শুক্রবার, ২৯ জানুয়ারী, ২০২১

বইয়ের পর্যালোচনা- সংগঠন ও বাঙালি। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ

আজ আমি আমার প্রিয় শিক্ষক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারের সংগঠন ও বাঙালি বই নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করছি। বহু বছর আগে বইটি পড়েছিলাম। বর্তমানে সংগঠন নিয়ে কিছু কাজকর্ম করতে গিয়ে পুনরায় পড়তে হচ্ছে। সংগঠনের নানা ধরনের সম্ভাবনা ও সীমাবদ্ধতা নিয়ে স্যারের অসাধারণ কিছু বক্তব্য তুলে ধরছি।

যেকোনো বই পড়তে এ চারটি প্রশ্ন মাথায় রেখে পড়লে পঠন আরও কার্যকর হয়।
ক। এ বইটি কী নিয়ে?
খ। এই বইয়ের বিস্তারিত ভাবে কী বলা হয়েছে? এবং কীভাবে বলা হয়েছে?
গ। বইয়ের যে বক্তব্য তা কি সত্য? পুরোপুরি সত্য নাকি আংশিক সত্য?
ঘ। এটা তাৎপর্য কী?
তথ্যসূত্র: How To Read A Book by Mortimer J. Adler and Charles Van Doren. (The Essence of Active Reading: The Four Basic Questions a Reader Asks). Page-53. 

ক। (সংগঠন ও বাঙালি) এ বইটি কী নিয়ে?
এ বই বাঙালির সাংগঠনিক দুর্বলতা নিয়ে। বাংলাদেশি মানুষের মধ্যে সাংগঠনিক দুর্বলতার কারণ তুলে ধরা হয়েছে।

খ। এই বইয়ের বিস্তারিতভাবে কী বলা হয়েছে? এবং কীভাবে বলা হয়েছে?

কিছু উক্তি তুলে ধরছি: আজকে আমরা কেবল দুইটি অধ্যায় নিয়ে পোস্ট করব। এভাবে পর্যায়ক্রমে বাকি অধ্যায়গুলোও আলোচনায় আসবে।

১। এদেশের কোটি কোটি মানুষ দুঃখ সমস্যায় আকীর্ণ। দেশের স্বাধীনতা আমাদের উদ্যমশীল মানুষদের সামনে মানুষের সমস্যা দূর করার সুযোগের সোনালি দরজা মেলে ধরেছে। তাই হাজার হাজার সংগঠন গড়ে তোলার ভেতর দিয়ে আমাদের দেশের বেদনাবিদ্ধ মানুষেরা ঐসব দুঃখের প্রতিকারের চেষ্টা করে যাচ্ছেন। - পৃষ্ঠা- ১১।

২। আমার মনে হয়েছে কোনো-একটা বড় কাজ করার জন্য কিছু মানুষের সুপরিকল্পিত ও সংঘবদ্ধ চেষ্টাই হলো সংগঠন। - পৃষ্ঠা-১২।

৩। ছোটবেলার পাঠ্যবইয়ে আমরা একটা কবিতা পড়তাম।

একটি লতা ছিঁড়তে পারো তোমরা সকলেই,
কিন্তু যদি দশটা লতা পাকিয়ে এনে দেই,
তখন তারে ছিঁড়ে ফেলা নয়তো সহজ কাজ,
ছিঁড়তে গেলে পাগলা হাতি হয়তো পাবে লাজ।

এই-যে 'দশটা লতা পাকিয়ে এনে দিই'- এই পাকানোটাই হলো সংগঠন। - পৃষ্ঠা-১৪

৪। Hierarchy - (হায়ারারকি) স্তর-পারম্পর্য। পারম্পর্য থাকে বলেই খুব অল্প সংখ্যক মানুষ সুসংহতভাবে এগিয়ে অনেক বড় ধরনের সাফল্য অর্জন করতে পারে। এমনই পারম্পর্য ভিত্তিক সাংগঠনিক সংহতির কারণে আলেকজান্ডার মাত্র ৪০ হাজার সৈন্য নিয়ে অর্ধেক পৃথিবী জয় করতে পেরেছিলেন। - সংগঠন ও বাঙালি, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, পৃষ্ঠা-১৪।

৫। বাঙালির সাংগঠনিক দুর্বলতার কারণ আত্মহত্যা। এই আত্মপরতার সামনে যেকোনো শুভবুদ্ধি ও সামষ্টিক কল্যাণকে পদদলিত করে যেতে আমাদের কোনো কুণ্ঠা নেই। - পৃষ্ঠা-১৮।

৬। পরীক্ষার নকলে, চাঁদাবাজির সহিংসতায়, সন্ত্রাসের তাণ্ডবে, শিক্ষাঙ্গনে, আদালতে, বাণিজ্যকেন্দ্রে- সব জায়গায় নির্বিবেক ব্যক্তিগত স্বার্থলিপ্সা সমষ্টির কল্যাণ ও সংঘবদ্ধতাকে বিপন্ন করতে উদ্যত। সারা জাতির প্রতিটি জায়গায় আজ এসব যা হচ্ছে তা তো লুণ্ঠন- যার অন্য নাম আত্মঘাত- যূথবদ্ধ মানুষের কল্যাণের ওপর ব্যক্তিস্বার্থের আক্রমণ। ন্যায় ও সংঘশক্তির সার্বভৌমত্বের ওপর আত্মপরায়ণ মানুষের সর্বাত্মক সন্ত্রাস। - পৃষ্ঠা-১৯।

৭। আমার হবে তো আমি পাব তো? তার ব্যক্তিকেন্দ্রিক স্বার্থ লিপ্সা আজও তার সংঘবদ্ধতার স্বপ্নের চেয়ে শক্তিশালী। - পৃষ্ঠা-২০।

৮। আত্মপ্রাপ্তির লাগামহীন লিপ্সায় তারা কামান্ধ ও আপোষহীন। এই জগতে কোনো মানুষের চেয়ে কোনোভাবে নিজেকে কম মনে করে এমন বাঙালি এই পৃথিবীতে নেই। - পৃষ্ঠা-২১।

৯। রাষ্ট্রীয় মূল্যবোধ ও তার ব্যবস্থাপনাঘটিত বিষয়ে আমরা পুরোপুরি অজ্ঞ। আমরা মুখে মুখে বলছি ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে রাষ্ট্র বড়। কিন্তু কাজের সময় দেখতে পাচ্ছি রাষ্ট্রের চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে ব্যক্তি বড়। - পৃষ্ঠা-২২।

১০। যেকোনো লোককে যদি আজও আপনি জিজ্ঞেস করেন: 'দেশ কোথায়', সে সবসময়ই উত্তর দেবে অমুক জেলায়। এর অর্থ একটাই। বাঙালির 'দেশ' চেতনা আজ অব্দি জেলাচেতনার বাইরে খুব একটা যায়নি। - পৃষ্ঠা-২৩।

১১। কাজেই নিজেরই উচ্চতর বিকাশের স্বার্থে নিজের ছোট স্বার্থকে ছাড় দিয়ে যে কিভাবে বৃহত্তর স্বার্থ সিদ্ধি করতে হয় কিংবা নিজের বড় ছাত্রটিকে অর্জন করতে হয় তা আমাদের জানা হয়ে ওঠা হয়নি। - পৃষ্ঠা-২৩-২৪।

১২। বহিরাগতদের আক্রমণের মুখে আমরা কেবল ই পালিয়েছি। মানুষ যুদ্ধে যায় একসঙ্গে কিন্তু পালা একা একা। পালাতে পালাতে আমরা একা হয়ে গেছি। একা আর বিচ্ছিন্ন। নিজের নিজস্ব ছোট্ট অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা ছাড়া আর কোন কিছুই আমাদের কাছে তত গুরুত্ব পায় না। আমাদের সাধারন মানুষের একাকিত্বের একটা বড় কারণ হয়তো এইটিই। - পৃষ্ঠা-২৫।

১৩। বৈরী ও চরমভাবাপন্ন প্রকৃতির সঙ্গে সংগ্রাম করে যে-মানুষদের টিকে থাকতে হয় সংঘবদ্ধতার চর্চা তাদের মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই জন্ম নেয়। কিন্তু বাংলাদেশের নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ু, উর্বর জমি আর খাদ্য ও পানীয়ের সহজলভ্যতার মধ্যে মানুষের সংঘবদ্ধতা অতটা অনিবার্য হয়নি। … … … সঙ্ঘবদ্ধ হওয়ার প্রয়োজন না থাকাও তাই আমাদের চরিত্রের ব্যক্তি কেন্দ্রিকতার একটি কারণ হতে পারে। - পৃষ্ঠা-২৫।

১৪। সাধারণ চালকেরা যখন গাড়ি চালায় (যারা অধিকাংশ এসেছে দরিদ্র পারিবারিক পটভূমি থেকে, যাদের শিক্ষার সুযোগ বা অন্য কোনো প্রাপ্তিই জীবনে জোটেনি) তাদের অনেকেই চালায় কিছুটা অসুস্থের মতো- সবাইকে পিছে ফেলে, দুগাড়ির মাঝখানকার বিপজ্জনক সংকীর্ণ গলির ভেতর আতঙ্ককর মাথা ঢুকিয়ে দিয়ে, অসহ্য হর্নের শব্দে সবাইকে উত্ত্যক্ত আর অসুস্থ করে। … … … তাকে যেতে হবে সবার সামনে- অন্যায়ভাবে ওভারটেক করে হোক, আইন অমান্য করে হোক, রাস্তার মানুষজনকে ওলটপালট করে হোক, ন্যায়নীতিকে পদদলিত করে হোক বা অন্য যেভাবেই হোক। … … … তার যুগ-যুগের বঞ্চনার প্রতিশোধ নিতে হবে। তার হাতে আজ নতুন মডেলের পাঁচ হাজার সিসির নিশান পেট্রোল। কেন সে থামবে? - পৃষ্ঠা-২৭।

... ... ... চলবে

তথ্যসূত্র:
১। How To Read A Book by Mortimer J. Adler and Charles Van Doren. (The Essence of Active Reading: The Four Basic Questions a Reader Asks). Page-53. 
২। সংগঠন ও বাঙালি। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। ঢাকা, মাওলা ব্রাদার্স, ২০১২।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন