আমরা কী তা আমাদের অতীত অবস্থান থেকে অনেকটাই জানা সম্ভব। আজকে যারা সফল তারা অতীতে প্রচুর পরিশ্রম করেছেন। ম্যালকম গ্ল্যাডওয়েলের বই বৃত্তের বাইরে বা আউটলায়ার্স থেকে আমরা ১০,০০০ ঘণ্টা সূত্রের কথা জানতে পারি। এ সূত্র মতে, বিশ্বে আজকে যারা কোন না কোন কাজে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছেন তারা আজকের অবস্থানে আসার আগে ১০,০০০ ঘণ্টা চর্চা করেছেন। একে বছরে হিসাব করলে সপ্তাহে নিরন্তর ৪০ ঘণ্টা করে চর্চা করে গেলে পাঁচ বছরের মতো সময় লাগবে। বাস্তবে এমন চর্চা অব্যাহত রাখতে দশ বছর লাগে।
আমার মনে হয়েছে এ বইয়ে ইচ্ছাকৃত চর্চা ও আপনি নিজে নিজের চেষ্টায় কীভাবে সফল হবে তা সম্পর্কে বলা হয়েছে। তবে তা ভুল। বইয়ে ঠিক এর বিপরীত তিনটি বিষয় নিয়ে আলাপ করা হয়েছে।
চিত্র : আউটলায়ার্স (বৃত্তের বাইরে) বইয়ের সূচি।
৩টি শিক্ষা হচ্ছে :
১। দক্ষতার একটি স্তর পার করলে আপনার সামর্থ্য আর কোন কাজে দিবে না।
২। আপনি কোন মাসে জন্মগ্রহণ করেছেন তাও আপনার সফলতায় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
৩। এশিয়ানরা গণিতে ভালো, কারণ আপনি কোথা থেকে এসেছেন তাও গুরুত্ব বহন করে।
১। দক্ষতার একটি স্তর পার করলে আপনার সামর্থ্য আর কোন কাজে দিবে না।
‘স্ব-নির্মিত পুরুষ’ বলে যে এক বক্তব্য আছে (যা আমি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি) তার রহস্য উন্মোচন করতে গিয়ে গ্ল্যাডওয়েল প্রথমে দেখেন আপনার দক্ষতা ও যোগ্যতা আপনাকে জীবনের শেষ কোথায় নিয়ে যায়।
অবশ্যই চর্চার দরকার আছে। কিন্তু তাদের প্রভাব তত বেশি নয়, বলা চলে সীমিত। এ থেকে দেখা যায়, একবার আপনি যখন আপনার কোন দক্ষতা ও সামর্থ্যরে উচ্চ সীমা পার করে ফেলেন তারপর আরও বেশি চেষ্টা করলেও কোন লাভ হয় না।
উদাহরণ স্বরূপ, ১৯৮০ সালের এনবিএ বাস্কেটবল খেলোয়াড়দের গড় উচ্চতা ধরুন। তাদের গড় উচ্চতা ৬ ফুট ৭ ইঞ্চি। এখন আপনার উচ্চতা যদি ৭ ফুটও হয়, অতিরিক্ত উচ্চতা আপনাকে অন্য খেলোয়াড়দের চেয়ে খুব বেশি সুবিধা দিবে না।
গ্ল্যাডওয়েল আবার আইনের বিদ্যালয়গুলোতেও অনুসন্ধান চালান। কিছু কিছু ল স্কুল পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য তাদের বেতন সহ কিছু নিয়মনীতি শীথিল করেন। তারপরেও দেখা যায় পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীরা অন্যদের তুলনায় খুব একটা ভালো করতে পারছে না। কিন্তু তাদের মধ্যকার এ পার্থক্য স্নাত্মক পাশ করার পর আর থাকে না।
তারাও তাদের পূর্বতন সহপাঠীদের মতো একই ভাবে কাজ করে যাচ্ছে এবং সমান পারিশ্রমিক পাচ্ছে। কিন্তু কেন?
কারণ আপনি যখন আইনি বিষয়ের একটি নির্ধারিত স্তর পার করবেন তখন সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য পুথিগত বিদ্যার চেয়ে ভিন্ন অন্যান্য দক্ষতা কাজে লাগে। যেমন সামাজিক দক্ষতা, বিভিন্ন মানুষের সাথে আপনার সম্পর্ক কেমন, কত বেশি মানুষের সাথে আপনার সম্পর্ক আছে, এমনকি নতুন ও ভিন্ন কোন কাজে আপনি কত বেশি দক্ষ তাও কাজে লাগে।
২। ভুল মাসে জন্মগ্রহণ করা আপনার জন্য এক অসুবিধা বলে পরিগণিত হতে পারে।
আপনি কি কখনো অষ্টম শ্রেণির ছেলের সাথে দশম শ্রেণির মেয়ের প্রেম হতে দেখেছেন? এ প্রশ্ন শুনে আপনি নিশ্চয় খুব অবাক হবেন। আপনি হয়তো বলবেন, ‘এ কী করে সম্ভব! সে তার চেয়ে দুই বছরের বড়। এ হতে পারে না। এ এক ধরনের পাগলামি।’
যাই হোক, এখন ধরুন, আপনার বয়স ৪০ বছর। আপনি আপনার স্ত্রীকে নিয়ে রেস্টুরেন্টে রাতের খাবার খেতে গেছেন। তখন কেউ যদি শোনে আপনার স্ত্রীর বয়স ৩৮, ৪২ বা কয়েক বছরের বড় বা ছোট তবে তাতে কেউ ততটা অবাক হবে না।
কারণ বয়সের তুলনা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায় যখন আপনি তরুণ। আপনি আপনার বন্ধুবান্ধবের চেয়ে বয়সে কতটা ছোট বা বড় তা অনেক বড় তফাত তৈরি করে, বিশেষ করে খেলাধুলার ক্ষেত্রে।
গ্ল্যাডওয়েল তার অনুসন্ধানে খুঁজে পান যে কানাডার পেশাগত হকি খেলোয়াড়দের মধ্যে যারা জাতীয় দলে সুযোগ পায় তাদের অর্ধেকেরও বেশি খেলোয়াড়ের জন্ম বছরের প্রথম ছয় মাসে। সেই অর্ধেকের ৮০% খেলোয়াড়ের জন্ম আবার বছরের প্রথম তিন মাসের মধ্যে।
এর কারণ হচ্ছে খেলোয়াড় হিসাবে যেসব শিশুদের ভর্তি করা হয় তা করা হয় জানুয়ারি মাসে। এখন কোন শিশু যদি ডিসেম্বরে জন্মগ্রহণ করে তবে তাকে প্রতিযোগিতা করতে হবে এক বছর বড় এক শিশুর সাথে, যার জন্ম হয়তো জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি বা মার্চে। আপনার বয়স যখন আট বছর তখন আপনি নয় বছরের একটি ছেলের সাথে শক্তি ও সামর্থ্যে কোন মতেই পারবেন না। বছরে কোন মাসে জন্মগ্রহণ হয় তারমতো এক ক্ষুদ্র বিষয় পুরো জীবনে বিশাল প্রভাব ফেলে। এ প্রভাবের মাত্রা ১২.৫%।
নিজের ব্যাপারে একটু চিন্তা করে দেখুন। আপনি যদি বছরের প্রথম তিন মাসে জন্মগ্রহণ করে থাকেন, তবে আপনি অন্য শিশু যারা বছরের শেষ তিন মাসে জন্মগ্রহণ করেছে তাদের চেয়ে বেশি শক্তিশালী ও সামর্থ্যবান ছিলেন।
৩। এশিয়ানরা গণিতে ভালো, কারণ আপনি কোথা থেকে এসেছেন তাও গুরুত্ব বহন করে।
বয়সের দিকটি নিয়ে আপনার চিন্তা করতে যদি অস্বস্তি লেগে থাকে তবে চিন্তা করুন, আপনি যেখানে জন্মগ্রহণ করেছেন সে জন্মস্থান যদি ভিন্ন কোন এক জায়গায় হত তবে কেমন হত। ওয়ারেন বাফেট প্রায়ই বলেন তিনি এ যুগে আমেরিকায় জন্মগ্রহণ করে ভাগ্যবান অনুভব করেন, কারণ তিনি যদি কয়েক হাজার বছর আগে জন্মগ্রহণ করতেন তবে এমনও হতে পারত তিনি কোন এক পশুর খাদ্যে পরিণত হয়েছেন।
উদাহরণ স্বরূপ, গ্ল্যাডওয়েল বলেন, এশিয়ানরা গণিতে ভালো তার কয়েকটি কারণ রয়েছে।
প্রথমত, এশিয়ান ভাষা এমন ভাবে নির্মিত যাতে করে শিশুরা খুব সহজেই গণনা করতে পারে। দ্বিতীয়ত, হাজার বছর ধরে ধান চাষ করতে করতে তাদের সংস্কৃতির মধ্যে শৃঙ্খলার এক বীজ রোপিত হয়েছে।
গম বা ভুট্টার চেয়ে ধান চাষ করা অনেক কঠিন। ধান চাষ করতে নির্দিষ্ট কিছু নিয়ম মানতে হয়, নিয়ন্ত্রণ, বিন্যাস ও ধৈর্য ধরতে হয়। ধান চাষীরা তাদের ফসলের পুরো ফলাফল পায়। এতে করে ধান চাষীরা কাজটা আরও ভালো ভাবে করতে উৎসাহ বোধ করে। কিন্তু ইউরোপে ভূমি মালিক বা সৈন্যরা ফসলের একাংশ নিয়ে নিত। এতে করে চাষীরা তাদের সর্বোচ্চ দিতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলত।
ধান চাষের মতো গণিতও খুব কঠিন। আপনাকে সমস্যার সাথে লেগে থাকতে হয় এবং এর সমাধান না পাওয়া পর্যন্ত আপনার মস্তিষ্ককে খাটিয়ে যেতে হয়। ইউরোপিয়ানরা তাদের এশিয়ান সহপাঠীদের চেয়ে অনেক দ্রুত গণিতের কঠিন সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করতে গিয়ে হাল ছেড়ে দেয়। এর কারণ হচ্ছে, না গণিত, না শৃঙ্খলা ইউরোপিয়ান সংস্কৃতির অংশ।
তো, এখান থেকে বলা যায়, আপনি কোথা থেকে এসেছেন তা বেশ গুরুত্ব বহন করে।
তথ্যসূত্র :
ক। আউটলায়ার্স। মূল : ম্যালকম গ্ল্যাডওয়েল। অনুবাদ : এ.এম. নাইম হোসেন ও ফজলে রাব্বি। ঢাকা, সাফল্য প্রকাশনী, ২০১৭।
খ। https://fourminutebooks.com/outliers-summary/