বৃহস্পতিবার, ২১ জানুয়ারী, ২০২১

অ্যাজ আ ম্যান থিংকথ (যেমন করে মানুষ চিন্তা করে)। মূল: জেমস অ্যালেন। অনুবাদ: ফজলে রাব্বি। ঢাকা, সাফল্য প্রকাশনী, ২০১৯।




অ্যাজ আ ম্যান থিংকথ (যেমন করে মানুষ চিন্তা করে)। মূল: জেমস অ্যালেন। অনুবাদ: ফজলে রাব্বি। ঢাকা, সাফল্য প্রকাশনী, ২০১৯।


যেমন করে মানুষ চিন্তা করে


বাইরের এমন কিছুই নেই যা আপনাকে উত্তম করে তুলতে পারে অথবা শক্তিশালী, ধনী, দ্রুত বা আরও বুদ্ধিমান করে তুলতে পারে। সবকিছুই ভিতরগত বিষয়। সবকিছুই আপনার ভিতরে আছে। নিজের ভিতরে ছাড়া বাইরে খুঁজে কোন লাভ নেই।

 

– মিয়ামোতো মুসাশি (দ্য বুক অব ফাইভ রিংস)

আপনার সাফল্যের সারথি





অ্যাজ আ ম্যান থিংকথ

(যেমন করে মানুষ চিন্তা করে)



মূল

জেমস অ্যালেন



অনুবাদ

ফজলে রাব্বি








 










প্রকাশক

সাফল্য প্রকাশনী

৭৬, ইসলামিয়া মার্কেট,

নীলক্ষেত, ঢাকা-১২০৫

মোবাইল : ০১৫৩৪ ৯০২ ৮৮২

সাপ্র : ১০

প্রথম প্রকাশ : ভাদ্র ১৪২৬ / আগস্ট ২০১৯

বিষয় : ব্যক্তিগত উন্নয়ন

স্বত্ব :র্  ফজলে রাব্বি

প্রচ্ছদ : সাফল্য কম্পিউটার্স


দাম : একশত পঞ্চাশ টাকা মাত্র ($১৫০.০০) (হার্ডকভার)


পরিবেশক : নীলক্ষেত বুক মার্কেট, ৪৭৬ নম্বর দোকান, বাকুশা মার্কেট, নীলক্ষেত, ঢাকা-১২০৫।

ফোনে অর্ডার করতে কল করুন ০১৬৮২ ০৫৮ ১৭১

সাফল্য প্রকাশনীর অনলাইন ওয়েরসাইট–www.saphollo.com

সাফল্য প্রকাশনীর যেকোন বই কিনতে ভিজিট করুন

www.rokomari.com//সাফল্য-প্রকাশনী


As A Man Thinketh, Translated by Fazle Rabbi, Published by Saphollo Prokasoni, 76, Islamia Market, Nilkhat, Dhaka - 1205.

Contact Office: 01534 902 882.

Website: www.saphollo.com

E-mail: sapholloprokasoni@gmail.com

Price: Tk 150.00 Only. US: $7. (Hardcover). ISBN: 978-984-93605-8-8

 





উৎসর্গ


মোহাম্মদ বরকতুল্লাহ

(বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগের অন্যতম মুসলমান বাঙালি চিন্তাবিদ ও সাহিত্যক)





 

 

 




সূচি



সূচনা পরিবর্তন মানেই কঠিন কিছু!

ভূমিকা একটি ছোট্ট পদক্ষেপ

অধ্যায় ১ চিন্তা ও চরিত্র

অধ্যায় ২ পরিবেশ পরিস্থিতির ওপর চিন্তার প্রভাব ১৩

অধ্যায় ৩ দেহ ও সুস্বাস্থ্যের ওপর চিন্তার প্রভাব ২৫

অধ্যায় ৪ চিন্তা ও উদ্দেশ্য ২৯

অধ্যায় ৫ সাফল্য অর্জনে চিন্তার মূল অবদান ৩৩

অধ্যায় ৬ রূপকল্প ও আদর্শ চিন্তা ৩৭

অধ্যায় ৭ প্রশান্তি ও নির্মলতা ৪১

লেখকের কিছু উক্তি ০০

ব্যক্তিগত উন্নয়নে অন্যান্য বইয়ের তালিকা ০০


 



ভূমিকা

এই ছোট্ট বইটি আমার দীর্ঘদিনের গভীর চিন্তা ও অভিজ্ঞতার ফসল। একে বেশি বড় করা হয়নি। কারণ বেশি লেখা দিয়ে চিন্তার ক্ষমতাকে পাঠকের কাছে ভারী করে তুলতে চাইনি। আমি ব্যাখ্যার চেয়ে পরামর্শ আকারে লিখেছি। এর উদ্দেশ্য একটাই–একটি সত্যের আবিষ্কার ও উপলব্ধির পথে পুরুষ ও নারীদের সহায়তা করা। সত্যটি হচ্ছে:

মানুষ নিজে নিজেকে গড়ে তুলতে সক্ষম

মানুষ নিজের চিন্তা দ্বারা নিজেকে গড়ে তুলতে সক্ষম। তারা যেসব চিন্তাকে নির্বাচন করে এবং উৎসাহ দেয় সেগুলো দ্বারাই সে গড়ে ওঠে। মানুষের মন হচ্ছে তার আসল কারিগর। ব্যক্তির ভিতরগত চরিত্র এবং বাহ্যিক পরিবেশ পরিস্থিতি সবই মূলত তার চিন্তার ফসল। তারা হয়তো এ ব্যাপারে অজ্ঞ হতে পারে, কষ্ট পেতে পারে। কিন্তু এ কথা সত্য। এই বইয়ের মাধ্যমে তাদের সেই অজ্ঞতা ও দুর্দশা দূর করে মানুষকে আলোকিত ও আনন্দের স্পর্শ দেওয়াই একমাত্র লক্ষ্য।


- জেমস অ্যালেন

ব্রড পার্ক এভিনিউ

ইলফ্রাকোম্বে

ইংল্যান্ড


 




চিন্তা ও চরিত্র


মানুষ তার মন-মস্তিষ্কে যেমন চিন্তা করে বাস্তবে তার চরিত্রে ঠিক সেই রূপটিই ফুটে ওঠে। মানব জীবনের সাথে চিন্তার বিষয়টি এতটাই জড়িত যে তা পুরো জীবনভর বিস্তৃত। চিন্তার প্রভাবজনিত ক্ষমতা এত ব্যাপক যে আমাদের প্রতিটি অবস্থা, জীবনের প্রতিটি পরিস্থিতির সাথে এর সরাসরি সম্পৃক্ততা রয়েছে। সোজাসুজি বলতে গেলে একজন মানুষ তাই যা সে চিন্তা করে। একজন মানুষের সামগ্রিক চরিত্র গড়ে ওঠে তার জীবনভর চিন্তার ফলাফল স্বরূপ।

আপনি চারাগাছ দেখেছেন নিশ্চয়? চারাগাছ কি বীজ ছাড়া অঙ্কুরিত হতে পারে? একটি বীজ ছাড়া যেমন চারাগাছ অঙ্কুরিত হয় না তেমন চিন্তা ছাড়াও মানুষ কাজ করতে পারে না। একজন মানুষের প্রতিটি কাজের পিছনে থাকে অন্তর্নিহিত চিন্তার বীজ। গূঢ়, এক ধরনের গুপ্ত চিন্তা যা কর্মের মাধ্যমেই প্রকাশ পায়। চিন্তার এই বীজ ব্যতীত কোন কাজই ঘটে না। এই কথা অন্য সবকিছুর প্রতিই প্রযোজ্য। যেসব কাজকে ‘স্বতঃস্ফূর্ত’ ও ‘অভাবিত’ বলে উল্লেখ করা হয় সেগুলোর প্রতিও একইভাবে সত্য।

কাজ হচ্ছে চিন্তা থেকে প্রস্ফুটিত। আর সুখ-দুঃখ হচ্ছে চিন্তার ফল স্বরূপ। এভাবে মানুষ নিজেই তার শস্য ভা-ারে ভালো-মন্দ শস্য তোলে।


ÒThought in the mind hath made us,

What we are

By thought was wrought and built.

If a man’s mind

Hath evil thoughts,

 

Pain comes on him as comes

The wheel the ox behind...

..If one endure

In purity of thought,

Joy follows him

As his own shadow-sure.Ó


মানুষ বড় হয় নিয়মমাফিক। মানুষ কখনো চালাকি বা কারচুপির মাধ্যমে বড় হয় না। চিন্তা জগতের কারণ ও প্রভাবে মানুষ সরাসরি বেড়ে ওঠে। এ কথা দৃশ্যমান বস্তুর মতো সত্য। একটি মহান ও ফেরেশতার মতো চরিত্র কখনো হঠাৎ সৃষ্টি হয় না; বরং দীর্ঘদিনের ঠিক চিন্তা করে যাওয়ার স্বাভাবিক ফল। মহান চরিত্র গঠনে নিয়মিত চর্চা করতে হয়। আমরা হয়তো তাকে আজকে দেখছি। কিন্তু যার চরিত্র মহান তিনি এই চর্চা ও চিন্তা বহু আগে থেকেই করে আসছেন। আবার এর বিপরীত কথাও সত্য। একটি নীচ ও পশুবৎ চরিত্রও ঠিক একই প্রক্রিয়ায় গড়ে ওঠে। দীর্ঘদিন বেঠিক চিন্তা করে যাওয়ার স্বাভাবিক ফল। সে বহু দিনে থেকে নিজের মধ্যে লজ্জাকর ও ঘৃণ্য চিন্তা পোষণ করতে থাকে এবং একদিন তা সুযোগ পেয়ে বাস্তব জগতে প্রকাশ পায়।

অস্ত্রাগারে যেমন অস্ত্র তৈরির ছাঁচ আছে। যেমন ছাঁচ হবে তেমন অস্ত্র তৈরি হবে। ঠিক একইভাবে মানুষ নিজেই নিজেকে গড়ে তোলে বা ধ্বংস করে এবং তা চিন্তা দ্বারা। এভাবে সে নিজেকে স্বর্গীয় সুখ, শক্তি ও শান্তিতে পূর্ণ করে। ঠিক চিন্তা করলে এবং তাকে বাস্তবে প্রয়োগ করা হলে মানুষ ঐশ্বরিক পরিপূর্ণতা লাভ করে। আবার বেঠিক চিন্তা করলে এবং তার ভুল প্রয়োগে মানুষ পশুর চেয়েও নিচে নেমে যায়। এই দুই চরম অবস্থার মধ্যেই মানুষের চারিত্রিক অবস্থান বিরাজমান। এ থেকেই বোঝা যায় মানুষ নিজেই নিজেকে গড়ে তোলে এবং সে নিজেই নিজের ওপর কর্তৃত্ব করতে সক্ষম।

আজ পর্যন্ত যত কিছু আবিষ্কার হয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে মানুষ তার নিজের চিন্তার ওপর কর্তৃত্ব করতে পারে, নিজ চরিত্রের রূপকার এবং পরিবেশ, পরিস্থিতি ও সৌভাগ্যের সৃষ্টিকর্তা ও রূপদানকারী।

মানুষের মধ্যে ক্ষমতা, বুদ্ধিমত্তা ও ভালোবাসার মতো অসাধারণ সব গুণাবলি দেওয়া হয়েছে। তাকে নিজের চিন্তা জগতের মালিক করে সৃষ্টি করা হয়েছে। এই চিন্তাশক্তি দিয়েই সে প্রতিটি পরিস্থিতিকে মোকাবিলা করতে সক্ষম। চিন্তাশক্তি হচ্ছে এক ধরনের রূপান্তরকারী শক্তি। এই শক্তির দ্বারা মানুষ নিজেকে তার ইচ্ছামতো গড়ে তুলতে পারে।

মানুষ সবসময়ই তার নিজের ওপর নিজে কর্তৃত্বকারী। এমনকি সবচেয়ে দুর্বল ও মন্দ সময়েও। কিন্তু তার দুর্বল ও মন্দ সময়ে সে একজন বোকা মালিক যে তার কাজকর্মে ভুল করে। আর যখন সে নিজের পরিস্থিতি নিয়ে চিন্তা ও অনুধাবন করে এবং কায়মনোবাক্যে খুঁজে দেখে তখন সে একজন বিজ্ঞ মালিক হয়ে ওঠে। সে যখন নিজের চালচিত্র খুঁজে পায়, নিজে কোন ধরনের নিয়মকানুন মেনে চলে যা আবিষ্কার করে তখন সে একজন অভিজ্ঞ মালিক হয়ে ওঠে। তখন সে নিজের শক্তিকে বুদ্ধিমত্তা সাথে এবং দরকার মতো কাজে লাগাতে সক্ষম হয়। এভাবে সে যেকোন পরিস্থিতি থেকে আশানুরূপ ফল লাভ করতে পারে।

এভাবেই একজন সচেতন মানুষ কাজ করে। মানুষ এভাবেই নিজের ভিতর চিন্তাভাবনার নিয়মকানুন খুঁজে বের করে। আপনাকে কাজ করে অভিজ্ঞতা নিতে হবে। একমাত্র বাস্তব জগতে কাজ করেই আপনি নিজেকে আবিষ্কার করতে পারবেন। নিজেকে বিশ্লেষণ করা এবং নিজের অভিজ্ঞতাকে ফিরে দেখার মধ্যেই রয়েছে আসল শক্তি।

খনি থেকে যখন স্বর্ণ ও হীরা উত্তোলন করা হয় তখন অনেকদূর পর্যন্ত খুঁড়তে হয়, খুঁজতে হয়। ঠিক তেমনভাবে মানুষকেও তার নিজের সত্তাকে খুঁজে পেতে আত্মার গভীরে অনুসন্ধান করে দেখতে হয়। মানুষ নিজেই তার চরিত্রের নির্মাতা, নিজেই তার জীবনের রূপকার এবং সৌভাগ্যের সৃষ্টিকর্তা। আপনি নিজেই নিজেকে নির্ভুলভাবে পরিমাপ করতে পারেন। নিজের চিন্তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, পরিবর্তন ও সৃষ্টি করতে পারেন। আপনাকে কেবল নিজের চিন্তার প্রতি লক্ষ রাখতে হবে। মানুষ নিজের চিন্তার ওপর নিয়ন্ত্রণ রেখে তার জীবন ও পরিস্থিতির ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে সক্ষম হয়। সে যখন নিজের প্রতিটি অভিজ্ঞতা অনুসন্ধান করে দেখে, এমনকি তুচ্ছ থেকে তুচ্ছ ঘটনাও খুঁজে দেখে তখন নিজেকে আয়নার মতো পরিষ্কারভাবে দেখতে পায়। নিজের সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করে মানুষ বিজ্ঞতা ও ক্ষমতা লাভ করে।

এভাবে মানুষ যখন নিজেকে পরিচালিত করে তখন এই প্রচলিত কথাই সত্য হয়ে ওঠে, ‘যে খোঁজে সেই খুঁজে পায় এবং যাঁর কাছে জিজ্ঞেস করা হয় তিনি তাঁর উত্তর দিবেন।’ একমাত্র ধৈর্য সহকারে, নিয়মিত চর্চার মাধ্যমে একজন মানুষ যখন নাছোড়বান্দার মতো লেগে থাকে কেবল তখনি সে জ্ঞানের রাজ্যে প্রবেশ করতে সক্ষম হয়।


 




পরিবেশ পরিস্থিতির ওপর চিন্তার প্রভাব


মানুষের মন-মস্তিষ্ক হচ্ছে বাগানের মতো। একে বুদ্ধিমত্তার সাথে চাষ করা সম্ভব। আর বাগান যদি সাজানো না হয় বা অবহেলা করা হয় তবে সেখানে অপ্রয়োজনীয় গাছপালার বীজ পড়বে এবং বন্য লতাপাতায় ভরে যাবে।

একজন মালী যেমন তার বাগানের যত্ন নেয়, চাষ করে, অগাছা থেকে ভূমিকে বাঁচিয়ে রাখে এবং যেসব ফুলফল চায় সেসব গাছপালা লাগায় তেমনই একজন মানুষের মন হচ্ছে তার বাগান। তিনি মনের সেই বাগান থেকে ভুলভাল ও অপ্রয়োজনীয় চিন্তা দূর করেন এবং আকাক্সিক্ষত ও দরকারি চিন্তাকে ফুলফলের মতো যত্ন করেন। এ প্রক্রিয়ায় একজন মানুষ দেরিতে হলেও বুঝতে পারে যে তিনি হচ্ছেন তার আত্মার যত্নকারী, নিজের জীবন পরিচালনাকারী। তিনি নিজের চিন্তা করার নিয়মকানুনকেও আবিষ্কার করেন এবং এও বুঝতে পারেন যে তার চরিত্র, পরিবেশ পরিস্থিতি ও সৌভাগ্যের ওপর মন ও চিন্তাশক্তির প্রভাব রয়েছে।

চিন্তা ও চরিত্র মূলত একই জিনিস। বলতে পারেন, চরিত্র কেবল চিন্তার প্রকাশ। চিন্তার যে ধরন ও আকার প্রকার থাকে তাকে বাস্তবে যখন প্রয়োগ করা হয় তাই চরিত্র। একজন ব্যক্তির বাহ্যিক পরিস্থিতি হচ্ছে তার অভ্যন্তরীণ চিন্তার বহিঃপ্রকাশ। যেকোন মানুষের বাহ্যিক পরিবেশ তার ভিতরের চিন্তাভাবনারই প্রকাশ।

কিন্তু তারমানে এই নয় যে একজন মানুষের যেকোন সময়ের পরিবেশ পরিস্থিতি বা আর্থিক অবস্থা তার সব ধরনের চরিত্রের নির্দেশক। তবে এ কথাও সত্য যে মানুষের বাহ্যিক অবস্থা তার ভিতরগত চিন্তার সাথে এত অতপ্রতোভাবে জড়িত যা বলার অপেক্ষা রাখে না। এসব চিন্তাভাবনা তার উন্নতি বা অবনতিতে সরাসরি ভূমিকা রাখে।

আজকে প্রতিটি মানুষ যে যে অবস্থানে আছে তা তার অন্তঃসত্তার ফলাফল, যেসব চিন্তা তিনি দীর্ঘদিন যাবৎ করেছেন তার দ্বারা নির্মিত চরিত্র তাকে আজকে এখানে নিয়ে এসেছে। যেকোন ব্যক্তি তার আজকের অবস্থানে পথভ্রষ্ট হয়ে আসেনি; বরং ধীরে ধীরে পর্যায়ক্রমে যেসব চিন্তা তিনি দীর্ঘদিন থেকে করে আসছেন তাই তাকে বর্তমান পরিবেশ পরিস্থিতিতে এনে দাঁড় করিয়েছে। এ এমন এক ধরনের আইন যার কোন ব্যতিক্রম নেই।

এ কথা উভয় ধরনের লোকের জন্য সত্য। যারা তাদের আশেপাশের পরিবেশ পরিস্থিতির সাথে নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারে না তাদের জন্য যেমন এ কথা সত্য তেমন যারা নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারে তাদের জন্যও সত্য।

মানুষ হচ্ছে এক ধরনের উন্নয়নশীল ও বিবর্তনবাদী প্রাণী। এ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে যেতে মানুষ বুঝতে পারে সে যেকোন পরিবেশ পরিস্থিতি থেকে শিখতে পারে এবং সেই শিক্ষা কাজে লাগিয়ে উন্নত হতে পারে। এভাবে সে অন্য কোন পরিবেশ পরিস্থিতিতে সেই শিক্ষা কাজে লাগিয়ে অগ্রগতি করে।

অবশ্য আজকের যুগে আসতে মানুষকে প্রচুর সংগ্রাম করতে হয়েছে। তার আশেপাশের পরিবেশ পরিস্থিতির সাথে লড়াই করে বাঁচতে হয়েছে। তাই সে হয়তো ভুলভাবে চিন্তা করছে যে মানুষ মনে হয় বাহ্যিক পরিবেশ পরিস্থিতির সৃষ্টি। কিন্তু সে যখন নিজের সৃজনশীল ক্ষমতার পরিচয় পায় এবং তার চিন্তাক্ষেত্রের জমিতে নির্দিষ্ট লক্ষ্যের বীজ বপণ করে তখন দেখে যে আশেপাশের পরিবেশ পরিস্থিতি তদানুযায়ী গড়ে উঠছে। এভাবেই সে নিজেই নিজের ওপর কর্তৃত্ব করতে সক্ষম হয়।

যেকোন ব্যক্তি যিনি কখনো আত্মনিয়ন্ত্রণ ও আত্মশুদ্ধির চর্চা করেছেন তিনি জানেন যে চিন্তাভাবনা কী করে মানবজীবনের ওপর প্রভাব ফেলে। তিনি আরও লক্ষ করেন চিন্তার একটু পরিবর্তন তার মানসিক অবস্থার পরিবর্তন করে। আর তার মানসিক অবস্থার পরিবর্তন তার বাহ্যিক অবস্থার পরিবর্তন করে।

তাই এ কথা সত্য যে একজন মানুষ যখন আগ্রহের সাথে নিজের দোষত্রুটি দূর করে এবং দৃঢ় চরিত্র গঠন করে তখন তিনি দ্রুত গতিতে উন্নতির পথে এগিয়ে যায়। এ কর্ম তার অবস্থার পরিবর্তন করে এবং সৌভাগ্যের দিকে ধাবিত করে।

একজন মানুষের আত্মা যা কিছু নিয়ে থাকে তাই তার প্রকৃত রূপ। যা সে ভালোবাসে, যা সে ভয় পায় এবং যা সে আকাক্সক্ষা করে তার দিকেই তা ধাবিত হয়। একজন মানুষের আত্মার গভীরতম অনুভূতি চিন্তার মাধ্যমে প্রকাশ পায়। আর বাইরের পরিবেশ পরিস্থিতি হচ্ছে আর কিছুই না আত্মা দ্বারা আকৃষ্ট পরিবেশ পরিস্থিতি।

প্রতিটি চিন্তাই হচ্ছে বীজের মতো। যেমন বীজ হবে তেমন শস্য পাব। আবার যে চিন্তাগুলো জমিতে ঠিকভাবে পড়তে পারবে না, শিকড় গড়তে অক্ষম তারা সেই অনুযায়ী ফলাফল আনতেও ব্যর্থ। এজন্যই বলা হয়, ভালো চিন্তা ভালো ফলাফল আনে, খারাপ চিন্তা খারাপ ফলাফল আনে।

আমাদের বাহ্যিক পরিবেশ পরিস্থিতি আমাদের ভিতরগত চিন্তা জগতেরই প্রকাশ। আমরা ভিতরে যা চিন্তা করি, আমরা তেমন পরিস্থিতির দিকেই এগিয়ে যাই এবং আমাদের পরিবেশও হয় তেমন। মানুষ যাকে ভালো বা মন্দ পরিবেশ বলে বোঝাতে চায় তা আর কিছুই নয় তার ভিতরের চিন্তাগত পরিবেশ। পরিবেশ ভালো হোক বা মন্দ হোক, উভয় দিক থেকেই আমাদের কিছু না কিছু শেখার আছে। একজন কৃষকের মতো, মানুষ নিজেই নিজের শস্য লাগায় এবং ফসল ঘরে তোলে। এ থেকে সে ভালো-মন্দ, আশীর্বাদ বা অভিশাপ সবকিছুর মধ্য দিয়ে যায় ও শেখে। পরবর্তী ফসল ফলানোর সময় এই শিক্ষাকে কাজে লাগায়।

তবে অদম্য আকাক্সক্ষা, উচ্চাকাক্সক্ষা ও দৃঢ়তার সাথে যেসব চিন্তা করা হয়, যা একজন মানুষের চিন্তা জগৎকে আচ্ছন্ন করে রাখে (একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যে চিন্তা করতে করতে, সেই লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য বাস্তব-অবাস্তব সব ধরনের কল্পনা করা ও সম্ভাব্য সকল পথ বিবেচনা করা) তা একদিন না একদিন পূরণ হবেই। এ ধরনের মানুষের ইচ্ছা-অনিচ্ছা পূরণ করতে যেন বাহ্যিক পরিবেশ পরিস্থিতিও সায় দেয়।

অগ্রগতির যেমন নিয়মকানুন আছে তেমন সমঝোতারও নিয়মকানুন আছে। এসব নিয়মকানুন সবজায়গায় বিস্তৃতভাবে ছড়ানোছিটানো। যে মানুষ অগ্রগতি চায় তিনি যেমন এসব নিয়মকানুন থেকে নিজের জন্য উপায় খুঁজে নিতে পারে। আবার যিনি জীবনের সাথে সমঝোতা চায় তার জন্যও আছে যথাযথ পন্থা।

মানুষ ভাগ্য বা পরিবেশের দয়াদাক্ষিণ্য থেকে আসেনি। বরং একজন মানুষ তার আজকের অবস্থানে এসেছে হয় তার ঘৃণ্য চিন্তার কারণে অথবা দৃঢ় আকাক্সক্ষার ভিত্তিতে। এজন্যই একজন পবিত্র ও সৎ চিন্তাশীল ব্যক্তি কখনো হঠাৎ করে হতাশায় বা বাহ্যিক কোন চাপের মুখে পড়ে অপরাধ করে না। আর যারা নিজেদের চিন্তায় দীর্ঘদিন যাবৎ অপরাধ করার চেতনা বহন করে, হৃদয়ের গভীরে অন্যায় করার আকাক্সক্ষা পোষণ করে তারাই দেখবেন সুযোগ পেলেই অপকর্ম করে। অন্যায়ের সুযোগ মানুষকে অন্যায়কারী বানায় না বরং মানুষের পূর্ব চিন্তা যা দীর্ঘদিন যাবৎ সে সবার অলক্ষে লালনপালন করছে তাই সুযোগ পেয়ে প্রকাশিত হয়।

পরিস্থিতি মানুষকে তৈরি করে না বরং পরিস্থিতি মানুষকে কেবল প্রকাশ করে। আরও ভালো শব্দ হচ্ছে পরিস্থিতি মানুষকে অনাবৃত করে। একজন মানুষের ভিতরে যেসব চিন্তা থাকে পরিস্থিতি সেসব চিন্তাকে কাজে লাগানোর সুযোগ দেয় মাত্র। মানুষের ভিতরের চিন্তাই বাইরে ক্রিয়া করে। যার মধ্যে উচ্চাকাক্সক্ষা আছে, সুখী ও সম্পদশালী হওয়ার চিন্তা আছে তার পরিবেশ সে নিজেই তৈরি করে।

আমাদের আত্মাও ঠিক তেমন। চিন্তার মতো, আত্মাও ঠিক সেই জিনিসগুলোকে আকর্ষণ করে যেগুলো ব্যক্তি তার নিজের ভিতর লালনপালন করে। একজনের পবিত্রতা ও অপবিত্রতার মাধ্যমেই তার শক্তিমত্তা ও দুর্বলতা প্রকাশ পায়।

মানুষ যা চায় সে কেবল তাই আকর্ষণ করে না বরং মানুষ নিজে যা সে কেবল তাই আকর্ষণ করে। মানুষ তাদের খেয়ালখুশি মতো চলে, স্থূলকল্পনা করে, খেয়ালি পছন্দ অনুযায়ী কাজ করে নিজের শক্তিকে খর্ব করে, কিন্তু তাদের আসল খাদ্য হচ্ছে অভ্যন্তরীণ চিন্তাভাবনা ও আকাক্সক্ষা। এই খাদ্য যদি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয় তবে মন সুস্থ থাকবে। আর যদি নোংরা হয় তবে মনও দুর্বল হয়ে পড়বে। আমাদের কর্মের যে শেষ ফলাফল তৈরি হয় তা মূলত আমাদের নিজেদের চিন্তার ফল। আমরা যেমন আমাদের ফলাফলও তেমন তৈরি হয়।

যে ব্যক্তি নিজের চিন্তা ও কর্মের মধ্যে সামঞ্জস্য রাখতে পেরেছেন তিনিই তার ভাগ্যকে সৌভাগ্যে পরিণত করতে পেরেছেন। তারাই মূলত মুক্তির দেবদূত, স্বাধীনতার মূর্ত প্রতীক। একজন মানুষ যা চায় বা আশা করে অথবা যা কিছুর জন্য দোয়া করে তা সে পায় না বরং সে যা ন্যাযসঙ্গতরূপে অর্জন করতে সক্ষম কেবল তাই পায়। তার চাওয়া, আশা বা দোয়া কেবল তখনই চরিতার্থ হয় এবং উত্তর আসে যখন সেগুলো ব্যক্তির চিন্তা ও কর্মের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়।

একজন যখন এই সত্যের নিচে রেখে নিজেকে বিচার বিশ্লেষণ করবে তখন ‘পরিস্থিতির বিরুদ্ধে লড়াই’ করার কি কোন মানে থাকে? পরিস্থিতির বিরুদ্ধে লড়াই করার মানে কি এই নয় যে মানুষ এমন এক প্রভাবের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করছে যার মূল কারণ সে নিজেই নিজের হৃদয়ের গভীরে যতেœর সাথে লালনপালন ও রক্ষণাবেক্ষণ করছে। এই কারণটি দুই রকম হতে পারে। ব্যক্তি নিজে জেনেশুনে অনৈতিকতাকে বেছে নিয়েছে অথবা অসচেতনভাবে এ তার এক দুর্বলতা। কিন্তু যাই হোক না কেন এ জিনিস তার অধিকারীর ভিতরে আঠার মতো বাস করে এবং অধিকারীর যেকোন প্রচেষ্টায় বাধা দেয়।

মানুষ তার পরিবেশ পরিস্থিতি বদলানোর জন্য খুব উদ্বিগ্ন কিন্তু নিজেকে উন্নত করতে অনিচ্ছুক। অতএব তার অবস্থারও বদল ঘটে না। যে ব্যক্তি আত্মবিসর্জনের মাধ্যমে সঙ্কুচিত হয়নি বরং সমৃদ্ধ হয়েছে সে কখনো তার হৃদয়ের নির্দিষ্ট আকাক্সক্ষা পূরণে ব্যর্থ হয়নি। এ কথা ধ্রুব সত্য। এমনকি যে ব্যক্তির সম্পদ অর্জনই একমাত্র উদ্দেশ্য তাকেও তার উদ্দেশ্য পূরণের আগে অনেক কিছু উৎসর্গ করতে হয়।

চলুন, একজন গরিব মানুষের চিন্তাকে বিশ্লেষণ করি। তিনি তার প্রতিকূল পারিপার্শ্বিক অবস্থা নিয়ে বেশ উদ্বিগ্ন। তার আশেপাশের অবস্থা এবং ঘরের পরিবেশের হয়তো উন্নতি দরকার। অথচ তিনি তার কর্মক্ষেত্রে দায়িত্ব এড়িয়ে চলেন। চিন্তা করেন, মালিক যেহেতু তাকে বেতন কম দেয় তাই তিনি কাজে ফাঁকি দিয়ে মালিকের সাথে প্রতারণা করবেন।

এমন ব্যক্তি সমৃদ্ধির মূলভিত্তি সম্পর্কেই জানে না। তার কৃতকর্ম যে তাকে কেবল উন্নতি করতে দিচ্ছে না তাই নয়, তাকে আরও অবনতির দিকে ঠেলে দিচ্ছে। তার এমন চিন্তা তাকে আরও অলস, ধোঁকাবাজি ও হীন চিন্তা করতে এবং কাজ করতে উৎসাহ দিচ্ছে।

এবার একজন ধনী মানুষের চিন্তাকে বিশ্লেষণ করি যে হয়তো তার অতিভোজনের দরুন মারাত্মক রোগে আক্রান্ত। তিনি বড় অংকের টাকা দিয়ে অতিভোজনের মতো রোগ থেকে মুক্তি পেতে চান কিন্তু নিজের অতিভোজনের আকাক্সক্ষা ত্যাগ করতে রাজি নন। তিনি তার বাসনা চরিতার্থ করতে চান ও (প্রকৃতির বিরুদ্ধে) অতিমাত্রায় ভোজন করতে চান এবং সুস্বাস্থ্যও বজায় রাখতে চান। এমন ব্যক্তি তো স্বাস্থ্য বজায় রাখার পুরোপুরি অনুপযুক্ত। কারণ তিনি এখনো একটি স্বাস্থ্যকর জীবনের প্রথম সূত্রই শেখেননি।

আবার একজন শ্রমজীবী মানুষের কথা ধরি, (যিনি ব্যবসায়ী তিনিও এক ধরনের শ্রমজীবী মানুষ) যিনি সরকারি নিয়মকানুনের তোয়াক্কা না করে অসাধু উপায়ে নিজের অর্থকে লুকিয়ে রাখেন। তিনি হয়তো আশা করেন কর্মচারীদের বেতন হ্রাস করে আরও বেশি মুনাফা করবেন। এমন মানুষ সর্বদিক থেকে সমৃদ্ধির জন্য অনুপযুক্ত। অবশেষে তিনি নিজেকে দেউলিয়া হিসাবে খুঁজে পান। তার সম্মান ও সম্পদ উভয়ই উবে যায়। তিনি আশেপাশের পরিবেশ পরিস্থিতিকে দোষ দেন। কিন্তু তিনি হয়তো জানেন না যে তিনি নিজেই তার অবস্থার সৃষ্টিকারী।

আমি এই তিন ধরনের মানুষকে তুলে ধরলাম কেবল তাদের ভিতরের সত্যকে তুলে ধরার জন্য। যদিও এসব কারণ যে সবসময় সচেতনভাবে ঘটে তা নয়। অনেক সময় মানুষ নিজেই জানে না মানে অসচেতনভাবেই এ ধরনের আচরণ করে থাকে। যতক্ষণ পর্যন্ত না মানুষ একটি সমাপ্তিতে না পৌঁছায় ততক্ষণ পর্যন্ত সে নিজের এসব চিন্তাকে উৎসাহ দিয়ে যায় যেসব চিন্তা হয়তো তার অবস্থার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এ ধরনের অবস্থা চলতেই থাকে। কিন্তু এমনই যে হতে হবে তা নয়। একজন পাঠক হিসাবে আপনার যদি একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য থাকে, নিজের চিন্তাধারাকে ধরতে পারেন, নিজের জীবনের ধরনধারণ সম্পর্কে বুঝতে পারেন তাহলে বাহ্যিক কোন পরিস্থিতিই আপনাকে যুক্তি হিসাবে বাধা দিতে পারবে না।

[ফজলে রাব্বির কথা–অনেকেই বাহ্যিক পরিস্থিতির কারণে ব্যর্থ হয়েছেন বলে যুক্তি দেখান। বাহ্যিক পরিস্থিতি যেমন বাবা-মা, পরিবার, বউ, ছেলে-মেয়ে বা দেশের দুবস্থার কথা বলে যুক্তি দেখাতে চান যে তিনি এসব কারণে ব্যর্থ হয়েছেন। কিন্তু লেখক বলতে চান যে আপনার যদি একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য থাকে, নিজের চিন্তাধারাকে ধরতে পারেন বা নির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়েই চিন্তা করেন, নিজের জীবনের ধরনধারণ সম্পর্কে বুঝতে পারেন বা নিজের নির্দিষ্ট লক্ষ্য সম্পর্কিত হাবভাব নিয়েই জীবন ধারণ করেন তাহলে বাহ্যিক কোন পরিস্থিতিই আপনাকে যুক্তি হিসাবে বাধা দিতে পারবে না।]

একজন মানুষ হয়তো কিছু কিছু কাজে সৎ হতে পারে তারপরেও সে দুঃখ কষ্ট ভোগ করতে পারে। একজন মানুষ হয়তো কিছু কিছু কাজে অসৎ হতে পারে, তারপরেও সে সম্পদশালী হতে পারে। এসব ক্ষেত্রে উপসংহার এমন হতে পারে যে একজন মানুষ ব্যর্থ হয় কারণ সে আংশিকভাবে সৎ। আবার আরেকজন মানুষ উন্নতি করে কারণ সে আংশিকভাবে অসৎ। এসব থেকে আমরা এক ধরনের ভাসাভাসা বিচারবিবেচনা গ্রহণ করি–যে মানুষ অসৎ সে হয়তো একদম সবকিছুতেই দুর্নীতিগ্রস্ত এবং যে মানুষ সৎ সে হয়তো একদম সবকিছুতেই ধার্মিক। প্রগাঢ় জ্ঞান ও দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতার আলোকে যদি এসব ধারণা বিশ্লেষণ করা হয় তবে এগুলোর অসারতা ধরা পড়ে। একজন অসৎ মানুষের হয়তো এমন কিছু প্রশংসনীয় গুণ থাকতে পারে যা অন্যদের নেই। আবার একজন সৎ মানুষের হয়তো এমন কিছু আপত্তিকর দোষ থাকতে পারে যা অন্যদের নেই।

একজন সৎ মানুষ ভালো ফলাফল লাভ করে তার সৎ চিন্তা ও কর্মের জন্য। সে আবার কলঙ্কগ্রস্ত হতে পারে তার দোষের কারণে। একজন অসৎ মানুষও ঠিক একইভাবে নিজের সুখ-দুঃখ লাভ করে।

মানুষ কি কেবল একটি দোষ-গুণের কারণে দুঃখ বা সুখ ভোগ করে? হ্যাঁ, করে। মানুষ এমন করেই চিন্তা করতে ভালোবাসে। তার মধ্যে যে অহং বিদ্যমান, এই চিন্তা করেই সেই অহং সন্তুষ্ট হয়। কিন্তু মানুষ যখন তার নিজের মন্দ, তিক্ত ও অপবিত্র সব চিন্তা নিজের কাছেই উন্মোচিত করে, আত্মাকে ধুয়ে মুছে পাক-পবিত্র করে তখন সে এমন এক অবস্থায় এসে দাঁড়ায় যেখান থেকে সে নিজের দুঃখ-দুর্দশার কারণ হিসাবে এসব চিন্তাকে চিহ্নিত করতে পারে। এ যাত্রাপথে চলতে চলতে ব্যক্তি নিজেকে শুদ্ধ ও নির্মল করে তোলে। এই বিশ্লেষণ ও কর্মপন্থাই আমাদেরকে উচ্চতর জীবনযাপনের দিকে ধাবিত করে। তখন আমরা বুঝতে পারি, অনুধাবন করি যে এ বিশ্বের যিনি সৃষ্টিকর্তা তিনি পুরোপুরি একজন ন্যায় বিচারক। তিনি মন্দ কর্মের জন্য ভালো ফলাফল বা ভালো কর্মের জন্য কখনো মন্দ ফলাফল দেন না। এই ধরনের জ্ঞানের অধিকারী ব্যক্তি যখন এই জ্ঞানের আলোকে নিজের অতীত জীবন বিশ্লেষণ করেন তখন সে তার অতীতের অজ্ঞতা ও অন্ধত্ব সম্পর্কে সচেতন হয়। সে অনুধাবন করে যে তার জীবন মূলত ন্যায়সঙ্গতভাবেই আজকের অবস্থানে পৌঁছেছে। আসলে সে আজকে তা আবিষ্কার করল মাত্র।

ভালো চিন্তা ও কাজ কখনো মন্দ ফলাফল আনে না; মন্দ চিন্তা ও কাজ কখনো ভালো ফলাফল আনে না। কথায় বলে, ধানের চারা থেকে তো ধানই হবে, আর মান্দার গাছ থেকে কাঁটা। প্রকৃতির এই নিয়মকে মানুষ বেশ ভালোভাবেই জানে ও মানে। কিন্তু নিজেদের জীবনে, মানসিক ও নৈতিক জগতে খুব কম মানুষই এ নিয়মকে অনুসরণ করে।

দুঃখদুর্দশা হচ্ছে মন্দ চিন্তার ফলাফল। এ নিয়ম সবসময়ের জন্যই সত্য। এতে করে বোঝা যায় উক্ত ব্যক্তি নিজের সাথে, নিজের আত্মার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। সেই দুঃখদুর্দশার অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে দুর্দশার আগুনে সেসব মন্দ চিন্তার বিনাশ। আর যে ব্যক্তি ভালো ও পবিত্র চিন্তা করে তার জন্য কোন দুঃখদুর্দশা নেই। স্বর্ণকে আগুনে পুড়িয়ে পবিত্র ও আলোকিত করার পর তার মধ্যে কি আর কোন দুঃখদুর্দশা থাকতে পারে?

পরিবেশ পরিস্থিতির মাধ্যমে কোন মানুষ যখন দুঃখদুর্দশার সম্মুখীন হয় তখন এতে বোঝা যায় তিনি তার মানসিক অবস্থার সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ। সৌভাগ্য কোন বস্তুগত বিষয় নয় বরং ন্যায়সম্মত চিন্তার ফলাফল; দুর্ভাগ্য কোন বস্তুগত বিষয় নয় বরং অনৈতিক চিন্তার ফলাফল। একজন ব্যক্তি হয়তো অভিশপ্ত হয়েও ধনী হতে পারে, আবার আরেকজন আশীর্বাদপুষ্ট হয়েও গরিব হতে পারে।

আশীর্বাদ ও ধনসম্পদ একত্রে তখনই কাজ করবে যখন ধনসম্পদ ন্যায়সঙ্গতভাবে ও বিজ্ঞতার সাথে ব্যবহার করা হবে। আর একজন গরিব লোক তখনই হীনাবস্থায় নেমে আসে যখন সে তার অংশের সুযোগকে অন্যায়ভাবে আরোপিত মনে করে কাজ করে।

হীনাবস্থা বা দুর্ভাগ্যের দুই চরম অবস্থা হচ্ছে অভাব ও অসংযম। এরা উভয়ই একজনের মানসিক ভারসাম্যহীনতার ফলাফল। একজন ব্যক্তি তার অবস্থার জন্য সুখী, স্বাস্থ্যবান ও সমৃদ্ধশালী হয় না বরং এই সুখ, স্বাস্থ্য ও সমৃদ্ধি তার ভিতরগত চিন্তা ও বাহ্যিক কাজের সামঞ্জস্যের ফলাফল।

একজন ব্যক্তি সত্যিকার অর্থে একজন ব্যক্তিত্ববান মানুষ হয়ে ওঠে যখন সে অন্যদের সম্পর্কে বা পরিবেশ পরিস্থিতি সম্পর্কে অভিযোগ দেওয়া ও তিরস্কার করা বন্ধ করে এবং নিজের ভিতরের ন্যায়বিচারকে আবিষ্কার করে। এ ন্যায়বিচারই তার জীবনকে পরিচালিত করে। এভাবে সে যখন তার মন মস্তিষ্ককে এই ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে পরিচালিত করে তখন সে অন্যদের প্রতি অভিযোগ দেওয়া ও তিরস্কার করা বন্ধ করে এবং নিজেকে পবিত্র ও দৃঢ় চিন্তা দিয়ে গঠিত করে, পরিস্থিতির কারণে আহত না হয়ে বরং একে নিজের সাহায্যে প্রয়োগ করে এবং দ্রুত উন্নতি করে। এভাবে সে নিজেই নিজের মধ্যে এক ধরনের গোপন শক্তির উৎস খুঁজে পায় এবং নিজের সুযোগ সম্ভাবনাকে কাজে লাগায়।

এই মহাবিশ্বের ওপর মূল কর্তৃত্বকারী শক্তি হল আইনকানুন, বিশৃঙ্খলা নয়। জীবনের মূল আত্মা ও শ্রেষ্ঠত্ব হল ন্যায়বিচার, অবিচার নয়। আত্মিক জগৎকে চালিত করে ও এগিয়ে নিয়ে যায় ন্যায়পরায়ণতা ও পবিত্রতা, দুর্নীতি নয়। মহাবিশ্বের এই পবিত্রতা ও ন্যায়পরায়ণতাকে খুঁজে বের করাই আমাদের অস্তিত্বের লড়াই। এই লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে যেতে যেতে মানুষ আবিষ্কার করে যে সে বস্তু ও অন্যান্য মানুষের প্রতি নিজের চিন্তাধারা পরিবর্তন করতে পারে এবং অন্যরাও তার প্রতি ভিন্ন চিন্তাধারা নিয়ে এগিয়ে আসতে পারে।

প্রত্যেক ব্যক্তির মধ্যেই এই প্রমাণ পাওয়া যায় এবং আমরা যদি একটু খুঁজে দেখি, একটু পদ্ধতিগতভাবে অন্তর্দর্শন ও আত্মবিশ্লেষণ করি তবে খুব সহজেই তার প্রমাণ পাব। একজন মানুষকে যদি তার চিন্তাধারার আমূল পরিবর্তন করার সুযোগ দেওয়া হয় তবে সে বিস্মিত হবে যে এর ফলে তার জীবনে, বস্তুগত বিষয়ের ওপর কত দ্রুত প্রভাব পড়ছে। মানুষ বিশ্বাস করে তার চিন্তাধারা গোপন রাখা সম্ভব। আসলে কী তাই! না, তা নয়। এই চিন্তাধারা দ্রুত অভ্যাসে পরিণত হয় এবং এই অভ্যাস তার পছন্দসই পরিবেশ পরিস্থিতিকে কাছে টানে। অভদ্র, নৃশংস ও পশুবৎ চিন্তাসমূহ উন্মত্ততা ও অস্বাভাবিক যৌনকর্মকা-মূলক অভ্যাসে পরিণত হয়। এ অভ্যাস আবার নিঃসঙ্গতা ও অসুখবিসুখের মতো পরিবেশ পরিস্থিতিকে কাছে টানে। সব ধরনের অপবিত্র চিন্তা একজনকে দুর্বল করে তোলে এবং গোলমেলে অভ্যাসে পরিণত হয়। এ অভ্যাস আবার বিক্ষিপ্ত ও প্রতিকূল পরিবেশ পরিস্থিতিকে কাছে টানে। ভয়-ভীতি, সন্দেহ ও সংশয়মূলক চিন্তা একজনের মধ্যে অমানবিকতা ও অস্থিরতার অভ্যাসে পরিণত হয়। এ অভ্যাস আবার ব্যর্থতা, দারিদ্র্য ও অন্যের ওপর দাসসুলভ নির্ভতার পরিবেশ পরিস্থিতিকে কাছে টানে। আলস্যের চিন্তা অপরিচ্ছন্নতা ও অসততার অভ্যাসে পরিণত হয়। এ অভ্যাস আবার নোংরা ও নিদারুণ দারিদ্র্যের পরিবেশ পরিস্থিতিকে কাছে টানে। ঘৃণাপূর্ণ ও নিন্দাসূচক চিন্তা একজনকে হিং¯্র করে তোলে এবং সবকিছুতে দোষারোপ করার অভ্যাসে পরিণত হয়। এ অভ্যাস অনিষ্টকর ও নিপীড়নের পরিবেশ পরিস্থিতিকে কাছে টানে। স্বার্থপর চিন্তা সবসময় নিজের সুবিধার কথা চিন্তা করার অভ্যাসে পরিণত হয়। এ অভ্যাস আবার পীড়াদায়ক পরিবেশ পরিস্থিতিকে কাছে টানে।

অন্যদিকে, সব ধরনের সুন্দর চিন্তা–দয়ামায়া ও উদারতার অভ্যাসে পরিণত হয়। এ অভ্যাস আনন্দদায়ক ও স্বাস্থ্যকর পরিবেশ পরিস্থিতিকে কাছে টানে। পবিত্র চিন্তাসমূহ মিতাচার ও আত্মনিয়ন্ত্রণের অভ্যাসে পরিণত হয়। এ অভ্যাস স্থিরতা ও শান্তিময় পরিবেশ পরিস্থিতিকে কাছে টানে। নিজের ওপর আত্মবিশ্বাস, সাহস ও দৃঢ়চেতা চিন্তা পুরুষালি অভ্যাসে পরিণত হয়। এ অভ্যাস সাফল্য, প্রাচুর্য ও স্বাধীনতার পরিবেশ পরিস্থিতিকে কাছে টানে। কর্মশক্তিতে পূর্ণ তেজোময় চিন্তা পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা ও উদ্যোগী অভ্যাসে পরিণত হয়। এ অভ্যাস মধুময় এক শান্তশিষ্ট পরিবেশ পরিস্থিতিকে কাছে টানে। ভদ্র, অমায়িক ও ক্ষমাপূর্ণ চিন্তা কোমলতা ও ন¤্রতার অভ্যাসে পরিণত হয়। এ অভ্যাস প্রতিরক্ষামূলক ও সংরক্ষণশীল পরিবেশ পরিস্থিতিকে কাছে টানে। ভালোবাসাপূর্ণ ও নিঃস্বার্থ চিন্তা অন্যদের জন্য আত্মবিস্মৃতির অভ্যাসে পরিণত হয়। এ অভ্যাস নিশ্চয়তা, চিরস্থায়ী সুখসমৃদ্ধি ও প্রকৃত ধনসম্পদের পরিবেশ পরিস্থিতিকে কাছে টানে।

একটি নির্দিষ্ট চিন্তার স্রােত যখন অধ্যবসায়ের সাথে বহমান তখন তা ব্যক্তির চরিত্রে ও আশেপাশের পরিবেশ পরিস্থিতিতে ফুটে উঠতে বাধ্য। হতে পারে এই চিন্তার স্রােত ভালো বা মন্দ। তাতে কিছু যায় আসে না। ভালো চিন্তা হলে ভালো চরিত্র ও পরিবেশ। আর মন্দ চিন্তা হলে মন্দ চরিত্র ও পরিবেশ। একজন মানুষ হয়তো তার পরিবেশ পরিস্থিতিকে সরাসরি নির্বাচন করতে পারে না। কিন্তু সে তার চিন্তাকে বেছে নিতে সক্ষম এবং এই চিন্তাই পরোক্ষভাবে এবং নিশ্চিতভাবে তার পরিবেশ পরিস্থিতিকে আকার আকৃতি দেয়।

প্রকৃতি মানুষকে সব ধরনের চিন্তা করে তৃপ্তি নেওয়ার সুযোগ দিয়েছে। এভাবে প্রকৃতি মানুষকে উৎসাহিত করেছে এবং তার সামনে অবারিত সুযোগের দ্বার উন্মোচিত করে রেখেছে। এর মাধ্যমে সব ধরনের চিন্তার বাস্তব প্রতিফলন ঘটা সম্ভব, ভালো বা মন্দ, যেকোন ধরনের চিন্তা।

একজন মানুষ যখন অপবিত্র ও অপকর্মের চিন্তা বাদ দেয় তখন সারা বিশ্ব তার প্রতি নমনীয় হয়ে থাকে এবং তাকে সহায়তা করতে প্রস্তুত হয়। তার মধ্য থেকে দুর্বল ও মন্দ চিন্তা সরিয়ে দেওয়া হলে সে তার আশেপাশে সব জায়গাতেই সুযোগ ও সম্ভাবনার দেখা পায়। আশেপাশের সব মানুষের হাতগুলো যেন তার দৃঢ়চেতা চিন্তাকে সহায়তা করতে উদ্বুদ্ধ হয়ে ওঠে। তাকে যদি ভালো চিন্তা করতে উৎসাহ দেওয়া যায় তবে তাকে কোন কলঙ্ক, অমর্যদা বা দুর্ভাগ্য বেঁধে রাখতে পারে না।

এই পৃথিবী বহু বিচিত্র জিনিসের এক মিলনস্থল। রঙের যেমন হাজার প্রকার ও ধরন রয়েছে তেমন লাখো সম্ভবনায় পূর্ণ এ বিশ্ব। আপনার সামনে প্রতিটি মুহূর্তে অত্যন্ত সুন্দরভাবে সুযোগ ও সম্ভবনাকে উপস্থাপন করা হচ্ছে। আপনাকে কেবল আপনার চিন্তাকে একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যে ধাবিত করতে হবে।


ÒSo You will be what you will to be;

Let failure find its false content

In that poor word, Ôenvironment,Õ

But Sririt Scorns it, and is free.

 

ÒIt master time, it conquers space;

It cowes that boastufl trickster, Chance,

And bids the tyrant Circumstance

Uncrown, and fill a servant’s place.

 

ÒThe human Will, that force unseen,

The offspring of a deathless Soul,

Can hew a way to any goal,

Though walls of granite intervene.

 

ÒBe not impatient in delays

But wait as one who understands;

When spirit rises and commands

The gods are ready to obey.Ó


 




দেহ ও সুস্বাস্থ্যের ওপর চিন্তার প্রভাব


দেহ হচ্ছে মনের দাস। দেহ কেবল মনের দেওয়া নির্দেশগুলো মেনে চলে এবং প্রদানকৃত কাজগুলো সম্পাদন করে। মন থেকে যেকোন নির্দেশ, তা হয়তো ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত হতে পারে, দেহ তাই মানতে বাধ্য। মন যখন অনৈতিক চিন্তায় ডুবে থাকে তখন দেহ দ্রুত অসুখবিসুখ ও পতনের দিকে ধাবিত হয়। আবার মন যখন সুন্দর ও সন্তুষ্ট চিন্তা দ্বারা গঠিত তখন দেহও তারুণ্য ও সৌন্দর্যের আবরণে নিজেকে প্রস্তুত করে।

অসুখবিসুখ ও সুস্বাস্থ্যের মতো পরিবেশ পরিস্থিতিরও মূল শিকড় হচ্ছে আমাদের চিন্তায়। মসৃণ চিন্তা একটি মসৃণ দেহের মাধ্যমে নিজেকে প্রকাশ করে। আবার ভয়ভীতির চিন্তা একজন মানুষকে গুলি করে মারলে যেমন, তেমন মেরে ফেলতেও সক্ষম। আর সারা বিশ্বে এই ভয়ভীতির চিন্তা মানুষকে যেভাবে হত্যা করছে তা অন্য কিছুতে নয়। যদিও এই মৃত্যু ধীরে ধীরে ঘটে, তাই অনেকেই ঠিক মৃত্যুর আসল কারণ সম্পর্কে বুঝতে পারে না।

যেসব লোকজন অসুখবিসুখের ভয়ে জীবন কাটায় তারা শেষমেশ সেই অসুখেই দ-প্রাপ্ত হয়। দুশ্চিন্তা সমগ্র দেহের শৃঙ্খলা নষ্ট করে এবং একে অসুখবিসুখের প্রতি প্রস্তুত করে। অনৈতিক চিন্তা যদি দেহের ক্ষতিসাধন করতে নাও পারে, তবে তারা দ্রুত ¯œায়ুতন্ত্রের বিনাশ ঘটাবে।

দৃঢ় চিন্তা, সৎ ও সুখী চিন্তা দেহকে প্রাণবন্ত ও লাবণ্যময় করে তোলে। আমাদের দেহ হচ্ছে খুবই হালকা ও নমনীয় উপাদানে তৈরি, যা সেই চিন্তাগুলো দ্বারা খুব দ্রুত প্রভাবিত হয় যেগুলো দ্বারা মন প্রভাবিত এবং সেই ধরনের কাজ করে দেখায়, ভালো বা মন্দ যেকোন কাজ।

মানুষের মধ্যে অনৈতিকতা ও বিষাক্ত কর্মকা- ততদিন রয়ে যাবে যতদিন তাদের মধ্যে অপরিচ্ছন্ন চিন্তা বংশবিস্তার করছে। একটি পরিচ্ছন্ন হৃদয় থেকে পাওয়া যায় একটি পরিচ্ছন্ন দেহ ও জীবন। আবার একটি কলুষিত মন মস্তিষ্ক থেকে পাওয়া যায় একটি কলুষিত জীবন ও অসুস্থ দেহ। চিন্তা হচ্ছে একটি ঝরণার মতো। পাহাড় থেকে যেমন ঝরণা উৎসারিত হয় এবং সেই ঝরণা থেকে নদীর উৎপত্তি, তেমন মন-মস্তিষ্ক থেকে চিন্তা উৎসারিত হয় এবং সেই চিন্তা থেকে কর্ম, জীবন ও জীবনের স্ফূর্তির উৎপত্তি। ঝরণাকে পরিচ্ছন্ন রাখুন। দেখবেন বাকি সবকিছুই সুন্দরভাবে বয়ে চলছে।

একজন মানুষ যখন খাদ্য তালিকার পরিবর্তন করে তাতে কোন লাভ হয় না যদি না সে তার চিন্তার পরিবর্তন আনে। যখন সে তার চিন্তাকে পরিচ্ছন্ন করে তখন তার আর কোন অপবিত্র খাবারের প্রতি আকাক্সক্ষা জাগে না।

পরিচ্ছন্ন চিন্তা পরিচ্ছন্ন অভ্যাস গঠন করে। সাধু বলে বহুল পরিচিত এমন কোন লোক সাধু হতে পারে না যে তার দেহকে পরিচ্ছন্ন করেনি। যিনি তার চিন্তাকে শক্তিশালী ও পরিশুদ্ধ করেছেন ক্ষতিকর জীবাণুর ভয়ভীতি নিয়ে তাকে উদ্বেগ্ন হতে হয় না।

আপনি যদি আপনার দেহকে রক্ষা করতে চান তবে আপনার মনকে আগে রক্ষা করুন। আপনি যদি আপনার দেহকে উজ্জীবিত রাখতে চান তবে আপনার মনকে আগে সুন্দর করে গড়ে তুলুন। বিদ্বেষ, ঘৃণা, হতাশা, মনমরা ভাব বা অন্যের প্রতি হিংসা আপনার দেহের স্বাস্থ্য ও শান্তি কেড়ে নেয়। একটি বিষণœ চেহারা হঠাৎ করে তৈরি হয় না; এ হচ্ছে বিষণœ চিন্তার ফল। অনেকের চেহারার বলিরেখা দেখে বোঝা যায় তার অহংকার, বিদ্বেষ ও মূর্খতা।

আমি একজন ছিয়ানব্বই বছর বয়স্ক মহিলাকে চিনি, যার চেহারা একটি শান্তশিষ্ট মেয়ের মতো। আমি একজন মধ্য বয়স্ক পুরুষকে চিনি, যার চেহারায় অতিবৃদ্ধের ছাপ পড়ে গেছে।

একজনের চেহারা হচ্ছে মিষ্টি স্বভাব ও সদর্থক চিন্তার প্রতিরূপ। আরেকজন হচ্ছে রাগ, বিদ্বেষ ও অসন্তুষ্টির প্রতিচ্ছায়া।

একটি গৃহ যেমন ঝলমলে রোদ ও পর্যাপ্ত বাতাস ভিন্ন সুবাসিত ও বাসযোগ্য হয়ে উঠতে পারে না তেমন শান্তুশিষ্ট, পবিত্র ও নির্মল চিন্তা ব্যতীত দেহ-মন মজবুত ও সুগঠিত হতে পারে না।

মানুষের চেহরা দেখলেই অনেক কিছু বোঝা যায়। কিছু মানুষের চেহারায় করুণা ও দয়াদাক্ষিণ্যের ছাপ ফুটে ওঠে, কিছু মানুষের চেহারায় দৃঢ় ও পবিত্র চিন্তার ছাপ, আর কিছু মানুষের চেহারায় ফুটে ওঠে রাগ ও বিদ্বেষের ছাপ : এদেরকে দেখে কে না চিনতে পারবে? যারা তাদের জীবনকে সততার সাথে পরিচালিত করেছে বয়স তাদেরকে পরিপক্কতার সাথে শান্তশিষ্টভাবে জীবনের পথে ধাবিত করেছে, যেন দিনের শেষে পশ্চিম দিগন্তে সূর্যের অস্তমন। আমি সম্প্রতি একজন দার্শনিককে তার মৃত্যুশয্যায় দেখেছিলাম। বয়স ভিন্ন তাঁর সবকিছুই যেন নবীন। তিনি এত শান্তভাবে বিদায় নিলেন যেন তাঁর মৃত্যু ঘটেনি।

দেহের ক্ষতিকর জীবাণুকে ধ্বংস করতে উল্লসিত ও আনন্দদায়ী চিন্তার চেয়ে বড় কোন চিকিৎসক নেই। দুঃখ ও হতাশার ছায়া থেকে মুক্তি দিতে অন্যের মঙ্গলকামনা করার চিন্তার চেয়ে বড় কোন প্রতিষেধক নেই। আর কেউ যদি মন্দ চিন্তা নিয়ে বাস করে তবে তার মধ্যে সন্দেহ, অন্যদের বিদ্রুপ ও হিংসা করার মতো আত্মা ধ্বংসকারী নেতিবাচক গুণের বিকাশ ঘটবে, যা উক্ত ব্যক্তিকেই আপন কারাগারে বন্দি করে ফেলবে।

কিন্তু সবার ভালো চিন্তা করা, সকলের সাথে হাসিখুশি থাকা, ধৈর্য ধরে অন্যের ভিতর থেকে ভালো গুণাগুণকে খুঁজে বের করা– এ ধরনের স্বার্থপরতাহীন চিন্তা একজনকে বেহেশতের রাস্তা দেখায়। সকলের প্রতি শান্তি বর্ষণের চিন্তা যিনি বজায় রাখেন তিনি নিজেই আল্লাহর ভালোবাসা খুঁজে পান।


 




চিন্তা ও উদ্দেশ্য


চিন্তা যতক্ষণ না একটি নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যের সাথে যুক্ত হচ্ছে ততক্ষণ বুদ্ধিমত্তা দিয়ে কোন কিছুই অর্জন করা যায় না। বেশিরভাগ মানুষের প্রবণতা হচ্ছে এদিক-সেদিক চিন্তা করা। এতে করে জীবনে কিছুই অর্জিত হয় না। লক্ষ্যহীন চিন্তা করা এক ধরনের অধার্মিকতা। যিনি নিজেকে বিপদ-আপদ ও সর্বনাশ থেকে রক্ষা করতে চান তার উচিত এ ধরনের চিন্তা রোধ করা।

যাদের জীবনে একটি নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য নেই তারা খুব সহজেই দুশ্চিন্তা, ভয়ভীতি, সমস্যা ও আত্মকরুণার শিকার হয়। (আত্মকরুণা হচ্ছে নিজের প্রতি সমবেদনা। এ ধরনের লোকজন সাধারণত যেকোন সমস্যার জন্য বাহ্যিক কারণসমূহকে দায়ী করে নিজের দুর্বলতার প্রতি সমবেদনা জানায়।) এ সবই হচ্ছে দুর্বলতার লক্ষণ। এগুলো মানুষকে ইচ্ছাকৃত পাপকর্ম করার দিকে তাড়িত করে। সেই পাপকর্ম বিভিন্ন উপায়ে হতে পারে। এছাড়াও এ ধরনের নেতিবাচক গুণাবলি মানুষকে ব্যর্থতা, অসন্তুষ্টি ও ক্ষতির সম্মুখীন করে। এরা নিজেদের দুর্বলতার কারণে সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী এ বিশ্ব থেকে কিছুই গ্রহণ করতে পারে না।

একজন পুরুষের উচিত তার হৃদয়ে একটি বৈধ ও আইনসম্মত উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য ধারণ করা এবং এ উদ্দেশ্য পূরণে কাজ করা। তার উচিত এই উদ্দেশ্যকে তার চিন্তার মূল কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করা। এ উদ্দেশ্য হয়তো এক ধরনের আত্মিক শক্তিতে পরিণত হবে বা বিষয়বস্তুতে রূপান্তরিত হবে। ব্যক্তির চারিত্রিক দৃঢ়তা ও অধ্যবসায় অনুযায়ী তার নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য একদিন পূরণ হবেই। তার উচিত এই নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যকে তার চূড়ান্ত কর্তব্য বলে গণ্য করা এবং সর্বপ্রধান দায়িত্ব বলে পালন করা। এ কাজে সাফল্য লাভের জন্য তাকে সর্বদা নিবেদিত প্রাণ থাকতে হবে। ক্ষণস্থায়ী চিন্তা (যে ধরনের চিন্তা সাময়িক উত্তেজনা দেয়), খামখেয়ালিপনা ও অপ্রয়োজনীয় স্পৃহার মতো যেকোন চিন্তাকে কোনভাবেই নিজের উদ্দেশ্যের উপর স্থান দেওয়া উচিত নয়। এ পন্থা হচ্ছে আত্মনিয়ন্ত্রণ ও প্রকৃত মনোযোগের মূল কলাকৌশল। এমনকি সেই ব্যক্তি যদি তার উদ্দেশ্য পূরণে ব্যর্থও হয় (কারণ সফল হওয়ার আগে যেকোন ব্যক্তিকে তার দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে হবে), তার চরিত্রের মধ্যে এমন এক ধরনের দৃঢ়তা তৈরি হবে যা তার প্রকৃত সাফল্যের কারণ হবে। ব্যর্থ হলেও সে ঠিক ঐ জায়গা থেকেই আবার আরম্ভ করবে এবং সাফল্যের পতাকা ছিনিয়ে আনবে।

যারা একটি মহৎ উদ্দেশ্যের চেতনা দ্বারা নিজেদের প্রস্তুত করতে পারে না তাদের উচিত তাদের চিন্তাকে আগে একটি মহৎ উদ্দেশ্যের দিকে নিয়োজিত করা। তাদের কাজ যত ছোটই হোক না কেন সেই কাজও অনেক গুরুত্ব সহকারে করা দরকার। এভাবেই চিন্তা একটি নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যের প্রতি নিবিষ্ট ও একাগ্র হবে। এই দৃঢ়তা থেকে ব্যক্তির মধ্যে শক্তি আসবে এবং গঠনমূলক চিন্তা করার সাহস জোগাবে।

মানসিকভাবে দুর্বল একজন ব্যক্তি নিজেই নিজের দুর্বলতা সম্পর্কে জানে। তিনি এও বিশ্বাস করেন যে চেষ্টা ও চর্চা দ্বারা একজনের ক্ষমতা বৃদ্ধি করা সম্ভব। নিজের উদ্যমে একবার কাজ আরম্ভ করলে, চেষ্টা ও চর্চা করে গেলে, ধীরে ধীরে কাজ করার ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে এবং কাজও সম্পন্ন হবে।

দৈহিকভাবে দুর্বল একজন ব্যক্তি নিজেকে পরিকল্পিত ও ধৈর্যশীল কোন প্রশিক্ষণ দ্বারা বলশালী করে তুলতে পারে। ঠিক তেমনই একজন ব্যক্তি চিন্তার দ্বারাও নিজের ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে পারে। তাকে কেবল ঠিকভাবে চিন্তা করা শিখতে হবে।

প্রথমে দুর্বল ও লক্ষ্যহীন চিন্তাগুলো বাদ দিতে হবে। তারপর একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যে চিন্তা করতে হবে। এভাবেই একজন ব্যক্তি সফল ব্যক্তিদের সারিতে উঠে দাঁড়াবে। যারা সফল তারা বোঝে যে ব্যর্থতা হচ্ছে সাফল্যের পথে এগিয়ে যাওয়ার একেকটি ধাপ। নির্দিষ্ট লক্ষ্যে চিন্তা করলে যেকোন ব্যক্তির মধ্যে এই বোধ উদয় হবে। তিনি দৃঢ় চিন্তা করতে সক্ষম হবেন। দ্বিধাহীনভাবে চেষ্টা করবেন এবং দক্ষতার সাথে যেকোন কিছু অর্জন করবেন।

একজন ব্যক্তি যখন তার উদ্দেশ্য সম্পর্কে স্পষ্ট হয়, তাকে অবশ্যই মানসিকভাবে একদম উদ্দেশ্য বরাবর এগিয়ে যাওয়া উচিত। ডানে নয়, বামে নয়, বরং একদম সোজা উদ্দেশ্য বরাবর। সন্দেহ ও ভীতিকে জোর করে তাড়িয়ে দিতে হবে। এগুলো সংহতি নষ্ট করে। ব্যক্তি যখন উদ্দেশ্য বরাবর এগিয়ে যায়, এ ধরনের নেতিবাচক গুণাবলি তাকে বাধা দেয়। উদ্দেশ্যমুখী ও বরাবর চেষ্টা করতে বাধা দেয়। ফলে চেষ্টা হয়ে পড়ে খ-িত, অকার্যকর। সন্দেহ ও ভীতিমূলক চিন্তা আজ পর্যন্ত কিছু অর্জন করতে পারেনি এবং পারবেও না। এরা সর্বদাই ব্যক্তিকে ব্যর্থতার দিকে ঠেলে দেয়। উদ্দেশ্য, ক্ষমতা, কাজ করার শক্তি ও যত ধরনের দৃঢ় চিন্তা আছে তার সবকিছুই নষ্ট হয় যখন সন্দেহ ও ভীতি প্রবেশ করে।

জ্ঞান থেকে আমরা কাজ করার প্রেরণা পাই। আমাদের বিশ্বাস হয় যে আমরা কাজটি করতে পারবো। সন্দেহ ও ভীতি হচ্ছে জ্ঞানের সবচেয়ে বড় শত্রু। আর যে ব্যক্তি জ্ঞান অর্জন করতে গিয়ে এদের ধ্বংস করবে না, বরং উৎসাহ দিবে সে পদে পদে ব্যর্থ হবে।

যে ব্যক্তি সন্দেহ ও ভীতিকে জয় করতে পারে সে ব্যর্থতাকেও জয় করতে পারে। তার প্রতিটি চিন্তার সাথে এক ধরনের শক্তি থাকে এবং প্রতিটি সমস্যাকে সাহস দিয়ে মোকাবিলা করে ও বিজ্ঞতার সাথে সমস্যার সমাধান করে। কৃষক যেমন ঋতু অনুযায়ী চারা রোপণ করে, সময়মতো এগুলো বিকশিত হয় এবং ফল দেয়। তদরূপ, উক্ত ব্যক্তি ঠিক সময়ে তার উদ্দেশ্য জ্ঞাপন করে, এগুলো বিকশিত হয় এবং আকাক্সিক্ষত ফলাফল দেয়।

চিন্তা যখন একটি নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যের সাতে যুক্ত হয় তখন এরা অপ্রতিরোধ্য এক শক্তিতে পরিণত হয়। যে এ কথা জানে সে আজেবাজে বা অনর্থক চিন্তা করে সময়ের অপচয় করে না। বড় ও বৃহৎ কোন উদ্দেশ্য পূরণে নিজেকে নিয়োজিত করে। যে এ কৌশল অনুযায়ী কাজ করে সে তার মানসিক ক্ষমতাকে তার বুদ্ধিমত্তার সাথে উদ্দেশ্য পূরণে কাজে লাগায় এবং নিজেকে সৌভাগ্যের দিকে পরিচালিত করে।


 




সাফল্য অর্জনে চিন্তার মূল অবদান


মানুষ যা কিছু অর্জন করে বা অর্জন করতে ব্যর্থ হয় তার সবকিছুই তার চিন্তার সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত। এই বিশ্ব হচ্ছে ন্যায্যভাবে ভারসাম্যপূর্ণ এক জগৎ। এখানে ভারসাম্যে কোন ধরনের তারতম্য হওয়া মানেই ধ্বংস। একজন ব্যক্তির দায়িত্ব হচ্ছে নিজেকে প্রকৃত মানুষ হিসাবে গড়ে তোলা। একজন ব্যক্তির দুর্বলতা ও দৃঢ়তা, পবিত্রতা ও অপবিত্রতা সবকিছুই তার নিজের, অন্যের নয়। এগুলো ব্যক্তি নিজেই নিজের কাছে টানে, অন্য কেউ নয়। এগুলোকে যদি পরিবর্তন করতে হয় তবে সেই কাজটিও তাকেই করতে হয়, অন্য কেউ নয়।

ব্যক্তির পরিবেশ পরিস্থিতি সম্পূর্ণভাবে তার নিজের অধীন, অন্যের নয়। তার দুঃখদুর্দশা ও আনন্দ সম্পূর্ণই তার নিজের দ্বারা প্রসূত। যেমন করে সে চিন্তা করে সে তেমনই। সে যেমন করে চিন্তা করতে থাকে সে তেমনই থাকে।

একজন দৃঢ় ব্যক্তি কখনো একজন দুর্বল ব্যক্তিকে সহায়তা করতে পারে না যদি না দুর্বল ব্যক্তি নিজে থেকে সহায়তার জন্য ইচ্ছুক হয়। এরপরেও দুর্বল ব্যক্তিকে নিজে থেকেই শক্তিশালী হতে হবে, নিজের আপন চেষ্টায় বলবান হতে হবে। দুর্বল ব্যক্তি যেমন চরিত্রকে আদর্শ মনে করে, চরিত্রের প্রশংসা করে তেমন করে নিজের চরিত্রকে গঠন করতে হবে। নিজের পরিস্থিতি নিজেকেই বদলাতে হবে, অন্য কেউই এ কাজ তার জন্য করে দিতে পারে না।

আমরা এমন কথা অনেক শুনেছি এবং দেখিছি যে একজন অত্যাচারীর অধীনে শত শত মানুষ দাসত্ব করছে। এসব দেখে আমরা খুব সহজেই সেই অত্যাচারীকে ঘৃণা করি। তবে এখন আমাদের মধ্যে এক ধরনের ভিন্ন চিন্তাও চলছে। প্রথাগত চিন্তার বিপরীত এক চিন্তা। এ কথাও তো বলা যায়, ‘একজন ব্যক্তি অত্যাচারী কারণ বহু মানুষ দাসসুলভ আচরণ করছে। চলুন, আমরা এমন দাসদের অবজ্ঞা ও ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখি।’

সত্য হচ্ছে অত্যাচারী ও দাস একে অপরকে না জেনেই সহায়তা করছে এবং বাহ্যিকভাবে দেখলে মনে হয় একজন অপরজনের উপর অত্যাচার করছে। কিন্তু সত্য হচ্ছে তারা উভয়ই উভয়ের উপর অত্যাচার করছে।

দুর্বল অত্যাচারিতের কাজকর্মে এবং অত্যাচারীর ক্ষমতার অপব্যবহারে যথার্থ জ্ঞান পাওয়া যায়। উভয়ের দুঃখদুর্দশার জন্য কাউকেই নিন্দা করা যায় না, তা থেকে যথার্থ ভালোবাসা পাওয়া যায়। অত্যাচারিত ও অত্যাচারী উভয়ে সমবেদনা পাওয়ার যোগ্য।

যে ব্যক্তি দুর্বলতাকে জয় করেছে এবং নিজের সকল স্বার্থপর চিন্তা বাদ দিতে পেরেছে সে না অত্যাচারিত হতে পারে, না অত্যাচারী হতে পারে। কেউই তাকে বেঁধে রাখতে পারে না। সে স্বাধীন।

একজন মানুষ জীবনে উপরে উঠবে না নামবে, অথবা সাফল্য অর্জন করবে তার সবকিছুই নির্ভর করে তার চিন্তার মাত্রার ওপর। সে দুর্বল হবে না শোচনীয় অবস্থা থাকবে, অথবা দুঃখদুর্দশার মধ্যে পড়বে তার সবকিছুই নির্ভর করে তার চিন্তাকে উচ্চমাত্রায় না নেওয়ার ফলে।

একজন মানুষ যদি সাফল্য অর্জন করতে চায়, তা যেকোন কিছুতে হতে পারে (হয়তো সাংসারিক ধনসম্পদ অর্জন করতে চায়), আগে তার চিন্তাকে দাসসুলভ মনোবৃত্তির উপরে উঠাতে হবে। [মানুষের মধ্যে এক ধরনের দাসসুলভ বা পশুধর্ম বিদ্যমান। একে কোন মতেই প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না।] সাফল্য অর্জনের জন্য তাকে যে সম্পূর্ণ পশুত্ব ও স্বার্থপরতা বাদ দিতে হবে তা নয়, কিন্তু এর একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অংশ অবশ্যই বাদ দিতে হবে বা কুরবানি করতে হবে। একজন মানুষ যার প্রথম চিন্তার মধ্যে পশুধর্মের প্রভাব রয়েছে সে না ঠিকভাবে চিন্তা করতে পারে, না পদ্ধতিগতভাবে পরিকল্পনা করতে পারে। সে তার সুপ্ত প্রতিভাকে খুঁজে পায় না এবং বিকশিত করতে পারে না। যেকোন কাজে উদ্যোগ নিয়েই সে ব্যর্থ হয়। যেহেতু সে নিজের চিন্তার ওপর দৃঢ়তার সাথে নিয়ন্ত্রণ রাখতে ব্যর্থ, সেহেতু সে তার আশেপাশের পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না এবং যেকোন ধরনের গুরুতর দায়িত্বও পালন করতে অক্ষম। সে স্বতন্ত্রভাবে কাজ করার যোগ্য নয় এবং ভিড়ের মধ্যে একা, দৃঢ়ভাবে দাঁড়াতে অক্ষম। অথচ সে শুধু তার সীমিত চিন্তা দ্বারা আবদ্ধ। এসব চিন্তা সে নিজেই নির্বাচন করেছে। [একজন দুর্বল মানুষ যেমন দুর্বল চিন্তা করতে পারে। তেমনই একজন দুর্বল মানুষ সবল ও দৃঢ় চিন্তাও করতে পারে। এটা তার সচেতন ইচ্ছার ওপর নির্ভর করে।]

যেকোন ধরনের উন্নয়ন, যেকোন ধরনের কাজে সাফল্য অর্জন বিসর্জন ছাড়া হয় না। একজন মানুষের সাংসারিক ধনসম্পদ দেখে বোঝা যায় যে সে তার পশুত্বের বিশৃঙ্খল চিন্তার কতটুকু বিসর্জন দিতে পেরেছে এবং সে তার মনমস্তিষ্কের উন্নতিতে কতদূর অগ্রসর। সম্পদশালী মানুষ তার উন্নত চিন্তা দ্বারা দৃঢ়চেতা মনোভাব ও আত্মনির্ভরতা অর্জন করে এবং তার পরিকল্পনা মতো এগিয়ে যায়। সে যত বেশি তার চিন্তাকে উন্নত করতে পারে তত বেশি মনুষ্যত্ববোধ জেগে ওঠে, ন্যায়পরায়ণ ও বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন হয়ে ওঠে। তার সাফল্যও তত বড় হয়ে ওঠে এবং তার অর্জন হয়ে ওঠে টেকসই ও আশীর্বাদপুষ্ট।

মহাবিশ্ব কখনো লোভী, অসৎ বা দুশ্চরিত্রকে সহায়তা করে না। যদিও মাঝে মাঝে উপরি উপরিভাবে তাই মনে হয়। আসলে মহাবিশ্ব সবসময় সৎ, মহানুভব ও চরিত্রবানকে সহায়তা করে। মানব জাতির জন্য যুগ যুগ ধরে যত মহান শিক্ষক এসেছেন তাঁরা সকলেই এ কথাকে নানাভাবে বলেছেন, প্রমাণ করেছেন এবং তাঁরা এও জানতেন যে একজন মানুষকে উন্নত হতে হলে অধ্যবসায়ের সাথে তার চিন্তাকে প্রথমে উন্নত করতে হবে।

বুদ্ধিবৃত্তিক অর্জন হচ্ছে চিন্তার পবিত্রতা ধরে রাখার ফল। জ্ঞানের খোঁজে বা জীবন ও প্রকৃতির সত্য ও সুন্দরের খোঁজে যারা নিজেদের সমর্পণ করে, চিন্তার পবিত্রতা ধরে রেখে অনুসন্ধান বজায় রাখে তারাই বুদ্ধিবৃত্তিক সক্ষমতা অর্জন করে।

আত্মিক অর্জন হচ্ছে পবিত্র আকাক্সক্ষার ফলাফল। যিনি নিয়মিতভাবে পবিত্র ও মহৎ চিন্তা করে, শুদ্ধ ও নিঃস্বার্থ চিন্তা নিয়ে বাস করে যেমন মধ্যগগনে সূর্য বা পূর্ণচন্দ্র, তিনি চারিত্রিক দিক থেকে মহান ও বিজ্ঞ হয়ে ওঠেন এবং আশীর্বাদপুষ্ট এমন এক প্রভাব বিস্তারকারী পর্যায়ে ওঠেন যা অকল্পনীয়।

যেকোন কিছুতে কৃতিত্ব অর্জন করতে পারার মুহূর্তটি হচ্ছে দীর্ঘদিনের চিন্তা ও চেষ্টার সর্বোত্তম ফলাফল। এ যেন রাজার মুকুট স্বরূপ। আত্মনিয়ন্ত্রণ, দৃঢ়তা, পবিত্রতা, ন্যায়পরায়ণতা ও চিন্তাকে ঠিকভাবে পরিচালিত করতে পারার ফলে মানুষ উপরে ওঠে। আর পশুত্ব, শ্রমবিমুখতা, অপবিত্রতা, দুর্নীতি ও বিশৃঙ্খল চিন্তা মানুষকে নিচে নামায়।

একজন মানুষ হয়তো সাফল্যের উচ্চ শিখরে আরোহণ করছে তবুও তার মধ্যে আত্মিক শূন্যতা থাকতে পারে, এমনকি দুর্বল চারিত্রিক গুণাবলি যেমন ঔদ্ধত্য, স্বার্থপরতা ও দুর্নীতিগ্রস্ত চিন্তা তাকে গ্রাস করতে পারে।

ন্যায়পরায়ণ চিন্তা দ্বারা যে সাফল্য অর্জন করে সেই প্রকৃত সফলতার স্বাদ পায়। সাফল্য অর্জন করার পর তা বজায় রাখতে পূর্বের মতোই চিন্তার শৃঙ্খলা ও পবিত্রতা ধরে রাখতে হয়। অনেকেই সাফল্য অর্জনের পর এ কাজটি বাদ দিয়ে দেয় এবং দ্রুত ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।

যত ধরনের কৃতিত্বপূর্ণ অর্জন আছে, হোক তা ব্যবসাবাণিজ্যে, বুদ্ধিবৃত্তিক বা আত্মিক জগতে, সবকিছুই হচ্ছে একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পরিচালিত চিন্তার ফলাফল। কাজের ধরন ভিন্ন হতে পারে, পেশা বা বৃত্তি নানান ধরনের হতে পারে কিন্তু সবকিছুতেই নৈপুণ্য অর্জন করতে সেই একই সূত্র, একই পদ্ধতি লাগে–একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পরিচালিত চিন্তা।

যে ব্যক্তি অল্প কিছু অর্জন করতে চায় তাকে অবশ্যই অল্প কিছু উৎসর্গ করতে হবে। যে ব্যক্তি অনেক কিছু অর্জন করতে চায় তাকে অবশ্যই অনেক কিছু উৎসর্গ করতে হবে। আর যে ব্যক্তি আরও উপরে উঠতে চায় তাকে অবশ্যই ব্যাপকভাবে উৎসর্গ করতে হবে।


 




রূপকল্প ও আদর্শ চিন্তা


স্বপ্নদ্রষ্টারা হচ্ছে বিশ্বের ত্রাণকর্তা। আমাদের এই দৃশ্যমান বিশ্ব অদৃশ্য শক্তি দ্বারা চালিত। একে বাঁচিয়ে রেখেছে অদৃশ্য শক্তি। মানব জাতির যত পরীক্ষানিরীক্ষা, পাপকর্ম ও হীন কাজ আছে তার সবকিছু ছাপিয়ে স্বপ্নদ্রষ্টারা এগিয়ে চলে। তাদের দূরদৃষ্টিসম্পন্ন পথ তারা একাই নির্ধারণ করে এবং নিঃসঙ্গভাবে এগিয়ে যায়। মানব সভ্যতা কখনো এর স্বপ্নদ্রষ্টাদের ভুলতে পারে না এবং তাদের স্বপ্নকে ম্লান ও বিস্মৃত হতে দিতে পারে না। বরং সভ্যতা স্বপ্নদ্রষ্টাদের স্বপ্ন নিয়েই বাঁচে।

সংগীত শিল্পী, ভাস্কর, চিত্রকর, কবি, ধর্মপ্রবক্তা ও সাধু মানুষজন হচ্ছেন এই বিশ্বের নির্মাতা, স্বর্গের পথপ্রদর্শক। আজকের বিশ্ব এত সুন্দর কারণ তাদের মতো মহান ব্যক্তিরা বিশ্বে বিচরণ করেছেন। এমন মহান ব্যক্তিদের শ্রম ভিন্ন মানব সভ্যতা বিলীন হয়ে যেত।

যার একটি সুন্দর স্বপ্ন আছে, মনমস্তিষ্কে মহৎ চিন্তা রয়েছে সে একদিন সেই স্বপ্নকে পূরণ করবেই। কলম্বাস একটি নতুন জগতের স্বপ্ন দেখেছিলেন এবং তিনি তা আবিষ্কার করেন। কোপার্নিকাস আমাদের সৌরজগতের কেন্দ্র হিসাবে সূর্যকে চিহ্নিত করেন এবং গত দুই তিন হাজার বছরের ভুল (পৃথিবীই এই মহাবিশ্বের কেন্দ্র) ধরিয়ে দেন। বুদ্ধ তার স্বপ্নকে ধরে রাখেন। আত্মিক জগৎ এক ধরনের নিষ্কলুষিত স্থান এবং শান্তির জায়গা বলে স্বপ্ন দেখেন এবং তিনি সেখানে বাস করেন।

আপনার রূপকল্পকে লালনপালন করুন, আপনার ধারণাগুলোকে লালনপালন করুন, আপনার হৃদয়ে যে সংগীত গুণগুণ করে তাকে লালনপালন করুন, আপনার মনমস্তিষ্ককে যে সৌন্দর্য বিমোহিত করে তাকে ধরে রাখুন, যে কমনীয়তা ও পবিত্রতা আপনার চিন্তাকে সাজিয়ে রাখে তাকে বজায় রাখুন। কারণ এগুলো থেকেই আনন্দদায়ক পরিবেশ পরিস্থিতির জন্ম হবে। স্বর্গীয় যত সুখানুভূতি তা এ ধরনের চিন্তা থেকেই জন্ম নেয়। আপনি যদি এমন চিন্তার প্রতি একাগ্র থাকেন তবে একদিন না একদিন আপনার রূপকল্প পূরণ হবেই।

কোন কিছু লাভ করতে হলে আকুলভাবে কামনা করতে হয়। কোন কিছু অর্জন করতে হলে উচ্চাকাক্সক্ষী হতে হয়। মানুষের অন্তরস্থ আকাক্সক্ষার পূরণই কি তাকে তৃপ্ত করে না? নাকি মানুষের খাঁটি উচ্চাকাক্সক্ষা খাদ্যের অভাবে অনাহারে থাকে?

স্বপ্ন যখন দেখবেন তখন মহৎ স্বপ্ন দেখুন। কারণ আপনি যা স্বপ্ন দেখবেন আপনি তাই হয়ে উঠবেন। আপনার রূপকল্প, আপনার জীবনের একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যই একদিন আপনার মধ্য দিয়ে সত্য হয়ে উঠবে। আপনার আদর্শ চিন্তাই একদিন ভবিষ্যদ্বাণীর মতো সত্য হয়ে উঠবে, সকলের সামনে উন্মোচিত হবে।

সবচেয়ে বড় কৃতিত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে প্রথমে একটি স্বপ্ন দেখার সাহস করতে পারা। একটা সময় পর্যন্ত এই স্বপ্ন দেখতে পারাই সবচেয়ে বড় কাজ। একটি ছোট্ট বীজের মধ্যে ঘুমিয়ে থাকে বিশাল বড় বটগাছ, ডিমের মধ্যে অপেক্ষা করে পাখা মেলে উড়ে চলা এক পাখি এবং আত্মার মধ্যে বাস করে ব্যক্তির গভীরতম স্বপ্ন। আর এই স্বপ্নই হচ্ছে বাস্তব জগতের বীজস্বরূপ।

আপনার পরিবেশ পরিস্থিতি হয়তো প্রতিকূলে আছে কিন্তু এই প্রতিকূলতা বেশিদিন থাকবে না যদি আপনি একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য নেন এবং তা অর্জনে সংগ্রাম করেন। লক্ষ্য ভিন্ন আপনি যাত্রা করতে পারবেন না এবং লক্ষ্য নিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতেও পারবেন না। ধরুন, এক তরুণ দরিদ্রতা দ্বারা নিষ্পেষিত। দৈনিক পরিশ্রম করে তাকে চলতে হয়। কোন এক অস্বাস্থ্যকর কারখানায় অনেক সময় ধরে সে কাজ করে। বিদ্যালয়ে গিয়ে পড়ালেখা করতে পারেনি এবং সব ধরনের সুযোগ সুবিধা বঞ্চিত। কিন্তু সে ভালো কিছুর স্বপ্ন দেখে। সে বুদ্ধিমত্তার সাথে চিন্তা করে এবং সুযোগ সুবিধা খোঁজে। তার মধ্যে দয়া ও মমতা রয়েছে। তার আচরণে রয়েছে লাবণ্য। সে নিজের মধ্যে জীবনের এমন এক আদর্শ পরিস্থিতি ধারণ করে যা তাকে আরও বিস্তৃত স্বাধীনতা দেয় এবং আরও বড় দায়িত্ব পালনের সম্ভাবনা তৈরি করে। এই চাঞ্চল্য তাকে কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করে এবং সে তার অবসর সময়ের সর্বোচ্চ ব্যবহার করে। হয়তো তার অবসর তেমন নেই, খুব অল্প সময়। কিন্তু তবুও সে তা ব্যবহার করে নিজের উন্নতির জন্য। তার আশেপাশের যেসব সুযোগ ও সম্ভাবনা আছে সেগুলোকে কাজে লাগিয়ে নিজের দক্ষতা বৃদ্ধি করে। এভাবে ধীরে ধীরে সে তার মনকে উন্নত করে যা কারখানার অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের শৃঙ্খলে বাঁধা ছিল। এভাবে তার মানসিকতা এতটাই দৃঢ় হয়ে ওঠে যে কাপড় সেলাই করে যেমন সুন্দর একটি জামা হয় তেমন সুযোগও তার সমানে এসে হাজির হয়। সে সেই সুযোগকে কাজে লাগায়। কারণ সে সুযোগ কাজে লাগাতে সম্পূর্ণ প্রস্তুত। কয়েক বছর পর আমরা হয়তো সেই তরুণকে দেখবো একজন পরিপক্ক পুরুষ হিসাবে। আমরা দেখব সে তার মনমস্তিষ্ককে এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম যে তা আশেপাশের পরিবেশ পরিস্থিতিকেও বদলে দিতে পারে; সে তার হাতে বিশাল বিশাল সব কাজের দায়িত্ব তুলে নিয়েছে এবং তা পালন করছে; সে যখন কথা বলে তখন মানুষের জীবন বদলে যায়; পুরুষ ও নারী, সব ধরনের লোকজন তার কথায় নিজেদের চরিত্রকে বদলে ফেলে এবং সে সূর্যের মতো দীপ্তিমান। সে তরুণ বয়সে একটি স্বপ্ন দেখেছিল। আজকে সেই স্বপ্ন পূরণ করে সে অন্যদের জন্য আদর্শ স্বপ্নে পরিণত হয়েছে।

প্রিয় পাঠক, আপনি কি আপনার রূপকল্প, আপনার অন্তরস্থ জীবনের লক্ষ্য খুঁজে পেয়েছেন? এ কোন অলস ইচ্ছা নয়। এ হচ্ছে আপনার জীবনের সুন্দরতম জিনিস, আপনার হৃদয়ের গভীরতম আকাক্সক্ষা। একে অনুসরণ করে যান। ভালোবাসুন, গোপনীয়তার সাথে কাজ করে যান। আপনার হাতে আপনার চিন্তা মতোই ফলাফল দেওয়া হবে। আপনি তাই পাবেন যা আপনি অর্জন করবেন, কমও না, বেশিও না। আজকে আপনার পরিবেশ পরিস্থিতি যাই হোক না কেন, আপনি হয় ব্যর্থ হবেন, এমনই থেকে যাবেন অথবা আপনার চিন্তা, আপনার রূপকল্প, আপনার আদর্শ অনুযায়ী নিজেকে গড়ে তুলবেন। আপনার অন্তরস্থ আকাক্সক্ষা যদি ছোট কিছু হয় তবে আপনার পরিণতিও তাই হবে। আর আপনার অন্তরস্থ আকাক্সক্ষা যদি মহান কিছু হয় তবে আপনার পরিণতিও তাই হবে।

স্ট্যান্টন ক্রিকহাম ডেভিসের মতে, ‘আপনি হয়তো অনেক দিন যাবৎ অপেক্ষা করে আছেন। একদিন দেখলেন, আপনার সামনে বাধাস্বরূপ যে সমস্যা দীর্ঘদিন ধরে দাঁড়িয়ে আছে তা আজ সমাধান হয়ে গেছে। আপনি এক জনসভার সামনে দাঁড়িয়ে, কানের ওপর কলম, হাতে কালির দাগ এবং আপনার মধ্যে অনুপ্রেরণার ঝড় বইছে। মেষপালক যেমন মেষদের পথ দেখায়, তেমন আপনিও মানুষকে পথ দেখাবেন। আপনার গুরু, আপনার নির্দেশক হয়তো বলবে, “আমার কাছে তোমাকে শেখানোর মতো আর কিছুই নেই।” তখন থেকে আপনি নিজেই গুরু হয়ে উঠবেন এবং অন্যদের স্বপ্ন পূরণে পথ দেখাবেন। আপনি নিজের মধ্যে এ বিশ্বকে নতুনভাবে এবং আরও উত্তমভাবে তৈরির পথ দেখবেন।’

যে ব্যক্তি চিন্তা করে না, অজ্ঞ এবং শ্রমবিমুখ, সে পরিস্থিতির শিকার। সে কখনো পরিস্থিতিকে নিজের কাজে ব্যবহার করতে পারে না। কারণ সে কাজ করতে অনাগ্রহী। এমন লোক কেবল সৌভাগ্য, কপাল ও সুযোগের কথা বলে বেড়ায়। একজন মানুষের উন্নতি দেখে বলে, ‘তার কী কপাল!’ কাউকে মেধাবী হয়ে উঠতে দেখলে বলে, ‘সবাই তাকে কত সাহায্য করেছে!’ কাউকে খ্যাতিমান হয়ে উঠতে দেখলে বলে, ‘সে কত সুযোগ পেয়েছে!’ এমন লোকজন কখনোই মহান মানুষের কষ্ট দেখে না, তারা কতবার ব্যর্থ হয়েছে তা দেখে না, তারা কতশত সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে এবং সেই সমস্যা থেকে শিক্ষা নিয়ে লাভবান হয়েছে তা দেখে না। এমন লোকজন কখনোই দেখে না মহান মানুষ কত কিছু উৎসর্গ করেছে, কত ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করেছে, নিজেদের কর্মের ওপর বিশ্বাস রেখেছে যে তারা তাদের অন্তরস্থ রূপকল্প বা জীবনের লক্ষ্য পূরণ করতে সক্ষম। এমন লোকজন কখনোই মহান মানুষের মানসিক যন্ত্রণা ও শূন্যতা দেখে না; তারা কেবল ঝলমলে আলো ও আনন্দ দেখে এবং একে বলে ‘সৌভাগ্য’। এমন লোকজন কখনোই মহান মানুষের দীর্ঘ ও কষ্টসাধ্য যাত্রা দেখে না, বরং দেখে লক্ষ্য পূরণের বিজয় উৎসব এবং একে বলে ‘তার কপাল ভালো’। তারা কখনোই কার্যধারা বুঝতে চায় না, কেবল ফলাফল কী হবে তাই বুঝতে চায় এবং কাজ না করে রাতারাতি ফলাফল লাভ করতে চায়।

মানুষের যত ধরনের প্রাপ্তি আছে, অর্জন বা কৃতিত্ব আছে, তার সবকিছুই চেষ্টা দ্বারা অর্জিত। কসরত করে, খাটাখাটি করে অর্জন করতে হয়েছে। চেষ্টার সাথে সাথে অর্জনও জড়িত। যার চেষ্টা যত বেশি তার অর্জনও তত বড়। তবে রাতারাতি কোন কিছু পাওয়া যায় না। মেধা, শক্তি, বস্তুগত বিষয়, বুদ্ধিমত্তা ও আত্মিক শক্তি– এগুলো সবই চেষ্টার ফল। চিন্তার একাগ্রতা, যেকোন বিষয়ে অর্ধেক কাজ না করে পুরোপুরি কাজটি সম্পন্ন করা এবং নিজের অন্তরস্থ রূপকল্প বা জীবনের লক্ষ্য অনুধাবন করাই মেধা, শক্তি, বস্তুগত বিষয়, বুদ্ধিমত্তা ও আত্মিক শক্তিতে পরিণত হয়। এর জন্য দরকার চেষ্টা।

আপনি আপনার মনমস্তিষ্কে যে রূপকল্প বা জীবনের লক্ষ্য নির্দিষ্ট করেছেন, আপনার হৃদয়ে যেসব আদর্শকে সিংহাসনে বসিয়েছেন তাই আপনার জীবনকে নির্মাণ করবে, আপনি তাই হয়ে উঠবেন।


 




প্রশান্তি ও নির্মলতা


বিজ্ঞতার সবচেয়ে চমৎকার গুণ হচ্ছে মনের প্রশান্তি। এ প্রশান্তি হচ্ছে দীর্ঘদিনের আত্মনিয়ন্ত্রণের ফলাফল। এর উপস্থিতি থেকে বোঝা যায় ব্যক্তি অনেক দিনের চেষ্টা ও অভিজ্ঞতার ফলে পরিণত অবস্থায় পৌঁছেছে। বহু বছর ধরে জ্ঞানের প্রয়োগ এবং চিন্তার নিয়মিত চর্চার ফলে ব্যক্তির মধ্যে এমন এক প্রশান্তির ছাপ পাওয়া যায়।

একজন মানুষ তখনই শান্তি অনুভব করে যখন সে বুঝতে পারে যে সে চিন্তা থেকে প্রসূত এক সত্তা। এ ধরনের অনুভূতির জন্য অন্যদের ও তাদের চিন্তাকেও বোঝা দরকার। বুঝতে পারা বা উপলব্ধি করতে পারা অনেক বড় গুণ। যখন সে নিজেকে ও অন্যকে ঠিকভাবে বুঝতে পারবে তখন সে আরও স্পষ্টভাবে আশেপাশের বিশ্বকে দেখতে পাবে। সে প্রতিটি কাজের কারণ ও প্রভাব সম্পর্কে জানতে পারবে। এই উপলব্ধি তাকে তাড়াহুড়া করা, রাগ, দুশ্চিন্তা ও শোক করা থেকে বিরত রাখবে। এতে করে সে পবিত্রতা, সহিষ্ণুতা ও প্রশান্তি অনুভব করবে।

একজন শান্ত মানুষ নিজেকে কীভাবে পরিচালিত করতে হয় তা শেখে, অন্যদের সাথে নিজেকে কীভাবে খাপ খাওয়াতে হয় তা জানে এবং এর বিপরীতে অন্যরা তার আত্মিক ক্ষমতার প্রতি শ্রদ্ধা অনুভব করে ও তার ওপর নির্ভর করে। একজন মানুষ যত বেশি নিজেকে শান্ত ও স্থির করতে পারে তার সাফল্য, তার প্রভাব, ভালো কিছু করার প্রতি তার ক্ষমতা তত বড় হয়। এমনকি একজন সাধারণ ব্যবসায়ীও তার ব্যবসায় দারুণ উন্নতি উপভোগ করে যখন তিনি আত্মনিয়ন্ত্রণ ও মনের স্থিরতা অর্জন করেন। লোকজন সবসময় যার আচরণ অপরিবর্তনীয় তার সাথে কাজ করতে পছন্দ করে।

একজন শান্ত ও শক্তিশালী মানুষ সবসময় লোকজনের ভালোবাসা ও সম্মান পায়। তিনি হচ্ছেন মরুভূমিতে ছায়াতরু অথবা ঝড়ের সময় নিরাপত্তাদানকারী এক বিরাট পাথর। শান্ত ও সুস্থির এক হৃদয়কে কে না ভালোবাসে? সুন্দর ও নির্দিষ্ট মনোভাবসম্পন্ন, ভারসাম্যপূর্ণ এক জীবনকে কে না ভালোবাসে? যারা এ ধরনের আর্শীবাদপূর্ণ গুণাবলির অধিকারী তাদের জন্য রোদ কি বৃষ্টি কোন প্রভাব ফেলতে পারে না। যারা সবসময় অক্ষুব্ধ, নির্মল ও শান্ত তারা যেকোন পরিস্থিতিতে একই রকম থাকেন। তাদের চরিত্রের এই সূক্ষ্ম পবিত্রতা, যাকে আমরা প্রশান্তি নাম দিয়েছি, তা মূলত আত্মার নির্যাস। এটা বিজ্ঞতার মতো বহুমূল্যবান, স্বর্ণের চেয়েও বেশি আকাক্সিক্ষত– এমনকি স্বর্ণের চেয়েও উত্তম। একটি নির্মল ও প্রশান্ত জীবনের চেয়ে কেবল টাকাপয়সা খুঁজে বেড়ান কতটা তুচ্ছ এক জিনিস। শান্ত ও সন্তুষ্ট এক জীবনের মধ্যে সত্য নিহিত। সমুদ্রের উপরি ভাগে যেমন উত্তাল ঢেউ, কিন্তু এর নিচে যেখানে এই প্রচ- ঝড়তুফান পৌঁছাতে পারে না সেখানে শায়িত এক নির্মল প্রশান্তি।

অগ্নিশর্মা মেজাজের কারণে কত লোকের সুন্দর ও মধুর জীবন তছনছ হয়ে গেছে এবং তাদের জীবন হয়ে গেছে বিষণœ ও খিটখিটে। অতিমাত্রার ক্রোধ কত মানুষের জীবনের পবিত্রতা ছিনিয়ে নিয়েছে এবং তাদেরকে মন্দ পথে পরিচালিত করেছে। বেশিরভাগ মানুষ কি আত্মনিয়ন্ত্রণের অভাবে নিজেদের জীবনে ধ্বংস ডেকে আনছে না? জীবনের সুখ নষ্ট করছে না? দেশের মানুষের জন্য এ প্রশ্ন এখন খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দেখা দিয়েছে। আমরা এমন কত লোককে দেখি যাদের জীবন সুন্দরভাবে ভারসাম্যপূর্ণ? কার মধ্যে এমন তীব্র পবিত্রতা বিদ্যমান যা তার চরিত্রকে মহিমান্বিত করে?

হ্যাঁ, এ কথা সত্য যে মানব সভ্যতা কেবল জ্ঞানী ও বিজ্ঞ ব্যক্তিদের আবেগ দ্বারা বেড়ে উঠেছে, দুঃখদুর্দশা দ্বারা আলোড়িত হয়েছে, আশঙ্কা ও সন্দেহ দ্বারা এগিয়ে গেছে। কিন্তু এমনটা তখনই হয়েছে যখন তাঁর চিন্তা ছিল নিয়ন্ত্রিত ও পবিত্র। তাঁর এই আত্মনিয়ন্ত্রণ ও পবিত্রতাই তাঁর আত্মার ঝড়তুফান থেকে তাকে রক্ষা করেছে এবং মহৎ কর্মে উদ্বুদ্ধ করেছে।

একটি ক্ষতিগ্রস্ত আত্মা, সে যে পরিস্থিতির মধ্য দিয়েই যাক না কেন, এও জানে যে এ জীবন হচ্ছে আশীর্বাদের এক মহাসাগর। এক দিকে যেমন ঝড়তুফান আছে তেমন অন্য দিকে আশীর্বাদেরও কমতি নেই। আর প্রায়ই দেখা যায় ঝড়তুফানের পর সূর্যের আলোয় ঝলমল করা এক তীরভূমি। এই তীরভূমি যেন অপেক্ষা করে আছে। নিজের হাতে, শক্ত করে চিন্তার রাশ টেনে ধরুন। আপনার আত্মা আপনার কথা শোনার জন্য বসে আছে। আপনি যদি নিজেই নিজের নিয়ন্ত্রণ নেন, তবেই সে জেগে উঠবে, আপনাকে এগিয়ে যাওয়ার শক্তি দিবে। আত্মাকে জাগিয়ে তোলার সেই শক্তির নাম আত্মনিয়ন্ত্রণ। আত্মনিয়ন্ত্রণ নিজেই এক শক্তি। ঠিক চিন্তা করা পারা হচ্ছে দক্ষতার লক্ষণ। ধৈর্যশীলতা হচ্ছে এক ধরনের ক্ষমতা। নিজের হৃদয়কে বলুন, ‘শান্ত হও, স্থির হও।’


 




লেখকের কিছু উক্তি


১। একজন মানুষকে শিখতে হবে যে সে জিনিসের ওপর কর্তৃত্ব করতে পারে না, বরং নিজের ওপর কর্তৃত্ব করতে পারে; সে অন্যের ইচ্ছাশক্তির ওপর বল প্রয়োগ করতে পারে না, বরং নিজের আপন ইচ্ছাশক্তিকে পরিবর্তন ও নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। আশেপাশের বিষয়বস্তু তখনই একজন মানুষকে সহায়তা করে যখন মানুষ নিজে সত্যের সেবক। যে মানুষ নিজের ওপর কর্তৃত্ব করতে পারে লোকজন তাঁর কাছে পথের দিশা খোঁজে।

২। সোজাসুজি বলতে গেলে একজন মানুষ হচ্ছে যা সে চিন্তা করে।

৩। একজন মানুষ ন্যায়সঙ্গতভাবে কাজ করতে পারে না যতক্ষণ পর্যন্ত না সে একটি সুখী, স্বাস্থ্যবান ও সমৃদ্ধ সত্তায় পরিণত হতে পারছে। আর সুখ, স্বাস্থ্য ও সমৃদ্ধি নির্ভর করে একজন মানুষ যখন নিজের ভিতর ও বাইরের পরিবেশ পরিস্থিতির সাথে ভারসাম্য বজায় রেখে চলতে পারে।

৪। একজন মানুষ আজ বা কাল আবিষ্কার করবেই যে সে তার জীবনের মাঝি, আত্মার মালি।

৫। সবকিছুর উপরে একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য নিন। একটি বৈধ, ন্যায়সঙ্গত লক্ষ্য এবং দরকারি উদ্দেশ্য গ্রহণ করুন। এর প্রতি নিজেকে অকপটভাবে নিয়োজিত করুন।

৬। আপনি যা কিছু অর্জন করেন অথবা অর্জন করতে ব্যর্থ হন তার সবকিছুই আপনার চিন্তার সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত।

৭। ডোবা জলাভূমিতে জন্মে সবচেয়ে সুন্দর ফুল। ঠিক তেমন দারিদ্র্যের অন্ধকারতম ভূমিতে মানবজাতির উৎকৃষ্ট ফুল বেড়ে ওঠে ও বিকশিত হয়।

৮। পরিবেশ পরিস্থিতি একজন মানুষকে তৈরি করে না, বরং তাকে উন্মোচিত বা প্রকাশ করে মাত্র।

৯। যখন স্বপ্ন দেখবেন তখন বড়, মহৎ স্বপ্ন দেখুন। আপনি যে স্বপ্ন দেখবেন আপনি তাই হয়ে উঠবেন। আপনার দূরদৃষ্টি একদিন আপনাকে সেই জায়গায় নিয়ে যাবে, আপনার আদর্শ একটি ভবিষ্যদ্বাণী মতো ফলে যাবে।

১০। প্রকৃত সাফল্য পেতে নিজেকে এই চারটি প্রশ্ন করুন : কেন? কেন নয়? আমি কেন নয়? এখন কেন নয়?

১১। ভালো চিন্তা ভালো ফলাফল বয়ে আনে, মন্দ চিন্তা মন্দ ফলাফল বয়ে আনে।

১২। সুখী অবস্থা হচ্ছে মানসিক এক ভারসাম্য; অসুখী অবস্থা হচ্ছে মানসিকভাবে ভারসাম্যহীনতা।

১৩। ভারসাম্যপূর্ণ জীবনের একটি আত্মিক দিক হচ্ছে ভালোবাসার প্রকাশ।

১৪। যে ব্যক্তি অল্প কিছু অর্জন করতে চায় তাকে অবশ্যই অল্প কিছু উৎসর্গ করতে হবে, যে ব্যক্তি অনেক কিছু অর্জন করতে চায় তাকে অবশ্যই অনেক কিছু উৎসর্গ করতে হবে। আর যে মহান কিছু অর্জন করতে চায় তাকে অবশ্যই মহান কিছু উৎসর্গ করতে হবে।

১৫। আপনার যদি ভালো কিছু করার প্রকৃত ইচ্ছা থাকে তবে অর্থের জন্য অপেক্ষা করার দরকার নেই। আপনি এখন, এই মুহূর্তেই কাজ আরম্ভ করতে পারেন। এখন যেখানে আছেন সেখান থেকে শুরু করতে পারেন।

১৬। মানুষের যত কাজকর্ম আছে তার দুইটি দিক আছে : চেষ্টা ও ফলাফল। একজনের চেষ্টার তীব্রতা নিরুপণ করা যায় ফলাফল দেখে।

১৭। মানুষ তার বিভিন্ন শক্তি বিভিন্ন দিকে ব্যয় করে। এসব বিভিন্ন শক্তিকে একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যেও ব্যয় করা সম্ভব। এ কেবল একটি পদ্ধতিগত ব্যাপার।

১৮। সুন্দর ও সুশীল স্বভাব ব্যতীত কোনকিছুই চিন্তা করবেন না। আর আপনার উপস্থিতির সৌন্দর্য ও সুশোভিত রূপের চেয়ে উত্তম কিছু হতে পারে না।

১৯। মানুষ তার নিজের দ্বারা তৈরি হয় অথবা বিনষ্ট হয়। ঠিকমতো নির্বাচন করতে পারলে সে ঊর্ধ্বে আরোহণ করে। সে ক্ষমতা, বুদ্ধিমত্তা ও ভালোবাসার প্রতীকে পরিণত হয়, নিজস্ব চিন্তার ওপর কর্তৃত্ব করে এবং প্রতিটি পরিস্থিতির মূল চাবিকাঠি ধরে রাখে।

২০। মানুষ তার পরিবেশ পরিস্থিতি উন্নত করতে বেশ উদ্বিগ্ন, কিন্তু নিজেকে উন্নত করতে অনিচ্ছুক। তাই তারা যেখানে আছে সেখানেই পড়ে রয়।

২১। ধন্যবাদ জানানোর চেয়ে জরুরি আর কোন কতর্ব্য হতে পারে না।

২২। কোন ধরনের প্রলোভন, প্ররোচনা মানুষকে টানতে পারে না যদি না তার হৃদয় তাতে সাড়া দেয়।

২৩। আমাদের চিন্তা আমাদেরকে যেভাবে তৈরি করে আমাদের জীবনও তেমন। এজন্য একজন মানুষ যখন তার আশেপাশের জিনিসপত্র ও লোকজনের প্রতি চিন্তাভঙ্গি পরিবর্তন করে তখন সে জিনিসপত্র ও লোকজনের পরিবর্তিত রূপ দেখে, যা তার চিন্তাভঙ্গির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।

২৪। প্রথমত এবং একটি সময় পর্যন্ত সবচেয়ে বড় কৃতিত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে একটি স্বপ্ন। বিশাল বটবৃক্ষ লুকিয়ে থাকে একটি ছোট্ট বীজের ভিতর, ডিমের ভিতর অপেক্ষা করে আকাশে উড়ে চলা এক পাখি এবং মানুষের মহত্ত্ব ও বিশালতা লুকিয়ে থাকে তার আত্মায়। স্বপ্ন হচ্ছে বাস্তবতার চারাগাছ।

২৫। ফসল ফলানোর নিয়ম হচ্ছে আপনি যা রোপণ করবেন তারচেয়ে বেশি ফসল তুলবেন। একটি কাজ রোপণ করলেন এবং আপনি একটি অভ্যাস গড়লেন। একটি অভ্যাস রোপণ করলেন এবং আপনি একটি চরিত্র গড়লেন। একটি চরিত্র রোপণ করলেন এবং আপনি একটি ভবিষ্যৎ গড়লেন।

২৬। যে ব্যক্তি তার ভুলত্রুটি ও ব্যর্থতা সহ্য করতে পারে না, অন্যকে জানাতে ও সকলের সামনে তুলে ধরতে পারে না বরং সেগুলোকে লুকানোর চেষ্টা করে সে সত্যের পথে চলার অযোগ্য।

২৭। যে ব্যক্তির চিন্তাভাবনা ও কাজ মন্দ এবং আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে ভালো ফলাফলের জন্য তার অবস্থা অনেকটা সেই কৃষকের মতো যে তার জমিতে আগাছা রোপণ করে আল্লাহর কাছে ধানের ভালো ফসলের জন্য প্রার্থনা করে।

২৮। একজন মানুষের অনুভব অনুভূতি যত গভীর হবে তিনি তত বেশি গভীর চিন্তা ও ধ্যান করতে সক্ষম হবে এবং এর চর্চায় তত বেশি সফল হবে।

২৯। একজন মানুষ যত বেশি শান্ত ও স্থির হবে তার সাফল্য, তার প্রভাব-প্রতিপত্তি, তার ভালো কাজ করার ক্ষমতা তত বড় হবে। বিজ্ঞতার এক বড় রত্ন হচ্ছে মনের প্রশান্তি।

৩০। অন্যের কাছে আপনি যখন অভিযোগ করেন তার মানে হচ্ছে সমস্যার মূল কারণ আপনি নিজেই।

৩১। আমরা জ্ঞান দিয়ে কী করতে পারি? জ্ঞান দিয়ে নতুন কিছু করা, জ্ঞান থেকে কিছু একটা খুঁজে বের করে কাজে লাগানোর ইচ্ছা প্রকাশ করা। আমরা এটাই করতে পারি।

৩২। যারা সন্দেহ ও ভীতিকে জয় করতে পেরেছে তারা ব্যর্থতাকেও জয় করেছে।

৩৩। একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে চিন্তা করতে পারাই হচ্ছে দৃঢ়চেতা মানুষ হওয়ার প্রথম ধাপ। এরা এমন মানুষ যারা তাদের একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনের পথে ব্যর্থতাকে সাফল্য অর্জনের সিঁড়ি মনে করে।

৩৪। অর্জন করতে হয়ে আকাক্সক্ষা দরকার; উপরে উঠতে হলে উচ্চাকাক্সক্ষা দরকার।



 




তথ্যসূত্র


১। মান্দার গাছ : বাংলাদেশের পুষ্প-বৃক্ষ লতা-গুল্ম। লেখক : মোকারম হোসেন। ঢাকা, তরুপল্লব, ২০১৭, পৃষ্ঠা ৯০।

২। ফ্রান্সিস বেকন তাঁর উচ্চ পদ প্রবন্ধে বলেছেন, ‘ভালো কিছু করতে পারার শক্তি অর্জন– এই হওয়া চাই সকল উচ্চাকাক্সক্ষার প্রকৃত লক্ষ্য।’ বেকনের প্রবন্ধ। মূল : ফ্রান্সিস বেকন। অনুবাদ : কাওসার হুসাইন। ঢাকা, ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড, ২০০০।


 

ব্যক্তিগত উন্নয়নে

অন্যান্য বইয়ের তালিকা


০১. থিংক এন্ড গ্রো রিচ। মূল: নেপোলিয়ন হিল। অনুবাদ: ফজলে রাব্বি। ঢাকা, সাফল্য প্রকাশনী, ২০১৫।

০২. ডিভেলপিং দ্য লিডার উইদিন ইউ। মূল: জন সি. ম্যাক্সওয়েল। অনুবাদ: ফজলে রাব্বি। ঢাকা, সাফল্য প্রকাশনী, ২০১৭।

০৩. সাকসেস থ্রো এ পজেটিভ মেন্টাল এটিটিউড। মূল: নেপোলিয়ন হিল ও ডব্লিউ. ক্লেমেন্ট স্টোন। অনুবাদ: ফজলে রাব্বি। ঢাকা, সাফল্য প্রকাশনী, ২০১৭।

০৪. টাইম ম্যানেজমেন্ট। মূল: ব্রায়ান ট্রেসি। অনুবাদ: মোহাম্মদ রাশেদুল হক ও ফজলে রাব্বি। ঢাকা, সাফল্য প্রকাশনী, ২০২০।

০৫. অবজারভেশন। মূল: রাসেল এইচ. কনওয়েল। অনুবাদ: ফজলে রাব্বি। ঢাকা, সাফল্য প্রকাশনী, ২০১৭।

০৬. জিরো টু ওয়ান। মূল: পিটার থিয়েল ও ব্লেইক মাস্টার। অনুবাদ: ফজলে রাব্বি। ঢাকা, সাফল্য প্রকাশনী, ২০১৮।

০৭. আউটলায়ার্স। মূল: ম্যালকম গ্ল্যাডওয়েল। অনুবাদ: এ.এম. নাইম হোসেন ও ফজলে রাব্বি। ঢাকা, সাফল্য প্রকাশনী, ২০১৮।

০৮. ৭ স্ট্র্যাটেজিস ফর ওয়েলথ এন্ড হ্যাপিনেস। মূল: জিম রন। অনুবাদ: ফজলে রাব্বি। ঢাকা, সাফল্য প্রকাশনী, ২০১৯।

০৯. ওয়ান স্মল স্টেপ ক্যান চেঞ্জ ইউর লাইফ। মূল: ড. রবার্ট মৌরার (পিএইচডি)। অনুবাদ: ফজলে রাব্বি। ঢাকা, সাফল্য প্রকাশনী, ২০১৯।

১০. অ্যাজ আ ম্যান থিংকথ। মূল: জেমস অ্যালেন। অনুবাদ: ফজলে রাব্বি। ঢাকা, সাফল্য প্রকাশনী, ২০১৯।

১১. স্টার্ট উইথ হোয়াই। মূল: সাইমন সিনেক। অনুবাদ: ফজলে রাব্বি। ঢাকা, সাফল্য প্রকাশনী, ২০২০।

১২. এটিটিউড ইজ এভরিথিং। মূল: জেফ কেলার। অনুবাদ: ফারহা আহমেদ, শাহরিয়ার মাহমুদ ও ফজলে রাব্বি। ঢাকা, সাফল্য প্রকাশনী, ২০২০।

১৩. মেনটরিং ১০১। মূল: জন সি. ম্যাক্সওয়েল। অনুবাদ: ফজলে রাব্বি। ঢাকা, সাফল্য প্রকাশনী, ২০২০।

১৪. গেট স্মার্ট। মূল: ব্রায়ান ট্রেসি। অনুবাদ: ফারহা আহমেদ। সম্পাদনা: ফজলে রাব্বি। ঢাকা, সাফল্য প্রকাশনী, ২০২১।

১৫. সেল্ফ-ইমপ্রুভমেন্ট ১০১। মূল: জন সি. ম্যাক্সওয়েল। অনুবাদ: ফজলে রাব্বি। ঢাকা, সাফল্য প্রকাশনী, ২০২১।

১৬. টিমওয়ার্ক ১০১। মূল: জন সি. ম্যাক্সওয়েল। অনুবাদ: ফজলে রাব্বি। ঢাকা, সাফল্য প্রকাশনী, ২০২১।

 

পাঠকের জন্য:


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন