শুক্রবার, ২২ জানুয়ারী, ২০২১

দি ইফেক্টিভ এক্সিকিউটিভ। মূল: পিটার এফ. ড্রুকার। অনুবাদ: শাহরিয়ার মাহমুদ, ফারহা আহমেদ এবং ফজলে রাব্বি। ঢাকা, সাফল্য প্রকাশনী, ২০২১।


একজন কার্যকর ও সফল কার্যনির্বাহীর প্রয়োজনীয় গুণাবলি




 

আমার জীবনের একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য হচ্ছে মানুষের জন্য উপকারী সেবা সম্পন্ন করা, একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যের ক্ষমতাকে তুলে ধরা যাতে করে মানুষ নিজেদের জীবনকে সমৃদ্ধি ও সাফল্যের পথে পরিচালিত করতে পারে। ঠিক এই কারণেই আমি প্রতিদিন সকালবেলা ঘুম থেকে উঠি, নতুন নতুন পথ খুঁজি, কী কী করা যায় তা নিয়ে চিন্তাভাবনা করি। এরই একটি উপায় হচ্ছে সাফল্য প্রকাশনীর মাধ্যমে ২০৩০ সালের মধ্যে অনুপ্রেরণার ৬৪টি বই প্রকাশ করা।

 

―ফজলে রাব্বি (সাফল্য প্রকাশনী, ঠিক ধারণা ব্লগ)



 

                              সাফল্য সম্বন্ধে সহযোগিতা


১৯৬৬ সালে প্রকাশিত ঞযব ঊভভবপঃরাব ঊীবপঁঃরাব / চবঃবৎ ঋ. উৎঁপশবৎ বইয়ের অনুসরণে বাংলা অনুবাদ




একজন কার্যকর ও সফল কার্যনির্বাহীর প্রয়োজনীয় গুণাবলি

দি ইফেক্টিভ এক্সিকিউটিভ



মূল

পিটার এফ. ড্রুকার



অনুবাদ

শাহরিয়ার মাহমুদ

ফারহা আহমেদ

ফজলে রাব্বি
















প্রকাশক

সাফল্য প্রকাশনী

৩০২, লালবাগ রোড, ওয়ার্ড নং: ২৫,

লালবাগ, ঢাকা-১২১১।

মোবাইল: ০১৫৩৪ ৯০২ ৮৮২

সাপ্র: ০১৫

প্রথম প্রকাশ: চৈত্র ১৪২৭ / আগস্ট ২০২১

বিষয়: ব্যক্তিগত উন্নয়ন

স্বত্ব:র্  ফজলে রাব্বি

প্রচ্ছদ: সাফল্য কম্পিউটার্স


দাম: চারশত সাতানব্বই মাত্র ($৪৯৭.০০)


পরিবেশক: নীলক্ষেত বুক মার্কেট, ৬৪, ইসলামিয়া মার্কেট, নীলক্ষেত, ঢাকা-১২০৫।

ফোনে অর্ডার করতে কল করুন ০১৬৮২ ০৫৮ ১৭১

সাফল্য প্রকাশনীর অনলাইন ওয়েরসাইট– িি.িংধঢ়যড়ষষড়.পড়স

সাফল্য প্রকাশনীর যেকোনো বই কিনতে ভিজিট করুন

িি.িৎড়শড়সধৎর.পড়স/সাফল্য-প্রকাশনী

যঃঃঢ়://িি.িভধপবনড়ড়শ.পড়স/হরষশযবঃনসধৎশবঃ


ঈৎবধঃরারঃু ধহফ ঢ়ৎড়নষবস ংড়ষারহম, ঊফরঃবফ নু ঋধুষব জধননর, চঁনষরংযবফ নু ঝধঢ়যড়ষষড় চৎড়শধংড়হর, ৩০২, খধষনধময জড়ধফ, ডধৎফ ঘড়: ২৫, খধষনধময, উযধশধ-১২১১. ঈড়হঃধপঃ ঙভভরপব: ০১৫৩৪ ৯০২ ৮৮২.

ডবনংরঃব: িি.িংধঢ়যড়ষষড়.পড়স

ঊ-সধরষ: ধফসরহ@ংধঢ়যড়ষষড়.পড়স

চৎরপব: ঞশ ৪৯৭.০০ ঙহষু. টঝ: $২০. (ঐধৎফপড়াবৎ). ওঝইঘ: ৯৭৮-৯৮৪-৯৩৬১৪-৮-২

 





উৎসর্গ

(মূল লেখক জেফ কেলার উৎসর্গ করেছেন)



লিও তলস্তয়

যে আমার প্রতি বিশ্বাস রেখেছে এবং আমার স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে কাজ করার জন্য উৎসাহিত করেছে




 

 

 





সূচি



ভূমিকা যে রাত আমার জীবন বদলে দেয় ১১

আমি কাজে যেতে ভয় পেতাম ১২

সাহায্য আসে অজানা জায়গা থেকে ১৩

উকিল থেকে মোটিভেশনাল স্পিকার ১৪

নিজের ভিত মজবুত করা ১৫

আপনি কীভাবে এ বই থেকে উপকৃত হবেন ১৭

চিন্তা করুন... কাজ করুন... কথা বলুন ১৮

প্রথম ভাগ সাফল্যের সূত্রপাত হয় চিন্তায় ১৯

এক আপনার মনোভাব হচ্ছে আপনার ভুবনকে দেখার জানালা ২০

মনোভাবের সংজ্ঞা ২২

সবাই একটি পরিষ্কার মনের জানলা দিয়ে আরম্ভ করে ২৩

নিজের জানালা পরিষ্কার করুন ২৪

আপনিই আপনার মনোভাবকে নিয়ন্ত্রণ করেন ২৪

মনোভাব ও সাফল্য ২৬

দুই আপনি একজন মনুষ্য চুম্বক ২৮

কীভাবে এই নীতি কাজ করে ৩০

একজন মানুষ যা কিছু নিয়ে সবচেয়ে বেশি চিন্তা করে তা তার জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করে

৩১

মনোভাব পরিবর্তনের কারণে আমি আবাসন কোম্পানির মালিক হলোাম ৩২

মনোভাব বনাম কর্ম সাধন ৩৩

আপনার পরিস্থিতি আপনার চিন্তারই প্রতিফলন ৩৩

নিজের চিন্তা বদলান ৩৪

পুনরাবৃত্তি হলো চাবিকাঠি ৩৫

রাতারাতি সাফল্য পাওয়ার আশা করবেন না ৩৬

তিন মনের জানালা দিয়ে নিজের সাফল্যকে স্পষ্টভাবে দেখুন ৩৭

ছোটবেলার ‘মনের চলচ্চিত্র’ ৩৮

নিজের মনের ছবির দায়িত্ব নিতে শিখুন ৩৯

পুরোনো ছবির অর্থ বদলে ফেলুন ৩৯

নতুন ছবি তৈরি করুন ৪০

বিক্রয়কর্মে সাফল্য লাভের জন্য কল্পচিত্র গঠন করুন ৪১

নিশ্চিন্ত থাকুন এবং নিজের ইন্দ্রিয়গুলোকে সজাগ রাখুন ৪১

নিজের জন্য একটি চেক লিখুন ৪২

পছন্দসই চাকরি পাওয়া ৪৩

এটি দু’ভাবে কাজ করে ৪৪

লাইটস... ক্যামেরা... একশন ৪৫

চার অঙ্গীকার করুন... আর জীবন বদলে দিন ৪৬

অঙ্গীকারের ‘জাদু’ ৪৭

বদ্ধদ্বার খুলে যাবে ৪৮

একটি সতর্কবাণী ৫০

অঙ্গীকার কীভাবে একজন উদীয়মান ঔপন্যাসিকের কাজে এল ৫০

তিনি হার মানতে রাজি হননি ৫২

যতদিন লাগে লাগুক ৫৩

অঙ্গীকার করার সময় হয়েছে ৫৪

পাঁচ সমস্যাকে সুযোগে রূপান্তর করুন ৫৫

সুবিধা খুঁজে নেওয়া ৫৬

শোক থেকে শক্তি ৫৭

ব্যবসায় অভিশাপ হচ্ছে ছদ্মবেশে থাকা আশীর্বাদ ৫৮

হতাশা থেকেই পেশাবদল হয় ৫৯

কীভাবে দুর্ভোগ আমাদের উপকার করে ৬১

ইতিবাচক জিনিস খুঁজুন ৬২

ব্যক্তিগত উন্নয়নে অন্যান্য বইয়ের তালিকা ১৪১



 




মুখবন্ধ


ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত বই সাধারণত অন্যান্য লোকজনকে কীভাবে পরিচালনা করতে হয় তা নিয়ে কাজ করে থাকে। এই ধরনের বইয়ের মূল বিষয় হচ্ছে একজন ব্যক্তি নিজেকে কীভাবে উত্তমভাবে পরিচালনা করতে পারে যাতে করে সে তার ব্যক্তি ও কর্মজীবনে কর্মদক্ষতার পরিচয় দিতে পারে। অবশ্য একজন ব্যক্তি তো সবসময়ই নিজেকে পরিচালিত করতে পারে। কিন্তু আমরা এখানে কেবল পরিচালনা কার কথাই বলছি না, বলছি কার্যকর ও সফলভাবে পরিচালনা করা যাতে করে আমরা যা চাই তা যেন অর্জন করতে পারি। আর নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, যে সকল নির্বাহী-কর্মকর্তা নিজেদের কার্যকর ও সফলভাবে পরিচালনা করতে পারে না তারা তাদের সহযোগী ও অধস্তনদের যথাযথভাবে পরিচালনা করতে পারবে এমন আশা করা যায় না। ব্যবস্থাপনা ব্যাপারটা সম্পূর্ণরূপে নিজে করে দেখাতে হয়, একে উদাহরণস্বরূপ অন্যদের সামনে উপস্থাপন করতে হয়। যে সকল কার্যনির্বাহী নিজেদের কাজে তাদের কীভাবে কার্যকর ও সফল করে তুলতে হয় তা জানে না, তারা ভুল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে।

একজন ব্যক্তি যথার্থ কর্মক্ষম হওয়ার জন্য তার বুদ্ধিমান হওয়া, কঠোর পরিশ্রমী কিংবা জ্ঞানী হওয়া যথেষ্ট নয়। কর্মদক্ষতা বা কার্যকারিতা সম্পূর্ণ ভিন্ন ও আলাদা এক বিষয়। কার্যকারিতা বিশেষ কোনো প্রতিভা, বিশেষ দক্ষতা কিংবা প্রশিক্ষণ ইত্যাদি থেকে ভিন্ন কিছু।

একজন কার্যনির্বাহী কিংবা পরিচালক হিসাবে কার্যকারিতা বা কর্মদক্ষতা মানে কিছু নির্দিষ্ট ও সাধারণ কাজ বা বিষয় বলতে পারেন। কার্যকারিতা আসে অল্প কিছু চর্চা বা অভ্যাস থেকে। এসব চর্চা বা অভ্যাস সম্পর্কেই এ বইয়ে বলা হয়েছে। তবে এই চর্চা বা অভ্যাসগুলো কারও জন্মগত কোনো প্রতিভা নয়। আমেরিকা, ইউরোপ, ল্যাটিন আমেরিকা ও জাপান ইত্যাদি দেশের ব্যবসায়িক কোম্পানি, সরকারি অঙ্গপ্রতিষ্ঠান, শ্রমিক ইউনিয়ন, হাসপাতাল, বিশ্ববিদ্যালয়, সামাজিক সংগঠন ইত্যাদির অসংখ্য পরিচালকের সাথে উপদেষ্টা হিসাবে কাজ করে আমি এমন একজন পরিচালকেরও দেখা পাইনি যিনি প্রাকৃতিকভাবে বা জন্মগতভাবে পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনার গুণাবলি প্রাপ্ত হয়েছেন। প্রত্যেক কর্মক্ষম ও পারদর্শী ব্যক্তিকে তার কর্মদক্ষতা ও পারদর্শিতাতে পারঙ্গম হয়ে উঠতে শিখতে হয়েছে। তারা এই গুণ তাদের অভ্যাসে পরিণত হওয়া অবধি শিখে গেছে। তবে যারাই এটা শেখার চেষ্টা করেছে তারা সফল বৈ কখনো ব্যর্থ হয়নি। কর্মদক্ষতা বা কার্যকারিতায় উন্নত হওয়ার বিষয় শেখা যায় এবং এটি শিখে অর্জন করতে হয়।

সফলভাবে ফলাফল আদায়ের কলাকৌশল বা উত্তম কার্যকারিতা হলো তা যার জন্য পরিচালক বা কার্যনির্বাহীদের নিয়োগ দেওয়া হয়, বেতন প্রদান করা হয়। তারা ব্যবস্থাপক বা ম্যানেজার হতে পারে। তাদের নিজেদের কাজকর্ম ও কৃতিত্বের পাশাপাশি অন্যেদের কাজকর্ম ও কৃতিত্বের জন্যও জবাবদিহিতা করতে হয়, কিংবা তারা নিজেরাই নিজেদের কর্ম ও কৃতিত্বের জন্য জবাবদিহিতার সম্মুখীন হয়। কার্যকারিতা বা কর্মদক্ষতা বিনে কৃতিত্বের কোনো আশা করা যায় না। কাজের ক্ষেত্রে কতটুকু বুদ্ধিমত্তা ও জ্ঞানের প্রয়োগ হলো, কিংবা কত সময় লেগেছে এসব গুরুত্বপূর্ণ নয়। অথচ এটা দেখে আশ্চর্য হতে হয় যে একজন কার্যকর কার্যনির্বাহীর প্রয়োজনীয়তার প্রতি আমরা কত কমই না গুরুত্ব দিয়ে থাকি। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান; যেমন ব্যবসায়িক কোম্পানি, বৃহৎ সরকারি অঙ্গসংগঠন, শ্রমিক সংঘ, বড় হাসপাতাল কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় এসবের সৃষ্টি হয়েছে বর্তমান কালে। একশ বছর আগেও এমন প্রতিষ্ঠানের সংস্পর্শে কেউ আসেনি বা বড়জোর মাঝে মাঝে স্থানীয় ডাকঘরে এক-দু’টি চিঠি পাঠানোর জন্য যাওয়া হত। পরিচালক বা কার্যনির্বাহী হিসাবে কার্যকারিতার মানে হলো কোনো প্রতিষ্ঠানের এবং প্রতিষ্ঠানকে ঘিরে কার্যকারিতা। এখন, প্রসঙ্গত, বিশেষত সেসব ব্যক্তি যাদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ রয়েছে তারা তাদের পুরো কর্মজীবন একই ধরনের প্রতিষ্ঠানে কাটিয়ে দিতে পারে। প্রতিটি উন্নত রাষ্ট্রের সমাজগুলো একেকটি সামাজিক সংগঠনে রূপ নিয়েছে। বর্তমানে একজন ব্যক্তির কর্মদক্ষতা নির্ভর করে তার একটি প্রতিষ্ঠানে কর্মক্ষম ও দক্ষ হয়ে উঠার উপর, এক্সিকিউটিভ তথা কার্যনির্বাহী হিসাবে দক্ষ হয়ে উঠার উপর। একটি আধুনিক সমাজের কার্যকারিতা এবং তার কার্য-সম্পাদনের সক্ষমতা-এমনকি হয়তো তার টিকে থাকার সক্ষমতা-বৃহদাকারে নির্ভর করে সেসব ব্যক্তির কর্মদক্ষতার উপর যারা সেসব প্রতিষ্ঠানে কাজ করে। একজন কর্মদক্ষ কার্যনির্বাহী বর্তমানে খুব দ্রুত সমাজের মূল উপাদানে পরিণত হচ্ছে এবং একজন কার্যনির্বাহী ব্যক্তির কার্যকারিতা বৃদ্ধি করাটা মূল কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটা যেমন কাজকর্ম শুরু করতে যাওয়া তরুণদের জন্যও সত্য, তেমন মাঝ বয়সে কাজ করে যাওয়া মধ্যবয়স্ক ব্যক্তিদের জন্যও সত্য।



 




সূচনা


কীসে একজন কার্যকারিতাসম্পন্ন নির্বাহী হওয়া যায়? - পিটার এফ. ড্রুকার


একজন কার্যকারিতাসম্পন্ন নির্বাহী হতে গেলে লিডার তথা নেতা হতে হবে এমন কোন বাধ্যবাধকতা নেই; যদিও লিডার নামক এই পরিভাষাটি এখন ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। নেতাদের যেমন জনগণকে মোহিত করার এক ধরনের সক্ষমতা থাকে, উদাহরণ হিসাবে বলছি, হ্যারি ট্রুম্যানের তো এর এক আউন্স পরিমাণও ছিল না। [এক আউন্স সমান ২৮.৩৫ গ্রাম।] কিন্তু তারপরও তিনি আমেরিকার ইতিহাসে সবচেয়ে যোগ্য ও প্রতিথযশা কার্যনির্বাহী। তেমনিভাবে, আমি গত ৬৫ বছর ধরে বিভিন্ন ব্যবসায়িক ও অলাভজনক প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী প্রধানদের সাথে পরামর্শক হিসাবে কাজ করেছি। তারা কেউই প্রচলিত অর্থে নেতা বলতে যা বোঝায় তা ছিল না। তারা তাদের ব্যক্তিত্বে, মনোভাবে, মূল্যবোধে, শক্তি কিংবা দুর্বলতায় স্বাভাবিক সংজ্ঞার চেয়েও বেশি ছিল। তাদের মাঝে ছিল বহির্মুখী থেকে অন্তর্মুখী ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ, ছিল সহজ-সরল থেকে নিয়ে কঠোর স্বভাবের কিংবা উদার থেকে নিয়ে মিতব্যয়ী।

যে বিষয়গুলো তাদের কর্মক্ষম ও দক্ষ করে তুলেছে তা হলো তারা সকলে আটটি বিষয় অনুসরণ করত এবং পালন করত:

ক্স তারা জিজ্ঞেস করে, “কী করতে হবে?”

ক্স তারা জিজ্ঞেস করে, “কোম্পানির জন্য কোন কাজ বা সিদ্ধান্তটি যথোপযুক্ত?”

ক্স তারা কার্যকর পরিকল্পনা তৈরি করে।

ক্স তারা সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর এসব সিদ্ধান্তের ফলাফল যাই হোক নিজের কাঁধে তার দায়িত্ব তুলে নেয়। তারা সিদ্ধান্ত গ্রহণে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেয়।

ক্স মানুষের সাথে যোগযোগ স্থাপনে দায়িত্বশীল আচরণ করে।

ক্স তারা সমস্যার চেয়ে সুযোগ ও সম্ভাবনাসমূহের প্রতি অধিক গুরুত্ব দেয়।

ক্স তাদের মিটিং ও সভা-সেমিনার ফলপ্রসূ ও উৎপাদনমুখী হয়।

ক্স তাদের চিন্তাভাবনা ‘আমি’ কেন্দ্রিক নয়; বরং ‘আমরা’ কেন্দ্রিক। তারা ‘আমি’র চেয়ে ‘আমরা’ চিন্তা করতে ও বলতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে।

প্রথম দু’টি অনুশীলন বা চর্চা তাদেরকে তাদের যে জ্ঞানের প্রয়োজন তা প্রদান করে। পরবর্তী চারটি বিষয় চর্চা তাদের জ্ঞানকে কর্মে পরিণত করতে সাহায্য করে। সর্বশেষ দুটি তাদেরকে দায়িত্বশীল ও জবাবদিহিতামূলক আচরণে সাহায্য করে।


প্রয়োজনীয় জ্ঞান অর্জন করুন


আপনার প্রথম অনুশীলনটি হলো নিজেকে জিজ্ঞেস করা যে কী করতে হবে। লক্ষণীয় বিষয় হলো প্রশ্ন এটা নয় যে, ‘আমি কী করতে চাই?’ কী করতে হবে তা জানতে চাওয়া ও প্রশ্নটিকে গুরুত্বপূর্ণভাবে নেওয়া ব্যবস্থাপনা কাজে সফলতার জন্য অতীব জরুরি। এই প্রশ্নটি করতে ব্যর্থ হওয়ার কারণে একজন শ্রেষ্ঠ কার্যনির্বাহীকেও ব্যর্থতার মুখ দেখা লাগতে পারে।

১৯৪৫ সালে ট্রুম্যান যখন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন, তিনি জানতেন তিনি ঠিক কী করতে চান; তিনি রুজভেল্টের নতুন চুক্তির আলোকে সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংস্কার সম্পন্ন করেন, যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে থেমে গিয়েছিল। যথাশীঘ্র তিনি জানতে চান তাকে কী করতে হবে, যদিও, কিন্তু তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন পররাষ্ট্রনীতিকে সর্বাগ্রে রাখতে হবে। তিনি তার কর্মসূচিকে এমনভাবে সাজান যাতে করে পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা সচিবদের সাথে পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ে আলাপ-আলোচনা শুরু করা যায়। যার ফলে, যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ে তিনিই প্রেসিডেন্ট হিসাবে সর্বাধিক পারদর্শিতার স্বাক্ষর রাখেন। তিনি ইউরোপ ও এশিয়া বিষয়ে সাম্যবাদের নীতি অবলম্বন করেন এবং তার মার্শাল পরিকল্পনার মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে ৫০ বছর এগিয়ে নিয়ে যান।

তেমনিভাবে, জ্যাক ওয়েলচ যখন জেনারেল ইলেক্ট্রনিক্সের প্রধান নির্বাহী নির্বাচিত হন, তিনি বুঝতে পেরেছিলেন তাকে কী করতে হবে। প্রধান নির্বাহী হিসাবে তার উদ্দেশ্য বিদেশে তাদের ব্যবসা বাড়ানো ছিল না। বরং তিনি চেয়েছিলেন যে, জেনারেল ইলেক্ট্রনিক্সের ব্যবসা থেকে নিস্তার পাওয়া, তাদের লাভের পরিমাণ যত বড়ই হোক না কেন, তা তাদেরকে শিল্পক্ষেত্রে প্রথম বা দ্বিতীয় স্থানে নিয়ে যেতে পারেনি।

“কী করতে হবে?” এই প্রশ্নের উত্তরে সাড়া দিতে গিয়ে সবসময় একাধিক জরুরি কাজ সম্পাদন করতে হয়। কিন্তু কর্মদক্ষ কার্যনির্বাহীগণ নিজেকে ছন্নছাড়া করে ফেলেন না। তারা সবসময়, পারতপক্ষে, কেবল একটি কাজের উপর তাদের মনোযোগ নিবদ্ধ রাখেন। এমন কার্যকর ও সফল নির্বাহী খুব কম আছে যারা তাদের কর্মদিবসে একটার চেয়ে বেশি দুইটা গুরুত্বপূর্ণ কাজে মনোযোগ দিয়েছে। ব্যতিক্রম থাকতে পারে। তবে ব্যতিক্রমীরা অবশ্যই প্রতিভাবান বলতে হবে। কিন্তু আর বাকি আমরা যারা, তারা একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজেই পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে কার্যকর ও সফল নির্বাহী হয়েছে। আমার এযাবৎ এমন কোন নির্বাহী বা পরিচালকের সাথে দেখা হয়নি যে কিনা দুয়ের অধিক কাজ করতে গিয়ে কার্যকর ফলাফল দিতে পেরেছেন। তাই, কী করতে হবে?-তা জিজ্ঞাসা করার পর, তারা কাজের গুরুত্ব অনুসারে তালিকা তৈরি করেন এবং সেই তালিকা অনুযায়ী অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে সুস্থিরভাবে কাজ করে যান। একজন প্রধান কার্যনির্বাহীর প্রথম ও প্রধান কাজ হলো কোম্পানির মিশন ও লক্ষ্যকে পুনরায় সংজ্ঞায়িত করা। একটি ইউনিট বা বিভাগীয় দল প্রধানের প্রথম দায়িত্ব হলো ঐ বিভাগের সাথে হেডকোয়ার্টারের সম্পর্ককে ঝালাই করে নেওয়া। অন্যান্য কাজ তা যতই গুরুত্বপূর্ণ বা আবেদনপূর্ণ হোক না কেন, তা পরে করতে হবে। যাই হোক, তালিকার মধ্যকার সর্বপ্রথম কাজটি সম্পাদন করার পর একজন কার্যনির্বাহী তার মূল তালিকার দ্বিতীয় কাজ করার পরিবর্তে পুনরায় অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে তালিকা প্রস্তুত করে। সে নিজেকে জিজ্ঞাসা করে, “এখন আবশ্যিকভাবে কোন কাজটি সম্পাদন করতে হবে বা কী করতে হবে?” সাধারণত এ পদ্ধতিতে কাজ করার ফলে এখন নতুন ও ভিন্ন একটি অগ্রাধিকার প্রাপ্ত কাজের তালিকা সামনে আসে।

আমেরিকার সর্বাধিক সুবিধিত কার্যনির্বাহী হিসাবে খ্যাত জ্যাক ওয়েলচ তাঁর আত্মজীবনীতে এ ব্যাপারে লিখেছেন। তিনি প্রতি পাঁচ বছর অন্তর অন্তর, তার আত্মজীবনী অনুসারে, জ্যাক ওয়েলচ নিজেকে জিজ্ঞেস করতেন, “এখন কী করতে হবে?” এবং প্রতিবার, নতুন ও ভিন্ন অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত কাজ তার সামনে চলে আসত।

কিন্তু, ওয়েলচ আগামী পাঁচ বছর কোন ক্ষেত্রে তার মনোযোগ ও শ্রম নিবদ্ধ করবেন তা নির্ধারণ করার আগে আরেকটি বিষয়ও ভেবে নিতেন। তিনি নিজের কাছে জানতে চাইতেন, তার তালিকার শীর্ষে থাকা কাজগুলোর কোন দুটি বা তিনটি কাজ করার জন্য তিনি সর্বাধিক সক্ষম ও উপযুক্ত। অতঃপর তিনি সেই কাজে মনোনিবেশ করতেন; অন্য কাজগুলো প্রতিনিধিদের দিয়ে দিতেন। কর্মদক্ষ কার্যনির্বাহীগণ ঠিক সেইসব কাজেই সবচেয়ে বেশি মনোযোগ দেন যেগুলোতে তারা সবচেয়ে বেশি দক্ষ। তারা জানে যে কোম্পানি তখনই সচল ও ভালো কাজ করবে যখন তার ঊর্ধ্বতন ম্যানেজমেন্ট (পরিচালক ও নির্বাহীগণ) কাজ করে, এবং যদি তারা কাজ না করে, তবে কোম্পানিও বসে যাবে।

একজন কর্মদক্ষ কার্যনির্বাহীর দ্বিতীয় কাজ হলো-যেটা প্রথমটার মতোই গুরুত্বপূর্ণ জিজ্ঞাসা, “কোম্পানির জন্য এটা কি যথাযথ ও কল্যাণকর?” তারা এটা জিজ্ঞেস করে না যে এটা কোম্পানির মালিকদের জন্য যথাযথ ও কল্যাণকর কিনা অথবা কোম্পানির শেয়ারের মূল্য বৃদ্ধি করবে, নাকি কোম্পানির অন্যান্য কর্মচারী বা কার্যনির্বাহীদের জন্য যথার্থ। অবশ্যই তাদের জানা আছে যে, শেয়ারহোল্ডার, কর্মকর্তা ও পরিচালগণ কোম্পানির গুরুত্বপূর্ণ অংশ এবং একটি সিদ্ধান্ত নিলে তা পূরণ করতে এদের সকলকেই দরকার। তারা অবগত আছে যে, শেয়ারের মূল্য কেবল শেয়ারহোল্ডারদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ নয়; বরং কোম্পানির জন্যও গুরুত্বপূর্ণ, যেহেতু দর বা আয়ের অনুপাত পণ্য উৎপাদনের মূলধন নির্ধারণ করে দেয়। তারা এও জানে, যে সিদ্ধান্ত কোম্পানির জন্য যথার্থ নয় তা আবশ্যিকভাবে শেয়ারহোল্ডারদের জন্যও যথাযথ বিবেচ্য নয়।

এই দ্বিতীয় কাজটি ব্যক্তি মালিকাধীন বা পারিবারিক ব্যবসার কার্যনির্বাহীদের জন্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ-প্রতিটি দেশের অধিকাংশ ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানসমূহের জন্য-বিশেষত যখন তারা মানুষ নিয়ে কাজ করে। সফল পারিবারিক কোম্পানিতে, একজন আত্মীয়কে কেবল তখনই পদোন্নতি দেওয়া হয় যদি সে অন্যান্য অনাত্মীয় প্রার্থীদের চেয়ে ঐ স্তরের জন্য অধিক যোগ্য বলে বিবেচিত হয়। ডুপন্ট (উঁচড়হঃ) পরিবারের কথায় ধরুন, তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানটি পারিবারিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থাকাকালীন ঊর্ধ্বতন সকল কার্যনির্বাহী বা পরিচালকই (উকিল ও একাউন্টেন্ট ব্যতীত) ছিল পরিবারের সদস্য। প্রতিষ্ঠাতাদের সকল পুরুষ উত্তরসূরিগণ কোম্পানিতে প্রাথমিক পর্যায়ের চাকরির জন্য মনোনীত হত। প্রাথমিক স্তরের পর, পরবর্তী পদে উন্নীত হওয়ার জন্য, পরিবার বহির্ভূত ব্যক্তিদের দ্বারা গঠিত পরিচালকম-লী কর্তৃক সংশ্লিষ্ট পদে অন্য সকল প্রার্থী বা কর্মকর্তাদের চেয়ে দক্ষতায় ও কর্মকা-ে শ্রেষ্ঠ বলে বিবেচিত হতে হত। শতাব্দী ধরে একই নীতি অনুসরণ করতে দেখা যায় বৃটেনের অত্যন্ত সফল পারিবারিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান জে. লায়ন্স অ্যান্ড কোম্পানিতে (ঔ. খুড়হং ্ ঈড়সঢ়ধহু) (যেটি বর্তমানে একটি বৃহৎ কোম্পানির অংশবিশেষ)। এক শতাব্দী ধরে তারা এ নীতি অনুসরণ করে আসছে। তারা তখন বৃটেনের খাদ্য ও হোটেল ইন্ডাস্ট্রিতে রাজণ¡ করত।

কোম্পানির জন্য কোনটি যথাযথ তা জানতে চাওয়া এর নিশ্চয়তা দেয় না যে, এর মাধ্যমে সঠিক সিদ্ধান্ত গৃহীত হবে। সর্বাধিক মেধাবী ও দক্ষ কার্যনির্বাহীরাও মানুষ এবং তাই তারা ভুল ও ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে। কিন্তু প্রশ্ন করতে ব্যর্থ হওয়া মূলত ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণের উৎস এতে কোন সন্দেহ নেই।


একটি কার্যকর পরিকল্পনা লিপিবদ্ধ করুন


কার্যনির্বাহীরা হচ্ছে মূলত কর্মী, তারা কাজ করতে পছন্দ করে এবং কাজের মাধ্যমে একটি ফলাফল নিয়ে আসে। তারা পরিকল্পনা ও সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করে। জ্ঞান বা তথ্য একজন কার্যনির্বাহীর কাছে কোনো মূল্য রাখে না যতক্ষণ পর্যন্ত না তা কর্মে পরিণত হয়। কিন্তু কাজে নামার আগে তিনি তার গতিপথ বা কর্মপথ ঠিক করে নেন, একটি কার্যকর পরিকল্পনা লিপিবদ্ধ করেন। তিনি ভালো করে তার কাক্সিক্ষত ফলাফল, সম্ভাব্য প্রতিবন্ধকতা, ভবিষ্যৎ অবস্থা, কোথায় কোথায় খোঁজখবর রাখতে হবে সেই জায়গাসমূহ এবং তিনি কীভাবে তার সময় অতিবাহিত করবেন তার সারসংক্ষেপ ইত্যাদি বিষয় নিয়ে চিন্তা করেন।

প্রথমত, একজন কার্যনির্বাহী তার কাক্সিক্ষত ফলাফল ঠিক করেন এ প্রশ্ন করার মাধ্যমে, “আগামী ১৮ থেকে ২৪ মাস বা ২ বছরের মধ্যে কোম্পানি আমার থেকে কী রকম অবদান প্রত্যাশা করে বা করা উচিত? কী ধরনের ফলাফল আমি নিয়ে আসতে পারি? কতটুকু সময়ের মধ্যে?” অতঃপর তিনি কার্য সম্পাদনের বাধাগুলো খতিয়ে দেখেন, “এই ধরনের কাজ কি নৈতিক? কোম্পানির কাছে কি এ ধরনের কাজের গ্রহণযোগ্যতা আছে? এটা কি বৈধ? কোম্পানির লক্ষ্য, মূল্যবোধ ও নীতিমালার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ?” এসব প্রশ্নের জবাব ‘হ্যাঁ’ হলেই যে কাজটি কার্যকর ও সফল হবে তা বলা যায় না। কিন্তু এই নিয়মনীতি না মানলে কার্যকর পরিকল্পনা ও পদক্ষেপ ভুল ও অকার্যকর ফলাফল নিয়ে আসবে তা নিশ্চিত।

একটি কার্যকর পরিকল্পনা (কাজ করার) একনিষ্ঠতা ও দৃঢ় ইচ্ছার দলিল, তবে তা করবই-এমন কোনো অঙ্গীকার নয়। এটিকে স্থির ও অলঙ্ঘনীয় কোন কিছু চিন্তা করা যাবে না। সময়ে সময়ে এতে পরিমার্জন করা উচিত, কারণ প্রতিটি সফলতা যেমন নতুন সম্ভাবনার দ্বার উম্মোচন করে, তেমনিভাবে প্রতিটি ব্যর্থতাও। একই কথা যেকোনো ব্যবসার জন্যও সত্য, ব্যবসায়িক পরিবেশের যখন পরিবর্তন ঘটে, বাজার বা বিশেষ করে কোম্পানি বা সংগঠনের মধ্যকার মানুষের মাঝে যখন পরিবর্তন ঘটে, তখন কার্যকর পরিকল্পনাতেও পরিমার্জনের প্রয়োজন দেখা দেয়। একটি লিখিত পরিকল্পনার নমনীয়তা বা পরিবর্তনযোগ্যতা থাকা জরুরি।

পাশাপাশি, একটি কার্যকর পরিকল্পনার প্রত্যাশার অনুপাতে ফলাফল যাচাই করার জন্য নিয়ম সৃষ্টি করা জরুরি। কর্মদক্ষ কার্যনির্বাহীরা সাধারণত তাদের কার্যকর পরিকল্পনা যাচাইয়ের দুটি ব্যবস্থা করে থাকেন। প্রথম নিরীক্ষণটি হয়ে থাকে পরিকল্পনা সময়কালের মাঝামাঝি সময়ে। যেমন, ১৮ মাসের পরিকল্পনা নিলে ৯ম মাসের দিকে একবার পুনঃনিরীক্ষণ করেন। আর দ্বিতীয়টি হয়ে থাকে সময়ের শেষ দিকে, নতুন পরিকল্পনা গ্রহণের পূর্বে।

পরিশেষে, একজন কার্যনির্বাহীর টাইম ম্যানেজমেন্ট তথা সময় ব্যবস্থাপনার জন্য কার্যকর পরিকল্পনাই মূল ভিত্তি হওয়া উচিত। একজন কার্যনির্বাহীর জন্য সময় একটি দুর্লভ ও সর্বাধিক মূল্যবান উপাদান। আর বিভিন্ন সংস্থাভেদে-হোক তা সরকারি প্রতিষ্ঠান, ব্যবসায়িক বা অলাভজনক প্রতিষ্ঠান-তারা প্রত্যেকেই প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই সময় নষ্টকারী। একটি কার্যকর পরিকল্পনাও ভেস্তে যেতে পারে যদি একজন কার্যনির্বাহী কীভাবে তার সময় অতিবাহিত করবেন তার ছক নির্ধারণ না করেন।

জনশ্রুতি আছে যে নেপোলিয়ন বলেছিলেন, কোন সফল যুদ্ধ তার পূর্ব-পরিকল্পনাকে অনুসরণ করে সফল হয় না। তথাপি নেপোলিয়ন তার প্রতিটি যুদ্ধের জন্য পরিকল্পনা গ্রহণ করতেন এবং তা পূর্বের যেকোনো সেনাপ্রধানের চেয়েও নিখুঁত ও নিপুণভাবে। একটি কার্যকর পরিকল্পনা ছাড়া পরিচালক বা কার্যনির্বাহীরা তাৎক্ষণিক ঘটনা বা পরিস্থিতির পাঁকে বাঁধা পড়ে যায়। আর পরিকল্পনা যখন পুনঃনিরীক্ষণ করা হয় না, তখন একজন কার্যনির্বাহী বুঝতে পারে না যে কোন ব্যাপারটা আসলেই গুরুত্বপূর্ণ আর কোনটা ¯্রফে উপদ্রব।


কাজ


যখন তারা পরিকল্পনাকে কার্যে পরিণত করে, কার্যনির্বাহীদেরকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ, যোগাযোগ, সম্ভাবনা (সমস্যার বিপরীত) এবং মিটিংয়ের প্রতি বিশেষ মনোযোগ দেওয়া জরুরি। আমি এসবকে একসাথেই বিবেচনায় রাখব।


সিদ্ধান্ত গ্রহণে দায়বদ্ধতার পরিচয় দিন:

মানুষ বা লোকজন না জানার আগ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যাবে না।

একটি কার্যকর পরিকল্পনা তৈরি করার পর তা বাস্তবায়নে দায়িত্বপ্রাপ্ত ও দায়বদ্ধ ব্যক্তির নাম উল্লেখ করতে হবে।

সময়সীমা (ডেডলাইন) দিতে হবে।

সিদ্ধান্তটি যাদের যাদের কাজকর্মকে প্রভাবিত করবে তাদের সকলকে তা জানতে হবে, বুঝতে হবে এবং এর অনুমোদন দিতে হবে-অথবা এর তীব্র বিরোধিতা না করলেও মৌন সম্মতি থাকতে হবে।

সিদ্ধান্তটি যেসব ব্যক্তিকে জানাতে হবে তাদের নামের উল্লেখ থাকতে হবে, যদি তারা সরাসরি এর দ্বারা প্রভাবিত নাও হয় তবুও তাদের নামের উল্লেখ থাকতে হবে।


উল্লেখযোগ্য সংখ্যক প্রাতিষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়, কারণ এই মূল সূত্রাবলি অনুসরণ করা হয় না। ত্রিশ বছর আগে আমার একজন ক্লায়েন্ট জাপানের ক্রমবর্ধমান বাজারে তাদের নেতৃস্থানীয় অবস্থান হারিয়ে ফেলে, কারণ কোম্পানিটি নতুন একটি জাপানি সহযোগী প্রতিষ্ঠানের সাথে জয়েন্ট ভেঞ্চার তথা যৌথ উদ্যোগে ব্যবসা পরিচালনা করতে যাওয়ার পর এটা স্পষ্ট করেনি, কারা কোম্পানির ক্রয় প্রতিনিধিকে জানাবে যে, সহযোগী প্রতিষ্ঠান ফুট ও পাউন্ডের পরিবর্তে মিটার ও কিলোগ্রামে পণ্য ক্রয় করবে। এই তথ্য যে কাঁচামালের ক্রয় বিভাগ বা ক্রয় প্রতিনিধিকে বলতে হবে তা কোন পক্ষই জানায়নি।

প্রতিটি সিদ্ধান্তকে সময়ে সময়ে পুুনঃনিরীক্ষণ করা গুরুত্বপূর্ণ। আগে থেকে যেসব বিষয়ে সম্মত হওয়া গেছে সেগুলোর ব্যাপারে চিন্তা করা, সেগুলোকে সযতেœ প্রথম স্তরে নিয়ে আসা আবশ্যক। আর এ পদ্ধতিতে, একটি দুর্বল বা যথাযথ নয় এমন সিদ্ধান্তকে বড় কোন ক্ষতি হওয়ার আগেই শোধরানো সম্ভব। এই পুনঃনিরীক্ষণের ফলে আমরা যা কিছু অনুমান করেছি তার সাথে বর্তমান অবস্থার কতটুকু মিল বা ফারাক তা বোঝা যায় এবং তদানুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া যায়।

এ ধরনের পুনঃনিরীক্ষণ বিশেষত গুরুত্বপূর্ণ সকল অতি গুরুত্বপূর্ণ ও জটিল সিদ্ধান্তের জন্য আবশ্যক। বিশেষ করে, জনবল নিয়োগ বা তাদের পদোন্নতির কাজগুলো।

 

জনবল বাছাইয়ের সিদ্ধান্তগুলো নিরীক্ষা করলে দেখা যায় এ সকল বাছাইয়ের এক-তৃতীয়াংশ সফল হয়ে থাকে।

আর এক-তৃতীয়াংশ হয়-না সফল, না ব্যর্থ। কিছুটা মাঝামাঝি ধরনের।

বাকি এক-তৃতীয়াংশ সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ প্রমাণিত হয়।

কর্মদক্ষ কার্যনির্বাহীরা এটা জানে এবং ছয় থেকে নয় মাস পর পর তারা তাদের কোম্পানি বা সংগঠনের লোকজন নিয়োগের ব্যাপারে যেসব সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তা পুনঃনিরীক্ষণ করে। এভাবে তারা তাদের সিদ্ধান্তের ওপর নিরীক্ষা চালায়। যদি তারা দেখতে পায় একটি সিদ্ধান্তের প্রত্যাশিত ফলাফল অর্জিত হয়নি, তারা এটা মনে করে না যে, ব্যক্তিটি যথাযথভাবে কাজ করেনি। তারা মনে করে, বরং তারা নিজেরাই ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছে। একটি সুব্যবস্থাপনা সমৃদ্ধ কোম্পানিতে, এটি দেখা যায় যে, যেসব ব্যক্তি নতুন কাজ পায়, বিশেষত পদোন্নতি লাভের পর, (তাদের ব্যর্থতার জন্য) তাদেরকে দোষারোপ করা হয় না।

কার্যনির্বাহীরা প্রতিষ্ঠান ও তাদের অধস্তনদের কাছে এ বিষয়ে দায়বদ্ধ যে, গুরুত্বপূর্ণ কাজে তারা কোন নিষ্কর্মা ব্যক্তিকে নিয়োগ দান করবে না। কোনো একজন কর্মী তার দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন করতে পারছে না বা কর্মদক্ষ নয়-এটা আসলে উক্ত কর্মীর দোষ নয়; বরং তাকে যে নিয়োগ দিয়েছে তার দোষ। তাই উক্ত কর্মীকে ছাঁটাই করতে হবে। যেসব লোকজন তাদের নতুন পদে ঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারছে না, তাদের উচিত তাদের পূর্বের পদে, যেখানে তারা কাজ করতে সক্ষম সেখানে, সেই বেতনে ফিরে যাওয়া। কিন্তু এমন সুযোগ খুব কমই প্রদান করা হয়। কোনো কর্মীকে পদোন্নতি দেওয়ার পর যদি সে উক্ত পদে কর্মদক্ষতা প্রদর্শন করতে ব্যর্থ হয়, তবে তাকে চাকরিচ্যুত করার বদলে তার পূর্বের পদে, পূর্বের বেতনে কাজ করতে দেয়া উচিত। কিন্তু দেখা যায়, তাকে পুরোপুরি চাকরি থেকেই বাদ দিয়ে দেয়া হয়। চাকরিচ্যুত করাটা একটা নিয়মে দাঁড়িয়ে গেছে। অন্তত, আমেরিকার শিল্পকারখানাগুলোতে তাই হয়। কিন্তু সামনে যাওয়ার যেমন সুযোগ থাকে, তেমন পিছিয়ে আসার সুযোগ রাখাটাও মানুষের জন্য অনেক বড় শক্তিশালী উৎসাহদায়ক প্রেরণা হিসাবে কাজ করে। এর একটা শক্তিশালী প্রভাব রয়েছে। এতে করে কর্মীরা নিরাপদে তার দক্ষতার জায়গায় ফিরে আসতে পারে, নিজস্ব গ-িতে কাজ করতে পারে এবং নতুন নতুন কাজে, উদ্যোগে ঝুঁকি নিতে পারে, কারণ সফল না হলেও পিছনে ফিরে আসার সুযোগ আছে। একটি কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠানের কর্মক্ষমতা বা সাফল্য লাভের সম্ভাবনা নির্ভর করে কর্মচারীদের এমন ইচ্ছার ওপর। আর কর্মচারীদের ইচ্ছা নির্ভর করে, মানে কর্মচারীরা বিভিন্ন কাজে উদ্যোগ নেয়ার, ঝুঁকি নেয়া বা কর্মদক্ষতা দেখানোর ইচ্ছা নির্ভর করে তারা তাদের পূর্ববর্তী পদ ও বেতনে ফিরে যাওয়ার সুযোগের ওপর।

সিদ্ধান্ত পুনঃনিরীক্ষণের একটি নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতি থাকা দরকার। এটা হতে পারে আত্ম-উন্নয়নের একটি শক্তিশালী হাতিয়ার। একটি সিদ্ধান্তকে তার প্রত্যাশা বা কাক্সিক্ষত ফলাফলের ভিত্তিতে পরিমাপ করা দরকার। আমরা কী আশা করেছিলাম এবং বাস্তবে কী পেলাম, এ দুইয়ের তুলনামূলক চিত্র পরিমাপ করে দেখার পদ্ধতি থাকা দরকার। এটাই কার্যনির্বাহীদের দক্ষতাকে প্রকাশ করে। কোথায় তাদের উন্নতি সাধন প্রয়োজন এবং কোথায় তাদের জ্ঞান ও তথ্যের ঘাটতি রয়েছে তা দেখায়। এটি তাদেরকে তাদের বুনিয়াদ দেখিয়ে দেয়। প্রায় সময় এ ধরনের পরিমাপ থেকে দেখা যায় যে, তাদের সিদ্ধান্তসমূহ কার্যকর হয় না, কারণ তারা সংশ্লিষ্ট কাজে সঠিক ব্যক্তিকে নিয়োগ করে না। নির্দিষ্ট পদে সর্বাধিক উপযুক্ত ব্যক্তিকে নিয়োগ করা যুগপৎ গুরুত্বপূর্ণ ও সঠিক কাজ, যা অনেক কার্যনির্বাহী উপেক্ষা করে। এর কারণ কিছুটা এই যে, উপযুক্ত ব্যক্তিগণ ইতোমধ্যে (কোথাও না কোথাও গুরুত্বপূর্ণ) কাজে নিয়োজিত। সিদ্ধান্ত পুনঃনিরীক্ষণের একটি নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতি কার্যনির্বাহীর দুর্বল দিকগুলোকেও দেখিয়ে দেয়, বিশেষত যেসব ক্ষেত্রে তারা অনুপযুক্ত তা। এসব ক্ষেত্রে, দক্ষ কার্যনির্বাহীগণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে না বা কোন পদক্ষেপ নেয় না। তারা প্রতিনিধি নিযুক্ত করে। প্রত্যেকেরই এরকম একটি বলয় থাকে। কারণ প্রতিভাবান নির্বাহী বলতে কিছু নেই। সফল ও কর্মদক্ষ কার্যনির্বাহীরা কিছু নীতি ও অভ্যাস মেনে চলে।

যেকোনো প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানির সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিষয়টা মনে করা হয় কেবল জ্যেষ্ঠ কার্যনির্বাহীরাই নিবে বা সিনিয়র এক্সিকিউটিভদের সিদ্ধান্তই গুরুত্বপূর্ণ এবং তা মেনে চলা হবে। এটা মারাত্মক এক ভুল চিন্তা। প্রতিষ্ঠানের প্রতিটি স্তরে সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রয়োজন হয় বা গ্রহণ করা হয়, যার সূচনা হয়ে থাকে স্বতন্ত্র পেশাদার অবদানকারী ও প্রথম সারির মানে উৎপাদনের প্রথম সারির সুপারভাইজার বা কর্মীদের কাজকর্ম দেখে যে কর্মকর্তা। এ ধরনের প্রাথমিক বা নিম্নস্তরের সিদ্ধান্তগুলো জ্ঞান-ভিত্তিক সংগঠন বা কোম্পানির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নলেজ ওয়ার্কারস (তথ্যভিত্তিক কর্মী) তথা তথ্যের ওপর ভিত্তি করে যারা কাজ করে এমন কর্মচারীদের উচিত তাদের নিজেদের দক্ষতা ও বিশেষ গুণাবলির কথা জানা, যেমন, ট্যাক্স একাউন্টেন্টের কাজ ট্যাক্স একাউন্টেন্ট ছাড়া অন্য কেউ করতে পারবে না। কারণ তার দক্ষতার জায়গা হচ্ছে রাজস্ব ও হিসাববিজ্ঞান। একজন ট্যাক্স একাউন্টেন্টকে ট্যাক্স একাউন্টিংয়ের ব্যাপারে অন্য যে কারও চেয়ে বেশি জানতে হবে, দক্ষ হতে হবে। কারণ তার সিদ্ধান্ত পুরো কোম্পানির ওপর প্রভাব সৃষ্টি করবে। কোম্পানির প্রতিটি স্তরে, প্রতিটি বিভাগে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারা একটি গুরুত্বপূর্ণ দক্ষতা। তথ্যের ওপর ভিত্তি করে যেসব প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে তার প্রত্যেক কর্মীকে এ বিষয়গুলো সম্পর্কে বিশদভাবে শেখানো দরকার।


যোগাযোগ স্থাপনে দায়বদ্ধতা গ্রহণ


[একজন কর্মদক্ষ কার্যনির্বাহী মানুষের সাথে যোগযোগ স্থাপনে দায়িত্বশীল আচরণ করে এবং কোনো ভুলভ্রান্তি হলে তার দায়দায়িত্ব নিজের ওপর নেয়।] কর্মক্ষম কার্যনির্বাহীগণ এটি জরুরি মনে করেন যে, তাদের পরিকল্পনা এবং এ সংক্রান্ত তথ্য-উপাত্ত অবশ্যই সকলের বোধগম্য হতে হবে। বিশেষত, এর অর্থ দাঁড়ায় তারা তাদের পরিকল্পনাকে তাদের সহকর্মীদের; অগ্রজ, অনুজ ও সমকক্ষ সবাইকে জানায় এবং তাদের মন্তব্য আশা করে। এর পাশাপাশি, তারা প্রত্যেক ব্যক্তিকে কাজ সম্পাদনে কী কী তথ্য প্রয়োজন তাও জানিয়ে দেয়। অনুজ থেকে অগ্রজ পর্যন্ত তথ্যের প্রবাহ সর্বাধিক দৃষ্টিগ্রাহ্য হয়ে উঠে। তবে কার্যনির্বাহীদেরকে তার সমকক্ষ ও অগ্রজ বা ঊর্ধ্বতনদের তথ্য ও পরামর্শের প্রতি সমান গুরুত্ব প্রদান করা আবশ্যক।

আমরা সকলে জানি, চেস্টার বার্নার্ডের ক্লাসিক এক বই রয়েছে যা ১৯৩৮ সনে প্রকাশিত হয়। বইয়ের শিরোনাম: দ্য ফাংশন অফ দ্য এক্সিকিউটিভ। তাকে এ বইয়ের জন্য ধন্যবাদ। কারণ তিনি এ বইয়ে দেখান যে প্রতিটি প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানি দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত মালিকানা বা পরিচালনার জন্য নয়; বরং তথ্যের জন্য। তথাপি, অনেক পরিচালক বা কার্যনির্বাহীরা এমনভাবে আচরণ করে যেন কোম্পানির মধ্যে ঠিকভাবে তথ্য-প্রবাহের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজ কেবল তথ্য-বিশেষজ্ঞদের দায়িত্ব। যেমন অ্যাকাউন্ট্যান্ট বা হিসাবরক্ষকের কাজ। ফলশ্রুতিতে, তারা এত বেশি তথ্য লাভ করে যার অনেককিছুই তাদের দরকার নেই এবং তারা সেসব তথ্যের ব্যবহারও করতে পারে না। তখন এতকিছু থেকে খুব সামান্য কিছুই তাদের কাজে লাগে। আবার এত অপ্রয়োজনীয় তথ্য থেকে প্রয়োজনীয় তথ্যটুকু খুঁজে বের করাও কষ্টকর ও সময়সাপেক্ষ। এই সমস্যা সমাধানে উত্তম পন্থা হলো একজন কার্যনির্বাহীকে তার প্রয়োজনীয় তথ্য চিহ্নিত করতে হবে, এর জন্য অন্যদের জিজ্ঞেস করতে হবে এবং তা না পাওয়া পর্যন্ত চেষ্টা করতে হবে এবং অন্যদের চাপ দিতে হবে।


সম্ভাবনার প্রতি মনোযোগী


[কর্মদক্ষ কার্যনির্বাহীরা সমস্যার চেয়ে সুযোগ ও সম্ভাবনাসমূহের প্রতি অধিক গুরুত্ব দেয়।] উপযুক্ত এক্সিকিউটিভরা সমস্যার চেয়ে সম্ভাবনার উপর বেশি মনোযোগ দেয়। সমস্যাকে অবশ্যই মূল্যায়ন করতে হবে। সমস্যাকে কখনো গালিচার নিচে লুকিয়ে রাখা যাবে না। কিন্তু সমস্যা সমাধানের চিন্তা করা, যদিও তা গুরুত্বপূর্ণ, কোনো ধরনের ফলাফল বয়ে আনতে পারে না। এটা কেবল ক্ষতি এড়ায়। কেবল সম্ভাবনা নিয়ে চিন্তা করা, সম্ভাবনার প্রতি মনোযোগী হওয়া এবং একে কাজে লাগানোর মাধ্যমেই ফলাফল পাওয়া যায়।

তাছাড়া, দক্ষ কার্যনির্বাহীরা সামাজিক, ব্যবসায়িক বা যেকোনো ধরনের পরিবর্তনকে কোনো রকমের হুমকি হিসাবে বিবেচনা না করে সম্ভাবনা হিসাবে দেখে এবং একে কাজে লাগায়। তারা নিয়মতান্ত্রিকভাবে পরিবর্তনকে দেখে, প্রতিষ্ঠানের কাজের ভেতরে ও বাইরে দেখে এবং জিজ্ঞেস করে, “কীভাবে আমরা এই পরিবর্তনকে আমাদের কোম্পানির জন্য সুযোগ হিসাবে কাজে লাগাতে পারি?” বিশেষত, এক্সিকিউটিভরা এই সাতটি অবস্থাকে সম্ভাবনা হিসাবে দেখতে পায়:


তাদের নিজেদের কোম্পানি বা প্রতিদ্বন্দ্বী কোম্পানি কিংবা ইন্ডাস্ট্রিতে অপ্রত্যাশিত সাফল্য বা ব্যর্থতা;

মার্কেটে, প্রক্রিয়াকরণ ব্যবস্থায়, পণ্য বা সেবা ইত্যাদির বর্তমান অবস্থা ও ভবিষ্যৎ অবস্থার মধ্যে যে ফারাক বিদ্যমান তার মধ্যে (যেমন উনবিংশ শতাব্দীতে, কাগজ উৎপাদনকারী কারখানাগুলো প্রতিটি গাছের ১০ শতাংশ যা কাষ্ঠম-ে পরিণত হবে তার উপর মনোযোগ দিত, বাকি ৯০ শতাংশকে কী কাজে লাগানো যায় তার দিকে তাদের কোন ভ্রুক্ষেপ ছিল না, এই অবশিষ্ট অংশ পুরোপুরি অকেজো প্রমাণিত হত);

প্রক্রিয়াকরণ ব্যবস্থায়, পণ্য বা সেবায় নতুনত্ব, হোক তা কোম্পানি বা ইন্ডাস্ট্রির ভেতরে বা বাইরে;

ইন্ডাস্ট্রির বা মার্কেটের কাঠামোতে যেকোনো পরিবর্তন;

জনমিতি [জনমিতি তথা জনসংখ্যা বিশ্লেষণ হচ্ছে একটি দেশ বা স্থানের জনসংখ্যার বয়স, জাতি ও লিঙ্গ বিচারে গবেষণা করা]

মানসিকতা, মূল্যবোধ, উপলব্ধি, মন-মেজাজ ও নীতিনৈতিকতার পরিবর্তন; এবং

নতুন জ্ঞান অথবা নতুন তথ্য-প্রযুক্তি


দক্ষ কার্যনির্বাহীরা এ বিষয়টি নিশ্চিত করেন যে, সমস্যার অতি চিন্তা যেন সম্ভাবনাকে গ্রাস করে না ফেলে। অধিকাংশ কোম্পানিতে মাসিক ব্যবস্থাপনা তথ্য-বিবরণীর প্রথম পাতাটি মূল সমস্যাসমূহকে নথিভুক্ত করে। বরং সম্ভাবনাকে প্রথম পাতায় স্থান দেওয়া এবং সমস্যাবলিকে দ্বিতীয় পাতার জন্য রেখে দেওয়া অধিক বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক। যদি না কোন বড় ধরনের বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে হয়, সম্ভাবনাগুলোকে বিচারবিশ্লেষণ ও যথাযথভাবে কাজে লাগানো উপায় বের না করা অবধি সমস্যাগুলো নিয়ে পরিচালনা সভায় আলোচনা করা উচিত নয়।

সম্ভাবনামুখী মানসিকতা তৈরি করার জন্য কর্মী হচ্ছে অন্যতম হাতিয়ার। দক্ষ কার্যনির্বাহীরা তাদের সেরা জনবলকে সমস্যার পরিবর্তে সম্ভাবনা খুঁজে বের করতে এবং তা কাজে লাগাতে নিয়োজিত করেন। সম্ভাবনার জন্য কর্মী খুঁজে পাওয়ার একটি উপায় হলো ব্যবস্থাপনা পর্ষদের প্রতিটি সদস্যকে আদেশ দেওয়া তারা যেন ছয় মাস অন্তর অন্তর দুটা তালিকা তৈরি করে, যার একটি হলো পুরো কোম্পানির সম্ভাবনাগুলোর তালিকা করা। আর দ্বিতীয়টি হলো কোম্পানির সেরা ও কর্মঠ কর্মীদের তালিকা করা। এই বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করতে হবে। অতঃপর দুটি চূড়ান্ত তালিকা তৈরি করা হবে এবং দক্ষ মানুষগুলোকে শ্রেষ্ঠ সম্ভাবনাগুলোকে কাজে লাগানোর সুযোগ দিতে হবে। প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখি, জাপানে বড় বড় কোম্পানি বা সরকারি প্রতিষ্ঠানে এই সংমিশ্রণকে প্রধান জনবল বিষয়ক কাজ মনে করা হয়; এই কাজটি জাপানের ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রধান শক্তি।


মিটিং তথা সভা-সেমিনারকে কার্যকর ও উৎপাদনমুখী করুন


দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও এর পরবর্তী সময়ে সর্বাধিক দৃশ্যমান, শক্তিশালী এবং যুক্তিযুক্তভাবে কার্যকর বেসরকারি এক্সিকিউটিভ কিন্তু কোন ব্যবসায়ী ছিলেন না। তিনি ছিলেন ফ্রান্সিস কারডিনাল স্পেলম্যান, নিউইয়র্কের জেলা পর্যায়ের রোমান ক্যাথলিক চার্চের প্রধান এবং আমেরিকার বিভিন্ন প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা। যখন স্পেলম্যান দায়িত্ব গ্রহণ করেন, তখন চার্চের অবস্থা ছিল দেউলিয়া প্রায় এবং নীতিভ্রষ্ট। তার উত্তরাধিকারী আমেরিকান ক্যাথলিক চার্চে নেতৃত্বের স্থান অধিকার করেন। স্পেলম্যান প্রায় বলতেন, তার জাগ্রত অবস্থায় তিনি দিনে দুবার ২৫ মিনিটের জন্য নিঃসঙ্গ সময় পেতেন: একটি যখন তিনি সকালে ঘুম থেকে উঠে তার ব্যক্তিগত প্রার্থনা কক্ষে প্রার্থনা করতেন এবং অন্যটি রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে প্রার্থনার সময়। অন্য সময় তিনি সর্বদা মানুষের মাঝে থাকতেন; সভা বা খাওয়া-দাওয়ায়। সকালে একটি ক্যাথলিক সংস্থার সাথে নাস্তা করেন তো রাতে অন্যটির সাথে।

ঊর্ধ্বতন কার্যনির্বাহীরা একটি জেলার ক্যাথলিক চার্চের আর্চবিশপের মতো বন্দি সময় পার করেন না। [আর্চবিশপ হচ্ছে চার্চ বা খ্রিস্টানদের ধর্মীয় উপাসনালয়ের প্রধান হুজুর বা যাজক।] কিন্তু কার্যনির্বাহী বা এক্সিকিউটিভদের প্রতিদিনের কার্যদিবস পর্যালোচনা করে পাওয়া যায় যে, একজন ছোটোখাটো কার্যনির্বাহী বা পেশাজীবীও প্রতিদিন তার কাজের সময়ের অর্ধেকের বেশি সময় অন্যান্য মানুষের সাথে সময় অতিবাহিত করেন। অর্থাৎ যেকোনো ধরনের মিটিং বা সভা-সেমিনার বা দাওয়াতে ব্যস্ত থাকেন। ব্যতিক্রম হলো কিছু ঊর্ধ্বতন গবেষক। এমনকি একজন ব্যক্তির সাথে কথা বলাও একটা মিটিং হিসাবে গণ্য। অতএব, যদি তারা কর্মক্ষম ও কার্যকর ফলাফল চায়, তবে এক্সিকিউটিভদেরকে অবশ্যই এসব মিটিংয়ে উৎপাদনমুখী হতে হবে। তাদের এটা নিশ্চিত করতে হবে যে, তাদের মিটিংটা তাদের কাজের একটি অংশ, কোনো ধরনের অহেতুক অধিবেশন বা কথাবার্তা না।

একটি কার্যকর মিটিং পরিচালনার চাবিকাঠি হলো আগে থেকে এটি ঠিক করা যে, কোন ধরনের মিটিং অনুষ্ঠিত হবে। বিভিন্ন ধরনের মিটিং বা সভার ভিন্ন ভিন্ন প্রস্তুতির প্রয়োজন হয় এবং তা ভিন্ন ভিন্ন ফলাফল নিয়ে আসে। যেমন বিবৃতি, ঘোষণা বা প্রেস রিলিজ তৈরির ভিন্ন ভিন্ন সভা।

এসব মিটিংকে উৎপাদনমুখী ও কার্যকর করার জন্য, একজন ব্যক্তি মিটিং বা সভার পূর্বে একটি খসড়া প্রস্তুত করে নিতে হবে। সভা শেষে, একজন পূর্বনিযুক্ত সদস্য চূড়ান্ত পত্রটি পড়ে শোনাবে।

কোন একটি ঘোষণা প্রস্তুতকরণের সভায়—যেমন একটি সাংগঠনিক পরিবর্তনের সভা বা মিটিং। এ ধরনের সভার আলোচনা সীমাবদ্ধ থাকবে ঘোষণার বিষয়বস্তু নিয়ে, যে যে ধরনের পরিবর্তন হচ্ছে বা হবে তা নিয়ে, এগুলো নিয়ে আলোচনা চলবে এবং এ ব্যাপারেই কেবল আলোচনা করা উচিত।

যে মিটিংয়ে কোন সদস্য রিপোর্ট বা প্রতিবেদন জমা দিবে বা উপস্থাপন করবে। এ ধরনের মিটিংয়ে আর কিছু না কেবল সেই উপস্থাপিত প্রতিবেদনের উপরই আলোচনা করা কাম্য।

যে মিটিংয়ে একাধিক সদস্য বা সকল সদস্য প্রতিবেদন দাখিল করে। এ ধরনের মিটিংয়ে কোন ধরনের আলোচনাই থাকা উচিত নয় অথবা আলোচনা হলেও তা উপস্থাপিত প্রতিবেদনের বিষয়াবলি পরিষ্কার করার লক্ষ্যে প্রশ্ন করা যেতে পারে এবং এ পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকা চাই। বিকল্প হতে পারে, প্রতিটি প্রতিবেদনের জন্য একটি সংক্ষিপ্ত আলোচনা অনুষ্ঠিত হতে পারে, যেখানে সকল অংশগ্রহণকারীগণ প্রশ্ন করার সুযোগ পাবে। যদি এই প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়, তবে মিটিং শুরু হওয়ার পূর্বে প্রতিটি প্রতিবেদন সকল অংশগ্রহণকারীর মাঝে বণ্টন করে দিতে হবে। এ ধরনের মিটিংয়ে প্রতিটি প্রতিবেদনের জন্য সময় বেঁধে দিতে হবে—যেমন, হতে পারে ১৫ মিনিট।

কার্যনির্বাহী বা পরিচালকদের জানানোর মিটিং। এ মিটিংয়ে কার্যনির্বাহী বা পরিচালনকগণের উচিত অন্যদের শোনা এবং প্রশ্ন করা। তার উচিত মিটিংয়ের সারসংক্ষেপ সকলের সামনে উপস্থিত করা; নাকি প্রেজেন্টেশন দেয়া।

আবার কিছু কিছু মিটিং আছে যেখানে কেবল কার্যনির্বাহী বা এক্সিকিউটিভের উপস্থিতিতে অংশগ্রহণকারীদের বসে থাকাই একমাত্র কাজ। যাজক প্রধান স্পেলম্যানের প্রাতরাশ ও নৈশরাশ ছিল উক্ত প্রকৃতির। এসব মিটিংকে কার্যকর বা উৎপাদনমুখী করার সুযোগ নেই। এগুলোকে বলতে পারেন খ্যাতির বিড়ম্বনা। ঊর্ধ্বতন পরিচালকগণ ততক্ষণ পর্যন্ত কার্যকর যতক্ষণ তারা এ ধরনের সভাসমূহকে তাদের কর্মদিবসে অন্যায়ভাবে প্রবেশে বাধা দিতে পারে। উদাহরণস্বরূপ স্পেলম্যানকে নেয়া যায়। তিনি ব্যাপকভাবে প্রভাবশালী একজন যাজক বা হুজুর ছিলেন। কারণ তিনি এরকম মিটিং সমূহকে প্রাতরাশ বা নৈশভোজে সীমাবদ্ধ রেখেছিলেন এবং দিনের অন্য সময়কে এসব থেকে মুক্ত রাখতেন।

মিটিংকে কার্যকর করে তুলতে হলে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ আত্ম-নিয়ন্ত্রণ দরকার। এর জন্য দরকার একজন কার্যনির্বাহীকে আগে থেকে নির্ধারণ করা যে কোন ধরনের মিটিং করবেন, তার জন্য যথাযথ প্রস্তুতি নেয়া এবং পরবর্তীতে তিনি ঐ প্রক্রিয়াতে অনড় থাকবেন। এটাও গুরুত্বপূর্ণ যে, নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য সাধিত হওয়ার পর মিটিংকে সমাপ্ত করে দেওয়া। দক্ষ এক্সিকিউটিভ বা কার্যনির্বাহীগণ আলোচ্যসূচি অনুযায়ী আলোচনা শেষ হওয়া মাত্রই মিটিং শেষ করেন। অন্য কোনো বিষয় উপস্থাপন করেন না। আলোচ্যসূচি অনুযায়ী আলোচনা শেষ হওয়া মাত্রই তারা সারসংক্ষেপ উপস্থাপন করে এবং মিটিং মুলতবি করে।

যথাযথভাবে ফলো-আপ বা পরবর্তী খোজ-খবর রাখা মিটিংয়ের মতোই গুরুত্বপূর্ণ। আলফ্রেড স্লোয়ানকে বলা চলে ফলো-আপের ওস্তাদ বলা চলে। আমার দেখা মতে তিনি সর্বাধিক কর্মদক্ষ একজন ব্যবসা পরিচালক বা এক্সিকিউটিভ। আলফ্রেড স্লোয়ান, যিনি ১৯২০ থেকে ১৯৫০ অবধি জেনারেল মটরসের পরিচালনায় ছিলেন, সপ্তাহের ছয় কর্মদিবসের অধিকাংশই তিনি মিটিংয়ে অতিবাহিত করতেন—সপ্তাহের তিনদিন আনুষ্ঠানিকভাবে কোম্পানির কমিটি মিটিং করতেন, বাকি তিনদিন প্রয়োজনীয় মিটিং করতেন কোম্পানির বিভিন্ন এক্সিকিউটিভ, স্বতন্ত্র জেনারেল মেনেজার বা ছোট ছোট দলের কার্যনির্বাহী বা পরিচালকদের সাথে। আনুষ্ঠানিক মিটিংয়ের প্রারম্ভে স্লোয়ান মিটিংয়ের উদ্দেশ্য বা আলোচ্যসূচি স্পষ্ট করতেন। অতঃপর বাকিদের কথা শুনতেন। তিনি কোনো নোট গ্রহণ করতেন না এবং কোনো অস্পষ্ট বিষয় স্পষ্ট করা ছাড়া অন্য কোন কথা বলতেন না। মিটিং শেষে তিনি সারসংক্ষেপ করতেন, অংশগ্রহণকারীদের ধন্যবাদ জানাতেন এবং মিটিং ত্যাগ করতেন। অতঃপর, তৎক্ষণাৎ অংশগ্রহণকারীদের একজনকে উদ্দেশ্য করে সংক্ষিপ্ত একটি বার্তা লিখতেন। তাতে আলোচনা এবং এর উপসংহার সংক্ষিপ্ত পরিসরে তুলে ধরতেন। আর মিটিংয়ে গৃহীত কোন নির্ধারিত কাজ বা অ্যাসাইনমেন্ট থাকলে তা উল্লেখ করতেন। (আলোচ্য বিষয়ের উপর অন্য কোন সভা অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত গৃহীত হলে বা কোন বিষয়ে গবেষণার প্রয়োজন হলে তাও উল্লেখ করে দিতেন।) সময়সীমা বেঁধে দিতেন এবং পরিচালক যিনি অ্যাসাইনমেন্টটি তৈরির দায়িত্বপ্রাপ্ত তার নামও উল্লেখ করা থাকত। অতঃপর বার্তাটি মিটিংয়ে উপস্থিত সকল অংশগ্রহণকারীর কাছে প্রেরণ করতেন। এই ছোট বার্তাগুলো একেকটা ছিল চমৎকার মাস্টার পিস। ঠিক এভাবেই স্লোয়ান নিজেকে একজন অসাধারণ কর্মক্ষম কার্যনির্বাহীতে পরিণত করেন।

কর্মক্ষম পরিচালকগণ জানেন যে, যেকোনো মিটিং হয় উৎপাদনমুখী হবে নাহয় সময়ের অপচয়।


চিন্তা করুন এবং বলুন: “আমরা”


সর্বশেষ অভ্যাস হলো: কখনো ‘আমি’ হিসাবে চিন্তা করবেন না অথবা ‘আমি’ শব্দ বলবেন না। ‘আমরা’ বলতে ও চিন্তা করতে শিখুন। কর্মক্ষম এক্সিকিউটিভরা জানেন যে, তাদের সর্বোচ্চ দায়িত্ব রয়েছে, যা তারা না কারো সাথে শেয়ার করতে পারেন, না এড়িয়ে যেতে পারেন। আজকে তাদের কর্তৃত্ব আছে, কারণ তাদের উপর সংস্থা বা কোম্পানির আস্থা ও বিশ^াস আছে। এর অর্থ হলো তারা নিজেদের প্রয়োজন ও সম্ভাবনা চিন্তা করার আগে কোম্পানির প্রয়োজন ও সম্ভাবনার চিন্তা করেন। শুনতে এটা খুবই সাধারণ মনে হলেও আদতে তা নয়। তাছাড়া একে অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে পালন করতে হয়।

ইতোমধ্যে আমরা কর্মক্ষম কার্যনির্বাহীদের আটটি অভ্যাস নিয়ে আলোচনা করেছি। সর্বশেষ একটি বোনাস অভ্যাস নিয়ে কথা বলছি। এটি এত গুরুত্বপূর্ণ যে, আমি একে সবার উপরে রাখব: আগে শুনুন, পরে বলুন।

কার্যকারিতাসম্পন্ন নির্বাহীগণ তাদের ব্যক্তিত্ব, দক্ষতা, দুর্বলতা, মূল্যবোধ ও বিশ্বাসে ব্যাপকভাবে ভিন্ন ভিন্ন প্রকৃতির হয়ে থাকেন। একটি বিষয়ে তারা সবাই এক, আর তা হলো তারা সঠিক কাজ যথাযথভাবে সম্পাদন করেন। অনেকে জন্মগতভাবে কর্মদক্ষ ও প্রভাবশালী। কিন্তু চাহিদা এতই বড় ও ব্যাপক যে, তা কেবল অনন্য প্রতিভাধর ও মেধাবীরাই সন্তুষ্ট করতে পারে। কর্মদক্ষতা একটি শৃঙ্খলা। আর প্রতিটি শৃঙ্খলার মতো কর্মদক্ষতাও শেখা যায় এবং অর্জনযোগ্য (অহফ, ষরশব বাবৎু ফরংপরঢ়ষরহব, বভভবপঃরাবহবংং পধহ নব ষবধৎহবফ ধহফ সঁংঃ নব বধৎহবফ)। আমি তো বলব অবশ্যই অর্জন করা উচিত।


 








একজন কার্যকর ও সফল কার্যনির্বাহীর প্রয়োজনীয় গুণাবলি





অধ্যায় ১


কর্মদক্ষতা বা কার্যকারিতাসম্পন্ন হওয়া শেখা যায়


কার্যকারিতাসম্পন্ন হওয়াই হলো একজন নির্বাহীর কাজ। ‘কার্যকর হওয়া’ এবং ‘কাজ সম্পন্ন বা বাস্তবায়ন করা’, সর্বোপরি কাছাকাছি পর্যায়ের অর্থ। এই দুইটাকে যেন সমার্থক শব্দ বলা যায়। একজন কার্যনির্বাহী কোন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান বা হাসপাতালে কাজ করতে পারেন, কোন সরকারি সংস্থা বা শ্রমিক ইউনিয়নে, কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে বা আর্মিতে, যেখানেই কাজ করেন না কেন, একজন নির্বাহীর কাছে, সর্বপ্রথম, কাম্য হলো সঠিক কাজ সঠিকভাবে সম্পন্ন করা। আরও সহজভাবে বললে তিনি কর্মদক্ষ হবেন এটাই কাম্য।

তথাপি, প্রায়ই দেখা যায়, অত্যধিক কর্মক্ষম ব্যক্তিগণ কার্যনির্বাহীর পদে অনুপস্থিত। কার্যনির্বাহীদের মাঝে উচ্চতর বুদ্ধিমত্তার উপস্থিতি সাধারণ একটি বিষয়। কল্পনাপ্রবণতা তাদের মাঝে নেই বললেই চলে। তাদের জ্ঞানের মাত্রা অনেক উঁচুতে হয়ে থাকে। কিন্তু একজন মানুষের কর্মক্ষমতা ও তার বুদ্ধিমত্তা, তার কল্পনা বা জ্ঞানের মাঝে পারস্পরিক সম্পর্ক খুব কম পরিলক্ষিত হয়। মেধাবী মানুষ প্রায়ই মারাত্মকভাবে অকার্যকর হয়ে থাকে; তারা বুঝতে ব্যর্থ হয় যে, মেধাবী হওয়াটাই যথেষ্ট নয়। তারা কখনো শেখেনি যে, বুদ্ধিমত্তা বা মেধা কেবল তখনই কাজে আসে যখন একটি নিয়মতান্ত্রিক কঠোর পরিশ্রম তার সাথে থাকে। অন্য দিকে, প্রতিটি সংস্থায় কিছু অত্যধিক প্রভাবশালী পরিশ্রমী কর্মী থাকে। যখন অন্যরা ক্ষিপ্রতা ও ব্যস্ততার ভাব নিয়ে দৌড়ঝাঁপ করে, যাকে অনেক উজ্জ্বল সম্ভাবনাময় মানুষ মনে করে খুব ভালো, একে ‘সৃষ্টিশীলতার’ সাথে গুলিয়ে ফেলে, তখন পরিশ্রমী ব্যক্তিরাই ধীর পায়ে অগ্রসর হয় এবং সবার আগে উপস্থিত হয়, অনেকটা প্রাচীন রূপকথার কচ্ছপের মতো। [তখন ক্ষিপ্রতা ও ব্যস্ততার ভাব নিয়ে যারা দৌড়ঝাঁপ করত তাদের দেখা যায় না।]

বুদ্ধিমত্তা, কল্পনা ও জ্ঞান অবশ্যই প্রয়োজনীয় উপাদান, তবে কার্যকারিতা বা কর্মদক্ষতা হচ্ছে সেই উপাদান যা এগুলোকে ফলাফলে পরিণত করে। এগুলোর মাধ্যমে (বুদ্ধিমত্তা, কল্পনা ও জ্ঞানের মাধ্যমে), এগুলো শুধু কী অর্জন করবে তার সীমারেখা ঠিক করে দেয়।


কেন আমাদের কার্যকারিতাসম্পন্ন কার্যনির্বাহী প্রয়োজন?


এসব কিছু স্পষ্ট হওয়া চাই। কিন্তু কেন কার্যকারিতাসম্পন্ন হওয়ার প্রতি খুব অল্পই ভ্রুক্ষেপ করা হয়, এমন একটি সময়ে যেখানে কার্যনির্বাহীর কাজের উপর হাজারো বই এবং প্রবন্ধ-নিবন্ধ রয়েছে?

এই উদাসীনতার একটি কারণ এই যে, কার্যকারিতা হলো একটি প্রতিষ্ঠানের নলেজ ওয়ার্কারস (তথ্যভিত্তিক কর্মী) তথা তথ্যের ওপর ভিত্তি করে যারা কাজ করে এমন কর্মচারীদের বিশেষ দক্ষতা। পূর্বে মুষ্টিমেয় কিছু ছাড়া এর কোন অস্তিত্বই ছিল না।

দৈহিক পরিশ্রম লাগে এমন কাজের জন্য, আমাদের কেবল দক্ষতার প্রয়োজন হয়; তা হলো কোন কাজকে যথাযথভাবে করিয়ে নেওয়ার পরিবর্তে যথাযথভাবে নিজে সম্পন্ন করা। দৈহিক পরিশ্রমকারী কর্মীরা সর্বদা মূল্যায়িত হয় তাদের নির্ধারিত ও স্বতন্ত্র কাজের পরিমাণ ও গুণমানের আলোকে। বিগত একশ বছর ধরে আমরা জেনেছি কীভাবে দৈহিক পরিশ্রমকারী কাজের দক্ষতা পরিমাপ করতে হয়। আমরা এটাও খুঁজে বের করতে সক্ষম হয়েছি যে কোন জায়গায় উন্নতি ঘটালে আমরা একজন স্বতন্ত্র কর্মীর কাজকে বহুগুণ বৃদ্ধি করতে সক্ষম হব।

পূর্বে, দৈহিক পরিশ্রমকারী কর্মীরা-সে হতে পারে যন্ত্রপাতির পরিচালক বা সামনের সারির কোন সৈনিক-সব সংস্থায় এরাই আধিপত্য করত। তখন কর্মদক্ষ বা কার্যকারিতাসম্পন্ন ব্যক্তি কম হলেও চলত। উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তারা আদেশ দিত এবং অন্যরা তাদের আদেশ বাস্তবায়ন করত। তারা ছিল সমগ্র জনবলের তুলনায় খুবই ছোট একটি দল। তারা ভুল করুক বা ঠিক করুন তাতে আমরা তেমন গ্রাহ্য করতাম না। আমরা অল্প কিছু প্রতিভাবান মানুষের ওপর নির্ভর করতাম। তারা তাদের সাধ্যমতো চেষ্টা করত। আর বাকিরা যারা দৈহিক পরিশ্রমের কাজ করত তারা তা কঠিন হলেও পরিশ্রমের মাধ্যমে শিখে নিতো।

এটা কেবল ব্যবসা বা সেনাবাহিনীর ব্যাপারে সত্য ছিল না। বর্তমানে এটা বোঝা মুশকিল যে, একশ বছর আগেও আমেরিকার গৃহযুদ্ধ চলাকালীন সময় ‘সরকারি কর্মচারী’ ছিল মুষ্টিমেয় কিছু লোক। আব্রাহাম লিংকন যখন যুদ্ধ পরিচালনা করছেন, তখন তার সহকর্মী ছিলেন পঞ্চাশজনেরও কম অধস্তন কর্মী। যাদের অধিকাংশই কোনো ‘কার্যনির্বাহী’ ও নীতিনির্ধারক ছিল না; ছিল টেলিগ্রাফ কেরানি। ১৯০০ সালের দিকে, থিওডোর রুজভেল্টের সময়ে ওয়াশিংটনে সমগ্র আমেরিকান সরকারের কর্মচারী খুব বেশি হলে একটি মার্কেটের ভবনেই জায়গা দেয়া সম্ভব।

অতীতের হাসপাতালগুলো জানতই না ‘স্বাস্থ্যসেবা পেতে পরামর্শক’ কী অথবা এক্স-রে ও ল্যাব কারিগর, ডাইয়েটেশিয়ান ও থেরাপিস্ট, সমাজকর্মী সহ ইত্যাদি কিছু বিষয় আছে। এখনকার হাসপাতাল প্রতি একশ রোগীর জন্য আড়াইশর মতো কর্মী নিযুক্ত করে। অতীতে কিছু নার্স ছাড়া ছিল পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার জন্য কিছু কর্মী, রান্নাকর্মী এবং বুয়া। চিকিৎসক ছিলেন একজন নলেজ ওয়ার্কারস (তথ্যভিত্তিক কর্মী) তথা তথ্য বা জ্ঞানের ওপর ভিত্তি করে যারা কাজ করে এমন। তার সহকর্মী থাকত একজন নার্স।

অন্যভাবে বলতে গেলে বলতে হয়, বর্তমান সময় পর্যন্ত যেকোনো কোম্পানি বা সংগঠনের প্রধান সমস্যা হচ্ছে দৈহিক পরিশ্রমকারী কর্মীদের দক্ষতা বিষয়ক সমস্যা। এখন পর্যন্ত নলেজ ওয়ার্কারস (তথ্যভিত্তিক কর্মী) তথা তথ্য বা জ্ঞানের ওপর ভিত্তি করে যারা কাজ করে এমন ব্যক্তিদের গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়নি। [নলেজ ওয়ার্কারস তথা তথ্য বা জ্ঞানের ওপর ভিত্তি করে যারা কাজ করে এমন ব্যক্তিদের আমরা জ্ঞানকর্মী বা তথ্যকর্মী বলতে পারি।]

মূলত, অতীতে কোম্পানি বা সংগঠনের ছোট্ট একটি অংশে জ্ঞানকর্মীরা কাজ করত। তাদের অধিকাংশই পেশাজীবী হিসাবে নিজেরাই কাজ করত। বেশি দরকার হলে বিশেষজ্ঞ কাউকে ভাড়া করা হত। আর কোম্পানিতে থাকলে সে ক্লার্ক হিসাবে কাজ করত। মানে তথ্য গুছিয়ে রাখা, কেউ চাইলে তা বের করে দেয়া সহ বিভিন্ন কাজ। তাদের কার্যকরী হওয়া বা না হওয়া কেবল তাদেরই দুশ্চিন্তার কারণ ছিল এবং কেবল তাদেরকেই প্রভাবিত করত।

বর্তমানে, তথ্যভিত্তিক সংস্থাই হলো যেকোনো সংস্থা বা কোম্পানির মূল বিষয়। আধুনিক সমাজ হলো বৃহৎ সুশৃঙ্খল প্রতিষ্ঠানসমূহের সমাজ। এসব সমাজের প্রতিটিতে, সামরিক বাহিনীসহ, আকর্ষণের মূল কেন্দ্রবিন্দু সরে গেছে তথ্যভিত্তিক কর্মীদের দিকে। বর্তমানে একজন ব্যক্তি তার পেশি বা হাতে যত বেশি কাজ করে তার চেয়ে বেশি কাজ করে তার মস্তিষ্ক দিয়ে। এই হার ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে। ক্রমবর্ধমানভাবে, অধিকাংশ মানুষ যারা জ্ঞান, তথ্য ও আইডিয়াসমূহকে কাজে লাগানোর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হয়েছে, তাদের শারীরিক বা হস্তসাধিত দক্ষতার বিপরীতে তারাই যেকোনো সংস্থা বা কোম্পানিতে কাজ করে এবং তারাই সংস্থার মধ্যে কর্মদক্ষ যেহেতু তারা সংস্থার জন্য অবদান রাখতে পারে।

এখন কর্মদক্ষ বা কার্যকারিতাসম্পন্ন ব্যক্তি হওয়া কেবল মেধা বা প্রতিভার ওপর ছেড়ে দিতে পারি না। বর্তমানের প্রয়োজনীয়তার সাপেক্ষে একে অবহেলা করারও সম্ভব নয়।

দৈহিক পরিশ্রমকারী কর্মীদের দক্ষতা পরিমাপ ও নিরীক্ষার জন্য আমরা যে চিত্তাকর্ষক পরিমাপক পদ্ধতি তৈরি করেছি—শিল্পকারখানার প্রকৌশল বিভাগ থেকে শুরু করে পণ্যের গুণগত মান নিয়ন্ত্রণ পর্যন্ত তা আসলে জ্ঞান বা তথ্যভিত্তিক কাজকর্মের জন্য খাটে না। একটি কোম্পানির ইঞ্জিনিয়াররা হয়তো একটি ভুল পণ্যের জন্য দারুণ কোনো পরিকল্পনা করে বসে আছে। যা করার কথা নয়। কিন্তু এরচেয়ে মারাত্মক বিষয় কোম্পানিতে আছে যা মালিকের পছন্দ হবে না এবং যেসব বিষয়ের উপযোগিতা কম, অপ্রয়োজনীয় বলা চলে। সঠিক বিষয়ে কাজ করাটাই জ্ঞান বা তথ্যভিত্তিক কর্মীর (নলেজ ওয়ার্কারের) কাজকর্মকে কার্যকর করে তোলে। এটা দৈহিক পরিশ্রমকারী কর্মীদের দক্ষতা পরিমাপক মানদ- দিয়ে পরিমাপ যোগ্য নয়।

কোন জ্ঞান বা তথ্যভিত্তিক কর্মীকে কঠিনভাবে বা বিশদভাবে তদারকি করা যায় না। তাকে কেবল সাহায্য করা যায়। তবে তাকে অবশ্যই নিজেকে নিজে পরিচালিত করতে হবে এবং নিজেকে সে পরিচালিত করবে কার্যসম্পাদন ও অবদান রাখার প্রতি তথা কর্মদক্ষ বা কার্যকারিতাসম্পন্ন হওয়ার প্রতি।

কিছু দিন আগে দ্য নিউ ইয়র্কার ম্যাগাজিনের এক কার্টুনে দেখা যায় যে, একটি অফিসের চিত্র যার দরজায় লেখা ছিল খ্যাতিমান: চ্যাস, স্মিথ, জেনারেল সেলস ম্যানেজার, অ্যাজেক্স সাবান কোম্পানি। অফিসের দেয়ালটি ছিল সম্পূর্ণ খালি, কেবল বড় করে একটি লেখাই ছিল, ‘ঞযরহশ’ তথা ‘চিন্তা করুন’। অফিসের ব্যক্তিটি তার ডেস্কের উপর পা ছাড়িয়ে দিয়ে বসে বসে আকাশের দিকে সিগারেটের কু-লী পাকানো ধোয়া ছাড়ছে। অফিসের বাইরে দিয়ে দুজন বয়স্ক লোক যাওয়ার সময় একজন আরেকজনকে জিজ্ঞাসা করে: ‘কিন্তু আমরা কীভাবে নিশ্চিত হবো যে, স্মিথ আসলে সাবান নিয়েই চিন্তা করছে?’

এখন একজন তথ্যভিত্তিক কর্মী আসলে কী নিয়ে চিন্তা করছে তা তো কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারবে না—তথাপি এটাই তার নির্দিষ্ট দায়িত্ব; এটাই তার ‘চাকরি’।

একজন জ্ঞানভিত্তিক বা তথ্যভিত্তিক কর্মীর অনুপ্রেরণা নির্ভর করে তার কার্যকারিতাসম্পন্ন হওয়ার উপর, তার অর্জন করার সক্ষমতার উপর।  যদি তার কাজে কার্যকারিতা বা কর্মদক্ষতা না থাকে, তার কার্যসম্পাদন ও অবদান রাখার অঙ্গীকার শীঘ্রই নির্জীব হয়ে পড়বে এবং সে একজন সময় অপচয়কারী দাসে পরিণত হবে যে কিনা ৯টা-৫টা সময় কাটাচ্ছে।

জ্ঞানভিত্তিক কর্মী নিজে এমন কিছু করে না যা নিজে থেকে উপযোগী বা কার্যকর। সে নিজে কোন বস্তুগত পণ্য উৎপাদন করে না—যেমন ধরুন, একটি গর্ত বা পরিখা খনন, এক জোড়া জুতা, একটি যন্ত্রাংশ তৈরি করে না। সে জ্ঞান, আইডিয়া, তথ্য ইত্যাদি উৎপাদন করে। এই পণ্যগুলো নিজে থেকে কার্যকর নয় অথবা নিজে থেকে বেকার বলতে পারেন। এগুলোকে মূল্যবান কিছুতে পরিণত করতে হলে অন্য কোনো ব্যক্তি যার এ সম্পর্কে জ্ঞান আছে তার সাহায্য-সহযোগিতা দরকার। অপর ব্যক্তি এগুলোকে গ্রহণ করবে এবং এগুলোকে বাস্তবে পরিণত করবে। [তা হতে পারে বাস্তবিক কোনো পণ্য বা সেবাতে পরিণত করা। যেমন দুরদুরান্তে মোবাইলে টাকা পাঠানো যায়—এটা একটা আইডিয়া। কিন্তু একে বাস্তবে পরিণত করে পণ্য ও সেবা দিচ্ছে রকেট, বিকাশ, নগদের মতো প্রতিষ্ঠান।] সর্বোৎকৃষ্ট জ্ঞান বা তথ্য যদি কোন কাজে বা আচরণে রূপান্তরিত বা ব্যবহৃত না হয় তবে তা নিরর্থক। এজন্যই জ্ঞানভিত্তিক কর্মী এমন কিছু করে যা দৈহিক পরিশ্রমকারী বা ম্যানুয়েল কর্মীর করার প্রয়োজন পড়ে না। একজন জ্ঞানভিত্তিক কর্মীর অবশ্যই তার কর্মদক্ষতা বা কার্যকারিতার প্রমাণ দিতে হবে। সে তার পণ্যের উপযোগিতার উপর নির্ভশীল থাকতে পারবে না যেভাবে এক জোড়া ভালো জুতা থেকে সুবিধা পাওয়া যায়।

একজন তথ্যভিত্তিক কর্মী হলো ‘উৎপাদনের একটি অন্যতম উপাদান’ যার মাধ্যমে বর্তমানের উন্নত সমাজ ও অর্থনীতি গড়ে উঠেছে—যেমন, যুক্তরাষ্ট্র, পশ্চিম ইউরোপ, জাপান এবং ক্রমবর্ধমানভাবে সোভিয়েত ইউনিয়ন গড়ে উঠেছে এবং একে অপরের সাথে প্রতিযোগিতা করছে।

এটা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বিশেষভাবে সত্য। শিক্ষা একমাত্র সম্পদ যার বিচারে আমেরিকা সবচেয়ে বেশি প্রতিযোগিতামূলক সুবিধার মধ্যে রয়েছে। আমেরিকার শিক্ষা বা শিক্ষাব্যবস্থা সারা বিশে^র সকলের কাছে আকর্ষণীয় এক ব্যাপার এবং প্রত্যাশিতও বটে। আবার এটা (শিক্ষাব্যবস্থা) গরিব কোনো সমাজের জন্য সাধ্যাতীত এক বিষয়। কারণ শিক্ষা হলো আমাদের দেশে সর্বাধিক ব্যয়বহুল একটি খাত। বিজ্ঞানের যেকোনো বিষয়ের উপর একটি পি.এইচ.ডি. নিতে ব্যয় হয় ৮৫ লাখ টাকা থেকে ১ কোটি ৭০ লাখ টাকা [১ থেকে ২ লাখ ডলার ব্যয় হয়। ১ ডলার সমান ৮৫ টাকা ধরে বাংলাদেশি টাকায় ৮৫ লাখ টাকা থেকে ১ কোটি ৭০ লাখ টাকা ব্যয় হয়]। এমনকি যেকোনো ছেলে-মেয়ে কোনো ধরনের পেশাদার যোগ্যতা ছাড়াই তার স্নাতক বা অনার্স সম্পন্ন করতে ব্যয় হয় ৪২ লাখ ৫০ হাজার টাকা [৫০ হাজার ডলার ব্যয় হয়। ১ ডলার সমান ৮৫ টাকা ধরে বাংলাদেশি টাকায় ৪২ লাখ ৫০ হাজার টাকা ব্যয় হয় অনার্স সম্পন্ন করতে]। যা কেবল একটি ধনী সম্প্রদায়ই বহন করতে পারে।

শিক্ষা হলো এমন একটি খাত যেখানে পৃথিবীর সর্বাধিক ধনী সমাজ, মানে যুক্তরাষ্ট্র, স্বাভাবিকভাবেই অন্যান্য যেকোনো সমাজের চেয়ে বেশি সুবিধাভোগী—এজন্যই এই সমাজ, এই দেশ জ্ঞানভিত্তিক কর্মীদের বেশি কর্মদক্ষ বা কার্যকারিতাসম্পন্ন করে গড়ে তুলতে পারে। আর জ্ঞানভিত্তিক কর্মীদের কাছে উৎপাদনশীলতার অর্থই হচ্ছে সঠিক কাজকে সম্পাদন করিয়ে নেওয়ার সামর্থ্য। এরই মানে হচ্ছে কর্মদক্ষতা বা কার্যকারিতাসম্পন্ন হওয়া।


কার্যনির্বাহী কে?


আধুনিক প্রতিষ্ঠানে প্রত্যেক জ্ঞানভিত্তিক কর্মী হলো একজন ‘কার্যনির্বাহী’, যদিও তার পদ ও জ্ঞানের বদান্যতায়, সে যেকোনো অবদান রাখার জন্য দায়বদ্ধ হতে পারে যা মূলত একটি প্রতিষ্ঠানের কার্য সম্পাদন ও ফলাফল লাভের সক্ষমতাকে প্রভাবিত করে। এটা হতে পারে বাজারে নতুন কোন পণ্য আনা বা মার্কেটের বড় একটি অংশ কোম্পানির আয়ত্তে আনা। এটা হতে পারে কোনো হাসপাতালের রোগীকে বেডে বেডে গিয়ে সেবা দেওয়ার সক্ষমতার মতো নানা বিষয়। এমন একজন ব্যক্তি (হতে পারে তিনি পুরুষ বা মহিলা) অবশ্যই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে; সে কেবল আদেশ দিয়ে গেলেই হবে না। সে তার কাজের জন্য দায়বদ্ধ থাকবে। আর তার কাছে কাম্য হলো, তার জ্ঞানের কল্যাণে, অন্য যে কারও চেয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে যথাযথভাবে প্রস্তুত থাকবে। হয়তো তার প্রস্তাব বা উল্লেখিত সিদ্ধান্ত উপেক্ষিত হতে পারে; তার পদাবনতি হতে পারে অথবা চাকরি চলে যেতে পারে। কিন্তু যতক্ষণ তার কাছে চাকরি থাকবে, ততক্ষণ তার লক্ষ্য, তার কাজ করার মানদ- এবং তার অবদান তাকে রেখেই কাজ করে যেতে হবে।

অধিকাংশ ম্যানেজার তথা ব্যবস্থাপকই হচ্ছে কার্যনির্বাহী—যদিও সবাই নয়। তবে অনেক ম্যানেজারই আধুনিক সমাজে কার্যনির্বাহী তথা এক্সিকিউটিভে পরিণত হচ্ছে। কারণ তথ্যভিত্তিক প্রতিষ্ঠানে ‘ম্যানেজার’ ও ইন্ডিভিজুয়াল প্রফেশনাল কন্ট্রিবিউটরস তথা ‘পেশাদার স্বতন্ত্র (ব্যক্তি) অবদানকারী’ উভয়কেই দরকার। তথ্যভিত্তিক প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব পালনে, সিদ্ধান্ত গ্রহণে এবং কর্তৃত্ববান স্থানে বা পদে এই উভয় শ্রেণিকেই দরকার। এটা আমরা কয়েক বছরের গবেষণা ও পর্যবেক্ষণ থেকে শিখেছি।

এই বিষয়টি অত্যন্ত চমৎকারভাবে সাম্প্রতিক এক পত্রিকার সাক্ষাতকারে ফুটে উঠেছে, যা নেয়া হয়েছিল ভিয়েতনামের জঙ্গলে আমেরিকান পদাতিক বাহিনীর একজন অধিনায়কের কাছ থেকে।

সংবাদকর্মী তার কাছে জানতে চায়, ‘কীভাবে আপনি এমন বিশৃঙ্খল পরিস্থিতে কমান্ড ধরে রাখেন?’ তরুণ দলনায়ক বলেন: ‘এখানে, আমিই একমাত্র ব্যক্তি যে দায়বদ্ধ। এই লোকগুলো যখন জঙ্গলে শত্রুর মোকাবিলা করবে তখন তারা দৌড়ের ওপর থাকে। তখন আমি থাকি অনেকদূরে। তখন যদি তারা না জানে তারা কী করবে তবে তা মারাত্মক ব্যাপার হতে পারে। আমার দায়িত্ব হচ্ছে এটা নিশ্চিত করা যে তারা যেন আগে থেকেই জানে তাদের অনিশ্চিত অবস্থায় কী করতে হবে। তারা কী করবে তা তো অবশ্যই তৎকালীন পরিস্থিতি ও অবস্থার ওপর নির্ভর করে। সেই পরিস্থিতি ও অবস্থা বিবেচনা করে তারা কাজ করতেই পারে। উক্ত পরিস্থিতিতে যেই থাকুক, তার ওপর সিদ্ধান্তের ভার থাকবে, কিন্তু দায়িত্বটা সবসময়ই আমার।’

একটি গরিলা যুদ্ধে, প্রত্যেক ব্যক্তিই একজন ‘কার্যনির্বাহী’।

অনেক ম্যানেজারই আছে যারা পরিচালক বা কার্যনির্বাহী নয়। আবার, অনেক মানুষ, অন্যান্য মানুষের চেয়ে শ্রেষ্ঠ এবং কখনো কখনো যাদের ওপর প্রাধান্য বিস্তার করে এমন মানুষের সংখ্যা লাখ ছাড়িয়ে যায়। কিন্তু তারপরেও দেখা যায়, কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠানে তারা গুরুতর কোনো কার্যকর প্রভাব বিস্তার করতে পারে না। যেকোনো কোম্পানির উৎপাদন কারখানার সরদার কর্মী বা প্রধান কর্মীরা এমন ব্যক্তি হয়ে থাকে। তারা আক্ষরিক অর্থে ‘পরিদর্শক’, উৎপাদন কাজ ঠিকভাবে হচ্ছে কিনা তা দেখে বেড়ায়। তারা এই অর্থে ব্যবস্থাপক বা ম্যানেজার যে তারা অন্যের কাজের ব্যবস্থাপনা করে। কিন্তু তাদের না আছে দায়িত্ব, না কর্তৃত্ব, না নির্দেশনা দিবে, না কর্মীদের সন্তুষ্ট করবে এবং কাজের গুণমান বদলাবে বা কাজ করার পদ্ধতি পরিবর্তন করবে। তবুও তাদের পরীক্ষা নেয়া হয় এবং ব্যাপকভাবে প্রশংসা করা হয় যেসব মানদ-ের ভিত্তিতে তা হচ্ছে দৈহিক পরিশ্রমকারী কর্মীদের যেসব মানদ-ে পরীক্ষা নেয়া হয়। [তারা কাজ করে জ্ঞানভিত্তিক, কিন্তু তাদের পরিমাপ করা হয় দৈহিক পরিশ্রমকারী বা ম্যানুয়েল কর্মীদের মানদ-ের ভিত্তিতে। এখানেই পার্থক্য।]

বিপরীত দিকে, একজন জ্ঞানভিত্তিক কর্মী হলেই যে তাকে শত শত মানুষকে পরিচালিত করতে হবে তা নয়। সে শত লোককে পরিচালিত করুক আর না করুন, একজন জ্ঞানভিত্তিক কর্মী একজন কার্যনির্বাহী হিসাবেই দায়িত্ব পালন করে। কোন একটি ব্যবসাতে, বাজার গবেষণার জন্য হয়তো দুইশত কর্মী থাকতে পারে, যেখানে তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীর বাজার গবেষক মাত্র একজন। এই একজন ব্যক্তি, একাই অনুসন্ধান চালায় এবং তার কাজকর্মের জন্য একজন সহকর্মী রয়েছে। এই দুই অবস্থায়, দুই কোম্পানির ক্ষেত্রে বাজার গবেষণার ক্ষেত্রে অবদানের ব্যাপারটা ভিন্ন হবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু দুইশত কর্মী নিয়ে কাজ করার মধ্যে আমলাতান্ত্রিক জটিলতাও রয়েছে। এই দুই অবস্থাকে বিচার করুন। দুইশত কর্মী অবশ্যই একজন ব্যক্তির চেয়ে অনেক বেশি কাজ করতে সক্ষম। কিন্তু এর মানে এই নয় যে তারা কোম্পানির জন্য বড় কোনো অবদান রাখছে বা মূল্যবান কিছু উৎপাদন করতে পারে। [এখানেই আসে জ্ঞানভিত্তিক কর্মীর কথা।]

তথ্য বা জ্ঞানভিত্তিক কাজকে পরিমাণ দ্বারা নির্ধারণ যায় না। [কত বেশি পরিমাণ কাজ হলে তা দ্বারা জ্ঞানভিত্তিক কাজের কার্যকারিতা নির্ধারণ করা যায় না]। না এটাকে তার খরচ বা ব্যয়ের মাধ্যমে সংজ্ঞায়িত করা যায়। এটা নির্ধারণ করা যায় এর ফলাফলের মাধ্যমে। আর এসবের জন্য, দলের আকৃতি (কতজন মানুষ নিয়ে আপনি কাজ করছেন) এবং ব্যবস্থাপনা বিভাগের বিশালতা দিয়ে কাজ হয় না।

বাজার গবেষণায় অনেক মানুষের উপস্থিতি, সূক্ষ্ম বিচার-বিশ্লেষণ, কল্পনা এবং গুণমান যা একটি কোম্পানির দ্রুত প্রবৃদ্ধি ও সাফল্য লাভের সম্ভাব্যতা নিশ্চিত করতে পারে। এখন কোম্পানির উন্নয়ন ও সাফল্যের জন্য এই যদি হয় তাহলে দুইশত মানুষ তো খুব কমই। কিন্তু আমাদের এটাও চিন্তা করে দেখতে হবে যে একজন ম্যানেজারের কাছে এই দুইশত লোক যেসব সমস্যা নিয়ে আসবে এবং তাদের পারস্পরিক অভ্যন্তরীণ ত্রুটিবিচ্যুতি থাকবে তা সে কীভাবে সামলাবে। ঐ ম্যানেজার বা ব্যবস্থাপক তো এদের পরিচালনা করতেই ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠবে, কোম্পানির জন্য কার্যকর ফলাফল আনতে কাজ করবে কখন। সে তো এদের নিয়েই ব্যস্ত থাকবে। যার ফলে বাজার গবেষণা ও এ সংক্রান্ত কোম্পানির জন্য মৌলিক কোন সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো আর সময় থাকবে না। সে হয়তো বিভিন্ন ব্যক্তিকে জিজ্ঞেস করতে করতেই সময় পার করবে এবং এই প্রশ্ন করতে সময় পাবে না যে, ‘যখন আমরা ‘আমাদের মার্কেট বা বাজার’ বলি তখন আদতে তার দ্বারা কী বুঝিয়ে থাকি?’ ফলশ্রুতিতে, সে হয়তো বাজারের গুরুত্বপূর্ণ কোন পরিবর্তন খেয়াল করতে ব্যর্থ হবে, যা অবশেষে তার কোম্পানিকে অবনতির দিকে নিয়ে যাবে।

আবার, একজন স্বতন্ত্র (ব্যক্তি) বাজার পর্যালোচক যার কোন সহযোগী নেই, সেও উৎপাদনমুখী হতে পারে কিংবা নাও হতে পারে। সে হতে পারে তার কোম্পানির জ্ঞান ও তথ্যের এবং স্বপ্নের উৎস যা কোম্পানিকে সমৃদ্ধ করে। অথবা সে তার অধিকাংশ সময় নানা তথ্যের বিশদ বিবরণ খুঁজতে খুঁজতে ব্যস্ত এবং এতে সব সময় পার করে ফেলে। যা প্রায় গবেষক গবেষণা করতে গিয়ে ভুল করেন। কাজ কেন শুরু করেছেন সেই প্রশ্ন ভুলে, যা দরকার তা ভুলে অপ্রাসঙ্গিক ও অপ্রয়োজনীয় বহু তথ্য নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করে সময় ব্যয় করে। ফলাফল—দরকারি জিনিস দেখে কম, শোনে কম এবং চিন্তা করে আরও কম।

আমাদের প্রতিটি জ্ঞানভিত্তিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে এমন কিছু ব্যক্তি থাকে যারা কাউকেও পরিচালনা করে না তথাপি তারা কার্যনির্বাহী। কদাচিৎ আমরা এমন পরিস্থিতি দেখে থাকি যেমন ভিয়েতনাম জঙ্গলের ঘটনায় দেখা যায়, যেখানে সর্বাবস্থায়, সমগ্র দলের যেকোনো সদস্যকে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য ডাকা হতে পারে, সেই সিদ্ধান্তের ওপর সকলের জীবনমরণ নির্ভর করবে। কিন্তু ল্যাবরেটরিতে একজন রসায়নবিদ যে সিদ্ধান্ত নেয় যে একটি পদ্ধতিতে তার গবেষণা চালিয়ে নিলে এক ধরনের সিদ্ধান্ত পাওয়া যায়। আবার আরেক পদ্ধতিতে তার গবেষণা চালিয়ে নিলে অন্য একটি সিদ্ধান্ত হয়তো পাওয়া যেত, যা তার কোম্পানির ভবিষ্যৎ বদলে দিতে পারত। হয়তো সে একজন গবেষণা পরিচালক। কিন্তু তারপরেও সে একজন রসায়নবিদ, যার ওপর ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব বর্তায় না। আর যদি সে ঊর্ধ্বতন কর্মী না হয়ে অধস্তন কর্মী হয়, তাতে অবস্থার কোনো পরিবর্তন হবে না। ঠিক একইভাবে যেকোনো কোম্পানির জন্য কোন জিনিসটি ‘একটি বিক্রয়যোগ্য পণ্য’ এ সিদ্ধান্ত নিতে পারে কোম্পানির সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট।  অথবা একজন জুনিয়রও এ সিদ্ধান্ত নিতে পারে। বর্তমানের সকল বড় প্রতিষ্ঠানের জন্য এ কথা সত্য।

এ বইয়ের আমি সেসব নলেজ ওয়ার্কার, ম্যানেজার অথবা স্বতন্ত্র (ব্যক্তি) পেশাজীবীকে ‘কার্যনির্বাহী তথা পরিচালক’ বলেছি, যাদের কাছে তাদের পদমর্যাদা ও জ্ঞানের কারণে তাদের কাজের স্বাভাবিক পরিক্রমায় এমন সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রত্যাশা করা হয় যে সিদ্ধান্তের প্রভাব পড়বে সমগ্র কাজ ও ফলাফলের ওপর। তারা হয়তো জ্ঞানভিত্তিক কর্মীদের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ হবে না। কারণ অন্যান্য যেকোনো সেক্টরের মতো নলেজ ওয়ার্কেও অদক্ষ কাজ ও রুটিন (ঁহংশরষষবফ ড়িৎশ ধহফ ৎড়ঁঃরহব) রয়েছে। কিন্তু তারা যেকোনো বড় প্রতিষ্ঠানের জ্ঞানভিত্তিক সব ধরনের কাজের অগ্রগতির ক্ষেত্রে একটি বড় অবদান রাখে।

এটা এখন অনুভব করা শুরু হয়েছে—যেভাবে ব্যবস্থাপক ও স্বতন্ত্র পেশাদার অবদানকারীদের জন্য কার্যকর ফলাফল আনতে পারার স্বীকৃতি স্বরূপ পুরস্কার দেয়ার চেষ্টা করা হয়।  গুটিকয়েক মানুষ এটা অনুভব করতে পারে যে প্রতিষ্ঠান যত বড়ই হোক না কেন, তা হোক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বা সরকারি প্রতিষ্ঠান, গবেষণাগার বা হাসপাতাল যাই হোক, তাৎপর্যপূর্ণ ও অপরিবর্তনীয় প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম এমন সিদ্ধান্ত খুব কমই লোকই নিতে পারে। এখানেই জ্ঞানভিত্তিক কর্মীদের কার্যকারিতা দেখানোর জায়গা। জ্ঞানের ব্যাপারে যিনি বিজ্ঞ তিনি ঠিক ততটাই কর্তৃত্ববান যতটা একজন ব্যক্তি পদের কারণে কর্তৃত্ববান। এ ধরনের সিদ্ধান্তগুলো কিন্তু উচ্চপদস্থ ব্যবস্থাপনা বোর্ড যে রকম সিদ্ধান্ত নেয় ঠিক তেমনই গুরুত্ববহ সিদ্ধান্ত। (জনাব ক্যাপেল তার বক্তব্যের মাধ্যমে ঠিক এই পয়েন্টই তুলে ধরতে চেয়েছেন।)

আমরা এখন জানি, কোম্পানির হায়ারারকি তথা স্তর-পারম্পর্যের দিক থেকে সবচেয়ে অধস্তন ম্যানেজারও যে ধরনের কাজ করে তা গুরুত্বের দিকে থেকে কোম্পানির প্রেসিডেন্ট বা সরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠান প্রধান বা প্রশাসকের সমপর্যায়ের। তা সেই কাজগুলো কী? তা হচ্ছে পরিকল্পনা প্রণয়ন, সংগঠিত করা, একীভূত করা তথা সব তথ্য এক করা, কর্মীদের উৎসাহ দান এবং কাজকর্ম ফলাফল থেকে কতদূরে আছে তা পরিমাপ করা (ঢ়ষধহ, ড়ৎমধহরুব, রহঃবমৎধঃব, সড়ঃরাধঃব ধহফ সবধংঁৎব)। তার পরিধি হয়তো আকারে ছোট, কিন্তু তার বলয়ের মধ্যে সেই একজন কার্যনির্বাহী।


 

[চিত্র: কম্পাসের মতো যেকোনো ম্যানেজার তার পরিধির মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ যেসব কাজ করে তা উল্লেখ করা হলো।]


একইভাবে, প্রত্যেক সিদ্ধান্ত-গ্রহণকারী ব্যক্তি একটি কোম্পানির প্রধান বা সরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রশাসক যে কাজ করে থাকে ঠিক একই কাজ করে। তার কাজের পরিসর হয়তো সীমিত, কিন্তু তার বলয়ের মধ্যে সেই একজন কার্যনির্বাহী। এমনকি তার কাজ বা তার নাম যদি তার প্রতিষ্ঠানের তালিকায় বা টেলিফোন ডিরেক্টরিতে নাও থাকে তবুও সে একজন কার্যনির্বাহী।

আর তাই, সিদ্ধান্ত-গ্রহণকারী ব্যক্তি কোম্পানির প্রধান হোক বা অধস্তন ম্যানেজার হোক, তাকে অবশ্যই কর্মদক্ষ হতে হবে।

এই বইয়ে প্রদত্ত অধিকাংশ উদাহরণ নেয়া হয়েছে প্রধান কার্যনির্বাহীর কাজ ও অভিজ্ঞতা থেকে—এসব নির্বাহীরা ছিলেন সরকারি প্রতিষ্ঠানে, সেনাবাহিনীতে, হাসপাতালে, ব্যবসা সহ প্রভৃতি ক্ষেত্রে। উদাহরণ হিসাবে এদের নেয়ার মূল কারণ হলো এই প্রতিষ্ঠানগুলো সহজে গমনযোগ্য এবং জনগণের জন্য উন্মুক্ত। তাছাড়া, বড় জিনিস যত সহজে পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ করা যায়, ততটা ছোট ক্ষেত্রে সম্ভব হয় না।

কিন্তু এই বইটি এ ব্যাপারে নয় যে, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা কী করছে বা কী করা উচিত। এ বইটিতে তাদেরকে রাখা হয়েছে যারা জ্ঞানভিত্তিক কর্মী, যারা তাদের গৃহীত পদক্ষেপ ও সিদ্ধান্তের জন্য দায়বদ্ধ, যা তাদের কোম্পানির কার্যসম্পাদনের সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে নেওয়া হয়। বইটি তাদের উদ্দেশ্যে যাদের আমি ‘এক্সিকিউটিভ তথা কার্যনির্বাহী’ বলে থাকি।


কার্যনির্বাহীদের বাস্তবচিত্র


একজন কার্যনির্বাহীর বাস্তব অবস্থা হচ্ছে তাকে অবশ্যই কর্মদক্ষ হতে হবে, কিন্তু কর্মদক্ষ করে গড়ে তোলা অত্যন্ত কঠিন কাজ। প্রকৃতপক্ষে, একজন কার্যনির্বাহী যতক্ষণ না কর্মদক্ষ হয়ে ওঠার চেষ্টা করে তত সে সফল হয় না। নিজে থেকে কর্মদক্ষ হয়ে ওঠার চেষ্টা না করলে তাদের অবস্থা হয় নিষ্ফলা মাঠের মতো। [নিষ্ফলা মাঠের মতো, জায়গা দখল করে আছে কিন্তু কোনো ফল দেয় না, নিরর্থক।]

সমস্যাটি দেখার জন্য প্রতিষ্ঠানের বাইরের একজন জ্ঞানভিত্তিক কর্মীর বাস্তবতা বিবেচনা করুন। একজন চিকিৎসকের কর্মদক্ষতার কোন সমস্যা নেই। যে রোগী তার কাছে আসে সে তার (চিকিৎসকের) জ্ঞানকে কার্যকরীভাবে প্রয়োগ করার সকল উপকরণ সাথে নিয়েই আসে। যখন চিকিৎসক তার রোগীর সাথে থাকে, সে রোগীর সমস্যা এবং তা সমাধানের জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করতে পারে। তার ও রোগীর কাজের মধ্যে কোনো ধরনের বাধাবিপত্তি থাকলে তা সে (চিকিৎসক) সর্বনি¤েœ নামিয়ে আনতে পারে। একজন চিকিৎসকের কাছে যে ভূমিকা প্রত্যাশা করা হয় তা সুস্পষ্ট। রোগীর অবস্থা দেখে এটা নির্ধারিত হয় যে চিকিৎসকের কী করতে হবে আর কী করতে হবে না। রোগীর অভিযোগ চিকিৎসকের অগ্রাধিকার বা কর্তব্যকে প্রতিষ্ঠা করে। লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ঠিক করে দেওয়া হয় যা রোগীর সুস্থতা ফিরিয়ে আনতে অথবা অন্তত তাকে ভালোবোধ করতে সহায়তা করে। চিকিৎসকরা নিজেদের গুছিয়ে রাখা বা তাদের কাজকে শৃঙ্খলার সাথে করার জন্য খুব একটা প্রশংসিত নয়। কিন্তু কার্যকারিতার ব্যাপারে তাদের খুব কম সংখ্যককেই সমস্যা পোহাতে হয়।

যেকোনো প্রতিষ্ঠানের একজন কার্যনির্বাহীর অবস্থা চিকিৎসকের চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন। কার্যনির্বাহীর পরিস্থিতিতে, চারটি বাস্তবতা রয়েছে যার উপর তার কোন হাত নেই। তার কোন পছন্দ থাকে না; বরং ‘অবশ্যম্ভাবী পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নিতে হয়।’ কিন্তু এ ধরনের পরিস্থিতি ফলাফলহীনতা তৈরি করে এবং কার্যকর কার্যসম্পাদনের পথে বাধা দেয়।

১. একজন নির্বাহীর সময়ে প্রত্যেকের অধিকার থাকে। যদি কেউ নির্বাহী থেকে তার কর্ম-তৎপরতার বিচারে সংজ্ঞায়িত করতে চায় তবে তাকে সংজ্ঞায়িত করতে হবে প্রতিষ্ঠানের একজন কয়েদি হিসাবে। যে কেউ তার থেকে সময় নিতে পারে এবং প্রত্যেকে তাই করে। হয়তো কোন নির্বাহীর এ ব্যাপারে কিছু করা থাকে না। সে, নিয়মানুযায়ী, কিছু করতে পারে না। যেমন একজন চিকিৎসকের মতো, সে দরজা দিয়ে বের হয়ে তার নার্সকে বলতে পারে না যে আমি আগামী আধঘণ্টা কারো সাথে দেখা করতে চাই না। ঠিক তখনই, নির্বাহীর টেলিফোনটি বেজে উঠবে এবং তাকে কোম্পানির সব থেকে সেরা গ্রাহকের সাথে বা নগর প্রশাসনের কোন পদস্থ কর্মকর্তার সাথে কিংবা তার বসের সাথে কথা বলতে হতে পারে এবং আধঘণ্টা ইতোমধ্যে শেষ হয়ে গেছে। 

২. নির্বাহীগণকে তাদের কাজে ব্যস্ত রাখা হয় যতক্ষণ না তারা তাদের বাস্তবতাকে পরিবর্তনের জন্য ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করে যাতে তারা বসবাস করে এবং কাজ করে।

যুক্তরাষ্ট্রে, এই অভিযোগটি সাধারণ যে, কোম্পানির প্রধান বা অন্য কোন সিনিয়র কর্মকর্তা এখনো মার্কেটিং বা কারখানা পরিচালনার কাজ করে থাকে, যদিও সে পুরো ব্যবসা পরিচালনার দায়িত্বে এবং তার উচিত কোম্পানি ও ব্যবসার সামগ্রিকভাবে দিকনির্দেশনা দেয়ার ক্ষেত্রে সময় ব্যয় করা। এই দোষারোপটি বারবার করা হয়ে থাকে যে, আমেরিকার নির্বাহীগণ, নিয়মতান্ত্রিক পড়ালেখার মধ্য দিয়ে যখন ¯œাতক সম্পন্ন করে তারা তখন হাতেকলমের কাজ করতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে এবং এ অভ্যাস ছাড়তে পারে না। তাদেরকে যদি ব্যবস্থাপনার দায়িত্বও দেয়া হয়, তবুও তারা আগের অভ্যাস ধরে রাখে। তবে একই অভিযোগ সেসব দেশেও শোনা যায় যেখানে কর্মক্ষেত্রের ধরন সম্পূর্ণ ভিন্ন। ইউরোপের জার্মান ভাষাভাষী দেশসমূহে [অস্ট্রিয়া, বেলজিয়াম, ডেনমার্ক, ইংল্যান্ড, নেদারল্যান্ড প্রভৃতি], উদাহরণস্বরূপ, শীর্ষ ব্যবস্থাপকে উন্নীত হওয়ার পথ হলো কেন্দ্রিয় সচিবালয়, যেখানে ব্যক্তি একজন ‘জেনারেলিস্ট’ তথা বহু দক্ষতা সম্পন্ন ব্যক্তি হিসাবে কাজ করে। তথাপি, জার্মান, সুইডেন বা নেদারল্যান্ডের কোম্পানিগুলোর শীর্ষ ব্যবস্থাপনা পর্ষদসমূহ সমালোচিত হয় কেবল তাদের ‘কারিগরি’ মনোভাবের কারণে, যেমনটা যুক্তরাষ্ট্রে হয়ে থাকে। এই মনোভাব একটি প্রতিষ্ঠানে আছে কিনা তা যদি পর্যবেক্ষণ করা হয়, তবে দেখা যাবে এটা কেবল শীর্ষদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; এটা পুরো নির্বাহীদের দলের মাঝেই বিস্তৃত। কর্মক্ষেত্রের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠার ক্ষেত্রের এ ধরনের ‘কারিগরি’ মনোভাবের পিছনে অবশ্যই কোন কারণ রয়েছে।

মূল সমস্যা হলো একজন কার্যনির্বাহী বা পরিচালকের আশেপাশের অবস্থা। যতক্ষণ সে তার ঐকান্তিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে এর পরিবর্তন না করছে, নানান ঘটনা প্রবাহই (ভষড়ি ড়ভ বাবহঃং) নির্ধারণ করে দিবে সে কোন কাজের বিবেচনা করবে এবং কী কাজ করে।

ঘটনা-প্রবাহের (ভষড়ি ড়ভ বাবহঃং) উপর নির্ভর করা একজন চিকিৎসকের কথা ধরা যাক। যে চিকিৎসক কোন রোগী আসার পর, রোগীকে জিজ্ঞেস করে, ‘আপনি কেন এসেছেন?’, চিকিৎসক প্রত্যাশা করে তার রোগী প্রাসঙ্গিক কোন উত্তর দিবে। যখন রোগী বলে, ‘ডাক্তার, আমি ঘুমাতে পারছি না। গত তিন সপ্তাহ ধরে ঘুমাতে পারিনি,’ তখন সে ডাক্তারকে তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাটি তুলে ধরছে। এমনকি ডাক্তার যদি গভীর পর্যবেক্ষণের পর এ সিদ্ধান্তও নেয় যে তার ঘুমহীনতা আসলে একটি বড় সমস্যার ছোট কোন লক্ষণ, তবুও সে রোগীর কয়েক রাতের প্রশান্তির জন্য কোন ব্যবস্থা নির্দেশ করবে।

কিন্তু একজন নির্বাহীকে ঘটনাবলি কিছুই নির্দেশ করে না বললেই চলে, মূল সমস্যা তো দূরের কথা। ডাক্তারের ক্ষেত্রে, রোগীর অভিযোগটি প্রধান ও গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটা রোগীর কাছেও প্রধান সমস্যা। কিন্তু একজন নির্বাহী তারচেয়েও জটিল বিষয় নিয়ে উদ্বিগ্ন। কোন ঘটনাবলি গুরুত্বপূর্ণ আর কোনগুলো নিছক গালগল্প, ঘটনাবলি নিজেরাও তা নির্দেশ করতে পারে না। এমনকি সেসব কোন লক্ষণও নয়; যেখানে রোগীর বর্ণনা চিকিৎসকের জন্য একটি লক্ষণ তো দেখায়।

যদি একজন নির্বাহী ঘটনাবলির প্রবাহকে (ভষড়ি ড়ভ বাবহঃং) নির্ধারণ করার সুযোগ করে দেয় যে সে কী করবে, কোন কাজ করবে এবং কোন বিষয়কে গুরুত্ব সহকারে নিবে, তবে সে কার্যক্রম চালানোর নামে নিজের দক্ষতাকে খ- খ- করে ভেঙে ফেলছে, নিজের পরিচালনার দক্ষতাকে নষ্ট করছে। সে হয়তো একজন চমৎকার মানুষ। তবে নিশ্চিতভাবে সে নিজের জ্ঞান ও সক্ষমতাকে নষ্ট করছে এবং যৎসামান্য যে কর্মদক্ষতা সে অর্জন করতে সক্ষম ছিল তাও ছুড়ে ফেলেছে। নির্বাহীর যা প্রয়োজন তা হলো কিছু মানদ- যা তাকে প্রকৃত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উপর কাজ করতে সুযোগ করে দিবে, আর তা হলো, তার অবদান ও ফলাফল (পড়হঃৎরনঁঃরড়হং ধহফ ৎবংঁষঃং), যদিও মানদ- দুটো ঘটনা প্রবাহে পাওয়া যায় না।

৩. তৃতীয় বাস্তবতা একজন কার্যনির্বাহীকে অকার্যকর কাজকর্মের দিকে ধাবিত করে। কারণ হলো প্রতিষ্ঠানের ভেতরগতভাবে তার অবস্থান। এর অর্থ হলো সে ততক্ষণই কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারে যতক্ষণ তার ভূমিকা ও সিদ্ধান্তকে প্রতিষ্ঠানের অন্যরা মান্য করে এবং কাজে লাগায়। প্রতিষ্ঠান মানে হচ্ছে একজন স্বতন্ত্র ব্যক্তির শক্তিকে বহুগুণ বৃদ্ধি করা। প্রতিষ্ঠান তার জ্ঞান ও পরামর্শকে গ্রহণ করে ও তাকে তাদের সম্পদ, অনুপ্রেরণা এবং অন্যান্য নলেজ ওয়ার্কারদের লক্ষ্য হিসাবে ব্যবহার করে। জ্ঞানভিত্তিক কর্মীগণ কদাচিৎ একে অন্যের বলয়ে এসে পড়ে, এর যথার্থ কারণ হচ্ছে তারা নলেজ ওয়ার্কার তথা জ্ঞানভিত্তিক কর্মী। প্রত্যেকের নিজস্ব দক্ষতা ও চিন্তাভাবনা রয়েছে। এক ব্যক্তি হয়তো ট্যাক্স অ্যাকাউন্টে (কর হিসাব রক্ষণাবেক্ষণ বিদ্যা) আগ্রহী, অন্য ব্যক্তি জীবাণুবিদ্যায় বা পৌর কর্পোরেশনের ভবিষ্যৎ প্রশাসকদের প্রশিক্ষণ ও উন্নয়নে। কিন্তু সামনের দরজার ব্যক্তিটা হয়তো কস্ট অ্যাকাউন্টিং এর চমৎকার পয়েন্টগুলো নিয়ে কাজ করতে আগ্রহী বা হাসপাতাল অর্থনীতি বা নগর সনদের বৈধতা নিয়ে পড়াশোনায় আগ্রহী।  তারা প্রত্যেকে যা কিছু আবিষ্কার বা খুঁজে বের করে, তা অন্যদেরকে কোম্পানির জন্য ইতিবাচক ফলাফল নিয়ে আসতে ব্যবহার করতে সক্ষম হতে হবে।

সাধারণত যেসব মানুষ একজন কার্যনির্বাহীর কর্মদক্ষতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে, তাদের ওপর নির্বাহীর সরাসরি নিয়ন্ত্রণ থাকে না। তারা অন্য সেক্টরের মানুষ, সেসব ব্যক্তি যারা প্রতিষ্ঠানের পরিভাষায় ‘পাশ^স্থ বা সাইড লাইনের মানুষ’ অথবা তারা তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। যতক্ষণ না নির্বাহী এসব মানুষের কাছে ঘেঁষতে পারে, তার ভূমিকাকে তাদের জন্য ও তাদের কাজে লাগাতে পারে, ততক্ষণ তার কোন কার্যকারিতা নেই।


৪. সবশেষে, প্রতিষ্ঠানের ভেতরগতভাবে একজন কার্যনির্বাহীর অবস্থান।


প্রত্যেক নির্বাহী, হোক সে কোনো ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের কার্যনির্বাহী বা গবেষণা ল্যাব, সরকারি সংস্থা, বড় কোনো বিশ^বিদ্যালয়, বিমান বাহিনী প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী, সে উক্ত প্রতিষ্ঠানকে এত গভীর ও নিবিড়ভাবে দেখতে পায় যা অন্য কেউ দেখে না। এর ফলে সে যদি বাহিরের অবস্থা দেখতে যায় তবে তা দেখে উদাসীন ও ঝপসা দৃষ্টিতে। প্রথম কথা হচ্ছে, বাহিরে কী ঘটে তা সে প্রথফ দফায় জানতে পারে না। এটা তার কাছে আসে প্রতিবেদনের প্রাতিষ্ঠানিক ছাঁকনির মাধ্যমে যেখানে বাস্তবতার কোনো আকৃতি-প্রকৃতি থাকে না।

কিন্তু প্রতিষ্ঠান একটি বিমূর্ত জিনিস। গাণিতিকভাবে বলতে গেলে বলতে হয়, এটা এমন এক অবস্থান নির্দেশ করে যার কোনো আকার বা বিস্তৃতির সীমা নেই। এমনকি সর্ববৃহৎ প্রতিষ্ঠানটিও সে যে পরিবেশে টিকে আছে তার বাস্তবতা বিচারে বাস্তবসম্মত নয়।

বিশেষত, প্রতিষ্ঠানের ভেতরে কোন ফল পরিলক্ষিত হয় নয়। এর সকল ফলাফল ও ফসল বাহ্যিক। ব্যবসায়িক ফলাফল, উদাহরণত, আসে একজন গ্রাহকের হাত ধরে, যে ব্যবসার ব্যয় ও প্রচেষ্টাকে লাভ ও রাজস্বে পরিণত করে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের পণ্য বা সেবা ক্রয় করার প্রতি আগ্রহ দেখানোর মাধ্যমে। ক্রেতা বা গ্রাহক যোগান ও চাহিদার বাজার বিবেচনার উপর ভিত্তি করে একজন ভোক্তা হিসাবে তার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে বা একজন স্থানীয় সরকার হিসাবে যে বা যারা অ-অর্থনৈতিক মূল্যের ভিত্তিতে যোগান ও চাহিদা নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। উভয় ক্ষেত্রে, সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী ব্যক্তি একজন বাহিরের লোক; ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের ভেতরের কোনো লোক নয়।

একইভাবে, একটি হাসপাতালের ফলাফল বিবেচিত হয় তার রোগীদের বিবেচনায়। অথচ রোগী হাসপাতাল প্রতিষ্ঠানের কোনো সদস্য নয়। রোগীর কাছে হাসপাতাল ততক্ষণ ‘বাস্তব ও অস্তিত্বমান’ যতক্ষণ সে তাতে অবস্থান করে। তার অন্যতম আকাক্সক্ষা হলো যত দ্রুত সম্ভব একটি ‘অ-হাসপাতাল’ পরিবেশে ফিরে যাওয়া।

একটি প্রতিষ্ঠানের ভেতরে যা ঘটে থাকে তা হলো প্রচেষ্টা ও ব্যয় (বভভড়ৎঃ ধহফ পড়ংঃ)। ব্যবসা মানেই একটি ‘মুনাফার জায়গা’ বলে যে কথা প্রচলিত তাকে বলা যেতে পারে এক ধরনের মজার কৌতুক। আসলে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান মানে প্রচেষ্টার জায়গা (বভভড়ৎঃ পবহঃবৎং)। এটাই সত্য। একটা প্রতিষ্ঠান যত কম ফলাফল সৃষ্টির দিকে মনোযোগ দিবে, তত এটা তার কাজ ভালোভাবে করতে পারবে। অটো মোবাইল (গাড়ি) বা ইস্পাত উৎপাদনের জন্য ১ লাখ কর্মচারী লাগে, কিন্তু বাজার মূলত চায় একটি স্থূল ইঞ্জিনিয়ারিং ত্রুটি সারতে। মানুষ যত কম হবে, পরিসর যত ছোট হবে, অভ্যন্তরীণ সক্রিয়তা যত কমবে, তত বেশি একটি প্রতিষ্ঠান যথাযথভাবে তার বেঁচে থাকার দায়িত্ব পালন করতে পারবে। আর তা হচ্ছে তার আশেপাশের পরিবেশের সেবা করা (ঃযব ংবৎারপব ঃড় ঃযব বহারৎড়হসবহঃ)।

এই বহিঃবিভাগ, যা একটি অনস্বীকার্য বাস্তবতা। অভ্যন্তরীণভাবে, একটি কোম্পানির ভেতর থেকে এ ধরনের বাহ্যিক পরিবেশকে কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে, ফলাফল পরস্পরের উপর নির্ভশীল, উদাহরণস্বরূপ যুদ্ধক্ষেত্র, যেখানে পরিণতি নির্ধারিত হয় উভয় পক্ষের সেনাবাহিনীর সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপ ভিত্তিতে। একটি ব্যবসাতে, গ্রাহকের পছন্দ ও মূল্যায়নকে বিজ্ঞাপন ও প্রচারের মাধ্যমে প্রভাবিত করার চেষ্টা করা হতে পারে। কেবল কঠিন পরিস্থিতি ও চরম ঘাটতি সৃষ্টি হওয়া ছাড়া; যেমন একটি যুদ্ধকালীন অর্থনীতিতে হতে পারে, এমন কঠিন পরিস্থিতি ছাড়া গ্রাহকের শেষ কথা জানানোর ও ‘না’ বলার ক্ষমতা বা প্রত্যাখ্যান করার ক্ষমতা (াবঃড় ঢ়ড়বিৎ) থাকে (যা ব্যাখ্যা করে কেন কমিউনিস্ট অর্থনীতি সমস্যায় নিপতিত হয় যখনই তা কঠিন পরিস্থিতি বা চরম ঘাটতি কাটিয়ে উঠে এবং বাজারের যোগান ব্যবস্থা পর্যাপ্ত স্থিতিশীল হওয়ার আগেই রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষ ঠিক না করে গ্রাহক ঠিক করে যে গ্রাহক শেষ কথা জানাবে এবং ‘না’ বলার অধিকার তার আছে)। তবে প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ই একজন নির্বাহীর কাছে সর্বাধিক গোচরীভূত থাকে। অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলো সহজেই তার কাছে প্রতিভাত হয়। অভ্যন্তরীণ সম্পর্ক ও পরিচিতজন, সমস্যা ও চ্যালেঞ্জসমূহ, এর রটনা ও উড়ো খবর সবকিছু তার কানে পৌঁছায় এবং প্রতিটি ক্ষেত্র তাকে স্পর্শ করে। যতক্ষণ না সে বিশেষভাবে চেষ্টা করে বাহ্যিক বাস্তবতাগুলোতে সরাসরি প্রবেশাধিকার লাভ করার, সে ক্রমবর্ধমানভাবে অভ্যন্তরীণ বিষয়ের প্রতি মনোযোগী থাকে। প্রতিষ্ঠানের যত উপরে সে পৌঁছায়, তত বেশি তার মনোযোগ প্রতিষ্ঠানের বাহ্যিক ঘটনাবলির পরিবর্তে অভ্যন্তরীণ সমস্যাবলি ও চ্যালেঞ্জসমূহের প্রতি মনোযোগী হয়।

একটি প্রতিষ্ঠান, একটি সামাজিক নিদর্শন, জৈব জীব থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। তথাপি, তা এমন একটি আইনের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত যা প্রাণী ও উদ্ভিদজগতের আকৃতি-প্রকৃতিকে পরিচালনা করে: পৃষ্ট ব্যাসার্ধের বর্গের সাথে চলনসই, কিন্তু ভর বৃদ্ধি পায় তার ঘনত্বের সাথে (ণবঃ রঃ ংঃধহফং ঁহফবৎ ঃযব ষধি ঃযধঃ মড়াবৎহং ঃযব ংঃৎঁপঃঁৎব ধহফ ংরুব ড়ভ ধহরসধষং ধহফ ঢ়ষধহঃং: ঞযব ংঁৎভধপব মড়বং ঁঢ় রিঃয ঃযব ংয়ঁধৎব ড়ভ ঃযব ৎধফরঁং, নঁঃ ঃযব সধংং মৎড়ংি রিঃয ঃযব পঁনব)। প্রাণীটি যত বেশি বৃদ্ধি পেতে থাকে, তত বেশি তার কাঁচামাল ও উপাদানসমূহকে প্রাণীর ভর ও অভ্যন্তরীণ কাজ, রক্ত সঞ্চালন ও বার্তা পৌঁছানো, স্নায়বিক কার্যক্রম ইত্যাদির জন্য ব্যয় করতে হয়।

একটি অ্যামিবার (অনুজীব) প্রতিটি অংশ পরিবেশের সাথে স্পষ্ট ও সরাসরি যোগাযোগ রক্ষা করে। অতএব এর চারপাশকে অনুভব করার জন্য বা একসাথে টিকে থাকার জন্য এর বিশেষ কোন অঙ্গের প্রয়োজন হয় না। কিন্তু একটি বড় ও জটিল প্রাণীর যেমন মানুষের অস্তিত্ব ধরে রাখতে কঙ্কালের প্রয়োজন হয়। তার খাদ্য গ্রহণ ও হজম, শ্বাস গ্রহণ ও ত্যাগ, কোষে অক্সিজেন সরবরাহ, প্রজনন ইত্যাদি কাজের জন্য সব ধরনের বিশেষ অঙ্গের প্রয়োজন হয়। অধিকন্তু, একজন মানুষের মস্তিষ্ক ও একাধিক জটিল স্নায়বিক কার্যপ্রক্রিয়ার প্রয়োজন হয়। একটি অ্যামিবার অধিকাংশ ভর সরাসরি তার অস্তিত্ব ও প্রজননের সাথে সম্পৃক্ত। অন্য দিকে বড় প্রাণীর অধিকাংশ ভর—তার উপাদান, খাদ্য, শক্তির যোগান, তার কোষ—বাহিরের বিচ্ছিন্নতা দূর করতে, তার জটিল গঠন-প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে এবং ভারসাম্য ঠিক রাখতে ব্যবহৃত হয়।

একটি প্রতিষ্ঠান আদতে কোন প্রাণী নয় যে সে নিজে নিজেই শেষ হয়ে যায় এবং প্রজাতির বংশবিস্তার ধরে রাখার মাঝে স্বার্থকতা খুঁজে পাবে। প্রতিষ্ঠান সমাজের একটি অঙ্গ এবং এটা তার চারপাশে নিজের ভূমিকা ও অবদান প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে নিজের পূর্ণতা লাভ করে। তথাপি, একটি প্রতিষ্ঠান যত বেশি বড় হয় ও বাহ্যত সাফল্য লাভ করে, তত বেশি তার অভ্যন্তরীণ ঘটনাবলি একজন নির্বাহীর আগ্রহ, শক্তি ও সক্ষমতার সাথে জড়িত হয়ে পড়ে। ফলে তার প্রকৃত কাজ ও কার্যকারিতা বহির্বিভাগে হ্রাস পেয়ে যায়।

এই বিপদটি বর্তমানে আরও প্রকট আকার ধারণ করেছে কম্পিউটার ও তথ্য-প্রযুক্তির অগ্রগতির ফলে। কম্পিউটার, একটি যান্ত্রিক নির্বোধ বা গাধা হওয়ায়, কেবল পরিমাণযোগ্য ডেটা তথা তথ্য নিয়ে কাজ করতে পারে। এই তথ্যগুলো নিয়ে কম্পিউটার দ্রুতগতিতে, নির্ভুলভাবে ও যথার্থতা সহকারে কাজ করে। অতএব এটি বড় আয়তনের দুর্লভ পরিমাণযোগ্য ডেটাকে বিচূর্ণ করে। একজন ব্যক্তি, প্রসঙ্গক্রমে, সাধারণত কোম্পানির ভেতরে কী ঘটছে তার পরিমাপ করতে পারে—ব্যয় ও উৎপাদনের পরিমাণ, হাসপাতালে রোগীর পরিসংখ্যান বা প্রশিক্ষণ প্রতিবেদন। বাহিরের প্রাসঙ্গিক ঘটনাবলি কদাচিৎ পরিমাপযোগ্য আকৃতিতে পাওয়া যায় যতক্ষণ না এসব নিয়ে কিছু করার সুযোগ হাতছাড়া হয়।

এটা একারণে নয় যে, বাহিরের ঘটনাবলির অনুপাতে আমাদের তথ্য-সংগ্রহের সক্ষমতা কম্পিউটারের প্রযুক্তিগত সক্ষমতা থেকে পিছিয়ে আছে। চিন্তিত হওয়ার জন্য যদি কেবল এটাই একমাত্র কারণ হত, তবে আমরা আমাদের পরিসংখ্যানের কাজের মাত্রা বাড়িয়ে দিতাম এবং কম্পিউটার আমাদের এই যান্ত্রিক সীমাবদ্ধতা নিরসনে সহযোগী হতে পারত। কিন্তু সমস্যাটা হলো বাহিরের গুরুত্বপূর্ণ ও প্রাসঙ্গিক ঘটনাবলি প্রায়ই গুণগত মানসম্পন্ন (য়ঁধষরঃধঃরাব) হয়ে থাকে এবং তা পরিমাণযোগ্য (য়ঁধহঃরভরধনষব) নয়। তাছাড়া এসব কোন ‘ফ্যাক্ট তথা তথ্য’ নয় কারণ তথ্য হলো একটি ঘটনা যা কেউ চিহ্নিত ও সংজ্ঞায়িত করেছে এবং শ্রেণিবিভাজন করেছে। আর সবচেয়ে বড় কথা বক্তা ঐ ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে তার দিক থেকে প্রাসঙ্গিক বিষয় তুলে ধরে সমাপ্ত করেছে। পরিমাণযোগ্য হওয়ার জন্য কারো প্রথমে একটি ধারণা থাকা চাই। প্রথমে অসংখ্য সমস্যাবলি থেকে একটি বিমূর্ত দৃষ্টিভঙ্গি ও আদর্শ বের করে আনতে হবে। অতঃপর তা উল্লেখপূর্বক তালিকাভুক্ত করা হবে।

থ্যালিডোমাইড ট্র্যাজেডি (ঃযব ঃযধষরফড়সরফব ঃৎধমবফু) যা উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বিকৃত ও অঙ্গহীন সন্তান জন্ম নেওয়ার কারণ হয় তা এখানে উল্লেখযোগ্য একটি উদাহরণ হতে পারে। [থ্যালিডোমাইড ট্র্যাজেডি—১৯৫০-৬০ এর দশকে অন্তঃসত্ত্বা নারীদের ক্ষেত্রে থ্যালিডোমাইড নামক এক ধরনের ঔষধ ব্যবহার করা হতো। অনুমান করা হয় ১ লাখের মতো শিশু এর দ্বারা আক্রান্ত হয়।] তখন ইউরোপীয় মহাদেশে চিকিৎসকদের কাছে এই গবেষণার পরিসংখ্যান ছিল যে, জন্ম নেওয়া বিকৃত নবজাতকগুলো তাৎপযপূর্ণভাবে স্বাভাবিক নবজাতকদের চেয়ে অপেক্ষাকৃত বড় ছিল এবং এত বেশি বড় ছিল যে, তা একটি বিশেষ ও নতুন সমস্যারূপে চিহ্নিত হয়। ক্ষতি যা হওয়ার তা আগেই হয়। যুক্তরাষ্ট্রে, ক্ষতিটা রোধ করা সম্ভবপর হয়েছিল, কারণ একজন সরকারি চিকিৎসক গুণগত পরিবর্তন উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। তিনি দেখলেন যে ঔষধের কারণে ত্বকে ক্ষুদ্র ও অনুল্লেখ্য জ্বালা-পোড়া সৃষ্টি হয়। তিনি এর সাথে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি সমস্যা যা অনেক বছর আগে সৃষ্টি হয়েছিল তার মাঝে সামঞ্জস্য খুঁজে পান এবং থ্যালিডোমাইডের প্রকৃত ব্যবহার শুরু হওয়ার আগেই সতর্ক করে দেন।

‘ফোর্ড এডসেল’র অনুরূপ একটি অভিজ্ঞতা আছে। এডসেল নির্মাণ করার পূর্বে তার সম্ভাব্য সকল সংখ্যাগত পরিসংখ্যান তুলে ধরা হয়। এসবের ফলাফল ছিল এই যে, এটি (এডসেল) বর্তমান সময়ের বাজারের জন্য একদম উপযুক্ত গাড়ি। আমেরিকান গ্রাহকদের মধ্যে যে গুণগত পরিবর্তন (য়ঁধষরঃধঃরাব পযধহমব) ঘটেছে—মটরগাড়ি ক্রয়ের মনোভাব আয়-নির্ভর চাহিদা থেকে রুচি-নির্ভর চাহিদার দিকে ঝুঁকে পড়েছে (ভৎড়স রহপড়সব-ফবঃবৎসরহফবফ ঃড় ঃধংঃব-ফবঃবৎসরহবফ)—তা কোন পরিসংখ্যানমূলক গবেষণা উপস্থাপন করতে পারেনি। এটা তথ্যে পরিমাপ করতে, সংখ্যা দিয়ে বুঝতে বুঝতে এত সময় লেগেছে যে তত দিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে—এডসেল গাড়ি বাজারে চলে এসেছে এবং বিরাট ক্ষতির সম্মুখীন হয়।

 

[চিত্র: ১৯৫৮ সালে ফোর্ড কোম্পানি নির্মিত এডসেল গাড়ি।]


বাহিরের প্রকৃত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা মানুষের প্রবণতা বা সামাজিক ঝোঁক (ঃৎবহফং) নয়। বরং তা হলো সামাজিক ঝোঁকের মধ্যকার পরিবর্তন (পযধহমবং রহ ঃযব ঃৎবহফং)। এসব নির্ধারকগুলোই চূড়ান্তভাবে কোন প্রতিষ্ঠান ও তার শ্রমের সফলতা কিংবা ব্যর্থতা নির্ধারণ করে। এমন পরিবর্তনগুলোকে হৃদয়ঙ্গম বা উপলব্ধি করতে হবে। এগুলোকে কেবল তথ্যে ভিত্তিতে গণনা, নির্ধারণ কিংবা শ্রেণিভাগ কোনটাই করা যায় না। শ্রেণিভাগ করলে হয়তো কাক্সিক্ষত আকার বা পরিসংখ্যানে প্রকাশ করতে পারেন। যেভাবে এডসেল গাড়ির ক্ষেত্রে দেখা যায়। কিন্তু এই পরিসংখ্যান কখনো প্রকৃত আচরণের সাথে মেলে না।

কম্পিউটার একটি যুক্তি ও সূত্র নির্ভর যন্ত্র। এই দিকটা যেমন এটার শক্তিশালী দিক, তেমন অন্যদিকে এটার সীমাবদ্ধতাও আছে। প্রতিষ্ঠানের বাইরে কী ঘটছে তার প্রতিবেদন ফাইল আকারে কম্পিউটারে ইনপুট দেয়া যাবে না। ফাইল দেখে, তথ্য দেখে কম্পিউটার বা অন্য কোনো যুক্তিনির্ভর যন্ত্র যেমন সিদ্ধান্ত নিতে পারে তেমন প্রতিষ্ঠানের বাইরে যেসব ঘটনাবলি ঘটে তাকে ফাইল বন্দি করা যায় না। এদিক থেকে মানুষের কথা যদি বলি, মানুষ নিজেও পুরোপুরি যুক্তিনির্ভর প্রাণী নয়। মানুষের যে আবেগ-অনুভূতি, উপলব্ধিসম্পন্ন জ্ঞান আছে—এটাই মানুষের শক্তিশালী দিক।

বিপদের বিষয় হলো নির্বাহীগণ তথ্য ও উদ্দীপনা-অনুপ্রেরণার প্রতি অবহেলা প্রদর্শন করে কম্পিউটারের লজিক এবং কম্পিউটারের ভাষার উপযোগী করে পেশ করা সম্ভব হয় না। একজন নির্বাহী হয়তো ঘটনা কেন ঘটে তার অনুভব-অনুভূতির প্রতি অন্ধ থাকতে পারেন এবং ঘটনা ঘটার পরে তথ্য আকারে যা এলো তার ব্যাপারে জানতে পারেন। বর্তমানে যে একজন নির্বাহীকে প্রচুর পরিমাণে কম্পিউটার তথ্য দেখতে হয়, এত তথ্যের ভিড়ে তিনি প্রকৃত ঘটনাই দেখতে পান না। তথ্যের এ বন্যা তাকে প্রকৃত ঘটনা দেখতে বাধা দেয়।

যদিও কম্পিউটার একটি সম্ভাবনাময় এবং কাজের যন্ত্র তবুও একজন নির্বাহীকে এর সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে এবং নিজেকে তথ্যের এ বন্যা থেকে মুক্ত করে বেশি বেশি বাহিরের দিকে মনোযোগ দিতে হবে। কম্পিউটারের প্রতি অতি মাত্রায় নির্ভর হলে দেখা যাবে ‘কম্পিউটারিস্ট তথা কম্পিউটার রোগ’ হচ্ছে। আর তা সত্যিই দুর্ভাগ্যের বিষয়।

কম্পিউটার কেবল এমন এক অবস্থাকে দেখায় যা অতীতে ঘটেছিল। [কারণ অতীত থেকেই তো আপনি তথ্য নিয়েছেন এবং সেই তথ্য কম্পিউটারে দিয়েছেন। আর সেই তথ্যে ভিত্তিতেই কম্পিউটার আপনাকে অতীতে কী ঘটেছিল তা আরও পরিষ্কারভাবে দেখায়।] একজন কার্যনির্বাহীর বসবাস এবং কাজ হচ্ছে তার প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরে। প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরে সে বাস করে। যতক্ষণ না তারা বাহিরের অবস্থা আন্দাজ করতে নিজে থেকে তৎপর হয়, ততক্ষণ ভেতরের অবস্থা তাদেরকে বাহিরের অবস্থা, প্রকৃত বাস্তবতা দেখতে বাধা দেয়, তাকে অন্ধ করে রাখে।

এই চারটি বাস্তবতার জন্য একজন নির্বাহী পরিবর্তিত হতে পারে না। আবার এই চারটি বিষয়ই তার অস্তিত্বের জন্য প্রয়োজনীয় শর্ত। তবে তাকে অবশ্যই মনে করতে হবে যে, যদি না সে কার্যকারিতা শেখার ব্যাপারে তৎপর হয়, সে অকার্যকর হয়ে পড়বে।


কার্যকারিতার অঙ্গীকার


ক্রমবর্ধমান কার্যকারিতা বৃদ্ধি করা—হতে পারে একমাত্র ক্ষেত্র যাতে আমরা তাৎপর্যপূর্ণভাবে একজন নির্বাহীর কর্মদক্ষতা, অর্জন ও সন্তুষ্টির মাত্রা বৃদ্ধির আশা রাখতে পারি।

আমরা নিশ্চিতভাবে অনেক বেশি কর্মদক্ষ মানুষকে অনেক জায়গায় বসাতে পারি। আমরা অত্যধিক জ্ঞানসম্পন্ন মানুষকে কাজে লাগাতে পারি। প্রসঙ্গত আমি স্বীকার করি যে, এই দুটি জায়গাতেই অনেক বেশি চেষ্টা করেও কোনো ফলাফল আশা করা যায় না। হয়তো আমরা যে দিকে অগ্রসর হচ্ছি সেখানে আমরা ইতোমধ্যে অসম্ভব বা অন্তত অলাভজনক কাজ করে যাচ্ছি। তবে আমরা সুপারম্যান তথা অতিমানব জাতীয় কোনো প্রজাতি জন্ম দিতে যাচ্ছি না। আমাদের প্রতিষ্ঠানকে আমাদের যে জনবল আছে, যেরকম মানুষজন আছে তা দিয়েই প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানি চালাতে হবে।

ব্যবস্থাপকদের কর্মদক্ষতা বৃদ্ধিতে লিখিত নানা বই রয়েছে। তাদের প্রত্যেকের চিন্তায় ‘ভবিষ্যতের ম্যানেজার’ হবে ‘সব কাজে কাজী’। একজন সিনিয়র কার্যনির্বাহীর ব্যাপারে বলতে গেলে বলতে হয়, তার সম্পর্কে আমাদের বলা হয়, একজন অসাধারণ বিশ্লেষক এবং সিদ্ধান্ত-গ্রহণকারী হতে হবে। মানুষের সাথে কাজ করার ক্ষেত্রে তার দক্ষ হওয়া উচিত এবং প্রতিষ্ঠানকে বোঝার ক্ষেত্রে ও কর্মীদের মধ্যকার সম্পর্কের শক্তি সম্বন্ধে পারদর্শী হওয়া চাই। তার গণিতে দক্ষ হতে হবে ও শৈল্পিক অন্তর্দৃষ্টি এবং সৃষ্টিশীল মনোভাব থাকা প্রয়োজন। প্রত্যাশা করা হয় সর্বজনীন প্রতিভা। আর সর্বজনীন প্রতিভা সবসময়ই বিরল। মানবজাতির অভিজ্ঞতা থেকে পাওয়া যায়, মানবজাতির মধ্যে সবচেয়ে বেশি যে ধরনের মানুষ যাওয়া যায় তা হচ্ছে অপরিপক্কতা, অদক্ষতায় ভরপুর মানুষ। একে বলা যেতে পারে সর্বজনীন অপরিপক্কতা ও অদক্ষতায় পূর্ণ মানুষ। অতএব এতক্ষণ আমরা একজন সিনিয়র কার্যনির্বাহীর যেসব গুণ থাকা দরকার বলে আরোপ করেছি, তা সবার মধ্যে পাওয়া যাবে খুব কম—এ ব্যাপারে আমরা নিশ্চিত। তাই আমাদেরকে এমন এমন কর্মীদের কোম্পানিতে যোগ করতে হবে যারা এসব গুণের যেকোন একটির অধিকারী। সে হবে উল্লেখিত দক্ষতাগুলোর যে কোনটিতে সর্বোচ্চ পারদর্শী ব্যক্তি। আর এভাবে কর্মী নিয়োগ করলে প্রতিষ্ঠানে কোনো গুণের অভাব ঘটবে না এবং এরা একে অন্যের প্রতিভার প্রতি সর্বাধিক বিনয়ী থাকবে।

আমাদেরকে যেকোনো কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠানকে এমন এক পদ্ধতিতে প্রতিষ্ঠা করা শিখতে হবে যে, যেকোনো ব্যক্তি যার কোন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে দক্ষতা আছে সে যেন উক্ত দক্ষতাকে কাজে লাগাতে পারে। (এ ব্যাপারে চতুর্থ অধ্যায়ে বিশদভাবে আলোচিত হবে।) তবে দক্ষতার মানদ- নির্ধারণের মাধ্যমে আমরা নির্বাহীর প্রয়োজনীয় কর্মদক্ষতা নাও পেতে পারি। সর্বজনীন প্রতিভাধর ব্যক্তির দেখা পাওয়া তো দূরের কথা। হঠাৎ একদিন মানুষের কর্মদক্ষতায় আকস্মিক কোনো বিরাট পরিবর্তন ঘটবে এমনটা আশা করা আমাদের উচিত নয়; বরং আমাদের আশেপাশে যেসব প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি আছে তাকে দিয়ে মানুষের কর্মদক্ষতার পরিধিকে বাড়াতে হবে।

একই কথা, জ্ঞানের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। প্রসঙ্গত, আমাদের অত্যধিক ও উপযুক্ত জ্ঞানসম্পন্ন জনবল প্রয়োজন। উল্লেখযোগ্য উন্নতি সাধনের জন্য প্রয়োজনীয় প্রচেষ্টাকে হয়তো বেশি বৃদ্ধি করা যাবে যদি আমরা আমাদের আশেপাশের যেসব প্রয়োজনীয় জ্ঞান ও পদ্ধতি আছে তাকে দিয়ে চেষ্টা করি।

পনেরো বছর আগে যখন ‘অপারেশন রিসার্চ’ (ব্যবস্থাপনা বিভাগগুলোর সমস্যা সমাধান ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিশ্লেষণমূলক প্রক্রিয়া) এর উদ্ভব হয়, একদল মেধাবী চর্চাকারী বা অনুশীলনকারী ‘ভবিষ্যতের অপারেশন রিসার্চারদের’ জন্য একটি দিক-নির্দেশনা পত্র প্রকাশ করে। [‘ভবিষ্যতের অপারেশন রিসার্চারদের’ জন্য মানে ভবিষ্যতে একজন কার্যকর ও সফল অপারেশন রিসার্চার হতে প্রয়োজনীয় যেসব গুণের দরকার তার দিক-নির্দেশনা পত্র প্রকাশ করে]। তারা সবসময় একজন বহুবিদ্যাজ্ঞ এর কামনা করেছে যে সবকিছু জানে ও মানব-জ্ঞানের সকল শাখায় অত্যন্ত পারঙ্গমতার সঙ্গে কাজ করতে সক্ষম। এই গবেষণা কর্ম অনুসারে, একজন অপারেশন রিসার্চারকে বাষট্টি (৬২টি) বা তার অধিক বিজ্ঞান ও মানবিক বিষয়ের উপর অগাধ জ্ঞান থাকতে হবে। যদি এমন ব্যক্তির দেখা মিলে, আমার মনে হয় সে হয়তো গুদাম ঘরের পণ তালিকা তৈরি বা পণ্য উৎপাদন প্রক্রিয়ার ওপর পর্যবেক্ষণ চালাতে ব্যর্থ হবে।

ব্যবস্থাপকদের কর্মদক্ষতা বৃদ্ধিতে একটু কম উচ্চাভিলাষী প্রোগ্রামের কথা যদি আমরা চিন্তা করি, তবে দেখব, সেখানেও একজন বহুকর্মে দক্ষ ব্যক্তির আশা করা হচ্ছে। যেমন এ ধরনের ব্যবস্থাপকদের কর্মদক্ষতা বৃদ্ধির প্রশিক্ষণে থাকে হিসাববিজ্ঞান, মার্কেটিং, মূল্য-নির্ধারণ ও অর্থনীতির বিশ্লেষণ, আচরণগণ বিজ্ঞান: যেমন মনোবিজ্ঞান, এবং প্রাকৃতিক বিজ্ঞান: যেমন পদার্থবিজ্ঞান থেকে নিয়ে জীববিজ্ঞান ও ভূগোল ইত্যাদি পর্যন্ত। আর আমরা এমন মানুষেরও প্রয়োজনীয়তা অনুভব করি যে আধুনিক প্রযুক্তির গতিবিধিকে বুঝতে পারে, আধুনিক বিশ^ অর্থনীতির জটিলতাকে অনুধাবন করতে পারে এবং আধুনিক সরকারের গোলক ধাঁধাকে ধরতে পারে।

এসবের প্রতিটি একেকটি বৃহৎ জায়গাজুড়ে বিস্তৃত, এমনকি সে মানুষের জন্যও যে ¯্রফে এবং ¯্রফে একটি বিষয় নিয়ে কাজ করে। আজকালকার প-িতগণও এসব ক্ষেত্রের ছোট্ট একটি শাখা বা উপশাখা নিয়ে বিশেষত্ব লাভের প্রতি মনোযোগী এবং সংশ্লিষ্ট শাখায় নিজেকে একজন অভিযাত্রী হিসাবে দাবি করে এবং এসব ব্যাপারে কোনো অতিজ্ঞানী হওয়ার ভানও করেন না। [বিজ্ঞানী আইজ্যাক নিউটন এজন্যই বলেন, পৃথিবীর এই বিপুল জ্ঞানভা-ারকে জানার ক্ষেত্রে আমি সাগরের তীরে দাঁড়িয়ে থাকা এক শিশুর মতো, যে শুধু সারাজীবন নুড়িই কুড়িয়ে গেল। সমুদ্রের জলরাশির মতো বিশাল এই জ্ঞান আমার অজানাই থেকে গেল।]

আমি এটা বলতে চাচ্ছি না যে, একজন ব্যক্তির এসব শাখার মৌলিক জ্ঞানটুকু রাখা যাবে না।

বর্তমান সময়ের তরুণ, উচ্চ শিক্ষিত (তা হোক সে ব্যবসা, চিকিৎসা বা সরকারি পর্যায়ে) ব্যক্তিদের দুর্বলতাসমূহের একটি হলো তারা একটি সংকীর্ণ বিষয়ে বিশেষত্ব লাভ করে সন্তুষ্ট থাকে এবং অন্য সকল শাখার প্রতি বিরূপ মনোভাব পোষণ করে। একজন ব্যক্তি যে কিনা হিসাবরক্ষক তার বিশদভাবে ‘মানব সম্পর্কের কী কী ধরন’ তা সম্পর্কে জানার প্রয়োজন নেই অথবা একজন প্রকৌশলীর এটা জানার দরকার নেই যে একটি নতুন পণ্যের প্রচারণা কীভাবে চালাতে হবে। তবে একজন ব্যক্তির অন্তত এটুকু জানার দায়বদ্ধতা আছে যে, এই শাখাগুলো কী, কেন এগুলোর অস্তিত্ব এবং কোম্পানি এগুলো দ্বারা কী করতে চাচ্ছে। একজন ব্যক্তির ইউরোলজি তথা মূত্রব্যবস্থা বিজ্ঞানে দক্ষ হওয়ার জন্য মনোরোগ সম্পর্কে জানার প্রয়োজন নেই। তবে তার জানা উচিত সাইকিয়াট্রি তথা মনোরোগ বিষয়টি আসলে কী। কৃষি বিভাগে ভালো একটি চাকরি লাভের জন্য কারো আন্তর্জাতিক আইনজ্ঞ হতে হবে না। তবে তার আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিষয়ে পর্যাপ্ত পরিমাণ জানাশোনা থাকা চাই, যাতে করে ক্ষুদ্র কোন খামার নীতির মাধ্যমে সে আন্তর্জাতিক ক্ষতি করে না বসে।

যাহোক, এই বিষয়টি সর্বজনীন বা সর্ব বিষয়ে দক্ষ ব্যক্তি, যা সর্ব বিষয়ে প্রতিভাধর ব্যক্তির মতো অস্তিত্বহীন, তা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। আমাদের জানতে হবে কীভাবে একজন ব্যক্তি যে বিষয়ে দক্ষ তাতে সে ব্যক্তিকে সর্বোচ্চ কার্যকর উপায়ে ব্যবহার করা যায়। এর অর্থ হলো ক্রমবর্ধমান কার্যকারিতা। যদি কেউ তার উপাদানের বা যোগানের সরবরাহ বাড়াতে না পারে, তবে তাকে অবশ্যই তার উৎপাদিত বস্তুর গুণগত মান বাড়াতে হবে। আর কার্যকারিতা এমন একটি যন্ত্র যা জ্ঞান ও দক্ষতা থেকে আরও বেশি ও উত্তম ফলাফল বের করে আনে।

প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনের স্বার্থেই কার্যকারিতা এভাবে উচ্চমাত্রার অগ্রাধিকারের বিষয়ে পরিণত হয়েছে। এটা আরও বেশি অগ্রাধিকার লাভ করে যেহেতু এটা একজন পরিচালকের হাতিয়ার এবং তার কার্যসম্পাদন ও অর্জনের প্রবেশপথ।


তবে কার্যকরী হওয়া কি শেখা যায়?


যদি কার্যকারিতা কোন প্রতিভা হয় যা সহকারে এজন মানুষ জন্মগ্রহণ করে, যেভাবে একজন মানুষের জন্মের সময় গানের গলা থাকে, ছবি আঁকার মতো চোখ থাকে, তবে আমরা একটু সংকটেই পড়ে যেতাম। কারণ আমরা জানি এই জগৎসংসারে অতি অল্প মানুষই অসাধারণ প্রতিভা নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। অতএব শুরুতেই আমাদের অত্যধিক কার্যকারিতার যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তি খোঁজা উচিত নয়। আর যাদেরকে পাওয়া যায় তাদেরকে সর্বোচ্চ উপায়ে প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের মেধা ও প্রতিভাবে বিকশিত করার সুুযোগ করে দিতে হবে। আর যদি আমরা জন্মগত প্রতিভার আশায় বসে থাকি তবে আধুনিক সমাজ বা প্রতিষ্ঠানের জন্য খুব কম সংখ্যকই কার্যনির্বাহী পাব। এতে করে নির্ঘাতভাবে বর্তমান সভ্যতা বিপদে পড়বে। কারণ কাজ অনেক, সমাজে প্রতিষ্ঠান অনেক, কিন্তু জন্মগত প্রতিভাবান কার্যনির্বাহীর সংখ্যা সেই তুলনায় নগণ্য। তাই বলতে হচ্ছে, কার্যকারিতা যদি কোনো জন্মগত প্রতিভা বা মেধা হত, তবে আমাদের বেশ বিপদেই পড়তে হত। দেখা যেত বড় বড় সমাজে বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলো ঠিকভাবে কার্যকর হয়ে উঠতে পারছে না কেবল কার্যকর কার্যনির্বাহীর অভাবে।

আর যদি কার্যকারিতা শেখা যায়, প্রসঙ্গত, প্রশ্ন আসে যে, এতে কী কী আছে? ব্যক্তিকে কী শিখতে হবে? শেখার ধরন কী রকম? এটি কি এমন জ্ঞান—যে জ্ঞান একটি নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতি ও তত্ত্ব দ্বারা শেখা যায়? এটা কি এমন একটি দক্ষতা যা একজন ব্যক্তি শিক্ষানবীশ হিসাবে শেখে? অথবা এটা কি এমন কোন অভ্যাস বা অনুশীলন যা একজন ব্যক্তি কোন কাজকে বারবার করার মাধ্যমে অর্জন করে থাকে?

আমি এই প্রশ্নগুলো অনেক বছর ধরে করে আসছি। একজন পরামর্শক হিসাবে, আমি অনেক প্রতিষ্ঠানের কার্যনির্বাহী তথা পরিচালকের সাথে কাজ করেছি। কার্যকারিতা আমার কাছে দুটি কারণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

প্রথমত, একজন পরামর্শক যার পরিচয় অনুযায়ী জ্ঞান ছাড়া অন্য কোনোভাবে কর্তৃত্বের সুযোগ নেই, তার অবশ্যই কার্যকরী হতে হবে, অন্যথায় সে কিছুই না।

দ্বিতীয়ত, সর্বাধিক কার্যকর পরামর্শককে কোনো কিছু বাস্তবায়ন করার জন্য তার সেবা গ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানের মানুষের উপর নির্ভর করতে হয়। তাদের কার্যকারিতা, অতএব, নির্ধারিত হয় সর্বশেষ বিশ্লেষণে যে পরামর্শক আদৌ কোন ভূমিকা রেখেছে কিনা এবং সাফল্য অর্জন করতে পেরেছে কিনা; নাকি সে সম্পূর্ণ ‘লস প্রজেক্ট’ বা খরচের একটা অতিরিক্ত জায়গায় পরিণত হয়েছে অথবা একটা ভাঁড় মাত্র।

পরামর্শক হিসাবে কাজ করতে গিয়ে আমি শীঘ্রই বুঝতে পারলাম যে, ‘ইফেক্টিভ পারসোনালিটি (বভভবপঃরাব ঢ়বৎংড়হধষরঃু) তথা কার্যকর ব্যক্তিত্ব’  বলতে কিছু নেই। আমার যেসব নির্বাহীদের সাথে সাক্ষাৎ হয়েছে তারা একে অপর থেকে স্বভাব ও সক্ষমতায়, তারা যা করে ও যেভাবে করে, তাদের ব্যক্তিত্ব, জ্ঞান ও আগ্রহে সম্পূর্ণরূপে ভিন্ন—এক কথায় মানুষকে যা কিছু অন্যদের থেকে ভিন্ন করে তোলে তার সবদিক থেকেই তারা ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তিত্ব। তবে একটি বিষয়ে তারা সবাই এক। তা হলো সঠিক কাজকে সঠিকভাবে সম্পাদন করা এবং করিয়ে নেওয়া।

যে সকল নির্বাহীদের আমি জানি এবং যাদের সাথে আমি দীর্ঘদিন কাজ করেছি তারা ভিন্ন ভিন্ন প্রকৃতির হয়ে থাকে। তারা বহুর্মুখী, অন্তর্মুখী, নির্লিপ্ত বা মারাত্মক লজ্জাপ্রবণ হয়ে থাকে। কিছু আছে স্থুলকায়, তো কিছু কৃশকায়, কিছু আছে পেরেশান ও উদ্বিগ্ন আর কিছু আছে নিরুদ্বেগ। কেউ কেউ প্রচ- মদ্যপান করে, আবার কারো কাছে মদ দুচোখের বিষ। কিছু আছে যারা সবাইকে মাতিয়ে রাখে, প্রাণবন্ত, অন্যদিকে কারো কারো ব্যক্তিত্ব হীম হয়ে থাকা ম্যাকেরেলের (এক ধরনের সামুদ্রিক মাছ) মতো। নির্বাহীদের কারো কারো অবয়ব ও ব্যক্তিত্ব সত্যিকার “নেতার” মতো। তবে তাদের সবাই গণমাধ্যম বা জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে আগ্রহী নয়। তারা সবাই আত্মপ্রচারণা পছন্দ করে না। কেউ কেউ আছে বিজ্ঞ ও জ্ঞানী, জ্ঞানের প্রতি আছে প্রবল আকর্ষণ, আবার অনেকে আছে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বহির্ভূত। অনেকে জ্ঞানের প্রতি গভীর আগ্রহ লালন করে, আবার অনেকে আছে যারা নিজের পেশার সংক্ষিপ্ত জ্ঞান ছাড়া আর কিছুই জানে না এবং এতে তাদের মাথাব্যথাও নেই। তাদের অনেকে আত্মকেন্দ্রিক, যদিও প্রকৃতপক্ষে স্বার্থপর নয়। তবে তাদের অনেকেই আছে যারা মানসিকতা ও আচরণে উদার। অনেকে আছে যারা কেবল তাদের কাজ নিয়েই ব্যতিব্যস্ত, অন্যদিকে অনেকে আছে যাদের আগ্রহ বাহ্যিক বিষয়ে—সামাজিক কাজে, উপাসনালয়ে বা চিনা কবিতা চর্চায় কিংবা আধুনিক গানে। আমার দেখা নির্বাহীদের কেউ কেউ যুক্তি-বিশ্লেষণ ইত্যাদির আলোকে কাজ করে, আর কেউ কেউ প্রধানত নির্ভর করে তাদের উপলব্ধি ও অন্তর্দৃষ্টির উপর। অনেকে আছে যারা সহজে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে। অন্যদিকে অনেকের যখনই কোন পদক্ষেপ নিতে যায় তাদের বেশ বেগ পেতে হয়।


 

[চিত্র: বরফে হীম হয়ে যাওয়া সামদ্রিক ম্যাকেরেল মাছ।]


এক কথায় বলতে গেলে বলতে হয়, কার্যকরী নির্বাহীগণ একে অপর থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির হয়ে থাকে, যেভাবে একে অপর থেকে ভিন্ন হয়ে থাকে চিকিৎসক, স্কুল শিক্ষক বা বাদ্যবাদকরা। নিষ্ফল ও অকার্যকর ব্যক্তিরা যেমন তাদের ব্যক্তিত্ব ও চরিত্রের বিভিন্ন দিক দিয়ে ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে ঠিক তেমন কার্যকর নির্বাহীরাও ব্যক্তিত্ব, চারিত্রিক ধরন ও মেধার দিক থেকে পরস্পর ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে।

কার্যকর নির্বাহী তথা পরিচালকদের মাঝে একটি বিষয় সাধারণ এবং সবার মাঝে পরিলক্ষিত, তা হলো তাদের অভ্যাস বা চর্চা যা তাদের কার্যকর প্রমাণিত করে, তাদের পরিচয় ও যোগ্যতা যেরকমই হোক না কেন। আর এসব অভ্যাস বা চর্চায় কার্যকর নির্বাহীরা পারদর্শী। হোক তারা কোনো ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে, সরকারি দপ্তরে, হাসপাতালে বা বিশ^বিদ্যালয়ের প্রধান হিসাবে। সব জায়গাতেই তারা এসব অভ্যাস বা চর্চা বজায় রেখেছে।

প্রসঙ্গক্রমে, আমি অনেককে দেখেছি যারা তাদের জ্ঞান, চিন্তা, পরিশ্রম ও বুদ্ধিমত্তায় অনন্য ও অসাধারণ, কিন্তু তারা যখন এই অভ্যাস বা চর্চাগুলোকে বুঝতে ব্যর্থ হয়, তখন তারা তাদের কার্যকারিতা ধরে রাখতে পারে না।

কার্যকারিতা, ভিন্নভাবে বললে, এটা একটা অভ্যাস; অর্থাৎ অনেক ধরনের চর্চার সমন্বয়। আর চর্চার ব্যাপারটা তো সবসময়ই শেখা যায়। কারণ চর্চা বিষয়টা সাধারণত সহজ হয়ে থাকে। অবশ্য বাহ্যত তাই মনে হয়; এমনকি একজন সাতবছরের বাচ্চারও অনুশীলন বা চর্চা করার ব্যাপারটা বুঝতে সমস্যা হয় না। তবে কাজে দক্ষ ও শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করা অত্যন্ত কঠিন। তা অর্জন করে নিতে হয়, যেভাবে আমরা গুণের নামতা শিখি; অর্থাৎ, বিরক্তিকরভাবে তা পুনরাবৃত হতে থাকে, ৬ ী ৬ = ৩৬। এই নামতা ততক্ষণ ধরে পড়ে যেতে হবে যতক্ষণ পর্যন্ত না এটা গুণ করার সময় চিন্তা করা ছাড়াই, স্বতঃস্ফূর্তভাবে চলে আসে এবং একটি দৃঢ় ও বদ্ধমূল অভ্যাসে পরিণত হয়। অনুশীলন বা চর্চার ব্যাপারটা বারবার করার মাধ্যমে যেকেউ শিখতে পারে। বারবার অনুশীলন করতে হয়, প্রতিনিয়ত অনুশীলন করার মাধ্যমে অভ্যাসে পরিণত করতে হয়।

আমার পিয়ানো শিক্ষক ছোটবেলায় রাগ করে আমাকে একটি কথা বলেছিলেন। ‘তুমি কখনো আর্থার স্কেনাবেলের মতো করে মোজার্ট সংগীত বাজাতে পারবে না, কিন্তু সে যেমন নিজের মতো করে নিজের সবটুকু দিয়ে সংগীত চর্চা করত, তুমিও ঠিক তেমনভাবে নিজের সবটুকু দিয়ে চর্চা করতে পারো।’ পিয়ানো শিক্ষক যা যোগ করতে ভুলে গেছেন তা হলো—সম্ভবত এটি তার কাছে স্পষ্ট ছিল যে সর্বশ্রেষ্ঠ পিয়ানো বাদকও উৎকৃষ্ট পন্থায় পিয়ানো বাজাতে সক্ষম নয় যদি না তারা নিজেদের সংগীত চর্চার প্রতিনিয়ত অনুশীলন করে এবং তাদের এ চর্চা বহু বছর ধরে অব্যাহত রাখে।


 

[চিত্র: আর্থার স্কেনাবেল পিয়ানো বাজাচ্ছেন।]


ভিন্নভাবে বললে, যেকোনো সাধারণ ব্যক্তি তার স্বাভাবিক গুণাবলি নিয়ে যেকোনো চর্চায় উৎকর্ষ অর্জন করতে পারবে না—তা বলা যায় না। মহান বা সর্বশ্রেষ্ঠ হওয়ার ব্যাপারটা হয়তো তাকে মোহাবিষ্ট করে রাখতে পারে। কারণ মহান বা সর্বশ্রেষ্ঠ হতে গেলে আসলে প্রতিভার দরকার। কিন্তু তাই বলে শ্রেষ্ঠ হওয়া যাবে না—তা তো কোথাও বলা নেই। যেহেতু কার্যকারিতা হচ্ছে একটি দক্ষতা, তাই অন্য যেকোনো দক্ষতার মতো কার্যকারিতাসম্পন্ন ব্যক্তি হওয়ার বিষয় শেখা যায়। আপনার যা দরকার তা হলো ‘স্কেল বা মাপকাঠি’।

এ ধরনের পাঁচটি অনুশীলন মানে পাঁচটি অভ্যাসের কথা নি¤েœ দেয়া হলো যা একজন কার্যকর নির্বাহী হওয়ার জন্য অত্যাবশ্যক:

১. কার্যকর নির্বাহীগণ জানে কোথায় তাদের সময় ব্যয় হয়। যদিও তাদের নিজেদের আয়ত্তে নিজের বলে সময় খুব কম থাকে, তবুও তারা সেই সময়কে পদ্ধতিগতভাবে বা নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে সাজিয়ে নেয়। [নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে আপনার সময়কে সাজিয়ে নিতে পড়–ন বই: টাইম ম্যানেজমেন্ট। মূল: ব্রায়ান ট্রেসি। অনুবাদ: মোহাম্মদ রাশেদুল হক ও ফজলে রাব্বি। ঢাকা, সাফল্য প্রকাশনী, ২০২০।]

২. কার্যকর পরিচালকগণ বাহ্যিক অবদানের উপর গুরুত্বারোপ করে। তারা কাজের চেয়ে ফলাফল লাভের উপর তাদের প্রচেষ্টাকে বেশি ব্যয় করে। তারা এই প্রশ্নের মাধ্যমে শুরু করে যে, ‘আমার কাছে কী ধরনের ফলাফল প্রত্যাশা করা হয়?’ কী কাজ করতে হবে তার পরিবর্তে ফলাফলের উপর তারা বেশি মনোযোগ দেয়, কাজের কৌশল ও হাতিয়ার তো অনেক দূরের বিষয়।

৩. কার্যকর নির্বাহীগণের বুনিয়াদ হলো তাদের দক্ষতা ও শক্তিশালী দিক, তাদের জেষ্ঠ্যদের, সহকর্মীদের ও অধস্তনদের দক্ষতা ও শক্তিশালী দিক। তেমনিভাবে তারা নির্ভর করে পরিস্থিতি অনুযায়ী অর্জিত শক্তির উপর, তথা তারা কী করতে পারবে। তাদের বুনিয়াদ দুর্বলতা বা অযোগ্যতার উপর নয়। তারা যা করতে পারে না এমন বস্তু দিয়ে কাজের সূচনা করে না।

৪. কার্যকর নির্বাহীগণ গুটিকয়েক প্রধান বিষয়ের উপর তাদের মনোযোগ নিবদ্ধ করে যেখানে সর্বোচ্চ শ্রম ব্যয় করলে অসাধারণ ফলাফল লাভ করা যায়। তারা অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত কাজ নির্ধারণে নিজেদের বাধ্য করে এবং পরবর্তীতে অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত কাজে নিজেদের ব্যস্ত করে। তারা জানে ‘প্রথম কাজ প্রথমে করতে হবে’ (ফড় ভরৎংঃ ঃযরহমং ভরৎংঃ), এ ছাড়া অন্য কোন বিকল্প তাদের হাতে নেই এবং কোনোভাবেই দ্বিতীয় কাজটি প্রথমে করে না। ‘প্রথম কাজ প্রথমে করতে হবে’ এবং তারা সবসময় তাই করে। এর বিকল্প হলো কোন কাজই না করা।

৫. সর্বশেষ, কার্যকর নির্বাহীগণ কার্যকর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে থাকে। তারা জানে যে, সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণের এটা একটা প্রক্রিয়া। তারা জানে যে, একটি কার্যকর পদক্ষেপ নিতে গেলে বিচারবিবেচনা করতে হয়। এটার ভিত্তি হতে হয় ‘ভিন্নমত পোষণকারী বিভিন্ন মতামত’ থেকে বিচারবিবেচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানে কাজে লাগবে—এমন কোন সমাধান বেছে নেয়া। ঘটনা বা তথ্যের ভিত্তিতে সবাই একমত হওয়ার চেয়ে ‘ভিন্নমত পোষণকারী বিভিন্ন মতামত’ থেকে বিচারবিবেচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানে কাজে লাগবে—এমন কোন সমাধান বেছে নেয়া দরকার। এটাই কার্যকর সিদ্ধান্ত গ্রহণের বুনিয়াদ। তারা এও জানে যে, দ্রুত অনেক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার মানে হলো ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণ। যেটা দরকার তা হলো অল্প কিছু মৌলিক সিদ্ধান্ত। যেটা প্রয়োজন তা হলো চটকদার কৌশলের পরিবর্তে একটি উপযুক্ত পরিকল্পনা।

এগুলোই হলো একজন কার্যকর ও সফল কার্যনির্বাহীর প্রয়োজনীয় উপাদান। আর এগুলোই হলো এ বইয়ের বিষয়বস্তু।



 




অধ্যায় ২


নিজের সময়কে জানুন / সময় জ্ঞান


অধিকাংশ কার্যনির্বাহীর কাজের আলোচনা শুরু হয় কাজের পরিকল্পনার উপদেশ প্রদানের মাধ্যমে। স্পষ্টত একে ন্যায়সঙ্গত মনে হতে পারে। এর মাঝে ভুল যেটা তা হলো এটা কদাচিৎ সফল হয়। পরিকল্পনাটা সবসময় কাগজে থেকে যায়, সদিচ্ছা হিসাবে থেকে যায়। খুব কম সময়ই তা সাফল্যের মুখ দেখে।

দক্ষ কার্যনির্বাহীগণ, আমার পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, তাদের কাজ দিয়ে আরম্ভ করে না। তারা তাদের সময় দিয়ে যাত্রা শুরু করে। আর তারা শুরুতেই পরিকল্পনা করে বসে না। বরং প্রথমে খুঁজে বের করে কোন খাতে তাদের সময় ব্যয় হবে। অতঃপর তারা তাদের সময়কে সাজানোর চেষ্টা করে এবং সময় নষ্ট হওয়ার পথ বন্ধ করে দেয়। সবশেষে তারা তাদের বিবেচনাকৃত মোক্ষম সময়কে একটি বৃহৎ চলমান ইউনিটে রূপ দান করে। এই তিন-স্তরবিশিষ্ট প্রক্রিয়া (ৎবপড়ৎফরহম ঃরসব, সধহধমরহম ঃরসব, ধহফ পড়হংড়ষরফধঃরহম ঃরসব):

ক্স সময়ের রেকর্ড করা (কখন কী কাজ করছেন তা রেকর্ড করা, কখন কী করবেন তা নয়। বর্তমানে কখন কী কাজ করছেন তা রেকর্ড করা),

ক্স সময়কে সাজানো এবং

ক্স আপনার সময়কে সামষ্টিক এক রূপ প্রদান

এগুলোই হচ্ছে একজন কার্যনির্বাহীর নৈপুণ্যের মূলভিত্তি।

দক্ষ কার্যনির্বাহগণ জানে যে, সময় একটি সীমাবদ্ধ বিষয়। যেকোন প্রক্রিয়ার বাহ্যিক সীমারেখা নির্ধারিত হয় অপ্রতুল উপাদানের মাধ্যমে। আর উক্ত প্রক্রিয়ায় আমরা “পূর্ণতা” বলে থাকি সময়কে।

সময় একটি অনন্য উপকরণ। অন্যান্য প্রধান উপকরণসমূহের মাঝে, টাকা সব থেকে বেশি পরিমাণে থাকা উপকরণ। আমাদের এটা অনেক আগে থেকেই শেখা উচিত ছিল যে, মূলধনের চাহিদাই বড় কথা, যোগানটা তত বড় নয়। আর মূলধনের চাহিদাই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও কর্মকা-ের সক্রিয়তার সীমা নির্ধারণ করে দেয়। মূলধনের চাহিদা ও যোগান ছাড়াও, তৃতীয় উপাধান হচ্ছে মানুষ বা লোকবল। যদিও এটার ক্ষেত্রেও যোগ্য মানুষের সীমিত যোগান রয়েছে। কাজের সময় দক্ষ লোক পাওয়া মুশকিল। কিন্তু একজন ব্যক্তি কখনো সময়কে বৃদ্ধি করতে পারে না, ভাড়া করতে পারে না, কিনতে পারে না বা কাউকে ধারও দিতে পারে না।

সময়ের যোগান সম্পূর্ণরূপেই বাঁধাধরা একটা ব্যাপারা। এটাকে টেনে বড়ও করা যায় না, ছোটও করা যায়। মানুষের চাহিদা যত বড়ই হোক না কেন, যোগান সবসময় একই রকম এবং অপরিবর্তনশীল থাকে। এর জন্য কোন মূল্য নির্ধারণ করা যায় না এবং কোন প্রান্তীয় উপযোগিতা রেখাও (সধৎমরহধষ ঁঃরষরঃু পঁৎাব) থাকে না। অধিকন্তু, সময় দ্রুত ফুরিয়ে যায় এবং একে সংরক্ষণ করা যায় না। বিগত সময় যেটা চলে গেছে তা চিরদিনের জন্য চলে গেছে। আর কখনো তা ফিরে পাওয়ার নয়। তাই সময়ের যোগান অত্যধিক কম।

সময় প্রতিস্থাপনযোগ্য নয়। সীমার ভেতরে, আমরা যেকোন উপকরণকে অন্য উপকরণ দিয়ে প্রতিস্থাপন করতে পারি, যেমন অ্যালুমিনিয়ামের পরিবর্তে তামা ব্যবহার করা যায়। আমরা পুঁজির স্বল্পতা জনবল দিয়ে প্রতিস্থাপন করতে পারি। আমরা জ্ঞান বা শক্তি দু’টির যেকোনটার অতিরিক্ত ব্যবহার করতে পারি। কিন্তু সময়ের পরিবর্তে কোন কিছু ব্যবহার করা যায় না, সময়ের অতিরিক্তও কিছু ব্যবহার করা যায় না।

অথচ সবকিছুর জন্য সময় দরকার। এটা একটা প্রকৃত সর্বজনীন অবস্থা। প্রতিটি কাজ সংঘটিত হতে সময় লাগে এবং পুরো সময় খরচ করে। তথাপি, মানুষ এই অনন্য, অপ্রতিস্থাপনযোগ্য এবং আবশ্যকীয় উপকরণকে তুচ্ছভাবে গ্রহণ করে। অন্য যেকোন কিছুর চেয়ে একজন দক্ষ কার্যনির্বাহীকে আলাদা ও বৈশিষ্ট্যম-িত করে সময়ের প্রতি তার ভালোবাসা ও যত্নবান থাকার প্রবণতার জন্য।

এসব কথার পর সিদ্ধান্ত নেয়া যায় যে, মানুষ তার সময়-ব্যবস্থাপনায় যথাযথভাবে দক্ষ নয়।

যদিও মানুষের, অন্য সকল প্রাণীর মতো, “দেহঘড়ি” আছে। যে ব্যক্তি আটলান্টিক মহাসাগর জেট বিমানে করে পাড়ি দিয়েছে সে জানে যে মানুষের মধ্যে সময় ব্যবস্থাপনা সম্পর্কিত জ্ঞান ও এর দক্ষ ব্যবহার খুব কমই বিদ্যমান। অবশ্য এটা আমরা মনোবৈজ্ঞানিক পরীক্ষানিরীক্ষার মাধ্যমেও দেখেছি। একজন মানুষকে যদি একটি বদ্ধ ঘরে রাখা হয়, যেখান থেকে বাইরের আলো-আঁধার বোঝা যায় না অথবা দেখা যায় না, তখন সেই মানুষটি দ্রুত তাদের সময়জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। এমনকি বিদঘুটে অন্ধকারের মধ্যে মানুষ স্থান বা অবস্থান সম্পর্কিত যে অনুভূতি তাও হারিয়ে ফেলে। আবার একটি আলোকিত ঘরের মধ্যেও যদি একজন মানুষকে বন্দি করে রাখা হয়, তাকে কয়েক ঘণ্টা সেই আলোকিত ঘরে রাখলেও সে আন্দাজ করতে পারে না কত সময় ব্যয় হয়ে গেছে। তার রুমে অতিবাহিত সময় সম্পর্কে হয়তো কমিয়ে বলবে অথবা বাড়িয়ে বলবে।

যদি আমাদেরকে আমাদের স্মৃতির উপর নির্ভর করে বলতে হয় কত সময় অতিবাহিত হয়েছে, তাহলে আমরা কখনো বলতে পারব না আমাদের সময় কীভাবে পার হয়ে গেল। [এজন্যই এ অধ্যায়ের শুরুতে বলা হয়েছে, সময়ের রেকর্ড করার কথা (কখন কী কাজ করছেন তা রেকর্ড করা, কখন কী করবেন তা নয়। বর্তমানে কখন কী কাজ করছেন তা রেকর্ড করা)।]

আমি মাঝে মাঝে সেসব কার্যনির্বাহী যারা তাদের স্মৃতির উপর নির্ভর করে তাদের কাছে অনুরোধ করি তারা কীভাবে তাদের সময় ব্যয় করবে তা অনুমানের ভিত্তিতে লিখে দিতে। অতঃপর আমি এই অনুমানের ভিত্তিতে লিখা বর্ণনাটি কয়েক সপ্তাহ বা কয়েক মাসের জন্য সরিয়ে রাখি। এ সময়, কার্যনির্বাহীগণ তাদের প্রকৃত সময়-যাপনের একটি নথি তৈরি করে। পরে দেখা যায়, তারা যেভাবে তাদের সময় পার হবে ভেবেছিল এবং প্রকৃত সময়-যাপনের যে নথি উভয়ের মাঝে খুব কম মিল পরিলক্ষিত হয়। দুটোই পুরোপুরি ভিন্ন।

একটি কোম্পানির প্রধান কার্যনির্বাহী তো একবার নিশ্চিতভাবে ধরে নিয়েছিল যে, সে তার সময়কে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে মেনে চলে। সে তার সময়কে তিনটি অংশে ভাগ করেছে। এক-তৃতীয়াংশ সে চিন্তা করল তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে অতিবাহিত করবে। অন্য এক-তৃতীয়াংশ তার গুরুত্বপূর্ণ গ্রাহকদের সাথে এবং অবশিষ্ট এক-তৃতীয়াংশ সামাজিক কাজকর্মে ব্যয় করবে। তার ছয় সপ্তাহের স্পষ্ট রেকর্ড থেকে এটা বের হয় যে, সে এই তিন শ্রেণীর কোনটাতেই তার সময় ব্যয় করেনি। সে জানত এ খাতগুলোতে তার সময় দেওয়া দরকার, কিন্তু স্মৃতি যা বরাবরই বাধ্যগত, তাকে জানায় যে, এ খাতগুলোতে সে ইতোমধ্যেই সময় ব্যয় করেছে। প্রসঙ্গত, প্রকৃত বিবরণ থেকে জানা যায় যে, সে তার অধিকাংশ সময় অনেকটা ডিস্প্যাচারের (যার কাজ বার্তা গ্রহণ করা ও মানুষ, গাড়ি প্রভৃতিকে সংগঠিত রাখা) মতোই কাটিয়েছে। সে তার ব্যক্তিগতভাবে পরিচিত গ্রাহকদের অর্ডার ট্র্যাক করত এবং ফোনে ফোনে তাদের সাথে পরিকল্পনা নিয়ে কথা হত। অধিকাংশ অর্ডারই সঠিকভাবে সম্পন্ন হচ্ছিল এবং নির্ধারিত সময়েই হস্তান্তরের অপেক্ষায় ছিল। তার এতে নাক গলানো ¯্রফে এতটুকু করেছে যে, অর্ডার সম্পাদনে কিছুটা বেগ পেতে হয়। যাহোক, যখন তার সেক্রেটারি তার সময়-রেকর্ড নিয়ে উপস্থিত হয়, সে তাকে বিশ্বাসই করতে পারছিল না। এই নথিটিকে তার কাছে বিশ্বাস করাতে আরও দুই-তিনটি সময়-রেকর্ডের প্রয়োজন হয় যে, সময়-যাপনের প্রশ্নে সর্বদা স্মৃতি বা মনে রাখার পরিবর্তে রেকর্ড তথা নথিকে বিশ্বাস করতে হয়। তাই আপনার সময় কোথায় ব্যয় হচ্ছে তা সম্পর্কে অনুমান বা ‘মনে মনে আছে’ না বলে রেকর্ড রাখুন। এতে করে স্পষ্টভাবে আপনার সময় কোথায় যাচ্ছে তা খুঁজে পাবেন।

একজন দক্ষ কার্যনির্বাহী জানে যে, তার সময়কে সুশৃঙ্খল করতে হলে, প্রথমে তাকে জানতে হবে তার সময় কোথায় ব্যয় হয়।


কার্যনির্বাহীর কাছে সময় চাহিদা


কার্যনির্বাহীর কাছে সময় চাহিদা (ঞযব ঃরসব ফবসধহফং ড়হ ঃযব বীবপঁঃরাব)। ফলাফলহীন এবং সময়ের অপচয় করার জন্য সবসময়ই একটা অতিরিক্ত চাপ পোহাতে হয়। যেকোন কার্যনির্বাহী, সে একজন ব্যবস্থাপক হোক বা অন্য যেকেউ, তাকে তার সময়ের গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ এমন এমন ক্ষেত্রে ব্যয় করতে হয় যা আদৌ কোন কাজের না। অধিকাংশই সন্দেহাতীতভাবে অপব্যয়। কোম্পানিতে যত বেশি সে পদোন্নতি পাবে, কোম্পানি তত বেশি তার সময়ে ভাগ বসাবে।

একটি বড় কোম্পানির প্রধান কর্মকর্তা একবার আমাকে বলেছিল যে, তার দুই বছরের কার্যনির্বাহীর দায়িত্বে, সে প্রতিদিন বিকালে বাইরে আহার করত, কেবল ক্রিসমাস ও নববর্ষের দিন ছাড়া। সকল নৈশভোজই ছিল অফিসের কাজে বা প্রয়োজনে, যেগুলো তার কয়েক ঘণ্টা করে নষ্ট করত। তথাপি, তার কাছে কোন বিকল্প ছিল না। কখনো নৈশভোজের আয়োজন থাকত অবসর-গ্রহণকারী কোন কর্মকর্তার সম্মানে যে দীর্ঘ পঞ্চাশ বছরের চাকরি জীবনের সমাপ্তি ঘটাতে যাচ্ছে বা কোন স্টেট যাতে তার কোম্পানি ব্যবসা করে তার গভর্নরের সম্মানে, একজন কার্যনির্বাহী কর্মকর্তা হিসাবে তাকে অবশ্যই সেখানে উপস্থিত থাকতে হবে। অনুষ্ঠান তার কাজের একটি অংশ। আমার বন্ধু বিভ্রান্ত হয়নি যে, এই ডিনারসমূহ আদৌ কোম্পানি বা তার বিনোদনে বা আত্ম-উন্নয়নে কোন ভূমিকা রাখতে পারে। তথাপি তাকে সেখানে যেতে হত এবং অমায়িকভাবে ডিনারে অংশগ্রহণ করতে হত।

এ ধরনের সময় নষ্টকারী বিষয় একজন নির্বাহীর জীবনে প্রচুর পরিমাণে থাকে। যখন কোম্পানির সেরা গ্রাহকটি ফোন করে, সেল্স ম্যানেজার বলতে পারে না যে, “আমি ব্যস্ত।” তাকে শুনতে হয়, যদিও অন্য সব গ্রাহক তার সাথে কথা বলতে চায়, সে কথা বলে সামনের শনিবারে কোথাও ব্রিজ গেম খেলা নিয়ে বা তার মেয়ের উপযুক্ত কলেজে ভর্তি হওয়া নিয়ে। হাসপাতাল ব্যবস্থাপকের তার বিভিন্ন কর্মকর্তা-কর্মচারী কমিটির প্রতিটিতে অংশগ্রহণ করতে হয়, চিকিৎসকদের, নার্সদের, টেকনিশিয়ানদের ইত্যাদি ইত্যাদি। নচেৎ, তারা মনে করবে তাদের অবজ্ঞা করা হচ্ছে। সরকারি দপ্তরের ব্যবস্থাপককে যখন কোন মন্ত্রী বা সংসদ সদস্য ফোন করে এবং অল্প সময়ের মধ্যে কোন তথ্য তাকে (মন্ত্রিকে) সরবরাহ করতে বলে তখন তার মনোযোগ বেশি প্রদান করতে হয়। হয়তো কাজটি হলো টেলিফোন বুক থেকে বা “ওয়ার্ল্ড অ্যালমেনাক" থেকে কোন তথ্য বের করে দেওয়া আর এটা করতে গিয়ে তার পুরো দিনই নষ্ট হয়ে যায়। [ওয়ার্ল্ড অ্যালমেনাক হচ্ছে নানা বিষয় বা ঘটনা সম্বলিত বই।]

যারা ব্যবস্থাপক নয় তাদের অবস্থাও খুব ভালো নয়। তাদেরও তাদের সময়ে অন্যকে ভাগ দিয়ে সময় অপব্যয় করতে হয়। এতে করে তাদের কর্মদক্ষতার বা কাজের ফলাফলে কোনো উপকার হয় না; বরং ক্ষতি হয়। কিন্তু এতদসত্ত্বেও তাদের অনাগ্রহ প্রকাশের কোন সুযোগ নেই।

প্রত্যেক নির্বাহীর কাজে, সময়ের বড় একটি অংশ নির্ঘাত এমন এমন কাজে নষ্ট করতে হবে যা, যদিও তা স্পষ্টত সম্পাদন করতেই হবে, (কোম্পানি বা তাদের জীবনে) অল্প বা কোন ভূমিকাই রাখে না।

তা সত্ত্বেও একজন কার্যনির্বাহীর অধিকাংশ কাজ, সর্বনিম্ন কার্যকারিতার জন্য হলেও, তার সময়ের অত্যন্ত বড় একটি অংশকে দাবি করে। আর এক নাগাড়ে সর্বনিম্ন পর্যায়ের চেয়েও কম সময় উক্ত কাজে ব্যয় করা সময় নষ্ট করা ছাড়া আর কিছুই নয়। উক্ত কার্যনির্বাহী কাজের সিকি ভাগও সম্পাদন করতে পারে না এবং তাকে পুনরায় শুরুও করতে হয়।

ক্স উদাহরণস্বরূপ মনে করুন, একটি প্রতিবেদনের প্রথম খসড়াটি প্রস্তুত করার জন্য অন্তত ছয় থেকে আট ঘণ্টা সময় লাগে। এখন, উক্ত কাজের জন্য প্রতিদিন পনেরো মিনিট করে দু’বার তিন সপ্তাহ ব্যয় করার কোন মানে হয় না। দিন শেষে একটি খালি কাগজ যাতে কিছু কালো দাগ টানা আছে তা ছাড়া আর কিছুই থাকবে না তাতে। কিন্তু কেউ যদি দরজা বন্ধ করে, টেলিফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে ও প্রতিবেদন তৈরির জন্য কোমর বেঁধে নামে এবং পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টা কোনরূপ বিঘœতা ছাড়া সময় দেয়, তবে সম্ভাবনা আছে সে এমন কিছু একটা প্রস্তুত করবে যাকে আমি “জিরো ড্রাফট তথা শূন্য খসড়া” বলে থাকি, এটা মূলত প্রথম খসড়ার পূর্বের খসড়া। তখন থেকে, কেউ চাইলে অল্প অল্প করে বিভিন্ন সময়ে চমৎকারভাবে কাজ করতে পারবে, সে পুনরায় লিখতে পারবে, অনুচ্ছেদ, স্তবক বা প্রতিটি বাক্য পড়ে পড়ে সংশোধন ও সম্পাদনা করতে পারবে।

একই বিষয় প্রযোজ্য এক্সপেরিমেন্ট তথা পরীক্ষানিরীক্ষা চালানোর ক্ষেত্রেও। পরীক্ষানিরীক্ষা করার জন্য ব্যক্তিকে পাঁচ থেকে বার ঘণ্টা অব্যাহতভাবে যন্ত্রপাতি ইত্যাদি প্রস্তুত করার জন্য এবং সম্পন্ন করার পর অন্তত একবার চালু করে দেখতে হবে। নচেৎ, তাকে নতুন করে আরম্ভ করতে হবে।

কার্যকরী হওয়ার জন্য প্রত্যেক নলেজ ওয়ার্কারকে এবং বিশেষত কার্যনির্বাহীকে, সময়কে একাধিক বড় বড় ভাগে বিন্যস্ত করতে হবে। তার সময় বিন্যাসে ছোট ছোট অংশ যথেষ্ট নয় যদিও তা একত্রে বড় একটি পরিমাণে রূপ নেয়। [নলেজ ওয়ার্কারস তথা তথ্য বা জ্ঞানের ওপর ভিত্তি করে যারা কাজ করে এমন ব্যক্তিদের আমরা জ্ঞানকর্মী বা তথ্যকর্মী বলতে পারি। নলেজ ওয়ার্কারস (তথ্যভিত্তিক কর্মী)।]

মানুষের সাথে কাজ করা, ব্যয়কৃত সময় অনুপাতে, কার্যনির্বাহীদের কাজগুলোর মধ্যে অবশ্যই একটি মূল কাজ। আমাদের আশেপাশের মানুষ আমাদের প্রচুর সময় ব্যয় করে। আর অধিকাংশ মানুষই সময় নষ্টকারী।

মানুষের সাথে অল্প কিছু সময় অতিবাহিত করা পুরোপুরিভাবে অনুৎপাদনশীল একটি কাজ। মানুষের সাথে যোগাযোগ বা মানবিক সম্পর্ক তৈরির ক্ষেত্রে যদি কেউ কোন কিছু অর্জন করতে চায়, তবে তাকে মোটামোটি বৃহৎ পরিমাণ একটি সময় ব্যয় করতে হবে। যে ব্যবস্থাপক মনে করে সে পরিকল্পনা, নির্দেশনা ও তার কোন এক অধস্তন কর্মকর্তার কাজ নিয়ে পনেরো মিনিটের মাঝে আলোচনা করে শেষ করতে পারবে এবং অনেক ব্যবস্থাপক তাই মনে করে, সে কেবল নিজেকে প্রতারিত করছে। যদি কেউ তার কাজের ফলাফল জানতে চায়, তবে তাকে অবশ্যই অন্তত এক ঘণ্টা বা সাধারণত তার বেশি ব্যয় করতে হবে। আর যে মানব-সম্পর্ক গড়ে তুলতে চায় তার অবশ্যই আরো বেশি সময় চাই।

অন্যান্য তথ্যভিত্তিক কর্মীদের সাথে সম্পর্ক তৈরি করা বিশেষত সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। কারণ যাই হোক- তথ্যভিত্তিক কর্মীদের বর্ণ বা শ্রেণী আলাদা হতে পারে, তারা ঊর্ধ্বতন বা অধস্তন কর্মকর্তা হতে পারে, তাদের কাজকর্মের জ্ঞানগর্বে দক্ষ হতে পারে, সে নিজেকে নিয়ে বেশি ব্যস্ত হতে পারে, প্রভৃতি বিষয় হতে পারে। আর এসব বিষয়ই একে অপরের সাথে আন্তরিক সম্পর্ক তৈরিতে এক ধরনের অদৃশ্য বাধা তৈরি করে। একজন দৈহিক পরিশ্রমকারী কর্মীকে (ম্যানুয়াল ওয়ার্কার- গধহঁধষ ড়িৎশবৎ) তার ঊর্ধ্বতন বা অধস্তন কর্মীরা যতবার ডাকে বা তার সাহায্য চায়, তারচেয়ে অনেক বেশি একজন তথ্যভিত্তিক কর্মীকে তার ঊর্ধ্বতন বা অধস্তন কর্মীরা ডাকে বা তার সাহায্য চায়। অধিকন্তু, যেহেতু যেভাবে দৈহিক পরিশ্রমকারী কর্মীদের কাজের পরিমাণ পরিমাপ করা যায় সেভাবে তথ্যভিত্তিক কর্মীদের কাজকে পরিমাপ করা যায় না, তাই কেউ কয়েক শব্দে বলতে পারে না যে একজন তথ্যভিত্তিক কর্মী আদৌ সঠিক কাজ করছে কিনা এবং তা কীভাবে করছে। যেকেউ একজন দৈহিক পরিশ্রমকারী কর্মীকে বলতে পারে, “আমাদের এখানে কাজের মানদ- হলো ঘণ্টায় পঞ্চাশটি পণ্য তৈরি করা, আর তুমি কেবল বিয়াল্লিশটি করতে পেরেছ।” কিন্তু একজন নলেজ ওয়ার্কারের ক্ষেত্রে, তার সাথে বসা লাগে আর বসে ভাবতে হয়, কী করতে হবে এবং কেন করতে হবে, এমনকি এটা জানার পূর্বে যে সে কী আদৌ কোন সন্তোষজনক কাজ করতে পারছে নাকি পারছে না। এটা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার।

যেহেতু নলেজ ওয়ার্কার নিজেই নিজের পরিচালক, তাকে অবশ্যই জানতে হবে তার কাছে কোন অর্জন প্রত্যাশা করা হচ্ছে এবং কেন। তার অবশ্যই যারা তার জ্ঞানের উপর ভিত্তি করবে তাদেরকে বুঝতে হবে। এ কারণে, তার অনেক তথ্য দরকার, আলোচনা, দিক-নির্দেশনা ইত্যাদির দরকার। এগুলো সবই প্রচুর সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। সাধারণত যা কিছু বিশ^াস করা হয় তারচেয়েও বেশি পরিমাণে একজন তথ্যভিত্তিক কর্মীর সময় তার সিনিয়র কর্মকর্তা এবং তার সহকর্মীদের সময় ও দক্ষতা নিয়েই তৈরি হয়।

তথ্যভিত্তিক কর্মীদেরকে অবশ্যই পুরো প্রতিষ্ঠানের ফলাফল ও কর্মদক্ষতা প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্যের উপর জোর দিতে হবে যদি কোন ফলাফল বা কার্যসিদ্ধির ইচ্ছা থাকে। এর অর্থ হলো তার কাজ থেকে নিয়ে ফলাফল পর্যন্ত তার চিন্তা-পরিকল্পনাকে পরিচালনা করতে সময়কে আলাদা করে রাখতে হবে এবং তার বিশেষ কর্মদক্ষতা যা কেবল তিনিই সম্পাদন করতে পারেন, সেটার ওপর জোর দিতে হবে।

যখনই তথ্যভিত্তিক কর্মীরা কোন প্রতিষ্ঠানে চমৎকার দক্ষতা দেখায়, সিনিয়র কার্যনির্বাহীগণ নিয়মতান্ত্রিক রুটিনে তাদের সাথে বসার জন্য সময় নেয়। মাঝে মাঝে তারা কর্মঠ জুনিয়রদের সময় উপেক্ষা করেও জ্ঞান বা তথ্যভিত্তিক কর্মীদের সময় নেয়। তাদের কাছে জানতে চায়: “এই প্রতিষ্ঠানের প্রধান হওয়ায় তোমার কাজের ব্যাপারে আমাদের কী কী জানা উচিত? এই প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে তুমি কী বলতে চাও? কোন কোন জায়গায় তুমি সম্ভাবনা দেখতে পাও যা আমরা এখনো খুঁজে পাইনি? কোথায় কোথায় সমস্যা দেখতে পাচ্ছ যার ব্যাপারে আমরা এখনো উদাসীন? আর কোম্পানি সম্পর্কে আমার কাছে থেকে তুমি কী কী জানতে চাও?”

এ ধরনের ব্যস্ততাহীন বা ধীরেসুস্থের ভাবের আদান-প্রদান সরকারি সংস্থা ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানেও সমানভাবে প্রয়োজনীয় ও আবশ্যক, তেমনিভাবে গবেষণাগার এবং সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের মাঝেও দরকার। এটা না করলে, তথ্যভিত্তিক কর্মীরা তাদের উদ্দীপনা হারাবে ও নিছক কাল-ক্ষেপণকারীতে পরিণত হবে বা তারা তাদের শক্তি-সামর্থ্যকে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব লাভে ব্যয় করবে এবং প্রতিষ্ঠানের সম্ভাবনা ও প্রয়োজন থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে। তবে এরকম একটি সেশন করতে দীর্ঘ সময়ের দরকার পড়ে, বিশেষত যেহেতু এটা সুস্থির ও স্বাচ্ছন্দ্যজনক উপায়ে হতে হবে। তাদেরকে এটা অনুভব করতে হবে যে, “আমাদের কাছেই আছে পৃথিবীর সব সময়।” এর প্রকৃত অর্থ হলো ব্যক্তিকে দ্রুত একটি বড়সড় কাজ সম্পন্ন করতে হবে। এর অর্থ এটাও যে, সে যে সময়টা দিবে তার পরিমাণ বড় হতে হবে। আর এ সময়ের মধ্যে কোনো বিঘœ ঘটতে পারবে না।

পেশাগত সম্পর্কের সাথে ব্যক্তিগত সম্পর্ক মিশিয়ে ফেললে, তাতে প্রচুর সময় নষ্ট হয়। যদি তাড়াহুড়া করা হয়, তবে তা সংঘাতে রূপ নেয়। তথাপি অনেক প্রতিষ্ঠান এই ব্যাপারটা গুলিয়ে ফেলে এবং এ ধরনের গুলিয়ে যাওয়া সম্পর্কের উপরই টিকে থাকে। মানুষ যত বেশি একত্রিত হবে, তত বেশি সময় তাদের ভাবের আদান-প্রদানে নষ্ট হবে এবং তত কম সময় তাদের কাজের জন্য, কার্য সম্পাদন ও সম্পূর্ণকরণ এবং ফলাফলের জন্য অবশিষ্ট থাকবে।

‘ম্যানেজমেন্ট তথা ব্যবস্থাপনা’ বিষয়টি দীর্ঘদিন ধরে ‘নিয়ন্ত্রণ’ নামক পরিমাপক মানদ- দ্বারা পরিচালিত। যার অর্থ হচ্ছে, একজন ব্যক্তি কেবল গুটিকয়েক মানুষ সামলাতে পারে যদি সেই সব মানুষ একত্রে তাদের কাজ করে (যেমন, হিসাবরক্ষক, সেলস ম্যানেজার এবং উৎপাদনকারী এই তিনজনকে সাথে নিয়ে কাজ করতে হবে যদি তারা কোন ফলাফল পেতে চায়)। অন্যদিকে, (একটি কোম্পানির বা ব্র্যান্ডের) বিভিন্ন শহরের শাখা বিপণিগুলোর ম্যানেজারদের একে অপরের সাথে কাজ করতে হয় না, ফলে যেকোন সংখ্যক ব্যক্তি একজন আঞ্চলিক ভাইস-প্রেসিডেন্ট বা উপ-পরিচালকের কাছে বোধমগ্য উপায়ে প্রতিবেদন দাখিল করতে পারে আর এতে তাকে বা তাদেরকে ‘নিয়ন্ত্রণ’ নামক পরিমাপক মানদ-ের লঙ্ঘন করতে হয় না। এই থিওরির মূল্য থাকুক বা না থাকুক (ঃযব ংঢ়ধহ ড়ভ পড়হঃৎড়ষ ঃযবড়ৎু), এতে সন্দেহের অবকাশ কম যে, যত বেশি মানুষ একত্রে কাজ করবে, তত বেশি মানুষের কাজ করা ও সমাপ্ত করার চেয়ে পারস্পরিক ভাবের আদান-প্রদানে বেশি সময় ব্যয় হবে। বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলো কার্যনির্বাহীদের সময় প্রচুর পরিমাণে ব্যবহার করে শক্তি সঞ্চয় করে থাকে।

প্রতিষ্ঠান যত বড় হবে, একজন কার্যনির্বাহী প্রকৃত সময় তত কম পাবে। তার জন্য সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো তার সময় কোথায় যায় তা জানা (সময় রেকর্ড করা) এবং তা নিয়ন্ত্রণে ব্যবস্থা করা।

একটি প্রতিষ্ঠানে সদস্য সংখ্যা যত বেশি হবে, ততই প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন কর্মকর্তা-কর্মচারীর উপর (মানে সর্বস্তরের কর্মীদের তথা মানুষের ওপর) সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা পড়বে। তবে মানুষের ক্ষেত্রে দ্রুত নেয়া সিদ্ধান্তগুলো বেশির ভাগ সময় ভুল হয়। মানুষের ক্ষেত্রের একটি উপযুক্ত দাপ্তরিক সিদ্ধান্ত নিতে বেশ বড় রকমের একটা সময় লাগে। তাছাড়া একটি সিদ্ধান্ত তখনই স্পষ্ট হয় যখন ঐ বিষয়ে একাধিকবার কাজ হয়। তখন বোঝা যায় সিদ্ধান্ত ও এর কার্যকারিতা।

আমার দেখা কার্যনির্বাহীদের মধ্যে অনেকে আছে যারা দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে; আবার কিছু আছে যারা বরং অপেক্ষাকৃত বেশি সময় নেয় সিদ্ধান্ত গ্রহণে। তবে কোন ব্যতিক্রম ছাড়াই তারা সকলেই নতুন কর্মী বাছাইয়ের সিদ্ধান্তে ধীর গতিতে অগ্রসর হয় এবং তারা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হওয়ার আগে একাধিকবার কাটছাঁট করে।

আলফ্রেড পি. স্লোয়ান, দ্য জুনিয়র, পৃথিবীর সর্ববৃহৎ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান জেনারেল মটরসের প্রধান, এর ব্যাপারে বলা হয় তিনি কখনো প্রথম বৈঠকেই কর্মী বাছাইয়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেননি। তিনি একটি পরীক্ষামূলক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন এবং নিয়মানুযায়ী তাও কয়েক ঘণ্টার বিনিময়ে। অতঃপর, কয়েক দিন ও কয়েক সপ্তাহ পরে, তিনি প্রস্তাবটি নিয়ে পুনরায় পর্যালোচনা করতেন, যেন তিনি এ বিষয়ে কোন আলোচনাই আগে করেননি। কেবল যখন একই নাম দুই বা তিনবার তার সামনে আসত, তখনই সিদ্ধান্ত গ্রহণে অগ্রসর হতেন। স্লোয়ান তার নির্বাচিত বিজয়ীদের জন্য সর্বদা উপযুক্ত মর্যাদা প্রাপ্ত হতেন। কিন্তু যখন তার গোপনীয়তা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হয়, তার ব্যাপারে বলা হয়ে থাকে: ‘কোন গোপনীয়তা নেয় আমি শুধুমাত্র এটা মনে করি যে, প্রথম যে নামটা আসে তা ভুল হতে পারে এবং অতঃপর আমি পুরো প্রক্রিয়াটি পুনরায় বিবেচনা করি ও বিশ্লেষণ করি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার আগে।’ অবশ্য স্লোয়ান ধৈর্যশীল মানুষের কাতারে ছিলেন না।

খুব কম কার্যনির্বাহী অনুরূপ উপায়ে কর্মী বাছাই করে থাকে। তবে আমার যত কার্যকর কার্যনির্বাহীর সাথে দেখা হয়েছে তারা এই বিষয়টি শিখেছে যে, তাদেরকে মানুষের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য লাগাতার ও নিরবচ্ছিন্নভাবে সিদ্ধান্তটির ব্যাপারে কয়েক ঘণ্টা চিন্তা করা লাগবে যদি তারা সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হতে চায়।

একটি মাঝারি আকারের সরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের পরিচালক এই বিষয়টি আবিষ্কার করেন যখন তার একজন সিনিয়র প্রশাসনিক কর্মকর্তাকে তার চাকরি থেকে অব্যহতি দেওয়ার প্রয়োজন দেখা দেয়। লোকটির বয়স ছিল ৫০ এবং তার কর্মজীবনের পুরোটা সময় সে এই প্রতিষ্ঠানের সাথে ছিল। দীর্ঘকাল ধরে যথাযথভাবে সেবা দেওয়ার পর হঠাৎ তার অবস্থা মন্দ হতে থাকে। স্পষ্টত সে তার চাকরি সামলাতে ব্যর্থ হচ্ছিল। কিন্তু পাবলিক সার্ভিস কমিশন যদি অনুমতিও দেয়, তবুও তাকে চাকরিচ্যুত করা যাবে না। হয়তো তার পদাবনতি হতে পারে। কিন্তু এটা, পরিচালক মনে করে, উক্ত ব্যক্তিকে ধ্বংস করে দিতে পারে। অন্যদিকে, তার দীর্ঘসময়ের উৎপাদনমুখী নিষ্ঠাবান সেবার কারণে কোম্পানি তার কাছে ঋণী, দায়বদ্ধ। তথাপি, তাকে প্রশাসনিক পদে বহাল রাখা সম্ভব ছিল না; তার ভুলগুলো অত্যধিক দৃশ্যমান ছিল এবং অবশ্য তা পুরো প্রতিষ্ঠানকে দুর্বল করে তুলছিল।

পরিচালক ও সহকারি পরিচালক একাধিকবার এ বিষয়ে আলোচনা করেছিল যার ফলাফল ছিল শূন্য। কিন্তু যখন একটি সম্পূর্ণ বিকাল, তিন-চার ঘণ্টা, কোন ধরনের বিঘœতা ছাড়া সমস্যাটি সমাধানে ব্যয় করে, সুস্পষ্ট সমাধান হাতে আসে। এটা সহজে অনুমেয়, তাদের কেউই এটা ব্যাখ্যা করতে পারেনি যে, কেন তারা এ সমাধানটি আগে দেখতে পায়নি। এ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কর্মকর্তাটিকে পদটি থেকে সরিয়ে তার উপযুক্ত পদে নিযুক্ত করা হয়। এমন একটি পদে যেখানে প্রশাসনিক কর্মক্ষমতার প্রয়োজন পড়ে না যা সে করার সামর্থ্য হারিয়েছে।

অব্যাহত, নিরবচ্ছিন্ন বড় পরিমাণে সময় বের করা জরুরি এরূপ একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য, অর্থাৎ নির্দিষ্ট একটি সমস্যা নিয়ে গবেষণা চালানোর জন্য কাকে ‘টাস্ক ফোর্সে’ রাখা হবে; একটি প্রাতিষ্ঠানিক গঠনতন্ত্রে বা স্তর-পারম্পর্যে ম্যানেজারের উপর বা পুরাতন একটি প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজারের উপর দায়িত্বগুলো কী কী; শূন্য পদে কি এমন কাউকে নিয়োগ করা হবে যার মার্কেটিংয়ের উপর জ্ঞান আছে যা এই পদের জন্য প্রয়োজনীয় কিন্তু তার কোন প্রযুক্তিগত প্রশিক্ষণ নেই নাকি যে প্রথম সারির প্রযুক্তিবিদ কিন্তু মার্কেটিংয়ে তার জ্ঞান শূন্যের কোঠায় তাকে নিয়োগ দেওয়া হবে ইত্যাদি ইত্যাদি।

কর্মী বাছাই একটি সময় ক্ষেপণকারী বিষয়, এর সাধারণ একটি কারণ ¯্রষ্টা মানুষকে প্রতিষ্ঠানের দক্ষ লোকবল হিসাবে সৃষ্টি করেননি। তারা একটি প্রতিষ্ঠানের কার্যসম্পাদনের যোগ্যতা ও উপযুক্ততা নিয়ে পৃথিবীতে আসে না এবং এই কাজের জন্য তাদেরকে সংস্কার করা বা পুনর্গঠন করাও যাবে না। মানুষ সবসময় উপযুক্তই থাকে (প্রায় ক্ষেত্রে)। মানুষকে দিয়ে কাজ করিয়ে নেওয়ার জন্য (বিকল্প যেহেতু হাতে নেই) মানুষ সবসময় উপযুক্তই থাকে। অতএব পর্যাপ্ত পরিমাণের সময়, চিন্তা ও পরীক্ষানিরীক্ষার প্রয়োজন হয়।

পূর্ব ইউরোপের স্লেভিক কৃষকদের একটি প্রবাদ আছে: ‘কারো পায়ে যা নেয়, তা কারো মাথায় পাওয়া যায়।’ একে শক্তি সংরক্ষণ আইনের একটি কল্পিত সংস্করণ হিসাবে বিবেচনা করা যেতে পারে। তবে এটা মোটের উপর অনেকটা ‘সময় সংরক্ষণ আইনের’ মতো বলা চলে। যত বেশি সময় আমরা আমাদের ‘পায়ের’ কাজ থেকে তথা ম্যানুয়াল বা দৈহিক পরিশ্রম বা শারীরিক কাজ থেকে ছুটি নিব, তত বেশি আমাদেরকে মাথার কাজে অর্থাৎ জ্ঞান-সংশ্লিষ্ট (তথ্যভিত্তিক) কাজে সময় ব্যয় করতে পারব। যত বেশি আমরা একে নিম্নপদস্থ কর্মীদের জন্য, যন্ত্র-পরিচালকদের ও কেরানিদের জন্য সহজ করে তুলব, তত বেশি কাজ তথ্যভিত্তিক কর্মীদের মাধ্যমে সম্পাদন করতে পারব। কেউ জ্ঞানকে কাজ থেকে দূরে রাখতে পারে না। একে কোথাও না কোথাও ফিরিয়ে দিতে হয় এবং তা দ্বিগুণ-চতুর্গুণ বেশি আকারে।

নলেজ ওয়ার্কারদের উপর সময়ের চাহিদা কখনো নিম্নগামী হওয়ার নয়। যন্ত্র-চালকগণ এখন সপ্তাহে মাত্র চল্লিশ ঘণ্টা কাজ করে থাকে এবং শীঘ্রই তা কমে পয়ত্রিশ ঘণ্টায় চলে আসবে এবং তাদের জীবন অন্য যে কারো থেকে উত্তম হবে, চায় সে যতক্ষণ কাজ করুক ও যত ধনীই হোক। কিন্তু অনিবার্যভাবে যন্ত্র-চালকদের অবসরের জন্য মূল্য দিতে হচ্ছে জ্ঞানভিত্তিক কর্মীদের দীর্ঘক্ষণ কাজ করার মাধ্যমে। এমন নয় যে, কার্যনির্বাহীদের বর্তমান বিশ্বের শিল্পোন্নত দেশসমূহে তাদের অবকাশ যাপনে সমস্যা রয়েছে। অন্যদিকে, তারা সর্বত্র দীর্ঘক্ষণ কাজ করে যাচ্ছে এবং অন্যকে সন্তুষ্ট রাখতে তাদের সময়ের চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বরং কার্যনির্বাহীর সময় স্বল্পতার অবস্থা ভালো হওয়ার চেয়ে মন্দতর হচ্ছে।

এর একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো একটি উন্নতমানের জীবনযাত্রা উদ্ভাবন ও পরিবর্তন অর্থনীতির পূর্ব-আন্দাজ করে। কিন্তু উদ্ভাবন ও পরিবর্তন কার্যনির্বাহীর উপর অপরিমিত সময় তলব করে। সবাই যা চিন্তা করতে পারে ও সম্পাদন করতে পারে তা হলো ইতোমধ্যেই জানা বিষয়ে চিন্তা করা এবং সচরাচর একজন ব্যক্তি যে কাজ করে তাই করা।

ক্স দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বৃটিশরা কেন এত বেশি পিছিয়ে পড়ে সে বিষয়ে ব্যাখ্যা প্রদান করতে গিয়ে সম্প্রতি ব্যাপক আলোচনা উঠেছে। অবশ্যই এর একটি কারণ হতে পারে পূর্ববর্তী প্রজন্মের বৃটিশ ব্যবসায়ীরা একে তাদের কর্মীদের মতো সহজভাবে নিয়েছিল এবং তাদের মতো অল্প সময় কাজ করেছিল। তবে এটা কেবল তখন সম্ভব যখন ব্যবসা বা শিল্প প্রতিষ্ঠান পূর্ব প্রতিষ্ঠিত নিয়ম বা রুটিনে আটকে থাকে এবং উদ্ভাবন ও পরিবর্তনকে উপেক্ষা করে।

এসব কারণে, প্রতিষ্ঠানের চাহিদা, মানুষের চাহিদা, পরিবর্তন ও উদ্ভাবনের সময় চাহিদা, এটা ক্রমবর্ধমানভাবে জরুরি যে, কার্যনির্বাহী তার সময় ব্যবস্থাপনায় সক্ষম হবে। তবে কেউ যতক্ষণ তার সময় কোথায় ব্যয় হয় তা খুঁজে বের করতে না পারে ততক্ষণ তার সময়-ব্যবস্থাপনার কোন প্রশ্নই আসে না।


টাইম-ডায়গনোসিস তথা সময়-বিশ্লেষণ


ব্যক্তির সময় কোথায় ব্যয় হচ্ছে তা জানার পূর্বে তাকে সময় রেকর্ড করতে হবে। [লেখক এ অধ্যায়ের শুরুতে যেমন বলেছেন, সময়ের রেকর্ড করতে হবে (কখন কী কাজ করছেন তা রেকর্ড করা, কখন কী করবেন তা নয়। বর্তমানে কখন কী কাজ করছেন তা রেকর্ড করা)] সময়কে সাজানোর পূর্বে ব্যক্তিকে সময় রেকর্ড করতে হবে। সময় রেকর্ড করার প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি আমরা এ শতকের শ্রেষ্ঠ অংশকে বিশ্লেষণ করার মাধ্যমে অনুধাবন করতে পেরেছি। অর্থাৎ, আমরা এটা জানতে পেরেছি ম্যানুয়াল কাজের বিচারে, দক্ষ বা অদক্ষ, ১৯০০ সালের দিকে যখন কোন একটি ম্যানুয়াল কাজ সম্পাদনে কতটুকু সময় ব্যয় হয় তা জানার জন্য বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনার সূচনা হয়েছিল তখন থেকে। ইন্ডাস্ট্রিয়াল পদ্ধতিতে ম্যানুয়াল কাজের পরিচালনায় নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে সময় বণ্টন না করার ফলে কোন দেশ যে পিছিয়ে আছে তা বলা যাবে না। সব দেশেই ইন্ডাস্ট্রিয়াল পদ্ধতিতে ম্যানুয়াল কাজ করা হয় এবং এটা সময়ের নিয়মতান্ত্রিক উপায়েই হয়ে থাকে। তাহলে তফাত কোথায়?

আমরা এই জ্ঞানকে প্রয়োগ করেছি সেসব স্থানে যেখানে সময় বড় একটা ভূমিকা রাখে না; অর্থাৎ যেখানে সময়-ব্যবহার ও সময়-অপচয়ের মাঝখানে তফাত হলো প্রাথমিকভাবে দক্ষতা ও খরচ (পড়ংঃং)। তবে আমরা যেসব কাজে সময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে তাতে প্রয়োগ করিনি এবং তাকে বিশেষত সময়ের সাথে মানিয়ে নিতে হবে: একজন জ্ঞানসংশ্লিষ্ট কর্মীকে, বিশেষ করে একজন কার্যনির্বাহীকে। ঠিক এখানেই তফাত। এখানেই সময়ের ব্যবহার এবং এর অপচয়ের মধ্যকার পার্থক্য নির্ণীত হয় কার্যকারিতা ও ফলাফলের মাধ্যমে। [এজন্যই বাংলাদেশে এত বিদেশি কর্মী। দৈনিক প্রথম আলোতে ১৯ অক্টোবর ২০১৯ এ একটি প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। শিরোনাম: বাংলাদেশে এত বিদেশি কর্মী কেন? লেখক আলী ইমাম মজুমদার, সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব। প্রতিবেদন মতে, বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর বিদেশি কর্মীরা ৪২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা নিয়ে যাচ্ছে।]

অতএব কার্যনির্বাহীর কার্যকারিতার প্রথম পদক্ষেপ হলো প্রকৃত সময়-ব্যবহারের লিখিত বিবরণ তথা রেকর্ড রাখা।

ক্স কোন পদ্ধতিতে এই লিখিত বিবরণ বা রেকর্ড রাখা হবে তা আমাদের বিবেচ্য বিষয় নয়। বড় কথা হচ্ছে রেকর্ড থাকতে হবে। অনেক কার্যনির্বাহী আছে যারা এরূপ সময়সূচি নিজেরাই নিজেদের জন্য ব্যবহার করে থাকে। অন্যান্যরা, যেমন কোম্পানির চেয়ারম্যান বা প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা একজন সহকারী রাখেন তাদের সময়সূচি রেকর্ড করার জন্য। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো সময়সূচি তৈরির কাজটি হওয়া চাই এবং সূচি বা বিবরণটি ‘প্রকৃত সময়ের আলোকে’ হতে হবে, অর্থাৎ ইভেন্ট বা ঘটনা ঘটার সময়, পরবর্তীতে স্মৃতির উপর নির্ভর করে নয়।

অনেক নির্বাহীই এমন একটি সময়সূচির ডায়েরি নিয়মিতভাবে ব্যবহার করে থাকে এবং প্রতিমাসে নিয়মিতভাবে এর খোঁজখবর রাখে। কার্যনির্বাহীরা কমপক্ষে প্রতি তিন চার সপ্তাহ পর পর এই সময়সূচির ডায়েরি দেখে এবং বছরে দুইবার অন্তত পুনর্নিরীক্ষণ করে। এ ধরনের পরীক্ষানিরীক্ষার পর প্রত্যেকেই তাদের সময় ও কাজের ব্যাপারটা পুনর্বিবেচনা ও পুনর্বিন্যাস করে নেয়। তারা তাদের কাজের গতিধারা নির্ধারণ করে এ ধরনের সময়সূচির ডায়েরি পুনর্নিরীক্ষণ করার মাধ্যমে। হয়তো তারা ছয় মাস পরে দেখল, তারা এমন এক তুচ্ছ কাজে সময় বেশি ব্যয় করেছে যা তার কর্মদক্ষতার মূল সময়ের অপচয় ঘটিয়েছে। সময়-ব্যবহার (ঃরসব-ঁংব) অনুশীলনের মাধ্যমে ধীরে ধীরে উন্নতি লাভ করে। তবে এটা তখনই উন্নত হবে যখন এই চর্চা করার চেষ্টা প্রতিনিয়ত করে যাবেন। সময়ের অপচয়কে রোধ করার জন্য প্রতিনিয়ত চেষ্টা করে যেতে হবে।

এরপর আসে, নিয়মতান্ত্রিক সময়-ব্যবস্থাপনা (ংুংঃবসধঃরপ ঃরসব সধহধমবসবহঃ)। প্রত্যেক ব্যক্তিকে তার অনুৎপাদনশীল ও সময়-অপচয়কারী কর্মকা- খুঁজে বের করতে হবে এবং যদি সম্ভব হয় তবে তার থেকে মুক্তি পেতে হবে। আর তা করার জন্য প্রত্যেক ব্যক্তিকে একাধিক বিশ্লেষণাত্মক প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে।

১. প্রথমত ব্যক্তিকে অপ্রয়োজনীয় কাজ যা মোটেও করা যাবে না তা খুঁজে বের করতে হবে এবং তা দূর করতে হবে, এমন সব কাজ যা কোন ফলাফল আনে না এবং আপনার সময়ের সম্পূর্ণ অপচয় ঘটায়। এই সময় অপচয়ের কাজগুলোকে খুঁজে পাওয়ার জন্য, ব্যক্তিকে তার সময়সূচির সকল কাজকে খতিয়ে দেখতে হবে। যেকোনো কাজ করার আগে নিজেকে জিজ্ঞেস করুন: “যদি এই কাজ না করা হয় তা হলে কী ঘটতে পারে?” এবং যদি এর উত্তর হয়, “কিছুই ঘটবে না”, তবে অবশ্যই এটা করা থেকে বিরত থাকতে হবে।

এটি অত্যন্ত চমৎকার যে ব্যস্ত মানুষরা এমন কত কাজ করে যা বাদ দেওয়া যায় না। যেমন, উদাহরণ হিসাবে বলা যাক, অসংখ্য বক্তব্য, ডিনার, কমিটির সদস্যপদ এবং পরিচালনা যা একজন ব্যস্ত মানুষের কাছ থেকে অযৌক্তিকভাবে অনেক সময় নিয়ে নেয়, যা তারা কদাচিৎ উপভোগ করে বা ভালোভাবে কাজটি সম্পন্ন করে না বললেই চলে। কিন্তু বছরের পর বছর তা সহ্য করে যেতে হয়, যেভাবে মিশরে প্লেগ রোগ মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ে। মূলত, ব্যক্তিকে যেটা করতে হবে তা হলো, তাকে “না” বলতে হবে যদি কোন কর্মকা- তার প্রতিষ্ঠানের কোন কাজে না আসে অথবা তার নিজের কিংবা যে প্রতিষ্ঠানের জন্য কাজ করছে তার কোন উপকারে না আসে।

উপরে উল্লেখিত প্রধান কার্যনির্বাহী যার প্রতি সন্ধ্যায় ডিনারে অংশগ্রহণ করতে হতো, সে যখন এই ডিনারগুলোতে দেওয়া সময় বিশ্লেষণ করে দেখে, এটা প্রতীয়মান হয় যে, এর এক-তৃতীয়াংশ কোম্পানির সিনিয়র ব্যবস্থাপকদের ব্যতিরেকে আঞ্জাম দেওয়া যেত। প্রকৃতপক্ষে, সে দেখতে পায়, (কিছুটা তার মর্মবেদনার কারণ হয়) তার গৃহীত নিমন্ত্রণগুলোর উল্লেখযোগ্য সংখ্যকে নিমন্ত্রণকর্তা কর্তৃক সাদরে গ্রহণ হয় না। ভদ্রতার খাতিরে তারা তাকে আমন্ত্রণ জানায়। তবে তারা আশা রাখে যে, তাদের আবেদন প্রত্যাখ্যাত হবে। তারা জানেও না যে, তাদের নিমন্ত্রণ কবুল করলে তার সাথে তাদের কীভাবে আচরণ করতে হবে।

আমি এখনো এমন একজন নির্বাহী পাইনি, তার পদ ও স্থান নির্বিশেষে, এক-চতুর্থাংশ দাওয়াত যা সে বাদ দিতে পারে, যেখানে সে না গেলেও কিছু যায় আসে না। এটা অনেকটা ডাস্টবিনে নিক্ষেপ করা অপ্রয়োজনীয় কাগজের মতো।

২. পরবর্তী প্রশ্ন হলো: “আমার সময়সূচির কোন কাজটি অন্য কারো মাধ্যমে, উৎকৃষ্টভাবে না হলেও, ঠিকঠাকভাবে সম্পাদন করা যাবে?”

পূর্বে উল্লেখিত কোম্পানির চেয়ারম্যান এটা বুঝতে পারলেন যে, কোম্পানির যেকোন সিনিয়র নির্বাহীকে বাকি এক-তৃতীয়াংশ আনুষ্ঠানিক-ভোজগুলোতে অংশগ্রহণ করতে পারে। অনুষ্ঠান কর্তৃপক্ষের আসল চাওয়া হলো অতিথিদের তালিকায় যেন কোম্পানির নাম থাকে।

অনেকদিন যাবৎ ম্যানেজমেন্টে “প্রতিনিধি” বিষয়ে প্রচুর আলাপ হয়েছে। প্রত্যেক ম্যানেজার, তাদের প্রতিষ্ঠান যেমনই হোক না কেন; ব্যবসায়িক, সরকারি, বিশ্ববিদ্যালয় বা সামরিক বাহিনী; তার কাজকে অন্যদের হাতে সঁপে দেওয়ার প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। মানে কোনো একজন প্রতিনিধির হাতে কাজ সঁপে দিতে বলা হয়েছে। আবার, বড় বড় কোম্পানির অধিকাংশ ম্যানেজার নিজেদের এই শাস্ত্রীয় উপদেশ দিয়েছেন এবং তা অনেকবার দিয়েছেন। কিন্তু তারপরেও আমি এর তেমন কার্যকারিতা দেখি না। লোকজন এটা শোনে না কারণ: এটা খুব একটা কা-জ্ঞানের পরিচয় বহন করে না। আরেকজন ‘আমার কাজ’ করবে এ কেমন কথা! আরেকজনকে যদি ‘আমার কাজের’ অংশবিশেষ করতে হয় তবে তা তো নিশ্চয় মন্দ কিছু। কারণ এতে বোঝায় আমি নিজের কাজে ফাঁকি দিচ্ছি বোঝায়। একজন মানুষকে তো তার কাজের জন্যই বেতন দেয়া হচ্ছে। কিন্তু প্রতিনিধির হাতে কাজ তুলে দিন, এমন বক্তব্যের মানে হচ্ছে সবচেয়ে অলস ম্যানেজারই সবচেয়ে উত্তম ম্যানেজার। ব্যাপারটা তো হিতাহিতজ্ঞান শূন্যই নয়, অনৈতিকও বটে।

এজন্যই আমি যত নির্বাহীকে দেখি তারা সকলেই তাদের সময় রেকর্ড রাখার পর দেখা যায়, তারা নিজেরা ব্যক্তিগতভাবে না থাকলেও যেসব কাজ হতো, সেখানেও তারা প্রতিনিধি নিয়োগ দিতে পারছে না, নিজেই সব কাজ করতে যাচ্ছে। সময় রেকর্ড বা সময়সূচির ডায়েরি থেকে এটা স্পষ্ট দেখা যায় যে একজন প্রধান কার্যনির্বাহীর পক্ষে সব কাজ নিজে করা সম্ভব নয়। আরও দেখা যায় যেসব কাজকে সে জরুরি মনে করে, যা সে করতে চায় এবং করতে বদ্ধপরিকর তার জন্য পর্যাপ্ত সময় থাকে না। সময় রেকর্ড বা সময়সূচির ডায়েরি থেকে এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে তার অন্যতম কাজ হচ্ছে অন্যদেরকে এসব গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতে দিকনির্দেশনা দেয়া, অন্যদের দিয়ে এসব কাজ করিয়ে নেয়া। একমাত্র তখনই সে কোম্পানির জন্য এবং নিজের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলোর দিকে মনোযোগী হতে পারবে।

একটি চমৎকার উদাহরণ হলো নির্বাহীদের ভ্রমণ। অধ্যাপক সিরিল নর্থকোট পারকিনসন তার একটি রম্যরচনায় দেখান যে একজন বিরক্তিকর সিনিয়র কর্মকর্তা থেকে বাঁচার দ্রুততম উপায় হলো তাকে বিশ্ব-ভ্রমণকারী বানানো। যদিও জেট বিমান ব্যবস্থাপনা যন্ত্র হিসাবে নিশ্চয় অতিরিক্ত মূল্যায়িত। একজন নির্বাহীর জন্য উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ভ্রমণের প্রয়োজন দেখা দেয়; তবে একজন জুনিয়রও কাজটি ভালোভাবেই আঞ্জাম দিতে পারে। তবে ভ্রমণ তার জন্য একটি মহৎ কাজ। একজন তরুণ হিসাবে হোটেলের বিছানায় আরামদায়ক বিশ্রাম তার প্রাপ্য। জুনিয়র ক্লান্তি সহ্য করতে পারে এবং সে অন্য যেকোনো অভিজ্ঞ ব্যক্তির চেয়ে দারুণভাবে কাজ করতে পারে। কিন্তু একজন ক্লান্ত সিনিয়র কর্মকর্তা এ ধকল নিতে সক্ষম নয়।

অনেক সভা আছে যাতে নির্বাহীকে অংশগ্রহণ করতে হয়। কিন্তু এসব সভা নয় এমন নয় যে নির্বাহী ছাড়া অন্যরা তা সামলাতে পারবে না। ঘণ্টার পর ঘণ্টা একটি ফাইল নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে বহু সময় ব্যয় হয়ে যায়, অথচ আলোচনা করার জন্য ফাইলটির প্রথম খসড়াটিও এখনো তৈরি হয়নি। গবেষণাগারে, একজন সিনিয়র পদার্থবিদ তার কাজের উপর পত্রিকায় জনপ্রিয় আর্টিকেল লেখার জন্য অনেক সময় ব্যয় করে। অথচ তার আশেপাশে অসংখ্য বিজ্ঞান-জানা লোক আছে যারা পদার্থবিদ যা বলতে চাচ্ছে তা অনায়াসে লিখতে পারে, যারা পাঠযোগ্য ইংরেজি ভাষায় লিখতে পারে, যেখানে পদার্থবিদ কেবল উচ্চতর গণিতের কথাই বলে। মোট কথা, নির্বাহী অনেক কাজের আঞ্জাম নিজে নিজে দিয়ে থাকে যা সহজেই অন্যকে দিয়ে করানো যায় এবং তা অন্যকে দিয়েই করানো উচিত।

“প্রতিনিধিত্ব” পরিভাষাটি সাধারণত এমনভাবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে যা একটি ভুল ধারণার অবতারণা করে এবং এটা ভুল দিকে আপনাকে নিয়ে যায়। আসল ব্যাপারটা হচ্ছে, নিজেকে থাকা লাগে না এমন সব কাজ যদি প্রতিনিধি দিয়ে করানো যায়, তাহলে একজন ব্যক্তি তার নিজের গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো করতে পারে এবং গুরুত্বপূর্ণ এসব কাজ করার জন্য পর্যাপ্ত সময়ও পায়। আর তাছাড়া এটাই নির্বাহীর কার্যকরিতার ক্ষেত্রে একটি মোটাদাগের অগ্রগতি।

৩. সময় অপচয়ের সাধারণ একটি কারণ যা নির্বাহীর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে এবং সে চাইলেই তা রোধ করতে পারে। তা হচ্ছে অন্যদের সময় নষ্ট না করা, যা সে নিজে অপচয় করে।

এর কোন লক্ষণ থাকে না। তারপরেও তা খুঁজে বের করার একটি সহজ উপায় আছে। আর তা হলো মানুষকে জিজ্ঞাসা করা। দক্ষ নির্বাহীগণ নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে ও কোন ধরনের লজ্জা ছাড়া জিজ্ঞাসা করতে শিখেছে যে, “আমি কি আপনার কার্যকারিতায় কোন ভূমিকা না রেখে কেবল আপনার সময় অপচয় করি?” এই প্রশ্নটি করতে পারা ও প্রশ্ন করতে গিয়ে সত্যের মুখোমুখী হতে ভীত না হওয়া দক্ষ নির্বাহী হওয়ার একটি চিহ্ন।

যে পদ্ধতিতে একজন নির্বাহী উৎপাদনশীল কাজ করে তা অন্য কারো সময় নষ্টের কারণও হতে পারে।

একটি বড় কোম্পানির সিনিয়র অর্থ ব্যবস্থাপক ভালোভাবেই জানত যে সে তার অফিসে অনুষ্ঠিত মিটিংগুলো প্রচুর সময় নষ্ট করে। এই ব্যক্তিটি তার অধস্তন কর্মকর্তাদের প্রতিটি সভায় আমন্ত্রণ জানাত সভার বিষয় যাই হোক না কেন। যার ফলে, সভায় অনেক বেশি সময় চলে যেত এবং যেহেতু প্রত্যেক অংশগ্রহণকারীকে সভার প্রতি নিজের আগ্রহ প্রকাশ করতে হবে, তাই প্রত্যেকে অন্তত একটি প্রশ্ন করত যার অধিকাংশই থাকত অপ্রাসঙ্গিক। যার কারণে সভা অবিরাম চালু থাকত। কিন্তু সিনিয়র নির্বাহী, তাদের কাছে জানতে চাওয়ার আগে, জানতই না যে তার অধস্তনরাও এই সভাগুলোকে সময়ের অপচয় হিসাবে নিত। অত্যধিক গুরুত্বের বিষয়টি মাথায় রেখে প্রতিষ্ঠানের প্রত্যেকে মর্যাদার আসনে সমাসীন করেছে এবং অবগতশীলদের একজন হওয়ায় সে এই ভয়ে থাকত যে, সভাতে যাদেরকে ডাকা হয় না তারা নিজেকে তুচ্ছ ও বঞ্চিত মনে করতে পারে।

এখন, অবশ্য, সে তার অধস্তনদের মর্যাদালাভের চাহিদাকে ভিন্ন উপায়ে পূরণ করে। সে একটি ছাপানো কাগজে লিখে পাঠায়, “আমি (মি. স্মিথ, জনস্ ও রবিনসনকে) আমার সাথে (বুধবার ৩টায়) চারতলার সভাকক্ষে দেখা করার অনুরোধ করছি (আগামী বছরের মূলধন বরাদ্দ বিষয়ে আলোচনার জন্য)। যদি মনে করেন, তথ্যগুলো আপনার জানা প্রয়োজন বা আলোচনায় অংশগ্রহণ করতে চান তবে আসুন। তবে যেকোন ইভেন্টের তৎক্ষণাৎ পর তার আলোচনা ও সিদ্ধান্তের পরিপূর্ণ সারসংক্ষেপ পেয়ে যাবেন। আপনার মন্তব্যের প্রত্যাশায় এসব আলোচনার সারসংক্ষেপ দেয়া হবে।”

যেখানে আগে ডজনখানেক মানুষ আনষ্ঠানিকভাবে সভায় অংশ নিত এবং পুরো বিকাল বেকার কাটিয়ে দিত, সেখানে এখন তিনজন ব্যক্তি ও একজন সচিব টিকা-টিপ্পনী লিখে ও একঘণ্টা বা এর বেশি কিছু সময়ের মাঝেই বিষয়টি সমাধান করে ফেলছে। আর কেউ মনে করে না যে তাকে বাদ দেওয়া হয়েছে।

অনেক নির্বাহী এই অপ্রয়োজনীয় ও অনুৎপাদনশীল সময়-চাহিদার ব্যাপারে অবগত; তথাপি তারা একে উপেক্ষা করতে ভয় পায়। তারা চিন্তা করে গুরুত্বপূর্ণ কিছু হয়তো বাদ যাবে। এই ভীতি তাদেরকে অপ্রয়োজনীয় ও অনুৎপাদনশীল কাজ বজায় রাখতে বাধ্য করে। এই ভয় কাটিয়ে উঠা সম্ভব। যদি আপনি ভুল করেও থাকেন তবে দ্রুতই তা শোধরে নেয়া যাবে। কারণ আপনারা অনেকে একসাথে কাজ করছেন। কেউ যদি ভুল করেও ফেলে, আরেকজনের চোখে তা ধরা পড়বে এবং শোধরে নেয়া সম্ভব। [ভুল করুন, ভুল থেকে শিক্ষা নিন। ভুল করলে ভুল শোধরানো সম্ভব। কিন্তু সময়ের অপচয় করতে সময় পাওয়া সম্ভব নয়।]

যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যেক নতুন প্রেসিডেন্ট প্রথম প্রথম অনেক নিমন্ত্রণপত্র গ্রহণ করত। অতঃপর তারা বুঝতে পারে তাদের আরও অনেক কাজ আছে এবং এই নিমন্ত্রণপত্রগুলোর অধিকাংশ তার কার্যকারিতায় কোন ভূমিকা রাখে না। তারপর, তারা সাধারণত দ্রুত নিজেদের সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে এবং অনভিগম্য হয়ে যায়। কয়েক সপ্তাহ বা মাস পর, প্রসঙ্গত, তার ব্যাপারে সংবাদকর্মী বা মিডিয়াকর্মীরা জানায় যে সে সবার সংস্পর্শ হারাচ্ছে। এভাবেই তারা সাধারণত অপ্রয়োজনে সময় নষ্ট করা এবং জনসম্মুখে আসাকে তাদের জাতীয় মঞ্চ হিসাবে ব্যবহার করার মাঝে একটি ভারসাম্য রক্ষা করতে পারে।

প্রকৃতপক্ষে, একজন নির্বাহীর অত্যধিক অন্তরীণ হয়ে যাওয়ার পিছনে অতটা ঝুঁকির কিছু থাকে না। আমরা সাধারণত আমাদের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোকে অতি মূল্যায়িত করি এবং নিজেদের ব্যাপারে চিন্তা করি আমি নিজে না করলে তো এ কাজ হবে না। এমনকি অনেক দক্ষ নির্বাহীরাও অসংখ্য অপ্রয়োজনীয় ও অনুৎপাদনশীল কাজ করে থাকে।

তবে অতিরিক্ত কাটছাঁট করলে যে খুব একটা ভয়ের কারণ নেই, বরং এতে কার্যকারিতা আরও বৃদ্ধি পায়, তার প্রমাণ পাওয়া যায় অতিরিক্ত অসুস্থ বা প্রতিবন্ধী লোকজনের কাজকর্ম দেখে।

এর উত্তম উদাহরণ হলো হ্যারি হপকিন্স (ঐধৎৎু ঐড়ঢ়শরহং), দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের গোপন উপদেষ্টা। তিনি ছিলেন একজন মৃত্যুপথযাত্রী, বলতে গেলে মারা যাওয়া এমন একজন ব্যক্তি যার কাছে প্রতিটি পদক্ষেপ মর্মযাতনার ছিল। তিনি প্রতিদিন কেবল কয়েকটি ঘণ্টা কাজ করতে পারতেন। এটা তাকে বাধ্য করে অন্য সকল বিষয় থেকে মুখ ফিরিয়ে কেবল প্রকৃত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মনোযোগী হতে। যার ফলে তার কার্যকারিতা নষ্ট হয়নি। অন্যদিকে, তিনি, যেমনটা চার্চিল একবার বলেছিলেন, “যেকোনো বিষয়বস্তুর হৃদপি-” (খড়ৎফ ঐবধৎঃ ড়ভ ঃযব গধঃঃবৎ) এ পরিণত হন এবং যুদ্ধরত ওয়াশিংটনে অন্য যে কারো থেকে সর্বাধিক সফল একজন ব্যক্তি হিসাবে পরিগণিত হন।

এটা অবশ্যই একটা চরম অবস্থা, তবে এটা এই বিষয়টাকে স্পষ্ট করে যে যদি কেউ চেষ্টা করে তবে সে তার নিজের সময়ের উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং আরো নির্দেশ করে যে, কার্যকারিতা না হারিয়েও একজন ব্যক্তি চাইলে সময়-অপচয়কারীদের থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারে।

 

চিত্র: হ্যারি হপকিন্স, যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব। তথ্যসূত্র: যঃঃঢ়ং://বহ.রিশরঢ়বফরধ.ড়ৎম/রিশর/ঐধৎৎুথঐড়ঢ়শরহং


সময়-অপচয়কারীদের বাদ দেওয়া


এই তিনটি ডায়গোনস্টিক অনুৎপাদনশীল ও সময়-নষ্টকারী কর্মকা- নিয়ে কাজ করে যার উপর প্রত্যেক নির্বাহীর আংশিক হলেও নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। প্রত্যেক জ্ঞানসংশ্লিষ্ট কর্মী ও নির্বাহীর তা জানতে চাওয়া উচিত। ব্যবস্থাপকগণ, প্রসঙ্গত, অদক্ষ ব্যবস্থাপনা ও ত্রুটিপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের কারণে যে সময়-নষ্ট হওয়ার পরিবেশ সৃষ্টি হয় সে ব্যাপারেও তাদের সমান গুরুত্ব দেওয়া জরুরি। অদক্ষ ব্যবস্থাপনা সকলের সময় নষ্ট করে। তাছাড়া সবার উপর, এটা ব্যবস্থাপকেরও সময় নষ্ট করে।


প্রথম কাজ


১. এখানে প্রথম কাজ হলো সময় নষ্টকারী বস্তু যা নিয়মতান্ত্রিকতা ও দূরদর্শিতার অভাবের কারণে সৃষ্টি হয় তা খুঁজে বের করা। যে লক্ষণটি খুঁজে দেখতে হবে তা হলো চলমান সংকট কেন ঘটছে, যে সংকট কয়েক বছর পরপর ফিরে আসে। যে সংকট দুইবার সংগঠিত হয় তা আর যেন না ঘটে সে ব্যাপারে সদাসতর্ক থাকতে হবে।

বার্ষিক ইনভেনটরি সংকটের অন্তর্ভুক্ত (ইনভেনটরি মানে আপনার দোকান বা কোম্পানির পণ্যের তালিকা বছরে একবার মিলিয়ে দেখা। যত ধরনের পণ্য আছে, গুদামজাত অবস্থায় বা বিক্রি হয়েছে বা কোম্পানির সম্পদ সবকিছু পুনর্নিরীক্ষণ করা হয়।)। কম্পিউটারের কারণে আমরা পূর্বের তুলনায় অত্যধিক বীরত্ব ও ব্যয়ের বিনিময়ে আমরা এর মোকাবিলা করতে পারি সত্য, তবে বড়সড় উন্নতি বলা যায় না।

একটি চলমান সংকট সর্বদা পূর্ব থেকে পরিদৃষ্ট হওয়া চাই। তবেই একে হয় প্রতিরোধ করা যাবে বা একটি নিয়মতান্ত্রিকতায় আনা যাবে যা একজন কেরানি সামলাতে সক্ষম হবে। “রুটিনের” সংজ্ঞা হলো এটা অদক্ষ মানুষকে বিবেচনাহীনভাবে এমন কাজ করার সক্ষমতা দান করে যা একজন প্রতিভাধর ব্যক্তির কাছাকাছি পর্যায়ের। কারণ একটি রুটিন নিয়মতান্ত্রিক ও পর্যায়ক্রমে নির্ধারণ করা হয় সেই অভিজ্ঞতা থেকে যা একজন সক্ষম ব্যক্তি তার গতকালের সংকট থেকে শিক্ষা লাভ করেছে।

চলমান সংকট একটি প্রতিষ্ঠানের শুধুমাত্র নিম্ন পর্যায়ে সীমাবদ্ধ নয়। এটা সবাইকে পীড়া দেয়।

কয়েক বছর যাবৎ, একটি বড়সড় প্রতিষ্ঠান ডিসেম্বরের প্রথম দিকে এরকম এক সংকটের সম্মুখীন হয়। একটি তুমুল ব্যবসায়িক মৌসুমে, শেষ-চতুর্থাংশ সাধারণত বছরের সর্বনিম্ন, চতুর্থ-চতুর্থাংশের বিক্রি ও লাভ সহজে অনুমান করা যায় না। প্রতিবছর, প্রসঙ্গত, ব্যবস্থাপনা পরিষদ একটি অনুমিত উপার্জন উপস্থাপন করে থাকে যখন তারা দ্বিতীয়-চতুর্থাংশের শেষের দিকে একটি অন্তবর্তী প্রতিবেদন জারি করে তখন। তিন মাস পর, চতুর্থ কোয়ার্টারে, প্রবল ছুটাছুটি ও পুরো কোম্পানিজুড়ে জরুরি পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল ঊর্ধ্বতন ব্যবস্থাপনা পর্ষদের পূর্বাভাসকে বাস্তবায়ন করতে। তিন থেকে পাঁচ সপ্তাহ পর্যন্ত, ব্যবস্থাপকদের কেউই কোন কাজ সম্পাদন করিয়ে নিতে পারেনি। একটি কলমের খোঁচায় এই সংকট শেষ হয়েছিল; সর্বোচ্চ ব্যবস্থাপকগণ বছর শেষের নির্দিষ্ট একটি অনুমিত পরিমাণ নির্ধারণ করার পরিবর্তে একটি নির্দিষ্ট সময়ের ফলাফলের অনুমিত পরিমাণ নির্ধারণ করে। [মানে ফলাফলের ভিত্তিতে কাজ আরম্ভ করে। পূর্বে আনুমানিক একটি সংখ্যা উল্লেখ করা হত। কিন্তু এখন ফলাফলের ভিত্তিতে ভবিষ্যৎ লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়।] এটা সম্পূর্ণরূপে পরিচালক, শেয়ারের অংশীদার এবং অর্থ-সংশ্লিষ্ট সম্প্রদায়কে সন্তুষ্ট করে। তাছাড়া কয়েক বছর আগে যা সংকটের সৃষ্টি করত তা এখন কোম্পানিতে পরিলক্ষিতই হয় না-এমনকি চতুর্থ-চতুর্থাংশের ফলাফল পূর্বের ফলাফলের তুলনায় কিছুটা ভালো, যেহেতু নির্বাহীদের সময় পূর্বাভাস তৈরিতে আর ব্যয় হচ্ছে না।

 

চিত্র: ব্যবসার ক্ষেত্রে বছরের তিন মাস পর পর আয়-ব্যয় হিসাব করা হয়। তথ্যসূত্র: যঃঃঢ়ং://িি.িরহাবংঃড়ঢ়বফরধ.পড়স/ঃবৎসং/য়/য়ঁধৎঃবৎ.ধংঢ়

জনাব ম্যাকনামারা প্রতিরক্ষা সচিব হিসাবে নিযুক্ত হওয়ার পূর্বে, একই ধরনের শেষ মুহূর্তের একটি সংকট সমগ্র আমেরিকান প্রতিরক্ষা বিভাগকে প্রতি বছর নাড়া দিত, অর্থ বছরের শেষের দিকে জুনের ৩০ তারিখে। মে-জুন মাসে প্রতিরক্ষা বিভাগের প্রত্যেক ব্যবস্থাপক, সামরিক বা বেসামরিক, প্রতি অর্থবছর কংগ্রেসকর্তৃক বরাদ্দকৃত অর্থ ব্যয়ের খাত নিদারুণভাবে খুঁজে বের করত। অন্যথায়, সে ভয়ে থাকত যে তাকে টাকাটা ফেরত দিয়ে দিতে হবে। (শেষ মুহূর্তে এসে খরচ করার মাতলামি রাশিয়াতেও দীর্ঘস্থায়ী রোগে পরিণত হয়েছিল।) তবে ম্যাকনামারা দেখা মাত্রই বুঝতে পেরেছিল এই সংকটটি অপ্রয়োজনীয়। কারণ আইন অনুমোদন প্রদান করেছিল যে, প্রয়োজনের স্বার্থে অব্যবহৃত অর্থ অন্তর্বতী হিসাবের সাথে যোগ করে দেওয়া যাবে।

এক কথায়, চলমান সংকট অপরিচ্ছন্নতা ও অলসতার আলামত।

ক্স অনেক বছর আগে আমি যখন প্রথম উপদেষ্টা হিসাবে কাজ শুরু করি, তখন শিখেছিলাম কীভাবে একটি সুব্যবস্থাপনাপূর্ণ শিল্প-এলাকাকে কীভাবে অব্যবস্থপাপূর্ণ শিল্প-এলাকা থেকে আলাদা করে দেখাতে হয়। আমি শীঘ্রই জানতে পারলাম, একটি সুব্যবস্থাপূর্ণ এলাকা সম্পূর্ণ শান্ত ও হট্টগোলবিহীন থাকে। একটি কারখানা যেটা নাটকীয়তায় ভরপুর, যেখানে শিল্পের মহাকাব্য দর্শকদের সামনে উন্মোচিত হয় তা অদক্ষ ব্যবস্থাপনায় পূর্ণ থাকে। একটি সুব্যবস্থাপূর্ণ কারখানা সাধারণত একঘেয়ে হয়ে থাকে। উত্তেজনাপূর্ণ কিছুই তাতে ঘটে না, কারণ সংকট এখানে পূর্ব অনুমিত হয় এবং এটাকে রুটিনে পরিণত করা হয়।

একইভাবে একটি সুব্যবস্থাপনাপূর্ণ প্রতিষ্ঠান সাধারণত নিষ্প্রভ প্রকৃতির হয়। এ জাতীয় প্রতিষ্ঠানের নাটকীয় বস্তু হলো মৌলিক বা প্রাথমিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যা প্রতিষ্ঠানের ভবিষ্যৎ ঠিক করে দেয়। এ ধরনের প্রতিষ্ঠানে বিগত দিনের বীরত্ব নিয়ে কেউ রোমন্থন করে না।


দ্বিতীয় কাজ


২. প্রায়ই অত্যধিক জনবলের কারণে সময় অপচয়ের (ঃরসব-ধিংঃবং) সৃষ্টি হয়।

ক্স আমার প্রথম শ্রেণির পাটিগণিতে এই প্রশ্নটি এসেছিল যে, “যদি দুজন পরিখা খননকারীর একটি পরিখা বা গর্ত খনন করতে দুইদিন লাগে তবে, চারজন খননকারীর কতদিন প্রয়োজন হবে?” প্রথম শ্রেণির বই হিসাবে অবশ্যই এর উত্তর হবে একদিন। কিন্তু এ ধরনের কাজ যেখানে, প্রসঙ্গত, নির্বাহীরা সংশ্লিষ্ট তাতে হয়তো সঠিক উত্তর হবে “চার দিন”, যদি অনন্তকালের জন্য না হয়।

চারজন মানুষের জন্য হয়তো কাজটি খুবই সামান্য। কিন্তু কাজের চেয়ে যখন কর্মীর সংখ্যা বেশি হয়ে যায় তখন কাজের কাজ কিছুই হয় না। গণিতের ক্ষেত্রে এমন হলেও, বাস্তব জীবনে আমলাতান্ত্রিক কাজের অভিজ্ঞতা আমাদের ভিন্ন গল্প বলে। সাধারণত যেটা প্রচলিত তা হলো যে জনবলের আকার বড়, তারা উল্লেখযোগ্য পরিমাণ সময় কাজ করার পরিবর্তে পরস্পর আলাচারিতায় ব্যয় করে।

লোকবল অতিরিক্ত হওয়ার একটি স্পষ্ট লক্ষণ রয়েছে। যদি কোন প্রতিষ্ঠানের সিনিয়র অফিসারগণ-বিশেষত ব্যবস্থাপকরা-তাদের সময়ের একটি ক্ষুদ্র অংশ, হতে পারে দশভাগের একভাগ, কর্মচারীদের পারস্পরিক সমস্যায়, মতবিরোধ ও সংঘর্ষে, সহযোগিতার অভিযোগ ও আইনগত বিতর্ক ইত্যাদিতে ব্যয় করে, তবে এটা স্পষ্ট যে, কর্মচারীদের সংখ্যা অবশ্যই বেশি। লোকজন বেশি হলে একে অপরের কাজে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে। তারা কার্য সম্পাদনের উপকরণ হওয়ার পরিবর্তে এর প্রতিবন্ধকতারূপে আবির্ভূত হয়। অন্যদিকে একটি অনাড়ম্বর প্রতিষ্ঠানে, কর্মকর্তা-কর্মচারীরা একে অপরের সাথে ধাক্কা না খেয়ে নির্বিঘেœ চলতে পারে এবং হারহামেশা ব্যাখ্যা না দিয়েও তাদের কার্য সম্পাদন করতে পারে।

 

অধিক জনবলের অজুহাত হিসাবে পেশ করা হয় যে কর্মকর্তা হিসাবে আমাদের একজন তাপগতিবিদ্যাবিশারদের (বা একজন সুনামধন্য আইনজীবী বা অর্থনীতিবিদের) প্রয়োজন। এই বিশেষজ্ঞগণ অত বেশি ব্যবহৃত হয় না; হয়তো কখনোই ব্যবহৃত হয় না; কিন্তু “তাকে আমাদের পাশে চাই যাতে প্রয়োজনের সময় কাছে পাই।” (এবং তাকে অবশ্যই আমাদের সমস্যাবলির সাথে পরিচিত থাকতে হবে এবং শুরু থেকেই আমাদের প্রতিষ্ঠানের একজন সদস্য হয়ে থাকতে হবে।) কাজের প্রয়োজনে কোন দলে একজন ব্যক্তির সেসব জ্ঞান থাকা জরুরি যা নিয়মিত ও দীর্ঘসময় ধরে প্রয়োজন। বিশেষজ্ঞ যাদের কালে-ভদ্রে একবার প্রয়োজন হয় বা এটা-ওটা কাজে পরামর্শক প্রয়োজন হয়, তারা সর্বদা প্রতিষ্ঠানের বাইরে থাকবে। তাদেরকে প্রয়োজনের সময় নিয়োগ করা এবং একটি সম্মানী নির্ধারণ করা তাদেরকে স্থায়ীভাবে রেখে দেওয়ার থেকে অনেক কম মূল্যের যেখানে তারা একজন অস্থায়ীভাবে নিযুক্ত অথচ দক্ষ ব্যক্তি যে পুরো কোম্পানির প্রভাব বিস্তার করার সামর্থ্য রাখে। তার সার্বিক কাজ হলো অকাজ করা।


তৃতীয় কাজ


৩. সময় অপচয়ের আরেকটি সাধারণ বিষয় হলো ভুল বা ত্রুটিপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। এর লক্ষণ হলো অতিরিক্ত ও অকারণে মিটিং ডাকা।

সংজ্ঞা অনুযায়ী মিটিং বলতে বোঝায় ত্রুটিপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের প্রতি স্বীকৃতি প্রদান। কারণ একজন ব্যক্তি হয় মিটিং করবে নয়তো কাজ করবে। একজন ব্যক্তি উভয় কাজ একই সময়ে করতে পারে না। একটি চমৎকারভাবে অঙ্কিত কাঠামোতে (পরিবর্তনশীল বিশ্বে যা সকলের স্বপ্ন হয়ে থাকে) হয়তো মিটিং নামক বস্তুটির কোন অস্তিত্বই নেই। প্রত্যেকে জানে তার কাজটি করার জন্য তার কী জানা প্রয়োজন। প্রত্যেকের কাছে তার কাজ সম্পাদনের প্রয়োজনীয় উপাদান হয়তো সাথে থাকবে। আমরা মিটিং করে থাকি কারণ বিভিন্ন কাজে নিযুক্ত মানুষের সংঘবদ্ধভাবে একটি কাজ সম্পাদন করার জন্য। আমরা মিটিং করে থাকি কারণ কোন একটি কাজ সম্পন্ন করতে একজন ব্যক্তির কাছে প্রয়োজনীয় জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা থাকে না তাই। অতএব বিভিন্ন মানুষের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাকে একত্রিত করে কার্যটি সম্পাদন করা হয়।

সবসময় প্রয়োজনের চেয়ে বেশি মিটিং করা হয়ে থাকে। প্রতিষ্ঠান সর্বদা চায় সংঘবদ্ধভাবে কাজ করতে। সেই লক্ষ্যে সহযোগিতামূলক পরিবেশ সৃষ্টির জন্য একজন অভিজ্ঞ আচরণ-বিষয়ক বিজ্ঞানী নানা প্রচেষ্টা চালিয়ে যায়। যা আদতে অপ্রয়োজনীয়। তবে যদি কোন প্রতিষ্ঠানে একজন নির্বাহী খুবই অল্প সময়ের বেশি মিটিং-সম্মেলনে ব্যয় করে তবে এতে সন্দেহ নেই যে প্রতিষ্ঠানটি ত্রুটিপূর্ণ।

প্রতিটি মিটিং একাধিক ফলো-আপ মিটিংয়ের সৃষ্টি করে-আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিক, যাই হোক, উভয় ধরনের মিটিংয়ে কয়েক ঘণ্টা করে সময় ব্যয় হয়। সুতরাং সভাসমূহ উদ্দেশ্যপূর্ণভাবে পরিচালিত হওয়া চাই। একটি নির্দেশনাবিহীন মিটিং কেবল উপদ্রবই নয় বরং সাক্ষাৎ বিপদ। মোদ্দাকথা, মিটিং একটি নিয়মে পরিণত না হয়ে দৈবাৎ ও ব্যতিক্রম বিষয় হওয়া চাই। যে প্রতিষ্ঠানে সবাই সর্বদা মিটিংয়ে ব্যস্ত থাকে সে প্রতিষ্ঠানে কোন কাজই সম্পাদিত হয় না। যে সকল সময়সূচিতে একের পর এক মিটিংয়ের অস্তিত্ব দেখা যায়-যেই সময় হোক না কেন, যেমন, কর্মকর্তাগণ যদি তাদের কোম্পানিতে এক-চতুর্থাংশ বা তার বেশি নিজেদের মিটিং এ দেখতে পায়-তবে তা সময়-অপচয়কারী ত্রুটিপূর্ণ প্রতিষ্ঠান।

কিছু ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে। বিশেষ কিছু মাধ্যম আছে যার উদ্দেশ্য হলো সভা বা মিটিং করা-যেমন এরূপ কোম্পানির পরিচালকবৃন্দ তথা ডু পন্ট ও নিউজার্সির স্ট্যান্ডার্ড অয়েল যারা বিবেচনা ও অনুরোধের চূড়ান্ত মাধ্যম তবে তা কোন কিছু পরিচালনা করে না। তবে এই দুই কোম্পানি যেহেতু অনেক আগে অনুধাবন করেছিল, যে ব্যক্তিগুলো এই পরিষদে আসন লাভ করে তারা অন্য কোন কাজ করতে পারে না; ঠিক একই কারণে, যাহোক, বিচারকগণ তাদের অবসর সময়ে অ্যাডভোকেট হিসাবে কাজ করতে পারে না।

নিয়ম হিসাবে, মিটিং বা সভা একজন নির্বাহীর উপর সময় চাহিদা সৃষ্টিকারী বস্তুগুলোর অন্যতম হওয়া যাবে না। অত্যধিক মিটিং কাজের ভুল গঠন-প্রকৃতি ও ত্রুটিপূর্ণ প্রাতিষ্ঠানিক উপাদানকে নির্দেশ করে। অধিক হারে মিটিং এটা বুঝায় যে কাজটি একটি পদ বা একটি উপাদানে সীমাবদ্ধ থাকা উচিত ছিল তা বিভিন্ন পদ ও উপাদানে ছড়িয়ে গেছে। এটা আরও নির্দেশ করে যে, দায়িত্ব পরিব্যপ্ত হয়ে গেছে ও তথ্যগুলো কাক্সিক্ষত মানুষের কাছে পৌঁছায়নি।

একটি বড় কোম্পানিতে, সভাসমূহ মহামারী আকার ধারণ করার গোড়ার কারণ এনার্জি বিজনেস বা শক্তির ব্যবসার প্রথাগত অথচ অপ্রচলিত প্রতিষ্ঠান। বর বাষ্পের টারবাইনসমূহ, ১৯০০ সালেরও পূর্ব থেকে চলে আসা কোম্পানির প্রথাগত ব্যবসা, একটি বিভাগে ছিল তাদের নিজস্ব ব্যবস্থাপনা ও নিজস্ব কর্মীদের তত্ত্বাবধানে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, প্রসঙ্গত, অত্র কোম্পানি বিমানের ইঞ্জিন নির্মাণের দিকে ঝুঁকে। ফলে, অন্য একটি বিভাগে যা বিমান নির্মাণ ও প্রতিরক্ষা সামগ্রী উৎপাদনের সাথে সংশ্লিষ্ট তাতে একটি জেট বিমানের উচ্চমান সম্পন্ন ইঞ্জিন নির্মাণ করছিল। সবশেষে, তাদের একটি পারমাণবিক শক্তি বিভাগ গঠিত হয়েছিল, যা ছিল সম্পূর্ণরূপে গবেষণাগারের ফসল এবং প্রাতিষ্ঠানিকভাবে তাদের সাথে কম-বেশি এখনো সম্পৃক্ত।

তবে বর্তমানে শক্তির এই তিনটি উৎস নিজস্ব মার্কেট নিয়ে একে অপর থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। ক্রমবর্ধমানভাবে, তারা একে অপরের বিকল্পে, পাশাপাশি সম্পূরকে পরিণত হচ্ছে। তিনটির প্রতিটি মিতব্যয়ী ও লাভজনক যারা নির্দিষ্ট শর্তের ভিত্তিতে বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম তৈরি করে থাকে। এ হিসাবে তারা পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী। তবে তাদের মধ্যে দুটিকে পাশাপাশি স্থাপন করলে, একজন ব্যক্তি কার্য দক্ষতা অর্জন করে যা এক ধরনের সরঞ্জাম নিজেই অধিকার করে।

কোম্পানির যেটা প্রয়োজন ছিল তা হলো একটি স্পষ্ট ও শক্তিশালী পরিকল্পনা। এটা একটা সিদ্ধান্তের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিল যে যন্ত্র উৎপাদনের এই তিনটি বিভাগকে একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বীরূপে ব্যবহার করবে; নাকি তিনটির একটিকে প্রধান রেখে বাকি দু’টিকে তার সম্পূরক হিসাবে রাখবে; বা সবশেষে, নাকি তিনটির যেকোন দু’টিকে প্রধান রাখবে এবংকোন দু’টি প্রধান হবে? একটি ‘এনার্জি প্যাকেজ’ হিসাবে বিকশিত করা হবে। সিদ্ধান্তের প্রয়োজন ছিল বিদ্যমান মূলধনকে কীভাবে তিনটি বিভাগে ভাগ করে দিবে সে ব্যাপারেও। মোটের উপর, প্রসঙ্গত, শক্তির বা বিদ্যুতের ব্যবসার জন্য একটি প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল যা সংশ্লিষ্ট মার্কেটের বাস্তবতা তুলে ধরে, অর্থাৎ একই গ্রাহকের জন্য একই পণ্য তথা বৈদ্যুতিক শক্তি উৎপন্ন করা। তিনটি উপাদানের পরিবর্তে, প্রতিটি অন্যটি থেকে আলাদা হয়ে যায় একাধিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। প্রত্যেকের নিজস্ব আচরণ পদ্ধতি, নিয়ম-নীতি এবং নিজস্ব ক্যারিয়ার-সোপান এবং প্রত্যেকে নির্দ্বিধায় মনে করে যে, সে আগামী দশকের মাঝে সমগ্র বিদ্যুৎ ব্যবসার ৭৫ শতাংশ একাই দখল করে নিবে।

ফলে, তিনটি বিভাগই নিজেদের অব্যাহতভাবে নানা মিটিংয়ে জড়িয়ে ফেলে। যেহেতু প্রতিটি ভিন্ন ভিন্ন ব্যবস্থাপককে প্রতিবেদন দাখিল করত, সেহেতু এই মিটিংগুলো ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সকলের উপর ঝেঁকে বসে। অবশেষে, তিনটি বিভাগই তাদের মূল প্রতিষ্ঠান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। আর একজন ব্যবস্থাপকের তত্ত্বাবধানে একটি প্রাতিষ্ঠানিক শাখায় নিজেদের সংঘবদ্ধ করে। তাদের মাঝে এখনো দ্বন্দ্ব বিদ্যমান এবং বড়সড় কৌশলপূর্ণ সিদ্ধান্তসমূহ এখনো নেওয়ার বাকি আছে। তবে অন্তত এতটুকু হয়েছে যে, এই সিদ্ধন্তসমূহের প্রয়োজনীয়তা কতটুকু। অন্তত শীর্ষ ব্যবস্থাপকগণ প্রতিটি মিটিংয়ে অংশ নিয়ে এর রেফারিগিরি (খবরদারি) করে না। আর বর্তমান মিটিংয়ের সামগ্রিক সময় হলো পূর্বের মিটিংগুলোতে অপচয়কৃত সময়ের চেয়ে অনেক অল্প সময়।


চতুর্থ কাজ


৪. সর্বশেষ সময়-অপচয়কারী প্রধান বস্তু হলো তথ্যের ভুল ব্যবহার।

একটি বড় হাসপাতালের প্রশাসক (ধফসরহরংঃৎধঃড়ৎ) অনেক বছর ধরে ডাক্তারের টেলিফোনের মাধ্যমে জ¦ালাতনের স্বীকার হত। ডাক্তাররা ফোন করে তার কাছে তাদের রোগীদের যাদের হাসপাতালে ভর্তি করানো প্রয়োজন তাদের জন্য বেড চাইত। রিসিপশনে বসা ব্যক্তিরা জানত তাদের কোন “ফাঁকা বেড” নেই। তথাপি পরিচলক সবসময় কয়েকটা বেড পেয়ে যেত। রিসিপশনে থাকা লোকেরা জানতে পারত না কখন বেড ফাঁকা হয়। একজন রোগী হাসপাতাল ছেড়ে দেওয়ার পর তাদের জানানো হত না। সংশ্লিষ্ট নার্সরা অবশ্য জানত। পাশাপাশি যারা রোগীর বিল তৈরি করত তারাও জানত। রিসিপশনে থাকা ব্যক্তিরা, প্রসঙ্গত, বেড গণনা করত সকাল-৫টার দিকে-যেখানে রোগী ছাড়পত্র নিত বেলা বাড়ার পর, যখন ডাক্তার এসে একবার দেখে যেত তারপর। এই বিষয়টি সঠিকভাবে সম্পাদন করার জন্য আহামরি মেধার প্রয়োজন ছিল না; বরং দরকার ছিল নোট বা পাতার একটি অতিরিক্ত কার্বন কপি যা নার্সের হাত থেকে সামনের অফিসে পৌঁছাত।

এর চেয়েও খারাপ আরেকটি ব্যাপার আছে। তা হলো ভুল পদ্ধতিতে তথ্য সরবরাহ করা। সাধারণত এমন কাজ অনেক প্রতিষ্ঠানই করে।

উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো (সধহঁভধপঃঁৎরহম নঁংরহবংং) সাধারণত উৎপাদন পরিসংখ্যানের সমস্যায় ভোগে যেগুলো অপারেটিংয়ের লোকজনের ব্যবহারের পূর্বে রূপান্তর করে নিতে হবে। তারা “গড় প্রতিবেদন” পেশ করে যা হিসাবরক্ষকের প্রয়োজন। অপেরাটিংয়ের লোকজন অবশ্য “গড় প্রতিবেদন” চায় না বরং তারা অত্যধিক বেশি চায়-পণ্য মিশ্রণ, পণ্য-উৎপাদন উঠানামা করা, পরিচালনার দৈর্ঘ্য ইত্যাদি। তারা যা চায় তা পাওয়ার জন্য হয়তো তাদেরকে “গড় প্রতিবেদনের” সাথে মানিয়ে নিতে হবে বা নিজেদের গোপন কোন হিসাব রক্ষণা-বেক্ষণকারী প্রতিষ্ঠান থাকতে হবে। হিসাবরক্ষকের কাছে সকল তথ্য থাকে, কিন্তু কেউই, নিয়ম হিসাবে, কী প্রয়োজন তা বলতে সাহস করে না।

সময়-অপচয়কারী ব্যবস্থাপনা ত্রুটি যেমন অতিরিক্ত জনবল, ত্রুটিপূর্ণ প্রতিষ্ঠান, ভুল তথ্য সরবরাহ ইত্যাদি হয়তো দ্রুত সমাধান করা যাবে। অন্য সময়, তাদেরকে সংশোধন করতে দীর্ঘ, ধৈর্যপূর্ণ কাজের প্রয়োজন হয়। এসব কাজের ফলাফল অনেক বড় হয়ে থাকে এবং বিশেষত সময় লাভের বিষয় বিবেচনায় রাখতে হবে।


নিয়ন্ত্রণে থাকা সময়গুলোকে একত্রীকরণ


যে সকল নির্বাহীগণ তাদের সময়ের হিসাব রাখে ও তা পর্যালোচনা করে এবং তা সাজানোর চেষ্টা করে, তারা নির্ধারণ করতে পারে তাদের গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্য কতটুকু সময় অবশিষ্ট আছে। কতটুকু এমন সময় আছে যা বিবেচনাপূর্ণ, যাতে এমন কাজ সম্পাদন করা যাবে যা কোম্পানির জন্য ভূমিকা রাখে।

এটা কোন সাধারণ কাজ নয়, চাই যত কঠিনভাবে নির্বাহী সময়-নষ্টকারীদের ছাঁটাই করুক না কেন।

আমার দেখা সর্বাধিক চমৎকার উপায়ে সময়কে গুছিয়ে চলা ব্যক্তি ছিলেন একটি বড় ব্যাংকের প্রধান যার সাথে শীর্ষ ব্যবস্থাপনা বিভাগের গঠন-প্রকৃতির উপর আমি দু’বছর কাজ করেছিলাম। দু’বছর ধরে তার সাথে আমার মাসে একবার দেখা হত। তার সাথে আমার অ্যাপয়েন্টমেন্ট থাকত সবসময় দেড় ঘণ্টার। তিনি সর্বদা সেশনের জন্য প্রস্তুত থাকতেন এবং শীঘ্রই আমি আমার কাজ কী তাও শিখে নিই। কখনো আলোচ্য বিষয়ের একটি পয়েন্টের চেয়ে বেশি কথা হয়নি। তার সাথে থাকার এক ঘণ্টা বিশ মিনিট পর, প্রেসিডেন্ট আমার দিকে ফিরে বলত, “মি. ড্রুকার, আমি মনে করি আপনি এখনই এর একটি সারসংক্ষেপ তৈরি করবেন এবং আমাদের আগামীর করণীয় বিষয়ে একটি রূপরেখা তৈরি করবেন।” আর তার অফিসে এক ঘণ্টা ত্রিশ মিনিট কাটানোর পর, তিনি দরজায় দাঁড়িয়ে আমার সাথে করমর্দন করে আমাকে বিদায় করে দিতেন।

এভাবে প্রায় এক বছর চলার পর অবশেষে আমি তার কাছে জানতে চাই, “কেন এক ঘণ্টা ত্রিশ মিনিট?” তার উত্তর ছিল, “এটা খুব সহজ নয়। আমি আবিষ্কার করেছি যে, আমার মনযোগের সীমা এক ঘণ্টা ত্রিশ মিনিট। যদি আমি কোন বিষয়ে এর চেয়ে বেশি সময় কাজ করি, তবে আমি পুনরাবৃত্তি করতে থাকি। একইভাবে, আমি শিখেছি যে, গুরুত্বপূর্ণ কোন কাজকে অল্প সময়ে সুরাহা করা যায় না। একজন ব্যক্তি সেটুকু পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে না যেখানে সে বুঝতে পারে যে, অন্যজন কী বিষয়ে কথা বলছে।”

প্রতিমাসে যে সময়টা আমি তার সাথে তার অফিসে থাকি, সেই সময় একটি ফোন কলও আসে না এবং তার সহকারী তার মাথায় এসে এই বলে বাড়ি দিত না যে গুরুত্বপূর্ণ একজন ব্যক্তি সত্ত্বর তার সাথে দেখা করতে চায়। একদিন তার কাছে আমি এ ব্যাপারে জানতে চাই। তিনি বলেন, “আমার সচিবকে কড়াভাবে নির্দেশনা দেওয়া আছে যে, এ সময়ে যেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ও আমার স্ত্রী ছাড়া আর কেউ আমার কাজে ব্যাঘাত ঘটাতে না পারে। প্রেসিডেন্ট কদাচিৎ ফোন করেন এবং আমার স্ত্রী এ ব্যাপারে ভালোই জানে। আমি কাজ শেষ করা অবধি আমার সহকারী সবকিছু নিয়ন্ত্রণে রাখে। তারপর পরবর্তী আধ ঘণ্টায় আমি প্রতিটি কল ব্যাক করি। এক্ষেত্রে আমি নিশ্চিত করি যে আমি সকল বার্তা পেয়েছি। তবুও আমার মাঝে মাঝে এমন সংকটের মধ্য দিয়ে যেতে হয় যা নব্বই মিনিট বা দেড় ঘণ্টা অপেক্ষা করতে পারে না।”

বলাবাহুল্য, এই প্রেসিডেন্ট এক মাসের সেশনে অন্য যে কারো থেকে বেশি অর্জন করেছিলেন এবং তার সমকক্ষের নির্বাহীগণ একমাসের সভায় যা করতে পারে তার থেকেও বেশি কাজ করেছিলেন।

কিন্তু এই নিয়মতান্ত্রিক মানুষটিকেও তার কাজে সমস্যায় পড়তে হয়েছিল। কারণ তার সময়ের প্রায় অর্ধেক সময় কম গুরুত্বের ও গৌণ মূল্যের কাজে ব্যয় হয়ে যাচ্ছিল, এমন কাজ যা তাকে করতে হত-যেমন গুরুত্বপূর্ণ ক্লায়েন্ট যে সবেমাত্র এসেছে তার সাথে দেখা করা, কোন কোন মিটিং যা তাকে ছাড়া অনুষ্ঠিত হতে পারে তাতে অংশগ্রহণ করতে বাধ্য হওয়া; নিত্যদিনের সমস্যার সুনির্দিষ্ট সমাধান যার খবর তার কাছে পৌঁছা প্রয়োজনীয় ছিল না অথচ নিয়মিত পৌঁছাত।

যখনই আমি একজন সিনিয়রকে এই দাবি করতে দেখি যে তার সময়ের অর্ধেকেরও বেশি তার নিয়ন্ত্রণে এবং তা তার মূল্যবান সময় সে নিজেই বিবেচনাপূর্বক অতিবাহিত করে, আমি নিশ্চিত থাকি যে, তার সময় কোথায় ব্যয় হচ্ছে সে ব্যাপারে তার কোন ধারণাই নেই। শীর্ষ নির্বাহীগণের সময়ের সর্বোচ্চ এক-চতুর্থাংশ সময় তার ইচ্ছাতে ও নিয়ন্ত্রণে ব্যয় হয়, কেবল এই সময়টা সে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ব্যয় করতে পারে, এমন বিষয় যা (সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের) অগ্রগতিতে ভূমিকা রাখে, এমন বিষয় যার জন্য তাকে বেতন দেওয়া হয়। এটা যেকোন প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে সত্য-তবে শীর্ষ সরকারি অঙ্গপ্রতিষ্ঠানগুলোতে সর্বোচ্চ কর্মকর্তাদের সময়গুলো অনুৎপাদনশীল কাজে ব্যয় হওয়ার যে প্রবণতা তা অন্য যেকোন বড় প্রতিষ্ঠান থেকেও বেশি।

একজন নির্বাহী যত উপরে যায়, তার নিজের সময়ের উপর নিয়ন্ত্রণহীনতার পরিমাণ তত বাড়তে থাকে এবং কোন উৎপাদনশীল কাজে ব্যবহার হয় না। প্রতিষ্ঠান যত বড় হয়, তত তাকে ক্রিয়াশীল ও উৎপাদনমুখী রাখার পরিবর্তে সংঘবদ্ধ ও সচল রাখা বেশি জরুরি হয়ে পড়ে।

তাই ক্রিয়াশীল নির্বাহীগণ জানে যে তার গুরুত্বপূর্ণ সময়কে একত্রিতভাবে ব্যবহার করা কর্তব্য। সে জানে যে তার বড় পরিসরের সময় প্রয়োজন এবং ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সময়গুলো এক কথায় কোন সময়ই নয়। এমনকি কর্মদিবসের এক-চতুর্থাংশ সময়, যদি একত্রিতভাবে পায়, তার গুরুত্বপূর্ণ কার্য সম্পাদনের জন্য যথেষ্ট। কিন্তু অন্যদিকে তিন-চতুর্থাংশ সময়ও বেকার যদি তা বিক্ষিপ্তভাবে কাজে লাগাতে হয়।

তাই টাইম ম্যানেজমেন্ট তথা সময় ব্যবস্থাপনার জন্য সর্বশেষ গৃহীত পদক্ষেপ হতে হবে সময়কে একীভূত রেখে তা ব্যবহার করা। সেই সময়গুলো যা নথিভুক্ত ও বিশ্লেষণ করার পর নির্বাহীর কাছে মনে হবে তা তার করায়ত্তে আছে।

[ফজলে রাব্বির কথা-ব্যক্তিগতভাবে আমি অনুবাদ করি। আমি দেখেছি ৫০ মিনিট টানা কাজ করলে আমার জন্য সবচেয়ে ভালো হয়। আমি মনোযোগ ধরে রেখে কাজ করতে পারি। কিন্তু এর বেশি সময় হলেই নিজের ভেতর অস্বস্তি ও বিরক্তি তৈরি হয়। তারপর ১৫-২০ মিনিটের একটা ব্রেক নিলে আবার কাজ করার স্পৃহা তৈরি হয়। এখানে আপনাকে খুঁজে বের করতে হবে আপনি কত সময় একটানা কাজ করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন।]

কিছু চমৎকার উপায় আছে যা অবলম্বন করে এটা করা সম্ভব। কিছু লোক আছে, সাধারণত সিনিয়র কর্মকর্তাগণ, যারা সপ্তাহে একদিন ঘরে বসে কাজ করে; এটা বিশেষত সম্পাদক ও গবেষক বিজ্ঞানীদের একক দীর্ঘ সময়ে লাগাতার কাজ করার একটি সাধারণ পদ্ধতি।

অন্যান্য কর্তা-ব্যক্তি পরিচালনামূলক যেকোন কাজ-মিটিং, পুনরালোচনা, সমস্যা-নির্ণয় সেশন ইত্যাদি-সপ্তাহে নির্দিষ্ট দুই দিনের জন্য নির্ধারণ করে দিতে পারে, যেমন হতে পারে সোমবার ও শুক্রবার। আর বাকি দিনগুলোর সকালসমূহ প্রধান বিষয়ের চলমান কাজের জন্য নির্ধারণ করা যেতে পারে।

এই উপায়েই পূর্বে উল্লিখিত ব্যাংক প্রেসিডেন্ট তার সময়কে সাজাতেন। সোমবার ও শুক্রবারে থাকত তার পরিচালনামূলক কাজ, যেমন: মিটিং, চলমান বিষয়ে সিনিয়র নির্বাহীদের সাথে সাক্ষাৎ করা ইত্যাদি। তেমনিভাবে ঐদিনগুলোতে মূল্যবান গ্রাহকদের জন্যও সময় বরাদ্দ ছিল। মঙ্গলবার, বুধবার ও বৃহস্পতিবার, এই দিনগুলোর বিকালবেলা নিয়মিত কোন কাজের জন্য বরাদ্দ ছিল না-এসময় যেকোন কাজ পড়ে যেত এবং অবশ্যই কোন না কোন কাজ তিনি সর্বদা করতেন, চাই তা জরুরি কোন অফিসিয়াল সমস্যা, ব্যাংকের কোন বিদেশী প্রতিনিধি বা কোন গুরুত্বপূর্ণ গ্রাহকের হঠাৎ সাক্ষাৎকার, কিংবা হঠাৎ ওয়াশিংটন যাত্রা। তবে এই দিনসমূহের সকালবেলা তিনি গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্য বরাদ্দ রাখতেন-প্রতিটি ছিল দেড় ঘণ্টাব্যাপী।

আরেকটি চমৎকার উপায় হলো বাসায় প্রতিদিন সকালে কর্মঘণ্টা বরাদ্দ রাখা।

প্রফেসর সুন কার্লসনের গবেষণায় একজন প্রভাবশালী নির্বাহীর আলোচনায় এসেছে যে, তিনি ঘরে প্রতিদিন সকালে কাজে যাওয়ার আগে দেড় ঘণ্টা পড়াশোনা করতেন। এ সময় তার টেলিফোন সংযোগ বন্ধ থাকত। এমনকি যদি সকালে অফিসে সময়মতো পৌঁছাতে হয়, তাহলেও এ পদ্ধতি বেশ কার্যকর। কিন্তু কাজ সম্পাদনের সর্বাধিক জনপ্রিয় একটি পদ্ধতি হচ্ছে বাসায় রাতে ডিনারের পর তিন ঘণ্টা সময় কার্য সম্পাদনে অতিবাহিত করা। অথচ সেই সময়, অধিকাংশ কার্যনির্বাহী এতই ক্লান্ত থাকে যে, একটি কাজ যথাযথভাবে করার অবস্থায় থাকে না। বিশেষত মাঝবয়সী ও বৃদ্ধ বয়সের ব্যক্তিরা ঘুমাতে চলে যায়। তাদের জন্য ভোরে ওঠা রাতে ডিনারের পর কাজ করার চেয়ে বেশি সহজ। রাতে কাজ করার জনপ্রিয় একটি কারণ হলো এর খারাপ বৈশিষ্ট্যসমূহ: অনেকে মনে করে এটা একজন নির্বাহীকে তার সময়কে নিয়ন্ত্রণ করা এবং দিনের বেলা সময়কে ব্যবস্থাপনার অধীনে আনা থেকে পরিত্রাণ দেয়।

তবে যে প্রক্রিয়ায় একজন ব্যক্তি তার মূল্যবান সময়কে একক সময়ে পরিণত করার চেষ্টা করে তা তাকে কার্যে পরিণত করার ন্যায় গুরুত্বপূর্ণ নয়। অধিকাংশ ব্যক্তি তার কাজকে নিয়ন্ত্রণ করে দ্বিতীয় পর্যায়ের বা কম গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলোকে একত্রে করার মাধ্যমে। এভাবে তারা এ কাজগুলোর মাঝে একটি অবসর সময় বের করে নেয়। তবে এই প্রক্রিয়াটি বেশি কার্যকর নয় এবং বেশিদূর যেতে পারে না। কারণ এতে একজন ব্যক্তি এখনো তার মননে ও সূচিতে কম গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলোকে, এমন কাজ যা তাকে করতেই হয় যদিও তা অগ্রগতিতে কোন ভূমিকা না রাখে, অগ্রাধিকার দিয়ে দেওয়া হয়। ফলে, নতুন কোন কাজের চাপ আসলে তা তার ব্যবহারযোগ্য সময় ও ঐ সময়ের কাজের বিনিময়ে তাকে সামলাতে হয়। কয়েক দিন বা সপ্তাহের মধ্যে, তার মূল্যবান বিবেচনাপূর্বক সময়গুলো আবার হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। সে নতুন কোন সংকট, উত্তেজনা ও তুচ্ছ বিষয় দ্বারা আটকা পড়ে যায়।

প্রভাবশালী নির্বাহীগণ কতটুকু মূল্যবান সময়কে বাস্তবিক অর্থেই নিজের দাবি করতে পারে তা আন্দাজ করার মাধ্যমে যাত্রা শুরু করে। অতঃপর তারা নিরবচ্ছিন্ন সময়গুলোকে যথাযথ পরিমাণে একপাশে সরিয়ে রাখে। আর পরে যদি দেখা যায় যে, এই সংরক্ষিত সময় অন্য কোন ব্যস্ততা গ্রাস করে নিচ্ছে, তবে তারা তাদের সময়সূচিকে পুনরায় খুঁটিয়ে দেখে এবং সম্পূর্ণ উৎপাদনশীল কর্মকা-গুলোর চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের মাধ্যমে সৃষ্ট হওয়া আরও কিছু সময় চাহিদা থেকে নিস্তার লাভ করে। তারা জানে যে, পূর্বে যেমন বলা হয়েছে, একজন ব্যক্তি কদাচিৎ অতিরিক্ত কাটছাঁট করতে পারে।

সকল কার্যনির্বাহীগণ তাদের সময় ব্যবস্থাপনাকে সবসময় নিয়ন্ত্রণ করে। তারা কেবল একটি চলমান সূচি সাথে রাখে না; বরং তা সময়ে সময়ে পর্যালোচনা করে। তারা গুরুত্বপূর্ণ কাজ সম্পাদনে নিজেদের জন্য সময়সীমা বেঁধে দেয়, তাদের নিজেদের ব্যবহারযোগ্য সময়ের মূল্যায়নের ভিত্তিতে।

একজন অত্যধিক প্রভাবশালী ব্যক্তি, আমি জানি, এমন দু’টি তালিকা সাথে রাখে-একটি জরুরি কাজের এবং অন্যটি অপ্রিয় কাজের যা তাকে করতে হয়-প্রতিটিরই সময়সীমা বেঁধে দেওয়া থাকে। যখন সে তার সময়সীমা অতিক্রান্ত হয়ে যেতে দেখে, সে বুঝতে পারে তার সময় আবারো তার হাত থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে।

সময় সর্বাধিক গোপনীয় এক সম্পদ। আর যদি একে বিন্যস্ত করা না হয়, তবে অন্য কোন কিছুকে বিন্যস্ত করা যাবে না। অধিকন্তু, একজন ব্যক্তির তার সময়কে পর্যালোচনা করার একটি সহজসাধ্য অথচ নিয়মতান্ত্রিক উপায় হচ্ছে তার কাজকে পর্যালোচনা করা এবং কোন জিনিসটি আদতে গুরুত্বপূর্ণ তা ভেবে দেখা। এদের মাধ্যমেই ব্যক্তি তার সময়কে পর্যালোচনা করতে পারে।

জ্ঞান ও প্রজ্ঞার সর্বপ্রাচীন চিকিৎসাপত্র হচ্ছে “নিজেকে জানো”। নশ্বর মানুষের কাছে এটা অত্যন্ত কঠিন এক কাজ। তবে প্রত্যেকে এই অনুজ্ঞা মেনে চলতে পারে, “নিজের সময়কে জানো”। যদি সে কার্যকারিতা ও অবদান রাখার পথে নিজের নৈপুণ্য দেখাতে চায় তবে ‘নিজের সময়কে জানো’ অনুজ্ঞাটি মেনে চলতে পারে।


 




অধ্যায় ৩


আমি কী অবদান রাখতে পারি?


কর্মদক্ষ নির্বাহীগণ অবদানের উপর মনোযোগী হয়। তিনি তার কাজের মাধ্যমে ও বাহ্যিকভাবে তার লক্ষ্যে দৃষ্টি স্থির রাখেন। তিনি জানতে চান: “আমি কী অবদান রাখতে পারি যা তাৎপর্যপূর্ণভাবে আমার প্রতিষ্ঠানের কার‌্যাবলি ও এর ফলাফলে প্রভাব রাখতে সক্ষম?” তিনি তার দায়িত্বের উপর জোর দেন।

ভূমিকা রাখার প্রতি মনোযোগী হওয়া কার্যকারিতার অন্যতম চাবিকাঠি: একজন ব্যক্তির কাজে-এর আকার, ধরন, মান ও প্রভাবে; তার সাথে অন্যের সম্পর্কে-তার সিনিয়র, সহযোগী ও জুনিয়র; নির্বাহী হিসাবে বিভিন্ন উপকরণ ও মাধ্যমের ব্যবহারে যেমন মিটিং ও প্রতিবেদন।

উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নির্বাহীগণ নিচের দিকে মনোযোগ দেওয়ার প্রবণতা দেখায়। তারা ফলাফলের চেয়ে প্রচেষ্টা নিয়ে বেশি ব্যস্ত থাকে। তারা সর্বদা এই বিষয়ে পেরেশান থাকে যে, তাদের প্রতিষ্ঠান ও সিনিয়রগণ তাদের কাছে কী চায় ও তাদের জন্য নির্বাহীদের কী করা উচিত। সর্বোপরি তারা (সিনিয়র) চিন্তিত থাকে যে অথরিটি বা কর্তৃত্ব তাদের (নির্বাহী) উপর থাকা উচিত। ফলশ্রুতিতে, তারা (নির্বাহী) কার্যকারিতা ও প্রভাব হারায়।

একটি বড় ম্যানেজমেন্ট কনসালটিং ফার্মের (ব্যবস্থাপনা বিষয়ক পরামর্শ অফিস) প্রধান কর্মকর্তা কোন গ্রাহক তথা প্রতিষ্ঠানের সাথে কাজ শুরু করত ঐ প্রতিষ্ঠানের সিনিয়র কার্যনির্বাহীদের সাথে একে একে সাক্ষাৎকার নেওয়ার মাধ্যমে। সে তাদের সাথে কাজের ব্যাপারে, প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে, এর ইতিহাস ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ব্যাপারে আলাপের পর, জানতে চাইত (যদিও কদাচিৎ, তবে অবশ্যই এই শব্দগুলোর মাধ্যমে): “আপনি কী কাজ করেন যা আপনার পারিশ্রমিক গ্রহণ করাকে ন্যায়সঙ্গত প্রতীয়মান করে?” তার বর্ণনানুযায়ী, অধিকাংশ জবাব দেয়, “আমি হিসাববিভাগ পরিচালনা করি,” বা “আমি বিক্রয়-সেবার দায়িত্বে আছি।” অবশ্য সাধারণ একটি উত্তর এরকম হয়, “আমার তত্ত্বাবধানে ৮৫০ জন মানুষ কাজ করে।” গুটি কয়েক উত্তর দেয়, “আমার কাজ হলো আমাদের ম্যানেজার তথা ব্যবস্থাপকদের কাছে তাদের প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহ করা যাতে করে তারা সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে।” বা “আমার দায়িত্ব হলো ভবিষ্যতে গ্রাহকগণ কী ধরনের পণ্য চাইতে পারে তা খুঁজে বের করা,” বা “সামনে যে সিদ্ধান্তগুলো কোম্পানির প্রেসিডেন্টের নিতে হবে সেগুলোর ব্যাপারে চিন্তা করা এবং তা প্রস্তুত করা।”

যে ব্যক্তি প্রচেষ্টার উপর বেশি মনোযোগ দেয় এবং যে তার অধিনস্ত কর্মকর্তাদের উপর বেশি জোর খাটায় সে একজন অনুগত কর্মী, তার উপাধি ও পদবি যতই চড়া হোক না কেন। কিন্তু যে ব্যক্তি তার ব্যক্তিগত ভূমিকার উপর জোর দেয় এবং ফলাফলের দায়-ভার গ্রহণ করে, চাই সে যত জুনিয়রই হোক, সেই মূলত “টপ ম্যানেজমেন্ট” তথা ‘কর্মদক্ষ ব্যবস্থাপক’ শব্দ-বান্ধবটির আক্ষরিক উদাহরণ। সে নিজেকে অন্য সবার কর্মকা-ের জন্য দায়বদ্ধ জ্ঞান করে।


নির্বাহীর নিজের প্রতি নিজের প্রতিজ্ঞা


ব্যক্তিগত ভূমিকা বা অবদানের উপর জোর প্রদান নির্বাহীর মনোযোগকে তার নিজের বিশেষত্ব, নিজের সংকীর্ণ দক্ষতা, নিজের বিভাগ ইত্যাদি থেকে সরিয়ে সামগ্রিক কার্যক্রমের উপর নিবদ্ধ করে। এটা তার মনোযোগকে বাহ্যিক বিষয়ে রূপান্তর করে, একমাত্র স্থান যেখানে ফলাফল প্রতিভাত হয়। তাকে চিন্তা করতে হবে তারা সমগ্র প্রতিষ্ঠান ও এর উদ্দেশ্যাবলি, ইত্যাদির সাথে তার দক্ষতা, বিশেষত্ব, কাজ বা তার বিভাগের কী সম্পর্ক আছে। সে, অতঃপর, গ্রাহক, ক্লায়েন্ট বা রোগী প্রমুখের দৃষ্টিকোণ থেকেও চিন্তা করতে শেখে। কোম্পানি যা উৎপাদন করে তার মূল কারণ হচ্ছে গ্রাহক, ক্লায়েন্ট বা রোগী প্রমুখ। চাই তা কোন ভোগ্যপণ্য হোক বা সরকারি নীতি কিংবা হোক স্বাস্থ্যসেবা। ফলে সে কী করে এবং কীভাবে করে তা বস্তুগতভাবে ভিন্ন হয়ে যায়।

যুক্তরাষ্ট্র সরকারের বড় একটি বৈজ্ঞানিক সংস্থা কয়েকবছর আগে এই বিষয়টা বুঝতে পেরেছিল। প্রকাশনালয়ের পুরনো পরিচালকটি অবসর গ্রহণ করে। তিনি ত্রিশের দশকে প্রতিষ্ঠানটির সূচনালগ্ন থেকে তাদের সাথে ছিলেন এবং তিনি না ছিলেন বিজ্ঞানী, না প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত লেখক। যে প্রকাশনাটি তিনি চালু করেছিলেন তা পেশাগত সাজসজ্জার অভাবে প্রায়ই সমালোচনার স্বীকার হত। তার স্থলে একজন উপযুক্ত বিজ্ঞান লেখককে নিয়োগ করা হয়। শীঘ্রই প্রতিষ্ঠানে একটা পেশাদারি ভাব চলে আসে। কিন্তু বিজ্ঞান সম্প্রদায় যাদের উদ্দেশ্যে এত আয়োজন তারা প্রতিষ্ঠানটির প্রবন্ধ-রচনা পড়া ছেড়ে দেয়। একজন মান্যবর বিশ্ববিদ্যালয় বিজ্ঞানী, যিনি দীর্ঘদিন প্রতিষ্ঠানটির সাথে নিবিড়ভাবে কাজ করে গেছেন, অবশেষে প্রশাসককে (ধফসরহরংঃৎধঃড়ৎ) জানান, “পূর্ববর্তী পরিচালক আমাদের জন্য লিখতেন। আর আপনার নতুন লোক যেন আমাদের দিকে লেখা ছুঁড়ে মারছে। (ঞযব ভড়ৎসবৎ ফরৎবপঃড়ৎ ধিং ৎিরঃরহম ভড়ৎ ঁং; ুড়ঁৎ হবি সধহ ৎিরঃবং ধঃ ঁং.)”

পুরনো পরিচালক এ প্রশ্নটি করেন যে, “এই প্রতিষ্ঠানের ফলাফলে অবদান রাখতে আমি কী করতে পারি?” তার উত্তর ছিল, “আমি তরুণ বিজ্ঞানীদের আমাদের প্রতিষ্ঠানে কাজ করতে আগ্রহী করে তুলতে পারি, তাদেরকে আমাদের হয়ে কাজ করতে প্রলুব্ধ করতে পারি।” কাজেই, তিনি প্রধান সমস্যাবলি, গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তসমূহ এবং এমনকি কোম্পানির অভ্যন্তরীণ বড়সড় বিতর্ক ইত্যাদির উপর জোর দিতেন। আর এটি তাকে একাধিকবার তার প্রশাসনের সাথে সরাসরি দ্বন্দ্বে অবতীর্ণ করে। কিন্তু পুরনো লোকটি ছিল অনড়। তিনি বলতেন, “আমাদের প্রকাশনার জন্য পরীক্ষা এটা নয় যে আমরা তাদের পছন্দ করি কিনা; আসল পরীক্ষা হলো কীভাবে এত এত তরুণ বিজ্ঞানী আমাদের কাছে কাজের জন্য আবেদন করবে এবং তারা কতটা উপযুক্ত হবে।”

আমি কী অবদান রাখতে পারি তা জানতে চাওয়ার মানে হলো কাজের জন্য অব্যবহৃত ও সুপ্ত যোগ্যতাকে খুঁজে বের করা। যাকে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক পদে চমৎকার কাজ মনে করা হয় তা মূলত কাজের অবদানের পূর্ণ যোগ্যতার ফ্যাকাশে ছায়া।

আমেরিকার বড় বাণিজ্যিক ব্যাংকের এজেন্সি বিভাগকে সাধারণত লাভজনক অথচ একঘেয়ে কাজ মনে করা হয়। এই বিভাগটি কর্পোরেশনের নিরাপত্তার জন্য রেজিস্ট্রার (নিবন্ধক) এবং পণ্য স্থানান্তর প্রতিনিধি হিসাবে, টাকার বিনিময়ে, কাজ করে। এটা নথিতে থাকা স্টক-হোল্ডারদের নাম সংগ্রহ করে, সেগুলোকে তালিকাভুক্ত করে ও তাদের লাভের চেকটা তাদের কাছে হস্তান্তর করে এবং এরকম নানা কেরানি প্রকৃতির কাজ করে থাকে-এসব কিছু নির্ভুলতা ও অত্যধিক দক্ষতার দাবি রাখে-কিন্তু আদতে ব্যাপারটা দুর্দান্ত এক কল্পনায় পর্যবসিত হয়।

অথবা কার্যকর হতে পারে যতক্ষণ না নিউ ইয়র্কের বড় একটি ব্যাংকের এক এজেন্সির নতুন ভাইস-প্রেসিডেন্ট জিজ্ঞেস করেছিল, “এজেন্সি কী অবদান রাখতে পারে?” তারপর তিনি অনুভব করেছিলেন যে, তার কাজটি তার সাথে ব্যাংকের গ্রাহকদের জ্যেষ্ঠ অর্থ নির্বাহী কর্মকর্তার সরাসরি যোগাযোগের সুযোগ করে দেয়া। গ্রাহকরাই এখানে ব্যাংকের সকল সেবায় “ক্রয় সিদ্ধান্ত” গ্রহণকারী ছিল-ডিপোজিট, লোন, বিনিয়োগ, পেনশন-তহবিল ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি। অবশ্য এ কাজ করতে হলে এজেন্সির নিজেকে দক্ষতার সাথে পরিচালিত হতে হবে। তবে যেহেতু এই নতুন ভাইস-প্রেসিডেন্ট অনুধাবন করেছিলেন, এর বড় সম্ভাবনা রয়েছে ব্যাংকের অন্যান্য সব সেবা বিক্রয়ের ক্ষেত্রে প্রণোদনা দিতে। এজেন্সির নতুন প্রধান কর্মকর্তার তত্ত্বাবধানে, এজেন্সি, পূর্বে একটি দক্ষ কেরানি সম্প্রদায় ছিল। আর বর্তমানে পুরো ব্যাংকের জন্য সফল মার্কেটিং জনশক্তিতে পরিণত হয়।

যেসব কার্যনির্বাহী নিজেদের জিজ্ঞাসা করে না, “আমি কী অবদান রাখতে পারি?” তাদের নির্ধারিত লক্ষ্য কেবল ছোটই হয় না বরং ভুল হয়। অধিকন্তু, তারা তাদের অবদানকে হয়তো সংকীর্ণভাবে সংজ্ঞায়িত করে।

“অবদান মানে কী?” অবদান বিষয়টাকে দুইটি ব্যাখ্যা দিয়ে বোঝানো সম্ভব। হয়তো এর দ্বারা দুইটি ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি বা আঙ্গিককে বোঝানো হবে। কারণ প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের তিনটি বড় জায়গায় কাজ করতে হয় (ঋড়ৎ বাবৎু ড়ৎমধহরুধঃরড়হ হববফং ঢ়বৎভড়ৎসধহপব রহ ঃযৎবব সধলড়ৎ ধৎবধং: ওঃ হববফং ফরৎবপঃ ৎবংঁষঃং; নঁরষফরহম ড়ভ াধষঁবং ধহফ ঃযবরৎ ৎবধভভরৎসধঃরড়হ; ধহফ নঁরষফরহম ধহফ ফবাবষড়ঢ়রহম ঢ়বড়ঢ়ষব ভড়ৎ ঃড়সড়ৎৎড়.ি):

১. এর সরাসরি ফলাফলের প্রয়োজন হয়;

২. মান নির্ধারণ ও তা নিশ্চিতকরণ;

৩. এবং মানুষকে আগামীর জন্য তৈরি করা ও উন্নত করা।

যদি এই তিনটার কোনটাতে কাজ করা না হয়, প্রতিষ্ঠান যত বড়ই হোক না কেন এটা ক্ষয় হতে হতে একসময় নিঃশেষ হয়ে যায়। এই তিনটাকে, অতএব, প্রত্যেক নির্বাহীর অবদানের অংশীভূত করতে হবে। তবে তাদের তুলনামূলক গুরুত্ব নির্বাহীর গুরুত্ব ও ব্যক্তিত্ব ভেদে ও প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন ভেদে বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে।

সরাসরি ফলাফল (ফরৎবপঃ ৎবংঁষঃং ড়ভ ধহ ড়ৎমধহরুধঃরড়হ) প্রতিষ্ঠানের দৃষ্টিগ্রাহ্য একটা ব্যাপার। এটা একটা নিয়মও বটে। একটি ব্যবসাতে, তা অর্থনৈতিক ফলাফল হয়ে থাকে, যেমন বিক্রি ও মুনাফা। একটি হাসপাতালে তা রোগীর যত্ন ইত্যাদি হয়ে থাকে। তবে অনেক ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ ফলাফলও সম্পূর্ণরূপে স্পষ্ট হয় না, যেমনটা ব্যাংকের এজেন্সির ভাইস-প্রেসিডেন্টের উদাহরণ থেকে প্রতীয়মান হয়। আর যখন সন্দেহের সৃষ্টি হয় যে সরাসরি ফলাফল কতটুকু হওয়া উচিত, তখন কোন ফলাফলই আর পাওয়া যায় না।

একটি উদাহরণ হলো গ্রেট ব্রিটেনের জাতীয় বিমান-সংস্থার কার্যকারিতা (বা তাদের অকার্যকারিতা)। তারা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান হিসাবে পরিচালিত হবে এটাই কাম্য ছিল। পাশাপাশি তারা বৃটেনের জাতীয় নীতির এবং কমনওয়েলথের সংহতি রক্ষার উপকরণ হিসাবে কাজ করবে। কিন্তু ব্যাপকভাবে তারা কাজ করেছে বৃটিশ বিমান ইন্ডাস্ট্রিকে বাঁচিয়ে রাখার স্বার্থে। সরাসরি ফলাফলের (ফরৎবপঃ ৎবংঁষঃং ড়ভ ধহ ড়ৎমধহরুধঃরড়হ) তিনটি ভিন্ন ভিন্ন ধারণার মাঝে পিষ্ট হয়ে, তারা এই তিনটির বিচারে খুব বাজেভাবে সাড়া প্রদান করেছে।

[ফজলে রাব্বির কথা-তিনটি বিষয়ের বিচারে গ্রেট ব্রিটেনের জাতীয় বিমান-সংস্থা খুব বাজেভাবে সাড়া প্রদান করেছে। এ তিনটি বিষয় হচ্ছে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান হিসাবে তারা পরিচালিত হবে, তারা বৃটেনের জাতীয় নীতির এবং কমনওয়েলথের সংহতি রক্ষার উপকরণ হিসাবে কাজ করবে। আর তৃতীয় এবং প্রকৃত অর্থে তারা কাজ করেছে বৃটিশ বিমান ইন্ডাস্ট্রিকে বাঁচিয়ে রাখার স্বার্থে। এই তিনটি কাজ করতে গিয়ে সরাসরি ফলাফলের ভিত্তিতে তারা খুব বাজেভাবে সাড়া প্রদান করেছে।]

সরাসরি বা প্রত্যক্ষ ফলাফল সর্বদা প্রথমে আসে। একটি প্রতিষ্ঠানের যত্ন ও পরিচর্যায় এই তিনটি সেই ভূমিকাই পালন করে যে ভূমিকা মানবদেহে পুষ্টির যোগান দিতে ক্যালোরি (পধষড়ৎরবং) পালন করে থাকে। কিন্তু যেকোন প্রতিষ্ঠানের তাদের মান নির্ধারণ ও তা সর্বদা নিশ্চিত রাখার জন্য অঙ্গীকারাবদ্ধ থাকা চাই, যেভাবে একটি মানবদেহের মাঝে ভিটামিন ও মিনারেল থাকা চাই। প্রতিষ্ঠানের এমন কিছু তো থাকা চাই যা তাকে পরিচিত করে তুলবে যার জন্য তার অস্তিত্ব টিকে থাকবে, অন্যথায় এটা অপ্রতিষ্ঠানিক ব্যবস্থায় রূপ নিবে; যেখানে থাকবে সন্দেহ ও স্থবিরতা (পড়হভঁংরড়হ ধহফ ঢ়ধৎধষুংরং)। একটি ব্যবসাতে, মানের নিশ্চয়তা হতে পারে টেকনিকাল বা প্রযুক্তিগত নেতৃত্বের দিক দিয়ে অথবা (যেমনটা সিয়ার্স রোবাকের-ঝবধৎং জড়বনঁপশ ক্ষেত্রে) হতে পারে আমেরিকান পরিবারগুলোর জন্য উপযুক্ত পণ্য ও সেবা খুঁজে বের করা এবং সেগুলোকে সর্বনিম্ন দামে ও সর্বোচ্চ গুণগতমানে উৎপাদন করা।

গুণগতমানের প্রতিশ্রুতি, ফলাফলের মতো ততটা স্পষ্ট নয় (াধষঁব পড়সসরঃসবহঃং, ষরশব ৎবংঁষঃং, ধৎব হড়ঃ ঁহধসনরমঁড়ঁং)।

যুক্তরাষ্ট্রের কৃষিবিভাগ দীর্ঘদিন ধরে দু’টি মৌলিক অসঙ্গত মানদ-ের মাঝে ক্ষতবিক্ষত হয়ে আসছে-একটি হলো কৃষি উৎপাদনশীলতা এবং অন্যটি হলো “দেশের মেরুদ-” হিসাবে “পারিবারিক খামার।” প্রথমটি রাষ্ট্রকে কৃষি-শিল্প বিপ্লবের দিকে নিয়ে যাচ্ছে, যা অত্যধিক যন্ত্র নির্ভর ও শিল্পোন্নত এবং বৃহৎ বাণিজ্যিক ব্যবসা। আর দ্বিতীয়টি মূলত আবেগের চরিতার্থকরণ যা অনুৎপাদনশীল গ্রামীণ প্রলেতারিয়েত বা দরিদ্রতম শ্রেণিকে সমর্থন করে। কিন্তু যেহেতু খামার নীতি-অন্তুত অল্প ক’দিন আগ পর্যন্ত-দু’টি মানদ-ের মাঝে দোদুল্যমান, সেহেতু এটা সর্বসাকুল্যে যা করতে সক্ষম হয়েছে তা হলো প্রচুর পরিমাণে অর্থ ব্যয় করা।

সবশেষে বলতে হয়, প্রতিষ্ঠান হলো, বৃহৎ অর্থে, নৈতিক মানদ-ের সীমাবদ্ধতাগুলো অতিক্রম করার মাধ্যম যাতে করে যেকোনো ব্যক্তি অবদান রাখতে সক্ষম হয়। যে প্রতিষ্ঠান নিজেকে টিকিয়ে রাখতে সক্ষম নয় তা ব্যর্থ প্রতিষ্ঠান। অতএব একটি প্রতিষ্ঠানকে আজকে এমন মানুষ নিয়োগ দিতে হবে যে বা যারা আগামীকাল বা ভবিষ্যতে প্রতিষ্ঠানকে চালিয়ে নিয়ে যাবে। একে তার মানবসম্পদকে সর্বদা নবায়ন করতে হবে। এর উচিত অবিচ্ছিন্নভাবে তার মানবসম্পদকে হালনাগাদ করা। পরবর্তী প্রজন্মের উচিত বর্তমান প্রজন্ম যে শ্রম ও ত্যাগ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রদান করেছে তাকে মেনে নেওয়া। অতঃপর তাদের উচিত তাদের পূর্বসূরিদের উপর ভর করে একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করা যা তাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য ভিত্তি হিসাবে কাজ করবে।

একটি প্রতিষ্ঠান যা কেবল বর্তমানের ভিশন, নৈপুণ্য ও পূর্ণতার মাত্রা নিয়ে টিকে থাকতে চায়, তারা নিজেদেরকে মানিয়ে নেওয়ার সক্ষমতা ক্ষয় করে ফেলেছে। আর যেহেতু মানব-সম্পর্কের ব্যাপারে কেবল এবং কেবল একটি বিষয় সত্য আর তা হলো পরিবর্তন। সুতরাং অপরিবর্তনশীল কোনো প্রতিষ্ঠান আগামীকালের কোন পরিবর্তনের মাঝে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে সক্ষম হবে না।

একজন কার্যনির্বাহীর অবদানের প্রতি মনোনিবেশ মানুষকে উন্নত করার ক্ষেত্রে নিজেই একটি মজবুত চালিকাশক্তি। মানুষ তাদের উপর আরোপিত চাহিদার মাত্রা অনুযায়ী নিজেদের মানিয়ে নেয় বা নিতে পারে। যে নির্বাহী নিজের দৃষ্টি অবদানের উপর নিবদ্ধ করে, সে তার সাথে যারা কাজ করে তাদের দৃষ্টি ও মানকেও উন্নত করে।

একজন নতুন হাসপাতাল প্রশাসক, তার প্রথম স্টাফ মিটিং এ, চিন্তা করল যে, অত্যন্ত জটিল একটি বিষয়ে সবার সম্মতির সাথেই সুরাহা হয়ে গেছে, যখন কেউ একজন অংশগ্রহণকারী জানতে চাইল যে, “এই সমাধান কি নার্স ব্রায়ানকে সন্তুষ্ট করেছে?” মুহূর্তেই আবার বিতর্ক শুরু হয়ে যায় এবং তা চলতেই থাকে যতক্ষণ না সমস্যাটির আরও অধিক উচ্চাভিলাষী সমাধান পেশ করা হয়েছিল।

নার্স ব্রায়ান, প্রশাসক জানতে পারে, দীর্ঘদিন হাসপাতালে সেবা দিয়েছিল। তার বিশেষ কোন পদবি ছিল না। এমনকি কখনো সুপারভাইজরও ছিল না। কিন্তু যখনই তার ফ্লোরে রোগীদের পরিচর্যার ব্যাপারে কোন সিদ্ধান্তের বিষয় আসত, নার্স ব্রায়ান জিজ্ঞাসা করত, “আমরা কি এই রোগীর জন্য আমাদের সাধ্যের সর্বোচ্চটুকু করছি?” নার্স ব্রায়ানের ফ্লোরের রোগীরা অন্যান্য ফ্লোরের চেয়ে ভালোভাবে ও দ্রুত আরোগ্য লাভ করত। ধীরে ধীরে বছরের পর বছর, পুরো হাসপাতাল যা “নার্স ব্রায়ানের নীতি” সেটাকেই গ্রহণ করে নেয়। অন্যভাবে বললে, তারা শিখে নিয়েছিল যে, “আমরা কি অত্র হাসপাতালের উদ্দেশ্যানুযায়ী অবদান রাখছি?”

যদিও প্রায় দশ বছর আগে নার্স ব্রায়ান অবসর গ্রহণ করেছিল, তবুও তার রেখে যাওয়া মানদ- প্রশিক্ষণ ও পদবিতে তার চেয়ে শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিদের উপর প্রভাব বিস্তার করত।

অবদান রাখার প্রতিশ্রুতি মূলত দায়িত্বশীলতার সাথে কার্যকারিতা পালন করার প্রতিশ্রুতিকে বোঝায়। এটা ছাড়া, একজন মানুষ নিজের সাথে প্রতারণা করে, তার প্রতিষ্ঠানকে বঞ্চিত করে এবং যাদের সাথে সে কাজ করে তাদেরকে প্রতারিত করে।

কার্যনির্বাহীর ব্যর্থতার সর্বাধিক সাধারণ একটি কারণ হলো তার নতুন পদের চাহিদার অনুপাতে পরিবর্তন হওয়ার অক্ষমতা বা অনীহা। যে নির্বাহী তার স্থানান্তার বা পদোন্নতির পূর্বে সাফল্যের সাথে যে কাজ করেছিল তাই করতে থাকে সে প্রায় ব্যর্থতার দ্বারপ্রান্তে আছে। কোম্পানির ফলাফলের ক্ষেত্রেও কোনো পরিবর্তন আসে না, কারণ সে নিজের প্রতি নিজে অবদান রাখার জন্য কোনো প্রতিজ্ঞা করেনি। এর ফলে কর্মক্ষমতার তিনটি মাত্রার মাঝে তুলনামূলক গুরুত্বও পরিবর্তন হয়। যে নির্বাহী এই বিষয়টি বুঝতে অক্ষম আকস্মিকভাবে সে ভুল কাজ ভুলভাবে করে বসবে-এমনকি যদিও সে তার পূর্বের কাজে যেভাবে ঠিক ঠিক উপায়ে করেছিল সেভাবে করে তবুও। [কারণ বর্তমান পদ-পদবি ও দায়িত্ব পালনের জন্য তাকে যে ধরনের পরিবর্তন নিজের মধ্যে আনা দরকার সে তা আনেনি।]

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ওয়াশিংটনের কার্যনির্বাহী হিসাবে অনেক উপযুক্ত মানুষের ব্যর্থ হওয়ার পিছনে এটাই ছিল মূল কারণ। ওয়াশিংটনের রাজনৈতিক হওয়া বা যেসব মানুষ নিজেদের মতো ছিল তারা হঠাৎ নিজেদের একটি বড় মেশিনের চাকায় দেখতে পায়। এ ব্যাপারটা ছিল সর্বোচ্চ অবদান রাখার জায়গা। অসংখ্য মানুষ নিজেদের ওয়াশিংটনের কার্যনির্বাহী হিসাবে যথার্থ প্রমাণিত করেছিল যদিও তাদের কোন রাজনৈতিক বোধ ছিল না বা হাতে গণা কজন মানুষের সাথে আইন অনুশীলনের চেয়ে বড় কোন প্রতিষ্ঠানে কাজ করেনি। রবার্ট ই. শেরউড ছিলেন দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধের তথ্য সংক্রান্ত বিশাল অফিসের ডারেক্টর (ঙভভরপব ড়ভ ডধৎ ওহভড়ৎসধঃরড়হ)। তিনি উক্ত অফিসের সর্বাধিক প্রভাবশালী প্রশাসক ছিলেন। তিনি পূর্বে লেখালেখির সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন (ক্ষমতার কার্যকারিতার উপর লিখিত সর্বাধিক বোধগম্য বইসমূহের একজন লেখক। বই: জড়ড়ংবাবষঃ ধহফ ঐড়ঢ়শরহং (ঘবি ণড়ৎশ, ঐধৎঢ়বৎ ্ জড়,ি ১৯৪৮) এর জন্য তিনি আত্মজীবনী বিভাগে পুলিৎজার পুরস্কার (১৯৪৮) পান)। তিনি ছিলেন একজন নাট্যকার যার পূর্বেকার “প্রতিষ্ঠান” ছিল তার নিজের একটি টেবিল ও টাইপরাইটারের সমন্বয়ে গঠিত।

 

চিত্র: রবার্ট ই. শেরউড, দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধের তথ্য সংক্রান্ত অফিসের ডারেক্টর। তথ্যসূত্র: যঃঃঢ়ং://বহ.রিশরঢ়বফরধ.ড়ৎম/রিশর/জড়নবৎঃথঊ.থঝযবৎড়িড়ফ

যে সকল ব্যক্তি যুদ্ধচলাকালীন ওয়াশিংটনে সফল হয়েছিল তারা অবদানের উপর জোর দিয়েছিল। ফলে, তারা যা করেছিল এবং তাদের কাজে (তিনটি) মানদ-ের প্রতিটিতে যে তুলনামূলক গুরুত্ব প্রদান করেছিল, উভয় কাজের পরিবর্তন সাধিত করেছিল। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় ব্যর্থরা কঠোর শ্রম দিয়েছিল। কিন্তু তারা নিজেদের চ্যালেঞ্জ দিতে পারেনি এবং তাদের প্রচেষ্টাকে পুনঃনির্দেশ প্রদানের প্রয়োজনীয়তা অনুভবে ব্যর্থ হয়।

ক্স সাফল্যের আরেকটি অনন্য উদাহরণ হলো এক ব্যক্তি যিনি তার ষাট বছর বয়সে একটি বড় ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের প্রধান কার্যনির্বাহী হন যাদের দেশব্যাপি ছড়ানো অসংখ্য শাখা দোকান আছে। এই ব্যক্তিটি বিশ কিংবা তারও বেশি সময় ধরে কোম্পানির দ্বিতীয় স্তরে চাকরিরত ছিলেন। তিনি সন্তুষ্টচিত্তে একজন অবসর গ্রহণেচ্ছুক কড়া কার্যনির্বাহীর তত্ত্বাবধানে কাজ করেন যে তার চেয়ে বয়সে কয়েক বছর ছোট ছিল। তিনি কখনো প্রেসিডেন্ট হওয়ার প্রত্যাশা করেননি। কিন্তু তার বস হঠাৎ করে পঞ্চাশ বছর বয়সে মারা যায় এবং তার বিশ্বস্ত প্রতিনিধিকে তার দায়িত্ব গ্রহণ করতে হয়।

নতুন প্রধান একজন অর্থনৈতিক কর্মকর্তা হিসাবে এসেছিলেন এবং পরিসংখ্যানে দক্ষ ছিলেন-ব্যয় নির্ণয় পদ্ধতি, ক্রয় ও বর্ণনা তালিকা প্রণয়ন, নতুন নতুন দোকানসমূহের অর্থায়ন, বাণিজ্য অধ্যয়ন ইত্যাদি। সাধারণত লোকেরা ছিল তার কাছে একেকটা ছায়াদার মূর্তির মতো। তবে যখন তিনি হঠাৎ নিজেকে প্রেসিডেন্ট হিসাবে আবিষ্কার করেন, তিনি নিজের কাছে জানতে চান, “এমন কী কাজ যা একমাত্র আমিই করতে পারি এবং যদি ভালোমতো করা যায়, এই কোম্পানিতে প্রকৃত অর্থেই একটি পার্থক্য তৈরি করে দিবে? কাজটি হবে, সত্যি সত্যিই একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান, তিনি ইতি টানেন, ভবিষ্যতে হবে এমন ব্যবস্থাপকদের উন্নত করা। কোম্পানি নিজেই তার নির্বাহী কর্মকর্তা উন্নয়ন নীতির কারণে অনেক বছর যাবৎ গর্ব করে আসছিল। তবে, নতুন প্রধান নির্বাহী মন্তব্য করেন, “একটি নীতি নিজে কিছুই করতে পারে না। আমার অবদান হবে এটা নিশ্চিত করা যে এই নীতি যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে।”

তখন থেকে, তার কর্মজীবনের শেষদিন অবধি, তিনি মধ্যাহ্নভোজ থেকে ফেরার পথে অফিসার বিভাগ দিয়ে সপ্তাহে তিন দিন হেঁটে যেতেন এবং যেতে যেতে পর্যবেক্ষক কমিটিতে থাকা তরুণ অফিসারদের আট-দশটা ফাইল বিক্ষিপ্তভাবে হাতে নিতেন। তার অফিসে ফিরে এসে, প্রথম ব্যক্তির ফাইলটি খুলে দেখতেন, দ্রুত একে স্ক্যান করে নিতেন এবং ঐ ব্যক্তির বসকে ফোন করতেন। “মি. রবার্টসন, নিউ ইয়র্ক থেকে প্রেসিডেন্ট বলছি। আপনার একজন কর্মী, নাম জো জোনস। আপনি না তার ব্যাপারে সুপারিশ করেছিলেন যে তাকে এমন একটি জায়গায় রাখা হোক যেখানে পণ্যদ্রব্য বিপণনের অভিজ্ঞতা লাভ করতে পারবে? আপনি করেছিলেন। তাহলে কেন আপনি এ ব্যাপারে আর কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি?” এবং ঐ ব্যক্তিটি হয়তো পদাবনতি লাভ করে।

পরবর্তী ফাইলটি খোলা হয়, তিনি তখন অন্য একজন ব্যবস্থাপককে ফোন করেন অন্য একটি শহরের: “মি. স্মিথ, নিয় ইয়র্ক থেকে প্রেসিডেন্ট বলছি। আমি লক্ষ করেছি যে, আপনি আপনার একজন কর্মী, ডিক রো, এর ব্যাপারে সুপারিশ করেছেন তাকে যেন এমন একটি পদে রাখা হয় যেখানে থেকে সে দোকানের হিসাব-নিকাশের কাজ শিখতে পারবে। আমি সবেমাত্র দেখতে পেলাম আপনি কর্মীর ব্যাপারে সুপারিশের নিয়মিত খোঁজ-খবর রেখেছেন। আমি আপনাকে বলতে চাই, আমি কত আনন্দিত হয়েছি তা বলে বোঝাতে পারব না এটা দেখে যে, আপনি আমাদের তরুণ কর্মীদের মানোন্নয়নে কাজ করছেন।”

এই ব্যক্তিটি তার স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণের অল্প কয়েক বছর আগে প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব হাতে নেন। তবে বর্তমানে, দশ বা পনেরো বছর পর, নির্বাহীগণ যারা তার সাথে কখনো দেখাও করেনি তারা কোম্পানির তার সময়কাল থেকে যুগান্তকারী সাফল্য ও প্রবৃদ্ধির কৃতিত্ব, অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে, তাকেই প্রদান করে।

তার নিজেকে জিজ্ঞাসা করা যে, “আমি কীভাবে অবদান রাখতে পারি?” ব্যাপক অর্থে রবার্ট ম্যাকনামারা এর যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা সচিব হিসাবে অসাধারণ কার্যকারিতাকেও ব্যাখ্যা করে-যে পদটিতে দায়িত্ব পালন করার জন্য তিনি মোটেও প্রস্তুত ছিলেন না, যখন প্রেসিডেন্ট কেনেডি ১৯৬০ সালের শরৎ মৌসুমে তাকে ফোর্ড মটর কোম্পানি থেকে এনে সর্ব কঠিন মন্ত্রীসভার কাজে নিযুক্ত করেন।

ম্যাকনামারা, ফোর্ড কোম্পানিতে যিনি একজন অন্তরীণ মানুষ (রহংরফব সধহ) হিসাবে উপযুক্তভাবে কাজ করেছেন, সম্পূর্ণরূপে রাজনীতির অ-আ-ক-খ না জানা মানুষ ছিলেন এবং অধীনস্থদের সাথে কংগ্রেশনাল মৈত্রী করার চেষ্টা ত্যাগ করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু কয়েক সপ্তাহ যাওয়ার পর, তিনি বুঝতে পারলেন যে, প্রতিরক্ষা সচিব নির্ভর করে কংগ্রেসের উপলব্ধি এবং সাপোর্টের উপর। ফলে তিনি নিজেকে বাধ্য করেছিলেন এমন কাজ করতে যা একজন লজ্জাশীল ও অরাজনৈতিক ব্যক্তির জন্য যুগপৎ কঠিন ও অনীহাপূর্ণ: কংগ্রেস মনোভাব ধারণ করা, কংগ্রেসের কমিটিতে সর্বাধিক প্রভাবশালী ব্যক্তি সম্পর্কে জানা, কংগ্রেসের অন্তঃদ্বন্দ্বের নানা অদ্ভুত শিল্পে পারদর্শিতা অর্জন করা। এটা সুনিশ্চিত যে সফলভাবে তিনি কংগ্রেসকে সামলাতে সফল হননি, তবে পূর্বের অন্য যেকোন সচিব থেকে ভালো পারফর্ম তিনি অবশ্যই করেছিলেন।

ম্যাকনামারার গল্প দেখায় যে একজন নির্বাহীর পদমর্যাদা যত বড় হয়, তত বেশি তার অবদানে বাহিরের কার্যক্রম বিজড়িত থাকে। প্রতিষ্ঠানের অন্য কেউ নিয়মানুযায়ী বাহিরের কাজে অতটা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে না।

সম্ভবত যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয় প্রধানসমূহের বর্তমান প্রজন্মের সব থেকে বড় ত্রুটি হলো প্রশাসনের উপর, তহবিল-গঠন ইত্যাদির উপর তাদের অভ্যন্তরীণ মনোযোগ। তথাপি বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য কোন প্রশাসন ছাত্রদের সাথে যোগাযোগ স্থাপনে সক্ষম নয় যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের “গ্রাহক”। প্রশাসন থেকে ছাত্রদের দূরত্ব নিশ্চয় একটি বড় কারণ ছাত্রদের অসন্তোষ এবং বিশৃঙ্খলার, যা উদাহরণস্বরূপ ১৯৬৫ সালে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে বার্কলি আন্দোলনে ভূমিকা রেখেছিল।


কীভাবে একজন বিশেষজ্ঞকে কার্যকর করে তুলতে হয়?


অবদানের উপর জোর প্রদান করা নলেজ ওয়ার্কার তথা জ্ঞানসংশ্লিষ্ট কর্মীদের জন্য বিশেষত গুরুত্বপূর্ণ। একমাত্র এটাই তাকে অবদান রাখতে সুযোগ করে দিবে।

জ্ঞানসংশ্লিষ্ট কর্মীরা কোন ‘পণ্য’ উৎপাদন করে না। তারা আইডিয়া, তথ্য ও ধারণা ইত্যাদির সৃষ্টি করে। তাছাড়া জ্ঞানসংশ্লিষ্ট কর্মী তথা তথ্যভিত্তিক কর্মীরা সাধারণত বিশেষজ্ঞ হয়ে থাকে। মূলত, নিয়মানুযায়ী সে কেবল তখন কার্যকারিতা প্রদর্শন করতে পারে যখন সে একটি কাজ ভালোভাবে করতে পারে; অর্থাৎ যদি সে উক্ত কাজে বিশেষজ্ঞ হয়ে থাকে। বিশেষত সে নিজে একটি বিচ্ছিন্ন অংশ এবং অনুর্বর বস্তু। তার কাজের মূল ফলাফল ফলপ্রসূ হওয়ার পূর্বে অন্য সব বিশেষজ্ঞদের স্বতন্ত্র ফলাফলগুলোকে এক করতে হয়। এরপরই একজন বিশেষজ্ঞের কাজ মূল্যবান হয়ে দেখা দেয়।

এখানে মূল কাজ হচ্ছে একজন বহু কাজে পারদর্শী ব্যক্তি গড়ে তোলা নয়। বরং একজন বিশেষজ্ঞকে তার ও তার বিশেষত্বকে কার্যকরি করে তোলার সুযোগ করে দেওয়া। এর অর্থ হলো তাকে অবশ্যই চিন্তা করতে হবে কারা তার আউটপুট বা উৎপাদিত পণ্য বা আদর্শ ব্যবহার করতে যাচ্ছে এবং সেসব ব্যবহারকারীর বিশেষজ্ঞের সৃষ্ট বস্তু বা পণ্যের কার্যকর ব্যবহারে কী কী বিষয় জানা ও বোঝা প্রয়োজন সে দিকেও বিশেষজ্ঞদের খেয়াল রাখতে হবে।

বর্তমানে সবাইকে এটা বিশ্বাস করতে দেখা যায় যে, আমাদের সমাজ দু’টি ধারায় বিভক্ত, বিজ্ঞানী ও সাধারণ মানুষ। তাই এটা চাওয়া স্বাভাবিক যে, সাধারণ মানুষগণ বিজ্ঞানীদের জ্ঞান, পরিভাষা, তাদের ব্যবহৃত যন্ত্র ইত্যাদি সম্পর্কে অল্প-বিস্তার জ্ঞান রাখবে। তবে সমাজ যদি কখনো সেভাবে ভাগ হত, তবে তা ছিল একশত বছর আগে। বর্তমানে, আধুনিক প্রতিষ্ঠানের প্রত্যেক ব্যক্তি বিশেষায়িত বিষয় ও জ্ঞানে উচ্চতর দক্ষতাসম্পন্ন, প্রত্যেকে নিজ নিজ বিষয়ের সরঞ্জাম ও উপাদান রাখে, নিজস্ব চিন্তাচেতনা ও সংশ্লিষ্ট বিষয়ের গূঢ় রহস্য ইত্যাদিতে সম্যক অবগত। আর বিজ্ঞান, কালপরিক্রমায়, এত বেশি বিক্ষিপ্ত ও শাখা-প্রশাখাসম্পন্ন হয়ে গেছে যে, যে বিষয়টি একশ্রেণিভুক্ত পদার্থবিজ্ঞানীদের কাছে দুর্বোধ্য তা অন্য একশ্রেণিভুক্ত পদার্থবিজ্ঞানীদের কাছে কিছুই না।

একজন কস্ট অ্যাকাউন্টেন্ট এর অবস্থা একজন বায়োকেমিস্ট বিজ্ঞানীর মতো। এই অর্থে যে তার নিজের একটি নির্দিষ্ট প্রকৃতির জ্ঞানে বিশেষত্ব আছে যে জ্ঞানের নিজস্ব থিওরি আছে, আইডিয়া ও ভাষা আছে। তেমনিভাবে একজন বাজার বিশ্লেষক ও কম্পিউটারের লজিক নিয়ে যে কাজ করে তাদের অবস্থাও একই। সরকারি এজেন্সির বাজেট কর্মকর্তা ও মনোবিজ্ঞানীদের ব্যাপারেও একই কথা প্রযোজ্য। এদের প্রত্যেকের কাজকে (ক্ষুদ্র পরিসরে হলেও) অন্যদের বুঝতে হবে যদি কেউ একজন নিজের কাজে কার্যকারিতা দেখাতে চায়।

একজন জ্ঞানবান ব্যক্তির কাছে সর্বদা এটা কাম্য যে তাকে বা তার কর্ম ও জ্ঞানকে বুঝে আসার ব্যাপারে সে নিজে দায়বদ্ধ থাকবে। এটা মনে করা অসভ্য ঔদ্ধত্যপূর্ণ যে একজন সাধারণ মানুষের তাকে বোঝা উচিত এবং এও মনে করা যে, তার বিষয়গুলো ঐ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কিছু মানুষের জন্য বুঝতে পারাই যথেষ্ট। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় বা গবেষণাগারে, এই মনোভাব বড় আফসোসের বিষয়। এটা আজকাল অনেক বেশি প্রচলিত যে দক্ষ ব্যক্তিকে নিন্দা করা ও তার কাজকে ব্যর্থতায় পর্যবসিত করা এবং তার জ্ঞানকে অর্জনযোগ্য জ্ঞানের পরিবর্তে নিছক প-িতগিরিতে পরিণত করে। যদি একজন ব্যক্তি কার্যনির্বাহী হতে চায়-অর্থাৎ, যদি সে তার অবদানের জন্য দায়বদ্ধ বিবেচিত হতে চায়-তবে তার “পণ্যের” ব্যবহারযোগ্যতা নিয়ে তার মাথাব্যথা থাকা চাই।

একজন কার্যকারিতাসম্পন্ন নির্বাহী এ বিষয়টির ব্যাপারে ওয়াকিফহাল। কারণ তারা তাদের ঊর্ধ্বমুখী ঝোঁকের মাধ্যমে অজ্ঞাতসারে তাড়িত হয়ে এই খোঁজে থাকে যে, অন্য ব্যক্তিরা কী চায়, কী দেখতে পায় এবং কী বোঝে। কার্যকারিতাসম্পন্ন নির্বাহীগণ প্রতিষ্ঠানের অন্য সকলকে জিজ্ঞাসা করতে থাকে যে, তাদের সিনিয়র কর্মকর্তা, অধিনস্ত কর্মকর্তা, সর্বপরি অন্য সেক্টরে তাদের সহকর্মীদের: “এই প্রতিষ্ঠানে আপনি অবদানের ছাপ রাখার জন্য আমার কী ভূমিকা প্রত্যশা করেন? আর যখন আপনি এটা চান, তখন তা কীভাবে এবং কোন আকৃতি-প্রকৃতিতে চান?”

যদি কস্ট একাউন্টেন্টরা (পরিব্যয় হিসাবরক্ষকগণ), উদাহরণস্বরূপ, এই প্রশ্নটি করত, তারা শীঘ্রই দেখতে পেত-তাদের কাছে স্পষ্ট হত-তাদের কোন ধারণাটি তাদের ম্যানেজারের, যারা ঐ হিসাব নিয়ে কাজ করবে, তাদের কাছে অপরিচিত। তারা শীঘ্রই খুঁজে পেত, যে সংখ্যাটি তাদের কাছে গুরত্বপূর্ণ তা পরিচালক ব্যক্তিদের কাছে অপ্রাসঙ্গিক এবং যে সংখ্যাটি তাদের সামনে মাঝে মাঝে ধরা দেয় ও তারা কদাচিৎ তা প্রতিবেদনে অন্তর্ভুক্ত করে তাই পরিচালকবৃন্দের কাছে আদতে প্রয়োজনীয়।

যে বায়োকেমিস্ট কোন ঔষধ-প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানে এই প্রশ্নটি করে সত্বর সে লক্ষ করবে যে, চিকিৎসকগণ তার এই গবেষণাকে কাজে লাগাতে পারবে যদি তা বায়োকেমিক্যাল বা জৈব রসায়নের পরিভাষায় না হয়ে চিকিৎসকের পরিভাষায় হয়। চিকিৎসকের তখন বায়োকেমিস্টের গবেষণার উপর আদৌ কোন পরীক্ষানিরীক্ষা চালানোর প্রয়োজন আছে কিনা সেই সিদ্ধান্ত গ্রহণে ভেবে দেখার অবকাশ থাকবে অথবা গবেষকের গবেষণার উপর ভিত্তি করে আদৌ কোন ঔষধ প্রস্তুত না করার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে।

সরকারি প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞানীরা যারা অবদান রাখার চেষ্টা করে তারা অল্প সময়ের মধ্যে এটা বুঝতে পারে যে, তাদেরকে রাষ্ট্রের পলিসি-মেকার বা নীতি-নির্ধারকদের কাছে একটি বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি কোথায় নিয়ে যেতে পারে তা অবশ্যই খোলাসা করতে হবে। ফলে নীতি-নির্ধারকরা অবশ্যই এমন এমন নীতি গ্রহণ করবে যার ফলে বিজ্ঞানীরা যেন ভুল পথে যেতে না পারে। অর্থাৎ নীতি-নির্ধারকদেরকে বৈজ্ঞানিক গবেষণার অনুসন্ধানের ফলাফল সম্পর্কে ধারণা রাখতে হবে।

জেনারেলিস্ট বা বহুবিদ্যাবিশারদের একমাত্র অর্থবহ সংজ্ঞা হলো সে এমন একজন বিশেষজ্ঞ যে তার জ্ঞানের ক্ষুদ্র শাখাটিকে বিশ্ব-জ্ঞানের সাথে জুড়ে দিতে পারে। হয়তো অল্প কিছু লোকের একাধিক বিষয়ে জ্ঞান থাকে। কিন্তু এটা তাদেরকে বহুবিদ্যাবিশারদ করে না; এটা তাদেরকে কয়েকটি বিষয়ে বিশেষ জ্ঞানসম্পন্ন করে তোলে। আর একজন ব্যক্তি অধৈর্যশীল বা একগুঁয়ে হতে পারে। তা সে এক বিষয়ে জানুক আর তিন বিষয়ে। যে ব্যক্তি, প্রসঙ্গত, তার অবদানের জন্য দায়বদ্ধ থাকে সে তার জ্ঞানের সংকীর্ণ শাখাকে সুবিশাল জ্ঞান-সুমুদ্রের মেল-বন্ধনে নিয়ে আসে। সে হয়তো কখনো একাধিক জ্ঞানের শাখাকে একটি মূল কা-ে একীভূত করতে সক্ষম হয় না। তবে সে অবিলম্বে উপলব্ধি করতে পারে যে, তাকে অন্যদের চাহিদা, দিক-নির্দেশনা, সীমাবদ্ধতা ও জ্ঞান ব্যবহারে সক্ষম হতে হবে। তাকে যদি তার কাজের সত্যিকার ফলাফল দেখতে হয় তবে কাজের সাথে সংশ্লিষ্ট অন্যদের ব্যাপারে তার পর্যাপ্ত জানাশোনা থাকতে হবে। এমনকি যদি এটা তাকে বৈচিত্র্যের আনন্দ ও সমৃদ্ধির মূল্যায়ন করতে সাহায্য নাও করে, তবুও এটা তাকে জানাশোনাসম্পন্ন ব্যক্তিদের ঔদ্ধত্যের বিরুদ্ধে সাহায্য করবে প্রতিরোধ তৈরি করতে। এটা এক ধরনের অবক্ষয়জনিত রোগ যা জ্ঞানকে শেষ করে দেয় এবং একে সৌন্দর্য ও কার্যকারিতা থেকে বঞ্চিত করে।


সঠিক মানব-সম্পর্ক


একটি প্রতিষ্ঠানের নির্বাহীদের মানুষের সাথে সুসম্পর্ক থাকে না কারণ তাদের “মানুষকে বোঝার প্রতিভা” রয়েছে। তাদের সাথে মানুষের ভালো সম্পর্ক তৈরি হয়, কারণ তারা নিজেদের কাজে অবদান (পড়হঃৎরনঁঃরড়হ) রাখার প্রতি এবং অন্যের সাথে তাদের সম্পর্কের প্রতি গুরুত্ব দেয়। ফলে, তাদের সম্পর্কগুলো ফলদায়ক (ঢ়ৎড়ফঁপঃরাব) হয়-এটাই হচ্ছে ভালো মানব-সম্পর্কের কার্যকর সংজ্ঞা। উষ্ণ অনুভূতি ও মনোজ্ঞ শব্দাবলি অর্থহীন (মানে অতিকথায় তোষামোদ করা অর্থহীন), বাজে মনোভাবের আবরণযুক্ত প্রদর্শনী বৈ কিছু নয়, যদি, মোটের উপর, কাজ-কর্মভিত্তিক সম্পর্ক থেকে কোন ফল ও অর্জন লাভ করা না যায়। অন্যদিকে, মাঝে মাঝে দু-চারটি কঠিন শব্দ একটি সম্পর্ককে নষ্ট করতে পারে না যদি তা সংশ্লিষ্ট সকলের জন্য ভালো ফলাফল ও কল্যাণ নিয়ে আসে।

যদি আমাকে বলা হয় এমন একজন ব্যক্তির নাম বলতে যার, আমার অভিজ্ঞতা মতে, মানুষের সাথে সব থেকে বেশি ভালো সম্পর্ক আছে, তবে আমি তিনজনের নাম বলব: জেনারেল জর্জ সি. মার্শাল, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী প্রধান; আলফ্রেড পি. স্লোয়ান (জুনিয়র), উনিশ-বিশের দশকের শুরু থেকে নিয়ে পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি অবধি জেনারেল মটরসের প্রধান; এবং স্লোয়ানের একজন সিনিয়র সহযোগী, নিকোলাস ড্রাইস্ট্যাড, চরম হতাশার মাঝে যিনি “ক্যাডিলাক” গাড়িকে একটি সফল বিলাসবহুল গাড়ি নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছিলেন (এবং ১৯৫০ এর দিকে কিছু সময় জেনারেল মটরসের প্রধানের দায়িত্ব চমৎকারভাবে পালন করেছিলেন, তবে তার হঠাৎ মৃত্যু এতে বাঁধ সাধে।

এসব ব্যক্তি মানুষের পক্ষে যত ভিন্ন ও বৈচিত্র্যময় হওয়া সম্ভব ততটাই ছিলেন: মার্শাল, “একজন পেশাদার সৈনিক,” অসাধারণ, কঠোর সংযমী ও নিবেদিত-প্রাণ, তবে অত্যধিক লাজুক ও আকর্ষণীয়; স্লোয়ান, “একজন প্রশাসক” গম্ভীর, মার্জিত ও নির্জনতা প্রিয়; আর ড্রাইস্ট্যাড, আন্তরিক, হাস্যোজ্জ্বল, কথা বলে বেশি এবং অতিমাত্রায় “ হাইডেলবার্গের অতীত ঐতিহ্যের বাহক” একজন জার্মান কারিগর। তাদের প্রত্যেকে কাজকর্মের প্রতি গভীর ত্যাগের জন্য উৎসাহিত করে গেছেন এবং অবশ্যই, যারা তাদের জন্য কাজ করেছিল তাদের (সেসব মানুষের) হৃদয়ে ছিল তাদের কপটাহীন শ্রদ্ধা। এই তিনজনই, তাদের ভিন্ন ভিন্ন উপায়ের, মানুষের সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলেন-তাদের সিনিয়র, সহযোগী এবং অধিনস্ত সকলের সাথে-অবদান রাখাকে কেন্দ্র করে। এই তিনজনকেই মানুষের (নির্বাচন ও ব্যবস্থাপনা) ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয়েছিল। তবে এদের কেউই মানব-সম্পর্ক নিয়ে পেরেশান ছিলেন না। তারা একে সহজভাবেই গ্রহণ করে ছিলেন।

অবদানের উপর মনোযোগ নিজে নিজেই কার্যকর মানব-সম্পর্কের চারটি মৌলিক প্রয়োজনীয় বস্তুর দাবি করে:

যোগাযোগ (পড়সসঁহরপধঃরড়হং);

দলবদ্ধ কাজ (ঃবধসড়িৎশ);

আত্ম-উন্নয়ন (ংবষভ-ফবাবষড়ঢ়সবহঃ);

অপরের উন্নয়ন (ফবাবষড়ঢ়সবহঃ ড়ভ ড়ঃযবৎং)।


যোগাযোগ


১. ব্যবস্থাপনা বিভাগের মনযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে গত বিশ বছর বা তার অধিক সময় ধরে কমিউনিকেশন্স তথা মানুষের সাথে যোগাযোগ করার ব্যাপারটা ছিল। ব্যবসা, জনপ্রশাসন, সেনাবাহিনী, হাসপাতাল, এক কথায় আধুনিক সমাজের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে, সর্বত্র যোগাযোগ নিয়ে ব্যাপক সচেতনতা ছিল।

বর্তমান সময় পর্যন্ত এর ফলাফল অপ্রতুল। যোগাযোগ স্থাপন বর্তমান হোক কিংবা বিশ-ত্রিশ বছর আগে, যখন প্রথম এর প্রয়োজনীয়তার ব্যাপারে সচেতনতা তৈরি হয়, এখনো অপর্যাপ্ত। আধুনিক প্রতিষ্ঠানে যথাযথ যোগাযোগ স্থাপন এখনো ত্রুটিপূর্ণ। তবে আমরা বুঝতে শুরু করেছি কেন এই ব্যাপক যোগাযোগ স্থাপন প্রচেষ্টা কোন ফলাফল বয়ে আনতে পারছে না।

আমাদের যোগাযোগ স্থাপন প্রক্রিয়া উপর থেকে নিচের দিকে প্রবাহিত হয়ে থাকে, ব্যবস্থাপক থেকে কর্মকর্তাদের দিকে, ঊর্ধ্বতন থেকে অধস্তনের দিকে। তবে বাস্তবিকভাবে যোগাযোগ স্থাপন অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে যদি তা নিম্নগামী সম্পর্কের ভিত্তিতে হয়। এসব আমরা জানতে পেরেছে উপলব্ধি ও যোগাযোগ তত্ত্ব (ঢ়বৎপবঢ়ঃরড়হ ধহফ পড়সসঁহরপধঃরড়হং ঃযবড়ৎু) নিয়ে কাজ করার সময়। যত কঠিনভাবে সিনিয়র তার অধস্তনকে কিছু বলতে চাইবে, এটা সম্ভব যে তত বেশি ভুল অধস্তন শুনতে পাবে। সিনিয়রের প্রত্যাশা অনুযায়ী সে শুনবে যা তাকে শুনানো হয়, তবে কী বলে হয়েছে তা মোটেও সে বুঝতে পারবে না।

তবে যে সকল নির্বাহী তাদের কাজে অবদান রাখতে দায়বদ্ধ তারা নিয়মানুযায়ী চাইবে যেন তাদের অধীনস্ত ব্যক্তিরাও দায়বদ্ধ থাকার মানসিকতা রাখে। তাদের এই প্রশ্নটি করার প্রবণতা আছে যে, “কোন ভূমিকার জন্য অত্র প্রতিষ্ঠান ও আমি, তোমার সিনিয়র হিসাবে, তোমাকে জবাবদিহিতার মুখোমুখি করা উচিত? তোমার কাছে আমাদের কী প্রত্যাশা করা উচিত? তোমার জ্ঞান ও দক্ষতার সর্বাধিক উপযুক্ত ব্যবহার কী হতে পারে?” এবং তখনই কেবল যোগাযোগ স্থাপন সম্ভব হয় এবং নির্ঘাত সহজ হয়।

একবার অধীনস্ত কর্মী যদি চিন্তা করে তার কাছে কী ধরনের ভূমিকা প্রত্যাশা করা উচিত, তবে তার সিনিয়রের, অবশ্যই, তার প্রস্তাবিত অবদানের যথার্থতা যাচাইয়ের অধিকার ও দায়িত্ব দু’টাই থাকবে।

আমাদের সকল অভিজ্ঞতার আলোকে, অধীনস্তদের কর্তৃক নিজেদের জন্য নির্ধারিত উদ্দেশ্যাবলি প্রায় কখনো তা হয় না যা সিনিয়রগণ হওয়া উচিত মনে করে থাকে। অধীনস্তগণ বা জুনিয়ররা, অন্যভাবে বললে, বাস্তভাবে সম্পূর্ণ ভিন্নরূপে উপলব্ধি করে ও দেখে। যত বেশি তারা সক্ষম হবে, যত বেশি তারা দায়িত্ব গ্রহণ করবে, তত বেশি তাদের বাস্তব উপলব্ধি এবং এর উদ্দেশ্যমূলক সুযোগ-সুবিধাদি ও প্রয়োজনীয়তা তাদের সিনিয়রদের ও প্রতিষ্ঠানের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ভিন্নতর হবে। তবে তাদের চিন্তাচেতনার ও তাদের সিনিয়রদের তাদের কাছে প্রত্যাশার মাঝে যেকোন বৈপরীত্য স্পষ্টরূপে দৃশ্যমান হয়ে উঠবে।

এই বৈপরীত্যের মাঝে কে সঠিক আর কে ভুল তা নিয়মানুযায়ী গুরুত্বপূর্ণ কোন বিষয় নয়। কারণ অর্থবহ উপায়ে কার্যকর যোগাযোগ ইতোমধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। [কমিউনিকেশন তথা যোগাযোগে দক্ষতা অর্জনের জন্য পড়তে পারেন: সাকসেস থ্রো এ পজেটিভ মেন্টাল এটিটিউড। মূল: নেপোলিয়ন হিল ও ডব্লিউ. ক্লেমেন্ট স্টোন। অনুবাদ: ফজলে রাব্বি। ঢাকা, সাফল্য প্রকাশনী, ২০১৭।]


দলবদ্ধ কাজ


২. অবদান রাখার উপর গুরুত্বারোপ যোগাযোগ স্থাপনে প্রলুব্ধ করে এবং দলবদ্ধ কাজের পথ সুগম করে দেয়।

“আমার কাজ কার্যকর হওয়ার জন্য কে কে এর ফলাফল (ড়ঁঃঢ়ঁঃ) ব্যবহার করলে ভালো হয়?” এ ধরনের প্রশ্নের সাথে সাথে এটা প্রতীয়মান হয় যে, যেসব ব্যক্তি কর্তৃপক্ষ নয় বা কর্তৃত্বের ভূমিকায় নেই, হোক তা ঊর্ধ্বতন বা অধস্তন, স্বতন্ত্র নির্বাহী সকল ব্যক্তি, তারাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দেখা দেয়। এটা একটা জ্ঞানসংশ্লিষ্ট বা তথ্যভিত্তিক সংস্থার বাস্তবতাকে স্পষ্ট করে: কার্যকর কাজ মূলত করা সম্ভব হয় তখনই যখন বিভিন্ন জ্ঞান ও দক্ষতার মানুষ একে অপরের সাথে দলবদ্ধভাবে কাজ করে। এসব ব্যক্তির একে অপরের সাথে মিলে স্বেচ্ছায় এবং পরিস্থিতির যৌক্তিতা ও কাজের চাহিদা অনুযায়ী কার্য সম্পাদন করে, একটি নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে গঠিত অবকাঠামো অনুযায়ী নয়।

উদাহরণস্বরূপ, একটি হাসপাতাল-এটা হয়তো আধুনিক জ্ঞানসংশ্লিষ্ট বা তথ্যভিত্তিক সংগঠনগুলোর সর্বাধিক জটিল সংস্থা: এখানে থাকে নার্স, ডায়েটিশিয়ান, থেরাপিদাতা, মেডিকেল ও এক্স-রে যন্ত্রবিদ, ফার্মাকোলজিস্ট (ঔষধবিদ্যা বিশারদ), প্যাথলজিস্ট (রোগবিদ্যা বিশারদ) এবং অন্যান্য অসংখ্য স্বাস্থ্যসেবা সংশ্লিষ্ট পেশাজীবীদের একই রোগীর জন্য কাজ করতে হয় এবং খুবই অল্প সচেতন আদেশ ও নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে। তথাপি, তাদের সবাইকে একটি সাধারণ সমাপ্তির জন্য কাজ করতে হয় এবং একটি পদক্ষেপের সাধারণ পরিকল্পনার আওভুক্ত থেকে কাজ করতে হয়; (আর তা হলো) চিকিৎসার জন্য ডাক্তারের দেওয়া প্রেসক্রিপশন। প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো বিবেচনায়, এই স্বাস্থ্যসেবা সংশ্লিষ্ট সকল পেশার মানুষ তাদের স্ব স্ব প্রধানের কাছে জবাবদিহি থাকে ও তার কাছে রিপোর্ট করে, প্রত্যেকে তার পেশার উচ্চতর বিশেষায়িত জ্ঞানের আলোকে পরিচালনা করে; অর্থাৎ একজন পেশাজীবী হিসাবে কাজ করে। তবে প্রত্যেককে স্বতন্ত্র রোগীর নির্দিষ্ট অবস্থা, পরিস্থিতি ও প্রয়োজনের আলোকে অন্য সকল ব্যক্তিকে অবগত রাখতে হয়। অন্যথায়, তাদের প্রচেষ্টার ফসল হিতে বিপরীত হতে পারে।

যে হাসপাতালে অবদানের প্রতি গুরুত্বারোপ সকলের স্বভাবে পরিণত হয়, তাতে এরকম দলবদ্ধ কার্য সম্পাদন অসম্ভব কিছু নয়। অন্যান্য হাসপাতালে, এই সমান্তরাল যোগাযোগ স্থাপন, উপযুক্ত কাজ নির্ভর স্বতস্ফূর্ত স্ব-সংগঠিত দলের, সম্ভবপর হয়ে উঠে না। নানান কমিটি গঠন, কর্মী মিটিং, বুলেটিন ছাপানো, অনুপ্রেরণা প্রদান ইত্যাদির মাধ্যমে যোগাযোগ স্থাপন ও সমন্বয় সাধনের চরম প্রচেষ্টা সত্ত্বেও তা হয় না।

বর্তমান সময়ের প্রতিষ্ঠানগুলোতে একটি প্রাতিষ্ঠানিক সমস্যা আছে যার কারণে প্রচলিত আদর্শ ও তত্ত্ব সম্পূর্ণরূপে অপর্যাপ্ত। জ্ঞানসংশ্লিষ্ট কর্মীদের তাদের নিজেদের জ্ঞান-ক্ষেত্রের প্রতি মনোভাবে পেশাদারিত্বের পরিচয় দিতে হবে। তাদের নিজেকেই নিজেদের সক্ষমতা ও কাজের মানের জন্য দায়বদ্ধ থাকতে হবে। নিয়মতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান বিবেচনায়, তারা নিজেদেরকে একটি ক্রিয়াশীল বিশেষত্বের সম্পদ হিসাবে দেখতে পাবে-চাই তা বায়োকেমিস্ট্রি হোক বা হাসপাতালে নার্সিং হোক। তাদের কর্মী ব্যবস্থাপনার বিচারে-তাদের প্রশিক্ষণ, তাদের রেকর্ড, পাশাপাশি তাদের প্রশংসা ও পদোন্নতি-তারা এই জ্ঞানমুখী ক্রিয়ার দ্বারা পরিচালিত হবে। কিন্তু তাদের কাজেকর্মে, ক্রমবর্ধমানভাবে তাদের একটি দলের, যেখানে সতীর্থরা ভিন্ন জ্ঞান-সম্প্রদায়ের তবে একটি নির্দিষ্ট কার্য সম্পাদনে দলবদ্ধ, দায়িত্বশীল সদস্য হিসাবে আচরণ করতে হবে।

ঊর্ধ্বমুখী অবদানের প্রতি মনোযোগ নিজেই প্রাতিষ্ঠানিক সমস্যার সমাধান করবে না। তবে এটা কোন কাজ ও যোগাযোগ-প্রয়োজনীয় বুঝতে সাহায্য করবে যাতে করে একটি ত্রুটিপূর্ণ প্রতিষ্ঠান যথাযথভাবে কাজ করতে পারে।

জ্ঞানসংশ্লিষ্ট কর্মীদের মাঝে পারস্পরিক যোগাযোগ প্রতিনিয়ত সংকটপূর্ণ হয়ে উঠছে তথ্য সরবরাহে কম্পিউটার বিপ্লবের ফলে। কয়েক যুগ ধরে সমস্যাটি হচ্ছে কীভাবে “তথ্যের” ভেতর দিয়ে যোগাযোগ রক্ষা করা যায়। যেহেতু তথ্য-উপাত্ত মানুষের মাধ্যমে ব্যবহার করতে হবে ও প্রবাহিত করতে হত, এটা সবসময় যোগাযোগের মাধ্যমে ব্যাহত হত; অর্থাৎ, মতামত, প্রভাব, মন্তব্য, মূল্যায়ন, পক্ষপাতিত্ব ইত্যাদি। এখন হঠাৎ করে আমরা এমন একটি পরিস্থিতির সম্মুখীন যাতে তথ্যাবলি ব্যাপক পরিসরে অব্যক্তিক এবং তাই, কোনরূপ যোগাযোগ মাধ্যম ছাড়া। এটা নির্ভেজাল তথ্য।

তবে আমাদের বর্তমানে ন্যূনতম যোগাযোগ স্থাপনের সমস্যা দেখা দিয়েছে যাতে আমরা পরস্পরকে বুঝতে পারি এবং একে অপরের প্রয়োজনকে, লক্ষ্য, উপলব্ধি এবং কাজ করার প্রক্রিয়াকে জানতে পারি। তথ্য এসব বিষয়ের যোগান দেয় না। কেবল কারো প্রত্যক্ষ সংস্পর্শে, হোক তা আওয়াজের মাধ্যমে বা লিখিত শব্দের মাধ্যমে, যোগাযোগ স্থাপন করা যায়।

যত বেশি আমরা তথ্য সরবরাহকে স্বয়ংক্রিয় করব, তত বেশি আমাদের কার্যকর যোগাযোগ স্থাপনের জন্য সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। [দলবদ্ধ কাজের কলাকৌশল সম্পর্কে জানতে পড়তে পারেন: টিমওয়ার্ক ১০১। মূল: জন সি. ম্যাক্সওয়েল। অনুবাদ: ফজলে রাব্বি। ঢাকা, সাফল্য প্রকাশনী, ২০২১।]


আত্ম-উন্নয়ন


৩. স্বতন্ত্র আত্ম-উন্নয়ন বড় পরিসরে নির্ভর করে অবদানের উপর জোর দেওয়ার উপর (ভড়পঁং ড়হ পড়হঃৎরনঁঃরড়হং)।

যে ব্যক্তি নিজেকে জিজ্ঞাসা করে, “সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ অবদান কোনটি যা আমি এই প্রতিষ্ঠানের কল্যাণে রাখতে পারি?”, সে কার্যত জিজ্ঞাসা করে, “কোন ধরনের আত্ম-উন্নয়ন আমার প্রয়োজন? আমার আন্তরিক অবদান রাখার জন্য কী ধরনের জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জন করতে হবে? কার্য সম্পাদনে আমাকে কতটুকু শক্তি প্রদান করতে হবে? আমার নিজের জন্য কী রকম মানদ- তৈরি করতে হবে?” [আত্ম-উন্নয়নের জন্য পড়তে পারেন: সেল্ফ-ইমপ্রুভমেন্ট ১০১। মূল: জন সি. ম্যাক্সওয়েল। অনুবাদ: ফজলে রাব্বি। ঢাকা, সাফল্য প্রকাশনী, ২০২১।]


অপরের উন্নয়ন


৪. যে নির্বাহী অবদানের উপর মনোযোগী হয় সে অন্যকেও উন্নতির দিকে তাড়িত করে। এবার সে তার অধীনস্ত কর্মী বা সহযোগী কিংবা সিনিয়র হোক। সে এমন মানদ- স্থাপন করে যা ব্যক্তিভিত্তিক নয়, বরং কাজভিত্তিক। একইভাবে, তা উৎকৃষ্টতার দাবিতে হয়ে থাকে। কারণ তা উচ্চাকাক্সক্ষা, উচ্চাভিলাষী লক্ষ্য, বড়সড় কার্যসম্পাদনের দাবিতে হয়ে থাকে।

আমরা আত্ম-উন্নয়ন সম্পর্কে খুবই কম জানি। তবে আমরা একটি বিষয় জানি: মানুষ সাধারণভাবে, জ্ঞানসংশ্লিষ্ট কর্মীরা বিশেষত, তাদের নিজেদের উপর আরোপিত দাবি বা চাহিদের নিরিখে বেড়ে ওঠে। তারা বেড়ে ওঠে সেই অনুযায়ী যাকে তারা অর্জন ও সাফল্য মনে করে। যদি তাদের নিজেদের উপর চাহিদা স্বল্প হয়, তবে তারা স্থির ও নিস্তব্ধ থেকে যাবে। যদি তারা নিজেদের উপর বড় কোন চাহিদা সৃষ্টি করে, তারা সুবিশাল উচ্চতায় বেড়ে উঠবে-ব্যর্থদের দ্বারা কৃত প্রচেষ্টার চেয়ে বেশি কোন প্রচেষ্টা করা ছাড়া। [অপরের উন্নয়নের কলাকৌশল জানতে পড়তে পারেন: ৭ স্ট্র্যাটেজিস ফর ওয়েলথ এন্ড হ্যাপিনেস। মূল: জিম রন। অনুবাদ: ফজলে রাব্বি। ঢাকা, সাফল্য প্রকাশনী, ২০১৯।]


ফলপ্রসূ মিটিং


মিটিং, প্রতিবেদন বা প্রেজেন্টেশন এসবই সাধারণত একজন নির্বাহীর কাজ হয়ে থাকে। এসব তার নির্দিষ্ট ও প্রতিদিনের সরঞ্জাম। এগুলো তার সময়ের উপরও ব্যাপক চাহিদা রাখে-এমনকি সে যদি তার সময়কে বিশ্লেষণে সক্ষম হয় এবং যা নিয়ন্ত্রণ করা দরকার তা নিয়ন্ত্রণে কার্যকরও হয়।

কার্যনির্বাহীগণ জানে মিটিং, প্রতিবেদন ও প্রেজেন্টেশন ইত্যাদির মধ্য দিয়ে কী প্রত্যাশা করা যায় এবং সংশ্লিষ্ট ইভেন্টের উদ্দেশ্য কী বা কী হওয়া উচিত। তারা নিজেদের কাছে জানতে চায়: “কেন আমরা এই মিটিং ডেকেছি? আমরা কি কোন সিদ্ধান্ত চাই, আমরা কি কোন তথ্য সরবরাহ করতে চাই বা নাকি আমরা চাই স্পষ্ট করতে আমাদের কী করা উচিত তা?” তারা জোর দেয় যে, একটি মিটিং ডাকার পূর্বে, কোন প্রতিবেদন চাওয়ার পূর্বে বা কোন প্রেজেন্টেশন প্রস্তুত করার পূর্বে উক্ত কাজগুলোর উদ্দেশ্য জানাতে হবে ও উল্লেখ করতে হবে। তারা জোর দেয় যে, মিটিং সেই অবদানের জন্য কাজ করে যা পূর্ণ করার জন্য তারা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।

কার্যকারিতাসম্পন্ন ব্যক্তি সর্বদা একটি মিটিংয়ের সূচনালগ্নে এর নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য ও ভূমিকা স্পষ্ট করে যা এই মিটিংয়ের মাধ্যমে অর্জন করা হবে। সে এটা নিশ্চিত করে যে, মিটিং নিজেই তার উদ্দেশ্যকে স্পষ্ট করে তুলবে। সে তার আহ্বায়িত মিটিং যেন একটি “বেকার সেশনে” পরিণত না হয় সেই দিকে সতর্ক থাকে। এমন “বেকার সেশন” যেখানে অংশগ্রহণকারীদের চমৎকার চমৎকার আইডিয়া থাকে, কিন্তু সেগুলোকে কাজে লাগানোর জন্য মেনে নেওয়া হয় না। তবে তার ডাকা মিটিংও, যেখানে নানা চিন্তাভাবনা ও আইডিয়া বিকশিত হয়, সেখানে কোন এক সদস্যকর্তৃক সাধারণ একটি প্রেজেন্টেশন দিয়েই শেষ হয়ে যায় না; বরং প্রত্যেক অংশগ্রহণকারীকে চ্যালেঞ্জ করতে ও উদ্বুদ্ধ করতে হয় দারুণ দারুণ চিন্তাভাবনা ও আইডিয়ার জন্য। সে সবসময়, সভার শেষ পর্যায়ে এসে, সূচনা বক্তব্যটি পুনর্ব্যক্ত করে এবং সর্বশেষ উপসংহারকে মূল উদ্দেশ্যের সাথে সম্পর্কযুক্ত করে।

একটি মিটিংকে ফলপ্রসূ করে তোলার জন্য আরও কিছু নিয়ম আছে (যেমন, স্পষ্ট অথচ অবমূল্যায়িত নিয়ম হলো যে, একজন হয়তো একটি মিটিং পরিচালনা করবে এবং পেশকৃত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো শ্রবণ করবে বা সে সেশনে অংশগ্রহণ করবে ও কথা বলবে: একই ব্যক্তি উভয়টা করবে না)। কিন্তু মৌলিক ও অপরিহার্য নিয়ম হচ্ছে মিটিংয়ের প্রারম্ভ ঘটবে অবদান রাখার দৃষ্টিকোণ থেকে।

অবদানের প্রতি জোর দিয়ে প্রধান নির্বাহী একটি মৌলিক সমস্যা দূর করে: ঘটনাবলির দুর্বোধ্যতা ও বিশৃঙ্খলা এবং কোনটি অর্থবহ ও কোনটি নিছক “কোলাহল” তা নির্ধারণে ব্যর্থতা হওয়ার ব্যাপারটা দূর করে। অবদানের উপর জোর প্রদান একটি সংগঠনের নীতি নির্ধারণ করে। এটা ঘটনাবলির প্রাসঙ্গিকতা তুলে ধরে।

অবদানের প্রতি মনোযোগ একজন নির্বাহীর পরিবেশ পরিস্থিতি থেকে যে ধরনের দুর্বলতা তৈরি হয় সেগুলোকে শক্তিতে পরিণত করে। একজন নির্বাহীর পরিবেশ পরিস্থিতি থেকে যে ধরনের দুর্বলতা তৈরি হয়, যেমন অন্যদের ওপর নির্ভর করতে হয়, ঠিক সেই কাজটিই তার শক্তিতে পরিণত হয়। এটা একটা দলের সৃষ্টি করে, দলবদ্ধ কাজের সূচনা করে।

সবার শেষে বলব, অবদান রাখার প্রতি গুরুত্বারোপ করলে তা কেবল প্রতিষ্ঠানের ভেতর বসে বসে কাজ করার প্রবণতাকে দূর করে। এটা নির্বাহীকে পরিচালিত করে-প্রচেষ্টা, কাজ ও সম্পর্কের অভ্যন্তরীণ বিষয় থেকে চোখ সরিয়ে তাদের বাহ্যিক বিষয়ে নিবদ্ধ করতে-অর্থাৎ, প্রতিষ্ঠানের ফলাফলের দিকে মনোনিবেশ করতে। এটা তাকে বাহিরের জগতের দিকে-হোক তা বাজার বা ক্রেতা অথবা কোন রোগী, কিংবা সরকারি সংস্থার বাইরের নানাজাতের মানুষ হোক-প্রত্যক্ষ সংস্পর্শে নিয়ে আসে এবং সেও দৃঢ় প্রচেষ্টা চালায় সকলের সাথে যোগাযোগ রাখতে।

অবদান রাখার প্রতি মনোযোগ প্রদান মূলত কার্যকারিতার প্রতি মনোযোগ প্রদান।


 




অধ্যায় ৪


শক্তিকে উৎপাদনমুখী করা


কার্যকারিতাসম্পন্ন নির্বাহী তার শক্তিকে উৎপাদনশীল করে। সে জানে দুর্বল ভিত্তির উপর কোন কিছু নির্মাণ করা যায় না। ফলাফল অর্জন করতে হলে, ব্যক্তিকে বিদ্যমান সকল শক্তির ব্যবহার করতে হবে-সহযোগীদের শক্তি, সিনিয়রদের শক্তি, এবং তার নিজের শক্তি। এই শক্তিগুলোই একজন ব্যক্তির প্রকৃত সুযোগ তৈরি করে। শক্তিকে উৎপাদনশীল করা প্রতিষ্ঠানের অদ্বিতীয় উদ্দেশ্য। এর মানে এই নয় যে আমাদের মধ্যকার শক্তিশালী দিক নিয়ে কাজ করলে আমাদের কোনো দুর্বলতা থাকবে না। বরং শক্তিশালী দিক নিয়ে কাজ করার ফলে আমাদের দুর্বলতাগুলো অপ্রাসঙ্গিক হয়ে উঠবে। শক্তিশালী দিক নিয়ে কাজ করার মানে হলো সম্মিলিত কাজের জন্য প্রত্যেক মানুষের শক্তিকে একেকটি ইট হিসাবে ব্যবহার করা, যেন শক্তিশালী ইটের তৈরি এক অভেদ্য দুর্গ।


শক্তিকে কাজে লাগানো


যে জায়গাটিতে নির্বাহী প্রথম শক্তির চ্যালেঞ্জের মুখোমুখী হয় তা হলো কর্মী নিয়োগ। দক্ষ নির্বাহীগণ কর্মী নিয়োগ ও তার পদোন্নতি দিয়ে থাকে সে কী করতে পারে তার ভিত্তিতে। সে কর্মী নিয়োগের সিদ্ধান্ত তার দুর্বলতাকে কমানোর জন্য নয় বরং শক্তিকে বৃদ্ধি করার জন্য গ্রহণ করে থাকে।

প্রেসিডেন্ট লিঙ্কন যখন জানতে পারলেন যে, জেনারেল গ্রান্ট, তার প্রধান কমান্ডার, মদ পছন্দ করেন, বলছিলেন যে: “যদি আমি তার কোন ব্র্যান্ড পছন্দ তা জানতাম, তবে আমি এক ব্যারেল বা বেশকিছু তার কাছে পাঠাতাম।” কেন্টাকি ও ইলিয়নস এ তার শৈশব কাটানোর পর, লিঙ্কন নিশ্চিতভাবে মদ ও তার ক্ষতি সম্বন্ধে অবগত ছিলেন। কিন্তু সকল ইউনিয়ন জেনারেলের মাঝে, গ্রান্ট একাই অব্যাহতভাবে প্রমাণ করে গিয়েছিলেন যে, তিনি পরিকল্পনা ও বিজয়ী লড়াই পরিচালনায় দক্ষ। গ্রান্টের নিয়োগলাভ ছিল গৃহযুদ্ধের মোড় পরিবর্তনকারী বিষয়। এটা ছিল একটি বাস্তবসম্মত নিয়োগ, কারণ লিঙ্কন যুদ্ধ জয়ে তার (গ্রান্ট) পরীক্ষিত সক্ষমতার জন্য তাকে নির্বাচন করেছিলেন এবং তার স্বাচ্ছন্দ্যের কারণে নয়, অথবা তার দুর্বলতা না থাকার কারণেও নয়।

লিঙ্কন এটা কঠিন পন্থায় জানতে পেরেছিলেন। তিনি গ্রান্টকে নির্বাচন করার আগে আরও তিন-চারজন জেনারেলকে নিয়োগ দেন যাদের যোগ্যতা হিসাবে বলা যায় তাদের বড়সড় কোন দুর্বলতা ছিল না। ফলে, মানুষ ও বস্তু ইত্যাদির মাঝে নর্থের মারাত্মক শ্রেষ্ঠত্বের পরও ১৮৬১ থেকে ১৮৬৪ দীর্ঘদিন বছরে বড় কোন অগ্রগতি সাধন করেনি। অন্যদিকে, রবার্ট এডওয়ার্ড লি, কনফেডারেট বাহিনীর প্রধান, শক্তি থেকে কর্মীর যোগান দিয়েছেন। লি’র প্রত্যেক জেনারেল, স্টোনওয়েল জ্যাকসন থেকে নিয়ে অন্যরা, ছিল সুস্পষ্ট ও স্মরণীয় দুর্বলতার অধিকারী। তবে এই ব্যর্থতাকে লি যথাযথভাবে অপ্রাসঙ্গিক মনে করতেন। তাদের প্রত্যেকের শক্তিমত্তার একটি নিজস্ব জায়গা ছিল। এটা ছিল সেই শক্তি এবং একমাত্র শক্তি, যা লি ব্যবহার করেছিলেন এবং কার্যকর করে তুলেছিলেন। ফলে, লিঙ্কন যে সকল অল-রাউন্ডার ব্যক্তিকে নিয়োগ দিয়েছিলেন তাকে লি’র “একমুখী হাতিয়ার”-যারা সংকীর্ণ পরিসরের মানুষ তবে বৃহৎ শক্তিধর-মাধ্যমে চরমভাবে পর্যদুস্ত হয়েছিল।

যারা দুর্বলতা থেকে বাঁচতে মানুষকে কাজে নিয়োগ করে বা কোন সংস্থায় কর্মী নিয়োগ করে তারা সর্বোচ্চ মাঝারি পর্যায়ে গিয়ে তাদের যাত্রা শেষ করবে। অল-রাউন্ডার মানুষের ধারণাটির ব্যাপারে বলা হয়ে থাকে যে, সেসব মানুষ যাদের কেবল শক্তিই আছে, দুর্বলতা একেবারেই নেই (চাই পরিভাষাটি “পুরো মানুষের” হোক বা “পরিপক্ক ব্যক্তিত্ব” বা “অধিক মানিয়ে নিতে পারা মানুষ” কিংবা “বহুবিদ্যা বিশারদ”কে নির্দেশ করুক।) এ ধরনের ব্যবস্থাপত্র কেবল মাঝারি পরিমাণ পারফর্ম্যান্সের জন্য, যদিও একেবারে ব্যর্থতার জন্য নয়। শক্তিধর মানুষের শক্তিশালী দুর্বলতাও থাকে। যেখানে চূড়া আছে, সেখানে উপত্যকাও থাকে। আর একজন ব্যক্তি একাধিক ক্ষেত্রে শক্তিমান বা পারদর্শী হয় না। মানব জ্ঞান, অভিজ্ঞতা ও সক্ষমতার এত ক্ষেত্রে যেন এই মহাবিশে^র মতো বিশাল, সেখানে একজন সর্বাধিক প্রতিভাধর ব্যক্তিকের জ্ঞান, অভিজ্ঞতা ও সক্ষমতাও কিছু নয়। “দক্ষ মানুষ” বলতে কোন কিছু নেই, বরং প্রশ্ন হলো “কী বিষয়ে দক্ষ?”

 

চিত্র: মানুষের জীবনে আছে শক্তিশালী দক্ষতা ও দুর্বলতা। যেখানে চূড়া আছে, সেখানে উপত্যকাও থাকে।

যে নির্বাহী একজন মানুষ কী করতে পারে তা চিন্তা না করে কী করতে পারে না তা নিয়ে চিন্তা করে এবং যে শক্তিকে কার্যকর করে তোলে না, বরং দুর্বলতাকে কাটানোর চেষ্টা করে সে নিজে একজন দুর্বল মানুষ। সে সম্ভবত অন্যের মধ্যকার শক্তিকে নিজের প্রতি হুমকিস্বরূপ দেখে। কিন্তু আজ পর্যন্ত কোন নির্বাহীকেই তার অধীনস্তদের শক্তিশালী দক্ষতা ও কার্যকারিতার জন্য ভুগতে দেখা যায়নি। মানুষের শক্তিশালী দিক কাজে লাগানোর সুযোগ করে দেয়ার ক্ষেত্রে এন্ড্রু কার্নেগির চেয়ে বেশি গর্ব করতে পারে এমন কোন গর্বিত ব্যক্তি নেই। একজন কার্যনির্বাহীর কাজেকর্মে সফল হতে তার প্রেসক্রিপশনের চেয়ে ভালো কোনো চিকিৎসাপত্রও নেই। এন্ড্রু কার্নেগি, যুক্তরাষ্ট্রের স্টিল ইন্ড্রাস্ট্রির জনক। তিনি তার সমাধি পাথরের জন্য এই লেখা পছন্দ করেছিলেন,

“এখানে শায়িত আছে একজন ব্যক্তি যে জানত কীভাবে তার নিজের চেয়ে উত্তম ও দক্ষ মানুষকে তার কাজে নিয়োগ দিতে হয়।”

কার্নেগির সাথে যারা কাজ করত তারা প্রত্যেকেই শ্রেষ্ঠ ছিল, কারণ কার্নেগি তাদের শক্তিশালী দিক খুঁজে বের করেছিলেন এবং তাকে কাজে লাগিয়েছেন। এসব স্টিল এক্সিকিউটিভের প্রত্যেকে একটি সুনির্দিষ্ট ক্ষেত্রে দক্ষ ছিলেন এবং সুনির্দিষ্ট একটি কাজের জন্য দক্ষ ছিলেন। কার্নেগি, অবশ্য, তাদের সবার মাঝে প্রভাবশালী কার্যনির্বাহী ছিলেন।

জেনালের রবার্ট এডওয়ার্ড লি এর আরেকটি ঘটনা শক্তিকে উৎপাদনমুখী করার অর্থকে স্পষ্ট করে। গল্পটা এরকম, লি’র একজন সেনাপতি তার আদেশ অমান্য করেছিল এবং যার ফলে, তাকে সম্পূর্ণরূপে হতাশ করেছিল এবং এটা কোন প্রথমবারও ছিল না। লি, যিনি সাধারণত নিজের রাগকে দমিয়ে রাখতেন, প্রচ- ক্রোধে ফেটে পড়লেন। যখন তার রাগ কমে আসে, তার একজন সহকারী সসম্মানে তার কাছে জানতে চায়, “কেন আপনি তাকে তার দায়িত্ব থেকে অব্যহতি দিচ্ছেন না।” (বলা হয়ে থাকে) লি বলেন, অত্যন্ত বিস্ময় নিয়ে তার সহকারীর দিকে তাকালেন এবং বললেন, “কী উদ্ভট কথা-সে তো কার্যসম্পাদন করে দেখাতে পারে।”

যোগ্য নির্বাহীগণ জানে যে তাদের অধীনস্ত লোকেরা তাদের কার্যসম্পাদন করার জন্য পারিশ্রমিক নিয়ে থাকে, তাদের সিনিয়রকে খুশি করার জন্য নয়। এতে কিছু আসে-যায় না নায়িকা বা অভিনেত্রীরা কতবার পরিচালক বা ডিরেক্টরদের ওপর রাগ ঝেড়েছে যদি সে তার কাজের মাধ্যমে দর্শকদের কাছে টানতে পারে। একজন অপেরা ম্যানেজারকে পারিশ্রমিক দেওয়া হয় সবকিছুর পরও নায়িকার বকা-ঝকা সহ্য করার জন্য, যদি তাই তার কাজে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের উপায় হয়। এটা গুরুত্বপূর্ণ নয় যে, একজন প্রথম সারির শিক্ষক বা তুখড় জ্ঞানী ব্যক্তি প্রতিষ্ঠানের প্রধানের সন্তুষ্টিপ্রাপ্ত বা আলোচনার মিটিংয়ে বন্ধুসুলভ কিনা। প্রতিষ্ঠানের প্রধান বা অনুষদ প্রধানকে পারিশ্রমিক প্রদান করা হয় একজন প্রথম সারির শিক্ষককে বা প্রথম সারির বিদ্বানকে তার কাজ কার্যকর পন্থায় করতে সুযোগ করে দেওয়ার জন্য এবং এর কারণে যদি প্রশাসনিক রুটিনে কোন অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতি তৈরি হয় বা অসন্তুষের তৈরি হয় তবুও তা করতে হবে। কারণ যে পারিশ্রমিক দেওয়া হয় সেই অনুপাতে এটা অনেক কম ঝামেলার।

যোগ্য নির্বাহীগণ কখনো জানতে চায় না যে, “সে কীভাবে আমার সাথে মানিয়ে নেয়?” তাদের প্রশ্ন হলো “সে কী অবদান রাখে?” তাদের প্রশ্ন এটা নয় যে, “সে কী করতে পারে না?” বরং প্রশ্ন এটা যে, “সে কোন কাজটি অসাধারণ উপায়ে সম্পাদন করতে পারে?” কর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রে তারা একটি প্রধান ক্ষেত্রে প্রার্থীদের শ্রেষ্ঠত্ব বা কর্মদক্ষতা আছে কিনা তা খোঁজ করে। যে পারফর্ম্যান্স সাধারণত সবাই করে তারা তা খোঁজে না।

একটি শক্তিশালী ক্ষেত্র খুঁজে বের করা এবং একে কাজে লাগানোর চেষ্টা করা মানুষের প্রাকৃতিক ও স্বভাবগত বিষয়। মূলত “সম্পন্ন মানুষ” বা “পরিপক্ক ব্যক্তিত্ব” ইত্যাদির ব্যাপারে যে আলাপ হয় তার দ্বারা একটি জিনিস লুকানোর চেষ্টা করা হয়। মানুষের প্রাকৃতিক ও স্বভাবগত যে মেধা ও দক্ষতা রয়েছে তাকে এড়িয়ে সব কাজের কাজী মানে “সম্পন্ন মানুষ বা পরিপক্ক ব্যক্তিত্ব” গড়ে তোলার ওপর জোর দেয়া হয়। এর ফলে মানুষের প্রাকৃতিক ও স্বভাবগত যে মেধা ও দক্ষতা রয়েছে তার প্রতি ঘৃণা তৈরি হয়। এটা অন্যভাবে বলতে গেলে শ্রেষ্ঠত্বের প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন করা হয়। অথচ মানুষের উচিত তার সকল উপকরণকে একটি মাত্র কাজের পিছনে ব্যয় করা, একটি মাত্র প্রচেষ্টার জায়গা তৈরি করা, একটি বিষয়ে পূর্ণতা লাভ করা। মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব কেবল একটি বিষয়ে অর্জন করা সম্ভব বা সর্বোচ্চ গুটিকয়েক বিষয়েই সম্ভব।

অনেক বিষয়ে আগ্রহী ব্যক্তির অস্তিত্ব পৃথিবীতে আছে এবং এটাই সাধারণত আমরা বুঝিয়ে থাকি যখন আমরা “সর্ব প্রতিভাধর” শব্দবান্ধবটি উল্লেখ করি। একাধিক বিষয়ে নৈপুণ্যের অধিকারী ব্যক্তির হদিস তেমন একটা পাওয়া যায় না বললেই চলে। এমনকি লিওনার্দো কেবল চিত্রকলাতেই শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছিলেন যদিও একাধিক বিষয়ে তার আগ্রহ ছিল; গোথে এর সকল কবিতা যদি হারিয়ে যেত এবং তার জীবন-কর্মের মধ্যে কেবল দর্শন ও আলোকবিদ্যায় অগভীর ও ভাসা ভাসা কাজগুলো থাকত, তবে হয়তো তার কর্ম সর্বাধিক পরিচিত বিশ্বকোষে পাদটিকা হওয়ার যোগ্যতাও অর্জন করত না। যা একজন বর্ণাঢ্য ও মহান মানুষের ব্যাপারে সত্য তা আমরা বাকিদের ব্যাপারে তো দ্বিগুণ সত্য। অতএব যদি একজন নির্বাহী শক্তির ব্যাপারে না খুঁজে এবং শক্তিকে উৎপাদনশীল করার কাজ না করে, তবে সে কেবল মানুষ কী করতে পারে না, তার দুর্বলতা কী, তার ত্রুটি কী, কার্য সম্পাদন ও কার্যকারিতায় বাধা ইত্যাদি বিষয়ই তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়াবে। যা নেই তা নিয়ে মাথাব্যথা ও দুর্বলতার উপর গুরুত্বারোপ সময়ের অপচয়। এটাকে আমরা বলতে পারি মানব সম্পদকে নষ্ট না করলেও অপব্যবহার করে।

শক্তিশালী দিকটির উপর জোর দেওয়া মূলত কার্যকারিতার তলব করা। যে ব্যক্তি প্রথমে জিজ্ঞাসা করে না, “একজন মানুষ কী করতে পারে?” সে তার সহযোগী আদতে যতটুকু আউটপুট দেওয়ার ক্ষমতা রাখে তার চেয়েও কম পরিমাণ গ্রহণ করতে বাধ্য। সে অগ্রিম তার সহযোগীর অকার্যকারিতাকে অজুহাত হিসাবে পেশ করে। সে ধ্বংসাত্মক তবে তা জটিল পর্যায়ের নয়, বাস্তববাদী হওয়া তো তার জন্য বহুদূর। একজন প্রকৃত চাপ সৃষ্টিকারী বস এবং কোন না কোনভাবে মানুষকে উৎসাহদানকারী সব বসই চাপ সৃষ্টিকারী বস-সবসময় একজন মানুষের কী ভালোভাবে করা উচিত তা দিয়ে কাজ শুরু করে এবং সে (চাপ সৃষ্টিকারী বস) চায় যে সে (কর্মচারী বা অনুরাগী) প্রকৃত-অর্থেই তা করবে।

দুর্বল দিকগুলোর বিপরীতে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা একটি প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্যকে বিফল করে। যখন মানুষের দুর্বল দিকগুলো অসাড় ও ব্যাপকভাবে ক্ষতিহীন বিবেচিত হয় তখন মানুষের শক্তিশালী দিকগুলোকে কার্যসম্পাদনে দ্বিগুণ করে তোলার জন্য প্রতিষ্ঠান হলো নির্দিষ্ট হাতিয়ার। শক্তিশালী মানুষের না প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন, না সে তার কামনা করে। তারা নিজেরা নিজেদের মতো করে দক্ষভাবে কাজ করতে পারে। অন্যদিকে, আমরা বাকিরা, বড় একটি অংশ, আমাদের এত বেশি শক্তিশালী দিক নেই যে তা নিজে নিজে কার্যকর প্রমাণিত হবে যদিও আমাদের সীমাবদ্ধতা আছে তবুও। “কেউ সাহায্যের জন্য কেবল একটি হাত ভাড়া করতে পারে না-কারণ একটি হাত ভাড়া করলেও পুরো একজন মানুষ তার সাথে চলে আসবে।” এমন একটি প্রবাদ লোকজন বলে থাকে। তেমনিভাবে, একজন মানুষ কেবল তার শক্তিশালী দিক নিয়েই মানুষ হয় না; তার দুর্বলতা সবসময় তার সাথে থাকে।

তবে আমরা একটি প্রতিষ্ঠানকে এভাবে গঠন করতে পারি যে দুর্বলদিকগুলো তার কাজ ও কার্যসম্পাদনের (ড়িৎশ ধহফ ধপপড়সঢ়ষরংযসবহঃ) বাইরে থাকবে অথবা একপাশে রেখে দেয়া সম্ভব হবে। আমরা শক্তিশালী দিকগুলোকে প্রাসঙ্গিক করার নিমিত্তে তাকে গঠন করতে পারি। একজন দক্ষ কর হিসাবরক্ষক হয়তো নিজে নিজের ফার্ম বা ব্যবসা পরিচালনা করতে গিয়ে হিমসিম খাচ্ছে। কারণ সে হয়তো গ্রাহকদের সাথে মানে লোকজনের সাথে আলাপ-আলোচনা করতে বা খাপ খাইয়ে নিতে ততটা দক্ষ নয়। কিন্তু একটি প্রতিষ্ঠানে এমন একজন ব্যক্তিকে একটি ব্যক্তিগত অফিস রুম দেওয়া যেতে পারে এবং অন্যান্য মানুষের সরাসরি যোগাযোগ থেকে তাকে বিরত রাখা হবে। একটি প্রতিষ্ঠানে একজন ব্যক্তি তার শক্তিশালী দিকটিকে কার্যকর করে তুলতে পারে এবং তার দুর্বল দিকটিকে অপ্রাসঙ্গিক প্রমাণ করতে পারে। একজন ছোটখাট ব্যবসায়ী যে ফাইন্যান্স তথা আর্থিক বিষয়ে দক্ষ কিন্তু উৎপাদন ও মার্কেটিং তথা বাজারজাতকরণে দুর্বল সেও এ ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হতে পারে। কিন্তু একটি বড় প্রতিষ্ঠানে যে ব্যক্তি কেবল ফাইন্যান্সে দক্ষ তাকে কেবল সেই কাজের সুযোগ দিয়ে আরও উৎপাদনক্ষম মানুষে পরিণত করা সম্ভব।

যোগ্য নির্বাহীরা দুর্বল দিকগুলোর প্রতি অন্ধ নয়। যে নির্বাহী জানে যে তার কাজ হলো জন জোনস নামক কর্মী হিসাবনিকাশের কাজে দক্ষ, কিন্তু লোকজনের সাথে ততটা ভালোভাবে মিশতে পারে না। তিনি কখনো জন জোনসকে ম্যানেজারের দায়িত্ব দিবেন না। এতে করে জোনস যেমন তার কাজ ভালোভাবে করতে পারবে, প্রতিষ্ঠানও দক্ষ একজন কর্মী পাবে।

তবে অনেক মানুষ আছে যারা অন্যের সাথে মিশতে পারে। দক্ষ ট্যাক্স একাউন্টেন্ট তথা কর হিসাবরক্ষকগণ এক্ষেত্রে বিরল দৃষ্টান্ত। অতএব, এমন ব্যক্তি এবং তার তো অন্যরা যা করতে পারে তা হলো একটি প্রতিষ্ঠানের সাথে জুড়ে থাকা। সে যা করতে পারে না তা হলো তার সীমাবদ্ধতা এবং এর বেশি কিছু না।

এসব কিছু স্পষ্ট, যে কেউ এমনই বলতে পারে। তবে কেন, সবসময় এটা করা হয় না? কেন সেসব নির্বাহী অপ্রতুল যারা শক্তিকে উৎপাদনমুখী করতে পারে-বিশেষত তাদের সহযোগীদের শক্তিকে? এমনকি লিঙ্কন কেন শক্তিকে কাজে না লাগিয়ে তিনবার দুর্বল বিষয় নিয়ে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন?

মূল কারণ হলো নির্বাহীর তাৎক্ষণিক কাজ হলো মানুষ নিয়োগ করা নয়; শূন্যপদ পূর্ণ করা। ফলে, কাজকে এমনভাবে শুরু করার প্রবণতা দেখা যায় যে, যেন তা প্রকৃতিরই অংশবিশেষ। তাই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি পদকে পূর্ণ করার জন্য মানুষ খোঁজে। তাই এতে ভুল হওয়া সম্ভব যে, টেনেটুনে উপযুক্ত কাউকে দিয়ে পদগুলো পূর্ণ করা হবে-কাক্সিক্ষতদের মাঝে সর্বনিম্ন এমন একজন ব্যক্তিকে পদে নিয়োগ দিয়ে দাও। আর এটা নির্ঘাত মধ্যম মানের কাজ হবে।

এ ধরনের ব্যাপারে সবচেয়ে প্রচলিত বিষয় কী আছে? সর্বত্র প্রচলিত যে সমাধান তা হলো কাজকে এমনভাবে প্রস্তুত করা যাতে বিদ্যমান ব্যক্তিদেরকে শক্তিশালী দিকগুলোকে তাতে ব্যবহার করা যায়। কিন্তু এই সমাধানটি যেকোন রোগের চেয়েও বেশি খারাপ-হয়তো কোন ছোট ও সাধারণ প্রতিষ্ঠান ছাড়া। চাকরিকে সর্বদা নৈর্ব্যক্তিক (ড়নলবপঃরাব) হতে হবে; অর্থাৎ, ব্যক্তির পরিবর্তে কাজের দ্বারাই তা নির্ধারিত হতে হবে।

এর একটি কারণ হলো একটি প্রতিষ্ঠানের কোন কাজের বিবরণ, গঠন-প্রক্রিয়া এবং পদবি ইত্যাদির পরিবর্তন পুরো প্রতিষ্ঠানে পরিবর্তন পরবর্তী নানা প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। কোম্পানির চাকরি বা কাজগুলো পরস্পর নির্ভরশীল ও সম্পর্কযুক্ত। কারো পক্ষে কেবল একটি কাজে লোক নিযুক্ত করতে হবে বিধায় সকলের কাজ ও দায়-দায়িত্বের মাঝে পরিবর্তন আনা সম্ভব নয়। কেবল একজন ব্যক্তির জন্য কোন কাজকে গঠন-বিন্যাস করতে গিয়ে এটা প্রায় নিশ্চিতভাবে ঘটে যে, দিনশেষে এর ফলে কাজের চাহিদার মাঝে ও তার জন্য বিদ্যমান মেধা ও মেধাবির মাঝে বড় রকমের পার্থক্য তৈরি হয়ে যায়। এর ফলে একজনকে নিযুক্ত করতে গিয়ে একাধিক ব্যক্তিকে তাদের স্থান থেকে সরিয়ে বিক্ষিপ্ত করে ফেলতে হয়।

উক্ত বিষয়টি কেবল কোন আমলাতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান যেমন সরকারি এজেন্সি বা বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের জন্য নয় সবার জন্যই সত্য। কাউকে বিশ্ববিদ্যালয়ে বায়োকেমিস্ট্রির কোন প্রাথমিক কোর্স পড়াতে হবে। যদিও প্রাথমিক বিষয় তবু শিক্ষককে এতে দক্ষ হওয়া চাই, বিশেষজ্ঞ হওয়া চাই। কোর্সটি সাধারণ এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়ের প্রাথমিক ও মৌলিক জ্ঞানগুলো এতে আলোচিত হবে, শিক্ষকের এতে আগ্রহ আছে কি নেই তা বিবেচ্য নয়।

কী শেখাতে হবে তা নির্ধারিত হয় ছাত্রদের প্রয়োজনের ভিত্তিতে-অর্থাৎ এটা একটা নৈব্যক্তিক চাহিদা-যা প্রত্যেক শিক্ষককে মেনে নিতে হবে। যখন অর্কেস্ট্রার পরিচালকের প্রথম শ্রেণির চেলিস্টের পদ পূর্ণ করতে হয়, তখন সে এমন কোন নিম্নস্তরের চেলিস্ট করবে না যে, একজন প্রথম শ্রেণির “অবো” বাদক, এমনকি “অবো’ বাদকদের যে কোন চেলিস্ট এর চেয়ে ভালো মিউজিশিয়ান হতে হয় তবুও। কারণ নতুন একজনকে স্থান দেওয়ার জন্য পরিচালক পুনরায় স্বরগ্রাম রচনার ঝুঁকিটা নিবে না। অপেরা ম্যানেজার যে জানে তাকে পারিশ্রমিক দেওয়া হয় “ফার্স্ট লেডির” বকা-ঝকা মেনে নেওয়ার জন্য, সেও প্রত্যাশা করে “ফার্স্ট লেডি” টস্কা (ঞড়ংপধ) গানই গাইবে।

   

চিত্র: চেলিস্ট বা চেলো বাদক (বামদিকের ছবির বাদ্যযন্ত্রের বাদক) এবং অবো বাদক (ডানদিকের ছবির বাদ্যযন্ত্রের বাদক)। তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া

তবে নৈর্ব্যক্তিক, বস্তুকেন্দ্রিক কাজের একটি সূক্ষ্ম কারণ রয়েছে। এটাই একমাত্র উপায় কোন প্রতিষ্ঠানে নানা বৈচিত্র্যের মানুষ যোগান দেওয়ার এবং নিয়োগ করার। এটি একমাত্র উপায় কোন প্রতিষ্ঠানের ব্যক্তিত্ব ও স্বভাবের মাঝে পার্থক্য মেনে নেওয়ার এবং উৎসাহিত করার। বৈচিত্র্য মেনে নেওয়ার জন্য, অবশ্যই সম্পর্কগুলো কাজকেন্দ্রিক হতে হবে, ব্যক্তিকেন্দ্রিক হওয়া যাবে না। অর্জনগুলো পরিমাপ করতে হবে অবশ্যই অবদান (পড়হঃৎরনঁঃরড়হ) ও পারফর্ম্যান্স তথা কার্যসম্পাদনের দক্ষতার বস্তুনিষ্ঠ মানদ-ের ভিত্তিতে। এটা তখনই সম্ভব যখন কোন কাজ বা পদ নির্ণিত হয় নৈব্যক্তিকভাবে। অন্যথায়, “কোনটি সঠিক?” সেই প্রশ্ন না করে “কে সঠিক?” সেই প্রশ্ন দেখা দিবে। কখনো ব্যক্তি-নির্বাচনের সিদ্ধান্ত “আমি কি এই ব্যক্তিকে চিনি?” বা “সে কি গ্রহণযোগ্যতা লাভ করতে পারবে?” এর ভিত্তিতে করা যাবে না, বরং নির্বাচন করতে হবে “এ কি সেই ব্যক্তি যে অসাধারণ কাজটি সম্পাদন করতে সব থেকে বেশি যোগ্য?” এই প্রশ্নের ভিত্তিতে।

ব্যক্তিত্বের ভিত্তিতে কোন কাজের বা চাকরির গঠন-বিন্যাস নির্ধারণ এটা নিশ্চিত করে যে, তা পক্ষপাত ও প্রথাগত আচরণের দিকে পরিচালিত করবে। আর এর উভয়টিই কোন প্রতিষ্ঠান গ্রহণ করতে পারে না। ব্যক্তি-সংশ্লিষ্ট সিদ্ধান্তে সবসময় সমতা ও নৈর্ব্যক্তিকতা থাকা প্রয়োজন। অন্যথায় প্রতিষ্ঠান হয়তো তার দক্ষ মানুষ হারাবে বা তাদের অনুপ্রেরণা ধ্বংস করে দিবে। প্রতিষ্ঠানে বৈচিত্র্যও থাকা জরুরি নচেৎ এটা পরিবর্তনের ও ভিন্নমত পোষণের সৌন্দর্য হারাবে যা সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে অতীব প্রয়োজনীয় (৭ম অধ্যায়ে এ সম্পর্কে আরো আলোচিত হবে)।

এটা অনুমান করা হয় যে, যেসব ব্যক্তি প্রথম সারির নির্বাহীদের দল গঠন করে সাধারণত তারা তাদের কাছাকাছি সহকর্মী বা অধীনস্তদের নিকটবর্তী নয়। মানুষকে কারো ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দের ভিত্তিতে বাছাই না করে সে কী করতে পারে তার ভিত্তিতে বাছাই করা মানে তার পারফর্ম্যান্স তথা কার্যসম্পাদনে দক্ষতা প্রত্যাশা করা, প্রথা বা নিজের পছন্দ অনুসরণ করা নয়। এই ফলাফল নিশ্চিত করার জন্য, তারা নিজেদের মাঝে ও তাদের কাছের সহকর্মীদের মাঝে দূরত্ব বজায় রাখে।

এটা প্রায়ই বলা হয়, লিঙ্কন কেবল তখন একজন যোগ্য প্রধান নির্বাহী হতে পেরেছিলেন যখন তিনি তার ব্যক্তিগত সম্পর্কের, যেমন, স্ট্যান্টন, তার যুদ্ধসচিব-মানুষগুলো থেকে তফাতে ও দূরে চলে যান। ফ্রাঙ্কলিন ডি. রুজভেল্টের মন্ত্রিসভায় কোন বন্ধু ছিল না-এমনকি হ্যানরি মর্গেনথাও, তার কোষাগার সচিব এবং সকল বেসরকারি কাজে তার দরকারি লোকও তার বন্ধু ছিল না। জেনারেল মার্শাল ও আলফ্রেড পি. স্লোয়ানও একইভাবে সবার থেকে দূরে থাকতেন। এ সকল উষ্ণ হৃদয়ের মানুষগুলো-মানুষের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের প্রয়োজনের সময়-বন্ধু বানানোর ও ধরে রাখার ঐশ্বরিক উপহারপ্রাপ্ত। যাই হোক, তারা জানত যে তাদের বন্ধুত্ব সবসময় কর্মস্থল ও কর্মসময়ের বাহিরে। তারা জানত যে তারা কাকে পছন্দ করল বা কাকে গ্রহণ করল তা অপ্রাসঙ্গিক। আর তারা সকলের থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার মাধ্যমে অসাধারণ বৈচিত্র্যের অধিকারী এবং শক্তিশালী দল গঠনে সক্ষম হয়েছিল।

তবে কীভাবে শক্তিশালী দিকগুলোর উপর ভিত্তি করে কর্মী নিয়োগ করত, ব্যক্তিকেন্দ্রিক কাজ সৃষ্টির ফাঁদে হোঁচট না খেয়েও?

সাধারণত তারা চারটি নীতি অনুসরণ করে:


প্রথম নীতি


১. তারা এই ধারণায় কাজ শুরু করে না যে, কাজ বা চাকরি প্রকৃতিগতভাবে বা ¯্রষ্টা কর্তৃক সৃষ্ট। তারা জানে যে, কাজগুলো প্রণয়ন করা হয়েছে অত্যধিক পতনযোগ্য বা ভুলসম্পন্ন মানুষের জন্য। কাজেই তারা সবসময় অসম্ভব কাজের উপর সজাগ দৃষ্টি রাখে, এমন কাজ যা সাধারণ মানুষের জন্য নয়।

এমন কাজগুলো সাধারণ। এসব কাগজে-কলমে দেখতে অনেক যৌক্তিক মনে হতে পারে। তবে তা পূর্ণ করা যায় না। একাধিক জানাশোনা ব্যক্তি দিয়ে চেষ্টা করা হয়েছে-তবে কেউ ভালো করেনি। ছয় মাস বা এক বছর পর, কাজটি তাদের পরাজিত করে।

প্রায় সর্বদা এমন একটি কাজ সৃষ্টি করা হয় বিরল একজন মানুষকে সুযোগ দেওয়ার জন্য এবং তা তার মানসের সাথে মিল রেখেই করা হয়। এটা সাধারণত বিভিন্ন মেজাজের সমন্বয়ের দাবি করে যা একজন ব্যক্তির মাঝে কদাচিৎ পাওয়া যায়। প্রত্যেক ব্যক্তি বিভিন্ন ধরনের জ্ঞান ও উচ্চতর দক্ষতা অর্জন করতে পারে। তবে তারা তাদের মেজাজ ও স্বভাবকে পরিবর্তন করতে পারে না। যে কাজ অসম মেজাজের দাবি করে তা “অসম্পাদনযোগ্য কাজ”, মানুষ-হন্তারক।

নিয়মটি সহজ: যে কাজ দুই বা তিনজন ব্যক্তি সফলভাবে সম্পন্ন করতে ব্যর্থ হয়, যদিও তারা তাদের পূর্ববর্তী কাজ ভালোভাবে সম্পন্ন করে, তবে সেই কাজ মানব-সাধনযোগ্য নয়। একে রিডিজাইন তথা নতুন করে নকশা করতে হবে।

মার্কেটিং বিষয়ে যে কোন রচনার সমাপ্তি এভাবে হয় যে, বিক্রয় ব্যবস্থাপনা বিভাগ বিজ্ঞাপন ও প্রচার বিভাগের একসাথে একই মার্কেটিং কার্যনির্বাহীর তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হবে। বড়, জাতীয় উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ও গণ-বিপণির ভোক্তা শ্রেণির অভিজ্ঞতা হলো যে এই সামগ্রিক মার্কেটিংয়ের কাজ রীতিমতো অসম্ভব। এমন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের যুগপৎ মাঠপর্যায়ের বিপণনে উচ্চতর কার্যকারিতা-অর্থাৎ পণ্য পরিচালনায় এবং বিজ্ঞাপন ও প্রচারে চরম কার্যকারিতা-অর্থাৎ মানুষ পরিচালনায় দক্ষতা থাকতে হবে। এসব কাজ বিভিন্ন ধরনের মানুষের প্রয়োজনীয়তা উপস্থাপন করে যা একজন মানুষের মাঝে কদাচিৎ পাওয়া যায়।

যুক্তরাষ্ট্রের একটি বড় প্রতিষ্ঠানের প্রধানের দায়িত্ব পালন এমন একটি অসম্ভব কাজ। অন্তত আমাদের অভিজ্ঞতা এমন যে, এই পদে কেবল অল্প কিছু মানুষের কাজ চালিয়ে যাওয়া সম্ভব-এমনকি যদিও নির্বাচিত মানুষটির অন্যান্য পূর্ববর্তী কাজে অর্জনের যথেষ্ট ও সুদীর্ঘ রেকর্ড় থাকে।

আরেকটি উদাহরণ হতে পারে আজকের দিনের বড় আন্তর্জাতিক মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলোর ভাইস-প্রেসিডেন্ট বা উপ-প্রধানের পদটি। মূল কোম্পানির সংশ্লিষ্ট এলাকার বাইরে পণ্য উৎপাদন ও বিপণন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠা মাত্রই-তারা তাদের সর্বমোট অংশের এক-পঞ্চমাংশ অতিক্রম করা মাত্রই-সেসব কিছু যা মূল কোম্পানির সাথে সংশ্লিষ্ট নয় তা একটি প্রাতিষ্ঠানিক অঙ্গে স্থাপন একটি অসম্ভব, মানুষ-বিনাশকারী, কাজের সৃষ্টি করে। কাজটি হয়তো বিশ্বব্যাপী পণ্য-শ্রেণি (যেমন হল্যোান্ডে ফিলিপস কোম্পানি করেছে) কর্তৃক স্বীকৃত হবে, নয়তো প্রধান বাজারগুলোর সাধারণ সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈশিষ্ট্য অনুসারে স্বীকৃত হবে। যেমন, এটা তিনটা কাজে ভাগ হবে:

১. শিল্পোন্নত দেশে (যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, পশ্চিম ইউরোপ, জাপান) ব্যবসা ব্যবস্থাপনা;

২. উন্নয়নশীল দেশে ব্যবসা ব্যবস্থাপনা (যেমন ল্যাটিন আমেরিকার অধিকাংশ দেশ, অস্ট্রেলিয়া, ইন্ডিয়া, নিকট প্রাচ্য);

৩. অবশিষ্ট অনুন্নত দেশে ব্যবসা ব্যবস্থাপনা।

কতিপয় প্রধান ক্যামিকাল কোম্পানি এই পথ অনুসরণ করছে।

একটি বড় দেশের রাষ্ট্রদূত অনুরূপ দুর্দশায় নিপতিত হয়। তার দূতাবাস এত প্রকা- হয়ে গেছে যে, আর তার কর্মকা- এত বেশি ছড়িয়ে আছে যে, যে ব্যক্তি একে পরিচালনা করতে পারে তার প্রথম কাজটির জন্য কোন সময় এবং অনেকটা বলতে গেলে আগ্রহও থাকে না। থাকে না তার এসাইনমেন্ট হিসাবে প্রাপ্ত রাষ্ট্রটিকে জানা, তার সরকার, নীতি, মানুষ ইত্যাদি সম্পর্কে অবগত হওয়া এবং অবগতি করা, তাদের সাথে পরিচিতি হওয়া ও তাদের বিশ্বাস অর্জন করা ইত্যাদি। আর ম্যাকনামারার পেন্টাগনে সিংহ-বশিকরণ আইনেও (গৎ. গপঘধসধৎধ'ং ষরড়হ-ঃধসরহম ধপঃ ধঃ ঃযব চবহঃধমড়হ), আমি এখনো বিশ্বাস করতে পারি না যে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা সচিবের কাজ আদতে সম্ভব কিনা (যদিও আমি স্বীকার করি যে, এর বিকল্পও আমার হাতে নেই)।

তাই কার্যকারিতাসম্পন্ন নির্বাহী প্রথমত নিশ্চিত করে যে, কাজটি যথাযথভাবে সাজানো হয়েছে। যদি অভিজ্ঞতা তাকে ভিন্ন কিছু বলে, তবে সে অসাধ্যসাধন করার জন্য প্রতিভাধরের খোঁজে বের হয় না। সে কাজটি পুনরায় বিন্যাস্ত করে। সে জানে যে, প্রতিষ্ঠানের পরিক্ষানিরীক্ষা প্রতিভার ভিত্তিতে হয় না। এটা হলো সাধারণ মানুষ থেকে অসাধারণ কাজ সম্পাদন করিয়ে নেওয়ার সক্ষমতা অর্জন।


দ্বিতীয় নীতি


২. শক্তিশালী দিকগুলোকে কাজে লাগানোর আরেকটি নীতি হলো প্রতিটি কাজকে চাহিদাসম্পন্ন ও বড় করে তোলা। এর চ্যালেঞ্জ থাকা উচিত একজন শক্তিশালী দিকসম্পন্ন মানুষের মাঝে যা আছে তা বের করে আনার। এর সুযোগ থাকা চাই যাতে করে যে কোন শক্তি যা কাজের সাথে প্রাসঙ্গিক তা তাৎপর্যপূর্ণ ফল নিয়ে আসতে পারে।

প্রসঙ্গত এটা অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের নীতি নয়। তাদের মাঝে কাজকে ছোট করার প্রবণতা দেখা যায়-যা তখন কেবল অর্থবহ হয় যখন মানুষকে নির্দিষ্ট একটি সময়ের মাঝে নির্দিষ্ট কোন কাজ বিন্যস্ত ও প্রস্তুত করা হয়। তথাপি মানুষ যেভাবে আসে আমাদের তাদের দিয়ে শূন্য পদ ভর্তি করা উচিত নয়। সহজ এর উপরের যে কোন কাজের চাহিদাও পরিবর্তনশীল এবং তা প্রায়ই আকস্মাৎ হয়ে থাকে। উপযুক্ত ব্যক্তি তখন অনুপযুক্ত হয়ে যায়। শুধুমাত্র কাজ যদি বড় হয় এবং শুরু করার চাহিদাসম্পন্ন হয়, তবে কেবল এটা একজন মানুষকে সুযোগ করে দিবে পরিবর্তিত পরিস্থিতির চাহিদায় নিজের উত্তরণ ঘটাতে।

এই নিয়মটি প্রাথমিক স্তরের জ্ঞানসংশ্লিষ্ট কর্মীদের কাজের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। তার দক্ষতার জায়গা যেটাই হোক, এটাকে পূর্ণরূপে কাজে লাগানো উচিত। তার প্রথম কাজে, মানদ- নির্ধারিত হয় যার মাধ্যমে সে তার বাকি কর্মজীবন নিজেকে পরিচালনা করবে এবং যার মাধ্যমে সে তাকে ও তার ভূমিকাকে পরিমাপ করবে। যখন সে প্রথম কোন পরিপক্ক পর্যায়ের কাজে প্রবেশ করে, তখনো তার কোন কার্য সম্পাদনের সুযোগ হয় না। স্কুলে একজন ছাত্রের পক্ষে প্রতিজ্ঞা করাই শুধু সম্ভব। কাজে পরিণত করা বাহিরের জগতে এসেই শুধু সম্ভব, হোক তা গবেষণাগার, শিক্ষকতা পেশা, ব্যবসা বা একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান। নলেজ ওয়ার্ক তথা জ্ঞানসংশ্লিষ্ট কাজের প্রাথমিক পর্যায়ের ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বাকি অংশ, তার সহকর্মী ও সিনিয়র, যুগপৎ উভয়ের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হলো সে কী করতে পারে তা খুঁজে বের করা।

পাশাপাশি এটাও সমান গুরুত্বপূর্ণ যে, যত দ্রুত সম্ভব এটা খুঁজে বের করা যে, সে কি ঠিক জায়গায় আছে বা এমনকি সঠিক কাজে আছে। দৈহিক পরিশ্রমের কাজে (ম্যানুয়াল ওয়ার্কে) প্রয়োজনীয় দক্ষতা ও প্রবণতা পরীক্ষানিরীক্ষা করার অনেক নির্ভরযোগ্য উপকরণ আছে। একজন ব্যক্তি অগ্রিম পরীক্ষা করতে পারে যে একজন ব্যক্তি কাঠমিস্ত্রি বা যন্ত্রবিদ হিসাবে ভালোভাবে কাজ করতে পারবে নাকি পারবে না। কিন্তু নলেজ ওয়ার্ক তথা জ্ঞানসংশ্লিষ্ট কাজের জন্য এরকম উপযুক্ত কোন পরীক্ষা নেই। জ্ঞানসংশ্লিষ্ট কাজের ক্ষেত্রে যা প্রয়োজনীয় তা হলো এই বা ঐ নির্দিষ্ট দক্ষতাটি নয়, বরং বাহিরের বিন্যাস গুরুত্বপূর্ণ এবং এটা প্রকাশ পাবে শুধুমাত্র কার্যসম্পাদনের মাধ্যমে। [এজন্যই প্রশ্ন করতে বলা হয়েছে: এই লোকটি কী করতে পারে? (ডযধঃ পধহ ঃযরং সধহ ফড়?)]

একজন কাঠমিস্ত্রি বা যন্ত্রবিদের কাজ কারুশিল্পের মাধ্যমে নির্ধারিত হয় এবং তা খুব কমই এই দোকান থেকে ঐ দোকানে বিভিন্ন হয়ে থাকে। কিন্তু জ্ঞানসংশ্লিষ্ট কর্মীর কোন প্রতিষ্ঠানে ভূমিকা রাখার সক্ষমতার জন্য, প্রতিষ্ঠানের মূল্যবোধ ও লক্ষ্য অন্ততপক্ষে তার পেশাদার জ্ঞান ও দক্ষতার মতো গুরুত্বপূর্ণ। একজন তরুণ কর্মী যার কোন প্রতিষ্ঠানে কাজ করার সঠিক শক্তি বা দক্ষতা রয়েছে হয়তো সে অন্য প্রতিষ্ঠানের জন্য সম্পূর্ণরূপে অনুপযুক্ত প্রমাণিত হবে, অথচ বাইরে থেকে দেখলে উভয়কে অবিকল মনে হবে। কাজেই প্রথম কাজ হবে তাকে ও তার প্রতিষ্ঠান উভয়কে পরীক্ষা করার সুযোগ দেওয়া।

এটা কেবল বিভিন্ন ধরনের প্রতিষ্ঠানের জন্য সত্য নয়, যেমন সরকারি প্রতিষ্ঠান, বিশ্ববিদ্যালয় বা ব্যবসা; এটা সমানভাবে একই ধরনের প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যাপারেও সত্য। আমি এখনো এমন কোন বড় দুটি ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান দেখিনি যাদের একই মূল্যবোধ আছে এবং একই বিষয়ে অবদান রাখার প্রতি জোর দেয়। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসাবে যে ব্যক্তি প্রাণবন্ত ও উৎপাদনমুখী, হতে পারে সে অন্য একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে নিজেকে হারিয়ে ফেলবে, দুর্দশাগ্রস্থ ও হতাশ হয়ে পড়বে। সিভিল সার্ভিস কমিশন যত যাই করুক, সরকারের সকল প্রতিষ্ঠান একই নিয়ম পালন করার জন্য ও মানদ- ব্যবহার করার জন্য, সরকারি সংস্থাসমূহ দশ বছরের মধ্যে যদি থিতু হয়ে যায় তবে প্রত্যেকেই আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্য ধারণ করবে। প্রত্যেকে তার কর্মীদের থেকে ভিন্ন ভিন্ন আচরণ প্রত্যাশা করে; বিশেষত যারা পেশাদার পদে আছে তারা, কার্যকরী হওয়ার জন্য ও অবদান রাখার জন্য।

তরুণ থাকা অবস্থায় স্থানান্তর হওয়া সহজ-অন্তত পশ্চিমা রাষ্ট্রে যেখানে স্থানান্তর গ্রহণযোগ্য। একজন ব্যক্তি যদি একই প্রতিষ্ঠানে দশ বছর বা তার বেশি কাটিয়ে দেয়, তবে তাদের জন্য অন্যত্র চলে যাওয়া কঠিন হয়ে যায়, বিশেষত যারা অত্যধিক কার্যকারিতার প্রমাণ দিতে পারেনি তারা। তরুণ জ্ঞানসংশ্লিষ্ট কর্মীদের তাই নিজেকে আগেভাগে জিজ্ঞাসা করা চাই: “আমি কি আমার দক্ষতা হিসাবে সঠিক কাজে আছি বা সঠিক জায়গায় আছি?”

তবে উত্তর তো দূরে থাক, সে প্রশ্নটিও করতে পারবে না, যদি তার শুরুর কাজটি অত্যধিক ছোট প্রকৃতির হয়, সহজ হয় এবং একে এমনভাবে সাজানো হয় যেন তা তার অনভিজ্ঞতার ক্ষতিপূরণ হয়, সে কী করতে পারে তার জন্য নয়।

তরুণ নলেজ ওয়ার্কার তথা জ্ঞানসংশ্লিষ্ট কর্মীদের নিয়ে যত জরিপ করা হয়েছে-আর্মি মেডিকেল শাখার চিকিৎসক, গবেষণাগারের কেমিস্ট বা রসায়নবিদ, নির্মাণ-প্রকল্পের প্রকৌশলী বা হিসাবরক্ষক, হাসপাতালের নার্স-একই ফলাফল উৎপন্ন করে। যারা উৎসাহ-প্রাণ এবং যাদের, ফলশ্রুতিতে, তাদের কাজের প্রেক্ষিতে দেখানোর মতো ফলাফল আছে তারাই সেসব ব্যক্তি যাদের সক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করা হয় এবং ব্যবহার করা হয়। যারা গভীরভাবে হতাশ হয়ে আছে তারা সব কোন না কোনভাবে বলে, “আমার সক্ষমতা ব্যবহার হচ্ছে না।”

তরুণ জ্ঞানসংশ্লিষ্ট কর্মী যার কাজ চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করার মতো অত বড়সড় নয় এবং তার সক্ষমতা পরীক্ষার সম্মুখীন হয়, সে হয়তো তার কাজ ছেড়ে দেয় বা তিক্ততা, নাক-সিটকানো ও অনুৎপাদনশীলতার কারণে মাঝপথে এসে অনাগ্রহী হয়ে পড়ে। সর্বত্র নির্বাহীগণ অভিযোগ করে যে, অনেক তরুণ কর্মী ভেতরে প্রেরণার আগুন নিয়ে এসে শীঘ্রই পোড়া-কাঠে পরিণত হয়। তারা কেবল নিজেদেরই দোষারোপ করতে পারে: তারা তরুণদের ছোট কাজ দিয়ে তাদের আগুনকে নিভিয়ে দেয়।


তৃতীয় নীতি


৩. যোগ্য নির্বাহীগণ জানে যে, একজন ব্যক্তি কী করতে পারে তা দিয়ে আরম্ভ করা উচিত, নাকি একটি কাজ কী চায় তার ভিত্তিতে মানুষকে কাজে নামানো উচিত। প্রসঙ্গত এটা নির্দেশ করে যে, তারা মানুষের ব্যাপারে তাদের চিন্তাকে কাজে লাগায় একটি কাজের শূন্য পদ পূরণের সিদ্ধান্ত গ্রহণের বহু আগে এবং তা স্বাধীনভাবে।

এটাই কারণ বর্তমানে মূল্যায়ন-প্রক্রিয়ার ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতার, যেখানে মানুষ বিশেষত যারা জ্ঞানসংশ্লিষ্ট কাজে আছে তাদের নিয়মিত মূল্যায়ন করা হয়। এর উদ্দেশ্য হলো বড় কোন পদে পদায়নের জন্য ব্যক্তিটি উপযুক্ত কিনা তার সিদ্ধান্ত গ্রহণের পূর্বে তার ব্যাপারে একটি উপযুক্ত মূল্যায়নে পৌঁছা।

যাহোক, যেখানে প্রায় সকল বড় প্রতিষ্ঠানে মূল্যায়ন প্রক্রিয়া থাকে, অথচ গুটিকয়েক প্রতিষ্ঠান এ প্রক্রিয়াটি কাজে লাগায়। বারবার একই নির্বাহীগণ যারা বলে যে অবশ্যই তারা তাদের অধীনস্তদের মূল্যায়ন করে অন্তত বছরে একবার, তাদের জ্ঞানের সর্বোচ্চটুকু কাজে লাগিয়ে, তারা নিজেরাই তাদের সিনিয়রদের কর্তৃক মূল্যায়িত হয় না, তাদের কাজকে যাচাইবাছাই করা হয় না। বারংবার মূল্যায়ন প্রক্রিয়া কাগজেকলমে থেকে যায় এবং কেউ সেটার খোঁজ করে না যখন কোন অফিসিয়াল কর্মকর্তার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয়। প্রত্যেকে সেগুলোকে বাদ করে দেয়, কারণ তারা ঐগুলোকে অকার্যকর কাগজ মনে করে। সর্বোপরি, কোন ব্যতিক্রম ছাড়া সবাই, মূল্যায়ন মূলক সাক্ষাৎকার সভায় অংশগ্রহণ করে যেখানে সিনিয়রগণ অধীনস্তদের সাথে এমন কিছু আবিষ্কার নিয়ে আলোচনা করে যা কখনো ঘটেনি। তথাপি মূল্যায়নমূলক সাক্ষাৎকার পুরো সিস্টেম বা গঠনতন্ত্রের সমস্যা। ভুলের একটি কারণ উল্লেখ করা যেতে পারে, তা হলো ম্যানেজমেন্ট বিভাগ থেকে প্রকাশিত একটি বইয়ের বিজ্ঞাপনে দেখানো হয় যে, মূল্যায়নমূলক সাক্ষাৎকার হলো সিনিয়রদের “সব থেকে বেশি অরূচিকর কাজ”।

মূল্যায়ন, যেমনটা অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানে ব্যবহৃত হচ্ছে, মূলত একে আবিষ্কার করা হয়েছিল ও সাজানো হয়েছিল ক্লিনিকাল ও অ্যাবনরমাল মনোবিজ্ঞানীদের মাধ্যমে (ঃযব পষরহরপধষ ঢ়ংুপযড়ষড়মরংঃ ড়ৎ ঃযব ধনহড়ৎসধষ ঢ়ংুপযড়ষড়মরংঃ)। তারা এটা করেছিল নিজেদের কাজের জন্য। ক্লিনিশিয়ান হলো একজন থেরাপিস্টও, যে রোগ নিরাময় করে। ন্যায়সঙ্গতভাবে তার চিন্তা রোগীর জন্য কোনটি ঠিক-তা না হয়ে তার জন্য কোনটি ভুল তা হয়ে থাকে। সে কারণ হিসাবে মনে করে যার সমস্যা সেই কেবল তার কাছে আসে। তাই ক্লিনিকাল মনোবৈজ্ঞানিক বা অ্যাবনরমাল মনোবৈজ্ঞানিক মূল্যায়নকে কাজে লাগায় একটি মানুষের মাঝে দুর্বলতা নির্ধারণের প্রক্রিয়া হিসাবে।

এ ব্যাপারে আমি প্রথম অবগত হয় যখন আমি জাপানের একটি ব্যবস্থাপনা বিভাগের সংস্পর্শে এসেছিলাম তখন। নির্বাহীদের বিকাশের লক্ষ্যে একটি সেমিনারে, আমি বিস্মিত হই যখন জানতে পারি-জাপানের অংশগ্রহণকারীদের কাছ থেকে জানতে পারি-জাপানের বড় প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্তারা মূল্যায়ন প্রক্রিয়া ব্যবহার করে না। যখন আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম কেন নয়?, তাদের একজন উত্তর দেয়, “তোমার এই মূল্যায়ন কেবল একজন ব্যক্তির ভুল ও দুর্বলতা বের করে আনার সাথে সংশ্লিষ্ট। যেহেতু আমরা কোন লোককে বহিষ্কার করার এখতিয়ার রাখি না বা তাদের অগ্রগতি ও পদোন্নতি অস্বীকার করতে পারি না, সেহেতু এর প্রতি আমাদের কোন আগ্রহ নেই। অন্যদিকে, যত কম আমরা তার দুর্বলতা সম্পর্কে জানতে পারব, ততই উত্তম। আমাদের যা জানা প্রয়োজন তা হলো একজন মানুষের শক্তিশালী দিকসমূহ এবং সে কী করতে পারে। তোমার মূল্যায়ন এতে সর্বনিম্ন চাহিদাও সৃষ্টি করে না।” পশ্চিমা মনোবিদ-বিশেষত যারা মূল্যায়ন ধারার সূচনা করে-অবশ্যই তারা দ্বিমত পোষণ করবে। তবে এভাবেই তারা, সকল নির্বাহী, জাপানের বা আমেরিকার কিংবা কানাডার, প্রথাগত মূল্যায়নকে বিচার করে থাকে।

মোটের উপর, পশ্চিমারা অবশ্যই জাপানিদের অর্জনগুলো ভালোভাবেই চিন্তা করবে। যেমনটা প্রত্যেকে শুনেছে, জাপানে চাকরির বয়স আমৃত্যু। একবার যদি কোন ব্যক্তি পারিশ্রমিকের আওতায় চলে আসে, সে সবসময় তার পেশায় বা শ্রেণিতে অগ্রসর হতে থাকে-কর্মী হিসাবে, সাদা কলারের কর্মকর্তা হিসাবে বা পেশাদার এবং নির্বাহী কর্মকর্তা হিসাবে-তার বয়স ও সেবার দৈর্ঘ্য হিসাবে, পাশাপাশি প্রতি পনেরো বছর পরপর তার বেতন দ্বিগুণ হতে থাকে। সে না চাকরি ছাড়তে পারে, না তাকে কেউ ছাড়তে বাধ্য করতে পারে। কেবল শীর্ষ পর্যায়ে গেলে এবং পয়তাল্লিশ বছর পর পৃথকীকরণ হয়ে থাকে, শুধু নির্বাচিত কতিপয় মানুষ তাদের দক্ষতা ও মেধার বলে সিনিয়র নির্বাহী কর্মকর্তার পদে পদোন্নতি লাভ করে। জাপান কীভাবে এমন একটি সিস্টেম বা ব্যবস্থাপনা নিয়ন্ত্রণ করেছে যা ব্যাপক হারে ফলাফল ও অর্জন এনে দিয়েছে? এর উত্তর হলো তাদের প্রক্রিয়া তাদেরকে (জাপানিদের) নিজেদের দুর্বলতা শূন্যে নিয়ে যেতে বাধ্য করে। যেহেতু তারা সরাসরি কাউকে স্থানান্তর করতে পারে না, তাই নির্বাহী দলে এমন কাউকে কামনা করে যে কাজটি করতে পারে। তারা সবসময় শক্তিশালী দিকটি খুঁজে বের করে।

আমি জাপানের পদ্ধতি কাউকে সুপারিশ করি না। এটা আদর্শিক ভিত্তি থাকে অনেক দূরে অবস্থান করে। একটি ক্ষুদ্র দল যারা তাদের কার্যক্ষমতা প্রমাণ করেছে তারা যে কোন গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতে সক্ষম। অবশিষ্টটুকু প্রতিষ্ঠান চালিয়ে নিয়ে নেয়। কিন্তু যদি আমরা পশ্চিমে অত্যধিক গতিশীলতা বা স্থানান্তরিত হওয়া থেকে উপকৃত হতে চাই, যা ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান উভয় আমাদের প্রথানুসারে উপভোগ করে থাকে, আমাদের উচিত জাপানের প্রথাকে রপ্ত করা তথা শক্তিশালী দিক খুঁজে বের করা ও তাকে কাজে লাগানো।

একজন সিনিয়রের কাছে দুর্বলতার উপর জোর দেওয়া, যেমনটা মূল্যায়ন তাকে করতে বলে, তার সাথে তার অধীনস্তদের সম্পর্কের সততাকে নষ্ট করে। অনেক নির্বাহী যারা কার্যত মূল্যায়নকে ব্যহত করে, তাদের রীতি-নীতি তাদেরকে তাদের স্বভাবের অনুসরণে চাপিয়ে দেয়। এটাও যথাযথভাবে বোঝা যায় যে, ত্রুটি, ভুল ও দুর্বলতা ইত্যাদি খুঁজে বের করা অরূচিকর। একজন মানুষের ত্রুটি নিয়ে আলোচনা করা যখন সে একজন রোগী হিসাবে এসে সাহায্য চায়, তখন নিরাময়কারীর তা দায়িত্ব হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু, হিপোক্রেটিসের সময় থেকে যেহেতু জানা আছে, এটা পূর্ব থেকে ডাক্তার ও রোগীর মাঝে একটি পেশাগত ও সুবিধাপূর্ণ সম্পর্কের জানান দেয় যা সিনিয়র ও জুনিয়দের কর্তৃত্বপূর্ণ সম্পর্কের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এটা এমন একটি সম্পর্ক যা একত্রে কাজ চালিয়ে যাওয়াকে প্রায় অসম্ভব করে তোলে। তাই অল্প ক’জন নির্বাহী অফিসিয়াল মূল্যায়ন যে করে থাকে তা আশ্চর্যজনক নয়। এটা একটা ভুল উপায়, ভুল একটি পরিস্থিতিতে, ভুল উদ্দেশ্য সাধনে।

মূল্যায়ন এবং এর পিছনের দর্শন “সম্ভাব্যতার” সাথে প্রবলভাবে জড়িত। তবে অভিজ্ঞ ব্যক্তিরা জেনেছে যে, একজন ব্যক্তির পক্ষে কারো সম্ভাব্যতা যাচাই সম্ভব নয় যেকোন সময়ের জন্য বা যেকোন কাজের মাধ্যমে যা সে বর্তমানে করছে তার থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। “সম্ভাব্যতা” হলো “প্রতিশ্রুতির” সমার্থক শব্দ। এমনকি কেউ যদি প্রতিশ্রুতি দেয়, তবে হয়তো তা বাস্তবায়িত হবে না, যেখানে সেসব মানুষ যারা এমন প্রতিশ্রুতি (যদি তা কেবল এ কারণে যে, তাদের সুযোগ ছিল না) প্রদান করেনি তারা মূলত কার্যসম্পাদন করে।

পরিমাপ করার মাধ্যমে একজন যা কিছু পায় তা হচ্ছে পারফর্ম্যান্স তথা কার্যসম্পাদনের দক্ষতা। আর যা কিছু পরিমাপ করা উচিত তা হলো পারফর্ম্যান্স তথা কার্যসম্পাদনের দক্ষতা। এটা কোন কাজকে চ্যালেঞ্জিং ও বড় করার আরও একটি কারণ। এটা একজন মানুষ তার প্রতিষ্ঠানের কার্যসম্পাদন ও ফলাফলে যে ভূমিকা রাখতে পারে সে ব্যাপারে চিন্তা করারও একটি কারণ। কারণ একজন মানুষ অন্য কারো পারফর্ম্যান্স পরিমাপ করতে পারে কেবল প্রত্যাশিত সুনির্দিষ্ট পারফর্ম্যান্সের বিপরীতে।

তবুও কারো কারো মূল্যায়ন-প্রক্রিয়ার কিছু কাঠামো প্রয়োজন বা অন্যথায় সে ব্যক্তি মূল্যায়নের কাজটি ভুল সময়ে করে বসতে পারে, অর্থাৎ যখন একটি শূন্য পদ বা কাজকে পূর্ণ করাটা জরুরি হয়ে পড়ে। যোগ্য নির্বাহীরা তাই সাধারণত তাদের নিজস্ব, মৌলিক, ভিন্ন কাঠামো ব্যবহার করে কাজ করে থাকে। এটা শুরু হয় একজন ব্যক্তির অতীত ও বর্তমান পদে প্রত্যাশিত প্রধান প্রধান ভূমিকাগুলো বর্ণনার মাধ্যমে এবং নির্ধারিত লক্ষ্যের বিপরীতে তার কর্মক্ষমতার বিবরণ সাথে যুক্ত হয়। অতঃপর চারটি প্রশ্ন সামনে আসে:

(ক) “সে কোন কাজ ভালোভাবে সম্পাদন করেছে?”

(খ) “সে, ফলশ্রুতিতে, কোন কাজ ভালোভাবে সম্পাদন করতে পারবে?”

(গ) “তার শক্তিশালী দিক থেকে পূর্ণরূপে উপকৃত হওয়ার জন্য তার কাছে শেখার বা জানার মতো কী আছে?”

(ঘ) “যদি আমার কোন ছেলে বা মেয়ে থাকত, তাকে কি আমি এই লোকটির তত্ত্বাবধানে কাজ করতে দিতাম?”

(১) “যদি হ্যাঁ, তবে কেন?”

(২) “যদি না, তবে কেন?”

এই মূল্যায়ন সাধারণত যেমন মনে হয় তার চেয়েও বেশি জটিল হয় যখন তা কোন মানুষের উপর পরিচালিত হয়। এটা শুরু হয় একজন মানুষ কী করতে পারে তা দিয়ে। এতে দুর্বলতাকে তার শক্তিশালী দিকগুলোর পূর্ণ ব্যবহারে, তার নিজের অর্জনে, কার্যকারিতা ও পূর্ণতার বিপরীতে সীমাবদ্ধতা হিসাবে দেখা হয়।

সর্বশেষ প্রশ্নটি (২) কেবল প্রাথমিকভাবে শক্তির সাথে সম্পৃক্ত নয়। অধীনস্তরা, বিশেষত উজ্জ্বল, তরুণ এবং উচ্চাভিলাষী, নিজেদের একজন শক্তিশালী ও প্রভাবশালী কর্তা বা নেতার ইচ্ছানুসারে গঠন করতে চায়। কাজেই, কোন প্রতিষ্ঠানে একজন শক্তিশালী ও প্রভাবশালী অথচ দুর্নীতিগ্রস্থ কর্তা বা নেতার চেয়ে ধ্বংসাত্মক ও দুর্নীতিপরায়ণ আর কেউ হয় না। এমন ব্যক্তি একা একা বেশ চমৎকারভাবেই সবকিছু পরিচালনা করতে পারে; এমনকি প্রতিষ্ঠানের ভেতরে থাকাকালে যদি তার সকল ক্ষমতাকে অবজ্ঞা করা হয় তবুও সে পরিচালনা করতে পারে। কিন্তু একটি প্রতিষ্ঠানের ক্ষমতাবান পদে যদি তাকে বসানো হয়, তবে সে ধ্বংস ডেকে আনবে। তাই এটা একটা জায়গা যেখানে দুর্বলতা গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রাসঙ্গিক।

চরিত্র ও সততা নিজে নিজে কোন পূর্ণাঙ্গ ভূমিকা রাখে না-এটা সত্য। তবে এগুলোর অনুপস্থিতি সবকিছুকে ত্রুটিপূর্ণ করে তোলে। অতএব, এটা একটা ক্ষেত্র যেখানে দুর্বলতা একটি অযোগ্যতা হিসাবে বিবেচ্য। কর্মক্ষমতা ও শক্তির বিপরীতে সীমাবদ্ধতা নয়।


চতুর্থ নীতি


৪. যোগ্য নির্বাহীগণ জানে যে, শক্তি অর্জন করতে হলে দুর্বলতার সাথে মানিয়ে নিতে হবে।

ইতিহাসে কিছু মহৎ কমান্ডার আছে যারা আত্মকেন্দ্রিক, দাম্ভিক এবং আয়নায় যা দেখে সেসবের প্রতি প্রশংসা-মুখ ছিল। (এর বিপরীত অবশ্যই আকারে বড়: ইতিহাসে অসংখ্য জেনারেল আছে যারা নিজেদের শ্রেষ্ঠত্বের কারণে অভিভূত, তবে ইতিহাসে তারা মহান কমান্ডার হিসাবে স্বীকৃত নয়।) একইভাবে, যেসব মহান রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব যারা তাদের শরীরের প্রতিটি লোম দিয়ে প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রী হতে চায় না-তাদেরকে রাষ্ট্রনায়ক হিসাবে স্মরণ রাখা হয় না। সে বড় জোর একজন কার্যকর-হয়তো অতিমাত্রায় কার্যকর-সহযোগী হবে। এর বিপরীত সেই ব্যক্তি যে এই মোহে ভোগে যে পৃথিবী বা নিদেনপক্ষে পুরো জাতি আসলেই তাকে চায় এবং তার ক্ষমতায় যাওয়ার উপর নির্ভরশীল। যদি প্রয়োজনটা হয় বিপদজনক পরিস্থিতিতে শাসন করার সক্ষমতা, তবে ডিজরেইলি বা ফ্রাঙ্কলিন ডি. রুজভেল্টদেরকে মেনে নিতে হবে এবং তাদের ন¤্রতা নিয়ে অত্যধিক চিন্তিত হওয়া যাবে না। নিশ্চয় কোন মহৎ ব্যক্তি তাদের ব্যক্তিগত সহকারীদের সমান নয়। তবে সহকারী হয়ে পড়ে হাসাহাসির পাত্র। সে অনিবার্যভাবে অপ্রাসঙ্গিক সকল বৈশিষ্ট্য ও সেসব বৈশিষ্ট্য যা নির্দিষ্ট কোন কাজ সম্পাদনে প্রয়োজনীয় নয়, যার কারণে একজন মানুষ ইতিহাসে স্থান পায় সেসব বৈশিষ্ট্য সে দেখাতে পারে না।

যোগ্য নির্বাহী তাই জিজ্ঞাসা করবে: “এই ব্যক্তিটির কি প্রধান কোন ক্ষেত্রে শক্তিশালী দক্ষতা আছে? এই দক্ষতা বা শক্তি কি কাজের সাথে প্রাসঙ্গিক? যদি সে এই একটি জায়গায় শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করে, তা কি বড় কোন পার্থক্য গড়ে দিতে সক্ষম হবে?” এবং যদি এর উত্তর হয় “হ্যাঁ”, সে অগ্রসর হবে এবং মানুষটিকে নিয়োগ দিবে।

নির্বাহীগণের মাঝে কদাচিৎ এই বিভ্রম কাজ করে যে, দু’টি মাঝারি মানের অর্জন একটি দক্ষ মানুষের কোন অর্জনের সমান। তারা এও জানে যে, নিয়মানুযায়ী দু’টি মাঝারি মানের অর্জন একটি মাঝারি মানের অর্জনের চেয়েও কম-তারা বরং একে অপরের পথে চলে আসে। তারা মেনে নেয় যে, কোন কর্মক্ষমতা অর্জনে দক্ষতাসমূহের সুনির্দিষ্ট হতে হবে। তারা কখনো দক্ষ মানুষের কথা বলে না, বরং একজন মানুষের নির্দিষ্ট একটি বিষয়ে দক্ষতার কথা বলে। তবে এই একটি কাজেই, তারা শক্তিমান ও শ্রেষ্ঠত্বের জন্য শ্রম দিতে পারে এমন মানুষের খোঁজ করে।

এ থেকে এটা বোঝা যায় যে, তারা কর্মী নিয়োগে সুযোগ-সুবিধার উপর জোর দেয়-সমস্যার উপর নয়।

তারা সর্বোপরি কোনরূপ বিতর্ক মেনে নেয় না: “আমি তাকে বাদ দিতে পারি না; আমি তাকে ছাড়া সমস্যার সম্মুখীন হব।” তারা জানে, “অপরিহার্য মানুষ” শব্দবান্ধবটির তিনটি ব্যাখ্যা হতে পারে: সে মূলত অযোগ্য এবং যদি কোন চাহিদা বা কাজ থেকে বেঁচে থাকতে পারে তবেই সে হাফ ছেড়ে বাঁচে; তার শক্তিকে ভুলভাবে ব্যবহার করা হয়। তাকে তার দুর্বল সিনিয়র যে নিজে একা দাঁড়াতে সক্ষম নয় তার পিছন থেকে তাকে সাপোর্ট দিতে হয়; বা কোন মারাত্মক সমস্যাকে সামলানোর জন্য ও প্রতিহত করার জন্য তার শক্তিকে ভুলভাবে ব্যবহার করা হয়, যদি না শক্তি বা দক্ষতার ব্যাপারটি গোপন না করা হয়।

এই পরিস্থিতিগুলোর যে কোনটিতে, অপরিহার্য মানুষকে যেকোনভাবে স্থানান্তর করতে হবে এবং তা শীঘ্র করতে হবে। অন্যথায় ব্যক্তি তার দক্ষতা বা শক্তির অপচয় করতে করতে নষ্ট করে।

একজন প্রধান নির্বাহী যার ব্যাপারে তৃতীয় অধ্যায়ে আলোচিত হয়েছে-তার একটি বড় রিটেইল চেইন শপের ম্যানেজার উন্নয়ন নীতি কার্যকর ছিল অথচ অপ্রচলিত প্রক্রিয়ার উদ্ভাবনের কারণে-তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে, যে কর্মীকে তার বস “অপরিহার্য” হিসাবে উল্লেখ করবে তাকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ঐ স্থান থেকে সরিয়ে দেওয়ার। “এটি হয়তো নির্দেশ করে,” তিনি বলেন, “যে আমার একজন দুর্বল ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা আছে বা একজন দুর্বল অধীনস্ত আছে বা হতে পারে উভয়টা। যেটাই হোক, যত তাড়াতাড়ি তা আমরা বুঝতে পারব, ততই উত্তম।”

এটা একেবারে একটা অলঙ্ঘনীয় নিয়ম হতে হবে যে সে ব্যক্তিকে সামনে নিয়ে আসা যে কর্মক্ষমতার পরীক্ষায় কোন একটি কাজে সর্বাধিক উপযুক্ত। অন্যদিকে সকল বিতর্ক-“সে (এ কাজের জন্য) অপরিহার্য”... “সে সেখানের মানুষগুলোর কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না”... “সে এখনো অত্যন্ত তরুণ”... বা “আমরা সেখানে কোন মানুষকে বাস্তবিক অভিজ্ঞতা ছাড়া বসাতে পারি না।”-এ ধরনের অজুহাতকে উড়িয়ে দিতে হবে। কেবল কাজ সর্বোচ্চ যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তির উপযুক্ত হয় না, বরং যে ব্যক্তির কর্মক্ষমতা প্রমাণিত সেও সুযোগ গ্রহণ করতে পারে। সমস্যার পরিবর্তে সুযোগকে কাজে লাগানো কেবল সর্বাধিক কার্যকর প্রতিষ্ঠানের সৃষ্টি করে না, বরং এটা উদ্দীপনা এবং ত্যাগেরও সৃষ্টি করে।

বিপরীতভাবে, কার্যনির্বাহীর কর্তব্য হলো যে কাউকে কোন দয়ামায়া না দেখিয়ে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া-বিশেষত যেকোন ম্যানেজার-যারা অব্যাহতভাবে অসাধারণ কোন কাজ করে দেখাতে অক্ষম। এমন মানুষের অন্যকে বিপথগামী করে স্বপদে থেকে যাওয়া চূড়ান্তভাবে পুরো প্রতিষ্ঠানের জন্য অন্যায়। একজন অধিনস্তের প্রতি এটা একেবারেই অন্যায় যে সে তার সিনিয়রের অপর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধার কারণে অর্জন ও স্বীকৃতি থেকে নিজে বঞ্চিত হবে। মোটের উপর, এটা উক্ত ব্যক্তির প্রতি কা-জ্ঞানহীন রূঢ়তা। সে জানে যে সে অযোগ্য-চাই তা সে স্বীকার করুক বা না করুক। অবশ্যই, আমি কোন পেশায় এমন কাউকে দেখিনি যে ঐ কাজের জন্য অযোগ্য অথচ সে ঐ কাজের চাপ ও অত্যাচারে ধীরে ধীরে ক্ষয়প্রাপ্ত হচ্ছে না এবং সে চুপিসারে মুক্তি পাওয়ার প্রার্থনা করছে না। জাপানের আমৃত্যু চাকরি কিংবা পশ্চিমের বিভিন্ন রকমের বেসামরিক চাকরিতে প্রমাণিত অযোগ্যতাকে বরখাস্ত বা স্থানান্তরের কারণ হিসাবে বিবেচনা করা একটি মারাত্মক দুর্বলতা এবং অপ্রয়োজনীয় একটি কাজ।

জেনারেল মার্শাল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জোর দিয়েছিলেন যে, যদি কোন জেনারেলের কর্মক্ষমতা অসাধারণ পর্যায়ের চেয়েও কম হয় তবে তাকে তাৎক্ষণিক ঐ দায়িত্ব থেকে অব্যহতি দেওয়া হবে। তাকে দায়িত্বে বহাল রাখা, তিনি কারণ হিসাবে বলেন, সেনাবাহিনী ও জাতি তার থেকে যে দায়বদ্ধতা প্রত্যাশা করে বা দাবি রাখে সাফল্যের সাথে কাজ করার, নাকি ব্যর্থতার। মার্শাল এ ব্যাপারে কোন বিতর্ক করা সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেন: “কিন্তু আমাদের প্রতিস্থাপনের বা বিকল্প ভাবার কোন সুযোগ নেই।” তিনি বলেন, “এখানে যেটা গুরুত্বপূর্ণ তা হলো এই মানুষটা কাজটার জন্য উপযুক্ত নয়। কোথা থেকে তার বিকল্প আসবে সেটা পরবর্তী প্রশ্ন।”

তবে মার্শাল অবশ্য জোর দিয়েছিলেন যে, কোন ব্যক্তিকে তার দায়িত্ব থেকে অব্যহতি দেওয়া তা তার জন্য শাস্তি হিসাবে কম ঐ ব্যক্তির শাস্তির থেকে যে তাকে ঐ পদে নিয়োগ দিয়েছিল। “একমাত্র বিষয় যা আমরা জানি তা হলো ব্যক্তিটির জন্য ঐ স্থানটি ভুল ছিল,” তিনি যুক্তি দিয়েছিলেন। “এর অর্থ এই নয় যে, সে অন্য কোন কাজের জন্য আদর্শ ব্যক্তি নয়। তাকে নিয়োগ করাটা আমার ভুল ছিল, এখন এটা আমার দায়িত্ব যে, সে কী করতে পারে তা খুঁজে বের করা।”

পুরোপুরিভাবে, জেনারেল মার্শাল একটি উত্তম উদাহরণ পেশ করেন যে, কীভাবে একজন মানুষ শক্তিকে উৎপাদনমুখী করে। যখন তিনি ত্রিশের দশকের মাঝামাঝিতে প্রভাবশালী একটি পদে পদায়ন হন, তখন যুক্তরাষ্ট্রের আর্মিতে অন্য কোন তরুণ জেনারেল ছিল না যে সক্রিয়ভাবে দায়িত্ব পালন করে। (মার্শাল নিজে চার মাসের মাথায় চাকরি-জীবনের শেষ সীমায় পৌঁছেছিলেন। তার ষাটতম জন্মদিন, যখন তিনি সেনাবাহিনী প্রধান হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণে যথেষ্ট বয়সী ছিলেন, ৩১ ডিসেম্বর, ১৯৩৯। তাকে নিয়োগ করা হয়েছিল ঐ বছরের পহেলা সেপ্টেম্বর।) দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী জেনারেলগণ তখনো জুনিয়র অফিসার ছিল। যখন মার্শাল তাদেরকে বাচাই করে প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করে তখন পদোন্নতির এক-আধটু আশা দেখা যাচ্ছিল। আইজেনহোয়ার ছিল তাদের মধ্যে বয়সীদের একজন এবং সে নিজেও তখনো, তিশের দশকের মাঝামাঝিতে, একজন মেজর ছিল। তথাপি ১৯৪২ সালের মধ্যে, মার্শাল আমেরিকার ইতিহাসে সর্ববৃহৎ ও সর্বাধিক সক্ষম জেনারেলদের বাহিনী গঠন করতে পেরেছিলেন। এতে প্রায় কোন ব্যর্থতা ছিল না বললেই চলে এবং অধিক দ্বিতীয় সারিভুক্ত ছিল না (হড়ঃ সধহু ংবপড়হফ-ৎধঃবৎং)।

এটা সামরিক ইতিহাসে সেরা শিক্ষাগত শ্রেষ্ঠত্বসমূহের একটি-সম্পাদিত হয়েছিল এমন একজন মানুষের মাধ্যমে যার মধ্যে “নেতৃত্বের” সব গুণ ছিল না; যেমন, ব্যক্তিগত আকর্ষণীয়তা বা একজন মন্টোগমেরিয়ানের মতো আকাশসম আত্মবিশ্বাস, একজন ডে গলে বা একজন মাকআর্থার। মার্শালের যা ছিল তা হলো কিছু মূলনীতি। “এই লোকটি কী করতে পারে?”-এটাই ছিল তার নিয়মিত প্রশ্ন। আর একজন মানুষ যদি কিছু করতে পারে, তার ত্রুটি তখন দক্ষতার সামনে ছোট হয়ে যায়।

উদাহরণস্বরূপ, মার্শাল বারবার জর্জ পেটন্সের উদ্ধার কাজে এগিয়ে আসেন এবং নিশ্চিত করেন যে, এই উচ্চাভিলাষী, ব্যর্থ অথচ যুদ্ধকালীন শক্তিশালী কমান্ডার যেন গুণমানের, যা শান্তিকালীন একজন দক্ষ সেনাবাহিনী অফিসার এবং সফল সৈন্যে পরিণত করে, অভাবের কারণে শাস্তি না পায়। তথাপি মার্শাল নিজে পেটনের মতো জবরদস্ত সুদর্শন তলোয়ারকে অতিশয় অপছন্দ করতেন।

মার্শাল দুর্বলতা নিয়ে তখনই উদ্বিগ্ন হতেন যখন তা একজন মানুষের শক্তির পূর্ণ বিকাশকে বাধাগ্রস্থ করত। এ সমস্যাগুলো তিনি কাজ ও ক্যারিয়ারের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দিয়ে ডিঙানোর চেষ্টা করতেন।

উদাহরণস্বরূপ, তরুণ মেজর আইজেনহোয়ার, মার্শাল কর্তৃক সম্পূর্ণ স্বেচ্ছায় ত্রিশের দশকের মাঝামাঝিতে যুদ্ধ-পরিকল্পনায় নিযুক্ত হয় যাতে করে নিয়মতান্ত্রিক কৌশলী বোধগম্যতা সে অর্জন করতে পারে যা স্পষ্টত তার মাঝে অনুপস্থিত ছিল। আইজেনহোয়ার ফলশ্রুতিতে একজন কৌশলী হতে পারে নাই বটে তবে সে কৌশল এবং এর প্রয়োজনীয়তা বোঝার জন্য শ্রদ্ধা অর্জন করেছিল এবং এর ফলে তার শক্তিশালীদিকটির মাঝে মারাত্মক একটি সীমাবদ্ধ দূর করতে সক্ষম হয়েছিল এবং দল-গঠনকারী ও কৌশলগত পরিকল্পনাকারী হিসাবেও সক্ষমতা অর্জন করে।

মার্শাল সবসময় সর্বাধিক যোগ্য ব্যক্তিকে নিয়োগ করতেন, তার পূর্ববর্তী চাকরিতে তার যত প্রয়োজনীয়তাই থাকুক না কেন। মার্শালকে যখন কোনো ঊর্ধ্বতন ব্যক্তি কোনো ব্যক্তির জন্য বলতেন যে তাকে এ কাজ থেকে অন্য কাজে না নিতে, বা কোন অপরিহার্য ব্যক্তির কর্মস্থল বা পদ পরিবর্তন না করতে অনুরোধ করতেন, তখন তিনি জবাব দিতেন, “আমরা কাজে এ ধরনের পরিবর্তন আনতে বাধ্য... আমরা এই কাজ, এই দায়িত্ব সেই ব্যক্তিকে ও সেই সৈন্যবাহিনীকে দিতে বাধ্য।”

তার জীবনে একটি ব্যতিক্রমই ছিল: যখন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট মিনতি করে যে, মার্শাল তার কাছে অপরিহার্য, তাই তিনি ওয়াশিংটনে থেকে যান, ইউরোপের সর্বাধিনায়কের দায়িত্ব আইজেনহোয়ারের হাতে ন্যস্ত করেন এবং এভাবে তার জীবনের স্বপ্নকে ছেড়ে দেন।

সব শেষে, মার্শাল জানত এবং প্রত্যেকে তার থেকে এটা জানতে পারল-যে, ব্যক্তি-নির্বাচন বা প্রত্যেক কর্মী-নির্বাচন এক ধরনের জুয়ার মতো। একজন ব্যক্তি কী করতে পারে তার উপর ভিত্তি করে, এটা অন্তত একটা যৌক্তিক ও লাভজনক জুয়াতে পরিণত হয়।

একজন সিনিয়র অন্যের কাজের ব্যাপারে দায়বদ্ধ। তার অন্যের ক্যারিয়ারের উপরও ক্ষমতা রয়েছে। শক্তিশালী দিকগুলোকে উৎপাদনমুখী করা অতএব কার্যকারিতার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এটা একট নৈতিক অনুজ্ঞা, কর্তা ও তার পদের দায়িত্ব। দুর্বলতার উপর গুরুত্বারোপ করা কেবল বোকামিই নয়; বরং দায়িত্বহীনতা। একজন সিনিয়র কর্মকর্তা প্রতিষ্ঠানের কাছে বাধ্য যে, তার নিয়ন্ত্রণাধীন প্রত্যেক ব্যক্তির শক্তিকে যতটুকু সম্ভব উৎপাদনমুখী করা। তবে যে যাদের উপর কর্তৃত্ব চালায় সেসব মানুষের কাছে সে আরও বেশি বাধ্য যাতে করে তারা তাদের মাঝে যে শক্তি আছে তার সর্বোচ্চটুকু লাভ করে। প্রতিষ্ঠানকে প্রত্যেককে তার শক্তির মাধ্যমে অর্জনে সাহায্য করতে হবে তার দুর্বলতা ও সীমাবদ্ধতাকে তোয়াক্কা না করে।

এটা ক্রমবর্ধমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে, জটিল হয়ে উঠছে। অল্প কিছুদিন আগেও, তথ্য-সংশ্লিষ্ট কাজ ও কাজের পরিধি ছিল পরিমাণে ও আকারে ছোট। জার্মান বা স্ক্যান্ডিনাভিয়ান সরকারগুলোতে সরকারি কর্মকর্তা হওয়ার জন্য, “আইনে” ডিগ্রি থাকা জরুরি ছিল। একজন গণিতবিদ এতে আবেদন করতে পারত না। অন্যদিকে, যে ব্যক্তি তার জ্ঞানকে ব্যবহার করে তার জীবিকা নির্বাহ করতে চাইত তার তিন কি চার ধরনের চাকরিতে আবেদনের সুযোগ ছিল। বর্তমানে জ্ঞান-সংশ্লিষ্ট কাজের পরিমাণ ও পরিধি আশ্চর্যজনকহারে বেড়ে গেছে। ১৯০০ সালের দিকে, সকল জ্ঞান-সংশ্লিষ্ট বিষয়ের প্রায়োগিক খাতগুলো ছিল তখনো প্রথাগত পেশাগুলো-আইন, চিকিৎসা, শিক্ষকতা এবং ধর্মপ্রচার। বর্তমানে ‘শ এর বেশি নানারকমের কাজের খাত রয়েছে। অধিকন্তু, প্রতিটি জ্ঞান-সংশ্লিষ্ট খাতসমূহ উৎপাদনমুখী কাজে নিবেদিত। আর এর সুযোগ করে দিচ্ছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, বিশেষত, ব্যবসায় ও সরকারি প্রতিষ্ঠান।

অন্যদিকে, যেকেউ তার সক্ষমতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ জ্ঞানের খাত ও তৎসংশ্লিষ্ট কাজ যা ব্যক্তিটির জন্য সর্বাধিক উপযুক্ত তা খোঁজার চেষ্টা করতে পারে। কাউকে আর খুব নিকট অতীতের মতো বিদ্যমান জ্ঞান-খাত ও এতদসংশ্লিষ্ট কাজে নিজেকে মানিয়ে নিতে হচ্ছে না। অন্যদিকে, একজন তরুণ ব্যক্তির জন্য এটা ক্রমবর্ধমানভাবে কঠিন যে, সে তার পছন্দ ঠিক করে নিবে। তার নিজের কাছে পর্যাপ্ত তথ্য থাকে না, না তার নিজের ব্যাপারে না সুযোগ-সুবিধার ব্যাপারে।

ব্যক্তির জন্য এটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ যে, সে তার শক্তিকে উৎপাদনশীলতার দিকে পরিচালিত করা। প্রতিষ্ঠানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হলো তার নির্বাহী শক্তিশালী দিকগুলোর উপর গুরুত্বারোপ করবে এবং তাদের নিজেদের দলের মাঝে ও নিজেদের অধীনস্তদের মাঝে শক্তিগুলোকে উৎপাদনমুখী করার জন্য কাজ করবে।

কাজেই শক্তি বৃদ্ধির জন্য কর্মী নিয়োগ নির্বাহীর নিজের কার্যকারিতার জন্য প্রয়োজনীয় এবং তার প্রতিষ্ঠানের কার্যকারিতার জন্যও গুরুত্বপূর্ণ, তবে জ্ঞান-সম্পর্কিত কাজের জগতে এটা (শক্তি বৃদ্ধির জন্য কর্মী নিয়োগ) সমানভাবে স্বতন্ত্র ব্যক্তি এবং সমাজের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ।


আমি আমার বসকে কীভাবে বশে আনব?


সর্বোপরি, কার্যকারিতাসম্পন্ন নির্বাহী চেষ্টা করে তার সিনিয়রের শক্তিকে পরিপূর্ণরূপে উৎপাদনমুখী করতে।

আমি এখনো এমন কোন ম্যানেজার পাইনি, চাই তা ব্যবসা, সরকারে, বা অন্য কোন প্রতিষ্ঠানে, যে বলেনি যে: “আমার নিজের অধীনস্তদের পরিচালনা করতে বড় কোন সমস্যা হয় না। তবে আমি আমার বসকে কীভাবে সামলাব?” এটা অবশ্য অত্যন্ত সহজ-তবে নির্বাহীরাই কেবল তা জানে। রহস্যটি হলো নির্বাহীগণ বসের শক্তিকে উৎপাদনশীল করে তোলে।

এটা প্রাথমিক বিচক্ষণতা হওয়া চাই। জনপ্রিয় কিংবদন্তির বিপরীত, অধীনস্তগণ, নিয়মানুযায়ী, পদ ও শ্রেষ্ঠত্বের অযোগ্য বসকে ডিঙিয়ে যেতে পারে না। যদি তাদের বসের পদোন্নতি না হয়, তবে তারাও তার পিছনে সারি সারি পড়ে থাকবে। আর যদি তাদের বস কোন অযোগ্যতা বা ব্যর্থতার কারণে অব্যহতি লাভ করে, তবে সফল ব্যক্তি কদাচিৎ উদীয়মান, তরুণ ও সম্ভাবনাময় ব্যক্তি লাইনের প্রথমে থাকে। তাকে মূলত অন্যত্র থেকে আনা হয় এবং তার সাথে তরুণ, উজ্জল-ভবিষ্যৎ ব্যক্তিকেও নিয়ে আসা হয়। অন্যদিকে, একজন সফল ও দ্রুত পদোন্নতিপ্রাপ্ত সিনিয়র হিসাবে, কোন কিছুই তার কাছে সফলতার মতো সহায়ক নয়।

তবে বিচক্ষণতা বাদেও, বসের শক্তিকে উৎপাদনশীল করা (ঢ়ৎড়ফঁপঃরাব) অধীনস্তদের নিজেদের কার্যকারিতার মূল চাবিকাঠি। এটা তাকে এমন একটা পন্থায় তার অবদানের উপর মনোযোগ দিতে সুযোগ করে দেয়, যা উপর মহলে গ্রহণযোগ্যতা লাভ করে এবং ব্যবহারের জন্য নির্ধারিত হয়। এটা তাকে সেসব বিষয় অর্জন করতে ও পূর্ণ করতে সাহায্য করে যেসবে তার বিশ্বাস আছে।

ব্যক্তি তার বসের চাটুকারিতা করে তার শক্তিকে উৎপাদনশীল (ঢ়ৎড়ফঁপঃরাব) করতে পারবে না। উৎপাদনশীল করার জন্য তাকে যা নিয়মসিদ্ধ তাই করতে হবে এবং সিনিয়রের কাছে এমন একটি পন্থায় তা উপস্থাপন করতে হবে যা তার কাছে বোধগম্য।

যোগ্য নির্বাহী এটা মেনে নেয় যে, তার বস একজন মানুষ। (যা বুদ্ধিমান তরুণ জুনিয়র অফিসারের কাছে মাঝে মাঝে কঠিন ঠেকে।) যেহেতু সিনিয়র একজন মানুষ, তার নিজের শক্তি আছে; তবে সাথে সাথে সীমাবদ্ধতাও আছে। তার শক্তির উপর ভিত্তি করে কোনকিছু গড়ে তোলা, অর্থাৎ, নিজে যা করতে পারে তা করার সুযোগ করে দেওয়া, তাকে কার্যকারিতাসম্পন্ন প্রমাণিত করবে-এবং অধীনস্তকে কার্যকারিতাসম্পন্ন করবে। তার দুর্বলতার উপর ভিত্তি করে কোনকিছু গড়ে তোলা অধীনস্থের দুর্বলতার উপর কোনকিছু গড়ে তোলার মতো হতাশাজনক ও বোকামি হবে। কার্যকরী নির্বাহী তাই জিজ্ঞেসা করে; “আমার বস কোন কাজ ভালোভাবে আঞ্জাম দিতে পারে?” “তিনি কোন কাজটি ভালোভাবে সম্পাদন করেছেন?” “তার শক্তিকে ব্যবহার করার জন্য তার কী জানা থাকতে হবে?” “তিনি আমার কাছ থেকে কার্যসম্পাদনে কী পেতে পারেন?” সে তার বস কী করতে পারে না তার জন্য খুব বেশি উদ্বিগ্ন হয় না।

অধীনস্তগণ বসকে “পুনর্গঠন” করতে চায়। সক্ষম সরকারি কর্মকর্তা নিজেকে তার এজেন্সির নবনিযুক্ত রাজনৈতিক প্রধানের প্রশিক্ষক হিসাবে নিজেকে দেখতে অনীহা প্রকাশ করে। সে তার বসকে তার সীমাবদ্ধতা দূর করতে ব্যবহার করে। নির্বাহীগণ বরং প্রশ্ন করে: “নতুন বস কী করতে পারে?” এবং যদি এর উত্তর হয়, “সে কংগ্রেসের সাথে, হোয়াইট হাউজ ও জনসাধারণের সাথে সম্পর্ক নির্মাণে পারদর্শী,” তবে তখন সরকারি আমলা তার মন্ত্রীর এই দক্ষতাগুলোকে কাজে লাগাতে প্রচেষ্টা চালায়। শ্রেষ্ঠ কোন প্রশাসনের জন্য ও নীতির জন্য, সিদ্ধান্তগুলো নিরর্থক হয় যদি না তার সাথে রাজনৈতিক কোন ব্যক্তির দক্ষতা থাকে। [কারণ নীতিগুলো প্রয়োগ করবে রাজনৈতিক ব্যক্তিরা। তাই তাদেরকে এসব নীতি প্রয়োগের ব্যাপারে কার্যকরী হতে হবে।] একবার যদি রাজনৈতিক ব্যক্তি জানতে পারে, সরকারি আমলা তাকে সমর্থন করে, সে শীঘ্রই নীতি ও প্রশাসনের ব্যাপারে তার কথা মন দিয়ে শুনবে।

কার্যকারিতাসম্পন্ন নির্বাহী এও জানে যে, বস, মানুষ হওয়ায়, কার্যকারিতার জন্য তার নিজস্ব পন্থা রয়েছে। [কার্যকরভাবে কাজ করার জন্য তার নিজেরই কিছু পন্থা রয়েছে।] সে এই পথগুলো খুঁজে বেড়ায়। সেসব হতে পারে কেবল আচরণ ও অভ্যাস, তবে সেগুলোও গুরুত্বপূর্ণ।

এটা আমি স্বীকার করি এবং এটা যে কারো কাছে স্পষ্ট যে মানুষ হয় ‘পাঠক’ নয় ‘শ্রোতা’। (ছোট একটি দল বাদে যারা কথাবার্তার মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করে এবং যাদের সাথে কথা বলে তাদের প্রতিক্রিয়া তারা তাদের সাইকিক রাডারের মাধ্যমে প্রত্যক্ষ করে; প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট এবং প্রেসিডেন্ট লিন্ডন জনসন এই শ্রেণিভুক্ত, উইন্সটন চার্চিলও বাহ্যত এতে অন্তর্ভুক্ত)। যেসব মানুষ যুগপৎ পাঠক ও শ্রোতা-নিয়মানুযায়ী শিক্ষানবিশ আইনজীবীকে উভয়টা হতে হয়-তারা ব্যতিক্রম। একজন পাঠকের সাথে কথা বলা সাধারণত সময়ের অপচয়। সে পড়ে নেওয়ার পরই কেবল শোনে। একজন শ্রোতার কাছে এক গাদা প্রতিবেদন জমা দেওয়াও সময়ের অপচয়। সে শুধু উচ্চারিত শব্দের সাহায্যে এতে কী আছে তা বুঝতে পারে।

[ফজলে রাব্বির কথা: অনুবাদে সামনে যাওয়ার আগে পাঠককে ছোট্ট একটি তথ্য জানানো দরকার। শিক্ষার্থীদের মধ্যে তিন ধরনের শিক্ষার্থী পাওয়া যায়। এক, দেখে শিখে, দুই, শুনে শিখে এবং তিন, অভিজ্ঞতার মাধ্যমে শেখে। অভিজ্ঞতা বলতে তারা একটি জিনিসকে ধরে, বাস্তবে সেই কাজ করে শেখে। কাজকর্ম করে এমন সব মানুষের মধ্যেই এ ধরনের চরিত্র দেখা যায়। কিছু মানুষকে দেখবেন লিখে দিলে তা অনুযায়ী খুব ভালো কাজ করতে পারে। আবার কিছু মানুষ কেবল শুনতে চায় কাজটা কী। কোনো ধরনের লেখা দেখতে চায় না। এরা ‘শ্রোতা’ ধরনের মধ্যে পড়ে। আবার কিছু মানুষ আছে কেবল লেখা বা শুনে সন্তুষ্ট নয়। তারা কাজটি হাতেকলমে করে দেখতে চায় ফলাফল কী আসে। তারপরই তারা কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে। এদের বলা হয় অভিজ্ঞতার মাধ্যমে শেখা ব্যক্তি। আমি এ ব্যাপারে জেনেছি লেখক ব্রায়ান ট্রেসির বই ক্রিয়েটিভিটি অ্যান্ড প্রবলেম সলভিং থেকে।]

কিছু মানুষ আছে যাদের জন্য সবকিছুকে এক পৃষ্ঠায় সংক্ষিপ্ত আকারে উল্লেখ করে দিতে হয়।(প্রেসিডেন্ট আইজেনওয়ার এর এটা প্রয়োজন হত) কিছু মানুষের কেউ কোন সুপারিশ করলে তার চিন্তা প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে সক্ষম হতে হয় এবং অতঃপর কোনকিছু তাদের কাছে অর্থবহ হওয়ার আগেই তারা প্রতিবেদন তলব করে বসে। কিছু সিনিয়র কর্মকর্তা সবকিছুর উপর ষাট পৃষ্ঠার পরিসংখ্যান চান। অনেকেই আবার কাজের আগে আগে থাকতে চান যাতে করে তারা নিজেদের চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের জন্য প্রস্তুত করতে পারে। অনেকেই একটি বিষয় সম্পর্কে শুনতেই চায় না সেটি পরিপক্ক না হওয়া পর্যন্ত, ইত্যাদি।

বসের শক্তি নিয়ে চিন্তাভাবনার জন্য অভিযোজনের প্রয়োজন হয় এবং তাদেরকে ফলপ্রসূ বানানোর প্রচেষ্টা সবসময় “কী” এর পরিবর্তে “কীভাবে” কে প্রভাবিত করে। এটা সেই বিন্যাসের সাথে সংশ্লিষ্ট যাতে বিভিন্ন বিষয়, সব প্রাসঙ্গিক উপস্থাপিত হয়, কী গুরুত্বপূর্ণ বা সঠিক তার পরিবর্তে। যদি কোন কাজে সিনিয়রের শক্তি তার রাজনৈতিক দক্ষতায় নিহিত থাকে, এমন কাজ যাতে রাজনৈতিক দক্ষতা প্রাসঙ্গিক, তখন তার সামনে প্রথমে পরিস্থিতির রাজনৈতিক দিকগুলো তুলে ধরা চাই। এটা তাকে আন্দাজ করতে সাহায্য করবে বিষয়টা আদতে কী নিয়ে এবং তার শক্তিকে নতুন একটা নীতির পিছনে ব্যয় করতে সহায়ক হবে।

আমরা সকলে অন্যদের বেলায় বেশ পটু। মানুষ নিজেদের যেমন দেখে তারচেয়ে পরিষ্কার ও স্পষ্টভাবে আমরা তাদের দেখতে পাই বলে আমরা মনে করি। এমনকি আমরা আমাদের নিজেদের চেয়েও অন্যদের বেশি স্পষ্ট আকারে দেখতে পাই। তাই বসকে ফলবান করা সাধারণত একেবারেই সহজ। তবে এটা তার শক্তি ও সে কী করতে পারে তার উপর জোর দেওয়াটা তলব করে। এটা চায় ব্যক্তিকে শক্তির উপর ভর করে গড়ে তোলা হোক যাতে করে দুর্বলতা অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে। অল্প কিছু বিষয় আছে যা নির্বাহীকে তার সিনিয়রের শক্তির উপর ভিত্তি করে কোন কিছু গড়ে তোলার মতো কার্যকর করে তাকে উপস্থাপন করে।


নিজেকে কার্যকারিতাসম্পন্ন ব্যক্তি হিসাবে গড়ে তোলা


কার্যকারিতাসম্পন্ন নির্বাহী তাদের নিজেদের কাজকে শক্তি ও দক্ষতার সাহায্যে পরিচালনা করে। তারা যা পারে তাকে উৎপাদনমুখী করে তুলতে পারে। আমার জানা মতে, অধিকাংশ নির্বাহী, সরকার, হাসপাতাল, ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানে, যা তারা করতে পারে না সেসব ব্যাপারে অবগত থাকে। তারা শুধু তাদের বস, কোম্পানির নীতি, সরকার যা করার অনুমতি দেয় না সেসব নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকে। ফলে তাদের সময় ও শক্তিকে তারা যা করতে পারে না তার অভিযোগ করে করে নষ্ট করে। 

কার্যকারিতাসম্পন্ন নির্বাহীগণ অবশ্যই তাদের সীমাবদ্ধতা নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকে। তবে তারা যেসব কাজ করতে পারে, যেসবের অনুমতি তাদের আছে তা তারা খুঁজে বের করে এবং এসব কাজ গুরুত্বপূর্ণও বটে। অন্যরা যখন কোন কোন কাজ কেন তারা করতে পারছে না তার অভিযোগ করতে থাকে, তখন কার্যকর নির্বাহীগণ তা করতে এগিয়ে আসে। ফলে, যে সীমাবদ্ধতাগুলো তাদের সহযোগীদের উপর কঠিন বোঝা হয়ে চাপে কখনো কখনো তা হাল্কা হয়ে যায় তাদের কাছে।

একটি প্রধান রেল সড়কের ব্যবস্থাপনা বিভাগের সবাই জানত যে, সরকার কোম্পানিকে কোনকিছু করতে দিবে না। কিন্তু নতুন একজন ফাইনান্সিয়াল ভাইস-প্রেসিডেন্ট নিযুক্ত হয়ে আসেন যিনি তখনো জানতেন না যে সরকার কিছু করতে দিবে না। নিযুক্ত হওয়ার পর তিনি ওয়াশিংটন যান এবং অভ্যন্তরীণ রাজ্য-বাণিজ্য কমিশনে দেখা করেন এবং কিছু মৌলিক কাজের জন্য অনুমতি প্রার্থনা করেন। কমিশনার বলেন, “এসবের অধিকাংশ আমাদের উদ্বেগের বা কাজের বিষয় নয়। বাকিগুলোর জন্য আপনাকে চেষ্টা করতে হবে এবং পরীক্ষানিরীক্ষা করতে হবে। তারপর আমরা আপনার কাজে সাহায্য করতে সচেষ্ট হব।”

“কোন একজন আমাকে একটি কাজ করার অনুমতি দিবে না”-এমন দাবিকে নিষ্ক্রিয়তা ও আলসেমির চাদর হিসাবে সন্দেহ করা উচিত। তবে আদতে যেখানে পরিস্থিতি সীমাবদ্ধতা তৈরি করে এবং প্রত্যেকে বরং কিছুটা জটিল সীমাবদ্ধতার মাঝে জীবনযাপন করে ও কাজ করে-সেখানে কিছু গুরুত্বপূর্ণ, অর্থবহ, প্রাসঙ্গিক কাজ থাকে যা সম্পাদন যোগ্য। নির্বাহীগণ সেগুলোর খোঁজে থাকে। যদি সে এই প্রশ্ন দিয়ে শুরু করে যে, “আমি কী করতে পারি?” তবে সে নিশ্চিত যে, সে মূলত তার সময় ও সুযোগ অনুসারে যতটুকু কার্য সম্পাদনের সামর্থ্য রাখে তারচেয়ে বেশি কাজ করেছে।

শক্তিকে ফলপ্রসূ করা একজন ব্যক্তির কার্যক্রম ও সক্ষমতার বিচারে সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ।

এটা জানা খুব কঠিন নয় যে, আমরা কীভাবে ফলাফল লাভ করি? একজন ব্যক্তি সাবালকত্ব লাভের পরপর তার ভালোমতো জানাশোনা থাকে যে, সে কি সকালে ভালোভাবে কাজ করতে পারে নাকি রাতে। যে কেউ ভালো জানে সে কি অনেক ড্রাফট করার পর শেষ পর্যায়ে এসে ভালোভাবে লিখতে পারে, নাকি একেবারে সঠিক না হওয়া পর্যন্ত প্রতিটি বাক্য খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সংশোধন করে তারপর চমৎকারভাবে লিখতে পারে। যে কেউ তার ব্যাপারে ভালো জানে সে কি সবার সামনে পূর্ব-প্রস্তুতকৃত বক্তব্য ও নোট দেখে ভালো বক্তব্য দিতে পারে; নাকি কোন কিছুর সাহায্য না নিয়েই চমৎকারভাবে কথা বলতে পারে। মানুষ জানে সে কি কমিটির একজন সদস্য হয়ে কাজ করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে নাকি একাকী ভালো কাজ করতে পারে; নাকি সে কমিটির সাথে কাজ করতে গেলে নিষ্কর্মা হয়ে পড়ে।

কিছু মানুষ তাদের সামনে একটি পূর্ণরূপরেখা থাকলে ভালোভাবে কাজ করতে পারে; অর্থাৎ তারা কাজ শুরু করার আগেই সে সম্পর্কে ভেবে রাখে। অন্যদিকে কিছু আছে যারা কয়েকটি এলোমেলো নোট থাকলেই তা ব্যবহার করে ভালো কাজ করতে পারে। কেউ চাপে থাকলে ভালো কাজ করে, আবার কেউ অফুরন্ত সময় হাতে পেলে ভালো সেবা দিতে পারে এবং নির্দিষ্ট সময়সীমা শেষ হওয়ার আগেই কাজ শেষ করে। কিছু আছে যারা শুধু পাঠ করে, আর কিছু আছে যারা শুধু শ্রোতার ভূমিকা পালন করে। উপরে বর্ণিত সবকিছু মানুষের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য যে সম্পর্কে সে অবগত থাকে-যেভাবে সে জানে সে কি ডা-হাতি নাকি বা-হাতি।

অনেকে দাবি করতে পারে, এসব অপ্রয়োজনীয় ও অগভীর কথাবার্তা। সবসময় এসব সঠিক হয় না-এসব বৈশিষ্ট্যের ও অভ্যাসের অধিকাংশ একজন ব্যক্তির ব্যক্তিত্বের মৌলিক দিকগুলো তুলে ধরে, যেমন পৃথিবীর সম্পর্কে তার উপলব্ধি ও নিজের ব্যাপারে তার জানাশোনা। কিন্তু যদি অগভীর হয়েও থাকে, তবুও এই অভ্যাসগুলো একজন ব্যক্তির কার্যকারিতাসম্পন্ন হওয়ার উৎস। এ ধরনের মানুষের অধিকাংশই যেকোন কাজে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে। উপযুক্ত কার্যনির্বাহী এ সম্পর্কে অবগত ও তা মানার চেষ্টা করে।

সব মিলিয়ে একজন প্রভাবশালী নির্বাহী নিজের মতো থাকতে চায়; অন্য কেউ হওয়ার চেষ্টা সে করে না। সে নিজের কর্মক্ষমতা ও নিজের ফলাফলের উপর দৃষ্টি রাখে এবং প্যাটার্ন তথা গঠন বা প্রকারভেদের মাধ্যমে নিজের জীবনকে উপলব্ধি করার চেষ্টা করে। যে জিজ্ঞাসা করে, “তুলনামূলক সহজ উপায়ে কোন কাজ আমি করতে সক্ষম যে কাজ অন্য মানুষের কাছে কিছুটা কঠিন হিসাবে দেখা দেয়?” একজন ব্যক্তি, উদাহরণস্বরূপ, চূড়ান্ত প্রতিবেদন লেখাকে সহজ মনে করে, যেখানে অনেকে ভীতিকর জ্ঞান করে। একইভাবে, সে জটিল প্রতিবেদনগুলো নিয়ে চিন্তা করা ও কঠিন বিষয়ে সিদ্ধান্ত-গ্রহণ মূল্যহীন মনে করে। অন্যভাবে, সে একজন চিন্তাশীল হিসাবে অধিক দক্ষ যে সমস্যাকে সাজানো ও উপস্থাপনে পটু। এর সমাধানে বা সিদ্ধান্ত গ্রহণে নয়, যেখানে পরিচালনার ভার গ্রহণ করতে হয়।

ব্যক্তি তার সম্পর্কে ভালো বলতে পারে যে, সে সাধারণত প্রথম থেকে নিয়ে শেষ অবধি একাকী কাজ করলে চমৎকার করতে পারে; নাকি দলবদ্ধভাবে কাজ করলে ভালো করে। কোন কোন ব্যক্তি বোঝা-পড়া ও আলোচনা করতে দক্ষ, বিশেষত আবেগসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো যেমন ইউনিয়নের কোন চুক্তি নিয়ে আলাপ-আলোচনা করা। তবে একই সময়ে, সে এও জানে যে ইউনিয়ন কী ধরনের প্রশ্ন করতে পারে সে ব্যাপারে তার পূর্ব অনুমান কতটুকু সঠিক বা ভুল।

এসব বিষয় অনেক মানুষের মাথায় থাকে না যখন তারা কোন মানুষের দুর্বলতা ও শক্তি নিয়ে কথা বলে। তারা সাধারণত কোন বিষয়ের জ্ঞানকে বা কোন শিল্পের প্রতিভাকে তুচ্ছ করে থাকে। কিন্তু মেজাজ বা স্বভাবও কোন অর্জন বা বড় কোন কাজের ক্ষেত্রে বেশ উল্লেখযোগ্য একটি বিষয়। একজন তরুণ তার স্বভাব সম্পর্কে মোটামুটি জ্ঞান রাখে। তাই কার্যকারিতাসম্পন্ন হওয়ার জন্য সে নিজের সক্ষমতা নিয়ে যা জানে তার উপর ভিত্তি গড়ে তোলে। আর সে ঐ কাজকে তার জানা সর্বোৎকৃষ্ট পন্থায় সম্পাদন করে।

বইয়ে এতক্ষণে যা আলোচিত হলো তার বিপরীতে, শক্তিকে ফলপ্রসূ করা একটা এটিটিউড তথা মনোভাব বা দৃষ্টিভঙ্গি, যেরকম এটা একটা অনুশীলন বা চর্চার বিষয়। তবে এই দৃষ্টিভঙ্গি বা মনোভাবকে অনুশীলনের মাধ্যমে উন্নত করা সম্ভব। যদি কেউ নিয়ম করে নেয় যে, সে তার সহযোগী সম্পর্কে জিজ্ঞেস করবে জুনিয়র বা সিনিয়র হোক-“এই ব্যক্তিটি কী করতে পারে?”। যেকেউ নিজের মধ্যে এ ধরনের চর্চা বা অভ্যাস গঠন করতে পারে যে “সে কী করতে পারে না?” এটা জিজ্ঞেস না করে জিজ্ঞেস করবে-“এই ব্যক্তিটি কী করতে পারে?”। তবে শীঘ্রই সে শক্তিশালী দিক খুঁজে বের করতে পারবে এবং সেই শক্তিশালী দিক ব্যবহারের মনোভাবও গ্রহণ করবে। ফলশ্রুতিতে, এই প্রশ্নটি অন্যকে করতে শিখে যাবে।

একটি প্রতিষ্ঠানের সবক্ষেত্রের কার্যকারিতায়, ব্যক্তি সুবিধাগুলোকে আহার প্রদান করে ও সমস্যাগুলোকে অভুক্ত রাখে। বর্তমানে কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠানে কর্মী নিয়োগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই মানুষ বিবেচনা অনেক বেশি দরকারি হয়ে উঠেছে। দক্ষ কার্যনির্বাহী নিজেকে সহ সব মানুষকে একটি সুযোগ হিসাবে মনে করে। সে জানে যে, কেবল শক্তিশালী দিকই কার্যকর ফলাফল সৃষ্টি করে। দুর্বলতা শুধু মাথাব্যথার কারণ হয় এবং দুর্বলতার অনুপস্থিতি কোন কিছুই সৃষ্টি করে না।

অধিকন্তু, সে জানে যে, কোন মানব-সম্প্রদায়ের মান নির্ধারিত হয় তাদের নেতার কার্যক্রমের ভিত্তিতে। তাই সে নেতৃত্ব কার্যক্রমকে কেবল সঠিক শক্তির উপর গড়ে তোলে।

খেলাধুলার ক্ষেত্রে আমরা দীর্ঘদিন ধরে জানি যে, যখন কোন খেলোয়াড় কোন খেলায় নতুন রেকর্ড় গড়ে, পুরো পৃথিবীজুড়ে সেই খেলায় অর্জনের নতুন মাত্রা নির্ধারিত হয়। দীর্ঘ অনেক বছর ধরে, কেউ এক মাইল চার মিনিটের কম সময়ে অতিক্রম করতে পারত না। হঠাৎ, রোগার ব্যানিস্টার পুরাতন রেকর্ড়টি ভেঙে দেয়। শীঘ্র, পৃথিবীর সকল অ্যাথলেটিক ক্লাবে সাধারণ খেলোয়াড়রা গতকালকের রেকর্ডটিতে পৌঁছার চেষ্টা শুরু করে দেয়। অন্যদিকে নতুন নেতাগোছের খেলোয়াড়গণ চার মিনিটের সীমা অতিক্রম করার চেষ্টা শুরু করে দেয়।

মানুষ নিয়ে কাজকারবার করার ক্ষেত্রে (ওহ যঁসধহ ধভভধরৎং), নেতা ও সাধারণের মধ্যকার দূরত্বের বিষয়টি আনুপাতিক হারে চলে। [এখানে সাধারণ মানুষ বলতে যারা নেতার অনুসরণ করে, অনুসারী বা কর্মীদল।] যদি নেতাদের কার্যক্রম বৃদ্ধি পায়, তবে সাধারণদের কার্যক্রমও বৃদ্ধি পায়। দক্ষ নির্বাহী জানে যে পুরো একটি সম্প্রদায়ের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধির চেয়ে একজন নেতার কর্মক্ষমতা বাড়ানো সহজ। সে তাই এটা নিশ্চিত করে যে, সে নেতৃত্বের স্থানে, মান-নির্ধারণী স্থানে, কর্মক্ষমতা-তৈরির স্থানে এমন ব্যক্তিকে নিয়োগ করে যার অসাধারণ কাজ করার ক্ষমতা আছে, গতি-নির্ধারণী কাজ করার সামর্থ্য আছে। আর এটা সবসময় একজন মানুষের একটা শক্তিশালী জায়গার উপর জোর দেওয়াকে কামনা করে এবং দুর্বলতাকে বাদ দিয়ে চিন্তা করতে হবে, যতক্ষণ তা বিদ্যমান সকল শক্তিকে ক্ষতিগ্রস্থ না করে। একজন মানুষ যতক্ষণ তার শক্তিশালী দিক কাজে লাগাচ্ছে, লাগাতে পারছে ততক্ষণ তার দুর্বল দিক অপ্রাসঙ্গিক বলা যেতে পারে।

একজন নির্বাহীর কাজ মানুষকে পরিবর্তন করা নয়। বরং, যেমনটা বাইবেল আমাদেরকে প্রতিভার উপমার ক্ষেত্রে অবহিত করে (রহ ঃযব ঢ়ধৎধনষব ড়ভ ঃযব ঞধষবহঃং), তার কাজ হলো সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীর কর্মক্ষতার সক্ষমতাকে দ্বিগুণ করা, একজন ব্যক্তির মাঝে যে শক্তি, স্বাস্থ্য ও উৎসাহ-উদ্দীপনা আছে তাকে কাজে লাগানোর মাধ্যমে।

[পাঠকের সুবিধার্থে সাফল্য প্রকাশনী থেকে বাইবেলের এই বিষয়টি উইকিপিডিয়ায় বাংলা অনুবাদ করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। আপনি উইকিপিডিয়ায় এ বিষয়ে আরও পড়ে পারেন: চধৎধনষব ড়ভ ঃযব ঃধষবহঃং ড়ৎ সরহধং লিখে সার্চ দিবেন। তারপর ভাষা-বাংলা করে নিলেই পড়তে পারবেন।]


 




অধ্যায় ৫


আগের কাজ আগে করা


কার্যকারিতার যদি কোন “গোপন” সূত্র থেকে থাকে তবে তা হচ্ছে-একাগ্রতা। কার্যকর কার্যনির্বাহক আগের কাজ আগে করে এবং এক সময়ে কেবল একটি কাজই করে।

একাগ্রতার প্রয়োজনীয়তা একজন কার্যকর কার্যনির্বাহকের স্বভাব এবং মানুষের স্বভাবজাত প্রবৃত্তি উভয়ের মাঝেই নিহিত। এর কারণসমূহ এতক্ষণে স্পষ্ট হয়ে যাবার কথা: তাদের হাতে যত সময় আছে তার তুলনায় অধিক পরিমাণ জরুরি কাজ তাদের করতে হয়। একজন কার্যকর কার্যনির্বাহকের অবদান পর্যালোচনা করার সময় তার দ্বারা সম্পাদিত গুরুত্বপূর্ণ কাজের সংখ্যাই আগে বিবেচনা করা হয়; তার জন্য বরাদ্ধকৃত স্বল্প সময়ে সে আসলে কী পরিমাণ জরুরি কাজ সম্পাদন করতে পারছে। একজন কার্যনির্বাহক তার সময়ের যত সদ্ব্যবহারই করুক না কেন, এর বেশির ভাগই সে নিজের কাজে ব্যয় করতে পারে না। আর তাই সবসময় সময়ের স্বল্পতা রয়েই যায়।

একজন কর্মকর্তা যত বেশি অবদান রাখার চেষ্টা করবে, তার তত বেশি সময়ের প্রয়োজন হবে। যত বেশি সে ব্যস্ততার চেয়ে ফলাফল অর্জনে বেশি মনোনিবেশ করবে, তত বেশি সে টেকসই হয় এমন সব প্রচেষ্টায় মন দিবে-এমন সব প্রচেষ্টা যেগুলো সফল করার জন্য বিপুল সময় ব্যয় করতে হয়। এমন অর্ধদিন কিংবা দুই সপ্তাহের প্রকৃত কার্যকরী সময় পাবার জন্য প্রয়োজন আত্মনিয়ন্ত্রণ এবং “না” বলার ইস্পাত কঠিন সংকল্প।

একই ভাবে একজন কার্যনির্বাহক যত বেশি নিজের দক্ষতা এবং কর্মক্ষমতাকে বৃদ্ধির চেষ্টা করবে সে তত বেশি নিজের মানবিক শক্তির বিকাশে একাগ্রতার প্রয়োজন উপলব্ধি করবে, যাতে সে তার সামনে আসা সকল সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে সক্ষম হয়। এটাই কাক্সিক্ষত ফলাফল পাবার একমাত্র উপায়।

কিন্তু দেখা গেছে দুটি কাজ করা তো দূরের কথা, আমরা এক সময়ে একটি কাজই একাগ্রভাবে করতে পারি না। মানুষের বিচিত্র ধরনের কাজ করার অসাধারণ ক্ষমতা অবশ্যই রয়েছে; মানবজাতি হলো “বহুজাতিক যন্ত্র”। কিন্তু মানুষের এই ক্ষমতার যথাযথ ব্যবহার তখনই হয় যখন বহু সংখ্যক স্বতন্ত্র ক্ষমতার অধিকারী মানুষকে একটি কাজ সম্পাদনে নিয়োজিত করা হয়। এটাই হলো একাগ্রতা, যেখানে সকল প্রার্থীদের মনোযোগ কেবল একটি অর্জনের উপর নিবদ্ধ থাকে।

আমরা যথাযথ কারণেই কয়েকটি বল বাতাসে রাখাকে সার্কাসের খেলা বলে আখ্যায়িত করে থাকি। তা সত্ত্বেও একজন জাগলার দশ মিনিটের বেশি খেলা চালিয়ে যেতে পারে না। এর বেশি সময় চেষ্টা করলে বল মাটিতে পড়ে যাবার সম্ভাবনা থাকে।

 

চিত্র: জাগলার বল নিয়ে খেলা দেখাচ্ছে। তথ্যসূত্র: শাটারস্টক

অনেকে অবশ্য এ কথায় অসম্মতি জানাবে। অনেক মানুষই আছে যারা এক সময় দুটি কাজ পাশাপাশি করার মাধ্যমে নিজের ক্ষমতার পূর্ণ ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারে। তবে এক্ষেত্রে তাদের এটা নিশ্চিত করতে হয় যে দুটি কাজ সফলভাবে করার জন্য প্রতিটি কাজে যেই ন্যূনতম সময় ব্যয় করা প্রয়োজন, তা তারা করতে পেরেছে। কিন্তু খুব কম সংখ্যক মানুষই একই সাথে তিনটি কাজ সফলভাবে করতে সক্ষম।

অবশ্য মোজার্ট এটা পারতেন। তিনি একই সাথে একাধিক অসামান্য এবং কালজয়ী সুর তৈরি করতে সক্ষম ছিলেন। কিন্তু তিনিই একমাত্র ব্যতিক্রম। অন্যান্য বিখ্যাত সুরকার যেমন বাখ, হ্যান্ডেল, হেইডেন কিংবা ভারডি এক সময়ে কেবল একটি সুরই রচনা করতেন। তারা আগের সুরটি শেষ না করে বা সেটা তৈরি করা সাময়িক বা সম্পূর্ণরূপে বন্ধ না করে নতুন কোন সুর রচনায় হাত দিতেন না। এক্সিকিউটিভ তথা কার্যনির্বাহকদের এটা কখনোই ভাবা উচিত নয় যে তারা “কার্যনির্বাহী মোজার্ট” হতে পারবে।

একজন কার্যনির্বাহকের জন্য নিবিড় একাগ্রতা আবশ্যক, কারণ তাকে বহুরকম কাজ সম্পাদন করতে হয়। একই সময়ে একটি কাজ করার অর্থ হলো কাজটি দ্রুততম সময়ে করা। একজন মানুষ যত বেশি সময়, প্রচেষ্টা ও সম্পদ একাগ্রভাবে ব্যয় করবে, সে তত বেশি সংখ্যক বৈচিত্র্যপূর্ণ কাজ সম্পাদন করতে পারবে।

আমার জানামতে কোন প্রধান কার্যনির্বাহী এতটা সাফল্য অর্জন করতে পারেনি যতটা সাম্প্রতিক সময়ে অবসরে যাওয়া একজন ফার্মাসিউটিক্যাল ফার্মের প্রধান করতে পেরেছেন। যখন তিনি এই পদে যোগদান করেন তখন এই কোম্পানিটি খুবই ছোট ছিল এবং কেবল একটি দেশের মাঝেই তাদের কার্যক্রম সীমিত ছিল। কিন্তু ১১ বছর পর তার অবসরে যাবার সময় কোম্পানিটি বিশ্বের অন্যতম নামকরা একটি প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত হয়েছে।

তিনি প্রথম কয়েক বছর কেবল গবেষণা পরিচালনা, গবেষণা কার্যক্রম এবং গবেষক দল নিয়েই কাজ করেছিলেন। এই প্রতিষ্ঠানটি কখনোই গবেষণা ক্ষেত্রে অগ্রগামী ছিল না, এমনকি অন্যদের গবেষণা অনুসরণের ক্ষেত্রেও এটি ছিল পশ্চাৎপদ। নতুন কার্যনির্বাহী কোন বিজ্ঞানী ছিলেন না। কিন্তু তিনি উপলব্ধি করেছিলেন পাঁচ বছর আগে প্রতিষ্ঠানের কর্তারা যা করেছিলেন, ৫ বছর পর আর সেই কাজ করলে চলবে না। প্রতিষ্ঠানটিকে নিজের গতিপথ নির্ধারণ করতে হবে। ফলশ্রুতিতে ৫ বছরের মাথায় প্রতিষ্ঠানটি দুটি নতুন গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে নেতৃত্বের পদে আসীন হতে সক্ষম হয়।

প্রধান কার্যনির্বাহী এরপর প্রতিষ্ঠানটিকে একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার কাজে নামেন। তত দিনে সুইস ফার্মাসিউটিক্যালের মতো কোম্পানিগুলো ঔষধ ব্যবসায় বিশ্বব্যাপী নিজেদের প্রভাব বিস্তার করে ফেলেছে। ওষুধ সেবনকে গভীরভাবে বিশ্লেষণ করে তিনি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, স্বাস্থ্যবীমা এবং সরকারি স্বাস্থ্যসেবা ওষুধ চাহিদার ক্ষেত্রে প্রধান প্রভাবক হিসাবে কাজ করে। তাই তিনি কোন দেশে নিজের ব্যবসা বিস্তারের সময়কে এমনভাবে বেছে নিতেন যখন সেই দেশের স্বাস্থ্যসেবার ব্যাপক বিস্তার ঘটতে শুরু হত। এই পন্থা অবলম্বনের ফলে তিনি কোন দেশে বিদ্যমান খ্যাতনামা আন্তর্জাতিক ঔষধ কোম্পানিগুলো থেকে ব্যবসা না কেড়েই সেই দেশে নিজের ব্যবসার প্রসার ঘটাতে পেরেছিলেন।

কর্মজীবনের শেষ ৫ বছর তিনি আধুনিক স্বাস্থ্যসেবার সাথে তাল মিলিয়ে চলার কৌশল আবিষ্কারের দিকে ঝুঁকে ছিলেন। বর্তমানে আধুনিক স্বাস্থ্যসেবা দ্রুতই “জনহিতকর” স্বাস্থ্যসেবায় পরিণত হচ্ছে। এক্ষেত্রে জনপ্রশাসনসমূহ যেমন সরকার, অলাভজনক হাসপাতাল, আঞ্চলিক সংস্থা (যেমন-আমেরিকার ব্লু ক্রস) বিল পরিশোধ করবে, তবে একজন নির্দিষ্ট ব্যক্তি যেমন-ফিজিশিয়ান, ওষুধ ক্রয়ের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে। এই কৌশলটি আদৌ কাজ করবে কিনা তা বলার সময় এখনো আসেনি। এটা কেবলই ১৯৬৫ সালে নির্ধারিত হয়েছিল, তার অবসরে যাবার কিছু দিন আগে। কিন্তু আমার জানা মতে তার প্রতিষ্ঠানটি একমাত্র প্রতিষ্ঠান যারা কিনা এমন কৌশল, মূল্য, বিপণন এবং বিশ্বব্যাপী ঔষধ শিল্পের সম্পর্ক নিয়ে ভেবেছে।

একজন প্রধান কার্যনির্বাহীর এক কর্মজীবনে এত বৃহৎ মাত্রার একটি কাজ করার ঘটনা খুবই দুর্লভ। অথচ এই মানুষটি একটি শক্তিশালী, দক্ষ কর্মী নির্ভর, আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান গড়ার মতো এমন তিনটি কাজ করে দেখিয়েছেন। তিনি এটা করতে সক্ষম হয়েছেন, কারণ তিনি এক সময়ে কেবল একটি কাজের উপরেই মনোনিবেশ করতেন।

এটাই হলো একই মানুষের “অনেক ধরনের কাজ”, এমন কি অনেক কঠিন কাজ করতে পারার “রহস্য”। তারা একই সময়ে কেবল একটি কাজই করে। ফলে একটি কাজ করতে আমাদের চেয়ে তাদের অনেক কম সময় প্রয়োজন হয়।

যারা কোন কাজ একবারে শেষ করতে পারে না, তাদের শেষ পর্যন্ত অনেক বেশি কাজ করতে হয়। প্রথমত, তারা কোন একটি কাজ সম্পন্ন করার সময়কে অবহেলা করে। তারা ভাবে সবকিছু তাদের পরিকল্পনা মাফিক হবে। কিন্তু সকল কার্যনির্বাহী জানে কোনকিছুই পরিকল্পনামাফিক হয় না। সবসময় কোন না কোন অপ্রত্যাশিত ঘটনা অবশ্যই ঘটবে। অপ্রত্যাশিত কিছু ঘটাই সার্বজনীনভাবে প্রত্যাশিত। আর সেটা প্রায় কখনোই মনোরম কিছু হয় না। আর তাই কার্যকর কার্যনির্বাহক সবসময় যত সময় লাগবে তারচেয়েও অধিক সময় হাতে নিয়ে কাজে নামে। দ্বিতীয়ত, একজন সাধারণ কার্যনির্বাহক সবসময় তাড়াহুড়ো করে কাজ করে, কিন্তু এতে সে আরও বেশি পিছিয়ে পড়ে। কার্যকর কার্যনির্বাহক প্রতিযোগিতা করে না। সে নিয়মিত একটি নির্দিষ্ট গতিতে কাজ চালিয়ে যায়। আর সবশেষে, একজন সাধারণ কার্যনির্বাহী একই সাথে অনেক কাজ করার চেষ্টা করে। ফলে তার কোন কাজই ঠিকমতো হয় না। যদি কোন একটি কাজে কোন ব্যাঘাত ঘটে, তবে তার পুরো পরিকল্পনাই বিনষ্ট হয়ে যায়।

কার্যকর কার্যনির্বাহকেরা জানে, তাদের অনেক কাজ সম্পন্ন করতে হবে এবং সেগুলো কার্যকরভাবে সম্পন্ন করতে হবে। এজন্য তারা সংগঠনের পাশাপাশি তাদের নিজস্ব সময় ও শক্তি ব্যবহার করে একই সময়ে কেবল একটি করে কাজ সম্পন্ন করে এবং আগের কাজটি আগে করে।


অতীতকে ভুলে যাওয়া


কার্যনির্বাহীর প্রচেষ্টাকে একীভূত করার প্রথম নিয়মটি হলো-অতীতে যেই প্রচেষ্টা বিফল হয়েছে তা পরিত্যাগ করা। কার্যকর কার্যনির্বাহকেরা নিয়মিত এবং পর্যায়ক্রমে তাদের এবং তাদের সহযোগীদের পরিকল্পনাগুলো পর্যালোচনা করে এবং জিজ্ঞেস করে: "আমরা যদি ইতোমধ্যে কাজটা না করে থাকি, তবে এখন কি কাজটা করব?” উত্তর যদি বিনাশর্তসাপেক্ষে "হ্যাঁ" না হয়, তবে তারা তৎক্ষণাৎ কাজটা পরিত্যাগ করে বা বন্ধ রাখে। অন্ততপক্ষে, তারা এটুকু নিশ্চিত করে যে আর কোনও সম্পদ যেন এই বিফল প্রচেষ্টায় ব্যয় না হয়। তারা প্রতিষ্ঠানের এই মূল্যবান সম্পদ, বিশেষত জনশক্তির মতো দুর্লভ সম্পদ, অতীতের এই কাজ থেকে সরিয়ে এনে ভবিষ্যতের ফলদায়ক কোন কাজে বিনিয়োগ করে।

তাদের ভালো লাগুক আর নাই লাগুক, কার্যনির্বাহকেরা আসলে সবসময় তাদের অতীতকে পরিত্যাগ করে চলেছে। এটা অনিবার্য সত্য। আজকের ফলাফল সর্বদাই গতকালের গৃহীত কর্ম ও সিদ্ধান্তের ফসল। কিন্তু তার উপাধি বা পদমর্যাদা যাই হোক না কেন, একজন মানুষ কখনোই ভবিষ্যতে কী হবে তা বলতে পারে না।

গতকালের সিদ্ধান্ত ও কর্ম, তা সেটা যত সাহসী বা যৌক্তিক হোক না কেন, তা আজকের অবশ্যম্ভাবী সমস্যা, সংকট ও বোকামিতে পরিণত হতে পারে। তা সত্ত্বেও একজন কার্যনির্বাহীকে-তা সে সরকারি প্রতিষ্ঠান, ব্যবসা কিংবা যেকোন সংস্থাতেই কাজ করে থাকুক না কেন, প্রতিনিয়ত আজকের সম্পদকে আগামীদিনের ফলাফল অর্জনের কাজে বিনিয়োগ করতে হয়। এর অর্থ হলো তাকে সবসময় নিজের শক্তি, অর্থ, ক্ষমতা ও মেধাকে কাজে লাগিয়ে নিজের অথবা তার পূর্বসূরিদের সিদ্ধান্ত এবং কাজকে চালিয়ে যেতে হচ্ছে কিংবা পরিবর্তন করতে হচ্ছে। সত্যি বলতে অন্য যেকোন কাজের চাইতে এসব কাজের পিছনেই তার সবচেয়ে বেশি সময় দিয়ে হয়।

তারপরেও যেসব কাজ কোন ফলাফল দিতে অক্ষম, তাদের পরিত্যাগ করার মাধ্যমে একজন কার্যনির্বাহী নিজের মূল্যবান সময় ও শ্রমের অপচয় রোধ করতে পারে।

সম্পূর্ণ ব্যর্থ কোনকিছু পরিত্যাগ করতে খুব বেশি সমস্যা হয় না। কেবল নিজেকে গুটিয়ে ফেলতে হয়। অবশ্য, অতীতের সাফল্য তাদের কর্মজীবনের বাইরেও প্রভাব ফেলে। সবচেয়ে বিপজ্জনক হলো এটা নিশ্চিত করা যে, কোন ক্রিয়াকলাপগুলো ভালোভাবে কাজ করবে আর কোনগুলো কোন কারণে ফলদায়ক হবে না। এগুলো একসময় “পরিচালকের অহংয়ে বিনিয়োগ” এবং পবিত্র কিছুতে পরিণত হয়, যা আমি আগেই ব্যাখ্যা করেছি।* [*পিটার ড্রুকার রচিত ম্যানেজিং ফর রেজাল্টস তথা ফলাফলের জন্য পরিচালিত বই দেখুন।]

অথচ এদের যদি সময়মতো পরিত্যাগ করা না হয়, তবে এরা প্রতিষ্ঠানের জীবনীশক্তি শুষে নেয়। দেখা গেছে সবচেয়ে যোগ্য লোকেরাই এই পরিচালকের অহংয়ে বিনিয়োগ থেকে কোন ‘‘আশাদায়ক ফল’’ পাবার ব্যর্থ চেষ্টা করে থাকে।

প্রতিটি সংস্থাই এই ধরনের জোড়া রোগের প্রতি অত্যন্ত সংবেদনশীল, তবে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো এক্ষেত্রে একটু বেশিই দুর্বল। সরকারি পরিকল্পনা এবং ক্রিয়াকলাপ, অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমের গতিতেই পুরাতন হয়। তা সত্ত্বেও এদের শুধু চিরন্তন হিসাবেই কল্পনা করা হয় না; বরং আইনসভায় সিভিল সার্ভিসের আওতায় এনে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহারও করা হয়।

১৯১৪ সালের আগ পর্যন্ত এটা খুব বিপজ্জনক ছিল না। তখন সরকার যখন ছিল ছোট এবং সামাজিক জীবনে এর প্রভাব ছিল ক্ষুদ্র। কিন্তু আজকের সরকারের নিজের শক্তি ও সম্পদ অতীতের কাজে ব্যয় করার সুযোগ নেই। তারপরও দেখা গেছে আমেরিকার অর্ধেক ব্যুরো এবং ফেডারেল এজেন্সিগুলো এমন সব কাজ তদারকি করছে যাদের কোন ব্যবস্থাপনার প্রয়োজনই নেই, যেমন ইন্টারস্টেট কমার্স কমিশন, এটা এমন এক সংস্থা যারা কিনা জনগণকে এমন এক রেলপথের একাধিপত্য হতে রক্ষায় নিয়োজিত যা ত্রিশ বছর আগেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে। অথবা তাদের বেশির ভাগ ফার্ম প্রোগ্রামের মতো তারা এমন সব পরিকল্পনা গ্রহণে ব্যস্ত যা প্রকৃতপক্ষে তাদের রাজনীতিবিদদের খুশি রাখার প্রচেষ্টা ছাড়া আর কিছুই না।

বর্তমানে এমন একটি নতুন নীতিমালার প্রয়োজন যেখানে কার্যকর প্রশাসনের অধীনে প্রতিটি আইন, সংস্থা ও সরকারের প্রতিটি পরিকল্পনা অস্থায়ী হিসাবে বিবেচিত হবে এবং নির্দিষ্ট সময় (যেমন দশ বছর) পর পর সেগুলো অচল বলে বিবেচিত হবে যদি না সতর্কভাবে সেই পরিকল্পনাটির ফলাফল এবং গুরত্ব পর্যালোচনা করে সেটিকে নতুন আইনের আওতায় দীর্ঘায়িত করা হয়।

রাষ্ট্রপতি জনসন ১৯৬৫-১৯৬৬ সালে সমস্ত সরকারি সংস্থা এবং তাদের পরিকল্পনাগুলো অধ্যয়নের আদেশ দিয়েছিলেন। এর জন্য তিনি সেক্রেটারি ম্যাকনামারা দ্বারা গঠিত “পরিকল্পনা পর্যালোচনা”কে (ঢ়ৎড়মৎধস ৎবারব)ি বেছে নিয়েছিলেন। সেক্রেটারি মূলত এটা তৈরি করেছিলেন প্রতিরক্ষা বিভাগকে সকল অপ্রচলিত এবং অনুন্নত কাজ থেকে মুক্ত করার জন্য। এটা একটা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় এবং ভালো প্রথম পদক্ষেপ ছিল।

তবে এটা ততক্ষণ ফল দেবে না যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা প্রচলিত এই ধারণা থেকে বেরিয়ে না আসি যে-সমস্ত পরিকল্পনা চিরস্থায়ী যদি না তারা অকার্যকর বলে প্রমাণিত হয়। বরং আমাদের ধারণা এমনটি হওয়া উচিত যে সমস্ত পরিকল্পনাই দ্রুত অচল হয়ে পড়ে এবং তাদের পরিত্যাগ করতে হয় যদি না তাদের নতুন কোন প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়ে থাকে। অন্যথায়, আধুনিক সরকার যা কিনা ক্রমাগত নিজের আইন, নিয়ম এবং বিধিমালার মাধ্যমে সমাজকে চাপে রেখে নিয়ন্ত্রণ করছে, একসময় নিজের ‘ওজনের’ ভারে মুখ থুবড়ে পড়বে।

যদিও সরকার সাংগঠনিক চাপ দ্বারা বিশেষভাবে বিপদগ্রস্থ, তবে কোন সংস্থাই এই রোগ থেকে মুক্ত নয়।

বৃহত্তর কর্পোরেশনের ব্যবসায়ী যিনি সরকারে আমলাতন্ত্র সম্পর্কে সর্বাধিক অভিযোগ করেন, দেখা গেছে তিনি নিজেই তার সংস্থায় এমন “নিয়ন্ত্রণ” বৃদ্ধিকে উৎসাহিত করছেন যা বাস্তবিকভাবে কোন কিছুকেই নিয়ন্ত্রণ করছে না। তার প্রতিষ্ঠানের সকল অধ্যয়ন, গবেষণা কিংবা সম্পর্কের ব্যপ্তি এবং প্রসারণ আসলে তার সিদ্ধান্তহীনতাকে লুকোনোর প্রচেষ্টা মাত্র। তিনি নিজেই তার কর্মীদের মূল্যবান শ্রম ও প্রতিষ্ঠানের সম্পদ অতীতের অচল পণ্য উৎপাদনে ব্যয় করছেন, যা কিনা ভবিষ্যতের কোন সফল পণ্য উৎপাদনে কাজে লাগত। যেই শিক্ষাবিদ কোন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের অপচয় নিয়ে সবচেয়ে বেশি সচ্চার, দেখা গেছে তিনি এমন এক বিষয়কে তার সিলেবাসের আওতায় রেখেছেন যা আজকের দিনে অপ্রচলিত এবং গুরুত্ত্বহীন বলে প্রমাণিত।

যেই কার্যনির্বাহী নিজেকে এবং নিজের প্রতিষ্ঠানকে কার্যকর হিসাবে দেখতে চায়, সে প্রতিষ্ঠানের সকল পরিকল্পনা, কার্যক্রম এবং প্রচেষ্টা নিজ হাতে তদারকি করে। সে সবসময় এই প্রশ্নটি জিজ্ঞেস করে-“এই কাজটি কি করা উচিত?” যদি উত্তর ‘না’ হয় তবে সে সঙ্গে সঙ্গে সেই কাজটি পরিত্যাগ করে। এরপর এমন অল্প কিছু কাজে নিজেকে নিয়োজিত করে যার সফলতা তার এবং তার প্রতিষ্ঠানকে উন্নতির শিখরে নিয়ে যেতে পারবে।

সর্বোপরি, কার্যকর কার্যনির্বাহক কোন নতুন কাজ শুরুর আগে পুরাতন কাজকে ত্যাগ করে। এ কাজটি সাংগঠনিক “ওজন নিয়ন্ত্রণ” রাখার জন্য প্রয়োজনীয়। এটা ছাড়া একটা সংস্থা শীঘ্রই আকৃতি, সংহতি ও পরিচালনার যোগ্যতা হারিয়ে ফেলবে। সামাজিক সংস্থাগুলো জৈবিক জীবের মতোই মেদহীন এবং পেশীবহুল হওয়া দরকার।

তবে সকল কার্যনির্বাহকই জানে, নতুন কিছু করা কখনোই সহজ নয়। এতে সবসময়ই কোন না কোন সমস্যা দেখা দেয়। যদি কেউ প্রতিকূল পরিবেশ থেকে নিজেকে মুক্ত করার কোন পন্থা আগে থেকেই ঠিক করে না রাখে, তবে সে প্রথম থেকেই নিজেকে ব্যর্থতার জন্য তৈরি করে নিচ্ছে। কোনকিছু থেকে বেরিয়ে আসার বা তা পরিত্যাগ করার কার্যকর পদ্ধতি তারাই গঠন করতে পারে, যারা নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণ করেছে। এমন মানুষ সবসময় প্রয়োজনের চাইতে বেশি ব্যস্ত থাকে। কেউ যদি তাদের বর্তমান কাজ থেকে মুক্ত করে না থাকে, তবে তারা নতুন কোন কাজ হাত দিবে তা আশা করা যায় না।

এর ব্যতিক্রম-নতুন কাজে “নতুন ব্যক্তি নিয়োগ” দেয়াটাও অনেক বেশি বিপজ্জনক। মানুষ নতুন ব্যক্তিদের নিয়োগ দিয়ে থাকে প্রতিষ্ঠিত এবং সফলভাবে সচল কর্মকা-ের বিস্তার ঘটানোর জন্য। কিন্তু মানুষ নতুন কিছু শুরু করে থাকে অভিজ্ঞ এবং আগেই যোগ্যতা প্রমাণ করেছে এমন ব্যক্তিদের নিয়ে। প্রতিটি নতুন কাজই অনেকটা জুয়া খেলার মতো। অন্য মানুষ কাজটি আগে অনেক বার করে থাকলেও, একজন কার্যকর কার্যনির্বাহক কখনোই নতুন কাজে অনভিজ্ঞ ব্যক্তিদের নিয়োগ দিয়ে কাজের ঝুঁকি বাড়ানোর মতো বোকামি করবে না। তারা পূর্বের বিরূপ অভিজ্ঞতা থেকে জানে, অনেক মানুষকেই প্রথমে প্রতিভাবান মনে হলেও “তাদের সাথে কাজ” করার ছয় মাসের মাথায় তারা নিজেদের ব্যর্থ প্রমাণ করে।

একটি সংস্থাকে প্রায়শই নতুন দৃষ্টিভঙ্গির নতুন মানুষ নিয়োগ দিতে হয়। কারণ একটি সংস্থা একই নীতি নিয়ে চলতে থাকলে, একসময় তা অচল হয়ে পড়তে পারে। কিন্তু সুযোগ থাকলে কোন সংস্থাই ঝুঁকিপূর্ণ কোন কাজে নতুন লোকবল নিয়োগ দেয় না, বিশেষ করে শীর্ষস্থানীয় কিংবা নেতৃত্বস্থানীয় পদে তো অবশ্যই না। তারা এমন সব কাজে নতুন লোক নিয়োগ দেয় যা ইতোমধ্যে সংজ্ঞায়িত এবং যুক্তিসঙ্গতভাবে বোধগম্য।

পুরাতনের পদ্ধতিগত পরিত্যাগই নতুনের সূচনা করার একমাত্র উপায়। আমার চেনা কোন প্রতিষ্ঠানে নতুন বুদ্ধি এবং কৌশলের অভাব নেই। “সৃজনশীলতা” আমাদের সমস্যা নয়। কিন্তু খুব কম প্রতিষ্ঠানই নিজস্ব উপায় বা কৌশলকে কাজে লাগাতে পারে। তাদের বেশির ভাগই পুরাতন ধ্যানধারণাকে আঁকড়ে ধরে পড়ে থাকে। সকল পরিকল্পনা ও কার্যক্রমকে নিয়মিতভাবে যাচাই করা এবং অচল পদ্ধতিসমূহকে বর্জন করার মাধ্যমে আজকের এই আমলাতান্ত্রিক সমাজেও সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটানো সম্ভব।

ডু পন্ট (উঁ চড়হঃ), বিশ্বের অন্যান্য বৃহত্তর কেমিক্যাল কোম্পানিগুলোর চাইতে অনেক ভালো অবস্থানে আছে। এর কারণ কোনও পণ্য বা প্রক্রিয়ার বিক্রয় বা কার্যকারিতার নিম্নগতির ঘ্রাণ পেতে শুরু করলেই তারা সেটা পরিত্যাগ করে।

ডু পন্ট মূল্যবান লোকবল, অর্থ ও সম্পদ পুরাতনকে রক্ষার জন্য বিনিয়োগ করে না। তবে রাসায়নিক শিল্পের ভেতরে এবং বাইরে পরিচালিত বেশির ভাগ ব্যবসা বিভিন্ন নীতি মেনে চলে; যথা: “এই পণ্যটি এই সংস্থাটি কর্তৃক নির্মিত এবং এর প্রাপ্য বাজার বজায় রাখা আমাদের দায়িত্ব।”

অন্যান্য সংস্থাগুলো কেবল তাদের কর্মকর্তাদের সৃজনশীলতার উপর সেমিনারগুলোতে প্রেরণ করে এবং নতুন পণ্যের অনুপস্থিতি সম্পর্কে অভিযোগ করে। ডু পন্ট নতুন পণ্য তৈরি এবং বিক্রয়ে এতটাই ব্যস্ত যে তাদের এর কোনটাই করার সময় নেই।

কার্যকর নতুনের আবির্ভাবের জন্য পুরাতনকে পরিত্যাগের বিষয়টা সার্বজনীন। এটা নিশ্চিত ভাবে বলা যায় যে ১৮২৫ সালে যদি পরিবহন মন্ত্রণালয়ের অস্তিত্ব থাকত, তবে আজকের দিনেও আমাদের ঘোড়ার গাড়িতে চলাচল করতে হত এবং ঘোড়াকে দ্রুতগামী করার জন্য চমৎকার সব গবেষণা পরিচালিত হত!


অগ্রাধিকার এবং উত্তরোত্তর কাজের অগ্রাধিকার


ভবিষ্যৎ সবসময়ই বরাদ্ধকৃত সময়ের চেয়ে অধিক পরিমাণ উৎপাদনশীল কর্ম এবং কর্মসম্পাদনে সক্ষম লোকের সংখ্যার চেয়েও অধিক সংখ্যক সুযোগ নিয়ে আসে। তবে একই সাথে তা নিয়ে আসে প্রচুর সমস্যা ও সঙ্কট।

সুতরাং কোন কাজগুলো অগ্রাধিকার পাবে এবং কোনগুলো পাবে না, সে সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। একমাত্র প্রশ্ন হলো, কে এই সিদ্ধান্তটি নেবে-কার্যনির্বাহী নাকি কাজের চাপ। তবে কোন না কোনভাবে, কাজগুলো প্রাপ্ত সময়ের সাথে সমন্বিত করা হবে এবং সুযোগগুলোকে শুধু সেসব যোগ্য লোকের জন্য বরাদ্ধ করা হবে যারা সেই সব সুযোগের দায়িত্ব নিতে সম্পূর্ণ প্রস্তুত।

যদি কার্যনির্বাহীর বদলে কাজের চাপ সিদ্ধান্ত গ্রহণকে প্রভাবিত করে, তবে গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলোকে নিশ্চিতভাবে বিসর্জন দেয়া হবে। তখন কাজটির সর্বাধিক সময়সাপেক্ষ অংশটির জন্য কোনও সময় থাকবে না-যা হলো সিদ্ধান্তকে কর্মে রূপান্তর। কোন কাজই প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রম এবং আচরণের অংশ না হওয়া পর্যন্ত সমাপ্ত হয় না। এর অর্থ হলো অন্যান্য লোকজন কাজটিকে নিজের ভেবে না করলে কাজটি প্রায় কখনোই সম্পন্ন হবে না, তাদের পুরনো কাজ নতুনভাবে করতে হবে, নতুন কিছু করার প্রয়োজনীয়তা বুঝতে হবে, কার্যনির্বাহকের “সমাপ্ত” প্রকল্পকে নিজেদের দৈনন্দিন জীবনের অংশ হিসাবে ধরে নিতে হবে। কিন্তু সময় স্বল্পতার কারণে যদি এই কাজগুলো প্রত্যাখ্যাত হয়, তবে সব কাজ ও প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হবে। তখন এটা কার্যনির্বাহীর মনোনিবেশ করা এবং কাজের অগ্রাধিকার আরোপ করতে ব্যর্থ হবার ফলাফল হিসাবেই গণ্য হবে।

অগ্রাধিকারের নিয়ন্ত্রণ চাপের উপর ছেড়ে দিবার আরও একটি সম্ভাব্য ফলাফল হলো, শীর্ষস্থানীয় ব্যবস্থাপনার কাজগুলো একেবারেই সম্পূর্ণ না হওয়া। তাদের কাজ স্থগিত হয়, কারণ গতকালের সমস্যা সমাধান না করেই আগামী দিনের জন্য আরেকটি সমস্যার সূত্রপাত ঘটে। আর কাজের চাপ সবসময় অতীতকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকে। একটি শীর্ষদল, যারা চাপ দ্বারা নিজেদের নিয়ন্ত্রিত হতে দেয়, তারা সবসময় এমন একটি কাজ বাদ দেয় যা কেউ করতে পারে না। এরা প্রতিষ্ঠানের বাইরের অন্য কিছুতে নজর দেয় না। ফলে তারা বাস্তবতার সাথে সম্পর্ক হারিয়ে ফেলে, যেখানে বাস্তবতাই ফলাফল অর্জনের একমাত্র প্রকৃত ক্ষেত্র। কারণ চাপ সবসময় ভেতরের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করে। চাপ ভবিষ্যতের বদলে অতীত, সুযোগের পরিবর্তে সংকট, বাস্তবতার বদলে তাৎক্ষণিক দৃশ্যমান এবং প্রাসঙ্গিকের পরিবর্তে গুরুতর বিষয়কে প্রাধান্য দেয়। (চৎবংংঁৎবং ধষধিুং ভধাড়ৎ যিধঃ যধং যধঢ়ঢ়বহবফ ড়াবৎ ঃযব ভঁঃঁৎব, ঃযব পৎরংরং ড়াবৎ ঃযব ড়ঢ়ঢ়ড়ৎঃঁহরঃু, ঃযব রসসবফরধঃব ধহফ ারংরনষব ড়াবৎ ঃযব ৎবধষ, ধহফ ঃযব ঁৎমবহঃ ড়াবৎ ঃযব ৎবষবাধহঃ.)

কাজটি অবশ্য অগ্রাধিকার নির্ধারণ করা নয়। ওটা সহজ। প্রত্যেকেই সেটা করতে পারে। খুব কম সংখ্যক কার্যনির্বাহী কাজে মনোনিবেশ করতে পারে কারণ তাদের “উত্তরোত্তর কাজের অগ্রাধিকার (ঢ়ড়ংঃবৎরড়ৎরঃরবং)” স্থাপনে অসুবিধা হয়-যার অর্থ হলো কোন কোন কাজগুলো না করা-আর সিদ্ধান্তে অটল থাকা।

অধিকাংশ কার্যনির্বাহী এটা শিখেছে যে, কোন কিছু স্থগিত করা মানে সেটা পরিত্যাগ করা। তাদের অধিকাংশই এটা ভাবে যে পূর্বে স্থগিত কোন প্রকল্প বর্তমানে হাতে নেবার মতো অনাকাক্সিক্ষত কিছু আর হতে পারে না। কারণ এর সময়সূচি বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ভুল হয়ে থাকে, আর সাফল্যের প্রচেষ্টায় সঠিক সময় একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। যেই কাজটি পাঁচ বছর আগে করা উচিত ছিল, তা পাঁচ বছর পরে করা নির্বুদ্ধিতা ছাড়া আর কিছু নয়।

ভিক্টোরিয়ান উপন্যাসের বাইরে, ২১ বছর বয়সে প্রায়ই বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া, এরপর ৩৮ বছর বয়সে বিধবা এবং বিপত্নীক অবস্থায় আবার নিজেদের খুঁজে পাওয়া জুটির কাছে বাস্তবে সুখ ধরা দেয় না। এখন ২১ বছর বয়সে বিয়ে হলেও এই জুটি হয়তো পরস্পরকে বোঝার সুযোগ পেয়েছে, একসাথে বড় হবার সুযোগ পেয়েছে। কিন্তু সতেরো বছর সময় তাদের মাঝে দূরত্ব এনে দিয়েছে, তারা পরিবর্তিত হয়েছে এবং নিজের মতো বিকাশ লাভ করেছে।

যেই ব্যক্তি যৌবনে ডাক্তার হতে চেয়েছিল কিন্তু বাধ্য হয়ে তাকে ব্যবসায়ী হতে হয়েছে, এখন পঞ্চাশ বছর বয়সে একজন সফল ব্যবসায়ী হবার পরেও সে যদি তার প্রথম ভালোবাসার কাছে ফিরে যায় অর্থাৎ মেডিকাল কলেজে ভর্তি হয়, তবে সে একজন সফল ডাক্তার হওয়া তো দূরের কথা, পড়াশোনাই শেষ করতে পারবে না। তার যদি অসাধারণ প্রেরণা থাকে, যেমন একজন মেডিকেল মিশনারি হবার তীব্র আকাক্সক্ষা, তবে হয়তো সে সফল হতে পারে। কিন্তু তা না হলে সে মেডিকেল কলেজের পড়াশোনা, নিয়মশৃঙ্খলা ও সর্বোপরি ডাক্তারি পেশার সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হিমসিম খাবে এবং একসময় ক্লান্ত হয়ে পড়বে।

যেই ব্যবসায়িক সংযোগ, ছয় বা সাত বছর আগে সঠিক মনে হয়েছিল কিন্তু কোম্পানির প্রেসিডেন্ট কারো অধীনে কাজ করতে অস্বীকৃতি জানানোয় তা আর আগায়নি, তা বর্তমানে সেই জেদি কার্যনির্বাহী অবসরে গেলেও, কোনো পক্ষের জন্যেই আর সুফল বয়ে আনবে না।

যেই কার্যনির্বাহী কোন স্থগিত কিছুকে পরিত্যাগ করে, সে আসলে কোন কিছু স্থগিত করতে লজ্জা পায়। তারা জানে সেই কাজটি অগ্রাধিকার পাবার যোগ্য নয়; কিন্তু কাজটিকে উত্তরোত্তর অগ্রাধিকার দেয়াটাও বিপজ্জনক। কারণ যেই কাজটি একজন স্থগিত করেছে, তা হয়তো তার প্রতিদ্বন্দ্বীর সুযোগে পরিণত হয়েছে। কোন গ্যারান্টি নেই যে একজন রাজনীতিবিদ বা প্রশাসক যেই নীতিমালাটি পরিত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তা ভবিষ্যতে বিপজ্জনক কোন রাজনৈতিক সংকটে বিস্ফোরিত হবে না।

রাষ্ট্রপতি আইজেনহাওয়ার কিংবা রাষ্ট্রপতি কেনেডির কেউই, উদাহরণস্বরূপ, নাগরিক অধিকারকে অগ্রাধিকার দিতে চাননি। আর রাষ্ট্রপতি জনসন ক্ষমতায় এসে ভিয়েতনাম এবং বৈদেশিক সম্পর্ককে উত্তরোত্তর কাজের অগ্রাধিকার হিসাবে বিবেচনা করেছিলেন। (এই কারণে যেই লিবারেলরা প্রথমে তার দারিদ্রতা নির্মূলকে অগ্রাধিকার দেয়াকে সমর্থন দিয়েছিল, তারাই পরবর্তীতে তার প্রতি সহিংস প্রতিক্রিয়া দেখায়, যখন বিভিন্ন ঘটনা তাকে তার অগ্রাধিকারের সময়সূচি পরিবর্তন করতে বাধ্য করে।)

উত্তরোত্তর কাজের অগ্রাধিকার (ঢ়ড়ংঃবৎরড়ৎরঃরবং) স্থাপন করাও অপ্রীতিকর। প্রতিটি উত্তরোত্তর কাজের অগ্রাধিকার অন্য কারও শীর্ষ অগ্রাধিকার। এর পরিবর্তে একটি “শীর্ষ অগ্রাধিকারগুলোর তালিকা” তৈরি করে “অল্প অল্প করে” লিস্টের সব কাজ করার চেষ্টা করা সহজ। এতে সবাইকে খুশিও রাখা যায়। কিন্তু সবচেয়ে বড় সমস্যা এটাই যে, এক্ষেত্রে লিস্টের কোন কাজই সম্পন্ন হয় না।

অগ্রাধিকার বিশ্লেষণ সম্পর্কে অনেক কথা বলা যেতে পারে। তবে অগ্রাধিকার এবং উত্তরোত্তর কাজের অগ্রাধিকার (ঢ়ড়ংঃবৎরড়ৎরঃরবং) সম্পর্কিত সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বুদ্ধি বিশ্লেষণ নয়, বরং সেটা হলো সাহস।

বিশ্লেষণের চেয়ে সাহসই প্রকৃতপক্ষে অগ্রাধিকার সনাক্ত করার গুরুত্বপূর্ণ নিয়মগুলোকে নির্দেশ করে:

▪ অতীতের বদলে ভবিষ্যৎকে বেছে নিন;

▪ সমস্যার পরিবর্তে সুযোগের উপর মনোনিবেশ করুন;

▪ গড্ডলিকা প্রবাহে গা না ভাসিয়ে নিজের পথ নিজেই বেছে নিন;

▪ উচ্চাকাক্সক্ষী হোন, সহজ এবং ‘নিরাপদ’ কিছু বেছে না নিয়ে এমন বিষয়ে উচ্চাকাক্সক্ষা প্রদর্শন করুন যা কোনও পার্থক্য তৈরি করবে।

অনেক বিজ্ঞানীর গবেষণা এটাই দেখিয়েছে যে (অন্তত আইনস্টাইন, নিলস বোর বা ম্যাক্স প্ল্যাঙ্কের বুদ্ধিমত্তার নিচের স্তরের ক্ষেত্রে) সফলতা অর্জন, গবেষণা করার ক্ষমতার চেয়েও সুযোগের পিছনে ছোটার সাহসের উপর বেশি নির্ভরশীল। যারা সমস্যার চ্যালেঞ্জের চেয়েও সহজে সফলতা লাভের আশায় গবেষণা প্রকল্প নির্বাচন করে তারা সাধারণত বড় কোন অবদান রাখতে পারে না। তারা অনেক পাদটীকা বের করতে পারলেও, পদার্থবিদ্যার নতুন সূত্র কিংবা নতুন কোন তত্ত্ব আবিষ্কার তাদের দ্বারা সম্ভব হবে না। যারা সুযোগকে অগ্রাধিকার দেয় তারাই প্রকৃতপক্ষে কৃতিত্বপূর্ণ কিছু অর্জন করতে পারে।

একই ভাবে ব্যবসা ক্ষেত্রে যারা নতুন উদ্ভাবনকে অগ্রাধিকার দেয়, তারাই পুরাতনকে আঁকড়ে থাকা কোম্পানিগুলোর চেয়ে অধিক সাফল্য অর্জন করে। কাজটি যতই ছোট কিংবা বড় হোক না কেন, নতুন কিছু করাটা অবশ্যই ঝুকিপূর্ণ, অনিশ্চিত ও শ্রমসাধ্য। তবে সমস্যা সমাধানের চাইতে সুযোগের সদ্ব্যবহার করা বেশি ফলদায়ক। সমস্যার সমাধান কেবল অতীতের ভারসাম্য বজায় রাখে।

অগ্রাধিকার ও উত্তরোত্তর কাজের অগ্রাধিকারকে (ঢ়ড়ংঃবৎরড়ৎরঃরবং) সর্বদাই বাস্তবতার আলোকে পুনর্বিবেচনা ও সংশোধন করতে হবে। কোন আমেরিকান রাষ্ট্রপতিকেই ঘটনাবলির কারণে নিজের মূল অগ্রাধিকার তালিকা মেনে চলতে দেয়া হয়নি। সত্যি বলতে, একজন মানুষের অগ্রাধিকার তালিকার সব কাজ সম্পন্ন করার প্রচেষ্টাই তার অগ্রাধিকার এবং উত্তরোত্তর কাজের অগ্রাধিকারকে পরিবর্তন করে।

অন্য কথায় বলতে গেলে, একজন কার্যকর কার্যনির্বাহী কখনোই একটির বেশি কাজের উপর মনোযোগ দেয় না। হাতের কাজটি শেষ হলে সে পরিস্থিতি পুনর্বিচার করে পরবর্তী গুরুত্বপূর্ণ কাজটি নির্বাচন করে।

একাগ্রতা-অর্থাৎ সময় ও ঘটনাবলির উপর গুরুত্ব এবং অগ্রাধিকার অনুসারে নিজের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেবার সাহসই-কেবল একজন কার্যনিবাহীর সময় ও ঘটনাবলির উপর কর্তৃত্ব করার একমাত্র আশা। তা না হলে সময় ও ঘটনাবলিই তার উপর কর্তৃত্ব করবে।


 




অধ্যায় ৬


সিদ্ধান্ত-গ্রহণের উপাদানসমূহ


সিদ্ধান্ত-গ্রহণ একজন কার্যনির্বাহীর দায়িত্বসমূহের মধ্যে একটি। সিদ্ধান্ত নেবার জন্য তার খুব বেশি সময় খরচ হয় না। কিন্তু কোন সিদ্ধান্ত-গ্রহণ করা হবে সেটা একটা বিশেষ নির্বাহী কর্ম। আর তাই কার্যকর কার্যনির্বাহী সংক্রান্ত আলোচনায় সিদ্ধান্ত-গ্রহণকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়।

কেবল কার্যনির্বাহকেরাই সিদ্ধান্ত-গ্রহণ করে থাকে। বস্তুত, পুরো প্রতিষ্ঠানের কর্মক্ষমতা এবং ফলাফলের গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে, পদমর্যাদা অথবা জ্ঞান কাজে লাগিয়ে এমন সিদ্ধান্তসমূহ গ্রহণ করার ক্ষমতাই একজন কার্যনির্বাহীকে সংজ্ঞায়িত করে।

আর তাই একজন কার্যকর কার্যনির্বাহী কার্যকর সিদ্ধান্তই নিবে।

তারা একটি পদ্ধতিগত প্রক্রিয়ায় পরিষ্কারভাবে সংজ্ঞায়িত উপাদানসমূহ নিয়ে ধাপে ধাপে সিদ্ধান্ত গ্রহণের পথে অগ্রসর হয়। তবে আশ্চর্যজনকভাবে, এই প্রক্রিয়াটি আজকের দিনের অন্যান্য বইয়ে বর্ণিত “সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ার” সাথে খুবই কম সাদৃশ্য বহন করে।

কার্যকর কার্যনির্বাহীগণ অনেক সিদ্ধান্ত নেয় না। তারা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলোর উপরেই মনোনিবেশ করে। তারা “সমস্যা সমাধানের” বদলে কোন সিদ্ধান্তটি কৌশলগত আর কোনটি সাধারণ তা নিয়ে ভাবার চেষ্টা করে। তারা কম সংখ্যক কিন্তু অতি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো নিতে সর্বাধিক ধারণাগত বিচারবুদ্ধির প্রয়োগ করে। তারা একটি পরিস্থিতির অপরিবর্তনীয় উপাদানসমূহ চিহ্নিত করার চেষ্টা করে। আর তাই তারা খুব দ্রুত গতিতে সিদ্ধান্ত নেবার পরিপন্থী। অনেক বেশি উপাদান নিয়ে হেরফের করাকে তারা নির্বুদ্ধিতা কিংবা অলস চিন্তা হিসাবে গণ্য করে। তারা একটি সিদ্ধান্তের আদ্যোপান্ত এবং এর বাস্তবিকতা সম্পর্কে জানতে বদ্ধ পরিকর। তারা কৌশলের পরিবর্তে প্রভাব চায়, তারা চতুরের বদলে বিচক্ষণ হতে চায়।

কার্যকর কার্যনির্বাহী জানে কোন সিদ্ধান্তটি নীতিগতভাবে আর কোনটি ব্যবহারিক দিক বিবেচনা করে গ্রহণ করতে হয়। তারা জানে সঠিক এবং ভুল সমঝোতার মাঝে পার্থক্য অনুধাবন করাই সবচেয়ে কঠিন সিদ্ধান্ত। তারা এই পার্থক্য সম্পর্কে বুঝতে শিখেছে। তারা জানে এই প্রক্রিয়ার সবচেয়ে সময়সাপেক্ষ বিষয়টি সিদ্ধান্ত নেয়া নয়, বরং সেটা কাজে লাগানো। যদি একটি সিদ্ধান্ত “কাজে লাগানো” না হয় তবে সেটা প্রকৃত সিদ্ধান্ত বলে গণ্য হবে না। সেটা কেবলই সদিচ্ছা। এর অর্থ হলো একটি কার্যকর সিদ্ধান্ত সর্বাধিক ধারণাগত জ্ঞান থেকে উৎপত্তি লাভ করলেও সেটা বাস্তবে রূপ দেবার প্রক্রিয়াটা হতে হবে সর্বাধিক সহজ এবং সাবলীল।


সিদ্ধান্ত-গ্রহণ সংক্রান্ত দুটি গবেষণা


আমেরিকার দুর্দান্ত ব্যবসায়িক নির্মাতাদের মাঝে সবচেয়ে কম জনপ্রিয় থিওডোর ভেইল সম্ভবত আমেরিকার ব্যবসায়িক ইতিহাসের সবচেয়ে কার্যকর সিদ্ধান্তগ্রহীতা ছিলেন। ১৯১০ এর ঠিক আগে থেকে বিশ-দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত বেল টেলিফোনের সভাপতি হিসাবে কর্মরত থাকা অবস্থায়, ভেইল সংস্থাটিকে বিশ্বের বৃহত্তম এবং অন্যতম সমৃদ্ধশালী বেসরকারি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছিলেন।

ব্যক্তিগত মালিকানাধীন টেলিফোন সিস্টেমকে আমেরিকায় গুরুত্বের সাথে দেখা হয় না। কিন্তু উত্তর আমেরিকা মহাদেশের কিছু অংশতে (যুক্তরাষ্ট্র এবং দুটি সর্বাধিক জনবহুল কানাডিয়ান প্রদেশ কুইবেক ও অন্টারিও) এই বেল সিস্টেম চলমান রয়েছে। এটা পৃথিবীর একমাত্র উন্নত অঞ্চল যেখানে টেলিযোগাযোগ সরকারি মালিকানাভুক্ত নয়। এছাড়া একটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলে ব্যবসা একচেটিয়াকরণ এবং নিজের প্রকৃত বাজারে সফলতা অর্জন করা সত্ত্বেও বেল সিস্টেম একমাত্র সর্বজনীন সেবা যা ঝুঁকি গ্রহণ, নেতৃত্ব ও দ্রুত বিকাশের ক্ষেত্রে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করেছে।

ভাগ্য কিংবা “আমেরিকার রক্ষণশীলতা” দিয়ে একে ব্যাখ্যা করা যাবে না। এর ব্যাখ্যা নিহিত রয়েছে ভেইলের নেওয়া ৪টি কৌশলগত সিদ্ধান্তের মাঝে যা তিনি ২০ বছরের কর্মজীবনে গ্রহণ করেছিলেন।

ভেইল খুব তাড়াতাড়িই বুঝতে পেরেছিলেন যে, একটি টেলিফোন সিস্টেমকে ব্যক্তিগত মালিকানা এবং স্বায়ত্তশাসিত ব্যবস্থাপনার অধীনে থাকতে হলে স্বতন্ত্র ও পৃথক কিছু করতে হবে। সমগ্র ইউরোপে সরকারি মালিকানাধীন টেলিফোন ব্যবস্থা প্রায় কোনোরকম ঝুঁকি ছাড়াই চলছিল। সরকারের বিরুদ্ধে গিয়ে বেলকে একটি ব্যক্তিগত মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান হিসাবে ধরে রাখার সময় পার হয়ে গেছে। তাছাড়া একটি সম্পূর্ণ রক্ষণাত্মক অবস্থান কেবল তাদের জন্য পরাজয়ই নিয়ে আসবে। এটা ব্যবস্থাপনার কল্পনাশক্তি এবং ক্ষমতাকে পঙ্গু করে দিবে। বেলের এমন একটি নীতির দরকার ছিল যা বেলের মতো একটি প্রাইভেট কোম্পানিকে জনগণের কাছে যেকোন সরকারি প্রতিষ্ঠানের চাইতে অধিক আকর্ষণীয় করে তুলবে। আর এটাই ভেইলকে বেল টেলিফোন কোম্পানিকে জনগণের সেবা এবং সন্তুষ্টি লাভের একটি প্রতিষ্ঠান হিসাবে গড়ে তোলার প্রেরণা জুগিয়েছিল।

“আমাদের ব্যবসা হলো সেবা প্রদান”-ভেইল দায়িত্ব নেবার পর এটাই বেল কোম্পানির স্লোগানে পরিণত হয়। সেই সময়ে, শতাব্দীর শেষের দিকে এই সিদ্ধান্তটি ছিল ধর্মবিরোধী। কিন্তু ভেইল এই মত প্রকাশের বিরুদ্ধে ছিলেন, যে তার প্রতিষ্ঠানের ব্যবসা হলো মুনাফাহীন সেবা। বরং তিনি চেয়েছিলেন যে তার ম্যানেজমেন্টের কাজ হবে সেবা প্রদানকে কার্যকর এবং লাভজনক করে তোলা। তিনি এদিকে সতর্ক দৃষ্টি রেখেছিলেন যে, তার কোম্পানির ম্যানেজার এবং তাদের কাজের সফলতার মাপকাঠি যেন মুনাফা অর্জন না হয়ে সফল সেবা প্রদান হয়ে থাকে। এরপর শীর্ষ কর্মকর্তাদের কাজ হবে কোম্পানিকে সংগঠিত এবং অর্থায়ন করার মাধ্যমে সবচেয়ে সেরা সেবাপ্রদান এবং সন্তোষজনক আর্থিক মুনাফা অর্জন করা।

একই সময়ে ভেইল এটাও অনুধাবন করেছিলেন যে, একটি দেশব্যাপী একচেটিয়া যোগাযোগ ব্যবস্থা, একটি স্বাধীন কর্মপ্রচেষ্টা অর্থাৎ একটি অবাধ বেসরকারি ব্যবসা হতে পারে না। তিনি সরকারি নিয়ন্ত্রণকে সরকারি মালিকানার একমাত্র বিকল্প হিসাবে চিহ্নিত করেছিলেন। আর তাই কার্যকর, সৎ ও নীতিগত সরকারি নিয়ন্ত্রণই ছিল বেল সিস্টেমের জন্য কাম্য এবং এর সংরক্ষণের জন্য অপরিহার্য।

পাবলিক রেগুলেশন, আমেরিকায় অপরিচিত না হলেও ভেইল তার সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর সময় তা অচল হয়ে পড়েছিল। আদালতের সহায়তা প্রাপ্ত ব্যবসায়িক বিরোধিতা, কেবল আইনের বইগুলোই কামড়ে পড়েছিল। কমিশনগুলোতে লোকবল এবং অর্থায়ন ছিল অপ্রতুল। তারা তৃতীয় শ্রেণীর কর্মভারহীন পদে এবং প্রায়শই রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির উপায়ে পরিণত হয়েছিল।

ভেইল, নীতিমালা কার্যকর করাকে বেল সিস্টেমের লক্ষ্য হিসাবে নির্ধারণ করেছিলেন। তিনি একে প্রতিটি আঞ্চলিক টেলিফোন সংস্থার প্রধানের মূল দায়িত্ব হিসাবে চিহ্নিত করে তাদের এই দায়িত্ব অর্পণ করেছিলেন। তাদের কাজ ছিল নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোকে পুনরুজ্জীবিত করা ও নিয়ন্ত্রণ এবং মূল্য-নির্ধারণের নতুন উপায় উদ্ভাবন করা, যা নায্য ও মানসম্মত হবে এবং জনগণকে নিরাপত্তা দিবে, একই সময়ে বেল সিস্টেমকে তার কাজ করার সুযোগ দিবে। এই সংস্থাগুলোর প্রধানদের মধ্য থেকেই বেলের শীর্ষ ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য নির্বাচন করা হয়েছিল। এর ফলে সম্পূর্ণ প্রতিষ্ঠানে নীতিমালা সম্পর্কে ইতিবাচক মনোভাব গঠন সম্ভব হয়েছিল।

ভেইলের তৃতীয় সিদ্ধান্তের ফলে, টেলিফোন শিল্পের অন্যতম সফল বৈজ্ঞানিক গবেষণাগার-বেল ল্যারেটরি তথা গবেষণাগারগুলোর প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়েছিল। আবারো ভেইল বেসরকারি একাধিপত্যকে টেকসই করার চাহিদা নিয়ে কাজে নেমেছিলেন। কিন্তু এবার তিনি এই প্রশ্নটি জিজ্ঞেস করেছিলেন: “কীভাবে এই একাধিপত্যকে সত্যিকারভাবে প্রতিযোগিতামূলক করা সম্ভব?” স্পষ্টতই এটা একই পণ্য সরবরাহ করে এমন একজন সরবরাহকারীর সাথে স্বাভাবিক প্রতিযোগিতার মতো হবে না। আবার, কোন প্রতিযোগিতা ছাড়া এমন একচেটিয়া ব্যবসা শীঘ্রই অনমনীয়, বৃদ্ধি এবং পরিবর্তনের অযোগ্য হয়ে উঠবে।

কিন্তু ভেইল বলেছিলেন, এক্ষেত্রে ভবিষ্যতের সাথে বর্তমানের একটি প্রতিযোগিতার আয়োজন করা সম্ভব। টেলিযোগাযোগের মতো একটি প্রযুক্তিনির্ভর শিল্পের ভবিষ্যৎ নির্ভর করে ভিন্ন এবং অভিনব প্রযুক্তি উদ্ভাবনের উপর। এই উপলব্ধির উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা বেল গবেষণাগারগুলো মোটেই এক নম্বর মানের শিল্প গবেষণাগার ছিল না। এমনকি আমেরিকাতেও এটা প্রথম ছিল না। কিন্তু এটা প্রথম শিল্প গবেষণা প্রতিষ্ঠান, যা ইচ্ছাকৃতভাবে বর্তমানকে অচল প্রমাণ করার কাজে নিয়োজিত ছিল, তা সেই বর্তমান প্রযুক্তি যতই লাভজনক বা কার্যকর হয়ে থাকুক না কেন।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় যখন বেলের এই ল্যাব এটার চূড়ান্ত রূপ ধারণ করে, তখন এটা ছিল ঐ শিল্পে শ্বাসরুদ্ধকর এক উদ্ভাবন। এমন কি আজকের দিনেও কিছু ব্যবসায়ী বুঝতে পারে না যে, একটি গবেষণাকে উৎপাদনশীল হতে হলে তাকে “বিশৃঙ্খল” হতে হবে। তাকে আজকের শত্রু এবং আগামীর সম্ভাবনার ¯্রষ্টা হতে হবে। আজকের দিনে বেশির ভাগ শিল্প গবেষণাগারে “প্রতিরক্ষামূলক গবেষণা” বিদ্যমান যা বর্তমানকে ধরে রাখতে চায়। কিন্তু প্রথম থেকেই বেল ল্যাব এই প্রতিরক্ষামূলক গবেষণাকে নাকচ করে দিয়েছিল।

ভেইলের এই ধারণা কতটা যথার্থ ছিল, বিগত দশ-পনেরো বছরে সেটা প্রমাণ হয়ে গেছে। বেল ল্যাব প্রথমে টেলিফোন প্রযুক্তিকে বিস্তৃত করে যাতে সমগ্র উত্তর আমেরিকা মহাদেশ একটি স্বয়ংক্রিয় সুইচবোর্ডে পরিণত হয়। এরপর এটা বেল সিস্টেমকে এমন সব অঞ্চলে পৌঁছে দেয় যা বেল কিংবা তার প্রজন্ম কোনদিন কল্পনাও করেনি; যেমন টেলিভিশন প্রোগ্রাম ট্রান্সমিশন, কম্পিউটার ডাটা ট্রান্সমিশন-যা বিগত কয়েক বছরে দ্রুত বর্ধমান যোগাযোগ ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে এবং যোগাযোগ স্যাটেলাইট।

যেই বৈজ্ঞানিক এবং প্রযুক্তিগত উন্নয়ন এই নতুন ট্রান্সমিশন সিস্টেমগুলোকে সম্ভব করে তুলেছিল তাদের জন্ম হয়েছিল মূলত বেল ল্যাবে, তা সেটা বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব যেমন গাণিতিক তথ্য তত্ত্ব, নতুন পণ্য এবং প্রক্রিয়া যেমন ট্রানজিস্টর কিংবা কম্পিউটারের যুক্তি ও নকশা যাই হোক না কেন।

তার কর্মজীবনে, বিংশ শতকের প্রথমদিকে, ভেইল গণ-মূলধন বাজার (সধংং পধঢ়রঃধষ সধৎশবঃ) উদ্ভাবন করেছিলেন-আবারো এটা নিশ্চিত করতে যাতে একটি বেসরকারি ব্যবসা হিসাবে বেল সিস্টেম টিকে থাকতে পারে।

শিল্পগুলো সাধারণত সরকার দ্বারা পরিচালিত হয় কারণ তারা সমাজতন্ত্রের কারণে তাদের প্রয়োজনীয় মূলধন অর্জন করতে ব্যর্থ হয়। প্রয়োজনীয় মূলধন অর্জন করার ব্যর্থতাই ছিল, ১৮৬০ থেকে ১৯২০ সালের মধ্যবর্তী সময়ে ইউরোপীয় রেলপথের সরকারি মালিকানার অধীনে আসার অন্যতম প্রধান কারণ। আধুনিকীকরণের জন্য প্রয়োজনীয় মূলধনকে আকর্ষণ করার অক্ষমতা, গ্রেট ব্রিটেনে কয়লা খনি এবং বৈদ্যুতিক শক্তি শিল্প জাতীয়করণের পিছনে অনেক বড় ভূমিকা পালন করেছিল। এটা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে মুদ্রাস্ফীতিকালীন সময়ে ইউরোপ মহাদেশে বৈদ্যুতিকশক্তি শিল্পের জাতীয়করণের অন্যতম কারণ ছিল। বৈদ্যুতিকশক্তি সংস্থাগুলো, মুদ্রার অবচয়ের ভারসাম্য রক্ষা করতে তাদের মূল্য বৃদ্ধি করতে ব্যর্থ হয়েছিল, ফলে তারা আধুনিকীকরণ ও সম্প্রসারণের জন্য মূলধন আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়নি।

ভেইল সমস্যাটিকে পূর্ণরূপে অনুধাবন করতে পেরেছিলেন কিনা তা জানা যায়নি। কিন্তু তিনি স্পষ্টতই দেখেছিলেন যে বেল টেলিফোন সিস্টেমের প্রচুর পরিমাণে মূলধনের নির্ভরযোগ্য এবং সুস্থিত সরবরাহের প্রয়োজন ছিল যা বর্তমান মূলধন বাজার থেকে পাওয়া সম্ভব নয়। অন্য গণ সেবাদানকারী সংস্থা (ঃযব ড়ঃযবৎ ঢ়ঁনষরপ ঁঃরষরঃরবং), বিশেষ করে, বৈদ্যুতিকশক্তি সংস্থাগুলো, অনুমানের উপর ভিত্তি করে তাদের মূলধন বিনিয়োগ করত। তারা হোল্ডিং কোম্পানি গঠন করেছিল যারা প্যারেন্ট কোম্পানির শেয়ারকে আকর্ষণীয় করে তুলত। অপরদিকে তাদের মূল ব্যবসার চাহিদা পূরণ হত বীমা কোম্পানির মতো প্রচলিত উৎসগুলো থেকে। ভেইল বুঝেছিলেন এই মূলধন সরবরাহ প্রক্রিয়া নিরাপদ নয়।

বিশ দশকের প্রথম দিকে তার নকশা করা এটিঅ্যান্ডটি (অঞ্ঞ) কমন স্টকের সাথে এই অনুমানমূলক শেয়ারের আইনগত রূপ ছাড়া আর কোন মিল ছিল না। এটা সাধারণ জনগণের জন্য একটি নিরাপদ উৎস হবার কথা ছিল, উদীয়মান মধ্যবিত্ত শ্রেণীর “স্যালি আন্টি”, যাদের কিছু অর্থ বিনিয়োগ করার সামর্থ্য ছিল, কিন্তু বড় ঝুঁকি নেবার মতো মূলধন ছিল না, তাদের জন্য মূলত এটা করা হয়েছিল। ভেইলের এটিঅ্যান্ডটি কমন, প্রায় নিশ্চিত লভ্যাংশের কারণে বিধবা, এতিমদের বিনিয়োগ করার জন্য উপযুক্ত ছিল। একই সময়ে, একটি সর্বজনীন শেয়ার হবার কারণে এটা মূলধনের মূল্যবিচার এবং মূল্যস্ফীতি থেকে রক্ষার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল।

ভেইল যখন এই আর্থিক উপকরণটি ডিজাইন করেছিলেন, তখন এই “স্যালি আন্টি” এর মতো বিনিয়োগকারীদের অস্তিত্ব ছিল না। এমন সর্বজনীন শেয়ার কেনার মতো অর্থ আছে, এরকম মধ্যবিত্ত শ্রেণীর তখন মাত্র উদ্ভব হয়েছে। তারা তখনও ব্যাংকে সঞ্চয়, বীমাপত্র এবং বন্ধক রাখার মতো পুরনো বিনিয়োগ অভ্যাস থেকে বের হতে পারেনি। যারা একটু সাহসী তারা আবার বিংশ শতকের অনুমানমূলক স্টক মার্কেটেই বিনিয়োগ করে চলছিল, অথচ সেখানে তাদের থাকার কোন প্রয়োজনই ছিল না। ভেইল নিশ্চিতভাবেই “স্যালি আন্টিদের” তৈরি করেননি। কিন্তু তিনি তাদের বিনিয়োগকারীতে পরিণত করে, তাদের বিনিয়োগ এমনভাবে স্থানান্তর করেছিলেন যাতে তারা এবং বেল সিস্টেম উভয়ই মুনাফা অর্জন করতে পারে। এই একটি কাজ বেল সিস্টেমকে কয়েকশ বিলিয়ন ডলার এনে দিয়েছিল যা তারা গত অর্ধ শতক সময়ের মাঝে বিনিয়োগ করেছে। এই পুরো সময় জুড়ে এটিঅ্যান্ডটি কমন আমেরিকা এবং কানাডার মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বিনিয়োগ পরিকল্পনার মূল ভিত্তি হিসাবে পরিচয় লাভ করেছে।

 

চিত্র: আন্টি স্যালি হচ্ছে ইংল্যান্ডের এক ধরনের স্থানীয় খেলা। যেমন বাংলাদেশে কানামাছি, বরফ-পানি ইত্যাদি। তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া।

ভেইল আবারো এই ধারণাটি কার্যকর করার নিজস্ব মাধ্যম বলে দিয়েছিলেন। এত বছর ধরে বেল সিস্টেম ওয়াল স্ট্রিটের উপর নির্ভর না করে নিজেই নিজের ব্যাংকার এবং আন্ডার রাইটার হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছে। পরবর্তীতে ভেইলের আর্থিক নকশার সহকারী, ওয়াল্টার গিফোর্ডকে বেল সিস্টেমের প্রধান কর্মকর্তার দায়িত্ব দেয়া হয় এবং তিনি ভেইলের উত্তরসূরিতে পরিণত হন।

ভেইল তার এবং তার কোম্পানির সমস্যা সমাধানে যেই সিদ্ধান্তগুলো নিয়েছিলেন, তা অদ্ভুত ছিল বটে। কিন্তু তাদের পিছনের মৌলিক চিন্তাটি সত্যিকারের কার্যকর সিদ্ধান্ত বলে বিবেচিত।

আলফ্রেড পি. স্লোয়ান জুনিয়রের উদাহরণ এটা স্পষ্টভাবে দেখিয়ে দেয়।* স্লোয়ান, যিনি বিশ্বের সর্ববৃহৎ নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের নকশা করেছিলেন, ১৯২২ সালে জেনারেল মটরসের প্রধানের পদে আসীন হন। সেই সময়ে ভেইলের কর্মজীবন প্রায় শেষের দিকে। তিনি খুব ভিন্ন রকমের একজন মানুষ ছিলেন, তার সময়ও ছিল ভিন্ন। তারপরেও স্লোয়ান যেই সিদ্ধান্তের জন্য সবচেয়ে বেশি পরিচিতি লাভ করেছেন তা হলো-জেনারেল মটরসের সাংগঠনিক কাঠামো বিকেন্দ্রীকরণ। এই সিদ্ধান্তটি, পূর্বে থিওডোর ভেইলের বেল টেলিফোন সিস্টেমের জন্য নেয়া সিদ্ধান্তের অনুরূপ।

*এখানে ব্যবসায়িক উদাহরণগুলো এমনভাবে বেছে নেয়া হয়েছে যাতে সেগুলো সহজে বোধগম্য হয়। ওপর দিকে বেশির ভাগ সরকারি নীতিমালা বোঝার জন্য তাদের পটভূমি, ইতিহাস, নীতি সম্পর্কে অনেক বেশি ব্যাখ্যার প্রয়োজন হয়। একই সময়ে এই বড় উদারহরণগুলো দ্বারা ব্যবসায়িক কাঠামো সহজেই দেখানো সম্ভব। কিন্তু সরকারি, সামরিক, হাসপাতাল কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় সংক্রান্ত সিদ্ধান্তগুলো এই অংশে এবং আগামী অধ্যায়ে যেই ধারণা নিয়ে আলোচনা করা হবে তারই উদাহরণ।

স্লোয়ান তার মাই ইয়ার্স উইথ জেনারেল মটরস* (*নিউ ইয়র্ক, ডাবলডে, ১৯৬৪) বইয়ে যেমনটা উল্লেখ করেছেন: ১৯২২ সালে তিনি যেই কোম্পানিটির দায়িত্ব গ্রহণ করেন সেটা ছিল প্রায় স্বাধীন প্রধান কর্মকর্তাদের একটি শিথিল সংঘ। এখানের প্রত্যেকটি মানুষ এমন একটি ইউনিটের দায়িত্বে ছিল, যা কয়েক বছর আগে ছিল তার নিজের মালিকানায় এবং এদের প্রত্যেকে এখনও স্বতন্ত্র মালিকের মতোই ইউনিটগুলো পরিচালনা করছিল।

এই জাতীয় পরিস্থিতি মোকাবিলার দুটি প্রচলিত উপায় ছিল। প্রথমটি হলো, শক্তিশালী স্বতন্ত্র ব্যক্তিদের তাদের ব্যবসা বিক্রি করার পরে কাজে অব্যাহতি দেয়া। এভাবেই জন ডি রকফেলার স্ট্যান্ডার্ড ওয়েল ট্রাস্ট এবং স্লোয়ানের কয়েক বছর আগে জে পি মরগান ইউ এস স্টিল গঠন করেছিলেন। বিকল্প উপায়টি ছিল নতুন কেন্দ্রীয় অফিস থেকে ন্যূনতম হস্তক্ষেপ রেখে প্রাক্তন মালিকদের কোম্পানির দায়িত্বে রেখে দেয়া। এটা ছিল “স্টক অপশনের তৈরি নৈরাজ্য” যেখানে আশা করা হত যে নিজস্ব আর্থিক স্বার্থ, তাদেরকে সম্পূর্ণ ব্যবসার স্বার্থে কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করবে। জেনারেল মটরসের প্রতিষ্ঠাতা ডুরান্ট এবং স্লোয়ানের পূর্বসূরি পিয়েরে ডু পন্ট এই পথেই গিয়েছিলেন। কিন্তু স্লোয়ান যখন দায়িত্ব নেন, তখন শক্তিশালী এবং স্বতন্ত্র মনোভাবসম্পন্ন এই ব্যক্তিদের একত্রে কাজ করার অপারগতার কারণে পুরো কোম্পানি প্রায় ধ্বংস হওয়ার পথে।

স্লোয়ান বুঝেছিলেন যে এই সমস্যাটা ছোট ও স্বল্পমেয়াদি কোন সমস্যা নয়, বরং এটা বৃহৎ ব্যবসার একটা সর্বজনীন সমস্যা। স্লোয়ান দেখেছিলেন বড় ব্যবসায় দিকনির্দেশনা এবং কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণের মাঝে ঐক্য থাকা প্রয়োজন। কিন্তু এর পাশাপাশি এখানে শক্তি, উদ্যম ও উদ্দীপনা থাকাও সমানভাবে দরকার। অপারেটিং ম্যানেজারদের নিজের মতো কাজ করার স্বাধীনতা থাকতে হবে। তাদের এই কাজ করার দায়িত্ববোধ এবং কর্তৃত্ব থাকতে হবে। তাদের নিজের সামর্থ্য দেখানোর সুযোগ দিতে হবে এবং কাজের স্বীকৃতি প্রদান করতে হবে। স্লোয়ান তাৎক্ষণিকভাবেই বুঝেছিলেন একটি ব্যবসা যত বড় হবে, তাকে ততই নিজেদের কর্মীদের মধ্য থেকে শক্তিশালী এবং স্বাধীন কার্যনির্বাহক তৈরি করতে হবে।

স্লোয়ানের আগে প্রত্যেকেই সমস্যাটাকে ব্যক্তিত্বের সমস্যা হিসাবে দেখেছিল এবং ভেবেছিল এটা সমাধানের উপায় হলো ক্ষমতার লড়াই, যেখানে কেবল একজন মানুষ বিজয়ী বলে ঘোষিত হবে। কিন্তু স্লোয়ান একে এমন একটি সাংগঠনিক সমস্যা হিসাবে চিহ্নিত করেছিলেন, যা একটি নতুন কাঠামো তৈরির মাধ্যমে সমাধান করা সম্ভব। অর্থাৎ, বিকেন্দ্রীকরণ, যা স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনের সাথে কেন্দ্রীয় দিকনির্দেশনা এবং নীতিমালার সমন্বয় করবে।

এটা কতটা সফল হয়েছিল তা হয়তো তুলনামূলকভাবে দেখানো যাবে: একটা ক্ষেত্র ছিল যেখানে জেনারেল মটরস কখনো অসাধারণ সাফল্য পায়নি। ত্রিশ দশকের মধ্যভাগ থেকে (১৯৩০ সালের কথা) জেনারেল মটরস, আমেরিকার মানুষদের রাজনৈতিক মনোভাব এবং আমেরিকান সরকারের দিকনির্দেশনা ও নীতিমালা অনুমান এবং অনুধাবনের ক্ষেত্রে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। এই একটি ক্ষেত্রে তখনও “বিকেন্দ্রীকরণ” করা হয়নি। ১৯৩৫ সাল থেকে জেনারেল মটরসের কোন সিনিয়র কর্মকর্তা একজন রক্ষণশীল রিপাবলিকান ছাড়া অন্য কিছু হবে, এমনটা কল্পনাও করা যেত না।

ভেইল এবং স্লোয়ানের এসব সিদ্ধান্তের মাঝে কিছু মিল পাওয়া যায়। যদিও তারা সম্পূর্ণ ভিন্ন সমস্যা নিয়ে কাজ করে অত্যন্ত নির্দিষ্ট কিছু সমাধান বের করেছিলেন। তারা দুজনেই একটি সমস্যাকে চিন্তার সর্বোচ্চ স্তরে গিয়ে বোঝার চেষ্টা করতেন। অন্য কথায় তারা তাৎক্ষণিকভাবে সিদ্ধান্ত না নিয়ে কৌশলগত সিদ্ধান্ত নিতেন। তারা উদ্ভাবক ছিলেন। তারা অত্যন্ত বিতর্কিত ছিলেন। তাদের পাঁচটি সিদ্ধান্তই সেই সময়ে “সবাই যা জানত” তার সরাসরি বিরোধিতা করেছিল।

ভেইল, বেল সিস্টেমের প্রধান হিসাবে দায়িত্ব নেবার প্রথমদিকে একবার বহিষ্কৃত হয়েছিলেন। তার ব্যবসাকে সেবা হিসাবে প্রচার করা, অনেকের কাছে পাগলের প্রলাপ বলে মনে হয়েছিল। কারণ তারা “জানত” যে ব্যবসার একমাত্র লক্ষ্য হলো মুনাফা অর্জন। কোম্পানির অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য একটি নীতিমালা প্রয়োজন-তার এই বিশ্বাস আসলেই যুক্তিসঙ্গত ছিল। কিন্তু সেসময় অনেকেই একে বোকামি না হয় অনৈতিক চিন্তা বলে আখ্যায়িত করেছিল। “এসব মানুষ ভাবত” যে নীতিমালা হলো “আসন্ন সমাজতন্ত্র” এবং একে মোকাবিলা করতে হবে। কিন্তু কয়েক বছর পর ১৯০০ সালে তাদের টনক নড়ে যখন তারা টেলিফোনের রাষ্ট্রীয়করণের চাহিদা দেখতে পায়। তখন বেল সিস্টেমের বোর্ড ভেইলকে আবার ফিরিয়ে আনে। তবে তার বর্তমান প্রক্রিয়া এবং কৌশলগুলো অপ্রচলিত করার জন্য অর্থ ব্যয় করার সিদ্ধান্ত (যদিও তারা কোম্পানির পক্ষে সর্বাধিক মুনাফা অর্জন করেছিল) এবং এই লক্ষ্যে একটি বৃহৎ গবেষণাগার তৈরি এবং এর পাশাপাশি তৎকালীন বিনিয়োগ অনুসরণ করতে অস্বীকৃতি জানানো হয় এবং একটি অনুমানমূলক মূলধন কাঠামো তৈরি, তার বোর্ড কর্তৃক সমানভাবে প্রতিরোধ করা হয়েছিল।

একইভাবে, আলফ্রেড পি. স্লোয়ানের বিকেন্দ্রীকরণও ছিল সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য এবং সবার “জানা এবং পরিচিত ব্যবস্থার” বিপরীতমুখী।

সেই সময়ের আমেরিকান ব্যবসায়ী নেতাদের মধ্যে স্বীকৃত মৌলিক চিন্তার অধিকারী ছিলেন হেনরি ফোর্ড। তবে ভেইলের এবং স্লোয়ানের সিদ্ধান্তগুলো ফোর্ডের জন্যেও অনেক বেশি “বন্য” ছিল। ‘টি’ মডেল গাড়ির কথা অনেকেই জানেন। ‘টি’ মডেল গাড়ির নকশা সম্পূর্ণ হবার পর ফোর্ড নিশ্চিত ছিলেন যে এটা সর্বকালের শ্রেষ্ঠ গাড়ি হবে। কিন্তু তা হয়নি। অপর দিকে, ভেইল পুরাতনকে অপ্রচলিত বলে আখ্যায়িত করার উপর গুরুত্বারোপ করতেন। তাই ভেইলের আইডিয়া অন্যদের কাছে পাগলামি বলে মনে হয়েছিল। তিনি (ফোর্ড) নিশ্চিত ছিলেন যে শক্তিশালী কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণই দক্ষতা ও সাফল্য অর্জনের একমাত্র উপায়। স্লোয়ানের বিকেন্দ্রীকরণকে তার আত্মঘাতী বলে মনে হয়েছিল।


সিদ্ধান্ত-গ্রহণ প্রক্রিয়ার উপাদানসমূহ


ভেইল এবং স্লোয়ান যেই সিদ্ধান্তগুলো নিয়েছিলেন তাদের বৈশিষ্ট্য অভিনবত্ব কিংবা বিতর্কিত স্বভাব নয়, বরং তাদের বৈশিষ্ট্য হলো:

১। সমস্যাটি সর্বজনীন এবং একটি নিয়মমাফিক ও নীতিগত সিদ্ধান্তের মাধ্যমে সেটা সমাধান করা সম্ভব-তার স্পষ্ট উপলব্ধি;

২। সমস্যাটির সমাধানকে যেই শর্তগুলো পূরণ করতে হবে তাদের সংজ্ঞায়িত করা, অর্থাৎ সীমারেখা শর্ত পূরণ;

৩। কোন কাজটি ‘সঠিক’ তা নিয়ে ভাবা, অর্থাৎ আপস, অভিযোজন এবং মনোনিবেশ করার দিকে নজর দেবার আগে কোন সমাধানটি সীমারেখার শর্তগুলোকে পূর্ণভাবে সন্তুষ্ট করছে তা নির্ধারণ।

৪। সিদ্ধান্তটি কার্যকর করার জন্য কোন কোন পদক্ষেপ নিতে হবে তা নির্ধারণ।

৫। “প্রতিক্রিয়া” গ্রহণ, যা বাস্তবিক ক্ষেত্রে সিদ্ধান্তের বৈধতা এবং কার্যকারিতা পরীক্ষা করবে।

এগুলো কার্যকর সিদ্ধান্ত-গ্রহণ প্রক্রিয়ার উপাদান।


কার্যকর সিদ্ধান্ত-গ্রহণ প্রক্রিয়ার প্রথম উপাদান


১। কার্যকর সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীর প্রথম প্রশ্নটি হলো: “এই পরিস্থিতি কি সর্বজনীন নাকি ব্যতিক্রম?” “এই ঘটনা কি আগেও অনেক বার ঘটেছে এমন কোন ঘটনার সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ?” “নাকি এটা একটা ব্যতিক্রম ঘটনা যা ব্যতিক্রমভাবেই মোকাবিলা করতে হবে?

সর্বজনীন হলে সর্বদা একটা নিয়ম, নীতি মেনে সেটা মোকাবিলা করতে হবে। ব্যতিক্রমটা ঘটলেই কেবল সেটা ব্যতিক্রমভাবে দেখা হবে।

সত্যি বলতে দুটির বদলে চারটি ভিন্ন ঘটনার মাঝে তুলনা করা উচিত। হয়তো দেখা যাবে, প্রথম স্বতন্ত্র ঘটনাটি সত্যিকারের সর্বজনীন ঘটনার কেবল একটি লক্ষণ।

কার্যনির্বাহীর কাজ চলাকালীন বেশির ভাগ সমস্যাগুলো এই প্রকৃতির। উদাহরণস্বরূপ, ব্যবসার সংগ্রহমূলক সিদ্ধান্ত আসলে ‘সিদ্ধান্ত’ নয়। এটা অভিযোজন। সমস্যাটা সর্বজনীন। উৎপাদনের ক্ষেত্রে কথাটি আরও বেশি প্রযোজ্য।

সাধারণত, একটি পণ্য নিয়ন্ত্রণ এবং প্রকৌশল দল এক মাসের মধ্যে শতশত সমস্যার সমাধান করে। কিন্তু এদের বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে এদের অধিকাংশই একটি অন্তর্নিহিত সমস্যার লক্ষণ মাত্র। কারখানার একটি অংশে কাজ করা একজন স্বতন্ত্র প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ প্রকৌশলী বা উৎপাদন প্রকৌশলীর চোখে সাধারণত এটা ধরা পড়বে না। সে হয়তো প্রতি মাসে উত্তপ্ত তরল বহন করা পাইপের সংযোগে কোন সমস্যা দেখবে । কিন্তু কয়েক মাস যাবৎ তার দলের এই সমস্যা পর্যবেক্ষণ করলে মূল সমস্যাটি ধরা পড়বে। তখন দেখা যাবে যন্ত্রের তাপ কিংবা চাপ বেশি হবার কারণে হয়তো এই সমস্যা দেখা দিয়েছে এবং পুরো পাইপ সংযোগের নতুন নকশা করলেই এই সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে। এই কাজটি করা না হলে তারা কেবল বারবার বিভিন্ন অংশের তারের সংযোগ ঠিক করতেই থাকবে, কিন্তু মূল সমস্যাটি অনিয়ন্ত্রিতই রয়ে যাবে।

তারপরে আরও একটি সমস্যা রয়েছে যা একটি স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠানের জন্য অনন্য ঘটনা হলেও প্রকৃতপক্ষে সর্বজনীন।

যে প্রতিষ্ঠান অন্য বৃহত্তর প্রতিষ্ঠানের সাথে একীভূত হওয়ার প্রস্তাব পেয়েছে, সেটি এই প্রস্তাবটি গ্রহণ করলে আবার কখনও এমন সুযোগ পাবে না। একটি স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান, এর পরিচালনা পর্ষদ এবং ব্যবস্থাপনা কমিটির জন্য ঘটনাটি অনন্য। কিন্তু এমন ঘটনা অহরহ ঘটছে। এই প্রস্তাবটি গ্রহণ করা হবে কি হবে না, সেই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবার জন্য কিছু সাধারণ নিয়ম মেনে চলতে হয়। তবে এক্ষেত্রে অন্যের অভিজ্ঞতার দিকে নজর দিতে হয়।

এবার একটি সত্যিকারের অনন্য, অসাধারণ ঘটনার কথা বলব।

১৯৬৫ সালের নভেম্বর মাসে, যেই ব্ল্যাকআউট উত্তর আমেরিকার সেন্ট লরেন্স থেকে ওয়াশিংটন পর্যন্ত পুরো উত্তর-পূর্ব অঞ্চলকে অন্ধকারে নিমজ্জিত করেছিল, তাকে একটি সত্যিকারের অনন্য এবং ব্যতিক্রমী ঘটনা হিসাবে ধরা হয়। যেমনটি ধরা হয়েছিল ষাট দশকের গোড়ার দিকে থ্যালিডোমাইড দুর্ঘটনাকে, যার ফলে তখন অসংখ্য বিকৃত শিশুর জন্ম হয়েছিল। আমাদের বলা হয়েছিল এই ঘটনাগুলো ঘটার সম্ভাবনা এক কোটিতে একটি বা দশ কোটিতে একটি। আমি যেই চেয়ারে বসে আছি, সেটি হঠাৎ পরমাণুতে বিভাজিত হওয়া যেমন অসম্ভব, এমন অস্বাভাবিক ঘটনার পুনরাবৃত্তি হওয়াও তেমনি অসম্ভব।

অনন্য ঘটনাগুলো সত্যিই বিরল। যখন এদের আবির্ভাব ঘটে তখন জিজ্ঞেস করতে হয় “এটি কি সত্যিই ব্যতিক্রম নাকি সাধারণ কোন ঘটনার নতুন লক্ষণ?”

আর এই সাধারণ কোন ঘটনার নতুন লক্ষণ প্রকাশই হলো সিদ্ধান্ত-গ্রহণ প্রক্রিয়ার চতুর্থ এবং শেষ শ্রেণীবিভাগ।

উদাহরণস্বরূপ, আমরা এখন জানি যে, উত্তর-পূর্বের ব্ল্যাকআউট এবং থ্যালিডোমাইড ট্র্যাজেডি উভয়ই কেবল আধুনিক শক্তি প্রযুক্তি ও আধুনিক ঔষধ বিজ্ঞানের প্রেক্ষিতে প্রথম ঘটনা ছিল এবং ভবিষ্যতে এই ত্রুটিগুলো বারবার হবার সম্ভাবনা রয়েছে যদি না এদের কোন সাধারণ এবং সর্বজনীন সমাধান পাওয়া যায়।

প্রকৃত অনন্য ঘটনা ব্যতীত সকল সমস্যার একটি সর্বজনীন সমাধান আবশ্যক। এজন্য দরকার একটি নীতিমালা এবং নিয়মাবলি। একই সাধারণ ঘটনা মোকাবিলার একটি সঠিক নীতিমালা নির্ধারণ করা হয়ে গেলে সেই সমস্যার যেকোন রূপকেই ঐ মূল নীতির আলোকে সমধান করা যাবে। তবে অনন্য ঘটনাবলিকে অবশ্যই স্বতন্ত্রভাবে দেখতে হবে। ব্যতিক্রমের জন্য নীতিমালা গঠন সম্ভব নয়।

কার্যকর সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী এই চারটি ঘটনার কোনটি নিয়ে মোকাবিলা করছে তা বোঝার জন্য যথেষ্ট সময় ব্যয় করে। সে জানে, পরিস্থিতির সঠিক শ্রেণীবিভাগ চিহ্নিত করতে ভুল হলে সে ভুল সিদ্ধান্ত নিবে।

এখন পর্যন্ত সর্বাধিক বার করা প্রচলিত ভুল হলো, সর্বজনীন পরিস্থিতিকে, অনন্য ঘটনার ধারাবাহিকতা হিসাবে বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়া, অর্থাৎ বোধগম্যতা এবং নীতির অভাব থাকা সত্ত্বেও বাস্তববাদী হওয়া। এটি কার্যনির্বাহীকে অনিবার্যভাবে হতাশা এবং নিরর্থকতার দিকে পরিচালিত করে।

আমি মনে করি, কেনেডি প্রশাসনের অধিকাংশ জাতীয় বা আন্তর্জাতিক নীতির ব্যর্থতায় এটা স্পষ্টভাবে প্রদর্শিত হয়েছে। এত প্রতিভাবান সদস্য থাকা সত্ত্বেও কেনেডি প্রশাসন কেবল একটি ব্যাপারে সফলতা অর্জন করতে পেরেছিল: কিউবার মিসাইল সংকট। অন্যথায়, এটা বাস্তবে কিছুই অর্জন করেনি। এর সদস্যরা যেমনটি বলেছিল, এর মূল কারণ হলো “বাস্তববাদ”; অর্থাৎ কোন নিয়ম বা নীতি গঠন না করে সবকিছুকে “সম্ভাব্যতার” আলোকে যাচাই করা। কিন্তু সবার মতো প্রশাসনের সদস্যরাও বুঝেছিল যে তাদের জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক নীতিমালা সম্পর্কিত প্রাথমিক ধারণা এবং যুদ্ধ পরবর্তী সময়ের প্রাথমিক ধারণাগুলো অত্যন্ত অবাস্তব ছিল।

একইভাবে কোনও নতুন ঘটনাকে পুরাতন ঘটনার আলোকে মোকাবিলা করাও প্রচলিত একটি ভুল।

এটা সেই ত্রুটি যা একটি স্থানীয় বিদ্যুতের ব্যর্থতাকে নিউইয়র্ক-অন্টারিও উত্তর-পূর্ব সীমান্তের বৃহৎ ব্ল্যাকআউটে পরিণত করেছিল। পাওয়ার ইঞ্জিনিয়াররা, বিশেষত নিউ ইয়র্ক সিটিতে, একটি সাধারণ ওভারলোড মোকাবিলার জন্য সঠিক নিয়মটি প্রয়োগ করে। কিন্তু তাদের নিজস্ব যন্ত্রগুলো ইঙ্গিত দিয়েছিল যে অসাধারণ কিছু ঘটতে চলেছে। আর তাই তাদের ব্যতিক্রম কিছু করা প্রয়োজন।

এর বিপরীতে, রাষ্ট্রপতি কেনেডির, কিউবার ক্ষেপণাস্ত্র সঙ্কটে বিজয়লাভ, অসাধারণ, ব্যতিক্রমী ঘটনাকে বিবেচনা করার চ্যালেঞ্জকে স্বীকৃতি দেয়ার ফলাফল। কেনেডি চ্যালেঞ্জটি গ্রহণ করার সাথে সাথে বুদ্ধি এবং সাহসের অসাধারণ পরিচয় দিতে পেরেছিলেন।

মৌলিক সমস্যার বিশ্বাসযোগ্য কিন্তু ভুল সংজ্ঞা প্রদানের ভুলটিও প্রায়শই করা হয়। এখানে একটি উদাহরণ দেয়া হলো:

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে আমেরিকান সামরিক বাহিনী উচ্চ প্রশিক্ষিত মেডিকেল লোকদের ইউনিফর্মে ধরে রাখার অক্ষমতায় জর্জরিত ছিল। তাদের কাছে কয়েক ডজন গবেষণাপত্র এবং প্রস্তাবিত প্রতিকার ছিল। কিন্তু সকল গবেষণাপত্রের ত্রুটি ছিল বিশ্বাসযোগ্য কিন্তু ভুল বিষয়টি মূল সমস্যা হিসাবে চিহ্নিত করা-আর তা হলো পারিশ্রমিক। অথচ আসল সমস্যাটি ছিল সামরিক মেডিকেল ব্যবস্থার প্রচলিত কাঠামো। আজকের যেই চিকিৎসাবিজ্ঞান বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের উপর বেশি জোর দেয়, তার সাথে সামরিক পরিষেবার সাধারণ চিকিৎসকের উপর গুরুত্বারোপ বেমানান ছিল। সামরিক চিকিৎসায় পেশাগত পথ বিশেষায়িতকরণ থেকে চিকিৎসা এবং হাসপাতাল প্রশাসনের দিকে যায় এবং গবেষণা ও বিশেষায়িত অনুশীলন থেকে দূরে সরে যায়। এখনকার তরুণ, সু-প্রশিক্ষিত চিকিৎসকেরা তাই মনে করে সামরিক ক্ষেত্রে সাধারণ চিকিৎসকের পদে কাজ করে তাদের সময় ও দক্ষতার অপচয় হবে। তারা নিজেদের দক্ষতা বৃদ্ধি করে একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক হবার সুযোগ চায়।

এখন পর্যন্ত সামরিক বাহিনী এই মৌলিক সিদ্ধান্তের মুখোমুখি হয়নি। তারা কি সশস্ত্র পরিষেবার চাহিদা দ্বিতীয় স্তরের এমন মেডিকেলকর্মী দিয়ে মিটিয়েই সন্তুষ্ট থাকবে যারা বৈজ্ঞানিক, গবেষণা-ভিত্তিক এবং উচ্চতর বিশেষায়িত বেসামরিক পেশায় থাকার যোগ্য নয়? নাকি তারা সামরিক কাঠামো থেকে ব্যতিক্রম একটি চিকিৎসাবিজ্ঞান অনুশীলনের ক্ষেত্র তৈরি করবে? যতদিন পর্যন্ত সামরিক বাহিনী এই আসল সিদ্ধান্তে উপনীত না হবে, ততদিন পর্যন্ত তরুণ চিকিৎসকেরা তাদের থেকে পালিয়ে বেড়াবে।

অথবা সমস্যাটির সংজ্ঞা হয়তো অসম্পূর্ণ।

এটা ১৯৬৬ সালে অনিরাপদ গাড়ির কারণে আমেরিকার অটোমোবাইল শিল্পের উপর আসা আঘাতের কারণ ব্যাখ্যা করে। এর পাশাপাশি এটাও ব্যাখ্যা করে কেন এই আঘাত পুরো অটোমোবাইল শিল্পকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল। এমন না যে শিল্পটি নিরাপত্তার দিকে একদমই নজর দেয়নি। বরং এটা নিরাপদ হাইওয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং এবং ড্রাইভার ট্রেনিংয়ের উপর ব্যাপক গুরুত্ব দিয়েছে। এই দুর্ঘটনাগুলো যে অনিরাপদ সড়ক ও অসচেতন চালকের কারণে ঘটছে তার সপক্ষে যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে। মহাসড়ক চৌকি থেকে শুরু করে স্কুল পর্যন্ত, যানবাহনের নিরাপত্তার সাথে জড়িত সকল সংস্থাই তাদের প্রচারের জন্য একই লক্ষ্যগুলো বেছে নিয়েছে।

এই প্রচারণা কাক্সিক্ষত ফলাফল এনেছে। সুরক্ষার জন্য নির্মিত মহাসড়ক এবং নিরাপত্তা প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত চালক, দুর্ঘটনার সংখ্যা কমিয়েছে। কিন্তু প্রতি হাজার গাড়ি কিংবা প্রতি হাজার মাইলে দুর্ঘটনার হার কমে আসলেও মোট দুর্ঘটনার সংখ্যা এবং তাদের ক্ষয়ক্ষতি বেড়েই চলেছে।

অনেক আগেই এটা স্পষ্ট হওয়া উচিত ছিল যে, চালকের একটা ক্ষুদ্র অংশ-যেমন মাতাল চালক কিংবা “দুর্ঘটনা প্রবণ” চালকের ৫ শতাংশ-মোট দুর্ঘটনার তিন চতুর্থাংশের জন্য দায়ী। এই চালকেরা ড্রাইভিং ট্রেনিংয়ের ঊর্ধ্বে এবং তারা সবচেয়ে নিরাপদ সড়কেও দুর্ঘটনা ঘটাতে সক্ষম। অনেক আগেই এটা স্পষ্ট হওয়া উচিত ছিল যে, সুরক্ষা আইন এবং সুরক্ষা প্রশিক্ষণ সত্ত্বেও ক্ষুদ্র তবে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে যেই সকল দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে, তাদের ব্যাপারে আমাদের কোন ব্যবস্থা নিতে হবে। তার মানে নিরাপদ সড়ক এবং নিরাপদ গাড়ি চালনা প্রচারণার সাথে দুর্ঘটনার ক্ষয়ক্ষতি কমানোর প্রকৌশলকেও সংযুক্ত করতে হবে। ভুল বা সঠিক যেমনভাবেই চালানো হোক না কেন, সব অবস্থাতেই নিরাপদ থাকবে-আমাদের এমন গাড়ি নির্মাণ করতে হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত অটোমোবাইল শিল্প এটা দেখতে ব্যর্থ হয়েছিল।

এই উদাহরণটি থেকে বোঝা যায় যে, অসম্পূর্ণ ব্যাখ্যা প্রায়শই কেন সম্পূর্ণ ভুল ব্যাখ্যার চেয়ে বেশি বিপজ্জনক হয়ে থাকে। নিরাপদ ড্রাইভিং প্রচারণার সাথে সংযুক্ত সকলে-অটোমোবাইল শিল্প, হাইওয়ে কমিশনার, অটোমোবাইল ক্লাব এবং বীমা সংস্থাগুলো ভেবেছিল দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনাকে গ্রাহ্য করা মানে হলো বিপজ্জনক গাড়ি চালানোকে উৎসাহ দেয়া। সম্ভাবনাকে নৈতিকতার সাথে মিশিয়ে ফেলার এই প্রবৃত্তি মানুষের স্বভাবজাত, আর এটাই অসম্পূর্ণ ধারণাকে এতটা বিপজ্জনক এবং তাদের সংশোধনকে এতটা কঠিন করে তোলে।

এ কারণেই কার্যকর সিদ্ধান্ত গ্রহীতা প্রাথমিকভাবে এটা ধরে নেয় যে সমস্যাটি সর্বজনীন।

সে ধারণা করে, তার মনোযোগ আকর্ষণ করা ঘটনাটি আসলে একটি লক্ষণ। সে তখন আসল সমস্যার খোঁজ করে। সে শুধু লক্ষণ দেখেই রোগের নিরাময় করে না।

যদি ঘটনাটি আসলেই অনন্য হয়, তবে অভিজ্ঞ সিদ্ধান্ত গ্রহীতা তার পিছনে কোন নতুন সমস্যা দায়ী সেটি খোঁজার চেষ্টা করবে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যাবে এখন যাকে অনন্য মনে হচ্ছে, সেটি নতুন একটি সর্বজনীন সমস্যা মাত্র।

এটা ব্যাখা করে, কেন একজন কার্যকর সিদ্ধান্ত গ্রহীতা সবসময় তার সমাধানকে ধারণাগত চিন্তার সম্ভাব্য সর্বোচ্চ স্তরে রাখে। কোন সুরক্ষা পরের কয়েক বছর সবচেয়ে ভালো দামে বিক্রি করা সহজ হবে, এটা ভেবে সে তাৎক্ষণিক অর্থায়ন সমস্যার সমাধান করে না। সে যদি সুদূর ভবিষ্যতে পুঁজিবাজারের প্রয়োজন প্রত্যাশা করে, তবে সে একজন নতুন ধরনের বিনিয়োগকারী আবিষ্কার করে এবং এমন একটি সর্বজনীন-পুঁজিবাজারের সুরক্ষার নকশা করে যার এখনো কোন অস্তিত্ব নেই। যদি একদম বিশৃঙ্খল কিন্তু দক্ষ বিভাগীয় প্রধানদের নিয়ন্ত্রণে আনার প্রয়োজন হয়, তবে সে সবচেয়ে অবাধ্যদের বহিষ্কার করে না এবং বাকিদের টাকা দিয়ে হাতে আনে না। সে একটি বৃহৎ প্রতিষ্ঠানের জন্য একটি সাংবিধানিক তত্ত্ব তৈরি করে। সে যদি নিজের শিল্পকে একচেটিয়া হিসাবে দেখতে পায়, তবে সে সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে নিন্দা করে সন্তুষ্ট থাকে না। সে এই জনসাধারণ নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে প্রতিযোগিতাহীন,দায়িত্বহীন বেসরকারি উদ্যোগ ও নিয়ন্ত্রণহীন, একচেটিয়া এবং সমপরিমাণে দায়িত্বহীন সরকারি উদ্যোগের মধ্যবর্তী একটি স্বেচ্ছাপ্রণোদিত “তৃতীয় পন্থা” হিসাবে মনোনীত করে।

সামাজিক এবং রাজনৈতিক জীবনের একটি অন্যতম সুস্পষ্ট সত্য হলো ক্ষণস্থায়ীর দীর্ঘায়ু। পানশালার জন্য নির্ধারিত ব্রিটিশ সময়সূচি, ফ্রেঞ্চ ভাড়া নিয়ন্ত্রণ কিংবা ওয়াশিংটনের “অস্থায়ী” সরকারি ভবন-যাদের সকলেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় তড়িঘড়ি করে “কয়েক মাসের অস্থায়ী জরুরি অবস্থা” চলাকালীন সময়ের জন্য নির্ধারণ বা নির্মাণ করা হয়েছিল, তারা সকলেই পঞ্চাশ বছর পরেও আমাদের সাথে রয়ে গেছে। একজন কার্যকর সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী এটা জানে। সে নিজেও তাৎক্ষণিকভাবে অনেক সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। কিন্তু সে প্রতিবার নিজেকে জিজ্ঞেস করে, “আমাকে যদি দীর্ঘদিন এই সিদ্ধান্তের সাথে টিকে থাকতে হয় তবে কি আমি সেটা পারব?” যদি উত্তরটি “না” হয় তবে সে আরও সাধারণ, আরও ধারণাগত এবং আরও সর্বাঙ্গীণ সমাধান খোঁজার চেষ্টা করে যা সঠিক নীতিকে অধিষ্ঠিত করে।

ফলস্বরূপ, কার্যকর কার্যনির্বাহক অনেক বেশি সংখ্যক সিদ্ধান্ত নেয় না। এমন না যে সে একটি সিদ্ধান্ত নিতে অনেক বেশি সময় লাগায়। বরং নীতির উপর ভিত্তি করে নেয়া সিদ্ধান্ত, লক্ষণ এবং যুক্তিযুক্ততার উপর ভিত্তি করে নেয়া সিদ্ধান্তের চেয়ে বেশি সময় নেয় না। আসলে একজন কার্যকর কার্যনির্বাহকের বহুসংখ্যক সিদ্ধান্ত নেবার প্রয়োজন নেই। যেহেতু সে নিয়ম এবং নীতিমালার প্রেক্ষিতে একটি সর্বজনীন সমস্যার সমাধান করে, তাই সে একটি নিয়মের অধীনে থাকা সকল ঘটনার সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারে।

একটি পুরনো আইনি প্রবাদ আছে, “যে দেশে আইন যত বেশি, সেই দেশে দক্ষ আইনজীবী তত কম।” বাস্তবে এটা হলো সেই দেশ যা প্রতিটি সমস্যাকে একটি সাধারণ আইনের আওতায় থাকা বিশেষ ঘটনা না ভেবে, অনন্য এবং অসাধারণ ভেবে সমাধান করতে চায়। একইভাবে যেই কার্যনির্বাহী অনেক সিদ্ধান্ত নিতে চায়, সে অলস এবং অকার্যকর।

একজন সিদ্ধান্ত গ্রহীতা সবসময় কোন অস্বাভাবিক কিছু ঘটছে কিনা তার লক্ষণ খোঁজার চেষ্টা করে, সে সবসময় জিজ্ঞেস করে: “ব্যাখ্যাটি কি সমস্ত পর্যবেক্ষণকৃত ঘটনাগুলোকে ব্যাখ্যা করে?” সমাধানটি কি ফলাফল আনতে পারে সেটা সে লিখে রাখে, যেমন সড়ক দুর্ঘটনা দূর করা-সমাধানটি আসলেই সড়ক দুর্ঘটনা দূর করছে কিনা সেটা সে নিয়মিতভাবে পরীক্ষা করবে। সবশেষে, কোন অস্বাভাবিক কিছু ঘটলে, যদি সে ঐ ঘটনাটিকে ব্যাখ্যা করতে অসমর্থ হয় কিংবা ঘটনা অন্য পথে গড়ায় তবে সে আবার সমস্যাটিকে নিয়ে বিস্তারিতভাবে ভাবতে শুরু করে।

এগুলো প্রকৃতপক্ষে ২ হাজার বছর আগে হিপোক্রিটাসের রেখে যাওয়া চিকিৎসাবিদ্যার মূলনীতি। এরপর প্রথমে এরিস্টটল দ্বারা ব্যাখ্যকৃত এবং পরবর্তীতে মাত্র চারশ বছর আগে গ্যালিলিও দ্বারা পুনর্নিশ্চিত বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণের নীতিতে পরিণত হয়। অন্য ভাবে বলতে গেলে, এগুলো পুরানো, সুপরিচিত, সময়-পরীক্ষিত নিয়ম যা যে কেউ শিখে পদ্ধতিগতভাবে প্রয়োগ করতে পারবে।


কার্যকর সিদ্ধান্ত-গ্রহণ প্রক্রিয়ার দ্বিতীয় উপাদান


২। সিদ্ধান্ত প্রক্রিয়ার দ্বিতীয় প্রধান উপাদানটি হলো-সিদ্ধান্তটি কোন ফলাফল অর্জন করবে তা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা। এই সিদ্ধান্তটি গ্রহণের উদ্দেশ্য কী? কোন ন্যূনতম লক্ষ্যগুলো সিদ্ধান্তটি দ্বারা অর্জিত হতে হবে? একে কোন শর্তগুলো পূরণ করতে হবে? বিজ্ঞানে এদের সীমারেখা শর্ত (নড়ঁহফধৎু পড়হফরঃরড়হং) বলে। একটি সিদ্ধান্তকে কার্যকর হতে হলে এই সীমারেখা শর্তগুলোকে পূরণ করতে হবে। একে নিজের লক্ষ্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে।

এই সীমারেখা শর্তগুলোকে যত সংক্ষিপ্তভাবে এবং পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করা হবে, সিদ্ধান্তটি তত বেশি কার্যকর এবং উদ্দেশ্য পূরণে সফল হবে। বিপরীতভাবে, একটি সিদ্ধান্ত যতই চমৎকার হোক না কেন, এই শর্তগুলো সঠিকভাবে ব্যাখা করা না হলে সেটা অকার্যকর বলে প্রমাণিত হবে।

“এই সমস্যাটি সমাধানের জন্য ন্যূনতম কী করা প্রয়োজন?”-এইরূপে সীমারেখা সিদ্ধান্তগুলোকে সাধারণত ব্যাখ্যা করা হয়। “বিভাগীয় প্রধানদের অপসারণ করে,” আলফ্রেড পি. স্লোয়ান ১৯২২ সালে জেনারেল মটরসের দায়িত্ব নিয়ে প্রথমে এই প্রশ্নটি জিজ্ঞেস করেছিলেন, “আমাদের চাহিদা কি পূরণ করা সম্ভব?” তার উত্তরটি অবশ্যই নেতিবাচক ছিল। প্রধান অপারেটিং পদে শক্তি এবং দায়িত্বের উপস্থিতি ছিল তার সমস্যার সীমারেখা শর্ত। কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ এবং একতার পাশাপাশি এটাও সমানভাবে দরকার ছিল। এক্ষেত্রে সীমারেখা শর্ত, ব্যক্তিত্বের সমন্বয়ের পরিবর্তে কাঠামোগত সমস্যার সমাধান দাবি করেছিল। এ কারণেই তার সমাধান দীর্ঘস্থায়ী হয়েছিল।

উপযুক্ত সীমারেখা শর্ত খুঁজে পাবার কাজটি সবসময় সহজ হয় না এবং বুদ্ধিমান ব্যক্তিরা সবসময় এতে সম্মতও হন না।

পাওয়ার ব্ল্যাকআউটের পরদিন সকালে একটি নিউ ইয়র্ক সংবাদপত্র প্রকাশিত হতে পেরেছিল: দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস। সংবাদপত্রটি তৎক্ষণাৎ তাদের কার্যক্রম হাডসন নদীর অপরপ্রান্তের নিউ জার্সির নিউওয়ার্কে (ঘবধিৎশ) স্থানান্তর করেছিল যেখানে পাওয়ার প্ল্যান্টগুলো সচল ছিল। সেখানে দ্য নিউওয়ার্ক ইভেনিং নিউজ (ঞযব ঘবধিৎশ ঊাবহরহম ঘবংি) নামক একটি স্থানীয় সংবাদপত্রের একটি বৃহৎ ছাপাখানা ছিল। কিন্তু নিউ ইয়র্ক টাইমসের অর্ডার করা দশ লাখ কপির অর্ধেকেরও কম পাঠকের কাছে পৌঁছেছিল। জনশ্রুতি আছে, টাইমস ছাপাখানায় যাবার পরপরই নির্বাহী সম্পাদক এবং তার তিনজন সহকারী একটি শব্দের সঠিক বানান নিয়ে তর্ক শুরু করে। তাদের সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে ৪৮ মিনিট সময় লাগে যা ছিল মোট ছাপার সময়ের অর্ধেক। টাইমসের সম্পাদক বলেছিলেন, দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস, যুক্তরাষ্ট্রে ইংরেজি বানানের আদর্শ হিসাবে পরিচিত, আর তাই তারা বানান ঘটিত ভুল করতে পারে না।

ঘটনাটির সত্য কিনা আমার জানা নেই। কিন্তু গল্পটিকে যদি সত্যি বলে ধরে নেই, তবে ভাবতে হয় টাইমসের ব্যবস্থাপনা কমিটি এই সিদ্ধান্তটিকে কেমন ভাবে দেখেছিল। তবে এতে কোন সন্দেহ নেই যে, নির্বাহী সম্পাদকের মৌলিক অনুমান এবং উদ্দেশ্য বিবেচনায় সিদ্ধান্তটি সঠিক ছিল। স্পষ্টতই তার সীমারেখা শর্ত পরদিন সকালে দশ লাখ কপি ছাপানো ছিল না, বরং তার লক্ষ্য ছিল আমেরিকার ব্যাকরণের অগ্রদূত হিসাবে টাইমসের সুনাম ধরে রাখা।

কার্যকর কার্যনির্বাহী জানে যেই সিদ্ধান্ত সীমারেখা শর্তকে সন্তুষ্ট করতে পারে না সেটা অকার্যকর এবং অনুপযুক্ত। এটা ভুল সীমারেখা শর্তকে সন্তুষ্ট করা সিদ্ধান্তের চাইতেও ক্ষতিকর। দুটি বিষয়ই ভুল, তবে ভুল সীমারেখা শর্ত থেকে সঠিক সিদ্ধান্তটিকে সরিয়ে আনা সম্ভব। কারণ সিদ্ধান্তটি তখনো তার কার্যকারিতা হারায়নি। কিন্তু সীমারেখার শর্তের অনুপযুক্ত সিদ্ধান্ত থেকে কিছুই পাওয়া যায় না।

বস্তুত, একটি সিদ্ধান্ত কখন পরিত্যাগ করতে হবে সেটা বোঝার জন্য সীমারেখা শর্ত সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা থাকা আবশ্যক।

এর দুটি বিখ্যাত দৃষ্টান্ত বিদ্যমান-একটি হলো সিদ্ধান্ত যেখানে সীমারেখা শর্ত বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছে এবং অপরটি হলো একটি সিদ্ধান্ত যেখানে সীমারেখা সিদ্ধান্ত এতটাই স্পষ্ট যে একটি নতুন এবং উপযুক্ত নীতিমালা দ্বারা তৎক্ষণাৎ ভাবে ভুল সিদ্ধান্তটি পরিবর্তন করা সম্ভব হবে।

প্রথমটির উদাহরণ হলো, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মান সেনাদক্ষদের বিখ্যাত স্লিফেন প্ল্যান। এই পরিকল্পনার উদ্দেশ্য ছিল পূর্ব ও পশ্চিমে তাদের সেনাবাহিনী বিচ্ছিন্ন না করেই, একসাথে পূর্ব ও পশ্চিম উভয়ের বিরুদ্ধে জার্মানিকে যুদ্ধ করতে সক্ষম করা। এটা সম্পাদন করতে, স্লিফেন প্ল্যান প্রস্তাব করেছিল দুর্বল শত্রু, অর্থাৎ রাশিয়ার বিরুদ্ধে প্রতীকী বিরোধিতা দেখিয়ে সমস্ত শক্তি ফ্রান্সকে দ্রুত পরাস্ত করায় নিয়োজিত করা এবং এরপর ফ্রান্স দখল শেষে রাশিয়ার সাথে মোকাবিলা করা। এর মানে হলো যুদ্ধের প্রথম থেকে শুরু করে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে নির্ধারিত জয়ের আগ পর্যন্ত রাশিয়ান সেনাবাহিনীকে জার্মান অঞ্চলের মোটামুটি গভীরে প্রবেশ করতে দেয়া। কিন্তু ১৯১৪ সালের আগস্টে এটা প্রতীয়মান হয় যে, রাশিয়ান সেনাবাহিনী অগ্রযাত্রার গতিকে খাটো করে দেখা হয়েছে। পূর্ব প্রসিয়ার যেসকল জমিদারদের সম্পত্তি রাশিয়ানদের দখলে চলে গিয়ে ছিল তারা তখন নিরাপত্তার জন্য মরিয়া হয়ে পড়ে।

স্লিফেন নিজে স্পষ্টভাবে সীমারেখা শর্তের কথা মাথায় রেখেছিলেন। কিন্তু তার উত্তরসূরিগণ সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী এবং কৌশলবিদের পরিবর্তে প্রযুক্তিবিদ ছিলেন। তারা স্লিফেন প্ল্যানের মূল শর্ত-জার্মান বাহিনীকে অবিচ্ছিন্ন রাখার শর্তকেই পরিত্যাগ করেছিল। সেসময় তাদের এই পরিকল্পনাকে বর্জন করা উচিত ছিল। কিন্তু তার পরিবর্তে তারা এই পরিকল্পনাটি ধরে রেখে তার সফলতাকে অসম্ভব করে ফেলেছিল। তারা পশ্চিমের সেনাবাহিনীকে দুর্বল করে সেখানে তাদের প্রাথমিক বিজয় থেকে পুরোপুরি বঞ্চিত করেছিল, অথচ তারা পূর্বে সেনাবাহিনীকে রাশিয়ানদের পরাস্ত করার মতো শক্তিশালী করে তোলেনি। ফলে তারা সেই কাজটিই করেছিল যা প্রতিরোধ করতে স্লিফেন প্ল্যানের নকশা করে হয়েছিল-আসন্ন যুদ্ধে অচলাবস্থা, যেখানে কৌশলের শ্রেষ্ঠত্বের চেয়ে জনশক্তির শ্রেষ্ঠত্বকে শেষ পর্যন্ত জিততে হত। কিন্তু কৌশলের পরিবর্তে তারা বিভ্রান্তি এবং সিদ্ধান্তহীনতার বেড়াজালে আটকা পড়ে কোন অলৌকিক ঘটনার অপেক্ষা করছিল।

এর বিপরীত উদাহরণ হলো: ১৯৩৩ সালে রাষ্ট্রপতি হবার সময় ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্টের পদক্ষেপ। তার প্রচারণার পুরো সময়ে রুজভেল্ট অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের জন্য একটি পরিকল্পনা করেছিলেন। ১৯৩৩ সালে এমন একটি পরিকল্পনা কেবল আর্থিক রক্ষণশীলতা এবং একটি সুষম বাজেটের মাধ্যমেই করা সম্ভব ছিল। তারপরে, এফডিআর উদ্বোধনের ঠিক আগে, ব্যাঙ্ক হলিডেতে অর্থনীতিটি ধসে পড়ে। অর্থনৈতিক নীতি তখনও হয়তো অর্থনৈতিকভাবে কাজ করছিল। তবে এটি স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে রাজনৈতিকভাবে সেখানে টিকে থাকা সম্ভব হবে না।

রুজভেল্ট অবিলম্বে একটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য দ্বারা তার প্রাক্তন অর্থনৈতিক লক্ষ্যকে প্রতিস্থাপন করেন।

তিনি পুনরুদ্ধার থেকে সংশোধনের দিকে চলে আসেন। নতুন বিবরণীর জন্য রাজনৈতিক গতিশীলতার চাহিদা দেখা দেয়। এটা, অর্থনৈতিক নীতিতে, প্রায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে, রক্ষণশীলতার পরিবর্তে একটি নতুন মৌলিক উদ্ভাবনের দিকে পরিচালিত করে। সীমারেখা শর্তগুলো পরিবর্তিত হয়েছিল-তাই রুজভেল্টের মতো একজন সিদ্ধান্ত গ্রহীতা প্রায় স্বজ্ঞাতভাবেই বুঝেছিলেন যে এর অর্থ হলো-কার্যকারিতা পেতে হলে তাকে তার মূল পরিকল্পনা সম্পূর্ণরূপে বর্জন করতে হবে।

তবে সমস্ত সম্ভাব্য সিদ্ধান্তের মধ্যে সবচেয়ে বিপজ্জনকটি চিহ্নিত করতেও সীমারেখা শর্ত সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা থাকা আবশ্যক। এটা এমন একটা সিদ্ধান্ত যা সমস্ত পরিকল্পনা ভেস্তে গেলেও ‘হয়তো’ কাজ করবে। এই সিদ্ধান্তগুলো সবসময়ই যুক্তিসঙ্গত। কিন্তু শর্তগুলো নিয়ে ভাবতে গেলে দেখা যাবে তারা আসলে পরস্পরের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। মনে হবে এমন একটি সিদ্ধান্ত সফল হওয়া অসম্ভব ব্যাপার। অলৌকিকের সমস্যা এটা নয় যে তাদের ঘটার সম্ভাবনা বিরল, বরং এটা যে তাদের উপর ভরসা করা যায় না।

একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ হলো ১৯৬১ সালে রাষ্ট্রপতি কেনেডির বে অফ পিগস সিদ্ধান্ত। সেখানে একটি পরিষ্কার শর্ত ছিল কাস্ত্রোর উচ্ছেদ। কিন্তু আরেকটি উল্লেখযোগ্য শর্ত ছিল আমেরিকান প্রজাতন্ত্রের একটিতে মার্কিন বাহিনী হস্তক্ষেপ করছে, এটা বুঝতে না দেয়া। দ্বিতীয় শর্তটি আসলে অযৌক্তিক ছিল। তাছাড়া পৃথিবীর কেউই এক মুহূর্তের জন্য আক্রমণটিকে  কিউবানদের স্বতঃস্ফূর্ত উত্থান বলে বিশ্বাস করত না। আমেরিকান নীতিনির্ধারকদের কাছে তখন নিরবিরোধী থাকাকে একটি বৈধ এবং প্রয়োজনীয় শর্ত বলে মনে হয়েছিল। তবে এই দুটি শর্ত একে অপরের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে পারত যদি তাৎক্ষণিকভাবে কাস্ত্রোর বিরুদ্ধে একটি বিদ্রোহ, কিউবার সেনাবাহিনীকে পুরোপুরি পঙ্গু করে দিত। একটি পুলিশ শাসিত রাজ্যে এমন কিছু অসম্ভব না হলেও, সেটা ঘটার সম্ভাবনাও ছিল বিরল। হয় পুরো ধারণাটি বর্জন করা উচিত ছিল কিংবা আক্রমণের সাফল্য নিশ্চিত করার জন্য আমেরিকান পূর্ণ সমর্থন নিশ্চিত করা উচিত ছিল। এই কথা বলা অসম্মানজনক নয় যে, রাষ্ট্রপতি কেনেডির ভুল “বিশেষজ্ঞদের কথা শোনা” ছিল না। আসলে তার ভুল ছিল সিদ্ধান্তটির সকল সীমারেখা শর্ত সম্পর্কে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে চিন্তা না করা এবং কোন সিদ্ধান্তের দুটি ভিন্ন এবং বেমানান শর্তকে পূরণের চিন্তা আসলে সিদ্ধান্ত নয় বরং অলৌকিকের প্রার্থনা-এই অপ্রীতিকর বাস্তবতা মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানানো।

তবুও গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে “তথ্যের” উপর ভিত্তি করে শর্তগুলোকে নির্ধারণ এবং ব্যাখ্যা করা যাবে না। এই কাজটি ব্যাখ্যার আলোকে করতে হয়। এটা একটা ঝুঁকিমূলক বিবেচনা।

যেকেউ ভুল সিদ্ধান্ত নিতে পারে। আসলে সবাই কোন না কোন সময় ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। কিন্তু কারোই এমন সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত নয় যেটা সীমারেখা শর্ত পূরণে পুরোপুরি ব্যর্থ।


কার্যকর সিদ্ধান্ত-গ্রহণ প্রক্রিয়ার তৃতীয় উপাদান


৩। কোনটি গ্রহণযোগ্য (কে সঠিক) এই চিন্তার বদলে কোনটি সঠিক-এই ধারণা নিয়ে কাজ শুরু করার উচিত। কারণ শেষ পর্যন্ত সবাইকেই আপস করতে হয়। কিন্তু সীমারেখা শর্ত পূরণে কোনটি সঠিক সেটা কেউ জানে না, কেউ যদি সঠিক এবং ভুল আপসের মাঝে পার্থক্য বুঝতে না পারে, তবে সে শেষ পর্যন্ত ভুল আপসটি করবে। [সবসময় ব্যক্তির চেয়ে সমাধানের দিকে নজর দিন। কে কোন কথা বলল, তা চিন্তা করার চেয়ে সমাধান কী কার্যকর কিনা তা চিন্তা করুন।]

১৯৪৪ সালে আমার প্রথম বড় কনসাল্টিং এসাইনমেন্টে আমি এটা শিখেছি। কাজটা ছিল জেনারেল মটরস কর্পোরেশনের ব্যবস্থাপনা নীতি এবং ব্যবস্থাপনা কাঠামো গবেষণা। কাজের শুরুতে প্রতিষ্ঠানের তৎকালীন চেয়ারম্যান এবং প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আলফ্রেড পি. স্লোয়ান জুনিয়র আমাকে তাঁর অফিসে ডেকে বলেছিলে: “কী পর্যবেক্ষণ করতে হবে, কী লিখতে হবে বা কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে হবে, সেটা আপনাকে আমি বলব না। আমার একমাত্র নির্দেশ হলো আপনি যেমনটা দেখছেন সেটাই লেখা। আমাদের প্রতিক্রিয়া নিয়ে দুশ্চিন্তা করবেন না। আমাদের পছন্দ-অপছন্দ নিয়ে ভাববেন না। সর্বোপরি, আপনার সুপারিশ গ্রহণযোগ্য করতে আমাদের কি ধরনের আপস করতে হবে সেটা নিয়েও চিন্তা করবেন না। আপনার সাহায্য ছাড়াও এই কোম্পানির প্রত্যেক কার্যনির্বাহী যেকোন ধরনের যৌক্তিক আপস করতে সদা প্রস্তুত। কিন্তু আপনি “সঠিক” বলতে কী বোঝাচ্ছেন সেটা তাদের বলে না দিলে তারা সেই “সঠিক” আপসটি করতে পারবে না।” একজন সিদ্ধান্ত গ্রহণে নিয়োজিত কার্যনির্বাহকের উচিত এই কথাগুলো লোহার ফলকে খোদাই করে রাখা।

রাষ্ট্রপতি কেনেডি বে অফ পিগসের ব্যর্থতা থেকে এই শিক্ষাটি পেয়েছিলেন। এই কারণেই তিনি দু বছর পর কিউবান মিসাইল সংকট মোকাবিলায় সফল হয়েছিলেন। তার দৃঢ়ভাবে সিদ্ধান্তের সকল সীমারেখা শর্ত বিবেচনার সংকল্প এবং কোন আপসগুলো করতে হবে (যেমন-বিমান পর্যবেক্ষণ, অন-দ্য-গ্রাউন্ড পর্যবেক্ষণের প্রয়োজনীয়তা স্পষ্টভাবে নাচক করার পর, আমেরিকার সেই দাবি পরিত্যাগ) সেই সম্পর্কিত জ্ঞান এবং কোন বিষয়গুলোর উপর জোর দিতে হবে (সোভিয়েত মিসাইলগুলোকে নিজেরা ধ্বংস করে সেগুলো রাশিয়ায় ফেরত পাঠানো) সেই উপলব্ধি এই সফলতার পিছনে দায়ী।


দুই ধরনের আপস


আপস দু ধরনের। একটিকে পুরনো একটি প্রবাদ দিয়ে ব্যক্ত করা যায়, “নাই-মামার চাইতে কানা-মামা ভালো।” (ঐধষভ ধ ষড়ধভ রং নবঃঃবৎ ঃযধহ হড় নৎবধফ)। অপরটিকে সলোমনের বিচারের গল্প দিয়ে ব্যক্ত করা যায়। এই গল্পের প্রতিপাদ্য বিষয় হলো,

“অর্ধেক শিশুর চেয়ে , শিশু না পাওয়াই উত্তম।” (যধষভ ধ নধনু রং ড়িৎংব ঃযধহ হড় নধনু ধঃ ধষষ)। প্রথম উদাহরণে সীমারেখা শর্তগুলো পূরণ হচ্ছে। মামা না থাকার চেয়ে, একজন কানা মামার উপস্থিতি এখানে কাম্য লক্ষ্যকে পূরণ করছে। কিন্তু একটি অর্ধেক মানব শিশু এখানে সীমারেখা শর্তকে সন্তুষ্ট করতে ব্যর্থ। কারণ একটি অর্ধ মানব শিশু আসলে একটি দ্বিখ-িত লাশ মাত্র।

কোন কাজটি গ্রহণ যোগ্য হবে আর কোনটি বাধার মুখে বলা যাবে না-সেটা নিয়ে ভাবা অনর্থক। যেগুলো নিয়ে দুশ্চিন্তা করা হয় সেগুলো কখনোই ঘটে না। আর যেই আপত্তি এবং সমস্যাগুলো নিয়ে কেউ কোনদিন চিন্তাও করেনি, দেখা যাবে সেগুলোই হঠাৎ দুর্গম বাধায় রূপ নিয়েছে। “কোনটি গ্রহণযোগ্য?” এই প্রশ্ন দিয়ে কাজ শুরু করে কোন ফল পাওয়া যায় না। বরং এর উত্তর খুঁজতে গিয়ে মূল্যবান সময় ও সুযোগের অপচয় ঘটে এবং শেষ পর্যন্ত উত্তরটিও খুঁজে পাওয়া যায় না।


কার্যকর সিদ্ধান্ত-গ্রহণ প্রক্রিয়ার চতুর্থ উপাদান


৪। সিদ্ধান্তকে পদক্ষেপে পরিণত করা সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ার চতুর্থ প্রধান উপাদান। সীমারেখা শর্ত নির্ধারণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ার সবচেয়ে কঠিন ধাপ হলে, সিদ্ধান্তকে পদক্ষেপে পরিণত করা-এর সবচেয়ে সময়সাপেক্ষ ধাপ। অথচ সিদ্ধান্ত নেবার শুরতেই সিদ্ধান্তটি কার্যকর করার পদক্ষেপ নির্বাচন না করলে সিদ্ধান্তটি কার্যকারিতা হারাবে।

আসলে বাস্তব ক্ষেত্রে কাজে লাগানো না গেলে কোন সিদ্ধান্তই আসলে প্রকৃত সিদ্ধান্ত বলে গণ্য হবে না। সেগুলো কেবলই ভালো উদ্দেশ্য।

বেশির ভাগ নীতিমালার, বিশেষ করে ব্যবসায়িক নীতিমালার মূল সমস্যা হলো: সেখানে পদক্ষেপের কোন প্রতিশ্রুতি নেই। পদক্ষেপটি কে নিবে, দায়িত্বটি কার সে সম্পর্কে কোন সুস্পষ্ট নির্দেশনা নেই। এ কারণেই প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা এই নীতিমালাগুলোকে গুরুত্বের সাথে দেখে না।

সিদ্ধান্তকে কর্মে রূপান্তর করতে হলে কিছু সুনির্দিষ্ট প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে: কাকে এই সিদ্ধান্তটি জানাতে হবে? কোন পদক্ষেপ নিতে হবে? কে এই পদক্ষেপটি নেবে? আর পদক্ষেপটি কেমন হলে দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি কাজটি করতে সক্ষম হবে? প্রথম এবং শেষ প্রশ্নটি বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই উপেক্ষা করা হয় যার ফলাফল হয় ভয়াবহ।

কর্ম গবেষকদের (ড়ঢ়বৎধঃরড়হং ৎবংবধৎপযবৎং) মাঝে কিংবদন্তীতে পরিণত হওয়া একটি গল্প “কাকে জানাতে হবে?” এই প্রশ্নটি গুরুত্বের উপর আলোকপাত করে। শিল্প যন্ত্রপাতি প্রস্তুতকারক একটি বৃহৎ প্রতিষ্ঠান কয়েক বছর আগে একটি মেশিনের মডেলকে বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয়। অনেক বছর যাবৎ এই মেশিনটিকে স্ট্যান্ডার্ড মেশিন হিসাবে ধরা হত এবং এর সমসাময়িক অন্য মেশিনগুলো তখনো ব্যবহার করা হচ্ছিল। সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল যে এই পুরনো মেশিনের বর্তমান মালিকদের কাছে আরও তিন বছর প্রতিস্থাপন হিসাবে মেশিনটি বিক্রি করা হবে, এরপর মেশিনটি নির্মাণ এবং বিক্রয় একেবারেই বন্ধ করে দেয়া হবে। অনেক বছর ধরেই এই মডেলের মেশিনটির অর্ডার কমে আসছিল। কিন্তু যখন পুরনো ক্রেতারা জানতে পারে যে মডেলটি আর বিক্রি করা হবে না তখন তারা তড়িঘড়ি করে মডেলটি অর্ডার দিতে শুরু করে। ফলে মডেলটির চাহিদা হুট করেই বেড়ে যায়। কিন্তু কেউ তখন জিজ্ঞেস করেনি: “এই সিদ্ধান্তটি কাকে জানানো উচিত?” আর তাই এই মডেলটির যন্ত্রাংশ কেনার দায়িত্বে থাকা কর্মী বিষয়টি সম্পর্কে অজ্ঞাত ছিল। তাকে বর্তমান বিক্রয় হারের উপর ভিত্তি করে যন্ত্রাংশ কেনার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল এবং পরবর্তীতে সেই নির্দেশ পরিবর্তন করা হয়নি। যখন মডেলটি নির্মাণ বন্ধ করার সময় আসে তখন প্রতিষ্ঠানের গুদামে আরও ৮ থেকে ১০ বছর ধরে মডেলটি তৈরি করার মতো যন্ত্রাংশ রয়ে গিয়েছিল। ফলে তারা অত্যন্ত ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছি।

কাজটিকে অবশ্যই দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিদের সামর্থ্যরে মধ্যে হতে হবে।

একটি কেমিক্যাল কোম্পানি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পশ্চিম আফ্রিকার দুটি দেশে বিপুল পরিমাণে নিজেদের মুদ্রা অবরুদ্ধ অবস্থায় পেয়েছিল। এই অর্থকে রক্ষার জন্য তারা স্থানীয় ব্যবসায় নিজেদের অর্থ বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। এই বিনিয়োগ স্থানীয় অর্থনীতিতে অবদান রাখবে এবং বাইরে থেকে কোন আমদানিও করতে হবে না। আর যদি ব্যবসাটি সফল হয়, তবে কারেন্সি রেমিট্যান্স পুনরায় চালু হলে সেটা স্থানীয় বিনিয়োগকারীদের কাছে বিক্রয় করা যাবে। এই ব্যবসা প্রতিষ্ঠার জন্য কোম্পানিটি একটি গ্রীষ্মম-লীয় ফল সংরক্ষণের জন্য একটি সাধারণ রাসায়নিক প্রক্রিয়া গঠন করে। ফলটি উভয় দেশেরই অন্যতম প্রধান ফসল ছিল এবং তখন অবধি পশ্চিমা বাজারগুলোতে ট্রানজিটের সময় মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছিল।

ব্যবসাটি উভয় দেশেই সফল হয়েছিল। কিন্তু একটি দেশে স্থানীয় ম্যানেজার ব্যবসাটিকে এমনভাবে সাজিয়েছিল যে সেখানে উচ্চ দক্ষতা এবং প্রযুক্তিগতভাবে প্রশিক্ষিত ব্যবস্থাপক দলের প্রয়োজন পড়ে। কিন্তু পশ্চিম আফ্রিকায় এমন লোক পাওয়া সহজ ছিল না। অন্য দেশের স্থানীয় ম্যানেজার সেখানের লোকদের সামর্থ্য (যাদের হাতেই একসময় ব্যবসাটি তুলে দেয়া হবে) বিচার করে তার ব্যবসা সাজিয়েছিল। সে ব্যবসা ও প্রস্তুত প্রণালী সহজ করার জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করেছিল এবং ব্যবসার শীর্ষ পর্যন্ত সকল পদে স্থানীয় লোকদের নিয়োগের ব্যবস্থা করেছিল।

কয়েক বছর পর দু দেশের মাঝে কারেন্সি ট্রান্সফার আবার শুরু হয়। ততদিনে ব্যবসাটি সুপ্রতিষ্ঠিত হলেও প্রথম দেশে ব্যবসাটি কেনার মতো কেউ ছিল না। স্থানীয় কারোই ব্যবসাটির দায়িত্ব নেবার মতো ব্যবস্থাপনা ও প্রযুক্তিগত দক্ষতা ছিল না। তাই ব্যবসাটিকে লোকসানে বন্ধ করে দিতে হয়েছিল। দ্বিতীয় দেশে অনেক স্থানীয় উদ্যোক্তা ব্যবসাটি কেনায় আগ্রহ দেখায় এবং কোম্পানিটি তার মূল বিনিয়োগের চাইতে অধিক লাভে ব্যবসাটি বিক্রয় করতে সক্ষম হয়।

উভয় জায়গায় প্রক্রিয়া এবং এর উপর নির্মিত ব্যবসায়টি মূলত একই রকম ছিল। তবে প্রথম দেশে কেউ প্রশ্ন করেনি: “এই সিদ্ধান্ত কার্যকর করার মতো লোক কি আমাদের আছে? এবং তারা কী করতে পারে?”

ফলস্বরূপ, সিদ্ধান্তটি অকার্যকর হয়।

সিদ্ধান্তকে কার্যকরী পদক্ষেপে পরিণত করার জন্য মানুষকে আচরণ, অভ্যাস বা দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে হয়, তখন এই বিষয়গুলো দ্বিগুণ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীকে কার্যক্রমের দায়িত্ব পরিষ্কারভাবে বণ্টনের পাশাপাশি এটাও নিশ্চিত করতে হয় যে যাদের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে তারা সেটা পালনের যোগ্য কিনা। তাকে নিশ্চিত করতে হয় যে তাদের পদক্ষেপ, তাদের সাফল্যের মাপকাঠি এবং তাদের উদ্দীপনা একই সাথে পরিবর্তন হয়েছে। তা না হলে তারা  অভ্যন্তরীণ মানসিক দ্বন্দ্বে পক্ষাঘাতগ্রস্থ হয়ে পড়বে।

বেল সিস্টেমের ব্যবসাকে সেবায় পরিণত করার যে সিদ্ধান্ত থিওডোর ভেইল নিয়েছিলেন তা পরিমাপের নতুন মাপকাঠি নির্ধারণ করা না হলে পরিকল্পনাটি ব্যর্থতায় পর্যবসিত হত। কিন্তু ভেইল এই কাজে তার ম্যানেজারদের দক্ষতা পরিমাপের একটি নতুন মানদ-ের নকশা করেছিলেন। আগে বেল ম্যানেজারদের তাদের ইউনিট বিক্রির মুনাফার ভিত্তি অথবা খরচের পর কত আয় হয় তার ভিত্তিতে বিচার করা হত। নতুন মাপকাঠির কারণে তারা নতুন উদ্দেশ্যকে দ্রুত আয়ত্ত্ব করতে পেরেছিল।

এর বিপরীত হলো একজন প্রতিভাবান চেয়ারম্যান এবং নির্বাহীর সাম্প্রতিক ব্যর্থতা যিনি একটি পুরানো, বৃহত্তর এবং গর্বিত আমেরিকান কোম্পানিতে নতুন প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ও উদ্দেশ্য উপস্থাপন করতে চেয়েছিলেন। পরিবর্তনগুলো প্রয়োজন, এই বিষয়ে প্রত্যেকেই একমত হয়েছিল। অনেক বছর যাবৎ নিজ ক্ষেত্রে শীর্ষ অবস্থানে থাকার পর কোম্পানিটিতে বয়সের ছাপ পড়েছিল। ছোট বড় সব ক্ষেত্রেই নতুন এবং আক্রমণাত্মক প্রতিদ্বন্দ্বীর আবির্ভাব ঘটেছিল। কিন্তু নতুন ধারণাগুলোর জন্য গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করতে সেই চেয়ারম্যান সর্বাধিক দৃশ্যমান এবং সর্বাধিক বেতনের পদে পুরাতনের সবচেয়ে বড় সমর্থকদের পদোন্নতি দিয়েছিলেন-বিশেষত তিনটি নতুন কার্যনির্বাহী উপ-রাষ্ট্রপতি পদে। প্রতিষ্ঠানের লোকদের কাছে এর একটিই অর্থ ছিল: “তারা আসলে মন থেকে কথাগুলো বলছে না।”

নতুন কার্যক্রমের জন্য যা প্রয়োজন, তার বিপরীতে আচরণের জন্য যদি সর্বাধিক পুরস্কার দেওয়া হয়, তবে সবাই এটাই ভাববে যে শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিগণ এই বিপরীত আচরণই প্রত্যাশা করে এবং এর জন্য পুরস্কৃত করে।

ভেইল যা করেছেন তা সবাই পারবে না। তিনি যেমন তার সিদ্ধান্তের মাঝেই সিদ্ধান্তকে কর্মে রূপান্তরিত করার পন্থা বের করেছিলেন সেটা সবার দ্বারা সম্ভব নয়। কিন্তু কোন নির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত কার্যকর করার জন্য কোন কোন পদক্ষেপগুলো নেয়া উচিত এবং কাদের সেই পদক্ষেপগুলো নেয়া উচিত সেটা সবাই ভেবে বের করতে পারে।


কার্যকর সিদ্ধান্ত-গ্রহণ প্রক্রিয়ার পঞ্চম উপাদান


৫। অবশেষে, সিদ্ধান্তের বিষয়ে একটি প্রতিক্রিয়া তৈরি করতে হবে যাতে সিদ্ধান্তের আওতায় থাকা প্রত্যাশাগুলোর প্রকৃত ঘটনার সাপেক্ষে নিয়মিতভাবে পরীক্ষা করা যায়।

মানুষ সিদ্ধান্ত নেয়। মানুষ মাত্রই ভুল করে। তাদের সেরা কাজটাও দীর্ঘস্থায়ী হয় না। তাদের সেরা সিদ্ধান্তটাও ভুল হবার উচ্চ সম্ভাবনা থাকে। এমনকি সবচেয়ে কার্যকর সিদ্ধান্তটিও একসময় অচল হয়ে যায়।

এর যদি প্রমাণ দরকার হয়, তবে ভেইল এবং স্লোয়ানের সিদ্ধান্ত সেটা সরবরাহ করবে। তাদের কল্পনাশক্তি এবং সাহস সত্ত্বেও, ভেইলের শুধু একটি সিদ্ধান্ত-ব্যবসা হলো পরিষেবা-এখনও কার্যকর। পঞ্চাশের দশকে এটিঅ্যান্ডটি কমন শেয়ারের বিনিয়োগ চরিত্রে মারাত্মক পরিবর্তন আসে। এর পিছনে পেনশন ট্রাস্ট এবং মিউচয়াল ফান্ডের মতো প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগের উত্থান দায়ী যা মধ্যবিত্তদের বিনিয়োগের নতুন ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছিল।

বেল ল্যাবগুলো তাদের প্রভাবশালী অবস্থান বজায় রাখলেও, নতুন বৈজ্ঞানিক এবং প্রযুক্তিগত উন্নয়ন-বিশেষত মহাকাশ প্রযুক্তি এবং লেজার ডিভাইস এটা যুক্তিসঙ্গতভাবে স্পষ্ট করে দেখিয়ে দিয়েছিল যে কোন যোগাযোগ সংস্থা যত বড়ই হোক না কেন, কেবল নিজস্ব প্রযুক্তিগত এবং বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার দ্বারা বেশিদূর আগাতে পারবে না। একই সাথে প্রযুক্তির বিকাশের কারণে পঁচাত্তর বছরে প্রথমবারের মতো এই সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল যে নতুন টেলিযোগাযোগ প্রক্রিয়া, টেলিফোনের সাথে ব্যাপক আকারে প্রতিযোগিতা করবে। তাছাড়া বৃহৎ যোগাযোগের ক্ষেত্রে, উদাহরণস্বরূপ, তথ্য এবং তথ্য যোগাযোগ ক্ষেত্রে কোন একটি যোগাযোগ মাধ্যম আধিপত্য বজায় রাখতে পারবে না। ভেইল যেমনটা ভেবেছিলেন তেমনভাবে তো নয়ই। আর বেসরকারি মালিকানাধীন টেলিযোগাযোগ সংস্থার অস্তিত্বের জন্য বিধিমালার প্রয়োজন থাকলেও (আলাদা প্রদেশভিত্তিক যেই বিধিমালা কার্যকর করার জন্য ভেইল অক্লান্ত পরিশ্রম করেছিলেন), সেই বিধিমালা জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটের বাস্তবতার কাছে দিন দিন অনুপযুক্ত হয়ে উঠছে। তবে বেল সিস্টেম, ফেডারেল সরকার কর্তৃক প্রদান করা অনিবার্য এবং প্রয়োজনীয় বিধিমালা নিয়ে ভাবেনি। বরং তারা সেটাকে বিলম্বিত করার জন্য সেই কাজগুলো করেছিল-যা ভেইল সতর্কভাবে এড়িয়ে চলতেন।

স্লোয়ানের জেনারেল মটরসকে বিকেন্দ্রীকরণ এখনও টিকে থাকলেও, দ্রুতই এটা স্পষ্ট হয়ে উঠছে যে এ বিষয়ে শীঘ্রই আবার নতুনভাবে চিন্তা করতে হবে। তাঁর নকশার মূলনীতি এতবার এতভাবে পরিবর্তন এবং সংশোধন করা হয়েছে যে এখন আর সেগুলোকে চেনাই যায় না। উদাহরণস্বরূপ, স্বায়ত্তশাসিত অটোমটিভ বিভাগগুলো এখন আর তাদের উৎপাদন এবং সমাবেশ কার্যক্রম পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করে না। আর তাই তারা ফলাফলের জন্যেও পুরোপুরি দায়বদ্ধ নয়। শেভ্রোলে থেকে ক্যাডিলাক পর্যন্ত সকল গাড়ি, স্লোয়ানের মূল্য তালিকাকে আগেই পরিত্যাগ করেছে। সর্বোপরি, স্লোয়ান একটি আমেরিকান কোম্পানির নকশা করেছিলেন এবং শীঘ্রই বিদেশী অনুদান লাভ করলেও সেটা সাংগঠনিক এবং পরিচালনা কাঠামোর দিক থেকে আমেরিকান কোম্পানিই রয়ে গেছে। কিন্তু আজকের দিনে জেনারেল মটরস প্রকৃত পক্ষে একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান। এর দুর্দান্ত বৃদ্ধি এবং বড় সুযোগগুলো যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে বিশেষত ইউরোপে ক্রমবর্ধমান। কেবলমাত্র বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের একটি সঠিক নীতি এবং কাঠামো পেলেই এটা সাফল্য ও সমৃদ্ধির সাথে টিকে থাকতে পারবে। ১৯২২ সালে স্লোয়ান যা করেছিলেন সেই কাজটি আবারো করতে হবে। বিশেষত শিল্পটি অর্থনৈতিক সমস্যায় জর্জরিত হলে এই কাজটির প্রয়োজনীয়তা আরও স্পষ্ট হবে। যদি বড় আকারে দ্রুতই কাজটি করা না হয়, তবে স্লোয়ানের সেই সমাধান জেনারেল মটরসের গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়াবে।

জেনারেল আইজেনহাওয়ার যখন রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন, তখন তার পূর্বসূরি হ্যারি এস ট্রুমান বলেছিলেন: “বেচারা আইক; যখন তিনি জেনারেল ছিলেন, তখন তিনি আদেশ দিতেন এবং সেটি কার্যকর হত। এখন তিনি যেই বড় অফিসে বসতে যাচ্ছেন সেখানে আদেশ দিবেন ঠিকই, কিন্তু কিছুই ঘটবে না।”

“কিছুই ঘটবে না” এর কারণ এই নয় যে জেনারেলদের রাষ্ট্রপতির চেয়ে বেশি কর্তৃত্ব আছে। এর কারণ হলো সামরিক সংগঠনগুলো অনেক আগেই জেনেছে যে বেশির ভাগ নির্দেশই নিষ্ফল হয়। আর তাই নির্দেশ কার্যকর জন্য তারা সংগঠিত প্রতিক্রিয়ার ব্যবস্থা করেছে। তারা অনেক আগেই বুঝেছে যে নিজের চোখে দেখা প্রতিক্রিয়াই আসল প্রতিক্রিয়া। *রিপোর্ট দেখে আসলে তেমন কোন কাজ হয় না, আর এই কাজটিই রাষ্ট্রপতিরা করে থাকেন। কিন্তু সামরিক বাহিনী অনেক দিন আগেই শিখেছে যে যেই অফিসার নির্দেশ দেয়, তাকেই সেই নির্দেশ সফলভাবে কার্যকর হয়েছে কিনা সেটা নিশ্চিত করতে হয়। সে কখনো নিজের অধীনস্থদের কথার উপর ভরসা করে না, সে অন্তত নিজের বিশ্বস্ত কাউকে দিয়ে হলেও বিষয়টি পরীক্ষা করে দেখে। এমন না যে সে তার অধীনস্থদের অবিশ্বাস করে, সে নিজের অভিজ্ঞতার কারণে মুখের কথাকে অবিশ্বাস করে।

[*এটি খুব প্রাচীন সময়ে প্রতিষ্ঠিত সামরিক অনুশীলন ছিল-প্রাচীনতম চীনালিপি যেমনটা বলে, থুসিডাইডেস ও জেনোফোন দু’জনেই একে পাত্তা দেননি এবং সিজারও একই কাজ করেছিলেন।]

এ কারণেই একজন ব্যাটালিয়ন কমান্ডারের তার লোকদের পরিবেশিত খাবার আগে নিজের চেখে দেখা উচিত। সে অবশ্যই মেন্যু দেখে এটা সেটা অর্ডার দিতে পারে। কিন্তু না; তাকে মেসের হলে গিয়ে আসল হাড়ি থেকে খাবার চেখে দেখতে হবে।

কম্পিউটারের আবির্ভাবের কারণে এটা আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। কারণ সিদ্ধান্ত গ্রহীতা তখন মূল কর্মক্ষেত্র থেকে আরও দূরে সরে আসবে। বাইরের জগতে বেরিয়ে এসে কাজের অগ্রগতি না দেখলে সে বাস্তবতার সাথে সম্পর্ক হারিয়ে ফেলবে। কম্পিউটার কেবল বিমূর্ত জিনিস নিয়ে কাজ করতে পারে আর বিমূর্ত জিনিসের উপর তখনই বিশ্বাস করা যায় যখন তাদের বাস্তব কিছুর সাপেক্ষে পরীক্ষা করা হয়ে থাকে। তা না হলে তারা আমাদের কেবল বিভ্রান্তই করবে।

যেই অনুমানের উপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে সেগুলো অকাট্য নাকি অপ্রচলিত, সেটা যাচাইয়ের জন্যেও নিজের চোখে পরীক্ষা করার বিকল্প নেই। এটা ধরেই নিতে হবে যে সকল অনুমানই এক সময় অচল হয়ে পড়ে। কোনো বাস্তবতাই দীর্ঘস্থায়ী হয় না।

অযৌক্তিক এবং অচল হবার পরেও কোন কাজে লেগে থাকার পিছনে বাইরের জগতে গিয়ে দেখা এবং খোঁজার ব্যর্থতা দায়ী। ব্যবসার পাশাপাশি সরকারি নীতিমালার ক্ষেত্রেও এটা প্রযোজ্য। এক্ষেত্রে উদাহরণস্বরূপ, ইউরোপে স্ট্যালিনের যুদ্ধোত্তর নীতির ব্যর্থতা, দে গলের ইউরোপের বাস্তবতার সাথে যুক্তরাষ্ট্রের নীতিকে সামঞ্জস্যপূর্ণ করার অক্ষমতা কিংবা ব্রিটেনের ইউরোপীয় অভিন্ন বাজারের বাস্তবতা বোঝার ব্যর্থতার কথা উল্লেখ করা যায়।

প্রতিক্রিয়া জানার জন্য সুসংহত তথ্যের প্রয়োজন। প্রয়োজন রিপোর্ট এবং পরিসংখ্যান। কিন্তু বাস্তবতার সাথে সরাসরি সম্পর্কযুক্ত প্রতিক্রিয়া গঠন না করলে এবং সচক্ষে পরিস্থিতি না দেখলে মানুষ নিজেকে অকার্যকর এবং কট্টরবাদী বলে প্রমাণ করবে।

এগুলোই হলো কার্যকর সিদ্ধান্ত-গ্রহণ প্রক্রিয়ার উপাদান। কিন্তু সিদ্ধান্তটা আসলে কী হবে? (ইঁঃ যিধঃ ধনড়ঁঃ ঃযব ফবপরংরড়হ রঃংবষভ?)


অধ্যায় ৭


কার্যকরী সিদ্ধান্তসমূহ


একটি সিদ্ধান্ত হলো একটি বিবেচনা। এটা বিভিন্ন বিকল্পের মাঝে একটি বেছে নেয়ার প্রক্রিয়া। এটা কদাচিৎ ঠিক এবং ভুলের মাঝে একটি বেছে নেয়ার প্রক্রিয়া হিসাবে বিবেচিত হয়। সিদ্ধান্ত-গ্রহণকে বড়জোর “প্রায় ঠিক” এবং “হয়তো ভুল” এই দুটির মাঝে একটি নির্বাচন করার পদ্ধতি বলা যেতে পারে। কিন্তু প্রায় সবসময়ই একে দুটি কার্যধারার মাঝে একটিকে নির্বাচনের পদ্ধতি বলা হয়, যেখানে একটি অপরটির চেয়ে কিছুটা হলেও অধিকতর গ্রহণযোগ্য।

সিদ্ধান্ত গ্রহণের উপর লেখা বেশির ভাগ বই পাঠকদের বলে থাকে: “প্রথমে তথ্য সংগ্রহ করুন।” কিন্তু যেসকল কার্যনির্বাহী কার্যকরী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে তারা জানে প্রথম কাজ তথ্য সংগ্রহ নয়। প্রথম কাজ হলো মতামত। এই মতামতগুলো বস্তুত অপরীক্ষিত তত্ত্ব যা বাস্তবতার প্রেক্ষিতে প্রমাণিত না হলে সম্পূর্ণ অকার্যকর বলে বিবেচিত হবে। কোন তথ্যটি সঠিক তা যাচাইয়ের জন্য প্রথমে প্রয়োজন একটি প্রাসঙ্গিক অনুমাপক বা মানদ-। এটা কার্যকরী সিদ্ধান্ত গ্রহণের একটি গুরুতর ধাপ এবং সাধারণত এর সর্বাধিক বিতর্কিত দিক।

সবশেষে এটা বলা যায় যে, সিদ্ধান্ত গ্রহণের উপর লেখা বিভিন্ন প্রবন্ধ যেমনটা দাবি করে থাকে, কার্যকরী সিদ্ধান্ত মোটেই তেমনভাবে তথ্যের উপর একমত হওয়া থেকে শুরু হয় না। যে অনুধাবন থেকে একটি সঠিক সিদ্ধান্তকে বেছে নেয়া হয় তার উৎপত্তি ঘটে নানামুখী মতবিরোধ এবং স্বতন্ত্র বিকল্পগুলোকে গভীরভাবে বিবেচনা থেকে।

প্রথমেই তথ্য সংগ্রহ করা অসম্ভব কাজ। প্রাসঙ্গিক কোন মানদ- না থাকলে কোন তথ্যও পাওয়া সম্ভব নয়। বিচ্ছিন ঘটনা, তথ্য হতে পারে না।

পদার্থবিজ্ঞানে কোন বস্তুর স্বাদকে তথ্য হিসাবে বিবেচনা করা হয় না। এমনকি কিছুদিন আগ পর্যন্ত রঙকেও উপাত্ত হিসাবে বিবেচনা করা হত না। রান্নায় স্বাদের গুরুত্ব অপরিসীম, চিত্রাঙ্কনে রঙের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। পদার্থবিদ্যা, রন্ধনশিল্প এবং চিত্রাঙ্কন; ভিন্ন ভিন্ন জিনিসকে গুরুত্ব দিয়ে থাকে এবং সেখানে ভিন্ন ভিন্ন জিনিসকে তথ্য হিসাবে বিবেচনা করা হয়।

কিন্তু কার্যকর কার্যনির্বাহী এটাও জানে, মানুষ তথ্যের সন্ধান দিয়ে কাজ শুরু করে না। তারা কাজ শুরু করে মতামত দিয়ে। এটা ভুল কিছু নয়। কোন বিষয়ে অভিজ্ঞ মানুষের সেই বিষয়ে কোন মতামত থাকাটা প্রত্যাশিত। একজন মানুষ কোন নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করার পরেও যদি সেই ক্ষেত্রের বিষয়ে তার কোন অভিমত গঠিত না হয়, তবে বলা যেতে পারে সে কাজে অমনোযোগী এবং তার চিন্তাভাবনা অপরিপক্ক।

অনিবার্যভাবে মানুষ অভিমত দিয়েই সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া শুরু করে। তাদের কখনোই তথ্য সংগ্রহ দিয়ে প্রক্রিয়াটি শুরু করতে বলা উচিত নয়। এমনিতেও তারা তাদের মতো করেই কাজ করবে। অর্থাৎ তারা এমন সব তথ্য খুঁজবে যা তাদের মতামতের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। তাছাড়া কেউই নিজের পছন্দসই তথ্য খুঁজে পেতে ব্যর্থ হয় না। একজন ভালো পরিসংখ্যানবিদ এই কথাটি জানে, আর তাই সে সকল তথ্যকেই অবিশ্বাস করে। সে হয় তথ্য সংগ্রহকারীর সাথে পরিচিত বা তাকে একেবারেই চেনে না, কিন্তু উভয়ক্ষেত্রেই সে সন্দেহপ্রবণ থাকে।

কোন মতামতকে বাস্তবতার প্রেক্ষিতে পরীক্ষা করার পদ্ধতি কেবল একটি এবং এই কঠিন পদ্ধতিটির ভিত্তি হলো—মতামতই প্রথম এবং প্রধান, এই বিষয়টি স্পষ্টভাবে অনুধাবন করা। তবেই, কারো বুঝতে অসুবিধা হবে না কেন আমরা অপরীক্ষিত তত্ত্ব দিয়ে প্রক্রিয়াটি শুরু করছি। বিজ্ঞানের মতো সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রেও এটাই প্রথম ধাপ। আমরা জানি একটি তত্ত্ব নিয়ে কীভাবে কাজ করতে হয়—কেউ তত্ত্ব নিয়ে তর্ক করে না, তারা তত্ত্বকে পরীক্ষা করে। তারা যাচাই করে কোন তত্ত্বটি বাস্তবসম্মত ও প্রাসঙ্গিক এবং কোনগুলো অবাস্তব ও অকার্যকর। তারা কার্যকরগুলোকে নির্বাচন করে এবং অপ্রাসঙ্গিকগুলোকে প্রথমেই প্রত্যাখ্যান করে।

কার্যকর কার্যনির্বাহী মতামতকে প্রাধান্য দেয়। কিন্তু সে এটাও নিশ্চিত করে যে, এই মতামত প্রদানকারীরা যেন এই সম্পর্কে যাতে অবগত থাকে যে তাদের মতামতের প্রাসঙ্গিকতাকে “পরীক্ষা” করা হবে। তাই কার্যকর কার্যনির্বাহী জিজ্ঞেস করে: “কোন কোন তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে এই তত্ত্ব বা মতামতকে যাচাই করা হবে?” সে এই কাজটি নিজের এবং তার সহকর্মীদের জন্য অভ্যাসে পরিণত করে, যাতে তারা সহজেই বুঝতে পারে কোন বিষয়গুলোকে লক্ষ্য, গবেষণা ও পরীক্ষা করতে হবে। সে এটাও দৃঢ়ভাবে নিশ্চিত করতে চায় যে, যারা অভিমত দিচ্ছে তারা যেন সেই অভিমতের সপক্ষে কোন যুক্তিগুলো উপস্থাপন করতে হবে সেই সম্পর্কে অবগত থাকে।

হয়তো এখানে সবচেয়ে গুরুতর প্রশ্নটি হলো: “প্রাসঙ্গিকতার মানদ- কী?” বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, প্রাসঙ্গিকতা নির্ভর করে, কোনো মতামত আলোচিত বিষয়বস্তুর এবং সেই সম্পর্কিত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে কতটা যুক্তিসঙ্গত তার উপর। যখনই কেউ একটি প্রকৃতরূপে কার্যকর এবং সম্পূর্ণভাবে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের পন্থাকে বিশ্লেষণ করবে, সে দেখতে পাবে সেক্ষেত্রে উপযুক্ত মানদ- সন্ধানের পিছনে প্রচুর মানসিক ও শারীরিক শ্রম ব্যয় করতে হয়েছে।

এ কারণেই থিওডোর ভেইলের সেবাকে বেল সিস্টেমের প্রধান ব্যবসা নির্বাচন করার সিদ্ধান্তটি এতটা কার্যকর বলে প্রমাণিত হয়েছিল।

কার্যকর সিদ্ধান্ত-গ্রহণকারী ধরে নেয় যে গতানুগতিক মানদ- সঠিক মানদ- নয়। তা না হলে, সিদ্ধান্ত নেবার প্রয়োজনই হত না, সামান্য পরিবর্তন করে নিলেই কাজ হয়ে যেত। গতানুগতিক মানদ- অতীতের সিদ্ধান্তের পরিচায়ক। একটি নতুন সিদ্ধান্তের প্রয়োজন সাধারণত এটাই ইঙ্গিত দেয় যে মানদ-টি এখন আর প্রাসঙ্গিক নয়।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংগ্রহ ও তালিকা নীতিগুলো যে খারাপ অবস্থায় ছিল তা কোরিয়ান যুদ্ধের সময় থেকেই সবাই জানত। এ নিয়ে অসংখ্য গবেষণা করা হলেও পরিস্থিতি ভালো হবার পরিবর্তে আরও বেশি খারাপের দিকেই যাচ্ছিল। যখন রাষ্ট্রপতি কেনেডি, রবার্ট ম্যাকনামারাকে প্রতিরক্ষা বিভাগের সেক্রেটারি হিসাবে নিয়োগ দেন তখন তিনি প্রথমেই সামরিক বাহিনীর গতানুগতিক তালিকার মানদ-কে চ্যালেঞ্জ করেন। এই চ্যালেঞ্জটি ছিল সামরিক বাহিনীর সংগ্রহে থাকা মোট অর্থ এবং মোট জিনিসের তালিকার পরিমাপের বিরুদ্ধে। এর পরিবর্তে ম্যাকনামারা খুব সামান্য কয়টি জিনিসকে চিহ্নিত এবং পৃথক করে দেখেন যে জিনিসগুলো মোট সংখ্যার মাত্র ৪ শতাংশ, মোট সংগ্রহে থাকা অর্থের ৯০ শতাংশকে নির্দেশ করে। একই ভাবে তিনি এটাও আবিষ্কার করেন যে, খুব সামান্য—হয়তো ৪ শতাংশ—জিনিস যুদ্ধের ৯০ শতাংশ প্রস্তুতির জন্য কাজে লাগে। যেহেতু কিছু জিনিস উভয় লিস্টেই ছিল, তাই বাস্তবে দেখা যায় যে মোট জিনিসের মাত্র ৫ বা ৬ শতাংশই প্রকৃতপক্ষে অত্যন্ত প্রয়োজনীয়, তা সেটা সংখ্যা বা অর্থ যেটার ভিত্তিতেই যাচাই করা হোক না কেন। ম্যাকানামারা জোর দিয়ে বলেন যে এদের প্রত্যেকটিকে আলাদা ভাবে এবং অত্যন্ত সতর্কতার সাথে তদারকি করতে হবে। বাকি জিনিসের ৯৫ শতাংশ, যা মোট অর্থ কিংবা যুদ্ধ প্রস্তুতির, কোনটির হিসাবের মাঝেই পড়ে না তাদের ব্যতিক্রম ব্যবস্থাপনার অধীনে রাখা হবে। এর অর্থ হলো এদের সম্ভাবনা এবং গড়ের ভিত্তিতে তদারকি করা হবে। এই নতুন পরিমাপকের ফলে তাৎক্ষণিকভাবে সংগ্রহ, তালিকা রক্ষণ এবং রসদ সম্পর্কিত অত্যন্ত কার্যকর সিদ্ধান্তসমূহ নেয়া সম্ভব হয়েছিল।

উপযুক্ত পরিমাপক বা মানদ- নির্ধারণের সর্বাপেক্ষা উত্তম উপায় হলো “প্রতিক্রিয়া” সন্ধান করা, যা আগেই আলোচনা করা হয়েছে। এক্ষেত্রে “প্রতিক্রিয়াটি” কেবল সিদ্ধান্ত গ্রহণের পূর্বে দেখা হবে।

বেশির ভাগ কর্মী সম্পর্কিত বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে তাদের “গড়” পরিমাপ করা হয়। যেমন, প্রতি একশ কর্মীর দ্বারা আকস্মিকভাবে অপচয়কৃত সময়ের হার, পুরো কর্মশক্তির মাঝে অনুপস্থিতির হার অথবা প্রতি একশ জনে অসুস্থতার হার। কিন্তু যেই কার্যনির্বাহক নিজে বাইরের জগতে বেরিয়ে এসে খোঁজ করে, সে দ্রুতই বুঝতে পারে যে তার ভিন্ন একটি পরিমাপকের প্রয়োজন। গড় মান ইনস্যুরেন্স কোম্পানির কাজে লাগে। কিন্তু কর্মী ব্যবস্থাপনার সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে এটা অর্থহীন এবং বিভ্রান্তিকর।

সাধারণত বড় দুর্ঘটনাগুলোর সিংহভাগই কোন কারখানার একটি বা দুটি অংশেই ঘটে থাকে। এক বিভাগেই সর্বাধিক অনুপস্থিতি পরিলক্ষিত হয়। এমনকি আমরা এটাও জানি যে, অসুস্থতার ঘটনাও সবখানে সমানভাবে ঘটে না, বরং কর্মক্ষেত্রের খুব ছোট্ট একটি অংশেই এর উপস্থিতি দেখা যায়। উদাহরণস্বরূপ—কমবয়স্ক অবিবাহিত নারী। কর্মী সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত, যেমন—সমগ্র কারখানাব্যাপী নিরাপত্তা প্রচারণা—গড় মানের ভিত্তিতে নেয়া হলে কাক্সিক্ষত ফলাফল তো পাওয়া যাবেই না, বরং এতে করে পরিস্থিতি আরও চরম আকার ধারণ করতে পারে।

একই ভাবে, বাইরের জগতে গিয়ে সময়মতো গাড়ির নিরাপত্তাজনিত কৌশল সন্ধানে অপারগতা অটোমোবাইল শিল্পের ব্যর্থতার একটি বড় কারণ ছিল। অটোমোবাইল কোম্পানিগুলো কেবল প্রতি মাইল বা প্রতি গাড়িতে প্রতি জন যাত্রীর দুর্ঘটনার গতানুগতিক হার পরিমাপ করেছিল। যদি তারা প্রকৃত সংখ্যাটির অনুসন্ধান করত, তবে দেখত যে তাদের দুর্ঘটনাজনিত শারীরিক আঘাতের পরিমাণকেও বিবেচনায় রাখা উচিত ছিল। আর এটাই তাদের দুর্ঘটনার ক্ষয়ক্ষতি কমানোর কৌশল উদ্ভাবনের প্রয়োজনীয়তাকে তাদের সামনে তুলে ধরে সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করতে পারত; আর তা হলো—মটরগাড়ির নকশা পরিবর্তন এবং পরিবর্ধন।

আর তাই, উপযুক্ত পরিমাপক সন্ধান করা কোন গাণিতিক অনুশীলন নয়। এটা একটা ঝুঁকি-গ্রহণ বিবেচনা।

যখনই কেউ এই বিবেচনা করবে, তাকে অবশ্যই কিছু বিকল্প উপায় হাতে রাখতে হবে, যেখান থেকে সে একটিকে নির্বাচন করবে। যেই বিচারে কাউকে শুধু ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ বলতে হয় সেটা প্রকৃতপক্ষে কোন সুবিচার নয়। কিছু বিকল্প উপায় সামনে থাকলেই কেবল একজন কাজটার প্রকৃত গুরুত্ব অনুধাবন করার আশা করতে পারে।

আর তাই কার্যকর কার্যনির্বাহীগণ সবসময় বিকল্প পরিমাপক রাখার উপর জোর দেন, যাতে তারা উপযুক্ত পরিমাপকটিকে বাছাই করতে পারেন।

একটি মূলধন বিনিয়োগ প্রস্তাবকে যাচাই করার অনেক উপায় রয়েছে। তাদের একটি হলো আসল বিনিয়োগটি ফিরে পেতে কত সময় লাগবে তার পরিমাণ। আরেকটি জোর দেয় বিনিয়োগের মুনাফার হারের উপর। তৃতীয়টি গুরুত্ব দেয় বিনিয়োগ থেকে কত অর্থ ফেরত পাওয়া যাবে তার বর্তমান মূল্যের উপর। এরকম আরও অনেক পরিমাপক রয়েছে যার ভিত্তিতে একটি বিনিয়োগের কার্যকারিতা যাচাই করা যেতে পারে। একজন কার্যকর কার্যনির্বাহী কখনোই এই গতানুগতিক পরিমাপকগুলোর কোনটিতে সন্তুষ্ট হবে না। হিসাবরক্ষণ বিভাগ তাকে যতই আশ্বস্ত করে থাকুক না কেন যে এই উপায়গুলোর কেবল একটিই “বিজ্ঞানসম্মত”। আর বাকিগুলো বিবেচনায় রাখার দরকার নেই। কিন্তু একজন কার্যকর কার্যনির্বাহী কখনোই এই গতানুগতিক পরিমাপকগুলোর কোনটিতে সন্তুষ্ট হবে না। সে নিজের অভিজ্ঞতা থেকে জানে যে, প্রতিটি বিশ্লেষণ একই মূলধন বিনিয়োগ সিদ্ধান্তের ভিন্ন ভিন্ন দিক উন্মোচন করে। যতক্ষণ না পর্যন্ত সে সিদ্ধান্তটির প্রতিটি সম্ভাব্য দিক যাচাই করছে, ততক্ষণ পর্যন্ত সে বুঝতে পারবে না যে কোন পরিমাপকটি ঐ মূলধন বিনিয়োগের কার্যকারিতা বিচারবিশ্লেষণের প্রকৃত কৌশল। এটা হিসাবরক্ষকদের যতই বিরক্তির উদ্রেক করে থাকুক না কেন, কার্যকর কার্যনির্বাহী সবসময় একই বিনিয়োগ সিদ্ধান্তকে তিনভাবে পরিমাপ করে দেখবে। এর কারণ হলো যাতে সে শেষ পর্যন্ত বলতে পারে—“এই পরিমাপকটি এই সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য উপযুক্ত।”

কেউ যদি সকল বিকল্প উপায়কে বিবেচনা না করে তবে বুঝতে হবে সে সংকীর্ণ মনের অধিকারী।

সর্বোপরি, এটা এই বিষয়টাকে ব্যাখ্যা করে যে, কেন একজন কার্যকর সিদ্ধান্ত-গ্রহণকারী ইচ্ছাকৃতভাবে সিদ্ধান্ত-গ্রহণের সকল বইয়ে বর্ণিত দ্বিতীয় প্রধান নির্দেশকে উপেক্ষা করে ঐক্যমত পোষণের পরিবর্তে মতানৈক্য এবং দ্বিমত পোষণ করে।

একজন কার্যনির্বাহীকে যেসব সিদ্ধান্ত নিতে হয়, তা তারিফ কিংবা প্রশংসা পাবার জন্য নেয়া হয় না। বরং সেগুলো নেয়া হয় পরস্পর বিরোধী মতামতের সংঘাত এবং সংঘর্ষের মাধ্যমে। সিদ্ধান্ত-গ্রহণের প্রথম নিয়ম হলো—মতভেদ না থাকলে সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে না।

বলা হয়, আলফ্রেড পি. স্লোয়ান তার শীর্ষ কমিটির এক মিটিংয়ে বলেছিলেন, “বন্ধুগণ, দেখা যাচ্ছে বিষয়টিতে আমরা সবাই একমত।” টেবিলে বসা সবাই মাথা নেড়ে তার কথায় সায় দেয়। “তাহলে, “ তিনি বলে চলেন, “আমি বাকি আলোচনা পরবর্তী মিটিং পর্যন্ত মুলতবি করছি যাতে আমরা নিজেদের মাঝে কিছু মতভেদ গঠনের সুযোগ পাই এবং সিদ্ধান্তটির প্রকৃত অর্থ অনুধাবন করতে পারি।”

স্লোয়ান মোটেই একজন “স্বজ্ঞাত” সিদ্ধান্ত-গ্রহণকারী ছিলেন না। তিনি সবসময় অভিমতসমূহকে যুক্তির সপক্ষে যাচাই করার উপর জোর দিতেন। তিনি চাইতেন না কেউ প্রথমেই একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছে পরে সেটির সপক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করুক। কিন্তু তিনি জানতেন সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হলে পরিমিত মতভেদ আবশ্যক।

আমেরিকার ইতিহাসের কার্যকর রাষ্ট্রপতিদের সকলেরই মতভেদ তৈরির নিজস্ব উপায় ছিল যা ব্যবহার করে তারা কার্যকরী সিদ্ধান্ত নিতেন। লিংকন, থিওডোর রুজভেল্ট, ফ্রাঙ্কলিন ডি. রুজভেল্ট, হ্যারি ট্রুম্যান—এদের প্রত্যেকেরই নিজস্ব কৌশল ছিল। কিন্তু তাদের সকলেই “সিদ্ধান্তটির প্রকৃত অর্থ অনুধাবন” করার জন্য প্রয়োজনীয় মতবিরোধ তৈরি করতেন।

ওয়াশিংটন, আমরা জানি, মতবিরোধ ও দ্বন্দ্ব ঘৃণা করতেন এবং একটি সংঘবদ্ধ মন্ত্রিসভা কামনা করতেন। তা সত্ত্বেও তিনি জরুরি বিষয়ের ক্ষেত্রে হ্যামিল্টন এবং জেফারসন, উভয়েরই মতামত জিজ্ঞেস করে প্রয়োজনীয় মতানৈক্য তৈরি করতেন।

সুসংহত মতভেদের তাৎপর্য সম্ভবত যেই রাষ্ট্রপতি সবচেয়ে বেশি অনুধাবন করেছিলেন, তিনি ছিলেন ফ্রাঙ্কলিন ডি. রুজভেল্ট। যখনই কোন দরকারি বিষয় সামনে আসত, তখনই তিনি নিজের একজন সহকারীকে আলাদাভাবে ডেকে বলতেন, “তুমি আমার এই কাজটি করবে—কিন্তু ব্যাপারটিকে গোপন রাখবে।” (এটি সম্ভব হয়েছিল, কারণ রুজভেল্ট ভালোভাবেই জানতেন যে ওয়াশিংটনের প্রত্যেকে বিষয়টি সম্পর্কে তাৎক্ষনিকভাবেই জানতে পারবে।) এরপর রুজভেল্ট প্রথমজনের সাথে দ্বিমত পোষণ করবে, এমন আরো কয়েকজন সহকারীকে ডেকে একই কাজ করতে দিতেন, আবারো একইভাবে “গোপনে”। ফলস্বরূপ, তিনি যুক্তিসঙ্গতভাবে নিশ্চিত হতে পারতেন যে, সকল বিষয়ের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিটি দিক ভালোভাবে বিবেচনা করে তার সামনে উপস্থাপন করা হয়েছে। তিনি নিশ্চিত হতে পারতেন যে কারো পূর্বধারণার বশবর্তী হয়ে তিনি কোন সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন না।

এই অনুশীলনটি রুজভেল্টের ক্যাবিনেটের একজন “পেশাদার ব্যবস্থাপক” দ্বারা তীব্রভাবে সমালোচিত হয়েছিল। তিনি একে জঘন্য প্রশাসন হিসাবে আখ্যায়িত করেছিলেন। এই ব্যক্তিটি ছিলেন তার স্বরাষ্ট্র সচিব, হ্যারল্ড আইক্স, যার ডায়েরি রাষ্ট্রপতির “অবহেলা”, “নির্বিচার” এবং “বিশ্বাসঘাতকতার” সুদীর্ঘ বর্ণনায় পরিপূর্ণ থাকত। কিন্তু রুজভেল্ট জানতেন আমেরিকার রাষ্ট্রপতির মূল কাজ পরিচালনা নয় । তার কাজ হলো নীতিমালা গঠন, সঠিক সিদ্ধান্ত-গ্রহণ। আর এই কাজগুলো করার মূল ভিত্তি হলো আইনজীবীদের ভাষায় যাকে বলে “বিরোধী প্রক্রিয়া”। এই প্রক্রিয়ায় আইনজীবীরা বিরোধের মধ্য থেকে আসল সত্যটি বের করে আনে এবং এটা নিশ্চিত করে যে, কেসের সকল গুরুত্বপূর্ণ দিক আদালতের সামনে উপস্থাপিত হচ্ছে।

মতবিরোধের উপর গুরত্বারোপের পিছনে তিনটি প্রধান কারণ রয়েছে:

প্রথমটি হলো, এটা সিদ্ধান্ত-গ্রহণকারীর, তার প্রতিষ্ঠানে বন্দি হওয়া থেকে রক্ষা পাবার একমাত্র রক্ষাকবচ। সবাই সবসময় সিদ্ধান্ত-গ্রহণকারী থেকে কিছু না কিছু পেতে চায়। সবাই বিশেষ অনুরোধকারী, সবাই—অনেক সময়—সৎ উদ্দেশ্য নিয়েই—তার সিদ্ধান্ত থেকে কোন সুবিধা পেতে চায়। যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি থেকে শুরু করে নকশা পরিবর্ধনে কাজ করা সবচেয়ে জুনিয়র ইঞ্জিনিয়ার যেই হোক না কেন, এই কথা সবার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। এই বিশেষ অনুরোধ আর পূর্বনির্ধারিত ধারণার বেড়াজাল থেকে মুক্ত হবার একমাত্র পথ হলো যুক্তিসঙ্গত, নথিভুক্ত, চিন্তাযুক্ত মতবিরোধ।

দ্বিতীয়ত, কেবল মতভেদ দ্বারাই একটি সিদ্ধান্তের বিকল্প সিদ্ধান্তসমূহের সন্ধান পাওয়া যায়। যতই সাবধানতার সাথে চিন্তা করা হোক না কেন, বিকল্পবিহীন সিদ্ধান্ত হলো আসলে মরিয়া জুয়াড়ির চাল। এক্ষেত্রে সিদ্ধান্তটি ভুল প্রমাণিত হবার সমূহ সম্ভাবনা থেকে যায়। এর কারণ হয় সিদ্ধান্তটি প্রথম থেকেই ভুল ছিল আর নয়তো পরিস্থিতির পরিবর্তনে সেটা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। যদি কেউ সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় যথাযথ বিকল্প নিয়ে ভেবে থাকে, তবে তার হাতে একটি ভিন্ন উপায় থেকে যায়। এমন একটি বিকল্প উপায় যা আগেই যাচাই-বাছাই করা হয়ে গেছে। এমন একটি বিকল্প ব্যতীত কেউ কোন কাজে নামলে প্রতিকূল অবস্থায় তার সিদ্ধান্তটি ভুল প্রমাণিত হলে সে অথই সাগরে পড়বে।

আগের অধ্যায়ে আমি ১৯১৪ সালে জার্মান সেনাবাহিনীর স্লিফেন প্ল্যান এবং রাষ্ট্রপতি ফ্রাঙ্কলিন ডি. রুজভেল্টের মূল অর্থনৈতিক প্রোগ্রাম উভয়ের কথাই উল্লেখ করেছি। দুটি পরিকল্পনাই যখন কার্যকর হবার কথা ছিল, তখনই ঘটা কিছু ঘটনার আলোকে সেগুলো ব্যর্থ প্রমাণিত হয়েছিল।

জার্মান সেনাবাহিনী কখনোই এই ঘটনার প্রভাব কাটিয়ে উঠতে পারেনি। এটা কখনোই আর নতুন কোন কৌশলগত ধারণার জন্ম দেয়নি। এটা বারবার কেবল ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছিল। কিন্তু এমনটা হওয়াই ছিল স্বাভাবিক। কারণ ২৫ বছরে জার্মান সেনাবাহিনী স্লিফেন প্ল্যানের কোন বিকল্প প্ল্যান তৈরির কথা চিন্তা করেনি। তাদের সমস্ত দক্ষতা কেবল এই মহাপরিকল্পনার খুঁটিনাটি যাচাইয়ে ব্যয় হয়েছিল। যখন পরিকল্পনাটি সম্পূর্ণ ভেস্তে যায় তখন তাদের হাতে বিকল্প কোন পরিকল্পনাই আর ছিল না।

কৌশলগত পরিকল্পনার উপর এত সতর্ক প্রশিক্ষণ সত্ত্বেও সেনাদক্ষগণ কেবলই স্বতঃস্ফূর্ত কিছু সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছিল, আর তা হলো, একবার একদিকে এবং আরেকবার আরেকদিকে ছোটা, কিন্তু কেন তারা ছুটছিল তার আসল কারণই তারা বুঝতে পারেনি।

১৯১৪ সালের আরেকটি ঘটনা বিকল্প পরিকল্পনা না থাকার ঝুঁকিকে তুলে ধরে। রাশিয়ানরা সৈন্য সমাবেশের আদেশ দেবার পর জারের মাঝে দ্বিধা দেখা দেয়। তিনি তার সেনাপ্রধানকে ডেকে তাকে সৈন্য সমাবেশ বাতিল করার আদেশ দেন। “মহামান্য,” সেনাপ্রধান জবাব দেন, “এটা অসম্ভব, একবার সৈন্য সমাবেশের আদেশ হয়ে গেলে সেটা বন্ধ করার বিকল্প কোন পন্থা নেই।” আমি এটা মোটেই বলছি না যে রাশিয়ানরা শেষ মুহূর্তে তাদের সৈন্য সমাবেশ বাতিল করলেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধ প্রতিহত করা সম্ভব হত। কিন্তু সেক্ষেত্রে যুদ্ধ প্রতিহত করার একটি সুযোগ অন্তত সৃষ্টি হত।

অপরদিকে, রাষ্ট্রপতি রুজভেল্ট, যিনি তার সম্পূর্ণ প্রচারণা—সনাতনপন্থী অর্থনীতি—এই স্লোগানের উপর ভিত্তি করেছিলেন, তিনি রাষ্ট্রপ্রধান হিসাবে যোগ দেবার কয়েক মাস আগে একটি সুদক্ষ কর্মীদল গঠন করেছিলেন যাকে পরবর্তীতে “ব্রেইনস ট্রাস্ট” (ইৎধরহং ঞৎঁংঃ) বলা হত। তিনি পুরানো সময়ের “প্রগতিশীলদের” প্রস্তাবের ভিত্তিতে এই দলকে একটি বিকল্প একটি মৌলিক নীতি তৈরির নির্দেশ দিয়েছিলেন যার লক্ষ্য ছিল বৃহদাকারে অর্থনৈতিক ও সামাজিক সংস্কার।

ব্যাংকিং ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে যখন এটা প্রমাণ করে দিয়েছিল যে, সনাতনপন্থী অর্থনীতি আসলে রাজনৈতিক আত্মহত্যায় পরিণত হয়েছে, তখন রুজভেল্টের হাতে বিকল্প একটি পরিকল্পনা তৈরিই ছিল। আর তাই তিনি একটি নীতিমালা উপস্থাপন করতে পেরেছিলেন।

তা সত্ত্বেও পরবর্তীতে একটি পরিকল্পিত বিকল্প ব্যতীত রুজভেল্টের অবস্থাও সেই জার্মান সেনাবাহিনী আর রাশিয়ান জারের মতোই করুণ হয়েছিল। তিনি যখন রাষ্ট্রপতি হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন, তখন রুজভেল্ট উনিশ শতকের প্রচলিত আন্তর্জাতিক অর্থনীতি তত্ত্বে বিশ্বাসী ছিলেন। কিন্তু ১৯৩২ সালের নভেম্বরে তার নির্বাচন এবং একই বছরের মার্চে অফিসের দায়িত্ব গ্রহণের মধ্যবর্তী সময়ে আন্তর্জাতিক অর্থনীতির মতো অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিও তলাবিহীন ঝুড়িতে পরিণত হয়।

রুজভেল্ট স্পষ্টভাবে এটা দেখতে পেলেও, কোন বিকল্প ছাড়া তাকে অসম্পূর্ণ স্বতঃস্ফূর্ততার দ্বারস্থ হতে হয়েছিল। একজন অত্যন্ত সমর্থ এবং কর্মতৎপর ব্যক্তি হওয়া সত্ত্বেও, রুজভেল্টকে কেবল মরীচিকার পিছনে ছুটতে হয়েছিল। ফলে তিনি একটি থেকে আরেকটি চরমপন্থার দ্বারস্থ হয়ে চলেছিলেন—যেমনটা তিনি লন্ডন ইকোনমিক কনফারেন্স বানচালের সময় করেছিলেন। ফলে তিনি ধূর্ত অর্থনীতিবিদদের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছিলেন। তাদের পরিকল্পনাসমূহ যেমন—ডলার অবমূল্যায়ন বা রৌপ্য পুনঃনির্মাণ—উভয়েই প্রকৃত সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে অপ্রাসঙ্গিক ছিল।

আরেকটি পরিষ্কার উদাহরণ হলো, ১৯৩৬ সালে অপ্রতিরোধ্য জয়ের পর রুজভেল্টের সুপ্রিম কোর্টকে “বাক্সবন্দি” (ঢ়ধপশ) করার পরিকল্পনা। যখন এই পরিকল্পনাটি কংগ্রেসে (যেই কংগ্রেসের উপর তার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ আছে বলে তিনি মনে করতেন) তীব্র বিরোধিতার সম্মুখীন হয়, তখন রুজভেল্টের হাতে আর কোন বিকল্প উপায় ছিল না। ফলস্বরূপ, তাকে শুধু তার কোর্টকে সংশোধন করার পরিকল্পনাই হারাতে হয়নি, সাথে তার বিশাল জনপ্রিয়তা এবং বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা সত্ত্বেও অভ্যন্তরীণ রাজনীতির নিয়ন্ত্রণও হারাতে হয়েছিল। [ফজলে রাব্বির কথা—রুজভেল্টের সুপ্রিম কোর্টকে ‘বাক্সবন্দি’ করার পরিকল্পনার ব্যাপারে এমআইটি বিশ^বিদ্যালয়ের অর্থনীতিবিদ ড্যারন এসমগলু এবং হার্ভার্ড বিশ^বিদ্যালয়ের অর্থনীতিবিদ জেমস এ রবিনসনের লেখা দি অরিজিনস অব পাওয়ার, প্রসপারিটি অ্যান্ড পোভার্টি: হোয়াই নেশনস ফেইল বইয়ে উল্লেখ করেছে। বইয়ের শিরোনামের মানে হচ্ছে জাতি কেন ব্যর্থ হয়: ক্ষমতা, প্রাচুর্য এবং দারিদ্র্যের উৎস। এখানে পিটার ড্রুকার যেমন বিকল্প উপায়ের কথা বলেছেন, হোয়াই নেশনস ফেইল বইয়ে লেখক এসমগলু ও রবিনসন বলেন মত প্রকাশের স্বাধীনতা, সবাই একসাথে বসে কথা বলে, আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা।]

সর্বোপরি, কল্পনাশক্তিকে জাগ্রত করার জন্য মতভেদ প্রয়োজন। কোন বিষয়ে নিশ্চিত হবার জন্য অবশ্যই কল্পনার দরকার হয় না। তবে এই কথা শুধু গণিতের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। কিন্তু অন্য সকল অনিশ্চিত ব্যাপার, বিশেষ করে কার্যনির্বাহী যে ধরনের কাজ করে থাকে—তা সেটা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক কিংবা সামরিক যাই হোক না কেন—তাকে “সৃজনশীল” সমাধান খুঁজতে হয় যা নতুন কোন প্রেক্ষাপটের সূচনা করে। এর অর্থ হলো মানুষের কল্পনাশক্তি—একটি নতুন, ভিন্ন উপায়ে কোন কিছু উপলব্ধি করার ক্ষমতা—থাকার প্রয়োজনীয়তা অবশ্যই রয়েছে।

আমি স্বীকার করছি যে, প্রথম শ্রেণীর কল্পনাশক্তি বিপুল পরিমাণে সরবরাহ হয় না। কিন্তু সাধারণত যতটা ভাবা হয় এটা ততটা অপ্রতুলও নয়। কল্পনাশক্তিকে চ্যালেঞ্জ এবং উদ্দীপিত করতে হয়, তা না হলে এটা লুকায়িত এবং অব্যবহৃত রয়ে যায়। মতভেদ, বিশেষ করে যৌক্তিক, নথিভুক্ত এবং চিন্তার উদ্রেক করে—এমন মতভেদ কল্পনাশক্তির বিকাশের ক্ষেত্রে সবচেয়ে কার্যকর উদ্দীপক হিসাবে কাজ করে।

খুব কম মানুষেরই হাম্পটি-ডাম্পটির মতো প্রাতঃরাশের আগেই অসংখ্য অবাস্তব কল্পনা করার ক্ষমতা রয়েছে। তারপরে আরও কম সংখ্যক মানুষের হাম্পটি-ডাম্পটির ¯্রষ্টা, অ্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ডের লেখক লুইস ক্যারলের মতো কল্পনাশক্তি থাকে। আবার অনেক ছোট্ট শিশুদের অ্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড উপভোগ করার মতো কল্পনাশক্তি থাকে। আবার যেমন জেরোম এস. ব্রুনার বলেছেন, একজন আট বছর বয়সী শিশুও চোখের পলকে বলে দিতে পারে যে ৪ গুণ ৬ এবং ৬ গুণ ৪ এর ফলাফল সমান এবং একটি অন্ধ ভেনেশিয়ান (ধ নষরহফ ঠবহবঃরধহ) আর অন্ধ এক ভেনেশিয়ান (ধ ঠবহবঃরধহ নষরহফ) এক জিনিস নয়। *এটা প্রথম শ্রেণীর কল্পনাশক্তির উদাহরণ। অথচ, অধিকাংশ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ ধরেই নেয় যে একটি অন্ধ ভেনেশিয়ান (ধ নষরহফ ঠবহবঃরধহ) আর অন্ধ এক ভেনেশিয়ান (ধ ঠবহবঃরধহ নষরহফ) এক জিনিস। [*এ বিষয়ে আরও জানতে পডুন বই—টুয়ার্ড এ থিওরি অফ ইন্সট্রাকশন (ঞড়ধিৎফ ধ ঞযবড়ৎু ড়ভ ওহংঃৎঁপঃরড়হ) (কেমব্রিজ,হার্ভার্ড, ১৯৬৬), পৃষ্ঠা-৬৪, দেখুন।]

ভিক্টোরিয়ান সময়ের এক পুরনো গল্প আছে, একজন দক্ষিণ সাগরের দ্বীপের বাসিন্দা পশ্চিম থেকে ঘুরে এসে তার দ্বীপের বাসিন্দাদের জানায়, পশ্চিমাদের বাড়িতে কোন পানির ব্যবস্থা নেই। তার দ্বীপে ফাঁপা কাঠের গুঁড়িতে করে পানি সরবরাহ করা হত এবং সেটা স্পষ্ট দেখা যেত। কিন্তু পশ্চিমের শহরে এটা করা হত পাইপের ভেতর দিয়ে আর তাই কেউ কল খুললেই কেবল পানির দেখা পাওয়া যেত। কিন্তু সেই পর্যটককে কেউ এই কলের বিষয়টি সম্পর্কে অবগত করেনি।

 


[অনেকটা ঢাকা শহরের খোলা ড্রেনের মতো।]

আমি যখনই এই গল্পটি শুনি তখনই কল্পনাশক্তির কথা ভাবি। আমরা যদি “কল” না খুলি তবে কল্পনাশক্তির ধারা প্রবাহিত হবে না। এই কলটি হলো যুক্তিযুক্ত, সুশৃঙ্খল মতভেদ।

একজন কার্যকর সিদ্ধান্ত-গ্রহণকারী, এ কারণেই, মতানৈক্যের সূচনা করে। এটা তাকে বিশ্বাসযোগ্য অথচ মিথ্যা বা অসম্পূর্ণ কোন তথ্যের বিরুদ্ধে সুরক্ষা প্রদান করে। এটা তাকে বিকল্প পন্থাগুলো দেখায় যা থেকে সে সঠিক সিদ্ধান্তটি বেছে নিতে পারে এবং কোন কারণে সিদ্ধান্তটি ব্যর্থ হলে সে যেন অথই সাগরে না পড়ে, সিদ্ধান্তহীনতায় না ভোগে। এর পাশাপাশি এটা তার এবং তার সহকর্মীদের কল্পনাশক্তির বিকাশ ঘটায়। মতভেদ বা দ্বিমত বিশ্বাসযোগ্যতাকে সঠিক এবং সঠিককে একটি ভালো সিদ্ধান্তে পরিণত করে।

কার্যকর সিদ্ধান্তগ্রহীতা এই ধারণা নিয়ে কাজ শুরু করে না যে, একটি কার্যধারাই সঠিক আর বাকি সব ভুল। সে এটাও ভাবে না যে, “আমার কথাই ঠিক, তার কথা ভুল।” কেন মানুষ দ্বিমত করে, এর কারণ খুঁজে বের করার প্রত্যয় নিয়েই সে কাজ শুরু করে।

কার্যকর কার্যনির্বাহী অবশ্যই জানে যে তার চারপাশে অনেক নির্বোধ এবং দুষ্ট ব্যক্তি রয়েছে। কিন্তু সে এটা মনে করে না যে, সেই মানুষটি যা বলছে সেই কথাটির পিছনে নির্বুদ্ধিতা কিংবা প্রতারণা রয়েছে, বিশেষ করে যখন সে কথাটির আসল উদ্দেশ্য সম্পর্কে সম্পূর্ণ অবগত। সে জানে যতক্ষণ পর্যন্ত ভিন্নটি প্রমাণ না হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত বিতর্ককারীকে যথেষ্ট বুদ্ধিমান এবং ন্যায্য বলে ধরে নিতে হবে। আর তাই এই ধারণা পোষণ করতে হবে যে লোকটি দ্বিমতের পিছনে তার পরিস্থিতিটিকে ভিন্নভাবে দেখার ধরন বা অন্য কোন সমস্যা দায়ী। এজন্য একজন কার্যকর কার্যনির্বাহী সবসময় প্রশ্ন করে: “এই লোকটি যদি আদতেই কার্যকর, যুক্তিবাদী, বুদ্ধিমান হত, তবে সে পরিস্থিতিটিকে কীভাবে দেখত?”

কার্যকর কার্যনির্বাহীর প্রথম কাজ হলো অনুধাবন (ঁহফবৎংঃধহফরহম)। এরপরেই কেবল সে কে সঠিক আর কে ভুল, সেই বিষয় নিয়ে চিন্তা করে।*

একটি নামকরা আইন অফিসে একজন নতুন, সদ্য আইনের স্কুল থেকে পাশ করা আইনজীবীকে নিয়োগ দেয়া হলো। তার প্রথম দায়িত্ব হলো প্রতিপক্ষ আইনজীবীর মক্কেলের সপক্ষে একটি শক্তিশালী মামলার ড্রাফট তৈরি করা। একজন নতুন আইনজীবীর নিজের মক্কেলের দায়িত্ব নেবার আগে এমন কিছু করাটা বুদ্ধিমানের কাজ (কারণ তাকে এটা ভাবতে হবে যে প্রতিপক্ষ আইনজীবীও তার কাজ সম্পর্কে অবগত)। এটা একজন নতুন আইনজীবীর জন্য একটা কার্যকর প্রশিক্ষণ। কারণ এটা তাকে এই শিক্ষা দেয় যে, “আমি জানি আমার মামলাই সঠিক,”—এই ধারণা নিয়ে কাজ শুরু করা যাবে না। বরং তাকে এই ধারণা রাখতে হবে যে কী দেখালে, বোঝালে কিংবা শোনালে প্রতিপক্ষের কাছে তার মামলাটিকে বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হবে। এটা তাকে দুটি মামলাকেই একে অপরের বিকল্প হিসাবে দেখতে সাহায্য করে। আর তখনই সে নিজের মামলার আসল অর্থ বুঝতে পারে। আর তাহলেই সে আদালতে কেন বিকল্পটির বদলে তার মামলাটি সঠিক, তার সপক্ষে একটি শক্তিশালী যুক্তি উপস্থাপন করতে সক্ষম হবে।

এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, খুব বেশি মানুষ এই কাজটি করে না, তা সে কার্যনির্বাহী হোক আর না হোক। বেশির ভাগ মানুষ এই ধারণা নিয়েই কাজ শুরু করে—তারা যা ভাবে সেটাই একমাত্র সঠিক।

আমেরিকান স্টিলের কার্যনির্বাহীরা কখনোই এই প্রশ্নটি জিজ্ঞেস করেনি, “কেন শ্রমিক ইউনিয়ন **“ফেদারবেডিং” (ভবধঃযবৎনবফফরহম) শব্দটি শুনলেই উত্তেজিত হয়ে ওঠে?” শ্রমিক ইউনিয়নও কখনো এই প্রশ্নটি জিজ্ঞেসের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেনি যে, কেন প্রতিবার তাদের চেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হলেও স্টিলের ব্যবস্থাপনা কমিটি বারবার ফেদারবেডিংয়ের উপর জোর দেয়। দুই পক্ষই একে অপরকে ভুল প্রমাণ করার জন্য মরিয়া। কিন্তু তাদের একজনও যদি অপরজনের দৃষ্টিভঙ্গি বোঝার চেষ্টা করত, তবে উভয় পক্ষই লাভবান হত এবং শুধু আমেরিকাতেই নয়, বিশ্বব্যাপী স্টিল শিল্পের শ্রমিক-মালিক সম্পর্ক আরও জোরদার এবং শক্তিশালী হত।

*এটা অবশ্য নতুন কিছু নয়। এটা প্রকৃতপক্ষে মেরি পার্কার ফোলেটের বক্তব্যের পুনর্নির্মাণ (তার বই ডায়নামিক এডমিনিস্ট্রেশন, হেনরি সি. মেটকাফ এবং এল. আরউইক [নিউ ইয়র্ক, হার্পার অ্যান্ড রো, ১৯৪২] কর্তৃক সম্পাদিত, দেখুন), যিনি কিনা আবার, অলংকারশাস্ত্রের উপর লেখা প্লেটোর দুর্দান্ত রচনা—দ্য ফ্রেড্রাস কে সম্প্রসারিত করেছিলেন।

[**ফেদারবেডিং: কর্মসংস্থান তৈরি করতে বা বেকারত্ব প্রতিরোধের জন্য সাধারণত ইউনিয়ন চুক্তির ফলস্বরূপ ইচ্ছাকৃতভাবে উৎপাদন সীমাবদ্ধ করা বা (একটি ব্যবসায়) অতিরিক্ত কর্মীদের ধরে রাখা।]

সে যত সংবেদনশীলই হোক না কেন বা সে যতই অন্য পক্ষের ভুল সম্পর্কে নিশ্চিত হোক না কেন, একজন কার্যনির্বাহী যে কিনা সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে বদ্ধপরিকর, বিষয়টিকে তার প্রতিপক্ষের দৃষ্টিতে দেখার জন্য নিজেকে বাধ্য করে। সে এই কাজটিকে তার বিকল্প পন্থাগুলোকে বিবেচনা করার একটি উপায় হিসাবে গণ্য করে। সে মতবিরোধকে নিজের হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করে, একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের সবদিক সতর্কভাবে যাতে বিবেচিত হয় সেই বিষয়টি নিশ্চিত করে।

একজন কার্যকর সিদ্ধান্তগ্রহীতা শেষ একটি প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে: “এই সিদ্ধান্তটি কি আসলেই গুরুত্বপূর্ণ?” একটি বিকল্প, সবসময়েই কিছু না করার বিকল্প।

প্রতিটি সিদ্ধান্ত হলো অস্ত্রোপচার করার মতো। এটা একটা প্রক্রিয়াতে হস্তক্ষেপ করা, আর তাই এখানে আঘাত পাবার ঝুঁকি অবশ্যই থাকবে। একজন ভালো চিকিৎসক যেমন অকারণে অস্ত্রোপচার করবে না, তেমনি একজন মানুষ অপ্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নিবে না। ভিন্ন ভিন্ন চিকিৎসকের মতো ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তির কাজ করার ধরন ভিন্ন। কেউ বেশি প্রগতিশীল আবার কেউ বেশি রক্ষণশীল। কিন্তু তারা সকলেই এই নিয়মগুলো মেনে চলে।

একজন মানুষকে তখনই কোন সিদ্ধান্ত নিতে হয় যখন সিদ্ধান্তহীনতার অভাবে একটি পরিস্থিতি অধঃপতিত হবার সম্ভাবনা থাকে। এটা সুযোগ গ্রহণের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। যদি কোন গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ সামনে এসে থাকে আর কোন উদ্যোগ না নিলে সেটা উধাও হবার ঝুঁকি থাকে—তখন একজন মানুষ কাজে নেমে পড়ে এবং একটি বড় পরিবর্তন আনার চেষ্টা করে।

থিওডোর ভেইলের সমসাময়িকেরা সরকারি মালিকানার ধ্বংসাত্মক বিপদ সম্পর্কে তার সাথে একমত ছিল, কিন্তু তারা সেই বিপদের লক্ষণ সমূহের সাথে লড়াইয়ের মাধ্যমে এই বিপদের সাথে মোকাবিলা করতে চেয়েছিল, অর্থাৎ আইনসভায় বিলের বিরোধিতা, এক প্রার্থীকে সমর্থন বা আরেক প্রার্থীর বিরোধিতা ইত্যাদি। একমাত্র ভেইলই বুঝতে পেরেছিলেন যে একটি ক্ষয়মূলক পরিস্থিতিকে মোকাবিলার জন্য এই পন্থাটি অকার্যকর। কেউ যদি প্রতিটি লড়াইও জেতে, তারপরেও সে মূল যুদ্ধে পরাজিত হবে। তিনি অনুধাবন করেছিলেন যে, নতুন একটি পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য প্রয়োজন একটি বড় পদক্ষেপ। তিনি একাই দেখেছিলেন যে ব্যক্তিগত ব্যবসাকে জাতীয়করণের একটি কার্যকর বিকল্প হিসাবে উপস্থাপন করতে হলে সেটাকে জনসাধারণের নিয়ন্ত্রণের আওতায় আনতে হবে।

অপরদিকে অনেকে এটাও আশা করে যে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ না করা হলেও তাদের কোন সমস্যা হবে না। যদি “আমরা যদি কিছুই না করি তবে কী হবে?”—এই প্রশ্নটির উত্তর “এটা আপনাআপনি ঠিক হয়ে যাবে,”—হয়ে থাকে, তবে সেক্ষেত্রে কারো হস্তক্ষেপের প্রয়োজন নেই। আবার যদি কোন পদক্ষেপ নিলেও পরিস্থিতির পরিবর্তন হবার সম্ভাবনা না থাকে, তাহলে যত কষ্টদায়কই হোক না কেন সেক্ষেত্রে কোন হস্তক্ষেপ করার প্রয়োজন নেই।

একজন বিরল কার্যনির্বাহীই কেবল এটা বুঝতে পারে। ব্যাপক আর্থিক সংকটে থাকা একজন হতাশাগ্রস্থ ব্যবসায়ী বলে যে ছোটখাট কিছু কিছু ক্ষেত্রে অর্থ ব্যয় হ্রাস করলেও তার অবস্থার কোন পরিবর্তন হবে না। সে হয়তো এটাও জানে যে, নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকা উল্লেখযোগ্য ব্যয়গুলো হলো বিক্রয় ও বিতরণ। কিন্তু তারপরেও সে তার সমস্ত শ্রম এই ব্যয়গুলোকে নিয়ন্ত্রণে আনার পিছনে খরচ করবে। তারপরে সে একটি সুদক্ষ এবং সুপরিচালিত কারখানার দুই তিনজন পুরোনো শ্রমিককের “অপ্রয়োজনীয়” কর্মসংস্থান নিয়ে অনেক হৈ চৈ করার মাধ্যমে নিজের কথা ও প্রচেষ্টা উভয়কেই কলঙ্কিত করবে। এই অল্প কজন সেমিপেনশনারকে (ংবসরঢ়বহংরড়হবৎং) দূর করলে যে আদৌ কোন লাভ হবে না—এর বিরুদ্ধে সে অনৈতিক যুক্তি দেখাবে “সবাই তো কিছু না কিছু বিসর্জন দিচ্ছে,” সে তর্ক করবে, “তবে আমার কারখানার লোকেরাই বা বাদ যাবে কেন?”

যখন সমস্যাটি শেষ হয়ে যাবে, তখন সংগঠনটি দ্রুতই ভুলে যাবে যে তিনিই ব্যবসাটিকে বাঁচিয়েছিলেন। তারা কেবল এটাই মনে রাখবে যে, তিনি দু-তিনজন হতভাগ্য শ্রমিকের কর্মসংস্থান কেড়ে নিয়েছেন। আর এটা ভাবাটাই সঠিক। “ডি মিনিমিস নন কিউরেট প্রিটর” তথা একজন হাকিম খুঁটিনাটি বিষয়কে গণ্য করেন না বা একজন সেনাপতি ছোটোখাটো বিষয়ে মাথা ঘামায় না—দুই হাজার বছর আগে রোমান আইনে এই কথাটাই বলা হয়েছিল। কিন্তু অনেক সিদ্ধান্ত-গ্রহণকারী আজও এটা শিখতে পারেনি।

সিদ্ধান্তসমূহের সিংহভাগ এমন চরম পরিস্থতির মাঝেই বিরাজমান। সমস্যা নিজে থেকেই সমাধান হবে না, কিন্তু সেটা যে সবসময় ধ্বংসাত্মক কিছুতেই পরিণত হবে তাও নয়। সুযোগ কোন বড় পরিবর্তন কিংবা নতুন আবিষ্কার নয়, বরং এটা পূর্বাবস্থা থেকে উন্নতি লাভের উপায় মাত্র। তারপরেও আমরা সুযোগ খুঁজে থাকি। অন্য ভাবে বলতে গেলে আমরা কোন পদক্ষেপ না নিলেও অবশ্যই বেঁচে থাকব। কিন্তু কোন পদক্ষেপ নেয়াটাই আমাদের জন্য উত্তম।

এমতাবস্থায় একজন কার্যকর সিদ্ধান্ত-গ্রহণকারী নিষ্ক্রিয়তার ঝুঁকির সাথে সক্রিয়তার প্রচেষ্টা এবং ঝুঁকিকে তুলনা করে। এক্ষেত্রে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের কোন সূত্র নেই। কিন্তু এর নিয়মাবলি এতই স্পষ্ট যে একটি কঠিন পরিস্থিতিতে সিদ্ধান্ত নেয়াটা খুব বেশি কঠিন হয় না। এগুলো হলো:


▪ লাভের পরিমাণ যদি ব্যয় ও ঝুঁকির চাইতে বেশি হয় তবে পদক্ষেপ নিন; আর

▪ পদক্ষেপ নিন বা না নিন; কিন্তু কাজ “অর্ধসমাপ্ত” রাখবেন না বা আপস-মীমাংসা করবেন না।


একজন চিকিৎসক যিনি কেবল অর্ধেক টনসিল কিংবা অর্ধেক এপেন্ডিক্স কেটে বের করে, সে সম্পূর্ণ কাজটি সম্পন্ন করলে যেই ঝুঁকি থাকত সেই একই পরিমাণ ঝুঁকিই নিচ্ছে। কিন্তু এক্ষেত্রে সে রোগটিকে নিরাময় তো করেইনি; বরং রোগীর অবস্থা আরও খারাপের দিকে নিয়ে গেছে। সে হয় অস্ত্রোপচার করবে, নয়তো করবে না। একইভাবে একজন কার্যকর সিদ্ধান্তগ্রহীতা হয় কোন পদক্ষেপ নিবে, নয়তো কিছুই করবে না। সে অর্ধ-পদক্ষেপ নিবে না। এই কাজটি সবসময়ই ভুল এবং এটা মোটেও কাজটা করার ন্যূনতম শর্ত পূরণের কোন উপায় নয়।

এখন সিদ্ধান্তটি গ্রহণ যোগ্যতা লাভ করেছে। সকল খুঁটিনাটি এবং বিশেষ বিষয় বিবেচনা করা হয়ে গেছে। সকল বিকল্প পন্থা বিশ্লেষণ করা হয়ে গেছে। সকল ঝুঁকি ও লাভ পরিমাপ করা হয়েছে। সবকিছু এখন জানা। আর তাই কোন পদক্ষেপটি এখন নেয়া উচিত হবে, সেটা পরিষ্কারভাবে বোঝা যাচ্ছে। এই অবস্থায় সিদ্ধান্তটি প্রায় “নিজে থেকেই” সামনে উপস্থিত হয়।

আর এই ঠিক অবস্থাতেই বেশির ভাগ সিদ্ধান্তগুলো হারিয়ে যায়। হঠাৎ করে এটা বোঝা যায় যে, এই সিদ্ধান্তটা নেয়া এখন কার্যকর, সহজ ও পছন্দসই হবে না। এটা স্পষ্ট যে একটি সিদ্ধান্ত নিতে যেমন বিচারবিবেচনা প্রয়োজন হয়, তেমনি সাহসেরও দরকার পড়ে। কেন ওষুধের স্বাদ জঘন্য হবে তার কোন সহজাত কারণ নেই—কিন্তু কার্যকরগুলোর স্বাদ জঘন্য হবে সেটা নিশ্চিত ভাবে বলা যায়। একইভাবে, কেন সিদ্ধান্ত নেওয়ার কাজটি বিরক্তিকর বা কষ্টসাধ্য হবে তার কোন সহজাত কারণ নেই—কিন্তু কার্যকরগুলো অবশ্যই কষ্টসাধ্য হবে।

কার্যকর কার্যনির্বাহী একটি কাজ একই সময়ে কখনোই করবে না। আর তা হলো “চল আরেকবার আলোচনা বা গবেষণা করা যাক”—এই কথায় রাজি হওয়া। এটা কাপুরুষের কাজ—কাপুরুষেরা মরে হাজার বার, বীরের মৃত্যু হয় একবার। যখন আরেকবার “গবেষণা” করার দাবির সম্মুখীন হতে হয়, তখন একজন কার্যকর কার্যনির্বাহী প্রশ্ন করে: “নতুন করে বিশ্লেষণ করলেই যে ভালো কোন ফল আসবে সেটা বিশ্বাস করার কি কোন কারণ আছে? আর নতুন কাজটি যে প্রাসঙ্গিক হবে সেটা মনে করার কোন যুক্তি কি আছে?” যদি উত্তরটি “না” হয়—যেটা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই হয়ে থাকে—তবে কার্যকর কার্যনির্বাহী আরেকটি নতুন গবেষণা করার নির্দেশ দেয় না। সে নিজের সিদ্ধান্তহীনতাকে ঢাকতে দক্ষ মানুষের সময় ও শ্রম অপচয় করে না।

একই সময়ে সে না বুঝে ঝোঁকের বশে কোন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে না। যেকোন বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের মতোই সে নিজের মনের কথা শুনতে শিখেছে, যাকে সক্রেটিস “ডিমন তথা দৈত্য বা শয়তান: অভ্যন্তরীণ কণ্ঠস্বর বলে আখ্যায়িত করেছেন, শরীরের অভ্যন্তরীণ অন্ত্রের কোথাও থেকে উৎপত্তি হওয়া কণ্ঠ যে ফিসফিস করে বলে “সাবধান!”। কোন কিছু কঠিন, দ্বিমতযোগ্য বা ভীতিজনক হবার মানে এই নয় যে সেটা সঠিক হলেও করা যাবে না। কিন্তু তারপরেও মানুষ এক মুহূর্তের জন্য হলেও থেমে যায় যখন নিজেকে অস্বস্তি, বিচলিত ও বিরক্তিকর অবস্থায় আবিষ্কার করে, যদিও এর কারণ তার জানা নেই। “যখন আমার মনোযোগ ব্যহত হয়, তখন আমি কাজটা করা বন্ধ করে দিই,” আমার পরিচিত একজন সেরা সিদ্ধান্তগ্রহীতা বিষয়টাকে এভাবে ব্যাখ্যা করেছেন।

দশবারের মাঝে নয়বারেই দেখা যায় যে, এই অস্বস্তির পিছনে কোন ক্ষুদ্র বিষয় দায়ী। কিন্তু দশবারের বার হঠাৎ দেখা যায় যে, কোন একটি গুরুতর বিষয় উপেক্ষিত হয়েছে, বড় কোন ভুল হয়েছে কিংবা পুরো বিষয়টিকেই ভুলভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। দশবারের বার সিদ্ধান্তগ্রহীতা হঠাৎ মাঝরাতে ঘুম থেকে জেগে উঠে আর বুঝতে পারে—যেমনটা শার্লক হোমস তার বিখ্যাত গল্পে বুঝেছিল— “সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সূত্রটি ছিল বাস্কারভিলের কুকুরটি ডাকত না।”

কিন্তু কার্যকর সিদ্ধান্ত-গ্রহণকারী দীর্ঘসময় অপেক্ষা করে না—বড় জোর কয়েক দিন বা কয়েক সপ্তাহ। যদি তার “দৈত্য বা শয়তান” ততদিনে কিছু না বলে, তবে সে দ্রুততার সাথে কাজে নেমে পড়ে, তা সেটা তার পছন্দ হোক বা না হোক।

কার্যকর কার্যনির্বাহীদের নিজের পছন্দ মতো কাজ করার জন্য পারিশ্রমিক দেয়া হয় না। তাদের পারিশ্রমিক দেয়া হয় সঠিক এবং যথাযথ কাজটি করার জন্য—বিশেষ করে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ অর্থাৎ কার্যকর সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য।


সিদ্ধান্ত-গ্রহণ এবং কম্পিউটার


এই কথাগুলো কি আজকের দিনে প্রযোজ্য? যেখানে কম্পিউটার এখন আমাদের হাতের নাগালে। আমাদের বলা হয়, এই কম্পিউটার একসময় সিদ্ধান্ত-গ্রহণকারীদের, অন্তত ব্যবস্থাপনার মধ্যবর্তী সিদ্ধান্ত-গ্রহণকারীদের প্রতিস্থাপন করবে। কয়েক বছরের মধ্যেই এটা সকল উপদেশমূলক সিদ্ধান্তগুলো নেয়া শুরু করবে—আর শীঘ্রই কৌশলগত সিদ্ধান্তগুলোও নিজের হাতে নিয়ে নিবে।

প্রকৃতপক্ষে কম্পিউটার কার্যনির্বাহীদের সঠিক সিদ্ধান্তগুলো নিতে বাধ্য করবে, যা বর্তমানে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে স্বতঃস্ফূর্তভাবে নেয়া হয়। এটা গতানুগতিক সিদ্ধান্ত নেয়, এমন অনেক মানুষকে প্রকৃত কার্যনির্বাহী এবং সিদ্ধান্তগ্রহীতায় রূপান্তর করবে।

কম্পিউটার হলো একজন কার্যনির্বাহীর শক্তিশালী হাতিয়ার। হাতুড়ি কিংবা করাতের মতো এটা মানুষের সাহায্য ছাড়া আর কোন কাজ করতে পারে না। এটা মানুষের মতো এবং মানুষের চেয়ে অত্যন্ত দ্রুত কেবল একটি কাজ করতে সক্ষম—আর তা হলো—যোগ ও বিয়োগ। আর যন্ত্র হবার কারণেই এটা ক্লান্ত হয় না, বিরক্ত হয় না, ওভারটাইমের জন্য অতিরিক্ত অর্থ দাবি করে না। সকল যন্ত্রের মতোই এটা মানুষের কাজ মানুষের চেয়ে ভালোভাবে করতে পারে—কম্পিউটার মানুষের ক্ষমতাকে বহুগুণ বৃদ্ধি করে (অন্য যন্ত্র যেমন—চাকা, উড়োজাহাজ কিংবা টেলিভিশন এমন সব কাজ করতে পারে যা মানুষের পক্ষে করা অসম্ভব, এরা মানব সভ্যতার জন্য সম্ভাবনার নতুন দ্বার খুলে দেয়, অর্থাৎ মানবক্ষমতাকে বর্ধিত করে।) কিন্তু অন্য সব যন্ত্রের মতো কম্পিউটার কেবল একটি বা দুটি কাজই করতে পারে। এর কিছু সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। আর এই সীমাবদ্ধতাগুলোই আমাদের প্রকৃত সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করবে, যা আজকের দিনে “অ্যাড হক” তথা “প্রয়োজনীয় অভিযোজন” বলে পরিচিত ।

[ফজলে রাব্বির কথা—“অ্যাড হক” শব্দটি এসেছে ল্যাটিন শব্দ ভা-ার থেকে। এর মানে হচ্ছে ‘এজন্য বা এ পরিস্থিতির জন্য’। বর্তমানে আমেরিকান ইংরেজিতে অ্যাড হক সাধারণত ব্যবহার করা হয় কোন একটি বিশেষ বা হঠাৎ পরিস্থিতিতে ব্যবহৃত কলাকৌশল। সাধারণত পূর্বপরিকল্পনা ছাড়া হঠাৎ পরিস্থিতি থেকে উদ্ভূত সমস্যা মোকাবিলার জন্য কোনো কলাকৌশল ব্যবহার। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বলব, যেহেতু বাংলাদেশের ১০০ বছরের পরিকল্পনা বা বিশ^নেতা হওয়ার কোনো বাসনা নেই, সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের সব পরিকল্পনাই অ্যাড হক পরিকল্পনা। তথসূত্র: যঃঃঢ়ং://িি.িষবধৎহবৎংফরপঃরড়হধৎু.পড়স/য়ধ/যিধঃ-ফড়বং-ধফ-যড়প-সবধহ]

কম্পিউটারের আসল ক্ষমতা এর যৌক্তিকতার মধ্যে নিহিত। একে যা করার জন্য প্রোগ্রাম করা হয়, এটা ঠিক সেটাই করে। ফলে কাজটা দ্রুত ও নিখুঁত হয়। একই কারণে একে নির্বোধও বলা যেতে পারে; কারণ যুক্তি মূলত বোকামি। এটা শুধু সহজ ও সুস্পষ্ট কাজটা করছে। অপরদিকে, মানুষ যুক্তি দিয়ে নয়, বোধ তথা ইন্দ্রিয় দিয়ে সবকিছু বিচার করে। এর অর্থ হলো সে ধীর ও ভাবপ্রবণ। কিন্তু একই সাথে সে বুদ্ধিমান ও সপ্রতিভ। মানুষ নিজেকে যেকোন পরিস্থিতিতে খাপ খাওয়াতে পারে, অর্থাৎ সে অতি স্বল্প তথ্য বা তথ্যের অনুপস্থিতিতেও পুরো পরিস্থিতি অনুধাবন করতে সক্ষম। সে এমন অনেক কিছু মনে রাখতে পারে যা তাকে কেউ প্রোগ্রাম করে শিখিয়ে দেয়নি।

একটি সহজ ও একটি সাধারণ ক্ষেত্র, যেখানে একজন গতানুগতিক ব্যবস্থাপক সরাসরি ও তৎক্ষণাৎ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে থাকে, তা হলো তালিকা ও স্থানান্তর সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত। একজন সাধারণ স্থানীয় বিক্রয় কর্মকর্তা জানে যে, ক্রেতা “ক” সাধারণত একটি কঠিন শিডিউল মেনে তার কারখানা পরিচালনা করে এবং কোন কারণে পণ্য সরবরাহ করতে দেরি হলে সে বিপদের সম্মুখীন হবে। সে এটাও জানে যে, ক্রেতা “খ” সাধারণত অতিরিক্ত পণ্য তার সংগ্রহে রাখে এবং পণ্য সরবরাহ করতে কিছু দিন দেরি হলেও তার তেমন কোন ক্ষতি হবে না। সে জানে ক্রেতা “গ” ইতোমধ্যে তার কোম্পানির উপর বিরক্ত এবং সে কেবল অন্য কোম্পানিকে পণ্য সরবরাহের দায়িত্ব দেবার সুযোগ খুঁজছে। সে জানে তার পরিচিত কোন কারখানাতে অনুরোধ করে সেখান থেকে সে পণ্যটি এনে সরবরাহ করতে পারবে। আর এই সকল অভিজ্ঞতার আলোকেই একজন সাধারণ বিক্রয় কর্মকর্তা বিভিন্ন পরিস্থিতিতে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেয়।

কম্পিউটার এসবের কিছুই জানে না। অন্তত তাকে বিশেষ ভাবে এই বিষয়ে প্রোগ্রাম করা না হলে সে ক্রেতা “ক” এর কোম্পানির নীতি বা ক্রেতা “খ” এর পণ্য সংগ্রহ সম্পর্কে কিছুই জানতে পারবে না। এটা কেবল সেই কাজগুলোই করতে পারে যা তাকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এর “সিদ্ধান্ত” নেওয়ার ক্ষমতা একটি স্কেল বা ক্যাশ রেজিস্টারের চেয়ে বেশি নয়। এটা কেবল একটা কাজই করতে পারে—গণনা।

যখনই কোন কোম্পানি তার সংগ্রহ তালিকার নিয়ন্ত্রণ একটি কম্পিউটারের হাতে দিবে, সেটা বুঝতে পারবে যে তার এখন কিছু নিয়ম তৈরি করতে হবে। এর একটি সংগ্রহ তালিকা নীতিমালা গঠন করতে হবে। এই সমস্যা মিটে গেলে দেখা যাবে, সংগ্রহ সংক্রান্ত কোন মৌলিক সিদ্ধান্তই বস্তুত কোন সংগ্রহমূলক সিদ্ধান্ত নয়। এগুলো আসলে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ব্যবসায়িক সিদ্ধান্ত। সংগ্রহ তালিকা মূলত বিভিন্ন ঝুঁকির ভারসাম্য রাখার একটি উপায় মাত্র: সেবা ও সরবরাহ দ্বারা ক্রেতাদের অসন্তুষ্ট করার ঝুঁকি; উৎপাদন সময়সূচিতে বাঁধা কিংবা অস্থিরতার ঝুঁকি; এবং নষ্ট, অচল কিংবা অপ্রচলিত হতে পারে এমন পণ্যের পিছনে অর্থ ব্যয়ের ঝুঁকি।

প্রচলিত গতানুগতিক কার্যধারা এক্ষেত্রে কাজে আসে না। “আমাদের লক্ষ্য হলো ৯০ ভাগ ক্রেতার ৯০ ভাগ পণ্য বিতরণ প্রতিশ্রুতি পূরণ করা।”—এ কথাটা সুনির্দিষ্ট শোনায়। কিন্তু কেউ যখন এই কাজটা কম্পিউটারে বসে ধাপে ধাপে করার চেষ্টা করে তখন সে বুঝতে পারে এই চেষ্টা আসলে অর্থহীন। তার মানে কি এই বোঝায় যে, আমাদের ক্রেতারা তাদের প্রত্যাশিত ১০টি অর্ডারের ৯টিই পাবে? এর মানে কি এই যে আমাদের সেরা ক্রেতারা সবসময় তাদের সকল অর্ডার সময় মতো পাবে-তাছাড়া “সেরা ক্রেতা” কথাটার অর্থই বা কি? এর মানে কি এই যে আমাদের লক্ষ্য, আমাদের সকল পণ্যের ক্ষেত্রে সকল প্রতিশ্রুতি পূরণ করা? নাকি আমাদের সবচেয়ে বেশি উৎপাদিত পণ্যের ক্ষেত্রেই শুধু এই কথাটা প্রযোজ্য? এবং আমাদের অন্যান্য শত শত পণ্য যা আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ না হলেও আমাদের অনেক ক্রেতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ এবং তারা সেগুলোর কোন একটা যদি অর্ডার দিয়ে থাকে তবে সেক্ষেত্রে কী করণীয়? এবং এ বিষয়ক কোন নীতিমালা কি আমাদের আছে?

এই প্রতিটি প্রশ্নের জন্য একটি ঝুঁকিপূর্ণ, সর্বোপরি একটি নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রয়োজন। যতক্ষণ পর্যন্ত না এই সিদ্ধান্তগুলো নেয়া হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত একটি কম্পিউটার সংগ্রহ তালিকাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। এই সিদ্ধান্তগুলো অনিশ্চিত বিধায় এগুলোর প্রাসঙ্গিকতা স্পষ্টভাবে একটি কম্পিউটারকে বোঝানো সম্ভব নয়।

এ কারণেই কম্পিউটার—বা অনুরূপ যেকোনো যন্ত্র—কে পূর্বনির্ধারিত প্রতিক্রিয়াভিত্তিক কাজ করতে দেয়া হয়, (দূরবর্তী কোন অঞ্চলে কোন শত্রুপক্ষীয় পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্রের উপস্থিতি দেখা যাচ্ছে কিনা বা কোনো পেট্রোলিয়াম শোধনাগারে অস্বাভাবিক পরিমাণে সালফার সমৃদ্ধ অপরিশোধিত তেলের উপস্থিতি রয়েছে কিনা) যেখানে সিদ্ধান্তটি প্রত্যাশিত ও সুচিন্তিত। হুট করে এসব সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে না। বা এদের ছোট ছোট অংশে বিভক্ত করে অভিযোজিত করা যাবে না, যাকে পদার্থবিজ্ঞানের পরিভাষায়, বাস্তব সিদ্ধান্তের পরিবর্তে ‘অপার্থিব’ সিদ্ধান্ত বলা হয়। এক্ষেত্রে সিদ্ধান্তটি হতে হবে নীতিগত।

কম্পিউটার এর পিছনে দায়ী নয়। কম্পিউটারের মতো একটি যন্ত্র কোন কিছুর ঘটার পিছনে দায়ী হতে পারে না। এটা কেবল আগে থেকে ঘটমান কাজে কিছুটা স্বস্তি নিয়ে আসে। ছোট অভিযোজন থেকে এমন নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়ার প্রক্রিয়া অনেক আগে থেকেই চলে এসেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এবং যুদ্ধ পরবর্তী পরিস্থিতিতে, এই বিষয়টি আরও বেশি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এর কারণ হলো সে সময় সামরিক কার্যক্রম অনেক বেশি বৃহৎ এবং পরস্পর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল।

যেমন—তখন সকল অপারেশন, সশস্ত্র কার্যক্রমের সমস্ত শাখা এবং মধ্যম স্তরের কমান্ডারদের সমন্বয়কারী রসদ সরবরাহ ব্যবস্থাকে কৌশলগত সিদ্ধান্ত পরিচালনার ক্রমবর্ধমান কাঠামো সম্পর্কে অবগত থাকতে হত। তাদের স্থানীয় ঘটনাবলি দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার পরিবর্তে প্রতিনিয়ত বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্ত নিতে হত। যেসকল দ্বিতীয় স্তরের সেনাধ্যক্ষগণ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বীরের মর্যাদা লাভ করেছিলেন, যেমন- রোমেল, ব্র্যাডলি কিংবা ঝুকভ; তারা সকলেই সুচিন্তিত মৌলিক সিদ্ধান্ত নেওয়া “মধ্যম ব্যবস্থাপক” ছিলেন। তাদের কেউই আগেরকার সময়ের যুদ্ধের “সুদর্শন তলোয়ার দল” কিংবা সুদর্শন অশ্বারোহী সেনাধ্যক্ষদের পন্থা অবলম্বন করেননি।

ফলস্বরূপ, সিদ্ধান্ত-গ্রহণ এখন আর হাতে গোনা কিছু শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিদের মাঝে সীমাবদ্ধ নয়। কোন না কোন ভাবে, একটি প্রতিষ্ঠানের প্রত্যেক জ্ঞানকর্মীকে হয় নিজেকে একজন সিদ্ধান্তগ্রহীতায় পরিণত করতে হবে, অথবা নিজেকে সিদ্ধান্ত-গ্রহণ প্রক্রিয়ার একজন বুদ্ধিমান, সক্রিয় ও স্বতন্ত্র অংশে পরিণত করতে হবে। আগে যা সীমিত কিছু মানুষের ক্ষমতা হিসাবে গণ্য হত, এখন নতুন সামাজিক ব্যবস্থায় তা বৃহৎ জ্ঞান প্রতিষ্ঠানের প্রতিটি ক্ষেত্রের একটি স্বাভাবিক কাজে পরিণত হয়েছে। কার্যকর সিদ্ধান্ত-গ্রহণের ক্ষমতা, নলেজ ওয়ার্কার তথা জ্ঞানকর্মী বিশেষ করে দায়িত্বশীল এবং কার্যকর জ্ঞানকর্মীদের সক্ষমতা নির্ধারণ করে।

সিদ্ধান্ত স্থানান্তরিত করার একটি ভালো উদাহরণ হলো আমাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া নতুন কৌশল—বহুল আলোচিত পিইআরটি (প্রোগ্রাম ইভ্যালুয়েশন অ্যান্ড রিভিউ টেকনিক) অর্থাৎ কর্মসূচি মূল্যায়ন ও পর্যালোচনা প্রযুক্তি। যার লক্ষ্য জটিল কোনো কার্যক্রমের অন্তর্গত গুরুতর কাজগুলোর একটি রোডম্যাপ সরবরাহ করা, যেমন—একটি নতুন মহাকাশ যান গঠন এবং নির্মাণ। পিইআরটি (প্রোগ্রাম ইভ্যালুয়েশন অ্যান্ড রিভিউ টেকনিক) অর্থাৎ কর্মসূচি মূল্যায়ন ও পর্যালোচনা প্রযুক্তির উদ্দেশ্য হলো, এমন কার্যক্রমের প্রতিটি অংশের এবং কাজের ধারাবাহিকতা, প্রতিটি অংশের নির্দিষ্ট সময়সীমা নির্ধারণের অগ্রিম পরিকল্পনা করা যাতে কার্যক্রমটি সময়মতো সম্পন্ন হয়। এটা প্রয়োজনীয় অভিযোজনকে তীব্রভাবে অগ্রাহ্য করে। এর পরিবর্তে এখানে উচ্চ ঝুঁকিসম্পন্ন সিদ্ধান্তসমূহ নেয়া হয়। প্রথম কয়েকবার অপারেটিং কর্মীদের একটি পিইআরটি সময়সূচি তৈরি করে নিতে হয়, আর অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাদের প্রতিটি সিদ্ধান্ত ভুল প্রমাণিত হয়।কারণ তারা এখনো প্রয়োজনীয় অভিযোজনের মাধ্যমে এমন কাজ করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে যা পদ্ধতিগত, ঝুঁকিমূলক সিদ্ধান্ত-গ্রহণের মাধ্যমেই কেবল করা সম্ভব।

একটি কম্পিউটারও কৌশলগত সিদ্ধান্ত-গ্রহণের ক্ষেত্রে একই প্রভাব ফেলে। যদিও এটা অবশ্যই, সেই সিদ্ধান্তগুলো নিতে অক্ষম। এটা কেবল একটা অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ সম্পর্কিত কিছু অনুমান থেকে কী উপসংহার টানা যায় কিংবা বিপরীতভাবে, কিছু নির্দিষ্ট প্রস্তাবিত ক্রিয়াকলাপ থেকে কী অনুমান করা যায়—তা নিয়ে কাজ করতে পারে (তাও আবার সম্ভাব্য, নিশ্চিত নয়)। আবারো বলতে হয়, এটা কেবল গণনাই করতে পারে। এ কারণে সবসময় এটা স্পষ্ট বিশ্লেষণ দাবি করে, বিশেষ করে একটা সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় শর্ত পূরণের ক্ষেত্রে। এজন্য ঝুকিপূর্ণ, উচ্চতর সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রয়োজন হয়।

সিদ্ধান্ত-গ্রহণের ক্ষেত্রে কম্পিউটারের অতিরিক্ত প্রভাব রয়েছে। যদি সঠিকভাবে ব্যবহার করা যায়, তবে এটা প্রতিষ্ঠানের ব্যস্ত ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ কিছু জরুরি তথ্য দিয়ে তাদের কাজে ভার কমাতে পারে, যার ফলে তারা বাইরের জগতে গিয়ে তাদের কাজের প্রকৃত ফলাফল সম্পর্কে ধারণা নেওয়ার সুযোগ পায়।

কম্পিউটার সিদ্ধান্ত-গ্রহণের ক্ষেত্রে একটি সাধারণ ভুলকে পরিবর্তনও করতে পারে। একটি স্বাভাবিক এবং সাধারণ পরিস্থিতিকে ধারাবাহিক অনন্য ঘটনাবলি ভাবার ভুল প্রবণতা আমাদের অনেক দিনের। আমরা স্বভাবগতভাবেই লক্ষণ দেখে ওষুধ দিই। কিন্তু কম্পিউটার শুধু সাধারণ ঘটনাকেই যুক্তি দিয়ে বিশ্লেষণ করতে পারে। আর তাই ভবিষ্যতে হয়তো আমরা অনন্য, অসাধারণ ঘটনাবলিকে সাধারণ ভাবার ভুল করতে শুরু করব।

এই প্রবণতা দেখে হয়তো এটা প্রতীয়মান হয় যে, আমরা কম্পিউটারকে, প্রমাণিত এবং পরীক্ষিত একজন সামরিক ব্যক্তি দ্বারা প্রতিস্থাপিত করতে চাচ্ছি। এই বিষয়টিকে উচ্চপদস্থ সামরিক কর্তাদের গজগজানি বলে উড়িয়ে দেয়া যাবে না। সামরিক সিদ্ধান্তকে মানসম্মত করার প্রয়াসে করা সবচেয়ে জোরালো দাবিটি করেছিলেন স্যার সলি জাকারম্যান (ঝরৎ ঝড়ষষু তঁপশবৎসধহ) নামক একজন অসামান্য বেসামরিক “ব্যবস্থাপনা বিজ্ঞানী”। স্যার জাকারম্যান ছিলেন একজন বিশিষ্ট ব্রিটিশ জীববিজ্ঞানী, যিনি ব্রিটিশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা হিসাবে কম্পিউটার বিশ্লেষণ এবং গবেষণা কার্যক্রমের বিকাশে প্রধান ভূমিকা পালন করেছিলেন।

কম্পিউটারের সর্বাধিক প্রভাব তার সীমাবদ্ধতার মধ্যে নিহিত, যা আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে ক্রমান্বয়ে বাধ্য করতে থাকবে এবং সর্বোপরি মধ্যম ব্যবস্থাপকদের অপারেটর থেকে কার্যনির্বাহী এবং সিদ্ধান্ত গ্রহীতা হতে বাধ্য করবে।

এটা এমনিতেও হত। এমন প্রতিষ্ঠানের সবচেয়ে বড় শক্তি হলো, এরা অনেক আগেই ব্যবস্থাপনাকে সত্যিকার সিদ্ধান্ত হিসাবে গণ্য করতে শুরু করেছিল। ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের মাঝে জেনারেল মটরস কিংবা সামরিক বাহিনীর মাঝে জার্মান সেনাদক্ষ্যগণ এর উদাহরণ।

যত দ্রুত অপারেটিং ম্যানেজারগণ প্রকৃত ঝুঁকি এবং অনিশ্চয়তার উপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত নেয়া শিখবে, তত দ্রুত আমরা বৃহৎ সংগঠনগুলোর মূল সমস্যার একটিকে কাটিয়ে উঠতে পারব—আর তা হলো শীর্ষ পদগুলোতে সিদ্ধান্ত-গ্রহণের উপর প্রশিক্ষণ ও পরীক্ষার অনুপস্থিতি। যতদিন পর্যন্ত আমরা পরিচালনা স্তরে চিন্তাভাবনার বদলে অভিযোজনের মাধ্যমে, জ্ঞান ও বিশ্লেষণের বদলে “অনুভূতি” দিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করব, ততদিন আমাদের সরকারি, সামরিক কিংবা ব্যবসা ক্ষেত্রের পরিচালকেরা শীর্ষ কার্যনির্বাহী হিসাবে প্রথম কৌশলগত সিদ্ধান্ত নেওয়ার মুখে প্রশিক্ষণহীন এবং অপরীক্ষিতই রয়ে যাবে।

একটি সামান্য স্কেল একজন স্কুল ছাত্রকে একজন গণিতবিদে পরিণত করতে যতটা সাহায্য করে, একটি কম্পিউটার একজন কর্মচারীকে সিদ্ধান্তগ্রহীতায় পরিণত করতে ঠিক ততটুকুই সাহায্য করে। কিন্তু কম্পিউটার আমাদের একজন সামান্য কর্মচারী এবং একজন সম্ভাব্য সিদ্ধান্তগ্রহীতার মাঝে প্রাথমিক পার্থক্য করতে বাধ্য করবে। আর এটা দ্বিতীয় দলের মানুষদের উদ্দেশ্যমূলক, কার্যকর সিদ্ধান্ত গ্রহণ শিখতে বাধ্য করবে। কেউ যদি এই কাজটি ভালোভাবে না করে তবে কম্পিউটার তার কাজ করতে পারবে না। কেন কম্পিউটারের আবির্ভাব সিদ্ধান্ত-গ্রহণের ক্ষেত্রে আগ্রহ সৃষ্টি করেছে, তার পিছনে যথেষ্ট কারণ রয়েছে। কিন্তু কম্পিউটার সিদ্ধান্ত-গ্রহণের দায়িত্ব সম্পূর্ণ “নিজের কাঁধে তুলে নিবে” এমনটা কখনোই ভাবা হয়নি। কম্পিউটারকে সিদ্ধান্ত-গ্রহণের প্রক্রিয়ার অন্তর্ভুক্ত করার কারণ হলো—যদি কম্পিউটার গণনার দায়িত্ব নেয়, তবে প্রতিষ্ঠানের সর্বস্তরের মানুষ কার্যনির্বাহী হয়ে কার্যকর সিদ্ধান্ত নেয়া শিখতে বাধ্য হবে।


উপসংহার


কার্যকারিতা অবশ্যই শিখতে হবে


এই বই দুটি বিষয়ের উপর ভিত্তি করে লেখা হয়েছে:


▪ কার্যনির্বাহীর কাজ হলো কার্যকর হওয়া; এবং

▪ কার্যকারিতা শেখা সম্ভব।


কার্যনির্বাহীকে কার্যকর হওয়ার জন্য পারিশ্রমিক প্রদান করা হয়। যে প্রতিষ্ঠানের জন্য তিনি কাজ করেন, তাদের এই কার্যকারিতা পাওনা। তবে—একজন কার্যনির্বাহককে তার পদমর্যাদা অর্জন করতে হলে কী শিখতে হবে এবং কোন কাজগুলো করতে হবে?—এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য এই বইটি সামগ্রিকভাবে, সাংগঠনিক কর্মক্ষমতা এবং নির্বাহী কর্মক্ষমতাকে নিজের ও কার্যনির্বাহীদের লক্ষ্য হিসাবে ধরে নিয়েছে।

কার্যকারিতা শেখা সম্ভব—এটা দ্বিতীয় ভিত্তি। এই বইটি তাই নির্বাহী কর্মক্ষমতার বিভিন্ন মাত্রাকে ক্রমানুসারে এমনভাবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছে যাতে তা পাঠকদের কার্যকর কার্যনির্বাহী হবার শিক্ষা লাভের জন্য উজ্জীবিত করে। এটা অবশ্যই কোনও পাঠ্যপুস্তক নয়, কারণ কার্যকারিতা শেখা গেলেও তা শেখানো সম্ভব নয়। সর্বোপরি, কার্যকারিতা কোন “বিষয়বস্তু” নয় বরং এটা একটা স্ব-শৃঙ্খলা। কিন্তু এই বই জুড়ে, এর অন্তর্নিহিত কাঠামোতে এবং যেভাবে বইটি তার বিষয়বস্তুকে উপস্থাপন করে, সেখানে সবসময় একটি প্রশ্নই উঠে আসে: “কোন প্রতিষ্ঠানে এবং একজন কার্যনির্বাহীর কর্মদিবসের কোন কোন কাজের ক্ষেত্রে কার্যকারিতা দেখানো সম্ভব?”

কিন্তু খুব কমই এই প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা হয়: “কেন কার্যকারিতা থাকা প্রয়োজন?” কার্যকারিতার লক্ষ্যকে কেউ গুরুত্ব দেয় না।

এই অধ্যায়গুলোর যুক্তিপ্রবাহ এবং অনুসন্ধানগুলোর দিকে ফিরে তাকালে, কার্যনির্বাহীর কার্যকারিতার একটি অভিনব দিক উন্মোচিত হয়। কার্যকারিতা নিজেকে মানুষের আত্মবিকাশ, প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নের এবং আধুনিক সমাজের পরিপূর্ণতার অপরিহার্য অংশ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছে।


কার্যকারিতার প্রথম ধাপ


১। কার্যকারিতার প্রথম ধাপ হলো একটি প্রক্রিয়া; সময় কীভাবে ব্যয় হচ্ছে তার রেকর্ড রাখা। এটা যান্ত্রিক প্রক্রিয়া। এমনকি কার্যনির্বাহীর নিজের এই কাজটা করার দরকার নেই; এই কাজ একজন সহকারীকে দিয়ে করানোই উত্তম। তা সত্ত্বেও, একজন কার্যনির্বাহী যদি কেবল এই কাজটাই করতে থাকে, সে যথেষ্ট উন্নতি করতে পারবে। এর ফলাফল তাৎক্ষণিকভাবে পাওয়া যাবে। আর তাৎক্ষণিক না পেলেও খুব দ্রুতই ফল পাওয়া যাবে। যদি ধারাবাহিকভাবে কাজটা করা হয়। তবে সময়ের রেকর্ড রাখা, একজন মানুষকে বৃহত্তর কার্যকারিতা অর্জনের জন্য পদক্ষেপ নিতে উদ্বুদ্ধ করবে।

একজন কার্যনির্বাহকের সময়ের বিশ্লেষণ, অপ্রয়োজনীয় সময় অপচয়কারীদের নির্মূল করতে কিছু পদক্ষেপ নেয়া আবশ্যক। এক্ষেত্রে কিছু মৌলিক সিদ্ধান্ত-গ্রহণের প্রয়োজন পড়ে। এজন্য একজন মানুষের আচরণ, সম্পর্ক এবং সং¯্রবে কিছু পরিবর্তন আনতে হয়। এটা বিভিন্ন কাজে, বিভিন্ন লক্ষ্য অর্জনে সময়ের নানাবিধ ব্যবহারের আপেক্ষিক গুরুত্ব সম্পর্কে কিছু প্রশ্নের জন্ম দেয়। এর অধিকাংশ কাজের স্তর ও গুণগত মানকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা থাকতে হবে। এই কাজটা কয়েক মাস পরপর একটা চেকলিস্ট দেখার মাধ্যমে, অর্থাৎ লিখিতভাবে করা যেতে পারে। কাজটা এখনও নিজেকে কিছু অপ্রতুল সম্পদের কার্যকর ব্যবহারের সাথেই সম্পৃক্ত করে, যেমন: সময়।


কার্যকারিতার দ্বিতীয় ধাপ


২। পরবর্তী ধাপ যেখানে একজন কার্যনির্বাহীকে তার দৃষ্টি, অবদান রাখার উপর নিবদ্ধ রাখতে বলা হয়, সেটা প্রক্রিয়াগত থেকে ধারণাবাদী, যান্ত্রিক থেকে শুরু করে বিশ্লেষণ এবং কার্যকারিতা থেকে ফলাফল পর্যন্ত বিস্তৃত। এই ধাপে কার্যনির্বাহী নিজেকে এই অনুধাবনের জন্য প্রস্তুত করে যে, কেন তাকে পারিশ্রমিক দেয়া হচ্ছে এবং তাকে কী অবদান রাখতে হবে। এটা জটিল কোন বিষয় নয়। কার্যনির্বাহক, অবদান সম্পর্কিত সোজাসাপটা প্রশ্নগুলোই নিজেকে জিজ্ঞেস করে যা কমবেশি পরিকল্পিত হয়ে থাকে। কিন্তু এই প্রশ্নগুলোর উত্তরের কাজ হলো তার চাহিদা বৃদ্ধি, তার এবং তার প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য ও নীতি নির্ধারণ করা। উত্তরগুলোর কাজ হলো কার্যনির্বাহীর সামগ্রিক মান উন্নয়ন। সর্বোপরি, এই প্রশ্নগুলো কার্যনির্বাহীকে অধীনস্থ থাকার বদলে দায়িত্বশীল হতে বলে। তাকে “বসকে খুশি করো” এই ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে অনুপ্রাণিত করে। নিজের এবং নিজের অবদানের উপর দৃষ্টিনিবদ্ধ করার মাধ্যমে আসলে একজন কার্যনির্বাহী শুধু কর্মপদ্ধতি নিয়ে না ভেবে উদ্দেশ্য ও ফলাফল নিয়ে ভাবতে শুরু করে।


কার্যকারিতার তৃতীয় ধাপ


৩। শক্তিকে কার্যক্ষম করা, মৌলিকভাবে একটি দৃষ্টিভঙ্গি যা আচরণে প্রকাশ পায়। এর ভিত্তি হলো ব্যক্তির প্রতি সম্মান—নিজের এবং অন্যদের প্রতি শ্রদ্ধা। এটা একটা কার্যক্ষম মূল্য নির্ধারণ প্রক্রিয়া। কিন্ত এটা আবার “করার মাধ্যমে শেখা” এবং অনুশীলনের মাধ্যমে আত্মউন্নয়নও বটে।

শক্তিকে কার্যক্ষম করতে, কার্যনির্বাহী স্বতন্ত্র উদ্দেশ্য ও প্রতিষ্ঠানের চাহিদা, ব্যক্তিগত ক্ষমতা ও প্রতিষ্ঠানের ফলাফল, ব্যক্তিগত অর্জন ও প্রতিষ্ঠানের সুযোগকে একীভূত করে।


কার্যকারিতার চতুর্থ ধাপ


৪। পঞ্চম অধ্যায়—“আগের কাজ আগে করা”, পূর্ববর্তী অধ্যায়—“নিজের সময়কে জানুন / সময় জ্ঞান” এর প্রত্যুত্তর হিসাবে কাজ করে। এই দুই অধ্যায়কে দ্বৈত স্তম্ভ বলা যেতে পারে, যার মধ্যস্থলে কার্যনির্বাহকের কার্যকারিতা বিচরণ এবং বিস্তার লাভ করে। কিন্তু এক্ষেত্রে প্রক্রিয়াটি এখন আর সম্পদ বা সময় নিয়ে কাজ করবে না। এখন এর বিচরণ ক্ষেত্র হলো ফলাফল ও কার্যনির্বাহী এবং প্রতিষ্ঠানের কার্যক্ষমতা।

এখন থেকে পূর্বঘটিত কোন বিষয় রেকর্ড আর বিশ্লেষণ নয়; বরং এখন আমাদের চারপাশে নতুন কিছু ঘটিয়ে দেখাতে হবে। আর এখানে তথ্য সন্ধান নয়, এখানে চরিত্র—দূরদৃষ্টি, স্বাবলম্বিতা, সাহসিকতা গঠন করা হবে। অন্য কথায় এখানে নেতৃত্ব গঠন করা হবে, তবে এই নেতৃত্ব প্রতিভা কিংবা জ্ঞানের নয়, এটা হবে বিনয়ী কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী নেতৃত্ব যা গুরুত্ব প্রদান করবে আত্মোৎসর্গ, সংকল্প এবং গুরুতর উদ্দেশ্যের উপর।


কার্যকারিতার পঞ্চম ধাপ


৫। কার্যকরী সিদ্ধান্ত, যেটা সর্বশেষ অধ্যায়ে আলোচনা করা হয়েছে, তা যুক্তিযুক্ত পদক্ষেপের সাথে সম্পর্কিত। কার্যকারিতা অর্জনের এমন কোন নির্দিষ্ট বা চিহ্নিত পথ নেই, যে পথে একজন কার্যনির্বাহীকে চলতে হবে। কিন্তু এক ধাপ থেকে আরেক ধাপে যাবার জরিপকৃত কিছু স্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, একজন কার্যনির্বাহক একটি সাধারণ সমস্যা গঠন করা কিছু ঘটনা প্রবাহ দেখে কীভাবে সেই সমস্যা সমাধানের সিদ্ধান্তটি নিতে পারে তা কোথাও বলা নেই। এটা পরিস্থিতি ভেদে ভিন্ন হয়ে থাকে। কিন্তু কী করতে হবে এবং কোন ক্রমানুসারে করতে হবে সেটা স্পষ্ট বলাই থাকে। এই দিকনির্দেশনাগুলো মেনে একজন কার্যনির্বাহী একটি দায়িত্বশীল সিদ্ধান্ত নেবার জন্য নিজেকে প্রশিক্ষণ দিতে পারে। কার্যকরী সিদ্ধান্তের জন্য প্রক্রিয়া ও বিশ্লেষণ উভয়েরই প্রয়োজন হয়, তবে এর সারমর্ম হলো কর্মের নৈতিকতা।

একজন নির্বাহীর আত্ম-বিকাশের জন্য কার্যকারিতার প্রশিক্ষণ ছাড়াও অনেক কিছু রয়েছে। তাকে জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জন করতে হবে। কর্মক্ষেত্রে সে যত অগ্রসর হবে, তাকে ততই নতুন নতুন কাজ করার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে, আবার পুরোনো কিছু অভ্যাস ত্যাগও করতে হবে।

তবে জ্ঞান, দক্ষতা এবং অভ্যাস, যেভাবেই অর্জন করা হোক না কেন, কার্যনির্বাহী তার থেকে বিশেষ কোন উপকার পাবেন না যদি না তিনি প্রথমে নিজের কার্যকারিতার বিকাশ ঘটান।

কার্যকর কার্যনির্বাহী হওয়ার মাঝে অহংকারের কিছুই নেই। এটা হাজারো মানুষের মতোই নিজের কাজ করা বোঝায়। কেউ কার্যকর কার্যনির্বাহী হিসাবে প্রশিক্ষিত করার এই নিবন্ধকে কেউ কিয়ের্কেগার্ডের আত্মবিকাশের মহান পুস্তিকা “খ্রিস্টানত্বের জন্য প্রশিক্ষণ” (ঞৎধরহরহম রহ ঈযৎরংঃরধহরঃু) এর সাথে তুলনা করবে এমন সম্ভাবনা নেই। একজন মানুষের জীবনে কার্যকর কার্যনির্বাহী হওয়া ছাড়াও অনেক উচ্চাভিলাষ থাকতে পারে। কিন্তু এই লক্ষ্যটা এতটাই মহৎ যে আমরা এটা অর্জনের আশা অবশ্যই করতে পারি । কারণ আজকের আধুনিক সমাজ এবং প্রতিষ্ঠানে বহুসংখ্যক কার্যকর কার্যনির্বাহী থাকার প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম।

আমাদের যদি জ্ঞানের পদগুলোতে সাধু-সন্ন্যাসী, কবি বা এমনকি প্রথম স্তরের প-িতদের প্রয়োজন হত তাহলে বৃহত্তর প্রতিষ্ঠানগুলো অযৌক্তিক এবং অসম্ভব হয়ে পড়ত। সাধারণ মানুষ অসাধারণ কর্মদক্ষতা প্রদর্শন করে বৃহত্তর প্রতিষ্ঠানগুলোর চাহিদা পূরণ করতে পারে। এটাই একজন কার্যকর কর্মকর্তাকে করে দেখাতে হবে। লক্ষ্য মহৎ হলেও, পরিশ্রমের মাধ্যমে সকলের পক্ষে লক্ষ্যটা অর্জন সম্ভব হলেও, এক্ষেত্রে একজন কার্যকর কার্যনির্বাহকের আত্মোন্নয়নই তার প্রকৃত ব্যক্তিগত উন্নয়ন বলে গণ্য হয়। এটা যান্ত্রিকতা থেকে দৃষ্টিভঙ্গি, বিশ্বাস, চরিত্র এবং প্রক্রিয়া থেকে প্রতিশ্রুতি পর্যন্ত বিস্তৃত।

একটি প্রতিষ্ঠানের উন্নতির জন্য একজন কার্যকর কার্যনির্বাহীর আত্মবিকাশ অপরিহার্য, তা সেই প্রতিষ্ঠান ব্যবসায়িক, সরকারি সংস্থা, গবেষণাগার, হাসপাতাল কিংবা সামরিক বাহিনী যাই হোক না কেন। তার কর্মদক্ষতা, প্রতিষ্ঠানের কর্মদক্ষতারই প্রতিচ্ছবি। কার্যনির্বাহীগণ, কার্যকর হবার পথে অগ্রসর হলে তারা পুরো প্রতিষ্ঠানের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি করতে পারে। তারা নিজেদের পাশাপাশি অন্যদেরও লক্ষ্য অর্জনে অনুপ্রাণিত করতে সক্ষম।

ফলস্বরূপ, প্রতিষ্ঠানটি কেবল সক্ষমই হয়ে ওঠে না, সাথে বিভিন্ন কাজ করার এবং বিভিন্ন লক্ষ্য অর্জন করার জন্য অনুপ্রাণিত হয়। কার্যনির্বাহী কার্যকারিতার বিকাশ, প্রতিষ্ঠানের দিকনির্দেশ, লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্যগুলোকে চ্যালেঞ্জ করে। এটা মানুষের দৃষ্টিকে সমস্যা থেকে সুযোগের দিকে, দুর্বলতার দুশ্চিন্তা থেকে শক্তির বিকাশের দিকে নিয়ে আসে। এমতাবস্থায় প্রতিষ্ঠানটি উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন উচ্চাকাক্সক্ষী মানুষদের আকৃষ্ট করতে শুরু করে এবং কর্মীদের উচ্চ কর্মদক্ষতা ও উদ্যম প্রকাশে উৎসাহিত করে। তাদের কর্মীরা দক্ষ হয়, কারণ তারা নিজেদের মান, অভ্যাস ও পরিবেশের মাধ্যমে তাদের আত্মবিকাশে উদ্বুদ্ধ করে। আর এই পরিবেশের সৃষ্টি তখনই হয়, যখন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা পদ্ধতিগত, একাগ্র এবং উদ্দেশ্যমূলক স্ব-প্রশিক্ষণের মাধ্যমে নিজেদের কার্যকর কার্যনির্বাহী হবার লক্ষ্যে নিয়োজিত করে।

আধুনিক সমাজ, কার্যক্রম পরিচালনা এবং অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য বৃহৎ প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মক্ষমতা, ফলাফল, মূল্যবোধ, মানদ- ও স্ব-চাহিদার উপর নির্ভরশীল।

প্রাতিষ্ঠানিক কর্মক্ষমতার প্রয়োজনীয়তা বর্তমানে অর্থনৈতিক এমনকি সামাজিক ক্ষেত্রকেও ছাড়িয়ে গেছে। উদাহরণস্বরূপ—শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা , জ্ঞানের অগ্রগতিতেও এর চাহিদা দেখা দিয়েছে। ক্রমবর্ধমান বৃহত্তর প্রতিষ্ঠান যাকে জ্ঞানসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান হিসাবে গণনা করা করা হয়, সেটা বিপুল সংখ্যক নারী ও পুরুষকে জ্ঞানসংশ্লিষ্ট কর্মী হিসাবে নিয়োগ দেয় যাদের কার্যনির্বাহী হিসাবে দায়িত্ব পালন করতে হয়। এই নারী ও পুরুষদের ফলাফল প্রদর্শন করতে হয়। তারা নিজেদের জ্ঞান ও কর্মের মাধ্যমে এমন সব সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে যা সমগ্র প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম এবং কর্মক্ষমতার উপর প্রভাব ফেলে।

কার্যকর প্রতিষ্ঠান, কার্যকর কার্যনির্বাহীর চাইতেও বিরল। মাঝে মাঝে এখানে সেখানে কিছু উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত দেখা গেলেও সামগ্রিকভাবে প্রতিষ্ঠানের কার্যকারিতা এখনও আদিম। আধুনিক বৃহৎ ব্যবসাক্ষেত্রে, আধুনিক বৃহৎ সরকারি সংস্থায়, আধুনিক বৃহৎ হাসপাতালে বা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিপুল পরিমাণ সংস্থান এনে একত্রিত করা হলেও, এর অধিকাংশ ফলাফলই হয় মাঝারি গোছের। নতুন কোন সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপ নেয়া এড়াতে অনেক বেশি শ্রম, প্রচেষ্টা অতীতকে ধরে রাখার জন্য ব্যয় করা হয়। প্রতিষ্ঠান ও কর্মকর্তা উভয়কেই পদ্ধতিগতভাবে কার্যকারিতা গঠনের জন্য কাজ করতে হবে এবং কার্যকারিতার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। তাদের সুযোগের সদ্ব্যবহার এবং সমস্যার নির্মূলকরণ শিখতে হবে। তাদের শক্তিকে সামর্থ্যে পরিণত করতে হবে। তাদের সবকিছু করার চেষ্টার বদলে গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলোতে মনোনিবেশ করার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে।

তবে কার্যনির্বাহীর কার্যকারিতা অবশ্যই কার্যকর সংগঠনের একটি মৌলিক চাহিদা এবং সাংগঠনিক উন্নয়নের একটি অত্যাবশ্যক উপাদান।

কার্যনির্বাহীর কার্যকারিতা আধুনিক সমাজের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক বিকাশের একটি সেরা সম্ভাবনা।

একজন জ্ঞান কর্মী, এই বইয়ে যেমনটা বারবার বলা হয়েছে, দ্রুতই উন্নত দেশগুলোর বড় সম্পদে পরিণত হচ্ছে। সে একটা বৃহৎ বিনিয়োগ হিসাবে বিবেচিত হচ্ছে; কারণ শিক্ষাই সবচেয়ে ব্যয়বহুল বিনিয়োগ। সে প্রধান ব্যয় কেন্দ্র হয়ে উঠছে। জ্ঞানকর্মীকে কার্যক্ষম করা, একটি শিল্পোন্নত সমাজের বিশেষ অর্থনৈতিক চাহিদায় পরিণত হচ্ছে। এমন সমাজের শ্রমিকের ব্যয়, স্বল্পোন্নত কিংবা উন্নয়নশীল দেশের শ্রমিকের ব্যয়ের সাথে তুলনীয় নয়। কেবল জ্ঞানকর্মীদের কার্যক্ষমতা; স্বল্প মজুরিসম্পন্ন উন্নয়নশীল অর্থনীতির বিপরীতে উন্নত দেশগুলোকে নিজেদের জীবনযাত্রার উচ্চমান ধরে রাখতে সাহায্য করতে পারে।

বর্তমানে একজন অত্যন্ত আশাবাদী মানুষই কেবল শিল্পোন্নত দেশগুলোর জ্ঞান কর্মীর কার্যক্ষমতা নিয়ে সন্তুষ্ট হতে পারবে। বলতে বাধ্য হচ্ছি, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে, কর্মক্ষেত্রে কায়িক শ্রম থেকে মানসিক শ্রমের দিকে কেন্দ্রের যে অসাধারণ স্থানান্তর ঘটেছে, তা কোন বিস্ময়কর ফলাফল প্রদর্শন করতে পারেনি।

উৎপাদনশীলতা এবং মুনাফা বৃদ্ধি—অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি পরিমাপের দুটি মূল চাবিকাঠি—এদের কোনটিতেই লক্ষণীয় কোন প্রবৃদ্ধি চোখে পড়েনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে শিল্পোন্নত দেশগুলো যত উন্নতিই করে থাকুক না কেন, জ্ঞান কর্মীদের কার্যক্ষম করার ক্ষেত্রে তারা এখনো পিছিয়ে রয়েছে। এটা অর্জনের চাবিকাঠি অবশ্যই কার্যনির্বাহীর কার্যকারিতা। কারণ কার্যনির্বাহক নিজেই নিশ্চিতভাবে একজন জ্ঞান কর্মী। তার স্তর, মান, তার নিজস্ব চাহিদা; তার এবং তার সহকর্মীদের অনুপ্রেরণা, দিকনির্দেশনা ও দায়িত্বশীলতার একটি বড় অংশ দখল করে আছে।

কার্যনির্বাহকের কার্যকারিতার সামাজিক গুরুত্ব আরও বেশি। জ্ঞানকর্মীর মনস্তাত্ত্বিক এবং সামাজিক চাহিদার সাথে প্রতিষ্ঠানের ও শিল্পনির্ভর সমাজের লক্ষ্য একত্রীকরণের উপর আমাদের সমাজের সংহতি ও শক্তি নির্ভর করে।

জ্ঞান কর্মী সাধারণত কোনও অর্থনৈতিক সমস্যা নয়। সে সমৃদ্ধশালী হয়ে থাকে। তার কর্মসংস্থান সুরক্ষিত এবং তার জ্ঞান তাকে ইচ্ছামতো কর্মসংস্থান পরিবর্তনের স্বাধীনতা দিয়ে থাকে। তবে তার মানসিক চাহিদা এবং ব্যক্তিগত মূল্যবোধ, প্রতিষ্ঠানে তার কাজ ও অবস্থানের মাধ্যমে মেটাতে হবে। সে একজন পেশাদার। কিন্তু সে কর্মচারী এবং তাকে কর্মক্ষেত্রের আদেশ মেনে চলতে হয়। জ্ঞানের ক্ষেত্রে কাজ করলেও, সে সাংগঠনিক উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যমূলক জ্ঞানের অধীনস্থ। জ্ঞানের ক্ষেত্রে কোনও ঊর্ধ্বতন বা অধস্তন নেই, কেবল আছে অল্পবয়স্ক এবং বয়স্ক মানুষ। তা সত্ত্বেও সংগঠনের একটি শ্রেণিবিন্যাস প্রয়োজন। এগুলো নতুন সমস্যা নয়। অফিসার কর্পোরেশন এবং সিভিল সার্ভিস তাদের দীর্ঘকাল ধরে চেনে এবং জানে কীভাবে তাদের সমাধান করতে হয়। কিন্তু এগুলোই প্রকৃত সমস্যা। একজন জ্ঞানকর্মী দরিদ্র নয়। সে বিচ্ছিন্নতার ঝুঁকিতে থাকে, কেতাদুরস্ত শব্দ ব্যবহার করতে গেলে বলতে হয়, সে একঘেয়েমি, নিরাশা এবং নীরব হতাশার ঝুঁকিতে আছে।

শ্রমিকের চাহিদা এবং একটি বিস্তৃত অর্থনীতির ভূমিকার অর্থনৈতিক দন্দ্ব যেমন উন্নয়নশীল দেশগুলোতে উনিশ শতকের সামাজিক প্রশ্ন ছিল, তেমনি জ্ঞান কর্মীর অবস্থান, কাজ এবং পরিপূর্ণতা বিংশ শতাব্দীতে উন্নত দেশে রূপান্তরিত হওয়া এসব দেশের সামাজিক প্রশ্নে পরিণত হয়েছে।

আমরা এর অস্তিত্ব অস্বীকার করলেই এই প্রশ্নটি অদৃশ্য হয়ে যাবে না। এটা ভাবা (যেমনটি তাদের নিজস্ব উপায়ে গোঁড়া অর্থনীতিবিদ এবং মার্কসবাদী উভয়েই করে থাকে) অর্থনৈতিক এবং সামাজিক কর্মক্ষমতার কেবল একটিই “অভিন্ন বাস্তবতা” রয়েছে, তাহলেও সমস্যাটি দূর হবে না। আবার সামাজিক মনোবিজ্ঞানীদের (যেমন, ইয়েলের প্রফেসর ক্রিস আর্গিরিস) নতুন রোমান্টিসিজম, যারা যথার্থই বলেছেন যে সাংগঠনিক লক্ষ্যগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে ব্যক্তিগত পরিপূর্ণতায় রূপ নেয় না, আর তাই আমাদের সেগুলো নিয়ে ভাবা উচিত নয়—এই তত্ত্বটিও সমস্যাটিকে সমাধান করতে অক্ষম। আমাদের সংগঠনের কার্যক্রম পরিচালনা এবং ব্যক্তিগত অর্জন ও পরিপূর্ণতা, উভয় চাহিদাকেই পূরণ করতে হবে।

এই প্রশ্নটির উত্তর হলো কার্যনির্বাহকের কার্যকারিতা অর্জনের লক্ষ্যে আত্মোন্নয়ন। এটাই সাংগঠনিক লক্ষ্য ও ব্যক্তিগত চাহিদাকে একীভূত করার উপায়। যেই কার্যনির্বাহী নিজের শক্তিকে কার্যক্ষমতায় রূপান্তরের লক্ষ্যে কাজ করে—সে নিজের ও সহকর্মীদের এবং ফলশ্রুতিতে তার সংগঠনের সার্বিক উন্নয়ন করতে সক্ষম হয়। সে নিজের জ্ঞানের ক্ষেত্রকে সাংগঠনিক সুযোগের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে তোলে। আর এভাবেই নিজের কাজে মনোনিবেশ করার মাধ্যমে সে তার ব্যক্তিগত নীতিকে সাংগঠনিক ফলাফলে পরিণত করে।

উনিশ শতক পর্যন্ত শ্রমিকেরা বিশ্বাস করত যে, তাদের লক্ষ্য কেবল অর্থনীতি কেন্দ্রিক। আর্থিক চাহিদা পূরণেই তারা সন্তুষ্ট ছিল। কিন্তু “মানবিক সম্পর্ক” বিদ্যালয় যেমনটা দেখিয়েছে, তেমনি কথাটা মোটেও সত্য ছিল না। এটা তখনই মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছিল, যখন তাদের পারিশ্রমিক তাদের জীবিকার স্তরের উপরে চলে গিয়েছিল। জ্ঞানকর্মীর আর্থিক চাহিদা অবশ্যই রয়েছে। এর অনুপস্থিতি একটি প্রতিবন্ধক। কিন্তু এর উপস্থিতিও যথেষ্ট নয়। তার সুযোগের প্রয়োজন, তার অর্জনের প্রয়োজন, তার প্রয়োজন পরিপূর্ণতা। তার মূল্যবোধ ও নীতি দরকার। একমাত্র নিজেকে কার্যকর কার্যনির্বাহকে পরিণত করার মাধ্যমেই একজন জ্ঞানকর্মী এই চাহিদাগুলো পূরণ করতে পারে। কার্যনির্বাহীর কার্যকারিতাই কেবল এই সমাজের দুটি চাহিদার মাঝে সামঞ্জস্য তৈরি করতে পারে: একটি প্রতিষ্ঠানের তার কর্মীদের কর্মে অবদানের চাহিদা এবং একজন কর্মীর তার প্রতিষ্ঠান থেকে ব্যক্তিগত উদ্দেশ্য পূরণের চাহিদা। আর তাই কার্যকারিতা অবশ্যই শিখতে হবে।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন