সুইস চিজ মডেল (Swiss Cheese Model)


ছবিসূত্র: উইকিপিডিয়া

সুইস চিজ মডেল (Swiss Cheese Model) একটি জনপ্রিয় ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা ও নিরাপত্তা বিশ্লেষণ মডেল। এটা মূলত ভুল বা দুর্ঘটনা এড়ানোর জন্য ব্যবহার করা হয়। বিভিন্ন নিরাপত্তা স্তরের কথা বিবেচনা করে এটা তৈরি করা হয়েছে। এই মডেলটি প্রথম ১৯৯০ সালে সুইস নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ জেমস রিজন দ্বারা প্রস্তাবিত। মডেলটি দুর্ঘটনা বা ভুল খুঁজে বের করার জন্য ব্যবহার করা হয়। এক্ষেত্রে একাধিক স্তরের ত্রুটি বা দুর্বলতা একসাথে খুঁজে বের করা যায়। যেমন, মানবিক ত্রুটি, প্রযুক্তিগত ত্রুটি, নীতি বা ব্যবস্থাপনাগত সমস্যা।

সুইস চিজ মডেল-এর মূল ধারণা:

এটা একটা ছবি হিশাবে কল্পনা করা যেতে পারে যেখানে প্রতিটি স্তর (বা নিরাপত্তা ব্যবস্থা) সুইস চিজের মতো ছিদ্রযুক্ত। এই ছিদ্রগুলো প্রতিটি স্তরের দুর্বলতা বা ত্রুটি নির্দেশ করে। তবে, যখন একাধিক স্তরের মধ্যে ছিদ্রগুলো লাইন আপ করে (অর্থাৎ একের পর এক ছিদ্রগুলো একে অপরের সালে মিলে যায়), তখন দুর্ঘটনা বা ভুল ঘটতে পারে।

মূল উপাদান:

নিরাপত্তা স্তর: সুইস চিজ মডেলে প্রতিটি স্তরে একটি নিরাপত্তা ব্যবস্থা বা প্রটোকল থাকে। যেমন সুরক্ষা প্রক্রিয়া, নিয়মাবলি, প্রক্রিয়াজাতকরণ পদ্ধতি বা কর্মীদের প্রশিক্ষণ ইত্যাদি।

ছিদ্র/দুর্বলতা: প্রতিটি স্তরের মধ্যে ছিদ্র বা দুর্বলতা থাকে। যা মানুষের ত্রুটি, প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা অথবা ব্যবস্থাপনাগত ভুল হতে পারে।

দুর্ঘটনা/ভুল: যখন একাধিক স্তরের ছিদ্র একে অপরের সাথে লাইন আপ করে (অথবা একে অপরকে সমর্থন করে), তখন একটি দুর্ঘটনা বা ভুল ঘটে।

উদাহরণ: ধরা যাক, একটি বিমান দুর্ঘটনা। সুইস চিজ মডেল ব্যবহার করে এটা ব্যাখ্যা করা যেতে পারে।

স্তর ১ (প্রযুক্তিগত স্তর): বিমানের যান্ত্রিক ত্রুটি। এখানে একটি প্রযুক্তিগত সমস্যা হতে পারে। যেমন বিমানের যান্ত্রিক যন্ত্রাংশের কোন ত্রুটি।

স্তর ২ (ম্যানেজমেন্ট স্তর): বিমানের রক্ষণাবেক্ষণের সময় কিছু ভুল বা অবহেলা হতে পারে। যেখানে বিমানের নিয়মিত চেক-আপ সঠিকভাবে হয়নি।

স্তর ৩ (মানবিক স্তর): পাইলট বা ক্রু সদস্যরা ভুল সিদ্ধান্ত নিতে পারে। যেমন বিমানের জরুরি অবতরণের সময় সঠিকভাবে প্রতিক্রিয়া না জানানো।

এখন, যদি এই তিনটি স্তরের মধ্যে কোন একটি স্তরে ভুল বা ত্রুটি হয়ে থাকে, তাহলে দুর্ঘটনা ঘটবে না। কিন্তু যদি তিনটি স্তরের ছিদ্র একে অপরের সঙ্গে মিলে যায়, তাহলে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। যেমন বিমানের যান্ত্রিক ত্রুটি, রক্ষণাবেক্ষণের সময় অবহেলা করা এবং ক্রুর ভুল সিদ্ধান্ত একত্রিত হয়ে দুর্ঘটনাটি ঘটাতে পারে।

সুইস চিজ মডেল-এর ব্যবহার:

ছবিসূত্র: https://www.researchgate.net/figure/Reasons-Swiss-Cheese-Model-Source-Reason-1997_fig1_363263905


নিরাপত্তা ব্যবস্থা: এটি বিশেষত শিল্প, চিকিৎসা, বিমান পরিবহন ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ খাতে যেখানে ভুল বা দুর্ঘটনার সম্ভাবনা অনেক বেশি সেখানে ব্যবহৃত হয়। এখানে বিভিন্ন স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা একে অপরকে সমর্থন করে থাকে।

ঝুঁকি বিশ্লেষণ: এই মডেলটি ঝুঁকি ব্যবস্থাপনায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এটা দেখায় যে এক-দুইটি ভুল বা ত্রুটি সত্ত্বেও দুর্ঘটনা নাও ঘটতে পারে যদি অন্যান্য স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা কার্যকর থাকে। তবে যখন একাধিক স্তরের ত্রুটি একসাথে কাজ করে, তখন বড় দুর্ঘটনা ঘটে।

মডেলটির গুরুত্ব:

বহু স্তরের নিরাপত্তা: একক নিরাপত্তা ব্যবস্থা বা একটি স্তরের উপর নির্ভরশীল না থেকে একাধিক স্তরের নিরাপত্তা তৈরি করা জরুরি।

ত্রুটি গোপন করা উচিত নয়: কোনো একক ত্রুটি বা ভুলের কারণে দুর্ঘটনা ঘটে না; বরং একাধিক ত্রুটি একসাথে সংযুক্ত হলে তা বিপদে পরিণত হয়। এই কারণে ঝুঁকি বিশ্লেষণ এবং প্রতিটি স্তরের ত্রুটি চিহ্নিত করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ: এটা সিস্টেমের দুর্বলতা বা সমস্যা চিহ্নিত করতে সাহায্য করে। যাতে এগুলোকে প্রতিরোধ করা যায় এবং দুর্ঘটনার ঝুঁকি কমানো যায়।

উপসংহার: সুইস চিজ মডেল (Swiss Cheese Model) একটি কার্যকর মডেল যা বিভিন্ন ঝুঁকি স্তরের মাধ্যমে দুর্ঘটনা বা ভুলের উৎস বিশ্লেষণ করতে সাহায্য করে। এটা সুপারিশ করে যে একাধিক নিরাপত্তা স্তর এবং প্রক্রিয়া তৈরি করা উচিত যাতে দুর্ঘটনা বা ভুলের প্রবণতা কমানো যায় এবং সিস্টেমের দুর্বলতা চিহ্নিত করা যায়।


----------------------------------------  ------------------------------------  ---------------------------

বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে সুইস চিজ মডেল (Swiss Cheese Model) ব্যবহার

বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে সুইস চিজ মডেল (Swiss Cheese Model) ব্যবহার করা যেতে পারে। বাংলাদেশের বিভিন্ন সেক্টরে দুর্ঘটনা বা ঝুঁকি মোকাবেলা করার জন্য এটা একটা কার্যকর কৌশল হতে পারে। এখানে আমরা কিছু উদাহরণ দেখব যে কীভাবে এই মডেলটা বাংলাদেশের বিভিন্ন খাতে প্রযোজ্য হতে পারে:


১. বিমান পরিবহন খাতে (Airline Safety): বাংলাদেশের বিমান পরিবহন খাতে মাঝে মাঝে দুর্ঘটনা ঘটে। এসব দুর্ঘটনার পিছনে নানা স্তরের ত্রুটি বা দুর্বলতা থাকতে পারে। সুইস চিজ মডেল অনুযায়ী, একটি দুর্ঘটনা কোন একক ত্রুটির কারণে ঘটে না; বরং একাধিক স্তরের ত্রুটি একত্রিত হয়ে ঘটে।

উদাহরণ:

স্তর ১ (প্রযুক্তিগত ত্রুটি): বিমানের যান্ত্রিক ত্রুটি বা বিমানের সিস্টেমের কোন প্রযুক্তিগত সমস্যা হতে পারে। যেমন ইঞ্জিনের কোন যান্ত্রিক ত্রুটি।

স্তর ২ (ম্যানেজমেন্ট ত্রুটি): বিমানের রক্ষণাবেক্ষণে অবহেলা। যেমন বিমানের নির্দিষ্ট যন্ত্রপাতি পরিদর্শন করা হয়নি অথবা ত্রুটিপূর্ণ যন্ত্রাংশ ব্যবহৃত হয়েছে।

স্তর ৩ (মানবিক ত্রুটি): পাইলট বা ক্রু সদস্যের ভুল সিদ্ধান্ত। যেমন জরুরি অবতরণ বা দুর্যোগ পরিস্থিতি সামাল দিতে ব্যর্থতা।

দুর্ঘটনা: যদি এই তিনটি স্তরের ছিদ্র একত্রিত হয়ে যায়, তাহলে বিমান দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। যেমন যান্ত্রিক ত্রুটি, রক্ষণাবেক্ষণ ত্রুটি এবং মানবিক ত্রুটি একত্রে ঘটলে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।


২. চিকিৎসা খাত (Healthcare Safety): বাংলাদেশে স্বাস্থ্যখাতে ভুল চিকিৎসা বা রোগীদের সঙ্গে অবহেলার ঘটনা মাঝেমধ্যেই ঘটে। সুইস চিজ মডেলের মাধ্যমে আমরা বুঝতে পারি যে, একক ত্রুটি (যেমন একজন ডাক্তার বা নার্সের ভুলের কারণে) পুরো দুর্ঘটনা নাও ঘটতে পারে। তবে একাধিক স্তরের ত্রুটি একত্রিত হয়ে বড় ধরনের বিপদ সৃষ্টি করতে পারে।

উদাহরণ:

স্তর ১ (চিকিৎসা পদ্ধতির ত্রুটি): রোগীর সঠিক ডায়াগনসিস না হওয়া। যেমন ভুল রিপোর্ট বা ভুল চিকিৎসা পদ্ধতি।

স্তর ২ (মানবিক ত্রুটি): ডাক্তার বা নার্সের ভুল সিদ্ধান্ত। যেমন ভুল ওষুধ প্রদান বা ভুলভাবে রোগীকে চিকিৎসা দেওয়া।

স্তর ৩ (প্রকল্প ব্যবস্থাপনা ত্রুটি): হাসপাতালের কর্মীদের পরিসেবা পর্যাপ্ত না হওয়া অথবা রোগীর পরিস্থিতিতে পর্যাপ্ত মনোযোগ না দেওয়া।

দুর্ঘটনা: যদি চিকিৎসা পদ্ধতির ভুল, মানবিক ত্রুটি এবং প্রশাসনিক দুর্বলতা একত্রিত হয়, তবে রোগী মারা যেতে পারে অথবা তার শারীরিক অবস্থা আরও খারাপ হতে পারে।


৩. সড়ক দুর্ঘটনা (Road Traffic Accidents): বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনার হার অনেক বেশি। সুইস চিজ মডেল এই খাতে বিপদ এবং দুর্ঘটনার বিভিন্ন স্তর বিশ্লেষণ করতে সাহায্য করতে পারে।

উদাহরণ:

স্তর ১ (পরিবহন ও যানবাহন নিরাপত্তা): গাড়ির যান্ত্রিক ত্রুটি। যেমন ব্রেক কাজ না করা অথবা সিগন্যাল সিস্টেমের ব্যর্থতা।

স্তর ২ (মানবিক ত্রুটি): ড্রাইভারের অদক্ষতা বা অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালানো। মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি চালানো অথবা সড়কে চলার সময় হেলমেট না পরা।

স্তর ৩ (সড়ক অবকাঠামো ত্রুটি): সড়কগুলোর মান খারাপ থাকা। সড়কের সিগন্যাল সিস্টেমের দুর্বলতা অথবা সড়কে দুর্ঘটনাপ্রবণ জায়গা থাকা।

দুর্ঘটনা: যদি এই স্তরগুলো একত্রিত হয়ে যায়, যেমন অসুস্থ বা অদক্ষ ড্রাইভারের সঙ্গে খারাপ রাস্তা এবং ত্রুটিপূর্ণ গাড়ি, তাহলে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।


৪. প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং জরুরি সেবা (Natural Disasters and Emergency Response):

বাংলাদেশে প্রায়ই প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটে। এখানকার ভৌগলিক অবস্থান বাংলাদেশকে প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ এলাকা করে তুলেছে। যেমন ঘূর্ণিঝড়, বন্যা ও অন্যান্য প্রাকৃতিক বিপর্যয়। দুর্যোগের সময় ভুল বা অপর্যাপ্ত প্রস্তুতি নিয়ে বড় ধরনের বিপদ ঘটতে পারে।

উদাহরণ:

স্তর ১ (প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের পূর্বাভাস): সঠিক সময়ে ঘূর্ণিঝড় বা বন্যার পূর্বাভাস না দেওয়া অথবা তা যথাযথভাবে প্রকাশ না করা।

স্তর ২ (সরকারি প্রস্তুতি এবং পরিকল্পনা): দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির পক্ষ থেকে আগাম প্রস্তুতি না নেওয়া হলে অথবা দুর্যোগকালীন কার্যক্রমে ব্যর্থতা।

স্তর ৩ (জনসাধারণের প্রস্তুতি): জনসাধারণের অজ্ঞতা বা দুর্যোগ সম্পর্কে সচেতনতার অভাব। যার ফলে তারা সতর্ক হয় না অথবা প্রাথমিক সাহায্য ব্যবস্থা গ্রহণ করে না।

দুর্যোগ: যদি এই তিনটি স্তরের দুর্বলতা একত্রিত হয়—ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাস না দেওয়া, সরকারি প্রস্তুতির অভাব এবং জনগণের প্রস্তুতির অভাব—তাহলে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি এবং প্রাণহানি ঘটতে পারে। যেমন ফেনী অঞ্চলে ২০২৪ এ বিরাট ক্ষয়ক্ষতি এবং অনেক প্রাণহানি ঘটেছে।


৫. শিল্পক্ষেত্রে নিরাপত্তা (Industrial Safety):

বাংলাদেশের শিল্পক্ষেত্রে নানা দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে। বিশেষ করে গার্মেন্টস ও ফ্যাক্টরি শিল্পে। এই খাতেও সুইস চিজ মডেল ব্যবহৃত করা যায়।

উদাহরণ:

স্তর ১ (যন্ত্রপাতি ও প্রক্রিয়াগত ত্রুটি): ফ্যাক্টরি মেশিন বা যন্ত্রপাতির ত্রুটি। যেমন মাল্টিটাস্কিং মেশিনের ত্রুটি।

স্তর ২ (কর্মী প্রশিক্ষণ): কর্মীদের সঠিকভাবে প্রশিক্ষণের অভাব। যেমন নিরাপত্তা বিধি পালন না করা।

স্তর ৩ (পর্যাপ্ত তত্ত্বাবধানের অভাব): কারখানার ব্যবস্থাপনা বা নিরাপত্তা তত্ত্বাবধায়কদের কর্তব্যে অবহেলা।

দুর্ঘটনা: যদি এই ত্রুটিগুলো একত্রিত হয়—যেমন যন্ত্রপাতির ত্রুটি, নিরাপত্তা প্রশিক্ষণের অভাব এবং তত্ত্বাবধায়ক ত্রুটি—তাহলে শিল্পক্ষেত্রে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।

উপসংহার:

সুইস চিজ মডেল বাংলাদেশের বিভিন্ন খাতে দুর্ঘটনা বা ঝুঁকি বিশ্লেষণ করার একটি কার্যকরী উপায় হতে পারে। যেখানে বিভিন্ন স্তরের ত্রুটি একত্রিত হয়ে বড় ধরনের সমস্যা বা দুর্ঘটনা তৈরি হচ্ছে সেখানেই এই মডেল কাজে লাগানো যায়। কোন ধরনের একটি বা একক স্তরের দুর্বলতা বা ত্রুটির কারণে দুর্ঘটনা নাও ঘটতে পারে। কিন্তু যখন একাধিক স্তরের দুর্বলতা একত্রিত হয়, তখন বড় ধরনের একটি বিপর্যয় ঘটতে পারে।

ফজলে রাব্বি (Fazle Rabbi)

আমার জীবনের একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য ২০৩০ সালের মধ্যে ৬৪টি অনুপ্রেরণামূলক বই প্রকাশ করা। saphollo.com

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন