রামসফেল্ড ম্যাট্রিক্স (Rumsfeld Matrix) হলো একটি চিন্তাধারা বা কাঠামো যা মানুষকে বিভিন্ন স্তরের জ্ঞানের বিষয়ে চিন্তা করতে সাহায্য করে। এটা মূলত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ডোনাল্ড রামসফেল্ডের একটি বিখ্যাত বক্তব্য থেকে উদ্ভূত, যেখানে তিনি ৪টি জ্ঞানের ধরন উল্লেখ করেন। এই ম্যাট্রিক্স জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা এবং অনিশ্চয়তা মোকাবিলায় ব্যবহৃত হয়। এটা ৪টি প্রধান অংশে বিভক্ত:
১. Known Knowns (জানা-জানা)
এটা সেই বিষয়গুলো যা আমরা জানি। আর আমরা জানি যে আমরা সেগুলো সম্পর্কে জানি। উদাহরণস্বরূপ, আমরা জানি যে আগুনে হাত দিলে হাত পুড়ে যাবে। এটা আমাদের পর্যবেক্ষণ জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত।
২. Known Unknowns (জানা-অজানা)
এটা সেই বিষয়গুলো যা আমরা জানি যে আমরা জানি না। উদাহরণস্বরূপ, মঙ্গল গ্রহে প্রাণ আছে কিনা সেটা কি আপনি জানেন? উত্তরটা আপনার অজানা। কিন্তু আপনি এই আপনি প্রশ্নটা সম্পর্কে সচেতন। আপনি প্রশ্ন সম্পর্কে জানেন, কিন্তু উত্তর আপনার কাছে অজানা। আবার বাংলাদেশের ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থান এমন একটি জানা-অজানা বিষয়। আমরা সবাই জানি স্বৈরাচার ও ফ্যাসিবাদের পতন হবে। কিন্তু কবে হবে সেটা কেউ জানত না। এজন্যই হেফাজত আন্দোলন, নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলন, ভ্যাট বিরোধী আন্দোলন, কোটা সংস্কার আন্দোলন সহ নানা ধরনের প্রতিবাদ ও আন্দোলন চলতে থাকে।
৩. Unknown Knowns (অজানা-জানা)
এটা এমন কিছু ধারণা বা জ্ঞান যা আমরা জানি, কিন্তু আমাদের সচেতনতা বা দৃষ্টি প্রক্রিয়া থেকে আমরা বুঝতে পারি না বা সেটা পুরোপুরি কাজে লাগাই না। এটা এমন কিছু যেটা আমাদের অভিজ্ঞতায় থাকতে পারে, কিন্তু আমরা সেগুলির প্রতি যথাযথ মনোযোগ দিই না অথবা এগুলোর গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারি না।
৪. Unknown Unknowns (অজানা-অজানা)
এটা সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং অংশ। এটা এমন বিষয় যা আমরা জানি না এবং আমরা জানি না যে আমরা এটা জানি না। উদাহরণস্বরূপ, ভবিষ্যতের কোনো অজানা প্রযুক্তি বা ঘটনা।
রামসফেল্ড ম্যাট্রিক্সের ব্যবহার
এই ম্যাট্রিক্স ব্যবহার করা হয় ঝুঁকি বিশ্লেষণ, সমস্যা সমাধান এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে। এটা ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা ও সীমাবদ্ধতা বোঝার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে, যখন জটিল বা অনিশ্চিত পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়, তখন এটা খুব কার্যকর একটি পদ্ধতি।
উদাহরণ:
একটি ব্যবসায়িক পরিকল্পনা তৈরির সময়:
জানা-জানা বিষয়: বর্তমান বাজারের অবস্থা।
জানা-অজানা বিষয়: ভবিষ্যতে বাজারের প্রতিযোগিতা।
অজানা-জানা বিষয়: কর্মীদের বিশেষ দক্ষতা যা পুরোপুরি চিহ্নিত হয়নি।
অজানা-অজানা বিষয়: ভবিষ্যতে উদ্ভূত কোনো সংকট বা প্রযুক্তিগত পরিবর্তন।
রামসফেল্ড ম্যাট্রিক্স জ্ঞানের সীমাবদ্ধতাগুলো চিনতে সাহায্য করে এবং যেকোন প্রক্রিয়ায় উন্নতির সুযোগ তৈরি করে।
রামসফেল্ড ম্যাট্রিক্স বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে কীভাবে প্রযোজ্য হতে পারে, সেই সম্পর্কে কিছু উদাহরণ দেওয়া হলো:
১. Known Knowns (জানা-জানা): এটা সেই জ্ঞান যা আমরা জানি এবং জানি যে আমরা জানি। উদাহরণ:
বাংলাদেশের প্রধান শিল্পের অবস্থা হিশাবে আমরা জানি যে বাংলাদেশের অর্থনীতি কৃষি এবং পোশাক শিল্পের উপর নির্ভরশীল। এই বিষয়ে আমাদের স্পষ্ট ধারণা আছে এবং এই ব্যাপারে আমাদের কাছে যথেষ্ট তথ্যও রয়েছে।
নির্বাচনী ব্যবস্থা: বাংলাদেশের সাধারণ নির্বাচন কীভাবে অনুষ্ঠিত হয় এবং নির্বাচনের নিয়মাবলি সম্পর্কে আমরা জানি, এটা আমাদের জানা-জানা বিষয়।
২. Known Unknowns (জানা-অজানা): এটা সেই বিষয় যা আমরা জানি যে আমরা জানি না। উদাহরণ:
আসন্ন বন্যার প্রকৃতি: আমরা জানি যে বাংলাদেশে প্রতি বছর বর্ষাকালে বন্যা হয়। কিন্তু আমরা জানি না যে এবারের বন্যা কতটা তীব্র হবে অথবা এটা কোন কোন এলাকাকে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
বৈশ্বিক অর্থনীতির পরিবর্তন: বাংলাদেশে অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি নির্ভর করে বৈশ্বিক বাজারের পরিস্থিতির উপর। কারণ বাংলাদেশ উৎপাদনের দিক থেকে স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। উৎপাদনের দিকে নজর না দিলে নানা দেশ থেকে আন্তর্জাতিক দরে পণ্য আমদানি করতে হয়। তাই আমরা জানি যে আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি বাংলাদেশের উপর প্রভাব বিস্তার করে। কিন্তু আমরা জানি না আন্তর্জাতিক বাজারের কী কী পরিবর্তন হবে অথবা এর প্রভাব কেমন হবে।
৩. Unknown Knowns (অজানা-জানা): এটা এমন কিছু যা আমরা জানি, কিন্তু আমরা জানি না যে আমরা জানি। উদাহরণ:
বাংলাদেশি শ্রমিকদের সক্ষমতা: বাংলাদেশে অসংখ্য অভিজ্ঞ শ্রমিক রয়েছে। কিন্তু অনেক সময় এই দক্ষতা বা অভিজ্ঞতাগুলো সঠিকভাবে মূল্যায়ন করা হয় না। এটা এক ধরনের অজানা-জানা বিষয়।
স্থানীয় বাজারের চাহিদা: অনেক সময় ব্যবসায়ীরা জানে, কিন্তু এই জ্ঞানকে পুরোপুরি কাজে লাগায় না। যেমন কোন পণ্যের চাহিদা হয়তো ঠিকভাবে মাপা হয়নি, যদিও তারা পূর্ব অভিজ্ঞতার মাধ্যমে এটা জানত।
৪. Unknown Unknowns (অজানা-অজানা): এটা সেই বিষয় যা আমরা জানি না এবং জানি না যে আমরা এটা জানি না। উদাহরণ:
ভবিষ্যতের প্রযুক্তিগত বিপ্লব: বাংলাদেশের প্রযুক্তি খাতে কী ধরনের নতুন উদ্ভাবন বা বিপ্লব ঘটবে তা এখনই বলা কঠিন। যেমন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) বা ব্লকচেইন প্রযুক্তি কীভাবে বাংলাদেশে পরিবর্তন আনবে, তা এক ধরনের অজানা-অজানা বিষয়।
প্রাকৃতিক দুর্যোগের নতুন ধরন: বাংলাদেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগের ধরন এবং মাত্রা সম্পর্কে আমরা জানি। তবে ভবিষ্যতে কী নতুন ধরনের দুর্যোগ (যেমন, আকস্মিক জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সুনামি বা ঘূর্ণিঝড়) ঘটতে পারে, তা সম্পূর্ণ অজানা।
রামসফেল্ড ম্যাট্রিক্সের উপকারিতা:
এই ৪টি বিভাগের মাধ্যমে বাংলাদেশে বিভিন্ন বিষয়ে অনিশ্চয়তা বা ঝুঁকি সম্পর্কে আরও ভালোভাবে চিন্তা করা যায়। বিশেষ করে “অজানা-অজানা” বিষয়গুলো থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যতে আমাদের প্রস্তুতি নেওয়া দরকার। যখন কোনো প্রতিষ্ঠান বা সরকার আগাম বুঝে নিতে পারে যে কিছু কিছু বিষয় একেবারেই অজানা, তখন তারা আরও দৃঢ়ভাবে অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত থাকতে পারবে।
এইভাবে, রামসফেল্ড ম্যাট্রিক্স বাংলাদেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক বা সামাজিক যেকোন ক্ষেত্রেই ঝুঁকি বিশ্লেষণের জন্য উপকারী হতে পারে।
পাশাপাশি ব্ল্যাক সোয়ান মডেল পড়ুন।
৪. শিক্ষা ব্যবস্থায় স্থানীয় শিক্ষকদের অভিজ্ঞতা: