বৃহস্পতিবার, ১০ জানুয়ারী, ২০১৯

পরিচিত ও হিংসা বইয়ের পর্যালোচনা, লেখক অমর্ত্য সেন


আমরা প্রথম পরিচ্ছেদ - বিভ্রম থেকে হিংসা - আলোচনা করবো।

আলোচনার অন্যতম দিকগুলো :

১। একজন ব্যক্তির কেবল একটিই পরিচয় থাকে না। যেকোন ধরনের একটি নির্দিষ্ট পরিচয়ের বাইরেও তার অন্য অনেক ধরনের পরিচয় রয়েছে।

২। হঠাৎ করে উপলব্ধ যেকোন একটি পরিচয়ের ওপর বেশি জোর দেওয়া বা সেই পরিচয়কে উলটে ফেলার সংঘবদ্ধ প্রয়াস পৃথিবীতে অনেক ধ্বংস ঢেকে এনেছে।

বিভ্রম থেকে হিংসা। বিভ্রম মানে বিভ্রান্তি বা ভুল এবং আমাদের অনেক ভুল চিন্তা-ভাবনা থেকেই আমাদের মধ্যে হিংসার উৎপত্তি ঘটে। প্রথম পরিচ্ছেদে উদ্ধৃত - ‘নরহত্যার সর্দারদের নেতৃত্বে মানুষ “নিজেদের লোক”-এর পক্ষ নিয়ে শত সহ¯্র অন্য লোকদের খুন করল। সরলবিশ্বাসী মানুষের ওপর একমাত্রিক বৈরিতামূলক পরিচয় চাপিয়ে দিয়ে হিংসাকে চাগিয়ে তোলা হয়, আর একাজের ধ্বজাধারী হয় সন্ত্রাসের দক্ষ কারিগররা।’

আবার অন্য জায়গায় আছে - ‘“সামাজিক পুঁজি” নিয়ে সাম্প্রতিক লেখালেখিতে রবার্ট পাটনাম ও অন্যান্যদের জোরালো কাজে এটা যথেষ্ট স্পষ্ট হয়েছে যে, কোনও সামাজিক সম্প্রদায়ের মধ্যে অন্যের সঙ্গে নিজের অভিন্নতাবোধ সেই সম্প্রদায়ের সকলের জীবনযাপন অনেক উন্নততর করে; সম্প্রদায়-অন্তর্ভুক্তির চেতনা সেজন্য পুঁজির মতোই সম্পদ বলে স্বীকৃত হয়।’ আমরা একটি সমাজে বাস করি। এখানে বিভিন্ন ধরনের, নানান চিন্তা-ভাবনার মানুষ বাস করে। নানান দিক, নানান দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের নিজের দেখার পরিসরকে বড় করে। অপর একজনের অভিমত আমার নিজের মতামতের সাথে মিলে না বলে অসহিষ্ণু হওয়া বুদ্ধিমানের পরিচয় নয়।
সমাজের বিভিন্ন গোষ্ঠী ও মতামতের সাথে পরিচিত হলে ভালো ও মন্দ উভয় দিকই থাকে। আবার সমাজ থেকে বাইরে থাকলেও এক ধরনের বৈরী মনোভাব তৈরি হয়। এবার মহাভারতের একটি বক্তব্য তুলে ধরছি।

‘অপমানকর পরিচয়লক্ষণ আরোপের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সংস্কৃতি বিভিন্ন সময়ে মনুষ্যত্বের সর্বজনীনতা ঘোষণা করেছে। কমবেশি দু’হাজার বছর আগেকার ভারতীয় মহাকাব্য মহাভারতে তার্কিক প্রশ্নকর্তা ভরদ্বাজ বর্ণাশ্রমের পক্ষে সামাজিক প্রধান ভৃগুর যুক্তির প্রত্যুত্তরে জিজ্ঞাসা করেন, “আমরা তো দেখি সকলের ওপরেই কামনা, ক্রোধ, ভয়, দুঃখ, চিন্তা, ক্ষুধা ও শ্রম প্রভাব বিস্তার করে, তা হলে আমাদের জাতিভেদ হয় কী করে?”’
জাতিভেদ ছাড়াও বিভিন্ন মানুষকে বিভিন্ন বর্গে বিভক্ত করে অন্যদের প্রতি হিংসা উৎপাদন করার রীতি দেখা যায়। যেমন ভারতে ১৯৪০ দশকের হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা। লেখকের মতে, ‘বহু মানুষের ভারতীয়, উপমহাদেশীয়, এশীয়, মানবজাতির সদস্য, ইত্যাদি পরিচয়গুলো যেন ধসে গেল- হঠাৎই তারা যেন হিন্দু, মুসলমান, শিখ সাম্প্রদায়িক পরিচয়ে ভাগ হয়ে গেল।’ এরপর যে হত্যাকা- হলো তা অকল্পনীয়।

একজন মুসলমানেরও বহু পরিচয় রয়েছে। অবশ্য আমরা প্রায়ই তা ভুলে যাই বা একটি পরিচয়ের ওপর চাপ দিয়ে অন্য পরিচয়গুলোকে ভুলতে বাধ্য করা হয়। আরেকটি উদ্ধৃতি তুলে ধরছি,

‘মানুষমাত্রেই নিজেদের বিভিন্নরূপে দেখতে পায়- তার কারণও আছে। যেমন বাংলাদেশের একজন মুসলমান শুধু মুসলমানই নন, তিনি বাঙালি এবং বাংলাদেশের নাগরিকও, তার ওপর তিনি প্রত্যাশিতভাবেই বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও গানবাজনা সম্বন্ধে যথেষ্ট গর্বিত। এসব ছাড়াও তাঁর অন্যান্য পরিচয় থাকতে পারে, যেগুলো লিঙ্গ, বৃত্তি, রাজনীতি, শিল্পরুচি ইত্যাদির সঙ্গে যুক্ত। পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের বিচ্ছেদ কোনওমতেই ধর্মের কারণে হয়নি; অবিভক্ত পাকিস্তানের দু’দিকেই জনতার অধিকাংশ ছিলেন মুসলমান। বিরোধের কারণ ছিল ভাষা, সাহিত্য ও রাজনীতি।’

আমাদের বহুমাত্রিক পরিচয় রয়েছে এবং এসব পরিচয়কে যুক্তির সাথে ব্যবহার করতে হবে। দেখা যায় আমরা যখন আমাদের নানা দিকে পরিচয়কে বাদ দিয়ে একটি নির্দিষ্ট পরিচয়কে অবলম্বন করি তখন অন্যদের সাথে আমাদের বিভেদ অনেক বেশি প্রকট হিসাবে দেখা হয় এবং আমাদের মনোভাবকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। আমাদের বহুমাত্রিক পরিচয় ও যুক্তির ব্যবহার আমাদেরকে ভ্রান্তির পথ থেকে দূরে রাখবে এবং আমাদের মনোভাবকে অন্যের প্রতি অনেকটা সহযোগিতাপূর্ণ করে তুলবে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন