যুদ্ধ বিগ্রহ লড়াই যেন সর্বদাই বীরত্বের এক ইতিকথা। রামায়ণ, মহাভারত, ইলিয়ডের মতো মহাকাব্য সৃষ্টিই হয়েছে যুদ্ধ বিগ্রহের মাধ্যমে বীরত্বকে তুলে ধরার জন্য। যেন সমগ্র পৃথিবীকে জানান দেয় যে দেখ যুদ্ধ করতে পেরেছে বলে রাম-রাবণ, অর্জুন-কৃষ্ণ-দূর্যোধন ও একিলিসের মতো বীর হয়ে পৃথিবীর ইতিহাসে বেঁচে রয়েছি। আসলেই কী তাই! যুদ্ধে যে আর কত লাখো সৈন্য মারা গেল তাদের অনুভূতির কী হল? তারা কোথায় গেল? তারা কি কেবল গাছ থেকে ঝরা পাতার মতো ঝরে পড়ল? তারা কি মানুষ ছিল?
আমি বলব, ‘হ্যাঁ, তারা মানুষ ছিল।’ এমনই এক মানুষকে নিয়ে এরিক মারিয়া রেমার্ক লিখলেন তাঁর অসাধারণ এক উপন্যাস ‘অল কোয়ায়েট অন দা ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট’। যদিও মনে হতে পারে লেখক রেমার্ক তো একজন সাধারণ মানুষ, পল বোমারকে নিয়ে লিখে। এ প্রশ্নের উত্তরে আমার মনে পড়ে জোসেফ ক্যাম্পবেলের কথা। তাঁর বই ‘মিথের শক্তি’তে তিনি বলেন,
‘আমি মনে করি না সাধারণ ব্যক্তি বলে কিছু আছে। জীবনের অভিজ্ঞতায় প্রতিটি মানুষ পরমানন্দে সম্ভাবনাময়ী। তাকে যা করতে হয় তা হল নিয়ত এই আনন্দকে চেনা এবং এর চর্চা করে এর সঙ্গে জীবন যাপন করা। সাধারণ মানুষ হিসাবে কাউকে আখ্যায়িত করা হলে আমি সবসময়ই অস্বস্তি বোধ করি, কারণ সাধারণ মানুষ, মহিলা বা শিশু কোথাও, কখনও আমার চোখে পড়েনি।’
আমিও ক্যাম্পবেলের মতোই বলতে চাই, সাধারণ মানুষ বলতে কিছু নেই। প্রতিটি মানুষই তার নিজ গুণে, নিজ অভিজ্ঞতায় অনন্য। এমনই এক শক্তিশালী চরিত্র পল বোমার। সে সতেরো বছররের এ জার্মান কিশোর। জীবনে যখন রঙিন স্বপ্ন দেখার সময়, ঠিক তখনই আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িযে গেল প্রথম বিশ্বযুদ্ধে। তার সেই কিশোর জীবন পার করার আগেই তাকে প্রবেশ করতে হল যুদ্ধের বিভীষিকাময় এক প্রান্তরে। ট্রেনিং ক্যাম্পের কঠোর পরিশ্রম, ওপরওয়ালার অপরিসীম দুর্ব্যবহার আর যুদ্ধের নারকীয় তাণ্ডবে অনুভব করল, হাজার বছরের সভ্যতাও মানুষের পশুত্বকে মুছে দিতে পারেনি। অনুভব করল, যুদ্ধের প্রথম বোমাটা ঠিক হৃদয়ের মধ্যেই পড়ে; গুঁড়িয়ে দেয় সমস্ত চেতনা আর মানবিক মূল্যবোধ।
আজ যেখানে বিজ্ঞানের বদৌলতে আমরা জানতে পেরেছি হৃদয় বলতে কিছু নেই, মন কেবল মস্তিষ্কের একটি অংশ, সেই যান্ত্রিক যুগে যুদ্ধের প্রথম বোমাটা আসলে কোথায় পড়বে? হয়তো মন-মস্তিষ্কের যে জায়গায়, কোন এক গহীন কোণে যেখানে একদা ছিল ছোট্ট এক লাল টুকটুকে গোলাপ ফুল, কাউকে দিবো বলে হয়তো সংগোপনে, সযত্নে ভালোবাসা দিয়ে লালনপালন করছিলাম, ঠিক সেই জায়গায়ই হয়তো যুদ্ধের প্রথম বোমাটা পড়বে। আর মুছে দিবে মনুষ্যত্বের সব চিহ্ন। জাগিয়ে তুলবে কুম্ভকর্ণকে।
মানুষের সামনে যুদ্ধের মতো মহান ও উজ্জ্বল জীবনকে প্রকৃতপক্ষে কেমন তাই তুলে ধরবে ‘অল কোয়ায়েট অন দা ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট’। বই পাঠ শেষে প্রতিটি পাঠকই অনুভব করবে, পল বোমারের মতো শান্ত এক নির্মল পরিবেশ। যুদ্ধ, লড়াই ও শান্তি কী এবং কীভাবে আমাদের জীবনে প্রভাব ফেলে তার অত্যুৎকৃষ্ট বর্ণনা বোমারের মাধ্যমে পাঠক তার পাঠের মাধ্যেই অনুভব করবে। সেই রোমাঞ্চিত জীবনের আহ্বান জানিয়ে শেষ করছি ‘অল কোয়ায়েট অন দা ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট’।
তথসূত্র :
১। অল কোয়ায়েট অন দা ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট। মূল : এরিক মারিয়া রেমার্ক। রূপান্তর : জাহিদ হাসান। ঢাকা, প্রজাপতি প্রকাশন।
২। মিথের শক্তি। মূল : জোসেফ ক্যাম্পবেল। অনুবাদ : খালিকুজ্জামান ইলিয়াস। ঢাকা, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র, ২০১৮। উল্লিখিত উদ্ধৃতি নেওয়া হয়েছে ২৩২ পৃষ্ঠা থেকে।
৩। বাল্মীকি রামায়ণ। সারানুবাদ : রাজশেখর বসু। ঢাকা, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র, ২০১৭। উল্লিখিত কুম্ভকর্ণের চরিত্র তুলনা নেওয়া হয়েছে ২৫০ পৃষ্ঠা থেকে।