত বেশি হতাশ না হতাম, তাহলে কখনোই পেশাবদলের চিন্তা করতাম না। যদি আমার চাকরিকে ‘সি’ বা ‘সি-’ রেটিং দিতাম, তাহলে আমি ওকালতিই করতে থাকতাম। আমি ‘সি’ গ্রেডের জীবনই পার করতাম। যেহেতু আমার কাজ ছিল ‘ডি’ গ্রেডের আর তা ‘এফ’ গ্রেডের দিকে এগোচ্ছিল, তাই আমি নিজের জীবন পরিবর্তন করতে অনুপ্রাণিত হই!

যখন কেউ আমাকে আমার পেশাবদলের কারণ জিজ্ঞেস করে, আমি কোনো দ্বিধা ছাড়াই জবাব দিই, ‘প্রচ- কষ্ট’– শারীরিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক। এই কষ্ট এতই দুঃসহ ছিল যে তা আমাকে জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিতে বাধ্য করেছিল। আমার জীবন এখন ‘এ’ এবং আমি আরও বেশি উন্নতির পথে অগ্রসর হচ্ছি!

এখন আপনার জীবনের দিকে তাকান। আপনি কি এমন কোনো ঘটনা মনে করতে পারেন যেখানে আপনি একটি খারাপ অভিজ্ঞতাকে ভালো অভিজ্ঞতায় রূপান্তরিত করতে পেরেছিলেন?

হয়তো আপনার চাকরি চলে গিয়েছিল, এরপর আপনি তারচেয়ে ভালো একটি চাকরি পান। অথবা আপনার এমন কোন রোগ হয়েছিল যার কারণে আপনি নিজের খাদ্যাভ্যাস পালটে ফেলেন কিংবা ব্যায়াম করতে শুরু করেন। মনোযোগ দিয়ে এই কঠিন সময়গুলোর কথা চিন্তা করুন– এর থেকে আপনি কী সুবিধা বা শিক্ষা পেয়েছেন তা চিন্তা করুন। কোন ইতিবাচক শিক্ষা অবশ্যই আছে– আপনাকে শুধু তা খুঁজে নিতে হবে!

 

কীভাবে দুর্ভোগ আমাদের উপকার করে

এবার আপনাদের এমন ৭টি উপায় বলব যার ফলে দুর্ভোগ আমাদের উপকারে আসে:

১। দুর্ভোগ আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দেয়: আপনি কোন মরণঘাতী রোগ থেকে সেরে উঠলে দেখবেন ভাঙা ছাদ বা ফুটো হওয়া টায়ার আর আপনাকে বিরক্ত করছে না। আপনি তখন দৈনন্দিন জীবনের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অসুবিধাগুলোর ঊর্ধ্বে গিয়ে গুরুত্বপূর্ণ জিনিসগুলোর প্রতি মনোনিবেশ করতে পারবেন।

২। দুর্ভোগ আমাদের কৃতজ্ঞ হতে শেখায়: কোনোকিছু হারানো এবং কোনোকিছুর অভাবজনিত সমস্যাগুলো আপনাকে জীবনের প্রতি কৃতজ্ঞ হওয়ার শিক্ষা দিবে। শুনতে খারাপ লাগলেও এটাই সত্য যে কিছু হারানোর আগে আমরা অনেক সময়ই তার প্রকৃত মূল্য বুঝি না। যখন আপনি গরম পানি পাবেন না, তখন আপনি এর মূল্যায়ন করবেন। যখন অসুস্থ হবেন তখন সুস্থতার মর্ম বুঝবেন। প্রকৃত জ্ঞানী সেই, যে শত অভাব ও হতাশার পরেও তার জীবনের প্রতিটি জিনিসের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে। মনে রাখবেন, আমরা সবসময়ই আমাদের চিন্তা দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছি। তাই আপনি যত বেশি জীবন নিয়ে সন্তুষ্ট থাকবেন, তত বেশি জীবনে নতুন কিছু অর্জন করতে পারবেন।

৩। দুর্ভোগ লুকায়িত সম্ভাবনা বিকশিত করে: কোনো কঠিন সমস্যা কিংবা বাধার সম্মুখীন হওয়ার পর আপনি মানসিকভাবে আরও বেশি শক্তিশালী হয়ে ওঠেন। জীবন আপনার পরীক্ষা নিয়েছে আর আপনি সেই পরীক্ষায় জয়ী হয়েছেন। এরপর যখন আবার কোনো বিপত্তি আসবে আপনি আগের চেয়েও সহজে তার মোকাবিলা করতে পারবেন। সমস্যা ও বাধাবিপত্তি আমাদের প্রকৃত সত্তার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। আমরা যেসব কাজ কখনো করার কথা চিন্তাই করিনি, সেগুলোও আমরা করে দেখাই। এই বিপদগুলোর সম্মুখীন না হলে আমরা হয়তো নিজেদের এই গুণগুলো সম্পর্কে জানতে পারতাম না। দুর্ভোগ আপনার সামর্থ্য ও সক্ষমতাকে উন্মোচন করার পাশাপাশি এই গুণগুলোকে আরও শাণিত করতে সাহায্য করে।

৪। দুর্ভোগ জীবনে পরিবর্তন আনতে এবং কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে উদ্বুদ্ধ করে: অনেক মানুষই শত কষ্টের পরেও একই অবস্থায় পড়ে থাকে। কোনো বড় সঙ্কট আসার পরেই কেবল তারা নতুন করে জীবন সমন্বয় করার প্রেরণা পায়। আমরা অনেক সময় জীবনে পথভ্রষ্ট হয়ে পড়ি। তখন জীবন আমাদের সামনে নানা সমস্যা তুলে ধরে, যাতে আমরা আবার সঠিক পথে ফিরে আসতে পারি।

৫। দুর্ভোগ আমাদের মূল্যবান শিক্ষা দেয়: কোনো অসফল ব্যবসার কথা চিন্তা করুন। ঐ ব্যবসায়ী উক্ত পরাজয় থেকে এমন কোনো মূল্যবান শিক্ষা নিতে পারবে যা তাকে পরবর্তীতে উন্নতির শিখরে নিয়ে যাবে।

৬। দুর্ভোগ নতুন দরজা উন্মোচন করে: একটি সম্পর্ক ভেঙে গেলে আপনি তারচেয়েও সন্তোষজনক সম্পর্কে জড়াতে পারেন। চাকরি হারালে আরও ভালো চাকরি পেতে পারেন। এগুলো আসলে সমস্যার ছদ্মবেশে থাকা সুযোগ। জীবন এক দরজা বন্ধ করলে আরও ভালো নতুন এক দরজা খুলে দেয়।

৭। দুর্ভোগ আত্মবিশাস ও আত্মসম্মানবোধ বৃদ্ধি করে: যখন আপনার সমস্ত সাহস ও সংকল্প একত্রিত করে একটি সঙ্কটের মোকাবিলা করবেন তখন আপনার আত্মবিশ্বাস শতগুণে বেড়ে যাবে। আপনার আত্মমর্যাদা বৃদ্ধি পাবে। এই ইতিবাচক মনোভাবগুলো আপনার ভবিষ্যৎ জীবনকে আরও সমৃদ্ধ করে তুলবে।


ইতিবাচক জিনিস খুঁজুন

জীবনে দুঃখদুর্দশা আসবেই। আমি বলছি না যখন বাধাবিপত্তি আসবে তখন আপনি নিজের কষ্টকে উপেক্ষা করুন কিংবা বাস্তবতাকে অস্বীকার করুন। আমি বলতে চাই, আপনি তৎক্ষণাৎ নিজের ভাগ্যকে দোষ না দিয়ে কিংবা একবারে হতাশ না হয়ে ঠান্ডা মাথায় নিজের অবস্থা বিবেচনা করুন। আপনি হয়তো অনেক সময়ই তৎক্ষণাৎ কোন বিপত্তির ভালো দিক খুঁজে পাবেন না, কিন্তু তা অবশ্যই থাকবে।

আপনার সবসময়ই সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। আপনি নিজের সমস্যার কাছে হার মেনে শুধু কুফলগুলো চিন্তা করে হতাশ হতে পারেন। কিন্তু তা কেবল আপনার অবস্থার অবনতিই ঘটাবে। অথবা আপাতদৃষ্টিতে মনে হওয়া সমস্যাগুলোকে সুযোগ হিসাবে বিবেচনা করে এর থেকে কিছু শিখতে পারেন। বিশ্বাস করুন আর নাই করুন, আপনার সমস্যাগুলো আপনাকে ধ্বংস করতে নয় আপনাকে গড়তেই আবির্ভূত হয়!

তাই পরবর্তীতে যখন যখন সমস্যায় পড়বেন, তখন নিরুৎসাহিত হয়ে হাল ছেড়ে দিবেন না। সমস্যাগুলো যাতে আপনার মনোভাব বা দৃষ্টিভঙ্গির জানালাকে মেঘে ঢেকে দিতে না পারে। জানালা থেকে মেঘগুলো সরিয়ে সোনালী আলো প্রবেশ করতে দিন। যখন সবকিছুর সমাধান হয়ে যাবে তখন দেখবেন আপনি আগের চেয়েও ভালো অবস্থায় আছেন! নেপোলিয়ন হিলের এই কথাগুলো মনে রাখবেন: ‘প্রত্যেক সমস্যার আড়ালে একটি সমান অথবা এর তুলনায় বড় কোনো সুযোগ থাকে। অথবা প্রত্যেক দুর্ভোগ নিজের সঙ্গে সমপরিমাণ বা তারচেয়েও বেশি সুযোগ নিয়ে আসে।’

সবসময় নিজেকে জিজ্ঞেস করুন, জীবনের প্রতিকূলতা আপনার কী কাজে লেগেছে কিংবা এর থেকে কী শিখতে পেরেছেন। সেই শিক্ষা অনুযায়ী সামনে অগ্রসর হোন এবং নিজেকে একজন যোগ্য মানুষ হিসাবে গড়ে তুলুন। সঙ্কটের মুহূর্তে সর্বদা আশাবাদী থাকার চেষ্টা করুন এবং খোলা মনে চিন্তা করুন। কারণ এই মনোভাব আপনাকে সেই দূর্যোগপূর্ণ সময়ে কোনো না কোনো সুফল খুঁজে পেতে সাহায্য করবে।


 





দ্বিতীয় ভাগ


ভেবেচিন্তে কথা বলুন



    


বারবার আপনি যা কিছু আওড়ান, তাই আপনার ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়।

-  টম হপকিন্স

  




 





অধ্যায় ৬


আপনি প্রতিনিয়ত যেসব শব্দ ব্যবহার করেন, তাই আপনার ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে।

- এন্থনি রবিন্স


আপনার ব্যবহৃত শব্দগুলো আপনার জীবনের নতুন সূচনা করবে


শেষ কবে নিজের দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত শব্দগুলো নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করেছেন? আপনি কি সতর্কভাবে শব্দগুলো নির্বাচন করেন?

আপনি হয়তো চিন্তা করছেন, ‘জেফ, শব্দের ওপর এত গুরুত্ব কেন? কী লাভ হবে এতে?’ উত্তরটা সহজ। আপনার উচ্চারিত শব্দগুলোর অসামান্য ক্ষমতা রয়েছে। এই শব্দগুলো আপনার ভবিষ্যৎকে গড়ার অথবা ধ্বংস করার ক্ষমতা রাখে। আপনার কথায় আপনার বিশ্বাসের প্রতিফলন ঘটে এবং এই বিশ্বাস আপনার জীবনকে চালিত করে।

এই প্রক্রিয়াটিকে ডমিনোর একটা সারির মতো চিন্তা করুন, তাহলে তা এমন দেখাবে:

চিন্তা– শব্দ– বিশ্বাস– কর্ম– ফলাফল

প্রক্রিয়াটি এভাবে কাজ করে: টমের মাথায় একটি চিন্তা আসে– ‘আমি একজন ভালো বিক্রেতা হতে পারব না।’ এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে, টম এই কথাটি কেবল একবার চিন্তা করবে না। কখনোই না। কথাটি তার মাথায় ঘুরতেই থাকবে। হয়তো জীবনে কয়েকশ, এমনকি হাজারোবার তার এই কথাটি মনে পড়বে!

এরপর টম এই চিন্তা প্রকাশের জন্য জুতসই শব্দ ব্যবহার শুরু করে। সে তার বন্ধু ও সহকর্মীদের বলে, ‘আমি কখনোই ভালো বিক্রেতা হতে পারব না’ বা ‘আমি সেলস কল করতে ঘৃণা করি।’ এক্ষেত্রেও টম একই কথার পুনরাবৃত্তি করছে।


 


এই অবস্থায় তার বিশ্বাস দৃঢ় হয়। এই ধাপটি গুরত্বপূর্ণ। কারণ হল, আপনি জীবনে যা কিছু অর্জন করবেন তা আপনার বিশ্বাসেরই প্রতিফলন। এক্ষেত্রে, টম বিশ্বাস করছে সে সেলস এ কখনোই ভালো করবে না এবং বেশি অর্থ উপার্জন করতে পারবে না। এই কথাটি তার অবচেতন মনে চিরদিনের জন্য দাগ কাটবে।

এই বিশ্বাসের ফলে কী হবে? যেহেতু টম নিজের ওপর আস্থা হারিয়েছে, তাই সে আর কর্ম সম্পাদনে আগ্রহ দেখাবে না। সে একজন সফল বিক্রেতা হওয়ার আর কোন চেষ্টাই করবে না।

ফলস্বরূপ টম তার কাক্সিক্ষত ফলাফল পাবে না।


কথা বা শব্দ হচ্ছে মানব সভ্যতার সবচেয়ে বড় ও শক্তিশালী আফিম।

- রুডইয়ার্ড কিপলিং


আরও দুশ্চিন্তার বিষয় হল টমের মনে আরও নতুন নতুন নেতিবাচক চিন্তার আবির্ভাব হবে। এগুলো তার চিন্তায় নিয়মিত ঘুরপাক খাবে যা আগের চেয়েও খারাপ ফল বয়ে আনবে। এই দুষ্টচক্র চলতেই থাকবে!

কিন্তু এমনটা নাও হতে পারত। টম যদি ইতিবাচক চিন্তা করে সেগুলো ইতিবাচক শব্দে রূপান্তরিত করত, তাহলে সে নিজের সেলসের ক্ষমতার ওপর বিশ্বাস স্থাপন করতে পারত। এই বিশ্বাস তাকে কার্যকরী পদক্ষেপ (কর্ম) নিতে উদ্বুদ্ধ করত, যার ফলাফল হত অসাধারণ!

মূল কথা হল, নিজের ব্যবহৃত শব্দগুলোর গুরুত্ব অনুধাবন করুন। যারা নিয়মিত নেতিবাচক চিন্তায় নিমগ্ন থাকে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি স্বাভাবিকভাবেই নেতিবাচক রূপ ধারণ করে। এটি সাধারণ কার্যকারণ  তথা পধঁংব ধহফ বভভবপঃ এর উদাহরণ। আপনি সারাক্ষণ হতাশাব্যঞ্জক কথা বলে ভালো কিছু পাওয়ার আশা করতে পারেন না। কারণ নেতিবাচক কথা পরবর্তীতে অবিশ্বাসে রূপ নেয়– যার ফলশ্রুতিতে আপনার কাক্সিক্ষত ফলাফলও নেতিবাচক হয়।


আমি আপনার ঘরের কিছু মেরামত করি তা আপনি কেন চাইবেন না

যখনই ঘরের কিছু মেরামতের কথা আসে, আমি সেখান থেকে পালাই। টয়লেটের ট্যাংক ঠিক করার চেয়ে মাউন্ট এভারেস্টে চড়া আমার জন্য সহজ। ছুতার কিংবা ইলেক্ট্রিশিয়ানের কাজ? আমার কোনো ধারণাই নেই। আমার সবচেয়ে বড় দুর্বলতা জানতে চান কি? কোনো জিনিসের সাথে যেই ইন্সট্রাকশন ম্যানুয়েল (নির্দেশনামূলক কাগজ) দেওয়া থাকে, তা দেখে ঐ জিনিসটা সমন্বয় করা। আপনারা জানেন আমি কীসের কথা বলছি– সেই যে কিছু সাদাকালো বুকলেট যেখানে নির্দেশনা লেখা থাকে (যা খুবই দুর্বোধ্য!)– ‘ছবি ১০ দেখে নাটবল্টুগুলো জুড়ে দিন... এই অংশ এখানে লাগান।’

সুপারম্যানের ওপর ক্রিপ্টনাইটের যেই প্রভাব আমার ওপরে এসব ইন্সট্রাকশন ম্যানুয়েলেরও একই প্রভাব। যদি পুরনো সুপারম্যানের প্রোগ্রাম দেখে থাকেন, তাহলে হয়তো মনে পড়বে, ভিলেনগুলো সুপারম্যানের দিকে গুলি ছুড়ত, কিন্তু সেগুলো তার কোনো ক্ষতিই করতে পারত না। কিন্তু সুপারম্যানের একটাই দুর্বলতা ছিল– ক্রিপ্টনাইট। যখনই কোনো ভিলেন ক্রিপ্টনাইট তার সামনে আনত, সুপারম্যান ভীত ও দুর্বল হয়ে পড়ত।

আমারও ইন্সট্রাকশন শিট দেখলে একই অবস্থা হয়। আমি জানি এতে চোখ বুলালেও কোনো লাভ হবে না। আমি কোনোভাবেই তা বুঝব না। তাই আমি এমন অবস্থায় সবসময় ডলোরিসের শরণাপন্ন হই। ডলোরিসের জন্য এটা কোনো ব্যাপারই না।

তাহলে কেন এমনটা হল? আমি নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে জ্ঞানী ব্যক্তি বলে দাবি করছি না, তবে আমার বুদ্ধিমত্তা নেহায়েত কম নয়। তাহলে কি আমার জিনে অন্যদের মতো জিনিস মেরামতের দক্ষতা দেওয়া হয়নি? নাহ, ব্যাপারটা তা নয়।

উত্তরটা সহজ। গত চল্লিশ বছর ধরে আমি ক্রমাগত বলে যাচ্ছি, ‘আমি মেকানিকাল কাজে পটু নই’ এবং ‘আমি কিছু মেরামত করতে পারব না’– চল্লিশ বছর ধরে বলা এই কথাগুলোই আমার কাল হয়েছে। আমার মজ্জায় ঢুকে গেছে আমি এই কাজগুলো করতে অক্ষম।

এখন বুঝতে পারছেন আমি না জেনেই কীভাবে নিজেকে এই অবস্থায় এনেছি? সত্যি বলতে আমি যদি এর বিপরীত কথাগুলো বলতে শুরু করি, তবে নিশ্চয়ই এই দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে পারব।


বিজ্ঞানীদের ব্যবহৃত শব্দগুলো প্রয়োগ করতে পারেন

কথা বা শব্দ থেকে একজন মানুষের চারিত্রিক দৃঢ়তা, মানসিক স্থিরতা বা অস্থিরতা প্রকাশ পায়।

- প্লুটার্ক


অনেক বছর আগে আমি কেন্ট কালারস নামক একজন বিজ্ঞানীর লেখা পড়েছিলাম। তিনি নাসায় এক্সট্রা টেরেস্ট্রিয়াল ইন্টেলিজেন্স প্রজেক্টে (মহাজাগতিক বুদ্ধিমান প্রাণী সন্ধান প্রকল্প) কর্মরত ছিলেন। ফিজিক্সে ডক্টরেট করা বিজ্ঞানী কালারস এমন একটি সফটওয়ার তৈরির কাজ করছিলেন যা মহাবিশ্বের বিভিন্ন রেডিও সিগনাল ও বুদ্ধিমান প্রাণীর সন্ধান করবে।

অনেকটা স্টার ট্রেক চলচ্চিত্রের মতো শোনাচ্ছে, তাই না? কিন্তু ভাববেন না এটা কোন কল্পকাহিনী। এটি একটি প্রযুক্তিগত বৈজ্ঞানিক গবেষণা।

কিন্তু বিজ্ঞানী কালারসের একটি শারীরিক প্রতিবন্ধকতা আছে। তিনি কীভাবে এটা ব্যাখ্যা করেন তা বলি। তিনি নিজের অবস্থাকে একটি তুচ্ছ সমস্যা এবং ‘সামান্য অসুবিধা’ বলে আখ্যায়িত করেন। তাহলে বিজ্ঞানী কালারসের সেই প্রতিবন্ধকতাটি কী? সামান্য আরথ্রাইটিস? কিংবা অনিয়মিত মাইগ্রেনের ব্যথা?

বিজ্ঞানী কেন্ট কালারস অন্ধ। ঠিকই শুনেছেন, তিনি অন্ধ। কী অদ্ভুত ব্যাপার! একজন মানুষ তার অন্ধত্বকে সামান্য অসুবিধা বলছে!

এই শব্দচয়নের মাধ্যমে কেন্ট কালারস নিজেকে অসামান্য সাফল্য অর্জনের জন্য তৈরি করেছেন। তিনি অক্ষমতার বদলে নিজের সক্ষমতাকে প্রাধান্য দিয়ে অনেক দৃষ্টিশক্তি সম্পন্ন মানুষের চেয়েও বেশি কৃতিত্ব অর্জন করেছেন।

আপনি নিজের জীবনে এখন কি ধরনের প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হচ্ছেন? চিন্তা করুন তো, আপনি যদি সেই প্রতিবন্ধকতাগুলোকে ‘সামান্য অসুবিধা’ হিসাবে বিবেচনা করেন তাহলে জীবনে কতটা উন্নতি সাধন করতে পারবেন!


বলব... নাকি বলব না

আমি যখন অনুপ্রেরণামূলক ইতিবাচক শব্দ ব্যবহারের ওপর গুরুত্ব দিয়ে কথা বলি, তখন অনেকেই আমাকে জিজ্ঞেস করেন, ‘জেফ আমি এই শব্দগুলো কি শুধু নিজেকে বলব নাকি অন্যদের সাথে কথা বলার ক্ষেত্রেও ব্যবহার করব?’ আপনার হয়তো ভয় হয়, অন্য মানুষদের নিজের লক্ষ্যের কথা বললে তারা আপনাকে দাম্ভিক ভাববে অথবা আপনাকে নিয়ে হাসাহাসি করবে।

আমি এই বিষয়ে কিছু উপদেশ দিব। তবে মনে রাখবেন, এক্ষেত্রে কোনো ধরাবাধা নিয়ম নেই। আপনার যা কিছু সুবিধা হয়, আপনি সেই কাজটিই করবেন।

শুরুতে এটাই বলব, যত বেশি সম্ভব নিজের সাথে আত্মগঠনমূলক কথা বলুন। নিজের সাথে কথা বললে আপনার অন্যরা কী ভাবছে তা নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে হবে না। আপনি নিয়মিত ইতিবাচক কথা শুনছেন কিনা এটাই বড় কথা। বারবার এই কথাগুলো নিজেকে শোনালে তা আপনার অবচেতন মনে গেঁথে যাবে।

আপনি অন্যদের সাথে নিজের লক্ষ্য নিয়ে কথা বলবেন কী বলবেন না, তা ঠিক করা ততটা সোজা নয়। আমি এক্ষেত্রে একটা জিনিস শিখেছি: নেতিবাচক মানুষকে নিজের উদ্দেশ্যে জানাবেন না। এসব মানুষ আপনাকে শুধুই নিরুৎসাহিত করবে। তা কে-বা চায়? মজার বিষয় হল, এদের বেশিরভাগই ব্যক্তিগত জীবনে অসফল। তাদের কোন লক্ষ্য বা স্বপ্ন নেই। আর তাই তারা অন্যদের পথে বাধার সৃষ্টি করতে চায়।

তবে অনেক সময় অন্যদের সাথে কথা বলে আপনার লাভও হতে পারে। এক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হবে আপনি এমন কাউকে নিজের লক্ষ্যের কথা বলছেন যে কিনা আপনাকে উৎসাহ দিবে এবং যে নিজেই একজন আশাবাদী মানুষ। এমন মানুষকেই নিজের মনের কথা বলবেন যে আপনাকে যেকোনো ধরনের সাহায্য করতে প্রস্তুত এবং আপনার সফলতা যাকে অত্যন্ত আনন্দিত করবে। আপনার বন্ধুবান্ধব, সহকর্মী বা পরিবারে নিশ্চয়ই এমন কাউকে খুঁজে পাবেন।

আপনার লক্ষ্য অর্জনের সাথে যারা জড়িত তাদের কাছে নিজের মনোভাব ব্যক্ত করা জরুরি। যেমন, একজন সেলস ম্যানেজার যদি সামনের বছর তার বিক্রয় ২০% বৃদ্ধি করতে চায়, তবে তাকে নিজের কর্মচারীদের এই লক্ষ্য সম্পর্কে অবহিত করতে হবে। তবেই তারা সকলে মিলে এই লক্ষ্য অর্জন করতে পারবে।

আমি আপনাদের নিজের উদ্দেশ্য পূরণের জন্য ইতিবাচক শব্দচয়নে উদ্বুদ্ধ করার পাশাপাশি এটাও বলতে চাই যে আপনার পথের সম্ভাব্য প্রতিবন্ধকতা এবং অন্যদের প্রতিক্রিয়াকে একেবারেই উপেক্ষা করবেন না।  কোন লক্ষ্য অর্জনের পথে অগ্রসর হওয়ার আগে সেই পথে কী ধরনের বাধার সম্মুখীন হতে পারেন, সে সম্পর্কে আগে থেকে জেনে রাখা ভালো। আমি নিজে মনে করি এসব বিষয়ে আপনার কোনো শুভাকাক্সক্ষীর সাথে আলোচনা করুন, যে কিনা আপনাকে যেকোনো সমস্যা মোকাবিলার বিষয়ে গঠনমূলক পরামর্শ দিতে পারবে।

সাথে এটাও বলব, আপনারা এমন সব মানুষের সাথে নিজের পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করুন যারা ঐ বিষয়ে দক্ষ এবং যারা আপনাকে বুদ্ধিদীপ্ত কোনো সমাধান দিতে পারবে। আপনি যদি নিজের একটা ব্যবসা খুলতে চান, তাহলে এলমার আঙ্কেলের সাথে কথা বলে কোন লাভ হবে না, যদি তিনি নিরাশাবাদী হন এবং অন্যের কর্মচারী হিসাবে সারাজীবন কাজ করে থাকেন। তিনি নিজের ব্যবসা খোলা সম্পর্কে কি বা জানেন? বরং তিনি আপনাকে নিজের ব্যবসা না খোলার উপদেশ দিবেন। এলমার আঙ্কেলের সাথে কথা বলার পর আপনি আত্মবিশ্বাস হারাবেন। এমন পরামর্শের কোনো প্রয়োজন নেই!


কথা ও দায়বদ্ধতা

যারা সবসময় অর্থাভাব নিয়ে বিলাপ করে তারা সাধারণত অধিক অর্থ উপার্জনে সক্ষম হয় না।

- জেফ কেলার


এমন অনেক কারণ থাকতে পারে যার জন্য আপনি অন্যদেরকে নিজের উদ্দেশ্য জানানোর প্রয়োজন বোধ করবেন। এটাই হল দায়বদ্ধতা। অর্থাৎ আমি যদি কাউকে নিজের লক্ষ্য সম্পর্কে জানাই তবে আমাকে ঐ লক্ষ্যটি অর্জন করতেই হবে! এই পদ্ধতিকে ‘সব পথ বন্ধ করে দেওয়া’ তথা ‘বার্নিং ইউর ব্রিজেস’ বলে।

আগেই বলে নেই, আমি সম্পর্ক কিংবা ব্যবসার ক্ষেত্রে এই তত্ত্ব ব্যবহারে বিশ্বাসী নই। কিন্তু অনেক সময় জীবনে কিছু অর্জন করতে হলে সেই পথ থেকে বিচ্যুত হওয়ার অন্য সব পন্থা বন্ধ করে দিতে হয়।

এটি একটি কার্যকরী কৌশল হতে পারে। হয়তো এক বন্ধুকে জানালেন আপনি এই সপ্তাহে তিনবার জিমে গিয়ে ব্যায়াম করবেন। আপনি জানেন সপ্তাহ শেষে ঐ বন্ধুটি আপনাকে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করবে। আর এ কারণেই আপনি সপ্তাহে তিনবার জিমে গেলেন!

আরেকটি নাটকীয় উদাহরণ হল মোটিভেশনাল স্পিকার জিগ জিগলার। জিগলার ঠিক করলেন, তিনি ডায়েট করে ৯২ কেজি থেকে ওজন কমিয়ে ৭৫ কেজিতে নিয়ে আসবেন। একই সময়ে তিনি তার ঝবব ণড়ঁ অঃ ঞযব ঞড়ঢ় বইটিও লিখছেন।

এই বইতে জিগলার লিখলেন তার ওজন কমে ৭৫ কেজি হয়েছে। কথাটি বই প্রকাশ হওয়ার ১০ মাস আগে লেখা হয় এবং তিনি এই বইয়ের ২৫ হাজার কপি প্রিন্ট করার সিদ্ধান্ত নেন! মনে রাখতে হবে, এই কথাগুলো লেখার সময় জিগলারের ওজন ছিল ৯২ কেজি। তাকে ২৫ হাজার মানুষের সামনে এই কথাটি প্রমাণ করে দেখাতে হবে!

তার ওজন ৭৫ কেজি, এই কথাটি সত্য প্রমাণ করার জন্য জিগলার জানতেন তাকে বই প্রকাশের আগে ১৭ কেজি ওজন কমাতেই হবে এবং তিনি ঠিক তাই করেছিলেন!

এই কৌশলটি ভেবেচিন্তে (সবদিক বিবেচনা করে) ব্যবহার করবেন। কারণ এটি সবক্ষেত্রে কার্যকর নয়। যেই লক্ষ্যগুলো আপনার জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ এবং যেকোনো মূল্যে তা আপনি অর্জন করতে চান– কেবল সেক্ষেত্রেই এটি প্রয়োগ করবেন। এটি কি ঝুঁকিপূর্ণ? অবশ্যই। কিন্তু এর উদ্বুদ্ধ করার ক্ষমতাও প্রবল!


কথা ও অনুভূতি

এন্থনি রবিন্স তার বেস্ট সেলিং বই অধিশবহ ঃযব এরধহঃ ডরঃযরহ এ পুরো এক অধ্যায় জুড়ে আমাদের অনুভূতি, বিশ্বাস ও কর্মদক্ষতার ওপর শব্দভান্ডারের প্রভাব নিয়ে আলোচনা করেছেন। আমি রবিন্সের সব দর্শনের সাথে একমত না হলেও তার শব্দচয়নের ক্ষমতা সম্পর্কিত মতবাদের সাথে সহমত পোষণ করি। রবিন্স খুব ভালোভাবে আমাদের অনুভূতির তীব্রতার ওপর শব্দচয়নের প্রভাব পর্যবেক্ষণ করেছেন।

ধরুন, কেউ আপনাকে মিথ্যা বলেছে। আপনি হয়তো বলতে পারেন এতে আপনি ‘রাগান্বিত’ কিংবা ‘দুঃখিত’ হয়েছেন । কিন্তু আপনি যদি ‘অগ্নিশর্মা, ক্ষুব্ধ কিংবা ক্রুদ্ধ’ জাতীয় শব্দ ব্যবহার করেন, তবে আপনার শারীরবৃত্তি ও আচার-ব্যবহার নাটকীয়ভাবে বদলে যাবে। আপনার চেহারা রক্তিম বর্ণ ধারণ করবে। আপনার রক্তচাপ বেড়ে যাবে। আপনি উত্তেজনা বোধ করবেন।

অপরদিকে আপনি যদি বিষয়টিকে ‘বিরক্তিকর’ বলে আখ্যায়িত করেন, তাহলে আপনার অনুভূতির তীব্রতা অনেকটাই কমে যাবে। এমনকি রবিন্স এও বলেন, যদি আপনি ‘বিরক্ত’ হয়েছেন বলে চিন্তা করে থাকেন, তবে হয়তো তা আপনার হাসির উদ্রেক করবে এবং নেতিবাচক অনুভূতির চক্রকে ভেঙে দিবে। আপনি হালকা বোধ করবেন।


এমন সব কথা নির্বাচন করুন যা আপনাকে আপনার লক্ষ্যের দিকে অগ্রসর হতে সহায়তা করবে।

- জেফ কেলার


রবিন্স নেতিবাচক অনুভূতি হ্রাস করার আরেকটি কৌশল বলেছেন। এক মুহূর্তের জন্য ‘আমি ধ্বংস হয়ে গেছি’ কথাটির জায়গায় ‘আমার কাজে বাধার সৃষ্টি হয়েছে’ কথাটি বলুন। অথবা ‘আমি ঘৃণা করি’ এর বদলে ‘আমি চাই’ কথাটি বলুন। আপনি অবশ্যই পছন্দসই শব্দ ব্যবহার করে নিজের ইতিবাচক অনুভূতি বৃদ্ধি করতে পারেন। ‘আমি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ’ এর পরিবর্তে ‘আমি অদম্য’ বলুন! অথবা ‘আমি ঠিক আছি’ না বলে বলুন ‘আমি দারুণ আছি’ বা ‘আমি অসাধারণ বোধ করছি!’

এই চমৎকার শব্দগুলো আপনার মনোবল বৃদ্ধি করবে এবং আপনার চারপাশের সবকিছুর ওপরেও গভীর প্রভাব ফেলবে। আপনি যখন সজ্ঞানে এমন শব্দগুলো ব্যবহার শুরু করবেন, একই সাথে আপনার চলার পথও পরিবর্তন করে ফেলবেন। অন্যরাও আপনাকে ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখতে শুরু করবে এবং আপনার নিজের প্রতি ধারণাও বদলে যাবে।


আরও কাছ থেকে আপনার কথা পর্যবেক্ষণ করুন

একটু সময় নিয়ে নিজের জীবনের কথা ভাবুন। আপনি কি কোন ক্ষেত্রে ‘আমি পারব না’, ‘আমি যোগ্য নই’, ‘এটা অসম্ভব’– এই কথাগুলো ব্যবহার করেন? আমরা সকলেই নিচের এই কথাগুলো বলে এমন মানুষদের চিনি:

আমি আঁকতে পারি না

আমি অংকে ভালো নই

আমার নাম মনে থাকে না

আমি কখনোই এত টাকা উপার্জন করতে পারব না

আপনি যখন এই কথাগুলো ১০, ২০ কিংবা ৩০ বছর ধরে প্রতিদিন বলতেই থাকবেন, তখন মনের অজান্তেই নিজেকে ব্যর্থতার জন্য তৈরি করবেন। এই কথাগুলো আপনার মনোভাবের সাথে জড়িত। এই প্রত্যেকটি উদাহরণ আপনার নেতিবাচক মনোভাবের প্রতিচ্ছবি। আপনি যখন নোংরা প্রলেপ দেওয়া জানালা দিয়ে পৃথিবীকে দেখবেন তখন নেতিবাচক ভাষা ব্যবহার করবেন... এবং হতাশাব্যঞ্জক ফলাফল পাবেন।

সৌভাগ্যবশত নিজের ভাষাকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা আপনার আছে। অর্থাৎ আপনি একটি আশাব্যঞ্জক বিশ্বাস সিস্টেম গড়ে তুলে পছন্দসই ফলাফল পেতে পারেন। প্রথম ধাপ হল সচেতনতা। চলুন আপনি জীবনের প্রধান চারটি ক্ষেত্রে কী ধরনের ভাষা ব্যবহার করে আসছেন তা জেনে আসি। এগুলো হল: সম্পর্ক, আর্থিক সংস্থান, ক্যারিয়ার এবং স্বাস্থ্য।


১। সম্পর্ক

আপনি কি ‘এখন আর ভালো নারী কিংবা পুরুষ খুঁজে পাওয়া যায় না!’ অথবা ‘সবাই শুধু আমার সুযোগ নেয়!’– এ ধরনের কথা বলেন? যদি বলে থাকেন তবে আপনি নিজেকে ব্যর্থ সম্পর্কে জড়ানোর জন্য উদ্বুদ্ধ করছেন। আপনার মস্তিষ্ক আপনার প্রতিটি কথা শোনে এবং সেগুলোকে বাস্তবে রূপ দিতে চায়। উপরের উদাহরণগুলোর মতো কথা বলতে অভ্যস্ত হলে আপনি জীবনে এমন ধরনের মানুষের সাথেই সম্পর্কে জড়াবেন যারা আপনাকে শুধুই হতাশ করবে বা আপনার সুযোগ নিবে। আপনি কি তাই চান? যদি তা না চান তাহলে এই কথাগুলো বলা (এবং চিন্তা করা) বন্ধ করুন!


২। আর্থিক সংস্থান

নিজের আর্থিক অবস্থা এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা বর্ণনার সময় আপনি কী ধরনের ভাষা ব্যবহার করেন? ‘আমার ধারদেনা অনেক বেশি’, ‘এখন অর্থনৈতিক মন্দা চলছে’ কিংবা ‘মানুষ এখন আর আগের মতো কেনাকাটা করে না’– এই ধরনের কথাগুলো আপনার বিরূদ্ধে কাজ করে। আপনার উচিত এমন ভাষা ব্যবহার করা যা আপনার সমৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা পুনর্নির্মাণ করে। আপনি কিন্তু এই শব্দগুলো ব্যবহারের কয়েকদিনের মাঝেই প্রচুর সম্পদের মালিক হয়ে যাবেন না । আপনি তখনই এসব অর্জন করতে পারবেন যখন আপনি এগুলো পাওয়ার সম্ভাবনায় বিশ্বাস স্থাপন করবেন। আপনার ভাষার পরিবর্তনই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ!

নিজের দরিদ্রতা নিয়ে হাহুতাশ করে কেউ কোনোদিন ধনী হতে পারেনি। যারা সবসময় অর্থাভাব নিয়ে বিলাপ করে তারা সাধারণত অধিক অর্থ উপার্জনে সক্ষম হয় না।


৩। ক্যারিয়ার

আমি যদি জিজ্ঞেস করি, আপনি দশ বছর পর নিজেকে কোথায় দেখতে চান, তাহলে কী উত্তর দিবেন? সত্যি করে বলুন। আপনি কি এখনকার অবস্থাতেই নিজেকে দেখেন? নাকি এখনকার চেয়ে উচ্চ অবস্থানে আরও বেশি চ্যালেঞ্জ ও দায়িত্ব নিতে এবং বেশি উপার্জন করতে দেখেন? আপনার উত্তর যদি হয়, ‘আমি জানি না আমার কী হবে’, তাহলে আপনার জীবনে খুব বেশি পরিবর্তন হওয়ার সম্ভাবনা নেই। আপনার ভাষা আপনার দূরদৃষ্টি ও দিকনির্দেশনার অভাবেরই বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। কিন্তু আপনি যদি নিয়মিত ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা করেন, মনে মনে হলেও, তবে আপনার জীবনে উন্নতি ও নিজের লক্ষ্যে পৌঁছানোর সম্ভাবনা বহুগুণ বেড়ে যাবে।

একই কথা আপনার ব্যবসার ক্ষেত্রেও খাটে। আপনি কি সর্বদা ব্যবসার উন্নতির কথা বলেন? নাকি ভাবেন আপনি কখনোই নিজের লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবেন না?


৪। স্বাস্থ্য

এতে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই যে আমাদের স্বাস্থ্যের ওপর আমাদের কথার গভীর প্রভাব রয়েছে। যেমন ধরুন, আমরা কয়েকজন মিলে একটি পরিপূর্ণ ও স্বাস্থ্যসম্মত খাবার খেতে বসলাম। দুই ঘণ্টা পর আমি আপনাকে ফোন করে জানালাম আমাদের সাথে যারা যারা খেয়েছিল তাদের সবার বদহজম হয়ে হাসপাতালে ভর্তি! মনে করুন, আমি ফোন করার আগ পর্যন্ত আপনি সম্পূর্ণ সুস্থ ছিলেন। আমার কথা শোনার পর আপনার কি প্রতিক্রিয়া হবে?

সম্ভবত আপনার পেটে মোচড় দিবে এবং আপনি অসুস্থ বোধ করবেন। কেন? কারণ আমার কথায় আপনার এই বিশ্বাস জন্মেছে যে আপনিও অসুস্থ আর তাই আপনার শরীরও একই প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে। কথাগুলো যদি মিথ্যা হত এবং আমি নিষ্ঠুর রসিকতার স্বরূপ আপনাকে কথাগুলো বলতাম, তারপরও আপনার একই প্রতিক্রিয়া হত! আপনার শরীর আপনার এবং অন্যদের কথার প্রতি সংবেদনশীল। আর তাই ‘আমার শরীরে সারাক্ষণ ব্যথা’ অথবা ‘আমার ঠান্ডা লেগেই থাকে’ এ ধরনের কথা বলা থেকে বিরত থাকুন। এই কথাগুলো বারবার বলার মাধ্যমে আপনি নিজের শরীরকে সর্বদা অসুস্থ থাকার জন্য নির্দেশ দিচ্ছেন!

দয়া করে আমাকে ভুল বুঝবেন না। আমি বলছি না আপনি নিজের অসুস্থতাকে আমলে নিবেন না বা আপনি যেকোনো অসুখকে চিকিৎসা ছাড়াই জয় করতে পারবেন। কিন্তু আপনার দুর্ভোগ ও কষ্ট বাড়ায় এমন কথা বলে আদৌ কোনো লাভ হবে না।


আপনার সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ রয়েছে

তাহলে কী চিন্তা করেছেন আপনি এই চারটি ক্ষেত্রে কী ধরনের ভাষার প্রয়োগ করেন? আমরা যখন কিছু কথা বারবার পুনরাবৃত্তি করি তখন সেগুলো আমাদের মনে গেঁথে যায়। কথাগুলো মাথার ভেতরে ভাঙা রেকর্ডের মতো বাজতেই থাকে। সমস্যা হল, আপনি যত বেশি কথাগুলো উচ্চারণ করবেন, তত গভীরভাবে কথাগুলো মাথায় গেঁথে যাবে এবং আপনি আরও দৃঢ়ভাবে কথাগুলোয় বিশ্বাস স্থাপন করবেন। আর সেগুলো আপনার জন্য একই ফল বয়ে আনবে।

আপনি অতীতে যা বলেছেন এখনো অন্ধের মতো তাই বলে যাবেন, এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। নিজের ভাষাকে পরিবর্তন করতে শুধু প্রয়োজন শৃঙ্খলা ও সতর্কতা, যা আপনার জন্য সুফলই বয়ে আনবে! তাই এখন থেকেই সচেতনভাবে নিজের ভাষা নির্বাচন করুন। এমন সব কথা নির্বাচন করুন যা আপনাকে আপনার লক্ষ্যের দিকে অগ্রসর হতে সহায়তা করবে। কোনো বন্ধুকে বলুন আপনার ভুল হলে তা শুধরে দিতে।

মনে রাখবেন, আপনি নিজের উদ্দেশ্যে পৌঁছানোর লক্ষ্যে কীভাবে কথা বলবেন তা সম্পূর্ণ আপনার হাতে। আর তাই এমন শব্দাবলি চয়ন করুন যা আপনার কাজের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং সেই অনুযায়ী পদক্ষেপ নিন। আর দেখুন আপনি কত সুন্দরভাবে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাচ্ছেন!



 





অধ্যায় ৭


আপনার কথার ধরন অনুযায়ী আপনার দিন আবর্তিত হয়।

- অজানা বক্তা


কেমন আছেন?


‘কেমন আছেন?’ তথা ‘হাউ আর ইউ’ প্রশ্নের উত্তর আমাদের কাছে খুবই ছোট ও নগণ্য। কিন্তু আমাদের উচিত দিনে অন্তত দশবার এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া। সম্ভব হলে পঞ্চাশবার। অতএব এটি ঠুনকো কোন বিষয় নয়। এ হল আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের স্বাভাবিক আলাপচারিতার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

যখন আপনার কাছে কেউ জানতে চায়, ‘কেমন আছেন?’ আপনার উত্তর কী হয়? সাধারণত আপনি দু’একটি শব্দেই উত্তর দিয়ে থাকেন। তথাপি এই ক’টি শব্দ আপনার ও আপনার মনোজাগতিক অবস্থা সম্পর্কে অনেক কিছু জানিয়ে দেয়। বাস্তবিকই আপনার উচ্চারিত বাক্য আপনার মনোভাব নির্ধারণ করে।

আমার মতে, ‘কেমন আছেন?’ প্রশ্নের উত্তরগুলোকে তিনটি শ্রেণীভুক্ত করা যায়: নেতিবাচক, মধ্যপন্থি ও ইতিবাচক। চলুন এই তিনটি শ্রেণী ও এদের সাধারণত প্রদত্ত উত্তরসমূহকে বিশ্লেষণ করা যাক।


নেতিবাচক উত্তর

কেমন আছেন এর প্রতি উত্তরে সাধারণত এই শব্দগুলো দেখা যায়:

‘যাচ্ছেতাই’

‘ভয়ঙ্কর’

‘আর পারছি না!’

‘যাক বাবা! আজ শুক্রবার।’

‘খুব একটা সুবিধের না!’

‘আর বলো না!’

যখন কেউ আমার ‘কেমন আছেন?’ প্রশ্নের উত্তরে ‘আর বলো না।’ উত্তর দেয়, তখন বুঝতে পারি, আমি তাকে সমস্যায় ফেলে দিয়েছি। ব্যক্তিটি অনেকগুলো অভিযোগের তীর আমার দিকে ছুঁড়ে দিবে। কেন তার কাছে ‘কেমন আছেন’ জানতে চাইলাম, এজন্য অপরাধী করবে।

অন্যদিকে, তাদের ওপর খুব মায়া হয় যারা উত্তরে বলে, ‘যাক বাবা! আজ শুক্রবার’। তাদের এমন অভিব্যক্তির অর্থ দাঁড়ায়, তাদের জন্য সোমবার, মঙ্গলবার, বুধবার, বৃহস্পতিবার সবসময় অশুভদিন। তাদের কাছে সপ্তাহের চার-পঞ্চমাংশ ‘যাচ্ছেতাই’। পঞ্চমদিন, শুক্রবার, তাদের কাছে আনন্দের দিন। কারণ আগামী দু’দিন তাদের অফিস নেই, কোনো কাজ নেই। এটা কি জীবনযাপনের কোনো পদ্ধতি? আপনি কি অনুধাবন করতে পারছেন এই নেতিবাচক উত্তরগুলো কীভাবে আপনার মন ও চিন্তাকে প্রভাবিত করছে? কীভাবে আপনার চারপাশের মানুষগুলোকে আক্রান্ত করছে?


মধ্যপন্থি উত্তর

মধ্যপন্থি উত্তরগুলো নেতিবাচক উত্তরসমূহের চেয়ে কিছু অংশে ভালো। তবে এরকম মনোভাবও পরিহার করা উচিত। মধ্যপন্থি উত্তরসমূহ সাধারণত হয়ে থাকে:

‘আমি ঠিক আছি।’

‘যাচ্ছে কোনোরকম।’

‘আরও খারাপ হতে পারত।’

‘আগের মতোই।’

‘লাইফটা ঝুলে আছে।’

‘মোটামুটি।’

আপনি কি ‘যাচ্ছে কোনোরকম’ প্রকৃতির মানুষের সাথে আপনার জীবনের দীর্ঘ সময় কাটাতে চাইবেন? এ ধরনের মানুষকে কি আপনার উপযুক্ত ব্যবসায়িক পার্টনার মনে করেন? যখন আমরা যাচ্ছে কোনোরকম, মোটামোটি, ঝুলে আছে এ ধরনের শব্দবলি ব্যবহার করি, আমরা আমাদের মনোবল ও চালিকা শক্তি হ্রাস করি। আপনি কোন উচ্ছ্বসিত ব্যক্তিকে ‘আরও খারাপ হতে পারত বলতে শুনেছেন? কেউ স্বাভাবিক অভিব্যক্তিতে ‘ঝুলে আছে কোনোমতে’ বলতে দেখেছেন? উত্তর আশা করি ‘না’ই হবে। এ প্রকৃতির লোকগুলোকে দেখে মনে হবে কয়েক রাত এরা দু’দ- ঘুমাতে পারেনি।

এভাবে জীবন চলতে দেওয়া যায় না। যারা কেমন আছেন প্রশ্নের উত্তরে মধ্যপন্থি উত্তর দেয়, তারা মনোভাবে ও আচরণেও মধ্যপন্থি থাকে, দিনশেষে তাদের ফলাফলও মধ্যপন্থি হয়। আমি জানি আপনি আপনার জীবনে এমনটা হোক তা চান না!


ইতিবাচক উত্তর

আপনার চেহারার উজ্জ্বল ভাব ধরে রাখার জন্য হাসি খুব সহজ অথচ মূল্যবান এক পদ্ধতি।

- অজানা বক্তা


তৃতীয় শ্রেণী হল যারা ইতিবাচক উত্তর দেয়। এরা অত্যন্ত উদ্যমী ও চমৎকার মানুষ। তাদের উত্তরগুলো হয়ে থাকে:

‘অনেক ভালো আছি’

‘খুব ভালো আছি’

‘দারুণ’

‘চমৎকার’

‘অসাধারণ’

‘বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছি!’

‘জীবন এর চেয়ে মধুর হয় না!’

যারা ইতিবাচক শব্দ বা বাক্য ব্যবহার করে তাদের কথার মধ্যে জাদু থাকে। আপনি যদি তাদের আশেপাশে থাকেন তাদের কথা ও আচরণ আপনার মনকেও ভালো করে দিবে। পাঠক সত্যি করেই বলুন, যখন আপনি ইতিবাচক শব্দগুলো পড়ছিলেন তখন আপনার মনের অবস্থা কী ছিল? আপনার অবস্থা জানি না, কিন্তু আমি যখন শব্দগুলো পুনরায় দেখছি আমি তখন আমার মাঝে উদ্দীপনা ও সঞ্জীবনী শক্তি অনুভব করছি। এ প্রকৃতির লোকগুলোর সাথেই আমি আজকে দেখা করতে চাই। এরাই আমার মন-মানসিকতার সাথে মিলে।

নেতিবাচক ও মাঝারি মানের শব্দ ও বাক্যগুলো আবার পড়ে দেখুন। উচ্চস্বরে পড়–ন। পড়তে ও শুনতে কেমন লাগছে?

যদি বিকল্প হাতে থাকে, তবে আমি সে সকল মানুষের সঙ্গ বেছে নিব যারা ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করে ও উচ্ছ্বসিত জীবনযাপন করে। যারা নেতিবাচক ও মৃতপ্রায় জীবনযাপন করে তাদের দিকে ফিরেও চাইব না। একটি প্রাচীন প্রবাদ আছে, প্রত্যেক মানুষই ঘরের প্রাণবন্ততা ও জীবনীশক্তি ফিরিয়ে আনে। কেউ ঘরে প্রবেশ করে ঘর আলোকিত করে, কেউ ঘর থেকে প্রস্থান করে ঘর আলোকিত করে। আপনি তাদের দলভুক্ত হোন যারা ঘরে প্রবেশ করলে ঘর আলোকিত হয়।

আমার ক্ষেত্রে, কেউ যখন আমাকে জিজ্ঞেস করে কেমন যাচ্ছে দিনকাল। আমি প্রতিউত্তরে বলি, অসম্ভব ভালো যাচ্ছে। একথা অন্যের মাঝেও ইতিবাচক মনোভাব সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখে। আমি যত বেশি এই বাক্যটি আওড়াই তত বেশি আমার ও আমার চারপাশ অন্যরকম ভালো লাগায় ভরে ওঠে।


ইতিবাচক মানুষের সঙ্গ গ্রহণ করুন

আপনি ইতোমধ্যে প্রতিটি শ্রেণীর– নেতিবাচক, মধ্যপন্থি ও ইতিবাচক– সাধারণত ব্যবহৃত কিছু উত্তর পেয়েছেন। আপনি কোন দলভুক্ত? কী ধরনের বাক্য আপনি প্রায়শ ব্যবহার করে থাকেন? আপনার চারপাশের মানুষগুলো কীভাবে ‘কেমন আছেন’ প্রশ্নের উত্তর দিয়ে থাকে?

যদি এমন হয় যে, আপনি নেতিবাচক বা মাঝারি মানের শব্দাবলি ব্যবহার করেন ‘কেমন আছেন’ এর উত্তরে, তবে আমার পরামর্শ থাকবে এমন বাক্য ব্যবহার পরিহার করুন এবং ইতিবাচক শব্দ ব্যবহার করতে শিখুন। কেন ব্যাখ্যা করছি, শুনুন। যখন আপনাকে জিজ্ঞেস করা হয় কেমন আছেন আর আপনি এর উত্তরে বলেন, ‘ভয়ানক অবস্থা’ বা ‘অতটা খারাপও না’, তখন আপনার শরীরে তা বিরূপ প্রভাব তৈরি করে। সাধারণত আপনার কাঁধ ঝুঁকে যায় এবং চেহারায় মলিন ভাব সৃষ্টি হয়। হতাশা ভর করে।

তাছাড়া, আপনার আবেগ বা অনুভূতি তখন কেমন হয়? যখন বলেন, ‘যাচ্ছেতাই’, কেমন বোধ করেন আপনি? অবশ্যই তখন ভালো লাগার কথা না! আপনার ভেতরের অবস্থা খুব সম্ভবত বাহিরের চেয়ে বেশি শোচনীয়। তার কারণ, নেতিবাচক শব্দ ও চিন্তা, নেতিবাচক অনুভূতির জন্ম দেয়। যা ক্রমান্বয়ে খারাপ ফলাফল ডেকে আনে।

তাই আপনার কর্তব্য হল এই অবস্থা থেকে উত্তরণ। হতে পারে এমন কোন অবস্থার সম্মুখীন হয়েছেন যা আপনাকে যাচ্ছেতাই অবস্থা বলতে বাধ্য করেছে। যেমন হতে পারে, আপনি কোন সম্ভাব্য বড় ক্লায়েন্ট হারিয়েছেন বা কোন এক ব্যবসায়িক চুক্তি হাতছাড়া হয়ে গেছে অথবা আপনার ছেলে স্কুলে রেজাল্ট খারাপ করেছে। বিশ্বাস করুন, আপনার এমন নেতিবাচক মনোভাব না আপনার ছুটে যাওয়া ক্লায়েন্টকে পাইয়ে দিবে, না আপনার ছেলের রেজাল্টের উন্নতি ঘটাবে। বরং কাঁটা ঘায়ে নুনের ছিটা হয়ে নেতিবাচক মনোভাব আপনার অবস্থা আরও শোচনীয় করে তুলবে। আপনার ভারাক্রান্ত মন তাদের মন খারাপের কারণ হয়ে উঠবে।


নতুন অভ্যাস গড়ে তুলুন

‘ভালো আছি’ এ কথাটি বারবার বলুন। আল্লাহ আপনার কথা শুনবেন এবং আপনার কথার মান রাখবেন।

- এলা উইলার উইলকক্স


যদি আপনার কয়েকটা নেতিবাচক শব্দ বা বাক্যের ফলাফল এত ব্যাপক হয়, তবে কেন আপনি এসব শব্দ পরিহার করছেন না? খুব সম্ভবত আপনি জানেনই না, আপনি চাইলে আপনার মনোভাবে পরিবর্তন আনতে পারেন। আপনার দীর্ঘদিনের অভ্যাসকে আপনি বয়ে বেড়াচ্ছেন– যে অভ্যাস আপনার ক্ষতি বৈ কিছু করছে না।

আপনার বাক্যসমূহ আপনার ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করে দেয়। যেমন আপনি যদি বলেন, সবকিছু খুব খারাপ যাচ্ছে, তবে আপনি অবচেতনভাবে সেসব লোক ও অবস্থার মুখোমুখি হন যা আপনার বক্তব্যকে সমর্থন করে ও সত্যে পরিণত করে। অন্যদিকে আপনি যদি বলেন, আপনার দিনকাল বেশ ভালো যাচ্ছে তবে আপনার ধ্যান-মন সবকিছু আপনাকে ভালো ও উত্তম বস্তুর দিকে তাড়িত করে।

বিষয়টি উদাহরণের মাধ্যমে খোলাসা করা যাক। আপনি যখন বলেন, ‘অনেক ভালো আছি! বা খুব ভালো আছি!’, তখন আপনার ইতিবাচক শব্দগুলো আপনার দেহভঙ্গিতে প্রতিফলিত হয়। আপনার বডি ল্যাঙ্গুয়েজ বা দেহের ভাষা থাকে আত্মবিশ্বাসে ভরপুর। আপনার সজীবতা ও উদ্যম অন্যকে মুগ্ধ করে, কাছে টানে। আপনার ব্যাবসায়িক ও ব্যক্তিগত সম্পর্কে উন্নতি ঘটে। তবে ইতিবাচক শব্দের ব্যবহার মুহূর্তেই আপনার সকল সমস্যা দূর করে দিবে এমন নয়। তবে আপনার দৈনন্দিন জীবনে নতুন মাত্রা যোগ হবে। তা হল, আমরা জীবনে যা চাই তা পাব।

আমার পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, ইতিবাচক মনোভাব জীবনের সে সকল ছোট ছোট বস্তুর একটি যা আপনার জীবনে ব্যাপক পরিবর্তন আনতে সক্ষম। ১৫ বছর আগে মানুষ যখন আমার কাছে জানতে চাইত কেমন আছি, আমি শুধু বলতাম ‘ঠিক আছি’ তথা ‘ওকে’। আমার জীবন এই ‘ওকে’তে আটকে ছিল। আমার মানুষের সাথে সম্পর্ক, সাফল্য, প্রাপ্তি ও ধ্যান-জ্ঞান সবকিছুই ‘ওকে’তে সীমাবদ্ধ হয়েছিল। চারপাশের মানুষগুলোর সাথে ভালো সম্পর্ক, বড় সাফল্য ইত্যাদি আমার জীবনে অনুপস্থিত ছিল। এক কথায় জীবনে মুষড়ে ছিল।

তারপর সৌভাগ্যক্রমে আমি বুঝতে পারলাম আমার জীবন এই দুই বর্ণে (ওকে) সীমাবদ্ধ বা এর সমান নয়। আমি কথা বলার ধরন পরিবর্তন করলাম। আমি সজীবতা ও প্রফুল্লতা নিয়ে কথা বলতে শুরু করলাম, ‘দিনকাল অনেক ভালো যাচ্ছে!’ প্রথম প্রথম অবশ্য বলতে সংকোচ হত। আড়ষ্টতা কাজ করত। কিন্তু সপ্তাহ শেষে আমি অভ্যস্ত হয়ে যাই। শব্দটি আমার মাঝে জাদুর ন্যায় কাজ করত। চমৎকার অনুভূতি আমার মাঝে কাজ করত। আর চারপাশের মানুষগুলো আমার প্রাণবন্ততা দেখে আমার সাথে কথা বলতে উৎসাহী হত।

বিশ্বাস করুন, এ কোন রকেট বিজ্ঞান নয়। ইতিবাচক ও সজীব মনোভাব গড়ে তোলার জন্য আপনার মেধা, টাকা কিংবা সুন্দর চেহারার প্রয়োজন নেই। কেবল প্রয়োজন প্রাণোচ্ছ্বাস ও ইতিবাচক সাড়া। আশা করি, আমার মতো আপনিও চমৎকার ফলাফল পাবেন।


 

যদি আমি ভালো বোধ না করি তবে?

মেঘাচ্ছন্ন দিন কখনো প্রাণবন্ত স্বভাবের সাথে মিলে না।

- উইলিয়াম আর্থার ওয়ার্ড


যখন আমি সবাইকে পরামর্শ দিই, ‘কেমন আছ?’ এর উত্তরে উৎসাহপূর্ণ প্রতিক্রিয়া দেখান, আমার শ্রোতাবৃন্দের কেউ না কেউ আমাকে একটি প্রশ্ন প্রায় করে থাকে, যদি আমি প্রকৃত অর্থেই ভালো না থাকি তবুও কি আমি বলব আমি প্রচ- ভালো আছি?

আমাকে ভুল বুঝবেন না। আমি মিথ্যাকে প্রশ্রয় দিই না। সর্বদা সত্যের পক্ষ অবলম্বন করি। তবে আমার মনে হয় না, ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখানোর মাঝে সত্য-মিথ্যার কিছু আছে। বুঝিয়ে বলছি।

মনে করুন, শায়লা প্রচ- ক্লান্ত। যখন অফিসে কেউ তার কাছে জানতে চায়, ‘কেমন আছ, শায়লা?’, সে উত্তরে সোজাসাপ্টাই বলে, ‘আমি বড্ড ক্লান্ত!’ এখানেই সমস্যাটা সৃষ্টি হয়। শায়লার এভাবে প্রতিক্রিয়া দেখানো তার ক্লান্তিভাবকে দৃঢ় করে। তার মস্তিষ্ক আরও বেশি ক্লান্তির প্রতি সাড়া দেয়। তার অবসাদগ্রস্থতা বৃদ্ধি পায়। হয়তো সে উত্তর দেওয়ার পর, ডেস্কে তার মাথা এলিয়ে দিবে এবং ক্লান্তির শ্বাস নিবে। পুরোদিন মাটি করে সে অফিসে নিষ্কর্মা কাটিয়ে দিবে।

চলুন, এবার প্রশ্নকারীর প্রতিক্রিয়া দেখা যাক! সে হয়তো এখন আফসোস করতে শুরু করেছে, শায়লার অবসাদগ্রস্থতা বাড়িয়ে দিয়েছে বলে। বিরূপ প্রভাব তার মাঝেও ভর করতে শুরু করে। কারণ কেউ যখন আপনাকে বলে, সে ক্লান্ত, এ কথা শোনার পর অবশ্যই আপনি খুশিতে আটখানা হন না। ‘ক্লান্ত’ শব্দটা শুনে আপনিও হাই তুলতে আরম্ভ করে দেন। তাই শায়লা শুধু নিজেকে ভারাক্রান্ত করেনি; বরং তার সহকর্মীর মাঝেও তা ছড়িয়ে দিয়েছে।

যা হোক, তারপর, শায়লা একটি পরিশ্রান্ত দিনশেষে বাড়ি ফেরে। দেহজুড়ে ভর করে আছে অবসাদ। ঘরে প্রবেশ করে, তার পছন্দের চেয়ারে সে গা এলিয়ে দেয়। লটারি ড্রয়ের দিন ছিল আজ। সে পত্রিকার পাতা হাতে তুলে নেয়। ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে তার লটারিটি বের করে সে নাম্বার মিলিয়ে নেয়। অবিশ্বাস্যভাবে সে লটারি জিতে যায়। মুহূর্তেই সে এক কোটি টাকার মালিক বনে যায়। কী মনে হয় আপনার? শায়লা কী করবে? সে কিন্তু প্রচ- ক্লান্ত!

আমরা সবাই জানি, সে চেয়ার ছেড়ে লাফাতে আরম্ভ করবে। খুশিতে চিৎকার চেঁচামেচি করবে। দিকবিদিক হাত ছুঁড়বে। মনে হতে পারে, সে যেন অ্যারবিকস ক্লাস করছে। স্বাভাবিকভাবে, সে দৌড়ে গিয়ে তার ফোন হাতে নিবে এবং তার পরিবার-পরিজন, প্রিয়জন-পরিচিতজন সবাইকে জানাবে। অফুরন্ত উচ্ছ্বাসে সে সারারাত কাটিয়ে দিবে। ভাবতে থাকবে, টাকা দিয়ে সে কী কী করবে।

কিন্তু দশ সেকেন্ড আগেও মেয়েটি অবসাদগ্রস্থ ছিল। নিমিষেই তার সব ক্লান্তি উবে গেল। আর সে ১৫ বছরের তরুণীর ন্যায় লাফাতে আরম্ভ করল। ১০ সেকেন্ডে কী এমন ঘটে গেল যার কারণে শ্রান্তির অতল থেকে আনন্দের শিখরে পৌঁছে গেল? সে কি কোন ভিটামিন বি-কমপ্লেক্স খেয়েছে? নাকি কেউ তার মুখে হিমশীতল পানি ঢেলে দিয়েছে?

না, এমন কিছুই ঘটেনি। তার অবস্থার পরিবর্তন সম্পূর্ণটা ঘটেছে মনোজগতে! তার মানসিকতায়!

আমার উদ্দেশ্য কোনোভাবেই শায়লার ক্লান্তিকে উপেক্ষা করা নয়। সে প্রকৃতপক্ষেই অবসাদগ্রস্থ। কিন্তু তার ক্লান্তি যতটা না শারীরিক তার চেয়েও বেশি মানসিক। অতএব, শায়লা কি আসলেই সত্য বলেছিল যখন সে বলল, ‘আমি ক্লান্ত’? এতে সত্য-মিথ্যা কিছু যায় আসে না। বরং এখানে গুরুত্বপূর্ণ হল শায়লা কোন বিষয়ের ওপর জোর দিতে চাচ্ছে। সে চাইলে তার ক্লান্তিকে বড় করে দেখাতে পারে। অন্যদিকে সে চাইলে, তার জীবনে অর্জিত ভালো দিকগুলো নিয়েও চিন্তা করতে পারে। তার সৌভাগ্যের কথা চিন্তা করতে পারে। এতে করে সে তার উদ্যম ও শক্তি ফিরে পাবে।

আমাদের অনুভূতি তথা ফিলিংস আমাদের আচার-ব্যবহারকে নানাভাবে প্রভাবিত করে। যদি আমরা নিজেদের বলি আমরা ক্লান্ত, তবে আমাদের মস্তিষ্ক ওভাবেই সাড়া দেই এবং আমরা ক্লান্তি অনুভব করতে শুরু করি। যদি বলি, প্রচ- ভালো আছি, তবে আমাদের মস্তিষ্কও ইতিবাচক সাড়া দেয়। আমরা প্রাণশক্তি ফিরে পাই। ২য় অধ্যায় থেকে আমরা জেনেছি, আমরা তাই হতে পারি যা আমরা চাই।


কথা বলার সময় উজ্জীবিত ও প্রাণবন্ত থাকুন

আগামী এক মাস, এভাবে উত্তর দিন। কেউ যদি জিজ্ঞেস করে, কেমন আছেন, তবে প্রাণবন্ত উত্তর দিন। আপনি যেখানেই থাকুন, হোক তা অফিসে কিংবা দোকানের ক্যাশ কাউন্টারে। আপনি বলুন, আপনি অসাধারণ সময় পার করছেন বা দারুণ আছে। মুখে হাসি ফুটিয়ে রাখুন, চোখ উজ্জল রাখুন। এটা জরুরি না যে, আপনি তখন প্রচ- ভালো থাকুন বা না থাকুন। আপনি শুধু এটাকে আপনার জীবনের মূলনীতি বানিয়ে নিন। অন্যভাবে বললে, যদি আপনি ইতিবাচক মনোভাবের মানুষ হতে চান, এমন ভাবে জীবন অতিবাহিত করুন যেন আপনি ইতোমধ্যে ইতিবাচক কিছু পেয়ে গেছেন। আপনার কাক্সিক্ষত বস্তু আপনি খুব শীঘ্রই পেয়ে যাবেন। 

চিন্তার কোনো কারণ নেই। প্রথম প্রথম বলতে অস্বস্তি লাগতে পারে। লেগে থাকুন, অভ্যাস হয়ে যাবে। খুব শীঘ্র আপনি অনুভব করতে শুরু করবেন আপনি আসলেই ভালো সময় পার করছেন... অন্যরা আপনার সঙ্গ লাভ করতে চাইছে... ধীরে ধীরে সুসংবাদ আপনার দুয়ারে হানা দিবে।

যা হোক, কেমন আছেন আপনি?

আমি শুনতে পাচ্ছি আপনি বলছেন, অ-নে-ক-ভা-লো-আ-ছি!


 





অধ্যায় ৮


সমস্যাকে জিইয়ে রাখলে কমে না; বরং ডালপালা গজিয়ে ওঠে এবং বৃদ্ধি পায়।

- লেডি হল্যান্ড


অভিযোগ করা থেকে বিরত থাকুন


কেউ যখন আপনার কাছে তার সকল অভিযোগ-অনুযোগ পেশ করে আর অভিযোগের তীর আপনার দিকে নিক্ষেপ করে, তখন আপনার কেমন লাগে? আশা করি, খুব বেশি সুখকর অনুভূতি হয় না। সত্য হল, একজন অভিযোগকারীকে কেউ পছন্দ করে না। হয়তো যারা অভিযোগকারী তারাই কেবল একে অপরকে পছন্দ করে।

আমাদের প্রত্যেকেরই অভিযোগ-অনুযোগ আছে ও থাকবে। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হল, আপনি দৈনিক কতবার অভিযোগ করেন? হয়তো আপনি চিন্তা করছেন, আপনি দৈনিক কী পরিমাণ অভিযোগ করেন? খুব সহজেই আপনি তা বের করতে পারবেন। আপনি আপনার বন্ধু, আত্মীয় ও সহকর্মীদের জিজ্ঞাসা করুন। তারাই আপনাকে বলে দিবে।

আমার আলোচনাতে অভিযোগ তথা কমপ্লেইন বলতে সে সব অভিযোগ-অনুযোগ বোঝাচ্ছি না, যা সমাধান লাভের আশায় করা হয়। এটা অবশ্যই গঠনমূলক ও প্রশংসনীয়। আমার আলোচনাতে ঐ সব মুহূর্তও অন্তর্ভূক্ত নয় যখন আপনি আপনার জীবনের ভালো-খারাপ অভিজ্ঞতা আপনার পরিবার-পরিজন ও বন্ধু-বান্ধবের সাথে শেয়ার করেন আপনার জীবন বিনির্মাণের উপকরণ হিসাবে। তাছাড়া, অভিজ্ঞতা শেয়ার করা ও একে অপরকে সাহায্য করা আমাদের মানবিক হওয়াকে প্রকটিত করে।

 

কেউই আপনার দুঃখদুর্দশার গল্প শুনতে ইচ্ছুক নয়

নিজের প্রতি করুণা ও সমবেদনা এমন এক মহৌষধ যা সুখের ত্রুটিসমূহকে সারিয়ে তুলে।

- আর্ল নাইটিঙ্গেল


উদাহরণ দিলে বিষয়টা স্পষ্ট হবে যে, কোন ধরনের অভিযোগ সমাধানের পরিবর্তে বিপরীত ফলাফল নিয়ে আসে। অভিযোগের ক্ষেত্রে সাধারণত সর্বাধিক ব্যবহৃত বিষয় হল অসুস্থতা। অভিযোগের ধরন সাধারণত হয়ে থাকে, ‘আমার পিঠের ব্যথা আমাকে খুঁড়ে খুঁড়ে খাচ্ছে’ বা ‘আমার প্রচ- মাথাব্যথা আছে।’ অনেকেই আছেন তারা তাদের অসুস্থতা শৈল্পিক উপায়ে ব্যাখ্যা করেন। যেমন আমার গলা থেকে এই সবুজ বস্তুগুলো বেরিয়ে আসছে... আর আপনার সহকর্মী যদি বলে যে, সে বমি বমি বোধ করছে আপনার দিন কি ভালো যাবে?

আপনার পেটে যদি ব্যথা থাকে আমি আপনার জন্য কী বা করতে পারি? আমি কোন চিকিৎসক নই। শারীরিক সমস্যা হলে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হোন। তাছাড়া, আপনি কেন তা আমাকে বলছেন? খুব সম্ভবত আপনি আমার কাছে সহানুভূতি চাচ্ছেন। কিন্তু আপনি কি লক্ষ করেছেন এর মাধ্যমে আপনি আমাকে ছোট করছেন। অন্যদিকে নিজের ভোগান্তি বাড়াচ্ছেন। নিজের দুঃখদুর্দশার আলোচনা সমস্যাকে ঘনীভূত বৈ কিছু করে না। আর আশেপাশের মানুষগুলোকে দূরে ঠেলে দেয়।

অসুখের অভিযোগের কথাই ধরুন। এর প্রকৃতি হল এটি তার আলোচনাকে দীর্ঘ করে। কীভাবে? আপনি আপনার বন্ধুকে আপনার যন্ত্রণাদায়ক ইনফ্লুয়েঞ্জা বা অসুস্থতার কথা বর্ণনা করেন। আপনার বন্ধু আপনার কথা কেড়ে বলতে শুরু করে, ‘তুমি তো জান না! ভাইরাস জ্বরে আক্রান্ত হই, আমার শরীরের তাপমাত্রা ছিল ২০৪ ডিগ্রি। হাসপাতালে ছিলাম অনেক দিন। মনে হচ্ছিল মরেই যাব।’ বা অন্য কাউকে আপনার পিঠের বা পায়ের ব্যথা সম্পর্কে বলুন, আর দেখুন কত সেকেন্ড সময় লাগে আপনার কথা কেড়ে নিয়ে নিজের ব্যথা বা অসুস্থতার কথা বলা শুরু করতে। অভিযোগকারীরা এই গেম খেলতে অভ্যস্ত। তাদের সমস্যা ও যন্ত্রণা সবসময় আপনারগুলোর চেয়ে কয়েক গুণ বেশি।


অন্যকে আপনার কাজে ব্যত্যয় ঘটাতে দিবেন না

আরেকটি সাধারণত ব্যবহৃত অভিযোগের বিষয় হল আবহাওয়া। যখন বৃষ্টি পড়া আরম্ভ হয় মানুষ বলতে শুরু করে, কী বাজে ও দুর্বিসহ একটা দিন!। কেউ যখন আমার সামনে এভাবে তার বিরক্তি প্রকাশ করে আমি বলি, ‘বৃষ্টিস্নাত চারপাশ। কী চমৎকার একটি দিন!’ বৃষ্টির জন্য দিনকে বিরক্তিময় বলা প্রকারান্তরে নিজেকে খারাপ অবস্থায় বিজড়িত করা। অধিকন্তু, দোষারোপ করলে পরিস্থিতি পালটাবে না। তাই এমন সব অবস্থা যার ওপর হাত নেই এবং তা আপনার জীবনে গুরুত্বপূর্ণ কোনো প্রভাবও রাখে না সেগুলো নিয়ে পেরেশান হওয়ার কোনো মানে হয় না।

সর্বশেষ, অভিযোগের তুচ্ছ ও হাস্যকর একটি ধরন হল, ‘ওয়েটার আমার অর্ডার নিতে ৫ মিনিট দেরি করেছে’ বা ‘জনের অফিসের জানালা আমারটার চেয়ে বড়’। জীবন অনেক সময় আমাদের এমন কিছু কঠিন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন করে যা থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখতে আমরা তুচ্ছাতিতুচ্ছ সমস্যা নিয়ে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ি। যখন আপনি গুরুত্বহীন বস্তুগুলোকে বড় করে দেখেন, তখন যেন আপনি নিজেই আপনার ব্যক্তিগত সমস্যাকে দেখিয়ে দিচ্ছেন। যদি আমি আপনার বস হই বা দলের একজন সদস্য হই, আমি বুঝে পাচ্ছি না আপনার প্রতিক্রিয়া কেমন হতে পারে যখন আমাদের এর চেয়েও গুরুতর অথচ গুরুত্বপূর্ণ কোনো সমস্যায় নিপতিত হতে হয়!


তার অভিযোগ যৌক্তিক

সুখী জীবনের রহস্য হল যখন অন্যরা তাদের সমস্যা নিয়ে বসে আছে তখন আপনি আপনার জীবনের সুখের মুহূর্তগুলোর হিসাব করুন।

- উইলিয়াম পেন


সম্প্রতি আমি একটা কঠিন সময় পার করছিলাম। কোনোকিছুই আমার পরিকল্পনা অনুযায়ী হচ্ছিল না। অফিসে বসে বসে কেবল চিন্তা করি। বুঝতেই পারছেন, ব্যবসা-বাণিজ্যে যে সমস্যাগুলো সাধারণত হয়ে থাকে। প্রত্যাশিত কোনো কাজের ফলাফল দেখতে পাচ্ছিলাম না। আর বলতে দ্বিধা নেই, আমি এক আধটু অভিযোগ-অনুযোগ করছিলাম।

তারপর একদিন পেড্রু আমার ঘরে আসে। পেড্রুর বয়স বিশ বছর। ৬ বছর আগে সে হন্ডুরাস থেকে এখানে আসে। বাসা-বাড়ি ও অফিস পরিষ্কার করে এমন একটি সংস্থার অধীনে কাজ করে। আমি পূর্বে ইতিবাচক মনোভাবের মানুষের কথা বলেছিলাম। পেড্রু হল আমার দেখা সর্বাধিক ইতিবাচক মনোভাবের মানুষ। সদা হাস্যোজ্জ্বল ও প্রাণবন্ত।

সেদিন আমি পেড্রুর কাছে তাদের দেশে আঘাত হানা হ্যারিকেন মিচ এবং এর ক্ষয়-ক্ষতি সম্পর্কে জানতে চাই। মুহূর্তেই তার মুখের হাসি চলে যায়। উক্ত হ্যারিকেনের কারণে হওয়া ক্ষয়-ক্ষতির বর্ণনা করে। হাজার হাজার মানুষ মারা যায়। দশ লাখেরও বেশি মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়ে।

পেড্রু আরও বলে, তার মা-বাবা, ভাই এখনো হন্ডুরাসে বসবাস করে। সে জানে না তার পরিবার বেঁচে আছে নাকি মরে গেছে। তাদের সাথে যোগাযোগের কোনো মাধ্যম নেই। ঐ এলাকার সব ধরনের যোগাযোগ ব্যবস্থা নষ্ট হয়ে গেছে। পেড্রু প্রতিদিন তার পরিবার নিয়ে চিন্তা  করে।

আপনার পরিবার জীবিত আছে কিনা তা না জানার যন্ত্রণা কতটা গভীর তা কল্পনা করতে পারেন?

তারপর পেড্রু হন্ডুরাসের মানুষকে সাহায্য করার জন্য কী কী করছে তা বলতে আরম্ভ করে। সে মানুষের জন্য টাকা, কাপড়-চোপড় ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় বস্তু সংগ্রহ করছে। সে বিভিন্ন ত্রাণ সংস্থার সাথে কাজ করছে। শোকে মুহ্যমান হওয়ার পরিবর্তে সে তাদের দুর্দশা কিছুটা লাঘবে সাধ্যানুযায়ী যা পারছে করে যাচ্ছে।

পেড্রুর সাথে কথা বলার পর আমি অনুভব করলাম পেড্রুর সমস্যা বিবেচনায় আমার সমস্যা কতটা অবান্তর ছিল... এবং আমি কতটা ভাগ্যবান! বিশ্বাস করুন, আমি অভিযোগ করা ছেড়ে দিয়েছি। নব উদ্যমে আমার মন চাঙা হয়ে ওঠে এবং মন ভালো হয়ে যায়। ফলে বাকি দিনটা আমার ভালোই কাটে।

যাহোক, কিছুদিন পরে পেড্রুর সাথে আমার আবার দেখা হয়। মন কাড়া হাসি ও সজীবতা তার চেহারায় আগের মতো লেগেই আছে। সে সুসংবাদ দিল তার পরিবার এখনো বেঁচে আছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হল তারা বন্যায় সবকিছু হারিয়েছে এবং তারা এখন একটি আশ্রয়কেন্দ্রে বাস করে। বিশুদ্ধ পানির অভাব, সর্বত্র রোগের প্রাদুর্ভাব ইত্যাদি নানা সমস্যায় তারা জর্জরিত। নিজের সবকিছু হারানো এবং সে ক্ষত নিয়ে জীবন নতুনভাবে শুরু করা, বিশেষত এমন কঠিন অবস্থায় কতটা গভীর হতে পারে এ যন্ত্রণা আমার জানা নাই। আপনি জানেন কি?

কোনো সন্দেহ নেই, এ কষ্ট অনেক গভীর। পেড্রুর একশবার সুযোগ আছে তার পরিবারের দুর্দশায় বিষণœ ও ভারাক্রান্ত হওয়ার। কিন্তু সে হয়নি। সে জানে এ মুহূর্তে দুঃসময়ের অভিযোগ করা এবং ভারাক্রান্ত হয়ে থাকা সময় ও শক্তির অপচয়। পেড্রুকে অসংখ্য ধন্যবাদ, আমাদের মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য যে, অভিযোগ-অনুযোগ কিংবা হাহাকার জীবনের বিপরীত বা কঠিন সময়ের যথাযথ প্রতিক্রিয়া নয়।


ভিন্নভাবে মূল্যায়ন করতে শিখুন

আপনার বর্তমান সুখময় মুহূর্তগুলোকে অধিক গুরুত্ব দিন, যা প্রত্যেকের প্রচুর পরিমাণে রয়েছে। অতীতের দুর্ভাগ্য নিয়ে পড়ে থাকবেন না, যা প্রত্যেকের কিছু না কিছু থাকে।

- চার্লস ডিকেন্স


আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা যা পেড্রু আমাকে শিখিয়েছে তা হল বস্তু বা অবস্থাকে ভিন্নভাবে দেখতে শেখা। এ খুব গুরুত্বপূর্ণ। দীর্ঘদিন ধরে আমি লক্ষ্য করে আসছি যে, অভিযোগকারীরা ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করতে জানে না। তাদের প্রবণতা হল, তারা সমস্যাকে বাস্তবতার চেয়ে বড় করে দেখানোর চেষ্টা করে।

আশাবাদী মানুষ... চাঙা মনোভাবের মানুষ... তাদের প্রবণতা হল তারা জীবনে কোনো জিনিসটি সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ তা বোঝার ও উপলব্ধি করার চেষ্টা করে।

অভিধানে দৃষ্টিভঙ্গি তথা ঢ়বৎংঢ়বপঃরাব বলতে বোঝায় বস্তুকে তার সঠিক রূপে দেখার বা তার সাথে অন্যান্য বস্তুর প্রাসঙ্গিক সম্পর্ক বুঝতে পারার ক্ষমতা। আপনার বন্ধুদের মাঝে এমন কেউ আছে যে পরিস্থিতির কারণে বাতাসবিহীন টায়ারের চেয়ে বেশি বেঁকে যায়? বা তাদের কী খবর যারা বিবাহ অনুষ্ঠানে আসন-বিন্যাসকে কেন্দ্র করে পরিবারের সদস্যদের সাথে সম্পর্ক খারাপ করে? এটা স্পষ্ট যে, এ ধরনের মানুষের বস্তুর প্রাসঙ্গিক গুরুত্ব বা অন্যভাবে বললে কখন কাকে কতটুকু গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন সে সম্পর্কে অবগত নয়।

এক্ষেত্রে আমার মনে হয় এডি রিকেনবেকার আমাদেরকে ভালো শেখাতে পারবেন। প্রশান্ত মহাসাগরে হারিয়ে যাওয়ার পর রিকেনবেকার প্রায় ২১ দিন যাবৎ একটি ভেলায় ভেসে ছিল। তার ক্রমে বেঁচে থাকার আশা ফিকে হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে মৃত্যু থেকে বেঁচে গেল। উদ্ধার হওয়ার পর তার অভিব্যক্তি ছিল, ‘যদি আপনার পান করার জন্য যথেষ্ট পরিমাণে বিশুদ্ধ পানি ও প্রচুর পরিমাণে খাদ্য থাকে, তবে জীবনে অন্য কিছুর জন্য হাহাকার করা বা অভিযোগ করা মোটেও সমীচীন হবে না।’

জীবনে যা কিছুর জন্য আমি কৃতজ্ঞ তার কিছু আপনার সাথে বিনিময় করছি:

১। আমি সুস্থ আছি।

২। ডলোরিস সুস্থ আছে।

৩। আমাদের নিজের একটি বাড়ি আছে।

৪। আমাদের পর্যাপ্ত পরিমাণে খাওয়ার জন্য খাদ্য এবং পান করার জন্য বিশুদ্ধ পানি আছে।

৫। আমরা যুক্তরাষ্ট্রে স্বাধীনভাবে বসবাস করি। [পাঠক, আপনি বলতে পারেন, আমরা বাংলাদেশে স্বাধীনভাবে বসবাস করি।]

৬। আমি আমার কাজকে ভালোবাসি।

৭। আমি প্রায়ই ভ্রমণে বের হই এবং চমৎকার সব মানুষের সাথে সাক্ষাৎ করি।

৮। আমার কিছু বিশ্বস্ত বন্ধু আছে।

৯। আল্লাহর ইবাদাত আমাকে আলোড়িত করে এবং সজীব করে।

এগুলো আমার জীবনের যাবতীয় অনুগ্রহের খ- চিত্র। দুঃখের বিষয় হল আমি অনেক সময় কিছু অনুগ্রহকে গৌণ মনে করি। কিন্তু আমি আমার যাবতীয় অনুগ্রহ ও সুখের মুহূর্তগুলোকে উপভোগ করতে শিখে গেছি। এই অনুভূতি আমার মনোভাবকে চাঙা করে এবং জীবনযাত্রাকে গতিশীল করে।

তো, আপনার সেই সমস্যাটা কী যার জন্য আপনি অভিযোগ করছেন? তা কি আদৌ জীবন-মরণ কোনো সমস্যা? আরেকবার কখনো কোনো সমস্যা যদি আপনার গতিশীল চলার পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়, তবে একটি কলম ও কাগজ নিন, আর ওসব বিষয় লিখুন যার জন্য আপনি আল্লাহর প্রতি এবং আপনার জীবনের প্রতি কৃতজ্ঞ।

বিশ্বাস করুন আপনার অভিযোগ-অনুযোগ সব পালিয়ে যাবে। [আল্লাহই আপনার জন্য যথেষ্ট।]


যা কিছু কল্যাণকর তার উৎস হোন

আমি বলছি না যে, চেয়ারে গা এলিয়ে বসে থাকুন আর সব সমস্যাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিন। বরং আমি বলছি, হাহাকার বা অভিযোগ অনুযোগ করা বাদ দিয়ে আপনার মনোযোগ আর শক্তিকে সমস্যা সামাধানের পিছনে ব্যয় করুন বা নিদেনপক্ষে সমস্যার পরিধি কমিয়ে আনুন। যেমন ধরুন, আপনি কিছুটা ক্লান্তি বোধ করছেন। এখন সবাইকে– আপনি ক্লান্ত, আপনার খুব বাজে দিন পড়েছে এসব বলে না বেড়িয়ে, চেষ্টা করুন কীভাবে ক্লান্তি দূর করা যায়। নিয়মিত ব্যায়াম করুন বা আগে আগে ঘুমানোর অভ্যাস করুন।

পুনশ্চ অভিযোগ বা হাহাকার তিনভাবে আপনাকে আক্রান্ত করে। প্রথমত, কেউ আপনার অসুস্থতা বা সমস্যার দুঃসংবাদ শুনতে বসে নেই। দ্বিতীয়ত, অভিযোগ বা হাহাকার আপনার সমস্যাকে আরও ঘনীভূত করে এবং আপনাকে শোচনীয় করে। অতএব কেন বারবার অতীতের দুঃখ-যাতনার স্মৃতি রোমন্থন করতে থাকবেন? তৃতীয়ত, অভিযোগ-অনুযোগ আপনার কোনো কল্যাণ বয়ে আনবে না। অন্যদিকে সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য কোনো গঠনমূলক পদক্ষেপ গ্রহণে আপনার অন্তরায় হবে।

বলা হয়ে থাকে, ৯০ শতাংশ মানুষের আপনার সমস্যায় কিছু যায় আসে না। অন্যদিকে বাকি ১০ শতাংশ আপনাকে সমস্যাগ্রস্থ পেয়ে পৈশাচিক আনন্দ পায়! যদিও কাজটা কঠিন, কিন্তু আমরা চাইলেই অভিযোগ করা বা হাহাকার করা বন্ধ করে দিতে পারি। অতএব এখন থেকে, আমরা নিজের ও অন্যের প্রতি একটু করুণা করি। নিজেদের আলাপচারিতাকে হতাশাপূর্ণ না করে মুখর করে তুলি।

যারা খুব বেশি হাহাকার করে না (পাশাপাশি তারাও যারা খুবই ইতিবাচক মনোভাবের) তারা অত্যন্ত চমৎকার ও হাস্যেজ্জ্বল মানুষ। তাদের সাহচর্য গ্রহণ করুন। ফলত মানুষ আপনাকে দেখে না দেখার ভান করে অন্য পথ ধরবে না।

 





তৃতীয় ভাগ


আল্লাহ তাদের সাহায্য করে যারা কাজ করে



    


কোনোকিছুই নিজে নিজে হয় না। যদি কোন বস্তু লাভ করার দৃঢ় ঐকান্তিকতা ও স্বতঃস্ফূর্ত প্রচেষ্টার সম্মিলন ঘটে, তবেই তা লাভ করা যায়।

- বেন স্টেইন

  


 





অধ্যায় ৯


আয়নায় একজন মানুষের কেবল চেহারা দেখা যায়। কিন্তু ব্যক্তি মানুষটাকে দেখা যায় সে যে বন্ধুদের সাথে চলাফেরা করে তাদের দেখলে।

- বাইবেল, প্রোভার্বস ২৭


ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করে এমন লোকজনের সাথে চলাফেরা করুন


উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ওঠার পর মাইক তার প্রতিবেশী বন্ধুদের সাথে অনেক বেশি সময় কাটাত। মাইক যখন অতীতের কথা স্মরণ করত তখন বলত, তারা রাস্তার ওপর বসে থাকত এবং রাস্তা দিয়ে চলাচল করা গাড়িগুলো দেখেই সময় পার করত। তাদের না ছিল কোন লক্ষ্য, না ছিল কোন স্বপ্ন। তারা ছিল নেতিবাচক মনোভাবের মানুষ।

মাইক যদি বলত, তাদের কিছু একটা করা দরকার, সময়কে এভাবে নষ্ট হতে দেওয়া যায় না, তবে তারা তা উড়িয়ে দিত। তারা বলত, ‘এসব বোকামি! অথবা কোনো কাজের কাজ না!’ অনিচ্ছা সত্ত্বেও মাইক তাদের সঙ্গ লাভের জন্য তাদের সাথে থাকত।

বিদ্যালয়ের গ-ি পেরিয়ে মাইক যখন কলেজে ওঠে, তখনো সে কিছু খারাপ মানুষের সাথে চলাচল করে। তবে কলেজে এসে সে কিছু ভালো মানুষের সাহচর্যও গ্রহণ করে। এমন মানুষ যারা সবসময় নতুন কিছু শিখতে চায়... নতুন কিছু অর্জন করতে চায়। মাইক সিদ্ধান্ত নেয়, সে এ ধরনের লোকের সাথে সময় কাটাবে। এভাবে কয়েকদিন যেতে না যেতেই মাইক ভালো অনুভব করতে শুরু করল। তার জীবনবোধ ও মনোভাবের উন্নতি ঘটল। নতুন নতুন লক্ষ্য ঠিক করে কাজ করতে লাগল।

বলতে ভালো লাগছে, মাইকের এখন একটি ব্যবসা-সফল ভিডিও প্রোডাকশন কোম্পানি আছে এবং চমৎকার একটি পরিবার আছে। একে একে সে তার ঠিক করা প্রতিটি লক্ষ্য বাস্তবায়ন করে। আমি তার কাছে জানতে চাইলাম তার স্কুলের বন্ধুদের কী খবর। সে প্রতিউত্তরে বলল, ‘তারা এখনো সেখানেই থাকে। আগের মতো বেকার সময় পার করে। এখনো তারা তাদের জীবনের জন্য কিছু করার গরজ বোধ করে না!’

মাইক আরও বলে, ‘আমি যদি তাদের সঙ্গ না ছাড়তাম, তবে হয়তো আজকে এ অবস্থানে আসা সম্ভব হত না। হয়তো গলির এক কোণে আমিও তাদের মতো পিনবল খেলায় মত্ত থাকতাম এখন।’

মাইকের গল্প আমাদের জীবনে সঙ্গীর প্রভাব কত বেশি তা স্মরণ করিয়ে দেয়। তারপরও আমরা একদল খারাপ লোকের সঙ্গ বেছে নিই। আমরা এর অনিবার্য ফল কী হতে পারে তার চিন্তাও করি না।

একটি স্বতঃসিদ্ধ কথা আছে, ‘আপনি কাদের সাথে ঘুরে বেড়ান তা বলুন, আমি আপনাকে বলব আপনি কোন প্রকৃতির মানুষ।’ বাক্যটি ছোট কিন্তু তার অর্থ ব্যাপক। এক বাক্য অনেক কিছু বলে দেয়। কখনো চিন্তা করে দেখেছেন এই একটি নীতি বাক্য কীভাবে আপনার জীবনের আকৃতি-প্রকৃতি গড়ে দেয়?

উঠতি বয়সের কথা মনে করে দেখুন। মনে পড়ে, আমাদের মা-বাবা আমরা কাদের সাথে মিশি এ ব্যাপারে কী পরিমাণ পেরেশান ছিল? তারা আমাদের বন্ধুদের সাথে দেখা করতে চাইত এবং তাদের সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চাইত। কেন বলতে পারেন? কারণ তারা জানত, আমরা আমাদের বন্ধু-বান্ধবদের মাধ্যমে প্রবলভাবে প্রভাবিত হতে পারি... আমরা হয়তো তাদের কিছু স্বভাব গ্রহণ করে নিতে পারি... এবং হয়তো আমাদের বন্ধুরা যে কাজ করছে আমরাও ওসব কাজে লিপ্ত হতে পারি। তাদের পেরেশানি বা চিন্তা যৌক্তিক ছিল। আমি বাজি রাখতে পারি যে, আপনার যখন সন্তান-সন্ততি হবে আপনিও তাদের বন্ধুগুলোকে পর্যবেক্ষণে রাখবেন। কারণ এরাও আপনার সন্তানকে প্রভাবিত করতে পারে।


 

বিষাক্ত মনের মানুষ এবং উন্নত মনোভাবের মানুষ

আমরা প্রত্যেকে আমাদের চারপাশের চিন্তাভাবনার, আশা-নিরাশার ও উদ্দীপনা-আলস্যের অংশবিশেষ।

- অজানা বক্তা


বর্তমানে সাহিত্য জগতে দু’টা পরিভাষা খুবই প্রচলিত; বিষাক্ত মানুষ তথা ঃড়ীরপ ঢ়বড়ঢ়ষব এবং উন্নত মনোভাবের মানুষ তথা হড়ঁৎরংযরহম ঢ়ৎড়ঢ়ষব। বুঝতেই পারছেন, বিষাক্ত মানুষ তারা যারা নেতিবাচক পরিবেশের রাজ্যে বাস করে। অভিধানে ‘ঃড়ীরপ’ মানে বিষাক্ত। বিষাক্ত মানুষ তারা যাদের বাক্যবাণে বিষ মেশানো থাকে। অন্যদিকে ‘হড়ঁৎরংযরহম’ মানে কোনোকিছুর প্রবৃদ্ধিতে সাহায্য করা। উন্নত মনোভাবের মানুষ অবশ্যই ভালো স্বভাবের ও পরোপকারী হয়ে থাকে। তারা আপনাকে সাহস যোগাবে। মনোবল চাঙা করবে। এদের সঙ্গলাভ করা পরম আনন্দের।

বিষাক্ত মানুষ আপনাকে সবসময় নিচে নামাতে চাইবে। আপনি করতে পারেন না বা আপনার পক্ষে অসম্ভব এমন বিষয় নিয়ে তারা কথা বলবে। আপনার মাঝে নৈরাশ্য জাগানোর যত আয়োজন সব তারা করবে। ভঙ্গুর অর্থনীতির কথা বলবে, তাদের জীবনের সমস্যার কথা বলবে, আপনার জীবনের আশু সমস্যার কথা তুলে ধরবে, ভবিষ্যতের ভয়ঙ্কর সমস্যার গল্প করবে। মোদ্দাকথা আপনাকে হতাশ করে ছাড়বে। যদি প্রসন্ন কপালের অধিকারী হোন, তবে তারা তাদের দুঃখদুর্দশা নিয়েও কয়েকটা কথা বলবে।

তাদের কথা শোনার পর আপনি অবসন্ন ও হতাশা বোধ করতে শুরু করবেন। অনুপ্রেরণাদানকারী বক্তা তথা মোটিভেশনাল স্পিকার লেস ব্রাউন এ সকল লোককে ‘স্বপ্ন হত্যাকারী’ বলে অবহিত করেছেন। মনোবিজ্ঞানী জ্যাক ক্যানফিল্ড বলেছেন, ‘শক্তি নিঃশেষকারী’। কারণ তারা আপনার সকল ইতিবাচক শক্তিকে শুষে নেয়। কখনো খারাপ মানুষের পাল্লায় পড়েছিলেন? তার সাথে থেকে কি মনে হয়েছিল সে ব্যক্তি আপনার যাবতীয় শারীরিক শক্তি তার কবজায় নিয়ে নিচ্ছে? আমি মনে করি, আমাদের প্রত্যেকের কম-বেশি এরকম অভিজ্ঞতা আছে। একটি বিষয় খুবই নিশ্চিতভাবে বলা যায়, খারাপ লোকদের সময় দিতে শুরু করুন, তাদের খারাপ প্রভাব আপনাকে নিচে নামিয়ে ছাড়বে।

অন্যদিকে আপনি যখন ভালো, উৎসাহী ও উপকারী মানুষের সাহচর্যে থাকেন, তখন আপনার মনোভাব কেমন হয়? আপনার মনোবল বাড়ে এবং আত্মিক শক্তি বৃদ্ধি পায়। অত্যন্ত চমৎকার ও জাদুকরী কিছু আছে যা তাদের মাঝে কাজ করে। তাদের ইতিবাচক ও কার্যকরী শক্তি একটি ঘরকে আলোকিত করতে সক্ষম। যখন আপনি তাদের মাঝে থাকেন, আপনি তাদের মনোভাব ও দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করতে শুরু করেন। আপনার মনে হতে থাকে, লক্ষ্য পূরণে আপনি এক অসাধারণ শক্তি লাভ করেছেন।

যখন আমি প্রাণবন্ত মানুষের কথা ভাবি তখন সর্বাগ্রে জন লিসিচ্ছির কথা মাথায় আসে। প্রতিবার তার সাথে কথা বলার পর মনে হয়, এই বুঝি পৃথিবীটা জয় করে ফেললাম! জন হল আমার দেখা সর্বাধিক প্রাণবন্ত ব্যক্তি।

আমি নিজেকে খুবই ইতিবাচক ও প্রাণবন্ত মনের মানুষ ভাবতে চাই। ১০ এর স্কেলে, আমি নিজেকে ৯.৫ দিব। জন লিসিচ্ছিকে অবশ্য ১৪ দিতে হবে। সে সবসময় কয়েকে ধাপ এগিয়ে থাকে। সে সবসময় ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করে। সর্বদা উদ্যমী ও প্রাণবন্ত। তার মনোভাব মানুষকে বড় কিছু করতে উদ্বুদ্ধ করে।

কল্পনা করতে পারেন আপনার জীবনে জনের মতো একজন বন্ধু থাকলে, জীবন কতটা এগিয়ে যাবে?


রেডিও’র অর্থহীন গান

আপনার বন্ধুবান্ধব আপনার দূরদৃষ্টিকে প্রসারিত করবে অথবা আপনার স্বপ্নকে গলাটিপে হত্যা করবে।

- অজানা বক্তা


আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি আপনার জীবনেও এমনটা ঘটে থাকে। রেডিওতে আপনি একটি গান শুনলেন। গান শুনে আপনার অভিব্যক্তি হয়, কী হাস্যকর একটি গান! কিন্তু কিছু সময় যাওয়ার পর আবার আপনি সেই একই গান শোনা শুরু করেন। পরদিন, একই গান আপনি একাধিকবার শোনেন। গানটি আপনার প্রিয় গানের তালিকার উপরে চলে আসে। আপনি না শুনে থাকতে পারেন না। প্রতিদিন কয়েকবার করে আপনি এই গান শোনেন।

তারপর অদ্ভুত এক স্বভাব আপনাকে পেয়ে বসে। আপনি বাসায় বসে আছেন এবং হঠাৎ করে সেই ফালতু গানটি গুনগুন করে গাইতে থাকেন। ঐ সময় যদি আমি আপনাকে জিজ্ঞাসা করি, গানটি কেমন? তবে আপনি উত্তর দিবেন, জঘন্য একটি গান! তারপরও কেন আপনি বারবার গানটি শোনেন? বাস্তবতা হল, যা কিছু আপনি বারবার শুনবেন তা আপনার মস্তিষ্কের ও চিন্তাভাবনার সর্বাগ্রে থাকবে।

গানটির জনপ্রিয়তা আস্তে আস্তে কমে যায়... রেডিওতেও গানটি আর তেমন বাজানো হয় না... আপনিও গানটি গুনগুন করা বা গাওয়া কমিয়ে দেন। একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা এখান থেকে আমরা পাই। মস্তিষ্ক সেসবের প্রতি বেশি সাড়া দেয় যা বারবার তাকে আলোড়িত করে। দূর্ভাগ্যক্রমে মস্তিষ্ক কোন বক্তব্যটি ভালো আর কোনটি খারাপ তার মাঝে পার্থক্য করতে পারে না। যদি আমরা কোনোকিছু প্রায়শ শুনতে থাকি আমরা তা খুব সহজে বিশ্বাস করে নিই এবং সে বিশ্বাস মতে কাজ করি। তাই যেভাবে একটি গান ক্রমাগত শোনার কারণে সেই গান নিয়ে চিন্তা করি, সেভাবে সফলতার অব্যাহত চিন্তা আমাদের সাফল্যের চিন্তা করতে বাধ্য করবে।

অতএব যদি আমরা আমাদের মস্তিষ্ককে সর্বদা ইতিবাচক ও কল্যাণকর বার্তা দিতে পারি, তবে আমাদের ধ্যানধারণা ইতিবাচক হবে এবং আমাদের অভীষ্ট লক্ষ্য পূরণের পথ মসৃণ হবে। যত বেশি ভালো মনোভাবকে শক্তিশালী করা হবে তত বেশি তা কল্যাণকর। কীভাবে আমরা ইতিবাচক মনভাবের মাত্রা বাড়াতে পারি? একটি পদ্ধতি হল অনুপ্রেরণামূলক বই পড়া। শুভেচ্ছা আপনাকে! কারণ সে কাজটাই আপনি এখন করছেন! তাছাড়া, অনুপ্রেরণামূলক বক্তব্যও আমরা শুনতে পারি এবং ভালো মনের মানুষের সাথে অনেক বেশি সময় কাটাতে পারি।


স্মোকির স্পঞ্জ তত্ত্ব

আমি ইতিবাচক মনোভাব অর্জন এবং ভালো মনের মানুষের সাথে সময় কাটানোর গুণ অর্জন করেছি আমার বন্ধু গ্লিন ‘স্মোকি’ স্টোভারের কাছ থেকে। স্মোকি গোরস্থান ও শেষকৃত্যের রসদ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানে দীর্ঘ ৪৫ বছর চাকরি করে। এখানে কাজ করলে একজন মানুষ এমনিতেই মনমরা হয়ে যাবে। কিন্তু আপনার জ্ঞাতার্থে বলে রাখছি, স্মোকি ইতিবাচক প্রেরণার এক বৃহৎ উৎস। যতবার আমার স্মোকির সাথে ফোনে কথা হয় আমার অনুপ্রেরণার মাত্রা আকাশচুম্বী হয়।

স্মোকি আমাকে বোঝাল যে, মানব সম্প্রদায় স্পঞ্জের মতো। আমরা আমাদের চারপাশের মানুষ যা বলে তা শুষে নিই। তাই, যদি আমরা খারাপ মানুষের সাথে সময় ব্যয় করি, তবে আমরা খারাপ আচার-ব্যবহারগুলো শুষে নিই এবং আমাদের মন-মানসিকতা প্রভাবিত হয়। এর বিপরীত তত্ত্বও সত্য। যদি আমরা ভালো মনের মানুষের সংশ্রব বেছে নিই, তবে আমরা তাদের ভালো দিকগুলো দ্বারা প্রভাবিত হবো। আমরা ভালো বোধ করতে শুরু করি... এবং ভালো কিছু করার প্রেরণা লাভ করি।

আমি একবার স্মোকির কাছে জানতে চাইলাম, ‘যদি তুমি একজন খারাপ মন-মানসিকতার মানুষের সাথে কথা বল তবে তুমি কী কর?’

সে জানাল, ‘আমি যত দ্রুত সম্ভব তার থেকে মুক্তি পাওয়ার চেষ্টা করি। অনেকটা বলি এরকম, ‘হেই চার্লি, তোমার সাথে দেখা হয়ে ভালোই লাগল।’ এরপর আমি অন্যজনের সাথে কথা বলা আরম্ভ করে দিই।’

তারপর আমি আবার স্মোকিকে প্রশ্ন করি, ‘তোমার কি কখনো কোন খারাপ বন্ধু ছিল?’

সে বলল, ‘ছিল। তবে দীর্ঘসময় ছিল না।’

বেশ ভালো, স্মোকি!


আপনার বন্ধুত্বকে নিয়মিত পরিমাপ করুন

আপনার চারপাশের বস্তু ও পরিবেশ আপনাকে সাফল্যের দিকে নিয়ে যাচ্ছে নাকি পিছন থেকে প্রবলভাবে টেনে ধরছে?

- ডব্লিউ. ক্লেমেন্ট স্টোন


এটা অত্যন্ত দরকারি যে, সময়ে সময়ে মানুষের সাথে আপনার বন্ধুত্বকে মেপে দেখা। এমনকি ওসব ব্যক্তি যাদের সাথে আপনার দীর্ঘ সময়ের বন্ধুত্ব রয়েছে তাদের ব্যাপারও পূনর্বিবেচনা করুন। এটা কোনো তুচ্ছ বিষয় নয়। যারা আপনার থেকে সময় নেয় তাদের আপনার সর্বোৎকৃষ্ট বস্তু ‘মস্তিষ্কের’ ওপর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রয়েছে।

আপনি কি খারাপ বন্ধু বেষ্টিত হয়ে আছেন? তাদের সাথেই কি দীর্ঘসময় ব্যয় করেন? সেরকম যদি হয়, আপনার কাছে অনুরোধ থাকবে, তাদের সাথে সময় কাটানো কমিয়ে দিন বা তাদেরকে মোটেও সময় দিবেন না।

খুবই রূঢ় শোনাচ্ছে, তাই না? যেহেতু আমি এমন কিছু বন্ধুর সাথে সময় দেওয়া কমিয়ে দিতে বা একেবারে না দিতে বলছি যারা দীর্ঘসময় ধরে আপনার জীবনে জুড়ে আছে। কোন সেমিনারে আমি সম্পর্ক পূনর্বিবেচনার কথা বললে, শ্রোতাদের মধ্য থেকে একজন হাত উঁচিয়ে বলে ওঠে, ‘আপনি খুব কঠিন কথা বলছেন।’ শ্রোতারা সাধারণত বলে থাকে, ‘খারাপ বন্ধুদের সাথে সম্পর্ক ছেদ না করে আমাদের কি তাদের আত্মোন্নয়নে সাহায্য করা উচিৎ নয়?’

যাহোক, যেটা আপনার ভালো মনে হয় তাই করুন এবং অবশ্যই প্রতিটি অবস্থা তার ধরন অনুযায়ী মোকাবিলা করতে হবে। তবে অভিজ্ঞতার আলোকে বলা যায়, অধিকাংশ সময় আপনার সঙ্গ আপনার খারাপ বন্ধুর কোনো কাজে আসে না এবং আপনারও কোনো লাভ হয় না। তারা নিজেই নিজের ক্ষতি বাড়ায় কারণ তারা তাদের অবস্থার পরিবর্তন করতেই চায় না। তারা শুধু চায়, তাদের দুঃখ-দুর্দশার গল্প শোনার জন্য কিছু মানুষ।

যদি আপনার ভেতরের প্রবল কোন শক্তি আপনাকে খারাপ বন্ধুদের দিকে তাড়িত করে, তবে নিজেকে প্রশ্ন করুন, ‘কেন আপনি তাদের সাথে মিশতে চাচ্ছেন?’ সচেতনভাবে বা অবচেতনভাবে, হয়তো আপনি চাচ্ছেন ফিরে আসতে– তবে এই আবেদন নিতান্তই দুর্বল।

প্রসঙ্গক্রমে, আমি মনে করি, কাউকে তার মন্দ গুণ ও স্বভাব থেকে বের হয়ে আসতে সাহায্য করা অত্যন্ত চমৎকার একটি কাজ। কিন্তু যদি আপনার এই প্রচেষ্টা কয়েক বছর ধরেই চলমান... সাফল্যের কোনো আশাও দেখতে পাচ্ছেন না... তবে মনে হয়, এই প্রচেষ্টা বাদ দিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়া উচিত।

একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় স্পষ্ট করা জরুরি। আমি সিদ্ধান্ত জানাচ্ছি না যে, নেতিবাচক বা খারাপ মনোভাবের মানুষ অন্যদের চেয়ে বেশি মূল্যহীন। বরং আমি বলছি, খারাপ মনোভাবের মানুষের সাথে সময় দেওয়ার কারণে নানা পরিণতি বরণ করতে হবে। কেমন পরিণতি? আপনি যতটুকু সুখী হতে পারতেন বা সফল হতেন তারচেয়ে কম সুখী ও সফল হবেন।


বিষাক্ত মনের আত্মীয়

যদি আপনার বিষাক্ত মনের কোনো আত্মীয় থাকে, তবে আপনি কী করবেন? এটা সত্য যে, বিষয়টি খুবই স্পর্শকাতর। আমার পরামর্শ হল, আপনার পরিবারের সদস্যদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিবেন না। পারিবারিক বন্ধন খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও প্রয়োজনীয়। আমি মনে করি আমাদের প্রত্যেকের পারিবারিক সম্প্রীতি বৃদ্ধিতে ও সংরক্ষণে সর্বাত্মক চেষ্টা করা উচিত।

এতদসত্ত্বেও আমি বলব, সময়ে সময়ে আপনার বিষাক্ত আত্মীয়দের ওপর কিছুটা নিয়ন্ত্রণ রাখবেন। আপনি তাদেরকে ত্যাগ করছেন না বা তাদের সাথে কথা বলা বন্ধ করছেন না; বরং তাদের সাথে সম্পর্ক কিছুটা সীমিত করে দিচ্ছেন।

যেমন যদি আপনার নেতিবাচক মনোভাবের কোন আত্মীয় থাকে এবং আপনি জানেন যে, তারা আপনার সমালোচনা করে, আপনাকে অপমান করে, তবে দিনে কয়েকবার করে তাদের ফোন করা থেকে বিরত থাকুন। এর সুফল কী হবে? আপনি হয়তো লক্ষ্য করেছেন, প্রতিদিন আমরা রেডিও কিংবা টিভি চালু করার পর বা পত্রিকার পাতা উল্টানোর পর সব ধরনের খারাপ সংবাদের কারণে ভারাক্রান্ত হই। আপনার কি মনে হয়, আত্মীয়-স্বজনের ফোন করে আমাদের আরও বেশি বেদনাগ্রস্থ করে দেওয়া উচিত? আমার মনে হয় না!

আরেকটি পরামর্শ যা আত্মীয়, বন্ধু কিংবা অপরিচিত যে কারও ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। তা হল, অন্য কেউ যখন খারাপ বা নেতিবাচক বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে চায়, তাকে থামিয়ে দিন। তাকে কথা বলার সুযোগ দিয়ে নিজেকে অভিযুক্ত করা থেকে বিরত থাকুন। খারাপ প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে। আপনার কাজ হল প্রসঙ্গ পরিবর্তন করা। ভালো কিছুর আলোচনা করুন।

ভুল বুঝবেন না। আমি বলছি না আপনি আত্মীয়দের সাথে সম্পর্ক ছেদ করুন বা বলছি না পারিবারিক অনুষ্ঠানে যাওয়া বাদ দিন। বরং যা চাচ্ছি তা হল, খারাপ মনের আত্মীয়দের সাথে যোগাযোগ কমিয়ে দিন। ফলশ্রুতিতে আপনাকেও ছোট হতে হবে না।


কর্মক্ষেত্রে ইতিবাচক সহকর্মী

ইতিবাচক মনোভাবসম্পন্ন বন্ধুবান্ধব আপনার স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী।

- ড. আরভিন সারাসন


প্রতিটি সংস্থায় কিছু না কিছু নেতিবাচক মনোভাবের মানুষ থাকে। হয়তো আপনার কাজের স্বার্থে তাদের সাথে ভাবের আদান প্রদান করতে হয় কিংবা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করতে হয়। কিন্তু সাবধান! এসব বিষাদ ও সর্বনাশের দূতের সাথে প্রয়োজনের বেশি খাতির জমাবেন না।

উদাহরণস্বরূপ, যদি আপনি নিয়মিত তাদের সাথে মধ্যাহ্নভোজ করেন, তবে তা কমিয়ে দিন বা বাদ দিন! তারা ক্রমশ আপনার মস্তিষ্ককে বিষাক্ত করে ছাড়বে। যদি তারা আপনার মস্তিষ্কে তাদের বিষাক্ত বর্জ্য ভর্তি করতে থাকে, তবে আপনি আপনার কাজে নিজের সেরাটা দিতে পারবেন না। তাদের প্রতি বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখানো বা তাদের সরাসরি না করা যাবে না। বরং কৌশলী পন্থায় তাদের এড়িয়ে চলুন। কাজের মাত্রা বাড়িয়ে দিন। ব্যস্ততা দেখান। কাজকে অজুহাত হিসাবে ব্যবহার করে ডেস্কে আহার করুন... ক্লায়েন্টের সাথে আহার করতে হবে অজুহাত দিন... বা ক্যাফেটেরিয়ায় ভিন্ন একটি টেবিল গ্রহণ করুন। আপনার বুদ্ধিতে যা পারেন করুন, তবু আপনার আহারকাল ইতিবাচক অভিজ্ঞতাপূর্ণ করুন।

এ ব্যাপারে কোনো ভুল করবেন না। ভালো মনের মানুষ যে কোনো সংস্থার জন্য আশীর্বাদ... অন্যদিকে মন্দ মনোভাবের মানুষ অগ্রগতির পথে প্রতিবন্ধক। নিচু মনোভাবের কর্মীদের সমস্যা এতটাই প্রকট আকার ধারণ করেছে যে, আমি সম্প্রতি দিনব্যাপী সেমিনারের একটি ইমেইল পেয়েছি, যার বিষয়: ‘কীভাবে মনোভাবজনিত সমস্যাগ্রস্থ কর্মকর্তাদের আইনানুগ পন্থায় বরখাস্ত করতে হয়!

উৎপাদনমুখীতা ও অগ্রগতি প্রশ্নে বর্তমানে সকল বণিক সম্প্রদায় ঐকমত্য পোষণ করেছেন যে, মনোভাবের ওপর সবকিছু নির্ভর করে!


বন্ধু নির্বাচনে বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিন

যেমনটা আমি আলোচনার শুরুতেই বলেছি, আপনি কার সাথে ঘুরে বেড়ান তা বলুন, আমি আপনাকে বলব আপনি কোন প্রকৃতির মানুষ। যদি আপনি কর্মক্ষেত্রে পদোন্নতি অর্জনের ব্যপারে আন্তরিক হোন... নিজের ব্যবসায় সাফল্য চান... বা একজন মানুষ হিসাবে নিজের উন্নতি কামনা করেন, তবে এমন সব মানুষের সাথে চলাফেরা করুন যারা আপনাকে আপনার কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে নিয়ে যাবে।

প্রাণবন্ত ও ভালো মানুষের সাথে চলাফেরা বাড়িয়ে দিন। লক্ষ্য পানে ছুটতে নতুন প্রেরণা পাবেন। মনে সতেজ ভাব বিরাজ করবে। আপনি একজন ইতিবাচক ও ভালো মনের মানুষে পরিণত হবেন– এমন মানুষ যাকে অন্যরা তাদের পাশে দেখতে চায়। আমি আগে কোনোরকমভাবে চিন্তা করতাম ভালো মনের মানুষের সাথে থাকা গুরুত্বপূর্ণ এবং মন্দ মনোভাব ও স্বভাবের মানুষকে পরিহার করা উচিত। কিন্তু এখন আমি বিশ্বাস করি, যদি আপনি জীবনে সর্বোচ্চ সাফল্য চান, একজন সুখী ও প্রাণবন্ত মানুষ হতে চান, তবে ভালো মনের মানুষের সংশ্রবের বিকল্প নেই।

তাই, ভালো মনোভাব ও স্বভাবের মানুষকে, উৎসাহী ও অনুপ্রেরণাদানকারী মানুষকে কাছে টানুন। তারাই আপনাকে সাফল্যের পথে সাহায্য করবে।


 





অধ্যায় ১০


তাই করুন যা করতে ভয় পান। আপনার সামনে থেকে ভয় লেজ গুটিয়ে পালাবে।

- রালফ ওয়াল্ডো এমারসন


ভয়কে মোকাবিলা করে উন্নতি লাভ করুন


গিল এগলস, অনুপ্রেরণাদানকারী বক্তা, একবার অসাধারণ একটি কথা বলেন। আমি ছিলাম দর্শকের সারিতে। তার বক্তব্য শুনছিলাম। অত্যন্ত মূল্যবান কথা বলেছিলেন তিনি। সবগুলোই হৃদয়ে গিয়ে ঠেকে। তবে একটি বাক্য ছিল স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখার মতো। তা হল, যদি তুমি সত্যিই সফল হতে চাও, তবে অস্বস্তিকর অবস্থায় পড়ার মানসিকতা তোমার থাকতেই হবে।

এই বাক্যটি কখনো ভুলে যাওয়ার মতো নয়। গিলের কথা ঠিক। যদি গন্তব্যে পৌঁছাতে চান, নিজের যোগ্যতাকে কাজে লাগাতে চান, তবে আপনাকে অবশ্যই অনাকাক্সিক্ষত অবস্থায় পড়ার মানসিকতা রাখতে হবে। এমন কাজ করতে হবে যা করতে ভয় পান। তবেই আপনি নিজের যোগ্যতাকে শাণিত করতে পারবেন!

খুবই সহজ, তাই না? অথচ মানুষ ভীতিকর অবস্থায় পড়লে বা নতুন কোনো কাজ করতে গেলে কী করে? ভয়ের কারণে তারা পিছপা হয়। তারা এগিয়ে যাওয়ার কোন পদক্ষেপই নেই না। আমি ভালো করেই জানি... কারণ আমি আমার জীবনের প্রথম ত্রিশ বছর এ কাজই করতাম। নিঃসঙ্কোচে বলতে পারি, এ এক ধরনের পরাজিত মানসিকতা। হার মানা কৌশল।

আমাকে একজন সফল ব্যক্তি দেখান, আমি আপনাকে এমন কাউকে দেখাব যে ভয়কে পাত্তা না দিয়ে কাজে নেমে পড়ছে।

 

ভয়ের স্বরূপ উন্মোচন

জীবনে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। পরিস্থিতিগুলোকে শুধু বুঝে নিতে হয়।

- মেরি কিউরি


কখনো নতুন কোনো কাজ করার প্রাক্কালে ভয় পেয়েছিলেন বা ঘাবড়ে গিয়েছিলেন? সেই ভয়ে কি কাজই করতে পারেননি? আমি নিশ্চিত আপনি জীবনে কখনো কখনো নতুন কাজ করতে গিয়ে ঘাবড়ে গিয়েছিলেন এবং অসাড় হয়ে গিয়েছিলেন। আমিও এর ব্যতিক্রম নই। এমন হওয়া খুবই স্বাভাবিক। মানুষ মাত্রই এমন।

এটাও সত্য যে ভয়ের মাত্রা ব্যক্তিভেদে ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। কারও কাছে যা যমদূতের ভয়, তা অন্যের কাছে ছেলেখেলাও হতে পারে। যেমন কারও কাছে মানুষের সামনে কথা বলা ভীতিকর, তো কারও কাছে নতুন ব্যবসায় হাত দেওয়া ভীতিকর। আবার অনেকেই কারও কাছে দিকনির্দেশনা চাইতেও ভয় পায়... কেউ বান্ধরীর সাথে ঘুরতে যেতে ভয় পায়। আপনার ভয়কে তুচ্ছ বা অর্থহীন যাই মনে করুন, এই আলোচনা আপনার কাজে আসবে।

যখন আমি ভয়ের কথা বলি, আমি সেসব পরিস্থিতির কথা বুঝাই না, যা আপনাকে ক্ষতিগ্রস্থ করে বা আপনার স্বাস্থ্যের জন্য অকল্যাণ ঢেকে আনে। যেমন খাঁড়া পাহাড় থেকে লাফিয়ে পড়া, অনেক উঁচু থেকে লাফ দেওয়া কিংবা বাঞ্জি জাম্পিং। এগুলো অত্যন্ত ভীতিকর। আমি নিজেই ভয় পাই এবং এসব করতে যাওয়ার ইচ্ছা আমার নেই। আমি এখানে সেসব ভয়ের কথা বলছি যা আপনার ব্যক্তিগত ও ক্যারিয়ারের পথে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়। এগুলো সে সব বস্তু যা আপনাকে ভয় পাইয়ে দেয়, কিন্তু আপনি জানেন, জীবনে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে এগুলো অতীব প্রয়োজন।


স্বস্তিদায়ক বলয় তথা কমফোর্ট জোন

যখন আপনাকে ভয় ও উদ্বেগ গ্রাস করে, তখন আপনি মূলত আপনার জন্য স্বস্তিদায়ক বলয় থেকে বেরিয়ে যান। একটু বিশদভাবে এই বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করা যাক। পাশাপাশি আপনার সাফল্য ও সুপ্ত যোগ্যতার বিকাশে কতটুকু প্রাসঙ্গিক তাও তুলে ধরা হবে।

আমাদের প্রত্যেকের একটি স্বস্তিদায়ক বলয় থাকে। এ হচ্ছে আমাদের আচার-ব্যবহারের একটি সুপরিচিত চৌহদ্দি। যতক্ষণ আমরা এই সীমানার ভেতরে থাকি আমরা নিরাপদ ও স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। নিচের বৃত্তকে আপনার স্বস্তিদায়ক বলয় মনে করুন।


 


বৃত্তের মধ্যকার পরিস্থিতি ও কার্যকলাপ আপনার কাছে পরিচিত এবং আপনার জন্য ভীতি সৃষ্টিকারী নয়। এগুলো আপনার নিত্যকর্ম ও দৈনন্দিন জীবনের অংশ। এমন কাজ যা আপনি গলদঘর্ম না হয়ে করতে পারেন। এ সকল কাজের মধ্যে আছে বন্ধু বা সহকর্মীদের সাথে কথা বলা, অফিসে নিয়মতান্ত্রিক কাজ সম্পাদন ইত্যাদি।

অন্যদিকে, বৃত্তের বাইরের কিছু কঠিন কাজের সম্মুখীন আপনাকে প্রায়শ হতে হয়। ঐ কাজগুলোকে ডায়াগ্রামে ‘ক’ সংকেত দিয়ে প্রকাশ করা হয়েছে। যা তুলনামূলক কম ভীতিকর তা বৃত্তের কিছুটা নিকটে। অন্যদিকে বেশি ভীতিকরগুলো অন্যটির চেয়ে কিছুটা দূরে। বেশি ভীতিকর শ্রেণীর কাজগুলোই আপনাকে ভয়ার্ত করে তুলে।

স্বস্তিকদায়ক বলয় তথা কমফোর্ট জোনের বাইরের কাজসমূহ যখন আপনার সামনে আসে, আপনি ঘাবড়ে যান। আপনার হাতের তালু ঘর্মাক্ত হয়। আপনার হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়। আপনি তখন নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করেন:

কাজটি কি করতে পারব?

অন্যরা হাসবে না তো?

বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয় স্বজনগণ কী বলবে?

উপরের ডায়াগ্রামটি আপনার ব্যাপারে কী বলে? ‘ক’ বর্ণটি আপনার কোন ভয়কে নির্দেশ করে। অন্যভাবে, কোন ধরনের ভয় আপনাকে আপনার সাফল্যের পরবর্তী ধাপে পৌঁছাতে বাধা দিচ্ছে?

নতুন কোনো সম্ভাবনার দিকে এগিয়ে যাওয়ার ভয়?

ক্যারিয়ার পরিবর্তন করার ভয়?

নতুন কোনো কাজ শেখার ভয়?

কলেজ তথা শিক্ষাজীবনে ফিরে যাওয়ার ভয়?

বা নিজের চিন্তাভাবনাগুলো অন্যকে বলার ভয়?

নাকি মানুষের সামনে কথা বলার ভয়?

‘ক’ সংকেত আপনার যে ধরনের ভয়কেই নির্দেশ করুক, রাখঢাক না রেখে তা স্বীকার করুন এবং মেনে নিন। আমার ধারণা হাজার হাজার মানুষ আপনার মতো একই জিনিসের ভয়ে ভীত। চলুন, যা অধিকাংশ মানুষ ভয় পায় তা বিশ্লেষণ করে দেখা যাক।


ভয়ের সর্বাধিক সাধারণ কারণসমূহ

অনেক অনুষ্ঠানে আমি বক্তব্য দেওয়ার আগে শ্রোতাদের মাঝে একটি কার্ড বিলি করি। তাদেরকে এতে পেশাগত ও ব্যক্তিগত জীবনে উন্নতির প্রতিবন্ধক ভয়ের কারণসমূহকে লিখতে বলি। তারপর আমি কার্ডগুলো সংগ্রহ করে তাদের সামনে পাঠ করি।

আপনার কী ধারণা? তারা এতে কী লেখে? অধিকাংশ শ্রোতা একই উত্তর দেয়। পেশা ও স্থান নির্বিশেষে তাদের সবার সমস্যা একই। নি¤েœ খুবই সাধারণ কিছু ভয় তুলে ধরা হল:

১. বক্তব্য দেওয়া বা প্রেজেন্টেশন দেওয়া। প্রায় প্রতিটি দলের জন্য এ এক নম্বর ভয়। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ জনসম্মুখে কথা বলতে ভয় পায়।

২. ‘না’ শোনার ভয় কিংবা তাদের আইডিয়া অগ্রাহ্য বা প্রত্যাখ্যান হওয়ার ভয়। এই উত্তরটি বিক্রয় প্রতিনিধিদের কাছ থেকে পাওয়া। বিশেষত যারা স্বেচ্ছায় ও যেচে গিয়ে পণ্য বিক্রি করে।

৩. পেশা পরিবর্তন বা নিজের নতুন ব্যবসা শুরু করা। কয়েক বছর ধরে আমি লক্ষ্য করছি যে, অনেক মানুষ এই ভয়ে আক্রান্ত এবং সংখ্যাটা দিনদিন বড় হচ্ছে। বর্তমান কর্পোরেট আমেরিকায় উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নির্জীব প্রাণ কর্মী রয়েছে। তারা আরও বেশি সন্তোষজনক কর্মক্ষেত্র চায়... কিন্তু তারা এ ব্যাপারে কিছু করতে ভয় পায়।

৪. ব্যবস্থাপক বা নির্বাহী কর্মকর্তাকে দুঃসংবাদে দেওয়া (যা তারা শুনতে চায় না)। এর কী আর ব্যাখ্যা দেওয়ার দরকার আছে। আশা করি, আপনি নিজেই তা বুঝতে পারছেন।

৫. ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলা। অনেক সাধারণ শ্রেণির কর্মকর্তা-কর্মচারী, এমনকি ব্যবস্থাপকও কোম্পানির মালিক বা নির্বাহী প্রধানের সাথে কথা বলতে ভয় পায়। এমনকি তারা সভাপতি বা প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার সাথে দু’একটা বাক্য বিনিময় করতেও ভয় পায়। তারা ভয় পায় পাছে কোনো অসংলগ্ন কথা না বলে ফেলে!

৬. ব্যর্থতার ভয়। অনেকেই আছেন যারা নতুন কোনো কাজ করার সাহস করতে পারে না। তাদের ভয় হল তারা ব্যর্থ হতে পারে। (এই বিষয়ে আমরা একাদশ অধ্যায়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।)

যাহোক, উপরে বর্ণিত পয়েন্টসমূহের কোনটায় কি আপনি বিষ্মিত হয়েছেন? বা এদের কোনটায় কি আপনি ভুগছেন? বা অতীতে কি এমন কোন ভীতি ছিল? সত্য হল, অধিকাংশ মানুষ তাদের জীবনের কোনো না কোনো সময় এ সকল ভয়ের সম্মুখীন হয়।

আপনি সম্মুখীন হয়েছেন বা হচ্ছেন এমন কোনো ভয় যদি উক্ত তালিকায় না থাকে, তবে চিন্তার কোনো কারণ নেই। আপনি আপনার ভয়ের চেয়ে বেশি শক্তিশালী... এবং একে জয় করতে পারবেন।


ভয় থেকে পালিয়ে বেড়ানো

উদ্বেগজনক পরিস্থিতিতে অধিকাংশ মানুষ ভয় পেয়ে পশ্চাদপসরণ করে। আমিও একসময় তাই করতাম। এড়িয়ে যাওয়ার কারণে বা পিছু হটার কারণে ভয় বা উদ্বেগের সম্মুখীন হতে হয় না। কাজের চিন্তায় চিন্তায় নির্ঘুম রাত পার করা থেকেও নিস্তার পাওয়া যায়। যেমন আপনার কোম্পানি আপনাকে প্রস্তাব করল একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে প্রেজেন্টেশন দিতে, কিন্তু আপনি এড়িয়ে গেলেন। এতে করে আপনি বক্তব্য প্রস্তুত করতে গিয়ে রাত জাগা ও চিন্তিত থাকা থেকে রেহাই পেলেন... পরদিন বক্তব্য দিতে গিয়ে অস্বস্তিকর অবস্থায়ও পড়তে হল না।

আমি এই উপকারই লক্ষ্য করেছি পিছু হটার– দুশ্চিন্তার ক্ষণিক মুক্তি। এ ব্যাপারে অল্পক্ষণ চিন্তা করে দেখুন। পশ্চাৎপদতার অন্য কোনো উপকার কি আপনার চোখে পড়ছে? ভয় থেকে পিছু হটার আর কোনো উপকার আছে কি? আমি হাজারো মানুষকে জিজ্ঞাসা করেছি ভয় থেকে পালানোর অন্য কোন সুফল আছে কিনা। কিন্তু এ তালিকায় নতুন একটিও যোগ করতে পারেনি। সঙ্গতভাবে বলা যায়, আর কোন কারণ নেই!


যে মূল্য আপনি দিচ্ছেন

যাহোক, আমি চাই আপনি অন্তত একবার চিন্তা করে দেখুন কী চড়া মূল্যই না আপনি দিচ্ছেন যখন আপনার সমৃদ্ধির পথে প্রতিবন্ধক হয়ে থাকা ভয় থেকে পালাচ্ছেন। পিছু হটার ফলে যা ঘটে:

আত্মসম্মানবোধ হ্রাস পায়।

আপনি অসহায় ও হতাশাগ্রস্থ হয়ে পড়েন।

স্বেচ্ছায় নিজের সাফল্যকে ধ্বংস করেন।

কর্মচাঞ্চল্যহীন বিরক্তিকর জীবনের দিকে নিজেকে তাড়িত করেন।

ক্ষণিকের ভয় ও দুশ্চিন্তা থেকে বাঁচার জন্য এসব চড়া মূল্য হয়ে যাচ্ছে না তো? আমরা অনেকেই এত বেশি ক্ষতি স্বীকার করতে প্রস্তুত কেবল অস্থায়ী অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতি থেকে বাঁচার জন্য। অন্যের হাসির পাত্র না হওয়ার জন্য।


কলেজে থাকাকালীন আমার কৌশল

যে স্বাস্থ্য হারায় তার ক্ষতির পরিমাণ অনেক, যে একজন বিশ্বস্ত বন্ধু হারায় তার ক্ষতির পরিমাণ আরও বেশি, কিন্তু যে সাহস হারায় সে সবকিছুই হারায়।

- মাইগুয়েল ডি সার্ভেন্টেস


কলেজে পড়াকালীন আমি অত্যন্ত লাজুক প্রকৃতির ছিলাম। নিজেকে নিয়ে প্রায়ই অস্বস্তিতে ভুগতাম। তবে কোনো মেয়েকে ঘুরতে নিয়ে যাওয়ার প্রশ্নে কখনো প্রত্যাখ্যাত হতে হয়নি। এখনো আমাকে দেখলে হয়তো আপনারা ভাববেন, ‘সে দেখতে সুদর্শন, যদিও টম ক্রুজ নয়।’

আমার পদ্ধতি ছিল খুবই সাদামাটা। আমি কখনো কাউকে আমার সাথে ডেটে যাওয়ার জন্য বা ঘুরতে যাওয়ার জন্য বলিনি! ফলে কেউ আমাকে প্রত্যাখ্যান করার সুযোগ পায়নি! এই ছিল আমার পরিকল্পনা! আর আমি কী অর্জন করতে পেরেছি? আমি নিজেকে নিয়ে অশান্তিতে ভুগতাম। আমি জানতাম আমি হাল ছেড়ে দিব। নিজেকে নিষ্প্রাণ মনে হত। আন্দাজ করতেই পারছেন, আমি অতটা সামাজিক ছিলাম না। আমি নিজের সাফল্যকে গলা টিপে মারছিলাম।

যেহেতু আমি ভয়ের মুখোমুখি হতে ভয় পেতাম, তাই আমি অন্যান্য বন্ধু যারা ইতিমধ্যেই তাদের অভিসারিণীকে নিয়ে ঘুরতে গিয়েছে তাদের তুলনায় পিছিয়ে পড়লাম। তখন আমার মনের অবস্থা কেমন ছিল বলে আপনার মনে হয়? প্রচ- শোচনীয়। আপনার জ্ঞাতার্থেই বলা, আমার জীবনে আমি খুব একটা ডেটে যাইনি। নিজে বন্দোবস্ত করা ডেটে তো নয়ই। অন্যরা ব্যবস্থা করে দিলে তবেই যাওয়া হত। কারণ আমি চাই না কেউ আমার প্রস্তাবে ‘না’ বলুক। ‘না’ শোনার ক্ষমতা আমার ছিল না! আমি যেন প্রকারান্তরে নিজেকেই ‘না’ করছিলাম।

বুঝতে পারছেন ভয় থেকে পালানোর এবং এড়িয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা কীভাবে আমার বিরুদ্ধে কাজ করেছে? সন্দেহ নেই, যদি কলেজে কাউকে ডেটে যাওয়ার জন্য প্রস্তাব করতাম তবে অনেকেই ফিরিয়ে দিত। কিন্তু ফিরিয়ে দেওয়াতে আমার নিশ্চয় মৃত্যু হত না! হয়তো আমি অন্য কাউকে জিজ্ঞাসা করতে পারতাম... আবারও অন্য কাউকে... এভাবে একদিন এমন কারও দেখা পেয়ে যেতাম যে বলত, ‘হ্যাঁ’।

কিন্তু তেমন কিছুই হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে এসে ‘প্রত্যাখ্যান ভয়’ মোকাবিলা করতে আমি ছোট ছোট পদক্ষেপ গ্রহণ করি। ধীরে ধীরে আমার আত্মবিশ্বাস বেড়ে ওঠে। ভার্সিটিতে এসে ডলোরিসের সাথে সাক্ষাতের মাহেন্দ্রক্ষণটি পেয়ে যাই। বর্তমানে আমাদের বিবাহিত জীবনের ১৮ বছর চলছে।


নতুন জীবন

আমি আপনার থেকে কোনো অংশেই ব্যতিক্রম নই। আপনার মতো আমারও ভয় আছে। জীবনের পিছনের ৩০ বছরের দিকে যখন তাকাই, আমি কী দেখতে পাই জানেন? আমি দেখতে পাই একজন সার্থক ব্যক্তি যিনি সাফল্যের সাথে আইনজ্ঞের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। কিন্তু আরেকজন ব্যক্তির অস্তিত্বও আমি দেখতে পাই। লাজুক, অনিশ্চিত, ভীতু ও সংবেদনশীল এক ব্যক্তি। অনুপ্রেরণাদানকারী বক্তার সাথে কি এসব গুণ মানানসই?

তবে যা আমার জীবনের বাঁক পরিবর্তন করল... আগের আমি আর বর্তমান আমির মাঝে বিস্তর ফারাক করে দিল... তা হল আমি ভয়কে মোকাবিলা করতে শিখেছি। অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতিতে ভীত না হয়ে পদক্ষেপ নিতে শিখেছি। দীর্ঘ হতাশা ও নৈরাশ্যের পর আমি বুঝলাম যে, পিছু হটা আমার কোনো কল্যাণ করছিল না– কখনো কোনো কল্যাণ করতে পারবেও না।

যদি প্রথমে আমার ইতিবাচক মনোভাব গড়ে না উঠত, তবে আমার পক্ষে ভয়কে জয় করা সম্ভবপর হত না। ‘আমি পারব’ মানসিকতা ছিল কোনো কাজের পদক্ষেপ নেওয়ার বাড়তি শক্তি। যখন আপনার মনে হবে আপনি পারবেন, তখন আপনি ভীত না হয়ে সামনে অগ্রসর হতে চাইবেন। আমার ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল।

দুর্দান্ত ইতিবাচক মনোভাবের বলে বলীয়ান হয়ে আমি মনস্থির করলাম জীবনে একজন নির্জীব দর্শক না হয়ে সক্রিয় অংশগ্রহণকারী হব, যোগ্যতার ভূমিতে কর্ষণ করব যদিও সাথে ভয় ছিল। শুরু থেকে আমি নিজের ব্যাপারে প্রশান্তি বোধ করতে আরম্ভ করি। নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করি। ফলে সব ধরনের সম্ভাবনার দ্বার আমার সামনে উন্মোচিত হয়ে যায়।

ইতিবাচক মানসিকতার চর্চা ও ভয়কে কাবু করার কারণে আপনি কি নিজের জীবনে অভাবনীয় সাফল্য ও পুরষ্কার প্রাপ্তির সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছেন?


পরিস্থিতি নিজের অনুকূলে আনুন

যদি আপনাকে অপ্রত্যাশিত সমস্যাগুলোর দ্বিধা-ভয়হীনভাবে মোকাবিলা করার পথ বাতলে দিতে পারতাম, তবে হয়তো আপনি অত্যন্ত আনন্দিত ও কৃতজ্ঞ হতেন। তাই নয় কি? কিন্তু দুর্ভাগ্য ওরকম কোনো জাদুকরী সমাধান নেই। কোনো জাদুর কাঠিও নেই, যা নাড়লে আপনার ভয় দূর হয়ে যাবে। তবে কীভাবে আপনি ভীতিকর কাজগুলো করার জন্য নিজের মাঝে উৎসাহ-উদ্দীপনা সৃষ্টি করবেন? সাফল্য লাভে যে কাজগুলো আপনার না করলে নয়।

আপনি যখন পরেরবার ভীতিকর এমন কোনো পরিস্থিতির মুখোমুখি হবেন, তখন ঘাবড়ে না গিয়ে পরিস্থিতিকে ভিন্ন আঙ্গিকে মূল্যায়ন করুন। অধিকাংশ মানুষের প্রথম চিন্তা হল, ‘আমি এ কাজটি ভালোভাবে করতে পারব না। অন্যরা তখন আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করবে বা মুখ ফিরিয়ে নিবে।’ একটি কাজকে সবচেয়ে ভালোভাবে সম্পন্ন করার চিন্তায় তারা ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে। আর এই পেরেশানির কারণে তারা পিছপা হয়। কিন্তু আপনার উচিত ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে পরিস্থিকে নিয়ন্ত্রণ করা। যতটুকু সম্ভব আগে থেকে প্রস্তুতি গ্রহণ করুন। ফলাফল কী হবে তা নিয়ে অতিমাত্রায় চিন্তিত হয়ে পড়বেন না।

কাজে নামার পূর্বে এটা চিন্তা করুন যে, আপনি সফল হবেন। বিজয় আপনার ভাগেই লেখা হবে। তারপর কাজ শুরু করুন। এভাবেই চিন্তা করা উচিত। প্রথম পদক্ষেপ নেওয়ার কারণে এবং শুধু অংশগ্রহণের কারণে আপনি বিজেতা, ফলাফল যা হোক।


এগিয়ে যান, যদিও আপনি শঙ্কিত

মনে করুন, আপনি মানুষের সামনে কথা বলতে ভয় পান। ভয়কে মোকাবিলা করুন এবং যেভাবেই হোক কাজটি করুন। বক্তব্য দেওয়ার উদ্দেশ্যে শ্রোতাদের সামনে দাঁড়াতে পারলেই আপনি বিজয়ী ও সফল। হয়তো আপনার হাঁটু, গলা, এমনকি পুরো শরীর কাঁপছে। এসব কোনো ব্যাপার না। আপনি ভয় থেকে পিছু হটেননি এবং চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছেন। আপনার জন্য শুভেচ্ছা অপেক্ষা করছে। সম্ভাব্য ফলাফল হল আপনার আত্মবিশ্বাস ও শ্রদ্ধা বেড়ে যাবে। আনন্দে মন নেচে উঠবে।

প্রথম প্রচেষ্টাতে, আপনি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বক্তার মতো আপনাকে অভ্যর্থনা জানানো হবে না। তাতে কি? মোকাবিলা করুন। প্রথম দফাতে একজন সফল বক্তা হওয়ার মনোভাব নিতান্তই বোকামি। প্রথমবার ক্রিক্রেট খেলার পর কি আপনি একজন পেশাদার খেলোয়াড় হতে পেরেছেন? বা সফল সাঁতারু প্রথমবার পানিতে নেমেই কি পেশাদার সাঁতারু হয়ে যায়? প্রতিটি যোগ্যতা অর্জনের জন্য দীর্ঘসময়ের প্রয়োজন হয়।

আমার প্রথম অনুপ্রেরণামূলক বক্তব্যটি মনে আছে। এটি ছিল ১৯৮৮ সালে... একটি সাদামাটা বক্তব্য ছিল। এটি ছিল একদল রিয়েল এস্টেট বিক্রয় প্রতিনিধির সামনে উন্মুক্ত আলোচনা। এক কথায় বলতে গেলে, আমি ভীতসন্ত্রস্ত ছিলাম। পুরো বক্তব্য জুড়ে লিখিত খসড়া থেকে চোখ সরাতে পারিনি। সৌভাগ্যক্রমে, আমার বক্তব্যের বিষয় ছিল সহজ সরল ও সোজাসাপ্টা। ফলে শ্রোতাদের মাঝে আশানুরূপ সাড়া পেয়েছিলাম। তবে নিজেকে একজন ভালো বক্তা মনে করার জন্য অনেককাল অপেক্ষা করতে হয়।

দ্বিতীয় প্রেজেন্টেশনে আমি কিছুটা উন্নতি করেছিলাম। ৫টি বা তারচেয়ে বেশি প্রেজেন্টেশন সম্পন্ন করার পর লিখিত খসড়ার ওপর নির্ভরতা ছেড়ে দিই... শ্রোতাদের সাথে সম্পর্ক বৃদ্ধি করি। আজ ১১ বছর পর আমি একজন পেশাদার বক্তা যে পুরো আমেরিকা জুড়ে সারাবছর হাজারো মানুষের সামনে বক্তব্য দিয়ে বেড়ায়।

তবে ভুলে যাবেন না এ যাত্রা শুরু হয়েছিল একজন অপেশাদার ব্যক্তির মাধ্যমে যে ১৯৮৮ সালে খুবই সাদামাটা বক্তব্য দিয়ে তার যাত্রা শুরু করেছিল।


সে তার স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করেছে

ভয়ের খাঁচা থেকে বের হয়ে আসার পথ হল কাজ শুরু করা।

- জু টাই


আপনাকে একজন মহিলার গল্প শোনাব যে স্বস্তিদায়ক বলয়ের বাইরে এসে কাজ করতে পারত। তার নাম ডটি বর্মন। ৩২ বছর ধরে নিউইয়র্কে তিনি উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ইংরেজি শিক্ষক ছিলেন। তথাপি, ১০ বছর বয়স থেকে তার ইচ্ছা ছিল শো ব্যবসায় পা দিবে। এটি ছিল তার আবছা চিন্তাভাবনা। ক্যারিয়ার হিসাবে কখনো চিন্তা করে দেখেনি। বরং সে বৈষয়িক ও জীবিকার নিরাপত্তার কারণে শিক্ষকতাকে পেশা হিসাবে বেছে নেয়। শিক্ষকতার সময় ডটি গান লিখত এবং তা নিজে নিজেই গাইত। এটি ছিল তার নিছক একটি শখ। তবে সে তার স্বপ্নকে বাঁচিয়ে রেখেছিল। ১৯৮০ সালে ডটি সিদ্ধান্ত নেয়, সে শিক্ষকতা পেশা ছেড়ে দিবে এবং স্টেজ পারফর্মার হিসাবে পেশা শুরু করবে। ১৯৮৮ সালে সে তার নিবন্ধন জমা দেয়। তারপর কঠিন বাস্তবতা তাকে স্পর্শ করে। অজানার পথে পা বাড়াতে এতটায় ভীত হয়ে পড়েছিল যে, সে নিবন্ধন প্রত্যাহার করে নেয় এবং শিক্ষকতায় ফিরে যায়।

কিন্তু ডটির ভেতরের সত্ত্বা তার স্বপ্নকে মারা যেতে দেয়নি। ছয় মাস পরে ১৯৮৯ সালের জানুয়ারি মাসে সে তার ভয়কে জয় করে আবার কাজে নামে এবং তার শিক্ষকতা পেশা ছেড়ে দেয়। তখন ডটি তার জীবনের ৫০তম বসন্তে পা দিল! ১৯৯২ সালে, ডটি তার নিজের একার গানের শো পরিচালনা করে। তার শো’টি ছিল নিরাপদ জীবিকার শিক্ষকতা পেশা ছেড়ে শো ব্যবসায় পদার্পণ নিয়ে!

১৯৯৮ সালের বসন্তে ষাট বছর বয়সী ডটি তার প্রথম একক গানের সিডি ভালোবাসি আমার কম্পিউটার বের করে। সিডিতে ছিল একগুচ্ছ জ্ঞানগর্ভ ও অনুপ্রেরণামূলক গানের সমাহার। এ গানগুলো সে নিউ ইয়র্কের একটি সরাইখানায় গানের অনুষ্ঠানে পরিবেশন করে– সে তার মৌলিক গান ও গল্পসমূহ বিভিন্ন থিয়েটার ও সরাইখানায় উপস্থান জারি রাখে... এবং পুরো দেশজুড়ে বিভিন্ন সংস্থার জন্য গেয়ে যায়।

ডটি প্রথম ব্যক্তি যে স্বীকার করেছে যে, তার ক্যারিয়ার পরিবর্তন নানা প্রতিকূলতায় ভরপুর ছিল। তবে এটি কি তার জন্য লাভজনক হয়েছে? ডটির মতে, ‘আমি জীবনে এত বেশি সুখী কখনো হয়নি।’

অসাধারণ, ডটি! সে ভয়কে জয় করেছে... এবং আমাদেরকে নিজ নিজ স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য উৎসাহিত করেছে!


কাজে নেমে পড়–ন

ভয় থেকে পালানো একটি পরাজিত কৌশল।

- জেফ কেলার


রালফ ওয়াল্ডো এমারসন কিছু সরল উপদেশ দিয়েছেন। মেনে চলতে পারলে জীবন বদলে যাবে। তিনি বলেন, ‘তাই করুন যা করতে ভয় পান। আপনার সামনে থেকে ভয় লেজ গুটিয়ে পালাবে।’ উপদেশ হিসাবে এটি যথেষ্ট। কিন্তু কিছু মানুষ কাজ করতে অনেক বেশি ভয় পায়। কিছু পূর্বে যা বলেছি তা আবার মনে করুন। ভয়কে পাত্তা দিলে আপনাকে অনেক চড়া মূল্য দিতে হবে।

পরিশেষে বলব, ভয় থেকে পালানো একটি পরাজিত কৌশল। এমন কাজ আপনার জন্য কেবল হতাশা ও দুরবস্থাই বয়ে আনবে। নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে বলতে পারি।

অল্প মাত্রায় ভয় থাকা অস্বাভাবিক নয়। প্রতিটি সফল ব্যক্তির ভয় থাকে। তবে তাদের মাঝে আর ব্যর্থদের তফাৎ হল ব্যর্থরা যখন ভয়ে হাল ছেড়ে দেয়, সফলরা ভয় থাকা সত্ত্বেও সামনে অগ্রসর হয়। এটা সত্য, ভয় থাকা সত্ত্বেও অগ্রসর হওয়া সহজ কাজ নয়। তবে একবার যদি আপনি কাজে নেমে পড়েন, তবে আপনার সাহস ও আত্মবিশ্বাস বাড়বে। ভালো লাগতে শুরু করবে।

গত ১৪ বছরে আমেরিকার নানান অঞ্চলে ও বিদেশে যাওয়ার সুযোগ আমার হয়েছে... হাজারো মানুষের সাথে কথা বলার সুযোগ হয়েছে। এমন কাউকে পাইনি যে ভয়কে মোকাবিলা করেছে... ঘাবড়ে না গিয়ে কাজ করেছে... এবং পরবর্তীতে অনুতপ্ত হয়েছে। কেউ না! অন্যদিকে হাজারো মানুষ পেয়েছি যারা ভয়ের কারণে পিছপা হয়ে আফসোস করছে ও অনুতপ্ত হয়েছে এবং তাদের স্বপ্নের ইতি ঘটেছে।

আমার একজন বন্ধু প্রায় বলে, ‘তাদের দলভুক্ত হবেন না যারা তাদের স্বপ্নের বিনিময়ে আফসোসকে ক্রয় করে নেয়।’

তাই নিজেকে ঝাঁকুনি দিন! অগ্রসর হোন! ভয়ের সম্মুখীন হোন এবং সহজ ও স্বস্তিদায়ক বলয় প্রতিদিন বড় করুন। ব্যায়ামের চর্চা যেমন দেহের শক্তি বাড়ায়, তেমন ভয়কে দূর করার কাজ করলে সাহসেরও শক্তি বৃদ্ধি পায়। স্বস্তিদায়ক বলয়ের কোনো কাজ একাধিকবার করলে তাও ঐ বলয় বা বৃত্তের অংশ হয়ে যায়।

যদি নিজের স্বস্তিদায়ক বলয়কে বড় করেন, তবে বোনাস হিসাবে আপনি আরেকটি পুরষ্কার পাবেন। তা হল: জীবনের কিছু কিছু জায়গায় যখন আপনি ভয়কে মোকাবিলা করে অগ্রসর হবেন, অন্য কিছু ক্ষেত্রে আপনার আত্মবিশ্বাসের মাত্রা বৃদ্ধি পাবে। এতে কোনো সন্দেহ নেই। যেমন, আমি যেরকম একজন ভালো বক্তা হতে পেরেছি, সেভাবে একজন ভালো বিক্রেতাও হয়েছি... দক্ষ ব্যবসায়ী হতে পেরেছি... যোগ্য শ্রোতা হতে পেরেছি... তালিকা এভাবে বড় হতে থাকবে।

আপনি চেষ্টা করলে হয়তো এড়িয়ে যেতে পারেন। কিন্তু কঠিন, অপ্রত্যাশিত ও অস্বস্তিকর কাজ করা ব্যতিরেকে আপনি কখনো নিজের যোগ্যতার পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটাতে পারবেন না। জীবন কখনো তাদের পুরষ্কৃত করে না যারা নিজেদেরকে কঠিন ও প্রতিকূল পরিস্থিতির মুখোমুখি করতে ভয় পায়। বিজেতার আসনে সমাসীন দেখার জন্য প্রয়োজন হল ভয় থাকা সত্ত্বেও বসে না থেকে সামনে অগ্রসর হওয়া।

ভয়কে মোকাবিলা করুন... যোগ্যতাকে কাজে লাগান... এবং নিজেকে সমৃদ্ধির পথে দেখতে পাবেন। পাবেন একটি রোমাঞ্চকর, কোলাহলপূর্ণ জীবন। এটি এমন এক সিদ্ধান্ত যার কারণে কখনো পস্তাতে হবে না।

 





অধ্যায় ১১


ব্যর্থতা হল অপার বুদ্ধিদীপ্ততায় নতুন করে শুরু করার একমাত্র পথ।

- হেনরি ফোর্ড


কাজে নামুন এবং ব্যর্থ হোন


সে ২৬ বছর ধরে তার ক্রেডিট কার্ডের বিল দিতে পারেনি।

কাজের আশায় তাকে ২৫ বার এ দরজা থেকে ও দরজায় ধরনা দিতে হয়েছে।

১৮ বার চাকরিচ্যুত হয়েছে।

বার্ষিক ১৮ লাখ টাকা কামাই করার জন্য তাকে ২৬ বছর কাজ করতে হয়েছে।

সময়ে সময়ে তাকে ত্রাণের খাবার ওপর নির্ভর করতে হয়েছে, নিজের গাড়িতে রাত্রিযাপন করতে হয়েছে।

হয়তো আপনি চিন্তা করছেন, ‘এই বইটি যদি সাফল্যগাঁথা হয়, তবে কেন একজন মহিলার ক্রমাগত ব্যর্থতার একঘেয়ে ও নীরস গল্প বলে যাচ্ছেন?

কেন তা আপনাকে জানাব? উপরে বর্ণিত ব্যর্থতাগুলো একজন সুপরিচিত ও সফল ‘টক শো’ উপস্থাপিকা, সেলি জেসি রাফায়েলকে নিয়ে। তিনি মিডিয়া জগতে ক্যারিয়ার গড়ার স্বপ্ন দেখতেন এবং এত ব্যর্থতা সত্ত্বেও তিনি তা অর্জন করেছেন।

যতদিন না সে সফলতার মুখ দেখেনি ততদিন সে ব্যর্থ হচ্ছিল... এবং ব্যর্থ হচ্ছিল...। টিভি উপস্থাপনার মাধ্যমে সেলি জেসি রাফায়েল কোটি টাকা আয় করেছিল এবং একটি দীর্ঘ ও সফল টিভি উপস্থাপনা ক্যারিয়ার উপভোগ করে। এসব সম্ভব হয়েছিল কারণ সে তার শত ব্যর্থতার মাঝেও নিজের মনোবল ও ইতিবাচক মনোভাব ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছিল।


কাজের প্রথম দিকের ঘটনা

সেলি জেসি রাফায়েলের মতো কারও পক্ষে ১৬ বছর ধরে ব্যর্থতার যন্ত্রণা বয়ে বেড়ানো, অথচ হার না মেনে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া কীভাবে সম্ভব? যদি আপনি শৈশবকালে ফিরে যান, লক্ষ্য করবেন আপনিও একই রকমের মনোভাব ও প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। ক্রমাগত ব্যর্থতার পরেও ধৈর্য ধরে কাজ করে গেছেন।

মনে পড়ে যখন আপনি সাইকেল চালানো শিখেছিলেন? সম্ভবত নিরাপত্তা চাকা সহকারে প্রশিক্ষণ শুরু করেছিলেন। একটা সময় পরে সেই চাকাগুলো খুলে নেওয়া হয়, আপনার পক্ষে দু’চাকার ওপর নিজের ভারসাম্য রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়ে। আপনি সোজা হয়ে বসার ও ভারসাম্য রক্ষায় রীতিমতো সংগ্রাম চালিয়েছেন। হতে পারে, কয়েকবার পড়েও গিয়েছিলেন আর হাতে-পায়ে আঁচড় পড়ে গিয়েছিল। তখন জীবনের প্রত্যুষে আপনি ব্যর্থতা সম্পর্কে প্রাথমিক জ্ঞান লাভ করেন।

যখন আপনি অনুশীলন করেন, মা-বাবা আপনার পাশে থেকে দিক-নির্দেশনা দিয়ে যায়। উৎসাহ দেয়, পড়ে গেলে ধরে উঠিয়ে দেয়। আপনি ভীত ছিলেন... কিন্তু রোমাঞ্চিত ছিলেন। আপনি অপেক্ষায় ছিলেন কখন সফল হবেন, কখন আপনি অবশেষে কারও সাহায্য ছাড়া সাইকেল চালাতে সক্ষম হবেন। আপনি প্রচেষ্টা চালিয়ে গেলেন এবং অবশেষে সাইকেল চালানোয় দক্ষতা অর্জন করলেন।

সে বস্তুটি কী যা সাইকেল চালানোয় চূড়ান্ত সফলতায় ভূমিকা রেখেছিল? তা ছিল অধ্যাবসায় ও পুনরাবৃত্তি। যত দীর্ঘ সময় প্রয়োজন পড়–ক আপনি নাছোড়বান্দার মতো প্রচেষ্টা জারি রেখেছেন! পাশাপাশি লক্ষ্য পূরণে আপনি ছিলেন উদ্যমী ও উৎসাহী– যার কারণে সক্ষমতা অর্জনে কোনো বিলম্বকে আপনি পাত্তা দেননি। আরেকটি মন্ত্র আপনার সহায়ক ছিল, ইতিবাচক প্রেরণার প্রভাবকে কখনো ছোট করে দেখতে নেই। আপনি জানতেন, বাবা-মা আপনার পাশেই ছিল আপনাকে সাহায্য করার জন্য। তারা আপনার সাফল্যের ভিত্তিপ্রস্তরের ভূমিকায় ছিল।

ছয় বছর বয়সে শিক্ষানবিশ হিসাবে আপনি ছিলেন আশাবাদী... রোমাঞ্চিত... ও চ্যালেঞ্জ নিতে বদ্ধ পরিকর। আরেকবার চেষ্টা করতে আপনি কখনো পিছপা হতেন না। আপনি জানতেন দিনশেষে আপনি সফল হবেন।

কিন্তু সে অনেক আগের গল্প।


গতকাল ও আজ

সফলতা হল উদ্দীপনা ও অনুপ্রেরণা না হারিয়ে ক্রমাগত ব্যর্থ হতে থাকা।

- উইন্সটন চার্চিল


এখন দেখা যাক কীভাবে একজন পরিণত মানুষ নতুন যোগ্যতা অর্জনে অগ্রসর হয়। আপনি কি তাদের ব্যাপারে বলতে পারবেন যে, তারা আশাবাদী... শিহরিত... চ্যালেঞ্জ গ্রহণে প্রস্তুত? আমরা প্রত্যেকে জানি এর উত্তর হবে, ‘না’।

মনে করুন, আমরা একদল প্রাপ্তবয়স্ক মানুষকে বললাম নতুন একটি সফটওয়্যার প্রোগ্রাম আয়ত্ত করতে বা কোম্পানিতে অন্য একটি পদে যেতে। তাদের উত্তর কী হতে পারে?

হয়তো তারা এড়িয়ে যেতে চাইবে।

বা অভিযোগ করবে।

বা তারা অজুহাত দেখাবে কেন তাদের তা করা উচিত নয়।

কিংবা তাদের সক্ষমতা নিয়ে খোদ তারাই সন্দিহান হয়ে পড়বে।

অথবা ভয়ে পিছু হটবে।

প্রাণশক্তিতে টইটম্বুর ও রোমাঞ্চপ্রিয় ছয় বছরের বাচ্চাটির কী হল? কীভাবে সেই শিশুটি পরিণত বয়সে পৌঁছাতে গিয়ে তার সঞ্জীবনী শক্তি হারিয়ে নতুন কিছু শিখতে নির্জীব ও ক্রন্দন-প্রায় হয়ে উঠল। পরিণত মানুষ হিসাবে আমাদের অনেকে লোকে কী ভাবছে তা নিয়ে বেশি চিন্তিত হয়ে পড়ে। মানুষ আমাকে দেখে হাসবে বা সমালোচনা করবে এই চিন্তা করে গড়িমসি করি।

ছয় বছর বয়সে আমরা জানতাম সাইকেল চালানো শিখতে গিয়ে সাইকেল থেকে পড়ে যাব। কিন্তু পড়ে যাওয়াকে গায়ে না মেখে আবার উঠে পুনরায় চেষ্টা করতাম। সাইকেল থেকে পড়ে যাওয়াটা তখন ‘খারাপ’ কিছু ছিল না। কিন্তু পরিণত বয়সে এসে আমরা চিন্তা করা শুরু করলাম পড়ে যাওয়া ‘খারাপ জিনিস’, ভুলে গেলাম শেখার অবিচ্ছেদ্য অংশ হল পড়ে যাওয়া বা ভুল করা।

যেমনটা দশম অধ্যায়ে বলেছি, নতুন কিছু শিখতে গিয়ে অস্বস্তিতে পড়তে হয়। ভীতিপ্রদও হতে পারে। কিন্তু যদি চোখকে আপনার লক্ষ্য থেকে সরিয়ে রাখেন এবং অন্যরা আপনাকে দেখে কী ভাবছে তা নিয়ে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েন, তবে নিজের প্রতি আপনি চরম অবিচার করছেন। নতুন কোন সক্ষমতা অর্জনে বা অর্থবহ লক্ষ্যে পৌঁছাতে, আপনার যা কিছু করা দরকার তা করতে বদ্ধ পরিকর হতে হবে, এমনকি যদি নেতিবাচক মন্তব্যের সম্মুখীন হতে হয় বা মুখে কেউ কালি মেখে দেয় তবুও।

সফল ব্যক্তিরা ব্যর্থতার পথ ধরে সাফল্য খুঁজে পায়। যদিও ব্যর্থতা তাদের কোন সুখকর অনুভূতি দেয় না, তবুও তারা মনে করে ব্যর্থতা সাফল্যের পথে অপরিহার্য। যাহোক, কোন কাজে পারঙ্গমতা অর্জনে চাই সময়, প্রচেষ্টা ও নিয়মানুবর্তিতা... এবং যেকোনো মূল্যে গন্তব্যে পৌঁছার অদম্য ইচ্ছা।


ব্যর্থতা হচ্ছে কোটি টাকা অর্জনের আসল সিঁড়ি

সব থেকে বড় ভুল যা একজন ব্যক্তি করে থাকে তা হল কোনো কাজ করতে গিয়ে ভীত হওয়া।

- এলবার্ট হুবার্ড


একজন বেসবল খেলোয়াড়ের কথাই ধরুন। বর্তমানে যে ১০ বারের মধ্যে ৩ বার ব্যাট লাগাতে পারে তাকে সেরা মনে করা হয়। তার মানে ৭০ শতাংশ ব্যর্থ। একজন ব্যাটসম্যানকে কোটি কোটি টাকা পুরস্কার দেওয়া হয় সে ৭০ শতাংশ ব্যর্থ হয়ে, ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিয়ে ৩০ শতাংশ সফল হয় বলে। কিন্তু যারা ৭০ শতাংশ ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিতে পারে না, নিজেদের সমৃদ্ধ করে ৩০ শতাংশ সফলতা আনতে ব্যর্থ হয়, তাদেরকে দর্শকরা তিরস্কার করে।

প্রসঙ্গক্রমে, ১৯৯৮ এর মৌসুমে সেন্ট লুইস কার্ডিনালসের মার্ক ম্যাকউইরের ব্যাটিং ছিল রোমাঞ্চকর। তিনি এ সময় ৭০টি হোম রান করেন। একজন অসাধারণ খেলোয়াড়। কিন্তু আপনি কি জানেন, সে এই সিজনে ১৫৫ বার স্ট্রাইক আউট হয়? আর তার ক্যারিয়ার জুড়ে হোম রান সংখ্যা ৪৫৭টি, যা করতে সে ১,২৫৭ বার স্ট্রাইক আউট হয়। যা তার রানের তুলনায় তিনগুণ বেশি। যদি আমি সর্বশ্রেষ্ঠ বাস্কেটবল খেলোয়াড়ের নাম বলতে বলি, কার নাম প্রথমে মাথায় আসবে? হয়তো অনেকে ভাবছেন মাইকেল জর্ডানের কথা। আমি তাকেই ভোট দিব। তার পরিসংখ্যানটি আপনার জানাচ্ছি। মাইকেল জর্ডানের ক্যারিয়ারে সফল নিক্ষেপণের (শুটিং) পরিমাণ তার মোট নিক্ষেপণের ৫০ শতাংশ। অন্যভাবে বললে তার ক্যারিয়ারের অর্ধেক শট ছিল ব্যর্থ।

অবশ্য, এই নীতি কেবল খেলাধুলার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। আমরা আরও জানি, বিনোদন জগতের তারকাগণ ও মিডিয়া ব্যক্তিত্বদের ক্ষেত্রেও ব্যর্থতা অদ্ভুত কোন বিষয় নয়। অনেক তারকার দশ থেকে পনেরো বছর লেগে যায় তাদের ক্যারিয়ার সূচনাকারী পর্দায় আসতে। আর এ দীর্ঘসময়ে শত শত প্রত্যাখ্যান তাদের কপালে জোটে। তাদের সাফল্যের নানা গল্পের মাঝেও সময়ে সময়ে চরম পতনের দেখা পেতে হয়।

যেদিন জেরি সাইনফিল্ড কলেজ সমার্পণ করে সে রাতে তার প্রথম কমেডি গিগ তৈরি করে। এটি নিউ ইয়র্কের একটি কমেডি ক্লাবে প্রদর্শিত হয়। সে ব্যর্থ হয়। সে সন্ধ্যার অভিজ্ঞতা জিজ্ঞাসা করা হলে সে জানায়, ‘অবশ্যই এটি একটি পরাজয়ের অনুভূতি।’ কিন্তু সে হাল ছাড়েনি। সে নিয়মিতভাবে প্রতিরাতে একক কৌতুক প্রদর্শন করে গেছে। দীর্ঘ পাঁচটি বিভীষিকাময় বছর শেষে, সে ১৯৮১ সালে একটি শো’তে আমন্ত্রণ পায়। তার সহযোগী ছিল জনি কার্সন। এটি ছিল তার বড় একটি অর্জন... এবং এরপর তাকে আর পিছনে তাকাতে হয়নি।

এক কথায়, উপরে বর্ণিত প্রতিটি ব্যক্তি অনুধাবন করতে পেরেছেন যে, সফলতার অন্যতম শর্ত হল অধ্যাবসায়। অর্থাৎ আপনি যদি চেষ্টা অব্যাহত রাখেন, নিজের উন্নতি সাধনে ক্রমাগত কাজ করতে থাকেন এবং সকল প্রতিকূল অবস্থা সয়ে যান তবে আপনি সফল হতে পারবেন। তবে এজন্য আপনাকে ক্রমাগত ব্যাট চালিয়ে যেতে হবে... অনেক অডিশন দিতে হবে... উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সম্ভাব্য গ্রাহকের সাথে দেখা করতে হবে।


ব্যর্থতার অভিজ্ঞতার মাধ্যমে নিজেকে নির্ভীক করে তুলুন

[ব্যর্থ হওয়া সত্ত্বেও নিজের অদম্য ইচ্ছা বজায় রাখুন।] আপনাদের দু’জন ব্যক্তির গল্প শোনাব যারা একটি বই রচনা করেছিল। বইটি ছিল অনেকগুলো অনুপ্রেরণামূলক গল্পের সংকলন। তারা মনে করেছিল কোন প্রকাশককে রাজি করিয়ে মোটামুটি তিন মাসের মধ্যেই বই প্রকাশ করে ফেলবে।

প্রথম প্রকাশককে জানানোর পর সে না করে দেয়।

দ্বিতীয়জন এর উত্তর: ‘না’।

তৃতীয়জন: ‘না’।

এভাবে একে একে ৩০ জন প্রকাশক তাদের ফিরিয়ে দেয়।

তিন বছরে ৩৩বার প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর তাদের মনের অবস্থা কেমন হতে পারে? এরপর তারা কী করেছিল আপনার মনে হয়? তারা তাদের এ বইকে অন্য একজন প্রকাশকের হাতে দেয়।

৩৪তম প্রকাশকের উত্তর ছিল: ‘হ্যাঁ’।

এবং সেই ‘হ্যাঁ’– তাদের ৩৩বার ব্যর্থতার পর– চিকেন সূপ ফর দ্য সোল (আত্মার জন্য মুরগির সূপ) বইটির জন্য প্রকারন্তরে লেখকদ্বয়ের জন্য আশানুরূপ সাফল্য নিয়ে আসে। বইটির লেখকদ্বয় হল জ্যাক ক্যানফিল্ড ও মার্ক ভিক্টর হানসেন। যদি আপনি গত পাঁচ বছরে বইয়ের দোকানে গিয়ে থাকেন, তবে বাজি রাখতে পারি যে, আপনি বইটি দেখেছেন। আশা রাখছি, চিকেন সূপ সিরিজের একটি বই আপনার পড়ে দেখার সুযোগ হয়েছে।

চিকেন সূপ ফর দ্য সোল (আত্মার জন্য মুরগির সূপ) সিরিজটির তিন কোটিরও বেশি সংখ্যক কপি বিক্রিত হয়েছে! আর এটা সম্ভব হয়েছিল জ্যাক ক্যানফিল্ড ও মার্ক ভিক্টর হানসেন বারবার ব্যর্থ হওয়ার পরও তাদের অদম্য ইচ্ছা বজায় রাখার কারণে... সাফল্যের দেখা পাওয়া অবধি প্রচেষ্টা চালিয়ের যাওয়ার কারণে।

কোন জিনিসটি ৩৩ বার প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পরও তাদের উদ্দীপনাকে ধরে রেখেছিল? তাদের মনোভাব ও মানসিকতা! যদি তাদের নেতিবাচক মনোভাব থাকত, তবে তারা প্রথম এক-দুই চেষ্টায় আশা ছেড়ে দিত। ফলে স্বর্ণের খনিও তারা হারাত! কিন্তু তাদের মনোভাব ক্রমাগত ব্যর্থতার পরও ইতিবাচক ছিল; বরং এই প্রত্যাখ্যান তাদের সংকল্পের মাত্রা বাড়িয়েছে।

পরিশেষে ইতিবাচক মনোভাবের মূল্য কত দাঁড়াল? তাদের ক্ষেত্রে এ মূল্য দাঁড়িয়েছে জনপ্রতি ১০ কোটি টাকা... এবং সংখ্যাটা প্রতিনিয়ত বড় হচ্ছে!

রাতারাতি সফলতা আসে না

সাফল্য বলতে বোঝায় অন্যরা আশা ছেড়ে দেওয়ার পরও নিজে আশা না ছেড়ে লেগে থাকা।

- উইলিয়াম ফেদার


আরেকজন ব্যক্তি যিনি দীর্ঘসময়ের ব্যর্থতার দহন সহ্য করেছেন তিনি হলেন সফল রেডিও উপস্থাপ রাশ লিম্বা। কয়েক বছর ধরে লিম্বা একটি স্বল্প আয়ের চাকরি করেন এবং ক্রমাগত মানুষের হাসিঠাট্টার স্বীকার হন তার বিরাট সাফল্য অর্জনের পূর্বে। তিনি দীর্ঘ বারো বছর ধরে রেডিওতে বাজে সময় পার করছিলেন। এরপর একদিন তাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়। ১৯৭৯ সালে তিনি রেডিও’র চাকরি ছাড়েন এবং পাঁচ বছর বিক্রয় প্রতিনিধির চাকরি করেন। চাকরিটা তার জন্য কখনো মানানসই ছিল না। প্রতিটি দিন ছিল দুর্বিসহ। ১৯৮৩ সালে তিনি আবার নতুন উদ্যমে রেডিও জগতে ফিরে আসেন। এর পরের ইতিহাস সকলের জানা।

তাই আপনি যখন কোনো কাজ সঠিকভাবে করতে থাকেন, তবে ‘ব্যর্থতা’ নামে কিছুই তাতে থাকে না। থাকে শুধু ফলাফল ও প্রাপ্তি। হয়তো কেউ বেশি পায় ও সফল হয়। কেউ হয় কম। ব্যর্থতা মানে এই নয় যে, আপনি সর্বশেষ সীমায় পৌঁছে গেছেন এবং সফলতা ধরাছোঁয়ার বাইরে। সফলতা তখনই অনিশ্চিত হয়ে যায় যখন আপনি হাল ছেড়ে দেন। হাল ছেড়ে দেওয়া মানে হেরে যাওয়া। কিন্তু অব্যাহত প্রচেষ্টা ও দৃঢ়তা-অদম্যতার সম্মিলিত রূপ সাফল্যের জন্ম দিতে পারে।


কখনো হাল ছাড়বেন না

১৯৯০ এর শুরুতে একটি মিডওয়েস্টার্ন কোম্পানির মালিক আমাদের অফিসে ফোন করে এবং আমার বক্তব্যের অনুষ্ঠানের ব্যাপারে খোঁজখবর নেয়। আমাদের প্রতিষ্ঠানের কাজ ও প্রকাশনা সম্পর্কে জানতে চায়। আমি তার সাথে ফোনে কথা বলি এবং তখনি তাকে সব তথ্য অবগত করি। পরবর্তীতে তার সাথে যখন যোগাযোগ করি সে জানায়, ‘আমরা এ ব্যপারে চিন্তা করছি, তবে এখনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারিনি।’

প্রথমদিকে আমরা প্রতি সপ্তাহে ফোন করতাম। কোনো সাড়া নেই। তারপর, প্রতিমাসে একবার ফোন করতাম। প্রত্যাখ্যাত! কয়েক বছর ধরে আমরা এই ভদ্রলোককে ফোন করে যাই। আমরা তাকে ত্রৈমাসিক নিউজলেটার ও প্রচারপত্র পাঠাতে থাকি। এমনটা করার কারণ আমাদের ক্রমাগত ব্যর্থতা।

কিন্তু ১৯৯৮ সালের বসন্তকালে তার কোম্পানির প্রতিনিধি আমাদের ফোন করে এবং আমাকে তাদের বিক্রয় সভার একটি অনুপ্রেরণামূলক অনুষ্ঠানে বক্তা হিসাবে আমন্ত্রণ জানায়। অনুষ্ঠানে যখন মালিকের সাথে ব্যক্তিগতভাবে কথা হয়, তিনি বলেন, ‘আপনার অধ্যবসায় দেখে আমি মুগ্ধ। আপনার অফিসের একজন আমাকে ক্রমাগত কয়েক বছর ফোন করেছে... এবং আপনি আশা ছেড়ে দেননি।’

হ্যাঁ, আমরা কয়েক বছর ধরে ব্যর্থতার যাতনা সহ্য করে যাচ্ছিলাম। কিন্তু যখন আমরা কাজটি হাতে পাই, তখন এই ব্যর্থতা ও প্রচেষ্টা মূল্যবান হয়ে ওঠে।


গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রশ্ন

আপনি কি সাফল্যের গোপন রহস্য সম্পর্কে জানতে চান? এ বেশ সহজসরল। ব্যর্থতার মাত্রা বাড়িয়ে দিন। আরও ব্যর্থ হোন।

- থমাস জে. ওয়াটসন


যদি আপনার কাক্সিক্ষত ফলাফল না পান কিংবা ব্যর্থতায় উৎসাহ হারিয়ে ফেলেন, তবে নিজেকে এই প্রশ্নগুলো করুন:

১. আমার সময়সূচি কি বাস্তবসম্মত নয়? হয়তো আপনি চাচ্ছেন কিছু সিঁড়ি বাদ দিয়ে দুম করে সাফল্যের চূড়ায় পৌঁছাতে। প্রতিটি ধাপ বা সিঁড়ি ক্রমান্বয়ে পেরিয়ে সাফল্য আসে। এক ঝটকায় চূড়ায় পৌঁছা অসম্ভব। আপনি হয়তো জানেন না এক পর্যায় সমাপ্ত করে অন্য পর্যায়ে পৌঁছাতে কত সময় লাগবে। তাই ধৈর্য ধরুন। নিজের উন্নতি-অগ্রগতিকে অন্যের সাথে তুলনার তীব্র বাসনা দমিয়ে রাখুন! হয়তো আপনি কারও থেকে অনেক দ্রুতগতিতে ছুটছেন অথবা কারও থেকে অনেক ধীরগতিতে। উন্নত ও ইতিবাচক মনোভাব ধরে রাখুন... পদক্ষেপ নিন... পরিস্থিতির সাথে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিন... এবং ফলাফল অবশ্যই আসবে।

২. আমি কি সত্যিই দৃঢ়প্রতিজ্ঞ? আরাধ্য বস্তু পেতে দীপ্তশিখার মতো প্রখর মনোবাসনা কি আপনার আছে? যেকোনো মূল্যে আমি তা করব এবং হাল ছেড়ে দিব না– এমন বাসনা সফলতার জন্য অপরিহার্য। হ্যাঁ, আপনার কাজকে যদি ভালোবাসেন, তবে দৃঢ় ও অটুট থাকা বহুলাংশে সহজ হয়ে যায়। অতএব সে সকল বস্তুর পিছনে ছুটে চলুন যার সাথে আপনার আবেগ জড়িয়ে আছে। ছেড়ে দেওয়ার মানসিকতা যাতে না আসে সে দিকে লক্ষ্য রাখুন।

৩. আমার মাঝে কি নিরুত্তাপ ও নিরুৎসাহিতা প্রবলভাবে বিরাজ করে? ব্যর্থ ফলাফল মানুষের মাঝে হতাশার উদ্রেক করতে পারে। এজন্য আমাদের এমন সব মানুষের মাঝে থাকা প্রয়োজন যারা আমাদের নির্ভরতা দেয় এবং আমাদের প্রতি আস্থা রাখে। যদি আপনি নেতিবাচক মানুষের পাল্লায় পড়েন, যারা অনেক বেশি সমালোচনা প্রিয় বা তারা নিজেদের উন্নতির প্রতি উদাসীন, তবে আপনার উৎসাহ-প্রেরণা সব শেষ হয়ে যাবে। তাই তাদের সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলুন যারা আপনাকে উৎসাহ যোগাবে এবং সাফল্যের দিকে পরিচালিত করবে।

৪. আমি কি সাফল্যের প্রস্তুতি নিচ্ছি? সফল হওয়ার জন্য পরিপূর্ণ প্রস্তুতি আবশ্যক। আপনি নিজের গন্তব্যে পৌঁছাতে যা কিছু করণীয় তার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ কি নিচ্ছেন? যেমন: বই পড়া, অনুপ্রেরণামূলক বক্তব্য শোনা, বিভিন্ন প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করা এবং আপনি যে বিষয়ে কাজ করছেন সেই বিষয়ে সর্বাধিক সফল মানুষগুলোর পথ অবলম্বন করা ইত্যাদি। সফল ব্যক্তিরা সর্বদা তাদের যোগ্যতাকে আরও শাণিত করতে ব্যস্ত থাকে। যারা ব্যর্থ হয় তারা একই কাজ তার প্রাসঙ্গিক-আনুষাঙ্গিক বিষয়বস্তু না বুঝে বারবার একই ভাবে করতে থাকে। তাই কৌশলী হোন। কাজে নামার আগে মনে করুন কিছুই জানে না। যাবতীয় রসদ-সরঞ্জাম সংগ্রহ করুন, যা আপনাকে সঠিক পথে নিয়ে যাবে এবং এগিয়ে যেতে সাহায্য করবে।

৫. আমি কি আসলেই ব্যর্থ হতে চাই? ব্যর্থতাকে বরণ করে নিন। এটি অবশ্যম্ভাবী। সফলতা অর্জনের পূর্বে আপনাকে পরাজয় দেখতেই হবে। আমাদের ব্যর্থতাগুলো থেকে আমরা অত্যন্ত মূল্যবান পাঠ গ্রহণ করি। ব্যর্থতা উন্নতি ও অগ্রগতির জন্য অপরিহার্য। স্বাভাবিকভাবেই একে গ্রহণ করুন। সফলতার পথে এটি অন্তরায় নয়; বরং সাধারণ প্রক্রিয়া। এতে করে ব্যর্থতা আপনার ওপর বিজয়ী হতে পারবে না। সত্য হল, যদি ব্যর্থতাকে ভয় না পান, আপনি সাফল্যের পথেই আছেন। লক্ষ্য অর্জনে অপরিহার্য অথচ বড় একটি উপাদান হিসাবে ব্যর্থতাকে সাদরে গ্রহণ করুন।

 

ব্যর্থতাকে সাফল্যে রূপান্তর

ব্যর্থতা একটি শিখন প্রক্রিয়া। এতে করে দেখা যায়, আপনি ব্যর্থতা থেকে কী কী শিখেছেন এবং নিজের জীবনে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে এসব শিক্ষা কীভাবে কাজে লাগিয়েছেন। ব্যর্থতা মানে কোনো পরিস্থিতিতে মানিয়ে নেওয়াকে নির্দেশ করে। ব্যর্থতা থেকে পালানোর চেষ্টা করবেন না। পালানোর কারণে আপনি আদতে কোনো ঝুঁকি নিলেন না... এবং অর্জন করতে পারলেন কম। যেমন বেভারলি সিল একবার মন্তব্য করেছিলেন, ‘ব্যর্থতা আপনাকে হতাশাগ্রস্ত করবে সত্য, কিন্তু আপনি যদি কোনো চেষ্টাই না করেন, তবে আপনি নিজেকে নিশ্চিত পরাজয়ের দিকে ঠেলে দিবেন।’

না, আপনার প্রতিটি চুক্তি সফল হবে না। প্রতিটি বিনিয়োগ থেকে আপনি মুনাফা লাভ নাও করতে পারেন। জীবনে হার-জিত সূর্যের ন্যায় সত্য। সর্বাধিক সফল ব্যক্তির জন্যও এটি প্রযোজ্য। বিজয়ী জানে তাকে হাঁটার আগে হামাগুড়ি দিতে হবে। দৌড়ানোর আগে তাকে হাঁটতে হবে। প্রতিটি নতুন লক্ষ্যের সাথে অনেকগুলো অনিবার্য ব্যর্থতা যুক্ত থাকে। নির্ভর করছে আপনার ওপর। আপনি কি হতাশাজনক অবস্থাসমূহকে সাময়িক বাধা ও চ্যালেঞ্জ মনে করবেন, নাকি অনতিক্রম্য বাধা মনে করবেন।

যদি আপনি প্রতিটি ভুল ও পরাজয় থেকে শেখার অভ্যাস গড়ে তোলেন, প্রত্যাশিত সর্বশেষ ফলাফলের ওপর মনোযোগ নিবদ্ধ রাখেন, তবে ব্যর্থতা একদিন আপনাকে সাফল্যের মুখ দেখাবেই।


 





অধ্যায় ১২


যদি তুমি অন্যরা যা চায় তা পেতে সাহায্য করো, তবে নিজে যা চাও তাই পাবে জীবনে।

- জিগ জিগলার


নেটওয়ার্কিং– যা সুফল বয়ে আনে


১৯৯০ সালের শেষের দিকে আমি ফ্রিল্যান্স লেখক স্টু কামেনের সাথে দেখা করি। এটা আমার ব্যবসাতে সারা জীবনের জন্য একটি অবিশ্বাস্য সুফল এনে দিয়েছে। আপানাদের ঘটনাটি জানাচ্ছি।

১৯৯২ সাল। তখন স্টু ‘থিংক এন্ড গ্রো রিচ’ নামক একটা সংবাদপত্রে নিয়মিত লিখতেন। স্টুরই পরামর্শে পত্রিকাটির প্রথম পৃষ্ঠাতেই আমাকে নিয়ে একটি গল্প প্রকাশ করে– কীভাবে আমি আইনজীবী থেকে একজন অনুপ্রেরণাদানকারী বক্তায় পরিণত হলাম। ঐ সময়েই আমি আবার সংবাদপত্রটির সাথে বই বিক্রির একটা ব্যবসায়িক চুক্তিতে স্বাক্ষর করি এবং তারা আমার ‘এটিটিউড ইজ এভিরিথিং’ বইটি তাদের প্রকাশনীর মাধ্যমে প্রচার করে। তখন হাজার হাজার বই বিক্রি হয়।

‘থিংক এন্ড গ্রো রিচ’ সংবাদপত্রটি তাদের প্রকাশনী থেকে আমার নিজের কিছু প্রবন্ধও প্রকাশ করে। ফলস্বরূপ তাদের পাঠকদের কাছ থেকে প্রচুর সাড়া পাই এবং বিভিন্ন সময়ে তাদের কাছ থেকে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বক্তব্য প্রদানের আমন্ত্রণ পাই।

এই সময়ে জিম ডুনোভান নামক নিউ ইয়র্কের তাদের একজন গ্রাহকের কাছ থেকে একটা চিঠি আসে। আমাদের মধ্যে ভালো বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। জিম আমাকে আইএনটিআই পাবলিশিং এন্ড রিসোর্স বুকস নামক প্রকাশনীর সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়, যারা আপনার হাতে থাকা আমার বইটি প্রকাশ করে। এর মধ্যে জিম নিজে ‘হ্যান্ডবুক টু এ হ্যাপিয়ার লাইফ’ এবং ‘দিস ইজ ইউর লাইফ, নট এ ড্রেস রিহার্সেল’ নামক দুইটি গুরুত্বপূর্ণ বই লিখে ফেলে।

আমার সাথে এতো ভালো কিছু ঘটে যাওয়ার পিছনে মূলত কাজ করেছিল স্টু কামেনের সাথে আমার পরিচয় হওয়া... তারপর থিংক এন্ড গ্রো রিচ সংবাদপত্রটির নেটওয়ার্কের আওতায় আসা... এবং জিম ডুনোভানের নেটওয়ার্কের আওতাভুক্ত হওয়া। নেটওয়ার্কিং এর ক্ষমতা এক কথায় অসাধারণ!

আপনাকে যদি সফলতায় পৌঁছানোর জন্য দুটি রাস্তা থেকে একটি বেছে নিতে বলা হয় এবং রাস্তা দুটোর একটি যদি কম সময়ের, আর অপরটি যদি হয় দীর্ঘ সময়ের; আপনি কি কম সময়ের রাস্তাটি বেছে নিবেন না? নেটওয়ার্কিং বা ভালো যোগাযোগ ও সম্পর্ক তৈরি করাও এমন একটি রাস্তা, যা আপনার কাজকে আরও সহজ করে দেয় এবং দ্রুততার সাথে সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দেয়। সবশেষে যত ভালো ও মজবুত সম্পর্ক তৈরি করবেন, আপনার সাফল্যের জন্য ততো ভালো সুযোগ তৈরি হবে।


নেটওয়ার্কিং এর সুবিধা

যদি আপনি ইতিবাচক ও প্রাণবন্ত হোন, মানুষ আপনার সঙ্গ কামনা করবে।

- জেফ কেলার


আসলে সাফল্য আপনাকে দিয়ে আরম্ভ হয় এ কথা সত্য। কিন্তু এর ক্রমবর্ধমান উন্নতির পিছনে কাজ করে মানুষের সাথে আপনার সম্পর্ক ও সংশ্লিষ্টতা। এককথায়, বড় মাপের সাফল্য আপনার একার পক্ষে অর্জন সম্ভব হবে না।

তাই নেটওয়ার্কিং কিংবা মানুষের সাথে সম্পর্ক তৈরি করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অধ্যায়টি বোধগম্য হওয়ার জন্য নেটওয়ার্কিং পরিভাষাটির ব্যাখ্যা প্রয়োজন। নেটওয়ার্কিং হল পারস্পরিক সুবিধা বৃদ্ধির জন্য মানুষের সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলা।

ব্যবসার ক্ষেত্রে নেটওয়ার্কিং-এর সুবিধা নিচে উল্লেখ করা হল:

১. ব্যবসাতে নতুন গ্রাহক তৈরি বা ব্যবসায়িক নেতৃত্ব লাভ হয়।

২. চাকরির সুযোগ সুবিধা তৈরি হয়।

৩. জটিল পদের জন্য সঠিক মানুষ বাছাই করতে সাহায্য করে।

৪. গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ও সাহায্য সরবরাহ করে।

৫. সমস্যা সমাধানে সাহায্য করে।


ব্যক্তি পরিসরে নেটওয়ার্কিং আপনার জন্য যা করতে পারে:

১. নতুন বন্ধুদের সাথে পরিচয়ের মাধ্যমে আপনার সামাজিক সম্পর্ক বৃদ্ধি করে।

২. বিভিন্ন বর্ণের, সংস্কৃতির ও দর্শনের মানুষের সাথে আপনাকে পরিচিত করে তোলে।

৩. আপনাকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য-উপাত্ত দিয়ে সাহায্য করে।

৪. আপনার আধ্যাত্মিক উন্নতিতে অবদান রাখে।

এখন আমরা জানলাম নেটওয়ার্কিং কী করতে পারে। প্রশ্ন থেকে যায়– নেটওয়ার্কিং এর কার্যকারিতা বাড়ানোর জন্য আমরা কী করতে পারি? ১৬টি উপায় বলছি যা আমি মনে করি খুবই কার্যকর। বিষয়টিকে সহজ করার জন্য আমি উপায়গুলোকে ৪টি আলাদা কিন্তু সম্পর্কিত বিভাগে বিভক্ত করেছি। ১. মনোভাব ও কর্ম

২. সুপারিশ

৩. যোগাযোগ

৪. পরিকল্পনা অনুসরণ করা তথা ফলো-আপ (ভড়ষষড়-িঁঢ়)


মনোভাব ও কর্ম

১। বিজয়ী মনোভাবের প্রতিফলন ঘটান। নেটওয়ার্কিং প্রশ্নে মনোভাবের ওপর সবকিছু নির্ভর করে! যদি আপনি ইতিবাচক মনোভাব সম্পন্ন হয়ে থাকেন এবং উদ্যমী হয়ে থাকেন, মানুষ আপনার সাথে সময় কাটাতে চাইবে। তারা আপনাকে সাহায্য করতে চাইবে। অন্যদিকে, যদি আপনি মনমরা ও নেতিবাচক মনোভাব সম্পন্ন হয়ে থাকেন, তাহলে তারা আপনাকে এড়িয়ে চলবে। আপনাকে তাদের বন্ধু-বান্ধব কিংবা সহকর্মীদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে তারা দ্বিধান্বিত হবে।

২। নিজেকে বিভিন্ন দল ও সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ত করান। কার্যকরী নেটওয়ার্ক ও সম্পর্ক গঠনের ব্যাপারটা বকেয়া পরিশোধ, কোনো পত্র-পত্রিকায় নিজের নাম অন্তর্ভুক্তকরণ কিংবা সাক্ষাৎকারে উপস্থিতি ইত্যাদির চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আপনাকে অবশ্যই নির্দিষ্ট ও স্পষ্ট করতে হবে কখন আপনি ঐ নির্দিষ্ট দলটিকে সময় দিবেন।

আপনি কী করতে পারেন? নতুন সংগঠনের ক্ষেত্রে, আপনি কমিটিতে স্বেচ্ছাসেবকের কাজ করতে পারেন অথবা কর্মকর্তা কিংবা বোর্ড পরিচালনা কমিটির সদস্য হতে পারেন। অন্য সদস্যরা আপনাকে সম্মান করবে, যখন দেখবে আপনি হাতা গুটিয়ে কাজে নেমে পড়েছেন। তারা আপনার নেতৃত্ব দক্ষতা, চরিত্র এবং সবশেষে যা দেখবে তা হল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক– আপনার মনোভাব ও চিন্তাভাবনা।

এবার কিছু সময়ের জন্য স্টু কামেনের আলোচনায় ফিরে যাওয়া যাক। তিনি বিজ্ঞাপন সংস্থার মানুষের সাথে সম্পর্ক তৈরি করতে চেয়েছিলেন। তাই তিনি ১৯৯৪ সালে ‘লং এডভারটাইজিং ক্লাব’ নামক ক্লাবটিতে যুক্ত হন। স্টু তাৎক্ষণিকভাবে তাদের দলীয় মিটিং-এ সময় দেওয়া আরম্ভ করে দেন। তারা যখন বিভিন্ন কর্ম পরিকল্পনার জন্য স্বেচ্ছাসেবক চাচ্ছিল, স্টু দেরি না করে নিজের নাম লেখালেন। এরপর থেকে সক্রিয়ভাবে সংস্থায় জড়িয়ে পড়লেন!

ছয় মাসের মধ্যে কেউ একজন তাকে এসে বলল, ‘আমি শুনেছি, তোমার মধ্যে ভালো কিছু আছে। তুমি কঠোর পরিশ্রমী ও উদ্যমী। তুমি কি আমাদের বোর্ড পরিচালনা কমিটিতে সদস্য হতে ইচ্ছুক?’ আপনি যেমন চিন্তা করছেন, স্টু সেদিন আনন্দচিত্তে প্রস্তাবটি গ্রহণ করেছিল। আর কয়েক মাসের মধ্যে তিনি তার ব্যবসাতে সাফল্য দেখতে পেলেন। ১৯৯৯ সালের শুরুর দিকে স্টু আমাকে বলেছিল, তার তখনকার ব্যবসার পঞ্চাশ শতাংশেরও বেশি গ্রাহক ‘লং আইল্যান্ড এডভারটাইজিং ক্লাবের মাধ্যমে পরিচিত মানুষের কাছ থেকে পাওয়া। নেটওয়ার্কের মাধ্যমে মানুষ অল্প সময়ে অধিক ভালো ফলাফল পেতে পারে স্টু এর ঘটনা তার প্রমাণ।

৩। আপনার নেটওয়ার্কের মানুষগুলোকে সাহায্য করুন। অন্যের সাহায্য করা আপনার নেটওয়ার্ক গঠনে এবং উপকার পাওয়ার ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। আপনি কী পাবেন তা না ভেবে, ভাবা উচিত কীভাবে আপনি সর্বদা অন্যের সাহায্য করতে পারেন। যদি আপনি মরিয়া হয়ে হয়ে উঠেন দেওয়ার পরিবর্তে নেওয়ার জন্য, তাহলে আপনাকে সাহায্য করার মতো কোনো মানুষ খুঁজে পাবেন না। অন্যের জন্য অতিরিক্ত কিছু মাইল এগিয়ে যাওয়া, নিজের দিকে ভালো কিছু এগিয়ে আনার অন্যতম একটি উপায়।

কীভাবে আপনার নেটওয়ার্কের লোকগুলোকে সাহায্য করবেন? আগ্রহী কিংবা সম্ভাব্য গ্রাহকদের কোনোকিছুর সুপারিশের মধ্য দিয়ে শুরু করতে পারেন। তাছাড়া যখন আপনি কোন প্রবন্ধ অথবা কোন তথ্য দেখতে পান, যা আপনার নেটওয়ার্কের মধ্যকার কোন মানুষের উপকারে আসতে পারে, তাকে ঐ তথ্যটি দিয়ে সাহায্য করুন।


অনবরত যারা ভোগ করে তারা পায় না; বরং তারাই পায় যারা দান করে।

- ইউজিন বেঞ্জ


যখন আমি কার্যকরী নেটওয়ার্কের কথা চিন্তা করি, প্রথম যে নামটি আমার মনে আসে, তা হল, মার্ক লেব্লেঙ্ক। মার্ক এমন ব্যবসায়ী যারা নিজেদের ব্যবসা সম্প্রসারণ করতে চায় এবং বিক্রেতাদের কাছে নিজেদের পণ্য আরও বেশি পরিমাণে বিক্রি করতে চায়, তাদেরকে ব্যবসায়িক পরামর্শ দিতেন। আমি অনেক মানুষের কাছে মার্কের নাম সুপারিশ করেছি। কেন? তিনি ছিলেন বুদ্ধিমান, সেবামুখী মানুষ, যিনি আমাকে যথেষ্ট উৎসাহ জুগিয়েছেন... এবং আমাকে আমার ব্যবসা প্রতিষ্ঠার কাজে সাহায্য করেছেন।

মার্ক আমাকে তার নেটওয়ার্কের আওতাধীন মানুষগুলোর সংস্পর্শে নিয়ে যান, যারা আমাকে তাদের সাধ্য অনুযায়ী সাহায্য করেন। মার্ক তার উপস্থাপনার সময় আমার পণ্যগুলো বিলি করতেন। তিনি এমন একজন ব্যক্তি, যিনি শুধু দিয়েই যান... দিয়েই যান... এবং দিয়েই যান। এই একটি কারণে সবাই তাকে সবসময় সাহায্য করার জন্য এগিয়ে আসে। আর এটিই একটি কারণ, যার ফলে তার নিজের ব্যবসাতে এত উন্নতি ছিল!

বাইবেলে যেমন বলা হয়েছে, ‘দাও এবং এটা তোমার দিকেই ফিরে আসবে।’

এটাই সত্য।


সুপারিশ

৪। যদি আপনি কাউকে কোন চাকরির জন্য সুপারিশ করেন, তবে সেও যেন আপনার নাম তুলে ধরে তা নিশ্চিত করুন। স্পষ্ট করা যাক। মনে করুন, আপনি আপনার গ্রাফিক্স ডিজাইনার জেইন জোন্সের ব্যাপারে জন স্মিথকে জানালেন। আপনি হয়তো বলবেন, ‘জেইনকে একটা কল করো এবং তাকে বলো যে, আমি তোমাকে তার কাছে ফোন করতে বলেছি।’ অথবা আপনি হয়তো নিজেই জেইনকে কল করে বলবেন যে, জন স্মিথ তার সাথে যোগাযোগ করবে।

এরপর, আপনি জেইনের সাথে যখন দেখা করবেন বা কথা বলবেন, মনে করে তার কাছে জানতে চাইবেন যে, জন কল করেছিল কিনা এবং পরে কী হল। আপনি বারবার কোনো না কোনোভাবে জেইনকে মনে করিয়ে দিন যে, আপনি তার ব্যাপারে যতœশীল এবং তার ব্যবসার প্রসারে তাকে সাহায্য করতে চাচ্ছেন।

৫। সতর্কভাবে বাছাই করুন। যার সাথেই আপনার দেখা হয় তার ব্যাপারেই সুপারিশ করতে যাবেন না। আপনার নেটওয়ার্কের মানুষগুলোর সময়ের মর্যাদা দিন। অদক্ষ মানুষের জন্য সুপারিশ আপনার ওপর খারাপ প্রভাব ফেলবে। নিজেকে প্রশ্ন করুন, একটা নির্দিষ্ট সুপারিশ কি সত্যি আপনার নেটওয়ার্কের মধ্যকার মানুষটির জন্য উপকারী? মনে রাখবেন, যার জন্য সুপারিশ করছেন তার গুণ ও যোগ্যতাই মুখ্য, পরিমাণ নয়।


যোগাযোগ

অন্যকে সহযোগিতার মাধ্যমে আপনি দ্রুত ও সর্বাধিক সাফল্য অর্জন করতে পারবেন।

- নেপোলিয়ন হিল


৬। একজন ভালো শ্রোতা হোন। আপনি কি কখনো এমন কোন মানুষের সাথে কথা বলেছেন, যে নিজের এবং নিজের ব্যবসার ব্যাপারে বলতেই থাকে; কিন্তু একটি মুহূর্তের জন্যও আপনার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে না? আমরা সবাই ‘আমি, আমি, আমি’ প্রকৃতির হয়ে গেছি এবং তারাই যেন শেষ মানুষ, যাদের আপনি সাহায্য করতে চান।

আপনার কথোপকথনে অন্যের দিকে খেয়াল রাখুন। অন্যদের নিয়ে আলোচনা করুন। তাদের কাজ ও আগ্রহ সম্পর্কে বলতে দিন। যার ফলে আপনি যতœশীল, চিন্তিত ও বুদ্ধিমান হিসাবে গ্রহণযোগ্যতা পাবেন। অবশেষে আপনার পালা এলে তখন কথা বলুন। নিজের সম্পর্কে তাদের জানান। এটি ডেল কার্নেগির বিশ^বিখ্যাত বই প্রতিপত্তি ও বন্ধুলাভ তথা ঐড়ি ঃড় রিহ ভৎরবহফং ধহফ রহভষঁবহপব ঢ়বড়ঢ়ষব এর অন্যতম সূত্র এবং এটা খুবই কার্যকর!

৭. মানুষকে সময়ে সময়ে ফোন করুন, কারণ তাদের ব্যাপারে আপনি যতœশীল। যখন কেউ আপনাকে ফোন করে আপনি কেমন বোধ করেন? কেমন অনুভূতি হয় যখন ফোন করে বলে, ‘আমি তোমার ব্যাপারে চিন্তা করছিলাম? এখন কেমন আছ? কী করছ?’ আমি বাজি রাখতে পারি, আপনার তখন মনে হবে আপনি লাখ টাকা জিতেছেন! যদি তেমন হয়, তবে কেন আমরা মাঝে মাঝে অন্যকে ফোন করি না?

হরহামেশা, আপনার পরিচিত মানুষকে ফোন করা একটি কাজ বানিয়ে নিন। জিজ্ঞাসা করুন কেমন আছে তারা। বলুন তাদের পাশে আছেন। সহযোগিতা ও অনুপ্রেরণার দিন। আপনি তাদের প্রতি যতœবান শুধু এ কারণে তাদের ফোন করুন এবং এটিই মানুষের কাছ থেকে এমন আচরণ ও ভালোবাসা পাওয়ার পদ্ধতি।

প্রতি ডিসেম্বরে আমি আমার গ্রাহক যাদের সাথে দীর্ঘদিন ধরে কথা হচ্ছে না তাদের ফোনে খোঁজখবর নিই। তাদের অনেকে আছেন যারা দীর্ঘদিন ধরে আমার কোম্পানি থেকে কোনোকিছু ক্রয় করেননি। আমি কল দিই অনুপ্রেরণার জন্য এবং তাদের সাথে বন্ধুত্ব অক্ষুণœ রাখার জন্য। তাদেরকে কোনোকিছু বিক্রয় করার চেষ্টা করি না। অতীতে তারা আমাকে যে সেবা প্রদান করেছে, তার জন্য তাদের প্রশংসা করি। তারা কেমন আছে, ব্যক্তিগত ও ব্যবসায়িক দিনকাল কেমন যাচ্ছে তা শোনার উদ্দেশ্য থাকে।

এতে করে আমার ব্যবসায়িক কোনো উপকার আসলে, তা উত্তম। আর যদি আমার ব্যবসায়িক কোনো উপকার না হয়, তাও উত্তম।

বছরের পর বছর, এ সকল ফোন কলের কারণে আমার ব্যবসা সচল থাকে। কেউ হয়তো বলবে, ‘আমার আরও কিছু “মনোভাবের ওপর সবকিছু নির্ভর করে” (অঃঃরঃঁফব ওং ঊাবৎুঃযরহম) লেখাযুক্ত ল্যাপেল পিন চাই অথবা আমাদের কোম্পানি ছ’মাসের মধ্যে একটি বিক্রয় সভা করতে যাচ্ছে এবং তারা চায় আপনি এ অনুষ্ঠানে বক্তব্য উপস্থাপন করুন।’

দয়া করে মনে করবেন না, এটা আমার কোনো হীন প্রচেষ্টা বা ব্যবসায়িক কোন কৌশল। আমি চাই না, এই মানুষগুলো আমাকে কাজ দিক বা আমার কোম্পানি থেকে কেনাকাটা করুক। আমি চাই, মনেপ্রাণে চাই, তারা কেমন আছে ও কী করছে। তাদের সাথে সম্পর্ক জোরদার করতে গিয়ে ব্যবসা নিছক একটি উপজাতক হিসাবে আবির্ভূত হয়।

৮. প্রতিদিন মানুষের সাথে মিলিত হওয়ার সুযোগ খুঁজুন। যেকোনো স্থানকে সম্পর্ক বৃদ্ধিতে কাজে লাগাতে পারেন। হতে পারে, তা স্বাস্থ্য সংঘে কিংবা সুপারমার্কেটের লাইনে দাঁড়িয়ে। আপনি জানেন না কোন স্থানটি কাজে লাগবে। জানেন না কোনো বীজ থেকে আপনার সম্পর্কের নতুন চারাটি গজাবে।

সাপ্তাহিক ছুটিতে যখন আমি ব্যায়ামাগারে যাই, মনোভাবের ওপর সবকিছু নির্ভর করে লেখাযুক্ত টি-শার্ট পরে যাই। এটি আড়ষ্টতা ভাঙতে অনেক বেশি সহায়ক। মানুষ আমার কাছে আসে এবং ‘মনোভাবের ওপর সবকিছু নির্ভর করে’ বিষয়টি নিয়ে কথা বলে। কথোপকথন আমাকে তাদের ব্যাপারে জানার সুযোগ করে দেয় এবং তাদেরকে আমার কোম্পানি সম্পর্কে অবগত করার সুযোগ পাই।

৯. প্রতিটি মানুষকে মূল্যায়ন করুন এবং সমান গুরুত্ব দিন। কেবল প্রভাবশালীদের গুরুত্ব দিবেন আর অন্যদের নয়– এমন যেন না হয়। উন্নাসিকতা পরিহার করুন। যে কারও সাথে আপনার দেখা হোক (তারা বড় মাপের ব্যক্তি হোক বা না হোক) হতে পারে তার এমন কোনো বন্ধু বা পরিচিত ব্যক্তি আছে যে আপনার পণ্য বা সেবার দ্বারা উপকৃত হবে। তাই, কোনো সভায় বা অনুষ্ঠানে কারও সাথে কথা বলতে পূর্ণ মনোযোগ ও গুরুত্ব দিন।

কথা দিন তাদের মতো হবেন না, যারা কোথাও গেলে কথা বলার জন্য চারপাশে গুরুত্বপূর্ণ মানুষ খুঁজে বেড়ায়। এটি খুবই বিরক্তিকর! আপনি কারও সাথে কথা বলছেন এবং হঠাৎ করে ঘরের কোণায় আপনার শ্রোতা আরেকজনকে লক্ষ্য করে– যাকে সে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি মনে করে– ফলে সে আপনার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দেয় এবং আচমকা ঐ ব্যক্তির সাথে কথা বলা আরম্ভ করে দেয়। এমনটি করবেন না! প্রতিটি ব্যক্তি যার সাথে আপনি মিলিত হোন শ্রদ্ধা ও সম্মান রেখে কথা বলুন।

১০. সভা-সেমিনারে নতুন নতুন মানুষের সাথে মিলিত হওয়ার চেষ্টা করুন। প্রতিটি জমায়েতে একই মানুষের সাথে বসা থেকে বিরত থাকুন। যদিও সেমিনারের বিষয় ইত্যাদি নিয়ে বন্ধুদের সাথে কথা বলা ইতিবাচক, কিন্তু নতুন মানুষের সাথে পরিচিত হওয়ার কারণে বেশি উপকৃত হতে পারবেন।

১৯৯৪ সালে আমি ওয়াশিংটন ডিসিতে জাতীয় বক্তা সমিতির বার্ষিক সম্মেলনে যোগদান করি। মধ্যাহ্ন ভোজে আমি বন্ধুদের সাথে খেতে না বসে একদল অপরিচিতদের সাথে যোগ দিই। ঐ টেবিলে বসে আমি একজন মহিলার সাথে পরিচিত হই। তার নাম ছিল জোয়ান বার্গ। আমাদের আলাপচারিতায় নানা বিষয় উঠে আসে। তার কোম্পানি প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের জন্য চমৎকার প্রশিক্ষণ কর্ম সম্পাদন করে থাকে।

কথা প্রসঙ্গে জানা গেল জোয়ানও মনোভাবের ওপর সবকিছু নির্ভর করে দর্শনে বিশ্বাসী! আর গত ৫ বছর ধরে সে আমার কোম্পানি থেকে মনোভাবের ওপর সবকিছু নির্ভর করে যুক্ত ল্যাপেল পিন ক্রয় করে এবং তা প্রশিক্ষণের সময় প্রশিক্ষণার্থীদের মাঝে বিলি করে। পাশাপাশি, জোয়ান আমার সাহিত্য কর্ম তার প্রোগ্রামে প্রচার করে, যার ফলে আমার হাজার হাজার ডলার আয়ের সুযোগ হয়েছে। সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল জোয়ান আমার একজন ভালো বন্ধুতে পরিণত হয়।

আমি আনন্দিত যে, সেদিন আমি বন্ধুদের সাথে খেতে বসিনি। তা না হলে সেদিন একটি বড় সুযোগ হাত ফসকে যেত।

১১. স্বস্তিদায়ক বলয়ের বাইরে যাওয়ার সাহস রাখুন। যেমন, যদি নিজেকে কারও সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে মন চায়, তবে তাই করুন। হয়তো আপনি সংশয়ে আছেন। ভাবছেন ব্যক্তিটি অনেক বড় মাপের বা ব্যস্ততার দরুন আপনার সাথে কথা বলতে পারবে না। এমনকি যদি বিচলিত হয়ে পড়েন, নিজেকে বাধ্য করুন অগ্রসর হতে এবং কথা বলতে। সময় গড়ালে তার সাথে সম্পর্ক সহজ হয়ে যাবে।

১২. যা প্রয়োজন হয় তা জিজ্ঞেস করুন। অন্যকে সাহায্য করার কারণে এখন আপনার অধিকার আছে তার সাহায্য কামনা করার। লজ্জিত হবেন না। যেহেতু আপনার পরিচিতদের আপনি সাধ্যমতো সাহায্য করেছেন, সেহেতু তারাও কৃতজ্ঞতাবোধ থেকে চাইবে আপনার জন্য কিছু করতে।


পরিকল্পনা অনুসরণ করুন তথা ফলো-আপ (ভড়ষষড়-িঁঢ়)

প্রতিনিয়ত কাজ করে যান, কাজটি বারবার করুন এবং পুনর্নিরীক্ষণ করুন।

- অজানা বক্তা


১৩. কারও সাথে প্রথম সাক্ষাতের পরপরই ছোট্ট একটি বার্তা পাঠান। যেমন কোথাও নৈশ ভোজনে গেলেন এবং নতুন কারও সাথে পরিচয় হল। অনুষ্ঠান শেষে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাকে একটি ক্ষুদে বার্তা দিন যে, তার সাথে সাক্ষাতে আপনি আনন্দিত বা তার সাক্ষাৎ উপভোগ করেছেন। নিজের সম্পর্কে সংক্ষেপে এমন কিছু বলুন যা তাকে মুগ্ধ করবে। এমন কোন তথ্য দিন যা সে পছন্দ করবে (যেমন হতে পারে কোনো ব্যবসায়িক সাময়িকীর নাম এবং সাথে সদস্য কার্ড)। অথবা জিজ্ঞাসা করুন তার জন্য কিছু করতে পারেন কিনা।

লক্ষ্য রাখবেন, বার্তাটি যাতে সাক্ষাতের ৪৮ ঘন্টার মধ্যেই পৌঁছানো হয়। দেরি হলে আপনাকে ভুলেও যেতে পারে।

১৪. মুগ্ধতার স্বীকারোক্তি দিন। যদি ভালো কোনো বক্তব্য শ্রবণ করেন বা সুন্দর প্রবন্ধ পাঠ করেন, তবে বক্তাকে বা লেখককে লিখে পাঠান, আপনি তাদের বক্তব্য বা প্রবন্ধ উপভোগ করেছেন এবং এর মাধ্যমে উপকৃত হয়েছেন। একশজনে একজন এই কাজটা করে। আপনি সেই একজন হওয়ার চেষ্টা করুন!

আমি বলছি না, বক্তা বা লেখকগণ মহৎ ব্যক্তি যাদের তোয়াজ করা প্রয়োজন হবে। আমার উদ্দেশ্য হল, বক্তা ও লেখকদের বড় একটি নেটওয়ার্ক থাকে। অনেকের সাথে তাদের পরিচয় আছে। ফলে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষের সাথে আপনার পরিচিতি গড়ে উঠবে।

১৫. যখন আপনি কোনো সুপারিশমূলক (রেফারেল) বা উপকারী লিখিত বস্তু গ্রহণ করেন, সবসময় একটি ধন্যবাদ বার্তা তাকে লিখে পাঠান বা ফোনে তার প্রশংসা করুন। এই উপদেশ মেনে চলুন যদি আপনার আরও বেশি সুপারিশমূলক (রেফারেল) বার্তা বা উপকারী বার্তা পাওয়ার ইচ্ছা থাকে। যদি আপনি ঐ ব্যক্তির যথাযোগ্য প্রশংসা না করেন, তবে পরবর্তীতে সে আপনাকে সাহায্য করার অনুপ্রেরণা হারাবে।

১৬. শুভেচ্ছা বার্তা বা চিঠি প্রেরণ করুন। যদি আপনার পরিচিত কেউ পদোন্নতি লাভ করে বা পুরষ্কার কিংবা অন্য কোনো অনুষ্ঠান উদযাপন করে (যেমন বিয়ে বা শিশুর জন্মানুষ্ঠান), তবে অভিনন্দন জানিয়ে তাকে ক্ষুদে বার্তা প্রেরণ করুন। প্রত্যেকে প্রশংসিত হতে এবং স্বীকৃতি পেতে পছন্দ করে, কিন্তু খুব কম মানুষই অন্যের প্রশংসা করে। এ রকম চিন্তাভাবনা আপনাকে অন্যদের থেকে আলাদা করে দিতে পারে। কারও পরিবারের সদস্য মারা গেলে শোক বার্তা প্রেরণ বা স্মৃতিচারণমূলক উপহার প্রেরণও যথাযথ।


নেটওয়ার্ক তথা সম্পর্কের হাত বড় করুন

উপরে বর্ণিত সম্পর্ক তৈরির ধারণাটি বরফস্তুপের চূড়া মাত্র। আপনার নিজের নতুন নতুন ধারণাকে কাজে লাগাতে হবে। কীভাবে? কোনো পাঠাগার বা বইয়ের দোকানে যান এবং নেটওয়ার্কিং বা সম্পর্ক তৈরি বিষয়ে চমৎকার বইগুলো খুঁজে বের করুন... অন্যরা কীভাবে সম্পর্ক তৈরি করছে তা লক্ষ্য করুন। যেটা আপনার জন্য সহজ তা অবলম্বন করুন।

মনে রাখা প্রয়োজন, সম্পর্ক তৈরি হতে সময় লাগে। তৎক্ষণাৎ সুসম্পর্কের ফলাফল পাওয়া যায় না। তাই ধৈর্যশীল হোন! সম্পর্কের মজবুত ভিত গড়ে তুলুন। তাকে ছড়াতে দিন এবং পাকাপোক্ত হতে সাহায্য করুন। সম্পর্কের সুফল ঘরে তুলতে হলে আপনাকে দীর্ঘসময় অপেক্ষা করতে হবে।

সর্বশেষ বিষয়: আপনাকে আপনার নিজের কাজকর্মে দক্ষ হতে হবে। সম্পর্ক তৈরির দক্ষতা মানে এ নয় যে আপনার নিজ কাজকর্মে অদক্ষ হলেও চলবে। আপনি ব্যক্তি হিসাবে হয়তো গুরুগম্ভীর, কিন্তু যদি আপনি আপনার কাজকর্মে মেধাবী না হোন এবং প্রতিনিয়ত শেখা ও উন্নতিসাধন অব্যাহত না রাখেন, আপনার সব প্রচেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে।

এবার অগ্রসর হোন! বর্ণিত কৌশলগুলোর যেকোনো কৌশল সম্পর্ক তৈরিতে কাজে লাগান। পরিচিত মানুষগুলোর সাহায্য করুন এবং সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা করুন। এর ফলে আপনার সহযোগিতায় এবং আপনাকে সফল করে তুলতে বিশাল সৈন্যবহরকে আপনার পাশে পাবেন!


 





উপসংহার


পরিস্থিতি পরিবর্তন করতে হলে প্রথমে চিন্তার পরিবর্তন করুন।

- নরম্যান ভিনসেন্ট পিল


মনোভাব বদলান, জীবন বদলে যাবে


নভেম্বর ১৬, ১৯৯৮। ম্যানিলা, ফিলিপাইনস।

একটু আগে ২০টিরও বেশি দেশের মানুষের সামনে বক্তব্য প্রদান শেষ করলাম। আমার জন্য অসাধারণ এক প্রাপ্তি! শ্রোতাদের অনেকে বক্তব্য শেষে আমার কাছে ব্যক্তিগতভাবে দেখা করতে আসেন। তারা আমাকে ধন্যবাদ জানায় ম্যানিলাতে এসে জীবন পরিবর্তনকারী নীতি তাদের সাথে শেয়ার করার জন্য।

যখন সবাই রুম পরিত্যাগ করে চলে যায়, আমি আমার কাগজপত্র গোছাতে আরম্ভ করি। কিন্তু কেন জানি কিছুক্ষণের জন্য থেমে যাই। আমি জনশূন্য মিলনায়তনের দিকে তাকালাম... বাড়ি থেকে ৮,০০০ মাইল দূরে। নিজেকে চিমটি কাটলাম... স্বপ্ন দেখছি না তো!

১৯৮৫ সালে ফিরে গেলাম। আমার ঢেরায় বসে আছি। বিষণœ ও হতাশাগ্রস্ত। ওকালতি পেশা ছিল আমার। কিন্তু নিজের পেশাকে কখনো পছন্দই হয়নি। অন্য কিছু ভাবছিলাম। কিন্তু কী করব, কীভাবে করব তার নূন্যতম ধারণাও ছিল না। এখন ১৯৯৮ সালের শরৎকালে এসে আমি ফিলিপাইন্সে বসে আছি। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মানুষের সামনে অনুপ্রেরণামূলক বক্তব্য দিয়ে বেড়াচ্ছি। ‘কীভাবে সম্ভব হল এটা?’ নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করলাম।

স্পষ্ট ও ঝাঁজালো কণ্ঠে উত্তর শুনতে পেলাম। আমি আমার মনোভাব পরিবর্তন করেছিলাম।

যদি মনোভাব পরিবর্তন করতে পারেন, আপনার চারপাশে অগ্নি স্ফুলিঙ্গের ছড়াছড়ি দেখতে পাবেন। মনোবল চাঙা হবে। নতুন সম্ভাবনা আপনার সামনে আসতে থাকবে। পদক্ষেপ নিতে সাহস পাবেন। আর অপ্রত্যাশিত চমৎকার সব ফলাফল পাবেন। এজন্যই আমি বলি, মনোভাব পালটান, জীবন পালটে যাবে।

আপনার মনে হতে পারে আমি মজা করছি। তবে সত্য হল আমার জীবনের গত ১৪ বছর ছিল ক্রমাগত সাফল্যের গল্প। তবে এই যাত্রায় আমাকে পরাজয় ও বাধাবিপত্তিরও সম্মুখীন হতে হয়েছে। কিন্তু সাফল্যের যে মূলনীতিগুলো এ বইয়ে আলোচনা করেছি, তাই আমাকে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়ার জন্য উৎসাহ দিয়েছে, পথ দেখিয়েছে এবং শক্তি জুগিয়েছে।


জীবনের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করুন

এমন ভাবে কাজ করুন যেন ব্যর্থ হওয়াটা অসম্ভব ছিল।

- ডর্থি ব্র্যান্ড


সময় দিয়ে বইটি পড়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। এটি নির্দেশ করে আপনি প্রকৃতপক্ষে আপনার ভেতরের সুপ্ত যোগ্যতার বিকাশে আগ্রহী। তথাপি, এই বই পড়া আপনার কাক্সিক্ষত জীবন লাভের প্রথম পদক্ষেপ মাত্র। যখন আপনি এই আইডিয়াগুলোকে কাজে লাগাবেন এবং তা বাস্তবায়নের জন্য কাজ করবেন, তখন ধরে নিবেন, আপনি নিজের জীবনে অসাধারণ কিছু ঘটবে।

আপনি হয়তো লক্ষ্য করেছেন শতকরা ৫ জন মানুষ সাফল্যের সর্বোচ্চ শিখরে আরোহণ করতে পারে। কেন এমন হয়? ১৪ বছরের গবেষণায় আমি যা দেখেছি:

খুব কম লোকই আছে যারা এই বইয়ে বর্ণিত মূলনীতিগুলো নিয়মিত অনুসরণের চেষ্টা করে।

লোকজন জানে, তাদের চিন্তা বাস্তবে পরিণত হবে, তারপরও খুব কম লোকই আছে যারা নিয়মিত ইতিবাচক মনোভাব ধরে রাখতে পারে।

লোকজন জানে, তারা তাদের মস্তিষ্ককে সাফল্য বা ব্যর্থতার জন্য প্রস্তুত করছে, তারপরও খুব কম লোকই আছে যারা কথা বলার সময় নিজেদের উচ্চারিত শব্দ ও বাক্যের প্রতি লক্ষ করে। [লক্ষ মানে খেয়াল করা। আর লক্ষ্য মানে গন্তব্য।]

মানুষ যখন ভয়কে জয় করতে পারবে তখন তাদের যোগ্যতার বিকাশ ঘটবে। এমন করতে হলে, যেসব কাজ করতে মানুষ ভয় পায় সেসব কাজই করতে হবে। কিন্তু খুব কম লোকই আছে যারা নিজেদের ভয়ের মোকাবিলা করার জন্য পদক্ষেপ নেয়।

খুব কম লোকই আছে যারা কালো মেঘের আড়ালে লুকিয়ে থাকা সূর্যের হাসি দেখতে পায়।

খুব কম লোকই আছে যারা প্রতিজ্ঞা করে যে, তারা ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে এগিয়ে যাবে... এবং তাদের কাজ সম্পন্ন হওয়া অবধি প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়ার দৃঢ় মনোবল ধরে রাখবে।

আপনাকে চ্যালেঞ্জ করছি, উক্ত ছোট্ট দলের একজন সদস্য হোন।

আপনার যোগ্যতা ও সক্ষমতা আপনাকে আপনার স্বপ্নের চেয়েও বড় করতে পারে। শ্রেষ্ঠত্ব আপনার মাঝে লুকিয়ে আছে... আপনার মনোভাবই হল সে সুপ্ত যোগ্যতায় পৌঁছার অন্যতম চাবিকাঠি। আমার মনোভাব বদলানোর কারণে আমার জীবন বদলে গেছে। তাই যদি ইতিবাচক মনোভাব আমার মাঝে জাদুর মতো কাজ করতে পারে, তবে আপনার ক্ষেত্রে কেন নয়?

আপনাদের কাছে ড. চার্লস সুইন্ডলের একটি বক্তব্য তুলে ধরছি। তিনি মনোভাবের ইতিবাচকতার নির্যাস উপস্থাপন করেছেন এবং কীভাবে এটি আমাদের জীবন নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখে তা বর্ণনা করেছেন:


“জীবনে দিন যত গড়াচ্ছে, তত অনুধাবন করতে পারছি জীবনে মনোভাবের প্রভাব। আমার কাছে পরিস্থিতির চেয়ে মনোভাবই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এটি গুরুত্বপূর্ণ অতীতের চেয়ে, শিক্ষার চেয়ে, টাকা-পয়সার চেয়ে, পরিস্থিতির চেয়ে, ব্যর্থতার চেয়ে, সাফল্যের চেয়ে, লোকে যা চিন্তা করে, বলে ও করে তার চেয়ে। এটি অবয়ব, প্রতিভা ও দক্ষতার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এটি গড়তে বা ভাঙতে পারে একটি কোম্পানিকে... একটি উপসনালয়কে... একটি ঘরকে।”

উল্লেখ্য, প্রতিটি দিনের শুরুতে আমাদের কাছে সুযোগ থাকে কীভাবে বা কোন মনোভাবে আমরা সেই দিনটিকে মূল্যায়ন করব তা ঠিক করার। আমরা আমাদের অতীতকে বদলাতে পারব না... লোকে যে নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ায় বা পদ্ধতিতে কাজ করে আমরা তা পরিবর্তন করতে পারব না। আমরা যা অনিবার্য তাকে পালটাতে পারব না। যেটা আমাদের পক্ষে করা সম্ভব তা হল একটি স্ট্রিং (বাদ্যযন্ত্রের তার) যা আমাদের আছে তাতেই সুর তোলা। আর তা হল চিন্তাভাবনা ও মনোভাব।

‘আমি বিশ্বাস করি, জীবন হচ্ছে আমার সাথে যা ঘটে তার মাত্র ১০ ভাগ, আর আমি কীভাবে প্রতিক্রিয়া করি তাই হচ্ছে বাকি ৯০ ভাগ।’ অতএব সিদ্ধান্ত আপনার... আমরা আমাদের চিন্তা ও মনোভাবের নিয়ন্ত্রক।”


প্রতিটি বাক্যই শক্তিশালী ও আবেদনময়ী। নয় কি? চার্লস সুইন্ডলের পরামর্শ গ্রহণ করুন এবং ‘একটি স্ট্রিং (বাদ্যযন্ত্রের তার) যা আপনার আছে তাতেই সুর তুলুন।’ আর তা হল আপনার মনোভাব।

এখনি সময় নিজের মনোভাব ও চিন্তাকে নিয়ন্ত্রণ করার। এখনি সময় নিজের জীবনে অলৌকিক কিছু ঘটানোর।

অগ্রসর হোন। নিজের প্রতি আস্থা রাখুন। স্বপ্নকে বাস্তবায়নের প্রেরণা ও উৎসাহ খুঁজে নিন। লেগে থাকুন। সর্বোপরি, কখনো ভুলে যাবেন না যে, মনোভাবের ওপর সবকিছু নির্ভর করে!

সাফল্য অভিযাত্রায় আল্লাহ আপনার সহায় হোক।

 

ব্যক্তিগত উন্নয়নে

অন্যান্য বইয়ের তালিকা


০১. থিংক এন্ড গ্রো রিচ। মূল: নেপোলিয়ন হিল। অনুবাদ: ফজলে রাব্বি। ঢাকা, সাফল্য প্রকাশনী, ২০১৫।

০২. ডিভেলপিং দ্য লিডার উইদিন ইউ। মূল: জন সি. ম্যাক্সওয়েল। অনুবাদ: ফজলে রাব্বি। ঢাকা, সাফল্য প্রকাশনী, ২০১৭।

০৩. সাকসেস থ্রো এ পজেটিভ মেন্টাল এটিটিউড। মূল: নেপোলিয়ন হিল ও ডব্লিউ. ক্লেমেন্ট স্টোন। অনুবাদ: ফজলে রাব্বি। ঢাকা, সাফল্য প্রকাশনী, ২০১৭।

০৪. টাইম ম্যানেজমেন্ট। মূল: ব্রায়ান ট্রেসি। অনুবাদ: মোহাম্মদ রাশেদুল হক ও ফজলে রাব্বি। ঢাকা, সাফল্য প্রকাশনী, ২০২০।

০৫. অবজারভেশন। মূল: রাসেল এইচ. কনওয়েল। অনুবাদ: ফজলে রাব্বি। ঢাকা, সাফল্য প্রকাশনী, ২০১৭।

০৬. জিরো টু ওয়ান। মূল: পিটার থিয়েল ও ব্লেইক মাস্টার। অনুবাদ: ফজলে রাব্বি। ঢাকা, সাফল্য প্রকাশনী, ২০১৮।

০৭. আউটলায়ার্স। মূল: ম্যালকম গ্ল্যাডওয়েল। অনুবাদ: এ.এম. নাইম হোসেন ও ফজলে রাব্বি। ঢাকা, সাফল্য প্রকাশনী, ২০১৮।

০৮. ৭ স্ট্র্যাটেজিস ফর ওয়েলথ এন্ড হ্যাপিনেস। মূল: জিম রন। অনুবাদ: ফজলে রাব্বি। ঢাকা, সাফল্য প্রকাশনী, ২০১৯।

০৯. ওয়ান স্মল স্টেপ ক্যান চেঞ্জ ইউর লাইফ। মূল: ড. রবার্ট মৌরার (পিএইচডি)। অনুবাদ: ফজলে রাব্বি। ঢাকা, সাফল্য প্রকাশনী, ২০১৯।

১০. অ্যাজ আ ম্যান থিংকথ। মূল: জেমস অ্যালেন। অনুবাদ: ফজলে রাব্বি। ঢাকা, সাফল্য প্রকাশনী, ২০১৯।

১১. স্টার্ট উইথ হোয়াই। মূল: সাইমন সিনেক। অনুবাদ: ফজলে রাব্বি। ঢাকা, সাফল্য প্রকাশনী, ২০২০।

১২. এটিটিউড ইজ এভরিথিং। মূল: জেফ কেলার। অনুবাদ: ফারহা আহমেদ, শাহরিয়ার মাহমুদ ও ফজলে রাব্বি। ঢাকা, সাফল্য প্রকাশনী, ২০২০।

১৩. মেনটরিং ১০১। মূল: জন সি. ম্যাক্সওয়েল। অনুবাদ: ফজলে রাব্বি। ঢাকা, সাফল্য প্রকাশনী, ২০২০।

 

মেনটরিং ১০১

ধরুন, আপনার গাড়ির ওপরে অনেক টায়ার রয়েছে। যখন আপনার নিজের গাড়ির টায়ার ব্রাস্ট হল আপনার গাড়ির ওপরে থাকা টায়ার কিন্তু আপনি ব্যবহার করতে পারছেন না, শুধুমাত্র সামান্য কিছু যন্ত্রপাতি না থাকার কারণে। ঠিক তেমনই আমাদের জীবনে অনেকের মধ্যে অনেক ধরনের মেধা, ভালো চিন্তাধারা লুকিয়ে আছে। কিন্তু সেটাকে আমরা নিজেরাই ঠিকভাবে মূল্যয়ন না করার কারণে জীবনে সফলতার দ্বারপ্রান্তে আমরা পৌঁছাতে পারি না বা নিজেকে ঠিকভাবে গড়ে তুলতে পারি না। অনেক সুযোগ-সুবিধা থাকা সত্ত্বেও আমরা দিক-নির্দেশনার অভাবে নিজেদের জীবনকে কাজে লাগাতে পারি না।

তাই সাফল্য প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হল জন সি. ম্যাক্সওয়েলের বেস্ট সেলিং বই মেনটরিং ১০১। এ থেকে কিছু উদ্ধৃতি দিচ্ছি। এতে বইয়ের বিষয়বস্তু সম্পর্কে বুঝতে সহজ হবে:

১। মেনটরিং মানে আপনি নিজে যেমন আছেন সেখান থেকে আরও উন্নত হওয়া।

২। বিজ্ঞ পরামর্শ দ্বারা প্রশিক্ষণ বা মেনটরিং করার অন্যতম উদ্দেশ্যই হচ্ছে মানুষকে আরও এগিয়ে যেতে, উন্নত হতে সাহায্য করা।

৩। আপনি মানুষকে মেনটরিং বা বিজ্ঞ পরামর্শ দ্বারা তখনই প্রশিক্ষণ দিতে পারবেন যখন আপনি নিজে উন্নত হবেন এবং একজন নেতা হিসাবে এগিয়ে যাবেন।

৪। আপনার কাজগুলোর প্রধান কাজ হচ্ছে মানুষকে উন্নত করা। একে অন্যতম কাজ হিসাবে বিবেচনা করুন। মানুষকে উন্নত করার প্রতি সর্বোচ্চ মনোযোগ দিন।

বইয়ের সূচি, বিষয়বস্তু ও পর্যালোচনা (বুক রিভিউ) দেখতে ক্লিক করুন: িি.িংধঢ়যড়ষষড়.পড়স অথবা িি.িংধঢ়যড়ষষড়.পড়স/নষড়ম.


 

জিরো টু ওয়ান

আমাদের একটু ভিন্ন প্রশ্ন করতে হবে: ‘এমন কোনো কোম্পানি ভবিষ্যতে খুব মূল্যবান হতে পারে কিন্তু কেউ সৃষ্টি করছে না?’ প্রশ্নটি যত সহজ মনে হয় আসলে ততটা সহজ নয়। কারণ অভিনব কোনো কোম্পানি সৃষ্টি করলেই হবে না, সেটাকে মুনাফাজনক প্রতিষ্ঠানেও পরিণত করতে হবে। আপনার প্রতিষ্ঠান অনেক সেবা দিতে পারে, কিন্তু নিজের জন্য যথেষ্ট মুনাফা না-ও অর্জন করতে পারে। কেবল সমস্যার সমাধান করা বা সেবা প্রদান করাই যথেষ্ট নয়: আপনার নিজেকে বেঁচে থাকতে হলেও কিছু মুনাফা অর্জন করতে হবে।

এর মানে ব্যবসা অনেক বড় হলেও ব্যবসায় মন্দা ঘটতে পারে। উদাহরণ স্বরূপ, আমেরিকার আকাশ পথের ব্যবসা। এ পথে বহু কোম্পানি আছে যারা লাখো যাত্রীদের সেবা দিয়ে যাচ্ছে। প্রতিবছর কোটি কোটি টাকা আয় করছে। কিন্তু ২০১২ সালে দেখা গেল, গড়ে প্রতি যাত্রীর ভাড়া ১৪ হাজার ৫০০ টাকা অথচ একজন যাত্রী থেকে যাত্রা প্রতি মুনাফা হচ্ছে মাত্র ৩০ টাকা। একে এবার গুগলের সাথে তুলনা করা যাক। গুগল আকাশ পথের বিমান কোম্পানিগুলো থেকে অনেক কম সেবা দিয়েছে। কিন্তু তার লাভের অঙ্ক বেশ বড়। গুগল ২০১২ সালে বিমান কোম্পানিগুলোর ১৬ হাজার কোটি টাকার বিপরীতে ৫ হাজার কোটি টাকা আয় করেছে। কিন্তু গুগল সেই আয় থেকে ২১% মুনাফা অর্জন করেছে। যা বিমান কোম্পানিগুলোর মোট মুনাফা থেকে ১০০ গুণ বেশি। আর এখন তো গুগল যা টাকা আয় করে তা আমেরিকার সব বিমান কোম্পানির তিন গুণকেও ছাড়িয়ে গেছে।

আকাশ পথের এ উড়োজাহাজ কোম্পানিগুলো একে অপরের সাথে প্রতিযোগিতা করে। আর গুগল ব্যবসা করে একা। অর্থনীতিতে এই পদ্ধতির একটি নাম আছে। প্রথমটি হচ্ছে পূর্ণ প্রতিযোগিতার বাজার এবং দ্বিতীয়টি হচ্ছে একচেটিয়া বাজার। একচেটিয়া বাজার কী এবং আপনি কীভাবে একচেটিয়া বাজার তৈরি করতে পারেন তা জানতে পড়–ন পিটার থিয়েল রচিত এবং ফজলে রাব্বি অনূদিত জিরো টু ওয়ান বই। অনলাইনে দেখতে ক্লিক করুন: িি.িংধঢ়যড়ষষড়.পড়স অথবা িি.িংধঢ়যড়ষষড়.পড়স/নষড়ম.

 

পাঠকের লেখার সুবিধার্থে এই পৃষ্ঠা ইচ্ছাকৃতভাবে খালি রাখা হয়েছে:




কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন