বৃহস্পতিবার, ২১ জানুয়ারী, ২০২১

বইয়ের পর্যালোচনা - সভ্যতা। মূল: ক্লাইভ বেল। অনুবাদক: মোতাহের হোসেন চৌধুরী


সভ্যতা মানে কী? ছোট্ট এক শব্দে এত কী শক্তি যা পুরো মানবজাতিকে বদলে দিতে পারে। আছে, এমনই এক শক্তি আছে সভ্যতা নামক এ ছোট্ট শব্দে। লেখক ক্লাইভ বেলের মতে সভ্যতা বলতে মূল্যবোধ ও বিচারবোধের শক্তিকে বুঝিয়েছেন। সভ্যতার কারিগর সমঝদাররা। সভ্যতার যুগ সৃষ্টির যুগ নয়, সমঝদারির যুগ। এভাবেই বইয়ের বক্তব্য এগিয়ে চলেছে। সাথে সাথে চলেছে বাংলাদেশের পরিবেশ পরিস্থিতি অনুযায়ী ক্লাইভ বেলের বক্তব্যের ঘাত-প্রতিঘাত। এর মূল রূপকার মোতাহের হোসেন চৌধুরী। একটি গোলাপের সৌন্দর্যকে যেমন বুদ্ধি দিয়ে নয়, অনুভূতি দিয়ে উপলব্ধি করতে হয়, তেমন সুভাষী ও সুসংবদ্ধ শব্দের জাদুকর মোতাহের হোসেন চৌধুরী লেখনীকেও চিত্তে গ্রহণ ও উপলব্ধি করতে হয়। ব্যক্তিগতভাবে এ বই পাঠ করে আমার অতৃপ্ত চিত্ত যেন তৃপ্তির পরশ পেল। তা কী করে ঘটল? এমন প্রশ্নের জবাব ছোট করে বইয়ের কয়েকটি উক্তি তুলে ধরার মধ্য দিয়ে প্রকাশ করছি:


১। সভ্যতার বিচার মানুষের কৃতিত্বে। কারণ সভ্যতা সৃষ্টি হয় কৃতিত্ব দিয়ে, অস্তিত্ব দিয়ে নয়। - পৃ. ০৬

২। সভ্যতার সাধনা আলোক ও মাধুর্যের সাধনা, যে যুগে দুই বস্তুর সাধনা বড় হয়ে উঠেছে, যে যুগে ইতর সুখের চেয়ে সূক্ষ্ম সুখকে বড় করে দেখা হয়েছে, সে যুগকেই আমরা সভ্যযুগ বলি। - পৃ. ১১

৩। বাঁচার উপায়কে যখন বড় করে তুলি জীবন তখনই হয় দরিদ্র, বাঁচার উদ্দেশ্যকে বড় করে তুললেই জীবন ঐশ্বর্যশালী হয়ে ওঠে, আর তাতেই সভ্যতার স্ফূতি। - পৃ. ১৩

৪। অবসরের প্রয়োজন আছে, অবসরের অভাবে মানুষ মেশিনে পরিণত হয়, মানুষের স্বাধীনতা বলে কিছুই থাকে না। - পৃ. ১৫

৫। মনে রাখা দরকার, মানবপ্রীতি বড় কথা, মনুষ্যত্বপ্রীতি আরো বড় কথা, আর ধ্যান, কল্পনা ও চিন্তাশীলতার মারফতেই মনুষ্যত্বের প্রকাশ। - পৃ. ১৫


৬। সভ্যতা জিনিসটা আসলে কী? সুমানসিকতা সৃষ্টির উপায়ই সভ্যতা। - পৃ. ১৮

৭। সভ্যতার বৈশিষ্ট্য:


পরস্পরের অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা, ঈশ্বর ও পরকালে বিশ্বাস, নারীর প্রতি সম্মান ও সমদর্শিতা সভ্যতার অনিবার্য গুণ বলে অনেকের বিশ্বাস। - পৃ. ১৯


ক। সামরিক শক্তির শ্রেষ্ঠতাও সভ্যতার বিশেষ লক্ষ্য নয়। - পৃ. ২১

খ। যান্ত্রিক কলাকৌশলের প্রাচুর্যকে সভ্যতার বৈশিষ্ট্য বলে গ্রহণ করা যায় না। - পৃ. ২১

গ। স্বদেশপ্রেমকেও সভ্যতার বৈশিষ্ট্য বলা যায় না। - পৃ. ২০

ঘ। অসতীত্ব সভ্যতার অনিবার্য গুণ নয়। - পৃ. ২০

ঙ। ভোটাধিকারকে সভ্যতার বিশেষ লক্ষণ বললে অনেক অসভ্য জাতিকে সভ্য বলে গ্রহণ করতে হয়। - পৃ.২১

চ। কমফার্ট বা আরাম সভ্যতার সৃষ্টি হলেও সভ্যতার বিশেষ লক্ষণ নয়। - পৃ. ২২

কমফার্ট সভ্যতার সহায়ক নয়, বরং অনেক সময় পরিপন্থী। - পৃ. ২২

ছ। সুসভ্যতা আনতে হলে বিশেষ সাধনা দরকার। - পৃ. ২৩


৮। মানুষ যখন প্রয়োজনের তাগিদের ঊর্ধ্বে উঠেছে তখনই সভ্যতা সৃষ্ট হয়েছে। - পৃ. ২৪

৯। মহাযুগ আত্মপ্রসারের যুগ, আর সুসভ্য যুগ আত্মপ্রকাশের। - পৃ. ২৮

১০। বিচার-বুদ্ধির যতবেশি প্রতিষ্ঠা সমাজ তখা সভ্যতারও ততবেশি উন্নতি। মূল্যবোধ ও যুক্তি-বিচারের প্রভুত্ব সাংসারিক নিরাপত্তার ওপর নির্ভরশীল। - পৃ. ২৯

১১। বুদ্ধির দ্বারা সহজ প্রবৃত্তিকে শোধিত করে নেওয়ার চেষ্টাই সভ্যতার প্রথম লক্ষণ। দ্বিতীয় লক্ষণ দূরবর্তী সূক্ষ্ম উপভোগের জন্য নিকটবর্তী স্থূল সুখকে বর্জন করা। - পৃ. ৫৪



মূল্যবোধ ও যুক্তিবোধ সভ্যতার বিশেষ বৈশিষ্ট্য। সমঝদারিও তাই। এগুলো অর্জনের উপায় চর্চা ও সাধনা। এ অর্জন সম্ভব, যদি ব্যক্তির মধ্যে সুসভ্য হয়ে ওঠের আকাঙ্ক্ষা ও চেষ্টা থাকে। সে লক্ষ্যে এ বই এক পথ নির্দেশনা স্বরূপ। এর সাথে মোতাহের হোসেনের লেখা সংস্কৃতির কথা এবং বার্ট্রেন্ড রাসেলের বই সুখ (অনুবাদক মোতাহের হোসেন চৌধুরী) পড়েছিলাম। এ সকল বইয়ের মধ্যে চমৎকার এক সেতুবন্ধন পরিলক্ষিত করেছি। এ সেতুবন্ধন কেবল লেখক ও লেখার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না। এগুলোকে ছাড়িয়ে সারাবিশ্বকে আলিঙ্গন করতে শেখায়।


সভ্যতা বইকে রেটিং দিলাম ৫.০০ এ ৫.০০।


তথ্যসূত্র :

১।  সভ্যতা। মূল: ক্লাইভ বেল। অনুবাদক: মোতাহের হোসেন চৌধুরী। ঢাকা, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র, ২০১৮।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন